অফিসে চিতোশির যুদ্ধ
১৯৭১ সাল ২৯ সেপ্টেম্বর চাঁদপুরে শাহরাস্তি থানার অধীন বিতনি নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জহিরুল হক পাঠান ও কমরেড কলিমউল্যাহ গ্রুপের সঙ্গে ২ দিন ধরে প্রচণ্ড লড়াই হয়। অফিস চিতোশির যুদ্ধে বহু রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্লাটুন ছিল ওয়ারিয়া বাজারের কাছে এক পীরের বাড়িতে আর একটি দল ছিল মুচি পাড়ায়। ওয়ারিয়া বাজারের দল খবর পা পাকবাহিনী রাজাকারদের রেখে চিতোশী চলে এসেছে, কাল বিলম্ব না করে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন অবস্থান থেকে এসে তাদের ঘিরে ফেলে। প্রথম দিনই প্রচণ্ড গোলাগুলির মাঝে ৩ জন রাজাকার রাইফেল ও প্রচুর গোলা-বারুদ নিয়ে সারেন্ডার করে। ৭/৮ জন পালাবার সময় নিজ মেনের ও সাত পুকুরিয়ার জনগণ ধরে ফেলে। জনতা আনন্দ উল্লাসে রাজাকারদের কিল-ঘুসি ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখে। জনতা কয়েকজনকে গরুর মতো পায়ে বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে রাখে। প্রতিটি যুদ্ধেই লক্ষ্য করা গেছে জনগণ শুধু বুলেটকে ভয় করেছে, তা না হলে বঙ্গবন্ধুর কথা অনুযায়ী তারা বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে জালেমদের দেশ ছাড়া করত। এই ২-৩ দিনে জনগণ কাদা, পানি উপেক্ষা করে বালতিতে করে যোদ্ধাদের জন্য রুটি সবজি, পানি সরবরাহ করে। উভয় পক্ষে তুমুল লড়াইয়ে রাজাকারদের বুলেট প্রায় শেষ হয়ে আসছে। কোনো পাক সৈন্য তাদের সাহায্য এগিয়ে আসেনি। এই যুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাঠান একটি ঘর থেকে ১২ জন যুবতী মেয়েকে উদ্ধার করে। উদ্ধারের সময় পাঠানকে লক্ষ্য করে দুইজন দালাল পিস্তলের গুলি ছুড়তে থাকলে কলিমউল্যা ভূঁইয় তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের একজনকে মেরে ফেলেন। আরেক জনকেও লাথি মেরে ফেলে দিয়ে হাতিয়ার নিয়ে বেঁধে ফেলেন। এখানে সুলতান ভূঁইয়া নামক একজন চেয়ারম্যানকে মারা হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ১৫০ মণ ধান, ৮০ মণ চাল, ২২০ মণ পাট, ৩০০ পিস শাড়ি কাপড়, প্রচুর তামা-কাঁসার আসবাপত্র, ৩ নৌকায় ২০ টি গরু, ১২টি খাসি ছাগল উদ্ধার করে। হাতিয়ারের মধ্যে ৩” মর্টারের ২টি, চাইনিজ এল এমজি ২টি, ২০টি চায়নিজ রাইফেল ও প্রচুর বুলেট দখল করে। ধান, চাল, কাপড়, সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা প্রকাশ্যে দরিদ্র জনগণের মাঝে বন্টন করে দেয়। যুবতী মেয়েদের ডা. বদরুন্নাহারের দ্বারা চিকিৎসা করানো হয়। আমাদের তরফ থেকে নগদ অর্থ ও কাপড়চোপড় দিয়ে তাদের ভারতে পাঠানো হয়।
অফিস চিতোশী ক্যাম্প দখলের পর শত শত জনতা বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে শ্লোগানে শ্লোগানে আনন্দ উল্লাসে মুখরিত করে। এই ক্যাম্প দখলের জন্য অফিস চিতোশী, চান্দাই, শানেঙ্গা নোয়াপাড়া, এঘরিয়া মনিপুর, মির্জাপুর পানৈর ঘোড়িয়া, বগৌড় শ্যামপুর, বড়তুলা মশদ পাড়ার জনগণ যেভাবে সহযোগিতা করেছে এই স্মৃতির কথা চিরদিন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
[২৪] ডা. দেলোয়ার হোসেন খান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত