You dont have javascript enabled! Please enable it!

অপারেশন সার্চলাইট

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পরিচালিত হয় নিরস্ত্র বাঙালী জনগোষ্ঠির ওপর পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরেচিত সামরিক অভিযান। পরিকল্পিত এই অভিযানকে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে অভিহিত করে। এই অভিযানে ঢাকা বিভিন্ন এলাকা রক্তাক্ত হয়ে ওঠে
প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক, গবেষক ও বিভিন্ন নিবন্ধকারের ভাষ্য অনুযায়ী “অপারেশন সার্চলাইট”-এর বর্ণনা এরকমঃ ২৫ মার্চ ১৯৭১। তেজগাঁও এয়ারপোর্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা অসমাপ্ত রেখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁর বিশেষ বিমানে আরোহণের ঠিক আগে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক টিক্কা খানের দিকে তাকান। তারপর বললেন-‘ওদের শায়েস্তা কর। দেশের সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারীর কাছ থেকে “অপারেশন সার্চলাইট’ চালাবার নির্দেশ আসে। এরপর মধ্যরাতে ঢাকার বাঙালীদের “শায়েস্তা করার” অভিযান হয়। এই অতর্কিত সামরিক অভিযান হাজার হাজার নিরীহ, অসহায় বাঙালীর জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়। ধ্বংসের ঘন আচ্চাদনে সুন্দর বাংলাদেশের প্রান্তর ঢেকে যায় এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভঙ্গুর সম্পর্কেও বিলীন করে।
‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর রাত্রি সংযুক্ত পাকিস্তানের শেষ রাত্রি। মুসলিম জাতিতত্ত্বের ধারণা সমাধিস্থ সেদিনই। জিন্নাহর দিজাতিতত্ত্ব প্রচণ্ড এক ধাক্কায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় সে রাতে। এ অভিযান থেকেই উদগত হয় বাঙালীদের ব্যাপক গণযুদ্ধের এবং শুরু হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ফলে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের রক্তাক্ত অভ্যুদয় ঘটে।
২৫ মার্চের আগে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রতিটি সাংবাদিককে ঢাকা থেকে বের করে দেয়। তারা স্থানীয় প্রচার মাধ্যমের ওপর আরোপ করে কঠোর সেন্সরশিপ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনজন বিদেশী সাংবাদিক ঢাকায় লুকিয়ে থাকেন-তারা হলে-আরনল্ড জেটলিন, মাইকেল লরেন্ট এবং সাইমন ড্রিং। ৩১ মার্চ ১৯৭১ লন্ডনের “ডেইলি টেলিগ্রাফ” পত্রিকায় প্রত্যাক্ষদর্শী সাইমন ড্রিং-এর ‘ডেট লাইন ঢাকা’ শিরোনামে “অপারেশন সার্চলাইটের” ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানের সংহতির জন্য ঢাকা কি মূল্য দিয়েছে, “ডেট লাইন ঢাকায় তার চিত্র তুলে ধরে।
বর্ণনাটি এ রকমঃ ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর ঢাকা মহানগরী মুহূর্মুহু তোপধ্বনি প্রকল্পিত হতে থাকে এবং সর্বত্র বোমাবারুদের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। টিক্কা খান বর্বর সামরিক শক্রি প্রয়োগ করে নির্মমভাবে গণবিদ্রোহ দমনে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়াটার্স, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর প্রধান কার্যালয় পিলখানা সেনা-অভিযান বিধ্বংস হয়। এই সকল অভিযানে নির্বিচারে ভারি আর . আর. গান ব্যবহার করা হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তৈরি আমেরিকান ট্যাঙ্ক ও এক কলাম সৈন্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি ঘিরে ফেলে। মধ্যরাতেই তারা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ে এবং নিকটবর্তী ছাত্রাবাসে গোলাগুলি চালানোর ক্ষেত্রে হিসাবে একে ব্যবহার করে। আকস্মিক গোলাবর্ষণে ইকাবাল হলেই ২০০ ছাত্র নিহত হয়। ছাত্ররা বুঝেই পারেনি তাদের ওপর এভাবে ভয়ংকর আক্রমণ চালানো হতে পারে। এক দিকে হলগুলির দিকে উপর্যপুরি শেল নিক্ষেপ করা হতে থাকে অন্যদিকে চলতে থাকে মেশিনগানের গুলি। দ’দিন পর্যন্ত পোড়া ঘরগুলির জানালা-দরজায় মৃতদেহ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। পথেঘাটে মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। নিকটবর্তী পুকুরেও অনেক মৃতদেহ দেখা গেছে। অন্য একটি হলের মৃতদেহগুলিকে সৈন্যরা ত্বরিত গর্ত খুঁড়ে গণকবর দেয় এবং পরে ট্যাঙ্ক চালিয়ে সমান করে দেয়। ইউনিভার্সিটি সংলগ্ন বসবাসকারী জনসাধারণও এই আগুনে শিকার হয়। রেললাইন সংলগ্ন বস্তিগুলিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়।
এই ঘটনার দু’দিন পরও ইকবাল হলের যত্রতত্র মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। মৃতদেহ পড়ে থাকে আশপাশের জঙ্গল এবং পুকুরে। শিক্ষকদের মধ্যে ৭ জন মৃত্যুবরণ করেন তাদের নিজেদের বাসাবাড়িতেই। একটি বাড়িতে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেয়া ১২ জনকে নির্বিচারে গুলি করে মারা হয়। সেনাবাহিনী এইসব মৃতদেহগুলির বেশিরভাগই সরিয়ে ফেলে। কিন্তু ইকবাল হলে করিডোরে তারপরও দেখতে পাওয়া যায় ৩০ টি ছাত্রের রক্তাক্ত মৃতদেহ।
অন্য একটি ছাত্রবাসে গণকবর খুঁড়ে নিহত ছাত্রদের পুঁতে রাখা হয়। তারপর কবরগুলির ওপর দিয়ে চালানো হয় বুলডোজার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের আশেপাহসের এলাকায় বসবাস্রত বহু মানুষ এই নির্বিচার গোলাগুলির শিকার হন। রেললাইনের দু’পাশ দিয়ে গড়ে ওঠা বস্তিগুলিকে নির্বিচারভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। আর্মির টহলধারী দলগুলি আশেপাশের বাজারগুলি ধ্বংস করে দিয়েছে। দোকানের মালিক এবং কর্মচারীদের ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে মারা হয়েছে।
দু’দিন পর যখন সত্যিকার ভয়াবহতা বোঝা গেছে, তখন অনেক মৃতদেহই দেখা গেছে কম্বল এবং কাঁথা মুড়ি দেওয়া, ঠিক যেন তারা ঘুমিয়ে আছে। এই একই এলাকায় অবস্থিত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজও সেনাবাহিনীর নির্বিচার গোলাগুলি থেকে রক্ষাপায়নি। রক্ষা পায়নি পাশের একটি মসজিদও। আর্মি কমান্ডোদের দ্বারা গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ সংযুক্ত পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক।
ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের (বর্তমান হোটেল শেরাটন) ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে রক্ত রঞ্জিত নাটক প্রত্যক্ষ করেন। পরে এ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ‘প্রায় রাত সাড়ে দশটায় রাতের খাবার শেষ করে আমরা আমাদের রুমে চলে যাই। ঘন্টাখানেক পর প্রচণ্ড তোপাধ্বনিতে আমরা জেগে উঠি। আমার বন্ধু ও সহচররা আমার রুমে চলে আসে। আমরা দেখতে পাই, আর্মি অপারেশনে নেমেছে। ঘরে বসেই আমরা তিন ঘণ্টা ধরে দেখতে পাই, আর্মি অপারেশনে নেমেছে। ঘরে বসেই আমরা তিন ঘন্টা ধরে দেখতে পাই আর্মি অপারেশন। বেশ কিছু স্থানে দেখা যায় প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা। আমরা দেখতে পাই স্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দি পিপল’ এর অফিস ধ্বংস হতে। এই পত্রিকাটি নিয়মিত আর্মি ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে উত্তেজনাকর সংবাদ পরিবেশন করত। প্রজ্বলিত দিগন্তের পানে তাকিয়ে আমার চিন্তা অতীত ও ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলে। ভেবে অবাক হই, ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কি আছে।… আমার কি আর ফিরে না আসার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি?
“ডেইলি টেলিগ্রাফ”- এর ৩১ মার্চ ১৯৭১-এর রিপোর্টটির একটি অংশ এরকমঃ ‘আল্লাহ এবং পাকিস্তানের ঐক্যের নাএ’ ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত ও সস্ত্রস্ত নগরী। দীর্ঘ ২৪ ঘন্টার নৃশংস অভিযান, ঠাণ্ডা মাথায় বোমাবর্ষণ এবং গোলাগুলি চালিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কমপক্ষে সাত হাজার মানুষ হত্যা করেছে। তারা বিশাল এলাকা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার স্পৃহা শুরুতেই স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অবশ্য দাবি করেছেন, পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রধানের এ দাবি সত্ত্বেও শহর থেকে হাজার হাজার মানুষ গ্রামের দিকে ছুটে পালাচ্ছে। শহরের রাস্তাঘাটগুলি প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে এবং প্রদেশটির নানা জায়গা থেকে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের খবর আসছে।
কিন্তু এরপরও দেখা ট্যাঙ্কবহর নিয়ে সেনাবাহিনী যেভাবে ছোট-বড় শহরগুলিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তাতে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধ খুব একটা বেশি নেই। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যৎসামান্য অভিযোগেই সেনাবাহিনী গুলি করে মারছে সাধারণ মানুষকে এবং দালান-কোথা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে নির্বিচারভাবে। দৃশ্যতই মনে হচ্ছে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে করেই হোক পূর্ব পাকিস্তানের ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
..সেনাবাহিনীর এই বর্বর অভিযানকে আন্দাজ করা যাবে বিছানাতে ছাত্রদের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে, ঢাকার বাজারগুলিতে, দোকানের আশপাশে বিভিন্ন মানুষের মৃতদেহ দেখে, ভস্মীভূত ঘর-বাড়িতে আগুনে পোড়া নারী ও শিশুর দেহ দেখে। পাকিস্তানের হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজনদের যেখানেই পাওয়া গেছে সেখানেই গণহারে গুলি করে মারা হয়েছে। বাজার এবং শপিংমলগুলি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ঢাকা বিভিন্ন সরকারী দালানে তুলে ধরা হয়েছে পাকিস্তানের পতাকা। এ পর্যন্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি। তবে কমপক্ষে তাদের দু’জন সৈন্য এবং একজন অফিসার মারা পড়েছে।আনুমানিক ৩ ব্যাটিলিয়ন সৈন্য ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অভিযানে অংশগ্রহণ করে। রাত ১১টায় অভিযান শুরু হয়। একদিকে শুরু অয় প্রচণ্ড গোলাগুলি অন্যদিকে শহরবাসীও দ্রুত রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করতে থাকে। কেউবা গাড়ি উল্টিয়ে রাস্তা বন্ধ করে, গাছ কেটে সড়ক অবরুদ্ধ কিংবা আসবাপত্র, কংক্রিটের পাই ইত্যাদি ঠেলে আনতে থাকে রাস্তার দিকে। শেখ মুজিবকে এ সময়ে টেলিফোনে এই ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা জানানো হয়। কিন্তু তিনি তাঁর বাড়ি ছাড়তে অস্বীকার করেনঃ যদি আমি এখন পালিয়ে যায় আমাকে ধরার জন্যে তারা পুরও ঢাকা শহর জ্বালিয়ে দেবে’- একজন সহকারীকে, যিনি গ্রেফতার এড়াতে পেরেছিলেন, বলেন শেখ মুজিব।
একদিকে সেনাবাহিনীর দলগুলি এগিয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের দিকে অন্যদিকে তাদের অন্য দলগুলি অভিযান চালিয়েছে রাজারবাগের পুলিশ সদর দপ্তরে যা শহরের মধ্যেই অবস্থিত। প্রথমে ট্যাঙ্ক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে সেনাবাহিনী এগিয়ে গেছে পুলিশ লাইনের দিকে তারা পুলিশের ডরমিটরিতো গোলা ছুড়ে এবং নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে হত্যা করেছে। ঠিক কত লোক রাজারবাগে সেই অভিযানে নিহত হয়েছে জানা যায়নি। কিন্ত সেখানে সে রাতে অবস্তানরত ১১শ’ পুলিশের মধ্যে খুব কম সংখ্যক জীবন বাঁচাতে পেরেছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় যখন এই ধরনের অভিযান চলছিল তখন সেনাবাহিনীর অন্য ইউনিটগুলি শেখ মুজিবের বাড়িঘেরাও করে বসে। রাত ১টার কিছুটা পর যোগাযোগ করা হলে জানা যায় তিনি সম্ভাব্য এমন একটি আক্রমণ বুঝতে পেরেছেন এবং সে কারণেই বাড়ির চাকর-বাকর এবং দেহরক্ষীদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেখ-এর একজন পড়শি জানান যে রাত ১.১০ মিনিটে একটি ট্যাঙ্ক একটি সেনাবাহিনী ভর্তি গাড়ি এবং কয়েকটি ট্রাক বোঝাই সৈন্য গুলি ছুড়তে ছুড়তে শেখ মুজিবের বাড়িতে প্রবেশ করতে থাকে। শেখ মুজিবের একজন সহযোগী এবং বডিগার্ডকে সেনাবাহিনী নির্মমভাবে নির্যাতন করে।
শেখ মুজিবকে যখন তার বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সম্ভবত সেনা সদর দপ্তরের দিক তখন সৈন্যরা আবার ফিরে আসে তার বাড়িতে। তারা বাড়ি থেকে সব ধরনের কাগজ ও দলিলপত্র নিয়ে যায় এবং বাড়ির গেটে উড়তে থাকা বাংলাদেশ সবুজ লাল এবং হলুদ রঙের পতাকাতে উপর্যুপরি গুলি চালায়। ২৬ মার্চের রাত ২টা পর্যন্ত ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি জায়গায় আগুন জ্বলতে থাকে। পাকিস্তানী সৈন্যরা যত্রতত্র ছাত্রদের হত্যা করতে থাকে এবং বাংলাদেশের নতুন জাতীয় পতাকা খুলে ফেলে সেখানে পাকিস্তানের পতাকা লাগিয়ে দেয়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ‘দি পিপল’ পত্রিকার অফিসটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাবাহিনী। তারা জনশূন্য এক পত্রিকার অফিসটিকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং সেখানে অবস্থিত একজন নৈশ প্রহরীকে হত্যা করে। এই পত্রিকা অফিসের সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আশপাশের অনেক ঘর-বাড়ি। ২৬ তারিখের ভোরের ঠিক আগে দিয়ে গোলাগুলি অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সূর্য ওঠে, তখন নগরীর চারদিকে এক ভয়ংকর নিস্তব্ধ বিস্তার করতে থাকে। ঢাকা শহরকে তখন মনে হ একটা মৃতের নগরী। কাক এবং মাঝে মধ্যে সেনাবাহিনী ভারি যানের শব্দ ছাড়া তখন কিছুই শোনা যায় না।
এদিকে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে, কোনো রকম সতর্কবাণী ছাড়াই সেনাবাহিনীর কলামগুলি পুরনো ঢাকার দিকে যাত্রা করে। পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকার অলিগলি এই এলাকাটিতে লক্ষ লক্ষ লোকের বসবাস। পরের প্রায় ১১ ঘন্টা ধরে হানাদার বাহিনী এলাকগুলি পুরনো ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ইংলিশ রোড, ফ্রান্স রোড, নয়াবাজার, সিটি বাজার ইত্যাদি এলাকাগুলিতে কয়েক হাজার লোককে পুড়িয়ে মারা হয়। এলাকার একজন বৃদ্ধ লোক জানান, সৈন্যরা হঠাৎ করে রাস্তার শেষ প্রান্তে চলে আসে এবং তারা আমাদের বাড়ি-ঘরের ওপর গুলি ছুড়তে ছুড়তে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।
এদের মধ্যে সৈন্যদের একটি ইউনিট গ্যালন গ্যালন পেট্রোল নিয়ে এসেছিল। এ মুহূর্তে যারা পালাতে চেষ্টা করেছিল তাদের গুলি করে মারা হলো। যারা তাদের ঘর-বাড়িতে রয়ে গেল তারা আগুনে পুড়ে মারা গেল। এই এলাকায় নারী ও শিশু মিলে সেদিন রাত দু’টোর মধ্যে মারা গিয়েছে প্রায় ৭শ’ মানুষ। সেনাবাহিনী ঠিক একই ধরনের অভিযান পরিচালনা করেছে একই এলাকার অর্ধেক বর্গমাইলের মধ্যে আরও তিনটি জায়গায়।
একটি এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পর সৈন্যরা আরেক এলাকায় চলে গেছে। আর এক দল মৃতদেহগুলিকে ট্রাকে টেনেহিচড়ে তুলেছে এবং অন্যত্র সরে গেছে। এ এলাকার পুলিশ স্টেশনগুলিও আক্রমণ শিকার হয়েছে। একজন পুলিশ ইন্সপ্যাক্টর জানান, গত শনিবার সকালে সে এসব এলাকার ধ্বংসস্তূপগুলির মধ্যে তার কনস্টেবলদের খুঁজছিল। “এসব এলাকায় প্রায়’ ২৪০ জন কনস্টেবল ছিল কিন্তু এ পর্যন্ত আমি তাদের ৩০টির মৃতদেহ খুঁজে পাই”, তিনি জানান।
পাকিস্তান বাহিনী পুরনো ঢাকায় যে গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তার উত্তাপ বেশি পড়ে এখানকার একটি হিন্দু এলাকায়। এখান সৈন্যরা প্রথমে ঘর- বাড়ি থেকে লোকজনকে বেরিয়ে আসতে বলে এবং এরপর দলবদ্ধভাবে নির্বিচার গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করে। এই এলাকাটিকেও পরে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। ২৬ মার্চ রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত হানাদার সৈন্যরা পুরনো ঢাকায় অবস্থান করে। এদের সহযোগিতা করছিল স্থানীয় কিছু বাঙালী দালাল। এই দালালরা দেখিয়ে দিন কোন কোন বাড়িতে আগুন দিতে হবে এবং কোন কোন বাড়ি আওয়ামী লীগের সমর্থকদের। তারপর সৈন্যরা সেগুলিতা সরাসরি ট্যাঙ্ক থেকে, রিকোয়েলস গুলিবর্ষণ করত অথবা গ্যালন গ্যালন পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিত।
এই অভিযানের অন্যতম আক্রন্ত স্থান ছিল বাংলা দৈনিক ইত্তেফাক। এখানে বিভিন্ন শ্রেণীর প্রায় ৪ শ’ লোক আশ্রয় নিয়েছিল। ঠিক ঘড়িতে যখন ৪টা বাজে, তারিখ ২৬ মার্চ, ৪টি ট্যাঙ্ক পত্রিকার অফিসটি সামনে এসে দাঁড়ায়। বেলা ৪.৩০ মিনিটে পুরো পত্রিকাটির অফিসে লেলিহানে ভস্মীভূত হতে থাকে। শনিবার সকাল অব্যাহতভাবে আগুন জ্বলার পর এই অফিসে মৃতদেহ আর ধ্বংসস্তূপ কেবল অবস্থিত থাকে সৈন্যরা যেভাবে দ্রুত এই এলাকায় এসে পৌঁছেছিল ঠিক সেইভাবেই তারা দ্রুত এ এলাকা ছেড়ে চলে যায়। শনিবার সকালে রেডিওতে ঘোষণা দেয়া হয় যে শহর থেকে কার্ফিউ সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তুলে দেওয়া হয়েছে। রেডিও থেকে সে সময় বারবার করে সামরিক আইনের জারিকৃত কার্যকলাপ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, পত্র-পত্রিকার ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছে। সরকারী কর্মচারীদেরকে এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সকল তাদের কাজে যোগ দিতে বলা হয় এবং কারও কাছে যদি আগ্নেয়াস্ত্র থাকে হস্তান্তর করতে আহবান জানানো হয়।
হারুন হাবীব

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!