You dont have javascript enabled! Please enable it!

একুশের আন্দোলনে মেডিকেল ব্যারাক

একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী কয়েকদিনের আন্দোলনে মেডিকেল ব্যারাক ছিল একমাত্র আশ্রয়স্থল। একুশের সকল আন্দোলন ছিল ব্যারাককেন্দ্রিক।
মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্ররা সারাক্ষণ পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত থাকার কথা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মত জটিল বিষয়ের বাইরে সময় দেয়া তাদের পক্ষে হয়ত সম্ভব ছিল না। কিন্তু দেশ মাতৃকার টানে সময়, ইতিহাস ও জাতির প্রয়োজনে এক অনিবার্য আকর্ষণে তারা একুশের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
একুশের আন্দোলনে মেডিকেল ব্যারাকের ঐতিহাসিক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও একুশের ইতিহাসে আজও তা উপেক্ষিত। আহমেদ রফিক যথার্থই বলেছেন, “ভাষা-আন্দোলনের রাজনৈতিক ভাষ্যে বা ইতিহাসে কিংবা স্মৃতিকথায় মেডিকেল ব্যারাকের ছাত্রদের প্রাপ্য স্বীকৃতি কমই দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ লেখক বা বক্তা ব্যারাকের চত্বরটুকু নিঃশব্দে দ্রুত পায়ে পার হয়ে গেছেন। এর একটি কারণ, ব্যারাকের কোনো ভাষাসৈনিক এ পর্যন্ত নিজেদের রাজনৈতিক ভূমিকাটুকু চিহ্নিত করে রাখার জন্য কলম ধরেনি। যারা ধরেছেন, তারা এই বৃত্তের বাইরে, অন্য পাড়ার মানুষ।” (সূত্র: একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯)

অধ্যাপক ডা. আব্দুল কাদের খান বলেন, “একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রবৃন্দই মাতৃভাষা আন্দোলনের সূচনা করে। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলই ছিল আন্দোলনের আতুর ঘর, তার প্রাণকেন্দ্র। যে কোন প্রগতিশীল আন্দোলোনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য ১৯৪৮ সালের পর ভাষা-আন্দোলন ধীরে ধীরে ব্যাপ্তি লাভ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন পেশায়রত এবং রাজনীতিবিদের ও জনসাধারণের সম্পৃক্ততায় তা এক গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন মেডিকেল কলেজে হোস্টেলে গুলি বর্ষণের পর পরই দ্রুত গণ-জোয়ারে গতি-সঞ্চারিত হয়ে বাঁচা মরার লড়াইয়ের তীব্র হতে তীব্রতর গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। এ আন্দোলন গণ-আন্দোলনে পরিণত না হলে ‘একুশে’ কখনও ‘ঐতিহাসিক একুশে তে রূপান্তরিত হতো না। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই অবদানের স্বীকৃতি নেই। যদিও ঢাকা মেডিকেল কলেজই এ আন্দোলনের আতুর ঘর তথাপি-রাজনীতিবিদদের একুশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভাষণে, পত্র পত্রিকার প্রবন্ধে, রেডিও, টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাষা আন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভূমিকায় মেডিকেল কলেজের নামটি খুঁজে পাওয়া দুস্কর, পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় বৃহত্তর স্বার্থে ‘বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর’। এ যেন ‘ক্ষুদ্রকে’ অবজ্ঞা করে সত্যকে আড়াল করারই প্রয়াস” (সূত্র” একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ডা. আব্দুল কাদের খান, ১৩ জানুয়ারি, ২০১০)
ঢাকা মেডিকেল ব্যারাক বায়ান্নর একুশের আন্দোলনে সকল রাজনীতিবিদদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। নবীন-প্রবীণ সকল মতাদর্শের রাজনৈতিক কর্মীদের আশ্রয়স্থল ছিল এই ব্যারাক। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, আবুল হাশিম, মাওলানা ভাসানী, সামছুল হক, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুবকে যেমন আসতে হয়েছে তেমনি আসতে হয়েছে জহির রায়হান, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদসহ আরও অনেককেই। কমিউিনিস্ট পার্টির নেতাদেরও প্রধান আশ্রয়কেন্দ্র ছিল এই মেডিকেল ব্যারাক।
আহমদ রফিক বলেন, “সে সময়ের রাজনৈতিক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান রাজনৈতিক আশ্রয়স্থল ছিল ব্যারাক। ‘ভুতলবাসী’ মানুষের নির্ভয়, নিরাপদ সাময়িক আস্তানার ব্যবস্থা এবং যোগাযোগ রক্ষার উপায় ছিল মেডিকেল ব্যারাক। সাধারণভাবে আটচল্লিশ থেকে একান্ন পর্যন্ত যা ঘটেছে, বাহান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে আন্দোলনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তাই নতুনভাবে দেখা গেল। ব্যারাকই বাকি কটা দিন এই আন্দোলনের স্থায়ী আস্তানা এবং অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো।
বায়ান্নর ভাষাসংগ্রামী মোহাম্মদ সুলতান বলেন, “ঢাকা মেডিকেল কলেজ আর তা ছাত্রাবাস মহান তীর্থস্থানে পরিণত হলো।” (সূত্র: একুশের সংকলন ৮০, বাংলা একাডমি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৮০) একুশের আন্দোলনে মেডিকেল ব্যারাক প্রাঙ্গণে যে রক্ত ঝড়েছিলো সেই রক্তস্নাত বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটেছিল। বায়ান্নর ভাষাসংগ্রামী, লেখক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, “১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে যে মুহুর্তে পাকিস্তানি বুলেটে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল আর তার রক্তে মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণ রঞ্জিত হয়েছিল সেই মূহুর্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম হয়েছিল।” (সূত্র: রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারি- রফিকুল ইসলাম, একুশের নির্বাচিত-প্রবন্ধ, সূচীপত্র, ফেব্রুয়ারি, ২০০৮, পৃ. ১৮৭)

শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের সম্মিলিত ফসল শহীদ মিনার আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শহীদ মিনার সকল গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একমাত্র আশ্রয় ও উৎসস্থল হিসেবে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। শহীদ মিনার আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি হাসি-কান্নার ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী, আমাদের অস্তিত্বের প্রহরী। শহীদ মিনার আমাদের জাতীয় প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পাবার দাবি রাখে। ভাষাশহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্যেই শহীদ মিনার নির্মাণের কথা চিন্তা করা হয়। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের এক রাতের শ্রমে নির্মিত হয় প্রথম শহীদ মিনার ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। আহমদ রফিক যথার্থই বলেছেন: ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ অর্থাৎ প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা, স্থান নির্বাচন এবং প্রাথমিক উদ্যোগ পুরোটাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছত্রদের সমন্বিত প্রয়াস। “শহীদ মিনার ব্যারাকের রাজনীতি সচেতন কয়েকজন ছাত্রের স্বতঃস্ফূর্ত ও তাৎক্ষণিক বা আকস্মিক চিন্তায় এবং সমষ্ঠিগত ফসল।”
শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা ও প্রাথমিক উদ্যোগে সম্পর্কে ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, প্রথম শহীদ মিনারের অন্যতম স্থপতি ডা. শরফুদ্দিন আহমদ বলেছেন, “২৩ ফেব্রুয়ারি। সবাই হোস্টেলের মধ্যে আবদ্ধ। বাইরে যাওয়া যায় না, রাইফেল নিয়ে পুলিশ প্রহরায়। ভিতরে বসে স্থানে স্থানে জটলা করছি। এমনিভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। ভিপি গোলাম মাওলা আর আমাকে ঘিরে পাঁচ নম্বর ব্যারাকের বারান্দায় ছাত্রদের আলোচনা চলছে ঘটনা প্রবাহের ওপর। এখন আর কী করা যায় তাই বলাবলি করছি সবাই। এমনি সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এলো একটা প্রস্তাব। যুগান্তর আনয়নকারী এক ঐতিহাসিক প্রস্তাব! প্রস্তাবে বলা হলো, আচ্ছা, শহীদের লাশ আমরা নাই বা পেয়েছি, তাকে কী শহীদদের স্মৃতি উদ্দেশে আমরা তো আমাদের হোস্টেলের ভিতর একটা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ বানাতে পারি। আমরা সবাই একমত হয়ে বলে ওঠলাম, উত্তম অতি উত্তম প্রস্তাব।” (সূত্র: ত্রিকাল ত্রিগুণ- কর্নেল (অব:) এস.ডি. আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫৬)
প্রথম শহীদ মিনার সম্পর্কে বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের মেডিকেল কলেজের অপর কর্মী সাঈদ হায়দার লিখেছেন, “এটাকে স্বতঃস্ফূর্ত একটি পরিকল্পনা বলা চলে। দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে।” (সূত্র: ভাষা আন্দোলন: ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব, পূর্বোক্ত, পৃ. ২১৫)
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন ভিপি গোলাম মাওলা ও জিএস শরফুদ্দিন আহমদের অনুরোধে ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ প্রথম শহীদ মিনারের নকশা অংকন করেছিলেন বদরুল আলম।
প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের অন্যতম তত্ত্বাবধায়ক শরফুদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, “প্রশ্ন উঠল নকশার, মাল মসলার। নতুন কলেজ ভবন তৈরির জন্য ইট বালি সবই জমা আছে কলেজ ক্যাম্পাসে, সিমেন্ট আছে গুদামে। কিন্তু নকশা তৈরি করবে কে?
মাওলা ভাই বললেন, ‘বদরুল আকার হাত ভালো, সেই পারবে।’ নকশা আঁকার ভার পড়র বদরুল আলমের ওপর প্রথম নকশটা অনেকেই পছন্দ হয় নি। দ্বিতীয়বার করা হল, সঙ্গে আরও দুই একজন যোগ দিল। হায়দার ভাইও বোধহয় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত যে-নকশাটা দাঁড় করানো হল সেটাই মনোনয়ন পেল। এরপর কাজ শুরু। তাই বলি, পরিকল্পনা সমষ্টিগত যেমন শুরুতে তেমনি কাজের শেষে” (সূত্র: স্মৃতিবিস্মৃতির ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৩)।
বদরুল আলম বলেন, মাওলা ভাই ও আরও কিছু ছাত্র আমাকে বললেন, “ভাষার জন্য ছেলেরা রক্ত দিল, এটা ধরে রাখার জন্য একটা স্মৃতিস্তম্ভের নকশা বানিয়ে নিয়ে দিও। তখন এত রাতে আমার মাথায় কিছুই আসছিল না। হঠাৎ মনে হলো, ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম, ওখানে সুন্দর ইটবাঁধানো একটা স্তপ ছিল। বাবা বললেন, এটা স্মৃতিস্তম্ভ। কেউ মারা গেলে তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য এটা বানানো হয়। সেই স্তপ কল্পনা করে একটি নকশা করলাম। কারও তেমন পছন্দ হলো না। পরে ভিক্টোরিয়া পার্কে সিপাহি বিদ্রোহের যে স্মৃতিস্তম্ভ আছে, সেটির আদলে একটি নকশা বানালাম। অধ্যাপক মির্জা মাজহারুল ইসলামের ঘরে বসে বানাই সেটা। সবার পছন্দ হলো। রাতেই ইট, সিমেন্ট, বালু ও রাজমিস্ত্রি জোগাড় হয়ে গেল। ভোর পাঁচটার মধ্যে ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট প্রস্থের শহীদ মিনার তৈরি হলো। ২৩ ফেব্রুয়ারির সেই রাতে হোস্টেলের সবাই অংশগ্রহণ করেছিল শহীদ মিনারটি তৈরি করতে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব হতো না (সূত্র: প্রথম শহীদ মিনার-ডা. আফজালুন নেসা, প্রথম আলো, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮)
শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে আর শেষ হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে। প্রথম শহীদ মিনার তৈরির উপকরণ সংগ্রহ করা হয় মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ থেকেই। কলেজ সম্প্রসারণের জন্য সংরক্ষিত ইট, বালু ব্যবহার করা হয় এবং সিমেন্ট সংগ্রহ করা হয় মোতালেব ও পিয়ারু সর্দারের সিমেন্টের গুদাম থেকে। ছাত্রদের উদ্যোগেই রাজমিস্ত্রি যোগার, উপকরণ সংগ্রহসহ সকল কার্যক্রম ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের একক শ্রম আর সাধনার ফসল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্যারাকে অবস্থানরত প্রায় সকল ছাত্ররাই নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন।
প্রথম গড়া শহীদ মিনারটির ভিত ছিল পাঁচ ফুট গভীর, পাদদেশ ছিল ছয় ফুট লম্বা, ছয় ফুট চওড়া আর উচ্চতা ছিল এগার ফুট।
এ প্রসঙ্গে কর্নেল (অব.) ডা. শরফুদ্দিন আহমদ বলেন, “ঢাকা মেডিকেল কলেজের নতুন বিল্ডিং তৈরি করার জন্য কলেজ হোস্টেল আর তার পাশে হাসপাতালের খালি জায়গাতে রাখা ছিল ইট আর বালির বিরাট স্তপ। আর টিনের একটা ছাপরা ঘরের মধ্যে ছিল অনেক বস্তা সিমেন্ট। এগুলোর মালিক ছিল ঠিকাদার পিয়ারু সরদার। আমরা স্থির করলাম এই সমস্ত ইট, বালি সিমেন্ট দিয়ে ওই রাতেই শহীদ মিনার তৈরি করবো। মালিকের অনুমতির জন্য ভিপি গোলাম মাওলা দু’জন ছাত্রকে পাঠিয়ে দিল অনুমতি নিতে এবং সিমেন্টের গুদাম ঘরের চাবি আনতে। অনুমতি আর চাবি নিয়ে ছাত্র দু’জন ফিরে এলো। তারা বলল, পিয়ারু সরদার বলেছে, ‘মিঞারা, তোমরা যা প্রয়োজন তা নাও’।”
যে দু’জন ছাত্র সে রাতে চাবি আনার জন্য পিয়ারু সর্দারের বাড়িতে গিয়েছিলেন তারা দু’জনই তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র আহমদ রফিক ও আলী আজগর।
ডা. শরফুদ্দিন আহমদ আরও বলেন, “শহীদ মিনার তৈরি শুরু হলো। ভিপি আমাকে বলেন, আপনি তো একজন ইঞ্জিনিয়ার, ড্রইং সম্পর্কে আপনার ট্রেনিং আছে। নকশা অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব এবং কাজের সার্বিক পরিচালনার ভার রইলো আপনার ওপর। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে উপস্থিত প্রায় সব বাঙালি ছাত্রই পালাবদল করে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি কাজে অংশ নিল। আর আমাদের মধ্যে পনের বিশ জনের একদল তো সারারাত ধরেই কাজ করলাম।
কাছাকাছি এক মহল্লা থেকে একজন রাজমিস্ত্রি আনা হয়েছিল তার কাজের যন্ত্রপাতিসহ। সেই রাজমিস্ত্রির পরিচালনা অনুসারে আমরা ছাত্ররাই সব কাজ করলাম। ভিতের গর্ত খোঁড়া, ইট, বালি, সিমেন্ট বয়ে আনা, পানি আনা, বালি সিমেন্ট মিশিয়ে পানি দিয়ে গুলে দেয়া, রাজমিস্ত্রির সঙ্গে সঙ্গে ইটা গাঁথা ইত্যাদি যাবতীয় কাজ।
তেইশ-চব্বিশ ফেব্রুয়ারির সেই রাতটা ছিল বেশ ঠান্ডা। ঝির ঝির করে হাওয়া চলচিল। চব্বিশে ফেব্রুয়ারি ভোর হওয়া পর্যন্ত আমরা শহীদ মিনার তৈরির কাজ শেষ করলাম। শুধু মিনারের চূড়ার এক ফুট খানিক অসমাপ্ত রইলো। বলা হলো, পরে ওইটুকু সমাপ্ত করা হবে। আমাদের হাতে তৈরি এই শহীদ মিনারের ভিত ছিল পাঁচ ফুট গভীর, পাদদেশ ছিল ছয় ফুট লম্বা, ছয় ফুটি চওড়া, আর উচ্চতা এগার ফুট। সমস্ত রাত ঠান্ডার মধ্যে কাজ করে আমাদের অনেকেরই হাত ফুলে গিয়েছিল। আর কিছু ছেলের হাতে ফোস্কাও পড়েছিল।” (সূত্র: ত্রিকাল -ত্রিগুণ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫৬-২৫৭)
প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের একক কৃতিত্বেয় দাবিদার ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রসমাজ। তারাই ছিল রাজমিস্ত্রী, তারাই ছিল যোগালি। লাইনে দাঁড়িয়ে হাতে হাতে ইট বহন করে। সকলের সম্মিলিত শ্রমে গড়ে ওঠে স্মৃতির মিনার।
শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ মোট দু’বার উদ্ধোধন করা হয়েছিল। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবার উদ্বোধন করা হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ তারিখে উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা পুরানো ঢাকার লক্ষ্মীবাজার নিবাসী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান। ২৬ তারিখ আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন একুশের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে প্রথম আইন-পরিষদ থেকে পদত্যাগকারী সদস্য, ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন।
প্রথম শহীদ মিনারে পরিকল্পনা, নকশা ও নির্মাণে যে মেডিকেল ছাত্রদের একক অবদান তেমনি মিনার উদ্বোধনের ক্ষেত্রেও সকল কৃতিত্ব মেডিকেল ছাত্রদের। একজন ভাষা শহীদের পিতাকে দিয়ে প্রথম শহীদ মিনার উদ্বোধনের চিন্তা ও বাস্তবায়ন পুরোটাই ছিল মেডিকেল কলেজের ছাত্রদেরই সফল উদ্যোগ। পরবর্তীতে আবারো নেতৃস্থানীয় কাউকে দিয়ে উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত ছিল যথার্থ ও বাস্তবসম্মত। মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের একটি মহৎ অর্জন শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ। মিনারের নকশা বা স্থাপনাশৈলী যাই হোক ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে মিনারটি হয়ে উঠে পুরো বাঙালি জাতির ভালোবাসা আর হৃদয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে ঢাকায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারটি হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির প্রেরণার উৎস। আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক। মানুষের ঢল নামে শহীদ মিনারে ‘নারী পুরুষ নির্বিশেষে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করতে থাকে। শহীদ স্মৃতি স্তম্ভে শুধু হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিই ছিল না, এরা ফুল, মালা, টাকা পয়সা এমনকি সোনার গহনা পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছিল শহীদ মিনারের পাদদেশে।
এমনিভাবে প্রথম শহীদ মিনার একদিকে যেমন অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালবাসার তীর্থভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পায়, অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠীর কাছে হয়ে ওঠে আতংক আর উদ্বেগের কারণ। মাত্র আড়াই দিনের বেঁচে থাকা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের দূর্জয় ঘাঁটি হিসেবে পরিগণিত হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর হতে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল মাত্র আড়াই দিনের অস্তিত্ব নিয়েই ইতিহাসের অমর কাব্য রচনা করেছে ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয় প্রথম শহীদ মিনার। পরদিন (২৭ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক আজাদ অন্যান্য খবরের সাথে শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলার খবর ছাপে নিম্নোক্ত শিরোনামেঃ “মেডিকেল হোস্টেলে নির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের বিলোপ” “গতকল্য (২৬ ফেব্রুয়ারি) মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের স্মরণে নির্মিত যে স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করা হয়েছিল, পুলিশ সন্ধ্যায় তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে।”
প্রথম শহীদ মিনার ধ্বংসের পর মিনারের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। বাংলা ভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি বাঙালির হৃদয়ে চির জাগরুক হয়ে ওঠে। সেই চেতনার দূর্নিবার শক্তি জাতীয় জীবনে আজও আমাদের প্রেরণা ও সাহস যোগায় সংগ্রামে ও সংকটে।
‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’-প্রথম শহীদ মিনারেই উত্তরসূরি আজকের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। প্রথম শহীদ মিনারের নির্মাতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রসমাজের এটাই সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ও অর্জন।
‘শহীদ মিনার’ আজ শুধু একটি স্থাপত্যের নাম নয়, বাঙালি জাতির অস্তিত্বের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত। শহীদ মিনার বাঙালির স্বাধীন ঠিকানা, আমাদের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, হাসি-কান্না ও উৎসব আনন্দের তীর্থভূমি। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে ‘অমর একুশে’ বাঙালির মহা মিলন মেলায় পরিণত হয়।
এমন একটি ঐতিহাসিক, মর্যাদাসম্পন্ন মহান স্থাপত্য কীর্তি ‘শহীদ মিনার’ এর প্রথম নাম ছিল ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। আর এই স্মৃতিস্তম্ভের পরিকল্পনা, নকশা, নির্মাণসহ সকল কৃতিত্বের একমাত্র দাবিদার ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সমাজ।
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিকেল ছাত্রদের দ্বারা প্রথম শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল বলেই আজকে আমরা বিশ্বের দরবারে গর্ববোধ করতে পারি, আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারি বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা, আমাদের শেকড় ও অস্তিত্বের কথা। ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রদের অবিস্মরণীয় ও অমর সৃষ্টির কারণেই আজকের শহীদ মিনার আমাদের প্রাণের মিনার।

সূত্র: ঢাকা মেডিকেল কলেজ: সেবা সংগ্রাম ঐতিহ্য – অধ্যাপক ডাঃ মনিলাল আইচ লিটু, এম আর মাহবুব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!