বাদুড়গাছি গণহত্যা (১৮ মে ১৯৭১)
বাদুড়গাছি গ্রামটি ডুমুরিয়া থানার শোভনা ইউনিয়নে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খুলনায় ঘটে যাওয়া অন্যান্য গণহত্যার সাথে বাদুড়গাছি গণহত্যার কিছু মৌলিক ভিন্নতা রয়েছে। খুলনার প্রায় সব গণহত্যা এবং হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা। কিন্তু বাদুড়গাছি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল এমন একটি গোষ্ঠীর দ্বারা, মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে ছিল না, বরং স্থানীয় রাজাকারদের বিরুদ্ধে তারা বেশকিছু সফল অভিযানও করেছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সত্তরের দশকের শুরুর দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চীনা কমিউনিস্ট বিপ্লব প্রভাবিত ‘নকশালবাড়ি আন্দোলন’ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। এই আন্দোলনের একটি পন্থা ছিল ‘শ্রেণিশত্রু খতম’ করা। শ্রেণিশত্রু খতমের নাম করে তারা অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিকে হত্যা করে তাদের সম্পদ লুঠ করেছিল। এছাড়া এর মাধ্যমে অনেক নকশালবাদী ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাও চরিতার্থ করতো। বাদুড়গাছি গণহত্যা এমনই সম্পদ লিপ্সা ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে সংঘটিত হয়।
গণহত্যার ঘটনা
১৯৭১ সালের ১৮ মে আট-দশজন সশস্ত্র নকশালপন্থী সকাল নয়-দশটার দিকে বাদুড়গাছি গ্রামে প্রবেশ করে। বাদুড়গাছি গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী দুই-তিনটি ইউনিয়নের তৎকালীন সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী ছিলেন পুলিন সরদার, দয়াল সরদার, বিষ্ণুপদ সরদার প্রমুখ সরদারবংশীয় ভ্রাতৃগণ। সন্ত্রাসীদের আগমন বুঝতে পেরে তারা বাড়ির দোতলা থেকে বন্দুক ফায়ার করে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে তথাকথিত এই বিপ্লবীরা সরদার বাড়ির অপর এক ভাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে এবং সবাইকে নিরস্ত্র করে বেঁধে ফেলে। বাড়ির মহিলারা এ সময়ে তাদের যাবতীয় অলংকার ও অর্থাদির বিনিময়ে ধৃত ভ্রাতৃত্রয়ের জীবন ভিক্ষা চায়। তাদের কাকুতি-মিনতিতে কর্ণপাত না করে ঘাতকরা হতভাগ্য সরদার ভাইদেরকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ঘেংরাইল নদীর তীরে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে। এরপর তারা সরদার বাড়িতে লুঠ করে। হত্যা ও লুণ্ঠন শেষে তারা “শ্রেণিশত্রু খতম হলো” এই মর্মে শ্লোগান দিতে দিতে চলে যায়।১২৩ এই গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিল ডুমুরিয়ার শোভনা গ্রামের নকুল মল্লিক নামক একজন নকশাল সদস্য।১২৪
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই সরদাররা ছিল পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের কাছে অনেকটা অভিভাবকের মতো। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ডুমুরিয়া থানার অন্যান্য স্থানে যে লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু হয়েছিল, এই সরদারদের প্রভাবের কারণে বাদুড়গাছি ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তা হয়নি। এদের নিহত হবার পরদিন থেকেই কাছাকাছি তিন-চারটি ইউনিয়নে ভয়াবহ নির্যাতন ও লুণ্ঠন শুরু হয়ে যায়। ফলে এলাকার অধিবাসীরা দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।১২৫ এর মাত্র তিনদিন পর এই দেশত্যাগীদের একাংশ চুকনগর গণহত্যার শিকার হয়।
……………………………………………………
১২৩. সাক্ষাৎকার, রণজিৎ সরদার (বাদুড়গাছি, ডুমুরিয়া; রণজিৎ সরদাদের পিতা এই হত্যাকাণ্ডে নিহত হন), ১২ ডিসেম্বর ২০০৪। সাক্ষাৎকার, মণিমোহন রায় (পশ্চিম পাতিবুনিয়া, ডুমুরিয়া), ২৪ ডিসেম্বর ২০০৫।
১২৪. সাক্ষাৎকার, কামাখ্যাপ্রসাদ রায়চৌধুরি, ২৬ জুলাই ২০১৪।
১২৫. সাক্ষাৎকার, রণজিৎ সরদার, ১২ ডিসেম্বর ২০০৪।
……………………………………………………
সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার