You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.11 | বাজুয়া গণহত্যা | খুলনা - সংগ্রামের নোটবুক

বাজুয়া গণহত্যা (১১ মে ১৯৭১)

বাজুয়া দাকোপ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে আনুমানিক পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে বাজুয়া বাজারের অবস্থান। এই বাজারের পার্শ্ববর্তী পসুর নদীর অপর তীরে বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার সীমানা। ১৯৭১ সালের ১১ মে এই বাজুয়া বাজার ও তৎসংলগ্ন হাইস্কুলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা চালায়।

গণহত্যার পটভূমি
বাজুয়া গণহত্যা ছিল মূলত শরণার্থী গণহত্যা। মে মাস থেকে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, রামপাল, মংলা প্রভৃতি উপজেলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর স্থানীয় শান্তি কমিটির দুর্বৃত্তরা ব্যাপক নিপীড়ন ও লুঠতরাজ চালানো শুরু করে। এর ফলে এ সব এলাকার অধিবাসীরা নিরাপত্তার জন্য পসুর নদী অতিক্রম করে বাজুয়া বাজার ও তৎসংলগ্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। উল্লেখ্য, প্রায় শতভাগ হিন্দু অধ্যুষিত এবং নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন থাকায় বাজুয়া এলাকায় তখনো পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা তাদের সহযোগীরা কোনো অত্যাচার-লুণ্ঠন করতে পারেনি। এ জন্য পার্শ্ববর্তী বাগেরহাট জেলার কয়েক হাজার হিন্দু শরণার্থী এখানে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, সুবিধামতো সময়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ কোনো পথ দিয়ে ভারতে চলে যাওয়া। এ জন্য শরণার্থীদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে ভারতে যাওয়ার নিরাপদ পথ অনুসন্ধানের জন্য পাঠানোও হয়েছিল। তাদের ফিরে আসা পর্যন্ত এই শরণার্থীরা বাজুয়া এলাকায় বিশেষত বাজুয়া বাজার ও তৎসন্নিহিত বাজুয়া হাইস্কুল ভবন ও স্কুলের মাঠে অবস্থান করছিল।

গণহত্যার ঘটনা
১১ মে মঙ্গলবার ছিল বাজুয়ার সাপ্তাহিক হাটবার। ফলে বাজারে সেদিন লোক সমাগম ছিল অন্যদিনের তুলনায় বেশি। এছাড়া রামপাল, মোড়েলগঞ্জ ও মংলা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে বহু মানুষ এই এলাকায় আশ্রয় নেওয়ায় হাটে সেদিন ব্যাপক জন সমাগম হয়েছিল। বাজুয়া বাজারে তখন লালু বেদে নামক একজন স্বাধীনতাবিরোধী বাস করতো। বেশ কিছুকাল থেকেই সে স্থানীয় হিন্দুদের নানারকম হুমকি দিয়ে আসছিল। প্রায়ই সে বলতো যে মিলিটারি নিয়ে এসে সে সবাইকে শায়েস্তা করবে। দেখা গেলো যে, হাটবারের দিন সত্যিই সে খুলনা শহর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে খবর দিয়ে বাজুয়ায় নিয়ে এসেছে।১১৭ একটি লঞ্চে করে খুলনা থেকে বেলা তিনটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা বাজুয়া বাজারে পৌঁছায়। প্রথমে নদী থেকে মিলিটারি বাজুয়া বাজারের দিকে কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এরপর বাজারে নেমে লালু বেদেকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় বাজুয়া হাইস্কুলে প্রবেশ করে।
বাজুয়া মাঠে তখন পাঁচ শতাধিক শরণার্থী অবস্থান করছিল। মিলিটারিরা স্কুলের মাঠে গিয়েই সরাসরি তাদের উপর গুলি করা শুরু করে। আকস্মিক এই আক্রমণের ফলে শরণার্থীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। এই সময়ে পাকিস্তানি সেনারা পলায়নপর মানুষের উপর এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকে। তাদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে স্কুলের মাঠ, ভবন ও আশেপাশের জায়গাগুলোতে অর্ধশতাধিক মানুষ মারা যায়।১১৮ প্রাণভয়ে যারা পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের একটা বড়ো অংশ পার্শ্ববর্তী ধোপাদী গ্রামে আশ্রয় নেয়। বাকিদের অনেকে নদী সাঁতরিয়ে চুনকুড়ি, হরিণটানা, লাউডোব প্রভৃতি আশেপাশের গ্রামে পালিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় শরণার্থীদের ফেলে যাওয়া মালামালসহ বাজুয়া বাজারের দোকানপাটে লুঠপাট। জেমস টি সরকার নামক একজন মুক্তিযোদ্ধা এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে:
মিলিটারিরা এসে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে এদেশীয় বিহারী ও অন্যান্যরা লুটপাট ধর্ষণ আরম্ভ করে। সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। বিকালে এরা চলে গেলে পরে আমরা গিয়ে লাশগুলো পশুর নদীতে ভাসিয়ে দেই এবং অল্প আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা করি। এই রাতেই সব ভারতে চলে গেল।১১৯
বাজুয়া গণহত্যার পর দাকোপ থানার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে। দলে দলে মানুষ দেশত্যাগ করে ভারত অভিমুখে যাত্রা করে। বাজুয়ায় মারা যাওয়া অধিকাংশ মানুষই ছিল পার্শ্ববর্তী বাগেরহাট জেলার। তবে বাজুয়ার স্থানীয় দু’তিনজন অধিবাসীও এই গণহত্যায় প্রাণ হারান। বিভিন্ন সূত্র থেকে এই গণহত্যায় মারা যাওয়া ত্রিশ জনের নাম জানা গেছে।১২০
……………………………………………………
১১৭. লালু বেদের আদি নিবাস ছিল কুমিল্লায়। বাজুয়া বাজারে সে একটি মুদির দোকান দিয়ে সপরিবারে সেখানেই বাস করতো। অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক মানসিকতার এই ব্যক্তি পরবর্তীকালে দাকোপ পিস কমিটির সদস্যও হয়েছিল। স্বরোচিষ সরকার, একাত্তরে বাগেরহাট (ঢাকা: সাহিত্য বিলাস, ২০০৬), পৃ. ২৪৭।
১১৮. সাক্ষাৎকার, সুকুমার রায় (ধোপাদী, দাকোপ), ২০ আগস্ট ২০১০।
১১৯. জেমস টি সরকার, “আমার দেখা প্রথম মুক্তিযোদ্ধা”, স ম বাবর আলী (সম্পা.), স্পন্দন- ৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় দিবস রজত জয়ন্তী সংখ্যা (খুলনা: ডরোথি রানা প্রকাশনী, ১৯৯৬), পৃ. ১০৫।
১২০. শেখ গাউস মিয়া, খুলনা জেলা, পৃ. ৩১৫। স্বরোচিষ সরকার, একাত্তরে বাগেরহাট, ২৪৭-৪৮, ৩২৮। সাক্ষাৎকার, সুকুমার রায় (ধোপাদী, দাকোপ), ২০ আগস্ট ২০১০।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার