কোমলপুর গণহত্যা (৩ মে ১৯৭১)
কোমলপুর গ্রামটি ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। ডুমুরিয়া সদর থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বদিকে গ্রামটির অবস্থান। গ্রামটি ছিল ডুমুরিয়া থানার অন্যতম রাজাকার অধ্যুষিত এলাকা। ৩ মে তারিখের গণহত্যার ঘটনাটি ঘটে কোমলপুরের দক্ষিণ প্রান্তে কাটাখালি নদীর তীরে।
গণহত্যার ঘটনা
বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা ও সন্ত্রাসের কারণে এপ্রিল মাস থেকে ডুমুরিয়া থানার হিন্দু অধিবাসীরা ভারতে শরণার্থী হয়ে চলে যাচ্ছিল। ২ মে তারিখে ডুমুরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে থানা পিস কমিটির একটি সভা হয়। ঐ সভায় আলোচনা হয়েছিল যে পরের দিন অর্থাৎ ৩ মে বেলা দশটার মধ্যে ভাণ্ডারপাড়া ইউনিয়নের বান্দা এলাকায় পাকিস্তানি মিলিটারি অভিযান চালাবে। এই খবরটি বান্দা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় জানাজানি হয়ে গিয়েছিল।
৩ মে তারিখে খুব সকাল থেকে বান্দা এলাকার অধিবাসীদের অনেকে নৌকাযোগে ভারত অভিমুখে রওনা হয়েছিলেন। এই দিন সকাল থেকে কিছু পাকিস্তানি সেনা বান্দা এলাকায় প্রবেশ করছিল। বান্দা গ্রামের শরণার্থী বোঝাই কয়েকটি নৌকা যখন কোমলপুর সংলগ্ন কাটাখালি নদীতে পৌঁছায়, তখন নদীর দক্ষিণ পার থেকে হঠাৎ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা গুলি করতে শুরু করে। এরা যে নদীর দক্ষিণ পারে ছিল, এই খবরটি নৌকার আরোহীরা কেউ জানতো না। ফলে আকস্মিক গুলি শুরু হওয়ায় তারা হতচকিত হয়ে যায়। প্রাণে বাঁচার জন্য নৌকার আরোহীরা দ্রুত নদীর উত্তর পাড় অর্থাৎ কোমলপুরে নৌকা ভিড়ায়। এরপর তারা নৌকা থেকে নেমে দৌড়ে ঘন গাছপালার আড়ালে আশ্রয় নেয়। দূর থেকে তা দেখতে পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করতে করতে একেবারে নদীর তীরে চলে আসে। উল্লেখ্য, কাটাখালি নদীটি ছিল প্রস্থে বেশ ছোট। ফলে নদীর উত্তর পার দাঁড়িয়ে দক্ষিণ পারে লুকিয়ে থাকা মানুষ লক্ষ করে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করতে থাকে।
বেলা তখন আনুমানিক বারোটা। নদীর এক পাড় থেকে পাকিস্তানি সেনারা মানুষকে লক্ষ করে গুলি করছে আর শিশু ও বয়স্ক মানুষ-সহ বেশ কয়েকজন নারী- পুরুষ অপর পাড়ে রাস্তার আড়ালে শুয়ে পড়ে জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এভাবে পুরুষরা প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হলেও বান্দা গ্রামের রুক্ষ্মমালা ঘোষ, ধানিবুনিয়ার রাজেশ্বরী মল্লিক এবং কুশারহুলা গ্রামের নগর নামক দুই বছরের একটি শিশু মৃত্যুবরণ করে।১০০ নগর নামক এই ছোট্ট শিশুটি তাঁর বাবা পঞ্চরামের কোলে ছিল এবং সেই অবস্থায় পাকিস্তান সেনারা তাঁকে গুলি করেছিল। হাতে গুলি লাগায় পঞ্চরাম সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। নিরঞ্জন বাছাড় নামক আরেক ব্যক্তি এখানে গুলিতে আহত হয়েছিলেন।
এভাবে কিছুক্ষণ গুলি করে পাকিস্তানি সেনারা বান্দার দিকে চলে যায়। এই গোলাগুলির মধ্যে ছিলেন লোহাইডাঙা গ্রামের সমীর কুমার বিশ্বাস। তিনি জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানি সেনারা যখন গুলি করছিল, তখন গুলি থেকে রক্ষা করার জন্য তার মাতামহী তার মাথা মাটির সাথে চেপে ধরে রেখেছিল। ফলে তিনি সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।১০১ গণহত্যার পরপরই মৃতদেহগুলো তাৎক্ষণিকভাবে নদীতে ফেলে দিয়ে এই শরণার্থীরা আবার নৌকায় উঠে প্রাণভয়ে ভারত অভিমুখে পাড়ি জমায়।
……………………………………………………
১০০. সাক্ষাৎকার, শেখর রঞ্জন ঘোষ (কোমলপুর গণহত্যায় মারা যাওয়া রুক্ষ্মমালার পৌত্র, বান্দা, ডুমুরিয়া), ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৩।
১০১. সাক্ষাৎকার, সমীর কুমার বিশ্বাস (লোহাইডাঙা, ভান্ডারপাড়া, ডুমুরিয়া), ৫ মার্চ ২০১৩।
……………………………………………………
সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার