You dont have javascript enabled! Please enable it!

ফুলতলা-দেবীতলা-বাদমতলা গণহত্যা (১৯ মে ১৯৭১)

ফুলতলা, দেবীতলা ও বাদামতলা বটিয়াঘাটা থানার গঙ্গারামপুর ও বটিয়াঘাটা ইউনিয়নের পরস্পর সংলগ্ন তিনটি গ্রাম। এপ্রিল-মে মাসে সমগ্র খুলনায় যখন গণহত্যা ও নির্যাতনের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, বটিয়াঘাটা থানার বেশিরভাগ হিন্দু অধিবাসী তখন দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।১৩২ এই সময়ে পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলা থেকে অনেক শরণার্থী বটিয়াঘাটা এলাকায় এসে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছিল। স্থানীয় ‘শান্তি কমিটি’ মারফত পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই খবর পেয়ে লঞ্চ যোগে ফুলতলা গ্রামে আসে। পলায়নপর ও দেশত্যাগে উদ্যত মানুষের কাছে থেকে তাদের শেষ সম্বলটুকু লুণ্ঠন এবং ফেলে যাওয়া স্থাবর ও অন্যান্য সম্পত্তি দখল করার লক্ষ্যেই তথাকথিত ‘শান্তি কমিটি’ পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা এই গণহত্যা ঘটিয়েছিল বলে অনুমান করা যায়।

গণহত্যার ঘটনা
১৯৭১ সালের ১৯ মে তারিখে সকাল সাতটার দিকে পাকিস্তানি মিলিটারি লঞ্চে করে ফুলতলা গ্রামে এসে পৌঁছায়। মিলিটারি আসার সংবাদে গ্রামবাসীরা পালিয়ে পার্শ্ববর্তী বাদামতলা গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। যে যার মতো প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়ায় ফুলতলা গ্রামের রাজেন্দ্রনাথ মণ্ডল নামক অশীতিপর একজন বৃদ্ধ এবং রামলাল নামক মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তি তখনও গ্রামে রয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে প্রবেশ করে কাউকে না পেয়ে ওই দুই ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে এবং পুরো গ্রামটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফুলতলা গ্রামে হত্যা ও অগ্নিসংযোগের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেবীতলা গ্রামে প্রবেশ করে। দেবীতলা গ্রামও মিলিটারির আতঙ্কে কার্যত জনশূন্য হয়ে পড়েছিল অল্প কয়েকজন বৃদ্ধ তখন পর্যন্ত গ্রাম ত্যাগ করতে পারেননি। মিলিটারি গ্রামে প্রবেশ করেই এ রকম চার- পাঁচজন বৃদ্ধকে গুলি করে হত্যা করে। দেবীতলার পার্বতী মণ্ডল নামক একজন বৃদ্ধকে মিলিটারিরা উপুড় করে গাছের ডালে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে এবং পরে তাকে বেয়নেট বিদ্ধ করে হত্যা করে।১৩৩
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তার সহযোগীদের এই নির্মম জিঘাংসার আতঙ্কে ফুলতলা, দেবীতলা, বসুরাবাদ প্রভৃতি গ্রামের অধিবাসীরা বাদামতলা বাজারে সমবেত হয়েছিল। শান্তি কমিটির সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এরপর বাদামতলা বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। তাদের অগ্রসর হতে দেখে লোকজন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাদামতলা বাজারের সামান্য উত্তর দিকে ঘেরাও করে পলায়নপর বহু মানুষকে আটক করে। তারপর ধৃত এইসব মানুষকে তারা লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে।১৩৪ গণহত্যার পর গ্রামগুলোতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার সহযোগীরা ব্যাপকভাবে অগ্নিসংযোগ করেছিল। ত্যাগ করে যাওয়া বাড়িঘরে গৃহত্যাগী মানুষদের ফিরে আসার সম্ভাবনাটুকু শেষ করে দেওয়ার জন্যই এই অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল বলে অনুমিত হয়।
ফুলতলা-দেবীতলা-বাদামতলা গণহত্যায় নিহত স্থানীয় ২৮ জনের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া প্রাণকৃষ্ণ হালদার, তুমতি বাছাড়, ঝড় বিশ্বাস, প্রেমদাসী মণ্ডল, তৃপ্তি রানী রায়, মমতা রানি, টুকু রানি রায়, অধর মণ্ডল, সুশীল কুমার রায়, ডা. শরৎচন্দ্র বিশ্বাস প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।১৩৫ এইসব আহতরা শরীরে জখম নিয়ে ঐ দিনই ভারতের পথে পাড়ি জমায়। খোরশেদ আলম নামক ডুমুরিয়া থানার রানাই গ্রামের এক গ্রাম্য চিকিৎসক বাদামতলায় আহত হওয়া একটি পরিবারের চিকিৎসা করেছিলেন। তার বর্ণনা থেকে এ সম্পর্কে কিছুটা জানা যায়। উল্লেখ্য, বাদামতলা থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার নৌকা বেয়ে ঐ পরিবারটি খোরশেদ আলমের কাছে পৌঁছায়। তিনি বলেন :
খানসেনারা ওদের গুলি করেছিল। তারাও যাচ্ছিল ভারতে। যে ভদ্রলোক আমাকে নিতে এসেছিল তার নাম বলল কালিপদ। দেখলাম তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে, মেয়ের একটা বাচ্চা মমতা নাম করে, এরা সবাই গুলিতে আহত। কালিপদর বাবাও তাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি গুলিতে মারা যান। পথিমধ্যে তাঁকে মুখে আগুন দিয়ে নদীতে ফেলে দেন তারা। আমি তাদের তাৎক্ষণিকভাবে রক্ত বন্ধ হওয়ার জন্য ইনজেকশন দিলাম। সবাই কমবেশি জখম ছিল। কারও হাত ভেঙে গেছে। একজনের তো বুকের এক সাইডে গুলি লেগে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল।১৩৬
স্থানীয় এসব আহতরা ছাড়া যেসব মানুষ দূরবর্তী এলাকা থেকে এসে বটিয়াঘাটায় আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকে এই গণহত্যায় আহত ও নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের নাম-পরিচয় সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
……………………………………………………
১৩২. মুক্তিযুদ্ধের সময় বটিয়াঘাটা থানার মোট অধিবাসী ছিল প্রায় আটাত্তার হাজার। এর মধ্যে প্রায় পঁয়ষট্টি শতাংশ ছিলো হিন্দু অধিবাসী।
১৩৩. সাক্ষাৎকার, অচিন্ত্য বিশ্বাস (ফুলতলা, বটিয়াঘাটা) ১২ ফেব্রয়ারি ২০১২। অচিন্ত্য বিশ্বাস সিপিবি-এর একজন কেন্দ্রীয় নেতা। এছাড়া দেখুন, আবু মো. দেলোয়ার হোসেন (সম্পা.), মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, ২য় খণ্ড, (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৯), পৃ. ২০৭–০৮। ৭৮
১৩৪. তদেব।
১৩৫. সাক্ষাৎকার, অচিন্ত্য বিশ্বাস (ফুলতলা, বটিয়াঘাটা)। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১২।
১৩৬. খোরশেদ আলম (রানাই, খর্নিয়া, ডুমুরিয়া)-এর জবানবন্দী। অন্তর্গত, রাশেদুর রহমান (সম্পা.), খুলনা ১৯৭১: অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান (ঢাকা: প্রথমা, ২০১৩), পৃ. ৭৭।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!