পানা-কামারাবাদ গণহত্যা (আগস্ট মাসের শেষার্ধ)
পাইকগাছা উপজেলার লতা ইউনিয়নের একটি গ্রাম হলো পানা। এই গ্রামের পশ্চিম দিকে হাড়িয়া নদী এবং এই নদীর পশ্চিম পারে রয়েছে কপিলমুণি ইউনিয়নের কামারাবাদ গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কামারাবাদ সুইচ গেট সংলগ্ন এলাকা ছিল বসতিশূন্য। আগস্ট মাসের শেষার্ধে এই কামারাবাদের গেটের কাছে স্থানীয় রাজাকাররা তিনজনকে হত্যা করে।
গণহত্যার ঘটনাটি ঘটে পানা গ্রামের দুলাল সরদারকে কেন্দ্র করে। দুলাল সরদার স্থানীয় সোলাদানা হাটে দোকানদারি করতেন। এপ্রিল মাস থেকে এখান দিয়ে প্রায়ই পিরোজপুর বাগেরহাট প্রভৃতি এলাকার অধিবাসীরা নদীপথে নৌকায় করে শরণার্থী হিসেবে ভারতে চলে যাচ্ছিল। এপ্রিল মাসে এ রকম একটি শরণার্থী নৌকা বহরের উপরে সোলাদানা এলাকার কতিপয় দুর্বৃত্ত হামলা করে। দুলাল সরদার ছিলেন সুঠাম দেহী ও সাহসী যুবক। শরণার্থীদের সাথে মিলে তিনি এই দুর্বত্তদের প্রতিরোধ করেন। তবে এই ঘটনার পরে শরণার্থীরা তাদের মালামাল দুলাল সরদারকে রেখে দিতে অনুরোধ করে। ঠিক হয় যে, ভারত থেকে ফিরে আসলে তিনি এই মালপত্র ফেরত দিবেন। এই সময়ে এলাকার হিন্দুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে দুলাল সরকারও ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চলে যাওয়ার আগে সমস্ত মালপত্র রেখে যান ধলাই গ্রামের বন্ধুস্থানীয় শাহজাহানের কাছে৷
কিছুদিন ভারতে থাকার পর আমন মৌসুমে ধান রোপণের জন্য তিনি আগস্ট মাসের প্রথম দিকে আবার দেশে ফিরে এসেছিলেন। এসে স্বভাবতই তিনি তাঁর রেখে যাওয়া জিনিসপত্রের খোঁজ নেন। এটাই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। শাহজাহানের এক ভাই রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে কপিলমুণি রাজাকার ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। এলাকায় লুঠপাট করে তারা ইতোমধ্যে অনেক সম্পদেরও মালিক বনে গেছে। ফলে সম্পদ ফেরত দেওয়ার কোনো ইচ্ছা তাদের ছিল না। তারা বরং সিদ্ধান্ত নেয় দুলালকে হত্যা করার। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে একদিন ভোর বেলায় কয়েকজন রাজাকার দুলাল সরদারের বাড়িতে হানা দেয়। দুলাল সরদার শরীরে শাড়ি পেঁচিয়ে আত্মগোপন করার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত রাজাকাররা তাঁকে ধরে ফেলে। এরপর তাঁকে একটি নৌকায় তুলে রাজাকাররা আশেপাশের কয়েকটি গ্রামে হানা দিয়ে আরও দুইজন যুবককে আটক করে। এর একজন ছিলেন কপিলমুণি ইউনিয়নের বিরাশী গ্রামের সোনা গাজি।২১৩ দুপুরের দিকে রাজাকারা এই তিনজনকে চোখ বেঁধে দুলাল সরদারের বাড়ির ঠিক পশ্চিম পার কামারাবাদ গেটের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
দুলাল সরদারের মা মানদা দাসী এই ঘটনার পরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। বহুদিন তিনি নদীর তীর বরাবর হেঁটে বেড়াতেন এবং কেঁদে কেঁদে ‘দুলাল দুলাল’ বলে ছেলেকে ডাকতেন। ২১৪ তাঁর আশা ছিল ছেলের মৃতদেহটি তিনি অন্তত পাবেন। কিন্তু সন্তানহারা এই দুখিনী মায়ের সেই আশা কখনও পূরণ হয়নি।
……………………………………………………
২১৩. বিরাশী গ্রামটি ছিল রাজাকার অধ্যুষিত। এই গ্রামের দাউদ গাজি নামক একজন রাজাকার ছিল কপিলমুণি এলাকায় বহু অপকর্মের হোতা। ৭ ডিসেম্বর কপিলমুণি রাজাকার ক্যাম্পের পতন হলে জনতার দাবির মুখে মুক্তিযোদ্ধারা দাউদ গাজির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল।
২১৪. সাক্ষাৎকার, বিমল সরদার (দুলাল সরদারের ছোট ভাই, পানা, পাইকগাছা), ৮ এপ্রিল ২০১২।
……………………………………………………
সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার