You dont have javascript enabled! Please enable it!

খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠন

রাজাকার শব্দটি আরবি ‘রেদাকার’> রেজাকার’ শব্দেরই বাংলা রূপ, যার শাব্দিক অর্থ হলো স্বেচ্ছাসেবক।২৭ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতায় এরা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় সহযোগী গোষ্ঠী। খুলনা জেলার মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাসে রাজাকার বাহিনী সৃষ্টির একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে; কারণ, রাজাকারদের সাংগঠনিক যাত্রা শুরু হয়েছিল খুলনা শহরেই। তৎকালীন পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর মজলিশে সুরা সদস্য মাওলানা এ কে এম ইউসুফ ছিলেন খুলনার অধিবাসী এবং তার সক্রিয় সাংগঠনিক তত্ত্বাবধানে এই বাহিনীর সূচনা হয়। ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনার খানজাহান আলি রোডে অবস্থিত টুটপাড়া কবরস্থান সংলগ্ন একটি আনসার ক্যাম্পে জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের ৯৬ জন কর্মী সমন্বয়ে এই বাহিনীর সৃষ্টি হয়।২৮ এরপর অতিদ্রুত গোটা দেশে রাজাকার বাহিনীর শাখা প্রশাখা বিস্তৃত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি মিলিটারি কর্তৃপক্ষও এ রকম একটা সশস্ত্র সহযোগী বাহিনীর প্রয়োজন অনুভব করেছিল। তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাদের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি এ প্রসঙ্গে পরবর্তী কালে তা স্বীকার করেছেন। নিয়াজি দাবি করেছেন যে, রাজাকার বাহিনী তাঁরই সৃষ্ট।২৯ এমনকি অবসর জীবনে তিনি বিট্রেআল অব ইস্ট পাকিস্তান শীর্ষক যে বইটি লিখেছেন, সেটি রাজাকারদের নামে উৎসর্গ পর্যন্ত করেছেন। রাজাকার বাহিনীর প্রতি পাকিস্তানি সেনাদের প্রগাঢ় অনুরাগের বিষয়টি এ থেকে বোঝা যায়।
রাজাকার বাহিনীতে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তাদেরকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এক. যারা ইসলাম ও পাকিস্তানকে অভিন্ন জ্ঞানে একে রক্ষা করার জন্য বাঙালি হত্যা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে দায়িত্ব মনে করেছিল। দুই. যারা ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করা এবং লুঠপাট ও ধর্ষণের লোভনীয় সুযোগ নিতে চেয়েছিল এবং তিন. গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর জনগণ, যারা নিরাপত্তা তথা পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে এই বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিল।
দেশের সর্বত্র রাজাকার বাহিনীর শাখা ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে স্থানীয় শান্তি কমিটিসমূহের বিশেষ সহযোগিতা ছিল। তাদের উদ্যোগ ও আগ্রহে জুন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই রাজাকার বাহিনী বিস্তৃত হয়েছিল। এরপর থেকে শান্তি কমিটির নেতাসহ দেশের কয়েকজন পীর-মাওলানা এই বাহিনীকে সরকারি স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানাতে থাকে। ইতোমধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান আনসার বাহিনীর বহু সদস্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এবং বাকিরা ছিলেন পলাতক। ফলে সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খান রাজাকার বাহিনীকেই আনসারের স্থলাভিষিক্ত করার পরিকল্পনা করেন। জুন মাসেই টিক্কা খান ‘পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স ১৯৭১’ জারি করেন। এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ১৯৫৮ সালের আনসার অ্যাক্ট বাতিল করে ওই বাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে বিলুপ্ত ঘোষণা হয়। একই সাথে আনসার বাহিনীর সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, মূলধন ও দায় এবং রেকর্ডপত্র রাজাকার বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। আনসার বাহিনীতে তখনও কর্মরত থাকা অ্যাডজুট্যান্টদের রাজাকার অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে নতুন ভাবে পদায়ন করা হয়।৩০
আগস্টের শুরুর দিকেই রাজাকার বাহিনী মোটামুটিভাবে একটি আধা সামরিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। অক্টোবর মাস পর্যন্ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত ও প্রয়োজনীয় অস্ত্র সজ্জিত রাজাকারের সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার; এদের সংখ্যা এক লাখে উন্নীত করার চিন্তাও তাদের ছিল।৩১ প্রকৃতপক্ষে রাজাকার বাহিনীই ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কার্যকর এবং সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী সহযোগী গোষ্ঠী। এদের অবস্থান ও গুরুত্ব বোঝা যায় ২৩ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখের একটি ঘোষণা থেকে। ওই দিন রাজাকার ডাইরেক্টরেট-এর এক ঘোষণায় রাজাকারদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি এবং সেনাবাহিনীর মতো তাদের ফ্রি রেশনের সুবিধা দেয়া হয়। ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া এই বেতনের হার ছিল: কোম্পানি কমান্ডার রেশনসহ মাসিক ৩০০ টাকা ও রেশন ছাড়া ৩৫৫ টাকা, প্লাটুন কমান্ডার রেশনসহ ১৩৫ টাকা ও রেশন ছাড়া ১৮০ টাকা ও সাধারণ রাজাকার রেশনসহ ৭৫ টাকা এবং রেশন ছাড়া ১২০ টাকা।৩২ এর বাইরেও অবাধ লুণ্ঠনের মাধ্যমে তারা প্রচুর অর্থ-সম্পদ উপার্জন করতো। আসলে ১০/১২ দিনের ট্রেনিং-এ কোনও রকম প্রকৃত আদর্শিক অনুপ্রেরণা ব্যতীত স্বাধীনতাকামী একটি গেরিলা বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজাকারদের যুদ্ধে টিকে থাকার বাস্তব কারণ ছিল না। তাদের মূল কাজ তাই হয়ে পড়েছিল লুণ্ঠন, হত্যা ও ধর্ষণ করা এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে তথ্য সরবরাহ করা। তখনকার পরিস্থিতিতে এমনকি পাকিস্তান পিপলস পার্টিও রাজাকারদের সমালোচনা করেছিল।৩৩
মুক্তিযুদ্ধকালীন খুলনা জেলার প্রতিটি থানায়ই রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। যেমন, দাকোপ থানার চালনা ইউনিয়নের খাটালিয়া-লক্ষ্মীখোলা রাজাকার ক্যাম্প, বটিয়াঘাটা থানার বটিয়াঘাটা রাজাকার ক্যাম্প, বারোআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প, দৌলতপুর থানার দৌলতপুর ও শিরোমনি রাজাকার ক্যাম্প, রূপসা থানার ঘাটভোগ ইউনিয়নের আলাইপুর রাজাকার ক্যাম্প, পাইকগাছা থানার কপিলমুণি ও গড়ইখালি রাজাকার ক্যাম্প, ডুমুরিয়া থানার খর্নিয়া, কাপালিডাঙ্গা ও জামিরা বাজার রাজাকার ক্যাম্প প্রভৃতি।
……………………………………………………
২৭. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, ২য় সং. (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯২), ভুক্তি ‘রাজাকার’। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় দক্ষিণ ভারতের হায়দারাবাদের তৎকালীন নিযাম ভারত ইউনিয়নের সাথে একীভূত হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ‘রেজাকার’ নামে একটি তথাকথিত স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা বাহিনী গঠন করেছিলেন। অবশ্য তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ায় ‘রেজাকার’ নামক সংগঠনের এটাই প্রথম নজির।
২৮ আহমদ শরীফ ও অন্যান্য (সম্পা.), একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়। ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্ৰ, ১৯৯২), পৃ. ৮৮।
২৯ মুনতাসীর মামুনের কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই দাবি করেন। বিস্তারিত দেখুন, মুনতাসীর মামুন, পরাজিত পাকিস্তানী, পৃ. ৬৭।
৩০. আহমদ শরীফ, একাত্তরের ঘাতক, পৃ. ৮৯৷
৩১. তদেব, পৃ. ৯০৷
৩২. তদেব, পৃ. ৯১। তৎকালীন দ্রব্যমূল্য অনুযায়ী প্রতিমণ চালের দাম ছিলো ২৫/৩০ টাকা।
৩৩. দৈনিক সংগ্রাম, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!