You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৪৯-১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে মেডিকেল কলেজের ছাত্রসমাজ

১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত বিশেষ কোন আন্দোলন হয়নি। ভাষা আন্দোলনের এই স্তিমিত পর্বেও ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সমাজ ছিলেন সদা প্রস্তুত। বিভিন্ন সময় তাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত ছিল। ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্র যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলে থাকত তাদের উদ্যোগে উক্ত হল থেকে উর্দুভাষী ছাত্রদের প্রতিহত করার প্রচেষ্টা স্বার্থক হয়েছিল।
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ১৯৪৮ সালের পর হতে ১৯৫২ সালের চরম পরিণতি পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রসমাজের ভূমিকা প্রসঙ্গে ডা. খোন্দকার আলমগীর বলেন, “আমাদেরও এমন একটা গ্রুপ গড়ে ওঠে- স্টাডি সার্কেল হিসেবে। মেডিকেলে ছাত্র আবদুল মানাফ (খুলনার), মাহমুদ খান (চট্টগ্রাম), কবীর আহমেদ (সিলেট)। পরবর্তীতে আরও একটি গ্রুপ হয়েছিল অন্যদের নিয়ে। ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ সালে শুরু হলেও দীর্ঘ চার বছর পরে ১৯৫২ সালে চরম পরিণতিতে এগিয়ে আসতে সম্ভব হয়েছিল এইসব কর্মীদের তৎপরতায়। ………. ৫০ থেকেই রাস্তায় নেমে আসতে থাকি আমরা বিভিন্ন সময়ে মিছিল-শোভাযাত্রা করে। ইতিমধ্যে মি. জিন্নাহ মারা গেলেন, লিয়াকত আলী নিহত হলে গুলিতে। ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে মেতে রইলেন নেতারা। পাকিস্তানের গঠনতন্ত্র রচনার উদ্যোগ আয়োজনের খবরাখবর কাগজে বেরোলেই ছাত্রদের মধ্যেও সাড়া পড়ে যেত বাংলা বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে।”
(সূত্র: দৈনিক সংবাদ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১)

১৯৪৯-৫১ সালের ভাষা আন্দোলনে অকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের ভূমিকা প্রসঙ্গে আ.জা.ম. তকীয়ুল্লাহ বলেন, “আমি ১৯৪৯ সাল থেকে আত্মগোপনে চলে যাই এবং ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত জেলে ছিলাম। ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনসহ ছাত্র অন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ পর্যন্ত পুরো আন্দোলনকে প্রাণবন্ত রাখতে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সালের আন্দোলনে মেডিকেল ছাত্র আমজাদ, আবদুল হাইসহ অনেকেই গ্রেপ্তার হন এবং তাদের কলেজে থেকে বহিষ্কার করা হয়। তৎকালীন মেডিকেল ছাত্র মোবারকেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।” (বিশেষ সাক্ষাৎকারে আ.জা.ম. তকীয়ুল্লাহ, ১৮ অক্টোবর, ২০০৯)।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। নাজিমুদ্দিনের এই বক্তব্যের পর পরই শুরু হয় প্রতিবাদ বিক্ষোভ আর মিছিল। এ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অংশগ্রহণ করেন।
৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে যে সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দে যোগদান করেন। উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন শরফুদ্দিন আহমদ, আহমদ রফিক, মো. আলী আসগর, মোজাম্মেল, আবদুল সালামসহ আরও কয়েকজন। সভা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। গোলাম মাওলাকে মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধি হিসেবে সদস্য মনোনীত করা হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে।
৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা উক্ত কর্মসূচিতে স্ব:স্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি গোলাম মওলার পরামর্শক্রমে জি, এস শরফুদ্দিন কাদের সর্দারের বাসায় গিয়ে তাকে বুঝিয়ে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায় করেন। সেদিনের এ কাজটি ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের এক দূরদর্শী পদক্ষেপ। ডা. শরফুদ্দিন এ বিষয়ে লেখককে জানান, ‘পুরানো ঢাকার জনগণ বিশেষ করে কাদের সর্দার যদি ভাষা-আন্দোলনের পক্ষে এ সিদ্ধান্ত না নিতেন তাহলে আমাদের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন হতো।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সমাজ বিশেষ করে গোলাম মাওলা ও শরফুদ্দিনের আলোচ্য পদক্ষেপটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এমন পরিস্থিতিতে উর্দুভাষী পুরানো ঢাকাইয়াদের ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে না পারলে এই আন্দোলনকে সার্থক করা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য হত। এ অবস্থাটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভাষা-আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান।

একুশের আন্দোলনে
একুশের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হয় ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্যে তৎকালীন সরকার এক মাসের জন্যে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেন। এই ঘোষণার পর পর শুরু হয় উত্তেজনা। একুশের প্রস্তুতি পর্বে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ছিলেন খুবই তৎপর। একুশ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচিকে সফল করে তুলতে তারা ১৪৪ ধারা জারির পূর্বেই নানা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। মেডিকেল ব্যারাকের ছাত্ররা উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কর্মমুখর সময় অতিবাহিত করে ২০ ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সমাজের জন্য এই দিনটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ডা. সাঈদ হায়দার বলেন, “বায়ান্নোর ২০ ফেব্রুয়ারির একটি উত্তেজনাপূর্ণ বিকেল। মেডিকেল ছাত্রাবাসের প্রতিটি ছাত্রকর্মী এবং সাধারণ ছাত্রদের অধিকাংশই ছিল ২০ ফেব্রুয়ারির রাত থেকে শহরে সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে।” (সূত্র: পিছু ফিরে দেখা, পৃ. ২৭৭) আহমদ রফিক বলেন, “বিশে ফেব্রুয়ারির দিনটি এক অদ্ভূত অনুভূতি দিয়ে ঘেরা। সেদিন বিকেল থেকে গভীর রাত অবধি সময় যেন টেনশনে বিঁধে অস্তির। এর কারণ একুশের বিক্ষোভ-হরতালের উপর ১৪৪ ধরার শরসন্ধান। ছাত্রদের বুকে তুমূল উত্তেজনা।” (সূত্র: একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস, পৃ. ৫)
১৪৪ ধারা জারির পর পরই মেডিকেল ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকে। মেডিকেল ব্যারাকের সকল ছাত্ররা, ‘১৪৪ ধারা মনি না’ বলে স্লোগান দিতে থাকে এবং আগামীকাল অথ্যাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল কর্মসূচি পালনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। এ ঘোষণার সাথে সাথে মেডিকেল কলেজে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়াও ব্যারাকের বিভিন্ন স্থানে এবং কক্ষে ছাত্ররা সমবেত হয়ে ছোট ছোট প্রতিবাদ সভা ও ১৪৪ ধারার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও নানা শ্লোগান দিতে থাকে। “এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়া ছিল তাৎক্ষণিক ও স্বত:স্ফূর্ত। আশ্চর্য যে, ছাত্রদের কাউকে বলে দিতে হয়নি যে ‘১৪৪ ধরা মানিয়া, মানবো না। হয়তো তাই সেদিন সন্ধ্যায় মঞ্জুর হোসেনের আবেগ-মথিত ভরাট গলায় ধ্বনিত হয়:
‘চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙ্গবোই ভাঙ্গবো।’ অন্যদিকে ১৪৪ ধারা ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মেডিকেল ব্যারাকের এক স্বত:স্ফূর্ত সমাবেশে এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। এ ছাত্র-সমাবেশে বক্তৃতা করেন আবুল হাশেম, আলিম চৌধুরী, মঞ্জুর হোসেন প্রমুখ ছাত্র। সেদিন সন্ধায় ব্যারাকময় প্রবল উত্তেজনা, ছাত্রকর্মীদের ছোটাছুটি- সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ব্যারাকের এখানে সেখানে ক্ষুব্ধ ছাত্রদের ছোট ছোট জটলা।” (সূত্র: স্মৃতিবিস্মৃতির ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩১)। ১৪৪ ধারা জারির পর সার্বিক পরিস্থিতি ও পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনার জন্য সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ৯৪ নবাবপুর রোড আওয়ামী লীগের অফিসে প্রবীণ নেতা আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি গোলাম মাওলা অংশগ্রহণ করেন। সভায় অংশগ্রহণের পূর্বে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে অবস্থান করার জন্য মেডিকেল ব্যারাকের সচেতন ছাত্ররা গোলাম মাওলাকে অনুরোধ করেন। সাধারণ ছাত্রসমাজ একত্রিত হয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে তাদের সর্বসম্মত মতামত গোলাম মাওলাকে জানিয়ে দেয়া হয়।
সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বিপক্ষে তুমূল বিতর্কের সৃষ্টি হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিশেষ করে প্রবীণ নেতারা ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে অন্যদিকে ছাত্রনেতারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এমতাবস্থায়, সভাচলাকালীন সময়ের মধ্যেই ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার ব্যাপারে মেডিকেল কলেজের ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অনুমান বিকেল ৩.১০ থেকে ৩.৩০ (মতান্তরে ৪টা) মিনিটের দিকে তৎকালীন অবাঙালি জেলা প্রশাসক এ. এইচ. কোরেশীর নির্দেশে সিটি এসপির সরাসরি নির্দেশ পুলিশ মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের সামনে বিক্ষোভরত ছাত্রজনতার উপর দু’দফায় ২৭ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এটাই পর্ব পাকিস্তান ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ছাত্রদের উপর পুলিশের প্রথম গুলিবর্ষণের ঘটনা।
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। উক্ত পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় লাল কালির সংবাদ শিরোনাম ছিল “শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’ ‘মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলি বর্ষণ।’ গুলিবর্ষণের ফলে কয়েকজন ছাত্র শহীদ হন।
গুলি বর্ষণের পর আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং ব্যারাক প্রাঙ্গণ। একদিকে প্রতিবাদ-আন্দোলন অন্যদিকে আহতদের চিকিৎসার সেবা চালিয়ে সেদিন মেডিকেলের ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, ওয়ার্ডবয়, নার্স ও সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। ডা. সাঈদ হায়দার বলেন, “মিছিলকারীদের উপর লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণের বর্বরোচিত নির্যাতনে আন্দোলনে সংগঠকরা যখন ছাত্রভঙ্গ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে পুলিশি তৎপরতার কারণে ছাত্রনেতারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন- আন্দোলনের সেই বিপর্যস্ত পর্যায়ে একে জিইয়ে রাখতে ও শক্তিশালী করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বহন করে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা। এই পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলন পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় মেডিকেল ব্যারাক এবং নেতৃত্বের দায়িত্বও এসে পড়ে তাদের উপর। আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি দেয়া, প্রচারকার্য পরিচালনা, পরস্পর যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ আন্দোলনের সার্বিক সমন্বয় সাধনের কাজটিও সম্পন্ন করে কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা”। তিনি আরও বলেন, “মেডিকেল ব্যারাকের সামনের রাস্তায় এবং ব্যারাক প্রাঙ্গণে পুলিশের গুলিবর্ষণের পর স্বভাবতই আহতদের সেবা প্রদানের দায়িত্বটা এসে পড়ে মেডিকেল ছাত্রদের উপর। হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সদের তৎপরতার কথা ছেড়ে দিলেও গুলিবিদ্ধ ও আহতদের হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে পৌঁছে দেয় মেডিকেল ছাত্রাবাসের বাসিন্দারাই। বরকতকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যায় শফিকুর রহমান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, জব্বারকে বহন করে।
২০/৯ নম্বর করে সিরাজুল ইসলাম এবং ১৮/৭ নম্বরের ফজলে রাব্বী: রফিক উদ্দিনকে হাসপাতালে ভর্তি করে ১৮/১০ এর হুমায়ুন হাই এবং ১৮-৯ এর মোশাররফুর রহমান। (সূত্র: পিছু ফিরে দেখা, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭০-৭১)
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি বর্ষণের পর আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণের জন্য সেদিন রাত্রে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে গোলাম মাওলাকে আহ্বায়ক করে একটি নতুন সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।
একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং গুলিবর্ষণের পূর্বে অর্থাৎ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হবার পর থেকেই প্রতিবাদমুখর ছাত্র-জনতা ও রক্তপিপাসু পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের পটভূমি সম্পূর্ণরূপে মেডিকেল কলেজ ছাত্রবাস ব্যারাক চত্বরে এসে পরে। আর এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন কেন্দ্রিয় নেতৃত্ব ছিল অনুপস্থিত তখনই আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রসমাজ। সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর আন্দোলনে গতিসঞ্চার হয়। মেডিকেল কলেজের সকলপন্থি ছাত্ররা একতাবদ্ধ হয়ে সম্মিলিতভাবে একুশের আন্দোলনকে স্বার্থক করে তুলেন।
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস এই স্বল্পকালীন অথচ ঐতিহাসিক সংগ্রাম পরিষদ এবং মেডিকেল কলেজের ছাত্রসমাজ একুশের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
যে কয়েকজনের মরদেহ, কবর এবং পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এর পেছনে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের অমানসিক শ্রম আর দুঃসাহসিক কর্মস্পৃহা। ভাষাসৈনিক ও বিশিষ্ট লেখক এম. আর আখতার মুকুল বলেন, “কিন্তু মেডিকেল কলেজের দুজন ছাত্র এক দুঃসাহসিক কাজ করে বসলো। কারফিউ এর মধ্যে এঁরা সৈন্যদল চলে যাবার পর এই দুইজন ছাত্র শহীদদের কবরগুলো চিহ্নিত করে এলো। এই জন্যই পরবর্তীকালে ছাত্রসমাজ প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আজিমপুর গোরস্থানে এই কবরগুলি ‘জিয়ারত’ ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে সক্ষম হচ্ছেন।” (সূত্রঃ বাহান্নর জবানবন্দী- এম.আর. আখতার মুকুল, সাগর পাবলিশার্স, ফাল্গুন ১৩৯২, পৃ. ৩১)
যে দুজন মেডিকেল ছাত্র ভাষাশহীদদের মরদেহ শনাক্ত কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৎকালীন বামপন্থি ছাত্রনেতা খোন্দকার আলমগীর এবং আমীর আহসান।
এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে খোন্দকার আলমগীর বলেন, “শহীদের মৃতদেহ মর্গে, আহতদের চিকিৎসার পরে কয়েকজনের মৃত্যু হলে তাদের মৃতদেহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের কোণায় আড়াল করে রাখা হয়। এগুলো পাহাড়ারত ছিলাম আমরা কয়েকজন। কিন্তু রাত তিনটের দিকে সামরিক বাহিনীর লোকজন হাসপাতাল ঘেড়াও করে লাশ নিয়ে যায় রাত চারটের মধ্যেই। সকাল বেলা কারফিউর সময় পার হওয়ার সাথে সাথে আমরা ভাবছিল লাশগুলো কোথায় নিয়ে যেতে পারে? আমির আহসানসহ আমরা ঠিক করলাম আজিমপুর কবরস্থানেই খোঁজ নেয়া যায়। না পেলে বনানী যাবার চেষ্টা করা যাবে। বনানী তখন অনেক দূর।
