অমরখানা পাকিস্তানী প্রশাসনিক আক্রমণ, পঞ্চগড়
অমরখানা পঞ্চগড় জেলার পঞ্চগড় সদর থানার সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। অমরখানা সড়কপথে পঞ্চগড়ের মাধ্যমে দিনাজপুর শহরের সাথে যুক্ত । অমরখানা দিনাজপুর শহরের অন্যতম প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত ছিল। অমরখানায় ইপিআর- এর ৯ নম্বর উইং-এর একটি বিত্তপি ছিল। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানী বাহিনী এটি দখল করে এবং একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এটি ছিল পাকবাহিনীর সর্বউত্তরের অগ্রবর্তী ঘাঁটি।
পাকবাহিনী অবস্থানঃ
অমরখানা বোর্ড অফিসে ছিল পাকবাহিনী মূল অবস্থান। জগদল-পঞ্চগড় পাকা সড়কের পাশে বধুন মেম্বারের বাড়ি ছিল পাকবাহিনীর লঙ্গরখানা। ১০-১৫ জনের একটি সক্রিয় দল সেখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করত। পাকবাহিনী টহল দলগুলোও এটাকে অস্থায়ী বিশ্রামস্থল হিসেবে ব্যবহার করত।
মোট ২১ জন নিয়ে রাতের অপারেশন। কমান্ডার মাহবুব ছিল সামনে, পেছনে আহিদার, তারপর গোলাম গাউস, এমনিভাবে এক এক করে ২১ জন। ৪টা এসএলআর, ১০টা রাইফেল, ১২টা গ্রেনেড আর দুটো কুড়াল। প্রতিটা এসএলআরের জন্য দু ম্যাগাজিনে ৬০টা করে ১২০ রাউন্ড বুলেট। প্রতিটা রাইফেলের জন্য বুলেট ১০টা করে।
শালামারা ব্রিজ পর হয়ে একসময়ে সন্তর্পণে শত্রু এলাকায় প্রবেশ করল। গেরিলারা। এখানে থেকে অমরখানা পাকবাহিনীর ঘাঁটি এক মাইলের মতো। রাস্তাটা সোজা গিয়ে উঠেছে অমরখানা বোর্ড অফিসের সামনে। শত্রুপক্ষের পেট্রোল পার্টি থাকতে পারে রাস্তায়। যে কোনো মুহূর্তে ওদের মুখোমুখি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনাও রয়েছে। গেরিলা দল দুই সারিতে এগোচ্ছে। যতটা নিঃশব্দে আর দ্রুততার সাথে এগোনো যায়, গেরিলারা সেভাবেই এগোচ্ছে। কিছুদূর এগোনের পর এক টুকরা ফাঁকামতো উঁচু জায়গা দেখা গেল। বর্ষায় পানি চারদিকে। ঠিক হলো, এ জায়গাটা হবে আরপি বা রিটার্ন পোষ্ট। অপারেশন শেষে যে যেখানেই থাক, এখানে এসে সমবেত হবে।
ওমর আলী হাত ইশারা করে সামনের দিকে আবছা কালোমতো পাটক্ষেতটা দেখিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল ওই পাটক্ষেতটা ধরে বুধন মেম্বারের বাড়ির পেছনের পাটক্ষেতটা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। সিদ্ধান্ত শেষে ঠিক হলো, বুধনের বাড়িতে পাকবাহিনীর লঙ্গরখানায় গ্রেনেড ছুঁড়বে মতিয়ার আর খলিল। ওদের সাথে থাকবে কমান্ডার মাহবুব। আহিদার আর গোলাম মোস্তফার কাছে থাকবে এসএলার। মুক্তিযোদ্ধাদের পেছন থেকে কভার দেবে ওরা। ওদের একটু পেছনেই ডান-বাঁয়ে বড় খলিল আর গোলাম গাউসের নেতৃত্ব থাকবে ৮ জন রাইফেল ম্যান, দুজন কুড়াল্ধারী আর শুধু গ্রেনেড হাতে থাকবে দুজন। তারা থাকবে সেকেন্ড ম্যান হিসেবে। কেউ আহত হলে তার হাতিয়ার ব্যবহার করবে এরা।
আগে থেকে ছক পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট গ্রপে ভাগ হয়ে গেল দলটি। সামনে মাহাবুব আর ওমর আলী। খানিকটা ব্যবধানে মতিয়ার আর খলিল। তাদের পেছনে আহিদার, মোস্তফা আর জাব্বার। আর তাদের সামান্য পেছনে গোলাম গাউসের নেতৃত্ব রাইফেল বাহিনী।
গেরিলারা এবার পাটক্ষেতের বাইরে একটা ধু ধু খোলামতো জায়গায় এসে নিজেদের অবস্থান নেয়। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে কথাবার্তার শব্দ কানে এলো। কেউ একজন চিৎকার করে কাউকে ডেকে উঠল। একটি অট্টহাসির শব্দ ভেসে এলো। ডানে অমরখানার দিক থেকে মেশিনগানের আর্তনাদ ভেসে আসছে। সেই সাথে বিক্ষিপ্তভাবে বর্ষিত চাইনিজ রাইফেলের পরিচিত শব্দও। রেডিও কমান্ডার ফিসফিসিয়ে অর্ডার দিল, চার্জ।
খলিল-মতিয়ার এক সঙ্গে দুটো গ্রেনেড ছুড়ল। সাথে সাথে আরো দুটো। মাহাবুবের হাতেরটা উড়ে গেল সেই সাথে। ধমাধম টিনের ছাদের ওপরে গিয়ে পড়ল গ্রেনেড পাঁচটা। থার্টি সিক্স হ্যান্ড গ্রেনেড অসম্ভব শক্তিশালী। অসম্ভব ধ্বংস করার ক্ষমতা তার। ছোড়ার পরপরই শব্দ করে করে গড়িয়ে পড়তে লাগল সেগুলো আঙিনার মধ্যে। গ্রেনেডগুলো টিনের সাথে বাড়ি খেয়ে গড়িয়ে পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে কাদা-পানি ভেঙে একবারে অবিশ্বাস্য গতিতে এক ছুটে তখন মুলি বেড়ার কাছে পৌঁছে গেছে গেরিলারা। সেখান থেকে পেছনে ফিরতেই তীব্র আলোর বিচ্ছুরণসহ প্রথম গ্রেনেডটাকে ফাটতে দেখল তারা একই সাথে চারটা গ্রেনেড চার্জ করা হলো। তীব্র আলোর ছটা আর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল চারদিক। বাড়ির ভেতরে তখন হৈ চৈ, গোলমাল, তারস্বরে চিৎকার, সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল চাইনিজ রাইফেল থেকে গুলিবর্ষণ। মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকে সাহসী গোলাম গাউসের নেতৃত্ব রাইফেল বাহিনীও পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করল। এসব কিছুই ঘটল মাত্র অল্প সময়ের ব্যবধানে। পাকবাহিনীর সেন্ট্রি আর পেট্রোল পার্টি মুক্তিবাহিনী আসার পথের সন্ধাই শুধু পায়নি, মুক্তিবাহিনী এখন কোথায়, কোনখানে আছে, সেই অবস্থানের হদিস করে ফেলেছে। তা ওরা মুক্তিবাহিনীর দিকে তাক করে গুলি ছুড়ছে অবিরাম।
এমন সময় শুরহু হলো শেলিং। বোঝা গেল মেজর শংকরের নির্দেশেই এটা হচ্ছে। মাতার ওপর দিয়ে শিস বাজিয়ে বুলেটের ছুটে যাওয়া আর দিগন্ত কাঁপানো একটার পর একটা শেলের বিস্ফোরণ। পেছনে জ্বলছে বুধন মেম্বারের বাড়ি। আর সেই বাড়িকে কেন্দ্র করে অমরখানা বোর্ড অফিসের আশপাশে সৃষ্টি হয়েছে এক নারকীয় অবস্তার। মুক্তিবাহিনী নিরাপদে আরপিতে ফিরে এলো।
[৫৯৬] সংকলন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত