You dont have javascript enabled! Please enable it!

আলতাপোল লেন গণহত্যা 

২৬ মার্চ থেকে খুলনা শহরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছিল। এর পর থেকে পাকিস্তানি সেনারা প্রতি রাত্রে খুলনা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশি চালাতো। ৩১ মার্চ রাতে তল্লাশি চালানোর কথা বলে তারা শহরের আলতাপোল লেনে মহাদেব চক্রবর্তীর বাড়িতে প্রবেশ করে। এই মহাদেব চক্রবর্তী বিএল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ব্রজলাল চক্রবর্তীর জ্ঞাতিভাই যদু চক্রবর্তীর পুত্র। স্বভাবতই তিনি ছিলেন একজন সম্মানিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। পাকিস্তানি সেনারা মহাদেব চক্রবর্তীর সাথে দেখা করার কথা বলে তাঁর বাসভবনে প্রবেশ করে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্রাশ ফায়ারে তাঁকে-সহ পরিবারের মোট সাতজনকে গুলি করে হত্যা করে।৪৭ এর মধ্যে তাঁর বাড়ির একজন ভাড়াটিয়া অধিবাসী, একজন কাজের লোক এবং সুজিৎ কুমার সর্ববিদ্যা নামক এক ব্যক্তির নিহত হওয়ার কথা জানা যায়।৪৮ এই হত্যাকাণ্ডটি খুলনা শহরে ব্যাপক ত্রাস ও ভীতির সঞ্চার করে। হত্যাকাণ্ডের পরদিন তাঁদের বাড়ির সামনে রাস্তায় তিন সহোদর-সহ অন্য একজনের মৃতদেহ পড়ে ছিল। এই ঘটনার একটি মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাওয়া যায় কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের রচনায়:
পিচ ঢালা রাস্তার উপরে উকিলবাবুর তিন ছেলে শুয়ে আছে, সঙ্গে ধুতি-ফতুয়া গায়ে আর একজন মাঝবয়েসি লোক। কি বিচিত্র শোয়ার ভঙ্গি তাদের? মাটিকে ভূমিবাহু ধরলে একজনের পা ত্রিভুজের মতো ভাঁজ করা, অন্য পা মেলে দেওয়া। ছোট ছেলেটি, রাজপুত্রের মতো চেহারা, টকটকে ফর্সা রং, টিকোলো নাক, লাল গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট, হাঁটু ভাঁজ করে তলপেটের কাছে নিয়ে যেন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মেজভাই দলামোচড়ানো, ডানবাহুর নিচে প্রায়- ছিন্ন মাথা, দুই চোখ চেয়ে রয়েছে, বাঁ হাতটি বড়ো ভাইয়ের গলার উপর মেলে দেওয়া। কি নিশ্চিন্তে আরামের সাথে শুয়ে থাকা, শুধু জীবিতেরা এভাবে ঘুমাতে পারে না।৪৯
সাউথ সেন্ট্রাল রোড ও আলতাপোল লেন গণহত্যার পর শহরের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো ফাঁকা হয়ে যায় এবং প্রাণভয়ে বাসিন্দারা গ্রামের দিকে সরে যেতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এরপর শহরের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালানো শুরু করে। খালিশপুরের মুন্সিবাড়ির গণহত্যা এই প্রক্রিয়ারই একটি অংশ।
……………………………………………………
৪৭. দুর্গাপদ রায়, “খুলনা শহর: উৎপত্তি ও বিকাশ (১৮৪২-১৯৮৪)”, অপ্রকাশিত পিএইচডি থিসিস, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৪, পৃ. ৩২৬।
৪৮. শেখ গাউস মিয়া, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খুলনা জেলা (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০০৮), পৃ. ৩০০।
৪৯. হাসান আজিজুল হক, একাত্তর করতলে ছিন্ন মাথা (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৮), পৃ. ১১৷ সাক্ষাৎকার, হাসান আজিজুল হক (বিহাস, রাজশাহী), ১৯ আগস্ট ২০১০।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!