আইরন জয়কুলের যুদ্ধ, বরিশাল
পাকিস্তান নবম ডিভিশনের সদর দপ্তর যশোর সেনানিবাসে। এই ডিভিশনের জে ও সি ছিলেন মেজর জেনারেল এইচ, এম আনসারী। ডিভিশনের অপারেশন এলাকা ছিল যশোর, খুলনা, বরিশাল সহ দক্ষিণ বাংলার সমগ্র এলাকা। এই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সাহায্যকারী এবং সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্স হিসেবে আর একটি নতুন প্যারামিলিটারী ফোর্স গঠন করে। এই বাহিনীর নাম ছিল, ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস। এই বাহিনী, রাজাকার, মুজাহিদ ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা মিলিশিয়া সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। সংক্ষেপে এই বাহিনীকে ইপিকাফ বলা হতো। এই বাহিনীর ডাইরেক্টর জেনারেল (ডিজি) ছিল মেজর জেনারেল জমশেদ খান। সদর দপ্তর ছিল ঢাকা। এই বাহিনীর সদস্যদের প্রধান কাজ ছিল, রাজাকার ও শান্তি কমিটি সদস্যদের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি ও খবরা-খবর সংগ্রহ করা ও তাদের উপর আক্রমণ করা। গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, ও বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া ছিল এদের নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। কাউখালি এলাকা তখন পাকসেনাবাহিনীর ১০৭ পদাতিক ব্রিগেডের ১৫ এফ, এফ (ফ্রেন্টীয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট) এর একটি কোম্পানি অপারেশন ছিল। এই কোম্পানির সাথে ছিল ৫ উইং ইপিকাফের এক প্লাটুন। কুতুবকাঠি যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারেনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী। জেনারেল আনসারী এর প্রতিশোধ নেবার জন্য ইপিকাফের ডিজি মেজর জেনারেল জামশেদ খান ও ১০৭ ব্রিগেডের মালিক হায়াত খানকে ডেকে পাঠালেন তার সদর দপ্তরে। তারা প্ল্যান করল, কাউখালি এলাকায় ১৫ এফ এফ ও ৫ উইং ইপিকাফের সদস্যদের নিয়ে একটি সম্মলিত আক্রমণ পরিচালনা করার। এই আক্রমণের প্রস্তুতি পর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানা খুঁজে বের করতে তারা তাদের দালাল ও রাজাকারদের নিযুক্ত করল। গোপন আস্তানার খবর পেলেই সেখানে সম্মিলিত আক্রমণ করা হবে। কুতুবকাঠি যুদ্ধের পর হাবিবুর রহমান ও আব্দুল হাই পনার দলের মনোবল তখন আকাশ ছোঁয়া। এ দু’দলের যোদ্ধারা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের খাঁটি জনযোদ্ধার দল। কারণ এরা কেহই ভারতে গিয়ে গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ নেয়নি। এরা সকলেই ছিল এক একজন অসম সাহসী দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। এরা প্রমাণ এরা কুতুবকাঠি যুদ্ধে দিয়েছে। আইরন ফয়কুল গ্রামটি কাউখালী সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অক্টোবর প্রথম সপ্তাহে এই গ্রামের অতি উৎসাহী কয়েকজন গ্রামবাসী যেমন- মেম্বার আবী আবদুল্লাহ, এনায়েত মোল্লা, আওয়াল পেশকার ও ইসমাইল মুন্সি এরা সবাই মিলে কুতুবকাঠি যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সফলতার জন্য তাদের নিজ গ্রামে অভ্যর্থনা দেবার মনস্থ করল। তারা কমান্ডার হাবিবুর রহমান ও তার দলের সদস্যদেরকে নিয়ন্ত্রণ করল একবেলা তাদের গ্রামে চারটে ডালভাত খাওয়ার জন্য। হাবিবুর রহমান তাদের এই আহবানকে সাদরে গ্রহণ করলেন। এ ব্যাপারটা গ্রামের মোটামুটি সবাই জেনে গেল। কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পেলনা কত বড় সর্বনাশ ততক্ষণে ঘটে গেছে। তখন ইপিফাকের গুপ্তচর দল বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামই ছিল। এরা গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছে দিত। কিন্তু কারা যে এই গুপ্তচর ছিল তা বোঝা বড়ই মুশকিল। তাদের চিহ্নিত করে বের করাও দুরূহ কাজ ছিল। এই গুপচর, হাবিবুর রহমানের দলের খবর কাউখালীতে অবস্থিত ৫ উইং ইপকাফদের সদস্যরা আইরন জয়কুল গ্রাম আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হলো। ঝালকাঠিতে অবস্থিত সেনাক্যাম্পেও তারা এ খবর পৌছ দিল। সিদ্ধান্ত কাউখালী ও ঝালকাঠি, এই দুই ক্যাম্প থেকে দু দিক দিয়ে সাঁড়াশি আক্রমণ করা হবে। কাউখালী থেকে আইরন জয়কুল গ্রামে আসার পথ ছিল গারতা খালের পাড়ের উপর দিয়ে রাস্তা বরাবর। ঝালকাঠি থেকেও একটা মাটির কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটা পথে আইরন জয়কুল গ্রামে আসা যায়। কাউখালী থেকে পাকসেনার দল প্র্যান মোতাবেক রাস্তার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল। তারা যখন বাশরী কাঠালিয়া গ্রাম হয়ে এসে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল তখন গ্রামের অনেকেই তা জেনে যায় ও দেখে ফেলে। এদিকে ঝালকাঠি থেকে সেনাদল কাঁচা রাস্তা ধরে এগোতে লাগল। প্রথমে তারা গুয়াটন কলেজ মাঠে এসে যখন একত্রিত হয়, এরপর জাপসি গ্রামের ভিতর আইরন জয়কুলের দিকে এগোতে থাকে তখন গ্রামের লোকজন পাকসেনাদের এই তৎপরতা দেখে ফেলে। হাবিবুর রহমান ছিল খুবই রণকৌশলে সমৃদ্ধ, চৌকস একজন কমান্ডার। সে গ্রামের বেশ দূরে তার নিজস্ব লোক রেখেছিল, মিলিটারী পরিভাষায় যাকে বলা হয় “লুক আউট ম্যা”। এদের কাজ হলো কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে থেকে দেখবে শত্রুর আনাগোনা। এদিকে দুপুরের খাবার তৈরি হয়েছে। কিন্তু খাবার দিতে একটু দেরি হচ্ছে। মনে হয় ইচ্ছাকৃত এই দেরি। এর মধ্যেই “লুক আউট ম্যান” এসে খবর দিল একদল পাকসেনারা তাদেরকে আক্রমণ করতে আসছে, সকলেই আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করল। হাবিবুর রহমান বুঝতে পারল যে পাকসেনারা তাদেরকে দুদিক থেকেই ঘিরে ফেলেছে। এখন একমাত্র পথ ওদের সাথে যুদ্ধ করা। দলে দলে বিভক্ত হয়ে ওরা দুদিকে পজিশন নিয়ে নিল। পাকসেনারা দুদিক থেকেই আক্রমণ শুরু করল। দুইপক্ষেই তখন শুরু হয়েছে তুমুল যুদ্ধ। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনী ফায়ারের জন্য এগোতে পারল না। তারা গ্রামের দুপাশে পজিশন নিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি করতে লাগল
[১৪৭] হামিদুল হোসেন তারেক
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত