প্রথম শহীদ মিনারের প্রথম আলোকচিত্র শিল্পী
ডা. এ. হাফিজের সাক্ষাৎকার
অমর একুশের ইতিহাসে ১৯৫২ সালের ২৪ তারিখে প্রথম শহিদ মিনারের ছবি তোলার ঘটনাটি ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের প্রথম ছবিটি তুলেছিলেন তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ডা. এ হাফিজ। তিনি ছিলেন বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের অন্যতম কারিগর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘৫২ সালে সারারাত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে ২৪ ফেব্রুয়ারি তার নিজের ক্যামেরায় ঐতিহাসিক এই ছবিটি তুলে রাখেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। ১৯৫৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে প্রবাসে। ১৯৯৯ সালে অবসর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং অধ্যাবধি সেখানেই অবস্থান করছেন। ২০১৩ সালে ডা. এ হাফিজের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ও কথা হয়। আমাকে তার যুক্তরাষ্ট্রের ঠিকানা ও ই-মেইল নম্বর প্রদান করেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল, ভাষাসৈনিক ও বিশিষ্ট শল্যচিকিৎসক অধ্যাপক ডা. কবির উদ্দিনের স্ত্রী তসলিমা কবির এবং প্রথম শহিদ মিনারের নকশাকার ভাষাসৈনিক ডা. বদরুল আলমের স্ত্রী অধ্যাপক ডা. আফজালুন্নেসা।
আমি প্রথম শহিদ মিনারের ছবি উদ্ধার এবং এ প্রসঙ্গে কয়েকটি প্রশ্ন করে তাকে একটি মেইল করি। তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রশ্নের উত্তর এবং ছবি পাঠিয়ে দেন। প্রথম শহিদ মিনারের ছবিটি আমরা ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরে সংরক্ষণ করি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইতিহাস সংরক্ষণ প্রকল্পের পক্ষে অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু এবং ভাষা আন্দোলন জাদুঘরের উদ্যোগে উক্ত ছবিটি পোস্টার আকারে ছাপিয়ে বাঁধাই করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
২০১৩ সালে ছবিটি আমার হস্তগত হওয়ার পর ২০১৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘নিউ এজ’ পত্রিকায় প্রথম শহিদ মিনারের ছবিটি ছাপা হয় এবং এ বিষয়ে COLLECTING MEMORABILIA OF LANGUAGE MOMNENT শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এতে বলা হয়, “… Recently Bhasha Andolan Gabeshana Kendra O Jadughar has collected the image of the first Shaheed Minar installed by the medical college students on February 23, 1952, which has been donated by Dr. MA Hafiz, an expatriate in the US…”
প্রথম শহিদ মিনারের আরও ছবি তুলেছিলেন ডা. মঞ্জুরুল হক (বর্তমানে প্রয়াত)। তিনি ছবিটি তার বন্ধু ডা. এমদাদুল হকের কাছে রেখে দেন। ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আমি এদাদুল হকের উত্তরার বাসায় তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। তখন তিনি আমাকে উক্ত ছবিটি হস্তান্তর করেন এবং এ বিষয়ে বলেন, “আমি ব্যারাকে আসার পর আমার বন্ধু মঞ্জুরুল হক-এর নিকট থেকে খুবই স্মরণীয় একটি ঘটনা জানতে পারি। মঞ্জুরের শখ ছিল ছবি তোলা। সে তার নিজের ক্যামেরায় প্রায়ই ছবি তুলতো। সে আমাকে জানায় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে শহিদ স্মৃতিস্তম্ভের ছবি তোলার কথা। তার নিজস্ব ক্যামেরায় সে নিজেই প্রথম শহিদ মিনারের ছবি তোলে এবং আমাকে উক্ত ছবির একটি কপি প্রদান করে। মঞ্জুরুল হক থাকত ১২ নং ব্যারাকের ৩ নং রুমে। এই ব্যারাকের সামনেই গুলি হয়েছিল এবং সেখানেই গড়ে উঠে প্রথম শহিদ মিনার। প্ৰথম শহিদ মিনারের ছবি তোলার বিষয়ে আরও একজনের নাম জানা যায় তিনি হলেন ডা. এ হাফিজ। ডা. এ হাফিজ একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যিনি প্রথম শহিদ মিনারের প্রথম আলোকচিত্রী। অন্যান্য ছবির চেয়ে তার তোলা ছবিটি সম্পূর্ণ এবং সুস্পষ্ট। তিনি আজও ছবিটি সযত্নে সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সংক্ষিপ্ত এক সফরে তিনি ঢাকায় আসেন। আমি তাকে ধানমন্ডিতে অবস্থিত ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানাই। তিনি সানন্দে রাজি হন এবং ৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ তারিখে ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর আসেন। সেখানেই কথা হয় তার সাথে। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং প্রথম শহিদ মিনারের ছবি তোলা প্রসঙ্গে তিনি খোলামেলা কথা বলেন প্রথম শহিদ মিনারের আলোকচিত্রী, ভাষাসংগ্রামী ডা. এ হাফিজ লেখকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই ১৯৫০ সালে। তখন মেডিকেল কলেজের সাংস্কৃতিক সংগঠন “শিল্পীসংঘ’ ছিল বেশ জনপ্রিয়। আমার সিনিয়র বন্ধু শাহজাহান হাফিজ, মাস্তানা এবং বদরুল আলমের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আমি ‘শিল্পীসংঘ’-এর সদস্য হই। বেহালা বাজানো ও সংগীত পরিবেশন ছিল আমার মূল কাজ।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমতলার সভায় যোগদান করি এবং সভা শেষে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে ব্যারাকে চলে আসি। আমি, আব্দুল হাইসহ আরও ৪ থেকে ৫ জন ব্যারাকে ২০ নং রুমে (ফজলে রাব্বীর রুম) বসে আছি। ৩টা কি সোয়া ৩টার দিকে হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে আমরা রুমের বাইরে এসে দেখতে পেলাম গুলিবিদ্ধ একজনকে ছাত্ররা ধরে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছে। সকলের সাথে আমিও এতে অংশ নেই।
শুনতে পেলাম আরেক জনের ঊরুতে গুলি লেগেছে। তাকেও হাসপাতালে আনা হয়েছে। পরে জানলাম তার নাম বরকত। এ অবস্থা দেখে আমরা হতভম্ব হয়ে যায়। সারা শহরে ছাত্রহত্যার খবর পৌঁছে যায়। হাসপাতালে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। আমাদের কন্ট্রোল রুমের মাইক থেকে সর্বশেষ খবর পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে জনতার মাঝে। আমি রক্তাক্ত দেহে আমাদের বাসায় যাই। আমার এক বড়ো ভাই ছিলেন তৎকালীন এম এল এ। তার নাম আব্দুল হামিদ। তিনি তখন বাসায় ছিলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন ‘গায়ে রক্ত কেন?’ আমি বললাম, ‘আপনার মুসলিম লীগ সরকার কী করেছে দেখেন। এ কথা শুনে তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং সাথে সাথে গেঞ্জি ও লুঙ্গিপরা অবস্থায় চলে যান। রাতে বাসায় ফিরেই ‘আবেদ কোথায়’ বলে আমার খোঁজ করতে থাকেন। আবেদ আমার ডাক নাম। আমি কান্নাজড়িত কন্ঠে সব ঘটনা বললাম। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘আমি আজ থেকে আর মুসলিম লীগে নাই।’ অবশ্য পরে তিনি সত্যিই পদত্যাগ করেছিলেন।
২২ তারিখ সকালে ব্যারাকে চলে আসি। গায়েবানা জানাজায় অংশ নেই। ২২ তারিখেও গুলি হয়। বেশ কয়েকজন মারা যায়। মরদেহ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। সেদিন আমার হাতে ক্যামেরা ছিল। আমি মর্গে গিয়ে গোপনে মরদেহের ছবি তুলি। আমি নিজে সাতটি মরদেহ দেখতে পাই। মরদেহের ছাবি ‘আজাদে’ ছাপা হয়েছিল। ছবির নিচে আমার নামও ছাপা হয়। এরপর থেকে পুলিশ আমাকে খুঁজতে থাকে। ২৩ তারিখ আমি ব্যারাকে চলে আসি।
ফজলে রাব্বীর রুমটি ছিল আমার আস্তানা। আমরা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির সিদ্দান্ত নেই। বদরুল আলম ছিলেন অঙ্কনে পারদর্শী। তাকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভের নকশা তৈরি করা হলো। আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি গোলাম মওলা ও জিএস শরফুদ্দিনের নেতৃত্বে আমরা সারারাত জেগে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করলাম।
২৪ তারিখ ভোরে আমি বাসায় চলে আসি। আমার মাকে শহিদ মানার তৈরির ঘটনা বলি। আমি তখন থাকতাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আবাসিক ভবনে। মা এসব কথা শুনে শহিদ মিনার দেখার ইচ্ছা পোষণ করেন। আমি তাকে নিয়ে শহিদ মিনারে চলে আসি। আমাদের বাসার নীচতলায় ছিল হলুদ গাঁদা ফুলের বাগান। সে সেখান থেকে ফুল নিয়ে মালা তৈরি করেন শহিদ মিনারে দেওয়ার জন্য। মা ফুলের মালা রাখলেন শহিদ মিনারে। তখনই আমি ছবি উঠালাম। আমার মেজ ভাই আবদুল আজিজ কৃষি বিভাগে চাকুরি করতেন। সে ১৯৫০ সালে আমেরিকা থেকে আমার জন্য একটি ক্যামেরা নিয়ে আসেন। ক্যামেরাটি ছিল BOIGHT GLANDER VITO-235 MM ক্যামেরা। এই ক্যামেরাটি দিয়েই আমি প্রথম শহিদ মিনারের ছবি তুলি। আমি নিজে সে রাতেই ছবি ডেভেলব ও প্রিন্ট করি। আমি ছবি তোলা, ডেভেলব ও প্রিন্ট করার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। ছবি প্রিন্ট করে আমার কাছে একটা রাখি, একটা বড় ভাই আবদুর রশিদ-কে এবং একটা মেঝভাই আব্দুল আজিজ-কে দেই। ছবির নেগেটিভটি আজও আমি যত্ন করে রেখেছি। পুলিশ ঘটনা জেনে যায় এবং আমাকে খুঁজতে থাকে। আমি পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে যাই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঢাকায় আসি।”
ডা. এ হাফিজের তোলা ছবিটি প্রসঙ্গে অধ্যাপক আফজালুন্নেসা বলেন, “ডা. হাফিজ ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তিনি প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণে অংশ নেন। তার ছবি তোলার শখ ছিল। বাহান্নর ২৪ তারিখ সকালে তিনি প্রথম শহিদ মিনারের প্রথম ছবিটি তুলেছিলেন। মূল ছবিটি এবং ছবির নেগেটিভ আজও তিনি সযত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছেন।
(সাক্ষাৎকার গ্রহণ- এম আর মাহবুব)
সূত্র: ঢাকা মেডিকেল কলেজ: সেবা সংগ্রাম ঐতিহ্য – অধ্যাপক ডাঃ মনিলাল আইচ লিটু, এম আর মাহবুব