কাঠেঙ্গা গণহত্যা (৩০ সেপ্টেম্বর ও ২২ নভেম্বর ১৯৭১)
কাঠেঙ্গা গ্রামটি ডুমুরিয়া থানার ধামালিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। ডুমুরিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে খুলনা ও যশোর জেলার সীমান্তে গ্রামটির অবস্থান। গ্রামের পশ্চিম পাশে ভবদহ নামক একটি নদী বয়ে গেছে। কাঠেঙ্গার পূর্ব পাশে টোলনা গ্রাম এবং দক্ষিণ পাশে চেঁচুড়ি গ্রামের অবস্থান।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধামালিয়া ইউনিয়ন ছিল মুসলিম লীগ ও জামায়াত ইসলামী অধ্যুষিত এলাকা। এই ইউনিয়নের কাঠেঙ্গা, টোলনা, জামিরা প্রভৃতি গ্রামগুলোতে রাজাকার বাহিনীর ব্যাপক দাপট ছিল। এই এলাকার রাজাকারদের দ্বারা ডুমুরিয়া উপজেলার সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। কাঠেঙ্গা প্রাইমারি স্কুলের মাঠ এবং ভবদহ নদীর তীরে এই গণহত্যাগুলো ঘটানো হতো। ভবদহ নদীতে গণহত্যা হতো মূলত ধারাবাহিকভাবে। খুলনা ও যশোরের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেদের ধরে এনে রাতে এই নদীর তীরে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত।
কাঠেঙ্গার পার্শ্ববর্তী চেঁচুড়ি গ্রামের আকবর সরদার নামক একজন যুবককে রাজাকাররা ভবদহ নদীর পার্শ্ববর্তী কপালিয়া বাজারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই যুবক ছিল দরিদ্র। পার্শ্ববর্তী মান্দ্রা গ্রাম থেকে তাঁকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে প্রথমে কপালিয়া বাজারে একটি বকুল গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে। কিছুক্ষণ প্রহার করার পর রাজাকাররা তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশ ছুরি দিয়ে ফেড়ে দেয়। নির্যাতন আর রক্তক্ষরণে আকবর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এই সময়ে কপালিয়া বাজার মসজিদে আজান হচ্ছিল। আকবর শেষবারের মতো একটু নামাজ পড়ার জন্য রাজাকারদের কাছে করুণ মিনতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে আকবরকে ঝুলিয়ে রেখে রাজাকাররা নামাজ পড়তে যায়। নামাজ পড়ে তারা যখন ফিরে আসে, তখন আকবর ‘আল্লাহ আল্লাহ’ বলে জিকির করছিল। রাজাকাররা সেই অবস্থায় গুলি করে তাঁকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। এছাড়া এই নদীতে ডুমুরিয়ার মজিদ বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধা সাইদ, আবদুল আলী, এম এম হক প্রমুখকে হত্যা করা হয়েছিল বলে জানা যায়।২২৭
কাঠেঙ্গা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে মূলত দুই পর্বে গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই মাঠের পার্শ্ববর্তী তাগের আলী হালদারের বাড়িটি স্থানীয় রাজাকাররা দখল করে নির্যাতন কেন্দ্র বানিয়েছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবকদের ধরে এখানে এনে নির্যাতন করা হতো। ৩০ শে সেপ্টেম্বর রাতে এখানে কিছু যুবককে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। পরে গভীর রাতে স্কুলের মাঠে নিয়ে গিয়ে তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়। কাঠেঙ্গা গ্রামের রাজাকারদের সাথে এই রাতে পার্শ্ববর্তী জামিরা বাজার ক্যাম্পের রাজাকাররাও গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল।২২৮ এই গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে চেঁচুড়ি গ্রামের সাত জনের নাম জানা গেছে।
কাঠেঙ্গা স্কুল মাঠে আরেকটি গণহত্যা হয় ২২ নভেম্বর তারিখে। উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বর মাস থেকে ভারতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ডুমুরিয়া এলাকায় প্রবেশ করেছিল। এর আগে মূলত মজিদ বাহিনীর গেরিলারা মুক্তিযুদ্ধ করছিল। সেপ্টেম্বর মাস থেকে মজিদ বাহিনীর গেরিলা ও মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে থাকে। ফলে রাজাকাররা এই সময়ে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। এলাকায় সন্দেহভাজন কাউকে পেলে তারা তাকে হত্যা করতো। ২২ নভেম্বর রাজাকাররা এ রকম চব্বিশ জন যুবককে বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে। পরে রাত্রে তাদের কাঠেঙ্গা প্রাইমারি স্কুল মাঠে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করে।২২৯ এখানে গুলিবিদ্ধ হয়েও চেঁচুড়ি গ্রামের জব্বার মোল্লা ও বশির গাজী জীবিত ছিলেন।
কিন্তু হাত পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধা থাকায় উঠে পালাতেও পারেননি। পরদিন সকালে রাজাকাররা এই খবর পেয়ে এই দুইজনকে বাঁধন খুলে জামিরা বাজারে নিয়ে যায়। সেখানে খেজুর গাছের সাথে ঝুলিয়ে তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়।২৩০
কাঠেঙ্গা গণহত্যায় নিহত হয়েছিলেন চেঁচুড়ি গ্রামের ছবেদ আলীর ছেলে লুৎফর সরদার। দরিদ্র পিতামাতার একমাত্র সন্তান লুৎফর সরদারকে রাজাকাররা তাদের বাহিনীতে যোগ দিয়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে বলেছিল। লুৎফর তাতে রাজি না হওয়ায় রাজাকাররা তাঁকে চেঁচুড়ি মাঠে ধরে নিয়ে যায়। একমাত্র সন্তানের প্রাণ রক্ষার জন্য লুৎফরের পিতামাতা রাজাকার ও পিস কমিটির লোকজনের পায়ে ধরে মিনতি জানায়। এর ফলে রাজাকাররা তাঁদের আশ্বস্ত করে যে, লুৎফরকে মারা হবে না, একটু বুঝিয়ে-সুজিয়ে তাকে রাতে ছেড়ে দেয়া হবে। আশ্বাস পেয়ে লুৎফরের পিতামাতা বাড়ি চলে যান।
রাত গভীর হলে হঠাৎ অনবরত গুলির শব্দ হতে থাকে। লুৎফরের পিতামাতা এতে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। দ্রুত তাঁরা চেচুড়ি মাঠের দিকে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন লুৎফরের মৃতদেহ পড়ে আছে, চোখটা খোলা, মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। একমাত্র পুত্রের এই বীভৎস মৃত্যু দেখে লুৎফরের পিতা ছবেদ আলী পরদিন থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
পরদিন লুৎফরকে কবরস্থ করা হয়। লুৎফরের মা প্রায়ই ছেলের এই কবরটা জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতেন। কখনও আপন মনে ছেলের সাথে কথা বলতেন, কখনও কবর জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠতেন।২৩১
……………………………………………………
২২৭. সাক্ষাৎকার, শেখ আমজাদ হোসেন (চিংড়া, ডুমুরিয়া), ৩০ এপ্রিল ২০১৫। এই আমজাদ হোসেন ছিলেন মজিদ বাহিনীর একজন গেরিলা যোদ্ধা।
২২৮. শেখ আব্দুল জলিল, ডুমুরিয়ার ইতিহাস (ডুমুরিয়া: আরণ্যক প্রকাশনা, ২০০৩), পৃ. ১২৮ ৷ বর্তমান লেখক সরজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে (২৫ ডিসেম্বর ২০০৪) এই গণহত্যার নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পেয়েছেন। কারো মতে এই সংখ্যা আঠাশ, কারো মতে বত্রিশ।
২২৯. সাক্ষাৎকার, আবদুল মোতলেব সরদার, মো. আলতাফ হোসেন গাজী ও অন্যান্য, ২৫ ডিসেম্বর ২০০৪।
২৩০. সাক্ষাৎকার, আবদুল গফুর মোল্লা (চেঁচুড়ি, ধামালিয়া, ডুমুরিয়া), ৮ জানুয়ারি ২০১৭।
২৩১. সাক্ষাৎকার, আতিয়ার সরদার (চেঁচুড়ি, ধামালিয়া, ডুমুরিয়া), ৮ জানুয়ারি ২০১৭। আতিয়ার সরদার লুৎফর সরদারের কাকাতো ভাই। কাকা ছবেদ আলীর কাছেই তিনি লালিত পালিত হন। লুৎফরের মৃতদেহ তিনি কাঁধে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন।
……………………………………………………
সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার