মুন্সিবাড়ি গণহত্যা
মুন্সিবাড়ি গণহত্যার প্রেক্ষাপট ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। খুলনার শিল্পাঞ্চল খালিশপুরে তখন অনেক বিহারি মুসলমান বসবাস করতো। মতাদর্শের দিক দিয়ে তারা ছিল পাকিস্তানপন্থী। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাঙালিদের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছিল। ২৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে খালিশপুরের শ্রমিক ইউনিয়ন মাঠে বাঙালি-বিহারি সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষ দাঙ্গায় রূপান্তরিত হয় এবং নিউ কলোনি, ক্রিসেন্ট জুট মিলসহ সমগ্র খালিশপুরে ছড়িয়ে পড়ে। দাঙ্গায় উভয় পক্ষের শতাধিক মানুষ নিহত হয়।৫০
খালিশপুর আওয়ামী লীগের তখনকার সভাপতি ছিলেন মুন্সি সিদ্দিকুর রহমান। একদিকে তিনি ছিলেন একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা, অন্যদিকে প্রচুর বিষয়-সম্পত্তির মালিক। স্বভাবতই প্রভাব ও প্রতিপত্তির দিক দিয়ে তিনি খালিশপুরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাই তিনি বিহারি তথা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের সম্ভাবনার মধ্যে ছিলেন। বিশেষত ২৭ মার্চের বাঙালি- বিহারি দাঙ্গার পরে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন।
এতৎসত্ত্বেও মুন্সিবাড়িতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের ঘটনাটি ছিল দৃশ্যত আকস্মিকই। খালিশপুরে বিহারিদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মিয়া মতিউল্লাহ৫১ ও মোহাম্মদ আলী বিহারি ছিল অন্যতম। ৭ এপ্রিল সকালে মুন্সি সিদ্দিকুর রহমানের সাথে বিহারি নেতা ফরিদ মিয়া, মতিউল্লাহ ও মোহাম্মদ আলী বিহারি এক সমঝোতাসূচক আলোচনায় মিলিত হয়। এই দিনের আলোচনায় বিহারি নেতারা পূর্বের তিক্ত সম্পর্ক ভুলে একসাথে শান্তিতে থাকার ও এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার ব্যাপারে একমত হয়।৫২ এই আলোচনা ও সমঝোতার পর মুন্সি সিদ্দিকুর রহমান নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। বাড়িতে সেদিন তাঁর জামাতা হাবিবুর রহমানসহ আরও কতিপয় আত্মীয়-স্বজন ছিলেন। দুপুরে আহারের পর বাড়ির সকলে কেউবা দাবা, লুডু ইত্যাদি খেলে কেউবা অলসভাবে শুয়ে সময় অতিবাহিত করছিলেন। মহিলারা গল্প-গুজবে মেতেছেন, বাচ্চারা হৈচৈ করছে—বেশ আনন্দঘন পরিবেশ—বাঙালি পরিবারে মেয়ে-জামাই বেড়াতে এলে যেমনটি হয়।
বেলা তখন আনুমানিক তিনটা-সাড়ে তিনটা। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে জনৈক ব্যক্তি ছুটে এসে খবর দিলো যে, মুন্সিবাড়ির উল্টোদিকের সামনের বাড়ি মিলিটারি ঘেরাও করেছে। মুন্সি সিদ্দিকুর রহমানকেও তারা খুঁজছে। মুহূর্তেই সারা বাড়িতে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। মুন্সি সিদ্দিকুর রহমান দ্রুত বাড়ির সকল পুরুষকে পালিয়ে যেতে বললেন এবং নিজে বাড়ির পেছনের বাগানের মধ্যে দিয়ে পার্শ্ববর্তী গোয়ালখালির দিকে পালিয়ে যান।
কিছুক্ষণের মধ্যে মিলিটারি মুন্সিবাড়ি ঘিরে ফেলে এবং বাড়ির দারোয়ান হারেজ শরীফ ও এনায়েত শরীফকে অস্ত্রের মুখে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়।৫৩ বাড়িতে ঢুকে তারা জানতে চায়, মুন্সি সিদ্দিকুর রহমান কোথায় আছে? বাড়ির সবগুলো কক্ষ, বাথরুম প্রভৃতি স্থানে তারা তল্লাশি করতে থাকে। এরপর বাড়িতে থাকা সমস্ত পুরুষদের একে একে উঠানে দাঁড় করানো হয়। অনেক খোঁজাখুজির পরও যখন তারা মুন্সি সাহেবকে পেলো না, তখন তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ধৃতদের উপর নির্যাতন শুরু করে। কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে মিলিটারি হঠাৎ কয়েকজনের পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে দেয়। এই বীভৎস দৃশ্য দেখে বাড়ির মহিলা ও শিশুসহ সকলে চিৎকার শুরু করলে মিলিটারি ব্রাশ ফায়ার করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই তেরো জন নিহত হন। আজিমুদ্দিন এবং মন্টু খাঁ নামক দুইজন গুলি শুরুর সাথে সাথে অন্য কয়েকজনের দেহের তলায় পড়ে যাওয়ায় মারাত্মক আহত হয়েও বেঁচে যান। বাড়ির লোকজন যারা বেঁচে ছিলেন, তারা বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে যান।৫৪
……………………………………………………
৫০. সাক্ষাৎকার, রমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী (রংপুর, ডুমুরিয়া, খুলনা), ১৫ এপ্রিল ২০১৫। রমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী ছিলেন ঐ দিনের দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শী। এছাড়া দেখুন, বাবর আলী, স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান (খুলনা: ডরোথি রানা প্রকাশনী, ১৯৯১), পৃ. ৫১।
৫১. মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই মতিউল্লাহ চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এজন্য সে মতিউল্লাহ ‘গুণ্ডা’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। সাক্ষাৎকার, মোস্তফা খালিদ খসরু (মুন্সি সিদ্দিকুর রহমানের ভাগ্নে, খুলনা), ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪।
৫২. সাক্ষাৎকার, মোস্তফা খালিদ খসরু (খুলনা), ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪
৫৩. হারেজ শরীফ ও এনায়েত শরীফ আপন দুই ভাই। তাদের বাড়ি ছিলো ফরিদপুরে।
৫৪. সাক্ষাৎকার, মোস্তফা খালিদ খসরু (খুলনা), ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪। এই খালিদ খসরুর দুই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এদিন এখানে গুলিতে নিহত হন।
……………………………………………………
সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার