You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.05 | পাতিবুনিয়া গণহত্যা | খুলনা - সংগ্রামের নোটবুক

পাতিবুনিয়া গণহত্যা (৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)

পাতিবুনিয়া গ্রামটি ডুমুরিয়া থানার শোভনা ইউনিয়নের একটি গ্রাম। ডুমুরিয়া থানা সদরের প্রায় বারো কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ঝিলা নদীর তীরে গ্রামটির অবস্থান।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে এই গ্রামে মুক্তিযুদ্ধপন্থী সশস্ত্র বামপন্থীরা একটি ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান করছিল। সশস্ত্র এই বামপন্থীদের স্থানীয় নেতা ছিলেন শেখ আবদুল মজিদ; তাঁর নাম অনুসারে এই বামপন্থীরা মজিদ বাহিনী নামেও পরিচিতি অর্জন করেছিল।২১৭ ৪ সেপ্টেম্বর তারিখে পাতিবুনিয়ায় অবস্থানরত এই বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে ঝিলা নদীতে পাকিস্তানি সেনা, বিহারি ও রাজাকারদের একটি লঞ্চ আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেয়। এই আক্রমণে বেশ কয়েকজন রাজাকার মারা যায় এবং কিছু গোলাবারুদ-সহ ১১টি রাইফেল মুক্তিসংগ্রামীদের হস্তগত হয়।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি মিলিটারি একটি গানবোট নিয়ে পাতিবুনিয়া গ্রাম আক্রমণ করে। উল্লেখ্য, আগের দিন লঞ্চ ডুবিয়ে দেওয়ার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিংবা রাজাকাররা আবার পাল্টা আক্রমণ করতে পারে, এই আশংকায় ঐ দিন সকাল থেকে মজিদ বাহিনীর যোদ্ধারা পাতিবুনিয়ায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু সেদিন সকাল গড়িয়ে বিকাল হয়ে যাওয়ার পরও আক্রমণের কোনো আলামত না দেখে বেলা চারটার দিকে চার- পাঁচজনের একটি ছোট দল পাতিবুনিয়া গ্রামের ঘাঁটিতে রেখে বাকিরা অন্যত্র চলে যায়। তাঁদের চলে যাওয়ার ঘণ্টা খানেক পর বেলা পাঁচটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা গানবোট থেকে পাতিবুনিয়া গ্রামের উপর গুলি ও শেল নিক্ষেপ শুরু করে। বেশ কিছুক্ষণ গোলা নিক্ষেপের পর স্থলভাগ থেকে পাল্টা আক্রমণের আলামত না দেখে পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের মধ্যে রাজাকারদের নামিয়ে দেয়৷
রাজাকাররা গ্রামে ঢুকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাসি চালাতে থাকে। প্রথমে তারা গোলক রায়, পুলিন রায় প্রমুখের বাড়ি প্রবেশ করে সেখানে কাউকে না পেয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামের অধিবাসীরা এ সময়ে ভয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। অনুমতি রায় নামক একজন বৃদ্ধা তাঁর তিন বছর বয়সী পৌত্রী মলিনা রায়কে কোলে নিয়ে বিরের মধ্য দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন। রাজাকাররা তাঁর পিছু ধাওয়া করে শিশুটি-সহ তাঁকে গুলি করে। প্রথম গুলিটি লাগে শিশু মলিনা রায়ের গায়ে। অনুমতি রায় শিশুটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় বুকে চেপে ধরেন, প্রায় সাথে সাথে রাজাকাররা তাঁকে গুলি করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং কিছুক্ষণ পর মারা যান। মারা যাওয়ার সময়ও তাঁর কোলে ছিল মলিনা রায়ের রক্তাক্ত মৃতদেহ।২১৮
রাজাকাররা এরপর গ্রামের উত্তর পাড়ার সরদার বাড়িতে প্রবেশ করে। ঐ বাড়ির অধিবাসীরা তখন বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বের বিলে আউশ ধানের ক্ষেত এবং খালের ঝোপের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। রাজাকাররা গুলি করতে করতে ধানক্ষেতে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে সরদার বাড়ির তিনজন এবং মন্টু কুমার নামক একজন মুক্তিসংগ্রামীকে গুলি করে হত্যা করে।২১৯
এঁদের হত্যা করে চলে যাওয়ার সময়ে রাজাকাররা ঐ গ্রামের মনোহর মণ্ডলের কয়েকটি পোষা হাঁস ধরে নিয়ে যায়। তারা যখন হাঁস ধরার চেষ্টা করছিল, তখন একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। রাজাকারদের তাড়া খেয়ে একটি হাঁস উড়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি গাছের আড়ালে গিয়ে পড়ে। রাজাকাররাও হাঁসের পিছনে পিছনে দৌড়ে সেখানে হাজির হয়। দুর্ভাগ্যবশত ঐ গাছের আড়ালে সরদার বাড়ির মহেন্দ্র সরকার লুকিয়ে ছিলেন। রাজাকাররা তাঁকে দেখামাত্র চার-পাঁচ গজ দূর থেকে গুলি করে। মহেন্দ্রনাথ সরকার সেখানেই প্রাণ হারান।
এই গণহত্যার পরে রাজাকাররা যখন গানবোটে ফিরে যাচ্ছিল, তখন স্থানীয় পি কে বলাবুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনন্ত কুমার রায়কে সপরিবারে বিলে একটি ঝোপের আড়ালে দেখতে পায়। তাঁকে লক্ষ করে রাজাকাররা অস্ত্র তাক করে এগিয়ে যায় এবং অনন্ত রায়কে ধরে নিয়ে যায়। রাজাকারদের আরেকটি দল সাহস ইউনিয়নের নোয়াকাটি গ্রামের জোবেদ আলী কাজি নামক মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠককে আটক করে। পঞ্চাশোর্ধ এই ব্যক্তি হিন্দু অধ্যুষিত পাতিবুনিয়া গ্রামে আশ্রয় নিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের মানসিকভাবে শক্তি যোগাতেন। বিশেষত চুকনগর গণহত্যার পর তিনি এই অঞ্চলের দুর্দশাগ্রস্ত জনগণকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে আসছিলেন। ধৃত এই দুইজনকে রাজাকাররা গানবোটে নিয়ে যায়। জানা যায়, অনন্ত রায়কে তারা গাবতলা গ্রামে নিয়ে বোট থেকে নদীর চরে নামিয়ে দিয়েছিল। নামিয়ে দিয়ে তারা অনন্ত রায়কে চলে যেতে বলেছিল। কিন্তু এটা ছিল পাকিস্তানি সেনাদের একরকম জীবন নিয়ে খেলা। অনন্ত রায় যখন চরের কাঁদার মধ্য দিয়ে হেটে তীরে ওঠার চেষ্টা করছিলেন, তখন পিছন দিক থেকে তাঁকে গুলি করা হয়। তাঁর মৃতদেহ সেখানেই পড়ে ছিল, জোয়ারের স্রোতে পরে সেটি ভেসে যায়। জোবেদ আলী কাজিকেও পাকিস্তানি সেনারা অত্যাচার করে হত্যা করেছিল বলে জানা যায়৷২২০
……………………………………………………
২১৭. শেখ আবদুল মজিদ ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকা একটি সশস্ত্র বাহিনী ডুমুরিয়া থানায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। শেখ মজিদ তাঁর পার্টির নির্দেশ উপেক্ষা করে একটি বাহিনী-সহ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ডুমুরিয়া উপজেলায় পকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সাথে তাঁর বাহিনীর সবচেয়ে বেশি মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
২১৮. সাক্ষাৎকার, গোলক রায় (পাতিবুনিয়া, শোভনা, ডুমুরিয়া), ২০ এপ্রিল ২০১৫।
২১৯. সাক্ষাৎকার, মহারানি সরকার ও তারক সরকার (পাতিবুনিয়া সরদার বাড়ি, ডুমুরিয়া), ২০ এপ্রিল ২০১৫।
২২০. সাক্ষাৎকার. গোলক রায় ও অশোক সরকার (পাতিবুনিয়া (শোভনা), ডুমুরিয়া), ২০ এপ্রিল ২০১৫। কেউ কেউ মনে করেন, জোবেদ আলী কাজি গানবোটের বাথরুমে নিজের কাপড় গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। ধরা পড়ার পর থেকে অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করছিল। তাঁর কাছ থেকে যেন কোনো তথ্য পাকসেনারা বের করতে না পারে এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার শত্রুদের হাতে তাঁর যেন মৃত্যু না হয়, এই বিপ্লবী প্রেরণা থেকে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার