You dont have javascript enabled! Please enable it!

অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশ ছাত্র- সংগ্রাম পরিষদের এই চার নেতার নির্দেশে ২৫শে মার্চের অনেক আগেই সারাদেশে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ গড়ে ওঠে৷ পরিষদই ৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে পল্টন ময়দানে জনসভায় এক ইস্তেহার প্রচার করেন। এরাই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার মূল রূপকার। ‘ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’ই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ – কবিগুরুর এই গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বলে ঘোষণা করেন৷ ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আহূত জনসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে সর্ব প্রথম পরিষদের পরিকল্পিত সবুজ-লাল ও লালের বুকে সোনালী রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা বঙ্গবন্ধু উত্তোলন করেন৷ প্রত্যক্ষ যুদ্ধে চার ছাত্রনেতা তেমন অবদান না রাখতে পারলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিনগুলোতে তাদের অবদান ইতিহাসে স্বর্ণ অক্ষরে লিখা থাকবে।

জাতীয় যুবনেতাদের সাথে মত বিনিময়
শেখ ফজলল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদের সাথেও আনোয়ারুল আলম শহীদ সাক্ষাৎ করেন৷ চার নেতা আমার সম্পর্কে খুবই উৎসাহ দেখান। তাদের পক্ষে সম্ভাব্য সকল সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন। বাংলাদেশের গত এক যুগের আন্দোলনে এই চার যুবনেতার অবদান খুবই প্রশংসনীয় ও গৌরবোজ্জল৷ জনাব তোফায়েল আহমেদ বেশী সময় আন্দোলনের মূল কেন্দ্রে না থাকলেও ‘৬৯-এর গণ-আন্দোলনে তিনি যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাই-ই তাকে এতটা শীর্ষে নিয়ে এসেছে। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের সকল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন। এই নেতারাই মূল দল আওয়ামী লীগ এবং ছাত্র, যুবক, কৃষক ও শ্রমিকের মধ্যে সব সময় একটা সাধু, সুন্দর ও সফল সমন্বয় ঘটিয়ে আদোলনকে উত্তরোত্তর এগিয়ে নিয়েছেন। ‘৬৯-র গণ-আন্দোলনে এরা একইভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও তারা জাতীয় নেতৃত্ব ও ছাত্র-যুব সমাজের মধ্যে সর্বদা সুন্দর ও সফল সমন্বয় ঘটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন৷

স্বাধীন বাংলা বেতার
‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছে। আমরা শত্রুমুক্ত এলাকায় দেখেছি, শত শত লোক পাট বিক্রি করে সম্ভব হলে প্রথমেই এক ব্যাণ্ড রেডিও কিনতেন। চুপিসারে দোকানীকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘এটায় স্বাধীনবাংলা বেতার শোনা যাবে তো? আমি আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পাট কাটার পর যে কোন সাধারণ কৃষক একখানা রেডিওর প্রয়োজনীয়তা সবার আগে অনুভব করতেন। জুলাই থেকে অক্টোবর, এই সময়ের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার এক ব্যান্ড রেডিও আমাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার জনসাধারণ কিনেছিলেন এবং প্রতি রেডিওর জন্য ১০ টাকা করে ট্যাক্স দিয়েছেন। মুক্ত এলাকায় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ কার রেডিওতে কত জোরে বাজছে তার প্রতিযোগিতা চলতো। অন্যদিকে হানাদার নিয়ন্ত্রিত এলাকার প্রায় সবাই ঘরের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০১

কোণে খুব নীচু শব্দে রেডিও শুনতেন। শীতের সময় অসংখ্য মানুষকে লেপ কাথার নীচে রেডিও নিয়ে, মুখ ঢেকে ঘাপটি মেরে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ শুনতে দেখা গেছে। পাশের কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করলেন, কি কিছু খবর আছে? কয়টা? যে রেডিও শুনেছিলেন, সে লেপের নীচ থেকে মুখ বের করে হয়ত সোল্লাসে বলে উঠতেন, চার-পাঁচটা। মানে চার-পাঁচজন হানাদার মারা পড়েছে। একটা বেতার মাধ্যম যে কতখানি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে, তা ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ সেই সময়ের জনপ্রিয়তার দিনগুলো না দেখলে অনুভব করা দুঃসাধ্য। বেতারের এক অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিয়ত বেতারের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত হয়েছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে বেতার কেন্দ্রের যে বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছি। আধুনিক কালে যে কোনও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজস্ব বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা যে আরও গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ তা উপলব্ধি করে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নামে একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেন। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ গড়ে উঠেছিল, তাদের অন্যতম হলেন, বেতারের সর্বময় দায়িত্বে নিয়োজিত টাংগাইলের গণ-পরিষদ সদস্য জনাব আবদুল মান্নান। অন্যরা হলেন আমিনুল হক বাদশা, শামসুল হুদা, টি. এইচ, সিকদার, আশফাকুর রহমান, শহীদুল ইসলাম, তাহের সুলতান, মাহবুব উদ্দীন, নজরুল, সুকুমার বিশ্বাস, মোস্তফা আনোয়ার, আবদুল্লাহ্ আল ফারুক, আবুল কাশেম সন্দীপ, আবদুস শাকুর। বেতার প্রকৌশলীদের মধ্যে সৈয়দ আবদুস শাকের, রশীদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, এ. এম. শফিউজ্জামান, রেজাউল করিম, কাজী হাবিবুল্লাহ প্রমুখ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত অনুষ্ঠান সূচী :-
১। আগ্নি শিখা,
২। রক্ত স্বাক্ষর,
৩। বজ্র কন্ঠ,
৪। দর্পন,
৫। জাগরণী,
৬। ঐক্যতান,
৭। চরম পত্র,
৮। জল্লাদের দরবার,
১। বহির্বিশ্ব ও বিদেশী নাগরিকদের জন্য ইংরেজী অনুষ্ঠান,
১০। বাংলা ও ইংরেজী খবর,
১১। পত্র-পত্রিকা থেকে বিশ্ব জনমত ইত্যাদি।
সুসাহিত্যিক শওকত ওসমান, রনেশ দাসগুপ্ত, সৈয়দ আলী আহসান, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ এ. আর. মল্লিক, ডঃ সারোয়ার মূর্শেদ, ডঃ মাযহারুল ইসলাম, ডঃ সনজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০২

হক, ডঃ অজয় রায়, অধ্যাপক আবদুল হাফিজ, ফয়েজ আহমেদ, গাজীউল হক, বিখ্যাত চিত্র- পরিচালক জহির রায়হান, সিকান্দার আবুজাফর, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, আবু তোয়াব খান, মহাদেব সাহা, ডঃ মঈদুল ইসলাম, মাহবুব তালুকদার, উম্মে কুলসুম, নাসিমা চৌধুরী, নওয়াজেশ হোসেন, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, বদরুল হাসান, মামুনুর রশিদ ও আরও অনেকের ক্ষুরধার লেখনি মুক্তিযোদ্ধাদের দেহ-মনে সিংহের তেজ ও ব্যাঘ্রের ক্ষিপ্রতা এনে দিত। তথ্য ও বেতার বিভাগের চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুণ্ডু, নাজির আহমেদ ও টাংগাইলের সৈয়দ আবদুল মতিন প্রমুখ বিভিন্ন ধরনের চিত্র অংকন করে নরপশু ইয়াহিয়া ও তার জল্লাদ বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ছবি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন।
স্বাধীন বাংলা বেতারের যেসব কন্ঠশিল্পী বিপ্লবী বাংলার বীর সন্তানদের দেশাত্মবোধক গানের সুরে মাতিয়ে তোলেন, আন্দোলিত করেন তারা হলেন, বিখ্যাত গায়ক আবদুল জব্বার, সমর দাস, আপেল মাহমুদ, অজিত রায়, রথীন্দ্রনাথ রায়, কাদেরী কিবরিয়া, রফিকুল আলম, এম. এ. মান্নান, সিলেটের স্বপ্না রায়, কল্যাণী ঘোষ, অলোকময় লাহা, প্রবাল চৌধুরী, অরূপরতন চৌধুরী, সুকুমার বিশ্বাস, আমার পরম প্রিয় সর্দার আলাউদ্দিন ও উমা চৌধুরী সহ আরও অনেকে।
খবর, বেতার কথিকা ও বেতার নাট্যে অংশ নিতেন হাসান ইমাম, সুভাষ দত্ত, সুমিতা দেবী, রাজু আহমেদ, নারায়ণ ঘোষ, বাবুল আখতার, মাধুরী চক্রবর্তী, প্রসেনজিৎ বোস, আজমল হুদা মিঠু প্রমুখ। প্রযোজক ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন আলি যাকের, আলমগীর কবীর, মোস্তফা মনোয়ার, তাহের সুলতান, এম. আর. আখতার মুকল, কামাল লোহানী। ইংরেজী সংবাদ পড়তেন মিসেস পারভীন হোসেন ও নাসরীন আহমেদ। বাংলাদেশে বেতার অনুষ্ঠান মালার মধ্যে বজ্রকন্ঠ, চরমপত্র ও জল্লাদদের দরবার সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
চলচ্চিত্র শিল্পীরাও স্বাধীনতা আন্দোলনে বসে থাকেনি। বেতার, টি ভি ও সিনেমার সাথে জড়িত থেকে তারা প্রতি মুহুর্তে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপক্ষে কাজ করেছেন। চিত্রাভিনেত্রী কবরী চৌধুরীর রেডিওতে আবেগময়ী করুণ সাক্ষাৎকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণোজ্জ্বল হয়ে আছে। আগষ্টের মাঝামাঝি চলচ্চিত্র কুলাকুশলীরা মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহের জন্য কোলকাতার রাস্তায় নামেন। সুচন্দার সাথে জহির রায়হানের দীর্ঘদিনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকলেও এক সময় তারা যে সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে কোলকাতার রাস্তায় ঘুরে লক্ষ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন; তা এক অভাবনীয় ইতিহাস। ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহের এই অভিযানে দলমত নির্বিশেষে সকল কলাকুশলীরাই আগ্রহ নিয়ে নেমে ছিলেন এবং সংগ্রামের শেষ দিন পর্যন্ত দেশপ্রেমের দুর্বার সংকল্পে তারা ছিলেন একাগ্রচিত্ত।
১১ই নভেম্বর ‘৭১ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আনোয়ার-উল-আলম শহীদের ৪০ মিনিটের এক সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। পরদিন সকালে তা পুনঃপ্রচার করা হয়। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন বেতারের দায়িত্বপ্রাত্ত্ব কর্মকর্তা গণ-পরিষদ সদস্য জনাব আবদুল মান্নান। জনাব মান্নান তদানীস্তন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও টাংগাইল
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৩

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার ভবনে আনোয়ার-উল-আলম শহীদের সঙ্গে ‘চরমপত্র’ পাঠক ও লেখক বিখ্যাত এম. আর. আখতার (মুকুল) ও জয় বাংলা পত্রিকার মূল দায়িত্ব-প্রাপ্ত বাংলাদেশের খ্যাতনামা সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাক্ষাৎ হয়। এম. আর. আখতার (মুকুল) ও আবদুল গাফফার চৌধুরী আনোয়ার-উল-আলম শহীদকে আপন জনের মত গ্রহণ করেন। কোলকাতায় থাকার সময় প্রতিদিন তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। এম. আর. আখতার তার চরমপত্রে বহু জায়গায় আমার সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। এম. আর. আখতারই বলতে গেলে আমার নিয়ন্ত্রিত মুক্তিযোদ্ধা দলকে ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ বানিয়ে ছাড়েন। আমি এতে খুব একটা খুশী হতে পারিনি। বিশেষ কারো নামে বাহিনী না বলে, মুক্তিবাহিনী বললেই বেশী খুশী হব বলে শহীদ সাহেবকে অনেক করে বলে দিয়েছিলেন। তবুও আখতার সাহেব কিন্তু ‘কাদেরিয়া বাহিনী’, ‘কাদেরিয়া মাইর’, ‘কাদেরিয়া বাহিনীর গারুর মাইর’- এই সমস্ত বিশেষণে মুক্তিবাহিনীকে ভূষিত করতে নিরুৎসাহিত হননি বরং আরও উৎসাহ দেখিয়েছেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী টাংগাইল মুক্তিবাহিনীকে তার লেখনীর মাধ্যমে সব রকম সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। তিনি তার দেয়া আশ্বাস খুবই একাগ্রতার সাথে পালন করেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী ভারত উপমহাদেশের একজন বিরল ক্ষুরধার লেখনী প্রতিভাসম্পন্ন সহিত্যিক ও সাংবাদিক। তার লেখা একটি গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’, বাঙালী মানসপটে চিরদিন স্থায়ী হয়ে থাকবে। গাফফার চৌধুরীর মত যুক্তি ও অবেগের সংমিশ্রণে সহজ, সরল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় লেখার ক্ষমতা বাঙালী সাংবাদিকদের মধ্যে কজনের আছে, তা জোরের সঙ্গে বলা খুবই দুস্কর। তার কলম মুক্তিযুদ্ধের সারাটা সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে আগুন ঝরিয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার আগ্নেয়াস্ত্রের বুলেটের চেয়ে গাফফার চৌধুরীর কলমের একটি আচড় আমার কাছে মোটেই দুর্বল মনে হয়নি।

মেজর সফিউল্লাহ্
১৯শে মার্চ ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব জয়দেবপুরে আসে। ঢাকা থেকে জয়দেরবপুরে আসার পথে স্থানীয় জনগণ ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব সহ ১৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের গতিরোধ করেন। পাঞ্জাব রেজিমেন্ট জনগণকে বেরিকেড উঠিয়ে নিতে বললে জনগণ তা অস্বীকার করেন। এদিকে রাস্তা বেরিকেড মুক্ত করার জন্য ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব ২ নং রেজিমেন্টকে নির্দেশ প্রদান করে। নির্দেশ পেয়ে জয়দেবপুর রাজবাড়ী থেকে ২ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু’টি কোম্পানী আবরুদ্ধ ১৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে উদ্ধারে এগিয়ে যায়। বাঙালী সৈন্যদের দেখেও স্থানীয় জনগণ ব্যরিকেড উঠাতে রাজী হয়না। তাদের একমাত্র দাবী ‘পাঞ্জাবী সৈন্যরা ঢাকা ফিরে যাও’। শেষে ব্রিগেডিয়ার বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহকারী ব্যাটেলিয়ান কমাণ্ডার মেজর সফিউল্লাহকে রাস্তা ব্যারিকেড মুক্ত করতে নির্দেশ দিয়ে, প্রয়োজনে গুলি চালাতে বলে। ব্রিগেডিয়ারের নির্দেশে ছোটখাট বাঙালী মেজর ভদ্রলোক কোন
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৪

অস্বস্তিতে পড়েছিলেন কিনা জানিনা, তবে তার নির্দেশে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রায় ৩০০ রাউণ্ড গুলি ছুঁড়ে। এতে সরকারী হিসাবে ৫ জন, বেসরকারী হিসাবে ২৫ জন নিহত ও ৭০-৮০ জন সাধারণ মানুষ আহত হয়। বাঙালীদের রক্তের উপর দিয়ে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট জয়দেবপুরে আসে। জয়দেবপুরের অবস্থা তেমন ভাল নয় দেখে তারা রাতেই আবার ট্রেনযোগে ঢাকা রওনা হতে গেলে জনগণ রেল সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে। জয়দেবপুর স্টেশনে ১৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ঢাকায় যাওয়ার রাস্তা পরিস্কার করার জন্যে সফিউল্লাহ্‌র নির্দেশে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা গুলি ছুঁড়তে অস্বীকার করলে ১৫ জন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈন্যকে আটক করা হয়। অন্যেরা দারুণ অনিচ্ছা নিয়ে গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ২ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টর ১৬–১৭ জন সৈন্য ঐ রাতে অস্ত্রসহ শিবির থেকে পালিয়ে যায়। ২৩শে মার্চ ২ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমাণ্ডার কর্ণেল মাসুদুল হাসানকে ঢাকায় বদলি করে তার স্থলে কর্ণেল কাজী আবদুল রফিককে জয়দেবপুরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২৫ শে মার্চ কাল রাতে ঢাকার বুকে ট্যাংক ও কামান নিয়ে হানাদাররা যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন সে খবর বিদ্যুৎ গতিতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২৬শে মার্চ দুপুরের পর সারা বাংলার একটি কাক পক্ষীরও জানতে বাকী থাকেনা যে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রংপুর ও দেশের অন্যান্য বড় বড় শহর ও সেনা ছাউনিগুলোতে কি ঘটেছে। কিন্তু ঢাকার নাকের ডগায় থেকে ও মেজর সফিউল্লাহ্ ২৭শে মার্চ পর্যন্ত নাকি এসবের কিছুই জানতেন না। ২নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈন্যরা বার বার বলেছেন, তারা ২২–২৩ তারিখ থেকেই পশ্চিমাদের মনোভাব বুঝতে পেরেছিলেন। সৈনিকদের চাপে ও জীবনের ভয়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে ২৮শে মার্চ দুপুর ১২ টার দিকে ২ কোম্পানী সৈন্য নিয়ে টাংগাইলের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
মেজর সফিউল্লাহ্ তাঁর ব্যাটেলিয়ান নিয়ে ময়মনসিংহে পিছিয়ে এসে কোনরকম প্রতিরোধ গড়ে না তুলে ময়ময়নসিংহ এবং সেখান থেকে নরসিংদীর দিকে গতি পথ পরিবর্তন করেন। এক কোম্পানী সৈন্য নরসিংদীতে রেখে তিনি কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় পিছিয়ে যান। বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী নরসিংদীতে পৌছার একদিন পর ১লা এপ্রিল হানাদার বাহিনী নরসিংদীর উপর প্রচণ্ড বিমান হামলা চালায়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের কাছে বিমান বিধ্বংসী কোন অস্ত্র না থাকলেও তারা খুবই সাহসিকতার সাথে সারাদিন হানাদারদের আক্রমণ প্রতিহত করে কয়েকজন আহত সহযোদ্ধাকে নিয়ে নরসিংদী থেকে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার দিকে পিছিয়ে যায়। মেজর সফিউল্লাহ্ ব্রাহ্মণবাড়ীয়াতে অপেক্ষা না করে এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে সোজা সিলেট চলে যান। সেখানে কর্ণেল (পরবর্তীতে জেনারেল) এম. এ. জি. ওসমানীর সাথে দেখা করেন। কর্ণেল সি. আর. দত্তের (চিত্তরঞ্জন দত্ত) সাথেও সিলেটে মেজর সফিউল্লাহর সাক্ষাৎ হয়েছিল। সিলেট কিভাবে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা করে মেজর কিউ. এম. জামানকে সিলেটের ভার দেওয়া হয়। মেজর সফিউল্লাহ্ আবার ব্রাহ্মণবাড়ীয়াতে ফিরে আসেন। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া পৌঁছার একটু পরেই তিনি প্রথম হানাদারদের দ্বারা আক্রান্ত হন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৫

৬-৭ ঘণ্টা সাহসিকতার সাথে স্থল ও বিমান হামলা প্রতিহত করে সসৈন্যে শাহবাজপুর ও মাধবপুরে সরে যান৷ সেখানে পৌঁছে পরবর্তী সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলা করতে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্হা গড়ে তুলেন। ২-৩ দিন পর হানাদাররা শাহবাজপুরে ও মাধবপুরেও আক্রমণ করে৷ মেজর সফিউল্লাহের নেতৃত্বে সৈনিকেরা হানাদারদের ১৪-১৫ দিন ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। শত্রুর চাপ ভীষণ ভাবে বেড়ে গেলে তারা ভারতের দিকে আরও সরে গিয়ে তেলিয়াপাড়াতে নতুন ঘাঁটি গাড়েন৷ তেলিয়াপাড়াতেও হানাদারদের সাথে অবিরাম যুদ্ধ চলে। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হানাদারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে টেকা যাবেনা মনে করে নতুন রণকৌশল গ্রহণ করে ভারতের আরও কাছাকাছি মনতলা-সিংগাইর বিল এলাকায় দলকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেন। মে মাসের শেষ দিকে হানাদারদের প্রচণ্ড চাপে বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত ভারত সীমান্ত অতিক্রম করেন। আগষ্টের মাঝামাঝি তাঁরা আবার সুসংগঠিত হয়ে সিংগাইর বিল এলাকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বেশ কিছ জায়গা শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হন৷ স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধ পর্যন্ত মেজর সফিউল্লাহ এখান থেকেই পরিচালনা করেন। নভেম্বরের ৩০ তারিখ মেজর সফিউল্লাহ, তার দল নিয়ে বাংলাদেশের আরও অভ্যন্তরে এগুতে শুরু করেন। ৪ঠা ডিসেম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১১ শত সৈন্যের একটি দল নিয়ে মাধবপুর, শাহবাজপুর ও সরাইলের পথে আশুগঞ্জে তিনি শত্রুর মাখোমখি হন৷ ইতিমধ্যে মিত্রবাহিনীর একটি ডিভিশন আখাউড়ায় উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মেজর সফিউল্লাহর দল ৪-৫ই ডিসেম্বর সারা দিনরাত লড়াই চালিয়ে আখাউড়ায় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হতে সক্ষম হয়৷ আশুগঞ্জে বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রবল চাপের ফলে হানাদাররা সেতুর অপর পারে, ভৈরবে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মেজর সফিউল্লাহ, ভৈরবে কিছু সৈন্য রেখে দ্বিতীয় বেংগল রেজিমেন্টের বাকী সৈন্য নিয়ে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এই সময় ঐ পথে মিত্রবাহিনীর সৈন্যরাও ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিল। সফিউল্লাহর দল ১৩ই ডিসেম্বর নরসিংদী- ডেমরার মাঝামাঝি অবস্থান নেন। ১৬ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তারা বিজয়গর্বে— ঢাকায় প্রবেশ করেন৷

মেজর খালেদ মোশাররফ
মেজর খালেদ মোশাররফও তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫৭তম ব্রিগেডের একজন মেজর ছিলেন। ২২শে মার্চ তাকে কুমিল্লার ৪র্থ বেংগল রেজিমেন্টের সহকারী অধিনায়ক হিসাবে বদলী করা হয়৷ খালেদ মোশারফ এর আগেও ৪র্থ বেংগল রেজিমেন্টে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। তিনি তার পুরোনো ব্যাটেলিয়ানে বদলীর আদেশ পেয়ে স্বভাবত খুশী হয়েছিলেন। ২৪শে মার্চ ৪র্থ বেংগল রেজিমেন্টের কমান্ডেন্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত খানের কাছ থেকে দায়িত্বভার বুঝে নেন৷ দায়িত্বভার বুঝে নেয়ার সাথে সাথে তাকে নতুনভাবে আদেশ দেয়া হয় যে, একটি কোম্পানী নিয়ে (তাকে) সীমান্ত নিকটবর্তী শমসের নগর যেতে হবে। কারণ সীমান্ত এলাকায় সশস্ত্র ভারতীয় নকশাল পন্থীরা একটি আক্রমণের পরিকল্পনা আটছে। ইতিমধ্যেই তাকে সাহায্যের জন্য বেংগল রেজিমেন্টের আরও দুটি কোম্পানী এবং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী পাঠানো হয়েছে বলে জানানো হয়৷ খালেদ মোশাররফ ২৪ শে মার্চ রাতে বেংগল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী নিয়ে কুমিল্লা থেকে শমসের নগরের উদ্দেশে
রওনা হন। যাবার পথে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় ৪র্থ বেংগল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানী কমান্ডার মেজর শাফায়াত জামিলের সাথে দেখা হয়। মেজর শাফায়াত জামিলকে দিন দশেক আগে কোম্পানী সহ ব্রাহ্মণবাড়ীয়া পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। দায়িত্বশীল বাংগালী সামরিক অফিসারদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে কেন এমনিভাবে দূরে পাঠানো হচ্ছে, এই নিয়ে তাদের মনে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছিলো। মেজর খালেদ মোশারফ তার কোম্পানী নিয়ে ২৫শে মার্চ শমসের নগর এসে কমাণ্ডেন্টের কথা অনুসারে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের উপস্থিতির কোন হদিস তো পেলাইনা, আশেপাশে কোথাও বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে দু’টি কোম্পানী থাকার কথা ছিল, তাদের কোন ছায়াও দেখতে পেলেন না। এতে তার মনে পূর্ব সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। তিনি তাৎক্ষনিক ভাবে বেতারে কুমিল্লা হেডকোয়ার্টারের সাথে বার বার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু বিফল হন। ঐ অবস্থাতেই ২৫শে মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত শমসের নগরেই কাটান। বেতার যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ায় তিনি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ২৬শে মার্চ সকালে আবার কুমিল্লার সাথে বেতার যোগাযোগ চেষ্টা করেন। কিন্তু না। ততক্ষণে কুমিল্লা হেডকোয়ার্টার থেকে সকল বেতার যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। মেজর খালেদ মোশাররফ তার কনভয় নিয়ে ২৬শে মার্চ বিকেলে আবার ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার দিকে যাত্রা করেন। শাফায়াত জামিলের কোম্পানীর সাথে খালেদ মোশাররফের বেতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ২৭শে মার্চ ভোর ৬টায় শাফায়াত জামিল খালেদ মোশাররফকে জানান যে, ব্যাটেলিয়ান কমাণ্ডার মিটিং ডেকেছেন। শাফায়াত জামিলের কথা শুনে খালেদ মোশাররফ বলেন, “মিটিং-এ যোগদান করার অর্থ আত্মহত্যা। তুমি তোমার কাজ সেরে ফেলো। পাঞ্জাবী কমান্ডিং অফিসার ও জোয়ানদের বন্দী কর। আমি তোমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।’ শাফায়ত জামিল সকাল ৯টার মধ্যে পাঞ্জাবী কমান্ডিং অফিসার সহ বেশ কয়েকজন জোয়ানকে বন্দী করতে সক্ষম হন। মেজর খালেদ মোশারফ ২৭ তারিখ দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শাফায়াত জামিলের সাথে মিলিত হন। তখন থেকে তারা উভয়ে পরিকল্পনা মাফিক কাজে হাত দেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের যারাই মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছেন, তাদের মধ্যে মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে পরিচালিত সৈন্যরাই হানাদারদের অগ্রাভিযানে প্রথম দুর্দান্ত সাহসিকতার সাথে বাধা প্রদান করতে সক্ষম হন। এটা খুবই সত্য যে, মেজর জিয়ার নেতৃত্বে ৮নং বেঙ্গল রেজিমেন্ট, মেজর সফিউল্লহর নেতৃত্বে ২নং বেংগল রেজিমেন্টে মেজর খালেদ মোশারফ ও মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ২৫শে মার্চের পর ভারতের দিকে পিছিয়ে যাবার সময় অনেক বেশী যুদ্ধ করেছেন। আখাউড়া-কসবা যুদ্ধে খালেদ মোশাররফ বিপুল সফলতা অর্জনের পরও সুবিধাজনক অনুকূল অবস্থানের জন্য আগরতলার কাছে মতিন গরের পাহাড়ী এলাকায় সরে এসে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করেন। এখান থেকেই তিনি সুস্থিরভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন। শালদা নদী, মন্দভাগ, কসবা, বেলুনিয়া, পরশুরাম ও আখাউড়ার কিছু অংশে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা বহু সফল যুদ্ধ পরিচালনা করেন। জুলাই মাসে শালদা নদীর পাশে রেলস্টেশনে হানাদারদের সুদৃঢ় ঘাটি দখল
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৭

করতে যেয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের এক প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার বেলায়েত অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে হানাদার ঘাটি দখলের সময় শহীদ হন। মেজর খালেদ মোশাররফের আর একজন সাহসী কোম্পানী কমান্ডার লেফটেন্যান্ট আজিজ পরশুরামের যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। মেজর খালেদ মোশাররফকে মতিনগর শিবির পরিচালনায় ওতপ্রোত ভাবে জড়িত থেকে যথেষ্ট যোগ্যতার সাথে সাহায্য করেন তৎকালীন ক্যাপ্টন আবদুল গফফার, ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন আশরাফ, মেজর সালেক, মেজর আইনুদ্দীন, প্রবাসী ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডাঃ মবিন। আগষ্টের ৩০ তারিখ খালেদ মোশাররফের একটি গেরিলা দল ঢাকায় হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে। মুক্তি বাহিনীর সাথে যোগাযোগ আছে অভিযোগে ঐ সময় বাংলাদেশের বিখ্যাত গায়ক ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ এবং ঢাকা বেতারের হাফেজ উদ্দীনকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মেজর খালেদ মোশাররফ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরতর আহত হন। মাথায় ব্যাণ্ডেজ নিয়েই তিনি স্বাধীন বাংলায় পদার্পণ করেন।

জেনারেল ওসমানী
১৬ই নভেম্বর আনোয়ার-উল-আলম শহীদ বাংলাদেশ স্বশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। শহীদ সাহেবকে অন্যান্যদের সাথে সাক্ষাতে কোন বেগ পেতে না হলেও জেনারেল ওসমানীর সাথে সাক্ষাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। এর একমাত্র কারণ তিনি যেমন জিয়াকে পছন্দ করতেন না, তেমনি টাংগাইল মুক্তি বাহিনীর প্রতিও সন্তুষ্ট ছিলেন না। বিশেষ করে আমার প্রতি একেবারেই নয়। কর্ণেল জিয়ার প্রতি অসন্তোষের কারণ ছিল জিয়ার বড় বেশী নামডাক হয়ে গেছে। আর জিয়াও জেনারেল ওসমানীকে খুব একটা তোয়াক্কা করতেন না। আমার ব্যাপার হলো, এলাকার লোকেরা এবং সহ- যোদ্ধারা আমাকে সি. ইন. সি. সাহেব বা স্যার বলে ডাকে। টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর ইস্তেহারেও আমাকে বার বার সর্বাধিনায়ক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে তিনি যারপর নাই চটে গিয়েছিলেন। তার ধারণা আমি তাকে চ্যালেঞ্জ করছি। এমনি একটি অবস্থায় আনোয়ার-উল-আলম শহীদের সাথে প্রধান সেনাপতি এম. এ. জি. ওসমানীর সাক্ষাৎ হয়। স্বাভাবিক কারণে সাক্ষাৎকারটি খুব একটা মধুর হওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু তবুও শহীদ সাহেব ও প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সাক্ষাৎকারে খুব একটা অপ্রিয় কিছু ঘটেনি। জেনারেল ওসমানি আমার প্রতিনিধি আনোয়ার-উল-আলম শহীদকে স্বাগত জানাতে গিয়ে প্রথমে জিজ্ঞেস করেন, ‘কি ব্যাপার। একটা দেশে কয়টা সেনা- বাহিনী থাকে? আর তার কয়টাই বা সি. ইন. সি. হয়? আমি শুনেছি কাদের নাকি নিজেই নিজেকে মুক্তিবাহিনীর সি. ইন. সি হিসাবে ঘোষণা করছে ?” শহীদ সাহেব অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জেনারেল ওসমানীর এই অযৌক্তিক অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘স্যার, আপনাদের খবর সংগ্রহের মাধ্যম কতটা শক্তিশালী তা আমার জানার কথা নয়। মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী আমার নেতা। তিনি কস্মিন কালে নিজেকে সি. ইন. সি. হিসেবে দাবী করেননি। আমরা তাকে সর্বাধিনায়ক
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৮

পদে বরণ করেছি। তিনি বাংলাদেশ বাহিনীর অথবা সমগ্র মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাধিনায়ক নন। তিনি আমাদের সর্বধিনায়ক, আমাদের দলের সর্বাধিনায়ক।’ আনোয়ার-উল-আলম শহীদের ধারালো যুক্তিপূর্ন কথার তোড়ে জেনারেল ওসমানী কিছুটা শান্ত ও প্রকৃতস্থ হন। সাক্ষাৎকারের পরিবেশও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ও মধুর হয়ে আসে। শহীদ সাহেবের কাছ থেকে আমার নেতৃত্ব সম্পর্কে বহু কথা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বহু সফল যুদ্ধের বর্ণনা শুনে এক পর্যায়ে খুশীতে আহলাদিত হয়ে জেনারেল ওসমানী বলে ওঠেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকে সেনাবাহিনীতে রয়েছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িত ছিলাম। খুব মনোযোগের সঙ্গে দেখেছি, গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছি, আমার যদি যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানও থাকে (গলার স্বর উচ্চাগ্রামে তুলে ম্যাপ দেখিয়ে) আমি বলছি, ‘কাদের সিদ্দিকী উইল বি দ্যা ফার্স্ট ম্যান টু রীচ ঢাকা।’ জেনারেল ওসমানীর ভবিষ্যৎ- বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। আমি সত্যিই ঢাকায় প্রথম প্রবেশ করেছিলাম। জেনারেল ওসমানী ব্রিটিশ আমলে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি সামরিক বাহিনীতে আয়ূব খানের চাইতে সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু বাঙালী হওয়ায় এবং তার নিজস্ব কিছু গোঁ থাকায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল থেকে কর্নেলে পদোন্নতি পেয়ে আটকে থাকেন এবং ৫৬ সালের পর সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কুমিল্লার মরহুম মেজর ওসমান গনি যেমনি বেংগল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা তেমনি এম. এ. জি. ওসমানী বেংগল রেজিমেন্টের শ্রীবৃদ্ধিতে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন। ৬৯-এর গণ-আন্দোলনের সময় কর্নেল ওসমানীকে আন্দোলনের স্বার্থে এখানে ওখানে দেখা যেতে থাকে। এইভাবেই তিনি বাংলার স্বাধীকার আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। ‘৬৯-এর গণ-আন্দোলনের তোড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেলে বঙ্গবন্ধুর সাথেও কর্নেল ওসমানীর গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। যদিও তারা একে অপরের সাথে আগেই পরিচিত ছিলেন। ৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে মৌলভী বাজারের এক নির্বাচনী এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক অবিস্মরণীয় জয়লাভে পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠী উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়ে নানা অপকৌশল শুরু করলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব বাঙ্গালীরাও সেই ঘৃণ্য অপকৌশলের সমুচিত জবাব দিতে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাঙালী সৈনিকদের উপর প্রভাব পড়বে মনে করে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার কর্নেল ওসমানীকে জেনারেল পদে উন্নীত করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের দায়িত্ব দেন। জেনারেল ওসমানী স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রায় পুরো সময়টাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে কাটিয়েছেন। তিনি খুব কম সময়ই যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেছেন। তার কথা ছিল, “একজন সার্থক ও কার্যকরী সেনাপতির যুদ্ধেক্ষেত্রে বাংকারে বসে কিংবা এখানে ওখানে যুদ্ধরত সৈনিকদের সাথে থেকে যুদ্ধ পরিচালনার কোন দরকার পড়েনা। নিখুঁত পরিকল্পনা করাই সফল সেনাপতির কাজ।” তাই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়াটা মোটেই পছন্দ করতেন না। শোনা যায়, মুজিবনগর সরকারের কাছে তিনি মাঝে-মধ্যেই পদত্যাগ করতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৯

চাইতেন। এও শোনা যায়, লিখিত পদত্যাগপত্র নাকি সর্বদাই তাঁর পকেটে থাকতো। দুষ্ট লোকেরা বলে, জেনারেল ওসমানী নাকি মুজিবনগর সরকারের কাছে আশি বার পদত্যাগ করতে চেয়েছেন। ১৬ই ডিসেম্বর সকাল দশটায় ভারতীয় সেনাবহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সানসিং, ব্রিগেডিয়ার ক্লে ও টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আমি নিজে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশন হেড-কোয়ার্টারে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব গ্রহণ করি। সেই খবর কোলকাতায় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান সেনাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার কাছে পাঠানো হয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা খবর পেয়েই তাৎক্ষনিক ভাবে তা জেনারেল ওসমানীকে জানান। কিন্তু জেনারেল ওসমানী খবরের সত্যতা প্রথম অবস্থায় মানতে দ্বিধাবোধ করছিলেন, তাকে ঢাকায় আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ পর্বে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ঐ সময় বাংলাদেশ সরকারও জেনারেল ওসমানীকে ঢাকায় হানাদারদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে হাজির হতে অনুরোধ করেন। জেনারেল ওসমানী বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধ এই বলে প্রত্যাখ্যান করেন যে, ‘ঢাকা পুরোপুরি মুক্ত কিনা সেই ব্যাপারে নিঃসন্দেহ নন। এমতাবস্থায় তার ঢাকা যাওয়াটা কোনমতেই বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা।” তিনি ঢাকা যানও নি। তাই বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ সরকার এয়ার কমোডর খোন্দকারকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে প্রেরণ করেন। জেনারেল ওসমানী ১৮ই ডিসেম্বর দুপুরে ভারত থেকে হেলিকপ্টার সিলেটের আকাশে এলে তার হেলিকপ্টারে ১ বা ২টি গুলি লাগলেও হেলিকপ্টারটি তেমন বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়না। সিলেটে অবতরণ সমীচিন হবেনা মনে করে তিনি আবার ভারতে ফিরে যান। ভারতে ফিরে গিয়েই দুটি অভিযোগ আনেন-
এক। তাঁর সন্দেহ তাকে হত্যা করার উদ্দেশে হেলিকপ্টারে গুলি ছোড়া হয়েছিল।
দুই। তাকে হত্যার পিছনে কর্নেল জিয়ার উস্কানি অথবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর মদত থাকলেও থাকতে পারে।
তিনি একবারও পকিস্তান সেনাবাহিনী অথবা পাক-সমর্থক অন্যান্য অস্ত্রধারীর কথা উল্লেখ করেননি। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকাতে হানাদাররা আত্মসমর্পণ করলেও সিলেটের হানাদাররা করেনি। তারা ১৮ই ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় সেনাবহিনী ও কর্নেল জিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু তখনও হানাদারদের ছোট ছোট অনিয়ন্ত্রিত দল এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। জেনারেল ওসমানীর হেলিকপ্টারে গুলি লেগেছিল। এটা সত্য, কর্নেল জিয়ার দলের অথবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোন সদস্য গুলি ছুঁড়েছিল কিনা তা আজও প্রমাণিত হয়নি। আর আদৌ কেউ ইচ্ছা করে হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি করেছিল কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। সিলেট হানাদার মুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দ- উল্লাসে আকাশে অসংখ্য গুলি ছুঁড়েছিল। তার কোন গুলি হেলিকপ্টারে লেগেছিল কিনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায়না। সিলেটের অনেকের ধারণা,হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে পালিয়ে থাকা ভীত ও অনিয়ন্ত্রিত হানাদারদের কেউ গুলি ছুঁড়েছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১০

এই ঘটনার পর জেনারেল ওসমানী একা আর কোথাও যাননি। ২০শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সকল মন্ত্রী মহোদয়দের সাথে একত্রে তিনিও ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন।

স্বাস্থ্য দপ্তরে ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী
আনোয়ার-উল-আলম শহীদ যখন সকলের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করছিলেন, তখন তার আর একজন সহকারী ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী, স্বাস্থ্য সচীব ডাঃ টি হোসেন ও স্বাস্থ্য দপ্তরের অন্যান্য কর্তা-ব্যক্তিবর্গের সাথে আলাপ-আলোচনা করে দেশের অভ্যন্তরে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর স্বাস্থ্য বিভাগের কাজকর্ম কি করে আরো সুষ্ঠ ভাবে চালানো যায়, তা ঠিক করে নিচ্ছিলেন। ১৭ই নভেম্বর টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিদ্বয় বিমান যোগে কোলকাতা থেকে গৌহাটি হয়ে তুরাতে পৌঁছেন।

দুঃখজনক অভিজ্ঞতা
এ প্রসঙ্গে কোলকাতার আর একটি ঘটনা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তরুণ নাট্যকার, নাট্য পরিচালক ও টি. ভি.-র অনুষ্ঠান উপস্থাপক মামুনুর রশিদ টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর উপর তিনটি ধারাবাহিক বেতারনাট্য বাণীবদ্ধ করেন। মামুনুর রশিদ মে মাসে কালিহাতীতে অস্ত্র উদ্ধারের সময় আমার সাথে ছিলেন। তারপর নানা দুঃখকষ্ট সয়ে ভারতে চলে যান এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। আমাদের প্রথম যুদ্ধ প্রচেষ্টা দেখে এবং নিজেও সেই প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার কারণে স্বভাবতঃই তিনি টাংগাইলের যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ ও প্রচারে আগ্রহান্বিত ছিলেন। নানাভাবে টাংগাইলের মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে বেতারে নিয়মিত প্রচার করছিলেন। টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের উপর তার রচিত নাটক বাণীবদ্ধ করে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারে পর্যায়ক্রমে প্রচার শুরু করেন। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ কোলকাতা পৌঁছার ২ দিন পর প্রথম অংশটি দুই দুইবার স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত হয়। ১৪ অথবা ১৫ই নভেম্বর দ্বিতীয় অংশটি প্রচার করা হয়। তৃতীয় অংশটি ২১শে নভেম্বর প্রচার করার কথা ছিল। কিন্তু কালো হাতের ইশারায় তা বন্ধ হয়ে যায়। বেতার কর্তার আপত্তি ও বিরাগের কারণ ছিল, মামুনুর রশিদের লেখা বেতার নাট্যগুলো কাদের সিদ্দিকীর বড় বেশী প্রশংসা করা হচ্ছে, হিরো বানানো হচ্ছে। ভাবখানা যেন এই, প্রশংসা করতে আপত্তি নেই তবে সেই প্রশংসা ও কৃতিত্ব যদি তাদের চাইতে বেশী উপরে তুলে দেয়, তাহলে পরে নীচে নামানো মুস্কিল হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এমন মনোভাব সকল নেতা পোষন না করলেও কিছু কিছু নেতা করতেন। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করবে, শহীদ হবে, দেশ স্বাধীন করবে আর তারা ক্ষমতায় বসবেন। যদি কোন কৃতি মুক্তিযোদ্ধা সেই সম্মানে ভাগ বসাতে চান তাতে তাঁরা কস্মিন কালেও রাজী নন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেমন অসংখ্য আত্মত্যাগে অবিস্মরণীয় উজ্জ্বল দিক আছে, তেমনি এমনি দুচারটি অন্ধকার ও কলঙ্কজনক দিকও আছে।

সামরিক পরিকল্পনা
আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও ডাঃ শাহাজাদা চৌধুরী যখন কোলকাতায়, তখন নুরুন্নবী, ফারুক আহমেদ ও সৈয়দ নূরু বসে নেই। নূরুন্নবী বার বার ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী যুদ্ধ পরিকল্পনা ঠিক করে নিচ্ছিল। নুরুন্নবীর সাথে লেঃ জেঃ অরোরার একবার, মেজর জেনারেল গিলের তিন বার এবং মেজর জেনারেল ওভানের একবার আলোচনা
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১১

হয়েছে। আলোচনার প্রেক্ষিতে ২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ইতিমধ্যে আমার কাছে পাঠানো হয়েছে। তাদের দায়িত্ব ছিল, ঢাকায় কতগুলো যুদ্ধ বিমান আছে, কি ধরনের বিমান এবং কোন দেশের তৈরী তার খোঁজখবর নেওয়া। দূত পৌছানোর আগেই নিজে থেকেই ঢাকা বিমান ঘাটির সর্বশেষ খোঁজখবর নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি রিপোর্ট তুরাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। নুরুন্নবীর সাথে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আলোচনায় শেষ সিদ্ধান্ত হলো-
এক। সে দেশের অভ্যন্তরে এসেই ভারতে খবর পাঠাবে। তারই খবর অনুযায়ী অরতীয় সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কয়েকজন অফিসার মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্ত এলাকায় আসবেন।
দুই। টাংগাইল মুক্তিবাহিনীকে নভেম্বরের শেষে অথবা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে টাংগাইলের কোন স্থানে দশ-বারো মাইল নিরাপদ এলাকার ব্যাবস্থা করতে হবে। যেখানে প্রায়োজনে ভারতীয় ছত্রীসেনা অবতরণ করতে পারেন।

শিবিরে শিবিরে
অন্যদিকে সৈয়দ নূরু ও ফারুক আহমেদ তুরা ও তুরার আশেপাশে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে শিবিরে ঘুরছিল। তারা টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর শুভেচ্ছা দেশের সকল প্রান্তের মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দিচ্ছিল। তাদের সাথে এক পর্যায়ে ইসলামপুরের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল বারেক, জামালপুরের কমান্ডার আজিজ মাষ্টার, জামালপুর পাথালিয়ার মুক্তিযোদ্ধা হিরু, ফুলপুরের কমান্ডার আলতাফ হোসেন, মাদারগঞ্জের কোম্পানী কমান্ডার মুক্তা, শ্রীবর্দীর সফল মুক্তিযোদ্ধা মুন্সি, ইসলামপুরের কমান্ডার মোহাম্মদ আলি, দেওয়ানগঞ্জের কমান্ডার ফজলুর রহমান, ময়মনসিংহের ডাঃ আবদুল হান্নানের ভাতিজা মিন্টু, ফুলপুর হালুয়াঘাটের কমান্ডার এখলাস উদ্দীন, রফিক ভূইঞার দেহরক্ষী, পরবর্তীতে কোম্পানী কমান্ডার আবদুর রশীদ সহ তুরা সেক্টরের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জামালপুরের মজনু, খোকা ও ইসলামপুরের হাশেমী মাসুদ জামিলের (যুগল) সাথে সাক্ষাৎ হয়। এ ছাড়া বাঘমারা সেক্টর কমান্ডার গৌরীপুরের তোফাজ্জল হোসেন চুন্নু, ময়মনসিংহের হাবিবুর রহমান, রংরার কোম্পানী কমান্ডার নাজমুল, কোম্পানী কমান্ডার উথুরার তারা, দুর্গাপুরের জালাল ও কাঞ্চনের সাথে দেশের অভ্যন্তরের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।

হাশেমী মাসুদ জামিল (যুগল)
তুরা সেক্টারের ‘বিশেষ গ্রুপের’ সদস্য হাশেমী মাসুদ জামিল ও আকতারকে নভেম্বরের মাঝামাঝি নেত্রকোণার কেন্দুয়া থানা মুক্তিবাহিনীর দু’টি কোম্পানীর সাথে যোগাযোগের জন্য পাঠানো হয়। তাদের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়, কেন্দুয়ার আশেপাশে অবস্থানরত খালিয়াজুড়ির মোহাম্মদ ইলিয়াস ও বারহাট্টার আবদুল কাদেরের কোম্পানীকে, নেত্রকোণা ও কেন্দুয়া সড়কের সব চাইতে বড় বসুবাজারের সেতু ধ্বংস করার নির্দেশ পৌঁছে দেওয়া। হাশেমী মাসুদ জামিল ও আকতার যথারীতি তাদের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কেন্দুয়ার পাশে এক গ্রামে মোহাম্মদ ইলিয়াসের কোম্পানী
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১২

হেড-কোয়ার্টারে পৌঁছে। মোহাম্মদ ইলিয়াস মাত্র কয়েকদিন আগে ট্রেনিং শেষ করে দল নিয়ে ভারত থেকে এসেছে। তাকে যখন জানানো হলো, ‘কর্তৃপক্ষের নির্দেশ, বসুবাজারের সেতু ভাঙ্গতে হবে। তখন তিনি হাশেমী মাসুদ জামিল ও আকতারেকে সাথে থেকে সেতু উড়িয়ে দেয়ায় সহায়তা করতে অনুরোধ জানালো। যুগল ও আকতার সানন্দে কোম্পানী কমান্ডার মোহাম্মদ ইলিয়াসের অনুরোধ রক্ষা করে। পরদিন সেতুটি সরজমিনে দেখতে আঠার-উনিশ বৎসরের কিশোর হাশেমী মাসুদ জামিল ইলিয়াস কোম্পানীর একজন যোদ্ধাকে নিয়ে শিবির থেকে বেরিয়ে পড়ে। সহযোদ্ধাটি যুগলকে বসুবাজারের একটি দোকানে নিয়ে যায়। দোকানদার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। সবকিছু শুনে তিনি সেতুর পাশের রাজাকারদের পরিচিত ও প্রিয় চাঁদ নামে ১৫-১৬ বছরের একটি কিশোরকে ডেকে এনে সবকিছু খুলে বলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে বলেন। চাঁদ—যুগলকে বেয়াই পরিচয় দিয়ে সেতু দেখাতে নিয়ে যায়। চাঁদ দীর্ঘদিন পুলের রাজাকারদের নানা ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করে আসছিল। তাই তার বেয়াই পরিচয় দেয়ায় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা হাশেমী মাসুদ জামিলকে কোন সন্দেহ করে না। কিন্তু সেতু দেখে ফেরার সময় রাজাকারদের মনে সন্দেহ জাগে। তাকে ফিরে আসতে দেখে রাজাকার কমান্ডার বলে, ‘কি বেয়াই ফিরে আসলেন যে?’ যুগল একটু ভয় পেয়ে গেলেও বিচলিত না হয়ে ঝটপট উত্তর দেয়, ‘আমি ভুলে বাজারে কিছু জিনিস রেখে এসেছি।’ তখন ছয়-সাত জন রাজাকার তাকে পাহারা দিয়ে বাজারে নিয়ে যায়। যে দোকানে যুগলকে প্রথম নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই দোকানের দূর থেকে সে দোকনদারকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘কি আমার জিনিসগুলো কোথায়? ছয়-সাত জন রাজাকার পরিবেষ্টিত হয়ে সকালের পরিচিত কিশোরটি কোন জিনিস রেখে যায়নি অথচ চাইছে এবং রাজাকারদের হাবভাবে সন্দেহের আভাস পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক দোকানদারটি ব্যাপারটা আঁচ করে নেন। তাড়াতাড়ি দোকানের ভিতর থেকে দুটি ‘টোপলা’ এনে দেন। ‘টোপলা’ হাতে যুগল চলে যেতে উদ্যত হলে দোকানদার আবার বলে ওঠেন, আপনি দেখছি মিঞা সাংঘাতিক ভোলা মানুষ। শুধু সওদা কি, এই যে এটাও রেখে যাচ্ছেন।’ এই বলে একটি তেলের বোতলও যুগলের হাতে তুলে দেন। ‘মেঘ না চাইতেই জল’, দোকানদার ভদ্রলোকের এমন নিখুঁত নিপুণ অভিনয়ের পর রাজাকারদের সন্দেহ করার মত কোন কারণ রইলোনা। যুগল ঘাটিতে ফিরে কোম্পানী কমান্ডার ইলিয়াসকে সব কিছু অবহিত করে। ঐ রাতেই সেতু উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ইলিয়াস ও আবদুল কাদেরের কোম্পানীতে চারশ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। দুই কোম্পানীর তিনশ মুক্তিযোদ্ধা মিলে রাত তিনটায় বসুবাজার সেতু আক্রমণ করলো। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে একটি ব্রিটিশ এল. এম. জি. একটি ২ ইঞ্চি মর্টার, শতাধিক এস. এল. আর. ও ৩০৩ রাইফেল সহ বেশ কয়েকটি এল. এম.জি.। মুক্তিযোদ্ধারা তিনভাগে ভাগ হয়ে তিন দিক থেকে সেতুতে আক্রমণ হানলো। জবাবে সেতু থেকে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা পাল্টা গুলি চালালে মুক্তিবাহিনীর নব্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত সদস্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দুর পিছিযে যায়। জামিল দশ-বারো জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সেতুর দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান নিয়েছিল। দলের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৩

একমাত্র এল. এম. জি. চালক মোকারম যুগলের সামনে সেতুর অনেকটা কাছে অবস্থান নিয়ে হানাদারদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার সাথে ছয়-সাত জন সহযোদ্ধা। অন্যেরা কখন পিছিয়ে গেছে, এক পর্যায়ে দেখা গেল, উভয় পক্ষের গুলির তোড় কমে এসেছে। যুগলের দৃষ্টি ছিল সামনে, লক্ষ্যবস্তুর উপর। পাশের সহযোদ্ধাদের দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই তার চক্ষু চরক গাছ, কেউ নেই। কোন ফাঁকে সহযোদ্ধারা তাকে একা ফেলে চলে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার। নিঃসীম অন্ধকার। যতদূর দৃষ্টি যায় কারও অস্তিত্ব নেই। শুধু সামনে এল. এম. জি. চালক মোকারাম ও তার ছয়-সাত জন সহযোদ্ধা। এমনি এক অস্বস্তিকর অসহায় অবস্থায় যুগল দিশেহারা হয়ে যুদ্ধ থেকে ফেরার সংকেত হিসেবে পর পর দুটি গ্রেনেড ফাটালো। কিন্তু তাতেও সামনে এগিয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা পিছিয়ে আসতে পারছিল না। কারণ শত্রুর বাংকার একেবারে কাছে, তাই পিছুতে অসুবিধা হচ্ছিল। অনেক চেষ্টার পর একমাত্র এল. এম. জি. চালক ছাড়া বাকীরা পিছিয়ে আসতে সক্ষম হলো। এল. এম. জি. চালক আহত হয়ে পড়ায় সে পিছুতে পারছিলনা। এমন নিদারুণ সংকটময় মুহূর্তে কি করা উচিত, ভেবে উঠতে পারছিলনা, তবু পিছিয়ে এসে সহযোদ্ধাদের পাগলের মতো খুঁজতে লাগল। অনেক খোঁজা-খুঁজির পর যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে চার-পাঁচশ গজ পিছনে প্রাচীর ঘেরা একটি বাড়ীর বিরাট পুকুরের পাশে সবাইকে জটলা পাকিয়ে বসে থাকা অবস্থায় পেয়ে গেল। তারা একজন দুজন করে ক্রমে ক্রমে পিছু হটে এখানে এসে জড়ো হয়েছে। পিছিয়ে আসার একমাত্র কারণ, এই তাদের জীবনের প্রথম যুদ্ধে অংশ গ্রহণ। কিন্তু তারা যখন শুনলো, তাদের এক সাথী আহত হয়ে শত্রুর নলের মুখে পড়ে আছে। তখন তাদের ভয়-ভীতি কর্পূরের মত উড়ে গেল।
রাতের ঘন অন্ধকার, তার চাইতেও বেশী কালো বিভ্রান্তির অন্ধকার। এমনি এক পরিবেশে মুক্তিযোদ্ধাদের দেহমনে কোথা থেকে যেন এলো অমিত তেজ, তাদের মনে স্পন্দিত হলো আত্মশক্তির শুভ উদ্বোধন। মৃতকে তুচ্ছে করে আবার পূর্ণোদ্যমে বসুবাজার সেতুর উপর ঝাপিয়ে পড়লো। তাদের সেই তেজ ও গতি পৃথিবীর প্রবলতম শত্রুর শক্তিশালী ঘাঁটি অনায়াসেই তছনছ করে দিতে পারে। হানাদার পোষ্য রাজাকার ও মিলিশিয়া কোন ছার। রাজাকার ও মিলিশিয়ারা এবার পাল্টা গুলি করার কোন সুযোগই পেলনা। তার আগেই খেল খতম। শুধুমাত্র ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়ে যাওয়া কয়েকজন রাজাকারের ভীত সন্ত্রস্ত হাত, আচমকা অজান্তে রাইফেলের ট্রিগারে চাপ পড়ায় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে একটা কি দুটো গুলি শুন্যে ভেসে এলো। বসু বাজার সেতু মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ দখলে। অন্ধকার তখনও কাটেনি, শীতের আমেজ কাটিয়ে, সূর্যদেব মূখ বের করছে এবং ক্রমশ কুয়াশার চাদর ভেদ করে আলো ফুটে উঠছে। অস্পষ্ট আলোতেও সেতুর পাশের গ্রামের জনসাধারণ যখন বুঝতে পারলেন সেতুর উপর যারা আছে তারা রাজাকার নয়, মুক্তিবাহিনী, তখন তাঁদের সে কি উল্লাস। চতুর্দিক থেকে লোকেরা যে যা পারলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিয়ে এলেন।
মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণে সেতুতে পাহারারত চল্লিশ জন রাজাকার ও মিলিশিয়ার
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৪

মধ্যে ছাব্বিশ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে, দুজন নিহত হয়। সেতুর দায়িত্বে নিয়োজিত বারোজন মিলিশিয়া নেত্রকোণার দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। স্থানীয় জনসাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচুর আদর-যত্ন করলেন। কিন্তু তারা যখন শুনলেন, মুক্তিযোদ্ধারা সেতুটি উড়িয়ে দেবে, তখন জনসাধারণ স্তম্ভিত হয়ে যান। নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সেতু উড়িয়ে দেয়া থেকে বিরত করতে সচেষ্ট হন। জনগণের কথা, ‘সেতু উড়িয়ে দিলে হানাদাররা এসে আশেপাশের গ্রাম গুলো জ্বালিয়ে দেবে।’ কিন্তু যুদ্ধের প্রয়োজনে সেতু না উড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন উপায় ছিল না। সেতু ও সেতুর আশেপাশে সারাদিন অপেক্ষা করে পশ্চিম দিগন্তে যখন অস্তমিত সূর্যের শেষ রক্তিম আভা মিলিয়ে আসছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বসুবাজার সেতু উড়িয়ে দিয়ে বিজয় গৌরবে নিজেদের ঘাঁটির পথ ধরলো। সাফল্যের আনন্দে হৃদয় তাদের ভরপুর, মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের দৃপ্ত শপথে চোখের তারায় ঝিলিক দিচ্ছে নতুন দিনের স্বপ্ন।

প্রতিনিধি দলের প্রত্যাবর্তন
২১শে নভেম্বর, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ তার দল নিয়ে নৌকাপথে ভারতের মানকাচর থেকে টাংগাইলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এবার তাদের সাথে আর এক ব্যক্তি, টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকারী নেতা গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বেশ কিছুদিন যাবৎ দেশের অভ্যন্তরে এসে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে শত্রুর আক্রমণে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষতি হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই, বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চলের সার্বিক প্রতিরক্ষার দায়িত্ব মুক্তিবাহিনী সফলতার সাথে পালন করছে। এমনি অবস্থাতে আমি বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে দেশের অভ্যন্তরে এসে কাজ করার অনুরোধ জানাই, তাই তিনি দীর্ঘ কয়েক মাস বাইরে কাটানোর পর নিজের হাতে যে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর গোড়া- পত্তন করেছিলেন, সেই বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত থেকে স্বাধীনতার লড়াই আরো জোরদার করতে অনেক রাজনৈতিক আন্দোলনের পীঠস্থান, প্রিয় জন্মভূমি টাংগাইলে প্রবেশ করছেন। ভাটি পথে ২৩শে নভেম্বর নির্বিঘ্নে, নিরাপদে কদ্দুস নগরে এসেই তারা এক হৃদয় বিদারক মর্মন্তুদ পরিস্থিতির মুখোমুখি হন।

দুর্গতদের মাঝে
১৭ই নভেম্বর, সিরাজগঞ্জের দিক থেকে এক ব্যাটেলিয়ন হানাদার কদ্দুস নগরের উপর হামলা করে। হামলায় মুক্তিবাহিনীর কোন ক্ষয়ক্ষতি করতে না পারলেও ফিরে যাওয়ার পথে হানাদাররা কদ্দুস নগরের পশ্চিমে ছাব্বিশা গ্রামটি সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। হানাদাররা ঐ গ্রামের চল্লিশ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু ও মহিলাকে অগ্নিদগ্ধ করে এবং প্রায় দুশ জনকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে পৈশাচিক তাণ্ডব নৃত্য করতে করতে সিরাজগঞ্জে চলে যায়। এই আকস্মিক হামলার কারণে কদ্দুস নগরের দায়িত্বে নিয়োজিত মেজর আবদুল হাকিম পূর্ব-পরিকল্পনা মত টাংগাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়কের যে কটি সেতু ধ্বংসের ভার তার উপর ন্যস্ত ছিল, তা পারেনি। হানাদাররা কোন ক্ষতি করতে না
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৫

পারলেও, আবদুল হাকিমের সকল পরিকল্পনা উল্টাপাল্টা করে দিতে সক্ষম হয়। ১৭ই নভেম্বর রাত থেকে মুক্তিবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকরা ছাব্বিশা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের নানাভাবে সাহায্য করতে থাকে। তারা এই বিষয়ে সদর দপ্তরেও খবর পাঠায়। তবে অত্যন্ত দূর্ভাগ্য, কদ্দুস নগরের দূত সদর দপ্তরে যাবার পথে কদ্দুসনগর-টাংগাইল রাস্তায় হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে নিহত হয়। এর ফলে সদর দপ্তর এবং আমি ২৫শে নভেম্বর পর্যন্ত কদ্দুস নগরের কোন খবরা খবর পাইনি। আমি যখন এলাচীপুরে তখন আনোয়ার-উল-আলম শহীদের প্রেরিত দূত সৈয়দ নুরুর কাছে প্রথম কদ্দুস নগরের বিপর্যয়ের সংবাদ পাই। ভারত প্রত্যাবর্তিত দল, গন- পরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, নুরুন্নবী ও ডাঃ শাহাজাদা চৌধুরীর কাছে মুক্তিবাহিনীর জন্য ঔষধপত্র, কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল। তারা সব কিছু দিয়ে ছাব্বিশা গ্রামের দুঃস্থদের সাহায্যে আত্মনিয়োগ করেন। শহীদ সাহেব কদ্দুস নগর আসা মাত্র ছাব্বিশা গ্রামে ত্রাণ পরিচালনার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। শহীদ সাহেব আসার আগে এই ব্যাপারটি দেখার মত তেমন দায়িত্বশীল কেউ ছিল না। তাই ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য এবং আহতদের চিকিৎসার কাজ আশানুরূপ দ্রুততার সাথে চলছিল না। শহীদ সাহেব এসে ছাব্বিশা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারের জন্য এক হাজার করে নগদ টাকা বরাদ্দ করেন। প্রতি পরিবারের প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রসহ কাপড়-চোপড় এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি করে ঘর তৈরী করে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, নুরুন্নবী, ডাঃ শাহাজাদা চৌধুরী, ফারুক আহমেদ ও লক্ষণ বর্মন সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে দুর্গতদের সেবায় লেগে পড়েন। ভারত থেকে নিয়ে আসা ঔষধপত্র এখানে এত কাজে লাগে, যেটা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। দীর্ঘ পাঁচ দিন এক নাগাড়ে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে তারা ছাব্বিশা গ্রামের করুণ অবস্থা অনেকটা ঘুরিয়ে ফেলেন। ছাব্বিশা গ্রামের দুঃস্থদের সব রকমের সাহায্যের ব্যবস্থা করে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ২৮শে নভেম্বর রাতে আনোয়ার-উল-আলম শহীদ তার দল নিয়ে আমার সাথে মিলিত হতে দক্ষিণে যাত্রা করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৬

এলাসিন ঘাটে বিপর্যয়

বাঐখোলা দিয়ে টাংগাইল-ঢাকা সড়ক পার হওয়ার সময় প্রথম জানতে পারলাম রাস্তাসহ মির্জাপুর থানা হানাদারদের দখলে চলে গেছে। মেজর হাবিব বিশেষ যোগ্যতার সাথে ঢাকার দিক থেকে সড়ক আগলে রেখেছিল। তাই ঢাকার দিক থেকে হানাদাররা রাস্তা দখল নিতে পারেনি। তবে ময়মনসিংহের দিক থেকে এক ব্যাটেলিয়ন হানাদার এসে ঢাকা-টাংগাইল সড়ক দখল নিতে সক্ষম হয়েছে। কারণ, মেজর হাকিম নির্ধারিত সময় ও নির্দিষ্ট দিনে তার ওপর যে কয়টি সেতু ভাঙার দায়িত্ব ছিল, সেইগুলো ভেঙে ময়মনসিংহের দিক থেকে আসা হানাদারদের গতিরোধ করতে পারেনি। ২৪শে নভেম্বর সন্ধ্যায় হানাদাররা ঢাকা-টাংগাইল সড়ক মুক্তিবাহিনীর পর থেকে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যস্ত সড়কের উপর মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে দখল নিতে পারলেও, এর পর থেকে হানাদাররা এক মুহূর্তের জন্যও এই রাস্তায় নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে চলাফেরা করতে পারেনি। বায়জিদ আলমের বজ্র কোম্পানী শামসু ও সোলায়মানের কোম্পানী এবং গাজী লুৎফরের কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধনৈপুণ্য ও দুর্জয় সাহসিকতার অবিস্মরণীয় স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়। এই সময় থেকে মনে হতে থাকে, এই সমস্ত কোম্পানীর যোদ্ধারা ঢাকা- টাংগাইল সড়কে নানাভাবে হানাদারদের বাধা দিয়ে ব্যতিব্যস্ত রাখতেই বুঝি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ২৫শে নভেম্বরের পর তারা বিধ্বস্ত সেতুগুলোর পাশে তৈরী বিকল্প কাঁচা রাস্তায় নিয়মিতভাবে ট্যাংক-বিধ্বংসী মাইন লাগাতে শুরু করে। ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন লাগাতে গিয়ে প্রথমাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছু অসুবিধায় পড়ে। প্রথম দিনে মাইনের আঘাতে একটি যাত্রীবাহী বাস দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই ঘটনার পর মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকে মাইন পোঁতা বন্ধ করে, শত্রুর গাড়ী দেখার পর মাইন পুঁতার কৌশল অবলম্বন করে। এমনকি দুই-একবার এমনও হয়েছে ছদ্মবেশে মুক্তিযোদ্ধারা যাত্রীবাহী গাড়ী থামিয়ে বাসে উঠে আস্তে আস্তে ড্রাইভারের কাছে গিয়ে সামনের ‘ড্রাইভারসনে’ বিপদের কথা জানিয়ে দিয়েছে। এমনকি দু’একটা যাত্রীবাহী গাড়ীকে তারা পুঁতে রাখা মাইনের ফাঁক দিয়ে পথ দেখিয়ে নিরাপদে রাস্তা পার করে দিয়েছে।
২৫শে নভেম্বর সন্ধ্যায় এলাচীপুরে এলাম। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা তখন বিপুল মনোবলে বলীয়ান। তাদের দুর্বার দুঃসাহসিক আক্রমণের সামনে হানাদাররা যে কিছুই না, তা ঢাকা- টাংগাইল সড়ক দখল এবং কয়েকদিন পর বেশ কয়েকটি যুদ্ধ জয়ে বুঝে ফেলেছে। তাই আমি চাইছিলাম, এই অটুট মনোবল থাকতে থাকতেই আরও দুএকটি বড় যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে বিজয় হাসিল করতে। গত কয়েক দিনের যুদ্ধাভিযানে উপর্যুপরি সফলতার সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন দেহ-মনে সিংহ-বিক্রম বোধ করছিল, তেমনি আবার পর পর হেরে পর্যুদস্ত হয়ে হানাদার পশুরা ভয়ে কুকড়ে গিয়েছিল। শত্রুর বড় বড় ঘাঁটিতে আঘাত হেনে বিজয় ছিনিয়ে আনার এই তো
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৭

সুযোগ। এলাচীপুরে এসে আবার নতুন করে কয়েকটি কোম্পানীর দায়িত্ব বন্টন করে দিতে মনোনিবেশ করলাম। এক হাজার যোদ্ধা বাছাই করে একটি শক্তিশালী দল গঠন করা হলো। ২৫শে নভেম্বর রাতে ভারত প্রত্যাগত প্রতিনিধি দলের সদস্য সৈয়দ নূরু এলাচীপুরে এলো। সৈয়দ নূরুর কাছে ভারত সহ কদ্দুস নগরের বহু খবর জানার পর রাতেই কদ্দুস নগরে দূত পাঠানো হলো। দুতের কাছে খবর পেয়ে শহীদ সাহেব গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সহ অন্যন্যদের নিয়ে ২৮শে নভেম্বর কদ্দুস নগর থেকে বিশেষ দূত বাদশাহ ও কোম্পানী কমাণ্ডার আনিস ইঞ্জিনিয়ার এলো। এ সেই বাদশা যাকে আমরা মুক্তিবাহিনীর ‘বিদেশ মন্ত্রী’ বলে অভিহিত করে পূর্বেই উল্লেখ করেছি। টাংগাইল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সেই প্রথম এবং একমাত্র ব্যক্তি, যে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের সারাটা সময় জুড়ে বিভিন্ন দায়িত্বভার নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত করেছে। সে কম করেও চল্লিশ বার ভারতের মানকচর এবং বাংলাদেশের কদ্দুস নগরের মধ্যে যাতায়াত করে খবর ও রসদপত্র আনা-নেয়া করেছে। কদ্দুস নগর থেকে মানকাচর পর্যন্ত নদীপথে এমন কোন জায়গা নেই, যা সে চিনেনা, এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে সে যায়নি বা থাকেনি, এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে সে পরিচিত নয় এবং দু’একজন বিশ্বস্ত লোক নেই। এমন একজন সফল ও নির্ভরশীল দূত এক গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে এসেছে, দুএক দিনের মধ্যে ভারত থেকে কোন এক দায়িত্বশীল সামরিক অফিসার আসবেন। তাকে কোথায় রাখা হবে এবং কিভাবে সাহায্য করা হবে, তা জানতেই সে এসেছে। কোম্পানী কমাণ্ডার আনিস ও বাদশাহকে পৃথক পৃথক ভাবে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে পরদিন সকালে পাঠিয়ে দেয়া হলো।

বিমান হামলা
২৮শে নভেম্বর সকালে, এলাচীপুর থেকে কেদারপুরে ঘাঁটি স্থানান্তরিত হলো। এই সময় এলাচীপুর, ফাজিলাহাটি, লাউহাটি, ফতেপুর ও কেদারপুরে প্রায় চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা, ডিফেন্স গেড়ে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কেদারপুর ঘাটে কয়েকদিন ধরে পুরোদমে প্রচুর খাদ্যসামগ্রী জনসাধারণের মধ্যে বিলি করা হচ্ছিল। আমি ২৮শে নভেম্বর খাদ্যসামগ্রী বিতরণ পরিদর্শনে গেলে এক মারাত্মক অঘটন ঘটে। আমাদের পৌঁছার দু’তিন মিনিট পর পুর্বদিক থেকে দুটি যুদ্ধ বিমান, ‘স্যাবর জেট’ বিতরণ কেন্দ্রের উপর দিয়ে উড়ে গেল। ‘স্যাবর জেট’ দু’টি এত নীচ দিয়ে গেল যে আমাদের গায়ে দূরন্ত ঝটকা, ঝড়ো হাওয়া এসে লাগলো। আচম্বিতে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতিতে মুক্তিযাদ্ধারা ও আমি হতভম্ব ও বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমাদের সামনে চটের ‘ছালাগুলো’ হাওয়ায় এদিক-সেদিক ছেড়া কাগজের মত উড়তে লাগলো। বিতরণের জন্য ছাড়িয়ে রাখা গম চালও বাতাসে উড়তে থাকলো। ধূলোবালির ঝড় আকাশটাকে ধূসর চাদরে ঢেকে দিল। পলকে ঘটে যাওয়া ঘটনা পূর্বে জানতে না পারলেও পর মুহূর্তে কি ঘটবে সেটি বুঝতে এক মুহূর্তও দেরী হলোনা, চিৎকার করে সহযোদ্ধা ও খাদ্যসামগ্রী নিতে আসাদের বললাম, ‘যে যেদিকে পার এদিক-ওদিক দৌড়ে সরে যাও। সাবধান, দলবেঁধে যাবেনা। কোথাও জটলা পাকাবেনা। চিৎকার করতে করতে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৮

গজ দক্ষিণে দৌড়ে গিয়ে নদীর উঁচু পারের আগলে মাটির সাথে মিশে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার পাশে আজাহার ছাড়া দ্বিতীয় কোন মুক্তিযোদ্ধা নেই। আমার আশংকা সত্যি হলো। যুদ্ধ বিমান দুটি পূবদিক থেকে সোজা পশ্চিমে গিয়ে আধা মিনিটের মধ্যে ঘুরে এসে মেশিনগানের কয়েক ঝাক গুলি ছুঁড়ে গেল। সমস্ত জায়গাটা মেশিনগানের আওয়াজে থর থর করে কেঁপে উঠলো। নদীর পারে ও মাঠে যে গরু-ছাগলগুলো ছিল যেদিকে পারলো দড়ি ছিঁড়ে দৌড়ে পালালো। নদীর পাড়ের গ্রামগুলোতে ভয়ার্ত মানুষের চিৎকার আশেপাশের লোকালয় থেকে ভেসে আসা কুঁকড়ে যাওয়া কুকুরের ভয়ার্ত আর্তনাদ ছাপিয়ে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ বিমান দুটি পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে বিকট শব্দে ট্র্যাপিং করে উড়ে গেল। এমনি করে বিনা বাধায় প্রায় আট-দশ বার চক্কর দিয়ে উপর্যুপরি ‘ট্র্যাপিং করে বিমান দুটির হানাদারদ্বয় (পাইলট) বেকুবের মতো যখন মনে মনে নিশ্চিত হলো, ‘মুক্তিলোগ বিল্‌স সাফ, তখন তারা ঢাকার দিকে দিকে উড়ে গেল। রক্ষা এই যে, পুবদিক থেকে প্রথম যখন স্যাবর দুটি আসে, তখন আমরা নদীর পাশে একটি উঁচু রাস্তার আড়ালে ছিলাম বলে শত্রু বিমান দুটি আমাদের দেখতে পায়নি। অপ্রস্তুত অবস্থায় পূবদিক থেকে পশ্চিমে চলে যাওয়ার সময় আমাদের আচমকা দেখতে পেয়ে আঘাত হানার আগেই বিমান দুটি নির্দিষ্ট স্থানটি পেরিয়ে যায়। প্রস্তুত হয়ে বিমান দুটি আবার পশ্চিম থেকে পুবে আক্রমণের উদ্দেশ্যে ফিরে এলো। এই সামান্য সময়ের ফাকে আমরা নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। স্যাবর দুটি আট-দশ বার প্রায় দু’শ গজ জায়গা জুড়ে ‘ট্র্যাপিং করে চলে যায়। বিমান দুটি চলে যাওয়ার পর আমরা সবাই আবার খাদ্যসামগ্রী বিতরণের স্থানে এলাম। মুক্তিযোদ্ধারা চার পাশে দ্রুততার সাথে বেশ কয়েকটি বড় বড় গর্ত খুঁড়ে ফেললো। এগুলো যেমন-তেমন গর্ত নয়, শেয়ালে খোঁড়া গর্তের মতো ভিতরের দিকটা বাকানো। আমি বার বার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানালাম। হানাদার বিমান দুটি যদি পূবদিক থেকে না এসে উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম যেকোন দিক থেকে আসতো, তবে প্রথম ‘গোত্‌তাতেই আমাদের খালি ময়দানে অসহায় অবস্থায় পেয়ে যেতো। সেক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের বাচার সম্ভাবনা থাকতো খুবই কম। দুটি হানাদার বিমানের এত তর্জন-গর্জন ও খালি মাঠে উদ্যত আস্ফালনে মুক্তিযোদ্ধা তো দূরের কথা, একটি কাক-পক্ষীরও কোন ক্ষতি হয়নি। ক্ষতির মধ্যে যা হবার তা হলো, প্রায় পাঁচশ’ গম-চাল ভর্তি বস্তা ছিঁড়ে একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে এবং সমস্ত গম-চাল পঞ্চাশ-ষাট গজ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ধূলোবালির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে যাওয়া গম-চাল একত্র করার কাজে লেগে পড়লো। হানাদার বিমান দ্বিতীয় বার আক্রমণ হানতে আসেনি। ঢাকা গিয়ে তাদের হাই কমান্ডের কাছে রিপোর্ট করে, তারা সমস্ত দুষ্কৃতিকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে এসেছে। রাতেই পাকিস্তান বেতারে খবর পরিবেশন করা হয়, ‘বিমান বাহিনীর দুটি স্যাবর জেট টাংগাইল-মানিকগঞ্জের মাঝমাঝি পঁচিশ’ দুষ্কৃতিকারীকে নিশ্চিহ্ন করেছে।

ট্রাইকিং স্কোয়াড
আমি কেদারপুর ঘাট থেকে লাউহাটি এলাম। লাউহাটির দায়িত্বে তখন ছিলেন কর্নেল
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৯

ফজলুর রহমান। তিনি ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। লাউহাটি ও ফাজিলহাটির বিভিন্ন ডিফেন্স লাইন পরিদর্শন করে কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের বেছে আলাদা দলে বিভক্ত করে এক জায়গায় রেখে রাত প্রায় দশটায় কেদারপুর খালের পাড়ে একটা ভাঙা শনের ঘরে রাত কাটালাম। বিভিন্ন কোম্পানী থেকে বাছাইয়ের পর আলাদা করে রাখা মুক্তিযোদ্ধারা পরদিন সকালে কেদারপুরের পাশের চরে গাছপালায় ঢাকা একটি জায়গায় সমবেত হলো। ভালোভাবে আরেক বার নিরীক্ষণ করে সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজন মত ছোট ছোট কয়েকটি দলে ভাগ করলাম। বিভক্ত দলগুলোর কমান্ডার এবং সার্বিক দায়িত্ব ও অভিযানের সমন্বয় সাধনের জন্য কেন্দ্রীয় কমান্ডও ঠিক করে নিলাম। যদিও পরবর্তী অপারেশনে আমি নিজেই তাদের সঙ্গে থাকবো। তবুও সুষ্ঠুভাবে অভিযান পরিচালনার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলো কোনটা কার নেতৃত্বে কিভাবে পরিচালিত হবে এবং তাদের কে কে নির্দেশ দেবে, তা ঠিক করে দেয়া হলো। এক হাজার মুক্তিযোদ্ধার দলকে মোট সাত ভাগে ভাগ করা হলো। প্রতি দলে একজন কমান্ডার নিয়োগ করা হলো। সাতটি দল তিনটি কেন্দ্রীয় কমান্ডে বিভক্ত হলো। তিনিটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের দয়িত্ব পেল যথাক্রমে ক্যাপ্টেন সবুর, মেজর মোস্তফা ও ক্যাপ্টেন ফজলুল হক। এই তিনটি কমান্ডের সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব পড়লো মেজর মোস্তফার ওপর। অভিযান সার্বিকভাবে পরিচালনা করবো আমি নিজে। সাতটি কোম্পানীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডাররা হলো, এক, ক্যান্টিন হুমায়ূন, দুই, ক্যাপ্টেন রবিউল আলম, তিন, ক্যাপ্টেন মকবুল হোসেন খোকা, চার, ক্যাপ্টেন সাইদুর রহমান, পাঁচ, মেজর মোস্তফা, ছয়, ক্যাপ্টেন ফজলুল হক, সাত, ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর খান।
কোম্পানী বিভক্তির পর পরিকল্পনার খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিয়ে সহযোদ্ধাদের বললাম, ‘অভিযানে সফল হওয়ার মূল চাবিকাঠি হলো, সহযোদ্ধাদের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে কমান্ডারের এবং কমান্ডারের পরিচালনা কৌশল সম্পর্কে সহযোদ্ধাদের সম্যক ধারণা। পরস্পরের মধ্যে যদি পরিষ্কার বোঝাপড়া না থাকে, তা হলে যত আধুনিক মারণাস্ত্র এবং যত সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণই থাকুক না কেন, অভিযানে সাফল্য অর্জন দুষ্কর। তাই অভিযানের আগে তোমরা যতটা সময় পারো একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করবে। আমার বিশ্বাস, অতীতে যেভাবে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে সফলকাম হয়েছি, বিশেষে করে রাস্তা দখলে আমরা যে সঙ্গবদ্ধ সফলতা অর্জন করেছি, সেই গতি অব্যাহত থাকলে স্বাধীনতা অর্জনে অবশ্যই সফলকাম হবো। তোমাদের সকলকে অসংখ্য শুভেচ্ছা ও সালাম।
আল্লাহ তোমাদের সহায় হউন।
‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী।’

এত কিছুর পরও সহযোদ্ধাদের পরবর্তী অভিযান স্থল বা লক্ষ্যবস্তুর কোন পরিষ্কার ধারণা দিলাম না। মুখ খুলে বা পরোক্ষভাবে, আকারে-ইঙ্গিতেও কাউকেই বুঝতে দিলাম না মুক্তি
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২০

বাহিনী এর পর কোথায় আঘাত হানবে। মুক্তিযোদ্ধারা শুধু বুঝলো, আঘাত হানতে হবে। যুদ্ধ পরিচালনায় এটা আমার একটা অন্যতম কৌশল। সহযোদ্ধাদের কাছে সময়ের আগে কোন পরিকল্পনা প্রকাশ করিনি। সাথে সাথে এও সত্য যে, যুদ্ধ সম্পর্কিত পরিকল্পনা এমনিভাবে গোপন রাখলেও কোন সময় সহযোদ্ধাদের মনে হয়নি যে তাদেরকে পরিস্থিতি সম্পর্কে সময়মত ওয়াকিবহাল করা হয়নি। কোন কোন অভিযানের কথা বিশেষভাবে গোপন রেখেছি। এমনকি একান্ত সহকারীকেও পরিকল্পনার কথা আগে জানাইনি। কিন্তু অন্যান্য অনেক ব্যাপারে অতি সাধারন ও একেবারে খোলামেলা ছিলাম। শুধু যেটা অসময়ে প্রকাশ পেলে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে –সেটাই গোপন রাখার চেষ্টা করেছি। এটা বুঝে সহযোদ্ধাদের মনে কখনও অহেতুক কোন প্রশ্ন জাগেনি বা অতিরিক্ত কোন কৌতূহলও প্রকাশ পায়নি।

কেদারপুরে লতিফ ভাই
কেদারপুর, ২৯শে নভেম্বর সন্ধ্যায় খবর এলো, শহীদ সাহেবের দলকে বহনকারী নৌকা কেদারপুর থেকে মাত্র দুমাইল দুরে। আধ ঘন্টার মধ্যেই নৌকাটি কেদারপুর ঘাটে ভিড়বে। সংবাদ পেয়ে খুবই উৎফুল্লও আনন্দিত হলাম। প্রতিনিধি দল সফল সফর শেষে ফিরে আসছে, তদুপরি বড় ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আসছেন। বড় ভাইয়ের সাথে তুরাতে ২০শে সেপ্টেম্বর শেষ দেখা হয়েছিল। তাই বড় ভাই আসাতে যারপর নাই আনন্দিত ও উল্লসিত হয়ে উঠলাম। লতিফ ভাই টাংগাইল মুক্তি বাহিনীর প্রথম সংগঠক। তবে তিনি তীব্র গতিতে সংগঠিত বিরাট মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক কর্মকান্ড দেখে যেতে পারেননি। তিনি যখন টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় কর্মকান্ড থেকে পরিস্থিতি জনিত কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, তখন মুক্তিবাহিনী কেবল ভূমিষ্ঠ হয়েছে, বাঁচবে কি বাঁচবে না –তা অনেকের পক্ষে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব ছিল না। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, জয়-পরাজয়, অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে হাটি-হাঁটি পা থেকে টাংগাইল মুক্তিবাহিনী আজ শক্ত পায়ে দৌড়াতে শিখেছে, সেই দৌঁড় পিছনে নয়, সামনে। পরাক্রমশালী শত্রুর ঘাঁটি দখল ও তছনছ করতে যে দূরন্ত তেজ, যে অবিশ্বাস্য গতির দরকার -সেই তেজ ও গতি আজ টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর করায়ত্ত্ব। স্বাভাবিক কারণে টাংগাইল মুক্তি বাহিনীর প্রথম সংগঠক গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে সম্পূর্ণ নিরাপদ বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চলে স্বাগত জানাতে পারায় এবং ভবিষ্যতে তার (লতিফ সিদ্দিকীর) মূল্যবান পরামর্শে ও উপস্থিতিতে মুক্তিবাহিনীর আরও কলেবর ও শ্রীবৃদ্ধি হবে বিধায় নিজে গৌরবান্বিত ও পুলকিত বোধ করছিলাম। শহীদ সাহেবের আসার খবর পেয়ে কেদারপুরে শিবির থেকে ঘাটের দিকে এগুলাম। কেদারপুর ঘাট থেকে মাইল খানেক নদীর ধারে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম।বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। কয়েক মিনিট অন্ধকারে দাড়িয়ে থাকার পর অগ্রবর্তী দলের একজন যোদ্ধা ছুটে এসে খবর দিল, প্রতিনিধি দলকে নৌকা থেকে নামানো হয়েছে এবং তাঁরা রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছেন। আমি যে জায়গায় অপেক্ষা করছিলাম, সেখান থেকে এগিয়ে ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর কুড়ি জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে প্রতিনিধি দলকে উষ্ণ সম্বর্ধনা জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিল। সে স্বভাবসিদ্ধ আন্তরিকতায় প্রতিনিধি
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২১

দলকে সাগ্রহে নৌকা থেকে নামিয়ে পথ দেখিয়ে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হলো। আমরাও প্রতিনিধি দশকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আরও এগিয়ে যেতে লাগলাম। মাঝপথে প্রতিনিধি দলের সাথে দেখা হলো। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ আগে আগে। তাঁর পিছনেই গণ-পরিষদ সদস্য বড় ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। প্রথমে আনোয়ার-উল-আলম শহীদকে জড়িয়ে ধরলাম। শহীদ সাহেবকে ছেড়ে দিতেই বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আমাকে জাপটে বুকে তুলে নিলেন। অজান্তে কয়েক ফোটা অশ্রুও উভয়ের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। দুই ভাই মিলনের আনন্দ সাগরে ভাসছিলাম। আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে লতিফ ভাইকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। এর পর নূরুন্নবী, ডাঃ শাহাজাদা চৌধুরী, ফারুক সহ অন্যান্যদের একে একে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। এরপর সবাই কেদারপুরের নির্দিষ্ট স্থানের দিকে ধীর পায়ে এগুলাম। কেদারপুরে আমার সাথে একই বাড়ীতে শহীদ সাহেব সহ অন্যান্যদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নির্দিষ্ট বাড়ীতে পৌঁছলে, বাড়ীর উঠোনে কর্নেল ফজলুর রহমান সত্তর জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে প্রতিনিধি দলকে আনুষ্ঠানিক ‘গার্ড অব অনারের’ মাধ্যমে অভ্যর্থনা করলেন। পরে প্রতিনিধি দলকে নিয়ে একটি ঘরে গিয়ে বসলাম। আমাদের মধ্যে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা হতে লাগলো। গণ- পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর খুশী যেন আর ধরেনা। অনেকদিন পর নিজের জেলার মুক্তাঞ্চলের মাটির স্পর্শ পেয়ে তার হৃদয়-মন পুলকিত। যে বীজ তিনি রোপন করেছিলেন, তা আজ মহীরুহ। সেই মহীরুহের সুন্দর ফল টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর সূর্য্য সেনারা তাদের দেখে ও তপ্ত প্রাণের স্পর্শে তিনি শিশুর মত আনন্দে উদ্বেলিত, অভিভূত। বর্তমান ও ভবিষ্যতের চাইতে অতীতের স্মৃতিচারণের খেই হারানো আবেগে অনেক কথার পর তিনি আমার সামনে কিছু জিনিসপত্র এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি দেশের অভ্যন্তরে তাদের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি জেনে বাংলাদেশ সরকার সরকারীভাবে তাদের জন্য সামান্য কিছু উপহার পাঠিয়েছেন। বিশেষ করে তোর জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একখানা চাদর ও কম্বল পাঠিয়েছেন। আর মুক্তিযোদ্ধদের জন্য একটি রেডিও গ্রাম ও বেশ কয়েকখানা দেশাত্মবোধক গানের রেকর্ড। টাংগাইল মুক্তিবাহিনীকে স্বীকৃতি জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তার উদ্দেশ্যে যে দুটি অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন, তা আমি শহীদকে দিয়ে দিয়েছি। লতিফ ভাই আমাকে একটি ব্যাক্তিগত উপহারও দিলেন। উপহারটি হলো, শীত নিবারণের একটি অতি সুন্দর চামড়ার জ্যাকেট। জ্যাকেটটি দু-একবার ব্যবহার করেই তা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহকে দিয়ে দিয়েছিলাম।
খাওয়া-দাওয়া শেষে প্রায় সারারাত গণ-পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী সহ সবাই তাঁদের কথা বললেন। প্রাতিনিধি দল কোথায় কি করেছেন, কতটা সাড়া পেয়েছেন, একে একে তা বলে গেলেন। প্রতিনিধি দলের অনুপস্থিতির সময় দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধারা ধারাবাহিক সাফল্যের প্রায় সমস্ত ঘটনা আমিও এক এক করে তুলে ধরলাম। আলাপ-আলোচনার সময় মোটেই বুঝা যাচ্ছিলনা, কে কাকে রিপোর্ট করছেন বা কে কার চেয়ে বেশী দায়িত্বশীল। আলাপ-
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২২

আলাচনার সময় বার বার মনে হচ্ছিল, আমরা সবাই সমান। একে অপরের পরিপূরক। কোন বাধা-নিষেধ নেই, কোন গোপনীয়তা নেই, সব কিছু খোলামেলা ভাবেই আলোচিত হচ্ছে। নিতান্ত পরবর্তী যুদ্ধের গোপন পরিকল্পনা ছাড়া মুক্তিবাহিনীতে অন্য সব কিছুর আলোচনার পরিবেশ মুক্ত হাওয়ার মত স্বচ্ছ, বন্ধনহীন। রাত দুটায় নুরুন্নবী আমাকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বললো এবং তা নুরুন্নবী ও আমার মধ্যে সীমিত রইলো। নুরুন্নবী আমাকে অত্যন্ত গোপন ভাবে পরবর্তী পরিকল্পনার কথা জানালো। বিশেষ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরবর্তী পরিকল্পনা কি, তার প্রেক্ষিতে মুক্তিবাহিনীর কি করা দরকার, প্রায় এক ঘন্টা ধরে অবহিত করলো।

নাগরপুর থানার অভিযান ব্যর্থ
৩০শে নভেম্বর, সকাল আটটা। আলাদা করে রাখা এক হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে আবার নির্ধারিত স্থানে সমবেত করা হলো। সেখানে গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, নূরুন্নবীও উপস্থিত হলেন। এইখানেই প্রথম নাগরপুর থানা অভিযানের পরিকল্পনা পেশ করলাম। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও বড় ভাইকে বললাম, ‘নাগরপুর থানা অভিযানের পরিকল্পনা তিন দিন আগে থেকে তৈরী হয়ে আছে। আপনারা অপেক্ষা করুন। নাগরপুর অভিযান শেষে এক অথবা দুই দিনের মধ্যে আমরা পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করবো।” বাছাই করা দুঃসাহসিক ও সুসংগঠিত এক হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নাগরপুর রওনা হলাম। বেলা বারোটায় নাগরপুর থানার উপর পশ্চিম দিক খোলা রেখে তিন দিক থেকে একসাথে আঘাতে হানা হলো। মেজর মোস্তফা দক্ষিণে, ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর দক্ষিণ-পুবে, ক্যাপ্টেন ফজলু এবং আমি পূর্বদিকে এবং ক্যাপ্টেন হুমায়ূন, ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী, ক্যাপ্টেন সাইদুর ও ক্যাপ্টেন মকবুল হোসেন খোকা উত্তর-পুব দিক থেকে থানার উপর আঘাত হানলো। দুখানা ব্রিটিশ ৩ ইঞ্চি মর্টার নাগরপুর থানার দুই মাইল দক্ষিণ-পূব থেকে অবিশ্রান্তভাবে গোলা নিক্ষেপ করতে লাগলো। প্রায় একঘন্টা ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপে থানার হানাদারদের অবস্থানটি একেবারে ধূলিময় হয়ে গেল। ধূলির ধূসর অবগুণ্ঠনের সুযোগে বিশেষ সংকেত পাওয়ার সাথে সাথে সহযোদ্ধারা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। দক্ষিণ-পুবের নাগরপুর বাজার মেজর মোস্তফা ও দুর্ধর্ষ কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর খানের চাপে মিনিট দশেকের মধ্যেই শত্রুমুক্ত হয়ে গেল। তারা পলায়ন পর শত্রুদের পিছু ধাওয়া করে নাগরপুর থানার হানাদার ঘাঁটির একশ গজের মধ্যে এগিয়ে গেল। পুবদিকে ক্যাপ্টেন ফজলু তার দল নিয়ে থানা সীমানার প্রায় পঞ্চাশ গজের মধ্যে এগিয়ে আটকে পড়লো। উত্তর-পুবে তিন জন দুর্ধর্ষ কমাণ্ডার হুমায়ূন সাইদুর ও খোকা থানার প্রায় ২৫ গজের মধ্যে পৌঁছে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা চতুর্দিক থেকে ঘাঁটটি চেপে ধরেছে। শত্রুদের শ্বাস ফেলার জো নেই। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল এর পরই। মুক্তিযোদ্ধারা কোন দিক থেকে আর এগুতে পারছেনা। সামনে সমতল খালি জমি, কোন আড়াল নেই এমনকি কোন ঝোপঝাড় পর্যন্ত নেই। এক ঘন্টা অনবরত মর্টার থেকে নিখুঁত নিশানায় গোলা নিক্ষেপের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৩

পরও শত্রুর তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। গোলার আঘাতে থানা কম্পাউন্ডের ঘরের টিনগুলো ঝরা- পাতার যত এদিক ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। তবুও হানাদাররা অক্ষত। তারা মাটির নীচে এমনভাবে শক্ত বাংকার করেছে যে, সেখানে কোন গোলার আঘাত পৌঁছাতে পারছেনা। অন্যদিকে বাংকারগুলো একটার সাথে আরেকটা সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত। মুক্তিযোদ্ধারা থানার পঞ্চাশ গজের মধ্যে পৌঁছে গেলে মর্টার থেকে দ্বিতীয়বার গোলা নিক্ষেপেরও কোন সুবিধা থাকলোনা। আবার মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করলে তা নিজেদের উপরও পড়তে পারে। মুক্তিযোদ্ধারা ঝড়ের বেগে প্রথম অবস্থায় থানার চল্লিশ-পঞ্চাশ গজের মধ্যে এগিয়ে গেলেও আক্রমণের ধার ক্রমেই কমে আসতে থাকে। পূর্বদিক থেকে প্রথম আক্রমণের সময় ক্যাপ্টেন ফজলুর দলের ষোল সতের বছরের যোদ্ধা শামসুল হক শত্রুর গুলিতে আহত হয়ে কুড়ি-পঁচিশ গজ সামনে পড়েছিল। হানাদারদের ভারী ও মাঝারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের অনবরত গুলির মাঝেও তার চিৎকার শোনা যাচ্ছিল, ‘আমারে হানাদার ধইরা আইন্যা দেও। আমি তাগোর রক্ত খামু।’ এ সময় আর এক মুক্তিযোদ্ধা ঘাটাইল বেঙ্গরোয়ার সুফী পাগল নুরুজ্জামানের পেটের ডান পাশে গুলি লেগে এফোড় হয়ে গেল। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সাথে সাথে তাকে পিছনে পাঠিয়ে দেওয়া হলো, কিন্তু আমার সামনে ছোট আলের আড়ালে অসহায়ভাবে পড়ে থাকা চর পাকুল্লার শামসুল হককে কিছুতেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছিলনা।
হানাদাররা মুক্তিবাহিনীর প্রথম ধাক্কা সামলে নিলে নতুন করে আক্রমণের কৌশল ভাবা শুরু হলো। আর সামনে না এগিয়ে যার যার অবস্থানে থাকতে নির্দেশ দেয়া হলো। টাংগাইলের মুক্তিযোদ্ধারা এ যাবৎ যতগুলো যুদ্ধ করেছে, সবগুলোর চাইতে বেশী অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে এই আক্রমণে। দুটি ৩ ইঞ্চি মর্টার, কুড়িটি ২ ইঞ্চি মর্টার, দুটি ৮২ ব্লান্ডার সাইট, দুটি রকেট লাঞ্চার এবং পঁচিশটি গ্রেনেড থ্রোয়িং রাইফেল, পাঁচটা এম. এম. জি., চল্লিশটা এল. এম. জি. ও কয়েক শত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। এত প্রচণ্ড চাপের মুখেও হানাদার ঘাঁটির পতন না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা বেশ বিস্মিত বোধ করছিল। কারণ সাত দিন আগেও ঢাকা-টাংগাইল সড়কের নানা স্থানে হানাদারদের শিয়াল ধাওয়া করেছে। যেখানে মুক্তিবাহিনী সেখানেই হানাদাররা লেজ তুলে দে ছুট। শত শত রাজাকার মিলিশিয়ার আত্মসমর্পণ। এসবের পর মুক্তিযোদ্ধারা হেঁটে নাগরপুর থানা দখলের আশা করেছিল। কিন্তু তা হলোনা।
হানাদার ঘাঁটির দখল নিতে আমরা ব্যর্থ হলাম। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে একদিনে চার লাখের উপর গুলি খরচ করে। গোলার পরিমাণও নেহায়েত কম নয়। নাগরপুর থানা অভিযানে চারশ’ ৩ ইঞ্চি মর্টার, পাঁচ হাজার ২ ইঞ্চি মর্টার, এক হাজার রকেট লাঞ্চার ও ব্লাণ্ডার সাইটের গোলা এবং পাঁচ হাজার গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যের হলেও সত্য, এত ব্যাপক আক্রমণের পরও নাগরপুর হানাদার ঘাঁটির পতন ঘটেনি। এর কারণ কি? এখানকার হানাদাররা অন্যান্য জায়গায় পর্যুদস্ত বিপর্যন্ত হানাদারদের চাইতে কি বেশী সাহসী ছিল? না, তা মোটেই নয়। মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ যুদ্ধ পরিকল্পনা থেকে বিচ্যুত হয়ে ভুল করে বসে, যার দরুণ
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৪

জয় করেও জয় সম্ভব হলোনা। মূল পরিকল্পনা ছিল, উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে একযোগে চাপ সৃষ্টি করলে হানাদাররা ঘাঁটি ছেড়ে পশ্চিমে সরে যাবে। হয়েছিলও তাই। কিন্তু বাদ সাধলো উত্তর-পূর্বদিকের ক্যাপ্টেন হুমায়ুন। পরিকল্পনা মাফিক তিন দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে হানাদাররা পশ্চিমে সরে যেতে শুরু করলে ক্যাপ্টেন হুমায়ূন উত্তেজনার বশে এবং জয় সুনিশ্চিত জেনে পশ্চিমে হানাদারদের পিছানোর রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এতে যা হবার তাই হলো। কোনদিকে পালাবার পথ না দেখে হানাদাররা আবার বাংকারে আশ্রয় নেয়। আর কোন পথ নেই। একমাত্র উপায়, যতক্ষণ সম্ভব মাটি কামড়ে বাংকারে পরে থাকা এবং প্রতিপক্ষকে জান দিয়ে প্রতিহত করা। কারণ তাদের পক্ষে আত্মসমর্পণের কথা বলারও কোন সুযোগ ছিল না।
ছোট শামসুকে আনতে গিয়ে এক জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়ে পিছু ফিরতে বাধ্য হয়েছে। আহত সহযোদ্ধা শামসুকে পিছনে নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। একে তো হানাদার ঘাঁটি সুনিশ্চিত দখল, সামান্য ভুলের জন্য হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার উপর একজন আহত সহযোদ্ধা শত্রুর গুলির সামনে পরে আছে, যে কোন মুহূর্তে আর একটা গুলি বীর মুক্তিযোদ্ধাটির প্রাণ প্রদীপ নিভিয়ে দিতে পারে। অনেকেই সহযোদ্ধাটিকে নিজের জীবন বাজী রেখে আনতে চাইছিল। কিন্তু সবাইকে টেক্কা দিয়ে ত্রিশালের আবুল কালাম পলকে হামাগুড়ি ও চিৎবাক খেয়ে অত্যন্ত সতর্কতা ও সাহসিকতার সাথে এগিয়ে গেল। গুলির বর্ষণ তখনও অব্যাহত রয়েছে। কালামের ডাইনে-বামে, সামনে-পিছনে গুলি পড়ছে। কোন কোন সময় গুলি তার এত কাছে পড়ছিল যে দূর থেকে সহযোদ্ধারা মারাত্মক অঘটনের আশঙ্কায় শিউরে উঠেছিল। তাদের চোখগুলো বিস্ফোরিত, পলকহীন। পূব দিককার মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্ত অস্ত্রগুলো একসাথে হানাদারদের বাংকারের উপর গুলি বর্ষণ করতে শুরু করলো। উদ্দেশ্য, শামসুকে বয়ে আনার সময় আবুল কালাম আজাদকে হানাদারদের গুলি থেকে আড়াল করা। যেই মুক্তিবাহিনীর গুলি আরম্ভ হলো সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী আবুল কালাম চাপ চাপ রক্তের উপর পড়ে থাকা শামসুকে জাপটে ধরে বিদ্যুৎ চমকানোর মত এক ঝলকে প্রায় পঁচিশ গজ পেছনে এসে একটি মরা খালে গড়িয়ে পড়লো। আমি কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ছুটে গিয়ে শামসু ও কালামকে ভালোভাবে দেখে নিলাম। দুজনের শরীরই রক্তে মাখামাখি। ভালোভাবে হাতিয়ে হাতিয়ে নিরীক্ষণ করে দেখা গেল, কালামের গায়ে গুলির কোন আঁচড় লাগেনি শামসুর পেটের ডান দিকে গুলি লেগে এফোঁড়-ওফোড় হয়ে গেছে। প্রায় দুঘন্টা পড়ে থাকার ফলে তার শরীর থেকে প্রচুর রক্ত ঝড়েছে এবং তখনও চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। যার দরুণ মুখটা অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে নেতিয়ে পড়েছে, তবুও গুলি লাগার পর থেকেই প্রলাপের মত বকেই চলেছে, ‘আমাকে মিলিটারী ধইরা আইন্যা দেও। আমি মিলিটারীর রক্ত খামু।’
বিকাল চারটায় নতুন কৌশলে মুক্তিযোদ্ধারা আবার হানাদারদের ওপর বিপুল বিক্রমে আঘাত হানলো। মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে সফল রকেট লাঞ্চার ও ব্লান্ডার সাইট চালক মজনু হানাদার ঘাটির পূর্ব দিককার ৪-৫টি বাংকার গুঁড়িয়ে দিলে বেশ কয়েকটি বাংকার মুক্তিযোদ্ধাদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৫

দখলেও এসে গেল। কিন্তু তবুও আর এগুনো যাচ্ছে না, পেঁচিয়ে বাংকার খোঁড়া হয়েছে। তাই পুব দিককার কয়েকটা বাংকার মুক্তিবাহিনীর দখলে এসে গেলেও হানাদারদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা লাইন বরাবরের মতই রয়ে গেল। আমি দীর্ঘ সময় ধরে ২ ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ করছিলাম। কয়েক ঘন্টা লাগাতার ২ ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলা ছোড়াতে দুটি হাতের কিছু কিছু ছিড়ে যাওয়ায় রক্ত ঝরতে থাকে। নাগরপুর থানা অভিযানে আমি ও মেজর মোস্তফা অন্যদের চাইতে নিখুঁত লক্ষ্যে ২ ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করলাম। দীর্ঘ সময় গোলা নিক্ষেপ করে ক্লান্ত হয়ে কিছুটা পরিবর্তন ও বৈচিত্রের জন্য ‘চাইনিজ ব্লান্ডার সাইট থেকে কয়েকটা সেল নিক্ষেপ করতে চাইলাম। মজনু বিরামহীনভাবে তার ব্লাণ্ডার সাইট থেকে গোলা নিক্ষেপ করে চলেছে। দ্বিতীয় ব্লাণ্ডার সাইটটি আমি নিলাম, এটা এর আগে একবারও ব্যবহার করা হয়নি। কারণ তাতে ‘ফ্লাশ প্রটেকটর’ ছিল না। যদিও বিখ্যাত আর. ও. সাহেব একটা কাঠের ফ্রেম তৈরী করে তাতে সুন্দর করে টিন লাগিয়ে সামান্য একটু ফুটো করে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের টুকরো দিয়ে ঢেকে কাজ চালানোর মত করে ‘ফ্লাশ প্রটেকটর’ তৈরী করেছিলেন। কিন্তু তা কতটা কার্যকরী হবে, এ বাপারে মুক্তিযোদ্ধাদের কারও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, আমারও না! ‘ফ্লাশ প্রটেকটর সেল নিক্ষেপের সময় কতটা প্রয়োজনীয় তাও তখন কারও জানা ছিল না। সব কিছু অজানা থাকা সত্ত্বেও অব্যবহৃত দ্বিতীয় ‘ব্লাণ্ডার সাইট থেকে গোলা বর্ষণের প্রস্তুতি নিলাম। হানাদারদের বাংকার থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে খালের পাড়ে শুয়ে সরাসরি বাংকারে প্রথম গোলা নিক্ষেপ করলাম। গোলাটি গিয়ে নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানলো ঠিকই। কিন্তু এদিকে মস্ত বড় এক বিপর্যয় ঘটতে ঘটতে বেঁচে গেলাম। গোলা ছোড়ার সাথে সাথে আর. ও. সাহেবের তৈরী ‘ফ্লাশ প্রটেকটর’ ছেঁড়া ন্যাকড়ার মত ছিঁড়ে-ফুড়ে প্রায় পঁচিশ গজ পিছনে উড়ে গিয়ে উঁচুতে একটা বাশঝাড়ে লটকে রইলো। ব্লাণ্ডার সাইটের ফ্লাশের তোড়ে আর. ও. সাহেবের তৈরী ‘ফ্লাশ প্রটেকটর’ উড়ে পিছনে যাওয়ার সময় আমার কপালের খানিকটা কেটে নিয়ে গেল। গোলার হল্কা যখন মুখে এসে লাগল তখন মনে হলো, আমার মাথার খুপড়ি উঠে গেছে। চট করে হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরলাম। তখনও মনে হচ্ছিল, কপালের চামড়া নীচ থেকে উপরের উঠে গেছে। চেপে ধরা হাত উপর থেকে নীচে, আস্তে আস্তে নামিয়ে আনলাম। না, আমার মাথার খুলি উড়ে যায়নি, কপালের চামড়াও ছিড়ে যায়নি। শুধু কপালের বাম দিকটা ফ্লাশ প্রটেকটরের ধাক্কায় খানিকটা কেটে গেছে। রক্ত ভেজা হাত মুছে আবার কপালে হাত দিলাম। এর মধ্যেই দুলাল, হালিম এবং ফজলু আমাকে ধরে সামান্য একটু পিছনে সরিয়ে নিয়ে ভেজা রুমাল কপাল বেঁধে দিল। অনভিজ্ঞতায় আকস্মিক ঘটে যাওয়া ঘটনায় খুব লজ্জাবোধ করলাম এবং বুঝতে পারলাম ঐ ব্লান্ডার সাইট থেকে গোলা ছোড়ার আগে হাতিয়ারটি সম্পর্কে আরো ভেবে নেয়া উচিত ছিল। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। তাই এর পর কি হবে, তা নিয়ে আলোচনার জন্য সকল কোম্পানী কমান্ডারদের ডেকে পাঠানো হলো। যারা কোম্পানী কমান্ডারদের ডাকতে গিয়েছিল সবাইকে বার্তা পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় ক্যাপ্টেন হুমায়ূন, সহকারী কমান্ডার ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী ও আরেক জন যোদ্ধারগুরুতর আহত হবার খবর নিয়ে এলো। অবশ্য আহত হবার পর পরই তাদেরকে পিছনে কেদারপুরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। নাগরপুর যুদ্ধে ছ’জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হলেও ঐ সময় কেদারপুরে ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী থাকায় এবং সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা পাওয়ার কারণে আল্লাহর রহমতে সকলেই বেঁচে যায়।
ছজন কোম্পানী কমান্ডার নিয়ে যখন পরবর্তী যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলছিলাম, তখন কমান্ডারদের প্রশ্ন করলাম, ‘যে থানা দখল করতে আমাদের কয়েক মিনিটের বেশী লাগা উচিত নয় অথচ আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের কয়েক ঘন্টার প্রবল চাপের মুখেও শত্রু ঘাঁটির কেন পতন ঘটছে না, তা আমি তো কিছুতেই বুঝে পারছিনা? তোমাদের যদি এর অন্তর্নিহিত কারণ জানা থাকে তা হলে বলো।’ তখনই জানা গেল হানাদার ঘাঁটি পতন না হওয়া মূল রহস্য। হুমায়ুনের অবর্তমানে তার কোম্পানীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার জানালো, ‘স্যার, পুব-দক্ষিণ দিক থেকে যখন আক্রমণ করা হয় তখন হানাদাররা গুটি গুটি পায়ে পশ্চিমে পালাতে শুরু করে। আমরা প্রায় একশ জন মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে গিয়ে ওদের পালাবার রাস্তা বন্ধ করে দিই। ওরা আবার ঘাঁটিতে ফিরে বাংকারে আশ্রয় নেয়। এবার বুঝলাম কেন ঘাঁটির পতন ঘটছেনা। রাতের মত যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ দিয়ে নাগরপুর থেকে প্রায় দুমাইল পূবে রাত কাটাবার ব্যবস্থা করলাম। ক্যাপ্টেন সবুর ও মেজর মোস্তফা নাগরপুর থানার এক-দেড় মাইল দক্ষিণে সরে গিয়ে রাত কাটালো। উত্তরের যোদ্ধারাও প্রায় এক-দেড় মাইল পুব-উত্তরে সরে গেল।
পরদিন সকালে নব উদ্যমে থানার উপর মুক্তিযোদ্ধারা পুনর্বার আঘাত হানলো। মুক্তিযোদ্ধারা যেন পণ করে বসেছে, নাগরপুর থানার দখল নিতেই হবে। এটা খুবই সত্য যে, এক হাজার মুক্তিযোদ্ধার সামনে নাগরপুর থানার নব্বই জন পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিশিয়া ও একশ চল্লিশ- দেড়শ’ জন রাজাকার কিছুই না। তবুও অবস্থান প্রতিকূল হওয়ার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের বিধ্বস্ত ঘাঁটির দখল নিতে পারলোনা। ৩০শে নভেম্বর, ও ১লা ডিসেম্বর সকালের কয়েক ঘন্টা যুদ্ধে ষোল-সতের জন নিহত ও দুজন হানাদার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়লেও ঘাঁটি হানাদারদের দখলেই থেকে গেল।

এলাসিন ঘাটে
১লা ডিসেম্বর সকাল ন’টায় খবর এলো, নাগরপুরের অবরুদ্ধ হানাদারদের উদ্ধারে টাংগাইল থেকে এক ব্যাটেলিয়ান নিয়মিত সৈন্য আসছে। খবর পেয়ে নাগরপুরে অপেক্ষা করা সমীচীন মনে না করে সবুর ও রবিউলের কোম্পানী নিয়ে এলাসিন ঘাটের দিকে এগিয়ে এলাম। মেজর মোস্তফা ও ক্যাপ্টেন মকবুল হোসেন খোকাকে নাগরপুরের মূল দায়িত্ব দেয়া হলো। এলাসিন খেয়াঘাট পাড়ে এসে শাহজানি চরের কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন মঈনুদ্দীনকে দলসহ পেয়ে গেলাম, তার কাছে এলাসিনের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানলাম। ধলেশ্বরী নদীর উত্তর পাড়ে যে হানাদাররা এসে গেছে, তা একটু একটু দেখা যাচ্ছিল৷ নদী প্রায় মাইল দেড়েক প্রশস্ত তাই অপর পাড়ের অবস্থা সঠিক বুঝা যাচ্ছিলনা। তবুও মোটামুটি আন্দাজে ক্যাপ্টেন মঈনুদ্দীন জানালো, ‘হানাদাররা অপর পাড়ে এসে গেছে। মাঝে মাঝে এইচ.
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৭

এম. জি. থেকে গুলি ছুঁড়ছে বটে, তবে এ পর্যন্ত নদী পার হওয়ার কোন চেষ্টা করেনি। আমরা খেয়া নৌকাগলো ডুবিয়ে দিয়েছি।’ মঈনুদ্দীনকে ওখানেই শক্তভাবে অবস্থানে থাকতে বলে নদীর পাড় ঘেঁষে উত্তর-পশ্চিমে এগুতে লাগলাম। এলাসিন খেয়াঘাটের উত্তর-পশ্চিমে লম্বালম্বি প্রায় এক মাইল প্রশস্ত চর পড়েছে। কোথাও পানির নাম নিশানা নেই, চর বরাবর আধা মাইল প্রস্থে অপর পাড় ঘেঁষে নদী বয়ে গেছে। তাই ওখান দিয়েই হানাদারদের পক্ষে নদী পার হওয়া সহজ। একবার তারা যদি পানি পার হয়ে চরের অর্ধেকটা পেরিয়ে আসতে পারে, তাহলে আর ফিরিয়ে রাখা যাবেনা। তাই শক্ত প্রতিরক্ষা লাইন গড়ে তুলতে খেয়াঘাটের উত্তর-পশ্চিমে এগুতে লাগলাম। এলাসিন ঘাট থেকে আধ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ধনবাড়ীর আবদুর রাজ্জাক তার কোম্পানী নিয়ে অবস্থানে ছিল। সেখানে পৌঁছলে আবদুর রাজ্জাক খুবই আনন্দিত ও গর্বভরে বলেলো, ‘স্যার, আমরা হানাদারদের এগুনো বন্ধ করে দিয়েছি। আজ আর ওদের পক্ষে নদী পার হওয়া সম্ভব হবে না। উত্তর-পশ্চিমের অবস্থা কি জানতে চাইেল আবদুর রাজ্জাক জানালো তার কোম্পানীর একটি অংশ ওখান থেকে আরো এই মাইল উত্তর-পশ্চিমে সমগ্র এলাকা জুড়ে অবস্থান নিয়ে আছে। আবদুর রাজ্জাককে উৎসাহিত করে আরও উত্তরে এগুতে থাকলাম। রাজ্জাকের কাছ থেকে দুশ গজও এগুতে পারিনি-বৃষ্টির মতো এইচ. এম. জি-র গুলি আসতে লাগলো। প্রথমাবস্থায় অপর পার থেকে ছোঁড়া গুলির কোন মূল্যই দিতে চাইনি। কারণ প্রায় দেড়-দুই মাইল দূর থেকে হানাদাররা গুলি ছুঁড়ছে। আমাদের অহঙ্কার ছিল, ওরা তিনশ গজ দূর থেকেও মুক্তিবাহিনীর গায়ে গুলি লাগতে পারেনা তাই আবার আড়াই তিন হাজার গজ দূরের গুলি কিভাবে লাগবে। কিন্তু না, মেশিনগানের গুলি আমাদের আশেপাশে সমানে পড়ছে। মেশিনগানের গুলি পাঁচ হাজার গজ দূরেও যদি কারো গায়ে লাগে, তাতে কি পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে তা আমাদের মোটেই অজানা ছিল না। তাই অবহেলা না করে কিছুর আড়াল নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফাঁকা জায়গা, ডানে-বামে-পিছনে দু-তিনশ গজের মধ্যে আড়াল নেবার মত কোন জায়গা নেই। শুধু ধু ধু বালির চর। খানিকটা সামনে মরা খালের মত একটা জায়গা দেখে দৌঁড়ে গিয়ে সেই খাদে লাফিয়ে পড়লাম। বেশ কিছু সহযোদ্ধাও আমাকে অনুসরণ করলো। খাদে লাফিয়ে পড়ায় হয়ত হানাদাররা আমাদেরকে দৃষ্টি থেকে হারিয়ে ফেলে। কারণ মাইল দেড়েক দূর থেকে কেউ কাউকে খুব একটা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলনা। আমরা যেখানে লাফিয়ে পড়েছিলাম, সেখানে নদীর পাড়ে বেশ কয়েকটি বড় বড় নৌকা বাধা থাকায় তার আড়াল পেয়ে গেলাম। নৌকার আড়ালে কিছু সময় দাড়িয়ে থেকে দেখলাম, গুলি আসা বন্ধ হয়ে গেছে। তখন সবুর ও রবিউলকে তাদের কোম্পানী নিয়ে খুব সন্তর্পণে আরো আধ মাইল উত্তর-পশ্চিমে এগিয়ে অবস্থান নিয়ে আমাকে খবর পাঠাতে বললাম। ক্যাপ্টেন সবুরের কাছ থেকে খবর পাওয়ার পরই আমরা আরো উত্তর-পশ্চিমে এগিয়ে যাবো। সবুর ও রবিউল, তাদের নিজ নিজ দল নিয়ে নদীর পার ঘেঁষে নিরাপদে নির্বিঘ্নে প্রায় এক মাইল উত্তর-পশ্চিমে এগিয়ে গেল।
ইত্যবসরে চার-পাঁচ জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে বড় একটা নৌকায় গিয়ে উঠলাম। নৌকাটিতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৮

লবণ ভর্তি। নৌকা ওয়ালাদের বাড়ী রংপুর জেলার গাইবান্ধায়। আজীবন ব্যবসায়ী। নদীপথে নৌকাযোগে তারা ব্যবসা করেন। নৌকার মাল্লাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা এই লবণ কোথা থেকে নিয়ে এলেন? আর ঢাকায়ই বা কি নিয়ে গিয়েছিলেন। নৌকা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বললেন,
— আমরা এক সপ্তাহ আগে পাট নিয়ে ঢাকা গিয়েছিলাম।
— এই যুদ্ধের সময় নদীপথে যাতায়াতে আপনাদের কোন অসুবিধা হয় না?
— যুদ্ধের শুরুতে যাতায়াতে আমাদের সামান্য অসুবিধা হতো। তবে চার-পাঁচ মাস যাবৎ কোন অসুবিধা নেই। ব্যবসার জন্য মিলিটারীরা তেমন কোন অসুবিধা করেনা। এখন মুক্তি- বাহিনীর দিক থেকেও কোন অসুবিধা নেই। কেন নেই, জিজ্ঞেস করায় তিনি বেশ কয়েক টুকরো কাগজ আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই যে, এই কাগজগুলো দেখালেই মুক্তিবাহিনীর দিক থেকে কোন অসুবিধা হয়না। মিলিটারীদের কাছে শুধু লাইসেন্স দেখাতে পারলে আর কোন অসুবিধা নেই। কাগজগুলো খুটিয়ে দেখলাম, তের-চৌদ্দ টুকরো কাগজ। তার মধ্যে দশ-এগারো টুকরো কাগজই আমার দলের। কাগজগুলোর প্রত্যেকটিতে আনোয়ার উল আলম শহীদের স্বাক্ষর রয়েছে। চার-পাঁচটি কাগজে আদায়কারী হিসাবে আবদুস সামাদের ও ছ’সাতটিতে আলীম ও মঈনুদ্দীনের স্বাক্ষর রয়েছে। কাগজগুলো নদীপথে যাতায়াতকারী ব্যবসায়ীদের মুক্তিবাহিনীকে কর প্রদানের রশিদ। তিনটিতে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর স্বাক্ষর রয়েছে। রশিদগুলোর একটিতে সর্বোচ্চ কর ছ’শ কয়েক টাকা। বাকীগুলোতে দু’শ, কোনটাতে দেড়শ, কোনটাতে ষাট-সত্তর টাকা। রশিদগুলো দেখে বেশ কৌতূহল জাগল। অন্যান্য নৌকায়ও একই রকম রশিদ আছে কিনা জানতে চাইলে নৌকার লোকজনেরা অনুরূপ কর প্রদানের রশিদ নিয়ে উপস্থিত হলেন। সব কটি নৌকায় ব্যবসায়ীদের কাছে ফিরতি পথে তিন দিন আগে স্বাক্ষর করা ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর রশিদ রয়েছে। অন্যদিকে এক সপ্তাহ আগে, কোনটাতে দশদিন আগে ঢাকা যাওয়ার পথে আবদুল আলীম ও ক্যাপ্টেন মঈনুদ্দীনের স্বাক্ষর করা রশিদ রয়েছে, দেখে খুবই উৎফুল্ল হলাম। সর্বত্র যে শৃঙ্খলার সাথে দ্রুত কাজ এগুচ্ছে তা নিয়মিত কর গ্রহণ দেখে বুঝতে পারলাম। বাবসায়ীদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাদের কর দিতে অসুবিধা হয় না? আপনারা কি সবাই স্বেচ্ছায় এই কর দেন?’ ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘এই কর দিতে আমাদের কোন অসুবিধা নেই। বরং সুবিধাই আছে। মুক্তিবাহিনীকে সামান্য কর দিয়ে আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করি। কর না দিলেই বরং অসুবিধা। করের পরিমাণও মোটেই বেশী নয়। একশ টাকার জিনিসে মাত্র এক টাকা। তাই আমরা স্বেচ্ছায় কর দিই। এতে নদীপথে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা নিরাপদ হয়েছে। কথার ফাঁকে একবার নৌকার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি, আপনাদের নৌকায় কোন খাবার-দাবার নেই? নৌকার প্রবীণ লোকটি সানন্দে বললেন,
— নিশ্চয়ই আছে। কিছুক্ষণ আগে আমরা ভাত পাক করেছি। গোলাগুলির চোটে খেতে পারিনি।
— দিন না, আমাদের কিছু খেতে। নৌকার লোকেরা অবাক! তারা সমস্বরে বলে উঠেন,
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৯

— আপনারা আমাদের খাবার খাবেন ?
— কেন খাবোনা? দিয়েই দেখুননা। বলতেই নৌকার লোকজনেরা পাঁচ-ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে টিনের থালা ও মাটির শানকীতে ভাত বেড়ে দিলেন। অন্যান্য নৌকার লোকেরাও দুএক জন করে তাদের নৌকায় নিয়ে খাওয়ালেন।
খাবার শেষে নৌকার লোকজনদের ধন্যবাদ দিয়ে চটপট উত্তর-পশ্চিমে রওনা হলাম। ক্যাপ্টেন সবুর ও কমাণ্ডার রবিউলের কাছে পৌঁছালে তারা উভয়েই সামনে এবং উত্তর-পশ্চিমের কিছু এলাকায় তাদের নিজেদের অবস্থান ঠিক আছে বলে জানালো। সবুরকে আমার তিন-চারশ গজ পিছনে এবং রবিউলকে সবুরের তিন-চারশ গজ পিছনে থেকে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে আরও উত্তর-পশ্চিমে এগুতে থাকলাম। আমাদের উদ্দেশ্য শুকনো চর সামনে রেখে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করা। সবুর থেকে প্রায় দু’শ গজ এগিয়ে এসেছি। সবুর ও রবিউলকে দু’শ গজ পিছনে ফেলে এসেছে। উত্তর-পশ্চিম বরাবর নদীর পাড় দিয়ে এগুচ্ছি, এমন সময় নদীর অপর পাড় থেকে আবার অসংখ্য গুলি আসতে থাকে। গুলি এড়ানোর উদ্দেশ্যে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু নদীর পাড়ে খোলা প্রান্তরে শুয়ে পড়াও নিরাপদ নয়। যেকোন ভাবেই একটা আড়াল চাই-ই। একবার নীচু হয়ে আবার সোজা হয়ে উত্তর-পশ্চিম বরাবর দ্রুত ছুটতে লাগলাম। ভাগ্যক্রমে, সোজা পশ্চিমে বয়ে যাওয়া ছোট একটি খালের আড়াল পেয়ে গেলাম। সাথের মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সবাই আমার পিছু পিছু দৌড়ে উলটেপালটে খালের মধ্যে এসে পরে তড়িৎ-অবস্থান নিয়ে নিল। এ সময় পাকুল্লার ফজলু হোচট খেয়ে কুড়ি-পঁচিশ হাত পিছনে গুলি বৃষ্টির মধ্যে ধানক্ষেতে শুয়ে পড়লো। খালের পাড়ে অবস্থান নিয়ে পিছনে পড়ে থাকা একমাত্র সহযোদ্ধা ফজলুকে চিৎকার করে ডাকলাম, তাড়াতাড়ি আয়, না হলে মারা পড়বি।’ ডাক শুনে ফজলু আচমকা সম্বিত ফিরে পেল এবং গুলি বৃষ্টির মাঝে দৌড়ে এসে খালে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আমি পুব-দক্ষিণে মুখ করে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে অবস্থান নিয়েছি। সঙ্গে মাত্র আট জন সহযোদ্ধা। বাকীরা কে কোথায় ছিটকে পড়েছে তার কোন হদিস জানিনা। নীচে তাকাতেই একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। একি। আমার থেকে মাত্র পঁচিশ-ত্রিশ গজ নিচে বালুর চরে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জন হানাদার খান-সেনা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাল বিলম্ব না করে রাশিয়ান এল. এম. জি থেকে হানাদারদের উপর মুষলধারায় গুলি ছোঁড়া শুরু করলাম। আমার পাশে আবদুল্লাহ। তার হাতের হাতিয়ারও তখন গর্জে উঠেছে। সে তার স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে দেখে দেখে গুনে গুনে হানাদারদের উপর গুলি চালাচ্ছে। হানাদারদের অবস্থান এত খারাপ যে, মার খাওয়া ছাড়া তাদের কোন কিছু করার নেই। অথচ আমাদের অবস্থান পরিবর্তনে কয়েক সেকেণ্ড দেরী হলে, এখন হানাদারদের যা ঘটছে তাই-ই উল্টে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘটতো। একটু সময় পেলেই হানাদাররা একেবারে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাড়ে এসে চেপে পড়তো। হঠাৎ হানাদারদের একটি গুলি আমার ডান পাশে অবস্থান নেয়া কামুটিয়ার ছানোয়ারের পিঠে এসে লাগে। সে সাথে সাথে নীচে গড়িয়ে পড়ে। ছানোয়ারকে জিজ্ঞেস করলাম,
— তুই পড়ে গেলি কেন? তোর কি হয়েছে?
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩০

— আমার গায়ে গুলি লেগেছে ?
— কে বলল তোর গায়ে গুলি লেগেছে ?
— হ্যাঁ স্যার, আমার গায়ে গুলি লেগেছে।
— আমি বলছি, তোর গায়ে গুলি লাগে নাই।
— তাহলে স্যার আমার গায়ে গুলি লাগে নাই।
— তুই পশ্চিমে চলে যা। ঐ যে বজলুরা গেছে। দে ছুট। এক দৌড়ে তাদের কাছে চলে যা। খালের পাড় ঘেঁষে প্রায় তিনশ’ গজ পশ্চিমে হালিম, আজাহার, বজলু, মামুদ, দুলাল ও পাকুল্লার ফজলু অবস্থান নিয়েছিল। আমি দেখেছি, ছানোয়ারের পিঠে গুলি লেগেছে। তবুও ছানোয়ারকে ধমকে আরও পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে পাঠানো ছাড়া কোন উপায় ছিল না। আমার ধমক খেয়ে ছানোয়ার গুরুতর ক্ষত নিয়েও একদৌড়ে হালিম, আজহার, বজলু, মাসুদ, দুলাল ও পাকুল্লার ফজলুর কাছে পৌঁছে যায়। তারা ছানোয়ারকে জাপটে ধরে বলে, ‘তুই দৌড়াচ্ছিস কেন? তোর গায়ে গুলি লেগেছে? তোর গা থেকে রক্ত ঝরছে। ছানোয়ার তখন বেসামাল, মোহাবিষ্টের মত শুধুমাত্র দুএকবার বললো, ‘না, স্যার বলেছেন, আমার গায়ে গুলি লাগে নাই। বলার পরপরই সে সাময়িকভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ঘন্টা খানেক সেবা শুশ্রূষা করার পর আবার তার জ্ঞান ফিরে আসে। অন্যদিকে এগিয়ে আসা হানাদারদের সুবিধাজনক অবস্থান থেকে বেশ কিছুক্ষণ গুলি চালিয়ে আবদুল্লাহকে আরো ডাইনে সরে যেতে বললাম। আবদুল্লাহ আমাকে একা রেখে সরে যেতে কিছুতেই রাজী নয়। আমি দুই দুই বার ধমক দিয়ে বলার পর আবদুল্লাহ একটুও সরে গেলনা। এর পর আবদুল্লাহকে আর পীড়াপীড়ি না করে অবস্থাটা কিছু সামলে নিয়ে দুজনেই চট্ করে পশ্চিমে ভাররা বাজারের দিকে সরে গেলাম।
এলাসিন ঘাটে আমার পিছন থেকে আকস্মিক গুলি আসার কারণ কি ? আর ক্যাপ্টেন সবুর, ক্যাপ্টেন রবিউল ও ক্যাপ্টেন ফজলুই বা গেল কোথায়? যখন সবুর ও রবিউলের সঙ্গে কথা বলে উত্তর-পশ্চিমে এগুচ্ছিলাম, ফজলু তখন আমার থেকে প্রায় একশ’ গজ পিছনে ছিল। তার শ’গজ পিছনে সবুর হানাদারদের সেই সময় নদীর অপর পাড়ে বসে বসে শুধু হাওয়া খায়নি। হানাদারদের একটি দল এলাসিন ঘাট থেকে প্রায় দুমাইল উত্তর-পশ্চিমে সরে নদী পাড় হয়ে নাগরপুরের পাড়ে এসে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল উঁচুতে, হানাদারদের নদী পার হয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া নদীর পানি ঘেঁষে মুক্তিযোদ্ধাদের নজর এড়িয়ে দক্ষিণে-পূর্বে এগুতে থাকে। আমি যখন সবুরের কাছ দিয়ে উত্তরে যাচ্ছিলাম, তখন হানাদাররা আমাদের বড়জোর একশ’ গজ পুবে নীচু তীর ঘেঁষে দক্ষিণে এগুচ্ছিল। আমরা ঐ স্থান ত্যাগ করে ছোট্ট খালের আড়াল নেবার একটু পরেই রবিউল যেখানে অবস্থান নেয়, হানাদাররা ঠিক সেইখানে নদীর পাড়ে উঠে আসে। ক্যাপ্টেন রবিউল তার সামনে অচমকা বেশ কিছু হানাদার দেখে ভয় পেয়ে যায়। সে নিজেও যেমন গুলি ছোড়েনি তেমনি সহযোদ্ধাদেরকেও গুলি ছুঁড়তে নির্দেশ না দিয়ে ‘দে ছুট’। রবিউল ‘দে ছুট’ দিলেও তার দলের সদস্যরা অসীম সাহসিকতার সাথে গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে ৷
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩১

কমান্ডারের নির্দেশ না পাওয়ায় গুলি ছুঁড়তে সামান্য দেরী হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা একটু অসুবিধায় পড়ে। তবুও ক্যাপ্টেন রবিউল পালিয়ে যাওয়ার পরও দুর্জয় যোদ্ধারা হানাদারদের উপর গুলি চালিয়ে তাদের গতি যদি সাময়িকভাবে রোধ করে দিতে না পারতো তাহলে ক্যাপ্টেন সবুর ও ক্যাপ্টেন ফজলু সহ প্রায় সত্তর-আশি জন মুক্তিযোদ্ধা নিশ্চিত মৃত্যু বরণ করতো। আমিও প্রাণে বাঁচাতাম কিনা, যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কমাণ্ডারহীন মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড সাহসিকতার সাথে লড়াই করে গুলি ছুঁড়ে আস্তে আস্তে পিছু হটতে থাকে। কিন্তু তাদের দুজন সহযোদ্ধা হানাদারদের গুলিতে আহত হয়। হানাদাররে প্রচণ্ড চাপের মুখে আহতদের ফেলে নেতৃত্বহীন বাকী যোদ্ধারা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

উড়ো খবরে শোকাহত কেদারপুর
ক্যাপ্টেন সবুর ও ক্যাপ্টেন ফজলুর দলের সদস্যরা আচমকা ঘটে যাওয়া বিপত্তিতে চার— পাঁচ ভাগে এদিক-ওদিক ছত্রভঙ্গ হয়ে ছিটকে পড়ে। দশ-বারো জনকে নিয়ে সবুর সোজা দুই- আড়াই মাইল পশ্চিমে চলে যায়। অন্যদিকে ফজলু ছ-সাত জন সহ এলাসিন ঘাট থেকে মাইল খানেক পশ্চিমে গিয়ে তারপর সোজা দক্ষিণে কেদারপুরে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন ফজলু কেদারপুরে পৌঁছবার প্রায় একঘন্টা আগে ক্যাপ্টেন রবিউল কেদারপুরে পৌঁছেছিল। সে কেদারপুরে আনোয়ার- উল-আলম শহীদ সহ গণ-পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীকে এই বিপর্যয়ের কথা জানিয়েছিল। ক্যাপ্টেন সবুর ও ক্যাপ্টেন ফজলু সহ বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা হানাদারদের হাতে ধরা পড়েছে। সর্বাধিনায়ক তার থেকে দূরে ছিল তাই সে তার সঠিক খবর বলতে পারছেনা। তবে তিনি নিজেও চারদিক থেকে শত্রুর দ্বারা ঘেরাও হয়েছিল, এরপর কি হয়েছে তা সে জানেনা। ক্যাপ্টেন রবিউলের এই খবরে নেতৃবৃন্দ যারপর নাই ব্যাকুল হয়ে পড়েন। বিশেষ করে গণ-পরিষদ সদস্য বড় ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী শিশুর মত অঝোরে কাঁদতে থাকেন। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও নুরুন্নবীর চোখেও অশ্রু। নূরু ও ফারুক হাউমাউ করে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। কারণ যুদ্ধের পুরো সময়টা হানাদার কর্তৃক আমি ঘেরাও হয়েছি, এমন খবর ওরা কখনও পায়নি। আর রবিউলের ভেজা জামা-কাপড়, উদভ্রান্ত চোখ-মুখ ও ধুলিমাখা শরীর দেখে তার রিপোর্ট কেউই একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছিল না। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী বার বার বুক চাপড়ে, কপালে কষাঘাত করে বিলাপ করে বলেছিলেন,
— আমি এলাম আর কাদেরের এমন বিপদ হলো। কাদেরকে আর দেখতে পাবো না? এখন যুদ্ধই চলবে কি করে?’

কর্নেলের কীর্তি
এ সময় কর্নেল ফজলু কেদারপুরে এসে হাজির। উনি নিজেও ঐদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড বাধিয়েছিলেন। আমি যখন আক্রান্ত হই তখন কর্নেল ফজলুর রহমান লাউহাটি থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এলাসিনের দিকে আসছিলেন। এলাসিন থেকে আধ মাইল দক্ষিণে থাকতেই প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। কর্নেল সাহেব আর যুদ্ধক্ষেত্র এলাসিন ঘাটে না গিয়ে সবাইকে পিছনে ফেলে কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে সোজা পূব-দক্ষিণে ‘দে ছুট’। এক দৌড়ে লাউহাটি। লাউহাটি গিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩২

প্রকৃতস্থ হয়ে কাপড়-চোপড় বদল করে আবার পূর্বের কর্নেলের বেশে ফিটফাট হয়ে মাত্র কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া নিদারুণ ঘটনাটি বেমালুম ভুলে গিয়ে নতুন কোন খবর আছে কিনা জানার জন্য হম্বিতম্বি করতে করতে কেদারপুরে আসেন। কেদারপুর এসে রবিউলের দেওয়া খবর থেকে উদ্ভুত নাজুক পরিস্থিতি দেখে একেবারে হতবাক হয়ে যান। শহীদ সাহেবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কি ব্যাপার। এম. এ. পি. সাহেব কাঁদছেন? ফারুক-নূরুর কি হয়েছে? আপনারই বা চোখ ছলছল করছে কেন? কি ব্যাপার?’ শহীদ সাহেব বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, ‘আমি বলতে পারবোনা, আপনি রবিউলের কাছ থেকে শোনেন। কর্নেল ফজলু ক্যাপ্টেন রবিউলকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে, সে টেপরেকর্ডারের মত হুবহু একই বর্ণনা দেয়। ক্যাপ্টেন রবিউলের কথা শুনে কর্নেল স্বমূর্তি ধরেন। তার সহযোদ্ধাদের রবিউলকে গ্রেফতার করতে নির্দেশ দিলেন। কর্ণেল ফজলুর উগ্র, রুদ্র রূপ এবং রবিউলকে পিঠমোড়া দিয়ে বাধতে দেখে গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এবং আনোয়ার-উল-আলম শহীদ সহ সবাই বলেন, ‘ওকে বাধছেন কেন? ওর কি দোষ? যা ঘটেছে ওতো তাই বলেছে। বিশেষ করে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘তুই ওকে ছেড়ে দে।’ লতিফ সিদ্দিকী ঐ সময় এত ভেঙে পড়েছিলেন যে, কথা বলতে পারছিলেন না। লতিফ সিদ্দিকী এবং কর্নেল ফজলু একসময় টাংগাইল বিবেকানন্দ আশ্রমে একই ক্লাশে পরতেন। তাই বহুদিন থেকে তাদের ‘তুই, তুমি’ সম্পর্ক। কর্নেল উত্তেজনায় রাজ্যের সমস্ত উম্মা ও ক্রোধ প্রকাশ করে উচ্চস্বরে চিৎকার করে লতিফ সিদ্দিকীকে বলেন, ‘তুই তো জানিস না। এই হারামজাদা ফটকাবাজদের আমি খুব ভালভাবে চিনি। শহীদ স্যার শুনুন, এইমাত্র আমি এলাসিন থেকে এসেছি। এই হারামজাদা কুত্তা যা বলেছে, সব মিথ্যা। আমার সাথে স্যারের একঘন্টা আগেও যোগাযোগ হয়েছে। (চোখমুখ খিচে, দাত কটমট করে রবিউলের দিকে তাকিয়ে ) এই হারামজাদা শুয়োরের মিথ্যা খবরে আপনারা চিন্তা করছেন। কর্নেল ফজলুর কথা শুনে লতিফ সিদ্দিকীর চোখে-মুখে একবার হাসির ঝিলিক খেলে যায়। পরক্ষণেই তিনি অঝোরে কেঁদে ফেলেন। অন্য সবার অবস্থাও একই রকম। কোনটা তারা বিশ্বাস করবেন? কর্নেলের কথা? না, প্রত্যক্ষদর্শী রবিউলের কথা? কর্নেল ফজলু চতুর্দিকে একবার চোখে ঘুরিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি, আপনারা আমার কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেননা। আমার কথায় একঘন্টা বিশ্বাস রাখুন, এই হারামজাদা যে আপনাদের মিথ্যা বলেছে, আমি অস্তুতঃ তার একটা প্রমাণ দিচ্ছি।’ এই বলে কর্নেল ফজলু জোরে জোরে পা ফেলে মাটি কাঁপিয়ে কেদারপুর থেকে আবার লাউহাটি ঘাটির দিকে রওনা হলেন। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ সহ সবাই আশার ক্ষীণ আলোটুকু বাঁচিয়ে রেখে কর্নেলের উপরই ভরসা করছেন। উপায় কি? এ ছাড়া তাদের করার আর কি আছে।
কর্নেলের ভাগ্য খুবই সুপ্রসন্ন। কেদারপুর থেকে লাউহাটি আসার পথে ক্যাপ্টেন ফজলুর সাথে তার দেখা হয়ে যায়। কর্নেল যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেলেন। ক্যাপ্টেন ফজলুর কাছে পর পর করে সব শুনলেন। কিন্তু আমার সম্পর্কে কিছুই নিশ্চিত হতে পারলেননা। তবুও নৈরাশ্য
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৩

ও হতাশাজনক অবস্থা সামাল দিতে ফজলুকে তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ফজলুকে বলেন, “দেখ ব্যাটা, তোকে কমাণ্ডার করার সময় আমিও স্যারকে অনুরোধ করেছিলাম। সেজন্য তুই কমাণ্ডার হতে পেরেছিস। একে তো তুই স্যারকে ফেলে পালিয়ে এসেছিস। এ জন্যই তোর গুলি খাওয়া উচিত। এরপরও আমি যা বলি, তা যদি তুই ঠিক ঠিক না করিস, তাহলে বেটা আমিই তোকে গুলি করব।’ ক্যাপ্টেন ফজলুল হককে কর্নেল সাহেব বলে দিলেন, সে যেন শহীদ সাহেবদের বলে-সর্বশেষ পরিস্থিতি জানানোর জন্যই সর্বাধিনায়ক তাকে কেদারপুরে পাঠিয়েছেন। ফজলুল হক একবার কর্নেলকে অনুনয় করে বলল, ‘আমি স্যারের কথা জানিনা, তারপরও এই মিথ্যা কথা কি করে বলবো? সত্যিই যদি স্যারের কোন ক্ষতি হয়, তাহলে আমার কি উপায় হবে। কর্নেল সাহেব অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তার ডান হাতের বেত বাম হাতের তালুতে জোরে জোরে যার কয়েক ঠুকে বললেন, ‘বদমাশ, তোর পরে কি হবে জানিনা। তবে এখন যদি আমার হাত থেকে বাচতে চাস্ তাহলে আমি যা যা বলছি, তাই সবাইকে বলবি। এই বলে ফজলুকে সাথে নিয়ে আবার কেদারপুরে ফিরে গেলেন।
ক্যাপ্টেন ফজলুল হককে দেখে কেদারপুরের সবাইতো অবাক। ফজলুল হকও কর্নেল সাহেবের শিখানো বুলি তোতা পাখীর মত গড়গড় করে আউরে গেল। এতে কিছুটা ফল দিল। কেদারপুরের শোকাতুর থমথমে ভাব কিছুটা কেটে গেল। কর্নেল সাহেব নিজের ঘাঁটি লাউহাটিতে না ফিরে, রাতে কেদারপুরে থাকা স্থির করলেন।

বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ভাররা বাজারে
আমি এবং আবদুল্লাহ দ্রুত পশ্চিম দিকে দৌড়ে ভাররা বাজারে এলাম। নদীর পাড়ের চাইতে জায়গাটি অনেকাংশে নিরাপদ। আহত ছানোয়ারকে ভাররা বাজারের একটি দোকানের পাশে বেঞ্চিতে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। ক্ষত থেকে তখনও রক্ত ঝরা বন্ধ হয়নি। তার কাঁধের পিছনে গুলি লেগে ছ-সাত ইঞ্চি গভীর গর্ত হয়ে গেছে। গুলিটা সম্ভবত ভিতরেই রয়ে গেছে। কারণ বেরিয়ে যাবার কোন চিহ্ন নেই। ক্ষতের রক্ত-মাংস থক থক করছে। গুলি লাগার তিন ঘন্টা পরও তাকে একটুও ঔষধ দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ আমাদের দলের চিকিৎসক আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। একে তো আমাদের সংখ্যা কম, তার উপর এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করে বেশ ক্লান্ত। এরপর যদি আবার মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত হানাদাররা আক্রমণ করে বসে তখন কি করে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই আরও নিরাপদ স্থানে সরে যাবার কথা ভাবছিলাম। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ভাবতে ভাবতে এবং ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে গুরুতর আহত ছানোয়ার সহ আমরা ভাররা বাজার থেকে আধ মাইল পশ্চিমে ভাররা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। এখানে উঠে আর এক বিপত্তি বাধলো। ভাররার চেয়ারম্যান মোটেই সুবিধাজনক লোক ছিল না। দালালির অভিযোগে ঐ বাড়ীর কর্তাকে কর্নেল ফজলুর ছোট ভাই মুসা আগষ্টের শেষাশেষি গ্রেফতার ও পরে হত্যা করেছিল। শুধু চেয়ারম্যানকে হত্যা করেই মুসা ক্ষান্ত হয়নি। দু’তিনটি ঘর সহ সব কিছু জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যদিও মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৪

মুসার এই কার্যকলাপ অনুমোদন করেননি। সে আমার অনুপস্থিতিতে তখন নিয়ন্ত্রণহীন বিদ্রোহীদের অন্যতম ছিল। এই অননুমোদিত কাজ করায় সদর দপ্তর কৈফিয়ত তলব করলে, মুসা সদর দপ্তরকে কোন পাত্তা না দিয়ে ভারতের দিকে সরে যায় এবং ২৫শে সেপ্টেম্বর ভারতে পৌছালে কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতার করে। যদিও আমার কাছে রিপোর্ট ছিল, মুসা ভাররার চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা করেছে এবং বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। তবে এই বাড়ীই যে সেই বাড়ী, তা এখানে উঠার আগের মূহুর্ত পর্যন্ত ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। সে যাই হোক, ভুলে হলেও চেয়রাম্যানের বাড়ীতে উঠে বাড়ীর করুণ অবস্থা দেখে সত্যিই মর্মাহত হলাম। বাড়ীর লোকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের কোন শীতবস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে পারলোনা। আমরা না খেয়েই কোন প্রকারে রাতটা কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল আহত ছানোয়ারকে নিয়ে। প্রায় ছ’সাত ঘন্টা হয়ে গেল, তাকে কোন ঔষধ দেয়া হয়নি এমকি কোন পথ্য দেয়া ও সম্ভব হয়নি। শুধু কাপড় ছিড়ে ক্ষতস্থানে বার বার ধাঁধা ছাড়া। কিন্তু রক্তক্ষরণ কিছুতেই বন্ধ হচ্ছেনা। শীতের রাত, অনবরত রক্তক্ষরণে ছানোয়ারের চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তাপও অনেক বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় কি করা যায়। শত কষ্টের মাঝেও বাড়ীর মহিলারা আহত মুক্তিযোদ্ধাটিকে শীত থেকে বাঁচাতে শতছিন্ন একটি লেপ সংগ্রহ করে দিয়েছিল। রাত দশটার দিকে কোনক্রমে একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার নিয়ে আসা হলো। তার কাছে একখানা সিরিঞ্জ ছিল। এ. টি. এস. এবং কমবাইয়োটিকস ইঞ্জেকশনও তিনি নিয়ে এসেছেন। ইঞ্জেকশন দিতে বলা হলে দেখা গেল ডাক্তার শুধু সিরিঞ্জ ধরে আছেন। তার থর থর করে হাত কাপছে। তিনি কিছুতেই এ. টি. এস. ইঞ্জেকশনের এ্যাম্পুল ভাঙছেন না বা ভাঙতে পারছেন না। চুপ করে আছেন কেন জিজ্ঞেস করলে, কাদো কাদো হয়ে ডাক্তার বললেন, ‘আমি স্যার, ইঞ্জেকশন দিতে জানিনা। আমার কাছে এই ঔষধগুলো ছিল। আমাকে ঔষধসহ দু’তিনজনে নিয়ে এসেছে। আমাকে আপনি রক্ষা করুন।’ ডাক্তার সত্য কথা বলেছেন। সেই সময় যুদ্ধে আহতদের প্রয়োজনীয় এ্যালোপ্যাথিক ঔষধ হোমিওপ্যাথিক ডাক্তাররাও রাখতেন। যদিও তার ব্যবহার গ্রামাঞ্চলের খুব কম হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারই জানতেন। ডাক্তারের কথা শুনে তার হাত থেকে সিরিঞ্জ এবং ঔষধ নিয়ে গরম পানিতে তাড়াতাড়ি সুই ও সিরিঞ্জ ধুয়ে ছানোয়ারের গায়ে গুলি লাগার প্রায় আট ঘন্টা পর প্রথম ইঞ্জেকশন দিলাম। এ সময় ঐ বাড়ীর এক খুবক কয়েকটা এ্যাসপ্রো ও নভালজিন ট্যাবলেট কোথা থেকে এনে দিল। দুটি নভালজিন ছানোয়ারকে দেয়া হলো। এরপর উষ্ণ গরম পানিতে ডেটল ঢেলে তুলা ভিজিয়ে কোন রকমে ক্ষতস্থান পরিস্কার করা হলো। ক্ষতস্থান তুলোতে ঢেকে ছেঁড়া কাপড় দিয়ে বাধা হলো। ছানোয়ারের গায়ে বেশ জ্বর এসেছিল। সে যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্ করে প্রলাপ বকছিল, ‘আমি আর বাঁচুমনা। আমি আর মা-বাবারে দেখতে পামু না। স্যার আমারে ফালাইয়া যাইয়েন না। মরলে কবর দিয়া যাইয়েন। আমরা তাকে নানাভাবে শান্তনা ও উৎসাহ দিলাম। ব্যাণ্ডেজ বাধার পর তাকে কমবাইয়োটিক্স ইঞ্জেকশন দেয়া হলো। এরপর প্রতি দুঘন্টা পর পর একটি করে কমবাইয়োটিক্স ইঞ্জেকশন দেয়া হতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৫

লাগলো। আহত ছানোয়ারকে এ. টি. এস. ও আধ ঘণ্টা পর কমবাইয়োটিক্স ইঞ্জেকশন দেয়ার পর আজাহার ও বজলুকে পাশে রেখে বাইরে এলাম। আমাদের সংখ্যা তখন একেবারে কম, তার মধ্যে আবার একজন গুরুতর আহত। সর্বদা সতর্ক থাকতে না পারলে যে কোন মূহুর্তে যে কোন দিক থেকে বিপদ ঘটতে পারে। বিপদ যেমন হানাদারদের দিক থেকে ঘটতে পারে, তেমনি মুক্তিবাহিনী এই বাড়ী পুড়িয়েছিল, বাড়ীর কর্তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল, সেই কারণেই বাড়ীর লোকজনদের দিক থেকেও আসতে পারে। তাই সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। তবে বাড়ীর লোক জনদের দিক থেকে আন্তরিক অচরণই পাওয়া গিয়েছিল, কোন বিপদ আসেনি। বাইরে এসে বাকী পাঁচ জনকে ডেকে খুব আস্তে আস্তে বললাম, ‘যত কষ্টই হোক, আমাদের পর্যায়ক্রমে দুইজনকে সর্বদা সতর্ক পাহারায় থাকতে হবে। একরাত না ঘুমুলে আমরা মরে যাবোনা। কাল সকালেই হয়ত আমাদের খাবার জুটবে। তোমরা একটা রাত কষ্ট করো। ছানোয়ারকে বাঁচানোই এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য। বাড়ীর কাছারি ঘরে থাকার একটা ব্যবস্থা করতে আবদুল্লাহ্ ও দুলালকে নিয়ে কাজে লেগে পড়লাম। পাঁচ জনের থাকার মত জায়গা জুড়ে মাটির উপর বিষত পুরু খড় বিছিয়ে তা অনেকক্ষণ পাড়িয়ে অনেকটা সমান করে নৌকার ছেঁড়া বাদাম বিছানো হলো, তার উপর আবার একখানা পুরানো চাদর। চাদরের উপর আবার এক-দেড় ফুট পুরু করে খড় বিছিয়ে পাড়িয়ে মসৃণ করে শোবার মত এক অভিনব শয্যা তৈরী হলো। শোবার প্রক্রিয়াটা হলো, আস্তে আস্তে বাদাম ও চাদরের মাঝখানে ঢুকে পড়া। দুজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে প্রায় চল্লিশ মিনিট পরিশ্রম করে খড়ের দুই পরতের মাঝে কোনরকমে একটি শীতের বিপর্যস্ত রাত কাটানোর ব্যবস্থা করা হলো। আমার পাহারা রাত দুটা থেকে। রাত দুটা পর্যন্ত পাহারায় থাকবে আজাহার ও মাসুদ। পাকুল্লার ফজলু আর বজলু থাকবে ছানোয়ারের শুশ্রূষায়। পরের পালায় আমি, দুলাল, হালিম ও আবদুল্লাহ। আমি, দুলাল ও হালিম প্রহরায় থাকবো, আবদুল্লাহ্ দেখবে ছানোয়ারকে।

যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা
সব ব্যবস্থা পাকা করে রাত সোয়া বারোটায় আমি, দুলাল হালিম ও আবদুল্লাহ কেবল খড়ের ভাজের মধ্যে নিজেদেরকে গলিয়ে দিয়েছি। মাসুদ ডেকে উঠল, ‘স্যার স্যার, একজন লোক আপনার সাথে কথা বলতে চান।’ প্রথম ডাকের জবাব দিয়ে খড়ের তৈরী লেপ- তোষকের স্তরের ফাঁক দিয়ে আস্তে আস্তে এমনভাবে বেরিয়ে এলাম, যাতে উপরের পরতের খড় ছড়িয়ে না যায়। কাছারি ঘরের একটু দক্ষিণে-পশ্চিমে গিয়ে দেখলাম, দুজন যুবককে সাথে নিয়ে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বৎসরের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে গেলেই যুগপৎ তারা সামরিক কায়দায় অভিবাদন করলো। জিজ্ঞেস করতেই মধ্যবয়সী ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি এই ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার। মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে খবর পেয়েছি মুক্তিযোদ্ধারা এদিকে এসেছেন। আমি তাই খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি। আপনি স্বয়ং আছেন, তা অবশ্য জানতামনা।’ কিছুটা সন্দিপ ও কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি যে স্বেচ্ছসেবক কমাণ্ডার তার কি কোন প্রমাণ আছে?’ ভদ্রলোক কোন উচ্চবাচ্য না করে তার লুঙ্গির কোচে গোঁজা একখানা ফুলস্কেপ কাগজ
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৬

বের করে আমার হাতে তুলে দিলেন। কাগজটি আর কিছু নয়, ইউনিয়ন স্বেচ্ছসেবক বাহিনীর তালিকা। তাতে কমাণ্ডার হিসাবে ভদ্রলোকের নাম পরিস্কারভাবে লিখা রয়েছে। তালিকাটিতে আমার ও আনোয়ার-উল-আলম শহীদের স্বাক্ষর আছে। স্বেচ্ছসেবক কমান্ডারের স্বাক্ষরও তালিকাটিতে রয়েছে। তাই যখন তাকে স্বাক্ষর করতে বললাম, তখন তিনি নির্দ্বিধায় তালিকার উল্টোপিঠে তিন-চার বার স্বাক্ষর করলেন। তার স্বাক্ষর তালিকার স্বাক্ষরের সাথে হুবহু মিলে গেল। এরপর আর আমার সন্দেহের কোন অবকাশ থাকলোনা। প্রায় আট-নয় ঘন্টা বিচ্ছিন্ন থাকার পর এই প্রথম সেচ্ছাসেবক কমাণ্ডারকে পেয়ে আমরা কিছুটা আশার আলোর ঝিলিক দেখতে পেলাম। স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডারকে বললাম, ‘আপনি যে ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার, এতে কোন সন্দেহ নেই। এখন বলুন, আপনি কি করতে পারেন?’ আমার কথায় স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার কিছুটা অবাক হলেও, দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘স্যার, যা বলবেন, তাই করতে পারবো।’ অনুরোধের সুরে স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডারকে বললাম, ‘দেখুন, আমাদের একজন আহত হয়েছে। তার জন্য তেমন কোন ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করতে পারিনি। আপনি যদি ঔষধপত্রের একটা ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে ভালো এবং আমাদের জন্য দুএকটা শীতবস্ত্র হলে বেঁচে যাই।’ স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার খুব উৎসাহের সাথে বললেন, ‘আমি এক্ষুনি ঔষধ এবং শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করছি।’ এই বলে এক পা এগিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
— স্যার, আপনারা কি খেয়েছেন।
— না ভাই, খাবারের কোন দারকার নেই। আপনি এই দুইটি কাজ করতে পারলেই যথেষ্ট।
– কেন স্যার, খাবার লাগবেনা? আমি ব্যবস্থা করছি। এই বলে চলে গিয়ে পনের মিনিটের মধ্যে তিন-চার জন স্বেচ্ছ সেবক নিয়ে বড় বড় তিনটি লেপ নিয়ে এলেন। লেপ এবং ঔষধপত্র দিয়ে স্বেচ্ছসেবক কমাণ্ডার উৎসুক্য নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— স্যার, আমার উপর কোন আদেশ।
— না ভাই, যথেষ্ট হয়েছে। সকাল হোক। তারপর দেখা যাবে।
— স্যার, হোগরার কোম্পানী কমাণ্ডার এখান থেকে দেড় মাইল পশ্চিমে আছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আরও দুতিনটি দল এদিক-ওদিক আছেন। যদিও তাদের সঠিক সংবাদ জানিনা, তবে চেষ্টা করলে রাতের মধ্যেই সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবো।
— যদি কোন অসুবিধা না হয়, ছত্রভঙ্গ মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদ এনে দিতে পারেন কিনা, একটু চেষ্টা করে দেখুন।
কমান্ডার ভদ্রলোক যারপর নাই দৃঢ়তার সাথে বললেন,
— স্যার, বলেন কি। কিসের কষ্ট। ছ’মাস হয় স্বেচ্ছাসেবক হয়েছি। এমন কোন কাজ নেই যা নির্দেশ পেলে করিনি। সব কাজ আপনার নামে করেছি। আজ সব দিকে স্বেচ্ছাসেবক পাঠাচ্ছি। ইনশাল্লাহ্ রাতেই সব খবর পেয়ে যাবো।
বাকী রাতটা জেগেই কাটিয়ে দিলাম। যদিও স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার দেখা করার পর আর
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৭

তেমন কোন উৎকণ্ঠা ছিল না। এই স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার যেন আল্লাহর আশীর্বাদ হিসেবে ১লা ডিসেম্বর রাতে হাজির হলেন। স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডারের সাথে দেখা হওয়ার পনের মিনিট পরে শীতবস্ত্র ও ঔষধ, চল্লিশ মিনিটে মধ্যে খাবার, দু”ঘন্টা পরই কমান্ডার সবুরের সংবাদ, রাত তিনটার হুগরার কোম্পানী কমান্ডারকে ডেকে আনা—এ সমস্ত কাজ যেন অলৌকিকভাবেই সুসম্পাদন করলেন। ভোর ৪টায় নিজে সবুরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন এবং সকালের খাবারের ব্যবস্থাও তিনিই করলেন। সকাল হতেই অবস্থা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এলো। তখনও শুধু আহত ছানোয়ারকে নিয় কিছুটা অসুবিধা রয়ে গেল। ওকে এখন কি করা যায়? ছানোয়ার খুবই সাহসী যোদ্ধা। জুনের সেই কামুটিায়ার যুদ্ধ থেকে শুরু করে ঢাকা-টাংগাইল সড়ক দখল, বাথুলী সম্মুখ যুদ্ধ, একদিন আগে নাগরপুর যুদ্ধ—এই সমস্ত যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে। যেকোন ভাবে হোক, ছানোয়ারকে সারিয়ে তোলা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
সকালেও ছানোয়ারের গায়ে একটি এ্যান্টিবায়োটিক্‌স ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে। ওর গায়ে তেমন জ্বর নেই। শরীরের ব্যথা-বেদনাও অনেক কমে এসেছে। সকালের রোদে বাড়ীর উঠোনে একটি চেয়ারে ওকে বসানো হলো। চোখ-মুখ ফ্যাকাশে, তবে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মাথা ও গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
— চেষ্টা করে দেখ তো দাড়াতে পারিস কিনা ?
একবার দাঁড়াতে চেষ্টা করেই বসে পড়লো,
— না স্যার, পারছিনা।
ছানোয়ারের অফুরন্ত মনোবল ও জেদী মানসিকতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম। তাই ওর দৃঢ় আস্থা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা নিলাম,
— ছানোয়ার, আমি একটা বিপদে পড়ছি। গতকাল থেকে ভাবছি, কথাটা তোকে বলি কি করে? তুই তো জানিস, যুদ্ধের কোন নিয়ম ভাঙা উচিত নয়।
— হ্যাঁ স্যার, আপনি তো কোন নিয়ম ভাঙতে পারেননা। আপনি নিয়ম ভাঙলে যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে !
— দেখ্‌ যুদ্ধে একটা নিয়ম আছে। গুরুতর আহতকে বয়ে নিতে না পারলে এবং তার শত্রুর হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবানা থাকলে, নিজেদেরই তাকে গুলি করে মেরে সৎকার করে যেতে হয়। কারণ আহত হয়ে শত্রুর হাতে ধরা পড়লে, শত্রুরা তার উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে সংগঠনের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করতে পারে। এখন তুই-ই বল্ আমি কি করি? আমার কথা শুনে ছানোয়ার চমকে উঠলো। সে যেন সামনে একটা ভয়ঙ্কর বিপদসঙ্কুল গভীর খাদ দেখতে পাচ্ছে, পেরোতে না পারলে নিশ্চিত মৃত্যু। মনে হলো খাদ পেরোনোর ক্ষমতা ও সামর্থ্য তার তখনও আছে।
— হ্যা স্যার, মিলিটারীদের হাতে ধরা পড়লে এর চেয়েও খারাপ হবে। আপনি আর কি করবেন? আমাকে এক ঘন্টা সময় দিন। যদি একটু একটু চলতে পারি, তাহলে আমাকে নিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৮

আপনাদের কোন অসুবিধা হবেনা।
ওর কথা শুনে ও অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো, আমার কথা ও পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে। ছানোয়ার আস্তে আস্তে দুই জনের কাধে হাত দিয়ে উঠে দাড়ালো, তারপর এক পা, দুপা করে পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে নিঃশেষিত শক্তির শেষ সঞ্চয়টুকু একত্রিত করে একাই একটা চক্কর দিল। আমি বুঝে নিলাম, ছানোয়ার মনোবল ফিরে পেয়েছে। ভাররা চেয়ারম্যানের বাড়ী থেকে কোনক্রমে যদি ওকে দেড় মাইল পশ্চিমে সরিয়ে নেয়া যায়, তাহলে আর কোন সমস্যাই থাকবে না। নৌকাপথে যেকোন দিক দিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। শাহাজানীর ‘শান্তি দলের’ (গোয়েন্দা বিভাগ) সিরাজ, শহীদ ও অন্য আরও দুজনকে দুরে ডেকে বললাম,
— যে ভাবেই হোক, ছানোয়ারকে শাহজানী পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। লক্ষ্য রাখবে ওর যাতে কোন কষ্ট না হয়। প্রয়োজনে ওকে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তরে পৌঁছে দেয়া তোমাদের প্রধান দায়িত্ব। আমি খবর রাখবো, এই কাজে যেন বিন্দুমাত্র অবহেলা না হয়। ছানোয়ার যদি কোন কারণে মরে যায়, তাহলে তোমাদের দায়ী করে ভবিষ্যতে অন্য দায়িত্বপূর্ণ কাজ থেকে বঞ্চিত করা হবে। শান্তিরা নিশ্চয়তা দিয়ে বললো,
— স্যার, যে করেই হোক, আমরা এর চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো এবং একেবারে পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তরে পৌঁছে দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই আপনার সামনে ইনশাল্লাহ্ হাজির হবো।
২রা ডিসেম্বর সকাল ন’টায় ছানোয়ারকে নিয়ে চারজন শান্তি ও দুজন স্বেচ্ছাসেবক আস্তে আস্তে গন্তব্যস্থলের দিকে চলে গেল।
এর মিনিট পনের পর আমরাও চেয়ারম্যানের বাড়ী থেকে চটপট বেরিয়ে পড়লাম। চেয়ারম্যানের বাড়ী থেকে ভাররা বাজার হয়ে এলাসিন ঘাটের দিকে এগিয়ে চলেছি। এলাসিনের মাইল দেড়েক পশ্চিমে থাকতেই হানাদারদের দেখতে পেলাম। হানাদাররা নাগরপুর থেকে টাংগাইল ফিরছে। সাথে নাগরপুরের অবরুদ্ধদের নিয়ে যাচ্ছে। কমান্ডার সবুর, আজাহার ও হালিম দূরবীন নিয়ে হানাদারদের গতিবিধি ভালোভাবে লক্ষ্য করে রিপোর্ট করে চলেছে। হানাদাররা সংখ্যায় কত, কয়জনকে কাধে নিয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে কতজন নিহত ও আহত হতে পারে। তিনজনে মিলে একের পর এক ধারা বিবরণীর মত রিপোর্ট দিয়ে চলেছে। তাদের রিপোর্ট, হানাদারদের সংখ্যা চারশ’র নীচে নয়, সাথে শতাধিক সাধারণ মানুষ এবং ছয়-সাতটি গরুর গাড়ী। চল্লিশ-পঞ্চাশ জনকে কাধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ধারণা, চল্লিশ-পঞ্চাশ জনের মধ্যে কম করে কুড়ি জন নিহত ও বাকীরা আহত।
আমাদেরকে প্রায় একঘন্টা ভাররা বাজারের দক্ষিণ-পূর্বে একটি গাছের নীচে অপেক্ষা করতে হলো। এ সময় দুইজন স্বেচ্ছাসেবক এসে খবর দিল। ঘাটপাড়ে ধানক্ষেতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার লাশ পড়ে আছে। খবর শুনে এলাকাটা তন্ন তন্ন করে খোঁজার ইচ্ছা হলো। হানাদাররা নদী পার হয়ে চলে গেলে সহযোদ্ধাদের নিয়ে নদীর পাড়ে যেখানে যেখানে গতকাল মুক্তিযোদ্ধারা
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৯

অবস্থান নিয়েছিল, সেই বিস্তীর্ণ এলাকার ধান ক্ষেতগুলি খোঁজা শুরু করলাম৷ অনেক খোঁজা- খুঁজির পর একটি অস্ত্রসহ দুজন মুক্তিযোদ্ধা লাশ পাওয়া গেল। পাশের গ্রামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বললেন, ‘এদের দুজনে একজন সকাল পর্যন্ত জীবিত ছিল। হানাদাররা ঘাটপাড়ে ঘাঁটি গেড়ে থাকায় গ্রামের লোকেরা তাকে তুলে আনতে পারেননি। সকালে হানাদাররা আহত মুক্তিযোদ্ধাটির কাতরানি শুনে বেয়োনেট দিয়ে তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। গ্রামবাসীদের কথাই হয়তো ঠিক। কারণ একজনের পাশে পড়ে থাকা রক্ত তখন পর্যন্ত চাপ ধরেনি। এক বুক বেদনা নিয়ে দুজন শহীদ যোদ্ধার লাশ সহ দুপুর বারোটায় কেদারপুর পৌঁছলাম। আমাকে দেখে আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, গণ-পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী সহ সবাই যেমন আনন্দে উদ্বেলিত, তেমনি দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ দেখে ব্যথিত হলেন। দুজন শহীদ যোদ্ধাকে আমাদের তৈরী ষ্ট্যাম্পে কেদারপুর জুম্মা ঘরের সামনে ছ’ ডেসিমেল জায়গা কিনে পূর্ণ ধর্মীয় মর্যাদায় ও সামরিক কায়দায় দাফন করা হলো।
তিনদিন পর আবার কেদারপুরের শিবিরে এসেছি। গণ-পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, ডা: শাহজাদা চৌধুরী ও নুরুন্নবী সহ সবাই আমাকে ঘিরে বসলেন। কর্ণেল ফজলুও তখন সেখানে। কর্নেল বললেন,
— স্যার, আপনার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে। যা আমি কারো সামনে বলতে চাইনা। কর্নেল সাহেবের কথা শুনে সবাই উঠে যাচ্ছিলেন। সবাইকে বসিয়ে কর্নেলকে নিয়ে বাইরে গেলাম। কর্নেল সাহেব আগের দিনের ঘটনা খুলে বলে শেষে বললেন,
— স্যার, আমি অন্যায় করে ফেলেছি। শহীদ স্যারসহ সবাইর কান্নাকাটি দেখে আমি আমার সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় আপনার সম্পর্কে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছি।
— আপনি ঠিক কাজই করেছেন। এ জন্য আপনি প্রশংসা পাবার যোগ্য। কেদারপুরে ঐ বিশেষ রাতে আরও কিছু ঘটনা ঘটেছিল। কর্ণেল ফজলুর প্রচণ্ড ধাতানির চোটে ক্যাপ্টেন ফজলু কেদারপুর পৌঁছে প্রথম অবস্থায়, শিখিয়ে দেয়া কথামতোই রিপোর্ট করেছিল। কিন্তু নিজেও যে আমার সম্পর্কে কিছুই জানেনা, তা রাত বারোটার মধ্যে প্রকাশ পেয়ে যায়। ফজলু আমাকে খুব ভালবাসে। এছাড়া সে আমার নিত্য সহচর দলের কমাণ্ডার। একদিকে বয়স কম, তদুপরি তার দায়িত্ব কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে অন্ততঃ সেই মুহূর্তে পালন করতে না পেরে সোজা কেদারপুর এসে কর্নেলের চোখ রাঙানীতে অনিচ্ছাকৃতভাবে, অবলীলাক্রমে তাকে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছিল। বিবেকের দংশনে সে ক্ষত বিক্ষত যন্ত্রণায় জর্জরিত। ফলে আসার পর থেকে সে আদৌ সুস্থ ও স্বাভাবিক নয়। তার চোখ রক্ত জবার মত লাল, শূন্য দৃষ্টি, চোখ দুটি অশ্রুতে ছল ছল করছে, উস্কো চুল, উদভ্রান্ত মুখাবয়ব দেখে কেদারপুরের অনেকেই আন্দাজ করে নেন, ফজলু কিছু একটা লুকাচ্ছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও কিছুতেই সে স্বাভাবিক হতে পারছিলনা। রাতের খাবার দেয়া হলে, ভাল লাগছেনা বলে না খেয়েই উঠে যায় ৷
কর্নেল উপস্থিত থাকায় ফজলু যেমন মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছিলনা, তেমনি অন্যরাও
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪০

কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছিলেননা। রাত বারোটায় ফজলু নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা, সে ফারুকের কাছে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে, ‘ফারুক ভাই, সত্যিকারে আমি স্যারের কোন খবর জানিনা। কর্নেল সাহেবের ধমকে যা বলেছি, সব মিথ্যে। স্যার আমার থেকে প্রায় একশ গজ উত্তরে ছিলেন। তাকে আমি শুধু উত্তর দিকে চলে যেতে দেখেছি। আমি কোনরকমে দক্ষিণে পালিয়ে এসেছি। ফজলুর কথা শুনে ফারুক দৌড়ে গণ-পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘লতিফ ভাই, সব মিথ্যে। ফজলু স্যারের কথা কিছুই জানেনা। কর্নেল সাহেব একটু সময়ের জন্য কেদারপুর ঘাটে গিয়েছিলেন। তাঁরও প্রচন্ড উৎকণ্ঠা ছিল। তিনি নিজেও অত্যস্ত আন্তরিকভাবে আমার খবর সংগ্রহের চেষ্টায় ছিলেন। তবে অতীতে সমস্ত রকম বিপর্যয়ে যেভাবে মোকাবেলা করতে দেখেছেন, সেই অভিজ্ঞতা ও সাহস থেকেই তিনি শহীদ সাহেবদের দৃঢ়তার সাথে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছিলেন। ক্যাপ্টেন ফজলুর স্বীকারোক্তির পর কেদারপুর শিবির আবার স্বজনহারা কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই সময় কর্নেল কেদারপুর ঘাট থেকে ফিরে নিদারুণ অসহায় কান্নাকাটি দেখে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সুরে সবাইকে বললেন, ‘আপনাদের কি বলবো? আমার মত একজন দায়িত্বশীল কমান্ডারের কথা বিশ্বাস করতে পারেননা, অথচ এক হারামজাদা রবিউল আর এই চ্যাংড়া ফজলু, যার নাক টিপলে এখনও দুধ পড়বে, এদের বিভ্রান্তিকর কথাই আপনারা বিশ্বাস করছেন। ভাবলে আমার লজ্জা হয়, দুঃখও হয়। আমি এলাম একটা ভাল সংবাদ দিতে। এদিকে আপনারা কাঁদছেন। আপনাদের সংবাদ দিয়ে কি লাভ। আপনাদের মন যতো চায় কেঁদে নিন। আমি চললাম। স্যার আসলেই এর একটা বিহিত করবো।’ কর্নেল ফজলুল রহমান আবার কেদারপুরের ঘাটে চলে গেলেন। বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও নতুন সুসংবাদের শব্দও প্রকাশ করলেন না।
সতিকার অর্থেই সেইদিন সামরিকভাবে হলেও কেদারপুর শিবিরের নেতৃস্থানীয়রা বিচার-বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। প্রথম রবিউলের নিদারুণ দুঃসংবাদ কেদারপুরের সবাইকে শোকাহত করেছিল। তারপর কর্নেল ফজলু এসে আশার ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে অবস্থা কিছুটা সামাল দিলেও ক্যাপ্টেন ফজলু যখন মিথ্যে বলাটা সবার কাছে স্বীকার করলো, তখন তাদের মানসিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটলো। অবস্থাটা এমন যে যখন যা বলছে, তাই মন্ত্রমুগ্ধের মত সবাই শুনেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন, পরক্ষণেই তাদের মনে হয়েছে, না এটা হতে পারেনা। আমার বিপদের আশঙ্কায় তারা যেমন আশঙ্কিত, তেমনি বিপদ মুক্তির কথা শুনতেও আগ্রহী। পর পর তিনজনের বিপরীত ভাষ্য। বিভ্রান্তির পর মহাবিভ্রান্তি, অন্ধকার থেকে তারা ক্রমশঃ খেই হারিয়ে ফেলেন। সত্যিকার অবস্থা সম্পর্কে সঠিক কোন সংবাদ না পেয়ে সব কিছু তালগোল ও জট পাকিয়ে ফেললেন। তারা আর কারো কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছিলেননা। মনের এই দুঃসহ দোটানার মাঝে রাতটা কাটলো। সকালেও কোন সঠিক সংবাদ সংগ্রহ করতে পারলেননা। সকালে কর্নেল ফজলু, বিখ্যাত ‘সিগন্যালম্যান ব্যারিষ্টার বাচ্চু, লাউহাটির ফজলু ও
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪১

বাশাইল-শুন্নার রঙ্গিলাকে ছয়-সাতজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে এলাসিনে পাঠালেন সর্বশেষ খবর সংগ্রহ করতে। তিনি নিজে কেদারপুর থেকে আড়াই-তিন মাইল এলাসিনের দিকে এগিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
কর্নেল ফজলুর দূতরা যখন এলাসিন ঘাটের দক্ষিণ-পূর্বে বসে হানাদারদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল, তখন আমরা এলাসিন ঘাটের এক দেড় মাইল উত্তরে বসে অনুরূপভাবে গতিবিধি দেখছিলাম। হানাদাররা চলে গেলে এলাসিন ঘাটে আসার মিনিট দুই পর দক্ষিণ দিক থেকে ঊর্ধশ্বাসে বাচ্চুকে ছুটে আসতে দেখলাম। বাচ্চু সহ কর্নেল ফজলুর দলের অন্যান্যরা আমাকে দেখে খুশীতে নাচতে লাগলো। তারা নিজেরাও গত রাতের দুঃসহ যন্ত্রণার শিকার। মহা বিভ্রান্তির ঘন অন্ধকার অবসানে স্বাভাবতঃই তারা শিশিরে সূর্যের আলোর মত আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তখনও এদের এত আনন্দ-উল্লাসের কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলামনা। কিছুটা অবাক হয়ে বাচ্চুকে জিজ্ঞেস করলাম,
— তুই কোথা থেকে এলি? তোর তো এখানে আসার কথা ছিল না। প্রধান ‘সিগন্যাল- ম্যান’ ব্যারিষ্টার বাচ্চু ঘটনার আদ্যোপান্ত খুলে বললো,
— স্যার, আপনি যখন নাগরপুরে চলে যান, তার একটু পরেই হেড কোয়ার্টার থেকে কেদারপুরে আসি। আপনার সাথে আমার দেখা হওয়া দরকার। তাই কেদারপুরে অপেক্ষা করছিলাম। গতকাল বিকেলে রবিউল গিয়ে আপনার সম্পর্কে দুঃসংবাদ দেয়ার পর সে যে কি কান্ড ঘটেছে, না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেননা।
— ঠিক আছে, তোমরা এক্ষুনি কেদারপুরে চলে যাও। আমি ওখানে গিয়েই যা ঘটেছে, তা জানবো। আর শোন, কেদারপুরে ভাল দেখে দুজনের কবরের জায়গা দেখতে বল।
বাচ্চু ব্যারিষ্টার লোকজনসহ দারুণ সুসংবাদ নিয়ে শত মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার মত কেদারপুরের দিকে ছুটলো। মাইল খানেক এগুবার পর কর্নেল সাহেবের সাথে তাদের দেখা হয়ে গেল। আমি দুঘন্টার মধ্যে কেদারপুরে ফিরছি, এই খবর পেয়ে সবাইকে অনেক পিছনে ফেলে আকাশ-বাতাস ধরণী কাপিয়ে কর্নেল কেদারপুর শিবিরে উপস্থিত হলেন। তাঁর তখন হাঁটা-চলা, কথাবার্তা, ভাব-ভঙ্গি সবই আলাদা। উন্নত শির, স্ফীত বুক, চোখে গৌরবের জ্যোতি, ঘন কালো গোঁফের ফাঁকে সবজান্তা হাসির উজ্জ্বল চিকনাই। দুর্লঙ্ঘ্য পর্বত ডিঙিয়ে শক্তিশালী শত্রুর বিষদাত ভেঙে বিশাল রাজ্যজয়ের বিজয়ী সেনাপতির ঢঙে নিজস্ব চিরাচরিত স্বাভাবিক চালের সুন্দর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কচমচ করে বীরদর্পে শিবিরের এদিক- ওদিক ঘুরছেন। হাতের বেত উচিয়ে একে-ওকে হাঁক-ডাক করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন, চতুর্দিকে নেতৃস্থানীয় ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের উপর ‘চুপচাপ মজা দেখ’ এমন ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনী বুলিয়ে নিচ্ছেন। এক সময় কেদারপুর স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার সামাদকে ডেকে গলায় যথাসম্ভব গমগমে ভরাট ভাব এনে বললেন, ‘দেখ, কোথাও দুটা কবরের জন্য ভাল জায়গা বের কর।’ কিসের কবর, কার কবর, কেন কবর, তার কিছুই বলছেন না। শুধু বিজয়গর্বে এদিক-ওদিক
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪২

পায়চারী করছেন, আর প্রয়োজনীয় কাজের তদারকি করছেন।কর্নেল সাহেব কাউকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছেন না, কারোর সাথে কোন আলোচনা করছেননা, যা করার একাই করছেন, তাঁর উপরও যে কেদারপুর শিবিরে কোন কমান্ডার বা কর্মকর্তা আছে, তা তার হাবভাব দেখে মোটেই মনে হচ্ছিলনা। অবশেষে, অবরুদ্ধ কৌতূহল দমন করতে না পেরে শহীদ সাহেব কোন খবর আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই কর্নেল সাহেব বললেন,
— না, স্যার, আপনাদের সাথে কথা বলে লাভ নেই। আপনারা তো আমার কথা বিশ্বাস করতে চাননা। স্যার আসুক, তাকেই বলবো।
শহীদ সাহেবের পর একে একে লতিফ সিদ্দিকী, নুরুন্নবী, ডাঃ শাহাজাদা চৌধুরী, ফারুক, নুরু, এমনকি ক্যাপ্টেন ফজলুল হকও বার বার কর্নেল সাহেবের কাছে তাঁর রহস্যময় হাবভাবের প্রেক্ষিত কিছু জানতে চাইলে একই উত্তর, ‘না, আমি কিছু বলতে চাইনা। ‘ ভাবখানা এই যে, এতক্ষণ এত করে বলার পরও তার কথা বিশ্বাস করা হয়নি। এখন তাঁর কাছে সঠিক সংবাদ থাকা সত্ত্বেও তিনি আর ঐ ব্যাপারে ‘টু’ শব্দটি করতে নারাজ। তিনি যেন অভিমান করে সবার সীমাহীন দুঃসহ কৌতূহল জাগিয়ে পূর্বের অবিশ্বাসের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে চান। এমনি অবস্থাতে দুপুর বারোটার পর কেদারপুরে এসে পৌঁছলাম। সদর দপ্তরের দূত বাচ্চু ব্যারিষ্টারের মত কদ্দুস নগর থেকে বিশেষ দূত বাদশাহ মিঞাও কেদারপুরে অপেক্ষা করছিল। সে খবর নিয়ে এসেছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অফিসার কদ্দুস নগরে এসেছেন। বাদশাহর কাছে থেকে কদ্দুস নগরের সমস্ত সংবাদ জেনে তখনই নূরুন্নবীকে বাদশাহর সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম। নুরুন্নবীকে নির্দেশ দেয়া হলো, ভারতীয় অফিসারটির সাথে আলাপ-আলোচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে একটি লিখিত রিপোর্ট তৈরী করে পাঠিয়ে দিতে এবং আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত তার সব রকমের নিরাপত্তা ও আতিথেয়তার ব্যবস্থা করতে। নুরুন্নবী ও বাদশাহকে বিদায় জানিয়ে দু’টি বকেয়া কাজে হাত দিলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৩

পন্নীদের বিচার : আকালুর অকাল

২০শে নভেম্বর। পাক বাহিনীর প্রথম সারির দালাল করটিয়ার জমিদার খসরু খান পন্নী, তার দুই ছেলে – সেলিম খান ও বাবলু খান পন্নীকে কোমরে দড়ি বেঁধে এলাচীপুর আনা হয়েছিল। তাদের বিচার স্থগিত রয়েছে। ইতিমধ্যে পন্নীদের নিয়ে ছোট-খাটো দু’একটা পরস্পর বিরোধী ঘটনাও ঘটে গেছে। কোন কোন মুক্তিযোদ্ধা পন্নীদের বিন্দুমাত্র মর্যাদা দিতে চায়নি। আবার দু’চার জন আছে যারা হাজার হলেও তো জমিদার, এই সংস্কারে একটু বেশী সুযোগ সুবিধা দেবার চেষ্টা করেছে। গরীবের রক্তশোষক জমিদাররাও তাদের অহংকারী ঠাট-ঠমক বজায় রাখার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছে। অনেকটা শরৎচন্দ্রের নতুন দার হারানো পাম্পসু খোঁজার মত। কোমরে দড়ি বাঁধার সময় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের খুব অনুনয় বিনয় করেছিল, কোমরে দড়ি বাঁধলে নাকি মান- সম্মান থাকবেনা। এলাচীপুরে তাদেরকে যখন একটি বাড়ীতে রাখা হয়, তখনও সাধারণ মানুষের রক্তের পয়সায় কেনা দূগ্ধ- ধবল-ফেননিভ মোলায়েম গদীর মখমলের বিছনায় অভ্যস্ত জমিদাররা সাধারণ শক্ত বিছানায় শুতে পারবেন না। গরীব প্রজাদের পিঠে চড়ে তাদেরই পিঠে চাবুক মেরে যারা বেড়ে উঠেছে, তাদের শক্ত সাধারণ মানের কাঠের বেঞ্চিতে বসলে ইজ্জত যাবে, দরিদ্র জনগনের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে যারা পোলাও-কোরমায় অভ্যস্ত, গ্রামের সাধারণ খাবারে তাদের পেট জ্বালা করবে। প্রথম প্রথম এমনি নানা ধরনের অনুযোগ করার পর যখন তারা বুঝলো যে, তাদের কোন বিশেষ মর্যাদা দেয়া হবেনা, তখন তাদের শক্ত বিছানা, গ্রামের খাবার, বেঞ্চে বসা, কোন কিছুতেই আর অসুবিধা হয়নি। এলাচীপুর ও লাউহাটিতে রাখার সময়ে লাউহাটির চেয়ারম্যান ও স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার কামাল খাঁ পন্নীদের সাথে অপ্রয়োজনে বার কয়েক দেখা করেছ। কর্নেল ফজলুর রহমানের কাছে কামাল খাঁ একটি লোভনীয় প্রস্তাবও দিয়েছিল। প্রস্তাবটি হলো, দুই-তিন লক্ষ টাকা অর্থদন্ড করে তাদেরকে ছেড়ে দিলে তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। এই সমস্ত কোন ঘটনাই আমার অজানা ছিলনা। তাই অবিলম্বে পন্নীদের ব্যাপারটা সেরে ফেলতে চাই। এই ধরনের জঘন্য প্রকৃতির লোকদের সংস্পর্শে মুক্তিযোদ্ধোরা যত কম আসে ততই মঙ্গল।
২রা ডিসেম্বর দুপুরে কেদারপুর বাজারের পাশে খালের ধারে দুটি বিচার অনুষ্ঠিত হলো। প্রথমটি বিচার নয়, শুধুমাত্র শুনানী।
ধৈর্য্য ধরে রবিউলের সমস্ত কথা শুনে সকলকে বললাম,
‘যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসলে একজন কমান্ডারকে যতটা দায়ী করা উচিত, এই ক্ষেত্রে কমান্ডার রবিউলকে তার চাইতেও বেশী দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে। কারণ রবিউল শুধু পালিয়েই আসেনি। তার ভীরুতার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে,
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৪

এমনকি দুজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদৎ বরণ করেছে। তাই আমি মনে করি, ক্যাপ্টেন রবিউলের ব্যাপারে আরো খুঁটিয়ে দেখে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে বিচার করা উচিত। এজন্য তাকে সদর দপ্তরে সাময়িকভাবে অন্তরীণ করে রাখাই উপযুক্ত মনে করছি এবং একটি ট্রাইবুনাল গঠন করে তাদের হাতে বিচারের ভার ছেড়ে দেওয়া উচিত।’
কমাণ্ডার রবিউলকে সরিয়ে নিলে রাজাকার বানানোর হোতা পাক-হানাদারদের দালাল ও তার দুই ছেলেকে কোমরে দড়ি বেঁধে হাজির করা হলো। করটিয়ার জঘন্যতম বদমেজাজী জমিদার খসরু খান পন্নী ও তার দুই ছেলে সেলিম খান, বাবুল খান পন্নীদের প্রথা অনুযায়ী বাধন খুলে দেয়া হলো। প্রথমে খসরু খান পন্নীর ছোট ছেলে বাবুল খান পন্নীকে জিজ্ঞেস করা হলো,
— তোমার কিছু বলার আছে ?
— আমাকে কি কারণে ধরে আনা হয়েছে জানিনা। বাবা এবং ভাই বর্তমান সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকলেও আমি সক্রিয় নই। আমার আর কিছু বলার নেই।
এ সময় খসরু খান পন্নী বসার জন্য একটি চেয়ার চাইলে তাকে জানিয়ে দেয়া হলো, কোন অভিযুক্তকে বিচারের সময় চেয়ার দেয়া হয় না এবং কোন অভিযুক্তকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেনা। গাদি গাদি টাকা আছে বলে তোমাদের জন্য এই রীতির কোন হেরফের হবে না।
এরপর সেলিম খান পন্নীকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘গ্রেফতার করে আনার ব্যাপারে তোমার কিছু বলার আছে ?’
সে বিন্দুমাত্র আত্মপক্ষ সমর্থন না করে বললো,
— আমরা রাজাকার বাহিনী গঠন করেছি। আমরা বুঝতে পারছি অন্যায় হয়ে গেছে। আপনারা আমাদের অর্থদণ্ড করে অন্ততঃ একবার সুযোগ দিন। আমরা আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলছি, এরপর সর্বস্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করবো।
পর্যায়ক্রমে খসরু খান পন্নীকে তার কিছু বলার আছে কিনা জিজ্ঞাস করলাম। খসরু খান পন্নীও সব কিছু অকপটে স্বীকার করে বললো,
— আমাদের ভুল স্বীকার করছি। (একেবারে গলে গিয়ে) বাবা, আপনারা আমাদের অর্থদণ্ড করে মাফ করুন।
তোমাদের অর্থদণ্ড করা হলে তা কত হতে পারে বলে মনে কর?
আমার কথা শুনে খসরু খান পন্নী যেন কিছুটা ভরসা পেলো। সে বেশ বিগলিত ও উৎসাহিত গলায় বললো,
আমাদের আগের অবস্থা নেই। বাড়ীতে কোন টাকা-পয়সা নেই। অর্থদণ্ড করা হলে বাড়ীর বউদের গহনা ও বগুড়ার যে জমি আছে তা বিক্রি করে শোধ করতে হবে। সাহেব, আপনিই ভেবেচিন্তে শাস্তি বিধান করুন।
খসরু খান পন্নীকে ব্যঙ্গ করে বললাম,
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৫

না, সাহেব অর্থদণ্ডের পরিমাণ নিরূপন করবেন না। তোমাকেই তিনি পরিমাণটা বলতে বলেছেন।
খসরু খান পন্নী কয়েক বার হাত কচলে বললো,
– দুই লাখ হলে……… আমরা কোনক্রমে শোধ করতে পারবো। তিন লাখ টাকা…… দিতে কষ্ট হবে। আপনি দয়া করে এর মধ্যে একটা সাব্যস্ত করে দিন।
খুব বিরক্ত হয়ে সাংঘাতিক রুঢ়ভাবে বললাম,
আমি খুব ভাল করেই জানি, তোমাদের বিন্দুমাত্র লজ্জা-শরম নেই। তুমি যদি আমাকে তোমার জমিদারীর প্রজা ভেবে থাক, তাহলে ভুল করছ। আমি তোমাদের মত লোকের মোসাহেব নই। তুমি কামাল খাঁকে দিয়ে কর্নেল ফজলুকে দুই লক্ষ টাকা পাইয়ে দেবার লোভ দেখিয়েছ। এমনিতেই রাজাকার বানানোর জন্য তোমার হাড়-মাংস কুত্তা দিয়ে খাওয়ানো উচিত। তার উপর আবার মুক্তিবাহিনীকে অর্থের লোভ দেখাচ্ছ? নিশ্চয়ই অর্থদণ্ড হবে, তবে তোমাদের ইচ্ছামত নয়।
এ কথা শুনে খসরু খান পন্নী কেঁদে ভেঙে পড়ে হাত জোর করে বললো,
— বাবা, আমার অন্যায় হয়ে গেছে, আমাকে ক্ষমা করেন। এর চেয়ে বেশী জরিমানা আমরা দিতে পারবোনা।
— শুধু অর্থদণ্ড নয়, বেত্রাঘাতও করা হবে। আমরা খুব ভাল করে জানি, অর্থশালীদের শুধু অর্থদণ্ড তাদের গায়ে-পায়ে বাজেনা। তোমাকে এবং তোমার বড় ছেলেকে মুক্তিবাহিনী গুলী করে মারতো। তবে আর একবার অপরাধ গুলো করার জন্য বেত্রাঘাত ও অর্থদণ্ড করে ভবিষ্যতের টোপ রেখে দিচ্ছে। আরেক বার আগের অপরাধগুলোর একটা করলেই মুক্তিবাহিনী তোমাদের পরপারে পাঠিয়ে দেবে।
খসরু খানের বাকশক্তি রহিত, একেবারে থ মেরে গেল। চোখ মুখ ফ্যাকাসে। তাকে দেখে মনে হবে একটা মৃতদেহকে দড়িতে বেঁধে রাখা হয়েছে।
‘আসামীদের মধ্যে দু’জন খসরু ও সেলিম খান পন্নী হানাদারদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এরা দুজনে মিলে টাংগাইলের চার ভাগের এক ভাগ রাজাকার বানিয়েছে। দুজনকে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে এবারের মত বেত্রাঘাত ও অর্থদণ্ড করা হলো। বাবুল খান পন্নী হানাদার দের সাথে সক্রিয় না থাকায় তাকে মুক্তি দেয়া হলো। খসরু খান ও সেলিম খান পন্নীর একশ এক টাকা করে দুই জনের দুইশ’ দুই টাকা জরিমানা ও প্রত্যেককে পাঁচটি করে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেয়া হলো। খসরু খান পন্নীর বয়স যেহেতু ষাটের উর্ধ্বে সেইহেতু তাকে মৃদুভাবে বেত্রাঘাত করা হবে। বেত্রাঘাত শেষে এরা পায়ে হেঁটে পাকা সড়ক পর্যন্ত যাবে। কোন যানবাহন ব্যবহার করতে পারবেনা।’ বিচার শেষে কামাল খাঁ নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য আমাকে অনেক ভাবে বললেন,
— স্যার, আমি অমন ভাবে বলি নাই। আমাকে পন্নী সাহেব বলেছিলেন তাই আমি
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৬

কর্ণেল সাহেবকে বলেছিলাম, এদের অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করে ছেড়ে দেয়া যায় কিনা।
— বুঝতে পেরেছি, আপনি ধনী মানুষ। জমিদাররা আপনার মত ধনী। আর এক সময় তো আপনারা ওদের প্রজা ছিলেন। তাই মনিবের নুনের গুণ ভুলতে পারেননি। এতে আর আপনার দোষ কি?
বিচার শেষে পন্নীদের বিদায় করে দেয়া হলো। এখানেও কামাল খাঁ নিজের শ্রেণী স্বার্থে নিয়ম বহির্ভূত কাজ করেন। কেদারপুর থেকে রাস্তার দূরত্ব বারো মাইল। এতটা রাস্তা হেঁটে যেতে সত্যিই খসরু খান পন্নীর খুব কষ্ট হচ্ছিল। পন্নীরা যখন কেদারপুর থেকে চার-সাড়ে চার মাইল অতিক্রম করেছেন, তখন অন্য পথে কামাল খাঁ ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে তাতে জমিদারদের তুলে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। তার ধারণা ছিল, অতো দূরে মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো আর লক্ষ্য করবেনা। কিন্তু দুটি গাড়ি যখন বাসাইলের কাছে পৌঁছে, তখন একদল মুক্তিযোদ্ধা গাড়ির গতি রোধ করে। অপরিচিত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গাড়ির গতি রোধ করায় কামাল খাঁ নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন,
— দয়া করে গাড়ি ছেড়ে দিন। এরা আমার আত্মীয়। আমার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। কামাল খাঁর অনুরোধ মুক্তিযোদ্ধারা শোনেনি। গাড়ি থেকে পন্নীদের নামিয়ে নেয়। তাদের এক কথা, ‘আপনাদের আবার কেদারপুরে যেতে হবে।’ পন্নীরা ঘোড়ার গাড়িতে যেতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধারা তাতেও আপত্তি তোলে। বাধ্য হয়ে পন্নীদের আবার প্রায় ছমাইল পায়ে হেঁটে সন্ধ্যায় কেদারপুর ফিরে যেতে হয়। পন্নীদের দেখে হাসতে হাসতে বললাম, ‘চোর বাটপাড়দের এমনি হয়। তবে নির্দোষ বাবুল খান পন্নীকে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরিয়ে এনে ঠিক কাজ করেনি। বাবুল খান পন্নী ইচ্ছে করলে এখান থেকে যে কোনও ভাবে যেতে পারেন। কিন্তু বাকী দু’জনকে অবশ্যই পায়ে হেঁটে পাকা সড়ক পর্যন্ত যেতে হবে। আর একবার ছলের আশ্রয় নিলে গুলি করা হবে। শওকত আলী ব্যারিষ্টারের চাচাতো ভাই লাউহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল খাঁকে কঠোরভাবে বলা হলো, ‘স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে যথেষ্ট অবদান থাকলেও আপনার অতীত কার্য- কলাপ খুব প্রশংসনীয় নয়। আপনি আবার এই ধরণের অসৎ পন্থা অবলম্বন করলে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ না দিয়েই গুলি করা হবে।’
কামাল খাঁ ভয়ে কাপতে থাকে। তাকে যে এইবারই গুলি করা হলোনা, এই পরম সৌভাগ্য। কামাল খাঁ এরপর আর তেমন ছলাকলা করেনি। পন্নীরাও পায়ে হেঁটে ঢাকা-টাংগাইল পাকা সড়ক পর্যন্ত যায়।
আনোয়ার-উল-আলম শহীদসহ গণ-পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী পরদিন সকালে সদর দপ্তরের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। শহীদ সাহেবের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হলো সফল সিগন্যালম্যান বাচ্চু ব্যারিষ্টারকে। পাকা সড়কের পশ্চিম পাড় পর্যন্ত শহীদ সাহেবের দলের নিরাপত্তার দায়িত্ব কর্ণেল ফজলুর রহমানের হাতে দেয়া হলো।
কর্ণেল ফজলুকে পুনঃ পুনঃ প্রশংসা করে টাংগাইল-করটিয়া রাস্তার কাছাকাছি অবস্থান
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৭

নিয়ে করটিয়া ও টাংগাইলের উপর চাপ সৃষ্টির নির্দেশ দিয়ে ৩ তারিখ সকালে আলো ফুটে উঠতে না উঠতেই কুদ্দুস নগরের দিকে যাত্রা করলাম।
কেদারপুর থেকে সিলিমপুর হয়ে চাড়াবাড়ী-পোড়াবাড়ীর রাস্তা ধরে কুদ্দুস নগর যাবো। সকাল ন’টায় যখন এলাসিনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ক্যাপ্টেন সবুর প্রস্তাব দিল যে, আমাদের কাছে যে উদ্বৃত্ত বিস্ফোরক আছে তা দিয়ে যাবার পথে এলাসিনের পাকা সেতু উড়িয়ে দিলে কেমন হয়? নাগরপুর মুক্ত রাখার জন্য নাগরপুর টাংগাইল রাস্তা অকেজো করে রাখা একান্ত প্রয়োজন। সেই বিচারে এলাসিনের সেতু ধ্বংসে আমার আপত্তি নেই। সকাল দশটায় এলাসিনের সেতু ধ্বংস করা হলো। এই সেতু ধ্বংস করতে মুক্তিযোদ্ধারা তেমন আনন্দ পাচ্ছিলনা। কারণ সেতু দখল ও ধ্বংস করার জন্য তাদের যুদ্ধ করতে হলোনা। যুদ্ধের উত্তেজনা অনুভব করলোনা, প্রতিপক্ষের কঠিন বাধা চুরমার করে কষ্টার্জিত জয়ের মধুর স্বাদ পেলোনা। শত্রু পক্ষের বাধার প্রাচীরের সবচেয়ে কঠিন অংশে আমি আঘাত হানবো। এই প্রতিযোগিতার লড়াইয়ে কেউ নামতে পারলোনা, নিদেনপক্ষে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু করেই রাজাকাররা যেমন প্রাণভয়ে উর্ধ্বশ্বাসে পালায়, তেমন কোন ঘটনাও ঘটলোনা। আশে পাশে কোন শত্রুর চিহ্ন নেই। নিরাপদে খালি মাঠে গোল দেয়ার মত পুল ভাঙতে আনন্দ না হবারই কথা। এলাসিন সেতু ধ্বংসের পর টাংগাইলের রাস্তা ধরে সোজা সুলতান হাজির বাড়িতে উঠলাম। সুলতান হাজী একজন কোটি পতি লোক। পাক-হানাদারদের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েনি বটে তবে সে স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকও নয়। এটা তার বহু কর্মকাণ্ড থেকে বার বার প্রমাণিত হয়েছে। তাঁকে বাড়ীতে পাওয়া গেল না। গ্রামের মধ্যে জমিদারী ঢঙে বিরাট বাড়ী। ঘরের ভেতরে চোখ ধাধানো আসবাবপত্রে শান শওকতের ছাপ। এই বাড়ীতেই খাবার ব্যবস্থা করা হলো। চার-পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি গেলাম আটিয়ায় হজরত শাহানশাহের মাজার শরীফে। টাংগাইলের লক্ষ লক্ষ লোক অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে প্রতি বছর আটিয়ার মাজার জিয়ারত করেন। আমিও জিয়ারত করে সুলতান হাজির বাড়ীতে খাবার খেয়ে ভর দুপুরে আবার পশ্চিম-উত্তরে বেরিয়ে পড়লাম।
সন্ধ্যার একটু আগে চাড়াবাড়ী-পোড়াবাড়ীর এক মাইল উত্তর-পুবে চাড়াবাড়ী- গোয়ালপাড়ায় আকালু মণ্ডলের বাড়ীতে এসে হাজির হলাম। এখানে আসার উদ্দেশ্য, বাড়ীর মালিক দূর্দান্ত বদমাইশ আকালুকে পাকড়াও করা
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পাক-হানাদার বাহিনী মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর বিন্নাফৈরের বাড়ী আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এই আকালু মন্ডলই তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। আগষ্টের শেষ সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর সংগঠন সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হলে চাড়াবাড়ী- গোয়ালপাড়ায় আকালু মণ্ডল নদীপথে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া কিছু শরণার্থীর সর্বস্ব লুট করে নেয়। এমনকি ভারতে পৌছে দেবার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে দু’চারজনের যথাসর্বস্ব মাঝপথে লুট করে নেয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৮

টাংগাইল বিন্দুবাসিনী স্কুলের স্বনামধন্য শিক্ষক, স্বাত্বিক পুরুষ, আমার পিতৃতুল্য শ্রদ্ধেয় হীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে ভারতে পৌঁছে দেবার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে জগন্নাথগঞ্জের কাছাকাছি তাদের সব কিছু লুট করে নিয়ে চম্পট দেয়। হীরেন স্যার অশেষ কষ্ট করে নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে মানকাচরে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর বিশেষ প্রতিনিধি আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিমের হাতে আমার জন্য একখানা পত্র তুলে দেন।
বাবা কাদের,
তুমি কেমন আছ, জানিনা। আমি সর্বস্বান্ত হয়ে ভারতে এসেছি। আমার সব গেছে তাতে বিন্দুমাত্র দুঃখ নাই। কিন্তু অসহায় লোকদের হয়রানির হাত থেকে তুমি রক্ষা করতে পারবে, এটাই আমার আশা। চাড়াবাড়ীর কাছে আকালু মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি আমাকে নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে নিয়ে এসে সব কিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। এমনকি সে আমাদের মাঝপথে ফেলে পালিয়ে গেছে। শুধু আমাকে নয়, এই রকম অনেক ঘটনা সে নিয়মিত ঘটাচ্ছে। যুদ্ধ ছাড়াও, সম্ভব হলে তোমার এইগুলি দেখা উচিত।
ভগবান তোমাকে জয়যুক্ত করুন।
তোমার শিক্ষক
হীরেন চক্রবর্তী
২৫-১০-৭১

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে হীরেন স্যারের পত্র পেয়ে আমার গায়ে আগুন ধরে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল- জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা। স্থলপথ ও জলপথ নিরাপদ করা। আমরা এব্যাপারে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছি। আমার অবর্তমানে আকালু মণ্ডলের এই তস্করীর কথা শুনে বিশেষ করে স্যারের চিঠি পেয়ে আকালু মণ্ডলকে ধরে আনার জন্যে কয়েকটি কোম্পানীর উপর দায়িত্ব দিই। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, দাইনার ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী। নিয়ত আলী চাচা দু’তিনবার আকালু মণ্ডলের বাড়ী ঘেরাও করে কিন্তু আকালু কাকের চেয়েও চালাক। সে প্রতিবারেই ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী চাচার হাত থেকে ফসকে যায়। মেজর মঈন উদ্দিনের কোম্পানী একবার আকালু মণ্ডলকে ধরি ধরি করেও হারিয়ে ফেলে। সেহেতু আমি নিজে ছ’সাত দিন আগে থেকে খোঁজখবর নিয়ে আকালু মণ্ডলকে জালে ফেলার পরিকল্পনা করি।
আকালু মণ্ডলের জানা ছিল, মুক্তিবাহিনীর কোন বড়সড় দল তখন তার গ্রামের আশে পাশে নেই। সিলিমপুর থেকে আকালু মণ্ডলের বাড়ী প্রায় পনের ষোল মাইল। সিলিমপুর থেকে উর্ধ্বশ্বাসে হাওয়ার বেগে ছুটছি। এতো দ্রুত ছোটার কারণ, চলতি পথে সহযোদ্ধারা বুঝতে না পারলেও আকালু মণ্ডলের বাড়ী ঘেরাও করে তাকে যখন পিছনে বাড়ীর জঙ্গল থেকে ছো মেরে ধরে আনা হলো, তখন উর্ধ্বশ্বাসে ছুটার কারণ সহযোদ্ধাদের কাছে পরিস্কার হয়ে গেল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৯

শুধু মণ্ডলকে ধরা নয়, আমরা ঠিক করলাম, বাড়ীটাও পুড়িয়ে দেবো। সেইমত, আধ ঘন্টার মধ্যে বাড়ী পুড়িয়ে দেয়ার কথা মহিলাসহ অন্যান্যদের জানিয়ে দেয়া হলো। তাদের বলা হলো, তারা নিজস্ব ব্যবহারিক জিনিসপত্র ও খাদ্য-দ্রব্য সরিয়ে ফেলতে পারবেন। আমরা যখন বললাম, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নেয়া যাবে, তখন দেখা গেল বাড়ীর লোকজনদের কাছে সমস্ত জিনিসপত্রই প্রয়োজনীয়। যে যা পারছেন, সরাচ্ছেন। প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্র আগে সরাচ্ছেন। তাদের সরানোর ঢঙ দেখে মনে হচ্ছিল দু’তিন দিনেও প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র সরানো শেষ হবে না আর মুক্তিযোদ্ধারাও বাড়ীতে আগুন দিতে পারবে না।
আকালু মণ্ডলকে হাত-পা বেঁধে বাড়ীর সামনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আধঘন্টা শেষ হলে, ক্যাপ্টেন সবুর বাড়ীর ভেতর গিয়ে লোকজনদের গদাই-সঙ্করী কর্মকাণ্ড দেখে, ফিরে এসে বললো, ‘স্যার, এরা যে তালে কাম করতাছে, তয় একমাসেও এগোর দরকারী জিনিস সরানো শেষ অইবোনা। আপনি যে কি অর্ডার দিলাইন, স্যার। অখন কি করমু স্যার ?’
সবুরকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দিলাম, ‘তুমি বাড়ীর ভেতর গিয়ে বলো, আর মাত্র পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হলো। এরপর ঘরে আগুন দেয়া হবে। তাই নেহায়েত যেটা প্রয়োজন, তাই নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে যান। সত্যি করেই পাঁচ মিনিট পর কাচারি ঘরে প্রথম আগুন দেয়া হলো। আকালু মণ্ডলের বাড়ীতে হুসাতটি ঘর। গোলাঘরে তখন পঞ্চাশ-ষাট মণ ধান-চাল ছিল। কাচারি ঘরে আগুন জ্বলে উঠলে নিজে ভেতর গিয়ে কয়েকজনকে ডেকে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললাম, ‘এক মিনিটে গোলাঘরের সমস্ত ধান-চাউল বের করে ফেল।’ ধমক খেয়ে দশ-বারোজন ঝড়ের বেগে গোলাঘর থেকে ধান-চাল বের করা শুরু করলেন। কুড়ি-পঁচিশ জন মুক্তিযোদ্ধাও তাদের সাথে হাত লাগালো। নির্ধারিত এক মিনিটে অবশ্য পঞ্চাশ-ষাট মন ধান-চাল তারা বের করতে পারলেন না। কিন্তু দ্রুততার সাথে কাজ করায় পুরো ধান-চাল বের করতে তিন মিনিটের বেশী সময় লাগলোনা। ক্যাপ্টেন সবুর একটার পর একটা ঘরে আগুন দিয়ে চলেছে। বাড়ীর উঠোনে স্তূপ করে রাখা ধান-চাউলের ছালা ও তালাই চাপিয়ে পানি ঢেলে ভিজিয়ে দেয়া হলো। তদুপরি পনের কুড়িটা কলাগাছ এনে ধান-চালের স্তূপের উপর ফেলা হলো। ক্যাপ্টেন সবুর সবশেষে শুন্য গোলা-ঘরটিতে আগুন দিল। দাউ দাউ করে ঘর গুলি জ্বলছে। আগুনের প্রচণ্ড তাপে টেকা একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়লো। মুক্তিযোদ্ধারা বাধ্য হয়ে বাড়ী থেকে প্রায় দু’তিনশ গজ দূরে সরে গেল। আকালু মণ্ডলের বাড়ীর আগুনে তখন সমস্ত এলাকাটা লাল হয়ে উঠেছে। আগুন একটু নিস্তেজ ও ঝিমিয়ে পড়লে আমরা আরও উত্তরে এগোতে শুরু করলাম। সাথে হাতে ও কোমরে দড়ি বাধা দুর্দান্ত দুষ্ট প্রকৃতির সেই আকালু মণ্ডল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫০

ছত্রীসেনা অবতরণ পরিকল্পনা

৩রা ডিসেম্বর গভীর রাতে চৌধুরী মালঞ্চ চরের একটি বাড়ীতে উঠলাম। চৌধুরী মালঞ্চের জীর্ণ বাড়ীতে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে আবার রওনা হলাম। সকাল আটটায় জোগারচর খেয়া পার হবো এই সময় ধলেশ্বরী নদীর রারুইপোটলের দিক থেকে দুজন মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে এসে খবর দিল, নুরুন্নবী সেখানে আছে। খবর পেয়ে আর উত্তরে না গিয়ে আধমাইল পশ্চিমে জোগার চরের ধলেশ্বরীর মোহনায় হাজির হলাম। নদীর পাড়ে ছোট দু’টি নৌকা। দুটি নৌকাতেই মুক্তিযোদ্ধারা রয়েছে। নুরুন্নবী অনেক দূর এগিয়ে এসে স্বাগত জানালো। নুরুন্নবীকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম,
– কি খবর? অতিথি ভালো আছেন? নিরাপদ বোধ করছেন তো?
– হ্যাঁ স্যার, অতিথির কোন স্বস্তি অভাব নেই। উনি বোধহয় নিরাপদ বোধ করছেন।
আমি নৌকার কাছে গেলে সাধারণ পোশাক পরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পিটার নৌকা থেকে নেমে অভিবাদন করলেন। অভিবাদনের জবাব দিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম উষ্ণ আলিঙ্গন শেষে ক্যাপ্টেনকে নিয়ে নৌকার ভেতরে গেলাম।
ভারতীয় সামরিক অফিসারটির নাম ক্যাপ্টেন পিটার বলা হলেও তার নাম আদৌ ক্যাপ্টেন পিটার নয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিনি একজন মেজর। তবে আমরা তাঁকে তাঁর ছদ্মনাম ক্যাপ্টেন পিটার বলেই অভিহিত করবো। ক্যাপ্টেন পিটারই হয়ত একমাত্র ভারতীয় সামরিক অফিসার, যিনি ২৮শে নভেম্বর রওনা হয়ে ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের দু’শ মাইল অভ্যস্তরে এসেছেন, নভেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত আর কোন ভারতীয় অফিসার হয়তো বাংলা- দেশের এত গভীর অভ্যন্তরে এমন ভাবে একা প্রবেশ করেননি।
ক্যাপ্টেন পিটার টাংগাইল এসেছেন মূলতঃ আমাদের নিয়ন্ত্রণধীন মুক্ত এলাকায় নিরাপদে ভারতীয় ছত্রীবাহিনী নামানোর জায়গা নির্ধারণ ও জায়গাগুলোর ম্যাপ-পয়েন্ট হাইকমাণ্ডের কাছে পাঠানো। শত্রুধাটি গুলোর উপর আমরা বিমান সাহায্য চাইলে ম্যাপ-পয়েন্ট ঠিক করে এয়ার ব্যাজে সংবাদ দেয়া। আমরা বিমান সাহায্য চাইলে ভারতীয় বিমান বাহিনী যে সেই সাহায্য দেবেন তা তারা নুরুন্নবীকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন পিটার এসে পৌছায় বিমান সাহায্য চাওয়া আরো সুবিধা হলো।
টাংগাইল ময়মনসিংহে হানাদার বাহিনীর অবস্থান এবং তাদের শক্তি সামর্থের মোটামুটি একটা প্রত্যক্ষ ধারণা অর্জন করে পরবর্তী আক্রমণের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা। দায়িত্বগুলো ক্যাপ্টেন পিটার খুব দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে সক্ষন হন। তার প্রমাণ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে ডিভিশন ময়মনসিংহ-জামালপুর-টাংগাইল প্রবেশ
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫১

করেছিল, সেই কলামই মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় পূর্ব পরিকল্পনা ও যথোপযুক্ত যুদ্ধ সরঞ্জাম না থাকার পরও ঢাকায় প্রথম প্রবেশ করে এবং মেজর জেনারেল জামশেদ ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির কাছে থেকে আত্মসমর্পণের সম্মতি আদায় করে।
ক্যাপ্টেন পিটারের সাথে যখন কথা বলছিলাম, তখন একটি সফল অভিযানের খবর এলো। অভিযানের নেতা স্বয়ং এসেছেন। ২৭শে নভেম্বর এলাচিপুরে মেজর আনিসকে বাহাদুরবাদ ফেরী ঘাট ধ্বংস করার দায়িত্ব দিয়েছিলাম। আনিস আগ্রহভরে সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। সে আমাকে অনুরোধ করেছিল, যেহেতু তার বাড়ী সরিষাবাড়ীতে, সেইহেতু বাহাদুরাবাদ ঘাটের ফেরী ডুবানোর দায়িত্ব তাকেই দেয়া হোক। এমনিতেই জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের উপর নজর রাখার দায়িত্ব তার কাধে আগে থেকেই ছিল। ১লা ডিসেম্বর রাত দশটায় বারোজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মেজর আনিস বাহাদুরাবাদ ঘাটের দশ মাইল উজানে ম্যাগনেটিক মাইন সহ তিস্তা, ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্রের পানিতে নেমে পড়ে। তাদের প্রত্যেকের কাছে দুটি করে মাইন। সাথে টাইম ফিউজ। ঘুটখুটে কালো অন্ধকার, ঠাণ্ডা পানিতে এক ঘন্টা ভাটিপথে সাঁতার কেটে তারা বাহাদুরাবাদ ঘাটে আসে। স্রোতের টানে ভাটিপথে ফেরীগুলোর একেবারে গা ঘেঁষে যাবার সময় টাইম ফিউজের বোতাম টিপে মাইন-গুলো ছেড়ে দেয়। মাইনগুলো চুম্বক আকর্ষণে আপনা-আপনি চারটি ফেরী ও একটি জেটির গায়ে আটকে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা চার মাইল ভাটিতে আসতেই বাহাদুরাবাদ ঘাটে কেয়ামতের আলামত শুরু হয়। দশ মিনিটে চব্বিশটি মাইনের ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে চারটি প্রধান ফেরীসহ মূল জেটিটি নদীর গর্ভে ডুবে যেতে থাকে। মাইন বিস্ফোরণে পাহারারত চার- পাঁচজন রাজাকারও মারা যায়।
মেজর আনিস এই অভুত পূর্ব অভিযানের সংবাদ দিতে নিজেই এসেছে। শুভ সংবাদে ছোট-খাটো মেজর আনিসকে বুকে জড়িয়ে আনন্দে নাচতে লাগলাম। আনিসকে নিয়ে কি যে করবো, কখনও বুকে, কখনও কোলে, কখনও বা কাধে তুলে নেয়ার পরও ভেবে পাচ্ছিলাম না। পরবর্তী যুদ্ধের জন্য বাহাদুরাবাদ ঘাট অচল করে ফেলা যে কি পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ – তা যে কোনো সমর কুশলীই অনুধাবন করতে পারবেন। বাহাদুরাবাদ ঘাট অচল করে দিতে মুক্তিবাহিনীকে অনুরোধ করতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ক্যাপ্টেন পিটারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন পিটার নুরুন্নবীকে সে কথা বলেছিলেনও। হয়তো আর একটু সময় পেলে আমাকেও বলতেন। কিন্তু একি অদ্ভুত যোগাযোগ। অনুরোধের আগেই বাহাদুরাবাদ ফেরীঘাট এমন লণ্ডভণ্ড, সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। সংবাদ শুনে ক্যাপ্টেন পিটার কিছুটা অবাক হয়ে গেলেন। তিনি তার মনোভাব গোপন না রেখে খোলাখুলিভাবে আমাকে বললেন, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা, আপনার এই কমাণ্ডার সাহেব কি করে এত দ্রুত ও নিখুঁতভাবে বাহাদুরাবাদ ঘাট অচল করে দিলেন। আর উনাকেই বা কে নির্দেশ দিয়েছিলেন।’ ক্যাপ্টেন পিটারকে কাছে টেনে বললাম, ‘নির্দেশটা আমিই দিয়েছিলাম। যুদ্ধের জন্য ঘাট অচল করা খুব জরুরী। বাহাদুরাবাদ ঘাট অচল করে দিতে আমার কাছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের একটা অনুরোধ ছিল। ক্যাপ্টেন পিটার সোল্লাসে বলে উঠলেন, ‘আমার
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫২

হয়ত আপনার সাথে অনেক সময় থাকতে হবে। সবাই আপনাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করছেন। আমি আলাদা থাকতে চাইছিনা। আমিও আপনার দলের হয়ে যাচ্ছি। আমি আপনাকে এখন থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন করবো। স্যার, এবার বলুন, ঐ সামান্য অনুরোধে আপনি বাহাদুরবাদ ঘাট অচল করে দিলেন, এটা যে আমার কাছে অবিশ্বাস্য। পূর্বের অনুরোধ কার্যকরী করতে আমাকে বলা হয়েছিল। আমি আপনার সম্পর্কে আগে প্রায় একমাস অনেক কিছু শুনেছি। এখন দেখছি, আপনার এবং আপনার দল সম্পর্কে আমি খুব সামান্যই শুনেছি।’ ক্যাপ্টেন পিটারের পিঠ আলতোভাবে চাপড়ে দিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে ভাই, আমাদের সঙ্গে যখন থাকছেন যতটুকু যা শোনার এবং দেখার, তা দেখেশুনে নিতে পারবেন।’ ক্যাপ্টেন পিটারের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে সাংগঠনিক কাজে একটু সময়ের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। ক্যাপ্টেনকে বলে গেলাম, ‘রাতে আবার দেখা হবে। তখন ম্যাপ নিয়ে বসবো। আজ রাতেই ম্যাপের কাজ সেরে ফেলতে চাই।’
পোটল ইউনিয়ন অফিস থেকে নানা জায়গায় দূত পাঠানোর কাজ শুরু হলো। সল্লা ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে আগেই আকালু মণ্ডলকে হেড-কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। মেজর আবদুল হাকিম, ক্যাপ্টেন আঙ্গুর, ক্যাপ্টেন আরজু, মেজর আনিস, ক্যাপ্টেন চান্দ মিঞা, ক্যাপ্টেন ইউনুস, ক্যাপ্টেন হবি, মেজর হাবিব, ক্যাপ্টেন বকুল, ক্যাপ্টেন মান্নান, ক্যাপ্টেন মোজাম্মেল, ক্যাপ্টেন রেজাউল করিম তরফদার, সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বেনু, ক্যাপ্টেন হাবিব, ক্যাপ্টেন আমান উল্লাহ্, মেজর মোস্তফা, ক্যাপ্টেন কাজী নুরু, ক্যাপ্টেন আবদুর রাজ্জাক, ক্যাপ্টেন আবদুল হাই ও মেজর তারা সহ প্রায় সত্তর জন কোম্পানী কমাণ্ডারকে তাদের কোম্পানীসহ কদ্দুসনগরের আশেপাশে পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে বার্তা পাঠানো হলো। বার্তা নিয়ে মুক্তিবাহিনীর দূতরা যার যার গন্তব্যের দিকে ছুটলো। দূত পাঠানোর পর ক্যাপ্টেন আমানউল্লাহর কোম্পানী নিয়ে কদ্দুসনগর-টাংগাইল সড়কে এসে উঠলাম। উদ্দেশ্য কদ্দুস নগর কিভাবে আরো নিরাপদ রাখা যায়। প্রয়োজনে কদ্দুস নগর টাংগাইল সড়কের আরো সেতু ধ্বংস করে ফেলা হবে। পালিমা সেতুটি আগেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। ফুলতলার দক্ষিণের সেতুটিও ধ্বংস করে দেয়া প্রয়োজন মনে হলো। ক্যাপ্টেন আমান উল্লাহকে সেতুটি উড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিয়ে তখনই জোগারচরের বারুই পটলের পথ ধরলাম।
ধলেশ্বরী নদীর বুকে নৌকায় রাতের খাবার শেষে ক্যাপ্টেন পিটারের সাথে ম্যাপ নিয়ে বসলাম। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। নৌকায় জলের আঘাত লেগে একটানা ছলাৎ শব্দের সিম্ফনি। শীতের গভীর হিম রাতের ঘুম ভাঙ্গিয়ে উত্তপ্ত ও উত্যক্ত করে মাঝে মধ্যে অনেক দুর থেকে ভেসে আসছে গুলি-গোলার শব্দ। দূর গ্রামে সচকিত মারমেয়ের থেমে থেমে শীতার্ত কাতর চিৎকার আর নদীর উপর বয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা হাওয়ার মৃদু সোঁ সোঁ ধ্বনির ঐকতান ছাড়া সর্বত্র নীরবতা। নৌকার ভেতর ছোট্ট টিমটিমে কেরোসিনের একটি বাতির মলিন আলো ঘিরে দেশ মাতৃকার সাধনায় কয়েকটি উজ্জ্বল মুখ, তাদের সকলের দৃষ্টি সামনে ম্যাপের উপর। সামান্য
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৩

ঝুঁকে, উৎসাহ আর কৌতূহল নিয়ে আমাকে আর ক্যাপ্টেনকে ঘিরে রয়েছে. নুরুন্নবী, ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর, গৌরাঙ্গীর আবদুল লতিফ ও ক্যাপ্টেন ফজলুল হক। আমি ও ক্যাপ্টেন পিটার ছাড়া আর কারোরই ম্যাপ সম্পর্কে ধারণা নেই, তবুও তাদের আগ্রহের বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিল না। আমি ম্যাপ পড়তে জানি কিনা সেটাও ক্যাপ্টেন পিটার জানেননা। ক্যাপ্টেন পিটারের কাছে টাংগাইলের কোয়ার্টার ইঞ্চি সমান এক মাইল, এক ইঞ্চি সমান এক মাইল-এই দুই ধরনের সামরিক ম্যাপ ছিল। ক্যাপ্টেন পিটার সযত্নে রাখা ম্যাপ দু’টি থলি থেকে বের করে বললেন, ‘এটা টাংগাইল সহ আশেপাশের এলাকার এক ইঞ্চি সমান এক মাইল ম্যাপ। এর চার পাশে আরও ম্যাপ ছিল। তবে সেইটুকু আমাদের দরকার নেই বলে বাদ দিয়ে দিয়েছি।’ দিক নির্দেশ করে, ম্যাপের এটা উত্তর, এটা দক্ষিণ। (ম্যাপের একটি জায়গায় আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে) ‘খুব সম্ভব আমরা এখানে বসে আছি।’ পর পর কয়েকটি পয়েন্ট নির্দেশ করে ‘এই টাংগাইল, এই কালিহাতী এই কুদ্দুস নগর, এই যে ধলেশ্বরী, যমুনা নদী। ক্যাপ্টেন আরো একটু এগুতে যাবেন, এই সময় ম্যাপের একটি জায়গা দেখিয়ে বললাম, ‘এই যে এইখানে হয়তো আমাদের হেড-কোয়ার্টার, আর এটা খুব সম্ভবত পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার কাঁচা রাস্তা।’ আর বেশী বলতে হলোনা, ক্যাপ্টেন ম্যাপ থেকে চোখ তুলে আমার দিকে চেয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার, ‘আপনি তাহলে ম্যাপ পড়তে জানেন?’
– হ্যাঁ, কিছু কিছু। আমার কাছেও একই ধরনের ম্যাপ আছে তো, তাই জায়গাগুলো আগে থেকেই চেনা।
– না, স্যার, আপনি ম্যাপ পড়তে জানেন। আপনি ম্যাপ পড়তে জানায় আমার সমস্যা অর্ধেকটা কমে গেল। স্যার, আমাদের কয়েকটা নিরাপদ ম্যাপ পয়েন্ট বের করতে হবে এবং তা লোক মারফত কালকের মধ্যেই পাঠিয়ে দেয়া উচিত। বেতারে বিশেষ সাংকেতিক শব্দের বার্তা পাঠানোর চেষ্টাও করবো। এই ম্যাপ পয়েন্টগুলো পরবর্তী পরিকল্পনার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। দীর্ঘ সময় ধরে নিরাপদ স্থান নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলো। টাংগাইল থেকে ছয়- সাত মাইল উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমে যে কোন দিকে নিরাপদ স্থান চিহ্নিত হতে পারে। চিহ্নিত স্থান থেকে খুব তাড়াতাড়ি ভারী গাড়িগুলি যাতে পাকা সড়ক পর্যন্ত অনায়াসে পৌছাতে পারে, সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়া ছত্রীসেনা অবতরণের পর কম করে এক ঘন্টা তাদের (ছত্রীসেনাদের) উপর সম্ভাব্য যে কোন হামলা মুক্তিবাহিনীকেই ঠেকাতে হবে। সমস্ত দিক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার- বিশ্লেষণ করে ছত্রীসেনা অবতরণের তিনটি স্থান প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হলো :
এক। ঘাটাইল থানার ব্রাহ্মণশাসন-মোগলপাড়ার পশ্চিমে চার-পাঁচ মাইল লম্বা দুই- আড়াই মাইল পাশ গৌরাঙ্গীর চক (মাঠ)।
দুই। কালিহাতী থানার বাংড়া-শোলাকুরার উত্তরে পাঁচ-ছয় বর্গমাইল বিস্তীর্ণ একটি চক।
তিন। কালিহাতী থানার ইছাপুর-সহদেবপুরের দক্ষিণে পাঠনের পুবে অপেক্ষাকৃত ছোট একটা চক।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৪

তিনটি জায়গার মধ্যে বেশী প্রাধান্য দেয়া হলো, ব্রাহ্মণশাসন -মোগলপাড়ার পশ্চিমে গৌরাঙ্গীর চকটিকে। এই চকে যেমন প্রয়োজনে বিমান নামানো সম্ভব, তেমনি হানাদারদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করাও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সহজ। দ্বিতীয় প্রাধান্য দেয়া হলো, ৩ নং স্থানটি অর্থাৎ ইচ্ছাপুর-সহদেবপুরের দক্ষিণে পাঠনের উত্তর পুবের অপেক্ষাকৃত ছোট চকটিকে। এইটিকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নিরাপদ রাখা সহজ। ২ নং স্থানটি অর্থাৎ বাংড়া ও শোলাকুরার উত্তরের চক। তিনটি স্থানের মধ্যে সবচেয়ে আয়তনে বড় হলেও স্থানটি মুক্তিবাহিনীর পক্ষে খুবই অসুবিধা- জনক। অনেক আলাপ-আলোচনা করে তিনটিরই ম্যাপ পয়েন্ট ডিগ্রীসহ চিহ্নিত করে পরদিন সকালে আবার সেই বাদশা মিঞাকে ভারতে পাঠানো হলো। অন্যদিকে বেতারে বিশেষ সাংকেতিক শব্দের মাধ্যমে হেড কোয়ার্টারকে জানিয়ে দেয়া হলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৫

ব্যাপক আক্রমণের প্রস্তুতি

৪ঠা ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি দলের নেতা বেসামরিক প্রধান আনোয়ার- উল-আলম শহীদ একমাস কয়েকদিনের ভারতে সফর শেষে ফিরলে সদর দপ্তরে তাদের প্রাণঢালা উষ্ণ সম্বর্ধনা জানানো হলো। দীর্ঘদিন পর গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী দেশের অভ্যন্তরে নিজের এলাকায় এসে যারপর নাই আনন্দিত বোধ করেন।
৫ই ডিসেম্বর সকালে অস্থায়ী বেসামরিক প্রধান হামিদুল হক লিখিতভাবে আনোয়ার- উল-আলম শহীদের কাছে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিলেন। শহীদ সাহেবের অনুপস্থিতিতে হামিদুল হক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাঁর দায়িত্ব পালনের পরও দু’একটি কাজ শহীদ সাহেবের অথবা আমার অনুমোদনের জন্য স্থগিত ছিল। শহীদ সাহেব পুনরায় তার দায়িত্বভার বুঝে নিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে রাতদিন খেটে বকেয়া কাজগুলো সেরে ফেলতে কাজে হাত দিলেন। একদিকে বকেয়া কাজ শেষ করা, অন্যদিকে জনসংযোগ এবং গণপরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর যত্ন নেয়া। এসব তিনি স্বাভাবিক স্বকীয় দক্ষতায় সুচারুরূপে সম্পাদন করেন।
৬ই ডিসেম্বর থেকে শুরু হলো, গণপরিষদ সদস্যদ্বয় আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও বাসেত সিদ্দিকীকে নিয়ে বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চলে ব্যাপক সাংগঠনিক সফর। পাথর ঘাটা, কালিদাস, সখীপুর, কচুয়া, বড় চওনা, সাগরদীঘিতে তাঁরা বেশ কয়েকটি বিরাট বিরাট জনসভা করলেন। সব জনসভাতে তাদের সকলের এক বক্তব্য, ‘আপনারা সমস্ত ভয়-ভীতি ঝেড়ে ফেলে শক্তভাবে মুক্তিবাহিনীর পাশে এসে দাঁড়ান। ইনশাল্লাহ্ স্বাধীনতা আর বেশী দূরে নয়।’ মুক্তাঞ্চল সফরকারী দল ১০ই ডিসেম্বর সাগরদীঘিতে সর্বশেষ জনসভা করলেন।
মুক্তিবাহিনীর দুর্বার চাপের মুখে, একের পর এক ঘাঁটি হাতছাড়া হওয়ার প্রেক্ষিতে যুদ্ধকে আর বিস্তৃত না করে হানাদাররা আত্মরক্ষার কৌশল হিসাবে নিজেদের শামুকের মত খোলস গুটাতে শুরু করলো। ডিসেম্বরের শুরুতে হানাদারদের আর কোন ঘাঁটি জিলা সদরের বাইরে রইলোনা। যোগাযোগের সুবিধার কারণে রাস্তার পাশে তখনও যে ক’টি থানা হানাদারদের কব্জায় রয়েছে, সেই ক’টির অবস্থাও নড়বরে জুবুথুবু। যে কোন সময় যে কোন দিন বেহাত হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় হানাদাররা নিশিদিন শঙ্কিত। পাকা রাস্তার বাইরে বাশাইল, নাগরপুর, কুদ্দুস নগর থানা এখন মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।

সাংগঠনিক সফর
পরদিন সাংগঠনিক সফরে বেড়িয়ে পড়লাম। গন্তব্যস্থল বেলকুচি বেতিল থানার একটি গ্রাম। পাবনা জেলার শাহজাদপুর, সোহাগপুর, বেলকুচি ও বেতিল থানার বিস্তীর্ণ এলাকায় মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছিল। মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জাকে অনেকগুলো যুদ্ধে আমার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারী অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। তখনও একটি তিন
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৬

ইঞ্চি মর্টার, একটি এইচ. এম. জি. সহ দশটি এল.এম. জি. নিয়ে একশ জন মুক্তিযোদ্ধা লতিফ মির্জাকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছিল। বারুই পটল থেকে সোজা পশ্চিমে ধলেশ্বরী-যমুনা পার হয়ে আরো তিন-চার মাইল পশ্চিমে গেলে হয়তো লতিফ প্রায় আট-দশ মাইল ধলেশ্বরী-যমুনা নদী দিয়ে পশ্চিম পাড়ে যাচ্ছিলাম। পথের মাঝে হুগড়া চরের কাছে আমার নৌকার পাশে ছোট্ট একটি নৌকা লাগলো নৌকায় মাত্র চার জন। ভালো করে খেয়াল করে দেখা গেল, সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এই নৌকার যে মূল ব্যক্তি, তাঁকে ৩রা ডিসেম্বর ঢাকায় খোঁজখবর নিতে পাঠানো হয়েছিল। মোশারফ হোসেন পাক-হানাদার বাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সৈনিক। তিন মাস আগে সে তেঁজগা ঘাঁটি থেকে চলে এসেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সে ঢাকার সামরিক ঘাঁটির খুঁটিনাটি সব খবর জানতো। তারই সহায়তায় মাত্র পনের-ষোল দিন আগে ঢাকা সামরিক ঘাঁটির সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে ভারতীয় বিমান বাহিনীকে দেয়া হয়েছিল। ভারতীয় বিমান আক্রমণের পর ঢাকা বিমান ঘাঁটির ক্ষয়-ক্ষতির নিশ্চিত খোঁজখবর নিতে তাকে আবার ঢাকা পাঠানো হয়। মোশারফ হোসেন ঢাকা বিমান ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণের খবর নিয়েই এসেছে। তার মতে চীনের তৈরী এগারটি মিগ-১৯ প্রথম আক্রমণেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। কুর্মীটোলা হানাদার ঘাঁটির রেল স্টেশনের পাশে সিগন্যাল ও এম. টির ব্যারাকগুলো একেবরে ধ্বংস হয়ে গেছে, তেঁজগা বিমান ঘাঁটির রানওয়ে অচল হয়ে গেছে। তেঁজগা ঘাঁটির দু’টি হ্যাঙ্গার ভেঙে পড়েছে এবং বিমান বন্দরের রাডার স্টেশনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
লতিফ মির্জার সাথে দেখা হলোনা বটে, তবে তার দলের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার সাথে বেতিল থানার একটি গ্রামে দেখা ও আলাপ-আলোচনা হলো। লতিফ মির্জা তখন সাংগঠনিক সফরে দশ-পনের মাইল দূরে ছিল। কোন আগাম খবর না দেয়াতে সে মোটেই জানতো না যে আমি ঐ দিন তার এলাকায় যাবো।
৬ই ডিসেম্বর সকালে বেতিল থেকে সল্লায় ফিরে এলাম। লতিফ মির্জাকে অভিযানে সাহায্য করতে যারা তখনও ছিল, তাদের পরদিন নিকড়াইলের আশেপাশে হাজির থাকার নির্দেশ দিলাম। ৬ই ডিসেম্বের সারাদিন সল্লাতে নৌকায় বসে পরবর্তী আক্রমণ পরিকল্পনার একটা খসড়া তৈরী শুরু করলাম। এরই ফাঁকে একবার জেনে নিলাম পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কোম্পানীগুলো ঠিকমত আসতে পারছে কিনা বা পূর্বে পাঠানো খবর তারা ঠিক সময়ে পেয়েছে কিনা। পশ্চিম এলাকায় মুক্তিবাহিনীর শক্তি কতখানি, কি ধরনের এবং কি পরিমাণ অস্ত্র আছে, মজুদ বিভিন্ন ধরনের গুলি-গোলার পরিমাণ কত, যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ কিভাবে ত্বরিত সরবরাহ করা সম্ভব, কাকে কাকে সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে—এসবের আলোকে একটা খসড়া পরিকল্পনা সল্লাতে বসে তৈরী করে ফেললাম।

নিকড়াইলে বৃহৎ সমাবেশ
৭ই ডিসেম্বর নুরুন্নবী নিকড়াইল স্কুলের পাশে ঘাঁটি গাড়লো। বেতার যন্ত্রগুলো শেষ বারের মত পরীক্ষা করা হলো। সকাল দশটায় আমি নিজেও নিকড়াইলে গেলাম। ৬ই ডিসেম্বর
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৭

গভীর রাতে মহান ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাত তারিখ সকাল হতে না হতেই, সকল শ্রেণীর মানুষ ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতির কথা বিভিন্ন ব্যক্তির মুখে মুখে জেনে গেছেন। স্বীকৃতির খবর শুনে জনসাধারণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে খুশীর বান ডেকেছে। শত শত হাজার হাজার লোক আমাকে যেখানে পাচ্ছেন, সেখানেই জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার ও আকাশবাণীর অনুষ্ঠান দিনের পর দিন শুনে ও উপর্যুপরি জাতীয় নেতাদের ভাষণ এবং মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়ে, তদুপরি বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চলে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক জনসভা ও নিজস্ব পত্রিকা রণাঙ্গনের বদৌলতে ৭১- এর স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে গ্রামের সাধারণ অশিক্ষিত মানুষও স্বীকৃতির অর্থ স্পষ্ট বুঝে ফেলেছেন। নিকড়াইল পৌঁছবার সাথে সাথে বিভিন্ন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানাতে লাগলো। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন পিটার অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই অবস্থা দেখে নিজেও এগিয়ে এসে আমাকে অভিনন্দিত করে বললেন, ‘আমার দেশ আপনাদের দেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেজন্য আমি জনগণ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আপনাকে, মুক্তিবাহিনীকে ও জনসাধারণকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’ ক্যাপ্টেন পিটারকে বুকে চেপে ধরে বললাম, ‘অভিনন্দন তো আপনাকেই জানানো উচিত। আপনি মহান ভারতের নাগরিক ও সেনাবাহিনীর একজন সদস্য। আমি আপনাকে অভিনন্দিত করছি। আপনার দেশ মুক্তি সংগ্রামের পুরোটা সময় যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে তা আমরা কোনদিন ভুলবোনা। বাংলার মানসপটে আপনাদের এই যুদ্ধের কথা চিরকাল উজ্জল থাকবে। আপনি আমার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ভারতের জনগণ ও কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দিন।
ত্রিশটি কোম্পানীতে বিভক্ত পাঁচ হাজার মুক্তিযোদ্ধা চরম আঘাত হানার প্রস্তুতি হিসাবে নিকড়াইলের আশেপাশে হাজির হয়েছে। কোম্পানী কমাণ্ডাররা একে একে আমার সাথে দেখা করে কথা বলছে। তাদের বিকেল দুটা ত্রিশ মিনিটে নিকড়াইল স্কুলে একত্রিত হতে বলা হয়েছে। কমাণ্ডারদের জমায়েতের আগে সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক বসলো। বৈঠকে মোয়াজ্জেম হোসেন খান, আবদুল আলীম, ভোলা, দুদুমিঞা, শামসু, বারী মিঞা, খোদা বক্স ও সিরাজ সহ আরও বেশ কয়েকজন উপস্থিত হলো। আলাদাভাবে আলীম ও ভোলার কাছ থেকে পশ্চিমাঞ্চলের মজুত অস্ত্র ও গোলা-গুলির হিসাব নিকাশ নিলাম। পরে সকলের সাথে পরবর্তী অভিযানে কিভাবে, কোনদিকে অস্ত্র ও গোলা-গুলি সরবরাহ করতে হবে, খাবার জোগাতে হবে, আহত-নিহতদের কিভাবে দেখতে হবে, উপরন্তু বন্দী ও ধরাপড়া শত্রুদের কোথায় কিভাবে সাময়িকভাবে রাখতে হবে তা নিয়ে দীর্ঘ সময় আলাপ-আলোচনা হলো। দুদুমিঞা, মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও বারী মিঞা অনেক মূল্যবান পরামর্শ দিলেন। তাদের পরামর্শ এবং তৈরী খসড়া মিলিয়ে সরবরাহের একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা হলো। ভোলা, আলীম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান,
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৮

দুদুমিঞা, শামসু, বারী মিঞা, সিরাজ, খোদাবক্স, রফিক, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, সামসু ও গিরানী সহ আরো বেশ কয়েকজনকে সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হলো। সরবরাহ ব্যবস্থার মূলে রইলো ভোলা ও আব্দুল আলীম। কারণ গোলাগুলি কোথায় কি মজুত আছে তা দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল এদের দুজনের উপর। তাই সামগ্রিকভাবে সরবরাহ ব্যবস্থাপনার মূল নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই তাদের উপর বর্তালো।
পরবর্তী অভিযান সফল করতে পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের পূর্ণ দায়িত্বভার নূরুন্নবীর হাতে তুলে দেয়া হলো। যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানীর সাথে সুষ্ঠ সমন্বয় সাধন, সফল অভিযানের একটি অত্যন্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ দিক। স্বাভাবিকভাবেই নূরুন্নবীর সঠিক দায়িত্ব পালনের উপর অভিযানের সফলতা ও ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের জন্য তাকে মুক্তিবাহিনীর দেড়শ জন সফল সংবাদবাহক দেয়া হলো। এছাড়া দশটি সামরিক বেতার ও চারটি বেসামরিক বেতার যন্ত্রের সাথে তার বেতার লাইন করে দেয়া হলো। তদুপরি, ভারতের সাথে সরাসরি যোগাযোগের জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বেতারযন্ত্র ও একটি সংকেত প্রেরক যন্ত্র দেয়া হলো। সর্বোপরি আমার নিত্য সহচর দলের জন্য বিশেষভাবে বেতার প্রশিক্ষণ নেয়া দলের অর্ধেক সদস্য ২টি বেতার নিয়ে নুরুন্নবীর দলের সাথে যুক্ত হলো, যাতে আমার সাথে নুরুন্নবীর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকে। নুরুন্নবীকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে নিকড়াইল স্কুলের একটি ঘরে সত্তর জন কমাণ্ডারকে নিয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনায় বসলাম।
আমরা যখন জরুরী শলাপরামর্শ করছি, তখন নিকড়াইলে অগণিত লোক সমবেত হয়েছেন। তারা সবাই আমার সাথে মিলিত হতে চান। মুক্তিযোদ্ধারা সকাল থেকে বার বার জনসাধারণকে অনুরোধ করেছে, ‘সর্বাধিনায়ক আপনাদের সাথে অবশ্যই খোলাখুলি মিলিত হবেন। আপনারা এখানে ভীড় না করে দয়া করে যার যার কাজে চলে যান।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। একে তো চতুর্দিকে বিপুল পরিমাণ মুক্তিবাহিনীর সমাবেশ ঘটেছে, তদুপরি স্কুলের পাশে খালি মাঠে দশ-বার খানা মাইকের হর্ণ পড়ে থাকতে দেখে জনসাধারণ একটা আন্দাজ করে নিয়েছিলেন, হয়তো মুক্তিবাহিনীর কোন সভা হতে পারে। জনগণও মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে কিছু শুনতে চান। বিশেষ করে আমি যখন সেখানে আছি। আমার কাছ থেকেই তাঁরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। দুপুর পর্যন্ত জনসাধারণকে বার বার বলা হচ্ছিল, আপনাদের যথা সময়ে জানানো হবে, সর্বাধিনায়ক কখন আপনাদের সাথে মিলিত হবেন। এতে দু-চার জন মনঃক্ষুন্ন হয়ে বলেন, ‘কখন আমাদের জানাবেন? রাত হয়ে গেলে? হয় আপনারা সি. ইন্‌. সি. সাহেবকে গিয়ে বলুন, আমরা তাঁর কথা শুনতে চাই, নয়তো আমাদের তার কাছে যেতে দিন। আমরা নিজেরাই তাকে বলবো। মুক্তিযোদ্ধারা জনসাধারণকে এই বলে থামিয়ে দেয়, ‘এই মুহূর্তে আপনাদের কিছুতেই সর্বাধিনায়কের সাথে কথা হতে পারেনা। তিনি খুবই জরুরী কাজ করছেন। জনসাধারণ কোন কথা শুনতে চাননা। বিকেল তিনটায় নিকড়াইল বাজারে ছয়-সাত হাজার লোক জড়ো হয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে মুহুর্মুহু শ্লোগান
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৯

দিতে থাকেন। কয়েকবার জোর শ্লোগান শুনে সভা কক্ষ থেকে বেরিয়ে বাজারের দিকে তাকালাম। আমাকে বেরুতে দেখে তারা আরো জোরে জোরে শ্লোগান দিতে লাগলেন। ব্যাপার দেখে তাড়াতাড়ি জনতার দিকে এগিয়ে গেলাম। স্কুল মাঠের শেষ প্রান্তে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধারা বাজারের দিককার ব্যারিকেড তুলে নিল। ব্যারিকেড তুলে নিলে অপেক্ষমান জনতা দৌড়ে এসে আমার সামনে জড়ো হলেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে শোরগোল ও পরে শ্লোগান তুললেও আমি তাদের সামনে যাওয়া মাত্র সবাই একেবারে চুপচাপ শান্ত হয়ে গেলেন। তাঁরা ভাবলেন, আমি হয়তো কিছু বলবো। জনতার মনের ভাব বুঝে বললাম, ‘আপনারা অধীর হবেননা। আমার হাতে এখন মোটেই সময় নেই। আমি আপনাদের সাথে অবশ্যই কথা বলবো। ঐ যে দেখছেন মাইকের হর্ণ রাখা হয়েছে ও শুধু আপনাদের সাথে ভালভাবে কথা বলার জন্য। আপনারা এখন শান্তভাবে অপেক্ষা করুন। আমরা দশ মিনিটের মধ্যে জানিয়ে দেবো কখন কোথায় সভা হবে?’ খালি গলায় আমার এই কথা বড় জোর দু-তিনশ জন শুনতে পেলেন। কেউ কেউ আগ্রহ নিয়ে শুনবার জন্য ভিড়ের মধ্যে গলা বাড়িয়ে দিলেন, কিন্তু তারা স্পষ্ট কিছু শোনার আগেই কথা
শেষ করে চলে এলাম।
ঘরে এসে সিগন্যালম্যান লতিফকে ডেকে বললাম, ‘নুরুন্নবী, আলীম ও ভোলাকে ডেকে আনো।’ নুরুন্নবী সেই সময় বেতার যন্ত্রগুলোর চ্যানেল মিলাচ্ছিল। ২টি বেতার যন্ত্রে অপারেটর অনবরত সীমান্তবর্তী ভারতের মূল ঘাঁটির সাথে যোগাযোগের চেষ্টায় কোড-ওয়ার্ডে ডেকে চলছিল। নুরুন্নবী, ভোলা ও আলীম আসা মাত্র বললাম, ‘নুরুন্নবী, তুমি ছোট দুইটা চৌকি দিয়ে সভা মঞ্চ তৈরী করে ফেলো। ভোলা ও আলীম, তোমরা মাইক লাগাবার ব্যবস্থা করো। আর মোয়াজ্জেম হোসেন খানকে বলো, তিনি এবং দুদুমিঞা যেন নিকড়াইল বাজারে গিয়ে ঘোষণা করে দেন, সন্ধ্যায় সভা হবে। সন্ধ্যার আগে কাউকে নিকড়াইল স্কুল মাঠে ঢুকতে দেয়া হবেনা। সভা শুরুর মাত্র পাঁচ মিনিট আগে জনগণকে সভাস্থলে আসতে দেয়া হবে। দায়িত্ব নিয়ে যে যার কাজে চলে গেল। মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও দুদুমিঞা নিকড়াইল বাজারে গেলেন। মোয়াজ্জেম হোসেন খান একটা টেবিলের উপর দাড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘আমাদের প্রিয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধের বীর সিপাহশালার কাদের সিদ্দিকী নিকড়াইল স্কুল মাঠে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ ও দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির উপর তার মূল্যবান বক্তব্য রাখবেন। আজ সন্ধ্যায় আহুত সভায় আপনারা দলে দলে যোগদান করে সভাকে সাফল্য মণ্ডিত করুন। সন্ধ্যায় সভা হবে শুনে স্থানীয় জনগণ তো অবাক। একি। এলাকায় এতদিন সাধারণত সভা হতো দিনে, রাতে সভা হবার নজির একেবারে বিরল। কিন্তু সর্বাধিনায়ক সন্ধ্যায় পর সভা করতে চান কেন? নানা জন নানা কিছু ভাবতে ভাবতে যার যার বাড়ীর দিকে চললেন। কেউ কেউ আবার ওখানেই বসে রইলেন, বক্তৃতা শুনে একেবারেই বাড়ী ফিরবেন। মুক্তিবাহিনী ঐ এলাকায় একটি সভা করবে, এমন একটা চাপা গুঞ্জন গত তিন দিন ধরে জনগণের মুখে মুখে ফিরছিল। কিন্তু কখন ও কোথায় সভা হবে, তা কারও জানা ছিল না। তিনটার পর যখন সভার স্থান ও সময় ঘোষণা
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬০

করে দেয়া হলো, তখন সভার সংবাদ বিদ্যুৎ-গতিতে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো।
বিকেল চারটায় কমাণ্ডাদের সাথে আলাপ-আলোচনা শেষ হলো। আলোচনা শেষে নিকড়াইল স্কুল মাঠে তাদের লাইনে দাঁড় করে চরম আঘাতের পূর্বে সকলের মুখে একে একে মিষ্টি তুলে দিলাম। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। আমি এক একজনের মুখে মিষ্টি তুলে দিচ্ছি। কমাণ্ডারদের কেউ কেউ আমার হাতের থালা থেকে মিষ্টি নিয়ে আমার মুখে গুঁজে দিচ্ছে। আট-দশটি মিষ্টি খাওয়ার পর আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো। আমি দিচ্ছি প্রতি কমাণ্ডাডারের হাতে করে, কিন্তু আমাকে যদি একটা করে খেতে হয়, তাহলে সত্তর জন কমান্ডারের হাতে সত্তরটি মিষ্টি খেতে হবে, যা আমার সাধ্যের অতীত। আমি আগেই বলেছি খোলামেলা পরিবেশে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি যোদ্ধা, প্রতিটি কমাণ্ডার স্বচ্ছ নির্মেঘ আকাশে মনের খুশীতে উড়ন্ত পাখীর মতো প্রাণবস্তু ও উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। এমন একটি মহৎ পবিত্র অনুষ্ঠানে একে অপরকে মিষ্টি মুখ করানোর মহাপার্বনে কিছুতেই মুখে গুঁজে দেয়া মিষ্টি ফেলতে পারছিলামনা। স্বতঃস্ফূর্ত হৃদয়ের আকর্ষণে কমাণ্ডারদের মিষ্টি তুলে দেয়ার বিরাম নেই। এমন আনন্দঘন উচ্ছ্বল মুহুর্তে কে শোনে কার কথা। এমন বড় সমাবেশ হয়তো কোন কমাণ্ডার আর নাও দেখতে পারে। বাজার দামে স্বাধীনতা কিনতে মৃত্যুকে তারা কেউই পরোয়া করেনা। চায় মৃতকে জয় করতে, চায় যতক্ষণ লড়ছে ততক্ষণ একে অপরের ভালোবাসার মাঝে বেঁচে থাকতে। যুদ্ধক্ষেত্রের রুঢ় কঠিন নিয়ম নিষ্ঠার মাঝে যখনই তারা অবসর পায়, তখনই একে অপরকে প্রাণ নিঙড়ানো ভালোবাসায় অভিষিক্ত করতে চায়। কাকে না করবো? মানা করা কি সম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে কৌশলের আশ্রয় নিলাম। সারিতে দাঁড়ানো কোন কমাণ্ডার আমার মুখে মিষ্টি তুলে দিল, সেই মিষ্টি নিয়ে পরবর্তী কমাণ্ডারের মুখে তুলে দিলাম। এভাবে মুখে মিষ্টি নিয়েই হয়তো পর পর ছয়-সাত জন কমাণ্ডারের মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে এগিয়ে গেলাম।
আমার হা-করা মুখে মিষ্টি থাকার পরও কোন কোন কমাণ্ডার এমনভাবে ওর মধ্যেই আর একটি গুঁজে দিল, যা দেখবার মত। পাঁচ-ছয়টি করে মিষ্টি মুখে নিয়ে সত্তর জন কমাণ্ডারকে মিষ্টি খাওয়ানো শেষ করলাম। এতে আমাকেও কম করে চোদ্দ-পনেরখানা মিষ্টি খেতে হয়েছিল।
সব চাইতে মজার ব্যাপার হয়েছিল, আমার হা করা মুখে চার-পাঁচটা মিষ্টির ফাক দিয়ে যখন কোন কমাণ্ডার আরও একটা গুঁজে দিতে চাইছিল, আর আমি মুখ শক্ত করে রাখছিলাম। কিন্তু কমাণ্ডাররা এতো জোরে ঠুসছিল যে, আরো বড় হা না করে আমার উপায় থাকেনি। কল কল করে মিষ্টির রস পড়ে আমার জামাকাপড় যে ভিজে যাচ্ছিল, সেদিকে কারও কোন খেয়াল নেই। মিষ্টি খাওয়ার পর শুরু হলো পাঁচ দলে বিভক্ত পাঁচ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে পর্যায়ক্রমে নিকড়াইল স্কুল মাঠে সমবেত করার কাজ।
ত্রিশটা কোম্পানীকে পাঁচটি মূল দলে ভাগ করা হয়েছে। মূল পাঁচটি দলকে আমার
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬১

সার্বিক নেতৃত্বে বিশেষ অভিযানকারী বিশাল দলে পরিণত করা হলো। পাঁচটি মূল দলের নেতৃত্বে পেলো-
এক। মেজর হাবিবুর রহমান
দুই। মেজর আব্দুল হাকিম
তিন। মেজর আনিসুর রহমান
চার। ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর খান
পাঁচ। ফজলুল হক ও গোলাম মোস্তফা।

এক। মেজর হাবিবের দায়িত্ব আমার দলের পশ্চাৎভাগ রক্ষা করা।
দুই। মেজর হাকিম বাকী চারটি দলকে সমভাবে ভারী অস্ত্র, যেমন-তিন ইঞ্চি মর্টার, রাণ্ডার সাইট, ৭২ আর. আর. ও রকেট লাঞ্চার দিয়ে আক্রমণে সাহায্য এবং ভারতীয় ছত্রীসেনা অবতরণের সময় অবতরণ স্থানটির নিরাপত্তা বিধান করবে।
তিন। মেজর আনিসের উপর দায়িত্ব দেয়া হলো, জগন্নাথগঞ্জ ও বাহাদুরাবাদ ঘাটের দিক থেকে আসা সম্ভাব্য হানাদার আক্রমণ প্রতিহত করার।
চার। ক্যাপ্টেন সবুর আঘাতকারী দলের ভূমিকা পালন করবে।
পাঁচ। মেজর গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে মেজর তারা, মেজর ছবি, ক্যাপ্টেন রেজাউল করিমের দল আমার সাথে ক্যাপ্টেন সবুরের দলের মতই আঘাতকারী দলের দায়িত্ব পালন করবে। আমার সাথে দুই দলের সমন্বয় রক্ষা দায়িত্ব পেল ক্যাপ্টেন ফজলুল হক।
মেজর হাবিব তার দলকে নিকড়াইল স্কুল মাঠে প্রথম সমবেত করলো। মেজর হাবিবের দল মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালে প্রত্যেকের সাথে দু’একটি কথা বলে পরিদর্শন শেষে আহ্বান জানালাম,
মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা, হানাদাররা বাংলার উপর যে তাণ্ডব লীলা বরদাশত করা যায় না। তোমরা জানো, মহান ভারতের মত অনেক দেশ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সমর্থনে অচিরেই আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে, আমাদের স্বীকৃতি দেবে। আমার বিশ্বাস, হানাদাররা আমাদের স্বাধীনতা বেশী দিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। গত একমাস ধরে প্রতিটি যুদ্ধে তোমাদের যে সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়েছি, তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা দুএকদিনের মধ্যেই টাংগাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুর মুক্ত করে ফেলতে পারবো। আজ আমাদের অস্ত্র ভাণ্ডার হানাদারদের চেয়ে মোটেই দুর্বল নয়। ওদের যে অস্ত্র আছে, আমাদেরও তা আছে। একদিন আমরা ওদের কামানের জবাবে রাইফেল ব্যবহার করেছি। আজ অবস্থা ঘুরে গেছে। এবার কামানের জবাব কামান দিয়েই দেবো। ওদের সমস্ত সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে, সহযোদ্ধা ভাইয়েরা ওদের একটিও অতিরিক্ত গুলি পাবার কোন সম্ভাবনা নেই। অথচ আমাদের তিন রকম সরবরাহ ব্যবস্থা অব্যাহত আছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬২

এক। আমাদের নিজস্ব মজুত আছে।
দুই। হানাদারদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে।
তিন। ভারতের সাথে আমাদের সরবরাহ লাইন সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে।
প্রয়োজনে ওদের উপর আমরা বিমান ব্যবহার করবো। দস্যুরা এতদিন আমাদের উপর বিমান থেকে আক্রমণ করতো। এবার ওদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে।
সহযোদ্ধা ভাইয়েরা, ওদের একটা অস্ত্রও আমরা ফিরিয়ে নিতে দেবনা। আমরাই হানাদারদের যুদ্ধের খায়েশ মিটিয়ে দিতে পারতাম। তার উপর আবার ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসছে। আজ থেকে প্রতিটি আঘাত হবে পুনঃ পুনঃ ধারাবাহিক জয়ের আঘাত। আমরা মৃত্যুকে বরণ করবো কিন্তু পরাজয় স্বীকার করবো না। আমি আশা করি, এরপর আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলায় এমনিভাবে আবার মিলিত হবো। আমি কামনা করি, প্রতিটি যুদ্ধে তোমরা সফল হও। প্রতিটি যুদ্ধে আমি আগের মতই তোমাদের পাশে পাশে থাকবো। আল্লাহ তোমাদের সহায় হউন।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী, বাংলা-ভারত মৈত্রী অমর হউক।’
মেজর হাবিবের দল চলে গেলে দ্বিতীয় দল, তারপর তৃতীয় এমনিভাবে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি দলের সাথে মিলিত হলাম এবং প্রত্যেক দলের সামনে একই বক্তৃতা করলাম।
হানাদারদের দৌড় কতটা, ওদের ক্ষমতা কি, তা নভেম্বরের ১৫ তারিখের পর মুক্তি বাহিনী ও জনগণ পুরোপুরি যেমন বুঝে ফেলেছিলেন, তেমনি হানাদাররাও নিজেদের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। শুধু তাই নয়, মুক্তিবাহিনী যে হেলাফেলার বস্তু নয় বরং পাল্টা আঘাত হানায় তারা দিনকে দিন দক্ষতা অর্জন করছে, তাও হানাদাররা বুঝে নিয়েছিল। যে কোন মূহুর্তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় তারা ছিল শঙ্কিত। আকাশ পথ খোলা থাকলেও খালি মাঠে তলোয়ার ঘুরানোর ক্ষমতা ও সাহস তখন হানাদাররা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা অন্ততঃ এতটুকু বুঝেছিল, হামলা হয়তো করা যাবে তবে বিনা ক্ষতিতে আগের মত আর ফেরা যাবেনা। তবুও শত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য সতর্ক পাহারা রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন পাঁচ ভাগে ভাগ করে পালাক্রমে স্কুল মাঠে সমবেত করা হলো, তেমনি একই কারণে জনগণকে সন্ধ্যার পর নিকড়াইল জনসভায় আহবান করা হলো।
পাঁচটার পর আশেপাশে ও দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে নিকড়াইলের দিক মানুষের ঢল নামলো। মুক্তিযোদ্ধারা নিকড়াইল স্কুল মাঠ থেকে বেশ দূরে চারদিকে শক্ত বেষ্টনী সৃষ্টি করে জনসাধারণকে থামিয়ে দেয়, যাতে তারা নির্দিষ্ট সময়ের আগে মাঠে প্রবেশ করতে না পারেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক সমাবেশের কারণ কি? নুতন কিছু ঘটছে কি? শেষ যুদ্ধ কি আসন্ন? ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর জানার কৌতূহলে নতুন পরিস্থিতিতে নতুন কিছু শোনার বুকভরা আশা নিয়ে জনসাধারণ বেষ্টনীর বাইরে বসে, দাঁড়িয়ে, অধীর আগ্রহে ছটফট করছেন। তাদের প্রতীক্ষার দুঃসহ সময় দেখতে দেখতে শেষ হলো। মাগরেবের নামাজের পর কোরান ও গীতা
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৩

পাঠের মাধ্যমে সভা শুরু হলো। ঘনায়মান শীতের সন্ধ্যায় নিকড়াইল স্কুল মাঠ কানায় কানায় ভরে গেল। সভার শুরুতে দুদু মিঞা বক্তব্য রাখলেন। এরপর ঘাটাইল থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন খান বক্তৃতা শুরু করলেন। তাদের একই বক্তব্য, ‘ভারত আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমাণ্ড গঠিত হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে লড়াই করে চলছে। স্বাধীনতা আর সুদূর পরাহত নয়। আপনারা আমাদের নেতা কাদের সিদ্দিকীর উপর আবিচল আস্থা রেখে শত্রুর উপর আরো দুর্বার গতিতে মুক্তিবাহিনীকে ঝাপিয়ে পড়তে সাহায্য করুন। দুদু মিঞা ও মোয়াজ্জেম হোসেন খান দুজনই সুবক্তা। গ্রাম্যে জনসভায় তাদের মত আকর্ষনীয় বক্তা খুব কমই দেখা যায়। দুইজনের বক্তৃতার উঠানামার তাল-লয়ের সাথে সভাস্থল যেন সমুদ্রের ছন্দিত ঢেউয়ের মত দুলছিল, জ্বালাময়ী বক্তৃতার উম্মাদনায় সমবেত জনতা ফুটন্ত জলের মত টগবগ করছিলেন। আসন্ন বিজয়ের উচ্চকিত ঘোষণায় তাদের মন-প্রাণ পরম প্রাপ্তির আশার আনন্দ-পুলকে বার বার আলোড়িত হচ্ছিল।
মোয়াজ্জেম হোসেন খানের বক্তৃতা চলার সময় আমি একবার সভাস্থল থেকে সামান্য দূরে একটি বেতার যন্ত্রের কাছে গেলাম। বেতারে ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষের সাথে সংযোগ হয়েছে। তারা আমার সাথে কথা বলতে চান। এর আগে কখনও আমার অথবা আমার দলের সাথে ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষের সংকেতিক শব্দ ছাড়া বেতারে কথা হয়নি। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় সমস্ত গোপনীয়তা ও নিয়মকানুনের বালাই ভেঙে ব্রিগেডিয়ার সান সিং সরাসরি ওয়ারলেসে আমাকে অভিনন্দিত করলেন। সান সিং উচ্ছ্বসিত ও উদ্বেলিত কন্ঠে বললেন,
আমার দেশ তোমাদের মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছে, স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে আমি তোমাকে, মুক্তিবাহিনীকে এবং তোমার দেশবাসীকে অভিনন্দিত করছি। উত্তরে বললাম,
― আমিও বাংলার সংগ্রামী জনগণ, মুক্তিবাহিনী ও আমার পক্ষ থেকে আপনাকে, আপনার সেনাবাহিনীকে, মহান ভারতের জনগণ ও সরকারকে আপনার মাধ্যমে অভিনন্দন জানাচ্ছি!
ব্রিগেডিয়ার সান সিং পালটা অভিনন্দন পাওয়ার পর পরই বললেন,
— আমরা খুব শীঘ্রই একত্রিত হতে পারবো বলে আশা করছি। তুমি তৈরী থেকো। প্রয়োজনে উত্তরে, তোমার সাহায্য চাওয়া হতে পারে।
ব্রিগেডিয়ার সান সিং-এর খোলাখুলি আলাপে আমার মনে হলো, ইচ্ছে করে শত্রু পক্ষকে আমাদের কথা শোনানোর জন্যই এমনটা করছেন। শত্রুপক্ষের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা, যুদ্ধের একটি প্রয়োজনীয় ও আবশ্যিক অঙ্গ। এটাও সত্য যে, যুদ্ধের গতি প্রকৃতি তখন একেবারে ঘুরে গিয়েছিল। ৪ঠা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। এমন একটা সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য বলতে গেলে, ভারত প্রস্তুত হয়েই ছিল। তাই পাল্টা
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৪

আঘাত হানতে ভারতের এক মুহুর্তও লাগেনি। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র বস্তুত তখন মৃত। দেশের হাজার মাইল ব্যবধানের দুই অংশই আক্রান্ত। পূর্ব অংশে পূর্ব পাকিস্তানের কবর রচনা করে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ মুক্তির প্রতীক্ষায় ক্ষণ গুণছিল। বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘিরে গড়ে উঠেছিল মুক্তাঞ্চল। দিনকে দিন মুক্তাঞ্চলের বিস্তৃতি ঘটেছিল, আর মুক্ত বাংলার আকাশে পত্পত্ করে উড়া লাল, সোনালী ও সবুজ রঙের জাতীয় পতাকাকে সুন্দর সকালের সোনালী সূর্য কিরণে, আর অস্তগামী সূর্য, সোহাগের লাল আভায় প্রতিদিন রাঙিয়ে দিচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পরই, আবার সভাস্থলে ফিরে এলাম। মোয়াজ্জেম হোসেন খানের পর বক্তৃতা করতে দাঁড়ালাম। সভায় প্রায় কুড়ি হাজার লোক জমায়েত হয়েছে। সবাই গভীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন। আমি উঠে দাঁড়াতেই সভাস্থল শ্লোগান ও করতালিতে ফেটে পড়লো। অনেকক্ষণ স্লোগান চলার পর শাস্ত হয়ে এলে, উচ্চারণ করলাম,
‘পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার শাস্তি আপনাদের উপর বর্ষিত হউক। ভাই ও বন্ধুরা, আপনারা জানেন, আজ বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশ মহান ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতি পেয়েছে। দুনিয়ার এমন কোন শক্তি নেই যে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ থামিয়ে রাখতে পারে, স্তদ্ধ করে দিতে পারে। হানাদাররা প্রথম যখন আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল, তখন তারা হয়তো ভাবেনি বাঙালীরা চিরকাল শুধু মার খাবেন, মার দিবেও। ওরা জানতোনা, বাঙালীর মাইর, দুনিয়ার বাইর। যখন মারে, তলপেটে মারে। ২৫শে মার্চের পর ওরা একের পর এক আমাদের উপর আঘাত হেনেছে। দু’একটি ক্ষেত্রে ওদের প্রতিহত করতে পারলেও গুঁড়িয়ে দিতে পারিনি। আপনারা জানেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, রংপুর, সৈয়দপুর, ভৈরব, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কালিহাতী, মধুপুরে ওরা নির্বিচারে বোমা ফেলেছে, মেশিনগান থেকে অগ্নি ঝরিয়েছে। কোথায় বোমা ফেলা হয়? কাদের বিরুদ্ধে মেশিনগান উচিয়ে ধরা হয়? একজন নয়, দুই জন নয়, ওরা সমস্ত বাঙালী জাতিটাকেই পাকিস্তানের শত্রু ধরে নিয়েছিল। ভাইয়েরা, অনেক অনেক ভুল করলেও ওরা এ ব্যাপারে নির্ভুল ছিল। সমস্ত বঙালী জাতি যে স্বাধীনতার পক্ষে এটা আজ দিবালোকের মত সত্য। গোড়ান-সাটিয়াচরা ও কালিহাতী যুদ্ধে হানাদারদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করতে পারলেও এর অব্যবহিত পরেই আমরা যখন ছিন্নমূল, বিশৃঙ্খল হয়ে এদিক ওদিক ছিটকে পড়েছিলাম, তখন জনসাধারণের উপর হানাদারদের অত্যাচার দেখে দূঃখে ব্যথায় বুক ফেটে যেতো। তখন আমার কিছু করার ছিল না। বার বার শুধু আল্লাহর দরবারে হাত তুলেছি, ‘আল্লাহ্ তুমি শক্তি দাও। আল্লাহ্ হয়তো আমার কান্না শুনেছিলেন। অনেকে বলেন-এতবড় মুক্তিবাহিনী আমি না থাকলে নাকি গড়ে উঠতোনা। আমার পরিশ্রম ও সাহসই নাকি এই এলাকায় এতবড় একটি দুর্বার ও সুসংগঠিত মুক্তিবাহিনী গঠনে প্রধান শক্তি, প্রধান স্তম্ভ।
বন্ধুরা-ভাইয়েরা, আমার কিন্তু কোনদিনই তা মনে হয়নি। ১৯শে এপ্রিলের পর আমি যখন ছিন্নমূল দিশেহারা হয়ে উদ্‌ভ্রান্তের মত বার বার টাংগাইলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত গিয়েছি, সমগ্র এলাকাটা চষে বেড়িয়েছি, তখন আমার না ছিল শক্তি সাহস, না ছিল
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৫

জনবল। এমনকি আমার কাছে তখন যে হাতিয়ার ছিল তাতে একটিও গুলি ছিল না। ১৯শে এপ্রিলের পর ৪ঠা মে প্রথম যখন সংগ্রামপুরে অভিযান পরিচালনা করেছিলাম, তখন রাতারাতি কিসের জোরে এত দুর্বার মৃত্যু ভয়হীন হতে পেরেছিলাম? টাংগাইলের বিস্তীর্ণ এলাকা সেই তের-চৌদ্দ দিনে একোণ থেকে সেকোণ পরিভ্রমণ ও পর্যবেক্ষণে প্রতিটি স্থানে শত শত মানুষ যেভাবে আমাকে সব কিছু উজার করে দিয়ে উৎসাহিত করেছিলেন, যেভাবে নিজের জীবন তুচ্ছ করে সাহস ও শক্তি জুগিয়েছেন, যেভাবে নিজেরা না খেয়ে আমাকে খেতে দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। জনগণের সম্মিলিত সেই অভূতপূর্ব উৎসাহ, সাহস ও সহযোগিতার উপর ভর করেই আমি এতটা দুর্বার হতে পেরেছিলাম, আমার মুষ্টিমেয় সহযোদ্ধারা এতটা প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হতে পেরেছিল। আমি মাত্র দশজন সহযোদ্ধা নিয়ে প্রথম অভিযানে নেমেছিলাম। আজ আমরা কজন নই। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বহু হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া লক্ষাধিক স্বেচ্ছাসেবক কোন কোন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হার মানিয়ে তাদের কাজ সম্পন্ন করছেন। আজ হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক শুধু নয়, আমরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের প্রতিটি স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ এক একজন দুঃসাহসিক দুর্দান্ত মুক্তিযোদ্ধা।
আগষ্টের পূর্ব পর্যন্ত আমরা খুব একটা আক্রমণত্মক অভিযান চালাতে পারিনি। একশ যুদ্ধ হলে, বড় জোর দশটাতে আক্রমণত্মক ভূমিকা নিতে পেরেছিলাম, বাকীগুলো ছিল আত্মরক্ষামূলক। কিন্তু আগষ্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে শত্রু আমাদেরকে আঘাত হানার আগেই তাদের উপর তীব্র আঘাত হানার কৌশল অবলম্বন করেছি। অক্টোবর-নভেম্বর পুরো দু’টি মাস আমাদের পরিকল্পিত, “আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে আক্রমণ হানার কৌশল দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার সাথে কাজে লাগিয়ে আমরা যেমন একদিকে কদ্দুসনগর, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট, চারাবাড়ি- পোড়াবাড়ি, নাগরপুর সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করেছি, তেমনি অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর আকস্মিক আঘাতের তোড়ে হানাদাররা পাথরঘাটা, ফুলবাড়িয়া, ভালুকা থানা, শিবগঞ্জ, কাশীগঞ্জ বাজার, ধলাপড়া, দেওপাড়া, বল্লা ও বাশাইল থানা থেকে লেজ তুলে পিছু হঠতে বাধ্য হচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওদের টাংগাইল শহর ছেড়ে জীবনেও আর গ্রামের দিকে পা বাড়াবার হিম্মত হবে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি। পাকিস্তানী দস্যুদের, তার বিচারের নামে প্রহসন ও তাকে বন্দী রাখার কোন অধিকার নেই। বঙ্গপিতাকে অবিলম্বে সসম্মানে ফিরিয়ে না দিলে, তাকে তার প্রিয়জনদের মাঝে আসতে না দিলে অবশিষ্ট পাকিস্তান অচিরেই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। পৃথিবীতে ঘাতক পাকিস্তানের নাম-নিশানা থাকবেনা। সারা বিশ্বের নেতৃবৃন্দ ও জনগনের কাছে আমার আবেদন- আপনারা নরপশুদের বলুন, বঙ্গবন্ধুকে ওরা সসম্মানে মুক্তি দিক।
ভাইয়েরা, বন্ধুরা, আমরা চরম আঘাত হানতে এগিয়ে যাচ্ছি। জানি না, আপনাদের সাথে এমনিভাবে আবার একত্রিত হতে পারবো কিনা। আপনারা আমাদের দোয়া করবেন, আমরা যেন শত্রু হননে নির্মম ও দুর্বার হতে পারি। আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে মহান ভারত, তার জনগণ ও
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৬

প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধীকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমার দেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য মহান ভুটানকেও অভিনন্দন জানাচ্ছি। সারা বিশ্বের কাছে আমাদের আবেদন, দিবালোকের মত সত্য; স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে ভারত ও ভুটানের মতো আপনারও স্বীকার করে নিন, স্বীকৃতি দিন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করুন। আমি শহীদ আত্মার শান্তি কামনা করে শেষ করছি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় যৌথ বাহিনী, জয় বাংলা ভারত মৈত্রী।’
সভাশেষে জনতা উৎফুল্লচিত্তে যার যার পথ ধরলেন। তাদের অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন। আর হানাদার অত্যাচারে অত্যাচারিত হতে হবেনা। স্বাধীন বাংলায় তাদের আর না খেয়ে মরতে হবেনা। বর্ষায় ভাঙাচাল দিয়ে টপটপ করে পানি পরবেনা। বিনা চিকিৎসায় তাদের মরতে মবেনা। ভবিষ্যৎ বংশধরেরা শিক্ষার সুযোগ পাবে, পাবে মাথা গোঁজার ঠাই। বাংলার ঘরে ঘরে আবার হাসির প্লাবন বইবে, মনের আনন্দে জেলে মাছ ধরবে, কৃষক হাল চালাবে, এমনি কত কি ভাবতে ভাবতে কল্পনায় ভবিষ্যতের একটি সুন্দর বাগান সাজাতে সাজাতে তারা যার যার ঘরে ফিরলো।
মেজর আনিস এগিয়ে গেল বাহাদুরাবাদ ও জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের মাঝামাঝি সুদৃঢ় অবস্থান গড়ে তুলতে। দুই নম্বর দলের কমাণ্ডার মেজর হাকিম ঘাটাইলের দিকে এগুতে শুরু করলো। এক নম্বর দলের নেতা মেজর হাবিবের দায়িত্ব পড়লো টাংগাইল-ময়মনসিংহ পাকা রাস্তা দখল নেয়ার। তিন নম্বর ও পাঁচ নম্বর দল নিয়ে গোপালপুর থানা দখলে বেরিয়ে পড়ার আগে নুরুন্নবী ও ক্যাপ্টেন পিটারকে ডাকলাম। ক্যাপ্টেন পিটার নিকড়াইলে মুক্তিবাহিনীর সারাদিনের কার্যক্রম দেখে যারপর নাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। ক্যাপ্টেন পিটার টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হবার পর থেকে সব সময় আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কত, আর স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যাই বা কত হবে? মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার ও যোদ্ধাদের সংগে বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলাপ আলোচনার সময় কৌশলে এ সম্পর্কে জানার চেষ্টাও করেছেন। এই প্রথম প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের এতবড় সমাবেশ দেখে এবং আমার বক্তৃতা শোনার পর তাঁর ধারণা হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কুড়ি-পঁচিশ হাজারের কম নয়। স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা লক্ষ্যাধিক। একজন সামরিক অফিসার এমন একটি বিশাল বাহিনীর নেতার পদমর্যাদা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সফল কর্মকাণ্ড দেখে ও ধীরে ধীরে মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা সম্পর্কে মোটামোটি একটা ধারণা হবার পর এবং সর্বোপরি আমার উপর ক্রমশ অপরিসীম আস্থা ও শ্রদ্ধা জানানোয় তিনি যেন প্রতি মুহুর্তে বেশী করে সম্মান দেখানোর চেষ্টা করছিলেন। ক্যাপ্টেন পিটারের প্রতি তার কর্তৃপক্ষের কড়া নির্দেশ ছিল, কাদের সিদ্দিকীকে মর্যাদা দেখানোর ব্যাপারে কখনো যেন তিনি কৃপনতা না করেন। যদিও আমার সাথে ক্যাপ্টেন পিটারের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী। প্রথম অবস্থায় তিনি যে সম্মান
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৭

দেখিয়েছেন তা আন্তরিক, না উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন, তা বোঝা না গেলেও ক্রমে ক্রমে নিজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অর্জিত ধারণা থেকে তার ব্যবহারের আন্তরিকতা ও বৈশিষ্ট্য থেকেই পরিস্কার হয়ে যায় যে, তিনি অকৃত্রিমভাবেই আমাকে সম্মান করেছেন, আস্থা ও বিশ্বাস করেছেন। গোপালপুর থানা অভিযানে বেরিয়ে পড়ার আগে ক্যাপ্টেন পিটারকে আরেক বার বললাম, ‘আপনাকে আগেই বলেছি, ম্যাপ পয়েন্ট সম্পর্কে আমার কেমন যেন একটা সন্দেহ রয়ে যাচ্ছে। আমি কিছুতেই সন্দেহমুক্ত হতে পারছিনা। তিনটা নির্দিষ্ট স্থানের দুইটার ম্যাপ পয়েন্ট আমার কাছে একটু ভুল মনে হচ্ছে। আমরা খুব সম্ভবত এ দুইটি একটু উত্তরে চিহ্নিত করেছি।’ ক্যাপ্টেন পিটার খুব ভালোভাবে ম্যাপের নথিং ও ইস্টিং লাইন মিলিয়ে দেখলেন। তাঁর পাঠানো বার্তার সাথে ডিগ্রির কোন গরমিল নেই। ক্যাপ্টেন পিটার নিশ্চিত হয়ে বললেন, ‘না স্যার, আমাদের চিহ্নিতকরণে ভুল নাও হতে পারে। আপনার সন্দেহ যদি সত্যও হয়, তাহলেও তা এক-দেড় মাইলের বেশী সরে যাবার সম্ভাবনা নেই। আপনি এ নিয়ে চিন্তা করবেন না।’ রাত এগারোটায় নিকড়াইল ত্যাগের সময় নুরুন্নবীকে বললাম, ‘তোমরা শেষ রাতে নিকড়াইল ত্যাগ করো। এত বড় একটা জমায়েতের পর নিকড়াইলে বেশী সময় থাকা ঠিক হবে না।’
দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধার বিশাল দুটি দল নিয়ে গোপালপুর থানা দখলের উদ্দেশ্যে ৮ই ডিসেম্বর দুপুরের পর ঝাওয়াইল পৌঁছলাম। পুরো দলকে গোপালপুর থেকে বেশ দূরে নিরাপদ অবস্থানে রাখা হলো। ঠিক হলো, সন্ধ্যার পরই গোপালপুর থানায় আঘাত হানা হবে। সন্ধ্যার পর যখন আমরা গোপালপুর থানার দিকে এগিয়ে যাবো ঠিক তখন ভারতের সীমান্তবর্তী ঘাঁটি থেকে আমাদের সংকেত গ্রাহক যন্ত্রে বিশেষ সংকেত আসতে থাকে। ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ আমার সাথে কথা বলতে চান। তারা সরাসরি ও. টি. সেটে কথা বলবেন। অপারেটর তাড়াতাড়ি সেট চালু করলো। সেট চালু হওয়া মাত্র অপর প্রান্ত থেকে অনুরোধ আসলো, ‘হেডকে দিন, ফাদার কথা বলবেন।’ ‘হ্যালো’ বলতেই অপর প্রান্ত থেকে পরিচিত কন্ঠ ভেসে এলো। ছোট্ট অনুরোধ, ‘জামালপুরে শত্রুর অবস্থান খুবই শক্ত। ভাঙা যাচ্ছেনা। আপনি পিছন থেকে জামালপুরের উপর আঘাত হানুন। যত শীঘ্র সম্ভব আঘাত করুন। ভাবনায় পড়ে গেলাম। কি করবো। আমরা জামালপুর থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে। গ্রাম- গঞ্জের ভিতর দিয়ে যেতে দূরত্ব আরো বেড়ে যাবে। একটু ভেবে নিলাম, এই দূরত্ব পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে যেতে কতটা সময় লাগবে? জামালপুর পৌছার পর শত্রু ঘাঁটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে মুক্তিযোদ্ধাদের কতটা বিশ্রামের প্রয়োজন? ভেবে-চিন্তে ঠিক করলাম, মোলপুর যাবো। মুক্তিযোদ্ধাদের অবশ্য ক্লান্তি ছিল না, থাকার কথাও নয়। আগে থেকে এমন ব্যবস্থা ছিল যে, মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়া ও সরবরাহের কোন চিন্তা-ভাবনা নেই। প্রয়োজন মত সব কিছুই হাতের কাছে পাওয়া যাবে।
৮ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জামালপুরের দিকে রওনা হওয়ার পর চার নম্বর বাহিনীর
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৮

কমাণ্ডার মেজর আনিসকে জামালপুর মধুপুরের মাঝে ধনবাড়ীতে আমাদের সাথে যোগ দিতে নির্দেশ পাঠালাম। এক নম্বর দলনেতা মেজর হাবিবকে নির্দেশ দেয়া হলো, পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত ময়মনসিংহ-টাংগাইল সড়ক দখল না নিতে।
গোপনীয়তা না রেখে সাহায্য চাওয়ায় আমার সন্দেহ হচ্ছিল। আর ভারতের সাথে যোগাযোগও করতে পারছিলাম না। সন্দেহ নিয়ে কোন কাজ করা ভাল নয়। তাই আমরা আর জামালপুরের দিকে না এগিয়ে দুই নম্বর দলের কমান্ডার মেজর হাকিমকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এগুতে বলা হলো। আমরা ঝাউয়াইল হয়ে ধনবাড়ীর দিকে এগুতে শুরু করলাম। একই সময়ে পশ্চিমের পিংনা-সরিষাবাড়ী থেকে মেজর আনিস তার দল নিয়ে ধনবাড়ীর দিকে অগ্রসর হলো। ঝাউয়াইল থেকে ধনবাড়ীর দিকে হাঁটতে ইটিতে বার বার জামালপুর আক্রমণের পরিকল্পনা আঁটছিলাম। আর জামালপুর অভিযান ভারতীয় সেনা বাহিনীর গোপনীয়তা না রেখে খোলাখুলি সাহায্য চাওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ উদ্ধারের চেষ্টা করছিলাম। রাত তিনটায় ধনবাড়ীর কাছে এক স্কুলের মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্রামের নির্দেশ দিয়ে মনে মনে ঠিক করলাম, আর জামালপুরের দিকে না এগিয়ে মেজর আনিসের দলের জন্যই অপেক্ষা করবো। একটু পরে ধনবাড়ীর দুই মাইল দক্ষিণে স্কুল মাঠে মেজর আনিস তার দল নিয়ে আমাদের সাথে মিলিত হলো। আমরা উভয় দলই দুই দিক থেকে কুড়ি মাইল পথ হেঁটে এসেছি।
সূর্যোদয়ের আগে আবছা আলোতে ধনবাড়ীর স্বেচ্ছাসেবক ও গ্রামবাসীদের সহায়তায় আমরা ভালোরকম নাস্তা করে পূর্বে মধুপুর থানার দিকে এগুতে লাগলাম। তিনটি দল একত্রে বেশ কয়েক মাইল পূবে এগুবার পর, তিন নম্বর ও পাঁচ নম্বর দল নিয়ে ডাইনে মোড় নিলাম। মেজর আনিসের দলটি দুইভাগে ভাগ হয়ে একদল মধুপুর, আরেক দল গোপালপুরের উপর আঘাত হানতে এগুতে থাকলো। ৯ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মুক্তিবাহিনীর হাতে মধুপুরে হানাদার ধাটির পতন ঘটলো। ৯ তারিখেই মেজর আনিসের দলের দ্বিতীয় অংশ গোপালপুর হানাদার ঘাঁটির উপর আঘাত হানলো। গোপালপুরে হানাদররা এবারও ঘাঁটির পতন রোধে সক্ষম হলো। পূর্ব পরিকল্পনা মত গোপালপুর আক্রমণে এগিয়ে না গিয়ে ১ তারিখে রাতে আমি গৌরাঙ্গী- চকের কাছাকাছি দত্তগ্রাম-নেয়ামতপুরে এলাম। দত্তগ্রাম-নেয়ামতপুরের আশেপাশে মেজর আবদুল হাকিম অপেক্ষা করছিল। সে তার দলটি তিনভাগে ভাগ করে তিনটা চিহ্নিত স্থানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাকা করেছে। মেজর হাকিমকে সাথে নিয়ে গৌরাঙ্গীচকের চারদিকে নিরাপত্তা গৌরাঙ্গীর উপর সবদিক থেকে শত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণের রাস্তা- ব্যবস্থা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। গুলোতে কঠোর সতর্ক পাহারার ব্যবস্থা করেছে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কোন খুঁত ধরা পড়লোনা। আমি যখন দুজায়গায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে মেজর হাকিমকে প্রশ্ন করলাম, মেজর হাকিম তখন খুব গর্বের সাথে উত্তর দিল, ‘এখানকার চাইতেও সেখানকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক সুদৃঢ় করা হয়েছে। আমি নিজে সেখানকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তদারকি করে এসেছি। এখানকার চাইতেও ঐ দুটি স্থানের যোদ্ধা সংখ্যাও কিছু বেশী। গৌরাঙ্গীচক থেকে দীঘলকান্দি আবদুল
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৯

হালিম চৌধুরীর বাড়িতে গেলাম। সেখানে একদিন আগে নুরুন্নবী ক্যাপ্টেন পিটার সহ তার দল ও সরঞ্জামাদি নিয়ে হাজির হয়েছিল। দীঘলকান্দিতে মেজর হাবিব ও মেজর হাকিমকে ডেকে শেষরাতে ঘাটাইল থানা অপারেশন কৌশল ঠিক করা হলো। থানায় সরাসরি আক্রমণ করবো ক্যাপ্টেন সবুরের দলসহ আমি নিজে। মেজর হাকিম প্রয়োজনে ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলা বর্ষণ করে থানা দখলে সাহায্য করবে।

ঘাটাইল থানা দখল
মেজর মোস্তফার একটি কোম্পানী থানার দুই-আড়াই মাইল দক্ষিণে কালিদাসপাড়া সেতুর দখল নেবে এবং সেতুটি ধ্বংস করে পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করবে এবং তারা মাঝেমধ্যে গুলি ছুঁড়বে। এতে যদি প্রলুব্ধ হয়ে ঘাটাইল থানার মূল ঘাঁটি থেকে কিছু হানাদার সেদিকে এগিয়ে যায়, তাহলে থানা দখলে বিশেষ সুবিধা হবে। দ্বিতীয়তঃ কালিদাসপাড়া সেতুতে বিস্ফোরণ ঘটার আধ ঘণ্টা পর মেজর হাবিব ঘাটাইল থানার এক মাইল উত্তরে বানিয়াপাড়া সেতু দখল করে উড়িয়ে দিয়ে অবস্থান নেবে। হানাদাররা যদি কালিদাসপাড়া সেতুর দিকে নাও যায়, এক মাইল উত্তরে বানিয়াপাড়া সেতু ধ্বংস হলে তারা অবশ্যই সেইদিকে যাবে। রাত দশটায় আমরা যার যার লক্ষ্যে এগুতে লাগলাম। ক্যাপ্টেন সবুর ও মেজর মোস্তফার দলসহ কালিদাসপাড়া সেতুর এক-দেড় মাইল পশ্চিমে সাধুটি স্কুল পর্যন্ত এগুলাম। রাত দুটায় মেজর মোস্তফাকে সাধুটি স্কুলে রেখে আমরা আরো উত্তরে অগ্রসর হওয়ার আগে মেজর মোস্তফাকে বললাম,
‘তোমার অস্ত্রের অভাব নেই, সহযোদ্ধাদের সংখ্যাও প্রচুর। আমি আশা করি তুমি সফল হবে। তোমার ঠিক সময়ে পুল দখলের উপর আমাদের থানা দখল নির্ভর করছে।’ বীর- ঘাটাইল পর্যন্ত এগিয়ে সেখানে মূল দল রেখে সত্তর জনকে নিয়ে করটিয়া কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক আবুল হোসেন সাহেবের বাড়িতে এলাম। বাড়িতে তেমন কেউ না থাকলেও তাড়াহুড়ো করে বাড়ির কাজের লোকেরা পরম যত্ন সহকারে রাত তিনটায় আমাদের ডাল-ভাত খাওয়ালেন। ঘড়ির কাটার সাথে তাল রেখে ঠিক চারটায় মেজর মোস্তফা কালিদাসপাড়া সেতুতে আঘাত হানবে। মেজর হাবিব চারটার দিকে বানিয়াপাড়া সেতুতে আঘাত করবে। ভোর সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে আমরা ঘাটাইল থানার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো। বীর ঘাটাইলের কুমুদিনী কলেজের অধ্যাপক আবদুস সাত্তারের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় বার বার ঘড়ি দেখছিলাম। ঠিক চারটায় কালিসাদপাড়ার দিক থেকে গুলির শব্দ আসতে শুরু করলো। গুলির শব্দ শুনে আরো দ্রুত পা চালিয়ে থানার পশ্চিমে রতনপুর মাদ্রাসার সামনে এলাম। ক্যাপ্টেন খোকা, ক্যাপ্টেন সবুর, ক্যাপ্টেন হবি তাদের কোম্পানী নিয়ে ঘাটাইল থানার পশ্চিম পাশে অবস্থান নিয়েছে। রতনপুর মাদ্রাসার সামনে মিনিট দশেক অপেক্ষা করতেই উত্তরে বানিয়াপাড়া সেতুতে মেজর হাবিব বিস্ফোরণ ঘটালো। কোন গোলা-গুলি ছাড়াই বিস্ফোরণ ঘটায় একটু বিস্মিত হলাম। দখলের আগে সেতুতে বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব নয়। আর দখল নিতে অন্ততঃ দু’একটি গুলি তো উভয় পক্ষ থেকে চলবে। তবে কি বিনা যুদ্ধে সেতু দখল হয়েছে?
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭০

সত্যিই তাই, সেই রাতে মেজর হাবিব গোলা-গুলি ছাড়াই সেতু দখল করে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। মিলিশিয়ারা সেই রাতে সেতুতে ছিল না, ছিল শুধু রাজাকার। মেজর হাবিব সেতুর কাছে গেলে পাশের গ্রামের একজন রাজাকার তাদের হাতে ধরা পড়ে। সে বলে, ‘পুলে কোন মিলিশিয়া নেই। রাজাকার যারা আছে, জীবন ভিক্ষা দিলে, তারা সারেন্ডার করতে রাজী আছে। যদি ছেড়ে দেন, আমি তাদের সবাইকে নিয়ে আসতে পারি।’ মেজর হাবিব তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে সেতুর আরো কাছে এগিয়ে রাজাকারটিকে ছেড়ে দেয়। রাজাকারটি তার কথা মতই কাজ করে। মিনিট দুয়ের মধ্যে ত্রিশ জন রাজাকার হাতিয়ার সহ দুই হাত উপর তুলে বানিয়াপারা সেতু থেকে ঢালু বেয়ে পশ্চিমে নেমে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তার নীচেই অপেক্ষা করছিল। রাজাকারদের তাৎক্ষনিকভাবে পাঠিয়ে দেয়। মেজর হাবিব রাত চারটার আগেই সেতু দখল করে সেতুতে বিস্ফোরক বসিয়ে সেফটি ফিউজ লাগিয়ে প্রহর গুনছিল। ঘড়ির কাঁটা ঠিক সাড়ে চারটা ছোয়ার সাথে সাথে সে ফিউজে আগুন দেয়। সাথে সাথে দিগ্‌-বিদিক কাপিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুমান মতো দুই সেতুর দিকে ঘাটাইল থানা থেকে সত্তর-আশি জন হানাদাররা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে যায়। ভোর পাঁচটায় আমরা ঘাটাইল থানায় আঘাত হানলাম। প্রথম ঝটিকা আক্রমনে ঘাঁটির উত্তর দিকটা আমাদের দখলে এসে গেল। কিন্তু সর্বত্র কংক্রিটের বাংকার থাকায় বাকী তিন দিকের বাংকারগুলো কিছুতেই দখল নিতে পারলামনা। ঘাটাইল থানায় তখন নিয়মিত সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার মিলে প্রায় আড়াইশ হানাদার ছিল। আশি-নব্বই জন দু’দিকে বেরিয়ে গেলেও বাকীরা শক্তভাবে ঘাঁটি আগলাচ্ছে। আধঘন্টা বার বার আক্রমণ চালিয়েও যখন পশ্চিম দিকের বাংকারগুলো দখল নেয়া সম্ভব হচ্ছিলনা, তখন ব্লাণ্ডার সাইট হাতে হানাদারদের যম দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা মজনু থানার সত্তর-আশি গজ পশ্চিমে একটি গাছের আড়াল নিয়ে ব্লান্ডার সাইট থেকে একটার পর একটা সেল নিক্ষেপ করে চললো। তিনশ’ জন মুক্তিযোদ্ধা দু’টি এম. জি., চারটি এম.এম. জি., চল্লিশটি এল. এম. জি. এবং অন্যান্য নানা ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে যা করতে পারছিলনা না, মজনু একটি ব্লাণ্ডার সাইটের পুনঃ পুনঃ আঘাত হেনে তা করতে সক্ষম হলো। ডাইনে-বামে একশ’ গজ জায়গা জুড়ে দৌড়াদোড়ি করে বার বার অবস্থান বদল করে দশ মিনিটে দুশ খানা সেল ছুঁড়ে থানার পশ্চিমের পাঁচটি বাংকারের তিনটি গুড়িয়ে দিল। আধঘন্টা মরনপন লড়াইয়ের পর পশ্চিমের বাংকারগুলো আমাদের দখলে এলো। থানার উত্তর ও পশ্চিমের বাংকারগুলো দখল নিতে আমাদের চারজন গুরুতর আহত হলো। উত্তর ও পশ্চিম মুক্তিবাহিনীর দখলে আসার পরও থানার পুরোপুরি দখল নেয়া সম্ভব হচ্ছেনা দেখে এক মাইল পশ্চিমে পিছিয়ে রতনপুরের ফারুকের বাড়ির পাশে মর্টার নিয়ে অবস্থানরত মেজর হাকিমের কাছে গেলাম। হাকিম ভোর চারটা থেকে গোলা ছোড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল। অথচ সকাল ছটা পর্যন্ত একটাও গোলা ছুঁড়তে পারেনি। কারণ, সে গোলা ছোঁড়ার কোন নির্দেশ পায়নি। আমাকে দেখা মাত্র মেজর হাকিম দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার, আমি কি করবো? আমার মর্টারের কি কোন দরকার নেই?’
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭১

না কমাণ্ডার, শেষ পর্যন্ত দেখছি থানা দখলে তোমার মর্টারের বেশী দরকার হয়ে পড়েছে।
মেজর হাকিম গোলা নিক্ষেপ করতে প্রস্তুত হলো। গোলা ছুঁড়তে গিয়ে সমস্যা দেখা দিল, তা হলো মুক্তিযোদ্ধারাও হানাদার ঘাঁটিতে প্রায় ঢুকে পড়েছে। একই জায়গায় শত্রু ও মিত্র বেছে মেজর হাকিম কি করে গোলা ছুঁড়বে? বাধ্য হয়ে মেজর হাকিমের আরও আধঘন্টা অপেক্ষা করতে হলো। উত্তর ও পশ্চিমের বাংকার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দু’শ গজ পিছিয়ে এলো। সাড়ে ছয়টায় মেজর হাকিম মর্টার থেকে গোলা ছুঁড়লো। গোলা লক্ষ্যস্থল থেকে কতদূরে এবং কোন্ দিকে পড়ছে তা দেখার জন্য একজন সহযোদ্ধাকে ও. পি. রাখা হলো। পর্যায়ক্রমে খবর আসতে লাগলো, মেজর হাকিমের প্রথম গোলা থানা পার হয়ে দুতিনশ গজ পিছনে পড়েছে। দ্বিতীয় গোলা খানার দুইশ’ গজ ডানে ও তৃতীয় গোলা পড়লো থানার পিছনে পাকা রাস্তায়। মেজর হাকিম পঞ্চম ও ষষ্ট গোলাতেই তার নির্দিষ্ট নিশানা পেয়ে গেলো। ষষ্ট গোলা থানার মূল ঘরের টিনের চালে গিয়ে পড়লে ও. পি, আনন্দে লাফিয়ে উঠে। সে সাথে সাথে পিছনে সংকেত পাঠায়, টার্গেট ঠিক হয়ে গেছে। এরপর মেজর হাকিমের সেকি রুদ্রমূর্তি। তার দ্রুত হাত চালনা দেখবার মতো।
একটানা দশ-বারোটি গোলা ছোড়ার পর দৌড়ে পিছনে, সামনে এবং ডানে-বামে গিয়ে মাথা নীচু করে ব্যারেলের দিকে উঁকি মেরে কি যেন দেখে নিয়ে আবার দৌড়ে মর্টারের কাছে এসে ব্যারেল ঠিক করে দশ-বারো কিংবা পনেরটি গোলা ছুঁড়ছে। আবার সেই পূর্বের মত সামনে পিছনে এবং ডানে-বামে থেকে ব্যারেলের দিকে উঁকি-ঝুঁকি মারা। এমনি করে আধঘন্টায় সে দু’শটি গোলা নিক্ষেপ করলো, যার একশসত্তর খানা ঘাটাইল থানার উপর পড়ে একেবারে তছনছ করে দেয়। ঘাটাইল থানা দখনে মেজর হাকিম যে অব্যর্থ লক্ষ্য ও ক্ষিপ্রতার সাথে মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম অবিস্মরণীয় ঘটনা |
মেজর হাকিম মর্টার থেকে গোলা ছোড়ার সময় মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে পিছনে এবং ডান-বাম থেকে ব্যারেলের দিকে উকিঝুঁকি মারছিল এই জন্য যে, তার কাছে মর্টারের রেঞ্জ- ফাইণ্ডার ছিল না। তাই মর্টার প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার বসিয়ে মর্টারের ব্যারেলের সরাসরি দশ-পনের হাত সামনে-পিছনে ও ডানে-বামে চারটি আড়াই থেকে তিন হাত লম্বা কাঠি গেড়ে রেখেছিল। মর্টার থেকে প্রথম গোলা ছোঁড়ার পর গোলা যখন থানার তিনশ’ গজ পিছনে পড়লো তখন মেজর হাকিম বামের কাঠি উঠিয়ে দুতিন ইঞ্চি পিছনে এনে গেড়ে দেয়। কাঠি একটু সরিয়ে দ্বিতীয় গোলা নিক্ষেপ করে ও. পি. -র সংকেতের অপেক্ষা করতে থাকে। সংকেত আসে, গোলা থানার দুশ গজ পিছনে একটু বাম দিকে পড়েছে। ডান পাশের কাঠি ইঞ্চি দুই পিছনে সরিয়ে আবার গোলা নিক্ষেপ করে। এবার খবর এলো, গোলাটি সামান্য ডানে একশ’ গজ পিছনে পাকা রাস্তার উপর পড়েছে। মেজর হাকিম এবার ডানের কাঠি আরো ইঞ্চি খানেক পিছনে সরিয়ে এবং সামনের কাঠি একটু বামে নিয়ে চতুর্থ গোলা নিক্ষেপ করে। এইভাবে সামনের, পিছনের, ডাইনের,
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭২

বামের কাঠি নাড়িয়ে চাড়িয়ে ষষ্ঠ গোলায় নিশানা পেয়ে যায়। সত্যিকার অর্থে ঐ কাঠিতেই ছিল মেজর হাকিমের যত যাদুমন্ত্র।
মজনুর রাণ্ডার সাইট এবং মেজর হাকিমের মর্টারের গোলার আঘাতে সকাল সাতটায় থানার পতন ঘটলো। নিয়মিত খান-সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার মিলে মোট একশ ত্রিশ জন মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়লো।
মেজর হাকিমের মর্টারের প্রথম গোলার আঘাতেই থানার অফিস ঘরে চার জন হানাদারের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। থানা দখলের পর অফিসঘরে চারটি ছিন্নভিন্ন দেহ ও মজনুর ব্লাণ্ডার সাইটের আঘাতে ধ্বসে যাওয়া বাংকার থেকে দশ-বারোটি থেঁতলে যাওয়া দেহ পাওয়া গেল। অফিসঘরে পড়ে থাকা চারটি ছিন্নভিন্ন দেহই পাওয়া গেল থানার সিন্ধুকের কাছে। হয়তো অবস্থা শোচনীয় ভেবে সিন্ধুকে রাখা লুটের মালামাল নিয়ে পগার পার হওয়ার ধান্ধায় ছিল। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। কালিদাসপাড়া ও বানিয়াপাড়া সেতুর দিকে যাওয়া রাজাকার ও মিলিশিয়ারাও মুক্তিবাহিনীর হাতে কেউ ধরা পড়লো, কেউ কেউ বা আত্মসমর্পণ করলো। কালিদাসপাড়া সেতু দখল নিতে গিয়ে মেজর মোস্তফার দলের একজন শহীদ ও দু’জন আহত হলো।
অপর দিকে ১০ই ডিসেম্বর সকালে জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে মার খাওয়া হানাদার বহনকারী সামরিক ও বেসামরিক চারশ গাড়ির কনভয় মধুপুরের দিকে পিছিয়ে আসতে থাকে। মেজর আনিস ও ক্যাপ্টেন আরজু হানাদারদের বিশাল বাহিনী মধুপুরের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে মধুপুর ঘাঁটি ছেড়ে পিছিয়ে আসে। হানাদার ব্রিগেডিয়ার কাদের খাঁ, ব্রিগেডিয়ার আক্তার নেওয়াজের ও কর্ণেল সুলতান মাহমুদের কমাণ্ডে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছয় হাজার নিয়মিত সৈন্য টাংগাইলের রাস্তা ধরে ঢাকার দিকে আত্মরক্ষায় পিছিয়ে আসতে থাকে। দুপুর বারোটায় তারা ঘাটাইলের উত্তরে বানিয়াপাড়া সেতুতে মেজর হাবিবের দ্বারা আক্রান্ত হয়। বাধা পেয়ে হানাদাররা কনভয়ের উপর বসানো পনের-কুড়িটি মেশিনগান থেকে একসাথে বৃষ্টির মত গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। মেজর হাবিব সামনে বিরাট হানাদার বাহিনী দেখে বেশীক্ষণ বাধা না দিয়ে পশ্চাদপসরন করে। পশ্চাদাপসরনের সময় তিনজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়। মেজর হাবিব বানিয়াপাড়া প্রতিরক্ষা তুলে নিলে ঘাটাইল থানায় বেশীক্ষণ থাকা সমীচীন বোধ হলো না। মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে দুই মাইল পশ্চিমে পিছিয়ে যাবার নির্দেশ দিলাম।
আমরা পিছিয়ে গোয়ালগণ্ডার আধা মাইল উত্তরে বিলের মাঝে একটি গ্রামে গিয়ে উঠলাম, সেই বাড়ির অর্ধেক লোকজনও পশ্চিমে সরে গিয়েছিলেন। বাড়িতে উঠলে ভিতর থেকে সতের-আঠার বছরের একটি মেয়ে বেরিয়ে এসে কোন পরিচয় না দিয়ে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “ছোট ভাই, কেমন আছেন?” আমি মেয়েটিকে এর আগে কখনো দেখিনি। তাই ‘ছোট ভাই’ বলে সম্বোধন করায় প্রথমে একটু বিস্মিত হলাম। আমাকে ‘ছোট ভাই’ বলে ডাকে শুধুমাত্র আমার ছোট ভাই-বোনেরা এবং ছোট ভাই-বোনদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবীরা। মেয়েটি আমার দিকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৩

কিছুটা অবাক হয়ে অকিয়ে আবার বললো, ‘আমাকে চিনতে পারছেননা? আমি রহিমার সাথে কুমুদিনী কলেজে পড়ি।’ মেয়েটিকে আমি চিনতে না পারলেও মেয়েটি আমাকে চেনে। মেয়েটির কথা শুনে বললাম, ‘ওছ, তুমি রহিমার সাথে পড়। কেমন আছ? কতদিন হয় বাড়ি এসেছ?’ মেয়েটি নিঃসংকোচে সমস্ত কথার উত্তর দিল।
আমরা দেড় ঘন্টা সে বাড়িতে কাটালাম। আমাকে ও আমার দলের প্রায় আশি মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ির ছয়-সাত জনে মিলে পরম যত্ন সহকারে বসতে দেয়া, খেতে দেয়া, সব কিছুতেই কুমুদিনী কলেজের ছাত্রীটি অন্যান্য সকলকে তড়িং কর্মতার দিক দিয়ে হার মানিয়ে দিন দুপুরে খাওয়ার সময় আশীজন মুক্তিযোদ্ধার একজনও বাদ পড়ল না, যাকে মেয়েটি নিজ হাতে তরকারী, ভাত, ডাল অথবা পানি এগিয়ে দেয়নি।

বিমান সাহায্যের অনুরোধ
বেতারে ক্যাপ্টেন পিটারের সাথে যোগাযোগ করলাম। তাকে বললাম, ‘ঘাটাইল ও গোপালপুর থানায় বিমান সাহায্য প্রয়োজন। আপনি কর্তৃপক্ষকে ঘাটাইল ও গোপালপুরে বিমান সাহায্য দিতে বলুন। সাবধান মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটির দু’তিনশ গজের মধ্যে পৌঁছে গেছে। হামলা যেন ঘাঁটির মধ্যে সীমিত থাকে। ঘাঁটির পঞ্চাশ গজ বাইরে বিমান থেকে ছোড়া একটি বুলেটও যেন না পড়ে।’ ক্যাপ্টেন পিটার বললেন, ‘স্যার, আমার সঙ্গে কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ এখনও চালু রয়েছে। আমি একটু আগেও আপনাকে বার কয়েক পাবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পাইনি। কর্তৃপক্ষ জানতে চেয়েছেন, আমাদের দেয়া পয়েন্টগুলো নিরাপদ আছে কিনা। আজ যে কোন সময় একটি বিশেষ ম্যাসেজ আসতে পারে। এই ব্যাপারে তাদের কি জানাবো?’
– এখনও সব ঠিক আছে। তবে বিশেষ কাজটির জন্য তৈরী হতে যেন আমাদের হাতে এক ঘন্টা সময় থাকে, এটা আপনি জানিয়ে দিন।
– স্যার, আমি আপনার বার্তা এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। আধঘন্টার মধ্যে আবার আপনার সাথে যোগাযোগ করবো।
টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে এই প্রথম ভারতের কাছে বিমান সাহায্য চাওয় হলো। আমি তখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই, বিমান সাহায্য আসবে কিনা এবং আসলে তা কখন আসবে। নানা কথা ভাবতে ভাবতে আধঘন্টা পর যখন বিলের মাঝের বাড়ি থেকে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বো, তখন বেতারে সংবাদ আসতে লাগলো। ক্যাপ্টেন পিটার জানালেন, বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছি। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এক ঘণ্টার মধ্যে বিমান সাহায্য আসছে। এরপর যখনই বিমান সাহায্যের প্রয়োজন হবে, অনুরোধ পাবার আধ ঘন্টার মধ্যেই বিমান সাহায্য পাঠাবেন। ক্যাপ্টেন পিটারের কথা শুনে খুব খুশী হলাম। পিটারের সাথে বেতারের লাইন কেটে দিয়ে তাড়াতাড়ি গোপালপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। গোপালপুরকে পাওয়া গেল। তাদের নির্দেশ দিলাম, ‘তোমরা থানা থেকে পাঁচশ গজ পিছিয়ে যাও। এখনি তোমাদের জন্য বিমান সাহায্য আসছে। হানাদার ঘাঁটির উপর বিমান হামলা শেষ হবার আগে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৪

তোমরা এগিয়ে যাবেনা। বিমান আক্রমণ হবার পরও এগিয়ে যাবার আগে আমার সাথে যোগাযোগ করো।’ ঘাটাইলের দিকেও দূত পাঠানো হলো। কেউ যেন থানার দিকে না যায়। বিমান সাহায্য আসছে।
ঠিক তিনটায় ভারতীয় তিনটি মিগ-২১ ঘাটাইল ও গোপালপুর থানার উপর উপর্যুপরি ষ্ট্রাপিং শুরু করলো। আমি ঘাটাইল থানার এক মাইল দূরে বীর ঘাটাইলের একটি বিরাট বট গাছের নীচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলাম। বিমান একবার করে ছোঁ মারছে আর মেশিন গানের বিকট শব্দে পুরো এলাকাটা থর থর করে কেঁপে কেঁপে উঠছে। থানা এলাকা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে পাহাড় সমান উঁচু হয়ে কালো ধোঁয়া উঠছে। এতদিন মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির উপর হানাদার বিমান এমনি করে মেশিনগান চালাতো, রকেট শেল নিক্ষেপ করতো, বোমা ফেলতো, মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উঠে আকাশে মিলিয়ে যেতো। আজ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো। আজ মুক্তিবাহিনীর উপর বিমান হানা হয়নি, হয়েছে হানাদরদের উপর। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাহিনী হিসাবে নিজেদের দাবী করলেও একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এটা প্রমাণ করে দিয়েছে, পাকিস্তান বাহিনী অজেয় নয়, দূর্দান্ত পাল্টা মারের মুখে তারা ভীরু ও দুর্বল। তারা নিরপরাধ নিরস্ত্রের সাথে সাহস দেখাতেই বেশী ওস্তাদ। আগষ্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের নানা স্থানে নিরীহ জনগণ ও অসংগঠিত প্রশিক্ষনহীন মুক্তিযোদ্ধাদের উপর বীরত্ব দেখাতে পারলেও, আগষ্টের পর থেকে আর খুব বেশী পারেনি। আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন টাংগাইল, পাবনা, ময়মনসিংহ ও ঢাকার কিছু জায়গায় জুলাই মাস থেকেই হানাদারররা দাও বসাতে বা কোন কেরামতি দেখাতে পারেনি। আক্টাবরের পর তো মারের গতিটাই সম্পূর্ণ পাল্টা যায়। তখন মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ কৌশল আক্রমনাত্মক আর হানাদারদের ভূমিকা হয়ে পড়ে আত্মরক্ষামুলক। প্রথমতঃ হানাদাররা তড়পাতো। টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর উত্তরোত্তর আক্রমণাত্মক ভূমিকায় সফলতা অর্জনে তাদের সেই তড়পানিও বন্ধ হয়ে যায়। জান বাচানোই তখন হানাদারদের প্রথম প্রধান ও শেষ লক্ষ্য হয়ে পড়ে। হানাদার বিমান বাহিনীর ক্ষেত্রেও কথাটা সমভাবে প্রযোজ্য। প্রতিরোধহীন ও পাল্টা হামলার আশঙ্কামুক্ত খোলা আকাশে তারা নির্বিচারে বাংলায় যত্রতত্র বোমা বর্ষণ করেছে। কিন্তু ভারতীয় বিমান বাহিনী যখন আঘাত হানলো, তখন হানাদাররা একটি বিমানও আকাশে উড়াতে পারেনি। মিগ-১১ ও স্যাবর জেট মিলিয়ে বাংলাদেশে হানাদারদের সাতশ আটশটি যুদ্ধ বিমান ৭ই ডিসেম্বরের মধেই সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়। মিত্র বাহিনীর বিমানকে বাঁধা দেবার মতো বিমান শক্তি আর হানাদারদের ছিলনা।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিনটি বিমান বিনা বাঁধায় গোপালপুর ও ঘাটাইল থানায় ষ্ট্রাপিং ও বোমা বর্ষণ করে চলে গেল। বিমান হামলার বার্তা বেতারে ইন্টারসেপ্ট করে হানাদাররা গোপালপুর ঘাঁটি ছেড়ে দিয়েছিল। তবে তারা ঘাঁটি ছাড়লেও দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে পারেনি, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে যায়। এখানে রাজাকার, মিলিশিয়া ও নিয়মিত খান সেনা সব
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৫

মিলিয়ে মোট তিনশ পঞ্চাশ জন হানাদার মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। বিমান আক্রমণে ঘাটাইল থানা হানাদার মুক্ত হয়ে গেলেও তখনই আমরা থানায় গিয়ে উঠলাম না। কারণ ঐ সময় বানিয়াপাড়া সেতুর পাশে রাখা কয়েকশ মণ পাট ভাঙা সেতুর নীচে খাদে ফেলে তার উপর মাটি চাপা দিয়ে হানাদাররা কোন রকমে গাড়ী পার করে আমাদের সামনে দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছিল। কচ্ছপ গতিতে গাড়ির বহর টাংগাইলের দিকে যাচ্ছে। গাড়িতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় প্রতিটি গাড়ির পেছনে কুড়ি পঁচিশ জন, আবার কোন কোন গাড়ির পেছনে আরো বেশী লোক হেঁটে যাচ্ছে। এদের বেশীরভাগই রাজাকার অথবা হানাদারদের সহযোগী মুসলীম লীগ, জামাতে ইসলামী ও অন্যান্য দলের দালাল। রক্ষা কর্তা প্রভুরা প্রাণভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। এতদিন তারা খুঁটির জোরে যৎকিঞ্চিত হলেও বানর নাচ নেচেছে। এমনিতেই করুণ অবস্থা, তার উপর হানাদাররা চলে গেলে তাদের যে কি নিদারুণ ভয়াবহ পরিণতি হবে ভেবে ‘যেতে নাহি দিব’ নয়, ‘আমরাও যাবো’, প্রাণ বাঁচার ক্ষীণ আশার গোঁ ধরে তারাও হেঁটে সাথে চলেছে। তখন হানাদারদের ভাবখানা এই, ‘নিজেরাই বাঁচিনা, নিজেদেরই জায়গা হচ্ছেনা, তোমাদের নেব কি করে? তোমাদের কাজ তো শেষ। এখন আর দরকার কী? যাও মুক্তিবাহিনীর হাতে মর গিয়ে। অপকর্মের সিংহভাগ তো তোমরাই করেছ।’
চলার পথে দুএকবার এও দেখা গেল, কোন রাজাকার গাড়িতে উঠার চেষ্টা করছে, অমনি পাকিস্তানী হানাদাররা লাথি মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দিচ্ছে। ১১ই ডিসম্বর সকাল থেকে টাংগাইল শহরেও এই ধরনের শত শত ঘটনা ঘটে। হানাদাররা প্রাণ বাঁচাতে বাসে, ট্রাকে, ট্যাক্সি- জীপে ঢাকার দিকে পালাচ্ছে আর ‘পুরাতন ভৃত্য’ রাজাকার, আল বদর, আল সাম্স ও দালালের দল সাথে যাবার জন্য গাড়ীতে উঠার চেষ্টা করছে। খান সেনারা তাদের ঘাড় ধরে, লাথি মেরে, বন্দুকের বাট দিয়ে গুতিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে। এত কিছুর পরও পিছু চলা ও গাড়িতে উঠার প্রাণান্তকর প্রয়াসের বিরাম নেই। অনেক কুখ্যাত বাঘা বাঘা দালালদেরও হানাদাররা এমনি ছিড়ানো আঁখের মত ছুঁড়ে ফেলে গিয়েছিল।

ছত্রীসেনা অবতরণ
বিকাল চারটায় বেতারে বার্তা এলো। সেই বিশেষ বার্তা, ছত্রীসেনা আসছে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে তারা টাংগাইলের আকাশে ছড়িয়ে পড়বে। খবর পাওয়ার সাথে সাথে মেজর হাকিমকে শেষ বারের মতো সতর্ক করে দিলাম, ‘তৈরী হয়ে যাও। তারা আসছেন। যে ভাবেই হোক তাদের এক ঘন্টা নিরাপদে রাখতে হবে।’ এদিকে তখন হানাদারদের সর্বশেষ গাড়িটি শোলাকুরা পেরিয়ে আরো দক্ষিণে চলে গেছে। টাংগাইলের আকাশে এক ঝাঁক বিমান দেখা গেল। টাংগাইল, কালিহাতী, ঘাটাইলের উপর দিয়ে দুটি মিগ-২১ তিন চার বার চক্কর দিল। বিমানগুলো প্রতিবারই নীচু হয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দেখিয়ে যাচ্ছিল। এর অর্থ বুঝতে আমাদের দেরী হলোনা। আমরা ধোঁয়ার কুণ্ডলী জ্বালিয়ে বিমান দু’টিকে সংকেত দিলাম। সংকেত বুঝার পর সে দুটি অনেক উপরে উঠে গেল অনেক উচুঁতে চক্কর মারা বিমানের ঝাঁকগুলো নীচে নেমে এলো। বিমান
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৬

গুলোকে খুব ধীর গতির মনে হচ্ছিল। নীচ দিয়ে দুই-তিন বার চক্কর দিয়ে দশ-বারোটি বিমানের ঝাঁক একদল ছত্রীসেনাকে নামিয়ে দিল। হুট করে বিমান থেকে বেরিয়ে আসা ছত্রীসেনাদের ঐ এলাকার মানুষ প্রথম লিফলেট বলে মনে করেন। কিন্তু তাদের ধারনা অল্পক্ষণের মধ্যে বদলে যায়। উড়তে থাকা কাগজের টুকরোগুলো যেন ক্রমশঃ বড় বিভিন্ন রং-এর ফুল, একটু পরে আবার ছাতার আকার নিতে লাগলো। প্রথম ঝাঁক বিমান একদল ছত্রীসেনাকে ছেড়ে সরতে না সরতে আর এক ঝাঁক এসে আরেক দল সেনাকে নামিয়ে দিল। এমনিভাবে এক ঘণ্টা ঘুরে ঘুরে তারা ছত্রীসেনাদের ছাড়তে লাগলো। কলিহাতী-পুংলির মাঝামাঝি আকাশ তখন ছত্রীসেনায় ছেয়ে গেছে। তাঁরা আস্তে আস্তে হেলেদুলে নীচে নামছেন। ছত্রীসেনারা যতই নীচে আসছেন, তাদের প্যারাসুট গুলো ততই বড় দেখা যাচ্ছে। আকাশে তখন অন্য কোন বিমানের আনাগোনা নেই। শুধু ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুটা ফাইটার কয়েক হাজার ফুট উঁচু দিয়ে চক্কর মারছে। সন্ধ্যার একটু আগে ছত্রীসেনারা একে একে টাংগাইলের মাটিতে নামতে থাকে। ছত্রীসেনা অবতরণের পর দেখা গেল, আমার সন্দেহই সঠিক হয়েছে। চিহ্নিত তৃতীয় স্থানের কিছু পশ্চিম দক্ষিণেই ছত্রীবাহিনীর বেশী অংশটা নেমেছে। অল্প-সংখ্যক ছত্রীসেনা প্রায় আধ মাইলের ব্যবধানে পড়েছে। তৃতীয় চিহ্নিত স্থান থেকে দুমাইল সোজা দক্ষিণে সত্তর-আশি জনের একটি দল পড়েছে। যদিও দ্বিতীয় চিহ্নিত স্থানের পশ্চিম প্রান্তে অবতরণ করা ছত্রীসেনাদের মুক্তিযোদ্ধারা সাথে সাথে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয় কিন্তু অন্য স্থানে অবতরণ করা ছত্রীসেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগ ঘটতে ঘটতে অনেক রাত হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ক্যাপ্টেন পিটারকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ক্যাপ্টেন পিটার এবং ছত্রীসেনা কর্ণেল দু’জনেরই মত, ‘স্থান চিহ্নিতকরণ ঠিকই ছিল, ছত্রীসেনাও ঠিক স্থানে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু প্রবল বাতাস থাকার কারণে নির্দিষ্ট স্থান থেকে তাঁরা কোন জায়গায় এক মাইল, কোন জায়গায় আধ মাইল দূরে গিয়ে পালিয়ে যাওয়া শত্রুদের একেবারে ঘাড়ের উপর পড়ে। এতে যদিও ছত্রীসেনাদের পনের-কুড়ি জন নিহত হন, তবু যুদ্ধের জন্য এটা শাপে বর হয়েছিল।’
ছত্রীসেনা অবতরণের সাথে সাথে দক্ষিণে এগুতে লাগলাম। আমার প্রথম ও প্রধান কাজ, ছত্রী সেনাদের মূল নেতার সাথে যোগাযোগ স্থাপন। কারণ পূর্বেই জানানো হয়েছিল, আমার যোগাযোগের জন্য ছত্রীসেনারা অপেক্ষা করবেনা। রাত আটটায় দীঘলকান্দি এসে পৌছলাম। এখানে আগে থেকেই নুরুন্নবী ও কাপ্টেন পিটার অবস্থান করেছিলেন। ক্যাপ্টেন পিটার একেবারে পাগলের মতো বারংবার বলতে লাগলেন, ‘স্যার, এখন প্রতিটা মিনিট যারপর নাই মূল্যবান। আমাকে কর্তৃপক্ষ বার বার জানিয়েছেন, আপনার সাথে ছত্রীসেনা দলের নেতার তাৎক্ষণিক যোগযোগ হওয়া দরকার। আপনি তাড়াতাড়ি লোক পাঠান। আমাদের সাথে ছত্রীসেনার যে ফ্রিকোয়েন্সি দেয়া হয়েছিল, তা কাজ করছে না। পিটারকে আশ্বস্ত করে বললাম, যোগাযোগের সমস্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমার ধারণা গভীর রাতে ছত্রীবাহিনীর মূল নেতাকে পেয়ে যাব।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৭

মধুপুর, গোপালপুর, কালিহাতী থানাসহ শোলাকুরা পর্যন্ত পাকা সড়ক মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ দখলে। পলায়নপর হানাদাররা পুংলি থেকে ফুলতলার মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছিল। হানাদাররা ময়মনসিংহ, জামালপুর থেকে বিধ্বস্ত হয়ে পিছিয়ে আসার সময় ১০ই ডিসেম্বর সারাদিন মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্নস্থানে তাদের পিছনে বার বার হামলা করেছে। মধুপুর থেকে শোলাকুরা পর্যন্ত পৌঁছতেই মুক্তিবাহিনীর লাগাতার চোরা গুপ্তা হামলায় হানাদাররা প্রায় কুড়িটি গাড়ি ও শতাধিক নিয়মিত সেনা খুইয়েছে। তিন ইঞ্চি মর্টার, রকেট লাঞ্চার, ব্লাণ্ডার সাইট ও মেশিন গানের পূনঃ পুনঃ আঘাতে শত্রুরা অতিষ্ট হয়ে পড়েছে। ভীত, সন্ত্রস্ত হানাদারদের মনে হতে থাকে রাস্তার প্রতি ঝোপে, প্রতি বাকে মুক্তিবাহিনী তাদের ঘাড় মটকে দিতে পারে। পশ্চাদপসরনে ব্যস্ত খান-সেনাদের মানসিক বিপর্যয়ের দিকটা আমাদের বুঝতে বাকী রইলোনা। আমার বার বার মনে হচ্ছিল, আর একটু চাপ দিতে পারলেই সব হানাদারদের ধরা যাবে। সেই মতই দুপুরের পর যখন টাংগাইল-ময়মনসিংহ রাস্তার উপর মুক্তিবাহিনীর চাপ আরো বাড়ানো হয়েছিল, তখন ছত্রীসেনা অবতরণের খবর আসে। খবর আসার সাথে সাথে মুক্তিবাহিনীর মর্টার আক্রমণ বন্ধ করে দেয়া হলো। ছাত্রীসেনা নামিয়ে নিয়ে বিমান গুলো চলে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা পরও হানাদারদের উপর আর মর্টার হামলা করা সম্ভব হলোনা। আমাদের তখনও সঠিক জানা নেই, ছত্রীসেনারা কোথায় কোথায় অবতরণ করেছেন। তাই আমরা চাইছিলাম না আমাদের মর্টারের গোলার আঘাতে কোনও ছত্রীসেনার ক্ষতি হোক। ঐ কারণে বিকেল সাড়ে চারটার পর থেকে মর্টার ফায়ার বন্ধ রাখা হলো এবং তা বন্ধ থাকলো পরদিন সকাল সাতটা পর্যন্ত।

জামালপুরের পতন
জামালপুর-ময়মসিংহের উপর দিয়ে মিত্রবাহিনীর দুটো ব্রিগেড ঢাকার দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। আমার দল নিয়ে ৯ তারিখ জামালপুর না গিয়ে ধনবাড়ীর কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছিলাম। ৮ তারিখ মাঝরাতে জামালপুর থেকে মধুপুর পিছিয়ে এসে এক ব্যাটেলিয়ান হানাদার সেনা পশ্চাৎরক্ষার জন্যে অবস্থান নেয়। বেশ কিছু হানাদার আবার জামালপুরের দক্ষিণে সমস্ত এলাকাটা জুড়ে একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এতে হানাদারদের উত্তর দিকের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী পিছন থেকে আক্রমণ করছে এটা জানার পর তারা বেশ শঙ্কিতও বোধ করছিল। ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেরের নেতৃত্বে একটি ভারতীয় বিগ্রেড ৩রা ডিসেম্বর কামালপুরের পাশ দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করে। কামালপুরে দীর্ঘ লড়াই চালাবার পরও যখন হানাদার ঘাঁটির পতন ঘটলোনা, তখন কামালপুর ঘাঁটি মুক্তিবাহিনী ও বি. এস.এফ. দিয়ে ঘিরে রেখে ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের ব্রিগেড বকশীগঞ্জের দিকে এগুতে থাকে। বকশীগঞ্জ, শ্রীবর্দী ও শেরপুরে ছোট-খাটো যুদ্ধ করে তারা ৮ তারিখ দুপুরে জামাল- পুরের ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পাড়ে এসে পৌঁছে। জামালপুরের পাশে ব্রহ্মপুত্র প্রায় এক মাইল প্রশস্ত। অন্যদিকে দক্ষিণ পারে শত্রুর সুদৃঢ় ঘাঁটি। ব্রহ্মপুত্র ভারতীয় বাহিনীর সামনে তখন বিরাট বাধা। এই সময় মেজর জেনরেল গিল হানাদারদের পিছনের দিক থেকে আঘাত হানার জন্য বেতারে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৮

বার্তা পাঠাতে তুরা ঘাঁটিকে নির্দেশ দেন। সেইমতো আমার সাথে তুরা ঘাঁটির যোগাযোগ হয়। ৮ তারিখ রাতে জামালপুরে হানাদার ঘাঁটির উপর বার বার আঘাত হেনেও ভারতীয় বাহিনী বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। ৯ই ডিসেম্বর পূর্নোদ্যোমে আঘাত হানার পরিকল্পনা নিয়ে মহেন্দ্রগঞ্জের রিয়ার বেস থেকে মেজর জেনারেল গিল ও ব্রিগেডিয়ার ক্লের একটি জীপে জামালপুরের দিকে যাচ্ছিলেন। গাড়িটি মেজর জেনারেল গিল নিজে চালচ্ছিলেন। কামালপুর ও বকশীগঞ্জের মাঝে দূর্ভাগ্যজনকভাবে একটি এ্যান্টি ট্যাংক মাইনের বিস্ফোরণে তাদের গাড়ি উল্টে যায়। জীপের ডান অংশ প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেজর জেনারেল গিল দারুণভাবে আহত হন। মাইনের আঘাতে তার দুটি পায়ের পাতার সমস্ত মাংস উড়ে যায় এবং হাড় বেরিয়ে পড়ে। শিরা ও ধমনী কেটে যাওয়ায় মোটা ধারায় অনবরত রক্তক্ষরণ শুরু হয়। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে সাথে সাথে হেলিকপ্টারে প্রথমে তুরা ও পরে শিলং মিলিটারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়ির অন্য আরোহী ব্রিগেডিয়ার ক্লের আশ্চর্যজনক ও অলৌকিকভাবে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান।
৯ই ডিসেম্বর দুপুরের পর ভারতীয় বিগ্রেড জামালপুরের উপর আবার আক্রমণ চালান। এই সময় মুক্তি বাহিনীর কয়েকটি কোম্পানী ও ভারতীয় বাহিনীর একটা অংশ জামালপুর থেকে ডাইনে ও বামে অনেকদূর এসে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে দক্ষিণ পাড়ে আসতে সক্ষম হয়। বিকালে ভারতীয় বিমান বাহিনী জামালপুর হানাদার ঘাঁটির উপর এক ঘন্টা ধরে উপর্যুপরি আঘাত হানে। তারা জামালপুরে কয়েকখানা হাজার পাউণ্ডের বোমা ফেলেন। হাজার পাউণ্ডের বোমাগুলো হানাদারদের শক্ত ভিত নাড়িয়ে দেয়। বোমার আঘাতে কংক্রিটের বাংকার গুলো অধিকাংশই গুড়িয়ে যায়। রাতে আরো বেশ কিছু সংখ্যক ভারতীয় সেনা ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ পাড়ে আসেন। ভারতীয় বাহিনীর বড় অংশটা নদী পেরিয়ে এলেও তাদের সমস্ত যানবাহন নদীর উত্তর পাড়েই পড়ে থকে। গভীর রাতে দেখা গেল, জামালপুর হানাদার ঘাঁটিতে তেমন কোন সাড়াশব্দ নেই। উত্তর পশ্চিম দিক থেকে ভারতীয় বাহিনী আস্তে আস্তে জামালপুর শহরে এসে দেখেন, শহর প্রায় ফাঁকা। গাড়ি, অস্ত্রশস্ত্র যত্রতত্র ফেলে পাক-হানাদাররা পালিয়েছে। ভারতীয় সেনারা জামালপুরে শত্রুর সাথে একটা বিরাট সংঘর্ষের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছিলেন। অথচ জামালপুরে তাদের বড় সড় প্রতিরোধের মুখে পড়তে হলোনা। এতে তারা খুশীই হলেন। তাঁরা বলেন, চরম আঘাতের জন্য শক্তি সঞ্চিত রইলো। জামালপুর থেকে পালিয়ে যাবার সময় ভারত-বাংলা যৌথ বাহিনীর কাছে ছ’শ হানাদার সেনা ধরা পরে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই মৃত।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৯

টার্গেট টাংগাইল

উত্তর-দক্ষিণে যাওয়া ময়মনসিংহ-টাংগাইল সড়কের পশ্চিম অংশে আমরা যখন হানাদারদের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে চলছিলাম, তখন সড়কের পূর্ব অংশে অবস্থানরত সকল কোম্পানীকে রাস্তা অবরোধ করতে হেড কোয়ার্টার থেকে নির্দেশ দেয়া হলো। নির্দেশ পেয়ে পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ কমান্ডার তাদের কোম্পানী নিয়ে কালিহাতী থেকে টাংগাইল, টাংগাইল থেকে মির্জাপুর এই দীর্ঘ সড়কের স্থানে স্থানে হানাদারদের উপর পূনঃ পৌণিক আঘাত হানিছল, কোথাও বা ছিল আঘাতের প্রতীক্ষায়। ১০ই ডিসেম্বর সারাদিনের খন্ড খন্ড যুদ্ধে আমরা পর্য্যদপ্ত শত্রু সেনাদের কাছ থেকে তিনিটি আর. আর. একটি তিন ইঞ্চি মর্টার, দুটো এম. জি. সহ পাঁচ- ছ’শ নানা স্বয়ংক্রিয় চাইনিজ অস্ত্র ও লক্ষাধিক গুলি-গোলা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হই। এতগুলো আনকোরা নতুন অস্ত্র পেয়েও আমরা তাৎক্ষনিকভাবে তা কাজে লাগাতে পারলামনা। কারণ হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা সমস্ত অস্ত্রই অকেজো। কোনটার ম্যাগজিন নেই, কোনটার বোস্ট নেই, কোনটার ফায়ারিং পিন নেই, কোনটার আবার ব্রিজ ব্লক গ্রুপ নেই। ১০ তারিখের উদ্ধারকৃত অস্ত্রের কিছু চালু করবার জন্য কয়েকজন লেগে গেল। তারা অনেক চেষ্টা করে সন্ধ্যার মধ্যে প্রায় সত্তর-আশিটি চাইনিজ রাইফেল ও স্টেনগান মেরামত করে ফেলে। রাত এগারোটায় হানাদারদের পরিত্যক্ত কয়েকটি গাড়ি থেকে মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা ও স্বেচ্ছা সেবকরা পনের কুড়িটি সীল করা বাক্স ও সাত-আটটি বস্তা উদ্ধার করে দত্তগ্রাম স্কুলের সামনে নিয়ে এলো। আমি তক্ষুনি দত্তগ্রামে উদ্ধারকৃত মালামাল দেখতে গেলাম সীলকরা বাক্সগুলো বিস্ফোরকের। মুক্তিযোদ্ধারা বস্তাগুলো খুললে, বস্তাগুলো থেকে কিছু অমূল্য সম্পদ বেরিয়ে এলো। দত্তগ্রাম স্কুলের সামনে বস্তাগুলো একটার পর একটা খালি করা হলো। সব কটি বস্তাই নানা ধরনর লোহা-লক্করে ভরা। অনেক অপ্রয়োজনীয় লোহা-লক্করের মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আকঙ্ক্ষিত হাতিয়ারের ক্ষুদ্র অংশগুলো বাছতে থাকে। নানা ধরনের এক গাদা টুকরো লোহা খোঁজাখুঁজি করে আর. আর.-এর পাঁচটি ব্রীজ ব্লক পাওয়া গেল। আমাদের দখলের তিনটি আর.আর, এর একটারও ব্রীজ ব্লক ছিল না। পাঁচখানা ব্রীজ ব্লক পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে আমি খুব আনন্দিত হলাম। কিন্তু একি। ব্রীজ ব্লক পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল প্রথমটাতে ফায়ারিং পিন নেই, দ্বিতীয়টিতেও না, তৃতীয়টিতেও না, চতুর্থটিতে ফায়ারিং পিন আছে, পঞ্চমটিতে নেই। একটি ভাল ব্রীজ ব্লক গ্রুপ পাওয়াতেই আমরা দারুণ খুশী। টুকরো লোহার স্তূপ থেকে বেছে দুটি এম.জি.-র প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করাও সম্ভব হলো। আর. আর.-এর ব্রীজ ব্লক হাতে নিয়ে দুচার বার নেড়েচেড়ে দেখে একজন সহযোদ্ধার হাতে দিয়ে ব্রীজ ব্লক হাতে নিয়ে টাংগাইল- ময়মনসিংহের পাকা সড়কের মোগলপাড়ার দিকে এগুলাম। এদিকে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা টুকরো
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮০

লোহা স্তূপের ভিতর থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ খুঁজে বের করে রাতের মধ্যে নানা ধরনের দু’শ চাইনীজ অস্ত্র সচল করে ফেললো। হানাদাদের কাছ থেকে দখল-করা একটি আর. আর. রাত দুটায় দিগর ইউনিয়ন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা যোগলপাড়ায় নিয়ে এলো। এই অকেজো হাল্কা কামান ব্রীজ ব্লক লাগিয়ে ঠিক করা হলো। কামান ঠিক হলো কিন্তু তা চালাবে কে? কামান চালানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কোন যোদ্ধা নেই। এই অসুবিধাটা অবশ্য বেশীক্ষণ স্থায়ী হলোনা।
অন্য সময় নতুন আধুনিক অস্ত্র দখল নিতে পারলে সেভাবে তা চালানোর ব্যবস্থা হয়েছে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হলোনা। আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকার সময় এ্যান্টি ট্যাংক গান চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। এ্যান্টি ট্যাংক গান এবং চাইনীজ এই হাল্কা কামান চালনা প্রায় একই রকম। বরং একটু সোজা। আমি ছাড়া আরও দুই জনের সামান্য অভিজ্ঞতা আছে। এদের মধ্যে একজন মেজর হাকিম, অন্য জন পাকিস্তান গোলন্দাজ বাহিনীর এক প্রবীন সৈনিক, এরা দুজন যদিও কখনও আর. আর. থেকে ফায়ার করেনি তবে তাদের প্রশিক্ষণ আছে, এমনকি তারা কয়েকবার কামানের ফায়ার দেখেছে। তিনজনে দেখে শুনে, পরামর্শ করে হাল্কা কামানে গোলা ভরলাম। মেজর হাকিমই প্রথম ফায়ার করতে এগিয়ে গেল। মেজর হাকিম অতি সহজেই আর. আর. থেকে প্রথম গোল নিক্ষেপন করলো। সামনে শত্রু নেই। পরীক্ষা করার জন্য গোলা-ছোঁড়া, তাই একটু উঁচু জায়গা থেকে তিন-চারশ’ গজ দূরে একটি খালের মধ্যে গোলা ছোড়া হলো প্রাক্তন সৈনিকটিও পাচ-ছ’টি গোলা ছুঁড়লো। আমিও কয়েকটি গোলা ছুঁড়ে দেখলাম আর. আর. থেকে গোলা ছোড়া অত্যন্ত সহজ। কোন ঝুঁকি নেই। ফামানের নলের সাথে কামান চালকের কোন সংযোগ থাকছেনা। ব্যারেল থেকে প্রায় এক ফুট পাশে নিশানা মেলানোর ব্যবস্থা। শুধুমাত্র হাত এগিয়ে ট্রিগার টিপলেই ফায়ার। হাল্কা কামান থেকে পরীক্ষামূলক ভাবে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রাক্তন সৈনিকটি যখন গোলা ছুঁড়ছিলা, তখন দুইজন মুক্তিযোদ্ধা কামান চালানোর জন্য স্বেচ্ছায় গিয়ে এলো। এদের একজন ধনবাড়ী ছাত্র, অন্যজন জোগারচরের মধ্যবয়সী কৃষক। এরা দুজনেই রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করতো। তারা সোজাসুজি প্রস্তাব করে বসলো, ‘স্যার, এই বড় অস্ত্রটা আমাদেরকে চালাতে দিন। আমি গোলা ছুঁড়ে তাদেরকেও সুযোগ দিলাম। আন্তরিকতা থাকলে যে বাঙালীরা সব পারে, তা এই দুইজন মূহুর্তের মধ্যে দেখিয়ে দিল। দুইজনই প্রথম দুইটি করে চারটি গোলা ছুঁড়লো। অতবড় একটি অস্ত্র, জীবনে এই প্রথম চালাতে তাদের বিন্দুমাত্র জড়তা নেই। তারাও মেজর হাকিম ও প্রাক্তন সৈনিকটির মতোই অতি সহজে গোলা ছুঁড়লো। এর পর এদের দুইজনকে দিয়ে প্রায় দশ-বারোটি গোলা ছোড়ানো হলো। আমি চট করে একটি জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ঐখানে ছোড়ো। মুহুর্তের মধ্যে ছুড়তে হবে। তারা করলোও তাই। তাড়াহুড়োর মধ্যে পূর্ব কোন অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও দেখিয়ে দেয়া নিশানার সাত-আট গজের বেশী দূরে তাদের কোন গোলাই পড়লোনা। দুইজনের মধ্যে কলেজের ছাত্রটির চাইতে চরের কৃষক যোদ্ধাটি সহজভাবে নিশানার কাছে গোলা ফেলতে পারছে। এদের দুইজনকেই মূল গানার করে, আরো
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮১

পনের জনকে তাদের সহকারী হিসাবে দিয়ে রাতের মধ্যে একটা আর. আর. সেকশন গঠন করা হলো।
রাত চারটায় মেজর হাবিবকে মোগলপাড়া থেকে উত্তরে এগিয়ে কালিদাসপাড়ায় অনুকূল অবস্থান থেকে রাস্তা অবরোধ করে থাকতে কড়া নির্দেশ দেয়া হলো। কোন ক্রমে যেন একটা কাক পক্ষীও ময়মনসিংহ-টাংগাইল পাকা সড়ক ধরে টাংগাইলের দিকে আসতে না পারে। মেজর হাবিবের মূল দায়িত্ব আমার পশ্চাৎভাগ রক্ষা করা। ভোর পাচটায় আড়াই হাজার মুক্তিযোদ্ধার এক বিশাল দল নিয়ে ময়মনসিংহ-টাংগাইল পাকা সড়ক ধরে টাংগাইলের দিকে এগুতে শুরু করলাম। মোগলপাড়া থেকে কদমতলী, আঠারদানা, হামিদপুর এবং কালিহাতী পর্যন্ত বিনা বাধায় এগিয়ে এলাম। কালিহাতীতে এসে দেখলাম, ক্যাপ্টেন রিয়াজ, মেজর নবী নেওয়াজ ও সামাদ গামা কালিহাতী থানা দখল করে বসে আছে। তাদের কাছে খবর পেলাম, কালিহাতী থেকে শোলারা পর্যন্ত সম্পূর্ণ রাস্তা মুক্তিবাহিনীর দখলে। খবর পেয়ে আমরা কালিহাতীতে না থেমে টাংগাইলের দিকে এগুতে লাগলাম। কালিহাতী থেকে শোলাকুরা, এই রাস্তাটুকু কমান্ডার মনি, গোলাম সরোয়ার ও চীনামুড়ার আবদুল হামিদ দখল করে রেখেছিল। আমরা শোলাকুরা সেতু পার হয়ে ইছাপুরের দিক থেকে শত্রুদের দ্বারা প্রথম বাধা পেলাম। আগের দিন, ময়মনসিংহ থেকে টাংগাইলের দিকে পালিয়ে আসা হানাদাররা পুংলি থেকে ইছাপুর পর্যন্ত রাস্তা অবস্থান নিয়ে বসে ছিল। তারা অবশ্য ইচ্ছা করে এই অবস্থান নেয়নি। হানাদাররা টাংগাইলের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছিল। তাদের গাড়ির সারি যখন শোলাকুরা থেকে টাংগাইল পর্যন্ত আস্তে আস্তে এগুচ্ছিল, তখনই গাড়ির সারির মাঝে, পুংলি নদীর পাড়ে ও পাকা সড়কের উপর এক ব্যাটালিয়ন ভারতীয় ছত্রীসেনা অবতরণ করে। এতে হানাদার দলের অর্ধেক অংশ আটকা পড়ে যায়। তারা মরিয়া হয়ে পাগলা কুকুরের মত ছত্রীসেনার বেষ্টনী ভেঙে টাংগাইলের দিকে যাওয়ার শেষ চেষ্টা করে। প্রথম আবস্থায় আচমকা একেবারে শত্রুদের ঘাড়ের উপর অবতরন করে যেমন ছত্রীসেনার একটা অংশ ভীষন বেকায়দায় পড়ে যায়, তেমনি শত্রুপক্ষও ঘাবড়ে যায়। ছত্রীসেনাদের কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও পুংলীর পাকা সড়কের উভয় পাশে নেয়ে-পড়া ছাত্রীসেনাদের অবস্থা সামলে উঠতে দেরী হলো না। মনোবলহীন, ক্লান্ত, পর্যুদস্ত হানাদাররা ভারতীয় ছত্রীবাহিনীর সামনে তোপের মুখে তুলার মতে উড়ে যেতে লাগল। ছত্রীবাহিনীর অবতরণ দেখে আটকা পড়া স্বগোত্রীয়দের উদ্ধারে এগিয়ে না এসে হানাদাররা টাংগাইলের দিকে ‘দে ছুট’। ছত্রীবাহিনীর সামনে পড়ে থাকা হানাদারদের একটা অংশ পাকা সড়ক ছেড়ে পশ্চিমে গ্রামের দিকে পালাতে শুরু করলো। এরপর ছত্রীবাহিনীর সাথে হানাদারদের সারারাত তুমুল যুদ্ধ হয়। পুংলি সেতু ও সড়কের উপর ছত্রীসেনাদের সেই রাতের লড়াই সত্যিই অবিস্মরণীয়। একেবারে শত্রুর মাঝে পড়েও তারা যেভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন, তার তুলনা মেলা ভার। ছত্রী- বাহিনীর গোলার আঘাতে পুংলি সড়কের উপর তিনশ’ সত্তর জন হানাদার নিহত হয় ও শতাধিক
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮২

আহত হয়। ছত্রীবাহিনীর ছ’জন বীর সৈনিক শহীদ ও পনের জন আহত হয়। পরদিন ১১ই ডিসেম্বর, সকালে ছত্রীসেনাদের হাতে ছশ হানাদার খানসেনা ধরা পড়ে।
পিছনে দ্রুত ছুটে আসা মারমুখী মুক্তিবাহিনী, সামনে ভারতীয় ছত্রীবাহিনী। পালাবার পথ নেই, সব রাস্তা বন্ধ। এমনি অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ও প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে হানাদাররা ১১ই ডিসেম্বর সকালে ইছাপুর থেকে মুক্তিবাহিনীর উপর গোলাগুলি চালাচ্ছিল। তাদের মেশিনগান ও কামানগুলো তখনো গর্জে উঠছে। শোলাকুরা সেতুতে হঠাৎ বাধা পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দুর্বার হয়ে ওঠে। আমাদের হাতে তখন বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ। তার ওপর পালিয়ে যাওয়া বিপর্যন্ত হানাদার দের দেখে আমাদের মনোবল হাজার গুণ বেড়ে গেছে। হানাদাররা যেমন মেশিনগান ও হাল্কা কামান থেকে গোলা ছুঁড়ছিল, তেমনি আমার সহযোদ্ধারাও তিনটি ৩ ইঞ্চি মর্টার, একটি হাল্কা কামান ও ছ’খানা ভারী মেশিনগান থেকে হানাদারদের উপর অবিরাম অগ্নিবৃষ্টি ঝরাচ্ছিল। আমি শোলাকুরা সেতুর দক্ষিণে দাঁড়িয়ে দলের তিনটি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আর.আর. এর অভাবনীয় গোলা ছোড়া দেখছিলাম। সেতুর উপরে দুইদিকে খানিকটা দূরে ২টি করে ভারী মেশিনগান পুরো এলাকাটা কাপিয়ে সমান তালে গর্জন করে চলেছে। পাকা সড়কে বাধা পেয়ে এক পাশে ক্যাপ্টেন সবুর, অন্য পাশে মেজর মোস্তফা, পাঁচশ’ করে মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে ইছাপুরের দিকে এগিয়ে চললো। ক্যাপ্টেন ফজলুল হক, ক্যাপ্টেন মকবুল হোসেন খোকা ও ক্যাপ্টেন তমসের, প্রত্যেকে পঞ্চাশ জন করে তিনটি দল নিয়ে হাল্কা অস্ত্রশস্ত্র সহ পাকা রাস্তার কোল ঘেঁষে ইছাপুরের দিকে এগুতে লাগলো। আমাকে তেমন কিছুই করতে হলোনা। এমনকি কিভাব সামনের বাঁধা অতিক্রম করতে হবে সেই পরামর্শ পর্যন্ত দিতে হলোনা। মুক্তিবাহিনীর চাপে আধঘন্টার মধ্যে হানাদাররা ইছাপুর থেকে ফুলতলা পর্যন্ত পিছিয়ে গেল। আমরা ইছাপুর দখল নেয়ার পর ফুলতলায় পিছিয়ে যাওয়া হানাদারদের উপর আঘাত হানার পরিকল্পনা করতে লাগলাম। মোগলপাড়া থেকে প্রায় আট মাইল এসে শোলাকুরায়, পরে ইছাপুরে আটকে গেলাম। ইছাপুর থেকে ফুলতলা, মাঝ- খানের এক মাইল সম্পূর্ণ খোলা। কোন বাঁক নেই। আড়াল নেবার জায়গা নেই, রাস্তার ডাইনে-বামে বহুদুর পর্যন্ত খোলা প্রান্তর। হানাদারদের অবিরাম গোলা গুলির বৃষ্টিধারা উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই এগুতে পারছেনা। দুই-তিনবার চেষ্টা করেও যখন খোলা জায়গাটা পার হওয়া গেল না, তখন আবার দুইটি টার্গেট দিয়ে সকাল আটটায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাহায্য চাইলাম।

দ্বিতীয়বার বিমান সাহায্য
টার্গেট দুটির একটি, টাংগাহিল নতুন জেলা কম্পাউন্ড এবং শহর থেকে ময়মনসিংহের দিকে দুই মাইল পর্যন্ত পাকা সড়কের উপর ষ্ট্রাপিং। দ্বিতীয়টি, এলেঙ্গা থেকে ফুলতলা পর্যন্ত এই দুই মাইল রাস্তা, রাস্তার আশে- পাশে ষ্ট্রাপিং ও রকেট বর্ষণ। অনুরোধ পাঠিয়েই ইছাপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের শোলাকুরা পর্যন্ত পিছিয়ে আসতে নির্দেশ দিলাম। ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল রেখে ঠিক
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৩

চারটি ফাইটার টাংগাইলের আকাশে দেখা দিল। মূহুর্তেই ডাইনে-বামে দুই চক্কর দিয়ে দুইটি বিমান টাংগাইল জেলা সদরের উপর ষ্ট্রাপিং শুরু করে দিল। অন্য দুটি এলেঙ্গা থেকে ফুলতলা, এই আধামাইল রাস্তার উপর নিখুঁতভাবে বার বার ষ্ট্রাপিং ও রকেট শেল নিক্ষেপ করলো। আশ্চর্যের বিষয়, ভারতীয় যুদ্ধ বিমান প্রথম টার্গেট জিলা সদর হানাদার ঘাঁটির একশ গজ বাইরে একটি বুলেটও ছুঁড়েনি। এর চাইতেও চমকপ্রদ হলো, এলেঙ্গা থেকে ফুলতলা, মাত্র আধামাইল জায়গার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ গজ নিশানার উপর ভারতীয় ফাইটার দুটি অব্যর্থ নিশানায় ষ্ট্রাপিং ও রকেট শেল নিক্ষেপ করলো। এলেঙ্গার মাত্র এক মাইল দক্ষিণে পুংলিতে ভারতীয় ছত্রীসেনারা, ফুলডলার এক মাইল উত্তরে মুক্তিবাহিনী। মাঝখানের এই স্বল্প পরিসর জায়গায় শত্রুর অবস্থানের উপর অব্যর্থ লক্ষ্যে অন্য কোন বিমান বাহিনী এমন নিখুঁত ও নিপুণ আঘাত হানতে পেরেছে কিনা, আমাদের জানা নেই। ১১ই ডিসেম্বরের ঐ বিমান আক্রমণে সামান্য ভুল হলেই নিজেদের ছোড়া বুলেটে দলের অসংখ্য যোদ্ধা প্রাণ হারাতো।
ভারতীয় বিমান বাহিনীর উপর্যুপরি হামলায় ডিসেম্বরের ৭ তারিখের মধ্যেই পাক হানাদার বাহিনীর বিমান শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। ৭ তারিখের পর ভারতীয় বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে দেখে দেখে লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত হানতে আর কোন অসুবিধা ছিল না। সেই সময় বঙ্গভবনে (গভর্ণর হাউস) ভারতীয় বিমানের নিখুঁত হামলায় তৎকালীন গভর্ণর ডাঃ মালেক ভয়ে খাটের নীচে লুকিয়েছিলেন। হানাদার জেনারেল নিয়াজী বোমার ভয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে হাতির পুলে এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই বাড়িতেও ভারতীয় বিমান তিন-পয়েন্ট রকেট সেল নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয়। তারপরই শুরু হয় নিয়াজীর এ বাড়ি সে- বাড়ি আশ্রয় নেয়া। সে যে বাড়িতেই আশ্রয় নিচ্ছে সেই বাড়িতেই নিখুঁত অব্যর্থ লক্ষ্যে ভারতীয় বিমান রকেট শেল নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয়েছে। জনগণের নির্ভুল সংবাদ সরবরাহ, স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল।

মৃত্যু যখন সুতোর ব্যবধানে
১১ই ডিসেম্বের, ভারতীয় বিমান হামলায় পর্যুদস্ত হানাদাররা দিশেহারা ও ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এলেঙ্গা থেকে ফুলতলা, এইটুকু দূরত্বের মধ্যে তাদের চল্লিশটি গাড়িতে আগুন ধরে যায়। কয়েক শত খানসেনা বিমান থেকে ছোঁড়া মেশিনগানের বুলেটে মারা যায়। বিমান আক্রমণের পর দেরী না করে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এই সময় একটি আকস্মিক ঘটনা ঘটে। টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় বীর ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর খান মরতে মরতে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেল। ক্যাপ্টেন সবুর মাঠের মাঝ দিয়ে ফুলতলার দিকে এগোবার উদ্দেশ্যে ইছাপুরের মীর আমজাদ হোসেনের পুরানো দালানবাড়ির পাশে তার দলের যোদ্ধাদের সমবেত করে পরবর্তী আক্রমণের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে দূরবীন নিয়ে শেষবারের মত ফুলতলা ভালোভাবে দেখে নিচ্ছিলো। ভালো করে সামনের দিকটা দেখে ক্যাপ্টেন সবুর একটি পুরানো মসজিদের দেয়াল ঘেঁষে কেবল বসার জন্য সামান্য নীচু হয়েছে, তখনই তার মাথার এক-দেড় ফুট উপরে হানাদারদের কামানের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৪

একটি গোলা মসজিদের দেয়ালের অনেকটা ভেঙে বেরিয়ে যায়। গোলার হল্কা লাগার সাথে সাথে সবুর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চার-পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে। না, সবুরের গায়ে কোন আঘাত লাগেনি। তবে সে কিছু বলতে পারছে না। আকস্মিক ঘটনায় সে বিমূঢ় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভাবলেশহীন চোখে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধারা সবুরকে ভালো করে মাটিতে শুইয়ে কেউ বাতাস করছে, কেউ বা কাপড় ভিজিয়ে তার চোখ মুখ ও মাথা ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমি যে সময়ে ক্যাপ্টেন সবুরকে সর্বশেষ নির্দেশ দিতে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ই অঘটনটি ঘটে। সবুর মাটিতে পড়ে যাওয়ার মিনিট খানেক পর সহযোদ্ধাদের কাছে খবর পেয়ে দৌড়ে তার কাছে গেলাম। সবুর তখনও মাটিতে পড়ে আছে। সবুরকে নাড়াচাড়া করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম,
– তোর কোথাও আঘাত লাগেনি তো?
সবুর তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমার পা জড়িয়ে ধরে বললো,
– স্যার, হায়, হায়, শালারা আমারে এহেবারে মাইরা ফালাইছিল। শালারা আমারে দেখলো কি কইরা? স্যার, আমার কিছু অয় নাই, কিন্তু আমার কানের তালা ফাইট্যা গেছে। আমি খালি বোমার আওয়াজ পাইতাছি। ক্যাপ্টেন সবুরকে নিয়ে এই আকস্মিক বিপর্যয় ঘটায় আক্রমন আধঘন্টা পিছিয়ে গেল। এই সময় ছত্রীবাহিনীর একশ জনের দুটি দলকে স্বেচ্ছা- সেবকরা ইছাপুর নিয়ে এলো। তারা মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এদের সঙ্গে মূল দলের বেতার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। দল দুটিতে একজন ক্যাপ্টেন ও তিনজন সুবেদার রয়েছেন। ক্যাপ্টেনকে আমার কাছে আনা হলো। ক্যাপ্টেনের কাছে সব শুনে তাদেরকে ইছাপুরে কিছু সময় অপেক্ষা করে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে অনুরোধ করলাম এবং এও বললাম, ‘আমাদের সঙ্গে দুই দলের যোগাযোগ রয়েছে। খাবার শেষে আপনাদের সেখানে পৌঁছে দেয়া হবে। এখান থেকে মূল দলের সাথে বেতারে যোগাযোগের চেষ্টা করুন।
মুক্তিযোদ্ধারা ফুলতলার দিকে এগুচ্ছে দেখে, ছত্রীসেনারাও যুদ্ধে অংশ নিতে চাইলেন। কিন্তু আমি তাদের বার বার অনুরোধ করে যুদ্ধে অংশগ্রহন থেকে বিরত করলাম। আমি তাদের বুঝালাম, ‘সামনে যে শত্রুরা রয়েছে, তারা বলতে গেলে একেবারে পর্যুদস্ত, পরাজিত। আমাদের যে শক্তি আছে তাতে অতিরিক্ত সাহায্য না হলেও চলবে। আপনাদের বরং মূল দলের সাথে একত্রিত হয়ে পরবর্তীতে সম্মিলিত আঘাত হানার জন্য তৈরী হওয়া উচিত।’ আমার পরামর্শে ছত্রীসেনারা খুশী হলেন।
ইছাপুর থেকে ফুলতলার দিকে এগুবার সময় হানাদারদের দিক থেকে প্রথম প্রথম বেশ বাধা আসলো। বিমান আক্রমনের পর দুর্বল হয়ে পড়লেও তারা যে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, এটা বেশ বোঝা গেল। তবে তাদের মধ্যে কোন শৃঙ্খলা নেই, সমন্বয় নেই। অন্যদিকে ইতিমধ্যে ইছাপুর থেকে ডান ও বাম, দুই পাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ফুলতলাকে চেপে ধরার মত অবস্হানে পৌঁছে গেছে। এ অবস্হায় রাস্তার কোল ঘেঁষে এগুনো মুক্তিযোদ্ধাদের উপর
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৫

গুলি ছুঁড়ে হানাদারদের বিশেষ সুবিধা হবার কথা নয়। পুরো দলের বেশী অংশটাই রাস্তার দুই পাশে অনেক দূর দিয়ে প্রায় দুই মাইল জুড়ে ছড়িয়ে ফুলতলার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ক্যাপ্টেন ফজলু, ক্যাপ্টেন তমসেরের দলের তিনশ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি ইছাপুর থেকে ফুলতলা দখলে অংশ নিলাম। পাকা রাস্তার দুই কোল ঘেঁষে ত্বরিৎবেগে পুরো দল নিয়ে ফুলতলার উত্তরের সেতু পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছে গেলাম। আমি যখন দল নিয়ে এগুচ্ছিলাম, তখন পিছন থেকে মেজর হাকিম, সামাদ গামা ও তারেক তিনটি ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে অনবরত ফুলতলার উপর গোলাবর্ধন করে চলছে। আমি ফুলতলার উত্তরের সেতুর উপর উঠে এক টুকরো লাল কাপড় তুলে সংকেত দেয়ার সাথে সাথে পিছন থেকে মর্টার ফায়ার বন্ধ হয়ে গেল। মর্টার ফায়ার বন্ধ হলে আমরা আবার এগোতে শুরু করলাম। হানাদারদের দিক থেকে এই সময় খুব একটা বাধা আসছিলনা। ৩ ইঞ্চি মর্টারের ফায়ার বন্ধ করলেও, তমসের ও আমি ২ ইঞ্চি মর্টার থেকে হানাদারদের উপর অনবরত গোলা ছুঁড়ে চলেছিলাম।
মুক্তিবাহিনীর প্রায় পুরো দলটা নিরাপদে সেতু পার হয়ে গেছে। মাত্র পঁচিশ-ত্রিশ জনের পার হতে বাকী। তখনও আমাদের দিকে কোন হতাহত হয়নি। হঠাৎ আমার ছোড়া একটি ২ ইঞ্চি মর্টারের গোলা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে না গিয়ে মাত্র পনের-কুড়ি গজ সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সেতুর উপর পড়লো। এই আকস্মিকতায় আমি প্রায় বিহবল হয়ে পড়লাম। মাত্র ছ’সাত সেকেণ্ডের মধ্যে গোলাটি ফাটবে। গোলাটি ফাটলে আমার কোন ক্ষতি হবেনা সত্য কিন্তু পুলের উপর গোলা ফাটলে দশ-পনের জন মুক্তিযোদ্ধা যে হতাহত হবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কয়েক হাত পিছনে একটা ২ ইঞ্চি মর্টার শেল পড়তে দেখে জামালপুর-পিয়ারপুরের আবদুস সাত্তার বিদ্যুৎবেগে পিছিয়ে এসে শেলটি খাবলা মেরে ধরে পুলের নিচে ছুঁড়ে মারলো। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা হঠাৎ ঘটে যাওয়া আকস্মিক ঘটনা জানার আগেই গোলাটি পুলের নীচে পানিতে পড়ে ফেটে গেল। সাত্তারের উপস্থিত বুদ্ধি, ক্ষীপ্রতা ও অসীম সাহসিকতা দেখে দৌড়ে গিয়ে তাকে জাপটে বুকে তুলে নিলাম। সাত্তার তখনও বুঝতে পারেনি গোলাটি কোন দিক থেকে এসেছিল।
সহযোদ্ধারা সেতু পার হয়ে ফুলতলা গ্রামের কাছে পৌঁছে গেছে। ডান এবং বামে চকের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া দলগুলোও গ্রামটিতে ঢুকতে শুরু করেছে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেও তাদের আগে যেতে পারছিনা, পিছনে পড়ে থাকছি। মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে সামনের সহ- যোদ্ধাদের আস্তে আস্তে ও সতর্কভাবে এগুতে বলছি। মিনিট পনেরর মধ্যে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলা হলো। তখন আর গ্রামের ভিতের থেকে তেমন গুলি আসছেনা। আমরা যখনই ইছাপুর থেকে ফুলতলার দিকে শেষবার খুব দ্রুত এগুচ্ছিলাম, তখন হানাদাররা প্রতিরোধ না করে সব কিছু ফেলে শুধু অস্ত্র ও কিছু গুলি নিয়ে পশ্চিমে গ্রামের দিকে সরে যেতে থাকে। আমরা ফুলতলা দখল নেয়ার পর দেখলাম পঞ্চাশ-ষাট জন হাত-পা কাটা আহত খান-সেনা রাস্তার এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যন্ত্রণায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, গোঙাচ্ছে, খান-সেনাদের প্রায় ত্রিশ-চল্লিশটি গাড়ী তখনো দাউ দাউ করে জ্বলছে। ফুলতলার সর্বত্র হানাদারদের সামরিক ও বেসামরিক গাড়ি
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৬

এদিক-ওদিক পড়ে আছে। ফুলতলা আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে পুংলিতে অবস্থান নেয়া বাহিনীর সাথে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ হলো।

ট্র্যাজিক ঘটনা
ব্রিগেডিয়ার ক্লের ১০ই ডিসেম্বর জামালপুর দখল নিয়ে সারাদিন তার যানবাহন ব্রহ্মপুত্র পাড় করান এবং মধুপুরের দিকে এগিয়ে আসার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১১ই ডিসেম্বর ভোরে তারা মধুপুরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলেন। খুব ধীর গতিতে বিনা বাধায় তারা মধুপুর হয়ে টাংগাইলের রাস্তা ধরেন। বেলা বারোটার দিকে তারা ঘাটাইল থানা অতিক্রম করলেন। এতদূর এগিয়ে আসার পরও তারা বাধা পাচ্ছেন না কেন তা হয়তো প্রথম অবস্থায় ব্রিগেডিয়ার ক্লের বুঝে উঠতে পারেননি। এই সময় আশে-পাশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর এগিয়ে যাওয়া উচিত, এটাও হয়তো উত্তেজনার বশে ঠিক বুঝতে পারেনি। রাস্তার দুই পাশে দু’টি মেশিনগান, দুটি রকেট লাঞ্চার ও একটি ব্লাণ্ডার সাইট বসিয়ে মেজর হাবিব কালিদাসপাড়ায় ময়ময়নসিংহ-টাংগাইল পাকা- সড়ক আগলে বসে ছিল। মেজর হাবিব দীর্ঘ সারিতে আসা মিলিটারী কনভয় দেখে নির্ঘাত শত্রু ভেবে সহযোদ্ধাদের সতর্ক করে দেয়। হানাদাররা এ পথেই আগের দিন পালিয়েছে। গাড়ির বহর মিত্রবাহিনীর হলে অবশ্যই আগে যোগাযোগ হতো। যোগাযোগ যখন হয়নি, তখন নিশ্চয়ই হানাদাররা। তাই মুক্তিযোদ্ধারা জবরদস্ত আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হলো। সামনের গাড়ি কালিদাসপাড়ার দু’শ গজের মধ্যে এলে রাস্তার দুই পাশ থেকে এম. জি. রকেট লাঞ্চার ও ব্লাণ্ডার সাইট এক সাথে এক তালে গর্জে উঠলো। ব্লাণ্ডার সাইটের গোলার আঘাতে কনভয়ের সামনের জীপ উল্টে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে গেল। বাধা পেয়ে মিত্রবাহিনীও এম. জি. থেকে মুষলধারে গুলি চালায়। ব্রিগ্রেডিয়ার ক্লের দশ-বারোটি গাড়ির পিছনে ছিলেন এতক্ষণ বিনা বাধায় আসার পর আকস্মিক বাধা পেয়ে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁক ঝাঁক গুলি ছোড়ার ফাঁকে ফাঁকে উচ্চ স্বরে গগনবিদারী ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিচ্ছিল। মুক্তিবাহিনীর গুলির জবাবে মিত্রবাহিনীও মুহুর্তের মধ্যে কয়েক হাজার গুলি ছুঁড়ছিলেন। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান শুনে বিস্মিত হয়ে আর গুলি না চালিয়ে তারা সমস্বরে গলা ফাঠিয়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে থাকেন এবং কনভয়ের উপর সাদা পতাকা উড়িয়ে দেন। এতক্ষণে উভয় দলই বুঝে যায়, তারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে গুলি চালিয়েছে। উভয় পক্ষ থেকে গুলি থেমে গেলে, মিত্রবাহিনীর দিক থেকে দুজন খালি হাতে কালিদাসপাড়ার দিকে এগিয়ে আসেন। মেজর হাবিব একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সামান্য একটু এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়। ভারতীয় সেনা দুইজন মুক্তিযোদ্ধার সামনে এসে বলেন, ‘বন্ধুরা, আমরা মিত্রবাহিনী। আমাদের উপর গুলি চালাবেননা।’ এ কথা শুনে ভারতীয় বাহিনীর দুজনকে ওখানেই দাড় করিয়ে মুক্তিযোদ্ধাটি দৌড়ে কমাণ্ডারের কাছে এসে রিপোর্ট করে, ‘সামনে শত্রু নয়, মিত্রবাহিনী।’ মেজর হাবিব নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভারতীয় বাহিনীর দিকে থেকে আরো কয়েক জনকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করে। ব্যাপারটা বুঝে ব্রিগ্রেডিয়ার ক্লের তুরাতে প্রশিক্ষণ নেয়া গোপালপুর
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৭

ঘাটাইল এলাকার চার-পাঁচ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সামনে পাঠিয়ে দেন। ভারতীয় বাহিনীর কয়েক জন সৈনিকের সাথে তারা এগিয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চিত হয় যে, সত্যিই এরা মিত্র- বাহিনী। বিশেষ করে মেজর হাবিব তুরাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চার-পাঁচ জন এগিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুজনকে চিনতে পারে। কারণ সে যখন তুরাতে ছিল, তখন ঐ দুজন সেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। ভুল বুঝাবুঝি দূর হলে মিত্রবাহিনীকে রাস্তা ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এর মধ্যে ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। মুক্তিবাহিনী গোলাগুলিতে মিত্র বাহিনীর সাতজন নিহত ও সতের জন গুরুতর আহত হয়। এদিকে মিত্র বাহিনীর গুলিতে মুক্তিবাহিনীর চার জন নিহত, এগার জন আহত হয়। এই ভুল বুঝাবুঝির পর ঢাকার শেষ যুদ্ধ পর্যন্ত টাংগাইলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর মধ্যে আর কোন ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়নি। ব্রিগ্রেডিয়ার ক্লের ঢাকা দখলের যুদ্ধে অসীম বীরত্ব ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। তা সত্ত্বেও একথা সত্যি, তিনি যদি সামান্য একটু সতর্ক ও যত্নবান হতেন, তাহলে উভয় পক্ষের অমূল্য কয়েকটি প্রাণ বিসর্জন দিতে হতো না।
মেজর হাবিবের সাথে যোগাযোগ হওয়ার পর মুক্তিবাহিনীই মিত্রবাহিনীকে রাস্তা দেখিয়ে টাংগাইলের দিকে নিয়ে আসতে থাকে। বেলা দেড়টায় তারা বাগুটিয়া পর্যন্ত এগিয়ে আসেন। বাগুটিয়াতে তাদের আবার মুক্তিবাহিনীর চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হতে হলো। তবে সামনে মুক্তিবাহিনী থাকায় গুলিতে চ্যালেঞ্জ নয়, শুধু থামিয়ে দেয়া হলো। বাগুটিয়ায় একদল মুক্তিযোদ্ধাকে অবস্থানে রেখে মেজর হাবিবের মতই কড়া নির্দেশ দিয়েছিলাম, কোনভাবেই যেন পিছনের দিক থেকে শত্রু বোঝাই কোন গাড়ি এগুতে দেয়া না হয়। এগিয়ে আসা গাড়িতে শত্রু নেই, এটা জানার পরও বাগুটিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা জিজ্ঞেস না করে রাস্তা ছেড়ে দিতে নারাজ। ব্রিগ্রেডিয়ার ক্লের একটু আগের আকস্মিক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন। তাই তিনি পীড়াপীড়ি না করে বাগুটিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের আমার সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ করলেন। ফুলতলায় আমাকে খবর দেওয়া হলো, মিত্রবাহিনী বাগুটিয়া পর্যন্ত এসে গেছেন। খবর পেয়ে বাগুটিয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। এই সময় ব্রিগ্রেডিয়ার ক্লের ছ-সাত জন সৈন্য নিয়ে পায়ে হেঁটে বাগুটিয়া থেকে এক মাইল টাংগাইলের দিকে ধুনাইল সেতু পর্যন্ত এসে গিয়েছিলেন। ব্রিগ্রেডিয়ারকে আগে থেকেই চিনতাম। ভারতে থাকার সময় ব্রিগ্রেডিয়ারের সাথে আমার দুই তিন বার দেখা হয়েছিল। দেখা মাত্র একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। উষ্ণ আলিঙ্গন শেষে ব্রিগেডিয়ার ক্লেরকে নিয়ে টাংগাইলের দিকে কিছুটা এগিয়ে বাংড়া ইউনিয়ন বোর্ড অফিসে এসে বসলাম। এই সময় কালিদাসপাড়া থেকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে আসা মুক্তিবাহিনীর কোম্পানী কমাণ্ডার চান্দ মিয়া কান্না জড়িত কণ্ঠে কালিদাসপাড়ার দুঃখজনক ঘটনা সবিস্তারে বললো। চান্দ মিয়ার কাছে সমস্ত ঘটনা শুনে ব্যথিত ও ক্ষুদ্ধ হলাম। আমার চোখে পানি এসে গেল। শুধু শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নয়, মিত্র বাহিনীর সৈনিকদের জন্যেও। ক্ষুদ্ধ হয়ে ব্রিগেডিয়ারকে বললাম,’এটা কি ধরনের ব্যাপার? আপনার কর্তৃপক্ষ ছত্রীসেনা নামানো থেকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৮

শুরু করে সব ব্যাপারে আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারলেন, আপনারা একদিন আগেও আমার কাছে সাহায্য চাইতে পারলেন আর এই জায়গাটুকু আসার সময় সামান্য একটু খোজখবর রাখতে পারলেন না?’ লজ্জিত ব্রিগেডিয়ার ক্লের কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে বলতে না দিয়ে আবার বললাম, ‘এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমাকে পরিষ্কার জানানো হয়েছিল, আমাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার উপর দিয়ে কোন দল যাবার সময় তা অবশ্যই আমাদের জানানো হবে।’ ব্রিগেডিয়ার ক্লের ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক ভদ্র ও মার্জিত রুচি সম্পন্ন দক্ষ অফিসার। তিনি কোন ভনিতা না করে নিজের ভুলের কথা সরাসরি স্বীকার করে বলেন, দেখুন কাদের ভাই, ভুলটা আমারই হয়েছে। আপনার সাথে যোগাযোগ করে এগুনোর নির্দেশ আমার উপরও রয়েছে। কিন্তু আজ সকাল থেকে হেড কোয়ার্টারের সাথে আমার বেতার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মাত্র ঘন্টা খানেক আগে আমাদের মধ্যে বেতার যোগাযোগ আবার স্থাপিত হয়েছে। আপনার সাথে আমার সরাসরি বেতার যোগাযোগ নেই। আমি হেড কোয়ার্টারকেও জানাতে পারছিলাম না, অথচ অপেক্ষা করাও যাচ্ছিলনা।” এটা সত্যিই আশ্চর্যের, আমার সাথে আপনার হেড-কোয়ার্টারের যোগাযোগ রইলো, তা এক মুহুর্তের জন্যও ছিন্ন হলোনা, শুধু আপনার ব্রিগেডের সাথেই হেড কোয়ার্টারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো, এর অর্থ ঠিক বুঝতে পারলাম না, এরপর ব্রিগেডিয়ার ক্লের খুবই আস্তরিকভাবে বললেন,
– দেখুন, যা হবার হয়ে গেছে। এর জন্য মন খারাপ করবেন না। শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েও আমাদের এমন ক্ষতি হতে পারতো কিংবা এর চেয়েও আরো বেশী, তা হয়নি। চলুন আমরা এগিয়ে যাই, এরপর আমার আর বলার কিছু রইলোনা। সত্যিকার অর্থে কালিদাস পাড়ায় ঘটে যাওয়া বিয়োগান্তক দুর্ঘটনা নিতান্তই আকস্মিক। এই ব্যাপারে ব্রিগেডিয়ার ক্লেরকে পুরোপুরি দায়ী করা চলে না। আমরা এবার যৌথভাবে টাংগাইলের দিকে এগুতে লাগলাম।

বিপর্যস্ত হানাদার বাহিনী
আমরা উত্তর দিক থেকে সাড়ে তিনটায় পুংলি সেতুর কাছে ছত্রীসেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলিত হলাম। অন্যদিকে টাংগাইল শহরের আশেপাশে যুদ্ধ করে চলেছিল কর্ণেল ফজলুর রহমান, মেজর মঈনুদ্দিন, ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী, মেজর লোকমান হোসেন, মেজর মোকাদ্দেস আলী ও মেজর মতিয়ার। দক্ষিণে টাংগাইল-ঢাকা রাস্তার উপর একের পর এক অবরোধ সৃষ্টি করে চলেছিল ক্যাপ্টেন বায়জিদ, ক্যাপ্টেন শামসুল হক, ক্যাপ্টেন সোলায়মান, ক্যাপ্টেন গাজী লুৎফর রহমান, ক্যাপ্টেন লায়েক আলম, ক্যাপ্টেন আজাদ কামাল, ক্যাপ্টেন সুলতানের কোম্পানীসহ অন্যান্য কয়েকটি কোম্পানী। ১১ ই ডিসেম্বর প্রত্যুষে যেমন কর্ণেল ফজলুর রহমান, মেজর মইনুদ্দিন, ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী, ক্যাপ্টেন করিম টাংগাইলের উপর আঘাত হানতে শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তেমনি মেজর লোকমান, মেজর মতিয়ার, মেজর মোকাদ্দেস পুবদিক থেকে টাংগাইল শহরে আঘাতহানার প্রস্তুতি নেয়। মেজর লোকমান, তার
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৯

দলের ৩ ইঞ্চি মর্টার ঘারিন্দায় বসিয়ে ভোর পাঁচটা থেকে টাংগাইল নতুন জেলা সদরের উপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। মর্টার চালক কায়েম উদ্দিন বিরামহীন ভাবে সকাল দশটা পর্যন্ত অব্যর্থ লক্ষ্যে মর্টারের গোলা ফেলেন। কায়েম উদ্দিনের বেশ সুবিধা হচ্ছিল, তার টার্গেটের এলাকা খুবই বিস্তৃত। জেলা সদরের এক বর্গমাইল জুড়ে হানাদাররা ঘাঁটি গেড়েছিল। সেখানে একজন সাধারণ মানুষও বাস করতেন না। তাই কায়েম উদ্দিন মনের আনন্দে পাঁচ ঘণ্টায় চারশ রাউণ্ড গোলা নিক্ষেপ করে। চতুর্দিক থেকে ক্রমশ মুক্তিবাহিনীর চাপ বাড়লে, অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদাররা ১০ই ডিসেম্বর সকাল থেকেই টাংগাইল শহর ত্যাগ করতে শুরু করেছিল। দুপুরের পর ময়মনসিংহ-জামালপুরের দিকে ব্রিগেডিয়ার কাদের খান ও ব্রিগেডিয়ার আক্তার নেওয়াজের ব্রিগেডের অর্ধেক যখন পিছন থেকে মার ও তাড়া খেতে খেতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে টাংগাইল এসে পৌঁছায়, তখন টাংগাইলের ব্রিগেডিয়ারটিও টাংগাইল থাকা আর নিরাপদ ও বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলোনা। তারাও পাততাড়ি গুটাতে শুরু করলো। কিন্তু ততক্ষণে পূব-পশ্চিমে, উত্তর-দক্ষিণে মুক্তিবাহিনীতে ছেয়ে গেছে, হানাদারদের টাংগাইল ছেড়ে যাওয়ার প্রায় সমস্ত পথই অবরুদ্ধ। তবু ১১ই ডিসেম্বর সকাল থেকে হানাদারদের টাংগাইল ছাড়ার হিড়িক লেগে গেল। তারা গাড়ীতে বোঝাই হয়ে ঢাকার দিকে পালাতে শুরু করলো। কিন্তু তাদের ঢাকা পর্যন্ত ফিরে যাওয়া হয়ে উঠলোনা। টাংগাইলের দক্ষিণ থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে পলায়ন পর হানাদারদের সফলভাবে বাধা দিতে সক্ষম হয়। ১০ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভাতকুড়া পুলের বিকল্প রাস্তা ক্যাপ্টেন বায়েজিদ কোম্পানী পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে শত্রুদের এগারটি গাড়ির কয়েকটি ধ্বংস ও বাকীগুলো বিকল হয়ে গেল, যার মধ্যে ব্রিগেডিয়ার কাদের খানের গাড়িও আছে। ব্রিগেডিয়ার কাদের খানকে বহনকারী বিরাট আকারের বুলেট প্রুফ শেভ্রোলেট কারটি মুক্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে বিকল্প রাস্তা থেকে প্রায় দশ-বারো ফুট উঁচুতে উড়ে গিয়ে রাস্তার উপর উল্টে পড়ে। ইঞ্জিনটি গাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় ৫০ গজ দূরে ছিটকে পড়ে। কাদের খান এমনিতেই ধূর্ত, তদুপরি তার ভাগ্যও ভাল। সেতুর নীচে বিকল্প রাস্তা দিয়ে গাড়িগুলো পার হওয়ার আগেই সে কয়েকজনকে নিয়ে হেঁটে বিকল্প রাস্তা পার হয়ে গিয়েছিল। তাই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে এ যাত্রায় সে বেঁচে গেল। রাস্তা পরিস্কার করতে হানাদারদের দুই ঘন্টা লাগে। রাস্তা পরিষ্কারের সাজসরঞ্জাম তাদের সাথেই ছিল। ব্যবস্থাটি খুবই অভিনব। বুডোজার দিয়ে ধাক্কা মেরে, উল্টে-পাল্টে পড়ে থাকা গাড়িগুলো আরও একটু গভীর খাদে ঠেলে কোনরকমে যাওয়ার মত রাস্তা করে তারা রাত বারোটার পর আবার ঢাকার দিকে এগুতে লাগলো। আগেই মূল দলের কয়েকটি গাড়ি করটিয়া পার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মটরা সেতুর বিকল্প রাস্তায় শামসুর কোম্পানীর পোঁতা মাইনের আঘাতে হানাদারদের আরো তিনটি গাড়ি বিকল হয়ে গেল। এইখানে হানাদার বহনকারী টাংগাইলের ব্যবসায়ী অজিত হোমের বেডফোর্ড গাড়ির ইঞ্জিন মাইনের আঘাতে গাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুলের পাশে একটি বিরাট গাছের উপর
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯০

গিয়ে আটকে পড়ে। সে এক দেখবার মত দৃশ্য। দেশ স্বাধীন হবার পরও বেশ কয়েকদিন গাড়ির ইঞ্জিনটি গাছে লটকে ছিল।
দুটি হানাদার ব্রিগেড রাস্তা পরিষ্কার করে আবার এগুতে থাকে। কিন্তু সর্বত্র মৃত্যু তাদের জন্য ওৎ পেতে বসে আছে। ২৫শে মার্চের পর কিছুদিন হানাদাররা যেমন স্বাধীনতাকামীদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, আজ মুক্তিবাহিনীও ঠিক তেমনি হানাদারদের তাড়িয়ে চলছে। পালিয়ে যাওয়া হানাদারগাড়ীগুলো জামুর্কী সেতুর বিকল্প রাস্তায় নামার সাথে সাথে পর পর কয়েকটি ‘এ্যান্টি ট্যাংক’ মাইনের বিস্ফোরণ ঘটলো। এতে এক গাড়ি অপর গাড়ির উপর গিয়ে ছিটকে পড়ে একটা এলোমেলো অবস্থার সৃষ্টি করলো। গাড়ির চালকরা এমনিতেই ছিল ভীত সন্ত্রস্ত। তারা কাঁচা মাটি দেখলেই ভয়ে আঁতকে উঠে কুঁকড়ে যেত। তিন-চারটি মাইনের বিস্ফোরণে ন’দশটি গাড়ি বিকল হয়ে গেল। তার মধ্যে দুইটি গাড়ি মাইনের প্রচণ্ড আঘাতে একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে দলা পাকিয়ে গেল। তবুও হানাদারদের ঢাকার দিকে যাবার বিরাম নেই। তাদের পণ, যে কজনই যাওয়া যায়, এমনকি যদি একজনও ঢাকা পৌঁছে, তাও অনেক লাভ। জামুর্কীতে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে সকাল হয়ে গেল। টাংগাইলের ব্রিগেডও যখন পালাতে শুরু করল, তখন সারা রাস্তার এদিক-ওদিক দুমড়ানো-মুচড়ানো বিধ্বস্ত গাড়ির বহর ছড়িয়ে পড়ে আছে। তারই ফাঁক দিয়ে হানাদারদের যেতে হচ্ছে। পিছনে এবং আশে-পাশে মারমুখী মুক্তিবাহিনী ডাইনে-বামে চতুর্দিকে শুধু মুক্তিবাহিনী, আতঙ্কগ্রস্ত হানাদাররা দিশেহারা। দ্রুত গাড়ি চালাতে গিয়ে পরিত্যক্ত বিকল গাড়িগুলোতে ধাক্কা খেয়ে চলন্ত কয়েকটা গাড়ি উল্টে- পাল্টে রাস্তায় বিরাট জট পাকিয়ে যেতে থাকে। অনেক হানাদার মরিয়া হয়ে বাঁচার শেষ চেষ্টায় পাকা রাস্তা ছেড়ে ডাইনে-বামে গ্রামের ভিতর দিয়ে পায়ে হেঁটে ঢাকার দিকে এগুতে লাগলো। হানাদাররা রাস্তা ছেড়ে দেয়ায় মুক্তিবাহিনীর ভীষণ সুবিধা হলো। ঢাকার দিকে এগোনো গাড়িগুলো মির্জাপুর পর্যন্ত গিয়ে আটকে পড়ে। কোনক্রমেই আর সামনে এগুতে পারছে না। বহরের প্রথম কয়েকটা গাড়ি মির্জাপুরে আটকে যাবার পর প্রায় সব হানাদার গাড়ি ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলো। এর পরই শুরু হলো হানাদার পাকড়াও অভিযান। হানাদাররা গাড়ি থেকে নেমে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সামনে এগুতে থাকে। তারা বোধহয় কিছু সময়ের জন্য ভুলে যায়, গুলি বোঝাই গাড়িগুলো আর তাদের সামনে নেই। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই হানাদারদের সব গুলি ফুরিয়ে আসতে থাকে। উপরন্তু চরম অস্থিরতা নিয়ে প্রতিকূল অবস্থায় তিন-চার মাইল হাঁটার পর তারা একেবারে ভেঙে পড়ে। এই সময় শুরু হয়, তাদেরকে বিল সেঁচে মাছ ধরার মতো পাকড়াও করার মহা উল্লাস পর্ব। আমরা বিশাল বাহিনী নিয়ে ১১ই ডিসেম্বর সারাদিনে চারশ জন নিয়মিত হানাদার খান-সেনা ধরতে পেরেছিলাম। ছত্রীবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ছশ জন। অন্যদিকে টাংগাইল-ঢাকা রাস্তা অবরোধ করে থাকা মুক্তিবাহিনীর অতি সাধারণ কোম্পানীগুলোতে কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের চাইতে বেশী শত্রুসেনাকে বন্দী করতে সক্ষম হয়। মির্জাপুরে ক্যাপ্টেন আজাদ কামাল কোম্পানী ১১ই ডিসেম্বর পাঁচশ পঞ্চাশ জন হানাদারকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯১

অক্ষত অবস্থায় ধরে ফেলে। কালিয়াকৈরের আশেপাশে মেজর আবদুল হাকিম দু’শ জনকে বন্দী করে। ক্যাপ্টেন সায়েক আলম, ক্যাপ্টেন গাজী লুৎফর রহমান, ক্যাপ্টেন সুলতান, কমাণ্ডার এন. এ. খান আজাদ ও কুর্নির বাদশাহর কোম্পানী সম্মিলিত ভাবে প্রায় চৌদ্দশ হানাদারকে অক্ষত অবস্থায় ধরে ফেলতে সক্ষম হয়। স্থানীয় জনগণ ও স্বেচ্ছা-সেবকরা এই সময় খুব একটা পিছিয়ে থাকেননি। ১১ তারিখ সারাদিনে তারা নিজেরা নিরস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও প্রায় শ’তিনেক হানাদার পাকড়াও করে। হানাদাররা পালিয়ে যাওয়ার সময়, কালিয়াকৈর বলিয়াদী ও মির্জাপুর-পাকুটিয়ার কাছে দুইটি বাজারে অসংখ্য লোককে গুলি করে হত্যা করেছিল। তবে এর পর তারা বেশীদূর সরে যেতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণ সম্মিলিতভাবে পিছু ধাওয়া করে সহজেই তাদের ধরে ফেলেন। জামুর্কীর কাছে হানাদাররা যখন গাড়ি ত্যাগ করে সহজেই তাদের ধরে ফেলেন। জামুর্কীর কাছে হানাদাররা যখন গাড়ি ত্যাগ করতে থাকে তখন ক্যাপ্টেন গাজী লুৎফর কোম্পানীর যোদ্ধারা হানাদারদের গাড়ি থেকে শত শত গোলা-গুলির বাক্স ও অস্ত্র তরিৎগতিতে নামিয়ে জমা করতে করতে জামুর্কী স্কুলের দুইটি বড় ঘর অস্ত্র ও গোলাবারুদে ভরে ফেলে।

মুক্ত টাংগাইল
১১ই ডিসেম্বর সকাল এগারোটার দিকে টাংগাইল পুরানো শহরের শেষ হানাদারটিও যখন ঢাকার দিকে পাড়ি দেয়, তখন কর্ণেল ফজলু তার বিশাল বাহিনী নিয়ে টাংগাইল শহরের পূর্ব-দক্ষিণ দিক দিয়ে পুরানো শহরে উঠে পড়েন। সকাল সাড়ে এগারোটায় পুরানো শহর মুক্তিবাহিনীর দখলে এসে যায়। টাংগাইল দখল অভিযানে দাইন্যার ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী চাচা, ক্যাপ্টেন আবদুল করিম ও মেজর মঈনুদ্দীনের কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রশংসনীয় অবদান রাখে। ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী চাচা পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বৎসর বয়সী হলেও সেইদিন তাঁর গায়ে সিংহের তেজ এসেছিল। নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, টাংগাইল পুরানো শহর দখল অভিযানে কোম্পানী কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী চাচার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। দাইন্যার কাছে হানাদারদের সাথে সামনাসামনি লড়াইয়ে ক্যাপ্টেন নিয়ত আলীর কোম্পানী বীর যোদ্ধা আবদুর রশিদ শহীদ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা টাংগাইল পুরানো শহরে উঠে পড়লে, টাংগাইলের নতুন জেলা সদরে প্রায় চার শত হানাদার আটকে পড়ে। টাংগাইলের পুরানো শহর থেকে নতুন জেলা শহরের দূরত্ব প্রায় এক মাইল। নতুন জেলা শহর থেকে পুরানো শহরের পাশ দিয়েই ঢাকা যেতে হয়। এছাড়া ভিন্ন কোন রাস্তা নেই। পুরোনো শহর দখল হয়ে গেলে জেলা সদর থেকে বেরোবার কোন রাস্তাই আর হানাদারদের জন্য খোলা রইলোনা। কর্ণেল ফজলু, মেজর মঈনুদ্দীন, ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী চাচা ও ক্যাপ্টেন আমানউল্লাহর কোম্পানীর হাতে আড়াইশ হানাদার ধরা পড়লো।
টাংগাইল এবং টাংগাইলের দক্ষিণে, টাংগাইল-ঢাকা সড়কে যখন এই অবস্থা, তখন ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও আমি বিশাল বাহিনী নিয়ে পুংলিতে অবস্থান করছিলাম। ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও আমি পুংলি পুলের নীচে বসে পরবর্তী অভিযানের আলাপ-আলোচনা করছি। টাংগাইল
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯২

মুক্তিবাহিনীর দখলে এসে গেছে, এইরকম একটা উড়ো খবর আসলেও তখন আমাদের কাছে কোন প্রকৃত খবর পৌছায়নি। ব্রিগেডিয়ার ক্লের চাইছিলেন, তখনই টাংগাইল পর্যন্ত এগিয়ে যাবেন। কিন্তু আমি বললাম, ‘ভালেভাবে খোঁজখবর না নিয়ে সন্ধ্যার আগে টাংগাইলের দিকে এগুনো বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা।’ দুইজনে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, শুধু মুক্তিবাহিনী হাল্কা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রথমে টাংগাইল পর্যন্ত এগিয়ে যাবে। তারপর তারা সংবাদ পাঠালে মিত্র- বাহিনী এগুবেন। ব্রিগ্রেডিয়ার ক্লের যখন শুনলেন, বিস্তীর্ণ এলাকা আমাদের কব্জায়, তখন তিনি খুশী হলেন। তিনি ধরে নিলেন, টাংগাইলের আশেপাশে প্রতিরোধ ভাঙতে তার বাহিনীকে বড় রকমের কোন সংঘর্ষে জড়িত হতে হবেনা। আর এই অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ও কর্মক্ষমতা দেখে অভিজ্ঞ সেনানায়ক বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে পড়েন। টাংগাইল মুক্তিবাহিনী যে শৃংঙ্খল, যুদ্ধ তৎপরতা ও শক্তি সাহসে সুশিক্ষিত নিয়মিত বাহিনীর চাইতে কোন অংশেই কম নয়, তা তিনি বুঝে ফেলেন।
বিকেল চারটায় কয়েকটা খোলা জীপে এম. জি. উচিয়ে একশ’ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন সবুর খুব ধীরে ধীরে টাংগাইলের দিকে এগুলো। সবুর এগিয়ে যাবার মিনিট পাঁচেক পর তিনটি জীপ ও তিনটি লরিতে মেজর মোস্তফা আরো একশ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এম. জি. উঁচিয়ে টাংগাইলের দিকে এগুতে থাকল। এর কয়েক মিনিট পর পাঁচটি জীপ ও লরিতে আশি জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা নিয়ে প্রতি গাড়ীতে একটি করে মেশিনগান বসিয়ে আমি নিজে টাংগাইলের দিকে এগিয়ে চললাম। যাবার সময় মেজর হাকিমকে নির্দেশ দিয়ে গেলাম, ‘তোমরা তোমাদের মর্টারের কামান নিয়ে দশ মিনিট পর টাংগাইলের দিকে এগুবে। ফুলতলায় বিমান ও মুক্তিবাহিনীর হামলায় ছত্রভঙ্গ খান-সেনারা সব ভারী অস্ত্র ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল। সেখানে তিনটি আর. আর, দুটি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও একটি ১২০ এম. এম. ভারী কামান সহ অসংখ্য অস্ত্র, গুলি-গোলা ও অক্ষত বেশ কয়েকটি গাড়ি আমাদের দখলে এসেছিল।
ক্যাপ্টেন সবুর, মেজর মোস্তফা ও আমি পর পর নতুন জেলা সদরের দিকে এগুচ্ছিলাম। এই সময় টাংগাইলের কয়েকজন অত্যুৎসাহী যুবককে আমরা পেয়ে যাই। টাংগাইলের কয়েকজন যুবক হানাদারদের গুলির মাঝ দিয়েও একটি বাসে পুংলির দিকে এগিয়ে আসছিল। তাদের কাছে নাকি খবর ছিল, মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী কালিহাতী পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। তাই নিজেরা উদ্যোগী হয়ে টাংগাইলের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানানোর জন্য একটি বাসে কালিহাতীর দিকে এগুচ্ছিল। আমরা যখন শিবপুর পুলের কাছাকাছি, তখন টাংগাইলের দিক থেকে একটি বাস আসতে দেখে চট্ করে রাস্তার দুই পাশে অবস্থান নিলাম। অন্যদিকে রাস্তার দুই পাশে দুটি জীপ দাঁড় করিয়ে মেশিনগান উচিয়ে রাখা হলো। ক্যাপ্টেন সবুর দুরবীন দিয়ে বাসটিকে খুব ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। তার বার বার মনে হলো, বাসটিতে চালক ছাড়া কোন আরোহী নেই। আমারও তাই মনে হলো। তাই দূরে থাকতে বাসটিকে গুলি করা হলো না। বাসটি শিবপুর পুলের উপর এলে পুলের মুখে এম. জি. উঁচানো দুটি পাকিস্তানী মিলিটারী
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৩

দ্বীপ দেখে বাস চালক চমকে উঠে জোরে ব্রেক কষে বাসটি থামিয়ে ফেললো। বাসটি থামতে পিছনের দিক থেকে ছ-সাত জন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে এলো। একই সময়ে বাসের চালক সহ চার জন আরোহী বাস থেকে নেমে পড়লো। তাদের প্রথম ধারণা হয়েছিল, সামনে হানাদার মিলিটারী। তারা হয়তো বলতে যাবে, আমরা আপনাদের গাড়িতে করে এগিয়ে আনতে যাচ্ছিলাম। এ সময় বিভিন্ন রকমের পোশাক পরা সশস্ত্র লোক দেখে তারা হকচকিয়ে যায়। মুহুর্তেই বুঝতে পারে, তারা ভুল শোনেনি। মুক্তিবাহিনী তাদের সামনে, তারা সোল্লাসে একের পর এক টাংগাইলের খবর দিতে থাকে। এদের কাছেই প্রথম জানতে পারলাম, টাংগাইলের পুরানো শহর মুক্ত। তবে জেলা সদরে তখনও হানাদার রয়েছে। এই অত্যুৎসাহী যুবকদের অন্যতম হলো, বল্লার আবদুল আলী সরকারের বড় ছেলে আশরাফ সরকার (আশু), অন্যজন টাংগাইল থানা এডুকেশন অফিসার জালাল মিঞার বড় ছেলে মন্টু। আমরা প্রথম এদের কথা বিশ্বাস করলাম না। গ্রেফতার করে এদের নিয়ে দেওলা পর্যন্ত এগুলাম। পনের- ষোলটা গাড়ির সারি দেওলা পর্যন্ত এলে জেলা সদরের দিক থেকে আমাদের উপর ব্যাপক – ভাবে মেশিনগানের গুলি আসতে লাগলো। মুহুর্তে আমাদের চার-পাঁচটি গাড়ি বিকল হয়ে গেল। পাকা রাস্তার উপর যেন অগ্ন্যুৎপাত শুরু হলো। আমরা ঝড়ের বেগে লাফিয়ে পড়ে রাস্তার পূব পাশে অবস্থান নিলাম। এই সময় গ্রেফতার করা অত্যুৎসাহী যুবকদের ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা’, তাদের হয়তো তখন এতদূর আসার জন্য আপসোসের শেষ রইলোনা। এদের ত্রাহি মধুসুদন অবস্থা দেখে কিছুটা ব্যাথিত হলাম। বেচারা এর আগে এমন গুলির মুখে কখনো পড়েনি। তাই সামনে উঁচু রাস্তার আড়াল থাকলেও নীচে রাস্তার পারে যেভাবে গড়াগড়ি করে হামাগুড়ি দিয়ে বুক, হাঁটু ও হাতে ছাল তুলে ফেলছিল, তা দেখে যে- কেউই ব্যথিত হবেন। হানাদারদের আকস্মিক গুলিতে গাড়ির ক্ষতি হলেও আমাদের কারো কোন ক্ষতি হয়নি। আমরা প্রতি মূহুর্তে এমন একটি আক্রমণের জন্য তৈরী ছিলাম। অবস্থান নিতে তাই কোন বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু অবস্থান নেয়ার পরও হানাদারদের একটি মেশিনগান আমাদের খুব অসুবিধায় ফেলে দিন। আট-দশ ফুট উঁচু রাস্তার আড়াল নিয়ে, রাস্তার কোল ঘেঁষে অবস্থান নেয়ার পরও হানাদারদের একটি মেশিনগানের দৃষ্টি এড়াতে পারলামনা। মেশিন- গান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি আমাদের আশে-পাশে এসে পড়ছিল। মেশিনগানের দৃষ্টি থেকে সরে যাবার জন্য ডানে-বামে গড়াগড়ি করতে করতে আমাদেরও ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ক্যাপ্টেন সবুর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে কোন রকমে মাদার ডায়েরীর দেয়ালের আড়ালে গিয়ে কোথা থেকে গুলি আসছে, তা লক্ষ্য করছিল। আমিও সরে গিয়ে রাস্তার পাশে দশ-পনের হাত মোটা প্রকাণ্ড একটি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে একই ব্যাপার লক্ষ্য করছিলাম। কোথা থেকে এমন দারুন নিশানায় গুলি আসছে, তা চিহ্নিত করতে আমাদের দশ মিনিট লেগে গেল। দশ মিনিট তীক্ষ্ম ভাবে নজর বুলিয়ে দেখতে পেলাম, জেলা সদরের পানির টাংকের উপরে বালির বস্তা দিয়ে চতুর্দিকে ভাল আড়াল বানিয়ে তার মাঝখান থেকে একটি নয়, দুটি মেশিনগান
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৪

অনবরত গুলি ছুঁড়ছে। হানাদারদের অবস্থান আমাদের থেকে পঞ্চাশ-ষাট ফুট উপরে। তাই তারা আমাদের উপর গুলি ছুঁড়তে খুবই সুবিধা পাচ্ছিল। কোথা থেকে শত্রুর গুলি আসছে তা নির্দিষ্ট করা গেল, কিন্তু এর প্রতিকার করা হবে কি করে? আমাদের কাছে অস্ত্রের মধ্যে কেবল মেশিনগান। মেশিনগান দিয়ে নীচ থেকে গুলি ছুঁড়ে কোন কাজ হবেনা। কাজেই মেজর হাকিমের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় রইলনা।
আমাদের বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেজর হাকিম তিনটি আর. আর. তিনটি তিন ইঞ্চি মর্টার, ছয়-সাতটি ব্লাণ্ডার সাইট ও রকেট ল্যাঞ্চার সহ তার গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে আমাদের সাথে মিলিত হলো। শত্রুর গুলি ছোঁড়া তখনও অব্যাহত রয়েছে। হাকিম এসে নিজেও একটু বিস্মিত হলো। কারণ সে যেদিকে যাচ্ছে মেশিনগানের গুলিও তাকে অনুসরণ করছে। একি ব্যাপার! রাস্তার আড়ালে এত নীচ দিয়ে চলার পরও শত্রুরা তাকে দেখছে কি করে? আমি রহস্যটা ভেঙে দিলাম। মেজর হাকিমকে গাছের আড়ালে ডেকে আঙ্গুল উচিয়ে পানির ট্যাংক দেখিয়ে বললাম, ঐ যে ওখান থেকে আসছে।’ মেজর হাকিমকে নির্দেশ দেয়া হলো, গ্রামের পুবদিক দিয়ে ঘুরে দক্ষিণে দেওলা ও কোদালিয়ার মাঝ থেকে হানাদারদের ঘাঁটির উপর গোলা ছুঁড়তে। এক রাতের প্রশিক্ষণ নেয়া আর. আর. চালকের পানি ট্যাংকের উপর হানাদারদের দেখিয়ে নির্দেশ দিলাম, ‘ঐ দুটি মেশিগান সহ চালকদের কাগজের টুকরোর মত ওখান থেকে উড়িয়ে দিতে হবে। আর. আর. চালকরা ভীষণ কষ্ট করে দেওলা গ্রামের ভিতর দিয়ে প্রায় দুই মাইল ঘুরে দেওলা-কোদালিয়ার মাঝামাঝি এসে নিরাপদ অবস্থানে তাদের হাল্কা কামানগুলো বসালো। কামান বসানোর পর তারা দুই মিনিটও দেরী করলোনা। একজন গোলা ভরে দিচ্ছে, অন্যজন ফায়ার করছে। দু’তিন মিনিটের মধ্যে তারা দশ-বারোটি গোলা ছুঁড়লো। প্রথম দুটি গোলাতেই সিদ্ধিলাভ। কামানের গোলার আঘাতে পানি ট্যাংকের উপরের বালির বস্তাগুলো হাল্কা শোলার মত উড়ে উড়ে ছিটকে পড়তে থাকে। গোলার আঘাতে হানাদাররা দলা পাকিয়ে নীচে পরে গেল। এর পর জেলা সদরের নানা জায়গায় তিনটি আর. আর., তিন ইঞ্চি মর্টার, সাত-আটটি মেশিনগান ও শ’দুই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এক সাথে গুলির বৃষ্টি করতে থাকে। সন্ধ্যা হয়ে এলে ধারিন্দার দিক থেকে মেজর লোকমান হোসেনের মর্টার প্লাটুনও কোদালিয়ায় আমাদের সাথে যোগ দেয়।
ঘনায়মান সন্ধ্যার ছায়া অন্ধকারে আমরা জেলা সদরের শামসুল হক গেটের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জনকে মুক্তিযোদ্ধারা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এদের সারিতেই পুংলির দিকে যাওয়া অতি উৎসাহী যুবকদের মিলিয়ে দিয়ে সকলকে তখনই টাংগাইল জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো। টাংগাইল জেলা সদরে তখনও তিনশ হানাদার আত্মসমর্পণ করেনি। মুক্তিবাহিনী প্রস্তাব পাঠালে তারা আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। তবে তাদের এক শর্ত, তারা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। নেহায়েত তা সম্ভব না হলে একমাত্র কাদের সিদ্দিকী নিজে এলে তারা আত্মসমর্পণ করতে রাজী। তাদেরকে বলা হলো, ‘কাদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৫

সিদ্দিকী নিজেই আসছেন। তারা যেন তাই বুদ্ধিমানের মত আত্মসমর্পণ করে।’ দ্বিতীয়বার, কাদের সিদ্দিকী এসেছেন, এই খবর পাঠানো হলে ক্যাপ্টেন মনোয়ার নামে একজন হানাদার এসে আমাকে দেখে এবং কথাবার্তা বলে নিঃসন্দেহ হয়ে তার মেজরের কাছে রিপোর্ট করলে হানাদাররা আর কোন গোলামাল না করে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে আত্মসমর্পন করলো। হানাদারদের নিরস্ত্র করে রাতের মত টাংগাইল কোর্টের পনের কুড়িটি ঘরে সতর্ক পাহারায় আটকে রাখা হলো।
সন্ধ্যার পর নতুন জেলা সদর থেকে টাংগাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়ক ধরে পায়ে হেঁটে পুরানো শহরের দিকে এগুতে লাগলাম। এই রাস্তার পাশেই আমাদের বহু দিনের বসত বাড়ি। কুমুদিনী কলেজের সামনে পাকা রাস্তা থেকে পঞ্চাশ গজ পশ্চিমে বহু পুরানো পোড়া বসত বাড়িটি এক নজর দেখে আবার শহরের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে তখন দু’শ মুক্তিযোদ্ধা নিচ্ছিদ্র পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যেন তখন তাদের হাতে বহু আদ্রিত বন্দী। সন্ধ্যা সাতটায় টাংগাইল জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের বারান্দায় এসে উঠলাম। আমি ২৬শে মার্চ কারো অনুমতি না নিয়ে এখান থেকেই এক বক্তৃতা করেছিলাম। তারপর এই প্রথম এলাম। প্রায় পনের দিন পর কর্ণেল ফজলুর সাথে দেখা হলো। কর্ণেল ফজুল আমাকে দেখে আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে জড়িয়ে ধরলেন। কর্ণেল ফজলু বজলুর রহমান কুতুব সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের একে একে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দিত করলাম। আফিসের সামনের রাস্তা তখন লোকে লোকারণ্য। কাদের সিদ্দিকী এসেছে, এটা শোনামাত্র যেমন নিকতবর্তী লোকজন অফিসের সামনে এসে ভেঙে পড়েন, তেমনি খবরটা সামান্য ছড়িয়ে পড়ার পর শহরের নানা দিক থেকে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে জনতার স্রোত বইতে থাকে। কর্ণেল ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বেশীরভাগ মুক্তিযোদ্ধারাই তখন বিশেষ বিশেষ দালালদের ধরার কাজে ব্যস্ত ছিল। ইতিমধ্যে তারা বেশ কয়েকজন দালালকে ধরে এনে হাত-পা বেঁধে আওয়ামী লীগ অফিসের পিছনে বসিয়ে রেখেছে। আমি বেশী সময় দেরী করতে চাইলামনা। কর্ণেলকে আদেশ দিলাম, ‘সারা শহরে রাত আটটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ জারী করে দিন। কাউকে যেন বাড়ির বাইরে দেখা না যায়।’ আদেশ পালনে কর্ণেল ফজলুর বেশী সময় লাগালো না। দুইটি জীপে মাইক লাগিয়ে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে কাজে নামিয়ে দিলেন। তারা আধঘন্টার মধ্যে সারা শহর একবার চক্কর মেরে ঘোষণা করলো, ‘মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে সারা শহরে আজ রাত আটটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ জারী করা হয়েছে। এই সময় কেউ বাড়িঘরের বাইরে বের হবেন না। কেউ রাস্তায় বেরোলে এবং তার গায়ে গুলি লাগলে মুক্তিবাহিনীকে দায়ী করা চলবেনা।’ স্বাধীনতা পাবার অপার আগ্রহে তখন প্রতিটি বাঙালী আন্তরিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। একবারের ঘোষণাতেই তাই কাজ হয়ে গেল। রাতে কেউ ঘর থেকে বেরোননি।
ভরা সাঝের অন্ধকার নামার পর পরই ভারতীয় বাহিনী টাংগাইলের পুরানো শহরের পাশ দিয়ে ঢাকার রাস্তা ধরলো। তাদের অনুরোধ করলাম ‘কোনক্রমেই রাতে ভাতকুড়া সেতু
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৬

পেরিয়ে যাবেনা। মিত্র বাহিনী আমার অনুরোধ রক্ষা করলো।
নির্বাচনের পর নানা টালবাহানা দেখে দেশ-বিদেশের বহু মানুষ সামরিক জান্তার বদ মতলব আঁচ করতে পেরেছিলেন। সারা দুনিয়া রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়েছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জির দিকে। বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের দৃষ্টি গভীরভাবে নিবদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশের উপর।
মার্চের শুরুতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তেজনায় শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা ভাল করেই জানতেন কোন প্রতিবেশী দেশের উত্তেজক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদেরও কিছু না কিছু স্পর্শ করবে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ভয়াবহ কিছু ঘটলে ভারতে তার অশুভ প্রভাব পড়তে বাধ্য। সারাদেশে যখন বিস্ময়কর অসহযোগ আন্দোলন চলছিল, তখন ভারতের বহু গান্ধীবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের আহুত অসহযোগ আন্দোলনকে মহাত্মাজীর অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করছিলেন। গান্ধীবাদী সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশে ঘোষণা করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ গান্ধীবাদী।
বাঙালীরা আন্দোলন অহিংস, শাস্তিপূর্ণ রাখতে চাইলে কি হবে, পাকিস্তানী খানেরা পরিকল্পনা করে রেখেছিল বাঙালীর রক্তে তার পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, শীতলক্ষ্যা, বুড়ি গঙ্গার পানি রক্তাক্ত করে তুলবে। বাঙালীর জাতীয় সত্তা চিরতরে বিশ্বের মানসপট থেকে মুছে ফেলবে। সে উদ্দেশ্যেই পশ্চিমা হানাদাররা আদিম হিংস্র বর্বরতায় অতর্কিতে বাঙালী জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, যদিও তাদের আশা পূর্ণ হয়নি। হানাদারদের বর্বরতার হাত থেকে বাঁচার আশায় নিরাপত্তার খোঁজে ১০ লক্ষ মানুষ ভারতে পাড়ি জমালেন। প্রায় দুই কোটি মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে এ গ্রাম সে গ্রাম করে কাটাতে লাগলেন। সর্বশান্ত যে ১০ লক্ষ মানুষ ভারতে আশ্রয় নিলেন তাদের অনেকে ছিলেন আহত, আবার কেউ কেউ মানসিক দিক থেকে ভারসাম্যহীন। কারণ, তারা চোখের সামনে বাড়িঘর জ্বলতে এবং ভাইবোন, বাবা-মাকে প্রাণ হারাতে দেখে গেছেন। স্বামীর সামনে স্ত্রী, মায়ের সামনে মেয়ে, ভাইয়ের সামনে বোন ধর্ষিতা হয়েছে। সোনার বাংলায় দানবীয় পশুশক্তি পৃথিবীর সর্বকালের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে।
ভারতে শরনার্থীর যে ঢল নামে, সে ঢল সামাল দিতে ভারতীয় জনসাধারণ হিমসিম খাচ্ছিলেন। প্রায় এক কোটি মানুষকে অন্ন বস্ত্র দিয়ে বাঁচানো যে-সে কথা নয়। তাদের শুধু খেতে দিলেই চলবে না, শান্তনা ও ভালবাসাও চাই। ভারতবাসীরা সেই ভালবাসাই উজার করে দিলেন।
ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসামে, প্রায় ৪০-৫০ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নিলেন। এই তিনটি রাজ্যের দুর্গমতম এলাকায় শরণার্থীদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করতে ভারতের মত বিশাল দেশের সরকারও হিমসিম খাচ্ছিলেন। বিশেষ করে জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৭

সহযোগিতা করতে এগিয়ে না এলে হয়তো ভারত সরকারের পক্ষেও বিশেষ কিছু করা সম্ভব হতো না। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ৪০-৫০ লক্ষ শরনার্থীদের আশ্রয় নিলেন, যার অর্ধেক কলকাতায়। মহানগরী কলকাতা সম্পর্কে যাদেরই সামান্য ধারণা আছে, তাঁরা ভাল করেই জানেন- কলকাতায় দু-বেলায় দু-মুঠো আহার জুটলেও মাথা গোঁজার একচিলতে জায়গা পাওয়া কত দূরূহ। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে সেই দুরূহ কাজই সম্ভব করলেন কলকাতাবাসীরা। লক্ষ লক্ষ গৃহস্থরা মানুষকে কলকাতাবাসী আপন করে নিলেন, আশ্রয় দিলেন নিজেদের ঘরে। এমনও দেখা গেল, কলকাতা শহরে যার নিজেরই হয়তো স্ত্রী-পুত্র পরিবার নিয়ে মাথা গোঁজবার তেমন ঠাই নেই, নিজেরাই কোন রকম ছোট একটি ঘরে থাকেন, এঁদেরও কেউ কেউ হাজার অসুবিধার মধ্যেও বাংলাদেশ থেকে আসা ছিন্নমূলদের দু-একজনকে জায়গা দিয়ে, খেতে দিয়ে, নিজেদের পরিবারে শরিক করে নিলেন। শুধু কলকাতায় নয়, ভারতের সর্বত্র একই দৃশ্য, একই মানসিকতা। সমস্ত ভারতবাসী তাদের মনপ্রাণ ঢেলে শরণার্থীদের যে যা পারলেন সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। এ সময় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা গেল ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথের বাঁকে, বাঁকে সময় সময় দেখা গেছে, নেতাদের মধ্যে স্বাধীনতার প্রশ্নেও কিছু কিছু মতবিরোধ ঘটেছে। ২৫ বৎসর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই প্রথম ভারতের রাজনৈতিক দল এক সারিতে মিলিত হয়েছে।
জনসংঘের মত দলও বাংলাদেশের স্বাধীনার স্বপক্ষে কাজ করেছে। দিল্লিতে তাঁরা তাদের সর্বকালের বৃহত্তম মিছিল ও সমাবেশ করেন, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের প্রশ্নে নিঃশর্ত সমর্থন জানায়। অন্যদিকে সর্বোদয় নেতা শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসাবে ইউরোপ সহ দুনিয়ার প্রায় সব কটি দেশ সফর করে বাস্তব অবস্থা বিশ্ব- বাসীর সামনে তুলে ধরে বাংলাদেশের স্বপক্ষে সমর্থন আদায় করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়প্রকাশ নারায়ণের ভূমিকা অতুলনীয়। অন্য নেতারাও সরকারী অথবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন অর্জনের চেষ্টা করেন।
আগষ্টের পর শরণার্থীদের চাপ ভারতের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠে। তাদের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। শুধু শরণার্থীদের জন্যই প্রতিদিন ভারতকে চার-সাড়ে চার কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছিল। এ ধরনের শরণার্থীর চাপ পৃথিবীর অনেক দেশের পক্ষেই সহ্য করা সম্ভব নয়। শুধু টাকা খরচ করেই ভারতের নিস্তার ছিল না, শত চেষ্টার পরও আশ্রয় শিবিরে বহু শরণার্থী মহমারীতে প্রাণ হারাতে থাকেন। অন্যদিকে শরণার্থী সমস্যা ভারতের আইন শৃঙ্খলার উপর একটা হুমকি হিসাবে দেখা দেবার উপক্রম হয়। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী ভারতের অবস্থা বোঝানোর উদ্দেশ্যে পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু সহানুভূতি অর্জনে বিফল হন। সমস্ত ইউরোপে এমতাবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছিল যে বহু দেশের জনসাধারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁদের সহানুভূতি এবং সহযোগীতার
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৮

হাত বাড়ালেও সেই সব দেশের সরকার বিরোধিতা করতে থাকে।
এই সময়ে এক যুগান্তকারী ঘটনা “রুশ-ভারত শান্তি ও সহযোগীতা চুক্তি”। এতে ভারত নিজেকে অনেকটা শক্তিশালী অনুভব করে। ভারত বুঝে নিয়েছিল বাংলাদেশের যে হত্যাযজ্ঞ ও রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে তা, কিছুতেই আলোচনা বা আপোষে সমাধান করা যাবে না। বাংলার দুর্জয় জনতা তা মেনে নেবে না। অন্যদিকে ভারতের ৬৫ কোটি মানুষও ততদিনে বাংলার নির্যাতিত বীর জনতার সংগে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন এবং সহযোগীতা না করা তখন ভারত সরকারের পক্ষে অসম্ভব ছিল। বাংলাদেশের মানুষের মত ভারতের ৬৫ কোটি মানুষও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, কখন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে, স্বাধীন হবে। আর সেই সংগ্রামে ভারত কতটা আন্তরিকতা নিয়ে কতটুকু সাহায্য করছে তা দেখতে প্রতিটি বঙ্গ সন্তানের মত ভারতবাসীরাও অধীর অপেক্ষায় ছিলেন
নানা দেশে ঘুরে ঘুরে সেই সমস্ত নেতাদের উদাসীন আচরণে ভারতের বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী খুবই ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। রুশ-ভারত চুক্তি সম্পাদনের পর তিনিও প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তিনি বুঝে নিয়েছিলেন নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। এ জন্য বাইরের তেমন সহানুভূতি পাওয়া যাবে না। সশস্ত্র সমাধানে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর উপর নির্ভর করতে হবে। সেই মতই প্রস্তুতি চললো। সারা দেশ তখন একটা ইস্যুর উপর এক আত্মা, এক প্রাণ। কোথাও কোন দলাদলি নেই, নেই কোন হানাহানি। বড় বিপদের মুখে কোন জাতি যখন এমন ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন কেউ তাকে পরাজিত করতে পারে না। মহান ভারতকেও পারেনি।
৩রা ডিসেম্বর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সংক্ষিপ্ত সফরে কলকাতা এলেন, ময়দানে একটি জনসভাও করলেন। ৭১-এর ৩রা ডিসেম্বর কলকাতা ময়দানের জনসভাই সম্ভবতঃ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জীবনে সব চাইতে বড় জনসভা। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য উপস্থিত হয়েছেন। এক সময় প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ালে জনতা শ্লোগানে ফেটে পড়লেন। তাঁরা গভীর আকুলতা নিয়ে যে কথাটি শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন, এই বুঝি প্রধানমন্ত্রী জনতার মনের কথা প্রাণের দাবী “বাংলাদেশের স্বীকৃতি” ঘোষণা করেন। জনতা অধীর অপেক্ষা করতে লাগলেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের শরণার্থীদের প্রতি গভীর সহানুভূতি জানালেন, দেশের চলমান নানা প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ যে কথাটি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বুক বেঁধে আছেন, সে কথাটি উচ্চারণ বা ঘোষণা করছেন না দেখে জনতা কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন।
বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে দেখা গেল দয়িত্বশীল এক সরকারী কর্মচারী প্রধানমন্ত্রীর হাতে এক টুকরো কাগজ তুলে দিলেন। কাগজে এক পলক চোখ বুলিয়েই সুদর্শনা প্রধানমন্ত্রী যেন কেমন একটু বিবর্ণ হয়ে গেলেন। সেও মাত্র মুহুর্তের জন্য, তারপর আবার মাইক্রোফোনে দু-
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৯

চার কথা বলে অকস্মাৎ সভা শেষ করে কলকাতা রাজভবনে চলে গেলেন। রাজভবনেই সাংবাদিকরা তার পিছু ধাওয়া করলেন। কি হয়েছে? কেন ওভাবে সভা ছেড়ে চলে এলেন?
সাংবাদিকদের চাপাচাপিতে আষাঢ়ের মেঘে ভরা আকাশের মত মুখে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘পাকিস্তান আমাদের বিমান ঘাঁটি গুলির উপর আঘাত হেনেছে। শত পীড়াপিড়িতেও আর একটি কথাও বললেন না। ছয়টি যুদ্ধ বিমান পাহারা দিয়ে তাকে দিল্লি নিয়ে গেল। রাজধানীতে পৌঁছেই সব কিছুর খোঁজখবর নিলেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ঐ রাতে বিদেশ সফরে যাবার কথা ছিল। তিনি তার নির্ধারিত সফর বাতিল করলেন না। রাত বারটায় জাতির উদ্দেশ্যে অনির্ধারিত বেতার ভাষণ দিলেন। তিনি বলেন, এই দুঃসময়ে তাকে বিদেশ যেতে হচ্ছে বলে খুব বেদনা অনুভব করছেন। কিন্তু তাঁর না গিয়ে উপায় নেই।
ভারতীয় বাহিনীকে পূর্ব-পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়া হলো, কোন ক্রমেই নিজের ভূখণ্ডে লড়াই নয়, লড়াই যদি করতেই হয় তা পাকিস্তানের ভূখণ্ডে করতে হবে। পূর্ব রণাঙ্গণে আগেই যৌথকমাণ্ড গঠিত হয়েছিল, তাই মুক্তি ও মিত্রবাহিনী জোরকদমে এগিয়ে চললো। পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনী তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখলো।
পশ্চিম রণাঙ্গণে ভারতীয় পদাতিক, বিমান, নৌবাহিনী এবং পূর্ব রণাঙ্গনে যৌথ বাহিনী যার যার এলাকায় দুর্দান্ত সফলতা অর্জন করে চললো।
প্রধানমন্ত্রী দ্রুত বিদেশ সফর শেষ করে দেশে ফিরে ৬ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশন ডেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেন। তার ঘোষণায় হাউজে আনন্দের ঢল নামলো। সেই ঢল পরদিন সারা ভারতকে ভাসিয়ে নেবার উপক্রম করলো। লক্ষ কোটি কণ্ঠে সবাই প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দিত করলেন। মহান ভারতের প্রধানমন্ত্রী এতদিনে তাদের মনের কথা, প্রাণের দাবীই নিজের কন্ঠে উচ্চারিত করে দেশবাসীকে সম্মানিত করেছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০০

ঢাকা চলো

১১ই ডিসেম্বর রাত দশটায় শুরু করে ক্যাপ্টেন বায়জিদ, ক্যাপ্টেন সোলায়মান, ক্যাপ্টেন শামসুল হক, ক্যাপ্টেন গাজী লুৎফর রহমান ও ক্যাপ্টেন নায়েক আলমের কোম্পানীর যোদ্ধারা ভাতকুড়া, করটিয়া, মটরা, জামুর্কী, শুভল্লা ও মির্জাপুরের বিকল্প রাস্তায় নিজেদের পোঁতা ট্যাংক মাইনস প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে ভোরের আগেই অপসারণ করতে সক্ষম হলো। মাইনস অপসারণ করতে আমাদের দুইজন আহত হলো। যৌথবাহিনী বিনা বাধায় সকাল আটটায় মির্জাপুর ও বেলা বারোটায় কালিয়াকৈর পৌঁছে গেল। ১২ই ডিসেম্বর সারাদিন যৌথবাহিনী কালিয়াকৈরে ঘাঁটি গেড়ে অবস্থান করলো। ১৩ই ডিসেম্বর সকাল দশটায় ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর পাঁচ হাজার সদস্য কড্ডা-মৌচাক পর্যন্ত এগিয়ে যেতে সক্ষম হলো।
অন্যদিকে সান সিংয়ের ব্রিগেডটি ১১ই ডিসেম্বর হালুয়াঘাট হয়ে ১১ই ডিসেম্বর সকালে শম্ভুগঞ্জ খেয়াঘাট পার হয়ে ময়মনসিংহ পৌঁছে যায়। শুধু হালুয়াঘাট ছাড়া আর কোথাও তাদের পাক-হানাদারদের সাথে মোকাবেলা করতে হয়নি। ব্রিগেডিয়ার সাং সিং বাবাজীর ব্রিগেড ১৩ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় টাংগাইল এসে পৌঁছে। টাংগাইলে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে রাত দশটার মধ্যে তারা কালিয়াকৈর পর্যন্ত এগিয়ে যায়।
১৩ই ডিসেম্বর রাত নটায় মেজর জেনারেল নাগরা টাংগাইল এলেন। ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও ব্রিগেডিয়ার সান সিং সন্ধ্যা থেকে টাংগাইলে অবস্থান করছিলেন। রাত সাড়ে নটায় টাংগাইল ওয়াপদা রেস্ট হাউসে পরবর্তী পরিকল্পনা আলোচনায় বসলেন। আলোচনার শুরুতে মেজর জেনারেল নাগরা মুক্তিবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বার বার ধন্যবাদ দিলেন। তিনি আন্তরিকভাবে বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের বিনা বাধায় এতটা পথ পাড়ি দিতে সাহায্য না করতেন, তাহলে আমাদের বাহিনী দীর্ঘ রাস্তায় যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো। রাস্তাতেই আমাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যেতো।’
১৪ই ডিসেম্বর সকালে মৌচাকের ঠেঙ্গারবান্দের কাছে একত্রিশ জন খান-সেনাসহ হানাদার ব্রিগেডিয়ার কাদের খান আমাদের হাতে বন্দী হলো। ব্রিগেডিয়ার কাদের খান সহ বন্দী পাক-হানাদারদের কয়েকদিন মুক্তিবাহিনীর হেফাজতে রাখা হলো। ব্রিগেডিয়ার ক্লের নেতৃত্বে যৌথবাহিনীকে কড্ডায় হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হতে হলো। কড্ডা সেতুর দক্ষিণ পাড়ে বংশাই নদীর পাড় ঘেঁষে হানাদাররা সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ঢাকার দিক থেকে এক ব্যাটেলিয়ন পাক-সেনা পূর্বেই কড্ডায় অবস্থানে ছিল। উপরন্তু ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাংগাইল থেকে পলায়নপর হাজার দুই সৈন্য কড্ডা পর্যন্ত গিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো সুদৃঢ় করার চেষ্টা করে। ১৪ই ডিসেম্বর, কড্ডায় যৌথবাহিনীর সাথে পাক-হানাদর-
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০১

দের এক মরনপণ যুদ্ধ হলো। ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের সাথে হানাদরদের মত ভারী অস্ত্র না থাকায় প্রথম অবস্থায় যৌথবাহিনী তেমন সুবিধা করতে পারছিলোনা। ব্রিগেডিয়ার ক্লেরও বেশী ক্ষয়— ক্ষতি স্বীকার করতে চাইছিলেননা। তিনি সম্মুখ সমরে বেশী জোর না দিয়ে ডাইনে-বামে তার বাহিনীকে ভাগ করে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় ছোট ছোট নৌকায় প্রায় অর্ধেক সৈন্যকে নদী পার করে দিতে সক্ষম হন। নৌকা সংগ্রহ এবং নদী পার করা, এই দুই ক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর মধ্যে একটা অবেগপ্রবণ ভাব লক্ষ্য করা যায়। তুমুল লড়াইয়ের আশঙ্কায় সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কিছুতেই যেতে দিতে চাইছিলেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মিত্রবাহিনীর অনুরোধ, ‘আপনারা এখন পিছনে থাকুন। পিছন থেকে সাহায্য করুন। আমরা ওদের সাথে আগে সামনা সামনি লড়ে দেখি, কত শক্তি রাখে। যদিও মুক্তিযোদ্ধারা সব সময় মিত্রবাহিনীর অনুরোধ রক্ষা করেননি। তারা প্রায় সর্বদা মিত্রবাহিনীর সাথে সাথেই থেকেছে। এমনকি কোন কোন জায়গায় মিত্রবাহিনীকে পাশ কাটিয়ে ডাইনে-বামে ঘুরে আগে চলে গেছে। তাদের এটা করার সুযোগও ছিল। কারণ, সমস্ত রাস্তা-ঘাট, গ্রাম-গঞ্জ, হাট- বাজার মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিত ছিল। ব্রিগেডিয়ার ক্লের অর্ধেক সৈন্য নদী পার করে দিয়ে দুই পাশ থেকে হানাদারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন। হানাদাররা দুই পাশ থেকে আক্রান্ত হয়ে কড্ডায় বেশী সময় অবস্থান না করে কড্ডা পুলের অর্ধেকাংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে জয়দেবপুর বোর্ড বাজার পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। যৌথবাহিনী কড্ডার দক্ষিণে আর অগ্রসর না হয়ে রাতের মত সেখানেই ঘাঁটি গাড়ে।

বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে জনসভা
১৪ই ডিসেম্বর বিকাল চারটায় টাংগাইল বিন্দুবাসিনী মাঠে মুক্তিবাহিনী এক জনসভা আহ্বান করলো। সভার কাজ দুই ভাগে ভাগ করা হলো। প্রথমার্ধে যৌথবাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরাকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা জানানো, দ্বিতীয়ার্ধে আনুষ্ঠানিক জনসভা। মুক্তিবাহিনীর সম্বর্ধনার জবাবে মেজর জেনারেল নাগরা বললেন, ‘এখানকার মুক্তিবাহিনী যে সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেছে, তার তুলনা হয়না। আমরা শুধু মুক্তিবাহিনীর জন্যই এত সহজে ঢাকার প্রান্ত সীমায় পৌঁছে যেতে পেরেছি। আমি মুক্তিবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মুক্তিবাহিনীর নেতা কাদের সিদ্দিকীকে ছালাম ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মুক্তিবাহিনীর এই বীরত্বের ইতিহাস আগামী দিনের মানুষেরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। এরপর তিনি জনগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ভারত সরকার, ভারতীয় সেনাবাহিনী আপনাদের বন্ধু। আপনারা এতদিন যে কষ্ট ও নির্যাতন ভোগ করেছেন, আমাদের বিশ্বাস, অল্প কয়েক দিনের মধ্যে আপনাদের সেই কষ্ট দূর হয়ে যাবে৷ পাকিস্তানীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, বাংলাদেশের আশি ভাগ এখন যৌথবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ঢাকার উপর আমরা কয়েক ঘন্টার মধ্যে মরণাঘাত হানবো। আপনাদের আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আর বেশী দূরে নয়। আপনারা ধৈর্য্য ধরে শান্তি বজায় রাখুন। যৌথবাহিনীকে সাহায্য
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০২

ও সহযোগিতা করুন।
জয় বাংলা, জয় হিন্দ, জয় যৌথবাহিনী, ইন্দিরা-মুজিব জিন্দাবাদ।

তিনি খুব ধীরে ধীরে হিন্দিতে বক্তৃতা করলেন। মাঠের আশপাশের দালান কোঠা, গাছপালা মানুষে ঠাসা। সমবেত লাখ-দেড় মানুষ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মেজর জেনারেল নাগরার সাথে কন্ঠ মিলিয়ে শ্লোগান দিলেন। সম্বর্ধনা শেষে মেজর জেনারেল নাগরা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল কুলকার্নিকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আবার সভামঞ্চে গেলাম। বিন্দুবাসিনী স্কুলের- ছাদে সভামঞ্চ, ছাদে উঠার জন্যে বাশ দিয়ে ছোট একখানা মই তৈরী করা হয়েছে। মই বেয়েই কর্মকর্তাদের সভামঞ্চে উঠতে ও নামতে হচ্ছে। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ সদর দপ্তরের দায়িত্বভার হামিদুল হকের হাতে দিয়ে ১৩ই ডিসেম্বর সকালে চলে এসেছিলেন। গণ-পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী ও বাসেত সিদ্দিকী সাহেবও এসেছেন। ১৪ই ডিসেম্বর সভার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছেন টাংগাইল বাস এসোসিয়েশনের সম্পাদক হাবিবুর রহমান খান (হবি মিঞা )। সভা শুরুর আগে মুছা তালুকদারের ছেলে জঘন্যতম রাজাকার কমাণ্ডার খোকাকে হাজির করা হলো। টাংগাইলের ঘৃণ্য রাজাকার সংগঠক ও কয়েক হাজার রাজাকারের নেতা খোকা, একদিন আগে পালিয়ে যাওয়ার সময় জোগনীচরে মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে হানাদরদের হাতে টাংগাইল জেলার যত লোক মারা গেছেন, তার অর্ধেকেরও বেশী অধ্যাপক খালেক ও এই জল্লাদ খোকার নির্দেশেই মরেছে। সভামঞ্চে হাত বাধা খোকাকে দেখে হাজার হাজার মানুষ তাকে তাদের হাতে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করতে থাকেন। জনতা বার বার দাবী করতে থাকেন, জল্লাদ রাজাকার সংগঠকের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। জনতাকে শান্ত হতে অনুরোধ জানিয়ে বলা হলো, ‘আমরা আপনাদের মনোভাব বুঝতে পেরেছি। আপনাদের ইচ্ছা ও নির্দেশ মতই কাজ করা হবে। মুক্তিবাহিনী এই হানাদার জল্লাদকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করছে এবং তা এখনই কার্যকরী করা হবে।’ ঘোষণা শেষ হতে না হতেই তিন জন মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার জল্লাদ খোকার পেটে বেয়োনেট বসিয়ে দিলো। দেহটি জনতার সামনে দেয়ার সাথে সাথে দেহের উপর হাজার মানুষ ক্ষোভ ও ঘৃণায় ফেটে পড়েন। মৃত খোকাকেই তারা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলার চেষ্টা করেন। জনতার এই অবস্থা দেখে কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা ও স্বেচ্ছাসেবক সভাস্থল থেকে দেহটি সরিয়ে নিয়ে কবর দিয়ে দেয়।
বিচার শেষে কোরান, গীতা পাঠের মাধ্যমে সভার কাজ শুরু হলো। প্রথম বক্তৃতা করলেন আনোয়ার-উল-আলম শহীদ। এর পর একে একে গণ-পরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকী ও লতিফ সিদ্দিকী তাদের সারগর্ভ বক্তব্য রাখলেন। বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে ৭১-র ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে টাংগাইল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পতাকা দিবস উদযাপন করেছিল। পতাকা দিবসের উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন টাংগাইল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৩

যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর খান মেনু। সভা পরিচালনা করেছিলাম আমি নিজে, শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। সেই দিনের সেই পতাকা দিবসে বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠ কাণায় কাণায় ভরে গিয়েছিল। হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে গণ-পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী বিনা প্রস্তুতিতে অনিন্দ্য সুন্দর সুললিত ভাষায় সংগ্রামী প্রত্যয়ে প্রজ্জ্বলিত যে ঐতিহাসিক শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন, তা টাংগাইলের প্রতিটি মানুষের স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকবে। লতিফ সিদ্দিকীর রাজনৈতিক জীবনে হয়তো সেই শপথবাক্য পাঠই সব চাইতে অনন্য ও অবিস্মরণীয় ঘটনা।
আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, বাসেত সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকী বার বার জনতাকে সর্বশক্তি দিয়ে হানাদারদের মোকাবেলায় আরও কঠিন মনোবল নিয়ে অগ্রসর হতে আহ্বান জানালেন। বিভিন্ন বক্তার বক্তৃতায় সভার সকলে উদ্বেলিত ও উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন। হানাদার- দের চরম নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে অসীম ত্যাগ ও অসম সাহসিকতার সাথে লড়াই করে মুক্তিযোদ্ধারা এত তাড়াতাড়ি মুক্তির আনন্দ উপহার দিতে পারবে, তা দেশবাসী যেন কল্পনাও করতে পারছিলেন না। যাদেরকে একদিন হানাদাররা সর্বস্বান্ত করে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তারাই আজ সিংহের তেজে বিজয়ীর বেশে উপস্থিত। এতে জনগণ স্বভাবতঃই আনন্দে ফেটে পড়ছিলেন। লতিফ সিদ্দিকীর বক্তৃতার পর আমাকে আহ্বান জানানো হলো। আমি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালাম। ২৬শে মার্চের পর এই প্রথম বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে জনসভায় বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়েছি। একদিকে যেমন আমার বুক যুগপৎ আনন্দ ও গৌরবে ফুলে উঠছিল, অন্যদিকে দখলদার বাহিনীর অত্যাচারে শত শত সহকর্মী ও হাজার হাজার স্বাধীনতা প্রিয় সাধারণ মানুষকে হারানোর ব্যথায় হুঁ হুঁ করে কাঁদছিল। দীর্ঘ ন’মাসের যুদ্ধে অনেক কিছু হারিয়েও সব পাওয়ার পরম পাওয়া প্রিয়তম স্বাধীনতার স্পর্শ পেয়েও পাকিস্তানের কারাগারে তখনও বন্দী বঙ্গবন্ধুর জন্য আমার মন বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছিল।
“আপনারা আমার সালাম গ্রহণ করুন। আপনাদের দোয়া ও পরম করুণাময়ের মেহেরবানীতে আবার আপনাদের সামনে আসতে পেরেছি। আমাদের বাহিনী ঢাকার দিকে এগিয়ে চলছে। এটা বক্তৃতার মুহুর্তও নয়। তবু আপনাদের অনুরোধে দুচার কথা বলছি। আমাদের স্বাধীনতা আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবেনা। ইনশাল্লাহ্ অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা আমাদের দখলে এসে যাবে। আজ আমার যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনি কষ্টও হচ্ছে। এই পর্যন্ত আমাদের একশ চল্লিশ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে, পাঁচ শ’র উপর আহত হয়েছে। শান্ত প্রকৃতির সরল প্রাণ বাংলার ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকরা যে এত দুর্বার, এত দুঃসাহসী হতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। আমি যেমন আপনাদেরকে সালাম জানাচ্ছি তেমনি প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবককে আমি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সালাম জানাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু এখনও হানাদারদের কারাগারে বন্দী। স্বাধীনতার সাথে সাথে আমরা বঙ্গবন্ধুকেও চাই। ঢাকা দখলের পর শুরু হবে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। আপনারা ভয় পাবেননা। আমরা যেভাবে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৪

হানাদাররে মোকাবেলা করে সফলতা লাভ করেছি, সেই ভাবেই বঙ্গবন্ধুকেও ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবো। “ভাইয়েরা, আজ আপনাদের সামনে যাকে দেখছেন, সে কাদের সিদ্দিকী নয়, কাদের সিদ্দিকী ধলাপড়া-মাকড়াই যুদ্ধে মারা গেছে। আজ যাকে দেখছেন, সে শুধু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং তার নির্দেশ।” শক্তি ও সাহসের সাথে আপনারা মোকাবেলা করুন। মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর নিহত সাথীদের আত্মার শান্তি, আহতদের আশু সুস্থতা কামনা করে শেষ করছি।
জয় বাংলা, জয় হিন্দ,
জয় যৌথবাহিনী, ইন্দিরা-মুজিব জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী অমর হউক

যৌথবাহিনীতে সামিল হয়ে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর ছয় হাজার যোদ্ধা ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ১৫ই ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার ক্লের ব্রিগেড যখন কড্ডায় অবস্থান নিয়েছিলেন, তখন নবীনগর-সাভারের রাস্তা ধরে ব্রিগেডিয়ার সান সিংয়ের নেতৃত্বে যৌথবাহিনী ঢাকার দিকে এগুচ্ছে। সন্ধ্যায় তারা নবীনগর-ঢাকা-যশোহর রোডের সংযোগ স্থলে পৌঁছে যায়। এই সময় সাভারের জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে (রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প) এক ব্যাটেলিয়ন হানাদার অবস্থান করছিল। ব্রিগেডিয়ার সান সিং এখানে হানাদারদের চরম বাধার সম্মুখীন হন।
ব্রিগেডিয়ার সান সিং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, বাবাজী নামেই পরিচিত। ভারতীয় অফিসারদের মধ্যে হয়তো তিনিই মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে প্রিয়। মুক্তিবাহিনীতে ছিল, অথচ বাবাজীকে চিনেনা অথবা নাম শুনেনি এমন মুক্তিযোদ্ধা খুব কম পাওয়া যাবে। ব্রিগেডিয়ার বাবাজী মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে নিয়োজিত ছিলেন। মেঘালয় সহ পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবির সরাসরি তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। তিনি তুরার যে ক্যাম্পে থাকতেন, সেই রওশন আরা প্রশিক্ষণ শিবির থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় পঁচিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিল। ঢাকা অভিযানের সময় রওশন আরা ক্যাম্পে ট্রেনিংপ্রাপ্ত দুই হাজার আর আমার দলের তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার বাবাজীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনীতে সামিল হয়েছিল। উপরন্তু ভারতীয় নিয়মিত বাহিনীর আটাশ শ সৈন্য তখন তাঁর সরাসরি নিয়ন্ত্রনাধীন। শত্রুর চাইতে বাবাজীর বাহিনীর শক্তি সামর্থ অনেক বেশী হওয়ার পরও হানাদাররা দুর্দান্ত লড়াই করলো। ব্রিগেডিয়ার বাবাজীর বাহিনীর বেশীরভাগ সাভার বিশ্ববিদ্যালয় ও পাকা সড়কের পশ্চিম পাশের কাঁচা রাস্তা দিয়ে সাভার বাজার পেরিয়ে ঢাকার দিকে যেতে সক্ষম হলো। চতুর্দিক থেকে ঘেরাও হয়েও তারা আত্মসমর্পণে নারাজ। ব্রিগেডিয়ার বাবাজীও শত্রুকে ঢাকার এত কাছে পিছনে ফেলে এগুতে রাজী নন। তাই, একদিকে তিনি যেমন শত্রু ঘাঁটি পতন ঘটানোর জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, অন্যদিকে তেমনি হানাদাররাও ঘাঁটি কামড়ে থাকার নীতি অবলম্বন করলো। বাবাজীর নেতৃত্বে তিন হাজার নিয়মিত ও অনিয়মিত যৌথবাহিনীর যোদ্ধা হানাদারদের ঘাঁটি চতুর্দিক থেকে ঘিরে আস্তে আস্তে তাদের ঘেরাওয়ের ফাস ছোট করে আনতে লাগলেন। রাত তিনটায় চরম সময় ঘনিয়ে এলো। যৌথ-
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৫

বাহিনী হানাদারদের ঘাঁটির পঞ্চাশ গজের মধ্যে পৌঁছে গেল। হানাদারদের সত্তর-আশিটি লাশ যৌথবাহিনীর হাতে এসে গেছে। তবু হানাদাররা আত্মসমর্পণ করছেনা। এই সময় ব্রিগেডিয়ার বাবাজী হানাদার ঘাঁটির একশ গজের মধ্যে একটি দু’তিন ফুট উঁচু দেওয়ালের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, ‘ডাইনে যাও, বাঁয়ে যাও, দেখ ডান পাশের বাংকার থেকে শত্রু গুলি ছুঁড়ছে, পিছনে দশ-বারো জন ভাগছে, ধর ওদের এই ধরনের নানা নির্দেশ দিচ্ছিলেন। হানাদারদের গুলি, বাবাজীর আশেপাশে এসে পড়ছিল। ব্রিগেডিয়ার বাবাজীকে দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে নির্দেশ দেয়ার দৃশ্যটি ছোট্ট এক মুক্তিযোদ্ধা অনেকক্ষণ ধরে অবাক বিস্ময়ে দেখছিল। গুলি এদিক-ওদিক পড়ছে, অথচ বাবাজীর গায়ে লাগছেনা দেখে ছোট্ট মুক্তিযোদ্ধাটি দৌড়ে বাবাজীর কাছে গিয়ে তাকে এক হেঁচকা টানে নীচে নামিয়ে অবাক বিস্ময় ও অপার কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই বাবাজী, আপ কেয়া হৈতা হ্যায় ! আপ ভূত হ্যায়? আপকা কিউ গুলি লাগতা নেহী পারতা হ্যায়?” বাবাজী প্রাণখোলা হাসি হাসতে হাসতে বাচ্চা মুক্তিযোদ্ধাটিকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘না, আমি ভুত না, তবে গুলি ফেরানোর মন্ত্র জানি।’ ব্রিগেডিয়ার বাবাজীর কথা বাচ্চা মুক্তিযোদ্ধাটির বিশ্বাস হলো। সে বাবাজীকে জোরে চেপে ধরে আরো আশ্চর্য হয়ে বললো, ‘এই জন্যই তো অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আপনার গায়ে একটি গুলিও লাগছে না।’ রাত সাড়ে তিন-চারটায় সাভারের হানাদার ঘাঁটির পতন ঘটলো। এখানে একশ চল্লিশ জন নিহত ও একশ সত্তর জন আহত হলো। যৌথবাহিনীর পক্ষে বারো জন শহিদ ও পাঁচ জন সামান্য আহত হয়। বারো জন শহিদের মধ্যে দশ জনই ভারতীয় নিয়মিত বাহিনীর। কড্ডার মত এখানেও মিত্রবাহিনী ‘আঘাত হানতে মুক্তিযোদ্ধাদের আগে যেতে দিতে চাননি। মুক্তিবাহিনীকে পিছনে রাখা মিত্র বাহিনীর কোন কৌশল বা উচ্চ নেতৃত্বের কোন নির্দেশও ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে মিত্রবাহিনীর নিয়মিত যোদ্ধারাই অল্প বয়সের মুক্তিযোদ্ধাদের স্নেহ, মমতা আর ভালবাসার টানে শত্রুর সামনে আগে যেতে বারন করেছেন।
১৩ই ডিসেম্বর রাতে মেজর জেনারেল নাগরা দুই ব্রিগেডিয়ার ও আমাকে নিয়ে যে আলোচনায় বসেছিলেন, সেখানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, পরিকল্পনা অনুযায়ী ময়মনসিংহ-টাংগাইলের দিক থেকে এগিয়ে যাওয়া যৌথবাহিনীর উপর ঢাকা দখলের দায়িত্ব নেই। এই বাহিনীর উপর ন্যস্ত দায়িত্ব, ঢাকার উত্তরে টঙ্গী পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া এবং পশ্চিম-উত্তরে যশোহর রাস্তা ধরে সাভার পর্যন্ত এগিয়ে অবস্থান নেয়া। সম্ভব হলে ঢাকার কাছে মীরপুর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে পশ্চিম-উত্তর দিক থেকে হানাদারদের ঘিরে রাখা। বিশেষ করে যশোহর রোড ধরে উত্তর বঙ্গের দিক থেকে কোন হানাদার যাতে পিছিয়ে এসে ঢাকা রক্ষায় সাহায্য করতে না পারে, এটা লক্ষ্য রাখা। এই আলোচনাতে আমি একটা প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলাম, সম্ভব হলে আমাদের বাহিনী ঢাকা দখলে এগিয়ে যেতে পারে কিনা? মেজর জেনারেল নাগরা বলেছিলেন, এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ আমাদের উপর নেই। এই প্রশ্নটা, পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় আমাদের মাথায় ছিল না। আপনার মতই দিন দুই ধরে প্রশ্নটা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৬

আমার মাথায় ঘুরছে। মূল প্ল্যান যখন হয়, তখন আমাদের ধারণা ছিল, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাংগাইল হয়ে ঢাকা পৌঁছানো কষ্টসাধ্য, দূরত্বও বেশী। তাই আমাদেরকে ঢাকা দখলের দায়িত্ব না দিয়ে ঢাকা চেপে ধরার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমার দুইটি ব্রিগেড যখন অতি সামান্য ক্ষয় ক্ষতিতে ঢাকার পনের-কুড়ি মাইলের মধ্যে পৌঁছে গেছে, তখন হাই কমাণ্ডের কাছে এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছি। কয়েক ঘন্টার মধ্যে আমরা পরবর্তী নির্দেশ পেয়ে যাবো। হ্যা, যৌথবাহিনী কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পরবর্তী নির্দেশ পেয়েছিল। নির্দেশ না বলে এটাকে পরামর্শ বলাই ঠিক হবে। হাইকমাণ্ড পরামর্শ দেন, ‘উত্তর থেকে এগিয়ে যাওয়া বাহিনী ঢাকার পনেরো মাইলের মধ্যে পৌঁছে গেলে তারা পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে বলে ধরে নেয়া হবে। উত্তরের বাহিনী যদি আরও এগিয়ে যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে কোন আপত্তি নেই। এই ব্যাপারে যা ভালো হয়, সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ণ অধিকার যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত সেনাপতিদের দেয়া হলো।’
পরিকল্পনা মত ঢাকা দখলের দায়িত্ব না থাকায় অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় উত্তর দিক থেকে এগিয়ে যাওয়া মিত্রবাহিনীর যেমন সৈন্য সংখ্যা বেশী ছিল না, তেমনি ভারী অস্ত্রশস্ত্রও ছিল না। যশোহর, খুলনা, বগুড়া, রংপুর এই সমস্ত সেক্টরের প্রতিটি ভারতীয় পদাতিক বাহিনীকে গোলন্দাজ ও ট্যাংক স্কোয়াড দিয়ে সাজানো হয়েছিল। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী সেক্টরের মিত্রবাহিনীর সাথেও গোলন্দাজ ও ট্যাংক স্কোয়াড ছিল। আখাউড়ার দিক থেকে এগিয়ে আসা যৌথবাহিনী ঢাকা দখল নেবেন, এটাই ছিল মূল পরিকল্পনা। আবার কোন কোন জেনারেল বলেছেন, ঢাকা দখল তাদের প্রথম পরিকল্পনায় ছিলনা। এজন্য কোন কোন সমর নায়ক একেবারে শুরুতেই এই পরিকল্পনাটিকে ‘ফলটি প্ল্যান’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কথা ছিল শেষ মুহূর্তে চীন সীমান্ত থেকে একটা মাউন্টেন ডিভিশনকে উত্তরে তুরা নিয়ে আসা হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দিল্লীর মনে হয়, চীন গোলমাল করতে পারে। তাই চীন-সীমান্ত থেকে মাউন্টেন ডিভিশন সরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। সেইজন্য হাল্কা অস্ত্রে মাত্র দুই ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে কোন রকমে উত্তর থেকে মিত্রবাহিনীর একটি কলাম এগিয়ে আসে। টাংগাইলে ছত্রীবাহিনী নেমে এই বাহিনীর সামান্য শক্তি বৃদ্ধি করে।
আখাউড়া হয়ে ঢাকা দখলে এগিয়ে যাবার সম্ভাবনা যে বাহিনীর আছে, সেই বাহিনীকে সবচেয়ে শক্তিশালী করে গঠন করা হয়েছে। এই বাহিনীর কাছে গোলন্দাজ ও ট্যাংক স্কোয়াড সহ বিশাল আকারের অনেকগুলো যুদ্ধ হেলিকপ্টারে রয়েছে। আখাউড়া হয়ে যৌথবাহিনী ঢাকার দিকে এগিয়েও আসে। কিন্তু সমস্ত পরিকল্পনা উলট-পালট করে দিয়ে উত্তর দিক থেকে এগিয়ে যাওয়া ঝটিকা বাহিনী, আখাউড়ার দিক থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীর ঢাকা পৌঁছার নির্ধারিত সময়ের ত্রিশ-চল্লিশ ঘন্টা আগে ঢাকার প্রান্ত সীমায় পৌঁছে যায়। মিত্রবাহিনী ও বাংলাদেশের বড় বড় যুদ্ধ বিশারদদের সম্মিলিতভাবে সযত্নে রচিত পরিকল্পনা উলট-পালট হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ কি? বাংলাদেশের উত্তরে তুরা ও ময়মনসিংহ সীমান্ত থেকে ঢাকার দূরত্ব প্রায় দু’শ মাইল। গ্রাম-গঞ্জের ভিতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে এগুতে দূরত্ব আরো বেড়ে যাওয়া
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৭

স্বাভাবিক। অন্যদিকে আখাউড়া থেকে মাত্র সত্তর-আশি মাইল। ঘোরা পথে তা কোনক্রমেই একশ যাইলের বেশী হবে না। তাই ঢাকা অভিযানে এই কম দূরত্বের রাস্তাটাই বেছে নেয়া হয়। কিন্তু প্রকৃত যুদ্ধের সময় দেখা গেল অস্ত্রশস্ত্র, নিয়মিত সৈন্যবল কম এবং দূরত্ব বেশী হওয়া সত্ত্বেও উত্তর দিক থেকে এগিয়ে যাওয়া যৌথবাহিনী সবার আগে ঢাকার পাদদেশে পৌছে গেল। এর অন্তর্নিহিত একমাত্র কারণ, আমরা ঢাকার ত্রিশ মাইল উত্তর থেকে ময়মনসিংহ- জামালপুর রাস্তার প্রায় ষাট মাইল মিত্রবাহিনী আসার আগেই মুক্ত করে ফেলেছিলাম। ঢাকার রাস্তায় উনিশটি নাগরপুরের তিনটি, কদ্দুস নগরের চারটি, টাংগাইল-ময়মনসিংহ রাস্তায় পাঁচটি ও গোপালপুর রাস্তায় একটি পাকা সেতু ধ্বংস করে হানাদারদের চলার পথ একেবারে বন্ধ করে ফেলা হয়েছিল। এছাড়া জামালপুর থেকে পালিয়ে আসা সাত হাজার, ময়মনসিংহের পাঁচ হাজার ও টাংগাইলের তিন হাজার মোট পনের হাজার নিয়মিত হানাদারদের দুই হাজারের বেশী ঢাকা পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারেনি। যারা পিছিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল, তারাও অক্ষত ছিল না। ছিল নেতৃত্ব ও মনোবলহীন, ভীত-সন্ত্রস্ত। মিত্রবাহিনীকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, শেরপুর, কামালপুর, জামালপুর, কড়া ও সাভার ছাড়া আর কোথাও হানাদারদের সাথে বড় রকমের লড়াই করতে হয়নি, আগেই আমরা হানাদারদের মেরুদণ্ড ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিলাম। টাংগাইলের মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই স্বাধীনতার পর আপসোস ছিল, দখল করা বড় অস্ত্র- গুলো হানাদারদের উপর ব্যবহার করার সুযোগ তারা পেল না।
চারদিন হলো টাংগাইল মুক্ত হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর প্রশাসনিক দপ্তরের বৃহৎ অংশ টাংগাইলে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। অন্যদিকে সাত হাজার পাক-হানাদার ও চৌদ্দ হাজার পাঁচশ রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী। শত শত অস্ত্র নানা দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বন্দীদের ঠিকমত রাখা, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশাসনিক অন্যান্য কাজ সারার জন্য ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে টাংগাইল ফিরেছি।
অন্যদিকে মেজর জেনারেল নাগরা ১৫ই ডিসেম্বর টাংগাইল সার্কিট হাউজে রাত কাটানো স্থির করেন। রাত এগারোটা, টাংগাইল পুরানো কোর্ট বিল্ডিংয়ের জিলা পরিষদ অফিসে বসে নিবিষ্ট মনে কাজ করছি। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। অপর প্রান্তে যৌথবাহিনীর নেতা মেজর জেনারেল নাগরা। জেনারেল নাগরা প্রথমেই শুভেচ্ছা জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছেন? আমি একটা প্রয়োজনে আপনাকে ফোন করছি, কিন্তু আপনাকে বলাটা ঠিক হবে কিনা, বুঝে উঠতে পারছিনা।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘আমার অনুরোধ রক্ষায় আপনার যদি কোন অসুবিধা হয়, নিঃসংকোচে না করে দিতে পারেন।
মেজর জেনারেল নাগরার কথা শুনে খুব আগ্রহভরে বললাম, ‘পারা না পারা তো পরের কথা। বলুন না, আপনার অনুরোধটা কি?
এরপরও তিনি একটু সংকোচের সাথেই বললেন,
– দেখুন দায়িত্বটা পুরোপুরি আমার, তাই আমার দায়িত্বের বোঝা আপনার ঘাড়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৮

চাপাতে সংকোচ হচ্ছে। ব্যাপারটা যে যুদ্ধের চেয়েও কঠিন। আপনার যদি কষ্ট হয়, আপনি আমাকে সাফ না করে দেবেন।
জেনারেল নাগরার কথাতে সংকোচের আভাস পেয়ে বললাম,
– ফোনে জানাতে কি কোন অসুবিধা আছে? তাহলে আমি এখনই আসছি।
– না, না, আপনাকে আসতে হবে না। ফোনে বলায় কোন অসুবিধা নেই। আমার অনুরোধ, যদি সম্ভব হয়, আগামীকাল নাস্তার ব্যবস্থাটা আপনি করে দিন। আমার এখানে অত লোকজন নেই। তাই হাজার বারো সৈনিকের নাস্তা সকালের মধ্যে করতে পারবোনা। সানন্দে জেনারেল নাগরার অনুরোধে রাজী হলাম। মেজর জেনরেল নাগরা শেষবারের মত আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন,
– বারো হাজার সৈনিকের নাস্তা চার-পাঁচ ঘন্টার মধ্যে ব্যবস্থা করা যে সে ব্যাপার নয়। আপনি একটু ভেবে দেখুন।
– নাস্তা তো হয়ে যাবে। এ নিয়ে ভাববেন না। যেহেতু আমরা একবার নাস্তা দেয়ার সুযোগ পেয়েছি, মেনুটা কি হলে ভাল হয়, বলুন।
নাগরার সহজ উত্তর,
– রুটি-হালুয়াই যথেষ্ট। রুটির সাথে সবজি হলে খুবই ভাল হতো। নাস্তার সাথে চা অবশ্যই চাই কিন্তু এতদূর থেকে চা নিয়ে খাওয়ায় অসুবিধা আছে। চায়ের ব্যবস্থা ওখানে করা যাবে। নাস্তার জন্য শুধু রুটি-হালুয়ার ব্যবস্থা যদি করেন, তাতেই চলে যাবে। ঠিক সময়েই নাস্তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে আশ্বাস দিয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম।
শুরু হলো যৌথবাহিনীর জন্য নাস্তা তৈরীর কাজ। সবকিছু প্রায় প্রস্তুতই ছিল। বিশাল বিশাল ডেকচি, কড়াই ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক যা লাগে, আধ ঘন্টার মধ্যেই সব সংগ্রহ হয়ে গেল। টাংগাইল আওয়ামী লীগ অফিসের পিছনে মাটি খুঁড়ে মস্ত বড় বড় কুড়ি খানা চুল্লী তৈরী করে নাস্তা তৈরী শুরু হলো। নাস্তা তৈরীর মূল দায়িত্ব নিলেন সকল কাজে পারদর্শী মোয়াজ্জেম হোসেন খান, হবি মিয়া, কমাণ্ডার খোরশেদ আলম ও কর্নেল ফজলুর রহমান। নাস্তা প্রস্ততে অপরিসীম অবদান রাখলো মেজর আলী হোসেন ও ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী চাচা। যৌথবাহিনীর জন্য নাস্তা প্রস্তুতের দায়িত্ব পেয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন খান, হবি মিয়া, খোরশেদ আলম, ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী ও কর্নেল ফজলুর রহমান আমার কাছে প্রস্তাব রাখলেন, আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে খাবার পাঠাচ্ছি, খাবার খেয়ে যোদ্ধা ভাইয়েরা যদি কিছুই মনে না রাখলো, তাহলে আমাদের খাবার পাঠানোর কোন অর্থ হয় না। আমরা শুধু সাদা রুটি আর হালুয়া অথবা সবজি ফ্রন্ট লাইনে পাঠাতে পারবোনা। আমাদের ইচ্ছামত খাবার তৈরীর অনুমতি দিন। ‘আপনারা যা খুশী করুন। আমি শুধু ঠিক সময়ে প্রত্যেকের জন্য পরিমাণ মত নাস্তা চাই।’
কর্নেল ফজলু, ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী, ক্যাপ্টেন খোরশেদ ও মোয়াজ্জেম হোসেন প্রায় দু’শ মুক্তিযোদ্ধা ও দু’শ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে দুঃসাধ্য সাধন করলেন। কুড়ি হাজার শুকনো রুটি,
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৯

কুড়ি হাজার পরটা, ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার পাউরুটি স্লাইস, বিশাল বিশাল দশ ডেকচি বুটের ডাল, বড় বড় আট-ন’ ডেকচি খাসির মাংস, পনের ডেকটি সবজির বিপুল পরিমাণ নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। এ ছাড়া জারিকেনে চা পাঠানোর ব্যবস্থা হলো। ভোর পাঁচটার মধ্যে টাংগাইল সার্কিট হাউজের সামনের মাঠে সমস্ত খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিলেন। আমিও তৈরী হয়ে ভোর সাড়ে পাচটায় সার্কিট হাউজ মাঠে হাজির হলাম। ছটায় ময়মনসিংহের দিক থেকে একটি হেলিকপ্টার এসে টাংগাইল সার্কিট হাউজের সামনের মাঠে অবতরণ করলো। অর্ধেক নাস্তা হেলিকপ্টারে তুলে দেয়া হলো। মেজর জেনারেল নাগরা হেলিকপ্টারে গিয়ে উঠলে বর্নীর আজাহার ও দেওয়ানগঞ্জের বাবলুকে নিয়ে আমিও হেলিকপ্টারে উঠলাম। হেলিকপ্টার পাখা মেলে ঢাকার দিকে উড়ে চললো। ঘড়ির কাটা যখন সাড়ে ছয়টায়, ঠিক তখন হেলিকপ্টারটি মৌচাকের স্কাউট প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের পাশে অবতরণ করলো। ব্রিগেডিয়ার ক্লের ওখানেই তার অস্থায়ী ব্রিগেড সদর দপ্তর স্থাপন করেছিলেন। তিনি দৌড়ে এসে খুব উত্তেজিতভাবে জেনারেল নাগরাকে বললেন,
– নিয়াজী খুব সম্ভবতঃ আত্মসমর্পণ করবে। আমাদের বেতারে বেশ কয়েকবার ওদের কথাবার্তা ধরা পড়েছে। আমার দিকে গতকাল বিকাল থেকে ওদের কোন তৎপরতা নেই। তবে সান সিং-এর সাথে সারারাত প্রচণ্ড লড়াই হয়েছে। রাত তিনটার পর অবশ্য সান সিং-এ দিকে গোলাগুলির আওয়াজ কমে এসেছে। ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের কথা শুনে জেনরেল নাগরা বললেন,
– ঠিক আছে। তুমি আমাদের সঙ্গে চল। আমরা সান সিং-এর খবর নিয়ে দেখি।

ব্যারেলের মুখে ঢাকা
মৌচাকে অর্ধেক নাস্তা নামিয়ে দিয়ে হেলিকপ্টার আবার উড়ে চললো পশ্চিম-দক্ষিণে। সাভারের জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়কে পশ্চিমে রেখে ঢাকা-যশোহর রাস্তার উপর দিয়ে ঢাকার দিকে চললাম। সাভার ও মীরপুরের মাঝামাঝি রাস্তার বাঁকে হেলিকপ্টার নামলো। নাস্তা নামিয়ে আবার টাংগাইল থেকে দ্বিতীয়বার নাস্তা আনতে হেলিকপ্টা উড়ে গেল। আমাদের নিয়ে জেনারেল নাগরা পাকা সড়কে একটি সেতুর উপর দাঁড়ালেন। মীরপুরের দূরত্ব এখান থেকে প্রায় দেড় মাইল। ব্রিগেডিয়ার সান সিং জেনারেল নাগরাও আমাদের সাথে মিলিত হয়ে রাতে তার সাথে হানাদারদের তুমুল লড়াইয়ের বর্ণনা দিলেন। জেনারেল নাগরা দূরবীন দিয়ে খুব ভাল করে বার বার ঢাকা দেখে নিলেন। সেতু থেকে শেরে বাংলা নগরের নতুন সংসদ ভবনের উপরের অংশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। যৌথাহিনীর দুইটি কোম্পানী রাস্তার দুই কোল ঘেঁষে খুব ধীরে মীরপুরের দিকে এগুতে লাগলো। আমরা পায়ে হেঁটে আরো সামনে এগিয়ে চললাম। আধ মাইল সামনে আর একটি ছোট্ট পুল। তার কাছে যেতেই বাম দিকে চকের মাঝ দিয়ে চার-পাঁচ জনকে ছুটে আসতে দেখা গেল। আমরা চারজনই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। হাত উপরে তুলে নাড়াচাড়া করে চার-পাঁচ জন দ্রুত দৌড়ে আসছে। ওরা কারা? ওরা কি হানাদারদের কেউ? না গ্রামবাসী? কাছে আসতেই দেখা গেল, ওরা হানাদার নয়, গ্রামবাসীও না, মুক্তিবাহিনীর বিখ্যাত ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর খান ও মেজর গোলাম মোস্তফা তিন জন সহযোদ্ধা নিয়ে দৌড়ে এসেছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১০

সবুর ও মোস্তফাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– কি ব্যাপার? তোমরা এইভাবে চকের (মাঠের) মাঝ দিয়ে দৌড়ে আসছ? সবুর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
– স্যার, আমরা মীরপুরের কাছে পৌঁছে গেছি। পিছন থাইক্যা যাতে আপনারা গুলি না ছাড়েন তাই-ই দিবার আইছি।
ব্রিগেডিয়ার সান সিং তো অবাক। বাবাজী বেঁটে খাটো সবুরকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– তোমরা তো মাঝরাতেও আমাদের সাথে ছিলে। কি করে অতদূর এগিয়ে গেলে? সবুর হাসতে হাসতে বললো,
– ঐ তো, ঐ জন্যই তো আমরা মুক্তি। গ্রামের মধ্য দিয়া সকাল সকাল পৌঁছে গেছি। মেজর মোস্তফা, ক্যাপ্টেন সবুর, ক্যাপ্টেন বকুল, ক্যাপ্টেন মোজাম্মেলের চার কোম্পানীর এক হাজার মুক্তিযোদ্ধা মীরপুর পুলের বাম পাশ (বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধ) পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এ খবর পেয়ে আমরা যেমন বিস্মিত হলাম, তেমনি আনন্দিতও হলাম। যৌথাহিনীকে রাস্তা ধরে আরও দ্রুত মীরপুর সেতুর কাছাকাছি এগিয়ে যেতে বলা হলো। কারণ, মুক্তিবাহিনী মীরপুর সেতুর একেবারে কাছে পৌঁছে গেছে। তাই মীরপুর সেতু পর্যন্ত খুব দ্রুত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব, তেমনি মীরপুর সেতুর পূব-উত্তরে মুক্তিবাহিনীর শুধু একক ভাবে আলাদা থাকাটাও নিরাপদ নয়। মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির জন্য তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাওয়া উচিত।

আত্মসমর্পনের আহ্বান
সকাল আটটায় রাজধানী ঢাকা শহরের প্রান্তসীমায় পৌঁছে ঢাকা-মীরপুর সড়কের হেমায়েতপুর সেতুর উপর দাঁড়িয়ে মেজর জেনারেল নাগরা এক টুকরো কাগজ জীপের বনেটে রেখে শত্রুপক্ষের কমাণ্ডার আমীর আবদুল্লাহ্ নিয়াজীকে যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের জন্য লিখলেন,
প্রিয় আবদুল্লাহ্, আমরা এসে গেছি। তোমার সব ভেল্কি খতম হয়ে গিয়েছে। আমরা তোমাকে চার পাশ থেকে ঘিরে ফেলেছি। বুদ্ধিমানের মত আত্মসমর্পণ কর। না হলে তোমার ধ্বংস অনিবার্য। আমরা কথা দিচ্ছি, আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের সাথে আচরণ করা হবে। তোমাকে বিশেষভাবে লিখছি, আত্মসমর্পণ করলে তোমার জীবনের নিশ্চয়তা দেয়া হবে।
তোমারই
মেজর জেনারেল নাগরা
১৬/১২/৭১ ইং
০৮-৩০ মিনিট।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১১

যৌথবাহিনীর চার সদস্য তিনজন মিত্রসেনা ও একজন মুক্তিযোদ্ধা নাগরার লেখা বার্তা নিয়ে সাদা পতাকা না থাকায় একটি সাদা জামা উড়িয়ে শত্রু অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর দিকে দুটি জীপে ছুটলো। আত্মসমর্পণের আহ্বান বার্তা নিয়ে চার সাহসী যোদ্ধা চলে যাবার পর আমরা আমিন বাজার স্কুলের পাশের পুল পর্যন্ত এগিয়ে যেতে শুরু করলাম।

হরিষে বিষাদ
আমি আগেই বলেছি, ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের বেতারে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত- সূচক কিছু বার্তা রাত চারটার দিকে ধরা পড়েছিল। লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করতে পারে, এই ধরনের আভাস-ইঙ্গিত ভারতীয় হাইকমাণ্ড নাকি পেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের কাছে এই সম্পর্কে তখনো হাইকমাণ্ডের কোন পরিস্কার বার্তা ছিল না। উত্তর দিক থেকে ঢাকার উপকণ্ঠে এগিয়ে যাওয়া যৌথ বাহিনীর কাছে কেবলমাত্র খবর ছিল, ১৬ই ডিসেম্বর সকাল এগারোটার পর যৌথবাহিনী ঢাকার উপর মরণ আঘাত হানবে। এই আক্রমণে সাহায্যের জন্য ঠিক এগারটায় বিমান বাহিনী ঢাকার উপর বোমাবর্ষণ করবে। অন্যদিকে মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্য জেনারেল মানেকশ পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানাচ্ছিলেন। আকাশবাণীতে মানেকশর আহ্বান বার বার প্রচার করা হচ্ছিল। ঢাকার আকাশে লক্ষ লক্ষ লিফলেট ছাড়া হয়। মানেকশর আহ্বান ‘হাতিয়ার ঢাল দো’ আণবিক বোমার মত কাজ করছিল। আমরাও বেতারে বার বার এই আহ্বানই শুনছিলাম। আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে নিয়াজী আমেরিকার দূতাবাস কিংবা জাতিসংঘের সাথে যোগাযোগ করেছে কিনা, করলে কি ধরনের যোগাযোগ করেছে, লিফলেট ছড়ানো ও মরণ আঘাত হানা ছাড়া হাইকমাণ্ড শত্রুর আত্মসমর্পণের অন্য কোন প্রক্রিয়া অবলম্বণ করেছেন কিনা তা মেজর জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে অগ্রসর যৌথ বাহিনীর জানা ছিল না। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বিরাজমান সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রায় পরাভূত শত্রুর মানসিক অবস্থা আঁচ করে এবং উত্তরোত্তর বিজয়ে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত হয়ে কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় দূত পাঠাই।
দূত পাঠানোর এক ঘন্টা পর ঠিক সাড়ে নটায় মীরপুর সেতুর দিক থেকে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসা গাড়ীর গর্জন শোনা গেল। দ্রুত ধেয়ে আসা গাড়ীর গর্জন শুনে আমাদের সৈনিকরা উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলো। পরক্ষণেই মাটি কাঁপিয়ে কয়েক ঝাঁক গুলির শব্দ ভেসে এলো। চার-পাঁচটি মেশিনগান একসাথে বিকট শব্দে গর্জে উঠে থেমে গেল। চকিতে ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর আবার থমথমে নীরবতা। ছুটে আসা গাড়ীর উপর গুলি ছুঁড়তেই দ্রুত অগ্রসরমান দুটি গাড়ীই নিশ্চল হয়ে গেল। আমাদেরও ভুল ভাঙলো। গাড়ী দুটো শত্রুর নয়, আমাদের গাড়ীই ফিরে আসছিল। গাড়ীর উপর কোন সাদা পতাকা বা কাপড় না থাকায় শত্রুরা খেয়ে আসছে ভেবে অগ্রবর্তী দলের সৈন্যরা গুলি ছুঁড়েছে।
প্রতিনিধি দল নিয়াজীর কাছে নাগরার চিঠি পৌছে দিলে, নিয়াজী আত্মসমর্পণে রাজী আছে বলে জানিয়ে দেয়। সামনে রক্তক্ষয়ী বিরাট যুদ্ধ হচ্ছে না এবং পাকিস্তান হানাদার বাহিনী
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১২

আত্মসমর্পণ করছে জেনে আনন্দে প্রতিনিধি দল নিজেদের সেনাপতিদের কাছে এই দারুণ সুখবরটি পৌঁছে দিতে হাওয়ার বেগে ছুটে আসছিল। আসার পথে আনন্দ-উদ্বেল আবেশে আনমনা হয়ে গাড়ীতে লটকানো সাদা জামাটি কখন যে প্রচণ্ড বাতাসে উড়ে গেছে তা তারা জানতেই পারেন নি। তাই এই বিভ্রাট। ভুল যখন ভাঙলো, তখন যা হবার হয়ে গেছে। তিনজন সাথে সাথে নিহত হলো। আমরা ঘটনাস্থল আমিন বাজার স্কুলের পাশে দৌড়ে গিয়ে দেখলাম, দু’টি জীপই বিকল হয়ে থেমে রয়েছে। একটিতে তিনজনের মৃতদেহ। রক্তে সমস্ত জীপটা ভেসে গেছে। তখনও তাদের দেহ থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। এত দুঃখের মাঝেও অন্যজন আহত অবস্থায় জীপের স্টিয়ারিং ধরে বসেছিলেন। দারুণ সুখবরটা যত তাড়াতাড়ি দিতে পারবেন, তত তাড়াতাড়িই যেন সহযোদ্ধা হারানোর দুঃখ ও গুলিতে আহত হওয়ার নিদারুণ যন্ত্রণার উপশম হবে। আহত অবস্থায় গলার স্বর জড়িয়ে আসা সত্ত্বেও যতদূর সম্ভব স্পষ্টভাবে প্রত্যয় মেশানো কণ্ঠে বিজয়ীর ভঙ্গিতে বললেন, ‘শত্রুরা, আত্মসমর্পণে রাজী হয়েছে। তাদের দিক থেকে এখনই কোন জেনারেল আত্মসমর্পণের প্রথম পর্ব সারতে আসছেন। যে মিত্রসেনা এই সংবাদ দিলেন, তার হাঁটুর নীচের অংশ বুলেট বিদ্ধ হয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে। তিনি তার ক্ষতস্থান দুহাতে চেপে ধরে আমাদের সর্বশেষ সংবাদ দিলেন। কয়েক হাজার বছর আগের ইতিহাস যেন ভিন্ন প্রেক্ষিত ও ভিন্ন পটভূমিকায় জীবস্তু হয়ে উঠলো। ম্যারাথন থেকে এথেন্স নয়, ঢাকা থেকে মীরপুরে গৌরবোজ্জ্বল মনপ্রাণ অথচ গুলিবিদ্ধ যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেহের দ্রুত নিঃশেষিত শক্তি শেষবারের মত জড়ো করে শত্রু সেনাদের আত্মসমর্পণ তথ্য পূর্ণ বিজদের দারুণ সংবাদ দিলেন এযুগের বীর সেনানী, এই শতাব্দীর ফিডি পাইডিস।
যৌথবাহিনীর সদস্যদের রক্তে তখন গাড়ী আর পীচঢালা কালো পথ পিচ্ছিল ও লাল হয়ে গেছে। রাস্তার দুপাশে অজস্র কৃষ্ণচূড়া গাছে মৌসুমের প্রথম ফুল গুচ্ছের লাল টকটকে রঙকে স্নান করে দিয়ে, নীচে পীচঢালা কালো পথে বয়ে চললো মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রসেনার মিলিত তাজা শোনিত ধারা, প্রস্ফুটিত হলো শান্তি, মৈত্রী, স্বাধীনতা ও বিশ্ব মানবতার লাল গোলাপ।

আত্মসমর্পণের প্রথম সামরিক পর্ব
আহত ও নিহতদের সরিয়ে নেয়ার জন্য হেলিকপ্টার আনা হলো। হেলিকপ্টার আমিন বাজার স্কুলের পাশে মসজিদসংলগ্ন পাকা বাড়ীর সামনে অবতরন করলে, তাতে আহত ও নিহতদের উঠিয়ে দেয়া হলো। হেলিকপ্টার মির্জাপুর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে উড়ে যাবার কয়েক মিনিট পর ঢাকার দিক থেকে একটি মার্সিডিজ বেন্‌জ ও দুইটি দ্বীপে দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর একজন মেজর জেনারেল, দুইজন লেঃ কর্নেল, একজন মেজর, দুইজন ক্যাপ্টেন ও কয়েকজন সিপাই আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক পর্ব সারতে এলো। হানাদারদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ দখলদার বাহিনীর সি. এ. এফ. প্রধান মেজর জেনারেল জামশেদ আত্মসমর্পণের প্রথম পর্ব সারতে এসেছে। আমরা যথারীতি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালাম। মেজর জেনারেল নাগরার বামে ব্রিগেডিয়ার সান সিং, তার বামে ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও সর্বশেষে আমি। মেজর জেনারেল জামশেদ যৌবাহিনীর
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৩

সেনা নায়কদের সামনে দাঁড়িয়ে সামরিক অভিবাদন করার পর নাগরার সামনে এসে, কোমর থেকে রিভলার বের করে প্রসারিত দুই হাতে নাগরার সামনে বাড়িয়ে দিল। মেজর জেনারেল নাগরা ছ’টি বুলেট খুলে রেখে রিভলারটি আবার জামশেদের হাতে ফেরত দিলেন। এরপর জামশেদ আগের মত দুই প্রসারিত হাতে তার সামরিক টুপিটি নাগরার হাতে অর্পণ করলো। মেজর জেনারেল নাগরা লাইন থেকে বেরিয়ে জামশেদের টুপিটি আমার হাতে তুলে দিলেন। জামশেদ তার গাড়ীটির ‘জেনারেল ফ্ল্যাগ’ এনে নাগরার হাতে তুলে দিল। নাগরা জেনারেল ফ্ল্যাগটি ব্রিগেডিয়ার সান সিং-এর হাতে অর্পণ করলেন। জেনারেল জামশেদ সবশেষে তার কোমর থেকে বেল্ট খুলে নাগরার হাতে দিল। নাগরা তা ব্রিগেডিয়ার ক্লেরকে দিলে তিনি সাময়িকভাবে ব্যাহারের জন্য জামশেদকে বেল্টটি ফিরিয়ে দিলেন। মেজর জেনারেল নাগরার গাড়ী থেকে যৌথবাহিনীর জেনারেল ফ্ল্যাগ (যৌথবাহিনীর ফ্ল্যাগ ছিল না। ভারতীয় বাহিনীর ফ্ল্যাগকে সাময়িকভাবে যৌথবাহিনীর জেনারেল ফ্ল্যাগ ধরা হতো) খুলে তা সমর্পিত পাকিস্তান বাহিনীর মার্সিডিজ বেন্‌জে লাগিয়ে জামশেদকে সাথে নিয়ে আমরা অবরুদ্ধ শত্রুঘাঁটির দিকে এগুলাম।
সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে জামশেদ, পিছনের সিটে আমরা চারজন। যৌথবাহিনী তখনও মীরপুর সেতু পার হয়নি অথচ আমরা ঢাকার দিকে যাচ্ছি, এ খবরও তাৎক্ষণিকভাবে সদর দপ্তরে পাঠানো গেল না। রওনা হওয়ার আগে শুধু নাগরা লেঃ কর্নেল কুলকার্নিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তুমি আমাদের খবর সদর দপ্তরে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করতে থাকো।’ মীরপুর পুলের ঢাকার পারে এসে মেজর জেনারেল নাগরা নিয়াজীর সাথে টেলিফোনে প্রথম যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। কিন্তু ফোন তুলতেই দেখা গেল, সেটি মৃত। মীরপুর থেকে নিয়াজীর সাথে যোগাযোগ করা গেল না, তাই বাধ্য হয়ে আরো এগুতে হলো। মীরপুর সড়কে মোহাম্মদপুর রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে জামশেদের সি. এ. এফ. সদর দপ্তর। জামশেদের সদর দপ্তরে এসেও জেনারেল নাগরা নিয়াজীর সাথে ফোনে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলেন। দপ্তরে দশ-বারটি ফোন অথচ প্রত্যেকটিই অচল। এ দেখে আমাদের মনে প্রশ্ন এলো—ব্যাপার কি? সব ফোনই মৃত কেন? তবে কি ওদের কোন দুরভিসন্ধি আছে? আমরা চারজন পাশের ঘরে গেলাম। নাগরা উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার? নিয়াজীর সংগে কথা না বলে আমাদের এতদূর আসাটা কি ঠিক হলো? ওদের কি বিশ্বাস করা যায়?’ আমি বললাম, ‘দেখুন, আমি প্রায় তিন বছর পাক-সেনা বাহিনীতে কাজ করেছি। এই যুদ্ধকালীন সময়টাতেও ওদের দেখেছি। আমি ওদেরকে শয়তানের সমান বিশ্বাসও করতে পারিনা।’ আমার কথা শুনে নাগরা দারুণ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন, ‘আমাদের জন্য তো তেমন চিন্তা করছিনা। চিন্তা আপনাকে নিয়ে। ওরা বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাদের যদি হত্যা করে, তাহলে আমাদের দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। ঢাকা দখল বিলম্বিত হবে।’ আমি নাগরার সাথে একমত হতে পারলাম না। বললাম, ‘আমাদের হত্যা করলে আর কিছু না হোক, ঢাকা দখল কয়েক ঘন্টা এগিয়ে যাবে। আর এখন ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। তাই চলুন বাঘের ঘরে গিয়েই দেখি।’ জামশেদকে নিয়ে চারজনে আবার বেরিয়ে পড়লাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৪

যৌথবাহিনীর জেনারেল ফ্ল্যাগ উড়িয়ে মার্সিডিজ বেন্জ সকাল দশটা পাঁচ মিনিটে নিয়াজীর ১৪তম ডিভিশন সদর দপ্তরের সামনে এসে দাঁড়ালো। জামসেদ আমাদের নিয়াজীর দপ্তরে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল, আমরা চারজনই দাঁড়িয়ে। নিয়াজীর এ. ডি. সি. এক ক্যাপ্টেন এসে বললো, ‘জেনারেল এখনই আসছেন। আপনারা বসুন। বসতে যেয়ে একটু অসুবিধা হলো। নিয়াজীর টেবিলের সামনে একই রকম তিনটি চেয়ার। আর দুটি ঘরের দুই কোণে, লোক চারজন। তিন চেয়ারে বসি কি করে? আমি ঘরের কোণ থেকে একটি চেয়ার আনতে পা বাড়িয়েছি, অমনি ব্রিগেডিয়ার ক্লের দৌড়ে এলেন। বলতে গেলে হাল্কা চেয়ারখানা দুইজনে ধরাধরি করে তিনটির পাশে এনে আগের মত পাশাপাশি বসলাম।

আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের আলোচনা
সকাল দশটা দশ মিনিট। নিয়াজী তার অফিস ঘরে এলো। অফিসে ঢুকে তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে বিজয়ী সেনাপতিদের সামরিক অভিবাদন জানালো। নিয়াজীর অফিসকক্ষে প্রবেশের সাথে সাথে সৌজন্যমূলকভাবে সবাই উঠে দাঁড়ালাম। নিয়াজীর অভিবাদন শেষে সবাই আবার বসলাম। আত্মসমর্পণ করার জন্য নিয়াজীকে নাগরা প্রথমেই ধন্যবাদ দিলেন এবং তাকে বুদ্ধিমান সেনানায়ক হিসাবে অভিহিত করে ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তারপর নিয়াজীর ছেলে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন। মেজর জেনারেল ‘নাগরা ও লেঃ জেনারেল নিয়াজী ব্রিটিশ আর্মিতে একসাথে কমিশন পাওয়ার পর একই একাডেমীতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। পাকিস্তান আর্মিতে থাকায় নিয়াজী লেঃ জেনারেল হয়েছে। নাগরা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে থাকায় এখনও মেজর জেনারেল। ধন্যবাদ ও পারিবারিক কথা শেষ করে নাগরা নিয়াজীকে তার সাথীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রথম ব্রিগেডিয়ার সান সিং বাবাজী, তারপর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের এবং সবশেষে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে। আমাকে পরিচয় দিতে গিয়ে মেজর জেনারেল নাগরা বললেন,
– ইনিই এখন মুক্তিবাহিনীর একমাত্র প্রতিনিধি। ইনিই তোমার পরম বন্ধু, সেই বিখ্যাত কাদের সিদ্দিকী।
কাদের সিদ্দিকী নামটা শুনে নিয়াজী আবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বার সামরিক অভিবাদন করলো এবং হাত এগিয়ে দিল। নিয়াজী হাত বাড়িয়ে দিলেও আমার দিক থেকে কোন সাড়া ছিল না। মুহূর্তে আমার কপাল এবং হাতে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠলো। প্রায় আধ মিনিট নিয়াজী হাত এগিয়ে দিয়ে রেখেছে অথচ আমি হাত মিলাচ্ছি না, এটা দেখে বিচক্ষণ নাগরার ব্যাপারটা বুঝতে দেরী হলোনা। তিনি আমাকে বললেন,
– আপনি কি করছেন? হাত মিলান। আপনার সামনে পরাজিত সেনাপতি।
– পরাজিতের সাথে হাত না মিলানো বীরত্বের অবমাননা হয় হউক। কিন্তু যারা শিশু ও নারী হত্যা করেছে, মা বোনদের ধর্ষণ করেছে তাদের হাতে হাত মিলিয়ে আমি আল্লাহর কাছে জবাবদিহি হতে চাই না। আমায় ক্ষমা করুন। আমার মনে হচ্ছিল, লক্ষ লক্ষ বাঙালীর
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৫

হত্যাকারী পাপিষ্ঠের সাথে হাত মেলাবো কোন অধিকারে? একদিন আগেও যে হাত আমাকে সুযোগ পেলেই হত্যা করতো, যে হাত আমার স্বজাতির রক্তে রাঙানো, মা-বোনের ইজ্জত আবরুকে ছিন্নভিন্ন করার কলঙ্কের দায় থেকে যে হাত মুক্ত নয় –নরপশু ঘাতকের সেই হাতে হাত মিলানোর অধিকার কে আমায় দিয়েছে।
নিয়াজীর সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা হলো। স্থির হলো, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মিত্র- বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডার লেঃ জেনারেল অরোরা স্বয়ং উপস্থিত হবেন। বিকাল সাড়ে চারটায় অরোরা ঢাকা আসবেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ পর্ব সম্পন্ন হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের প্রস্তাবে নিয়াজী প্রথম আপত্তি তুললো, কিন্তু তার আপত্তি শোনা হলো না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে। কারন ওখান থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালীর উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। নিয়াজীর রাজী না হয়ে উপায় ছিল না। পরাজিতকে বিজয়ীদের শর্ত মানতেই হয়। নিয়াজীকেও মানতে হলো। নিয়াজীর দপ্তর থেকেই যৌথবাহিনীর হাইকমান্ডের কাছে সব খবর পাঠানো হলো।

ঢাকা আমাদের কব্জায়
নরপশু হানাদাররা আত্মমর্পণ করেছে, এই খবর যেন কি করে সারা ঢাকায় বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে পড়লো। রেডিও, টি. ভি. সব বন্ধ। তবুও খবর জানতে ঢাকাবাসীদের দেরী হলোনা। যদিও সেই সময় ঢাকা শহরে লোকজন খুব একটা ছিল না। ঢাকার বাসিন্দারা পাঁচ-ছয় দিন আগে থেকেই রক্তক্ষয়ী তুমুল যুদ্ধের আশঙ্কায় যে যেদিকে পারছিলেন, ঢাকার বাইরে চলে যাচ্ছিলেন। ঢাকার শতকরা আশি ভাগ লোকই তখন শহরের বাইরে। যে কুড়ি ভাগ ছিলেন, তারাই স্বাধীনতার আনন্দ উচ্ছ্বাসে ঢাকা মাতিয়ে তুললেন। অবরুদ্ধ নগরীর ভীত ও বিষণ্ণ নীরব কান্নার পরিবেশ বদলে গিয়ে মুক্তির উল্লাসদীপ্ত ঝালমন হাসিতে ভরে উঠলো। অন্তরের সবটুকু ভলোবাসা ঢেলে প্রত্যয় ভরে সগর্বে দিক-বিদিক কাঁপিয়ে ঢাকাবাসী বার বার বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করছেন অখণ্ড ও সুসংহত জাতীয় অনুভূতি, “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।”
নিয়াজীর সাথে কথা শেষে আমার দলের সাথে মিলিত হতে মীরপুর ফিরে যাওয়া স্থির করলাম। ব্রিগেডিয়ার বাবাজীকে একটি গাড়ী চেয়ে দিতে অনুরোধ করলে তিনি বললেন, ‘তোমার জন্য আমার গাড়ী চেয়ে দিতে হবেনা। তুমি বললেই ঢের হবে।’ বাবাজীকে আর কিছু না বলে নিয়াজীর অফিসের সামনে চকচকে ঝকমকে গাড়ীর সারিতে জেনারেল ফ্ল্যাগ লাগানো একটি টয়োটা জীপকে ইশারা করতেই, জীপ চালক সারি থেকে গাড়ী বের করে নিয়ে এলো। জেনারেল ফ্ল্যাগ খুলে তাতে উঠলাম। গাড়ী এগিয়ে চলল, কিন্তু একি! আধমাইলও এগুইনি, চালক আর গাড়ী চালাতে পারছেনা। গাড়ী রাস্তার এদিক ওদিক যাচ্ছে। হানাদার ড্রাইভারের হাত কাঁপছে। আজ তাদের হাত কাঁপবারই কথা। অথচ একদিন আগেও এই সমস্ত হাত নিরীহ বাঙালীদের নির্মম ও নির্বিচারে হত্যা করতে মোটেই কাঁপতোনা। আজ পরাজিত হয়ে বড় সুবোধ সেজেছে ! তবে এটা ঠিক, সত্যিই আমাকে নিয়ে ড্রাইভার ভয়ে আধখানা হয়ে গিয়েছিল। ভনিতা নয়,
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৬

সত্যিকার অর্থেই সে কাঁপছিল। এটা লক্ষ্য করে ড্রাইভারকে গাড়ী থামাতে বললাম। আমি ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভারকে পাশে বসতে বললাম। পাকিস্তানী পাঞ্জাবী ড্রাইভার কাঁপতে কাঁপতে বললো, স্যার, আপনি যান। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকছি। এরপর আমি একাই গাড়ী নিয়ে চললাম। শেরে বাংলা নগরের মাঝ দিয়ে মীরপুরের রাস্তায় পড়ার একটু আগে যৌথ- বাহিনীর কয়েকটি গাড়ী দেখলাম। তাঁরা বাসে ট্রাকে গাদাগাদি হয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে এগুচ্ছে। মীরপুরের কাছে এসে থমকে গেলাম। মীরপুর সিনেমা হল থেকে পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট -এই রাস্তার মাঝে প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। যৌথবাহিনীর সৈন্যরা দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে। মীরপুর বেতার কেন্দ্রের সামনে গাড়ী থেকে নামলাম। মিত্রবাহিনীর একজন দৌড়ে এসে জানালেন, মীরপুর কলোনীর দিক থেকে গুলি আসছে। আমাদের দু-তিনজন আহত হয়েছে। মুক্তিবাহিনীও কলোনীর উপর গুলি ছুঁড়ছে। আমাদের এক অংশ পুলের ওপরে আটকে গেছে। আমাদের গুলি ছোঁড়ার কোন নির্দেশ নেই। এখন কি করি?”
– আপনি অপেক্ষা করুন। মুক্তিবাহিনী যদি থেকে থাকে, অল্পক্ষণের মধ্যে রাস্তা বাধা মুক্ত করা যাবে।
গাড়ী রেখে পায়ে হেঁটে কিছুদূর এগুলাম। প্রচণ্ড গুলি আসছে, বেশীদূর এগুনো গেল না। বাধ্য হয়ে মিত্রবাহিনীর সাথের এক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের পিছন দিয়ে বিউটি সিনেমা হলের দিকে এগুতে লাগলাম। সামান্য এগুতেই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখলাম। চিৎকার করে অনেক ডাকাডাকির পর একজন মুক্তিযোদ্ধার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হলাম। সে দৌড়ে এসে আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বললো,
– স্যার, আপনি এখানে? আমরা আইজই ঢাকা দখল কইরা ফেলুম।’
মুক্তিযোদ্ধাটিকে আরো জোরে চেপে ধরে তার চাইতেও আনন্দ, উৎসাহ, উত্তেজনায় টগবগ করতে করতে বললাম,
– তোমরা তো ঢাকা দখল কইরাই ফেলাইছ।
আমার কথা শুনে সে আকাশ থেকে পড়লো। অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করল,
– এ্যা, আমরা মীরপুর আইতে আইতেই ঢাকা দখল হইয়া গেল। স্যার কনতো, কারা কার দখল করলো?
তার পিঠ চাপড়ে বললাম,
– বলছি তো, তোমরাই দখল করেছ। এখন তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে তোমার কমান্ডারকে ডেকে আনো। মুক্তিযোদ্ধাটি রাস্তার পাশ দিয়ে এক দৌড়ে তার কমান্ডারের কাছে ছুটে গেল। দুতিন মিনিট পর ক্যাপ্টেন সবুর এসে হাজির। আমাকে দেখে সেও যারপর নাই বিশ্চিত হলো। গোলাগুলি হচ্ছে কেন জিজ্ঞেস করতেই সবুর উত্তেজিতভাবে বলল,
– স্যার, মীরপুর কলোনী থেইক্যা শালারা আমাগোর উপর গুলি চালাইছে। আমরাও ওগোর উলুর বাসা ভাইঙ্গ্যা দিছি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৭

– ওরা সারেন্ডার করেছে। ওদের উপর নির্বিচারে গুলি চালানো ঠিক হবেনা।
– সারেন্ডার করছে। তাইলে ওরা যে আমাগোর উপর গুলি চালাইল।
– ওরা যদি চালায় তাহলে তোমরা অবশ্যই দুএকটা চালাতে পারো। তবে ওদের উপর যত কম গুলি চালানো যায় ততই ভাল।
ইতিমধ্যেই মুক্তিবাহিনী গুলি আসা স্থানগুলো দখল করে নিয়েছে। সবুরকে আর গুলি না চালিয়ে শেরে বাংলা নগর পর্যন্ত গিয়ে অপেক্ষা করতে বলে আমি আবার টাংগাইলের দিকে গাড়ী ছুটলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৮

আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ

মীরপুর থেকে চার-পাঁচ জন সহযোদ্ধা নিয়ে টাংগাইলের দিকে আমার জীপ যখন ঝড়ের বেগে নবীনগর কালিয়াকৈর রাস্তার মোড়ে এলো, তখন দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা একদল যৌথ-বাহিনী গাড়ী থামানোর সংকেত দিল। গাড়ী থামালে আগ্রহভরে কাছে এসে ঢাকার খবর জানতে চাইল। কারণ তারা তখনও ঢাকার সর্বশেষ খবরের কিছুই জানেন না। আমি অত্যন্ত উল্লাসে তাদেরকে ঢাকা দখলের খবর জানালাম। আবার গাড়ী ছুটাবো, এমন সময় ফুলপ্যান্ট পরা হাফহাতা সার্ট গায়ে পূর্ণ বয়সী সুদর্শন একজন ভদ্রলোক কাগজ কলম হাতে দৌড়ে এলেন। কোন ভূমিকা না করে জিজ্ঞেস করলেন,
– আপনি কি ঢাকা থেকে ফিরছেন?
– হ্যা।
– আচ্ছা বলুনতো, এখন আপনার কেমন লাগছে?
– আপনার বাড়ী ডাকাতরা দখল করে নিলে, পরে ডাকাতদের যদি আপনি বন্দী ও বিতাড়িত করতে পারতেন, আপনার যেমন লাগতো বা লাগবে, আমার তেমন লাগছে।
– আচ্ছা আপনার কি খুব আনন্দ হচ্ছে? কেমন আনন্দ হচ্ছে?
– আমার খুব ভাল লাগছে তবে ভাষা দিয়ে আমার অনুভূতি বোঝাতে পারবোনা।
– আচ্ছা আপনার নামটা বলবেন কি?
– আমার নাম কাদের সিদ্দিকী।
– ওহ্, আপনিই কাদের সিদ্দিকী? পরে দয়া করে আমাকে একটু সময় দেবেন তো? আমি আপনার সাথে দেখা করব।
– নিশ্চয়ই, যখন খুশী আপনি আসবেন। আমরা সাদরে আপনাকে গ্রহণ করবো। আপনাকে ধন্যবাদ। এবার আমায় ছেড়ে দিন।
আবার টাংগাইলের দিকে জীপ ছুটালাম। মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে (বর্তমানে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ) এসে দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে সাথে ঢাকায় রওনা করিয়ে দিলাম। বেতারে টাংগাইলের সাথে যোগাযোগ হলো। গণপরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী, বাসেত সিদ্দিকী ও বেসামরিক প্রধান আনোয়ার-উল-আলম শহীদকে ঢাকা দখলের খবর জানালাম।
বিকাল তিনটায় ছ’সাতটি জীপসহ টাংগাইল ক-৯ টয়োটা কারে আবার ঢাকা রওনা হলাম। চারটা দশ মিনিটে ঢাকা বিমান বন্দরে পৌঁছলাম। ঢাকা বিমান বন্দরে মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সান সিং বাবাজী, ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও মিত্রবাহিনীর আরও দু’তিন জন মেজর জেনারেলের সাথে পরিচয় ও কথাবার্তা হলো। এর আগে বিমানবন্দরের প্রবেশ পথে ভারতীয়
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৯

গোলন্দাজ বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন আমার গতিরোধ করেছিলেন। বিমান বন্দরে তাদের কমাণ্ডার অবতরণ করবেন সেই হেতু কাউকে তিনি বিমান বন্দরে ঢুকতে দিতে রাজী নন। চ্যালেঞ্জের জবাবে ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
– আপনি কোন ব্রিগেডের? আপনারা ব্রিগেড কমাণ্ডারকে মেহেরবানী করে আমার নাম বলুন। ক্যাপ্টেন নাম জানে, ছুটে গিয়ে নাম জানানোর সাথে সাথে তাঁর ব্রিগেড কমান্ডার তাকে বলেছিলেন,
– তুমি করেছ কি? উনাদের সবাইকে আসতে দাও। ব্রিগেডিয়ারের এই আদেশের পর ক্যাপ্টেন ভদ্রলোক শুধু একবার আমার কাছাকাছি এসে বিমান বন্দরে ঢুকার অনুমতি দিয়েই সরে গিয়েছিলেন।
বিজয়ী সেনাপতি জগজিৎ সিং অরোরার জন্য পরাজিত বাহিনীর লেঃ জেনারেল নিয়াজী, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল জামশেদ এবং বিজয়ী বাহিনীর মেজর জেনারেল স্বগত সিং, মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার মান সিং, ব্রিগেডিয়ার ক্লের, মেজর হায়দার, ফ্লাইট লেঃ ইউসুফ (কর্ণেল তাহেরের বড় ভাই) সহ অন্যান্যদের খুব বেশী অপেক্ষা করতে হলো না। বিকাল চারটা চল্লিশ মিনিটে পঁচিশ-ছাব্বিশটি ভারতীয় চৈতক হেলিকপ্টার একটার পর একটা ঢাকার তেজগাঁ ঐতিহাসিক বিমান বন্দরে অবতরণ করলো। পরাজিত সেনাপতি নিয়াজী যৌথবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় বিজয়ী প্রধান সেনাপতি অরোরাকে প্রথম স্বাগত জানালো। এর পর বিজয়ী বাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার মান সিং, ব্রিগেডিয়ার ক্লের এবং আমি জেনারেল আরোরকে স্বাগত জানালাম। লেঃ জেনারেল অরোরার সাথে কোলকাতা থেকে প্রায় ষাট-সত্তর জন দেশী-বিদেশী সাংবাদিক এসেছেন। এ ছাড়া ভারতীয় কারগো বিমানে ইতিপূর্বেই আরও কিছু বিদেশী সাংবাদিক ঢাকায় এসে হাজির হয়েছিলেন। জেনারেল অরোরা হেকিকপ্টার থেকে নামার পর ঢাকা বিমান বন্দরে ঢল নামলো। ভিড় উপচে পড়লো। তিল পরিমান জায়গা নেই। সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। বিমান বন্দর নয়, এ যেন এক জনসমুদ্র, সবাই আনন্দ উচ্ছাসে বিহ্বল, উল্লাসে আত্মহারা। অরোরার সাথে অনেকের মধ্যে তার স্ত্রী এবং বাংলাদেশ বাহিনীর উপ প্রধান এয়ার কমোডর এ. কে. খোন্দকার এসেছেন। ঢাকা বিমান বন্দরে আমাকে দেখে জেনারেল অরোরা বিস্মিত ও অভূিত হলেন। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে বললেন,
– তুমিও এসে গেছ! আমার ধারণা তা হলে সত্য হলো। অরোরার স্ত্রী আমাকে দেখে ছুটে এসে জাপটে ধরে মহিলা সুলভ উচ্ছ্বসিত সুরে বললেন,
– আমি জানতাম, তুমি আসবে। এখন আমার কাজ, সেই ওয়াদা পূরণ করা। আমি এ যাত্রায়ই তোমার জন্য ভাল, সুন্দরী পাত্রী দেখে যাবো।
তেজগাঁ বিমান বন্দরে তখন উচ্ছ্বাসিত-উদ্বেলিত জনতার চাপাচাপি, ঠেলাঠেলিতে টেকা মুস্কিল। ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিকরা যার যার কাজে ব্যস্ত। ফটোগ্রাফাররা ঠেলাঠেলিতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২০

সবার উপরে, কনুই মেরে ফটো তোলার প্রয়োজনীয় অপেক্ষাকৃত ভাল জায়গা করে নিচ্ছেন। কেউ কেউ এমনকি কারো ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়েও ফটো তোলায় চেষ্টায় দ্বিধা বা কোন কুন্ঠা বোধ করছেননা। টি.ভি. ও চলচ্চিত্র ফটোগ্রাফাররা ভারী ভারী মুভি ক্যামেরা নিয়ে সময় সময় ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কির চোটে টাল সামানতে না পেরে উল্টে-পাল্টে পড়লেও তাদের উৎসাহের ভাটা নেই। সাংবাদিকরা কাগজ কলম নিয়ে ভিড়ের চাপে টালমাটাল। বারে বারে হুমড়ি খেয়েও সেনা-নায়কদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যারা শত চেষ্টা করেও কাছে যেতে পারছেননা, তারা দূরে থেকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন এবং জবাব কোন প্রকারে কাগজে আঁকিঝুঁকি দিয়ে টুকে নিচ্ছেন। প্রায় পনের মিনিট প্রচণ্ড দম বন্ধ করা ভিড়ের মধ্যে প্রাণান্তকর চেষ্টায় কোনরকমে হেঁটে যাওয়ার মত রাস্তা করে পরাজিত সেনাপতি নিয়াজিকে নিয়ে অরোরা বিমান বন্দরের বাইরে এলেন। নিয়াজীর গাড়ীতেই অরোরা উঠলেন। গাড়ীর পিছনে নিয়াজী ও অরোরা, সামনের সিটে অরোরার স্ত্রী। অরোরার গাড়ীকে অনুসরণ করে টাংগাইল ক-৯ গাড়ীটি। মূল সড়কে বাঁধ ভাঙা বন্যার মত জনতার প্লাবন জেগেছে। জনস্রোতের প্রবল চাপে সব কটি গাড়ী প্রথমে মন্থর পরে প্রায় থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো। ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মতন সেনানায়কদের এক নজর দেখতে গাড়ীর উপর ভেঙে পড়ছেন। এমন সময় কিছু বুঝার আগেই আমার গাড়ীর সামনের দরোজা খুলে অকস্মাৎ এক অপরিচিত ভদ্রলোক গাড়ীর মধ্যে ঝাপিয়ে পড়লেন। লোকটিকে ঝাপিয়ে পড়তে দেখে পিছনের সিটের দুইজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে জাপটে ধরল। লোকটি গাড়ীর মধ্যে হুড়মুড়িয়ে পড়ে টাল সামলাতে সামলাতে ইংরেজী, হিন্দি অঙ্গভঙ্গি করে বুঝাতে চেষ্টা করলেন, তিনি কোন খারাপ লোক নন, তিনি একজন সাংবাদিক এবং পশ্চিম জার্মানী থেকে এসেছেন। তাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত নিয়ে গেলে তাঁর পরম উপকার হবে। রাস্তার ভিড় সরানো গেছে এবং গাড়ীগুলো আবার চলতে শুরু করেছে। আমি নিজেই গাড়ী চালাচ্ছিলাম। গাড়ী চালানো অবস্থাতেই সাংবাদিক ভদ্রলোক আমার আট-দশটি ছবি তুলে নিলেন। বিমান বন্দরের সামনের মূল রাস্তায় পরার পর আর কোথাও লোকের ভিড়ে গাড়ীর গতি পুরোপুরি থেমে যায়নি। যদিও বিমান বন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে অগণিত মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা যেই নিয়াজীর মার্কামারা গাড়ীটি ও গাড়ীর ভিতর নিয়াজীকে দেখছেন, অমনি মনের ঝাল মিটিয়ে অবোধ্য ও অশ্রাব্য গালি ছুঁড়ে মারছেন এবং চিৎকার করে বলছেন,
– নিয়াজীকে আমাদের হাতে দাও। ও খুনী। ও আমাদের লক্ষ লক্ষ লোক মেরেছে, আমরা ওর বিচার করব। অরোরা ও নিয়াজীকে বহনকরা গাড়ীর আগে পিছে শতাধিক জীপ ও কার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সীমানায় মুক্তির আনন্দ সংগীত গেয়ে মিলিত হওয়া লক্ষ লক্ষ জনতার প্রবল চাপে শেষবারের মত থেমে গেল। এই সময় ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত জনতা একবার নিয়াজীকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। অনেক কষ্ট করে জনতার রোষানল থেকে নিয়াজীকে রক্ষা করা হলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২১

বিকেল পাঁচটা পাঁচ মিনিটে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুনিয়ার জঘন্যতম কলঙ্কিত নরঘাতক বাহিনীর দলপতি নিয়াজী বিষণ্ন পাংশুর মুখে কাপা হাতে আত্মসমর্পণ পত্রে স্বাক্ষর করলো। স্বাক্ষর কালে তাদের নিদারুণ পরাজয় ও নিঃশেষিত দম্ভের সাথে মিল রেখে কলমের কালিও সরছিল না, তাই তাকে অন্য একটি কলম দেয়া হলো। এই প্রথম তারা পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ হিসাবে স্বীকার করে নিল। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন এয়ার কমান্ডার এ. কে. খোন্দকার, বেসরকারীভাবে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করলাম আমি। উপস্থিত ছিলেন মেজর হায়দার, ফাইট লেঃ ইউসুফ।
নিয়াজীর আত্মসমর্পণ পত্রে স্বাক্ষর দান শেষ হতেই একশ জন দখলদার অফিসার ও একশ জন জোয়ান আত্মসমর্পণ প্রতীক হিসাবে তাদের অস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রাখলো।
আমার নেতৃত্বে ছ’হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও নাগরার দুই ব্রিগেড তখন কেবল ঢাকায় প্রবেশ করেছে। নারায়ণগঞ্জ দিয়ে এক ব্রিগেড মিত্রবাহিনী পূরানো ঢাকায় সবেমাত্র এসে হাজির হয়েছিল। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্ব পড়লো মেজর জেনারেল নাগরার দুইটি ব্রিগেড ও আমার উপর। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সময় মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সান সিং, ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও আমি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে খুবই উৎকণ্ঠায় ছিলাম। লক্ষ লক্ষ লোকের বিশৃঙ্খলার মাঝে যে কোন মুহুর্তে যে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এই আশঙ্কায় আমরা এক মুহুর্তও স্বস্তি বোধ করছিলাম না। বিশেষ করে আমার মনে দারুণ অবিশ্বাসের ঝড় বইছিল। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ছবি তুলতে দাঁড়ানো হয়ে উঠলোনা। এমনিতেই ঢাকাতে দখলদারদের সংখ্যা পূর্ব অনুমানের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। যৌথবাহিনীর অনুমান ছিল, ঢাকায় বড়জোর পঁচিশ-ত্রিশ হাজার হানাদার থাকতে পারে। কিন্তু ঢাকা পতনের পর দেখা গেল, ঢাকায় হানাদারদের সংখ্যা প্রায় পঞ্চান্ন হাজার। অন্যদিকে সর্বসাকূল্যে কুড়ি হাজারের বেশী যৌথবাহিনী তখনও ঢাকার আসে পাশে ঢুকতে পারেননি। এমন চরম অবস্থায় যে কোন মুহুর্তে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যেতে পারে। এ ভাবনাতে আমরা চারজন খুবই চিন্তিত ছিলাম।
আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ পর্ব শেষে অরোরা সোজা ১৪তম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারে চললেন। আমিও তার সাথে গেলাম। লেঃ জেনারেল অরোরা, মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সান সিং ও ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়লাম। দেশ স্বাধীন হয়েছে। হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছে। সর্বত্র আনন্দের প্লাবন বইতে শুরু করেছে। উপচে পড়া উজ্জ্বলতার মাঝেও আমার বুকটা ফাঁকা ফাঁকা বোধ হচ্ছিল। বুকের গভীর থেকে হু হু করে উঠে আসা শূন্যতা বোধ চেপে রাখতে পারছিলাম না, চোখ দিয়ে ফোটা অশ্রু বেরিয়ে আসছিল। মা, ভাই-বোনরা সেই আগষ্ট মাস থেকে বিচ্ছিন্ন। মাকে দেখতে মনটা খুব ব্যাকুল হয়ে উঠছে। সব কিছু ছাপিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কথা বার বার মনে পড়ছে। উৎসব মুখরিত জনারণ্যেও নিজেকে ভীষণ একা, বড়ই নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিলো। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতির বেদনা বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিচ্ছিলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২২

দূর্ঘটনা
ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণীর সাথে দেখা করতে বহু ইতিহাসের নীরব সাক্ষী ধানমন্ডীর ৩২ নং রোডের বাড়ীর গেটে এলাম। কিন্তু গেট তালাবদ্ধ। কেউ নেই। সবকিছু নীরব, নিঝুম। শীতের অবসন্ন গোধূলী সন্ধ্যায় নির্জনতা যেন আরো বিষণ্ণ দুর্বিসহ হয়ে উঠলো। আমার কিছুই ভাল লাগছিল না। একটা যন্ত্রণাকর অস্থিরতা নিয়ে গেটের সামনে ছটফট করছিলাম। দুএক মিনিট গেটের সামনে হাঁটাহাঁটি করতেই একজন বৃদ্ধ এসে জিজ্ঞেস করলেন,
– আপনারা কি চান?
– আমরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের লোকজনদের সাথে দেখা করতে চাই।
– তারা তো এখানে থাকেন না।
– কোথায় থাকেন?
– তা তো জানিনা, বাবা।
কথোপকথনের সময় সাদা রঙের একটি ডাটসান গাড়ী এসে থামলো। গাড়ী থেকে দু’জন লাফিয়ে পড়ে বললেন,
– আপনারা এখানে কেন এসেছেন? বঙ্গবন্ধুর পরিবারের লোকদের সঙ্গে দেখা করবেন? উনারা এখন ১৯ নং রোডে থাকেন। চলুন আমাদের সাথে আমরা রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
এরা কারা? শত্রু না মিত্র? ঢাকা তখনও যৌথবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ওদের সাথে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? এদের কোন কুমতলব, কোন খারাপ অভিসন্ধি নেই তো?
এত কিছু ভাববার মত তখন আমার মনের অবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর জন্য আমার মন তখন খুব চঞ্চল ও উতলা। বঙ্গবন্ধুর পরিবার পরিজনদের দেখা পেলেও দুঃসহ শূন্যতা ও অবসাদগ্রস্ত বিষণ্ণতা থেকে অনেকটা মুক্তি পাবো। এমন উদগ্র আশা ও বিশ্বাস নিয়ে সাত পাঁচ না ভেবে তাদের কথাতেই রাজী হয়ে গেলাম। সাদা ডাটশান আগে আগে চললো। পিছনে ষাট- সত্তর জন মুক্তিযোদ্ধা বোঝাই একটি কার ও ছ’টি জীপ। নিজে কার চালিয়ে ডাটশানের পিছু নিলাম। আমার পিছনে ছ’টি জীপ। গাড়ীগুলো ১৯ নং রোডের মোড় ঘুরতেই, বঙ্গবন্ধুর পরিবার পরিজন যে বাড়ীতে বন্দী, সেই বাড়ীর ছাদ থেকে আচকা সামনের সাদা ডাটশান ও আমাদের গাড়ীর সারির উপর মুষলধারে মেশিনগানের গুলি আসতে লাগলো। পথ দেখিয়ে নেয়া ভদ্রলোকদের গাড়ীটি গেটের সামনে পৌঁছে গিয়েছিল। হানাদারদের গুলিতে গাড়ীর আরোহী তিনজনই ঘটনাস্থলে মারা যায়। আমার গাড়ী দেওয়ালের সামান্য আড়ালে ছিল। তা সত্ত্বেও হানাদারদের ছোড়া অসংখ্য গুলির একটি গাড়ীর ইঞ্জিনে, অন্যটি মাথার দুই-তিন ইঞ্চি উপর গাড়ীর দরজা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। আমরা ঝড়ের বেগে গাড়ী থেকে বাইরে ঝাঁপিয়ে পরে দেয়ালের আড়ালে নিরাপদ অবস্থান নিলাম। কিন্তু গাড়ীগুলো পিছিয়ে নেয়া যাচ্ছিল না। আমরা অনেকক্ষন অপেক্ষা করলাম। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে পিছন থেকে একটি করে গাড়ী ঠেলে পিছনে সরিয়ে নেয়া হলো। কিন্তু আমার গাড়ীর কাছে যাওয়া গেল না। গাড়ী ওখানে রেখেই
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৩

পিছিয়ে এলাম। এক বুক আশা নিয়ে বেগম মুজিবকে দেখতে গেলেও পরিস্থিতির প্রতিকূলতার
কারণে দেখা হলো না।
১১ নং রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াতেই মিত্রবাহিনীর একজন মেজর এগিয়ে এসে বললেন,
– এমন বেকুব সৈন্য আমি আর দেখিনি। সেই বিকাল থেকে ওদের কতভাবে বুঝাতে চেষ্টা করছি, তোমাদের সবাই সারেণ্ডার করেছে। তোমরা আত্মসমর্পণ কর। কিন্তু তারা নিয়াজীর সারেণ্ডার মানতে রাজী নয়। ওরা এই কজনেই নাকি যুদ্ধ করবে।
১৬ই ডিসেম্বর রাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ১৮ ই ডিসেম্বর বিকালে পল্টন ময়দানে এক জনসভা করা হবে। এই সভায় দেশবাসীকে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা হবে। বাংলাদেশ সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত ঢাকায় এসে না পৌঁছে, ততক্ষণ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে জনগণকে অনুরোধ করা হবে এবং যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, তাদের প্রতিহত করতে হবে। ১৭ই ডিসেম্বর দুপুর থেকে মুক্তিবাহিনীর উদ্যোগে ঢাকার পল্টনে জনসভার প্রচার শুরু হলো। এই জনসভার প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা নিল সৈয়দ নূরু, ফারুক আহমেদ, দাউদ খান, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, আজিজ বাঙাল, সোহরাওয়ার্দী এবং মুক্তিবাহিনীর প্রচার বিভাগের আরও বেশ কয়েকজন সদস্য।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৪

শত্রুমুক্ত ঢাকায় প্রথম জনসভা

বেগম মুজিব সকাশে
১৮ই ডিসেম্বর ১৯৭১, শনিবার দুপুর। গণপরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী, অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ, বাসেত সিদ্দিকী, বেসামরিক প্রধান আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে স্বাধীন বাংলায় ঢাকার পল্টনে প্রথম জনসভা করতে রওনা হলাম। টাংগাইল থেকে মীরপুর, মোহাম্মদপুর হয়ে আমরা প্রথমে ধানমণ্ডিতে এলাম। ধানমণ্ডির ১৯ নং রোডের বাড়ীতে বঙ্গমাতা শেখ লুৎফুন্নেসা, বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, দুই ছেলে জামাল ও রাসেল, বঙ্গবন্ধুর নাতি জয় ও পরিবারের অন্যান্যদের সাথে দেখা হলো। বেগম মুজিব আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কেঁদে বললেন, ‘তোমরা বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আন।’ আমরা তাঁকে ওয়াদা দিলাম, স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেনই। পৃথিবীর কোন শক্তি নেই বঙ্গপিতাকে আটকে রাখতে পারে। কঠিন ওয়াদা দিয়ে বঙ্গপিতার কনিষ্ঠ সন্তান রাসেলকে কোলে তুলে নিলাম। গণপরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী, বাসেত সিদ্দিকী, অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ ও মুক্তিবাহিনীর বেসামরিক প্রধান আনোয়ার-উল-আলম শহীদ সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গপিতার পরিবারের সকলের সাথে কথা বলতে গিয়ে আবেগে অভিভূত হলো। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বার বার আমাকে বললেন, ভাই আব্বাকে ফিরিয়ে আনুন। আজ আপনাদের দেখে কত খুশী লাগছে। আব্বা উপস্থিত থাকলে আজকের এই খুশী আরো ভাল করে অনুভব করতে পারতাম বেরিয়ে আসার আগে বেগম মুজিবকে বললাম, ‘একটু পরে পল্টন ময়দানে মুক্তিবাহিনীর উদ্যোগে জনসভা হবে। আপনি অনুমতি দিলে আমি জামালকে নিয়ে যেতে চাই। ওকে আবার নিজে এসে পৌঁছে দিয়ে যাবো।’ তিনি অনুমতি দিলেন। জামালকে নিয়ে পনের কুড়িটি গাড়ীতে আমরা পল্টনের দিকে এগুলাম। মুক্তিবাহিনীর গাড়ীর সারি যখন ডানে সচিবালয়, বামে জি.পি. ও.-র মাঝ দিয়ে পল্টনের দিকে এগুচ্ছিল, তখন আমাদের বাম পাশ দিয়ে খুব দ্রুত দুইটি ডাটসান অতিক্রম করে যাচ্ছিল। গাড়ী দুইটি পার হয়ে যাবার সময় আমরা নারী কন্ঠের চিৎকার শুনতে পেলাম। এতে আমাদের সন্দেহ জাগলো। একেতো ট্রাফিক আইন ভেঙে বাম পাশ দিয়ে গাড়ী দুইটি অতিক্রম করে যাচ্ছিল, তদুপরি গাড়ীর ভিতর থেকে চিৎকার আসার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা গাড়ী দুইটি আটকে ফেললো। একটি গাড়ীর দুইজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। তের-চৌদ্দ বৎসরের দুইটি মেয়ে ও চারজন যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ল। মেয়ে দুইটির কাছ থেকে জানা গেল, তাঁদের বাসা মগবাজারের কাছে। তাদেরকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে। তাঁদের বাবাকেও লুটেরারা হাত-পা-মুখ বেঁধে গাড়ীর পিছনে বনেটের ভিতরে পুরে রেখেছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৫

মুক্তিযোদ্ধারা দৌড়ে গিয়ে গাড়ীর পিছনের বনেট খুলে সত্যিই একজন পূর্ণবয়স্ক লোককে আধমরা অবস্থায় বের করে নিয়ে এলো। লোকটি একজন অবাঙালী মোটর মেকানিক। ছয়জন দুষ্কৃতকারী তাকে বাড়ী থেকে তার দুই মেয়েসহ পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে তাঁরই গাড়ীতে পালাচ্ছিল। তাকে হয়তো তাঁরা একটু পরেই খুন করতো এবং মেয়ে দুইটির সম্মান-সম্ভ্রম নষ্ট করতো। মুক্তিযোদ্ধারা এই অন্যায় কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারেনা। দুষ্কৃতকারীরা যে ভদ্রলোককে ধরে এনেছে, তিনি অবাঙালী হলেও তার প্রতি ন্যায়বিচার না করে উপায় নেই। হাতে তেমন সময় ছিল না। তাই চারজন দুষ্কৃতকারীকেই পিঠামোড়া দিয়ে বেঁধে পল্টন ময়দানে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলাম।

স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা : সেই পল্টনে
পল্টনের প্রধান গেট দিয়ে আমাদের গাড়ী প্রবেশ করল। স্টেডিয়ামের গা ঘেঁষে গাড়ী থেকে নামলাম। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও আমি পাশাপাশি হেঁটে পল্টনের নির্দিষ্ট মঞ্চে গিয়ে উঠলাম। গণ-পরিষদ সদস্য ও অন্যান্যরাও মঞ্চে উঠে বসলেন। সভায় অসংখ্য লোক হয়েছে, পরদিন ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলোর কারোর মতে দুই লাখ, কারো তিন লাখ, কোন পত্রিকা আবার জনসমাগমের পরিমাণ দেড় লক্ষ বলে মন্তব্য করলো। পল্টন ময়দান কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল। পল্টনের চার পাশে দোকানঘর গুলোর ছাদে জমায়েত হয়েছে প্রচুর লোক। মাথা নীচু করে সভামঞ্চে বসে আছি। বামে বঙ্গপিতার দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল, ডানে মুক্তিযুদ্ধে আমার দক্ষিণ হস্ত আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও গণ-পরিষদ সদস্যবৃন্দ। কোরান ও গীতার অংশ বিশেষ পাঠের মাধ্যমে সভার কাজ শুরু হলো। সভা পরিচালনার দায়িত্বে নিলেন আনেয়ার-উল-আলম শহীদ। সভায় বক্তব্য রাখলেন তিন গণ- পরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকী, অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ ও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এরপর আনোয়ার-উল-আলম শহীদ তাঁর বক্তব্য শেষ করে আমাকে বক্তব্য পেশ করতে আহ্বান জানালেন।
স্বাধীন বাংলায় ঢাকায় প্রথম জনসভায় গণ-পরিষদ বাসেত সিদ্দিকী তাঁর বক্তৃতায় বললেন, ‘দশ লক্ষ প্রাণ ও নব্বই লক্ষ মানুষের গৃহত্যাগের বিনিময়ে আমরা মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু আমার দুঃখ আজ আমাদের মাঝে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত নেই। আমরা কাদেরিয়া বাহিনী শপথ নিচ্ছি, যতদিন সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে না পারবো ততদিন আমরা অস্ত্রত্যাগ করবো না।’
গণ-পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ তাঁর বক্তৃতার এক পর্যায়ে ঘোষণা করেন, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষ শহীদ হবে তবুও বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয় আনবে।’
গণ-পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী তাঁর বক্তৃতায় তেজদীপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘পল্টনেই বাংলাদেশের সকল সংগ্রামের ডাক উঠেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের আহ্বান সার্থক হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে আপন মহিমা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৬

নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আন্তরিক সমর্থন, অতুলনীয় সমবেদনা ও সহযোগীতা, ভারতীয় মহান জনগণের মহৎ আত্মত্যাগ ও রক্তের দামে মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন রচনা করলেন যে মিত্রবাহিনী, আমি তাঁদের সকলকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।’ তিনি শপথ করে বললেন, ‘২৫শে ডিসেম্বরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি না দিলে মুক্তিবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করবে। আমরা অবশ্যই মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণ সর্বোতভাবে সমর্থন করবো।
আনোয়ার-উল-আলম শহীদ আমাকে বক্তৃতা করার আহবান জানানোর আগে বললেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করার জন্য অস্ত্র ধারণ করেছিলাম। আমরা প্রমাণ করেছি, বাঙালীরা মাথা উচু করে বাঁচতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত না করা পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ থামাবেনা। যুদ্ধ চলতেই থাকবে।’
সকলের বক্তৃতার শেষে এলো আমার পালা। উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিকে একবার দেখে নিলাম। তারপর বললাম, ‘করুনাময় আল্লাহতালা আপনাদের সহায় হউন। আমরা দীর্ঘ নয় মাস হানাদারদের সঙ্গে অবিরাম নিরবিচ্ছিন্ন মরণজয়ী যুদ্ধ করে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য্যকে ছিনিয়ে এনেছি। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নের মণি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনও হানাদারদের কারাগারে বন্দী। বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত না করা পর্যন্ত স্বাধীনতার পূর্ণস্বাদ আমরা অনুভব করতে পারছিনা। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল আমার পাশেই বসে আছে। মুক্তির আনন্দে যখন বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বেলিত, তখন লক্ষ লক্ষ পিতা-পুত্র ভাই-বোন হারা মানুষের মত জামালের প্রাণও পিতার অভাবে কাঁদছে। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিটি স্বাধীনতাকামী বাঙালী জামালের মতই পিতার অনুপস্থিতিতে আজ শোকাহত। আমার বক্তৃতার শুরুতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দিক থেকে কয়েকটি গুলি এসে মঞ্চের উপর বাঁশে লেগে প্যাণ্ডেলের কিছু অংশ ছিঁড়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল। আমি বক্তৃতার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে কঠোরভাবে বললাম,
‘কারা সভাস্থলে গুলি ছুঁড়েছে তা আমরা বুঝি। হুশিয়ার করে দিচ্ছি, কারো লুটের রাজত্ব কায়েম করতে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দেয় নাই। আর একটি গুলিও যদি এদিকে আসে এবং সেই গুলিতে কারো সামান্য ক্ষতি হয়, তাহলে যারা গুলি ছুঁড়ছে তাদের আমরা আস্ত রাখবোনা, গুড়িয়ে দেব।’
এই হুঁশিয়ারীর পর গুলি থেমে গেল। আবার স্বাভাবিকভাবে সভার কাজ চলতে লাগল। আমি পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে এসে বললাম,
‘আমাদের সংগ্রাম ছিল হানাদারদের কামানের মুখ থেকে লাখো লাখো মা, বোন ও ভাইকে রক্ষা করা, বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করা। সে কাজ শেষ হয়েছে। আমাদের অপর কাজ, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগার ভেঙে বের করে আনা। ইয়াহিয়ার জেনারেলরা, তোমাদের মনে রাখা উচিত, বাংলার মুক্তি
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৭

বাহিনী কোন ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ শেখেনি। তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেই তারা যুদ্ধ শিখেছে। তোমরা এখনও আমাদের নেতাকে আটকে রেখেছ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনককে আটকে রাখার কোন অধিকার তোমাদের নেই। মুক্তিবাহিনীর অধিকার আছে যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে নেতাকে মুক্ত করে আনার। ঘাতকরা মনে রেখো, আগামী ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তেজগাঁ বিমান বন্দরে সসম্মানে পৌঁছে দিয়ে না গেলে আমরা পাকিস্তান আক্রমণ করবো এবং বিশ্বের মানচিত্র থেকে পাকিস্তানের নাম- নিশানা মুছে দেব। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা, পিতাহীন স্বাধীনতা অর্থহীন। জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে এনে স্বাধীনতা অর্থবহ করতে হবে। তোমরা প্রস্তুত হও।
ভাইয়েরা- বোনেরা, মুক্তিবাহিনী এমন বাংলাদেশ গড়তে চায়, যেখানে ধনী দরিদ্রের কোন ভেদাভেদ থাকেবেনা। আর এই সোনার বাংলা গঠনে যে বাঁধা আসবে তা আমরা সর্ব শক্তি দিয়ে রুখবো। বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার যতক্ষণ না ঢাকায় আসছে ততক্ষণ যা যেভাবে আছে, সেইভবেই থাকবে। কোন নড়চড়া করা চলবেনা। আইন কারো হাতে তুলে নিলে মুক্তিবাহিনী তা বরদাস্ত করবেনা। বন্ধুগণ, আপনারা সাহসের সাথে সব কিছুর মোকাবিলা করুন আমি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সালাম জানাচ্ছি। মুক্তিবাহিনীর হাতে শুধু অস্ত্রই ছিল না, ছিল জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা ও আশীর্বাদ। বাংলার জনগণ যে ত্যাগ- তিতিক্ষার পরিচয় দিয়েছেন, বিশ্বের যে কোনো স্বাধীনতার ইতিহাসে তা এক অনন্য, অতুলনীয় সংযোজন।
মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা, কোন বিজাতীয় দখলদার শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও জয়লাভ করলেই মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যেতে পারেনা। আমাদের সামনে আরো বড় যুদ্ধ পড়ে রয়েছে। সেখানে আমাদের হাতের এই অস্ত্র কোন কাজ দেবেনা, হানাদার বিতাড়িত দেশগড়ার যুদ্ধে আমাদেরকে দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে। আন্তরিকতা, দেশপ্রেম ও নিরলস কর্মশক্তিই হবে আমাদের আগামী দিনের হাতিয়ার। নিষ্ঠা, সততা, ন্যায়পরায়নতা, সুষ্ঠু সংগঠন ও সংগঠিত শ্রম ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারেনা। আমরা যে ওয়াদা দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম, সেই ওয়াদা এক মুহুর্তের জন্যও ভুলে গেলে চলবেনা। ভুখা-নাঙ্গা সাড়ে সাত কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে না পারলে আমাদের এই রক্তের দামে অর্জিত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হয়ে যাবে। লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মা আমাদের কিছুতেই ক্ষমা করবেনা।
পাকিস্তানী জান্তারা, তোমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যুদ্ধে আমাদের কাছে তোমরা নিদারুণভাবে পরাজিত হয়েছ। অনতিবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দাও। মনে রেখ, আমরা কথার বরখেলাপ করতে জানিনা। বঙ্গবন্ধুকে আটকে রাখলে পাকিস্তানের নাম-নিশানা ও থাকবেনা। আর এও ভেবে দেখ, তোমাদের পঁচানব্বই হাজার নরঘাতক আমাদের হতে বন্দী। বঙ্গবন্ধুকে অন্যায়ভবে আটকে রাখলে আমরা অন্য কিছু বিবেচনা করবো কিনা বলতে পারিনা।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৮

পাকিস্তানের শান্তি-প্রিয় জনগণের কাছে আমার আবেদন, মদ্যপ, লম্পট, খুনী ইয়াহিয়াকে আপনারা কাঠগড়ায় দাঁড় করান। বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে লম্পটটাকে বাধ্য করুন। তা না হলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাকী অংশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্বের নেতৃবৃন্দের কাছে আমার আহ্বান, আপনারা ইয়াহিয়া ও তার চেলা-চামুণ্ডাদের বুঝান, বাধ্য করুন, বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে। তা না হলে এই উপমহাদেশের তো নয়ই, সারা বিশ্বের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ভারতীয় জানগনকে গভীর শ্রদ্ধা ও সালাম জানাচ্ছি। লড়াইয়ে যে সকল ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। আল্লাহ্ আহতদের আরোগ্য করুন।
ভাই ও বোনেরা, আপনারা কি শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারিদের সহ্য করবেন? আপনারা কি লুটেরাদের প্রশ্রয় দেবেন?’
লক্ষ কন্ঠে জনতা উত্তর দিল, ‘না, না’।
‘আমরা যখন সভায় আসছিলাম, তখন এই চার জন এই দুইটি মেয়ে ও পঞ্চাশ হাজার টাকা লুঠ করে এদের বাবাকে বেধে নিয়ে যাচ্ছিল। এই দুষ্কৃিতকারীরা আমাদের কাছে হাতে- নাতে ধরা পড়েছে। এই যে, আমার হাতে দুষ্কৃতকারীদের লুঠ করা পঞ্চাশ হাজার টাকা। আপনারাই বলুন, এদের কি করা উচিত? আপনারা এদের কি করতে চান?’
জনতা উত্তোজিত হয়ে সমস্বরে চিৎকার করে উঠল,
‘নারী হরনকারী লুটেরাদের আমরা মৃত্যুদণ্ড চাই।’ হাজার হাজার লোক চিৎকার করে বললেন,
‘ওদের গুলি করে মারা হউক।’

দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড
আপনাদের নির্দেশ মুক্তিবাহিনী অবশ্যই পালন করবে। মুক্তিবাহিনী জনগণেরই আজ্ঞাবহ স্বেচ্ছাবাহিনী। এই চার দুষ্কৃতকারীকে সভাশেষে সভাস্থলে চারটি গুলি ও বেয়ানেট বিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করা হবে। এই চার জনের ভয়ানক শাস্তি দেখে অন্যান্য দুষ্কৃতকারীরা যাতে আর অপকর্ম করতে সাহস না পায়, তারই জন্য এদেরকে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেয়া হবে।
আমি আবার আপনাদের সালাম জানাই, ভারতীয় বাহিনীর যে ১৪ হাজার বীর যোদ্ধা বুকের রক্ত ঢেলেছেন, শহীদ হয়েছেন, তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের আত্মার মাগফেরাত ও আহতদের আশু সুস্থতা কামনা করছি। প্রতিটি বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও জনগণকে আমি সালাম, অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আমরা ওয়াদা করছি, অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলার মুক্ত মাটিতে ফিরিয়ে আনবোই আনবো। আপনারা মুক্তিবাহিনীর সফলতা কামনা করে আল্লাহ্‌র দরবারে দোয়া করুন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি কামনা করে আল্লাহ্‌র দরবারে মোনাজাত করুন। আপনারা আমাকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৯

দোয়া করুন, যেন লোভ, লালসা ও বিপদের মুখে মাথা উঁচু করে যেতে পারি ৷ আল্লাহ আপনাদের সহায় হউন।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় হিন্দ,
ইন্দিরা-মুজিব জিন্দাবাদ, বাংলা-ভারত মৈত্রী দীর্ঘজীবি হউক,
জয় যৌথবাহিনী।’

মোনাজাত শেষে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে সভার কাজ শেষ হলো। সভাশেষে সভামঞ্চের উত্তরে চার জন দুষ্কৃতকারীর প্রত্যেককে একটি করে বেয়নেট চার্জ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করা হলো। দেশ বিদেশের রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের শতাধিক সাংবাদিক পল্টন ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের ক্যামেরা এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরনের ছবি তুললো। সভাশেষে সাংবাদিকরা আমাকে ছেঁকে ধরলেন। তাদের নানা প্রশ্ন, মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে লড়লো? কেন পাকিস্তানীরা হারলো? বঙ্গন্ধুকে ছেড়ে না দিলে মুক্তি-বাহিনী কি ঠিকই পাকিস্তান আক্রমন করবে? যে চার জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো, তারা কি সত্যিই মৃত্যুদণ্ড পাবার মত অপরাধ করেছিল? এমনি অনেক প্রশ্নের মাঝে ১৮ই ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা শেষ হলো। সভাশেষ অবাঙালী ভদ্রলোকটিকে তার দুই মেয়ে ও পঞ্চাশ হাজার টাকা সহ বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হলো।
সভাস্থল থেকে বেরিয়ে যাবার সময় ঢাকা বেতারের কর্মীরা টেপরেকর্ডার নিয়ে দৌড়ে এলেন। তাদের অনুরোধ, ‘বেতারে প্রচারের জন্য একটি বাণী দিন।’ বেতার কর্মীদের প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভবে প্রত্যাখান করে বললাম, ‘বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় আসার আগে কেউ বেতার ভাষন দিন, তা আমরা আদৌ চাই না।
বেতার কর্মীদের টেপরেকর্ডার সহ ছুটে আসার কারন হলো, ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্র আমার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল। বেতার কেন্দ্রের দায়িত্বে তখন ছিল কর্নেল নাজিবুর রহমান পিন্টু ও নজরুল ইসলাম। কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর বেতার কর্মীদের খুঁজে বের করে ১৮ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তারা ঢাকা বেতার কেন্দ্র চালু করে।

পত্র-পত্রিকার প্রতিক্রিয়া
১৯শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রতিটি জাতীয় সংবাদপত্র ও বিদেশের অসংখ্য সংবাদপত্রে ১৮ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর আহুত জনসভার খবর ব্যানার হরফে ছাপা হয়। কোন কোন পত্রিকা আমাকে ব্রিগেডিয়ার, আবার কোন পত্রিকা মেজর জেনারেল হিসাবে আখ্যায়িত করে খবর ছাপেন। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ভূয়সী প্রশংশা করে আমার বক্তৃতার মূল অংশ ছাপা হয়। বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক পূর্বদেশ ১৯শে ডিসেম্বর রবিবারের সংখ্যায় পল্টন জনসভায় বক্তৃতার বিরাট ছবিসহ খবর ছাপালো। “পল্টন ময়দানে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩০

মুক্তিবাহিনীর ঐতিহাসীক জনসভা, পাকিস্তানের প্রতি চরম পত্র।” মস্ত বড় বড় লাল হরফে এর নীচে তারা ছাপালেন, “শেখ মুজিবকে মুক্তি দাও।” স্টাফ রিপোটারের খবর আমি হুবহু তুলে ধরছিঃ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নের মণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির জন্য শপথ গ্রহণের উদ্দেশ্যে আয়োজিত ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে গতকাল শনিবার বিকেলে অনুষ্ঠিত জনসভায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাংগাইল ও পাবনা এলাকার মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চরম হুঁশিয়ারী দিয়ে উপরোক্ত জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে তেজগাঁ বিমান বন্দরে অবতরন করানোর আহবান জানিয়েছেন। টাংগাইল, ময়মনসিংহ, ঢাকা, পাবনা এলাকার মুক্তিবাহিনীর উদ্যোগে আয়োজিত উক্ত জনসভায় বক্তৃতাকালে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক জনাব কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘আমার সংগ্রাম ছিল কামানের মুখ থেকে যে বাংলার লাখো লাখো মা, বোন, ভাইকে রক্ষা করা। সেই কাজ শেষ হয়েছে। আমার অপর সংগ্রাম হচ্ছে, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে বের করে আনা।’ পূর্বদেশ এমনিভাবে তিন গণপরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী, অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ, বাসেত সিদ্দিকী ও অনোয়ার-উল-আলম শহীদের বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়ে ছবিসহ পুরো প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে খবর ছাপে।
১৯শে ডিসেম্বর টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন উৎসাহী সদস্য মীরপুর বেতার কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ দুই কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সচল ট্রান্সমিটার টাংগাইলে নিয়ে আসে। তাদের ইচ্ছে ঐ ট্রান্সমিটার টাংগাইলে বসানো হবে। তাদের ইচ্ছার রূপ দিয়ে ট্রান্সমিটার বসানোর সবকিছু পাকাপাকি হলেও এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ট্রান্সমিটারটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে সম্মত হলেও ২৪শে জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু যখন টাংগাইল ঐতিহাসিক অস্ত্রগ্রহণের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন, তখন ট্রান্সমিটারে সামান্য গোলযোগ দেখা দেওয়ায় তা বঙ্গবন্ধুর হাতে চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে কয়েক মাস পর ট্রান্সমিটারটি আবার ঢাকায় ফিরিয়ে নেয়া হয়।
১৯শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের পত্রিকাগুলির মতো বিদেশী পত্রিকাগুলিও মুক্তিবাহিনীর তীব্র সমালোচনা করে বড় বড় হরফে খবর প্রকাশ করে। মধ্য প্রাচ্যের অধিকাংশ পত্রিকা গুলোতে ১৮ই ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে নারী হরনকারী ও লুটেরাদের মুক্তিবাহিনীর গুলি ও বেয়নেটে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করার ছবি প্রথম পৃষ্ঠায় ছেপে বড় বড় হরফে প্রচার করে যে, ‘বাংলাদেশে অবাঙালী মুসলমানদের নির্মমভবে হত্যা করা হচ্ছে।’ কোন কোন পত্রিকা এও বলল যে, ‘আত্মসমর্পণ কারীদের এইভাবে হত্যা করা হচ্ছে। তারা মুক্তিবাহিনী ও আমাকে পৃথিবীর নির্মম ও জঘন্যতম ব্যক্তি হিসাবে উল্লেখ করতেও পিছপা হলো না৷ বৃটেন, আমেরিকা ও ইউরোপের বহুল প্রচারিত অসংখ্য পত্রিকা একই ধরণের উদ্দেশ্য প্রণোদিত খবর প্রচার করে। তাঁরা একবারও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে এ সত্যাটা তুলে ধরার চেষ্টা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩১

করেনি যে, ছাপানো ছবিতে মুক্তিবাহিনী যাদের গুলি করেছে, তাদেরকে আদৌ আত্মসমর্পণ- কারী অথবা অবাঙালী মুসলমান কিংবা বাঙালী রাজাকার বা অন্য কিছুর জন্য শাস্তি দেয়া হয়নি। শাস্তি দেয়া হয়েছে লুটতরাজ নারী হরণের প্রমাণিত অপরাধে। এর পর থেকেই সারা পৃথিবীতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আমার বিরুদ্ধে একটা সুপরিকল্পিত অপপ্রচার চালাতে থাকে। অনেকাংশে এই অপপ্রচারের কল্যাণে মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের স্বীকৃতি আমি সারা পৃথিবীর প্রগতিশীলদের কাছ থেকে পাই। স্বাধীনতাকামী প্রগতিশীল মানুষ এ মিথ্যায় বিভ্রান্ত না হয়ে বরং প্রতিক্রিয়াশীলদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংবাদ থেকে আমার সত্যিকারের চরিত্র ও মানসিকতা খোঁজে বের করতে সক্ষম হন।

মায়ের সাথে
ঐ দিনের আর একটি বিশেষ ঘটনা হলো, ১৯শে ডিসেম্বর সকালে আমাদের আকুর টাকুর পাড়ার বিধ্বস্ত বাড়ী থেকে বেরিয়ে গাড়ীতে উঠতে যাব এমন সময় দুটি কার থেকে মা- ভাই-বোনদের নামতে দেখে চমকে উঠলাম। সেই আগষ্টের পর মা-ভাই বোনদের সাথে এই প্রথম দেখা। ঢাকার ১০৩ শরৎ গুপ্ত রোড, নারিন্দায় সারাহ খালার যে বাসায় মা-ভাই-বোনেরা সাময়িকভাবে ছিল, সেখানে ১৬ই ডিসেম্বর রাতে লোক পাঠিয়ে ছিলাম। কিন্তু মা ও ভাই-বোনদের নারিন্দার বাসায় পাওয়া যায়নি। ঢাকার শোচনীয় অবস্থা দেখে প্রচণ্ড যুদ্ধের আশঙ্কায় তারা ৯ই ডিসেম্বর সকাল ৮টায় নারিন্দা থেকে বেরিয়ে পড়েন। নারিন্দা থেকে রিক্‌সায় জিঞ্জিরা, তারপর পায়ে হেঁটে শুকনো বুড়িগঙ্গা পার হয়ে দশ বার মাইল দক্ষিনে গিয়ে একটি লঞ্চে উঠেন।
আমাদের দলের সদস্য ঢাকার সেলিম ও শাহ্ আলম আগে থেকেই লঞ্চের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। মার সঙ্গে তখন ছোটমা হেনা সিদ্দিকী, বোন রহিমা, শুশুমা, শাহানা, ছোটভাই মুরাদ, আজাদ, ইদ্রিস মামার মেয়ে পারভীন, ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী, ডাঃ লায়লা চৌধুরী ও তাঁর সাত-আট মাসের ছোট্ট মেয়ে। লঞ্চে আরিচা, তারপর শিবালয়ে, সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়ীতে মানিকগঞ্জের তরার ঘাটে। সেখান থেকে আবার নৌকায় তাঁদের নাগরপুর নিয়ে আসা হয়। তাঁরা নাগরপুরের এক চেয়ারম্যানের বাড়ীতে ওঠেন। চেয়ারম্যান পরম যত্নে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ঢাকা থেকে নাগরপুর আসতে তাঁদের আট দিন লেগে গেছে।
১৬ই ডিসেম্বর যখন দেশ স্বাধীন হলো তখন তাঁরা ঐ চেয়ারম্যানের বাড়ীতে। ১৭ তারিখ সন্ধ্যা থেকে মা টাংগাইল আসার জন্য ছটফট করছিলেন। ১৮ তারিখ সকাল থেকে মাঝে আর কেউ আটকে রাখতে পারছিলেন না। নাগরপুর থেকে চারটা ঘোড়ার গাড়ীতে ১৮ তারিখ দুপুরে সবাইকে এলাসিন নিয়ে আসা হয়। এলাসিন ঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমাণ্ডার চারানের ফরিদ মা, ভাই-বোন ও অন্যান্যদের পরম সমাদরে গ্রহন করে। এলাসিন থেকে সিলিমপুর পর্যন্ত আসতে রাত হয়ে যায়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাকে সিলিমপুর বাজারের কাছে এক বাড়ীতে থাকতে হয়। কমাণ্ডার ফরিদই মাকে টাংগাইলের খবরাখবর দেয়। যদিও তখন পর্যন্ত আমি মার কোন খবর জানতাম না। ১৯শে ডিসেম্বর ভোরে কর্নেল ফজলুর রহমানের দলের
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩২

কয়েকজন মার সিলিম-পুরে আসার খবর পেয়ে একটা বাসে মা ও ভাই-বোনসহ অন্যান্যদের সযত্নে টাংগাইল সার্কিট হাউজে নিয়ে আসে। মা সার্কিট হাউজে একমুহূর্তও অপেক্ষা করতে না চাইলে সেখান থেকে কারে আমাদের টাংগাইলের আকুর টাকুর পাড়ায় বিশ্বস্ত বাড়ীতে নিয়ে আসা হয়। মাকে পেয়ে মুহূর্তে সব পাওয়ার আনন্দে ভরে উঠলাম। মা-ভাই-বোনদের সাথে কিছুক্ষণ কাটিয়ে দুপুরে এসে একসাথে খাবো বলে বেরিয়ে পড়লাম।

প্রাসাদ ষড়যন্ত্র
ঘড়ির কাঁটা যেমন বার বার একই জায়গায় ঘুরে আসে। ইতিহাসের চাকাও তেমনি একই তালে ঘুরে ফিরে পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য যারা আত্মবলি দিয়েছেন, যারা জীবনের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছেন তারাও অনেকেই প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। ভারতের অন্যতম প্রধান স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজী সুভাষ বসুর সঠিক মূল্যায়নই বা কতটুকু হয়েছে। পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপক শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হককে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের নায়ক বা পাকিস্তান সৃষ্টির দুই তিন বছর যেতে না যেতেই পাকিস্তানের প্রধান দুশমন আখ্যায়িত করেছিল। মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকতে দেয়া হয়নি। স্বাধীনতা আন্দোলনের আর এক পুরোধা শামসুল হককে পাকিস্তানের দুশমন বলে আখ্যায়িত করে নানা ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। চল্লিশ বছর বয়সেই কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে নিখোজ হয়েছেন। একদিকে যেমন স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহল নিরন্তর ষড়ন্ত্রের জাল বুনেছে, অন্যদিকে তেমনি ষড়যযন্ত্রের জাল ছিন্ন ভিন্ন করে জীবনের অবিচ্ছিন্ন ধারার মত ঐতিহাসিক অনিবার্যতায় প্রগতির চাকা অবিরাম সামনের দিকে এগিয়েছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চুড়ান্ত বাধা-বিপত্তির গহীন খাদ পেরিয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে চরম ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য্যকে ছিনিয়ে আনতে বাঙালী জাতিকে আমরা যারা বেশী সাহায্য করেছি স্বাধীনতার পর প্রথম খড়গ নেমে এলো সেই আমাদের উপরই। অবস্থার চাপে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হইনি, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামে ছাত্রদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছাত্র রাজনীতি করেছি। স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত এগিয়ে নেয়ার সংগ্রামে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছি। স্বাধীনতার মাত্র দুই দিন পর বাংলাদেশ সরকার সেই আমার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে কিছুটা চমক দিতে পারলেও অভিনবত্ব কিছুই দেখাতে পারলেন না। আমার বিরুদ্ধে ওদের অভিযোগ, আমি নাকি আইন হাতে তুলে নিয়েছি। অতীতের অনেক দেশপ্রেমিকের মতই আমার গায়েও আইন ভঙ্গকারীর লেবেল এঁটে দেয়া হলো। অতীতের অনেকের মতই আমিও হলাম কুচক্রী মহলের আর এক নতুন শিকার। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ধারা অব্যাহত রইল।
২০শে ডিসেম্বর ভারতের বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা আমার গ্রেফতারী পরোয়ানার খবর ছাপালো যদিও বাংলাদেশের কোন পত্রিকা আমার গ্রেফতার সম্পর্কে কোন খবর
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৩

ছাপেনি। কারণ, গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী সম্পর্কে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার বিশেষ কিছু জানা ছিল না৷ বাংলাদেশ সরকার তখনও মুজিব নগরে। ভারতীয় পত্রিকাগুলো আমার গ্রেফতারের খবর ছেপে সাথে সাথে এর তীব্র সমালোচনা করল। তারা বাংলাদেশ সরকারের শুভ বুদ্ধি জাগায় ও দেশকে আরো একটা গৃহযুদ্ধে ঠেলে না দেয়ার পরামর্শ দিল।
কোলকাতায় যখন এতো ঘটনা ঘটছে আমি তখন টাংগাইলে। এই ব্যাপারে তখনও বিন্দু বিসর্গ জানি না। রাত ন’টায় ব্রিগেডিয়ার সান সিং -এর ফোন এলো। তিনি পরদিন সকালে টাংগাইল আসবেন অথবা আমি ময়মসিংহ যেতে পারবো কিনা- এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথা হলো। আমি সান সিংকে জানিয়ে দিলাম, পরদিন দুপুরে ময়মনসিংহ টাউন হলের সামনে এক সম্বর্ধনা সভা আছে। সেখানে অমি অবশ্যই উপস্থিত থাকবো। প্রয়োজন হলে সকালেও ময়মনসিংহ পৌঁছে যেতে পারি। সান সিং-এর টেলিফোনের ঘন্টা খানেক পর টেলিভিশনের উপস্থাপক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত নাট্যকার ও প্রতিবেদক সহযোদ্ধা মামুনুর রশিদ ও নুরুন্নবী উদ্ভ্রান্তের মত ঢাকা থেকে ছুটে এলো। তারা কোলকাতার কয়েকটি সংবাদপত্রও নিয়ে এসেছে। এদের দুজনের কাছ থেকে প্রথম গ্রেফতারী পরোয়ানা সম্পর্কে জানলাম৷ কিছু অথর্ব ও ঈর্ষাপরায়ন কুচক্রীয় প্ররোচনায় যদিও আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আগষ্ট থেকেই শুরু হয়েছিল কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলদের সেই ষড়যন্ত্র জমে উঠল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথেই।

মিত্রবাহিনীর প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ সরকার ১৯শে ডিসেম্বর আমার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে ২০শে ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তা কার্যকর করার নির্দেশ দেয়। পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডার লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ কার্যকর করতে ভারতীয় সেনাপতি মেজর জেনারেল বি. এন. সরকারকে নির্দেশ দেন। বি. এন. সরকার লেঃ জেনারেল অরোরার নির্দেশ পেয়ে প্রথমাবস্থায় একেবারে হতভম্ব হয়ে যান এবং তিনি ‘অরোরাকে বলেন, ‘কাদের সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করা এখন সময়োচিত হবে না। আর তার কাজের জন্য গ্রেফতার তো নয়ই বরং ভাকে প্রশংসা করা উচিত।’ কিন্তু এরপরও আরোরা বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ কার্যকর করতে বলেন। ঢাকার কর্তা এই অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে ব্রিগেডিয়ার সান সিং-এর শরণাপন্ন হন। টেলিফোনে তিনি সান সিংকে সমস্ত ঘটনা জানান। সব কিছু শুনে সান সিং বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘কাদের সিদ্দিকীকে আমি ছ-সাত মাস যাবত জানি। তার ভূমিকা ও ক্ষমতার জন্য তাকে গ্রেফতার করার কোন প্রশ্নই উঠে না।’ এর পরেও ঢাকার কর্তাটি যখন আরোরার মতই বলেলেন, ‘কাদের সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করার দুঃসাধ্য কাজটি তোমাকেই করতে হবে।’ তখন ব্রগেডিয়ার সান সিং উত্তেজনায় সামরিক বাহিনীর নিয়ম শৃঙ্খলা ভেঙে বলে উঠেন, ‘আমার পক্ষে কাদের সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করা মোটেই সম্ভব নয়। আমাকে তাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিলে আমি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করব।’ তিনি এই বলে ক্ষান্ত হলেন না,
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৪

কর্তাটিকে বলে দিলেন, ‘একজন সৎ নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসাবে আমার উচিত হবে আরেকজন কৃতি দায়িত্বশীলের সাথে সততার আচরণ করা। আমি তাকে তার গ্রেফতার সম্পর্কে জানিয়ে দেব। সান সিং ঢাকার কর্তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘টাংগাইল মুক্তি বাহিনীর যে পরিমাণ অস্ত্র ও সৈন্যবল রয়েছে, কাদের সিদ্দিকী রুখে দাঁড়ালে তাকে গ্রেফতার করা দুঃসাধ্য না হলেও প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ হবে। মনে রাখা দরকার, তার সহযোদ্ধারা বেতনভোগী সৈন্য নয়, স্বেচ্ছাসৈনিক। কাদের সিদ্দিকীর প্রতি তার সহযোদ্ধাদের যে ধরনের শ্রদ্ধা, মহত্ববোধ ও ভালবাসা আমরা লক্ষ্য করেছি, তাকে তাতে গ্রেফতার করতে যাওয়া ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে খুব একটা সুখের অভিজ্ঞতা হবে না। সান সিং-এর কথা শুনে ঢাকার কর্তা বললেন, ‘গ্রেফতার পরে দেখা যাবে। আমি তোমার সাথে পুরোপুরি একমত। আমিও অরোরাকে তোমার মতই একই কথা বলেছি। কাদের সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করতে যাওয়া আমাদের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তোমার সঙ্গে তার ভাল সম্পর্ক আছে, সেইজন্য তুমি তার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বল। পরে দেখা যাবে, কি করা যায়?’ দুই সেনাপতির মধ্যে এই ধরনের কতাবার্তার পরেই সান সিং আমাকে ফোন করেছিলেন। সত্যিকার অর্থে আমি তখন পর্যন্ত গ্রেফতারী পরোয়ানা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। কিন্তু সান সিং-এর টেলিফোন পাওয়ার একটু পরই গ্রেফতারের ব্যাপারে সব জেনে যাই। মামুন ও নূরুন্নবীর কাছ থেকে গ্রেফতার সম্পর্কে জেনে সান সিংকে টেলিফোন করলাম। বিগ্রেসিয়ান সান সিং আমার দিক থেকে ফোন পাওয়ার কথা ভাবছিলেন। ফোন ধরেই সান সিং জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার? কোন নতুন খবর আছে কি?’ হাসি মিশ্রিত কণ্ঠে সান সিংকে বললাম, ‘হ্যাঁ, আছে। আপনি যা জানেন, আমিও তা জানি। এইজন্য আপনার সাথে দেখা করতে আমি ময়মনসিংহ যাবো না। তবে কাল অবশ্যই ময়মনসিংহ যাবো। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ সম্পর্কে কোন কিছু আলোচনা করতে হলে তা টাংগাইলে এসেই করতে হবে। সান সিং তাঁর মনোভাব পরিষ্কার জানিয়ে বললেন, ‘তুমি ইচ্ছা করলে সকালে আসতে পার অথবা আমি সকালে আসব। তুমি যদি চাও, ময়মনসিংহ আসার জন্য যে কোন সময় আমাদের হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে পার।’
– এই ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে হলে আপনাকেই আসতে হবে।
গ্রেফতারী পরোয়ানার খবর অল্পক্ষণের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর শিবিরে বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়লো। মুক্তিবাহিনীর অনেকেই শিবির ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। প্রায় সব কোম্পানী কমাণ্ডাররা নানা দিক থেকে উল্কার বেগে ছুটে এলো। কমাণ্ডাররা সবাই উত্তেজিত কর্নেল ফজলু, মেজর হাবিব, মেজর হাকিম, ক্যাপ্টেন সবুর ও অন্যান্য কয়েকজন রাগ, অভিমান ও আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল, ‘আমরা সরকার-টরকার মানিনা। আমরা ঢাকার দিকের রাস্তা বন্ধ করে দেব। গ্রেফতারী পরোয়ানা তো দূরের কথা, এজন্য সরকার ভুল স্বীকার করলেও আমরা নিরস্ত্র হবোনা।
টাংগাইল ওয়াপদা ডাক বাংলোর সামনে সমবেত কমাণ্ডারদের পরিষ্কার জানিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৫

দিলাম, “সব সময় একই প্রক্রিয়ায় লড়াই করা যায় না, উচিত নয়। দেশে গৃহযুদ্ধ বাধাতে আমরা নিশ্চয়ই অস্ত্র ধারণ করি নাই। সরকারকে আমাদের মানতেই হবে। সরকারের ভুল ভ্রান্তির প্রতিবাদ করার ন্যায্য ও বৈধ পন্থা রয়েছে। উত্তেজনার বশে হঠকারীতা করার কোন সুযোগ নেই। পরাজিত শত্রুরা সব সময় চাইবে আমরা যাতে বিশৃঙ্খল হয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করি। তোমরা আমাকে কতখানি ভালবাস তা যুদ্ধের ময়দানে অসংখ্যবার দেখেছি। আমিও প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে যে আমার সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসি ও বিশ্বাস করি তার প্রমাণও তোমরা পেয়েছ। আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে লড়াই করে বিজয়ী হয়েছি। আজ এই মুহুর্তে আমার উপর যে আঘাত এসেছে তা আমাকে মোকাবিলা করার সুযোগ দাও। আমি যদি পরাজিত হই, তা হলে অবশ্য তোমরা সাহায্যের হাত প্রসারিত করবে। আমি তোমাদের শান্ত ও স্বাভাবিক থাকতে নির্দেশ দিচ্ছি। আমাদের সমস্ত কাজ পূর্ব পরিকল্পনামত অব্যাহত থাকবে। আমি এই ব্যাপারে সবার সঙ্গে কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনা করে ২৪শে ডিসেম্বর বিন্দুবাসিনী স্কুল ময়দানে প্রকাশ্য জনসভায় আমাদের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ঘোষনা করব। তোমরা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়াতে দিওনা। তোমরা গিয়ে সবাইকে শান্ত কর। মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ফসল যেন কিছুতেই বিনষ্ট না হয়। কমাণ্ডাররা উদ্বিগ্ন মনে যার যার শিবিরে চলে গেল। তারা এরপরও যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল। মামুনুর রশিদ ও নুরুন্নবী ঢাকা থেকে বিশেষ খবর নিয়ে এসেছে, এই কথা শুনে গণ-পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী, গণ-পরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকী ও অন্যান্যরা ওয়াপদা ডাক বাংলোয় এসে হাজির হলেন। কমাণ্ডাররা চলে গেলে বেসামরিক প্রশাসনে জড়িত প্রায় সবাই আমাকে ঘিরে ধরলেন। বাসেত সিদ্দিকী সাহেব উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন,
– স্যার, এ আবার কি ধরনের ব্যাপার? আমাকে নির্দেশ দিন। আমি কালকেই ঢাকা যাবো। আমি সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করব। বড়ভাই বাসেত সিদ্দিকী সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে ঘৃণাভরে বললেন,
– না, কক্ষনো না। যারা যুদ্ধ করেছে, যারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে, তাদের সম্পর্কে এই ধরনের অপমানকর আচরণ দরবারে সমাধান হতে পারেনা। আমরা কেউ সরকারের কাছে যেতে পারিনা। দরকার পড়লে সরকার অথবা সরকারের প্রতিনিধি এখানে এসে কথা বলবেন। আমরা এখানকার গণ-প্রতিনিধি। আমাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ না করে সরকার কিভাবে এই ধরনের ন্যাক্কারজনক কাজ করল, তা ভেবে পাই না। পল্টন ময়দানে দুই-আড়াই লাখ মানুষের মত নিয়ে চারজন দুষ্কৃতকারীকে উত্তম শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সেই সভায় আমরাও বক্তৃতা করেছি। সেখানে আমরাও উপস্থিত ছিলাম। মুক্তি বাহিনীর সাথে আমরা সবাই জড়িত। গ্রেফতারী পরোয়ানা একা কেন কাদের সিদ্দিকীর নামে আসবে? আমাদের সবার নাম বাদ পড়ল কেন? অপরাধ যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা আমরা সকলে করেছি। আর ন্যায় হলেও আমরা সবাই তার কৃতিত্বের দাবীদার। এই জন্য আমরা সরকারের কাছে কৈফিয়ত চাইবো।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৬

আনোয়ার-উল-আলম শহীদ এই সময় নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনেকের মধ্যে ক্রোধের ভাব লক্ষ্য করা গেলেও ছোট থেকে বড় মুক্তিযোদ্ধাদের একজনের মধ্যেও ভীতির লেশমাত্র ছিল না। আনোয়ার-উল-আলম শহীদের নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ, দীর্ঘ সাত মাস নানা ধরনের প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে আমাকে দেখেছেন। তিনি ভাল করে জানতেন, আমার কাছে ঐ সামান্য জটিলতা কোন ব্যাপারই নয়। এই জটিলতা কাটিয়ে উঠার জন্য কি পরিকল্পনা নেব, সেটাকে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য শহীদ সাহেব মানসিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এই সময় অধ্যাপক রফিক আজাদ, অধ্যাপক মাহবুব সাদিক, আলী হোসেন, দাউদ খান, সোহরাব আলী খান আরজু, এনায়েত করিম, মোঃ সোহরাওয়ার্দী, ফারুক আহমেদ, বুলবুল খান মাহবুব ও অন্যান্যরা পৃথিবীর বিপ্লবী ইতিহাস থেকে অনেক নজীর তুলে ধরে প্রচণ্ড উত্তেজনায় ফেটে পড়ে এই সমস্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনার যথাযথ ফয়সালা করতে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তাদের একমাত্র ফয়সালা হলো, এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। শক্তি প্রয়োগ করা টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব “চাপায় বাংলা” মোয়াজ্জেম হোসেন খান ভীষণ চড়া গলায় চিৎকার করে বার বার বলছিলেন,
এই ধরনের অসম্মানজনক আচরণের উপযুক্ত জবাব আমরা দেবোই। সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। সাম্রাজ্যবাদের দালালরা আমাদের মধ্যে আছে তারাই এই রকম ঘটনা ঘটাচ্ছে।’
তিনি প্রতিক্রিয়াশীলদের হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেন,
‘কাদের সিদ্দিকীর পিছনে শুধু টাংগাইলের সতের হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও সত্তর হাজার স্বেচ্ছাসেবক নয়, বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগণ তার সাথে রয়েছে। বিশ্বের প্রগতিশীল কোটি কোটি মানুষ কাদের সিদ্দিকীকে নিজের ভাই বন্ধু মনে করেন। এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের আচরণের যোগ্য জবাব আমরা দেবোই।

ঢাকায় বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার
২০শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সরকারের দপ্তর মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করা হলো। মেজর জেনারেল বি. এন. সরকার ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়দের নিয়ে আসেন। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রীমহোদয়গণ ও উচ্চ পদস্থ অফিসাররা ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করলে হাজার হাজার মুক্তি পাগল জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সিপাহসালারদের প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জানান। নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, মুশতাক আহমেদ, উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আবদুল মান্নান, মীজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ, এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান, জেনারেল এম. এ. জি ওসমানী প্রমুখ।
২১শে ডিসেম্বর সকালে ব্রিগেডিয়ার সান সিং হেলিকপ্টারে ময়মনসিংহ থেকে টাংগাইল
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৭

ময়মনসিংহে বৈরীতা
উড়ে এলেন। তিনি আমার সঙ্গে দীর্ঘ সময় উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ময়মনসিংহ ফিরে গেলে আমরা দুপুর বারোটায় রওনা হয়ে দুটায় ময়মনসিংহ পৌঁছলাম। ময়মনসিংহের মুক্তিযোদ্ধারা টাউন হল ময়দানে এক সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করেছিলেন। ২০শে ডিসেম্বর রাতে আওয়ামী লীগ নেতা গণ-পরিষদ সদস্য রফিক উদ্দিন ভূঁইঞা, সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে ছাত্রনেতা সৈয়দ আশরাফ ও অন্যান্যরা ২১শে ডিসেম্বর আমার সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান যাতে না হয় তার জন্য তৎপর হন। আমি যখন ময়মনসিংহে পৌঁছেছি, তখন টাউন হল ময়দানে দুই ধরনের মতাবলম্বীদের মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা বিরাজ করছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতি দেখে সোজা কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম। সেখানে থেকে ফোনে রফিক ভূইঞা ও অন্যান্যদের সাথে কথা বললাম। যে মুক্তিযোদ্ধারা সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজনে উঠে পড়ে লেগেছিল তাদেরকে ডেকে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান না করার অনুরোধ জানালাম। ব্রিগেডিয়ার সান সিংয়ের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে বিকাল পাঁচটায় ময়মনসিংহ থেকে টাংগাইল রওনা হলাম। ফিরে আসার পথে মুক্তাগাছা, গাবতলী ও আরো একটি জায়গায় সভা করতে হলো। সভা না করে ময়মনসিংহ থেকে ফিরে আসার জন্য লতিফ সিদ্দিকী সহ অনেকে আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করলেন। তারা যে কোন মূল্যে সভা করার পক্ষপাতি ছিলেন। সভা না করে ফেরায় বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আমাকে পশ্চাদাপসরণকারী বলে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধা করলেন না। বড় ভাইকে বললাম, ‘আমি যে পশ্চাদাপসরণ করতে জানি না, তা তো অনেকেই জানেন। ঢাকা ওদিকে নয়, ঢাকা অন্যদিকে। আমার আজকের সিদ্ধান্ত হয়তো একদিন বুদ্ধিমানের কাজ ও নির্ভুল হিসাবে আপনার প্রশংসা পাবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৮

টাংগাইলে জেনারেল অরোরা

২২শে ডিসেম্বর সকালে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কোলকাতা থেকে বিমানে ঢাকা এলেন। ১৪তম ডিভিশনের অফিসার মেসে ভারতীয় সেনাপতিদের সাথে আমার ব্যাপারে উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন। তার অধীনস্থ সেনাপতিদের প্রতি কিছুটা অনুযোগ করলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার যে আদেশ দিয়েছেন তা তাদের সততার সাথে পালন করা উচিৎ। তা না করলে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে।’
জেনারেল অরোরাকে সেইদিন আমার প্রতি বেশ ক্ষুব্ধ মনে হচ্ছিল। আগষ্টে পরিচয় হবার পর থেকে সর্বদাই তিনি আমার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু ২০শে ডিসেম্বর থেকে অরোরার মনোভাবের কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘ সময় সেনাপতিদের সাথে আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হয়, জেনারেল অরোরা নিজে টাংগাইল গিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হবেন। তিনি নিজে আমার সাথে এ ব্যাপারে কথা বললেন। তারপর যে পদক্ষেপ নেয়ার তা নেয়া হবে। অরোরা প্রথম প্রথম টাংগাইল আসার প্রস্তাবে সম্মত ছিলেন না। কিন্তু সব সেনাপতিদের অনুরোধে তিনি সম্মত হলেন। জেনারেলদের সম্মিলিত অনুরোধে ব্রিগেডিয়ার সান সিংকে নিয়ে টাংগাইলের প্রোগ্রাম করেন।
লেঃ জেনারেল অরোরার টাংগাইল আসার খবর ২২শে ডিসেম্বর সকাল ন’টায় আমাকে জানানো হলো। অরোরা টাংগাইল আসার আগে ১২ই থেকে ২১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর কয়েকজন জেনারেল টাংগাইল এসেছেন। তাদেরকে যথাযথ আদর-অপ্যায়ন ও মর্যাদা সহকারে অভ্যর্থনা করাও হয়েছিল। টাংগাইলে আসা জেনারেলদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, জেনারেল ওভান, জেনারেল জেকব ও মেজর জেনারেল নাগরা। ২২শে ডিসেম্বর সাড়ে এগারটায় ভারতীয় একটি চৈতক হেলিকপ্টার লেঃ জেনারেল আরোরাকে নিয়ে টাংগাইল সার্কিট হাউসের সামনে অবতরণ করলো। অরোরার এই প্রথম টাংগাইলে পদার্পণ। হেলিকপ্টারের এক পাশে ভারতীয় যষ্ঠ বিহার রেজিমেন্টের অফিসারবৃন্দ এবং অন্য পাশে আমরা কয়েকজন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। হেলিকপ্টারের দরজা খুলে লেঃ জেনারেল অরোরা ও ব্রিগ্রেডিয়ার সান সিং বেরিয়ে এলেন। ষষ্ঠ বিহার রেজিমেন্টের কর্নেলকে নিয়ে আমরা চার পাঁচ জন অরোরাকে স্বাগত জানাতে হেলিকপ্টারের কাছে এগিয়ে গেলাম। আরোরা আমাদের সাথে করমর্দন করে নির্দিষ্ট গাড়ীতে গিয়ে উঠলেন। মাঠের সার্কিট হাউস মাঠে অবতরণের পর থেকে আরোরার সম্বর্ধনায় নির্মিত বিন্দুবাসিনী স্কুল অভিবাদন মঞ্চ পর্যন্ত প্রায় দেড় মাইল পথে আমাদের একটি বাক্যও বিনিময় হলোনা।
অরোরাকে সম্বর্ধনা জানানোর জন্য ছ’শ মুক্তিযোদ্ধা বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে দাঁড়িয়ে ছিল। অল্প সময়ের ঘোষণায় প্রায় পনের কুড়ি হাজার লোক বিজয়ী সেনাপতিকে স্বাগত জানাতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৯

বিন্দুবাসিনী স্কুল ময়দানে জমায়েত হয়েছেন। অরোরা ও আমাকে বহনকারী গাড়ী টাংগাইল পৌরসভা অফিসের সামনে থামলে আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম গাড়ীর দরজা খুলে লেঃ জেনারেল অরোরাকে স্বাগত জানালেন। মাঠের মাঝখান দিয়ে লম্বালম্বি পাতা লাল কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে অরোরা অভিবাদন মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমিও তাঁর পাশে দাঁড়ালাম। হেলিকপ্টার অবতরণ করার পর একবার করমর্দন ছাড়া তখন পর্যন্ত আমাদের দুজনের মধ্যে কোন বাক্য বিনিময় হয়নি। এমনকি স্বাভাবিক সৌজন্যমূলক কুশল বিনিময়ও নয়। অভিবাদন মঞ্চের সামনে সুসজ্জিত ও সুশৃঙ্খল মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে অরোরা প্রথম অস্বাভাবিক অস্বস্তিকর নীরবতা ভাঙলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– এরা কারা? এরা কি বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক?
– সামনে দাঁড়ানো শতকরা নিরানব্বই জনই স্কুল-কলেজের ছাত্র, শ্রমিক, রিকশাওয়ালা বা কৃষক। তাদের একজনেরও যুদ্ধ শুরু পর্যন্ত কোন সামরিক অভিজ্ঞতা অথবা সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না। হয়তো দুএকজন আছে, যারা আগে সেনাবাহিনীতে কাজ করেছে।’ আমার কথা শুনে অরোরা কিছুটা অবাক হলেন। সামনে সটান দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দর সুবিন্যস্ত পোষাকে সজ্জিত বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে তেজোদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে হয়তো অভিজ্ঞ জেনারেলের মনে হলো কোন সেনাবাহিনীকে এত সুন্দরভাবে পোশাক পড়তে ও সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়ানো শিখতেই দু’তিন বৎসরের প্রশিক্ষনের প্রয়োজন। মাত্র আট-নমাস সময়ের মধ্যে প্রতি মুহুর্তে যুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও কি করে এত সুশৃঙ্খল, সুসংহত ও সুসংগঠিত হওয়া যায়? এই প্রশ্নে তাকে, তার মনকে টাংগাইলে পদার্পণের পর প্রথম আঘাত হানলো। বিখ্যাত জাহাজ মারা কমাণ্ডার মেজর হাবিবের নেতৃত্বে ছ’শ মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল অরোরাকে অভিবাদন জানালো। মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র অভিবাদন প্রদান দেখে অরোরা আরও মুগ্ধ ও বিস্মিত হলেন। সশস্ত্র অভিবাদনের এমন অনুপম ছন্দিত মধুর তাড়নায় ও শব্দের সমাহার লেঃ জেনারেল অরোরা অনেকদিন মনে রাখবেন। অভিবাদন শেষে মেজর হাবিব প্যারেড পরিদর্শনে লেঃ জেনারেল অরোরাকে আহ্বান জানাল। জেনারেল অরোরা মেজর হাবিবের সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিদর্শনে এগিয়ে গেলেন। অরোরা এবং হাবিব আগে আগে, আমি এবং এনায়েত করিম তাদের পিছনে। অরোরা পনের মিনিট ধরে সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যেককে ঘুরে ঘুরে দেখলেন ও নানা কিছু জিজ্ঞেস করলেন। এই সময় ধীর গতিতে জাতীয় সংগীতের সুর ব্যাণ্ডে বাজানো হচ্ছিল এবং তা মুক্তিযোদ্ধারাই বাজাচ্ছিল। পরিদর্শন শেষে অরোরার সাথে মঞ্চে ফিরে এলাম। সামনে মুক্তিযোদ্ধারা মঞ্চের অনেকটা কাছে এসে তাদের আয়তন ছোট করে মাটিতে বসে পড়ল৷ স্থানীয় জনগণ তখন মাঠে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে অরোরার বক্তব্য শোনার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। টাংগাইলবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে অরোরাকে অভিনন্দন জানিয়ে পনের মিনিট বক্তব্য রাখলাম। বক্তৃতায় লেঃ জেনারেল অরোরা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করলাম। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ জয়ের মতই দেশ গঠনের
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪০

