You dont have javascript enabled! Please enable it!

এমনি বাড়তে বাড়তে সেপ্টেম্বর মাসের ৬-৭ তারিখে আমাদের আলাদা ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দাঁড়ালো আঠার’শ।

ধৃত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকারোক্তি
একদিন দুপুরে ক্যাম্পের মাঝে ফ্লাগ পোষ্টের নীচে ছোট একটি টুলে বসে ঢাকা বেতার শুনছি। হঠাৎ একটি ঘোষণা। ঘোষক বলছে, ‘দুষ্কৃতকারী কাদের সিদ্দিকীর একজন সমর্থক আগস্টের ২২ তারিখে সেনা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। সতের বছরের এই তরুণকে কাদের সিদ্দিকী বলপূর্বক ধ্বংসাত্মক কাজে নিয়োজিত করেছিল। আবুল কালামের সাথে রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার এখন আপনাদের শোনানো হচ্ছে। ঘোষণাটি শুনে চমকে উঠলাম, আবুল কালাম ধরা পড়েছে এটা বেতার ইন্টারসেপ্ট করে আগেই শুনেছিলাম। ওকে যে আস্ত রাখবে না, এটা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন ছিলাম। কিন্তু সাক্ষাৎকার প্রচারের কথা শুনে চমকে উঠলেও কিছুটা আশ্বস্ত ও খুশী হলাম। আমার মনে সাথে সাথে একটা প্রশ্ন উকি মারলো, আবুল কালাম নামে কেউ ধরা পড়েছে বেতারে এই ঘোষণার পর তাকে চট করে বধ্যভূমিতে পাঠিয়ে দেয়া আর সম্ভব হবে না। হয়তো অনেকদিন জেলে থাকতে হবে। তাড়াতাড়ি টেপ রেকর্ডের বোতাম টিপে ধরলাম।
ঘোষকের মুখে কাদের সিদ্দিকীর নাম একবার উচ্চারণ সহ আবুল কালামের পুরো সাক্ষাৎকারটি টেপ হলো। আবুল কালাম তারটিয়া ধরা পড়েছিল। সে সাক্ষাৎকারে বললো, ‘আমি অল্প বয়সের ছেলে আমি কিছুই বুঝি না। ২৫শে মার্চে যখন গোলাগুলি শুরু হয় তখন আমি অন্যান্য লোকদের সাথে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাই। কাদের সিদ্দিকীকে আমি আগে থেকেই চিনি। তিনি আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যান। পাহাড়ের নানা জায়গায় রেখে প্রায় এক মাস ধরে রাইফেল, স্টেনগান, এল. এম. জি. চালানো, গ্রেনেড ফাটানো ও বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রশিক্ষণ দেন; আমাকে তিনি নিজে এবং আরও দু-তিনজন এই সমস্ত ট্রেনিং দিয়েছেন। আমি অন্যদের আগে কোনদিন দেখি নাই। তাদের নামও জানি না। আমার চোখ বেঁধে পাহাড়ে নেয়া হয়েছিল, এবং ট্রেনিং শেষে চোখ বেঁধে পাহাড় থেকে বের করে দেয়া হয়। আমাকে প্রথমে টাঙ্গাইল শহরে গ্রেনেড ফাটানোর জন্য পাঠানো হয়, একা ছেড়ে দেয়ার সময় বারবার বলা হয় যে, আমাকে প্রতি মুহূর্তে লক্ষ্য করা হবে। ঠিকমত কাজ না করলে গুলি করে হত্যা করা হবে। এই কথায় আমি ভয় পেয়ে যাই। এবং তার কথামত চলি। আমি টাঙ্গাইলে অনেকবার গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছি। ১১ই আগস্ট যখন মুক্তিবাহিনী মাটি কাটায় অস্ত্রবোঝাই জাহাজ মারে, তখন আমি প্রথম সুযোগ পেয়ে পালিয়ে আসি।
— দুষ্কৃতকারীরা যে মাটিকাটায় জাহাজ মেরেছে—তা আপনি দেখেছেন?
— হ্যাঁ, আমি জাহাজ থেকে অনেক বড় বড় অস্ত্র নামাতে দেখেছি। হাজার হাজার লোক জাহাজ থেকে অস্ত্র নামিয়ে নিচ্ছিল।
— আপনি কি তাহলে বলতে চান যে, আপনি স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন?
— হ্যা। আমি প্রথম সুযোগেই পালিয়ে এসে ধরা দিয়েছি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০১

— তাহলে আপনি ইচ্ছা করে দুষ্কৃতকারীদের সাথে সহায়তা করেন নি?
— আমিতো আগেই বলেছি, কাদের সিদ্দিকী আমার চাইতে সবল ও শক্তিশালী। তিনি আমাকে দিয়ে জোর করে এই কাজ করিয়েছেন।
— কাদের সিদ্দিকী কি প্রকৃতির লোক?
— কাদের সিদ্দিকী দুর্দান্ত, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। যে কোন লোক তার সামনে কথা বলতে ভয় পায়। আমিও পেয়েছি। আমি অনেকবার দেখেছি অন্যেরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না।
— তাহলে আপনি পাকিস্তানে বিশ্বাস করেন।
— পাকিস্তানতো আমাদের দেশ। একে রক্ষা করার জন্য আমাদের সব কিছু করা উচিৎ। আমিও সুযোগ পেলে সবকিছু করবো।
সাক্ষাৎকারটি শুনে খুবই উত্তেজনা বোধ করছিলাম। আমার একটাই ভরসা, যাক এত সুন্দর সোনার টুকরো ছেলে বেঁচে গেল। সাক্ষাৎকারে ছেলেটি ভালোই বলেছে। দেশের অগণিত মানুষ শুনলেন যে, পাকিস্তানীদের অস্ত্র বোঝাই জাহাজ মারা গেছে। মুক্তিবাহিনী আছে। ভালোই হলো। সাথে সাথে বাঁশী বাজিয়ে সকল সহযোদ্ধাদের একত্রিত করলাম। এসময় বাঁশী বাজলেই হুলস্থুল পড়ে যেত। আর আমি স্বয়ং বাঁশীতে ফু দিয়েছি। চারদিক থেকে মৌমাছির মত একটা আওয়াজ তুলে মুহূর্তে সকলে সমবেত হলো।
— এই মুহূর্তে ঢাকা বেতার থেকে আমাদের এক সহযোদ্ধার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হলো। তোমরা কি কেউ শুনেছ? সমবেত প্রায় ষোল শত মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে আট-দশজন বললো, “আমরা শুনেছি।”
তিন-চার জন বললো, ‘আমরা অর্ধেক শুনেছি। বাকীরা কেউ শোনেনি বা শুনতে পায়নি।
— তোমাদের সাক্ষাৎকারটি শোনানোর জন্যই এই অসময়ে বাঁশীতে ফু দিয়েছি। কোয়ার্টার মাষ্টার বেনু দৌড়ে মাইক নিয়ে এলো। রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকারটি মাইকে বাজিয়ে সহ যোদ্ধাদের শোনানো হলো। এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। ২৭শে আগস্টের পর থেকে রওশন আরা ক্যাম্পে প্রতিদিন অন্ততঃ দুইবার দেশের অভ্যন্তরে দেয়া আমার রেকর্ডকৃত বক্তৃতা শোনানো শুরু হয়েছিল। এবং তা মোটামুটি ক্যাম্প গোটানোর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত অর্থাৎ নভেম্বরের শেষ দিনটি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
১০ই সেপ্টেম্বর দুপুরে ব্রিগেডিয়ার সান সিং একটি টি. ভি. টীমের কথা জানিয়ে বললেন, “তাদের সাথে তোমাকে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। সাক্ষাৎকারটি হবে, জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে রংপুরের রৌমারিতে যে মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছে, তুমি টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ থেকে সেই মুক্তাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ করতে এসেছ।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০২

বিদেশী টি. ভিতে সাক্ষাৎকার
সন্ধ্যার পর মানকাচর থেকে লঞ্চে কুড়ি জন সদস্য সহ রৌমারিতে গেলাম। সঙ্গে ছিলেন ব্রিগেড মেজর মুখার্জী এবং গণ প্রতিনিধি লতিফ সিদ্দিকী। তাঁরা সেখানে বক্তব্য রাখবেন। মেজর মুখার্জী সাজলেন আমার সহকারী, নাম রহমত আলী। ১১ই সেপ্টেম্বর, সকাল দশটা। আমেরিকান টি. ভি. টিম এলো। তারা প্রথমে রৌমারি ক্যাম্প কমান্ডার মেজর শাফায়াত জামিল সাহেবকে টিম নেতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমরা শুনেছি টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ থেকে আপনাদের এখানে একদল মুক্তিযোদ্ধা এসেছে। আমরা তাদের সাথে কথা বলতে ও তাদের ছবি নিতে উৎসাহী। দয়া করে আমাদের দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবন কি?” “হ্যা, দু’তিন দিন আগে টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনীর নেতা কাদের সিদ্দিকী একটি দল নিয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে এসেছেন। তিনি আহত। চিকিৎসা ও যোগাযোগ স্থাপন, এই দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এসেছেন। আমরা তার সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ রেখে চলছিলাম। উভয় পক্ষ থেকে সাহায্য সহযোগিতাও অব্যাহত রয়েছে। সেই ভিত আরও মজবুত করতেই তিনি এসেছেন। তাকে আমি আপনাদের সাথে মিলিয়ে দিতে পারি, তবে তিনি তার দলের ছবি তুলতে দিবেন কিনা, তা আমি জানি না।”
আমরা তখন রোমারি থানার পাশে একটি বাড়ীতে ছিলাম। আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। গিয়ে দেখলাম, কর্ণেল জিয়াউর রহমানও সেখানে আছেন। টি. ভি. প্রতিনিধিরা আমাকে ছেঁকে ধরলেন। তাদের দু’টো টেপ রেকর্ডার, ছোট বড় চারখানা মুভী ক্যামেরা, তিন চারটা ষ্টিল কামেরা অনবরত চলতে লাগলো। প্রতিনিধি দলের নেতা শুভ সকাল জানিয়ে বললেন, ‘আপনার নাম জানতে পারি কি?’ আমি খাঁটি বাংলায় বললাম, ‘আমার নাম কাদের সিদ্দিকী। এই সময় ছদ্মবেশী রহমত আলী আমার বক্তব্য অনুবাদ করে দিতে গেলে টি. ভি. প্রতিনিধি দলের নেতা বলেন, ‘না, আপনার সাহায্যের কোন দরকার নেই। আমি এমনিতেই যতটুকু বুঝতে পারব, তাই যথেষ্ট।’ প্রতিনিধি দলের নেতা খুব আস্তে আস্তে ইংরেজীতে প্রশ্নগুলো করছিলেন। প্রশ্নগুলো বুঝতে আমার এতটুকু বেগ পেতে হলো না। প্রায় কুড়ি মিনিট নানা ধরনের প্রশ্নের পর প্রতিনিধি দলের নেতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘দুনিয়ার মানুষের কাছে আপনার কিছু বলার থাকলে আপনি তা বলতে পারেন। বিশ্ববাসীর কাছে আপনার আবেদন আমরা পৌঁছে দেব।’
আমি এই আহ্বানের অপেক্ষায়ই ছিলাম। ‘আমার আবেদন সারা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে আমি আপনাকে, আপনার দলকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। যুদ্ধমুখর বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সারা পৃথিবীর বিবেকবান, প্রগতিশীল, মুক্তি কামী মানুষের কাছে আমার এবং আমার দেশবাসীর পক্ষ থেকে আবেদন, আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করুন। ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। ইয়াহিয়ার হত্যাযজ্ঞে যারা সাহায্য করছে, আপনারা তীব্র ভাষায় তাদের নিন্দা করুন। আমরা বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা পৃথিবীর প্রতিটি সংগ্রামী মানুষকে এই বলে আশ্বস্ত করছি যে, বাংলার একজন তরুণ
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৩

বাংলাদেশ বেঁচে থাকতেও হানাদাররা বিনা প্রতিরোধে তাদের পাশবিক অত্যাচার ও নির্মম হত্যালীলা চালিয়ে যেতে পারবে না। শ্যামল সবুজ অথচ দুর্জয় শপথে দৃপ্ত বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানী পশুদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। আমি আবার রক্তাক্ত বাংলা ও বাঙ্গালীর পক্ষ থেকে সারা বিশ্ববাসীকে ছালাম জানাচ্ছি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী।’
টি. ভি. টিমের নেতা ছবি তুলতে চাইলে আমি রাজি হলাম। প্রায় এক ঘন্টা ধরে আমেরিকান টেলিভিশন টিম নানাভাবে ছবি তুললেন। এরপর শাফায়াত জামিলের ক্যাম্পের এক হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ভাবে মুভি ক্যামেরায় ছবি তোলা হল। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীতটি রেকর্ড ও ছবি করে বেলা তিনটায় আমেরিকান টি. ভি টিম বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
দুপুরে খাবার শেষ হতে না হতেই আবার আস্ট্রেলিয়ান টিম এসে হাজির। তারা গাছতলায় বসে থাকা অবস্থায় আমাদের পেয়ে গেলেন। ক্যাম্প কমাণ্ডার শাফায়াত জামিল এবারও পূর্বের মতো অস্ট্রেলিয়ান টি. ভি. টিমের নেতাকে আমার আসার কারণ ও উদ্দেশ্য জানালেন। এঁরাও আমাকে অসংখ্য প্রশ্ন করলেন। ‘পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে আপনারা কিভাবে লড়াই করছেন। তাদের সাথে আপনারা এঁটে উঠতে পারবেন কি? আমাদের কাছে কোন সাহায্য চান কি?” এমনি ধরনের অনেক প্রশ্ন। এই টি. ভি. টিমের নেতাও এক পর্যায়ে বললেন, ‘আপনার কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। যা আমরা সারা বিশ্বে প্রচার করতে পারি।’ এ অনুরোধের জবাবে আমেরিকান টি. ভি. টিমের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে রাখা অনুরূপ আবেদন রাখলাম। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব বক্তব্যের সাথে সংযোজন করে বললাম, ‘আমার দেশের আশি লক্ষ লোককে মহান ভারত আশ্রয় দিয়েছে, তাই মহান ভারতের নেতৃবৃন্দ ও জনগণকে আমার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।’ এরপর টি. ভি. টিম নানা পজিশনে প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি তুলল। মুক্তিবাহিনী একটি খরস্রোতা নদী সাঁতরে পার হয়ে যাচ্ছে, এমন একটি দৃশ্যও তারা ক্যামেরায় ধরলো।
অমেরিকান টীমের মত এঁদের অত যন্ত্রপাতি ছিল না। তবে আগ্রহ ছিল অনেক বেশী। অস্ট্রেলিয়ান টীম শাফায়াত জামিল, জিয়া, গণপ্রতিনিধি লতিফ সিদ্দিকী এবং রংপুরের লুৎফর রহমানের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে নিলো।
সন্ধ্যায় অস্ট্রেলিয়ান টীম রৌমারী ত্যাগ করার পর আমরাও রৌমারী ত্যাগ করে তুরা চলে এলাম। রৌমারীতে মেজর জামিল, মেজর জিয়াউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মাহমুদ প্রমুখ সামরিক নেতাদের সাথে ঘনিষ্ট আলাপ পরিচয় হলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৪

জোনাল কাউন্সিল

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকার দেশকে কয়েকটি বেসামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করেন। কোন কোন স্থানে দুটি জেলা আবার কোন কোন স্থানে তিনটি জেলা সমন্বয়ে একটি জোন গঠন করা হয়েছিল। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল জেলা নিয়ে একটি জোন। গণপরিষদ সদস্যদের মধ্যে থেকেই জোনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন।
তৎসময়ে মেঘালয়ের তুরা জেলার সং সং গিরি কৃষি খামারে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, পাবনা ও রংপুর এলাকার গণপরিষদ সদস্যদের হেডকোয়ার্টার ছিল।
৭ অথবা ৮ই সেপ্টেম্বর টাংগাইল-ময়মনসিংহ জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচনের জন্য একটি সভা বসলো। টাংগাইল-ময়মনসিংহের গণপরিষদ সদস্যদের মধ্যে রফিক ভুইয়াই সব চেয়ে প্রবীণ ও ক্ষমতাবান। আলোচনার শুরুতেই তিনি বলে বসেন, জোনাল কাউন্সিল চেয়ারম্যান নির্বাচনে তিনি কোন মতেই প্রার্থী হতে রাজী নন। কথাটি তিনি মোটামুটি আন্তরিক ভাবেই বলেছিলেন। কারণ তার সে সময় মন্ত্রীসভায় যোগদানের সম্ভাবনা ছিল। জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হলে তিনি সেই সুযোগ হারাবেন। রফিক উদ্দিন ভুইয়ার এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। এরপর কে প্রার্থী হতে পারেন এবং কে যোগ্য প্রার্থী হবেন ইত্যাদি নানা বিষয় আলোচনা হতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ বক্তৃতাও চললো। প্রায় চল্লিশজন গণপরিষদ সদস্যের মধ্যে টাংগাইলের সাতজন। অনেক বক্তৃতা ও আলাদা আলাদা ভাবে গ্রুপ মিটিং হলো। তারপর একসময় টাংগাইলের গণপরিষদ সদস্য হাতেম আলী তালুকদার সভার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। তিনি বলেন, “ময়মনসিংহ টাংগাইল জোনাল কাউন্সিল গঠনের পূর্বে আমাদের অবশ্যই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সভার কাজ শুরু করা উচিত ছিল। এখন যুদ্ধ চলছে। এই সময় যদি আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণ মর্যাদা না দিই, তাহলে যুদ্ধ শেষে যে মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা কি দৃষ্টিতে দেখব, কি রকম আচরণ করব তা এমনিতেই বুঝা যায়। আমরা যে মুক্তিযোদ্ধাদের ধন্যবাদ জানাইনি, শহীদদের স্মরণ করিনি, আপনারা কি ভেবেছেন এই কথা গোপন থাকবে? আমি আমার অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলছি কোন মতেই একথা গোপন থাকতে পারেনা।”
এরপর তালুকদার টেবিলের উপর খুব জোরে চাপড় মেরে বললেন, ‘এটা প্রচার হওয়ার পর আমাদের প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের যে প্রচন্ড ঘৃণা জম্মাবে, তাতে আমরা জোনাল কাউন্সিল টোনাল কাউন্সিল যাই করিনা কেন দেশে যেতে পারব না। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের আস্ত রাখবে না। তাই আমি আপনাদের সাথে একমত নই। আমি সভা ত্যাগ করছি।’ হাতেম আলী তালুকদার সভা ত্যাগ করতে উদ্যত হলে, সকলেই তার বক্তব্যের সাথে একমত হন এবং সবাই সমস্বরে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৫

বলে উঠেন, ‘হ্যা, এটা আমাদের ভুল হয়ে গেছে। তালুকদার সাহেব যা বলেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতক্ষণ যা আলোচনা হয়েছে তা কোন ক্রমেই আষ্ঠানিক আলোচনা হিসাবে ধরা যায় না। এতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক কলংক জনক অধ্যায় রচিত হবে। তাই আবার আমাদের নতুন করে সভার কাজ শুরু করা উচিত।’
তখন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। আবার সভার কাজ শুরু হলে যে সারা রাতেও শেষ হবেনা এই বোধটা সবারই জানা ছিল। তাই প্রবীণরা বললেন, ‘কাল সকালে নাস্তা শেষে আমাদের নতুন করে বসা উচিত।’ এ প্রস্তাবে সকলেই একমত হন। হাতেম আলী তালুকদার এ সময় আরেকটি বোমা ফাটালেন। তিনি বলেন, ‘আমার একটি কথা আছে। আমি প্রস্তাব করছি আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্নেহের কাদের ভাই যখন তুরাতে উপস্থিত, তিনি ময়মনসিংহ-টাংগাইলের সন্তান, আমরা আগমীকাল তাকে এই জোনাল কাউন্সিল নির্বাচনের জন্য আহুত সভায় সম্বর্ধনা জানিয়ে সভার কাজ শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানানোর সুযোগ নিতে পারি। আপনারা যদি আমার প্রস্তাবে একমত হন, তাহলে এখনই ঠিক হোক, কে কে গিয়ে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছোট ভাইকে এই সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানাবেন?’ এবারও হাতেম আলী তালুকদার জিতে গেলেন। সবাই তালুকদার সাহেবের সাথে একমত হন। অবশ্যই কাদের সিদ্দিকীকে সম্বর্ধনা জানানো একটা নৈতিক দায়িত্ব। তাঁরা আরও বলেন, ‘কাল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীক হিসেবে কাদের সিদ্দিকীকে সম্মানিত করে আমাদের আজকের ভুল অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পারব। সবাই একমত হলেন কাদের সিদ্দিকীকে আহ্বান করার জন্য হাতেম আলী তালুকদার রফিক উদ্দিন ভুইঞা, আছীমের গণ পরিষদ সদস্য নজরুল ইসলাম সকালে কাদের সিদ্দিকীর তাঁবুতে যাবেন এবং যেমন করেই হোক তাকে অবশ্যই সাথে নিয়ে আসবেন। এই সময় সবাই গণ পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর প্রতি দৃষ্টিদেন। সবাই প্রায় একত্রে বলেন, ‘লতিফ ভাই, আপনি তো রাতে কাদের ভাইয়ের সাথে একই তাঁবুতে থাকেবেন। আমরা কেন তাকে আগে জানাতে পারিনি, আপনি কিন্তু ভাই তা তাকে বুঝিয়ে বলবেন। কাদের ভাই যদি না আসে, তাহলে আমাদের মুখ থাকবেনা। আজ যে ভুল আমরা সকলে করে ফেলেছি তার জের যে কতদূর গড়াবে তার কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
লতিফ সিদ্দিকী বোধ হয় কোন সভায় এত দীর্ঘসময় নীরব থাকেন নি বা নীরব ভুমিকা পালন করেন নি। এত দীর্ঘ সময় নীরব থাকায় এবং একটি ত্রুটি দেখা দেওয়ায় গণপরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর গুরুত্ব খুবই বেড়ে যায়। তিনি সবাইকে বলেন, “কাদেরকে যদিও আমিই রাজনীতিতে হাতে খড়ি দিয়েছি, তবুও সে যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে এবং দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, তাতে আজ সে আমারও নেতায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া তার হাতে পায়ে এখনও গুলির আঘাত, পূর্ণ সুস্থ নয়। তবুও আমি তাকে আপনাদের কথা অবশ্যই বলব। আমার মনে হয় সে আপনাদের অনুরোধ ফেলবেনা।”
রাত একটায় পাঁচজন গণপরিষদ সদস্য আস্তে আস্তে তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। সন্তর্পণে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৬

ঢোকাটা আমার জন্য নয়, বাবার ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে সেইজন্য। তালুকদার সাহেব হুমায়ুন খালিদকে ঠেলা দিয়ে বললেন, “ছোট ভাইয়ের সাথে আপনারই তো বেশী খাতির। কথাটা আপনিই বলুননা?” হুমায়ুন খলিদ বললেন, ‘না, আপনিই বলুন।’
— না আপনিই বলুন।
তখন হুমায়ুন খালিদ বলেন, ‘বাবা কাদের, তোমাকে আমাদের তাঁবুতে একটু যেতে হবে। কিছু আলাপ আছে তুমি বোধ হয় এখনও খাওনি। লতিফের সাথে খাবার খেয়ে একটু আস। জানি তোমার শরীর খারাপ। তবুও একটু কষ্ট করতে হবে। পনের মিনিটের বেশী সময় নেবনা।
— ঠিক আছে, আপনারা যান। আপনারা কষ্ট করে এসেছেন। কি এমন জরুরী কাজ কিছুই জানিনা, না যেয়ে আপনাদের সাথে বেয়াদবি করব এটা কেন ভাবছেন? আপনারা যান আমি আসছি। চারজন গণপরিষদ সদস্য চলে গেলেন।
বড় ভাইকে জিজ্ঞেসা করলাম, “কি ব্যাপার। হঠাৎ করে কি হল?” বড় ভাই ঘটনার আদি অন্ত সব কিছু বর্ণনা করলেন।
গণপরিষদ সদস্যদের তাঁবুতে পৌছতেই হাতেম আলী তালুকদার আমাকে জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ফেললেন। এরপর শুরু হলো তালুকদার কি করে আচমকা কূটনৈতিক বোমা ফাটিয়ে বাজীমাত করলেন, তার ইতিবৃত্ত। একমাত্র বড়ভাই ছাড়া আর চারজন বললেন, “কাল কিন্তু ভাই, তোমাকে যেতেই হবে। তুমি একবার গেলেই জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদ আমরা পেয়ে যাব।”
সকাল হতে না হতেই রফিক উদ্দিন ভুইঞা ও হাতেম আলী তালুকদার মিশন নিয়ে হাজির। রফিক উদ্দিন ভুইঞা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এপ্রিলের পর রফিক ভূইঞার সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎ। পূরানো অনেক স্মৃতিচারণের পর রফিক উদ্দিন ভুইঞা বললেন, “ভাই, তুমি যেভাবে হানাদারদের মোকাবেলা করছে, তার তুলনা হয়না। তুমি আহত হয়ে ভারতে এসেছ, আমরা তোমাকে টাংগাইল-ময়মনসিংহ গণপরিষদ সদস্যদের সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীক হিসাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্মান জানাতে চাই। তাই তোমাকে অতি অবশ্যই আমাদের সাথে এখনই যেতে হবে।”
আমি অত্যন্ত বিনম্রভাবে রফিক সাহেবকে বললাম, “ভাই আপনারা এখানে এসেছেন, এতেই আমি আনন্দিত ও উৎসাহিত বোধ করছি। আপনাদের কাছ থেকে সম্বর্ধনা পাওয়ার মতো কোন যোগ্য কাজ আদৌ করেছি কিনা, ভারতে আসার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত আমার জানা ছিলনা। আপনাদের এই স্নেহ বিশ্বাস ও ভালোবাসা নিঃসন্দেহে আমাদের আগামী দিনে যুদ্ধের ময়দানে প্রেরনা যোগাবে। রফিক ভাই, যদি যেতে পারতাম, তবে আমিই সবচেয়ে বেশী খুশী হতাম। কিন্তু আমাকে ক্ষমা করবেন। এই মুহুর্তে আমার পক্ষে আপনাদের রেষ্ট হাউজে যাওয়া সম্ভব নয়।” এ অক্ষমতা প্রকাশের প্রেক্ষিতে রফিক ভুইঞা, হাতেম আলী তালুকদার, আছীমের নজরুল
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৭

ইসলাম বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। কিন্তু আমরা এক কথা, “আমি এখন কিছুতেই যেতে পারব না।” আপনার অসুবিধা কি? কেন যেতে পারবেন না? এই ধরনের হাজারো প্রশ্নে আমার একই কথা,’ ‘আমার অসুবিধা আছে। আমি এখন যেতে পারব না।’
দূতরা যখন রেষ্ট হাউজে ফিরে গেলেন, তখন অন্যান্য গণপরিষদ সদস্যরা রেষ্ট হাউসের বাইরে চেয়ার পেতে মোটামুটি একটা সভার আয়োজন করে ফেলেছিলেন। কিন্তু যাকে মালা দিয়ে, যার প্রশস্তি গেয়ে সভার কাজ শুরু করা হবে, সেই আসে নি। এখন উপায়? সবারই এক প্রশ্ন, তাহলে কি হল? কাদের সিদ্দিকী এল না কেন? কেউ কেউ আবার টিপ্পনি কাটতে লাগলেন, “এতটুকু বাচ্চা ছেলে, কালও নাক দিয়ে দুধ পড়তো, অথচ আজই আমাদের গণ প্রতিনিধিদের আহ্বান উপেক্ষা করলো?” এর জবাবে কেউ কেউ বলে উঠলেন, “এখন ও কথা বলে লাভ নেই। ব্যাপারটা শুধু কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে নয়, মুক্তিবাহিনীকে নিয়ে। তাই কাদের সিদ্দিকী বাচ্চা না বৃদ্ধ, সে ভাবে দেখলে বা বিচার করলে চলবে না। কাদের সিদ্দিকীকে না আনতে পারলে, আরেকটা ভুল হবে।”
এই সময় লতিফ সিদ্দিকী সমবেত গণ প্রতিনিধিদের সামনে একটি চিন্তা উদ্দীপক বক্তব্য রাখেন। তাঁর মূল বক্তব্য, “কাদের সিদ্দিকী আসেনি বা আসতে পারে নি, এটা আমাদের বিচার করে দেখতে হবে, আমরা অনেক গভীরের জিনিসই জানিনা। সে আজ একা নয়, তাকে মতামত নিয়ে চলতে হয়। তাকে তো আমরা মোটেই সময় দিইনি। তারও হয়তো সহকর্মীদের সাথে কথা বলার বা মত বিনিময়ের প্রয়োজন থাকতে পারে। অথবা যেখানে আছে, সেখানকার কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ আলোচনার প্রয়োজনও থাকতে পারে, যা সে আমাদের বলেনি। প্রশ্নটা যেহেতু কাদের সিদ্দিকীর নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে, সুতরাং এটা ভাবা উচিত নয় যে, অযৌক্তিক সমালোচনায় ভালো ফল হতে পারে, আমাদের যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করতে হবে।
লতিফ ভাইর কথা শেষ হতে না হতেই হাতেম আলী তালুকদার তাঁকে সমর্থন করে সোৎসাহে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, লতিফ ভাই ঠিক কথাই বলেছেন, একজন মানুষকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলা যায়না চলুন আমাদের বাড়ীতে যাবেন।” তিনি আরও বললেন, “তিনি একা নন, তাই এই ধরনের কথা রক্ষা করা তার জন্য অসুবিধাও হতে পারে। আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম। তিনি তো এটা বলেননি আমি যাব না, তিনি বলেছেন আমি এখন যেতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করুন। এর নিশ্চয়ই কোন অর্থ আছে, আমাদের আবার তার কাছে যাওয়া উচিত। এতে অনেকে মনে মনে বিরক্ত হলেও বাইরে কিন্তু হাতেম আলী তালুকদারের কথার সাথে সবাই সুর মিলালেন। এই সময় জামালপুরের গণপরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম এক নতুন বক্তব্য রাখলেন। তার কথা, “আমর কাদের ভাইকে চাই, তাঁকে আমরা আনবোই। আনতে আমাদের হবেই। আমি তাকে পাঁচ বছর যাবৎ চিনি, গত বারও আমাকে তিনি টাংগাইলের এক সেমিনারে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমিও গিয়ে তাঁকে অনুরোধ করব, আমার মনে হয় বিশেষ কোন অসুবিধার জন্য তিনি হয়তো আসতে পারেননি। আমি আরো মনে করি, তিনি এখানে থাকতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৮

থাকতে জোনাল কাউন্সিল চেয়ারম্যান নির্বাচনের ব্যাপারটি ফয়সালা হয়ে যাওয়া উচিত। আমরা যদি আগে থেকে একটা বোঝা পড়ায় এসে তাকে নিয়ে আসি এবং নির্বাচিত জোনাল কাউন্সিল চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সভার শুরুতেই তাকে সম্বর্ধিত করতে পারি, তাহলে সেটাই সবচেয়ে উত্তম হবে।
হাকিম সাহেব এত দূর এগুলেন কেন? তার এত দূর এগিয়ে আসার পিছনে সম্ভবত অতীতের কিছু কারণ কাজ করে ছিল। বিগত এপ্রিলে এই হাকিম সাহেবের জন্য লতিফ সিদ্দিকীকে যার পর নাই অস্বস্তি বিড়ম্বনা ও বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। হাকিম সাহেব সম্ভবতঃ সেই পূর্বেকার বদনাম ঘুচাতে চান। তাছাড়া তারা সাত-আট দিনে দেখেছেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উপর আমার কি গভীর প্রভাব। এতে লতিফ সিদ্দিকীকে তার পূর্বের অভিজ্ঞতা ভুলিয়ে দেয়ার জন্য অথবা এপ্রিল-পূর্ব স্বাভাবিক বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার জন্য জামালপুরের গণপরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম ও শেরপুরের গণপরিষদ সদস্য নিজামুদ্দিনসহ আরও কয়েক জন আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়, হাতেম আলী তালুকদার টাংগাইলের লোক হলেও ১৯৫০ সাল থেকে তিনি ময়মনসিংহেই থাকতেন এবং সেখানেই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বলতে গেলে, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহের একজন সুপরিচিত ও বলিষ্ঠনেতা। এই কারণে ময়মনসিংহ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এই সমস্ত এলাকার গণপ্রতিনিধিদের উপর তার কিছুটা প্রভাব ছিল। হাতেম আলী তালুকদারের প্রভাব এবং আবদুল হাকিম ও নিজাম সাহেবের মনোভাবের কারণে পরিস্থিতিটা তাদের অনুকূলে এসে যায়।
দ্বিতীয় বার এসে অনেক বলে কয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন। ততক্ষণে শাজাহান সাহেব জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে গেছেন। আমি গণপরিষদ সদস্যদের মিটিংয়ে পৌঁছলে তাদের মধ্যে থেকে রফিক ভাই এবং শাজাহান ভাই আমার গলায় দুই খানা মালা পরিয়ে দিলেন। আমি মালা দুইটি সহযোদ্ধা সামসুর গলায় পরিয়ে দিলাম।
শামসুর রহমান খান শাজাহান ময়মনসিংহ-টাংগাইল জোনাল কাউন্সিলের সর্বসম্মত চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। চেয়ারম্যান হিসাবে সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথমেই ঘোষনা করলেন, “এই জোনাল কাউন্সিলের যিনি সেক্রেটারী নির্বাচিত হবেন তাকে অবশ্যই ময়মনসিংহের লোক হতে হবে। আমি ময়মনসিংহ থেকে জোনাল কাউন্সিল সেক্রেটারী নেবো।” তুমুল করতালী দিয়ে প্রায় সবাই শামসুর রহমান শাজাহানের এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন।
শাজাহান ও রফিক ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের ও আমার নানা প্রশংসা করে আমাকে কিছু বলতে বললেন। আমি গণপরিষদ সদস্যদের সম্বর্ধনার জবাবে বললাম, “আজ আপনাদের সম্বর্ধনা পেয়ে আমি অভিভূত। মুক্তিযুদ্ধে এর শুভ প্রভাব পড়বে। আপনাদের যে কোন অনুরোধ মুক্তিযোদ্ধারা আদেশ বলে মেনে নেবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুসংহত না হলে মুক্তিযুদ্ধ অচল হয়ে পড়বে। আমরা আপনাদের সকল কাজে আন্তরিক ভাবে সমর্থন জানাবো।” শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরন
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০৯

করে এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনার দুর্বার শপথ নিয়ে বক্তব্য শেষ করলাম।
১১ই সেপ্টম্বর আবার লেফটন্যান্ট জেনারেল অরোরা এলেন। অরোরা আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলেন। লেফটন্যান্ট জেনারেল অরোরাকে এই প্রথম বললাম, “আমি সীমান্তে থাকতে চাই। আমাকে রৌমারী ও মহেন্দ্রগঞ্জ এলাকা দেয়া হলে এক মাসের মধ্যে কম করেও পনের মাইল অভ্যন্তরে গিয়ে ডিফেন্স গাড়ব। আমি যদি এই এলাকার পনের-কুড়ি মাইল মুক্ত রাখতে না পারি, তা হলে আমাকে সরিয়ে দিলে আমার কোন আপত্তি থাকবেনা।” জেনারেল অরোরা বললেন, তুমি থাকলে আমরা বরং খুশী হব। তোমার মত একজন চতুর সেনানায়কের অত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে থাকাটা আমরাও পছন্দ করিনা। তুমি নিঃসন্দেহে এখানে থাকতে পার।
এদিকে দলবল সহ জিয়াউর রহমানের ডাউকী যাওয়ার কথা হচ্ছিল। অক্টোবর মাসে জিয়াউর রহমানের দলকে ডাউকীতে স্থানান্তরিত করাও হয়েছিল। তাই এ এলাকায় আমি থাকতে চাইলে কোন দিক থেকেই কোন অসুবিধা ছিলনা, এ কথা অরোরা ভাল ভাবেই জানতেন।

পরিকল্পনা বদল
১২ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল। তুরা সার্কিট হাউসে দুপাতা কাগজে একটি সামরিক পরিকল্পনা অরোরার হাতে তুলে দিলাম। ঐদিনই জেনারেল অরোরা হেলিকপ্টারে তুরা ক্যাম্প থেকে কর্নেল জিয়ার তেলঢালা ক্যাম্পে গেলেন। অনেক আলাপ-আলোচনার পর আমি অরোরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, মানকাচরে এলাম। মানকারচর, ক্যাম্প ও অন্যান্য স্থান ঘুরে ফিরে একবার খেয়াঘাট পাড়ে গেলাম। খেয়াঘাটে মজনুর বাড়ীতে কমাণ্ডার হুমায়ুনের মা ও ভাই-বোনেরা উঠেছিলেন। তাদের সাথে দেখা করে ফিরে আসার সময় হঠাৎ দেলোয়ারকে দেখে চমকে উঠলাম। খেয়া থেকে নেমে, ছুটে এসে দেলোয়ার স্যালুট করল। পরে আবার পায়ে হাত দিয়েও সালাম করল। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, “দেলোয়ার। তুমি কোথা থেকে?”
দেলোয়ার বেঙ্গল রেজিমেন্টে হাবিলদার। সে বলেলা, ‘স্যার। আমি গৌরাঙ্গী থেকে আসছি।”
— কবে তুমি গৌরাঙ্গী থেকে রওয়ানা হয়েছো?
— তিনদিন আগে গৌরাঙ্গী থেকে রওয়ানা হয়েছি। তবে তার দুদিন আগে বহেরাতলী থেকে গৌরাঙ্গী যাই। আমি এতদিন বহেরাতলীতে ছিলাম।
ভীষণ কৌতূহল নিয়ে ওখানকার সার্বিক অবস্থা জানার জন্য আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি বহেরাতলীতে ছিলে। পাহাড়ের খবর কি?’ এবার দেলোয়ার যেন আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বললো, ‘স্যার, আর কইয়েন না। মিলিটারীরা আগষ্টের ২৭–২৮ তারিখে পাহাড় ছাইরা চইলা গেল। তারপর মুক্তিবাহিনীর সে কি রূপ, এক মুক্তিবাহিনী দল অন্য মুক্তিবাহিনী দলেরে মারে। রাস্তায় মানুষ পাইলেই তাদের পিঠে চাবুক বসায়। কোন বাড়ীর মালিক একদলরে মাছ-ভাত খাওয়াইল, একশ-দুইশ টেকা দিয়া সাহায্য করল তো দুই নম্বর দল আইয়া হেই মালিকের কাছে চাইল দুই হাজার টেকা। তারপরের দিন আর এডা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১০

মুক্তিদল হেই বাড়ীতেই চাইপা বইল। তাগো দাবী আরো বেশী। তাগোরে কথা, তুমি আগের দলরে খাসী জবাই কইরা খাওয়াইছ, আমাগোরে গরু জবাই জবাই কইরা খাওয়াইতে অইবো, লগে পাঁচ হাজার টেকা, না অইলে তোমাগোরে জীবন শেষ।’ এই বলে কাদতে কাদতে দেলোয়ার ধপ্ করে মাটিতে বসে পড়লো। আমারও কান্না পেয়ে গেল। দেলোয়ার আরো বললো, “যে মুক্তিবাহিনীর জন্য মানুষ নামাজ পড়ছে, রোজা রাখছে, খোদার দরবারে দোয়া করছে, আজ হেই মুক্তিবাহিনীর জন্য মানুষ হাত তুইল্যা বদদোয়া করতাছে, অভিশাপ দিতাছে। স্যার, কি কমু, কইতে ডর করে, আবার না কইলেও চলে না। স্যার, নামাজ পইড়্যা লোকে কয়, কাদের সিদ্দিকী কি বানাইছে? এই অত্যাচারী গোরে আল্লাহ নিপাত করুক। কাদের সিদ্দিকীর মাথায় গজব পড়ুক। কেউ কেউ স্যার এ-ও কয়, কাদের সিদ্দিকীর গায়ে গুলি লাগছে না ছাই। পারে নাই, পালাইছে। এই ফেরাউন গুলারে সাথে নিয়া যায় নাই। কাদের সিদ্দিকী যে ফেরাউন বানাইছে, তার জন্য তার জ্বইল্যা পুইড়্যা মরতে অইব। স্যার, কত কি যে কয়, আমি আর কত কইতে পারি?”
এসব শুনে আমার শরীর রি-রি করে উঠলো। দেলোয়ার সত্য কথাই বলছে। মুক্তিবাহিনীর বিশৃংখলা চরমে উঠেছিল। তারা নিয়ম-কানুন অগ্রাহ্য করে সর্বত্র অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল। কেউ কারো কথা শুনতো না, কেউ কাউকে মানতো না। অল্প কয়েক দিনের জন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডারই নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষমতা জাহির করতে জনসাধারণের উপর জোর জুলুম চালিয়েছে, মারধোর করেছে, অন্যায় অত্যাচার চালিয়েছে। তবে আনোয়ার উল-আলম শহীদ ৭ই সেপ্টেম্বর ফিরে যাবার পর ১৫ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। কিন্তু দেলোয়ার তা দেখে আসেনি, কারণ ৭৮ই সেপ্টেম্বর সে বহেরাতলী থেকে রওয়ানা হয়ে এসেছে, এই সময় কোম্পানী কমাণ্ডার মুসা বায়জিদ আলমকে বেদম প্রহার করেছিল। এবং পাহাড়ে সাত জন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক তাদের বেতন আনতে টাংগাইল জেলা সদরে যাওয়ার পথে এলেঙ্গার কাছে পাঠনে মুসা তাদের হত্যা করে। তাদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম তোতার বাবা এবং ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের দুলাভাই ছিলেন। দু-একজনতো মুক্তিবাহিনীর সর্বময় কর্তা বলেও দাবী করেছিল। দেলোয়ারের কথা শুনে রাগে, দুঃখে, অভিমানে আমি পাগলের মত হয়ে গেলাম। দেলোয়ারকে বললাম, ‘দেখ, সামনেই এনায়েত করিমের ক্যাম্প, তুমি সেখানে যাও। আমি তোমাকে ডেকে নেব।’ দৌড়ে গিয়ে গাড়ীতে উঠলাম। উর্ধ্বশ্বাসে তেলঢালা ক্যাম্পের দিকে টয়োটা জীপ ছুটালাম। পাহাড়ী রাস্তা। গাড়ীর গতি ষাট-সত্তর মাইলের মধ্যে উঠানামা করছে। ঝড়ের বেগে জিয়ার ক্যাম্পে প্রবেশ করলাম। আমি যখন জিয়ার ক্যাম্পের হেলিপ্যাডের কাছাকাছি এলাম, তখন জেনারেল অরোরার হেলিকপ্টারটি মাটি থেকে সামান্য উঠে গেছে। জীপ থেকে নামতে নামতে হেলিকপ্টারটি অনেক দূরে চলে গেল। কর্নেল জিয়া এবং সান সিং শুধু দাঁড়িয়ে আমার উসকো খুসকো চুল, শুকনো মুখ, রক্তলাল চোখ দেখে সান সিং জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে?”
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১১

— আমি এখানে থাকতে চাই না। ভিতরে যেতে চাই। তাই জেনারেলের কাছ থেকে প্ল্যানটি ফিরিয়ে নিতে এসেছিলাম। জিয়া বললেন,
— কাদের ভাই, এমন করছেন কেন? খারাপ কিছু ঘটেছে কি?
— না, খারাপ কিছু হয়নি, বলার সাথে সাথে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
সান সিং বললেন, “উদ্বেগের কিছু নেই। জেনারেল তুরাতে কম করেও ঘন্টা দুই অপেক্ষা করবে। তুমি তুরা চলে যাও। আমি এখান থেকে তুরার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। উনি যদি চলেও যান, তোমার ম্যাসেজ আমি তার কাছে পাঠিয়ে দেব।”
আবার জীপ ছুটালাম তুরার দিকে। এবার রাস্তা আরও চড়াই উতরাই। কিন্তু গাড়ীর গতি কমতে দিচ্ছি না। সেদিন তুরাতে কি ভাবে এসেছিলাম, তা নিজেই জানি না। তবে অত দ্রুত গতিতে আসতে সারা রাস্তায় কোন অসুবিধায় পরতে হয়নি। গাড়ী কোথাও বিপদগ্রস্ত হয়নি।
যখন তুরা সার্কিট হাউজ গেট দিয়ে ঢুকছিল। হেলিকপ্টারের পাখা তখন ঘুরতে শুরু করেছে। জীপ থেকে নেমে দৌড়ে হেলিকপ্টারের দিকে গেলাম। হেলিকপ্টারের পাখা একবার দ্রুত গতি নিয়ে আবার কমে গেল। তেল ঢালাতে হেলিপ্যাডের দিকে ধেয়ে আসা একটি জীপ দেখেছিলেন। ঠিক অনুরূপভাবে তুরাতেও একই জীপ আসতে দেখে পাইলট হেলিকপ্টারে টেক-অফ না করে ইঞ্জিনের গতি কমিয়ে দেন। ঘুরস্ত পাখার নিচ দিয়ে হেলিকপ্টারের কাছাকাছি যেতেই দরজা খুলে গেলে। আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম। লেফেটন্যান্ট জেনারেল আরোরার স্ত্রী সীট থেকে উঠে বললেন,
— কি কাদের, কি হয়েছে? কোন খবর আছে? অরোরারও একই প্রশ্ন।
— আমি দেশের ভেতরে যেতে চাই। তাই আমার পরিকল্পনা ফিরিয়ে নিতে এসেছি।
— তুমি দেশের ভেতরে গেলেও আমি খুশী। তোমার সাথে আমাদের সম্পর্ক সম মর্যদার ও বন্ধুত্বপূর্ণ। এখনই আমার অন্য একটা প্রোগ্রাম আছে। তুমি সান সিংকে যে পরিকল্পনা দিবে, যেমন ভাবে দেবে, তাই মেনে নেবে, তুমি তাকে বল আমি বলে দিয়েছি।
— তা কি করে সম্ভব? যুদ্ধের সময় একজন জেনারেলের (অন্য জনের মাধ্যমে পাঠানো) মৌখিক আদেশ তার অধঃস্তন সেনাপতি কেন পালন করবেন?
অরোরা বললেন, ‘করবে, তুমি অন্য কেউ নও। তোমাকে আমরা বিশ্বাস করি। তিনিও বিশ্বাস করবেন। তুমি দেখো তিনি অবশ্যই বিশ্বাস করবেন।
আমার তৈরী পরিকল্পনার কাগজটি অরোরা হাতে নিয়ে কয়েক বার মোচড়াতে মোচড়াতে বললেন,
— এটার কি আদৌ তোমার প্রয়োজন? এই পরিকল্পনা কিন্তু আমার কাছে থাকা অনেক নিরাপদ। তুমি যদি ছিড়ে ফেল তাহলেই তোমার কাছে এটা নিরাপদ হতে পারে।
— না, এ পরিকল্পনার আমার কোন প্রয়োজন নেই। সালাম জানিয়ে হেলিকপ্টার থেকে নেমে এলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১২

রাতে ব্রিগেডিয়ার সান সিং এর সাথে আলোচনায় বসলাম। সুদীর্ঘ আলোচনা হলো। ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কি ভাবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ রক্ষা করবেন। আর কি ভাবেই বা সাহায্য করবেন ইত্যাদি। দুজনের মধ্যেকার আলোচনা গভীর রাত পর্যন্ত চললো। অবশেষে স্থির হল, আমি আমার সহযোদ্ধাদের চার পাঁচ দিনের মধ্যে দলে দলে ভাগ করে দেশের অভ্যন্তরে পাঠাতে শুরু করব। আমি কোন এক সময় বিশেষ কোন স্থান দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করব।
পরদিন ১৩ই সেপ্টেম্বর, সকাল সাতটা। কমাণ্ডারদের ডেকে আমার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করলাম। শেষে বললাম, ‘যেহেতু আমাদের সবাইকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হবে বা করব, সেহেতু একটা আনুষ্ঠানিক প্যারেড করতে চাই। আর এই প্যারেডে প্রধান অতিথি হিসেবে আমরা লেঃ কর্ণেল জিয়াউর রহমানকে নিমন্ত্রন করবো। আগামীকালই সেই প্যারেড অনুষ্ঠান হবে। তোমরা সকলে মিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুন্দর একটা ব্যবস্থা কর।’ এরপর লেঃ কর্ণেল জিয়াউর রহমানের তেলঢালা ক্যাম্পে গেলাম।
আমার প্রশিক্ষণ শিবির থেকে কর্ণেল জিয়াউর রহমানের ক্যাম্পের দূরত্ব প্রায় চল্লিশ- পয়তাল্লিশ মাইল। আঁকা-বাকা পাহাড়ী রাস্তা। স্বচ্ছন্দে গাড়ী চালানো কোনক্রমেই সম্ভব নয়। আঁকা-বাকা পথে গাড়ী চালিয়ে এগারটার দিকে জিয়াউর রহমানের ক্যাম্পে উপস্থিত হলাম। আমি যাওয়ার সাথে সাথে জিয়াউর রহমান তাঁর এক সহকর্মীকে সুন্দর করে চা তৈরী করার নির্দেশ দিলেন। তারপর জানতে চাইলেন, আমি কি জন্য এসেছি। আমি বললাম,
— এইবার একটা কাজেই আপনার কাছে এসেছি।
— দীর্ঘদিন পর এমন কি কাজ যে, এই ভর দুপুরে আপনি নিজেই ছুটে এসেছেন? অন্যকে দিয়ে খবর পাঠালেই পারতেন।
— না ভাই, আমি যে জন্য এসেছি, তা অন্যকে দিয়ে খবর পাঠালে হতো না।
— তাহলে বলুন, কি এমন জরুরী কাজ। আমার ধৈর্য্য রাখতে অসুবিধা হচ্ছে।
— ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই জরুরী ও সম্মানজনক হলেও তা আপনার পক্ষে পালন করা খুবই সহজ। আগামীকাল সহযোদ্ধারা একটি অনুষ্ঠান করবে। প্রধান অতিথি হিসাবে আপনাকে পেতে চায়। এই দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে আপনার কাছে ছুটে এসেছি।
জিয়া অত্যন্ত আনন্দের সাথে আমার নিমন্ত্রন গ্রহণ করলেন। ১৪ই সেপ্টেম্বর বেলা এগারটায় জিয়াউর রহমান আমাদের ক্যাম্পে পৌঁছবেন। চা পান শেষে সোজা মানকাচর চলে গেলাম। সেখানে এনায়েত করিমকে বললাম, ‘হয়তো কিছু লোক এদিক ওদিক পাঠানো হতে পারে। খোজখবর নিয়ে আপনি বেশ কয়েকটি নৌকা জোগাড় করে রাখবেন, যারা এখান থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত সব রাস্তা চিনে।’ দুপুরে এনায়েত করিমের সাথে খেয়ে তুরার ক্যাম্পে ফিরে এলাম।
শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুতিপর্ব। তালিকা অবশ্য আগেই প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু এবার পুরো দুটি তালিকা দরকার। তুরা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ‘ক্যাম্প মেজরের’
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৩

দায়িত্ব পালন করছিল মেজর আবদুল হাকিম। আর ‘কোয়ার্টার’ মাস্টারের দায়িত্ব পালন করছিল ক্যাপ্টেন বেনু। মেজর হাকিম ১৩ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আমাকে ক্যাম্পের একটি হিসাব দিয়েছিল। তাতে ক্যাম্পের সদস্য সংখ্যা ছিল দুহাজার তিনশত জন। সেই হিসেবই আমি ব্রিগেড মেজর মুখার্জীকে দিয়ে দিই। হিসাবটা ছিল শুধু সংখ্যায়। রাত দশটায় হাকিম দৌড়ে এল।
— কি ব্যাপার?
— স্যার, একটু ভুল হয়ে গেছে। আসলে আমি লোক দাঁড় করিয়ে হিসাব নেইনি। আমি হিসাব দিয়েছিলাম কোম্পানী কমাণ্ডারদের হিসাব মত। ভাল করে শুনে দেখা যাচ্ছে, লোক একশ কুড়ি জন কম এবং তাদের যে তালিকা আছে, তা একটার পর একটা মিলিয়েও দেখেছি। লোক দুহাজার একশ আশি জন। একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। এমনি একটি ভুল তথ্য পরিবেশন করেছি। যা এসময় শোধরানোর আর উপায় নেই। মেজর হাকিমকে বললাম, ‘ঠিক আছে। তোমরা তেইশশ জনেরই একটা তালিকা বানিয়ে দাও। মেজর হাকিম অবাক।
— স্যার। তা কি করে সম্ভব? একশ কুড়ি জন কোথায় পাব।
— হয় আমাদের দলের অন্য একশ কুড়ি জনের নাম ঢুকিয়ে দাও। নয়তো একশ কুড়ি জনের নাম উল্টো করে দাও।
— স্যার, দাঁড় করিয়ে গুনতে গেলে তখন যে ধরা পড়ে যাব।
— না, ধরা পড়বে না, আমাকে না বলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কেউ তোমাদের দাঁড় করাতে যাবেনা। দরকার হলে, আমি ব্যাপারটা ব্রিগেডিয়ার সাহেবেকে জানিয়ে দেব।
এতবড় একটা ভুলের জন্য তাকে অবশ্যই গালমন্দ ও তিরস্কার পেতে হবে, এটা চিন্তা করে হাকিম খুবই উদ্বিগ্ন ও ভীত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সব কিছু জানানোর পরও সে তিরস্কৃত হলোনা বরং কিভাবে ভুল সংশোধন করে সব ঠিকঠাক করে নিতে হবে, এটা তাকে বুঝিয়ে দেয়া হলো। এত বড় একটা ফাড়া নির্বিঘ্নে কেটে যাওয়ায় মেজর হাকিম বারবার ইষ্ট নাম জপ করতে করতে ক্যাম্পে চলে গেল।

জিয়া সম্বর্ধিত
১৪ই সেপ্টেম্বর। বেলা এগারটা। ঘড়ির কাটার সাথে মিল রেখে একজন ক্যাপ্টেনকে নিয়ে কর্নেল জিয়াউর রহমান আমাদের ক্যাম্পে এলেন। জিয়াউর রহমানকে স্বাগত জানানোর জন্য আবদুল হাকিম, লোকমান হোসেন, মনিরুল ইসলাম, হুমায়ুন, বেনু ও অন্যান্য কোম্পানী কমাণ্ডার সহ আরো প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমরা দু’সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। গাড়ী থেকে নামতেই জিয়াকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানালাম। সারির মাঝখান দিয়ে হেঁটে কর্নেল জিয়া অভিবাদন মঞ্চে এসে দাড়ালেন। দু’হাজার মুক্তিযোদ্ধা তাকে সামরিক অভিবাদন জানাল। এরপর আমি জিয়াউর রহমানকে সম্বর্ধিত করে স্বাগত ভাষণ দিলাম। কর্নেল জিয়া জবাবে টাংগাইলের মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন এবং তাদের নেতা হিসাবে বারবার আমার আন্তরিক প্রশংসা করতে লাগলেন। মুক্তিযোদ্ধারা খুবই আগ্রহের সাথে জিয়ার দীর্ঘ বক্তৃতা শুনল। জিয়ার বক্তৃতায় আমার প্রতি তাঁর
পৃষ্ঠা নং ~ ২১৪

অকৃত্রিম বন্ধুত্ববোধের পরিচয় পেয়ে সহযোদ্ধারাও বেশ অনুপ্রাণিত হল। শেষে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নানা ধরনের আলাপ আলোচনা, মেলামেশা করে প্রায় তিন চারশ মুক্তিযোদ্ধার সাথে খাবার খেলেন। খাওয়া শেষে তাকে বিদায় জানালাম। ছয়-সাত দিন আগে কর্নেল জিয়াও তাঁর ক্যাম্পে আমাকে এমনি সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গে আর একটু আলোচনা করা দরকার। কর্ণেল জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে আছেন। এই লেখার মূল উদ্দেশ্যই হল ঘটনাকে তুলে ধরা, মত প্রকাশ করা নয়। মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ও দায়িত্ব পাঠকদের।

কর্ণেল জিয়াউর রহমান
কর্ণেল জিয়াউর রহমানের পূর্ব পুরুষ পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার অধিবাসী ছিলেন। তার পিতা মনসুরুর রহমান (ওরফে মানিক মিয়া)। পরে বগুড়া জেলার গাবতলী থানার মহীশাল ইউনিয়নের মহীশাল গ্রামে চলে আসেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। সেহেতু সরকারী চাকুরীর সুবাদে, তিনি পিতার সাথে বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের নানা স্থানে ঘুরেছেন এবং নানা স্কুলে পড়াশুনা করার সুযোগ পেয়েছেন। যেমন চরম পত্রের পাঠক এম. আর. আখতার সাহেবের পিতাও ছিলেন পুলিশ অফিসার। এ সুবাদে এম. আর. আখতার সাহেবও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরেছেন এবং সেখানকার স্থানীয় ভাষা শিখেছেন। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় চরম পত্র পাঠের মাধ্যমে আখতার সাহেব তার একাধিক জেলা সফরের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ দুর্লভ প্রতিভার চরমপত্রে বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
চাকুরীর এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমানের পিতা মনসুরুর রহমান টাংগাইল জেলার ঘাটাইল থানায় কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। ফলে কিশোর জিয়াউর রহমান ঘাটাইল হাইস্কুলেও কিছু দিন লেখা-পড়া করার সুযোগ পান।
অবশ্য তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মেট্রিক ও আই এ পাশ করেন। এরপর একজন “বয়েজ কমিশন অফিসার” হিসাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তিনি নানা সময়ে, নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান ১ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানী কমাণ্ডার ছিলেন। তিনি কচ্ছের রান এলাকায় অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তখন তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন। এরপর অনেকদিন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে তার কোনও সম্পর্ক ছিলনা। তিনিই ছিলেন একমাত্র বাঙ্গালী অফিসার, যাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে চীন, জাপান ও আমেরিকার পেন্টাগনে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছিল।
শোনা যায়, ১৯৬৫ সালের পর চট্টগ্রামে মিজো বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণের জন্য চীনের সহায়তায় আইউব খান যে “মিজো গেরিলা সাহায্য ক্যাম্প” খুলে ছিলেন, তাতে প্রায় এক বৎসর
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৫

ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান প্রশিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ‘৬৫ সাল থেকে ৭০-এর জানুয়ারী, এ সুদীর্ঘ সময় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
‘৭০ সালের গোড়ার দিকে, চট্টগ্রামের বেঙ্গল রেজিমেন্ট ট্রেনিং সেন্টার ৮ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের গোড়াপত্তন হয়। প্রায় পাঁচ বছর পর ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের (ব্যাটেলিয়ান) সহ অধিনায়ক হিসাবে আবার জিয়াউর রহমানকে বদলী করা হয়। তিনি সত্যিকার অর্থেই ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের গঠন ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত এই ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট অসম্পূর্ণ ছিল। পাঁচটি কোম্পানী নিয়ে একটি পদাতিক বাহিনী গঠিত হয়। ‘৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত নবগঠিত ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট সাড়ে তিনটি কোম্পানী ছিল। ‘৭০-এর ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের পর, পাকিস্তানের ইতিহাসে যখন এক চরম রাজনৈতিক উত্থান পতনের সূচনা হয়, তখনও পর্যন্ত জিয়াউর রহমান তার রেজিমেন্ট গঠনের কাজে পুরোপুরি ভাবে নিমগ্ন ছিলেন। ‘৭১ এর মার্চের ১৫-১৬ তারিখে, জিয়াউর রহমানের ব্যাটেলিয়ানের দু’টি কোম্পানী চট্টগ্রাম জে.টি.ও. আরেকটি কোম্পানীকে কালুরঘাট সেতুর পাহারার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এই সময় কাজের সুবিধার জন্য জিয়াউর রহমান কালুর ঘাটের কাছে বি. এন. কোয়ার্টার ও কন্ট্রোল রুম বসান।
২৪ মার্চ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান নিরুত্তাপেই কাটান। কিন্তু ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে ব্যাটেলিয়ননের বেশ কয়েকজন সদস্য জিয়াউর রহমানের কাছে নানা ধরনের কঠিন ও ভীতিপ্রদ খবর পৌঁছে দিতে থাকেন। ঐ সময়কার চরম রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সামরিক বিভাগের আভ্যন্তরীণ সন্দেহ, অবিশ্বাস, অসৎ ব্যবহার ও আক্রমণের প্রেক্ষিতে তাঁদের করণীয় কি, তা জানাতে জিয়াকে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। ২৫শে মার্চের রাত প্রচণ্ড উত্তেজনা ও উদ্বেগের মধ্যে কাটালো। ২৬শে মার্চ সকালে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে জিয়াকে ডেকে পাঠানো হয়। নানা কিছু ভেবে জিয়া ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে যাওয়া স্থির করেন। কিন্তু তাঁর কিছু সহকর্মী তাকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যেতে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করেছিলেন।
এত অনুরোধ ও নিষেধ উপেক্ষা করেও তিনি একখানা জীপে ই. বি. আর. সি. ক্যান্টনমেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর বেরিয়ে যাওয়ার সময় ৮ম রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাষ্টার ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ শিবিরে ছিলেন না। তিনি শিবিরে এসেই কমাণ্ডার কোথায় জানতে চান। কমাণ্ডার ই. বি. আর. সি. হেডকোয়ার্টারের দিকে গেছেন বলে সৈনিকরা তাঁকে জানালে, ক্যাপ্টেন অলি উন্মাদের মত একটা মিলিটারী মোটর সাইকেলে উর্ধ্বশ্বাসে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটেন। টাইগার পাসের কাছে তিনি জিয়ার জীপের গতি রোধ করে দাঁড়ান। জিয়ার গাড়ীর সামনে অলি তার মোটর সাইকেলটি ফেলে দিয়ে চালকের আসনে বসা জিয়াকে জিজ্ঞেস করেন, “স্যার আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” জিয়া স্বাভাবিক ভাবেই বললেন, “ক্যান্টমেন্টে যাচ্ছি। ব্রিগেডিয়ার ডেকে পাঠিয়েছেন।” অলি চিৎকার করে উঠেন, “আপনি এখন ক্যান্টমেন্টে যাচ্ছেন?
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৬

গেলেই আপনাকে গুলি করবে। আপনি জানেন কি, গত কাল চারশ বাঙ্গালী রিক্রুটকে গুলি করে হত্যা করেছে? কুমিল্লা বেঙ্গল রেজিমেন্ট লাইন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। কুর্মীটোলা ও জয়দেবপুর বেঙ্গল রেজিমেন্টের লাইনের উপর ট্যাংকের থেকে গোলা বর্ষণ করা হয়েছে। এই সমস্ত জানার পরও কোন সাহসে আপনি ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছেন?”
— কি করব? ক্যান্টনমেন্টে না গেলে যে কোর্ট মার্শাল হবে। এবার ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আপনি পাগল হয়ে গেছেন নাকি? কিসের কোর্ট মাশাল? গুলি করে মারবে ওরা। আপনি কিছুতেই ক্যান্টনমেন্টে যেতে পারবেন না” বলেই ক্যাপ্টেন অলি তার রিভলভার উচিয়ে বলেন, “আপনাকে এখনও কমাণ্ডার হিসাবে মানি। কিন্তু আপনি যদি ক্যান্টেনমেন্টে যেতে চান তাহলে আমিই আপনাকে গুলি করব। পশ্চিমাদের হাতে গুলি খেয়ে মরার চেয়ে বাঙালীর হাতে গুলি খেয়ে মরে অনেক শান্তি পাবেন।” অতিশয় আতঙ্কিত ও উত্তেজিত ক্যাপ্টেন অলি এই কথা বলেই জীপের সামনের সীটে বসে পড়েন। এবার অনুরোধ নয়। আদেশের সুরে বললেন, ‘গাড়ী ঘুরান।’ মেজর জিয়া ক্যাপ্টেন অলি আহমেদের কথামত গাড়ী ঘুরিয়ে নেন। তারপর শহরের মধ্যে এসে কালুরঘাট ও চট্টগ্রামের রাস্তার এক পাশে একটি গাছের নীচে বসে পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে ভাবতে শুরু করেন। এই সময় সেখানে আরও দুজন ক্যাপ্টেন ও একজন লেফটন্যান্ট এসে উপস্থিত হন। বেশ কয়েকজন বাঙালী সামরিক অফিসারদের দেখে খবরের কাগজের জনৈক হকার চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ অফিসে ছুটে গিয়ে খবর দেয়। খবর পেয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও গণপরিষদ সদস্য আবদুল হান্নান, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহান ও আরও কয়েকজন এসে প্রচুর সমাদর করে তাদের সংগ্রাম পরিষদ অফিসে নিয়ে যান।
বাঙালী সামরিক অফিসাররা তখন সংগ্রামী বাঙালীদের কাছে মহামূল্যবান। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে। ইতিমধ্যেই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নামে চট্টগ্রামে রেডিও ষ্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা বারবার প্রচার করা হচ্ছিল। জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম. আর. সিদ্দিকী, আবদুল হান্নান, এম. এ. মান্নান ও অন্যান্য বেশ কয়েকজন নেতা স্বাধীনতার পক্ষে হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেশবাসীকে অনুরোধ জানিয়েছেন। সেই সময় প্রভাবশালী কোন লোক পাওয়া গেলেই তাঁকে দিয়ে দেশবাসীর প্রতি আবেদন প্রচার করা হচ্ছিল। দু’তিনজন আনসার অ্যাডজুট্যান্ট, পুলিশের সাবেক ডি. আই. জি. এ ধরনের কিছু লোকের আবেদনও প্রচার করা হয়েছে। এর ঠিক পরেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের পেয়ে সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে যান। হান্নান সাহেব সামরিক অফিসারদের অনুরোধ করেন, “আপনাদের নেতা বেঙ্গল রেজিমেন্টকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে একটা আবেদন প্রচার করুন।” তখন একজন সামরিক অফিসারের আবেদন দেশবাসীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বারবার সামরিক অফিসারদের বুঝিয়ে বলা হচ্ছিল। এত বুঝিয়ে বলা ও অনুরোধ করা সত্ত্বেও পাকিস্তান
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৭

নামক রাষ্ট্র ও পাক-সামরিক বাহিনীর প্রতি তখন পর্যন্ত অকুণ্ঠ সমর্থক মেজর জিয়াউর রহমানের মধ্যে কোন ভাবান্তর ঘটলো না। বাঙালী সামরিক অফিসারদের মধ্যে সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোন বিবৃতি বা আবেদন প্রচারে ঘোর আপত্তি জানান। এখানেও ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ এগিয়ে আসেন। তিনি জিয়াকে জোরের সাথে বলেন, “আপনি বাঙালী সৈনিকদের যুদ্ধে অংশ নেয়ার আবেদন না জানালে আমাদের মধ্যে যিনি সিনিয়র, তিনিই জানাবেন। তবে আপনার আবেদন না জানানোর কোন কারণ খুঁজে পাই না। আমরা তো আর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতে পারছিনা। আমাদের সামনে এখন দু’টি পথ খোলা, হয় জয়, নয় মৃত্যু। এর মাঝামাঝি কি কোন পথ আছে?” জিয়া এবারও অলি আহমেদ ও অন্য দু-তিন জন সহকর্মীর চাপাঁচাপিতে বিবৃতি প্রচারে রাজী হলেন। সাথে সাথে তার বক্তৃতা রেকর্ড করার জন্য একটি টেপ রেকর্ডার আনা হলো। এখানে তিনি প্রথম নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে বক্তব্য রাখেন। তার ঘোষণার শুরুটা ছিল এই রকম, ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’ রেকর্ড করার সময় প্রবল উত্তেজনায় কেউ খেয়াল করেন নি, জিয়া সাহেব কি বলছেন। রেডিও সেন্টারে সম্প্রচার করা শুরু হলে ত্রুটিটা ধরা পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রচার বন্ধ করা হলো। এ কি বলেছেন? কে বাংলা দেশের প্রেসিডেন্ট? কে স্বাধীনতার ঘোষক? স্বাধীনতার টেপ রেকর্ডার নিয়ে বেতারের লোক আবার সংগ্রাম পরিষদ অফিসে ছুটে এলো। সংগ্রাম পরিষদের নেতারাও রেডিওতে জিয়ার বক্তৃতার প্রথম লাইনটি শুনে থ বনে যান। সাথে সাথে রেডিও ষ্টেশনে ফোন করা হয়, কি ব্যাপার, ওটা বন্ধ কর। রেডিও ষ্টেশন থেকে উত্তর এলো, ‘আমরা আগেই বন্ধ করে দিয়েছি। টেপ নিয়ে আপনাদের কাছে আমাদের লোক চলে গেছে। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে জিয়া সাহেব বলেন, ‘আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, আপনারা একটা খসড়া করে দিন।’
এবার সংগ্রাম পরিষদের নেতারা চিন্তাভাবনা করে পাঁচ-ছ’ লাইনের একটি খসড়া বক্তৃতা লিখে দিলেন। জিয়া বললেন, ‘আমি বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান, বাঙালী সৈনিক ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সংগ্রাম পরিষদে নেতৃত্বে বাঙালী সৈনিক যারাই আছেন, তাঁরা অস্ত্র ধারণ করুন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সুস্থ আছেন। তিনি নিয়ন্ত্রন কক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব নির্দেশ দিয়ে চলছেন। বিশ্ব বাসীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি, আপনারা আমাদের সাহায্য করুন। আল্লাহ আমাদের সহায়। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
বেতারে মেজর জিয়াউর রহমানের বক্তৃতা প্রচারের পর অন্যান্য অফিসারদের নিয়ে তিনি সোজা কালুরঘাট চলে যান। সেখান থেকে কোম্পানীর লোকজন নিয়ে আবার চট্টগ্রামে ফিরে এসে চট্টগ্রাম-ঢাকা সড়ক ধরে এগুতে থাকেন। ঐ সময় চট্টগ্রাম জেটিতে অবস্থানরত কোম্পানীকেও উইথড্র করে সাথে নিয়ে নেন। ঢাকার দিকে এগুতে দেখে সেই সময় হয়তো চট্টগ্রামের অনেকে ভেবেছিলেন, জিয়ার নেতৃত্বে সৈন্যরা ঢাকার দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৮

আদতে কিন্তু তা হয়নি। তারা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার দিকে কিছুদূর এগিয়ে শুভপুর ব্রীজের কাছ দিয়ে ত্রিপুরা সীমান্তের শ্রীনগর বি. ও. পি. হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের উপর বিখ্যাত শুভপুর ব্রীজ ভারতীয় সীমান্ত থেকে বড় জোড় তিনশ গজ। চট্টগ্রাম-ঢাকা রাস্তা এইখানেই ভারতীয় সীমান্তের সবচেয়ে কাছ দিয়ে গেছে। অফিসার ও অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম সহ মেজর জিয়া ভারতের ভিতরে অবস্থান নেন। সাধারণ সৈনিকরা ব্রীজটি আগলে বসে থাকেন। ত্রিপুরা সীমান্তের শ্রীনগর বি. এস. এফ. অবজারভেশন পোষ্ট এরিয়াতে মেজর জিয়া তার সেনাদের নিয়ে প্রায় সপ্তাহ দুই ছিলেন। এই শুভপুর ব্রীজে মেজর জিয়ার দলের সাথে হানাদারদের বেশ কয়েক বার সংঘর্ষ হয়। প্রথম দিকে দু’এক বার মেজর জিয়ার দলই জয়ী হয়। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে রাস্তা মুক্ত করতে হানাদাররা যখন ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্র নিয়ে হামলা করে, তখন জিয়ার নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা ভারত সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হন।
২৫শে মার্চের পর এই শুভপুর ব্রীজ ছাড়া মেজর জিয়াকে আর কোথাও প্রতিরোধ কিংবা সংঘর্ষের সম্মুখীন হয়ে হয়নি। এইখান থেকে জিয়ার দলকে মেঘালয়ের তেলঢালা ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। তেলঢালাতে তারা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তেলঢালা ক্যাম্পে জিয়াউর রহমান তাঁর নেতৃত্বে প্রায় চার হাজার সৈন্যের একটি দল গঠন করেন। যার নাম তাঁর নামানুসারে ‘জেড’ ফোর্স রাখেন।
অক্টোবর মাসে তেলঢালা ক্যাম্প থেকে প্রায় তিন’শ মাইল পূর্বে সিলেটের ডাউকি সীমান্তে আবার তারা ঘাঁটি গাড়েন। পরিকল্পনা তৈরী করা হয় যে, জিয়ার নেতৃত্বাধীন দলটি শেষ যুদ্ধের সময় ওখান দিয়েই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকবে। এবং তারা সিলেট জেলা দখল নেবেন। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ- ভারত যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের দুই একটি জায়গায় হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেনি। যেমন ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল ছ’টায় খুলনা বেতারকেন্দ্র করাচী থেকে প্রচারিত বাংলা সংবাদ রিলে করেছিল। এবং খুলনাস্থ পাক সেনা বাহিনী স্বাধীনতার দু’দিন পর ১৮ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছিল। ১৬ই ডিসেম্বর সকাল দশটা চল্লিশ মিনিটে হানাদার বাহিনী আমাদের কাছে আত্মসমর্পণের সুচনা করে এবং বিকেল পাঁচটা পাঁচ মিনিটে উভয় পক্ষের সেনাপতিরা আত্মসমর্পন পত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর প্রদান করেন। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার হানাদাররা আত্ম-সমর্পণ করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাস- ভবনের পাহারারত হানাদাররা ১৬ই ডিসেম্বরের সারাদিন তো নয়ই, রাতেও আত্মসমর্পণ করেনি। তারা হানাদার সেনাপতি নিয়াজীর আত্মসমর্পণ আদেশ মানতে রাজী নয়। পরের দিন অর্থাৎ ১৭ই ডিসেম্বর সকাল নটায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুজন ব্রিগেডিয়ার, চার-পাঁচ জন মেজর ও প্রায় দু’ ব্যাটেলিয়ান সৈন্যের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এমনি আর একটি ঘটনা সিলেটে ঘটে। সেখানেও হানাদাররা ঢাকার সাথে তাল রেখে আত্মসমর্পণ করতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১৯

রাজী হয়নি। কারণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোকজন ছাড়া অন্যদের হাতে আত্মসমর্পণ করতে হানাদার বাহিনীর প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। বিশেষতঃ মুক্তিবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পন করার ব্যাপারে তারা দারুন নিরাপত্তার অভাব অনুভব করছিল। দ্বিতীয়তঃ সিলেট জোনের কমাণ্ডার ছিলেন হানাদার বাহিনীর ট্রেনিং প্রাপ্ত অফিসার। সুতরাং নিজেদের ট্রেনিং প্রাপ্ত জুনিয়র অফিসারের কাছে আত্মসমর্পণ করার প্রশ্নে হানাদার অফিসাররা ভীষণ লজ্জাবোধ করছিল। ঢাকা থেকে পুনঃ পুনঃ আদেশ পাওয়া সত্ত্বেও তারা অধঃস্তন একজন মেজরের কাছে অত্মসমর্পণ করতে রাজী হয়নি। ১৮ই ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকে একটি ভারতীয় ব্রিগেড সিলেটে পৌঁছার পর, পাক আর্মি তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপরেও ১৮ই ডিসেম্বর সলুটিগড় বিমান বন্দরের পাহারারত সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করতে চায়নি, সিলেট বিমান বন্দরে তখন দুটি ‘ফোকার ফ্রেডশীপ’ পড়েছিল। সেই বিমানের সাহায্যে তারা বারবার পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল।
মেজর জিয়া ২৮–২৯শে মার্চ চার-পাঁচশ সৈনিক নিয়ে ভারতের শ্রীনগর বি. ও. পি.-তে পৌঁছে ছিলেন। নয় মাস পর ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর চার-সাড়ে চার হাজার সৈন্য সহ স্বাধীন বাংলার সিলেটে অবস্থান নেন। এর মাঝেও দুচারটি ঘটনা নিশ্চয়ই রয়েছে। এটা প্রমাণিত সত্য যে, তিনি ২৫শে মার্চ রাত পর্যন্ত পাক সেনাবাহিনীর একজন অনুগত অফিসার ছিলেন। যার পুরস্কার হিসাব তিনি বিদেশে নানা স্থানে পাক সেনাবাহিনীর ‘গোপনীয় ব্যাপার সংক্রান্ত’ বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছিলেন। আরও একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। মেজর জিয়া যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার ও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার দুসন্তান ও স্ত্রী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের অসংখ্য অফিসার ও জোয়ানদের স্ত্রী-পুত্র-পরিজনদের উপর হানাদাররা অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করলেও জিয়ার স্ত্রী ও দু সন্তান কুর্মীটোলা ক্যান্টনমেন্টে অত্যন্ত সম্মানজনক অবস্থায় ছিলেন।
জিয়াউর রহমান সম্পর্কে আমার মূল আলোচনা নয়। এহেতু তাকে নিয়ে আমি বেশী দূর অগ্রসর হতে চাইনা। শুধু কয়েকটা ঘটনা তুলে ধরলাম মাত্র। জিয়ার নেতৃত্বে বেশ কিছু সেনাপতি বিশেষ সাহসিকতার সাথে কাজ করেছেন। এঁদের মধ্যে মেজর (পরে কর্নেল) আবু তাহের, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর খালেক, মেজর জিয়াউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের (নিহত) নাম উল্লেখযোগ্য। আর জিয়ার সকল অবদান, সকল কৃতিত্ব ও সকল মহিমার পেছনে ক্যাপ্টেন অলি আহমেদের দান সর্বাধিক অথবা ষোল আনাই। পরম বিশ্বাস, আনুগত্য ভালবাসা নিয়ে অলি আহমেদ যুদ্ধের শুরু থেকে তার (জিয়ার) মৃত্যু পর্যন্ত সাথে ছিলেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২০

দেশে ফেরার প্রস্তুতি

সামাদ হলো গামা
কোম্পানী ভাগের পালা শুরু হলো। চললো অনেক রাত পর্যন্ত। পরদিন সকালেও কোম্পানী ভাগের কাজ চললো। কোম্পানী ভাগ শেষে কার কি অস্ত্র থাকবে, কার কি কর্তব্য ও দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা করতে করতে প্রায় বারোটা বেজে গেল। তাই খাওয়ার জন্য বিরতি দিতে হলো। খাবার শেষে ফিরে এসে ফ্যাগ পোস্টের নীচে ছোট্ট একটি বেঞ্চিতে বসেছি। দেহরক্ষীরা চার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এমনি এক সময় কাউলজানির পিন্টু এসে বলল, ‘স্যার আপনার সাথে হাবিব কোম্পানীর এক মুক্তিযোদ্ধা কথা বলতে চায়।”
“বেশ তো তাকে নিয়ে এস” বলতেই সামনে এসে দাঁড়ালো সাড়ে পাঁচফুট কি পৌনে ছয়ফুট লম্বা বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যের শ্যামলা একটি যুবক। যুবকটি এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াতেই মনে হল বুঝি পুরো পাহাড়টাই কেঁপে উঠলো।
— কি ভাই। কি বলবে? বল।
— স্যার, আমার নাম আবদুস সামাদ। আমার বাড়ী জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের কাছে পিকনাতে। জাহাজ মারা যুদ্ধে আমি কমান্ডার হাবিবর সাহেবের লগে আছিলাম। আমার কওয়ার তেমন কিছু নাই। আমার পেটভইরা খাইতে দেওয়া অয় নাই। পেট ভরে খেতে দেয়া হয়নি, শুনে আমি হোঁচট খেলাম এবং কিছুটা ক্ষুদ্ধও হলাম। যোদ্ধাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমি খুবই সতর্ক ছিলাম। যোদ্ধাটিকে জিজ্ঞোসা করলাম,
— কেন তোমাকে খেতে দেয়া হয়নি।
— খাইতে দেওয়া অইছে তয় পেট ভইরা খাইতে দেওয়া অয় নাই। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল ক্যাম্প কোয়ার্টার মাষ্টার ক্যাপ্টেন বেনু। তাকে জিজ্ঞোসা করলাম,
— কি মাস্টার। এসব কি শুনছি। ব্যাপার কি?
— স্যার, ও এই মাত্র ছয় রুটি খেয়ে এলো। অন্যান্য সহযোদ্ধারা তিনটি খায়। তিন রুটিতে হয়তো দুএক জনের সামান্য কম হলেও হতে পারে, কিন্তু আবার অনেকে দু’টি রুটির বেশী খেতে পারে না। খাওয়ার জন্য এখানে কারোরই তেমন কষ্ট হয় না একমাত্র এই সামাদ ছাড়া। ‘এই একমাত্র সামাদ ছাড়া’ কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। সকলের কষ্ট হয় না একজনের হয়, সে আবার কেমন কথা। সাথে সাথে কোয়াটার মাষ্টারকে নির্দেশ দিলাম,
— তুমি প্রত্যেক কোম্পানী থেকে দুজন করে এক্ষুনি আমার সামনে হাজির কর।
কোয়ার্টার মাস্টার বেনু চলে গেল। কিন্তু তার আর দুজন করে হাজির করার প্রয়োজন হল না। এর মধ্যেই আবিষ্কার হয়ে গেল, সামাদের পেট না ভরার রহস্য। বেনু চলে যেতেই
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২১

সামাদ বলল, “স্যার আমারা যেদিন জাহাজ মারি, হেই দিন হাবিব সাহেব, জিয়া, জাহাজের সারেং ও আমি পথম গিয়া জাহাজে উঠলাম। মস্ত জাহাজ। এদিক-হেদিক ঘোরা- ফিরা করতে করতে সুযোগ বুইঝা জাহাজের রান্নাঘরে ঢুইক্কা পড়লাম। দেহি কি,, রান্না করা খাবার পইড়া আছে। আমি সব হাঁড়ির ঢাকনা একটা একটা উচ্চা কইরা দেইখ্যা খালি মাংসের হাঁড়িটা বাইছ্যা নিলাম। মুরগীর মাংস। এমন সুন্দর কইরা রান্না করা। লাল টকটক করতাছে। যেমন স্বোয়াদ, তেমনি গন্ধ। খোশবোতে ঘরটা এবোরে ভইরা গেছে। ধৈর্য্য হারাইয়া ফালাইলাম। জিভে নালা আইস্যা গেল। অন্য কিছু না খাইয়া খালি মাংস খাওয়া শুরু কইরা দিলাম।”
একটু থেমে আবার অবদুস সামাদ বলল, “স্যার, যুদ্ধের মধ্যে আপনের কথা কত হুন্‌ছি, হুইনাই মনটা লাফাইয়া উঠতো। এহানে তো প্রত্যেক দিন আপনারে দেখতাছি। কিন্তু সাহস কইরা একদিনও কথা কই নাই। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। পেটের জ্বালায় আজ না কইয়া থাকবার পারলাম না।” আমি এতক্ষণে বুঝে ফেলেছি কেন সামাদের পেট ভরেনা। কারন ১৫০ জনের জন্য তৈরী মুরগীর মাংস যে অনায়াসে খেয়ে ফেলতে পারে, সে যে কত বড় পেটুক, তা আর আমার বুঝতে অসুবিধা হলনা। আর সেই সময় পাক হানাদারদের জুলুম করে নেয়া গ্রামবাসীদের খাসী মুরগী খাওয়া যারা দেখেছেন, তারাই আন্দাজ করতে পারবেন পাক হানাদার বাহিনী কি পরিমাণ খেতো। যারা দেখেননি তাদের পক্ষে তা কল্পনা করাও কঠিন।
আবদুস সামাদ কিন্তু বলেই চলছে, “আপনি হইলেন আমাগোর বড় স্যার। পেট ভইরা খাইতে দিবেন আর পিঠ ভইরা কাম নিবেন। যে কাম দিবেন জান দিয়া দিমু।” অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
— আচ্ছা ভাই তোমার যে এত খাবারের দরকার, তোমার কি বেশী কাজ করার কোন ক্ষমতা আছে?
— কি নাই স্যার। আপনি অক্ষুনি পাহাড় থাইক্যা লাফাইয়া পড়তে কন আমি পাহাড় খাইক্যা পড়ি।
— ঠিক আছে। তুমি যে এত লাফালাফি করছো, আগুনে ঝাপ দিবা, পাহাড় থেকে লাফ দিবা, কথাগুলো না হয় মানলাম। ঐ দেক, ছোট্ট একটা গাছ। ওটা খালি হাতে ভেঙে আনতে পারবা?
— খুব পারুম। হুকুম দিলেই পারুম।
— হুকুম না দিলে?
— অত জোর আছেনা স্যার।
সামান্য একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘যাও ঐ গাছটি তুলে নিয়ে আস।’ সামাদ পাহাড় কাঁপিয়ে দানবের মত গিয়ে তাজা গজারি গাছটা দুবাহু দিয়ে বুকে চেপে ধরে, ডানে বায়ে দুতিনটা মোচড় দিতেই গাছের শিকড় মড়মড় করে ভেঙে গেল। সে আরও কয়েকটি মোচড় দিয়ে গোড়া ভেঙে গাছটি উঠিয়ে নিয়ে এল এবং আমার সামনে এনে তা দম করে কাঁধ থেকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২২

ফেলে দিল। এক দেড় ফুট মোটা, প্রায় দশ বার ফুট লম্বা গাছটির ওজনও হবে দু আড়াই মন। গাছটি ভাঙতে আরও আড়াই তিন মন শক্তি খরচ করতে হয়েছে।
কাঁধ থেকে গাছটা ফেলেই সামাদ বলল, ‘স্যার, আমিতো দৈনিক বেশী খাবার চাই না, সপ্তাহে মাত্র দুইবার। তাও আবার শুক্রবার কিছুই খাইনা। আমি প্রায় দশ বছর ধইরা শুক্রবারে রোজা থাহি। এরপরও যদি আমারে সপ্তাহে দুইবার পেট পুইরা খাবার দেয়ন না অয়-তাইলে তো আমার শরিল নষ্ট হইয়া যাইবো। তহন তো আমি কোন কামই করতে পারুম না।’
কোয়ার্টার মাস্টার বেনু প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন মুক্তিযোদ্ধা এনে হাজির করল। যে কারণে তাদের ডেকে আনা, সে কারণ জিজ্ঞাসার প্রয়োজন ইতিমধ্যেই ফুরিয়ে গেছে। তবুও অনেককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা তোমাদের খাবার কি কম পড়ে? কোন অসুবিধা হলে অন্যকে বললে কাজ হবেনা, সরাসরি আমাকে বল।’
— খাবার আমাদের কম পড়েনা, তবে পানি খারাপ হওয়ার জন্য আমরা অনেকেই পেটের কষ্ট পাই।
— পেটের কষ্ট দূর হবে। সামাদকে বললাম,
— ঠিক আছে, তোমার ব্যবস্থাও হবে।
— স্যার, আমারে খালি এক টুকরা কাগজ লেইখ্যা দেন। সেদিন সামাদকে এক টুকরা কাগজ লিখে দিয়েছিলাম। কাগজে লেখা ছিল, ‘যাহার জন্য প্রযোজ্য।’ আর মাঝখানে ‘পত্র প্রদর্শককে তার ইচ্ছামত পেট ভরে খাওয়াতে হবে।’ নীচে আমার স্বাক্ষর।
যুদ্ধের পরবর্তী দিন গুলোতে সামাদের কাপড়-চোপড়, বিছানা-পত্র, ঘড়ি, অনেক কিছু খোয়া গেছে কিন্তু সেই এক টুকরো কাগজ কোন ক্রমেই হারায়নি। যখনই অসুবিধায় পড়েছে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তখনই পরম বিশ্বাসে সে অব্যর্থ মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এবং তাতে সঙ্গে সঙ্গে ফল পেয়েছে।
আবদুস সামাদ চলে গেল। কোয়ার্টার মাস্টার বেনুকে বললাম, ‘একে আর আমরা সামাদ বলে ডাকবো না। আজ থেকে একে সামাদ গামা বলে ডাকা হবে।’ পরে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সে সামাদ নামে পরিচিত ছিলনা। ‘গামা’ হিসাবেই সকল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিল। আমি আরো দু-চার বার এই গামাকে নিয়ে আলোচনা করব। কারণ গামাকে বাদ দিয়ে টাঙ্গাইল মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত আলোচনা এগিয়ে নেয়া খুবই কঠিন।
গামা চলে যেতে না যেতেই আর একটা স্মরণীয় ঘটনা ঘটলো। উপলদিয়ার বহুল আলোচিত ফজলুল হক মে মাসের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। তবে আমার সাথে নয়। বেনুর সাথেই বেশী সময় কাটিয়েছে। মাত্র পনের দিন আগে সে ক্যাপ্টেন বেনুর কোম্পানীর সাথে ভারতে এসেছে। এহেতু দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পথে তাকে বেনুর কোম্পানীভূক্তই করা হয়েছিল। কোম্পানীটি পরদিন ১৬ই সেপ্টেম্বর ডালু হয়ে সন্ধ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে। আমি তাঁবুতে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি। ঠিক এমনি সময় ছোট ফজলু আমার সামনে এসে বলল, ‘বজ্র ভাই, আপনার সাথে আমার কথা আছে।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৩

— কি কথা বলনা? ‘আমার কথা আছে’ এটুকু বলেই ফজলু নীরব হয়ে গেল। তিন চার বার তার কথা জানতে চাওয়ার পরও সে আর কিছু বলতে পারলো না। আমি আবার পা বাড়াতে যাব। এমন সময় ফজলু আমাকে জাপটে ধরে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘যুদ্ধের শুরুতে আমি আপনার সাথে ছিলাম। আমি কোন রাজনৈতিক কারণে যুদ্ধে আসিনি। আপনার জন্য যুদ্ধে এসেছি। আমি আপনার সাথে থাকতে চাই।’ কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধার সামনে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ফজলু এই কথাগুলো কোন মতে বলছিল। জুন-জুলাইয়ের পর আমার সাথে কোন মুক্তিযোদ্ধা এই ভাবে কথা বলতে পারেনি বা বলেনি। ফজলুর চোখের পানিতে আমার জামা কাপড় ভিজে যাচ্ছিল। ফজলুকে কাঁদতে দেখে আমারও কান্না পেয়ে গিয়েছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললাম, ‘দেখ, তোকে আমার সাথে রাখায় কোন আপত্তি নেই। আমি দৈনিক চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল হাঁটি। আর শুধু হাঁটা নয়, অন্যান্য কোম্পানীর চাইতে আমার সাথের যোদ্ধাদের অনেক বেশী যুদ্ধ করতে হয়। তোকে আমি স্নেহ করি, ভালবাসি। শহরের একই পাড়ায় আমাদের বাড়ি। উপরন্তু যুদ্ধের শুরুতে তুই যে ভাবে আমাকে তোদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলি, যার জন্য বোধ হয় আমার পক্ষে এতদূর আসা সম্ভব হয়েছে। এই সমস্ত কারণে আমার অন্তরে তোর স্থান দেবতুল্য। কিন্তু ভাই, আমার সাথে থাকলে সকলের সমান পরিশ্রম করতে না পারলে আমি তো তোকে কোন আলাদা সুবিধা দিতে পারব না।’ এ কথা শুনে ফজলু যেন জ্বলে উঠলো, ‘বিশেষ সুবিধা পেতে আমি আপনার সাথে থাকতে চাই না। আমি বেশী সুযোগ না নিয়েই আপনার সাথে থাকতে চাই।’ ফজলু সত্যিকার অর্থেই একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। নানা দিক থেকে বিচার করলে, ওর চরিত্রে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট। ফজলু মে মাসে শিবের পাড়ায় আমার সাথে মিলিত হবার সময় বলেছিল, ‘আমি কিন্তু আপনাকে ভাই ছাড়া কিছু ডাকতে পারব না। সে ডাকেওনি, হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও লাখো জনতা যখন আমাকে স্যার বলে সম্বাধন করতেন, তখনও সে আমাকে “বজ্র ভাই” বলে ডেকেছে। বজ্র আমার ডাকনাম।
ফজলু যখন সকলের মত সমান পরিশ্রম করতে পারবে তখন তাকে আমার দলে নিতে আর আপত্তির কোন কারণ থাকলো না। বেনুকে বললাম, ‘কি করব কমান্ডার। তোমার হিসাবে একজন কমিয়ে আমার হিসাবে একজন বন্ধু বাড়িয়ে দাও।’

প্রথম দলের প্রবেশ
পরদিন ১৬ই সেপ্টেম্বর দুপুর বারোটা। দুটি বাস ও দুটি ট্রাকে বেনুর কোম্পানীর একশ কুড়ি জন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রথম প্রবেশের জন্য যাত্রা করল। তারা বারেঙ্গা পাড়া স্কুলে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল। কথা ছিল, আমি তাদের ডালু পর্যন্ত এগিয়ে দেব। তাই তারা ভারতীয় সীমান্তের এক দেড় মাইল ভিতরে অপেক্ষা করছিল। আমি ডালুতে যাবো শুনে গণপরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ সাথে যেতে চাইলেন৷ আরো একজন সাথী হলেন। ইনি টাংগাইলের শওকত আলী তালুকদার। মাত্র দু’দিন আগে তুরা রওশন আরা ক্যাম্পে এসেছেন। বেলা দুটায় গণপরিষদ সদস্য হুমায়ুন
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৪

খালিদ, শওকত আলী তালুকদার, লোকমান হোসেন, সামসুল হক ও ফজলুকে নিয়ে জীপে উঠলাম। জীপে অতিরিক্ত চাকা না থাকায় কোয়ার্টার মাষ্টারকে চাকা সম্পর্কে বললে কোয়ার্টার মাষ্টার ভদ্রলোক সাদাসিদা ভাবেই বললেন, ‘গাড়ীর চারটি চাকাই নতুন। ট্যাংক ভর্তি তেল আছে। আর রাস্তার সর্বত্রই জীপ ঘোরা ফেরা করছে। যদি কোথাও কোন অসুবিধা হয়, আপনি যে কাউকে বললে সাহায্য পাবেন। আমার মনে হয়না চাকার জন্য আপনাকে অসুবিধায় পড়তে হবে। আমারও অবশ্য এরকম ধারণা হয়েছিল। সত্যিই চাকাগুলো একেবারে আনকোরা নতুন।
জীপ চলতে শুরু করলো। লোকমান ও সামসুর হাতে দু’টি চাইনীজ কারবাইন, ফজলুর হাত খালি। বিকেল সাড়ে চারটায় বারেঙ্গাপাড়া স্কুলে এসে বেনুর কোম্পানীর সাথে মিলিত হলাম। ইতিমধ্যেই তারা সীমান্ত পরিস্থিতির খোঁজখবর নিতে লোক পাঠিয়েছে। ভারতীয় বি. এস. এফ. ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিংও রয়েছেন। বারেঙ্গাপাড়া ক্যাম্প কমাণ্ডার অধ্যক্ষ মতিউর রহমানও উপস্থিত। তারা সবাই সহযোগীতা করছেন। অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ অনেকদিন পর বারেঙ্গা পাড়া এসেছেন। সবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আলাপ করে তিনি খুবই উৎসাহ বোধ করছিলেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সবাই আমাকে বারেঙ্গাপাড়া ত্যাগ করতে অনুরোধ করলেন। বিশেষ করে ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং-এর কৌশল হল, কাদের সিদ্দিকী একটি পরিচিত নাম। তিনি সীমান্তে এসেছেন, এটা গোপন থাকবেনা। তাই সীমান্তের অপর পাড়ে প্রহরা ব্যবস্থা আরো কড়া হবে। তিনি বললেন, ‘যেহেতু আপনার লোকদের ভিতরে যেতে হবে, সেহেতু আপনি এখান থেকে চলে যান।’ আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কোন আপত্তি না করে সহযোদ্ধাদের সবার সাথে কথা বলে তুরার উদ্দেশ্যে মহেন্দ্রগঞ্জের রাস্তা ধরলাম। আমার ধারণা ছিল, বারেঙ্গাপাড়া থেকে মহেন্দ্রগঞ্জ পনের মাইল। মানকাচর আরও পনের মাইল। এবং মানকাচর থেকে তুরা চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল। এই পথ অতিক্রম করতে তিন-চার ঘণ্টার বেশী লাগার কথা নয়।

কর্ণেল তাহেরের শিবিরে
আমার অনুমান সঠিক ছিল না। বারেঙ্গাপাড়া থেকে মহেন্দ্রগঞ্জের দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। দু’ ঘন্টা গাড়ী চালিয়ে মহেন্দ্রগঞ্জ বাজারের মাইল তিন উত্তরে বি. এস. এফ. ক্যাম্পের উত্তরে কর্ণেল আবু তাহেরের শিবিরে গেলাম। কর্ণেল আবু তাহেরের সঙ্গে ভারতে অবস্থান কালে এর আগেও কয়েকবার দেখা হয়েছে। আলাপ আলোচনাও হয়েছে। লোকটিকে আমার বেশ ভাল লেগেছে। কর্ণেল তাহেরের শিবিরে এই প্রথম এলাম। ক্যাম্পে সব মুক্তিযোদ্ধারা খাবার খাচ্ছিলেন। আমরা হাজির হলে কর্ণেল তাহের আমাদের খাবার খেতে অনুরোধ করলেন। শুধু অনুরোধ নয়, জোর করে হাতমুখ ধুইয়ে হাতে খাবারের থালা ধরিয়ে দিলেন। খাবারের পদ অনেক না হলেও অপূর্ব সুস্বাদু রান্না। খাওয়া শেষে তাহের সাহেব তাঁর সহযোদ্ধাদের আমার সাথে মিলিত হতে বললেন। তিনি আমার এমন প্রশংসা করছিলেন, যা শুনে মনে হলো আমাকে তিনি বহু যুগ থেকে জানেন। মুক্তিযোদ্ধারাও আমার সাথে মিলিত ও পরিচিত হতে খুব উদগ্রীব ছিলেন। তারাও ভাই
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৫

ও বন্ধুর যত খোলাখুলি মিশলেন। অনেক কথা, অনেক প্রশ্ন। এখানে একটা ব্যাপার আমাকে আকৃষ্ট করলো। তা হল, দেশের অভ্যন্তরে আমি সহযোদ্ধাদের সাথে যে ভাবে আচার আচরণ করি, কর্ণেল তাহেরও সহযোদ্ধাদের সাথে সেইভাবে আচার আচরণ করেন, মেলামেশা করেন। মুক্তিযুদ্ধের কলাকৌশল নিয়ে বেশ কয়েকবার কর্ণেল তাহেরের সঙ্গে আলোচনা করে যার পর নাই আনন্দিত ও খুশী হয়েছিলাম। শিবিরে এসে তাঁর সহযোদ্ধাদের দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। এই সেনানায়কের দেশের প্রতি ভালবাসা ও স্বাধীনতার জন্য সবকিছু, এমন কি জীবন উৎসর্গ করার একটা তীব্র আকাঙ্খা আমাকে মুগ্ধ করল।
প্রসঙ্গ ক্রমে কর্ণেল আবু তাহের সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা বাঞ্ছনীয়। ১৯৭১ সালের জুনের শেষে আবু তাহের লাহোর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে জুলাই মাসে ভারতে পৌঁছান। ভারতে আসার পর একদিনও কোথাও দেরী করেননি। স্ত্রী- পুত্রদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দিয়ে তিনি সোজা সীমান্তে চলে আসেন। ২রা অথবা ৩রা আগষ্ট তাকে মহেন্দ্রগঞ্জের দায়িত্ব দেয়া হয়। আমার দূত নুরুন্নবী যখন আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতে এসেছিলো, তখন আসা-যাওয়া উভয় সময়েই কর্ণেল তাহের তাকে স্বাগত ও বিদায় জানিয়ে ছিলেন। কর্ণেল তাহের ক্যাপ্টেন মাহমুদ নামে জনৈক সেনানায়কের নেতৃত্বে পঁচিশ-ত্রিশ জনের একটি দল নূরুন্নবীর সাথে দিয়ে বাহাদুরাবাদ ও ফুলছড়ি ঘাট অতিক্রম করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন।
কর্ণেল আবু তাহেরের শিবির ছিল দুটি- একটি ফ্রন্ট লাইন আরেকটি রিয়ার লাইন। আমরা কিন্তু এদিন ফ্রন্ট লাইনে যাইনি, রিয়ার লাইনেই গিয়েছিলাম। বলতে গেলে ইনিই অন্যতম সামরিক অফিসার, যিনি সহযোদ্ধাদের সাথে শিবিরে থাকতেন, তাদের সাথে একত্রে খেতেন। এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সহযোদ্ধাদের পাশাপাশি লড়াই করতেন।
দায়িত্ব পাবার পর কর্ণেল তাহের শতকরা পঁচাত্তর দিন ফ্রন্ট লাইনেই রাত কাটিয়েছেন। তার যুদ্ধক্ষেত্র ছিল মহেন্দ্রগঞ্জের কামালপুর। কামালপুর পাক হানাদার বাহিনীর এক দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসাবে পরিচিত ছিল। নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখে কামালপুর হানাদার ক্যাম্পের দখল নিতে কর্ণেল তাহের ও তার দল মরিয়া হয়ে লড়াই চালায়, পাক হানাদারদের প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি হয়। জামালপুর ক্যাম্প শেরপুর হেডকোয়ার্টার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক সপ্তাহের বিরামহীন যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও প্রায় তিনশ’ হানাদার খতম করেন এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র তাদের হস্তগত হয়। ক্যাম্পের পতন যখন অত্যাসন্ন ঠিক এমনি সময় হানাদারদের একটি ২ ইঞ্চি মর্টার শেল কর্ণেল তাহেরের পায়ে সরাসরি আঘাত করে তার ডান পায়ের হাঁটুর নীচের অংশটাই উড়িয়ে নিয়ে যায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ অবস্থাতেই তিনি সহযোদ্ধাদের এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিতে থাকেন। কয়েকজন যোদ্ধা তাদের প্রিয় নেতাকে ধরাধরি করে দ্রুত নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। কর্ণেলকে সাথে সাথে শিলং সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। শিলং সামরিক হাসপাতালে তাঁর পা কেটে বাদ দেয়া হয়। আবু তাহেরের
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৬

অনুপস্থিতিতে কামালপুর যুদ্ধের গতি হানাদারদের অনুকূলে চলে যায়। পতন প্রায় কামালপুর কিছু সময়ের জন্য রক্ষা পেয়ে যায়।
৬ই ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারত তার সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশে প্রবেশের নির্দেশ প্রদান করেন। এরপরেই ভারতীয় সেনাবাহিনী কামালপুরের পিছনে বকসীগঞ্জ, শ্রীবর্দি ও শেরপুর টাউন দখল করে নেন। তারা ৮ই ডিসেম্বর সকালে জামালপুরের ব্রহ্মপুত্রের উত্তর তীরে পৌঁছে যান। এতদসত্ত্বেও কিন্তু কামালপুর ঘাঁটির পতন হয়নি।
মস্তবড় একটি নদীর মধ্যে ছোট বালুচরের মত কামালপুর ছাউনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ ও আক্রান্ত অবস্থায় ৮ই ডিসেম্বর রাতে কামালপুর ঘাঁটির পতন ঘটেছিল।
মেজর আবু তাহেরের মহেন্দ্রগঞ্জ রিয়ার ক্যাম্পের সকলের সাথে মেলামেশা ও আলাপ আলোচনা করে অত্যন্ত আনন্দিত ও উৎফুল্ল চিত্তে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আবু তাহের সাহেব সহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা আমাদেরকে জীপ পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। জীপের কাছে এসে তাহের সাহেব বললেন, ‘আপনার জীপে অতিরিক্ত তেল আছে কি? আমি বললাম’কেন?’
— কারণ আপনি তুরা থেকে ডালু হয়ে এসেছেন। রাতে বর্ডার রোড ধরে যাওয়া ঠিক হবে না। আপনাকে হিলের মাঝ দিয়ে আমপাতি হয়ে গারো বাধার কাছে তুরা সড়ক ধরতে হবে। তাতে রাস্তার দূরত্ব বেশ কিছুটা বেড়ে যাবে। মাঝ রাস্তায় তেল ফুরিয়ে গেলে কোথায় পাবেন? আপনি এক জারিকেন তেল নিয়ে যান। আমি আপত্তি করে বললাম, ‘না, পুরো ট্যাংক তেল নিয়েই আমি তুরা থেকে বেরিয়েছি। তুরা ফেরার পর কমপক্ষে ২ গ্যালন তেল উদ্বৃত্ত থাকা উচিত।’ অভিজ্ঞ তাহের সাহেব আমার কথায় কোন কর্ণপাত না করে এক জারিকেন তেল জীপের ট্যাংকে ঢেলে দিলেন। এক জারিকেন তেল মানে চার গ্যালন অর্থাৎ কুড়ি লিটার। জীপের ট্যাংকে পুরো চার গ্যালন তেল ধরায় আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। সমান রাস্তায় চার গ্যালন তেলে কম করেও আশি মাইল চলা উচিত। কিন্তু আমি বড় জোর পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন মাইল রাস্তা গাড়ী চালিয়েছি। এত বেশী তেল লাগার কারণ কিছুই বুঝতে পারলাম না। হয়ত গাড়ী বেশী তেল খাচ্ছে, এ ধরনের সন্দেহ নিয়ে মেজর তাহেরের সাথে কোলাকুলি করে বিদায় নিলাম।
রাতে বর্ডার রোড ধরে চলা যাবে না। অগত্যা পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া আমপাতির খোয়া বিছানো সড়ক ধরতে হল। গাড়ী চলছে তো চলছেই। এই রাস্তায় প্রথমবার যাচ্ছি। রাস্তা ভালো করে চিনি না, তবে পথ ভুল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ উত্তর দক্ষিণে রাস্তা মাত্র একটিই। ডাইনে কিংবা বায়ে কোন রাস্তা বেঁকে যায়নি বা কোন রাস্তা এসেও মিশেনি। কিন্তু ঝাড়া দেড় ঘণ্টা গাড়ী চালানোর পরও তুরা মানকাচরের রাস্তার নাম নিশানা নেই, তাই রাস্তা ভুল হলো কিনা, এমন একটা ধারণা সবার মনে দোলা খেতে লাগলো। রাতে আমপাতির
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৭

রাস্তার আশে পাশে খুব একটা লোকজন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। গাড়ীর গতি কমছে না। দেখা যাক, হযতো সামনেই প্রার্থিত তুরা-মানকাচর সড়ক এমন আশা নিয়ে গাড়ী চালাচ্ছি। মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে গাড়ী ছাড়ার প্রায় দু ঘন্টা পর সামনে একটা ছোট্ট বাজার দেখা গেল। মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে আমপাতির রাস্তা ধরে আসার পথে একটাই বড় লোকালয় ও একমাত্র বাজার। তখনও বাজারে দুই চারজন লোক চলাফেরা করছিল। রাত প্রায় দশটায় একজন লোকের কাছে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, গারোবাধার পাকা সড়ক আরো বাহান্ন কিলোমিটার দূরে। কথাটা শুনে একেবারে অধৈর্য্য হয়ে পড়লাম। বোলতার বিছানো আঁকাবাকা পাহাড়ী রাস্তায় ঘন্টায় কুড়ি-পঁচিশ কিলো- মিটারের বেশী কিছুতেই পাড়ি দেয়া যাচ্ছে না। অর্থ দাড়াল চার ঘন্টা গাড়ী চালাতে পারলে তবেই তুরা ক্যাম্পে পৌঁছানো সম্ভব। আমার গাড়ী চালাতেও আর ভালো লাগছিল না। অথচ জীপে এমন আর একজনও নেই যে, গাড়ী চালাতে পারে। কয়েক মিনিট আগে একটি বাঘ আমাদের সামনে দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করছে। এই চুরাশি কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রমের সময় দু-তিন জায়গায় দু-তিনটি জংলী হাতি দেখেছি। হাতি সম্পর্কে আমাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে সাধারণ ধারণা ছিল, দলছাড়া একটি হাতি হলে সেটি মারাত্মক ও ভয়ংকর হবে। পথের মাঝে দল ছুট একটি করে হাতি দুইবার দেখেছি। যদিও হাতি দেখা জায়গাগুলো পিছনে ফেলে এসেছি। তবুও শংকা আর ভীতি থেকে মুক্ত হতে পারছিলাম না। এমন একটি পরিবেশে ঘড়ির কাটা যখন রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই করছে এবং কয়েক মাইল আগে পিছে, আশে-পাশে কোন মানুষ তো দূরের কথা জন বসতিও নেই। তখন সশব্দে গাড়ীর চাকা ফেটে গেল। পাহাড়ী জংগলাকীর্ণ রাস্তায় চলাফেরায় অনভিজ্ঞ যাত্রীদের অবস্থা কি হতে পারে তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন ভাবান্তর লক্ষ্য করা না গেলেও, গণপরিষদ সদস্য হুমায়ুন খালিদ ও শওকত আলী তালুকদার একেবারে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। অজানা আশংকায় তাদের মুখ বিবর্ণ, ফ্যাকাশে হয়ে গেল। পিছনের চাকা ফাটলেও কোন রকমে হয়তো হাঁটার গতিতে গাড়ী চালিয়ে নেয়া যাবে, তবে সেক্ষেত্রে ফেটে যাওয়া চাকাটি কোন কাজে আসবে না। চাকা ফেটে যাওয়ার পর গাড়ী থেকে সবাইকে নামিয়ে দেওয়া হল। সবাই আগে আগে হেঁটে চলেছে। আমি পিছনে কচ্ছপের গতিতে গাড়ী চালাচ্ছি। হাওয়া ছাড়া জীপের চাকা লাগাতার ঠক্‌ঠক, ঘচাং, ব্যাং, বিশ্রী শব্দ তুলেছে। আর গাড়ীখানা খোঁড়া গরু কিংবা ঘোড়ার মত অনবরত কুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। পাঁচ-সাত মিনিট হাটার পর গণ পরিষদ সদস্য হুমায়ুন খালিদ বললেন, ‘বাবা, আমার ভয়ও করছে, তার উপর বুড়ো মানুষ। আমি হেঁটে যেতে পারবো না।’ হুমায়ুন সত্যিই একটু বয়সী, তবে শওকত আলী তালুকদার ত্রিশ-বত্রিশ বৎসরের সুস্বাস্থ্যের সমর্থ যুবক। অথচ তারও একই কথা। তিনিও হেঁটে যেতে পারবেন না। হাঁটার কষ্টের চেয়ে, পাহাড়ী জংলী রাস্তায় গভীর রাতে হাতির ভয়ই তাঁর বেশী। অগতা আর কি করা। তাঁকেও গাড়ীতে তোলা হল৷ ষোল-সতের বছরের দুই তরুণ সামসু ও ফজলু এবং পঁচিশ-ত্রিশ বৎসরের মেজর লোকমান হোসেন হেঁটে চলল। তবে এবার গাড়ীর সামনে নয়, পিছনে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৮

খোঁড়া ঘোড়া চালানোর মত চাকা ফেটে যাওয়ায় গাড়ী চালিয়ে দেড় ঘন্টা পর দলবলসহ রাত একটা চল্লিশ মিনিটে তুরা-মানকাচর পাকা সড়কে পৌঁছে হাঁফ ছেড়ে বাচলাম। গারো বাধার মোড় থেকে কর্ণেল জিয়ার তেলঢালা ক্যাম্পের দূরত্ব মাত্র তিন-চার কিলোমিটার। সাব্যস্ত হল, আমি একজন সাথী নিয়ে পায়ে হেঁটে জিয়া সাহেবের ক্যাম্পে যাব। সম্ভব হলে একটি গাড়ী অথবা একখানা চাকা নিয়ে আসব। হুমায়ুন খালিদ এবারও আপত্তি তুললেন, ‘বাবা কাদের, তুমি চলে গেলে আমি এখানে থাকতে সাহস পাই না।’ অর্থাৎ এবারও তিনি সাথে যাবেন। অথচ তিনি যে আমার সাথে হেঁটে যেতে পারবেন না, তা দলের অন্যরা যেমন জানে, হুমায়ুন খালিদ সাহেব নিজেও তেমনি জানতেন।
গারো বাধার মোড়ে দুইটি বিশাল ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল। ট্রাকের পাশেই দু-তিন খানা চায়ের দোকান। মোড়ে পৌঁছেই চায়ের দোকানদারকে ডেকে তোলা হয়েছিল। তাই সেখানে ভয় বা নিরাপত্তার অভাব ছিল না। তবুও কেন যেন হুমায়ুন খালিদ আমাকে ছাড়তে চাইছিলেন না। কথাবার্তা চলছে, এমনি সময় তুরার দিকে একটি গাড়ীর শব্দ পাওয়া গেল। এ রাস্তা ধরে মানকাচরের দিকে গাড়ীটি যাবে। হাত দেখাতে ট্রাকটি থামল। গাড়ীটি ভারতের নয়, বাংলাদেশের। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করব তার আগেই ট্রাকের উপর থেকে তিন-চার জন একসাথে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই, আপনারা কোথায় যাবেন?’
— বেশীদুর যাব না। সামনেই, তেলঢালাতে যাবো। আপনারা ঐ দিক দিয়েই যাবেন, তাই হাত উঠিয়েছি। আমাদের দুইজনকে নিয়ে গেলে বড় উপকার হয়। আমাদের জীপের চাকা ফেটে গেছে।’ ট্রাকের উপর থেকে দু-তিন জন লাফিয়ে পড়ে বললো, ‘আমরাও তো তেলঢালা ক্যাম্পে যাব। চলুন আমাদের সঙ্গে।’ গণপরিষদ সদস্য হুমায়ুন খালিদ ড্রাইভারের পাশে উঠে বসলেন। আমাকে ভিতরে যেতে অনুরোধ করা হলো কিন্তু আমি গাড়ীর বাইরের পাদানীতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মাত্র তিন-চার কিলোমিটার পথ। ফাঁকা রাস্তা। সময় লাগলো তিন-চার মিনিট। গাড়ীখানা একেবারে ক্যাম্পের ভিতরে ঢুকে গেল। তবে কর্ণেল জিয়া যেখানে থাকেন সেখানে নয়।
একটু দূরে উল্টো পাশে আমি ও হুমায়ুন খালিদ গাড়ী থেকে নেমে প্রায় দুশ গজের মত হেঁটে কর্ণেল জিয়া ও অন্যান্য অফিসাররা যেখানে তাঁবুতে থাকেন সেখানে গেলাম। কাছাকাছি যেতেই পাহারারত সৈনিক প্রচণ্ড জোরে চ্যালেঞ্জ জানাল, পরিচয় দিয়ে সৈনিককে বললাম, ‘আপনার ডিউটি কমাণ্ডারকে ডেকে দিন, আমি অলি আহামদ অথবা জিয়া সাহেবের সাথে কথা বলতে চাই।’ পাহারারত সৈনিকটি খুব সম্ভবত আমাকে চিনতেন। নাম যে জানতেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সৈনিকটি তার ডিউটি কমাণ্ডারকে ডাকার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই ‘জেড’ ফোর্সের কোয়ার্টার মাষ্টার বন্ধুত্বের জ্বলন্ত প্রতীক অলি আহমেদ তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে? মনে হলো কাদের ভাই?’ সৈনিক বললেন, ‘হ্যা, স্যার, কাদের সাহেবই এসেছেন।’ ইতিমধ্যে আমি এবং হুমায়ুন খালিদ তাঁবুর কাছাকাছি এগিয়ে গিয়েছিলাম। ক্যাপ্টেন
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৯

অলি আহমেদ তাড়াতাড়ি আমাদের সামনে এসে অবাক করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ভাই এত রাতে? কি ব্যাপার?’ আমি সমস্ত বৃত্তান্ত জানিয়ে বললাম, ‘আমাকে একটা উইলি জীপের চাকা দিন, তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।’ ক্যাপ্টেন অলি সব শুনে বললেন, ‘বুঝতে পারছি, আপনাদের উপর দিয়ে কি ধকল গেছে। গাড়ীর চাকার কোন দরকার নেই। আমাদের কমাণ্ডারের গাড়ী সব সময়ের মত আজও কোথাও যাবার জন্য তৈরী আছে, আপনি যদি এখনই তুরা যেতে চান তবে কমাণ্ডারের গাড়ী নিয়ে যান (কমাণ্ডার যানে কর্ণেল জিয়াউর রহমানের গাড়ী)। আমি সকালেই আপনার জীপ তুরাতে পাঠিয়ে দেবো।’ কথাবার্তার সময় হয়তো কর্ণেল জিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। তিনিও তাঁবু থেকে বেরিয়ে রাত দুটায় আমাকে দেখে ক্যাপ্টেন অলির মত অবাক হয়ে গেলেন। অত্যন্ত সহানুভূতির সাথে জানতে চাইলেন, ‘কাদের ভাই, এত রাতে কেন?’ জিয়া সাহেবকে আমাকে আর কিছুই বলতে হলো না। ক্যাপ্টেন অলি আহমেদই টেপ রেকর্ডারের মত আমার রাতের বিড়ম্বনা হুবহু তুলে ধরলেন। এরই মধ্যে কর্ণেল জিয়ার ব্যবহারের “টয়োটা জীপ” আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। জিয়া সাহেব বারবার অনুরোধ করলেন, ‘রাত বেশী নেই, আপনি এখানে থেকে যান। মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর জিয়াউদ্দিনের তাঁবু ও বিছানা খালি পড়ে আছে, থাকার কোন অসুবিধা হবে না।’
— না ভাই, আমাকে যেতেই হবে তবে কাল বিকেলে একবার আসবো। জিয়া সাহেবের, টয়োটা জীপে আমরা উঠে বসলাম।
উইলি জীপের চাইতে টয়োটা জীপে অনেক বেশী আরাম, সারারাতের কষ্টের পর আমরা খুবই আরাম বোধ করছিলাম। লেংড়া গাড়ী দেড় ঘন্টা চালিয়ে আমার হাত-পা ব্যাথায় টনটন করছিল। জীপের সীটে বসে হাত পা ছড়িয়ে দিতেই সারা শরীরে একটা স্বস্তির ভাব বয়ে গেল। জিয়া সাহেবের গাড়ীর চালক অত্যন্ত ভালো গাড়ী চালাচ্ছিলেন। আমরা গারো বাধার মোড়ে এসে বাকী সাথীদের গাড়ীতে উঠিয়ে নিলাম। গারো বাধা মোড়ে অপেক্ষমান সাথীরা ভাবতেই পারেনি চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যেই আমি গাড়ী সহ ফিরে আসতে পারবো। রাত তিনটায় আমরা ক্যাম্পের তাঁবুতে প্রবেশ করলাম। ড্রাইভারকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি তুরাতে রাত কাটালেন না, তেলঢালা ক্যাম্পে ফিরে গেলেন।

পর্যায়ক্রমে প্রবেশ
১৬ই সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন বেনু দেশের অভ্যন্তরে ঢোকার পর আরো দুই দলের যাবার পালা। একদলের কমাণ্ডার মেজর লোকমান হোসেন এবং অন্যদলের মেজর মনিরুল ইসলাম। স্থির হলো, এই দুই দলই মানকাচর থেকে নদী পথে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে, মেজর লোকমান ও মেজর মনিরকে চারবাড়ী-পোড়াবাড়ীর ঘাট থেকে দক্ষিণে ঢাকার মানিকগঞ্জের ঘিওর, সাটুরিয়া, দৌলতপুর ও টাঙ্গাইলের নাগরপুর এবং মীর্জাপুর থানার কিছু অংশে অপারেশন চালানো এবং প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়া হলো। সাতশ’ মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত দুইটি দল ১৭ই সেপ্টেম্বর দুপুরে মেজর
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩০

লোকমান ও মেজর মনিরের নেতৃত্বে তুরার রওশন আরা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়ল।
১৬ তারিখের মত ১৭ তারিখেও সহযোদ্ধাদের মানকাচরে পৌঁছে দিলাম। আগের দিনের মত মানকাচরে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করলাম না। আমি যখন মানকাচরে তখন দেশের অভ্যন্তর থেকে সহযোদ্ধা আরিফ আহমেদ দুলাল এবং ক্যাপ্টেন বেনুর ছোট ভাই মিনু মানকাচরে এসে উপস্থিত হয়। দুলাল এবং মিনুকে দিন দশেক আগে গণ পরিষদ সদস্য হুমায়ুন খালিদের পরিবার ও সন্তান-সন্তুতির খোঁজ-খবর সংগ্রহ করতে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়েছিল। ভারতে আসার পর থেকে পরিবার পরিজনের জন্যে হুমায়ুন খালিদের ব্যাকুলতা এবং সবসময় তাঁর দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছিল। দুলাল ও মিনু হুয়ায়ুন খালিদ সাহেবের পরিবারিক সমস্ত খবর পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সংগ্রহ করে ফিরে এসেছে। তাদের দুজনকেই তুরা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তুরা ফেরার পথে কর্নেল জিয়ার তেলঢালা ক্যাম্পে গেলাম, ছোট খাটো ষোল-সতের বছরের তরুণ সহযোদ্ধা সামসু আমার সাথে ছিল।

জিয়ার সাথে শেষ সাক্ষাৎ
ভারতের মাটিতে শেষেবারের মত তেলঢালা ক্যাম্পে আমরা মিলিত হলাম। অনেক আলাপ আলোচনা হলো। ভারতে অবস্থানের সময় কর্নেল জিয়ার সাথে গড়ে উঠা সুন্দর সম্পর্ক ও মধুর স্মৃতি গুলোর কথা পুনঃ পুনঃ উল্লেখ করলাম। বিশেষ করে আমার সহযোদ্ধাদের প্রতি তার আন্তরিক ভালবাসা ও সম্মানবোধ এবং নানাভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য জিয়া সাহেবকে পরম কৃতজ্ঞতা ও অসংখ্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম। কথাবার্তা শেষে উঠতে যাবো, এমনি সময়ে কর্নেল জিয়াকে বললাম,
— জিয়াভাই, আমি যতবার আপনার এই অফিসার মেসে এসেছি ততবারই ঐকোণে দাঁড়িয়ে থাকা তিনি ইঞ্চি চাইনিজ মার্টরটি দেখতে পাচ্ছি। এটা কেন? এটা কি তাঁবুর শোভা বাড়ানোর জন্য? না হাতিয়ারটি বিকল হয়ে গেছে।
— না ভাই এটা শোভা বর্ধনের জন্য এখানে রাখা হয় নাই। বিকলও হয়নি। সত্য কথা কি জানেন? আমাদের কাছে এই মর্টারের যত গোলা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। মর্টারটির গোলা এখানেও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বলতে গেলে দেড়মাস যাবত এটা অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
— এই মর্টারের অসংখ্য গোলা আমাদের কাছে আছে। মর্টারটি বেশ হালকা। অভ্যন্তরে বহন করার জন্য খুবই উপযোগী। স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে না হয় এটা আমাকে দিন।
— কাদের ভাই, আমি আপনাকে সব দিতে পারি কিন্তু জানেনই তো সামরিক নিয়ম কানুন। অস্ত্র হস্তান্তরের এক্তিয়ার আমার নেই।
— তাহলে ওটা হারিয়ে গেছে এমন একটা রিপোর্ট দিয়ে দিন।
— সে উপায়ও নেই। একমাস আগে এই মর্টার সম্পর্কে জেনারেল হেডকোয়াটার মানে সি-ইন-সি এম.এ.জি ওসমানীর কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে। এখন হারিয়ে গেছে, বলার সুযোগ নেই। তবে সত্যি যদি মর্টারটি আপনার কাজে আসে, তাহলে জোর করে নিয়ে যেতে পারেন। আমি
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩১

আপনাকে স্বেচ্ছায় অথবা হাতে তুলে দিতে পারি না।
— জোর করে নিতেই বা আমার আপত্তি কোথায়?
— তাহলে নিয়ে যান। তবে আপনাকেই মর্টারটি গাড়িতে উঠাতে হবে, জেনারেল হেড-কোয়ার্টারে রিপোর্ট করে দেব, আপনি জোর করে এটি নিয়ে গেছেন। সেক্ষেত্রে কিন্তু আমাকে ভুল বুঝতে পারবেন না জেনারেল হেড কোয়ার্টার থেকে যদি কৈফিয়তত তলব করা হয় যে জোর করে নিয়ে গেল অথচ তোমারা বাধা দিলে না কেন? তখন অবশ্যই লিখব, ‘কাদের সিদ্দিকীর মত সম্মানিত একজন যোদ্ধা নিজের হাতে উঠিয়ে কোন জিনিস নিয়ে গেলে তা বল প্রয়োগ করে রেখে দেয়া ভদ্রোচিত আচরন হতো না বলে বাধা দেয়া হয়নি।’ এরপর আর কোন কথা থাকে না। উঠবার সময় মর্টারের ব্যারেলটি সামসুর হাতে তুলে নিজে বাইপার্ট এবং বেস প্লেট নিয়ে গাড়ীর দিকে এগুলাম। কর্নেল জিয়া, মেজর আবু তাহের, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, ক্যাপ্টেন খালেক ও আরো দু’তিন জন অফিসার জীপ পর্যন্ত এসে বিদায় জানালেন। কর্নেল জিয়া এরপরও দুই-তিন বার বললেন, ‘কাদের ভাই মর্টারটি নেবেন না, রেখে যান। আমার অসুবিধা হবে।’ আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘অসুবিধা হলে জোর করে রেখে দিন ইচ্ছা করে আমি রেখে যেতে পারিনা। কর্নেল জিয়াও হালকা সুরে বললেন, ‘না ভাই, আপনার হাত থেকে ওটি জোর করে রাখতে পারব না। তবে ওটা রেখে গেলে ভাল হতো। ‘ কথার ফাঁকেই মর্টারের দুটো অংশ গাড়ীতে স্বযত্নে রেখে কর্নেল জিয়া সহ সবাইর সাথে শেষবারের মত কোলাকুলি করে টয়োটা জীপে উঠে বসলাম।
তিন কোম্পানীতে বিভক্ত হয়ে সাড়ে আটশত মুক্তিযোদ্ধা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে৷ আরো দুইটি কোম্পানী ডালু সীমান্ত হয়ে দেশের অভ্যন্ত্যন্তরে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। এই দুই কোম্পানীর নেতৃত্বে রয়েছে কমান্ডার আঙ্গুর ও নলিনের আরজু। তিনশ’ জনের আর একটি কোম্পানী ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে এবং যে কোন মুহুর্তে রওয়ানার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ক্যাপ্টন হুমায়ুন তার দল নিয়ে মানকাচর থেকে নদীপথে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে। আমি ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের কোম্পানীর আগে অথবা পর পরই দেশের অভ্যরে প্রবেশ করব।
আমার পিছনে থাকবে অভিজ্ঞ কমান্ডার মেজর আবদুল হাকিম। সে আমার প্রবেশের দু’তিন দিনের মধ্যে ক্যাম্পের বাকী দলগুলোকে ঠিক মত পাঠিয়ে নিজেও দেশের ভিতরে ঢুকে পড়বে।

দুই ভাইয়ের শেষ আলোচনা
১৯ শে সেপ্টেম্বর। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সাথে কিছুক্ষণের জন্য আলাপ আলোচনায় বসলাম। তুরাতে দেখা হওয়ার পর প্রায় প্রতি দিনই আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনা হয়েছে। তবে এ দিনের আলোচনা শুধু পারিবারিক সমস্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাবা ও ছোট দু’ভাইয়ের ব্যবস্থা নিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা। দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পরিকল্পনায়
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩২

বড়ভাই প্রথম সামান্য একটু আপত্তি তুলে ছিলেন। যখন আমি পুরো অবস্থাটা তাকে বুঝিয়ে বললাম, তখন থেকে অর্থাৎ ১২ই সেপ্টেম্বর থেকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ পর্যন্ত বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকী আমাকে সর্বোতভাবে সাহায্য, পরামর্শও উৎসাহ জুগিয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশে লতিফ ভাইর আপত্তির প্রধান কারণ ছিল-ভিতরের অবস্থা আমার নিরাপত্তার জন্য কতখানি অনুকূল তা তিনি প্রথম অবস্থায় বুঝে উঠতে পারেননি। পাঁচ মাস ভারতে অবস্থানে তাঁর মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক যে, যখন শত শত, হাজারে হাজারে নেতৃস্থানীয়েরা নিরাপদে ভারতে অবস্থান করছেন, তখন আমার পক্ষে একা অতটা ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে কি না? ভারতে আসার পর এমন একটা মানসিকতা আমাকেও কয়েকটা দিনের জন্য আচ্ছন্ন করেছিল এবং অন্যান্য সেনানায়কদের মতই ভারতে অবস্থান করে যুদ্ধ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম। আগষ্ট পর্যন্ত নানা যুদ্ধে সফল হয়ে অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা জুড়ে শত্রু ও মিত্র সকলের সাথেই একই ধরনের আচরণ করেছি। লোভ-লালসা, আরাম-আয়েশ ও অকারন হিংসা-বিদ্বেষ কোন মতেই আমাকে গ্রাস করতে পারেনি। কিন্তু ভারতে থাকাকালীন নিশ্চিত নিরাপত্তা, সুস্থ-সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্যে খোঁজার প্রবণতা মুহুর্তের জন্য হলেও আমাকে স্পর্শ করেছিল। ভারতে থাকার কথা আমি একসময় চিন্তা করেছিলাম শুধু এই দেখে যে, ভারতের মাটির ছত্র ছায়ায় যারা যুদ্ধ করছেন, তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা, সুযোগ- সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা অনেক বেশী। দিন কুড়ি গাড়ীতে চড়ে চড়ে আমিও পায়ে হেঁটে চলায় কষ্ট বোধ করছিলাম। শত্রু মুক্ত এলাকায় কয়েকটা দিন বাস করে সম্পূর্ণ শত্রু বেষ্টিত এলাকা সম্পর্কে একটু ভাবতে বসেছিলাম। দেলোয়ারের সাথে মানকাচরে দেখা না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতো তা জোর দিয়ে বলতে পারি না।

সান সিংয়ের সাথে চূড়ান্ত আলোচনা
১৯শে সেপ্টেম্বরের রাত। ব্রিগেডিয়ার সান সিং এর সাথে পরবর্তী যুদ্ধ পরিকল্পনা ও কলা-কৌশল নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে শেষবারের মত আলোচনা করলাম। শত্রুকে চরম আঘাত হানার একটি খসড়া পরিকল্পনার উপর আমাদের আলোচনা হলো। দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর ভারত আমার সাথে কিভাবে যোগাযোগ রাখবে এবং আমিই বা কিভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ করব। ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ ব্যবস্থা কিভাবে অব্যাহত রাখা হবে, আমাদের কি কি ধরনের সরবরাহ প্রয়োজন হতে পারে তার উপর পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। আমার পক্ষ থেকে সরবরাহের জন্য কে বা কারা আসবেন এবং তাদের সাংকেতিক চিহ্ন কি হবে। আবু মোহাম্মাদ এনায়েত করিম আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে মানকাচরে অবস্থান করবেন। তার রক্ষণাবেক্ষণ ও চাহিদা পুরণের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

বিদায় তুরা
২০শে সেপ্টেম্বর সকালে ব্রিগেডিয়ার সানসিং, কর্নেল প্রীতম সিং, ব্রিগেড মেজর মুখার্জী, কোয়ার্টার মাষ্টার ও অন্যান্য ভারতীয় সামরিক অফিসারের সাথে বিদায় সাক্ষাৎ
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৩

করলাম৷ হুমায়ুন খালিদ, ফজলুর রহমান খান ফারুক, হাতেম আলী তালুকদার ও অন্যান্য গণ- পরিষদ সদস্যদের সাথে দুই দিন আগে বিদায়ী সাক্ষাৎ সেরে নিয়েছিলাম। আমি কখন এবং কোন পথে দেশে প্রবেশ করবো, তা গোপন রাখার জন্য ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের সাথে বিদায়ী সাক্ষাৎ সেরে নেই। ভারতীয় সামরিক অফিসারদের সাথে বিদায়ী সাক্ষাৎ শেষ করে বাবা, বড়ভাই, ও ছোট দু’ভাইয়ের সংগে ভারতের মাটিতে বারের মত আলাপ আলোচনা ও আলিঙ্গন শেষে সহযোদ্ধাদের দিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাবা ও ভাইয়েরাও জানে না কখন এবং কোন পথে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবো। তবে তারা এইটুকু জানতো যে ২৩ দিনের মধ্যেই আমি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করব।
২০শে সেপ্টেম্বর, সূর্য অস্তাচলের পথে। পশ্চিম দিগন্তু লাল হয়ে এসেছে। দিনের শেষ আলোটুকু বিলিয়ে দিগন্তের অপর পারে কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য দেবতা মুখ লুকোবে। পড়ন্ত বিকেলের রোদ এসে পড়েছে এক দল মুক্তিযোদ্ধার মুখে। তারা পিছেনে ফেলে যাচ্ছে সাতাশ আটাশ দিনের মধুর স্মৃতি। ভারত ত্যাগের শেষ ক্ষণটি উপস্থিত। আবার শুরু হবে ঘাত- প্রতিঘাত। মৃত্যুর সাথে প্রতি মুহুর্ত পাঞ্জা লড়া। মাইলের পর মাইল পায়ে হাঁটা। হানাদার বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পালা। ভারতের প্রান্ত সীমায় এসে একবার পিছু ফিরে তাকালাম। আমার চোখ দিয়ে দর দর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মহান ভারত তোমাকে সালাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৪

স্বদেশে সূর্যোদয়

আমার মন জুড়ে আলোড়ন তুলছে মহান ভারতে কয়েকটা দিনের স্মৃতি। আস্তে আস্তে আমাদের দৃষ্টি-সীমা থেকে আসাম মেঘালয়ের পাহাড়গুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। আর ফিকে হয়ে আসা দৃষ্টি-সীমায় মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে, জল্লাদ হানাদারদের ঘৃণিত মুখ। আমাদের সত্তর জনকে নিয়ে দুটি নৌকা ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ তুলে এগিয়ে চলেছে ব্রহ্মপুত্রের বুক চিরে। সত্তর জনের মধ্যে ভারতে আসার সময়ের দলটি তো ছিলই, উপরন্তু বিখ্যাত সামাদ গামার নেতৃত্বে দশ জনের একটি ‘মর্টার সেকশন’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এছাড়া নাগরপুর, মানিকগঞ্জ ও বরিশালের তের জন সদস্যকে দলভুক্ত করেছি। তিনটি বেতার যন্ত্রসহ আরো বারো জনের একটি ‘সিগন্যাল সেকশন’ গড়া হয়েছে।
রওনার সময় মেজর হাকিম কুড়ি-পঁচিশ টাকার একখানা সুন্দর চাদর কিনে দিয়েছিল। কমান্ডার হাকিমের জানা ছিল, আমি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই গাছের নীচে শুয়ে বিশ্রাম নিতাম। চাদরটি মাটিতে বিছিয়ে শোবার জন্য সত্যিই উপযোগী ছিল। পরবর্তীতে বেশ ভাল কাজ দিয়েছে।
আমাদের নৌকা দু’টি দক্ষিণে স্রোতের অনুকূলে ভেসে চলেছে। কিছু দূর এগিয়ে দেয়ার জন্য বিশ্বস্ত দুই সহযোগী মোয়াজ্জেম হোসেন খান এবং নুরুল ইসলাম সাথে এসেছেন। দুই জনেই নদী-পথটি খুব ভাল চিনেন। মোয়াজ্জেম হোসেন খান এবং নুরুল ইসলাম বাহাদুরাবাদ ঘাটের উত্তরে ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা-যমুনা যেখানে একত্রিত হয়েছে সে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ভারতে ফিরে যাবেন।
২৩শে আগস্টের শেষ রাতে আমরা ভারতে প্রবেশ করেছিলাম। এবং ২০শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আবার দেশের অভ্যন্তরে ফিরে এলাম। ২৩শে আগস্ট থেকে ২০শে সেপ্টেম্বর, এই সময়ের অনেকগুলো ঘটনার কথা বলেছি, তবুও কিছু ছোটখাটো ঘটনা বাদ পড়ে গেছে। ব্রিগেডিয়ার সান সিং নিজে আমাদের ডালুর সীমান্ত থেকে তুবার রওশন আরা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিলেন। রওশন আরা ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর তিনদিন পর্যন্ত আমার অবস্থান গোপন রাখা হয়েছিল। রওশন আরা ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর ব্যবহারের জন্য দুটি জীপ আমাকে দেয়া হয়েছিল। যার একটি আমেরিকান উইলি অন্যটি জাপানী টয়োটা। দুটি জীপই আমি ব্যবহার করেছি।
গুলিবিদ্ধ হওয়াতে মূলত চিকিৎসার জন্য আমি ভারতে গিয়েছিলাম। ভারতে পৌছানোর পরই আমার হাত ও পায়ের ক্ষতের চিকিৎসা শুরু হয়েছিল। ২৭–২৮শে আগস্ট পর্যন্ত হাতের যন্ত্রণা ও ফোলার কোন উপশম না হলেও পায়ের ক্ষত অনেকাংশে কমে গিয়েছিল। পায়ের ক্ষতে শুধু ব্যান্ডেজ বাধলেই স্বচ্ছন্দ্যে চলতে পারতাম। ২৪শে আগস্ট থেকে যার পর নাই যত্নের সাথে আমার চিকিৎসা শুরু হয়েছিল। ফলে ১লা সেপ্টেম্বর থেকে হাতের যন্ত্রণা ও ফোলা কমে এসেছিল। এক্স-রেতে কোন ত্রুটি ধরা পড়েনি। ৬–৭ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতে সক্ষম হয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৫

ছিলাম। তবে গাড়ির ঝাঁকিতে একটু ব্যাথা অনুভব করতাম। ১০ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাও অনেকাংশে কমে যায় এবং ক্ষত শুকাতেই যা একটু সময় নেয়। ২০শে সেপ্টেম্বর দেশে ফেরার সময় হাতে ব্যান্ডেজ ছিল তবে কোন ব্যথা বেদনা ছিল না। প্রায় শুকিয়ে আসা ক্ষতে যাতে ধুলোবালি না লাগে তার জন্যই শুধু ব্যান্ডেজ বেঁধে রাখা।
ভারতে অবস্থানের সময়ের একটা বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। কারণ এই বিষয়টি উল্লেখ না করলে সত্যের অপলাপ হবে। আমি যখন ভারতে অবস্থান করছিলাম তখন পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর বহু সেনাপতিদের সাথে দেখা হয়েছে, তারা অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে আমার সাথে কথা বলেছেন, খোঁজ-খবর নিয়েছেন, সম্বর্ধিত করেছেন। অথচ আমি চিকিৎসা ও যোগাযোগের জন্য ভারতে অবস্থান করছি এটা ওয়াকিবহাল থাকা সত্ত্বেও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কোন খোঁজ খবর নেন নি। এমনকি একটা শুভেচ্ছা বার্তাও পাঠান নি। কেন এটা হয়েছে তা বলা আমার সাধ্যের অতীত।
পূর্ব দিগন্ত লাল হয়ে এসেছে। ভোরের আলো ফুটতে আর বেশী দেরী নেই। আমাদের দুইটি নৌকা ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও তিস্তার মোহনায় এসে ভিড়ল। এক মাসের সামান্য কিছু কম সময় পর নব উদ্দীপনায়, উজ্জীবিত আমরা জন্মভূমির মাটিতে প্রথম সূর্যোদয় দেখলাম। মোয়াজ্জেম হোসেন ও নুরুল ইসলামকে বিদায় জানানো হলো। তাঁদের দায়িত্ব দেয়া হলো, পালা করে প্রতিমাসে দুবার দেশের অভ্যন্তরে এসে আমার সাথে দেখা করবেন। নুরুল ইসলাম ও মোয়াজ্জেম হোসেন খান শরণার্থী বোঝাই একটি নৌকায় আবার ভারতে ফিরে গেলেন।
আমরাও অপেক্ষা করতে চাইলাম না, ভোরের আলো স্পষ্ট হতে না হতেই হানাদার সুরক্ষিত বাহাদুরাবাদ ঘাট পেরোতে চাই। আমাদের ভরসা একটাই যে, স্রোত অনুকূলে। তবু বাহাদুরাবাদ ঘাট বাঁয়ে রেখে খানিকটা পশ্চিমে সরে স্রোতের অনুকূলে দক্ষিণে চললাম। আমাদের গতিপথ থেকে হানাদার-ঘাঁটির দূরত্ব প্রায় দু-আড়াই মাইল। ডানে বামে দু’দিকেই চর। মাঝখানে একশ-দেড়শ গজ চওড়া একটি শাখা বয়ে গেছে। দক্ষিণে প্রবাহিত এই শাখা নদী দিয়ে যাওয়াই উপযুক্ত মনে করলাম। কারণ ডান-বায়ে দু’দিকেই চর। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এটা ভাল করেই বুঝেছি, পাক-হানাদারদের হাতে সর্বাধুনিক অস্ত্র যতই থাকুক না কেন একবার মাটিতে নেমে রুখে দাঁড়াতে পারলে আমাদের কাছে হানাদাররা কিছুইনা। তাই নদীপথেও আমি মাটির কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি। তবে মূল নদীকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ায় আমাদের কিছুটা কষ্ট করতে হলো। ছোট নৌকাটি অনায়াসে পার হয়ে যেতে পারলেও পানি কম হওয়ায় বড় নৌকাটি ঠেকে গিয়ে সে এক বিশ্রী ব্যাপার হলো। শক্তিশালী চুম্বকে লোহা যেমন আটকে যায়, তার চাইতেও শক্তভাবে বালুতে নৌকা আটকে গেল। খালটি মোটামুটি প্রশস্ত হলেও কোন গভীরতা ছিল না। কোথাও হাঁটু জল, কোথাও বা তার চেয়ে একটু বেশী। এ অবস্থায় জনা পঞ্চাশেক সহযোদ্ধার সাথে অক্লান্ত পরিশ্রম করে, বলতে গেলে নৌকাটি কাধে তুলে মাইল খানেক বয়ে নিয়ে গেলাম।
নিরাপদে বাহাদুরাবাদ ঘাট পেরিয়ে আসতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ আনন্দিত। আমি
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৬

ভারত থেকে রওয়ানা হবার সময় মনে মনে স্থির করেছিলাম, ফেরার পথে জামালপুর-সরিষাবাড়ী রেল সড়কের বাউশি সেতু ভেঙে দিয়ে যাব। বাউশি সেতু ভাঙতে পারলে জামালপুর-সরিষাবাড়ী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আর এটা যদি করা যায় তাহলে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট এমনিতেই শত্রু- মুক্ত হয়ে যাবে। এতে আরেকটি বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে। তা হলো, জগন্নাথগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ ঘাটের মধ্যে যে ফেরী চলাচল করে, তাও বন্ধ হয়ে যাবে। এতে ভারতে যাতায়াতের পথ নিরাপদ হবে।এসব চিন্তা করে বাহাদুরাবাদ ঘাটের মাইল পনের ভাটিতে পুব দিকের একটি শাখা নদীতে ঢুকে পড়লাম। এ-শাখাটি বাউশি সেতুর নীচ দিয়ে গেছে। ছোট্ট নদীটি ধরে প্রায় মাইল কুড়ি এগুবার পর নৌকা থেকে নেমে পড়লাম। আমাদের কাছে যে পরিমাণ গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক ছিল, তা বহনের জন্য অতিরিক্ত একশ লোকের প্রয়োজন ছিল। বাউশি সেতুর দু-তিন মাইল উত্তরে দু’টি গ্রাম থেকে লোক সংগ্রহ করে, তাদের সাহায্যে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে এগিয়ে চললাম।

গুলির ভাষা যখন নীরব
সন্ধ্যা সমাগত। সামনেই জামালপুর-সরিষাবাড়ী রেল সড়ক। একমাইল পশ্চিম-দক্ষিণে সেই বাউশি সেতু। আমাদের পরিকল্পনা রেলসড়ক পার হয়ে পুবপাশে গিয়ে অতিরিক্ত জিনিসপত্র নিরাপদ স্থানে রেখে অথবা আরও দূরে কোনও নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিয়ে বাউশি সেতু আক্রমন করব। বাউশি সেতু খুবই সুরক্ষিত। তাই এই সতর্ক ব্যবস্থা। আমরা রেল লাইন ঘেঁষে গ্রামের আড়ালে পুব উত্তরে চলেছি। এমন সময় একটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। আগের রাতে একদল মুক্তিবাহিনী এসে আধ মাইল ব্যাপী রেল লাইন বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দিয়েছিল। রেল লাইন মেরামতের কাজ তখনও চলছে। এমন সময় উত্তর দিক থেকে একদল হানাদার রেল লাইন ধরে দক্ষিণে এগিয়ে যাচ্ছিল। হানাদারদের দেখা মাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হলো। হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ব্যবধান শুধু একটি খাল। খাল অতিক্রম করে রেল লাইনে যাওয়া যেমন আমাদের পক্ষে অসম্ভব, তেমনি হানাদারদের পক্ষেও। সবাইকে পজিশন নিতে নির্দেশ দিলাম। এর আগে কখনও হানাদারদের এত কাছে পেয়ে নাস্তানাবুদ না করে ছেড়ে দিইনি। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র উঁচিয়ে গ্রামের আড়ালে বসে গেল। দক্ষিণে চলে যাওয়া রাস্তাটিকে নিরাপদ মনে করে, হানাদাররা নিবিষ্ট মনে, হেলে দুলে চলছে।
সহযোদ্ধাদের প্রতি নির্দেশ, আমি গুলি ছুঁড়লেই আঘাত হানবে, আগে নয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চোখের সামনে বিশাল দেহধারী হানাদারদের একের পর এক যেতে দেখছে, অথচ আমার দিক থেকে কোনও সাড়া শব্দ নেই। আমার আঙুল ট্রিগারে। হানাদার দলের মূল নেতাকে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করে ফেলেছি। হানাদার নেতার কাঁধে ক্যাপ্টেনের ষ্টার দেখা যাচ্ছে। আমার বুক উত্তেজনায় টিপ্‌টিপ্ করছে। ট্রিগার টিপবো, ঠিক তখন আমার কানে এল একটি শব্দ। আমি তন্ময় হয়ে গেলাম। হাত জমে গেল। গুলি ছোঁড়া আর হলো না। বেত হাতে ক্যাপ্টেন ভদ্রলোক ভাঙা রেললাইন মেরামতরত বাঙালী শ্রমিকদের বলছেন, ‘ভাই, তোমলোগ ক্যাইসা আদমী হো। তোমহারা ভাইওনে আজাদীকে লিয়ে ইসকো তোড়া, উনলোগ আজাদী কি লিয়ে লড় রেহে হ্যায়,
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৭

আউর তোমলোগ আজাদী রুখনে কে লিয়ে গোলামী যে হো। ইয়ে ছোড় দো। ভাগ যাও। হো স্যাকে তো উন ভাইও কো মদত করো, যিনোনে আজাদী কে লিয়ে আপনা খুন বহারাহে হ্যায়।
ক্যাপ্টেন ভদ্রলোক ছিলেন একজন পাঠান। তার কথা শোনার পর আমার পক্ষে আর তাকে গুলি করা হলো না। স্বাভাবিক কারণেই তারা নিরাপদে বাউশির দিকে চলে গেল। উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অতিথিপরায়ণ পাঠান সৈনিকরা যে বাংলায় জল্লাদ ইয়াহিয়ার হত্যালীলা কোনক্রমেই সমর্থন করেননি, স্বাধীনতা যুদ্ধে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে।
আমরা আরও দক্ষিণ-পূর্বে এগিয়ে চললাম। ঠিক সন্ধ্যায় জামালপুর-সরিষাবাড়ী রেল লাইন অতিক্রম করলাম। দলের অধিকাংশের মাথাতেই গোলা-বারুদের বোঝা। তাই অনেকক্ষণ ম্যাপ দেখে একটি নিরাপদ স্থান চিহ্নিত করে স্থানীয় একজন লোককে একটি গ্রামের নাম জিজ্ঞেস করলাম। লোকটি অত্যন্ত আনন্দের সাথে গ্রামটি দেখিয়ে বললেন, ‘আপনি দেখছি এখানকার সব গ্রামের নামই জানেন। আপনি এর আগেও এখানে এসেছিলেন?’ আমি কোন উত্তর দিলাম না।
রাত কাটানোর জন্য জামালপুর থানার ভ্যাবলা গ্রামকে বেছে নেয়া হলো। পরদিন সকালে দেখা গেল, ম্যাপ দেখতে আমার ভুল হয়েছে। আমি পশ্চিমে সরিষা বাড়ী-জামালপুর রেল লাইন যাতে প্রায় তিন মাইল দুরে থাকে, এমনি একটা স্থান নির্ধারণ করেছিলাম। পশ্চিম দিকে রেল লাইনের দূরত্ব ঠিকই আছে। কিন্তু বিপত্তি বেধেছে পুব দিকের পাকা সড়কটি নিয়ে। আমার কাছে সেই ১৯৩৫-৩৭ সালের পুরানো মিলিটারী ম্যাপ। তা দেখেই আমরা পথ চলছিলাম। ৩৫ সালে যেখান দিয়ে জামালপুর থেকে মধুপুর-টাঙ্গাইল পাকা রাস্তা হওয়ার কথা ছিল, বৃটিশদের ভারত ছেড়ে চলে যাবার পর সেখান দিয়ে জামালপুর-মধুপুর পাকা সড়ক হয়নি। পাকা সড়ক হয়েছে আরও পশ্চিম ঘেঁষে। ম্যাপে দু’টি রাস্তারই উল্লেখ রয়েছে। পশ্চিম দিকের পাকা রাস্তাটি কাচা রাস্তা বলে উল্লেখিত হয়েছে। আর যেটি পায়ে হাঁটা কাচা রাস্তা, সেটিই পাকা রাস্তা হিসাবে ম্যাপে চিহ্নিত।

প্রবেশের পর প্রথম সংঘর্ষ
এই ভুলের মাশুলও আমাদের গুনতে হলো দারুণ ভাবে। অপরিচিত হাওর এলাকার কারণে সকালবেলা, না সারাদিন অপেক্ষা করে বিকেলে রওনা হবো? এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলাম না। এমন সময় ২২ শে সেপ্টেম্বর সকালে খবর এলো দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর দিক থেকে মিলিটারী, রাজাকার ও মিলিশিয়ারা গ্রামটিকে ঘিরে ফেলতে এগিয়ে আসছে। আমি দ্রুত রফিক, ফজলু, কাসেম ও ভুয়াপুরের দুলাল সহ আট’ন জনের একটি দল গ্রামের দক্ষিণে পাঠিয়ে দিলাম। তাদের একমাত্র কাজ কেবল একবার হানাদারদের উপর একঝাঁক গুলি ছুঁড়ে পিছিয়ে আসা। পুব ও পশ্চিম দু’দিকেই খোলা। কিন্তু আমাদের অবস্থান থেকে সোজাসোজি পুব অথবা পশ্চিম, কোন দিকেই যাবার উপায় নেই, কারণ সমস্ত এলাকাটা জুড়ে পানি আর পানি। সর্বত্র পানি থৈ থৈ করছে। ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে দক্ষিণে একটি বাড়ীতে গেলাম, যেখানে সামাদ গামা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৮

তার দল নিয়ে ছিল। গামা পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাকে মর্টার সহ আমাকে অনুসরণ করতে বললাম। বাড়ীর পশ্চিমে গিয়ে মর্টার বসিয়ে মূহুর্তের মধ্যে দক্ষিণ দিক লক্ষ্য করে দশ-বারো রাউণ্ড গোলাবর্ষণ করা হলো। পিন্টুকে বললাম অন্যদের নিয়ে ঘরের সমস্ত গোলা- বারুদ ও বিস্ফোরক গ্রামের পশ্চিমে সরিয়ে নিতে। মুক্তিবাহিনী কিছুটা অসুবিধায় পড়লেও ভাগ্য হয়তো সুপ্রসন্ন ছিল। গ্রামের পশ্চিমে বিলে বুক সমান পানি এবং সারা বিলে ধান বোনা ছিল। আল্লাহর আশীর্বাদ হিসাবে অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রাণ কর্তার মত চার পাঁচটি কোষা নৌকা ধান ক্ষেতের মধ্যে ছিল। পিন্টু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চটপট সমস্ত মালপত্র কোষা নৌকা- গুলোতে উঠিয়ে নিল।
দক্ষিণ দিক থেকে হানাদার বাহিনী গ্রামটির উপর আঘাত হানতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা রফিকের দলের হাতে প্রথম বাধা পেয়ে কিছুটা থমকে গেল। এ সময় ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে পরপর দশ বারোটি গোলা ছোঁড়াতে হানাদাররা কিছু সময়ের জন্যে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। শত্রুপক্ষেও যে ভারী অস্ত্র আছে তা তারা সহজেই বুঝতে পারল। নির্দেশ মত প্রথম একঝাক গুলি ছুঁড়েই রফিকের দল শত্রুকে আড়াল করে পিছিয়ে এল। আমি খুব তাড়াতাড়ি দলকে দুভাগে ভাগ করে ফেললাম। এক ভাগ থাকবে আমার সাথে, বাকী অংশ সোজা গ্রামের পশ্চিমে কোষা নৌকাগুলোর দিকে চলে যাবে এবং পিন্টুর সাথে মিলিত হবে। তাদের উপর কড়া নির্দেশ, ‘ধরা পড়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত একটা গুলিও ছুঁড়বে না। আমাদের এবার চরম পরীক্ষা। আমি চেষ্টা করছি শত্রুদের আস্তে আস্তে তোমাদের দিক থেকে সরিয়ে নিতে পারি কিনা।’ সামাদ গামা ফজলুল হক সহ প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ জন মুক্তিযোদ্ধা আস্তে আস্তে গ্রামের পশ্চিমে কোষা নৌকাগুলোর কাছে চলে গেল। সেখানে একাধারে কোমর পানি, অন্য দিকে ধানগাছগুলো পানির উপর একহাত জেগে আছে। সামান্য একটু নীচু হলেই মুক্তিযোদ্ধাদের আর দেখা যাচ্ছিল না। আমরা কিছু উত্তরে চলে এসে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুঁড়লাম। এতে মোটামুটি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলো। হানাদার বাহিনী পিন্টু-সামাদের দলকে বায়ে ফেলে গুলির শব্দ লক্ষ্য করে আমাদের দিকে এগুতে থাকলো। আমরা আরও কিছুটা উত্তরে চলে এলাম।
রাতে আমরা যে বাড়ীতে কাটিয়েছি, সেখান থেকে প্রায় আধ মাইল উত্তরে সরে এসে পুব দিকে যাবার একটি রাস্তা পেয়ে গেলাম। সে-রাস্তা ধরে পুবে এগুতে থাকলাম। সামান্য একটু পুবে এগিয়ে আবার এক ঝাঁক গুলি ছুঁড়লাম। এভাবে গুলি ছোড়ার উদ্দেশ্য একটাই, গুলি ছুঁড়ে বিভ্রান্ত করে, হানাদারদের আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে প্ররোচিত করা, যাতে বাকী দলটা নিরাপদ হতে পারে। হয়েও ছিল তাই।
আমার সাথে ত্রিশজনের একটি দল। তাও আবার দুভাগে বিভক্ত। ছ’সাত জন আমার সাথে। বাকীরা বামন আটার ক্যাপ্টেন হবির সাথে। তারাও আবার দুভাগে চলেছে। আমরা পূর্ব দিকে এগিয়ে একেবারে জামালপুর-মধুপুর পাকা সড়কের কাছাকছি এসে গেলাম। রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে দেখলাম কুড়ি-পঁচিশজন পাক হানাদার রাস্তার মুখ আগলে মেশিনগান হাতে বসে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩৯

রয়েছে। কাঁচা রাস্তার ডান বাম উভয় দিকেই পানি। জামালপুর- মধুপুরে পাকা সড়কের পূর্বপাশে যেতে হলে, হানাদারদের মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে হবে। আমরা আবার পশ্চিমদিকে পিছিয়ে এলাম। কিন্তু পশ্চিমে বেশী দূর যাওয়াও সম্ভব নয়। কারণ একদল হানাদার পশ্চিম দিক থেকেও অনেকটা এগিয়ে এসেছে। এই সময় আমার দেহরক্ষার দায়িত্ব প্রাপ্ত নতুন কমান্ডার ক্যাপ্টেন হবি, একেবারে ভেঙে পড়ে বলল, ‘স্যার, আমরা মরি ক্ষতি নেই, আপনি কয়েকজন নিয়ে যে দিকে পারেন চলে যান। আপনি ধরা পড়লে কিংবা মরে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে।’
– কোথায়? কোন দিকে যাব?
— স্যার, আপনার পায়ে পড়ি, যে দিকে খুশি চলে যান। আপনি মারা গেলে আমি মুখ দেখাতে পারব না। সবাই আমার নিন্দা করবে।
—ভেঙে পড়ো না। তোমরা মরেওতো আমাকে বাঁচাতে পারছ না। ধৈর্য ধরে পরিস্হিতি মোকাবিলা করে দেখা যাক কি হয়।
— স্যার, এরপরও ধৈর্য।
পূর্ব দিকই কিছটা নিরাপদ। মরণপণ করে তাই আবার পূর্বদিকে চলা শত্রু করলাম। সামনের দলকে আদেশ দিলাম, ‘ডান ও বাঁয়ে, যাবার মত কোন নৌকা পেলেই তাতে উঠে বস। আর নৌকা না পেলে এই রাস্তা দিয়েই পাকা সড়ক অতিক্রম করতে হবে। এতে যে ক’জন বেঁচে থাকি তাই লাভ।’ এখানে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। আমি যখন পাকা রাস্তায় ওৎ পেতে বসে থাকা হানাদারদের দেখে পশ্চিমে এসে গুলি চালিয়েছিলাম, তখন রাস্তার ডান বামে কোন নৌকা দেখতে পাইনি। মরিয়া হয়ে আবার যখন পূর্বদিকে এগুতে থাকি, তখন ডানপাশে দু’টি নৌকা দেখতে পেলাম। একটি ঢাকাইয়া ধরনের যাত্রীবাহী, অন্যটি সাধারণ কোষা নৌকা ৷ আমার আগে আগে যাওয়া চব্বিশ-পচিশ জনের দলটি ইতিমধ্যেই বড় নৌকাটিতে উঠে চলতে শুরু করেছে। দেরী না করে আমরাও কোষা নৌকাতে উঠে পড়লাম। আমাদের থেকে হানাদারদের দূরত্ব পূর্ব ও পশ্চিমে তখনও প্রায় এক মাইল ৷ হানাদাররা যেমন আমাদের দেখতে পাচ্ছে; তেমনি আমরা তাদের পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ভরসা শুধু এইটুকু যে, এতদূরে থেকে নিশানা ঠিক করে গুলি লাগানো সম্ভব নয়।
রফিক নৌকা বাইতে শরু করলো। কিন্তু অবস্হার প্রেক্ষিতে যত দ্রুত নৌকা চালনা দরকার রফিক তা পারছিল না। আমি রফিকের হাত থেকে লগি নিয়ে সবাই কে নীচু হয়ে বসে থাকতে বললাম। আমি নৌকা বাইতে জানতাম। তবে অনেকদিন নৌকা না বাওয়ায় কিছটা অসুবিধা হচ্ছিল। তৎসত্ত্বেও রফিকের চাইতে ভাল ও দ্রুত নৌকা চালাচ্ছিলাম।
চার-পাঁচ’শ গজ এগুতে একটি ধান ক্ষেত৷ ক্ষেতে পানির গভীরতাও কম। তাই নৌকা বাইতে বেশ সুবিধা হচ্ছিল। ক্ষেতের মাঝে কয়েকটি বাড়ী। বাড়ীগুলোর পাশ দিয়ে যখন আমরা যাচ্ছিলাম ঠিক তখন হানাদাররা আমাদের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করলো। মনুক্তিবাহিনী ও হানাদারদের মধ্যকার দূরত্ব প্রায় সাত-আটশ গজ। আমি খুব দ্রুত নৌকা বেয়ে বাড়ীগুলোর আড়ালে চলে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪০

এলাম। সৌভাগ্য ক্রমে কারো গায়ে গুলির একটি আঁচড়ও লাগল না। আরো একটু উত্তরে এগুতেই মাটি পেয়ে নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়লাম। অন্যেরাও আমাকে অনুসরণ করল তবে বড় নৌকাটি কিছুটা পশ্চিম-দক্ষিমে সরতে সরতে আমাদের হারিয়ে ফেলল।
জামালপুর-মধুপুরের পাকা রাস্তা আমাদের থেকে একশ, কি দেড়শ গজ দূরে। বাড়ীর আড়াল থেকে আমরা হানাদারদের দেখতে পাচ্ছিলাম। হানাদাররা আমাদের দেখতে পাচ্ছিল না। কিছুটা উত্তরে গিয়ে পাটক্ষেত আড়াল করে, পাকা সড়কের কুড়ি পঁচিশ গজের কাছাকছি এলাম।
কাছে এসে বুঝতে পারলাম, রাস্তায় যারা টহল দিচ্ছে, তারা মিলিটারী নয়, রাজাকার। আর এই সময় কেন যেন রাজাকাররা উচ্চস্বরে বলছিল, ‘আমরা এখানকার লোক না। মিলিটারীরা নিজেরাই মুক্তিবাহিনীর সাথে পারেনা, আর এই অচেনা জায়গায় আমাদের রাইখ্যা গেল। এখন যদি মুক্তিবাহিনী আসে, আমরা কি উপায় করমু।’ এ কথা শুনে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রফিক, ভুয়াপুরের দুলাল, ছোট সামসু ও আমি এক সাথে ‘ইয়া, ইয়া’ বলে হুংকার ছেড়ে রাস্তার উপরে লাফিয়ে পড়লাম। আমাদের হুংকারে রাজাকাররাও এক অভূতপূর্ব খেল দেখালো। তারা ভীত- সন্ত্রস্ত হয়ে কোন গোলাগুলি না ছুঁড়ে উত্তর ও দক্ষিণে দে ছুট। আধ মাইল না গিয়ে বোধ হয় তারা পিছনে ফিরে তাকায় নি। আমরা অনায়াসে রাস্তার পূব পাশে চলে এলাম। কিন্তু পিছনে তাকিয়ে দেখি, তখনও একজন রাস্তা পার হতে পারেনি। সে হলো আবদুল হালিম। আমি আবার দৌঁড়ে গিয়ে বলতে গেলে, তাকে ধরে টেনে হিঁচড়ে রাস্তার পুব পাশে নিয়ে এলাম। শারীরিক দিক থেকে দুর্বল কিন্তু প্রচণ্ড সাহসের অধিকারী আবদুল হালিম এদিন একটু আগেই আরেক বার এমনি অসুবিধা ঘটিয়েছিল। ভ্যাবলা গ্রাম। ভ্যাবলা গ্রাম থেকে প্রায় আধমাইল উত্তরে এসে আমরা পুব দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছি। সামনে পড়লো ছোট্ট একটি খাল। কাপড় ভিজিয়ে হাতিয়ার সহ সবাই খাল পার হয়ে গেল। কিন্তু হালিমের অস্ত্রটি ফস্কে গভীর পানিতে পড়ে গেল। আমি পিছনে ছিলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমার হাতিয়ারটা ছুঁড়ে দিয়ে বললাম, “তুই এটা ধর। এগিয়ে যা। আমি ডুব দিয়ে তোর গানটি তুলে আনছি।’ খালটিতে আট-ন’ ফুটের বেশী পানি ছিল না। আমি এক ডুবেই হালিমের স্বয়ংক্রিয় রাইফেলটি উঠিয়ে এনেছিলাম।
পাকা রাস্তা অতিক্রম করে আমরা সত্যিই কিছুটা স্বস্তিবোধ করলাম। কিন্তু অন্য দলটি কোথায় গেল, তাদের কি হলো, ধরা পড়লো কিনা? এইসব দুশ্চিন্তা আমার ও দলের নিরাপত্তাবোধে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। তবু আরও কিছুটা পুব দিকে এগুলাম। পাকা সড়কের পশ্চিম পাশে সর্বত্রই কেবল পানি কিন্তু পুব পাশে তা নয়। পাকারাস্তা থেকে দেড়-দুমাইল পূবে এসে একটি বাড়ীতে উঠলাম। সকাল ন’টা থেকে দেড়টা, এই সুদীর্ঘ সময় আমাদের হাপিত্যেশ, দৌড়াদৌড়ি ও উৎকণ্ঠায় কেটেছে। ফলে প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করছিলাম। বিরাট বাড়ী কিন্তু জন-মানব শূন্য। বাড়ীতে একজন মাত্র কাজের মহিলা। আর তাঁর তিন-চার বছরের ছোট্ট একটি বাচ্চা। ক্ষুধার জ্বালায় আমাদের পেট পুড়ে যাচ্ছে, খাবারের আবেদন জানালে মহিলা বললেন, ‘বাড়ীতে অনেক চাল আছে কিন্তু লবণ, তেল, ডাল অন্য কিছু নেই। মনিবরা তিন-চার মাস আগে বাড়ী ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪১

এখন আপনারাই বলুন আমি কি করি?’ মহিলাটিকে বললাম, ‘আপনি দয়া করে শুধু ভাত রেঁধে দিন।’ মহিলাটি ভাতের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। এই সময় ঐ গ্রামেরই মাঝারী বয়সের একজন লোক এলেন। তিনিই লবণ, তেল ও আধাসের আলুর ব্যবস্থা করে দিলেন। এই দিয়ে এ দিনের মত আমরা আহার-পর্ব সমাধা করলাম।
পেটের জ্বালা শতগুণ বেড়ে উঠলো। আমি ছট্‌ফট্ করতে লাগলাম। সাত-আট বছরের পুরানো ঘনিষ্ট অনুসারী আরিফ আহমেদ দুলাল সহ সাইদুর, খোকা, তমছের নিখোঁজ হওয়া দলে রয়েছে। অন্য দিকে বহুদিন পর এক বুক আশা নিয়ে যে ছোট ফজলু আমার নিত্য সহচর দলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, সেও রয়েছে প্রথম দলের সঙ্গে। আমরা তখনও কিছুই জানি না তারা কোখায় এবং তাদের কি হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারাও আমার মত খুবই ছটফট করছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকে অসংখ্যবার বিপদে পড়েছি। দু’একবার ছাড়া এভাবে মূল দলের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। এদিকে সূর্য অস্তগামী। সন্ধ্যায় আমরা আরও কিছুটা পুরে এগিয়ে এক বি.ডি. মেম্বারের বাড়ীতে উঠলাম। মেম্বার ভদ্রলোক বাড়ীতে ছিলেন না। মেম্বরের স্ত্রী দু সন্তানের জননী। অপূর্ব সুন্দরী মহিলা। নির্ভয়ে আন্তরিকতার সাথে আমাদের খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করলেন। শাশুড়ীকে নিয়ে আমাদের খাবার পরিবেশন করলেন। খাওয়া শেষ হলে মহিলাটি বললেন, ‘দেখুন, আপনারা দেশের জন্য লড়াই করছেন। আমরা তো আর কিছু করতে পারছি না, আমাদের সামান্য একটু যত্ন যদি দেশের কোন কাজে লাগে, তাই চেষ্টা করছি। আমার কথায় আপনারা ভুল বুঝবেন না। আপনারা আমার ভাইয়ের মত। আপনারা যদি সূর্য উঠার আগে এখান থেকে চলে যান, তাহলে এখানকার কেউ যেমন জানতে পারবে না, তেমনি আমাদের বাড়ী পুড়িয়ে দেয়ারও কোন ভয় থাকবে না। আমার অনুরোধ, আপনারা দয়া করে একটু কষ্ট করে সূর্য উঠার আগেই চলে যাবেন। মহিলাটি হয়তো কলেজ পড়ুয়া। তিনি অত্যন্ত গুছিয়ে কথা বলছিলেন। তার প্রতিটি কথার মধ্যে আন্তরিকতার ছাপ ফুটে উঠছিল।
আশ্বাস দিয়ে বললাম, ‘আপনাদের মত মায়েরা বোনেরা আছে বলেই আমরা হানাদারদের বিরুদ্ধে এতটা দুর্বার হতে পেরেছি। আপনি আমাদের ক্ষুধায় অন্ন জুগিয়েছেন, রাতে আশ্রয় দিচ্ছেন। আপনি নিশ্চিত থাকুন, সানন্দে আমরা আপনার অনুরোধ রক্ষা করবো।’
সারারাত আমাদের ঘুম হলো না। এপ্রিল মাসে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে হারিয়ে যেমন বিনিদ্র রজনী কেটেছিল এ রাতটাও ঠিক তেমনি কাটল। ভোর চারটায় বিছানা ছেড়ে উঠে হাত মুখ ধুয়ে, অন্ধকারেই বেরিয়ে পড়তে আমরা প্রস্তুত। বাড়ীর কর্ত্রী নিজে আমাদের সকলের হাতে চা তুলে দিলেন, এতটুকু জড়তা নেই। এ যেন নিজেরই ভাইদেরকে কোথাও যাওয়ার আগে তৈরী করে দিচ্ছেন। আমরা সকলেই দাঁড়িয়ে চা পান করে গৃহকর্ত্রীকে হাজার হাজার ধন্যবাদ ও সালাম জানিয়ে বের হয়ে পড়লাম।
বাড়ী থেকে সম্ভবত ১০০ গজও এগুতে পারিনি। হঠাৎ পূবদিক থেকে দশ-বারো বছরের একটি ছেলেকে ছুটে আসতে দেখলাম। আমাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় তাকে ধরা হলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪২

বন্দুক দেখেই সে জিজ্ঞেস করে বসলো, ‘আচ্ছা আপনারা কি কাদের সিদ্দিকীর লোক? আপনারা কি মুক্তিবাহিনী?’ কারণ জিজ্ঞেস করায় সে আবার বলল, ‘গতরাতে কাদের সিদ্দিকীর একদল মুক্তিযোদ্ধা চেয়ারম্যানের বাড়ীতে ছিলেন। তারা এই দিকেই আসছেন। আপনারা যদি কাদের সিদ্দিকীর দলের লোক হন, তাহলে বলুন, আমি দৌঁড়ে গিয়ে তাদেরকে খবর দেব।’ ছেলেটিকে আর কিছু বলতে হলো না। তার আগেই পূবদিক থেকে কুয়াশায় ভিতর দিয়ে লম্বা সারিতে একটি দলকে আবছা আবছা দেখা গেল। আমার থেকে প্রায় তিন-চারশ গজ আগে আগে যাওয়া স্কট পার্টির রফিক এবং সামসু দলটিকে চ্যালেঞ্জ করল। সাথে সাথে দলটি থমকে দাঁড়াল। গলার আওয়াজ ও দু’একটি কথা শুনে বুঝা গেল, তারা গতকাল দুপুরে হারিয়ে যাওয়া দলের অংশ। আগত দলের খোকা চিৎকার করে বলল, ‘রফিক ভাই, আমি খোকা, আমি খোকা। উনিশ- কুড়ি ঘন্টার দারুন দুর্ভাবনা ও দুশ্চিন্তার অবসানে আমাদের মিলন হলো। মিলনের সে কি আনন্দ এ যেন মহামিলনের মহা আনন্দের জোয়ার। সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরছে, পারলে একজন আর একজনকে কোলে তুলে নিচ্ছে। আমিও বন্যায় উপচে পরা নদীর মত আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে উঠলাম। পরক্ষণেই আমার আনন্দে নেমে এলো বিষাদের ছায়া। জানি না পিন্টু, ফজলু, সামাদ গামার দলের খবর কি? তারা কোথায় আছে এবং কেমন আছে?
আমরা পূব দিকে এগিয়ে চললাম। ভোর পাঁচটায় তুলসীপুর বাজারে পৌঁছলাম। এখান থেকে পাঁচ মাইল পশ্চিমে জামালপুর মধুপুরের পাকা সড়ক। মাইল দুই আড়াই পুবে মধুপুরের পাহাড়। তুলসীপুর থেকে সোজা দশমাইল উত্তরে জামালপুর এবং দশ মাইল দক্ষিণে ধনবাড়ী। তুলসীপুর হাইস্কুল ঘরের মাটিতে বসে আবার ম্যাপ খুললাম। এবার আমার চোখে আগের ভুল ধরা পড়ল।
জামালপুর থেকে তুলসীপুর বাজারের উপর দিয়ে সোজা ধনবাড়ীতে গিয়ে যে কাঁচা রাস্তাটি মিলেছে, সেটিই আমার ম্যাপে পাকা রাস্তা বলে চিহ্নিত রয়েছে। সামান্য ভুল যে কত বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে, কত বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে, তার এক মস্ত বড় শিক্ষা আমি এই ঘটনা থেকে পেলাম।

সামাদ গামাই
ভ্যাবলা গ্রাম থেকে অত্যন্ত সফলতার সাথে হানাদারদের বিভ্রান্ত ও প্রলুদ্ধ করে আমরা পিছু টেনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম। ফলে পিন্টু, ফজলু, সামাদ গামার দলকে কোন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি। তারা সম্ভাব্য বিরাট বিপদ ও প্রভূত ক্ষয় ক্ষতি থেকে বেঁচে যায়। ভ্যাবলা গ্রামের পশ্চিমে কোমর সমান পানিতে মুক্তিযোদ্ধারা নীচু হয়ে ধান ক্ষেতের সঙ্গে মিশে রয়েছে। তাদেরই শ’ তিনেক গজ সামনে দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে হানাদার বাহিনী আমার দলকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। পিন্টু, ফজলু, সামাদ গামার দল অস্ত্রবোঝাই কোষা নৌকাগুলো ঠেলতে ঠেলতে প্রায় এক মাইল গিয়ে একটি পরিত্যক্ত জঙ্গলাকীর্ণ পুরানো বাড়ীর শূন্য ভিটায় আশ্রয় নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা চরম উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে জঙ্গলের ভিতর চুপ করে বসে আছে। গোলা বারুদগুলো কোষা নৌকাগুলোতেই রয়ে গেছে। ধান
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৩

ক্ষেতের মধ্যে থাকায় নৌকাগুলো দূরে থেকে দেখার উপায় নেই। শুধু তাই নয়, কাছে এসেও খুব নিখুত ভাবে লক্ষ্য না করলে নৌকাগুলি দেখা যাচ্ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা উত্তেজিত, উদ্বিগ্ন ও ভীত সন্ত্রস্ত। অন্য দিক দারুন ক্ষুধার্ত, ক্লান্তও। অধিকন্তু নেতৃত্বহীন হওয়ায় ও অন্য দলের কোন খোঁজ খবর না জানায় তারা খুবই বিমর্ষ হয়ে উদ্দেশ্য-বিহীন ভাবে অপেক্ষা করছিল। তবে এমনি ভাবে তাদের বেশী সময় কাটেনি। কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে থাকার পরেই জঙ্গল বাড়ীতে জনৈক পূর্ণবয়স্ক লোক প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে আসেন। তিনি কেবল মাত্র পায়খানায় বসেছেন- এদিক ওদিক তাকিয়ে আশেপাশে অনেকগুলো লোককে হঠাৎ দেখতে পেয়ে তার পায়খানার বেগ একেবারে চলে যায়। তিনি বসা থেকে বিদ্যুৎপৃষ্টের মত তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারাও তাকে ধরে ফেললো।
মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পেয়ে লোকটি যেমন চমকে যান, তেমনি মুক্তিযোদ্ধারাও লোকটিকে জঙ্গলের দিকে আসতে দেখে কিছুটা বিচলিত হয়। জঙ্গলে পায়খানা করতে আসায় লোকটির প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের কোন সন্দেহ জাগেনি। তবে তিনি ফিরে গিয়ে হয়ত মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা ফাঁস করে দিতে পারেন, এটাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশঙ্কা। তাই লোকটিকে আটক করা। লোকটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বললেন, ‘আমি আপানাদের অবস্থা বুঝতে পেরেছি, আমাকে যেতে দিন। আপানাদের কোন ক্ষতি হবেনা।’ কেন যেন মুক্তিযোদ্ধারা লোকটির কথা সহজে বিশ্বাস করে ছেড়ে দিল। একটু পরেই একটি বাইকে করে দু কলসী পানি ও কয়েকটি গ্লাস নিয়ে এলেন। এরপর আধ ঘন্টা পর পর জঙ্গলে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ খবর নিতে লাগলেন। দেখা হওয়ার প্রায় আড়াই ঘন্টার মধ্যে আরও দু’ জন লোকের সহায়তায় ঝুড়িতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার নিয়ে এলেন। গ্রাম বাংলার চিরাচরিত খাবার ডাল-ভাত। লোকটি সারা দিন পরম আন্তরিকতা ও যত্নের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখাশোনা করেন। সন্ধ্যায় প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন গ্রামবাসীসহ মুক্তিযোদ্ধারা কোষা নৌকা থেকে গোলা বারুদ মাথায় তুলে দক্ষিণে ডুয়াইল-কেন্দুয়ার দিকে রওনা হয়। এর পরই শুরু হয় সামাদ গামার ভূমিকা।
গ্রামবাসীরা বিশেষ সতর্কতা ও যত্নের সাথে গোলা বারুদের বোঝা বহন করেছেন। গোলা বারুদ বহন গ্রামবাসীদের কাছে এক পরম পবিত্র আমানত মনে হচ্ছিল। গোলা বারুদ বহন করার দুর্লভ সুযোগ পাওয়ায় তাদের বুক গৌরবে স্ফীত হয়ে উঠেছিল। আর তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠছিল সৃষ্টি সুখের এক অনাবিল আনন্দ। মালপত্র প্রচুর হওয়ায় এবং তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার লোক কম থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বোঝার পরিমাণ একটু বেড়ে যায়। এমনিতেই তখন মুক্তিযোদ্ধারা ছিল বিমর্ষ, হতোদ্যম। তিন সাড়ে তিন মাইল চলার পর কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা যেন ক্লান্তিতে একেবারে ভেঙে পড়ে। দলের সামনে পিন্টু মাঝখানে ফজলুল হক, আর পিছনে সামাদ গামা। হতোদ্যম মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে চলছে। হঠাৎ সামাদ গামা লক্ষ্য করল, তার মর্টারের একটা অংশ ‘বেসপ্লেট’ পড়ে আছে৷ কাউকে কিছু না বলে সে সেই অংশটি কাঁধে তুলে নেয়। আর একটু সামনে এগুতেই গুলির একটা থলি রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে, সেটাও সে তুলে নেয়। এর পরেই শুরু
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৪

হলো, গুলির থলি রাস্তায় পড়ে থাকার পালা। পঞ্চাশটি করে গুলির থলিগুলো এমন ভাবে তৈরী যে, কোমরে বেঁধে বা কাধে ঝুলিয়ে বহন করা যেত এবং প্রতিটি থলির মুখ ক্লিপ দিয়ে বন্ধ করা থাকতো। সামাদ গামা এগিয়ে যাচ্ছে, আর রাস্তায় পড়ে থাকা গুলি ভর্তি থলিগুলো একে একে কাধে তুলে নিচ্ছে। এক সময় রাস্তার একপাশে মর্টারের আর একটি অংশ ‘বাইপার্ট’ পড়ে থাকতে দেখে, সামাদ গামা রাস্তায় পড়ে থাকা ‘বাইপার্টটি ও তুলে নেয়। মর্টারের ব্যারেল আগে থেকেই সে বহন করছিল। উল্লেখ্য যে, ব্যারেল, বাইপার্ট এবং বেসপ্লেট—এই তিন অংশ নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ মর্টার। যে কোন একটি না থাকলেই অস্ত্রটি সম্পূর্ণ অকোজো। দলের সঙ্গে তখন দেড়শটি ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা ছিল। রাস্তায় কয়েকটি গোলা পড়ে থাকতে দেখে সে সেগুলোও তুলে নেয়। রাস্তার যা কিছুই পড়ছে, সামাদ গামা বিশেষ যত্নের সাথে তা-ই উঠিয়ে নিচ্ছে। যেন সব কিছু উঠিয়ে নেয়ার দায়িত্বটা একা তারই। এমনি করে দীর্ঘ ছয় মাইল পথ অতিক্রম শেষে যখন মুক্তিযোদ্ধারা ডুরাইল-কেন্দুয়া এসে নৌকায় উঠে, তখন পাহলোয়ান সামাদ গামার কাধের দু দিকে ঝুলানো ৩০৩, ৭.৬৫, ৭.৬২-এর তিন হাজার গুলি, মর্টারের তিনটি অংশ এবং আট পাউণ্ড ওজনের মর্টারের আটটি গোলা। সব মিলিয়ে ওজনের পরিমাণ সাড়ে চার-পাঁচ মনের কম হবে না। এই বোঝা হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের মধ্যে কয়জনে বহন করতে পারে। সামাদ সত্যিই এক ব্যতিক্রম। এজন্যই বলছি, বলতে বাধ্য হচ্ছি, সামাদ গামা, গামাই। গামার মতই এক বিস্ময়কর পাহলোয়ান।
কেন এমন হলো? অর্থাৎ কেন রাস্তার উপর গোলাগুলি পড়ে ছিল। এ প্রশ্নের জবাব সম্ভবতঃ ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে। হতোদ্যাম, ব্যাথাতুর মুক্তিযোদ্ধারা চলতে চলতে অতিরিক্ত বোঝা বইতে পারছিল না। হাঁটতে হাঁটতে তাদের কেউ কেউ কাঁধ অথবা কোমর থেকে পঞ্চাশ রাউণ্ডের গুলির থলিগুলো আস্তে করে রাস্তার উপর ফেলে দিচ্ছিল। এভাবে ফেলে দিয়ে তারা নিজেদের একটু হাল্‌কা করতে চেয়েছিল। তারাও বুঝত, এভাবে গুলি ফেলে দেয়া মুক্তিবাহিনীর জন্য খুবই ক্ষতিকর। তবুও তাদের উপায় ছিল না। মর্টার সেকশনের সদস্যরাও একই কারণে মর্টারের অংশগুলো ফেলে দিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু এইভাবে গোলাগুলি ফেলে যেতে সামাদ গামা একেবারেই নারাজ। তাই সে কিছুই পড়ে থাকতে দেয়নি। ঐ দিন সামাদ গামা, বিশেষ করে মর্টারের পরিত্যক্ত অংশ দুটি যদি কুড়িয়ে না আনত, তাহলে একটি মর্টার সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যেত। ডুয়াইন-কেন্দুয়া থেকে সামাদ গামা, পিন্টু ও ফজলু তাদের দল নিয়ে নিরাপদে নলীন-ভুয়াপুরের কাছাকাছি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলিত হতে সক্ষম হয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৫

ছদ্মনামে

তুলসীপুর স্কুল ঘরে পাটি বিছিয়ে বসে আছি। তুলসীপুর বাজারের একমাত্র ঔষধের ডিসপেন্সারীর বৃদ্ধ ডাক্তার ‘কাদের সিদ্দিকী’ এসেছেন, এমন একটা খবর শুনে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে ছুটে এলেন। কিন্তু আগেই সহযোদ্ধাদের বলে দিয়েছিলাম, আমার তুলসীপুর বাজারে অবস্থানের কথা যেন বাইরে জানানো বা প্রচারিত করা না হয়। অথচ ডাক্তার ভদ্রলোক তার ডিসপেন্সারী ফেলে ছুটে এসেছেন কাদের সিদ্দিকীকে এক নজর দেখতে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে যখন বলল, ‘কাদের সিদ্দিকী তো এখানে আসেন নি, তার প্রধান সহকারী এসেছেন। আপনি হয়তো ভুল শুনেছেন। আপনি যদি তার সাথে দেখা করতে চান, তাহলে আমরা কমাণ্ডার সাহেবকে জানাতে পারি। ডাক্তার সাহেব কাদের সিদ্দিকীর সহকারীর সাথেই দেখা করতে রাজী। তাকে আমার কাছে নিয়ে আসা হলো। পঞ্চাশ-ষাট বৎসর বয়সী ভদ্রলোক আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, ‘আমি শুনছিলাম কাদের সিদ্দিকী এখানে এসেছেন, বড় আশা ছিল তাকে দেখার, তার সাথে দু’টি কথা বলার। তাঁর সম্পর্কে কত শুনেছি কিন্তু চোখে দেখিনি। আপনি তাঁর প্রধান সহকর্মী। আপনার সাথে দেখা হল, এতেই আমি খুশী।’ তারপর চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বললেন, ‘আমার এক ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। সে সেই জুন মাসে একবার এসেছিল। এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, কিছুই জানি না।’
অঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার ছেলের নাম কি?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আবুল মনসুর সে ময়মনসিংহ শহীদ মিন্টু কলেজে পড়তো। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সাহেব নাকি তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আমি শুনেছি, প্রিন্সিপ্যাল সাহেব মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, আর মনসুর যখন জুন মাসে এসেছিল, তখন সে বলেছিল, সে তার অধ্যক্ষ স্যারের সাথে আছে।’
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে আমি বিস্মিত ও মুগ্ধ হলাম। একজন মুক্তিযোদ্ধার পিতার এই ধরনের মন-মানসিকতা দেখে খুশী না হয়ে পারলাম না। ঘটনাক্রমে ডালু ক্যাম্পে আমার সাথে মনসূর ও অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের সাক্ষাৎ হয়েছিল। পিতা-পুত্রের চেহারায় যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। তাই তাকে বললাম, ‘আমিও কিছুদিন আগে ভারতে গিয়েছিলাম। আপনার ছেলেকে আমি দেখেছি। সে অত্যন্ত ভাল ছেলে, এবং মুক্তিযুদ্ধে বেশ দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের স্যার (কাদের সিদ্দিকী) ভারতেই আছেন। আপনি যদি আপনার ছেলেকে কোন চিঠি পত্র দিতে চান, আমাকে দিতে পারেন। আমি অবশ্যই পৌঁছে দেব।’
দুপুরের মধ্যেই প্রচার হয়ে গেল ওখানে কাদের সিদ্দিকী আসেন নি। কাদের সিদ্দিকীর প্রধান সহকারী এসেছেন। দুপুর থেকে তুলসীপুর বাজার লোকে ভরে যেতে লাগলো। তারা কাদের সিদ্দিকীর সহকারীকে দেখবেন। এত ঔৎসুক্যের কারণ কিছুদিন আগে এইখানে আমার এক
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৬

কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর হাবিব প্রায় এক সপ্তাহ ছিল। তারা ধনবাড়ীর কাছে চাঁদপুর গ্রামে হানাদারদের সাথে এক প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। সেই দিন মুক্তিযোদ্ধারা একজন সাথীকে চিরতরে হারিয়েছিল। তুলসীপুর-চাঁদপুর যুদ্ধে শাহাদৎ বরণকারী মুক্তিযোদ্ধার নাম বজলুর রহমান। বজলুর রহমান উপলদিয়ার ফজলুর চাচাতো ভাই। যাদের বাড়ীতে এপ্রিল মাসের চরম দুঃসময়ে আমাকে পরম যত্নের সাথে রাখা হয়েছিল। কমাণ্ডার হাবিব তার মধুর ব্যবহার ও অসীম সাহসিকতায় এ এলাকার সকলের অন্তর জয় করেছিলেন। তাই কাদের সিদ্দিকীর প্রতি তাদের এত ঔৎসুক্য, একই কারণে তার দলের প্রতিও। তুলসীপুর বাজারে যতই লোক বাড়তে থাকল, মুক্তিযোদ্ধারা জামালপুর-তুলসীপুরের রাস্তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ততই সুদৃঢ় করতে থাকল। কারণ হানাদারদের আসার এটিই একমাত্র রাস্তা। সমবেত জনতার চাপে বাধ্য হয়ে আমি ভিন্ননামে কাদের সিদ্দিকীর সহকারী সেজে বিকাল চারটায় তুলসীপুর বাজারে একটি টুলের উপর দড়িয়ে সমবেত জনতার সামনে উদাত্ত কণ্ঠে বক্তব্য রাখলাম। বক্তৃতার সময় দু’তিনবার বাধলেও খুব উদ্দীপ্ত ও আবেগ-মিশ্রিত বক্তব্য রাখতে সক্ষম হলাম।
কাদের সিদ্দিকীর প্রধান সহকারীর বক্তব্য শুনে লোকজনের মধ্যে ধন্য ধন্য রব পড়ে গেল। জনতার মাঝ থেকে কেউ কেউ বললেন, ‘আমরা কাদের সিদ্দিকী সাহেবের একজন কমাণ্ডারকে সপ্তাহ খানেক আগেও দেখেছি। তার মধুর ব্যবহার আমাদের অন্তর জয় করেছে। আজ তার প্রধান সহকারীকে দেখলাম। এর বক্তব্য আমাদের শুধু উদ্বুদ্ধই করেনি, আমাদের শরীর ও মনে স্বাধীনতার আগুন জ্বালিয়ে দিল। আমরা যদি স্বয়ং কাদের সিদ্দিকীকে দেখার সুযোগ পেতাম, তাহলে শত গুণ সাহস ও শক্তি অনুভব করতাম, ধন্য হতাম।’
বক্তৃতা শেষে জনগণের মাঝে এই ধরনের কথোপকথন, মন্তব্য শুনে বললাম, ‘দেখুন, প্রয়োজন হলেই আমাদের স্যার এখানে আসবেন। আমরা তাকে দেখেছি যেখানেই তাঁর প্রয়োজন, সেখানেই তিনি হাজির হয়েছেন।’ এ কথা শুনে জনৈক শ্রোতা বললেন, ‘তা কি করে হয়। সিদ্দিকী সাহেব নিজে এখানে আসবে?’ আমি আবার বললাম, ‘প্রয়োজনে অবশ্যই আসবেন।
সন্ধ্যার পর আমরা দক্ষিণে রওনা হলাম। উদ্দেশ্য ধনবাড়ীকে সামান্য বায়ে রেখে নলীনের কাছে ধলেশ্বরী-যমুনার পাড়ে গিয়ে পৌঁছানো। পথ চলতে চলতে গভীর রাতে ধনবাড়ী থেকে প্রায় মাইল চারেক উত্তরে এক বি.ডি. চেয়ারম্যানের বাড়ীতে উঠলাম। এ বাড়ীতে খাবার চাওয়া হলে বাড়ীর একজন খাবার প্রস্তুতে অসুবিধা আছে বলে জানালো এবং আমাদের কিছু চিড়া-মুড়ি খেতে দিল। আমি ঝামেলা করার পক্ষপাতী ছিলাম না। চিড়া-মুড়িই সই। চেয়ারম্যান বাড়ীর পাশের বাড়ী আমার ছাত্রজীবনের সহকর্মী কাজী নুরুল ইসলামদের। মুক্তিযোদ্ধারা চেয়ারম্যান বাড়ীতে উঠেছে, এই খবর পেয়ে নুরুর ছোট ভাই চেয়ারম্যান বাড়ীতে এসে হাজির। পনের-ষোল বছরের কিশোর। নুরুল ইসলামের সাথে বহু সাদৃশ্য দেখে ছেলেটিকে নুরুর ভাই বলে সন্দেহ জাগলো। আমি উঠে গিয়ে ছেলেটিকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি নুরুর ছোট
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৭

ভাই?’ প্রশ্নের মুখে ছেলেটি থ’মেরে গেল। বলল, ‘হ্যা’, সেও পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?”
— তোমার চেহারা দেখে। তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?
— ভাল। ভাইজান, পাশের বাড়ীটা আমাদের, এটা জেনেও আপনি আমাদের বাড়ী না উঠে এই দালাল চেয়ারম্যান বাড়ীতে উঠলেন? আপনি আমাদের বাড়ীতে চলুন। মা-বাবার সাথে দেখা করবেন।
— লক্ষী ভাইটি, আজ আমি তোমাদের বাড়ী যাব না। আর দেখছ না, তোমাকে কত দূর এনে কথা বলছি, আমি জেনেশুনেই দালাল বাড়ী উঠেছি। তুমি তোমার বাবা-মাকে আমার সালাম দেবে। নুরু খুবই ভাল আছে এবং আশে পাশেই আছে। আমি ইচ্ছা করেই ওকে বাড়ী আসতে বারণ করেছি। ও বাড়ী আসলে এই দালান চেয়ারম্যান তোমাদের হয়রানি করার সুযোগ পাবে। নূরুর কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে তোমার মা বাবা যেন শুধু বলেন ‘আমরা জানিনা। আজ কালকার ছেলে মেয়েরা পিতা-মাতার কথাবার্তা খুব বেশী শুনে না। তাই নূরুর ব্যাপারে আমাদের কোন দায় দায়িত্ব নেই।”
নুরুর ছোট ভাই বায়না ধরলো, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা হব। আমাকে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি করে নিন। আমি আপনার সাথে থাকব। আমি আপনার মত হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলাম, ‘না ভাই, তা হয় না। তোমার বয়স অল্প। মুক্তিযোদ্ধা হতে তোমার আরও তিন বছর সময় চাই। অতদিন যদি যুদ্ধ চলে, তুমি অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবে। এ কথায় নূরুর ছোট ভাই দুর্বল হয়ে গেল, উৎসাহ স্তিমিত হল তবুও সব শেষে সে আবদার করে বলল, ‘সকালে আপনারা যখন যাবেন, আমি তখন আপনাদের পথ দেখিয়ে দেব।’ তাতেও আপত্তি জানালাম, ‘দেখ ভাই একেতো আমার কাছে রাস্তা চেনার যন্ত্র আছে, তাছাড়া এই এলাকার সমস্ত রাস্তা ঘাট আমার চেনা। সুতরাং আমাদের এগিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই। তুমি বা তোমরা বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ কর এটা আমি চাই না।’
চেয়ারম্যানের বাড়ীতে আমরা রাতটা জেগে জেগেই কাটিয়ে দিলাম। ভোর হয়ে এল, পাখি ডাকছে। মসজিদে ভোরের আজান শুরু হলো। আর একটু পরেই পুব দিগন্তে হবে সূর্যোদয়। সুতরাং আর বিলম্ব করা চলে না। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আঁধার আবরণ থাকতে থাকতে জামালপুর-মধুপুর পাকা রাস্তার পশ্চিম পাশে এসে পড়লাম। আমরা পাকা রাস্তা থেকে মাইল আড়াই পশ্চিমে মধুপুর থানার পাকসী ইউনিয়নের এক ভদ্রলোকের বাড়ীতে উঠলাম। বাড়ীর মালিক এক বিচিত্র চরিত্রের জীব।

বিচিত্র মেম্বার
বাড়ীতে উঠতে না উঠতেই একেবারে শস্য ক্ষেতে ঢুকে পড়া গরু তাড়ানোর মত করে তিনি আমাদের তাড়াতে এলেন। লোকটির বিন্দুমাত্র ভাবনা চিন্তা নেই, তার সামনে সাতাশ-আঠাশ জন সশস্ত্র মানুষ। তবুও তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। তার রুঢ় ভাষণের প্রথম কথা, ‘আমি কোন মুক্তিবাহিনী-টাহিনী থাকতে দিতে পারবো
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৮

না। আর আপনারা জানেন না, এই ইউনিয়নে আমি এবং আমার চেয়ারম্যান হলাম গিয়া শান্তি কমিটির মেম্বার। আমরা দুজনেই এই এলাকায় পকিস্তানের খুঁটি। এই সব জেনে শুনেও আপনারা আমার বাড়ীতে উঠেছেন? আপনাদের সাহস তো কম না? আপনাদের সাহসের তারিফ না করে পারা যায় না।’ অসন্তোষ, বিরক্তি আর উত্তেজনা প্রকাশ করে লোকটি বলে চললেন, ‘জানেন, আমিও নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছি। আওয়ামী লীগ করতাম। কিন্তু এখন আমি শান্তি কমিটির মেম্বার। কত লোক রাজাকারে ভর্তি করলাম। আমি আপনাদের ক্ষতি করতে চাইনা, তাড়াতাড়ি কেটে পড়ুন।
বাড়ীর মালিকের কথা আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে শুনলাম। অনেকক্ষণ পর আস্তে আস্তে বললাম, ‘এতগুলো সশস্ত্র লোক দেখেও আপনি যে ভাবে কথাগুলো বললেন, তাতে আমাকেও আপনার সাহসের প্রশংসা করতে হয়। তবে আপনি কি মনে করেন আমাদের জোর করে তাড়াতে পারবেন? অথবা আপনার কথার ধাক্কায় আমরা আপনার বাড়ী থেকে চলে যাব?’ এতে যেন বাড়ীর মালিকের সামান্য একটু পরিবর্তন ঘটলো। আমি আবার বললাম, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা মুক্তিবাহিনীর প্রতি আপনার এত আক্রোশ কেন?’ এবার কিন্তু ভদ্রলোক স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘দেখেন আপনাদের কিছুটা মুক্তিবাহিনী মুক্তিবাহিনী মনে হচ্ছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীরা মিলিটারী আসার আগেই পালায়, এদের দিয়ে কিছু হবে? তাই আমি এতটা ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়েছি। তবে যাই বলেন, কাদের সিদ্দিকীর একটা দল আছে, শুনেছি কাদের সিদ্দিকীর মুক্তিবাহিনী নাকি পালায় না, তারা জাহাজ মেরেছে। মধুপুরের ক্যাম্প দখল করেছে বলেও শুনেছি। বাড়ীর মালিকের এ সমস্ত কথায় কিছুটা ভরসা পেয়ে বললাম, ‘আমরাও কাদের সিদ্দিকীর দলের লোক।’ কথাটা শুনেই লোকটি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্মিত চোখে বললেন, ‘অ্যা। তাহলে আপনারা আমার বাড়ীতে থাকেন, কিন্তু আপনারা যে কাদের সিদ্দিকীর দলের লোক তার প্রমাণ কি? আমাকে প্রমাণ দিতে হবে।
ভদ্রলোক প্রমাণ চান, প্রমাণ ছাড়া তিনি কি করেই বা বিশ্বাস করবেন যে আমরা কাদের সিদ্দিকীর দলের লোক? বিপদে পড়লে অনেকেই তো অনেক কথা বলে, অনেক অমুক্তিযোদ্ধাও কাদের সিদ্দিকীর দলের লোক’ বলে পরিচয় দিয়ে ফাড়া কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করতে পারে। এক্ষেত্রে তেমন হওয়া বিচিত্র নয়। তাই ভদ্রলোক মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়ের প্রমাণ চান। কিন্তু আমরা কাদের সিদ্দিকীর দলের লোক, এটা কিভাবে প্রমাণ করবো? আমরা ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, আপনি কি কাদের সিদ্দিকীকে চিনেন?’ তার সাফ জবাব, ‘না, আমি কোন দিন কাদের সিদ্দিকীকে দেখি নাই।’ এখন উপায়? প্রমাণ ছাড়া তিনি আমাদের থাকতে দিবেন না। কিছুতেই না। ইতিমধ্যেই অবশ্য বুঝে ফেলেছি লোকটার কথাবার্তা রুক্ষ হলেও মানুষ হিসেবে খারাপ নন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি তাঁকে দেখেন নি, তাঁকে চিনেনও না। তাহলে আমরা যে তার দলের লোক তা কি করে প্রমাণ করবো?’ গৃহকর্তা একটি প্রমাণের পদ্ধতি বাতলে দিলেন। তিনি বললেন, ‘সিদ্দিকীকে না চিনলে কি হবে, তাঁর হ্যান্ডবিল আছে না? আমার কাছে তাঁর অনেক হ্যাণ্ডবিল
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪৯

আছে। তাতে সিদ্দিকী সাহেবের দস্তখত আছে। আপনারা যদি তাঁর লোক হন, তাহলে তাঁর লেখা দেখান৷ তাহলেই চিনতে পারব।’ আমার কাছে পরিচয়-পত্র নেই। যদিও অন্যান্য কমান্ডারদের জন্য পরিচয়-পত্র ইস্যু করতাম। কিন্তু আমি আমার পরিচয়-পত্র ইস্যু করি কিভাবে?
অবশ্য এ সমস্যা নিয়ে আমাদের বেশীক্ষণ চিন্তা করতে হলো না। বুদ্ধিমান সহযোদ্ধা মকবুল হোসেন খোকা এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এল। সে আমাকে একটু দূরে নিয়ে বললো, স্যার, পায়খানায় যাওয়ার ছল করে একটু দুরে গিয়ে পরিচয়-পত্র লিখে আপনার পকেটে রাখুন। পরে এসে লোকটিকে তা দেখালেই চলবে। মকবুল হোসেন খোকার পরামর্শ আমার মনঃপুত হলো। তাই করলাম। পরিচয়পত্র পেয়ে লোকটি যেন আমাদের একেবারে আপন করে নিলেন। তাঁর বাড়িতে দুটি বাচ্চার গুটি বসন্ত হয়েছিল, তা সত্ত্বেও তিনি অন্য বাড়ী থেকে রান্না করিয়ে আমাদের খাওয়ালেন।
এর পর শুরু হলো এক অদ্ভুত ব্যাপার। খাওয়া শেষে লোকটি আমার কাছে এসে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন ‘আচ্ছা, আপনারা কোন দিকে যাবেন?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বললেন ‘যদি পশ্চিমে যান তাহলে বেলা দুটার আগে অথবা সন্ধ্যা ছটার পরে যেতে হবে। আর পূর্ব দিকে যদি যেতে চান তা হলে সন্ধ্যার আগে কিছুতেই যাবেন না। বাড়ীর মালিকের কথায় কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়ে বললাম, কোন দিকে যাব, কখন যাব, কোথায় যাব, এসব আপনার জানার কথা নয়।’ লোকটা কিন্তু নাছোড়বান্দা। পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর ঘুরে এসে একই কথা বলেত লাগলেন। আমরা যেমন বাড়ীটির দিকে বহু দুর পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলাম, তেমনি বাড়ীর মালিক শান্তি কমিটির সদস্যটিও সমস্ত রাস্তার খবরাখবর সংগ্রহের জন্য তাঁর নিজস্ব লোক রেখেছিলেন। যদিও এ বিষয়টি ঐ বাড়ী থেকে চলে আসার আগে পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারিনি।
কেন ভদ্রলোক বেলা দুটার আগে বাড়ী থেকে আমাদের বেরিয়ে যেতে বলছেন, তা জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমি বলতে পারব না। তবে আপনাদের চলে যাওয়া উচিত।’ অনেক ভেবে- চিন্তে তাঁর কথামত বেলা একটা-পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আমরা পশ্চিমে ডুয়াইল-কেন্দুয়ার দিকে বেরিয়ে পড়লাম। লোকটাকেও সাথে নেয়া হলো। দুজন ছদ্মবেশী মুক্তিযোদ্ধা বাড়ীর মালিককে সাথে করে আগে আগে চললো। তাদের প্রায় পাঁচশত গজ পিছনে ছয়-সাত জনের একটি অগ্রবর্তী দল৷ তার পরেই আমি, ছদ্মবেশী দুজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে দুটি রিভলবার। তাদের উপর নির্দেশ আছে, লোকটির আচরণ সন্দেহজনক লক্ষ্য করলে তৎক্ষণাৎ গুলি করবে। না, তিনি তেমন কিছু করেননি। আমরা প্রায় সাড়ে তিনটায় ডুয়াইল-কেন্দুয়া খেয়া পার হয়ে লোকটিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় দিলাম।
খেয়া পেরিয়ে আধমাইল দক্ষিণে এগুতেই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, কেন বাড়ীর মালিক দুটার আগে তার বাড়ী থেকে আমাদের যেতে বলছিলেন। আমরা মাত্র আধমাইল দক্ষিণে এসেছি। এমন সময় চার-পাঁচশ রাজাকার ও মিলিশিয়া ডুয়াইল-কেন্দুয়া বাজারে এসে জ্বালাও
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫০

পোড়াও শুরু করেছিল। এদিন চারটায় কেন্দুয়া বাজারে সরিষাবাড়ী থেকে যে হানাদার আসবে, এটা ঐ শান্তি কমিটির সদস্যের জানা ছিল, তাই বিকাল চারটার আগেই ডুয়াইল-কেন্দুয়া অতিক্রম করতে আমাদের তিনি বারবার তাগিদ দিচ্ছিলেন। যদিও তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
এমনি করে নানা জনে, নানা ভাবে বাংলার স্বাধীনতার জন্যে কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান রেখেছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫১

বিচ্ছিন্ন অবস্থার অবসান

আমরা ঝাউয়াইল-ভেঙ্গুলা নদীর পাশ দিয়ে দক্ষিণে যাচ্ছি, আর হানাদাররা প্রায় আধ- মাইল দূরে নদীর পূব পার দিয়ে উত্তর দিকে যাচ্ছে। হানাদাররা তাদের সেদিনের অপারেশন শেষ করে ঘাঁটিতে ফিরছিল। আমরা আমাদের ঘাঁটির দিকে এগিয়ে চলেছি, আমি সেই বিচিত্র ও দুর্লভ চরিত্রের মেম্বারের বাড়ীতে থাকতেই খবর পেয়েছিলাম যে, হুমায়ুন কোম্পানীর অতিরিক্ত রসদ ও গোলাবারুদ হানাদার বাহিনী দখল করে নিয়েছে। আমাদের যুদ্ধ রসদ আমার সামনে দিয়েই জল্লাদ বাহিনী বয়ে নিয়ে যাবে, এটা কখনও ভাবতে পারিনি। অথচ অভাবিত ব্যাপারটিই ঘটল। আধ মাইল দূরে নদীর পূর্ব পাশ দিয়ে গরুর গাড়ী বোঝাই করে হানাদাররা আমাদের রসদ নিয়ে গেল। চোখের সামনে দিয়ে আমাদের গোলাবারুদ নিয়ে যাচ্ছে-এ দেখেও কিছুই করার ছিল না। দশ-বারোটি গরুর গাড়ীতে নানা ধরনের প্রায় পাঁচ লক্ষ গুলি, পনের হাজার পাউন্ড বিস্ফোরক, কয়েকশ ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন এবং তিন হাজার গ্রেনেড সহ আরও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম। সত্যিকার অর্থে এই প্রথম মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে হানাদাররা গোলাগুলি ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হলো।
হানাদাররা আমাদের দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে গেলে, আমরা আরো দক্ষিণে এগুলাম, এই সময় মানসিক প্রশান্তি ও তৃপ্তি পেতে একটি মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করতে সহকর্মীদের বললাম। পরদিন ২৫ কি ২৬শে সেপ্টেম্বর দুপুরে হেমনগর ইউনিয়নের একটি গ্রামে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত
হলো।

মিলাদ-মাহফিল
মিলাদ মাহফিলের জন্য ঝাউয়াইল বাজার থেকে মিষ্টি আনা হলো। আমার কাছে তখন মাত্র আড়াইশ টাকা ছিল। তা থেকেই মিষ্টি আনা হলো। মিষ্টির দাম অবশ্য খুব একটা বেশী ছিল না। রসগোল্লা, চমচম ও সন্দেশের দাম ছিল যথাক্রমে দু’ আড়াই ও ছয় টাকা সের। কুড়ি পঁচিশ টাকার মিষ্টি মিলাদের জন্য যথেষ্ট। অনেক খোঁজাখুঁজি করে একজন মৌলভী পাওয়া গেল। মৌলভী দেখতে অতিশয় কদাকার, কুৎসিত। গায়ের রং ভোটকা কালো। কোমর অবধি উঠানো কুর্তা, হাঁটুর সামান্য একটু নীচু পর্যন্ত লুঙ্গি ঝুলিয়ে মৌলভী সাহেব মিলাদ পড়াতে এলেন। মৌলভীকে দেখে প্রথমে আমি বীতশ্রদ্ধ হলাম। অন্তর থেকে সম্মান শ্রদ্ধা বা ভক্তি করতে পারলাম না। কিন্তু মৌলভী যখন মিলাদের সুরা পড়তে শুরু করলেন, তখন মৌলভীর মধুর কন্ঠ শুনে অভিভূত হয়ে গেলাম। আমি ইতিপূর্বে এত সুমধুর কন্ঠে কোরান পাঠ শুনিনি। মৌলভী সাহেবের প্রতিটি সুরাই আমার মনে গভীর রেখাপাত করলো। মিলাদ শেষে অশ্রুসিক্ত নয়নে মৌলভী সাহেবকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ভদ্রলোককে ডেকে আনার সময় মিলাদের পারিশ্রমিক হিসেবে পনের কুড়ি টাকা দেব-ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু সুমধুর কোরানের আয়াত শুনে আর ঐ সামান্য পারিশ্রমিক দেয়ার কথা ভাবতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, এমন সরল, স্নিগ্ধ ও মধুর কন্ঠের অধিকারীকে সমস্ত জগৎটা দিয়ে দিলেও তাঁর
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫২

পূর্ণ মর্যাদা দেয়া হবেনা। অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে খালি হাতে মৌলভীকে বিদায় জানালাম। মিলাদ শেষে আবার রওনা হলাম। শুরুতেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ঈশান কোণ কালো হয়ে তর্জন-গর্জন করে মেঘ ঘনিয়ে এলো। বৃষ্টি শুরু হলো, আমরা দৌড়ে গিয়ে ছোট্ট কয়েকটি শনের ঘরে আশ্রয় নিলাম। আমরা যখন বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বাড়ীগুলোতে উঠি, তখন বাড়ীর মা-বোনেরা রান্নাঘরে ছিলেন। আমাদের বাড়ীতে উঠতে দেখে একজন মা-বোনও কিছু মাত্র আপত্তি কিংবা অস্বস্তি বোধ করলেন না। ঘন্টাখানেক মুষলধারে বর্ষনের পর বৃষ্টির মধ্যেই আবার পথ চলার উদ্যোগ নিচ্ছিলাম। বাড়ীর মা-বোনেরা বারবার বললেন, ‘বাবারা, তোমরা এই ভর সন্ধ্যায় কোথায় যাবে। এখনেই থেকে যাও।’ ছোট্ট ঘর, নিজেদেরই থাকবার জায়গা নেই। শত অসুবিধা জেনেও তারা আমাদের থাকতে অনুরোধ করলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অসুবিধা ও দুঃখ-কষ্টকে বাংলার মা-বোনেরা নিজেদেরই দুঃখ-কষ্ট বলে মনে করেছেন। গ্রাম বাংলার মেয়েদের মন-মানসিকতা শহুরে লোকদের মত অতটা কৃত্রিম নয়। নাগরিক জীবনে নানা সমস্যাজড়িত লোকদের আদর-আপ্যায়নের মধ্যে একটা আন্তরিকতার অভাব অনুভব করা যায়। গ্রামের লোকদের আদর-আপ্যায়নের মধ্যে এখনো রয়েছে উষ্ণ আন্তরিকতার স্পর্শ। আমরা থাকলাম না, বা থাকতে পারলাম না। বাড়ীর লোকজন ও মা-বোনদের অজস্র ধন্যবাদ ও সালাম জানিয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে কচুর পাতায় মাথা বাঁচিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। চলতে চলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। আমরা যমুনা নদীর পূর্ব পারের ওয়াপদার বাধ ধরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছি। পাশের জমি থেকে বাধের উচ্চতা প্রায় পনের-কুড়ি ফুট। বাহাদুরা বাদ ঘাট থেকে টাংগাইলের পোড়াবাড়ী পর্যন্ত প্রায় একশ মাইল উত্তর দক্ষিণে লম্বা এই বাধ। অন্য দিকে যমুনার পশ্চিম পাড়েও এই বাধের দৈর্ঘ্য প্রায় দু’শ মাইল। এই বাঁধ দুপাশের ঘর-বাড়ী ও শস্যক্ষেত্র গুলোকে প্রবল বন্যার হাত থেকে বাঁচানোর একমাত্র রক্ষা কবচ।
জামালপুরের ভ্যাবলা গ্রামে হানাদার বাহিনীর আক্রমণে মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে খুবই মর্মপীড়া ও অস্বস্তিবোধ করছিলাম। আমার অস্বস্তি ও মর্মপীড়ার বড় কারণ সামাদ গামা, পিন্টু ও ফজলুদের দলের কোন খোঁজ-খবর জানিনা। একটার পর একটা বাধা বিপদ যেন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছিল। সেই অবস্থাতে মিলাদ-মাহফিল শেষ করে, সন্ধ্যার অল্প পরেই ওয়াপদার বাঁধ ধরে দক্ষিণে চলছিলাম। হঠাৎ আমার বা পাশ থেকে কিছু সরে যাওয়া অনুভব করলাম। নলিন বাজারের দেড় দু মাইল উত্তরে থাকতে কিছু যাওয়ার অনুভূতি পেয়ে সবাইকে থামিয়ে দিলাম। অগ্রগামী দলকে বারবার জিজ্ঞেস করলাম, আশে পাশে কোন কিছু দেখেছে, বা কারও চলাফেরা অনুভব করছে কিনা? ‘না’, স্কট পার্টির চৌকষ দশ জন যোদ্ধার একই কথা, তারা কারও চলে যাওয়ার শব্দ বা মানুষের কোন অস্তিত্বও অনুভব করেনি। আমার সন্দেহ দূর হলোনা। পিছনের আরও পাঁচ জনকে আধ মাইল এগিয়ে রাস্তার দুই পাশে দেখে রিপোর্ট করতে নির্দেশ দিলাম। ফিরে এসে তারা রিপোর্ট দিল’ না, রাস্তায় অস্বাভাবিক কোনকিছু অথবা মানুষের অস্তিত্ব নেই।
আবার চলতে শুরু করলাম। আমাদের অগ্রবর্তী দল ৫০০ গজ আগে চলেছে। দ্বিতীয়
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৩

বার চলা শুরু করে মাত্র দু’শ গজ অগ্রসর হয়েছে, রাস্তার পাশ থেকে একজন সামনে এসে চুপ করে সামরিক কায়দায় সালাম করলো। এরকম একটা আকস্মিক ঘটনার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ছিলাম না। চমকে উঠলাম। কিন্তু মুহুর্ত মাত্র। নিজেকে সামলে নিয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে যাব, এমনি সময় আগন্তুক বললো, ‘আমি হনুমান কোম্পানীর লোক। আমাদের কেম্পানী স্যার, এখান থেকে আধামাইল দক্ষিণে আছে। আমরা আপনার আসার খবর পেয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
আমি তো অবাক। দু’ দু’বার অগ্রবর্তী দলের সদস্যরা খুব তীক্ষ্মভাবে রাস্তার উভয় পাশে দেখে ফিরে এসে রিপোর্ট করেছে, রাস্তা এবং রাস্তার আশে পাশে কিছুই নেই। অথচ আমি কিছু একটা পাশ কাটিয়ে যাওয়া অনুভব করছিলাম সেটা মিথ্যা নয়। আগন্তুকের একজন সাথী প্রায় তিনশ গজ উত্তরে এসে অনুরূপ লক্ষ্য রাখছিল। সে আমাদের দেখে নিঃসন্দেহ হয়ে ত্বরিৎ দক্ষিণে ছুটে যায়। মুক্তিযোদ্ধাটি তার সাথীকে নিশ্চিত করে দিয়ে যায় যে, ‘হ্যাঁ তাদের খবর নির্ভুল। এগিয়ে আসা দলটিতে স্বয়ং সর্বাধিনায়ক আছেন। তুমি আমাদের দলের পক্ষ থেকে তাকে প্রথম স্বাগত জানাবে। আমি পিছনে গিয়ে কোম্পানী কমান্ডারকে খবর দিচ্ছি।
আমাদের কথা শেষ হতে না হতেই স্কর্ট পার্টির সাথে ‘হনুমান কোম্পানীর’ কমান্ডার হুমায়ুনের দেখা হলো। সে আমাদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসছিল। অগ্রবর্তী দলের খোকা এবং সামসু দৌড়ে এসে খবর দিয়ে, কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুমায়ুন সামনে অপেক্ষা করছেন। তাকে আসতে দেয়া হবে কিনা?
— হ্যা, তাদের আসতে দাও। মিনিট খানেক পর কোম্পানী কমান্ডার হুমায়ুন আবার সামনে হাজির হলো। যথারীতি সালাম বিনিময়ের পর আবার হাঁটতে শুরু করলাম। এবার হুমায়ুন এবং তার দল পথ প্রদর্শক হিসাবে চললো। পরে আমরা নলিন বাজারের কাছে একটি বাড়ীতে উঠলাম। নলিন- বাউয়াইল-ভেঙ্গুলা এলাকায় সপ্তাহ খানেক যাবত হুমায়ুন অবস্থান করছিল। তার লুকিয়ে রাখা অস্ত্রশস্ত্র হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে, তা আগেই উল্লেখ করেছি। হুমায়ুনের ব্যর্থতা সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত নেব, তা মনে ঠিক করে রেখেছিলাম। কোম্পানীর অন্যান্য সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে নানা ধরনের রিপোর্ট পাওয়া সত্ত্বেও কোম্পানী কমান্ডার হুমায়ুনকে গোলা বারুদ খোয়ানোর দায় থেকে অব্যাহতি দিলাম। শুধু তাই নয়, হুমায়ুন ও তার সহযোদ্ধাদের শান্তনা দিয়ে বললাম, ‘তোমরা ভাল ভাবে কাজ কর। অস্ত্র খোয়া যাওয়ার জন্য মন খারাপ করো না। অস্ত্র যোগান দেয়া আমার কাজ, যুদ্ধে ব্যর্থতা দেখালে নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাথে কঠোর ব্যবহার করতাম। অস্ত্র খোয়ানোর জন্য আমি তা করতে চাইনা। অস্ত্রের চাইতে সহযোদ্ধারা আমার কাছে অনেক মূল্যবান। আমার কথা শুনে কোম্পানী কমান্ডার হুমায়ুন হাফ ছেড়ে বাঁচল। এসময় অতগুলো অস্ত্র খোয়া যাওয়ার জন্য অনুশোচনা ও শাস্তির ভয়ে সে দু’দুইবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। তারই সহযোদ্ধা সরিষাবাড়ীর নুরু ও আনোয়ার-উল-আলম শহীদের চাচাতো ভাই আবদুল করিম অস্ত্র খোয়া যাওয়ার পর তাকে সারাক্ষণ অনুসরণ করছে, এবং আত্মহত্যার প্রচেষ্টা থেকে তারাই
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৪

তাকে বিরত রেখেছিল। তাই আমার কথায় কোম্পানী কমান্ডার হুমায়ুন নতুন জীবন পেল। অনুশোচনাও অনেকটা কেটে গেল, যদিও সঠিক ভাবে অস্ত্র লুকাতে ব্যর্থ হওয়ার কারনে অনেক দিন পর্যন্ত সে নিজেকে দারুণ অপমানিত বোধ করেছিল।
হুমায়ুন কোম্পানী ক্রমিক সংখ্যা অনুসারে তার পরিচয় রাখতে পারেনি এ কোম্পানরি ক্রমিক সংখ্যা ছিল ৪৭-খ। জুলাই থেকে ৪৭–খ কোম্পানী বারবার হানাদারদের উপর ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। যুদ্ধে প্রভুত নৈপুণ্য ও সফলতা অর্জনের কারণে হানাদারদের কাছে এই কোম্পানী হনুমান লোক বলে পরিচিত হয়ে যায়, অক্টোবরের শুরু থেকে এই কোম্পাণীর নাম ৪৭–খ থেকে ‘হনুমান কোম্পানী’ হয়। মোটা বুদ্ধির হানাদাররা শেষ অবধি বিশ্বাস করতো যে, কাদের সিদ্দিকী একটি ‘হনুমান কোম্পানী’ গঠন করেছেন। হুমায়ুনের কোম্পানীকেই তারা ‘হনুমান কোম্পানী’ বলে অভিহিত করতো।
১৯৭১ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর। রাত আনুমানিক আটটা। কমান্ডার হুমায়ুন তার আয় – ব্যয়ের হিসাব পেশ করলো। আয়-ব্যয় সংক্রান্ত হিসাবে ব্যাপক গড়মিল দেখে বললাম, ‘অস্ত্র খোয়া যাওয়ার ক্ষতি আমি স্বীকার করলেও আর্থিক লেন-দেনের ত্রুটি কখনও সহজভাবে নেবনা। তোমার মনে রাখা উচিত, আমার অত্যন্ত প্রিয় সহকর্মী এবং তোমার চেয়ে অনেক বেশী সফল ও বায়োঃজ্যেষ্ঠ কোম্পানী কমান্ডার শওকত মোমেন শাজাহানকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আয়-ব্যয়ের ত্রুটি ও জনগণের উপর আদেশ সূচক চাহিদা-পত্র প্রেরণের অপরাধে পদচ্যূত করে বন্দী করা হয়েছিল। ভুল রিপোর্টের ভিত্তিতে তার উপর শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে। একজন নিষ্ঠাবান সফল ও সাহসী কমান্ডার হওয়া সত্ত্বেও তাকে রেহাই দিতে পারিনি। সাবধান, কোন কোম্পানী কমান্ডারের অর্থসংগ্রহের কোন এক্তিয়ার নেই। তবু কোন সময় বিশেষ প্রয়োজনে অর্থ সংগ্রহ করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। তবে সঠিক হিসাব নিকাশ অবশ্যই থাকা চাই।’ কমান্ডার হুমায়ুনকে আরও বললাম, ‘কত অর্থ সংগ্রহ করা হলো, কত খরচ হলো, এসব ব্যাপারে গুরুত্ব দেবার চাইতে আমি গুরুত্ব দিই, অর্থ কতটা ন্যায়সংগত ভাবে ব্যয়িত হয়েছে এবং তার যুক্তি সংগত হিসাব আছে কিনা।’
নলিন, বাউয়াইল ও ভেঙ্গুলা থেকে সাত দিনে সে একলাখ আশি হাজার টাকার উপর চাঁদা ও প্রায় কুড়ি হাজার জরিমানা আদায় করেছে। এর মধ্যে সে ছেষট্টি হাজার টাকা খরচ করেছে। কিন্তু টাকা সংগ্রহ ও ব্যয়ের সর্বাঙ্গীন ও লিখিত রিপোর্ট না থাকায় তাকে বিশেষ ভাবে সাবধান করে দিলাম। সমস্ত টাকা এবং কাগজপত্র হুমায়ুনের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ‘সাত দিনের মধ্যে আয়-ব্যয় সংক্রান্ত সুষ্ঠ হিসাব তৈরি করে হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেবে। এর পরও এ টাকা থেকে সহযোদ্ধাদের প্রয়োজনে যুক্তিসংগত ভাবে খরচ করতে পার। আমি শুধু চাই, সুষ্ঠ হিসাব এবং খরচের যুক্তিসংগত কারণ।’
সমস্ত অর্থ হুমায়ুনের হাতে তুলে দিয়ে ছোট একটি কাগজে ‘আমাকে দুই হাজার টাকা দেয়া হোক’ লিখে নীচে স্বাক্ষর করে হুমায়ুনের কাছ থেকে দু’হাজার টাকা নিলাম।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়
নলিনের দুমাইল পশ্চিমে জগৎপুরা চরের ধলেশ্বরী নদীর পারে আলি আকবরের বাড়ীতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৫

উঠলাম। এই সময় অবিরাম তিনদিন ঝড়-বৃষ্টি হওয়ায় কোথাও বেরোতে পারলাম না। এই তিন- দিন চল্লিশ জন সহযোদ্ধাসহ একবার মাত্র আড়াই সের চালের ভাত খেয়ে কাটাতে হল। তৃতীয় দিন ক্ষুধার জ্বালায় এতই কাতর হয়ে পড়লাম যে নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। আমাদের এ অবস্থা দেখে বাড়ীর মালিকের দয়া হলো। তার ঘরের কাড়ে রাখা ৪০০ সবরী কলার তিন-চারটি ছড়া নমিয়ে দিলেন। কলাগুলির কোনটা কাচা আবার কোনটা পাকা। কাঁচা পাকা প্রায় আশিটি কলা আমি একাই সাবাড় করে দিয়েছিলাম। যদিও কলাগুলি খুবই ছোট ছিল।
চতুর্থ দিনে আকাশ মেঘমুক্ত হতে শুরু করলো। ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলে ঘর থেকে বেরোবার একটা উপায় হলো। আলি আকবরের হাতে একশ টাকা দিয়ে বললাম, ‘দেখুন, আপনারাও পুরো চার দিন না খেয়ে আছেন। আপনাদের যে চাল ছিল, তাতো প্রথম দিনেই আমাদের খাইয়েছেন। তাড়াতাড়ি বাজার থেকে চাল এবং অন্যান্য তরিতরকারী যা পাওয়া যায় এনে আমাদেরও দুটো যেতে দিন, আপনারাও খান। আমরা আর ঘন্টাখানেক বা দু’ঘন্টার বেশী অপেক্ষা করতে চাইনা।’ এই সময় অর্জুনার মজিবর মিয়া নামে এক ভদ্রলোক এলেন। তাকে দুটি নৌকার ব্যবস্থা করতে বলা হলো। তিনি খুব খেটে খুটে এক ঘন্টার মধ্যেই দু’টি নৌকা সংগ্রহ করে আনলেন। জগৎপুরার চরে তিনদিন না খেয়ে থাকার পর চতুর্থ দিন সকালে খাবার খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
জগৎপুরা থেকে সোজা কয়েক মাইল পশ্চিমে শশুয়ার চরে এলাম। শশুয়ার চরের স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার বাহাজ উদ্দীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের এম.এ. শেষ পর্বের ছাত্র। ২৩শে জুন আমার সাথে তার মাত্র একবারই সাক্ষাৎ হয়েছিল। শশুয়ার চরে এসেই বাহাজ উদ্দীনকে ডেকে পাঠালাম। জুন থেকে সেপ্টেম্বর, এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে কত উলট পালটই না হয়ে গেছে। কিন্তু বাহাজ উদ্দীন ও তার স্বেচ্ছাসেবক দলের সবাই ঠিক আছে। শশুয়ার চরটি সাত-আট মাইল উত্তর দক্ষিণে লম্বা, মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ও তিন-চার মাইল দূরে অবস্থিত। চতুর্দিকেই পানি আর পানি, মনে হয় চরটি যেন পানির উপর ভাসছে। মুক্তিবাহিনী যখন বিশৃঙ্খল ও বিভ্রান্ত, তখনও বাহাজ উদ্দীন তার স্বেচ্ছা সেবকদল নিয়ে আগের মতই উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য ও আশ্রয় দিয়েছে।
১৯৭১ সালের ২রা অক্টোবর, খবর পেয়ে বাহাজ উদ্দীন পাগলের মত দৌঁড়ে নদীর ঘাটে এল। একটু পরেই দু’তিনশ স্বেচ্ছা সেবক পঙ্গপালের মত ছুটে আসতে লাগলো। আমাকে তারা নৌকা থেকে অতি যত্ন ও সম্মানের সাথে নামিয়ে নিল।
তারা সবাই আনন্দে উল্লসিত। চরের প্রত্যেকটি অধিবাসীর চোখ মুখ খুশীতে উজ্জ্বল। আমাকে নিজেদের এলাকায় নিজেদের মধ্যে পেয়ে তারা পরম ভাগ্যবান। সমাদরের কোন শেষ নেই। এই রকম ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও সমাদর সম্ভবতঃ ধর্মীয় নেতারাই পান। রাজনৈতিক নেতা কিংবা যোদ্ধা অথবা অন্য কেউ এইভাবে উচ্ছ্বসিত শ্রদ্ধা মেশানো ভালবাসা পেতে পারে, তা আমার ধারণায় ছিল না। শশুয়ায় চরের স্বেচ্ছা সেবক ও জনগণের মিলিত আনন্দ ও উল্লাসের বহিঃ প্রকাশ
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৬

লিখে কাউকে বুঝানো আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়।
শশুয়ার চরের জনগণের অনুরোধ ও চাপাঁচাপিতে একটি সভায় বক্তৃতা দিলাম। স্বেচ্ছা সেবকরা আমাকে সামরিক অভিবাদন জানালো। চরের অধিবাসীরা ভালবাসা ও স্নেহের নিদর্শন স্বরূপ একটি খড়ের টুপি ও একটি পাখা (চর এলাকায় খড় দিয়ে তৈরী) উপহার দিলেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি কামনা করে একটি মিলাদ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হলো। সারা দিন শশুয়ার চরে কাটিয়ে সন্ধ্যার পর আবার মাল্লাদের স্রোতের অনুকূলে নৌকা ভাসাতে বললাম। এবার গন্তব্যস্থল সেই জাহাজ মারা ঘাট-মাটি কাটার চর।

মাটিকাটা চরে
১১ই আগস্ট কমাণ্ডার হাবিবের নেতৃত্বে হানাদারদের যে দুটি জাহাজ মুক্তিবাহিনী দখল করেছিল, তা এর আগে আমি স্বচক্ষে দেখিনি। অবশ্য জাহাজ দুটি কত বড়, তা কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম। তবে ৩রা অক্টোবর প্রত্যুষে সামান্য কুয়াশার মধ্যে বহু দূর থেকে নদী মাঝে বট গাছের মত একটা কিছু দেখে সহযোদ্ধাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘নদীর মাঝে ঐ বটগাছ কেন?’ সহযোদ্ধা দুলাল আমার ভুল ভেঙে দিয়ে বললো, ‘স্যার, ঐ যে নদীর মাঝখানে কালো বিরাট পাহাড়ের মত দেখা যাচ্ছে, ওটা গাছ নয়। ওটাই আমাদের হাতে বিধ্বস্ত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। উল্লেখ্য আমার সহযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র ভুয়াপুরের দুলালই জাহাজ মারার সময় কমাণ্ডার মেজর হাবিবের সাথে ছিল। দুলালের কথা শুনে দূরবীন চোখে খুব ভালো করে ভাঙাচোড়া জাহাজ দেখে বিস্মিত হয়ে গেলাম। সেই আগস্ট থেকে এত দিন জাহাজ দু’টি সম্পর্কে যত কল্পনা করেছি, তা সবই ছিল অপ্রতুল। জাহাজ দুটি যে কত বড়, তার অর্ধেকও আমি অনুমান করতে পারিনি। কাছে গিয়ে জাহাজ দেখার কৌতূহল হাজার গুণ বেড়ে গেল। আমি আর ধৈর্য্য রাখতে পারছিলাম না। পাহাড়ের মত বিরাট জাহাজ। দেড় ঘন্টা পর জাহাজের কাছে নৌকা পৌঁছলো। এতো জাহাজ নয়, এ যেন দোমড়ানো লোহার পাহাড়। গোলার আঘাতে আঘাতে প্রায় দু’তিন’শ ফুট লম্বা দু’খানা অতিকায় জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ধলেশ্বরীর বুকে মুখ থুবড়ে পড়ে থেকে পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ দুটির চার পাশে ঘুরে ঘুরে আমাদের সবার বুক আনন্দ ও প্রত্যয়ে ভরে উঠল। জাহাজ দেখা শেষে আবার দক্ষিণে চললাম।
নিকড়াইল স্কুলের পাশে আমাদের নৌকা বাঁধা হলো। আমার মন আনন্দে ভরপুর, গৌরবে উদ্দীপ্ত। জাহাজ সম্পর্কে নানা অনুভূতির রেশ তখনো কাটেনি। এমন সময় খবর এলো, পিকনার কাছে দু’দিন আগে আব্দুল হাকিম এসে পৌঁছেছে। সে আমার সাথে দেখা করতে নিকড়াইলে এসেছে।

নিকাড়াইলে যোগাযোগ পুনঃ প্রতিষ্ঠা
আমরা নিকড়াইল ঘাঁটে এসেছি, এই খবর পেয়ে মেজর আবদুল হাকিম তার লোকজন নিয়ে উল্কার বেগে ঘাটপাড়ে ছুটে এলো। কাছে আসতেই হাকিমকে জাপটে ধরলাম। হাকিমের পাশে দাঁড়ানো পিন্টু। পিন্টুর দিকে চোখ পড়তেই আমার দেহ মনে বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে গেল। হাকিমকে ছেড়ে পিন্টুকে জাপটে কোলে তুলে নিয়ে ধপ্ করে ছেড়ে দিয়ে, উত্তেজনায় থর থর করে কাপতে কাপতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পিন্টু, তুই হাকিমের সঙ্গে কেন? বাকীরা কোথায়? আমরা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৭

সরে যাবার পর তোদের কি হয়েছিল?’ হাপাতে হাপাতে এক নিশ্বাসে অনেকগুলো প্রশ্ন করলাম। পিন্টু আদি অন্ত ঘটনা বর্ণনা করলো, যা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। কেবল অনুল্লেখ ছিল, দলের অপারেটর সহ দু’টি ওয়ারলেস সেট ভ্যাবলার বিপর্যয়ে খোয়া যাওয়ার কথা।
পিন্টুকে পেয়ে আনন্দে উম্মাদ হয়ে উঠলাম। সব হারিয়ে আবার একে একে সব ফিরে পেতে শুরু করেছি। পিন্টু ও মেজর হাকিম অন্যান্যদের সাথে কথাবার্তার সময় আরও একটি লোভনীয় খবর এলো। ৭ই সেপ্টেম্বরের পর আনোয়ার-উল-আলম শহীদ এক সপ্তাহের মধ্যে আস্তে আস্তে হেড কোয়ার্টার তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছিলেন। হেড কোয়ার্টারের বিশেষ দূত দু’তিন দিন আগে আমার খোঁজে পশ্চিমাঞ্চলে এসেছিল। হেড কোয়ার্টারের দূতের কাছে পূর্বের উল্লেখিত সমস্ত ঘটনা শুনে এবং একটি লিখিত রিপোর্ট পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। আমি তখন নিজেকে আর সামলাতে পারছিলাম না। নিয়তির বিধানই এই। চরম উৎকণ্ঠা ও বেদনার পরই নেমে আসে পরম আনন্দ, শান্তি ও তৃপ্তি। এখানেও তাই হলো। আমাদের কুশল সংবাদ সহ হেডকোয়ার্টারের সবার প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে ছোট্ট একটা বার্তা সহ দূতকে পাঠিয়ে দিলাম।
৩রা অক্টোবর। সন্ধ্যায় নিকড়াইল থেকে আরও কয়েক মাইল ভাটিতে গিয়ে জোগার চরের পশ্চিমে বারই পোটল চরে ঘাঁটি গাড়া হলো এবং দ্বিতীয় বার যুদ্ধ পরিকল্পনা করা হলো। আমি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছি প্রায় পনের-ষোল দিন হয়ে গেছে। এরমধ্যে কয়েকদিন সবার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিলাম। ৩রা অক্টোবর থেকে স্বাভাবিক যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়া শুরু হলো।
ভারত থেকে বারই পোটল চরে মোয়াজ্জেম হোসেন খান এসে হাজির হলেন। সে এসেই বললেন, ‘স্যার, আমি নয়শ ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এসেছি। আমিতো স্যার, ভারতে আপনার রাষ্ট্রদূত। এবার আমাকে যে ধরনের কাজ দেবেন সেটাই করবো। এই যে ব্রিগেডিয়ার সান সিং আপনাকে একখানা পত্র দিয়েছেন।’ বলেই সসম্মানে পত্রখানা আমার হাতে তুলে দিলেন। মোয়াজ্জেম হোসেন খান তখন যেন গর্বে ফেটে পড়ছিলেন। আমি দেশে প্রবেশ করার পর মোয়াজ্জেম হোসেন খানই প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র সহ ভারতে ট্রেনিং প্রাপ্ত নয়শ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে প্রথম এসেছেন। এতে তার গর্ব যেন হাজার গুণ বেড়ে গেছে। আর সত্য কথা বলতে কি, পুরোটা মুক্তিযুদ্ধে তিনি গর্ব অনুভব করার মত কাজই করেছেন।
মোয়াজ্জেম হোসেন খান যখন এলেন, তখন কয়েকজন কমাণ্ডার নিয়ে নতুন পরিকল্পনা প্রস্তুতে ব্যস্ত ছিলাম। মেজর হাকিম, জাহাজ মারা দুর্ধর্ষ কমাণ্ডার মেজর হাবিব, হনুমান কোম্পানীর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন হুমায়ুন, মেজর আংগুর, মেজর আরজু, সরিষাবাড়ীর মেজর আনিস, বামন আটার ক্যাপ্টেন হবি, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ সরিষাবাড়ীর লুৎফর রহমান, গোপালপুরের মেজর তারা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ক্যাপ্টেন রেজাউল করিমকে নিয়ে পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হলো ৭ই অক্টোবর রাতে টাংগাইল-ময়মনসিংহ সড়কের একটি সেতু ধ্বংস এবং ভুয়াপুর ও গোপালপুর এ দুটি থানা পূর্ণ দখল নিতে হবে। আক্রমণের ফলাফল কি হয়, তা জেনে যেতে মোয়াজ্জেম হোসেন খানকে দু’এক দিন অপেক্ষা করতে বলা হলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৮

অপারেশন ট্রায়ো

৭ই অক্টোবর ১৯৭১ সাল। পবিত্র শবেবরাতের রাত, প্রতিটি মুসলমানের কাছে শবেবরাতের রাতটি খুবই পবিত্র ও তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মনে করেন, শবেবরাতের রাতে আল্লাহর দরবারে প্রতিটি মানুষের পরবর্তী বছরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তাই শবে বরাতের রাতে প্রতিটি ধর্মপ্রান মুসলমান অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে সারারাত ইবাদত বন্দেগী করে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে দেন। ৭ই অক্টোবর রাতে আমরা আর একটি মিলাদ মাহফিলের ব্যবস্থা করতে পাশের গ্রামের স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডারকে নির্দেশ দিয়েছিলাম।

শবেবরাত উদযাপন
পবিত্র শবেবরাতে মুক্তিযোদ্ধারা একটি মিলাদের আয়োজন করেছে। অনেক হিন্দু ও দুই এক জন খৃষ্টান সহযোদ্ধাও মিলাদ মহাফিলে বসেছে। অন্য সহযোদ্ধারা ইচ্ছে করলে আলাদা ভাবে যাতে সময়টা কাটাতে পারে, সে রকম ব্যবস্থাও করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার জনৈক মৌলভীকে নিয়ে এসেছে। শুরু হলো মিলাদ মাহফিল। মৌলভী রসূল করিম (দঃ) -এ চরিত্র ও কর্মময় জীবন নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে শুরু করলেন। ছ’সাত দিন আগে অনুষ্ঠিত ঝাউয়াইল-ভেঙ্গুলার মিলাদ মাহফিলের মৌলভীর মতই এ মৌলভীও আবেগময় কণ্ঠে দোয়া দরূদ পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মুগ্ধ করে ফেললেন। মিলাদ শেষে মোনাজাতের জন্য মৌলভী আল্লাহর দরবারে হাত তুললেন। আমরা তাকে অনুসরণ করলাম।

মৌলভীর আজব মোনাজাত
মোনাজাতের আগ পর্যন্ত দোয়া দরুদ পরে মৌলভী সবাইকে মুগ্ধ ও অভিভূত করে ফেলেছিলেন, কিন্তু মোনাজাতের সময় তিনি একটি অভাবনীয় কাণ্ড বাঁধিয়ে বসেন। হাত তুলে অনেক সূরা পড়ে যখন বাংলায় বলা শুরু করলেন, “হে পরম করুণাময় আল্লাহ, তুমি পাকিস্তানের দুশমনদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা কর। তুমি সকলকে ঈমান দাও, পাকিস্তানকে বালা মুসিবত থেকে বাচাও, ইসলাম ধর্মের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে সাহায্য কর। হে আল্লাহ গো, আমাদের পাকিস্তানের দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করার, জেহাদ করার তৌফিক দাও। (আল্লাগো বলে কেঁদে বুক ভাসিয়ে) এরা যে উদ্দেশ্যে হাত তুলেছে সেই উদ্দেশ্য সফল কর। এদের তুমি জয়ী কর। তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ কর।” এই সময় আমার পাশে বসা স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা, সর্বনাশ। মৌলভী করছে কি? মুক্তিবাহিনীর মিলাদে হানাদারদের সফলতা কামনা করছে? পাক-দুশমনদের খতম কামনা করছে? নির্ঘাত মৌলভীর গর্দান যাবে।
মিলাদ মাহফিলের মৌলভী কিন্তু মোটেই জানতেন না যে, তিনি যাদের মাঝে বসে মিলাদ পড়ছেন, তারা কারা? পাক সমর্থক, না মুক্তিবাহিনী। তাই অত্যন্ত নিঃসংকোচে দরদ দিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৯

পূর্বোল্লেখিত কায়দায় মোনাজাত করলেন। মোনাজাত শেষে মৌলভীর সাথে মোসাফা করলাম। স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার তখনও কিন্তু ভীত-সপ্তন্ত্র। মৌলভীকে মোনাজাতের জন্য কিছু বললাম না। বরং যথাযথ সম্মান দেখিয়ে কুড়িটি টাকা দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডারের সাথে ছোট্ট ডিঙ্গিতে নামিয়ে দেয়া হলো।
পরের দিনের ঘটনা। হেচ্ছাসেবক কমান্ডার দুরু দুরু বুকে সাহসে ভর করে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “গত রাতে মৌলভী অমন মোনাজাত করার পরও কেন কোন প্রতিক্রিয়া দেখলাম না আমরা তখন বিজয়ী, মিলাদ শেষে একটি অপারেশনে গিয়ে ছিলাম। সফল অপারেশন শেষে ফিরে এসেছি। হাসতে হাসতে বললাম, “মৌলভী তো কোন ভুল করেনি, সেতো আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ার দোয়াই করেছিল। আর আমরা জয়ী হয়েছি। তাই ঐ অবুঝদের নিয়ে অত মাথা ঘামানো উচিত নয়। লোকটা যদি জানতো আমরা মুক্তিবাহিনী, তাহলে আমাদের জন্যে খোদার দরবারে মোনাজাত করে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ফেলতো। আমি মোনাজাতের সময় মৌলভীর অনুসরণ করিনা, হাত উঠিয়ে আমার মন যা বলে আমি তাই কামনা করি। আল্লাহর কাছে আমাদের মত ক্ষুদ্র মানুষের কি চাইবার আছে, তিনি তো সবই জানেন। তাই কি চাইব? আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।”
২৩শে জুন ভুয়াপুর থেকে লাবিবুর কোম্পানী নাগরপুর আক্রমণে যাচ্ছিল। সেখানকার রাস্তার সাথে পরিচিত বলে জাহাঙ্গীরও তাদের সাথী হয়েছিল, দুজনই টাংগাইলের স্বদলীয় বিশ্বাসঘাতকদের হাতে নিহত হয়েছিল। এরাই টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ। প্রায় তেমনি একটি বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটলো ৭ই অক্টোবর রাতে। তবে পূর্বের মত স্বদলীয়দের হাতে নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে হানাদারদের গুলিতে। ঘটনাটি এই রকম : ভুয়াপুর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল কদ্দুস আমার বহুদিনের ছাত্র সহকর্মী। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে আমার সহযোদ্ধা, জুন মাস থেকে আবদুল কুদ্দুস আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। এমনকি মাকড়াই-এর বিখ্যাত যুদ্ধ, তারপর ভারত গমন ও প্রত্যগমন সব সময়ই সে আমার দলভুক্ত ছিল। কিন্তু ৭ই অক্টোবর দুপুরে যখন ভুয়াপুর- গোপালপুর থানা পূর্ণদখলের পরিকল্পনা হলো, তখন আবদুল কদ্দুস বিনীত অনুরোধ করলো, ‘স্যার, যারা ভুয়াপুর আক্রমণ করতে যাচ্ছেন আমি তাদের সাথে আক্রমণে অংশ নিতে চাই। ভুয়াপুর থানা আক্রমণ ও দখলের যুদ্ধে অংশ গ্রহণে শুধুমাত্র একদিনের জন্য ছেড়ে দিলে আমি চিরঋণী থাকবো।’ আব্দুল কদ্দুস আরও বললো, ‘স্যার, আপনি তো জানেন, অনেকদিন ধরে আমরা আন্দোলন করছি। সেই আন্দোলনই আজ স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। আমার নিজের থানা শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধে অংশ নিতে পারবো না, এমন শাস্তি আমাকে দিবেন না। আপনি দয়া করে, থানা দখলের যুদ্ধে অংশ গ্রহণের অনুমতি দিন। এরপর আমার আর কিছু বলার থাকলোনা, কদ্দুসকে অনুমতি দিতে হলো। মুক্তিযোদ্ধারা থানাও দখল করেছিল। কিন্তু কুদ্দুস আর ফিরে আসেনি।
মিলাদ শেষে, ৭১ সালের শবেবরাতের রাতটা কিন্তু আমরা আল্লাহর এবাদত বন্দেগী ও
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬০

কান্নাকাটি করে কাটিয়ে দিইনি। রাতে সেতু আক্রমণের জন্য বেরিয়েছিলাম।

ফুলতলা সেতু ধ্বংস
জোগার চর থেকে দুটি নৌকায় এলেঙ্গার কাছে এসে নামলাম। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে দুমাইল পাড়ি দিয়ে ফুলতলা গ্রামের ভিতর দিয়ে নিরাপদে ফুলতলা ব্রীজের কাছে পৌঁছে গেলাম। রাত তখন আনুমানিক দুটা, আমরা উত্তর দিকে রাস্তার উপর উঠে সোজা পুলে আঘাত হানলাম। আমার সহযোদ্ধারা এমনিতেই খুব পারদর্শী, তার উপর আমি তাদের একেবারে পাশে। ফুলতলা সেতু দখল আমাদের কাছে ডাল-ভাত, পনের মিনিটের এক তরফা গুলিতে ফুলতলা সেতুর এক অংশের পতন ঘটলো। কিন্তু সমস্যা ও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ালো, একজন মিলিশিয়া। সে একটি বাংকার থেকে অনবরত লাইট মেশিন গানের গুলি চালাচ্ছে। সেতুটির উত্তর অংশ মুক্ত হলেও দক্ষিণ অংশ দখল করা যাচ্ছিলনা। এই সময় সহযোদ্ধা মকবুল হোসেন ছুটে এসে বললো, ‘স্যার আমারে যদি পারমিশন দেন, তাহলে ঐ শালার বাংকারে গিয়া গ্রেনেড মারি।’ ‘তুই পারবি’ বলে অনুমতি দিলাম। মকবুল সেতুর উপর দিয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে মিলিশিয়াটির বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করলো। আগেও প্রায় একশ খানা গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছে। হাত বোমার শব্দে মাঝে মধ্যে সমগ্র এলাকাটি প্রচণ্ড ভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। কিন্তু মকবুলের হাত বোমা যেন আগের সব বোমার শব্দ ও কাপনকে হার মানিয়ে দিল। হাত বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে এল. এম. জি. বন্ধ, বাংকারে মিলিশিয়াটির দেহ টুকরো টুকরো হয়ে গেল। পুল পুরোপুরি মুক্তিবাহিনীর দখলে এসে গেল। এই একজন মিলিশিয়াকে মারতে বা যুদ্ধ করতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় দশ মিনিট লেগেছিল।
ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপ বিস্ফোরক লাগানো শুরু করে দিল। বিস্ফোরক লাগানো শেষ হলে দেখা দিল আরেক বিপত্তি। পুলের ঠিক নীচে গলা সমান পানিতে কয়েকজন রাজাকার ঘাপটি মেরে বসে আছে। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের দেখে চিৎকার করে উঠলো, ‘বেটা শয়তানরা। বাঁচতে চাস তো তাড়াতাড়ি ভাগ।’ বেকুব, হতচকিত রাজাকাররা করুণ কন্ঠে বললো, ‘আমরা যুদ্ধ করি নাই। আমাগো মাফ করেন। আমরা কিছু করি নাই। মাফ চাইতাছি।’ মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে বললো, ‘বেটারা পালা, এক্ষুণি পুল ভেঙে পড়বে।’ (পুল ভাঙতে বা ভেঙে পড়তে তো রাজাকাররা দেখেনি। তাই ঠিক আন্দাজ করতে পারছিল না) মুক্তিযোদ্ধাদের ধমক খেয়ে কাকুতি মিনতি করতে তারা পুলের নীচ থেকে সরে গেলে পুলে বিস্ফোরণ ঘটানো হলো।
আমার নিজের দলের এটা তৃতীয় বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণে সেতুটি সম্পূর্ণ ধ্বসে গেল না। দেড়-দু ফুট নীচু হয়ে সেতুর মাঝখানের চার পাঁচ ফুট ভেঙে পড়লো। অতিরিক্ত বিস্ফোরক না থাকায় সেতুটি পুরোপুরি ধ্বংস করা নিয়ে আমরা আর মাথা ঘামালাম না। ৪ খানা রাইফেল ও একখানা এল. এম. জি. বগলদাবা করে যখন সরে যাবো, ঠিক তখন মুক্তাগাছার মকবুল বলল, ‘স্যার পুলের ওপাশে রাজাকারদের টিনের ঘরটা জ্বালাইয়া দিয়া আসি। মকবুলের প্রস্তাবটা খুবই লোভনীয়, অনুমতি না দিয়ে পারলাম না। মকবুল সহ চার-পাঁচ জন যোদ্ধা দৌঁড়ে গিয়ে রাজাকারদের পঞ্চাশ-ষাট হাত লম্বা ছাপড়া ঘরের উত্তর পাশে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬১

উঠলো। আমি দ্রুত রাজাকারদের জ্বলে ওঠা ঘরে গেলাম। উদ্দেশ্য, ভষ্মীভূত হওয়ার আগে ঘরে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু না। কোন কাগজপত্রের বালাই নেই। হঠাৎ দেখলাম ঘরের মাঝখানে একজন লোক পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে দেখলাম লোকটির হৃদক্রিয়াও স্বাভাবিক চলছে। প্রথম মনে করেছিলাম লোকটির গুলি লেগেছে। না তার কিছুই হয়নি। আক্রমণের সময় সবাই যখন পালিয়ে যাচ্ছিল, তখনও সে ঘুমিয়ে ছিল। ঘুম থেকে উঠে সবাইকে পালিয়ে যেতে দেখে সে না পালিয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। পুলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সময়ও সে নড়াচড়া করেনি। তার ধারণা ছিল, পুল ভেঙে মুক্তিবাহিনী চলে যাবে, সে ততক্ষণ ঘুমের ভান করে কাটিয়ে দেবে। বাইরে আগুন, ঘরেও আগুন, চারিদিকে মুক্তিবাহিনীর আনাগোনা। এতসব দেখেও সে পালায়নি বা পালাবার চেষ্টা করেনি। হাঁদা রাজাকারটিকে বেত দিয়ে খোঁচা মারলাম। তখনও বেটার নড়াচড়া নেই। বললাম, “বেটা শয়তান, ঘুমের ভান করছিস? ঘরে আগুন জ্বলছে। পুড়ে ছাই হবি। মুসলমানের ছেলে, পুড়ে ছাই হলে ধর্ম যাবে। বেটা ওঠ, তোদের সবাই পালিয়েছে, তুইও পালা।” বলেই রাজকারের পিঠে সপাং সপাং কয়েক ঘা বেত বসিয়ে দিলাম। বেতের আঘতে বেটা রাজাকার ঘুম ভাঙার ছুতো খুঁজে পেলো। বেত খেয়ে লাফিয়ে উঠে কাঁপতে কাঁপতে বললো, “এ্যা। কি হয়েছে? আমায় মাফ করেন। আমি কোন দোষ করি নাই।” রাজাকারটির পিঠে আরও কয়েক ঘা বসিয়ে দিয়ে বললাম, “যা, ভাগ।” রাজাকারটি পরিমরি করে ছুট দিলে, আমরা সফল অভিযান শেষে রাত চারটায় ক্যাপ্টেন আমান উল্লাহর এলেঙ্গা-হাকিমপুরের বাড়ীতে এলাম।
হাকিমপুর আমান উল্লাহর বাড়ী, অতীতে বহুবার এসেছি। তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম এলাম। আমাকে দেখে আমান উল্লাহর বাবা, চাচারা এবং বৃদ্ধা দাদী বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে পড়লেন। অন্যদের মত এ পরিবারের সবাই শুনেছিলেন, আমার গুলি লেগেছে। তাই দাদীর নজর আমার কোথায় গুলি লেগেছে, কিন্তু শত চেষ্টা করেও তিনি গুরুতর কোন আঘাতের দাগ খুজে পেলেন না। বারে বারে আমার শরীর হাতিয়ে দাদীর হয়তো মনে হলো, তাদের চেনা, প্রিয় বস্তু আগের চেয়ে আরও সহজ, সরল ও বলিষ্ঠ হয়েছে। আমান উল্লাহর বাবা ময়েজ সরকার ও চাচা ওমর আলী আমাকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। তাঁরা একেবারে আত্মহারা। আমাকে তারা সবাই নিজেদের ঘরের ছেলের মত মনে করতেন ও ভালবাসতেন। আমি এখনও তাদের ঘরের ছেলের মত রয়েছি কিনা- সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সেই বজ্র একই রয়েছে দেখে তাঁরা খুশীতে কাঁদবেন না হাসবেন, বুঝতে পাছিলেন না। তবে খুশীতেই হোক আর বেদনায়ই হোক, বাড়ীর প্রতিটি নারী পুরুষের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো।
বাড়ীর উঠানে বসে কথাবার্তা শেষ করে ভোরের আলো না ফুটতেই বেরিয়ে পড়বো, এমন সময় ঐ গ্রামেরই দুইটি ছেলে ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমানের কোম্পানী থেকে সিগন্যাল নিয়ে এলো। সদর দফতর ক্যাপ্টেন ফজলুর উপর দায়িত্ব দিয়েছে, সর্বাধিনায়ক সদর দফতরে না পৌঁছা পর্যন্ত তিনি কখন কোথায় আছেন এবং অন্যান্য প্রায়োজনীয় তথ্য যেন নিয়মিত সদর দফতরে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬২

হেডকোয়ার্টারের সাথে সংযোগ
সরবরাহ করেন। এই উদ্দেশ্যেই তাঁর দুই দুত রাতে আইসড়া থেকে হাকিমপুরে এসেছে। আর পাঁচ মিনিট পরে এলে হয়তো দূতদ্বয় আমার দেখা পেতো না। তারা সদর দফতরের বিশদ খবরাখবর ও সদর দফতরের প্রধান কর্মকর্তার একটি লিখিত নির্দেশ পাঠালাম, “এক সপ্তাহের মধ্যে সদর দফতরে আসার একদিন আগে তারিখ ও মোটামুটি একটা সময় জানাবো। আমার অনুপস্থিতির সময়ের একটা পরিপূর্ণ রিপোর্ট তৈরী রাখতে নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর আভ্যন্তরীণ কাজকর্মে হাত দেয়ার আগে পাহাড়ী এলাকার জনগণের সামনে হাজির হতে চাই। এ জন্য খুব অল্প সময়ের বিজ্ঞপ্তিতে যাতে একটা জনসভা করা যায়, এমন ব্যবস্থা রাখতেও বলা হচ্ছে।” দুত দুজন ভোর না হতেই ছুটলো পুবদিকে, আমরা প্রশান্ত ও উৎফুল্ল মনে চললাম পশ্চিমে। গন্তব্যস্থল যোগার চর, যেখানে শবেবরাতের রাতে মিলাদ পড়েছিলাম, সেখানে এবং সেই নৌকায়।

বিজয় সংবাদ
৮ই অক্টোবর। দুপুর একটা পেরিয়ে গেল। কোন সিগন্যাল এলো না। ভুয়াপুর এবং গোপালপুর অভিযানের সংবাদের আশায় ছট্‌ ফট্ করছি। মোয়াজ্জেম হোসেন খান বারবার বলছেন, “স্যার আমাকে অনুমতি দিন। আমি একদৌড়ে ভুয়াপুর গিয়ে সমস্ত খবর নিয়ে আসি।” তাঁর কথায় মনে হতে পারে ভুয়াপুর যেন হাতের কাছে, দুচারশ গজের মধ্যে। আদতে কিন্তু তা মোটেই নয়। যোগার চর থেকে ভুয়াপুরের দূরত্ব প্রায় দশ মাইল। ঘড়ির কাঁটা ঠিক দুটার ঘরে। এমন সময় উত্তর দিক থেকে দশ-বারো জনকে একটি লোকের পিছে ছুটে আসতে দেখা গেল। লোকগুলো আমাদের পাশ কাটিয়ে যোগার চর খেয়াঘাট পেরিয়ে গেল। আগে আগে ছুটে পালানো লোকটি খেয়াঘাট পার হয়েই স্থানীয় জনসাধারণের হাতে ধরা পড়ে গেল। লোকটি ধরা পড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখা গেল, উত্তর দিক থেকে আরো তিন-চার জন দৌড়ে আসছে। তাদের হাতে এবং কাঁধে হাতিয়ার। অস্ত্রসহ লোকজন আসতে দেখে আমরা সতর্ক হয়ে গেলাম। লোকগুলো একটু কাছে আসতেই তাদের চিনতে পারলাম। তারা মুক্তিবাহিনীর সদস্য। চিৎকার করে ডাক দিতেই আমাদের নৌকা থেকে প্রায় দুশ গজ দূরে তারা থমকে দাঁড়ালো। “এই দিকে আস” দ্বিতীয়বার আহ্বানের পর তারা সন্দেহ মুক্ত হয়ে নৌকার দিকে ছুটে এলো। কিন্তু নৌকাতে আমি আছি, এটা ঐ চারজন মুক্তিযোদ্ধা কল্পনাও করেনি। আচমকা আমাকে দেখে তারা প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেল। দৌড়ে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করতে তারা প্রকৃতিস্থ হয়ে বলল, “গত রাত একটায় ভুয়াপুর মুক্ত হয়েছে। প্রায় সত্তর-আশি জন রাজাকার ধরা পড়েছে। আমাদের দুই জন শহীদ হয়েছেন। এই দিকে ভুয়াপুর রাজাকার বাহিনীর সহকারী কমাণ্ডার পালিয়ে এসেছে, তাকে ধরতে আমরা ছুটে এসেছি।”
স্থানীয় জনসাধারণ ও স্বেচ্ছাসেবকরা পালিয়ে আসা যুবকটিকে ধরে আমাদের নৌকার কাছে নিয়ে এলো। যুবকটিকে দেখেই চিনতে পারলাম। যুবকটি বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকীর অতি ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় শিষ্য সল্লার মজনুর স্ত্রী সালুর চাচাতো ভাই। ডাকনাম খোকা। যুবকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি মিঞা রাজাকার হয়েছ?” খোকা কান্নায় ভেঙে পড়লো। ছুটে পালিয়ে আসায় সে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৩

তখনও হাঁপাঁচ্ছে। স্থানীয় জনসাধারণের হাতে ধরা পড়েছে। নিশ্চয়ই জান যাবে আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে। সামনে আমাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলো, হয়তো বাঁচার একটা ক্ষীণ আশাও সেই সাথে তার মনে ঝিলিক দিয়েছিল। মানুষ তৃণখণ্ড ধরেও বাঁচতে চায়। খোকার অবস্থাও তাই হলো। কাপতে কাপতে কান্নাজড়িত কন্ঠে অনুনয় করে বললো, “ভাইজান, আপনে তো আমাগোরে ভাল কইরাই চিনেন। কি করমু। চেয়ারম্যান আমারে জোর কইরা রাজাকারে ভর্তি কইরা দিছে?” আমি ক্রুদ্ধস্বরে ধমক দিয়ে বললাম, “মিঞা, জোর করে রাজাকারে ভর্তি করে দেয়া যায়। কিন্তু তুমি সক্রিয় না হলে কমাণ্ডার হলে কি করে? মিষ্টি কথায় চিড়া ভিজাতে চেষ্টা করো না।” ভুয়াপুর থেকে আসা চার জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে খোকাকে দিয়ে ভুয়াপুরে নিয়ে যেতে বলে, আমরা ভুয়াপুর ছুটলাম। বিজয়ের সংবাদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেহে যেন সিংহের তেজ এনে দিল। হাঁটা নয়, দৌড়ে ভুয়াপুর পৌছার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। কার আগে কে পৌঁছতে পারে, এ নিয়ে শুরু হলো প্রতিযোগিতা। নিকাড়াইল গ্রাম পার হয়ে একটু সময়ের জন্য দৌড়ে বিরতি দিলাম। এখানে দলটিকে দুই ভাগে ভাগ করলাম। যারা ছুটতে পারছিলো না, তাদের কয়েকজন ও সবল বুদ্ধিমান কয়েকজনের সমন্বয়ে একটি দল গঠন করে একটি বাড়ীতে রাখা হলো। আবার রওনার সময় বারবার বললাম, “তোমরা দুইজন করে পালা করে সব সময় পাহারায় থাকবে। রাতে যে কোন মুহুর্তে আমরা আসতে পারি।” উপলদীয়ার ফজলু ও টাংগাইলের দীঘুলিয়ার ফুলকে দলটি দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হলো। ফজলু এই প্রথম একটা দায়িত্ব পেল।
বিকাল চারটায় ছুটতে ছুটতে ভুয়াপুর এসে পৌঁছলাম। ভুয়াপুর দখল হয়েছে, সত্তর আশি জন রাজাকার ধরা পড়েছে এবং দুই জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে, তা জেনেছি। কিন্তু শহীদের মধ্যে আমার নিত্য সহচর ভুয়াপুরের কৃতী সন্তান কদ্দুস রয়েছে, তা জানা ছিল না। ভুয়াপুরের আরেক কৃতী সন্তান বড়লোকের পাড়ার আব্দুস সালামও তার নিজের থানা মুক্ত করার যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ করেছে। ভুয়াপুর কলেজ মাঠে বন্দী রাজাকারদের দেখার সময় আমাকে যখন শহীদের নাম জানানো হলো, তখন কদ্দুসের নাম শুনে শিশুর মত করে কেঁদে ফেললাম। ৭১- এর মুক্তিযুদ্ধে যে কোন সহযোদ্ধার মৃত্যুতে আমি একই রকম ব্যথা পেয়েছি। কিন্তু তারপরও কথা থাকে। জাহাঙ্গীর ও কদ্দুসের মৃত্যু যেমন আমার বুকের পাজর ভেঙে দিয়েছিল, তেমনি হৃদয়ে জ্বালিয়ে ছিল হানাদার খতমের তীব্র আকঙ্খা। কদ্দুসের মৃত্যু সংবাদ শুনে অনেকটা সময় স্বাভাবিক থাকতে পারলাম না। অসহায়ের মত কাঁদতে বসে পড়ে এক সময় মেজর হাবিবকে জিজ্ঞেস করলাম, “কদ্দুস ও সালামের লাশ কোথায়?”
— সালামের লাশ বড়লোকের পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তা দুপুরের আগেই যথাযথ মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে। কদ্দুসের লাশও গ্রামের বাড়ী ছাব্বিশাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে আপনার জন্য এখনো দাফন করা হয়নি। মেজর হাবিবের কথা শুনে লাফিয়ে উঠলাম। কদ্দুসের মুখ শেষবারের মত দেখার আশায় ছাব্বিশার দিকে ছুটতে শুরু করলাম। কদ্দুসের বাড়ী লোকে লোকারণ্য। আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীরা তো আছেনই, এ ছাড়াও প্রায় এক
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৪

হাজার স্বেচ্ছাসেবক এবং দুশ মুক্তিযোদ্ধা সুশৃঙ্খল ভাবে কদ্দুসের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অপেক্ষা শুধু আমার জন্যে। আমি কদ্দুসের বাড়ী পৌঁছলে কদ্দুসের বাবা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কদ্দুসের বাবা সারাদিন কাঁদতে কাঁদতে হয়তো শোকের জ্বালা কিছুটা ভুলে গিয়েছিলেন। আমাকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখে তিনি প্রথম শান্তনা দিলেন। তিনি কান্নাজড়িত ধরা গলায় বললেন, “বাবা কেঁদোনা, তুমি ভেঙে পড়োনা। তুমি কাঁদলেও আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাব না। আমি জানতাম আমার কদ্দুসের তোমার উপর কতখানি আস্থা ছিল। তুমি তাকে কতখানি ভালবাসতে তাও আমি জানি। দেশের জন্যে যুদ্ধ করতে যেয়ে আমার ছেলে মরেছে। বুকে গুলি লেগে আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। তার পিছনে তো গুলি লাগেনি। এমনিতে অসুখ হয়েতো সে মরতে পারতো। তুমি কান্না বন্ধ কর। যারা আমাকে ছেলেহারা করল, তাদের তুমি শায়েস্তা কর। যে জন্য আমার ছেলে জীবন দিল, সেই কাজ পূর্ণ কর।” এরপরও আমি ঠিক পূর্ণ শক্তি ফিরে পাচ্ছিলাম না। দুঃখ, বেদনা, ক্ষোভ ও অভিমানে আমার হাত পা থর থর করে কাপছিল। কদ্দুসের মুখ দেখে আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। কবরের পাশে মাটিতে বসে পড়লাম। কয়েকজন সহযোদ্ধা ধরাধরি করে আমাকে একটু সরিয়ে নিল। চার বৎসরের বিশ্বস্ত, আদর্শ সচেতন সহকর্মীকে এই ভাবে চির বিদায় দিতে হবে তা একবারও ভাবিনি। নিজে লাশ নামাতে চাইলাম। কিন্তু সহকর্মীরা আমার নাজুক অবস্থা দেখে রাজি হলো না। আমার সামনে কদ্দুসের বাবা, কদ্দুসের ছোটভাই আজিজ ও সহযোদ্ধারা লাশ কবরে নামালো। কাঁদতে কাঁদতে শেষবার মুখের কাফন সরিয়ে দিতে বললাম। কদ্দুসের মা, ছোটবোন ও মহিলা আত্মীয়স্বজনরা শেষ বারের মত কদ্দুসের মুখ দেখলেন। অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে কদ্দুসের দাফন শেষ হলো, দাফন শেষে কদ্দুসের বাড়ী থেকে হেঁটে ভুয়াপুর ফিরতে পারছিলাম না। সমস্ত শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছি। সবকিছু থাকতেও যেন কিছু নেই, সব হারিয়ে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে গেছি। আমার অসহায় অবস্থা দেখে দুলাল ও কাসেম এগিয়ে এলো। তারা দুই পাশ থেকে ধরে বলতে গেলে উঁচু করে আস্তে আস্তে ভুয়াপুর নিয়ে এলো। কদ্দুসের নাম অনুসারে এরপর থেকে ভুয়াপুর ‘কদ্দুস নগর’ বলে চিহ্নিত হয়।
কুদ্দুস নগরে ডাকবাংলোর সামনের মাঠে ঘন্টাখানেক চুপচাপ বসে থেকে আস্তে আস্তে ধৃত রাজাকারদের সামনে গেলাম। কলেজ মাঠে একশ আট জন রাজাকারকে কোমরে দড়ি বেঁধে পাশাপাশি লাইন করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রত্যেককে ভালোভাবে দেখলাম। এত দুর্বলদেহী রাজাকারদের দেখে কিছুটা বেদনাহত হলাম। রাজাকাররা কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। খালি গায়ে সবারই বুকের সবকটা হাড় গোনা যাচ্ছিল। সবার শরীরই শীর্ণ, ক্ষীণ ও লিকলিকে। নিজেদের শরীরের বোঝাই তারা বইতে পারছেনা। এরা গোলা-বারুদের বোঝা বইবে কি করে? তার উপর আবার দেশপ্রেমের আগুনে পোড়া খাঁটি স্বেচ্ছাসৈনিকদের সাথে মোকাবেলার মত দুরূহ কাজকে সম্ভব করবে কি করে? ধৃত রাজাকারদের কয়েকজনকে বেশ ভাল ভাবেই চিনতাম। যেমন আমাদের বাড়ীর পাশে ছোট্ট একটি চায়ের দোকানের চৌদ্দ-পনের বছরের কাজের ছেলে পাতলা লিকলিকে দুলাল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও দু’তিন দিন সে চায়ের দোকানে যথারীতি কাজ
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৫

করেছে। সেও আজ রাজাকার আর একজন বাংড়ার বাস কন্টাকটর। মাঝে মধ্যে সে বাবার কাছে মামলা মোকদ্দমার কাজে আসতো। সেও রাজাকার হয়েছে। আগেই বলেছি, মজনু ভাইর স্ত্রী সালুর চাচাত ভাই খোকা কদ্দুস নগরে রাজাকারদের সহকারী কমান্ডার ছিল। এই সমস্ত দেখে সত্যিই রাজাকারদের প্রতি আমার করুণা হচ্ছিল।
৭ই অক্টোবররের রাত। মুক্তিবাহিনীর তিনটি দল তিনটি লক্ষ্য বস্তু ঠিক করে তিন দিকে বেরিয়ে পড়ে। আমার নেতৃত্বে একটি দল ফুলতলা সেতু ধ্বংস করতে যায়। চার’শ মুক্তিযোদ্ধার দ্বিতীয় দলটি মেজর হাবিব, ক্যাপ্টেন আরজু, ক্যাপ্টেন আঙ্গুরের নেতৃত্বে কদ্দুস নগর দখলের অভিযানে এগিয়ে যায়। মেজর হাকিম, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন, ক্যাপ্টেন বেনু ও ক্যাপ্টেন তারার নেতৃত্বে পাঁচশ মুক্তিযোদ্ধার তৃতীয় দলটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গোপালপুর থানার উপর আঘাত হানার উদ্দেশ্যে যুদ্ধযাত্রা করে। গোপালপুর থানা অভিযানের দল নিম্নলিখিত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল-
১। একটি ৩ ইঞ্চি মর্টার
২। দুটি রকেট লান্সার
৩। একটি .৮২ ব্লান্ডার সাইট
৪। দশটি ২ ইঞ্চি মর্টার
৫। কুড়িটা গ্রেনেড থ্রোয়িং রাইফেল
৬। পঞ্চাশটি এল.এম.জি.
অন্যান্যদের কাছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। তেমনি কদ্দুসনগর অভিযানকারী দলের অনুরূপ একই সংখ্যক মর্টার, রকেট লান্সার, ব্লান্ডার সাইট, ২ ইঞ্চি মর্টার, গ্রেনেড থ্রোয়িং রাইফেল, এল. এম জ্বি. ছিল। গোপালপুরের চাইতে কদ্দুসনগর অভিযানে যোদ্ধাদের সংখ্যা কম হওয়ায় ছোট অস্ত্র কিছু কম দেওয়া হয়।
রাত বারোটায় মেজর হাবিব তাঁর দলকে দুভাগে ভাগ করে কদ্দুস নগর আক্রমণ পরিচালনা করে। মেজর হাবিবের নেতৃত্বে মূল আক্রমণকারী দলটি কদ্দুসনগরের সোজা উত্তরে এবং আঙ্গুর, আরজু, কদ্দুস, রফিকের নেতৃত্বে অন্য দলটি পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করবে। পরিকল্পনামত কদ্দুসনগরের বাজারের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে হানাদার ঘাঁটিতে মেজর হাবিব প্রথম আক্রমণ শুরু করলো। মিনিট দশেক অবিশ্রান্ত গুলি ছুঁড়ে গুলি ছোড়া বন্ধ করে। উত্তর দিক থেকে মেজর হাবিবের দলটি গুলি ছোড়ায় বিরতি দেওয়ার সাথে সাথে পশ্চিমের দলটি শত্রুঘাঁটির উপর মুষল ধারায় ১০ মিনিট গুলি ছুড়লো। তাদের গুলি ছোঁড়া বন্ধের পর পরই পশ্চিমে তিন মাইল দূর থেকে মোজাম্মেল ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। যুদ্ধে এই প্রথম গোলা নিক্ষেপ। এর আগে অবশ্য তাকে মর্টারের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষ ভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্য বস্তুর উপর সে কখনও গোলা ছোঁড়েনি। তবে তার প্রথমবারের গোলা নিক্ষেপ
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৬

এত নিখুঁত ও কার্যকরী হয় যে, অনেক অভিজ্ঞ মর্টার বিশারদও তাতে নিঃসন্দেহে অবাক হবেন। মর্টার থেকে মোজ্জাম্মেল প্রায় দশ মিনিট নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ৫০ রাউন্ড ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে। মর্টারের গোলা ছোড়া বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই, জয় বাংলা জয় মুক্তিবাহিনী, জয় বঙ্গবন্ধু, ইয়া আলী, প্রচন্ড শ্লোগান তুলে উত্তর দিক থেকে মেজর হাবিবের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু একি, ঘাঁটিতে একজন হানাদারও নেই। অন্যদিকে পশ্চিম দিক থেকে গুলি বর্ষণের সময় হানাদারদের একটি গুলি আচমকা কদ্দুসের বুকে লাগে। ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে নিক্ষেপ শুরুর পূর্বেই সে শাহাদৎ বরণ করে। মেজর হাবিব ক্যাম্পে উঠার পর এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে মাত্র ১০জন রাজাকার ধরতে সক্ষম হয়। বাকীরা পালিয়ে গেছে।
মেজর হাবিব অভিযান সফলের সংকেত দিতেই পশ্চিম দিক থেকে আঙ্গুর, আরজু, রফিকের দল এগিয়ে আসে। তারা এসেই মেজরকে জানায়, তাদের দলের আবদুল কদ্দুস শহীদ হয়েছে। অন্যদিকে মেজর হাবিবের দলের আব্দুস সালাম হানাদারদের ছোড়া এক ঝাঁক গুলি বিদ্ধ হয়ে শাহাদৎ বরণ করে। এই দুইজন ছাড়া কোন মুক্তিযোদ্ধার গায়ে একটু আঁচড়ও লাগেনি। মুক্তিযোদ্ধারা যখন কদ্দুসনগরের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, সাত-আট জন রাজাকারও ধরা পড়েচে, সেই সময় দু’টি রাজাকার একটি অভাবনীয় কান্ড ঘটায়। ক্যাপ্টেন মোতাহার, মাহফুজ, গৌরাঙ্গীর দুলাল ও গিরানী কলেজের দিক থেকে হাইস্কুল ঘেঁষে কদ্দুসনগর ডাকবাংলোর দিকে যখন যাচ্ছিল, তখন গাছের নিচের অন্ধকারের ভিতর থেকে দুজন রাজাকার হঠাৎ তাদের এসে বলে, “আমরা সালেন্ডার করমু।” মুক্তিযোদ্ধা চারজন তো অবাক। প্রায় আধঘন্টা চারিদিক তল্লাশী চালিয়ে কোন রাজাকারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অথচ এরা এখানে এলো কি করে? খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখলো, রাজাকার দুজনই বিবস্ত্র। রাইফেলের বেল্ট ও ম্যাগজিন খুলে একহাতে রাইফেল অন্যহাতে বোল্ট ম্যাগাজিন নিয়ে হাত তুলে দিগম্বর হয়ে দুই রাজাকার তাদের সামনে দাঁড়িয়ে। মুক্তিযোদ্ধারা দুইটাকে ধরে আচ্ছা করে উত্তম-মধ্যম দেয়ার পর কলেজে নিয়ে এসে কাপড় পরতে দেয়। পরদিন এই দুই রাজাকারকে যখন আমি দেখতে গেলাম, তখন তারা বললো, “সালেন্ডার করছি।” কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি ভাবে সারেন্ডার করেছ?”
— স্যার, গুলাগুলির সময় আমরা ভয়ে বাংকার ছাইড়া স্কুলের দালানে গিয়া পালাইয়া আছিলাম। তারপর জামাকাপড় খুইল্যা, রাইফেলের বেল্ট-ম্যাগাজিন আলাদা কইরা গাছের নীচে খারাইয়াছি। অনেক বাদে গাছের কাছে চার-পাঁচ জনেরে আইতে দেইখ্যা আমরা গাছের আড়াল থাইক্যা বারাইয়া কইলাম, আমরা স্যালেন্ডার করমু। সালেন্ডার স্যার ভালাই। তয় পয়লা পয়লা একটু কিল গুতা খাইতে অয়।’ এমনি বেকুব রাজাকারের উপর ভরসা করে পাকহানাদাররা লড়াই করছে। কদ্দুসনগরের যুদ্ধশেষে একশ-আট জন রাজাকার ধরা পড়ে। এর মধ্যে আটানব্বই জনকে স্থানীয় জনগণ ও স্বেচ্ছাসেবকরা ধরে মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেন। সব রাজাকারই অস্ত্রসহ ধরা পড়ে। শুধুমাত্র দুজন রাজাকার ছাড়া পালিয়ে যাওয়ার সময় সমস্ত রাজাকারদের পাকড়াও করতে স্বেচ্ছাসেবক ও জনগণের একটুও বেগ পেতে হয়নি। জনসাধারণের হাতে ধরা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৭

পড়ার দু’টি ব্যাতিক্রম ঘটনা তুলে ধরছি।
গোলা-গুলি চলার সময় একজন রাজাকার দক্ষিণ দিকে ছুটে পালাচ্ছিল। শিয়ালকোলের কাছে এলে সেখানকার জনগণ রাজাকারটিকে ধরার জন্য তাড়া করেন। বেকুব রাজাকারটি পনের কুড়ি জন লোকের বেষ্টনীতে পড়ে তার হাতের রাইফেল উঁচিয়ে ধরে। জনগণ তখন চিৎকার করে বলতে থাকেন, “শালা রাজাকার, যদি গুলি ছোড়স্ তাইলে একেবারে জান শেষ কইরা ফালামু।” একদিকে সাবধান বানী, অন্যদিকে পিছন থেকে একজন দ্রুত ছুটে এসে ধারলো দা দিয়ে এককোপে রাজাকারের রাইফেল ধরা ডান হাতের কব্জি কেটে ফেলেন। রাজাকারটি বুঝার আগেই তার হাত থেকে রাইফেলটি পড়ে যায়। হাত কাটা অবস্থাতেই স্থানীয় জনগণ তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পৌঁছে দেন।
অন্য ঘটনাটি ঘটে ছোট লোকের পাড়ায়। (এখানে ছোট লোকেরা বাস করেন না। গ্রামের নাম ছোট লোকের পাড়া। এখানকার লোকদের মন অনেক বড়) ছোট লোকের পাড়ার উপর দিয়ে একটি রাজাকার অস্ত্র নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল। স্থানীয় জনসাধারণ তাকে ধরতে গেলে সেও রাইফেল উঁচিয়ে ধরে। এখানেও একজন সাহসী লোক নিমিষে রাইফেল উঁচিয়ে ধরা রাজাকারটির দিকে ছুটে গিয়ে ধানকাটা কাচি দিয়ে এক হেচকা টানে রাজাকারের বা কান কেটে ফেলেন। আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনায় রাজাকারটি হতভম্ব হওয়ার সাথে সাথেই তিন-চার জন তাকে জাপটে ধরে রাইফেল কেড়ে নেন। এই দুটি ঘটনা ছাড়া বাকী সব রাজাকার বিনা বাধায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ও জনসাধারণের হাতে ধরা দেয়।

গোপালপুর অভিযান ব্যর্থ
৭ই অক্টোবর গভীর রাতে গোপালপুরে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। মেজর হাকিম, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন, ক্যাপ্টেন তারা ও ক্যাপ্টেন বেনুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে সারা রাত এবং ৮ই অক্টোবর সারা দিন যুদ্ধ চালালো। কিন্তু হানাদার ঘাঁটির পতন তারা ঘটাতে পারলো না। ৭ই অক্টোবর যুদ্ধ পরিকল্পনার সময় ঠিক হয়েছিল, যাকে বা যাদের যে যে অভিযানের দায়িত্বে দেয়া হবে, তাকে বা তাদেরকে সেই অভিযানে অবশ্যই সফল হতে হবে। হানাদারদের ঘাঁটি দখল না করে ফেরা চলবে না। ফুলতলা সেতু ধ্বংস ও কদ্দুসনগর দখলের পর গোপালপুর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সম্মানের লড়াই হয়ে দাঁড়ায়। তারা গোপালপুর থানা দখল না করে পিছু হটতে রাজী নয়। ৮ই অক্টোবর সারাদিন গোপালপুর থানার উপর নির্ভুল লক্ষ্যে প্রায় তিনশ ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করার পরও যখন হানাদার ঘাঁটির পতন ঘটলো না, তখন পরবর্তী রণকৌশল কি হওয়া উচিত মেজর হাকিমকে তা ভাবিয়ে তুলল। ইতিমধ্যে আক্রান্ত ঘাঁটিকে সাহায্য করতে ময়মনসিংহ- টাংগাইল থেকে হানাদার বাহিনীর তিনশ জন নিয়মিত সৈন্যের একটি দল গোপালপুর এসে পৌঁছে। তাতে গোপালপুরের হানাদারদের মনোবল অনেকটা বেড়ে গেছে।
৮ই অক্টোবর, সন্ধ্যায় গোপালপুর অভিযানের নেতা মেজর হাকিমকে নির্দেশ পাঠানো হলো, “যেহেতু মুক্তিবাহিনীর প্রথম আঘাত হানাদাররা সামলে নিয়েছে, সেই হেতু গোপালপুর ঘাঁটি দখল
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৮

কষ্টসাধ্য হবে। আজ যে বিপুল পরিমাণ গোলা-গুলির শ্রাদ্ধ হয়েছে, তা একেবারে নিষ্প্রয়োজন। গোলাগুলি আর খরচ না করে গোপালপুর থানাকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখো এবং সময় ও সুযোগ মত চোরা গোপ্তা আঘাত হানো। তোমরা ঘাঁটি দখল করতে পারোনি বলে লজ্জা অথবা অপমান বোধের কোন কারণ নেই। গোপালপুর ঘাঁটি থেকে হানাদারদের অবাধে বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিতে পারলেই আমি খুশী হব।” মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত সফলতার সাথে গোপালপুর ঘাঁটির হানাদারদের বলতে গেলে শিবির বন্দী করে রাখতে সমর্থ হয়। হানাদারদের অবরুদ্ধ রাখার সময়ে কয়েকটি অভূতপূর্ব ও চমকপ্রদ সাফল্য আসে। তার একটি হচ্ছে মেজর হাকিমের কোম্পানীর বারো-তের বৎসরের এক ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধা ভুলু চায়ের দোকানের কাজের ছেলের ছদ্মবেশে গোপালপুর হানাদারদের ঘাঁটিতে প্রবেশ করে সেখানে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আটজন হানাদার খতম করতে সক্ষম হয়। গোপালপুরের হানাদারদের আরও একঘরে করে ফেলার উদ্দেশ্যে, মেজর হাকিমের দল টাংগাইল-ময়মনসিংহের দিক থেকে গোপালপুরে আসার একমাত্র পাকা রাস্তার উপর সবচাইতে বড় সেতুটি ধ্বংস করে দেয়া। শহিদ ওরফে লালু, ভুলু ও অন্যান্য চার পাঁচ জন ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধার প্রতি রাতে ঘাঁটির আনাচে কানচে গ্রেনেড নিক্ষেপের চোটে গোপালপুরের হানাদারদের টিকে থাকা বেশ দুষ্কর হয়ে পড়ে। অন্য দিকে এমন কোন দিন যায়নি, যেদিন ওৎ পেতে বসে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে দু’এক জন হানাদার অক্কা পায়নি। গোপালপুর থানা অবরোধে ক্যাপ্টেন তারার কোম্পানী দুর্দান্ত সফলতা লাভ করে।

আবার নিকড়াইলে
রাজাকারদের শশুয়ার চরে পাঠিয়ে দিতে এবং সদর দফতরকে সবুর এবং অন্যান্যদের আমার সাথে মিলিত হতে নির্দেশ পাঠিয়ে পশ্চিমে নিকড়াইলের দিকে রওনা হলাম। কদ্দুস নগর আসার পথে নিকড়াইলে আমার দলের একটা অংশকে রেখে এসে ছিলাম। রাত ২ টায় নিকড়াইল গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনরকম সাড়াশব্দ না পেয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। গ্রামের স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যাপারটা বললে তারা খোঁজ-খবর নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান বের করলো। মুক্তিযোদ্ধারা নির্দিষ্ট বাড়ীর আশেপাশেই ছিল। তবে প্রথানুযায়ী কোন প্রহরা না রেখেই তারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি বাড়ীতে গিয়ে ঘুমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জাগালাম। কমান্ডার ফজলুল হক ও সহকারী কমান্ডার ফুলকে তীব্র, কঠিন তিরস্কার করে উভয়কেই প্রচন্ড জোরে দুঘা করে বেত মারলাম। এরপরও রাগ সামাল দিতে পারছিলাম না। ক্রোধ ও উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। এত উত্তেজিত এর আগে খুব কম হয়েছি। রাগে কথা বলতে পারছিলাম না। একটু পরে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললাম, “তোমাদের বার বার করে বলে গেছি, যত পরিশ্রমই হোক, যতই ক্লান্তি আসুক, তবুও পাহারা না রেখে সবাই ঘুমিয়ে পড়বে না। অথচ তোমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছো। একদিকে আমার কথা অমান্য করেছ, অন্যদিকে যদি হানাদাররা এসে তোমাদের এইভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় ধরতে পারতো। তাহলে তোমাদের জীবন তো যেতই, উপরন্তু আমাদের জন্য ওৎপেতে বসে থেকে সহজেই আমাকে সহ আমার দলকেও ধরতে সক্ষম হতো।” আমার কথা শুনে কমান্ডার ফজলু ও ফুল
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬৯

তাদের অপরাধের গুরুত্বটা বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলো। পরবর্তীতে তারা আর কোনদিন মুক্তিবাহিনীর কোন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় নি।
পরদিন ১ই অক্টোবর সকালে এলাম শশুয়ার চর। রাজাকারদের শশুয়ার চরে নিয়ে আসার নির্দেশ আগেই দেয়া হয়েছিল। শশুয়ার চরে একশ আট জন রাজাকারের সাথে এক এক করে কথা বললাম। কমান্ডার ও কদ্দুস নগরের আশেপাশের লোকজনদের কাছে ভাল ভাবে খোঁজ- খবর নিয়ে রাজাকারদের তিন ভাগে ভাগ করা হলো। প্রথম ভাগকে তৎক্ষণাৎ মুক্তি দিয়ে বাকী দুভাগের চল্লিশ জনকে মোয়াজ্জেম হোসেন খানের সাথে, চল্লিশ জন মুক্তিযোদ্ধাদের পাহারায় ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। চল্লিশ জন রাজাকারের তালিকায় প্রত্যেকের সম্পর্কে আমি নিজস্ব মন্তব্য রাখলাম। চল্লিশ জনের মধ্যে সাত আটজনের নামের পাশে মারাত্মক শব্দ প্রয়োগ করে বাকীদের বিষয়ও পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করলাম, সত্যিকার অর্থেই এরা দুষ্ট প্রকৃতির লোক, তবে মারাত্মক নয়। চল্লিশ জন রাজাকারকে ভারতে পাঠানোর কারণ, আমি যখন ভারতে ছিলাম তখন দেখেছি নকলা, নালিতাবাড়ী, শ্রীবর্দী, হালুয়া ঘাট, দুর্গাপুর এলাকার রাজাকারদের অথবা পাকিস্তানী হানাদার সমর্থকদের ধরে আনা হতো এবং তাদের নিয়ে ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় ছবি সহ বিরাট বিরাট সংবাদ প্রকাশিত ও প্রচারিত হতো। সেই উদ্দেশ্যেই একদল রাজাকার পাঠিয়ে দিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে শেষ অনুরোধ জানিয়েছিলাম, এরা যত মারাত্মকই হোক, সম্ভব হলে একজনকেও যেন মৃত্যুদন্ড দেওয়া না হয়।
রাজাকার নিয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন খান ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী দক্ষিণে এগুলাম। পথে সবুর দশ-বারো জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমার সাথে মিলিত হলো। ১২ই আগষ্ট গণপরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকীর বাড়ী থেকে ছুটি নেয়ার পর এই প্রথম আমার সাথে মিলিত হয়ে নিত্য সহচর দলের অন্তর্ভুক্ত হলো।
শাহজানি চরে সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন নায়েব সুবেদার মঈনুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়েছিল। প্রশিক্ষণ শিবির খোলার আগে পশ্চিমাঞ্চলের অনেক ছাত্র- যুবক সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মানকার চর চলে যেত। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রশিক্ষণ শিবির খোলায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণে ইচ্ছুকদের ভারতে যাবার প্রবণতা অনেকাংশে কমে যায়। তারা পর্যায়ক্রমে শাহজানি চরের প্রশিক্ষণ শিবিয়ে সামরিক কসরত শিক্ষালাভ করতে থাকে। সত্যিকার অর্থে মঈনুদ্দীন ও তার সহযোগীরা দক্ষতার সাথে খুব সুন্দর ও কার্যকরী প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলেছে৷ ৯ই অক্টোবর, দক্ষিণে যাবার পথে যাত্রা বিরতি দিয়ে মঈনুদ্দিনের শাহজানি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিদর্শন করলাম। প্রশিক্ষণ শিবির ঘুরে ঘুরে দেখে ও প্রশিক্ষণরত যোদ্ধাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। মঈনুদ্দীন ও প্রশিক্ষণ শিবিরের অন্যান্যরা জুলাই মাস থেকে আমার নেতৃত্বে গঠিত টাংগাইল মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে আসছিল। প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন শেষে ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মঈনুদ্দীনকে নদী পথে নজর রাখতে একটি অতিরিক্ত দল গঠনের নির্দেশ দিলাম। ১২ই অক্টোবর থেকে স্বাধীনতা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭০

প্রাপ্তি এবং বাংলাদেশ সরকারের ঢাকা প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত মেজর মঈনুদ্দীনের দল নদী পথে কড়া পাহারা ও সফলতার সাথে জলপথ কর আদায় করতে সক্ষম হয়। তারা হিসাব-কিতাবেও নিখুঁত ও আধুনিকতা বজায় রাখতে সমর্থ হয়। যদিও আগে থেকে উত্তরে আলিম এবং নাগরপুরের দক্ষিণে আবদুস সামাদের নেতৃত্বে জলপথ কর আদায় করা হচ্ছিল। মেজর মঈনুদ্দীনকে নতুন করে জলপথ কর ও জলপথের উপর নজর রাখার দায়িত্ব দেয়া হলে নদী পথে নিরাপত্তা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি কর আদায়ের ব্যবস্থাও সুগম হয়। ছ-সাতটি ঘাঁটিতে কর আদায় করা হলেও আব্দুল আলিমের মূল নেতৃত্বে মেজর মঈনুদ্দীন ও আব্দুস সামাদের সমন্বয়ে কোন ভুল বোঝাবুঝি ছাড়াই কর আদায়ের কাজটি সুসম্পন্ন হয়।
১৯৭১ সাল, ১০ই অক্টোবর। আমরা নাগরপুরের দিকে চলেছি। আশপাশের কোন কোন স্থান তখনও পুরোপুরি নিরাপদ ছিল না। চারাবাড়ি ও পোড়াবাড়ি ঘাটকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে পোড়াবাড়ির একমাত্র পাকা সড়কের বড় সেতু ও পাশের আর একটি সেতু ধ্বংস করে দিলাম। সন্তোষে মওলানা আব্দুল হামিদ ভাসানীর বাড়ির গা ঘেঁসে এই সেতুটি এবং কিছু দূরে বেলতা সেতু ধ্বংস করে দেওয়ার পর চারাবাড়ি-পোড়াবাড়ি ঘাট বলতে গেলে শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। কারণ টাংগাইল থেকে কোন যানবাহন নিয়ে স্বচ্ছন্দ্যে চারাবাড়ি-পোড়াবাড়ি যাওয়া হানাদারদের পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। সস্তোষ থেকে তিন মাইল পায়ে হেঁটে চারাবাড়ি পোড়াবাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার কষ্ট এবং মুক্তিবাহিনীর ভয়ে হানাদাররা এদিকে আসতে চায়নি।

এলাসিনে শত্রুর রসদ দখল
১১ই অক্টোবর রাতে তিনটি নৌকা ভাররা ঘাটে ভিড়লো। ইতিপূর্বে দেড়শ জনের হনুমান কোম্পানীর ভাররা বাজারে এসে অপেক্ষা করার কথা ছিল। নাগরপুর হানাদার ঘাঁটির বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল তার (ক্যাপ্টেন হুমায়ুন) উপরে। অনেক খোজাখুঁজি করার পরও হনুমান কোম্পানীর কাউকে না পেয়ে নদীর অপর পারে গিয়ে রাত কাটালাম। ১২ তারিখ সকালে গোয়েন্দা সূত্রে খবর পেলাম, টাংগাইল থেকে ত্রিশ-চল্লিশ জন রাজাকার ও মিলিশিয়া খাবার দাবার ও অন্যান্য রসদ পত্র নিয়ে এলাসিন-নাগাপুর রাস্তা ধরে যাবে। খবর পেয়ে আমরা এলাসিনের পথে ওৎ পেতে রইলাম।
গোয়েন্দা বিভাগের খবর যে মোটেই ভুল নয়, তা সকাল আটটার মধ্যেই বোঝা গেল। চার-পাঁচটা গরুর গাড়ী ও তিন-চারটি রিক্সা নিয়ে হানাদার পাকিস্তানীদের ফেউ রাজাকার ও মিলিশিয়ার একটি দল এগিয়ে আসছে। আমরা ২০ জন তাদেরকে স্বাগত জানাতে ওঁৎপেতে রয়েছি। রাজাকার ও মিলিশিয়ারা অত্যন্ত ঢিলেঢালা চালে উর্দু সিনেমার চটুল গান গাইতে গাইতে উত্তর থেকে দক্ষিণে আসছে। তাদের অত নিরাপদ বোধ করার কারণ, এর আগে এলাসিনের রাস্তায় তারা কোনদিন আক্রান্ত হয়নি। রাজাকার ও মিলিশিয়ারা এলোমেলো, আমাদের বন্দুকের নলের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। পিছনে এলাসিন বাজার আর সামনে এলাসিন স্কুল। এমন জায়গায় পিছন
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭১

ও ডানপাশ থেকে আক্রান্ত হয়ে মূহূর্তে রাজাকার ও মিলিশিয়ার দলটি তালগোল পাকিয়ে গেল। কয়েকজন মিলিশিয়া ছুটে পালাতে পারলেও কুড়িজন রাজাকার লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকার মত রাইফেল হাতে অসহায় অবস্থায় ধরা পড়লো। গাড়ীর গরুগুলো দড়ি ছিড়ে হামা হামা চিৎকার করে পালালো। রসদ বোঝাই গাড়ীগলো রাস্তার এপাশে ওপাশে ছিটকে পড়ে গেল। রিক্সা ফেলে চালকেরা দে ছুট। আমাদের আচমকা আক্রমণে তিনজন রাজাকার নিহত ও এগারোজন আহত হয়। মাত্র কয়েকজন মিলিশিয়া ছাড়া বাকী রাজাকাররা ধরা পড়লো। নাগরপুর ঘাঁটির জন্য নিয়ে যাওয়া সমস্ত রসদ মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গেল। সবুর, সাইদুর, কাসেম ও রফিককে নিয়ে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় এলাসিন বাজারে একটি ঔষধের দোকানে আহত রাজাকারদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো। গোলাগুলি ও অস্ত্র ছাড়া বাকী রসদ জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করালাম। খাদ্যদ্রব্য বিলাতে গিয়ে প্রথমে সামান্য একটু অস্বস্তি ও অসুবিধার সম্মুখীন হলাম। কেউ খাদ্যদ্রব্য নিতে সাহস পাঁচ্ছে না দেখে, স্থানীয় জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বললাম, “হানাদার- দের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া খাদ্যদ্রব্য মোটেই ধনী লোকের জন্য নয়। যারা অসহায় দরিদ্র, মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খাচ্ছে তাদের জন্যও নয়। দরিদ্র ভাই-বোনদের এই খাদ্য দ্রব্য ভাগাভাগি করে নিতে কোন অসুবিধা কিংবা ভয়ের কারণ থাকতে পারে না। বন্ধুরা, আপনারা এই খাবার ভাগা- ভগি করে নিন। এর জন্য যদি আপনাদের সামান্যতম অসুবিধা হয় আমরা তার প্রতিকার করবো।” একথার পর ১৫০ জন হানাদার সৈন্য ও রাজাকারের একসপ্তাহের খাবার প্রায় ৫০০ দরিদ্র ভাই-বোনেরা ভাগাভাগি করে নিলেন।
সতেরটি রাইফেল ও তিন হাজার গুলি বগলদাবা করে ও হানাদার বাহিনীর খাদ্যদ্রব্য দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে বিলিয়ে বেলা এগারটায় আবার পশ্চিম পাড়ে, ভাররা ঘাটে এলাম।
এলাসিন বাজারে গোলাগুলি চলার সময়েই ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের একজন সিগন্যাল এসে হুমায়ুনের অবস্থান ও নাগরপুরের প্রয়োজনীয় সমস্ত খবর দিয়েছিল। আমাদের নৌকা আবার ঘাটে ভিড়ার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন হুমায়ুন এসে স্বাগত জানালো। দুপুরের খাবার শেষে ক্যাপ্টেন হুমায়ুনকে নাগরপুর থানা আক্রমণের নির্দেশ দিলাম। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের সংগৃহীত তথ্য থেকে এটা পরিস্কার হয়ে গেল যে, সময়টা থানা আক্রমণের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল। পরিকল্পনা অনুসারে সামাদ গামার মর্টার প্লাটুনের সহায়তায় ক্যাপ্টেন হুমায়ুন তার কোম্পানী নিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আঘাত হানবে। আমরা সোজা উত্তর থেকে থানার উপর ঝাপিয়ে পড়বো।

নাগরপুর অভিযানে বিভ্রান্তি
১২ই অক্টোবর দুপুরে হুমায়ুনের নেতৃত্বে দু’শ মুক্তিযোদ্ধা নাগরপুর থানায় আঘাত হানতে এগিয়ে গেল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে প্রায় এক মাইল উত্তরে হানাদার সৈন্য দ্বারা আক্রান্ত হয়। তুমুল যুদ্ধ চললো। তাররা বাজার থেকে কমাণ্ডার হুমায়ুনের যাত্রা করার প্রায় ঘন্টা খানেকের মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের এক পর্যায়ে খবর এলো, মুক্তিবাহিনী হানাদারদের বিপুল ক্ষয়- ক্ষতি করেছে। উপরন্তু থানার উত্তর অংশের সমস্ত এলাকাটাই মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭২

খবর পেয়ে পরিকল্পনা মত টাংগাইল-নাগরপুর রাস্তা ধরে নাগরপুর থানার দিকে এগুলাম। কুড়িজন মুক্তিযোদ্ধা আমাকে অনুসরণ করলো। অস্ত্রের মধ্যে জিয়ার কাছ থেকে আনা সেই ৩ ইঞ্চি মর্টারসহ দলের প্রত্যেকের কাছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। আমরা যখন নাগরপুর থানার আধমাইল উত্তরে, ঠিক তখন ডানে বিরাট শষ্য ক্ষেতের মধ্যে বেশ কিছু লোক দেখতে পেলাম। লোকগুলো যে নিরন্ত্র নয় সে সম্পর্কেও আমরা নিঃসন্দেহ হয়ে গেলাম।
তারা পশ্চিম-উত্তর দিকে গুলি ছুড়ছিল। এই অবস্থা দেখে আর দক্ষিণে না গিয়ে ডান পাশে অর্থাৎ পশ্চিমে একটি গ্রামের মধ্যে চলে গেলাম। এবং পশ্চিম-উত্তরমূখী সৈনিকদের পিছন দিক থেকে আক্রমণ করলাম। এরকম জটিল অবস্থার প্রেক্ষিতে আক্রান্ত সৈন্যরা ভীষণ বেকায়দায় পড়ে গেল। তারা পিছনে ফিরে গুলি চালাতে শুরু করলো। এর মধ্যে আবার কেউ কেউ হাত তুলে চিৎকার করে কি সব বলতে লাগলো। আমি দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। তিন-চারশ গজ দূরে যুদ্ধরত অস্ত্রধারীরা কারা? মুক্তিবাহিনী? অথবা হানাদার? সঠিকভাবে নিরূপণ করতে পারছিলাম না। দূতের সংবাদ অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর এখানেই থাকার কথা। তাই একটু বিভ্রান্তিতে পড়লাম। গুলি ছোড়া বন্ধ করে ওদের পরিচয় জানার চেষ্টা করলাম। ধানক্ষেতের মাঝ থেকে প্রায় সত্তর-আশি জন আমাদের দিকে আপন জনের মত আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো। এগুতে থাকা সৈনিক দল মুক্তিবাহিনী অথবা হানাদার, এ বিভ্রান্তির ঘোর তখনও কাটেনি। কেবল তাকিয়ে আছি, লক্ষ্য করছি, সশস্ত্র লোকেরা আমার সামনে দিয়ে প্রায় ১০০ গজ দূরত্ব বজায় রেখে নাগরপুর- টাংগাইল রাস্তার দিকে যাচ্ছে। আমাদের কাছ থেকে রাস্তার দূরত্ব একশ গজ। স্বশস্ত্র লোকদের কাছ থেকেও ঐ রাস্তার দূরত্ব একশ গজ। এমনি সময় আমার বিভ্রান্তি কাটলো। সর্বনাশ। এতো হানাদার বাহিনী। আর একটু পূবে সরে গিয়ে নাগরপুর- টাংগাইল রাস্তার উপর উঠতে পারলে হানাদাররা যেমন নিরাপদ হবে, ঠিক তেমনি আমরাও চরম বিপদে পড়বো। কারণ আমাদের পিছনে এক হাজার গজের মধ্যে হানাদারদের নাগরপুর থানার সুদৃঢ় ঘাঁটি। সহযোদ্ধাদের দ্রুত ডানে সরে রাস্তার উপরে উঠে হানাদারদের রাস্তায় উঠার পথ রোধ করতে নির্দেশ দিলাম। দলের প্রায় অধিকাংশ সদস্য দৌড়ে রাস্তায় উঠে কিছুটা উত্তরে এগিয়ে গেছে, কিন্তু হানাদারদের রাস্তায় উঠা থেকে বিরত করতে পারছে না। হানাদারদের প্রতিহত করতে হলে আরোও উত্তরে যাওয়া চাই। আরোও উত্তরে যেতে হলে ছোট্ট একটা পুল অতিক্রম করা দরকার। এদিকে তখন হানাদাররা পুলটিকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে চলেছে। পুলের উপর দিয়ে উত্তরে যাওয়া অসম্ভব। পুলটির নীচ দিয়েও যাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে বুক সমান পানি। অধিকন্তু প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ ফুট লম্বা সেতুটির নীচের সমস্ত অংশটাই হানাদারদের দিক থেকে সম্পূর্ণ খোলা।
মুক্তিবাহিনীর প্রথম দলের যখন এই অবস্থা, তখন আব্দুস সবুর খান, মকবুল, আমি ও আরো কয়েকজন হানাদারদের উপর গুলি বর্ষণ করছিলাম। এমন সময় খবর এলো, অগ্রবর্তী দলের কেউ রাস্তা মুক্ত রাখতে পারছে না। খবর পেয়ে সঙ্গের যোদ্ধাদের উত্তরে পাঠিয়ে দিলাম। পিছনে পড়ে থাকলাম কেবল আব্দুস সবুর এবং আমি। সবুর আমার থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ পূবে সরে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৩

পজিশন নিয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকলে, আমি সবুরের কুড়ি-পঁচিশ গজ পূর্বে এসে দ্বিতীয়বার গুলি ছুঁড়তে শুরু করলাম। এরপর সবুর পজিশন ছেড়ে আরোও পুবে রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। সামনেই রাস্তা। মাঝে কুড়ি-পঁচিশ গজ ফাকা জায়গা। হানাদাররা ফাকা জায়গাটা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি ছুঁড়ে চলেছে। অপেক্ষা করার কোন উপায় নেই, সময়ও নেই। গুলি বৃষ্টির মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। দু’এক মিনিট দেরী হলেই চরম বিপদে পড়ে যাবো। এর অর্থ মারা যাওয়া অথবা ধরা পড়া। দুঃসাহসিক সবুর ঐ গুলি বৃষ্টির মাঝ দিয়ে পূবের বাড়িতে অবস্থান নেয়ার জন্য ছুটে গেল। আমি তার পিছু পিছু ছুটলাম। দুজনের তখন প্রায় একই গতি, নিশ্চিত মৃত্যুর গহ্বর পেরিয়ে জীবনকে ছোঁয়ার দূরন্ত অবিশ্বাস্য গতি। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও একই জায়গা দিয়ে চলে গেছে। দুই বাড়ির মাঝে ডোবায় সামান্য একটু জায়গায় আট-দশ আংগুল পানি। সবুর ঠিক ঠিক পেরিয়ে গেল। আমি সবুরের ঠিক পিছু পিছু না গিয়ে তিন-চার হাত ডানে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বিপদে পড়লাম। সবুরের পেরিয়ে যাওয়া রাস্তার তিন- চার হাত ডান দিয়ে পেরিয়ে যাওয়ার সময় অথৈ পানিতে তলিয়ে গেলাম।
এটা ছিল একটি গভীর ডোবা। আমি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছি। ঠাই পাঁচ্ছি না। এটা কিন্তু সবুরের দৃষ্টি এড়ায়নি। অথৈ পানিতে ডোবায় পড়ে আমার বহুদিনের ব্যবহৃত বৃটিশ এল. এম. জি. টি ধরে রাখতে পারছিলাম না। বারবার ভেসে উঠার চেষ্টা করেও ডুবে যাচ্ছিলাম। আমার অবস্থা দেখে সবুর খুব তৎপরতার সাথে আস্তে করে বললো, “স্যার, আইস্যা পড়েন, আমি বুঝছি। ব্যস, ঐটুকুই। সত্যিই সেদিন সবুর যেমন আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিল, আমিও সবুরের ঐ ‘বুঝতে’ পারার সঠিক অর্থ উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। সবুরের ইংগিত পূর্ণ কথা শোনামাত্র মুঠ আলগা করে প্রিয় এল. এম. জি. টি ছেড়ে দিলাম।
এল. এম. জি. টি ছেড়ে দিয়ে ধুপ ধাপ্ করে পানা সরিয়ে পানি থেকে উঠে দৌড়ে একটি বাড়ির আড়ালে চলে এলাম। সবুরও সাথে সাথে সামান্য দক্ষিনে সরে পুব দিকে চলে এলো। সবুরের ভাগ্য সত্যিই সুপ্রসন্ন। সে উন্মুক্ত জায়গায় বসে হানাদারদের উপর দুই মিনিট গুলি চালালো অথচ তার গায়ে একটি গুলিও হানাদাররা লাগাতে পারলো না। যদিও তার আশেপাশে অসংখ্য গুলি এসে পড়ছিল। আমি ও সবুর রাস্তায় এসে তাজ্জব বনে গেলাম। বাড়ী থেকে মাত্র কুড়ি পঁচিশ গজ উত্তরে এগিয়ে সব মুক্তিযোদ্ধারাই গুটলী পাকিয়ে রয়েছে। হানাদাররা যদি আর এক মিনিট সময় পায় তাহলে তারা নাগরপুর- টাংগাইল রাস্তার আড়াল পেয়ে যাবে। এমনকি তারা রাস্তাটি অবরুদ্ধ করে ফেলতে পারবে। চিন্তাভাবনার সময় নেই, একমিনিটের মধ্যেই একশ গজ উত্তরে যেতে হবে। সামসু, হালিম, খোকা, দুলাল, মকবুল ও দুরমুজ খানকে সাথে নিয়ে বুক সমান পানি ঠেলে পুলের নীচের বিপদসংকুল জায়গাটা পার হলাম। এই সময় সবুর পুল থেকে উত্তর পশ্চিমে হানাদারদের লক্ষ্য করে মুষলধারে গুলি বর্ষণ শুরু করলো। আমি চরম ঝুঁকি স্বীকার করে ছ’ সাত জন সহযোদ্ধা নিয়ে হানাদারদের একেবারে সামনা-সামনি এসে হাজির হলাম। আমরা একশ গজের বেশী এগিয়ে এসেছি। এখন আর রাস্তা অবরোধ করে মুক্তিবাহিনীর উত্তরে যাওয়া ঠেকিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৪

রাখা হানাদারদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কিছু হানাদার ইতিমধ্যে নাগরপুর-টাংগাইল রাস্তার পশ্চিমে অবস্থান নিয়েছে। ব্যাপারটি তখন এমন যে, পঁচিশ-ত্রিশ ফুট প্রশস্ত রাস্তার পূর্ব পাশে মুক্তিবাহিনী, পশ্চিম পাশে হানাদার। দুদলই মুখোমুখি। মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা যে হানাদারদের কাছে কোন হাত বোমা ছিলনা। মুক্তিবাহিনী যখন রাস্তার পশ্চিম পাশে আট দশটি হাতবোমা নিক্ষেপ করে, তখন হানাদাররা কোন হাতবোমা ছুঁড়তে পারেনি। রাস্তার পশ্চিম পাশের হানাদারদের গুলি ছুঁড়ে হটাতে না পারলেও হাতবোমা ছুঁড়ে সরানো গেল। সবুর বাকী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চলে এলো। আমরা যেমন আস্তে আস্তে উত্তরে সরে এসে ভাল ও মজবুত অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করছিলাম, ঠিক তেমনি হানাদাররাও আস্তে আস্তে দক্ষিণে সরে গিয়ে বাড়ীর আড়াল নিয়ে অবস্থান সুদৃঢ় করার প্রয়াস চালাচ্ছিল।
চরম ঝুঁকি পূর্ণ অবস্থান নিয়ে সবুর হানাদারদের উপর যে ভাবে নিরন্তর গুলি বর্ষণ করছিল-তা শুধু বাংলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেই নয়, যে কোন যুদ্ধের ইতিহাসেই এক বিরল ও বিস্ময়কর ঘটনা।
সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে উঁচু জায়গায় আড়াল নিয়ে গুলি ছোড়া হয়। এখানে ঘটে ছিল একেবারে উল্টো। আমাকে গুলি বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে সবুর উচু জায়গা পিছনে রেখে উন্মুক্ত জায়গায় বসে শুধু হাতের উপর এল. এম. জি. নিয়ে প্রায় দুই মিনিট গুলি ছোড়ে। ঐ যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধা ও আমার অভিমত আব্দুস সবুর খান ঐ দিন ঐ ভাবে গুলি চালাতে না পারলে আমার মৃত্যু ছিল অবধারিত।
আস্তে আস্তে যুদ্ধের গতি স্তিমিত হয়ে এলো। আমরা আরও এক হাজার গজ উত্তরে সরে একটি পুল সামনে রেখে সারাদিন অবস্থান নিয়ে থাকলাম। এসময় প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার পেটে আগুন, ক্ষুধার আগুন। ক্ষুধার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। গ্রামের লোকেরা পান্তাভাত, চিড়া- মুড়ি, ছাতু ও কলা-মূলা-আলু এনে রণক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ালেন, কিন্তু আমি কিছু খাওয়া দুরে থাকুক, একফোঁটা পানিও মুখে তুললাম না। আমার মনোবেদনার কারণ কি, সবুর তা বুঝতে পারে।
টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধে সবুরের মত সাহসী হাস্যোজ্জল, প্রাণবস্তু, খোলামেলা নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বিরল। সবুর তেমন লেখাপড়া জানে না এটা ঠিক, তবে তার সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি, বিচার- বিবেচনা অনেক অনেক তথাকথিত শিক্ষিত লোকের চাইতে হাজার গুণ বেশী। সবুর অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বললো, “স্যার, আপনে খাইন। আপনের অর্‌চ সন্ধা আইতে না আইতেই আইন্যা দিমু।”
— ঠিক আছে। সন্ধ্যা হোক, তুই অস্ত্র আইন্যা দে, তারপর খাব। সবুর কিন্তু সত্যিই তার কথার মর্যাদা রাখলো। একজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে একটি গামছা পরে বলতে গেলে হানাদার, রাজাকারদের ভিতর দিয়ে নির্ভুল ভাবে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছল। এবং অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, একডুবে প্রায় আট-দশ হাত পানির নীচ থেকে কক্ করা এল. এম. জি. টি তুলে নিয়ে এলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৫

ওখানে সবুর তার এল. এম. জি.-র দু’টা চেইন ফেলে এসেছিল। তাও একই সাথে তুলে নিয়ে আসে। রাত দশটায় সবুর বিজয়ীর বেশে এসে বহু স্মৃতি বিজড়িত এল এম. জি.টি আমার হাতে তুলে দিল।
রাত বারোটায় সারাদিনের যুদ্ধ ও দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত হয়ে ভাররা বাজারে মূল দলের সাথে মিলিত হলাম। ভাররা এসে জানতে পারলাম, কমাণ্ডার হুমায়ুন আক্রমণ করেছিল ঠিকই এবং যখন কিছুটা এগিয়েছে, তখনই তারা বিজয়ের সংবাদ পাঠায়। আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম, সেই সময় হুমায়ুন আবার কিছুটা বিপদে পড়ে যায়। আর শুধু বিপদ নয়, পূর্বের দু একটি স্থানের মত এখানেও সে হানাদারদের সঙ্গে বেশীক্ষণ টিকে থাকতে না পেরে ‘দে চম্পট’ নীতি অবলম্বন করে। ফলে যা কিছু দুর্ভোগ, তা আমাদের পোহাতে হয়।
সামাদ গামা কমাণ্ডার হুমায়ুনের যুদ্ধ পরিচালনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ ও ব্যথিত। তার আফসোস প্রায় পঞ্চাশটি ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপের পরও হুমায়ুন কোম্পানী এগিয়ে না গিয়ে বরং পিছিয়ে এলো। তাই অনুমতি চাইল, রাতে নাগরপুর মূলঘাঁটির উপর সে ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ করবে। অনুমতি দিয়ে বললাম, “বৃটিশ ৩ ইঞ্চি মটার থেকে নয়, চাইনীজ ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ করতে হবে। কারণ চাইনীজ মর্টারের গোলার কোন অভাব নেই, কিন্তু বৃটিশ ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলার পরিমাণ সীমিত।” সামাদ গামা তাতেই রাজী, সে নাগরপুর থানার এক দেড় মাইল উত্তরে একটি অত্যান্ত নিরাপদ জায়গা থেকে নাগপুর থানা লক্ষ্য করে দু’শ চাইনীজ ৩ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে। পরে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, তার ঐ রাতের গোলা নিক্ষেপ ছিল খুবই নির্ভুল। প্রায় একশ গোলা থানার সীমানায় পড়েছিল এবং সে রাতে হানাদারদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৬

হেডকোয়ার্টার অভিমুখে

১৩ই অক্টোবর সকালে হুমায়ুনের দলকে ঐ এলাকায় রেখে আরো দক্ষিণ নাগরপুর থানার কেদারপুরে এলাম। এখান থেকে মানিকগঞ্জের মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম সাহেবকে একটি পত্র পাঠালাম। পত্রের মূল বক্তব্য, যোগাযোগ সংক্রান্ত সামান্য ভুল বোঝাবুঝি দুর করা। উল্লেখ্য যে, জুলাই মাস থেকে নদী পথে সকল নৌযান থেকে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী কর আদায় করছিল। টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর ইস্যুকৃত কর আদায়ের কাগজপত্র দেখানো সত্ত্বেও কর প্রদানকারী নৌকাগুলো থেকে মানিকগঞ্জ মুক্তিবাহিনী দুএকবার কর আদায় করেছিল। মানিকগঞ্জ এলাকায় কর প্রদানকারী নৌকাগুলো থেকে দ্বিতীয়বার কর আদায়ের অথবা তাদের কাউকে নাজেহাল করার ঘটনা কয়েকবার ঘটেছিল। এরকম ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শুধু বিভ্রান্তকরই নয়, ক্ষতিকারকও বটে। তাই সকল এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটি ত্বরিৎ ও বাস্তবোচিত সমন্বয় বিধানে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম সাহেবের কাছে প্রস্তাব পাঠালাম, নদী পথে কোন নৌকায় কর আপনারা নিয়েছেন, এমন প্রমাণপত্র থাকলে উজান এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা তা অত্যন্ত মর্যাদার সাথে মেনে নেবো। ভাটিপথে কোন নৌকা যদি উজানের মুক্তিবাহিনীর বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারে, তাহলে আশাকরি আপনারাও তা মেনে নেবেন। বিশেষ করে ঢাকার দিক থেকে আসা যে কোন নৌকার কর আপনার আদায় করলে আমরা তা মেনে নেবে। এই ব্যাপারে আপনার কাছে একটি কর আদায়কারী প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছি। আশা করি আপনার দিক থেকেও প্রতিনিধি দল এসে পর্যায়ক্রমে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু যোগাযোগ গড়ে তুলবেন।’ আমার এই পত্রের পর কর আদায় সংক্রান্ত অথবা অন্য কোন ব্যাপার নিয়ে মানিকগঞ্জ-বিক্রমপুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আর কোন অসুবিধা বা ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। বরং একটা সুন্দর সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।

লাবিব জাহাঙ্গীর যেখানে নিহত হয়
১৩ই অক্টোবর সারাদিন কেদারপুর, লাউহাটি এবং আশেপাশের বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখলাম। জুন মাসে লাবিবুর রহমান ও জাহাঙ্গীর বাতেনের দলের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যেখানে শাহাদৎ বরণ করেছিল সেই স্থানটিও দেখতে গেলাম। কোম্পানী কমাণ্ডার গোলাম সরোয়ার ও লাল্টুর বর্ণনামত লাউহাটি- কেদারপুর রাস্তার পাশে তিন চারটি শনের ঘর তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। আমার সহযোদ্ধাদের রক্তে সিক্ত পায়ে চলার পথটিতে দাঁড়িয়ে, প্রিয় সহযোদ্ধাদের বিয়োগ ব্যাথায় কান্নায় বুক ভেঙে আসলো। সহযোদ্ধাদের শহিদ হওয়া স্থানটি নানাভাবে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে সেখানে থেকে ফিরে এলাম।

দুর্ঘটনা থেকে অব্যাহতি
বিকালে কেদারপুর ঘাটে নৌকায় বসে কি করে গ্রেনেড ফাটে, কেন ফাটে, আবার মাঝে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৭

মাঝে দু’একটি কেন ফাটে না ইত্যাদি সহযোদ্ধাদের নানাভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিছলাম। অন্যদিকে শতেক গ্রেনেড পরিষ্কার করে ব্যবহারের জন্য তৈরী করে নেয়া হচ্ছিল। গ্রেনেড মুছে ডেটোনেটর ভরে একের পর এক বেসপ্লেট গুলো শক্ত করে আটা হচ্ছে। এমন সময় আমার হাত থেকে হঠাৎ একটি গ্রেনেড ফসকে সামনে পড়ে যায়। পড়ে যাওয়া মাত্র গ্রেনেডটিতে ভোঁ ভোঁ শব্দ হতে থাকে। গ্রেনেডের ধর্ম এই যে, পিন খুলে গ্রেনেড ছোড়ার চার সেকেণ্ড পর তা বিস্ফোরিত হয়। তখন চার সেকেন্ড সময়ও নেই। চৌদ্দ পনের জন সহযোদ্ধা চারপাশে জড়াজড়ি করে বসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হলে তার আঘাতে সবাই ক্ষতবিক্ষত হয়ে দলা পাকিয়ে যাবে। এক মুহুর্ত নষ্ট না করে তপ্ত গ্রেনেড ধরে নিমিষে নৌকার ছোট্ট ফোকর দিয়ে নদীতে ছুঁড়ে মারলাম। গ্রেনেডটি পানিতে পড়ামাত্র ফেটে গেল। পানির প্রচণ্ড ধাক্কায় নৌকাটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সকল মুক্তিযোদ্ধাই অক্ষত বেঁচে গেল।
আমি তখনও উত্তেজিত। আমার কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। উত্তেজনায় শরীর ঝিমঝিম করছে। সৃষ্টিকর্তাকে লাখো লাখো শুকরিয়া জানালাম। অতীতে বহুবার আমি এমনি চরম অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি। অসংখ্য মানুষের প্রীতি, ভালবাসা এবং প্রকৃতির অপার মহিমায় বারবার বিপদমুক্ত হয়েছি। এবারও হলাম। সহযোদ্ধারা পুরো ব্যাপারটা বুঝার আগেই এত বড় একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেল। গ্রেনেড ফেটে নৌকায় ধাক্কা লাগবার পর মুক্তিযোদ্ধারা যখন ব্যাপারটার গুরুত্ব ও ভয়াবহতা উপলব্ধি করলো, তখন আমার প্রতি তাদের অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস আরো বহুগুণ বেড়ে গেল। এরকম চরম মুহুর্তে চরম উত্তেজনাকর অবস্থাতেও ধৈর্য্য ধরে স্থির থেকে পুরোপুরি সফলতার সাথে কাজ করতে পারলাম। এটা দেখে সহযোদ্ধারা খুবই গর্ব অনুভব করলো।
এ অভাবনীয় চরম উত্তেজনাকর ঘটনার রেশ কেটে যেতে না যেতে সাত-আট জনের একটি দল একটি বিশেষ বার্তা নিয়ে চল্লিশ মাইল রাস্তা অতিক্রম করে কেদারপুর ঘাটে এসে পৌছল। ‘পরদিন হেডকোয়ার্টারে পৌছবো- এমন একটি খবর দিয়ে দূতদের একজনকে হেড- কোয়ার্টারে যেতে নির্দেশ দিলাম। এতে তার কোন দুঃখ নেই, ক্লান্তি নেই, অনিচ্ছা নেই। আমার বার্তা সে হেডকোয়ার্টারে প্রথম বয়ে নিতে পারছে, এই দুর্লভ সুযোগ পেয়ে নিজেকে সে পরম ভাগ্যবান মনে করলো। সীমাহীন আনন্দে সে উদ্বেলিত। শুধু হেঁটে নয়, যেন নাচতে নাচতে ছুট
চললো।

মাল্লাদের বিদায়
১৪ই অক্টোবর সন্ধ্যার একটু আগে আমরা তিনটে নৌকা বিদায় করলাম। তিনটি নৌকার মধ্যে দুখানা জেলে নৌকা। নৌকা দুটি বারোদিন আগে ২রা অক্টোবর জগতপুর চর থেকে নেওয়া হয়েছিল। আর একটি শাহজানীর কমাণ্ডার মঈনুদ্দীন জোগাড় করে দিয়েছিল। মাঝিদের বিদায় দেওয়ার সময় একটা কিসের ব্যথা অনুভব করলাম। আমরা নৌকার মাল্লাদের সাথে এতোগুলো দিন-রাত কাটিয়েছি, থেকেছি, খেয়েছি। একটা মধুর আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল তাদের সাথে।
জেলে নৌকা দুটির মাল্লা পাঁচজন। পাঁচজনের প্রত্যেকেই বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রের অধিকারী। প্রত্যেকেই আলাদা ভাবে সমুজ্জল। পাঁচজনের মধ্যে আট-দশ বৎসরের একজন বালক, আরেকজন বৃদ্ধ, বয়স ষাট-পয়ষটি। বাকী তিনজন বলিষ্ঠ যুবক। সকলেরই বাড়ী সরিষাবাড়ী থানায়। গোপালপুর, কালিহাতী থানার নলিন, নিকড়াইল, শশুয়া থেকে জোগারচর-এই সমস্ত এলাকায় তারা প্রতি বছর মাছ ধরতে আসেন। মাছ ধরাই তাদের পেশা-জীবিকা। এদের দীর্ঘ দশ-বারো দিনের মধুর ব্যবহারে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন মুগ্ধ, অভিভূত, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে সম্মান ভালবাসা ও মর্যাদা পেয়ে তারাও তৃপ্ত, অভিভূত ও উল্লাসিত। জেলেরা চার- পাঁচ দিনের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে ছিল, তাদের সাথে যে লোকটি অতি সাধারণ ভাবে দিনরাত কাটিয়ে দিচ্ছে এবং সাদামাটা ব্যবহার করছে-তিনি আর কেউ নন, তিনি এলাকার মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতা।
কয়েকদিনে বাচ্চা ছেলেটি আমার কাছে খুবই প্রিয় হয়ে উঠেছিল। বৃদ্ধের প্রতিও আমার মনে একটা অপরিসীম মায়া, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জন্মেছিল। তাই এদের বিদায় জানবার সময় আমরা দারুণ ব্যথা অনুভব করলাম। বিদায়কালে যখন মাল্লাদের জিজ্ঞাসা করা হলো, “আপনাদের কত দিলে প্রাপ্য টাকা দেওয়া হবে।” তখন বৃদ্ধ মাল্লাটি বললেন,
— বাবা আপনেরা যহন আমাগোর নায় উঠেন, তহন আমরা খুব এডা খুশী অইয়া আপনেগো নায়ে উঠাই নাই। আমরা মাছ ধরবার আইছিলাম। আপনেগো জন্যে হেই মাছ ধরায় ক্ষতি অইলো, পয়লা আমাগোর তাই মনে অইছিল। বড় মিঞা (মুজিবর রহমান) সাহেব আমাগোর বইলা দিছিলাইন, আপনেরা দুই-তিন দিন নাও দুইডা রাখবাইন। দুইডা নায়ে দৈনিক একশ কইরা টেহা দিবাইন। কিন্তুক দিন অইয়া গেল তের চৌদ্দডা। আমরা পয়লা পয়লা খুশী অইতে না পারলেও পরে কিন্তুক নিজেগো খুব ভাগ্যবান মনে করছি। আমরা গরিব জাইল্যা মানুষ। আপনেগো মতন লোকের সাথে অ্যাক পাকে খাইতে পারমু, এক বিছানে হুইতে পারমু, এইড্যা তো জন্মেও ভাবি নাইক্যা। তাই বাবা টেহা পয়সা আমরা কিছু চাই না। আপনেগো লগে আমাগো তো প্যাট ভরছে। বাড়িতে দুই চাইরড্যা প্যাট আছে, ওগো জন্যে আপনে ইচ্ছা করলে দুই- তিনশ টেহা দিতে পারেন। আপনেরা যুদ্ধ করছেন। আমরা কিছু কইরতে পারিনা। তয় আমরাও স্বাধীন হইবার চাই। এই যে কয়দিন আপনেরা লগে আছিলেন আমাগো এই মেহনতটাই স্বাধীনতার জন্যে থাইক।’ বৃদ্ধের কথা শুনে আমার চোখে জল ছলছল করে উঠলো৷ বৃদ্ধকে বুকে জড়িয়ে ধরে অত্যান্ত শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সাথে বললাম, “যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমি কোথাও কারো সাথে এত দীর্ঘ সময় একত্রে কাটাতে পারিনি। আপনাদের পাশে এই দীর্ঘ দিন থাকার স্মৃতি সব সময় আমাদের উৎসাহিত করবে। আমাদের যুদ্ধটা সাহেব সুবাদের জন্য নয়, একেবারে আপনাদের মত সাধারণ মানুষের জন্য। আপনারা আমাদের দোয়া করবেন আমি এই যে টাকাটা দিচ্ছি এটা আপনাদের পারিশ্রমিক হিসাবে নয়, আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা হিসাবেই দিচ্ছি।” বৃদ্ধটি বারবার অর্থগ্রহণে আপত্তি করেন। কিন্তু আমার অশ্রু সিক্ত আবেগজড়িত অনুরোধ শেষ অবধি
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭৯

বৃদ্ধ মাঝি উপেক্ষা করতে পারেননি। টাকা তাকে নিতেই হল। বাচ্চা ছেলেটির হাতেও আরো কয়েকটি টাকা ধরিয়ে দিলাম।
অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সরিষাবাড়ির নৌকার মাল্লাদের আড়াই হাজার এবং বাচ্চা ছেলেটাকে তিনশ টাকা দিয়ে বললাম, “এরপর আপনাদের কখনো কোন কিছুর দরকার পড়লে আমার খোঁজ করবেন। আপনাদের জন্য কিছু করতে পারলে আমি খুশী হবো।” আমার কথা যেন বৃদ্ধের অতীত জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার জগতে প্রচণ্ড খোঁচা মারলো। বিগত সুদীর্ঘ জীবনে বৃদ্ধ অগণিত মানুষ দেখেছেন, তাদের সাথে থেকেছেন, উঠা বসা করেছেন। বৃদ্ধ মাঝি অনেক সাহেব-সুবরা, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের দেখেছেন, যারা বিপদে পড়ে তাদের মত জেলে-মুটে- মজুরদের সাথে ভাল ব্যবহার করেছে মিষ্টি কথা বলেছে, কাজ উদ্ধারের জন্য তোষামোদ করেছে অখচ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার পর তারা শুধু সব কিছু ভুলেই গেছে তা নয়, পরবর্তী কালে এই সাহেবসুবরাই তাদের ( খেটে খাওয়া মানুষদের) চরম তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা করেছে। কাদের সিদ্দিকীও যে আরও উপরে উঠে সম্মানিত ও বিখ্যাত হয়ে সাধারণ মানুষের কথা ভুলে যাবেন না, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? এ রকম মনে মনে ভেবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে স্মিতহাস্যে বৃদ্ধ জেলে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আমাগোরে এর পর দেখলে আপনি চিনতে পারবেন তো?” বৃদ্ধের কথার অন্তর্নিহিত ও ইঙ্গিতপূর্ণ তাৎপর্য অনুধাবন করে বললাম, দেখবেন, ঠিক পারব। সত্যি কথা বলতে কি এরপর দেখা হলে আমি তাদের বারবার চিনতে পেরেছি এবং যথাসাধ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে চেষ্টা করেছি।
শাহজানীর চর থেকে ভাড়া করা নৌকার মাল্লাদের প্রতি অত আকর্ষণ না জন্মালে, তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণস্পর্শ করতে পেরেছিল। শাহজানীর নৌকার মাল্লাদেরও ৫০০ টাকা দিয়ে খুব সম্মান দেখিয়ে সকলের সাথে বুকে মিলিয়ে বিদায় জানানো হলো।
১৪ই অক্টোবর সন্ধ্যা, সূর্য আস্তে আস্তে ডুবে গেলো। আকাশের গাঢ় লাল রংটুকুও মিলিয়ে যাচ্ছে। পাখীরা দিনান্তে যার যার ঠিকানায় ফিরে যেতে শুরু করেছে। আকাশে দু’একটা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। বইছে মৃদু মন্দ বাতাস। এ যেন বাতাস নয়, ঝির ঝির বাতাসের আড়ালে প্রকৃতি যেন কথা কইতে চায়। প্রকৃতি যেন প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধারা কানে কানে বলতে চায়, আহ্বান জানায়, তোমরা এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো।
আমরা এগিয়ে চলেছি। কেদারপুর থেকে সখীপুরের দিকে অনেকটা পথ আমি চিনি না। হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে কর্ণেল ফজলুর দলের যারা এসেছে, তাদের মধ্যে আজহারুল ইসলাম, বজলু, আব্দুল লতিফ ভোম্বল, ময়থার বেনু ও জাহাঙ্গীরের নাম উল্লেখযোগ্য। আর যাকে আগাম পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, তার নাম দুরমুজ খা। সে ঘাটাইল খানার গৌরাঙ্গী ইউনিয়নের অধিবাসী। ঐ পথ অতিক্রম করতে দুরমুজ খাঁকে বেশ কষ্ট ভোগ করতে হবে, এটা ভেবে আমি প্রথমে বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলাম। কিন্তু আমরা যখন এগুতে শুরু করলাম, তখন কর্ণেল ফজলু কোম্পানীর যোদ্ধাদের নৈপূণ্য ও ক্ষিপ্রতা দেখে অবাক ও বিস্মিত হয়ে গেলাম। দুরমুজ খাঁকে পাঠিয়ে দেয়ার অস্বস্তিও ভুলে গেলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮০

কেদারপুর থেকে হেডকোয়ার্টারের দূরত্ব প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল। ক্যাপ্টেন ফজলুর উল্কা গতি সম্পন্ন সহযোদ্ধারা এদিন সকালে বহেরাতলী থেকে কেদারপুরে আসে। তারাই আবার সন্ধ্যায় আমাকে পথ দেখিয়ে হেড-কোয়ার্টারে নিয়ে চলেছে। তাদের আনন্দ যেন ধরেনা। কর্ণেল ফজলু দলের সদস্যরা পালা করে দুএক মাইল সামনে ছুটে আবার পিছিয়ে এসে বারবার রাস্তার নিরাপত্তা খবর আমাকে অবহিত করছিল। রাত দশটার দিকে বন্নী গ্রামের মাঝ দিয়ে বাঐখোলায় ঢাকা-টাঙ্গাইল পাকা সড়ক অতিক্রম করলাম। ক্যাপ্টেন ফজলু কোম্পানীর এই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তায় কম করেও তিন চার বার এদিক ওদিক করেছে। ফলে তাদেরকে একশ কুড়ি মাইলের মত পথ চলতে হয়েছিল।

তেজপুর ঘাটে
ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তা অতিক্রম করে কাশিল-বিয়ালার মাঝামাঝি হাইলারাজার বাড়ীর পাশ ঘেঁষে বাথুলী হয়ে এগিয়ে চললাম। ১৫ই অক্টোবর ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে নৌকাগুলো বহেরাতলীর তেজপুর এসে ভিড়ল। এখানেই ক্যাপ্টেন ফজলু আমাদেরকে স্বাগত জানাতে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। তেজপুরে আসার আগ পর্যন্ত হেডকোয়ার্টারে খবর ছিল যে, ‘কাদের সিদ্দিকী আসছেন, তবে কখন কিভাবে আসছেন, তা তাদের জানা ছিল না। তেজপুরে প্রাতঃরাশ সারলাম। বহুদিন পর পাহাড়ের প্রাণ জুড়ানো বাতাস আমার শরীরে আনন্দের শিহরণ বইয়ে দিচ্ছিল। এক মূহুর্ত অপেক্ষা সইছিল না, পাহাড়ের মাঝে ছুটে যেতে ছট্‌ফট্ করছিলাম। কিন্তু ক্যাপ্টেন ফজলুর এক কথা, “স্যার, আমাদের এক ঘন্টা সময় দিতে হবে। এখন আমরা আপনাকে পাহাড়ে যেতে দিতে পারিনা, আমাদের কিছু আনুষ্ঠানিকতা সারতে হবে।” বাধ্য হয়ে তেজপুরে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হলো।
সকাল আটটা। তিনটি নৌকায় আমরা বহেরাতলী রওনা হলাম। তেজপুর থেকে বহেরাতলী দেখা যায়। দূরত্ব দেড় মাইলের বেশী নয়। মাঝখানের জায়গাটা বর্ষার পানিতে থৈ থৈ করছে। তেজপুরে ঘাটের পুব পাশে আসতেই সামনের দৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়ে গেলাম। চার- পাঁচ শত গজ দূরে পানির মধ্যে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে। প্রথমটায় ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অত পানির মধ্যে লোকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে কিভাবে। পরে খুব খেয়াল করে দেখলাম, লোকজন কেউ পানিতে দাঁড়িয়ে নেই। সকলেই নৌকার উপর দাঁড়িয়ে আছেন, নৌকায় ছই নেই বলে প্রথম অবস্থায় নৌকাগুলো দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল না। আমার নৌকা যখন দুসারিতে বাঁধা অসংখ্য নৌকার মাঝে এলো, তখন সেকি গগন বিদারী শ্লোগান। থৈ থৈ পানির মধ্যে শ্লোগানের এমন প্রচণ্ড আওয়াজ হতে পারে তা ভাবাই যায়না। জনতার মুখে তখন একই শ্লোগান—“তূর্য নিনাদ, বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ। হানাদারদের বাঁধবো, বঙ্গবন্ধুকে আনবো। জয় বাংলা, জয় কাদের সিদ্দিকী, জয় মুক্তিবাহিনী।” উত্তাল শ্লোগানের মাঝ দিয়েই আমরা বহেরাতলীতে পৌছলাম। তেজপুর থেকে বহেরাতলী পর্যন্তই শুধু নয়, বহেরাতলী থেকে সংগ্রামপুর পর্যন্ত একই ভাবে নৌকা এবং মানুষের সারি। তাদের বুকে হিম্মত, হাতে বৈঠা, মুখে শ্লোগান।
১৫ অক্টোবর ক্যাপ্টেন ফজলু অথৈ পানিতে দুসারিতে নৌকা বেঁধে আমাকে যে গণ-
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮১

সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন- তা সত্যিই চমকপ্রদ ও অতুলনীয়। তেজপুর থেকে বহেরাতলী হয়ে সংগ্রামপুর, এই তিন মাইল জুড়ে দুসারিতে নৌকা আর নৌকা। নৌকার উপরে হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দাঁড়িয়ে যে উন্নত মানের শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় দিয়েছেন তাও অতুলনীয়। বহেরাতলীতে ক্যাপ্টেন ফজলুর দল গার্ড অব অনার প্রদান করলো।
বহেরাতলীতে ক্যাপ্টেন ফজলু ও অন্যান্যদের সাথে কথা বলে সখীপুর রওনা হলাম। সংগ্রামপুর ঘাটপারে হামিদুল হক, খোরশেদ আলম আর. ও. সৈয়দ নূরু, ফারুক আহমেদ, নুরুন্নবী, মাষ্টার আমজাদ হোসেন এবং শওকত মোমেন শাজাহান সহ অন্যান্যরা স্বাগত জানাল। বাজারের পাশের বিড়ি-পাতার ব্যবসায়ীদের ক্যাম্প তখনও আগের মতই ছিল। এখানেই ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠিত অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। ভারত প্রত্যাবর্তনের পর পাহাড়ে প্রবেশের সময় আবার সংগ্রামপুর এসেছি। আসলে জায়গাটির নাম শালগ্রামপুর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে লোকেরা জায়গাটির নামকরণ করেন সংগ্রামপুর। পাঠান পাতার ব্যবসায়ীরা ফুল ও মালা দিয়ে আমাদের অভিনন্দিত করলেন।

বহেরাতলী থেকে সঙ্গীপুর
আবার শুরু হলো পথচলা। সংগ্রামপুর-সখীপুরের রাস্তাধরে আমরা এগিয়ে চলেছি।
রাস্তার দুপাশে মানুষ আর মানুষ। এত মানুষ এতদিন কোথায় ছিল তা আল্লা মালুম। সবাই কথা বলতে চান। হাত মিলাতে চান। চার পাঁচ শত গজ এগিয়ে যেতেই এক এক জন কোম্পানী কমাণ্ডার এগিয়ে এসে তার কোম্পানীর পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। সে এক দেখার মত দৃশ্য। সংগ্রামপুর থেকে সখীপুর মাত্র চার মাইল। এই সামান্য চার মাইল অতিক্রম করতে সময় লাগলো সাড়ে তিন ঘন্টা। রাস্তার উভয় পাশে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ানো মুক্তিযোদ্ধা ও স্বেচ্ছা দেবকদের অসংখ্য পরিচিত মুখ। প্রায় দুমাস পর আবার দেখা। সবার সাথেই দু-একটি কথা বলতে হচ্ছিল। আর জনসাধারণ তো আছেই। তারা আরোও উদগ্রীব আরো উৎসাহী। তাদের কেউ হাত মিলাচ্ছেন, কেউ বুক মিলাচ্ছেন আবার কেউ বা মাথায় হাত রেখে দোয়া করছেন। কেউ কেউ পদধূলি নিচ্ছে। মানুষের পায়ের চাপে শুধু ধূলি উড়ছে। সমস্ত আকাশ জুড়ে যেন এক বিরাট ধূলি মেঘ সৃষ্টি হয়ে সূর্য্য ঢাকা পড়ে গেছে।

সখীপুরে জনসভা
আমরা সখীপুরের দিকে এগুচ্ছি। শত শত ক্লান্তিহীন মানুষ আমাদের পিছু নিয়েছেন। বলতে গেলে সখীপুরে আহুত সভার চার ভাগের এক ভাগ লোক আমাদের পিছু পিছু আসছেন। ঠিক সাড়ে তিনটায় সখীপুর বাজারে এলাম। সখীপুর স্কুল মাঠে জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। হাজার হাজার লোক। এ যেন এক মিলনোৎসব। সখীপুর কমিউনিটি সেন্টারের সামনে, আনোয়ার-উল-আলম শহিদ, ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী, গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকী, টাঙ্গাইল বাস এসোসিয়েশনের সম্পাদক হাবিবুর রহমান (হবি মিয়া), বাশাইল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল আউয়াল সিদ্দিকী, সুসাহিত্যিক ও মুক্তিবাহিনীর প্রচার দপ্তরে নিয়োজিত অধ্যাপক মাহবুব সাদিক, অধ্যাপক কাজী
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮২

আতোয়ার সহ অন্যান্যরা অভিবাদন জানালেন।
আমি হেডকোয়ার্টারে আসছি-এটা নিশ্চিত হয়ে বেসামরিক প্রধান আনোয়ার-উল-আলম শহীদ তার সহকর্মীদের নিয়ে এলাকার কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। স্থলপথ নিরাপদ হলেও আকাশপথ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে তখন নিরাপদ ছিল না। স্থলপথে এগিয়ে আসা হানাদারদের মোকাবেলা করার সাহস ও শক্তি থাকলেও বিমান হামলা মোকাবিলা করার পুরোপুরি ক্ষমতা মুক্তিবাহিনীর ছিল না। ভারত সফরের পর প্রথম পাহাড়ে আসছি এবং খোলা মাঠে জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে না পারলে যে কোন সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সখীপুরের চারদিকে প্রায় বিশ মাইল জায়গা জুড়ে স্থায়ী ঘাঁটিগুলোকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু অতিরিক্ত সাড়ে তিন-চার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে সখীপুর বাজারের দু-আড়াই মাইল দূর থেকে পাঁচ-ছ, মাইল এলাকা ব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অতিরিক্ত তিন-চার হাজার মুক্তিযোদ্ধার প্রথম ও প্রধান কাজ, আকাশ পথে হামলা প্রতিহত করা। মোট ৮টি ভারী মেশিনগানের আটটিই এখানে নিয়োজিত করা হয়েছে। সত্তর-আশিটি এম. এম. জি তিনশ এল. এম. জি. এবং আড়াই হাজার স্বয়ংক্রিয় রাইফেল সদা প্রস্তুত। লক্ষ্য উপরে, আকাশ পথে। যে কোন সম্ভাব্য বিমান আক্রমণ প্রতিহত করতে মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত ৷ সেদিন বিমান হামলা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের কলাকৌশল ও নৈপুণ্য দেখে এরকম সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া মোটেই অযৌক্তিক নয় যে, বিমান হামলা হলেও তা সফলতার সাথে মুক্তিযোদ্ধারা রুখতে পারতো।
সভায় অসংখ্য লোক হয়েছে। এর আগে ৫ই আগষ্ট কচুয়া স্কুল মাঠে যে লোক সমাগম হয়েছিল- তার চাইতেও দ্বিগুণ-তিন গুন লোক হয়েছে। জনতার উৎসাহ উদ্দীপনা যেন অন্য যে কোন জনসভার চাইতে হাজারগুন বেশী। সখীপুর ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের সামনে পৌঁছলে অভিবাদন শেষে আনোয়ার-উল-আলম শহিদ তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে সভাস্থলে নিয়ে গেলেন কমাণ্ডার মতিয়ার রহমানের নেতৃত্ব ৩০০ মুক্তিযোদ্ধার একটি সুসজ্জিত দল আনুষ্ঠানিক ‘গার্ড অব-অনার’ প্রদান করলো। ‘গার্ড-অব-অনার শেষে মুক্তিযোদ্ধারা বসে পড়লো। স্থানীয় ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার, আমি তোমায় ভালবাসি” পরিবেশন করলো। তারপর কোরান, গীতা পাঠের মাধ্যমে ভারত প্রত্যাগমনের পর প্রথম পাহাড়ী এলাকায় জনসভার ক’জ শুরু হলো।
সর্বপ্রথম বেসামরিক প্রধান আনোয়ার-উল-আলম শহীদ স্বাগত জানিয়ে, অভিনন্দিত করে তার বক্তব্য রাখলেন। স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে জয়নাল মৌলানা একটি অতি সুন্দর বাস্তবমুখী বক্তব্য রাখলেন। গণপরিষদ সদস্য জনাব বাসেত সিদ্দিকী আবেগজড়িত কণ্ঠে অসীম সাহসিকতার সাথে হানাদারদের মোকাবেলা করতে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানালেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা ও অসুস্থদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করে, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের জেল থেকে ছিনিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৩

আনার সংকল্প ঘোষণার মাধ্যমে সিদ্দিকী সাহেব তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন।
বেসামরিক প্রধান আনেয়ার-উল-আলম শহীদ জলদগম্ভীর কন্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘এবার আমি আপনাদের পক্ষ থেকে ঢাকা-টাংগাইল-ময়মনসিংহ- পাবনা মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা জনাব আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে বক্তব্য রাখতে অনুরোধ জানাচ্ছি।’ তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনিতে সমগ্র সভাস্থল উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। তাঁরা এতক্ষন অসীম ধৈর্য্য ও আগ্রহ নিয়ে আমার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেই বহু আকাঙ্খিত শুভক্ষণটি সমাগত। তাই তারা আনন্দিত, উদ্দীপ্ত ও উদ্বেলিত। করতালি ও শ্লোগানের মাঝে মাইকের সামনে এসে দাড়ালাম।
টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই জনসভার গুরুত্ব অপরিসীম। মাত্র দুঘন্টার নোটিশে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ সখীপুর স্কুল মাঠে সমবেত হয়েছেন। এ যেন একটা সাধারণ সভা নয়, সুশৃঙ্খল একটি বাহিনীর সভা। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে চর্তুদিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম। যেদিকে তাকাই, শুধু পরিচিত আর পরিচিত মুখ। অসংখ্য পরিচিতদের মধ্যে হাটুভাঙ্গার স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার বারেক, কালমেঘার কমান্ডার কেতাব আলী, ফুলবাড়ীর আক্কেল আলী সিকদার, বাঘের বাড়ীর আবু বকর, ধানগড়ার শাজাহান ও সিরাজ, সাগরদীঘির মগদুস, দেওপাড়ার করিম মুন্দী, বহেরাতলীর গফুর সহ আরও অগণিত চেনা মুখ। তাদের কেউ কুড়ি মাইল, কেউ পঁচিশ মাইল আবার কেউ এসেছে ত্রিশ মাইল দূর থেকে।
আমি শাস্তভাবে উচ্চারণ করলাম, “আপনাদের সকলের উপর পরম করুণাময় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আপনারা আমার সশ্রদ্ধ সালাম গ্রহণ করুণ। প্রায় দীর্ঘ দুমাস পর আবার আপনাদের সামনে হাজির হতে পেরে আমি যার পর নাই আনন্দিত ও গর্বিত। আজ এই ভাবে আপনাদের দেখে আনন্দে ও গর্বে আমার বুক ভরে গেছে। আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি শহিদী আত্মাদের, আমি আশু সুস্থতা কামনা করছি তাদের যারা আহত হয়েছে। আমি সালাম ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি সহযোদ্ধাকে, প্রতিটি স্বেচ্ছা সেবক ও প্রাণপ্রিয় জন সাধারণকে। আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি আনোয়ার-উল- আলম শহীদ, ইদ্রিস আলী, হামিদুল হক, আব্দুস সবুর খান, নুরুন্নবী, শাহাজাদা চৌধুরী, খোরশেদ আলম আর.ও সাহেব, আমজাদ আলী মাষ্টার, ফারুক, সৈয়দ নুরু, মোকাদ্দেছ, মতিয়ার রহমান, কমান্ডার লতিফ, শওকত মোমেন শাজাহান ও অন্যান্যদের। আমি তাদের এই জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তারা যে বিশেষ সাহস ও কৃতিত্বের সাথে মুক্তিবাহিনীতে একতা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে৷ আরো যারা তাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে সে সব কোম্পানী কমান্ডার যোদ্ধাসহ অন্যান্যদেরও আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ভাই ও বোনেরা, আল্লাহর রহমতে এবং আপনাদের দোয়ায় আমি আবার আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি। এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। এখন আমাদের আঘাত হানার ক্ষমতা আগের চাইতে অনেক গুণ বেশী। মুক্তিযুদ্ধে আবার আমি মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করতে পারবো। আপনারা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৪

স্থির জেনে রাখুন, স্বাধীনতা বেশী দুরে নয়। জয় আমাদের হবেই। তবে আপনারা যে ত্যাগ ও দূঃখ কষ্ট স্বীকার করেছেন, তা অবর্ণনীয়। শুধু আপনারা কেন, সারা বাংলার মানুষ দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করেছে। আপনাদের এই ত্যাগ ও তিতীক্ষার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। আমাদের দেশের লাখো লাখো ভাই বোন, মা, বাবা নির্যাতন ভোগ করছেন, জালেমের হাতে শহীদ হচ্ছেন। শহীদদের রক্ত কিছুতেই ব্যর্থ হতে পারেনা। ভাইয়েরা, বোনেরা, বন্ধুরা, আমি ভারতে যেতে চাইনি, বাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম। ঐ সময় আমার পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। আমার চিকিৎসার কোন সুযোগ ছিল না। আমি জানি আমার অবর্তমানে আপনাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। আমার অপারগতার জন্য আপনারা আমাকে ক্ষমা করুন। আমি ইচ্ছা করে ভারতে না গেলেও, এখন দেখছি ভারতে গিয়ে ভালই হয়েছে। একদিকে যেমন আমাদের স্বাধীনতার প্রতি ভারতীয় জনগণ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কি গভীর সহানুভূতি রয়েছে, তা আমি লক্ষ্য করেছি, অন্যদিকে লাখো লাখো ছিন্নমূল বাস্তুহারাদের কি অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, তাও দেখেছি। সে সব ছিন্ন- মূলদের কথা মনে পড়লে এখনও আমার চোখে পানি আসে। তারা কেউই পরাধীন দেশে ফিরতে চায় না, তারা সবাই স্বাধীন বাংলাদেশ দেখতে চায় এবং এজন্য তারা আরও দুঃখ কষ্ট হাসিমুখে স্বীকার করতে প্রস্তুত।
যদিও আমার পক্ষে কলকাতা বা ভারতের বড় বড় শহরে গিয়ে বড় বড় নেতাদের দেখার সুযোগ হয়নি বা আমি দেখতে যাইনি। তবে সেখানে আমাদের নেতাদের কে কি করছেন, তার কিছু কিছু শুনেছি। আপনারা যখন আপনাদের কষ্টার্জিত অন্ন নিজেরা না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে তুলে দিচ্ছেন, তখন আমাদের কিছু কিছু নেতা কলকাতা, দিল্লি, বোম্বে সহ অন্যান্য বড় বড় শহরের বিলাসবহুল হোটেলে আরামে দিন কাটাচ্ছেন। এসব নেতাদের কারও কারও চরিত্র সম্পর্কে আমি এমন সব অভিযোগ শুনেছি, যা উচ্চারণ করতেও ঘৃণাবোধ হয়। লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। সীমান্তের মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে যখন আমাদের যোদ্ধা ভাইয়েরা অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, শীত বস্ত্রের অভাবে কষ্ট পাঁচ্ছে, রোগে ঔষধ পাঁচ্ছে না, শুনেছি তখনও ঐ সব নেতাদের দুচারজন রিলিফের মাল বিক্রি করে তাদের ভোগ বিলাসের উপকরণ বাড়িয়ে তুলছেন উদগ্র লালসা চরিতার্থ করে চলেছেন। বন্ধুরা, আমরা ঐ সব চোর, চোট্টা, লম্পটদের পরোয়া করি না। আমরা অস্ত্র ধরেছি, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে, তিনিই আমাদের নেতা। আমরা ধরেছি আপনাদের মুক্তির জন্যে, দেশের স্বাধীনতার জন্যে। স্বার্থপর, লোভী, চরিত্রহীন কিছু সংখ্যক বর্ণচোরাদের স্বার্থরক্ষার জন্য আমরা অস্ত্র ধরি নাই। বাংলার বুক থেকে হানাদারদের চীরতরে নির্মূল করাই আমাদের কাজ ও প্রধান কর্তব্য। আমাদের নেতা আজ হানাদারদের জিন্দানখানায় বন্দী। স্বাধীনতা এবং নেতাকে মুক্ত না করা পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবেই, চলবে। দুর্নীতিবাজ, স্বার্থপর, অর্থলোলুপ বদমাইশদের কথা ভাববেন না। একদিন না একদিন ওদের জনতার আদালতে বিচার হবেই।
আপনাদের ধন্যবাদ জানাবার ভাষা আমার নেই। পাহাড়ের মানুষ, চরের মানুষ আমাদেরকে সাহায্য না করলে আজকের এই অবস্থায় কিছুতেই আসতে পারতাম না। বন্ধুরা,
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৫

মুক্তি সংগ্রামে আপনারা যে ভাবে সাহায্য করে চলেছেন, তা ইতিহাসে এক দৃষ্টান্তহীন নজীর হয়ে থাকবে। আমি শেষবারের মত আবার আপনাদের অনুরোধ করছি, ইস্পাত-কঠিন মনোবল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করুণ। হানাদাদের ভারী অস্ত্রগুলো আমরা গুঁড়িয়ে দেবো। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমাদের হাতিয়ার হবে লাঙ্গল, কোদাল, কুড়াল, হাতুড়ি, কাস্তে। হানাদারদের ভারী ভারী অস্ত্রগুলি গলিয়েই তা করা হবে।
স্বেচ্ছাসেবক ভাইয়েরা, দীর্ঘ সময় তোমরা দেখেছ, একটি সুসংগঠিত সরবরাহ ব্যবস্থার কত প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কর্মতৎপরতা ও যোগ্যতার উপর মুক্তিযুদ্ধের গতি ও সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা, আমি তোমাদের সালাম জানাই। আমি এখন তোমাদেরই পাশে। তোমরা শত্রুর বুকে আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হও। পাহাড়ের জনগণ ও মা বোনেরা, আবার আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আমরা শপথ নিচ্ছি, বঙ্গপিতাকে যতদনি পর্যন্ত না হানাদারদের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত করে আনতে পারবো, বাংলা থেকে হানাদারদের যতদিন পর্যন্ত উৎখাত করতে না পারবো, ততদিন পর্যন্ত আমাদের জন্য আরাম হারাম। শহিদী আত্মার মাগফেরাত, আহতদের আশু সুস্থ কামনা করে আমি বিদায় নিচ্ছি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী।”
সভাশেষে মৌলানা জয়নাল আবেদীন একটি স্মরণীয় মোনাজাত করেন।
হাজার হাজার মানুষের উষ্ণ সান্নিধ্যে আমার মন ভরে উঠলো। সভাস্থলে জনসাধারণের বেশী সময় অপেক্ষা করা নিরাপদ নয়। জনসাধারণকে তাড়াতাড়ি সভাস্থল ত্যাগ করতে বলা হলো। আস্তে আস্তে তারা যে যার বাড়ি যেতে লাগলেন। জনগণ তখন নূতন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। তাদের বুক ভরা আশা। আর কোন ভয় নেই, চিন্তা নেই। এবার এক এক করে হানাদারদের ঘাটগুলোর পতন ঘটবে। হলোও তাই। ১৯৭১ সালের ২১শে অক্টোবরের মধ্যে টাংগাইল জেলা নতুন শহর বাদে সমগ্র এলাকাই মুক্ত হয়ে গেল। টাংগাইল পুরানো শহরও ১৯শে নভেম্বর একরাত মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিন্যাস
সভাশেষে বর্গারচালার হেডকোয়ার্টারে এলাম। হেডকোয়ার্টারে এসেই আমাদের বাহিনীর শক্তি, পরিধি, আঘাতের ক্ষমতা ও যুদ্ধের গতি প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা সভায় বসলাম। পর্যালোচনার সময় দেখা গেল, আগের তুলনায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ ক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে। সমগ্র টাংগাইল, ঢাকা জেলার তিনটি থানা, ময়মনসিংহের চারটি এবং পাবনার চারটি থানার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আমার নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর সাতানব্বইটি কোম্পানী ছড়িয়ে আছে। এই কোম্পানীগুলোর হাতে পদাতিক বাহিনীর ব্যবহারোপযোগী প্রায় সব রকম হাল্কা, মাঝারী ও ভারী অস্ত্র শস্ত্র রয়েছে। ভারী অস্ত্রের মধ্যে ৩ ইঞ্চি মর্টার, রকেট লান্সার ব্লান্ডারসাইট, হাল্কা কামান, হাল্কা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভারী মেশিনগান, শতাধিক এম.এম.জি. ছ-সাতশ’র উপর এল.এম.জি, রাইফেল, স্টেনগান, পিস্তল ও রিভলভার তো সাধারণ ব্যাপার। গোলাবারুদের সংখ্যা কত তার হিসাব রাখাই
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৬

কঠিন। সত্যি কথা বলতে কি, ১৯৭১ সালের আগস্টের পর টাংগাইল মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদের কথা ভাবতে হয়নি।
পর্যালোচনার সময় আরো লক্ষ্য করা গেল, ১৫ই অক্টোবর অবধি মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে চৌদ্দ হাজার। অলিকাভুক্তি স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যাও ষাট হাজারের উপরে। এ দিনের পর্যালোচনা সভায় সমগ্র এলাকাকে ৫টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হলো। প্রত্যেক এলাকা একজন সেক্টর কমান্ডার ও কয়েকজন কমান্ডারকে তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়া হলো। পর্যালোচনা সভায় নতুন পরিকল্পনা নেবার পরই যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি আরেকবার পাল্টে যায়।
এই সভাতে বেশ কয়েকজন কমান্ডারের পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। একজন কর্ণেল, কয়েকজন মেজর ও ক্যাপ্টেন এবং কয়েকজন কমান্ডার পদে উন্নীত হলো। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য এখানেই ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমানকে কর্ণেল পদে উন্নীত করে একটি সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হলো। সামরিক অঞ্চলগুলো হলো নিম্নরূপ :
সেক্টর নম্বর এক- টাংগাইল-মধুপুর সড়কের পশ্চিম থেকে যমুনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা। লক্ষ্য : গোপালপুর, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট, ধনবাড়ীর শত্রু ঘাঁটি এবং টাংগাইল-মধুপুর-ধনবাড়ী সড়ক। বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সরিষা বাড়ীর কমান্ডার আনিসের উপর ধনবাড়ী, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট আক্রমণের দায়িত্ব অর্পিত হলো। কমান্ডার আনিস তার কোম্পানী নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে এই দুস্থানে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করেন। গোপালপুর থানার দায়িত্ব পেলো মেজর আঙ্গুর, ক্যান্টন আরজু, মেজর তারা, ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন হবি। আরও চারটি কোম্পানী তাদের সাথে সংযুক্ত হলো। ঘাটাইল-কালিহাতী সড়কের দায়িত্ব দেয়া হলো ক্যাপ্টেন চাঁদ মিয়াকে। এই সকল কোম্পানীর মূল নেতৃত্ব ও কাজের সমন্বয় সাধনের ভার পেল দুর্ধর্ষ কমান্ডার মেজর আব্দুল হাকিম। কমান্ডার হাকিম গোপালপুরের নলিন বাজারে তার সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলো।
সেক্টর নম্বর দুই- নিয়ন্ত্রনাধীন এলাকা : ঢাকা-টাংগাইল সড়কের পশ্চিমে মির্জাপুর, নাগারপুর টাংগাইল থানা, মানিকগঞ্জের ধামরাই, ঘিওর, সাটুরিয়া, পাবনার চৌহালী ও বোতিল থানা। ধামরাই ও ঘিওর থানার দায়িত্ব কমান্ডার সুলতান এবং বোতিল ও চৌহালীর দায়িত্ব কমান্ডার মঈনুদ্দীন ও কমান্ডার মোজাম্মেলের উপর অর্পিত হলো। নাগরপুর, মীর্জাপুর, ঘিওর, ঢাকা-টাংগাইল সড়ক নজর রাখার দায়িত্ব পড়লো অন্য আরোও ছয়টি কোম্পানীর উপর। সঠিক তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় বিধানের ভার পেলো বহুল আলোচিত ও বিখ্যাত জাহাজমারা কমান্ডার মেজর হাবিবুর রহমান। নাগরপুর থানার সলিমাবাদে মেজর হাবিব তার দু’নম্বর সেক্টরের হেড- কোয়ার্টার স্থাপন করে এবং সলিমাবাদের কোম্পানী কমান্ডার, করটিয়া কলেজের প্রাক্তন ছাত্র শাহ আলমকে সেক্টর হেডকোয়ার্টার দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়।
সেক্টর নম্বর তিন— আওতাভুক্ত এলাকা: ঢাকা-টাংগাইল সড়কের পুব পাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং টাংগাইল জেলা শহরের শত্রু ঘাঁটি। এই অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়করা হলো, মেজর
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৭

মনিরুল ইসলাম, মেজর মোস্তফা, মেজর লোকমান, ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন কলিবুর রহমান বাঙ্গালী, কমান্ডার মতি, কমান্ডার মোকাদ্দেছ, পাক বাহিনীর গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কমান্ডার ক্যাপ্টেন আজাদ কামাল, ক্যাপ্টেন জসিম এবং ক্যাপ্টেন আমান উল্লাহর কোম্পানীসহ আরও চারটি কোম্পানী। এদের তত্ত্বাবধানে রইলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরল চরিত্রের অধিকারী কর্ণেল ফজলুর রহমান। কর্ণেল রহমান তাঁর সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলেন বহেরাতলীতে।
সেক্টর নম্বর চার টাংগাইল মধুপুর সড়কের পুবের সমস্ত এলাকা এই সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। এদের আক্রমণের লক্ষ্যস্থল কালিহাতী ও ঘাটাইল থানা এবং টাংগাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়কে শত্রুর কনভয়। এই অঞ্চলের দায়িত্ব পেলো ক্যাপ্টেন গোলাম সরোয়ার, ক্যাপ্টেন আব্দুল লতিফ, ক্যাপ্টেন রিয়াজ, ক্যাপ্টেন শাহজাহান। সার্বিক দায়িত্ব অর্পিত হল মেজর নবী নেওয়াজের উপর। সে তার সদর দফতর স্থাপন করলো মরিচাতে।
সেক্টর নম্বর পাঁচ- মধুপুর, মুক্তাগাছা ও ভালুকার সমগ্র অঞ্চল। আঘাত ও আক্রমণের লক্ষ্যস্থল ও লক্ষ্য বস্তু হলো : শত্রুর মধুপুর ঘাঁটি, জলছত্র ঘাঁটি, মুক্তাগাছা, ত্রিশাল ও ভালুকা থানা এবং টাংগাইল-ময়মনসিংহ ও ভালুকা সড়কে শত্রুর কনভয়। দায়িত্ব প্রাপ্ত কমান্ডার হলো ক্যাপ্টেন ইদ্রিস, মেজর আব্দুল গফুর, কমান্ডার আব্দুস সামাদ, ক্যাপ্টেন লাল্টু ও আরোও দু’টি কোম্পানী। এই সেক্টরকে দুভাগে বিভক্ত করা হলো। পূর্বাঞ্চলের পূর্ণ দায়িত্ব পেলো মেজর আফছার এবং পূর্ব-উত্তর অঞ্চলের দায়িত্বে থাকলো ক্যাপ্টেন লাল্টু।
মুক্তাঞ্চল সেক্টর বিভক্তি ও বিন্যাসের সময় পঞ্চাশটি কোম্পানীকে নিয়মিত, স্থায়ী ঘাঁটি রক্ষার দায়িত্ব প্রদান করা হলো। বাকী কোম্পানীগুলোকে রাখা হলো চলমান। যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানেই ঝটিকা আক্রমণ করবে অথবা যুদ্ধে সাহায্য করবে।
টাংগাইলের মুক্তিযোদ্ধাদের রণকৌশল ছিল গেরিলা যুদ্ধের চিরাচরিত কৌশলের অনেকটা বিপরীত। গেরিলাদের যুদ্ধ নীতি হলো, আঘাত করে পালিয়ে যাওয়া। আমাদের প্রাথমিক নীতি ছিল, ‘আঘাত কর ও অবস্থান কর।’ এবার সেই নীতিরও পরিবর্তন ঘটানো হলো। এবার টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর নতুন নীতি, “আঘাত কর, অবস্থান কর ও এগিয়ে যাও।” আমাদের এই নতুন ও দুঃসাহসিক রণকৌশলের মুখে হানাদার বাহিনী বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। এই সময় ভেতরে আঘাতের প্রচণ্ডতা যেমন বেড়ে যায়, তেমনি সীমাস্তের দিক থেকে হানাদার বাহিনীর উপর চাপও বৃদ্ধি পায়। ভিতর ও বাহির কোনদিক সামলাবে? আগষ্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হানাদাররা সীমান্ত নিয়ে তেমন চিন্তিত ছিল না। আক্টোবর-নভেম্বর থেকে তাদের সীমান্তের দিকটাও সামলাতে হচ্ছিল। হানাদারদের এই উভয় সংকটে আমরা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যাই।
সামরিক বিভাগের কাজকর্ম শেষ করে বেসামরিক বিষয়াদির উপর দৃষ্টি দিলাম। প্রথমে হাসপাতাল ও হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কে খোঁজখবর নিলাম। হাসপাতালটি মুখ্যতঃ মুক্তিবাহিনীর প্রয়োজনের তাগিদে গঠিত হলেও পরবর্তীতে জনসাধারণের প্রয়োজন ও চাহিদা মেটাতেও সক্ষম হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত হবার পর আমরা এটা পরিস্কার বুঝতেপৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৮

পেরেছিলাম যে, সাধারণ মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব আমাদের উপর আপনা- আপনিই এসে গেছে। শুধু নিজেদের চিকিৎসা, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের কথা চিন্তা করলে চলবে না। সমগ্র অঞ্চলের সকল জনগণের কথা ভাবতে হবে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা এভাবে চিন্তা করে কর্মতৎপর হতে সক্ষম হয়েছিলাম বলেই জনগণের কাছে প্রিয় ও বরণীয় হতে পেরেছি।
স্বাস্থ্য দফতরের বিভিন্ন বিভাগ ও উপ বিভাগের বিভিন্ন দিক আলোচনা ও পর্যালোচনা করে দেখা গেল, সামরিক বিভাগের মত এই বিভাগটিও বিশেষ দক্ষতা ও সফলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছে। স্বাস্থ্য দফতরের সাথে সংশ্লিষ্ট সহকর্মীরা প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে স্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র, একটি করে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দল ও মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকার জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র সরবরাহ করে চলেছে। স্বাস্থ্য দফতরকে আর কোন নতুন নির্দেশ দেয়ার ছিল না। সহকর্মীদের আরোও নিষ্ঠাবান ও সক্রিয় হতে পরামর্শ দিলাম। হাসপাতালের প্রাণশক্তি ডাঃ শাহাজাদা চৌধুরী সহ অন্যান্যদের ধন্যবাদ জানালাম। একে একে অর্থ, যোগাযোগ, গণসংযোগ ও কারা বিভাগের কাজকর্ম পর্যালোচনা করে খুবই সন্তুষ্ট হলাম। ভারত থেকে ফিরে প্রথম স্মরণীয় রাতটা হেডকোয়ার্টারে অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সাথে কাটালাম।

হেডকোয়ার্টারে নিদ্রাহীন রাত
কারও চোখে ঘুম নেই। সকলের মনেই এক অপার আনন্দের অনুভুতি। অনেক যোদ্ধা একত্র হলে যা হয়, এখানেও তাই হলো। গানে, গল্পে, অভিজ্ঞতা বর্ণনায় রাত কেটে গেল। একদল আরেক দলের কাছে, বিগত দুমাসের নানা অভিজ্ঞতা ক্লান্তিহীন ভাবে বর্ণনা করছে। শহীদ সাহেব কি ভাবে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে আবার ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ফিরে এলেন, হামিদুল হক ও আর. ও. সাহেব কি ভাবে অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন, আহত ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের কিভাবে জনগণ সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, আমজাদ মাষ্টার কিভাবে দিনের পর দিন অসুস্থদের পাশে কাটিয়েছে, হেডকোয়ার্টার খাদ্য দফতরের দায়িত্ব প্রাপ্ত করটিয়া কলেজের এম. এ. শেষ বর্ষের ছাত্র ওসমান কিভাবে আত্মগোপন করে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ করেছে, আর কিভাবেই বা হানাদাররা পাহাড়ের ভিতর এসে আবার চলে গেল—ইত্যাদি সমস্ত ঘটনার আদি অন্ত একের পর এক সকলে সোল্লাসে বর্ণনা করলো। চরম সময়ের অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করতে যেন দাউদ খান, হামিদুল হক ও অধ্যাপক মাহবুব সাদিকের জুড়ি নেই। তাদের ভীতপ্রদ চরম চাঞ্চল্যকর বিচিত্র অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই শুধু নন—আমিও উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠতে চাইছিলাম।
শহীদ সাহেবতো তার ভারত থেকে ফিরে আসার ঘটনা বলতে বলতে নিজেকে সামাল দিতে পারছিলেন না। রাতে হেডকোয়ার্টারে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম জানতে পারলো যে, কাদের সিদ্দিকীর নাম ও নির্দেশের বরাত দিয়ে শহীদ সাহেব গত ৭ই সেপ্টেম্বর কমাণ্ডারদের নিয়ে যে সভা করেছিলেন -ঐ সভার ব্যাপারে আমার সাথে তার কোন যোগাযোগ ছিল না। অর্থাৎ আমি তাকে কোনো নতুন নির্দেশ দিই নি। ৭ই সেপ্টেম্বরের সেই বিশৃঙ্খল ও বিভেদপূর্ণ অবস্থার প্রেক্ষিতে অন্যেরা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮৯

যদি জানতেন যে, শহীদ সাহেব আমার সাথে মিলিত হননি, নির্দেশও পাননি, তাহলে অনেকে হয়তো অত তাড়াতাড়ি একটা সিদ্ধান্তে আসতে চাইত না বা সাহসী হতো না। বিপদসংকূল সময় পেরোনোর পর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসায় সত্য প্রকাশে আর কোন অসুবিধা হওয়ার কারণ ছিল না, হলোও না। অসময়ে সত্য গোপনও সময় মত সত্য প্রকাশ করার এই সিদ্ধান্ত টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেই শুধু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়, বাঙালী জাতির বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ইতিহাসেও তা প্রভুত প্রশংসার দাবীদার। এক টানা ঘন্টা দুই সহকর্মীদের মন্তব্য, বক্তব্য ও নানা কাহিনী শোনার পর আমি আমার ভারত গমন থেকে প্রত্যাগমনের সমস্ত ঘটনা এক এক করে বর্ণনা করলাম। আমাকে ভারত সরকার, ভারতীয় সামরিক বাহিনী ও জনগণ কিভাবে দেখেছেন, ভারত গমনের ফলে দেশের অভ্যন্তরস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কর্তৃপক্ষের যোগাযোগর সুযোগ হওয়ায় পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে, ভারতে অবস্থান কালে দেশের সকল স্থানের মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে কিভাবে অভিনন্দিত করেছেন, বিশেষত: ভারতীয় জেনারেলরা কিভাবে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করেছেন, ইত্যাদি ঘটনার কোন কিছুই সহযোদ্ধাদের জানাতে বাকী রাখলাম না। এমনকি গণপরিষদ সদস্যদের মনোভাব, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোন আগ্রহ বা সাড়া না পাওয়া এবং দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্তের পশ্চাতে সেই ঘটনা, আলাপ করতে সকাল হয়ে গেল।

আমার অনুপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা
আমার অনুপস্থিতির সময় ১৯৭১ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে আনোয়ার-উল-আলম শাহীদ, হামিদুল হক, নুরুন্নবী, খোরশেদ আলম আর. ও. শওকত মোমেন শাহাজান, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ফারুক আহমেদ, ক্যাপ্টেন সবুর, ক্যাপ্টেন ইদ্রিস আলী, ক্যাপ্টেন মোকাদ্দেছ, ক্যাপ্টেন মতি, ক্যাপ্টেন লতিফ এবং আরও কয়েকজন অক্লান্ত পরিশ্রম করে, মুক্তিবাহিনীতে শৃংখলা ও মনোবল ফিরিয়ে আনে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর হেড কোয়ার্টার ভবানীপুর থেকে বর্গার চালায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।
ক্যাপ্টেন আজাদ কামাল এমনিতেই মির্জাপুর থানার লোক। আর যুদ্ধের পুরোটা সময় বলতে গেলে সে মির্জাপুর ও কালিয়াকৈর থানা এলাকার মধ্যেই কাটিয়ে দিয়েছে। ২০-২১শে সেপ্টেম্বর আজাদ কামালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল দেওহাটা রাজাকার ঘাঁটিতে এক ঝটিকা আক্রমণ চালায় এবং বিন্দুমাত্র ক্ষয় ক্ষতির সম্মুখিন না হয়ে তিন-চার হাজার গুলি ও পনেরটি নানা ধরণের অস্ত্র উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। আজাদ কামালের অন্য একটি দল ফুলবাড়ীয়া প্রাইমারী স্কুলে রাজাকারদের ঘাঁটির উপর গ্রেনেড হামলা করে। এতে পাঁচজন রাজাকার আহত ও দুজন নিহত হয়। এ অভিযানে ডুবাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ শাহাদাৎ বরণ করে।
নাটিয়াপাড়া (ইসলামপুর) পুল ধ্বংস করা দরকার। বিখ্যাত কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন ফজলুর
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯০

রহমানের নেতৃত্বে একটি দল ২রা অক্টোবর নাটিয়াপাড়া পুল ধ্বংসের উদ্দেশ্যে পুলের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত রাজাকারদের উপর হামলা চালায়। পুল থেকে রাজাকারদের বিতাড়িত করে আট-দশটি রাইফেল, হাজার তিনেক গুলি, কুড়িটি গ্রেনেড উদ্ধার করতে পারলেও এখানে মুক্তিবাহিনীর বীরযোদ্ধা ইব্রাহীম শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা ছানুসহ অন্য জন সামান্য আহত হয়। শহীদ ইব্রাহীম ছিল ই. পি. আর. এর নায়েক। মর্টার থেকে গোলা ছোড়ার সময় শত্রুর একটি গুলি তার বুকে বিদ্ধ হলে সে সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সেতু দখলে তিন জন রাজাকার নিহত হয়।
১৯৭১ সালের ৬ই অক্টোবর টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক স্মরণীয় বেদনার ও গৌরবের দিন। বল্লার শত্রু ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধারা অবরোধ করে রেখেছে। ক্যাপ্টেন ফজলুর নেতৃত্বে তিনশ মুক্তিযোদ্ধা চারদিন ধরে শত্রুর উপর চরম আঘাত হেনে চলেছে। বল্লার দখল তাদের চাই-ই চাই। ৬ই অক্টোবর দুপুরে পনের কুড়ি জন মুক্তিযোদ্ধা ঘোনাবাড়ীর একটি বাড়িতে খেতে বসেছে। এই সময় একজন হানাদার দালাল শত্রু শিবিরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খবর দেয়। প্রথমত মুক্তিযোদ্ধারা পাহারা রেখে দুপুরের খাবার খেতে বসেছে, ঠিক এমন সময় পাহারারত মুক্তিযোদ্ধাটি খবর দেয়, হানাদাররা বাড়ীটি ঘিরে ফেলেছে। কুড়ি জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে পনের জনই খেতে বসেছিল। খাওয়া রেখে অস্ত্র হাতে দুশমনের মোকাবেলায় তারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তিন দিকে ছুটলো। বাড়িটি ঘিরে ফেললে ষোল-সতের জন হানাদার বুকে হেঁটে পশ্চিম দিক থেকে বাড়ীটিতে উঠতে যাচ্ছিল। এটা লক্ষ্য করে মোমেন ও আবু হানিফ দৌঁড়ে গিয়ে তাদের উপর গুলি ছোড়া শুরু করে। সামান্য একটু আড়াল নিয়ে দশ-বারো গজ দূর থেকে হানাদারদের উপর এমন দুঃসাহসিক আক্রমণ খুব কমই হয়েছে। মোমেন ও আবু হানিফ এবং আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধার অবিরাম গুলির মুখে পশ্চিম দিকে হানাদারদের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। শুধু রুদ্ধ নয়, সেখানে আট জন হানাদার নিহত ও চারজন মারাত্মক ভাবে আহত হয়। অবস্থা চরম প্রতিকূল ও ভয়াবহ দেখে হানাদাররা লাশ ফেলে পিছু হটছিল। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। তারা আড়াল থেকে বেরিয়ে আরও এগিয়ে হানাদারদের উপর গুলি চালাতে থাকে। হঠাৎ হানাদারের একটি গুলি এসে মোমেনের বুক ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। হানিফের সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, সে বিরামহীন গুলিবর্ষণ করে চলেছে। হঠাৎ একটি গুলি এসে হানিফের বক্ষ ভেদ করে চলে যায়। সেও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মোমেন, হানিফ শহীদ হলে বাড়ীর পশ্চিম দিকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে দেখে তা সুদৃঢ় করতে এগিয়ে আসে রকেট ও আমীর। আমীরের নাম যদিও তার পিতামাতার দেয়া, তবে রকেটের আসল নাম কি তা মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। দ্রুত চলতে পারতো বলে জুলাই মাসের শেষে হেড- কোয়ার্টারের সহকর্মীদের অনুরোধে তার নাম দেয়া হয়েছিল রকেট। সে সময় থেকে রকেট নামের নীচে তার আসল নাম চাপা পড়ে যায়। রকেট ও আমীর পশ্চিম দিকে এসে অবস্থান নেয়ায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আবার শক্তিশালী হয়ে উঠে। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে তুমুল যুদ্ধ চলছে। মুক্তিবাহিনীর দুজন শহীদ ও তিন জন আহত হয়েছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯১

এ দুঃসংবাদ ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমানের কাছে পৌঁছলে তিনি তার দূর্ধর্ষ সহকারী ক্যাপ্টেন মোস্তফাকে পুরো দল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধার ও হানাদারদের ঘিরে ফেলতে ঘোনাবাড়ীতে পাঠিয়ে দেন। ঘন্টা তিনেক যুদ্ধ চলার পর বাড়ীর উত্তর পশ্চিম দিক থেকে কয়েকজন হানাদার রকেটের অবস্থান নেয়া বাড়ীতে উঠতে চেষ্টা করে। এটা লক্ষ্য করে আমীর ও রকেট ত্বরিৎ গতিতে সেদিকে ছুটে যায়। হানাদারদের কাছাকাছি হতেই রকেট শুনতে পায়, একজন হানাদার অন্য জনের কাছে গুলি চাইছে। এদিকে রকেটের গুলিও শেষ। নিজের গুলির ভাণ্ডার শূন্য তা বুঝতে না দিয়ে হানাদারদের দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণের জন্য সে ‘হ্যাণ্ডস আপ’ ‘হ্যাণ্ডস আপ’ বলে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ে। হানাদাররা হাত উঠাতে নারাজ। সম্ভবতঃ হানাদারদের কাছেও গুলি ছিল না। রকেট তার রাইফেল দিয়ে একটি হানাদারের মাথা লক্ষ্য করে সজোরে আঘাত হানে। আঘাতে হানাদারটির মাথা দুটুকরো হয়ে মগজ মাটিতে ছিটকে পড়ে। এই সময় অন্য একজন স্বাস্থ্যবান হানাদার রকেটের মাথায় আঘাত হানে, রকেট তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়। পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে রাইফেলের বাটের এক আঘাতে আরেকটি হানাদারের মাথা উড়িয়ে দেয়। আর এ সময় রকেটকে আঘাত করতে উদ্যত হানাদারটিকে আমীর রাইফেল দিয়ে ক্রমাগত পিটাতে থাকে। বিশাল ও দানবাকৃত হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা আমীরের রাইফেলের দুইটি আঘাতও সে সহ্য করতে পারলো না। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। কিন্তু আমীরের রাইফেলের বাটটি ভেঙে বহু দূর ছিটকে গেল।
মুক্তিযোদ্ধা রকেট মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তার দেহ প্রাণহীন হিম শীতল। শত্রু নিধনে তৎপর ও উম্মত্ত আমীরের সেদিকে কিছু মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ক্ষিপ্রতার সাথে রকেটের রাইফেল তুলে নিয়ে অবশিষ্ট হানাদারটিকে বারবার মরণাঘাত হানতে থাকে। হানাদারটিও কম যায় না। সেও আমীরকে পাল্টা আঘাত হানতে থাকলো। এক সময় আমীর হাতিয়ার ছেড়ে কোমর থেকে বেওনেট বের করে মাখনে ছুরি চালানোর মত হানাদারটির পেটে ঢুকিয়ে দিল। আমীর স্থান ত্যাগ করবে এমন সময় পাশ থেকে একটি গুলি এসে তার বাম পাঁজরে বিদ্ধ হয়। সেও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এদিকে অবস্থা গুরুতর দেখে হানাদাররা পশ্চাদপসরণ করতে থাকে।
ঘোনাবাড়ীর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর চার জন দুরন্ত বীর শাহাদৎ বরণ করে এবং ছজন আহত হয়। হানাদারদের ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল প্রচুর। মুক্তিযোদ্ধারা ঘোনবাড়ীর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কুড়িটি হানাদার লাশ দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। স্থানীয় জনসাধারণের মতে হানাদারদের পক্ষে পঞ্চাশ জন নিহত ও আশি জন আহত হয়েছিল। এই যুদ্ধ যেমন স্থানীয় জনসাধারণের কাছে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিল, ঠিক তেমনি বল্লা হানাদার ঘাঁটিতে খবর সরবরাহকারী কুখ্যাত দালালটিও উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করেছিল। উপযুক্ত শাস্তিটা কি ধরনের? তিন দিন পর স্থানীয় জনগণ তাকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলেছিলেন। ঘোনাবাড়ীতে চারজন শহীদ ও ছজন আহত হওয়ার পরদিন বল্লার যুদ্ধে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। আমীর, রকেট, মোমেন ও আবু হানিফ চারজন সুযোগ্য সহযোদ্ধা হারিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যেন পাগল হয়ে উঠেছিল। এর জের হিসাবে ৭ই অক্টোবর
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯২

সন্ধ্যায় শত্রুর গুলিবৃষ্টির মাঝে হেঁটে, মুক্তিবাহিনী বল্লা ঘাঁটি দখল ও কুড়িজন হানাদার বন্দী করতে সক্ষম হয়। বল্লা ঘাঁটিতে তখন প্রায় একশ নিয়মিত হানাদার ও দুশ রাজাকার ছিল। ৭ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সামনে তারা দাঁড়াতেই পারেনি।
আগষ্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে টাংগাইল শহরে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে গিয়ে সালাহউদ্দীন ও বাকু শহীদ হয়।
১৯৭১ সালের ২৯শে আগস্ট। কমাণ্ডার আবদুল হাকিম ভারতে যাওয়ার পথে ঝাউয়াইল- ভেঙ্গুলার কাছে গোপালপুর থানার পানকাতায় শত্রুদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়ে। সে হেমনগর হয়ে ঝাউয়াইলের মাঝ দিয়ে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পেরিয়ে যমুনা ধলেশ্বরীতে নৌকায় উঠবে, এই চিন্তা করে এগুচ্ছিল। পথে ২১শে আগস্ট সে পানকাতায় একদম অপ্রস্তুত অবস্থায় শত্রুর দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কামুটিয়ার মুস্তাফিজুর রহমান, কালিহাতীর সাইদুর রহমান, ছোট চওনার ইদ্রিস সহ আট জন মুক্তিযোদ্ধা পানকাতার যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ করে। আট জন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাদের অমূল্য জীবন দিয়ে তিনশ মুক্তিযোদ্ধার দলটিকে বাঁচিয়ে গেল।
হানাদাররা ঘেরাও করতে এসে অক্ষত ও নির্ঝঞ্ঝাটে যেতে পারেনি। তাদেরকেও প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছিল। পানকাতার যুদ্ধে হানাদারদের ষোলজন নিহত হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মেজর আফছার আমার সাথে যোগাযোগ করতে ভারতের আগরতলায় যান। তিনি আগরতলায় মুক্তিবাহিনীর নানা ক্যাম্পে দিন দশেক অতিবাহিত করেন।
এসময় তুরা থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের মুখে আমি মেজর আফছারকে দেশের ভিতরে চলে যাবার নির্দেশ দিই। মেজর আফছার দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভালুকা, ফুলবাড়িয়া ও ত্রিশালের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি সুবিন্যস্ত ও সুসংহত করেন।

অনন্য স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী
মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা দরকার। টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে হাজার হাজার স্বেচ্ছা সেবকরা যে অনন্য ভুমিকা পালন করেছে, তা বাংলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অকুণ্ঠ সমর্থন, সহযোগিতা ও সাহায্য দিয়ে স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাজের বোঝাই শুধু কমিয়ে দেয়নি, অনেক অনেক জায়গায় মহামূল্যবান তথ্য ও সংবাদ সরবরাহ করে তারা যুদ্ধের গতি প্রকৃতি পর্যন্ত পাল্টিয়ে দিয়েছেন। আমাদের বাহাত্তর হাজার স্বেচ্ছা সেবকদের সকলের কথা আলোচনা করতে পারব না, যদিও সবার কথাই আলোচিত হওয়া উচিত। স্বেচ্ছা সেবকদের প্রতীক হিসাবে দু’চার জনের কথা আলোচনা করছি। মূলতঃ এদের কথা ও অবদান আলোচনা না করলে টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
আমি যখন নিঃস্ব রিক্ত হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তখন বাঘের বাড়ীর আবুবকর বিশেষ আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার সাথে যথেষ্ট সহায়তা ও সাহায্য করেছিল। আবুবকরই সর্ব প্রথম আমাকে বলেছিল, ‘কাদের ভাই কয়েকটা বন্দুক এনে দিন। হানাদারদের সাথে যুদ্ধ কতে পারি
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৩

না পারি, চোর ডাকাত দমন করতে তো পারব। তাতে লোকেরা কিছুটা শাস্তি পাবে। পরিচয়ের পর থেকে, মুক্তিবাহিনী গঠন, যুদ্ধ পরিচালনা, স্বাধীনতা লাভ ও স্বাধীনতাত্তোর পর্যায় সকল অবস্থাতেই দৃঢ়চেতা আবুবকর পূর্বের মানসিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
এমনি একজন স্বেচ্ছা সেবক কমান্ডার দুর্গাপুরের হাসান ডাক্তার। এই ভদ্রলোক ৩রা এপ্রিল রাতে তার ভাইকে দিয়ে গরুর গাড়ী এনে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার সহযোগিতার সূত্রপাত করেন। মুক্তিবাহিনীর খাবার জোগাড়, থাকার ব্যবস্থা, খবর সংগ্রহ করে আনা, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গোলাগুলি সরবরাহ ইত্যাদি কর্মকান্ডে হাসান ডাক্তার তার স্বেচ্ছা সেবক দল নিয়ে যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
ভন্ডেশ্বর ইউনিয়নের আবু হানিফ এমনি আর একটি বিরল চরিত্র। দেওপাড়া থেকে বল্লা, মরিচা থেকে দেড়পাড়া, পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চল আবার পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চল যেখানেই যেদিকেই মুক্তিবাহিনীরা যাবে বা যাচ্ছে, ভন্ডেশ্বর ইউনিয়নের স্বেচ্ছা সেবক আবু হানিফের সহযোগিতা তাদের চাই চাই-ই। সত্যিকার অর্থে, ঐ এলাকায় তার সহযোগিতা ছাড়া মুক্তিবাহিনী একেবারেই অচল অকেজো। হানিফ নেই মানে সব থাকলেও যেন মুক্তিবাহিনীর পা নেই। তাই আর চলা সম্ভব নয়। আবার যুদ্ধক্ষেত্রে সব আছে কিন্তু হানিফের যোগাযোগ নেই। বুঝতে হবে মুক্তিবাহিনীর গুলি নেই। আবু হানিফের সাথে যোগাযোগ হওয়া মানেই গোলাবারুদ, খাবার দাবার সহ সব অসুবিধার অবসান।
ঘাটাইল থানাধীন রসলপুর ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার আবুল কাসেমের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। আবুল কাসেম জুলাই মাস থেকে মুক্তিবাহিনীর ‘সিগন্যালম্যান’ এ পরিণত হয়। তার যোগ্যতাও ছিল অপরিসীম। সারা রসুলপুর তো বটেই পাশের সাগরদীঘি, কাজলা, কামালপুর, পেঁচার আটা, শনখনা এইসব ইউনিয়ন তার নখদর্পণে। আবুল কাসেম নুরুন্নবী ও ডঃ চৌধুরীর সাথে আমার মা ও ভাইবোনদের স্বেচ্ছায় ঢাকা পৌঁছে দেয়ার গুরু দায়িত্ব পালন করেছিল।
রসুলপুরের পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন সাগরদীঘি। সাগরদীঘি স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার পাগাড়িয়ার রুপা সিকদারের দুই ছেলে মখদম ও জামাল সিকদার। এদের কর্মতৎপরতা বর্ণনা করে শেষ করবার নয়। সাগরদীঘি থেকে বড়চওনা এই বিরাট এলাকার খবরাখবর তারা যে দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার সাথে ঘণ্টায় ঘটায় মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরে পৌঁছে দিয়েছে, তার কোন তুলনা নেই।
দক্ষিণাঞ্চলে বংশী নগরের স্বেচ্ছা সেবক কমান্ডার আবুলের নিয়ন্ত্রণাধীন স্বেচ্ছা- সেবকদের ব্যাপার স্যাপার ছিল আলাদা ধরনের। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার দিক থেকে তারা যেকোন সর্বাধুনিক বাহিনীকে হার মানাতে পারে।
কার কথা রেখে কার কথা বলবো? বংশীনগরের স্বেচ্ছা সেবক কমান্ডার আবুল, কালমেঘার কিতাব আলী, ফুলবাড়িয়ার আক্কেল আলী সিকদার, হাটু ভাঙ্গার আব্দুল বারেক, গজারিয়ার মোজাম্মেল, বড় চওনার শাহজাহান, এদের নেতৃত্বাধীন স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে চওনা, কচুয়া, বাটাজোড়, কাছিনা, কালমেঘা, হতেয়া, পাপুড়িয়া চালা, বংশীনগর, হাটুভাঙা, পাথরঘাটা প্রতিমা
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৪

বংকী, লাংগুলিয়া, দারিয়াপুর ইত্যাদি এলাকার সব খবর নখদর্পণে। আধুনিক যানবাহনে চলাচলকারী হানাদারদের চাইতেও দ্রুততার সাথে এরা সকল প্রকার ঝুঁকি ও বিপদ মাথায় নিয়ে একস্থান থেকে অন্য স্থানের খবর ও তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের জন্য খবর ও তথ্য সংগ্রহ করা তাদের কাছে যেন এক অতীব সম্মান ও গৌরবের বিষয়। ইতিমধ্যে স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের কর্তব্য কর্মে এতই দক্ষতা অর্জন করেছে, এতই পারদর্শী হয়ে উঠেছে যে, সকল এলাকার সব রকমের তথ্য তাদের কাছে চাইবা মাত্র পাওয়া সম্ভব। টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ইতিমধ্যেই এক বিশাল সফল খবর সংগ্রহ ও পরিবেশন সংস্থায় পরিণত হয়েছে। যার শাখা প্রশাখা সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে।
কমান্ডার আবুলের নেতৃত্বাধীন স্বেচ্ছাসেবকদের হাজারো উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা তুলে না ধরলেই নয়। স্মরণীয় যে, আমি আক্কেল আলী সিকদারকে সাক্ষাতদান ও মুক্তিবাহিনীতে কাজ করতে সুযোগ দিয়েছিলাম। এবং একশ সায়ত্রিশ জন রাজাকারের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেছিলাম। আলোচ্য ঘটনা সেই দিনের। আমরা পাথরঘাটা থেকে বাঁশতৈল হয়ে হতেয়ার দিকে এগুচ্ছিলাম। তখন দুপুর গড়িয়ে সূর্য পশ্চিম দিগন্তে কিছুটা হেলে পড়েছে। আমাদের সামনে একটি বাইদ। কয়েকদিন ধরে কেবল বৃষ্টি আর বৃষ্টি। বাইদে কোথাও হাঁটু কোথাও আবার কোমর পানি। অপরিচিত কেউ দূর থেকে দেখলে নীচু বাইদকে একটি বিরাট নদী ছাড়া আর কিছুই ভাবতেন না। আমরা হতেয়ায় যাচ্ছি। সারা রাস্তায় মুক্তিবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকদের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুরো রাস্তাটাই সুগম, নিরাপদ। আমাদের তিনটি দল একের পর এক চলে গেছে। তিনটি দলের পিছনে আমি। আমার দলের সদস্য সংখ্যা চল্লিশ। মূল দলের আগে দশজনের একটি অগ্রবর্তী দল। একটু পিছনে আরও পাঁচজন, এরপরে আমি। আমার একটু পিছনে দশ জন আরও পিছনে সর্বশেষ পনের জন। এমনিভাবে প্রায় আধমাইল লম্বা লাইনে আমরা এগুচ্ছিলাম। আমাদের দলের অগ্রবর্তী দশ জন বাইদের কোমর পানিতে কাপড় ভিজিয়ে পার হয়ে গেছে। তাদের পেছনের পাঁচ জনও বাইদ পেরিয়ে কিছুটা চলে গেছে। এমন সময় হটাৎ ঝোপের আড়াল থেকে প্রচন্ড জোরে চ্যালেঞ্জ ভেসে এল, ‘হ্যান্ডেস- আপ, পাস ওয়ার্ড। সাবধান নাড়াচড়া কইরেন না, নড়লেই গুলি করমু, আপনারা কেরা।’ কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে কে যেন ছুঁড়ে মারলো। এদিকে কোমর সমান পানিতে আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। একি আবার কোন বিপদ। হঠাৎ করে কে আবার চ্যালেঞ্জ করছে। এমনতো হবার কথা ছিলনা।
সত্য কথা বলতে কি ঐ এলাকার স্বেচ্ছাসেবকদের পাস ওয়ার্ড আমাদের জানা ছিল না। আমি তখনো কোমড় সমান পানিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। আমার দশ-বারো হাত সামনে তমছের ও গোয়াইল বাড়ির আবুল কাশেম চ্যালেঞ্জকারীদের বারবার বলল, ‘দেখুন আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক আমরা পাস ওয়ার্ড জানিনা। আমাদের যেতে দিন। ঝোপের আড়াল থেকে স্বেচ্ছা সেবকদের একই কথা, একই হুঁশিয়ারী উচ্চারণ, ‘নড়লেই গুলি করমু। আপনারা যে মুক্তিবাহিনী তার প্রমাণ
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৫

কি? তারা গর্বের সাথে আরও বললো, ‘এই রাস্তা দিয়া আমাগো সি-ইন-সি সাব যাবেন। আমরা আপনাগোর না জাইনা, না পরীক্ষা কইরা যাইতে দিতে পারমু না। একথা শুনে তমছের খুব মিনতি করে স্বেচ্ছাসেবকদের বললো, ‘আপনারা দয়া করে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসুন এবং ভালো করে আমাদের দেখুন। আমরা সি-ইন-সি সাহেবের অগ্রবর্তী দল।’ আকুতি মিনতি কোন কিছুই স্বেচ্ছা সেবকদের টলাতে পারলো না। ঝোপের আড়ালে সদা সতর্ক স্বেচ্ছা সেবকদের সাফ জবাব, ‘না, ঝোপের ভিতর থাইকা বাইরাইতে পারমু না। এসময় অগ্রবর্তী সেকশন কমান্ডার মকবুল হোসেন খোকা ও মোতালেব হোসেন গুর্খা পিছিয়ে এসে স্বেচ্ছা সেবক দের কাছে যেতে চাইলে তাতেও তাদের আপত্তি। কাছে যাবার চেষ্টা করলে তারা গুলি করার হুমকি দিল। আমরা তখনো কোমর সমান পানিতে। মকবুল হোসেন খোকা চ্যালেঞ্জ প্রদানকারী স্বেচ্ছাসেবকদের তাদের কমান্ডারকে ডেকে আনতে অনুরোধ করলে জনৈক স্বেচ্ছা সেবক কমান্ডারকে আনতে ছুটে গেল।
চ্যালেঞ্জ প্রদানকারী স্বেচ্ছা সেবকদের প্রকৃত সংখ্যা কত, আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। তারা দু’একজন নয়, কম করে সাত-আট জন। জনৈক স্বেচ্ছা সেবক তার কমান্ডারকে ডেকে আনতে গেলে আমরা চ্যালেঞ্জকারীদের পুনরায় অনুরোধ করলাম, “আমাদের পানি থেকে উপরে উঠতে দিন। হয় আমরা এই পাড়ে, না হয় পিছিয়ে গিয়ে যে পাড় থেকে এসেছি, সেই পাড়ে গিয়ে উঠি।” আমাদের এ প্রস্তাবেও স্বেচ্ছা সেবকদের ঘোরতর আপত্তি, ‘না, আপনারা নড়াচড়া করতে পারবেন না। নড়লেই গুলি করমু। সত্যিই যদি আপনারা মুক্তিযোদ্ধা হন, তাইলে জোর করলে আপনাগোর অসুবিধা আছে। গুলিতে দুচারজন তো মরবাইনই। হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করলে বাকী যারা থাকবেইন, তাগোরও কঠোর শাস্তি হইবো। তাই নড়াচড়া কইরেন না।’
অগত্য আর কি করা? কোমর পানিতে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। ওখানকার স্বেচ্ছা সেবক কমান্ডার আবুল হোসেনকে পাওয়া গেল না। তবে স্বেচ্ছা সেবকটি একজন সহকারী কমান্ডারকে নিয়ে এসেছে। তাতেও সমস্যার সমাধান হলো না। সহকারী কমান্ডার আমাকে অথবা দলের কাউকে ভাল করে চিনে না। তাছাড়া তাকেও স্বেচ্ছা সেবক কমান্ডার আবুল কড়া নির্দেশ দিয়ে গেছে : “রাস্তাটির পুরো খোঁজ খবর রাখতে হবে। দুপুরের মধ্যে সর্বাধিনায়ক ঐ রাস্তা অতিক্রম করবেন।” সে তার কমাণ্ডারের কঠোর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে।
জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিচক্ষণ ও সফল মকবুল হোসেন খোকা সহকারী কমান্ডারের সাথে বেশ কয়েক মিনিট কথা বলে তাকে বুঝাতে ও বিশ্বাস করাতে সমর্থ হয় যে, আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক এবং সর্বাধিনায়কের অগ্রবর্তী দল। তবে কেবল কথা বলে তাদের বিশ্বাস করানো যায়নি। আমারা সর্বাধিনায়ক দলের লোক, একথার স্বপক্ষে আমার হাতের লেখা পুরানো দু-একটি ছোট কাগজ দেখাতে হলো। যা হোক, সহকারী কমান্ডারের নির্দেশে স্বেচ্ছা সেবকরা আমাদের যেতে দিতে সম্মত হল। স্বেচ্ছা সেবকরা আমাদের দেখছিল কিন্তু আমরা স্বেচ্ছা সেবকদের দেখতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৬

পাচ্ছিলাম না। এত বড় ঘটনার নায়করা কোন ক্রমেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে তাদের মুখ দেখাতে রাজী নয়। তারা তাদের মুখ দেখায়ও নি।
আক্কেল আলী সিকদার, বারেক ও কিতাব আলী মাষ্টার নানা প্রসঙ্গে অসংখ্যবার আমাদের আলোচনায় স্থান পেয়েছে। তাদের মতই আরেকজন সবল ও সার্থক স্বেচ্ছা সেবক কমাণ্ডার বৈলানপুরের ইব্রাহিম মেম্বারের ছেলে দুলাল। দুলালও যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ অবধি সাগরদীঘি, ধলাপাড়া, শেওড়াবাড়ী, বাঘের বাড়ী, দেওপাড়া ও মরিচা সহ অন্যান্য গ্রামে উল্কার বেগে ছুটে বেরিয়েছে। ওর নেতৃত্বাধীন স্বেচ্ছা সেবকরা এর মতই সদা প্রস্তুত, সদা তৎপর। এলাকার সব খোজ খবর যেন ওদের হাতের মুঠোয়।
বহেরাতলীর স্বেচ্ছা সেবক কমাণ্ডার আব্দুল গফুর। (হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে ক’দিন হলো মারা গেছে) খুব সাদাসিদে, শান্ত প্রকৃতির লোক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় সে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে হয়ে উঠে কঠোর, কঠিন ও নির্মম সে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে থাকে। একক প্রচেষ্টায় বহেরাতলী ইউনিয়নে একটি সুশৃঙ্খল মরণজয়ী স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী গড়ে তুলে। বহেরাতলীর ইউনিয়নের তদানীন্তন প্রতাপশালী চেয়ারম্যান আবু জাফর, সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক অবস্থা ও প্রতিপত্তিতে করটিয়া দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবদুল গফুরের চাইতে অনেক গুণ বেশী হওয়া সত্ত্বেও, স্বেচ্ছা সেবক বাহিনীতে, তিনি আব্দুল গফুরের নেতৃত্ব সানন্দে মেনে নেন। এবং একজন সহকারী স্বেচ্ছা সেবক কমাণ্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ৪ঠা মে অবাঙ্গালী পাতার ব্যবসায়ীদের ক্যাম্প অভিযানের আগে আমি এই আব্দুল গফুরের বাড়ীতেই দুপুরের খাবার খেতে উঠেছিলাম। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেদিন আমরা তার বাড়ীতে খেতে পারনি। খাবারের সকল উপাদান বিশেষ যত্ন ও আন্তরিকতার সাথে যোগাড় করা সত্ত্বেও আব্দুল গফুর আমাদের খাওয়াতে পারেনি। এই দুঃখ সে কোন দিন ভুলতে পারেনি। পরর্তীতে যতবারই সে আমার সাথে দেখা করেছে, ততবারই সেদিনের খাওয়াতে না পারার দুঃখ ব্যক্ত করে নিজের ভারাক্রান্ত বুকটা হালকা করতে চেষ্টা করেছে।
সখীপুর স্বেচ্ছা সেবক বাহিনীর দুই মূল নেতা জনাব আলী আসগর ও আব্দুল আউয়াল সিদ্দিকী। আব্দুল আউয়াল সিদ্দিকী বাশাইল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আলী আসগর খুব সম্ভবতঃ বাশাইল থানা আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় সদস্য ও গজারীয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের খাদ্য বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত ওসমান গনির বড় ভাই। এই দুইজন সখীপুর এলাকায় যেভাবে স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী গড়ে তুলেছেন এবং প্রতি মুহুর্তে মুক্তিবাহিনীর বেসামরিক সদর দফতরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন, তা অনেকের স্মৃতির পাতায় আজও ভাস্বর।
আলী আসগর ও ওসমান গনির আর একভাই আলী পাগল। ইনি হলেন, মুক্তিবাহিনীর আপদ-বিপদের ত্রানকর্তা, “মুশিকিল আসান”। কোন কিছুর খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আলী পাগলকে জিজ্ঞাসা করুন। সে ঠিক ঠিক বলে দেবে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করার জন্য
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৭

কোন অনুষ্ঠান করা দরকার। আলী পাগলকে বলা মাত্র দেখা যাবে সে আরোও দু’চার জন নিয়ে একটি সুন্দর দেশাত্মকবোধক বাউল, কিংবা জারি গানের আসর বসিয়ে ফেলেছে। যুদ্ধ চলাকালে দেখা গেছে, অনেক সময় আর. ও. সাহেব ও শওকত মোমেন শাজাহান আলী পাগলের কাছ থেকে আমার গতিবিধির খবর সংগ্রহ করছে। আমি কোথায় কখন অবস্থান করছি, আলী পাগল তা মোটামুটি নির্ভুলভাবে বলে দিতে পারতো। আলী পাগল যাদু মন্ত্র জানে, এরকম বিশ্বাস আমার নেই। অবশ্য তার এলাকার অনেক লোকের ধারণা, আলী পাগল টোটকা যাদুমন্ত্র জানেন। তাকে দীর্ঘদিন দেখে আমার অন্য রকম মনে হয়েছে। আলী সারাদিন ঘুরে বেড়ায়, দূর দূরান্তের লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলে, উঠাবসা করে, স্বাভাবিক কারণেই সে অন্যদের চাইতে অনেক বেশী খোজখবর রাখতে পারে। এবং নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি অভিজ্ঞতা খাটিয়ে যে সব খবরাখবর দেয়, তা অনেকাংশে নির্ভুল হয়।
পশ্চিম এলাকা। পশ্চিম এলাকাধীন কেদারপুরের সামাদ, গোপালদাস ও নিক্সন। নিক্সনের আসল নাম খুব সম্ভবতঃ রঞ্জিৎ রাজবংশী। রঞ্জিৎ রাজবংশী বললে কেউ তাকে চিনতে পারবে না। নিক্সন বললে টাংগাইলে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও স্বেচ্ছাসেবকই নয়, লক্ষ লক্ষ জনতা তাকে অনায়াসে চিনতে পারেন। সামাদ, গোপালদাস ও নিক্সন-এদের অবদানের তুলনা হয় না। লাউহাটির স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার কামাল খানের কৃতিত্ব মোটেই সামান্য নয়। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে তার অবদান বিশেষভাবে চিহ্নিত; সবার চোখে সে মর্যাদা সম্পন্ন স্বেচ্ছা সেবক কমাণ্ডার, পশ্চিম-দক্ষিণে নিক্সন, সামাদ ও উত্তরে কামাল খান এরাই সমগ্র এলাকাটিতে মুক্তিবাহিনীর কাজ সহজ করে এনেছিল।
শশুরা চরের বাহাজ উদ্দিন অর্জুনার, ফলদা ইউনিয়নের আবুল ও নয়ান খলিফার কথা আগেই আলোচিত হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে পটলের মোকাদ্দেছ, ইকবাল আনসারী ও আব্দুস সাত্তারের ভূমিকা মোটেই অনুজ্জল নয়। এছাড়াও শাহজানীর আব্দুল বারী ও ছাবেদ আলী স্বেচ্ছা সেবক কমাণ্ডার হিসেবে অনন্য অবদান রেখেছে।
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাহাত্তর হাজার। কার কথা আলোচনা করবো? কার কথা আলোচনার বাইরে রাখবো? প্রত্যেক স্বেচ্ছা সেবকই নিজ নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে। প্রত্যেক স্বেচ্ছা সেবকই ন্যায়সঙ্গত ভাবেই আলোচনায় আসার দাবী করতে পারে। কিন্তু এত স্বল্প পরিসরে সকল স্বেচ্ছা সেবকদের ত্যাগ, কর্মকাণ্ড ও অবদানের কথা আলোচনা বা বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না।
আর মাত্র দু’জনের কথা আলোচনা করেই স্বেচ্ছাসেবক অধ্যায়ের ইতি টানতে চাই। এদের একজন হলো ভরত, কুদ্দুস নগরের ভরত। অন্যজন আরফান ভাই, মুক্তিবাহিনীর কাছে যিনি কোম্পানী নামে পরিচিত। আরফান ভাই মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার সুচনা কিভাবে করেছিলেন সে সম্পর্কে ইতিমধ্যেই কিছুটা আলোকপাত করেছি। সাক্ষাতের প্রথম দিনেই তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘দেখুন আমার বয়স হয়েছে। যুদ্ধ করতে পারব না। কিন্তু যোদ্ধা ভাইদের সেবা করতে পারব। আমাকে সুযোগ দিন।’ আমিও তার বয়স ও আন্তরিকতার দিকে লক্ষ্য রেখে মুক্তিবাহিনীর
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৮

সাথে মেলামেশা ও কাজকর্ম করার সুযোগ দিয়েছিলাম। এর পর থেকে তিনি নিজের সততা, নিরলস প্রয়াস ও প্রতিভার দ্বারা অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন। কুদ্দুছ নগরে এসেছে, অথচ আরফান ভাইয়ের হাতে খাবার খায়নি এমন কোন মুক্তিযোদ্ধা হয়তো পাওয়া যাবেনা। রাত দুটায় হয়তো কোন দিক থেকে কোন সিগন্যালম্যান এসেছে। সে হয়তো না খেয়ে আছে। আরফান ভাই এটা সহ্য করতে নারাজ। তার কথা, “সিগন্যালম্যান কোথা থেকে এসেছে, কে জানে।” আবার কখন তাকে কোথায় যেতে হবে—তারও ঠিক নেই। কুদ্দুস নগরে এসে না খেয়ে থাকবে? এতে এলাকার বদনাম হবে। ব্যক্তিগত বদনাম তিনি সইতে পারেন কিন্তু এলাকার বদনাম কস্মিনকালেও না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কুদ্দুস নগর তিন তিনবার হানাদার কবলিত হয়েছে। কোন মুক্তিযোদ্ধাকে পিছনে ফেলে আরফান ভাই আগে ভাগেই পালিয়ে গেছেন এরকম অপবাদ শত্রুরাও দিতে পারবে না। জুন মাসে আরফান ভাই মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। আগষ্ট মাসে হানাদার বাহিনী কদ্দুস নগর দখল করে নেয়। সে সময় কদ্দুস নগর বাজারে আরফান ভাইয়ের একটি ছোট্ট দোকান হানাদাররা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। এতে আরফান ভাইয়ের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি আগের মতই স্বাভাবিক ভাবে কাজ করে গেছেন। কোনদিন কোন মুক্তিবাহিনীকে কদ্দুস নগরে এসে না খেয়ে থাকতে হয়নি। যেখান থেকে হোক, যেভাবেই হোক, তিনি অবশ্যই খাবার সংগ্রহ করেছেন।
যুদ্ধের সময় আরফান ভাইয়ের কোন দুঃখ ছিল না। তিনি যেন সবকিছু উজাড় করে দিতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিবাহিনীর জন্য সবকিছু হারিয়েও তিনি স্বাধীন বাংলায় কিছুই পাননি। বলতে গেলে সামান্য মর্যাদাটুকুও না। মুক্তিযোদ্ধারা আরফান ভাইকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, তা তিনি ভাল করেই জানেন। স্বাধীনতার পরও আরফান ভাইয়ের প্রতি মুক্তিযোদ্ধা বা স্বেচ্ছাসেবকদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি বরং বহুগুণ বেড়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর তিনি সত্যিকার অর্থে সম্মান ও মর্যাদা পেয়েছেন-এ কথা বলা কঠিন। একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও আমি দুএকটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না।
১৯৭২ সালের ৮ই অক্টোবর। সালাম ও কদ্দুসের প্রথম মৃতুবার্ষিকী। ‘৭১-র এই দিনটিতেই কদ্দুস নগরের বীর সস্তান কদ্দুস ও সালাম তাদের নিজের থানা হানাদার কবল মুক্ত করতে যেয়ে শাহাদাৎ বরণ করে। প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ হিসাবে কদ্দুস নগরে গিয়েছি। স্বাধীনতার পর অবশ্য অসংখ্যবার কদ্দুস নগরে গেছি। কদ্দুস নগরে গেলে ভরত ও আরফান ভাইর সাথে দেখা করিনি বা আরফান ভাইর তৈরী খাবার খাইনি—এমন কখনও হয়নি।
৮ই অক্টোবর, কদ্দুস নগর যেন নতুন সাজে সেজেছে। সে সাজ খুশীর নয়, আনন্দের নয়। কদ্দুস নগরের সাজ দুঃখের ও বেদনার। কলেজ মাঠে অগণিত লোক সমবেত হয়েছেন, হাজার হাজার লোকের সমাবেশ অথচ কোথাও কোন কোলাহল নেই, জ্বালাময়ী বক্তৃতা নেই, উত্তেজক
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯৯

শ্লোগান নেই। সকলের চোখে মুখেই ব্যথা ও বেদনার ছাপ। সর্বত্র গভীর নিস্তব্ধতা। স্বজনহারা ব্যথা নিয়ে বক্তৃতা মঞ্চে উঠে দাড়ালাম। শত চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলাম না। ব্যথা বেদনায় আমার মাথা অবনত হয়ে আসছিল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না, মুখে কথা সরছিল না। শত্রুর গুলির মুখে বুক চিতিয়ে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে লোকদের মাতিয়ে তুলতে পেরেছি, বিন্দুমাত্র বুক কাপেনি। কিন্তু সালাম কদ্দুসের স্মরণ সভায় ব্যথায় আমার বুক থরথর করে কাঁপছিল। শিশুর মত কাঁদতে কাঁদতে টলে পড়ে ছিলাম। কিছুই বলা হলো না। আমার দুচোখে অশ্রুর প্লাবন দেখে জনতা আমার অপারগতার অপরাধ ক্ষমা করেছিলেন কিনা জানিনা। তবে আমি পারিনি।
সভাস্থল থেকে তিন-চার জন সহকর্মী আমাকে ধরাধরি করে নামিয়ে সোজা আরফান ভাইয়ের দোকানে নিয়ে গেল। একজন ডাক্তার তাড়াতাড়ি ইনজেকশন দিলেন। কিছু সময় পর আমি সুস্থ বোধ করলাম। স্বাধীনতার প্রায় এক বছর পরেও তার দোকানের কোন পরিবর্তন নেই, উন্নতি নেই, শ্রীবৃদ্ধি নেই। একবছর আগে হানাদাররা পুড়িয়ে দিলেও গন্ধ তখনও রয়ে গেছে। ক্ষতচিহ্নও রয়েছে যত্রতত্র। এর আগে অনেক বার কদ্দুস নগরে এসেছি। কিন্তু আরফান ভাই কখনো কোন অনুযোগ বা অভিযোগ করেননি। অল্প কিছুদিন আগে দু’বান টিন পাওয়া যায় কিনা, জানতে আমার কাছে টাংগাইলে গিয়েছিলেন। যে কোন ভাবেই হোক, আরফান ভাইকে টিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ আরফান ভাই একটি মারাত্মক প্রশ্ন করে বসলেন, ‘সি- ইন-সি সাব, দেশ স্বাধীন হইছে প্রায় এক বছর। এর মধ্যে দেশের মানুষের কোন উন্নতি হইলো না। আমরা চাইরটা খাবারের নিশ্চয়তা পাইলাম না। হানাদাররা জ্বালাইয়া পোড়াইয়া দিল, তার কোন ক্ষতিপুরণ হইল না। অথচ যারা যুদ্ধের সময় দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে, তারাই আজ বহাল তবিয়তে আছে। আপনি কি এই জন্য যুদ্ধ করছিলেন? আপনার কাছে থাইকা আমরা কিছু চাই না। দেশের কাছে চাই। আপনি আর কতদিন এমনি চুপ কইরা বইসা থাকবাইন? যারা যুদ্ধের সময় সব হারাইছে-সব দিছে তারা না খাইয়া মরুক—এটা আপনি নিশ্চয় দেখতে চাননা। এ প্রশ্নের কি জবাব দেবো। একটি নয়, দু’টি নয়, এমনি হাজারো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমাদের আরফান ভাই।
ভরত প্রসংগে আসা যাক। ভরতের জাত ব্যবসা জুতা সেলাই। সে কদ্দুস নগর ডাক বাংলোয় চৌকিদারের কাজও করে। অবসর সময় জুতা সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করে। সে কখন, কি ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত হয়েছে-তা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। ভরতের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরছি। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস। হানাদার বাহিনী লঞ্চে প্রচুর কাপড়- চোপড় নিয়ে যাচ্ছিল। লঞ্চটি সিরাজগঞ্জ চাড়াবাড়ীর মাঝে আসতেই মুক্তিবাহিনী তা দখল করে সমস্ত মালামাল কদ্দুস নগর নিয়ে আসে। উদ্ধারকৃত বস্ত্র কদ্দুস নগর ডাকবাংলোর সামনে বসে দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করছিলাম। ভরত আমার থেকে সামান্য দূরে কি যেন একটা কাজ করছিল। দু’তিনটি লম্বা লাইন। অসংখ্য মানুষ কাপড় নিতে এসেছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০০

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের হাতে একটা একটা করে কাপড় তুলে দেয়া হচ্ছে। কেউ বাদ পড়ছেন না। হঠাৎ এক সময় দেখা গেল, ভরত লাইনে দাঁড়ানো জনৈকা মহিলাকে ধমকাচ্ছে, তিরস্কার করছে। ব্যাপারটা আমার নজরে পড়তেই ভরতকে ডেকে এনে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলাম, “কি ভরত। তুমি নিজে গরীব হয়ে গরীব মানুষদের প্রতি এই ভাবে অভদ্র আচরণ করছ? ঐ অভদ্র আচরণে তোমার একার ক্ষতি হবে না। আমাদেরও ক্ষতি হবে। তুমি কেন ঐ মহিলাকে গালিগালাজ করছ? তোমাকে এই জন্য শাস্তি পেতে হবে। ঐ ভদ্রমহিলার কাছে মাফ চাইতে হবে।” হতবাক হয়ে ভরত বললো, “হায়, হায়,। ও ভদ্রমহিলা না স্যার, ও আমার বউ। ও লাইনে দাড়াইছে তাই গালাগালি করছি। মুক্তিবাহিনী নিজেরাই যদি সাহায্যের জিনিসপত্র নিয়া নেয়, তাহলে অন্য মানুষ কি নিবো? ওর কাপড়ের দরকার নাই স্যার। আমি তাই ওকে বকছিলাম।”
ভরতের স্বার্থত্যাগের প্রবণতা ও প্রয়াসে মুগ্ধ হলাম। নিজে ভরতের স্ত্রীকে লাইন থেকে বের করে বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলাম। পরে খোজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম সত্যিই ভরতের স্ত্রীর কাপড়ের খুবই প্রয়োজন। আমি নিজে গিয়ে সুন্দর একখানা শাড়ী এবং বাচ্চার জন্যে সুন্দর দু’খানা জামা ও প্যান্ট ভরতের স্ত্রীর হাতে তুলে দিলাম। দেশ স্বাধীন হবার পর ‘৭২ সালের ৬-৭ই জানুয়ারী ভরত ঐ একই রকমের অরেকটা কাণ্ড ঘটিয়েছিল। সেদিন ভরত তার স্ত্রীকে রিলিফের গম- চাল কিছুতেই স্পর্শ করতে দেয়নি। জানি না, এখন ভরত তার যুদ্ধকালীন মনোভাব বজায় রাখতে পেরেছে কি না? নাকি চার পাশের কালনাগিনীদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস ও লোভ লালসার মধ্যে পড়ে ওর সেদিনের নিঃস্বার্থ মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে?
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০১

মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন

ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের পর দুদিন হেডকোয়ার্টারে কাটিয়ে আবার ব্যাপক সফরে বেরিয়ে পড়লাম। বেরোনোর সময় বহেরাতলীর ৩ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্ণেল ফজলুর রহমানকে পরবর্তী নির্দেশের জন্য ১ নম্বর সেক্টরের গোপালপুরের অর্জুনা ও নিকড়াইলের কাছাকাছি কোথাও গিয়ে অপেক্ষা করতে বললাম। ১৯শে অক্টোবর দুশ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে কর্ণেল ফজলুর রহমান পশ্চিমাঞ্চলে চলে গেলেন। বহেরাতলীর মূল নেতৃত্বে থাকলো মেজর লোকমান হোসেন।
মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে বেরিয়ে হেডকোয়ার্টার থেকে সোজা বাটাজোড় গেলাম। বাটাজোড় থেকে কালমেঘা ও হতেয়া, হতেয়া থেকে পাথর ঘাটা। এসব এলাকায় যেখানেই গেলাম, সেখানেই হাজার হাজার মানুষ প্রাণ ঢালা সমর্থনা জানালেন। তারা তাদের বিশ্বস্ত প্রাণপ্রিয় ভাই হিসাবে আমাকে বারবার প্রাণভরে দেখতে চাইলেন। যতই দেখছেন দেখার আগ্রহ যেন তাদের ততই বাড়ছে। এই দেখার যেন শেষ নেই। জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিতেও এসেছে লক্ষণীয় পরিবর্তন। আমি যেন এখন তাদের সকল বিশ্বাসের ভিত্তি, সকল সম্মানের উৎস, সকল গৌরবের উপাদানে পরিণত হয়েছি।
ভারত থেকে ফিরে জনসাধারণের মানসিকতার বহিঃপ্রকাশে আমি এক নতুন শক্তি, নতুন সাহস ও নতুন প্রেরণা খুঁজে পেলাম। এর আগে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের মনোবল টিকিয়ে রাখার জন্য খেয়ে, না খেয়ে, সময়ে অসময়ে উল্কার মত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়িয়েছি। এবার সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার। আমার জনগণকে ভীতিমুক্ত অথবা উৎসাহিত করার কিছুই নেই। জনগণের দৃঢ় মনোবল, মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি, সাহস, যুদ্ধ নৈপুণ্য ও স্বেচ্ছা সেবকদের অভুতপূর্ব শৃঙ্খলা আমাকেই অপরিসীম সাহস জোগালো। সকল বাধা-বিঘ্ন পার হয়ে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে যেতে সীমাহীন প্রেরণা দিল। সত্যিকার অর্থে বলতে কি আমি জনগণের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম। পাহাড়ের বাসিন্দাদের আমার কাছে নতুন বলে মনে হলো। তিন- চার মাস আগেও এমন অটুট বিশ্বাস, শক্তি, সাহস ও মনোবলের মানুষ পাহাড়ী এলাকায় দেখতে পাইনি। পাহাড়ী এলাকার জনগণ যেন আর সাধারণ মানুষ নন। তারা ইতিমধ্যেই কর্মযোগীতে পরিণত হয়েছেন। এদের এক এক জন যেন খালিদ-বিন-ওয়ালিদ, কামাল আতার্তুক, মহাবীর কর্ণ, ইশা খাঁ, মীর মদন, মোহনলাল, তীতুমীর, দুদু মিয়া ও সুর্য্য সেন হয়ে উঠেছেন।

সামান ফকির
আমার এই সফরের সময় হতেয়াতে বিরল চরিত্রের একজন লোক মুক্তিবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট হলো। টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধে যার অবদান ভুলবার নয়। সেদিন ছিল হতেয়া হাট, আমি হতেয়া হাইস্কুলের উত্তরে একটি বাড়ির গাছের নীচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা আরিফ
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০২

আহমেদ দুলাল, মকবুল হোসেন খোকা ও ফজলুল হক সামান্য কেনাকাটা করতে হতেয়া হাটে গেছে। হাট থেকে তারা তিন চারটি বড় বড় পেঁপে, মস্ত বড় এক ছড়ি সবরী কলাই শুধু কিনে আনেনি, একটি লোককেও সাথে নিয়ে এসেছে। দুলাল, খোকা, ফজলু যখন হতেয়া হাটে পেঁপে, কলা ইত্যাদি কেনাকাটা করছিল, তখন তারা একটি বিচিত্র ও বিরল ধরনের লোক দেখতে পায়। লোকটি নাভির নীচ থেকে হাঁটু অবধি গেরুয়া বসন পরিহিত। উদাম শরীর, নগ্ন পা, গোলগাল চেহারা। হাতে খমক, তাতে টুং টাং শব্দ। এই অদ্ভুত অথচ আকর্ষণীয় লোকটিকে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা কৌতূহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, “এই যে আপনি কি করছেন?” অস্ত্র হাতে দু’ তিন জনকে দেখে লোকটি লাফিয়ে উঠল, ভীতি মিশ্রিত কন্ঠে বললো, “এ্যা। হঠাৎ বাবুরা আমারে ধরছেন?” ব্যস এই কথাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের কৌতূহল আরোও বেড়ে গেল। তারা তাকে বলে কয়ে আমার কাছে নিয়ে এলো। আমারও লোকটিকে দেখে বেশ কৌতূহল জাগলো। লোকটির কথা বলার ঢং বিচিত্র। কন্ঠস্বর স্বতন্ত্র। আমার সামনে এসে কোন ভূমিকা না করে বললেন, “এই যে রাইফেলওয়ালা হঠাৎ বাবুরা আমারে এরেষ্ট কইরা লইয়া আইছে। আমি কিছু করি নাই। আমি কয়টা চারাগাছ কিনছিলাম।”
— আপনার বাড়ি কোথায়? আপনার নাম কি?
— ‘আমার নাম সামান পাগল। মুংগালিরা (মেয়ে লোকেরা) আমারে সামান পাগল কইয়া ডাহে। আমার সাথে কথা বলার সময়ও তিনি তার খমকে মাঝে মাঝে টুং টাং করে টোকা দিচ্ছিলেন। দেখলাম স্থানীয় লোকেরা তাঁকে সমীহ করেন, ভালবাসেন। বাড়ির মালিক তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে আমাকে বললেন,
— ইনি এই এলাকার খবু ভাল মানুষ। আমরা অনেকেই ইনার কাছে যাই।
সামান ফকির। তার বয়স কত? শিক্ষা কি? অদৌ লেখাপড়া জানেন কিনা, তা আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারবো না। স্বাস্থ্য সুঠাম ও নিটোল। গৌর বর্ণের এই মানুষটিকে দেখলে পঞ্চাশ-ষাট বছর বয়স্ক বলে মনে হবে। এলাকার অধিবাসীরা জানালেন, সামান ফকির কালমেঘা- কালিদাসের মাঝামাঝি গভীর জঙ্গলে একটি ছোট্ট গর্তে এক নাগাড়ে একযুগ অর্থাৎ বারো বছর তপস্যা করেছেন, ধ্যান মগ্ন ছিলেন। সুদীর্ঘ বারো বছরের এক দিনেও তাঁকে অন্য কোথাও দেখা যায়নি। লৌকিক হোক, অলৌকিক হোক লোকটির যে বিশেষ ক্ষমতা আছে তা যে কেউ একবার তাঁর দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই একই বসন, লোকটির ভিতর বাহির এক, নিষ্পাপ শিশুর মতই পবিত্র, প্রথম দর্শনেই তা বুঝতে পারলাম।
সামান পাগল কবি নন, সহিত্যিক নন। স্কুল কলেজের লেখাপড়ার মানদণ্ডে তিনি হয়তো শিক্ষিতও নন। তবে তিনি স্বভাব কবি, প্রকৃতির কবি। বিশ্ব প্রকৃতির ডাকে তিনি মুখে মুখে গান বাধেন, কবিতা রচনা করেন। তিনি প্রাণের আবেগে মনের আনন্দে বাংলার মাঠে মাঠে গ্রামে গ্রামে গেয়ে বেড়ান। বাংলার বুকে হানাদারদের অন্যায় অত্যাচারও এই আপন ভোলা, একলা চলা সামান পাগলের দৃষ্টি এড়ায়নি। একদিন হানাদারদের প্রতি বিরূপ ও বিক্ষুদ্ধ হয়ে রচিত একটি গান সামান
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৩

ফকির আমাকে গেয়ে শোনান। গানটির মধ্যে একদিকে যেমন জল্লাদ হানাদার বাহিনীর প্রকৃতি, চরিত্র, নৃশংসতা ফুটে উঠেছে, অন্যদিকে তেমনি বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের সাহস, সামর্থ্য, শৌর্য-বীর্য ও বীরত্ব গাঁথা ছবির মত ভেসে উঠেছে। গানটি :
“আহা। এবার এমন হারগিলারে কেরা দিল মাদবরী
আহা। সেই দুঃখে যে আমি মরি।। ঐ
এবার দেখি, কত খাটাশবাবু দারগা
শিয়াল পণ্ডিত দফাদার-
কত বিলাই পাইছে চকিদারী।। ঐ
আবার কত ঘড়ের কোণায় শুনি কানাকানি-
দল পাকাইয়া করে হানাহানি,
কত যে গুজব লইয়া করে টানাটানি।
ভুট্টো কানা বগে, মারে কুকানি……
আহা। কেমন, আয়ূব রাম শালীকের কেচর মেচর
টাকা পেচায় বসায় কাঁচারি।। ঐ
এবার এই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে
এত হিংসার আগুন কেন ধরে?
বাংলা লুইটা খাইল যত পশ্চিমা উচুঙ্গার দল বিহারী॥ ঐ
তারা এই বাঙালীর ধইরা খাইলো কত গরু-খাসী, করলো সর্বনাশী
আরও শুনে মানে কত ঝোপ জঙ্গলে রইলাম উপবাসী,
আজ বাঙালীর কি যে দিল মাথায় বারী ॥ ঐ
বাংলাদেশের টাকা নিয়া, উড়ছে ব্যাটারা আজ আকাশ দিয়া
আর আমরা কত ভাঙ্গা সড়কে পইড়া মরি।। ঐ
বাঙালীর ঘরে ধান চাল যত ছিল, সব ব্যাটারা লুইটা খাইল
আরো যে কত খাইল নাবরা চাবরা খীচুরী॥ ঐ
কলেজ ঘরে যাইয়া দেখি, স্কুল কলেজে নাই বেশী লেখাপড়ি
শুধু বেনিফিটের টাকা নিয়া করছে সব কাড়াকাড়ি।৷ ঐ
চিয়ার বেঞ্চি আজ কোথায় গেল
কোথায় গেল তার আলমারী॥ ঐ
এইবার কাদের সিদ্দিকী নামটি শুনি
কাদের বাংলার সোনার খনী
তার মুখে তরা সব শুনরে ধ্বনী
তার দ্বারা হবে মোদের সব ঘরবাড়ী।। ঐ”
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৪

হাড়গিলা বলতে বাংলাদেশের তাদেরকেই বুঝায়, যারা কিছুই বুঝেনা না, অথচ সবকিছু জানার বা বুঝার ভান করে থাকে। অযোগ্য অপদার্থ জঘণ্য ধরনের লোককে গ্রাম্য ভাষায় ‘হাড়গিলা’ বলে সম্বোধন করা হয়।
সামান ফকিরের আর একটি বিশেষ ঘটনা তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। দেড় মাস হলো আমার সঙ্গে তাঁর দেখা, এর পূর্বেই তিনি মুক্তিবাহিনীর অগণিত সহযোদ্ধা ও কমাণ্ডারের কাছে বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। আমার সাথে দেখা হবার পর তিনি যেন নিজেও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেলেন।
২৭শে নভেম্বর হানাদারদের চাপের মুখে মুক্তিবাহিনীর পাথর ঘাটা ঘাঁটির পতন ঘটে। এ দুঃসংবাদ শুনে সামান ফকির সেখানে ছুটে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থা দেখে তাদের উৎসাহিত ও উদ্বেলিত করার মানসে, সেখানে বসেই একটি গান বানিয়ে ফেললেন এবং সেই গান তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বারবার ঘুরে ফিরে গাইলেন। এ যেন গান নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা প্রদান-মরণকে জয় করে অমর, অক্ষয় হওয়ার আবেদন। তার সেদিনের গানের একটি কলিঃ
“আরে তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
মারো লাথি, ভাংগো ছাতি, আছে যত রাজাকার
উদ্ধার কর শেখ মুজিবর।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।”

সামান ফকির মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি শিবিরে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ভাবে উৎসাহিত করেছেন, সাহস, শক্তি জুগিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনি শুধু সামান ফকির নন, সামান পীর। সবাই তাকে সামান পীর বলে ডাকতেন।
আমিও বাদ যাইনি। সবাই যখন আমাকে ‘বঙ্গবীর’ বলে ডাকতেন, তখন একমাত্র সামান ফকিরই আমাকে বঙ্গপীর বলে সম্বোধন করতেন এবং এখনও করেন।
ঘুরতে ঘুরতে আবার ৩ নম্বর সেক্টরের রতনগঞ্জে এলাম। রতনগঞ্জ থেকে মরিচা। সেখান থেকে পরদিন বাসেত সিদ্দিকীর শেওড়াবাড়ীতে। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘুরে ফিরে এই শেওড়াবাড়িতে অনেকবার এসেছি। শেওড়াবাড়ি যেন একটি ট্রানজিট ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে।

দুর্ঘটনা
২৩শে অক্টোবর। দুপুর বারোটা। রাতে বা পরের দিন পশ্চিমাঞ্চলে চলে যাবো। হঠাৎ একটি মস্ত বড় অঘটন ঘটল। বাসেত সিদ্দিকীর বেঠকখানায় বসে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের হাতিয়ার পরিষ্কার করছিল। পাশের ঘরে বসে আমি ম্যাপ দেখছিলাম। এমন সময় হঠাৎ গুলির শব্দ। দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। পাহারারত মুক্তিযোদ্ধাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ কেউ কোন সদুত্তর দিতে পারলোনা। অন্য এক সহকর্মী পাশের ঘরে কি ঘটেছে তা জানতে ছুটে গেল। ফিরে এসে এক মর্মান্তিক খবর জানালো।

হাতিয়ার পরিস্কার করার সময় অসাবধানতায় গোয়াইল বাড়ির রফিকের হাতের অস্ত্র থেকে মিস্‌ফায়ার হয়েছে। রফিকের মিস্‌ফায়ার দুজনের গায়ে লেগেছে।
খবর শুনে বিদ্যুৎগতিতে পাশের ঘরে ছুটে গেলাম। গুলিবিদ্ধ দুজনের একজন নলুয়ার মোশারফ হোসেন, অন্যজন আনোয়ার-উল-আলম শহীদের চাচাতো ভাই ইছাপুরের করিম। দুজনের আঘাতই গুরুতর, একই গুলিতে দুজন আহত। গুলিটি প্রথম মোশারফের গলার নীচে লেগে কাঁধের নীচে দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে গলার নীচে দু’তিন ইঞ্চি পরিমাণ একটি গর্ত ও পিঠের দিকে প্রায় ছ’সাত ইঞ্চি বড় ক্ষতের সৃষ্টি হয়। মোশারফকে গুরুতর রূপে আহত করে একই গুলি করিমের পেটের ডান পাশ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ মোশারফের ক্ষতস্থান এত বড় ও গভীর যে ক্ষতস্থানের ছিদ্র দিয়ে এদিক থেকে ওদিক দেখা যাচ্ছিল। ক্ষতস্থানের রক্ত ও মাংস খল খল্ করছিল। শুশ্রুষাকারী দল এবং আমি নিজে খুবই দ্রুততার সাথে দুজনের ক্ষতস্থান বেঁধে ফেললাম। দুজনের কথাবার্তা তখনও স্বাভাবিক।
আহত মোশারফ বারবার পানি খেতে চাচ্ছিল। তাকে একটু একটু পানি দেয়া হচ্ছিল। মোশারফের ক্ষতের তুলনায় করিমের ক্ষতটা অতটা গুরুতর নয়। তবুও নিঃসন্দেহে খুবই মারাত্মক। আমি মোশারফের গায়ে হাত দিলে করিম চিল্লিয়ে উঠেছে “স্যার, আমি মরে গেলাম। আমারে ধরেন, আমারে বাঁচান।” আবার করিমের দিকে ছুটে যাই। করিম করুণ সুরে মিনতি করে “আমি আর বাঁচুম না। স্যার, আমারে ধরেন। আমি ডুইবা গেলাম।”
পরিদর্শনে বেরিয়েছি। আমাদের কাছে কোন অতিরিক্ত জিনিষপত্র ছিলনা, ঔষধও নয়। আহত দুজনকে কি ভাবে হেডকোয়ার্টারের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে স্থানীয় স্বেচ্ছা সেবকদের নির্দেশ দিলাম। আশপাশের সমস্ত এলাকা মুক্ত থাকায়, নৌকা পথে হেডকোয়ার্টারের কাছাকাছি যাওয়া খুব একটা অসুবিধা ছিল না। নৌকার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেয়ার সময় অন্য দুজন স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে হেডকোয়ার্টারে সিগন্যাল পাঠালাম, “গুলিতে আহতের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ পত্র নিয়ে একটি চিকিৎসক দল ইন্দ্রজানী শেওড়াবাড়ীর দিকে চলে আসতে থাকুক। ডাক্তারেরা যেন হাতে অথবা মাথায় সাদা-লাল কাপড় একত্রে জড়িয়ে রাখে। তারা যখন পানি পথে পাড়ি দেবে, তখন নৌকার উপর যেন লাল ও সাদা কাপড়ের নিশান উড়িয়ে রাখে। যাতে আহতদের বহনকারী দলটি তাদের সহজে চিনতে পারে।”
বিকেল চারটা। মোশারফ ও করিমকে দুটি আলাদা আলাদা নৌকায় হেডকোয়ার্টারের দিকে পাঠিয়ে দেয়া হল। সাথে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে নজরবন্দী হিসাবে রফিককে পাঠানো হলো।
বিদায় জানিয়ে নৌকা দুটির দিকে এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। আমার আশঙ্কা, আহত সহযোদ্ধা দুজন হয়তো বাচবে না। তবে গুলিবিদ্ধ হবার দুঘন্টা পরও তাদের দু’জনের মনোবল যে ভাবে অটুট রয়েছে, সাহস ও মনোবলের জোরে হয়ত বা তারা বেঁচেও উঠতে পারে এমন একটা ক্ষীণ আশা আমার মনে বারবার উঁকি দিচ্ছিল।
মোশারফের ক্ষত খুবই গভীর ও গুরুতর। মোশারফের কথা ভেবে আমার মন খুঁৎ খুৎ
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৬

করছিল। মোশারফ হোসেন ১৯৬৯ সালে জামুর্কী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে করটিয়া সাদৎ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়। কলেজ জীবন থেকেই মোশারফ আমার একজন সচেতন সহকর্মী হিসাবে পরিচিত ছিল। সে অনেক বলে কয়ে অনেক ধরাধরি করে অনুমতি নিয়ে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছিল এবং বেশ কয়েকটি যুদ্ধে বেশ দক্ষতা ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে।
নৌকা দু’টি অনেক দূর চলে যাবার পর বাসেত সিদ্দিকীর বৈঠকখনায় এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পরেই একজন সহযোদ্ধা এসে জানাল, নৌকা দু’টি বহুদূরে গিয়ে থেমে গেছে। নৌকা দু’টির কাছ থেকে একটি ছোট্ট ডিঙ্গি দ্রুত শেওড়া বাড়ীর দিকে আসছে। আমি আবার বেরিয়ে এলাম। সামনের সমস্ত জায়গাটাই খোলা ‘বিলাঞ্চল’। চাপড়া বিলের এ মাথা থেকে ও মাথা পানি থই থই করছে। সত্যিই নৌকা দু’টি থেমে আছে। একটি ডিঙ্গি আমাদের দিকে আসছে। আমার মনে প্রশ্ন জাগলোঃ কেন ওরা আসছে? তবে কি আহতদের মধ্যে কেউ চির বিদায় নিয়েছে? নাকি দুজনের একজনও বেঁচে নেই? না অন্য কিছু?
ডিঙি এসে শেওড়া বাড়ীর ঘাটে ভিড়লো। নৌকা থেকে স্বেচ্ছা সেবকদের নামার আগেই পানির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে?” ব্যাথাতুর স্বেচ্ছা সেবকদের কান্না বিজরিত জবাব, “নলুয়ার মোশারফ ভাই নেই।” মারা যাবার আশঙ্কা আমিও করেছিলাম। তবুও স্বেচ্ছা সেবকদের জবাবে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। সহযোদ্ধার মর্মান্তিক মৃত্যু আমাকে নির্বাক করে দিল। কিছু সময় নীরব থাকার পর সবুরকে ডেকে বললাম, “সবুর, আমার সাথে আয়। শেষবারের মতো মোশারফকে দেখে আসি।” চারজন মুক্তিযোদ্ধা সহ চাপড়া বিলের মাঝে মোশারফকে শেষবারের মত দেখলাম। শত চেষ্টা করেও নিজেকে সামাল দিতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর স্বেচ্ছা সেবকদের বললাম, “ভাইয়েরা, তোমরা ওকে আর হেডকোয়ার্টারে না নিয়ে সোজাসুজি কাউলজানি অথবা শূন্যায় নিয়ে যাও। সেখানকার স্বেচ্ছা সেবকদের কাছে কফিন পৌঁছে দিয়ে তোমাদের একজন সেখানে থেকে, অন্য সবাই চলে এসো। সে একাই এই ভাইটির কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তোমাদের পক্ষ থেকে তার আত্মার শান্তি কামনা করবে।
অন্য নৌকায় তখনও আহত করিম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল “স্যার, করিমকে দেখে যাবেন না।” স্বেচ্ছাসেবকদের বললাম, “না, আমার সাথে আবার দেখা হলে হয়ত মনে করবে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। তোমরা ওকে নিয়ে হেডকোয়ার্টারে চলে যাও।” রফিককে যারা পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের হাতে একটি চিঠি দিলাম, “মুক্তিযোদ্ধা মোশারফকে কবর দেয়ার সময় হেডকোয়ার্টারের থেকে যেন ছয় জনের একটি প্রতিনিধি দল থাকে। এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় সকল কমাণ্ডাররা পূর্ণ মর্যাদায় লাশ দাফন করে।

ভর্তি নৌকা দখল
২৩শে অক্টোবর রাতের শেষ প্রহরে পশ্চিমাঞ্চলের গোপালপুর থানার গাবসারা চরে এলাম। পরদিন সকালে মেজর হাকিম এলাকার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট পেশ করল। ২৪, ২৫, ২৬শে অক্টোবর জগন্নাথগঞ্জ ঘাট, নলিন, অর্জুনা, জগৎপুরার চর, কদ্দুসনগর ও গোপালপুরের বিস্তীর্ণ মুক্ত এলাকা ঘুরে দেখলাম। এই সময় আবদুল আলীমের নেতৃত্বাধীন জলপথ কর আদায়কারী দল, ক্যাপ্টেন রেজাউল করিম তরফদার ও মেজর মঈনুদ্দীনের কোম্পানীর সহায়তায় হানাদারদের পঞ্চাশ হাজার মণ চাল ও গম বোঝাই সতের-আঠারটি বিরাট বিরাট নৌকা আটক করে। নৌকাগুলো ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে হানাদারদের চাল গম নিয়ে উত্তরে যাচ্ছিল। চাল-গম বোঝাই আটক নৌকার সংবাদ ২৫শে অক্টোবর সন্ধ্যায় আমাকে জানালো। আটক নৌকার মাল্লাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে বলে নাগরপুর থেকে উত্তরে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত নদীর পারের জনগণের মধ্যে ত্রিশ হাজার মন চাল ও গম বন্টনে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিলাম। বাকি কুড়ি হাজার মন রাস্তার পূবপাশে পাঠাতে হবে। এত খাদ্য- শষ্য পাঠাতে অসুবিধা হলে পূর্বাঞ্চলে অন্তত দশ হাজার মন চাল গম পাঠাতেই হবে। আটক চাল ও গমের উপর সমস্ত দরিদ্র জনসাধারণের অধিকার রয়েছে। সময় যতই লাগুক, যতই পরিশ্রম হোক, দশ হাজার মন চাল ও গম পূর্বাঞ্চলে জনগণের মধ্যে বিলি করতেই হবে। ২৬ শে অক্টোবর অর্জুনা চরে জনগণের মধ্যে আমি নিজে সারদিন খাদ্যশষ্য বিতরণ করলাম। প্রথম সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সবার নাম লিখে প্রত্যেকের বাড়িতে পরিমাণমত চাল ও গম পৌছে দেয়া হবে। কিন্তু পরে সিদ্ধাস্ত হলো, যার যার মত এসে চাল ও গম নিয়ে যাবেন। এ বন্টন ব্যবস্থাতেও দুটি অসুবিধা দেখা দিল। এক, শারীরিক দিক থেকে যারা দুর্বল এবং যাদের বাড়ি একটু দূরে, সাহায্য নিতে এসে তারা কিছুটা অসুবিধায় পড়ছেন। দুই যাদের বাড়ি খাদ্য শষ্য বিতরন কেন্দ্রের খুব কাছে তাদের কেউ কেউ দু’তিনবার কেউ কেউ চার-পাঁচবার গম ও চাল নিচ্ছেন। ভাগ বাটোয়ারার প্রথমদিকে এই ফাকি ধরা না পড়লেও দুপুরের দিকে তা ধরা পড়ে যায়।
খাদ্য বিতরণের পদ্ধতি ছিল এই রকম : কুড়ি সের মত খাদ্য নেয়া যায় এ রকম একটি পাত্র নিয়ে যে কোন লোক পরিমাণ মত চাল ও গম (চাল ৮ সের ও গম ১২ সের) নিজেই তুলে নিতে পারবেন। এই পদ্ধতি মত বন্টন চলতে থাকলো। পাত্র হাতে পরিমাণ মত চাল ও গম ( চাল ৮ সের ও গম ১২ সের) মিলিয়ে দিচ্ছিল। এই পরিমাণটা ছিল এক জনের জন্য। যিনি পাত্র হাতে আসবেন, তিনিই ঐ পরিমাণ খাদ্য নিয়ে যেতে পারবেন। ধনী, নির্ধন, সবল দুর্বল, কোন বাছ বিচার নেই। সবার জন্যই একই ব্যবস্থা, তবে দুর্বল ও অক্ষমরা যাতে কোন ক্রমেই বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করতে মুক্তিবাহিনী ও স্বেচ্ছা সেবকরা তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করছিল। এমনকি তারা কাউকে কাউকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসছিল।
দুপুরের পর যখন একই ব্যক্তির বারবার চাল-গম নেওয়ার ঘটনা ধরা পড়লো, তখন দশ-বারো বার খাদ্য নেয়া তিন-চার জনকে আটক করে আমার সামনে হাজির করলো। অর্জুনা ইউনিয়নের স্বেচ্ছা সেবক কমাণ্ডার মন্টুর ক্রোধ ও অভিযোগ সবচেয়ে বেশী। তার অভিযোগ, এই পাবলিকরা সুযোগ পেয়ে একেবারে ঘাড়ে চড়ে বসেছে। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বারবার গম নিচ্ছে, এদের শায়েস্তা করা উচিত। মন্টুকে বললাম, “দেখো ভাই,এরা গরীব মানুষ। আমাদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৮

ভ্রান্ত বটন পদ্ধতির জন্য এরা একবারের জায়গায় দু’তিন অথবা সাত-আট বার চাল-গম নিয়েছে। আট-দশ বার নেয়ার জন্য আসতে যেতে তো এদের পরিশ্রম করতে হয়েছে। এবারের মত ছেড়ে দাও। আর যাতে আমরা ভুল না করি সে দিকে যত্নবান হওয়া উচিত।”
১৯৭১-এর ২৬শে অক্টোবর, বিকেল। পাঁচ-ছ’ দিন হলো রোজা শুরু হয়েছে। ‘৭১ সালে এত কষ্ট, ক্লান্তি ও পরিশ্রমের মধ্যেও বেশির ভাগ মুসলিম মুক্তিযোদ্ধারা একটি রোজাও ভাঙেনি। ইফতারের সময় সমাগত। তাই চাল-গম বিতরণ পরদিনের জন্য স্থগিত রাখা হল।
২৬শে অক্টোবর দুপুরে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল, যা না বললেই নয়। টাঙ্গাইল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জুন মাসের শুরু থেকে ১৬ই ডিসেম্বর হানাদারদের আত্মসমর্পণ পর্যস্ত এই দীর্ঘ সময় দুএকটি ব্যাতিক্রম ছাড়া এলাকার কোথাও কোন লুটতরাজ, খুন-খারাবি ও গুপ্তহত্যা হতে পারেনি। মুক্তাঞ্চলের জনগনের প্রতি আমার আহ্বানই ছিল, “আপনারা আমাদের খেতে দিচ্ছেন, পরতে দিচ্ছেন, আমরা যদি আপনাদের নিরাপত্তা দিতে না পারি, রাতে শান্তিতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিতে না পারি, তাহলে আমাদের জন্য এত কিছু করার কোন মানে হয় না। কোথাও কোন চুরি ডাকাতি হলে আমাকে ধরুন। হানাদার ও তাদের সমর্থিত রাজকার ছাড়া অন্য কেউ লুটতরাজ করলে আমাকে ধরুন, কোথাও কোন খুন হ’লে আমাকে কৈফিয়ৎ তলব করুন। আমি যদি উপযুক্ত জবাব দিতে না পারি, তাহলে মুক্তিবাহিনীর প্রতি আপনাদের আস্থা রাখার ও সাহায্য করার কোন কারণ থাকতে পারে না।”

গুপ্ত হত্যার রহস্য উদঘাটন
এত আশ্বাস ও সাবাধান বাণী সত্ত্বেও অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘাটাইলের বেয়াড়া নেয়ামতপুরের কাছে একটি গুপ্তহত্যা সংগঠিত হয়। হত্যার কারণ এবং কারা হত্যা করেছে সে সম্পর্কে জনগণের পক্ষ থেকে প্রশ্ন এলে আমরা সদুত্তর দিতে পারিনি। ১৩ই অক্টোবর সর্ব প্রথম নেয়ামতপুরের এই গুপ্তহত্যার খবর পাই। তারপর দীর্ঘ সময়ে ঝটিকা সফরে ব্যস্ত থাকায় এই অনভিপ্রেত হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করতে পারিনি। হেডকোয়ার্টারে পৌঁছেই, গৌরাঙ্গী ইউনিয়নের দুর্দান্ত সফল শান্তি (গোয়েন্দা) আব্দুল লতিফ ও সুবেদার দেলোয়ারকে এক নির্দেশ পাঠানো হয়, “বেয়ারা নেয়ামতপুরের কাছে একটি গুপ্তহত্যা সংগঠিত হয়েছে। এ সম্পর্কে তোমরা সরজমিনে তদস্তু করে এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দেবে।” ২৩শে অক্টোবর গাবসারা থেকে আরও দুই জন খ্যাতনামা ও চৌকষ সংবাদ সংগ্রাহককে ঐ এলাকায় নামানো হয়েছিল। ২৫শে অক্টোবর দেলোয়ার ও লতিফ তাদের রিপোর্ট পেশ করে। তাদের রিপোর্টে হত্যাকাণ্ডের যথাযথ কূল কিনারা পাওয়া না গেলেও হত্যা সম্বন্ধে সামান্য কিছু সূত্র পাওয়া যায়।
হত্যাকাণ্ডটি যখন সংগঠিত হয়, মেজর হাকিম ঐ এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কমাণ্ডার ছিল। হত্যা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে কোন সদুত্তর দিতে পারে নি। মেজর আংগুর, ক্যাপ্টেন আরজু ও ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম এরাও ঐ হত্যারহস্য সম্পর্কে কিছু জানে না বলে রিপোর্ট করে। এমনকি কদ্দুস নগরস্থ স্থায়ী ঘাঁটির আলীম, ভোলা, মোয়াজ্জেম হোসেন, দুদু মিয়া, স্বেচ্ছা সেবক
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০৯

কমান্ডার আব্দুল বারী, তাদের কারোও কাছ থেকে কোন সদুত্তর পাওয়া গেল না। ক্যাপ্টেন চান্দ মিয়া, ক্যাপ্টেন বেনু ঐ এলাকারই লোক। হত্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তারাও কোন সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলো। খোঁজখবর ও অনুসন্ধানের পরও হত্যারহস্য উদ্ঘাটিত হল না। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, ঐ হত্যা কারা করেছে। মুক্তিবাহিনী যদি ঐ হত্যা না করে থাকে, তাহলে কারা হত্যা করেছে। মুক্তিবাহিনী বা হানাদাররা মারলে লুকাবার কোন কারণ নেই, উপায়ও নেই। তবে কি কোন স্থানীয় লোক তার শত্রুতা চরিতার্থ করেছে? স্বার্থ উদ্ধার করেছে? পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়েছে? শত্রুতা সাধনের জন্য কেউ মেরে থাকলে এবং তা আবিষ্কৃত না হলে মুক্তিবাহিনীর জন্য মারাত্মক হতে পারে। হত্যা রহস্য উদঘাটনের জন্য আমি উঠে পড়ে লেগেছিলাম।
হানাদাররা যে ঐ খুন করেনি, এটা দিবালোকের মত পরিষ্কার। কারণ ঐ এলাকায় হানাদার বাহিনী কোনদিনই যেতে পারেনি। বাকী রইল আরো দুই পক্ষ, স্থানীয় শত্রু ও মুক্তিবাহিনী। অতীত অভিজ্ঞতায় আমার মনে হচ্ছিল জনসাধারণ হত্যায় জড়িত হওয়ার সাহস করেনি। মুক্তিবাহিনীর কোন সদস্যই ঐ হত্যায় জড়িত এমন একটি সন্দেহ আমার মনে বারবার উকি মারছিল। এর মধ্যে আমার দলের বিচক্ষণ ও চৌকষ দুজন শান্তি (গোয়েন্দা) হত্যাকাণ্ডের আরও কিছু তথ্য আবিষ্কার করে। তাদের সংগৃহিত তথ্যঃ কদ্দুস নগরের পাশে বামন আটায় রাত কাটানোর সময় ক্যাপ্টেন বেনু কোম্পানীর দুজন মুক্তিযোদ্ধা এল.এম.জি. কাঁধে শিবির থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারা প্রায় আট ঘন্টা শিবিরের বাইরে ছিল। কোথায় ছিল, কেন ছিল, এ সম্পর্কে কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি।
২৫শে অক্টোবর। ক্যাপ্টেন বেনুর পুরো কোম্পানী অর্জুনার পাশে অবস্থান করছিল। অত্যন্ত কৌশলে তার কোম্পানীর মধ্যে দুই-তিন জন শান্তিকে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। তারা ২৫শে অক্টোবর সারাদিন সারারাত কাটিয়ে আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচরের মত বেয়াড়া-নেয়ামতপুরের হত্যা- রহস্য উদ্ঘাটন করতে সমর্থ হলো। হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ রহস্য উম্মোচিত করে বুঝিয়ে দিল গোয়েন্দার কাজে তারা কতটা পারদর্শী।”
২রা অক্টোবর ক্যাপ্টেন বেনুর কোম্পানী বামনআটায় ঘাঁটি গেড়েছিল। দিনটি ছিল খুবই দূর্যোগপূর্ণ। কমাণ্ডার বেনুর নির্দেশে দুজন যোদ্ধা ঝড় ঝাপটা উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ে। বামনআটা থেকে পনের-ষোল মাইল পায়ে হেঁটে বেয়াড়া-নেয়ামতপুরে পৌঁছে ক্যাপ্টেন বেনু ও দুরমুজ খানের পুরানো শত্রুকে ঘর থেকে বের করে বাড়ির উঠানেই গুলি করে ফেলে রেখে চলে যায়। সবার চোখ ফাকি দিয়ে খুবই সন্তর্পণে তারা দুজন শিবির থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আবার রাতের শেষ প্রহরে সবার চোখে ধুলো দিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। কেউ জানে নাই, দেখে নাই, টের পায় নাই ক্যাপ্টেন বেনু এই রকমই মনে করেছিল। আসলে দুরমুজ খা এবং অন্য যোদ্ধাটির শিবির থেকে বেরিয়ে যাওয়া আবার শিবিরে ফিরে আসাটা তাদের অজান্তে চার-পাঁচ জন সাধারণ সহযোদ্ধা সহ শান্তি বিভাগের একজন সদস্য লক্ষ্য করেছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১০

২৫শে অক্টোবর রাতে বেয়াড়া-নেয়ামতপুরে স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে হত্যা সংক্রান্ত কিছু সূত্র আবিষ্কৃত হলো। নেয়ামতপুরের দুজন স্বেচ্ছাসেবক হত্যার রাতে নেয়ামতপুর-দীঘল- কান্দির মাঝামাঝি একজন সহ সশস্ত্র দুরমুজ খাঁকে দেখেছিল। এই বক্তব্যের সত্যতা মিললো পাঁচটিকরী কদ্দুসনগরের দুজন লোকের কাছে। তারাও দুজন সশস্ত্র লোককে শেষরাতে ঐ গ্রামের মাঝ দিয়ে বামন আটা অভিমূখে যেতে দেখেছেন। ২৫ তারিখ সারারাত নানাভাবে নানা সূত্র থেকে খবর সংগ্রহের পর ২৬শে অক্টোবর দুপুরে ক্যাপ্টেন বেনুকে নজরবন্দী ও দুরমুজ খাঁকে বন্দী করা হলো। দুরমুজ খার অন্য সাথী তখন ক্যাপ্টেন বেনুর কোম্পানীর অন্তর্ভূক্ত ছিল না। তাই তাকে ঐ সময় পাওয়া যায়নি। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখা গেল, হত্যাকাণ্ডে দুরমুজ খাঁয়ের অন্য সাথীর কোন ভূমিকা ছিল না। যেহেতু সে অন্য জেলার অধিবাসী এবং অপরিচিত, সেহেতু তাকে সাথী হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
বন্দী হবার পর দুরমুজ খাঁ সব অকপটে স্বীকার করে বলল, “আমি কমাণ্ডারের নির্দেশেই একাজ করেছি। এর আগেও আমি দেখেছি, দু’এক জন খারাপ লোককে মুক্তিবাহিনী শাস্তি দিয়েছে। এদের গুলি করে হত্যা করাটাও আমি শাস্তি মনে করেছিলাম। তবে চুপ করে রাতের অন্ধকারে করাটা অন্যায় হয়েছে, এজন্য যে কোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো”। ‘ক্যাপ্টেন বেনুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে বারবার একই কথা বলল, “আমি ঐ দুজনকে সত্যিকার অর্থেই দুষ্ট লোক বিবেচনা করে হত্যা করিয়েছি।” কিন্তু প্রথম সে অস্বীকার করলো কেন এবং ঘটনাটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করেনি কেন? জিজ্ঞাসা করলে সে কোনও সদুত্তর দিতে পারলো না।
অক্টোবর মাস, এ সময় মুক্তিবাহিনীতে একটি সুন্দর ও পাকাপোক্ত প্রশাসন কাঠামো গড়ে উঠেছে। তখন আর সেই জুন-জুলাইয়ের মত ছোটখাটো ঘটনা মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্বের উপর হুমকি স্বরূপ নয়। যতই দিন যাচ্ছিল, মুক্তিবাহিনী ততই ঘুটিয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে বিচার-আচার করতে চেষ্টা করছিল। ভালভাবে নানা দিক বিচার-বিবেচনা করে, শাস্তি নিরূপন করা হচ্ছিল। আগষ্টের পর থেকে বলতে গেলে মুক্তিবাহিনীর বিচার অভিধান থেকে মৃত্যুদণ্ড প্রায় উঠেই গিয়েছিল।
আমার সব সময় মনে হতো, মানুষ জন্মগতভাবে খারাপ নয়। অপরাধীও নয়। বিশেষ বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অথবা লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ অন্যায় পথে ধাবিত হয়। অথবা অন্যায় কাজ করে থাকে। পরিবেশ পরিস্থিতি বাদলানো গেলে অন্যায়ের প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাবে বা মানুষের চিন্তাধারা, কর্মকাণ্ডেও পরিবর্তন সুচিত হবে। মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় হয়েছিলও তাই। ৭১ সালের জুলাই থেকে ৭২ সালের মার্চ-এপ্রিল এই দীর্ঘ এগার বারো মাসে (শুধুমাত্র ৭১-এর আগষ্টের ২৫ তারিখ থেকে সেপ্টেম্বরের দশ-বারো তারিখ ছাড়া) টাংগাইল মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রিত মুক্তাঞ্চলের কোথাও কোন চুরি-ডাকাতি ও গুপ্তহত্যা হয়নি। মানুষ যেন কলিযুগ থেকে সত্যযুগে ফিরে গিয়েছিলেন। এটা এমনিতেই হয়নি। এর মূল কারণ প্রধানতঃ দুটি। প্রথমতঃ অন্যায়কারী যত শক্তিশালীই হোন না কেন, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। এই বদ্ধমূল বিশ্বাস তখন সর্বত্র বিরাজ করছিল। দ্বিতীয়তঃ মানুষ সাধারণত অভাবে পড়ে অথবা চাপের মুখে অন্যায় কাজে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১১

প্রবৃত্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই চাপ ও অন্ন বস্ত্রের অভাব অনেকাংশে কমে গিয়েছিল। এমন একটি সময়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অর্জুনায় দুরমুজ খাঁ ও কোম্পানী কমান্ডার বেনুর অপরাধের বিচার করতে যেয়ে আমি খুবই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। অবশেষে নানাদিক বিবেচনা করে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক একমাত্র গুপ্তহত্যায় জড়িত হওয়ার অপরাধে দুরমুজ খাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
রোজার মাস মুসলমানদের জন্য খুবই পবিত্র। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুরমুজ খাও রোজা রেখেছিল। ধর্মীয় কারণে ইফতারের আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্ভব নয়। অতএব সিদ্ধান্ত হলো ইফতার শেষে আবদুল হাকিমের কোম্পানী দুরমুজ খাঁকে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে।
দণ্ডাদেশ ঘোষণার পর দুরমুজ খাঁর মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় লক্ষ্য করা হচ্ছিল। না, দুরমুজ খাঁর কোন ভাবান্তর নেই। আঠার-উনিশ বছরের যুবক দুরমুজ খাঁ। লেখাপড়া না জানা সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী। আরব বেদুইনদের মতই দুরন্ত-দুঃসাহসিক। অত্যস্ত স্বাভাবিকভাবে সে আমাকে বললো, ‘স্যার, আমি যা করছি তাতে আগে হইক পরে হইক শাস্তি আমার হইতই। তবে সবসময় আশা আছিল, আমি শত্রুর গুলিতে মারা যামু। লোকে আমারে শহীদ কইব। কিন্তু তা তো হইল না। আমি অপরাধী হইয়া মইরা গেলাম। আমার অনুরোধ, আমি আইজ আপনার সাথে ইফতার করমু। আমি তার অনুরোধ রক্ষা করলাম। সারাদিন দুরমুজ খাঁকে খাদ্যশষ্য বিতরণ কেন্দ্র থেকে পঞ্চাশ-ষাট গজ দুরে কঠোর পাহারায় রাখা হলো। সারা দিনে তার মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। কাজের ফাঁকে তার দণ্ডাদেশ সম্পর্কে বারবার ভাবছিলাম।
দণ্ডাদেশ দণ্ডাদেশই। তা নিয়ে বারবার ভাববার কোন কারণ ছিল না। তবুও আমি দুরযুদ্ধ খাঁয়ের মৃত্যু দণ্ডাদেশ নিয়ে ভাবছিলাম। দণ্ডাদেশ পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে কি না, তা খুঁটিয়ে দেখছিলাম। ভাবনার কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে দুরমুজ দুঃসাহসিক দু’চার জন মুক্তিযোদ্ধার পরেই। অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে তার শৌর্য-বীর্য-বীরত্ব যারপরনাই প্রশংসনীয়। এ ছাড়াও মানুষ হিসাবে দুরমুজ খাঁ আর দশ জনের মতই একটি সুন্দর মনের অধিকারী। শাস্ত ও ভদ্র, তাই তাকে হারাতে আমার মন চাইছিল না। কিন্তু সে যে অন্যায় করেছে, তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক সাংঘাতিক ঘটনা। টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা, স্বেচ্ছাসেবকরা গোপনে কাউকে হত্যা করেনি। টাংগাইল মুক্তিবাহিনী এই প্রকার অপকর্ম ও অপরাধ থেকে সম্পূর্ণ যুক্ত। এই দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এবং টাংগাইল মুক্তিবাহিনীকে সকল প্রকার সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখার মানসে অনেক সাহস ও কৃতিত্ব প্রদর্শনের পরেও দুরমুজ খাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে।
দুরমুজ খাঁ সরাদিন আমার টেপ রেকর্ডে গান শুনলো। নানা ধরনের গান রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, দেশাত্ববোধক, বাউল, ভাটিয়ালী। গানের সুর ও তালে তালে দুরমুজ খাঁ নিবিষ্ট চিত্তে মাথা নেড়ে, হেলেদুলে সুরের ঝংকার ও গানের মর্মবাণী হৃদয়ঙ্গম করছিল। ব্যাপারটা সারাদিন আমার চোখে এড়ায়নি। যে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত,, ইফতারের পর যার প্রাণ পাখি উড়ে যাবে, কি করে ওভাবে গান উপভোগ করতে পারে? সুরের ঝংকারে ঝংকৃত হতে পারে? আমি বারবার
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১২

বিস্মিত হচ্ছিলাম। ইফতারের কিছু আগে আমরা ইফতার নিয়ে বসে পড়লাম। তখনও দুরমুজ খাঁ দেশাত্মবোধক গানে সব কিছু ভুলে তন্ময় হয়ে সুরের তালে তালে মাথা দোলাচ্ছিল। আমার পাঁচ-সাত গজের মধ্যে ঐ ভাবে গান উপভোগ করা তখন অনেকের পক্ষেই সম্ভব ছিলনা। দুরমুজ খাঁ কিন্তু পেরেছিল।
ইফতার শেষে দুরমুজ খাঁকে জিজ্ঞেসা করলাম, “মৃত্যুর আগে তোর কিছু বলার আছে কি?”
না তেমন কিছু বলার নেই। যা বলার আছে তা আপনার পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব নয়। পারা না পারা সেটা আমাদের ব্যাপার। তোর বলার কি আছে, অকপটে বল। এই সময়ে দুরমুজ খাঁ যা বললো, তা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। লেখাপড়া জানা নেই, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বালাই নেই, তবুও তার যুক্তি অকাট্য-খণ্ডন করা দুঃসাধ্য। তার বক্তব্য, ‘আমার কার্যকলাপের জন্য আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আমি নিজেও স্বীকার করছি, আমাকে গুলি করাই যুক্তিসংগত তবে আমি অনেক যুদ্ধে শত শত মুক্তিযোদ্ধার চাইতে অনেক বেশী ভাল করেছি। অনেক বেশী সাহসের সাথে লড়াই করেছি। আমি যে সাহসের সাথে লড়াই করেছি, তার জন্য আমার শাস্তির ব্যাপারে বিবেচনা করা যায় কিনা? এর আগে শুনেছি বহু অপরাধীকে মুক্তিবাহিনী সংশোধনের সুযোগ দিয়ে মৃত্যু দণ্ডাদেশ স্থগিত রেখেছে। এখনও দশ-বারো জন লোকের উপর মুক্তিবাহিনীর মৃত্যু দণ্ডদেশ ঝুলছে। তারা যদি আবার কোন অপরাধ করে তাহলেই শুধু মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হবে। তাই আমি চাই, আমার দণ্ডাদেশ বাতিল না করে স্থগিত রাখা হোক। এবং যুদ্ধে যেতে সুযোগ দেওয়া হোক। যুদ্ধে যদি গুলি খেয়ে মরে যাই, তখন যেমন মৃত্যুদণ্ডও কার্যকরী হবে, তেমনি আমিও একজন যোদ্ধা হিসাবে মরলাম, এটাও মনে করতে পারবো।’ মাথার উপর মৃত্যু- দণ্ডাদেশ ঝুলছে, এমন একজন লোকের ঐ ধরণের সহজ স্বাভাবিক আচররণ ও যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। সাথে সাথে পাশে বসা মেজর হাকিমকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। মেজর হাকিম বললো, ‘হ্যা। ব্যাপারটা ভেবে দেখা যেতে পারে। হেড কোয়ার্টার থেকে যখন শহীদ সাহেব সহ সবাই আসছেন। তখন এ ব্যাপারে তাদের মতামত জানা যেতে পারে।
দুরমুজ খাঁর দণ্ডাদেশ স্থগিত রইল। তাকে আলাদা করে রাখা হলো। ক্যাপ্টেন বেনুকে তার পদ থেকে অপসারিত করে পরবর্তীতে অন্যান্য কমাণ্ডারের ব্যাপক মতামত নিয়ে বিশেষ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে বিচারের জন্য নজরবন্দী করে রাখা হলো।
২৪শে অক্টোবর পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছেই হেড কোয়ার্টারে নির্দেশ পাঠিয়ে দিলাম, হিসাব-নিকাশ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র নিয়ে আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, নরুন্নবী, ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী, সৈয়দ নুরুল ইসলাম ও ফারুক আহমেদ যেন অনতিবিলম্বে আমার সাথে দেখা করে। আনোয়ার -উল- আলম শহীদ হেড কোয়ার্টার ত্যাগের প্রাক্কালে বেসামরিক প্রশাসনের দয়িত্ব লিখিতভাবে হামিদুল হককে হস্তান্তর করে আসবেন।
২৫শে অক্টোবর শহীদ তার দল নিয়ে রওনা হলেন। হেড কোয়ার্টার থেকে বেরোবার সময় তাদের বুঝতে বাকী থাকে না কেন সব কাগজপত্র নিয়ে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৩

আমি তখন যমুনার পারে ছোট্ট একটি শণের ঘরের পাশে অপেক্ষা করছিলাম। এর আগে শহীদ সাহেব একবার ভারত সীমান্তের নক্সী পর্যন্ত গিয়েছিলেন, নক্সী ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছতে তাদের কত পরিশ্রম, দুর্ভোগ এবং যাতনা ভোগ করতে হয়েছিল, তা লিখে শেষ করবার নয়। কষ্টকর ও ভীতিপ্রদ স্মৃতি বহন করে এবার হেড কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন, একি। এবার পথে কোন কষ্ট নেই, অসুবিধা নেই। কোন কিছুর অভাব নেই। যখন যা প্রয়োজন, তা অনায়াসেই পাওয়া যাচ্ছে। হেড কোয়ার্টার থেকে নবী নেওয়াজের কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছিল। যেখানে যখন যা প্রয়োজন, নৌকা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, সবকিছুই প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ যেন এক অলৌকিক ব্যাপার।
একটু বিচার করলেই দেখা যাবে এটা কোন অলৌকিক ব্যাপার নয়। এর মূলে ছিল আমাদের সুশৃঙ্খল, সুবিন্যস্ত সাংগঠনিক কাঠামো এবং স্বেচ্ছাসেবক ও মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় কার্যকলাপ। নির্দেশ ছাড়া আমি এতে তেমন কিছুই করিনি। তখন সংগঠন গড়ে উঠায়, সংগঠনের ভিত্তি মজবুত হওয়ায় নির্দেশ দিলেই কাজ হতো।

প্রতিনিধি দলের ভারত গমন
২৭শে অক্টোবর ভোরে আনোয়ার-উল-আলম শহীদ তার দল নিয়ে আমার সাথে মিলিত হলেন। আগে থেকেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে চিঠিপত্র, প্রতিনিধি দলের করণীয় কি কি এবং ভারত গমনের দিন ক্ষণ ইত্যাদি সবকিছুই ঠিক করে রাখা হয়েছিল। প্রতিনিধি দলকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছ’টি দ্রুত গতির নৌকাও প্রস্তুত ছিল।
আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, নুরুন্নবী, নুরুল ইসলাম, ডাঃ শাহাজাদা চৌধুরী, সৈয়দ নুরু ও ফারুক আহমেদের কাছে দুরমুজ খাঁর সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলাম। অনেক কথাবার্তার পর দুরমুজ খাঁর দণ্ডাদেশ স্থগিত রাখা হলো। আলোচনার ভিত্তিতে নিহত দু’জনের আত্মীয় স্বজনের কাছে মতামত চেয়ে লোক পাঠানো হলে তারাও অনুকূল মত দিলেন। তাই আর ঐ সময় দুরমুজ খাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো না। দেশ স্বাধীন হবার ৪ দিন পর নিহতদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে পুনরায় মতামত জানতে চাওয়া হয়। তারা সম্ভবতঃ সেই সময় স্বাধীনতার মহানন্দে মাতোয়ারা ছিলেন, দুরমুজ খাঁর উপর থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করে নিতে মুক্তিবাহিনীকে অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধে মুক্তিবাহিনী দণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়।
২৭শে অক্টোবর। শহীদ সাহেব ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। ছিন্নমূল শরণার্থীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ সাথে পাঁচ লক্ষ টাকা উদ্বাস্তু শিবিরে সাহায্য দেবার জন্য শহীদ সাহেবের হাতে তুলে দেয়া হলো। প্রতিনিধি দলের কার কি দায়িত্ব, তাও ভাগ করে দেয়া হল। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর যাবতীয় হিসাব-কিতাব, প্রশাসনিক ব্যবস্থাদি, জনগণের মানসিকতা, এক কথায় দেশের আভ্যন্তরীণ পুরো পরিস্থিতির একটি সুন্দর চিত্র বাংলাদেশ সরকারের কাছে তুলে ধরবেন এবং বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র, শ্রমিক, ও গণ প্রতিনিধিদের সাথে যথাসম্ভব যোগাযোগ করে অভ্যন্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৪

পৌঁছে দেবেন। নূরুন্নবী সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে পরবর্তী যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলাপ আলোচনা করবে এবং আমার দেয়া পরিকল্পনা তাদের সামনে তুলে ধরবে, উপরন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে অভ্যন্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরও সুদৃঢ় ও কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করবে। ডাঃ শাহাজাদা চৌধুরী বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সাথে দেশের অভ্যন্তরে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয় আলোচনা করে একটি প্ল্যান তৈরী করবে। সৈয়দ নূরু ও ফারুক আহমেদ মুক্তিবাহিনীর শিবিরে শিবিরে ঘুরে টাংগাইল মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাবে এবং দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা সংক্রান্ত প্রচার ব্যবস্থা কিভাবে আরও জোরদার ও ব্যাপক করা যায়, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে এবং অর্জিত অভিজ্ঞতা ফিরে এসে কাজে লাগাবে।
প্রতিনিধি দলকে লিখিত নির্দেশ দেয়া হলো, টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকারী নেতা গণ- পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী দেশে ফিরতে চাইলে, তাকে যেন সসম্মানে নিয়ে আসা হয়। আমিও বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর কাছে টেপে আমার মতামত জানালাম। তাছাড়া প্রতিনিধি দলের ভারত সফর সফল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার জন্যে ব্রিগেডিয়ার সান সিং ও আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিমকে আলাদা আলাদা দুখানা পত্র দেয়া হলো। শরণার্থীদের জন্য সাড়ে পাঁচ লাখ ও প্রতিনিধি দলের পথ খরচা বাবদ ত্রিশ হাজার টাকা সহ আনোয়ার-উল-আলম শহীদের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল ৩০শে অক্টোবর মানকার চরে পৌঁছল।

দক্ষিণাঞ্চল সফর
২৭শে অক্টোবর দুপুরে নদীপথে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করলাম। আবার সেই শাহজানী, তারপর শুটাইনের চর, সেখান থেকে চর পাকুল্যা। এই তিনটি স্থানে দু’দিন কাটিয়ে ফাজিলহাটীতে এসে উপস্থিত হলাম। অন্যদিকে পূর্ব নির্দেশ মত কর্নেল ফজলু ৩রা নভেম্বর কেদারপুরে ঘাঁটি স্থাপন করেন। রোজার মাসে যুদ্ধের তুলনামূলক সংখ্যা ও তীব্রতা কমিয়ে দিয়েছিলাম। মূল মূল ঘাঁটি ছাড়া প্রায় কুড়ি-বাইশ দিন পথে ঘাটে তেমন যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়নি। তবে এ সময়টাতে ভিন্ন প্রকৃতির দুচারটি মারাত্মক ঘটনা ঘটেছিল।
প্রথম ঘটনাটি এই রকম : আমি শাহজানীতে আর আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ভারতের পথে, এমনি সময় ২৭শে অক্টোবর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের জনৈক পাঞ্জাবী মেজর বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল মাঠে এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে খুব হামি তামি করে বলল, ‘আমি এইবার পাহাড়ে যাচ্ছি। কাদের সিদ্দিকীর একটা লোককেও থাকতে দিব না। কাদের সিদ্দিকীকে তো ধরবই, ধরব। তার সব চেলাদেরও গ্রেফতার করে আনব।’

পাথরঘাটায় হানাদারদের ব্যর্থ হামলা
দাম্ভিক এই মেজর ২৮শে অক্টোবর বিকেলে মুক্তিবাহিনীর পাথরঘাটা ঘাঁটি আক্রমণ করলো। মেজর ভদ্রলোক ১৬ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানী নিয়ে মুক্তিবাহিনীর পাথরঘাটার অগ্রবর্তী ঘাঁটি ঘিরে ফেলল। অপ্রস্তুত মুক্তিবাহিনী ঘেরাও এর মধ্যে পড়ে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। মেজরের নেতৃত্বে ছসাত জন হানাদার তিন জন পাহারারত মুক্তিযোদ্ধাদের একেবারে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৫

মাঝে এসে আকস্মাৎ হ্যান্ডস-আপ বলে গর্জে উঠলো। মুক্তিযোদ্ধারা হ্যান্ডস্-আপ করতে নারাজ। হতচকিত হয়ে গেলেও তারা তড়িৎ গুলিবর্ষণ শুরু করে দেয়। অত কাছাকাছি থেকে ঘেরাও হয়ে পড়া কোন লোক গুলি চালাতে পারে—এটা হয়ত মেজরটির জানা ছিল না। মুক্তিবাহিনীর প্রথম একঝাঁক গুলি দু’তিন জন খান সেনাসহ মেজরটির বুক ঝাঁঝরা করে বেরিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষা না করে চিৎবাক খেয়ে, উল্টে পাল্টে কোন রকমে ঘেরাও থেকে বেরুতে সক্ষম হয়। এই সময় হানাদারদের একজন চিৎকার করে উঠলো, “ইমাম জখম হো গিয়া, ইমাম জখম হো গিয়া।” চিৎকার শুনে অন্য দু’ জন খান সেনা এগিয়ে গেল। কিন্তু ততক্ষণে ইমাম শেষ।
ঘেরাও থেকে বেরিয়ে এসে, সুবিধা মত অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যুবাণ হানা শুরু করেছিল। ইমাম খতম হওয়ায় হানাদার বাহিনীর টিকে থাকা আর সম্ভব হলো না। প্রচুর গোলা- বারুদ ও সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা রণে ভঙ্গ দেয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দু’জন নিহত ও চারজন আহত হয়। হানাদারদের চারজন নিহত, তিনজন আহত ও দশজন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হয়। পরে অবশ্য শোনা গেছে, ঐদিন পাথরঘাটায় রাজাকাররা ইচ্ছে করেই মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা দিয়েছিল।

টাংগাইল শহরে গ্রেনেড নিক্ষেপ
৫ই নভেম্বর টাংগাইল শহরে নিষ্প্রদীপ মহড়া পালিত হলো। রাতটি মুক্তিবাহিনীকে এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিল। করটিয়ার আশে পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত বায়জিদ আলমের নেতৃত্বে ‘বজ্র কোম্পানী’ এবং স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার আনোয়ার দলের ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ পুরো রাত হাত বোমা নিক্ষেপের একটি উজ্জল দৃষ্টাস্ত স্থাপন করলো। টাংগাইল শহরের উপর নানাদিক থেকে প্রায় তিনশ হাত বোমা ছোড়া হয় কাগমারী ওয়ারলেস স্টেশনের কাছে রাজাকার ঘাঁটি, নগরজলফাই পুলের কাছে, টাংগাইল পাওয়ার স্টেশন, টাংগাইল জি. পি. ওর পিছনে ও শিবনাথ স্কুলে রাজাকার ঘাঁটিতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে ছসাত জন রাজাকার নিহত ও চল্লিশ জন আহত হয়।

পোড়াবাড়ীতে খণ্ডযুদ্ধ
৩রা ডিসেম্বর আছিম-পোড়াবাড়ীতে এক খণ্ডযুদ্ধে ইদ্রিস কোম্পানীর হাতে তিন জন খান সেনা, পাঁচ জন রাজাকার নিহত, এবং এক জন বন্দী হয়। এখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা সামান্য আহত হয়েছিল। ৫ই নভেম্বর থেকে ২৮শে নভেম্বর এই বাইশ-তেইশ দিনে আছিম, লহরের বাইদ, ও রাঙ্গামাটির ঘাঁটিতে গোলাবারুদসহ পর্যায়ক্রমে দুইশ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।

বন্দী বিনিময়
৭ই নভেম্বর পাক হানাদারদের বাহিনী আরেক বার ধলাপাড়ায় হামলা চালাতে আসে। ষোল ঘন্টা ধরে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চললে দশজন রাজাকার নিহত ও চারজন রাজাকার ও চারজন খান সেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হয়। কিন্তু যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা ধলাপাড়া ঘাঁটি আগলে রাখতে না পেরে, সামান্য পিছিয়ে যায়। অন্য দিকে কুয়াশার কারণে আশেপাশের অবস্থা ভাল দেখতে না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা হারুন বাংকারে বসে গুলি চালাচ্ছিল। এক সময় দু’তিনজন লোক তার দিকে আসতে দেখে। সে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৬

প্রথম তাদের গ্রামবাসী বলে মনে করেছিল। কিন্তু কাছে আসতেই হারুন বুঝতে পারে গ্রামবাসী নয়, হানাদার। তাদের লক্ষ্য করে সে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। আর এই সময় দুজন হানাদার পিছন থেকে মুক্তিযোদ্ধাটিকে জাপটে ধরে। হারুন হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। কিন্তু মরিচা থেকে এগিয়ে এসে মেজর নবী নেওয়াজের কোম্পানী হানাদারদের পিছন থেকে আক্রমণ করলে, হানাদাররা বেশীক্ষণ ধলাপাড়ায় না থেকে প্রথমে দেওপাড়া পরে কালিহাতিতে ফিরে যায়। দুপুরে হানাদাররা বন্দী মুক্তিযোদ্ধাটিকে দুজন হানাদার ও দু’জন রাজাকারের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। এভাবেই হানাদারদের সাথে মুক্তিবাহিনীর দ্বিতীয় বার বন্দী বিনিময় হয়।
১০ই নভেম্বর মুক্তগাছার বটতলায় মুক্তিবাহিনীর সাথে অনুরূপ আরেকটি খণ্ড যুদ্ধ হয়। এখানে তিন জন পাক সেনা ও পাঁচজন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী বেশ কয়েকটি হাতিয়ার এবং সাত জন রাজাকার বন্দী করতে সমর্থ হয়।
২৮শে অক্টোবর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দাম্ভিক মেজর পাথরঘাটায় নিহত হলে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেফতার করার সুখস্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে আমাকে গ্রেফতার করার একটা প্রচণ্ড প্রবণতা হানাদার বাহিনীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। পাথরঘাটা অভিযান ব্যর্থ হলে তারা নতুনভাবে পরিকল্পনা করতে থাকে। উদ্দেশ্য যেকোন ভাবে আমাকে আটক করা। কিন্তু সে সময় আমার অবস্থা ছিল খুবই সুবিধাজনক। তখন আর আমাকে আগের মত ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে হতো না। বরং জনগণই আমাকে বারংবার উৎসাহিত ও শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছিলেন। মুক্তিবাহিনীর সংগঠনও এমন একটা সুদৃঢ় কাঠামোর মধ্যে এসে গিয়েছিল যে, আমি না থাকলে বা আমার উপস্থিতির চেয়ে নির্দেশেই তখন বেশী কাজ হচ্ছিল। তাই সংগঠনের কাজে এক স্থান থেকে অন্য স্থান ঘুরে বেড়াতে পারছিলাম।
২৭শে অক্টোবর আমার নাগরপুর ও কেদারপুরের দিকে রওনার খবরটি হানাদারদের হেড- কোয়ার্টারে পৌঁছে যায়। হানাদার বাহিনী আমাকে গ্রেফতার করতে নাগরপুর ঘিরে অভিযানের প্রস্তুতি চালাতে থাকে। তাদের অভিযান প্রস্তুতির খবর আবার মুক্তিবাহিনীও জেনে ফেলে। হানাদারদের মুক্তিবাহিনী বিরোধী অভিযান প্রস্তুতি যখন চূড়ান্ত, ঠিক তখন অর্থাৎ ৬ই নভেম্বর হঠাৎ কর্ণেল ফজলুর রহমানকে সাথে নিয়ে একরাতে পঞ্চাশ মাইল উত্তরে চলে এলাম। হানাদাররা তো অবাক। তারা কোন্ দিকে অভিযান পরিচালনা করবে? হতেয়া-পাথরঘাটায় আমার উপস্থিতির খবরের উপর ভিত্তি করে অভিযান চালিয়ে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। চারিদিক থেকে নাগরপুর ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা যখন পাকা, তখন সেখানেও ফাঁকা। হানাদারদের মনে প্রশ্ন জাগে, লোকটা আসলে কি? কখন কোথায় থাকে, কোথায় যায় জানাইয়া যায়, না। ‘কভি ইধার কভি উধার। শালা দানব হ্যায়, ইয়া মানব। শালা জরুর ভূত হোগা।’
৭ই নভেম্বর রাতে গোপালপুর-মির্জাপুরের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় কর্ণেল ফজলুর রহমানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দেখুন, আপনি এর আশেপাশে আগেও থেকেছেন। রাতটা এখানেই কোথাও কাটিয়ে দিতে চাই। আপনার কোন পরিচিত জায়গা থাকলে নৌকা সেখানে ভিড়ান।’ না,
পৃষ্ঠা নং ~ ৫ ১৭

কর্ণেল ফজলুর রহমানের তেমন কোন জানাশোনা জায়গা নেই। তবুও আমরা যে কোন স্থানে উঠে পড়বো। তবে কোন অবস্থাতেই খালের পূর্বপাড়ে উঠা চলবে না, অবশ্যই পশ্চিম পাড়ে উঠতে হবে। তিনটি নৌকায় আমরা খালের পশ্চিম পার লক্ষ্য করে খুব ধীরে ধীরে এগুচ্ছি। থাকার স্থান অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে নৌকার ছইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বেশ কিছুক্ষণ ডান দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে একটি বাড়ীর ঘাটে মাল্লাদের নৌকা ভিড়াতে বললাম। বাইরে থেকে বাড়ীটি গাছপালায় ঢাকা। আমার ধারণা যদি ছোট্ট একটা ঘরও পাওয়া যায়, তাতেই অথবা তারই বাইরে কোন রকমে বাকী রাতটা কাটিয়ে দেবো। না, বাড়ী নির্বাচনে আমাদের ভুল হয়নি। বাড়ীর ঘাট দেখতে খারাপ হলেও, বাড়ীর অবস্থা মোটেই খারাপ নয়। নৌকা ঘাটে ভিড়িয়ে উপরে উঠে বাড়ীর স্বাচ্ছল্য ও শান-শওকত দেখে মুক্তিযোদ্ধারা বিস্মিত ও হতবাক হয়ে গেল। যাক, তা হলে রাতটা ও নিরাপদেই কেটে যাবে।
অখ্যাত, অজ্ঞাত অজ পাড়াগায়ে এ এক মস্ত বড় বাড়ী। বাড়ী তো নয়, যেন রাজ- প্রাসাদ। চার-পাঁচ হাজার বর্গ গজের উপর বিশাল বাড়ী, চারদিক নয়-দশ ফুট উঁচু প্রাচীরে ঘেরা। বাড়ীর দুটি অংশ-একটি বাইরের অন্যটি প্রাচীরের ভেতরে। বাইরের অংশে বিশাল তিনটি টিনের ঘর। প্রত্যেকটি ঘরই প্রায় পঞ্চাশ হাতের মত লম্বা। একটিতে থাকেন কাজের লোকজন, অন্যটিতে ধান-চাল, পাট ও অন্যান্য জিনিসপত্র। সব শেষটি হচ্ছে বাড়ীর মালিকের বসবার ঘর ও দাওয়াখানা।
বাড়ীতে উঠেই কর্ণেল ফজলুকে নির্দেশ দিলাম, ‘আধমাইলের মধ্যে আশ-পাশের তিনটি বাড়ীতে তিনটি দলকে অবস্থান নিতে বলুন। আমাদের সাথে বড় জোর পনের কুড়ি জন থাকবে। নির্দেশমত, কর্ণেল ফজলু সব ব্যবস্থা করলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কর্ণেল ফজলু এই প্রথম ( এবং শেষ বারের মত) দু’তিন দিন আমার সাথে থাকতে পারছেন। সত্যি কথা বলতে কি, কর্ণেল যে কোন কাজকর্ম ত্বরিৎ সম্পন্ন করতে ওস্তাদ। যতটা সময় কর্ণেল ফজলু সাথে ছিলেন, তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি।

ফাজিল ডাক্তার
বাড়ীর মালিক এমদাদ হোসেন, পেশায় একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। আমরা যখন শরিফপুরের এই বাড়ীটিতে উঠলাম, তখন বাড়ীর কাজের লোকেরা মোটামুটি সমাদর করেন। কিন্তু বিভ্রাট ও বিপত্তি বাঁধে খাবার নিয়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা যেখানে যে বাড়ীতেই উঠেছে, বাড়ীর মালিক দুষ্ট বা বজ্জাত চরিত্রের হলে তাড়াহুড়া করে গা ঢাকা দিয়েছে। স্বাভাবিক সৎ ও দেশপ্রেমিক হলে, মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসম্ভব সমাদর করেছেন। এই বাড়ীতেই প্রথম সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলো।
আমি মালিকের বৈঠকখানায় চুপচাপ বসে আছি। কর্ণেল ফজলুই সব ব্যবস্থা দেখেছেন, তদারকি করছেন। ফজলুর রহমান যেখানে উপস্থিত, সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার জন্য আমার বলার কিছু ছিল না, দরকারও পড়েনি। প্রায় আধঘন্টা বৈঠকখানায় চুপচাপ বসে থাকার পরও যখন দেখলাম, কর্ণেল ফজলুর কোন পাত্তা নেই, তখন উঠে পাশের ঘরে গেলাম। সেখানে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৮

কোন লোকজন নেই। পাশে আর একটি ঘর, সেটাও ফাকা। ব্যাপার কি? এরা গেল কোথায়? এই সময় আমার কানে সামান্য কিছু কথাবার্তা আওয়াজ ভেসে এলো। সেদিকে এগিয়ে গেলাম, কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম, ফজলু সেখানেই। বাড়ীর মালিককে ডেকে বের করার চেষ্টা করছেন। কর্ণেল ফজলুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ব্যাপার? কি হয়েছে?’ আমাকে দেখেই কর্ণেল ফজলু স্যালুট করে বলেন, ‘স্যার, কি বলব, এমন বেকুব লোক জীবনে দেখি নাই। থাকার জায়গা হলো খাওয়ার ব্যবস্থা কি হবে? কাজের লোকদের যখন খাওয়ার কথা বললাম, তাঁরা বললেন, জিনিসপত্র বাড়ীর ভিতরে। সেখান থেকে বের করা না গেলে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা হবে কি করে? তাই বাড়ীর মালিককে ডাকছি। কিন্তু ভিতর থেকে সে বের হবে না। এ এক মস্তবড় বেকুব। এই বেকুবের কথা হলো, আপনারা রাতটা কোন রকমে থাকেন। সকালে খাবারের ব্যবস্থা করে দেবো। তাই স্যার, ব্যাটাকে বুঝাচ্ছিলাম। বাড়ীর মালিকের ব্যবহারে অতিশয় অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুদ্ধ কর্ণেল ফজলু আবার বাড়ীর মালিককে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘দেখুন, আমরা চোর ডাকাত না, আমরা মুক্তিবাহিনী। বাড়ী থেকে বের হোন এবং আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করুন।’ বেয়াড়া ও উদ্ভট প্রকৃতির মালিকের সেই পুরানো কথা, ‘আমি ভয় পাইছি। রাইতটা কষ্ট কইরা থাহেন। সকালেই আপনাদের জন্য ভাল ভাল খাবারের ব্যবস্থা করমু।’
এই সময় একজন মহিলা জানালা দিয়ে মুখ বের করে বললেন, ‘বাবারা, আমার পোলা সত্যই ভয় পাইয়া গেছে। আপনারা রাইতে এই ভাবেই থাকেন। আমরা রাইতে গেট খুলতে পারমু না। এইবার আমি মুখ খুললাম। বিনিত ভাবে বললাম, ‘দেখুন, আমরা আপনাদেরই সন্তান— সস্তুতি। আমাদের ভাল করে দেখে যদি মনে হয়, আমাদের দ্বারা কোন ক্ষতি হতে পারে, তাহলে দরজা না হয় নাই খুললেন।’ জবাবে বৃদ্ধা মহিলা বললেন, ‘না বাবা, আপনেরা ভালামানুষ। আমরা আপনেগোর ভালবাসি। রাইতের মত আমার পোলারে মাফ করেন। সে আইতে বাইর পারব না।’
কর্ণেল ফজলু হুংকার ছেড়ে বললেন, ‘বেটা বদমাইশ, তুমি ভাবছ, তোমার এই দেওয়াল আমি ভাঙতে পারব না? গেট ভাঙতে কি আমার সময় লাগবে? আমি যদি গেট ভাঙি, তাইলে তোর কপালে বেটা দুঃখ আছে।’ এই সময় গোয়াইল বাড়ীর আবদুস সবুর ও কাউলজানির তমছের, ফজলুর চেয়ে আরও একধাপ এগিয়ে চিৎকার করে বললো, ‘এতদিন যুদ্ধ করলাম, এমন বদমাইশ মানুষতো আগে দেহি নাই। শালার বেটা শালা, শালার এত বড় বাড়ী। আমাদের চাইরটা খাবার দিব, তা শালায় পারব না।’ ফজলু, তমছের ও সবুরকে শান্ত করে আরেকবার বাড়ীর বৃদ্ধা মহিলাকে মা সম্বোধন করে বললাম, “আপনার ছেলে ভাল মানুষ হলে, তার বাড়ীর বাইরে না বেরুনোর তো কোন কারণ দেখছি না। আর এটাতো সাধারণ চিরাচরিত ভদ্রতা। কোন মানুষ বাড়ীতে এলে বাড়ীর লোকেরাই তাদের যত্ন করে থাকেন। আপনার গোলাভরা ধান চাল, খাবার-দাবার সব কিছু রয়েছে শুধু ঘর থেকে বের করে দিতে পারবেন না, এই জন্য একদল লোককে না খেয়ে রাত কাটাতে হবে-এটা কোন ধরনের কথা?”
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১৯

হাক ডাক চলার সময় আশ-পাশের বাড়ী থেকে বেশ কয়েকজন লোক এসে পড়েন। তাদের একজন বললেন, ‘এই ডাক্তার গোপালপুর শান্তি কমিটির মেম্বার। সে দু’দিন আগে আমার ছেলেকে হানাদার বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। আপনারা এখানে এসেছেন, আপনাদের এর বিচার করে যেতে হবে।’ কথাবার্তা চলার দশ মিনিটের মধ্যেই আরও দু’তিন জন লোক এসে অনুরূপ অভিযোগ করলেন। তাঁরাও বলেন, ‘খাওয়ার জন্য একে ডাকাডাকির দরকার নাই। আমরা আপনাদের জন্য খাবার তৈরী করে আনছি। তাঁদের একজন আবার গর্ব করে বলেন, আমরা এই ডাক্তারের মত ধনী হইতে না পারি, কিন্তু আমাদের আত্মা বড় আছে।
ডাক্তারের ব্যবহারে কর্ণেল ফজলুর মাথায় আগুন ধরে গেছে। তিনি আমাকে বার বার অনুরোধ করতে থাকেন, ‘স্যার, আপনি এখান থেকে সরে গিয়ে বৈঠকখানায় বসুন। আমি ঐ কুত্তার বাচ্চারে কি করে বার করতে হয় করছি।’ কর্ণেল ফজলু কথাবার্তার ব্যাপারে একটু স্বতন্ত্র। তার মুখে বিশেষন প্রায়ই শোনা যেতো। অনেক সময় আমার সামনে ঐ ধরনের কথা বলে, পরে লজ্জিত হতেন।
বাড়ীর মালিকের ব্যবহারে এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবেশীদের অভিযোগ শুনে আমিও কিছুটা বিরক্ত ও ক্ষুদ্ধ। মনে মনে চাচ্ছিলাম, বাড়ীর মালিকের উপযুক্ত শিক্ষা হোক। তাই সরে যাবার সময় কর্ণেলকে বললাম, ‘দেখুন, মা-বোন ও অন্যদের প্রতি অশোভন আচরণ করবেন না।
আমি সরে এলে কর্ণেল ফজলু আগুনের মত জ্বলে উঠলেন। বাংলা অভিধান যত অশ্রাব্য বিশেষণ আছে, বেছে বেছে একটার পর একটা প্রয়োগ করে উদ্ভট প্রকৃতির বাড়ীর মালিক কে বেরিয়ে আসতে আদেশ দিতে লাগলেন। অন্যদিকে দলের রকেট লান্সারকে গেটে গোলা বর্ষণের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলেন। রকেট ছুঁড়তে মুক্তিযোদ্ধারাও প্রস্তুত। এমনি অবস্থায় কেন যেন বাড়ীর মালিকের শুভবুদ্ধির উদয় হলো। সে কাকুতি-মিনতি করতে করতে, গেট খুলে বাইরে এসে কর্ণেল ফজলুর পা জড়িয়ে ধরলো। মনে হচ্ছিল, হাড্ডিসার, লোম উঠা একটি কুকুর। প্রভুকে দেখে লেজ নাড়তে নাড়তে সারা গা হেলিয়ে দুলিয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে পায়ের সামনে এসে পড়েছে।
অনুনয়-বিনয়, ডাকাডাকি, ধমক-হুংকার দিয়ে বাড়ীর মালিককে বের করতে এমনিতেই চল্লিশ মিনিট লেগে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কারও মেজাজ ঠিক নেই। বিশেষ করে কর্ণেল ফজলুর মেজাজ তখন সপ্তমে। তাঁর মাথা গরম, চোখ লাল। মুখে বিশেষ বিশেষ বিশেষণ, হাতে বেত। ক্রোধ ও উত্তেজনায় তিনি টগবগ করছিলেন। এ অবস্থায় বাড়ীর মালিককে সামনে দেখে কর্ণেল ফজলু ভূত দেখার মত লাফিয়ে গর্জন করে উঠলেন, ‘এ্যা, তুই শালা এই বাড়ীর মালিক? শালা তুই যে বজ্জাত, তা আমার আগেই বুঝা উচিত ছিল। তিন মাস আগে যতবার ফলদায় মুক্তিবাহিনীকে চিকিৎসা করতে গেছিস ততবার আমার কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা করে নিয়েছিস। আমি ভাবছি, শালা তুই ভাল ডাক্তার। সেই সময় ছেঁড়া লুঙ্গি আর একটা ছেড়া ছাতা নিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২০

গেছিস। গরীব মানুষ। তাই টাকা দিছি। আরে শালা ছদ্মবেশী, তুই তো আমাদের আগেই বোকা বানিয়েছিস?’
মুক্তিযোদ্ধাদের সোজা আদেশ দিলেন, ‘বাধ বেটারে। মুক্তিযোদ্ধারা বাধবার জন্য প্রস্তুতই ছিল। আমার কাছে রিপোর্ট করতে এসে কর্ণেল ফজলু বললেন, ‘স্যার, বেটারে আমি চিনি। বেটা পাক্কা বদমাইশ। এত বড় বাড়ী ওর। খেতে দিতে অসুবিধা, বাড়ী থেকে বের হতে অসুবিধা, এখন বুঝতে পারছি স্যার, ও কেন বের হয় নাই। ও তো স্যার প্রথমেই আমার সাথে জালিয়াতি করেছে।
কর্ণেলের রিপোর্টের পর তাকে বললাম, ‘লোকটাকে পাশের ঘরে রাখুন, বাড়ীর মহিলারা যেন বাইরে না আসেন, তাঁদের আপনারাও যেন কিছু না বলেন। একটু পরেই পাশের বাড়ীর লোকেরা খাবার নিয়ে এলেন। খাবার শেষে ডাক্তারের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের অভিযোগ একের পর এক বেড়েই চললো। আনীত অগণিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ডাক্তার সম্পর্কে কি করা উচিত, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হলো। এবারেও কর্ণেল ফজলুর দাবী ‘স্যার, এর বিচারের ভারটা আমার উপর ছেড়ে দিন।
— বিচারের ভার আপনাকে দিতে আমার কোন আপত্তি নেই, তবে পূর্বেকার অসস্তোষ নিয়ে বিচার করবেন, তা চলবে না। বিচারের সময় সামান্যতম আক্রোশ প্রকাশিত হলে আপনার বিচার হবে। শান্তভাবে, নিরূত্তাপ চিত্তে যদি কিছু করতে পারেন তা হলে যান, আপনি এর বিচার করুন। আমার কিছু বলার নেই।
কর্ণেল ফজলুর রহমান বিচারের ভার নিলেন। অনেক রাত পর্যন্ত প্রতিবেশীদের কথাবার্তা, নালিশ ও অভিযোগ শুনলেন। তারপর আত্মপক্ষ সমর্থন করে, অভিযোগ সমূহের উত্তরে ডাক্তারকে তার বক্তব্য পেশ করতে বলা হলো। ডাক্তার ও বাদী পক্ষের বক্তব্য গভীর মনযোগের সাথে শুনে কর্ণেল ফজলু অবশেষে রায় ঘোষণা করলেন, ‘এই ডাক্তার মানুষের মত চার হাত-পা বিশিষ্ট হলেও, আসলে একটি শয়তান। এর শরীরের প্রতিটি লোমকূপে একটি করে শয়তান বিদ্যমান। তার চিন্তা-চেতনা ও কার্যকলাপ ইবলিশকে হার মানায়। অতএব, শাস্তি স্বরূপ এই শয়তান ডাক্তারকে চব্বিশ ঘা বেত একলক্ষ টাকা জরিমানা করা হল। জরিমানা অনাদায়ে আরও একশ ঘা বেত। জরিমানার টাকা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে শোধ করতে হবে। টাকা পরিশোধে বিলম্ব হলে আরও পঞ্চাশ ঘা বেত।’
বিচারের রায় দানকালে কর্ণেল ফজলু একটি অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি রায়ে বলেন, ‘যাদের ছেলে, ভাই বা আত্মীয়-স্বজন এই ডাক্তারের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁরা পঁচিশ ঘা বেত মারবেন। আর অভিযোগ আনয়নকারীগণ দয়া করে বেত্রাঘাত না করলে মওকুফ করা প্রতি বেত্রাঘাতের জন্য তাদেরকে ‘হাজার টাকা করে জরিমানা দিয়ে ডাক্তার বেত্রাঘাত থেকে অব্যাহতি পেতে পারে।’ তবে যাদের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে অভিযুক্তকে এক ঘা বেত মারতেই হবে। কর্ণেল ফজলুর রহমানের এই অভিনব রায় শুনে ডাক্তারের
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২১

সে কি অবস্থা। তার মাথা নত, চক্ষু অশ্রুসজল। তার হাত-পা ও শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে। অবশেষে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললো, ‘স্যার, আমারে মাফ করেন। জরিমানা দরকার পড়লে আরও এক লাখ বাড়াইয়া দেন। তবু বেত মাইরেন না।’ বিচারের রায় আমাকে জানানো হলো। ফজলুর রহমানকে বললাম, ‘আপনার জানা উচিত, মুক্তিবাহিনী অর্থের জন্য লালায়িত নয়। আপনি যে বিচার করেছেন তা নিঃসন্দেহে যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তব ভিত্তিক। কিন্তু দাম্ভিক ডাক্তার তার জরিমানার টাকা আরও বাড়িয়ে দিয়ে তাকে বেত্রাঘাত থেকে অব্যাহতি দেয়ার যে আবেদন করেছে, তার প্রেক্ষিতে কি করছেন?’ আমার প্রশ্নের মুখে কর্ণেল যেন কিছুটা নড়েচড়ে উঠলেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ স্যার, এটা আমার ভুল হয়ে গেছে, ডাক্তারের আবেদন সম্পর্কে আমার কিছু একটা করা উচিত ছিল। আমাকে আরেকবার সুযোগ দিন।’
কর্ণেল ফজলু আবার বিচার সভা বসালেন। ডাক্তারের আবেদনক্রমে নতুন বিচার। অভিযোগকারীরা সবাই উপস্থিত। ডাক্তারকে তার আবেদন নতুন করে পেশ করতে বলা হলো। ডাক্তারের আবেদন, ‘আমি চব্বিশ বেত খেয়ে বাঁচুম না। বেত খেলে আমার মান-সম্মান কিছুই থাকবে না। আমি বুঝতে পারছি, আমার অন্যায় হয়েছে। বেত মাফ করে দিয়ে ইচ্ছা করলে, জরিমানার পরিমাণ আরও এক লক্ষ টাকা বাড়িয়ে দিন। বিচক্ষণ কর্ণেল ফজলু আরও বিজ্ঞতার পরিচয় দিলেন। ডাক্তারের মন-মানসিকতা, উদ্দেশ্য ও সমাজের উপর বিচারের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নিরপেক্ষভাবে বিচার বিবেচনা করে, অপরাধীর আবেদনের প্রেক্ষিতে রায় ঘোষণা করলেন, ‘যাদের অর্থ আছে, তারা চিরকাল অন্যায় করে অর্থ দিয়ে পার পেয়ে যাবে এটা মুক্তিবাহিনী মেনে নিতে পারে না। অপরাধীর অপরাধ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত ও গুরুতর। তাই উভয় শাস্তি বলবৎ থাকলো। উপরন্তু সরকারী জরিমানার পরিমাণ হলো এক লক্ষ পঁচিশ হাজার এবং বাধ্যতামূলক চব্বিশ ঘা বেতের জায়াগায় ত্রিশ ঘা বেত মারা হবে এবং তা মারবেন অভিযোগকারীরাই। তারা যদি একটি বেত্রাঘাতও কম মারেন, তাহলে প্রতি বেত্রাঘাতের জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। তবে কোন অভিযোগকারীই এক বেতের কম মারতে পারবেন না।”
ডাক্তারের বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ এনেছেন, তাদের সংখ্যা ছয়। ডাক্তার বুঝে যায় যত অর্থই থাকুক, ছ’টি বেত তাকে খেতেই হবে। ডাক্তারও সহজ লোক নয়, রীতিমত ধুরন্ধর। সে তার বুদ্ধির খেলা শুরু করে দেয়, একটু চালাকির আশ্রয় নেয়। বেত্রাঘাত মওকুবের আবেদন বাতিল হয়ে যাওয়ায় রাতেই বেত মারার অনুরোধ জানায়। তার ধারণা, রাতের অন্ধকারে বেত্রাঘাত করলে তা খুব কম লোকেই দেখতে পাবে এবং এতে করে তার মান-সম্মান অল্পই নষ্ট হবে। ধুরন্ধর ডাক্তারের এই বজ্জাতি কর্ণেলের কাছে দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে যায়। ন্যায় বিচারের মৌলিক উদ্দেশ্য ও সমাজের সর্বত্র শান্তির শুভ প্রভাব নস্যাৎ করে দিতে অপরাধী ডাক্তার ভিতরে ভিতরে তৎপর। এটা বুঝতে পেরে কর্ণেল ফজলু তার সমস্ত সংযম হারিয়ে ফেলে বলেন, ‘বেটা ডাক্তার, তোর মত হারামজাদা নচ্ছার আমি কখনও দেখিনি। তুই আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাস্? আমার চোখে ধুলো দিতে চাস? তুই চালাকের বাবা এখনও দেখিস নাই।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২২

তোকে তো রাতে বেত মারা হবেই না, ঢোল পিটিয়ে লোক জড়ো করে তিন-চার জায়গায় নিয়ে, প্রকাশ্যে বেতমারা হবে। এমন কি, তোর চুল কামিয়ে, কোমরে দড়ি বেধে গলায় ছেঁড়ে জুতা ঝুলিয়ে, দিগম্বর সাজিয়ে সমগ্র এলাকায় ঘোরানো হবে।
পরদিন বেলা বারোটায় বিচারের রায় কার্যকরী করা হলো। ডাক্তারকে মোট বাইশখানা বেত খেতে হলো। বেত্রাঘাতের সময় ডাক্তার ছয়জন অভিযোগকারীর হাতে-পায়ে ধরে কান্না- কাটি করে, ভাই, বাবা, চাচা বলে কাকুতি মিনতি করে, কিন্তু লাভ হয়নি। চার জন আপোষহীন- ভাবে ইচ্ছামত পাঁচটি করে বেত্রাঘাত করেন। ব্যতিক্রম মাত্র দুজন। তাও খুব সম্ভবত: টাকার লোভে নয়। ডাক্তারের কান্নাকাটি, হাত-পায়ে ধরা ও বাপ-চাচা ডাকার কারণে চক্ষু লজ্জাতে অথবা দয়াপরবশ হয়ে দুজন আটটি বেত কম মারেন। এ হেতু ডাক্তার প্রত্যেককে কুড়ি হাজার টাকা দিলে, তারা প্রথম তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন, কিন্তু মুক্তিবাহিনী যখন দুজন অভিযোগকারীকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয় যে, বেত্রাঘাত না করার জন্য টাকা তাদের নিতেই হবে, টাকা গ্রহণ না করলে তারা ডাক্তারের মতই অপরাধী বলে গণ্য হবেন, তখন তারা টাকা গ্রহণ সম্মত হন। বেত্রাঘাত শেষে জরিমানার পুরো টাকা দিয়ে ধুরন্ধর নরপিশাচ সফল সামাজিক অভিনেতা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার মুক্তিলাভ করে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৩

স্লো সেভেনটিন
১৯৭১ সাল। ৮ই নভেম্বর। বিকেল চারটায় গোপালপুরে, কদ্দুসনগর, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ও সরিষাবাড়ীর মক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি সম্মেলনে বসলাম। অনেক আলাপ আলোচনার পর প্রত্যেক কমাণ্ডারকে অল্প সময়ের নোটিশে ব্যাপক আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেয়া হলো। এমনকি ছোট ছোট আক্রমণ পরিচালনার পরিবর্তে যখন সম্মিলিতভাবে ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করা হবে, তখন মুক্তিবাহিনীর পরিচালনা পদ্ধতি কি হবে, কোন কমাণ্ডার কতজন মুক্তিযোদ্ধা পরিচালনা করবে, কোন, কোন, কমাণ্ডার কোন, কোন, কমান্ডারের নেতৃত্বে অভিযানে অংশ নেবে এবং চূড়ান্তভাবে কার আদেশ মেনে এগিয়ে যেতে হবে, তা সবাইকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয়া হলো। এই সভায় মেজর আবদুল হাকিমকে গোপালপুর, কদ্দুসনগর, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ও সরিষাবাড়ীর মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত কমাণ্ডাররা হলো—গোপালপুরের আঙ্গুর ও আরজু, ধনবাড়ীর নুরুল ইসলাম, সরিষাবাড়ীর আনিস, রেজাউল করিম তরফদার, আবদুল মান্নান, মোজাম্মেল এবং ক্যাপ্টেন তারা।
কমান্ডারদের সাথে আলোচনা শেষে কর্নেল ফজলুকে নিয়ে পাবনার বেলকুচির সিংগুলি গ্রামে গেলাম। দুদিন আগে বেলকুচি, সিরাজগঞ্জ, ওয়াপদা বাঁধের উপর মক্তিবাহিনী ও হানাদারদের মধ্যে এক তুমুল লড়াই হয়। যা শেষে হানাদার বাহিনী পিছু হটে গেলেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরণ করে। সিংগুলির চরেই তার দাফন সম্পন্ন হয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাটির কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানানোই ছিল সেখানে যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য। দ্বিতীয়তঃ বিশেষ সাহসিকতা ও বিক্রমের সাথে যুদ্ধ করার জন্য ওখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করা। সিংগুলিতে চিরনিদ্রায় শায়িত শহীদ মক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের কবর জিয়ারত করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে উৎসাহিত করে তাদের সাথে সন্ধ্যার খাবার খেয়ে নৌকাপথে আবার দক্ষিণদিকে যাত্রা করলাম।
৯ই নভেম্বর। প্রত্যুষে মুক্তিবাহিনীর নৌকা কেদারপুর ঘাটে ভিড়লো। কেদারপুর থেকে লাউহাটি হয়ে বিকেলে কর্নেল ফজলু সহ তিন’শ জন মক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে নাগরপুর থানার ফতেপুর গ্রামে ঘাঁটি গাড়লাম। এখানে আমি একটানা দশদিন অবস্থান করি। ১৯৭১ সালে মক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আর কোথাও এক নাগাড়ে এতোদিন থাকিনি। মক্তিবাহিনী ফতেপুর আসার দিন তিনেক পরেও এলাকার সাধারণ মানষ জানতে পারেনি, কে বা কারা এসেছে। তাঁরা আগে শুধু কর্নেল ফজলুকে দেখেছেন। এবার ফতেপুর এসে কর্নেল ফজলু খুব নড়াচড়া করতে পারেননি। কারণ তখন তিনি অসুস্থ। ৮ই নভেম্বর তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বর নিয়ে সারাদিন কোন রকমে কাটালেও ৯ই নভেম্বর থেকে তার চলাফেরা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফতেপুর এসে তিনি মাঝে মধ্যে বেরিয়েছেন। তবে বেশী সময়টাই দলাই মলাইয়ে কেটেছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৪

তিনি শুধু জ্বরেই নন, বাতেও আক্রান্ত হয়েছেন। বাতের উপশমে নানারকম তেল নিয়মিত মালিশ করা হচ্ছে। সহকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ও দুজন ভাল ডাক্তারের চেষ্টায় তের-চৌদ্দ দিন পর কর্নেল ফজলু মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেন।

প্রস্তুতি
ফতেপুর আসার পর থেকে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করলাম। জুলাই মাসের শেষ থেকে বারবার ভাবছিলাম সম্ভব হলে একবার টাংগাইল দখল করার চেষ্টা করবো। ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আমার সেই ইচ্ছা যেমন প্রবলভাবে বেড়ে যায়, তেমনি সহকর্মীরাও বারবার বলতে থাকে, হানাদাররা বাংলার মান সম্ভ্রম নষ্ট করছে, ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিচ্ছে, মা-বোনদের উপর পাশবিক অত্যাচার করছে। আমাদের তো এখন যথেষ্ট শক্তি আছে। আমরা চেষ্টা করলে ওদের ঘাঁটি দখল করে নিতে পারি। এই ধরনের কথাবার্তা সহযোদ্ধারা দিনের পর দিন বলে চলছিলো। তাই আমিও টাংগাইলের দখল নিতে চাইছিলাম। এর জন্য চললো পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। কিন্তু বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় ছিল না। সব কিছুই স্বাভাবিক চলছিল। শুধু মাঝে মধ্যে নানা দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার, স্থানীয় জনসাধারণ ও বার্তা বাহকেরা আসছে আর যাচ্ছে।

কোম্পানী পুনর্বিন্যাস
১১ই নভেম্বর টাংগাইল মুক্তিবাহিনীতে আর একবার কোম্পানী পুনর্বিন্যাস করা হলো। ৯ ও ১০ই নভেম্বর নানা স্থান থেকে ডেকে আনা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নতুন পাঁচটি কোম্পানী গঠন করা হলো। এই পাঁচটি কোম্পানীর দায়িত্ব তুলে দেওয়া হল আমার নিজের দলের ছয় জন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধার উপর। আবদুস সবুর খান, সাইদুর রহমান, মকবুল হোসেন খোকা, ফেরদৌস আলম রঞ্জু, আবদুল হালিম ও তমছের আলী কোম্পানী কমাণ্ডার ও সহকারী কমাণ্ডার পদে উন্নীত হলো। এদের সাহস যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে চারটি কোম্পানীর দায়িত্ব দেয়া হলো। আমার দল থেকে সবুর, সাইদুর, খোকা, রঞ্জু, হালিম, মালেক ও তমছের বেরিয়ে গেল। দলভুক্ত হলো তামাইটের আব্দুল্লাহ, কামুটিয়ার বজলু, লতিফ (ওরফে ভোম্বল) ছানোয়ার, বারপাখিয়ার বাবলু, জাহাঙ্গীর, বর্নীর আজাহার, পাকুল্লার ফজলু, দাপনাজোরের আবদুল মান্নান, শাখাওয়াত হোসেন, ঝনঝনিয়ার বেনু ও গৌরাঙ্গীর সেই দুর্মুজ খাঁ এবং আরও কয়েকজন। এরা ছাড়া দুলাল, মকবুল, কুমাইরা বাড়ীর আমজাদ, আবুল কাশেম, পিন্টু, ত্রিশালের আবুল কালাম, কস্তুরী পাড়ার শামসুসহ আরও অনেকেই ছিল।
সবুর, সাইদুর, খোকা, রঞ্জু, হালিম, তমছের কোম্পানী কমাণ্ডার পদে উন্নীত হয়ে যার যার দায়িত্ব নিয়ে চলে গেলে আমার নিজের দলের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কিছুটা শূণ্যতা দেখা দেয়। খাওয়া-দাওয়া ঠিক মত হচ্ছে না। পাহারারও ঠিক নেই। লোকজন আসলে দেখাশোনা হচ্ছে না, তারা ঠিকভাবে সম্মান পাচ্ছে না। এমনি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার প্রেক্ষিতে ১২ই নভেম্বর দুপুরে আমার সহচর দলের সবাইকে ডেকে বললাম, ‘সবুর, সাইদুর, খোকা, রঞ্জু, হালিম, তমছের—
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৫

এরা চলে গেছে। এখন থেকে তোমাদেরই ওদের কাজ করতে হবে। আমাকে যদি তোমাদের সব কাজ দেখাশোনা করতে হয়, তাহলে বাইরের কাজে দৃষ্টি দেয়া অসুবিধা হবে। তোমাদের সকলের সহযোগিতা না পেলে দ্রুততালে কাজ এগিয়ে নেয়া যাবে না।’ আমার কথা শুনে সহযোদ্ধারা সমস্বরে বলে উঠে, ‘আপনি আমাদের একজনকে কমান্ডার ঠিক করে দিন।’ ‘না, আমি কাউকে কমাণ্ডার বানিয়ে দিলে হয়তো কাজ চলবে। তবে তোমরা নিজেরাই নিজেদের কমান্ডার ঠিক করে নাও। তোমাদের মনোনীত কমাণ্ডারকে পনের দিন সব কিছু দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দেয়া হবে। পনের দিন তাঁর কোন ভুলত্রুটি ধরা হবে না। কিন্তু পনের দিন পর প্রতিটি কাজের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে।
নির্দেশ মত সহযোদ্ধারা আলাদাভাবে বসে দীর্ঘ সময় কথাবার্তা ও আলাপ আলোচনা করে কমাণ্ডার নির্বাচন করে সন্ধ্যায় আবার তারা হাজির হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে যে আমাকে রিপোর্ট করতে এলো, সে জার কেউ নয়, আমাদের পূর্ব পরিচিত ও বহুল আলোচিত উপলদিয়ার ছোট ফজলু। ফজলুকে কমাণ্ডার হিসাবে দেখে প্রথম অবস্থায় কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। দলের প্রায় সব সদস্যই দেখতে শুনতে ও বয়সের দিক থেকে ফজলুর চাইতে বড়। ফজলু আমার দেহরক্ষী দলের নেতা নির্বাচিত হতে পারে, এটা কল্পনাও করতে পারিনি। বিস্ময়ভরা চোখে ফজলুকে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি ব্যাপার। তোকে ওরা নেতা নির্বাচন করলো? ফজলু, তুই কি পারবি?
— আমি ঘর থেকে যখন বেরিয়েছি, তখন কিছুই শিখে আসিনি। সবাই যখন আমাকে তাদের নেতা নির্বাচন করলো, তখনও জানতাম না যে আমি তাদের আস্থার যোগ্য। আপ্রাণ চেষ্টা করব। যদি দায়িত্বপালন করতে না পারি একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কাজ করার সুযোগ তো রইলই।
— তোকে ওরা নেতা নির্বাচন করেছে, সহযোদ্ধারা যে দায়িত্ব দিয়েছে, সে দায়িত্বের বোঝা কি তুই বুঝতে পারছিস? আজ থেকে তোর পরিশ্রম বহুগুণ বেড়ে গেল। ঠিক আছে, চেষ্টা কর। পনের দিন তোকে শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হবে। এরপর পুরো দায়িত্বটা তোর। না পারলে কঠিন জবাবদিহি।
কর্নেল ফজলুর রহমান পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। অসুস্থ শরীর। তবুও তিনি সন্ধ্যাবেলায় একবার এসেছেন। এর আগের দিনও এ সময় এসেছিলেন। তিনি আমাদের কথায় যোগ দিয়ে বললেন, ‘স্যার, সবাই মিলে ওকে যখন কমাণ্ডার বানিয়েছে তখন নিশ্চয়ই পারবে। আমার শরীর ভাল হলেই ওকে সব বুঝিয়ে দেব?’
আমার দেহরক্ষী দলের কমাণ্ডার ও সহকারী কমাণ্ডার নির্বাচিত হলো যথাক্রমে উপলদীয়ার ফজলুল হক ও বারপাখীয়ার বাবুল। যুদ্ধের শুরু থেকে ফতেপুরে কমাণ্ডার নির্বাচন পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় দেহরক্ষী দলে কোন নির্বাচিত কমাণ্ডার ছিল না। যুদ্ধের শুরু থেকে আপন আপন দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার বলে আবদুস সবুর খান, সাইদুর রহমান, খোকা, তমছের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৬

এসেছিলো। সবুর যখন থাকতো, তখন সে নিজেই আমার টুকিটাকি কাজকর্ম করতো। পাহারা, খাওয়া-দাওয়া ও খবরা-খবর আদান প্রদানের দায়িত্ব তার হাতেই ন্যস্ত থাকতো। শুধু তাই নয়, সবুর ছোটখাট নির্দেশও দিতো। সবুরের অবর্তমানে মকবুল হোসেন খোকা সবুরের স্থান দখল করতো অথবা সাইদুর রহমান সবুরের কাজ চালিয়ে নিতো। সত্যিকার অর্থে সহচর দলের দায়- দায়িত্ব সম্পর্কে আমাকে এক মুহূর্তও ভাবতে হয়নি।
ফতেপুরে অবস্থান করছি। নানা পরিকল্পনা চলছে। সদর দফতর থেকে বার বার নানা সংবাদ আসছে। তার উত্তর দিচ্ছি। কদ্দুসনগর আঞ্চলিক উপ দপ্তর থেকেও প্রতিদিন চার-পাঁচটি ‘মেসেজ’ আসছে। উপরন্তু প্রত্যেক কোম্পানী থেকে একজন করে দ্রুত সব সময় আসছে আর যাচ্ছে। যোগাযোগের সুবিধার জন্য ১৪ই নভেম্বর ফতেপুর থেকে চার মাইল দূরে ফাজিলহাটিতে ওয়ারলেস বসানো হলো। তিনটি ওয়ারলেস সেট, প্রথমটি সিভিল, দ্বিতীয়টি সামরিক ও তৃতীয়টি সাংকেতিক। তিনটি সেটই দিবারাত্র কাজ করে চলেছে। এতে সুবিধা হলো অনেক, খবর দ্রুত আদান প্রদান সম্ভব হলো। তবে অসুবিধা যে মোটেই হলো না, তাও নয়। বেতারে কোন বার্তা পাঠানোর অর্থই হলো, শত্রুকে কিছুটা সুযোগ করে দেওয়া। মুক্তিবাহিনী কোনক্রমেই শত্রুকে সে সুযোগ দিতে চায় না। তাই দূত মারফত আসল খবর পাঠিয়ে শত শত উল্টা-পাল্টা মিথ্যা শব্দ প্রয়োগ করে বেতার ‘মেসেজ’ পাঠানো শুরু হলো। এরপরও শত্রুরা কিছু কিছু সারবস্তু এ থেকেও উদ্ধারে সক্ষম হতো। জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ ‘মেসেজ’ সব সময় দূত মারফতই পাঠানো হতো। ষাট- সত্তর মাইল দূরে কোন খবর পাঠানোও তখন খুব একটা অসম্ভব কাজ বলে গণ্য হতো না। মুক্তিবাহিনীর দূতেরা রীলে সিস্টেমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খবর বহন করে নিয়ে যেত। এই বিশেষ দায়িত্ব পালনে স্বেচ্ছাসেবকরা সব চাইতে বেশী সক্রিয় ছিল। যুদ্ধের যময় আঁকাবাকা বিপদ সঙ্কুল পথে দূতেরা কম করে হলেও ঘন্টায় দশ-পনের মাইল পথ অতিক্রম করতে পারতো। কখনও দৌড়ে কখনও সাইকেলে আবার কখনও ঘোড়ায় চড়ে তারা খবর বহন করতো। কোন দূতকেই অবশ্য একটানা ছয়-সাত মাইলের বেশী পথ অতিক্রম করতে হতো না। ক্লান্ত হয়ে পড়ার আগেই একজন আরেকজন হাতে বার্তা পৌঁছে দিত। নতুন বার্তা বাহক নতুন উদ্যম ও উৎসাহে ছুটতো পরবর্তী সংবাদ বাহকের কাছে। এইভাবে মুক্তিযুদ্ধের সারাটা সময় আমাদের খবরাখবর আদান প্রদান হতো।
১৪ই নভেম্বর। সন্ধ্যাবেলায় পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলের কোম্পানী কমাণ্ডাররা ফতেপুরে একত্রিত হলো। তাদের সবাইকে জরুরী তলব করা হয়েছিল। উপস্থিত ত্রিশ জন কোম্পানী কমাণ্ডারের মধ্যে অসুস্থ কর্নেল ফজলু, জাহাজমারা কমাণ্ডার মেজর হাবিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন রবিউল আলম, ক্যাপ্টেন শাহ আলম, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ সুলতান, বজ্র কোম্পানী কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন বায়েজিদ আলম, সহকারী কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন শামসুল হক। ক্যাপ্টেন হুমায়ুন, কমাণ্ডার মঈনুদ্দিন, ভারত থেকে সদ্যাগত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ধনবাড়ীর আবদুর রাজ্জাক, সরিষাবাড়ীর ক্যাপ্টেন আবদুল মান্নান, ক্যাপ্টেন মোজাম্মেল হক, সিরাজগঞ্জের
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৭

ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী, মেজর মনিরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন লায়েক আলম, ক্যাপ্টেন সবুর, ক্যাপ্টেন রঞ্জু, ক্যাপ্টেন সাইদুর, ক্যাপ্টেন তমছের, ক্যাপ্টেন সোলেমান, আনন্দের নাম উল্লেখযোগ্য। কেউ জানে না, তাদেরকে কেন ডাকা হয়েছে। রোজার দিন, ইফতারের আগে কমাণ্ডারদের সঙ্গে বসতে বা কোন কিছু নিয়ে আলোচনা করতে চাইলাম না। ইফতার এবং খাওয়া– দাওয়ার শেষে কমাণ্ডারদের নিয়ে আলোচনায় বসলাম। উপস্থিত সব কমাণ্ডারদের কাছ থেকে রিপোর্ট নেয়া হলো।
তাদের বর্তমান অবস্থা কি? শক্তি-সামর্থ্য কি? শত্রুদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তাদের ধারনাই বা কি? এ সব বিষয়ের উপর দীর্ঘ আলোচনা হলো। তিন-চার মাইল দূরত্ব বজায় রেখে ঢাকা-টাংগাইল সড়ক বরাবর অবস্থান গ্রহণ ও রাস্তার নিখুঁত খোঁজখবর নিতে সকল কমাণ্ডারদের নির্দেশ দেয়া হলো। তাদের জানিয়ে দেয়া হলো, ‘কারও কাছে কোন ভারি জিনিসপত্র থাকতে পারবে না। তাদের জিনিসপত্র ও গোলা-বারুদ অন্যভাবে সরবরাহ করার ব্যবস্থা হবে। ঝটিকা আক্রমণের জন্যে তারা যেন সর্বদা অতিরিক্ত ভারমুক্ত থাকেন এবং প্রত্যেক কমাণ্ডার যেন সব সময় দশজনের একটি দল নিয়ে পরবর্তী নির্দেশের জন্য প্রস্তুত থাকে। কমাণ্ডারদের আরও নির্দেশ দেয়া হলো, ‘তোমাদের আবার ডাকা হলে এক ঘন্টার মধ্যে সবাইকে হাজির হতে হবে। তবে যারা দশ মাইলের বেশী দূরে অবস্থান করবে, তাদের বেলায় সামান্য সময়ের হেরফের করা যেতে পারে। সভা শেষে কমাণ্ডাররা যার যার ঘাঁটির দিকে ছুটলো। তারা তখনও পরিস্কার বুঝতে পারলো না পরবর্তী অভিযান কি এবং কোথায়।
১৫ই নভেম্বর। সকাল হতে না হতেই দেখা গেল, নানা দিক থেকে প্রায় আশি-নব্বই জন লোক ফতেপুরে এসে উপস্থিত। এদের পরিচয় কি, তারা কোথা থেকে এসেছেন, উদ্দেশ্যই বা কি, তা অনেকেই জানেন না। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা জানে আগন্তুকরা সবাই স্বেচ্ছাসেবক। স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডারদের মধ্যে কালিয়াকৈর, গোড়াই, মির্জাপুর, বরাটি, ইছাইল, বানাইল, বনি, দেলদুয়ার, পাথরাইল, নলসন্ধা, বাজিতপুর, ভাতকুরা, করটিয়া ও ময়থার কমাণ্ডাররা রয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা-টাংগাইল সড়কের পুবের হাবলা, টেংগুরিয়াপাড়া, মহেড়া, ডুবাইল ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবকদেরও ডাকা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার ও সহকারী কমাণ্ডারদের নিয়ে আলোচনা সভা শুরু হলো। এই সভায় হেড কোয়ার্টার থেকে খোরশেদ আলম, আর. ও. এসেছেন। আলোচনার মূল উদ্দেশ্য কোথায়, কোন্ ধরনের ও কি পরিমাণ রসদ আছে এবং তা কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সুষ্ঠুভাবে পৌঁছে দেয়া যায় সে সম্পর্কে জানা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ। স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডারগণ তাদের কাছে রাখা গোলা-বারুদ, বিস্ফোরকের নিখুঁত হিসাব পেশ করলো। তারা যে কোন স্থানে, যে কোন সময়, যে কোন পরিমাণ রসদ ত্বরিৎ পৌছাতে সক্ষম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতেও সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এটা প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার খুবই দৃঢ়তার সাথে জানালো। স্বেচ্ছাসেবকদের দৃঢ় আস্থা, অটুট মনোবল ও সীমাহীন আন্তরিকতার পরিচয় পেয়ে আমি খুবই অভিভূত হলাম। সরবরাহ ব্যবস্থা আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৮

কমান্ডারদের নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কমাণ্ড গঠন করা হলো। এ কেন্দ্রীয় কমাণ্ডে দশ জন স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডারকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো।
ঢাকা-টাংগাইল পাকা রাস্তার দশ মাইল থেকে কুড়ি মাইল উত্তর-দক্ষিণের এক বিশাল এলাকার মূল নেতৃত্ব অর্পিত হলো কেদারপুরের আবদুস সামাদ, লাউহাটি ইউনিয়নের কামাল খাঁ, এলাচীপুরের হজরত আলী ও দৌলতপুর ইউনিয়নের সবুরের উপর। দ্রুতগতি সম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধা লাউহাটির ফজলুকে দেয়া হলো যোগাযোগের দায়িত্ব। ঢাকা-টাংগাইল পাকা রাস্তা সংলগ্ন উত্তর দক্ষিণের এলাকা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পেলো ভাতকুড়ার মোহর খাঁ, বর্নি ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার দেলোয়ার, পাকুল্লার লতিফ ও সুলতান, শুভুল্লার আলী আকবর ও ইছাইলের শান্তিপদ রায়। টাংগাইলের কাছাকাছি এলাকার মূল দায়িত্বে রইলো মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী। এক সপ্তাহ আগে মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ঢাকা-টাংগাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়কের সেতুগুলির অবস্থা কি? কোন সেতুতে কত জন রাজাকার মিলিশিয়া আছে। তার তথ্য সংগ্রহ করতে। সে সময় বোরকা পরা কোন মহিলা সাথে থাকলে রাজাকাররা তেমন সন্দেহ করতো না। তাই সোহরাওয়ার্দী পাড় দীঘলীয়ার আবদুস সালামের বোন জয়নব বুজীকে সাথে নিয়ে ঢাকা সড়কের কালিয়াকৈর থেকে ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুর পর্যন্ত প্রত্যেকটি পুলের নিখুঁত মানচিত্রসহ কোন পুলে কটি বাংকার, গান পজিশন কোন দিকে এবং কোথায় কত জন রাজাকার মিলিশিয়া আছে তার একটি নির্ভুল রিপোর্ট আমাকে দিয়েছিল। যে রিপোর্ট সেতু দখল অভিযানে খুবই কাজে লেগেছিল। স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডারদের জানিয়ে দেয়া হলো, প্রতি ইউনিয়নে সব সময়ের জন্য অন্ততঃ পক্ষে দু’হাজার মুক্তিযোদ্ধার দুই বেলার খাবারের সংস্থান রাখতে হবে। প্রয়োজনবোধে তাদের থাকার ব্যবস্থাও করতে হবে। স্বেচ্ছাসেবকগণ সানন্দচিত্তে নির্দেশ নিয়ে নিজ নিজ এলাকার দিকে যাত্রা করলো।
স্বেচ্ছাসেবকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে পশ্চিম-উত্তর এলাকার অধিনায়ক মেজর আবদুল হাকিমের কাছে একটি জরুরী বার্তা পাঠানো হলো। বার্তার বিষয়বস্তু, ‘১৮ই নভেম্বর থেকে ১৯শে নভেম্বর, দু’দিনের মধ্যে টাংগাইল-ময়মনসিংহ পাকা রাস্তায় কালিহাতী থেকে টাংগাইলে হানাদারদের আসার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।’ ১৫ই নভেম্বর গভীর রাতেই দ্রুত মেজর আবদুল হাকিমের হাতে জরুরী বার্তাটি পৌঁছে দেয়। সাথে সাথে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলেও একটা জোর তৎপরতা শুরু হয়ে যায়।
১৬ই নভেম্বর। কয়েকজন আমার সাথে দেখা করতে এলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আমার মামা করটিয়ার ইদ্রিছ আলী। তিনি মা ও ভাই-বোনদের খবর নিয়ে ঢাকা থেকে এসেছেন। মা, ভাই ও বোনেরা ভাল আছে। ইদ্রিছ মামা মার একখানা পত্র আমাকে দিলেন। মা লিখেছেন, ‘বাবা বজ্র, আমাদের জন্য কোন চিন্তা করিস না। তোর কাজ তুই চালিয়ে যা। মাঝে মধ্যে খবর দিস।’ ছোট ভাই-বোনেরাও চিঠি ও ছবি পাঠিয়েছে। মামার সাথে কথা বলে খুব আনন্দিত হলাম। রমজান মাস। দিনে খাবার-দাবারের কোন ব্যাপার নেই। মা, ভাই-বোন, সারাহ খালা, খালাতো
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২৯

বোন মাসকিন, ছোট ভাই মন্নুর কুশলাদি জেনে হাত খরচ বাবদ দেড় হাজার টাকা মামার হাতে তুলে দিয়ে বিদায় জানালাম।
অন্য সাক্ষাৎপ্রার্থী করটিয়া কলেজের ছাত্র। আমার খালাতো ভাই, প্রিয় সহকর্মী বানিয়ারার ওয়াদুদের খবর নিয়ে আর এক বিশ্বস্ত সহকর্মী ঐ গ্রামেরই আঃ মোমেন এলো। ওয়াদুদকে কলেজে ভর্তির আগে কোনদিন দেখিনি। বানিয়ারায় আমার নানার বাড়ী এটা জানতাম, কিন্তু ওয়াদুদের সাথে পরিচিত হবার আগে কোনদিন বানিয়ারা যাইনি। ওর সাথে পরিচয়টাও হঠাৎ করেই হয়। আমি তিন বছর লেখাপড়ার ক্ষতি করে ৬৮তে করটিয়া কলেজে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি। তখন জোর ছাত্র আন্দোলন চলছে। বড় ভাই রাজবন্দী হিসাবে ময়মনসিংহের জেলে। লতিফ সিদ্দিকীর ভাই হিসাবে চট করে আমার উপর অনেকেই কিছু আশা করেছিলেন। কিন্তু তখন আমি একেবারেই আনাড়ি। কেউ দাঁত দেখতে পাবে ভয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাখতাম। এমন অবস্থায়ও কিছু কিছু শ্লোগান দেবার মোটামুটি সাহস সঞ্চয় করেছিলাম। একদিন এক ছাত্র মিছিল করটিয়া থেকে ছ’সাতটি বাসে টাংগাইল যাচ্ছিল। মিছিলে আমিও ছিলাম। আমাদের বাসের সামনের দিকে ছোটখাটো খুব সুন্দর একটি ছেলে, তার চাইতেও সুন্দর শ্লোগান দিচ্ছিল। ওয়াদুদকে আমি সেই প্রথম দেখি। ও পড়তো বিজ্ঞান বিভাগে, আমি কলা বিভাগে। আমরা দুজন একই বর্ষের ছাত্র হলেও ও আমার চেয়ে সম্ভবতঃ আট—’ন বৎসরের ছোট। আর আকারে অর্ধেকের একটু বেশী। মিছিল মিটিংয়ে ওর সাথে আস্তে আস্তে পরিচয় হলো। ওদের গ্রামে গেলাম। জানলাম ও আমাদের খালাতো ভাই। ওর মাধ্যমেই বানিয়ারা চিনলাম। অনেকেই আমাকে চিনলো। ওয়াদুদ শেষ পর্যন্ত শিষ্যে পরিণত হয়ে গেল। এই ধরনের ভাই এবং সহকর্মীর খবর শুনে কে না খুশী হয়? আমিও খুব খুশী হলাম। অনেক কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা করে মোমেনকে তার খরচের জন্যে কিছু টাকা এবং ওয়াদুদদের বাড়ীর জন্যে তিনশত টাকা এবং পরবর্তীতে ওদের এলাকায় গেলে তাদের বাবা-মার সাথে দেখা করবো প্রতিশ্রুতি দিয়ে আন্তরিকভাবে বিদায় জানালাম।

শিবিরে লাবিব- জাহাঙ্গীর হত্যাকারী
এরপর এলো দুজন। এরা অন্য কেউ নয়, পূর্ব আলোচিত খন্দকার আবদুল বাতেনের দলের দুই নেতা শাহাজাদা ও শাহজাহান। এদের বিরুদ্ধে লাবিবুর রহমান ও জাহাঙ্গীর হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। আগষ্ট মাসে, কর্নেল ফজলুর রহমান যখন লাউহাটি- কেদারপুরে ঘাঁটি গাড়েন, তখন তারা আরও দক্ষিণে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। ভারত থেকে ফিরে আসার পর ওদের ব্যাপারটি আমার কাছে কর্নেল ফজলুই প্রথম তুলে ধরেন। আমিও কর্নেল ফজলুকে এই মর্মে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, ওদের সাথে একবার সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিতে পারলে খুব খুশী হবো। আমার ইচ্ছে অনুযায়ী কর্নেল ফজলু নানা প্রচেষ্টা ও কৌশল করে অবশেষে শাহজাহান ও শাহজাদাকে আমার সামনে আনতে সক্ষম হলেন। তবে বন্দী করে নয়, কথা বলার জন্য। কথা বলার জন্যে আমন্ত্রিত হয়ে বাতেনের দলের দুই দুষ্ট নক্ষত্র আমার সাথে দেখা করতে আসছে, এ খবর শোনার পর সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ১৬ই নভেম্বর আমার
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩০

সাথে দেখা করতে আসার পথে কেদারপুরের কাছে এই দুজনকে ধনবাড়ীর আবদুর রাজ্জাক ও ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের দল আটক করে।কর্নেল ফজলুর পথ প্রদর্শকের অনুরোধে তারা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তবে তাঁরাও সাথে সাথে ফতেপুরে লোক পাঠিয়ে তাদের মনোভাব জানিয়ে দেয়। তাদের একমাত্র দাবী, কমাণ্ডার লাবিবুর রহমান ও জাহাঙ্গীরের হত্যাকারীকে হাতে পেয়ে তারা কিছুতেই ছেড়ে দেবে না, ছেড়ে দিতে পারে না। কিন্তু তারা যখন জানতে পারলো, আমি দুজনকে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছি, তখন মনে মনে সন্তুষ্ট না হলেও তাদের আর কিছু করার থাকলো না।
বাতেনের দুই সহচর শাহজাদা ও শাহজাহানকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আমার সামনে হাজির করা হলো। অত্যন্ত যত্ন সহকারে আমার সামনেই ওদের বসতে দেয়া হলো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাল করে দেখলাম। তারপর চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন? আমি আপনাদের শুধু দেখার ও দুচারটা কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলাম। আপনারা আমার আমন্ত্রণ রক্ষা করায় খুবই খুশী হয়েছি। আপনারা যেখান থেকে এসেছেন, ঠিক সেখানে নিরাপদে পৌঁছে দেয়া আমার পবিত্র দায়িত্ব। এখন আপনারা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে কিছু বলার থাকলে বলুন।’
আমার আশ্বাস পাওয়ার পরও ওরা কতটুকু আশ্বস্ত হতে পেরেছিল বলা কঠিন। কর্নেল ফজলুর লোকজনের যোগাযোগ ও পরামর্শের ফলেই শাহজাহান ও শাহজাদা আমার সাথে দেখা করতে রাজী হয়। কিন্তু কেদারপুরে যখন মুক্তিযোদ্ধারা ওদের চ্যালেঞ্জ করে এবং হত্যার অভিযোগে কিছুক্ষণ আটকে রাখে, তখন ওরা বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ফিরে যাবার বা পালাবার কোন পথ তখন ছিল না। কেদারপুর থেকে ফতেপুর এসে আমার কাছে আশ্বাস পাওয়ার আগে পর্যন্ত তারা দারুণ অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠায় ছিল। আমার কথা শুনে অস্বস্তি ও ভীতি পুরোপুরি না হলেও কিছুটা সম্ভবতঃ কেটে যায়।
লাবিবুর রহমান ও জাহাঙ্গীর শহীদ হয়েছে সেই জুন মাসে। তারপর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ঘটনার পর ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সুসংহত ও শক্তিশালী হয়েছি, বিশাল মুক্তিবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক দল গড়ে উঠেছে। নভেম্বর মাসে আমার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা সতের হাজার ও স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা সত্তর হাজার। এমনি একটি বিশাল বাহিনী যেহেতু আমি পরিচালনা করছি তাই আমি যে একেবারে বিবেকহীন হবো না, এরকম একটা অনুমান করে শাহজাহান ও শাহজাদা আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী হয়েছিল। তারা ঐ আশ্বাস পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও, খুব একটা যে অবিশ্বাস করেছিল তা নয়। আশা-নিরাশা ও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে তারা দোল খাচ্ছিল। আমার কথা শেষে সামান্য আশ্বস্ত হয়ে শাহজাহান ও শাহজাদা বললো, ‘ স্যার, আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। আমাদের বিরুদ্ধে কমাণ্ডার লাবিবুর রহমান ও জাহাঙ্গীরের হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমরা জুন-জুলাই মাস থেকে আপনার নেতৃত্বে কাজ করতে আগ্রহী
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩১

ছিলাম ৷ কিন্তু মাঝখানের এই ঘটনাটি আমাদের দুরে সরিয়ে রেখেছে। আমরা আপনার সাথে যোগ দিতে পারছি না। আমাদের বিপদ দেখুন, একদিকে হানাদার বাহিনী থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়, অন্যদিকে আগষ্ট মাসে ফজলু সাহেব যখন প্রথম এলেন, সেই তখন থেকেই আমরা নিজেদের এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমরা নিজেরাই চাইছিলাম, বাঁচা-মরা ত্যাগ করে একবার আপনার সাথে কথা বলি। তাই যখন ফজুল সাহেবের লোকেরা আপনার সাথে সাক্ষাতের পরামর্শ দিলেন এবং আপনিও দেখা করতে চান বলে জানালেন, তখন সাথে সাথে আমরা রাজী হয়ে গেছি। স্যার, দেখুন, আমরা সম্পূর্ণ নির্দোষ। আপনার এখন যা ইচ্ছা তাই করুন।’
– আপনারা আমাকে স্যার সম্বোধন করছেন কেন? কেন করছেন জানি না। আপনাদেরকে কি কেউ এই সম্বোধন করতে শিখিয়ে দিয়েছে। সমস্বরে তারা দুজন বলে উঠলো, ‘না না, আপনি আমাদের সকলের স্যার। শিখিয়ে দিতে হবে কেন? আমরা নিজেরা আন্তরিকভাবে আপনাকে স্যার বলে সম্বোধন করছি।
– আপনারা আমায় কি বলে সম্বোধন করলেন, সেটা মোটেই দেখবার বিষয় নয়। লাবিবুর রহমান ও জাহাঙ্গীরের মৃত্যুতে আমি খুবই ক্ষুদ্ধ ও মর্মাহত। তবে আজ আপনাদেরকে লাবিব- জাহাঙ্গীর হত্যার অভিযোগে এখানে আনা হয়নি। আপনাদেরকে দেখার আমার খুব ইচ্ছা ছিল। তাই আপনাদেরকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। আপনারা আমার আমন্ত্রিত অতিথি। যতক্ষণ এখানে আছেন, ততক্ষণ সেই মর্যাদা আপনারা পাবেন। জুন মাসে যে পরিস্থিতিতে লাবিব- জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয়েছে, সে পরিস্থিতি বিচার করে দেখতে হবে। আপনারা কি করবেন না করবেন, সে সিদ্ধান্ত এখান থেকে নিরাপদে চলে গিয়ে নিজেরাই নেবেন। এখানে লাবিব-জাহাঙ্গীর বা অন্য কোন ব্যাপারে আপনাদেরকে কোন সিদ্ধান্তে আসতে হবে না। এলাকা ছেড়ে দুরে গিয়ে থাকতে যত কষ্টই হোক, আমাদের নিয়ম-নীতির বাইরে কাউকে এলাকার মধ্যে থাকতে দেয়া হবে না। মনে রাখবেন, যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মত মুক্তিবাহিনীর নামে ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খল দল গজিয়ে উঠুক – এটা যেমন শুরুতেও চাইনি, এখনতো একেবারেই চাই না। তবে এজন্য আমরা স্বাধীনতার সমর্থক বাঙ্গালীদের রক্তে হাত রঞ্জিত করতে চাই না, করবোও না। যে কোন ভাবেই হোক, অমন পরিস্থিতি হলে তা এড়িয়ে যাবো। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, যার খুশী, যেখানে খুশী, আলাদা আলাদা ভাবে দল গঠন করবেন।’
ততদিন লাবিব-জাহাঙ্গীর হত্যা রহস্য দিবালোকের মত স্পষ্ট ও পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। আমরা জানতাম, শাহজাদা ও শাহজাহানই লাবিবুর রহমান ও জাহাঙ্গীরকে হত্যা করেছে। তবুও নিজেদের শিবিরে আমন্ত্রিতদের প্রতি কোন রুঢ় আচরণ করতে পারলাম না।
অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আমার নেতৃত্বে লক্ষাধিক স্বাধীনতাকামী মানুষ কাজ করছেন, অথচ তখন শাহজাদা ও শাহজাহানদের লোকসংখ্যা ছিল চল্লিশ কি পঞ্চাশ জন। ইচ্ছা করলে অথবা হুকুম দিলে ওদেরকে মূহুর্তের মধ্যেই আমার সহযোদ্ধারা নির্মূল করে দিতো। আমরা তা করিনি। এ ব্যাপারে স্বাধীনতার পর সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করলে আমি জোরের সাথে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩২

বলেছিলাম, বাতেন সাহেব যে ছোট একটি দল গঠন করেছিলেন, তার সকল যোদ্ধাই আমার বিরোধী ছিল না। স্বাধীনতার বিরোধী তো নই। তারা সবাই সরল প্রাণ, সহজ মানুষ। বাতেন সাহেবকে বিশ্বাস করে তার দলে ভিড়েছে। তাই আমরা শাহজাহান, শাহজাদা কিংবা অন্য কোন লোকের ষড়যন্ত্রমূলক কাজের জন্য অন্যদের উপর খড়গ হস্ত হতে পারিনি।
১৭ই নভেম্বর। বাংলাদেশ সময় বেলা দুটো। আকাশবাণী থেকে প্রথম খবর প্রচারিত হলো, ঢাকার সাথে টাংগাইলের সড়ক যোগাযোগ মুক্তিবাহিনী বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। গত রাতে এক তুমুল যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে ছ’শ পাক-সৈন্য নিহত ও বন্দী হয়েছে। টাংগাইল জেলা শহর এখন মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। খবর শুনে আমরা তো অবাক। কে এই খবর দিল? এটা যদি প্রোপাগাণ্ডা হয়, তা হলে সত্যিকারের আক্রমণ পরিচালনার যে প্রস্তুতি চলেছে, সেটা মাঠে মারা গেল। খবর শুনে আমি বেশ কিছুক্ষণ ছট্‌ফট্ করে পায়চারী করলাম। মনে মনে স্থির করেছিলাম, ১৮ই নভেম্বর ঢাকা-টাংগাইল সড়কের বেশ কয়েকটি সেতু উড়িয়ে দেবো। ১৭ই নভেম্বর দুপুরে আকাশবাণী এবং রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পুনঃ পুনঃ এই খবর প্রচারিত হওয়ায় আমাদের পরিকল্পনা কিছুটা রদবদল করতে হলো।

সেতু দখল পরিকল্পনা
১৭ই নভেম্বর সন্ধ্যায় আবার কমাণ্ডারদের ডেকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সকল দিক তাদের সামনে তুলে ধরলাম। অনেক বিচার-বিবেচনা করে ১৯শে নভেম্বর সন্ধ্যায় আক্রমণের সময় স্থির করা হলো। ১৯শে নভেম্বরের সন্ধ্যাবেলা অভিযানের সময় নির্ধারণের মূল উদ্দেশ্য ছিল। ঐদিন মাহে রমজানের শেষ। পরদিন ঈদ। স্বাভাবিক কারণেই, রোজার শেষে ঈদের আনন্দ উপভোগের জন্য পাঞ্জাবী সৈনিকেরা ছোটখাট ধ
ঘাঁটিতে থাকবে না। মুল ঘাঁটিতে ফিরে যাবে। বারবার খবর প্রচারে হানাদাররা সক্রিয় হলেও, এটা একটা হাওয়াই খবর অনুমান করে ১৯ শে নভেম্বর নাগাদ তাদের দৃষ্টি ও সতর্কতা অনেকটা শিথিল হয়ে আসবে।
দিনক্ষণ ঠিক হলো। কোন কোন লক্ষ্যে আঘাত হানা হবে, কমাণ্ডারদের তা বুঝিয়ে বললাম, ‘আমাদের মূল আক্রমণের লক্ষ্য শত্রু ঘাঁটি নয়, মূল লক্ষ্য ঢাকা-টাংগাইলের পাকা সড়কের বড় বড় সেতুগুলো। টাংগাইলের দিক থেকে ভাতকুড়া সেতু হলো এক নম্বর। আর ঢাকার দিক থেকে কালিয়াকৈরের মহিষবাথান সেতু এক নম্বর। টাংগাইলের দিক থেকে এক নম্বর ভাতকুড়া, দুই নম্বর করটিয়া, তিন নম্বর করতিপাড়া, চার নম্বর মটরা, পাঁচ নম্বর বাঐখোলা, ছয় নম্বর ইসলামপুর, সাত নম্বর জামুর্কী, আট নম্বর পাকুল্লা, নয় নম্বর শুভুল্লা, দশ নম্বর কুর্নি, এগারো নম্বর মির্জাপুর, বারো নম্বর দেওহাটা, তের নম্বর কোদালিয়া, চৌদ্দ নম্বর সূত্রাপুর, পনের নম্বর কালিয়াকৈর (এক), ষোল নম্বর কালিয়াকৈর (দুই), সতের নম্বর মহিষ বাখান সেতু।
কোন্ কোন্ পুল ভাঙা হবে তা ঠিক হয়ে গেলে কে কোন পুলে অভিযান চালাবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। অনেক আলাপ আলোচনা শেষে ঘুরে ফিরে সকলের একই কথা, ‘স্যার, আপনি বলুন, আমাদের কার কোন্ কোন্ পুলে আঘাত হানা ঠিক হবে। আমি সাতদিন
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৩

খেটে পরিকল্পনা তৈরী করেছিলাম। কাকে কোথায় মোতায়েন করা হবে। কাকে কোন্ সেতু ভাঙার দায়িত্ব দেওয়া হবে-এ সম্পর্কে মোটামুটি একটা খসড়া চূড়ান্ত করে রেখেছিলাম। সেটাই কমাণ্ডারদের সামনে উপস্থাপন করলাম :-
এক: আমি নিজে ভাতকুড়া পুলে অভিযান পরিচালনা করবো,
দুই: করটিয়া পপুল : ক্যাপ্টেন বায়েজিদ,
তিন: করাতিপাড়া-মটরা পুল : ক্যান্টিন সোলেমান, ক্যান্টন শামসুল হক
চার: বাঐখোলা ও ইসলামপুর : ক্যাপ্টেন গাজী লুৎফর রহমান,
পাঁচ : জামুর্কী ও পাকুল্লা : জাহাজমারা মেজর হাবুিবর রহমান,
ছয়: শুভুল্লা ও কুর্নি : বাদশা, ক্যাপ্টেন এন. এ. খান আজাদ, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন ও ক্যাপ্টেন নায়েক আলম।
সাত: মির্জাপুর পুল : ক্যাপ্টেন আজাদ কামাল,
আট: দেওহাটা : ক্যাপ্টেন রবিউল ও ক্যাপ্টেন রঞ্জু,
নয়: কোদালিয়া : ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর, ক্যাপ্টেন সাইদুর, ক্যাপ্টেন তমছের আলী,
দশ: সূত্রাপুর ও কালিয়াকৈর (১) : ক্যাপ্টেন সুলতান, ক্যাপ্টেন নাসির,
এগার: কালিয়াকৈর (২) ও মহিষ বাথান : মেজর আফসার কোম্পানীর সহকারী ক্যাপ্টেন আব্দুল হাকিম।

পরিকল্পনা পেশ করার সময় কমাণ্ডারদের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠলো। গুঞ্জন অবশ্য আর কিছু নিয়ে নয়, সকল কমান্ডারের মুখে একই কথা, ‘আমার আর সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া চলে না।’ মেজর হাবিবুর রহমান ও ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বললো, ‘আমাদের যে যে টার্গেট দেওয়া হয়েছে-তা যদি ধ্বংস করতে না পারি, তাহলে সি. ইন. সি. স্যারের নিজের যুদ্ধে যাওয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে। আমরা এখন এত দুর্বল নই যে, সব যুদ্ধেই স্যারকে অংশ নিতে হবে। মেজর হাবিব বললো, ‘আপনি যে প্ল্যান দিয়েছেন, সেই প্ল্যান মত আপনার টার্গেটটি অন্য কাউকে দিয়ে আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। আমরা যদি কোন সেতুতে অভিযান চালিয়ে বিফল হই, তা হলে যে শাস্তি দেবেন, তা আমার মাথা পেতে নেব।’ মেজর ও সমবেত কমাণ্ডাররাও একই অনুরোধ জানিয়ে বললো, ‘এখন আর আপনার যুদ্ধে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা চিহ্নিত সকল টার্গেটে সফল হবো।’ সবুর এই সময় বললো, “সি, ইন. সি. স্যার যদি নিজেই এখনও যুদ্ধ করতে যান, তাইলে আমি আর কমাণ্ডার হইলাম ক্যান? আমারে গুলি কইরা মাইরা ফেলাইলেও সি. ইন. সি. স্যারকে যুদ্ধে যাইতে দিমু না। কমাণ্ডার হিসাবে আমি পাইটে যামু না। আমারে আবার সিপাহী বানাইয়া দেইক। তখন দেখমু আমি যাইতে পারমু কি না?’
অভিযান পরিচালনার সকল ব্যবস্থা ঠিকঠাক হওয়ার পরেও প্রায় ঘন্টাখানেক নানা কথাবার্তা ও আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে আমার যুদ্ধে যাওয়ার প্রশ্নটির ফয়সালা হচ্ছিল না। অগত্যা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৪

কিছু সময়ের জন্য সভার কাজ মূলতবী রাখা হলো। আলোচনা মূলতবী হলে ব্যক্তিগতভাবে অনেক কমাণ্ডার অভিযানে অংশ না নিতে অনুরোধ জানালো। আমি ততক্ষণে বুঝে নিয়েছিলাম কোম্পানী কমাণ্ডারদের ইচ্ছা অনুযায়ী যুদ্ধে অংশ নেয়া একেবারে অসম্ভব। আমিও কোম্পানী কমাণ্ডারদের ঐ অনুরোধ, আপত্তি মেনে নিতে রাজী ছিলাম না। কারণ তাদের ঐ ধরণের আবদার একবার মেনে নিলে পরবর্তীতে একই ধরণের বহু অনুরোধ তারা করবে বা করার সুযোগ পাবে। আর যদি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আমি দূরে সরে থাকি, তাহলে কোন এক সময় আমারও হয়তো যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া সম্পর্কে মনের মধ্যে সংশয়-সন্দেহ কিংবা ভীতি জাগতে পারে। আমি খুব ভালো করেই জানতাম আমার প্রতি সহযোদ্ধাদের যে অটুট আস্থা, বিশ্বাস, আন্তরিক শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা-তা কেবল সততা, সাহস ও কর্মক্ষমতার কারণে, আমাকে দেখে নয় বা কথা শুনেও নয়। তাই যুদ্ধ সংক্রান্ত যে কোন কর্মকাণ্ড থেকে পিছিয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধাদের আস্থা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার চিড় ধরা মোটেই অস্বাভাবিক নয়, বরং খুবই স্বাভাবিক। অতীতে বহু সেনাপতি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেদের নিরাপদে সরিয়ে রেখে অথবা অহংকার ও গৌরব প্রকাশ করে সহযোদ্ধাদের আস্থা ও সমর্থন হারিয়েছেন এবং নিজেদের বিপর্যয় ও অধঃপতন ডেকে এনেছেন। আমি সেই মারাত্মক ভুলটি করতে কিছুতেই রাজী নই। অতএব যুদ্ধে আমাকে যেতেই হবে এবং সফলতাও অর্জন করতে হবে। অন্যাথায় নেতৃত্বের কোন যোগ্যতা আমার থাকবে না। বিশেষতঃ চলমান জটিল পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে হেডকোয়ার্টারে বসে নেতৃত্ব দেয়ার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।
এক ঘন্টা পরে আবার সভা শুরু হলো। দ্বিতীয়বার আলোচনার শুরুতে কমাণ্ডারগণ তাদের পূর্বের অভিমত জানালো, ‘পরিকল্পনা নিখুঁত হয়েছে। আমাদের শক্তি সামর্থ যা, তাতে আমরা প্রতিটি অভিযানে সফল হবো, এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহে। শুধু আপনি অভিযানে যাওয়া বাতিল করুন।’ কমাণ্ডাররা আরও বললো, ‘আমাদের মতামত ব্যক্ত করলাম, কিন্তু আপনি যে ধরনের নির্দেশ দেবেন, আমরা নির্দ্বিধায় তা মেনে নেবো।” বিরতির সময় আমি চিন্তাভাবনা করে স্থির করে ফেলেছিলাম যে, ভাতকুড়া সেতু অভিযানের সিদ্ধান্ত তখনকার মত বাতিল করে দেবো। এই সিদ্ধান্তের কথা সবাইকে অবহিত করার সাথে সাথে দু’একজন কমাণ্ডার আনন্দ প্রকাশ করে বললো, ‘স্যার, ঢাকা-টাংগাইল রাস্তা দখলের লক্ষ্যে ভাতকুড়া সেতুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমরা চাইছিলাম ঐ পুল অভিযানের দায়িত্ব অন্য কাউকে দিন।’ ‘না, ভাইয়েরা, আমি অনেক ভেবেচিন্তে দেখেছি, ভাতকুড়া সেতুটি না উড়ালেও চলবে। করটিয়া সেতুতে যারা আক্রমণ চালাবে, তারা যদি সেটা ভালভাবে ধ্বংস করতে পারে, তা হলে করটিয়ার দক্ষিণের সমগ্র এলাকাটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। ভাতকুড়ার চেয়ে করটিয়ার সেতুটির দখল নেয়া সুবিধাজনক। তা ছাড়া সেতুটি ভাতকুড়ার চেয়ে অনেক বড়। তাই এটাকে টাংগাইলের দিক থেকে পরিচালিত আক্রমণের পয়লা নম্বর সেতুরূপে চিহ্নিত করা হলো।’ কয়টি সেতুতে আক্রমণ চালাতে হবে, কে কোন্ সেতুতে আঘাত হানবে, কিভাবে তারা সরবরাহ পাবে, অভিযান পরিচালনার সব
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৫

যখন ঠিক, তখন আর অতিরিক্ত আলোচনা করে সময় নষ্ট করার কোন হেতু নাই। ১৭ই নভেম্বর রাত সাড়ে দশটা কি এগারোটায় কমাণ্ডাররা নতুন অভিযানের ছবি ও ফলাফল কল্পনা করতে করতে যার যার ঘাঁটির দিকে রওনা হলো।
সেতুসমূহে বজ্রাঘাত হানতে দারুন তোড়জোড় চলছে। সর্বত্রই সাজ সাজ ভাব। যদিও পরিকল্পনা ও তা বাস্তবে রূপায়িত করতে যাওয়ার খবর সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা তখনও জানে না। তবু তারা তাদের অতীত অভিজ্ঞতায় এটা ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পারছে যে, অতি অল্প সময়ের মধ্যে কোনও বড় রকমের অভিযান হতে চলেছে। তাদের আন্দাজ-অনুমানের অবশ্য আরও কারণ ছিল। ১৪ই নভেম্বর মাত্র তিন দিনের ব্যবধান দু’বার কমাণ্ডারদের ডেকে পাঠানো এবং তাদের সাথে দীর্ঘ সময় আলোচনা করা, এটা খুবই বিরল ঘটনা। তাই সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা নতুন ও ব্যাপক এক অভিযানের জন্য মনে প্রাণে প্রস্তুত হচ্ছিল।
১৭ নভেম্বর দুপুরে বেতারে খবর প্রচারিত হবার পর হানাদার বাহিনী ঢাকা-টাণ্ডগাইল ও টাংগাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়কের উপর তাদের সতর্ক দৃষ্টি এবং পাহারা বাড়িয়ে দেয়। এমনিতেই সেতুগুলিতে কঠোর পাহারার ব্যবস্থা ছিল। ঢাকা-টাংগাইল যে কোন পাকা সেতুতে পঞ্চাশ থেকে একশ জন হানাদার সর্বদা পাহারা দিত। এরপরও দু’কোম্পানীর একটি টহলদারী দল রাস্তার সর্বত্র টহল দিয়ে ফিরছিল। ১৭ই নভেম্বর থেকে ১৯শে নভেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত দু’কোম্পানী পাক হানাদার প্রায় পনেরটি সামরিক গাড়ীতে একবার ঢাকার দিক থেকে টাংগাইল, আবার টাংগাইলের দিক থেকে ঢাকা—দু’দিকে যাওয়া আসা করে রাস্তার উপর কড়া নজর রেখে চলছিল। টাংগাইল-ময়মনসিংহ রাস্তায়ও অনুরূপ কড়া পাহারা চলছিল। ১৮ই নভেম্বর রাস্তার পাশে যেয়ে এই ধরনের পাহারা ও রাস্তার উপর পনের কুড়িখানা হানাদারদের গাড়ীর নিয়মিত ও ঘন ঘন আনাগোনা (একবার একদিকে চলে যাওয়া গাড়ীরগুলোর আবার ফিরে আসার মধ্যে ব্যবধান মাত্র এক ঘন্টা) দেখে কমাণ্ডাররা কিছুটা বিচলিত হয়ে পরে। প্রায় সব কমাণ্ডার আমার কাছে বার্তা পাঠালো, রাস্তায় কঠোর পাহারার মাঝখানের ঐ টহলহীন এক ঘন্টার মধ্যে সেতু দখল ও ধ্বংস করা না গেলে, হানাদারদের সাথে যুদ্ধ করে সেতু দখল ও বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব নাও হতে পারে। লড়াই করে অবশ্যই সেতু দখল করা সম্ভব, তবে অত তাড়াহুড়ার মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বাঞ্ছিত ফলাফল কতটা পাওয়া যাবে, তা বলা যায় না। এই অবস্থায় তাদের কর্তব্য কি তা তারা জানতে চায়।
দক্ষিণ দিকের পুল উড়িয়ে দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর, ক্যাপ্টেন তমছের আলী, ক্যাপ্টেন সাইদুর রহমান ছাড়া আর সব কমাণ্ডারের কাছ থেকে একই বার্তা এসেছিল। আমিও তাদের কাছে একই ধরণের বার্তা পাঠালাম, ‘তোমরা পরিকল্পনা মত কাজ কর, আগামীকাল দুপুরে তোমাদের সর্বশেষ নির্দেশ পাঠাচ্ছি। আক্রমণ প্রস্তুতি অব্যাহত রাখ। আস্তে আস্তে সময় কেটে গেল। এলো বহু আকাঙ্ক্ষিত ১৯শে নভেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ১৯শে নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ২০শে নভেম্বর দুপুর ঢাকা-টাংগাইল
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৬

রাস্তার ত্রিশ মাইল মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়ে সতেরটি সেতু বিস্ফোরকের আঘাতে উড়িয়ে দিতে সক্ষম হলো। এই ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় ঘটনাটি কিভাবে ঘটেছিল সেটাই এখন বলছি।
১৯শে নভেম্বর দুপুর পেরোতে না পেরোতেই প্রত্যেক কোম্পানীর কাছে একজন করে দূত গিয়ে হাজির হলো। সবার কাছে একই আদেশ। ব্যতিক্রম শুধু সবুর, তমছের ও সাইদুরের। সকলের কাছে পাঠানো নির্দেশ, ‘তোমরা সেতু দখল করবে। রাস্তার উপরে টহলদারী সৈন্য ঠেকানো তোমাদের কাজ নয়। তাদেরকে অন্যভাবে ঠেকানো হবে। আজ সন্ধ্যায় আজানের পর ইফতারের শেষে হানাদাররা যখনই উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢাকার দিকে যাবে, তখনই তোমরা পুলে আঘাত হানবে। প্রথম আঘাত হানবে ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর। দক্ষিণ দিক থেকে সবুরের সংকেতের পরই উত্তরে এক এক করে অপারেশন শুরু করবে। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন সবুর, ক্যাপ্টেন সাইদুর ও ক্যাপ্টেন তমছেরকে নির্দেশ দেয়া হলো, ‘তোমরা কোদালিয়া, সূত্রাপুর, কালিয়াকৈর, মহিষ বাথানের পুলতো ধ্বংস করবেই, উপরন্তু ঢাকার দিক থেকে হানাদার বাহিনী যাতে কোনক্রমেই সারারাতে টাংগাইলের দিকে আসতে না পারে—সেই ব্যবস্থা তোমাদের করতেই হবে। ইফতারের পর, হানাদার টহলদারী দল মহিষ বাথান পুল পেরিয়ে ঢাকার দিকে চলে যাবার পরই যেন আঘাত হানা হয়। আমি তোমাদের সফলতা কামনা করছি।’

ফজলুর বিচক্ষণতা
১৯শে নভেম্বর সকালে ফতেপুর ত্যাগ করে ফাজিলহাটিতে এলাম। ফাজিলহাটি থেকে একশ জনের খাবার ও ইফতারী তৈরী রাখতে দেলদুয়ারের স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশ পাঠালাম। কারা ইফতার করবে, খাবার খাবে-তার কোন ইঙ্গিত দেয়া হলোনা। ফাজিলহাটিতে আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা কাটালাম। ফাজিলহাটিতে যে বেতার স্টেশন বসানো হয়েছিল তা গুটিয়ে ফেলা হলো। দেখেশুনে বেছে বেছে তিনজন সুদক্ষ বেতার অপারেটরকে দলে নিলাম। আমার দেহরক্ষী দলের নেতৃত্ব করছিল ছোট ফজলু। এই ক’দিনে সে ধাতস্থ হয়ে গেছে। দায়িত্ব পাবার পর তার বুদ্ধি বিবেচনা, দায়িত্ববোধ ও কর্মকাণ্ডের সে কি উন্নতি যা ছিল অনেকের কল্পনার অতীত। লক্ষ্যনীয় বিষয় যে, সবুর, সাইদুর ও তমছেরের মত চৌকষ সহ যোদ্ধা থাকা সত্ত্বেও দেহরক্ষী দলের কাজকর্মে কখনো-সখনো যে সামান্য ভুলত্রুটি দেখা দিত, ফজলু দায়িত্ব নেয়ার পর সে সকল ত্রুটি বিচ্যুতিও কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। আমি কি খাবো, আমার সাথে কে কে দেখা করতে এসেছেন, পরের দিন কে কে দেখা করতে পারেন, কোথায় যাবো, সেখানকার রাস্তাঘাট ও পরিবেশ-পরিস্থিতি কেমন ইত্যাদি খবরাখবর সে আগেই সফলতার সাথে সংগ্রহ করতে সক্ষম হতো। বিশেষতঃ বাতেন দলের শাহজাহান ও শাহজাদা যখন আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে, তখন সে যে কঠোর ও সময়োচিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিল তা রীতিমত প্রশংসনীয়। কোন সাক্ষাৎ প্রার্থীর দেহ তল্লাসী করা হোক এটা আমি চাইতাম না। আবার চোখে ধুলো দিয়ে অস্ত্রসহ কোনও আগন্তুক আমার সামনে উপস্থিত হউন—তাও নিরাপত্তার খাতিরে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। দেহরক্ষী দলের কমাণ্ডার হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্তির তিন- চার দিন পর জনৈক আগন্তুকের দেহ তল্লাশীর নির্দেশ দিয়ে ফজলু বেশ বিপদে পড়েছিল। তল্লাশীর
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৭

কথা শুনে আমি তাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলাম, ‘যারা আমার সাথে দেখা করতে বা কথা বলতে আসেন, তাদের সাথে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করতে হবে। কেউ অস্ত্র নিয়ে আসুক তা আমি চাই না। এর অর্থ এই নয় যে, কারও দেহ তল্লাশী করতে হবে। মুক্তিবাহিনীর চোখ একটু তীক্ষ্ণ হওয়ার দরকার। দুখ দেখে যে কোন লোক সম্পর্কে ভালোমন্দের আঁচ পাওয়া দরকার। অস্ত্র নেই, অথচ তাকে তল্লাসী করা হলো, এটাও যেমন আমি সহজভাবে নেব না, আবার তোমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কেউ আমার সামনে অস্ত্র নিয়ে হাজির হলো, সেটাও ভালোভাবে নেব না। এই দুঃসাধ্য কাজটা অত্যস্ত যত্ন সহকারে করতে হবে। কাউকে লক্ষ্য করার সময় তিনি যেন বুঝতে না পারেন যে, তাকে নজরে রাখা হয়েছে।’
কঠোর শাসানি ও উপদেশের পর ফজলুর মাধ্যমে শাহাজান ও শাহজাদা আমার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছিল। এ ব্যাপারে কমাণ্ডার ফজলু তার দূরদর্শিতা ও দক্ষতার ছাপ রাখতে সক্ষম হয়। কেদারপুর থেকে ফতেপুর পুরো রাস্তাতেই তার লোক রেখে দীর্ঘ সময় ধরে আগন্তুকদের নানাভাবে লক্ষ্য করে। এমনকি দু’তিন জায়গায় শাহজাহান ও শাহাজাদাকে ফুলের মালা ও তোড়া দিয়ে অভিনন্দিত করে নিবিরভাবে আলিঙ্গন করে। আগন্তুকদের কাছে অস্ত্র লুকানো আছে কিনা আলিঙ্গনের সময় তা তারা মোটামুটি আন্দাজ করে নেয়। শিবিরের সামনে কমাণ্ডার ফজলু আরও দশ-বারো জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গভীর উৎসাহ দেখিয়ে আগন্তুকদের সাথে একের পর এক আলিঙ্গন করে তাদের কাছে কোন অস্ত্র নেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যায়।
ইফতারের একটু আগে কমাণ্ডার খোকার কোম্পানীসহ দেলদুয়ারে হাজির হলাম। দুদলের সদস্য সংখ্যা মোট একশ পঁচিশ জন। নির্দেশ মত দেলদুয়ারের স্বেচ্ছাসেবকরা জমিদার গজনবী সাহেবের বাড়ীর পূর্বপাশে খোলা মাঠে মুক্তিবাহিনীর ইফতারের ব্যবস্থা করেছে। স্কুলের সামনে কয়েকটি আম গাছের নীচে আমরা ইফতার করে আধ ঘন্টার মধ্যেই পেট ভরে খেয়ে নিলাম। রোজা শেষ। রোজা রাখার জন্য আর শেষ রাতে সেহরী খেতে হবে না, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ‘ইফতারীরও’ প্রয়োজন হবে না। একমাস রোজা রাখার পর যে কোন রোজাদারের কাছে শেষ ইফতার এক পবিত্র অনুভূতি, পরদিনই তো বহু আকাঙ্খিত পবিত্র ঈদ।
যুদ্ধের সময় প্রতিটি মুসলিম মুক্তিযোদ্ধা পুরো মাস রোজা রেখেছে। আমিও বাদ পড়িনি। পনের-ষোল বছর বয়স থেকে রোজা রেখে আসছি। প্রতিবারই রমজান মাসের শেষ দিন খুশীর ঈদের মধুর আনন্দ উপভোগ করেছি। এবার কিন্তু সেরকম খুশীর কোন অনুভূতি নেই। আনন্দের কোন প্রকাশ নেই। শেষ রোজার ইফতারী করতে যেয়ে আমার চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। আমার মত হয়ত আরও শত শত রোজাদার মুক্তিযোদ্ধার চক্ষু এমনিভাবে অশ্রুতে ভরে উঠেছিল। কত লাখো লাখো ছিন্নমূল, শত্রু কবলিত ও উদ্বাস্তু মুসলমান ৭১-এর খুশীর ঈদের মধুর স্বাদ থেকে বঞ্চিত রইলেন। আমার মনে হাজারো প্রশ্ন তোলপাড় করছে, হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধারা কি ভাবছে? কে কোন অবস্থায় রয়েছে? মা কোথায়? বাবা কোথায়? ভাই-বোনেরা কোথায়? পরবর্তী দিনগুলোতে কি ঘটতে যাচ্ছে? হাজারো ভাবনা, হাজারো জিজ্ঞাসা বুকে নিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৮

ইফতার ও আধা ঘন্টা পরে রাতের খাবার শেষে সেতু অভিযানে বেরিয়ে পড়লাম। ১৭ নভেম্বর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে, সেতু দখল অভিযানে আমি অংশ নেব না। কিন্তু ঐ সিদ্ধান্ত শুধু সহকর্মীদের খুশী করার জন্যই নিয়েছিলাম।

ভাতকুড়া সেতু অভিযান
ভাতকুড়া সেতু অভিযান। দেলদুয়ার থেকে সোজা দক্ষিণে পাথরাইল-চণ্ডী। চণ্ডী থেকে কুমুল্লীর মাঝ দিয়ে দেড়শ জনের একটি দল নিয়ে ভাতকুড়া ও কুমুল্লির মাঝামাঝি একটি নিরাপদ এবং সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করলাম। এখান থেকে দলটিকে তিনটি ছোট দলে বিভক্ত করা হলো। ক্যাপ্টেন মকবুল হোসেন খোকার নেতৃত্বে প্রথম দল ভাতকুড়া সেতু দখল করবে। ক্যাপ্টেন ফজলুর নেতৃত্বে ত্রিশ জনের দ্বিতীয় দল ভাতকুড়া সেতুর দেড়-দু মাইল উত্তরে টাংগাইলের দিকে সড়ক আগলে থাকবে। পনের জনের তৃতীয় ও সর্বশেষ দলটি কোপাখির বাবুলের নেতৃত্বে ভাতকুড়ার মাইল খানেক দক্ষিণে ক্ষুদিরামপুর রাস্তার উপর অবরোধ সৃষ্টি করবে। উভয় দলের দায়িত্ব সেতু ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা আগলে রেখে কোনো দিক থেকে যাতে সেতুতে সাহায্য আসতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। এছাড়া আরও প্রায় চল্লিশ জন সহযোদ্ধা নিয়ে আমি মর্টার প্লাটুনের দায়িত্ব নিলাম। নির্ভুল নিশানায় গোলাবর্ষণে অব্যর্থ সামাদ গামাও আমার সহযোগী।
ভাতকুড়া লৌহজং নদীর পাড়ে কর্ণেল জিয়ার কাছ থেকে নেয়া সেই চায়নীজ ৩ ইঞ্চি মর্টারটি বসানো হলো। এই মর্টার ব্যবহারের বিশেষ সুবিধা এই যে, এটা দিয়ে এক মাইল থেকে তিন-চার মাইলের মধ্যে লক্ষ্যবস্তুর উপর নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে আঘাত হানা যায়। কিন্তু ব্রিটিশ ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে এক মাইলের মধ্যে গোলা নিক্ষেপ খুবই বিপজ্জনক। অথচ আমরা চাচ্ছিলাম মর্টারটি ভাতকুড়া সেতুর কাছাকাছি কোথাও বসাতে, যাতে লক্ষ্যবস্তু দেখে দেখে সঠিক নিশানায় গোলা নিক্ষেপ করা যায়।

মোহর খাঁর কেরামতি
ব্রিটিশ ও চাইনীজ ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলা নিক্ষেপে সামাদ গামা ইতিমধ্যেই খুব পারদর্শী হয়ে উঠেছে। আমার ২ ইঞ্চি মর্টারের নিশানা ছিল অব্যর্থ। ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলা নিক্ষেপের আরও কিছু বাড়তি সুবিধা থাকায় আমার ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলা ছুঁড়তে আরও সুবিধা হতো। দলের সাথে মর্টার আছে আর আমি মর্টার থেকে গোলা ছুঁড়েছি বা কিভাবে ছুঁড়তে হবে-তা মর্টার প্লাটুনকে বুঝিয়ে দিয়েছি, এমনি অবস্থায় কোন অভিযান ব্যর্থ হয়েছে বা শত্রু ঘাঁটির পতন ঘটেনি, এমনটা কোন অভিযানেই হয়নি। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ছিল হিমালয়ের মতো উঁচু। পুল থেকে ১ মাইল দূরে মর্টার বসানোর কাজ শেষ হলে সামাদ গামাকে মর্টারের কাছে থাকতে নির্দেশ দিয়ে ভাতকুড়া গোরস্থানের পূবে পাকা রাস্তায় উঠে সরজমিনে দেখে ফিরে এসে গোলা ছুঁড়বো অথবা সামাদকে গোলা ছুঁড়তে নির্দেশ দেবো। দুলাল, শামসুল হক, আবদুল লতিফ, শামসু, ভোম্বল, ছানোয়ার, দুর্মুজ খান, আজাহার, বেনু মীর্জা, আবদুল্লাহ, আব্দুল মান্নান, পিন্টু ও মাসুদসহ
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩৯

কুড়ি জনকে নিয়ে আস্তে আস্তে লৌহজং নদী অতিক্রম করে ভাতকুড়া গোরস্থানের পশ্চিম পাশে গেলাম। ঢাকা-টাংগাইল পাকা রাস্তার দিকে কিছু দূর এগিয়ে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ভাল করে দেখেশুনে রাস্তা নিরাপদ বলে জানালে সড়কের উপর যাবার জন্য এগুতে শুরু করেছি, এমনি সময় ঘটলো এক চমকপ্রদ এবং অচিন্তনীয় ঘটনা। ভাতকুড়া পাকা রাস্তার মাত্র কুড়ি-পঁচিশ গজ পশ্চিমে গোরস্থানের কাছে এসেছি, এমনি সময় ভাতকুড়ার স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার দু’তিনজন মুক্তিযোদ্ধাসহ উত্তেজিতভাবে আমার সামনে এসে হাজির। তার হাপাতে হাপাতে বললো, ‘স্যার কাজ হইয়া গেছে। পুল দখল হইয়া গেছে। রাজাকাররা সারেন্ডার করছে।’ কাজ হয়ে গেছে, পুল দখল হয়ে গেছে, রাজাকাররা সারেন্ডার করেছে, কথাগুলো একত্রে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললেন। স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার মোহর খাঁকে কাছে টেনে নিচু গলায় বললাম, ‘একটাও গুলি হলো না অথচ এত সব হয়ে গেল কি করে? যে দলের সেতুতে আঘাত হানার কথা, তারা তো ঐ দোকান ঘরের কাছে। কি করে পুল দখল হলো?’ এর জবাবে মোহর খাঁ দুঃসাধ্য সাধনের ঘটনা বললেন, ‘স্যার, সোহরাওয়ার্দী ভাই একদিন আগে আমাদের এই পুলের সমস্ত খোঁজ খবর নিতে বলেছিলেন। আমি তো সব সময়ই করটিয়া, ভাতকুড়া, নগরজলপাই, আশিকপুর এই সমস্ত জায়গার খোঁজখবর এমনিতেই রাখতাম। ভাতকুড়া পুলে রাজাকারদের একটি নতুন দল আইছে। আসার ঠিক পরেই তাদের দুইজনের আমার সাথে যোগাযোগ হয়। এদের বেশীরভাগ গোপালপুর, কদ্দুসনগরের লোক। আমার সাথে একটু পরিচিত হওয়ার পরই তারা আমার কাছে জানতে চায় কিভাবে এখান থেকে পালাইয়া গিয়া মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করতে পারবে। আমি তাদের তিন-চার দিন ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে বলি। এই পুলে খারাপ প্রকৃতির পাকিস্তান সমর্থক রাজাকার ছিল মাত্র একজন। সে ঈদ করার জন্য দুপুরে বাড়ী চইল্যা গেছে।’ মোহর খাঁ আরও জানালেন, ‘অভিযান যে আসন্ন তাতো আমাগো যেদিন ডাকা হইছিল, সেই দিনই বুঝতে পারছিলাম। তবে আজ হবে সেটা জানতাম না। কিছু জরুরী খবর পৌছাইয়া দিতে আজ বিকালে দেলদুয়ার গেছিলাম। তখন জানলাম, আজ পুল দখল হইব। আমি আইস্যাই এদের সাথে যোগাযোগ করছি। তারা সারেণ্ডার করতে প্রস্তুত। শুধু প্রস্তুত নয় স্যার, তারা পুল ছাইড়া দিয়া পুব পাড়ে ঐ বাড়ীগুলোতে বইস্যা রইছে। এখন বলেন স্যার, রাজাকারদের কোথায় নিয়া যামু?’
মোহর খাঁর একটানা প্রায় মিনিট খানেক শ্বাসরুদ্ধকর কথা শুনে বললাম, ‘ঠিক আছে, আপনি প্রথমে রাজাকারদের রাইফেলের ম্যাগাজিন বোল্ট খুলে নিয়ে আসুন।’ বলা শেষ হতে না হতেই মোহর খাঁ ছুটলো রাজাকার লুকিয়ে থাকা বাড়ীর দিকে। আর সড়কে উঠা হলো না। একশ’ গজ পশ্চিমে, নদীর ধারে অপেক্ষা করতে থাকলাম। পিন্টুসহ আরেকজনকে মর্টার সেকশনের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। দ্বিতীয় বার নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সামাদ গামা যেন মর্টার ব্যবহার না করে। মোহর খাঁ যেন মোহর খাঁ নয়, ‘হাওয়া খাঁ’। চার-পাঁচ মিনিটও লাগেনি। যেমনি মোহর খাঁ ছুটে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি হাওয়ার বেগে ফিরে এলেন। তাঁর সাথে মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া আরও
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪০

তিনজন। এরা কারা? অন্য কেউ নয়, আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক রাজাকারদেরই তিন জন। উৎসাহী মোহর বা আমার অনুমতির অপেক্ষা করতে পারেনি। সতের জন রাজাকারের মধ্যে তিনজনকে তিনি সাথে নিয়ে এসেছেন। এ যেন হুকুম দেয়ার আগেই হুকুম তামিল। তাঁর হাতে একখানা গামছায় বাধা ষোলটি ম্যাগাজিন ও ষোল খানা বোল্ট। দুজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে অতিরিক্ত দুটা স্টেনগান, এ সবই রাজাকারদের অস্ত্র। মোহর খাঁর কাণ্ড দেখে আমি তো অবাক। রাজাকারদের সাথে তার যে একটা ভাল যোগাযোগ ও সম্পর্ক রয়েছে এ সব থেকেই তা আন্দাজ করা গেল। আবার পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাসহ মোহর খাঁকে অবশিষ্ট রাজাকারদের আনতে পাঠালাম। এ রকম ঘটনা ঘটছিল, তখন সেতু-অভিযান পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মকবুল হোসেন খোকা সর্বশেষ নির্দেশ নিতে আমার কাছে এলো। তাকে বললাম, ‘তুমি পুলে গিয়ে উঠ। পুল সম্পূর্ণ মুক্ত। দুজন দূত টাংগাইলের দিকে রাস্তা আগলে থাকা ক্যাপ্টেন ফজলুর কাছে পাঠিয়ে দাও।
নির্দেশ পেয়ে খোকা চলে গেল। আমাদের থেকে প্রায় তিনশ গজ উত্তরে দোকান ঘরের পাশে গাছের আড়ালে অপেক্ষমান দলের সবাইকে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে পুলে উঠলো। সত্যিই পুলটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কেউ নেই একেবারে ফাঁকা। সেতুটি শত্রুমুক্ত কেন তা কিন্তু খোকা তখনও জানতো না। পুল দখলের সংবাদ দূত মারফত ফজলুর কাছে পাঠিয়ে দিল। খোকা চলে যেতে না যেতেই মোহর খাঁর তৃতীয় বার আবির্ভাব ঘটলো। সকল রাজাকারদেরই তিনি সাথে নিয়ে এসেছেন। সাধারণভাবে নয়, কোমরে রশি বেঁধে। রশি বাঁধা অবস্থাতেই তিনজন রাজাকার ষোলটি রাইফেল পাজাকোলা করে নিয়ে এসেছে। রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করেছে তবু কোমরে ও হাতে রশি বাধা কেন? তাদেরকে কি সাধারণভাবে পাহারা দিয়ে আনা যেতো না? রাজাকারদের সাথে মোহর খাঁর শর্তই ছিল, ‘আমি তোমাদের বন্দী অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর হাতে দেব। মুক্তিবাহিনী তোমাদের বিচার করে পরে মুক্তি দেবেন। তবে মোহর খাঁ রাজাকারদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, আত্মসমর্পণকারীদের কোন বিচার হবেনা। এবং তিনি চেষ্টা করবেন পরবর্তীতে যাতে তারা সবাই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে পারে। মোহর খাঁর শর্তেই রাজাকাররা আত্মসমর্পণে সম্মত হয়েছে।
হাতে সময় খুবই কম। তাই যা কিছু করার ঝটপট্ করতে হবে। আট-দশ জন মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে রাজাকারদের কুমুল্লী প্রাইমারী স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা ভাতকুড়া সেতুর দিকে অগ্রসর হলাম। মোহর খাঁও আমার সাথে। গোলাগুলি যুদ্ধ ছাড়াই পুল দখলে মুক্তিবাহিনীর কোন কৃতিত্ব নেই। পুল দখলের শতকরা নিরানব্বই ভাগ কৃতিত্ব ও গৌরব ভাতকুড়া ইউনিয়নের সেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার মোহর খাঁ ও তাঁর স্বেচ্ছাসেবক দলের। মোহর খাঁকে পুলে রেখে টাংগাইলের দিকে এগুতে লাগলাম। তারটিয়া বটগাছের কাছে এসে ফজলুকে দেখতে পেলাম। সে খুব শক্তভাবে রাস্তা অবরোধ করে আছে। এখানে সামাদ গামা মর্টার নিয়ে আমার সাথে মিলিত হলো, তাকে বট গাছের আশপাশে কোন নিরাপদ স্থানে মর্টার বসাতে বললাম। ফজলুর দলকে নির্দেশ দেয়া হলো আরও সামনে এগিয়ে যেতে। ফজলু, দুলাল, মান্নান, মকবুল, আজাহার, জাহাঙ্গীর, ভোম্বল—সবাই রাস্তার দুই পাশ দিয়ে সতর্ক ভাবে টাংগাইলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তারা বটগাছ আর নগরজলপাই
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪১

সেতুর মাঝামাঝি এলে হানাদারদের বাংকারে জীবন্ত কিছুর নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল। কমাণ্ডার ফজলু, দুলাল, মান্নান রাস্তার ডানপাশ দিয়ে এগুচ্ছিল। ফজলুর পেছনে মুক্তগাছার দূর্ধর্ষ যোদ্ধা মকবুল, দুর্মুজ খাঁ, আজহার, ভোম্বল ও জাহাঙ্গীর যাচ্ছিল। এমনি অবস্থায় ফজলুর একেবারে সামনের বাংকার থেকে কে একজন রাইফেল উঁচিয়ে ধরে। চোখ কান খোলা সদা সতর্ক ফজলু উচিয়ে ধরা রাইফেলটি পা দিয়ে চেপে ধরে। সাথে সাথে রাইফেল থেকে একটি গুলি বেরিয়ে যায়। এদিকে দশ-বারো গজ পিছনের মকবুল উল্কাবেগে ছুটে গিয়ে দ্রুম দ্রাম বাংকারের ভেতর তিন রাউণ্ড গুলি করে বসে। তিন তিনটি গুলির প্রচণ্ড শব্দ রাতের গভীর নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান করে দিল। আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। শহরের দিক থেকে হানাদার বাহিনীর মেশিনগান গুলোও মুহুর্তে গর্জে উঠলো। সামনে কি ঘটছে তা জানতে আবদুল্লাহকে পাঠালাম। আবদুল্লাহ ফিরে এসে জানালো, তেমনি কিছু নয়। কয়েকজন রাজাকার ধরা পড়েছে।
আমাদের অগ্রবর্তী দল নগর জলপাই সেতু অতিক্রম করে গেল। খবর পাঠানো হলো, অগ্রবর্তী দল যেন কিছুতেই আশিকপুরের প্রখ্যাত যাদুকর পি. সি. সরকারের বাড়ী পেরিয়ে না যায়। প্রয়োজনবোধে পরে এগুবার অনুমতি দেয়া হবে। এর পরে শুরু হল সামাদ গামার বিরামহীন গোলাবর্ষণ। তার গোলার লক্ষ্য, টাংগাইল নতুন জেলা শহর। সামাদ দশ-পনের খানা গোলা নিক্ষেপ করছে আর আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘স্যার গোলা কি ঠিক জায়গায় পড়তাছে?’ ‘তুমি যত দূরে পার, গোলা নিক্ষেপ কর।’
এরপর যাদুসম্রাট পি. সি. সরকারের বাড়ীর দিকে ছুটলাম। বটগাছ থেকে মাত্র কয়েকশ গজ টাংগাইলের দিকে এগুতেই এক প্রচণ্ড চিৎকার ভেসে এল. ‘হল্ট, হ্যাণ্ডস্ আপ।’ এই বিকট চিৎকার শত্রুপক্ষের নয়, আমাদের অগ্রবর্তী দল শহর থেকে এগিয়ে আসা কুড়ি-পঁচিশ জন লোককে চ্যালেঞ্জ করেছে। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে তারা যন্ত্রের মত দাঁড়িয়ে যায় এবং আগত দলের একজন উচ্চস্বরে বলে উঠে, ‘আমরা পাসওয়ার্ড জানি না, বট গাছের নীচে মুক্তিবাহিনী আছে আমরা সেখানে যাব। আমরা রাজাকার, সারেন্ডার করছি।’ কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কি সোহরাওয়ার্দী ভাই?’ ‘হ্যা আমি সোহরাওয়ার্দী।’ ‘আপনি একা এগিয়ে আসুন। এগিয়ে এলে তাকে দেখে মুক্তিযোদ্ধাটি মহা খুশী। সোহরাওয়ার্দী টাংগাইল থেকে ঊনত্রিশ জন রাজাকারকে সারেণ্ডার করাতে নিয়ে এসেছে। তাকে আমার কাছে আনা হলো। সোহরাওয়ার্দীর কাজে খুশী হয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘তুমি যাদের সাথে করে এনেছ, তাদের নিয়ে তোমাদের গ্রামের স্কুল ঘরের সামনে চলে যাও।’
আমি আস্তে আস্তে টাংগাইলের দিকে এগুতে থাকলাম। যেতে যেতে টাংগাইল সি. ও. অফিসের সামনে পি. সি. সরকারের বাড়ীর কাছাকাছি ফজলুর অবস্থানে পৌঁছে গেলাম। ফজলু তার দলের একটি ব্লাণ্ডার সাইট, দুটি রকেট লাঞ্চার পাকা রাস্তার দুপাশে ও মীরের বেতকার কাচা রাস্তায় একটি সুন্দর অনুকূল স্থানে এম. এম. জি. টি বসিয়েছে। ঘুরে ঘুরে ওর সমস্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখলাম। ফজলুর অবস্থান থেকে টাংগাইল বাস স্ট্যাণ্ড পর্যন্ত এক মাইল রাস্তার কোথাও
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪২

কোন হানাদার ঘাঁটি নেই, কিন্তু টাংগাইল শহরের পশ্চিম দক্ষিণ দিক থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে কেন—জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন ফজলুকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘আমাদের দলের পশ্চিম দিক থেকে টাংগাইল শহর আক্রমণের কথা আছে, গোলাগুলির যে শব্দ শোনা যাচ্ছে, তা আমাদের দলেরই। প্ল্যান অনুযায়ীই কাজ হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সঠিক খবর জানতে পারবো।’
ক্যাপ্টেন ফজলুর সাথে কথাবার্তা চলাকালে দু’টি ওয়ারলেস সেটে অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগের আপ্রাণ চেষ্টা হচ্ছিল কিন্তু কিছুতেই রাত নটার পর থেকে অন্যান্য দলের সাথে বেতার যোগাযোগ করা গেল না। ফজলুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঘুরে ঘুরে দেখে উপলব্ধি করলাম, ভারী অস্ত্রশস্ত্রে নিয়মিত হানাদার বাহিনী সাজোয়া গাড়ী নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করলে হাল্কা অস্ত্রে ক্যাপ্টেন ফজলু তাদের ঠেকিয়ে রাখতে বা প্রতিহত করতে পারবে না। আশিকপুর থেকে কিছুটা পিছিয়ে এসে নগর জলপাই পুলের দক্ষিণ পাশে ফজলুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা নিরাপদ। তাই দলের অর্ধেক অংশকে পিছিয়ে গিয়ে অবস্থান নিতে পাঠালো। বাকী অংশ নিয়ে সে আমার পেছনে আসতে লাগলো।
আমরা ফিরে যাচ্ছি, ঠিক এমন সময় মীরের বেতকা গ্রামের ভেতর দিয়ে ছুটে এসে দু’তিন জন স্বেচ্ছাসেবক ও একজন মুক্তিযোদ্ধা টাংগাইল শহরের পশ্চিমাঞ্চলের খবর দিল, ক্যাপ্টেন মঈনুদ্দিন তিন’শ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে টাংগাইল শহরের উপর প্রচণ্ড হামলা চালিয়েছে। টাংগাইল থানা ও বাজিতপুর বিসিক ঘাঁটি থেকে হানাদাররা বাধা দিলেও তা কাটিয়ে উঠতে মুক্তিবাহিনীর বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। পুরানো শহরের অধিকাংশ মিলিটারী, রাজাকার ও পুলিশ জিলা শহরের দিকে সরে গিয়েছে। যারা নতুন জেলা শহরের দিকে যেতে পারেনি, তারা যে দিকে পেরেছে প্রাণ- ভয়ে পালিয়েছে। দেড়শর বেশী রাজাকার ও পুলিশ আত্মসমর্পণ করেছে অথবা ধরা পড়েছে, মুক্তিবাহিনীর কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পরবর্তী নির্দেশ কি? তাই তারা জানতে এসেছে।
মঈনুদ্দিন কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানিয়ে নির্দেশ দিলাম, তাদের আর উত্তরে এগুবার দরকার নেই। সামনা সামনি যুদ্ধের তেমন প্রয়োজন হবে না। সকাল ছ’টার মধ্যেই তারা যেন বিন্নাফের পর্যন্ত পিছিয়ে অবস্থান নেয়। প্রয়োজন হলে বিন্নাফের থেকে মঈনুদ্দিনকে আবার ডেকে আনা হবে। সংবাদবাহক দুজন আনন্দে নাচতে নাচতে পশ্চিমে ছুটলো।

সেতু ধ্বংস
আমরা ভাতকুড়ার দিকে এগিয়ে চললাম। ভাতকুড়া সেতুতে বিস্ফোরক লাগানোর কাজ ইতিমধ্যেই শেষ করে সহযোদ্ধারা অপেক্ষায় ছিল। কারণ বিস্ফোরণ ঘটানোর কাজটি আমি সমাধা করতে চেয়েছিলাম। বিস্ফোরক বিশারদ মুক্তাগাছার হাবিব খুবই যত্নের সাথে ভাতকুড়া সেতুতে চক্রাকারে বিস্ফোরক লাগিয়ে কর্টেক্স ডেটোনেটার সংযোগ করে রেখেছিল। শুধুমাত্র সেফটি ফিউজে আগুন লাগানো বাকী। ভাতকুরা পুলে ফিরে এসে মাত্র দুজনকে রেখে সবাইকে দক্ষিণে সরে যেতে বললাম। রাত
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৩

আনুমানিক দশটা দশ মিনিটে ভাতকুড়া সেতুতে বিস্ফোরণ ঘটানো হলো। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে সমস্ত এলাকা থর থর করে কেঁপে উঠলো। চারদিক ঘন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। আশেপাশের গরু বাছুরগুলো ভ্যাঁ ভ্যাঁ চিৎকার শুরু করে দিল। কিন্তু এত প্রচণ্ড ও শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটানোর পরও ভাতকুড়া সেতুটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হলো না। পুলটিকে একেবারে নীচে ফেলে না দিয়ে দুমড়ে- মুচড়ে রেখে দিতে চেয়েছিলাম। পুলটি নীচে পড়ে গেলে তার উপর হানাদাররা সহজেই অস্থায়ী পুল তৈরী করতে পারবে। দুষড়ে-মুচড়ে রেখে দিতে পারলে তার উপর বেলী ব্রীজ তৈরী করতে অনেক সময়ও পরিশ্রম লাগবে। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ হাবিবকে সাথে নিয়ে বিধ্বস্ত পুলটি আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। না, প্রথম বিস্ফোরণে আমাদের আশা পূরণ হয়নি। তাড়াহুড়ো করে দ্বিতীয় বার বিস্ফোরণ ঘটানো হলো। এবার পুলটির বেশীরভাগ অংশ ভেঙে নীচে পড়ে গেল এবং বাকী অংশ পূর্বদিকে হেলে পড়লো। হাবিব আরেকবার বিস্ফোরণ ঘটাতে চাইলো, ‘না, কোন দরকার নেই। আরও অসংখ্য পুল আছে, সেগুলো উড়ানো দরকার। এখানে অতিরিক্ত এক্সপ্লোসিভ খরচ না করে চল আমরা করটিয়ার দিকে এগুই।’
ভাতকুড়া গোরস্থান পেরিয়ে এসে ফজলুর দলের জন্য অপেক্ষা করতে হলো। ফজলুর দল এসে মিলিত হলে আবার চলতে লাগলাম। ঢাকা-টাঙ্গাইল পাকা রাস্তা ধরে করটিয়ার দিকে এগুবার সময় আমার মনে যেমন আনন্দের শিহরন জেগেছিল, তেমনি প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার মনেও আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছিল। এতদিন পাক হানাদার বাহিনী পাকা রাস্তাটি একচেটিয়া ব্যবহার করে এসেছে। বহুদিন পর অল্প সময়ের জন্য হলেও হানাদার মুক্ত রাস্তাটি মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করছে, যুদ্ধ পরিস্থিতির দিক দিয়ে এটা কম গৌরবের কথা নয়। আমরা যখন করটিয়ার দিকে এগুচ্ছি, তখন পাঁচ-ছ’টি বিস্ফোরণের গগন বিদারী শব্দ শোনা গেল। মনে হলো ভাতকুড়া থেকে ক্ষুদিরামপুর হয়ে করটিয়া পর্যন্ত পুরো রাস্তাটিই আমাদের দখলে এসে গেছে।
ছোট্ট একটি কালভার্ট। সাত-আট হাতের বেশী লম্বা হবে না। কালভার্ট থেকে একের পর এক গুলি আসছে। সামান্য এগিয়ে লৌহজং নদী পার হয়ে, ক্ষুদিরামপুর কালভার্টের অবস্থা লক্ষ্য করলাম। অন্যদিকে ফজলু, আজহার, খোকা, দুরমুজ খাঁ, আব্দুল্লা, দুলালসহ আরও ২৫-৩০ জন পশ্চিম দিক থেকে কালভার্টের একেবারে ২০-২৫ গজ কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তারা কালভার্টের বাঙ্কারে প্রচণ্ড গুলি ছোঁড়া শুরু করেছে। আমি সামাদ গামাকে ডেকে এনে বললাম, ‘সামাদ, ভাতকুড়া পুলেতো মর্টার ব্যবহার করতে পারলে না, এই ছারপোকা পুলটার কি করা যায়?’ সামাদ জায়গাটা দেখে একেবারে হতাশ হয়ে পড়লো, ‘না স্যার, গেরাম বাচাইয়া পুলে গোলা ফেলান যাব না।’ আমার ধারণা তাই ছিল। বড়ই প্রতিকূল অবস্থা, কোন অস্ত্র ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তিন ইঞ্চি মর্টার অচল, ২ ইঞ্চি মর্টার থেকেও দুশ গজের মধ্যে গোলা ফেলা খুব একটা সহজ সাধ্য নয়। দুইটি রকেট লান্সার আছে। তাও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কারণ কালভার্টের উত্তর পাশে গ্রাম, পূর্ব-পশ্চিমে রাস্তা, দক্ষিণে খোলা প্রান্তর। এদিকে রাজাকার দল চিৎকার করে বলছে,
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৪

— আমরা কোন ক্ষতি করি নাই, আপনারা যান গিয়া।
— স্যারেন্ডার কর, নইলে তোদের কপালে দুঃখ আছে।
— আপনারা আমাগোর ভাই। আমরা কোন ক্ষতি করি নাই। আপনারা যান গিয়া।
একশ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নিজে নানাভাবে দু ঘণ্টা চেষ্টা করেও আট-নয় জনের ক্ষুত্র রাজাকার দলটির পতন ঘটাতে বা আত্মসমর্পন করাতে পারলাম না। অগত্যা পঁচিশ জন মুক্তিযোদ্ধাকে কালভার্টের চারপাশে রেখে বাকীদের করটিয়া যেতে নির্দেশ দিলাম। আমরা কুমুল্লী মাঝিপাড়া প্রাইমারী স্কুল থেকে রওনা হয়ে করটিয়া হাটের দিকে সামান্য একটু যেতেই কমাণ্ডার শামসুল হকের সাথে দেখা। শামসুল হক তাদের অভিযানের খবর দিতে এসেছে। তারা ঢেলি- করটিয়া সেতু দখল করেছে, কিছুটা অংশ ইতিমধ্যে উড়িয়েও দিয়েছে। পুরো পুলটাই উড়িয়ে দেয়া হবে কিনা-তা জানতেই তার আসা। শামসু ও সোলায়মানের কোম্পানীতে তখন প্রায় দুশ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। শামসুকে বললাম, ‘পুলের বাকী অংশ উড়াতে হবে না। তোমরা করটিয়ার সমস্ত খবরাখবর নাও। সকাল আট টার মধ্যে সেতুসহ সম্পূর্ণ করটিয়া দখল করতে হবে। সকাল নটা পেরিয়ে গেলে, তোমরা আর করটিয়ার উত্তরে থেকো না। পশ্চিম দিক থেকে আঘাত হেনো। যদি রাতের মধ্যেই করটিয়া দখল হয়ে যায়, তাহলে পাথরাইলের দিকে লোক পাঠিয়ে আমাকে খবর দিও।’ শামসুকে নির্দেশ দেয়ার ঘন্টা খানেক আগে থেকে আমি একটু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম। আমার শরীর থর থর করে কাপছিল। বুক সমান পানি ভেঙ্গে লৌহজং নদী দু’ দু’বার এপার ওপার হয়েছি। তাতে আমার শরীর ও জামাকাপড় ভিজে গেছে। অন্যন্য মুক্তিযোদ্ধাদেরও অনুরূপ অবস্থা। তবে তাদের কারও জ্বর আসেনি।
অসুস্থ অবস্থায় কুমুল্লীর মাঝিপাড়ায় এলাম। তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলছিল। পথচলা দুরে থাক, আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। একটি ভাঙা ঘরের বারান্দায় টাল মাতাল অবস্থায় বসে পড়লাম। আমার অবস্থা দেখে কস্তুরিপাড়ার সামসু, আবদুল্লাহ ও আজহার- তিনজনে একসাথে জাপটে ধরলো। সামসুই সর্ব প্রথম বললো, স্যারের জ্বর এসেছে, স্যারের জ্বর উঠেছে। শুনে ক্যাপ্টেন ফজলুল হক দৌড়ে এলো। চারজনে মিলে পাজাকোল করে একটু দূরে নিয়ে একটি চৌকির উপর শুইয়ে দিল। এই সময় মোহর খাঁ ও সোহরাওয়ার্দী ছুটে এলো। আমার গায়ে হাত দিয়ে বিস্মিত হয়ে সোহরাওয়ার্দী বললো, ‘একটু আগেও স্যারকে সুস্থ দেখলাম। হঠাৎ করে এত জ্বর এলো কি করে?’
প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়েও সহযোদ্ধাদের দুশ্চিস্তা ও দুর্ভাবনা দেখে বললাম, ‘একটু পরেই হয়ত জ্বর ছেড়ে যাবে। উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। মোহর ভাই, প্রচণ্ড ব্যথা করছে, দেখুন কয়েকটা এসপ্রো অথবা ঐ জাতীয় কোন ট্যাবলেট পাওয়া যায় কিনা?’ সাথে সাথে মোহর খাঁ ঔষধ সংগ্রহের চেষ্টা করেন এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই এক গ্লাস গরম দুধ এনে আমাকে পান করান। গরম দুধ খেয়ে জ্বর কিছুটা কমে আসে।
কুমুল্লী মাঝিপাড়া থেকে মাইল দেড়েক দূরে চণ্ডীর একটি বাড়ীতে রাত কাটানোর জন্য
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৫

মোহর খাঁ ও সোহরাওয়ার্দী আমাদের পৌঁছে দিল। এ সময় সোহরাওয়ার্দীকে নির্দেশ দিলাম, তোমার ও মোহর খাঁর কাছে আত্মসমর্পিত রাজাকারদের আগামীকাল ফতেপুরে কর্ণেল ফজলুর কাছে পাঠিয়ে দিও। যদি রাজাকাররা বিশ্বস্ত হয়, তাহলে তাদের সাথে ছ’সাত জন যুক্তিযোদ্ধা দিলেই চলবে।’ জ্বর ও ব্যথা নিয়ে চণ্ডীর একটি বাড়ীতে বাকী রাতটা কোনরকমে কাটালাম। রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে ঘুম এলো।

আমাদের ঈদ
১৯৭১ সাল। ২০শে নভেম্বর। খুশীর দিন, ঈদ। বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। জ্ঞান হবার পর একটি ঈদেও মিষ্টি না খেয়ে কাটাইনি। ঈদের দিনে মিষ্টি খাওয়া হলো না বলে মনটা পীড়িত হচ্ছিল, ব্যথায় গুমরে মরছিল। ঠিক সেই মুহুর্তে একজন দেবদূতের মত পাথরাইলের বিখ্যাত মিষ্টি নিয়ে হাজির হলো। যে মিষ্টি নিয়ে এসেছে, সে আমার চেনা। কলেজ জীবনের সহপাঠী। মিষ্টি হাতে অতি সাধারণভাবে বললো, ‘আমি মাঝরাতে খবর পেয়েছি মুক্তিবাহিনী এই গ্রামে এসেছে। আর তাদের সঙ্গে তুইও আছিস। মা রাতেই বারবার বলছিলো, ঈদের দিন কাদেরের জন্য মিষ্টি নিয়ে যা। মায়ের কথাতেই ছুটে এলাম, তুই আমার সামনে একটা মিষ্টি খা বলেই একটি মিষ্টি আমার মুখে তুলে দিল।
সকালে রওনা হবো, ঠিক এমন সময় বাড়ীর চার-পাঁচজন মহিলা মস্ত বড় পাত্রে পায়েশ এনে দিলেন। তারা আন্দাজ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই মুসলমান। ঈদের দিনটি মুসলমানদের জন্য কত পবিত্র, কত আনন্দের, বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃষ্টান সকল মা- বোনেরাই তা জানেন। তাই চণ্ডীর বসাক মা-বোনেরা মুক্তিযোদ্ধা ভাই ও সন্তানদের শুভ সকালে মিষ্টি না খাইয়ে ছাড়তে রাজী নন।
আমি ভাবতেই পারিনি, ঈদের সুপ্রভাতে কপালেপাত্র মিষ্টি জুটবে। প্রিয় বন্ধু ও স্বেচ্ছাসেবকের আনা মিষ্টি খেয়ে এমনিতেই আমি মহাখুশী হয়েছিলাম। তার উপর বাড়ীর মা-বোনেরা নিজ হাতে রান্না করা পায়েশের যখন আমার সামনে এনে রাখলেন, তখন সদ্য রান্না করা ধূমায়িত পায়েশের পাত্রগুলোর দিকে তাকাতেই আমার চোখ দিয়ে টপ্‌ টপ্ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এ অশ্রু দুঃখের নয়, শ্রদ্ধা ও আনন্দের। বাংলার মা-বোনদের প্রতি আমাদের অন্তর শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো। পায়েশ খেয়ে বাড়ীর মা-বোনদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও নমস্কার জানিয়ে চণ্ডী থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
১৯শে নভেম্বর চারটের পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর অন্য কোম্পানীগুলো ঢাকা-টাংগাইল রাস্তার দিকে এগুতে থাকে। পাঁচটার মধ্যে তারা পাকা সড়কের পশ্চিমে যার যার সুবিধামত অবস্থান নিয়ে নেয়। আগের মত ঐ দিনও সড়ক পাহারায় নিয়োজিত দু’কোম্পানী হানাদার ‘কনভয়’ ঢাকা-টাংগাইল এবং টাংগাইল-ঢাকা যাতায়াত করে টহল দিচ্ছিল। দুবার টহলদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল, মুক্তিযোদ্ধারা তা বেশ ভাল- ভাবেই লক্ষ্য করলো। টহলদার বাহিনীর মধ্যে কোন সংশয় নেই, উত্তেজনা নেই। গাড়ীর মধ্যে তারা নিশ্চিন্তে, ঢিলেঢালা ভাবেই রয়েছে। ইফতারের কিছু আগে টহলদার বাহিনী পাকুল্লা থেকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫৬

ঢাকার দিকে এগুতে থাকে। এ সময় ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর খান কোদালিয়া পুলের খুব কাছাকাছি থেকে হানাদারদের ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়ার লোভনীয় দৃশ্য দেখছিল। ইফতারের মিনিট কুড়ি পর হানাদার দলটি কোদালিয়া সেতু পার হয়ে গেলে, ক্যাপ্টেন সবুর খান তার নেতৃত্বাধীন দলকে আরেকবার সতর্ক করে দিল। হানাদাররা সূত্রাপুর, গজারিয়াপাড়া ও কালিয়াকৈর পেরিয়ে গেল।

কোদালিয়া সেতু দখল
কোদালিয়া সেতু পার হয়ে যাওয়ার প্রায় দুঘন্টা পরেও যখন ‘মহিষবাথান’ পুল পেরিয়ে যাওয়ার সংকেত এলো না, তখন ক্যাপ্টেন সবুর খান কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কেন অনিবার্য সংকেতটি আসছে না? তবে কি শত্রুরা মহিষবাথান পুল পার হয়নি? ঢাকার দিক থেকে কোনও সংকেত ছাড়াও তারা পুলে আঘাত হানবে কিনা তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধা— দ্বন্দ্বে ছিল। দু’ঘন্টা কুড়ি মিনিট পরও যখন কোন সংকেত এলো না, তখন ক্যাপ্টেন সাইদুর রহমানের সাথে পরামর্শ করে সবুর মুক্তিযোদ্ধাদের কোদালিয়া সেতু আক্রমণের নির্দেশ দিল। মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে দৌড়ে গিয়ে পুলের উপর উঠলো। বিস্মিত ও হতচকিত শত্রুপক্ষ থেকে প্রথম অবস্থায় মৃদু বাধা আসলেও তা কাটিয়ে উঠতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ বেগ পেতে হলো না। কিন্তু পশ্চিম- দক্ষিণ দিক থেকে এগিয়ে আসা মুক্তিবাহিনীর প্রতি সেতু থেকে মিলিশিয়া ও রাজাকাররা দারুণভাবে গুলি ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু একদিক থেকে সবুর খান ও অন্যদিক থেকে সাইদুর রহমান পনের জন করে দু’টি দল নিয়ে পেছন দিক থেকে মিলিশিয়া ও রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে হানাদারদের সব প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। ফলে পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে চারজন মিলিশিয়াসহ প্রায় পঞ্চান্ন জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। কোদালিয়া পুল দখলে মুক্তিযোদ্ধা ও হানাদার বাহিনীর কেউই হতাহত হয়নি।

দেওহাটা সেতু
ক্যাপ্টেন সবুর খান কোদালিয়া সেতুতে আঘাত হানার চার-পাঁচ মিনিট পরেই দেড় দু’মাইল উত্তর পশ্চিমে দেওহাটা পুলে ক্যাপ্টেন রবিউল তার দল নিয়ে আঘাত হানে। দেওহাটা সেতুর পতন ঘটাতে তেমন গোলাগুলি বা সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হয়নি। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলের অধিকাংশ মিলিশিয়া ও রাজাকার রাস্তা আড়াল করে উত্তর-পূর্ব দিকে পালিয়ে যায়। দেওহাটাতেও সাত- আট জন মিলিশিয়া, রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।

গজারিয়াপাড়া সেতু ধ্বংস
ক্যাপ্টেন সবুর খান ও ক্যাপ্টেন রবিউল যখন কোদালিয়া ও দেওহাটা পুল দখল করে নেয়, তখন টহলদার হানাদার বাহিনী কালিয়াকৈর বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল। পেছনে গোলা- গুলির শব্দে তারা একটু হকচকিয়ে যায়। এই আকস্মিক বিপদের সময়ে তারা পিছনে যাবে না ঢাকার দিকে এগিয়ে যাবে, উদ্বিগ্ন খান সেনারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। এদিকে বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র মাইল দুয়েক পিছনে গজারিয়া পাড়ার সেতুটি ক্যাপ্টেন সুলতান ও ক্যাপ্টেন রঞ্জুর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়। নাকের ডগায় বিস্ফোরণ ঘটায় হানাদার বাহিনী
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৭

আর টাংগাইলের দিকে না ফিরে ঢাকার পথে দ্রুত গা ঢাকা দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে।

মহিষবাখান সেতু
টহলদার দলটি মহিষবাথান সেতু অতিক্রম করার সাথে সাথে ৬ নং আফসার কোম্পানীর অত্যন্ত সফল কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবদুল হাকিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কালিয়াকৈর থানা উন্নয়ন অফিসের দক্ষিণে মহিষবাথান সেতুর উপর উঠে পড়ে। এ সেতুটি তখন ছিল হানাদার নিয়ন্ত্রণমুক্ত। পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত রাজাকাররা ঈদের আনন্দ উপভোগের জন্য কালিয়াকৈর বাজারে চলে গিয়েছিল। হাকিমের দল ঝটপট তিনবার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মহিষবাথান সেতুটি নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আধ মাইল পিছিয়ে এসে কালিয়াকৈর থানা উন্নয়ন কেন্দ্র আড়াল করে রাস্তা আগলে বসে থাকে।

সূত্রাপুর সেতু
সুলতান ও রঞ্জুর দল গজারিয়া পাড়ার সেতুত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ওখান থেকে আরও আধ মাইল টাংগাইলের দিকে এসে সূত্রাপুর সেতু দখল নেয়। এখানে রাজাকাররা সামান্য গুলি ছুঁড়লেও পার্শ্ববর্তী পুলে ঘটায় তারা এমনিতেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আত্মরক্ষার চিন্তায় অস্থির ছিল। মুক্তিবাহিনীর খুব বেশী গোলা- গুলি ছুড়তে হলো না। অতি সহজেই ৩০ জন রাজাকারকে বন্দী করে মুক্তিবাহিনী পুলটি দখল করে নেয়। উল্লেখ্য যে, ২৯শে জুন মেজর আবদুল গফুর ও ক্যাপ্টেন খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা এই পুলটিতে সর্বপ্রথম বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। সেটাই ছিল আমার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর প্রথম সেতু ধ্বংস। এই বিস্ফোরন ঘটিয়েছিল জগন্নাথগঞ্জের বারী মাষ্টার ও রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র, হাজরা বাড়ীর আবদুল হাই। সেবার পুলটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। আগের চেয়ে আরও অধিক সুসংহত ও শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধারা এবার সেতুটির চিহ্ন রাখতে চায়নি। শত্রু পক্ষের ব্যাপক আক্রমণের তেমন আশংকা ছিল না। তাই মুক্তিবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানী ধীর স্থিরভাবে সেতুতে বিস্ফোরণের ব্যবস্থা করে। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে পুলের দু’দিকে পাঁচ-ছয় ফুট খুঁড়ে বিরাট গর্ত করে তাতে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিস্ফোরণের প্রচন্ড আঘাতে পুলটি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে নীচে পড়ে যায়।

মির্জাপুর সেতু
অন্যান্য সেতুর মত মির্জাপুর সেতু দখল করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অতটা সহজ হয়নি। সেতু থেকে মাত্র চার-পাঁচ গজ দূরে মির্জাপুর থানায় হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। সেতুতে মুক্তিবাহিনী আঘাত হানার সাথে সাথে থানা থেকে প্রচন্ড গুলি আসতে থাকে। ক্যাপ্টেন আজাদ কামাল এক দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের পর মির্জাপুর সেতুটি দখল করে নেয়। কোদালিয়া সেতু দখলের ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটের মধ্যে সবুর খান ইঞ্জিনিয়ার দলের সহায়তায় সেতুতে বিস্ফোরণ ঘটায়। সবুর খানকে যে পরিমাণ বিস্ফোরক দেয়া হয়েছিল, কোদালিয়া সেতু উড়িয়ে দিতে তার এক চতুর্থাংশও ব্যবহার করতে হয়নি। ১৯শে নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ২০শে নভেম্বর সন্ধ্যা-এই চব্বিশ ঘন্টায় মুক্তিবাহিনী ঢাকা-টাংগাইল সড়কের ছোট-বড়-মাঝারি নানা আকারের সতেরটি সেতু ধ্বংস করে দেয়। এর মধ্যে কমান্ডার সবুর খানের ধ্বংস করা কোদালিয়া ব্রিজটির কোন নাম-নিশানা ছিল না। ১৯ ও ২০শে নভেম্বরের এই সফল,
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৮

সার্থক ও সময়োচিত সেতু ধ্বংস অভিযান শুধু টাংগাইলের মুক্তিযুদ্ধের নয়, সমগ্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। নির্ভুল ও নিখুত সেতু ধ্বংস কার্যক্রমের পর থেকেই দাম্ভিক পাক হানাদার বাহিনীর আস্ফালন ও গৌরবে ক্রমশও ফাটল ধরতে শুরু করে। এই সময় থেকেই জল্লাদ বাহিনী আক্রমণাত্মক মনোভাব ত্যাগ করে আত্মরক্ষা মূলক ভূমিকা পালন করার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে শুরু করে।
মিলিশিয়া রাজাকারদের আত্মসমর্পণ ও কোদালিয়া সেতু ধ্বংস -এই দুটি বিরাট সাফল্যের প্রেক্ষিতে সবুর খানের আনন্দে ফেটে পড়ার অবস্থা। ইতিমধ্যে সুলতান কোম্পানীর সিগন্যাল দু’তিন বার ঢাকার দিকের খবরাখবর জানিয়ে গেছে। সূত্রাপুর, গজারিয়াপাড়া, মহিষবাথান, এ সেতুগুলো মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়েছে। তাই ক্যাপ্টেন সবুর খান পাকা সড়ক ধরে টাংগাইলের দিকে বীর বিক্রমে এগুতে থাকে। দেওহাটা সেতু থেকে প্রায় এক মাইল দূরে থাকতে রবিউল কোম্পানির দুজন সিগন্যালম্যান সবুরের কাছে দৌঁড়ে এসে বলল, স্যার, সর্বনাশ হইছে। সব বিস্ফোরক ফুরাইয়া গেছে। কিন্তু সেতুর কিছু হয় নাই। কমান্ডার সাহেব একেবারে বেহুঁশ হইয়া গেছে। তিনি পাগলের মত ছট্‌ফট করছেন। পুল ভাঙ্গতে না পারলে কমান্ডার সাবরে সি. ইন সি স্যার আস্ত রাখবো না। আপনে স্যার চলেন। ক্যাপ্টেন সবুর দ্রুত দেওহাটা সেতুতে চলে যান তাকে দেখেই ক্যাপ্টেন রবিউল তাঁর পা জড়িয়ে ধরে, ‘সবুর ভাই আমারে বাঁচান, পুলতো একটুও ভাঙ্গলো না, কিন্তু চার্জ সব শেষ। এখন উপায়। স্যার আমারে নির্ঘাৎ গুলি করবেন। রবিউলের কথা শুনে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করে অভিযোগের সুরেই সবুর বললো। ‘তুই তাইলে খালি কথারই মাতবর। মিটিংয়ের সোমতো ফট ফট্ করলি, সব পারবি। এত বড় বড় আওয়াজ করলি।, তাইলে কি খালি পাখী মারলি? তর চাইতে আমার পুল অনেক বড় আছিল। আমার বারুদ দেওয়া হইছে অনেক কম। তোর পুল ছোট, তাও তরে বারুদ দিছে অনেক বেশী। তারপরও সব শেষ করছস্? এহন আর কি উপায়? বারুদ নিয়ে আয়। পুল ফেলাইয়া দিই। রবিউলের তখন মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। আবার তার কাতর অশ্রুসজল অনুরোধ, ‘সবুর ভাই, আপনি না বাঁচাইলে আমার রক্ষা নাই। বিস্ফোরক কোথায় পাব? আমাকে মেজর হাবিবের সামনে তিনটি পুল ভাঙ্গার মত বিস্ফোরক দেয়া হয়েছে। এর পরও বিস্ফোরক চাইলে কে আমাকে দিবে? আপনার কাছে যদি কিছু থাকে, তা দিয়ে আমাকে বাঁচান। ‘ক্যাপ্টেন সবুর রবিউলকে খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে ক্রোধ মিশ্রিত সূরে বলল, “বেটা খালি ফট ফট করোস্। যা, এখন দুরে যাইয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়া অপেক্ষা কর, আমি পুল ফেলাইয়া দিয়া আহি।’ সবুর কঠোর কিন্তু কাজের লোক। সত্যিই সে অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে পুলের দু’টি স্থানে আশি পাউন্ট চার্জ বসিয়ে তাতে বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে প্রায় একশ ফুট লম্বা সেতুটির আশি ভাগ দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে অথচ এখানে রবিউল সাতশ পাউন্ড চার্জ বসিয়ে পর পর তেইশ বার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।
কোদালিয়া ও দেওহাটা সেতু দু’টি ঢাকা-টাংগাইল পাকা সড়কের বড় সেতু গুলোর মধ্যে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪৯

অন্যতম। দু’টিই ধ্বংস হয়ে গেছে। ঢাকার দিক থেকে সড়কপথে টাংগাইল আসা হানাদার বাহিনীর পক্ষে আপাততঃ সম্ভব নয়। তাই সবুর, রবিউল, আজাদ কামাল সহ সকল কমান্ডারগণ যেমন স্বস্তিবোধ করছিল, তেমনি প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাও ক্রমাগত বিজয় লাভের আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে পরম তৃপ্তিবোধ করছিল।
আজাদ কামাল মির্জাপুর সেতুর দখল নিয়েও তাতে বিস্ফোরণ ঘটায়নি। সে শুধু মির্জাপুর থানা উন্নয়ন অফিস ও দেওহাটা বাজারের মাঝামাঝি বাইমাইলের ছোট্ট সেতুটি উড়িয়ে দিয়েছে। সেতুর নীচে তখনও পানি ছিল তাই লোক পারাপারের জন্য লম্বা লম্বা কটা বাশ ফেলে সাঁকো তৈরী করা হয়েছে। সবুর, রবিউল ও সাইদুর নিজ নিজ দল নিয়ে মির্জাপুর এসে আজাদ কামালের সাথে মিলিত হলে মির্জাপুর যুদ্ধ পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান কেবল সেতু দখলে সীমাবদ্ধ না থেকে থানা দখলের লড়াইয়ে পরিণত হয়। সেতু দখলের পরেই আজাদ কামাল মির্জাপুর থানা দখলের জন্য এগিয়ে যায়। দীর্ঘ দু’ঘন্টা নানা দিক থেকে আক্রমণ চালিয়েও সে কোন সফলতা অর্জন করতে পারেনি। বরং থানা আক্রমণের সময় মুক্তিবাহিনীর একজন বীরযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করে। বড় লোকের পাড়ার জাহাঙ্গীর নামের এই তরুণ ও সুদর্শন মুক্তিযোদ্ধাটি সাহসী ও আমার খুবই প্রিয়পাত্র ছিল। ধর্মীয় ও সামরিক মর্যাদায় জাহাঙ্গীরকে সেখানেই দাফন করা হয়।
থানা আক্রমণে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সাহায্য প্রদানের জন্য অমিত তেজ কমান্ডার ক্যাপ্টেন সবুর এসে উপস্থিত হয়। তার উপস্থিতিতে থানা দখলের লড়াই একেবারে ভিন্ন রূপ নেয়। মির্জাপুরে তখন আটশ মুক্তিযোদ্ধা, আর তাদের পেছনে পাঁচ-ছ’ হাজার বীর জনতা। জনতা, শুয়ে বসে, দাঁড়িয়ে, নানা ভাবে অবস্থান নিয়ে শুধু শ্লোগানের পর শ্লোগান দিচ্ছেন, ‘জয় বাংলা, জয় মুক্তিবাহিনী, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় কাদের সিদ্দিকী’- একটানা বিরামহীন শ্লোগান। শ্লোগান তো নয়, যেন অভিশপ্ত হানাদার বাহিনীর প্রতি শ্লোগানের শেল নিক্ষেপ। শ্লোগানে শ্লোগানে কানফাটা গগনবিদারী হুঙ্কারে সমগ্র মির্জাপুর এলাকা টাইফুনে আক্রান্ত সামুদ্রিক জাহাজের মত থর থর করে কেঁপে উঠছিল। অথচ কি আশ্চর্য্য। হানাদার শিবিরে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। মির্জাপুর থানা দখলের যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অভিনব ঘটনা। তাই এ-সম্পর্কে একটু পরে বিশদভাবে আলোচনা করবো।

কুর্নি কালভটি ও সহুভুল্লা সেতু ধ্বংস
মির্জাপুরের পরেই মুক্তিযোদ্ধারা কুর্নির কালভার্ট ধ্বংস করে। প্রায় বিনা বাঁধায় আজাদ ও বাদশাহর কোম্পানী কালভাটটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন হুমায়ুন ও ক্যাপ্টেন লায়েক আলমের কোম্পানী সন্ধ্যা সাতটায় শুভুল্লা ব্রিজে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানে তাদের দীর্ঘ দু’ঘন্টা প্রচন্ড যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবার বড় কারণ হলো, তখন ঢাকা-টাংগাইল সড়কের উভয়দিকে অনবরত বিস্ফোরণের শব্দ হচ্ছিল। এতে শুভুল্লা ব্রিজে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা দিশেহারা হয়ে কোন দিকে পালাবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। ঠিক এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আচমকা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫০

আক্রমণে তারা আরও দিশেহারা হয়ে পড়ে। বাংকার ছেড়ে উঠলে মৃত্যু অবধারিত এটা ধরে নিয়ে প্রায় দু’থেকে সোয়া দুঘন্টা যুদ্ধ চালায়। শুভুল্লা সেতুর মজবুত বাংকারে বসে হানাদারদের গুলি ছোঁড়া যত সুবিধা ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের মোটেই তেমনটি ছিল না। তবুও মুক্তিযোদ্ধাদের পর্বত প্রমাণ উঁচু মনোবল ও অসীম সাহসিকতার কাছে হানাদারদের অবশেষে নতি স্বীকার করতে হয়। শুভুল্লা ব্রিজ দখলের যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়।
অপরদিকে হানাদার বাহিনীর ছজনের দেহ গ্রেনেডের আঘাতে ভিন্নভিন্ন হয়ে ছজন নিহত ও ষোল জন রাজাকার মিলিশিয়া গুরুতর আহত হবার পর শুভুল্লা পুলের অবশিষ্ট মিলিশিয়া ও রাজাকার অস্ত্র ফেলে দুহাত তুলে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারী মিলিশিয়া ও রাজাকারের সংখ্যা যথাক্রমে আট ও চল্লিশ।

পাকুল্লা সেতু আক্রমণ ও জামুর্কী সেতু দখল
পাকুল্লা সেতু। এ সেতু দখল অভিযানে মেজর হাবিবুর রহমান হানাদারদের সাথে চার ঘন্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়েও প্রথম ব্যর্থ হয়। অবশেষে রাত এগারোটায় অবরোধ উঠিয়ে এক মাইল উত্তরে জামুর্কী সেতু আক্রমণ করে। সুদীর্ঘ চার ঘন্টার এক প্রচন্ড যুদ্ধে পাকুল্লা সেতুর কোন ক্ষতিসাধন করতে না পারলেও, মাত্র দশ মিনিটের ঝটিকা আক্রমণে জামুর্কাই সেতুর প্রতিরোধ পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। সেতুতে পাহারারত ত্রিশ-চল্লিশ জন রাজাকার জামুর্কীর সুলতান ও পাকুল্লার লতিফের সাথে যোগাযোগ করে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। মেজর হাবিব যখন সেতুতে আঘাত হানে, তখনই আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক চল্লিশ-বিয়াল্লিশ জন রাজাকার আস্তে আস্তে তাদের বাংকার ছেড়ে রাস্তার পশ্চিম পাশের পাড়ার দিকে সরে যায়। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা দ্রুত হানাদার-পরিত্যক্ত বাংকারে অবস্থান নেয়। অন্য একটি দল বুকে হেঁটে পুলের অপর পাড়ে গিয়ে হানাদারদের বাংকারে হাতবোমা ছুঁড়তে থাকে। অন্যদিকে দশ জন সহযোদ্ধাসহ মেজর হাবিব জামুর্কী স্কুলের পাশ থেকে হানাদারদের বাংকারে প্রায় পাড় মিনিট অবিশ্রাস্তভাবে এম. এম. জি-র গুলি চালায়। মেশিনগান থেকে গুলি না চালালেও হানাদার বাহিনী পুলটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো। তবে মেজর হাবিবের গুলি বৃষ্টির মুখে সেতুর উত্তর-পূর্বের বাংকর থেকে পাক বাহিনীর গুলি ছোঁড়া একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। তারা মাথা তুলতে পারছিল না। আক্রমনের তীব্রতা সইতে না পেরে বাকী রাজাকার ও মিলিশিয়ারা সড়কের পশ্চিম পাশ ঘেঁসে উত্তর দিকে পালাতে শুরু করে। কিন্তু পালাবার সুযোগ কোথায়? তাদের পেছনেও ফাঁদ। নাছিপাড়া ও জামুর্কীর মাঝামাঝি যেতেই পাখীর খাচায় ঢোকার মত, মুক্তিবাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। তবে এখানে রাজাকাররা কোনও প্রতিরোধের চেষ্টা করেনি, বরং তাদের সঙ্গের বারো জন মিলিশিয়াকে নিজেরাই পাকড়াও করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করে এবং পঁয়ত্রিশ জন রাজাকার নিজেরাও আত্মসমর্পণ করে।
এক ঘন্টা দুঘন্টা নয়, সুদীর্ঘ চার ঘন্টা যুদ্ধ চালিয়েও পাকুল্লা সেতুর পতন ঘটাতে না পেরে স্বভাবতই মেজর হাবিব কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ছিল। এই ব্যর্থতার বেদনা সে মন থেকে মুছে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫১

ফেলতে পারছিল না। জামুর্কী সেতু দখলের পর সেখানে অপেক্ষা না করে ত্রিশ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সেতু পাহারায় রেখে কোম্পানীর ইঞ্জিনিয়ার সেকশনের (ঝনঝনিয়ার ছোট্ট ছেলে) ফারুককে সেতুতে দ্রুত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাকুল্লায় চলে আসতে নির্দেশ দিয়ে সে এগুতে যাবে ঠিক তখন টাংগাইলের দিক থেকে কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন গাজী লুৎফর রহমান এগিয়ে আসে। জামুর্কী সেতু থেকে পালিয়ে যাওয়া মিলিশিয়া রাজাকার যারা তার হাতে ধরা পড়েছে। তাদের কি করা হবে এবং কোন দিকে কোথায় পাঠানো হবে, তা জানতে চায়। মেজর হাবিব ক্যাপ্টেন গাজী লুৎফরকে বলে, ‘রাজাকার ও মিলিশিয়াদের শক্ত করে বেঁধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার পাহারায় ভিন্ন অথবা দেলদুয়ারের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে আপনি দ্রুত পাকুল্লাতে এসে আমার সাথে মিলিত হন।’ ব্যর্থতার জ্বালা, ক্রোধ ও উত্তেজনায় মেজর হাবিবের শরীরের রক্ত টগবগ করছে, তার মাথায় খুন চেপে গেছে। পাকুল্লা সেতু তার দখল করা চাই-ই-চাই। এ যেন তার মরণ-শপথ।

পাকুল্লা সেতু পতন
প্রথম অভিযানের সময় তার দল পাকুল্লা সেতুর তিনদিক থেকে আঘাত হেনেছিল। এবার সে পূর্ব-পরিকল্পনা পাল্টিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নিল-তিন দিক থেকে নয়, মাত্র একদিক থেকে আঘাত হানা হবে। দূর থেকে গুলি ছোড়া নয়, যেভাবেই হোক ঝুঁকি যতই থাকুক, হানাদারদের বাংকারে পৌঁছতে হবে। করলও ঠিক তাই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যখন কোন কমান্ডার যে কোন যুদ্ধ ক্ষেত্রে সামান্য একটু এগিয়ে গেছে, তখনই সাধারণ যোদ্ধাদের মধ্যে আরও এগিয়ে যাবার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সাধারণ যোদ্ধারা কখনও কমান্ডারদের পেছনে পড়ে থাকতে রাজী নয়। এখানেও সাধারণ যোদ্ধারা পেছনে পড়ে থাকতে রাজী হলো না। মেজর হাবিবকে কোম্পানীর বাছা বাছা কুড়ি জন যোদ্ধা শুধু হাতবোমা সম্বল করে বুকে বুকে হেঁটে পুলের উপর উঠে পড়ে। ভারী অস্ত্র নিয়ে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা পুলটির উত্তর ও পশ্চিম দিক আগলে রয়েছে। কিন্তু তারা একেবারেই নীরব। কুড়ি জন মুক্তিযোদ্ধা চরম ঝুঁকি নিয়ে, এক ঘন্টা ধরে বাংকারে বাংকারে প্রায় দুশ গ্রেনেড নিক্ষেপ করলো। সেতু পাহারায় ত্রিশ জন মিলিশিয়া ও পঞ্চাশ জন রাজাকারের মধ্যে কুড়ি জন মিলিশিয়ার দেহ ছিন্ন- ভিন্ন হয়ে গেল। অবশেষে তারা আত্মসমর্পণ করলো। অধিকাংশই আহত। কারও হাত নেই, পা নেই, কারও আবার নাড়ীভুড়ি বেরিয়ে গেছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য। এই যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়।
রাতের শেষ প্রহর। পাকুল্লা সেতু হানাদার মুক্ত হলো। মেজর হাবিব পাকুল্লা সেতুতে চাপ চাপ রক্ত দেখে খুবই মর্মাহত হলো। বেদনার তীব্র অনুভূতি তাকে যেন মুহূর্তকাল পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলে। এত রক্ত ঝরানোর বা রক্তের হোলি খেলায় অংশগ্রহণের ইচ্ছা তার মোটেই ছিল না। শত্রু হলেও তারাও যে মানুষ। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। এটা প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো। সব ক’টি যুদ্ধক্ষেত্রেই আহত-নিহতদের প্রতি সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ থেকে বার বার তা প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ করে ২৭শে জুলাই হাবিব যখন কালিদাসপাড়া সেতু আক্রমণ করেছিল, তখন সেখানে পরিচিতি দুজন রাজাকারের লাশ দেখে সে খুবই বেদনাভিভুত
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫২

হয়ে পড়েছিল। এমনকি নিহত রাজাকারদের বাড়ীতে খবরও সে পাঠিয়েছিল। সেই ঘটনার পর থেকে মেজর হাবিবকে শত্রুর প্রতি খুবই সহানুভুতিশীল দেখা গেছে। সে কখনও যুদ্ধশেষে রাজাকার বা হানাদার বাহিনীর কোন সদস্যের সাথে রুঢ় ভাষায় কথা পর্যন্ত বলতো না। সেই কোমল হৃদয় মেজর হাবিব কুড়ি জন মিলিশিয়াসহ ছ’জন রাজাকারের লাশ ও আরও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন শত্রুর রক্তাক্ত দেহ দেখে একেবারে শোকাচ্ছন্ন, মুহ্যমান হয়ে পরে। সেতু দখল নিতে পারায় যে আনন্দ তা নিমিষেই উবে যায়।
সফল ইঞ্জিনিয়ার ছোট ফারুক পাকুল্লা সেতুতে বিস্ফোরণ ঘটানোর আয়োজন করে ফেলে। অন্যদিকে আহত-নিহতদেরও সেতু থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। এরপর ইঞ্জিনিয়ার ফারুক বেশ দক্ষতার সাথে দুদু’ বার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেতুটি অকেজো করে দেয়।
পাকুল্লা সেতুর পর আরও দু’টি সেতু ধ্বংসের উদ্দেশ্যে মেজর হাবিব মির্জাপুরের দিকে ছুটলো। অবশ্য তাকে বেশী দূর অগ্রসর হতে হলো না। মাত্র দুমাইল দক্ষিণ-পুবে আছিমতলা সেতু পর্যন্ত যেতেই হুমায়ুন কোম্পানীর সিগন্যালম্যান এসে জানালো, তারা শুভুল্লা সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। মেজর হাবিব আবার পেছনে ফিরে আসলো। ১৯শে নভেম্বর। রাতের সেতু ধ্বংস অভিযান আপাততঃ শেষ হলেও থানা দখলের অভিযান তখনও বেশ জোরে-সোরেই চলছিল।

অভিনব যুদ্ধে থানা দখল
সে এক অভিনব যুদ্ধ। বাংলার আর কোথাও ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে এমন অভিনব কৌশলে হানাদারদের নাস্তানাবুদ করা হয়েছে কিনা, জানি না? মির্জাপুর সেতু দখল করে প্রায় তিন ঘন্টা মির্জাপুর থানার উপর ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে আজাদ কামাল যখন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত, তখন প্রায় তিনশ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সবুর সেখানে এসে হাজির। ক্যাপ্টেন সবুর খান কমাণ্ডার হিসাবে আজাদ কামালের চেয়ে অনেক বেশী সুদক্ষ। উপরন্তু মুক্তিবাহিনী গঠনের শুরু থেকে সে আমার সাথে সাথে থাকায় সকল মুক্তিযোদ্ধা ও কমাণ্ডারের উপর তার একটা আলাদা প্রভাব পড়েছিল। সবুর খান মির্জাপুরে এলে আপনা থেকেই যুদ্ধের নেতৃত্ব তার হাতে চলে যায়। সে নানা ভাবে থানার উপর ঘন্টা দুয়েক আক্রমণ চালায়। দু’চার, পাঁচশ নয়, আটশ মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পেছনে পাঁচ-সাত হাজার স্বতঃস্ফূর্ত জনতা। তাদের শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত, চতুর্দিক প্রকম্পিত শয়তানও বুঝি ভীত সন্ত্রস্ত। অথচ হানাদার শিবিরে কোন সাড়া শব্দ নেই, প্রতিক্রিয়া নেই। এমনকি নড়াচড়ার কোন আভাস-ইঙ্গিতও নেই। এমনি অস্বস্তিকর ও জটিল মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধারা যখন অধৈর্য্য হয়ে পড়ছিল, তখন সবুর খানের মাথায় এক অভিনব বুদ্ধি খেলে যায়। সে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডারদের ডেকে বলে, ‘যেহান থেইকা পারেন কয়ডা পাওয়ার পাম্প ও পাইপ জোগাড় কইড়া আনেন। স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডাররা তো সবুরের কথা শুনে অবাক। তুমুল যুদ্ধ চলছে, এখানে পাওয়ার পাম্প দিয়ে কি হবে? কিন্তু নির্দেশ নির্দেশই। প্রশ্ন করা ঠিক নয়, মেনে চলাই নিয়ম। কিছুটা সংশয়-সন্দেহ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা পাওয়ার পাম্প সংগ্রহে ছুটলো। ১৯শে নভেম্বর রাত তিনটা সাড়ে তিনটা নাগাদ স্বেচ্ছাসেবকরা পাঁচটি পাওয়ার পাম্প ও পাইপ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৩

হলো। রাতের অন্ধকারের আড়ালে, খালের পাড়ে পাওয়ার পাম্পগুলো বসানো হলো। এদিকে পূব আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে সূর্য উঠছে, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা পাম্পগুলো চালু করছে। পাঁচটি শক্তিচালিত পাম্প একতালে, পুরো গতিতে পানী তুলে চলেছে। হকচকিত ও বিভ্রান্ত হানাদাররা পাম্প লক্ষ্য করে মাঝে-মধ্যে গুলি ছুঁড়তে লাগলো। কিন্তু তাতে কি হবে? পাঁচটি পাম্পের মিলিত বিপুল জলধারা থানার পেছনে ছোট ডোবাগুলোতে গিয়ে পড়ছে। এভাবে পাম্পগুলো এক নাগাড়ে ছ’ঘন্টা চলার পর দেখা গেল, শুধু থানা নয়, থানার পশ্চিম পাশে মির্জাপুর হাইস্কুল এবং কলেজের মাঠ পুরোটা বর্ষার মত পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। থানার বাংকারগুলো একটিও খালি নেই, পানিতে সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। নভেম্বর মাসের শেষ। একে তো প্রচণ্ড শীত, তার উপর হিমশীতল খালের পানি। পানির মধ্যে থাকা হানাদারদের পক্ষে একেবারেই দুষ্কর হয়ে উঠলো। যুদ্ধ করা তো দূরের কথা, পানির মধ্যে বসে থাকাও কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। ছসাত ঘণ্টা অবিশ্রান্ত গুলি চালিয়ে যুদ্ধ করে যা সম্ভব হয়নি, পাঁচটি পাওয়ার পাম্প সাত ঘন্টা অনবরত পানি বর্ষণ করে অনায়াসে তা সম্ভব করেছে।
মির্জাপুর থানা অভিযানে বারো জন নিয়মিত খান সেনা, চারজন মিলিশিয়া ও সত্তর জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়লো। উল্লেখযোগ্য যে, মির্জাপুর থানা ঘাঁটির পাক-সেনারা সেদিন সত্যিই অসাধারন সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। থানা ছেড়ে দেয়ার পরও বত্রিশ জন নিয়মিত খানসেনা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। অসীম দুঃসাহসের সাথে লড়াই করে, মুক্তিবাহিনীর ঘেরাও ভেদ করে তারা ঢাকার দিকে সরে যেতে সক্ষম হয়। থানা দখলের একটু পরেই মির্জাপুর সেতুর একটি অংশ উৎফুল্ল মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দেয়।
২০শে নভেম্বর। সকাল সাড়ে আটটায় মটরা গ্রামে এলাম। আমরা শুধু ক্লান্ত নই, ক্ষুধার্তও। তাই অভিযানে অংশগ্রহণের আগে খেয়ে নিতে চাই। লৌহজং নদীর পশ্চিম পাড়ে কুমুল্লী গ্রামের একটি বাড়ীতে খাবার চাওয়া হলো। ঈদের দিন। সকল মুসলমান বাড়ীতেই কিছু না কিছু অতিরিক্ত খাবার তৈরী হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা খাবার চেয়ে নিরাশ হলো। পর পর দুটি বাড়ী থেকে বলা হলো, তাদের বাড়ীতে কোন খাবার নেই। মুক্তিযোদ্ধারা সাধারনত ধনী বাড়ী দেখেই খাবারের অনুরোধ জানায়। দু’টি বাড়ীতেই ‘না’ সূচক জবাব পেয়ে আমি কিছুটা বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হলাম। তৃতীয় বাড়ীতে খাবার চাইলেও একই জবাব এলো, ‘খাবার নেই’। এবার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে গেল। ‘খাবার নেই’ বলা লোকটির পিঠে ত্রিশালের কামাল সপাং সপাং তিন-চারটি বেত বসিয়ে দিল। ঝনঝনিয়ার বেনু তো রাগে ফেটে পড়ে আর কি সে চিৎকার করে উঠলো, ‘ঈদের দিন। সকাল বেলা। বাড়ীতে সাত-আটটা টিনের ঘর। বেটা, শালারা কয় কী, খাবার নাই। শালারা, একটা ভঙ্গি পাইছ?’
আমাদের আর বেশীদূর এগুতে হয়নি। তিন-চার বেত আর একটু ধমকেই কাজ হয়ে যায়। তৃতীয় বাড়ীর মালিক মুহূর্তের মধ্যে বড় বড় ডিশে করে খিচুরী ও মাংস নিয়ে এলো। শুধু তৃতীয় বাড়ীর মালিক নয়, প্রথম ও দ্বিতীয় বাড়ীর লোকজনও অনুরূপ খাবার নিয়ে হাজির হলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৪

দু’একটি বাড়ী থেকে কিছু মিষ্টান্ন ও এলো। কেন এমন হলো? ঐ গ্রামের লোকেরা প্রথমদিকে মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিল। বিশেষতঃ খাবার চাওয়া তিনটি বাড়ীর সবাই ছিল পাকিস্তান সমর্থক, রাজাকারদের আত্মীয় স্বজন, গোড়া মুসলীম লীগ পন্থী। মুক্তিবাহিনীর বেত খেয়ে তাদের চৈতন্যেদয় হলো এবং প্রচণ্ড ধমকের মুখে পন্থী-টন্থী সব গুলিয়ে গেল। এর পরই শুরু হয় শুধু অতিথি সেবাই নয়, জামাই আদর। মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু তিন বাড়ীর কোন খাবারই স্পর্শ করলো না। পাশের কটি বাড়ী থেকে দেয়া কিছু খাবার খেয়ে লৌহজং নদীর পূব পারে চলে এলাম।
নদীর পাড় ঘেঁষে মটরা জুম্মা ঘর। সকাল সাড়ে নটা। দু’চার জন করে লোক ঈদের নামাজে সামিল হতে জুম্মা ঘরে আসছেন। তখনও তেমন লোক সমাগম হয়নি। আগত লোকের সংখ্যা কুড়ি-পঁচিশ জনের বেশী হবে না। আমার ইচ্ছা হলো, এখানেই গ্রামের লোকের সাথে ঈদের নামাজ পড়বো। নামাজ শুরু হতে আরও দেরী হবে মনে করে মটরা সেতুটি দেখতে গেলাম। দূরবীন দিয়ে সেতুটি পরিস্কার দেখতে পেলাম, বেঞ্চিতে বসে তখনও যে কজন রাজাকার গাল-গল্প করছে। এদের সংখ্যা সতের-আঠার জন হবে বলে মনে হলো।
পুল দেখা শেষ, আবার জুম্মা ঘরের সামনে ফিরে এলাম। কিন্তু এ কি। জামাত শেষ করে সবাই চলে যাচ্ছেন? পুল দেখে ফিরে আসতে আমার দশ মিনিটও লাগেনি, এর মধ্যেই জামাত শেষ? নামাজে দাঁড়াতে এবং জামাতের লাইন সোজা করতেই তো ছসাত মিনিট লেগে যায়। ঈদের নামাজে অংশগ্রহণ করতে না পারায় আমার মন ব্যথায় ভরে উঠলো। অভিমান ও ক্ষোভে আহত হয়ে একবার ভাবলাম মৌলভীটাকে ডেকে আচ্ছা করে একটা ধমক লাগাই। আবার ভাবলাম না, কোন দরকার নেই। ঈদের জামাতে শরিক হওয়ার নসীব যদি না থাকে তো মৌলভীকে বকাঝকা করে লাভ কি?
মসজিদের সামনের তিন-চার হাত লম্বা একটি চারা গাছে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। চারা গাছটিতে যত হেলান দিচ্ছি গাছটিও আস্তে আস্তে বেঁকে যাচ্ছে। অনেকটা বেঁকে গেলে হঠাৎ খেয়াল হলো, চারা গাছটা আমার দেহের ভার সইতে পারছেনা। আমার অন্তরে মমতার এক তড়িৎ প্রবাহ বয়ে গেল। আপনা থেকেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো, আমার মধ্যে এক নতুন অনুভূতি নতুন উপলব্ধি জেগে উঠলো। এমনি করেই তো সবলের চাপ দুর্বলেরা সইতে পারে না। আস্তে আস্তে হেলে পড়ে, তারপর একদিন ঝরাপাতার মত নিঃশেষ হয়ে যায়। চট করে ঘুরে চারা গাছটিকে আলতোভাবে ধরে শপথ নিলাম, ‘আমরা যেমন সবল হয়ে দুর্বলের উপর ঝাপিয়ে পড়তে চাই না, ঠিক তেমনি দুর্বল হয়ে সবলের কাছে যেন কোনদিন নুইয়ে না পড়ি।

মটরা পুলে ঝড়
এর পর আর পায় কে? আমি লাফিয়ে উঠলাম। আর সহযোদ্ধারা তো সব সময় প্রস্তুতই ছিল। ইতিমধ্যে সামাদ গামা বর্নি থেকে তার মর্টার প্লাটুন নিয়ে আমাদের সাথে মিলিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা মটরার রাস্তা ধরে পুবে পাকা সড়কের দিকে দৌড়ে চললো। এই সময় দক্ষিণ দিক থেকে চার-পাঁচটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৫

শব্দ ভেসে এলো। বায়োজিদ আলম গত রাতে বাঐখোলা সেতু দখল করতে ব্যর্থ হওয়ায় পরদিন সকালে সেতুটি আক্রমণ করে দখল করে নেয়। এটা তারই সেতু উড়িয়ে দেওয়ার বিস্ফোরণের বিকট শব্দ।
মুক্তিযোদ্ধারা পুবদিকে এগিয়ে চলেছে, ওদের ছুটে চলার বিরাম নেই। আমি দু’বার কিছুটা আগে যেতে পারলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু আবদুল্লাহ, আজাহার, বজলু, মকবুল, ফজলু, মান্নান ও দুলালের আগে সেতুতে পৌঁছুতে পারলাম না। আবদুল্লাহ, ফজলু ও মান্নান দৌড়ে পুলে উঠেই বেঞ্চিতে বসে থাকা গল্পে মশগুল রাজাকারদের উপর এক ঝাঁক গুলি ছোড়ে। পাশের একটি বাংকারে রাইফেন উদ্যত এক রাজাকারকে দেখে আবদুল্লাহ্ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আবদুল্লাহর এক লাথিতে তার উদ্যত রাইফেলটি ছিটকে পড়ে যায়। সে তখন স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে রাজাকারটির উপর ছ’সাত রাউণ্ড গুলি ছোড়ে। অন্য এক রাজাকার যখন দুলালকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে উদ্যত, তখন মান্নান তাকে জাপটে ধরে এবং ফজলুর দ্রুত নিক্ষিপ্ত গুলিতে রাজাকারটি লুটিয়ে পড়ে। আমি তখনও সেতুর উপর উঠতে পারিনি। পুলের চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ পশ্চিমে একটু উঁচু জায়গায় আড়ালে দাঁড়িয়ে ফজলু, দুলাল, আবদুল্লাহ, মান্নান, আজাহার ও বজলুর বিস্ময়কর ও দুঃসাহসিক অভিযান লক্ষ্য করছিলাম। সহযোদ্ধাদের শিয়ালের ধূর্ততা নেকড়ের ক্ষিপ্রতা ও সিংহের তেজ দেখে অভিভূত হচ্ছিলাম। বছরের পর বছর সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নিয়মিত সৈন্যরাও এই সাধারণ যোদ্ধাদের মত ধীর-স্থির এবং পর্বতের মত অটল থেকে এত ধূর্ত, ক্ষিপ্র ও তেজী হতে পারে কিনা সন্দেহ।

কোদালের এক ঘায়ে রাজাকার খতম
মটরা পুল। এখানে উনিশ জন রাজাকার ছিল। চার জন মুক্তিবাহিনীর গুলিতে মারা যায় বাকী সবাই অস্ত্রসহ ধরা পড়ে। এদের মধ্যে দু’একজন স্বেচ্ছায় ধরা দেয়। সব মুক্তিযোদ্ধাই তখন সেতুর উপর উঠে গেছে এবং উত্তর ও দক্ষিণে দশ-বারো জন করে অবস্থান নিয়েছে। রাজাকারদের ফতেপুর পাঠানো স্থির হলো। মাত্র তিন জন মুক্তিযোদ্ধা পনের জন রাজাকারকে কোমরে রশি বেঁধে ফতেপুরের দিকে নিয়ে যাবে, এমন সময় ভিড়ের মাঝ থেকে একজন লোক কোদাল হাতে লাফিয়ে এসে একটি রাজাকারের মাথায় সজোরে আঘাত হেনে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘এই হারামজাদা আমার খাসী খাইছে, মুরগী খাইছে। সাত দিন আগেও আমার বাড়ীতে যাইয়া একটা ঘর জ্বালাইয়া দিয়া আইছে।’ চিৎকার আর কোদালের উপর্যুপরি আঘাতে রাজাকারটির মাথার খুলি ফেটে ঘিলু বেরিয়ে ছিটকে পড়ে গেল। তাকে বিরত করার সুযোগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা পেলো না। আকস্মিক ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় আমি একেবারে হতভম্ব, কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেলাম।
হাজার খানেক জনতা তখন পুলের চারদিকে। বার বার সাবধান করে দেয়া সত্ত্বেও তারা স্থান পরিত্যাগ করতে নারাজ। রাজাকারদের প্রতি স্থানীয় জনগণের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ ও ক্ষোভ দেখে তিনজনের পরিবর্তে সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে চৌদ্দ জন রাজাকারকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হলো। এত সতর্ক ও সাবধানতা সত্ত্বেও আরেকটি ঘটনা ঘটে গেল। সেতু থেকে মাত্র দুশ
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৬

গজের মত যাওয়ার পরেই আবার একদল জনতা একটি রাজাকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যেতে না যেতে সে রাজাকারটিও খতম। এবার আমি ভীষণ রেগে গেলাম। উত্তেজিত মারমুখী জনতাকে উদ্দেশ্য করে জোরের সাথে বললাম, ‘এভাবে কোন রাজাকারকে পিটিয়ে হত্যা করা মুক্তিবাহিনী বরদাস্ত করবে না। আপনাদের অভিযোগ নিশ্চয়ই শোনা হবে। তার অর্থ এই নয় যে, আপনারা ইচ্ছামত রাজাকারদের পিটিয়ে হত্যা করবেন।’ রাজাকাররাও কিছুটা স্বস্তি পেল। এরপর রাজাকারদের ফতেপুরে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়ে বললাম, ‘রাস্তায় কোন রাজাকার আক্রান্ত হলে প্রয়োজনে তোমরা গুলি ছুঁড়তেও দ্বিধা করবে না। তবে তোমাদের গুলি ছোড়া কাউকে হত্যা করতে নয়, শুধুমাত্র উত্তেজিত জনতাকে দূরে রেখে রাজাকারদের রক্ষা করাই হবে গুলির মুখ্য উদ্দেশ্য। এরপর আবার ফিরে এসে বিস্ফোরক দিয়ে মটরা সেতু উড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলাম। এই সময় দক্ষিণ-পূর্বদিক থেকে বায়েজিদ আলম তার কোম্পানী নিয়ে এসে হাজির হলো।
এরপর শুরু হলো করটিয়া দখলের অভিযান। করটিয়াতে তখনও তিন-চারশ রাজাকার, শতাধিক খান সেনা ও মিলিশিয়া অবস্থান করছিল। প্রায় চল্লিশ জন মুক্তিযোদ্ধা রাস্তার উভয়দিকে ক্ষেতের ভেতর দিয়ে সমান্তরালভাবে একই গতিতে এগিয়ে চলেছে। ছ’সাত জন সহযোদ্ধাসহ আমি রাস্তার উপর দিয়ে আস্তে আস্তে করটিয়ার দিকে এগুচ্ছি। মর্টার প্লাটুন নিয়ে সামাদ গামা আমাকে অনুসরণ করছে। সামাদ গামা মাঝে মাঝে তার ৩ ইঞ্চি মর্টার রাস্তার উপর বসাচ্ছে আর করটিয়াকে লক্ষ্য করে কুড়ি-পঁচিশ রাউণ্ড গোলা ছুঁড়ছে, আবার মূল দলকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে। একটা ভারী মর্টার নিয়ে এত ক্ষিপ্রতার সাথে গিয়ে বার বার একই লক্ষ্যে নিখুঁতভাবে গোলা নিক্ষেপ এক অভাবনীয় ও অসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু সামাদ গামা মর্টার চালনায় এই অসাধ্য ও অভাবনীয় কাজটি অনায়াসেই করে চলেছে।

করটিয়ার যুদ্ধ
আমার ডান পাশে চকের মাঝে বেনু, ভোম্বল, দুর্মুজ খাঁ, জাহাঙ্গীর, আজহার, বাম পাশে মান্নান, আবদুল্লাহ, মালেক, মকবুল, কাশেম, আবুল কালাম, তমছের আলী, রাস্তার উপর দিয়ে ফজলুল হক, দুলাল, শামসু, বজলু, পিন্টু ও জাহাঙ্গীরের ভাই বাবলু। মুক্তিযোদ্ধারা করটিয়ার দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। হিপ্‌পজিশনে গুলি ছুঁড়ছে আর এগুচ্ছে। ৩রা এপ্রিল ঠিক এমনিভাবে হানাদার বাহিনী অবিশ্রান্ত ধারায় গোলাগুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পাকা রাস্তার উপর দিয়ে টাংগাইল দখল করেছিল। আজ মুক্তিযোদ্ধারা ঠিক তেমনিভাবে হানাদারদের পিছু ধাওয়া করে চলেছে। মটরা থেকে করাতিপাড়া পর্যন্ত নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও, করাতিপাড়া গ্রাম নিয়ে আমরা একটু অসুবিধায় পড়লাম। হানাদারদের পক্ষে গ্রামটিতে অবস্থান নেয়া যেমন সুবিধাজনক, তেমনি আমাদের পক্ষে গ্রামটির দখল নেয়া বিপদজনক ও কষ্টকর। আমরা নির্বিচারে গ্রামের উপর গুলি চালাতে পারছিলাম না। তাই করাতি পাড়াকে সামনে রেখে অল্প সময়ের জন্য বিরতি দিতে হলো। এই সময় পুনরায় স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্য নিতে হলো। আট-দশজন স্বেচ্ছাসেবক অনেকটা ডাইনে ঘুরে গ্রামের পিছন দিয়ে ঢুকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৭

খবর সংগ্রহ করতে গেল। তবে সামাদ গামা একইভাবে করটিয়ার উপর গোলাবর্ষণ করে চলেছে। সে ইতিমধ্যেই কম করে তিনশ গোলা নিক্ষেপ করেছে। তার মর্টারের ব্যারেল আগুনের মত লাল টকটকে হয়ে উঠেছে। দুতিন জন মুক্তিযোদ্ধা বার বার ছেঁড়া চট পানিতে ভিজিয়ে ব্যারেল ঠাণ্ডা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সামাদ গামার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তার কাছে আগের চারশ’ গোলা ছিল। উপরন্তু মটরা সেতু দখলের পর গোলা চেয়ে পাঠানোয় স্বেচ্ছা সেবকরা দেলদুয়ার থেকে আরও তিনশ গোলা নিয়ে এসেছে। নতুন চালান আসায় সামাদ গামার উৎসাহ বহুগুণ বেড়ে গেছে। এত গোলা বর্ষণের পরও সামাদ গামার কোন ক্লান্তি নেই, অবসাদ নেই। বাধ্য হয়ে সামাদ গামাকে নির্দেশ পাঠালাম, ‘মিনিটে চার থেকে ছ’টির বেশী গোলা নিক্ষেপ করা চলবে না।’ স্বেচ্ছা- সেবকরা খবর নিয়ে এলো, করাতিপাড়ার হানাদাররা করটিয়া পর্যন্ত পিছিয়ে গেছে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী, জয় কাদের সিদ্দিকী, ইয়া আলী’ ইত্যাদি শ্লোগান দিতে দিতে রাস্তার পুবের করাতিপাড়া, পশ্চিমের মাদারজানীর ভিতর দিয়ে করটিয়ার উপকণ্ঠে এলো। মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে করটিয়া হাইস্কুল, মাদ্রাসা, সাবেক জমিদার পন্নীদের বাড়ী এবং ঐতিহাসিক সাদৎ কলেজ। মাঝখানের আধ মাইল ফাঁকা জায়গা। খালি জায়গাটা অতিক্রম করা নিয়ে আবার বিপদ দেখা দিল।
হানাদার বাহিনী করটিয়া বাজার ও জমিদার বাড়ীর আশে-পাশে অবস্থান নিয়ে আছে। ফাকা জায়গা অতিক্রমের জন্য কোনও ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করতে রাজী ছিলাম না। সামাদ গামার মর্টার প্লাটুন ডেকে আনা হলো। করাতিপাড়ার সামান্য পশ্চিমে মর্টার এবং আমি ও তমছের দুটি ২ ইঞ্চি মর্টার থেকে প্রায় চরশ’ গোলা নিক্ষেপ করলাম। এতে আশাতীত ফল ফললো। ২ ও ৩ ইঞ্চি মর্টারের প্রচণ্ড গোলার আঘাতের মুখে হানাদারদের পক্ষে করটিয়ায় টিকে থাকা সম্ভব হলো না। ইতিমধ্যে ফজলু, মান্নান, বেনু, আজহার, দুলাল ও দুর্মুজ খান পাকা রাস্তার কোল ঘেঁষে বুকে হেঁটে করটিয়া কলেজের প্রধান ফটক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আমরাও কলেজের আঙিনায় গিয়ে উঠলাম। আমাদের এগুতে দেখে ফজলু তার দল নিয়ে আরও একশ গজ এগিয়ে করটিয়া পুলের উপর থেকে বাজার এবং পন্নীদের বাড়ী লক্ষ্য করে এম. এম. জি., এল. এম. জি. ও রাইফেল থেকে প্রচণ্ডভাবে গুলি ছুঁড়তে লাগলো। পুবদিকের দলটিও দ্রুত করটিয়া হাইস্কুল ও মাদ্রাসা পর্যন্ত এগিয়ে পাকিস্তান সমর্থক জমিদার বাড়ী লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া শুরু করলো। আমি আস্তে আস্তে কলেজের প্রধান ফটকে গিয়ে ফজলুকে ডেকে নির্দেশ দিলাম, ‘আপাতত গুলি বন্ধ করে সুদৃঢ় অবস্থান নিয়ে কয়েক মিনিট অবস্থা পর্যবেক্ষণ কর। প্রয়োজনে লোক পাঠিয়ে সামনের সঠিক খবর জেনে নাও। ওভাবে গুলি খরচ করলে সরবরাহে টান পড়বে।
গুলি ছোড়া বন্ধ করে খোঁজ-খবর নেয়া শুরু হলো। গত রাতের আক্রমণে করটিয়ার হানাদাররা বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। করটিয়া-টাংগাইলের মাঝামাঝি ভাতকুড়া এবং ঢেলি করটিয়া পুল ধ্বংসের খবর তারা আগেই পেয়েছিল। উপরন্তু রাতে বায়জিদ কোম্পানী-দ্বারা ভীষণভাবে আক্রান্ত হয়ে মুল ঘাঁটি টাংগাইল থেকে কোন সাহায্যই পায়নি। এই জটিল ও ভয়াবহ অবস্থায়
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৮

মুক্তিবাহিনী যখন মটরা সেতু দখল করে করটিয়ার দিকে এগুতে থাকে, তখন হানাদাররা মুক্তিবাহিনীর গতি রোধ করতে বা তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে ভরসা পায়নি। মুক্তিবাহিনীর চাপের মুখে টিকতে না পেরে তারা করাতিপাড়া থেকে করটিয়া এবং করটিয়া থেকে কিছুটা পুবে সরে গিয়ে বাংড়া ও পৌলির কাছাকাছি আশ্রয় নেয়। খানসেনারা এতই ভীতি, ও আতংকের শিকার হয়েছিল যে, করটিয়া ধাটি থেকে পিছিয়ে টাংগাইলের দিকে যেতেও সাহস পায়নি। টাংগাইল- করটিয়ার মাঝখানে ভাতকুড়া ও ক্ষুদিরামপুরের পাকা রাস্তায় দু’তিনশ’ যোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন শামসুল হক ও ক্যাপ্টেন সোলায়মান অভিজ্ঞ পাকা শিকারীর মত সংগীন উচিয়ে ওৎ পেতে বসেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দুর্ভেদ্য ব্যূহ ভেদ করে টাংগাইলে পিছিয়ে যাওয়া অসম্ভব ভেবে খানসেনারা পূর্বদিকে সরে গিয়ে সাময়িক আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলো করটিয়া বাজার, দালাল জমিদার বাড়ী ও করটিয়ার আশে-পাশে কোনও হানাদার নেই। ভাল মানুষের মত তারা পূবদিকে সরে পড়েছে। তবে কিছু রাজাকার, আলবদর এখনও করটিয়ার এখানে-সেখানে পালিয়ে রয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য যুদ্ধ করা নয়, পালিয়ে থেকে আত্মরক্ষা করা।
এই সময় বায়েজিদ আলম শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আবার আমাদের সাথে মিলিত হলো। মান্নান, বজলু, ভোম্বল, বেনুসহ পনের জনের একটি দল সারাদিন পৌলি ও বাংড়ার রাস্তা আগলে বসে থাকলো। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে করটিয়া বাজারসহ সমগ্র এলাকা তন্ন তন্ন করে রাজাকার খুঁজতে লাগলো। ঘন্টা খানেক খোঁজাখুঁজি করে একশ কুড়িটি অস্ত্রসহ একশ চল্লিশ জন রাজাকার আটক করতে সক্ষম হলো। রাজাকার অনুসন্ধানে তারা এতই উৎসাহিত হয়ে পড়লো যে, মাঝে মাঝে আমাকে প্রায় একা ফেলে তল্লাসী চালাচ্ছিল। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ দল থেকে আলাদা হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে রাজাকার ধরে আনছিল। এই অবস্থা দেখে সহযোদ্ধাদের কঠিন তিরস্কার করে কড়া নির্দেশ দিলাম, ‘কোনক্রমেই তিনজনের চেয়ে ছোট দলে এদিক-ওদিক যাওয়া যাবে না।’

মুক্ত সড়কে
দুপুর বারোটার মধ্যে ঢাকা-টাংগাইল পাকা সড়ক অভিযানের পুরো রিপোর্ট এসে গেল। নিজে একবার করটিয়া থেকে কোদালিয়া পর্যন্ত সরজমিনে দেখার সিন্ধান্ত নিলাম। বায়েজিদ আলম ও অন্যদের উপর করটিয়ার দায়িত্ব দিয়ে ক্যাপ্টেন ফজলুকে নিয়ে দুটি সাইকেলে কাঁধে স্টেনগান ঝুলিয়ে কোদালিয়া সেতু অব্দি যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পুরো রাস্তাটাই নিরাপদ। করটিয়া থেকে করাতিপাড়ায় সামাদ গামার দল। সামান্য এগিয়ে মটরা পুলে আমার দলের একটি অংশ ও বায়েজিদের কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। তরপর বাঐখোলা ও নাটিয়াপাড়ার মাঝামাঝি পুলে বায়েজিদের অসংখ্য উৎসাহী মুক্তিযোদ্ধা। সারাটা রাস্তা সুসজ্জিত মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকায় মাত্র একজন সাথী নিয়ে মির্জাপুরের দিকে যাওয়া আমার পক্ষে মোটেই অস্বাভাবিক ও গুরুতর ছিল না। আমাদের দুজনকে সাইকেলে মির্জাপুরের দিকে এগুতে দেখে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৯

রাস্তার উপরে শত শত মুক্তিযোদ্ধা আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করে উৎসাহ জুগিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তার উপরে মানুষ আর মানুষ। যেন মানুষের বান ডেকেছে। তারা পোড়া আলু, চিড়া-মুড়ি, কলা, পেঁপে, দুধ যে যা পেরেছেন, তা নিয়েই রাস্তায় এসে হাজির হয়েছেন।
নাটিয়াপাড়া মোড় ঘুরতেই বহুদিন পর রহিম মাষ্টারের সাথে দেখা। এই রহিম মাষ্টার ৩রা এপ্রিল নাটিয়াপাড়া যুদ্ধের সময় টেলিফোনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। রহিম মাষ্টারকে বুঝে জড়িয়ে ধরে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। জেনে নিলাম, নাটিয়াপাড়া যুদ্ধের পরে কোথায়, কিভাবে ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর আরও এগিয়ে চললাম। সামনেই জামুর্কী পুল। পুলটি বেশ বড়। পুলটির হাড়-গোড় ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। নীচে অথৈ পানি। ওপারে যাবো কি করে? রাস্তার পূবে জামুর্কী হাইস্কুলের ভিতর দিয়ে কাঠের পুল পার হয়েই শুধু ওপারে যাওয়া সম্ভব। পাকা রাস্তার ঢাল বেয়ে নীচে নেমে জামুর্কী স্কুলের পেছনে পৌঁছতেই ঐ স্কুলের মাষ্টার আজাদ সাহেব দৌঁড়ে এসে আমার সাইকেল ধরলেন। তার চোখের সামনে আমি সাইকেলের বোঝা বহন করব, এটা মেনে নিতে তিনি রাজী নন। স্কুলের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় মুসলিম লীগ সদস্য প্রধান শিক্ষক জিয়ারত আলী সাহেবের সাথে দেখা হলো। তিনি আমাকে দেখে দ্বিধা ও অস্বস্তিবোধ করছিলেন। কিন্তু আমি যখন তাকে সালাম জানিয়ে বললাম,
— স্যার, কেমন আছেন?
তখন তাঁর মুসলিম লীগের লোক হওয়ার ভয়, ভীতি ও শঙ্কা কেটে গেল। তিনি কাঁদো কাদো গলায় বললেন,
— বাবা কাদের, বহুদিন পর তোমাকে দেখলাম। তুমি বেঁচে থাকো।
আমরা পাকা রাস্তার দিকে এগুলাম। পাকুল্লা বাজারের সামনে সুলতান, লতিফ ও কাটোরার নাসির সহ অন্যান্য সহযোদ্ধারা স্বাগত জানালো। এখানে করটিয়া থেকে আনা সাইকেল বদল করে, দুটি নতুন সাইকেল নিলাম। আমার অসাবধানতায় করটিয়ার ও পাকুল্লার চারটি সাইকেল হারিয়ে যাওয়ায় পরে মুক্তিবাহিনী সাইকেল মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল।
পাকুল্লা থেকে মির্জাপুরের দিকে এগিয়ে ধল্লা পৌঁছতেই, রাস্তার পাশে ঢাকা–ক ২৫৫ নম্বর বাসটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। স্থানীয় কয়েকজন লোক ডেকে গাড়ীটি ধাক্কা দিতে চললাম। ডিজেল গাড়ী চালু করতে কোন চাবির দরকার পড়ে না, এটা আমার জানা ছিল। আমি গাড়ীতে উঠে স্টিয়ারিং ধরলে পাঁচ-ছজন লোক একটু ধাক্কা দিতেই ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। বাস চালিয়ে শুভুল্লা সেতু অতিক্রম করে যেতে পারলাম না। শুভুল্লা পুলটি মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিয়েছে। শুভুল্লা পুলে ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের সহযোদ্ধারা খবর দিল, নির্দেশমত ক্যাপ্টেন আবদুস সবুর খান মির্জাপুর থেকে করটিয়ার দিকে রওনা হয়েছে। তাই আবার করটিয়ার দিকে ফিরতে হলো। শুভুল্লা থেকে পাকুল্লা এই সাড়ে চার মাইল রাস্তা তখনও অক্ষত ছিল। পাকুল্লা ফিরে গাড়ী থেকে নামতেই মেজর হাবিব এসে তার অভিযানের বিস্তারিত রিপোর্ট করলো। নাসিরকে ডেকে বললাম, ‘একজন
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬০

ড্রাইভার দিয়ে তোমরা কজন শুভুল্লা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে সবুরের দলটিকে এ পর্যন্ত গাড়ীতে এনে দাও এবং জামুর্কীতে এর দলের খাবার ব্যবস্থা করো।
আমরা আবার সাইকেলে চাপলাম। কিন্তু বেশী দূর এগুতে পারলাম না। পাকুল্লা বাজারের সামনে রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। অসংখ্য মানুষের ভালবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, আনন্দ ও শ্লোগান দিয়ে তারা আমাকে স্বাগত জানালেন। শুরু হয়ে গেল ঠেলাঠেলি, ধাক্কা ধাক্কি। সবাই এগিয়ে আসতে চান, কথা বলতে চান। মেজর হাবিব বহু চেষ্টা করেও বিশৃঙ্খল অবস্থাটা সামাল দিতে রীতিমত হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল। অনেক কথাবার্তার পর আবার সাইকেলে উঠবো, এমন সময় একটি অল্প বয়স্ক ছেলে এসে বললো,
— স্যার, আমার নাম ফারুক। আমি জামুর্কী ও পাকুল্লা সেতুতে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি। আমার বিস্ফোরণ কেমন হয়েছে, স্যার?
ফারুকের কথা শুনে একেবারে থ মেরে গেলাম। এত ছোট ছেলে এত বড় কাজ করেছে? মেজর হাবিবও ছেলেটির কথায় সায় দিয়ে বললো,
— হ্যা স্যার, এই ফারুকই আমার দলের মূল বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। ও খুব সাহস এবং বুদ্ধি রাখে।
হালকা-পাতলা সুদর্শন ছেলেটিকে প্রশংসার সুরে বললাম,
— দেখো ভাই, জামুর্কী সেতুতে বিস্ফোরণ ঘটানোর কোন তুলনা হয়না, তবে পাকুল্লা সেতু ধ্বংস অতটা ভাল হয়নি। আমি নিজেও গত রাতে ভাতকুড়া পুলে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি। এ পর্যন্ত যতগুলো ধ্বংস সেতু দেখলাম, তার মধ্যে জামুর্কী সেতুই এক নম্বর। তবে মির্জাপুরের কাছাকাছি সেতুগুলোর অবস্থা এখনও দেখিনি, তাই নিশ্চিত করে তোমাকে শ্রেষ্ঠ বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ বলে ঘোষণা করতে পারছিনা। এখান থেকে ফিরে করটিয়া সেতুতে বিস্ফোরণ ঘটাবো। সেটা যদি তোমার চেয়ে ভাল না হয়, তাহলে অবশ্যই তুমি এক নম্বর হবে। আমার একথা শুনে ফারুক আশ্চর্য হলো। তখন পর্যন্ত যে ক’টি বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, তার (ফারুকের) বিস্ফোরণই সবচেয়ে ভালো হয়েছে, আমার একথা শুনে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা খুশী ও আনন্দ যেন আর ধরে না। অন্যদিকে আমি ভাতকুড়া সেতু ধ্বংস করেছি, শুনে মেজর হাবিব যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে আশ্চর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— স্যার, আপনার তো ভাতকুড়া যাওয়ার কথা ছিল না?
— ছিল না, তবুও গেলাম। ভাতকুড়া সেতু ধ্বংস করতে না পারলে আমরা কিছুতেই করটিয়া দখল নিতে পারতাম না। অন্য কোন কোম্পানী যে ভাতকুড়া সেতু দখল নিতে পারে, এমন ভরসা পাইনি বলে আমাকেই যেতে হয়েছে। তবে তোমাকে অথবা সবুরকে যদি ভাতকুড়া সেতুর দায়িত্ব দিতে পারতাম, দিব্যি করে বলছি তা হলে তোমাদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি কিছুতেই খেলাপ করতাম না।
— স্যার, এখনও আপনি আমাদের ওপর পুরো ভরসা করতে পারছেন না, বলতে যেয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬১

সে থেমে গেল। আমি মেজর হাবিবকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— না কমাণ্ডার, ঠিক তা নয়। এই দেখো ভাই, আমার তো কোন ক্ষতি হয়নি, তোমার মত অত যুদ্ধও করতে হয়নি। মোহর খাঁর সহায়তায় বিনা যুদ্ধে রাজাকার সহ সেতু দখল করেছি। মেজর হাবিবকে সমস্ত এলাকার উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার নির্দেশ দিয়ে করটিয়া ফিরে এলাম। ফেরার পথেও সেই একই দৃশ্য। রাস্তার উপর যেন জনতার ঢল নেমেছে। করটিয়া এসে প্রথমে বাজার ও পরে কুখ্যাত দালাল জমিদার বাড়ী ‘দাউদমঞ্জিল’ তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলাম। আমি মির্জাপুরের দিকে রওনা হওয়ার আগেই করটিয়া ছোট তরফের দালাল জমিদার মেহেদী খান পন্নী, তার ছেলে সেলিম খান পন্নী এবং বাবুল খান পন্নীকে কোমরে দড়ি বেঁধে করটিয়া হাই স্কুল মাঠে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। ফিরে আসার পর অধ্যাপক মুশফিকুর রহমান আবুর নেতৃত্বে বায়েজিদ কোম্পানীর ছয়-সাত জন মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে দেলদুয়ারের এলাচীপুরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। বাবুল খান পন্নীর টাংগাইল ক-১ টয়োটা গাড়ীটিও মুক্তিবাহিনীরা নিয়ে নিল। ১৬ই ডিসেম্বর ‘৭১ বিকেলে হানাদার সেনাপতি নিয়াজী যখন যৌথ বাহিনীর লেঃ জেনারেল অরোরার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পন করে, তখন সেই গাড়ী চালিয়েই আমি ঢাকা বিমান বন্দর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েছিলাম। ঢাকা বিমান বন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাবার সময় ভারতীয় বংশোদ্ভূত পশ্চিম জার্মানীর বিখ্যাত সাংবাদিক ‘জয়োলাল’ গাড়ীতে লাফিয়ে উঠেছিলেন। জয়োলাল যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের উপর বস্তুনিষ্ঠ দুর্লভ ও চাঞ্চল্যকর তথ্যবহুল সংবাদ সরবরাহের জন্য ১৯৭২ সালে পশ্চিম জার্মানীর শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকের সম্মান লাভ করেন।
২০শে নভেম্বর সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন আব্দুস সবুর খান সত্তর-আশি জন মুক্তিযোদ্ধাসহ বিজয় গর্বে করটিয়ায় আমার সাথে মিলিত হলো। সেতু ধ্বংস অভিযানে সবুরই সবচেয়ে বেশী সফলতা ও কৃতিত্বের দাবীদার। বেঁটে-খাটো এই অসীম সাহসী যোদ্ধাটি গর্বে ও আনন্দে যেন অনেক উঁচু ও লম্বা হয়ে গেছে। তবে তার কোন অহংকার নেই, আস্ফালন নেই, উদ্ধত ও অস্বাভাবিক আচরণের লেশমাত্র নেই। সে ভিতরে দৃঢ়চেতা কিন্তু বাইরে শান্ত ও মধুর প্রকৃতির।
আলাপ-আলোচনা ও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সবুরকে নিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা স্থির করলাম। সংগৃহীত তথ্য থেকে এটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল যে, করটিয়ার হানাদাররা টাংগাইল সরে না গিয়ে পৌলি-বাংড়ার কাছে দু’তিনটি বাড়ীতে লুকিয়ে রয়েছে, তাদের কিভাবে পাকড়াও করা যায়? স্থির হলো, রাতের মত আমরা করটিয়া ও করাতিপাড়ায় ছড়িয়ে থাকবো? ভোর পাঁচটায় একদল সোনালিয়া খালের ভিতর দিয়ে এবং অন্যদল করটিয়া-বাংড়ার রাস্তা ধরে হানাদারদের উপর ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মত ঝাঁপিয়ে পড়বে।
২০শে নভেম্বর ঢাকা-টাংগাইল সড়কের কালিয়াকৈর থেকে ভাতকুড়া পর্যন্ত পুরো এলাকাটা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে এসেছিল। সেতু ধ্বংসের বিবরণ—
এক নম্বর: মহিষ ব্যাথান সেতু—ক্যাপ্টেন আবদুল হাকিমের কোম্পানী।
দুই নম্বর: গজারি পাড়া সেতু—ক্যাপ্টেন সুলতান ও ক্যাপ্টেন রঞ্জু কোম্পানী।
তিন নম্বর
চার নম্বর
পাঁচ নম্বর
ছয় নম্বর
সাত নম্বর:
আট নম্বর :
নয় নম্বর
দশ নম্বর
এগারো নম্বর :
বারো নম্বর
তের নম্বর
চৌদ্দ নম্বর
পনের নম্বর :
ষোল নম্বর :
সতের নম্বর :
আঠার নম্বর :

তিন নম্বর: সুত্রাপুর সেতু—ক্যাপ্টেন সুলতান ও ক্যাপ্টেন রঞ্জু কোম্পানী।
চার নম্বর: কোদালিয়া সেতু- ক্যান্টন আব্দুস সবুর খান ও ক্যাপ্টেন সাইদুর কোম্পানী।
পাঁচ নম্বর: দেওহাটা সেতু – ক্যাপ্টেন রবিউল আলম ব্যর্থ, পরে সবুর খান ধ্বংস করে।
ছয় নম্বর: বাইমাইল সেতু -ক্যাপ্টেন আজাদ কামাল কোম্পানী।
সাত নম্বর: মির্জাপুর সেতু- ক্যাপ্টেন আজাদ কামাল কোম্পানী।
আট নম্বর: কুর্নি সেতু – বাদশাহ ও ক্যাপ্টেন এন. এ. খান আজাদ কোম্পানী।
নয় নম্বর: শুভুল্লা সেতু- ক্যাপ্টেন লায়েক আলম ও ক্যাপ্টেন হুমায়ুন কোম্পানী।
দশ নম্বর: পাকুল্লা সেতু – মেজর হাবিব কোম্পানী।
এগারো নম্বর: জামুর্কী সেতু -মেজর হাবিব কোম্পানী।
বারো নম্বর: নাটিয়াপাড়া সেতু -ক্যাপ্টেন বায়জিদ আলম কোম্পানী।
তের নম্বর: নাটিয়াপাড়া বাঐখোলা সেতু ক্যাপ্টেন বায়েজিদ আলম কোম্পানী।
চৌদ্দ নম্বর: মটরা সেতু—ক্যাপ্টেন ফজলুল হক কোম্পনী (ফজলুল হক আমার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কোম্পানী কমান্ডার)।
পনের নম্বর: করাতিপাড়া সেতু ক্যাপ্টেন বায়েজিদ আলম কোম্পানী।
ষোল নম্বর: করাটিয়া সেতু –ক্যাপ্টেন ফজলুল হক কোম্পানী। (আমার নিজের দল)
সতের নম্বর: ঢেলি করাটিয়া সেতু-ক্যাপ্টেন শামসুল হক ও ক্যাপ্টেন সোলায়মান কোম্পানী
আঠার নম্বর: ভাতকুড়া সেতু-ক্যাপ্টেন ফজলুল হক কোম্পানী। (আমি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলাম)।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৩

বাথুলীর যুদ্ধ

করটিয়া কলেজের ভি. পি. করাতিপাড়ায় আবুল মনসুর ও সুজাদের বাড়ীর পাশে জিন্নাহদের বাড়ীতে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা হলো। সবুর রাত কাটাবে করটিয়া কলেজের আবাসিক এলাকায়। যথারীতি কঠোর পাহারার ব্যবস্থা করা হলো। পুব, পশ্চিম ও দক্ষিণ–তিন দিকই নিরাপদ। উত্তর দিকে কঠোর পাহারা বসানো হলো। করটিয়া স্কুল ও মাদ্রাসা সহ দালাল জমিদারদের বাড়ীর আশপাশে কঠোর নজর রাখা হলো। ঢাকা-টাংগাইল পাকা রাস্তা ও করটিয়া বাজারেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হলো। আমাদের জানা ছিল, করটিয়ার পুবে কটি বাড়ীতে পাকসেনারা আশ্রয় নিয়েছে। তারা যাতে কোনক্রমেই পালিয়ে যেতে না পারে তার জন্য কঠোর দৃষ্টি রাখা হচ্ছিল।

মুক্তাঞ্চলে বিভ্রান্ত হানাদার
গত রাতের মত আজকেও আমি কিছুটা জ্বর জ্বর অনুভব করছিলাম। রাত প্রায় দেড়টা। দালাল জমিদার বাড়ীর দিক থেকে কোলাহলের শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা খুব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু তবুও উর্দু জবানে কথাবার্তা, হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ একটু একটু কানে ভেসে আসছিল। পাহারারত এক মুক্তি যোদ্ধাকে ডেকে কারণ জিজ্ঞাসা করা হলো। সে কিছুই বলতে পারলোনা। ক্যাপ্টেন ফজলু নিজে অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে ছুটে গেল। ফিরে এসে জানালো, এখান থেকে যে ধরনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, এগিয়ে একেবারে মাদ্রাসা ও স্কুলের কাছে গিয়েও সেই একই শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।’ ঘটনাটি কিছুতেই পরিষ্কার হলোনা। এমন সময় অগ্রবর্তী দলের আবদুল্লাহ, বেনু, ভোম্বল ও দুলাল ছুটে এলো। তারা কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে, কোলাহলটা দালাল জমিদার বাড়ী থেকেই আসছে। কথাবার্তা যা শোনা যাচ্ছে তা পরিষ্কার উর্দু জবান। আমি আর ভরসা না পেয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম। আগত চারজনসহ আরও পনের-ষোল জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে করটিয়া খালের পাড়ে স্কুল পর্যন্ত এলাম। ততক্ষণে কথাবার্তার আওয়াজ একদম থেমে গেছে। ফলে কোন কিছু আন্দাজ করতে না পারলেও বার বার সন্দেহ হচ্ছিল, কিছু একটা হয়েছে। হানাদারদের কণ্ঠ শুনেছি, তাই কিছুটা পিছিয়ে এসে সাদৎ কলজে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন সবুরের খোঁজ করলাম। তাকে পাওয়া গেল। সে খুবই চঞ্চল ও উত্তেজিত। তাঁর দলও কিছুটা বিক্ষিপ্ত ও বিশৃঙ্খল। সবুরকে দেখে বিস্মিত হলাম।
— কি ব্যাপার? কোন গোলা-গুলি নেই, তোমার চোখ-মুখের এই অবস্থা কেন? তোমাকে এত উদ্বিগ্ন মনে হচেছ কেন?
ক্যাপ্টেন সবুর প্রকৃত ঘটনা জানালো। হানাদাররা সত্যিই করটিয়া এসেছিল। তবে এখন তারা টাংগাইলের দিকে পালিয়ে গেছে। সবুরের কথা শুনে একেবারে তাজ্জব বনে গেলাম। কিভাবে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৪

সম্ভব? পৌলি থেকে হানাদাররা কিভাবে করটিয়া পর্যন্ত এলো? আর করটিয়া থেকেই বা কিভাবে একটি গুলি খরচ না করে টাংগাইলের দিকে পালিয়ে গেল? সর্বত্রই মুক্তিবাহিনী ওৎ পেতে বসে আছে, সব পথই যে বন্ধ।
কিন্তু সে রাতে পাক-হানাদার বাহিনী অত্যন্ত দ্রুততা ও সফলতার সাথে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল। মুক্তিবাহিনীর চাপ ও আক্রমণের মুখে তারা করটিয়া থেকে পিছিয়ে গিয়ে পৌলি ও বাংড়ার কাছাকাছি ক’টি বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে বুঝতে পারে, স্থানটি মোটেই নিরাপদ নয়। মাইল আড়াই পুবে বাসাইল থানা, সেখানেও আশ্রয় নেয়া সম্ভব নয়। দু’দিন ধরে বাসাইল থানার উপর জোর আক্রমণ চলেছে। পশ্চিমে মুক্তিবাহিনী সক্রিয়। দক্ষিণের সমগ্র এলাকাটাই বিল। উত্তরে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ধানক্ষেত ও জলাভূমি। এমনি ঘেরাও অবস্থায় সারাদিন অপেক্ষা করে, রাত দশটায় মরিয়া হয়ে তারা পশ্চিম দিকে এগুতে থাকে। পশ্চিমে বাংড়া সড়কের উপর কঠোর পাহারা থাকলেও, দক্ষিণ-পশ্চিমে সোনালিয়া খালের ওপর মুক্তিবাহিনীর পাহারায় কিছুটা শিথিলতা ছিল। হানাদাররা বাংড়ার কঠিন ও বিপদজনক পথে না গিয়ে আঁকা-বাকা পথ ধরে শুকনো সোনালিয়া খালের মধ্যেদিয়ে খুব সন্তর্পণে নিরাপদে করটিয়া স্কুল মাঠ পর্যন্ত পৌছে। করটিয়া স্কুল মাঠে পাহারারত সবুর কোম্পাণীর মুক্তিযোদ্ধা যখন তাদের প্রচণ্ড চিৎকারে ‘হল্ট হ্যান্ডস আপ’ বলে চ্যালেঞ্জ করে, তখন বিভ্রান্ত ও বিস্মিত হানাদার দলের জনৈক সদস্য বলে ওঠে,
— কেয়া রাজাকার ভাইয়ো, হাম লোগ ভি রাজাকার হ্যায়। তোম রাজাকার হ্যায় না? তোমহারা কমান্ডার কাহা হ্যায়? জবাবে পাহারারত মুক্তিযোদ্ধাটি হানাদার দলের উপর গুলি না চালিয়ে শুধু বলে,
— হ্যায়, হাম রাজাকার হৈতা হ্যায়। হামারা কমান্ডার সাবকো হাম লে আইতা হ্যায়, বলেই দে ছুট। সে দৌড়ে গিয়ে কমাণ্ডার সবুরকে তৎক্ষণাৎ ঘটনাটি জানায়। পলায়ন পর মিলিটারী রাজাকারদের সংখ্যা পাঁচ-ছ, শ’র বেশী। তাই মুক্তিযোদ্ধাটি গুলি চালাতে সাহস করেনি। তাছাড়া রক্ষা যে, সে আচমকা হানাদারদের হাতে মুক্তিযোদ্ধাটি ধরা পড়ে যেতে পারতো। হানাদারদের ভুলে ও মুক্তিযোদ্ধাটির কৌশলে সবুরের পুরো দলটি বেঁচে গেল। মুক্তিবাহিনীর ভীতি ও চাপের মুখে সারা দিন কাটিয়ে হানাদাররা ভেবেছিল মুক্তিবাহিনী রাতে করটিয়ায় ঘাঁটি গেড়ে নাও থাকতে পারে। বিকেলে হানাদার দলটিকে ‘ওয়ারলেসে জানানো হয়েছিল যে, করটিয়ায় সামরিক সাহায্য পাঠানো হচ্ছে। সন্ধ্যার মধ্যে করটিয়া দুষ্কৃতিকারী মুক্ত হয়ে যাবে। এই খবরটাই হয়তো হানাদার- দের কিছুটা বিভ্রান্ত করছিল।
মুক্তিযোদ্ধটির কাছে থেকে এই সাংঘাতিক খবর শোনামাত্র কমান্ডার সবুর বিদ্যুৎ গতিতে লাফিয়ে ওঠে। সব মুক্তিযোদ্ধাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে সরিয়ে দেয়। সে নিজে পাঁচ-ছজন নিয়ে আস্তে আস্তে করটিয়া কলেজ গেট পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে হানাদারদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকে। স্কুলের মাঠে একত্রিত হওয়ার সময় হানাদার বাহিনীর ছোট একটি দল পাশের দালাল জমিদার মেহেদী খান পন্নীর বাড়ীতে যায়। বাড়ীর মহিলাদের কাছ থেকে হানাদাররা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৫

জানতে পারে মুক্তিবাহিনী করটিয়া থেকে চলে যায়নি তারা সমগ্র এলাকাই চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। এমন কি তাদের এটাও জানায় যে, দুষ্কৃতিকারীদের প্রধান নেতা কাদের সিদ্দিকীও আশেপাশে কোথাও আছে। ফলে হানাদার বাহিনী আর করটিয়ায় অপেক্ষা করতে সাহস পায়নি। মাঠের পাশ থেকে রাজাকার কমাণ্ডারকে যে ডেকে আনতে গেছে, সে যে মোটেই রাজাকার নয়, এটাও তারা পুরোপুরি বুঝে যায়। খান সেনারা আবার খাল ধরে সোজা পশ্চিমে করটিয়া হাট বাঁয়ে রেখে লৌহজং নদীর পাড় দিয়ে আস্তে আস্তে আশিকপুর পুলে গিয়ে উঠে।
সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়। সোনালিয়া খালে মুক্তিবাহিনীর প্রহরা দুর্বল ও শিথিল হওয়ার ফলে ঐ খাল দিয়ে করটিয়া হাট, ঢেলি করটিয়া হয়ে ক্ষুদিরাম পুরের ভিতর দিয়ে ভাতকুড়াকে সামান্য ডানে রেখে খাল ও নদীর পাড়ের যে স্থান দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তার দু’একশ গজের মধ্যে অনেক জায়গাতেই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সম্বর্ধনা জানানোর অপেক্ষায় ছিল। করটিয়া হাটে ক্যাপ্টেন এন. এ. খান আজাদের দল, ঢেলি করটিয়া ক্যাপ্টেন সোলায়মান, ক্ষুদিরামপুরে ক্যাপ্টেন শামসুল হকের (ছাত্রলীগের) দল, মাঝিপাড়া কুমুল্লীর পাশে খোকার দল সর্বদা ওৎ পেতে বসেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য কোন মুক্তিযোদ্ধাই হানাদারদের পালিয়ে যাবার খবর জানতে বা বুঝতে পারেনি। ১৯৪৫ সালে জাপানী সেনাবাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বৃটিশ সেনাদল যেভাবে বার্মা থেকে সাফল্যজনক ভাবে পশ্চাদপসরন করেছিল, ঠিক সেইভাবে পাক-হানাদার বাহিনীও মুক্তিবাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বিভ্রান্ত করে বিশেষ সফলতার সাথে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।
এতবড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা আর সে রাতে ঘুমাতে পারলোনা। ব্যাপারটি তাদের রাতের ঘুম হারাম করে দিল। রাত চারটা থেকে তারা বাজার, দালাল জামিদার বাড়ী ও অন্যান্য স্থানগুলো তন্ন তন্ন করে তল্লাসী শুরু করলো। দালাল মেহেদী খান পন্নীর বাড়ীর মহিলারা গত রাতের ঘটনা অস্বীকার করে বসলো। মিথ্যাকে যেহেতুে সব সময় সত্য বলে চালানো সম্ভব নয়, মহিলারাও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখতে পারলোনা। হানাদাররা খালের ভিতর দিয়ে পায়ে হেটে এবং গড়িয়ে গড়িয়ে এই দালাল জমিদার বাড়ীতে এসেছিল। তাদের সমস্ত শরীরে কাদামাটি লেপটে ছিল, শুধু বাড়ীর আশেপাশেই নয়, বৈঠকখানাতেও কাদামাখা বুটের ছাপ স্পষ্ট। এমনকি কাদামাখা শরীর নিয়ে দু’এক জন হানাদার যে তাদের সুন্দর দামী সোফাগুলিতে বসেছিল তার চিহ্নও রয়ে গেছে। এসব দেখে শুনে, মুক্তিযোদ্ধারা মহিলাদের গালিগালাজ করতে উদ্যত হলে, তাদের থামিয়ে দিয়ে দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে বললাম,
— আপনারা মায়ের জাত হয়ে এত মিথ্যা ও কপটতার আশ্রয় নিয়ে ভাল করছেননা। এজন্য অবশ্য আপনাদের কিছু বলার নেই। বাড়ীর কর্তারা যে মানসিকতায় লালিত পালিত, স্বাভাবিক কারণেই আপনারাও তার কিছুটা পেয়েছেন, আমরা কিন্তু এতটা আশা করিনি।

শত্রুর মুখোমুখি
সকাল সাড়ে ন’টায় খবর পেলাম, গতকাল সন্ধ্যায় বাশাইল থানা মুক্ত হয়েছে। আমি বাশাইল থানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। যাবার সময় মেজর হাবিবকে করটিয়া ঘাঁটি আগলে থাকার দায়িত্ব দিলাম। নদী পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা করটিয়া-বাশাইলের কাঁচা রাস্তা ধরলো। আমার আগে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৬

দুর্মুজ খাঁ, ভোম্বল, বজলু, মান্নান, দুলাল ও কালাম সহ বারো-তের জনের একটি স্কট পার্টি। রাস্তায় বহুদিনের স্মৃতি বিজাড়িত একটি প্রাচীন বটগাছ। বহুযুগের বহু ঘটনা, কাহিনী ও কিংবদন্তীর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর বয়স কত কে জানে? কেউ বলেন, দেড়শ’ কেউ বলেন দু’শ বছর। আবার কারও কারও মতে আড়াইশ বছরের কম নয়। বয়স যাই হোক, বটগাছটি বাশাইল-করটিয়া রাস্তায় কত পথিককে ছায়া দিয়েছে তার হিসাব নেই। আমাদের থেকে বটগাছের দূরত্ব পাঁচশ’ গজের মত। সামনে আট-দশ হাত প্রশস্ত ও চার-পাঁচ হাত উঁচু ছোট্ট একটি কালভার্ট। স্কর্ট পার্টি কালভার্ট পেরিয়ে প্রায় ১০০ গজ এগিয়ে গেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম বটগাছের নীচে কাশিল-বিয়ালা- বাথুলী সড়ক সামনে রেখে কিছু লোক অবস্থান নিয়ে আছে। আমার সন্দেহ হলো। যদিও আমাদের কাছে খবর ছিল রাস্তা নিরাপদ, বাশাইল থানা মুক্ত। তবুও স্কট পার্টিকে ইশারা দিলাম সাথে সাথে সবাই শুয়ে পড়ে অবস্থান নিল। দাঁড়িয়ে রইলাম শুধু আমি।
এই সময় বাথুলী বটগাছের নীচে অবস্থানরত একজন চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘ঘাবড়াও মাত রাজাকার ভাইয়ো, আ যাও।
কথা শুনে বুঝতে পারলাম হানাদারদের গলার আওয়াজ। যদিও এর আগে অনেক জায়গায় রাজাকারদের বিভ্রান্ত ও বিপদে ফেলার জন্যে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের কণ্ঠস্বর নকল করে উর্দু জবানে কথা বলেছে। কিন্তু সামনে যে লোকটি রাজাকারদের ডাকছে, সে যে মোটেই নকল করে ডাকছেনা, তা আমাদের বুঝতে বাকী থাকলোনা।
আমি অনেকবার পশ্চিম পাকিস্তানে ঘুরেছি, বহু উর্দুভাষীর সাথে কথা বলেছি। সত্যিকার উর্দুভাষীর কণ্ঠস্বর আলাদা ধরনের। মুহুর্ত বিলম্ব না করে হানাদারটির চাইতেও গলার আওয়াজ চড়িয়ে বললাম,
— গুলি মাত করনা। হাম লোক রাজাকার হ্যায়, হেড-কোয়াটারসে হাম লোক কো ভেজা। একথা শুনে রাস্তার অপর পারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করা লোকটি বোধহয় কিছুটা সাহস পেল। সে আবার চিৎকার করে বললো,
— তোম লোগ রাজাকার হ্যায় তো ফের রোখা কিউ? আগে আ যাও৷ এই দুই চিৎকারেই কাজ হয়ে গেল। আমরা প্রায় সবাই অনুকূল অবস্থানে ছিলাম। শুধু সামনের স্কট পার্টি একেবারে উম্মুক্ত প্রান্তরে ছিল। গুলি চালালে তাদের বেঁচে থাকার বা রক্ষা পাওয়ার মোটেই সম্ভাবনা ছিলনা। তাই প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে ঐভাবে চিৎকার করে হানাদারদের বিভ্রান্ত করার চেষ্ট করেছি। চিৎকার শুনে কর্তব্য কী, অগ্রগামী মুক্তিযোদ্ধারা তা মূহুর্তের মধ্যেই বুঝে ফেলে। রাস্তার ডান পাশে গড়িয়ে পড়ে তারা আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসতে থাকে। প্রায় সত্তর-আশি গজ পিছিয়ে একটা নিরাপদ অনুকূল অবস্থানও পেয়ে গেল। আমিও রাস্তার আড়াল নিয়ে বসে পড়লাম। হানাদার বাহিনী ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে, সামনের দল মোটেই রাজাকার নয়, মুক্তিবাহিনী। তাদের একজন চিৎকার করে বললো,
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৭

— উসনে ঝুট বলা হ্যায়। ও লোগ রাজাকার নেহি। ওহি কাদের সিদ্দিকী। উসকো মার ডালো।
সাথে সাথে হানাদাররা বৃষ্টির মত গুলি ছোঁড়া শুরু করে দিল। ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধাদের সকলেই সেতুর আড়ালে নিরাপদ অবস্থান পেয়ে গেছে। রাইফেলের গুলি তো দূরের কথা, ট্যাংক থেকে গোলা ছুঁড়লেও আমাদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এদিন আমার কন্ঠের উর্দু জবানই হানাদরদের বিভ্রান্তির একমাত্র কারণ ছিল না। আমার পরনে ছিল খাকী সামরিক পোশাক। অন্যদিকে প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধার গায়ে ছিল কালো, খাকী, নীল ও নানা রং-বেরংয়ের পোশাক, একটি সাধারণ রাজাকারের দলও এ ধরনের পোশাকই পড়ে থাকে। এসব কারণে হানাদাররা অতি সহজেই বিভ্রান্ত হয়েছিল। হানাদারদের মূহুর্তের বিভ্রান্তির জন্যেই দশ-বারো জন মুক্তিযোদ্ধার অমূল্য জীবন বেঁচে যায়।
হানাদাররা মুষলধারে গুলি ছুঁড়ছে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন বিপদ বা ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। অগ্রবর্তী দলকে অন্য পুলের আড়ালে থাকতে বলে অন্য দলকে করটিয়া-বাশাইল সড়কের আড়াল নিয়ে কাটিয়ার কাছ দিয়ে উত্তরে বাথুলী বাজার ও প্রাইমারী স্কুলের কাছে অবস্থান নিতে নির্দেশ দিলাম। সামাদ গামাকে তার মর্টার বাথুলী বাজারের উত্তর-পশ্চিমে বসাতে আদেশ দিলাম। অবস্থান নেয়ার জন্য সবাই উল্কার মত ছুটে চললো। বারোজনের একটি দল নিয়ে আমি মূল রাস্তার উপরে অপেক্ষা করতে থাকলাম। সবুর, ফজলু, সামাদ গামা ছ’সাত মিনিটের মধ্যেই নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নিল। আরও দু’শ গজ পশ্চিমে গিয়ে হানাদারদের দিকে মুখ করে স্কট পার্টিতে অবস্থান নিতে নির্দেশ দিলাম। আমি ওদের থেকে তিনশ’ গজ পশ্চিমে গিয়ে অবস্থান নিলাম। আমার অবস্থান নেবার পর স্কট পার্টি কামুটিয়ার রাস্তা ধরে বাথুলী প্রাইমারী স্কুলের দিকে ছুটলো। আলাদা আলাদা অবস্থান নেয়ার কারণ, যদি সবাই একসাথে পিছিয়ে আসতে থাকি, তাহলে হানাদাররা পেছন দিক থেকে আঘাত হানার সুযোগ পেতে পারে। স্কট পার্টি আমাদের সামনে দিয়ে পশ্চিমে চলে যাবার পর আমরাও তাদের পিছু পিছু বাথুলী বাজারের দিকে ছুটলাম।
সবুর, ফজলু ইতিমধ্যে চল্লিশ জন বাছা বাছা মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কাশিল-বিয়ালা বাথুলী রাস্তার পাশে হানাদারদের মুখেমুখি অবস্থান নিয়েছে। আমি দৌড়ে মর্টার প্লাটুনের কাছে গিয়ে হানাদারদের পিছানো দিকে মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দিলাম। সামাদ প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে গেল। কারণ মর্টার থেকে হানাদারদের দূরত্ব বড় জোর এক মাইল। উপরন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের পঞ্চাশ গজের মধ্যে অবস্থান নিয়েছে। এই বিপজ্জনক অবস্থায় সে কি করে গোলা নিক্ষেপ করবে? এক মাইল দূরত্বের কমে ব্রিটিশ ৩ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। গোলা নিক্ষেপে সামান্য হেরফের হলে, হানাদারদের কাছাকাছি অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরও ক্ষতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এটা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন সামাদ গামা গোলা নিক্ষেপে বিরত থাকলো। প্রায় দু’মিনিট তাকে চিন্তিত ও দ্বিধাগ্রস্ত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার? গোলা ছুঁড়ছো না কেন? এখন প্রতিটি সেকেন্ড অত্যন্ত মূল্যবান।’ সামাদ কেঁদে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬৮

বললো, ‘স্যার, ফজলু-সবুর ভাইয়েরা হানাদারগোর একেবারে কাছাকাছি চইলা গেছে। ঐ দেহেন, দেহা যায়। অহন আমি কি কইরা গোলা ছুড়মু।’ সত্যিই মর্টার প্লাটুনের অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও হানাদারদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সামাদ গামাকে বললাম, ‘আজ মর্টার ফায়ারিং- এ শত্রুদের দেখতে পাওয়াটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে সুবিধার। তুমি সরে দাঁড়াও। গোলা আমাকে দাও। আমিই প্রথম গোলা ছুঁড়ছি।’ আমার কথা শুনে সামাদ গামা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বললো, ‘স্যার, এহেবারে সর্বনাশ হইয়া যাইবো। আমাগো গোলায় মুক্তিরা মারা পড়বো।’ ধমক দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললাম, ‘দেখ, যুদ্ধ তোমার কাছে শিখতে হবেনা। মুক্তিযোদ্ধারা যতখানি এগিয়ে গেছে, তাতে মর্টার থেকে গোলা ছুঁড়তে আর এক মিনিট বিলম্ব হলে হানাদারদের হাতে ওরা নিশ্চিত ধরা পড়ে যাবে। আমি তোমাকে হানাদারদের উপর গোলা ছুঁড়তে বলিনি। গোলা ছুঁড়তে বলেছি হানাদারদের পেছনে। ৩ইঞ্চি মর্টারের গোলার আঘাতে হানাদারদের ক্ষতির চেয়ে গোলার আওয়াজ বেশী দরকার। সামাদ বোধকরি আমার কৌশল বুঝতে পারলো। সে এগিয়ে আসার আগেই হানাদারদের পাঁচ-ছশ গজ পেছনে আমি সাত-আটটি গেলা নিক্ষেপ করে ফেলেছি। গোলা গুলো হানাদারদের পেছনে ও সামান্য ডানে পড়তে থাকায়, ব্যারেল উঠিয়ে আরও একটু বামে সরিয়ে গোলাগুলো আরও কাছাকাছি নিক্ষেপের চেষ্টা করলাম।
দ্বিতীয় বার পরপর চারটি গোলা ছুঁড়লে দেখা গেল হ্যাঁ, এবার অনেকটা এগিয়ে এসেছে। হানাদারদের দেড়শ’ থেকে দু’শ গজ পেছনে গোলা পড়ছে। আমার নিশানা দেখে সামাদ গামা থ মেরে গেল। সামাদ আমার পা জড়িয়ে ধরে বললো, ‘স্যার, আপনি এত নিরিখ কইরা গোলা ছুঁড়তে পারেন?’ এ ধরনের কথা শোনার বা জবাব দেবার সময় তখন ছিলনা। সামাদের পিঠ জোরে চাপড়িয়ে বললাম, ‘আজ নিশানার প্রশ্ন নয়, পরে কোনদিন যদি সুযোগ হয় দেখা যাবে। আমি সবুরের কাছে চললাম। তুমি সব সময় আমাকে লক্ষ্য করবে। আমি হাতে সাদা কাপড় উঁচু করলেই গোলা ছুঁড়বে, নামালেই গোলা ছোঁড়া বন্ধ করে দেবে উঁচু নীচু নয়, আমার হাতের সাদা কাপড় দেখেতে পেলেই তুমি গোলা ছুঁড়বে। তবে সাবধান, গোলা যেন আর এগিয়ে না আসে। হানাদাররা যদি জায়গা ছেড়ে না দেয়, তাহলে সবুর ফজলুর দলকে পিছিয়ে নিয়ে আসবো। তখন তুমি নিশানা করে গোলা ছুঁড়বে, আমি চললাম। আমার যাওয়া পর্যন্ত তুমি পঁচিশ-ত্রিশটি গোলা ছোড়। তবে একবার গোলা ছুঁড়তে এক মিনিট বিলম্ব হলে, দ্বিতীয়বার আমার হাতে সাদা কাপড় না দেখে আর গোলা ছুঁড়বেনা।”

দুঃসাহসী আবদুল্লাহ
আমি হানাদারদের কাছাকাছি অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে ছুটছি। আমার সাথে ষোল-সতের জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। আমরা দৌড়ে চলেছি। সামাদ গামা একের পর এক ৩ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ করে চলেছে। ওদের কাছাকাছি পৌঁছবার আগেই সবুর, ফজলু ও সামাদ গামার গোলাগুলির চাপে হানাদাররা বাথুলী রাস্তা ছেড়ে বাশাইলের রাস্তা ধরে বিশৃঙ্খল অবস্থায় পশ্চাদাপসরন করতে শুরু করে। তখন হাতে সাদা কাপড় অপ্রয়োজনে বাহির থেকে দেখা যেতে পারে এই আশংকায় কাপড়ের টুকরো পকেটে ভরে রাখলাম। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা বটগাছ পর্যন্ত
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫৯

এগিয়ে গেছে। কিন্তু তারপর সম্পূর্ণ জায়গা ফাঁকা, কোনও আড়াল নেই। মুক্তিযোদ্ধারা আরও এগুচ্ছে। আমি ওদের সাথে মিলতে উর্ধ্বেশ্বাসে ছুটছি, কিন্তু পেরে উঠছি না। আমি পৌছবার আগেই বটগাছের নীচ থেকে বাশাইলের দিকে আরও একশ’ গজ এগিয়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের ‘হ্যান্ডস আপ’ ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চিৎকার করছে। হানাদার ও মুক্তিবাহিনী উভয় দলই তখন ফাঁকা জায়গায়। আবদুল্লাহ সবার আগে, তার এক পাশে আজাহার ও ময়থার বেনু। অন্য পাশে দুলাল, বজলু ও ভোম্বল। তার পনের-কুড়ি গজ পেছনে ডাইনে সবুর, বামে ফজলু ও রাস্তার উপর সাইদুর রহমান। হানাদারদের উদ্দেশ্যে আবদুল্লাহ হ্যান্ডস আপ! হ্যান্ডস আপ! বলে প্রচন্ড জোরে চিৎকার করেছে। অবস্থার বিপাকে বেশ কজন খানসেনার হাতও উপরে উঠে গেছে, কিন্তু পেছনের দু’একজন হানাদার সামনের সেনাদের হাত নীচে নামিয়ে নেয়ার জন্য ধমকাচ্ছে, গালি-গালাজ করছে। আবদুল্লাহ, আজাহার, ভোম্বল, বেনুরা হানাদারদের থেকে বড়জোর পঞ্চাশ গজ দূরে। পাসেনারা আরও পঞ্চাশ গজ পিছিয়ে যেতে পারেল একটি বাড়ীর আড়াল পেয়ে যাবে। মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁকা মাঠে বিপদে পড়বে, এটা আশংকা করে আমি জোরে সামনে ছুটলাম। ‘হ্যান্ডস আপ’ এর ঐ দৃশ্য দেখে আমার মনে হচ্ছিল আমি নিজে যেখানে উপস্থিত সেখানে একজন সাধারণ সহযোদ্ধা পুরো দলকে আত্মসমর্পণ করিয়ে ফেলছে, এ কেমন কথা? কোনও যুদ্ধেই সহযোদ্ধারা আমাকে একশ-দেড়শ গজ পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারেনি। আমি তখনও দেড়শ’ গজ পেছনে পড়ে আছি। এতটা পেছনে পড়ে থাকা প্রচন্ডভাবে আমার পৌরুষ আঘাত করছিল।
আমি জোরে আরও জোরে আবদুল্লাহর দিকে ছুটলাম। একনাগাড়ে ছুটে আবদুল্লাহর থেকে তিনি চার গজ সামনেও এগিয়ে গেলাম। এসময় হানাদরদের দিক থেকে প্রচণ্ড গুলি আসতে থাকলো। আবদুল্লাহ যখন ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চিৎকার করে এগুচ্ছিল, তখন কোন পক্ষ থেকেই মিনিট দুই গুলি চলেনি। মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেছিল শত্রুরা হাত তুলে ফেলেছে, তাদের উপর আর গুলি চালানো ঠিক হবে না। অন্যদিকে, অনেকক্ষন গুলি ছোঁড়ার কারণে হানাদারদের নতুন করে ম্যাগজিন ভরার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আমি যখন এগিয়ে যাই, তখন হানাদাররা কিছুটা আড়াল পেয়ে যায় এবং মুষলধারে গুলি ছোড়া শুরু করে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা ভয়ানক অসুবিধায় পড়ে গেল। আমি, আবদুল্লাহ ও অন্যান্যরা বলতে গেলে ফাঁকা জায়গায় হানাদারদের সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি।
মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে হানাদারদের উপর তেমন গুলির চাপ নেই। আমাদের প্রায় সব বন্দুকই ফাঁকা, সবাই গুলি ভরতে ব্যস্ত। এই অপ্রস্তুত অবস্থায় খান সেনারা আমাদের দেখে দেখে গুলি ছুঁড়তে লাগলো। আমাদের চারপাশে শিলাবৃষ্টির মত ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট এসে পড়ছিল। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে, চিৎবাঁক খেয়ে মূহুর্তে রাস্তার উপরে উঠে পড়লাম। আমার কাছে তখন রাস্তার উপরটাই বেশী নিরাপদ মনে হচ্ছিল। কারণ হানাদাররা রাস্তার দু’পাশ থেকে কোল ঘেঁষে গুলি চুঁড়ছিল। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা তখন আমাকে অনুসরণ করে রাস্তার উপরে উঠে পড়ল। অন্য-
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭০

দিকে সবুর, সাইদুর, ফজলুদের দলের প্রায় পনের কুড়ি জন স্বয়ংক্রিয় হাতিয়ারে নতুন করে গুলি ভরে হানাদারদের উপর গুলি বৃষ্টি শুরু করে দেয়। এতে আমাদের উপর হানাদরাদের চাপ শিথিল হয়ে পড়ে। আমরা পঞ্চাশ গজ পিছিয়ে এসে একটা অনুকূল ও নিরাপদ অবস্থান পেয়ে গেলাম। আমি আরিফ আহমেদ দুলালের চাইনীজ রাইফেল এক ঝটকায় নিয়ে ছ’সাত জন মুক্তিযোদ্ধা সহ চকের মাঝ দিয়ে কাশিল গ্রামের দিকে ছুটলাম। আমার উদ্দেশ্যে, পাশের গ্রাম থেকে হানাদাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। কিন্তু দক্ষিণ দিকে একশ’ গজ যাওয়ার পর আবার বিপদে পড়ে গেলাম। সামনে পানি, এগুনো সম্ভব নয়-পিছনোরও উপায় নেই। বামে হানাদার, ডানে পানা বোঝাই জলাভূমি। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আবার পেছনেই আসতে লাগলাম। দু’তিন জন নিরাপদে পিছিয়ে গেছে। ফাঁকা জায়গার মাঝামাঝি আমি একা, আর মাত্র পঞ্চাশ গজ উত্তরে যেতে পারলেই আড়াল পেয়ে যাবো। ছুটন্ত অবস্থায় জনৈক হানাদার আমাকে নিশানা করে গুলি ছুঁড়তে উদ্যত, চট করে বসে পড়ে তাকে লক্ষ্য করে চাইনীজ রাইফেল থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়লাম, হানাদারটি সাথে সাথে লুটিয়ে পড়লো। সেদিন যদি খান সেনাটি আগে গুলি ছোঁড়ার সুযোগ পেত, তাহলে আমার বিপদ ঘটতে পারতো।
গুলি ছোড়ে এক মুহুর্তও দেরী না করে আবার ছুটলাম নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে, পেয়েও গেলাম। বিশৃঙ্খলভাবে দৌড়াদৌড়িতে সকল মুক্তিযোদ্ধাই ক্লান্ত, শ্রান্ত। অনেক সময় ধরে এক নাগাড়ে গুলি ছোড়ায় রেগুলেটর সাময়িকভাবে বন্ধ হওয়ার দরুন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সব স্বয়ংক্রিয় হাতিয়ারগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। ভরসা কেবল ৩০৩ রাইফেল। সবাই তাড়াতাড়ি গ্যাস রেগুলেটর ঘুরিয়ে সক্রিয় করে নিচ্ছিল। এই যুদ্ধের মধ্যেও কাশিল, বিয়ালা, বাথুলী, দাপনাজোর, ফুলকি, ভুক্তা, কাটিয়া ও পৌলি প্রভৃতি এলাকায় লোকজন ছাতু, চিড়া-মুড়ি, দুধ-কলা ও কলস ভর্তি পানি এনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াতে শুরু করেছেন। আমি কিছু ছাতু, দুধ ও পানি খেয়ে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম। এত উত্তেজনার মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধাদের রসবোধ কমেনি। সবুর মুখ খুললো, ‘কোদালিয়া, মির্জাপুর, দেওহাটা কত যুদ্ধ কইরা আইলাম বন্দুক তুই থামলি না। মিলিটারী গো কেনা বন্দুক বইল্যা তুই তাগোর উপর চলতে চাসনা।’ সাইদুর সবুরকে সমর্থন করে বললো, ‘সবুর ভাই, আমার ও ঐ রকম মনে হইতাছে। কতদিন ধইরা যুদ্ধ করছি। কোনদিন গ্যাসের জন্য আমার অস্ত্র খাড়াইল না। আজ নলের মুখে হানাদারদের পাইয়াও বারবার বন্দুক খাড়াইয়া যাইতাছে।’ আমার ও ঐরকম একটা সন্দেহ হইছিল। আমিও তাদের সাথে যোগ দিলাম, ‘হ্যা, আজ কিন্তু আমারও ঐ রকম সন্দেহ হচ্ছে। আমাদের শতকরা আশিটা অস্ত্রই হানাদারদের কাছ থেকে দখল করা। তাই ওদের অস্ত্র বোধহয় ওদের উপর চলতে চাইছেনা। আমাদের উপরও কিন্তু তাদের অস্ত্র তেমন কোন কাজ করতে পারে নাই। তা না হলে এই এলোমেলো অবস্থায় কজন যে আজ মারা পড়ত, তা আল্লাহই জানেন। তোরা দেখ আমাদের গায়ে আঁচড়ও লাগেনি। এই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের রসবোধের জোয়ার যেন একটু ভাটা পড়ে। না, আঁচড় লেগেছে। তবে মুক্তিযোদ্ধারা তখনও বুঝতে পারেনি। ছোট্ট পুলের নীচে বসে আমরা যখন এই রসিকতা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭১

রছিলাম, তখন বেনু মির্জার পা থেকে জলের ধারায় রক্ত ঝরছিল। বেনু মির্জার পায়ের কাছে চাপ চাপ রক্ত। বজলু ও ভোম্বল তা সর্ব প্রথম লক্ষ্য করে। তারপর সবাই। ক্যাপ্টেন ফজলু বেনুকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বেনু, তোর পায়ের কাছে এত রক্ত কেন? তোর কি গুলি লেগেছে?’ বেনু আশ্চর্য হয়ে বললো, ‘না তো। কই? কিসের রক্ত?’ নিজের পায়ের দিকে তাকাতেই বেনু অবাক সত্যিই তো। রক্ত। রক্তে একেবারে ভেসে গেছে। তখনও কিন্তু বেনু জানেনা যে, তার পায়ে গুলি লেগেছে। সে ব্যথা অনুভব করছেনা। জমাট রক্ত সরিয়ে দেখা গেল, বেণুর পায়ের পাতা গুলিতে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেছে। পা থেকে তখনও রক্ত চুইয়ে পড়ছে।
বেনুকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা কিছু সময়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হলো। দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধ ক্লান্তিতে কিছুটা নুইয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধারা জনতার নিয়ে আসা খাবার খেয়ে, নতুন মনোবল ও শক্তি নিয়ে হানাদারদের উপর ঝাপিয়ে পড়লো। এবার পরিবর্তিত যুদ্ধ পরিকল্পনা। হানাদারদের উপর ঝটিকা আক্রমণের নেতৃত্বে থাকলো-সবুর, সাইদুর ও ফজলু। তারা পঞ্চাশ জন সহযোদ্ধা নিয়ে ‘ভি’ আকারে এগিয়ে গিয়ে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়লো। আমি কুড়ি-পঁচিশ জন নিয়ে পেছন থেকে কয়েকটি এল, এম. জি. ও দুটি মর্টার থেকে হানাদারদের উপর অবিরাম গুলি ও শেলবর্ষণ করতে লাগলাম। খাবার ও বিশ্রাম শেষে নয়া বলে বলীয়ান মুক্তিযোদ্ধারা সামনের গ্রামে হানাদারদের অবস্থান তিন-চার মিনিটের মধ্যে বিস্ময়করভাবে তছনছ করে ফেলতে সক্ষম হলো। অবস্থান ছেড়ে, আবার আগের মত বিশৃঙ্খল অবস্থায় বাশাইলের দিকে পিছুতে লাগলো। লাঙ্গুলিয়ার খাল পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়ে হানাদাররা আবার সুদৃঢ় অবস্থান নিতে চেষ্টা করে, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রবল চাপে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো। এইখানে আমি অবিস্মরণীয় গোলা নিক্ষেপ করলাম। একটি শেল হানাদারদের ত্রিশ-চল্লিশ গজ সোজাসুজি সামনে রাস্তার উপর পড়লো। দূরত্ব সামান্য একটু বাড়িয়ে দ্বিতীয় গোলা নিক্ষেপ করলাম। এটি একেবারে নিখুঁত ও নির্ভুল নিশানায় গিয়ে আঘাত হানলো। এ যেন দেখেশুনে শান্ত পানিতে ঢিল ছোড়ার মত অবস্থা। হানাদারদের অনেকেই এদিক- সেদিক ছিটকে পড়লো। অনেকে আবার আরও গুটিশুটি হয়ে গেল। আমি আরও একটি গোলা নিক্ষেপ করলাম। এটার নিশানাও নির্ভুল, পর পর দু’টি গোলার প্রচণ্ড আঘাতে হানাদারদের মাঝে মহামারি লেগে যায়। এর আগে দু’শ গোলায় হানাদারদের যে ক্ষতি করতে পারেনি, এই দুটি গোলায় তার চেয়ে অনেক গুণ বেশী ক্ষতি হলো। যাত্র ঐ দুটি গোলাতেই সেখানে আর অপেক্ষা করা বা পাল্টা আঘাত হানা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেনি। এছাড়া তাদের বেশীদুর পশ্চাদপ সরনের সুযোগ ছিলনা। মাইল খানেক পেছনে বাশাইল থানা। সেখান থেকে তাড়া খেয়েই এরা টাংগাইলের দিকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল। ভাগ্য মন্দ, আচমকা মুক্তিবাহিনীর সামনে পড়ে গিয়ে তাদের নিরাপদে পালানোর পথ বন্ধ হয়ে যায়। সামনে মুক্তিবাহিনী, পেছনে মুক্তিবাহিনী, এমনি অবস্থায় যা হয়—তাই হলো। মুক্তিবাহিনীর ফাঁদে পড়ে প্রচণ্ড চাপের মুখে, তারা উদ্দেশ্যহীন ভাবে দক্ষিণে কাশিল-বিয়ালার দিকে সরে যেতে থাকে। আমরা আর এ সময়ে ওদের উপর বেশী
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭২