যানবাহনের রাস্তাও তেমন সুবিধের ছিল না। আজিমপুর কবরস্থানেই কবর খননকারীদের দেখা যাওয়া সহজ হয়ে যায় গণকবর এবং বরকতের একক কবর শনাক্ত করবো। তাদেরই সাহায্যে উদ্ধার করা গেল শহীদদের রক্তস্নাত কাপড় চোপড় এবং ব্যান্ডেজ ইত্যাদি কবরস্থানের মাঝামাঝি একটি ছোট ঘর থেকে। ঐ ঘরটি মৃতদেহ গোছল করানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। উদ্ধারকৃত ব্যান্ডেজ ও কাপড়চোপড় একটা ছেরা ছালায় ভর্তি করে নেই। ছালাটি কেনা হয় ঘাসকাটায় নিযুক্ত একটি কিশোরের কাছ থেকে। কবরগুলোতেও গাছ ডাল ভেঙ্গে তাতে কাপড়ের টুকরা বেঁধে দেয়া হলো শনাক্তকরনের সুবিধার জন্য। আজিমপুর কবরস্থান থেকে সাইকেলে করে ফেরার পথে প্রথমেই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনে জনতার ভির দেখলাম। ঢাকেশ্বরী ও পলাশি ব্যারাকের বাসিন্দা সরকারি কর্মচারীবৃন্দ ও তাদের সন্তান সন্ততিরা ভির করছে। হলের মাইকে তিন-চার বার ঘোষণা দেই কবর পাওয়ার খবর এবং কবর শনাক্ত করা হয়েছে বলে। কিছু রক্ত-স্নাতা ব্যান্ডেজ ও কাপড়ের টুকরো ছোট ছোট ডালপালা রক্ত পতাকার এক শোভাযাত্রা স্বতঃস্ফুর্তভাবে কবরস্থানের দিকে যেতে থাকায় প্রতীয়মান জনতা এই এক নতুন কর্মসূচি পেলেন।” (সুত্র ঃ লেখকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে ডা. খোন্দকার আলমগীর, ফেব্রুয়ারি, ২০০৪)
এ প্রসঙ্গে ডা. শরফুদ্দিন আহমদ বলেন, “বেলা দশটার দিকে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের মধ্যবর্তী খোলা জায়গায় শহীদদের জন্য এক গায়েবি জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। আমার মনে হয় এতে পাঁচ থেকে সাত হাজার ছাত্র ও মানুষ অংশ নেয়। এতে ইমামতি করেন সমবেত জনতারই একজন মুরব্বি চেহারার পৌঢ় ভদ্রলোক। জানাজা নামাজ শেষে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করেই মিছিল হয়। কিন্তু এতে পুলিশ গুলি চালায়নি বা লাঠিচার্জও করেনি। কিছু লেখক দাবি করেন এতে লক্ষাধিক লোক সমবেত হয়েছিল। কিন্তু তা সঠিক নয়। আমি নিজেও এই নামাজে শরিক হয়েছিলাম এবং ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে এই অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলাম।” (সূত্র ঃ ত্রিকাল ত্রিগুণ, পৃ. ২৫৫-৫৬)

ব্লাড ব্যাংক স্থাপন
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ কর্তৃক গুলি বর্ষণের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক অভাবনীয় ও হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে। ভাষাশহীদদের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে যায় রাজপথ ও হাসপাতালের বিছানা। আহতদের চিকিৎসা, অপারেশনের জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর রক্তের। হাসপাতালে কোথাও রক্ত ছিল না। সংগত কারণেই প্রয়োজন হয় প্রচুর রক্তের আর এই রক্তের প্রয়োজন মেটাতে রক্ত সংগ্রহের জন্য ২২ তারিখে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় প্রথম রক্ত সংগ্রহ অভিযান ও ব্লাড ব্যাংক স্থাপন করা হয়। এটি ছিল মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এই প্রক্রিয়াটি চালুর মধ্য দিয়ে প্রথম ব্লাড ব্যাংক স্থাপনের চিন্তাভাবনার সূত্রপাত হয় এবং বিনামূল্যে রক্ত প্রদানের ব্যবস্থা চালু হয়” (সূত্র: লেখকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক মির্জা মাজহারুল ইসিলাম, ৫ মার্চ ২০০৮)।

আপনার রক্ত দিন
আজকের হত্যাকান্ডে আহত বন্ধুরা রক্তের অভাবে মেডিকেল হাসপাতালে মরতে বসেছে। আপনি দয়া করে ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দান করে তাদের বাঁচান।” (সূত্র: সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২।
আহমদ রফিক বলেন, “বাইশে ফেব্রুয়ারির আরও দু’একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের তরুণ চিকিৎসক ও ছাত্রদের উদ্যোগে ব্লাড ব্যাংক স্থাপন। উদ্দেশ্য গুলিতে আহতদের বিনামূল্যে রক্তাদানের জন্য সুব্যবস্থা করা। তাই ‘ব্লাড ব্যাংক’-এর তরফ থেকে স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য বারবার কন্ট্রোল রুম থেকে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে একাধিক পত্রপত্রিকায় রক্তদানের জন্য আবেদন প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়।” (সূত্র: ভাষা আন্দোলন: ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব, পৃ. ২০৬)

সূত্র: ঢাকা মেডিকেল কলেজ: সেবা সংগ্রাম ঐতিহ্য – অধ্যাপক ডাঃ মনিলাল আইচ লিটু, এম আর মাহবুব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!