আন্দোলনেও পিছপা হবে না, এ ঘোষণায় সমবেত জনতা মুহুর্মুহু করতালিতে ফেটে পড়লেন। আমার বক্তৃতা শেষে লেঃ জেনারেল অরোরাকে কিছু বলার জন্য আহ্বান জানালাম। জেনারেল অরোরা বক্তৃতার দ্রুত বাংলা বুঝতে না পারলেও গত নয় মাস সকল বয়সী এবং সকল শ্রেণীর বাঙালীদের সাথে মেলামেশা করার সুযোগে কিছু কিছু বাংলা বুঝতেন। আর শব্দ না হলেও অভিজ্ঞতা ও ধারণ ক্ষমতার জোরে হাবভাব দেখে তিনি ভাল-মন্দের অনেকটা আন্দাজ করতে পারতেন। বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে বক্তৃতার সময় সমবেত জনতার উচ্ছ্বাসিত করতালি এবং আশ্বস্ত ও বিশ্বস্ত চোখমুখ অরোরাকে আমার সম্পর্কে আবার ভাবিয়ে তুলল। অরোরা তার বক্তৃতার শুরুতেই টাংগাইলবাসীদের সালাম জানিয়ে বললেন, ‘আপনাদের গর্ব, কাদের সিদ্দিকীর মত একজন অনন্য সাধারণ বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্ম এই জেলাতেই হয়েছে। টাংগাইলের মত বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে কাদের সিদ্দিকী জন্ম নিলে পাকিস্তানী হানাদারদের পরাজিত ও বাংলাদেশ ছাড়া করতে ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশে প্রবেশের কোনই প্রয়োজনই হতো না। আমার বহুদিনের আশা ছিল, ইচ্ছে ছিল, আপনাদের সামনে এসে হাজির হব। আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে আহত কাদের সিদ্দিকীকে যখন দেখি তখনই আমার প্রগাঢ় ইচ্ছে হয়েছিল, যে জায়গা এই ধরনের সস্তানের জন্ম দিয়েছে সেই জায়গা আমি দেখবো। আজ আমার সেই সাধ, সেই আকাঙ্খা পূর্ণ হয়েছে। আপনাদের প্রত্যেককে, আমার একজন করে কাদের সিদ্দিকী মনে হচ্ছে। আমি আপনাদের এই বীর সন্তানকে তুরাতে প্রথম সাক্ষাতে বলেছিলাম, আপনি যে অবস্থানে আছেন, যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বেঁচে থাকলে আপনিই প্রথম ঢাকায় যাবেন। আমার সেই অনুমান মিথ্যে হয়নি, আপনাদের সুযোগ্য সন্তান ঢাকার বুকে প্রথম পা রেখেছেন। আজ আপনাদেরকে আমি দেখলাম। দীর্ঘদিন আপনাদের সম্পর্কে যে ধারণা করেছি, আপনাদের যে ভাবে ভেবেছি, আপনারা তার চাইতে অনেক বড়, অনেক মহৎ। আমরা চিরকাল আপনাদের বন্ধু হয়ে থাকবো। আমাকে আপনারা যে সম্মান দিলেন, যে আন্তকিতার সাথে গ্রহণ করেছেন, তা আমি আজীবন মনে রাখবো।
আল্লাহ্ আপনাদের মঙ্গল করুন।
জয় বাংলা, জয় হিন্দ, জয় বঙ্গবন্ধু।
জয় মুক্তিবাহিনী, ভারত-বাংলা মৈত্রী অমর হউক।’

বক্তৃতা শেষে অরোরা আমাকে জড়িয়ে ধরলে জনতা দুই বিজয়ী সেনাপতির আলিঙ্গনে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লেন। চারদিক মুক্তি ও মিত্রবাহিনী জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী অমর হউক, ইন্দিরা-মুজিব জিন্দাবাদ, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় হিন্দ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল। সভাশেষে অরোরা গাড়ীর কাছে এলে, সমবেত জনতা তার সাথে আলিঙ্গন ও করমর্দনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। আমার অনুরোধে তক্ষুনি গাড়ীতে না উঠে পৌরসভা অফিসের সামনে থেকে ঘ্যাগের দালানের পুল পর্যন্ত হেঁটে এলেন। শত শত মানুষ জেনারেল অরোরা ও
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪১

আমার সাথে আলিঙ্গন ও করমর্দন করতে লাগলেন এই সময় আমি ইচ্ছে করে সামান্য একটু পিছিয়ে পড়লাম। জেনারেল অরোরাকে একা পেয়ে জনতা আরো উত্তাল হয়ে উঠলেন। কার আগে কে অরোরাকে স্পর্শ করবেন, হাত মিলাবেন, বুকে বুক মেলাবেন, এই নিয়ে হুড়োহুড়ির তীব্র প্রতিযোগিতা লেগে গেল। চারদিকের জনতার চাপে অরোরার প্রাণ ওষ্ঠাগত। ভদ্রলোক ঘেমে নেয়ে উঠলেন এতেও জনতার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই, ক্লান্তি নেই, উৎসাহের তিল পরিমাণ ভাটা নেই। তারা মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সেনাপতির সাথে হাত মেলাবেনই। আলিঙ্গন করবেনই। তাতে যে দশাই হয় হউক। মিনিট দশেক আন্তরিকতার উষ্ণ আতিশয্যের অত্যাচারে অরোরার কাহিল অবস্থা দেখে আবার আস্তে আস্তে তার কাছাকাছি গেলাম। আমি তার কাছে এলে চাপ অনেকটা কমে এলো। অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরে এলো। আমরা আরও দশ মিনিট পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থেকে জনতার উষ্ণ আন্তরিক প্রাণঢালা স্পর্শ লাভ করলাম। এরপর আবার গাড়ীতে সার্কিট হাউসের দিকে ছুটলাম।
লেঃ জেনারেল অরোরা গাড়ীতে উঠেই বললেন, ‘আমি শুনেছি, এই শহরেই তোমার বাড়ী। আমি তোমার বাড়ী যেতে চাই। তোমার মা-বাবাকে দেখতে চাই।’
আরোরার অনুরোধে আমাদের পোড়াবাড়ীতে তাকে নিয়ে এলাম। জেনারেল গাড়ী থেকে নেমে কাউকে পথ দেখানোর সুযোগ না দিয়েই আমাদের বিধ্বস্ত বাড়ীর ভিতরে ঢুকে পড়লেন। আমি দৌড়ে তার সাথী হলাম। বাড়ীর ভিতর এসেই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মা কোথায়?’
গাড়ীর শব্দ শুনে মা ভাঙা টিনের ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ‘ঐ যে মা।’ অরোরা দৌড়ে গিয়ে মার পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। মায়ের পাশে বাবাও দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরিচয় করিয়ে দিতেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে বার বার পিঠ চাপড়ে ভাঙা বাংলায় বললেন, ‘আপনার ছেলে অনেক বড় আছে।’
অরোরা বাড়ীটা ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। বোনদের পরিবেশিত টাংগাইলের পোড়াবাড়ীর প্রসিদ্ধ চমচম দাঁড়িয়ে খেয়ে আমাকে নিয়ে সোজা সার্কিট হাউসের সামনে এলেন। বিদায় করমর্দন করে তাড়াহুড়ো করে হেলিকপ্টারে গিয়ে উঠলেন। কারও সাথে কোন কথা না বলে দ্রুত হেলিকপ্টারে উঠা দেখে যষ্ঠ বিহার রেজিমেন্টের অন্যান্য অফিসার ও জোয়ানদের মত আমিও খুবই বিশ্চিত হলাম। এটা সত্য, সেইদিন অরোরা টাংগাইল মুক্তি বাহিনী ও জনতার প্রাণ-মন মুগ্ধকর অকৃত্রিম আচরণে এতই মুগ্ধ ও সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে, যত তাড়াতাড়ি পারেন ঢাকা এবং সেখান থেকে কোলকাতায় ফিরে আমার সম্পর্কিত উদ্ভুত অনর্থক জটিল ব্যাপারটা ফয়সালা করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন।
মাত্র তিন ঘন্টার টাংগাইল সফর শেষে ঢাকায় ফিরে তিনি এক ভিন্ন চেহারায় আবিভূর্ত হলেন। দুপুরে খেতে খেতে শুধু টাংগাইলের মুক্তিযোদ্ধাদের ও আমার সম্পর্কে বার যার নানা ধরনের প্রশংসা করছিলেন, জেনারেল অরোরার প্রশংসার চোটে তার অধীনস্থ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪২

দু’একজন সেনাপতি মৃদু জিজ্ঞেস করনে, ‘স্যার, এত অল্প সময়ে কাদের সিদ্দিকী আপনাকে এত বড় যাদু কি করে করল?’
অরোরা নিঃসঙ্কোচে প্রাণখোলা হাসি হেসে তাদেরকে জানান, ‘যাদু সম্রাট পি. সি. সরকারের দেশের মানুষ তো। সিদ্দিকীও একটি জীবন্ত যাদু।’
এই সময় জেনারেল অরোরা তাদেরকে বার বার ধন্যবাদ দেন, যারা আমার গ্রেফতারের ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়ে তাকে সরজমিনে তদন্ত করতে অনুরোধ করেছিলেন। শোনা যায়, ঐ দিনই অরোরা ঢাকা থেকে কোলকাতা, কোলকাতা থেকে সোজা দিল্লীতে ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন এবং পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা তাঁর কাছে ব্যাখ্যা করেন। সব শুনে প্রধান মন্ত্রী নাকি বলেছিলেন, ‘আপনি উত্তম কাজই করেছেন। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ও প্রশাসন চালানোয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নেয়া মোটেই কল্যাণকর হবে না। এই ব্যাপারে দরকার পড়লে বাংলাদেশ সরকারের সাথে কথা বলা হবে।

সান সিং সম্বর্ধিত
২৪শে ডিসেম্বর বিকাল তিনটা। বিন্দুবাসিনী স্কুল ময়দানে মুক্তিবাহিনী আহুত ঐতিহাসিক জনসভা অনুষ্ঠিত হলো। সভায় লোক সমাগম হয়েছে আশাতীত। মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। তিল ধারনের স্থান নেই। মাঠের আশেপাশের দালান কোঠার ছাদ ভর্তি মানুষ আর মানুষ। মাঠের চারপাশে ও কাছেবিছের গাছগুলোও যেন মানুষের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। এই সভাতে আমি মার পাশে বসেছিলাম। ব্রিগেডিয়ার সান সিং মুক্তিবাহিনীর বিশেষ আমন্ত্রণে হাজির হয়েছেন। সভাটি দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হলো। প্রথম পর্ব ব্রিগেডিয়ার সান সিং এর সম্বর্ধনা এবং দ্বিতীয় পর্ব ব্রিগেডিয়ার সান সিং চলে যাওয়ার পর জনসভা।
ঘড়ির কাটার সাথে তাল রেখে তিনটায় ব্রিগেডিয়ার সান সিং বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠে এলেন। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমি সান সিংকে স্বাগত জানালাম। গণ পরিষদ সদস্যরা সভামঞ্চে বসে রইলেন। সান সিং সভামঞ্চে এলে কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই সমবেত জনতাকে ব্রিগেডিয়ার সান সিং-এর সাথে আমার পরিচয়, মুক্তিযুদ্ধে তিনি কিভাবে সাহায্য করেছেন সমস্ত কিছু তুলে ধরে টাংগাইলবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে তাকে অভিনন্দন জানালাম। এরপর সান সিংকে উদগ্রীব জনসাধারণের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলাম। ব্রিগেডিয়ার সান সিং বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে প্রথমেই লক্ষ জনতার সামনে আমার মা’র পা স্পর্শ করে সালাম করলেন। মা সামান্য অস্বস্তিবোধ করলেও সান সিং মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে অত্যন্ত সহজ, সরল বোধগম্য হিন্দিতে বললেন,
‘কাদের সিদ্দিকীর মত বীর সন্তানের যিনি জন্মদায়িনী, তার চরণ স্পর্শে আজ আমি ধন্য। আপনারা কাদের সিদ্দিকীর জেলার লোক। আপনাদের কাছে আসতে পেরে আমি গর্বিত। জুন মাসের শুরুতে যখন আমরা টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর প্রথম খবর পাই, তখন থেকে টাংগাইলবাসী
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৩

ও টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর প্রতি আমার এবং আমাদের একটা আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ গড়ে ওঠে। প্রথম প্রথম ঢাকার এত কাছে এত বড় একটা দূর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা শুনে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে না পারলেও, আগস্ট মাসে যখন কাদের সিদ্দিকীকে দেখি তখন আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। টাংগাইল মুক্তিবাহিনী ও কাদের সিদ্দিকীর ক্ষমতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে প্রতিদিনই আমাদের শ্রদ্ধা ও আস্থাবোধ বেড়ে চলেছিল। আমার দীর্ঘ দিনের সৈনিক জীবনে এত দ্রুত সুদক্ষ, সুসংহত ও সুসংগঠিত স্বেচ্ছাসৈনিক গড়ে তোলার মত ক্ষমতাসম্পন্ন এমন সুযোগ্য সংগঠক আর দেখিনি। স্বাভাবিক অনুকূল অবস্থার মধ্যেও এত বড় একটা সুশৃঙ্খল সংগঠন এত অল্প সময়ে গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কাদের সিদ্দিকী যা করেছেন, আগামী দিনে তা কারো পক্ষে করা সম্ভব হবে কি না, আমার জানা নেই। আপনারা কাদের সিদ্দিকীর জেলার লোক, আমি আপনাদেরকে নমস্কার জানাই, সালাম জানাই। আপনাদের অকুণ্ঠ ভালবাসা আমার বাকী সৈনিক জীবনের আনন্দ ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
জয় বাংলা, জয় হিন্দ, জয় মুক্তিবাহিনী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জিন্দাবাদ।’

সম্বর্ধনা শেষ ব্রিগেডিয়ার সান সিংকে আমরা সবাই রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম।
দ্বিতীয় পর্যায়ে কোরান ও গীতা পাঠের মাধ্যমে সভার কাজ শুরু হলো। সভায় কোন আনুষ্ঠানিক সভাপতি নেই। সভা শুরু হতে যাবে ঠিক এমন সময় সভামঞ্চের সোজাসুজি সামনে এক মহিলাকে উন্মাদের মত ছুটে আসতে দেখা গেল। সহযোদ্ধাদের বললাম, ‘দেখ, মহিলাটির কি হয়েছে? উনি কি বলতে চান? নিশ্চয়ই উনার কিছু বলার আছে।’
মাইক্রোফোন সামনে ছিল। কথাগুলো মাইক্রোফোনে ছড়িয়ে পড়লো, সভার লাখো মানুষের কানে। দায়িত্বশীল কয়েকজন সহযোদ্ধা দৌড়ে গিয়ে ভদ্রমহিলাটিকে সভাস্থল থেকে সরিয়ে নিল। পরে জানলাম, ঐ ভদ্রমহিলা বাসাইল থানার গণ-পরিষদ সদস্য শামসুদ্দীন আহমেদ বালু মোক্তারের স্ত্রী। উন্মাদিনীর মত ছুটে আসার কারণ, কয়েকদিন আগে তার স্বামীকে পাকিস্তানীদের সাথে সহযোগিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সভা পরিচালনা করছিলেন আনোয়ার-উল-আলম শহীদ। ২৪শে ডিসেম্বরের সভার প্রায় সমস্ত আয়োজন তত্ত্বাবধানে ছিলেন বাস এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী হবি মিঞা ও মোয়াজ্জেম হোসেন খান। সভার শুরুতে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে বক্তৃতা করলেন গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকী। আবদুল বাসেত সিদ্দিকী তার চিরাচরিত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গণ-পরিষদ সদস্যের চাইতে নিজেকে বার বার মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পরিচয় দিয়ে বক্তব্য পেশ করলেন। তিনি নিঁখুতভাবে যুদ্ধকালীন সময়ে আমার ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা ও সাহসিকতার ঘটনা এক এক করে জন সমক্ষে তুলে ধরলেন। উপরন্তু বাংলাদেশ সরকারের বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপের
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৪

কঠোর সমালোচনা করলেন। দ্বিতীয় বক্তা গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তিনি বললেন,
‘আমি টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর সূচনা করেছিলাম বটে কিন্তু আমি যা পারিনি, তা আমার ছোটভাই কাদের সিদ্দিকী পেরেছে। সেজন্য তাকে আমি ধন্যবাদ জানাই। নেতা হয়ে আমরা যা শুরু করেছিলাম, কর্মী হয়ে কাদের সেই আরদ্ধ কাজ নিষ্ঠা, সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে সুসম্পন্ন করেছে বলেই আজ সে নেতার আসনে আসীন হয়েছে। তাই তাকে নেতা বলে মেনে নিতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই বরঞ্চ আমি গর্ববোধ করি। কাদেরের মত যোগ্য নেতারই আজ আমাদের দেশে প্রয়োজন। দেশ স্বাধীন হয়েছে সত্য, এতে মুক্তিবাহিনীর কর্তব্য শেষ হয়ে গেছে, একথা ভাবলে ভুল করা হবে। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছিনিয়ে না আনা পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হতে পারে না। তাই মুক্তিবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত না করা পর্যন্ত অস্ত্র ত্যাগ করতে পারে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের স্বপক্ষে মুক্তিবাহিনী অস্ত্রধারণ করেছে। স্বাধীন বাংলায় আজ যদি পূর্বের অন্যায় অত্যাচার চলে, আর মুক্তিবাহিনী তা নীরবে সহ্য করে, তা হলে মুক্তিবাহিনী আর রাজাকারের মধ্যে আমি অন্তত কোন পার্থক্য খুঁজে পাবোনা। বঙ্গবন্ধুকে হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতেই হবে। মুক্তিবাহিনীকে পূর্বের চেয়ে আরো বেশী সুসংহত ও সুসংগঠিত থেকে সামাজিক সকল দুর্নীতি, অনাচার, অবিচারের মূলোৎপাটন
করতে হবে।’
এরপর গণ-পরিষদ সদস্য হাতেম আলী তালুকদার ও গণ-পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ বক্তৃতা করলেন। হাতেম আলী তালুকদার মুক্তিবাহিনীর প্রতি বার বার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন,
‘আমাদের পিঠের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে দিলেও মুক্তিবাহিনীর প্রতি পূর্ণ দায়িত্ব পালন করা হবে না।’
অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ পিঠের চামড়াকে বুকের চামড়ায় পরিবর্তন করে কাদো কাদো কণ্ঠে বললেন,
‘পিঠে কেন, আমরা বুকের চামড়া দিয়েও যদি মুক্তিবাহিনীকে জুতা বানিয়ে দিই, তাও তাদের ঋণ পরিশোধ হবে না।’
এরপর টাংগাইল-ময়ময়নসিংহ জোনাল কাউন্সিলের সভাপতি গণ-পরিষদ সদস্য শামসুর রহমান খান শাজাহান বক্তব্য রাখলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে এই তার প্রথম বক্তৃতা। অত্যন্ত সুন্দর চেহারা, সুললিত কণ্ঠস্বর, সংযত ও নিয়ন্ত্রিত নাটকীয় মুদ্রাভঙ্গির যাদুতে তার পূর্বের অনেক বক্তৃতার মতই এবারও জনতাকে মাতিয়ে তুললেন। তিনি পুনঃ পুনঃ মুক্তি বাহিনীর প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালেন। বিশেষ করে আমার প্রশংসায় তিনি তাঁর অভিধানের তুণ থেকে সমস্ত সুন্দর সুন্দর বিশেষণগুলো একের পর এক প্রয়োগ করলেন। স্বাধীনতা লাভের অব্যাহিত পরে টাংগাইলে এমন একটা অবস্থা বিরাজ করছিল যে, আমার
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৫

নামোল্লেখের সাথে জনতা হাততালিতে ফেটে পড়তেন। জনতাকে মাতিয়ে নাচিয়ে শামসুর রহমান খান শাজাহান তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন।

বেসামরিক প্রশাসন হস্তান্তর
সব শেষে আমি বক্তৃতা করতে দাড়ালাম।
‘উপস্থিত আমার মা, ভাই ও বোনেরা, আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি বিশেষ কয়েকটি সিদ্ধান্ত আপনাদের সামনে তুলে ধরতে। দীর্ঘ সময় ধরে আপনারা মাননীয় নেতাদের বক্তৃতা শুনেছেন৷ আমি তাই বক্তৃতা করতে চাই না। দেশ স্বাধীন হয়েছে। প্রতিটি মানুষের দ্বারপ্রান্তে স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দেয়া আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। রাজনৈতিক নেতারাই এই দায়িত্ব সুষ্ঠু এবং নিষ্ঠার সাথে পালন করতে সক্ষম বলে আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই বেসামরিক প্রশাসন চালানোয় সবচাইতে উপযুক্ত। আমরা তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজ এই মুহুর্ত থেকে বেসামরিক প্রশাসনের সমস্ত দায়িত্ব গণ-পরিষদ সদস্যদের হাতে তুলে দেয়া হবে। যেহেতু যুদ্ধকালীন অবস্থায় টাংগাইল ময়মনসিংহ নিয়ে একটি জোন গঠিত হয়েছিল এবং যার সভাপতি স্বনামধন্য গণ-পরিষদ সদস্য শামসুর রহমান খান শাজাহান। তাঁর উপরই টাংগাইলের বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা গণ-পরিষদ সদস্যদের সাথে মিলিত হয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এটা ঠিক করেছি। আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে, সাধারণ যে কোন আদেশ ও নির্দেশ গণ-পরিষদ সদস্যদের নেতা হিসাবে শামসুর রহমান খান শাজাহান দিলে মুক্তিবাহিনীসহ অন্যান্য সমস্ত প্রশাসন যন্ত্র তা নির্দ্বিধায় পালন করবে। তবে বিশেষ কোন নির্দেশনামা হলে, তা অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ গণ-পরিষদ সদস্যদের অনুমোদিত ও লিখিত হতে হবে। নীতি সংক্রান্ত কোন জটিল সমস্যা দেখা দিলে গণ-পরিষদ সদস্য এবং সমসংখ্যক মুক্তিবাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যক্তি একত্রিত হয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের ঐক্যমতের ভিত্তিতে কোন লিখিত নির্দেশ প্রদান করলে তা কার্যকরী করা হবে। কাউকে গ্রেফতার ও গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের মুক্তি, এ সমস্তই গণ-পরিষদ সদস্যদের ক্ষমতার আওতাভুক্ত। তবে দালাল ও রাজাকার হিসাবে কাউকে গ্রেফতার করতে বা গ্রেফতার করার তালিকা প্রস্তুতে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। গণ-পরিষদ সদস্যদের কাউন্সিল, তাদের সমস্ত ক্ষমতা মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে কার্যকরী করবেন। বিধিবদ্ধ যে কোন নির্দেশ, আদেশ বা অনুরোধ পালনে মুক্তিবাহিনী বাধ্য থাকবে।
যুদ্ধশেষে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর হাতে যে ষোল হাজার রাজাকার ও দালাল ধরা পড়েছে, তাদের এই মুহুর্তে মুক্তির আদেশ দেয়া হলো। পরর্তীতে এদের কাউকে গ্রেফতারের প্রয়োজন দেখা দিলে অবশ্যই তা করা হবে।
টাংগাইলবাসীর কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, শুধু রাজকার ছিল বা পাকিস্তানীদের সাথে থেকেছে, এই অপরাধে যেন কাউকে গ্রেফতার করা না হয়। যারা বাংলাদেশ চায়নি, তাদেরও স্বাধীন বাংলায় সুনাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাই হত্যা, লুট, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের প্রত্যক্ষ অভিযোগ ও প্রদান যাদের বিরুদ্ধে আছে, তাদেরকেই শুধু
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৬

বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় কারান। জনগণ এবং মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মার শান্তি এবং আহতদের আশু সুস্থতা কামনা করি। আল্লাহ্ আপনাদের মঙ্গল করুন। আপনাদের আবার সালাম জানিয়ে শেষ করছি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
জয় মুক্তিবাহিনী,জয় যৌথবাহিনী
ভারত-বাংলা মৈত্রী অমর হউক।’

বন্দী রাজাকারদের মুক্তি
২৪শে ডিসেম্বর বিকাল চারটা ত্রিশ মিনিট, বিশেষ করে টাংগাইলে বন্দী রাজাকারদের জন্য একটি স্মরণীয় মূহুর্তে আমি যখন বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে বক্তৃতা করছিলাম, তখন সেই বক্তৃতা ওয়ারেলেসে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিগুলোতে প্রচারিত হচ্ছিল। ২৪শে ডিসেম্বর সভা শুরুর আগেই রাজাকারদের আটকে রাখা শিবিরগুলোতে কমাণ্ডারদের লিখিত নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সভায় ঘোষণার সাথে সাথে যেন সমস্ত বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়। হলোও তাই। টাংগাইল বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে যখন ঘোষণা করলাম, সমস্ত রাজাকার ও দালালদের নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হলো। ঘোষণার সাথে সাথে প্রতিটি বন্দী শিবিরের বন্ধ কপাট খুলে দেয়া হলো, অবরোধ তুলে নেয়া হলো। টাংগাইল জেলখানার তালা খুলে গেলো। বিন্দুনবাসিনী স্কুল মাঠের বক্তৃতা বন্দী শিবিরের প্রতিটি রাজাকার- দালালরাও শুনেছিল। তারা এ ঘোষণায় আনন্দে ফেটে পড়ল। তাদের জীবনের কোন আশাই ছিল না, বাঁচার ক্ষীণতম আলোটুকুও ছিল না। মুক্তির এমন আকস্মিক ঘোষণায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়ল। এ কি স্বপ্ন। এ কি সত্য। ভাবনার ঘন তন্দ্রা কাটলে শরীরের সব শক্তি জড়ো করে গলা ফাটিয়ে পাগলের মত জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় কাদের সিদ্দিকী শ্লোগান দিতে লাগলো। ২৪শে ডিসেম্বর গভীর রাত পর্যন্ত রাজাকারদের দিগন্ত কাঁপানো বিরাহামহীন শ্লোগান শোনা গেল। পরবর্তী পর্যায় নিয়ে কোন বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় যাবো না বলে আমি এর শুভ ও অশুভ কোন দিক আলোচনা করছিনা। তবে এটুকু সত্য, মুক্তি দেয়া শতকরা আশি জন রাজাকার ছিল পরিবেশের চাপে বাধ্য। আর এও দেখা গেছে, মুক্তিপ্রাপ্ত রাজাকারদের আশি ভাগ পরবর্তী পর্যায়ে দেশ গঠনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে।
২৪শে ডিসেম্বর বেসামরিক প্রশাসন গণ-পরিষদ সদস্যদের হাতে তুলে দেয়ার আগে কর্ণেল ফজলুর রহমানকে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত করা হয়। পরের দিনগুলো খুব দ্রুততার সাথে এগুতে থাকলো। বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব গণ-পরিষদ সদস্যদের হাতে তুলে দিয়ে আমরা অনেকটা হাল্কা হলাম। মুক্তিবাহিনীকে ভালভাবে সুসংগঠিত করে তুলতে ও তাদের মানসিকতা খুঁটিয়ে দেখতে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার সাথে মিলিত হলাম। এই সময় কিছু মুক্তিযোদ্ধার মনে দুঃখবোধ লক্ষ্য করলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃখ হলো, তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হতে না হতেই মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। তাদের আক্ষেপ, দেশের জন্য কিছুই করতে পারলোনা। বিশেষ করে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৭

তুরাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় দেড় হাজার মুক্তিযোদ্ধা ১২-১৩ই ডিসেম্বর টাংগাইলে পৌছে সত্যিকার অর্থেই সামর্থ্য ও আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা কোন যুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি। তবে অনেক মুক্তিযোদ্ধার ধারণা ছিল, বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে তাদের হয়তো আর একবার লড়াই করতে হবে। এই নতুন সহযোদ্ধাদের বেশী বেশী সান্নিধ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, যুদ্ধ শুধু অস্ত্র দিয়ে নয়, কাস্তে-হাতুড়ী লাঙ্গল-কোদাল নিয়েও করা যায়। দেশ মুক্ত করার যুদ্ধের চেয়ে দেশ গঠনের যুদ্ধ কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং বেশী। তোমরা প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওনি বলে নিজেদের ছোট ভাবার কোন কারণ নেই। সুখী সমৃদ্ধ, শোষণহীন রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনের সংগ্রামে তোমাদের সামনে খোলা রয়েছে বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র।

প্রধানমন্ত্রী সকাশে
২৮শে ডিসেম্বর দুপুর। একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার টাংগাইল সার্কিট হাউসের সামনে অবতরণ করল। একটু পরেই আমাকে নিয়ে হেলিকপ্টার আবার দক্ষিণে ঢাকার দিকে উড়ে চলল। টাংগাইলের অনেক মুক্তিযোদ্ধা জানতে পারলোনা, আমি কোথায় যাচ্ছি? কেন যাচ্ছি। ভারতীয় হেলিকপ্টার তেজগাঁ সামরিক বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করলে মেজর জেনারেল বি. এন সরকার, মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সান সিং এবং একমাত্র সহযোদ্ধা মাসুদ সহ হেলিকপ্টার থেকে বের হলাম। প্রথমে আমরা ১৪তম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার অফিসার মেসে খাবার খেলাম। খাওয়া শেষে বেইলী রোডের সেন্ট্রাল সার্কিট হাউজে এলাম। সেন্ট্রাল হাউজে আমার এই প্রথম পদার্পণ।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকা এলেই বেইলী রোডের সেন্ট্রাল সার্কিট হাউজেই থাকতেন। বেছে বেছে কেন যেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সবচেয়ে পছন্দের ও বেশী ব্যবহৃত দুইটি রুমও আমাকে দেয়া হলো।
বিকেল চারটা ত্রিশ মিনিটে জেনারেলরা আমার সাথে মিলিত হলেন। পরবর্তী কর্মসূচী বাংলাদেশ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ। বেইলী রোডের সেন্ট্রাল সার্কিট হাউজ থেকে আমাদের নিয়ে নৌবাহিনীর মস্ত বড় সাদা একখানা শেভ্রলেট কার কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের দিকে এগিয়ে চললো। সচিবালয়ের প্রধান ফটকে গাড়ী থামলো। গাড়ী থামতেই চার-পাঁচ জন বেসামরিক অফিসার আমাদের স্বাগত জানালেন এবং সাথে সাথে দোতলায় প্রধানমন্ত্রীর অফিস ঘরে নিয়ে গেলেন। ভারতীয় সেনা বাহিনীর তিন সেনাপতি ও আমি প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঢুকে প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন করলাম। প্রধানমন্ত্রী চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে অভিবাদনের জবাব দিলেন এবং আমাদের বসতে বললেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর ঘরে আরো একজন বসেছিলেন। আমরা বসলে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দীন আহমেদ অন্য লোকটির সাথে মিনিট দুইয়েক কথা শেষ করে বিদায় নিলে ভারতীয় সেনাপতিদেরও একটু বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। তারা বাইরে গেলে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার নিভৃতে কথা হলো।
প্রধানমন্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে এলে চার-পাঁচ জন সংবাদিক আমাকে ঘিরে ধরলেন। কারণ, আমার গ্রেফতারী পরোয়ানা নিয়ে হৈ চৈ, এত ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হয়েছিল যে, প্রায় সারা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৮

দেশেই প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল, ‘তাজুদ্দীন সাহেব ষড়যন্ত্র করেই কাদের সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেছেন।’ সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন,
– প্রধামন্ত্রীর সাথে আপনার কি বিষয়ে কথা হলো?
– অনেক বিষয়েই তাজুদ্দীন ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে।
– আলোচনার পরিবেশ কেমন ছিল?
– সৌহার্দ্যপূর্ণ।
– আপনি কি প্রধানমন্ত্রীকে আপনার গ্রেফতারী পরোয়ানা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলেন?
– না।
– কেন?
– আমি মনে করি, এভাবে জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজন নেই।
– প্রধানমন্ত্রী আপনাকে কেন গ্রেফতার করার নির্দেশ দিলেন? তার সঙ্গে আপনার দেখা হলো অথচ জিজ্ঞেস করলেন না বা উনিও আপনাকে কিছু বললেন না, এটা কি করে সম্ভব?
– প্রধানমন্ত্রীই যে আমাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। আমরা জানি, পরাজিত শত্রুরা সর্বস্তরে, সর্বক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে সক্রিয় হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চায় আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করি, যাতে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ধ্বংস হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী যদি আমার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করেও থাকেন, তবুও আমি মনে করবো, শত্রুরা তাকে ভুল বুঝিয়েছিল। গ্রেফতার সম্পর্কে এখন কোন কথাই উঠতে পারে না। ব্যাপারটার উদ্ভব যেমন আকস্মিক, তেমনি তার তাৎক্ষনিক ফয়সালাও হয়ে গেছে।
– তবে কি আপনি মনে করেন, একজন কৃতি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আপনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারীতে প্রধানমন্ত্রীর কোন দায়-দায়িত্ব নেই?
– নিশ্চয়ও আছে। তবে এই ব্যাপারে আমি তাজুদ্দীন ভাইকে মোটেই দায়ী করবোনা।
– আচ্ছা, আপনারা নাকি তাজুদ্দীন সাহেবের হাতে অস্ত্র জমা দেবেন না?
– অস্ত্র জমা দেয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার কোন কথা হয়নি।
– তবে কি আপনারা অস্ত্র জমা দেবেন না।
– সব সময় সব যুদ্ধে অস্ত্রের দরকার পড়েনা।

বঙ্গভবনে
সচিবালয় থেকে সোজা বঙ্গভবন। উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। পৌঁছানোর সাথে সাথে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ারদের বার বার বললেন, ‘আমার দাদুভাই কত বড় হয়ে গেছে।’ উষ্ণ আলিঙ্গন শেষে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৯

মিত্রবাহিনীর সেনানায়কদের সামনেই আমাদের অনেক কথাবার্তা হলো। নজরুল ইসলাম সাহেব বার বার বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতির কথা বললেন এবং যুদ্ধকালীন নয় মাসের প্রবাসী সরকারের কিছু কিছু মধুর স্মৃতিচারণ করলেন। আলাপের শেষ পর্যায়ে তিনি আমাকে অন্দরমহলে গিয়ে তাঁর স্ত্রীর সাথে দেখা করতে বললেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের স্ত্রী এমন এক ধার্মিক, বিদুষী ও স্নেহপ্রবণ মহিলা, যিনি যুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিদিন নামাজ পড়ে তার স্বামী ও ছেলেমেয়েদের যতবার মঙ্গল কামনা করতেন ঠিক ততবারই বোধহয় আমার মঙ্গল কামনা করেছেন। আমি তাকে দাদী বলে ডাকি। দাদী উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে বলতেন, ‘তোমরা কোলকাতায় নিরাপদ আছো। আর আমার নাতিটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছ। ওকে আমার কাছে এনে দাও। আমাদের পরিবারের সাথে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের পরিবারের কোন আত্মীয়তা নেই। অনাত্মীয় যে আত্মীয়ের বেশী হতে পারে, এটা তার জ্বলন্ত নিদর্শন। বাড়ীর ভিতরে গিয়ে দাদীকে পা ছুঁয়ে ছালাম করলাম। সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্ত্রী ছোটো-খাটো খুব সুন্দর পুতুলের মত নিরীহ নিষ্পাপ, সাদাসিদে মহিলা। আনন্দে, খুশীতে, উচ্ছ্বাসে ছয় ফুট লম্বা নাতিকে কোলে নিতে চাইলেন। এত আনন্দের মাঝেও তিনি বার বার কেঁদে ফেললেন। নজরুল সাহেবের ছোট দুই মেয়ে রুপা ও লিলি। তারাও মায়ের আঁচল ধরে মাঝে-মধ্যে আমাকে ধরে নাচানাচি করতে লাগলো। বহুদিন পর দেখা হওয়াতে অনেক মধুর স্মৃতিচারণ হলো। দাদী রাতের খাবার খেতে বললেন। রাতের খাবার খেতে রাজী হয়ে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে এলাম। মেজর জেনারেল বি. এন. সরকার, মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সান সিং ও আমি বঙ্গভবন থেকে বেরোতেই প্রচণ্ড গতিতে তিন-চারটি জীপ ভয়ঙ্কর শব্দ করে আমাদের সামনে থেমে গেল। কিছু বুঝবার আগেই খোলা জীপ থেকে পঁচিশ-ত্রিশ জন লাফিয়ে পড়লো। মিত্রবাহিনীর সেনানায়করা ও আমি নিজেও কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেলাম। ভালো করে দেখে বুঝতে পারলাম এরা আমার দলেরই যোদ্ধা। গাড়ীর দরোজা খুলে বের হতেই ক্যাপ্টেন সবুর, মেজর হাবিব, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, নুরুন্নবী ও অধ্যাপক রফিক আজাদ দৌড়ে এলো। জিজ্ঞেস করলাম,
– তোমরা এখানে কেন? আর এভাবে হুড়মুড়িয়ে এসে বাড়ীর সামনে দাঁড়ালে কেন? সবুর কাঁদো কাঁদো ভাবে বললো,
– স্যার, আমাগোরে কোন দোষ নাই। আমরা খবর পাইলাম, আপনারে ঢাকায় নিয়া আইছে, আটকাইয়া রাখছে। তাই আমি দল নিয়া আইস্যা পড়ছি।
এ সময় আনোয়ার-উল-আলম শহীদ বললেন, ‘হ্যাঁ, ওরা প্রায় পঞ্চাশ-ষাট গাড়ী বোঝাই হয়ে ছুটে এসেছে। এদিক-ওদিক ঘুরছিল। পথে আমার সাথে দেখা। সবুরের কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিস, মিলিটারী হেড-কোয়ার্টার ও বঙ্গভবনে ফোনে খবর নিই। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে জানানো হয়, আপনি সেখানে গিয়েছিলেন, তবে বেরিয়ে গেছেন। এরপর সবুরকে তার দলবল সহ শেরে বাংলা নগরের পাশে রাখতে বলে আরো খোঁজখবর
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫০

নেবার চেষ্টা করি। বঙ্গভবনে ফোন করলে তারা জানালো, আপনি উপরাষ্ট্রপতির সথে কথা বলছেন। খবর পেয়ে সবুরকে নিয়ে আমিই এখানে এসেছি।’
এরপর আর রাস্তায় কোন কথা হলোনা। সবাই সেন্ট্রাল সার্কিট হাউজে এলাম। সেন্ট্রাল সার্কিট হাউজে পৌঁছে দিয়ে ভারতীয় সেনাপতিরা চলে গেলেন। সহযোদ্ধাদের সবাইর জন্য মিষ্টি ও কিছু হাল্কা খাবারের ব্যবস্থা হলো। এই সময় টি. ভি, কেন্দ্র থেকে মামুনুর রশিদ ও তার ভগ্নিপতি মোয়াজ্জেম হোসেন খান এসে হাজির। মোয়াজ্জেম হোসেন খানেরও সেই একই কথা,
‘স্যার, বার বার এই সমস্ত কি শুনি? এর একটা বিহিত অবশ্যই করতে হবে।
সবাইকে বেশ জোরের সাথে বললাম,
‘সব সময় সন্দেহ নিয়ে থাকলে হয় না। আমাদের প্রচুর শত্রু আছে। তারা গুজব ছড়াবেই। গুজবে এত তাড়িত হলে আমাদের খুবই ক্ষতি হবে। সবুরকেও নানাভাবে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়া হলো। সবাইকে খাইয়ে নিজে শেরে বাংলা নগরে গিয়ে অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সাথে দেখা করে তাদের টাংগাইল ফিরে যেতে বললাম।

আবার ষড়যন্ত্র : মুক্তিযোদ্ধা খুন
খন্দকার আবদুল বাতেনের লোকদের সাথে মুক্তিবাহিনীর আরও একবার বিরোধ হলো। টাংগাইল মুক্ত হলে স্বাভাবিক কারণে বেশীসংখ্যক মুক্তিবাহিনীর কোম্পানীগুলো টাংগাইল শহর, শহরের আশে-পাশে এবং থানাগুলোতে অবস্থান করছিল। মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট কিছু দল তখনও তাদের পুরানো অবস্থানগুলোতে ছিল। এমনি একটি ষাট-সত্তর জনের দল লাউহাটিতে অবস্থান করছিল। ২৮শে ডিসেম্বর রাতে খন্দকার আবদুল বাতেনের সহযোগী কয়েকজন যুবক টাংগাইল-লাউহাটির পথে মুক্তিবাহিনীর নিরস্ত্র তিনজন দূতের উপর আচমকা হামলা করে। এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর একজন দূত মারা যায় এবং দুইজন গুরুতর আহত হয়। লাউহাটিতে তখন বড় চওনার ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ছিল। নিহত যোদ্ধাটি ও সেখানে অবস্থানরত অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ী পাহাড় অঞ্চলে হওয়ায় অসস্তোষ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়লো। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস সেই রাতে কেদারপুর, ফাজিলহাটি, দেলদুয়ার ও নাগরপুরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের জরুরী ভিত্তিতে লাউহাটিতে সমবেত করে। গভীর রাতে লাউহাটির এ খবর টাংগাইল এলে, ক্যাপ্টেন সবুর খান ও আরো বেশ কয়েকজন দুর্ধর্ষ দুঃসাহসী কমাণ্ডার এবং প্রায় দু’ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান রাতারাতি লাউহাটি পৌঁছেন এবং বাতেনের দলের অবস্থান সন্দেহ করে কেদারপুরের দক্ষিণে বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘিরে ফেলেন। ২৯শে ডিসেম্বর সকালে মিত্রবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এই উদ্বেগজনক খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি ঢাকা থেকে টাংগাইল ফিরে এলাম। মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে গিয়ে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান ও অন্যান্য কমাণ্ডারদের সাথে বেতারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। মিত্র- বাহিনীকে অনুরোধ করে দুই কোম্পানী সৈন্য লাউহাটির ঘঠনাস্থলে পাঠিয়ে দিলাম। অনেক চেষ্টার
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫ ১

পর ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের সঙ্গে বেতারে যোগাযোগ হলে তাকে কঠোর নির্দেশ দিলাম, ‘যে যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় যেন তাৎক্ষণিকভাবে টাংগাইল ফিরে আসে। কোনক্রমেই যেন একটি গুলিও না চলে।’ জবাবে ব্রিগেডিয়ার ফজলু জানালেন, ‘আমাদের দুইজন মারাত্মক ভাবে জখম হয়েছে। একজন মারা গেছে। এর আগেও এরা লাবিবুর রহমান ও জাহাঙ্গীরকে নৃশংস- ভাবে হত্যা করেছে। এদের যদি শায়েস্তা করা না হয়, তাহলে এরা আরো অসংখ্য অঘটন ঘটাবে এবং তার শিকার বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই হতে হবে।’
এর পরও ব্রিগেডিয়ারকে টাংগাইলে ফিরে আসতে নির্দেশ দিলাম। মিত্রবাহিনীর দুইটি কোম্পানী লাউহাটি–কেদারপর পৌছলে, সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা টাংগাইল ফিরে এলো।
লাউহাটি থেকে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সবাই রাগে, ক্ষোভে ও উত্তেজনায় ফেটে পড়ে নিহত বন্ধুর লাশ দেখিয়ে আমাকে বলল, ‘আপনি এর বিহিত করতে না দিলে, পরিণতি ভয়াবহ হবে। আমরা দিনের পর দিন এমনি অন্যায় হত্যার শিকার হতে পারবোনা, নির্মম গুপ্তহত্যা আমরা সহ্য করবোনা।’
সহযোদ্ধাদের মনোভাব উপলব্ধি করে দৃঢ়তার সাথে বললাম, ‘যুদ্ধ-নৈপুণ্য ও অপূর্ব সাহসিকতার জন্য আমি তোমাদের সব সময় প্রশংসা করেছি এবং করবও। তবে উদ্ভুত পরিস্থিতি তোমরা যেভাবে মোকাবেলা করতে চাইছো, তা মোটেই সমর্থন করতে পারবোনা। একজন সহযোদ্ধার মৃত্যু ও দুইজন গুরুতর আহত হওয়ায় তোমাদের মত আমিও ব্যথিত। এই সমস্ত ঘৃণ্য লোকদের প্রতি ঘৃণায় আমার অন্তরও ভরে আছে। কিন্তু উপায় নেই। ক্ষমতা হাতে পেয়ে আমরা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারিনা। ২৪শে ডিসেম্বর বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব গণ- পরিষদ সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়ার পর ইচ্ছে করলেই আমরা যত্রতত্র অভিযান পরিচালনা করতে পারিনা। আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে, আমরা নিয়মনীতি ন্যায়সঙ্গত বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করলে পরিণাম মারাত্মক হবে। আমরা চেষ্টা করব, যেকোন ভাবেই হউক সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই সমস্যার সমাধান করতে।
যদিও আমরা কথাগুলো মুক্তিযোদ্ধারা আন্তরিকভাবে মেনে নিতে পারলোনা। তবুও আমার অনুরোধ তারা মেনে নেল।
এই সময় টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর এক উল্লেখযোগ্য স্মরনীয় ঘটনা হলো, দৈনিক পূর্বদেশে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর উপর একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ। ক্রোড়পত্র প্রকাশের জন্য অধ্যাপক রফিক আজাদ, অধ্যাপক মাহবুব সাদিক, অধ্যাপক আতোয়ার কাজী, বুলবুল খান মাহবুব, অধ্যাপক মুশফিকুর রহমান, ফারুক আহমেদ, সৈয়দ নুরু, সোহরাব আলী খান আরজু, মামুনুর রশিদ, ছোট রফিক ও আরো বেশ কয়েজন পুরো এক সপ্তাহ নিরলসভাবে কাজ করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫২

আশা-আকাঙ্খার নতুন বছর

সত্তর দশকের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য উজ্জ্বল ঘটনাবহুল একটি বছর, এক নদী রক্তে একটি স্বাধীন জাতির অভ্যুদয়ের বছর আপন মহিমা, ঐশ্বর্য্য ও ঐতিহ্য নিয়ে সংযোজিত হলো ইতিহাসের পাতায়। মহাকাল অতীতের অনেক গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক অধ্যায়ের মতই ৭১ সালকেও তার বুকে ঠাই করে দিল, আর তাঁর অনস্ত-অসীম গর্ভ থেকে উপহার দিল মানব জাতির জন্য একটি সম্ভাবনাময় নতুন বছর, ‘৭২’। বাংলার প্রতিটি মানুষের মনে ‘৭২’ শুভ হওয়ার শুভ প্রার্থনা। একাত্তরের মত নিষ্পাপ শিশুর ক্রন্দনরোল যেন আর কোনদিন বাংলার আকাশ- বাতাস ব্যথিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ না হয়, অবলা-অসহায় নারী যেন আর কোনদিন কোন দেশে কোন বাহিনীর সংঘবদ্ধ পাশবিক অত্যাচারের নির্মম শিকার না হয়, নিরীহ নিরপরাধ শান্তিপ্রিয় জনগণের পবিত্র রক্তের সাগরে যেন কোনদিন আর কোন সংগঠিত খুনীদল পাশবিক উল্লাসে স্নান করতে না পারে। যে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ বাংলাদেশের বুকের পাঁজর ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, সেই কালরাত্রি যেন আর কখনও বিশ্বের কোন জাতির জীবনে ফিরে না আসে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। আমাদের দেয়া সময়সীমাও পেরিয়ে গেল অথচ কোন শুভ সুচনা পরিলক্ষিত হলো না, আমি উদ্বিগ্ন ও কিছুটা শঙ্কিত। মনে প্রশ্ন ‘৭২ সালকে স্বাগত জানাবো কোন ভাষায়?
‘৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর থেকে ডিসেম্বরের শেষ দিন পর্যন্ত সারা বিশ্বের অসংখ্য সাংবাদিকের কাছে আলাদা আলাদা সাক্ষাৎকার দিয়েছি। প্রত্যেকের কাছে বলেছি, ‘আপনারা পাকিস্তানের শাসক ও মুরুব্বীদের বুঝান, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে এক মুহুর্ত আটকে রাখার কোন নৈতিক অধিকার তাদের নেই। বঙ্গবন্ধুকে আটকে রাখলে বা তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে।’
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দেবার দাবী জানালো। ফলাও করে প্রচার করল বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে না দেয়ার প্রতিক্রিয়া কি হবে তা। এতো কিছুর পরও পাক-শাসকদের শুভ বুদ্ধির উদয় হলোনা। পরিবর্তন যে হলোনা তাও নয়৷ রক্তপিপাসু জল্লাদ ইয়াহিয়া পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছে, স্থলাভিষিক্ত হয়েছে বাংলার গণ-হত্যার অন্যতম খলনায়ক জুলফিকার আলী ভুট্টো।
নতুন বছরের প্রথম তিন-চার দিন ব্যতিক্রমহীনভাবে কাটলো। টেলিফোনে ঢাকায় জেনারেল বি. এন. সরকার ও কলকাতায় জেনারেল আরোরার সাথে যোগাযোগ রাখছিলাম। নুরুন্নবী, মামুনুর রশিদ, নাজির হোসেন পিন্টু ও আরো কুড়ি-পঁচিশ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ঢাকায়
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৩

রাখা হলো। তাদের দায়িত্ব প্রতিটি বিদেশী সাংবাদিক ও বিদেশী সাংবাদ সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখা এবং বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ খবর জানার চেষ্টা করা। ‘৭১ সালের ২০শে ডিসেম্বর থেকে ‘৭২ সালের ৮ই জানুয়ারী, এমন কোনদিন যায়নি যে কোন বিদেশী সাংবাদিক অথবা সংবাদ সংস্থাকে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর তথ্য বিভাগের সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ সংবাদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেনি। অনেক সময় সাংবাদিকরা মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্ন শুনে হতবাক হয়েছেন। তারা এসেছেন খবর সংগ্রহ করতে, আর বিমান বন্দরে নামার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারাই তাদের কাছে খবর সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এ রকম ব্যতিক্রম পৃথিবীতে খুব কমই ঘটে।

বড় ভাইয়ের দুঃখজনক আচরণ
৫ই জানুয়ারী টাংগাইল নিরালার মোড়ে বড় ভাইকে নিয়ে এর অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলো। গোড়াই কটন মিলের শ্রমিকদের দেবেন বলে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী দুইদিন ধরে ত্রিশ হাজার টাকা চাইছিলেন। টাকা দেয়ার ইচ্ছা ছিল না বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। টাকা দেয়ার অসুবিধাও ছিল। মাত্র চার-পাঁচ দিন আগে চাহিদা মত বড় ভাইকে মুক্তিবাহিনীর তহবিল থেকে কুড়ি হাজার টাকা দেয়া হয়েছিল। এর পরও যখন তিনি পরে ফেরত দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরো বিশ হাজার টাকা চান, তখন কিছুটা অস্বস্থিতে পড়লাম। এসময় লতিফ সিদ্দিকী কেন, কোন সিদ্দিকীই যে টাকা ফেরত দেবেন না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। লিখিত নির্দেশ ছাড়া এ পয়সাও মুক্তিবাহিনীর তহবিল থেকে বের করার কোন উপায় ছিল না। বড় ভাইকে আরো টাকা নিতে পারি কিনা এ নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আমি চাইছিলাম, যেহেতু সরাসরি না করতে পারবোনা, সেইহেতু তার কাছে ধরাও দেবোনা। ৫ই জানুয়ারী সকাল সাড়ে দশটায় ভিক্টোরিয়া রোডে মুক্তি বাহিনীর প্রশাসনিক দপ্তরে গেলাম। অফিসে প্রবেশের কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি ফোন আসে। ফোনটি ধরলো হামিদুল হক মোহন। অপর প্রাপ্তে গণ-পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী,
– কাদের ওখানে আছে?
মোহন ফোনের রিসিভার চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গণ-পরিষদ সদস্য সাহেবকে কি উত্তর দেব?’ এড়িয়ে বাবার উদ্দেশ্যে মোহনকে বললাম, ‘আপনি বলে দিন, তিনি নেই, দোহন বলে দিল,
– তিনি নেই।
নেই বললে কি হবে? আমি যখন ঢুকছিলাম তখন গণ-পরিষদ সদস্য বড় ভাই লাতিফ সিদ্দিকী জোনাল কাউন্সিলের দোতলা থেকে লক্ষ্য করেছিলেন। মোহনের কাছে জবাব পেয়ে, সোজা দোতলা থেকে নেমে মুক্তিবাহিনীর প্রশাসনিক অফিসের দিকে পা বাড়ালেন। আমিও কাগমারী কলেজে যাবার জন্য অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ীতে উঠতে যাব, ঠিক এ-সময় বড়তাই ‘আহত বাঘের মত হুক্কার ছাড়লেন। তিনি সংযম, শালীনতা ও পরিমিতিবোধ হারিয়ে ফেলে উন্মাদের মত চিৎকার করে বললেন, ‘তোমরা দালাল, দালাল পুষছ। মোহনের মত দালালকে তোমরা জায়গা দিয়েছ। তোমাদের চেয়ে রাজাকারও ঢের ভাল।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৪

গালাগালির মাত্রা ও ভাষা এর চাইতে হাজার গুণ অসংযত, অশ্লীল ও কঠোর ছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সামনাসামনি এই পর্যন্ত কেউ এইভাবে আমাকে গালাগাল করতে পারেনি। সহযোদ্ধারা কল্পনাতেই আনতে পারেনি, আমাকে কেউ গালি দিতে পারে, তাও এ- ভাবে। কিন্তু না, আমাকে লোমচর্মসার একটি অপ্রয়োজনীয় তুচ্ছ কুকুর জ্ঞান করে এক নাগাড়ে প্রায় আধঘণ্টা বিকারগ্রস্তের যত গালাগালি করে গেলেন। দুঃখে, ক্ষোভে, অভিমান-অপমানে থরথর করে কাপলেও, চোখ দিয়ে পানি এসে গেলেও, নিজেকে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত রাখলাম। পাশে কুড়ি-পঁচিশ জন সশস্ত্র যোদ্ধা। যারা আমার জন্য যে কোন মুহূর্তে যে কোন পরিস্থিতিতে যে কোন শক্তিশালী শত্রুর সঙ্গে লড়ে জীবন দিতে পারে। তারাও মারণাস্ত্র হাতে মাথা নীচু করে অসহায়ের মতো নীরবে কাঁদল। তারা বুঝল, সব জায়গায় সব ক্ষেত্রে অস্ত্রই শক্তির উৎস নয়। দীর্ঘ সময় একতরফা গালিগালাজ করে বড় ভাইয়ের ক্রোধানল স্তিমিত হলে ক্ষোভে-অভিমানে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললাম, ‘আপনার আজকের আচরণ গুরুতর অশোভন। আমরা রক্তের দামে স্বাধীনতা কিনেছি। দালালদের জায়গা আমাদের ঘরে নয়। যাদের স্বাধীনতা অর্জনে কোন অবদান নেই, বিন্দুমাত্র ত্যাগ নেই, দালাল রাজাকারদের স্থান তাদের ঘরে। মোহনকে অন্য কিছুতে আখ্যায়িত করলে হয়তো বিকাবে, কিন্তু দালাল বলে নয়। মোহন বাংলা ছাত্র-ইউনিয়নের টাঙ্গাইল জেলার সভাপতি। আন্দোলনের শুরুতে যেমন আমাদের পক্ষে কাজ করেছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের শেষের তিন-চার মাস সে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আমাকে গালাগালির জন্য আমি অসন্তুষ্ট না হলেও, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপমানিত করায় আমি ব্যধিত ও ক্ষুব্ধ। আপনি ভবিষ্যতে এই ধরনের আচরণ করলে, নিয়মত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
লতিফ সিদ্দিকী ও দমবার পাত্র নন। তিনি এর পরও নানা ধরনের উচ্চারণের অযোগ্য ভাষা ব্যবহার করে রাগে গরগর করতে করতে তার অস্থায়ী আবাসস্থল টাংগাইল জেলা কাউন্সিল বাংলোর দিকে চলে গেলেন। এই অপ্রীতিকর দুঃখজনক ঘটনার পর থেকে বড় ভাই দীর্ঘদিন মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডের সংস্পর্শ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন।
কোন কাজে তাকে না ডাকলে তিনি আসা যাওয়া ছেড়ে দিলেন। অনেক সময় এই ক্ষোভের কারণ তিনি অযৌক্তিকভাবে আমার কোন অবদানই স্বীকার করতেন না। যদিও কোনদিন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেনি বা অন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখতে চাইলে তা মোটেই সহ্য করেননি। টাংগাইল ও দেশের অনেক মানুষই বড় ভাইয়ের বেমানান অসুন্দর আচরণের মধ্যে আমার প্রতি তার হিংসা আবিষ্কার করতে এবং ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষের বহিঃপ্রকাশ বলে ব্যাখ্যা দিতে পিছপা হননি। অনেকে আবার প্রকাশ্যেই বলা শুরু করেন, নিজে যা পারেননি, ছোট ভাই হয়ে কাদের সিদ্দিকী তা করেছে বলে লতিফ সিদ্দিকী সহ্য করতে পারছেননা।’
কেন এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে, সে অন্য কথা, অন্য বিশ্লেষণ, অন্য আঙ্গিকে তা দেখা যাবে। বড় ভাই চলে গেলে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে টাংগাইল ওয়াপদা ডাকবাংলোয় ফিরে ঘরের
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৫

দরোজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম। অন্যদিকে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার খবর দ্বিগুণ রং ও আকার নিয়ে ততক্ষণে সারা টাংগাইলে ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিবাহিনীর কারও ঘটনাটি জানতে বাকী নেই। সকাল সাড়ে এগারটায় কাগমারী কলেজে যাওয়ার কথা ছিল। কাগমারী কলেজে তখন প্রায় আঠারশ মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটি গেড়ে ছিল। এরা সবাই ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে এবং অধিকাংশই বড় কোন যুদ্ধে অংশ নেয়ার সুযোগ পায়নি। এই আঠারশ মুক্তিযোদ্ধারা বড় তিনটি কোম্পানীতে বিভক্ত ছিল। তিনটি দলের নেতৃত্বে ছিল যথাক্রমে টাংগাইল থানা পাড়ার আনোয়ার-উল হক তালুকদার সেলিম, মহেলার দুদুর ভাই তোফাজ্জল ও লাউহাটির একজন কোম্পানী কমাণ্ডার। কাগমারী কলেজে মুক্তিযোদ্ধারা আমার সেখানে যাওয়ার প্রত্যাশায় রয়েছে। কথা ছিল তারা আমাকে সশস্ত্র অভিবাদন জানাবে এবং একসাথে দুপুরের খাবার খাবে। সব কিছু প্রস্তুত, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু প্রত্যাশিত অতিথির দেখা নেই। কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে তারা বার বার মুক্তিবাহিনীর প্রশাসনিক দপ্তর ও সামরিক সদর দপ্তরে টেলিফোনে খোঁজখবর নিচ্ছিল। একদিকে এনায়েত করিম, অন্যদিকে মোয়াজ্জেম হোসেন খান শত চেষ্টা করেও কাগমারীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমার সর্বশেষ সংবাদ জানাতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধারাও নিরালার মোড়ের ঘটনা জেনে গেছে। তাই তারা আরো বেশী উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত। দেশ স্বাধীন হতে না হতেই নেতৃস্থানীয় একজন গণপরিষদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও অপমান করলেন। উপরন্তু হয়তো এই কারণে তারা আমার সান্নিধ্য লাভ থেকে বঞ্চিত হলো, তাদের সকল ব্যাকুলতা ও প্রস্তুতি বিফলে গেল। কিন্তু না, তাদেরকে বঞ্চিত হতে হয়নি।
আধঘন্টা পর দরজা খুলতেই উপস্থিত সবাই সচকিত হয়ে গেল। শহীদ সাহেব প্রায় আধঘন্টা ধরে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বাইরে অপেক্ষা কছিলেন। শহীদ সাহেবকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ব্যাপার? আপনি এখানে?’
শহীদ সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তিনি কি বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একটা কিছু লুকোতে গিয়ে হঠাৎ ধরা পরেছেন এমনি একটি পরিস্থিতিতে তাড়াতাড়ি অজুহাত দেয়ার মত বললেন, ‘আপনার কাগমারী কলেজে যাওয়ার কথা ছিল। আমিও সাথে যাব। তাই এসেছি।’
ঘড়ির দিকে তাকালাম। নির্ধারিত সময়ের পঁয়তাল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। শহীদ সাহেবকে নিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ীতে উঠে ক্যাপ্টেন ফজলুল হককে গাড়ী চালাতে বললাম। এতক্ষণ যে অস্বাভাবিক অস্বস্তিকর যন্ত্রণাদায়ক গভীর নীরবতা ও বিশ্রী থমথমে ভাব ছিল, তা ধীরে ধীরে কর্মচাঞ্চল্য গতিতে ভেসে গেল। ফিরে এল স্বাভাবিকতা। নিত্য দিনের মত যার যার দায়িত্ব নিয়ে আমার সাথে নিত্য সহচর দল বেরিয়ে পড়ল। নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা পর কাগমারী কলেজের মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে সশস্ত্র অভিবাদন জানাল। সমবেত মুক্তিযোদ্ধা ও উপস্থিত প্রায় পনের হাজার জনসাধারণের উদ্দেশ্য উদাত্ত কণ্ঠে প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম ধৈর্য্য, সংযম ও সহিষ্ণুতা বজায় রাখতে অনুরোধ জানালাম। কাগমারীতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ভুয়সী
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৬

প্রশংসা করলাম। প্রতিটি বড় বড় যুদ্ধে তাদের যে পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে তা বিভিন্ন উপমা দিয়ে বিশদভাবে তুলে ধরলাম। দুপুরে তাদের সাথে খাবার খেয়ে কাগমারী থেকে টাংগাইল হয়ে সোজা মির্জাপুর হাসপাতালে গেলাম। মির্জাপুর হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য রোগীদের দেখে বিকেল চারটায় মির্জাপুর স্কুল মাঠে বিরাট এক জনসভায় ভাষণ দিতে হলো। জনসভার মূল উদ্যক্তা ছিল আমার সহপাঠী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মির্জাপুরের পুলক সরকার ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা।
এই সময় মুক্তিবাহিনীর উদ্যোগে সর্বত্র প্রায় প্রতিদিনই সভা সমিতি অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। সভার যেন বিরাম নেই এবং প্রতিটি সভাতে আমার উপস্থিতি যেন আবশ্যিক অলঙ্কার। ১লা জানুয়ারী থেকে ৭ই জানুয়ারী মির্জাপুর, করটিয়া, কালিহাতী, মধুপুর, কুদ্দুসনগর, বাশাইল, নাগরপুর ও অন্যান্য বেশ কয়েকটি স্থানে মুক্তিবাহিনীর উদ্যোগে জনসভা হলো।

বাশাইলে অভূতপূর্ব জনসভা
প্রকৃতিতে অনন্য, বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল, তাৎপর্যে মহিমান্বিত এমন দু’টি -বল্লা ও বাশাইল জনসভার বিশেষ কিছু দিক তুলে ধরছি। নির্ধারিত দিন বাশাইল স্কুলের সামনে খোলা মাঠে লক্ষাধিক লোক সমবেত হয়েছে। প্রায় কুড়ি-পঁচিশটি গাড়ী আমাদের টাংগাইল থেকে বাশাইল জনসভায় নিয়ে চলেছে। সামনের তিন- চারটা গাড়ীর পর আমি। মুক্তিবাহিনীর গাড়ীর বহর করটিয়া থেকে পাকা রাস্তা ছেড়ে বাসাইলের কাঁচা রাস্তায় মাইল খানেক এগুতেই বাংড়ার পাশে জনতা ফুল, ফুলমালা ও তোড়া দিয়ে আমাদের অভিনন্দিত ও সম্মানিত করলেন। বাংড়া থেকে বাশাইল পর্যন্ত পুরো রাস্তায় দুপাশে অসংখ্য মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাসে আগ্রহে ভালবাসার ডালি সাজিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। গাড়ীর বহর কাছুটিয়া খেয়া পেরোবার পর আর গাড়ীতে উঠার কোন সুযোগ পেলাম না। বাশাইল পর্যন্ত উৎসাহিত উদ্বেলিত বাধনহারা স্বতঃস্ফূর্ত জনস্রোতে খড়কুটোর মত ভাসতে ভাসতে তিন মাইল পথ অতিক্রম করলাম।
যুদ্ধের শুরু থেকেই গলায় মালা নেয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। ব্যাপারটা মোটেই ধর্মীয় বা অন্য কারণ নয়। কেউ মালা দিতে এলে মালা প্রদানকারীর গলায় সে মালা পরিয়ে দিয়ে বহুবার বলেছি, ‘আমার এখনও মালা নেবার যোগ্যতা হয়নি।’ জনতার আনন্দ, আবেগ, উচ্ছ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে নাঙ্গুলিয়া খালের পারে এলাম। খালের পারে এক অশীতিপর বৃদ্ধা মালা হাতে অপেক্ষা করছিলেন। মালা হাতে এগিয়ে এলে বৃদ্ধাকে বললাম, ‘মা, মালা নেবার যোগ্যতা আমার হয়নি।’
বৃদ্ধার হাত থেকে মালাটি নিয়ে তারই গলায় পরিয়ে দেব এমন সময় বৃদ্ধা ভিন্ন মূর্তি ধারণ করলেন। অভিমানাহত জিদ নিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘তোমার মালা নেবার যোগ্যতা না হইলে, এদেশে কার হেই যোগ্যতা হইছে? আমি তোমারে মালা পরামুই। না হইলে এই যে, আমি তোমার সামনে দাড়াইলাম, তুমি আমারে পাড়াইয়া যাও।’
বয়সের ভারে বৃদ্ধার দেহ নুইয়ে পড়েছে। পরনের মলিন বস্ত্রের তালি, দারিদ্রতা, শোষণ-
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৭

বঞ্চনা আর অত্যাচারের চিহ্ন বৃদ্ধার শরীরে শুকনো খালের গভীরতা নিয়ে এঁকেবেঁকে রয়েছে। তার কোটরাগত দুটি চোখে অতীতের তিক্ত বিষাদময় জীবনের ছাপ। যে বৃদ্ধা কিছুক্ষণ আগেও অপাংক্তেয়, অবাঞ্ছিত ও লাইন থেকে বিতাড়িত হবার ভয়ে সংকোচে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, মালা হাতে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই বৃদ্ধার শীর্ণ দেহে এত শক্তি এত তেজ, এত বল এলো কোথা থেকে? শোষণে, বঞ্চনায় দারিদ্রতার নিষ্ঠুর আঘাতে-আঘাতে জর্জরিত ন্যূজ্ব হয়ে আসা মনে এত আশ্চর্য্য সুন্দর জিদ, কঠিন কোমল অধিকার এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল? অনেক বুঝানোর পরও বৃদ্ধা সংকল্পে অটল। কামুটিয়া থেকে হাজার জনকে নিরাশ করেছি। মালা হাতে প্রতীক্ষমানদের গলাতেই তাদের মালা পরিয়ে দিয়ে এতটা পথ পার পেলেও, বৃদ্ধার হাত থেকে কোন মতেই নিষ্কৃিতি পেলামনা। বৃদ্ধার হাতে ছোট্ট একটি মালা। সব ফুল এক রঙের নয়, এক জাতভুক্তও নয়। এক এক জায়গা থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে পরিশ্রম, ধৈর্য্য ও নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে মালাটি গাঁথা হয়েছে। ক্ষুদ্র মালা অথচ স্নেহ, মমতা, ভালবাসা ও মানবিকতার জোরে সারা পৃথিবীর মানুষকে একসূত্রে গাথার জন্য যেন মালাটি যথেষ্ট বড়। বৃদ্ধার সামনে মাথা নীচু করলাম। বৃদ্ধা গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে আনন্দে আমাকে জাপটে ধরলেন। আনায়াসে স্বচ্ছন্দে দুটি শীর্ণ হাতে বন্দী হয়ে গেলাম। হারিয়ে গেলাম ফেলে আসা সোনালী শৈশবে। অতি প্রত্যুষে পালিয়ে দুর গ্রামে মেলা দেখা শেষে দূর গোধুলিতে নীড়ে ফেরা পাখীদের কাকলির সুর বন্ধুর কাছ থেকে নেয়া তেঁপো বাঁশিতে সুর মেলাতে খেই হারানো আনন্দে প্রদীপ জ্বলা সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা, ঘরে ফিরেই চিন্তিত মায়ের বকুনি, খুঁজে খুঁজে হয়রান ক্রোধান্বিত বাবার পিটুনি খেয়ে স্নেহশীলা দাদীর কোলে মুখ গুঁজে অঝোর ধারার নীরব নিষ্পাপ কান্না, দাদীর পরম আদরে মাথায় হাত বুলানো, অকৃপণ মমতায় আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়ার সোহাগপূর্ণ স্বর্গীয় মূহুর্তগুলি আবার যেন মুহুর্তের জন্য ফিরে এসেছে। নিজেকে সংযত রাখতে পারলামনা। অব্যক্ত আবেগে চোখের দু’কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। চোখে-মুখে-কপালে স্নেহ-চুম্বন এঁকে দিয়ে বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, তুমি কাঁদছো কেন?’
অনুভূতির গভীর ভাষা কাউকে বলা যায় না, বুঝানো যায় না। সে শুধু উপলব্ধির। বৃদ্ধাকে বললাম, ‘মা, আমি জানিনা।’
কামুটিয়া থেকে বাশাইল পর্যন্ত কম করেও পঁচিশ-ত্রিশ হাজার মানুষ আমাদের আন্তরিক সম্বর্ধনা জানালেন। অর্ধেকের বেশী লোক কেউ খালি হাতে দাঁড়াননি। বাশাইল এসে দেখা গেল, আমার কার ও নিত্য সহচর দলের দুইটি জীপ শুধু মালা আর ফুলে ফুলে ভরে গেছে। পিছনের আরও দুটি জীপে পেপে, লেবু, কলা, ডালিম ও অন্যান্য ফলে ভর্তি। রাস্তায় জনসাধারণ প্রায় দু’শ মানপত্র দিয়েছেন। যার যেমন খুশী, কেউ ছাপিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছেন, কেউ ছাপানো মানপত্র ধাধানো ছাড়াই দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ হাতে লিখে দিয়েছেন। দু’তিনটা মানপত্র কুলার উপর খুব সুন্দর করে লেখা। মানপত্রের শ্রেণীবিভাগও বিভিন্ন, কোনটা দিয়েছেন ছাত্ররা, কোনটা গ্রামবাসীরা, কেউ আবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে। বাশাইলের তিন শহীদ তোফাজ্জল,
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৮

দুলাল মিঞা ও মোহাম্মদ সোহরাবের কবর জিয়ারত করে সোজা স্কুলের সামনে, সভাস্থলে এলাম।
সভায় বাশাইল থানাবাসীদের পক্ষ থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার ও আমাকে পৃথক পৃথক ভাবে সোনার মেডেল উপহার দেয়া হলো। এখানে খুব সুন্দর দু’টি মানপত্রও দেয়া হলো। এই সভাতে মোয়াজ্জেম হোসেন খান আমার সাংগঠনিক ক্ষমতা ও দক্ষতার কথা তুলে ধরে বিশ্বের দরবারে টাংগাইল তথা টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর স্বীকৃত মর্যাদা সম্পর্কে বাশাইলের জনসাধারণকে অবহিত করলেন। আমি বাশাইল থানার অধিবাসীদের বার বার সালাম জানিয়ে তাদের কৃতিত্ব ও প্রশংসনীয় অবদানের উল্লেখ করলাম। টাংগাইল মুক্তিবাহিনীতে বাশাইল থানার সদস্য সংখ্যাই খুব সম্ভবতঃ বেশী হবে বলে মন্তব্য করলাম এবং বললাম, ‘মুক্তিবাহিনীর প্রথম অভিযান হয়েছিল বাশাইল থানারই সংগ্রামপুরে। দ্বিতীয় অভিযানও বাশাইলকে কেন্দ্র করে হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাশাইলের মানুষ, বাশাইলের মুক্তিযোদ্ধারা যে ত্যাগ ও গৌরবোজ্জল ভূমিকা পালন করেছে, তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’
আরও একটি স্মরণীয় জনসভা হয় কালিহাতী থানার বল্লাতে। মুক্তিবাহিনীর প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ এই বল্লাতেই হয়েছিল। বল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে টাংগাইল জেলা কাউন্সিলের ডাকবাংলোয় অপেক্ষা করছিলাম। কারণ, বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি দল টাংগাইল আসার কথা ছিল। টি. ভি. দল পোড়াবাড়ী, ধ্বংসস্তূপ, অত্যাচারিত মা-বোনদের সাক্ষাৎকার, দখলদারদের নির্যাতনে হাসপাতালের শয্যায় শায়িত মারাত্মকভাবে আহত সাধারণ মানুষের জীবন চিত্র, ক্যামেরা ও বাণীযন্ত্রে আবদ্ধ করবেন। বল্লা জনসভায় যোগদানের জন্য মুক্তিবাহিনীর এক অংশ ইতিমধ্যেই ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে রওনা হয়ে গিয়েছে। মেজর হাবিব ও ক্যাপ্টেন সবুর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে আমার সাথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। বেলা তিনটায় বাংলাদেশ টি. ভি. দল দুইটি হেলিকপ্টারে টাংগাইল বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে অবতরণ করলো। আমার সাথে অনেকক্ষণ আলাপ-আলোচনা করে অনুরোধ করলেন, ‘আপনি যদি দয়া করে আমাদেরকে হানাদারদের ধ্বংসকৃত বাড়ীঘর এবং তাদের পৈশাচিকতার কিছু নিদর্শন দেখাতে নিয়ে যান, তাহলে আমরা ছবি তুলবো।’ বল্লাতে জনসভা থাকার কারণে তাদের সাথে যাওয়া সম্ভব নয়, এটা জানালে তারা বলতে গেলে প্রায় হতাশ হয়ে পড়লেন। এরপর তারা প্রস্তাব রাখলেন, ‘আপনি দয়া করে কালিহাতী ও বল্লার আশেপাশে কয়েকটি স্থান দেখিয়ে দিন।’ অন্য হেলিকপ্টারে আরও জনা দুই দায়িত্বশীল লোক দিন, যারা অন্যান্য জায়গা দেখিয়ে দিতে পারবেন। সবুরকে তার দল নিয়ে কালিহাতী স্কুলমাঠে অপেক্ষা করতে বললাম। হেলিকপ্টারে টি. ভি. দলের একাংশের সাথে আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও একজন সহযোদ্ধা, অন্য হেলিকপ্টারে আমি একজন সহযোগী নিয়ে উঠলাম। হেলিকপ্টার দুটি পর পর আকাশে উড়ল। হেলিকপ্টারে থেকে প্রথমে হানাদারদের পোড়ানো সয়া পালিমা গ্রামের ধ্বংসাবশেষের ছবি তোলা হলো। তারপর হেলিকপ্টারটি সোজা চলে এলো ব্রাহ্মণশাসন ও কালিদাসপাড়ার আকাশে। কালিদাসপাড়া সেতুর দুই পাশে পর পর প্রায় একশটি বাড়ী হানাদাররা পশ্চাদপসারনের সময়
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৯

১০ই ডিসেম্বর জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, যে ধ্বংশাবশেষ নমরুদ বাহিনীর শেষ অত্যাচারের সাক্ষ্য দিচ্ছিল হেলিকপ্টার থেকে ছবি তুলতে গিয়ে ক্যামেরাম্যান বার বার বললেন, ‘এই রকম বীভৎস পোড়ার ছবি জীবনে এই প্রথম তুলছি। কালিদাসপাড়া থেকে টি. ভি. দলকে সোজা নিয়ে গেলাম বল্লার আকাশে। বল্লাতেও একই অবস্থা। হানাদারদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে নির্গত পোড়া ধোঁয়ার গন্ধ যেন তখনও বল্লার বাতাসকে ভারী করে রেখেছে। অসংখ্য বার ধ্বংস- প্রাপ্ত বল্লা বাজার এর আগে ঘুরে ঘুরে দেখেছি। ত্রাণ-সামগ্রীর ব্যবস্থা করেছি কিন্তু আকাশ থেকে বল্লার ধ্বংসপ্রাপ্ত এত ভয়াবহ, এত বীভৎস যা আগে বুঝতে পারিনি। প্রায় দশ মিনিট নানাভাবে ঘুরে ফিরে নানা দিক থেকে খবু যত্নসহকারে টি. ভি. ক্যামেরাম্যানরা ‘পোড়ামাটি’ নীতির জঘন্য নজীর ক্যামেরায় ধরলেন। বল্লার ছবি তোলা শেষ হলে কালিহাতি স্কুল মাঠে এসে নামলাম। টি. ভি. দল আরো কিছু ছবি তুলতে আবার আকাশে উড়ল।
আনোয়ার-উল-আলম শহীদ গোপালপুর, মধুপুর ও অন্যান্য কয়েকটি জায়গায় হানাদারদের জ্বালানো-পোড়ানোর দ্‌গদগে ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে বল্লার পাশে পূর্ব নির্দিষ্ট স্থানে অবতরণ করেন। তাদেরকে নামিয়ে দিয়ে হেলিকপ্টারে অসমাপ্ত কাজ সারতে আবার আকাশ উড়ল। একটি জীপ শহীদ সাহেবকে বল্লা জনসভায় নিয়ে এলো।

বল্লায় জনসভা
বিকেল পাঁচটা। বস্ত্রার সভাস্থলে উপস্থিত হলাম। সভায় লোকের ভিড় উপচে পড়ছে। একটি অস্ট্রেলিয়ান ও একটি যুগোশ্লাভিয়ান টি. ভি. দল বল্লা জনসভার সবাক চিত্র তুলতে এসেছেন! বল্লাতে অনুষ্ঠিত পূর্বেকার সকল জনসভাকে ম্লান করে রেকর্ড সংখ্যক জনতার জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় কাদের সিদ্দিকী, জয় মুক্তিবাহিনী জয়-ধ্বনির মধ্যদিয়ে আমাকে সভামঞ্চে নিয়ে নির্দ্দিষ্ট চেয়ারে বসাল। শুরু হলো সভার কাজ। ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান, বল্লার নজরুল, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও আমি পর্যায়ক্রমে এই সভায় বক্তৃতা করলাম। সভা পরিচালনা করল সৈয়দ নুরু। ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান, ক্যাপ্টেন রবিউল আলম, মেজর মোস্তফা দীর্ঘদিন বল্লায় যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের ক’টি দিন বাদ দিলে বল্লার জনগণের অধিকাংশের অসহযোগিতা ও চরম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাদের বল্লাতে অবস্থান নিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল। সেই কারণে বল্লার জনগণের উপর ফজলুর রহমান ক্ষুব্ধ ও ক্ষিপ্ত। জনসভাতেও তিনি নিজেকে সংযত রাখতে পারলেননা। বক্তৃতা করতে উঠে সবাইকে সালাম জানিয়েই বল্লার লোকজনকে প্রকাশ্যে গালিগালাজ শুরু করে দিলেন। সতর্ক করে দিলে উত্তেজনাবশত বেখেয়াল মুখ মাইক্রোফোন থেকে না সরিয়ে আফসোস করে বললেন, ‘স্যার, আপনি তো বলছেন, কিন্তু আমি কি করমু, এই বল্লায় দাঁড়ালে আর বল্লার মানুষদের দেখলেই আমার মুখ দিয়ে আর ভাল কথা আসেনা। এই শালারা আমাদের নয়টা মাস কি জ্বালানই না জ্বালাইছে, এ গ্রামের শালার সবাই দালাল।’ খেদোক্তিগুলো বল্লার জনগণের উদ্দেশ্যে বলা না হলেও মাইকে কথাগুলো ধরা পড়ায় জনতা স্পষ্ট শুনতে পেলেন। নজরুল ইসলাম ও তার পর আনোয়ার-উল-আলম শহীদ সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করলেন। আমি সবাইকে সালাম ও অভিনন্দন জানিয়ে বললাম,
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬০

‘নিঃসন্দেহে এটা ঠিক, বল্লার কিছু মানুষ ঘোরতর অপরাধ করেছে এবং তারা অতি অবশ্যই নিকৃষ্টতম মানুষ। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, বল্লার সমস্ত লোকই খারাপ। এই নজরুল, এই রশিদ, এই শহীদ, এরা নয়টা মাসই আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে প্রশংসনীয় কাজ করেছে। বল্লায় নিঃসন্দেহে কয়েক শত রাজাকার তৈরী হয়েছিল, আবার বল্লা থেকেই শতাধিক বীর, ত্যাগী, দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধার সৃষ্টি হয়েছিল। আমি বুঝি বল্লাতে অবস্থানের সময় ফজলু সাহেবকে খুবই বিব্রত হতে হয়েছে। কিন্তু কিছু লোকের জন্য সবাইকে দোষী করা, অপরাধী করা মোটেই সমীচীন ও যুক্তিসংগত হবেনা।’ সবাইকে পুনঃ পুনঃ ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করলাম। জনসভা শেষে বল্লা-টাংগাইলের কাঁচা রাস্তা ধরে টাংগাইলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তির গুজব মুখরিত টাংগাইল
৭ই জানুয়ারী টাংগাইলে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো। রাত সাড়ে আটটায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তির উড়ো খবরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল এবং শূন্যে এলোপাথারী গুলি ছুঁড়তে লাগল। প্রথম অবস্থায় কি ঘটেছে কেন ঘটেছে বুঝতে না পেরে সাধারণ মানুষ কিছুটা হতভম্ভ হয়ে গেলেন। মুক্তিবাহিনীর নেতৃস্থানীয় অনেকে ও আমিও ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা উদ্বিগ্ন হলাম। কোম্পানী হেড-কোয়ার্টার গুলোতে বার বার ফোন করেও কোন যোগাযোগ স্থাপনে সদর দপ্তর ব্যর্থ হলো। প্রতিটি কোম্পানী হেড- কোয়ার্টারের ফোন অনবরত বেজে চলল অথচ ধরার কেউ নেই। প্রায় পনের মিনিট আপ্রাণ চেষ্টা করে সদর দপ্তরের বেতার বিভাগ দু’তিনটি শিবিরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সফল হলো। তাদের কাছ থেকে গোলাগুলির কিছুটা কারণ জানা গেল। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও নুরুন্নবীকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসিয়ে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান, মেজর হাবিব, ক্যাপ্টেন ফজলু ও ক্যাপ্টেন সবুর সহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। শূন্যে ছোঁড়া অজস্র গুলি বৃষ্টির মত যত্রতত্র আকাশ থেকে মাটিতে পড়ছিল। গুলি-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র আচ্ছাদন মাথার হেলমেট। আমরা দ্রুত প্রতিটি শিবিরে যাচ্ছি এবং শূন্যে এলোপাথারী গুলি ছোড়া বন্ধ করছি। অনেক শিবিরে আবার এমনও হলো, গুলি বন্ধ করে আমরা কিছুদূর সরে যেতেই আনন্দ উদ্বেল দিশেহারা মুক্তিযোদ্ধারা আবার গুলি ছোড়া শুরু করে দিচ্ছে। অনেক কষ্টে রাত সাড়ে এগারটা—বারটা নাগাদ গুলি-বৃষ্টি সম্পূর্ণ বন্ধ করা গেল। কয়েক ঘন্টার জন্য টাংগাইলের মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংবাদে বিহ্বল দিশেহারা হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। গভীর রাতে সকল কমাণ্ডারদের সদর দপ্তরে ডেকে কঠোরভাবে শাসানো হলো। তাদেরকে বলে দেয়া হলো, ‘উড়ো খবর তো দুরের কথা, সত্যি খবরেও আর শূন্যে এলোপাথারী গুলি চালাতে পারবেনা। একটি গুলি ছুঁড়তে হলেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হবে। দৃঢ়তার সাথে কমাণ্ডার দের বললাম, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে তোমাদের অপরিসীম অবদান থাকার কারণে ছোট-খাটো দুএকটি ত্রুটি-বিচ্যুতির জবাবদিহি না চাইলেও পরবর্তীতে বিনা অনুমতিতে একটি গুলিও যদি ছোড়া হয়, তাহলে তোমাদের প্রতি কঠোর হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবোনা।’ কপাল ভাল, শূন্যে কয়েক লক্ষ গুলি ছোড়া হলেও কারো কোন ক্ষতি হয়নি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬১

আনন্দ-বিস্ফোরণ

৮ই জানুয়ারী দুপুর বারটার মধ্যে টাংগাইলের মুক্তিযোদ্ধারা জেনে গেল, প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ সময় অপরাহ্ন দুটায় আকাশ- বাণীর খবরে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের প্রিয় নেতার মুক্তির বার্তা শুনলেন। সারাদেশে একটা খুশীর বান ডেকে গেল। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও আনন্দের সীমা নেই। দেশ শত্রুমুক্ত স্বাধীন হওয়ার পর আনন্দঘন মুহুর্তগুলোর মাঝেও পুঞ্জীভূত শূন্যতা, অপরিপূর্ণতার বিষন্ন রাতের ঘন অন্ধকার অবসান হলো জাতির পিতার নিশ্চিত মুক্তির সংবাদে। মুক্তিযোদ্ধাদের মন বর্ষার জলে দুই কূল ভাসানো পূর্ণ যৌবনা উচ্ছ্বাসিত নদীর মত বেগমান। বাংলা ও বাঙালীর অস্তিত্ব ও বাঁচার লড়াইয়ে ওতপ্রোত জড়িত শ্লোগান ‘জয়বাংলা’র বজ্রধ্বনিতে সারা টাংগাইল প্রকম্পিত হলো, পরতে পরতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মুক্তি আন্দোলনের পুরোধা নেতা বঙ্গবন্ধুর জয় নিনাদে ঘোষিত হলো নেতার মুক্তির শুভ সূচনার শুভবার্তা। ক্ষণটিকে স্মরণীয় করে রাখা ও আগামী দিনে দেশ গঠনে যে কোন শত্রুর মোকাবেলা করার সাহস ও প্রত্যয় ঘোষণার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা তোপধ্বনি করার ও প্রতিটি কোম্পানী থেকে একটি করে প্রতীকি গুলি ছোড়ার অনুমতি চাইল। সাময়িকভাবে প্রত্যেকের আবেদন অগ্রাহ্য করা হলো। বিকেলে সদর দপ্তরে কমাণ্ডারদের ডাকা হলো। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো রাত বারটা এক মিনিটে বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে ৩১ বার তোপধ্বনি করা হবে এবং প্রতিটি কোম্পানী, প্লাটুন ও যেখানেই মুক্তিযোদ্ধারা শিবির করে আছে, প্রতি ঘাঁটি থেকে একটি করে মেশিনগান চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গপিতার মুক্তির আনন্দ ধ্বনি করতে পারবে তবে গুলির পরিমাণ প্রতি মেশিনগান পিছু কিছুতেই এক হাজারের বেশী হতে পারবেনা এবং শূন্যেও গুলি ছোঁড়া যাবেনা। বাংকার খুঁড়ে মেশিনগানের নল বাংকারে ঢুকিয়ে তবে গুলি ছুঁড়তে হবে। এতেই মুক্তিযোদ্ধারা খুশী। পরিকল্পনা অনুযায়ী টাংগাইল বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠের উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লম্বালম্বি সারিতে প্রতিটিত দুই পাউণ্ড ওজনের ৩১টি বিস্ফোরক দলা নির্দিষ্ট দূরত্বে পর পর রাখা হলো। পাঁচ সেকেণ্ড অন্তর একের পর একটিতে অগ্নিসংযোগ করা হলো। একই সময়ে প্রায় তিনশটি শিবিরের মুক্তিযোদ্ধারা একসংগে মেশিনগান থেকে একনাগাড়ে গুলি ছুঁড়ে আনন্দ প্রকাশ করল। মুক্তিযোদ্ধাদের আনন্দ বিস্ফোরণের দোলায় সারা টাংগাইল কিছুক্ষণের জন্য কেঁপে কেপে উঠল।
৯ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে লণ্ডনে পৌছলে বৃটেনের প্রাধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বাঙালী জাতির স্থপতি, সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত প্রাণপ্রিয় নেতাকে আন্তরিক সম্বর্ধনা জানালেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘর আষাঢ়ের ভরা পুকুরের স্বচ্ছ পানির মত আনন্দে টলমল করছিল। আমার মনও ময়ুরের মত পেখম মেলে নাচছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬২

দেশ স্বাধীন হবার পর মাঝের কটা দিনের অব্যবস্থা ও অনেক অশুভ শঙ্কা মুহূর্তে মন থেকে মুছে গেল। সকলের মত আমারও আগ্রহ, বঙ্গবন্ধু কখন বাংলার পুতঃপবিত্র শ্যামল মাটির স্পর্শ পাবেন।

দিল্লীতে বঙ্গবন্ধু
১০ই জানুয়ারী ১৯৭২ সাল। ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর একটি বিমান বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লণ্ডন থেকে ঢাকার পথে দিল্লীতে অবতরণ করলো। ষাট কোটি ভারতবাসীর পক্ষ থেকে দিল্লীর লাখো জনতা, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, সেনাবাহিনীর তিন প্রধান, শীর্ষস্থানীয় নেতা ও বৈদেশিক কূটনীতিক বৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে বিপুলভাবে স্বাগত জানালেন। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ অসুস্থতার জন্য দিল্লীতে ছিলেন না। তিনি বঙ্গবন্ধুকে এ যুগের সব চাইতে বড় অহিংস গান্ধীবাদী নেতা বলে আখ্যায়িত করে পালাম বিমান বন্দরে শুভেচ্ছা বার্তাসহ মালা দিয়ে তার রাজনৈতিক সচিব অমরেশ চন্দ্র সেনকে পাঠালেন। পরে দিল্লীর রামলীলা ময়দানে সম্বর্ধনার জবাবে প্রথমে ইংরেজীতে দু একটা কথা বলার পর জনতার আকুল আবেদনে বঙ্গবন্ধু তার চিরাচরিত ভঙ্গিতে উদাত্ত কন্ঠে সহজ বাংলায় এক অবিস্মরণীয় বক্তব্য রাখলেন। এই সভায় এক পর্যায়ে তিনি বললেন, ‘আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেছে ভারতের সাথে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার মতের এত মিল কেন? আমি বলি এ মিল আদর্শের মিল, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের মিল। ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। আমিও আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি, তাই আমাদের মধ্যে এত মিল। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই ভারতবাসীকে। তারা আমার এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, খাইয়ে-পড়িয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে আমি কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাই। দুনিয়ার এমন কোন দেশ নাই, যেখানে তিনি যান নাই এবং সেই দেশের নেতাদের বলেন নাই যে, শেখ মুজিবকে মুক্তি দাও। আমাদের উভয় দেশের বন্ধুত্বের ফাটল ধরানোর চেষ্টা করা হবে। আমরা সেই চেষ্টা কিছুতেই সফল হতে দেবনা।’ দিল্লী থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজকীয় বিমানটি আবার ঢাকায় রওনা হলো। কোলকাতার মানুষ দেশে ফেরার পথে বাঙালী জাতীয়তাবাদের উদ্যোক্তা স্বাধীন বাংলার স্রষ্টা শেখ মুজিবর রহমানকে কিছুক্ষণের জন্য পেতে চেয়েছিলেন। কোলকাতায় ব্রিগেড ময়দানে তারা একটা সম্বর্ধনার ব্যবস্থাও করেছিলেন। কিন্তু সময়ের স্বল্পতা ও দেশের মাটির নাড়ীছেড়া টানে কোলকাতার মানুষ এদিন বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেলেন না। তবে বঙ্গবন্ধু আবাল্য স্মৃতিবিজড়িত কোলকাতা ও কোলকাতার মানুষের তার সান্নিধ্য পেতে বেশী সময় অপেক্ষা করতে হলোনা। ২রা ফেব্রুয়ারী ‘৭২ সাল কোলকাতায় একদিনের জন্য গিয়ে কোলকাতাবাসীর হৃদয়ের দাবী তিনি পুরণ করলেন। কোলকাতার বুকে অতীতকালে অত বড় জনসমাবেশ আর কখনও হয়নি। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভের সম্বর্ধনা সভাই ছিল কোলকাতার স্মরণাতীত কালের বৃহৎ জনসমাবেশ। অনেকে বলেন ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে বঙ্গবন্ধুর সম্বর্ধনা সভার সমাবেশে তার চাইতেও বেশী জন সমাগম হয়েছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৩

স্বদেশের মাটিতে
১০ই জানুয়ারী বিকেল তিনটায় ২১২ দিন পাক-দস্যুদের কারাগারে বন্দী থেকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা বাংলা ও বাঙালীর গর্ব, বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের প্রধান আলোকদিশারী বঙ্গপিতা শেখ মুজিবর রহমান তেজগাঁ বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন। তেজগাঁ বিমান বন্দরের উত্তাল উচ্ছ্বসিত বিশাল জনসমুদ্রের কোন বর্ণনা চলে না, তুলনা চলে না। সে এক অতুলনীয় দৃশ্য। তেজগাঁ বিমান বন্দরে পূর্বে অসংখ্য বার বিভিন্ন উপলক্ষে বিপুল জনসমাবেশ হয়েছে। কিন্তু এদিনের সমাবেশের কাছে অতীতের সকল ইতিহাস ম্লান হয়ে গেল। তেজগাঁ বিমান বন্দরে লাখো লাখো মানুষ সমস্ত নিয়ম-শৃঙ্খলা ভুলে বাংলার পরম প্রিয় নেতাকে যেভাবে পারলেন সম্বর্ধনা জানালেন। বিমান থেকে অবতরণের সিঁড়ির মুখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের উপেক্ষা অগ্রাহ্য করে কয়েকজন যুবক বিমানের সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে উঠে বঙ্গবন্ধুকে জাপটে ধরে তাদের হৃদয়ের উত্তাপ প্রকাশ করলেন। কে নেতা, কে কর্মী, কে আপন কে পর সব যেন একাকার হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে বিমান থেকে নামিয়ে অভিবাদন মঞ্চে নিয়ে যাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ল। ফুল, ফুলমালা, তোড়া দিয়ে, কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে স্পর্শ করে, কেউ বা আবার শুধু কাছ থেকে এক নজর দেখে হৃদয়ের ভালোবাসা আর অসীম শ্রদ্ধা জানালেন। ভিড় ঠেলে কোনক্রমে অভিবাদন মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো। তবে অবস্থার কোন উন্নতি হলোনা। উপচানো ভিড় সেখানেও। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সশস্ত্র অভিবাদন জানাতে মিত্রবাহিনী, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যে সমস্ত সৈনিক ও যোদ্ধারা দাঁড়িয়েছিলেন, ছাত্র-যুবক, জনতা তাদেরও ঠেলেঠুলে লাইনচ্যুত করে একাকার করে ফেললেন। অনেক কষ্টে ভিড় কোন রকমে সরানো হলে গার্ড-অব-অনার দেয়া হলো। অভিবাদন পরিদর্শনের পর বঙ্গবন্ধুকে একটি খোলা ট্রাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হলো। তেজগাঁ বিমান বন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মাত্র দুই মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগল। পৌনে পাঁচটায় বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার প্রিয় দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি খুব একটা স্বাভাবিক ছিলেন না, স্বাভাবিকভাবে বক্তৃতাও করতে পারছিলেন না। শুধু কাঁদছিলেন বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি কয়েক মিনিটের অবিস্মরণীয় বক্তব্য রাখলেন। তিন বললেন,
‘যারা বাংলার স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে, আমি তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি। সালাম জানাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যারা নয় মাস হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছে। সালাম জানাই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে, যারা আমার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে স্বাধীনতা অজর্নে সাহায্য করেছেন। আমি সালাম জানাই বাংলার প্রতিটি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী, মোক্তার, ডাক্তার ও মা-বোনদের, যারা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছেন, অমূল্য অবদান রেখেছেন, দেশকে স্বাধীন করেছেন।’ পাকিস্তানকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ‘ভুট্টো সাহেব সুখে থাকো সব বাধন শেষ হয়ে গেছে। আমি তোমাদের ব্যাপারে নাক গলাবোনা ৷
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৪

তোমরাও আমাদের ব্যাপারে নাক গলানোর চেষ্টা করোনা। শেখ মুজিব তাঁর প্রিয় কবিগুরুকে স্মরণ করে বললেন, ‘কবিগুরু তোমার কথা মিথ্যা হয়ে গেছে, বাঙালীরা আজ মানুষ হয়েছে, তারা স্বাধীন হয়েছে।’ তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে আবেদন জানালেন, ‘হানাদার পাকিস্তানীরা নয় মাসে আমার দেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। সমস্ত দেশকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। আমার মানুষ আজ অসহায়। তারা না খেয়ে আছে! আপনারা মানুষদের সাহায্য করুন। ভিক্ষা হিসাবে নয়, সংগ্রামী মানুষকে সংগ্রামী মানুষ হিসাবে আপনারা সাহায্য করুন। দেশবাসীকে শান্ত, সুশৃঙ্খল ও ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ জানিয়ে বললেন, ‘দেশে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। আপনারা শান্ত থাকুন। ধৈর্য্য ধারন করুন। যারা অন্যায় করেছে, যারা নারীধর্ষণ লুটতরাজ ও খুন-খারাপী করেছে, আমরা তাদের বিচার করবো। একানব্বই হাজার পাকিস্তানী সেনা আমাদের হাতে বন্দী। তাদের যারাই যুদ্ধ অপরাধের সাথে জড়িত, পুঙ্খানুপু তদন্ত করে তাদের বিচার করা হবে। কারো উপর অন্যায় করা হবেনা। আমার সোনার বাংলার মূল কথাই হলো, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।’
বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এলেন, লাখো লাখো মানুষ তাঁকে উষ্ণ অভ্যার্থনা জানালেন, অথচ আমাকে সেখানে দেখা গেল না। ১০ই জানুয়ারী সকালে দিল্লী থেকে যখন সরাসরি বঙ্গবন্ধু ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা বেতারে সম্প্রচারিত হচ্ছিল, তখন আমি চারাবাড়ীর কাছে একটি গ্রামে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। চারাবাড়ী থেকে ফিরলে বেশ কয়েকজন সহযোগী জিজ্ঞেস করলেন,
– স্যার, আপনি বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে তেজগাঁ বিমানবন্দরে যাবেন না?
– আজ বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাবার লোকের অভাব হবেনা। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে শ্রদ্ধা ও অর্ঘ্য নিবেদন করতে যাবো। তবে আজ নয়। আগামীকাল যেকোন সময় আমরা আমাদের প্রিয় নেতাকে দেখতে যাবো।
দুপুরে কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে পাথরাইলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম একটি পূর্ব নির্ধারিত জনসভায় যোগ দিতে। এই সভাতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ টেপ করে পরে তা সমবেত জনতাকে বাজিয়ে শোনানো হলো। পাথরাইল থেকে কদ্দুসের কবর জিয়ারত করতে কদ্দুসনগর গেলাম। কবর জিয়ারত করে শোকসন্তপ্ত বাবা-মাকে সান্তনা দিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে রাত দশটায় টাংগাইল ফিরলাম।

বঙ্গবন্ধুর ফোন
টাংগাইল ওয়াপদা ডাকবাংলোয় সত্তর-আশি জন সহকর্মীর সাথে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার গুরুত্ব, বিশ্ব রাজনীতিতে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ভূমিকা ইত্যাদি নানা আলাপ-আলোচনা করছিলাম। আলাপ-আলোচনায় কখন রাত এগারোটা বেজে গেছে কেউ আন্দাজ করতে পারিনি। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল আমি তখন খুব কমই টেলিফোন ধরতাম। কিন্তু কেন যেন নিজেই টেলিফোন ধরলাম ৷ টাংগাইলে তখনও স্বয়ংক্রিয় একক্সচেঞ্জ হয়নি। টেলিফোন ধরতেই অপারেটর আমার ছেলেবেলার বন্ধু
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৫

আবদুর রহমান লুলু শশব্যস্ত হয়ে বললো, ‘স্যার, বঙ্গবন্ধু কথা বলবেন। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে আছেন।’
‘হ্যালো’ বলতেই অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে এলো,
‘হ্যালো, কাদের? তুই কেমন আছিস্?’
‘ভালো আছি’ বলার আগেই বঙ্গবন্ধু আবার বললেন, ‘কি, আপনাকে যে সারাদিনে দেখতে পেলামনা। আপনি কি আসতে পারেন?’
আমার জীবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে টেলিফোনে এই প্রথম কথা। ভাবতে পারিনি বঙ্গবন্ধু নিজে ফোন করবেন। স্নেহময় পিতার ডাকে আনন্দে খুশীতে অভিভূত হয়ে বললাম, ‘ভালো আছি। খুব ভালো আছি। এখন আরো ভাল লাগছে। যখন বলবেন তখনই আসতে পারি। বললে রাতেই আসতে পারি। তবে দেড় ঘন্টা লাগবে। কারণ, টাংগাইল-ঢাকা রাস্তার বাইশ-তেইশটা পুল নেই।’
‘না, তোকে রাতে আসতে হবেনা। তুই সকালে চলে আয়। তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে। তোর সম্পর্কে অনেক শুনেছি। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করবো।’ বলেই বঙ্গবন্ধু টেলিফোন ছেড়ে দিলেন। টেলিফোনটি কার তা প্রথম বুঝতে না পারলেও, মিনিট ছয়েকের কথায় সহযোদ্ধারা বুঝে নিল স্বয়ং বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করছেন। বঙ্গপিতা ঢাকায় এসেই আমাদের খোঁজ করেছেন, এ জেনে সহযোদ্ধারা আরও বেশী আনন্দিত, অনুপ্রাণিত ও গৌরবান্বিত বোধ করলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৬

বঙ্গপিতার সান্নিধ্যে

রাতে কারো চোখে ঘুম এলো না। আনন্দ, উত্তেজনা, উদ্দীপনায় সবার রাত কাটলো। শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভোর সাড়ে পাচটায় টাংগাইল থেকে রওনা হয়ে সাতটায় ঢাকা ধানমন্ডীর ১৯ নম্বর রোডে পৌছলাম। গেটে পুলিশ প্রহরা। নিয়মমাফিক পুলিশের কাছে ভিতরে যাবার অনুমতি চাইবো, এমন সময় এক মধ্যবয়সী পুলিশ ইন্সপেক্টর দৌড়ে এসে প্রথমে সামরিক অভিবাদন ও পরে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। ভদ্রলোককে টেনে তুলে দেখি, আমাদের বাহিনীরই সদস্য। ‘তুমি এখানে কি করে?’
‘বঙ্গবন্ধু আসার পর তার বাসা পাহারায় থাকা উচিত। অথচ ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাহারা দেওয়াটা খুব শোভনীয় নয়, এমন অবস্থায় আমরা যারা ঢাকায় ছিলাম, তাদের মধ্যে থেকে আমাকে সহ চল্লিশ জন গতকাল থেকে এখানে ডিউটি দেয়া হয়েছে।’
পুলিশ ইন্সপেক্টরের সাথে কথা বলতে বলতেই বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। বারান্দার নীচে শাতাধিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে বঙ্গবন্ধু কথা বলে ভিতরে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ছাত্রদের মধ্যে দুচার জন বার বার পিছনে তাকিয়ে একে অপরকে বলছিল, ‘ঐ যে কাদের সিদ্দিকী এসেছে।’ কাদের সিদ্দিকী এসেছে কথাটা মুখে মুখে এদিক-ওদিক হতেই বঙ্গবন্ধুও শুনলেন। তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে ছাত্রবন্ধুদের ভিড় ঠেলে বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে প্রথমে সামরিক কায়দায় তারপর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে পর পর দুটো মালা একটি মুক্তিবাহিনী ও অন্যটি নিজের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর গলায় পরিয়ে দিলাম।
বঙ্গবন্ধু দুই হাতে জাপটে ধরে হারানো পুত্র ফিরে পাওয়ার মত আনন্দে কোলে তুলে এক দৌড়ে বাড়ীর ভিতরে চলে এলেন। বাড়ীর ভিতর করিডোরে আমাকে একবার ছেড়ে দিয়ে আবার কোলে তুলে নিলেন। বাসেত সিদ্দিকী, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, নুরুন্নবী, সৈয়দ নূরু ফারুক, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, এনায়েত করিম, সবুর, হাবিব, ও অন্যান্যরা ততক্ষণে বাড়ীর ভিতরে ঢুকে পড়েছে। তারা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বঙ্গবন্ধুর কাণ্ড দেখছে। বঙ্গবন্ধু স্নেহময় পিতার মত উজ্জ্বল, শিশুর মত প্রগলভ। তিনি যেন কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলেননা। বার বার অস্ফুট স্বরে কি বলছেন, আর আমাকে একবার কোলে তুলছেন, আবার ছেড়ে দিচ্ছেন। তিন-চার বার এমনি করে এক সময় তাঁর গলা থেকে মালা দু’টো খুলে আমার গলায় পরিয়ে দিতে গেলে আমি আপত্তি করলাম।
–না, আমি মালা নিই না। মালা নেবার যোগ্যতা আমার হয়নি। এই মালা আমার জন্য নয়, আপনার জন্য।
বঙ্গবন্ধু আমার মাথায় আলতোভাবে থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘এই মালা দুটি আমি তোকে পরিয়ে দিলাম।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৭

এই সময় বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, কন্যা ও পুত্ররা এলে আমাকে দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দেখ, আমার কাদের যুদ্ধ করেছে। এই দেখ, এরাই হচ্ছে কাদেরের সাথী।’ বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী কৌতূকচ্ছলে বললেন, ‘এ খবর নতুন নয়, আমি তোমার অনেক আগেই জানি।’ বঙ্গবন্ধু প্রতিটি সহযোদ্ধার সাথে এক এক করে আলিঙ্গন করে অবাক বিস্ময়ে বার বার প্রশ্ন করেলেন, তোরা কি করে দুর্দান্ত নরপশু সীমারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করলি! সত্যি তোরাই বাংলার গৌরব৷ তোরা আমার আহ্বানের মর্যাদা রেখেছিস। এখন আমাদের দেশ গড়তে হবে।
বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের পটভূমিকায় আমি সামান্য প্রাসঙ্গিক কিছু আলোচনা করতে চাই। দেশ স্বাধীন হবার পর স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পল্টন ময়দানে আমরা প্রথম জনসভা করেছিলাম। স্বাধীনতার পর সর্বপ্রথম আমার নামে সরকারী গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়েছিল, যদিও তা কার্যকরী হয়নি। যে কোন কারণেই হোক, কিছু নেতাদের ধারণা হয়েছিল, আমি সহজে অস্ত্রত্যাগ করবোনা। অথচ আমার কোন আচরণে তেমন কিছু কস্মিনকালেও প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে হয় না। ৭১ এর শেষ দিনগুলোতে আমার সম্পর্কে কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতার ভুল বুঝাবুঝি চরমে উঠেছিল। ৭২-এ বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে ও পরবর্তী কয়েকটা দিনেও এর কোন নিরসন হলো না। বরং ভুল বুঝাবুঝির মাত্রা বেড়েই চললো। কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সত্য-মিথ্যা নানা গুজব ছড়িয়ে, নানা কৌশলে, টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর কৃতিত্বকে ছোট করে দেখানোর অপচেষ্টায় মেতে উঠলেন। তাদের কেন জানি আমার সম্পর্কে অযৌক্তিক বিভ্রান্তি, অজানিত ভয়, অমূলক আশঙ্কা ছিল। ১০ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহুর্তে আমাকে যখন ঢাকা বিমান বন্দরে দেখা গেল না, তখন গুজব বাজরা আবার একতরফা নতুন গুজব ও অপপ্রচার ছড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ, মোক্ষম অজুহাত পেয়ে গেলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা দীর্ঘদিনের চর্চিত পরিশীলিত কূটকৌশলে কখনও বা নগ্নভাবে নানা ঘটনাকে উপমা করে আমার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করার অপচেষ্টা করলেন। তারা অনুভূতিতে খোঁচা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে এও বুঝাতে চেষ্টা করলেন,’সবাই আপনাকে শুভক্ষণে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে, শুধু সে (কাদের সিদ্দিকী) আসেনি-এর অর্থ কি? এর অর্থ একটাই, সে আপনাকেও মর্যাদা বা পাত্তা দিতে চায় না; আপনার উপস্থিতিও সে খুব একটা তোয়াক্কা করে না। রাজনৈতিক তবে অভিজ্ঞ অনেকে আবার মন্তব্য করলেন, ‘অল্প বয়সে হাতে অস্ত্র এলে অনেকেই অমন উগ্র হয়, অত্যাচারীতে পরিণত হয়, ধরাকে সরা জ্ঞান করে।’ নিরন্তর বানোয়াট অভিযোগ শুনতে শুনতে বঙ্গবন্ধুর মনেও হয়তো দুচার বার প্রশ্ন জেগেছিল, কেন কাদের এলো না? লন্ডনে বিভিন্নপত্র-পত্রিকার সাংবাদিকরা গুলি করে দুষ্কৃতিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার ছবি দেখিয়ে বার বার বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কে এই কাদের সিদ্দিকী?’ বঙ্গবন্ধু স্বাভাবিকভাবে বলেছিলেন, ‘ও কাদের, আমার ছেলে।’ দিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও আমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কাদের সিদ্দিকীকে চেনেন কি?’
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৮

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অত্যন্ত সহজ, স্বাভাবিক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কাদের আমার ছেলে।’
পরবর্তীতে এই নিয়ে অনেকের ভুল ধারণা হয়েছিল, ‘সত্যিকারের কাদের সিদ্দিকী কার ছেলে?’ বঙ্গবন্ধুর ‘আমারই ছেলে’ কথাটার অর্থ হয়তো অনেকেই সেইদিন সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেননি। ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ না করা পর্যন্ত যেখানেই যাত্রার সাময়িক বিরতি দিয়েছেন, সেখানেই বঙ্গবন্ধু আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়েছেন এবং পিতৃসুলভ উত্তর দিয়েছেন, তারপরও তেজগাঁ বিমান বন্দরে আমার অনুপস্থিতি সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর মনে প্রশ্ন জাগিয়েছিল। কিন্তু অন্ধকারে সাপ না খুঁজে পিতৃত্বের কর্তৃত্বে, নেতার অধিকারে, ভাইয়ের উদার ভালবাসায় রাত এগারোটায় তিনি সরাসরি আমাকে ফোন করেছিলেন।
আনন্দের আতিশয্যের অবসরে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত খোলাখুলি ও সরলভাবে বললেন, ‘অনেকে অনেক কথা বলেছে। আমি বিশ্বাস করি নাই। তাই তোকে ফোন করেছিলাম। তোর কথা আমি জেল থেকে বেরিয়েই শুনেছি। লন্ডনে অনেক সাংবাদিক তোর কথা জিজ্ঞেস করেছে। তোর অস্ত্র হাতে দুর্দান্ত সব ছবি দেখিয়েছে। অসংখ্য পত্রিকা তোর বিরুদ্ধে বড় বড় হরফে সংবাদ পরিবেশন করেছে। তাতেই আমি বুঝেছিলাম, সত্যিই তুই কাজের মত কাজ করেছিস। ইন্দিরা গান্ধী তোর কথা জিজ্ঞেস করেছেন। আমি সবাইকে বলেছি, কাদের আমার ছেলে।’
এরপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে স্নেহময় পিতার দরদ নিয়ে বললেন, ‘তুই এখন বল আমি ভুল বলেছি?’
বঙ্গবন্ধুর নৈকট্যের পরশে আমি অভিভূত। আবেগজড়িত কণ্ঠে বললাম,
‘মোটেই না। আপনি ভুল করলে আমরা স্বাধীনতা পেতামনা। আজও আপনি ভুল করেননি, ভবিষ্যতেও করবেননা বলে আমাদের বিশ্বাস।’
অনেক কথার পর বাড়ীর গেট পর্যন্ত এসে বঙ্গবন্ধু আমাদের বিদায় জানালেন। এই সময় মাথায় ব্যান্ডেজ বাধা বীর সেনানী খালেদ মোশাররফ বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে পরস্পরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

ক্রোড়পত্র প্রকাশে বাধা
বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রথম সাক্ষাতের তিন দিন পর আবার ঢাকায় এলাম। উদ্দেশ্য, দৈনিক বাংলাদেশ অবজার্ভারে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর উপর একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ চার ছাত্রনেতা-নুরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ. স. ম. আবদুর রব ও আবদুল কদ্দুস মাখনের হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ করা। যদিও প্রথমত এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে জানানোর তেমন পক্ষপাতি ছিলামনা, তবুও সহকর্মীদের প্রবল চাপে শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে বাধ্য হলাম। বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেও আমি এই ব্যাপারে মুখ খুললামনা। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, নুরুন্নবী, অধ্যাপক রফিক আজাদ, অধ্যাপক মাহবুব সাদিক, ফারুক আহমেদ, সৈয়দ নুরু, মোয়াজ্জেম হেসেন খান ও এনায়েত করিম বঙ্গবন্ধুর সামনে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেলেন। এখানে মোয়াজ্জেম হোসেন খানের
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৯

চিরাচরিত স্বাভাবিক গমগমে গলার প্রাধান্য মোটেই কমলোনা। তাদের অভিযোগ, ‘স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য আমার সংগ্রাম করেছি। চার ছাত্রনেতা সংবাদপত্র অফিসে হুমকি দিয়ে টাংগাইল মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে ক্রোড়পত্র প্রকাশ বন্ধ করে চরম অন্যায় ও গর্হিত অপরাধ করেছে। নেতা হিসাবে আপনি এর ব্যবস্থা নিন।’ বঙ্গবন্ধু নানা দেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত টেনে এবং বিবিধ যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করলেন, ‘তোরা বুঝতে পারছিস্ না। স্বাধীনতার পর এমন দুচারটা ছোটখাটো ঘটনা ঘটে। এইজন্য উত্তেজিত হলে চলেনা। আমি নিশ্চয়ই একটা কিছু করবো।’
কিন্তু না, সহযোদ্ধাদের তাৎক্ষণিক একটা ফয়সালা চাই। আমি বঙ্গবন্ধুর পাশে মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি কাদেরের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলব। তোরা আমাকে অব্যাহতি দে।’ তারপর আমাকে বললেন, ‘তুই এদের শান্ত কর। আমি নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব। এরপর সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘একটা ক্রোড়পত্র না বেরুনোয় তোদের দুঃখ হয়েছে। তোদের উপর যাতে একশ ক্রোড়পত্র বের হয়, আমি তার ব্যবস্থা করব।’ এরপরও সহযোদ্ধারা ক্ষোভ, উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, ‘ক্রোড়পত্র না বেরোনোয় দুঃখ নাই৷ আমরা নামের কাঙাল নই। হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন করে ক্রোড়পত্র প্রকাশে ছাত্রনেতারা হস্তক্ষেপ করে যে অন্যায় করেছেন, আমরা তার বিচার চাই।’ আমি দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভেঙে সহযোদ্ধাদের বললাম, ‘তোমাদের এর পর আর কথা বাড়ানো যুক্তিযুক্ত ও শোভন নয়। নেতাকে সময় দেয়া উচিত।’
মুখর সবাই এতে নীরব হলো। সহযোদ্ধাদের নিয়ে বেরিয়ে যাবো এ সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে কিছু সময় থাকতে বললেন। সহযোদ্ধারা চলে গেল। কিছু পরেই বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনে চলে গেলেন। আমি তাকে অনুসরণ করলাম।

বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী : রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতি সাঈদ চৌধুরী
১৪ই জানুয়ারী, ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাব শপথ গ্রহণ করলেন। একই দিনে টাংগাইলের কালিহাতী থানার নাগবাড়ী নিবাসী কট্টর মুসলিম লীগার মরহুম আবদুল হামিদ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র আবু সাইদ চৌধুরী গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নিলেন।

অস্ত্র জমা দেয়ার প্রাথমিক আলোচন
১৬ই জানুয়ারী বেইলী রোডের গণভবনে (পুরাতন প্রেসিডেন্ট হাউস) ডেকে নিয়ে অস্ত্র জমা দেয়া সম্পর্কে প্রথম জিজ্ঞেস করলেন। তিনি সাদা মাটা, কোনরকম রাখঢাক না করে সরাসরি বললেন, ‘নানা স্থানে অস্ত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাল নয়, নিরাপদও নয়। তোরা কি করবি?’
নেতাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম, ‘আমাদের কাছে নেতার আদেশই শিরোধার্য।’ এর পর অস্ত্র জমা দেয়া সম্পর্কে তেমন কোন কথা হলো না।

ওসমানী সকাশে
গণ-ভবন থেকে বেরিয়ে কেন জানিনা, কি ভেবে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭০

প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী সাহেবের সাথে দেখা করতে তার বাসভবনে গেলাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ন্যূনতম সৌজন্যমূলক আচরণও করলেন না। ওসমানী সাহেবের ঘরে ঢুকতে আমাকে পাক্কা পাঁচ মিনিট বিনা কারণে ও কোন দর্শনার্থী না থাকা সত্ত্বেও অপেক্ষা করতে হলো। ঘরে ঢুকে সামরিক অভিবাদন করার সময়ও নিয়ম-শৃঙ্খলা শিকেয় তুলে ভদ্রতার লেশটুকুও তুলে ওসমানী সাহেব বসে রইলেন। উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দেয়া কিংবা বসতে বলার শিষ্টাচারটুকু দেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না। অগত্যা অভিবাদন শেষে আহ্বান ছাড়াই অন্য একটি সোফায় বসে ওসমানী সাহেবের কুশল জিজ্ঞেস করলাম। এই সময় আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মত ওসমানী সাহেবের রাগ দ্বিগুণ হওয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত ও আকস্মিক একটি কারণ ঘটে গেল। ওসমানী সাহেবকে উপহার দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ছবি সম্বলিত একটি এ্যালবাম এনেছিলাম। ভুলক্রমে এ্যালবামটি গাড়ীতেই ছিল। কথা শুরু হতেই একজন সহযোদ্ধা এসে বললো, ‘সি. ইন.সি. স্যার, ওটা যে গাড়ীতে ফেলে এসেছি। নিয়ে আসব কি?’ আর যাবে কোথায়? অভিযোগ এখানেই প্রমাণিত হয়ে গেল। সহযোদ্ধাটির আর গাড়ী থেকে এ্যালবাম নিয়ে আসা হলোনা। ওসমানী সাহেব দাবানলের মত দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেন। সামনের ছোট টেবিল বার বার সজোরে চাপড়ে তার বিখ্যাত গোফ নাড়িয়ে নাড়িয়ে চোখেমুখে গনগনে আগুনের ফুলকি ছড়াতে ছড়াতে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘একটা দেশে কয়টা সি. ইন সি থাকে? তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ কর। আমি অনেকবার শুনেছি, খুব একটা বিশ্বাস করিনি, আজকে আমার সামনেই চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে।’
আগের থেকে ওসমানী সাহেবের বিবাগের কারণ কিছুটা জানতাম। রাগের পরিমাণ যে এত বড় বারুদ স্তূপে পরিণত হয়ে আছে, যাতে কণামাত্র উত্তাপ লাগলেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে, তা অবশ্যই জানা ছিল না। ওসমানী সাহেব নিঃসন্দেহে একজন স্বনামধন্য বাঙালী সেনাপতি। যদিও মুক্তিযুদ্ধে তার সেনাপতিত্বের কৃতিত্ব নিয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন আছে। তার সফলতা ও ব্যর্থতারও সত্যিকার মূল্যায়ন হওয়া উচিত। আতাউল গণি ওসমানী, এই নামটা একদা নিঃসন্দেহে বাঙালীদের প্রেরণা জুগিয়েছে। আবার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অথবা পরবর্তীতে অনেকবার হতাশ ও বিরোধী করে তুলেছে। ১০ই জানুয়ারী ওসমানী সাহেব ১ নম্বর সেক্টর কমাণ্ডার মেজর এম. এ. জলিলের মত একজন কৃতি মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেফতার করে স্বাধীন বাংলায় একটি অশুভ পদক্ষেপের সূচনা করেছিলেন। জিয়াউর রহমানকে তিনি দু’চোখে দেখতে পারতেন না। আমাকে তিনি যার পর নাই অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে খুব কম সময়ে তিনি কোলকাতাস্থ বাসভবনের শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়েছেন। এইসব জানার পর ওসমানী সাহেবের হামিতামি, উদ্ধতভাবে টেবিল চাপড়ানো বরদাস্ত করার কোন কারণ ছিল না, যৌক্তিকতাও ছিল না। তবু শান্তভাবে সৌজন্যের সাথে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে বললাম, ‘দেখুন, আমি ভাল করে জানি একটা দেশে কয়টা সি. ইন সি থাকে। আমি তা শুনতে বা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭১

বলতে আপনার কাছে আসিনি। আপনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ও প্রধান সেনাপতি। আমি সেই যুদ্ধে এক সাধারণ সৈনিক মাত্র। তাই বিজয়ী সৈনিক হিসাবে সেনাপতির সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে এসেছি। আমার বিশ্বাস, সেনাপতির কাছে সেনাপতিসুলভ আচরণই পাব।’
এই রুঢ় সত্য কথায় ওসমানী সাহেবের মাথায় বাজ পড়লো। প্রবাদ আছে, শক্তের ভক্ত নরমের যম। এইদিনও তাই হলো। শিষ্টাচার বজায় রেখে পাল্টা প্রচ্ছন্ন মৃদু ভর্ৎসনায় ওসমানী সাহেব ভিন্ন চেহারার মানুষ হয়ে গেলেন। তার বদমেজাজ বেমালুম উবে গেল। লজ্জিত হয়েছেন এমনভাবে বললেন, ‘না, না, তোমার উপর আমার খুবই বিশ্বাস আছে। তোমার মত ভাল ছেলে হয় না। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। আমি তোমার প্রধান সহকারী শহীদকেও তোমার সম্পর্কে আমার গভীর অনুভূতির কথা বলেছিলাম।’
এর পর আর উত্তপ্ত বাতাবরণ রইলনা। সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনেক কথা, মিষ্টি ও চা খাওয়ানোর পর স্বাগত জানাতে যে ওসমানী সাহেব সোফা থেকে উঠে দাঁড়াননি, তিনিই এবার দোতলা থেকে নীচে নেমে আমাদের গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন।
এটা সর্বজনবিদিত যে, ২৪শে জানুয়ারী আমরা এক ঐতিহাসিক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র সমর্পণ করেছিলান। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা যেমন উপস্থিত হননি, নিয়ন্ত্রিত হবার পরও তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ও প্রধান সিপাহসালার হওয়া সত্ত্বেও আতাউল গনি ওসমানী সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি।

বিভিন্ন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পরিচয়
১৬ই ডিসেম্বরের পরে বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেয়া অসংখ্য যোদ্ধাদের সাথে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগ ও আলাপ পরিচয় হয়। ২ নম্বর সেক্টরের মায়া, আজিজ, ৩ নম্বর সেক্টরের গিয়াস, সামাদ, আশেকুর রহমান, মাহবুব, নজরুল, সিরাজ, আরো অনেকে। এরা ৩ নম্বর সেক্টরে আগরতলার ইছামতী ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়েছিল। এদের কমান্ডার ছিলেন মেজর হায়দার। এরা বেশ কয়েকবার ঢাকার নানা স্থানে সফল অপারেশন পরিচালনা করেছেন। ২৩শে মার্চ, সাভারে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উঠালে সাভারের জাতীয় পরিষদ সদস্য খন্দকার নূরুল ইসলাম, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ আনোয়ার জং বাড়াবাড়ি করার অভিযোগ এনে আবদুস সামাদ, মোজাম্মেল হক ও গিয়াস উদ্দিনকে প্রচণ্ডভাবে তিরস্কার করে উন্মাদের মত গালিগালাজ করে। ২৬শে মার্চ পাকিস্তান বাহিনী বাঙালীদের উপর ঝাপিয়ে পড়লে অনেকেই যখন প্রতিরোধের জন্য নানাদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে, তখন এই দুই জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আশেপাশে আত্মগোপন করে থাকে। মে মাসের মাঝামাঝি দুই নেতাই যখন পাকিস্তানীদের কাছে আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা পাকাপাকি করে আনে, তখন আগরতলার ইছামতি ক্যাম্প থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ বেনজির আহমেদ এসে তাদেরকে আগরতলায় ইছামতি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে দুই নেতা দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত অতিথির মর্যাদায় ছিল। আমার সঙ্গে এদের ঢাকায় দেখা হলে এত আনন্দের মাঝেও মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্ষোভ প্রকাশে ভোলেননি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭২

৪ নম্বর সেক্টরে লালা, বাবলু, এম. এ. জলিল, তোহা, প্রেমতোষ সহ অন্যান্যদের সঙ্গে আমার সহযোদ্ধাদের আলাপ পরিচয় হয়। এরা মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বে সিলেটের নানা জায়গায় সফল আক্রমণ পরিচালনা করেছেন। কানাইঘাটে এরা সবচেয়ে সফল আক্রমণ চালিয়ে প্রায় দুই কোম্পানী নিয়মিত পাক-হানাদারদের ধ্বংস করে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র দখল করেছিলেন।
৮ নম্বর সেক্টরের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আকস্মিকভাবে গণভবনে আমার সাক্ষাৎ হয়। এঁরা ২৫শে মার্চের পর পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এঁদের মধ্যে ছিলেন কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান। এর নেতৃত্বে ছানা, আফতাব, শামসুদ্দিন, পঙ্গু, কাশেম, ইয়াকুব, ইউনুছ, জাফর, হামিদ, আশা, ছানোয়ার, কাজী কামাল আরো অনেকে কাজ করছিলেন।
এদের ধর্মদহের যুদ্ধ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এখানে এরা বীরবিক্রমে লড়াই করে হানাদারদের ত্রিশ জনের একটি শক্ত ঘাঁটি দখল করে বিপুল পরিমাপে অস্ত্র হস্তগত করে। মুক্তি বাহিনীর প্রবল চাপে হানাদাররা টিকতে না পেরে পাঁচটি লাশ ও তিনজন আহতকে ফেলে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীকেও এখানে প্রচুর মূল্য দিতে হয়। কমাণ্ডার হাবিবুর রহমান সহ আরও তিনজন আহত হয়।
আমি সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর আলোকপাত করছি না। সেহেতু সারা দেশে যে অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন, অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তাদের কথা লিখতে পারলাম না। যাদের সঙ্গে কোন না কোনভাবে এই সময়ে যোগাযোগ হয়েছে তাদের কথাই শুধু সামান্য তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।

অস্ত্র জমা দেওয়ার দিন নির্ধারণ
১৬ থেকে ২০শে জানুয়ারী, এই ক’দিনে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার আরো অনেকবার দেখা ও কথা হলো। ২০শে জানুয়ারীর আলোচনায় স্থির হলো, কিভাবে কত সুন্দরভাবে অস্ত্র জমা দেয়ার অনুষ্ঠানটিকে স্মরণীয় করা যায়, তার পরিকল্পনা নিয়ে টাংগাইল মুক্তিযোদ্ধারা আরেকবার মেতে উঠলো।
কর্মসূচী প্রণীত হলো,
(১) টাংগাইলের প্রান্তসীমার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে মুক্তিবাহিনী সাদর সম্বর্ধনা জানাবে এবং টাংগাইলের মূল সভামঞ্চ পর্যন্ত চল্লিশটি মোটর সাইকেল ও একটি জীপে এসকট করে নিয়ে আসবে।
(২) টাংগাইল শহরে ঢোকার পথে শিবনাথ হাই স্কুল ময়দানে তাকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে সশস্ত্র অভিবাদন জানানো হবে।
(৩) সশস্ত্র অভিবাদন শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল মাঠে। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে দীর্ঘ ন’ মাস মুক্তিযুদ্ধে আমার ব্যবহৃত অস্ত্র স্টেনগান বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়ে অস্ত্র জমা পর্বের সূচনা করা হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৩

(৪) বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠের অনুষ্ঠান শেষে জাতির জনককে নিয়ে যাওয়া হবে টাংগাইল পুলিশ প্যারেড ময়দানে। সেখানে তার সাথে আমি যৌথভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবো।
(৫) ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন শেষে বঙ্গপিতাকে নিয়ে যাওয়া হবে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে গঠিত সমবেত ‘ভবিষ্যৎ বাহিনী’র সামনে। ভবিষ্যৎ বাহিনী তাকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করবে।
(৬) মধ্যাহ্ন ভোজ শেষে টাংগাইল পার্কে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষন দেবেন এবং সভাশেষে ঢাকায় প্রত্যবর্তন করবেন।
পরিকল্পনা ঠিক হয়ে গেলে ২২শে জানুয়ারী আর একবার আমাকে বেইলী রোডের গণভবনে ডেকে পাঠালেন। তিনি ২৪শে জানুয়ারীর কর্মসূচী জানতে চাইলে সমস্ত কর্মসূচী পুঙ্খানুপুঙ্খ জানালাম। বঙ্গবন্ধু মাত্র একবার ‘গার্ড-অব-অনার’ না হলে চলতে পারে কি না, জানতে চাইলেন। আমি দৃঢ়তার সাথে বললাম, ‘না, সশস্ত্র অভিবাদন ছাড়া চলতে পারেনা।’ বঙ্গবন্ধু অস্ত্র জমা দেয়ার ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন ওজর আপত্তি তুললেন না। বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে চলে আসার সময় আমার কাধে হাত রেখে বললেন, ‘তোরা যেটা ভাল মনে করবি, তাই করিস। এই ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নাই। তবে জনসভা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে করবি। আমি রাজধানীর বাইরে এই প্রথম যাচ্ছি, তাই আওয়ামী লীগের জনসভা না হলে সেটা দৃষ্টিকটু দেখাবে ৷ যে দল স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, সেই দল এবং দলীয় কর্মীরা অসহায়বোধ করবে।’
কোন আপত্তি না করে বঙ্গবন্ধুকে কথা দিলাম, বিকেলের জনসভা আওয়ামী লীগের নামেই হবে।

সভাপতি জটিলতা
২২শে জানুয়ারী সন্ধ্যা থেকে জনসভা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে হবে, এই মর্মে মাইকে ঘোষণা শুরু হলো। এই ঘোষণার সাথে সাথে নতুন কিছু জটিলতা দেখা দিল। রাজনৈতিক দলের জনসভা হলে সেই দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই সাধারণত উদ্যোক্তা হন। এইখানে উদ্যোক্তা মুক্তিবাহিনী অথচ জনসভা হবে আওয়ামী লীগের। ভুল বুঝাবুঝি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ঢাকা থেকে টাংগাইল পৌঁছবার আগেই আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জনসভা হওয়ার ঘোষণা শুরু হয়েছিল। ঢাকা থেকে মুক্তি বাহিনীর প্রচার বিভাগকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছিলাম, জনসভা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে হবে, ঘোষণা দিতে। সন্ধ্যার একটু পর টাংগাইল পৌছতেই মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীরা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অসংখ্য কর্মী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এলেন। তাদের প্রশ্ন—দুই দিন ধরে মুক্তিবাহিনীর উদ্যোগে জনসভা হবে প্রচারের পর হঠাৎ কি করে এবং কেন তা আওয়ামী লীগের জনসভা বলে প্রচারিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জনসভায় তাদের তেমন আপত্তি ছিল না। তবে এ সময় মুক্তিবাহিনী ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতা সমর্থক অন্যান্য দলের অনেক সদস্যের টাংগাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৪

মান্নান সাহেবকে নিয়ে আপত্তি ছিল। মান্নান সাহেব খুব সম্ভবত টাংগাইলের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কখনও খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। এই অসন্তুষ্টি দেশ স্বাধীন হবার পর আরো ব্যাপক, আরো জঘন্য আকার ধারণ করে। আওয়ামী লীগের সমস্ত কর্মীরা এই সময় তাদের সভাপতির উপর যারপর নাই ক্ষুদ্ধ ছিলেন। তাদের অভিযোগ, জেলা আওয়ামী লীগের হিসাবে আবদুল মান্নান সাহেব যুদ্ধের সময় কিছুই করেননি। এমনকি তার নিজের জেলার যারা ভারতে গিয়েছিলেন, তাদের প্রতিও ভালো আচরণ করেননি। অনেকের অভিযোগ কোলকাতায় তিনি নাকি পরিচিত কর্মীদেরও চিনতে চাইতেননা। এই সমস্ত কারণে জনসভা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে হবে মেনে নিলেও, মান্নান সাহেবকে সভাপতির আসন দিতে অনেকেই আপত্তি তুললেন। বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সভার কথা বলেন, তখন কিন্তু এই ব্যাপারটা মোটেই ভাবিনি। আওয়ামী লীগের জনসভা হলে মান্নান সাহেব সেই সভায় সভাপতিত্ব করবেন, এতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না। কিন্তু বাধ সাধে মুক্তিবাহিনী, আওয়ামী লীগ ও অন্য দলের কর্মী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা। মান্নান সাহেবকে ভালো করে জানতেন, আমার অমতে ঐ সভায় তার সভাপতিত্ব করা অসম্ভব। মান্নান সাহেব দীর্ঘ সময় তার ভারতে অবস্থান এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ভুল বুঝাবঝি ও ঘটনা প্রবাহের একটি চিত্র তুলে ধরলেন। মান্নান সাহেবের কথা শেষ হলে বললাম,
– আপনার অনুমান মত আমরা নিঃসন্দেহে খুবই ছোট, খুবই বাচ্চা। কিন্তু গত নয় মাসের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি আমাদেরকেই মোকাবিলা করতে হয়েছে। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার কৃতিত্ব যখন আপনি স্বীকার করতে পারেন না, তখন সকলের অমতে আমার মত দেয়া সত্যিই অসুবিধা।
– তোমাদের কাজের অস্বীকৃতি কোনদিন জানাইনি। আমি পুরোপুরি তোমাদের সমর্থন করি। কিছু দুষ্ট লোক মুক্তিবাহিনীর সাথে আমার সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর জন্য নানা কৌশলে উঠে পড়ে লেগেছে।
অনেক আলাপ আলোচনার পর মান্নান সাহেব চলে গেলেন। কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত হলোনা।
রাত দুটায় আবার সভা বসলে জানিয়ে দিলাম, ‘মান্নান সাহেব কিংবা অন্য কেউ কবার কাদের সিদ্দিকীর নাম নিল কি নিল না, মুক্তিবাহিনীকে সালাম জানাল কি কি জানাল না, সেটা আমাদের দেখবার কথা নয়। আমি নেতাকে কথা দিয়ে এসেছি, জনসভা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে হবে। চিরাচরিত প্রথা আওয়ামী লীগের জনসভায় জেলা সভাপতি সভাপতিত্ব করেন। আর এই সভাতেও তাই করবেন, এর নড়চড় হবে না।’ সমবেতরা নানা জল্পনা-কল্পনা করতে করতে একে একে চলে গেলেন। আমিও বেরিয়ে পড়লাম, পরদিনের অনুষ্ঠানগুলির প্রস্তুতি পর্ব শেষবার স্বচক্ষে দেখার জন্য। যুদ্ধকালীন অনেক রাতের মত ২৩শে জানুয়ারীর রাতও বিনিদ্র কাটলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৫

নব অধ্যায়ের সূচনা

শনিবার ২৪শে জানুয়ারী, ১৯৭২ সাল। শীতের কুয়াশার চাদর ছিন্ন করে সূর্য্য আলো ছড়াতে শুরু করেছে। শুরু হলো টাংগাইলের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় গৌরবোজ্জল অধ্যায়ের। সোনালী আশীর্বাদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনে উন্মোচিত হলো আমৃত্যু স্মরনযোগ্য স্বর্ণময় একটি দিনের। উৎসবের আমেজে টাংগাইলের ঘুম ভাঙলো। কর্মচাঞ্চল্য সারা জেলায়। টাংগাইলের প্রান্তসীমানা থেকে জেলা শহরের ছাব্বিশ মাইল পথ নেতাকে নিয়ে আসার সমস্ত দায়-দায়িত্ব মুক্তিবাহিনীর। স্বাগত তোরন তৈরী, রাস্তায় দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জ্ঞাপন, রাস্তা ও সভা সমিতির নিরাপত্তা বিধান, সব কিছুই তাদের হাতে। তাই স্বাভাবিক কারণে মুক্তি বাহিনীর নেতৃস্থানীয়দের মত সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিনিদ্র কর্মব্যস্ত রজনী কেটেছে। তবুও তাদের কোন ক্লান্তি অবসাদ নেই। এমন একটি সুন্দর স্মরনীয় দিনের জন্য তারা শত রজনী তপস্যা করতে পারে, হাজারো ধকল অম্লান বদনে হাসিমুখে সইতে পারে। গোড়াই থেকে টাংগাইল পর্যন্ত দশ-পনের ফুট দূরে দূরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জ্ঞাপনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সভাস্থলে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাতের মধ্যেই দু’শ বাস ও ট্রাক ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দিয়ে ট্রাক ও বাসগুলো তাদের আবার নিয়ে যাবার জন্য রাস্তা থেকে দেখা না যায়, এমন স্থানে অপেক্ষা করছিল।
সকাল সাতটায় নেতাকে স্বাগত জানাতে টাংগাইলের প্রন্তসীমা গোড়াই রওনা হওয়ার আগে গণ-পরিষদ সদস্যদের ফোন করে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে গোড়াই কে কে যাবেন জানতে চাইলাম। ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করলাম, সবারই যাওয়া উচিত। আপনাদের গাড়ি তো আছেই, প্রয়োজনে যাতে অন্য গাড়ীতে আসতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও করা হবে। কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সহযোদ্ধা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো মুক্তিযোদ্ধাদের নানা উপদেশ ও পরামর্শ দিতে দিতে সকাল আটটা পনের মিনিটে গোড়াই এলাম। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন গণ-পরিষদ সদস্যও এসে পৌঁছলেন। প্রথমে পৌঁছলেন শামসুর রহমান খান শাজাহান, হাতেম আলী তালুকদার ও অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ। লতিফ সিদ্দিকী, ফজলুর রহমান খান ফারুক দ্বিতীয় দলে গোড়াই এলেন। বাসেত সিদ্দিকী সাহেব আমাদের সাথেই এসেছিলেন।
সবাই অধীর আগ্রহে নেতার আগমনের অপেক্ষায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিলাম। মুক্তিবাহিনীর একটি জীপ বার বার ঢাকার দিকে এগিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছিল। জয়দেবপুর ও কালিয়াকৈর টেলিফোন এক্সচেঞ্জে মুক্তিবাহিনী লোক বসিয়ে রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর গাড়ী জয়দেবপুর পার হতেই যেন খবরটা গোড়াই চলে আসে। সকাল পৌনে ন’টায় প্রথম খবর এলো, বঙ্গবন্ধু চৌরাস্তা অতিক্রম করেছেন। সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা একটু তৎপর হয়ে উঠল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৬

স্বাগত তোরণের কয়েকশত গজ পিছে রাস্তায় দুই পাশে ৪০টি মোটর সাইকেল দাঁড়িয়ে ছিল। মোটর সাইকেলগুলো বঙ্গবন্ধুকে এস্কর্ট করে নিয়ে যাবে। একখানা হুড খোলা উইলী জীপ নিয়ে সবার আগে থাকবেন অপূর্ব সুন্দর সামরিক পোষাকে সজ্জিত ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান। তিনি কখনও পিছনে, কখনও সামনে, ডাইনে-বামে লক্ষ্য রেখে মোটর সাইকেল আরোহীদের সংকেত দেবেন। মোটর সাইকেল আরোহীদের পিছনে তাকানোর কোন প্রয়োজন হবে না। ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানকে লক্ষ্য করলেই তারা অনায়াসে বুঝতে পারবে, কখন চলতে হবে, কখন থামতে হবে, আবার কখন গতি বাড়াতে বা কমাতে হবে। ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান গত দুদিন ধরে মোটর সাইকেল আরোহীদের প্রয়োজনীয় সংকেতগুলো বার বার শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছেন। গোড়াই থেকে টাংগাইল শহর পর্যন্ত ইতিমধ্যেই তিনি ৪ বার মহড়া দিয়েছেন। সর্বশেষ মহড়া হয়েছে রাত চারটায়। ব্রিগেডিয়ার ফজলু তার জীপ টাংগাইল জেলা স্বাগত তোরণ থেকে প্রায় আধ মাইল সামনে রেখেছেন। ঠিক দশটায় শতাধিক গাড়ীর লাইনে বঙ্গবন্ধুর গাড়ী এসে স্বাগত তোরণের সামনে এসে থামলো। দৌড়ে গিয়ে গাড়ী দরোজা খুলে দিলাম। বঙ্গবন্ধু গাড়ী থেকে নেমেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। মালা দেবার কোন অবকাশ পেলাম না। বঙ্গবন্ধুকে খুব সুন্দর, সতেজ, উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। আমাকে আলিঙ্গন মুক্ত গণ-পরিষদ সদস্য ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একের পর এক করমর্দন ও আলিঙ্গন মুক্ত করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কিভাবে যেতে হবে? কারে না জিপে যাবো?’ গোড়াই থেকে বঙ্গবন্ধুকে খোলা জীপে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়া হলো।
‘আপাতত কারে যাওয়াটাই ঠিক হবে। অসংখ্য পুল ভাঙা। তাই কারেই চলুন।’
বঙ্গবন্ধু কারে উঠে বসলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ডানে, আমি বামে। সামনের সিটে গাড়ীর চালক ও বঙ্গবন্ধুর এক দেহরক্ষী। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট খোলা জীপটি কারের ঠিক পিছনে রাখা হলো। সামনে থেকে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান সংকেত দেয়ার সাথে সাথে সাদা জুতো, মোজা, প্যান্ট, জামা, হাতে সাদা দস্তান, মাথায় সাদা টুপি পরিহিত চল্লিশ জন আরোহী তাদের মোটর সাইকেল আস্তে আস্তে, পরস্পর থেকে সমান দূরত্ব রেখে একই গতিতে চলতে শুরু করলো। দেখে মনে হচ্ছিল সোনালী রোদের সাথে এক ঝাক সাদা রোদ্দুর খেলতে খেলতে ঢেউয়ের মত দোল খেয়ে এগুচ্ছে। মোটর সাইকেলের সারির পরই বঙ্গবন্ধুর গাড়ী তাল মিল রেখে টাংগাইলের দিকে এগিয়ে চলল। গণ-পরিষদ সদস্যরা খোলা জীপের পরেই তাদের জন্য রাখা গাড়ীতে উঠলেন।
এই সময়ে একটি ঘটনা ঘটল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গাড়ীর সারি যখন ঢাকার দিক থেকে আসছিল তখন বঙ্গবন্ধুর গাড়ীর আগে পিছে পুলিশ এসকর্ট ছিল। পুলিশরা জীপে রাইফেল ও এল. এম. জি. উচিয়ে আসছিল। টাংগাইলের সীমানায় এসে বঙ্গবন্ধুর গাড়ী থামলে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান বন্দুক উঁচিয়ে আসা পুলিশ ও পুলিশের জীপগুলোকে একেবারে পিছনে সরিয়ে দিয়ে ঝাঁঝের সাথে পুলিশ দলের নেতা এক ডি. এস. পি-কে বললেন, ‘টাংগাইলে বন্দুক উচিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৭

রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবেনা। রাইফেল, এল. এম. জি. টাংগাইলের মানুষ বহু দেখেছে। তিনি আরও স্মরন করিয়ে দেন-পিছনে গিয়েও তারা যাতে আর রাইফেল, এল. এম. জি. না দেখান এমনটাই মুক্তিবাহিনী চায়। একে তো টাংগাইল মুক্তিবাহিনী নিয়ে নানা গুজব, নানা অপপ্রচারের অন্ত নেই, দ্বিতীয়ত বঙ্গবন্ধুর সাথে তার মন্ত্রীপরিষদের একজন সদস্যও আসেননি, এমনকি প্রতিরক্ষা দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সিপাহসালার মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীও না। তার উপর টাংগাইলের সীমানায় আসতে না আসতেই পুলিশ এস্কর্টদের অমনভাবে তাড়িয়ে একেবারে পিছনে সরিয়ে দেয়াতে বঙ্গবন্ধুর সাথে আসা আমলাদের মনে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। যদিও পুলিশদের সরিয়ে দেওয়াটা বঙ্গবন্ধু লক্ষ্য করেননি। তিনি মুক্তিবাহিনীর সুশৃঙ্খল সদস্যদের দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। সুশৃঙ্খল, সুবিন্যস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিখুঁত তালমিল রেখে গার্ড করে নিয়ে যাওয়া দেখে তিনি যারপর নাই মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছিলেন। গাড়ী চলা শুরু করতেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কারা? ওরা কি মুক্তিবাহিনী? তোর মুক্তিবাহিনী এত কিছু পারে কি করে?’ বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন, খেয়াল করার কোন ফুসরত তার ছিল না। অনেক পরে এক আমলা যখন বঙ্গবন্ধুকে জানালো, ‘পুলিশদের ঐভাবে পিছনে সরিয়ে দেয়া ঠিক কাজ হয়নি।’ তখন অপরাহ্ন, এর পূর্বে মুক্তিবাহিনীর অভূতপূর্ব মনোমুগ্ধ কর্মকান্ড দেখে তিনি মুগ্ধ, অভিভূত। স্মিত হেসে আমলাটিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা ঠিক কাজই করেছে। ওদের জায়গায় এসেছি, ওদের মতেই চলা উচিত।’
পাঠকের মনে একটি প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, কেন বঙ্গবন্ধু শুধু একা এলেন? কোন সহকর্মী কেন তার সাথে এলেন না? সত্যিকার অর্থেই দেশ স্বাধীন হবার পর গুজবে, অপপ্রচারে যে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে অন্যান্যদের না আসাটাই স্বাভাবিক। কারণ আর সবাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নন। অতীতে তাদের শক্তি, সাহস ও বুদ্ধিমত্তার অভাবের পরিচয়ও অসংখ্য বার পাওয়া গিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহকর্মীদের অনেকের ধারণা ছিল, ২৪ শে জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু টাংগাইল গেলে মুক্তিবাহিনী তাঁকে জিম্মি বানাবে। তার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেবে, এমন সব ভুতুড়ে লক্ষণও নাকি তাঁরা দেখেছেন। এমনকি কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর টাংগাইল আসার কর্মসূচী শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত বানচাল করতে চেষ্টা করেছিলেন। যাদের মন কলুষিত, অন্যদের মাঝেও তাঁরা কলুষতা খুঁজেন। বঙ্গবন্ধু যে কত সাহসী, কত মহান, কত নিশ্ছিদ্র তাঁর হিমালয় প্রমাণ আত্ম-প্রত্যয় – তা এখান থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। এত উত্তেজনা ও গুজব, এত হৈ চৈ, ভুল বুঝাবুঝির মাঝেও বঙ্গবন্ধুর বিন্দুমাত্র উৎকণ্ঠা নেই, উদ্বেগ নেই। তিনি টাংগাইলে এমন আচরণ করলেন, যেন নিজের বাড়ীতে এসেছেন। নিজের ছেলে- মেয়েদের মধ্যে এসেছেন এবং নিজের আত্মীস্বজনের মতই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিশে গিয়েছিলেন।
গোড়াই থেকে এক মাইলও এগুনো গেলোনা। মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজের (বর্তমানে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৮

মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ) সামনে প্রায় দশ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে থামতে হলো। এক-দুই মিনিট ভাষণ দিয়ে আবার তিনি গাড়ীতে উঠে বসলেন। বঙ্গবন্ধুর গাড়ী থামতেই সামনের মোটর সাইকেলগুলো নিখুঁতভাবে সম দূরত্ব বজায় রেখে থেমে গিয়েছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধু গাড়ীতে উঠতেই আবার মোটর সাইকেলগুলো সমান তালে আস্তে আস্তে চলা শুরু করল। ক্যাডেট কলেজ থেকে এক মাইল এগিয়ে গোড়াই কটন মিলের সামনে আবার নামলেন। ভাষণ দিলেন। এরপর মির্জাপুর। মির্জাপুর বাস স্ট্যান্ড লোকে লোকারণ্য। বঙ্গবন্ধু এখানেও বক্তৃতা করলেন। তারপর পাকুল্লা, জামুর্কী ও নাটিয়াপাড়ায় পথিপার্শ্বে তিনটি সভায় সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। বঙ্গবন্ধু গোড়াই থেকে টাংগাইলের দিকে পার হয়ে যাওয়ার পর পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জন্য রাখা গাড়ীগুলোতে একের পর এক উঠে পড়ল এবং চলমান গাড়ীর সারিতে মিশে গেল। জনসাধারণকেও টাংগাইল নিয়ে আসার জন্য চারশ ট্রাক বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গাড়ী এগিয়ে যাচ্ছে আর জনতার যে অংশ পিছনে পড়ছেন, তাঁরা একের পর এক গাড়ী বোঝাই হয়ে টাংগাইলের দিকে এগুতে থাকলেন।
বঙ্গবন্ধুর গাড়ী মটরা সেতুর বিকল্প রাস্তার উপর উঠতেই আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও বিখ্যাত কমান্ডার আবদুস সবুর খান মালা হাতে স্বাগত জানালেন। বঙ্গবন্ধু গাড়ী থেকে নেমে এলে বিশেষভাবে ব্যবস্থা করা টাংগাইল ক-১৫ খোলা জীপে তাকে তোলা হলো। গাড়ী এগিয়ে চললো। এবার বঙ্গবন্ধুর বাম পাশে জীপের পাদানিতে আমি, ডানে আনেয়ার-উল-আলম শহীদ। গাড়ীর চালক টাংগাইল রোড এন্ড হাইওয়েজের জীপ চালক নোয়াখালির নুরু। পিছনে টেপ- রেকর্ডার হাতে নাজিবুর রহমান পিন্টু। বঙ্গবন্ধু জীপে বসে চলতে চলতে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন। তিনি একদিকে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের তারুণ্য, কর্মস্পৃহা, নব উদ্দীপনা দেখে নতুন বাংলা গড়ায় আশান্বিত হয়ে উঠছিলেন, অন্যদিকে যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত সোনার বাংলার শ্মশান রূপ দেখে মাঝে মাঝে বিমর্ষ ও বেদনাহত হচ্ছিলেন। মটরা সেতু ও বটগাছের মাঝামাঝি একবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘টাংগাইলে কি হবে?’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম, ‘যা হবার তাই হবে এবং যা হওয়া উচিত।’ এই নিয়ে আর কোন কথা হলোনা। করটিয়া সাদৎ কলেজের সামনে এলে বঙ্গবন্ধুকে আবার নামতে হলো। বহু সংগ্রামের পীঠস্থান এই সাদৎ কলেজ। শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদায় আসীন করার নিরলস নিরস্তর দীর্ঘ রক্তঝরা সংগ্রামে সারা বাংলার অন্যান্য স্থানের চেয়ে এই কলেজে ভূমিকা মোটেই গৌণ নয়। কলেজের সামনে একশ’ গজ পায়ে হেঁটে বঙ্গবন্ধু আবার গাড়ীতে উঠলেন। কিন্তু মাত্র দু’তিনশ গজ এগিয়ে করটিয়া বাজারের পাশে করটিয়া জমিদার বাড়ী ও বোর্ড অফিসের মাঝামাঝি একটা অস্থায়ী সভার মঞ্চ হয়েছিল। এইখানের বঙ্গবন্ধু টাংগাইল শহরে প্রবেশের পূর্বে পথিপার্শ্বে ভাষণ দিলেন। করটিয়া এই সভামঞ্চের আশেপাশে বেশ কিছু সুযোগ-সন্ধানী অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদেরও দেখা গেল, যাদের মুক্তিযুদ্ধে কোন প্রশংসনীয় ভূমিকা নেই। এদের মধ্যে কে. কে. পন্নির পুত্র টিপুকেও মঞ্চের আশে-পাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার সংগঠক খসরু খান পন্নী ও সেলিম খান পন্নীকে দেখা যায়নি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৯

করটিয়া থেকে টাংগাইলের মাঝে ভাতকুড়া গোরস্থানের পাশে বঙ্গবন্ধুকে নামানো হলো।
১২ই ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর বিরাট অংশ যখন ঢাকার দিকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। এ সময় অধ্যাপক মুশফিকুর রহমান আবুর নেতৃত্বে পনের কুড়িজন মুক্তিযোদ্ধা আট-নয় জন দল হানাদারকে পিছু ধাওয়া করতে করতে ভাতকুড়া পর্যন্ত আসে। হানাদাররা কিছুতেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজী নয়। মুক্তিযোদ্ধারাও নাছোড় বান্দা। হানাদাররা ছুটে পালাচ্ছে, আবার মাঝে মাঝে পিছন ফিরে গুলি চালাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধার তেমন ব্যাপক গুলি ছুঁড়ছেনা। তারা হানাদারদের জ্যান্ত ধরতে বদ্ধপরিকর। ভাতকুড়ার কাছে মুক্তিবাহিনী যখন হানাদারদের একেবারে ধরে ফেলার উপক্রম করে, তখন হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধদের উপর গুলি চালায়। সবাই পজিশন নিতে পারলেও কমান্ডার অধ্যাপক মুশফিকুর রহমানের ছাত্র সদ্যাগত শফি পজিশনে যাবার আগেই তার কণ্ঠনালী ভেদ করে হানাদারদের একটি বুলেট বেরিয়ে যায়। সে সাথে সাথে লুটিয়ে পড়ে। কমান্ডার অধ্যাপক মুশফিকুর রহমান আবু দৌড়ে সহযোদ্ধাটির কাছে গিয়ে দেখে, সব শেষ হয়ে গেছে। যদিও এর পর হানাদারদের ধরতে তাদের বেশী বেগ পেতে হয়নি। মেজর মোকাদ্দেসের কোম্পানীর সহায়তায় কয়েক মিনিট পরই ৮ জন হানাদার নমরুদকে তারা হতে-নাতে জ্যান্ত ধরে ফেলে। শহীদ শফিকে ভাতুকুড়া গোরস্থানে যথাযোগ্য মর্যাদায় দাফন করা হয়েছিল। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত শেষে বঙ্গবন্ধু আবার গাড়ীতে উঠলেন।

সশস্ত্র অভিবাদন
ঠিক সকাল এগারোটায় বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী টাংগাইল ক-১৫ টয়োটা জীপ টাংগাইলের শিবনাথ হাই স্কুলের মাঠে প্রবেশ করল। প্রবেশের পথের দুই পাশে দুইটি এবং মাঠ থেকে বেরোবার পথে দুইটি মোট চারটি সিকা পাউডার গান সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি অভিবাদন মঞ্চে দাড়াতেই এক হাজার সুসজ্জিত মুক্তিযোদ্ধা তাঁকে সশস্ত্র অভিাদন জানালো। অভিবাদনের সময় একদল মুক্তিযোদ্ধা বাদ্যযন্ত্রে মৃদুলয়ে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ সুর বাজালো। বঙ্গবন্ধু জড়তাহীনভাবে মুক্তিযোদ্ধদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও আমি বঙ্গবন্ধুর দেড় ফুট পিছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। সামরিক অভিবাদন শেষে প্যারেড কমান্ডার বিখ্যাত জাহাজ মারা কমান্ডার মেজর হাবিব এগিয়ে সে বঙ্গবন্ধুকে প্যারেড পরিদর্শন করতে আমন্ত্রণ জানাল। মেজর হাবিবের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু প্যারেড পরিদর্শনে এগিয়ে গেলেন। তিন সারিতে দাড়ানো এক হাজার মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যেককে তিনি ঘুরে ঘুরে দেখলেন এবং নানা কথা জিজ্ঞেস করলেন। পরিদর্শন শেষে মঞ্চে ফিরে এসে দাঁড়াতেই তার সামনে মাইক্রোফোন এগিয়ে দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধু একবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি বলবো?’
– আপনার যা ইচ্ছা।
বঙ্গবন্ধু সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দিত করে বললেন,
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮০

‘আপনারা যা করেছেন, তার তুলনা হয়না। আমি আপনাদের দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আপনারা যুদ্ধ করেছেন, স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। আজ দেশ গড়ার লড়াইয়ে আপনাদের যুদ্ধ সময়ের মন নিয়েই এগিয়ে আসতে হবে। আমি আপনাদের একজন হয়ে কাজ করব।’
বক্তৃতা শেষে আবার গাড়ীতে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন,
– এরা কারা? এরা কি বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক?
– না, বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন থাকলেও থাকতে পারে। তবে তা হাজারে চার- পাঁচ জনের বেশী হবেনা। এদের প্রায় সবাই কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক ও নানা পেশার লোক। বঙ্গবন্ধকে আরও বললাম, আপনি কি করছেন? আপনি এদেরকে ‘আপনি আপনি’ করছেন। সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদের আমিও তুমি সম্বোধন করি। যদিও আলাদা আলাদাভাবে অনেককে আপনি বলি। আপনার ‘আপনি বলা শুনে এরা তো হাসবে।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮১

অস্ত্র হস্তান্তর

ঘড়ির কাঁটা এগারটা ত্রিশ মিনিটের ঘরে। বঙ্গবন্ধুকে বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে অস্ত্র জমা দেওয়ার মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো। অস্ত্র জমা দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা হিসাবে নানা ধরনের হাজার দশেক হাতিয়ার বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে সার করে দাঁড় করা ছিল। তিন হাজার সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের সামনে মাঠের এক পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও আমি মঞ্চে উঠতেই প্যারেড কমান্ডার মেজর আবদুল হাকিম মাঠে দাঁড়ানো মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করল এবং সশস্ত্র অভিবাদন জানাল। অভিবাদন শেষে অস্ত্র সমর্পণের প্রতীক হিসাবে আমার ব্যবহৃত স্টেনগান প্রসারিত দুই হাতে সটান দেহ, টান টান সিনা, সুশৃঙ্খল অনিন্দ্য সুন্দর সামরিক ছন্দে মেজর আবদুল হাকিম ত্রিশ কদম মঞ্চের দিকে এগিয়ে এনায়েত করিমের সামনে এলো। এনায়েত করিম ততক্ষণে মঞ্চের দিকে পিঠ ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন। এনায়েত করিমের হাতে অস্ত্রটি তুলে দিয়ে ঘুরে পূর্বের ভঙ্গিতে মার্চ করে তার স্থানে দাঁড়ানোর পর মেজর হাকিম এবং এনায়েত করিম এক সাথে, এক তালে, মঞ্চের দিকে মুখ ফেরাল। এর পর এনায়েত করিম স্টেনগানটি প্রসারিত দুই হাতে সামরিক কায়দায় মার্চ করে মঞ্চে উঠলে আমি দুই পা এগিয়ে অস্ত্রটি নিলাম। এনায়েত করিম এক পা পিছিয়ে অভিবাদন জানিয়ে আবার পিছু ফিরে মার্চ করে তার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন। এনায়েত করিমের দাঁড়ানোর সাথে তাল রেখে দুই জন এক সাথে বঙ্গবন্ধুর দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। এর পর দুই পা বামে সরে হাঁটু গেড়ে বহুদিনের ব্যবহৃত বহু লড়াইয়ের স্মৃতিবিজড়িত স্টেনগানটি বঙ্গবন্ধুর পায়ের সামনে রাখলাম। আমার হাঁটু গেড়ে বসার সাথে নিখুঁত সময় ও সুন্দর তাল রেখে মাঠের পাশে প্রতীক হিসাবে সারিবদ্ধ দাঁড়ানো তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধাও নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে লম্বালম্বি যার যার অস্ত্র মাটিতে রেখে আমার সাথে তাল রেখে দাঁড়িয়ে ডাইনে দুই কদম সরে গেল। বঙ্গবন্ধু নীচু হয়ে দুই হাতে স্টেনগানটি তুলে অনেকক্ষণ ধরে রাখলেন। অভিভূত আমি আস্তে আস্তে স্বস্থানে গিয়ে দাঁড়ালাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হাতের অস্ত্রটি ডান পাশে দাঁড়ানো আনোয়ার-উল-আলম শহীদের হাতে দিয়ে দুচোখে বন্যার জল, হৃদয়ে এক সাগর স্নেহ নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদের পর যেন পিতা পুত্রের মিলন। আমাদের দুজনের চোখের পানি কোন বাধ মানছিলনা। কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও উপস্থিত পঞ্চাশ-ষাট হাজার মুগ্ধ বিস্মিত মানুষ অশ্রুসিক্ত দুর্লভ অনুপম মহৎ ক্ষণটি দেখলেন।
অস্ত্র পরিদর্শনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে আহ্বান জানানো হলো। শত শত দেশী বিদেশী সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারদের ভিড়ের মাঝদিয়ে মাঠে রাখা অস্ত্রগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলেন এবং একটি ছোট্ট ছেলেকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ছেলেটি কে?’
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮২

– ছেলেটির নাম শহীদ। আমাদের নামটি মনে থাকতো না বলে ওকে আমরা লালু বলে ডাকি। এই ছেলেটি গোপালপুর থানায় গ্রেনেড চার্জ করে আট জন হানাদারের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু দশ-এগার বছরের শহীদকে কোলে তুলে নিলেন এবং দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের ছেলেটিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘এরাই আমার মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সকল কৃতিত্ব, সকল প্রশংসা এদের। অস্ত্র পরিদর্শন শেষে বঙ্গবন্ধুকে কিছু বলতে অনুরোধ করলাম। বঙ্গবন্ধু উল্টে আমাকে বললেন, ‘তুই বল।’
– আমার যা বলার বিকেলের জনসভাতেই বলবো। আপনি বলুন।
– না, তুই কিছু বল।
নেতার আদেশ পেয়ে বঙ্গবন্ধুকে সম্বাধন করে সমবেতদের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘আমরা আজ গর্বিত। যে নেতার আহ্বানে অস্ত্র ধরেছিলাম, স্বাধীন করে সেই মহান নেতার আহ্বানে তারই হাতে আমরা অস্ত্র জমা দিলাম। আমরা আশা করব, দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনে আমাদের এই অস্ত্র, এই পবিত্র আমানত কাজে লাগবে। দেশের মানুষ নয় মাস আধপেটা খেয়ে কোন কোন সময় না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে সাধারণ মানুষকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করেছি। দেশের মানুষ যদি পেটপুরে খেতে না পারে, রাতে নিরাপদে ঘুমুতে না পারে, দিনে নির্বিঘ্নে চলতে না পারে, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। গত নয় মাসে হানাদারদের হাত থেকে মা, বাবা, ভাই-বোন আত্মীয় স্বজনরা আমাদের রক্ষা করতে পারেননি। এই অস্ত্র দ্বারাই আমাদেরকে রক্ষা পেতে হয়েছে, এই অস্ত্র দ্বারাই দখলদারদের তাড়াতে হয়েছে। সেই অস্ত্রই আজ আমরা আপনার হাতে তুলে দিলাম। আমাদের কামনা, এর যেন অপপ্রয়োগ না হয়। আমরা মনে করি, সেনাপতির উপস্থিতিতে যোদ্ধাদের সেনাপতির ন্যায়সঙ্গত আদেশ পালনই একমাত কর্তব্য। আমরা তাই পালন করছি।
মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা, বিগত নয় মাস যুদ্ধের ময়দানে আমি তোমাদের সামনে ঠেলে দিয়ে পিছনে পড়ে থাকিনি। প্রতিটি যুদ্ধে তোমাদের আগে থেকেছি, আগে থাকার চেষ্টা করেছি। আবার যদি বাঙালীরা অত্যাচারিত হয়, আবার যদি আঘাত আসে, তা হলে আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদেরকে আগে ঠেলে দিয়ে পিছনে পড়ে থাকবোনা। আবার জাতীয় প্রয়োজন দেখা দিলে আমরা অবশ্যই অস্ত্র হাতে তুলে নেবো।’
আমার বক্তৃতার সময় বঙ্গবন্ধু অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি বার বার রুমালে চোখ মুছছিলেন। সমবেত হাজার হাজার জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারাও আনন্দ ও বেদনায় বারে বারে অশ্রুসিক্ত হচ্ছিলেন। আমার বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু মাইক্রোফোনের সামনে এলেন। তার তখন ভিন্ন চেহারা, চোখে অশ্রু, কন্ঠে আবেগ, দেহ-মনে আবেশ। যিনি ঘন্টা খানেক আগে শিবনাথ স্কুল মাঠে সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদের ‘আপনি’ সম্বোধন করে বক্তৃতা করেছেন, তিনি এখানে নেতা, পিতা ও ভাইয়ের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের ‘তুমি’ সম্বোধন করে কান্নাজড়িত দরদভরা কণ্ঠে এক অবিস্মরণীয় বক্তব্য রাখলেন,
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৩

‘আমি তোমাদের সালাম জানাই। ত্রিশ লক্ষ, মা ভাই-বোন শহীদ হয়েছেন। আমি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আমি তোমাদের হাতে অস্ত্র দিয়ে যেতে পারি নাই। শুধু হুকুম দিয়ে গিয়েছিলাম। তোমরা হানাদারদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে বিজয় সূর্য্যকে ছিনিয়ে এনেছ। তোমাদের তুলনা হয় না। বিশ্বে খুব কম এমন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। তোমাদের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক, রক্তের বন্ধন। তোমাদের নেতা কাদেরকে আমি মায়ের পেট থেকে পড়ার পরই দেখছি। শহীদকে আমি হতে দেখেছি। তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তোমরাই সত্যিকারের দেশ গঠনের উপযুক্ত সৈনিক। তোমরাই দেশ গঠন করবে। সরকারী কর্মচারী, পুলিশের কথা আমি শুনব না। তোমরা যে খবর দিবা, তোমরা যে রিপোর্ট পাঠাবা, তাই সত্য বলে ধরা হবে। কোন সরকারী কর্মচারী ঘুষ খেলে তাকে ছাড়া হবেনা। তোমরা আমাকে রিপোর্ট করবা। আমি তোমাদের রিপোর্ট বিশ্বাস করব এবং সরকারী কর্মচারীটিকে সোজা জানিয়ে দেয়া হবে, ‘ইউর সার্ভিস ইজ নো লংগার রিকোয়ার্ড।’ আমি সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ কাজ দেবো। তোমরা যারা স্কুল কলেজে পড়তে চাও, তারা স্কুল-কলেজে যাবে। সরকার তাদের সম্পূর্ণ খরচ করবে। যারা চাকরী করতে চায়, তাদের অগ্রগাধিকার দেয়া হবে। যারা কৃষিকাজ ও অন্যান্য পেশায় যেতে চাও, সরকার তাদের সব রকম সাহায্য করবে। কোন জাতি তার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান না দিয়ে বড় হতে পারেনা। আমি তোমাদের মাঝে আবার আসবো।
জয় বাংলা, জয় মুক্তিবাহিনী।’

শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন
বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হলো বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠ থেকে তিন চার শত গজ দূরে পুলিশ প্যারেড ময়দানে নতুন শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করতে। এই পথটুকু বঙ্গবন্ধু হেঁটে গেলেন। চল্লিশ-পঞ্চাশটি বিদেশী দল ও ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধকে প্রতি মুহূর্তে অনুসরণ করছিল। টাংগাইল আসার পর যেন তাদের ক্যামেরা আর থামতে চাচ্ছেনা। পুলিশ প্যারেড ময়দানে বঙ্গবন্ধু ও আমি দুইপাশে থেকে শ্বেত পাথরের প্রস্তর ফলক স্থাপন করলাম। প্রস্তর ফলক স্থাপনের পর বঙ্গবন্ধু দুই মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। সাথে সাথে আশে পাশে জন সমুদ্রের গর্জন নীরব হয়ে গেল। এমন নিস্তব্ধতা যে, সুঁই পড়লেও শোনা যাবে। দুই মিনিট নীরব থাকার পর শহীদি আত্মাদের মাগফেরাত কামনা করে বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য সবাই মোনাজাত করলাম।

ভবিষ্যত বাহিনীর সম্বর্ধনা
এরপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পুলিশ প্যারেড ময়দানের অন্য প্রান্তে দশ-বার বছর বয়সী কয়েক হাজার ভবিষ্যৎ বাহিনীর বাচ্চাদের সমাবেশে উপস্থিত হলেন। এটাও রীতিমত সুশৃঙ্খল বাহিনীর সমাবেশ। বাচ্চারা কেউ খালি হাতে আসেনি। সবাইর হাতে বাঁশ দিয়ে বানানো নানা ধরনের অস্ত্র। এগুলো বাচ্চারা নিজেরাই বানিয়েছে। তারাই নিজেদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৪

নাম দিয়েছে ভবিষ্যৎ বাহিনী।’ বঙ্গবন্ধু সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ভবিষ্যৎ বাহিনীর সামনে মঞ্চে দাঁড়াতেই তারা শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, কাদের সিদ্দিকী জিন্দাবাদ, ভবিষ্যৎ বাহিনী জিন্দাবাদ শ্লোগানে ময়দান মুখরিত করে তুললো। ভবিষ্যৎ বাহিনী গার্ড-অব-অনার শেষে বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমরা ভবিষ্যৎ বাহিনী বানিয়েছ, আবার যদি বাংলার মানুষকে শোষণ করা হয়, তোমরা তখন বাংলার মানুষের পক্ষে যুদ্ধ করবা। জয় বাংলা, জয় ভবিষ্যৎ বাহিনী।’ এই টুকুতেই ভবিষ্যৎ বাহিনীর কয়েক হাজার শিশু আনন্দ কলরবে মুখর হয়ে উঠলো। জয়ধ্বনির মাঝে বঙ্গবন্ধু অভিবাদন মঞ্চ থেকে নেমে এলেন।
এরপর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হলো ওয়াপদা ডাক বাংলোয়। সেখানে স্নান সেরে নেবেন। যখন স্নান করছিলেন তখন তার কালো কোট (মুজিব কোট) একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিষ্কার করছিল। গোড়াই থেকে টাংগাইল পর্যন্ত কাঁচা ও ইট বিছানো রাস্তা পেরিয়ে আসতে আসতেই জামা-কাপড় সব ধুলায় ধূসরিত হয়ে গিয়েছিল। একজন মুক্তিযোদ্ধার যখন এক হাতে ধরে অন্য হাতে কোটটি ভালভাবে ব্রাশ করতে অসুবিধা হচ্ছিল, তখন সে কোটটি আরেক জনের গায়ে চাপিয়ে ব্রাশ করতে চাইলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কোট পরবে কে? কেউ রাজী নয়। কান্ডটা আমার সামনেই হচ্ছিল। নূরুন্নবীকে বললাম, ‘তুমি কোট গায়ে দাঁড়াও। কোট পরষ্কিার করা দরকার। তাই ঐটি গায়ে চাপানো দোষের কিছু নেই।’ নূরুন্নবীর মরার উপর খাড়ার ঘার উপক্রম। কিছু বলার আগেই কোটটি তার গায়ে চাপিয়ে দেয়া হলো। নুরুন্নবীকে আগে বেশ মানানসই দেহ গড়নের অধিকারী বলে মনে হতো। মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের সফল কর্মকর্তা নুরুন্নবী যে অত বেঁটে খাটো ও ছোট— বঙ্গবন্ধুর কোট গায়ে চালাবার আগে আমাদের কারো মনে হয়নি। বঙ্গবন্ধুর কোটটি নুরুন্নবীর হাটু অব্দি এসে ঠেকেছে। কোটের ভিতরে আরেক নুরুন্নবীকে ঢুকালেও খুব একটা অসুবিধা হবেনা। ভীষণ ঢিলে-ঢালা, বৈসাদৃশ্য ও বেমানান ভাবে কোট গায়ে নুরুন্নবী যখন নেড়েচেড়ে এবং নড়েচড়ে দেখার চেষ্টা করছিল কোটটা তার গায়ে কতটা বেঢপ হয়েছে, তখন ভীষণ মজার দৃশ্যের অবতারনা হলো। অবস্থাটা উপভোগ করে উপস্থিত সবাই প্রাণ খুলে হাসলো।
স্নান শেষে বঙ্গবন্ধু তৈরী হয়ে নিলে মুক্তিযোদ্ধারা তার সাথে অসংখ্য ছবি তুললো। এই সময় বঙ্গবন্ধু আমার সব ভাই-বোনদের সাথে একত্রে ছবি তুলতে চাইলেন। ভাইদের মধ্যে গণ— পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী ও আমি এবং তিন বোন রহিমা, শুশুমা, শাহানা উপস্থিত ছিল। এ কজনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ছবি তুলবেন। কিন্তু কোনক্রমেই দুই ভাই, তিন বোন বঙ্গবন্ধুর সাথে কোন ছবিই তুলতে পারলামনা। পারিবারিক ছবি তোলা হচ্ছে জানার পরও উচ্ছ্বাস উজ্জ্বলতা এত বেশী যে কেউ না কেউ ছবিতে এসেই যাচ্ছে। এনায়েত করিম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, নুরুন্নবী, ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী প্রায় প্রতিটি ছবিতেই আছেন। অনেক অনুরোধের পর কোনরকমে শুধু পারিবারিক ছবি তোলার মত অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে, এমন সময় দেখা গেল ঠিক ছবি তোলার মুহুর্তে আলিমুজ্জামান খান রাজু কোথা থেকে এসে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৫

বঙ্গবন্ধুর পিছনে গলা বাড়িয়ে দিল। কিংবা খোদাবক্স মোক্তার সাহেবের ছেলে আনোয়ার বক্স কোথা থেকে ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ক্যামেরায় ধরা পড়ে রইল।
দুপুর একটায় খাবার খেতে টাংগাইল সার্কিট হাউসে যেতে ওয়াপদা ডাক বাংলোর দোতলা থেকে বঙ্গবন্ধু নেমে এলেন। তিনি গাড়ীতে উঠতে যাবেন এমন সময় একজন সম্মানিত অতিথির আবির্ভাব হলো। এই মহান অতিথি বাংলাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে ফোমিন। গাড়ী বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুকে তার দেশের স্বীকৃতির বার্তা দিলেন। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত হৃদ্যতার সাথে করমর্দন করে আন্দ্রে ফোমিনকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমাকেও আন্দ্রে ফোমিনের সাথে। আন্দ্রে ফোমিনকে তার সাথেই মধ্যাহ্ন ভোজনের আমন্ত্রণ জানালেন। টাংগাইল সার্কিট হাউসে বঙ্গবন্ধু সহ দুই-তিন’শ লোকের খাবার তৈরী করা হয়েছিল। খাবার খেতে পৌনে দু’টো বেজে গেল। খাবার শেষে বঙ্গবন্ধু সার্কিট হাউসের উপরে খোলা বারান্দায় বসে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে কিছু কথাবার্তা বলছেন। আমি সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে বাকী অনুষ্ঠানের খোঁজ খবর নিলাম। এত ঝুট-ঝামেলার মধ্যেও একটা বিষয়ে অনেকের মত আমার দৃষ্টি এড়ায়নি, গোড়াইতে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানানো থেকে গার্ড অব অনার, অস্ত্র জমা দেয়া, শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন, এর কোন জায়গায় আবদুল মান্নান সাহেবকে দেখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত খোঁজ নিতে বাধ্য হলাম, জনসভাতেও মান্নান সাহেবকে দেখা না যাওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে কিনা? দুটা দশ মিনিটে বঙ্গবন্ধু সভা পথে রওনা হলেন।

অবিস্মরণীয় জনসভা
২৪শে জানুয়ারী ‘৭২ দু’টো ত্রিশ মিনিট টাংগাইলের ইতিহাসে সর্বকালের সর্ববৃহৎ জন- সভায় বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হলেন। অনেকের ধারণা, এই জনসভায় দশ লক্ষের অধিক লোক সমাগম হয়েছিল। কারো আবার ধারণা, সাত-আট লক্ষের নীচে নয়। আধ মাইল প্রস্থ, এক মাইল লম্বা টাংগাইল পার্ক ভরে গিয়েছে, কোথাও তিল ধারনের জায়গা নেই। পার্কের আশেপাশে গাছ ও বাড়ি ঘরের ছাদও লোকে কানায় কানায় পূর্ণ। বঙ্গবন্ধু সভা মঞ্চে আসার সাথে সাথে কোরান ও গীতা পাঠের মাধ্যমে সভার কাজ শুরু হলো। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের এটাই রাজধানীর বাইরে প্রথম জনসভা। এখানেই প্রথম মান্নান সাহেবকে দেখা গেল। সভার নিয়ম অনুসারে সভাপতি শেষে ভাষণ দেন। সভাপতির বক্তৃতাই সমাপ্তি ভাষণ হিসাবে বিবেচিত হয়, সভাতে আর সবাই বক্তৃতা করেন। এখানে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হলো। সভাপতি আগে ভাষণ দিলেন। টাংগাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গণ-পরিষদ সদস্য মীর্জা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল ও মুক্তি বাহিনীর বেসামরিক প্রধান আনোয়ার-উল-আলম শহীদের মানপত্র পাঠ শেষে সভাপতি তার বক্তব্য রাখলেন। সংক্ষিপ্ত ভাষণে সভাপতি আবদুল মান্নান সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম জানালেন। কিন্তু আমার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করলেন না। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ সভা পরিচালনা করলেন। মান্নান সাহেবের বক্তৃতার পরই আনোয়ার-উল-আলম শহীদ আমাকে বক্তব্য রাখার আহ্বান জানালেন। সমবেত জনতাকে সালাম জানিয়ে বললাম,
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৬

‘আমরা আজ গর্বিত, বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে উপস্থিত। বঙ্গবন্ধু হাতে আমরা দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তুলে দিতে পেরেছি। এই জন্য আমরা আশ্বস্ত ও গর্বিত আজ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছি তাদের, যারা হানাদারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অমূল্য জীবন দান করেছেন। আমি সালাম জানাচ্ছি সেই ভারতীয় সৈনিকদের, যারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে আত্মহুতি দিয়েছেন। আমি মাগফেরাত কামনা করছি সেই সমস্ত বিদোহী আত্মাদের যারা হানাদারদের হাতে নিহত হয়েছেন। আমি আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করছি। বঙ্গবন্ধু, বাংলার মানুষ আজ আপনার কাছে ন্যায় বিচার চায় ও নিরাপত্তা চায়, প্রাপ্য মর্যাদা চায়। স্বাধীনতার পর মাত্র একমাস কয়েকদিনে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত নানা ভাবে হয়রানি করার চেষ্টা হয়েছে, নানা ভাবে গুজব ছড়ানো হয়েছে। আমরা গুজবের অবসান চাই। কোন নেতা কবে ভালো কাজ করেছিলেন, শুধু তার নিরিখে বিচার করলে চলবেনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা হঠকারিতা করেছেন, ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, তাদের সম্পর্কেও আপনাকে বিবেচনা করতে হবে। বাঙালীরা হঠকারীদের আর কিছুতেই বরদাস্ত করতে রাজী নন। যারা আমাদের মা-বোনদের হত্যা করেছে, ইজ্জত লুট করেছে, তাদের বিচার করতে হবে। আপনাকে প্রতিটি মানুষের জীবনের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করতে হবে।
সারা দুনিয়ার প্রগতিশীল মানুষ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেভাবে সাহায্য করেছেন, আমি তাদের সালাম জানাই। আমি সালাম জানাই ভারতের ষাট কোটি জনগণ, তাঁদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও সেনাবাহিনীকে। আমি সালাম জানাই সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে। সালাম জানাই আমার দেশের আপামর জনসাধারণ, মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রবন্ধুদের
মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা, আমরা আজ বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র জমা দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু আমাদের নেতা। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অস্ত্র ধরেছিলাম। তাঁর আহ্বানে ত্যাগ করলাম। এর অর্থ এই নয়, যে জনসাধারণ গত নয় মাস আমাদের সাহায্য করেছেন, বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাদের থেকে আমরা দূরে সরে গেলাম। যুদ্ধের সময় আমার আশা ছিল, স্বাধীন বাংলায় আমাদের হাতের মারণাস্ত্রগুলি দিয়ে লাঙ্গল, কোদাল, কাস্তে, হাতুড়ি, দা বানানো। জানিনা আমার সেই আশা সফল হবে কিনা। বঙ্গবন্ধু, আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ, সকল মারণাস্ত্রের লোহা গলিয়ে লাঙ্গল, কোদাল, গাইতি, শাবল তৈরী করুন।
মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীকে আমি কথা দিচ্ছি, মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি যুদ্ধে যেমন পিছে থাকি নাই, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশগড়ার সংগ্রামেও পিছিয়ে থাকবো না। আপনাদের সাথে একই কাতারে, একই সারিতে দাঁড়াবো। আপনারা আমাকে নির্লোভ থাকার দোয়া করবেন।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী,
ভারত-বাংলা মৈত্রী অমর হউক।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৭

আমার বক্তৃতা শেষে আমিই বঙ্গবন্ধুকে আহ্বান জানালাম। বঙ্গবন্ধু মাইক্রোফোনের সামনে এসে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,
‘আমি আপনাদের সালাম জানাই। আমি প্রতিটি শহীদ আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আমি সালাম জানাচ্ছি আপনাদের, টাংগাইল বাসীদের, যারা কাদেরের মত সন্তানের জন্মদিয়েছেন। টাংগাইলের মানুষ যা করেছে তার তুলনা হয় না। আমি তাই আপনাদের সম্মান জানাতে সবার আগে টাংগাইলে ছুটে এসেছি। আমাদের তিনশ বছরের পুরানো গ্রামের বাড়ী পাকিস্তানী হানাদাররা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে, আমি সেই বাড়ী দেখতে যাইনি। আমি টাংগাইলে এসেছি। আপনারা যা করেছেন, টাংগাইলের মুক্তিযোদ্ধারা, স্বেচ্ছাসেবকরা যা করেছে, সেই জন্যই তাদের এই সম্মান পাওয়া উচিত। এই সম্মান না দেখানো হলে অন্যায় করা হবে। আমি তাই আপনাদের মাঝে আপনাদের সালাম জানাতে এসেছি, শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। আমার দেশের এমন কোন একটি গ্রামও নেই, যেখানে পাকিস্তানী নরপশুরা অন্তত দশ জন লোককে হত্যা করেনি। আপনাদের এখানেও অসংখ্য লোক মারা গেছেন। টাংগাইল নিয়ে আমার গর্ব হয়। সারা দেশে প্রতিটি জেলায় যদি একজন করে কাদেরের জন্ম হতো তা হলে আমাদের নয় মাস যুদ্ধ করতে হতো না। আমাকে সাড়ে নয় মাস ফেরাউনের জিন্দাখানায় থাকতে হতো না। অনেক আগেই আমার দেশ স্বাধীন হতো। দশটা কাদেরও যদি থাকতো তা হলে হয়তো ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যের প্রয়োজন হতো না।’
‘কাদের পল্টন ময়দানে চারজন দুষ্কৃতকারীকে গুলি করে শাস্তি দিয়েছে। যারা লুটতরাজ করে, যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাদের হাজার জনকে যদি ও গুলি করে শাস্তি দিত, তাহলেও কাদের আমার ধন্যবাদ পেত।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণায় সারা মাঠ করতালিতে ফেটে পড়লো। দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি দেয়ার পুরষ্কার স্বরূপ ১৯শে ডিসেম্বর ‘৭১ তারিখে আমার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়েছিল। আর ২৪শে জানুয়ারী ‘৭২ বঙ্গবন্ধু টাংগাইল পার্ক ময়দানে দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি প্রদান এমনিভাবে প্রশংসা করলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে মুজিবনগর সরকারের গুণগত মৌলিক পার্থক্য এখানেই। এরপর মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা, আমি তোমাদের তিন বৎসর কিছু দিতে পারবনা।’ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশ্ন করলেন, ‘আরও তিন বৎসর যুদ্ধ চললে, তোমরা যুদ্ধ করতা না?’
মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা সমস্বরে চিৎকারে ফেটে পড়লো, ‘করতাম।’ ‘তাহলে মনে কর যুদ্ধ চলছে। তিন বৎসর যুদ্ধ চলবে। সেই যুদ্ধ দেশ গড়ার যুদ্ধ। অস্ত্র হবে লাঙ্গল, কোদাল।’ তিনি সরকারী কর্মচারীদের হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেলেন,
‘স্বজন প্রীতি, দুর্নীতি, ঘুষ চলবেনা। মুক্তিযোদ্ধারা তোমরা খবর পাঠাবা। দুর্নীতিবাজ সরকারী কর্মচারীদের একজনকে চাকরীতে বহাল রাখা হবে না।
আমার মুক্তিযোদ্ধারা, আমি অস্ত্র জমা নেবার সময় বলে দিয়েছি, প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার মান-সম্মান, মর্যাদা রাখার দায়িত্ব সরকারের, আমার। তোমরা যারা লেখাপড়া করতে চাইবে,
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৮

তারা পুরো সুযোগ পাবে। মুক্তিযোদ্ধারা যে প্রশসংনীয় ভূমিকা পালন করেছে, যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, সব কিছু দিয়েও তোমাদের ত্যাগের সঠিক মূল্য দেয়া যাবে না। তোমরা এই দেশেরই সন্তান। তোমরা সম্মানের সাথে চিরকাল থাকবে। তোমরাই নতুন ইতিহাসের স্রষ্টা। তোমাদের কোন অসুবিধা হলে আমাকে সরাসরি খবর দেবে। আমাকে না পাও কাদেরকে বলবে। শহীদকে বলবে। গণ-পরিষদ সদস্যদের বলবে। ওরা না শুনলে আমাকে বল। কেন শুনবে না? সবাই তোমাদের কথা শুনবে।
আমি সশ্রদ্ধচিত্তে ভারতের জনগণ ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে সালাম জানাই। বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই, যেখানে শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে আমার মুক্তির জন্য যাননি। অনেকে বলেছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী কবে যাবে। মতিলাল নেহেরুর নাতনী, পণ্ডিত জওরলাল নেহেরুর কন্যা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে আমি ভাল করে চিনি। তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য আমি ভালো করে জানি। আমি যেদিন বলব, সেই দিনই ভারতীয় সৈন্য বাংলা থেকে চলে যাবে। ভারতীয় সৈন্যরা হানাদার নয়। তাঁরা আমার বাংলার মানুষের দুঃখের ভাগী হতে এসেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হানাদারদের পরাজিত করতে তাদের চৌদ্দ হাজার বীর সৈনিক আমার শ্যামল বাংলার মাটিতে বুকের রক্ত ঝরিয়েছে। আমি তাদের যেদিন বলব, আপনাদের আর প্রয়োজন নেই, আমরা নিজেরাই পারবো, সেই দিনই তারা চলে যাবেন।
আমরা কারো সাথে শত্রুতা চাইনা। আপনারা আগ্রাসন বন্ধ করুন। রাশিয়া আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্যরাও আমাদের স্বীকৃতি দিন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, এটা বাস্তব সত্য। একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আমাদের পররাষ্ট্র নীতি হবে, সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়। আমরা জোট নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি। আমরা শান্তি ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। পৃথিবীর যেখানেই স্বাধীকার আন্দোলন হবে, মুক্তির আন্দোলন হবে, বাংলাদেশ সাধ্যমত মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়াবে। আমি সালাম জানাই বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষদের, রাশিয়া, যুগোশ্লাভিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক সরকার ও দেশবাসীকে। সালাম জানাই বৃটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী সহ আমেরিকার প্রগতিশীল মানুষদের, যারা আমাদের আন্দোলন সমর্থন করেছেন। পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। তাঁরা শান্তিতে থাকুন, এটা আমরাও চাই কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে অত্যাচার করেছে তার কোন নজির নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এত অল্প সময়ে এত লোক মারা যায়নি, যা আমার বাংলায় মারা গেছে। অত্যাচারী সৈন্যদের বিচার হবেই হবে। পাকিস্তান এখনও যে বাঙালী ভাইদের আটকে রেখেছে, অসদাচরণ করছে, পাকিস্তানের জনগণ, আপনারা আপনাদের সরকারকে তা বন্ধ করতে বলুন। আমার মানুষদের সসম্মানে দেশে আসার সাহায্য করুন।
চীন, আমেরিকা সহ অন্য কয়েকটি দেশের নাম উল্লোখ করে বলেন, ‘আপনারা স্বীকৃতি দিন। আমার দেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে কোন উপায় নেই।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৯

জনগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমরা সংগ্রাম করে জয়ী হয়েছি, আমরা সংগ্রাম করেই জয়ী হবো। আমরা কোন অন্যায় করিনি তাই হার মানবোনা।
জয় বাংলা, জয় মুক্তিবাহিনী
এবারের সংগ্রাম—দেশ গড়ার সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম-মুক্তির সংগ্রাম।’

———সমাপ্ত———

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!