বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৪শে নভেম্বর, শনিবার, ১৯৭৩, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রসঙ্গে
এক সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকার শিল্পখাতে মোট ৭৫০ কোটি টাকা মূলধন বিনিয়োগের এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই বরাদ্দের প্রায় শতকরা ৫১ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রায় এবং ৪৯ ভাগ স্থানীয় পুঁজি হিসেবে ব্যয়িত হবে।
সম্পূর্ণ পুঁজির শতকরা ৬৫ ভাগ অর্থাৎ প্রায় ৪৮৬ কোটি টাকা নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠার কাজে লাগানো হবে। চলতি প্রকল্পসমূহের শতকরা ২২ ভাগ অর্থাৎ ১৫৫ কোটি টাকা এবং শতকরা ১৩ ভাগ অর্থাৎ ৯৬ কোটি টাকা বর্তমানে বিদ্যমান কল-কারখানা সমূহের আধুনিকীকরণ কাজে খাটানো হবে। বাকী ১৩ কোটি টাকা গবেষণা ইত্যাদি পরীক্ষামূলক কাজে লাগানো হবে।
এই পরিকল্পনানুসারে কুমিল্লা জেলার আশুগঞ্জে প্রতিষ্ঠিতব্য পেট্রো-কেমিক্যাল কমপ্লেক্সই সর্ববৃহৎ একক প্রকল্প। এ প্রকল্প কৃত্রিম সূতা উৎপাদন করে দেশকে বস্ত্র ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দিতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের শতকরা ৫০ ভাগ কাজ প্রথম পঞ্চবার্ষিকীতেই সমাপ্তি পাবে বলে অনুমিত হচ্ছে।
যাহোক, এই হলো আমাদের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার এক মোটামুটি চিত্র এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে এর বিপুল ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন সম্পর্কে কারো দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই। তবুও আমাদের দেশে বিরাজমান কতিপয় বর্তমান সমস্যাবলীর দিকে এক গবেষণামূলক দৃষ্টি রেখে এবং তদনুযায়ী যাবতীয় উদ্যোগ নিয়ে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এর লব্ধ ফল আশাতীতভাবে আমাদের সবারই উপকারে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
আমাদের দেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এবং দিন দিনই আমাদের দেশের লোকসংখ্যা ভৌতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আহারের প্রশ্ন, কর্মসংস্থানের প্রশ্ন, আবাসের প্রশ্ন ইত্যাদি দিন দিনই এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। অথচ, আমাদের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের জমি অত্যন্ত সীমিত এবং একে বাড়ানোর কোনো রাস্তা নেই।
ফলে, আমাদের কৃষিকাজে আধুনিক উপায়ে ফলন বৃদ্ধি ও দ্রুত শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তা প্রকটরূপে দেখা দিয়েছে।
কৃষিকাজ আধুনিক সুযোগ, ব্যবস্থা ও নিয়মে নিয়ন্ত্রিত হলে ফলন অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে। ফলন বৃদ্ধি পেলে আহারের সমস্যা অনেকখানি আয়ত্ত্বে আসবে। আহার নিশ্চিন্ত দেশের মানুষ জীবনের অন্যান্য দিকেও গভীর মনোযোগ দিতে বা দ্রুত উন্নতি করতে সক্ষম হবে।
অনুরূপভাবে, দেশের বিভিন্ন নতুন নতুন কল-কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে দেশকে দ্রুত শিল্পায়িত করতে পারলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে, বেকারত্বের অভিশাপ দূর হবে, দেশের হাইজ্যাক-ছিনতাই হ্রাস পাবে, সবার মুখে হাসি আসবে, দেশ দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।
উদ্বৃত্ত উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের রপ্তানী বৃদ্ধি জন্যে একান্তভাবে সচেষ্ট হতে হবে। কারণ, রপ্তানী হলে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে, বিদেশের বিভিন্ন ঋণভার লঘু করতে পারবে এবং দেশের অভ্যন্তরে নানান বৃহৎ বৈজ্ঞানিক প্রকল্প বাস্তবায়িত করার প্রয়োজনীয় পুঁজি সঞ্চয় করতে পারবে। কারণ, পরমুখাপেক্ষী হয়ে এমন অকর্মণ্যতার দীনতা নিয়ে কখনোই চলা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে আমরা বিদেশের সঙ্গেও নিজেদের একটু তুলনা করে নিতে পারি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানী ও জাপান আমাদের বাংলাদেশের চেয়ে কোনো অংশেই কম বিধ্বস্ত হয়নি। বোমার আঘাতে বার্লিন সহ জার্মানীর বড় বড় শহরে শতকরা দশভাগের বেশী বাড়ী খাড়া ছিলোনা। এমন কি জার্মানী ও জাপান এ উভয় দেশই বিদেশী নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিলো। অথচ, কঠোর সাধনা ও নিরলস পরিশ্রমের ফলে তারা উভয়েই আজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে অন্যতম সর্বশীর্ষে সমুন্নত।
খনিজ তেল, খনিজ লোহা ইত্যাদি সহ জাপানে বহু রকমেরই কাঁচামাল নেই। তবুও জাপান আজ সারা বিশ্বের অন্যতম শিল্পোন্নত দেশ। জার্মানীও তাই। অনেক ক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রথম শ্রেণীর শিল্পোন্নত দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে।
সুতরাং, উপযুক্ত নিষ্ঠা, পরিশ্রম, আন্তরিকতা, গবেষণা, পর্যবেক্ষণ এবং বলিষ্ঠ সরকারী সহযোগী ও নেতৃত্ব পেলে আমরাও এ শূন্যাবস্থা থেকে গৌরবের চরম শীর্ষে অচিরেই সমুন্নত হতে পারবো এ নিশ্চয়ই কোনো দুরাশা নয়।
যাহোক, আবার আমাদের আসল আলোচ্যে আসা যাক।
আমাদের বর্তমান প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় যে দুর্বলতাটি সহজেই লক্ষ্য করা যায় তা হচ্ছে এই যে, বরাদ্দকৃত ৭৫০ কোটি টাকা পুঁজি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বেসরকারী খাতের জন্যে কত টাকা রাখা হয়েছে তার কোনো স্পষ্ট উল্লেখ নেই। অবশ্য আমাদের মতো বস্ত্র অসয়ম্ভর দেশে আশুগঞ্জে প্রতিষ্ঠিতব্য প্রকল্পের উপর উপযুক্ত গুরুত্ব নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমরা মনে করি।
আর একটি দুর্বলতা হচ্ছে এই যে, এ পরিকল্পনায় স্পষ্ট বা পূর্ণাঙ্গ কোনো রূপরেখা নেই। দেশ শত্রুমুক্ত হবার পর অসদুপায়ে অর্জিত এক বিপুল পরিমাণ অর্থ এখনো বহু লোকের হাতে অলসভাবে পড়ে আছে। অথচ এ অর্থ সরকারী তহবিলে আনার বা বিনিয়োগে খাটানোর কোনোই বাস্তব পদক্ষেপ এতে নেওয়া হয়নি।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এ অর্থের এক বিরাট অংশ ইতিমধ্যেই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে এবং এখনো বিপুল পরিমাণ অর্থ আমাদের দেশের বিভিন্ন গোপন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভাসমানভাবে ঘুরে পাচার প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে।
তাই সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, এই অসৎ অর্থ এই মুহূর্তেই উদ্ধারের যাবতীয় উদ্যোগ নেওয়া উচিত এবং সে অর্থ যাতে দেশের বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োজিত হয়ে সবার উপকারে আসতে পারে সে বিষয়ে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
