You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.27 | দেয়াড়া গণহত্যা (২৭ আগস্ট ১৯৭১) | খুলনা - সংগ্রামের নোটবুক

দেয়াড়া গণহত্যা (২৭ আগস্ট ১৯৭১)

দিঘলিয়া খুলনা জেলার একটি উপজেলা। এটি একটি ইউনিয়নও। খুলনা শহরের দৌলতপুরের পার্শ্ববর্তী ভৈরব নদের অপর পারেই এর অবস্থান। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত থেকে এখানে কিছু অবাঙালি বিহারি এসে বসবাস শুরু করে। এরপর থেকে এলাকাটিকে বিহারি কলোনি বলা হতো। মুক্তিযুদ্ধকালীন এখানকার বিহারিদের একাংশ পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী ছিল। জুন মাসের পর দিঘলিয়ায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছিল। রাজাকার ও বিহারিরা সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি সেনাদের গ্রামে ডেকে এনে দেয়াড়া গণহত্যা ঘটায়।
দেয়াড়া গ্রামের ডা. মতিয়ার রহমানের ছেলে শেখ আবদার হোসেন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর নেতৃত্বে এলাকার বেশকিছু যুবক সংগঠিত হয়ে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন। এই যুবকরা মাঝে মাঝে দিঘলিয়ায় রাজাকারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতেন। খবর সংগ্রহ ও যুবকদের সংগঠিত করার জন্য শেখ আবদার হোসেন মাঝে মাঝে লুকিয়ে গ্রামে আসতেন।
২৭ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে খুব সকালে রাজাকার ও বিহারিদের সাথে বেশকিছু পাকিস্তানি সেনা দেয়াড়া গ্রামে হামলা চালায়। দৌলতপুরের পিপলস জুট মিলের পার্শ্ববর্তী খেয়াঘাট পার হয়ে পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে প্রবেশ করেছিল। গ্রামে প্রবেশ করার পর স্থানীয় বিহারিরাও তাদের সাথে যোগ দেয়। পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও বিহারি মিলিয়ে শতাধিক হামলাকারী মুহূর্তের মধ্যে সারা গ্রাম ঘিরে ফেলে। প্রথমে তারা মুক্তিযোদ্ধা আবদার হোসেনকে খুঁজতে থাকে। আবদার হোসেনের বাড়িতে প্রবেশ করে প্রথমে তারা তাঁর পিতা ডা. মতিয়ার রহমানকে সামনে পায়। মতিয়ার রহমানকে তারা বলে, ‘চলেন।’ মতিয়ার রহমান বলেন, ‘কোথায় যেতে হবে?” হামলাকারীরা বলে, ‘কলোনিতে যেতে হবে।’ ইতোমধ্যে হামলাকারীদের কয়েকজন মতিয়ার রহমানের চাচাতো ভাই শেখ রহমত আলী পিরু ও শেখ মোশারফ আলী, ভাগ্নে শেখ ইসমাইল হোসেন (ছোট খোকা), জামাই আবদুল জলিল ও জলিলের সহোদর আবদুল বারিককে ধরে আনে। এরপর এই ছয়জনকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে রাস্তায় নিয়ে যায়। মতিয়ার রহমানের পুত্র আফজাল হোসেন ছিলেন এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, “একদল লোক আব্বাকে নিয়ে চলে যায়। আর একদল আমাদের বাড়িতে নির্বিচারে গুলি করতে শুরু করে। যে যেখানে পারছে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে। আমি একটি ঝোঁপের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাথি।… রাজাকারের দল আমাদের বাড়ি থেকে আমার বাবা-সহ ছয় জনকে ধরে নিয়ে যায়।”২১৫
