You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.15 | অপারেশন মংলা (নৌ-কমাণ্ডো) - সংগ্রামের নোটবুক

অপারেশন মংলা (নৌ-কমাণ্ডো)

মে মাসের মাঝামাঝি খুলনার রহমতউল্লা দাদুর নেতৃত্বে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নৌ কমান্ডো ট্রেনিং এর পর ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় নৌ কমান্ডো বাহিনী গঠন করার প্রক্রিয়া আরম্ভ হলো। এরা ভারতের মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক পলাশীতে ভাগিরথি নদীর ধারে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টর থেকে আগতদের ফ্রগম্যান ট্রেনিং দিয়ে পাকবাহিনী দখলকৃত চট্টগ্রাম, মংলা সমুদ্রবন্দর নোঙর করা সমুদ্রগামী জাহাজসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীবন্দরগুলোয় নোঙরকৃত জাহাজ এবং বড় বড় যুদ্ধ জাহাজ ও অন্যান্য নৌ্যানের নিচে লিমপেট মাইন লাগিয়ে তা ব্লাস্ট করে ওইগুলোকে দিয়েই সমুদ্রবন্দর দু’টিসহ অন্যান্য নৌবন্দরগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। ট্রেনিং শেষে বাশারসহ (নেভাল বাশার নামে পরিচিত) শ্যামনগরের ২৪ জন ছেলেসহ মোট ৩৪ জন নৌ-কমান্ডো ট্রেনিং নিয়ে ৯নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারে আসেন। তাদেরকেও বাকুন্ডিয়া বেইজ ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন সুলতান উদ্দিনের কমান্ডে পাঠানো হয়। বুকুন্ডিয়া বেইজ ক্যাম্পের জমিদার বাড়ির সামনে একটা দীঘি ছিল। ক্যাপ্টেন সুলতান পাকিস্তান নৌবাহিনীতে চাকরিতে থাকাকালে আমেরিকা থেকে ফ্রগম্যনশীপ ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাকনেভীর নামকরা নৌ কমান্ডো ছিলেন। তিনি দীঘিতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত নৌ-কমান্ডোদের সাথে আর কিছু ইচ্ছুক মুক্তিযোদ্ধাকে ফ্রগম্যান ট্রেনিং দিতে থাকেন। এরা ক্যাপ্টেন সুলতান উদ্দিনের সহযোগিতায় অল্প দিনেই একটা দুর্ধর্ষ নৌ-কমান্ডো বাহিনীতে পরিণত হয়। ভারতীয় বাহিনীর চার্লি সেক্টরের সমন্বয়ে সাব-সেক্টর কমান্ডার লেঃ জিয়াউওদ্দিনের তদারকিতে ও সহায়তায় এদের দিয়ে ৯নং সেক্টর এলাকাধীন মংলাবন্দরে নোঙর করা পাকবাহিনী ব্যবহৃত জাহাজসহ কয়েকটি বিদেশী নোঙরকৃত সমুদ্রগামী জাহাজ ডুবিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত হয়। জাহাজ ডোবানোর জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লিমপেট মাইন এসে গেল। এগুলো দেখতে কচ্ছপের পিঠের আকারের হেলমেটের মতো। ঈর কার্যকরিতা ফ্রগম্যান নৌ কমান্ডোরা শিখে নিলো অল্প দিনে। ১৫ আগষ্ট ’৭১ সন্ধ্যার পর অপারেশনের দিন নির্ধারণ করে সকল ফ্রগম্যান নৌ কমান্ডো মংলা বন্দরের অভিমুখে লেঃ জিয়াউদ্দিনের বাহিনীর সাথে রওয়ানা হয়ে যায়। অপারেশনকালে এদেরকে প্রয়োজনে ফায়ার সাপোর্ট দেবার জন্য খুলনার খিজির, আফজাল ও আনোয়ার নামে তিন অসম সাহসী কমান্ডোর নেতৃত্ব একদল মুক্তিযোদ্ধাদের একই সাথে লেঃ জিয়াউদ্দিনের সাথে মংলা পাঠানো হলো। সুন্দরবনের মাঝ দিয় বুড়ি গোয়ালিনী ফরেস্ট রেঞ্জ হয়ে তারা ৫টা নৌকা নিয়ে পশুর নদীতে মংলাবন্দরের উলটা দিকে অবস্থান নেয়। পূর্ব পরিকল্পনা মতে ফ্রগম্যানরা প্রত্যেকের বুকে লিমপেট মাইন ও জাহাজের তলার শ্যাওলা পরিষ্কার করে চুম্বক শক্তিসম্পন্ন ওই মাইন লাগানোর জন্য ফ্রগম্যান বেয়োনাট রবারের ফ্রগম্যান ফুটওয়্যার পরে নিলো। ১৪টি জাহাজের ভিড়ানো মংলা থেকে হিরণ পয়েন্ট পর্যন্ত। দু’জন করে ফ্রগম্যান এক একটা জাহাজ নির্দিষ্ট করে ডুব সাঁতার দিয়ে এগিয়ে চলল। ওদের ফায়ার কভার দেবার জন্য কমান্ডার খিজির, আফজাল ও আনোয়ার নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধারা মংলাবন্দরের পশুর নদীতে নোঙরকৃ জাহাজগুলোর কাছাকাছি স্থানে অবস্তান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। নৌ-কমান্ডোরা দু’জন করে প্রতিটি জাহাজের মাঝ বরাবর ডুব দিয়ে জাহাজের তলাদেশে বেয়নেট দিয়ে শ্যাওলা আঁচড়িয়ে ফেলে চুম্বকযুক্ত লিমপেট মাইনগুলো লাগিয়ে সেফটি পিন খুলে ট্রেনিংমতো ব্যাক স্ট্রোক সাঁতার দিয়ে জাহাজগুলো থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে আসে। লিমপেট মানিএর ডেটনেটরের সেফটি পিনগুলো খুলে ফেলার সাথে সাথে সেখানে পানির চাপ পড়তেই লিমপেট মাইনগুলো এক একটা করে সবগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকল। মাইনের বিস্ফোরণে জাহাজগুলোর তলদেশে ফেটে কয়েকঘন্টার মধ্যে ৬/৭টা জাহাজ ডুবে যায়। পাকবাহিনী যারা ঐ জাহাজগুলোতে পাহরায় ছিল তাদের অনেকেই পশুর নদীতে লাফিয়ে পড়ে ডুবে মারা যায়। মংলা বন্দরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থানরত পাকবাহিনী দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। কমান্ডার খিজির, আফজাল ও আনোয়ার বাহিনীও গোলাগুলির জবাব দিতে থাকেন, কমান্ডারদের বিনা বাধায় তীরে লাগানো নৌকাগুলোতে পৌঁছানো পর্যন্ত এই ফায়ার সাপোর্ট চলে। সুনীল বড়ুয়া নামে এক কমান্ডো পাক বাহিনী হাতে ধরা পড়লেও তার বুদ্ধিবলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিরে আসে।
অল্প সময়ের মধ্যে নৌ কমান্ডোরা অপারেশনের শেষ করে তীরে ফিরে এলে তাদের নিয়ে আমাদের বাহিনী সুন্দরবনের মধ্যে চলে যাওয়া ছোট খালে ঢুকে লেঃ জিয়াউদ্দিনের সুন্দরবন ঘাঁটির নির্ধারিত স্থানে ফিরে আসে। সেখান থেকে তাদের সেক্টরের বেইজ ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা হয়। এ অভাবনীয় সাফল্যের ফলে পাক সরকারসহ ঐ অঞ্চলের পাকসেনারা ভীতসস্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পরদিন দুপুরে আকাশবাণী থেকে সর্বপ্রথম মংলা বন্দরের সফল নৌ-কমান্ডো অপারেশনের খবর প্রচার করে। সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও একই খবর প্রচারিত হয়। সারা বিশ্বে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের এই অপারেশনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশী বিভিন্ন পত্রিকায় এ অপারেশনের কাহিনী ফলাও করে ছাপানো হয়।
[৩৬] ওবায়দুর রহমান মোস্তফা

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত