You dont have javascript enabled! Please enable it!

ফুলতলা গণহত্যা (২৮ মার্চ, ৩ মে ১৯৭১)

ফুলতলা হলো খুলনা জেলার একটি উপজেলা। খুলনা থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে যশোর-খুলনা সড়কের পাশেই এই উপজেলা সদরের অবস্থান। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এখানে গণহত্যা চলে।
এখানে সংঘটিত গণহত্যার দুটি পর্যায় রয়েছে। এর প্রথম পর্যায় সংঘটিত হয়েছিল ২৮ মার্চ ১৯৭১ তারিখে। ২৭ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি বহর যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে খুলনা শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এই খবর পেয়ে ফুলতলার স্থানীয় অধিবাসীরা নিজস্ব উদ্যোগে ব্যারিকেড এবং কিছু হালকা অস্ত্রশস্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। ফুলতলা গ্রাম সংলগ্ন প্রায় আধা কিলোমিটার রাস্তায় গাছ, ইট প্রভৃতি ফেলে এই ব্যারিকেড দেয়া হয়। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি সেখানে আটকে যায়। এই প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা পাঁচ ছয়টি দলে ভাগ হয়ে বেলা এগারোটার দিকে ফুলতলা গ্রামে প্রবেশ করে। সেনাবাহিনী প্রবেশের খবর পেয়ে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দ্রুত গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই সময়ে পাকিস্তানি সেনারা ফুলতলা গ্রামের সুকুমার কুণ্ডু ও অনন্ত কুণ্ডুর বাড়ি-সহ বেশকিছু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে যায়। এর কিছু পরে লুট শুরু হয়। লখাই নামক একজন অবাঙালি এই লুঠপাটে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নেয়।
পরদিন ২৮শে মার্চেও পাকিস্তানি সেনারা যশোর থেকে ফুলতলার উপর দিয়ে খুলনায় যাচ্ছিল। ফুলতলার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তারা ফুলতলা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় গুলি চালায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই গোলাগুলিতে ওইদিন ফুলতলায় বেশ কয়েকজন নিহত হন। এদের মধ্যে ফুলতলার ভরত ফার্মেসির মালিক ডা. মণীন্দ্রনাথ স্বর-এর মৃত্যু ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। সজ্জন ও ধর্মপ্রাণ এই মানুষটি ওই সময় তাঁর বাড়িতে পারিবারিক মন্দিরে পূর্বাহ্নের প্রার্থনা করছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা এ সময় পিছন থেকে তাঁকে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনি দেবতার বিগ্রহকে জড়িয়ে ধরেন এবং সেভাবেই মারা যান।৪০
এই হত্যাকাণ্ডের পরে এলাকায় ভীতির সঞ্চার হয় এবং এলাকাবাসী পরামর্শ করে রাতে গ্রাম পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত হয়, দশ-বারো জনের একটি দল লাঠি হাতে রাতে পালাক্রমে গ্রাম পাহারা দেবে। সেই মোতাবেক ২৮ মার্চ রাত থেকেই এলাকায় পাহারা চালু হয়। কিন্তু প্রথম দিন রাতেই পাহারারত একটি দলের উপর সশস্ত্র বিহারিদের একটি দল অতর্কিতে হামলা চালায়। ফলে দলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। মৃণাল কান্তি কুণ্ডু এবং মঙ্গল কুণ্ডু নামক স্থানীয় দুই যুবক বিহারিদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে যায়। মৃণাল কিছুক্ষণ লাঠি ঘুরিয়ে বিহারিদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু অকস্মাৎ অন্ধকারের মধ্যে একজন তার মাথায় কোপ মারে। সাথে সাথে কয়েকজন মিলে চারদিক দিয়ে তাঁকে লোহার রড দিয়ে পিটাতে থাকে। মৃণাল কুণ্ডু প্রতিরোধের শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
বিহারিরা এরপর মৃণাল কুণ্ডু ও মঙ্গল কুণ্ডুকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের কথোপকথন থেকে মৃণাল বুঝতে পারেন যে, কিছুক্ষণ পরে তাঁদের জবাই করা হবে। চারিদিকে তখন অন্ধকার। এক পর্যায়ে দুর্বত্তরা তাঁকে মাটিতে ফেলে দিয়ে গলায় ছুরি চালাতে শুরু করে। নিজের গলায় ছুরি চালানোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মৃণাল বলেন:
“আমার মাথাটা কাত করে দুইজন মাটির সাথে চেপে রাখে, আর কয়েকজন হাত ও পা চেপে ধরে রাখে। একইভাবে মঙ্গলকেও তারা মাটির সাথে চেপে ধরে। মঙ্গলের গলায় ছুরি চালানোর সময় কয়েকবার তাঁর গোঙানি শুনতে পাই। একপর্যায়ে তারা আমার গলায় ছুরি দিয়ে পোচ দিতে থাকে। তীব্র যন্ত্রণার সাথে সাথে আমি বুঝতে পারি, গলা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। হঠাৎ উপলব্ধি করলাম ছুরি চালানো বন্ধ করে তারা ছুরিটা পাশের একটি শানের উপর ঘসে ঘসে ধার দিচ্ছে। ধার দেওয়ার পরে তারা আবার আমার গলায় ছুরি চালায়। আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ি। এরপর সম্ভবত আমাদের মৃত ভেবে তারা চলে যায়।”৪১
পরদিন সকালে ছেলেকে বাঁচানোর জন্য মৃণালকান্তির পিতা সুকুমার কুণ্ডু ফুলতলা বাজারে ঔষধের খোঁজে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি বিহারিদের হাতে ধরা পড়েন। বিহারিরা তাঁকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে পার্শ্ববর্তী ভৈরব নদের তীরে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন যে, তাঁর মতো আরও সাত-আটজনকে সেখানে ধরে আনা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে তাঁদের জবাই করে নদীতে ফেলে দেয়া হবে।
বিহারিরা এই সময় আলোচনা করছিল যে, কিছুক্ষণ আগে জবাই করার সময়ে একজন তাদের অসাধানতায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে গেছে। আবার যেন কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালাতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছিল। সুকুমার কুণ্ডু বুঝতে পারেন মৃত্যু আসন্ন। হঠাৎ তিনি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে দড়ির বাঁধন ছিড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। সৌভাগ্যবশত দড়িটা ছিড়ে যায় এবং সুকুমার তৎক্ষণাৎ নদীতে ঝাঁপ দেন। বিহারি ঘাতকরা রে রে করে তেড়ে আসে। কিন্তু সুকুমার তখন নদীতে ডুব দিয়ে প্রাণপণে সাঁতার দিচ্ছেন। আরেকটি শিকার ফসকে যাওয়ায় ঘাতকরা এবার আরও সতর্ক হয়ে যায়। দেরি না করে অবশিষ্ট ধৃতদের দ্রুত জবাই করার দিকে তারা মনোযোগ দেয়।
সুকুমার কুণ্ডু নদী সাঁতরিয়ে অপর তীরে গিয়ে দেখতে পান, তাঁর প্রতিবেশী কৃষ্ণভূষণ কুণ্ডু (কেষ্ট) নদীর চরে পড়ে আছে, তাঁর গলার খানিকটা জবাই করা। তিনি বুঝতে পারেন, বিহারিরা কিছুক্ষণ আগে এঁর কথাই আলোচনা করছিল। কৃষ্ণভূষণ তখনও জীবিত ছিলেন এবং ইশারায় তাঁর জীবন রক্ষার জন্য সুকুমার কুণ্ডুকে অনুরোধ করেন। সুকুমার কুণ্ডু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কৃষ্ণভূষণের মাথার কাছে কিছুক্ষণ বসে পড়েন। এরপর কিছু শেওলা জড়ো করে কৃষ্ণভূষণের মাথাটা তার উপরে রাখেন। নদীর ওপারে একবার তাকিয়ে দেখেন, একজনকে ঠেসে ধরে জবাই করা হচ্ছে। চরের উপর নিঃসাড় হয়ে কিছুটা সময় পড়ে থাকার পরে কৃষ্ণভূষণ প্রাণত্যাগ করেন।৪২ এই ঘটনার পরে ফুলতলার অধিকাংশ হিন্দু অধিবাসী দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়।
৩ মে ১৯৭১ তারিখে ফুলতলার পার্শ্ববর্তী দামোদর গ্রামে আরেকটি গণহত্যা সংঘটিত হয়। দামোদর গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ শিবশংকর-এর সদ্য পরিত্যক্ত প্রাসাদোপম বাড়ির দখল নিয়ে স্থানীয় দুষ্কৃতী ও বিহারিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। উল্লেখ্য, এই শিবশংকর এপ্রিল মাসে সপরিবারে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর ফেলে রাখা বসতবাড়ি দখল করার জন্য স্থানীয় রাজ্জাক (গাড়াখোলা, ফুলতলা), ইউনুস (ভাটপাড়া, ফুলতলা) প্রমুখ দুষ্কৃতীদের সাথে বিহারিদের দ্বন্দ্ব বাধে।
