ডুমুরিয়া দাসপাড়া গণহত্যা
ডুমরিয়া উপজেলা সদরে অবস্থিত ডুমুরিয়া কলেজের উত্তর দিকে দাসপাড়ার অবস্থান। ১৯৭১ সালে পাড়াটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। ডুমুরিয়া বাজারের দক্ষিণ- পশ্চিম দিকে ছিল ভদ্রা নদী। ২ মে ১৯৭১ তারিখ রবিবার বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ এই নদী দিয়ে লঞ্চে করে পাকিস্তানি সেনারা ডুমুরিয়া থানায় এসে নামে। সেখান থেকে আরাজি ডুমুরিয়া গ্রামের সোনা খাঁ নামক এক ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা ডুমুরিয়া বাজারে প্রবেশ করে। অনন্ত বিশ্বাস নামক স্থানীয় এক অধিবাসী এই সময়ে মিলিটারির সামনে পড়ে যায়। মিলিটারিরা তাঁর পরিচয় জানতে চায় এবং ‘অনন্ত বিশ্বাস’ নামটি শোনা মাত্র তাঁকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। এ সময়ে তাঁর কোলে ছিল একটি ছোট শিশু। আতঙ্কে শিশুটি চিৎকার করতে থাকলে একজন পাকিস্তানি সেনা তাঁর পা ধরে পাশের একটি দেয়ালের গায়ে ছুড়ে মারে। এতে শিশুটি সেখানেই মারা যায়। এরপর তারা অনন্ত বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করে হাসপাতাল মোড়ের দিকে এগিয়ে যায়।
ডুমুরিয়া হাসপাতাল মোড়ে এলে সোনা খাঁর কাছ থেকে তারা জানতে পারে যে, সামনের পুরো পাড়াটা ‘মালাউন’ পাড়া। এরপর পাকিস্তানি সেনারা দাসপাড়ায় প্রবেশ করে। গ্রামে ঢুকে প্রথমে তারা নীলকমল দাস ও শরৎ দাসের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে নিমাই চন্দ্র দাস-সহ আরও কয়েক জনের বাড়িতেও তারা আগুন লাগিয়ে দেয়। মিলিটারি আসার খবরে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে গ্রামের অধিবাসীরা এই সময় দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। কয়েকজন আশ্রয় নেয় গ্রামের দক্ষিণ- পশ্চিম প্রান্তের একটি শুকনো খাল ও তৎসংলগ্ন বাগানে। পাকিস্তানি সেনারা একপর্যায়ে সেখানে গিয়ে হাজির হয় এবং শুকনো খালের খাড়িতে আশ্রয় নেওয়া সকলকে উঠে দাঁড়াতে আদেশ দেয়। প্রথমে হারান দাস নামক একজন যুবক উঠে দাঁড়ালে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা খালের মধ্যে বসে থাকা সকলকে একে একে গুলি করে। এখানে আশ্রয় নেওয়া গোলনা গ্রামের পঞ্চানন দাসের কোলে ছিল তাঁর আট-দশ মাস বয়সের শিশুপুত্র প্রফুল্ল দাস। গুলি থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্য পঞ্চানন শিশুটিকে বুকের মধ্যে নিয়ে উপুড় হয়ে বসে ছিলেন। ফলে পাকিস্তানি সেনা তাঁর পিঠে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে সে চিৎকার করে নিজের সন্তানটিকে পাশে রেখে বলে, “আমার সময় শেষ, তোমরা একে দেখ!’৯৮ পাকিস্তানি সেনারা এরপর একের পর এক পঞ্চানন দাস, ফণিভূষণ সরকার, নিমাই চন্দ্র দাস, হরেকৃষ্ণ দাস ও রণজিৎ দাসকে গুলি করে। পরে তাঁদের মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে যায়।
এই গণহত্যায় আহতদের মধ্যে অন্যতম হলেন ডুমুরিয়া দাসপাড়ার পঞ্চানন দাস, ফণিভূষণ সরকার, নিমাই চন্দ্র দাস, হরেকৃষ্ণ দাস ও রণজিৎ দাস। এর মধ্যে হরেকৃষ্ণ দাসকে পাকিস্তানি সেনারা মুখে রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি করেছিল এবং ফণিভূষণ সরকারকে নির্মমভাবে বেয়নেট চার্জ করেছিল।৯৯
……………………………………………………
৯৮. এই পঞ্চানন দাস অবশ্য সেদিন মারা যাননি। চিকিৎসায় তাঁকে সুস্থ্য করে তোলা সম্ভব হয়৷ সাক্ষাৎকার, হরেকৃষ্ণ দাস, (ডুমুরিয়া দাসপাড়া, ডুমুরিয়া), ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪।
৯৯. পাকসেনারা হরেকৃষ্ণ দাসের মুখে গুলি করেছিল। সেই গুলিতে তাঁর মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে যায়। এখনও (২০১৬) তিনি বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে বেঁচে আছেন। এছাড়া ফণিভূষণ সরকার বয়ে বেড়াচ্ছেন বেয়নেট চার্জের চিহ্ন। সাক্ষাৎকার, ফণিভূষণ সরকার ও হরেকৃষ্ণ দাস (ডুমুরিয়া দাসপাড়া), ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪।
……………………………………………………
সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার