You dont have javascript enabled! Please enable it!

চারাবাড়িঘাট গণহত্যা (১ অক্টোবর ১৯৭১)

ডুমুরিয়া উপজেলার ধামালিয়া ইউনিয়নের উত্তর সীমান্তের একটি স্থান চারাবাড়ি ঘাট। ডুমুরিয়া সদর থেকে স্থানটি প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এটি মূলত একটি বড়ো খালের তীরবর্তী নৌকার ঘাট। এই ঘাটের সংলগ্ন উত্তর পাশে রয়েছে পিপরাইল গ্রাম। গ্রামটি ফুলতলা উপজেলার জামিরা ইউনিয়নভুক্ত। চারাবাড়ি ঘাট মূলত ফুলতলা ও ডুমুরিয়া থানার সংযুক্তিস্থল।
চারাবাড়ি ঘাটের প্রায় দেড় কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে জামিরা বাজার। ১৯৭১ সালে এই বাজারে জনৈক মোস্তফা ডাক্তারের একটি দোকানে রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। পিপরাইল গ্রামের মনসুর সরদার ছিল এই রাজাকার ক্যাম্পের কমান্ডার। ডুমুরিয়া ও ফুলতলা থানার সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় উভয় থানার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ ধরে এনে এখানে নির্যাতন ও হত্যা করা হতো।
ডুমুরিয়ার উত্তরাঞ্চলে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রভাব ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। প্রায়ই খুলনা থেকে পাকিস্তানি সেনারা এখানে এসে রাজাকারদের নির্দেশনা প্রদান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা করতো। সেনাবাহিনীর এই সহায়তা পেয়ে স্থানীয় রাজাকারদের অত্যাচার ও নির্যাতন চরম আকার ধারণ করেছিল। এই রাজাকার ক্যাম্পে হাসেম আলী গাজী (পিতা: জয়নাল গাজী) নামক টোলনা গ্রামের এক যুকককে স্থানীয় শান্তি কমিটির আফসার মোল্লা ও ছহিল সরদার ধরে নিয়ে ব্যাপক অত্যাচার করেছিল। পিতার সামনে হাশেম আলীর হাতে পায়ের নখের মধ্যে এমনকি চোখের মধ্যেও খেজুর গাছের কাঁটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নির্মম এই নির্যাতনের এক পর্যায়ে সে মারা যায়। সুদর্শন যুবক হাসেম আলী ছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী। পুত্রের নির্যাতনের এই নির্মম দৃশ্য তাঁর পিতা জয়নাল গাজী শুধু অসহায় চোখে দেখেছিলেন।২৩২ এভাবে রাজাকারদের দাপটে সমগ্র অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। এসব কারণে মজিদ বাহিনীর এই অঞ্চলের যোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী মানুষ তখন এলাকাছাড়া হয়ে গিয়েছিল।
সেপ্টেম্বর মাসের দিকে জামিরা রাজাকার ক্যাম্পের কমান্ডারের দায়িত্বে ছিল চেঁচুড়ি গ্রামের গাউসুল আজম হাদি। স্থানীয় কারিগর পাড়ার মসজিদে শান্তি কমিটির এক সভা করে সে ঘোষণা দিলো, “যারা পাকিস্তানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে মজিদ বাহিনীতে যোগ দিয়েছে অথবা রাজাকারদের সাথে বিরোধিতার কারণে এলাকাছাড়া হয়ে আছে, তাদের আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। বিচার করে যার যেটুকু অপরাধ, সামান্য শাস্তি দিয়ে ক্ষমা করে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমি মসজিদে বসে প্রতিজ্ঞা করে বলছি, কাউকে হত্যা করা হবে না। আর যারা আত্মসমর্পণ করবে না, তাদের বংশের সব শেষ করে দেওয়া হবে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হবে। জমিজমা ও বাড়ির স্ত্রী কন্যাদের খানসেনা আর রাজাকারদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।” এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া মানুষজনকে দ্রুত নিজ বাড়িঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য স্থানীয় কমিটির লোকেদের দায়িত্ব দেওয়া হলো। শান্তি কমিটির তিনজন সদস্য স্থানীয় পলাতক ব্যক্তিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে দিলো।
১ অক্টোবর ছিল রাজাকার গাউসুল আজম হাদি ঘোষিত আত্মসমর্পণের দিন। শান্তিপূর্ণভাবে এলাকায় অবস্থানের আশ্বাস পেয়ে এদিন প্রায় পাঁচশত নারী-পুরুষ চেঁচুড়ি গ্রামের মধ্যপাড়া প্রাইমারি স্কুলের মাঠে সমবেত হয়। সভায় গাউসুল আজমও উপস্থিত ছিলেন। এক পর্যায়ে এই রাজাকার কমান্ডার কোরআন শরিফ মাথার উপরে রেখে সকলের উদ্দেশ্যে শপথ করে বললো, “কাউকে হত্যা করা হবে না। যেসব যুবকের তালিকা করা হয়েছে, তাদের এখন আলাদা করে জামিরা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তাদের পাকিস্তানের ও রাজাকারদের পক্ষে কাজ করার বিষয়টি ভালোভাবে বুঝিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে।” তালিকাভুক্ত যুবকদের পিতা-মাতাদের উদ্দেশ্য করে বললো, “আপনারা সবাই নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যান।” এরপর বেলা ১১ টার দিকে তালিকাভুক্ত প্রায় ৬০/৭০ জন যুবককে জামিরা বাজার রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো। এই যুবকদের অধিকাংশই ছিল ডুমুরিয়া থানার টোলনা, ধামালিয়া ও পাকুড়িয়া গ্রামের অধিবাসী। এছাড়া চেঁচুড়ি, দহকুলা, জামিরা ও পিপরাইল গ্রামের কিছু যুবকও ছিল।
জামিরা বাজারে নেওয়ার পরে সমগ্র বাজারে রাজাকারদের সশস্ত্র পাহারা বসিয়ে দেওয়া হয়। বলা হলো, কেউ অনুমতি ছাড়া বাজারে প্রবেশ করতে পারবে না, বের হতে পারবে না।” আগে থেকেই খবর দিয়ে আশেপাশের রাজাকারদের এখানে জড়ো করা হয়েছিল। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পরে রাজাকাররা উগ্রমূর্তি ধারণ করে। আটককৃতদের উপর শুরু হয় বেদম প্রহার। একপর্যায়ে তাদের মাটিতে ফেলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে গায়ে লবণ দেওয়া হতে লাগলো। এরপর রাত গভীর হলে ধৃতদের পিঠমোড়া করে বেঁধে চারাবাড়ি ঘাটে নিয়ে যাওয়া হলো। নয় জনের এক একটি করে দল তৈরি করে প্রতিটি দলকে একটি করে লম্বা দড়িতে বাঁধা হয়। এভাবে বেশ কয়েকটি লম্বা দড়িতে যুবকদের দলবদ্ধভাবে বাঁধা হলো। এরপর অস্ত্রের মুখে রাত আনুমানিক দুইটার সময় তাদের চারাবাড়ি ঘাটে নিয়ে একে একে গুলি করে হত্যা করা হয়।
টোলনা গ্রামের আবদুল হাকিম গাজী নামক এক ব্যক্তি এদিন গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন। দড়ি দিয়ে বেঁধে তাঁকেও রাতে চারাবাড়ি ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। গুলি তাঁর কপালের বাম পাশে লেগেছিল। কিন্তু সৌভাগ্যবশত সে গুলি তাঁর মাথার খুলির ভিতরে প্রবেশ না করে পিছলে বেরিয়ে যায়। গণহত্যা শেষ হওয়ার পরে কেউ বেঁচে আছে কিনা রাজাকাররা টর্চ মেরে তা পরীক্ষা করেছিল। আবদুল হাকিম গাজী তখন মরার ভান করে রক্তমাখা দেহ নিয়ে মাটিতে পড়ে ছিলেন। রাজাকাররা চলে গেলে তিনি তাঁর পিছনের বাঁধা হাত খুলে পার্শ্ববর্তী খালের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যান।২৩৩
রাতে এই গুলি করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিল জামিরা ক্যাম্পের রাজাকার তৈয়ব আলী। গুলিবিদ্ধ ও মুমূর্ষু অবস্থায় জোনাব আলী নামক টোলনা গ্রামের এক ব্যক্তি পানি পান করতে চেয়েছিলেন। রাজাকার তৈয়ব আলী তখন তাঁর মুখে প্রশ্রাব করে দেয়। ঘৃণায় জোনাব আলী রাজাকার তৈয়ব আলীর দিকে থু থু নিক্ষেপ করে। এতে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে রাজাকার তৈয়ব আলী বেয়নেট দিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী জোনাব আলীর মুখ ফেড়ে দেয়।২৩৪ সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
চারাবাড়ি ঘাটে গণহত্যায় নিহত প্রায় ষাট জনের নাম-পরিচয় জানা গেছে। তবে চারাবাড়ি ঘাট ছিল একটি ধারাবাহিক গণহত্যার স্থান। জুন মাস থেকে এখানে ধারাবাহিকভাবে গণহত্যা চলতো। চারাবাড়ি ঘাটের পার্শ্ববর্তী ডুমুরিয়া থানার পাকুড়িয়া, ধামালিয়া, টোলনা এবং ফুলতলা থানার পিপরাইল, ছাতিয়ানি, জামিরা প্রভৃতি গ্রাম থেকে বিভিন্ন সময়ে এই বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। ফলে এই বধ্যভূমিতে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি।
……………………………………………………
২৩২. সাক্ষাৎকার, আবদুল হাকিম গাজী (টোলনা, ধামালিয়া, ডুমুরিয়া)। ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬। নিহত হাসেম আলী গাজী ছিলেন এই আবদুল হাকিম গাজীর ভ্রাতুষ্পুত্র।
২৩৩. সাক্ষাৎকার, আবদুল হাকিম গাজী (টোলনা, ধামালিয়া, ডুমুরিয়া), ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬। এরপর বাংলাদেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি দিনের বেলা মাঠে ধান ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে থাকতেন। গভীর রাতে গোপনে বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়ে আসতেন। দেশ হানাদারমুক্ত . হওয়া পর্যন্ত তাঁর এভাবেই কাটে।
২৩৪. সাক্ষাৎকার, আবদুল হাকিম গাজী (টোলনা, ধামালিয়া, ডুমুরিয়া)। ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!