খুলনার খালিশপুরের কুখ্যাত ‘মতিউল্লাহ গুণ্ডা ছিল বিহারিদের নেতা। শিবশংকরের এই বাড়িটি দখল করার জন্য সে পাকিস্তানি সেনাদের খবর দিয়ে ফুলতলায় নিয়ে আসে। উদ্দেশ্য ছিল মিলিটারির ভয় দেখিয়ে বাড়িটি বিহারিদের পাইয়ে দেওয়া। কিন্তু ফুলতলায় পৌঁছে পাকিস্তানি সেনারা তাণ্ডব শুরু করে। স্থানীয় দামোদর গ্রামের সাহাপাড়া, পঙ্কজিনী বসু রোড ও বাজারের হিন্দু অধ্যুষিত পাড়াগুলোয় তারা আগুন লাগিয়ে দেয়। সাথে চলতে থাকে গুলিবর্ষণ ও ধরপাকড়। এদিন তারা আট-দশজন মানুষকে হত্যা করে। এরপর থেকে ফুলতলা ও এর আশেপাশের সমস্ত হিন্দুবাড়ি একেবারে জনশূন্য হয়ে যায়।৪৩
দামোদর গ্রামের এই গণহত্যার অল্পকাল পরে ফুলতলা বাজারে গড়ে ওঠে রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি। স্থানীয় ভৈরব নদের তীরবর্তী সেনের ঘাট ও বেজেরডাঙায় যশোর-খুলনা সড়কের পুলের ওপর এই রাজাকাররা অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। এর মধ্যে ফুলতলার তৎকালীন প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোধা শেখ মো. রফি ও আলকা মিলনী স্কুলের শিক্ষক শান্তিলতা সাহার মৃত্যু ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। রফিকে রাজাকাররা জবাই করে তাঁর খণ্ডিত মাথা তাদের ক্যাম্পের সামনে টানিয়ে রেখেছিল।৪৪ জানা যায়, রফিকে গুলি করার জন্য রাজাকাররা নদীর তীরে নিয়ে গিয়েছিল। তখন সন্ধ্যা সমাগত। নদী দিয়ে তখন কয়েকটি নৌকা যাচ্ছিল। রফি ঘাতক রাজাকারদের অনুরোধ করে বলেছিলেন, নৌকাগুলো চলে যাওয়ার পরে তাঁকে গুলি করতে। কারণ, তাঁকে গুলি করলে তা নৌকার আরোহীদের গায়ে লাগতে পারে।৪৫ শিক্ষক শান্তিলতা সাহা ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি আত্মগোপনে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন। ডুমুরিয়া উপজেলার উত্তরাংশের কোনো একটি বিলে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। রাজাকাররা তাঁকে আটক করে বেশ কয়েকদিন পাশবিক যৌন নির্যাতন করে। একপর্যায়ে তারা তাঁকে হত্যা করে।৪৬
……………………………………………………
৪০. সাক্ষাৎকার, সদানন্দ স্বর (মণিন্দ্রনাথ স্বরের পৌত্র, ফুলতলা বাজার), ১৪ এপ্রিল ২০১৫।
৪১. সাক্ষাৎকার, মৃণালকান্তি কুণ্ডু (ফুলতলা), ১৪ এপ্রিল ২০১৫। মৃণালকান্তি কুণ্ডুর এই গুরুতর অবস্থা দেখে তার বাড়ির সকলে প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। শুধু তাঁর বৃদ্ধ ঠাকুরমা এই রক্তাক্ত ছেলেটিকে নিয়ে সারারাত বসে থাকেন। পরে তাঁর অশেষ সেবা ও প্রচেষ্টায় মৃণালকান্তি মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসেন।
৪২. সাক্ষাৎকার, মৃণালকান্তি কুণ্ডু ও নির্মল কুণ্ডু (ফুলতলা), ১৪ এপ্রিল ২০১৫। মৃণালকান্তি তাঁর পিতা সুকুমার কুণ্ডুর কাছে অনেকবার এই ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন।
৪৩. সাক্ষাৎকার, অচিন্ত্যকুমার বিশ্বাস (দামোদর, ফুলতলা), ১৬ এপ্রিল ২০১৫।
৪৪. সাক্ষাৎকার, কামাখ্যা প্রসাদ রায়চৌধুরি (ভদ্রদিয়া, খর্নিয়া), ২৬ জুলাই ২০১৪। কামাখ্যা প্রসাদের সাথে শেখ রফির রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা ছিল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে রফি তাঁর সাথে দেখা করেছিলেন।
৪৫. সাক্ষাৎকার, রেজোয়ান রাজা (শেখ রফির ভ্রাতুষ্পুত্র, ফুলতলা), ১৩ নভেম্বর ২০১৫।
৪৬. সাক্ষাৎকার, নূরুল ইসলাম মানিক (কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, ডুমুরিয়া), ৮ নভেম্বর ২০১৪।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!