You dont have javascript enabled! Please enable it!

কপিলমুণি গণহত্যা (জুন থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১)

কপিলমুণি হলো পাইকগাছা উপজেলার অন্তর্গত একটি বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্র। জুন মাসে কপিলমুণির প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়ি দখল করে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীরা একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। এখানকার নেতৃস্থানীয় রাজাকারদের মধ্যে অন্যতম ছিল আফতাব ক্কারী (মাছিআড়া, তালা, সাতক্ষীরা), সৈয়দ ফকির (হরিদাসকাঠি, পাইকগাছা), আফসার মুন্সি (শ্রীরামপুর, পাইকগাছা) প্রমুখ। এখান থেকে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য রাজাকার ক্যাম্পও পরিচালনা করা হতো। পার্শ্ববর্তী এলাকাসহ দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষকে ধরে এনে এখানে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। প্রায় প্রতিদিনই গভীর রাত্রে এখান থেকে নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ শোনা যেতো। এখানে নির্যাতনের পরে হত্যা করে পার্শ্ববর্তী কপোতাক্ষ নদে লাশ ফেলে দেওয়া হতো। এখানকার নির্যাতন মাঝে মাঝে চরম নিষ্ঠুর আকার ধারণ করতো। ডিসেম্বর মাসে সাতক্ষীরার তালা থানার মাছিয়াড়া গ্রামের সৈয়দ গাজিকে (পিতা: রহিম বখশ্ গাজি) রাজাকাররা ধরে এনে জীবন্ত অবস্থায় শরীরে পেরেক বিদ্ধ করে দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিল। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এই রাজাকার ক্যাম্পের পতন হলে তাঁর মৃতদেহ দেয়ালে পেরেক বিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।১৯৬ কপিলমুণি বাজার থেকে রাজাকাররা প্রায়ই যুবকদের ধরে এখানে নিয়ে নির্যাতন করতো। ডুমুরিয়া থানার মাগুরখালী ইউনিয়নের গাজীনগর গ্রামের নিরঞ্জন মণ্ডল (১৮)-কে এখানকার রাজাকাররা কপিলমুণি বাজার থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁকে পরে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, রাজাকাররা তাঁকে হত্যা করেছিল।১৯৭

কপিলমুণি গণহত্যার ব্যাপকতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কপিলমুণি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা স ম বাবর আলী, সুনীল ফৌজদার প্রমুখের দেওয়া তথ্য থেকে এ ব্যাপারে কিছু ধারণা করা যায়। ৭ ডিসেম্বর তারিখে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে এই রাজাকার ঘাঁটির পতন হয়েছিল। এরপর এখান থেকে একশত পঞ্চান্ন জন রাজাকারকে বন্দী করে শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল। এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে এ সংক্রান্ত একটি সংক্ষিপ্ত সভাও হয়েছিল। সভার বিবরণ দিতে গিয়ে বাবর আলী বলেন:
এ সময়ে বেশ কিছু কাগজপত্রসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছুটে আসে। একটা কাগজে ওরা (রাজাকাররা) যাদের মেরেছে তার এক তালিকা পাওয়া যায়। দেখা গেল ১৬০১ (এক হাজার ছয়শত এক) জনকে রাজাকাররা হত্যা করেছে এবং আরো প্রায় ১০০০ (এক হাজার) জন লোককে হত্যার নীল নকশা তাদের কাগজে পাওয়া গেল।১৯৮
এই বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে, রাজাকাররা হত্যার লিখিত হিসাব রাখতো। অনুমিত হয় যে, রাজাকাররা পার্শ্ববর্তী সাতক্ষীরা জেলাসহ দূরবর্তী অন্যান্য স্থান থেকে মানুষজন ধরে এনে এখানে হত্যা করতো। জুন মাসে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপনের পর থেকে ডিসেম্বরে এর পতনের আগ পর্যন্ত প্রায় ছয় মাসব্যাপী এখানে গণহত্যা চলেছিল।
……………………………………………………
১৯৬. সাক্ষাৎকার, বাবর আলী, ০২ ডিসেম্বর ২০০৪। সাক্ষাৎকার, সুনীল ফৌজদার (কুলটী,
ডুমুরিয়া), ২৬ মার্চ ২০০৫।
১৯৭. সাক্ষাৎকার, অনুকুল রায় (শিবনগর, ডুমুরিয়া), ১১ মার্চ ১৯৭১।
১৯৮. বাবর আলী, দুর্জয় অভিযান, পৃ. ১০৭।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!