You dont have javascript enabled! Please enable it! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিকেল কলেজ - সংগ্রামের নোটবুক

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিকেল কলেজ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে যখন পাক-ভারত মহাদেশ দ্বিখন্ডিত হয়েছিল তখনই যেন রোপিত হয়েছিল ভাঙনের বীজ। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পশ্চিম ও পূর্ব অংশের মধ্যে যেমন ছিল বিশাল ভৌগোলিক দূরত্ব, মানসিকতার মাঝেও ছিল যোজন যোজন ফারাক। দীর্ঘ দুই যুগের পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায় নিপীড়নের ফলশ্রুতিতে একাত্তরে স্বাধিকারকামী পূর্ব পাকিস্তানিদের নিরীহ বাঙালিদের উপর নেমে এল ইতিহাসের জঘণ্যতম গণহত্যা। শুরু হয়ে গেল স্বাধীনতা যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে এই কলেজ থেকে পাশ করা চিকিৎসক, তৎকালীন ছাত্র, কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এদের অনেকেই অস্ত্রহাতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আবার কেউ কেউ হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা এবং অসহায় বাঙালিদের চিকিৎসা করেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভূমিকা তিনভাগে বর্ণনা করা যেতে পারে- এক ভাগে যারা ঐ সময়ে কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের তৎপরতা, আরেকভাগে এই কলেজ থেকে পাশকৃত চিকিৎসকদের একটি অংশ যাঁরা অন্যান্য হাসপাতাল ও সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে কর্মরত ছিলেন কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেছেন এবং শেষভাগে যারা অস্ত্রহাতে যুদ্ধ না করলেও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের চিকিৎসা করেছেন।
এই কলেজের তৎকালীন ছাত্রদের মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মোয়াজ্জেম হোসেন, সেলিম আহমেদ, আলী হাফিজ সেলিম, আবু ইউসুফ মিয়া, ইকবাল আহমেদ ফারুক, মুজিবুল হক, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, মোজাফফর আমজাদ হোসেন, ওয়ালী, ওসমান, গোলাম কবীর, জিল্লুর রহিম, ডালু, রুরুজ্জামান, শাহাদত প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এদের অনেকেই ঢাকা শহর কমান্ডের তত্ত্বাবধানে থেকে যুদ্ধে করেছেন। এই কলেজের কয়েকজন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা শহরের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ বর্তমান শহীদ ডাঃ ফজলে রাব্বি ছাত্রাবাসে রাজাকারদের উপর হামলা চালায়। ছাত্রাবাসের ১০৭নং রুমে সে সময় রাজাকারদের ঘাঁটি ছিল। তাঁদের গোপন হামলায় হোস্টেলে গেটে পাহারারত ২ জন রাজাকার নিহত হয়। গুলির শব্দ শুনে ১০৭ নং রুমে অবস্থানরত অন্যান্য রাজাকাররা পালিয়ে যায়। এদের একজন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকলে সেও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আঘাতে নিহত হয়।
একই দিনে তাঁরা ২১৯নং রুমে হামলা চালায়। এই গ্রুপটি কলেজ-ডি সেকশন হলেও বোমা চালিয়েছিল।
এই কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্রী নিপা লাহিড়ী যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে যাবার পথে ফতুল্লাতে নিহত হন। আর একজন ছাত্র সিরাজুল ইসলাম হাসপাতালে বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। তিনি রাতে হোস্টেলে না গিয়ে হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে ঘুমাতেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিছু স্বাধীনতা বিরোধী ছাত্রের সহায়তায় তাঁকে ১১ ডিসেম্বর রাতে রাজাকার বাহিনী ক্যান্সার ওয়ার্ড থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিমর্মভাবে হত্যা করে।
তৎকালীন সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের সদস্যদের মধ্যে স্কোয়াড্রন লীডার এম শামসুল হক, মেজর খুরশীদ, মেজর শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আব্দুল লতিফ মল্লিক, ক্যাপ্টেন আঃ মান্নান, লে আখতার, লে নুরুল ইসলাম প্রমুখ অফিসারবৃন্দ বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত ছিলেন। এদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ক্যাপ্টেন খুরশীদ বীরউত্তম ও লে আখতার বীরপ্রতীক উপাধি পেয়েছিলেন। তৎকালীন পাকিস্থান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের যে সমস্ত সদস্য শহীদ হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ডাঃ লে ক এ এফ জিয়াউর রহমান, ডাঃ মেজর আসাদুল হক, ডাঃ লে আমিনুল হক, ডাঃ লে খন্দকার আবু জাফর মোঃ নূরুল ইমাম প্রমুখ ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে কর্মরত প্রায় সকল চিকিৎসকই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। মুক্তিযোদ্ধা আসল নাম গোপন রেখে হাসপাতালে ভর্তি হতেন। হাসপাতালে এই সমস্ত কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করতেন অধ্যাপক ফজলে রাব্বি। তিনি তাঁর আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্যে করে। যুদ্ধের শেষের দিকে অধ্যাপক ফজলে রাব্বিসহ অনেক চিকিৎসককেই রাজাকার আলবদর বাহিনী গোপন চিঠির মাধ্যমে মৃত্যুর ভয় দেখিয়েছিলেন।
তাঁদের চিঠির ভাষা ছিল ‘কলকাতার মাড়োয়ারী দালালদের হত্যা করা হবে’। লাল কালির লেখা চিঠিতে একটি ‘তরবারির’ প্রতিকৃতি আঁকা ছিল। তবে চিঠির নিচে প্রেরকের ঠিকানা ছিল না। রাজাকারদের ভয়ভীতি উপেক্ষা করেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। শহীদ অধ্যাপক আলিম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে কর্মরত থাকলেও বেশীরভাগ সময় কাটাতেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা অনেক চিকিৎসক ভারতে গিয়ে বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঐ সমস্ত চিকিৎসকদের অনেকে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন। আবার কেউ আহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের চিকিৎসা করেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশকৃত চিকিৎসকদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন- ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, ডাঃ শিশির মজুমদার, ডাঃ সরওয়ার আলী, অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, ডাঃ ওয়াজেদুল ইসলাম খান, ডাঃ মাকসুদা নার্গিস, ডাঃ কাজি তামান্না, ডাঃ ফৌজিয়া মোসলেম ও ডাঃ সমীর কুমার শর্মা প্রমুখ (অনেকের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি)। দেশের ভিতর থেকে অসংখ্য চিকিৎসক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে অনেককে জীবন দিতে হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা চিকিৎসক, তৎকালীন ছাত্রছাত্রী এবং এই কলেজে কর্মরত চিকিৎসকদের তালিকাঃ
০১. ডাঃ মোঃ ফজলে রাব্বী
০২. ডাঃ মোঃ সামসুদ্দিন আহমেদ
০৩. ডাঃ মোঃ আব্দুল আলিম চৌধুরী
০৪. ডাঃ আজহারুল হক
০৫. ডাঃ এ.বি.এম. হুমায়ুন কবির
০৬. ডাঃ সোলায়মান খান
০৭. ডাঃ মিসেস আয়েশা বেদৌরা চৌধুরী
০৮. ডাঃ কায়সার উদ্দিন তালুকদার
০৯. ডাঃ মনসুর আলী
১০. ডাঃ গোলাম মর্তুজা
১১. ডাঃ হাফিজউদ্দিন খান
১২. ডাঃ জাহাঙ্গীর
১৩. ডাঃ এ জব্বার
১৪. ডাঃ এস কে লালা
১৫. ডাঃ হেম চন্দ্র বসাক
১৬. ডাঃ কাজী ওবায়দুল হক
১৭. ডাঃ নরেন ঘোষ
১৮. ডাঃ আলহাজ মমতাজ উদ্দিন
১৯. ডাঃ জিকরুল হক
২০. ডাঃ হাসিময় হাজরা
২১. ডাঃ শামসুল হক
২২. ডাঃ মফিজউদ্দিন খান
২৩. ডাঃ এম রহমান
১৪. ডাঃ অমূল্য চন্দ্ৰ চক্রবর্তী
২৫. ডাঃ এ গফুর
২৬. ডাঃ আতিকুর রহমান
২৭. ডাঃ মনসুর আলী
২৮. ডাঃ গোলাম সারওয়ার
২৯. ডাঃ রমনী দাস
৩০. ডাঃ আর সি দাস
৩১. ডাঃ এম কে সেন
৩২. ডাঃ রবিউল হক
৩৩. ডাঃ এস কে এম গোলাম মোস্তফা
৩৪. ডাঃ মিহির কুমার সেন
৩৫. ডাঃ মকবুল আহমেদ
৩৬. ডাঃ সালেহ আহম্মদ
৩৭. ডাঃ এনামুল হক
৩৮. ডাঃ অনিল কুমার সেন
৩৯. ডাঃ মনসুর (কানু)
৪০. ডাঃ সুশীল চন্দ্ৰ শৰ্মা
৪১. ডাঃ আশরাফ আলী তালুকদার
৪২. ডাঃ কাজল ভদ্র
৪৩. ডাঃ বজলুল হক
৪৪. লেঃ কঃ জিয়াউর রহমান (এ এম সি)
৪৫. লেঃ কঃ এ এফ এম ফারুক (এ এম সি)
৪৬. লেঃ কঃ বদিউল আলম (এ এম সি)
৪৭. লেঃ কঃ জাহাঙ্গীর (এ এম সি)
৪৮. লেঃ কঃ সৈয়দ আব্দুল হাই (এ এম সি)
৪৯. মেজর আব্দুল হক (এ এম সি)
৫০. মেজর রিয়াজুর রহমান (এ এম সি)
৫১. মেজর মজিবুদ্দিন আহমেদ (এ এম সি)
৫২. মেজর নাইমুল ইসলাম (এ এম সি)
৫৩. লেঃ নূরুল ইসলাম (এ এম সি)
৫৪. লেঃ এনামুল হক (এ এম সি)
৫৫. ডাঃ মনসুর রহমান
৫৬. ডাঃ গোপাল চন্দ্ৰ সাহা
৫৭. ডাঃ নরেন্দ্র নাথ দত্ত
৫৮. ডাঃ এ বি এম নরুল আলম
৫৯. ডাঃ এ মুকতাদির
৬০. ডাঃ বেরতি কান্তি সান্যাল
৬১. ডাঃ ক্ষিতিশ চন্দ্ৰ দে
৬২. ডাঃ এ রহমান
৬৩. ডাঃ এ নওশেদ আলী
৬৪. ডাঃ শহীদ মৌহিত ইসলাম
৬৫. মেজর আমিনুল ইসলাম (এ এম সি)
৬৬. লেঃ কঃ বি এ চৌধুরী (এ এম সি)
৬৭. লেঃ কঃ আমিনুল হক (এ এম সি)
৬৮. লেঃ খন্দকার নুরুল ইসলাম (এ এম সি)
৬৯. আ বা ম সিরাজুল হক (৪র্থ বর্ষ, ছাত্র)

সূত্র: ঢাকা মেডিকেল কলেজ: সেবা সংগ্রাম ঐতিহ্য – অধ্যাপক ডাঃ মনিলাল আইচ লিটু, এম আর মাহবুব