You dont have javascript enabled! Please enable it!

চুকনগর গণহত্যা ( ২০ মে ১৯৭১)

ব্যাপকতা ও নিহতের সংখ্যার বিচারে চুকনগর গণহত্যা খুলনা জেলা তথা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ গণহত্যা। পৃথিবীর ইতিহাসেও এতো স্বল্প সময়ের মধ্যে এতো বেশিসংখ্যক নিরস্ত্র ও উদ্বাস্তু অসামরিক মানুষকে হত্যা করার ঘটনা বিরল।

চুকনগরের অবস্থান
চুকনগর স্থানটি খুলনার ডুমুরিয়া থানার আটলিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত একটি ব্যবসায় কেন্দ্র। খুলনা শহর থেকে পশ্চিম দিকে ডুমুরিয়া হয়ে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে চুকনগর বাজার অবস্থিত। অবস্থানগত দিকে দিয়ে স্থানটি খুলনা জেলার পশ্চিম, সাতক্ষীরা জেলার পূর্ব এবং যশোর জেলার দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত। বর্তমানে খুলনা, সাতক্ষীরা ও যশোর শহর থেকে সরাসরি সড়ক চুকনগরে এসে মিলিত হয়েছে। একাত্তর সালে যশোর থেকে চুকনগরের ওপর দিয়ে সড়ক পথে সাতক্ষীরা যাবার রাস্তা ছিল। এছাড়া নদী পথে পার্শ্ববর্তী সকল স্থান থেকে এখানে আসার ব্যবস্থাও ছিল। চুকনগরের বাজার ব্যতীত পার্শ্ববর্তী সমগ্র এলাকা ছিল গ্রামাঞ্চল; জমি ছিল নিচু এবং ডোবা নালায় ভর্তি। ভদ্রা নদীর তীরে মজবুত বাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি প্রায়ই বিলে প্রবেশ করতো।

গণহত্যার প্রেক্ষাপট
চুকনগর গণহত্যার প্রেক্ষাপট আলোচনার জন্য দুটো বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এক. একই দিনে বহুসংখ্যক মানুষ কেন চুকনগরে এসেছিল; এবং দুই. চুকনগরে হাজির হবার পর কোন পরিপ্রেক্ষিতে তারা নিহত হয়েছিল। একই দিনে এতো মানুষ চুকনগরে কেন হাজির হয়েছিল, তার ভিন্ন ভিন্ন কিছু আঞ্চলিক পটভূমি রয়েছে।
২৫ মার্চের পর থেকে সমগ্র বাংলাদেশে যে গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু হয়েছিল, তার প্রাথমিক এবং প্রত্যক্ষ শিকার ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধা।১৩৭ ক্রমবর্ধমান এই সব নির্যাতনের কারণে বরিশাল, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট প্রভৃতি জেলা থেকে আত্মীয়তা ও পরিচয়ের সূত্রে অসংখ্য হিন্দু উদ্বাস্তু খুলনার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। এছাড়া খুলনা শহরে সংঘটিত গণহত্যার কারণেও বহু মানুষ এ সব গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা ডুমুরিয়া, ফুলতলা, কেশবপুর (যশোর জেলা), বটিয়াঘাটা, দাকোপ, পাইকগাছার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় লুণ্ঠন, অপহরণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তি দখল প্রভৃতি শুরু করে। ১৫ এপ্রিল ডুমুরিয়ার রংপুরে, ২০ এপ্রিল বটিয়াঘাটার জলমা-চক্রাখালী হাইস্কুল ও সংলগ্ন এলাকায়, ২৭ এপ্রিল রূপসার অজোগড়ায় গণহত্যা সংঘটিত হয়। এছাড়া ১৯ মে বটিয়াঘাটার ফুলতলা, দেবীতলা ও বাদামতলায় গণহত্যা সংঘটিত হয়। ১৮ মে ডুমুরিয়ার বাদুড়গাছিতে তৎকালীন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি তথাকথিত শ্রেণিশত্রু খতমের অংশ হিসেবে প্রকাশ্য দিবালোকে দক্ষিণ ডুমুরিয়ার অত্যন্ত সম্পদশালী ও প্রভাবশালী সরদার বাড়িতে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।১৩৮ এসব গণহত্যার শিকার ছিল মূলত হিন্দুরা। ফলে তারা চরম আতঙ্কে দেশত্যাগ করে ভারতে যাবার চিন্তা করতে থাকে। এই সময়ে সমগ্র ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছায় স্থানীয় দুষ্কৃতীরা ব্যাপক লুণ্ঠন ও জবরদখল শুরু করে। ১৮ মে তারিখে বটিয়াঘাটা, দাকোপ ও ডুমুরিয়ার বহু মানুষ বাস্তুত্যাগ করে ভারতের পথে রওনা হয়েছিল। ১৯ মে তারিখে সবচেয়ে বেশি মানুষ ভারতের পথে পাড়ি জমায়। ডুমুরিয়ার পার্শ্ববর্তী সকল থানার মানুষের ভারতে যাবার স্বাভাবিক পরিচিত পথ ছিল চুকনগর হয়ে সাতক্ষীরার সীমান্ত অতিক্রম করা। ১৯ মে সন্ধ্যার মধ্যেই অন্তত হাজার বিশেক মানুষ চুকনগরে পৌঁছায় এবং সেখানেই খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
সমবেত এই উদ্বাস্তু মানুষের ওপর ঠিক কী কারণে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, সে ব্যাপারে একক কোনো ঘটনার কথা জানা যায় না। চুকনগরের স্থানীয় অধিবাসী ও গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী এবং চুকনগর বাজারের তৎকালীন একজন ব্যবসায়ী বলাই কৃষ্ণ কুণ্ডু মনে করেন যে শামসুদ্দিন খাঁ নামক একজন বিহারি ভদ্রা নদীর খেয়াঘাটে পয়সা তুলতো। তার সাথে খেয়ার পয়সা নিয়ে কোনো পারাপারকারীর তর্ক হওয়ায় সে বিদ্বেষবশত পাকিস্তানি সেনাদের খবর দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছিল। বর্তমানে চুকনগর কলেজে অধ্যাপনায় রত মাওলানা মোহাম্মদ আলী ছিলেন ওই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনিও একই রকম মতামত দিয়েছেন।১৩৯ তবে চুকনগরের অপর একজন ব্যবসায়ী শেখ আবুল কালাম মহিউদ্দিন বলেছেন অন্য কথা। তার মতে যশোর থেকে চুকনগর হয়ে সাতক্ষীরার দিকে যে গাড়ি চলতো, সে রকম একটি গাড়ির ড্রাইভার ছিল জনৈক বিহারি। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সাথে তার বচসা হলে সে পরবর্তীতে আর্মিকে খবর দিয়ে এখানে এনেছিল।১৪০ বাস চালকের সাথে স্থানীয় একজন সময় নিয়ন্ত্রকের ‘কথা কাটাকাটি’ থেকে উদ্ভূত বিদ্বেষের কারণে ওই বিহারি ড্রাইভার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে খবর দিয়ে চুকনগরে এনেছিল—এ রকম কথাও জানা গেছে।১৪১ আবার এমনও তথ্য পাওয়া গেছে যে, গণহত্যার ঘটনা ঘটবার কিছু আগে সাদা পাগড়ি পরা একজন লোক ঘোড়ায় চড়ে ওই এলাকা ঘুরে গিয়েছিল।১৪২
প্রাপ্ত এই তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রাথমিকভাবে মনে হয় যে, কোনো একজন বিহারিই পাকিস্তানি সেনাদের খবর দিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, এই বিহারি খেয়াঘাটের পয়সা আদায়কারী না কি যশোর-সাতক্ষীরা রুটের বাস চালক ছিল। ভদ্রা নদীর খেয়ায় তখন শামসুদ্দিন খাঁ নামক একজন বিহারি পয়সা আদায় করতো এ ব্যাপারে যেমন বেশ প্রমাণ পাওয়া যায়, যশোর-সাতক্ষীরা রুটে বিহারি ড্রাইভার ছিল—এ ব্যাপারেও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। পয়সা আদায় বা অন্য কারণে যাত্রী অথবা সময় নিয়ন্ত্রকের সাথে এদের ঝগড়া লাগাও বিচিত্র কিছু নয়। এই জাতীয় পেশায় এ ধরনের বচসা একটি সাধারণ ব্যাপার। তবে ঝগড়ার জের ধরে সে অথবা তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে খবর দিয়েছিল কিনা—এই তথ্যটি যাচাই করা প্রয়োজন।
একাত্তর সালের অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগে একজন খেয়ার পয়সা আদায়কারীর পক্ষে পাকিস্তানি আর্মিকে খবর দেওয়া যতটা না বাস্তবসম্মত এবং যৌক্তিক মনে হয়, তারচেয়ে বরং একজন বাস ড্রাইভারের পক্ষে এই কাজটি অনেক সহজ। বিশেষত, এই বাসের রুট ছিল সাতক্ষীরা থেকে যশোর; আর যশোর ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ‘ড্রাইভার বিহারি’ খবর দিয়েছিল—এই সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি বলে মনে হয়। তবে খবর প্রদানকারী বাস ড্রাইভার হোক বা খেয়ার পয়সা আদায়কারীই হোক—শুধুমাত্র তাদের কথার ওপর নির্ভর করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চুকনগরে এসেছিল এ কথা তৎকালীন পাকিস্তানি আর্মির দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। কারণ, যে কোনো এক জনের মুখের কথায় সেনাবাহিনী সাধারণত কোথাও অগ্রসর হয় না। সুতরাং এই সম্ভাবনার ব্যাপারটা আংশিক একটি কারণ হিসেবে গ্রহণ করে অন্যান্য তথ্যের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন।
ডুমুরিয়ার মাগুরখালি ইউনিয়নের আলাদিপুর গ্রামের নির্মল কুমার রায় এই গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁর বক্তব্য থেকে এ সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন:
চুকনগর গণহত্যায় স্থানীয় যারা সহযোগিতা করেছিল তাদের অন্যতম হলেন চুকনগরের স্থানীয় চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন। ইনি খানদের এখানে নিয়ে আসেন। আমার বাবা (শিবপদ রায়, ইনি চুকনগর গণহত্যায় প্রাণ দেন) এখান দিয়ে (চুকনগর দিয়ে) সব সময় আসা-যাওয়া করতো। এখান থেকে লোক পার করতো ভারতে। আমার বাবা লোক ‘আনি দিলে ইনি (গোলাম হোসেন) পার করতেন।’ আমার বাবাকে উনি বললেন, “তোমাদের এলাকায় যত লোক আছে এই এলাকায় নিয়ে আস, কোন অসুবিধা হবে না, ভারতে পার করে দিবনে।” তার কথায় আমরা সবাই চলে এসেছিলাম, এর ভিতর গোলাম হোসেন যশোরে ফোন করে ঐ লোকদের নিয়ে আসে।১৪৩
এই গণহত্যার আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী ওই আলাদিপুর গ্রামেরই ডা. মুকুন্দ বিহারী রায়। তিনি পূর্বোক্ত চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনকে চিনতেন। তাঁর মতে, গোলাম হোসেন খানসেনাদের একজন নিকটতম সহযোগী ছিলেন। এই চেয়ারম্যান এবং আরও কয়েকজন খানসেনাদের সাথে যোগাযোগ করে নিয়ে আসেন। খানসেনাদের ডেকে নিয়ে আসার কারণ সম্পর্কে ডা. রায় মনে করেন যে, সমবেত উদ্বাস্তুদের সঙ্গে থাকা শেষ সম্বলটুকু লুঠ করে নেওয়ার জন্যই গোলাম হোসেনের এই তৎপরতা।১৪৪ উল্লেখ্য, এই গোলাম হোসেন তার নিজ ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতেও লুটতরাজ চালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ভারতে গোপন পথে মানুষ পার করা এবং চোরাচালানির সাথে যুক্ত ছিলেন। তাই তার পক্ষে পাকিস্তান আর্মির সহযোগিতায় হাজার হাজার বিপন্ন লোকের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা সম্ভব। পাকিস্তানি সেনার গণহত্যার পরে তিনি তার লোকজনের দ্বারা নিহতদের লাশ থেকে ঘড়ি, টাকাপয়সা ও অলংকারাদি লুঠ করেছিলেন বলেও জানা যায়। তিনিই যেহেতু স্থানীয় চেয়ারম্যান ছিলেন, তাই তার টেলিফোন বা অন্যবিধ কোনো যোগাযোগের সূত্রে পাকিস্তানি সেনারা চুকনগরে এসে থাকতে পারে। গণহত্যার আগে ঘুরে যাওয়া পাগড়িধারী লোকটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রেরিত ইনফরমার হয়ে থাকতে পারে।
তবে এসব সম্ভাবনা তাৎক্ষণিক কারণ মাত্র। কেননা চুকনগরে হাজার হাজার উদ্বাস্তুর উপস্থিতির খবর যে কেউই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে জানিয়ে থাকতে পারে। আবার এতো সংখ্যক লোকের প্রায় দুই দিনব্যাপী উপস্থিতির খবর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের নিজস্ব ইনফরমারের মাধ্যমে জানতে পারবে না, এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। অতএব, চুকনগরে দেশত্যাগী অসহায় মানুষের উপস্থিতির খবর কিভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানতে পেরেছিল, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কেন ওই বাহিনী তাদের নির্বিচারে হত্যা করলো।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দুরা ছিল পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্মমতার বিশেষ শিকার।১৪৫ চুকনগরেও এতো ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের এই সম্প্রদায়গত বিবেচনা বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল বলে মনে করা যায়। এই গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হলেন চুকনগরের বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম সরদার। তার দেওয়া তথ্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন:
রতন (রতন আলী সরদার) নামে আমাদের পাড়ার একজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামনে পড়ে যায়। তাকে জিজ্ঞাস করলো, “মুসলিম না মালায়োন”। মুসলমান পরিচয় দেবার পর লুঙ্গি খুলে দেখে নিশ্চিত হবার পর বলে “নারায়ে তাকবির” স্লোগান দেবার জন্য। … ওরা আমাদের বললো যে “মুসলিম কোন ধারে, আর মালায়োন কোন ধারে।” … বাধ্য হয়ে দেখিয়ে দিলাম। তারপর হিন্দু এলাকার দিকে গুলি করে চলে গেল…১৪৬
চুকনগরের অপর অধিবাসী মো. শের আলী সরদারও অনুরূপ তথ্য দিয়েছেন।১৪৭ এসব তথ্য থেকে মনে হয় পাকিস্তানি আর্মি এক জায়গায় এতো বিপুল সংখ্যক হিন্দুকে হত্যা করার নৃশংস অভিলাস থেকেই এই বিশাল গণহত্যা চালিয়েছিল। এই বীভৎস গণহত্যা ঘটানোর পরও যেহেতু সংশ্লিষ্ট সৈনিকদের কোর্ট মার্শাল বা অনুরূপ কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি, সেহেতু মনে হয় এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সক্রিয় সমর্থন ছিল। আংশিক প্রকাশিত হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টেও এই ধারণার পক্ষে জোরালো সমর্থন মেলে।১৪৮

গণহত্যার বিবরণ
মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ডুমুরিয়া, ফুলতলা, কেশবপুর, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ প্রভৃতি এলাকার পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। ফলে প্রাণভয়ে এ সব এলাকার অধিবাসী এবং এর বাইরের এলাকা থেকে আসা অভ্যন্তরীণ শরণার্থীরা সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যেতে থাকে। এছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের খবর এসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে ১৮ এবং ১৯ মে অসংখ্য মানুষ ভারতের পথে রওনা হয়। ১৯ মে তারিখে দেখা গেলো যে চুকনগর বাজার উদ্বাস্তুতে পরিপূর্ণ। চুকনগর বাজার ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী রাস্তাঘাট, স্কুল, মন্দির এবং নদীতে নৌকায়ও বহু মানুষ ভারতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাড়ি থেকে সঙ্গে করে আনা হাড়ি-পাতিলে কেউ কেউ রান্না চড়িয়েছিল, কেউ বা চেষ্টা করছিল যানবাহন জোগাড়ের। অনেকের কাছে নগদ অর্থ না থাকায় তাদের সঙ্গে রক্ষিত সোনা-দানা-অলঙ্কারাদি নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছিল। বাস্তুহারা ও হতবিহ্বল অন্তত বিশ হাজার মানুষ চুকনগরের বিভিন্ন স্থানে রাত্রিযাপন করে। পরদিন অর্থাৎ ২০ মে এখানে জমায়েত মানুষের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।১৪৯
এই অবস্থায় বেলা আনুমানিক দশটার দিকে খানসেনারা চুকনগরে পৌঁছায়। তারা কোন দিক থেকে এসেছিল—এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অশ্বিনীকুমার মণ্ডল (বয়ারভাঙ্গা, বটিয়াঘাটা) ও নিতাই গাইন (দাউনিয়া ফাঁদ, বটিয়াঘাটা) তাদের বর্ণনায় বলেছেন যে, পাকিস্তানি মিলিটারি যশোর থেকে চুকনগরে এসে এই গণহত্যা চালায়।১৫০ এই দুইজন প্রত্যক্ষদর্শী শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাবার পথে এই গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেন। এ ব্যাপারে চুকনগরের স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এরশাদ আলী মোড়ল (মালতিয়া, চুকনগরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম), সুধীর দাস (চুকনগর), আশুতোষ নন্দী (চুকনগর), শেখ আবুল কালাম মহিউদ্দিন (চুকনগর), এ বি এম শফিকুল ইসলাম (চুকনগর) প্রমুখ প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন যে, সাতক্ষীরা থেকে পাকিস্তানি সেনারা চুকনগরে এসেছিল।১৫১ উল্লেখ্য, এঁরা সকলেই চুকনগরের স্থানীয় বাসিন্দা এবং এদের দেওয়া তথ্য মোটামুটি একই। কোন দিক থেকে সেনাবাহিনীর গাড়ি এসেছিল, কোথায় প্রথমে থেমেছিল এবং কোন দিক থেকে গুলি ছোড়া শুরু করেছিল—এসব প্রশ্নে তারা অভিন্ন মতামতই দিয়েছেন।
তবে এ ব্যাপারে কিছুটা ভিন্ন মতামত দিয়েছেন এই গণহত্যার আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী অনিল কৃষ্ণ রায় (খড়িবুনিয়া, ডুমুরিয়া)। তাঁর মতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এসেছিল “যশোর থেকে। যশোর থেকে বাস এসে চুকনগর মোড় থেকে ব্যাক করে ‘আঠারো মাইল’ (একটি স্থানের নাম) গেলো। আঠারো মাইল থেকে আবার চুকনগর এসে গুলিগোলা আরম্ভ করে।”১৫২ তাঁর কথা মেনে নিলে এই দুই রকম তথ্যের একটা আপাত সমন্বয় হয়। কিন্তু যশোর থেকে গাড়ি এসে চুকনগর হয়ে আঠারো মাইল নামক স্থান থেকে আবার উল্টো দিকে ফিরে চুকনগরে কোনো সূত্র থেকে এমন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। উল্লেখ্য, অনিল কৃষ্ণ রায় চুকনগরের স্থানীয় বাসিন্দাও নন। এ সব বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে তাঁর মতামতকে সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করা গেলো না—যদিও তা বেশ চিত্তাকর্ষক। তবে বিভিন্ন জনের তথ্য থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, গাড়ি এসেছিল সাতক্ষীরার দিক থেকে। হয় তারা সাতক্ষীরার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে এসেছিল, অথবা গণহত্যা শুরুর বেশ আগে যশোর থেকে চুকনগর হয়ে তারা আঠারো মাইল বা অনুরূপ কোনো স্থানে পৌঁছেছিল এবং সেখান থেকে উল্টো দিকে পুনরায় চুকনগরে এসে গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছিল। এ রকম বিপ্রতীপ গতির কারণ হিসেবে বলা যায় যে, হয়তো প্রথমে চুকনগরে এসে আশেপাশের পরিস্থিতি দেখার জন্য আরও একটু এগিয়ে আঠারো মাইল পর্যন্ত গিয়ে পুনরায় ব্যাক করেছিল। অথবা, আঠারো মাইল বা অনুরূপ কোনো স্থানে হত্যাযোগ্য লোকজনের অবস্থান সম্পর্কে তাদের কাছে গোপন তথ্য থেকে থাকবে। কিন্তু সেটি ভিত্তিহীন দেখে তারা ফিরে চুকনগর আসে।
যা হোক, বেলা আনুমানিক দশটার দিকে বর্তমান চুকনগর কলেজের ঠিক দক্ষিণ পাশে কাউতলায় সাতক্ষীরার দিক থেকে এসে দুটি আর্মি ভ্যান (মতান্তরে তিনটি) থামে। এই স্থানটি তখন ‘পাটকোলার বিট’ নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিল। হানাদারদের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না এবং কোনো ভারী অস্ত্রও তারা ব্যবহার করেছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া তথ্য থেকে মনে হয় না। খুব সম্ভবত, এক প্লাটুন মতো সৈন্য চুকনগরে এসেছিল। তাদের সাথে আট/দশজন বিহারি ছিল বলেও অনেক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন। পাটকোলার বিট থেকেই পাকিস্তানি হানাদাররা গুলি করা শুরু করে এবং চার-পাঁচটি গ্রুপে ভাগ হয়ে চুকনগর বাজারের চারদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চুকনগর বাজারের মোড় থেকে পূর্ব-দিকের কাঁচা রাস্তা ধরে একটা গ্রুপ, যশোর ও সাতক্ষীরা অভিমুখী পাকা রাস্তা ধরে দুইটি স্বতন্ত্র গ্রুপ এবং পার্শ্ববর্তী নদীর তীর ঘেঁষে চুকনগর গ্রামের ভিতর দিয়ে অন্য আরেকটি গ্রুপ বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করতে করতে অগ্রসর হয়। এরপর প্রত্যেকটি গ্রুপই কখনও এককভাবে কখনও বিচ্ছিন্নভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে মানুষ হত্যা করতে থাকে। ১৫৩

গণহত্যার পদ্ধতি
চুকনগরে নেমে পাকিস্তানি সেনারা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে বিভিন্ন দিক থেকে গুলি করেছিল। শরণার্থীরা কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে থাকায় এবং গাছ- পালা, বাড়ি-ঘর, দোকান, বাজারের মোড় প্রভৃতির কারণে তাদের পক্ষে প্রথমেই বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি যে গুলি ঠিক কোন দিক দিয়ে আসছে। একইভাবে এই গুলি মুক্তিবাহিনী করছে না কি পাকিস্তান সেনাবাহিনী করছে অথবা এই দুই বাহিনীর মধ্যে কোনো যুদ্ধ হচ্ছে কি না—এসবও তারা বুঝে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী চুকনগরে নেমে সেখানকার অধিবাসী দুর্গাপদ নন্দী এবং তাঁর প্রতিবেশীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করায় আগুনের ধোঁয়া দেখে দূর থেকে অনেকে মনে করেছিল ‘হিন্দু পাড়ায় লুট হচ্ছে। উল্লেখ্য, মাত্র তিনদিন আগে বাদুড়গাছিতে লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেছিল। প্রথম দিকে লুঠপাট ও সেই সাথে গুলি ছোঁড়ার ঘটনা ঘটছে—এ রকম উড়ো কথাও ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানকার গণহত্যার শুরুটা হয়েছিল বেপরোয়া ও এলোপাথাড়ি গুলির মাধ্যমে। মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি এবং তাদের সম্ভাব্য কোনো আক্রমণের আশঙ্কা থেকে পাক হানাদাররা এ রকম এলোপাথাড়ি গুলি করে থাকতে পারে। তবে গোলাগুলি শুরুর অল্প পরেই তারা যখন বুঝতে পারে যে, পাল্টা আক্রমণের কোনো সম্ভাবনা সেখানে নেই, তখন তারা তাদের কৌশল পরিবর্তন করে।

লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা
হানাদারদের একটা গ্রুপ ভদ্রা নদীর তীরে গিয়ে নৌকায় পলায়নরত উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে পুরুষ মানুষদের ডাঙায় তুলে তাদের লাইন দিয়ে দাঁড়াতে নির্দেশ দেয়। এর ফলে অনেকেই নৌকা থেকে ডাঙায় এসে লাইনে দাঁড়ায়। মৃত্যুর আশঙ্কা সত্ত্বেও তাদের লাইনে দাঁড়ানোর কয়েকটি কারণ অনুমান করা যায়। প্রথমত, উদ্যত রাইফেল ও মেশিনগানের সামনে শত শত নৌকার ভিড় ঠেলে পরিবার পরিজন নিয়ে নৌকা বেয়ে পালাবার চেষ্টা করার অর্থ ছিল সপরিবারে গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে সলিলে সমাধিস্থ হওয়া। স্ত্রী পরিজন ও ছোট ছোট সন্তানদের মুখ চেয়ে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা অনন্যোপায় হয়ে তাই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, অনেকে তখনো ভাবছিলেন যে, মিলিটারিদের আদেশ মেনে হাত তুলে সারেন্ডার করলে বোধহয় তাদের হত্যা করা হবে না।
লাইনে দাঁড় করিয়ে মানুষ হত্যা করার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হলেন জগন্নাথ বালা (পূর্ব পাতিবুনিয়া, ডুমুরিয়া)। তিনি ভদ্রা নদীতে নৌকায় বসে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেন। তিনি বলেন:
(পাকিস্তানি সেনারা) লোকজনদের নৌকা থেকে নামিয়ে ডেকে নিয়ে পাঁচটা লাইন দেয়ায়। আমি দেখলাম আমাকেও ডাকছে হাত দিয়ে। লাইন দিতে দেখে আমি পিছিয়ে আসলাম। লাইনে গেলাম না। কিছুক্ষণ পরে পাঁচটা লাইনে পাঁচজন গুলি করলো। ঐ লাইনের সবগুলো লোক মারা গেলো।১৫৪

জগন্নাথ বালার প্রতিবেশী মনোরঞ্জন রায়ও (পূর্ব পাতিবুনিয়া, ডুমুরিয়া) প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় বলেছেন, আমি এক দিকের তিনটি লাইন দেখি। প্রতি লাইনে ২৫/৩০ জন হবে। একটা লাইনকে গুলি করতে দেখেই পাশের বিলে গিয়ে পড়লাম।১৫৫ নদীর তীরে ছাড়াও গণহত্যার শুরুতে চুকনগরের অন্যান্য স্থানেও লাইনে দাঁড় করিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। বিজয় কুমার রায় (আলাদিপুর, ডুমুরিয়া) এ রকম একটি দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী। এই গণহত্যায় তাঁর পিতা ও পিতৃব্যগণ নিহত হন। তাঁর দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, ওই দিন তিনি তাঁর পরিবারের সাথে যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের পাশে পুটিমারি বিলে বসে ছিলেন। হঠাৎ, হানাদার সেনারা এসে কয়েকটি ফাঁকা গুলি করে সবাইকে চুপচাপ লাইনে দাঁড়াতে বলে। লাইনে দাঁড় করিয়েই তাদের গুলি করা হয়। এরপর এলোপাথাড়ি গুলি শুরু হয়।১৫৬ লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় গুলিতে মারা যান ডুমুরিয়ার শিবনগরের মন্মথ রায়। তাঁর বেঁচে যাওয়া পুত্র বিনয় রায় বর্তমানে স্কুল শিক্ষক। বিনয় রায়ের দেওয়া বর্ণনায় একটি খালের পাশে লাইন দিয়ে হত্যা করার ঘটনা রয়েছে। তিনি বলেন :
(পাকিস্তানি সেনারা) দু’দিক দিয়ে গুলি শুরু করে। আমরা তখন খালের পাড়ে মাটিতে বসে থাকি। হঠাৎ একটা গুলি এসে মায়ের কোলের ছোট বোনটির মাথায় লাগে। ছোট বোনটির মাথা গুলিতে উড়ে যায়। সে গুলিতে আমার মাও আহত হয়। এ ঘটনা দেখে আমার বাবা নিজেই লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় খান সেনাদের গুলিতে আমার বাবা মারা যায়।১৫৭

পুকুরে গণহত্যা
লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা শুরু করলে মানুষজন প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। অনেকে বৃক্ষ আচ্ছাদিত গ্রামের ভিতর প্রবেশ করে। শুকনো মৌসুম থাকায় চুকনগর গ্রামের অনেক পুকুরে তখন পানি কমে গিয়েছিল। সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় গর্তের আকার ধারণ করেছিল। পুকুর পাড়ের গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের কারণে অনেক মানুষ পুকুরে লুকিয়েছিল। পাকিস্তানি হত্যাকারীরা স্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে পাখি শিকার করার ভঙ্গিতে মানুষকে গুলি করতে থাকে। চুকনগর গ্রামে গাছপালার মধ্যে অবস্থিত পুকুরসমূহে এভাবে একের পর এক তারা গণহত্যা চালিয়ে যেতে থাকে। চুকনগরের এ রকম একটি পুকুরে স্বামী সন্তান হারিয়েছিলেন কমলা জোয়ার্দার (কাতিয়ানাংলা, বটিয়াঘাটা)। তাঁর বিবরণ এ রকম:
পাকিস্তানিদের আসতে দেখে আমরা আগেই মালোপাড়া পুকুরের ভেতর নামিছিলাম। দুটো মেয়ে ওর বাবার কাছে ছিল। আর আমি আমার স্বামীর হাত ধরে ডুব দেই। আমার দেবরও আমার কোলের কাছে দাঁড়ানো ছিল।… আমার মাথাটা সরায়ে দিয়ে দেবরটাকে গুলি করলো। ওরা (পাকিস্তানি সেনা) এক গুলিতে দুই ভাইকে মেরে দেয়। বড় মেয়ের গায়ে গুলি লাগলো। গুলি করার সাথে সাথে সব ডুবে গেলো। মালোপাড়া পুকুরের সব জল লাল হয়ে যায়। ঐ পুকুরে ৫০-৬০ জন মারা পড়িল।১৫৮
চুকনগরে স্বামী হারানো আরেক নারী পুষ্প রানি রায় (কাতিয়ানাংলা, বটিয়াঘাটা)। তার দেওয়া বর্ণনা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী : লোকজন ভয়ে ছুটোছুটি করে পাশের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বড় ছেলেটিকে নিয়ে তার বাবা পানিতে একবার ডুব দিচ্ছিলো, আর একবার ভেসে উঠছিল, এমনি সময় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গুলি করে।১৫৯
পুষ্প রানি রায়ের স্বামীর নাম হরিভক্ত রায়। তীরে দাঁড়ানো পাকিস্তানি সেনাদের গুলি থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য তিনি যখন পুকুরে ডুব দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর কাঁধে ছিলো সাত বছর বয়সী প্রশান্ত রায়। এ পর্যায়ে দম নেওয়ার জন্য হরিভক্ত রায় জলের ওপর মাথা তুললে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গুলি করে। সেই মর্মন্তুদ স্মৃতি বর্ণনা করে প্রশান্ত রায় বর্তমান লেখককে বলেন, ‘বাবা মাথা তুলতেই মিলিটারি তাঁকে গুলি করে। তীব্র একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাবা তলিয়ে যেতে থাকেন। দেখলাম, জলের নিচ থেকে রক্ত উঠে আসছে। বাবা আমার হাত ধরে রেখেছিলেন। হঠাৎ তাঁর মুঠো আলগা হয়ে গেলো।১৬০
এ রকম আরেকটি পুকুরে পিতা এবং পিতৃব্যকে হারিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বৈরাগী (তেলিখালি, ডুমুরিয়া)। এই গণহত্যার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “ওরা (পাকিস্তানি সৈন্যরা) গুলি করে চলে যাবার পর এসে মালোপাড়ার পুকুরে বাবা আর এক জ্যাঠামশাইকে মৃত পেলাম…। গুলিতে বাবার মাথার ‘খাবরি’ (খুলি) উড়িয়ে নিয়ে গেছে…।”১৬১ চুকনগরের জেলে পাড়ায় পাশাপাশি চার/পাঁচটি পুকুরে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়।

নদীতে গণহত্যা
চুকনগর বাজার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় যখন বেপরোয়া এলোপাতাড়ি গুলি হচ্ছিল, তখন প্রাণভয়ে বহু মানুষ পার্শ্ববর্তী ভদ্রা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ১৬২ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র তরফদার (মাইটভাঙ্গা, বটিয়াঘাটা) তাঁর বর্ণনায় বলেছেন, “… বহু লোক সাঁতরিয়ে পার হচ্ছে, তখনও গুলি করে মেরে ফেলছে। কেউ হয়তো সাঁতরিয়ে উঠে যাচ্ছে। কেউ পানির নিচে পড়ে যাচ্ছে আর উঠছে না।”১৬৩ নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গুলি করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৌকায় উঠে নদীতে ঘুরে ঘুরে গুলি করে এবং বেয়নেট দিয়ে মানুষ হত্যা করেছিল।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী প্রবোধ চন্দ্র রায় (পূর্ব পাতিবুনিয়া, ডুমুরিয়া) এই পৈশাচিক ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে:
চারিদিকে গোলাগুলি হচ্ছে দেখে আমি আমার দু’মামাসহ (বিন্দু, নিশীকান্ত নদীতে ডুব দিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলাম। বিন্দু মামার ঘাড়ে ছিল তার চার-পাঁচ বছর বয়সের ছেলে। হঠাৎ একটা গুলি এসে লাগলো ছেলেটার মাথায়। তৎক্ষণাৎ শিশুটি মারা যায়। এরপর গুলি লাগে নিশিকান্তের আমার পাশেই ছিল—একসঙ্গে সাঁতরাচ্ছিলাম। পিঠে গুলি লেগে নাড়িভুড়িসহ পেট দিয়ে বের হয়ে যায়। হাত দিয়ে পেট চেপে সে আকূল হয়ে বাঁচার আকুতি জানাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে হাবুডুবু খেতে খেতে তলিয়ে যায়।”১৬৪
নদীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ছাড়াও অনেকে মারা গিয়েছিল সাঁতাররত অবস্থায় পরস্পরের সাথে জড়াজড়ি করে। অনেক মহিলা, শিশু এবং বৃদ্ধ এভাবে মারা পড়েছিল বলে স্থানীয় অনেকে জানিয়েছেন। নদীর চরে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাশ পড়ে ছিল।১৬৫

অন্যান্য স্থানে গণহত্যা
চুকনগরের পার্শ্ববর্তী পুটিমারি বিলেও বহুসংখ্যক মানুষ মারা পড়েছিল। তেমন কোনো উঁচু বাঁধ না থাকায় তখন এই বিলে প্রতিদিনই জোয়ারের জল প্রবেশ করতো। গণহত্যার দিনে পলায়নরত মানুষ বিলের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে, দৌড়ে অথবা খাল দিয়ে সাঁতরিয়ে পালানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই বিলে পিতা ও পিতৃব্যসহ মোট পাঁচজন স্বজন হারিয়েছিলেন মনোজ কান্তি রায় (আলাদিপুর, ডুমুরিয়া)। এই গণহত্যা সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন যে, বিলে জোয়ারের জল প্রায় এক ফুট মতো উঁচু ছিল। এর মধ্যে পালাতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ বিলেই মারা পড়ে।১৬৬ পুটিমারি গ্রামেরই বাসিন্দা সন্তোষ দাস ওই দিন তাঁর পিতাকে এই বিলে হারিয়েছিলেন। তাঁর বর্ণনা এ রূপ:
ঘরের দরজায় তালা দিয়ে আমার স্ত্রী, ভাইয়ের স্ত্রী, মা, বাবাকে নিয়ে বিলের মধ্যে ঝাঁপ দিব, এই সময় পেছন থেকে বাবাকে গুলি করলো। সঙ্গে সঙ্গে বাবা জলের মধ্যে পড়ে গেল। সে সময় পাকিস্তানি সেনারা বিলের ধারে বসে মাথা লক্ষ্য করে গুলি করছে।১৬৭
বিল ছাড়াও বিভিন্ন বাগান, ঘর, এমনকি গাছের শাখায় কিছু মানুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে মারা যায়। চুকনগর বাজার সংলগ্ন কালী মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া কিছু মানুষ এই গণহত্যার শিকার হয়। এই মন্দিরেই বসা অবস্থায় পিতা-পিতৃব্য ও অন্যান্য স্বজন মিলিয়ে সাতজনকে হারিয়েছিলেন পরবর্তীকালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পূর্ণেন্দু গাইন। তাঁর দেওয়া বর্ণনা এ রকম:
আমরা কালীবাড়ি বসা থাকা অবস্থায় কি করবো, কোথায় যাব এ সব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি হঠাৎ দেখলাম ৪/৫ জন পাকিস্তানী আর্মি এবং তাদের সাথে আরো ৪/৫ জন রাজাকার। আমরা যে বারান্দায় বসে ছিলাম তার সামনে এসে হাজির হলো এবং গুলি করা শুরু করলো। আমার চোখের সামনেই বারান্দায় বসে থাকা আমার বাবা, কাকা, কাকার বড় ছেলে, বাড়ির এক জেঠাতো ভাই, জেঠাতো ভাইয়ের ছেলে, আমার পিসে মশাই এবং পিসে ভাজা মশাইয়ের ছেলেকে গুলি করে মারলো।১৬৮
এই কালী মন্দিরের পিছন দিকে তখন একটি বড় বট গাছ ছিল। কোনো কারণে সেটি তখন কাত হয়ে থাকায় গাছের গোড়ায় শিকড়ের নিচে বেশ বড় গর্ত তৈরি হয়েছিল। গোলাগুলিতে আতঙ্কিত অনেকে এই গর্তে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তাঁদের প্রায় সকলেই মারা যায়। এছাড়া চুকনগর গ্রামের একটি গাব গাছ, বেশ কয়েকটি নারকেল গাছ এবং বাঁশঝাড়ে প্রাণভয়ে মানুষ আশ্রয় নিতে গিয়ে গুলিতে প্রাণ হারায়। স্থানীয় দাস পাড়ায় ঢুকেও পাকিস্তানি সৈন্যরা বহু মানুষকে হত্যা করে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা মানুষের অগণিত লাশ, অসংখ্য আহত ও স্বজনহারা মানুষের বুকফাটা আর্তনাদে সেদিনের চুকনগর পরিণত হয়েছিল এক নরককুণ্ডে।
প্রায় পাঁচ ঘণ্টা একটানা নির্মম গুলিবর্ষণের পর পাকিস্তানি হানাদাররা বেলা আনুমানিক সাড়ে তিনটার সময় যশোরের দিকে চলে যায়। তাদের চলে যাবার কারণ হিসেবে গোলাগুলি ফুরিয়ে যাওয়াকে প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মানুষ উল্লেখ করেছেন।১৬৯
গণহত্যা শেষ হওয়ার পরে মালতিয়া গ্রামের অধিবাসী এরশাদ আলী মোড়ল বধ্যভূমিতে আনুমানিক ছয় মাসের একটি কন্যাশিশু দেখতে পান। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, শিশুটি তার মৃত মায়ের স্তন্যপান করছিল। তিনি শিশুটিকে কোলে তুলে নেন এবং মালতিয়া গ্রামের মান্দার দাসের তত্ত্বাবধানে রাখেন। পরে মান্দার দাস শিশুটিকে লালন পালন করেন। গণহত্যার মর্মন্তুদ সাক্ষী হিসেবে সেই শিশুটি এখনও বেঁচে আছে। নাম: রাজকুমারী সুন্দরী।

মৃতের সংখ্যা
চুকনগর গণহত্যার নিষ্ঠুরতা ও ব্যাপকতা সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেলেও তা থেকে নিহত মানুষের মোট সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। এক কিলোমিটারেরও বেশি এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গণহত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল। বধ্যভূমির এই বিস্তৃতির কারণে প্রত্যক্ষদর্শী কারও পক্ষে মৃতদেহের সংখ্যা গণনা করা ছিল কার্যত অসম্ভব। এছাড়া মারা যাবার প্রায় সাথে সাথেই বহু লাশ নদীর স্রোতে ভেসে এবং ডুবে গিয়েছিল। গুরুতর আহত অনেকে ভারতে গিয়ে অথবা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্যত্র মারা গিয়েছিল। খুলনা জেলা ও তৎসংলগ্ন কয়েকটি এলাকার বাস্তুত্যাগী মানুষ ছিল এই গণহত্যার শিকার। ফলে এই ব্যাপক এলাকায় ছড়িয়ে থাকা জীবিত প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে চুকনগর গণহত্যায় নিহতদের সংখ্যা নির্ণয় একক প্রচেষ্টায় অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত সহায়ক উৎস এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রদত্ত সাক্ষ্য থেকে এ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
চুকনগর ও সমীপবর্তী এলাকার লোকজন এবং বহুসংখ্যক প্রত্যক্ষদর্শী এই গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা দুই হাজার থেকে পনেরো হাজারের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন অনুমিত সংখ্যার উল্লেখ করেছেন। ১৭০ সরজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই গণহত্যা ঘটেছিল। অর্ধ কিলোমিটারের মতো নদীর তীরবর্তী স্থান, একটি মন্দির, একটি বৃহৎ বট গাছসহ বেশ কিছু সংখ্যক গাছ, চুকনগর বাজারের মাঠ, রাস্তা, চুকনগর, পুটিমারি ও মালতিয়া গ্রাম, পুটিমারির বৃহৎ বিল, অন্তত চার-পাঁচটি পুকুর, দাসপাড়ার বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও বাগান এবং নদীবক্ষ ছিল এই গণহত্যার স্থান। এক প্লাটুন মতো সশস্ত্র সৈনিক অন্তত পাঁচ ঘণ্টা ধরে একতরফা ও বাধাহীনভাবে এই স্থানে গোলাবর্ষণ এবং বেয়নেট দিয়ে গণহত্যা চালায়। চুকনগরে সেদিন অন্তত বিশ-পঁচিশ হাজার উদ্বাস্তু উপস্থিত ছিল। ফলে অনেক মানুষ এই গণহত্যার শিকার হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়।
গণহত্যার পরদিন সকাল থেকে প্রায় সন্ধ্যা অবধি লাশ সরানোর কাজে নিয়োজিত ছিলেন চুকনগর গ্রামের আনসার আলী সরদার (পিতা: আখের আলী সরদার)। তাঁর দেওয়া বিবরণ এ রকম:
আমরা ৪২ জন ২১টি বাঁশে করে লাশ ঠেলে নদীতে ফেললাম। প্রতিবার আমরা ২০০টি লাশ ফেলেছি। ভোর থেকে বেলা চারটা পর্যন্ত লাশ ফেলেছি। প্রথম কিছুক্ষণ ২০০ করে লাশ গুনেছি। পরে আর গুণতে পারিনি। বিকেল ৪টা পর্যন্ত লাশ ফেললাম তারপর আর শক্তিতে কুলাইলো না।১৭১
ঐ গ্রামেরই আফসার আলী সরকার (পিতা: সবেদ আলী সরকার) লাশ অপসারণের অপর একজন কর্মী। তাঁর দেওয়া বর্ণনা নিম্নরূপ:
চিন্তায় চিন্তায় রাত কাটলো। সকালেবেলা একখান মিলিটারি গাড়ি আসলো। আমাদের বললো লাশ ফেলানোর জন্য। আমার সাথে ছিল আমার বিয়াই ইনসার আলী। সকাল থেকে রাত খানিকটা পর্যন্ত লাশ ফেললাম। প্রথমে গুনেছি তারপর গুনিনি। অগুনতি লাশ ফেললাম! সারাদিন আমরা সবাই মিলে কম করে হলেও ৫/৬ হাজার লাশ ফেললাম।১৭২
চুকনগর গ্রামের আনছার আলী (পিতা: ইবাদ আলী সরদার) এবং তার প্রতিবেশী বাবর আলী দড়ি দিয়ে বেঁধে দুশোরও বেশি লাশ ভদ্রা নদীতে ফেলেছিলেন।১৭৩ আনছার আলীর ভ্রাতা নিসার আলীও লাশ অপসারণ করেছিলেন। তিনি বলেছেন যে, তাদের বাড়ি থেকে বাজার পর্যন্ত তিন থেকে চার হাজারের মতো লাশ পড়েছিল। তিনি এবং তার পড়শি মামাতো ভাই মিলে দু’জনে শ’দেড়েক মতো লাশ নদীতে ফেলেছিলেন। বাগানের ভিতর ও রাস্তা থেকে এগুলো তারা নদীতে ফেলেন। চুকনগর গ্রামের মো. নজরুল ইসলাম সরদার (পিতা: মৃত কমর উদ্দিন সরদার), এয়াকুব আলী সরদার (পিতা: নবাব আলী সরদার), মো. শের আলী সরদার (পিতা: আহাদ আলী সরদার), দলিল উদ্দিন সরদার, আলী বাদশা (পিতা: মৃত সবেদ আলী সরদার) ও কাওসার আলীও গণহত্যার পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি লাশ অপসারণে অংশ নিয়েছিলেন। এরা প্রত্যেকেই দুই শতাধিক লাশ নদীতে ফেলেছিলেন বলে দাবি করেছেন।১৭৪ চুকনগর গ্রামের লাশ অপসারণকারী উল্লিখিত আলী বাদশা (পিতা: মৃত সবেদ আলী সরদার) বলেছেন যে তিনি ও গ্রামের সবাই মিলে ‘চার হাজার থেকে বিয়াল্লিশ শ’য়ের মতো’ লাশ নদীতে ফেলেছিলেন।১৭৫ চুকনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা পূর্ব দিকে রাস্তার দক্ষিণ পাশে এবং চুকনগর কলেজের পাশে অল্প কিছু সংখ্যক মরদেহ গণকবরে সমাহিত করা হয়েছিল বলে সরজমিন অনুসন্ধান কালে জানা গেছে। যে আট-দশজন স্থানীয় মানুষ মারা যায়, তাদেরকে পারিবারিকভাবে সমাহিত করা হয়েছিল।
লাশ অপসারণকারীদের কাছ থেকে চুকনগর গণহত্যায় মারা যাওয়া যে বিপুল সংখ্যক মানুষের কথা জানা যায়, মাঠ পর্যায়ে গিয়ে তার তেমন জোরালো সমর্থন মেলে না। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার ও ফিল্ড সার্ভের মাধ্যমে চুকনগর গণহত্যায় মারা যাওয়া দুইশতাধিক ব্যক্তির নাম-পরিচয় সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। এ সব নাম কেবল খুলনা জেলার বিশেষত ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলার। খুলনার অন্যান্য উপজেলা, বাগেরহাটের কয়েকটি উপজেলা এবং চুকনগরের পার্শ্ববর্তী যশোরের কেশবপুর উপজেলায় করা মাঠ জরিপে এই গণহত্যায় মারা যাওয়া কারও সন্ধান মেলেনি।১৭৬ দূরবর্তী অন্য কোনো জেলা থেকে এখানে এসে অনেকে মারা পড়েছিলেন বলে কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু এসব জেলায় মাঠ জরিপ করা সম্ভব হয়নি
চুকনগরের অনেক বয়স্ক ও বিশিষ্টজন মনে করেন বরিশাল, পিরোজপুর ও ফরিদপুর এলাকা থেকে এসে চুকনগরে অনেকে মারা পড়েছিলেন। কিন্তু এসব এলাকা থেকে ভারতে যাওয়ার স্বাভাবিক পথ চুকনগর নয়।১৭৭ বৰ্তমান লেখক খুলনা জেলা সংলগ্ন বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় মাঠ জরিপ করে চুকনগর গণহত্যায় মারা যাওয়া কারও সন্ধান পাননি। স্বরোচিষ সরকার-এর একাত্তরে বাগেরহাট শিরোনামের গ্রন্থে বাগেরহাটের ৮০৩ জন শহিদের নামের তালিকা রয়েছে। সেখানেও চুকনগরে মারা যাওয়া কারও নাম নেই।১৭৮ ফরিদপুর, বরিশাল কিংবা পিরোজপুরের মুক্তিযুদ্ধের যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও চুকনগর গণহত্যায় মারা যাওয়া কারও নাম পাওয়া যায় না। এ থেকে ধারণা হয়, চুকনগরে নিহত অধিকাংশই ছিলেন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা থানার মানুষ। এর বাইরে এখানে কেউ নিহত হয়ে থাকলে, তাদের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না।১৭৯ মনে হয়, চুকনগর গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে অতিরঞ্জন ঘটেছে।

……………………………………………………
১৩৭. হিন্দু নিধন সম্পর্কে পাকিস্তানি সামরিকচক্রের লিখিত নির্দেশ ছিল বলে হামুদুর রহমান কমিশনের প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের অব্যবহিত পরে পাকিস্তানের নবনিযুক্ত তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান ছিল ওই কমিটির উদ্দেশ্য। ২০০০ সালে ভারতের ‘ইন্ডিয়া টুডে’ রিপোর্টটি প্রকাশ করেছিল। ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে খবরের কাগজ, ১৯ বর্ষ, ৩৬ সংখ্যা, ৫ই সেপ্টেম্বর ২০০০ তারিখে এটি প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে বিবৃত ৮ নং বালুচের কমান্ডিং অফিসার ও পরবর্তীতে মুজাহিদ ব্যাটালিয়ন-৮৬ এর কমান্ডিং অফিসার (১৯৭১-এ ঠাকুরগাঁও ও বগুড়া ইউনিটে কর্মরত) লে. কর্নেল আজিজ আহমেদ খান (সাক্ষী নং ২৭৬)- এর দেয়া বিবৃতি উল্লেখযোগ্য। হিন্দু নিধন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জেনারেল নিয়াজী আমার ঠাকুরগাঁও ও বগুড়া ইউনিট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের কাছে জানতে চাইলেন—আমরা কতো জন হিন্দুকে হত্যা করেছি? মে মাসে হিন্দুদের হত্যা করার একটি লিখিত নির্দেশ আসে। এই নির্দেশটি দেন ২৩ ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ মালিক।’ বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, সুকুমার বিশ্বাস, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিকজান্তা ও তার দোসরদের তৎপরতা (ঢাকা: আহমেদ মাহফুজুল হক, ২০০১), ৪৪২-৮৯।
১৩৮. “বাদুড়গাছি গণহত্যা” অনুচ্ছেদটি দ্রষ্টব্য।
১৩৯. মুনতাসীর মামুন (সম্পা.), চুকনগরে গণহত্যা (ঢাকা: বাংলাদেশ চর্চা, ২০০২), পৃ. ৪৬।
১৪০. তদেব, পৃ. ৬৮।
১৪১. তদেব, পৃ. ১৩৩।
১৪২. তদেব।১৪৩. তদেব, পৃ. ৬২। সাক্ষাৎকার, নির্মল কুমার রায় (আলাদিপুর, ডুমুরিয়া), ২৯ ডিসেম্বর ২০০৪।
