You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের ভাষাচেতনা ও উর্দু নাটক ‘নাজমা-এ-নূরী’

১৯৪৮ সালের ২০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগ দেন ডা. টি. আহমদ। ১৯৫১ সালের আগস্ট মাসে মাঝামাঝি সময়ে একদিন প্রিন্সিপাল ছাত্রদের ডেকে নিয়ে জানিয়ে দেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ‘নাজমা-এ-নূরী’ নামে একটি উর্দু নাটক মঞ্চস্থ হবে। তখন কলেজে কোন ছাত্র সংসদ ছিল না ফলে শিক্ষাবহির্ভূত কর্মকান্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। প্রিন্সিপালের উক্ত সিদ্ধান্তে ভাষা- আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং নাটকটি প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন।
মাতৃভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধের কারণেই সেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাষাসংগ্রামী ছাত্ররা উর্দু নাটকটি মঞ্চায়ন করতে দেয়নি। ফলে পুরো আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে ডা. সাঈদ হায়দার বলেন, ‘খবর পাওয়া গেল উর্দু নাটক ‘নাজমা- এ-নূরী’র মহড়া জোরেসোরে চলছে। এর নাম ভূমিকা অর্থাৎ নায়িকার ভূমিকায় কলেজের মেধাবী ছাত্র এস.এম. রব এবং নায়কের ভূমিকায় সৈয়দ সাহাবুদ্দিন অংশ নিচ্ছে। যতদুর মনে পড়ে আরেকজন অভিনেতা ছিল আসদার। ….. গাইনির প্রফেসর হুমায়রা সাঈদ এবং হিস্টো-প্যাথলজিস্ট মুজাফফর হোসেনের নির্দেশনায় রিহার্সেল শেষ হলে লেকচার গ্যালারির মঞ্চে পরপর দু’দিন এই নাটক অভিনয়ের বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। একান্ন’র সেপ্টেম্বর প্রথম সপ্তাহের একটা দিন ছিল সেটা। সন্ধ্যার পরে ডাইনিং হলে ছেলেরা খেতে বসেছে। আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই নাটক শুরু হবে। উর্দু ড্রামা কেমন হবে, ছেলেরা যাকে কি যাবে না, খেতে খেতে এসব আলোচনাই হচ্ছিল। এর মধ্যে ‘জোরে’ স্লোগানে উচ্চস্বরে বলে উঠলো, “কিসের ড্রামা’ অন্যরাও সমস্বরে প্রতিউত্তর দিল, “কিসের ড্রামা’। শরফুদ্দিন বললো- ‘আগে সবাই খাওয়া শেষ করি, তারপর ড্রামা দেখতে যাব। তার কথায় মধ্যে কি ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন ছিল কে জানতো। সুন্দর করে সাজানো হয়েছে মঞ্চ। ওয়াইজঘাটের এম.সি রায় চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান থেকে মাইক এসেছে, এসেছে সাউট লাইট। দর্শকে গ্যালারি প্রায় পরিপূর্ণ। দর্শকদের মধ্যে আমন্ত্রিত সরকারি কর্মকর্তারা তো আছেনই তা ছাড়া উর্দুভাষী ব্যবসায়ী, এমনকি নবাবপুরের মোড়ে ফুলুরি বিক্রি করে যে বিহারীরা তারাও রয়েছে। ডাইনিং হল থেকে চলে গেল নাটকের স্থানে, নেতাদের নির্দেশে গ্যালারিতে স্থান নিল বেশ কিছু ছাত্র, তবে গ্যালারি পূর্ণ হয়ে যাওয়ার অনেকেই ঢুকতে না পেরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। দুজন ছাত্রনেতা মোবারক হোসেন এবং শরফুদ্দিন আহমেদ আসছিল সবার পিছনে। এর মধ্যে নাটকের প্রথম দৃশ্য শুরু হয়েছে। মোবারক বললো, “ইঞ্জিনিয়ার, আপনি আমার পিছনে আসুন, মুখে কোন কথা বলবেন না।’ মোবারক ধীর পদে সেদিনের ফিজিওলজি ল্যাবের পাশের হেলিক্স সিঁড়িটা দিয়ে উপরে উঠে যায়, তাকে অনুসরণ করে শরফুদ্দিন। ওরা এসে পড়ে দোতলার একটা অপরিসর কক্ষে সেখানে নানা ইলেকট্রিক তার, মুখে বলে, শরফুদ্দিন দু’দিকের এই পয়েন্ট দুটোয় এই তার দিয়ে সংযোগ ঘটালেই- সার্কিট বিনষ্ট করে- সব আলো নিভে যাবে।’ শরফুদ্দিন বলে ‘এ কাজও করবেন না, অঘটন ঘটতে পারে, হাতে দরে এ কাজ করা যাবে না।’ সে দ্রুত নেমে যায় এবং মরা শুকিয়ে যাওয়া ইউকেলিপটাস গাছের ছোট ডাল নিয়ে ফেরে। শুকনো রুমাল দিয়ে কাঠ ধরে, এবং তার সঙ্গে আটকে রাখা তার দিয়ে দু’পয়েন্টে সংযোগ ঘটাতেই সারা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল অন্ধকারে ডুবে যায়। সিঁড়ি বেয়ে নাটকের মঞ্চের দিতে ওরা যখন দৌড়ে এলো তখন একটাই স্লোগান শুধু শোনা যাচ্ছিলো, ‘কিসের ড্রামা’। হলে তখন তুমূল যুদ্ধ চলছে, বহিরাগত ফুলুরি বিক্রেতাদের অবশ্য ভাড়া করে এনেছিল নাটকের উদ্যোক্তরা, কিন্তু ছাত্রদের ইস্টক বর্ষণের প্রচন্ডতার মুখে তারাও পালালো। অভিনেতা এবং নাটকের পরিচালকেরা সেদিন উল্টোদিকে দিয়ে সুইপার কলোনী হয়ে পালিয়ে বাঁচে” (সূত্র: পিছু ফিরে দেখা, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬৬-৬৭)

সূত্র: ঢাকা মেডিকেল কলেজ: সেবা সংগ্রাম ঐতিহ্য – অধ্যাপক ডাঃ মনিলাল আইচ লিটু, এম আর মাহবুব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!