ভাষা আন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অবদান সর্বজনবিদিত। ১৯৪৭, ‘৪৮ এবং ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্বে মেডিকেল কলেজের ছাত্র সমাজের সাহসী ও প্রতিবাদী ভূমিকা ছিল গৌরবজনক। ১৯৪৭ সালে আন্দোলনের সূচনালগ্ন ছাত্র সমাজকে সুসংগঠিত করে আন্দোলনে নিয়ে আসা, সে সময়কার প্রতিকূল পরিবেশে খুবই কঠিন কাজ ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেধাবী ছাত্ররাই ভর্তির সুযোগ পায় এবং তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক পড়াশুনায় মগ্ন থাকত। আন্দোলনে জড়িত হলে তাদের সুন্দর জীবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এবং সরকারের রোষানলে পড়ে ভীষণ ক্ষতি হতে পারে। এসব জেনেও পড়াশুনার পাশাপাশি অনেকেই জাতীয় সংগ্রামের সংগে নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন দেশ মাতৃকার প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে। সেই কারণেই উক্ত মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনের পক্ষে সুসংগঠিত হয়েছে এবং আন্দোলনে যোগদান করেছে।
আহমদ রফিক যথার্থই বলেছেন, ‘এ সত্য অস্বীকারের উপায় নেই যে, মেডিকেল কলেজের ছাত্রগণ তাদের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পড়াশোনার অবকাশহীন মগ্নতা থেকেও কিছুটা সময় ছিনিয়ে নিয়ে জাতীয় সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন; কখনওবা জীবনটাকে ঘাতকের হাতে ছেড়ে দিয়েই করেছেন।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের ভাষা স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ডা. শরফুদ্দিন আহমদ বলেছেন, “মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা স্ব:তস্ফুর্তভাবে ভাষা আনেদালনে অংশগ্রহণ করেছিলো। তাদের মনোভাবটি এ রকম ছিলো যে, শিক্ষাজীবন শেষে চাকুরি না করে ‘প্রাইভেট প্যাকটিস’ করে জীবন নির্বাহ করা যাবে। কিন্তু অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের এ সুযোগটা না থাকায় তারা মনে করত রাজনীতির কারণে সরকারের রোষাণলে পড়ে শিক্ষা জীবন, সরকারি চাকুরি তথা কর্মজীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ফলে অনেকইে ভয়ে এ আন্দোলনে সক্রিয়তা দেখাতে দ্বিধান্বিত ছিল। এই ভয়টা মেডিকেল ছাত্রদের ছিল না। এ কারণে ব্যারাকের ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছে।”
সূত্র: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ এম আর মাহবুব, ভাষা আন্দোলন জাদুঘর, পৃষ্ঠা-৫৬-৫৭)
১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ। ১৯৪৭ সালে শুরু হয় ভাষা-আন্দোলনের সাংগঠনিক কার্যক্রম। ভাষা-আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভাষা-আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে প্রবৃত্ত হন। ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সমাজের অবদান সম্পর্কে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ও পরে প্রিন্সিপাল অধ্যাপক মির্জা মাজহারুল ইসলাম বলেন, “৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন রাষ্ট্রীয় কার্যে উর্দু ও উর্দু ভাষাভাষীদের দাপট শুরু হয় এবং ইংরেজ আমলের টাকা পয়সা, পোস্ট কার্ড, এনভেলাপ হতে বাংলা উঠিয়ে লেখা হয় তখনই আমাদের মনে ভাষার প্রশ্নটি উদয় হয় এবং এর প্রতিবাদের জন্য তৈরি হই। সলিমুল্লাহ হল থেকে আমি, ছাত্রনেতা (পরে বিচারপতি) আব্দুর রহমান চৌধুরী, শামসুল আলম (রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ২য় আহ্বায়ক) প্রথমে ১৯নং আজিমপুরে যাই। ইতোমধ্যে ভাষা-আন্দোলন পরিচালনার জন্য ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। ১৯নং আজিমপুর ছিল তাঁর বাসভবন। ভাষা-আন্দোলনের প্রথম দিকের সফল সাংগঠনিক তৎপরতা এখান থেকেই পরিচালিত হত এবং ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রেণির নেতারা এখানে জমায়েত হতেন। মেডিকেল কলেজে আমার পরিচিতি ছিল ব্যাপক। খেলাধুলা, লেখাপড়া ও রাজনীতিতে আমি ছিলাম সক্রিয়। আর সেই কারণেই মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে ১৯নং আজিমপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন অত্র এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। হারিকেনের আলো আঁধারিতে আমরা একত্রিত হয়ে আলোচনা করতাম। আমার ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সংগঠিত করে ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার।
তখন সময়টা ছিল বেশ কঠিন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে এটা অনেকেই চিন্তা করতেন না। বহু কষ্টে স্বল্পসংখ্যক ছাত্রদের এ কথাটি বুঝাতে সমর্থ হয়েছিলাম। তাছাড়া সরকার ভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের উপর কড়া নজর রাখতেন।
এই বিরূপ পরিবেশে কাজ করতে যেয়ে বিভিন্ন সময় নানা প্রতিকূলতা ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বাংলা ভাষার উপর আঘাত মানে আমাদের অস্তিত্বের উপর আঘাত। আমরা এই কথাটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতাম প্ৰথম দিকে যারা এ আন্দোলনের অংশগ্রহণ করতেন তাদের মধ্যে বদরুল আলম, আবু সিদ্দিক মিয়া, আবদুল মান্নান, আবদুল হাই ছিলেন অন্যতম। ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিনগুলোতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আন্দোলন সংগঠনে এরা আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। আমরা প্রায়ই এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বসতাম এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ করতাম।
১৯৪৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন সরকারের সহযোগিতায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে উর্দুভাষী পুরনো ঢাকার অধিবাসিরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের অস্থায়ী পলাশি ব্যারাক ছাত্রাবাসে হামলা চালায়। আক্রান্ত ছাত্ররা প্রতিরোধে গড়ে তুললে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় (সূত্র: দৈনিক আজাদ, ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৪৭) ভাষার প্রশ্নে সেই প্রথম প্রতিরোধ সংগ্রামে মেডিকেল ছাত্ররা অসম সাহসিকতার পরিচয় দেয়।
পলাশি ব্যারাকের সভা ও বিক্ষোভের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে এ বিক্ষোভে সরাসরি অংশ নেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২য় ব্যাচের ছাত্র সাঈদ হায়দার। ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকে শুরু করে বায়ান্নর আন্দোলনেও তিনি সাহসী সৈনিকের ভূমিকা পালন করেন। পলাশি ব্যারাকের বিক্ষোভ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “১৯৪৭ সালের একেবারে শেষের দিকের ঘটনা। পলাশি ব্যারাকে মেডিকেল ছাত্রাবাসের সামনের রাস্তায় প্রথম প্রতিরোধ সমর সংগঠিত হলো ভাষার প্রশ্নে। সেদিন এই রাস্তা বেয়ে জনা পঞ্চাশেক লোকের এক মিছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা স্বপক্ষে স্লোগান দিতে দিতে নাজিরা বাজার ও মৌলভী বাজারের দিক থেকে আসছিল।
………….. উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা সম্পর্কে প্রচার কাজে এদেরই এগিয়ে দিলেন নবাবগোষ্ঠী, হাতে প্লাকার্ড আর মুখে শালীনতাহীন বাংলাবিরোধী স্লোগান। মুহূর্তে প্রতিরোধ এলো, মিছিলের অগ্রগতিকে বাধা দিতে বেরিয়ে এলো মেডিকেল ছাত্ররা- শুরু হলো খন্ডযুদ্ধ। মিছিলের সাথে মোমিন কোম্পানির যে বাসটি ছিল তার ভিতর থেকে লুকিয়ে রাখা লাঠি ও রড নিয়ে ওরা আক্রমণ করলো ছাত্রদের, রেল লাইনের পাশে রক্ষিত প্রস্তরখন্ড নিক্ষেপ করে এবং হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে পাল্টা আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পরে মেডিকেল ছাত্ররা। অদূরে ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেলের ছাত্ররা বেরিয়ে এসে যোগ দেয় তাদের সাথে। কয়েক মিনিটের সেই খন্ডযুদ্ধ সম্ভবতঃ ভাষার প্রশ্নে প্রথম প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। মেডিকেল ছাত্রদের অনেকেই সেদিন আহত হয়েছিল, কেটে ছিঁড়ে গিয়েছিল তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কিন্তু দৃঢ় মনোবল নিয়ে তারা সেদিন ভাষা ও সংস্কৃতির শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করেছিল, প্রতি আক্রমণ করেছিল দুর্জয় সাহস আর ভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ নিয়ে।” (সূত্র: পিছু ফিরে দেখা- সাঈদ হায়দার, প্রথম প্রকাশ- ডিসেম্বর, ১৯৯৬, পৃ. ২৭২)
পলাশি ব্যারাকের বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী মেডিকেল ছাত্র বিগ্রেডিয়ার (অব:) ডা. মিরাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, “একদিন পুরানো ঢাকার উর্দুভাষী লোকজন তরবারি, লাটিসোটা নিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার স্লোগান দিতে দিতে পলাশি ব্যারাকে আক্রমণ চালায়। তারা একটি বাসের মধ্যে মাইক লাগিয়ে আসছিল। আমরা বাঁধা দেই। প্রথমে তাদের প্রতিরোধ করতে সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন মেডিকেল কলেজের ‘৪৭ ব্যাচের ছাত্র আবদুল হক। পরে সে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর নেন এবং বর্তমানে প্রয়াত। আবদুল হক দৌড়ে গিয়ে বাসের মধ্যে যে মাইক লাগানো ছিল, এর তার ছিড়ে ফেলে। পরে আমাদের সাহস বেড়ে যায় এবং আমরা সম্মিলিতভাবে তাদের প্রতিরোধ করি।”
(সূত্র: বিগ্রেডিয়ার (অব.) ডা. মিরাজ উদ্দিন আহমদের বিশেষ সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৯)
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পাকিস্তান-উত্তর প্রথম হরতাল পালিত হয়। ১১ মার্চ, ১৯৪৮ তারিখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকাসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে যে হরতাল পালিত হয়, শত নির্যাতন সত্ত্বেও ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা আন্দোলন থেকে পিছপা হননি বরং পরবর্তী ১২, ১৩, ১৫ মার্চ লাগাতার ধর্মঘট কর্মসূচি বেগবান করতে তারা যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন জাতীয় ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
১৩ মার্চ পালিত কর্মসূচি সম্পর্কে কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয় “ঢাকা মেডিকেল কলেজের এবং অপরাপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ১১ মার্চ তারিখের পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে ক্লাসে যোগদানে বিরত থাকে। (সূত্রঃ দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকা, ১৪ মার্চ, ১৯৪৮) ১১ মার্চের হরতাল কর্মসূচিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষ্যণীয়। ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে যারা আহত হন তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। ১২ মার্চ, ১৯৪৮ তারিখের কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, “অপরাহ্ন ৩টা পর্যন্ত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪০ জন আহতকে ভর্তি করা হয়। মি. ফজলুল হক ও আরও অনেককে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছাড়িয়া দেওয়া হয়।”
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণ-পরিষদের অধিবেশন শুরু হলে ২৫ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর সাথে বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার যে ঐতিহাসিক প্রস্তাব উত্থাপন করেন তা মুসলিম লীগ সদস্যদের বিরোধিতায় বাতিল হয়ে যায়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে সেই সমাবেশে যোগদান করেন। (সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮) ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় ১১ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উক্ত সভায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকজন ছাত্র উপস্থিত ছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররাও অংশগ্রহণ করেন। ধর্মঘটের দিন ছাত্ররা শ্রেণিকক্ষ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমে আসনে এবং পথ সভায় বক্তব্য রাখেন। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত করা হয় ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত উক্ত সংগ্ৰাম পরিষদ ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধি হিসেবে মির্জা মাজহারুল ইসলাম অন্তর্ভূক্ত হন।
১১ মার্চের হরতাল প্রসঙ্গে সাঈদ হায়দার বলেন: “১৯৪৮ এর আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালনের যে কর্মসূচি গৃহীত হয় তার অংশরূপে সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেটের সামনে অলি আহাদ প্রমুখ নেতার সাথে বেশকিছু সংখ্যক মেডিকেল ছাত্র অবস্থান গ্রহণ করে। এদের মধ্যে ছিরেন জসিমুল হক, আবু সিদ্দিক মিয়া, এম.আই. চৌধুরী, মো. আলী আসগর প্রমুখ। মেডিকেল কলেজের অন্যান্য ছাত্র কর্মীরা এদিন সক্রিয় ছিল পলাশি ও নীলক্ষেত ব্যারাক অঞ্চলে। ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবসের বিক্ষোভ প্রদর্শন ও পিকিটিং এর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ছিল রেলওয়ে ওয়ার্কশপ। এই ওয়ার্কশপের পিকেটিংয়ে অংশ নিয়ে ছিলেন মেডিকেল কলেজের দুর্ধর্ষ বামপন্থি ছাত্রকর্মী আমজাদ হোসেন ও আব্দুল হাই। ১১ মার্চের প্রতিবাদ দিবসে পুলিশের যথেষ্ট লাঠিচার্জ চলে একাধিক স্থানে। ছাত্ররা শুধু নির্যাতনের শিকারই হননি- পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছিল অনেক ছাত্রকে। মেডিকেল কলেজের যে সব ছাত্র সেদিন গ্রেপ্তার হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন মো. আলী আসগর, এম.আই. চৌধুরী, জসিমউদ্দীন, এস.এ. বারী, ফরিদুল হুদা প্রমুখ ছাত্রকর্মী।” (সূত্র: পিছু ফিরে দেখা, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬৯)
১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকায় আগমন করেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জিন্নাহ তাঁর ভাষণে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ছাত্রদের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। উক্ত সভায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা উপস্থিত থেকে জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হলে আবু ছিদ্দিক, আ. মান্নান, সাঈদ হায়দার, মির্জা মাজহারুল ইসলাম, আহমেদ ফজলুল মতিন, মাহফুজ হোসেন প্রমুখ। এ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে এবং ২২ ও ২৩ মার্চ মেডিকেল কলেজের জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদে ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আহমদ রফিক বলেন, ‘জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতা শুনতে যাওয়া এই ছাত্ররাই তাদের অন্য সহপাঠী ব্যারাক বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলে মিশে একুশের আন্দোলন সার্থক করে তুলতে সাহায্য করেছিলেন।’ (সূত্র: স্মৃতিবিস্মৃতির ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৮)
সূত্র: ঢাকা মেডিকেল কলেজ: সেবা সংগ্রাম ঐতিহ্য – অধ্যাপক ডাঃ মনিলাল আইচ লিটু, এম আর মাহবুব