১৪৪. সাক্ষাৎকার, ডা. মুকুন্দ বিহারী রায় (আলাদিপুর, ডুমুরিয়া), ২৯ ডিসেম্বর ২০০৪।
১৪৫ পূর্ববর্তী একটি টীকায় এ ব্যাপারে বলা হয়েছে। এছাড়া দেখুন, সুকুমার বিশ্বাস, দোসরদের তৎপরতা, পৃ. ৪৫৬৷
১৪৬ মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা, পৃ. ৮৭।
১৪৭ সাক্ষাৎকার, শের আলী সরদার (চুকনগর), ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৪।
১৪৮. আংশিক প্রকাশিত এই রিপোর্ট সৈন্যদের দেয়া জবানবন্দী থেকে জানা যায় যে, হিন্দুদের হত্যা করার জন্য শাস্তি বা জবাবদিহিতা তো দূরের কথা, বরং পাকিস্তানি সেনাদের কাছে তা ছিল সফলতার একটি সূচক। বিস্তারিত দেখুন, সুকুমার বিশ্বাস, দোসরদের তৎপরতা, পৃ. ৪৫৬-৫৮।
১৪৯. সাক্ষাৎকার, নির্মল কুমার রায়, মুকুন্দ বিহারী রায়, সরস্বতী মণ্ডল প্রমুখ, ২৯ ডিসেম্বর ২০০৪। মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা, পৃ. ১৩৮-৪৩। এই গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী সকলেই এই সংখ্যা লক্ষাধিক বলে উল্লেখ করেছেন।
১৫০. সাক্ষাৎকার, নিতাই গাইন (দাউনিয়া ফাঁদ, বটিয়াঘাটা), ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১২। মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা, পৃ. ৩৫-৩৭, ৫৩-৫৫৷
১৫১. মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা, পৃ. ৪২, ৪৯, ৬৫, ৬৭–৬৮, ১১১।
১৫২. তদেব, পৃ. ৩০।
১৫৩. বর্তমান লেখকের সাথে পূর্বোক্ত বেশ কয়েকজন সাক্ষাৎকার প্রদানকারীর বক্তব্য থেকে পাকিস্তানি সেনাদের এই বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে গণহত্যার বিষয়টি জানা গেছে।
১৫৪. সাক্ষাৎকার, জগন্নাথ বালা (পূর্ব পাতিবুনিয়া, ডুমুরিয়া), ১৬ ডিসেম্বর ২০০৪।
১৫৫. সাক্ষাৎকার, মনোরঞ্জন রায় (পূর্ব পাতিবুনিয়া, ডুমুরিয়া), ১৬ ডিসে. ২০০৪।
১৫৬. সাক্ষাৎকার, বিজয় কুমার রায় (আলাদীপুর, ডুমুরিয়া), ১৬ ডিসেম্বর ২০০৪।
১৫৭. মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা, পৃ. ৭৮।
১৫৮. তদেব, পৃ. ৬০।
১৫৯. তদেব, পৃ. ১০২।
১৬০. সাক্ষাৎকার, প্রশান্ত রায় (কাতিয়ানাংলা, বটিয়াঘাটা), ৪ জানুয়ারি ২০০৫।
১৬১. মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা, পৃ. ৭৬।
১৬২. ভদ্রা নদীতে সমুদ্রের সাথে লবণাক্ততার তারতম্যের কারণে বছরের এই সময়ে হাঙ্গরের উপদ্রব বৃদ্ধি পেতো। এমনকি বঙ্গোপসাগর থেকে কুমিরও এই নদীতে চলে আসতো। কিন্তু মৃত্যুতাড়িত অসহায় মানুষগুলো তখন অনোন্যপায় হয়ে ওই নদীতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচার শেষ চেষ্টা করেছিল।
১৬৩. মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা, পৃ. ১১৩।
১৬৪. সাক্ষাৎকার, প্রবোধ চন্দ্র রায় (পূর্ব পাতিবুনিয়া, ডুমুরিয়া) ও ভবেন্দ্রনাথ বালা (পূর্ব পাতিবুনিয়া), ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৪।
১৬৫. মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা, পৃ. ৪২, ৪৯, ৬৫, ৬৭-৬৮ ও ১১১।
১৬৬. সাক্ষাৎকার, মনোজ কান্তি রায় (আলাদিপুর, ডুমুরিয়া), ২৭ মার্চ ২০০৩।
১৬৭. মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা, পৃ. ১২১।
১৬৮. সাক্ষাৎকার, পূর্ণেন্দু গাইন (দাউনিয়াফাঁদ, বটিয়াঘাটা), ১১ জুন ২০০৪। তদেব, পৃ. ৯৫।
১৬৯. সাক্ষাৎকার, ঝড়ি সরকার (স্বামী এবং একমাত্র পুত্রকে হারিয়েছিলেন, সাহস, ডুমুরিয়া), কমলা মণ্ডল (সাহস) ও সরলা মণ্ডল (সাহস), ৩০ মার্চ ২০০৪। চুকনগর গণহত্যার সাক্ষ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্নজনের কাছ থেকে বর্তমান গবেষক এই তথ্য পেয়েছেন।
১৭০. মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট (ঢাকা)-এর উদ্যোগে ২০০০ সালের ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর যথাক্রমে চুকনগর কলেজ ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’দিন ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। এখানে চুকনগর গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রায় দুইশ’ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। এই সাক্ষাৎকারসমূহ উক্ত ইনস্টিটিউটের ঢাকাস্থ আর্কাইভসে রক্ষিত আছে। সেই উৎসসমূহ থেকে গণহত্যার নিহতের ভিন্ন ভিন্ন আনুমানিক সংখ্যা পাওয়া যায়।
১৭১. মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা, পৃ. ২৬।
১৭২. তদেব, পৃ. ৩১৷
১৭৩. ওই দুই জনের সাথে সাক্ষাৎকালে গবেষক এই তথ্য পেয়েছেন। তারিখ : ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি ২০০৫।
১৭৪. মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা, পৃ. ২৬, ৩২-৩৪, ৫২, ৬৯-৭০, ৮৭, ১০৯, ১১১–১২।
১৭৫. তদেব।
১৭৬. তবে এসব স্থান থেকেও কেউ কেউ এই গণহত্যায় মারা পড়ে থাকতে পারেন। সেটি হলেও সে সংখ্যাটা হবে নিতান্ত সামান্য।
১৭৭. বরিশালের শরণার্থীদের রুট ছিল বরিশাল- ঝালকাঠি- রাজাপুর- ভাণ্ডারিয়া- পিরোজপুর- কচুয়া- বাগেরহাট- ফকিরহাট- রূপসা- সুন্দরবন সংলগ্ন নদীপথে সাতক্ষীরা হয়ে ২৪ পরগণা। আরেকটি রুট: বরিশাল- ঝালকাঠি- রাজাপুর- ভাণ্ডারিয়া- পিরোজপুর- কচুয়া- বাগেরহাট— ফকিরহাট- রূপসা- খুলনা – দৌলতপুর- কেশবপুর- কলারোয়া— ২৪ পরগণা ইত্যাদি। ফরিদপুর এলাকার শরণার্থীদের ভারতে যাবার অন্যতম রুট ছিল ফরিদপুর- মধুখালী- বালিয়াকান্দি- মাগুরা- ঝিনাইদহ- চুয়াডাঙ্গা- মেহেরপুর- নদীয়া ইত্যাদি।
১৭৮. শহিদের এই তালিকার জন্য দেখুন, স্বরোচিষ সরকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৫-৩১।
১৭৯. অন্য একটি বিষয়ও এখানে বিবেচনা করা যায়। চুকনগরে আসা এক প্লাটুন পাকিস্তানি সৈন্যের কাছে হাজার-বারোশ’য়ের বেশি বুলেট থাকার কথা না। এই বুলেটের প্রতিটিতে একজন নিহত হয়েছে (যদিও বাস্তবে তা ঘটা সম্ভব নয়) ধরে নিলেও মৃতের সংখ্যা বুলেটের সংখ্যার চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!