তা’ না হলে অচিরেই এস অসৎ অর্থ বিদেশে পাচার হতে বাধ্য এবং এক বিপুল পরিমাণ অর্থের মুনাফা থেকেও আমাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার বঞ্চিত হতে বাধ্য।
পরিকল্পনাহীন উচ্ছেদ অভিযান প্রসঙ্গে
অননুমোদিত দোকান পাট উঠিয়ে দেবার কাজ কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকবার সম্পন্ন করেছেন। এক স্থান থেকে উঠিয়ে দিলেও ঐ সকল দোকানদাররা অন্যস্থানে পুনরায় তাদের জায়গা করে নিয়েছে। ঠিক এমনিভাবেই অনির্ধারিত স্থানে যে সকল বস্তিবাসীরা বাসস্থান করে গেড়ে বসেছিলো তাদেরকেও কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় তাড়া করেছেন। কিন্তু মূলতঃ একস্থান থেকে উঠে গিয়ে তারা আবার অন্যত্র স্থান করে নিয়েছে। স্থায়ীভাবে তাদের কাউকেই কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ করতে পারেননি। ইতিপূর্বে আমরা ফুটপাতের অননুমোদিত দোকানদারদের উঠিয়ে দেবার জন্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতা লক্ষ্য করেছিলাম। ঠিক একইভাবে বস্তিবাসীদেরকেও উচ্ছেদ করার কৌশল আমরা লক্ষ্য করেছিলাম। কিন্তু তাদেরকে স্থানীয় কোনো কর্মপন্থা গ্রহণ করতে আমরা দেখিনি। শুধু ছিন্নমূল বস্তিবাসীদের একস্থান থেকে তাড়িয়ে অন্যস্থানে পাঠিয়েছেন। এবং যে স্থানে পরে বস্তিবাসীরা জায়গা করে নিয়েছে সেটাও কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত জায়গা নয়। আমরা ফুটপাতের অননুমোদিত দোকানদারদের সরিয়ে নিয়ে স্থায়ী একটা স্থানে পুনর্বাসনের স্বপক্ষে—কিন্তু কোনো পরিকল্পনা ছাড়া শুধু শুধু স্থানচ্যূত করার কোনো ফায়দা আছে বলে আমরা মনে করিনা। এক জায়গা থেকে সরিয়ে দিলে তারা বাঁচবার তাগিদেই অন্যস্থানে জায়গা করে নেবে। ফলে এক স্থানের সৌন্দর্য রক্ষার্থে অন্য স্থান অসুন্দর হবে। ঠিক এমনিভাবে বস্তিবাসীদের জন্যে কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা না করে এক জায়গা থেকে তাড়িয়ে অন্য জায়গায় পাঠানো এবং সেই জায়গা থেকে আবার আর এক জায়গায় পাঠানো কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য ব্যাপার হতে পারেনা। বৃহৎ ঢাকা এবং পরিকল্পিত নগরী তৈরী করার যে মহৎ কর্মসূচী ইতিপূর্বে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে আমরা শুনেছিলাম তার নিমিত্তেই আমরা মনে করি, বস্তিবাসী বা ফুটপাতের দোকানদারদের অযথা পরিকল্পনাহীনভাবে স্থান থেকে স্থানান্তরে উচ্ছেদের নামে কষ্ট দেওয়া মোটেই উচিত নয়। এতে করে যেমন দুঃখী বস্তিবাসীরা মর্মান্তিক দুর্ভোগ পোয়ায় তেমনি সচেতন মানুষের বীতশ্রদ্ধা কর্তৃপক্ষের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়। ফুটপাতের ছোট ছোট দোকানদাররা স্থানীয়ভাবে মানুষের জন্যে যে যোগান দিতো উচ্ছেদের কারণে সেটাও বন্ধ হওয়ায় স্বভাবতঃই সাধারণ্যে ক্ষোভের কারণ হয়। অথচ যাদেরকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে তারা অন্যত্র গিয়ে ঠিকই আবার দোকান চালু করে নিচ্ছে। যদি কর্তৃপক্ষের পরিকল্পিত ঢাকা নগরী তৈরীর ইচ্ছা থাকে তাহলে অবশ্য এই ধরনের ক্ষুদ্র দোকানদারদেরকে একটি নির্ধারিত এলাকায় স্থান করে দিতে হবে। ঠিক তেমনিভাবেই বস্তি তুলে দিয়ে ছিন্নমূল মানুষের থাকবার একটা স্থায়ী ব্যবস্থা একটি বিশেষ এলাকায় নির্ধারিত করতে হবে। অন্যথায় পরিকল্পনাহীন এই উচ্ছেদ অভিযান কর্তৃপক্ষের প্রতি বীতশ্রদ্ধাই বাড়িয়ে তুলবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক