You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীনতার ঘোষণা ও খুলনায় প্রতিক্রিয়া

২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানি মিলিটারি গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের দখলদার হিসেবে উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।১১ চট্টগ্রামের কালুরঘাটে দখল করে নেয়া একটি বেতার কেন্দ্র থেকে পরবর্তী অন্তত দুইদিন অব্যাহতভাবে এই স্বাধীনতার বার্তা এবং প্রতিরোধ সংগ্রামের আহ্বান প্রচার করা হতে থাকে। স্থানীয় কয়েকজন বিদ্রোহী বাঙালি সেনা সদস্য এবং রাজনীতিবিদের যৌথ প্রচেষ্টায় এটি সম্ভব হয়।
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজ ছিলেন শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং এ সময় তিনি ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক সহযোগী বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের রামচন্দ্রপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবর রহমানের সাথে টেলিফোনে ঢাকার অবস্থা এবং সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২৬ মার্চ সকালে তিনি সেই নির্দেশ খুলনা শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন ইউসুফ এবং আব্দুল লতিফ খানের কাছে পৌঁছে দেন।১২
২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানের পর খুলনা শহরের রাজনৈতিক নেতারা আত্মগোপন করেছিলেন। এর পরবর্তী সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে খুলনা জেলার অধিকাংশ নেতা গোপনে ভারতে চলে যান। ফলে খুলনায় প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত করার গুরুদায়িত্ব বর্তায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ছাত্র লীগ, শ্রমিক লীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের উপর। ২৭ মার্চ সকালে সান্ধ্য আইনের মধ্যে অত্যন্ত সঙ্গোপনে কামরুজ্জামান টুকু, স ম বাবর আলী, শেখ আব্দুল কাইয়ুম, ডা. আসিফুর রহমান, কে এস জামান, জাহিদুর রহমান জাহিদ প্রমুখ তরুণ নেতৃবৃন্দ ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ সংক্রান্ত এক বৈঠকে বসেন।১৩ বৈঠকে আসন্ন যুদ্ধ মোকাবিলা করার জন্য অর্থ, অস্ত্র, রসদ, যুদ্ধ পরিচালনা ও পরিকল্পনা প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, একটি Revolutionary Council বা বিপ্লবী পরিষদের তত্ত্বাবধানে সমগ্র কার্যক্রম পরিচালিত হবে; খুলনা অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনায় এই পরিষদের সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত। স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুকে সর্বসম্মতিক্রমে এই বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়। এ ছাড়া সদস্য হিসেবে থাকেন স ম বাবর আলী, শেখ আব্দুল কাইউম, জাহিদুর রহমান জাহিদ, কে. এস জামান ও ডা. আসিফুর রহমান।১৪
২৬শে মার্চ-পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খুলনা জেলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে যে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন এবং স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগ দেখা দেয়, এই বিপ্লবী কাউন্সিল ছিল তার মধ্যে প্রথম। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায়ই তারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে খুলনা সার্কিট হাউজ এবং এর সমীপবর্তী ইউ এফ ডি ক্লাবে একটি গেরিলা অভিযান পরিচালনা করে।১৫ এ দিনের যুদ্ধের পর বিপ্লবী পরিষদ আরও পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করে। খুলনা শহর ও আশপাশের এলাকায় এই পরিষদ আরও অন্তত আটটি প্রতিরোধ ঘাঁটি গড়ে তোলে। এগুলো হলো: শিরোমনি, ফুলবাড়ি, রেলিগেট, দৌলতপুর, খুলনা রেল স্টেশন, গল্লামারি, রূপসা ও লবণচোরা। সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয় খুলনা শহরের উত্তরাংশে মিরেরডাঙায় অবস্থিত এজাক্স জুট মিলের অভ্যন্তরে। নানাভাবে তারা বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদও সংগ্রহ করতে পেরেছিল।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরাও স্বতন্ত্রভাবে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে। তাদের কাছে খবর ছিল যে, ২৭শে মার্চ যশোর সেনানিবাস থেকে মিলিটারিদের একটি কনভয় খুলনা শহরের দিকে আসছে। খবর পেয়ে পথিমধ্যে অবস্থিত প্রায় সকল বাজারেই স্থানীয় জনতা গাছ কেটে, ইট ফেলে এবং অন্যান্য উপায়ে ব্যারিকেড দিয়েছিল। খুলনা ও যশোরের মাঝামাঝিতে অবস্থিত নওয়াপাড়ার ব্যারিকেড সরিয়ে সৈন্যরা সকাল নয়টার দিকে খুলনা জেলার সীমানায় প্রবেশ করে।
খুলনায় প্রবেশের মুখে তারা প্রথম বাঁধার সম্মুখীন হয় যশোর রোডে অবস্থিত ফুলতলা থানা সদর সংলগ্ন বাজারে। এখানে ফুলতলার অ্যাডভোকেট কাজী আবদুস সালাম, কাজী তাবারক হোসেন (তাবু কাজী), খোকন কাজী প্ৰমুখ স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি শত শত বিক্ষুব্ধ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ফুলতলা বাজার থেকে বালিকা বিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছিলেন। এখানে খানসেনাদের সাথে পুলিশ-ইপিআর ও স্থানীয় জনতার সম্মিলিত বাহিনীর খণ্ডযুদ্ধ হয়। কিছুক্ষণ গোলাগুলির পর খানসেনারা ব্যারিকেড সরিয়ে খুলনা শহরের দিকে অগ্রসর হয়।
খুলনা শহরে প্রবেশের পথে পাকিস্তানি সেনবাহিনী পরবর্তী বাধার সম্মুখীন হয় দৌলতপুরের রেলিগেট এলাকায়। এখানে শ্রমিক নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে শ্রমিক-ছাত্র-জনতা একটি ব্যারিকেড গড়ে তুলেছিল। রেলিগেট এলাকার অনতিদূরে বর্তমান খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) পাশে প্রহরারত কিছু পাকিস্তানি সৈন্যের ওপর আড়ংঘাটার ময়দান থেকে যাওয়া কিছু পুলিশ ও ইপিআর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ করে।১৬ খুলনা শহরে প্রবেশের পথে খান সেনারা সর্বশেষ বাধার সম্মুখীন হয় বৈকালি সিনেমা হলের মোড় থেকে বয়রা মহিলা কলেজের মোড় পর্যন্ত এলাকায়। এখানেও পুলিশ, ইপিআর এবং সমবেত জনতার সাথে পাকবাহিনীর একটি যুদ্ধ হয়। তবে এই প্রতিরোধের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে খুলনায় প্রবেশে নিবৃত্ত করা যায়নি।১৭
২৮ মার্চেও পাকিস্তানি সৈন্যদের আরও কয়েকটি গাড়ি যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে খুলনায় এসেছিল। খালিশপুর নতুন রাস্তার মোড় থেকে একটি দল খালিশপুর শিল্পাঞ্চলের মধ্য দিয়ে এবং যশোর রোড হয়ে আরেকটি দল এদিন খুলনায় প্রবেশ করে। খালিশপুরের পিপ্লস, ক্রিসেন্ট ও প্লাটিনাম জুট মিল এবং নিউজপ্রিন্ট মিলের শ্রমিক-জনতার দ্বারা পাকিস্তানি সেনারা আবারো বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। তবে এবারও তাদের খুলনায় অনুপ্রবেশ থামানো সম্ভব হয়নি।১৮
২৭ ও ২৮ মার্চের এই জন-প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী নৃশংস হয়ে ওঠে। ২৮ মার্চ তারিখে বয়রা এলাকায় এরা আগের দিনের প্রতিশোধ নিতে ব্যাপক তাণ্ডব সৃষ্টি করে। বয়রায় ব্যাপক ভীতি সৃষ্টি করার পর পাকিস্তানি আর্মি তাদের প্রতিশোধ মিশনের অংশ হিসেবে ফুলতলায় গিয়ে আগের দিনের প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেয়া কাজী তাবারক হোসেন ও খোকন কাজীর বাড়িঘর লুঠ করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ দিনের এই অভিযানে সরো মোল্লা, সৈয়দ মোল্লা, ওহাব মহলদার, হাবিবুর রহমান প্রমুখ স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীরা পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।১৯
২৬ মার্চ-পরবর্তী খুলনায় তৃতীয় এবং প্রাথমিক পর্বের সর্বশেষ যে অভিযানটি হয়েছিল, কার্যকর অর্থে সেটাকে একটি যুদ্ধ বলা চলে। এটি ছিল আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র লীগ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, বিপ্লবী পরিষদসহ শ্রমিক- ছাত্র-জনতার নিজস্ব উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত একটি অভিযান। লক্ষ ছিল খুলনা শহরের অনতিদূরে অবস্থিত গল্লামারিতে রেডিও পাকিস্তান খুলনা কেন্দ্ৰ দখল করা।২০ ৪ঠা এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে বারোটার দিকে এই আক্রমণ শুরু করা হয়। তবে রেডিও সেন্টারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর এবং সেখানে প্রহরারত পাকিস্তানি সেনাদের ভারি অস্ত্রের মুখে মুক্তিবাহিনী এর দখল নিতে ব্যর্থ হয়।২১
গল্লামারি যুদ্ধের পরিসমাপ্তির সাথে আসলে খুলনার মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিহত করার প্রাথমিক চেষ্টা শেষ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ সময়ে রূপসা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নেন, অনেকে ভারতে গিয়ে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এপ্রিল মাসের মধ্যে খুলনা শহরের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে চলে যায়।
২৭শে মার্চ-পরবর্তী সপ্তাহ খানেকের সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক. অপ্রশিক্ষিত যোদ্ধা ও সাবেকি অস্ত্রশস্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালানো ও বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। দুই. এই যুদ্ধে বিজয়ের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক স্তরে কাজ করতে সক্ষম কেন্দ্রীয় সরকার বা নেতৃত্ব প্রয়োজন। এই দুইটি বিষয়ের জন্যই প্রয়োজন ছিল বেশ কিছু সময় এবং কার্যকর তৎপরতার।
……………………………………………………
১১. ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) এই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁর এই ঘোষণাটির জন্য দেখুন, হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা.), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, ৩য় খণ্ড (ঢাকা: তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮২), পৃ. ১।
১২. স্বরোচিষ সরকার, একাত্তরে বাগেরহাট (ঢাকা: সাহিত্য বিলাস, ২০০৬), পৃ. ৭১।
১৩. দুর্গাপদ রায় “খুলনা শহর : উৎপত্তি ও বিকাশ (১৮৪২-১৯৮৪)”, অপ্রকাশিত পিএইচডি থিসিস, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৪, পৃ. ৩০৪।
১৪. বাবর আলী, স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান (খুলনা: ডরোথি রানা প্রকাশনী, ১৯৯১), পৃ. ৩৪।
১৫. বাবর আলী, দুর্জয় অভিযান, পৃ. ৩৪-৩৫।
১৬. হাসান হাফিজুর রহমান, দলিলপত্র, পৃ. ৫৩৫-৩৬৷
১৭. তদেব, পৃ. ৩৮-৩৯। এই যুদ্ধে শহীদ হওয়া মুন্সি মোফাজ্জল হকের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার মোকসেদপুর থানার বাহাড়া গ্রামে। পুলিশে চাকুরির সূত্রে তিনি খুলনায় থাকতেন।
১৮. গাউস মিয়া, মহানগরী খুলনা: ইতিহাসের আলোকে (খুলনা : আলী হাফেজ ফাউন্ডেশন, ২০০২), পৃ. ৩৪৮।
১৯. বাবর আলী, দুর্জয় অভিযান, পৃ. ৩৯। এই হাবিবুর রহমান পরবর্তীকালে রাজাকার কমান্ডার হয়েছিল।
২০. বর্তমানে ভবনটি সংস্কার করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রশাসনিক ভবনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বেতার কেন্দ্রটি স্থানান্তরিত হয়েছে বয়রায়।
২১. এই যুদ্ধে গল্লামারি রেডিও সেন্টারের কাছে হাবিবুর রহমান ও মোসলেম আলি হাওলাদার নামে দুইজন যোদ্ধাসহ মোট পাঁচজন এবং সিটি কলেজের হোস্টেলের দক্ষিণ পাশে মেজর জয়নাল আবেদিন শহিদ হন। এ ছাড়া কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাও ওই দিন নিহত হয়েছিল। দ্র. মীর আমীর আলী, খুলনা শহরের ইতিকথা, (খুলনা: ইস্টার্ন প্রেস, ১৯৮০), পৃ. ৮৮।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!