You dont have javascript enabled! Please enable it!

কালীনগর গণহত্যা (জুলাইয়ের প্রথমার্ধ ১৯৭১)

কালীনগর গ্রামটি পাইকগাছা থানার দেলুটি ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। গ্রামটি পাইকগাছা থানার প্রায় সীমানায় অবস্থিত। এর অল্প দূরে বারোআড়িয়া নামক বটিয়াঘাটা থানার একটি বাণিজ্য কেন্দ্র অবস্থিত। বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা এবং ডুমুরিয়া থানার মিলনস্থলেই এই ব্যবসায় কেন্দ্রের অবস্থান।
কালীনগর গ্রামের গুরুপদ মণ্ডল নামক এক ব্যক্তির দর্জির দোকান ছিল বারোআড়িয়ার। লোকটি স্বভাবে ছিল প্রতিবাদী এবং সাহসী। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে বারআড়িয়ায় রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। রাজাকাররা প্রায়ই বাজারের দোকানদারদের ওপর নানাবিধ জুলুম করতো। এই জুলুমের শিকার হয় গুরুপদ মণ্ডলও। প্রথমদিকে টাকা-পয়সা, খাবার ও পোশাক-আশাক প্রদান করে তিনি রাজাকারদের সামলে আসছিলেন। কিন্তু ঘটনা যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে যৌন নিপীড়নের জন্য মেয়ে সরবরাহের পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন তিনি বাদ সাধেন। কারণ, তার নিজের মেয়ে তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। এছাড়া স্ত্রীও রয়েছে। এর ফলে রাজাকাররা তাঁর উপর ক্ষিপ্ত হয়।
একদিন সকালে রাজাকাররা হঠাৎ বাড়িতে প্রবেশ করে গুরুদাস মণ্ডলের স্ত্রী গুরুদাসীকে ধরে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়। স্ত্রীকে রক্ষা করার জন্য তিনি রাজাকারদের বাধা দিলে সাথে সাথে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। গুরুদাসীকে এরপর রাজাকাররা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। গুরুদাসী তখন মিনতি করে বলতে থাকেন যেন রাজাকাররা তাঁর সন্তানদের না মেরে তাঁকে মেরে ফেলে। কিন্তু রাজাকাররা বলতে থাকে, “তোর সামনেই সবগুলোকে গুলি করে মারবো!” এরপর তাঁর সামনেই তাঁর বড়ো ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। তখন সে ছিল একাদশ শ্রেণির ছাত্র। এরপর একে একে অপর এক পুত্র খোকন (পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র) এবং দুই কন্যা অঞ্জলি ও পারুলকেও গুরুদাসীর সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। গুরুদাসীর ছোট মেয়ে পারুল তখন দুগ্ধপোষ্য শিশু, মায়ের কোলেই সে ছিল। রাজাকাররা তাকে মায়ের কোল থেকে কেঁড়ে নিয়ে পাশের পুকুরে বুক অবধি পুঁতে ফেলে। আতঙ্কে শিশুটি চিৎকার করে কাঁদছিল। রাজাকাররা সেখানেই তার বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
চোখের সামনে স্বামী সন্তানদের খুন হতে দেখে গুরুদাসী চিৎকার করে বলতে থাকেন, “আমাকেও মেরে ফেল!” রাজাকাররা তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে গুরুদাসীকে তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে।১৯৯ বারোআড়িয়ার হাতেম, মোজাহার-সহ আরও কিছু রাজাকার ছিল এই হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের মূল হোতা। এই ঘটনার পরে গুরুদাসী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কালীনগর গণহত্যার নির্দিষ্ট তারিখ জানা যায়নি। জুলাই মাসের প্রথমার্ধের কোনো এক দিনে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়।২০০
……………………………………………………
১৯৯. সাক্ষাৎকার, গুরুদাসী মণ্ডল (কালীনগর, পাইকগাছা), ১৭ এপ্রিল ২০০৪। গুরুদাসীর পরিবারে এই হত্যাকাণ্ডটি খুলনা এলাকায় যথেষ্ট পরিচিত। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সে খুলনার কপিলমুণি, পাইকগাছা, চুকনগর, ডুমুরিয়া, বারআড়িয়া প্রভৃতি বাজারে লাঠি হাতে ঘুরে বেড়াতো। এভাবে লাঠি হাতে ঘুরে বেড়ানো অবস্থায় ডুমরিয়াতে তাঁর সাথে বর্তমান লেখকের আলাপ হয়।
২০০. তদেব।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!