চাপ সৃষ্টি করতে এগিয়ে গেলামনা। লাঙ্গুলিয়া খাল পার পর্যন্ত এগিয়ে অগ্রাভিযানে বিরত দিলাম। এখানে হানাদার পরিত্যক্ত একটি এল. এম. জি. তিনটি চাইনীজ রাইফেলসহ ছ’হাজার গুলি আমাদের হস্তগত হয়। হানাদারদের তিনটি লাশ ও তিনজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এলো। লাঙ্গুনিয়া খালের পাড়ে পরে থাকা হানাদারদের লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য বাশাইল থানার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এক বার্তা পাঠালাম, আহত তিনজন রাজাকারকে বাথুলী বাজার পর্যন্ত নিয়ে এলাম।
এর পর ঘটলো আর এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। বাশাইল-করটিয়ার রাস্তা ছেড়ে সামান্য উত্তরে বাথুলী বাজারে পৌছা মাত্র করটিয়ার দিক থেকে প্রায় তিনশ নিয়মিত হানাদার বাশাইলে আটকে পড়া খান সেনাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। আমরা আর পাঁচ মিনিট রাস্তার উপর অপেক্ষা করলে, হানাদারদের চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হতাম।
পেছন দিকটা সম্পূর্ণ নিরাপদ নয় জেনে, লাঙ্গুলিয়া খালের পাড় পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ফিরে আসতে নির্দেশ দিই। নির্দেশ পেয়ে প্রথম অবস্থায় খুবই বেদনাহত হয়েছিল। তারা দু’তিন বার আমাকে অনুরোধও করেছিল, দক্ষিণে সরে যাওয়া হানাদারদের বেশীদূর যাওয়ার রাস্তা নেই। আর একটু চাপ দিতে পারলে সবাই অস্ত্রসহ ধরা পড়বে। অগ্রবর্তী দলের কথায় কর্ণপাত করিনি। আমাকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলাম। বাধ্য হয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অগ্রবর্তী দল আমাকে অনুসরণ করে বাথুলী বাজার পর্যন্ত আসে। এখানে এসে পেছন দিক থেকে দীর্ঘ সারিতে প্রায় ৩শ নিয়মিত খানসেনাকে আসতে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা বিস্মিত হয়ে যায়। আমিও যুগপৎ বিস্মিত হই এবং এদের আক্রমনের হাত থেকে সময় মতো সরে আসতে পেরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। হানাদার দলটি অবশ্য বেশীক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করেনি। লাঙ্গুলিয়া খাল পাড়ে পড়ে থাকা ৮টি খানসেনার লাশসহ বাইশ-তেইশটি মৃতদেহ ও প্রায় চল্লিশ জন আহতকে নিয়ে আবার করটিয়ায় ফিরে যায়।

কর্নেল ফজলুর অভিনব বিচার
বাথুলীতে যখন যুদ্ধ চলছিল, ফতেপুরে তখন আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। আমি ফতেপুর থেকে ফাজিলহাটি, দেলদুয়ার হয়ে ১৯শে নভেম্বর রাতে ঢাকা-টাংগাইল পাকা সড়কে আঘাত হানতে যাই। অসুস্থতার কারণে কর্নেল ফজলুর রহমান ফতেপুরেই থেকে যান। তার সাথে তখন পনের-ষোল জন মুক্তিযোদ্ধা। এর মধ্যে আবার কজন অসুস্থ। ২০শে নভেম্বর দুপুরের মধ্যে তার কাছে প্রায় দু’শ রাজাকার পাঠানো হয়। সন্ধ্যার দিকে রাজাকারের সংখ্যা ছয়শতে গিয়ে ঠেকে। কর্নেল এমনিতেই অসুস্থ ও দুর্বল। বন্দী রাজাকারের সংখ্যা যখন শ’চারেকে দাঁড়ায়, তখন তিনি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সংখ্যা ছ’শতে দাঁড়ালো। তিনি শুধুমাত্র উদ্বিগ্ন নন, রীতিমত বিচলিত হয়ে পড়লেন। প্রচণ্ড উদ্বেগ আর উত্তেজনার মধ্যে তার ২০শে নভেম্বর রাত কাটে। সত্যিকার অর্থেই উদ্বিগ্ন হওয়ার মত যথেষ্ট কারণ ছিল। তারা মাত্র পনের-ষোল জন। রাজাকারদের পাহারা দিয়ে নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল খুবই কম। সব মিলিয়ে পঞ্চাশের বেশী হবেনা। আর এরা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় চতুর, সাহসী ও চৌকষ, এমন ভরসা করা যায় না। এমনি অবস্থায় ২১শে নভেম্বর
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৩

সকাল দশটা বাজতে না বাজতেই আরও দু’শ জন রাজাকার নিয়ে কুড়ি জন মুক্তিযোদ্ধা ফতেপুরে কর্নেলের কাছে হাজির। এই সময় তার অসুস্থতা আরও বেড়ে গেল, জ্বরের তীব্রতায় তিনি কোমর সোজা করে, মাথা ঠিক রেখে দাঁড়াতে পারছিলেন না। বন্দী আটশ রাজাকার মোটামুটিভাবে ট্রেনিং- প্রাপ্ত, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মাত্র সত্তর-আশি জন। এ সময় কর্নেল হানাদারদের ফতেপুরের দিকে এগিয়ে আসার সংবাদও বার বার পাঁচ্ছিলেন। এতে তার উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। হানাদাররা এসে পড়লে, তিনি তা মোকাবিলা করতে পারবেন না। রাজাকাররাও যদি তাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরে বিদ্রোহী হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের সামাল দেয়া বা দমন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। তাই শুধু উদ্বেগ নয়, ঘাবড়েও যান। অসুস্থতা ও জ্বরের ঘোর বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে নাড়ীর স্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন বা ঘাবড়ে গিয়েছেন, এটা কোন অবস্থাতেই বুঝতে দেয়া যাবে না। এটা প্রকাশ পেলে শত্রু তো উৎসাহিত হবেই, বিপদ বহুগুণ বেড়ে যাবে। শুধু বেড়ে যাবেনা, আটশ ট্রেনিংপ্রাপ্ত রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, ইচ্ছামত প্রতিশোধ নেবে।
বাইরে শান্ত থেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিকতা বজায় রাখা ছাড়া কর্নেলের আর কোন বিকল্প নেই। বেলা সাড়ে বারো কি একটা পর্যন্ত অনেক কষ্টে কোনক্রমে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে চললেন।কিন্তু এরপর বাহ্যিক কৃত্রিম স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলেন, তার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেল। হাজারো আশংকা নিয়ে কর্নেল ফজলু বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। তার পা চলছে না। চোখ লাল। মাথা ঘুরছে। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। তবুও উপায় নেই, কোন বিকল্প নেই। বিপদ হাঁটুর নীচে নয়, হাঁটুর উপর উঠে পড়েছে। তিনি পোশাক পরে নিলেন। বহু দিনের ব্যবহৃত বেতখানা ভালভাবে দেখে নিয়ে, শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে, কোন রকমে রাজাকারদের সামনে গিয়ে হাজির হলেন। ফতেপুর বাজারের পাশের মাঠে সারিবদ্ধ দাঁড়ানো আটশ রাজাকার বিচার ও শাস্তির অপেক্ষায়। কয়েকজনকে তিনি ভালভাবে নিরীক্ষণ করলেন। তার চোখের চাহনি, হাবভাব ও নিরীক্ষণের কায়দা-কৌশলই ছিল রাজাকারদের জন্য ভীতি ও আতংকের ব্যাপার। তালিকা দেখে দেখে যাকেই তার সন্দেহজনক ও মারাত্মক বলে মনে হচ্ছে, তাকেই লাইন থেকে বের করে সাথে সাথে ইশারায় নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘গুলি’ পাশে সদ্য প্রস্তুত দুই- তিন জন মুক্তিযোদ্ধা নেকড়ের ক্ষিপ্রতায় আদেশ পালন করছে।
এমনিভাবে ফতেপুর মাঠে আট জন রাজাকারকে গুলি করে শাস্তি দেবার পর কর্নেল ফজলু চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘তরা শালারা বাংলাদেশ চাস?’ বাকী রাজাকাররা আকাশ-বাতাশ প্রকম্পিত করে সম্মিলিত কন্ঠে জবাব দিল,
— হ্যাঁ, আমরা বাংলাদেশ চাই।
— তাহলে বল্ বেটারা, জয় বাংলা, জয় মুক্তিবাহিনী, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় কাদের সিদ্দিকী। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার এমন দুর্লভ ও অপ্রত্যাশিত সুযোগ। রাজাকারদের সেকি ভীষণ গগনবিদারী শ্লোগান। দেহের সমস্ত শক্তি, সমস্ত উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে তারা শ্লোগানের পর
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৪

শ্লোগান দিয়ে চলেছে। শ্লোগান দিতেই যেন তাদের জন্ম হয়েছে। শ্লোগান ছাড়া তারা যেন আর কিছু জানেনা, বুঝেনা। জয় মুক্তিবাহিনী ও জয় কাদের সিদ্দিকী শ্লোগান দুটির দিকেই তাদের ঝোঁক সবচেয়ে বেশী। এক সময় কর্নেল হাত তুলে থামতে বলেন। এ যেন আধুনিক বিদ্যুৎচলিত যন্ত্র। সুইচ টিপলে চলে, আবার টিপলেই বন্ধ হয়। হাত তোলার সাথে সাথে শ্লোগান বন্ধ, সব নীরব। যেন কবরের নীরবতা, সুঁই পড়লেই শব্দ শোনা যায়।
কর্নেল ফজলু দু’তিন মিনিট আবেগময়ী ভাষায় বক্তৃতা করলেন। মুক্তিবাহিনীর মহানুভবতার কথা উল্লেখ করে সকল রাজাকারদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোদের মুক্তি দিলাম।’ কর্নেলের মুখ থেকে ‘মুক্তি’ কথাটি বের হতে না হতেই আবার ফতেপুর শ্লোগানে শ্লোগানে থর থর করে কেঁপে উঠলো। ‘দশ মিনিটের মধ্যে তাদের স্থান ত্যাগ করতে হবে এবং দশজনের বেশী একত্র হতে পারবেনা’-এমন কঠোর নির্দেশ দিয়ে কর্নেল ফজলু তার ঘরে গিয়ে প্রচণ্ড জ্বরে কাপতে কাপতে বিছানায় শুয়ে পড়েন। কজন রাজাকারের সহায়তায় আটটি লাশ ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন করা হলো।
কর্নেল ফজলু এমনটি করলেন কেন? তার উদ্বেগের কারণ আগেই উল্লেখ করেছি। আলাপ আলোচনা করে আমি পরে জানতে পেরেছি, কর্নেল ফজলুর রহমান রাজাকারদের বিনা দণ্ডে মুক্তি দিতে চাননি। এতটুকু মাত্র বলা যেতে পারে, জ্বর ও উত্তেজনার কারণেই রাজাকারদের দোষত্রুটি সম্পর্কে পুংখানুপুংখরূপে বিচার বিবেচনা করা হয়নি। তবে এটা ঠিক, ৭১-এ বাংলাদেশে যারা রাজাকার হয়েছিল, তারা দু’একটি হত্যা, লুটতরাজ, নারীধর্ষন ও অগ্নিসংযোগের সাথে জড়িত নয়, এমন ধোয়া তুলসীপাতা রাজাকার একটিও খুঁজে পাওয়া যেতনা। তিনি তাই সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে ঐ দিনের দণ্ড নিরূপণ করেছিলেন। দ্বিতীয় কারণ হানাদাররা এসে রাজাকারদের যদি উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারতো, তাহলে যেমন হানাদারদের মনোবল বেড়ে যেত, ঠিক তেমনি মুক্তিবাহিনীর মনোবল স্বাভাবিক কারণেই কমে যেতে বাধ্য। অন্যদিকে রাজাকাররাও যদি বেঁকে বসতো, তাহলে উদ্ভুত পরিস্থিতি সামলাতে পারতো কিনা, এ ব্যাপারেও গুরুতর সংশয় ও সন্দেহ ছিল। তাই ঐভাবে নিজের উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বিচার করে তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে একাধিক উদ্দেশ্য সাধন করেছিলেন-
এক। এরপর যারা রাজাকার হবে, তাদের শাস্তি পেতে হবে।
দুই। হানাদার বাহিনীর বন্দী রাজাকারদের উদ্ধার করে নেওয়ার অথবা রাজাকারদের বেঁকে বসার আর কোন সম্ভবনা রইল না।
তিন। মুক্তিবাহিনী রাজকারদের হাতে পেয়েও ক্ষমা করে দিয়ে পরম মহানুভবতার পরিচয় দিল।

বাসাইল থানার পতন
নিহত ও আহতদের নিয়ে হানাদার দল টাংগাইলের দিকে চলে গেলে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ময়থা গ্রামে গিয়ে দ্বিতীয়বার বাশাইল থানায় দূত পাঠালাম। দূত ফিরে এসে বাশাইল থানা দখলের নিশ্চিত খবর দিল। সন্ধ্যায় নৌকাযোগে লাঙ্গুলিয়া খালের পাড়ে নেমে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৫

হেঁটে থানায় গেলাম। বাশাইল থানা তখন মেজর লোকমান হোসেন ও মেজর গোলাম মোস্তফার দখলে। বিজয়োল্লাসে তারা আমাকে স্বাগত জানালো। কিন্তু তাদের আনন্দ-উল্লাস বেশীক্ষণ স্থায়ী হলোনা। বাশাইল থানা দখলের সঠিক সংবাদ প্রেরণে ব্যর্থতা ও লক্ষ্যভ্রষ্ট গোলা নিক্ষেপের কারণে আমার মৃদু তিরষ্কারে তারা কিছুটা অস্বস্তি ও লজ্জায় পড়ে। মেজর লোকমানের পাঠানো সংবাদ পেয়ে করটিয়ার দিক থেকে বাশাইল আসার পথে বাথুলীতে আমাদের যে মারাত্মক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে, তার জন্য যারপর নাই বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। মেজর লোকমান করটিয়ায় আমার কাছে সংবাদ পাঠিয়েছিল যে বাশাইল সহ সমস্ত এলাকাটাই মুক্ত। অথচ তার খবর মোটেই সঠিক ছিল না। তিরস্কারের দ্বিতীয় কারণ-বাশাইল থানা দখলের যুদ্ধে প্রায় দুশ ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। যার মাত্র দশ-পনেরটা গোলা থানার আশেপাশে পড়ে। এর মধ্যে আবার মাত্র দুটি গোলা বাশাইল থানা উন্নয়ন ভবনের হানাদার ঘাঁটির কেন্দ্রবিন্দুতে পড়েছিল। বাকী গোলা সব থানা থেকে এক-দেড় মাইল দূরে গ্রামের আশেপাশে গিয়ে পড়েছিল। থানায় গোলা না পড়ার কারণে যত না ক্ষুদ্ধ, তার চাইতে বেশী ক্ষুদ্ধ হই হানাদার ঘাঁটির বাইরে লোকালয়ের আশেপাশে যত্রতত্র গোলা পড়ে বিস্ফোরিত হওয়ায়। আমি কমাণ্ডারদ্বয়কে কঠোরভাবে বললাম, ‘তোমাদের কাউকেই, নিরস্ত্র, নিরীহ জনসাধারণের উপর মর্টারের গোলা নিক্ষেপের অধিকার দেয়া হয়নি।’ রক্ষা যে তাদের নিয়ন্ত্রণহীন গোলা নিক্ষেপে আশপাশের গ্রামের কোন লোক বা পশু পক্ষীও হতাহত হয়নি। হতাহত হলে কমাণ্ডার দু’জনকে সত্যি খুব অসুবিধায় পড়তে হতো। বাশাইল থানা দখলের যুদ্ধে দশ-পনের জন মুক্তিযোদ্ধা দুর্দান্ত সাহসের পরিচয় দেয়। হানাদারদের বাংকারের একদম কাছে গিয়ে বারবার হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর ফলে থানা উন্নয়ন ভবনের পূর্ব-দক্ষিণ দিকের বাংকারগুলো মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। থানা উন্নয়ন ভবনের সামনে একটি বাংকার দখল নিতে গিয়ে কাউলজানির তোফাজ্জল শহীদ হয়। অন্যদিকে কাশিলের সোহরাব মিয়ার ছেলে দুলাল মিঞা ও টাংগাইল যুগনী গ্রামের মোহাম্মদ সোহরাব বাশাইল থানার বিজয়ের পতাকা উড্ডীন দেখে যেতে না পারলেও বুকের তাজা রক্ত ঢেলে থানা দখলের পথ সুগম করে সহযোদ্ধাদের কপালে জয়টিকা এঁকে শাহাদাৎ বরণ করে।

হেড-কোয়ার্টারে
কমাণ্ডার মোস্তফাকে তার দলসহ ফতেপুরে গিয়ে কর্ণেল ফজলুর রহমানকে সাহায্য করতে নির্দেশ দিয়ে একমাস কয়েকদিন পর ২২শে নভেম্বর আবার হেডকোয়ার্টারে পৌছলাম। ইতিমধ্যে বর্গারচালা থেকে ধুমখালী ছালাম ফকীরের বাড়ীতে তৃতীয় বার হেডকোয়ার্টার বদল করা হয়েছে। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ হেড কোয়ার্টারে ছিলেন না। তার জায়গায় সব বিভাগের সমন্বয় সাধনের কাজ হামিদুল হক দক্ষতা ও অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গণপরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকী, শওকত মোমেন শাজাহান, অধ্যাপক মাহবুব সাদিক, অধ্যাপক কাজী আতোয়ার, আলী আজগর খান দাউদ, সোহরাব আলী খান আরজু, মোহাম্মদ আলী হোসেন, টাংগাইল বাস এসোসিয়েশনের
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৬

সেক্রেটারী হাবিবুর রহমান হবি মিঞা, আউয়াল সিদ্দিকী ও বিখ্যাত আর. ও. সাহেব দারুণভাবে হামিদুল হককে সহযোগিতা করেছিলেন। সখিপুর বাজারের মাইল দুই পূবে ছালাম ফকিরের ধুমখালির বাড়ীতে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে পৌঁছে সেখানকার কাজকর্ম দেখে অবাক ও বিস্মিত হলাম। পাহাড়ের মানুষের কর্মতৎপরতায় আমি বহুবার বিস্মিত হয়েছি। এখানকার মানুষের অসাধ্য সাধনের ক্ষমতা আছে। তারা নির্ভরশীল ও আস্থাশীল কাউকে পেলে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মত অসাধ্য সাধন করতে পারেন, তা বারবার দেখেছি এবং প্রমাণ পেয়েছি।
ছালাম ফকিরের বাড়ী ঘিরে দিনরাত কর্ম ব্যস্ততা। চতুর্দিক থেকে লোকজন আসছে আর যাচ্ছে। এদের কেউ মুক্তিযোদ্ধা কেউ বা স্বেচ্ছাসেবক। কেউ খবর বয়ে আনছে, কেউ খবর নিয়ে যাচ্ছে। এখানেই তাদের কৃতিত্বের শেষ নয়। বেসামরিক দপ্তরের কাজকর্মের পুরো বিভাগটাই সখিপুরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। বেসামরিক দপ্তরের অধিকাংশ কর্মকর্তারাই সখিপুর কমিউনিটি সেন্টারে নিয়মিত সারাদিনের জন্যে বসেন। দিনের বেলায় হামিদুল হকের মূল দপ্তর সাখিপুরে, রাতে ছালাম ফকীরের বাড়ীতে। প্রচার দপ্তরও ছালাম ফকিরের বাড়ীতে, বেতার বিভাগ ঐ বাড়ী থেকে চার-পাঁচ মাইল পশ্চিমে বর্গার চালাতেই রয়েছে। সদর দপ্তর ও বেতার বিভাগের দূরত্ব চার-পাঁচ মাইল হলেও টেলিফোন ও দূতের মাধ্যমে এই দুই দপ্তরের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। এমনি একটি সময়ে আমি সদর দপ্তরে এসেছি। আমার যেন আর কিছু করার নেই সব কিছু নিয়ম মাফিক নিখুঁত, ত্রুটিহীন স্বচ্ছন্দে চলছে।
আমি হেড-কোয়ার্টারে এসেছি। স্বাভাবিক কারণেই হেড-কোয়ার্টারের দায়িপ্রপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মতৎপরতা কিছুটা বেড়ে গেছে। হেড-কোয়ার্টারের সার্বিক দায়িত্বে যেমন হামিদুল হক ছিলেন, তেমনি নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন যুদ্ধে আহত ক্যাপ্টেন খোরশেদ আলম খোরশেদ আলম মাস খানেক হলো অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। যদিও তখনও তাঁর ক্ষত পুরো শুকোয়নি। তা সত্ত্বেও সে অসামান্য তৎপর, এক কথায় অতুলনীয়। হেড-কোয়ার্টারে আমার বহুদিনের ব্যবহৃত নির্দিষ্ট চেয়ার-টেবিলে বসে ২৩শে নভেম্বর সারাদিন বকেয়া কাজকর্ম সারলাম। তেমন কোন জটিল কাজ ছিল না। বিভাগীয় সব নথিপত্রের উপর শুধু চোখ বুলানো আর কিছু কিছু পরামর্শ দেয়া। ধলাপাড়া হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ও গণপরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তার বিভাগের কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটিয়েছিলেন। তিনি এমন সুস্থ ও সুন্দর জনসংযোগের ব্যবস্থা করেছেন, যা অকল্পনীয়। অন্যান্য বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্তরাও যোগ্যতার ছাপ রেখে যাচ্ছে।
হেড-কোয়াটারে দু’টি নূতন বিভাগের কাজ দেখলাম। এক ‘সাংস্কৃতিক’ অন্যটি ‘স্থিরচিত্র’। আলী হোসেন, কবিয়াল শাহানশাহ, ছালাম ও ছামান ফকীরকে কেন্দ্র করে একটি সাংস্কৃতিক তৎপরতা গোড়া থেকেও চলছিল, কিন্তু তা তেমন সুসংহতরূপে ছিল না। এবার হেড কোয়ার্টারে এসে দেখলাম তা দু’টি সুসংহত বিভাগে রূপ নিয়েছে। যদিও সাংস্কৃতিক বিভাগ ডিসেম্বরের আগে তেমন প্রসার লাভ করতে পারেনি। কিন্তু ‘স্থির চিত্র’ বিভাগটি যুদ্ধের চরম
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৭

মূহুর্তে পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে সমর্থ হয়।
এই বিভাগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল, টাংগাইল থানা পাড়ার বজলুর রহমান কুতুব। এছাড়া ছবি তোলা এবং ছবি তোলার সাজ সরঞ্জাম সরবরাহ করে সাহায্য করছিল বাবুল হক, কোপাখীর বাবলু, ঢাকার সেলিম, লাউহাটির ফজলু, পাঠান পাতার ব্যবসায়ী মমতাজ খান, ডাঃ শাহাজাদা চৌধুরী ও টাংগাইলের আমজাদ মিয়ার ছেলে রতন। আমাদের অনেকগুলো দলে ক্যামেরা ছিল কিন্তু শুধু ক্যামেরা হলেই তো ছবি হয় না? আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। চরম অনিশ্চিত অবস্থায় ফটোর ব্যাপারে সকল দায়িত্ব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কুতুব তার কাধে তুলে নেয়। সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে নিয়মিত কাঁচা ফিল্ম সরবরাহ এবং ছবি তোলা হলে হানাদারদের নাকের ডগা দিয়ে টাংগাইল শহরে নিয়ে গিয়ে ছবি করে আনা শুরু হয়। টাংগাইল আদালত রোডে কুতুবদের একটি বহু পুরানো পাউরুটির দোকান আছে সেখানে সে মাঝে মাঝে বসতো। একদিন কয়েকটি পাউরুটির মধ্যে আমাদের তোলা ১২টি ফিল্ম নিয়ে হঠাৎ টাংগাইলের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার জি. সাহার থানাপাড়ার বাড়ীতে কুতুব গিয়ে হাজির। জি. সাহার ছেলে মনোজ সাহার সাথে কুতুবের আগে থেকেই ভাব ছিল। সে মনোজ সাহার কাছে তার উদ্দেশ্য খুলে বললো। বজলুর রহমান কুতুবের কথা শুনে প্রথম অবস্থায় মনোজ সাহা ও তার দাদার কাপন ধরে যায়। লোকটা বলে কি? দেখতে সাদাসিদা হলেও তলে তলে এসব কি করছে। করুণ কন্ঠে মনোজ বললো,
— কুতুব ভাই, এমনিতেই জাত-ধর্ম সব গেছে। মুসলমান হয়ে কোনরকমে জীবনটা বাঁচিয়েছি। আপনি শেষ পর্যন্ত পৈতৃক জীবনটাও শেষ করবেন? খালেক তো সবসময় পেছনে লেগেই আছে।
— না মনোজ, যত অসুবিধাই হোক একাজ তোমাকে করতেই হবে। স্যারও আশা করেন তোমরা এ কাজ করবে। এই……. এই যে স্যার তোমাকে চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিটা নিয়ে মনোজ সাহা মনযোগের সাথে পড়ে বললো,
— কুতুব ভাই, ঠিক আছে, আমরা যেভাবে পারি কাজ করে দেব। কিন্তু আর কেউ এলে চলবে না। আপনি যে দিন ফিল্ম দেবেন, সেই দিনই আবার ফিল্ম এবং ছবি নিয়ে যাবেন।
কুতুব তাতেই রাজী, কারণ তার কাজ চাই। এরপর সে নিয়মিত ফিল্ম দেয়া-নেয়া শুরু করে দেয়। মনোজ সাহারা প্রথম প্রথম সামান্য ভয় এবং দ্বিধাবোধ করলেও পরে দারুণ সাহসের পরিচয় দিয়েছে। যদিও তাড়াহুড়ার জন্য সব কাজ সব সময় নিয়ম মত করতে পারেনি, যার কারণে ছবির স্থায়িত্ব কখনো কখনো কম হয়েছে। তবে কাজ চলে গেছে।

অদ্বিতীয় সামাদ গামা
২৩শে নভেম্বরের সারাদিনের কাজ শেষ। পরদিন আবার পশ্চিমাঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যাবো। বহুদিনের নিত্যসঙ্গী ও অনেক যুদ্ধে সফল মর্টার প্লাটুনকে হেড কোয়ার্টারে রেখে যাবো। মর্টার প্লাটুন কমান্ডার সামাদ গামাকে কাছে ডেকে বললাম, ‘সামাদ, অনেকদিন তুমি আমার সাথে থাকলে, তোমার কাজে আমি যারপর নাই সন্তুষ্ট। তোমার ওপর আমার আস্থা জন্মেছে, তাই হেড কোয়ার্টারে রেখে যাচ্ছি। আশা করি,
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৮

তুমি এখান থেকে তোমার মর্টার প্লাটুন নিয়ে নানা প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে প্রয়োজনের সময় উপযুক্ত সাহায্য করতে পারবে। আমার সংগে তোমার দেখা হতে হয়ত সময় লাগবে। তাই আমার কাছে কিছু চাইবার থাকলে নির্দ্বিধায় চাইতে পারো। আমি তোমাকে পুরস্কৃত করতে চাই।’
— স্যার, পুরস্কার কি। আমার কিছু চাইবার নাই। তয় আপনি যহন চাইল্যা যাইতেছেন, আপনার সামনে আমার একবার আপিত্তি মিটাইয়া খাইবার আশা আছিল। আমার আর কিছু চাইবার নাই।
— তুমি শুধু একবার আপিত্তি মিটিয়ে খেতে চাও, আর কিছু চাবার নেই?
— না স্যার, যদি অসুবিধা থাহে তাহলে পরে ব্যবস্থা কইরেন।
— না, কোন অসুবিধা নেই। কাল যাওয়ার আগে তুমি আমার সামনে পেট ভরে মন যত চাইবে, ততই খেতে পাবে। এখন যাও। তবে তোমার মর্টার নিয়ে সর্বত্র আগের মত সফলভাবে কাজ চালাবে। এটাই আমি আশা করবো।
— আপনি চইল্যা গেলে স্যার, আমি কার অর্ডার মত কাজ করুম। আমি তো স্যার, যার তার কথায় দৌড়াইতে পারিনা।
সামাদের সাদামাটা খোলামেলা কথায় একটু হোচট খেলাম। সত্যই তো। আমার ভুল হয়েছে, ‘তুমি শহীদ, হামিদুল হক ও আর. ও. সাহেবের নির্দেশ মত কাজ করবে। তাঁদের নির্দেশই আমার নির্দেশ বলে মেনে নিবে।’
— তাহলে স্যার, এই তিন স্যারের নাম একটা কাগজে লিইখ্যা দেন। আমি একটা কাগজে এক- আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, দুই- হামিদুল হক, তিন- খোরশেদ আলম আর. ও. লিখে স্বাক্ষর করে দিলাম।
পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় সামাদকে ডেকে আনা হলো। কমাণ্ডার খোরশেদ আলম তার সামনে তিন-চারটা খাসী এনে হাজির করলো। খাসীগুলো সামাদকে দেখিয়ে বললাম, ‘এর মধ্যে কোনটা তোমার পছন্দ? কোনটাতে তোমার প্রয়োজন মিটতে পারে? একটাতে না হলে দুইটাতেও কোন আপত্তি নেই। তুমি বল। শুধু তোমার জন্যেই আলাদা করে রান্না করা হবে। সামাদ সব ক’টি খাসী মাটি থেকে উঁচু করে শুন্যে তুলে নেড়েচেড়ে দেখলো। তারপর আনন্দ ও সন্তুষ্ট চিত্তে মুখে মৃদু একটা হাসি ফুটিয়ে ঈষৎ মাথাটা নাড়িয়ে একটি খাসী দেখিয়ে বললো, ‘স্যার এটাতে হবে। সামাদের পছন্দ করা খাসী জবাই করা হলো, মাংস বানানোর পর ওজন করে দেখা গেল, সাড়ে উনিশ সের হয়েছে। পুরো মাংস তার জন্য আলাদা করে রান্না করা হলো। ডাল, তরকারী ও সের তিনেক চালের ভাতও তার জন্য আলাদা করে পাকানো হলো। সব রান্না শেষ, পুরো খাবার সামনে নিয়ে বেলা বারোটায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে পরম তৃপ্তি নিয়ে সামাদ গামা খেতে বসলো। আমি, হামিদুল হক, গণ পরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকী, আউয়াল সিদ্দিকী, আর. ও. সাহেব, শওকত মোমেন শাজাহান, অধ্যাপক মাহবুব সাদিক, কাজী আতোয়ার সহ দপ্তরের প্রায় সবাই খাওয়ার অভূত পূর্ব দৃশ্য দেখার জন্য সোৎসাহে সামাদ গামাকে ঘিরে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭৯

বসলাম। সামাদ গামা খেতে শুরু করেছে, তার হাত দ্রুত তালে উঠানামা করছে। এক নাগাড়ে দ্রুত তালে পাঁচ-ছ মিনিট গোগ্রাসে খেয়ে আধ-এক মিনিট বিশ্রাম নিচ্ছে। মানে দুএকটা কথাবার্তা বনে নিচ্ছে। তারপর আবার পূর্বের মত হাত চলছে। হাত চলাতো নয় এ যেন সেলাই কলের সুই উঠানামা। এমনি ভাবে প্রায় এক ঘন্টা সামাদ গামা তার জন্য রান্না করা সাড়ে উনিশ সের মাংসের প্রায় আঠার সের, সাথে দেড় সের চাউলের ভাত, সের তিনেক তরকারী, এক গামলা ডাল খেয়ে উঠে পড়লো। খাবার শেষে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঢক ঢক করে দুই জগ পানি পান করে নিন। তারপর মুখে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে অত্যন্ত বিনীতভাবে বললো, স্যার, আমি আপিত্তি মিটাইয়া খাইছি। আমারে এহন দশ মিনিট বিশ্রাম দিতে অইবো।’ সামাদ গামাকে দশ মিনিট বিশ্রাম দেয়া হলো। না। সে এত খেয়েও কোন অস্বস্তিবোধ করেনি, তার সেই মুহুর্তের বিশ্রাম মানে বাড়ীর উঠানে একটু পায়চারী। সত্যিই তার কোন অস্বস্তিভাব লক্ষ্য করা যায়নি। অন্যান্য সহযোগীদের সাথে খাবার খেয়ে ২৪শে নভেম্বর দুটায় পশ্চিমাঞ্চলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। হেড-কোয়ার্টারের অন্যান্যদের সাথে সামাদ গামাও আমাকে তিন-চার মাইল পথ এগিয়ে দিল।

ভ্রান্তিবিলাস
সামাদ গামার আর একটি ঘটনা উল্লেখ করে মুক্তিবাহিনীর এই গামা পর্বের ইতি টানবো। আমি যাওয়ার চার দিন পর সাময়িকভাবে মুক্তিবাহিনীর পাথরঘাটা ঘাঁটির পতন ঘরে। সেখানকার কমাণ্ডার মতি, আজাদ কামাল ও মজিবর রহমান, হেড কোয়ার্টারের কাছে মর্টার সাহায্য চেয়ে দূত পাঠায়। দুত এসে হামিদুল হককে পাথরঘাটার নাজুক পরিস্থিতি জানিয়ে মর্টার সাহায্য চায়। হামিদুল হক নিজে সামাদ গামার শিবিরে গিয়ে পাথরঘাটা মর্টার প্লাটুন নিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। কিন্তু সামাদ গামা হামিদুল হকের নির্দেশ তেমন গা করেনা। পরিস্থিতির গুরুত্ব বারবার বুঝাতে চাইলে সামাদ তাকে অনেকটা ঠাণ্ডা ও নির্বিকার কন্ঠে বলে, ‘আপনাদের তো স্যার, স্যার বইলায় মনে অয়। আমি যুদ্ধ দেইখা ভয় পাইনা, আর যাইতে পারুম না- তাও কই নাই। স্যার, আমারে যার যার অর্ডার শুনতে কইছে, তাগো অর্ডার ছাড়া যাইতে পারুম না।’ হামিদুল হক উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তিতে পড়ে গেল। যথা সম্ভব স্বাভাবিকতা বজায় রেখে সামাদ গামাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাকে কার কার অর্ডার মানতে বলা হয়েছে?’ তখন কুচে গোঁজা কাগজটি বের করে হামিদ সাহেবের হাতে দিয়ে বলল, ‘দেহেন, আমি তো নেহাপড়া জানি না, এইডার মধ্যে নেখা আছে। শহীদ বইল্যা একজন আছে, যারে আমি হেই অর্জুনার চরে দেখছি। এ ছাড়া আর দুই স্যারের কি নাম তাও জানিনা, তাগোর আমি জীবন দেহিও নাই।’ হামিদ সাহেব কাগজ হাতে আরও অস্বস্তি ও সংকটে পড়লেন। আমি যখন কাগজে নাম লিখে স্বাক্ষর করছিলাম হামিদুল হক তখন পাশেই ছিলেন। তিনি জানেন, ঐ কাগজে কার কার নাম আছে। তার মনে হয় সামাদ গামা তাকে চিনে না। আর তিনি যে হামিদুল হক একথা সামাদ গামা বিশ্বাস নাও করতে পারে। তখন আবার আর এক নতুন জটিল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। তবুও কাজ হলেও হতেই পারে, এমন একটা দুর্বল আশায় হামিদ সাহেব বললেন,
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮০

‘এই কাগজে তিন জনের নাম লেখা আছে। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, হামিদুল হক এবং খোরশেদ আলম আর. ও.। আমার নামই হামিদুল হক। তোমাকে আমি অর্ডার দিচ্ছি, তুমি এখনই পাথরঘাটায় যাও। সামাদ গামার কল্পনায় পূর্ব হতেই এটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল, বড় স্যার যার যার অর্ডার শুনতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তারা বড় স্যার থেকে শারীরিক গড়নে, লম্বা ও স্বাস্থ্যবান না হতে পারেন তবে নেহায়েত ছোট হবেন না। দেখতে ছোট খাটো ঘন শ্যামল হামিদুল হককে প্রথম থেকেই স্যার ভাবতে পারলেও, হেড়-কোয়ার্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা কস্মিন কালেও ভাবতে পারেনি। তাই ‘আমার নামই হামিদুল হক’ কথাটি শোনার সাথে সাথে তার ধারণা বাস্তবের কড়কড়ে শুকনো ডাঙ্গায় হোঁচট খেল। তার ধারণার সাথে এত বিস্তর ফারাকটাকে সে সহজ বুদ্ধি দিয়ে কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না। তাই সহজাত সারল্য নিয়েই আচমকা আকাশ থেকে পড়ার মত চমকে গিয়ে তার মনের তীব্র বিপরীত প্রতিক্রিয়া গোপন না করে আন্তরিকভাবে প্রতিবাদ করলো, ‘এ্যা। কন কি? আপনি হামিদুল হক স্যার অইবেন ক্যামনে? তিনি এহন হেড-কোয়ার্টারের সব চাইয়া বড় স্যার। স্যার দেহেন, আমাদের বিপদে ফেলাইয়েন না। সত্যিই আপনার নাম কি?’ হামিদুল হক এবার একেবারে বোকা বনে কিছুটা রেগে তার দপ্তরে চলে যান। একেবারে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে না দিয়ে অফিসে ফিরে চিঠি দিয়ে সামাদকে ডেকে পাঠান। হামিদুল হকের চিঠি এসেছে শুনে সামাদ উল্কারবেগে ছুটে সদর দপ্তরে হাজির হয়। সেখানে গিয়ে তার আগের দেখা লোককে বসে থাকতে দেখে ভূত দেখার মত আঁতকে ওঠে। হামিদুল হককেই জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার, হামিদুল হক স্যার আমারে ডাইক্যা পাঠাইছেন। তিনি কোথায়?’ বুঝুন ব্যাপারটা। মর্টার সাহায্য যত দ্রুত পাঠানোর চেষ্টা চলছে, ততই জল ঘোলা হচ্ছে। উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতির গিট যতই খেলার চেষ্টা হচ্ছে, ততই গিটের ফাস আটকে যাচ্ছে। হামিদুল হক বনাম সামাদের ভুল বুঝাবুঝি উত্তরোত্তর আরো গভীর হয়ে উঠেছে। একের পর এক মানসিকভাবে নাজেহাল হয়ে কঠিন অবস্থা সামাল দিতে গিয়ে হামিদ সাহেব তখন একটু ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন। কিছুটা উষ্মার সাথে বলেন, ‘ব্যাপারটা খুবই গুরুতর। প্রতিটি মিনিট এখন মূল্যবান। তোমার এখনই পাথরঘাটা যাওয়া উচিত। আমি তো বলেছি, আমি ই হামিদুল হক।’ বলিষ্ঠ সামাদ গামা যে আস্ত একটা খাসী খেয়ে ফেলতে পারে, যে সাড়ে চার পাঁচ মন বোঝা অনায়াসে কয়েক মাইল কাধে নিয়ে যেতে পারে, মাঝারী গোছের সজীব গাছ, শুধুমাত্র বাহুতে ধরে সিনার বলে ভেঙ্গে উপড়ে ফেলতে পারে, সেই ‘সামাদ গামা’ এই নাজুক অবস্থায় পড়ে একেবারে অসহায়ের মত কাঁদো কাঁদো হয়ে চেয়ারে বসে থাকা হামিদুল হককে অতি বিনয়ের সাথে বললো, স্যার, আমি আপনার কোন ক্ষতি করি নাই, কেন আমারে এই রকম বিপদে ফেলাইছেন? আপনি হামিদুল হক স্যার, তা আমি বুঝুম কি কইরা?’ অবস্থা যখন, কেহ কাহারে বুঝতে নারে, দোহার ভাষা দুই মত’ এ সময়ে কমাণ্ডার খোরশেদ আলম কোন কাজে অফিস ঘরে প্রবেশ করে, ব্যাপারটা বুঝতে পারে এবং এই সমূহ বিপদ থেকে হামিদুল হক ও সামাদ গামাকে রক্ষা করতে প্রয়াসী হয়। কমাণ্ডার খোরশেদ আলম সামাদ গামার পূর্ব
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮১

পরিচিত। তাই সে হামিদুল হককে ইঙ্গিত দেখিয়ে সামাদকে বলে, ‘ইনার নামই হামিদুল হক।’ সামাদ গামা কিছুটা আশ্বস্ত হওয়ার পরেও, হামিদ সাহেবের পাশে বসে থাকা গণ পরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকীকে বলে, ‘স্যার, বড় স্যার আপনারে খুব সম্মান করেন দেখলাম। আপনি বয়সী মানুষ, আপনিই বলেন, ইনিই কি হামিদুল হক স্যার?” রসিক বাসেত সিদ্দিকী মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘হ্যা, ভাই, ইনিই হামিদুল হক। সামাদ গামা তার উত্তর পেয়ে গেছে। এতক্ষণ পরিস্থিতি জনিত কারণে যার সাথে কানামাছি ভোঁ-ভোঁ খেলছিল, তিনিই যে তাকে নির্দেশ দেবার স্যার এবং তিনিই স্বয়ং হামিদুল হক, এই কথাটা বিশ্বাস করার পর সামাদ গামার সে এক ভিন্ন চেহারা। হামিদুল হকের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, বুক ফুলিয়ে দপ্তরের মাটি কাপিয়ে সামরিক অভিবাদন করে অত্যন্ত অনুগত সৈনিকের মত বলে, ‘স্যার, কি করতে হবে বলুন। হামিদুল হক ক্রমবর্ধমান জটিল পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যারপর নাই বিরক্তি হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু যখন বুঝতে পারলেন দোষ কারও নয়, পরস্পর পরস্পরের কাছে অপরিচিত হওয়ার কারণে এবং সামাদ গামা নিয়ম শৃঙ্খলার বড় বেশী অনুগত বলেই এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সামাদ গামার আন্তরিকতার বিন্দুমাত্র অভাব নেই, তখন তিনি মনে মনে হাসছিলেন। খুশী মনে পাশের দুজনকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি এদের সাথে পাথর ঘাটা যাও। যেভাবেই হোক পাথরঘাটা পুনর্দখল করতে হবে।
— স্যার, এই কথাটাই আমারে লিইখ্যা দেন, আমি একদৌড়ে পাথরঘাটা চইল্যা যাই।’ হামিদ সাহেব সাথে সাথে নির্দেশ নামা লিখে দেন। নির্দেশের কাগজ হাতে নিয়ে দৌড়ে দপ্তর থেকে বেরিয়ে নিজের শিবির থেকে ঝড়ের বেগে মর্টার গোলা ও সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাথরঘাটার দিকে ছুটলো। মাত্র দেড় ঘন্টায় বারো মাইল পথ অতিক্রম করে কোন বিশ্রাম না নিয়ে পাথরঘাটায় হানাদারদের উপর নির্ভুল নিশানায় গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে সে হানাদারদের বিতাড়িত করে পাথরঘাটা ঘাঁটি পুনর্দখলে সামাদ গামা অভূতপূর্ব সাহায্য করেছিল, তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পাথরঘাটা পুর্নদখলে ঐদিন মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে আর একজন অপরিসীম সাহায্য করেছিলেন, তাঁর নাম ছামান ফকির।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮২

দালালদের অপকীর্তি

ওদিকে পাকিস্তান রক্ষায় কিছু লোক কোমর বেঁধে নেমেছে। আমি একে একে এদের প্রধান কয়েকজন পাণ্ডার কথা বলছি। লুটতরাজ, জোর করে মুসলমান বানানো, নারীধর্ষণ ও হত্যা ছাড়াও হানাদারদের সক্রিয়ভাবে অস্ত্র হাতে যে পাণ্ডারা আমাদের বিরুদ্ধে নেমেছে তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিরা হচ্ছে-
এক। আমিনুল ইসলাম তালুকদার (খোকা), টাংগাইলের প্রধান রাজাকার কমাণ্ডার। তিন থেকে চার হাজার রাজাকার তার নিয়ন্ত্রণাধীন।
দুই। ননী মিঞা (রাজাফৈর, কালিহাতী), কালিহাতী থানার মূল রাজাকার কমাণ্ডার। সে পাঁচশ রাজাকারের নেতা।
তিন। নায়েব আলী ও আবদুল্লাহ (সাকরাইল), দুই-দুই চারশ রাজাকারের মূল নেতা এবং অসংখ্য অপকর্মের হোতা।
চার। হারেস আলী (ডিড্-রাইটার, টাংগাইল), দুই কোম্পানী রাজাকারদের অধিনায়ক।
পাঁচ। কাগমারী কলেজের পিয়ন সোহরাব আলী, দুর্দান্ত রাজাকার কমান্ডার।
ছয়। নুরু খলিফা, দর্জির কাজ বাদ দিয়ে সেও এক কোম্পানী রাজাকার কমাণ্ডার হয়ে বসেছে।
সাত। ইসমাইল (দিঘুলিয়া), দেড়শ’ রাজাকারের কমাণ্ডার।
আট। মিজানুর রহমান (সন্তোষ), এক কোম্পানী কমাণ্ডার।
নয়। অধ্যাপক আবদুল হাকিম (নেজামে ইসলাম), টাংগাইল আল-বদরদের কমাণ্ডার।
দশ। জব্বার মোক্তার, নাগরপুর থানার রাজাকারদের মূল কমাণ্ডার হয়ে বসেছে।
এগারো। আফজাল চৌধুরী (টাংগাইল), এক কোম্পানী রাজাকার কমাণ্ডার।
বারো। সামাদ বি. এস. সি. আল শামস্ কমাণ্ডার।
তের। জসিম চৌধুরী (ধলাপাড়া), ঘাটাইল থানা রাজাকার সহকারী কমাণ্ডার।
চৌদ্দ। কাজলার তায়েজ উদ্দিন (তাজু চেয়ারম্যান), ঘাটাইল থানার রাজাকার সহকারী কমাণ্ডার।
পনের। ডাঃ শওকত আলী ভূইয়া ( ধলাপাড়া ), ঘাটাইল থানার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সহ ঘাটাইল থানার রাজাকারদের মূল কমাণ্ডার
ষোল। আবদুল খালেক ( গোপালপুর), গোপালপুর থানার রাজাকারদের মূল নেতা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৩

এছাড়া আরও অসংখ্য রাজাকার ও দুর্দান্ত প্রকৃতির লোকজনদের নিয়ে হানাদাররা একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছে।
পাকিস্তানীদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ যখন চরমে, তখন জঙ্গী সরকার এক ঘোষণার মাধ্যমে সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের রায়কে নস্যাৎ করে স্বাধীনতা পক্ষীয় গণ-পরিষদ সদস্য দের পদ অবৈধ পন্থায় বাতিল করে টাংগাইলে কয়েকজন গণ-পরিষদ সদস্য হিসাবে মনোনীত করে। হানাদারদের দয়ার এম. পি. রা হলো-
এক। টিপু মীর্জা-টাংগাইল দক্ষিণ এলাকা।
দুই। হুমায়ুন হোসেন খান-নাগরপুর এলাকা।
তিন। আজিজুল হক থাকা মিঞা-মির্জাপুর এলাকা।
চার। এমদাদ আলী খান- বাশাইল এলাকা।
পাঁচ। জোয়াহর আলী ধা-কালীহাতী এলাকা।
ছয়। ডাঃ শওকত আলী ভূইঞা-ঘাটাইল এলাকা।
সাত। নুরুল ইসলাম (আউসনারার চেয়ারম্যান)- মধুপুর এলাকা।
আট। আবদুল হাই-গোপালপুর এলাকা।
নয়। দালাল অধ্যাপক আবদুল খালেক-টাংগাইল উত্তর এলাকা।
আমরা হাতের কাছে নিশ্চিত বিজয়কে আরও দ্রুত এবং দৃঢ় মুষ্টিতে ছিনিয়ে আনতে হিমালয়ের মতো দৃঢ়তা ও প্রত্যয় নিয়ে ব্যাপক ও গভীর কর্মচাঞ্চল্যে ব্যাপৃত। হানাদাররাও তাদের সাধের ‘তখতে তাউস’, মুক্তিযুদ্ধের উত্তপ্ত লাভা থেকে বাঁচিয়ে রাখার শেষ চেষ্টায় হতাশ হয়ে দিনকে দিন কু কর্মের গতি ক্লান্তিহীণভাবে বাড়িয়ে দিল। কুমারী পোকার মত নিজেদের খোঁড়া গর্তে নিজেরাই মরার পথ প্রশস্ত করে চললো।

শান্তি কমিটি গঠন
টাংগাইল হানাদার শিবিরেও তৎপরতার বিরাম নেই, দারুণ কর্মব্যস্ততা। ছুঁড়ে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়-গোড় ভাগাভাগি কামড়া-কামড়ির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে হানাদার সমর্থক কিছু প্রভুভক্ত রাজনৈতিক হ্যাংলা কুকুর। খান সেনাদের চাইতে তাদের উৎসাহই বহুগুণ বেশী। টাংগাইল পাক-হানাদারদের প্রধান পাণ্ডা কাগমারী কলেজের কুখ্যাত অধ্যাপক আবদুল খালেক। হেকিম হাবিবুর রহমানকে শান্তি কমিটির সভাপতি ঘাতক আবদুল খালেককে সাধারণ সম্পাদক করে
(১) বিজু মিঞা
(২) এমদাদ আলী খান দারোগা
(৩) আফাজ ফকির
(৪) ঘাটাইল হাই স্কুলের হেডমাষ্টার শামসুজ্জামান খান
(৫) ধলাপাড়ার ডাঃ শওকত আলী ভূইঞা
(৬) বল্লার আবদুর রাজ্জাক আনসারী
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৪

(৭) মুহাম্মদ ইসহাক আলী
(৮) মির্জাপুরের আবদুল ওয়াদুদ মওলানা
(৯) গোপালপুরের আবদুল খালেক
(১০) করটিয়ার জমিয়ার মেহেদী খান পন্নী খসরু
(১১) জমিদার পুত্র সেলিম খান পন্নী
(১২) টাংগাইলের আজিজুল হক বাকা মিঞা
(১৩) আশরাফ মীর্জা
(১৪) সাইদ দারোগা
(১৫) পটু হাফেজ
(১৬) গিনি মি এক্স
(১৭) বেতকার (টাংগাইল) সিরাজ (গুণ্ডা)
(১৮) আকুর টাকুর পাড়ার বাবু খান
(২০) সন্তোষের মতি ড্রাইভার
(২১) প্যাড়াডাইস পাড়ার নজরুল
(২২) টাংগাইলের তুলা মোক্তার
(২৩) টাংগাইল থানা পাড়ার জলিল মিঞা
(২৪) শিবনাথ হাই স্কুলের শিক্ষক টিপু মীর্জা
(২৫) নাগরপুরের হুমায়ুন হোসেন খান
(২৬) পোষনা- কালিহাতীর কুদ্দুস খানের ছেলে জোয়াহের খান
(২৭) পূর্ব আদালত পাড়ার খন্দকার মহিউদ্দিন,
(২৮) বিশু মিঞা, আদি টাংগাইল ঔষধের দোকানদার (২১) টিপু ফকির
(৩০) নান্নু
(৩১) খন্দকার আবদুর রহিম
(৩২) ক্যাপ্টেন ডাক্তার আবদুল বাসেত (গান্ধিনা)
(৩৩) ভুঙ্গু মিঞা (মোগলপাড়া, ইনসিওরেন্সের দালাল)
(৩৪) জালাল মিঞা, টি. ও. টাংগাইল আদালতপাড়া, (মন্টুর বাবা)
(৩৫) গণি দারোগা
(৩৬) রেজাউর রহমান
(৩৭) প্রফেসার হিরা, টাংগাইল
(৩৮) আফজাল চৌধুরী, টাংগাইল
(৩৯) খালেক মিঞা, টাংগাইল
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৪

(৪০) সামাদ বি. এস. সি. টাংগাইল
(৪১) লেবু মিয়া, রওশন টকিজ, টাংগাইল
(৪২) ইসমাইল মিঞা, ঘড়ির দোকানদার, টাংগাইল আদালত রোড
(৪৩) গফুর মোল্লা, ব্যবসায়ী, টাংগাইল
(৪৪) আবদুর রশিদ, ভাতকুড়া
(৪৫) ইউসুফ জাই, এডভোকেট, টাংগাইল কোর্ট
(৪৭) আবদুল হাই ছালাফী, (নেজামী ইসলামী) হতেয়া, সখিপুর।
(৪৮) আবদুস সালাম রাজী, (নেজামী ইসলামী)
(৪১) আতোয়ার হাজী টাংগাইল (নিউ মার্কেটে দোকান)
(৫০) তাজমিঞা, তাজপ্রেস, টাংগাইল
(৫১) আকরাম খান, আকুর টাকুর পাড়া, ম্যানেজার ঢাকার জমিদার
(৫২) বান্টিন, করটিয়ার জমিদার পুত্র
(৫৩) মোটা বুলবুল, থানা পাড়া, টাংগাইল
(৫৪) নবাব আলী মাষ্টার, করটিয়া। আরো অনেককে নিয়ে টাংগাইল জিলা শান্তি কমিটি গঠন করা হলো। কমিটির কর্মকর্তারাই হলো শান্তির নামে অশান্তির মূল হোতা। রাজাকার বানানো, ঘরবাড়ী জ্বালানো, লুটতরাজ, নারী অপহরণ ও ধর্ষণ, হেন জঘন্য অপকর্ম নেই, যা শান্তি কমিটির সদস্যরা করেনি। আবদুল খালেক এদের সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। এ ব্যাপারে করটিয়ার জমিদার মেহেদী খান পন্নীর (খসরু) স্থান দ্বিতীয়। রাজাকার দল ভারী করতে এদের দুজনে পাল্লাপাল্লি। কে কার চাইতে বেশী রাজাকার বানাতে পারে।
(১) বিজু মিঞা
(২) এমদাদ দারোগা
(৩) ডাঃ শওকত আলী ভূইয়া
(৪) আফাজ ফকির
(৫) ইসহাক আলী
(৬) গোপালপুরের আবদুল খালেক
(৭) মির্জাপুরের ওয়াদুদ মাওলানা
(৮) বক্সার আবদুর রাজ্জাক আনসারী
(৯) টিপু মির্জা
(১০) জোয়াহের খাঁ
(১১) টিপু ফকির
(১২) টাংগাইলের নান্নু
(১৩) ক্যাপ্টেন ডাঃ আবদুল বাসেত
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৬

(১৪) মোগলপাড়ার ভুঙ্গু মিঞা
(১৫) টাংগাইলের হিরা প্রফেসার
(১৬) আফজাল চৌধুরী
(১৭) টাংগাইলের খালেক
(১৮) গনি দারোগা
(১৯) সামাদ বি. এস. সি.
(২০) গফুর মোল্লা
(২১) অধ্যাপক হাকিম
(২২) এডভোকেট ইউসুফ জাই
(২৩) আবদুল হাই সালাফী
(২৪) সালাম রাজী
(২৫) আতোয়ার হাজী
(২৬) আকরাম খা
(২৭) করটিয়ার জমিদার পুত্র বাল্টিনসহ আরো অনেকে হানাদারদের নীচুস্তরের চৌকিদার হলেও নিজেদের দুষ্কর্মে এরা একে অপরকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে চলেছে।
টাংগাইলের লুটপাটের মূল নায়ক,
(১) বেতকার সিরাজ গুণ্ডা
(২) সাবালিয়ার ঠাণ্ডু
(৩) টাংগাইলের দেলোয়ার
(৪) রোস্তম
(৫) হেকিম হাবিবুর রহমানের শ্যালক কিসলু
(৬) টাংগাইলের ছানা
(৭) ঢাকার জমিদারের ম্যানেজার আকরাম খা
(৮) সাদেক রেজা
(৯) বল্লার মালেক মওলানা
(১০) বল্লার কাশেম আনসারী ও
(১১) নান্নু আনসারী, (এরা আবদুর রাজ্জাকের ভাই)
(১২) কাগমারী কলেজের পিওন সোহরাব
(১৩) তুলা
(১৪) মির্জাপুরের ওয়াদুদ মাওলানা
(১৫) সন্তোষের মতি ড্রাইভার
(১৬) নাগরপুরের জব্বার মোক্তার
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৭

(১৭) রাজাফৈরের ননী মিঞা
(১৮) টাংগাইলের বেড়াডোমার নূর
(১৯) সাকরাইলের আফাজ
(২০) অলোয়ার পিজু
(২১) আলোয়ার মতিয়ার
(২২) টাংগাইলের আবুল হোসেন বেপারী
(২৩) সন্তোষের মতি চেয়ারম্যান
(২৪) বাশাইল থানার বাথুলীর কাদের খাঁ
(২৫) আইনউদ্দিন
(২৬) মধুপুরে ইব্রাহীম সরকার
(২৭) করটিয়ার আলী মাষ্টার
(২৮) কালিহাতী থানার পলাশতলী গ্রামের আলাউদ্দিন
(২৯) ধলাপাড়ার জসিম চৌধুরী ও
(৩০) টাংগাইলের আকুরটাকুর পাড়ার বাবু বা আরো অনেকে। বাবু খাঁ যেন সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। বাবু খাঁর সাহসের তারিফ করতে হয় বৈকি। সে বহু জায়গায় তো করেছেই, এমনকি আমাদের বাড়ীর পোড়া টিনসহ জিনিসপত্র অন্যান্য লুটেরারা স্পর্শ করার সাহস না পেলেও বাবু খাঁ সেই হিম্মত দেখিয়েছে।
এ সময় টাংগাইলে এক নয়া উপদ্রব শুরু হলো। টাংগাইল-ময়মনসিংহ বাস রোডে যত বাস, ট্র্যাক্সি ও জীপ চলাচল করতো, সেগুলোকে এরা উপযাজক হয়ে তল্লাসী করতো। সুবিধা পেলে লুটপাট করতো, এমন কি মুক্তিবাহিনীর লোক বলে রাজাকার ও হানাদারদের কাছে অনেককে ধরিয়ে দিত।
(১) আবদুল খালেক
(২) আবদুর রাজ্জাক আনসারী
(৩) ওয়াদুদ মওলানা
(৪) টিপু মীর্জা
(৫) আবদুল হাই সালাফী
(৬) এডভোকেট ইউসুফ জাই
(৭) তাজ মিঞা
(৮) আকরাম খাঁ
(৯) টিপু ফকির
(১০) হিরা প্রফেসার
(১১) আফজাল চৌধুরী
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৮

(১২) সামাদ বি. এস. সি.
(১৩) গফুর মোল্লা
(১৪) ছালাম রাজী
(১৫) আতোয়ার হাজ
(১৬) ননী মিঞা
(১৭) মহিউদ্দিন—এরা ইসলাম ধর্মের প্রচারে যেন নিবেদিত প্রাণ, বদমাইশগুলো প্রতিদিন হিন্দুদের ধরে এনে জোর করে মুসলমান বানাচ্ছে। আগষ্টের মাঝামাঝি টাংগাইলের-
(১) অজিত হোম
(২) কানু ভট্টাচার্য
(৩) বাদল পাল
(৪) ছিদাম ঠাকুর
(৫) মনিধর প্রমুখকে ধরে এনে মুসলমান বানালো। ওয়াদুদ মাওলানা মির্জাপুরের আশপাশের অসংখ্য হিন্দুদের দিনের পর দিন জোর জবরদস্তি করে মুসলমান বানিয়ে চললো। আবদুল খালেকের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী সন্তোষ, ঘারিন্দা, এলেঙ্গা, মগরা, সদিলাপুর, এনায়েত পুর ও অসংখ্য গ্রাম একের পর এক জ্বালিয়ে ছারখার করে দু’তিন শত নিরীহ লোককে আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে। এ ছাড়াও রাজাকার ক্যাম্পে ধরে এনে খালেক সহস্রাধিক লোককে হত্যা করিয়েছে অন্যদিকে গোপালপুরের আব্দুল খালেক সমস্ত গোপালপুরটা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে।
(১) মির্জাপুরের ওয়াদুদ মাওলানা
(২) ধলাপাড়ার জসিম চৌধুরী
(৩) টিপু শীর্জা,
(৪) আকরাম খাঁ
(৫) রাজাফেরের ননী মিয়া
(৬) পোষনার জোয়াহের ধা
(৭) টিপু ফকির
(৮) টাংগাইলের নান্নু
(৯) গান্ধিনার ক্যান্টিন ডাঃ আবদুল বাসেত
(১০) সাবালিয়ার ঠাণ্ডু,
(১১) বল্লার মালেক মৌলানা
(১২) সন্তোষের মতি ড্রাইভার
(১৩) নাগরপুরের জব্বার মোক্তার
(১৪) ইসহাক আলী বল্লার মালেক মৌলানা ও তাদের আরো সাঙ্গ-পাঙ্গরাও জ্বালাও পোড়াও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকার পাত্র নয়। ওয়াদুদ মৌলানা মির্জাপুর, দেওহাটা, পাকুল্লা,
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৯

মহেড়া সহ বেশ কয়েকটি বিরাট প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ বাজার লুট ও পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। টাংগাইল পৌরসভার চেয়াম্যান শওকত আলী তালুকদারের ভায়রাভাই মোহাম্মদ ইসহাক আলীও কম যায়না। বরুনিয়া ভুক্তা, সুরুজ, আইসড়া এবং টাংগাইলের পাড়দিঘুলিয়ার এমন কোন হিন্দু ও আওয়ামী লীগ সদস্যের বাড়ী নেই, যা এই শয়তান ইসহাক লুটপাট করায়নি।
মুক্তিবাহিনী এদের দুষ্কর্ম ক্ষোভ ও রোষের সঙ্গে লক্ষ্য করছিল। আমরা নানাভাবে ঘৃণ্য দালালদের প্রতিহত ও শাস্তিবিধান করতে বদ্ধপরিকর হচ্ছিলাম। অনেককে শাস্তি দিতে মুক্তিযোদ্ধারা সক্ষম হয়। যেমন- নভেম্বর মাসের ২৬ তারিখে হানাদার বেষ্টিতে মির্জাপুর বাজারের একেবারে মাঝখান থেকে প্রকাশ্য দিবালোক ওয়াদুদ মৌলানাকে দুজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা টেনে হিচড়ে রিক্সায় তুলে নদীর পারে নিয়ে রিভলবারের গুলিতে হত্যা করে চকিতে মিলিয়ে যায়। বানরের পিঠা ভাগের মত ক্রম নিঃশেষিত হালুয়া-রুটির শেষ সুযোগ সদ্বব্যহারে শান্তি কমিটির সব সদস্যই যে একই চরিত্রের ছিল, তা নয়। (১) আশরাফ মীর্জা (২) আবু সাইদ দারোগা (৩) অধ্যাপক আ. ফ. ম. খলিলুর রহমান (৪) জলিল মিঞা (৫) ইসমাইল মিঞা (৬) তাজ মিঞা (৭) লেবু মিঞা (রওশন টকিজ) সহ আরো অনেকে উদ্ধৃতভাবে ধরাকে সরাজ্ঞান করে লাফালাফি-দাপাদাপি করেনি। টাংগাইল শান্তি কমিটির একজন ব্যাতিক্রমধর্মী চরিত্র হলেন, জামাতে ইসলামের শামসুজ্জামান খান। ইনি ঘাটাইল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। শামসুজ্জামানই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি শান্তি কমিটির নামে অশান্তি শুরু করলে প্রকাশ্যে জনসভায় প্রতিবাদ করেন। এতেও যখন কাজ হয়না, তখন পদত্যাগ করেন। এটাও একটা ইতিহাস যে, আর কোন শান্তি কমিটির মেম্বার এমনভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করার হিম্মত দেখাতে পেরেছেন কিনা আমার জানা নেই। আরও একজনের নাম উল্লেখ করতে হয়, সে হলো প্যাড়াডাইস নজরুল। কট্টর মুসলীম লীগার। অতীত কার্যকলাপ তার মোটেই প্রশংসনীয় নয়। গুণ্ডা নজরুল বলেই সে সমধিক পরিচিত। অতীতে অসংখ্য বার ছাত্র ও নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার ও উৎপীড়ন করেছে। নজরুল ১৯৬৯-র গণ-আন্দোলনের সময় হামিদপুরের ছাত্রলীগের মোহনকে মারধর করেছিল। সে বারই প্রথম প্রতাপশালী গুণ্ডা নজরুল ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতার হাতে উত্তম- মধ্যম খেয়েছিল। তার বাঁচারই আশা ছিল না। তবু ভাগ্যগুণে সে বেঁচে যায়। ৬৯-র গণ- আন্দোলনের গণ-পিটুনিতে তার কোন গুণগত পরিবর্তন হয়েছিল কিনা নিশ্চত করে বলা সম্ভব না হলেও এটা ঠিক, এরপর থেকে নজরুলের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অত্যস্ত আশ্চর্যের বিষয় যে নজরুলের মুক্তিযুদ্ধের সময় দুষ্কর্মের অন্যতম হোতা হওয়ার কথা ছিল, সেই নজরুল কিন্তু একেবারে নিরুৎসাহিত ছিল। যার ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে কোন ভোগান্তি সইতে হয়নি।
রাজাকার নেতা শান্তি কমিটির সেক্রেটারী জল্লাদ আবদুল খালেক অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে টাংগাইল বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে এক সভায় সগৌরবে ঘোষণা করলো-
“পাকিস্তানে একমাত্র মুসলমানরাই থাকবে। পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে মুসলমান
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯০

ব্যতীত ভিন্ন জাতির থাকার কোন অধিকার নেই। নিম্ন জাতের হিন্দু ও অন্যান্য যারা ধোপা, নাপিত, মেথর, মুচী তারা থাকতে পারবে, যেহেতু মুসলমানেরা ঐ ধরনের ছোট কাজ করতে পারেনা। যারা স্বেচ্ছায় মুসলমান হবে তারাই শুধুমাত্র পাকিস্তানে থাকতে পারবে, তবে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোন হিন্দু মুসলমান হলে তাকে কোরবানী দেয়া হবে।”

হিন্দু থেকে মুসলমান
যে সমস্ত হিন্দুরা তখন পর্যন্ত টাংগাইল শহরে ছিলেন, তারা এই ঘোষণায় চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন। এত কষ্টের পরও যারা এতদিন মাতৃভূমি ছাড়েনি, এবার বুঝি তাদের জীবন যায়। টাংগাইলের শিবনাথ হাই স্কুলের অত্যস্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কান্তি রায় তার ছেলে শিবু রায় এবং বিন্দুবাসিনী হাই স্কুলের সর্বজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত রাধিকারঞ্জন পাঠক। সর্বজন পরিচিত ও শ্রদ্ধেয় ডাঃ বীরেশ মজুমদার, কাগমারী কলেজের অধ্যাপক নিত্যানন্দ পাল, ভোলা পোদ্দার, শাস্তিপদ সাহা এবং নিকুঞ্জবিহারী সাহার নাতি সহ অসংখ্য লোককে হানাদার রাজাকার দালালরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ৩রা এপ্রিল থেকে হাজার হাজার মানুষকে ওরা নানাভাবে খুন অথবা গুম করেছে। এত ঝড়-ঝাপটা বিপদ মাথায় নিয়েও বুঝি হিন্দুরা শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। আবদুল খালেক টাংগাইলের বিশেষ বিশেষ হিন্দুর তালিকা করেছে। একদিন বিকালে টাংগাইল শান্তি কমিটির মেম্বার জলিল মিয়া নিকুঞ্জ বিহারী সাহার বাড়ীতে গিয়ে হাজির হলো। জলিল মিঞা শান্তি কমিটির মেম্বার হলেও খালেকের মত জল্লাদ নন। অত্যন্ত বিনয়ী ভদ্র মানুষ। জলিল মিঞাকে বিমর্ষ দেখে নিকুঞ্জ বিহারী জিজ্ঞেস করলেন,
— জ্বলিল ভাই, অমন করছেন কেন?
— আর বোধহয় আপনাদের রক্ষা করা গেলনা। খালেকের কারসাজিতে আপনাদের তালিকা করা হয়েছে। আপনারা আজ রাতেই শহর ছেড়ে চলে যান। না হলে, আপনাদের ওরা হত্যা করবে। আর কি বলবো নিকুঞ্জ দা। খালেকের ঘোষণা মতো মুসলমান হওয়ার দ্বিতীয় পথ খোলা আছে, তাও ওরা আপনাদের বিশ্বাস করবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছিনা।
জলিল মিঞার কথা শুনে থানা পাড়ায় মন্টু সাহাদের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিকুঞ্জবিহারী সাহা জলিল মিঞাকে বললেন,
জলিল ভাই, আমাদের যেভাবে পারেন বাঁচান। আমাদের ঘন্টা দুই ভেবে দেখার সময় দিন।
জলিল মিঞা চলে গেলে বাড়ীর মা-বোনরা অত্যন্ত দুঃখিত ও ব্যথিত হয়ে অনুযোগ করে নিকুঞ্জবিহারী সাহাকে বললো,
— আমরা আগেই বলছিলাম, কত লোক ভারতে চলে গেলো, আমরাও চলে যাই। কিন্তু শুনলোনা। এখন মুসলমান হও। গরুর মাংস খাও। মুসলমানের সাথে মেয়ে বিয়ে দাও। বাড়ীর মেয়েদের এই সমস্ত কথার উত্তর নিকুঞ্জবিহারী সাহার জানা ছিল না। পরিস্থিতি বড়ই মারাত্মক ও বিচিত্র। তিন ঘন্টা পর জলিল মিঞা আবার এলেন। ইতিপূর্বেই বাড়ীর অল্প
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯১

বয়সী যুবক-যুবতী ব্যতীত ভিন্ন জাতির থাকার কোন অধিকার নেই। নিম্ন জাতের হিন্দু ও অন্যান্য যারা ধোপা, নাপিত, মেথর, মুচী তারা থাকতে পারবে, যেহেতু মুসলমানেরা ঐ ধরনের ছোট কাজ করতে পারেনা। যারা স্বেচ্ছায় মুসলমান হবে তারাই শুধুমাত্র পাকিস্তানে থাকতে পারবে, তবে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোন হিন্দু মুসলমান হলে তাকে কোরবানী দেয়া হবে।”
যে সমস্ত হিন্দুরা তখন পর্যন্ত টাংগাইল শহরে ছিলেন, তারা এই ঘোষণায় চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন। এত কষ্টের পরও যারা এতদিন মাতৃভূমি ছাড়েনি, এবার বুঝি তাদের জীবন যায়। টাংগাইলের শিবনাথ হাই স্কুলের অত্যস্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কান্তি রায় তার ছেলে শিবু রায় এবং বিন্দুবাসিনী হাই স্কুলের সর্বজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত রাধিকারঞ্জন পাঠক। সর্বজন পরিচিত ও শ্রদ্ধেয় ডাঃ বীরেশ মজুমদার, কাগমারী কলেজের অধ্যাপক নিত্যানন্দ পাল, ভোলা পোদ্দার, হিন্দু থেকে মুসলমান শাস্তিপদ সাহা এবং নিকুঞ্জবিহারী সাহার নাতি সহ অসংখ্য
লোককে হানাদার রাজাকার দালালরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ৩রা এপ্রিল থেকে হাজার হাজার মানুষকে ওরা নানাভাবে খুন অথবা গুম করেছে। এত ঝড়-ঝাপটা বিপদ মাথায় নিয়েও বুঝি হিন্দুরা শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। আবদুল খালেক টাংগাইলের বিশেষ বিশেষ হিন্দুর তালিকা করেছে। একদিন বিকালে টাংগাইল শান্তি কমিটির মেম্বার জলিল মিয়া নিকুঞ্জ বিহারী সাহার বাড়ীতে গিয়ে হাজির হলো। জলিল মিঞা শান্তি কমিটির মেম্বার হলেও খালেকের মত জল্লাদ নন। অত্যন্ত বিনয়ী ভদ্র মানুষ। জলিল মিঞাকে বিমর্ষ দেখে নিকুঞ্জ বিহারী জিজ্ঞেস করলেন,
জ্বলিল ভাই, অমন করছেন কেন?
আর বোধহয় আপনাদের রক্ষা করা গেলনা। খালেকের কারসাজিতে আপনাদের তালিকা করা হয়েছে। আপনারা আজ রাতেই শহর ছেড়ে চলে যান। না হলে, আপনাদের ওরা হত্যা করবে। আর কি বলবো নিকুঞ্জ দা। খালেকের ঘোষণা মতো মুসলমান হওয়ার দ্বিতীয় পথ খোলা আছে, তাও ওরা আপনাদের বিশ্বাস করবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছিনা।
জলিল মিঞার কথা শুনে থানা পাড়ায় মন্টু সাহাদের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিকুঞ্জবিহারী সাহা জলিল মিঞাকে বললেন,
সময় দিন।
জলিল ভাই, আমাদের যেভাবে পারেন বাচান। আমাদের ঘন্টা দুই ভেবে দেখার
জলিল মিঞা চলে গেলে বাড়ীর মা-বোনরা অত্যন্ত দুঃখিত ও ব্যথিত হয়ে অনুযোগ করে নিকুঞ্জবিহারী সাহাকে বললো,
আমরা আগেই বলছিলাম, কত লোক ভারতে চলে গেলো, আমরাও চলে যাই। কিন্তু শুনলোনা। এখন মুসলমান হও। গরুর মাংস খাও। মুসলমানের সাথে মেয়ে বিয়ে দাও। বাড়ীর মেয়েদের এই সমস্ত কথার উত্তর নিকুঞ্জবিহারী সাহার জানা ছিল না। পরিস্থিতি বড়ই মারাত্মক ও বিচিত্র। তিন ঘন্টা পর জলিল মিঞা আবার এলেন। ইতিপূর্বেই বাড়ীর অল্প

বয়সী যুবক-যুবতীরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তারা মুসলমান হবেন। সকলের অনুরোধে নিকুঞ্জ বিহারী সাহাও রাজী হয়েছেন। তবে তার ইচ্ছা একটু পঞ্জিকা দেখে নেবেন। পঞ্জিকা না দেখে তিনি জীবনে কোন কাজ করেননি। যদি আর জীবনে হিন্দু হতে না পারেন তাই শুভক্ষণ দেখে তিনি মুসলমান হতে চান। নিকুঞ্জবিহারী সাহার মনোভাব দেখে বাড়ীয় যুবক-যুবতীরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন, ‘মুসলমান হবা তাও আবার পত্রিকা দেখা? ফালাইয়া দাও তোমার পাঞ্জি-টাঞ্জি।’ এরপর তিনি আর কি করবেন। জলিল মিঞাকে ধর্ম পরিবর্তনের কথা জানালে, তিনি খুশী হয়ে মসজিদে ছুটলেন।
বিকাল তিনটায় অনুষ্ঠানিকভাবে
(১) নিকুঞ্জ বিহারী সাহা,
(২) দুলাল কর্মকার,
(৩) অসিত নিয়োগী,
(৪) আনন্দ দাস,
(৫) দুলাল সেন,
(৬) হরিপার সরকার,
(৭) গোপাল সরকার
(৮) নিতাই বসাক,
(৯) মদনমোহন সাহা,
(১০) নিখিলচন্দ্র সাহা,
(১১) বিমল কুমার সাহা,
(১২) বলরাম সাহা,
(১৩) হরিপদ বসাক,
(১৪) আকালী বসাক,
(১৫) বাদল বসাক,
(১৬) উৎপল বসাক,
(১৭) মুরারী ধর,
(১৮) মণীন্দ্র সাহা,
(১৯) বিজয় চৌধুরী,
(২০) অখিল বসাক,
(২১) গোবিন্দচন্দ্র সাহা,
(২২) সুনীলকুমার সাহা,
(২৩) গোপাল সাহা,
(২৪) মনমোহন সাহা,
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯২

(২৫) অমূল্য কুমার বণিক,
(২৬) শৈলেশ সেন,
(২৭) মনোজ সাহা,
(২৮) রতন কুমার সাহা,
(২৯) রমেশ চর সাহা,
(৩০) স্বপন কুমার রায়,
(৩১) অনিল কুমার সাহা,
(৩২) জয় শীল,
(৩৩) রবি শীল,
(৩৪) লক্ষণ কুমার সাহা,
(৩৫) তারাপদ সাহা,
(৩৬) রবীন্দ্র লাহিড়ী,
(৩৭) শরৎ সাহা,
(৩৮) যতীন সাহা,
(৩৯) রতন মণ্ডল,
(৪০) অসিত রায়,
(৪১) মনোরঞ্জন সাহা,
(৪২) রুনু চক্রবতী,
(৪৩) সমীর বোস,
(৪৪) রনজিৎ মণ্ডল,
(৪৫) পরেশ সাহা,
(৪৬) চন্দন সাহা,
(৪৭) শিশু বোস,
(৪৮) শিখা বোস সহ শ’তিনেক হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হলো। তারা কতটা ইসলামের শান্তির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্মান্তরিত হলেন, তা ধর্মান্ধরা এক মুহুর্তের জন্য বুঝতে চেষ্টা করলোনা।
টাংগাইল বড় মসজিদে ধর্মান্তরনের অনুষ্ঠান শুরু হলো। ইসলামের বড় বড় পান্ডারা নতুন ধর্মাবলম্বীদের টুপী উপহার দিল। টাংগাইল মসজিদের সামনে নবাগত মুসলমানদের দেখার জন্য হাজার লোক জড়ো হয়েছে। এক পর্যায়ে আবদুল খালেক রেগেমেগে সমবেত জনতাকে বললো, ‘এরা কেউ আল্লাহর ফেরেশতা না, দেখার এমন কিছু হয় নাই। এরা এখনও কাফের, এখনও মুসলমান হয়ে সারেনি। মসজিদের মোল্লা তুলাকে এদের অজুর নিয়মকানুন ও কলেমা শেখানোর দায়িত্ব দেয়া হলো। তুলা দীর্ঘদিন টাংগাইন বড় মসজিদে আযান দিয়ে আসছে। একবার এতগুলো হিন্দুকে মুসলমান বানানোর প্রাথমিক দায়িত্ব পেয়ে সে ধন্য হয়ে গেল। খুশীতে আত্মহারা।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৩

দীর্ঘদিন আযান দেওয়ার পূণ্যে সে এতগুলো হিন্দুকে মুসলমান বানানোর প্রাথমিক দায়িত্ব পেরেছে। সে ভাবলো আল্লাহর খাস দরবারে পৌঁছে যেতে আর কোন অসুবিধা নেই। আল্লাহর আরশ থেকে তার ওপর আদেশ এসেছে। তাই পরম যত্নে সবাইকে অজু করিয়ে বার বার চার কলেমা তালিম দিয়ে মসজিদের ভেতর আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমান বানানোর জন্য নিয়ে গেল। অর্ধেক মসজিদের ভেতর ঢুকে গেছেন এমন সময় আবার আবদুল খালেক তেড়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘এরা এখনও মুসলমান হয় নাই। কোন কাফের মসজিদের চৌকাঠ পেরোতে পারেনা। আপনারা পেয়েছেন কি। মুসলমান না বানিয়েই এদের মসজিদের ভেতর নিয়ে এসেছেন?’ খালেক প্রফেসারের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, ওর একার কাঁধেই যেন পাকিস্তানী ইসলাম রক্ষার মূল দায়িত্ব পড়েছে। টাংগাইল মসজিদের মূল ইমাম সবাইকে কলেমা পড়ালেন এবং ইসলামের মহান দিকের কিছুটা আলোকপাত করলেন। তিনি বললেন,
“জোর-জুলুম ইসলামের পথ নয়, শান্তি ও সত্য ইসলামের পথ। আপনারা মনের দিক থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেই সত্যিকারের মুসলমান হবেন। জোর-জুলুমের মুখে মুসলমান হলে কোন কাজ হবেনা। আপনারা নির্ভয় হোন, আল্লাহ আপনাদের নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন। আল্লাহর দুনিয়ায় সকলেরই বাঁচার অধিকার আছে। আপনারা মনের বিরুদ্ধে কিছু করবেন না। ধৈর্য্য ধরুন। সকল বিপদ কেটে যাবে। আপনাদের মন যদি সত্যিই ইসলামের শান্তিতে মোহিত হয়, তবেই সত্যিকারের মুসলমান হবেন।”
নব দীক্ষিত মুসলমানদের নিয়ে টাংগাইল শহরে ধর্মান্ধ মুসলমানদের আনন্দ উৎসব লেগে গেল, মিষ্টি খাওয়ার ছড়াছড়ি।
নিকুঞ্জবিহারী সাহা মুসলমান হয়ে বাড়ীতে ফিরেও সারেনি, মসজিদ থেকে কয়েকজন এসে হাজির।
— শুধু আপনারাই মুসলমান হলে চলবেনা। বাড়ীর মেয়েদেরও মুসলমান হতে হবে। না হলে একত্রে বসবাস করা যাবেনা।
নতুন মুসলমানেরা তাতেও রাজী। নিজেরা যখন মুসলমান হয়েছেন তখন মেয়েরা বউয়েরা বাকী থাকবে কেন? তারা জানতে চাইলেন,
— মেয়েদের মুসলমান হতে আবার কি করতে হবে?
— না, তেমন কিছুই না। মওলানা সাহেব কলেমা পড়াবেন, এরপর নিয়মিত নামাজ- বন্দেগী করলেই চলবে।
মাগরেবের নামাজের পর একচোট মেয়েদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার পালা চললো। পদ্ধতি বড় সুন্দর। কোন জটিলতা নেই। মা-বোনেরা ঘরের ভেতর রইলেন। একটা কালো শাড়ীর এক মাথা ইমাম সাহেব, অন্য মাথা অন্দর মহলের মা-বোনেরা ধরলেন। শুরু হলো মুসলমান হওয়ার প্রক্রিয়া। ইমাম সাহেব কলেমা উচ্চারণ করলেন। ভেতর থেকে মেয়েরা সমন্বরে কলরব তুললেন। মা-বোনেরা কি উচ্চারণ করলেন, না করলেন, তা দেখে কে? কলরবই যথেষ্ট। এতেই
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৪

কট্টরেরা খুশী। তারা এইদিনে কাজের কাজ করেছেন, শাড়ী ধরে, কলেমা পড়ে মুসলমান হলেন সরযূবালা সাহা, লক্ষীরাণী সাহা, সিদ্ধিরাণী সাহা, জ্যোৎস্নারাণী সাহা, মিনু সাহা, পলি সাহা, অর্চনা সাহা, ভারতী সাহা, দীপ্তি লাহিড়ী, শিপ্রা লাহিড়ী আরো অনেকে।
শুরু হয়ে গেলো হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়ার জোয়ার। কয়েকদিনের মধ্যে তিন সাড়ে তিন হাজার মুসলমান হয়ে গেলেন। তারা নিয়মিত মসজিদে যাওয়া শুরু করলেন। নভেম্বরের শেষ এবং ডিসেম্বরের প্রথমদিকে দেখা গেল, নব দীক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যাই মসজিদে বেশী। শেষ পর্যন্ত এমন হলো, কোন জায়গায় পাঁচ-ছয়শ’ জনের নামজের জামাতে দু’তিন জন প্রকৃত মুসলমান। হিন্দু যারা মুসলমান হয়েছেন তারা কট্টরদের দেখাবার জন্য হলেও রীতিমত মসজিদে হাজিরা দিচ্ছেন। একদিন নিকুঞ্জবিহারী সাহা নামাজ পড়তে বসে হাঁটুর গুলে চোট লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তাঁকে কট্টরেরা বলে দিল, ‘আপনি শুধু মসজিদে এসে বসে থাকলেই চলবে। তা হলেই আপনি বেহেশেতে চলে যাবেন।’
টাংগাইলে মুসলমান হওয়ায় সাহা, বসাক, হোম, চক্রবর্তী, ভট্টচার্য, সেন, সরকার কেউ বাদ পড়েনি। আমি আশা রাখি পরবর্তী সংস্করণে তাদের প্রত্যেকের নাম ও কি পরিবেশে তারা হিন্দু থেকে মুসলমান, আবার মুসলমান থেকে হিন্দু হয়েছিলেন, তা তুলে ধরবার চেষ্টা করতে পারবো।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে অবস্থার নতুন মোড় নিল। দশ তারিখ মসজিদে প্রায় ছয়-সাতশ লোক মাগরেবের নামাজে দাঁড়িয়েছেন। এমন সময় টাংগাইলের আকাশে অসংখ্য যুদ্ধ বিমান চক্কর মারতে থাকে। এক সময় জামাতের মাঝখান থেকে সাত-আট জন দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। তার মধ্যে তুলাও রয়েছে। নব দীক্ষিতরা নামাজ পড়েই চলেছেন। কেউ উঠেছেন, কেউ বসছেন, তাঁরা কোন নিয়ম কানুন জানেননা, শিখেনওনি। কারণ নামাজ শিক্ষার আত্মিক প্রয়োজন কখনও অনুভব করেননি। জীবন বাঁচাতে এতদিন কাঠ মোল্লাদের দেখে দেখে তাল মিলিয়ে উঠাবসা করছেন। আসল মুসুল্লীরা পালিয়ে গেলে নামাজে আউল ঝাউল বেধে গেল। নতুন মুসলমানেরা কতক্ষণ উল্টাপাল্টা সেজদা দিয়ে আশপাশ ভালো করে দেখে অবস্থা বুঝে তারাও সমসজিদ থেকে চম্পট দিলেন। পরদিন আমাদের হাতে টাংগাইল শত্রু মুক্ত হলো, এরপর আর এদের মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে হয়নি।
২২ অথবা ২৩শে ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তিন-সাড়ে তিন হাজার নব-দীক্ষিত মুসলমানেরা টাংগাইল কালীবাড়ীতে অনুষ্ঠান করে আবার সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেন। এ অনুষ্ঠানও বিচিত্র। পুরোহিত কিছু জপতপ করলেন। গোবর, সামান্য গরুর চোনা ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে প্রসাদ বানিয়ে সকলের হাতে এক ফোটা দুই ফোটা করে তুলে দিলেন। সকলে তৃপ্তি সহকারে তা খেলেন। দু’একজন আবার সে প্রসাদ খেতে গিয়ে বমি করে ফেললেন। পুনঃ হিন্দু হওয়ার অনুষ্ঠানকে ষোল কলায় পূর্ণ করে দিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য। তাঁরা পুরোহিতের হাতে শ্রদ্ধাভরে কয়েক ঘটি জল তুলে দিয়ে বললেন,
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৫

-আমরা খোদ গঙ্গা থেকে এ জল নিয়ে এসেছি।
পুরোহিত সেই জল সবার উপর ছিটিয়ে দিলেন। এতে সত্যিই হিন্দু বন্ধুরা পরম তৃপ্তি অনুভব করলেন।
টাংগাইল কালীবাড়ী রাজাকাররা ক্যাম্প করায় সেটাকে ধুয়ে মুছে গোবরজল ছিটিয়ে পাক-পবিত্র করতে কিছুটা সময় লেগে যাওয়ায় এদের আবার হিন্দু হতে একটু দেরী হয়েছিল।
টাংগাইল নতুন জিলা শহর তখন মিলিটারীদের আঞ্চলিক সদর দপ্তর। প্রতিদিন শত শত নিরীহ লোককে সেখানে ধরে নিয়ে রাতের অন্ধকারে হত্যা করা হচ্ছে। টাংগাইল পুরানো শহরে রাজাকার ক্যাম্পেও একইভাবে হত্যাকাণ্ড চলেছে। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে যে যেদিকে পারছেন পালাচ্ছেনা। যারা পারছেনা, তারা ক্রমান্বয়ে হানাদারদের পাশবিক তাণ্ডবের শিকার হচ্ছেন।
এমন হতাশা ও নিরুৎসাহ ব্যঞ্জক অবস্থা বেশীদিন অপ্রতিহতভাবে চলতে দেয়া যায়না। তাই মক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের তেজ বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। এতে অভাবনীয় ফলও ফলে। মক্তিবাহিনীর চাপের মুখে নভেম্বরের শুরু থেকে হানাদার মিলিটারী ও রাজাকারদের জনসাধারণের ওপর অত্যাচারের মাত্রা ও লুটতরাজের লোভ বহুলাংশে কমে যায়। বিশেষ করে শহরের বাইরে গ্রামে গিয়ে তারা আর কোনও প্রকার তৎপরতা চালাতে সাহসী হয়নি। এটাও লক্ষ্যণীয় যে, রাজাকার ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে পূর্বে থেকেই দানা-বাঁধা ঠাণ্ডা লড়াই এ সময় চরমে উঠে। রাজাকারদের সবাই বাঙালী হওয়ায় খান-সেনারা তাদের সন্দেহ করতো। অক্টোবর থেকে তারা রাজাকারদের একেবারে বিশ্বাস করতে পারছিলনা। রাজাকারদের জাতীয়তাবাদী অনভূতি কম মাত্রায় ও বিলম্বে হলেও জাগতে শুরু করে। স্বজাতির উপর পাশবিক অত্যাচার এবং নিজেরা রাজাকার হওয়া সত্ত্বেও নিটক আত্মীয়স্বজন হানাদার মিলিটারীদের জঘন্য উৎপীড়নের হাত থেকে অব্যাহতি না পাওয়ায় দেরীতে হলেও তাদের অনেকেরই বোধোদয় হয়। তাছাড়া মক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে বাধ্য হয়ে রাজাকাররাও অবিশ্বাস করার মত কিছু কিছু কাজ করে চলেছিল। যেমন শিবির থেকে বাইরে যেতে পারলেই দলবদ্ধভাবে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ, হানাদারদের অসংখ্য গোপন খবর মুক্তিবাহিনীর কাছে পাঁচার করা ইত্যাদি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৬

ভারতে মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি দল

আনোয়ার-উল-আলম শহীন মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি দল নিয়ে মানকাচর পৌঁছলে, টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম তাদেরকে স্বাগত জানালেন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহমুদুল্লাহ্, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরও বেশ কজন অফিসার প্রতিনিধি দলকে আন্তরিক সম্বর্ধনা জানান। আনোয়ার-উল-শহীদ মানকাচরে এনায়েত করিমের শিবিরে পৌঁছলে বি. এ. এফ. মেজর বিন্দার সিং ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে তাকে ও তার দলকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এবং ঐ দিনই তাদের তুরার মূল ঘাঁটিতে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তৃতীয় দফায় নুরুন্নবীকে দেখে ব্রিগেডিয়ার সানসিং খুবই উৎসাহিত বোধ করেন। তিনি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে প্রতিনিধি দলের নেতা শহীদ সাহেবকে গ্রহণ করেন। টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি দলের হাতে অনেক কাজ, কিন্তু সময় খুবই কম। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সব কাজ সেরে দেশে ফিরতে হবে। তাই আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও ডাঃ শাহজান চৌধুরী পরদিন কলকাতা যাত্রা করেন। নুরুন্নবী থেকে যায় যুদ্ধকৌশল নিয়ে ভারতীয় জেনারেলদের সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলাপ-আলোচনা ও নতুন পরিকল্পনা তৈরীর জন্য। ফারুক, নূরু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মত বিনিময় ও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার দায়িত্ব নিয়ে তুরাতেই থেকে যায়।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আশ্বাস
আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ৩রা নভেম্বর কেলকাতা পৌঁছান। সেখানে পৌঁছেই তিনি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগে সচেষ্ট হন। তার বিশেষ সুবিধা ছিল যে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল সংসদের সহ-সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। সেই সুবাদে বাংলাদেশের প্রায় সকল জাতীয় নেতার সাথেই ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন। ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ও কৃষক নেতাদের সাথেও তার পূর্ব পরিচয় ছিল। এমনকি বাংলাদেশের গণপরিষদ সদস্যদের অধিকাংশকেই তিনি চিনতেন। এজন্য মুজিব নগরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগে তার বেগ পেতে হয়নি। প্রসঙ্গতঃ একটা ব্যাপার উল্লেখ্য যে, আমি যখন আগষ্টে ভারতে গিয়েছিলাম, তখন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে আমার সম্পর্কে খুব একটা আগ্রহ না দেখালেও সেপ্টেম্বর থেকে তারা আমাদের সম্পর্কে বেশ আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। পরবর্তীতে আমার প্রতিনিধিদের যথাযোগ্য সম্মান দেখানো হয়েছে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সম্মানও দেখানো হয়েছে। ৫ই নভেম্বর আনোয়ার-উল-আলম শহীদ বাংলাদেশের উপ রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খোন্দকার মুশতাক আহমেদ প্রমুখ মন্ত্রী মহোদয় ও উপদেষ্টা ইউসুফ আলীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। স্বাধীন বাংলা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৭

বেতারের ভারপ্রাপ্ত গণপরিষদ সদস্য সর্বজনাব আবদুল মান্নান, এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান, মিজানুর রহমান চৌধুরী সহ অন্যান্য বেশ কয়েকজন নেতার সাথেও শহীদ সাহেব ঐ একই দিনে কথা বলেন।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সার্থক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। এই ঐতিহাসিক নেতৃত্বের মূলে যারা অনন্য ও অতুলনীয় ছিলেন, তাদের মধ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী অন্যতম। ঐ সময়ের অন্যতম প্রধান এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খোন্দকার মুশতাক আহমেদ সম্পর্কে যথেষ্ট বিভ্রান্তি ছাড়া অন্যান্য নেতাদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের সংগ্রামের একনিষ্ঠ সহযোগী। আওয়ামী লীগ রাজনীতির সুখে-দুঃখে, তিনি বার বার অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে সংগঠনের হাল ধরেছেন। বঙ্গবন্ধু যত বার জেলে গেছেন, ততবারই অস্থায়ী সভাপতি হিসাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনকে বিশেষ করে বাংলার স্বাধীকার আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সফলতার সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ২৫শে মার্চ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হানাদারদের হাতে বন্দী হলে ১০ই এপ্রিল গঠিত গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে ১৭ই এপ্রিল শপথের মাধ্যমে গুরু-দায়িত্ব তিনি কাধে তুলে নেন। মুক্তিযুদ্ধের ন’মাসে সাদাসিধে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রবাসী সরকারের প্রধান সিপাহসালার হিসাবে তিনি তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও প্রিয় সহচরদের অন্যতম। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনে যতগুলো বড় বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল রচিত হয়েছে এর প্রতিটিতে জনাব তাজুদ্দীন আহমেদ তাঁর মেধা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তাজুদ্দীন আহমেদ তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় নেতৃত্বে তাঁর স্থান তখন দুই বা তিনে। এমন অবস্থায় ২৫শে মার্চ হানাদাররা যখন বাঙালীর উপর হিংস্র দানবের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনার বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে প্রবাসী গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনাব তাজুদ্দীন আহমেদ যে নিষ্ঠা, সততা, অপূর্ব কর্মক্ষমতা ও দক্ষ প্রশাসক হিসাবে ছাপ রেখেছেন, ইতিহাসের পাতায় তার নজির মেলা ভার। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অনাড়ম্বর বিলাসহীন জীবন-যাপন ভাবীকালের মুক্তিকামী সংগ্রামী মানুষের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীন আহমেদ সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর পণ করেছিলেন, যতদিন না দেশ স্বাধীন হচ্ছে, ততদিন তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন না। তিনি কখনও এই পণ ভাঙেননি। যুদ্ধের পুরো ন’মাস থিয়েটার রোডের বাড়ীর ছোট্ট একটি কক্ষে কাটিয়েছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৮

বেগম জোহরা তাজুদ্দীন ও ছেলেমেয়েরা থাকতেন সি. আই. টি. রোডের একটি বাড়ীতে। তিনি সপ্তাহে একমাত্র রবিবার দুপুরে সি. আই. টি. রোডের বাড়ীতে গিয়ে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে আসতেন। কোলকাতায় প্রবাসী জীবনের একদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি ঢাকা থেকে যে প্যান্ট-সার্ট পড়ে বের হয়েছিলেন, যুদ্ধের চার-পাঁচ মাস পর্যন্ত ঐ কাপড়েই কাটিয়ে দেন। সেই কাপড়েই তিনি ভারতীয় ও বিদেশী অনেক দায়িত্বশীল নেতা ও ব্যক্তির সাথে দেখা সাক্ষাৎ এবং সরকারের দৈনন্দিন কাজ সেরেছেন। তাজুদ্দীন আহমেদের সহকর্মীরা যখন তাকে বার বার অতিরিক্ত অন্ততঃ আর একটা কাপড় বানানোর অনুরোধ করেছেন, তখনই তিনি তাদের এই বলে শান্ত করেছেন যে, ‘যারা রণাঙ্গনে লড়াই করছে, তাদের এই এক কাপড়ই নেই। তাই তার ঐ এক কাপড় প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট।’ ঘরোয়াভাবে সহকর্মীদের তিনি এও বলতেন, পুরানো কাপড়েই তিনি বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আগষ্টের পর মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা জোর জবরদস্তি ও চাপাঁচাপি করে অফিসে ব্যবহারের জন্য দুই প্রস্থ পোশাক বানাতে বাধ্য করেন। যার এক প্রস্থ সামরিক, অন্যটি বেসামরিক। এরপরও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার হয়তো ত্রুটিমুক্ত ছিলনা। কিন্তু তারপরও নেতৃত্বের শীর্ষাসনে আসীন ব্যক্তিদের এমন কিছু সৎ, উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে, যা অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে খুঁজে পেতে কষ্ট হবে।
ক্যাপ্টেন মনসুর আলী গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করে যে কর্ম-দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তা অতুলনীয়। প্রবাস জীবনের নয়টি মাস তিনিও অতি সাধারণ জীবন-যাপন করেছেন। পেশায় একজন অধ্যাপক থাকার সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে একজন সম্মানিত ক্যাপ্টেন হিসেবে কিছুদিনের জন্য যোগ দিয়েছিলেন। মনসুর আলী সাহেবের ঐ ক্যাপ্টেন পদ কোনদিন পুরাতন হয়নি। পরবর্তীতে তিনি মন্ত্রি হয়েছেন, তবুও নামের আগে ক্যাপ্টেন বাদ দিতে পারেননি। বড় প্রাণখোলা মানুষ মনসুর আলী। তাঁর ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব তিনি যারপর নাই দক্ষতা ও সততার সাথে সম্পাদন করেন।
এ ছাড়া প্রবাসী সরকারের সাথে জড়িত আরও অসংখ্য নেতা ছিলেন, যাদের মধ্যে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা মাহমুদুল্লাহ্, ফণিভূষণ মজুমদার, কোরবান আলী, সোহরাব হোসেন, মোল্লা জালালউদ্দীন, রওশন আলী, মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, এম. আর. সিদ্দিকী, আবদুল মালেক উকিল, সৈয়দ আবদুস্ সুলতান, রসরাজ মণ্ডল, গৌরচন্দ্র বালা, চিত্ত সুতার, চট্টগ্রামের আবদুল হান্নান ও আবদুল মান্নান প্রমুখ যোগ্যতার সাথে নিজ নিজ ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করেছেন।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীন আহমেদ, মন্ত্রীসভার সদস্য ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ শহীদ সাহেবের সাথে অত্যন্ত আগ্রহ ও আন্তরিকতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বার বার আশ্বাস দেন, দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য যত রকম সাহায্যের প্রয়োজন, তা অবশ্যই দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীন আহমেদ অস্ত্রশস্ত্র সহ প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু নিয়মিত সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিলেন। মনসুর আলীও খোন্দকার
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৯

মুস্তাক আহমেদ আনোয়ার-উল-আলম শহীদের পেশকৃত হিসাব-কিতাবের কাগজপত্র দেখে অবাক ও বিস্মিত হলেন। এক পর্যায়ে মনসুর আলী সাহেব হিসাব সংরক্ষণের আধুনিক ও অভিনব পদ্ধতি দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে শহীদ সাহেবকে বলেন, ‘তোমাদের হিসাব কিতাব দেখে আমি অবাক হচ্ছি। কাদেরের মত একজন পঁচিশ বছরের যুবক কি করে এমন একটি সুসংগঠিত সংগঠন গড়ে তুলেছে। সে তো দেখছি, শুধু যোদ্ধাই নয়। এত উত্তেজনা, এত নিরাপত্তাহীনতার মাঝেও তোমরা যেভাবে প্রতিটি জিনিসের, প্রতিটি পয়সার হিসাব রেখেছ, আমরা এখানে নিরাপদে থেকেও তা পারিনি। সত্যিই আমরা সোনার বাংলা গড়তে পারবো।’ আনোয়ার-উল-আলম শহীদ অর্থ দপ্তরের সচিব খোন্দকার আসাদুজ্জামানের (মঞ্জু) সাথেও বেশ কয়েক বার সাক্ষাৎ করেন। খোন্দকার আদাসাদুজ্জামান টাংগাইলের গোপালপুর থানা নার্চির লোক। ‘৭১ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অর্থসচীব ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে তিনি পাকিস্তান সরকারের সাথে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং টাংগাইল সংগ্রাম পরিষদের প্রথম উপদেষ্টা নির্বাচিত হয়েছিলেন। টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধে তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তার ধীর স্থির সিদ্ধান্ত টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে যথেষ্ট শুভ প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে ২৭শে মার্চ থেকে ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত খোন্দকার আসাদুজ্জামানের কয়েকটি মূল্যবান পরামর্শ মুক্তিযুদ্ধের উপর সুদুর প্রসারী শুভ প্রভাব ফেলেছিল। যার একটি, ২৬শে মার্চ টাংগাইল গণ-সংগ্রাম পরিষদ যখন সমস্ত জেলার কর্তৃত্বভার নিজেদের হাতে নিয়ে নেন, তখন তাঁরা টাংগাইলের সমস্ত ব্যাংকের টাকা অন্যত্র সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শুধুমাত্র সংগ্রাম পরিষদের খোন্দকার আসাদুজ্জামানের আপত্তিতে টাকা সরানোর সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকরী হতে পারেনি। তার বক্তব্য ছিল, এই সময় ব্যাংক থেকে টাকা অন্যত্র সরানোর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। টাকা সরিয়ে ফেলতে গিয়ে হিতে বিপরীত হতে পারে। টাকা ব্যাংকেই থাক। প্রয়োজনীয় টাকা ব্যাংক থেকে চাহিদা পত্রের মাধ্যমে তুলে নেয়াই যুক্তিসঙ্গত হবে। পরবর্তীকালে যদি টাকা সরানোর প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন আরও ভেবেচিন্তে তা করা যাবে। টাংগাইল সংগ্রাম পরিষদ ব্যাংক থেকে টাকা সরাননি বা পারেননি। ৩রা এপ্রিল টাংগাইল শহর হানাদারদের দখলে চলে যায়। সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং হাজার হাজার জনসাধারণ ছিন্নমূল হয়ে নানাদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েন। নিয়মিত অর্থভাণ্ডারের অভাবে প্রথম অবস্থায় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও আমার মুক্তিবাহিনী গঠনে যথেষ্ট আর্থিক কষ্ট ভোগ করতে হয়। কিন্তু এই কষ্টের ফল স্বরূপ পরবর্তীতে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সর্বাধুনিক হিসাব সংরক্ষণের ব্যবস্থা, জন-সাধারণের সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব নিয়মিত অর্থভাণ্ডার গড়ে ওঠে।
চার জাতীয় ছাত্রনেতা-নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ. স. ম. আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখনের সাথে আনোয়ার-উল-আলম শহীদের সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হয়। বাংগালীদের স্বাধীকার আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধে উত্তরনের পটভূমিকায় চার জাতীয় ছাত্রনেতার
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!