রাস্তায় নিয়ে গিয়ে ধৃত এই ছয়জনকে হামলাকারীরা দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানো শুরু করে। পরে গুলি করে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করে গ্রামের অন্যদিকে চলে যায়। এভাবে সমগ্র গ্রামে তখন চলছে নৃশংস গণহত্যা। এই গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী দেয়াড়া গ্রামের সৈয়দ আবুল বাশার। গণহত্যার সময়ে ভয়ে তিনি রাস্তার একপাশে আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু ঐ গ্রামের জনৈক আক্রান্ত যুবক হামলাকারীদের আক্রমণের ভয়ে দৌড়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, “বাশার ভাই, আমাকে বাঁচাও।” লোকটির পিছনে অস্ত্র হাতে ধাওয়া করেছিল হামলাকারীরা। একপর্যায়ে তারা লোকটিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এরপর তারা ধরে আবুল বাশারকে। তাঁকেও এক পর্যায়ে মাটিতে ফেলে কোপাতে শুরু করে। একপর্যায়ে তিনি নিথর হয়ে পড়লে হত্যাকারীরা তাঁকে মৃত ভেবে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যায়। কিন্তু সৌভাগ্যবশত আবুল বাশার তখন মারা যাননি। হামলাকারীরা চলে গেলে তিনি ইশারায় তাঁর পুত্র সৈয়দ ওবায়দুল হক হিরুকে কাছে ডাকেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওবায়দুল হক হিরু বলেন, “… আমার আব্বাকে দেখিয়ে বলে, ‘ওই ব্যাটা মুক্তি আছে।’ এরপর আব্বাকে ওই দা দিয়ে কোপ দেয়। আব্বা উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। ওরা ফিরে যাচ্ছিল। এ সময়ে কে যেন বলে ওঠে, ‘এই! বাশারের শরীর থেকে রক্ত বেরোয়নি।’ যে আগে আব্বাকে কুপিয়েছিল, সেই আবার ফিরে এসে এলোপাতাড়িভাবে কোপাতে থাকে। আব্বার সারা শরীর থেকে রক্ত বেরুতে থাকে। ওরা চলে যায়।”২১৬
এভাবে গ্রামে ঘুরে ঘুরে রাজাকার, বিহারি ও পাকিস্তানি সেনারা এদিন দেয়াড়া গ্রামে গণহত্যা চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী এই গণহত্যায় ঐ দিন ৬১ জনকে হত্যা করা হয়েছিল বলে জানা যায়। এঁদের মধ্যে ২২ জনকে গ্রামে তিনটি গণকবরে সমাহিত করা হয়। অবশিষ্ট লাশ ফেলে দেওয়া হয় পার্শ্ববর্তী ভৈরব নদে। এই গণহত্যায় দিঘলিয়ার গোয়ালপাড়া গ্রামের রাজাকার শওকত হোসেন এবং ব্রহ্মগাতি গ্রামের আবু জাফর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিয়েছিল।
দেয়াড়া গণহত্যায় নিহত অধিকাংশই দেয়াড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন না। নিরাপত্তার কারণে তখন শহরের অনেক মানুষ রাতে দেয়াড়া-সহ আশেপাশের গ্রামে এসে রাত্রিযাপন করতো। রাতে এসে খুব সকালে এরা চলে যেতো। এরা অধিকাংশই খুলনার বাইরের মানুষ, খুলনাতে চাকরি, ব্যবসা অথবা শ্রমজীবী হিসেবে কাজ করতো। ফলে এঁদের নাম পরিচয় সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। মোট ১৫ জনের নাম-পরিচয় জানা গেছে।
……………………………………………………
২১৫. শেখ আফজাল হোসেনের সাক্ষাৎকার। অন্ত. গৌরাঙ্গ নন্দী, দেয়াড়া গণহত্যা (খুলনা: ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট, ২০১৫), পৃ. ২৯।
২১৬. সৈয়দ আবুল বাশারকে পরে খুলনা সদর হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি বেঁচে যান। সৈয়দ ওবায়দুল হক হিরুর সাক্ষাৎকার। অন্ত. গৌরাঙ্গ নন্দী, দেয়াড়া গণহত্যা (খুলনা: ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট, ২০১৫), পৃ. ২৭।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার