You dont have javascript enabled! Please enable it! স্বাধীনতা '৭১ - কাদের সিদ্দিকী (২০১-৪০০) - সংগ্রামের নোটবুক

অনন্য ভরত
রাতে ভুয়াপুর ডাক বাংলোতে এক মজার ঘটনা ঘটল। ডাক বাংলোর চৌকিদার—ভরত। বয়স আনুমানিক ত্রিশ-পয়ত্রিশ। শারিরীক গঠন সুন্দর ও বলিষ্ঠ। রাত দশটার দিকে হাত কচলাতে কচলাতে আমার সামনে এসে বলল,
— আমি একটা কথা কইতাম। যদি সাহস দেইন, তাহলে কই।
— বলুন না।
— স্যার, কথা আর কী, আমি মুক্তি বাহিনীতে যাইবার চাই। আপনি বোধ করি বড় সাব। আপনে আমারে একটা বন্দুক দিয়া মুক্তি বাহিনীতে নিয়া নেইন। ভরতের কথা শুনে বললাম, “আপনার বাড়ীতে বউ পোলাপান নেই? যুবকরা তো রয়েছে। আপনার এখন না গেলেও চলবে। নেহাতই যদি মুক্তিযোদ্ধা হতে চান, তা হলে পরে সময় হলে আপনাকে নেয়া হবে। আপনি অপেক্ষায় থাকুন।”
আমার কথা ভরতকে সন্তুষ্ট করতে পারলনা। সে আবার বলল, “না, না, স্যার, বাড়ীতে আমার বউ পোলাপান আছে। আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলে তাগোর কোন অসুবিধা হইবো না। আপনে আমারে নিয়া নেইন।” বলেই সে প্রসঙ্গ বদলাল, “স্যার আপনেরে স্যার স্যারই মনে অইতাছে। আইজ প্রেরায় পনের বছর ধইর‌্যা এই ডাক বাংলায় ডিউটি করি। এর মধ্যে মার্ত একবারই একটা বড় স্যার দেখছি। এবার আপনেরে দেইখ্যা হেই রকম মনে অইতাছে। এত বছর যে কতজন আইলো গেলো কিন্তু তাগোর সাথে রাইফেল বন্দুক আসে নাই। একবার মার্ত আইছিলো, অনেক রাইফেল বন্দুক দারোগা-পুলিশ মেলেটারী।”
‘একবার মাত্র আইছিলো’ এই কথাটির দ্বারা ভরত যা বুঝাতে চাইছিল, তা আমার বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো না। ৬৭ সালে কোন এক সময় বটতলার উকিল ময়মনসিংহের কুসন্তান, আয়ুব খানের তল্পীবাহক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর আবদুল মোনায়েম খান এই ডাক বাংলায় এসেছিল। তার সঙ্গে ছিল অগনিত দারোগা-পুলিশ-মিলিটারী।
এর আগেও এই ডাক বাংলোয় কয়েকবার এসেছি। এই ভরত ৬৭ সালের কোন এক রাতে ঠিক এমনি ভাবে হাত কচলাতে কচলাতে বলেছিল, “আপনারা এই বাংলায় আছেন। কিন্তু আপনাগোরে তো স্যার স্যার মনে অয় না। আপনাগোরে তো আমাগোর মত পাবলিক পাবলিক মনে অয়।”
ভরতের ধারণা, রাইফেল-বন্দুক না থাকলে সে স্যার হয় না। আর রাইফেল বন্দুক না থাকলে বড় স্যার হওয়া একেবারেই অসম্ভব। ভরত কিন্তু আমাকে চিনতে পারেনি।
পরে ভরতকে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি করে নেয়া হয়। এই দরিদ্র ভরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে, কেবল প্রশংসা করে তা শেষ করা যাবেনা। জুনের শেষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সারাটা সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে পাশে ছায়ার মত থেকে তাদের খাওয়ানো, গোলাবারুদ বহন, অসুস্থের সেবা ইত্যাদি এমন কোন কাজ নেই, যা ভরত করেনি।
পৃষ্ঠা নং ~ ২০১

২২ শে জুন ভুয়াপুরের আশপাশের প্রায় আট-দশ মাইল ঘুরে ফিরে দেখলাম। সন্ধ্যায় আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম, আলী আজগর খান ও মোয়াজ্জেম হোসেন খান এসে ভুয়াপুর ডাক বাংলোর সামনে বসে ছিলেন। লোকের পাড়া থেকে ফেরবার পথে, ডাকবাংলোর সামনে এঁদের দেখে খুবই খুশী হলাম। তারাও আমাকে দেখে খুবই আনন্দিত হলেন। তাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে ভুয়াপুর বাজার দেখতে গেলাম। সমস্ত বাজারটি ঘুরে দেখে ছয় সাত জন সশস্ত্র যোদ্ধা পরিবেষ্ঠিত হয়ে যখন ফিরছিলাম, ঠিক তখন একটি ঘটনার সূত্রপাত হলো। পথিমধ্যে এক ভদ্রলোক মুক্তিযোদ্ধাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই তোরা কোথায় যাচ্ছিস? কমাণ্ডার কোথায় থাকবে? তোরা কোথায় থাকিস?”
ভদ্রলোকটির এই ‘তুই’, ‘তুই’ সম্বোধন শুনে মুক্তিযোদ্ঘাঁটির মন মেজাজ বিগড়ে যায়। বিখ্যাত আর. ও. সাহেব আমার পাশে হাঁটছিলেন। এই আকস্মিক ও অবাঞ্ছিত ‘তুই’ সম্বোধন তাঁর কানে গেলে তিনি আস্তে আস্তে পিছিয়ে যান। এটা দেখে ভদ্রলোকটি নিজেই আর. ও. সাহেবকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেন, “তোমরা কোথা থেকে আসছো?”
এ কথা শুনে প্রথম জনের মত আর. ও. সাহেবের মোজাজও বিগড়ে যায়। আমিও ভদ্রলোকের কথা শুনছিলাম, কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। ভদ্রলোক আর. ও. সাহেবকে একই ভঙ্গিতে বারবার জিজ্ঞেস করে চলেছেন। অথচ আর. ও. সাহেব কোন সাড়া দিচ্ছেন না। সম্ভবত আর. ও. সাহেব মনে মনে ঠিক করে ফেলেন এই বেহায়া বেয়াদবকে কিছুটা শিক্ষা দেবেন। তিনি পাশের সহযোদ্ধাকে ইশারা করলেন ভদ্রলোককে পাকড়াও করতে। দু তিন জন সহযোদ্ধা ভদ্র- লোকটিকে বেঁধে ডাক বাংলোর সামনে নিয়ে এলে যোদ্ধাদের ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম, ভদ্রলোককে এখানে নয়, পাশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হোক।

আস্থাবানদের শৃঙ্খলাভঙ্গ
আমি ডাক-বাংলোর বারান্দায় একটি কাঠের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। পাশে আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, আলী আজগর খান দাউদ, এনায়েত করিম ও মোয়াজ্জেম হোসেন খান। এঁদের জিজ্ঞাস করলাম, “কেমন আছেন? এতদিন কোথায় ছিলেন?”
তারপর মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও দাউদ খানকে বললাম,
— কি ব্যাপার? আপনাদের কাজ কতদূর এগুলো?
— কাজ তো ভালই এগুচ্ছিল কিন্তু এক সপ্তাহ আগে আরজু ও সোহরাওয়ার্দী অস্ত্র নিয়ে আলাদা একটি দল গঠন করার ইচ্ছে প্রকাশ করে। আমরা তাদের সাথে একমত হতে পারিনি। তাই চলে এসেছি। তাদের কাজটা আমাদের ভাল লাগছেনা। ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করলে বা করতে
পারলেই বোধ হয় ভাল হতো।
এ সময় মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও দাউদ খানকে কিছুটা চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। এত চিন্তা করছেন কেন? আরজু সাহেবরা এখানেই আসছেন। সেই মুহূর্তে এই ধরণের নিশ্চিত আশ্বাস শোনার জন্য তারা মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। কথাশুনে মোয়াজ্জেম হোসেন
পৃষ্ঠা নং ~ ২০২

মহাশূন্য থেকে পড়ার মত করে বললেন,
— এ্যাঁ। আরজুরা আসছে? কিভাবে সম্ভব?
— আমি চারদিন আগে খবরটা পেয়েছি। খবর পেয়ে তাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমার সাথে দেখা করতে অসম্মতি জানান। তারা আমার দূতকে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, “কাদের সিদ্দিকী একাই মুক্তিবাহিনীর সোল এজেন্সি পায় নাই। সে ডাকলে বা খবর পাঠালেই যেতে হবে এমন নয়।” তাদের এ ধরণের কথাবার্তা মুক্তিযুদ্ধের জন্য মোটেই সুখবর নয়। তাই গতকাল তাদের ডেকে অথবা গ্রেফতার করে আনতে বড়সড়ো একটা দল পাঠিয়ে ছিলাম। তাদেরকে ওরা প্রথম চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। পরে যখন দেখেছেন, পায়ের তলায় মাটি নেই, তখন স্বেচ্ছায় এসেছেন। কয়েক মাইল হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় তাদের জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে মোয়াজ্জেম হোসেন খান, দাউদ খান, সোহরাব আলী খান আরজু ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে এক দীর্ঘ প্রাণ খোলা আলাপ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার সিদ্ধান্ত মত পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত মিলিয়ে গত ১৬ই জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। কিন্তু প্রচার চালাতে চালাতে তাঁরা গোপালপুরের ভেঙ্গুলায় এলে শয়তানের দুর্মতি তাদের বিপথে ঠেলে দেয়। ভেঙ্গুলায় সোহরাওয়ার্দী আরজু সাহেবকে অবহিত করে বেহুলার হাতেম আলী খান সাহেবের বাড়ীতে বেশ কিছু অস্ত্র আছে। আপনাদের স্মরন থাকার কথা, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমরা বেহুলায় গিয়ে ছিলাম এবং মিন্টুর সহায়তায় সেখানে ছয় হাজার গুলি সহ তেরটি রাইফেল লুকিয়ে রেখেছিলাম। সোহরাওয়ার্দী সেই সময় আমার সাথে ছিল, সুতরাং সেও খবরটা জানত।
এই গুপ্তধনের খবর শোনার সাথে সাথে তা পাবার আশায় আরজু সাহেব ‘আলীবাবা চল্লিশ চোরের’ আলীর ভ্রাতার মত যারপর নাই উৎসাহী হয়ে উঠেন। ‘শুভস্য শীঘ্রম্’। অতএব কাল বিলম্ব না করে ১৬ই জুন রাতে লুকিয়ে রাখা অস্ত্র বের করে এক নিজস্ব বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা আটেন। এ সময় মোয়াজ্জেম হোসেন ও দাউদ খান তাঁদের ঐ কার্যকলাপের সাথে একমত হতে না পারায় এবং বাধা দিলে জীবন যেতে পারে বিধায় তাদের সঙ্গ ত্যাগ করে ফিরে আসেন।
অস্ত্র হাতে পেয়ে আরজু সাহেব ও সোহরাওয়ার্দী নিজেদের বেশ শক্তিশালী মনে করেন। বাইশজন লোক সংগ্রহ করে, তাদের মধ্যে ঐ অস্ত্র বিতরণ করে ঘোরাফেরা শুরু করেন। স্থানীয় জনগণের কাছে কিছু চাঁদা সংগ্রহ এবং আরও গোটা চারেক অস্ত্র উদ্ধার করেন। কয়েকজন ডাকাতকেও মৃত্যুদন্ড দেন। আরজু সাহেবদের এ সব কার্যকলাপের কথা লোকমান-গফুর কোম্পানীর কাছ থেকে ১৮ই জুন যখন সর্বপ্রথম জানতে পারি, আমি তখন দেওপাড়া-শিবের পাড়ায় অবস্থান করছিলাম। সেখান থেকেই আরজু-সোহরাওয়ার্দীকে চিঠি লিখি। চিঠির জবাবে তারা কি বলেছিলেন, তা ইতিমধ্যেই বর্ণনা করেছি। তাদের বক্তব্য জানার পরই ধরে আনার জন্য
পৃষ্ঠা নং ~ ২০৩

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল পাঠিয়েছিলাম। তারাই আরজু সাহেব ও সোহরাওয়ার্দীকে পাকড়াও করে এনেছে।
আমরা ডাক-বাংলার বারান্দায় বসে কথা বলছি, এমন সময় একটি লোক এসে বলল, “স্যার, আমার একটু বয়স হইয়া গেছে। তবুও আমি মুক্তিযোদ্ধা হইতে চাই। বন্দুক লইয়া যুদ্ধ- টুদ্ধ করতে পারমুনা তবে মুক্তিবাহিনীর সেবায় যা লাগে তা সব করতে পারমু। আমারে মুক্তিবাহিনীতে নিতে হইবো। জানেন স্যার, দেশের লাইগ্যা বুকটা না আমার কেমন করে।”
তাকে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি করে নিই। লোকটি দরিদ্র। তবে তার প্রাণ বিশাল, ভালবাসা অফুরন্ত। পরে ইনি সকল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কদ্দুছ নগরের প্রিয় আরফান ভাই সংক্ষেপে ‘কোম্পানী’ বলে পরিচিত হয়েছেন।
আরফান মিয়ার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন চব্বিশ জন ছাত্র-যুবক সহ আরজু সাহেব ও সোহরাওয়ার্দীকে হাজির করা হলো। এদের মধ্যে কালাম, স্মৃতি, মতিও ছিল। এরা আগে থেকেই আমার সাথে কাজ করছিল। এদের তিন জনকে আলাদা নিয়ে দু’একটি কথা জিজ্ঞেস করলাম, বাকীদের এক এক করে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা অস্ত্র নিয়েছেন কেন? আপনারা কি করতে চান। আর আপনাদের কি-ই বা বলা হয়েছে?” তাদের এক কথা, ‘দেশের জন্য যুদ্ধ করব।’ এরপর আরজু সাহেবকে বললাম, “আপনি ও সোহরাওয়ার্দী গভীর জঙ্গলে আমার সাথে একমত হয়ে এসেছিলেন যে, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে। এবং সে ভাবে আপনারা লোকদের সংঘবদ্ধ করার প্রচেষ্টাও নিয়েছিলেন। তারপর কেন আলাদাভাবে দল গঠনে প্রয়াসী হলেন? আর এই অস্ত্রগুলো তো আমারই লুকিয়ে রাখা।”
আরজু সাহেব এবারও সেই পূর্বের জবাবই দিচ্ছিলেন। যা তিনি দূতকে জানিয়েছিলেন। আরজু সাহেব রাজনীতিতে আমার চাইতে সিনিয়র। মনে হয়, এহেতু মুক্তিযুদ্ধে আমার নেতৃত্ব মেনে নিতে ও আনুগত্য প্রদর্শন করতে সম্ভবতঃ তাঁর কষ্ট হচ্ছিল।
আরজু সাহেবকে শান্তভাবে ডাকবাংলোর বারান্দায় বসতে বললাম। এরপর গেলাম সোহরায়ার্দীর সামনে, “আপনি তো এই বাহিনীর সামরিক প্রধান। এই যে রিভলবার দিচ্ছি এটা একবার খুলুন, লাগান।”
— আমি এটা খুলতে, লাগাতে পারিনা।
— তাহলে এই যে ব্রেটাগান দিলাম, এইটা একবার খুলুন, লাগান।
— আমি এটাও খুলতে জানি না।
— তা হলে এই রাইফেলটি নিন, এটার বোল্ড, ম্যাগজিন খুলুন।
— আমি এটাও খুলতে পারবনা।
— আপনি কিছুই পারবেন না? তা হলে দল গঠন করেছেন, সামরিক নেতা হয়েছেন, এতগুলো মানুষ সাথে নিয়ে চলেছেন কি করতে? এদের মারতে?
পাশের এক মুক্তিযোদ্ধাকে আদেশ দিলাম, একে গুনে গুনে একশ’ খানা বেত্রাঘাত কর।
পৃষ্ঠা নং ~ ২০৪

আদেশ পালিত হতে এক মিনিটও বিলম্ব হলোনা। পঞ্চাশ ঘা বেত মারার পর সোহরাওয়ার্দী খুবই কাহিল হয়ে পড়ে। তখন তাকে ধরাধরি করে পাশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকী পঞ্চাশ বেত আর মারা হলো না। বাকী বেত মারলে সে বাঁচবে না। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার এসে অনেক চেষ্টা করে সোহররাওয়ার্দীকে কিছুটা সুস্থ করে তুললেন। পঞ্চাশ বেত মূলতবী রেখে চিকিৎসার জন্য চারশ’ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে টাংগাইলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বলে দেওয়া হলো হানাদারদের কাছে আমাদের নামে বদনাম করে ওদের ভেতরে ঢুকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে। পরবর্তীতে সোহরাওয়ার্দী সীমাহীন আস্থা ও সফলতার সাথে মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান
রেখেছে।
আরজু সাহেবকে বললাম, “এরপর আপনাকে কি করা যায়? আপনাকে আরেকবার সুযোগ দেয়া হলো। আপনি ইচ্ছা করলে এরপরও আমাদের সাহায্য করতে পারেন অথবা একজন সাধারণ মানুষের মত অবাধে জীবন-যাপন করতে পারেন, কিংবা ভারতে চলে যেতেও আপনার কোন বাধা নেই। তবে, আমাদের বিরুদ্ধাচারন করলে কিংবা হানাদার বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করলে, উপায় নেই। দেশদ্রোহীতার অভিযোগ আনা হবে এবং সে জন্য কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।”
শুধু আরজু সাহেব নন, উপস্থিত সবাই বিশেষ করে সদ্য আগত আনোয়ার-উল- আলম শহীদ, এনায়েত করিম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও আলী আজগর খান দাউদ (দাউদখান) হাঁফ ছেড়ে বাচেন। সোহরাওয়ার্দীর উপর এভাবে বেত্রাঘাত করা হবে, এটা তারা কল্পনাতেও আনতে পারেননি। তবে তারা খুব ভালভাবে উপলব্ধি করেছেন, অবস্থাটা খুবই ভয়াবহ। অতএব কোনও প্রকার ঢিমে তালার সুযোগ নেই, পদে পদে মৃত্যু সংগীন উচিয়ে আছে।
সোহরাব আলী খান আরজু সুদক্ষ সংগঠক ও দুর্দান্ত শক্তিশালী বক্তা। এই ঘটনার পর থেকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন ও মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে নিষ্ঠা ও ত্যাগের স্বাক্ষর রেখেছেন তা খুবই বিরল।
আসামের ধুবরী মানকাচরসহ ভারতের নানা জায়গা ঘুরে হঠাৎ বিকেলে নুরুল ইসলাম সাহেব এসে হাজির হয়েছেন।
রাতে সবার সাথে খাবার খেলাম। দুদু মিয়া ২০শে জুন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া দাওয়া তত্ত্বাবধান করছিলেন। শুধু তত্ত্বাবধান নয়, প্রতি বেলা পরম আস্তরিকতার সাথে খাবার পরিবেশন করছিলেন। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো, দুদু মিয়া তার ভাই, বন্ধু ও আত্মীয়দের পরম যত্ন ও নিষ্ঠার সাথে সেবা করে যাচ্ছেন।

চিত্র বিচিত্র
২৩শে জুন। এদিন সুবেহ সাদেকে এক অভিনব খবর এলো। ভুয়াপুরের পূব দক্ষিণে শিয়ালকোলের কাছাকাছি লোকমান হোসেন কোম্পানীর সংবাদ বাহক এসে জানাল, গতকাল-এ এলাকার এক কুখ্যাত ডাকাতকে গ্রেফতার করে তার হাত-পা বেঁধে একটি ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। অথচ মাঝরাত থেকে
পৃষ্ঠা নং ~ ২০৫

তাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। পাহারায় যারা ছিল, তারা পালাবার একটু আগেও ডাকাতটিকে দেখেছিল কিন্তু রাত একটার সময় শুধু কয়েকবার চিকার মত চিক্ চিক্ শব্দ শোনা যায়। এর পরে আসামীর ঘরে উকি মেয়ে দেখা গেল, সে নেই। তার হাত-পা বাঁধা দড়ি ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। তাদের ধারণা, ডাকাতটি নাকি নিজেকে নানা ভাবে পরিবর্তন করতে পারে। ইচ্ছামত বাঘ, ভালুক, ইদুর, চিকা, কোন কিছু হতেই নাকি তার কোন অসুবিধা হয় না। এ রকম একটি আজব খবর শুনে একটু আশ্চর্যও হলাম। আবার হাসিও পেল। লোকমানের দূতকে শুধু বলে দিলাম, “ঠিক আছে, তুমি যাও। তোমার কমাণ্ডারকে একবার আসতে বলো।”
আট দশজন একত্রে সকালে নাস্তা করতে বসলাম। এ সময় আগের দিন ধৃত লোকটিকেও আনা হলো। আমাদের সাথে তারও নাস্তার ব্যবস্থা ছিল। ইনি এক বিচিত্র মানুষ, নাম সিরাজ উকিল। টাংগাইলের চর এলাকার লোক। লোকটি বেশ সহজ সাদা-সিদে প্রকৃতির। অন্যকে তুই তুমি সম্বোধন করা তাঁর অভ্যাস। তাঁর এই চিরাচরিত অভ্যাস মতো আগের দিন তুই তুমির তুরি ছুটিয়েছিলেন। তাঁকে গ্রেফতার দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা দেখা দেয়নি। তিনি অবলীলাক্রমে নিঃসংকোচে ভাত খেলেন এবং চা পান করলেন, বেশ হাসি-ঠাট্টা মশকারীও করলেন। সিরাজ সাহেবকে বললাম, “আপনি এখন হয় শহরে নয়তো আপনার এলাকায় গিয়ে থাকুন। আপনার এইভাবে চলাফেরা বিপদ হতে পারে।”
এর সম্পর্কে আরও দু একটি কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। তাকে ধরে এনে একটি ঘরে কেন আটকে রাখা হয়েছিল, তার পর কেন তার বাধন খুলে দেয়া হয়, কেন তাকে জামাই আদর করা হলো, তা তিনি মূহূর্তের জন্যও ভেবে দেখেননি। ভুয়াপুর থেকে টাংগাইল শহরে গিয়েও তিনি তাঁর অভ্যাস মতই চলতে থাকেন। তিনি যেমন রাজাকারদের সভায় যান, তাদের সাথে আন্তরিকভাবে কথাবার্তা বলেন, অন্যদিকে আবার দেশ-প্রেমিকদের সাথেও উঠা বসা করেন, তাদের সাহায্য সহযোগিতা করারও চেষ্টা করেন। তাঁর ভেতর কোন কুটিলতা, জটিলতা আছে এমন কিন্তু নয়। অথচ তিনি উভয় পক্ষে আছেন, আন্তরিকভাবেই আছেন। এমন বিচিত্র মানুষ বড় দুর্লভ। এমন সাদাসিদে বিচিত্র মানুষের সুনাম করা সহজ কিন্তু দুর্ণাম করা বড় কঠিন।
১৪ আগস্ট, ১৯৭১ সাল। টাংগাইল বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান। আর এ অনুষ্ঠানের সভাপতি তদানীন্তন রাজাকার প্রধান, জামাতে ইসলামের নেতা কুখ্যাত আবদুল খালেক। হানাদার বাহিনীর সাথে তার প্রচুর দহরম মহরম। আর এরই সুবাদে লোক হত্যা ও হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমানদের সম্পত্তি লুটতরাজ করে হঠাৎ আলাদীনের চেরাগের বদৌলতে সে হয়ে উঠেছে বিপুল ধন-সম্পত্তির মালিক। ফলে গর্ব ও অহংকারে তার পা আর মাটিতে পড়ে না। সে তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। তার চোখে আর কেউ মানুষ নন, সবাই যেন শিয়াল-কুকুর, অপদার্থ। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এ সভায় আবদুল খালেক একটি চেয়ারে বেশ গর্ব ও অহংকার নিয়ে ডাটের সাথে
পৃষ্ঠা নং ~ ২০৬

বসেছিল। সেখানে সিরাজ উকিল উপস্থিত হয়ে দুর্দান্ত প্রকৃতির মহা প্রতাপশালী খালেককে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কি হে খালেক। একেবারে মাটিতে পা পড়ে না দেখছি। মনে হইতাছে কাপড় উদ্‌লা কইরা দিয়া বইস্যা আছ।”
এরকম কথা বললে ফল যা হবার, সিরাজ উকিলের ক্ষেত্রেও তাই হলো। আলবদর রাজাকার প্রধান, জামাতে ইসলামী নেতা নরহন্তা আবদুল খালেকের গর্ব ও অহংকারের প্রতি এ এক মারাত্মক আঘাত, প্রচণ্ড অপমান। বারুদে আগুন দিলে যেমন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে, ঠিক তেমনি সিরাজ উকিলের এ উক্তি আবদুল খালেকের অহংবোধের রাজ্যে প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানে। সে আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না। নিজেকে সামলাতে পারে না। ঘা খাওয়া সাপের মত লাফিয়ে উঠে, তৎক্ষনাৎ পাশে দাড়ানো এক আল-বদর রাজাকার নেতাকে বলল, “এই বেল্লেক বেতমিজকে ধরে নিয়ে আদব-কায়দা শিখিয়ে দাও।” যেমন হুকুম, তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে রাজাকাররা সিরাজ উকিলকে গ্রেফতার করে তাদের ‘বিভীষিকা ক্যাম্পে’ নিয়ে যায়। তারপর আচ্ছামত ধোলাই।
দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁকে আরেকবার অহেতুক বিপাকে পড়ে লাঞ্ছিত হতে হয়। ১৯৭৪ সালের ঘটনা। তখন সারা দেশে অস্ত্র উদ্ধারের যৌথ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। টাংগাইলেও তখন অবৈধ অস্ত্র খুঁজে বের করা হচ্ছিল। ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের বাসার পাশে সিরাজ উকিলের বাসা। একদিন গভীর রাতে সিরাজ উকিলের বাসার পাশে হঠাৎ ধুপ-ধাপ ঝুপ-ঝাপ ও দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ। দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ শুনে, কি হচ্ছে তা জানার জন্য তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ডানে-বায়ে তাকিয়ে দেখেন, তাঁর নিজের ও ব্রিগেডিয়ারের বাড়ী সহ আরও অনেকগুলি বাড়ী পুলিশ ও মিলিটারীরা ঘিরে রেখেছে। তিনি তখন সেই ভুয়াপুরের মত (পরবর্তীতে কুদ্দুছ নগর) পুলিশ ও মিলিটারীদের এর ওর সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকেন, “কি ব্যাপার? কি হয়েছে?” দু’তিন জনকে জিজ্ঞেস করে কোন সদুত্তর না পেয়ে, বোধ হয় মনে মনে তিনি রেগে যান। তিনি আবার সেই রাজাকার নেতা আবদুল খালেককে উদ্দেশ্য করে বলার ভঙ্গীতে বলেন, “খুব দেমাগ হয়ে গেছে দেখছি। বারবার জিজ্ঞেস করছি অথচ তোমাদের কানে যায় না। হচ্ছেটা কি শুনি?” গভীর রাতে একজন অপরিচিত লোকের এ ধরনের কথাবার্তা শুনে, মিলটারীদের মাথা গরম হয়ে যায়। মিলিটারীরা সিরাজ উকিলকে সপাং সপাং কয়েক ঘা বেত বসিয়ে দেয়।
২৩শে জুন দুপুরে নুরুন্নবী নামে বাইশ তেইশ বছরের একটি যুবক এসে জানাল, “ভারত থেকে আট জনের একটি দল এসেছে। তারা ঢাকা-টাংগাইল অথবা টাংগাইল-ময়মনসিংহের পাকা সড়কে পুল উড়াতে চায়। তাদের কাজে আপনার সহযোগিতা প্রয়োজন।” গোপালপুরের হেমনগরের নুরুন্নবী দলটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। চোখে চশমা আটা ছোট আকারের গোলগাল ছেলেটি আরো বলল, “দলটি প্রথম আমাদের গ্রামে এসেছেন। আমি তাদের পৌঁছে দিতে এসেছি। তবে এখানে এসে আপনাদের দেখে, আমার আর বাড়ী যাবার ইচ্ছা হচ্ছে না।
পৃষ্ঠা নং ~ ২০৭

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছর বায়োকেমিষ্টি নিয়ে এম. এস. সি. পরীক্ষা দিয়েছি। আমাকে যে ধরণের কাজ দেবেন তাই করব, করতে পারব।”
যুবকটির নিষ্পাপ, মায়াবী মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললাম, “আপনি সত্যিই যদি আমাদের সাথে সহযোগিতা করেন, তবে অনেক কিছু করতে পারবেন, এতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। আমাকে একটু সময় দিন। সন্ধ্যায় আমি আপনার সাথে আবার কথা বলব। আপনারা দূর থেকে পায়ে হেঁটে এসেছেন। খাবার খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিন।”
নুরুন্নবীর সাথে কথা শেষ করে খাবার খেয়ে ঘর থেকে বেরোতে না বেরোতেই আরেকটি সুখবর এলো, চারজন মিলিটারী পাওয়া গেছে। তাদের সাথে তিনটি চাইনিজ এল. এম. জি. আছে।
খবরের পর পরই চাইনিজ এল. এম. জি. সহ চারজন সামরিক পোষাক পরা লোক এসে হাজির হলো। তারা আমাকে মোটেই সম্মান দেখাল না। স্বাভাবিকভাবে যে সৌজন্যবোধ দরকার—তাও তারা দেখাল না। তখনো তাদের হাতে তিনটি চাইনিজ এল. এম. জি.। তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধারা বলেছিল, অস্ত্র নিয়ে কাদের সিদ্দিকীর সামনে যাওয়া যাবে না। কিন্তু তারা সে কথা মানেনি। তারা তাদের এল. এম. জি. অন্যদের হাতে দিতে রাজী হয়নি। তাই ত্রিশজন মুক্তিযোদ্ধা চারজন অস্ত্র সজ্জিত মিলিটারীকে দুদিক থেকে বেষ্টন করে আমার সামনে হাজির করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চারটি স্বয়ংক্রিয় চাইনিজ স্টেনগান, দুটি বৃটিশ এল. এম. জি. দু তিনটি ব্রিটিশ স্টেনগান ও ৩০৩ রাইফেল। সেনাবাহিনীর ট্রেনিং থাকার সুবাদে তারা বুঝতে পারে যে, তিনটি এল. এম. জি. থাকলেও অস্ত্র ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। তারা হয়ত দু তিন জনকে নিশ্চয়ই কাবু করতে পারবে। তবে তাদের বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই, এ বোধটাই সম্ভবতঃ তাদের কিছুটা শান্ত ও কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন করেছিল।
আমি তাদের বললাম, “আপনারা এসেছেন, আমরা খুশী হয়েছি। যদি চান, দেশের জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। আপনারা যখন ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তখন আর ব্যারাকে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। সেই হেতু জনগণের সাথে মিলে মিশে কাজ করতে হবে। আপনারা ইচ্ছা করলে আমাদের সাথে থাকতে পারেন বা অন্যত্র চলে যেতে পারেন। তবে অস্ত্র নিয়ে এ এলাকার যত্রতত্র ঘুরতে দেয়া হবে না। এখান থেকে চলে গেলে, মুক্তিযোদ্ধারা আপনাদের পাহারা দিয়ে সীমানার বাইরে দিয়ে আসবে। আর আমাদের সাথে থাকলে আপনাদের এই অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে। আপনাদের কি দায়িত্ব হবে, কি অস্ত্র আপনাদের হাতে দেয়া হবে তা আমরাই ঠিক করব। আপনাদের পনের মিনিট ভেবে দেখার সময় দেয়া হল। ঐ গাছের নীচে বসে ভেবে দেখুন। ইচ্ছা করলে চা-পানি পান করতে পারেন। আপনাদের জন্য খাবারও তৈরী আছে।”
ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়াটাই সমীচীন। তাই চার জনই ডাক বাংলো থেকে একটু দূরে, একটি গাছের নীচে গিয়ে বসল। তাদের চল্লিশজন মুক্তিযোদ্ধা ঘিরে রাখল। তারা চারজনে শলা- পরামর্শ শুরু করল।
পৃষ্ঠা নং ~ ২০৮

এদিকে বাহাজ উদ্দিন নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাষ্ট্রবিজ্ঞানের এম. এ. ক্লাশের জনৈক ছাত্র আমার সাথে মিলিত হতে এলো। বাহাজ উদ্দিন ভুয়াপুরের পশ্চিমে জগন্নাথগঞ্জ সিরাজগঞ্জের মাঝামাঝি শশুয়ার চরের বাসিন্দা। সে পশ্চিম এলাকার প্রধান স্বেচ্ছাসেবক সংগঠক হিসাবে অতুলনীয় অবদান রেখেছে।
বাহাজের সাথে কথাবার্তা শেষ হলে, কোম্পানী কমাণ্ডার লাবিবুর রহমান ও টাংগাইল বেড়াডোমার জাহাঙ্গীর দেখা করতে এলো। লাবিবুর রহমানের ভুয়াপুর থেকে আরোও দক্ষিণে নাগরপুর অভিযানে যাবার কথা ছিল। রওয়ানার আগে সর্বশেষ নির্দেশ জানতে এসেছে। জাহাঙ্গীর লাবিবুর রহমানের কোম্পানীভুক্ত ছিল না। তবু সে লাবিবুর কোম্পানী ভুক্ত হয়ে সেখানে যেতে আবেদন জানাতে এসেছে।আমি আপত্তি জানানো সত্ত্বেও যখন জাহাঙ্গীর বলল,
— আমি ঐ এলাকার সমস্ত রাস্তাঘাট চিনি। তাই আমার কোন অসুবিধা হবে না।
তখন জাহাঙ্গীরকে অনুমতি দিলাম।
লাবিবুর রহমানকে জানিয়ে দেয়া হলো, নাগরপুর থানা অভিযানে গোলাম সরওয়ার ও লালটু তাকে সাহায্য করবে। তবে মূল নেতৃত্ব থাকবে তার হাতে। একজন দারোগা পুলিশকেও হত্যা করা যাবে না। ধৃত দারোগা পুলিশকে জনগণের সামনে দাড় করিয়ে পাঁচ ঘা বেত মেরে ছেড়ে দিতে হবে। থানা দখল করে অস্ত্র গোলা-বারুদ ও বেতার যন্ত্র নিয়ে দশ দিনের মধ্যে হেড-কোয়ার্টারে আমার সাথে দেখা করবে। লাবিবুর ও জাহাঙ্গীরকে নানাভাবে সতর্ক করে দিয়ে তাদের হাসিমুখে বিদায় দিলাম। লাবিবুর রহমানের কোম্পানীকে কিছুদূর এগিয়ে দেয়া এবং ফেরার পথে প্রখ্যাত কৃষক নেতা মালেক ফকীরের কাছে রাখা সাইক্লোস্টাইল মেশিনটি নিয়ে আসার জন্য বুলবুল খান মাহবুবকে দায়িত্ব দেয়া হলো। তিনি লাবিবের কোম্পানীকে জোগার চর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলেন। কিন্তু এই বিদায়ই যে শেষ বিদায় হবে, এটা কেউ জানতাম না। টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে চরম বেদনাদায়ক ও বিষাদপূর্ণ ঘটনা কি করে ঘটল তা একটু পরে বর্ণনা করব।
নাবিবুর রহমান ও তার কোম্পানী চলে গেলে, চারজন মিলিটারীর একজন তার হাতিয়ার একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে দিয়ে আমার সামনে এসে বলল, “আমি আর অন্য কোথাও যাব না। আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই।” এই মিলিটারী ভদ্রলোক অস্ত্র ত্যাগ করার পর পরই আরেকজন তাকে অনুসরণ করল। তারও একই কথা। বাকী রইল দুজন। এর একজন বলল, “আমি আপনাদের সাথে থাকতে চাই। তবে আমার অস্ত্র আমাকে ব্যবহার করতে দিতে হবে।” সর্বশেষ জন বলল, “আমি চলে যেতে চাই।”
চার মিলিটারীর এসব কথাবার্তা শুনে খুবই অসন্তোষ প্রকাশ করে বললাম, “সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে এসেছেন। আপনাদের কাঁধে ঝুলানো এই অস্ত্র জনগণের টাকায় কেনা। সুতরাং অস্ত্র আমাদের কাছে থাকবে। কারণ আমরা জনগণের হয়ে, জনগণের পক্ষে, জনগণের জন্য যুদ্ধ করছি। আমাদের স্বার্থে নয়, জনগণের স্বার্থেই অস্ত্র প্রয়োজন।”
পৃষ্ঠা নং ~ ২০৯

অপর দুই জনের অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে মুক্তিযোদ্ধাদের এক মিনিট সময়ও লাগল না। অস্ত্রধারী সুন্দর দেহের অধিকারী রাজশাহীর রবিউল হা করে দাঁড়িয়ে রইল। পরে শুনেছি, এরা চারজনই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর উত্তম গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। একজন সত্যিকার অর্থে চলে যেতে চেয়েছিল, তাই তাকে নির্বিঘ্নে চলে যেতে দেয়া হলো।

স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন
জুন মাসের শেষ থেকে এলাকার ছাত্রবন্ধুদের মধ্যে আবদুল আলিম, শামসু, কুদ্দস, আজিজ বাঙ্গাল, ভোলা ও অন্যান্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের আন্তরিকভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করছিল। এই সময় এরা সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হয় এবং দারুণ প্রশংসনীয় ভূমিকাপালন করে। বয়স্কদের মধ্যে দুদু মিয়া তো ছিলেনই। আবদুল বারী নামে মধ্যবয়সী আরেকজন লোক এসে জুটেন। এর একটি বা দুটি গুণ নয়, অনেক অনেক গুন। মুক্তিবাহিনী ভুয়াপুর ত্যাগ করলে ভদ্রলোক যেমন শান্তি কমিটির সম্পাদক হতে দ্বিধা করেন নি, ঠিক তেননি মিলিটারীদের খবরা-খবর মুক্তিবাহিনীকে এনে দিতেও তার কোন অসুবিধা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সারাটা সময় ধরেই, তাঁর এই দুকুল রক্ষার ব্যাপারটা পুরো মাত্রায় লক্ষ্য করা গেছে। তবে মুক্তিবাহিনীর প্রতি সর্বদাই বারী মিয়া বিশ্বস্ত ছিলেন। এ কারণে তাঁকে অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদও দেয়া হয়েছে।
২৪শে জুন, ভুয়াপুরের সাত আট মাইলের মধ্যে অনেকগুলি গ্রাম ঘুরে ফিরে দেখলাম এবং বহুলোককে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি করে নেয়া হলো। এলাকায় একটি সুসংহত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের জন্য বেশ কয়েকজন কে দায়িত্ব দিলাম।
২৫শে জুন। ফলদায় ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমানের কোম্পানী পরিদর্শনের জন্য গেলাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই সর্বপ্রথম আমাকে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়া হলো। হাজার হাজার মানুষ এই গার্ড অব অনার প্রত্যক্ষ করেন।
ফলদায় জনগণের সামনে এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যেও আলাদাভাবে বক্তৃতা করতে হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের বললাম,
“সাধারণ জনগণকে নিরাপদ ও নিশ্চিত করাই আমাদের প্রধান কাজ। অসৎ দুষ্ট লোক যেমন আমাদের হাত থেকে রেহাই পাবে না, ঠিক তেমনি সৎ, নিরীহরা যাতে মুক্তিবাহিনীর হাতে নাজেহাল না হন, সেদিকেও কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, অস্ত্রের শক্তিতে যুদ্ধ জয় করা সম্ভব হলেও মানুষকে জয় করতে চাই অকৃত্রিম ভালবাসা ও মধুর ব্যবহার।”
ফলদায় ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান কোম্পানীর সদস্যরা কিছুটা শারীরিক ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখাল। ক্রীড়া নৈপুন্য দেখে আমি খুবই আনন্দিত হলাম। যুদ্ধবিদ্যা প্রশিক্ষণ, দৌড়-ঝাপ, প্যারেড, বক্সিং ও অন্যান্য খেলাধুলায় ফজলুর কোম্পানী সকল কোম্পানীর অগ্রভাগেই শুধু নয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বীও বলা যায়।
সন্ধ্যায় আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, আলী আজগর খান দাউদ, নুরুন্নবীসহ ভুয়াপুরে এলাম। রাতে নুরুন্নবীকে বললাম, “আপনি যদি সত্যি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধে অংশ
পৃষ্ঠা নং ~ ২১০

নিতে চান তাহলে একজনকে সাথে দিয়ে আপনাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে পাঠাব, সাথী হবেন নুরুল ইসলাম।”
নুরুন্নবী অত্যন্ত উৎসাহের সাথে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে বলল, “আশা করছি, আমি আপনার বিশ্বাসের পূর্ণ মর্যাদা দিতে পারব।”
এদিকে ভারত থেকে যে দলটি বিস্ফোরক নিয়ে এসেছিল, তারা ইতিমধ্যেই তিন মতে বিভক্ত হয়ে গেছে। আট জনের ছয়জন সমান দু’দলে। এক দল বলছে, “আমরা টাংগাইল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সহযোগিতা করব। তাদের সাথে মিলে মিশে কাজ করব। তাদের কথামত চলব।”
অন্য তিন জনের মত সম্পূর্ণ আলাদা। তারা কিছুতেই আমাদের সাথে সহযোগিতা করবে না। তাদের এক কথা,
— আমরা ভারত থেকে এসেছি। আমরা এদের কথা মানব কেন? দরকার হলে আমরা আবার ভারতে চলে যাব।
অন্য দুজনের কথা হলো,
— আমরা আর ভারতে যেতে রাজী না। আমরা এখানেই থাকব। এঁরা যে কাজ দেবেন তাই করব।
এদের সবাইকে বললাম, “আপনাদের এমন করার কোন কারণ নেই। আপনারা নিজেদের ইচ্ছা মতোই কাজ করবেন। আমাদের দিক থেকে সব রকম সাহায্য ও সহানুভূতি পাবেন। আমার অনুরোধ, আপনাদের দু’তিন জন এখানে থাকুন। বাকীরা আবার ভারতে যান। ওখানে যারা কাজ করছেন, তাদের ভালভাবে এখানকার কথা বুঝিয়ে বলুন। তারপর ইচ্ছা হলে আবার চলে আসবেন।”
২৫শে জুন রাতে নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলাম ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। তাঁদের সাথে ভারত থেকে আসা পাঁচজনকেও দেয়া হলো। এদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য সরিষাবাড়ীর লুৎফর রহমান।
পৃষ্ঠা নং ~ ২১১

প্রথম হেডকোয়ার্টার

রাতে সহকর্মীদের নিয়ে আবার পাহাড়ের দিকে রওনা হলাম। ভুয়াপুর থেকে দুটি নৌকায় ফটিকজানী নদী দিয়ে ভাটিপথে এগিয়ে চলেছি। সাথীদের মধ্যে-আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, এনায়েত করিম, দাউদ খান ও অন্যান্য সহযোদ্ধারা। আগের নৌকাটির নেতৃত্বে রয়েছে দেওপাড়ার রিয়াজ ও কাউলজানীর পিন্টু। দুজনকেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম, সামনে বাগুনডালী হাট। সে হাট পার হলেই ডান পাশে একটি ছোট খাল পাওয়া যাবে, আমাদের অবশ্যই ঐ খাল ধরতে হবে।

নৌকাপথে বিপত্তি
বাগুনডালী থেকে মাইল খানেক পূর্ব-দক্ষিনে কালিহাতী পুল। সেটি তখন মিলিটারীদের নিয়ন্ত্রণে। তাই ঐ রাস্তা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। কখনও কোন সংশয় দেখা দিলে, বাগুনডালী হাটের কাছে নৌকা পৌছাতেই যেন আমাকে ডাকা হয়। নৌকার ভেতর কথাবার্তা বলছি। দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে গেল তবু ডানে মোড় নিচ্ছেনা দেখে দুতিনবার জিজ্ঞেস করেছি,
— তোমরা তো ভাই খাল পেরিয়ে এলেনা?
— এখনও ডানে কোন খাল দেখতে পাঁচ্ছি না।
এমনি এক পর্যায়ে রাতের গভীর নিস্তব্ধতা ভেদ করে হঠাৎ খানসেনাদের মেশিন গান গর্জে উঠল। নৌকার আশে-পাশে বৃষ্টির মত গুলি পড়তে লাগল। আমাদের নৌকা তখন নদীর দক্ষিণ পাশে ঘেঁষে, স্রোতের টানে ভাটির দিকে চলছিল। অপ্রত্যাশিত ভাবে নৌকার চারপাশে অবিশ্রান্ত ধারায় গুলি পড়তে দেখে, প্রায় সকলেই হতভম্ভ হয়ে যায়। মাল্লারা কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। দু’একজন নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়তে চেষ্টা করে। এনায়েত করিম, শহিদ ও মোয়াজ্জেম হোসেন সকলের প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। তাদের গলা শুকিয়ে গেছে। জীবনের আশা বোধহয় এখানেই শেষ। এনায়েত করিমের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। তিনি নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়েন আর কি। এ অবস্থায় সবাইকে চুপ করে বসে থাকতে বলে আর. ও. সাহেবকে নিয়ে নৌকা থেকে নেমে গলুই ধরে আস্তে আস্তে টেনে ডান পাশে একটি সরু খালের ভেতর নিয়ে গেলাম। সামান্য এগিয়েই জায়গাটি চিনতে পারলাম, কালিহাতী মুন্সিপাড়ার কাছে মাঝিপাড়া গ্রাম। থানা মাত্র একশ গজদূরে। সামনে যাবার কোন রাস্তা নেই। তাই আবার পিছিয়ে গিয়ে উজিয়ে যেতে হবে। অন্যথা নৌকা ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু নৌকা ফেলে যাবার কোন উপায় তখন ছিল না। কারণ নৌকাতে বেতার যন্ত্রের সমস্ত সাজ সরঞ্জামই শুধু নয় অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদও রয়েছে। যা আমাদের এই কয়েকজনের পক্ষে বহন করা একেবারে অসম্ভব। সুতরাং নৌকা ত্যাগ করা যাবে না। অগত্যা নিঃশব্দে নৌকাটিকে পিছনে ঠেলে নদীতে ফেললাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ২১২

তখন অবশ্য গুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে কিছুদূর পিছিয়ে যাবার পরই, নৌকাটিকে লক্ষ্য করে হানাদাররা আবার বৃষ্টির মত গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। গুলি তো নয়, যেন মৃত্যু বান। তবে আমাদের ভাগ্য ভাল, একটি বাঁক পেয়ে গেলাম।
আর. ও. সাহেব, শামসু ও আমি গুণ টেনে নৌকাটি প্রায় এক মাইল উজানে আনার পর বাম দিকে একটি খাল দেখতে পেলাম। এই খালের কথাই নৌকার মাল্লা ও সহযোদ্ধাদের বার বার বলেছিলাম। খালের ভেতর নৌকা ঢুকিয়ে একটু নিরাপদ বোধ করে মাল্লা ও অন্যদের জিজ্ঞেস করলাম,
— এ খালটি আপনারা দেখতে পেলেন না?
— আমরা সব সময় নদীর ডান পার ধরেই গেছি। ডান পাশে একটি খাল পাব, এই আশায় সব সময় লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এটা আমাদের চোখে পড়েনি।
অন্যদিকে সামনের নৌকাটি মিলিটারীদের গুলির আঘাতে ডুবে যায়। এতে অস্ত্র শস্ত্র খোয়া গেলেও কোন প্রাণহানি ঘটেনি।
আবার মাল্লাদের নৌকা বাইতে বললাম। তখনও আমার সারা শরীর রি রি করছিল। আর একটু এগুলে কি সর্বনাশই না হতে পারত। অথবা শত্রুরা যদি জানতে পারত যে এই নৌকাতেই মুক্তিবাহিনী রয়েছে কিংবা আমি এ নৌকার যাত্রী, তাহলে কী পরিণামই হতো। এটা ভাবতেই সর্বাঙ্গে লোম পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছিল।
নৌকা এগিয়ে চলেছে। সামনে বাগুটিয়া পাকা কুয়াশার ভেতর রেখার মত আবছা দেখা যাচ্ছে। খালের ডান পারে নৌকা বাধতে বলে বাগুটিয়া পুলের অবস্থা দেখার জন্য মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে চারজন মুক্তিযোদ্ধা পাঠালাম। মনিরুল ইসলাম কিছুদুর এগিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এলো।
― কি ব্যপার।
— খালের মুখে অসংখ্য শত্রু সেনা ওৎ পেতে বসে আছে।
— কি বল। আচ্ছা তুমি নৌকায় থাক।
সবুর, হুমায়ূন, সাইদুর ও শামসুকে নিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে আস্তে আস্তে এগিয়ে একেবারে পাকা সড়কে পৌঁছে গেলাম। ডানে-বামে প্রায় দু’তিনশ গজ ঘুরে ফিরে কোন মিলিটারীর নাম গন্ধ পর্যন্ত দেখতে পেলামনা। অবশেষে ফিরে এসে নৌকা ছেড়ে দিতে বললাম।
পুলের উপরে বা আশে-পাশে কোন মিলিটারী ছিল না। অথচ মনির মিলিটারীর ভ্রান্ত খবর দিল কেন? কারন কিছুক্ষণ আগে গোলাগুলির মুখে পড়ে সবার মত মনিরও ভয় পেয়েছিল। মিলিটারী ভীতি তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। হতোদ্যম মন ও আচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে সে হানাদারদের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ছোট ছোট অসংখ্য ঝোপ-জঙ্গল দেখে সেগুলিই শত্রুসেনা মনে করে ভীত হয়ে ফিরে এসেছিল।
মাল্লারা খুব দ্রুত নৌকা বাগুটিয়া পুল পার করলেন। তখন রাত একটা। আমরা ক্ষুধায়
পৃষ্ঠা নং ~ ২১৩

খুবই কাতর। এ অবস্থায় কঠিন। কিছু খেয়ে নেয়া চাই। অথচ কাছাকাছি পরিচিত কোন বাড়ীও নেই৷ অগত্যা পাকা সড়ক থেকে ডাকাডাকি করে বাড়ীর মালিককে ঘুম থেকে জাগানো হলো।
খাবার চাইলে তিনি সানন্দে খাবারের ব্যবস্থা করলেন। তবে তারা যে মাংস দিয়েছিলেন, তাতে ছিল প্রচুর ঝাল। পরের তিন-চারদিন আমরা প্রত্যেকেই পেটের অসুখে ভুগেছিলাম। তবে এর অর্থ এই নয় যে, খাবার পরিবেশনের পিছনে আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল।
২৬ শে জুন, দুপুরে আমরা ভণ্ডেশ্বর বাজারে পৌঁছলাম। এখানে একটি জনসভা করে মরিচাতে গেলাম। নবী-নেওয়াজ পনের জন সহযোদ্ধাসহ আমাদের অভিনন্দন জানাল। মাস খানেক হল কমাণ্ডার নবী নেওয়াজ তার দল নিয়ে মরিচাতে দৃঢ়ভাবে ঘাঁটি গেড়ে আছে। আমি রাতটা কাকড়াজানের এক মেম্বারের বাড়ীতে কাটালাম।
হেডকোয়ার্টারে যাব। কিন্তু হেডকোয়ার্টার কোথায়? এই পনের দিনে তা নিজেই জানিনা। তাই দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছ থেকে জেনে নিলাম, হেডকোয়ার্টার কচুয়া বহেরাতলীর মাঝামাঝি একটি গ্রামে, নাম আন্ধি। জায়গাটি দুর্গম ও নিরাপদ। নতুন হেড কোয়ার্টার নির্বাচনে শওকত মোমেন শাজাহান নিপুন বাস্তবতা বোধের পরিচয় দিয়েছে। শওকত মোমেন শাজাহান একটি সুসজ্জিত দলের নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের কাকড়াজান থেকে হেড কোয়ার্টার অবধি পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। ২৭ শে জুন সকাল দশটায় হেড কোয়ার্টারে পৌঁছলাম।
হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে গফুর, ঘাটাইলের খোরশেদ, মির্জাপুরের পুলক সরকার ও মনীন্দ্র মোহন ঘোষের নেতৃত্বে একশ জনের একটি দলকে গোড়াইয়ের কাছে একটি পুল বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিলাম। এই দলের সাথে গেল ভারতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ একটি দল।

হাসপাতাল স্থাপন
হেড কোয়ার্টারের যাবতীয় খোঁজ খবর নিলাম। হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে কিনা, করা হলে কোথায় এবং কি অবস্থায় আছে, তা জানতে চাইলাম। আগেই খবর পেয়েছিলাম, ১৯শে জুন কামুটিয়া হয়ে মিলিটারীরা বাশাইলের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে কমাণ্ডার মোকাদ্দেছ তার দল নিয়ে অসীম সাহসিকতার সাথে হানাদারদের বাধা দিয়েছিল। কিন্তু ঐ দিন ৩ ইঞ্চি মর্টারের একটি গোলা প্রতিরক্ষা ব্যুহের প্রায় দুমাইল পিছনে, বাথুলী বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের একেবারে মাঝখানে এসে পড়ে। এতে দুজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর রূপে আহত হয়। আহতদের একজন টেংগুরিয়া পাড়ার হাবিবুর রহমান তালুকদার খোকা। খোকা আমার ছাত্র জীবনের সহযোগী। অন্যজন রামপুরের আনোয়ার হোসেন। এদের অবস্থা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম। বেলা একটায় মুক্তি বাহিনীর ভ্রাম্যমান হাসপাতালটি পরিদর্শন করতে গেলাম।
আন্ধি থেকে দেড় মাইল দক্ষিণে একটি বাড়ীর দুটি ঘর নিয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। চিকিৎসার সর্বাধুনিক সরঞ্জাম বলতে যা বুঝায় তার প্রায় সব কিছুই আছে। ছজন মুক্তিযোদ্ধা তখন হাসপাতালে শয্যাশায়ী। খোকা ও আনোয়ার হোসেনের আঘাত খুবই
পৃষ্ঠা নং ~ ২১৪

গুরুতর। আমি প্রথমে খোকার কাছে গেলাম। খোকার হাঁটুর নীচে পিছনের দিকের প্রায় সমস্ত অংশটাই সেলের আঘাত উড়ে গেছে। ক্ষতের পরিমাণ লম্বায় ছ’সাড়ে ছ’ইঞ্চি, প্রন্থে ইঞ্চি তিনেক। দুই ইঞ্চির মত গভীর। হাঁটুর নীচে পিছনের দিক থেকে সম্পূর্ণ হাড়টাই বেরিয়ে আছে। ওর পায়ে ব্যাণ্ডজ বাধা ছিল। তা নিজে খুলে, ক্ষতস্থান দেখে অঝোরে কেঁদে ফেললাম। তখন খোকাই বলল, “কাদের ভাই, আপনে কাঁদলে আমরা কি করমু? তাও তো বেঁচে আছি। ঐ গোলাটা অন্য কোথাও লাগলে মরে যেতেও তো পারতাম!”
খোকার মাথায় হাত রেখে বললাম,
— তা সত্য, যা হয়নি তা ভেবে কি লাভ? কিন্তু আমার দুঃখ হয় তোর মত একজন সহযোদ্ধাকে কাজে লাগাতে পারব না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তোর যে কত দিন কাটাতে হবে, তা আল্লাহ্ই জানেন। আর এ অবস্থায় তোকে যদি বাঁচাতে না পারি সেটাই হবে আমার চরম যন্ত্রনার কারণ।
পাশের বিছানায় আনোয়ারও কাতরাচ্ছিল। আনোয়ারের পাশে বসে ওর মাথা ও সারা শরীরে আস্ত আস্তে হাত বুলিয়ে দিলাম। ওর যে দারুণ যন্ত্রনা হচ্ছে, তা গায়ে হাত দিয়েই বুঝতে পারছিলাম। আনোয়ারের উরু ও কোমরের সংযোগস্থলের সমস্ত মাংস গোলার আঘাতে উড়ে গিয়েছিল। অন্য চারজনের কারোর আঘাত তেমন গুরুতর নয়। এরা পনের বিশ দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে অংশ নিতে পারবে বলে মনে হলো।
এক এক করে সকল আহতদের দেখে ও শান্তনা দিয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা দেখতে অন্য ঘরে গেলাম। বলতে গেলে সারা ঘরটাই হাসপাতালের সাজ-সরঞ্জাম ঔষধপত্রে ঠাসা। শপথ অনুষ্ঠানের দিন চিকিৎসার জন্য একটা ছোট-খাট যাই হোক ব্যবস্থা রাখতে শওকত মোমেন শাজাহান ও হামিদুল হককে বলে গিয়েছিলাম। কেবল বলে গেলেও চিকিৎসা পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়িত করা যে কতখানি কঠিন ব্যাপার, তা আমি বুঝতাম। অথচ আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মত এঁরা সুন্দর, সুশৃঙ্খল হাসপাতালের ব্যবস্থা করেছেন এবং সবরকম ঔষধপত্র এনে গুদামজাত করেছেন, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাই মুশকিল। শওকত মোমেন শাজাহান, হামিদুল হক কেবল হাসপাতাল স্থাপন ও ঔষধপত্রের ব্যবস্থাই করেননি, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র কাউলজানির শাহজাদা চৌধুরীকে স্থায়ী ডাক্তার হিসাবে এনেছেন। শাহজাদা চৌধুরী আবার তার আরেক বন্ধু (এক বছরের সিনিয়র) ডাক্তার নিশি রঞ্জন সাহাকে নিয়ে এসেছে। সব কিছু দেখাশুনা ও নিখুঁত পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন মানব প্রেমিক, শিক্ষক কূলের গৌরব আমজাদ হোসেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও যে চিকিৎসকের চাইতে রুগীদের বেশী কাজে লাগা যায়, তাদের সারিয়ে তোলা যায় এই নিরহংকার ও মানবতার প্রতীক মানুষটিকে না দেখলে, তা অনেকের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন।
শাজাহান ও হামিদুল হকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাইরে থেকে ঔষধপত্র ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস পত্র সম্ভব হয়েছে। এ কাজে সংগ্রামপুরের সেই পাতার ব্যবসায় মমতাজ খান
পৃষ্ঠা নং ~ ২১৫

ঢাকা থেকে অনেক দুষ্প্রাপ্য ঔষধ, অক্সিজেনের বোতল, সার্জারীর যন্ত্রপাতি, কেরসীনের পাখা ও অন্যান্য জিনিস পত্র সংগ্রহ করে দিয়েছে। এই মমতাজ খানের সাহায্য সহযোগীতা না পেলে হয়তো অত তাড়াতাড়ি মুক্তিবাহিনী একটা স্থায়ী হাসপাতাল গড়ে তুলতে সক্ষমই হতোনা। সে সময় ঢাকাতে একত্রে অনেক টাকার ঔষধ কিনতে সরকারী বিধি নিষেধ ছিল। সাধারনভাবে কেনাও হতোনা। কিন্তু মমতাজ খান পাঠান হওয়ার সুবাদে এবং তার এক ভাই আর্মির কর্ণেল হওয়ায় তার পক্ষে ঔষধ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল। অনেক সময় কোন ভাবেই প্রয়োজনীয় ঔষধ কিনতে না পেরে নকল ক্যাপ্টেন সাজতেও দ্বিধা করেনি। একবার এক জীবনদায়ী ঔষধ কোন ক্রমেই ঢাকাতে না পেয়ে সে সকালে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে বিকেলে ঔষধ নিয়ে ফিরেছিল। আমাদের বাহিনীতে মমতাজ খানের অবদান অপরিসীম। হাসপাতালের প্রশাসন ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র, রোগীদের প্রতি সেবা শুশ্রূষা দেখে খুবই সন্তোষ প্রকাশ করলাম। দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য নিষ্ঠা দেখে সংশ্লিষ্ট সকলের উচ্ছাসিত প্রশংসা করলাম। বিশেষ করে হাস- পাতালের গোড়াপত্তনের জন্য-শাজাহান ও হামিদুল হককে পুনঃ পুনঃ ধন্যবাদ জানালাম। স্বাভাবিক, সুন্দর ও ভালোবাসা মিশ্রিত কাজের জন্য শাহজাদা চৌধুরী, নিশি রঞ্জন সাহা ও আমজাদ হোসেনকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। এ ছাড়া হাসপাতালের সাথে জড়িত ডাঃ অমল কৃষ্ণ সরকার, রতন, বিমল, নিজাম উদ্দিন, আঃ মজিদ, মোস্তাফা, সিরাজুল ইসলাম, বেলায়েত হোসেন, শুকুর মামুদ, ওসমান গনি, মফিজুর রহমান ও মোতালেবকে বারবার প্রশংসা করে হাসপাতাল ত্যাগ করলাম।

নিয়মনীতি প্রনয়ন
আন্ধি হেড-কোয়ার্টারে ফিরে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে হাত দিলাম। প্রথমতঃ ইতিমধ্যে একটা সুসংহত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে উঠেছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের সংখ্যা তখন প্রায় তিন হাজার অথচ তারা তখনও চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি। অনুমোদনের জন্য তাদের তালিকা হেডকোয়ার্টারে পড়ে আছে। ভেবেচিন্তে, খোঁজ-খবর করে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন। এজন্য কিছুটা সময় ও সুযোগেরও সরকার।
দ্বিতীয়তঃ প্রতিদিন শত শত লোক মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হতে আসছে। প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের কখন ও কিভাবে ভর্তি করে নেয়া যায়।
তৃতীয়তঃ তখন পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর স্থায়ী কোন তহবিল গঠন করা হয়নি এবং খাদ্য সংক্রান্ত স্থায়ী কোন ব্যবস্থাও গড়ে উঠেনি। এই সমস্ত বিষয়ে কি করা যায়, কি ভাবে সকল সমস্যার সমাধান করে সর্বত্র গতি আনা যায়, ইত্যাদি বিষয়ে কয়েকদিন ধরে বারবার ভাবছিলাম।
তাছাড়া চারান—বল্লা ও বাশাইলে মিলিটারীরা যে মার খেয়েছে, মার খেয়ে ক্ষিপ্ত কুকুরের মত বদলা নেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে এবং সুযোগ পেলেই যে মুক্তিবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, এটা ভাল করে জানতাম। তাই সময় নষ্ট না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবকিছু একটা
পৃষ্ঠা নং ~ ২১৬

সুদৃঢ় পদ্ধতির মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টায় লেগে গেলাম।
চারটি ‘সিভিল ওয়ারলেস’ পূর্বাঞ্চলের নানা স্থানে বসিয়ে সমস্ত এলাকার তাৎক্ষণিক ও সঠিক খবরাখবর সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা চালানো হলো। এ ব্যাপারে ভুয়াপুরের অপারেটর আনিসের সাহস ও দক্ষতা সংবাদ সংগ্রহে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল।
অন্যদিকে আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, এনায়েত করিম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও আলী আজগর খান দাউদ–এদের কি কাজ দেয়া যায়, তা ভাবছিলাম। রাত বারটা পর্যন্ত নানা কাগজ-পত্র দেখে ও কাজ সেরে পাশের একটি পরিত্যক্ত বাড়ীতে শুতে গেলাম।
রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে গন্তব্যস্থলে চলে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমনি সময় কয়েকজন স্থানীয় লোক এলেন। সকাল সাতটার মধ্যে প্রায় জনা দশেক লোক এসে হাজির তাদের সকলের একই কথা, একই অভিযোগ। মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক শওকত মোমেন শাজাহান তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেছেন এবং তাদের উপর জোর জুলুম চালিয়েছেন। তাদের মুখে অভিযোগ আর প্রত্যেকের হাতে একখানা করে শাজাহান কর্তৃক ইস্যুকৃত কাগজ। প্রতিটি পত্রের ভাষা এক, বক্তব্য অভিন্ন। শুধু পরিমাণের ক্ষেত্রে কিছুটা হেরফের।
শাজাহানের চিঠিগুলোর বক্তব্য, ‘আপনি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পাঁচ মন চাউল, দুটি খাসি ও দু হাজার টাকা …… তারিখের মধ্যে পৌঁছে দেবেন। জিনিসগুলো ও টাকা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে পৌঁছে দেয়া না হলে, কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে। অবাধ্য হলে, কি করে বাধ্য করতে হয়, তা আমাদের ভাল করে জানা আছে।”
চিঠির নীচে শওকত মোমেন শাজাহানের স্বাক্ষর ও তারিখ অতি পরিস্কার। কোথায়ও কোন অস্পষ্টতা নেই। জিনিসপত্রের পরিমাণ হয়তো কারো বেলায় পঁচিশ মন চাউল, দশটি খাসি ও দশ হাজার টাকা। আবার কারো বেলায় হয়ত আরো বেশী। একজন কর্মঠ ও বিশ্বাসভাজন অধিনায়কের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে দিনের কাজ শুরু করলাম। দিনটি যে খুব ভাল যাবে না, তা শুরুতেই বুঝলাম।
আন্ধি গ্রামে বাদশা তালুকদারের শ্বশুর বাড়ীর সামনে একটি গাছের নীচে বসে কাজ শুরু করলাম। কাজের শুরুতেই আলোচনা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেন শাজাহান, হামিদুল হক, খোরশেদ আলম আর. ও. এবং সবুর খান। আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তু শহীদ সাহেব। শহীদ সাহেবের অনুরোধ, ‘আমাকে একটি কাজ দিন। আমি এখানেই থাকব।’ মোয়াজ্জেম হোসেন খান, দাউদ খান ও এনায়েত করিমের অভিমত, ‘আমাদেরকে পশ্চিম এলাকায় পাঠালেও (ভুয়াপুর গোপালপুরের চর এলাকা) আমরা সেখানে কাজ পরতে পারব। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে মোটামুটি— ভাবে লোকজন সংগঠিত করতে পারব।’
কুড়ি-পঁচিশ দিন আগে, গভীর জঙ্গলে মোয়াজ্জেম হোসেন খানের সঙ্গে যখন প্রথম কথা হয়েছিল, তখন নেতৃত্বের কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এখন অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন নেতৃত্বের প্রশ্নে অনিশ্চিয়তা নেই। সহকর্মীদের প্রায় সবাই বুঝে গেছে, নেতৃত্ব কার হাতে বা কে দেবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ২১৭

সাধারণ বন্দীদের তো কথাই নেই, কিছুদিন আগেও যাদের মধ্যে কিছু কিছু সন্দের ছিল, তারাও সন্দেহমুক্ত হয়েছে। আর যারা এখনো সংশয়মুক্ত হতে পারেনি, তারাও অবস্থা দেখে সব মেনে নিয়েছেন। কারণ মাঠ তখন খালি ছিলনা। ঝড় ঝাপটা, ঘূর্ণি-দূর্যোগ বুকে ঠেকিয়ে শত্রুর উদ্যত মেশিনগান অগ্রাহ্য করে প্রতিদিন মাইলের পর মেইল পায়ে হেঁটে সমস্ত দলটাকে এগিয়ে নেয়া সহজ কথা নয়। যুদ্ধ পরিচালনা ও তাতে অংশগ্রহণ করা আরও কঠিন। সর্বোপরি, সর্বত্র ঘুরে ঘুরে
জনগণের মনোবল বৃদ্ধি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সান্নিধ্য দান, এইসব অবস্থা ও পরিবেশের প্রেক্ষিতে অনেকের পক্ষেই সহজ ছিলনা। এই অমানুষিক পরিশ্রম করতে জীবনের প্রতি ঝুঁকি নিতে যারা পারেনি তাদের এ সময় মাথা নীচু করে পিঁছে সরে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। যুদ্ধ ও বক্তৃতা বা কথার তুবড়ি ছোটানো এক জিনিস নয়। যুদ্ধ যুদ্ধই। আর কথা কথাই। ফাঁকা বুলিতে কখনও কাজ হয় না। যুদ্ধ তো নয়ই। যুদ্ধ মানেই সংঘাত, লড়াই। বাঁচা মরা, রক্ত নিয়ে হলি খেলা, যুদ্ধ মানেই প্রতিনিয়ত অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া। এ মহান ও ভীষণ পরীক্ষাগুলোতে উত্তীর্ণ হতে না পারলে যুদ্ধের নেতাগিরি মুহূর্তেই শেষ।
আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, এ সময় আমার বিশেষ কোন সুযোগ ছিল না, বরঞ্চ অসুবিধা ছিল বেশী। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা দৈনিক দশ মাইল হাঁটলে আমার হাঁটতে হতো চল্লিশ মাইল। ত্রিশ-চল্লিশ মাইল পায়ে হাঁটা একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপারে হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সারাটা সময় কোথাও একনাগাড়ে দু’একদিনের বেশী অবস্থান করিনি। এজন্যই হানাদার বাহিনী আমার সঠিক অবস্থান সম্পর্কে সব সময় বিভ্রান্ত ও বিব্রত থাকত।
টাংগাইল হানাদার হেড কোয়ার্টারে হয়তো খবর গেছে, কাদের সিদ্দিকী এখন ধলাপাড়ার। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিকল্পনা করে আমাকে ধরতে যাবে, এমন সময় হয়তো খবর এলো, সিদ্দিকীকে এই মাত্র ভুয়াপুরে দেখা গেছে। এবার ধলাপাড়ার দিকে না গিয়ে বাংলা হানাদার বাহিনী হয়তো ভুয়াপুরের দিকে এগুনোর কথা ভাবছে অথবা কিছুটা পথ এগিয়ে গেছে। সে সময় আরেকটি খবর পৌঁছল, কাদের সিদ্দিকীকে এইমাত্র নাগরপুরের কাছে এলাসিন খেয়াপার হতে দেখা গেছে। অথবা তিনি এলাসিনের পাশে তাররা বাজারে অপেক্ষা করছেন।
সে সময় আমার অবস্থান সংক্রান্ত এই রকম খবরগুলো মোটেই মিথ্যা ছিল না। তবে গাড়ী ঘোড়ায় দ্রুত চলা মানুষের কাছে এই খবরগুলো অবশ্যই স্বাভাবিক ছিল না। ছিল বিশ্বয়কর। ধলাপাড়া থেকে ভুয়াপুরের দূরত্ব কম করে পঁচিশ মাইল। তারপর হানাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে চলতে আঁকাবাঁকা পথে আরও হয়তো দু’চার মেইল দূরত্ব বেড়ে যেত।
ভুয়াপুর থেকে নাগরপুর-এলাসিন-এর দুরত্ব ত্রিশ মাইলের কম নয়। তাই এতো অল্প সময়ের মধ্যে অত দূরত্ব অতিক্রম করা একজন মানুষের পক্ষে কি করে সম্ভব? এটা ভেবে টাংগাইলের দালালরা চিন্তিত, হতবাক। জুন মাসের শেষের দিকে মিলিটারীরা তাই বলতে শুরু করেছিল ‘শালা ক্যামসা আদমি হ্যায়। ইয়ে মানব হ্যায় ইয়াদানব: কপ্তি ইদার ওদার ও শালা হাওয়ামে চলতা হয়? মানুষ যে সব পারে। বাঙালী অসাধ্য কিছু নেই, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার জলন্ত প্রমাণ।
পৃষ্ঠা নং ~ ২১৮

পরিশেষে সাব্যস্ত হলো, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, এনায়েত করিম ও নুরুল ইসলাম টাংগাইলের পশ্চিম এলাকার বেসামরিক দায়িত্বে থাকবেন। শহীদ সাহেব আপাততঃ হেডকোয়াটারে জয়েন করবেন। প্রথম অবস্থায় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সুন্দর ও নির্ভুল তালিকা প্রস্তুত এবং হাতে লেখা একটি সংবাদপত্র বের করার উদ্যোগ নেবেন। এরপর শাজাহানকে আমার অনুপস্থিতির সময়কালীন পরিচালনা সংক্রান্ত রিপোর্ট পেশ করতে বলা হলো। শাজাহান পূর্ব থেকে কোন রিপোর্ট তৈরী করে রাখেনি। এজন্য অবশ্য তাকেও পুরোপুরি দোষারোপ করা যায় না। সম্ভবতঃ তখনকার কাজকর্মে ঢিলেঢালা অবস্থাই তার রিপোর্ট তৈরী না করার কারণ। রিপোর্ট চাওয়ায় প্রথম অবস্থায় শাহাজান কিছুটা বিব্রত ও অবাক হয়ে যায়। তাকে যখন বুঝিয়ে বলা হলো- এটাই নিয়ম, একটা লিখিত রিপোর্ট অবশ্যই পেশ করতে হবে, তখন রিপোর্ট তৈরীর জন্য একদিনের সময় চাইলে তাকে তা দেয়া হলো।
নুতন ও আরো অধিক নিরাপদ স্থানে হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা যায় কিনা, সে বিষয়ে সহকর্মীদের পরামর্শ চাইলাম। এ প্রসঙ্গে শাজাহান, হামিদুল হক ও আর. ও. সাহেব প্রায় একসাথে বললেন, ‘এর চাইতে অনেক ভালো ও নিরাপদ একটি জায়গা আছে। দেখলে হয়তো আপনার পছন্দ হতে পারে। জায়গাটি খুবই দুর্গম, গাড়ী-ঘোড়া তো দূরের কথা পায়ে হেঁটে যাওয়াও খুব কষ্টের ব্যাপার। এ কথা শুনে সাথে সাথে জায়গাটা দেখতে গেলাম। জায়গাটা বেশ পছন্দ হলো। এর সার্বিক নিরাপত্ত সম্পর্ক যতটা বলা উচিৎ ছিল সহকর্মীরা ঠিক ততোটা বলতে পারেনি। স্থানটি প্রকৃতই এত দুর্গম যে সার্বিকভাবেই তা অপরাজেয়। আর যদি কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, তবে সুশৃঙ্খল ও সর্বাধুনিক অস্ত্রধারী সেনাবাহিনীর পক্ষের তা জয় করা অসাধ্য।
মহানন্দপুরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম স্থায়ী সদর দপ্তর স্থাপিত হলো। কুড়ি পঁচিশ মাইল দূরে একটি ছোট প্রাইমারিস্কুল ঘর। যার চার পাশে কোন বেড়ার বালাই নেই। স্কুলের পশ্চিম পাশে একটি দুটি বাড়ী। আর আধা মাইল পূবে তিন চারটি বাড়ী। তিন দিকে নীচু হওয়ায় সামান্য বৃষ্টি হলেই পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। এইখানেও সময় দপ্তর স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলল।

ট্রেনিং ক্যাম্প
…. কিছু পূর্ব পশ্চিমে শাজাহানের উদ্যোগে মুক্তিবাহিনীর জন্য একটা ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। মহানন্দপুর থেকে দক্ষিণে চার মাইল হেঁটে দুপুরে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ পরিদর্শনে গেলাম। ট্রেনিংরত প্রায় তিনশ মুক্তিযোদ্ধা আনুষ্ঠানিকভাবে গার্ড অব অনার প্রদান করল। কোলকাতার স্বপন ভট্টাচার্য এই ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমাণ্ডার।
এক মাইল জায়গা জুড়ে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প। অথচ ট্রেনিং ক্যাম্পের গা ঘেঁষে গেলেও কোন লোক বলতে পারবেন না যে, পাশেই চলেছে এই মহাযজ্ঞের বিরটি প্রয়োজন। এমন কি এখানে কোনও মানুষ আছে বা থাকতে পারে। ট্রেনিং ক্যাম্পের ভেতর ঢুকলেও তা সহজে
পৃষ্ঠা নং ~ ২১৯

বোঝা যাবে না। নানা স্থানে চল্লিশটির মত ছোট ছোট টিনের চালা ঘর। সবই জঙ্গলের আড়ালে, আশ-পাশ, এমন কি উপর থেকেও দেখার উপায় নেই।
ট্রেনিংয়ের জন্য যতটা জায়গা প্রয়োজন ততটাই পরিষ্কার করা হয়েছে, বেশী নয়। ট্রেনিংয়ের জন্য ছোট ছোট মাঠ। কোথাও একটি পাতাও পড়েনি। সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হচ্ছে। ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে প্রকান্ড কয়েকটি গাছ। এ গাছগুলোর আগ ডাল হচ্ছে এলাকা পর্যবেক্ষণের স্থান। ডালে বসে তারা সারাদিন এলাকার উপর নজর রেখে চলেছে। এ সব কান্ড কারখানা দেখে বিস্মিত ও অবাক হলাম এবং শাজাহানের দায়িত্ববোধ ও কাজকর্মে পারদর্শিতা দেখে তার ভূয়সী প্রশংসা করলাম।
মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত স্বপন ভট্টাচার্য। কুড়ি বাইশ বছরের বলিষ্ঠ যুবক, পুলিশের লোক। স্বপনের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে এবং তার কিছু কাজ প্রত্যক্ষ করে প্রশিক্ষক হিসাবে যে অযোগ্য ও অদক্ষ লোককে দায়িত্ব দেয়া হয়নি, এটা উপলদ্ধি করে মনে মনে খুবই খুশী হলাম। পশ্চিম দিগন্তে রক্তিম সূর্যের আভা তখনও ম্লান হয়নি। প্রকৃতির বুকে শান্ত সমাহিত ভাবমূর্তি। আমি হেডকোয়ার্টারের সামনে বসে আছি। আমার মন জুড়ে নানা চিন্তা, নানা ভাবনা। তবে একটি চিন্তাই প্রধান-গেরিলা যুদ্ধের মূলমন্ত্র ‘হিট এন্ড রান’। এই পদ্ধতি আমাদের পক্ষে সব সময় পালন করা সম্ভব কি? ‘হিট এন্ড রান’ কোথায় করব? একটা নিরাপদ এলাকা না থাকলে ক্লান্ত যোদ্ধারা কোথায় গিয়ে ক্লান্তি দূর করবে? অথবা নতুন ভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করবে? আর যে স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি চালাবে সে স্থান ছেড়ে এলে, হানাদাররা সমস্ত এলাকা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের খেতে দিচ্ছেন, পড়তে দিচ্ছেন, তাদের ঘরবাড়ী হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে, আর মুক্তিযোদ্ধারা তা বসে বসে দেখবে, এটা হতে পারে না। এমন কোন গ্রাম নেই যে গ্রামের দু’চার জন ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক ইতিমধ্যেই মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হয়নি। কাজেই খানসেনারা যে কোন বাড়ীঘর পোড়ালে বা আগুন দিলে, তাতে মুক্তিবাহিনীর কোন না কোন সদস্যের ক্ষতির সম্ভাবনা শতকরা একশ ভাগ। তাই সব জায়গায় ‘হিট এন্ড রানের’ কোন উপায় নেই। ‘হিট এড স্টে’ নীতির বাইরে আপাততঃ কিছুই ভাবা যায় না। এহেতু একটি নিরাপদ এলাকা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ভীষণ ভাবে অনুভব করতে লাগলাম।
প্রকৃতির সাধারণ নিয়মই এই, আলোর পর অন্ধকার। আনন্দের পর বেদনা। সেদিন হেড কোয়ার্টারের নিরাপদ স্থান ও ট্রেনিং ক্যাম্প দেখে খুবই খুশী ও আনন্দিত হয়েছিলাম।

বিশ্বাস ঘাতকদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা খুন
যদিও একই সময় দুশ্চিন্তা ও বেদনার কারণও ছিল একাধিক। প্রথমতঃ আঞ্চলিক অধিনায়ক শওকত মোমেন শাজাহানের বিরুদ্ধে জোর জুলুমের অভিযোগে। দ্বিতীয়তঃ হেড কোয়ার্টারকে কিভাবে আরও নিরাপদ করা যায়-এ নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিলাম। তৃতীয়তঃ এ সময় কেন যেন লাবিবুর রহমান ও গোলাম সরোয়ার- লালটুর কোম্পানীর কথা বারবার মনে পড়ছিল। কারণ এর
পৃষ্ঠা নং ~ ২২০

মধ্যে তাদের ফিরে আসা উচিৎ ছিল। আর কোনও কারণে ফিরে আসতে না পারলেও অন্ততঃ একটা খবর পাঠাতে পারত। এই প্রথম এত বড় দুই দুইটা কোম্পানী প্রায় পাঁচ-ছয় দিন হেড কোয়ার্টার থেকে যোগাযোগহীন ও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এর পূর্বে, এত দীর্ঘ সময় আর কোনও কোম্পানী আমার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেনি। এক অজানা আশংকায় খুবই চিন্তিত ও বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম।
এই উৎকণ্ঠা নিয়ে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। জনৈক দূত এসে খবর দিল, নাগরপুরের মুক্তিযোদ্ধারা সফল অভিযান চালিয়ে ফিরে এসেছে। এখান থেকে দেড় মাইল দূরে আছে। তাদের হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসা হবে, নাকি অন্য কোথাও অবস্থান করতে বলা হবে? নাগরপুরের সফল অভিযানের কথা শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললাম, “তাদের আশে পাশের দুতিনটি বাড়ীতে রাখার ব্যবস্থা করে কমাণ্ডার, সহকারী কমাণ্ডার এবং তাদের দেহরক্ষীদের এক্ষুনি আমার সামনে হাজির কর।”
হেডকোয়ার্টারে অভ্যর্থনার দায়িত্বে নিয়োজিতদের ডেকে নাগরপুর অভিযানের বিজয়ী যোদ্ধাদের স্বাগত জানানোর কোন ব্যবস্থা হয়েছে কি না জানাতে চাইলে, ইতিমধ্যেই বিজয়ীদের সাদরে বরণ করার জন্য দলসহ একজন কমাণ্ডার অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছেন বলে জানাল। আমি তখন খুব খুশী ও আনন্দিত। কারণ পরপর পাঁচটি থানা দখলের শুভ প্রভাব শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবলই বাড়িয়ে দেয়নি, মুক্তিবাহিনীর উপর স্থানীয় জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসও বেড়েছে বহুগুন।
অল্পক্ষণের মধ্যেই সরোয়ার, লাল্টু ও আরও ছয়-সাত জন সহযোদ্ধা এসে হাজির হলো। চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে তাদের আলিঙ্গন করলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “লাবিব কোথায়? লাবিবের কোম্পানী কোথায়?” জবাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে হৃদয় বিদারক, সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা শুনতে হল।
২৫শে জুন। পাঁচ ও এগার নম্বর কোম্পানী যথাক্রমে লাবিবুর রহমান ও সরোয়ার লালটুর নেতৃত্বে নাগরপুর থানার উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। থানার পুলিশরা সম্ভবত এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের ঝটিকা আক্রমণের মুখে তারা একেবারেই দাঁড়াতে পারেনি। কোনও প্রকার বাধা না দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। নির্দেশ মত, থানার বেতার যন্ত্র, অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়। এবং প্রত্যেক পুলিশকে পাঁচ ঘা করে বেত মেরে অন্যান্য থানার পুলিশদের মত সতর্ক বাণী শুনিয়ে ছেড়ে দেয়।
থানা দখলের পর লাবিবুর রহমান শুনতে পায় ওখানে আরও একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠিত হয়েছে। লাবিব তাদের সাথে যোগযোগের উদ্যোগ নেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে লাবিবুর রহমান একটি লোক পাঠায়। প্রেরিত লোক, নাগরপুর থেকে ছয় সাত মাইল দক্ষিণ-পূর্বে চল্লিশ পঞ্চাশ জন নিয়ে গঠিত দলটির সন্ধান পায়। এই দলটি আর কারো নয়, ১৭ই মে গোলাবাড়ী ফরেস্ট ক্যাম্পে যে খন্দকার আবদুল বাতেন আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, তিনি ফিরে গিয়ে এই দল
পৃষ্ঠা নং ~ ২২১

গঠন করেছেন। এ দলের অস্ত্রের সংখ্যা খুবই কম। পঞ্চাশ জনের দলের পনের ষোল জনের হাতে রাইফেল অন্য চার পাঁচ জনের কাছে একনালা-দোনালা বন্দুক। বাকীদের হাত খালি।
দূতের বক্তব্য শুনে, বাতেনের দলের একজন এসে লাবিবুর রহমানের সাথে দেখা করে।
— আমরা এখানকার স্থানীয় লোক। আপনাদের আসার খবর পেয়ে বহুদূরে সরে গেছি। তাছাড়া আমাদের এই বলে ভয় দেখানো হয়েছে যে, আপনারা নাকি আমাদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেবেন।’ জবাবে লাবিবুর রহমান বলে,
— কোন স্থানীয় দলের সাথে বল-প্রয়োগে লিপ্ত হতে সর্বাধিনায়ক আমাদের নিষেধ করেছেন। তবে এটা সত্য, ব্যাঙের ছাতার মত নানা জায়গায় মুক্তিবাহিনী গজিয়ে উঠলে তার কার্যকরী ক্ষমতা থাকবে না। তাই সমস্ত এলাকা একটা সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত।
পরের দিনের ঘটনা। খুব ভোরে বাতেন দলের সহকারী কমাণ্ডার শাহাজাদা ও শাজাহানসহ আরও দুজন মুক্তিবাহিনীর শিবিরে আসে। মুক্তিবাহিনী এ সময় কেদারপুরে অবস্থান করছিল। শাজাহান ও শাহাজাদাকে লাবিবুররের দল আন্তরিক অভ্যর্থনা জানায় এবং মধ্যাহ্ন ভোজে আপ্যায়িত করে। তারা কথা দিয়ে যায়—পরদিন সকালে এসে লাবিবের দলের সাথে মিলিত হবে। এরপর সকলে মিলেমিশে কাজ করবে, এই মর্মে বাতেনের একখানা পত্রও তারা লাবিবের কাছে হস্তান্তর করে। মিলেমিশে কাজ করার অভিপ্রায় শুনে ও পত্র পেয়ে লাবিবুর রহমান বেশ খুশী হয়। ঐ এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী দল আছে এটা তাকে আগেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল। অবশেষে সেই বিরোধী দল স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছে, মিলেমিশে কাজ করার অভিপ্রায় জানিয়েছে, সর্বাধিনায়কদের নেতৃত্ব মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এতে লাবিব শুধু খুশীই নয়, বেশ গর্বও বোধ করতে থাকে।
রাতে আরেকবার বাতেনের দূত এসে হাজির।
— আমরা আগামীকাল আপনাদের সাথে মিশে যাব। তাই আমাদের শিবির গুটিয়ে ফেলার আগে, একবার আপনাকে আপ্যায়িত করতে চাই। এহেতু আগামীকাল সকালে আমাদের শিবিরে যেতে বাতেন সাহেব আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছেন।
লাবিবুর রহমান কঠিন প্রকৃতির কুটিল চরিত্রের লোক নয়। একেবারে সাদামাটা ও সদা হাস্যোজ্জ্বল স্বভাবের মানুষ। বিশ্বাসপ্রবন এই লোকটি কোনও ঘটনাকে কখনো বাকা চোখে দেখেনি। মানুষের রূপ যে দুটি-একটি বাইরের অন্যটি ভেতরের, এটাও সে বুঝতে চায়না। অনেক সময় যে মিঠে কথায় ভিটে ছাড়া হতে হয়, অনেকে আবার অন্তরে বিষ রেখে মুখে মধু ঝরিয়ে থাকে, এটাও লাবিবুর রহমান বিশ্বাস করে না। সে সবাইকে তার মতই সহজ সরল মনে করে। তার কাছে বাতেনও সহজ-সরল, সাদা-মাটা নির্ভেজাল, অতএব তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে আপত্তি কোথায়?
পরদিন সকালে দুজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে লাবিব বাতেনের শিবিরের দিকে রওনা হয়। লাবিবুর রহমান তার শিবির থেকে প্রায় মাইল দেড়েক এসেছে। চকের মাঝে তিন চার খানা বাড়ী।
পৃষ্ঠা নং ~ ২২২

মূল রাস্তা থেকে বামে মোড় নিয়ে বাড়ীগুলোর পাশ দিয়ে আর হাজার গজ এগুলেই বাতেনের শিবির। সে বাড়ীগুলোর পাশ ঘেঁষে এগিয়ে চলেছে। এমনি সময় আচমকা গুলির শব্দ। কোন কিছু বুঝতে না বুঝতেই লাবিবুর রহমান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার পেছনে জাহাঙ্গীরও গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। সামান্য পিছনে থাকায় তৃতীয় জনের গায়ে গুলি লাগেনি। সে দৌড়ে আরো পিছনে সরে এসে পজিশন নিয়ে গুলি চালাতে চালাতে শিবিরের দিকে ছুটতে থাকে। গুলির শব্দ মুক্তি বাহিনীরাও শুনেছিল। ফলে তারাও কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছিল। কারণ তাদের কমান্ডার যে দিকে গেছেন, সে দিক থেকেই গুলির আওয়াজ আসছে। এ জন্য পনের জনের একটি দল গুলির শব্দ লক্ষ্য করে দৌড়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে পিছিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ঘাঁটির সাথে দেখা হলে সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “সামনে ঐ বাড়ীগুলোর কাছে আমাদের উপর গুলি ছোড়া হয়। কমান্ডার সাব ও জাহাঙ্গীর ভাই গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। আমি কোন রকমে পালিয়ে এসেছি। আপনারা তাড়াতাড়ি চলুন।”
পনের জনের দলটি উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলল। আরও মুক্তিযোদ্ধা পাঠানোর জন্য ক্যাম্পে একজনকে পাঠানো হলো। কমাণ্ডার সরোয়ার ও লালটু গুলির আওয়াজে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। খবর পাওয়া মাত্র ত্রিশ জনের আর একটি দল নিয়ে তারাও ঘটনা স্থলের দিকে ছুটল। প্রথম দলটি ঘটনাস্থলে এসে বাড়ীর গা ঘেষে সরু রাস্তার উপর চাপ চাপ রক্ত দেখতে পেল। কিন্তু আশপাশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও লাবিবুর রহমান এবং জাহাঙ্গীরের আহত অথবা নিহত দেহের কোন সন্ধান পেল না।
দ্বিতীয় দলটি ঘটনাস্থলে পৌঁছে, পশ্চিম দিকে সরু রাস্তাটি ধরে কিছুদূর অগ্রসর হয়েও রক্তের চিহ্ন দেখতে পেল। রক্তের চিহ্ন দেখে দেখে তারা হাজার গজ পশ্চিমে একটি গ্রামে পৌঁছল। গ্রামের লোকজন তাদের জানালেন, এখানে কিছুক্ষণ আগেও একদল সশস্ত্র লোক অপেক্ষা করছিল। পূর্বদিকে কয়েকটি গুলির আওয়াজের পর তারা চলে গেছে।
ক্যাম্প থেকে আরও একশ’ জনকে ডেকে আনা হলো। এরপর সারা দিন তিন চার মাইল জায়গা জুড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা হলো। ধলেশ্বরী নদীর চার পাঁচ মাইল ভাটি পর্যন্ত দুদিন খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে বিফল হয়ে এক বুক দুঃখ ও বেদনা নিয়ে তারা ফিরে এসেছে।
পরে অবশ্য অনেকে বলেছেন, এ ঘটনার সময় বাতেন ওখানে ছিলেন না। তাই হত্যা- কাণ্ডের জন্য তাকে দায়ী করা চলে না। শাহাজাদার দেয়া পত্রটাও ছিল একটা ছল মাত্র। বাতেন নাকি সে সময় ভারতে ছিলেন। তবে শাহাজাদা ও শাজাহান যে বাতেনের দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য তাতে কোন ছল নেই।
এমন আকস্মিক ও মর্মান্তিক খবর শুনে কারও পক্ষেই স্থির থাকা সম্ভব নয়। আমার পক্ষেও সম্ভব হলো না। মুহূর্তে আপনা আপনি দু’চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে লাবিবের উপর দুঃখ হলো, ঐ এলাকায় বিরোধী দলের কথা ওকে বারবার বলে দিয়েছিলাম। তারপরও ও এমন বোকার মত
পৃষ্ঠা নং ~ ২২৩

কাজ করলো? দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে কাঁদতে কাঁদতে একসময় খোলা আকাশের নীচে বসে পড়লাম। তখন আর আমি আমার মধ্যে নেই। মাথা নুইয়ে মাটিতে বসে আছি। কেউ আর কাছে
আসছে না। আসতে সাহস পাঁচ্ছে না।
নতুন হেডকোয়ার্টারে কাজ সেরে ফারুক সাড়ে বারটায় রাত কাটানোর জন্য এলে সবুর তাকে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে বলল, “ভাই, নাগরপুরে বাতেনের দল লাবিব সাহেব ও জাহাঙ্গীর ভাইরে মাইরা ফ্যালাইছে। এই খবর পাইয়া স্যার একটুও নড়াচড়া করতাছেন না, কথাও কইতাছেন না। আমরা ডাকতে সাহস পাইতাছিনা। অহন ভাই আপনে তাড়াতাড়ি যা অয় এডা কিছু করেন। ”
হামিদুল হক, খোরশেদ আলম আর. ও. শাজাহান এবং মহু সর্দার প্রায় তিন ঘন্টা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। ফারুক প্রথম তাদের সাথে কথা বলল তারপর বুকে সাহস নিয়ে ধীরে ধীরে আমার কাছে এলো। সে প্রথমে নীচু স্বরে দু’তিনবার ডাকছিল। কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে আস্তে আস্তে শরীর নাড়া দিয়ে ডাক দিল। আমি ‘উ’ বলে একবার সাড়া দিয়ে আবার চুপ হয়ে গেলাম। চার ঘন্টা কোথায় ছিলাম, এটা আমি নিজেই জানিনা। তখনও চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ফারুক সবুর, শাজাহান, আর. ও. হামিদুল হক পাজা কোল করে নিয়ে একটি ছনের ঘরে চৌকিতে শুইয়ে দিল। সারারাত একটি কথাও বললাম না। একফোটা পানিও পান করলাম না। সারাটা রাত জেগে কাটল।
জাহাঙ্গীরের মৃত্যু সংবাদ শুনে, ফারুকও হাউমাউ করে কাঁদছিল। কারণ জাহাঙ্গীর ছিল ফারুকের ঘনিষ্ট বন্ধু। বহুদিন একত্র থেকেছে, খেয়েছে, উঠাবসা করেছে। ওদের উভয়ের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক নিবিড় সম্পর্ক। এমন বন্ধু, সহকর্মী ও ভাইকে হারিয়ে ফারুকের বুকও পর্বত প্রমাণ ব্যথায় ভরে উঠেছিল।

কোম্পানী বিন্যাস
পরের দিন সকাল সাতটা। মহানন্দপুরের নূতন হেডকোয়ার্টার উদ্বোধন করলাম। মুক্তাঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও শক্তিশালী করতে নিম্নলিখিত স্থানে ঘাঁটি স্থাপনের ব্যবস্থা হলো :
(১) বহেরাতলী:- ৪ নং কোম্পানী, অধিনায়ক ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান, সহ অধিনায়ক গোলাম মোস্তফা।
(২) মরিচা:- ২ নং কোম্পানী, অধিনায়ক নবী নেওয়াজ।
(৩) দেওপাড়া:- ১ নং কোম্পানী, অধিনায়ক লোকমান হোসেন।
(৪) রাঙ্গামাটি:- ১১ নং কোম্পানী, অধিনায়ক মনিরুল ইসলাম।
(৫) ধলাপাড়া:- ১ নং (ক) কোম্পানী, অধিনায়ক আব্দুল হাকিম।
(৬) আছিম:- ১২ নং কোম্পানী, অধিনায়ক লালটু, সহ অধিনায়ক গোলাম সরোয়ার
(৭) ভালুকা-শ্রীপুর :- ৬নং কোম্পানী, অধিনায়ক আফসার উদ্দিন আহমেদ।
(৮) হতেয়া:- ১৩ নং কোম্পানী, অধিনায়ক হবি, সহ অধিনায়ক, ইউনুস।
পৃষ্ঠা নং ~ ২২৪

(৯) পাথরঘাটা :- ৩ নং কোম্পানী অধিনায়ক মতিয়ার রহমান, সহ-অধিনায়ক মোকাদ্দেছ আলী।
পশ্চিমাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হলো, ১ নম্বর (খ) কোম্পানীর অধিনায়ক আবদুল গফুর ও ১ নম্বর (গ) কোম্পানী কমাণ্ডার খোরশেদ আলমের উপর। এ ছাড়াও হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২৭ নম্বর কোম্পানীকে পশ্চিম অঞ্চলের ভুয়াপুরকে কেন্দ্র করে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনার দায়িত্ব দেয়া হলো। বিশেষ করে ২৭ নম্বর হাবিবের কোম্পানীর উপর দায়িত্ব দেয়া হলো নদীপথ আগলে রাখার। তিনশ জন মুক্তিযোদ্ধার আরও কয়েকটি দল রেজাউল করিম, আমানউল্লাহ্, হুমায়ূন ও বেণুর নেতৃত্বে হাবিবকে সাহায্য করবে। ৫ই জুলাইয়ের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়ে গেল।

ধলাপাড়া জনসভা
৩০শ জুন, ধলাপাড়ায় একটি জনসভা আহ্বান করা হলো। এই জনসভায় এ এলাকার গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকীও উপস্থিত হলেন। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় সভার কাজ শুরু হলো। দু’তিন জন মুক্তিযোদ্ধা তাদের বক্তব্য রাখল। এরপর জনগণের পক্ষ থেকে জনৈক ব্যক্তি সহযোগিতার কথা ব্যক্ত করে প্রচণ্ড আবেগে বক্তৃতা করে সভাস্থল মাতিয়ে তুললেন। এরপর বাসেত সিদ্দিকী অত্যন্ত সাবলীল ও সুন্দরভাবে তার বক্তৃতা শুরু করলেন। জনগণের করনীয় কি সে সম্পর্কে আবেগময়ী ভাষায় বক্তৃতা করে চলেছেন। এ সময় দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রচণ্ড গুলির আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। এতে জনসাধারণ কিছুটা হতভম্ব হয়ে কোন দিক থেকে শব্দ আসছে তা লক্ষ্য করতে চেষ্টা করেন। জনতা কিছুটা উসখুস করতে থাকায় বাসেত সিদ্দিকী সাহেব জনতাকে শান্ত হতে অনুরোধ করে বসে পড়লেন।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে বললাম,
“আপনারা শাস্ত হোন। ভয় পাবার বা ভীত হবার কোন কারণ এখনও ঘটেনি। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুকে বাধা দিয়েছে। তাদের বাধার প্রাচীর ভেঙে আপনাদের পর্যন্ত পৌঁছানো, হিমালয় অতিক্রম করার চাইতেও দুঃসাধ্য। হানাদারদের মেশিনগানের গর্জন যতই তীব্র হোক- একটি মুক্তিযোদ্ধার দেহে প্রাণ থাকতে আপনাদের গায়ে আঁচড় লাগতে পারবে না। আপনাদের রক্ষা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমি আজ আর এক মিনিটও নষ্ট করতে চাইনা। আমাকে এক্ষুনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতে হবে, আপনারা আমাকে ক্ষমা করুন। আপনারা নিশ্চিস্তে আস্তে আস্তে যার যার বাড়ী চলে যান। আবার পরে সুযোগ এলে আপনাদের সামনে হাজির হব।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী।”

ধলাপাড়া থেকে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে তিন সাড়ে তিন মাইল কুড়ি পচিশ মিনিটে পাড়ি দিয়ে দেওপাড়া এসে দেখলাম, মুক্তিযোদ্ধারা যার যার পজিশন থেকে বেশ শক্তভাবে হানাদার মোকাবেলা করছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ২২৫

ঘন্টা খানেক যুদ্ধ চালিয়ে হানাদাররা যখন বুঝতে পারল এ যাত্রায় তাদের দেওপাড়া দখল অসম্ভব, তখন গতিপথে পরিবর্তন করে কস্তুরীপাড়া, ভণ্ডেশ্বর হয়ে নাগবাড়ী আবু সাইদ চৌধুরীর বাড়ীতে গেল। হানাদার বাহিনী বাড়ীটিকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলল। বাড়ী থেকে কোন বাধা না পেয়ে হানাদারদের একটি দল প্রাচীর ঘেরা প্রকাণ্ড বাড়ীটির ভেতর প্রবেশ করল এবং আবু সাইদ চৌধুরীর ম্যানেজার শামসুজ্জোহা ওরফে মুচু মিয়াকে গ্রেফতার করে। খোঁজ-খবর জানতে তাঁকে পীড়ন করতে লাগল। হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন ম্যানেজার মুচু মিয়াকে বাড়ীর সব ঘরে আগুন ধরিয়ে দিতে নির্দেশ দিলে মুচু মিয়া ঘৃণাভরে ক্যাপ্টেনের নির্দেশ প্রত্যাখান করলেন!
নির্দেশ পালন না করায় এবং কোন খবর বের করতে না পারায় বিশালদেহী শামসুজ্জোহা ওরফে মুচু মিয়াকে হা করিয়ে ক্যাপ্টেন তার মুখে রিভলবারের নল ঢুকিয়ে পরপর দু’রাউণ্ড গুলি মিয়াকে করে। হানাদাররা মুচু মিয়াকে এভাবে হত্যা করে চরম বর্বরতার নিদর্শন রাখল। মুচু মিয়াকে হত্যা করে বাড়ী থেকে কয়েক লাখ টাকা এবং সের পাঁচেক সোনা লুট করে তিনখানা টিনের ঘরও জানিয়ে দেয়।
চৌধুরী বাড়ীতে মিলিটারী এসেছে এ খবর পেয়ে রতনগঞ্জ এবং ডাবাইলের মুক্তিযোদ্ধারা কমাণ্ডার রবিউলের নেতৃত্বে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে এসে বাড়ীর দক্ষিণে পজিশন নিয়ে প্রচণ্ড গোলা- গুলি ছোড়তে লাগলে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলির মুখে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী আস্তে আস্তে পিছু হটতে শুরু করে।
মুক্তিবাহিনীর চাপে হানাদাররা চৌধুরী বাড়ী থেকে সরে এসে সোজা পশ্চিম চারানের মধ্যে দিয়ে কালিহাতীর রাস্তা ধরল। নাগবাড়িতে গোলাগুলির সময়, বল্লা থেকে আরেকটি মুক্তিবাহিনীর দল আগ চারানের মাঝ দিয়ে নাগ বাড়ীর দিকে এগিয়ে আসছিল। মুক্তযোদ্ধাদের চারান পৌঁছার চার পাঁচ মিনিট আগে হানাদার বাহিনী চারান অতিক্রম করে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা আর পাঁচ সাত মিনিট আগে এলে, হানাদারদের ঘিরে ফেলতে পারতো এবং তাদের চরম বিপর্যয় ঘটত।
ডাবাইল–রতনগঞ্জ থেকে এগিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধারা চৌধুরী বাড়ীর তিনটি ঘরের আগুন নেভাতে চেষ্টা করল। গ্রামবাসীরাও ছুটে এলেন। সকলের চেষ্টায়, আধপোড়া তিন খানা ঘরের আগুন নিভিয়ে ফেলা সম্ভব হলো।
মুক্তিযোদ্ধারা আবু সাইদ চৌধুরীর বাড়ীর ভেতর ঢুকে, মুচুমিয়ার রক্তাক্ত নিষ্প্রাণ দেহ এবং আরও দুতিন জনকে আহত অবস্থায় দেখতে পেল। আহতদের তাৎক্ষনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হলো। মুচু মিয়ার লাশ দাফনের প্রস্তুতি চলল, ইতিমধ্যে মুচু মিয়ার গ্রাম ছাতিহাটিতে খবর পাঠানো হয়েছিল। গ্রাম থেকে লোকজন এসে তার প্রাণহীন দেহখানা নিয়ে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সাথে আবু সাইদ চৌধুরীর বাড়ীতে হানাদারদের উপর ঝাঁপিয়ে না পড়লে বাড়ীটির চিহ্ন থাকত কিনা তা বলা দুষ্কর।
আমরাও দেওপাড়া থেকে একদল হানাদারকে তাড়াতে তাড়াতে নাগবাড়ীর দিকে
পৃষ্ঠা নং ~ ২২৬

আসছিলাম। তারা ভণ্ডেশ্বর পর্যন্ত এসে কলিহাতীর রাস্তা ধরল। আমিও আর না এগিয়ে ভণ্ডেশ্বর থেকে আবার মরিচাতে ফিরে গেলাম।

বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ
অন্যদিকে ২৫শে জুন, ভাওয়ালিয়া রাজঘাটে হানাদার বাহিনীর সাথে ৬ নম্বর কোম্পানীর মুখোমুখি দীর্ঘ বিয়াল্লিশ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। অধিনায়ক আফসার উদ্দীনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী অসীম বীরত্বের সাথে সকল আক্রমণ প্রতিহত ও দুশমনদের পর্যুদস্ত করে। পঁচিশ জন নিহত ও আরো জনা পঁচিশ-তিরিশ আহত হবার পর হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারা আটটি মৃতদেহ ও চারজন আহতকে ফেলে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে তিনজন আহত হয়।
তিন দিন পর, ২৮শে জুন ৬ নম্বর কোম্পানীর তিনজন বীর তরুণ, শত্রু ঘাঁটিতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে সাতজন হানাদার হত্যা ও দশ বারজনকে জখম করে।
২১শে জুন, কমাণ্ডার গফুর, ঘাটাইলের খোরশেদ আলম, মির্জাপুরের পুলক সরকার ও মনীন্দ্র ঘোষের দল দু’তিন ভাগ হয়ে এক ঝটিকা আক্রমণে সুত্রাপুর দখল করে নেয়। এখানে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাঁচজন রাজাকার ধরা পড়ে। পুল শত্রুমুক্ত হলে, পুলের দুপাশে এবার্টমেন্টের গা ঘেঁষে মাটি খুঁড়তে শুরু করে। পাহাড়ের মাটি বড় শক্ত। অনেক চেষ্টা করেও বেশী খুঁড়া গেল না। এমনিতেই প্রায় এক ঘন্টা মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তা অবরোধ করে বসে আছে। যে কোন সময় হানাদার বাহিনীর বিরাট কনভয় এসে পড়তে পারে। তাই বিস্ফোরন ঘটাতে কমাণ্ডার গফুর, জামালপুর হাজারী বাড়ীর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র হাবিব ও সরিষাবাড়ীর বারী মাস্টারকে নির্দেশ দিলে তারা দ্রুত বিস্ফোরণ ঘটায়। বিস্ফোরনের শব্দে প্রায় পচিশ ত্রিশ মাইল কেঁপে উঠে এ যেন একটা মৃদু ভূকম্পন।
সুত্রাপুর ব্রিজ থেকে ত্রিশ মাইল উত্তরে মুক্তিবাহিনীর হেড কোয়ার্টার আধি, সখীপুর, কচুয়া, বড়চওনা থেকে বিস্ফোরনের শব্দ শোনা গিয়েছিল। মাটি শক্ত থাকায় এবং গর্ত গভীর হওয়ায় ও বিস্ফোরক কম থাকায় পুলটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হলো না। সাময়িকভাবে গাড়ি চলার অযোগ্য হয়ে পড়ল। ঢাকার বত্রিশ তেত্রিশ মাইল উত্তরে সংগঠিত এই বিস্ফোরনের খবর, ৩০শে জুন বি. বি. সি. ফলাও করে প্রচার করলো, ‘ঢাকার বত্রিশ মাইল উত্তরে উত্তরাঞ্চলের একমাত্র সড়ক যোগযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। যারা বিস্ফোরন ঘটিয়েছেন, তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানীদের হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছেন। ঢাকার উত্তরে এক বিরাট এলাকা পাকিস্তান বাহিনীর কাছে দুর্ভেদ্য হয়ে পড়েছে। এই এলাকায় চব্বিশ পঁচিশ বছরের কাদের সিদ্দিকী নামে মুজিবের এক তরুণ অনুসারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’
এই খবর আরো বড় করে প্রচার করল ‘ভয়েস অব আমেরিকা’। এই সংবাদ বিশ্বের আরো বহু দেশের বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হলো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশবাণী ৩১শে জুন এই সংবাদ বার বার প্রচার করেছিল। ৩০শে জুন দুনিয়ার মানুষ প্রথম জানতে পারে, ঢাকার
পৃষ্ঠা নং ~ ২২৭

অদূরে একদল দুর্জয় মুক্তিবাহিনী হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে। যার নেতৃত্ব করছেন চব্বিশ বছরের একজন ছাত্র। কাকড়াজানে আনিসুর রহমানের কাছে জানতে চাইলাম বেতার যন্ত্রগুলো সুষ্ঠুভাবে কাজ করছে কিনা? আনিস এ ক’দিনেই সব কটি বেতার চালু করেছে। সাত-আটজন কলেজের ছাত্রকে বেতার চালানোর তালিম দিয়েছে। ছাত্র বন্ধুরা অত্যান্ত আগ্রহ ও নিষ্ঠার সাথে যন্ত্রগুলো চালনা ও মেরামতের তালিম নিচ্ছিল। এরা দু’তিন দিনেই সেটগুলো নিখুঁতভাবে চালানোর যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছে।
অপারেটর আনিসুর রহমান ভাল লেখাপড়া জানে। বেতার যন্ত্র মেরামতের ব্যাপারে তার গভীর জ্ঞান রয়েছে। মুক্তিবাহিনী বেতার সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার এবং বেতার যন্ত্রগুলোর মাধ্যমে খবরা- খবর সংগ্রহের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিশেষ সফলতা অর্জন একমাত্র আনিসুর রহমানের জন্যই সম্ভব হয়েছিল।
বেতার নিখুঁত ভাবে চলছে দেখে বেশ তৃপ্তি বোধ করলাম। আরও একাগ্রতার সাথে কয়েকদিন প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে উপদেশ দিয়ে নতুন হেড-কোয়ার্টার মহানন্দপুরে ফিরে গেলাম।
৩১শে জুন সকাল। আঞ্চলিক অধিনায়ক শওকত মোমেন শাজাহানকে হিসাব পেশ করতে বলা হলো। আমার অনুপস্থিতি সময়ের আর্থিক আয়-ব্যয় সংক্রান্ত একটি লম্বা তালিকা ও একটি রিপোর্ট দিল। আর্থিক ব্যয়-সংক্রান্ত তালিকা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল দুই লক্ষ আশি হাজার টাকার গরমিল রয়েছে। অন্যদিকে শাজাহানের ষোলখানা চাহিদা পত্র অভিযোগ আকারে পেশ করে পাহাড়ের জনগণ ন্যায় বিচার দাবী করেছিলেন।
চাহিদা পত্রগুলো দেখে শাজাহান স্বাভাবিক ভাবেই বলল, ‘হ্যাঁ’ পত্রগুলো আমার লেখা এবং আমিই পাঠিয়েছি। তবে এতে কোন অন্যায় আছে বা হয়েছে, তা মনে করিনি। আমি সরল- ভাবেই প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র দাবী করেছি। তবে এগুলো যে একটু কঠিন হয়েছে, তা পরে বুঝতে পেরেছি। পুনরায় হিসাব মিলিয়ে দেখতে শাজাহানকে দুপুর পর্যন্ত সময় দেয়া হলো।
একটি নতুন গ্রেনেড পার্টি শহরে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল। বেশ কয়েক দিন থেকেই অবশ্য এই গ্রেনেড পার্টি (জানবাজ পার্টি নামে পরিচিত) তৈরী করা হচ্ছিল। আগেই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, শহরে যাদের আত্মীয়-স্বজন রয়েছে এবং শহর যারা ভাল চিনে তাদের মধ্য থেকেই যেন স্বেচ্ছাসৈনিক হিসাবে নেয়া হয়। গ্রেনেড পার্টির সদস্যদের সাথে কথাবার্তা এবং নানা উপদেশ দিলাম। এ দলে যারা সামিল হলো তাদের মধ্যে সালাহউদ্দীন,বাকু, আবুল কালাম, মিনু, আবদুস সবুর এবং হেলুর নাম সমধিক উল্লেখ যোগ্য।

কমান্ডো বাকুর দুঃসাহসিকতা
দুপুরে জানবাজ পার্টিকে হেড-কোয়ার্টার থেকে বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া হলো। এদেরই অন্যতম বাকু ২রা জুলাই প্রথম ধরা পড়েছিল। ২শরা জুলাই, পাক-হানাদার বাহিনীর জনৈক কর্ণেল টাংগাইল শহরে মোটরযোগে যাচ্ছিল। জানবাজ পার্টির বাকু আগে থেকেই এই কর্ণেল ভদ্রলোকের যাতায়াতের খবর রেখেছিল। তাই থানার কাছাকাছি উপযুক্ত জায়গায় সে ওৎ পেতে
পৃষ্ঠা নং ~ ২২৮

ছিল। থানা থেকে কর্নেল যেই বেরিয়েছে, অমনি তার গাড়ীর উপর বাকু একখানা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। দুর্ভাগ্য বশতঃ গ্রেনেডটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। বিস্ফোরণের শব্দে চারদিক থেকে পুলিশ, মিলিশিয়া ও হানাদার সমর্থকরা জায়গাটি ঘিরে ফেলে। বাকু ধরা পড়ে। হানাদার কর্নেল বাকুকে রাত আটটায় সামরিক ঘাঁটিতে পাঠিয়ে দিতে ও.সি. কে নির্দেশ দিয়ে চলে যায়। শহরের স্বাধীনতাকামী মানুষ বাকুর ধরা পড়ার ঘটনায় খুবই মর্মাহত হন। এটা নিশ্চিত যে, সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ে হানাদাররা বাকুকে গুলি করে মারবে। কিন্তু সন্ধ্যা সাতটায় এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটল। থানা হাজতে থাকাকালে বাকু একজন পুলিশকে জানাল, সে পেশাব করবে। পুলিশটি তাকে বাইরে নিয়ে এলে বাকু সেই সুযোগে হাতকড়া পড়া অবস্থাতেই পুলিশটির মাথায় এমন প্রচণ্ড আঘাত করল যে, সে তৎক্ষনাৎ সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। বাকু চোখের নিমিষে উধাও। শহরের কয়েকটি বাসায় পর্যায়ক্রমে আত্মগোপন করে থেকে-সে মুক্তাঞ্চলে ফিরে আসে এবং হাত-কড়া কেটে তাকে মুক্ত করা হয়। বাকুর এই অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের কাহিনী দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের মনোবল প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যায়।
৩১শে জুন, বিকাল তিনটা। শওকত মোমেন শাজাহানকে দায়িত্ব থেকে অপসারিত করে গ্রেফতার করা হলো। কারণ তার কার্যকলাপ মোটেই স্বাভাবিক ও সুখকর নয়। চৌদ্দ-পনের দিন হাজার দেড়েক মুক্তিবাহিনীর প্রশাসন চালাতে গিয়ে সে সাত লাখের উপর টাকা খরচ করেছে। কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রও সংগ্রহ করেছে। যেমন-রেইনকোট, গামবুট, ছাতা ইত্যাদি। এসব জিনিস পত্রের অধিকাংশই ছিল অপ্রয়োজনীয়। এছাড়াও সে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রায় দেড় লাখ টাকার কাপড় ক্রয় করেছে। অথচ আমি শাজাহানকে বারবার বলেছিলাম, ‘স্বেচ্ছা সৈনিকদের নিয়মিত সেনাবাহিনীর সাথে পাল্লা দিয়ে সাজ-পোশাক পরা অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর।’ তার পরও শাজাহান অযথা মুক্তিবাহিনীর জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছে।
পরিস্থিতির সকল দিক বিচার-বিবেচনা করে শাজাহানকে একমাস দশদিন আটক করে রাখার নির্দেশ দেয়া হলো। আটক থাকার পর মুক্তি পেয়ে শাজাহান পূর্বের মতই পূর্ণোদ্যমে মুক্তিবাহিনীতে যথারীতি কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও আমার প্রতি তার আস্থা ও বিশ্বাসের কোন দিন বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি।
পৃষ্ঠা নং ~ ২২৯

ভারতের সাথে প্রথম যোগাযোগ

বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখলে আনার ফলে শত্রুবাহিনীর চাপ ক্রমেই বেড়ে চলল। সেই চাপ কমাতে হলে, তাদের যাতায়াতের পথ বিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন। সেজন্য সেতু ধ্বংস করা অপরিহার্য হয়ে পড়ল। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক নেই। আর শত্রুর কাছ থেকে যে বিস্ফোরক কেড়ে নেয়া যাবে, সে সুযোগও তেমন নেই। কারণ হানাদাররা বিস্ফোরক নিয়ে চলাফেরা করে না। কাজেই বিস্ফোরক সংগ্রহ এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকার ও মিত্র বহিনীর সাথে যোগোযোগ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলামের উপর দেয়া হলো।
২৬শে জুন, ভুয়াপুর থেকে নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলাম ভারতের পথে নৌকা যোগে রওনা হলেন, তারা জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের উত্তরে যমুনার পারে রঘুনাথপুর গিয়ে উঠলেন। তাঁদের সাথে ভারত থেকে আসা আরও পাঁচজন, এদের নেতা লুৎফর রহমান। ওখান থেকে ২৭শে জুন, নৌকাযোগে রওনা হয়ে দু’দিন দু’রাত চলার পর তারা বাহাদুরাবাদ ঘাটের দশ-পনের মাইল উত্তরে চ্যাঙ্গাইনার চরে হাজির হলেন। এই চর এলাকা ছিল খুবই বিপজ্জনক। ডাকাতের উৎপাতে ওখানকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। নুরুন্নবীর দলও ডাকাতের কবলে পড়ে। রাতের অন্ধকারে ডাকাতরা নুরুন্নবীদের নৌকা আক্রমণ করল। সঙ্গী লুৎফর রহমান ডাকাতদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালাতে চাইল কিন্তু নুরুন্নবী বাধা দিল। কারণ গুলির শব্দে বাহাদুরাবাদ ঘাটের শত্রুরা সাবধান হয়ে যেতে পারে এবং তাদের সন্ধানে বেরিয়ে আসতে পারে। অধিকন্তু ভারতে যাওয়া-আসার এই পথে মুক্তিবাহিনী ভবিষ্যতে চলাফেরা করতে পারবে না। নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলামের দায়িত্ব ছিল একটি গোপন ও নিরাপদ পথ আবিষ্কার করা, যে পথে নৌকাযোগে যাতায়াত করা সম্ভব। তাদের মতে এটাই সেই সহজ সুন্দর ও নিরাপদ পথ। সেজন্য ডাকাতদের কবল থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল পিছিয়ে এসে, অন্য এক পথে আবার তারা যাত্রা শুরু করে।
এবার জামালপুর মেলান্দ থানার কাছে এসে তারা দুভাগে ভাগ হলো। দু’টি দল দু’টি পথ নিল এখান থেকে প্রায় পনের মাইল হাঁটতে হবে। দৈবাৎ একটি দল ধরা পড়লেও অন্য দলটি যাতে মুজিব নগরে আমার খবর অথবা পত্র যথাস্থানে পৌঁছে দিতে পারে, তাই এ ব্যবস্থা। প্রথম দলে রইল—নুরুন্নবী, নুরুল ইসলাম ও লুৎফর রহমান। তারা ইসলামপুর হয়ে সীমান্ত ঘাটি পোড়াখাসিয়ায় পৌঁছবার চেষ্টা করবে। দ্বিতীয় দলে—রকিব, টুকু, ফয়েজ ও বাদল। এ দলটি দেওয়ানগঞ্জ হয়ে মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিবাহিনী ঘাঁটিতে যাবার চেষ্টা করবে। উভয় দলের রাস্তাই দুর্গম ও বিপদ সংকুল। কিন্তু সব বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে তারা চলতে লাগল। নুরুন্নবী দল ২শরা জুলাই হাজারী বাড়ীর বশীর মাষ্টারের বাড়িতে আশ্রয় নিল। বশীর মাস্টার অত্যন্ত নির্ভীক ও সাচ্চা দেশ প্রেমিক৷ তিনি খুব গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিলেন। এবং অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে
পৃষ্ঠা নং ~ ২৩০

আতিথেয়তা করলেন। বশীর মাস্টার সাহেব টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর কথা আগে থেকেই বলে ছিলেন। তার এক ছেলে মোনায়েম খানের দৈনিক পয়গাম পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন তবুও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও সমর্থন ছিল সুদৃঢ়।
ঐ গ্রামের বি. ডি. চেয়ারম্যান ছিল শান্তি কমিটিরও চেয়ারম্যান। সে যদি একবার টের পায় তবে নুরুন্নবীদের তো বিপদ আছেই। তদুপরি বশীর সাহেবের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। তবুও তিনি ভ্রুক্ষেপ না করে নুরুন্নবীর দলকে আশ্রয় দিলেন। তিনি অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা দলকেও এমনিভাবে আশ্রয় দিতেন। পরদিন ৩শরা জুলাই। আবার তাদের যাত্রা শুরু হলো। হাজারীবাড়ী রেল স্টেশন ছিল হানাদারদের একটি শক্ত ঘাঁটি। জল্লাদ হানাদারদের চোখে ধুলা দিতে নুরুল ইসলাম গ্রাম্য লোকের মত কাপড় পড়লেন। লুৎফর রহমান মাথায় টুপি, চোঙা জামা পরে পাকা মৌলভী সাজল। তার অবশ্য এমনিতেইই দাড়ি ছিল। কিন্তু ফ্যাসাদ বাধল নুরুন্নবীকে নিয়ে। একে তো যুবক তার উপর চোখে চশমা। দেখলে মনে হয় কলেজের ছাত্র। সে সময় কোন শিক্ষিত যুবক ঐ এলাকায় ছিল না বললেই চলে। আর থাকলেও সাধারণতঃ তারা চলাফেরা করত না। নুরুন্নবীর হাতে একটা ছাতা ও একটি বাজারের থলে দেয়া হলো। তারা তিনজন পরস্পর থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সতর্কতার সাথে রেলস্টেশন অতিক্রম করে ঘাটে হাজির হলো। নদীর ঘাটে তখন চার-পাঁচটি নৌকা ছিল। কিন্তু তারা কেউ বক্সীগঞ্জের দিকে যেতে চাচ্ছে না। এমন সময় এক বৃদ্ধ এগিয়ে এসে লুৎফরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস্ফিস করে বললেন, ভাইজতা, আপনাগোরে আমি চিনবার পারছি। আপনেরা আমার নায় উইঠ্যা পড়েন। ইনসাফ কইরা যা ভাড়া দেন—তাই লইমু। আমি মুক্তিবাহিনীর নোক হরহামেশাই নইয়া যাই।’
নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলাম সহজে এই বৃদ্ধ মাঝিকে বিশ্বাস করতে পারল না। কি জানি, বুড়ো শেষ পর্যন্ত হানাদারদের মুখে ঠেলে দেবে নাতো? তারা বৃদ্ধকে পুংখানুপুংখরূপে দেখতে লাগল। না, তার মুখে কুটিলতার কোন ছাপ নেই। মনে হয়—সে সরলতার এক জীবন্ত প্রতীক। অবশেষে তারা বৃদ্ধের নৌকায় উঠে বসল। নৌকা যখন বক্সীগঞ্জের কাছাকাছি পৌঁছে, তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। যাত্রীদের খাওয়া জোটে নি। তাছাড়া অপরচিত জায়গায় রাতে নৌকা চালানোও বিপদ জনক। অগত্যা তারা মেষের চরে এক বাড়ীতে আশ্রয়ের জন্য গেল। বাড়ীর মালিক বেশ সহৃদয় ব্যক্তি। তিনি তাদের আশ্রয় দিতে কোনও আপত্তি করলেন না। তবে এ কথাও জানিয়ে দিলেন, পাশের বাড়িটি এক ইঞ্জিনিয়ারের। সে গত নির্বাচনে পি. ডি. পি-র টিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। হানাদার বাহিনীর সাথে তার মিল-মহব্বতই শুধু নয়, যোগাযোগও রয়েছে।
সাংঘাতিক খবর, অতএব এ বাড়িতে থাকা সমীচীন নয়। সবাই এক গ্লাস করে পানি খেয়ে আবার সীমান্ত অভিমুখে রওনা হলো রাত বারোটায় সীমান্তের কাছাকাছি এক গ্রামে দেখেশুনে কিন্তু এমন বাড়ীতে আশ্রয় নিতে গেল, যে বাড়ীর মালিক ইতিপূর্বে জামাতে ইসলামী করতেন৷ ২৫শে মার্চের পর, পাক হানাদার বাহিনীর পৈশাচিকতা তার রাজনৈতিক মত ও পথ একেবারে পাল্টে দিয়েছে। তিনি মুক্তিবহিনীর একজন গোড়া সমর্থক হয়ে উঠেছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৩১

এই ভদ্রলোকের বাড়িতে তাদের রাত ভালভাবেই কাটল। তিনি যথেষ্ট সহযোগিতা করলেন। ভোর রাতে এক কাঠুরিয়াকে পথ প্রদর্শক হিসাবে সাথে দিলেন। কোমর পানি ভেঙে, তিন মাইল বিলাভূমি পাড়ি দিয়ে তারা পাহাড়ে প্রবেশ করল। কাঠুরিয়ার এটা পরিচিত পথ। সে তাড়াতাড়ি পথ চলছে। পিছনে নুরুন্নবীর দল। চলতে চলতে গলদঘর্ম প্রায়। পথে তাদের দুতিন জন লোকের সাথে দেখা হয়। তারা উৎসুক হয়ে পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। কাঠুরিয়া তাদের বিড়ির পাতার ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচয় দিয়ে পথ চলতে থাকে।
৪ঠা জুলাই তারা সীমান্ত অতিক্রম করল। এখান থেকে পাহাড়ের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। কথায় কথায় কাঠুরিয়া বলল, ‘এই অঞ্চলে হানাদার বাহিনী আগে টহল দিবার আইত কিন্তুক এহন মুক্তিবাহিনীর ডরে তারা আর আহে না। তারা তাগোর ক্যাম্প থেকেই আর বাইর অয়না।’
বেলা বাড়ছে। অথচ সেই কোন সকালে, সামান্য কিছু মুখে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঘর থেকে বেরিয়েছে। ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে, আর পথ চলতে পারছে না। তারা একটি গারো বাড়ীতে উঠল৷ খেতে চাইলে বাড়ীর মালিক তাদের কিছু মুড়িও একটি কাঠাল এনে দেন। তাদের আর কি প্রয়োজন, তা পরিস্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করলে, মুক্তিযোদ্ধারা ভদ্রলোককে জানালেন, পোড়াখাশিয়ায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আছে। সেখান যাওয়ার জন্য আমাদের একজন পথ প্রদর্শক দরকার, ভদ্রলোক ক্ষেত থেকে তার ছোট ছেলেকে ডেকে এনে সাথে দিয়ে বললেন, ‘এ আপনাদের ক্যাম্পে দিয়ে আসবে।’
কাঠুরিয়াকে বিদায় দেবার পালা। এত পরিশ্রম করে, পথ দেখিয়ে আনার জন্য তাকে কিছু বকশিস দেয়া প্রয়োজন। বকশিস হিসাবে কিছু টাকা দিতে চাইলে সে ভীষণ আপত্তি জানাল, ‘যারা দেশের জন্য জান দিবার যাইত্যাছে, তাগরে একটু সাহায্য কইরা পয়সা নিমু এত ছোট মনের আমি অহনও অই নাই, অগত্যা তাকে কেবল শুষ্ক ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় করা ছাড়া আর কোন উপায় রইল না।
দুপুরে গড়িয়ে বিকেলে নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলামের দল যখন পোড়াখাশিয়ায় পৌঁছায় তখন সে কী উল্লাস। ওখানকার মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগের জন্য খুবই উদগ্রীব ছিলেন। অবশেষে সে সুযোগ আসায় তাঁদের আনন্দ আর উল্লাসের যেন সীমা পরিসীমা থাকে না। নুরুন্নবী পৌছার খবর –বাংলাদেশ ফোর্স ও মিত্রবাহিনীকে জানিয়ে দেয়া হলো।
পোড়াখাসিয়া ক্যাম্পে সেই সুবেদার আবদুর রহিম, যিনি শুরুতে গোড়ান সাটিয়াচরা ও কালিহাতী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তার সাথে দেখা হলো। পরদিন সকালে ঢালু ক্যাম্পের অধিনায়ক ডঃ মাহমুদ ও অধ্যাপক হান্নান সাহেবের সঙ্গেও যোগাযোগ ঘটল। বিকেলে মিত্র বাহিনীর বিগ্রেডিয়ার সানসিং (বাবাজী) এর সঙ্গে নুরুন্নবী দেখা করে। পরে বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিনিধির সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ হয়। এদের সাথে টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে সে জানায়, ‘দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ প্রচণ্ড গতিতে চলছে। প্রয়োজন
পৃষ্ঠা নং ~ ২৩২

আরও অস্ত্রের, আরও বিস্ফোরকের। এ সব নিয়ে যত দ্রুত ফিরে যাওয়া যাবে, যুদ্ধ ততই অনুকূলে আসবে।’
ভারতে নুরুন্নবী যারপর নাই সাড়া ও সব সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়ে খুশী হলো।
নুরুন্নবী, নুরুল ইসলামের দল ছ’টি নৌকায় বিস্ফোরক, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাারুদ বোঝাই করে ৫ই জুলাই আবার টাংগাইলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। নিরাপত্তার জন্য তাদের সাথে দেওয়া হল একটি মুক্তিযোদ্ধা দল।
বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে গেলে দ্রুত ভুয়াপুর পৌঁছানো যায়। তাই নৌকার বহর সেই পথই ধরল। এর আগে কিন্তু বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা কোনদিন চলাচল করেনি। এই ঘাট পাক-বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি।
যমুনা নদীর পূর্ব পারে বাহাদুরাবাদ, পশ্চিম পারে ফুলছড়ি ঘাট। পাকহানাদাররা সারারাত নদীতে সার্চ লাইট ফেলে পাহারা দেয়। অধিকন্তু হানাদারদের গান বোট গুলো নদীর উপর নিরন্তর ঘোরাফেরা করে। এমন কড়া ও সতর্ক পাহারার ভেতর চলাচল বিপদ সংকুল। তা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধারা এ পথই ধরল। কিন্তু শীঘ্রই তাদের ভুল ভাঙল। কিছুদূর এগুবার পর মনে হলো, দুশমনরা নৌকাগুলোকে সন্দেহ করছে। কাজেই কিছুটা পিছিয়ে এসে, অন্য পথ ধরার পরিকল্পনা নিল। এ দলটির পথ প্রদর্শক ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুব। বাহাদুরাবাদ ঘাট পার করে দেবার দায়িত্ব ছিল তার। আর নৌকা প্রহরা দলের অধিনায়ক ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রেজাউল করিম। সহকারী অধিনায়ক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমজাদ হোসেন। সকলের সাথে পরামর্শ করে নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলাম স্থির করলেন, ইসলামপুর হয়ে বাহাদুরাবাদ-জামালপুর রেল লাইনের পাথরঘাটা ব্রিজের নীচ দিয়ে যাবেন। তবে পথ দুর্গম ও বিপদ সঙ্কুল। শুধু দিনে নয়, রাতেও রাজাকাররা পুলটি পাহারা দেয়। ইসলামপুরের ব্রিজটি এর আগে মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করতে চেষ্টা করেছিল। তাই পাহারাও বেশ কড়া, কিন্তু তবু যেতে হবে। উপায় নেই। তবে একটি সুবিধা হল। পুলের পাশে ধর্মকুড়া হাট। ঐ দিন ছিল হাটবার। হাটুরে নৌকার সাথে মিশে পার হয়ে যাওয়া সহজ হবে। আর যদি বাধা আসেই তবে লড়াই করে কাটিয়ে যেতে হবে। ছয়টি নৌকা সেতুতে আটকে যেতে পারে, এ ধরনের সমস্যার কথা চিন্তা করে বাধা নুরুন্নবী খুব বিব্রতবোধ করতে লাগল। আবার পরক্ষণেই মনস্থির করে ফেলল, চেষ্টার ত্রুটি করবেনা। বিপদ দেখে পিছু হটা মুক্তিবাহিনীর ধর্ম নয়।
নৌকা এগিয়ে চলল। প্রথম নৌকায় নুরুন্নবী, নরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মাহবুব দ্বিতীয় নৌকায় রেজাউল করিম, তৃতীয় নৌকায় আমজাদ হোসেন, চতুর্থ নৌকায় রকিব, পঞ্চম নৌকায় ফয়েজ, যষ্ঠ নৌকায় বারেক। সকলের প্রতি নির্দেশ : প্রথম নৌকা সবার আগে পুলের নীচে যাবে। যদি কোন বিপদ দেখা দেয়, তাহলে সব কটি নৌকা পারে ভিড়িয়ে কভারিং ফায়ার দিয়ে প্রথম নৌকাটিকে ফিরে আসতে সাহায্য করবে। আর যদি প্রথম নৌকা সেতু অতিক্রম করে যেতে পারে, তবে অন্য সবকটি দ্রুত প্রথম নৌকাটিকে অনুসরণ করবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৩৩

মুক্তিবাহিনীর সব যোদ্ধারা নৌকার মধ্যে রইল, কেবল কমাণ্ডাররা নৌকার ছইয়ের উপর উঠে বসল। একসঙ্গে বড় বড় ছয়টি নৌকা দেখে হাটভরা লোকের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। তাদের অনেকেই প্রশ্নও করলেন, “কোথাকার নাও? কোথায় যাবে? নায়ের ভিতর কি আছে?” ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে প্রথম নৌকা পাথরঘাটা সেতুটি অতিক্রম করল। কিন্তু দুশ গজ সামনে আরও একটি সেতু। সেতুটিতেও রাজাকার পাহারা ছিল। কিন্তু একসাথে ছয়টি নৌকা দেখে তারা কোন উচ্চবাচ্য করল না। নৌকাগুলো গ্রামের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। গ্রামের অজস্র ছেলেমেয়ে দু’তীরে ভীড় করে দেখছে তারা বুঝতে পেরেছে নৌকাগুলো মুক্তিবাহিনীর।
দেওয়ানগঞ্জের পথে মুটাইল গ্রাম। রাত বারটার দিকে মূটাইল গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা বাদলের বাড়ীতে পৌছাল, সারাদিন মুক্তিযোদ্ধাদের পেটে দানাপানি পড়েনি। তারা ক্ষুধায় কাতর। বাদলের মা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে আনন্দে আত্মহারা হলেন, তিনি যেন তার ছেলেকেই কাছে পেয়েছেন। সেই গভীর রাতে খাসী জবাই করে বাদলের বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের পেটপুরে খাওয়ালেন। বাদল তখন ১১ নম্বর সেক্টরের রৌমারী থানায় মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বাদলের খবরাখবর জানিয়ে রাত তিনটায় আবার রওনা হলো। পথ প্রদর্শক ক্যাপ্টেন মাহবুব ওখান থেকে বিদায় নিয়ে মানকাচরে ফিরে গেলেন।
৭ই জুলাই, সারাদিন ভাটিপথে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হয়ে, পাক-হানাদারদের দৃষ্টি এড়িয়ে মাঝরাতে মুক্তিযোদ্ধা দলটি ভুয়াপুরে এসে পৌঁছে। ভারতের সাথে সফল যোগাযোগ করে বিপুল অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে নুরন্নবী ও নুরুল ইসলাম ফিরে এসেছে, এ খবর পাবার পর ভুয়াপুরের বেসামরিক প্রধানদ্বয় এনায়েত করিম ও মোয়াজ্জেম হোসেন খান এবং বেসামরিক প্রশাসনের সাথে জড়িত আলিম, ভোলা, সামসু, মাহফুজ সিদ্দিকী, মোতাহার, বুলবুল খান মাহবুব, দুদু মিয়া, বারী মিয়া ও জীয়াসহ অন্যেরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। তাদের সফল প্রত্যাবর্তনের ফলে ভুয়াপুর থেকে একশ পঞ্চাশ মাইল দূরে ভারতের মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ঘাটির সাথে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর একটি সরবরাহ লাইন স্থাপিত হয়।
নুরুন্নবী ও নূরুল ইসলামের দলের ভারত গমন ও সফল প্রত্যাবর্তন সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট রাতেই আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। ৮ই জুলাই সকাল সাতটায় আমি সেই রিপোর্ট পেলাম। নূরন্নবীদের আনা অস্ত্র-শস্ত্র পশ্চিম অঞ্চলের বেসামরিক প্রশাসনকে হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দিলাম। অস্ত্র বিলি বন্টনের তালিকা সম্পন্ন করে শেষবারের মতো হেড-কোয়ার্টার পুনঃবিন্যাসের কাজে মনোনিবেশ করলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৩৪

প্রশাসনিক পুর্নবিন্যাস

মহানন্দপুর প্রাইমারী স্কুলে মুক্তিবাহিনীর বেসামরিক সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়েছে। সামরিক সদর দপ্তর এখান থেকে প্রায় তিন-চার মাইল দূরে।
প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর বিন্যাস হলো এভাবে :-
১. সামরিক বিভাগ।
২. বেসামরিক বিভাগ।
৩. বেতার, টেলিফোন ও যোগাযোগ।
৪. জনসংযোগ।
৫. খাদ্য।
৬. স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা।
৭. বিচার ও কারাগার
৮. সদর দপ্তর প্রতিরক্ষা।

দফতর বন্টন
(১) সামরিক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হলো—অস্ত্র-শস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ পরিচালনা। সামরিক বিভাগকে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হলো—
(ক) প্রতিরক্ষা ঘাটিগুলোর সাথে সমন্বয় সাধন, যুদ্ধ পরিচালনা ও মুক্তাঞ্চল রক্ষনাবেক্ষন।
(খ) অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণ।
(গ) মুক্তিবাহিনীতে সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ।

(২) বেসামরিক বিভাগ :-
জনসংযোগ, সাধারণ প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন, অর্থসংগ্রহ, আয়-ব্যায়ের হিসাব সংরক্ষণ। মুক্তিবাহিনীর যাবতীয় প্রচার এবং সকল বিভাগের সাথে সমন্বয় সাধন। বেসামরিক প্রশাসনকেও আবার কয়েক ভাগে ভাগ করা হল-
(ক) স্থানীয় জনগণের সাথে যোগাযোগ স্থাপন, জনগণের অভাব অভিযোগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া এবং তার প্রতিকার সাধন। এই বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হল আনোয়ার-উল- আলম শহীদের উপর।
(খ) স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর তালিকা প্রণয়ন ও তাদের সুসংগঠিত করে গড়ে তোলা। প্রশিক্ষণ দান ও তাদের মধ্যে কাজ বন্টন। এ বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্তরা হলেন—সোহরাব আলী খান আরজু ও আলী আজগর খান দাউদ।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৩৫

(গ) অর্থ বিভাগ :-
স্বেচ্ছায় অর্থদান, জরিমানা আদায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর কর আরোপ ও সংগৃহীত অর্থের পুংখানুপুংখ হিসাব রাখা। এ দায়িত্ব অর্পিত হলো প্রাক্তন সৈনিক আনোয়ার হোসেনের উপর।
(ঘ) প্রচার বিভাগ :-
মুক্তিবাহিনীর যাবতীয় প্রচারযোগ্য সংবাদ, নির্দেশনামা, উদ্দীপনামূলক কবিতা ও প্রবন্ধ। নানা ধরণের দলিল দস্তাবেজ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রচার বিভাগের। এই বিভাগের প্রথম দায়িত্ব দেওয়া হয়— ফারুক আহমেদ, সৈয়দ নুরু ও কচুয়ার আবদুল্লাকে। পরে এই বিভাগে যোগ দেন, অধ্যাপক মাহবুব সাদিক, সোহরাব আলী খান আরজু ও অধ্যাপক কাজী আতোয়ার। এই বিভাগের রনাঙ্গন পত্রিকার সাথে আগষ্টে এসে যুক্ত হন কাগমারী মোহাম্মদ আলী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিক আজাদ ও ইডেন কলেজের অধ্যাপক শরীফ।
রনাঙ্গন পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও সহ সম্পাদক ফারুক আহমেদ ও সৈয়দ নুরুর নাম ছাপা হতো। সেপ্টেম্বর থেকে ‘রনাঙ্গন’ পরিচালনা করতো মূলত অধ্যাপক মাহবুব সাদিক, সোহরাব আলী খান আরজু, সৈয়দ নূরু, ফারুক আহমেদ ও শওকত মোমেন শাজাহান। রনাঙ্গনের কয়েকটি সংখ্যায় মাহবুব সাদিক, সোহরাব আলী খান আরজু ও ফারুক আহমেদের নাম সম্পাদক হিসাবেও ছাপা হয়।
রনাঙ্গনের একমাত্র দুর্দান্ত কার্টুন শিল্পী ছিল আনিস।
সাধারণ প্রশাসনের সমস্ত বিষয় ও বিভাগের উপর প্রথম অবস্থায় তত্ত্বাবধান আমি নিজেই করছিলাম। কিন্তু আগষ্ট মাসের শুরু থেকে সাধারণ প্রশাসনের সমস্ত দায়িত্ব আস্তে আস্তে ছেড়ে দিই আনোয়ার-উল-আলম শহীদের উপর। তাঁকে সাহায্য করেন— হামিদুল হক, আবদুল আউয়াল সিদ্দিকী ও বাসেত সিদ্দিকী। অন্যদিকে জুলাইর মাঝামাঝি থেকে পশ্চিম অঞ্চলের প্রশাসনের সাহায্য করেন আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, নুরুল ইসলাম, মোতালেব মাস্টার, আলীম, ভোলা, বুলবুল খান মাতুব্বর ও মোয়াজ্জেম হোসেন দুদু মিয়া।

(৩) বেতার ও টেলিফোন যোগাযোগ :-
এ বিভাগের দায়িত্ব ছিল দুটি-(ক) নিজেদের খবর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়া, (খ) শত্রুর সঠিক সংবাদ যতটা সম্ভব সংগ্রহ করা এবং তা তাৎক্ষনিকভাবে সদর দপ্তরে প্রেরণ করা। এই বিভাগের সাফল্য ও ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ড যুদ্ধের গতি প্রকৃতিকে প্রচুর প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রথম অবস্থায় এ বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয় ধরে আনা মিরপুরের ওয়ার্লেস অপারেটর আনিসের উপর। পরে এ দায়িত্ব গ্রহণ করে আজিজ বাংগাল, শামসু, রশিদ, আবদুল আজিজ, হাকিম ও আরো কয়েকজন। হেড-কোয়ার্টার থেকে মাইল দুই দূরে ইংরাজ নামক এক কাঠুরিয়ার বাড়ীতে বেতার বসানো হয়। বাড়ীর মালিক জনাব ইংরাজ
পৃষ্ঠা নং ~ ২৩৬

শুরু থেকে শেষ অবধি তাদের খাবার তৈরী সহ অন্যান্য নানা ধরণের কাজ অত্যান্ত সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেন।
মুক্তিবাহিনীর বেতার যন্ত্র চালু হবার পর, এদের সাথে দখলদার হানাদারদের নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য বেতার ঘাটির দেশপ্রেমিক বাঙালী অপারেটরদের একটা ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠে। মুক্তিবাহিনীকে শুরু থেকেই যারা সক্রিয় ও নিঃস্বার্থভাবে সহযোগীতা করেছে তাদের মধ্যে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের বেতার ঘাটির আবুবকর সিদ্দিকীর নাম উল্লেখ না করলেই নয়। দেশপ্রেমের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আবুবকর সিদ্দিকী নিজে ওয়ারলেস সেট সহ সেপ্টেম্বরে মুক্তিবাহিনীতে যোগাদান করে। আবুবকর ছাড়াও টাংগাইল-কাগমারী স্টেশনের আবদুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ স্টেশনের জিল্লুর রহমান, জামালপুর স্টেশনের মুজিবর রহমান ও সিরাজগঞ্জ স্টেশনের আবদুর রহমান তাদের ওয়ারলেসের মাধ্যমে খবরাখবর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ সাহায্যকরেছে।

(৪) যোগাযোগ :-
এ দপ্তরের কাজ অনেকটা গুপ্তচর বৃত্তির মত। দক্ষতা ও নৈপুণ্য বৃদ্ধির জন্য এ দপ্তরটির কর্মকাণ্ড মোটামুটি দুভাগে বিভক্ত করা হয় :
(ক) নিজেদের আভ্যন্তরীণ সঠিক খবর সংগ্রহ এবং তা আমাকে পুংখানুপুংখরূপে অবহিত করা।
(খ) অনুরূপভাবে শত্রুপক্ষের পুংখানুপুংখ খবর সংগ্রহ ও তা আমাকে জানানো। প্রথমে এ দপ্তরের সার্বিক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল— আবদুল খালেক, আনোয়ার ও মুসার উপর। ১২ই জুলাই থেকে এ দপ্তরের ভার গ্রহণ করে নুরুন্নবী।

(৫) খাদ্য বিভাগ :-
এই বিভাগ খাদ্য ও অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির যোগানদার। খাদ্য বিভাগের প্রধান দায়িত্ব হলো, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সুষ্ঠু সরবরাহ অব্যাহত রাখা। তাছাড়া মুক্তাঞ্চলে অত্যাবশ্যকীয় জিনিস পত্রের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে কিনা সেদিকে সতর্ক নজর রাখা। শুধু তাই নয়, বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে, বিশেষ বিশেষ পণ্যের ঘাটতি পূরণ করাও খাদ্য দপ্তরের অন্যতম প্রধান কাজ। খাদ্য ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উপর নজর রাখা ও তা সুষ্ঠুভাবে সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হলো হমিদুল হক, খোরশেদ মাষ্টার, আউয়াল সিদ্দিকী, খোরশেদ আলম আর. ও. ও আরও চার জনকে। পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্ব পেলেন-আবদুল আলীম, ভোলা ও মোয়াজ্জেম হোসেন খান।
খাদ্য দপ্তরের একটি বিশেষ বিভাগ :-
শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা ও স্বেচ্ছাসেবকদের খাদ্য যোগানের পূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হল করটিয়া সাদৎ কলেজের এম. এ প্রথম বর্ষের ছাত্র ওসমান গণি ও তার ভাই আলীর উপর।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৩৭

(৬) স্বাস্থ্য বিভাগ :-
এ বিভাগের দু’টি অংশ।
(ক) আভ্যন্তরীণ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা।
(খ) বহির্বিভাগ : সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার প্রতি লক্ষ্য রাখা, প্রয়োজনীয় ঔষধ-পত্র সংগ্রহ ও চিকিৎসা। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে এই বিভাগ আহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য বেশ কয়েকটি অস্থায়ী আঞ্চলিক হাসপাতাল ও একটি কেন্দ্রীয় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাছাড়া জনগণের জন্য বাইরে থেকে ঔষধ সংগ্রহ শুধু নয়, প্রতিটি ইউনিয়নে দুতিনজন করে চিকিৎসা কর্মীকে চিকিৎসার দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বে ছিল ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র শাহাজাদা চৌধুরী ও সদ্য পাশ করা ডাক্তার নিশি রঞ্জন সাহা এবং মাষ্টার আমজাদ হোসেন।

(৭) বিচার ও কারাগার বিভাগ :-
(ক) বিচার বিভাগঃ- স্থানীয় বিচার নিষ্পত্তি ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যের ত্রুটি-বিচ্যুতির বিচার ও প্রয়োজনীয় আটক করা বা অন্য কোন শাস্তি বিধান।
(খ) কারাগার বিভাগ :- বাইরের লোকদের বিশেষ কোন কারণে, কিছু সময় আটক রাখতে হলে তাদের জন্য আলাদা কারাগার। মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ কোন ত্রুটি বা অপরাধ করলে তাদের সাময়িকভাবে বন্দী করে রাখার জন্য এক বিশেষ কারাগার। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ অবধি জেল ব্যবস্থার মূল দায়িত্বে ছিলেন আনোয়ার উল-আলম শহীদ। তাঁকে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে অত্যন্ত কর্মঠ আনসার আলী ও বিখ্যাত মহু সর্দার।

(৮) হেডকোয়ার্টার নিরাপত্তা বিভাগ :-
হেডকোয়ার্টারের নিরাপত্তা ও তদারকের মূল দায়িত্ব তুলে দেয়া হলো পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে বেরিয়ে আসা সৈনিক খলিলুর রহমানের উপর। সাড়াসিয়া বাইদের খলিলুর রহমান স্থানীয় লোক। তার বাড়ী মহানন্দপুর হেডকোয়ার্টার থেকে এক মাইল পূর্ব-দক্ষিণ কোণে। চারশ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে খলিলুর রহমান বিশেষ সফলতা ও দক্ষতার সাথে হেড-কোয়ার্টারে ব্রহ্মণবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে। তাকে যারা সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করে, তাদের মধ্যে কালিহাতী ছাত্রলীগের সভাপতি হামিদপুরের আবদুর রাজ্জাক, ঢাকা কলেজের ছাত্র সানু, কালিহাতীর আবদুল মান্নান, বীরেন বর্মন, কচুয়ার ছোট আবদুল্লাহ, লাল মোহন ও আরও অনেকে।
হানাদার বাহিনীর টাঙ্গাইল ঘাঁটির উপর জুলাই মাসের প্রথম থেকে ক্রমাগত আঘাত হানা শুরু হলো। এতে গ্রেনেড গ্রুপ বিশেষ দক্ষতা ও সফলতার পরিচয় দেয়। হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রেখে তদের চলাফেরায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে রাস্তা-ঘাট ও সেতু ধ্বংস করে দেয়া
পৃষ্ঠা নং ~ ২৩৮

অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অথচ রাস্তা-ঘাট ধ্বংস করার মত বিস্ফোরক তখনও মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিল না। কিন্তু বিস্ফোরক নেই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকাও যায় না। ৩শরা জুলাই পশ্চিমাঞ্চলের বেসামরিক প্রধানকে নির্দেশ পাঠানো হলো ময়মনসিংহ -টাংগাইলের পাকা সড়কের দু’তিনটি জায়গা কেটে হানাদার বাহিনীর চলাফেরা বন্ধ করে দেয়া হোক।

স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতা
নির্দেশ পেয়ে এনায়েত করিম, নূরুল ইসলাম ও মোয়াজ্জেম হোসেন খান স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডারদের ডেকে তাদের সাথে তারা কি ধরনের কাজ, কত সময়ে সম্পন্ন করতে পারেন, প্রয়োজনের সময় কত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া যেতে পারে, এ প্রসঙ্গে আলোচনা করলেন। অথচ মূল কাজটি কি তা ঘূর্ণাক্ষরেও তাদের বলা হলো না। আঞ্চলিক বেসামরিক প্রধানদের স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডাররা সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দিলে মোয়াজ্জেম হোসেন খান, নূরুল ইসলাম ও এনায়েত করিম তাদের ৬ই জুলাই সন্ধ্যায় কোদাল ও ঝুরি নিয়ে ভুয়াপুরে সমবেত হতে অনুরোধ করেন।
৬ই জুলাই, সন্ধ্যা। আর বসে থাকা যায় না। স্বেচ্ছাসেবকরা বেরিয়ে পড়ল। গোবিন্দাসী— ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার খোদা বকস হালিম ও জলিলের নেতৃত্বে তিনশ’জন, শিয়াল- কোলের হুমায়ুন কবির ও আজিজের নেতৃত্বে দু’শ পঞ্চাশ জন, ফলদার আবুল ও নয়ান খলিফার নেতৃত্বে দু’শ জন স্বেচ্ছাসেবক ভুয়াপুরে এসে হাজির হলো। বড় লোকের পাড়ার সিরাজ ও ছোট লোকের পাড়ার সাইদের নেতৃত্বে এলো আরও প্রায় একশ পঞ্চাশ জন স্বেচ্ছাসেবক। একশ জনের মত নিয়ে এলো নিকরাইলের কমাণ্ডার বাছেত।
মোট এগার-বারশ’ দুঃসাহসিক স্বেচ্ছাসেবক ভুয়াপুরে সমবেত হয়েছে। কাজের জন্য তাদের আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ জানেনা, তাদের কাজ কি, কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে। অবশ্য তারা তা জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। তাদের মন-প্রাণ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আন্দোলিত হচ্ছে, আনন্দে টগবগ করছে। গৌরবে তাদের বুক ভরে উঠছে৷ এই প্রথম তারা দেশের ডাকে ঘর থেকে বেরিয়েছে এবং দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মস্থলে নিরাপদে নিয়ে যাওয়ার ও ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পড়েছে মেজর হাবিবের উপর। যাওয়া-আসার পথে ও কাজ চলাকালীন সময়ে কর্মস্থলের নিরাপত্তার জন্য নিখুঁত প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করা হয়েছে।
সন্ধ্যা সাতটা। অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। আকাশে সাদা-কালো মেঘের আনাগোনা। ঝিরঝিরি বাতাস বইছে! একটু একটু বৃষ্টিও হচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টি দুর্যোগের এমন একটি রাত যেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার পরম আশীর্বাদ। ভুয়াপুর থেকে গন্তব্যস্থলের দূরত্ব বার মাইল। তবে এই বার মাইল পথের কোথাও কোনো অসুবিধা নেই। পুরো পথের দু’পাশেই মুক্তিবাহিনী ঘাটি আগলে রয়েছে।
‘জয় বাংলা’ জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী ধ্বনি দিয়ে বিশাল স্বেচ্ছাসেবক দলের যাত্রা
পৃষ্ঠা নং ~ ২৩৯

শুরু হলো। বার মাইল রাস্তা পাড়ি দিয়ে রাত বারটা ত্রিশ মিনিটে তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছল। যথারীতি কাজ শুরু হলো। কাজ একটাই, মাটি কেটে সড়ক ধ্বসিয়ে দেওয়া। হাজার হাজার কোদাল একসাথে চলছে। মাটি প্রকৃত পক্ষে মাটি নয়। সড়কের সর্বত্রই ইট আর পাথর। হাজার কোদালের আঘাতের কাছেও যেন তা নতি স্বীকার করতে চায়না। তবুও রণে ভঙ্গ দিলে চলবে না। কোদালের পর কোদাল চালিয়ে কাজ শেষ করতে হবে। সুদীর্ঘ চার ঘন্টা তারা অবিরাম কোদাল চালিয়ে গেল। এ সময় খোরশেদ আলম চল্লিশ জন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কর্মস্থল থেকে আড়াই মাইল এগিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে পথ আগলে রইল। কমাণ্ডার হাবিবও কালিহাতীর দিকে দুমাইল এগিয়ে রক্ষাব্যূহ রচনা করল।
হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের এই কর্মকাণ্ডের কথা জেনে যায়। দুষ্কৃতকারীদের মাটি কেটে সড়ক ধসানোর কাজ ব্যর্থ করে দিতে তারা আনুমানিক রাত চার টায় কালিহাতীর দিক থেকে ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। কমাণ্ডার হাবিব দেখে শুনে একটা ভাল জায়গায় পজিশন নেয়। উদ্দেশ্য কালিহাতীর দিক থেকে হানাদার বাহিনী এগিয়ে এলে সে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবে। অস্ততঃ কয়েকটা হানাদার খতম করে কয়েক খানা অস্ত্র দখল করবে। অথচ আধ ঘন্টা অবিরাম গোলা চালালেও হানাদার বাহিনী তাদের ঘাটি ছেড়ে এগিয়ে এলো না। মুক্তিসেনাদের কাছে তখন তিন ইঞ্চি মর্টার না থাকায় তারা চার মাইল দূরে হানাদার বাহিনীর কালিহাতীর ঘাঁটিতে গোলাবর্ষণ করতে পারল না।
গুপ্তচরদের কাছে খবর পেয়ে হানাদার বাহিনী প্রায় নির্ভুল নিশানায় গোলাবর্ষণ করে চলেছে। এমতাবস্থায় কমাণ্ডার হাবিব আর বেশী সময় উন্মুক্ত স্থানে এগার-বারশ’ দেশ প্রেমিক বাংলা মায়ের দামাল ছেলে স্বেচ্ছা সেবকদের রাখাটা যুক্তি সঙ্গত মনে করলোনা। তাই ভোর সাড়ে চারটায় কাজ ছেড়ে স্বেচ্ছা সেবকদের ভুয়াপুরের দিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার বিষয়, হাবিবের নির্দেশে সেচ্ছা সেবকরা যখন সড়ক ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, তখন হানাদারদের একটি গোলা স্বেচ্ছা সেবক দলের ঠিক মাঝখানে এসে পড়ে। এতে কুড়িজন স্বেচ্ছাসেবক আহত হয়। আহতদের তাৎক্ষনিকভাবে বাঁশের চাঙারিতে ভুয়াপুরে নিয়ে যাওয়া হলো: গুরুতর আহতদের মধ্যে ঘাটকান্দির হজরত আলী এলেঙ্গা-ভুয়াপুরের সড়কে শাহাদৎ বরণ করে। আহতরা অল্পদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে।
ঘাটকান্দির হজরত আলীর লাশ যখন তার নিজের বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তার বাপ-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজন সবাই হাউ-মাউ করে বুক চাপড়িয়ে কাঁদছেন। তাদেরকে তখন শান্তনা দেবার ভাষা কারো ছিল না। সবাই তাঁদের কান্নার অংশীদার। বাংলার এক তরুণ দামাল ছেলে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমাদের সবার মনে দেশ-প্রেমের নব চেতনার জন্ম দিয়ে গেল। সেই সকরুণ দৃশ্য চোখে না দেখলে তা কাউকে বুঝিয়ে বলা যায় না।
তরুণ হজরত আলীর বয়স ঊনিশ-কুড়ি। সন্ধ্যায় ঘর থেকে বেরুনোর সময় মাকে
পৃষ্ঠা নং ~ ২৪০

বলেছিল, ‘মা, আমি ওদের সাথে গেলাম। দেখো, আমি ফিরে আসব। আমি ভাল কাজ দেখাতে পারলে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারব। সবাই যুদ্ধ করছে, সবাই দেশের জন্য কাজ করছে। আমি চুপ চাপ ঘরে বসে থাকবো? এটা হয়না।’ এ কথা শুনে মা তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে খুশী মনে বিদায় দিয়েছিলেন।
পুত্র বিয়োগের ব্যথায় মুহ্যমান বাংলার এই পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো ছিল। পুত্রের এই মৃত্যুর জন্য একবারও তাঁরা দেশের চলমান পরিস্থিতিকে দায়ী করেননি। হজরত আলীর মরদেহের প্রতি দেড় হাজার স্বেচ্ছা সেবক ও পাঁচশ’ মুক্তিযোদ্ধা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অস্ত্র নিম্নমুখী করে সম্মান প্রদর্শন করে যখন তাকে কবরস্থ করল, তখন শোকাহত ব্যাথাতুর পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজন নিজেরাই নিজেদের শান্তনা দিচ্ছিলেন, ‘সবাই একদিন মরবে। আমার ছেলেও মরেছে। অসুখ-বিসুখ হয়েও তো মরতে পারত। আমার ছেলে দেশের জন্য কিছু করতে গিয়ে মরেছে, এটাই আমাদের শান্তনা, আমাদের শান্তি।” এটাই হলো বাঙালী চরিত্রের একটা মহান ও গৌরবোজ্জ্বল দিক।
সড়ক পুরোপুরি কেটে ধ্বসিয়ে দিতে না পারায়, স্বেচ্ছাসেবকদের মনে একটা দুঃখ ও অস্বস্তিবোধের জন্ম হলো। কোন কাজে হাত দিয়ে তা ফেলে রাখা তাদের ধর্ম নয়, তাছাড়া ঐ সড়ক ধ্বংস করা যুদ্ধ কৌশলের জন্য খুবই অপরিহার্য। অথচ কাজটা শেষ হলো না। একথা চিন্তা করে তারা মোটেই স্বস্তি পাঁচ্ছিল না।
১২ই জুলাই। একবার অসফল হলে বারবার চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? বরং এটাই তো সফলতার চাবিকাঠি। আবার সড়ক বিচ্ছিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা সভা ডাকা হলো। আঞ্চলিক প্রধানরা ৬ই জুলাইয়ের দুঃখ জনক ও নির্মম ঘটনায় কিছুটা বিহ্বল ও হতাশ হয়ে পড়েছিল। তাঁদের মধ্যে কিছুটা সন্দেহ ও হতাশা দেখা দিয়েছিল, আবার ঐ ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে স্বেচ্ছাসেবকদের পাওয়া যাবে কি না। একজন স্বেচ্ছাসেবকের অকাল ও আকস্মিক মৃত্যু ও আরো কুড়ি জনের আহত হবার প্রতিক্রিয়া এলাকার লোকের মনে হতাশার সৃষ্টি করতে পারে। লোকের মনের ভয় ভীতি দূর করে, তাদের হারানো সাহস ও উদ্দীপনা ফিরিয়ে এনে চাঙ্গা করে তুলতে আলীম, ক্যাপ্টেন মোতাহার, ভোলা ও শাজাহানকে আঞ্চলিক প্রশাসকরা গ্রামে গ্রামে প্রচারে পাঠালেন। কিন্তু পরম আশ্চর্যের বিশ্চর্যের বিষয়, হানাদার বাহিনীর আকস্মিক গোলাবর্ষণ, হজরত আলীর শাহাদৎ বরণ ও কুড়িজন স্বেচ্ছাসেবকের আহত হওয়ার ঘটনা এলাকার স্বেচ্ছাসেবক বা জনগণের মধ্যে বিন্দুমাত্র হতাশা বা নিরুৎসাহ সৃষ্টি করতে পারেনি।
১৩ই জুলাই। নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট স্থানে আগের চেয়ে অনেক বেশী সংখ্যাক স্বেচ্ছাসেবক এসে হাজির হলো। তারা পুনরায় সড়ক কাটার কাজে অংশ গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আবার যাত্রা শুরু হলো। ১৩ই জুলাই, রাত এগারটায় তারা টাংগাইল-ময়মনসিংহ সড়কের ইছাপুরে হাজির হলো। ৬ই জুলাইয়ের চাইতে দ্বিগুণ-তিনগুণ উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে আবার শুরু করল সড়ক ধ্বংস করার কাজ। প্রতিরক্ষায় এবার অন্য ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হলো। গফুর ও খোরশেদ
পৃষ্ঠা নং ~ ২৪১

আলম পঞ্চাশজন করে সদস্য নিয়ে কর্মস্থল থেকে যথাক্রমে দুমাইল উত্তর ও দক্ষিণে কালিহাতী ও টাংগাইলের দিকে এগিয়ে অবস্থান নিল। মেজর হাবিব চল্লিশ জনের আরেকটি দল নিয়ে সোজাসুজি কালিহাতী থানার উপর আক্রমণ চালাল। এবার আর শত্রুর অপেক্ষায় বসে থাকা নয়, শত্রুর একেবারে ঘাড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা।
সারারাত মেজর হাবিবের দল নানাভাবে নানা দিক থেকে কালিহাতীর হানাদারদের উপর হামলা চালাতে থাকে। সেদিন কিন্তু আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হানাদাররা বাইরে গোলা-গুলি ছোড়ার কোন সুযোগ পেল না। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে, যে সব রাজাকার পুলিশ ও মিলিশিয়া মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিল তাদের অনেকেই জুলাই মাসের ১৩ তারিখে মুক্তিবাহিনীর হামলার সময় কালিহাতীর ঘাঁটিতে ছিল। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই পরে বলেছিল, ঐ রাতে তাদের অনেকেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। চারদিক থেকে হঠাৎ গুলি হওয়ায় তারা ঘাঁটি ছেড়ে পালাবার সুযোগ পায়নি। এ হামলায় চারজন হানাদার নিহত ও সাতজন আহত হয়েছিল। আহতদের মধ্যে পরে একজন মারা যায়।
শরারাত কালিহাতী থানার উপর অবিরাম গুলি-গোলা বর্ষণ করে সকাল সাতটার দিকে মেজর হাবিব তার দল নিয়ে কালিহাতী থেকে বার মাইল দূরে ভুয়াপুরে ফিরে যায়। অন্য দিকে সতের আঠারশ স্বেচ্ছা সেবক রাত চারটা পর্যন্ত অবিরাম কোদাল চালিয়ে ইছাপুরের কাছে সড়কের দু’জায়গা প্রায় পঞ্চাশ ষাট হাত করে ধ্বসিয়ে ফেলে। এতে অন্তত পক্ষে কয়েকদিন গাড়ী চলার জন্য সড়কটি অকেজো হয়ে যায়। মেরামত করার পরও এ রাস্তা বারবার ভেঙে ফেলার অথবা মাইন পুঁতার একটা মোক্ষম সুযোগ মুক্তিবাহিনীর হাতে থেকেই গেল।
স্বেচ্ছা সেবকরা কাজ শেষ করে, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী’ ধ্বনি দিতে দিতে ভুয়াপুরে ফিরে এলো। তাদের কাজে মুক্তাঞ্চলের জনগণের মনোবল বিপুল পরিমাপে বেড়ে যায়। এই বীরোচিত কাজে অংশ গ্রহণের জন্য পুরষ্কার স্বরূপ— পরবর্তীতে অনেক স্বেচ্ছা সেবককে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি করা হয়। এদের এই প্রবল উৎসাহ ও নির্ভয় আত্মত্যাগের স্পৃহা ভিয়েতনামের বেপরোয়া ও স্বাধীনতা প্রিয় জনগণের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।
পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তরে ৮ই জুলাই সারাদিন সকলের দায়-দায়িত্ব ভাগ বাটোয়ারা করে দিলাম। প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন করে দিয়ে বিকালে ধলাপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। চব্বিশ-পঁচিশ জন সহযোদ্ধা নিয়ে বিরামহীন হেঁটে, ধলাপাড়া হয়ে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকীর সেহরাবাড়ীর বাড়ীতে পৌঁছলাম। সদর দপ্তর থেকে সেহরাবাড়ীর দূরত্ব সতের আঠারমাইল।
ভোর চারটায় আমাকে জাগিয়ে খবর দেয়া হলো, নরুল ইসলাম ও নুরুন্নবীর ভারত থেকে নিয়ে আসা গোলাবারুদ দুমাইল দূরে আঙ্গারখোলা বাজার পর্যন্ত আনা হয়েছে। গোলাবারুদ বহন করে আনার কাজে সাহায্য করছে স্বেচ্ছা সেবকগণ। ভুয়াপুরের স্বেচ্ছা সেবকদের অবশ্য মাঝপথে বদল করা হয়েছে। তবুও ভুয়াপুরের সত্তর আশি জন স্বেচ্ছা সেবক বাসেত সিদ্দিকীর
পৃষ্ঠা নং ~ ২৪২

বাড়ী পর্যন্ত রসদ বহন করে নিয়ে এসেছে।
৯ই জুলাই সকাল ছ’টায় তের-চোদ্দদিন পর আবার নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলামকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। তাদের নির্ঝঞ্চাট ও সফল প্রত্যাবর্তনে এতই অভিভূত হলাম যে, বারবার উচ্চ কণ্ঠে বললাম “এই ধরনের কর্মঠ ও সাহসী সহকর্মীর সমন্বয় যেখানে ঘটেছে, সেখানে জয় আমাদের অনিবার্য।”
বাসেত সিদ্দিকীর বাড়ীতে ভুয়াপুর থেকে আসা স্বেচ্ছা সেবকদের সকলের নাস্তার ব্যবস্থা করা হলো। আমি পনের-ষোলজন স্বেচ্ছা সেবককে হাত মুখ ধোয়ার পানি এগিয়ে দিলাম। নাস্তার সময় সবাইকে এটা ওটা পরিবেশন করে নিজেও তাদের সাথে বসে সকালের নাস্তা করলাম।
স্বেচ্ছা সেবকদের হাত-মুখ ধোয়ার পানি এগিয়ে দিচ্ছি, থালা ধুয়ে দিচ্ছি, খাবার পরিবেশন করছি, আমার এরকম কাজ দেখে ভুয়াপুর থেকে আসা স্বেচ্ছা সেবকরা অভিভূত ও মুগ্ধ হলো। আমার সম্পর্কে তাদের হয়তো ধারণা ছিল, যার কথায় হাজার হাজার মুক্তিসেনা উঠাবসা করছে, অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত রয়েছে, লাখো লাখো জনতা যার অঙ্গুল হেলনে জান কোরবানের প্রতিযোগিতায় সদা অবতীর্ণ তেমন একটি লোক সহকর্মীদের জন্য এতোটা করবেন বা করেন, তা হয়তো তারা ভাবতেই পারেনি।
খাবার শেষে, বইলানপুর অভিযানের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মত স্থানীয় ও ভুয়াপুর থেকে আসা স্বেচ্ছা সেবকদের আলিঙ্গন করে উষ্ণ ভালবাসায় উৎসাহিত করলাম, তাদের সামনে তিন চার মিনিট বক্তব্য রাখলাম। বক্তব্যের পুরোটাই ছিল স্বেচ্ছা সেবকদের সুসংহত সহযোগীতার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও ধন্যবাদ জানানো। একটা জনযুদ্ধে স্বেচ্ছা সেবকদের সমর্থন ও সহযোগিতা যে কত গভীর ভাবে প্রয়োজন তা বিশদভাবে তুলে ধরলাম।
ভুয়াপুর থেকে আসা স্বেচ্ছা সেবকদের মধ্যে শামসুল আলম সাহেবকে দেখে একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। হতভম্ব ও অভিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “শেষ পর্যন্ত আপনিও এসেছেন?”
শামসুল আলম সম্পর্কে দু’একটি কথা বলা আবশ্যক। আলম সাহেব আমার চাইতে ছয় সাত বছরের বড়। যে ছোট ফজলুর কথা বারবার আলোচনা করেছি এবং আরো করব, সেই ফজলুর টাংগাইলের বাসায় ‘৬৭ থেকে ৬৯ সাল পর্যন্ত আলম সাহেবরা ভাড়া থাকতেন। আলম সাহেব একজন চৌকষ খেলোয়ার। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ও ক্রিকেট খেলায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ইনি সে সময় বলতে গেলে আমাদের পাড়ায় খেলাধূলা ও সংস্কৃতির জগতে সকলের কাছে একজন হীরোর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। আমি নিজেও আলম সাহেবের পাশে বসতে পারলে বা তার সাথে কথা বলতে পারলে ধন্য মনে করতাম, শ্রদ্ধাও করতাম অপরিসীম।
শামসুল আলম ১৯৬৯ সালে এম. এ. পাশ করে টাঙ্গাইল থেকে চলে যান এবং তথ্য ও বেতার বিভাগে একটি গুরুত্বপূর্ণ চাকরী নেন। প্রায় দুই আড়াই বছর পর হঠাৎ করে আলম
পৃষ্ঠা নং ~ ২৪৩

সাহেবকে দেখে আমার খুবই ভাল লাগল। মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো কাজে অংশ নেয়ার পথে তাঁর উচ্চশিক্ষা ও পদমর্যাদা এতটুকুও বাধার সৃষ্টি করেনি। তাই আধমন গুলির বোঝা মাথায় নিয়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। শুধু তাই নয়। গুলির বোঝা মাথায় তুলে নিতে পারায় তিনি সীমাহীন গর্ববোধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করায় কৃষক, তাঁতী, জেলে, মজুর থেকে শুরু করে উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, শিক্ষক, অধ্যাপকের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। এটা যে এমনিতেই হয়েছে, তা কিন্তু নয়। একদিকে দেশপ্রেমের দুর্বার আকর্ষণ ও কাজে অংশ গ্রহণের আগ্রহ। অন্যদিকে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর সুদৃঢ় নেতৃত্ব ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে আমার পূনঃ পুনঃ সফলতা অর্জন সকল শ্রেণীর ও সকল স্তরের মানুষকে এক সারিতে দাঁড় করিয়েছে। তাদের মধ্যে ইস্পাত কঠিন একতা ও সংহতি সৃষ্টি হয়েছিল বলেই সকল ভেদাভেদ তুলে গিয়ে তাঁরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহান কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে পেরেছেন।
জুন-জুলাই থেকে টাংগাইল, পাবনা, ময়মনসিংহ ও ঢাকার অনেক এলাকার অগনিত মানুষ টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের কথা শুনেছেন এবং মনে মনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁদের হৃদয়ের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করেছেন। তাদের অনেকেই হয়তো আমাকে চোখে দেখেন নি। আমার বয়স কত তাও জানেন না, শিক্ষা-দীক্ষার কথাও বিচার করেননি। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তাঁদের প্রধান বিচার্য ছিল, অত্যাচারী জালেমদের প্রতি আমার আপোষহীন মনোভাব, দুর্বার সাহস, সুদৃঢ় মনোবল, শত্রু হননে নিপুন কার্যকর নেতৃত্ব ও সাধারণ মানুষের প্রতি গভীর আগ্রহ, সীমাহীন ভালবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ।
ভারত থেকে নিয়ে আসা অস্ত্র ও গোলা বারুদের পরিমাণ সামান্য নয়, প্রচুর। অস্ত্র শস্ত্রের মধ্যে রয়েছে তিন হাজার গ্রেনেড, নানা ধরনের পঞ্চাশ হাজার গুলি, দু’শ ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন, দু’হাজার সাধারণ মাইন, চারখানা ওয়ারলেস সেট, তিন হাজার পাউণ্ড বিবিধ বিস্ফোরক এবং বিস্ফোরণ ঘটানোর যাবতীয় দ্রব্যসামগ্রী। বাদ গিয়েছে কেবল ডেটোনেটর। কারণ ছয়টি নৌকার মধ্যে পাঁচটি ৭ই জুলাই প্রত্যূষে ভুয়াপুরের ঘাটে পৌছালেও অন্য নৌকাটি ভুলক্রমে অন্য পথে চলে যায়। আর ভুল পথে চলে যাওয়া নৌকাটিতেই ছিল ডেটোনেটরের প্যাকেট।
দুপুরের পর নুরুন্নবীর দলের আনা সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ নিরাপদ স্থানে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। এ কাজে সাহায্য করল স্বেচ্ছা সেবকবৃন্দ।
অস্ত্র লুকিয়ে রেখে আমি ফুলবাড়ী থানার আছিমের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাসেত সিদ্দিকী, নুরন্নবী, নুরুল ইসলাম ও মোয়াজ্জেম হোসেন খানসহ সেহরাবাড়ী থেকে রওনা হয়ে পাল্লা পাল্লি করে পায়ে হেঁটে সাগরদীঘির পাঁচ মাইল পূবে লহরের বাইদে লালটু, সরোয়ার ও ইদ্রিস কোম্পানীর সাথে রাত কাটালাম।

আছিমে জটিলতা
২৮শে জুন গফুর ও খোরশেদ আলম কোম্পানী সূত্রাপুর ব্রীজ আংশিক ধ্বংস করে আসার পর একশ’ পাউণ্ড বিস্ফোরক থাকা সত্ত্বেও তার কোন সদ্ব্যবহার করতে পারছিলাম না।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৪৪

কারন একটিও ডেটোনেটর ছিল না। আমি খবর পেয়েছিলান, চার পাঁচ দিন আগে ভারতে ট্রেনিং নিয়ে তিন চার শ’ মুক্তিযোদ্ধা প্রচুর বিস্ফোরকসহ ডেটোনেটর নিয়ে আছিম এসেছে। খবর পেয়ে যোগাযোগ বিভাগের আবদুল খালেকের নেতৃত্বে চার জনের একটি দল আছিমে পাঠিয়েছিলাম। আছিম থেকে দু’মাইল পশ্চিমে লহরের বাইদে আগে থেকেই আমাদের একটি স্থায়ী ঘাঁটি ছিল।
আবদুল খালেক লহরের বাইদ পৌঁছলে, সেখানকার কোম্পানী কমান্ডার তাকে পৌঁছে দিয়ে আসে। ভারত থেকে আছিমে আসা মুক্তিযোদ্ধারা আমার প্রতিনিধি হিসাবে তাকে বেশ সমাদরে গ্রহণ করে। খালেকের উপর নির্দেশ ছিল, ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলোচনা করে তাদের সহযোগিতা আদায় করবে। এবং তাদেরও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবার সকল ব্যবস্থা পাকাপাকি করবে। তাদের কাছে অতিরিক্ত ডেটোনেটর থাকলে, তার দু’একটি নিয়ে তাৎক্ষনিক ভাবে সদর দপ্তরে ফিরে আসবে। কিন্তু আছিমের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একদিন কাটিয়ে আবদুল খালেকের ভাবাস্তর ঘটে। তাকে পরের দিন এসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সহযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে পাঠিয়ে দেয়। সহযোদ্ধারা তাকে পরদিন আনতে গেলে সে মুক্তিযোদ্ধাদের বলল, ‘আমার ফিরতে আরো দু’চারদিন সময় লাগবে।”
গোয়েন্দা বিভাগের মাধ্যমে আসল খবর সংগ্রহ করে ফেলেছিলাম ৮ই জুলাই খবর পেলাম, আবদুল খালেক আছিমে গিয়ে ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারে নেতা হয়ে বসেছে। ভারত ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের মন- মানসকিতা ছিল খুবই সহজ ও সরল। আবদুল খালেক তাদের এই সহজ সরল মন-মানসিকতা ও আচরণের মধ্যে নিজের উচ্চাভিলাষ অর্থাৎ নেতা হবার সুযো খুঁজে পায়। সে এই দুর্লভ ও অপ্রত্যাশিত সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না। অন্যদিকে আমার প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের যে শ্রদ্ধা ভালবাসা রয়েছে, তা নষ্ট করতে সে তাদের মন বিষিয়ে তুলতে চেষ্টা করে।
এই রিপোর্ট পেয়ে তাৎক্ষনিকভাবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি দুর্যোগ ঘনীভূত হতে দেয়া উচিত নয়, চক্রান্তটি অংকুরেই বিনাশ করতে হবে। রাঙ্গামাটিতে অবস্থান নেয়া মনিরের দলকে লহরের বাইদের উত্তরে, আবদুল হাকিমের নেতৃত্বে তিনশ জনের একটি দলকে লহরের বাইরে এক মাইল উত্তর পশ্চিমে এবং ৬ নম্বর কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন চারশ মুক্তিযোদ্ধাকে আছিমের সোজাসুজি এক মাইল দক্ষিণে অবস্থান নিতে কড়া নির্দেশ পাঠানো হয়।
৮ই জুলাই যখন কমাণ্ডারদের স্বসৈন্যে আছিমের আশপাশ উপস্থিত হতে নির্দেশ দিলাম তখন দুটি কাজ সেরে নিলামঃ
(১) তিনজন সুচতুর ও সফল গোয়েন্দার মাধ্যমে আছিমের সর্বশেষ খবরের ব্যবস্থা। নির্ভুল তথ্য সংগ্রাহক তিনজন গোয়েন্দা হলো এক. সাগরতীর আবদুস সবুর, বয়স আনুমানিক আঠার। দুই, কাউলজানীর বাচ্চু। বয়স কুড়ি একুশ।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৪৫

তিন, ঘাটাইল থানার রসুলপুর ইউনিয়নের ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর বয়সের আবুল কাশেম। এই তিন সুদক্ষ ও দেশপ্রেমিক গোয়েন্দা কোন সময়ই সংবাদ ও তথ্য সংগ্রহে বিফল হয়নি। এমন কি যে কোন বিপদ ও ঝুঁকি মাথায় করেও কর্তব্যকর্ম সাধনে এগিয়ে গেছে। টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধে এদের দেয়া কোন রিপোর্ট বিন্দুমাত্র ভুল প্রমানিত হয়নি।
(২) আছিমে ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের শুভেচ্ছা বানীসহ খবর পাঠানো হয় যে, ১০ই জুলাই দিনের কোন এক সময় ঘন্টা খানেকের জন্যে তাদের শিবিরে উপস্থিত হব এবং তাদের সাথে কিছু সময় কাটাব।
৮ই জুলাই বাছেত সিদ্দিকীর সেহরাবাড়ীতে কাটিয়ে পরদিন ৯ই জুলাই রাত প্রায় আটটায় লহরের বাইদে এসে উপস্থিত হলাম। লহরের বাইদে এসেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি বিশ্বাস ঘাতক আবদুল খালেকের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহনে আবদুল হাকিম, মনিরুল ইসলাম, গোলাম সরোয়ার, লালটু, ইদ্রিস ও মেজর আফসারের সাথে আলোচনায় বসলাম। ছয় সাত জন কোম্পানী কমাণ্ডারদের সাথে আছিমের পরিস্থিতি ছাড়াও, পূর্বাঞ্চলের আইন শৃঙ্খলা ও জনগণের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়সমূহও আলোচনা করলাম। তবে এই আলোচনায় আছিমের উদ্ভূত পরিস্থিতিই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পেল।
লহরের বাইদে বসে কমাণ্ডারদের সাথে প্রায় ঘন্টা খানেক আলোচনার পর বললাম, “বাইরে গিয়ে আরো ভেবে চিন্তে তোমাদের মতামত জানাও।” কমান্ডাররা ঘরের বাইরে গেলে- ঘরে এলো তিনজন। এরা আর কেউ নয়, অতিশয় দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দাত্রয়-সবুর ও কাশেম, সঠিক সময়োচিত সংবাদ সংগ্রহে যাদের তুলনা নেই। তারা মৌখিকভাবে, খুব নিচু স্বরে আছিমের সর্বশেষ অবস্থা অবহিত করল এবং দুপাতার একটি লিখিত রিপোর্ট দিল।
তিন গোয়েন্দার সিনিয়র বাচ্চু ব্যারিষ্টার একটি জরুরী ও ভীতিপ্রদ খবর সরবরাহের মত করে বলল, “স্যার। আগামীকাল আপনার আছিমে না যাওয়াই শ্রেয়। আবদুল খালেক দল ত্যাগ করে শুধু বিশ্বাসঘাতকতাই করেনি। সে আপনাকে হত্যা করার সুগভীর ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত রয়েছে।”
কঠিন সমস্যা। ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ছোট্ট একটি চালা ঘরে গিয়ে বাসেত সিদ্দিকী, নুরুন্নবী, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, নূরুল ইসলামের সাথে নির্ধারিত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বসলাম। আগামী কালের পরিকল্পনায় প্রচণ্ড ঝুঁকিই শুধু নয়—আমার জীবন নাশের সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এসব কিছুর পরও মত প্রকাশ করলাম, “যে কোন ভাবেই হোক, নির্ধারিত পরিকল্পনা মাফিক আমাদের কর্তব্য সম্পাদনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। অন্যথা শিথিলতা আসবে, যার পরিনাম মোটেই শুভ হবেনা।” সামান্য একটু ঘুরে ফিরে পায়চারী করে আবার সামরিক নেতাদের সাথে আলোচনায় বসলাম। মেজর আবদুল হাকিম মতামত পেশ করে বলল, “যে কোনো ঝুঁকি নিয়ে নির্দিষ্ট কর্মসূচী মত আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত”। কিন্তু অন্য দুজন অভিজ্ঞ কমাণ্ডার, ক্যাপ্টেন গোলাম সারোয়ার ও ক্যাপ্টেন লালটু
পৃষ্ঠা নং ~ ২৪৬

ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করল। লালটুর অভিমত পুরোপুরি মেজর হাকিমের মতই। কিন্তু গোলাম সরোয়ারের অভিমত একেবারেই বিপরীত। এরপর আমার একান্ত প্রিয় ও বিশ্বস্ত সহচর ক্যাপ্টেন ইদ্রিসকে তার মতামত ব্যক্ত করতে বললে সে আমার আছিমে যাওয়ার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি জানাল। নৌবাহিনীর সুদক্ষ ক্যাপ্টেন মনির ও মেজর আফসার উদ্দিনেরও একই মত। সাতজন কমাণ্ডারের পাঁচজন পরদিন আমার আছিমে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করার পক্ষে।
সাতজন কমাণ্ডারের পাঁচজন ঐ পরিকল্পনার বিপক্ষে অভিমত প্রকাশ করল কেন? তারা কী প্রতিপক্ষ বিশ্বাসঘাতক আবদুল খালেকের শক্তি ও দম্ভ দেখে ভীত হয়ে পড়েছিল? তাই ঝুঁকি নিতে চায়নি। অথবা কর্তব্য সম্পাদনে যোগ্যতা ও দক্ষতার অভাব? এর কোনটাই নয়। আসল কথা, অল্প সময়ে তারা আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছিল। সীমাহীন ভালবাসা ও মমত্ববোধের কারণে তারা আমাকে কোন অজানা বিপদ ও ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যেতে দিতে চায়নি। অন্য দুজন কমাণ্ডারেরও শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কমতি ছিল না। তারা বরং বিষয়টিকে অত গুরুত্ব না দিয়ে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে দেখতে চেয়েছিল। পাঁচজন কমাণ্ডার আমার আছিম যাওয়ার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে বলল, “এ মতামত একান্তই ব্যক্তিগত। এরপর আপনি যে নির্দেশ দেবেন, আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে পালন করতে প্রস্তুত রয়েছি।” সকলের কথা শোনার পর বললাম,
— দেখ, মনোবল, অস্ত্রবল, জনবল এবং যুদ্ধ নৈপুন্য-কোন দিক দিয়েই প্রতিপক্ষ আমাদের চাইতে শক্তিশালী নয়। তবে আমি বিপদ দেখছি এক জায়গায়। তা হলো, মুক্তি বাহিনীর নিজেদের মধ্যে কোন সংঘর্ষ হোক, এটা আমি চাইনা। তোমরা যাই বল না কেন, আমি সকল দিক ভেবে চিন্তে দেখেছি। আছিম আমাকে যেতেই হবে। আছিম না গেলে এবং শত্রুকে পরাভূত করতে না পারলে বাইরে যেমন প্রতিক্রিয়া হবে, তেমনি আমাদের নিজেদের মধ্যে এর অশুভ প্রভাব পড়তে বাধ্য। আর এর চুড়ান্ত পরিনতি কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। অতএব কাল দশটার ভেতর আছিম অবশ্য অবশ্যই যাব। তোমাদের উপর আমার নির্দেশ, তোমরা যেমন অনেক জায়গায় দুর্ধর্ষ হানাদারদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে, প্রয়োজনে এবারেও শত্রুকে তেমনি পর্যদুস্ত করবে। উচ্চাভিলাষী চক্রান্তকে ছিন্নভিন্ন করবে। আর এ কাজে আমাদের বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হবেনা। তোমরা আমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। অবস্থা যত প্রতিকূলই হোক না কেন, গুলি এক পক্ষ থেকে চলে চলুক, ওরা চালাতে চায় চালাক। তবে আমাদের পক্ষ থেকে নয়। কোনও গোলাগুলি না ছুঁড়ে, অত্যন্ত কৌশলে ওদের নিয়ন্ত্রণ ও আত্মসমর্পন করাতে চাই। এর পরও যদি আমাদের দুজন প্রিয় সহকর্মীকে প্রাণ দিতে হয়, তবুও তা মেনে নিতে হবে। মনে রাখবে, এই অভিযানে আমার জীবনের প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। তবে জীবনের জন্য আমার কিছুমাত্র পরোয়া নেই। সংগঠনের প্রশ্ন আপাতত আমাদের সকলের বেঁচে থাকা দরকার। আমি আশা করি, আগামীকাল আমরা বিগত দিনের আদর্শবোধ, কঠোর পরিশ্রম ও যুদ্ধ নৈপুন্যের উজ্জ্বল নিদর্শনের পরিচয় দিতে সক্ষম হব। তোমাদের সবাইকে শুভ রাত্রি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী’
পৃষ্ঠা নং ~ ২৪৭

কমান্ডাররা দ্রুত তাদের ঘাঁটিতে চলে গেল এবং সব রকম প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। পরদিন সকাল আটটায় কমাণ্ডার ইদ্রিসের নেতৃত্বে পঁচিশ জনের একটি দল প্রথমে ভারত ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের আছিম ক্যাম্পে গিয়ে তাদের সাথে চা পান করে আধঘন্টার মধ্যে ফিরে এলো। ইদ্রিসের ক্যাম্প ত্যাগের কয়েক মিনিটের মধ্যে মেজর আফসার উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন দু’শ জনের একটি দল শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য তাদের ক্যাম্পে গেল। মেজর আফসার এখানে থাকতে থাকতেই ক্যাপ্টেন লালটু ও ক্যাপ্টেন সরোয়ারের নেতৃত্বে আড়াইশ জন মুক্তিযোদ্ধা আছিম বাজারে গিয়ে উপস্থিত হয়। এর ঠিক কয়েক মিনিট পর উত্তর দিক থেকে আরোও দেড়শ জনের একটি দল নিয়ে ক্যাপ্টেন মনির আছিম বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পৌঁছল। সকাল ন’টায় আমরা আছিম বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সঙ্গীদের মধ্যে রয়েছেন, বাসেত সিদ্দিকী, নুরুন্নবী, নূরুল ইসলাম ও মোয়াজ্জেম হোসেন খান। আর সহযোদ্ধাদের মধ্যে আছে, দুধর্ষ আবদুস সবুর, সাইদুর রহমান, আরিফ আহমেদ দুলাল, আবদুল হালিম, মকবুল হোসেন খোকা, ফেরদৌস আলম রঞ্জু, আবদুল কদ্দুস, আমজাদ, মাসুদ, কাসেম, রফিক ও আরো অনেকে। ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নেতৃত্বাধীন পঞ্চাশ জনের দলটি কোথায়, কিভাবে অবস্থান নেবে, কি ভাবেই বা প্রতিকূল অবস্থায় মোকাবেলা করবে ইত্যাদি রওনা হওয়ার এক ঘন্টা আগে ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছি। রাতে নিজের দলকে অন্ততঃ দশবার মহড়া দিয়ে অবস্থা মোকাবেলার কলাকৌশল সম্পর্কে তালিম দিয়েছি। অবস্থা মোকাবেলার জন্য, গোয়েন্দা বিভাগের তিন জনও সাথে আছে। এ ছাড়া দু’শ মুক্তিযোদ্ধার একটি সুদক্ষ দল নিয়ে কমাণ্ডার আবদুল হাকিম আমার পশ্চাৎ ভাগ রক্ষা করছে।
এল. এম. জি. হাতে সদাসতর্ক দুলাল, হালিম, খোকা ও রঞ্জু। এদের উপর কড়া নির্দেশ, তারা কোন ক্রমেই আমার কাছ থেকে পাঁচ গজের বেশী দূরে না যায়। সবুর ও সাইদুরের কাছে চাইনীজ ও ব্রিটিশ এল. এম. জি। তারাও পাশাপাশি থেকে সর্বত্র ঈগল দৃষ্টি রাখবে। এ ছাড়া সাদা পোষাকে চারজনকে রিভলভার দিয়ে আমার একেবারে গায়ে গায়ে মিশে থাকবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আর কোন সময়েই কোথাও যাওয়া-আসা, অভিযান ও অবস্থান উপলক্ষে আমার জন্য এত কঠোর বিশাল ও নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, প্রয়োজনও পড়েনি।
আছিম বাজার। সকাল নটায় রওনা হয়ে নটা পঁচিশ মিনিটে আছিম বাজারে ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পৌঁছলাম। এই মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিল, ই. পি. আর-এর ল্যাম্প নায়েক সুদর্শন আবদুল মান্নান। আর সহকারী আরেকজন ল্যান্স নায়েক সুদর্শন ও স্বাস্থ্যবান মোজাম্মেল হক। আমি নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে বসলাম। দুই একটা কথাবার্তার পর যথারীতি তারা নিজেদের হাতের তৈরী পরাটা এবং মাংস এনে দিল। ওরাও আমাদের সাথে সামান্য খেল এবং খুবই আন্তরিক আচরন করল। খাবার শেষে দলত্যাগী বিশ্বাস ঘাতক আবদুল খালেক অত্যন্ত রাজকীয় ঢঙে দশজন সশস্ত্র ব্যক্তি পরিবেষ্টিত হয়ে আমার সামনে এল। কুটিল চরিত্রের অকৃতজ্ঞ
পৃষ্ঠা নং ~ ২৪৮

আবদুল খালেক সাধারণ ভদ্রতা করতেও যেন দ্বিধা করছিল। অথচ সাতদিন আগেও এই লোকটি আমার সামনে পোষা কুকুরের মত অতি ভক্তি প্রদর্শন করত। পা চাটা কুকুর শ্রদ্ধা, ভক্তি ও আনুগত্যের নিদর্শন হিসাবে মিনিটে শতবার ‘স্যার স্যার’ করত। সময় ও সুযোগ পেলেই আমাকে খুশী করার ও সন্তুষ্ট রাখার জন্য মাথা নীচু করে হাত কচলাতে কচলাতে চাটুকারের মতো বিভিন্ন প্রশংসা ও তেল মর্দনের প্রয়াস পেত। অথচ কি আশ্চর্য আছিম বাজারে তার সে কি উদ্ধত ও দাম্ভিক আচরন। আমন্ত্রিত অতিথিকে সামরিক রীতি অনুসারে অভিবাদন তো নয়ই, আচ্ছালামু আলায়কুম পর্যন্ত বলল না।
বিশ্বাসঘাতক আবদুল খালেক সামনে এসেই জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের খওয়া দাওয়ার কোন কষ্ট হয়নি তো?”
— যেন কোন সম্রাট তার মোসাফের খানার মোসাফেরদের খাওয়া দাওয়ার খোঁজ খবর করছে।
— কেমন আছ।
— ভালই আছি। আমিইতো এদের নেতৃত্ব দিচ্ছি।
নেতৃত্ব সংক্রান্ত কোন প্রশ্ন না করলেও সে অযাচিতভাবে বলল, ‘আমিই তো এদের নেতৃত্ব দিচ্ছি।”
আবদুল খালেকের অযাচিত কথা শুনে বহুল প্রচলিত একটি গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। পথ দিয়ে এক পথিক হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ অন্য এক পথিকের সাথে দেখা। প্রথম পথিক দ্বিতীয় পথিককে জিজ্ঞেস করলেন,
— ভাই যাচ্ছেন কোথায়?
দ্বিতীয় পথিক ছিল চালাক ও কূটিল চরিত্রের লোক। নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির ও সম্মান আদায়ের জন্য বলল,
— আমি হাজার টাকা বেতনে চাকরী করি।
— কোথায় চাকরী করেন ভাই?
— আমার শ্বশুর মস্ত বড় ধনী। তার লক্ষ টাকার কারবার। প্রশ্ন এক, অথচ উত্তর অপ্রাসঙ্গিক। নিজের পরিচিতি প্রকাশের এ এক উগ্র বাসনা। আবদুল খালেকের অবস্থাটাও হয়েছিল ঠিক এই রকম।
আবদুল খালেকের অযাচিত ও বিরক্তিকর জবাব শুনে বললাম, “আমি জানি তুমি এদের নেতৃত্ব করছ। এজন্য আমি গর্বিত। কিন্তু তোমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তা পালন করলে আরো বেশী গর্বিত হতাম। তবে তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসিনি। আমি এখানে এসেছি, প্রথমতঃ মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের দেখতে ও তাদের কথা শুনতে। দ্বিতীয়তঃ তাদেরকে সহযোগিতা করতে এবং প্রয়োজনবোধে সহযোগিতা নিতে। আমাদের প্রচুর বিস্ফোরক থাকা সত্ত্বেও, কয়েকটি ডেটোনেটরের অভাবে তা কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। ডেটোনেটর সংগ্রহ
পৃষ্ঠা নং ~ ২৪৯

করার জন্য তোমাকে এদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এ দায়িত্ব পালন করলে আমার মত আর কেউ খুশী ও আনন্দিত হতো না।”
খালেক আমার সামনে আসার আগে ঐ দলের ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপের কয়েকজন সদস্য উদ্বৃত্ত ডেটোনেটরের কথা অত্যন্ত আনন্দের সাথে আমাকে জানিয়েছিল। কিন্তু আমাদের কোন ডেটোনেটর নেই, খালেকের মুখে এ অস্বীকৃতি শোনার পর অন্যান্য সদস্যরাও আর ডেটোনেটরের ব্যাপারে কোন কথা বলল না।
চা-পান শেষে প্রত্যেকের সাথে করমর্দন ও আলিঙ্গন করলাম। তারপর ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে এক বক্তৃতা করলাম। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যথেষ্ট অনুকূল সাড়া জাগল, বার বার হাততালি ও মুহুর্মুহু শ্লোগান তুলে তারা আমার নেতৃত্বের প্রতি হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা নিবেদন করল। আমাদের ও ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে উঠেছিল, বক্তব্যের আন্তরিকতায় ধুলিসাৎ হয়ে গেল। আড়াইশ মুক্তিযোদ্ধা আমার নেতৃত্বে কাজ করতে উন্মুখ হয়ে উঠল।
আছিম বাজারের আরো দু’একটি ঘটনা তুলে ধরা দরকার। আমি যখন আছিম বাজারে রওনা হই, তখন ভারত থেকে আসা চারশ’ মুক্তিযোদ্ধা আছিম বাজারে ঘাঁটি গেড়েছিল। তাদের অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৩০৩ রাইফেল, স্টেনগান ও এল. এম. জি.। অন্যদিকে ১০ই জুলাই ন’টার মধ্যে প্রায় ছয়শ’ মুক্তিযোদ্ধা আছিম বাজারে উপস্থিত হয় এবং নবাগতদের সাথে অত্যন্ত ভদ্রোচিত ও সম্মানজনক আচরণ করে। এই ছয়শ’ মুক্তিযোদ্ধা আধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত এবং তারা যে কোন সময় যে কোন নিয়মিত বাহিনীর মোকাবেলা করতে পারে ও করেছে। এদের সংখ্যা, অস্ত্র শস্ত্র প্রশিক্ষণ ও ভদ্রোচিত ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণে আছিম বাজারে নবাগত মুক্তিযোদ্ধারা খুবই মুগ্ধ ও উৎসাহিত বোধ করে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নবাগত মুক্তিযোদ্ধারা চিন্তা চেতনায় খাঁটি দেশপ্রেমিক, স্বভাবে সরল-সহজ, আচরণে নম্র ও ভদ্র এবং যোদ্ধা হিসাবে নির্ভীক ও উৎসর্গিত প্রাণ।
ছয়শ’ সুসজ্জিত মুক্তিযোদ্ধা আছিম বাজার ও তার চারপাশে উপস্থিত হলে সামরিক বেসামরিক সাজে আরও তিনশ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সকাল নটা পঁচিশ মিনিটে আছিম বাজারে নিজে হাজির হলাম। প্রথমে ছয়শ’ পরে তিনশ উপরন্তু আমাকে সশরীরে দেখে দাম্ভিক উচ্চাভিলাষী আবদুল খালেক কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। যাদের সহায়তায় সে একটি সুগভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছিল-যে জালে ফেলে আমাকে হত্যা করে নেতৃত্ব কেড়ে নিতে চেয়েছিল, তারাও অবস্থা দেখে এবং পরিণামের কথা চিন্তা করে একেবারে চুপসে গেল।
আবদুল খালেক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করল কেন? বা কোন বিশেষ পরিস্থিতি তাকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করেছিল? যতদিন আবদুল খালেক আমার সাথে কাজ করেছে ততদিন সে দেখেছে, আমি কোথাও কুড়ি-পঁচিশ জনের বেশী সদস্য নিয়ে যাই না। কোথাও যাতায়াতে সাথীদের সংখ্যার স্বল্পতাই বোধ করি আবদুল খালেকের মনে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার
পৃষ্ঠা নং ~ ২৫০

মানসিকতা জাগ্রত করেছিল। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টি করে বা অন্য কোন কূট কৌশলে নেতৃত্বের উলঙ্গ উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করা যাবে না- এটা ভেবেই আমাকে পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে পথের কাঁটা দূর করতে সে এক ভীষণ ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। কিন্তু ঐদিন হাজার মুক্তিযোদ্ধার সমাবেশ দেখে আবদুল খালেক একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়ে। নেতৃত্বের গুণ যে চক্রান্ত নয় বরং অধীনস্থদের আস্থা ভালবাসা এবং নিজের চরিত্রে নিহিত দৃঢ়তা, ষড়যন্ত্রকারী খালেক এটা আগে বুঝতে পারেনি।
আবদুল খালেক নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে। চতুর ও ধুরন্ধর খালেক উপরে উপরে তার দাস্তিক ভাব বজায় রাখতে কার্পণ্য করেনি। সে ভয় পায়নি, ঘাবড়ে যায়নি, পূর্বের মতই সুস্থ ও স্বাভাবিক আছে, এমন একটা কৃত্রিম ভাব দেখাবার চেষ্টা করে। আবদুল খালেকের এই বেসামাল ভাব কাটিয়ে উঠতে ও স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে যে তাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করে তার নাম খন্দকার জহুরুল হক।
কে এই জহুরুল হক। তার বয়স সতের আঠারর বেশী নয়। বাড়ী টাংগাইলেই এবং আমার প্রতিবেশী। তাদের তিন ভাইয়ের বড় আজিজুল হক, মেজ ভাই সাইফুল হক। জহুরুল হক তৃতীয়। আজিজুল হক আমার পরম বন্ধু ছিল। আজিজুল ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়ে চলে গেলে তারই ছোটভাই সাইফুল হকের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। বয়সে সমান হলেও সাইফুল আমার চাইতে দু’ক্লাস উপরে পড়াশুনা করত। তবে এ ব্যবধান আমাদের বন্ধুত্বের পথে কোন বাধা সৃষ্টি না করে বরং উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল। সেদিনের সেই ঘনিষ্ঠতা ও ভ্রাতৃত্ত্ব আজও বহাল আছে। জহুরুল হককে আমি ছোট ভাইয়ের মতই স্নেহ করতাম। জহুরুল হক কেন ঐ সময় খালেকের সাথে হাত মিলাল, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। সম্ভবতঃ খালেকের মত তার মধ্যেও নেতা হবার খায়েশ জেগেছিল। ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের মনে আলাদা অস্তিত্ব বজায় রাখার ও বৈরী মানসিকতা জাগিয়ে তোলার সিংহভাগ কৃতিত্বের দাবীদার এই দু হতভাগ্য কুচক্রী।
অবশ্য এর দুমাস পর ভারত থেকে এক নির্দেশে আছিম বাজারের বর্ণিত মুক্তিযোদ্ধাদের আমার নেতৃত্বে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে মান্নান বকুল ও মোজাম্মেল সবাই ছিল এবং এরা খুব সুন্দর কাজ করেছে।
সামান্য একটু পিছনে তাকাচ্ছি। আবদুল খালেক আমার সাথে উদ্ধত আচরণ করেছিল এটা ঠিক। তবে তার এই উদ্ধত ও দাম্ভিক ব্যবহার তার তথাকথিত নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। খালেকের আচরণে তারা মনে মনে খুবই ক্ষুদ্ধ হয়েছিল। ফলে আমার নেতৃত্বের প্রতি তারা শুধু আস্থাশীল হয়ে উঠেনি একেবারে দলের অন্তর্ভুক্তিতে ঝুঁকে পড়েছিল। আছিম বাজার থেকে ফিরে আসার সময় ঐ দলের জনৈক মুক্তিযোদ্ধা চলতে চলতে আমার হাতে এক ফাঁকে চুপ করে একটি ম্যাচ গুঁজে দেয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে অন্য একজন সহযোদ্ধার হাতে ম্যাচটি তুলে দিই। এবং অতি সাবধানে তা একটি কাপড়ের ব্যাগে পুরে বাঁশের আগায় ঝুলিয়ে একটু
পৃষ্ঠা নং ~ ২৫১

দূরে রেখে বহন করতে বলি। নির্দিষ্ট বাড়ীতে এসে ম্যাচটি খুব সাবধানে খুলে দেখা গেল তাতে ডেটোনেটর রয়েছে।
আমাদের সাথে ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের বসে খাবার খাওয়া ও আন্তরিক কুশলাদি বিনিময়, আমার বক্তৃতায় পুনঃ পুনঃ শ্লোগান, হাততালি, উচ্ছ্বাস প্রকাশ ও অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে বিদায় জানানোর ঘটনার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে তাদের গভীর শ্রদ্ধা ও আনুগত্য। ব্যতিক্রম শুধু আবদুল খালেক ও জহুরুল হক।
জহুরুল হকের আরও একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ৩০শে সেপ্টেম্বর। জহুরুল হক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহমুদের হাতে বন্দী হয়। বন্দী অবস্থায় সে আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে চিঠি পাঠায়। পত্র পেয়ে ভারতে আমাদের প্রধান প্রতিনিধি এনায়েত করিমের মাধ্যমে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহমুদকে এক পত্র লিখি,
“অবিলম্বে জহুরুল হককে মুক্তি দিয়ে টাংগাইল পাঠিয়ে দেবার সুব্যবস্থা করলে বাধিত হবো।”
জহুরুল হকের বিষয়টি জানিয়ে এফ. এফ. এর দায়িত্ব প্রাপ্ত ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার সান সিং (বাবাজী) এবং তদানীন্তন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জিয়াউর রহমানকে পৃথকভাবে দু’টি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। আমি তাদের লিখেছিলামঃ
“খন্দকার জহুরুল হককে আমি একেবারে ছোটবেলা থেকে চিনি ও জানি। তার মা-বাবা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং করেন। তাই তার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রমূলক আচরন হলে, তা আমার পক্ষে নীরবে সহ্য করা সম্ভব নয়। সত্যিকার ভাবে অন্যায় কিছু করে থাকলে অবশ্য আমার বলার কিছু নেই। আশা করি আপনি আমার পত্রের মর্যাদা দেবেন।”
সত্যিই তারা পত্রের বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন। ৬ই অক্টোবর জহুরুল হককে বন্দীদশা থেকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং এনায়েত করিম তাকে টাংগাইল পাঠিয়ে দেয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করেন। ২৭-২৮শে অক্টোবর লাউহাটিতে আমার সাথে জহুরুল হকের দেখা হয়। এবার তার সম্পূর্ণ আলাদা চেহারা। সে একটি পরিবর্তিত নতুন মানুষ।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। আছিম থেকে লহরের বাইদ। আছিমের পশ্চিমে সাথীদের নিয়ে খাবার খেয়ে পনের মিনিট পরে লহরের বাইদে এসে হাজির হলাম। আছিম সফর নির্বিঘ্নে ও নির্ঝঞ্চাটে হওয়ায় সহকর্মীরা অত্যন্ত আনন্দিত ও উল্লসিত। জনগণও প্রায় প্রচুর অনুপ্রেরণা ও সাহস। ফেরার পথে দুবার প্রায় তিন-চার হাজার লোকের সামনে বক্তৃতা করতে হলো। সকলেই একবার দেখতে চান, কথা শুনতে চান। লহরের বাইদের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিকাল চারটায় সাগরদীঘিতে এলাম।

সাগরদীঘির জনসভা
সাগরদীঘিতেও এক জনসভায় বক্তৃতা দিলাম। দুপুর বারটায় এই জনসভার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। জনসমাগমও হয়েছে প্রচুর। সভার শুরুতে গোলাম সরোয়ারের নেতৃত্বে একটি সুসজ্জিত দল সাগরদীঘি মাঠে আমাকে
পৃষ্ঠা নং ~ ২৫২

সামরিক অভিনন্দন জানাল। সভায় নুরুন্নবী, মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও বাসেত সিদ্দিকী স্থানীয় জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন। সর্বশেষে আমি বক্তৃতা করতে দাড়ালাম :
“এই মুক্তি সংগ্রাম সমস্ত জাতির জীবন মরনের সংগ্রাম। এই জনযুদ্ধে জয়লাভ আমাদের করতেই হবে। নচেৎ নর পশুরা বাঙালী জাতির চিহ্ন পর্যন্ত রাখবে না। আজকের এই যুদ্ধ মুক্তি বাহিনীর একার যুদ্ধ নয়। এর দায়দায়িত্ব ও ভালমন্দ দেশের প্রতিটি মানুষের। আপনাদের ভাইবোন, মা-বাপ কোন না কোন ভাবে এই মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছেন। বাঁচার জন্য, অধিকার আদায়ের দাবীতে আমাদের এই সংগ্রাম। এটা ন্যায় ও সত্যের সংগ্রাম। আমাদের ঈমান যদি ঠিক থাকে, সংকল্পে যদি অটল থাকতে পারি, তাহলে জয় আমাদের সুনিশ্চিত।”
বক্তৃতার উপসংহারে শপথ নিয়ে বললাম,
“মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের ওয়াদা দিতে পারি, একজন মুক্তিযোদ্ধাও বেঁচে থাকতে হানাদার পশুদের বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়া হবে না। আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব বজায় রাখার ও মহান নেতা বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনার জন্য জীবন-যৌবন তুচ্ছ করে, আমরণ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আপনাদের কাছে বিশেষ কিছু আশা করি না। শুধু এইটুকু প্রার্থনা করি, আপনারা আমাদের ভুলত্রুটি ও দুর্বলতা সাহসের সাথে ধরিয়ে দিন। আশীর্বাদ করুন, আমরা যেন আপনাদের মুখ রক্ষা করতে পারি ও দেশকে শত্রু মুক্ত করতে পারি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী।

বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই সভাস্থলে যেন শপথের বজ্র-নিনাদ উঠল। প্রায় দশ হাজার লোক ধনি-প্রতিধ্বনিত হতে থাকল, ‘দেশের জন্য আমরা জান কোরবান করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।’
‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী, জয় কাদেরিয়া বাহিনী।’

মুক্তিযোদ্ধা বাসেত সিদ্দিকী
সাগরদীঘি সভা শেষে অসংখ্য লোকের সাথে অল্প সময়ের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে কথাবার্তা বললাম। চেয়ারম্যান চানু ভুইঞার সাথে কয়েকটা জরুরী বিষয়ে কথাবার্তা সেরে নিলাম। ইউনিয়নের চাঁদা আদায় করে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়ার দায়িত্ব মুক্তিবাহিনী চানু ভূইঞার উপর অর্পণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত চানু ভূইঞা নিঃসন্দেহে একজন ধুরন্ধর প্রকৃতির লোক ছিলেন। তবে এটা সত্য যে, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ধুর্তামী করেননি বা করতে পারেননি। চানু ভুইঞার সাথে কথা শেষ করে সাগরদীঘি ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কমাণ্ডার রুপা সিকদারের দুই ছেলে মোকদম ও জালাল সিকদারের সাথে এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা নিয়ে সামান্য কিছু আলাপ-আলোচনা করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম। সাগরদীঘির সকল প্রয়োজনীয় কাজ শেষ। পরবর্তী গন্তব্যস্থল সেহরাবাড়ী। ধলাপাড়া হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক, গণপরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকী দিন পনের আগে থেকেই আমাকে বার বার
পৃষ্ঠা নং ~ ২৫৩

বলছিলেন, ‘আমি একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ভর্তি হতে চাই। এরজন্য যে যে শর্ত পূরণের প্রয়োজন, আমি তার সব কিছু পুরণে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সম্পূর্ণ যোগ্য, এই সার্টিফিকেট আপনার কাছ থেকে পেতে চাই।’ আগের দিন চারটায় রওনা হয়ে পনের মাইল হেঁটে সন্ধা সাড়ে সাতটায় লহরের বাইদ পৌঁছেও আবদুল বাসেত সিদ্দিকী এই কথা বলেছিলেন, এই যে এতটা পথ স্বচ্ছন্দে হেঁটে এলাম, আমি এই জন্য নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার কিছুটা যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছি।
তাই নিজের বাড়ীতে ফেরার সময় আবার তিনিই উদ্যোগী ও অগ্রণী ভূমিকা নিলেন। কে কত তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারে, এই প্রতিযোগিতার সূত্রপাতও তিনি করলেন। পঞ্চাশ বছর বয়সী গণ-পরিষদ সদস্যের উৎসাহে ও অনুপ্রেরণায় আমরা সবাই হাঁটার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলাম। সাগরদীঘি থেকে বিকাল পাঁচটা ত্রিশ মিনিটে সেহড়াবাড়ী রওনা হয়ে পঞ্চান্ন মিনিটে নয় মাইল রাস্তা অতিক্রম করলাম। এই পথ অতিক্রম শেষে দেখা গেল, বাসেত সিদ্দিকী সাহেবই প্রথম তার বাড়ীতে প্রবেশ করলেন। বাড়ীতে প্রবেশ করে মূহুর্তের মধ্যে আবার ফিরে এসে বললেন, “দেখুন স্যার, আমি নিশ্চয়ই এখন মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। এই নয় মাইল নির্দিষ্ট সময়ে আমি দলের সাথে অতিক্রম করেছি এমনকি আমি প্রথম হয়েছি।” সত্যিই তিনি প্রথম হয়েছেন। আবদুল বাসেত সিদ্দিকীর কথা শুনে বললাম, “হ্যাঁ স্যার, আপনি এই মূহুর্ত থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অনুমোদিত হলেন।”
মহেন্দ্রক্ষণে মুক্তিবাহিনীতে এক অমূল্য উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সংযোজন হলো। আবদুল বাসেত সিদ্দিকী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সফলভাবে পালন করে মুক্তিবাহিনীর উত্তরোত্তর গতি ও শ্রীবৃদ্ধি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকী যেমন আমাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে এসেছেন, ঠিক তেমনি আমিও তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করেছি। পরেও উভয়ের দিক থেকে এই সম্বোধন বহাল রয়েছে।

নীতিমালা প্রণয়ন
আছিমের ঘটনা মোকাবেলা শেষে সব মিলে আশি-পঁচাশি মাইল পায়ে হেঁটে ১১ই জুলাই বেলা এগার-সাড়ে এগারটায় আবার সদর দপ্তরে এলাম। গণ-পরিষদ সদস্য জনাব আবদুল বাসেত সিদ্দিকী, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, নুরুল ইসলাম ও নুরুন্নবী এঁরা চার জনই সদর দপ্তরে এই প্রথম এলেন। গভীর জঙ্গলে এই চরম অবস্থাতেও কয়েকটি ভাঙা ঘরে অত সুন্দর সাজানো-গোছানো দপ্তর দেখে তারা বিস্মিত ও অভিভূত হন। দুপুরের খাবার পর তাদের বিস্ময় আরও বাড়তে থাকে। মহানন্দপুর এসে তারা ভাঙা বাড়ীগুলোতে সাজানো গোছানো দপ্তর দেখেছেন, কাজ দেখেননি। দুপুরের পর তাদের কিছু কাজকর্ম দেখারও সুযোগ হলো। কাজ দেখে তাঁরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এ তো সাধারন কার্যালয় নয়, এখানে যেন পাল্লা দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে কাজ চলে। কাজ করার পদ্ধতিও অভিনব। কোন কাজ ফেলে রাখার অবকাশ নেই। সব কাজ অবশ্যই সুসম্পন্ন করে
রাখতে হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৫৪

দুপুরের পর সদর দপ্তরে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সারতে নির্দিষ্ট টেবিলে বসলাম। মহানন্দপুরে দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আমার ব্যবহারের জন্য একটি ছোট চেয়ার ও টেবিলের ব্যবস্থা হয়েছিল, যা প্রায় সময়ই খালি পড়ে থাকত। তবে মহানন্দপুর সদর দফতর স্থাপিত হবার পর প্রতিমাসে অন্ততঃ চার-পাঁচবার ঐ চেয়ারে বসে নিয়মিত কাজ করেছি।
জুলাইয়ের শেষ থেকে আনোয়ার-উল-আলম শহীদ সদর দপ্তরের প্রধান কর্তা হিসাবে দায়িত্ব পেলেন। তার ক্ষমতাও বেড়ে গেল অপরিসীম। এই অপরিসীম ক্ষমতা প্রয়োগে তিনি কখনও অপব্যবহার করেছেন, এরকম অভিযোগ মুক্তিবাহিনীর অত্যন্ত সফল গোয়েন্দা বিভাগ একবারের জন্যও আনতে পারে নি। শহীদ সাহেবের ক্ষমতা প্রথম অবস্থায় তেমন কিছু ছিলনা। দপ্তরে বসে তার কাজই ছিল শুধু অন্যদের কাজ কর্মে সামান্য খোঁজ-খবর নেয়া। মুক্তিযোদ্ধা ও স্বেচ্ছা সেবকদের তালিকা প্রস্তুত করন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের চাহিদা পত্র প্রণয়ন। সাদা কথায়, ক্ষমতাহীন দায়িত্ববান একজন কেরানী। এ রকম হওয়ার কারণও ছিল। শহীদ সাহেব মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় দুই মাস পর আমাদের সাথে মিলিত হন বা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। এই দুই মাসে টাংগাইল মুক্তিবাহিনীতে প্রায় তিন হাজারের বেশী মুক্তিযোদ্ধার সমাবেশ ঘটেছে। এমন অবস্থায় শহীদ সাহেব যখন প্রথম আসেন, তখন তিনি কে? কোথা থেকে এসেছেন? তিনি কি ধরনের কাজ করতে পারেন, এই ধরনের অনেক কথাবার্তা সহযোদ্ধাদের মধ্যে হয়। এটা হওয়ারও একটা কারণ ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের শতকরা পঁচানব্বই জনই শহীদ সাহেবকে জানে না। এজন্য আমি প্রথম অবস্থায় খুবই অস্বস্তিতে পড়েছিলাম। কারণ শহীদ সাহেব ছাত্র রাজনীতিতে আমার চেয়ে প্রবীণ। শুধু প্রবীণই নন, শহীদ সাহেবের প্রতি আমার গভীর ও অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। অথচ আমার পক্ষে ঐ সময় তাকে মুক্তিবাহিনীর নেতা বানানো সম্ভব ছিলনা, আর তিনি সম্ভবত হতেও চান নি। কারণ অত কষ্টসাধ্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তার পক্ষে মোটেই সম্ভবপর নয়। এমন অবস্থায় কি করা যায় এমন প্রশ্নের সামনে শুধুমাত্র মানিয়ে নেয়ার তাগিদে তাকে প্রথমে দপ্তরে বসিয়ে পূর্বোল্লিখিত কাজগুলো দেয়া হয়েছিল।
২৯শে জুন থেকে ১১ই জুলাই পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কাগজে কলমে তাকে দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল অনেক। কিন্তু কিছুই কার্যকরী করতে বলা হয়নি। শুধু ভয় ছিল যদি কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া হয়। ইতিমধ্যে যে হয়নি তাও নয়। ৬ই জুন, ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমানের কোম্পানীর সদস্য তালিকা সুন্দর ও সঠিকভাবে প্রস্তুত করার সময় তালিকায় কিছু ভুল ত্রুটি ধরা পড়লে, তা সংশোধন করে দিতে তিনি অনুরোধ করেছিলেন। ক্যাপ্টেন সাহেব কিন্তু শহীদ সাহেবের অনুরোধের এক রত্তিও গুরুত্ব দেননি। তাঁর দেয়া লিষ্টে ভুল ধরা পড়েছে, এই কথায় তিনি যার পর নাই বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হন। শহীদ সাহেবের টেবিলে তাঁর হাতের ছোট বেতটি বারবার ঠুকেঠুকে অত্যন্ত উদ্ধতভাবে দেমাক দেখিয়ে বলে গিয়েছিলেন, “আমি যে তালিকা দিয়েছি, তাই-ই ঠিক। এই ব্যাপারে একমাত্র সর্বাধিনায়ক জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আপনি জিজ্ঞেস করার কে? আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন, এমন কোন আদেশ
পৃষ্ঠা নং ~ ২৫৫

আমাদের কাছে নেই৷ তাই সাবধান। আপনি আর ভবিষ্যতে এই সমস্ত ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে না। কোম্পানী কমান্ডাররা যাই-ই বলে, মাথা নীচু করে আনন্দের সাথে তা পালন করার চেষ্টা করুন।”
আর একটি ব্যাপারও দেখবার মত। ২৯শে জুন থেকে ১১ই জুলাই এই বার-তের দিন আমার অনুপস্থিতিতে যে সমস্ত কোম্পানী কমাণ্ডার মহানন্দপুর সদর দপ্তরে এসেছে, তারা প্রত্যেকে শহীদ সাহেবের চেয়ারে বসেছে। কোন কোম্পানী কমান্ডার এলেই শহীদ সাহেব তার চেয়ার ছেড়ে দিয়ে কোম্পানী কমাণ্ডারকে বসতে আহ্বান করেছেন। কোম্পানী কমাণ্ডাররা শহীদ সাহেবের চেয়ারে বসে তাদের কথাবার্তা বলেছে। অন্যদিকে শহীদ সাহেব বা দপ্তরের অন্যান্য সহকর্মীরা দাঁড়িয়ে অথবা অন্য কোন চেয়ারে বসে কোম্পানী কমান্ডারের কথাবার্তা শুনেছে।
১১ই জুলাই, দুপুরে সদর দপ্তরে বসে প্রথমেই এই সমস্ত ত্রুটিগুলো দূর করতে মনযোগী হলাম। চেয়ারে বসার ব্যাপারটা আগেই আমার চোখে পড়েছিল। কাজ করতে করতে মাঝে মধ্যে কোন ব্যাপার জিজ্ঞেস করতে শহীদ সাহেবের টেবিলে গেলে তিনি তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠে তো দাঁড়াতেনই, এমন কি চেয়ার ছেড়ে দূরে সরে গিয়ে আমাকে বসতে বলতেন। কিন্তু আমি একবারও শহীদ সাহেবের চেয়ারে বসিনি। সামনে রাখা চেয়ারে বসে অথবা দাঁড়িয়েই কথা শেষ করেছি। তাই এই ব্যাপারে একটি লিখিত আদেশ জারীর কথা চার পাঁচ দিন আগে থেকেই ভাবছিলাম। দুপুরে দপ্তরে বসেই ‘সদর দপ্তর ও আঞ্চলিক দপ্তরগুলোর পরিচালনার নিয়মবিধি’ তৈরীর কাজে হাত দিলাম। আমার পরামর্শে কয়েকজন মিলে আধঘন্টা খেটে সুন্দর একটি নিয়মবিধি তৈরী করে ফেলেন। এই নিয়মবিধি তৈরীতে অবদান রাখেন, হামিদুল হক, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, দাউদ খান, খোরশেদ আলম আর. ও, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, বাসেত সিদ্দিকী, ফারুক আহমেদ ও আনোয়ার-উল-আলম শহীদ। অধ্যাপক রফিক আজাদ, অধ্যাপক মাহবুব সাদিক ও সোহরাব আলী খান আরজু তখন সদর দপ্তরেই ছিলেন। তবে তাঁরা সেদিন তেমন ভূমিকা নিতে পারেননি বা নেননি। কারণ তাঁরা তখনও পূর্ণ স্বস্তিবোধ করছিলেন না। কি বলতে কি হয়, কি বলা উচিত, এই ভাবনা-চিন্তা তাদের হয়তো দূর হয়ে সারেনি। আর এটা হওয়াই স্বাভাবিক৷ ঐ ধরনের অভাবনীয় ঘটনার সাথে কেউ পরিচিত ছিলেন না। তাঁদের মুক্তিবাহিনীতে আসার বেশী দিনের নয়, কারো পাঁচ-ছয় দিন আবার কারো বা বার-তের দিন।
দপ্তর পরিচালনার নীতি মালা—
(১) দপ্তরে কার্যরত কাউকে তার চেয়ার অন্য কোন উর্ধ্বতন বা অধস্তন সদস্যের জন্য ছেড়ে দিতে হবে না।
(২) কোন কাজে জটিলতা দেখা দিলে, সেই জটিলতা দূর করতে দপ্তরে কর্মরত উর্ধ্বতন হন আর অধস্তনই হন, কেউ নিজের টেবিলের কাজের গড়মিলের জন্য অন্যকে ডেকে আনতে পারবেন না। ত্রুটি দেখা দিলে নিজে উঠে গিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করে উদ্ভূত ত্রুটি দূর করবেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৫৬

(৩) বাইরের কোন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি দেখা করতে নির্দিষ্ট সময়ে এলে দপ্তরের নিজের চেয়ারে বসে তার সঙ্গে কথা বলা চলবে না। সাক্ষাৎ প্রার্থীর সাথে একই রকম আসনে পাশাপাশি অথবা সামনা সামনি বসে কথাবার্তা বলতে হবে। কোন সদস্য অথবা কমাণ্ডার দপ্তরে এসে কর্মরত সদস্যের সাথে উচ্চস্বরে হুমকি দিয়ে কথা বলতে পারবে না। শত ভুল-ত্রুটি, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কীত যে কোন বিষয়ে শান্ত মেজাজে আলাপ-আলোচনা করতে হবে।
(৪) সদর দপ্তরের নির্দিষ্ট আঙিনার ভেতরে বাইরে থেকে আসা কোন মুক্তিযোদ্ধা কোনক্রমেই অস্ত্র সাথে রাখতে পারবে না। কমাণ্ডাররা শুধুমাত্র তাদের নামে বরাদ্দকৃত ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র হাতিয়ার পিস্তল, রিভলবার সাথে রাখতে পারবেন।
(৫) সর্বাধিনায়কের সদর দপ্তরে অবস্থানকালীন সময়ে সদর দপ্তরের নিরাপত্তার দায়িত্বভার তার দেহরক্ষী বাহিনীর উপর ন্যস্ত থাকবে।
আনোয়ার-উল-আলম শহীদকে লিখিত নির্দিষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হলো-
(১) জুলাইয়ের ১১ তারিখ থেকে পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আনোয়ার-উল-আলম শহীদ সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বেচ্ছা সেবক বাহিনীর সুষ্ঠ তালিকা প্রস্তুতে যে কোন কোম্পানী কমাণ্ডার, স্বেচ্ছা সেবক কমাণ্ডার অথবা যে কোন ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাইতে পারবেন। তার সাহায্য চাওয়াই নির্দেশ বলে বিবেচিত হবে। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ তালিকার শুদ্ধতা সার্টিফিকেট না দিলে তালিকা বৈধ বলে বিবেচিত হবে না।
(২) তিনি মুক্তিবাহিনীর কোম্পানীগুলোর ব্যয় সংক্রান্ত হিসাব জমা নেবেন। হিসাবের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। কোম্পানী কমাণ্ডার যে হিসাব দেবে তাই তিনি গ্রহণ করে সুন্দর ভাবে সংরক্ষণ করবেন।
(৩) তিনি মুক্তিবাহিনীর কোম্পানীগুলোর ব্যয় সংক্রান্ত অর্থ মঞ্জুর করবেন। তবে কোম্পানী কমাণ্ডার যে অর্থই দাবী করবেন তাই তিনি বিনা প্রশ্নে মঞ্জুর করতে বাধ্য থাকবেন।
(৪) জনগণের যে কোন অভাব-অভিযোগের দরখাস্ত তিনি গ্রহন করবেন এবং ইচ্ছা করলে কাউকে জিজ্ঞোস না করেও একটি দরখাস্তে পাঁচশত টাকা পর্যন্ত অর্থ বরাদ্দ করতে পারবেন। জনগণের আবেদনের ভিত্তিতে বড় রকমের কিছু করতে হলে হামিদুল হক, খোরশেদ আলম আর. ও., ফারুক আহমেদ, গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকী, সৈয়দ নুরু, নুরুন্নবী এঁদের মধ্যে যে কোন তিন জনের মত নিয়ে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থ সাহায্য মঞ্জুর করতে পারবেন।
(৫) বেসামরিক প্রধান হিসাবে তিনি কোন ক্রমেই পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত একদিনে পঁচিশ হাজার টাকার উর্ধে অর্থ সাহায্য মঞ্জুর করতে পারবেন না।
(৬) বেসামরিক প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে আনোয়ার- উল-আলম শহীদের যে কোন আর্থিক চাহিদা অর্থ দপ্তর পূরণ করতে বাধ্য থাকবে।
(৭) দপ্তর বন্টনের সময় বেসামরিক প্রশাসক হিসাবে তার উপর সকল দপ্তরের সমন্বয়ের
পৃষ্ঠা নং ~ ২৫৭

যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, জুলাইয়ের ১১ তারিখের এই আদেশে সেই দায়িত্ব সক্রিয়ভাবে পালনের পূর্ণ অধিকার তাকে প্রদান করা হলো।
নুরুন্নবীকে যোগাযোগ দপ্তরের এবং গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকীকে জনসংযোগ বিভাগের প্রধান করা হলো।”
দপ্তর পরিচালনা বিধি এবং বাসেত সিদ্দিকী ও নুরুন্নবীকে নতুন দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বকেয়া কাজ সারতে লেগে গেলাম। দু’শ, নানা ধরনের আবেদন। এতে আছে অর্থ সাহায্য, জমি নিয়ে বিবাদ ও নানা ধরনের স্থানীয় সমস্যার উল্লেখ। এ ছাড়া প্রায় ছয়শ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ও তাদের সম্পর্কে সমীক্ষা। ছয় হাজার নতুন স্বেচ্ছা সেবকদের তালিকাও অনুমোদনের জন্য রাখা ছিল। এ ছাড়াও গত ছয়-সাত দিনের তিন লক্ষ টাকা খরচের মঞ্জুরী এবং অর্থ আয়-ব্যয় অনুমোদন।

স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কাঠামো
স্বেচ্ছা সেবক বাহিনীর একটি কাঠামো জুলাইয়ের ১১ তারিখেই তৈরী করা হয় এবং তা এদিন থেকেই কার্যকর হলো। স্বেচ্ছা সেবক বাহিনীর কাঠামোটি এই রকম :-
(১) স্বেচ্ছ সেবক বাহিনীর প্রাথমিক ইউনিট :-
প্রতিটি গ্রাম থেকে ঊর্ধ্বে ত্রিশ, নিম্নে কুড়িজন সকল বয়সের দেশপ্রেমিক লোক নিয়ে এই ইউনিট গঠিত হবে। এই ইউনিট পরিচালনার জন্য একজন কামাণ্ডার ও একজন সহকারী কমাণ্ডার নিযুক্ত হবে
(২) ওয়ার্ড ইউনিট :-
ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে ওয়ার্ড ইউনিট গঠিত হবে। এই কমিটির নিজস্ব ত্রিশ জন সদস্য থাকবে ও প্রতিটি গ্রাম ইউনিটের উপর এই কমিটির নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এই ইউনিটে একজন কমাণ্ডার ও ওয়ার্ডে যে কটি গ্রাম ইউনিট থাকবে ততজন সহকারী কমাণ্ডার নিয়ে গঠিত হবে।
(৩) ইউনিয়ন ইউনিট :-
এই ইউনিটের নিজস্ব একশত জন সদস্য রাখার ক্ষমতা থাকবে। ইউনিয়ন ইউনিটের একজন কমাণ্ডার, দুইজন সহকারী কমাণ্ডার এবং ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডের কমাণ্ডারকে অতিরিক্ত সহকারী কমাণ্ডার নিয়ে ইউনিয়ন ইউনিট গঠিত হবে। ইউনিয়ন ইউনিট কমাণ্ডার ও সহকারী কমাণ্ডার, মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তর থেকে নিয়োগ করা হবে। ইউনিয়ন ইউনিট গঠন করে, ইউনিয়ন ইউনিট কমান্ডার হিসেবে পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করে সদর দপ্তরে পাঠাতে হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৫৮

সাধারণতঃ প্রস্তাবিত পাঁচজনের মধ্যে থেকে সদর দপ্তর কাউকে অনুমোদন করবে।
(৪) আঞ্চলিক ইউনিট :-
আঞ্চলিক ইউনিটগুলো সাধারণতঃ ইউনিয়ন ইউনিট ও ওয়ার্ড ইউনিটসহ আরো অতিরিক্ত পঞ্চাশ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এই ইউনিটের কামাণ্ডার ও সহকারী কমাণ্ডার সরাসরি মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে নিযুক্ত হবে।
স্বেচ্ছা সেবক বাহিনীর গঠন কাঠামোতে ইউনিয়ন ইউনিট সব চাইতে বেশী ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পায়। স্বাভাবিকভাবে ইউনিয়ন ইউনিটের কমান্ডারের ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। ইউনিয়ন ইউনিটের নিম্নতন ইউনিটের উপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ছিল। ইউনিয়ন ইউনিটের কমাণ্ডারের তার আওতাভুক্ত এলাকার বিচার-আচার, চাঁদা আদায়, খাদ্য-দ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী সংগ্রহ ও মুক্তিবাহিনীর জন্য অর্থ সংগ্রহের পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৫৯

ঝটিকা আক্রমণ পরিকল্পনা

দপ্তরের কাজ কর্ম শেষ করে সাংগঠনিক সফরে বের হলাম। হতেয়া, বাঁশখালি, হাটুভাঙ্গা, কালিয়াকৈর হয়ে শামসুল হকের (পরবর্তীতে বাংলাদেশের মন্ত্রী) বাড়ী ঠেঙার বাধ। সেখান থেকে ফুলবাড়িয়া, কাচিনা হয়ে বাটাজোর।

সাংগঠনিক সফর
হতেয়ায় তখন ইউনুছের কোম্পানী, হাটু ভাঙ্গায় আজাদ কামালের কোম্পানী, মল্লিক বাড়ীর কাছে মেজর আফসার ও হাকিমের কোম্পানী। এই তিনটি জায়গায় পর্যায়ক্রমে তিন রাত কাটালাম এবং মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের সামনে আলাদা আলাদা বক্তৃতা করলাম।
কাচিনাতে মেজর আফসার স্বাগতঃ জানালেন। আমি ঐ এলাকা সফরে যাওয়ার কয়েক দিন আগে ভালুকার রাজঘাটে মেজর আফসারের কোম্পানীর সাথে হানাদার বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হানাদারদের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়। মেজর আফসার হানাদারদের আটটি লাশ ও ছ’হাজার গুলিসহ একুশটি অস্ত্র ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন। এই যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও ছয়-সাত জন সামান্য আহত হয়। নিহত মুক্তিযোদ্ধার কবর জিয়ারত ও আহতদের শয্যাপাশে হাজির হতেই এই এলাকায় এসেছি। নিহত মুক্তিযোদ্ধার কবরের পাশে গিয়ে নিজেকে সংযত রাখতে পারলাম না। সাথীহারা ব্যথায় ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। অন্য মুক্তি যোদ্ধাদের চোখও স্বজন হারা বেদনার অশ্রুতে ছল ছল করছিল। একজন মৌলানা খুবই আবেগে কোরান পাঠ করে মোনাজাত করলেন। সমগ্র পরিবেশ করুণ বিষাদে ছেয়ে গেল। মিনিট পনের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখ মুখ লাল হয়ে গেল, মুখটাও অনেক খানি ফুলে গেল। আমি চলৎ শক্তি হারিয়ে ফেললাম।
এরপরও আস্তে আস্তে আহত সহযোদ্ধাদের শয্যাপাশে গিয়ে প্রত্যেকের কাছেই কিছুক্ষণ করে কাটালাম। নিহত বন্ধুর কবর ও আহত সহযোদ্ধাদের শয্যাপাশে আমি পুরোপুরি প্রকৃতস্থ ছিলাম না। একথা আমাকে বলতেই হবে, অনেক সময় নিহত বন্ধুদের পাশে শিশুর মত কাঁদতে দেখে নতুন ও অপরিচিত যোদ্ধাদের মনে প্রশ্ন জাগত, এমন করে যে শিশুর মত কাঁদে সে আবার শত্রুর মোকাবেলা করে কি করে? আমার যে শরীরে হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্রের অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষণ এক নিমিষের জন্যও কাঁপন ধরাতে পারেনি, সেই শরীর সহযোদ্ধার কবর ও আহতদের শয্যাপাশে বার বার কেঁপে উঠছিল। যে প্রেম মানুষকে বড় করে, যে ভালবাসা মানুষকে কালোত্তীর্ন করে, যে স্নেহ-মমতা দূরকে কাছে টানে, হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের উষ্ণতা সঞ্চালিত করে, সেই প্রেম ভালবাসার আলোতে উদ্ভাসিত হয়েছি আমরা সবাই। আমার সহযোদ্ধাদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও সহযোদ্ধাদের আমার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসার
পৃষ্ঠা নং ~ ২৬০

অদৃশ্য গ্রন্থিই মুক্তিবাহিনীকে দিনে দিনে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করে তুলছে। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা একে অপরকে আদর্শিক বন্ধনে ‘ভাই’ বলে চিনতে পেরেছ, মানতে পেরেছ, পেরেছ ভালবাসতে।
আহতদের দেখে ১৭ তারিখ রাত আটটায় বাটাজোড়ের সানোয়ার উদ্দীন সুনু তালুকদারের বাড়ীতে এলাম। রাতে মেজর আফসার তার গত মাসের যুদ্ধ সংক্রান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট ও আর্থিক আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করলেন।
১৮ই জুন থেকে ১৪ জুলাই মেজর আফসারের আর্থিক আয় হয়েছে সাথে পাঁচ লাখ টাকা। দেড় লক্ষ টাকা জরিমানা হিসাবে এবং বাকী চার লাখ জনসাধারণের স্বেচ্ছা-চাঁদা থেকে আদায় হয়েছে। মোট আদায়কৃত সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা থেকে আটশ মুক্তিযোদ্ধার প্রয়োজনীয় খরচ পত্রের জন্য দেড়লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। হিসাব নিখুঁত ও পরিস্কার। নগদ চার লাখ টাকা এবং পুরো হিসাব মেজর আফসার আমার সামনে পেশ করলে দীর্ঘ সময় ধরে আয়-ব্যয় সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখে আয়-ব্যয়ের অনুমোদনে স্বাক্ষর দিলাম। নগদ চার লাখ টাকা মেজর আফসারের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ‘এখনই কোন দূত মারফত এ থেকে মাত্র দশ হাজার টাকা ও হিসাবটা সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দিন। বাকী টাকাটা আপনার কাছে থাক। এমন নিখুঁত হিসাব থাকলে টাকা আপনার হাতে থাকায় আমার কোন আপত্তি নেই।
১৫ই জুলাইয়ের পর থেকে মুক্তিবাহিনী হানাদারদের উপর পরিকল্পনা মাফিক প্রচণ্ড চাপ বৃদ্ধি করল। শত্রুপক্ষের উপর বিরামহীন আক্রমণের পরিকল্পনায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনে উৎসাহ ও উদ্দীপনা জাগল। আক্রমণের সুফলও তারা হাতে হাতে পেল। ক্রমাগত আক্রমণের চাপে হানাদাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শঙ্কিত ও কোণঠাসা হয়ে পড়ল।
১৮ই জুলাই থেকে অবিরাম গুলিগোলা চালিয়ে ১৯ই জুলাই হানাদার বাহিনী দেওপাড়া ঘাটি দখল করে নিতে সক্ষম হলো। তবে বিনা বাধায় নয়, তাদের দুদিন প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করতে হলো।

এ্যামব্যুস বীরবাসুন্ডা
১৮ই জুলাই, ভোরে কালিহাতী থেকে দুই কোম্পানী হানাদার দেওপাড়ার দিকে এগুতে লাগল। কস্তুরীপাড়া বাজার পর্যন্ত এগিয়ে এলে, ভোর পাঁচটায় মুক্তিবাহিনী মিলিটারীদের এগিয়ে আসার খবর পায়। সঙ্গে সঙ্গে হানাদারদের উপর আক্রমণ
চালানোর কৌশল ঠিক করে দেওপাড়া থেকে এক-দেড় মাইল এগিয়ে বীরবাসুন্ডা ও তার আশে-পাশে ঘাপটি মেরে তারা শিকারের অপেক্ষায় বসে থাকে।
হানাদাররা খুব সতর্কতার সাথে প্রায় এক মাইল লম্বা সারিতে খুবই ধীর গতিতে, চতুর্দিকে চোখ রেখে দেওপাড়ার দিকে এগুচ্ছে। ওদিকে মুক্তিযোদ্ধারাও বন্ধুক উচিয়ে ট্রিগার আঙ্গুল রেখে পাকা শিকারীর মত চুপচাপ বসে আছে। হানাদাররা দেওপাড়ার তিন পোয়া মাইল দূরে থাকতে মুক্তিবাহিনী প্রথম আঘাত হানল। মুক্তিবাহিনীর এতোটা কাছে এসে গেছে, হানাদাররা তা টেরই পায়নি।
চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূর থেকে আচমকা ছোড়া গুলিতে মুহুর্তে হানাদারদের আট-দশ জন
পৃষ্ঠা নং ~ ২৬১

গুরুতর আহত হলো। অবশিষ্টরা দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়া শুরু করে দেয়৷ হানাদারদের উপর সামনে থেকে গুলি চলেনি। গুলি এসেছে দক্ষিণ পাশ থেকে। ফলে দিশেহারা হানাদাররা দৌড়ে রাস্তার উত্তর পাশে পজিশন নিয়ে দক্ষিণ ও সামনের দিকে যখন গুলি ছোড়া শুরু করে, ঠিক তখন উত্তর দিক, মানে হানাদারদের একেবারে পেছন থেকে ছয়জন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির অগ্নি ফুলকি ঝরিয়ে গা ঢাকা দেয়। এতে ফল হলো খুবই মারাত্মক ও অভূতপূর্ব। হানাদার বাহিনীর দশ জন নিহত ও কুড়িজন আহত হলো। এতে তাদের আর এগিয়ে যাবার বা লড়াই করার শক্তি ও সাহস রইল না। তারা সুবোধ বালকের মত আস্তে আস্তে পিছনে সরে যেতে লাগল। পিছিয়েও কিন্তু হানাদার বাহিনীর দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনার শেষ হলো না। আরো কঠিন দুর্ভোগ ও বিপর্যয় একটু পিছনে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বীরবাসুণ্ডা ও কস্তুরী পাড়ার পাশে চারটি দল শত্রু নিধনের অপেক্ষায়। দেওপাড়ার দিকে তাদের সামনে দিয়ে হানাদাররা যখন যাচ্ছিল, তখন পঞ্চাশ গজের মধ্যে পেয়েও তারা শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
হলোও তাই। হানাদাররা মার খেয়ে লেজ গুটিয়ে, কালিহাতীর দিকে ফিরছে। বীরবাসুণ্ডার কাছাকাছি এলে তাদের মধ্যে দেখা দেয় শিথিলতা ও বিশৃঙ্খলা। কে কাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হলো প্রতিযোগিতা ও ঠেলাঠেলি। কেউ কাউকে মানছে না। কেউ কারো হুকুম তামিল করছেনা। শত্রুর এমন অরাজক ও বিশৃঙ্খল অবস্থা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এনে দিল এক সুবর্ণ সুযোগ। দেখতে দেখতে হানাদার বাহিনীর ত্রিশ-চল্লিশ জন মুক্তি যোদ্ধাদের ত্রিশ-চল্লিশ গজের মধ্যে এসে গেল। আর অপেক্ষা নয়। তাদের হাত নিশপিশ করছে, বুকের স্পন্দন বহুগুণ বেড়ে গেছে। শত্রু হননের লোভ আর সংবরণ করতে পারছেনা। তারা হানাদার পশুদের বুক লক্ষ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছোড়া শুরু করে দিল। মাত্র দু’তিন মিনিট। তারপর দে ছুট।
দেওপাড়ার কাছে হানাদাররা যেমন মার খেয়েছে, এক মাইল পিছনে এসে এখানে অনুরূপ মার খেল। দ্বিতীয়বার মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে দিশেহারা হানাদার বাহিনীর একেবারে লেজে-গোবরে অবস্থা হয়ে যায়। বীরবাসুণ্ডায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় একশজন হানাদার কিছুক্ষণের জন্য আটকে পড়ে। এই শতাধিক মিলিটারীর প্রায় পঁচিশ জন আহত ও নিহত।

দেওলা খেয়াঘাটে পরপার
বীরবাসুণ্ডাতেই কিন্তু হানাদার বাহিনীর বিড়ম্বনার শেষ নয়। হরিপুর- কস্তুরী পাড়ার মাঝে দেওলা খেয়াঘাটে কমাণ্ডার লোকমান হোসেন স্বয়ং ষোল জন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করে। সে প্রথমে কস্তুরী পাড়ায় অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু বীরবাসুপ্তার আক্রমণের কথা চিন্তা করে, এত কাছাকাছি আবার আক্রমণের খুব একটা ফল ফলবেনা ভেবে দল-বল নিয়ে কিছু পশ্চিমে সরে শত্রুহননের অপেক্ষা করতে থাকে। বীরবাসুণ্ডায় আক্রান্ত হবার পর হানাদরা বাহিনী রাস্তার উভয় পাশে পজিশন নিয়ে প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করল। কিন্তু তাদের উপর আর
পৃষ্ঠা নং ~ ২৬২

কোন আক্রমণ হলো না। এ অবস্থায় তাড়াতাড়ি সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
দেওলা খেয়াঘাট। মাঝারি সাইজের একটি নৌকায় কুড়ি-পঁচিশ জন করে হানাদার দেওলা খেয়া পার হতে লাগল। পঁচিশ-পঁচিশ-পঞ্চাশজন পার হয়ে তারপর আহত নিহতদের পার করা শুরু করল। এদিকে লোকমান হোসেন সত্তর-আশি গজ দূরে বসে হানাদারদের খাল পার হওয়ার দৃশ্য দেখছে। লোকমান হোসেনের হিসাব মত কাঁধে বয়ে নেয়া আহত-নিহতদের সংখ্যা সত্তরের উপর। তবে তার পাশের সহযোদ্ধাদের অনুমান, আহত-নিহতদের সংখ্যা চল্লিশের বেশী নয়।
তখনও প্রায় আশি জন হানাদার খেয়াঘাটের পুব পারে রয়েছে। খেয়া নৌকা আর একবার এপার থেকে ওপারে গেল। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা একটি বাধের আড়ালে পজিশন নিয়ে আছে। তাদের বন্ধুকের নলের মুখে প্রায় ঘন্টা খানেক যাবৎ পর্যায়ক্রমে হানাদাররা খাল পার হচ্ছে। খেয়া পার হতে আর মাত্র পঞ্চাশ-ষাট জন বাকী। মুক্তিযোদ্ধারা এতটা সময় একেবারে চুপচাপ বসেছিল। কিন্তু আর বসে থাকা যায় না। কুড়ি-পঁচিশ জনকে নিয়ে খেয়া নৌকা খালের মাঝে এসে গেছে। এমন সময় খেয়া নৌকা ও পুব পারের হানাদারদের উপর মুক্তিবাহিনী আবার আঘাত হানল। কমাণ্ডার লোকমানের এল. এম. জি. কর কর শব্দে গর্জে উঠল। সদা প্রস্তুত অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলোও অগ্নি ঝরাতে শুরু করে দিল। গুলির সাথে সাথে খেয়া নৌকার মিলিটারীরা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এদের অনেকেই রক্ষা পেল না। কারণ পাকিস্তানী হানাদাররা একজনও সাঁতার জানত না। এখানে মুক্তিবাবাহিনীর মাত্র দশ মিনিটের তুমুল গুলি বর্ষণে হানাদারদের ক্ষতির পরিমাণ হলো সবচেয়ে বেশী। দিশেহারা হানাদাররা দশ-বারটি সর্বাধুনিক অস্ত্র ফেলে চলে গেল। অবশ্য মুক্তিযোদ্ধারা তখনই অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করতে পারেনি। যুদ্ধ শেষে অস্ত্রগুলো স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা সংগ্রহ করে রাতে দেওপাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে পৌঁছে দিয়েছিল। ১৮ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর বিপুল ক্ষতি সাধন করতে পারলেও, পরদিন অর্থাৎ ১৯শে জুলাই হানাদারদের সাথে পেরে উঠল না।

শিবের পাড়ার মরণ ফাঁদ
দেওপাড়া দখল করতে এসে, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেয়ে হানাদাররা খ্যাপা কুকুরে মত উন্মাদ হয়ে উঠে। তাদের নরঘাতক রক্ত পিপাসু কর্নেল ঘোষণা করল, ‘যে ভাবেই হোক দেওপাড়া আমাদের চাই-ই। আমাদের ক্ষয় ক্ষতির বদলা নিতে হবে। এক এক করে দুষ্কৃতিকারীদের গাছে ঝুলিয়ে বেয়নেট খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে হবে।
১৯শে জুলাই ভোর চারটা থেকে হানাদাররা দেওপাড়াকে লক্ষ্য করে কালিহাতী থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ শুরু করল। সিক্স পাউণ্ডার ও ১২০ এম. এম. গান থেকে বিরামহীন গোলা বর্ষণে সমস্ত অঞ্চল থর থর করে কাঁপতে লাগল। সিক্স পাউণ্ডারের গোলার আওয়াজ বজ্রপাতের চেয়েও ভীতি প্রদ।
ভারী গোলার আড়ালে হানাদাররা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল। সামনে ছোট্ট একটি খাল। কিন্তু খেয়া নৌকা নেই। বাধ্য হয়ে থামতে হলো তাদের। শুধু থামা বা বসে থাকা নয়,
পৃষ্ঠা নং ~ ২৬৩

এলোপাথারি গুলি চালাতে লাগল। বেলা এগার-সাড়ে এগারটার দিকে হানাদারদের গোলার আঘাতে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের কিছুটা ক্ষতি হলো। এর আগে সাত ঘন্টায় হানাদারদের শত শত গোলার আঘাতেও মুক্তিযোদ্ধাদের কোন ক্ষতি হয়নি। বেলা এগারটায় সিক্স পাউণ্ডারের একটি গোলা লোকমানের রাইফেলের নলের উপর পড়ল। লোকমান এবং তার সঙ্গী আঘাত না পেলেও তাদের বাঙ্কারটি পুরোপুরি ধসে গেল। এতে তারা প্রায় জীবন্ত কবরস্থ হওয়ার উপক্রম হল। লোকমানের সঙ্গী তাকে টেনে হিচড়ে মাটির নীচ থেকে বের করে। লোকমান সঙ্গে সঙ্গে সিক্স পাউণ্ডারের গোলার গর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে আশ্রয় নিল। মাত্র আট শ গজ দূর থেকে দেওপাড়াকে লক্ষ্য করে, হানাদাররা গুলি ছুঁড়ে চলছিল, তাই বাঙ্কারের বাইরে এক মুহুর্তও নিরাপদ নয়। কমাণ্ডার লোকমান হোসেন তার দলকে ঘাঁটি ছেড়ে ধলাপাড়ায় পিছিয়ে যেতে নির্দেশ দিল। মুক্তি বাহিনী প্রায় একমাস দেওপাড়ায় ঘাঁটি গেড়ে থাকার পর এই প্রথম পশ্চাদপসরন করল। এই পশ্চাদ-পসরন অনেক মুক্তিযোদ্ধার পছন্দ হয়নি, কমাণ্ডার লোকমান হোসেনেরও নয়। তবুও শত্রুর তীব্র আক্রমণের মুখে বাধ্য হয়ে তাদের সাময়িকভাবে পিছিয়ে যেতে হয়েছিল। তবে শত্রু চ্যালেঞ্জ মুক্ত ছিল না। সবাই কমাণ্ডারের আদেশ বিনা বাক্যে মেনে নিল কিন্তু গোহাইল বাড়ীর রফিক ও সবুর বেঁকে বসল। রফিকের কথা, ‘আমাকে গুলি করে মেরে যেতে পারেন কিন্তু হানাদারদের উপর গুলি না ছুড়ে ডিফেন্স থেকে বিদায় নিচ্ছিনা।” সবুরের কথাও তাই। বাধ্য হয়ে লোকমান শিবের পাড়ার দিক থেকে রফিক ও সবুরকে এ্যামবুশ করতে অনুমতি দিল। তবে এক মিনিটের বেশী গুলি চালানো যাবে না, মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হলে সর্বাধিনায়ক তাকে রেহাই দেবেন না বলে তাদের সতর্ক করে দিল।
তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধারা দেওপাড়া ঘাটি ত্যাগ করেছে। অন্যদিকে হানাদাররা দেওপাড়া বাজারে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। শতাধিক হানাদার দেওপাড়া বাজারের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পজিশন নিয়েছে, অনেকে আবার দোকানগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
এদিকে রফিক ও সবুর প্রায় চার ঘন্টা দেওপাড়া বাজারের একশ গজের মধ্যে শিকারের আশায় নির্বিকার বসে আছে। ষোল-সতের জনের একটি হানাদার দল সম্ভবতঃ লোকজন খুঁজতে দেওপাড়ার দক্ষিণে শিবের পাড়া রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল। হানাদাররা কুড়ি পঁচিশ গজের মধ্যে এলেই রফিক ও সবুর অকস্মাৎ গুলি ছুঁড়ল। কমাণ্ডারের নির্দেশ মত মাত্র এক মিনিট। দেখে দেখে গুলি ছুঁড়ে বারজন হানাদারের ভবলীলা সাঙ্গ করে তারা নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে গেল।
কমাণ্ডার লোকমান তার দলবল নিয়ে ধলাপাড়া এসে বংশাই নদীর পারে প্রায় এক মাইল জায়গা জুড়ে বাঙ্কার খুঁড়ে, নদী সামনে রেখে বেশ মজবুত অবস্থান গড়ে তুলল। দেওপাড়া ঘাটির তুলনায় ধলাপাড়া বেশ সুবিধাজনক এবং রক্ষা করাও সহজ। বংশাই নদীর উপর ভালভাবে দৃষ্টি রাখতে পারলে, হানাদারদের পক্ষে পার হওয়া কোন ক্রমেই সম্ভব নায়।
দেওপাড়ার প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ আমি ১৮ই জুলাই ও পরদিন সকালে বারবার
পৃষ্ঠা নং ~ ২৬৪

শুনতে পাচ্ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় সংক্রান্ত খবরও দু’বার পেয়েছিলাম। ১৯শে জুলাই রাত আটটায় ধলাপাড়া থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল দক্ষিণে কালমেঘায় বসে, হেড কোয়ার্টার থেকে তৃতীয় বার খবর পেলাম। হেড কোয়ার্টারের বেতার পাক-মিলিটারী খবর ইন্টারসেপ্ট করে এই মর্মে খবর উদ্ধার করেছে যে, দেওপাড়ার যুদ্ধে দুষ্কৃতিকারীদের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। দুষ্কৃতিকারীদের সত্তর জন নিহত ও তিনশ জন ধরা পড়েছে। এ খবর শুনে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়ে পড়লাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর সত্তর জন তো দূরের কথা, হানাদার বাহিনী সাতজন মুক্তি যোদ্ধাকেও এক সময়ে আহত করতে পারেনি। আর তিনশ মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়েছে? তবে তো পুরো দলটাই ধরা পড়ে গেছে। আমি স্থির থাকতে পারলাম না। কালমেঘা থেকে ধলাপাড়া রওনা হলাম। রাত বারটায় কচুয়ায় সাগরদীঘির সিগন্যাল ম্যান আবদুস সবুরের সাথে দেখা হলে সে জানাল, ‘দেওপাড়া কোম্পানীর সঠিক খবর বলতে পারবনা, তবে লোকমান সাহেব অক্ষত আছেন এবং তার দলের বড় অংশ ধলাপাড়া পর্যন্ত পিছিয়ে এসে অবস্থান নিয়েছেন।’ এ খবর শুনে কিছুটা স্বস্তিবোধ করলাম।
২০শে জুলাই। চারটায় ধলাপাড়া হাইস্কুলে হাজির হলাম। এত সকালে আমাকে দেখে লোকমান যুগপৎ বিস্মিত ও উৎসাহিত বোধ করল। সে জানত, ঐ দিন আমি তাদের থেকে চল্লিশ মাইল দূরে অবস্থান করছিলাম। এই চল্লিশ মাইল পায়ে হেঁটে, তাদের দুঃসময়ে উল্কার বেগে ছুটে এসেছি, এজন্য কমাণ্ডার লোকমান যার পর নাই উৎসাহিত। শুধু তাই নয়, আমার প্রতি লোকমান এবং তার দলের আস্থা ও বিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে গেল। তাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকল না, সহযোদ্ধাদের যে কোন বিপদ ও বিপর্যয়ের সময় আমি সমস্ত বাধা, সমস্ত বিপত্তি উপেক্ষা করে তাদের পাশে এসে দাড়াব। লোকমানের সহযোদ্ধারা আনন্দ, উৎসাহ ও গর্বে ফেটে পড়ছিল। আমার উপস্থিতিতে তারা যেন প্রাণভরে আনন্দ সাগরে অবগাহন করছিল। মুক্তি যোদ্ধাদের সবাইকে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করে এবং বিপদের মুখে সাহস, ধৈর্য্য ও দূরদর্শিতার জন্য কমাণ্ডার লোকমানকে ‘মেজর’ পদে উন্নীত করলাম। আর্মীর হাবিলদার ‘মেজরের’ মর্যাদা পেয়ে বিশেষ গৌরব বোধ করতে থাকে এবং এক সীমাহীন উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে। নতুন পদমর্যাদা তাকে আরও অধিক দায়িত্ব সচেতন করে তুলল এবং পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে মেজর লোকমান হোসেন তার সম্মানজনক পদের মান রাখতে সক্ষম হয়।
ধলাপাড়া ত্যাগ করার আগে মেজর লোকমানকে নির্দেশ দিলাম, দু’একদিন পর পর বিরামহীন ভাবে দেওপাড়া হানাদারদের উপর চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে হবে।
২০শে জুলাই আবার সদর দপ্তরে ফিরলাম।

ভালুকার ঘুঘু ফাঁদে শত্রু
১৯শে জুলাই যখন কমাণ্ডার লোকমান হোসেনের কোম্পানী দেওপাড়া থেকে পশ্চাদপসরণ করে, ঠিক সেইদিন সেই সময় হানাদার বাহিনী ভালুকা থানা দখল করতে এসে মেজর আফসারের কোম্পানীর হাতে প্রচণ্ড মার খায়। সূর্য উঠার আগেই হানাদাররা কাওরাইদের দিক থেকে
পৃষ্ঠা নং ~ ২৬৫

ভালুকায় আসতে থাকে। খবর পেয়ে মেজর আফসার তার এক কমান্ডার, কাচিনার জহিরুল ইসলামকে হানাদারদের মোকাবেলা করতে আদেশ দেয়। জহিরুল ইসলাম তার দল নিয়ে থানা থেকে দু’মাইল এগিয়ে সিডষ্টোর বাজারে তিন জায়গায় আলাদা-আলাদা ভাবে অবস্থান নিয়ে হানাদারদের উপযুক্ত স্বাগত জানাতে ওৎ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। ভোর চারটায় হানাদাররা তার বন্দুকের নলের পুরো আওতায় এলে কমান্ডার জহিরুল ইসলামের দল দুই দিক থেকে হানাদারদের উপর আচমকা প্রচণ্ড আঘাত হানে। আচমকা আঘাতের ধাক্কা হানাদাররা সামলে উঠার আগেই, পিছনে ওৎ পেতে বসে থাকা তৃতীয় দল প্রচণ্ড গুলি বর্ষণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলার মুখে বেসামাল হয়ে হানাদার দলটি ছত্রভঙ্গ ও নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়ে। পর্যুদস্ত ও বিপর্যন্ত হানাদার বাহিনী যদিও এল. এম. জি. -র এলোপাথাড়ী গুলি ছুঁড়ে দিগবিদিক কাঁপিয়ে তুলেছিল। এর ফলে কিন্তু একটি কাকপক্ষীও সেইদিন মারা যায়নি বা আহত হয়নি।
ভালুকা থানা দখল করতে আসা পাকিস্তানী বাহিনীর যুদ্ধ করার সাধ যুদ্ধ যাত্রার তিন চার ঘন্টার মধ্যেই মিটে যায়। তারা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থায় পিছু হটতে বাধ্য হয়। পিছু হটার সময় তারা আটজন নিয়মিত সৈন্যের লাশ ফেলে যায়। এই যুদ্ধে প্রায় কুড়িজন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও বাইশ জন আহত হয় বলে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকদের অভিমত, আহত-নিহতদের সংখ্যা অনেক বেশী। মুক্তিযোদ্ধাদেরও এই যুদ্ধে ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। এই যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও চারজন গুরুতর আহত হয়। একটি এল. এম. জি., এগারটি চাইনীজ ও ৩০৩ রাইফেলসহ প্রায় দশ হাজার নানা ধরনের গুলি মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
পাথরঘাটায় অবস্থানরত কোম্পানীর একটি দল ২২শে জুলাই, মতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে পাথরঘাটা থেকে পাঁচ-ছয় মাইল পশ্চিমে রাত বারটায় বাশাইল থানার কাছাকাছি অবস্থান নেয়। বাকী রাতটা তাদের শিকারের আশায় অপেক্ষা করেই কাটে। থানার ভেতরে গিয়ে আক্রমণ চালানো রণকৌশলগত কারণে সুবিধাজনক নয়, নিজের পক্ষে ক্ষয়-ক্ষতির সম্ভাবনা যেমন বেশী, তেমনি সুরক্ষিত বাশাইল থানার উপর বাইরে থেকে গুলি চালালে হানাদারদের তেমন ক্ষতি করা যাবে না। তাই সকাল হওয়া পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হয়। সাধারণতঃ সকালে থানা থেকে এক বা একাধিক দলে বিভক্ত হানাদাররা টহলে বের হয়। আর সেই সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সারারাত ওৎপেতে থাকা। ভোর সাড়ে চার পাঁচটায় তাদের সারা রাতের প্রতীক্ষা সফলতায় পর্যবসিত হয়। মতিয়ার রহমান তার দলের দশ জন সহযোদ্ধাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে যেখানে অবস্থান নিয়েছিল, ঠিক সেই পথে পাঁচজনের একটি হানাদার দল পশ্চিম থেকে পূবে গ্রামের দিকে চলেছে। মতিয়ার রহমানের দলের ওৎ পেতে বসে থাকা স্থানটির কুড়ি গজের মাঝ দিয়ে হানাদাররা পাশ কাটিয়ে গেল। তারা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি যে, মৃত্যু তাদের জন্য ওৎ পেতে আছে। হানাদাররা সহজ ও স্বাভাবিক ছন্দেই হাঁটছিল। পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনী মতিয়ার রহমানের দলকে পাশ কাটিয়ে কুড়ি গজও যেতে পারেনি। পিছন থেকে মতিয়ার
পৃষ্ঠা নং ~ ২৬৬

দলের পাঁচজন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে হানাদারদের পিছে কয়েক ঝাঁক গুলি ছুঁড়ে। মাত্র এক দুই মিনিটের ব্যাপার। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে চারজন হানাদার রাস্তার উপরই লুটিয়ে পড়ে। খুনীদের রক্তে মাটি লাল হয়ে উঠে। অন্যজন আহত হয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা এক মুহুর্তে দেরী না করে পাঁচজন হানাদারদের পাঁচটি অস্ত্র ও গুলি তুলে নিয়ে দে ছুট? এই সময় থানা থেকে গুলি বৃষ্টি আসতে থাকে কিন্তু ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ শেষ, তাদের আর পায় কে। গায়ে একটু আঁচড় না লাগিয়ে চারজন হানাদারকে অক্কা পাইয়ে ও একজনকে আহত করে গুলিসহ পাঁচটি হাতিয়ার দখল করে মতিয়ার রহমানের দল বীরদর্পে তাদের কোম্পানীর মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

অপারেশন পাওয়ার হাউস
অন্যদিকে ২৩শে জুলাই বাকু এবং কালাম টাংগাইল পাওয়ার হাউসে হাতবোমা নিক্ষেপ করে তিনজন হানাদারকে খতম ও দুইজনকে আহত করে। বাকু ও কামাল ২৩ তারিখ বিকেল চারটায় টাংগাইলের পুব উত্তর দিক থেকে মোটর সাইকেলে পাকা সড়ক ধরে টাংগাইল শহরের দিকে এগুতে থাকে। কামাল মোটর সাইকেল চালাচ্ছে বাকু তার পেছনে। তারা যখন কুমুদিনী কলেজের সামনে দিয়ে শহরের দিকে এগুচ্ছে তখন দ্রুতবেগে একটি সামরিক জীপ তাদের অতিক্রম করে যায়। পেছনে সামরিক জীপ দ্রুতবেগে আসতে দেখে প্রথমটায় দুজনেই কিছুটা ঘাবড়ে যায়। জীপটি পাশ কাটিয়ে শহরের দিকে চলে গেলে তারা স্বস্তি বোধ করে। কামাল মোটর সাইকেলের গতি সামান্য কমিয়ে দেয়। আর মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের রাস্তা। বাকুর হাতে পিন খোলা তাজা গ্রেনেড। অসাবধানতাবশতঃ তার মুঠি একটু শিথিল হলেই ঐ হাতবোমা তাদের উড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু অসম সাহসী বাকু একেবারে নিরুদ্বিগ্ন, নির্বিকার। তাদের মোটর সাইকেল পাওয়ার হাউসের সামনে এসে পড়ে। কামাল মোটর সাইকেলের গতি একটু কমিয়ে দেয়। গেটের পাঁচ- সাত গজের মধ্যে তখন জটলা পাকিয়ে গাল-গল্প করতে থাকা পাঁচ-ছয় জন হানাদার ও দুইজন সশস্ত্র পাহারারত জল্লাদকে লক্ষ্য করে পলক না পড়তেই নির্ভুল লক্ষ্যে বাকু তার গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। কালাম মোটর সাইকেলের গতি পুরো মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। দেখতে না দেখতেই তারা ডাইনে বেঁকে পলাশতলী রোড ধরে বিন্দুবাসিনী গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে শহরের লোকের সাথে মিশে যায়। হাতবোমার প্রচণ্ড শব্দে পাওয়ার হাউসটাই যেন একবার কেঁপে উঠে। গেটে পাহারারত দুজন এবং জটলা করে গল্পে মেতে থাকা পাঁচ-ছয়জনের মধ্যেও একজন নিহত হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এম. জি. উঁচিয়ে ছাদে বসে থাকা হানাদারটি আচম্বিত হামলার প্রেক্ষিতে এতই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল যে, সে বাকুদের উপর এক রাউণ্ড গুলিও ছুঁড়তে পারে নি। যদিও দুই কিশোর চকিতে মিলিয়ে যাওয়ার পর এম. জি. থেকে লক্ষ্যহীনভাবে হাজার হাজার গুলি ছুঁড়ে আসমান ফুটো করেছিল।
২৪শে জুলাই। পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান কার্যালয় ভুয়াপুরে পশ্চিম অঞ্চলের বেসামরিক
পৃষ্ঠা নং ~ ২৬৭

প্রধান আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও নূরুল ইসলাম কোম্পানী কমান্ডারদের এক গুরুত্বপূর্ণ সভা আহ্বান করেন। মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরের প্রতিনিধিত্ব করেন গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকী ও নুরুন্নবী। আলোচনার বিষয়বস্তু, সদর দপ্তর থেকে পাঠানো নির্দেশ মত আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি ও পশ্চিমে মুক্তাঞ্চলের ডিফেন্স সুদৃঢ় করা। কোম্পানী কমান্ডারদের এই সভায় স্থির হয়, পূর্বাঞ্চলের মত ভুয়াপুরের চতুর্দিকে স্থায়ী প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করতে হবে। সব সময়ে নদী ও সড়কে হানাদারদের গতিপথে ওৎপেতে থেকে হামলা পরিচালনা ও দুই এক দিন অন্তর হানাদরদের স্থায়ী ঘাঁটিতে আতর্কিত ঝটিকা আক্রমণ চালাতে হবে। এ ছাড়াও টাংগাইল শহরে প্রতি রাতে নিয়মিতভাবে গ্রেনেড নিক্ষেপের ব্যবস্থা করতে হবে। সভায় উপস্থিত কমান্ডারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, দুর্ধর্ষ কমাণ্ডার মেজর হবিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন খোরশেদ আলম, মেজর আবদুল গফুর, রেজাউল করিম তলুকদার, হুমায়ূন বেনু ও আমান উল্লাহ।
মেজর হাবিবকে টাংগাইল ময়মনসিংহ পাকা সড়কে নিয়মিত তৎপাতার দায়িত্ব দেয়া হয়। টাংগাইল শহরের শত্রু ঘাঁটিতে হাতবোমা নিক্ষেপ ও ঝটিকা আক্রমণের দায়িত্ব নিল আমান উল্লাহ। গোপালপুর থানায় অনুরূপ নিরন্তর আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্ব বর্তায় বেনু ও হুমায়ূনের উপর। টাংগাইলের দিকে পুংলি এলেঙ্গার কাছে সর্বদা হানাদারদের কনভয়ের উপর চোরা-গোপ্তা আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্বভার ক্যাপ্টেন খোরশেদ আলমকে দেয়া হলো। গফুরের দায়িত্ব, ভুয়াপুরের প্রধান কার্যালয়কে আগলে রাখা এবং যমুনা-বলেশ্বরী নদী নিরাপত্তা বিধান। যদিও নদীপথের মূল দায়িত্ব অর্পিত হলো মেজর হাবিবের উপর, অবর্তমানে কমাণ্ডার রেজাউল করিম সেই দায়িত্ব পালন করবে বলে স্থির হলো।
গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল বাসেত সিদ্দিকী ও নুরুন্নবী ভারতে যাবার উদ্দেশ্যে ২২ তারিখে সদর দপ্তর মহানন্দপুর থেকে ভুয়াপুরে গিয়েছিলেন। সেই সুবাদে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ সভার সময় দপ্তরের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ লাভ করেন। সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য আঞ্চলিক বেসামরিক প্রধান আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিমের হাতে ভুয়াপুরের সভা সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট তুলে দিয়ে নূরুন্নবী, আবদুল বাসেত সিদ্দিকী ও নুরুল ইসলাম ২৫শে জুলাই ভারতে তাদের দ্বিতীয় যাত্রা করলেন।

ফুলতলার আক্রমণ
টাংগাইল ময়মনসিংহ সড়কের উপর মেজর হাবিব প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়। ২৬ তারিখে পনের জনের একটি দল নিয়ে ফুলতলা গ্রামের পাশে টাংগাইল ময়মনসিংহ পাকা সড়কে সারারাত ওৎপেতে বসে থাকে অথচ অন্য রাতের মত সামরিক গাড়ীর যাতায়াত নেই। রাত দুটার দিকে যদিও পর পর তিন-চারটি গাড়ী তাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। কিন্তু সেই গাড়ীগুলো হানাদার বাহিনীর নয়, সাধারণ পণ্যবাহী ও একটি যাত্রীবাহী গাড়ী। রাত বারটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত মশার কামড়ে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠে। সারারত সমস্ত স্নায়ু টান টান করা প্রতীক্ষার পর, ভোর হয় হয় সময়েও
পৃষ্ঠা নং ~ ২৬৮

যখন শিকারের টিকিটি দেখা নেই, তখন তাদের টগবগানো উত্তেজনায় ভাটি আর পর্বত প্রমাণ ধৈর্য্যে ফাটল ধরে ধরে অবস্থা। শিকার পাওয়ার আর কোন আশা নেই, আরেক রাতে সুদে আসলে উসুল হবে, এই চিন্তা করে কিছুটা হতাশা নিয়ে তারা ঘাঁটিতে ফিরে যাবে, এমন সময় বহুদূর থেকে কয়েকটি গাড়ীর শব্দ ভেসে আসে। একটু পরে গাড়ীর হেড লাইটের আলো তাদের দৃষ্টিগোচর হয়। আলো দেখে অভিজ্ঞ কমাণ্ডার মেজর হাবিব উৎসাহিত হয়ে উঠে। সে আঠার বৎসর বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরী করেছে, তাই তার মিলিটারী গাড়ীর হেডলাইটের আলো চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। সহযোদ্ধাদের সতর্ক করে নির্দেশ দেয়, ‘সারা রাতের মশার কামড়ের শোধ তুলতে হবে’, কথা শুনে ওৎপেতে থাকা সহযোদ্ধাদের মনে আবার পূর্বের তেজ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা ফিরে এল। তাদের বারে বারে অবাধ্য হতে চাওয়া ধৈর্য্য যেন তড়িৎ প্রবাহে পূর্বের সতেজতা লাভ করুন। পঞ্চেন্দ্রীয় আবার টনটনে সতর্ক হলো। মুক্তিযোদ্ধারা আগ্রহে ওৎপেতে অপেক্ষা করছে, শিকার আসছে-এ দেখা যায়। উত্তেজনার তাদের দেহমন ছটফট করছে। রক্তকণাগুলো খুবই দ্রুত বইছে ও ভীষণভাবে দাপাদাপি শুরু করেছে। চুপচাপ শান্ত মস্তিস্কে শিকারের দিকে চেয়ে থাকতে আর যেন তর সয় না। গাড়ীগুলো খুব ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। দু’তিন শত গজ দূরে থাকতেই পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গেল, এগিয়ে আসা তিনটি গাড়ী হানাদার- দেয়। ভোর চারটা ত্রিশ মিনিট। হানাদারদের প্রথম গাড়ী কমান্ডার হাবিরের সামনে এসে গেল। মেজর হাবিব পাকা রাস্তা থেকে ষাট-সত্তর গজ পশ্চিমে অবস্থান নিয়েছিল। গাড়ীগুলো মুক্তি বোদ্ধাদের সামনে এসে পড়লে কমান্ডার হাবিব তার এম. এম. জি. থেকে প্রথম গুলি ছুঁড়ল। সাথে সাথে সহযোদ্ধারা তাকে অনুসরণ করল। প্রথম ট্রাক গুলিতে সামনের গাড়ী নিয়ন্ত্রন হারিয়ে রাস্তার পুব পাশে উল্টে পড়ে গেল। মেজর হাবিব চালককে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে আর সহযোদ্ধারা গাড়ীর পুরো অংশে গুলি ছুঁড়ছে। তিনটি গাড়ীর দুটি জীপ আচমকা গুলিবৃষ্টির মূখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি রাস্তার পূর্ব পাশে পড়ে যায়। দ্বিতীয় জীপটি রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে পড়ে তবে সে গাড়িটিরও চাকা বায়ুহীন হয়ে যায়। তিনটি গাড়ীতে ত্রিশজন হানাদার নিয়মিত প্রভাতী টহলে বের হয়েছিল। অন্যান্য দিন এই টহল নির্বিঘ্নে হলেও ২৭শে জুলাই সকাল তাদের জন্য মোটেই শুভ হয়নি। ফুলতলায় মুক্তিবাহিনীর ফাঁদে পড়ে হানাদারদের সাত জন নিহত ও তের জন আহত হয়। অতর্কিত হানায় হানাদারদের ঘায়েল করে মেজর হাবিব সেখানে এক মুহুর্তও অপেক্ষা করেনি।

অধিকৃত শহরে ত্রাস
২৭শে জুলাই রাতে আমান উল্লাহর দল টাংগাইলের উপর প্রথম ঝটিকা আক্রমণ চালায়। আমান উল্লাহ, আনিস ও আরো চারজন টাংগাইল নতুন জেলা সদরের দিকে এগিয়ে গেল। তারা ধূলের চরের কাছাকাছি পুলিশ লাইন ও জেল থানার কাছে নির্বিঘ্নে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু তারপরই বিপত্তি। নতুন জেলা সদর সার্চলাইট জ্বালিয়ে দিনের মত আলো করে রাখা হয়েছে। আমান উল্লাহর দলকে হানাদার- দের উপর গুলি চালাতে হলে আরো এক হাজার গজ এগুতে হবে। আলোর মধ্যে এক হাজার
পৃষ্ঠা নং ~ ২৬৯

গজ তো দূরের কথা, একশ গজও যাওয়া সম্ভব নয়। আমান উল্লাহ ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ল কি করা যায়? আট মাইল পথ তারা খুবই প্রতিকূল পরিবেশে পায়ে হেঁটে এসেছে। যে জন্য আসা, তা যেন নাগালের বাইরে রয়ে গেল। ঘাটে এসে নৌকা ডুবার মত অবস্থা। তবে কি এমনি ফিরে যাবে, পশুশ্রম ছাড়া আর কিছুই হবে না। এতদূর থেকে গুলি চালানো যে কোন কাজের কাজ হবে না, তা বুঝতে তাদের বাকী থাকে না। হাতে তেমন সময়ও নেই। রাত দুটায় তার দলের চারটি ছোট ছোট গ্রুপ শহরে হানাদারদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে গ্রেনেড ছুঁড়বে। শহরে গ্রেনেড ছোড়ার পর শত্রুরা আরো সজাগ হয়ে যাবে। তখন তাদের কিছুই করা সম্ভব হবে না। যা করার রাত দুটার আগেই করতে হবে তখন রাত প্রায় এক-টা, হাতে আর একটি ঘন্টা সময়। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। এই সময় আনিসের মাথায় এক অভিনব বুদ্ধি আসে। সে আমান উল্লাহকে বলল, “সার্চ লাইটগুলো ভেতরে নয়, সীমানার একেবারে বাইরে। আমরা হানাদারদের শিবিরে গুলি করার আগেই যদি বেশ কয়েকটি সার্চ লাইট গুলি করে নিভিয়ে দিই, তা হলে সমস্ত এলাকাটাই অন্ধকারে ডুবে যাবে।” আনিসের বৃদ্ধি কমাণ্ডার আমান উল্লাহ মনঃপুত হয়। তারা খুব ভালভাবে শত্রুপক্ষের অবস্থান দেখে নেয়, কোথায় কোথায় বাঙ্কার আছে দিনের মত আলো থাকায় পাকিস্তানী হানাদারদের বাঙ্কারগুলো স্পষ্টভাবে তাদের নজরে আসে। ভালভাবে সমস্ত জায়গাটা দেখে নিয়ে চারজন চারটি পোস্টের নীচে গিয়ে সার্চ লাইটে গুলি ছুঁড়ে। বৈদ্যুতিক বাতিগুলো নিমিষে নিতে যায়। এতে নিকষ গভীর অন্ধকারে সমস্ত এলাকাটি ডুবে গেল।
এরপর শুরু হলো হানাদার বাহিনীর নিশি জাগরণ। আমান উল্লাহ ও আনিসের গুলিতে শত্রুর তেমন কোন ক্ষতি না হলেও সারারাত তাদের চরম উদ্ভিগ্নতায় কাটাতে হলো। মুক্তি বাহিনীর দশ গুলির জবাবে হানাদাররা হাজার গুলি চালাতে লাগল। সারারাত গুলির শ্রাদ্ধ চলল। শহরেও হানাদার ঘাঁটির উপর পর পর উনিশ কুড়িটা হাতবোমা বিস্ফোরিত হলো। এতে পাক বাহিনীর অবস্থা চরম দুর্দশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।

কালিদাস পাড়া সেতু
২৭শে জুলাই রাতে মেজর হাবিবুর রহমান তার দল নিয়ে দ্বিতীয়বার টাংগাইল ময়মনসিংহ সড়কে আক্রমণ করল। ত্বরিৎ ও তীব্র আক্রমণ। তারা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে। ২৭শে জুলাই রাত দুটায় কমাণ্ডার হাবিবুর রহমান, ছোট ফজলু ও কামরুলসহ কুড়ি বাইশ জনের দুটি দল নিয়ে ব্রাহ্মণশাসন ঘাটাইলের মাঝামাঝি কালিদাস পাড়া পাকা সেতুর রাজাকারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মিনিট কুড়ির আক্রমণে রাজাকাররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হাবিবের আক্রমণে ত্রিশজন রাজাকার এগারটি মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যায়। কমাণ্ডার হাবিব নিহতদের মধ্যে তার পরিচিত দুজন রাজাকারকে দেখতে পায়। তারা মোটেই দূধর্ষ প্রকৃতির নয়, অতি সাধারণ ঘরের সন্তান। নিরীহ ও সাধারণ রাজাকারদের মৃত্যুতে কমান্ডার হাবিবের অন্তর কেঁদে উঠে। এরপর থেকে প্রতিটি আক্রমণে রাজাকারদের প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা ও মমত্ববোধ লক্ষ্য করা গেছে।
কালিদাস পাড়া যুদ্ধে নিহত দুজন পরিচিত রাজাকারের বাড়ীতে তাদের মৃত্যু সংবাদ
পৃষ্ঠা নং ~ ২৭০

পাঠিয়ে দিয়ে কালিদাস পাড়া সেতু থেকে মেজর হাবিব চোদ্দটি রাইফেল ও এক হাজার গুলি উদ্ধার করে চটপট সরে পড়ে।
২৪শে জুলাই, টাংগাইলে রাজাকার ও আলবদরের একটি গ্রুপের এক মাস ব্যাপী প্রশিক্ষণ শেষ হল। অন্যদিকে এস. এস. সি পরীক্ষাও শেষ। ১৪ই জুলাইয়ে টাংগাইলে এস. এস. সি. পরীক্ষা বন্ধ করতে মধুপুরের দিক থেকে আসা একটি পরীক্ষার্থী বোঝাই বাসে কদমতলী বাজারের সামনে মিনু হাত বোমা ছুঁড়েছিল। এতে একজন পরীক্ষার্থী নিহত ও ষোলজন আহত হয়। একই দিনে করটিয়া, টাংগাইল ও কালিহাতীতে পরীক্ষার্থীবাহী ছটি গাড়ীর উপর মুক্তি যোদ্ধারা হাতবোমা ছুঁড়ে। ফলে ৭১ সালে টাংগাইল ও করটিয়া কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীদের শতকরা প্রায় আশি জন অনুপস্থিত ছিল। পঞ্চাশ ভাগ পরীক্ষার্থী ইচ্ছা করে হানাদার নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে চায় নি। এর পরেও যারা পরীক্ষা কেন্দ্রে হাজির হয়েছিল-তাদের অধিকাংশই হয় হানাদার সমর্থক অথবা সমর্থকদের সন্তান সন্ততি। এর মধ্যে সামান্য সংখ্যক ভাল ছেলে-মেয়েরাও ছিল। যারা সত্যিকার অর্থে খুব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী।

রূপবাণীতে বিস্ফোরণ
২৪ শে জুলাই রূপবানী সিনেমা হলে শ’তিনেক রাজাকার, আল-বদর ও তিনশ এস. এস. সি. পরীক্ষার্থী সিনেমা দেখতে ঢুকেছে। মিনু ও ছোট আনিসও তাদের সঙ্গে সিনেমা হলে ঢুকল। তাদের উদ্দেশ্য সিনেমা দেখা নয়, আলবদর রাজাকারদের একটি উচিৎ শিক্ষা দেয়া। হলে ঢুকে মিনুর সামান্য খটকা লাগে, হাতবোমা ছুঁড়লে দুএকজন নিরীহ মানুষও মরতে পারে। কিন্তু হলের পরিস্থিতি খুব ভালভাবে দেখার পর তার দ্বন্দ্ব কেটে যায়। রাজাকার-আলবদররা সবাই এক জায়গায় বসেছে। রূপালী পর্দায় একেবারে কাছাকাছি থেকে হলের প্রায় বার আনা অংশই তারা দখল করে রেখেছে। সিনেমা চলছে। উর্দু ছবি। প্রচণ্ড কিল-ঘুষি মারপিটের বই। দর্শকদের কৌতূহল উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। দর্শকদের দৃষ্ট পর্দায় নিবন্ধ। দ্রুম-দ্রুম কিল-ঘুষি চলছে, নায়ক ভিলেনের উপর গুলি চালাচ্ছে। ভিলেন আবার নায়ককে বিপদে ফেলার জন্য মাইন পুঁতে রাখছে। কোন কোন সময় তা আবার বিস্ফোরিত হচ্ছে, তবে নায়কের কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। এসব দৃশ্য দর্শকরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পর্দায় দেখে চলছে। কখনও হাততালি দিচ্ছে। কখনো উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে। আবার কখনও আনন্দে চিৎকার করে উঠছে। কারও কোনও খেয়াল নেই। সকলের দৃষ্টি সামনে, রূপালী পর্দার উপর।
প্রায় একঘন্টা ধরে সিনেমা চলছে। পর্দায় একটি চরম উত্তেজনাকর মুহুর্তে হলের মধ্যে প্রচণ্ড শব্দে পর পর তিনটি বিস্ফোরণ ঘটল। দর্শকরা প্রথমে বুঝতেই পারেনি সিনেমা পর্দার বিস্ফোরণে হল এমন কেঁপে উঠছে কেন। চারদিকে শোর গোল পড়ে গেল। চীৎকার হৈ চৈ করে সবাই হল থেকে বের হতে শুরু করল। মিনু ও ছোট আনিসও ভীত সন্ত্রস্ত দর্শকদের সাথে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। সিনেমা হলে তিনটি হাতবোমা বিস্ফোরণে ছয় জন রাজাকার আনবদরের দেহ টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আট জন রাজাকার হলের মধ্যে মারা পড়ে। ঐ দিনের
পৃষ্ঠা নং ~ ২৭১

হাতবোমার আঘাতে সত্তর জনের উপর আলবদর, রাজাকার আহত হয়। এদের মধ্যে গুরুতর আহত চারজন হাসপাতালে মারা যায়।

মর্টার উদ্ধার
১৯শে জুলাই, দেওপাড়া ঘাঁটি পতনের পর মুক্তিযোদ্ধারা ধলাপাড়ায় নতুন ঘাঁটি স্থাপন করে। নির্দেশ অনুসারে দেওপাড়া হানাদার ঘাঁটির উপর মাঝে মাঝে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলল। এতে দেওপাড়ায় হানাদাররা নিজেদের শিবিরেই বন্দী হয়ে পড়ল। ২৮ শে জুলাই। লোকমান কোম্পানীর সেকশন কমাণ্ডার মফিজের নেতৃত্বে আঠার জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল দেওপাড়ায় সারারাত শত্রুর অপেক্ষায় ওৎপেতে কাটিয়ে দিল। সকালেও তেমন কোন সুযোগ এল না। তাই তারা একটু পিছিয়ে হানাদারদের জন্য ওৎপেতে অপেক্ষা করতে থাকে। সকাল আটটায় বহু প্রতিক্ষিত সেই সুযোগ এল। দেওপাড়া আর্মী ক্যাম্প থেকে দশজন হানাদার মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে দিয়ে ফরেষ্ট অফিসের দিকে এগুতে থাকে। হানাদার দলটি একেবারে কাছে এলে মুক্তিযোদ্ধারা বেপরোয়া গুলি চালাল। আচকা গুলিতে দুজন হানাদার নিহত ও অন্যান্যরা অল্পবিস্তর আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের জবাবে হানাদারদের স্থায়ী ক্যাম্প থেকে আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো অবিশ্রান্ত গুলি আসা শুরু হলো। মুক্তিযোদ্ধারা যদিও নিরাপদে সরে এল, কিন্তু মফিজের হাতের ২ ইঞ্চি মর্টার নীচে খাদে পড়ে যায়। যেখানে মর্টার পড়ে-সে জায়গাটি বেশ গভীর জঙ্গল। অস্ত্র ফেলেই মফিজকে পিছিয়ে যেতে হলো। নিরাপদ জায়গায় এসে, সে অস্ত্রের চিন্তায় ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে। কারণ মুক্তিবাহিনীর একে তো অস্ত্র কম, তার উপর তার হাত থেকে অস্ত্র ফসকে গেছে। সে সহযোদ্ধাদের মূল ঘাঁটিতে পাঠিয়ে দিল।
দেওপাড়ার আশে-পাশে সারাদিন থেকে মফিজ শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখে এবং কার কাছ থেকে সাহায্য ও সহযোগিতা পাওয়া যেতে পারে, এমন লোকও খুঁজতে থাকে। সে পেয়েও যায় একজন বৃদ্ধকে। বৃদ্ধের নাম করিম মুন্সি। বয়স পঞ্চাশ-ষাট। চুলদাড়ি সব পাকা। উৎসাহী ও রসিক প্রকৃতির লোক। বৃদ্ধ হলেও বেশ সরল ও সাহসী। যেহেতু মুন্সি সেহেতু তার মাথায় সব সময় টুপি থাকত। তবে চরিত্রে কোন গোঁড়ামি ছিল না। তার গ্রাম দেওপাড়ার আধ মাইল পশ্চিমে শিবের পাড়া। করিম মুন্সি মে মাসের ২২-২৩ তারিখ থেকে আমার সাথে শুধু পরিচিতই হননি, আস্তে আস্তে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। করিম মুন্সি ঐ দিন মফিজকে ঐ বিপদ থেকে বাঁচাতে বিরাট সাহায্য করেছিলেন। তিনি প্রথমে মফিজের অস্ত্র ফেলে আসা জায়গাটির একেবারে কাছ দিয়ে সোজাসুজি দেওপাড়া বাজারে যান এবং একটু পরেই ফিরে আসেন। মুন্সি মিলিটারীদের নাকের ডগা দিয়ে যাওয়া আসা করলেও তারা তাকে কিছুই বলে নি। সকালের যুদ্ধক্ষেত্রে বিকেল তিন-টায় করিম মুন্সি তিন-চার জন রাখালকে ঘাস কাটার নামে পাঠিয়ে দেন। তারা ঘাস কাটতে শুরু করে দেয়। ঘাস কাটা রাখালদের হানাদাররা কিছুই বলছে না দেখে তিনটা ত্রিশ মিনিটে মফিজ খালি গায়ে গামছা পরে, কাচি ও ঝুড়ি নিয়ে রাখাল সেজে ঘাস কাটার ছলে রাখালদের সাথে যোগ দেয়। মনযোগ সহকারে অনেকক্ষন ঘাস কাটায় তার ঝুড়ি ভরে যায়। ঘাস কাটা তার আসল
পৃষ্ঠা নং ~ ২৭২

উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য ঘাস কাটার ফাঁকে ফাঁকে হারিয়ে যাওয়া মর্টার খুঁজে বের করা। এক সময় সে নির্দিষ্ট স্থানটি আবিস্কার করে ফেলে। মর্টারটি দেখতে পেয়ে মফিজের মনে আনন্দের শিহরন বয়ে যায়। ঘাস কাটতে কাটতে এক সময় ক্যাম্প আড়াল করে মফিজ মর্টারটি ঝুড়ির মধ্যে তুলে নেয়। এরপর আস্তে আস্তে দূরে সরে পড়তে থাকে। অন্যান্য রাখালের সাথে ধীরে ধীরে ওখান থেকে চলে আসে। ক্যাম্পে ফিরে এসে কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর লোকমান হোসেনকে যখন সারাদিনের রিপোর্ট দেয়, তখন তার আনন্দ দেখে কে!

ক্ষুদে জানবাজ
৩০ শে জুলাই, কালিহাতীতে চোদ্দ-পনের বছরের দুই মুক্তিযোদ্ধা এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটায়। কালিহাতী স্কুল মাঠে রাজাকারদের ট্রেনিং ক্যাম্প। শিবির থেকে প্রতিদিন সকালে কালিহাতী থেকে শোলাকুড়া পর্যন্ত প্রতিটি পুলে রাজাকারদের পাহারা বদলী করা হয়। গ্রেনেড পার্টির হায়দার ও বাচ্চু এই ব্যাপারটি সাতদিন নিখুঁতভাবে লক্ষ্য করেছে। ৩০শে জুলাই ভোর রাতে তারা কালিহাতী রাস্তার উপরে দু’টি প্রকাণ্ড বট গাছে উঠে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। অন্যান্য দিনের মত সে দিনও দুটি ট্রাক ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসে। তবে বদলী রাজাকারদের নিয়ে নয়, রাজাকারদের সকালের নাস্তা ও চা পৌছে দেয়ার জন্য। দু’টি খোলা ট্রাকের উপরে চার + চার = আট জন, আর ভেতরে আরও দুই+দুই = চার জন রাজাকার। হায়দার ও বাচ্চু ঐ ট্রাকের উপর হাতবোমা ছোড়ার পরিকল্পনা করল। কারণ বেশ বেলা হয়ে গেলে সরে পড়া কঠিন হতে পারে। ক্যাম্প থেকে ট্রাক দু’টি বটগাছের নীচে আসতেই, দুজনে এক সাথে দু’টি করে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারল। মুহুর্তে ট্রাক দু’টি একবার হাওয়ায় ভেসে উঠে আবার থপ্ করে মাটিতে আছড়ে পড়ল। বিস্ফোরিত গ্রেনেডের অসংখ্য টুকরো বটগাছের নানা স্থানে আঘাত করে। তবে মুক্তিযোদ্ধারা মোটা ডালের আড়ালে থাকায় তাদের কোন ক্ষতি হলো না। গ্রেনেড ফাটার পর তারা বটগাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে পাকা সড়কের পূব পাশে জেলে ও কামার পাড়ার মাঝ দিয়ে কস্তুরী পাড়ার দিকে নিরাপদে সরে পড়ে। এই ভয়াবহ গ্রেনেড বিস্ফোরণে প্রথম গাড়ীর একজন ও দ্বিতীয় গাড়ীর দুজন রাজাকার অক্কা পায়। বলতে গেলে আট জনই আহত-নিহত হয়। কারণ ট্রাকের বাইরের আটজন রাজাকারই কম বেশী আহত হয়েছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৭৩

বন্দী বিনিময়

সামরিক বিপর্যয়
জুনের শেষের দিকে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি একেবারে পাল্টে গেল। মুক্তাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য আক্রমণই সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা—এই রণনীতি অনুসরণ করে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের ঘাঁটিতে ক্রমাগত হামলা চালাচ্ছিল। হানাদাররাও জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করার সংকল্পে মরিয়া হয়ে উঠল। সারা জুন মাস মুক্তিবাহিনী সাফল্যের পর সাফল্য অর্জন করেছে। জুলাইয়ের ১৫ তারিখের পর সাফল্যের পাল্লা কিছু সময়ের জন্য হানাদারদের দিকে চলে যায়। মুক্তিবাহিনীর দেওপাড়া ও বাশাইল প্রতিরক্ষা ঘাঁটির পতন ঘটেছে। বল্লার মুক্তিযোদ্ধারা তিন মাইল পিছিয়ে বহেরাতলীতে দ্বিতীয় ঘাঁটি স্থাপন করেছে। উত্তরে রাঙ্গামাটি, পূর্বে আছিম ও ভালুকা, দক্ষিণ- পুবে কালিয়াকৈরের ফুলবাড়ী ও শ্রীপুরে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ঘাঁটির উপর বিরামহীনভাবে হানাদাররা আঘাত হেনে চলেছে। পশ্চিমাঞ্চলে পাবনার বেলকুচি, বেতিল, শাহজাদপুর ও কাজীপুর থানার যুক্তাঞ্চলগুলো প্রায় হাতছাড়া। এমনি বিপর্যস্ত অবস্থায় স্বাভাবিক কারণেই মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা হতাশ ও হতোদ্যম। এই অবস্থা লক্ষ্য করে এক শিবির থেকে আরেক শিবিরে উল্কার বেগে ছুটে বেড়াচ্ছিলাম এবং মাঝে মাঝে আচমকা আঘাত হেনে শত্রুর বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি করে হৃত মনোবল ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কিছু মূল ঘাটির পতন ঘটলেও চোরাগোপ্তা মারে ১৫ই জুলাই থেকে ২০শে আগষ্ট পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী অভাবনীয় সাফল্য অর্জন
করে।
২১শে জুলাই, মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর মহানন্দপুর এলাম। ২১-২২ তারিখ সদর দপ্তরের নানা কাজ কর্ম শেষ করে বিকেলে সাগরদীঘির রাঙ্গামাটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি পরিদর্শনে বের হলো, ঠিক এমনি সময় খবর এল পাথর ঘাটার মতিয়ার রহমান ও মোকাদ্দেছের কোম্পানী আক্রাস্ত হয়েছে। সারাদিন যুদ্ধ চালিয়ে টিকে থাকতে না পেরে তারা পাথরঘাটা থেকে সাড়ে তিন মাইল পিছিয়ে বাঁশতলী এবং রতনপুরে নতুন ঘাঁটি গেড়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলও কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছে। তাই প্রয়োজনীয় নির্দেশের জন্য কোম্পানী কমাণ্ডার সদর দপ্তরে দূত পাঠিয়েছে।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ঘাঁটিতে টিকে থাকতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকেই আমরা এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম, অস্ত্রের ভারসাম্যের প্রশ্নে আমাদের চাইতে হানাদার বাহিনী অনেক অনেক বেশী শক্তিশালী। তাই আমাদের পক্ষে সম্মুখ সমর বা নিয়মিত যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর আক্রমণ মোকাবেলা সম্ভব নয়। সেই কারণে আমরা সম্মুখ সমর সতর্কতার সাথে এড়িয়ে ঝটিকা আক্রমণই বরাবর চালিয়ে এসেছি এবং তাতে প্রচুর পরিমাণে সফলতাও পেয়েছি। অতীত অভিজ্ঞতা প্রসূত রণনীতি
পৃষ্ঠা নং ~ ২৭৪

পাথরঘাটার কমাণ্ডাররা সঠিকভাবে প্রয়োগে সেদিন ব্যর্থ হয়েছিল। তারা একটু সতর্ক থাকলে এগিয়ে আসা হানাদারদের উপর মাঝপথে যদি বারবার চোরাগোপ্তা আঘাত হানতে পারত, তাতে হয়তো হানাদারদের অসুবিধায় ফেলে সম্মুখ সংঘর্ষ এড়ানো যেত এবং পাথরঘাটা ঘাটির পতন নাও হতে পারত। পাথরঘাটার মুক্তিযোদ্ধাদের খবর সংগ্রহ ব্যবস্থা ছিল দুর্বল। সে কারণে তারা ঠিক সময়ে শত্রুর গতিবিধির সঠিক খবর সংগ্রহ করতে পারেনি, তাই সময় মত আঘাতও হানতে পারেনি। আমি সাগরদীঘি যাবার পরিকল্পনা বাতিল করে মরিচার কমাণ্ডার নবী নেওয়াজকে দেওপাড়ার প্রয়োজনীয় খবরা-খবর রাখতে নির্দেশ পাঠালাম।
রতনপুর ও বাঁশতলীতে নতুন ঘাঁটি পরিদর্শন ও সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে তাৎক্ষনিকভাবে রতনপুর ও বাঁশতলী অভিমুখে রওনা হলাম। খবর দিতে মতিয়ার – মোকাদ্দেছ কোম্পানীর যে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা এসেছিল, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আজাহারুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, ফিরোজ ও নিতাই। আমি সদর দপ্তর মহানন্দপুর থেকে সোজা বহেরাতলীতে এলাম। বহেরাতলীর এক মাইল পশ্চিমে কাকরাজান ও বহেরাতলীর মাঝামাঝি একটা গ্রামে রাত কাটানোর ব্যবস্থা হলো। আমার দলের সাথে মতিয়ার ও মোকাদ্দেছ কোম্পানীর যোদ্ধারাও রয়ে গেল।

দেওপাড়া ফরেষ্ট ক্যাম্প ভষ্মীভূত
সন্ধ্যা হতেই উনিশ জন সহযোদ্ধা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাত আটটায় মরিচাতে পৌঁছে নবী নেওয়াজের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় খবরাখবর শুনে দেওপাড়ার দিকে ছুটলাম। আমাদের উদ্দেশ্য দেওপাড়া ফরেষ্ট অফিসের হানাদার ঘাঁটিতে অতর্কিতে হামলা করে ফরেষ্ট অফিস দখল ও ধ্বংস করে দেয়া। আমার দলকে তিনভাগে ভাগ করে ফরেষ্ট অফিস আক্রমনের পরিকল্পনা করলাম। আমি প্রথমে ফরেষ্ট অফিসে ঢুকব বলে স্থির হলো। ছয়জনের দু’টি দলের একটি উত্তর, অন্যটি পুব দিক থেকে ফরেষ্ট অফিসে আক্রমণের জন্য এক দেড়শ’ গজ দূরে সুবিধামত জায়গায় অবস্থান নেবে। সংকেত দেয়ার পরই শুধু তারা ফরেষ্ট অফিসে গুলি ছুঁড়বে। আমরা আট জন হলাম—আবদুস সবুর খান, সাইদুর রহমান, মকবুল হোসেন খোকা, আবদুল হালিম, আরিফ আহমেদ দুলাল, গোহাইল বাড়ীর আবুল কাশেম, ভুয়াপুরের কদ্দুস ও আমি। আমার দলকেও দুভাগে ভাগ করলাম। আমার সাথে থাকল কদ্দুস, সাইদুর ও হালিম। অন্যদলে বাকী চারজন। দুভাগে বিভক্ত দুটি দলই সমানতালে বুকে হেঁটে আস্তে আস্তে ফরেষ্ট অফিসের হানদার ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ক্যাম্পে চারটি বাঙ্কার ছিল। আমরা যখন দেওপাড়া ফরেক্ট ক্যাম্পে হামলা করি, তখন সেখানে পনেরজন রাজাকার ও ছয়জন পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিশিয়া ছিল। আমাদের কাছে খবর ছিল, রাতে শুধু মাত্র দুটি বাঙ্কারে একজন করে দুজন ও ফরেক্ট ক্যাম্পের সুন্দর তিনটি ঘরের মাঝামাঝি একজন পাহারা দেয়। শিয়াল যেমন মুরগী ধরে ঠিক তেমনি পাহারারত তিনজন রাজাকারকে আমরা পেছন দিক থেকে জাপটে মুখ চেপে ধরে ফেললাম। তিনজন রাজাকারই টুটা করার সুযোগ পেল না। আক্রমণের প্রথম পর্ব অবিশ্বাস্য
পৃষ্ঠা নং ~ ২৭৫

রকমের নিঃশব্দতার মধ্যে সেরে ফেলা হলো। পাহারারত রাজাকাররা কাবু হয়ে গেলে তিনটি ঘরে একই সাথে অত্যন্ত দ্রুত পরপর প্রায় ত্রিশটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হলো। ফরেষ্ট ক্যাম্পের একশ’ জন রাজাকার ও মিলিশিয়ার ছয়জন আহত ও চার জনের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। বাকী কজন জামা কাপড় ফেলে প্রায় উলঙ্গ হয়ে জান নিয়ে পালিয়ে বাঁচে। ক্যাম্পে রাজাকার ও মিলিশিয়াদের একুশটি অস্ত্রই আমরা ছিনিয়ে নিলাম। অস্ত্রের মধ্যে চারটি চাইনিজ রাইফেল, দুটা স্টেনগান, পনেরটি ৩০৩ রাইফেল, নব্বইটি হাতবোমা ও আট হাজার গুলি। উত্তরে এবং পুরে অবস্থান নেয়া বারজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গুলি ছোড়ার জন্য উসখুস করছিল। গ্রেনেডের পর গ্রেনেড ফাটার ফলে সমস্ত এলাকা কেঁপে কেঁপে উঠছে অথচ গুলি চালানোর কিংবা অগ্রসর হওয়ার কোন নির্দেশই তাদের কাছে এলো না। ভীষণ অস্বস্তিকর অবস্থা। একটা কিছু হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কি হচ্ছে? পক্ষে না বিপক্ষে। জানতে না পেরে আক্রমণের জন্য অপেক্ষমান মুক্তিযোদ্ধারা যার পর নাই উৎকণ্ঠিত। যে ধরণের সংকেতে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ সেই সংকেত আসছে না। প্রতিটি মিনিট একটি যুগ। অপেক্ষার যেন শেষ নেই। জায়গা ছেড়ে কোথাও যাবার সুযোগ নেই। এগিয়ে গিয়ে কৌতূহল মেটানোর অবকাশ নেই। যুদ্ধ পরিকল্পনার বিন্দু পরিমাণ ত্রুটি বিচ্যুতি হলেই ভয়াবহ পরিনাম হতে পারে। তাই ধৈর্য্য ধরে শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। এক সময়ে ফরেক্ট ক্যাম্পে গ্রেনেড ফাটা বন্ধ হয়ে গেল। অন্য দিকে দিকবিদিক কাঁপিয়ে এক মাইল দক্ষিণ পশ্চিমের দেওপাড়া তহসিল অফিসের হানাদাররা অনবরত মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ছে। এই অবস্থায়ও আক্রমণ চালাবার নির্দেশ না পেয়ে স্বভাবতই ওৎ পেতে বসে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা একটা অস্বস্তিকর জ্বর জ্বর ভাব বোধ করছিল। ঠিক এমন সময় সকল উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে গুলি না চালিয়ে ফরেষ্ট ক্যাম্পে চলে আসার সংকেত তারা পেল। অভিযান সফলের সংকেত পেয়ে উর্ধ্বশ্বাসে মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে এল।
দশ জনকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দ্রুত উত্তর পুব দিকে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিলাম। অন্যদিকে ছয়জনকে তিনটি ঘরে ক্ষিপ্রতার সাথে আগুন ধরিয়ে দিতে আদেশ দিয়ে, কিছুটা দক্ষিণ পশ্চিমে এগিয়ে গিয়ে হানাদার ক্যাম্প লক্ষ্য করে দুই ইঞ্চি মর্টার থেকে দশ বারটি গোলা নিক্ষেপ করলাম। ফরেক্ট ক্যাম্প দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। সমস্ত এলাকা আলোকিত হয়ে গেছে। দশ পনের মিনিট আগুন জ্বলার পর ফরেষ্ট ক্যাম্পের ঘরগুলো যখন ভেঙে ভেঙে পড়তে থাকল, তখন সাথের নয় জনকে নিয়ে ফরেষ্ট ক্যাম্প ছেড়ে ধলাপাড়ার স্থায়ী ঘাঁটি অভিমুখে রওনা হলাম।
দেওপাড়া ফরেষ্ট ক্যাম্প থেকে আধ মাইল এসে আগে পাঠিয়ে দেয়া সহযোদ্ধাদের পেয়ে গেলাম। অস্ত্র নিয়ে আগে চলে আসা সহযোদ্ধাদের করুণ অবস্থা দেখে খুবই ব্যথিত হলাম। ক্যাম্প থেকে হানাদারদের অস্ত্রশস্ত্র যে দশজন বয়ে এনেছে তা তাদের পক্ষে বহন করা একেবারেই অসম্ভব। তাই তারা অত অস্ত্রশস্ত্রের বোঝা নিয়ে মরিয়া প্রায়, একেবারে জীবন যায় যায় অবস্থা। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ জিরিয়ে হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা অস্ত্র
পৃষ্ঠা নং ~ ২৭৬

ও গোলাবারুদ ভাগাভাগি করে আবার ধলাপাড়া ঘাঁটির দিকে এগুতে লাগলাম।
না, উদ্ধারকৃত অস্ত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। উনিশ জনের মধ্যে কমপক্ষে আট জনকে সব সময় অতিরিক্ত বোঝামুক্ত, প্রস্তুত রাখতে চাই। বাকী এগারজন, এগার জনের পক্ষে প্রায় কুড়ি মণ বয়ে নিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। অথচ এই অস্ত্র আমাদের কাছে মহামূল্যবান। দখল করা অস্ত্রশস্ত্র ধলাপাড়া ঘাঁটিতে অতি অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে। অগত্যা অনন্যেপায় হয়ে পাশের গ্রামের কয়েকজনের শরণাপন্ন হতে হলো। দেওপাড়া ধলাপাড়া রাস্তার পশ্চিমে চম্বলতলা গ্রাম। এ গ্রামেরই এক বাড়ীর দরজায় মুক্তিযোদ্ধারা কড়া নাড়তেই ধড়মড় করে একজন লোক উঠে এল। প্রথমে বাড়ীর লোকেরা ভেবেছিল রাজাকার অথবা পাকসেনারা বাড়ী লুটপাট করতে কিংবা অন্য কোন মতলবে এসেছে। সভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলে দুএক কথার পর যখন তাঁরা বুঝতে পারলেন হানাদার নয়, তাঁদের দরজায় মুক্তিযোদ্ধারাই কড়া নেড়েছে, তখন তারা উল্লাসে ফেটে পড়লেন। বস্তুতঃ বাড়ীর সবাই জেগেই ছিলেন। পাঁচ-সাত মাইলের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলিতে কেউ ঘুমোতে পারছিলেন না। অজানা ভয়ে সবাই শঙ্কিত ও উৎকণ্ঠিত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে দেখে তারা তাই খুবই উল্লসিত হলেন। সহযোদ্ধারা তাঁদের সহযোগিতা চাইলে বিদ্যুতের মত কাজ হলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পনের-ষোল জন সবল লোক তিনজন মুক্তিযোদ্ধার পিছু পিছু দেওপাড়া ধলাপাড়া রাস্তায় এসে অস্ত্রশস্ত্র মাথায় নিয়ে আমাদের ভারমুক্ত করলেন। স্থানীয় লোকদের পুরো রাস্তাটা পাড়ি দিতে হলোনা। ধলাপাড়ার কমাণ্ডার লোকমান হোসেনকে দেওপাড়ার দিকে এগিয়ে এসে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলাম। ধলাপাড়ার চার নম্বর কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর লোকমান হোসেন পঞ্চাশজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ধলাপাড়া থেকে দুই মাইল এগিয়ে অবস্থান নিয়ে বসেছিল। রাত সাড়ে বারটায় আমরা তার অবস্থান পর্যন্ত এলে মেজর লোকমানের দল আমাদের চ্যালেঞ্জ করল। ঐ রাতের গোপন সংকেত সঠিকভাবে বলার সাথে সাথে কমাণ্ডার লোকমান হোসেন এসে চাবুকের মত সোজা হয়ে অভিবাদন করল। মেজর লোকমানের দলের সাথে দেখা হওয়ার পর স্থানীয় লোকদের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার জন্য বার বার ধন্যবাদ দিয়ে বুকে বুক মিলিয়ে বিদায় জানালাম। স্থানীয় লোকেরা অত্যন্ত খুশী হয়ে ঘরে ফিরে গেলেন।
গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এই স্থানীয় লোকেরা বার বার বলেছিলেন, “ওরা আমাদের সব সময় জ্বালিয়ে মারছে, অন্ততঃ সপ্তাহে একবার যদি আপনারা ওদের ঘাঁটিতে এই রকম হামলা করেন, তা হলে আর আমাদের জ্বালাতে পারবে না।” মুক্তিবাহিনীর ঐ রাতের আক্রমণের ফলাফল কি তা কিন্তু স্থানীয় লোকেরা একবারও জানার আগ্রহ প্রকাশ করেনি। অস্ত্র এবং গোলাবারুদের বোঝার পরিমাণ দেখে তারা ধরেই নিয়েছিলেন, আমাদেরই জয় হয়েছে।
মেজর লোকমান হোসেন এবং তার দলের সদস্যরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলা বারুদ দেখে স্থানীয় লোকদের চাইতেও অনেক বেশী আনন্দিত ও উল্লিসিত হলো।

বিপত্তিতে বিলম্ব
২৩শে জুলাই বাঁশতলীর নতুন ঘাঁটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নির্বিঘ্নে যেতে পারলে
পৃষ্ঠা নং ~ ২৭৭

রাত এগারটায় রতনপুর বাঁশতলীর ঘাঁটিতে পৌঁছতে পারতাম, কিন্তু আমাদের নৌকা দুটি যখন কালিয়ান-কাউলজানীর কাছাকাছি আসে, তখন কালিয়ানের দক্ষিণ থেকে নৌকা দু’টির উপর আচমকা গুলি শুরু হয়। ফলে যাত্রায় কিছুটা বিঘ্ন ও বিলম্ব ঘটে। কালিয়ান-কাউলজানী এলাকায় তখন শত্রু থাকার কোন সম্ভাবনা ছিল না। যদিও গুলিতে আমাদের নৌকার তিলমাত্র ক্ষতি হয়নি; তবু গুলির উৎস জানতে কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল। খোঁজ-খবর নিয়ে আবিষ্কৃত হলো, বাশাইল থানা থেকে একদল রাজাকার পথ ভুলে ঐ পর্যন্ত এসে এলোপাথারী গুলি চালিয়ে আবার ফিরে গেছে। খবরটা আমার মনঃপুত হলো। রাজাকার না হলে, অতগুলো গুলি ছুঁড়ল অথচ একটি গুলিও আমাদের নৌকায় তো লাগলই না, এমনকি নৌকার আশে পাশে কোথাও পড়ল না। আন্দাজ করেছিলাম, গুলি যারা ছুঁড়ছে তারা নিশ্চয়ই রাজাকার। মুক্তিবাহিনী হলে নিশ্চয়ই অতোগুলো গুলিতে নৌকা দুটো ঝাঁঝরা হয়ে যেত। পাক-হানাদার বাহিনী হলেও এর কোন ব্যতিক্রম হত না। কিন্তু যেহেতু ব্যতিক্রম সেহেতু অনুমান, গুলি যারা ছুঁড়ছে তারা নির্ঘাত রাজাকার। একেবারে রাজাকার না হলেও পুলিশের ঊর্ধ্বে নয়। ঘন্টা তিনেক কাউলজানী বাজারের কাছে অপেক্ষা করে রাস্তাঘাটের খবরা-খবর নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করব ঠিক তখন আর এক নতুন বিপত্তি দেখা দিল।
মোকাদ্দেছ-মতিয়ারের দলের খবর দিতে আসা একজন সহযোদ্ধা আজাহারুল ইসলামের চোখ-মুখ রক্ত জবার মত লাল হয়ে উঠেছে। সে ঠিক দু’ঘন্টা আগের মত স্বচ্ছন্দ ও সহজভাবে চলাফেরা করতে পারছেনা। সহযোদ্ধাটির অস্বস্তিকর ভাব কয়েক মিনিট আগে প্রথম চোখে পড়েছিল। মিনিটে মিনিটে তার চলাফেরার অবনতি ঘটছে দেখে কাছে ডাকলাম,
— তোর কি হয়েছে?
সতের-আঠার বছরের শ্যামলা বলিষ্ঠ গড়নের সুদর্শন ছেলেটি বলল,
— না, কিছু হয়নি।
— তোর চোখ-মুখ লাল কেন? তোর চোখ কি সব সময় লাল থাকে? উত্তর দিতে হলো না, ওর হাত ধরেই বুঝলাম শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
— কিরে, তোর না কিছু হয়নি? জ্বরে তো শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তোর হাতিয়ারটা আমাকে দে।
আজহারের রাইফেলটি নিয়ে আরেকজনের হাতে তুলে দিলাম। আজাহার বোধহয় এতক্ষণ হাতিয়ারের জোরেই দাঁড়িয়েছিল। হাতিয়ার নেয়ার সাথে সাথে সে মাটিতে বসে পড়ল। তার তখন দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা বসে থাকারও শক্তি নেই। এমন অবস্থায় রাতের মত যাত্রা স্থগিত রাখা ঠিক হলো।
কাউলজানী বাজার থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে বাদিয়াজানে ঘাটের সোজা পাঁচশত গজ পুবে কাউলজানীর চৌধুরী বাড়ী। আমরা রাতে চৌধুরী বাড়ীতে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিরাট বাড়ী। এতো বাড়ী নয়, একটা পাড়া৷ আধ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে দু’শ পরিবারের গাদাগাদি বাস। এই
পৃষ্ঠা নং ~ ২৭৮

বাড়ীর বা পাড়ার পঁচিশ-ত্রিশজন তখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছে। এদের মধ্যে রঞ্জু ও কলিবুর রহমান বাঙালী পরবর্তীকালে খুবই দায়িত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছে। চৌধুরী বাড়ীর পূব আঙিনায় একটি বৈঠকখানায় বসার সাথে সাথে বাড়ীর ভেতর থেকে দশ বারজন পুরুষ ও দু’তিন জন মহিলা বেরিয়ে এলেন। মুক্তিযোদ্ধারা তখন পুরো গ্রামটার চার দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সতর্ক প্রহরায় নিয়োজিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে মানে তাদের থাকতে ও খেতে দিতে হবে। বলার আগেই ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেল। আর শুধু মুক্তিযোদ্ধারা নয়, আমি স্বয়ং এই প্রথম চৌধুরী বাড়ীতে থাকতে এসেছি। স্বভাবতই বাড়ীর সবাই খুবই গর্বিত। কেউ কেউ হয়তো দুঃখিত হতেও পারেন কিন্তু তা প্রকাশের কোন সুযোগ ছিল না, কারণ খুশী হওয়া লোকের সংখ্যাই ছিল বেশী।
আমি মাত্র মিনিট খানেক হলো বৈঠকখানায় বসেছি। এর মধ্যেই রঞ্জুর মা এলেন, এসেই রঞ্জুর খোঁজ খবর নিলেন। একটু পরে এলেন ডাঃ শাহজাদা চৌধুরীর মা। তিনিও ছেলের খোঁজ- খবর নিলেন। এরপর চৌধুরী বাড়ীর সব চাইতে ধনী পরিবারের একজন মা, তার সঙ্গে দশ বছরের একটি ছেলে নিয়ে এলেন, নাম নজরুল ইসলাম চৌধুরী। মায়ের বয়স চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ। তিনি এসেই তার ছেলের হাত আমার হাতে দিয়ে বললেন, “ওর বাবা ছয়-সাত মাস আগে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। আমাদের পয়সা-কড়ির খুব একটা অভাব নেই। এই-ই আমার একমাত্র ছেলে, একে দেখাশুনা করার অভিভাবকের অভাব আছে। তুমি আমার বড় ছেলে, এর দায়িত্ব বাবা, তুমি নাও।”
আমি প্রথম অবস্থায় অপ্রস্তুত হলেও, ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে আন্তরিকভাবে বললাম, “এর দায়িত্ব তো আমার ঘাড়ে আপনা-আপনিই এসে গেছে। এই দেশের সমস্ত এতিম ছেলে- মেয়েরা আমার ভাই বোন। আপনি এর জন্য উদ্বিগ্ন হবেন না। এর জন্য যখন যা প্রয়োজন মায়ের মতই আমাকে জানিয়ে দেবেন, আমি সাধ্যমত সব করার চেষ্টা করব।”
এই দিকে জ্বরে কাতর আজাহার খুবই ছট্‌ফট্ করছিল। জ্বরের যন্ত্রনায় একজন সহযোদ্ধা ভীষণ ছট্‌ফট্ করছে অথচ নিজে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও একফোঁটা ঔষধ তার মুখে তুলে দিতে পারছি না, এর চেয়ে দূঃখ আর কি হতে পারে। নিজের দলটির টুকিটাকি অসুখ-বিসুখ দেখাশুনা করার ভার যার উপর, তাকে ইতিমধ্যেই তিনবার অনুযোগের সুরে বলেছি,
“তোমার কাছে ভাই সবই আছে অথচ জ্বরের একটা বড়ি অথবা একফোঁটা ঔষধ যখন নিতান্তই প্রয়োজন, তাই-ই নেই। যখন যা প্রয়োজন তখন তা না থাকলে, অন্য সব থেকে লাভ কি?”
ঔষধ না থাকায় এমনিতেই চিকিৎসার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহযোদ্ধাটি যার নাই অস্বস্তিবোধ করছিল, তার উপর আমার কথাতে তার লজ্জা ও আত্মক্ষোভে মাটিতে মিশে যাবার অবস্থা হলো। তারও কোন দোষ ছিলনা। সাতদিনের আনুমানিক হিসাব ধরে জ্বরের জন্য নানা ধরনের কুইনাইন ও অন্যান্য ঔষধ-পত্র সাথে নিয়েছিল। কিন্তু চলার পথে যে সমস্ত অসুস্থ সাধারণ মানুষদের সাথে দেখা হয়েছে তাদেরকেই ঔষধ দেয়া হয়েছে, এতে তার ঝুঁলির প্রায় অনেক
পৃষ্ঠা নং ~ ২৭৯

ঔষধই ফুরিয়ে এসেছে। জ্বরের বড়ি এদিন দুপুরেই শেষ হয়েছে। এদিকে আজাহারের জ্বর বেড়েই চলেছে। ১০৪ ডিগ্রি যখন পেরিয়ে গেল, তখন খুব বিচলিত হয়ে পড়লাম। ঔষধ বলতে, ঘন্টা দু’ যাবত আজাহারের উপর শুধু দলাই মলাই চলছে। সহযোদ্ধারা কেউ হাত টিপছে, কেউ ঠাণ্ডা পট্টি লাগাচ্ছে। একাজে আমিও হাত লাগাচ্ছি। রাত দশটায় নজরুলদের দোতলায় আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। সাথে তখন সত্তর জন সহযোদ্ধা, তাদের পাঁচ ভাগে ভাগ করে দিলাম। চারটি দল গ্রামের চার কোনে প্রহরায় থাকল। পঞ্চম দলটি আমার সাথে রাত কাটাবে। দু’টি ঘরে আমার দলের রাত কাটানোর ব্যবস্থা হলো। দোতলা ঘরে রাত কাটানোর জন্য খুব একটা উপযোগী বলে মনে হলো না। তাই সাবধানতার জন্য ছয় জনকে নীচে সিঁড়ির সামনে রাখলাম। দলের বাকীরা দোতলায় আমার সাথে রাত কাটাবে। কড়া নির্দেশ দিলাম, বাকী রাতটুকু কেউ ঘুমাতে পারবে না। সারা রাতই পনের মিনিট অন্তর অন্তর গ্রামের চার কোণের সার্বিক খবর আনতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধারা দুপুর বারটায় খাবার খেয়েছিল, এরপর একবার চা পান করেছে। ঘড়ির কাটা রাত এগারটা ছুঁই ছুঁই করছে। এত দীর্ঘ সময় অভুক্ত থেকে স্বাভাবিক ভাবেই সবাই ক্ষুধার্ত। খাবারও প্রস্তুত। সকল সহযোদ্ধাদের নিজে বসে থেকে খাবার খাওয়ালাম। আমি খেলাম না। কয়েকজন দু’তিন বার খাবার খেতে অনুরোধ করল এবং কেন খাচ্ছিনা জিজ্ঞেস করল। আমি সব সময় সহযোদ্ধাদের পাশে বসে খাবার খেতাম। কিন্তু ঐ রাতে ব্যতিক্রম দেখে খোকা, দুলাল, সামসু ও সবুর বার বার জিজ্ঞেস করলে বললাম, “আমি একটু পরে শোবার ঘরে গিয়ে খাব।” আমার জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া হলো। অসুস্থ আজাহারের জন্য খুব সুন্দর করে রান্না করা সুজি ও গরম দুধ নেয়া হলো। আজহারকে খেতে বললে, আজাহার বলল, “খেতে পারবে না।”
তুই যদি কিছুই না খাস তাহলে যে আমারও খাওয়া চলে না।
এই কথা শুনে অত জ্বরের মধ্যেও আজহার একটু বিচলিত হলো। সাথে সাথে সে খাবার খেতে রাজী হয়ে গেল। সে সুজি খেতে শুরু করল কিন্তু পাঁচ-সাত চামচ খাওয়ার পর পরই বমি করে ফেলল।জ্বর এত তীব্র যে, কোন কিছুই তার পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়। খালি পেটে থাকা যে জ্বরের জন্য ভাল নয়, তা সবাই বুঝতে পারলাম। তাই সামান্য কিছু খাওয়ার জন্য ওকে আবার বললাম। আগের মতই সে খেতে রাজী হলো। এই বার ওর মুখে দুধের গ্লাস তুলে দেয়া হলো। ঢকঢক করে সে আধ গ্লাস দুধ পান করে ফেলল। এবার কিন্তু বমি হলো না। মিনিট দশেক দেখে খুব খুশী হলাম। এর পর আমি সামান্য ভাত খেয়ে এক গ্লাস দুধ পান করে রাতের খাবার শেষ করলাম।
আজাহারের জ্বর কিছুতেই কমছেনা। ছেলেটা পাগলের মত ছট্‌ফট্ করছে। এই দেখে অত রাতেও ওর মাথায় আবার পানি ঢালা হলো। ঠাণ্ডা পানির পটি কপালে সদা সর্বদা তো আছেই। পালা করে তিন জন সব সময় আজাহারের সেবা শুশ্রূষা করছে, সেবা-শুশ্রূষা মানে হাত-পা-
পৃষ্ঠা নং ~ ২৮০

মাথা টিপে দেয়া। রাত একটায় হাত-পা টিপে দেয়ার কাজে আমি অংশ নিলাম। মাথা, হাত ও পা টিপে দিচ্ছি। আঙ্গুল ফুটিয়ে দেয়ার সময় আজাহার হঠাৎ করে বুঝতে পারে ওর পায়ে আমার হাত পড়েছে। সে ত্বড়িৎ পা দু’টি সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে অথচ পা সরানোর মত শক্তিও ওর তখন নেই। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি হয়েছে আজাহার?’ সে অস্পষ্ট অস্ফুট স্বরে বলল,
— স্যার, আপনি আমার পায়ে হাত দিয়েন না। আমি এমনিতেই ভাল হয়ে যাব।
— কেন, পায়ে হাত দিলে কি তোর জাত যাবে? মাথায় হাত দেয়া যাবে, পায়ে হাত দেয়া যাবে না? অসুখটা ভাল হয়ে যাক, তখন আমাদের কষ্ট করতে হবে না। মুক্তিবাহিনীতে যখন এসেছিস্ তখন তোর চোখ মুখ ও হাতের মত পাও যে আমার কাছে দরকারী। পা না থাকলে তো মাইলের পর মাইল চলতে পারবি না।
এরপর আমি মাথার কাছে বসলাম। আমাকে তখন সাহায্য করছিল কুমাইরা বাড়ীর আমজাদ, ভুয়াপুরের কদ্দুস, রফিক ও কাশেম। আজাহারের মাথার কাছে বসে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। এই সময় আজাহার বারবার জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে থাকে, ‘আমি আর বাঁচবনা, এই আমার শেষ।’ আজহারের হাত টেনে নিয়ে বললাম, “তুই আমাকে শক্ত করে ধরে থাক, দেখবি সকালের মধ্যে তোর জ্বর সেরে যাবে।”
রাত দুটায় আজাহার ঘুমিয়ে পড়ল। আমরা পাঁচজন সারা রাত ওর কাছে ঠায় বসে কাটিয়ে দিলাম। হাত ধরতে বলার পর থেকে ভোর পাঁচটায় ঘুমভাঙা পর্যন্ত আজাহার আমার হাত ছাড়েনি। সত্যিই যাদু-মন্ত্রের মত পরম মেহেরবান খোদাতালার শুভ ইচ্ছায় ভোর চারটায় আজাহারের জ্বর ছেড়ে যায়।

পাথরঘাটা পুর্ণদখল
দুপুরে মোকাদ্দেছ ও মতিয়ার রহমানের নতুন ঘাঁটিতে পৌছে যুদ্ধ পরিস্থিতির পর্যালোচনা করলাম। পর্যায়ক্রমে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে মনে হলো, অস্ত্রবল ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলের অভাবে পাথরঘাটা ঘাঁটির পতন ঘটেনি। পতন ঘটেছে সঠিক কৌশল ও সময় মত শত্রুকে আঘাত না হানতে পারার কারণে। সহযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস, মনোবল ও উৎসাহ দেখে খুবই খুশী হলাম। আমার সাথে তখন ষাট জন মুক্তিযোদ্ধা। তারা যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম। বিকেল থেকে শুরু হলো পাথরঘাটা ঘাটির তথ্যানুসন্ধানের কাজ।
২৪শে জুলাই বিকেল থেকে নানাভাবে খবর সংগ্রহ করা হলো। মনে মনে স্থির করে ফেললাম, পাথরঘাটা থেকে হানাদারদের অবশ্যই হটাতে হবে। অন্ততঃ অল্পক্ষণের জন্য হলেও। এটা করতে না পারলে, আমার আসার কোন প্রভাব মুক্তিযোদ্ধাদের উপর যেমন পড়বে না, তেমনি হানাদাররাও আমাদের চাপের ভয়াবহতা বুঝতে পারবেনা। তাই মরিয়া হয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে লাগলাম। এর আগে কোন যুদ্ধকে মর্যাদার লড়াই হিসাবে মনে করিনি। কিন্তু মোকাদ্দেছ, মতিয়ার কোম্পানীর চারশ সহযোদ্ধার অফুরন্ত মনোবল দেখে বার বার মনে হলো,
পৃষ্ঠা নং ~ ২৮১

কমাণ্ডারদের একটু সাহস ও কৌশলের দুর্বলতার কারণেই এমনটা হয়েছে। আমি যে কোম্পানী কমাণ্ডারদের চাইতে বেশী সাহস ও বুদ্ধি রাখি, এটা সহযোদ্ধাদের দেখানো উচিত। কারণ মুক্তিযুদ্ধে কেবল কথা বলে আস্থা ও সম্মান কুড়ানো যায় না। আস্থা ও মর্যাদা কুড়াতে হয় প্রত্যক্ষভাবে
কাজ করে।
২৫শে জুলাই। দুপুরের খাবার শেষ। মুক্তিযোদ্ধাদের সমবেত করে জানতে চাইলাম, কে কে আমার সাথে স্বেচ্ছায় অভিযানে যেতে রাজী আছে। সবাই সহযোগী হতে ইচ্ছা প্রকাশ করল। আমি হাসতে হাসতে বললাম,
– বন্ধুরা, এটা আমার আদেশ নয়, এটা আমার অনুরোধ। তাই ভেবে-চিন্তে বল।’ তখনো সকলেই আগের মতই ইচ্ছা প্রকাশ করল। “ভাইয়েরা এতজনের দরকার নেই। আমার সঙ্গে তোমাদের মধ্যে থেকে মাত্র ত্রিশজনকে নিতে চাই। সবাই যখন যেতে চাও, তখন আমিই ত্রিশজনকে বেছে নেব।”
কিছু সাহসী ও অভিজ্ঞ যোদ্ধা বেছে নিলাম। এবং তাদের পরামর্শে অন্যদের নিয়ে মোট ত্রিশজনের একটি দল গঠন করলাম। বেছে বেছে নেয়া ত্রিশজনকে আলাদা করে আমার দলের সাথে রাখলাম। তখনও অনেকেই জানেনা, আমার আসল উদ্দেশ্য কি? পরিকল্পনাই বা কি? বিকেল পাঁচটায় নব্বই জন সহযোদ্ধা নিয়ে পন্নীদের রতনপুর খামারবাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লাম।
২২শে জুলাই সন্ধ্যায় যখন পাথরঘাটার মুক্তিবাহিনী ঘাঁটির পতন ঘটে, তখন পাকবাহিনীর নিয়মিত দুটি কোম্পানী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। অতি সহজেই ঘাঁটির পতন ঘটায়, তারা স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের নিরাপদ বোধ করতে থাকে। এতে তাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনাও বেড়ে যায়। পরদিন ২৩শে জুলাই হানাদারবাহিনীর একশ জন সৈন্য মির্জাপুরে ফিরে যায়। দু’দিন দুদল হানাদার ফিরে যাবার পর পাথরঘাটা ফরেষ্ট অফিস ঘাঁটিতে অবশিষ্ট থাকে মাত্র নব্বই কি একশ জন! ২৪শে জুলাই ফিরে যাওয়া দলের গতিবিধি মুক্তিবাহিনী পুরোটাই লক্ষ্য করেছে। ২৩ তারিখে ফেরার সঠিক খবরও সংগ্রহ করা হয়েছে। এ অবস্থায় ২৫শে জুলাই হানাদারদের ঘাঁটিতে আক্রমণের নতুন কৌশল অবলম্বন করা হলো। যোদ্ধাদের নিয়ে পাথরঘাটার অনেকটা পশ্চিম- দক্ষিণে বরদাম পর্যন্ত চলে এলাম। সেখান থেকে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে ছ’টি নৌকায় পাক-বাহিনীর পতাকা উড়িয়ে আবার পাথরঘাটার দিকে রওনা হলাম। প্রত্যেকটি নৌকার সামনে ও পেছনে দু’তিন জন করে খাকী পোষাক পরা, হেলমেট মাথায় মুক্তিযোদ্ধা দাড় করিয়ে রাখা হলো। নৌকা দেখে কারো বুঝবার উপায় নেই যে, এগুলো পাকবাহিনীর নয়। আশপাশের গ্রামেও এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলো। গ্রামের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় আশপাশের লোকজন ছুটাছুটি দৌড়া-দৌড়ি শুরু করে দিল। অনেকে পালাতে লাগল। ভীত-সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীদের এই ছুটাছুটি ও পলায়ন দেখে আমরা খুশী হলাম। নৌকাগুলো ঠিক সাড়ে ছয়-টায় পাথরঘাটা ক্যাম্পের হাজার গজের মধ্যে এসে গেল৷ নৌকাগুলো এত কাছাকাছি হওয়ার পরও হানাদারদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলো না৷ নৌকাগুলো আস্তে আস্তে যথারীতি এগুচ্ছে। হানাদার ক্যাম্প মাত্র তিনশ গজ দূরে। তখনও
পৃষ্ঠা নং ~ ২৮১

হানাদাররা নৌকায় নিজেদের লোক সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত। তাদের মধ্যে কোন উত্তেজনা নেই। তাদের হয়তো রসদ অথবা বদলী লোক আসছে। আমার নৌকা সবার ডানে, মনে হয়েছে জায়গাটি খুবই নিরাপদ। শত্রুরা গুলি ছুঁড়লেও কুড়ি-পঁচিশ গজ সরে যেতে পারলেই আড়াল পেয়ে যাব। প্রথম নৌকা ঘাটের একশ গজের মধ্যে চলে গেছে। পাহারারত সৈনিকটি তখন ঘাট পারে এগিয়ে এল। দুটি নৌকা ঘাটের পঁচিশ গজ কাছে গিয়ে, ঘাটে না ভিড়ে বামদিকে সরে যেতে থাকে। এতেও পাহারারত সৈনিকটির মনে কোন সন্দেহ জাগে না। সে মনে করে, পেছনের নৌকায় হয়তো কোন বড় অফিসার আছেন। সেহেতু সামনের নৌকা দুটি সরে গিয়ে, অফিসারকে আগে নামার সুযোগ করে দিচ্ছে। দুটি নৌকা বামে ও একটি নৌকা ডানে এগিয়ে, ঘাট থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে বিনা বাধায় ভিড়ল। আমার নৌকা পশ্চিমের ঘাট থেকে প্রায় তিনশ গজ পূব-দক্ষিণে ভিড়ে গেল। আমাকে আর একটি নৌকা অনুসরণ করছিল। শেষ নৌকা তখন মাত্র কুড়ি-পঁচিশ গজ দূরে। বাঁ দিকে নোঙর করা নৌকা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুততার সাথে নেমে পড়ে। তখনও পাহারারত সদস্যটির লক্ষ্য এগিয়ে আসা নৌকাটির দিকে। ডান পাশে নোঙর করা নৌকা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নেমে পড়েছে। শেষ নৌকাটি যখন ঘাটে ভিড়বে ভিড়বে অবস্থা, ঠিক সেই মুহূর্তে পাহারারত সৈনিকটির মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়। সে চাইনিজ রাইফেল তুলে নৌকাটিকে চ্যালেঞ্জ করল। তার রাইফেল তোলাই সার। কারণ ডানদিকের নৌকা থেকে দু’টি দল পাহারারত সৈনিকটির চার-পাঁচ হাত পেছনে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিল। বন্দুক উঁচিয়ে চ্যালেঞ্জ করার সাথে সাথে পেছন থেকে একজন ৩০৩ রাইফেলের বাট দিয়ে পাঞ্জাবী সৈনিক- টির মাথায় প্রচণ্ড জোরে আঘাত হানল। আঘাতের আওয়াজ হলো প্রায় গুলির শব্দের মতই। সৈনিকটির মাথা দু’ভাগ হয়ে গেল। গুলির আঘাতের চাইতেও সে ত্বরিৎ মৃত্যুবরণ করল। ৩০৩ রাইফেল যুদ্ধের জন্য যেমন, তেমনি বাঙালীদের হাতে লাঠি হিসাবেও তা খুবই উপযোগী হাতিয়ার। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা বেশ কয়েকবার এই ভাবেই তার প্রমাণ রেখেছি।
ঘাটপারে আচমকা শব্দ শুনে পাহারারত দ্বিতীয় সৈনিকটি স্বাভাবিক ভাবেই সেই দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। কি ঘটছে, তা বুঝতে পারার আগেই হানাদারটির পেছন থেকে একযোগে গুলি ও গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে শুরু হলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে, কোন উপায় না দেখে, সে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার পক্ষে আর পানি থেকে উঠে আসা সম্ভব হলো না। প্রথম পাহারারত হানাদারটির মাথায় আঘাত করার সময়, বামদিকের চল্লিশ জনের দলটি পেছন থেকে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। হানাদার বাহিনী পশ্চিম দক্ষিণ থেকে আক্রমণের কথা ভাবতেই পারেনি। পাথরঘাটা ক্যাম্পে যে আট-দশটি বাঙ্কার খোঁড়া হয়েছিল তার ছ’টির মুখই ছিল পশ্চিম দিকে। মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চিম দিকটি আগলে ছিল। পশ্চাৎ রক্ষার জন্য তারা মাত্র দু’টি বাঙ্কার পূবদিকে খুঁড়েছিল। মিলিটারিরা ফরেষ্ট ক্যাম্পে এসে পশ্চিমের বাঙ্কার গুলো মাটি দিয়ে ভড়াট করে ফেলে। পুব-উত্তর দিকে নতুন করে দশটি বাঙ্কার খুঁড়ে। কারণ মুক্তিবাহিনী বা তাদের ভাষায় দুষ্কৃতিকারীরা পূব-উত্তরের দিকে আছে। তাই বন্দুকের নলও হওয়া উচিত পূব-উত্তরে।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৮৩

কিন্তু ২৫শে জুলাই সন্ধ্যায়, তাদের যমদূতেরা পূর্ব-উত্তর দিক থেকে না এসে পশ্চিম দিক থেকে একেবারে ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পঁচিশ গজের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে যাবার পরও তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, কি ঘটছে।
বাম দিকের দলের নেতা আবদুস সবুর খান, সাইদুর, খোকা, আমজাদ, কদ্দুস, বেনুসহ চল্লিশ জনের একটি দল নিয়ে প্রথমে আঘাত হানল। আমি তখন সবুর থেকে প্রায় একশ পঞ্চাশ গজ দক্ষিণে। সন্ধ্যায় ক্যাম্প কমান্ডার লেফটেন্যান্ট নাজমুল হুদা এক সুবেদার ও দুজন হাবিলদার বেষ্টিত হয়ে ডাকবাংলোর সামনে বসে বেশ আমেজের সাথে চা পান করছিল। সবুরের দল প্রথমে এই চারজনের উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল, হঠাৎ বাঘের সামনে পড়লে মানুষ যেভাবে আর্ত চিৎকার করে উঠে, তেমনি অকস্মাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে ষোল পাঞ্জাব রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্টের শেষ চিৎকার ‘ভা-গো দুশমন অ্যায়া’ বলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমরা হানাদারদের ব্যারাকের উপর বৃষ্টিধারার মত গুলি ছুঁড়তে লাগলাম। রফিক, মুক্তাগাছার মকবুল ও মোতালেব গুর্খা সহ ছ’সাত জন অসীম সাহসিকতার সাথে ক্যাম্পের পূর্ব উত্তরে ছুটে গিয়ে বাঙ্কারে বাঙ্কারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে লাগল। মাত্র কুড়ি মিনিটের ঝটিকা আক্রমণে প্রচণ্ড ক্ষমতাধর হানাদার বাহিনী একেবারে চুপসে গেল। তারা পালাবার পথ খুঁজে পেলনা। পশ্চিম দিক থেকে আমরা আক্রমণ করেছি। পুবে শত্রু আছে জেনেও তারা বিশৃঙ্খলভাবে ক্যাম্প ছেড়ে ছুটে পূব দিকেই গেল। পাথরঘাটা পুনর্দখলের কুড়ি পঁচিশ মিনিটের যুদ্ধে হানাদাররা পুরোপুরি নেতৃত্ব হীন হয়ে, বারটি মৃতদেহ ও আহত ছজনকে ফেলে পালাতে শুরু করে। আহত নিহতদের চাইতে হানাদারদের অস্ত্র-শস্ত্রে ও ব্যবহারিক দ্রব্য-সামগ্রী পড়ে ছিল অনেক বেশী। হানাদাররা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে, পূর্ব দিকে মাইল খানেক গিয়ে সোজা দক্ষিণে চলতে শুরু করে। তাদের অর্ধেকের হাতেই অস্ত্র নেই। যাদের হাতে অস্ত্র আছে, তাদেরও অনেকের কাছে কোন গুলি নেই। অনেকেই পোষাক ও জুতা মোজা পরার সুযোগ পায়নি। এখানেও সেই বইলানপুরের পুলিশদের পালাবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
ফুল দল থেকে দুজন হানাদার ছিটকে পড়েছিল। তারা একটু পরেই মুক্তিবাহিনীর কাছে ধরা পড়ে। পাথরঘাটা দখলে আসায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ, কাপড়-চোপড় রেশন ও টাকা-কড়ি আমাদের হাতে আসে। টাকার পরিমাণ প্রায় চল্লিশ হাজার। দখলকৃত অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে দুটি চাইনিজ আড়াই ইঞ্চি মর্টার, দশটি চাইনিজ কারবাইন, একটি ৮২ ব্লান্ডার সাইট, দুটি চাইনীজ এল, এম, জি, একটি চাইনীজ এম, এম, জি, কুড়িটি চাইনীজ রাইফেল সহ কয়েকটি ৩০৩ রাইফেল।
আমি যখন বিকেল চারটায় রতনপুরের ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন হাসতে হাসতে সহযোদ্ধাদের বলেছিলাম, ‘তোমরা আজ রাতে এখানে থাকবে না। তোমাদের পুরানো জায়গায় থাকবে। সন্ধ্যা সাতটায় রতনপুরের দলের অর্ধেক সদস্য পাথরঘাটা ক্যাম্পে এসে উদ্ধারকৃত মাল একত্রিত ও ঘাঁটির প্রতিরক্ষার দায়িত্বে লেগে গেল। ক্লান্ত হয়ে আমি ঠিক সেই
পৃষ্ঠা নং ~ ২৮৪

জায়গাটিতেই গিয়ে বসলাম, সেখানে হানাদার কমাণ্ডার লেফটেন্যান্ট নাজমুল হুদা একটু আগেই বসেছিল।
মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কথা শুনে অসংখ্য লোক ক্যাম্পে আসতে চেষ্টা করলে তাদের ফিরিয়ে দিয়ে বলা হলো, সকালের আগে কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আসতে পারবে না। রাত আটটায় এলাকার সর্বত্র কারফিউ জারী করা হলো।
আমি সামান্য একটু বিশ্রাম নিয়ে সবুরকে ডেকে বললাম, “সবুর, যারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গেল তাদের সঠিক খবর জানতে না পারলে রাতটা আমাদের জন্য মোটেই নিরাপদ নয়। মোকাদ্দেছ ও মতিকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এস।” মতি ও মোকাদ্দেছকে হাসতে হাসতে বললাম, “দেখ তোমাদের এই পাথরঘাটা ক্যাম্পে আমি খাবার খেতে চেয়েছিলাম। তোমরা ডাকাতদের হাতে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলে, আমরা ডাকাতদের তাড়িয়ে দিয়েছি। তোমরা এখানে অনেকদিন যাবৎ আছ। তাই ডাকাতরা কোন দিকে গেল, এক ঘন্টার মধ্যে তার সঠিক খবর এনে দাও। আমার বিশ্বাস, এই কাজটা তোমরা সহজেই করতে পারবে। মতিয়ার ও মোকাদ্দেছ সমস্বরে বলল, ‘হ্যা, হ্যা, স্যার এক ঘন্টার মধ্যে আমরা সঠিক খবর এনে দিচ্ছি।”
রাত বারটা। তখনো মৃত দেহগুলো পড়ে আছে। সৎকারের প্রয়োজন। বারটি হানাদার লাশ ফরেষ্ট ক্যাম্প থেকে এক মাইল দক্ষিণে ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন করা হলো। ছজন আহতের মধ্যে দুজনের অবস্থা খুবই গুরুতর। শত্রু হওয়া সত্ত্বেও যন্ত্রণা কাতর হানাদারদের দেখে আমাদেরও কষ্ট হচ্ছিল। যতটা সম্ভব ঔষধপত্রও দেয়া হলো। তবে সর্বাধুনিক চিকিৎসা পাওয়া হানাদারদের মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসায় বোধ করি তেমন কাজ হচ্ছিল না। তাছাড়া আহত হলেও দু’তিনজন হানাদার ছিল বেশ বদমাশ প্রকৃতির। যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে, ছটফট করছে অথচ আমাদের ঔষধ খাবে না, সামান্য পানিও না। ওদের কথা হলো, ‘তোম লোগ কাফের হো। মর যাউ, তব ভি পানি নেহি পিউঙ্গা।’ অনেক অনুনয় বিনয় করে টুপি পরা দাড়িওয়ালা লোক এনে আরবী উর্দুতে কথা বলিয়ে, দোয়াদরূদ শুনিয়ে এই মূর্খ ও গোয়ারদের কিছুটা পথে আনা হলো। মোল্লাদের দিয়েই দুনিয়ার এই বিদ্যাবুদ্ধিহীন নির্বোধ আজব চিজদের ঔষধপত্র, দুধ ও পানি পান করানো হলো। আহতের মধ্যে দুজন রাত দুটায় মারা গেল। তাদেরও দাফন করা হলো। চারজন আহত ও ছজন অক্ষত বন্দীর অবস্থা মোটামোটি স্বাভাবিকই ছিল। পরদিন সকালে আরও দুজন পাক-হানাদার স্থানীয় জনসাধারনের হাতে ধরা পড়ে। জনগণ তাদেরকেও বেদম প্রহারের পর মুক্তিবাহিনীর শিবিরে পৌছিয়ে দেন।
২৬ শে জুলাই। মুক্তিবাহিনীর হাতে অক্ষত আট জন, সামান্য আহত চার জন হানাদার বন্দী। সুস্থ আট জনের মধ্যে তিনজন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের লোক। এদের ব্যবহার অপূর্ব। প্রথম অবস্থায় যদিও এই তিন জন খাবার ও পানি পান করতে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু যখন কোন কিছু না খাওয়ার কারণ জানতে চাইলাম, তখন তারা জানাল, ‘হাত পাউ বান্দে হুয়ে পাঠান কভি খানা নেহি খাতা।” তাদের বুঝলাম, আপনারা যুদ্ধ করতে এসে ধরা পড়েছেন,
পৃষ্ঠা নং ~ ২৮৫

আপনাদের হাতে কোন মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়লে অথবা বন্দী হলে, মুক্তিযোদ্ধারা এর চাইতে অনেক বেশী অপমান ও নির্যাতন ভোগ করত। আমার কথায় তারা প্রতিবাদ করল, “নেহী, হামলোগ কভি কিসিপর কই কিসিমকা জুলুম নেহী কিয়া।” অনেক ভাবে বলা-কওয়ার পর তারা ব্যাপারটা বুঝল। এরপর প্রায় ত্রিশ ঘন্টা অত্যান্ত সৌজন্যমূলক ভদ্রোচিত আচরণ করেছে৷ কিন্তু দুজন পাঞ্জাবী সৈনিক ত্রিশ ঘন্টা মুক্তিবাহিনীর হাতে কিছুই খেলনা। শুধু খেতে অস্বীকার করল না, মুক্তিবাহিনীকে ঐ অবস্থায়ও প্রচণ্ডভাবে গালিগালাজ করে চলল।
পাথরঘাটার পরাজয় হানাদাররা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। বরং এ পরাজয়ে তারা বিশেষভাবে ক্রোধান্বিত হয়। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বেশী সৈন্য না থাকায়, তারা এক অথবা দুই কোম্পানী সৈন্য নিয়ে পাথরঘাটায় আর হামলা চালাতে সাহস পায়নি। আমরাও বসে থাকলাম না। এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করলাম। ২৬ শে জুলাই দুপুরে কমাণ্ডার আজাদ কামালকে নির্দেশ দেয়া হলো, “দেওহাটা, হাটুভাঙ্গা ও মির্জাপুরের দুজন হানাদার সমর্থক চেয়ারম্যানকে সন্ধ্যার আগে, অবশ্য অবশ্যই পাথরঘাটায় ধরে আনতে হবে।” পাকিস্তান সেনা বাহিনীর প্রাক্তন গেরিলা সৈনিক আজাদ ত্বরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করল। দুজন চেয়ারম্যানকে আনতে তাকে কষ্ট করতে হলো না। সে অনায়াসে তাদের ডেকে আনল। চেয়াম্যানদ্বয় আমার সামনে বলির পাঠার মত কাপছিল। আমি তাদের আশ্বস্ত করলাম, “আপনাদের কোন ভয় নেই। আপনাদের প্রভুদের কিছু খবর দেওয়ার জন্য ডেকে আনা হয়েছে।” দুজন চেয়ারম্যানের হাতে একই বিষয়বস্তু সম্বলিত দু’টি চিঠি তুলে দিলাম। আমার পক্ষে পত্র দু’টিতে স্বাক্ষর করল রঞ্জু।
পত্রের বক্তব্যঃ-
‘আপনাদের বারজন সৈনিক আমাদের হাতে বন্দী। এর মধ্যে চারজন আহত। আমরা এদের ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার বিশ্লেষণ করেছি। আমরা এদের দুজনকে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও স্বোচ্ছারের জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছি। বিনিময়ের ভিত্তিতে একদিনের মধ্যে আপনারা সৈনিকদের ফেরত নিতে পারেন। পাথরঘাটা যুদ্ধে নিহত চৌদ্দ জনের লাশ যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে। ইচ্ছা করলে আমার দেওয়া তালিকা থেকে প্রত্যেক জীবিত সৈন্যের বিনিময়ে তিনজন এবং একজন মৃত সৈনিকের বিনিময়ে দুজন বেসামরিক ব্যাক্তিকে ছেড়ে দিতে হবে। এ বিনিময় সংক্রান্ত দায়িত্ব পত্র বাহকদের মত লোকেরাই ভালভাবে পালন করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি আশা করব, এই পত্রের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষনিকভাবে জানানোর মত জ্ঞান আপনাদের আছে।’ এই পত্রের প্রতিক্রিয়া হলো ব্যাপক। হানাদাররা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তারাও যে বিপদে পড়লে কখনো কখনো সুবোধ বালকের মত হয়ে যায়, তা এখান থেকে আমরা বুঝে নিলাম। আমার তালিকা মত, স্বাধীনতা-সমর্থক সত্তর জনকে ছেড়ে দিয়ে, কবরস্থ সৈনিকদের লাশসহ সবাইকে হানাদাররা বিনিময়ের ভিত্তিতে ফিরিয়ে নিল। মুক্তিবাহিনী এই প্রথম একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি হিসেবে হানাদারদের কাছে স্বীকৃতি লাভ করল। এবং এটাই প্রথম মুক্তিবাহিনীর সাথে হানাদারদের বন্দী বিনিময়। আনুষ্ঠানিক বন্দী বিনিময় পরবর্তীতে আরও দুবার হয়েছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৮৬

রাজাকারদের আত্মসমর্পন

২৭ শে জুলাই, দুপুরে হতেয়া রওনা হলাম। একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে নিয়েই হতেয়ায় যাচ্ছি। জুন মাসে ৩ নম্বর কোম্পানী কমাণ্ডার শওকত মোমেন শাজাহান কালমেঘা- হতেয়া ও ফুলবাড়ীয়া এলাকায় পরিভ্রমনের সময় ফুলবাড়ীয়া ইউনিয়নের চেয়াম্যান মুসলীম লীগের আক্কেল আলী সিকদারকে দেশদ্রোহী ও হানাদার-সমর্থক দালাল বলে চিহ্নিত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে গুলি করে। কিন্তু সে সামান্য আহত হয়ে, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেঁচে যায়। আহত চেয়াম্যান গত একমাস ধরে, আমার কাছে আত্মসমর্পন করতে বার বার প্রস্তাব পাঠাচ্ছিল। আক্কেল আলী সিকদার দীর্ঘদিনের মুসলীম লীগার হলেও, ২৫ শে মার্চের পর সত্যিকার অর্থেই তার মন— মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছিল। কিন্তু স্থানীয় লোকজন ও ৩ নম্বর কোম্পানী কমাণ্ডার শওকত মোমেন শাজাহান তা বিশ্বাস করতে পারেনি। বিশ্বাস না করার কারণও ছিল, একটি দু’টি নয়, ভুরি ভুরি। তাই শওকত মোমেন শাজাহান তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেবার জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল।
পাথরঘাটার একটু পুবে পেকুয়া- বাঁশতলীর কাছে একটি বাড়িতে রাত কাটালাম। বাড়িটি একজন হিন্দু ভদ্রলোকের। বিরাট বাড়ি কিন্তু পরিত্যক্ত। বাড়ির বাসিন্দারা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ভয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে বাড়িটি সম্পূর্ণ অক্ষত, ঝকঝকে তকতকে রয়েছে। তখনকার মত বাড়িটির দেখাশুনা করার দায়িত্ব স্বেচ্ছাসেবকদের উপর বর্তেছে।
২৮ শে জুলাই, সকাল দশটায় হতেয়াতে গেলাম। অসংখ্য স্থানীয় লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তাদের অনেকে আমাকে চেনেন, অনেকে শুধু নাম শুনেছেন, কেউ আবার শুধু আমাদের কাজের কথা শুনেছেন। এই ধরনের অসংখ্য লোকের ভিড় এগারটা থেকে বারটা পর্যন্ত আরও বাড়তে থাকে। ভিড় ক্রমাগত বেড়ে যেতে থাকায় বারটার পর লোকজনের সাথে দেখা করা বন্ধ করে দেয়া হলো। জনগণকে অনুরোধ করা হলো, দুঘন্টা পর বেলা দুটায় হতেয়া আপগ্রেড স্কুল মাঠে আমরা সভা করব। আপনারা দয়া করে দুটায় স্কুল মাঠে উপস্থিত থাকবেন। ঠিক কাটায় কাটায় বারটায় আমার স্কুল জীবনের বন্ধু, হাটুভাঙ্গা ইউনিয়নের স্বেচ্ছা সেবক কমাণ্ডার আবদুল বারেক ফুলবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আক্কেল আলী সিকদারকে এনে হাজির করল। তখন বারেকের ব্যবহার বন্ধুর মত নয়, একজন সুশৃঙ্খল বাহিনীর দায়িত্বশীল লোকের ব্যবহার। সে শুধু বলল, “আমার সাথে করে আনা লোকটি আক্কেল আলী সিকদার। সে আমার স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেছে বিধায় মাননীয় সর্বাধিনায়কের সামনে আমি তাকে পেশ করলাম।” এই বলে মূহুর্ত দেরী না করে সে চলে গেল।

অনন্য আক্কেল আলী
অনেক দিন থেকে আক্কেল আলী সিকদারের ইচ্ছার কথা শুনেছিলাম। তাকে অনেকক্ষণ
পৃষ্ঠা নং ~ ২৮৭

খুঁটিয়ে দেখলাম। আঙ্কেল আলী সিকদারের চোখ মুখের দিকে তাকালে যে কেউ তার বুদ্ধি দীপ্তি উপলব্ধি করতে পারবেন। তার চোখ দুটো তীক্ষ্ণ ও জ্বল জ্বলে, মুখের শ্রী খুবই আকর্ষণীয়, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, স্বাস্থ্য ভাল, গায়ের রঙ ঘন শ্যামলা। সিকদারকে পাঁচ সাত মিনিট ভালভাবে দেখে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। আমাকে চেয়ার থেকে উঠতে দেখে সেও চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তার ক্ষতস্থানগুলো একটি ভালভাবে দেখলাম। আক্কেল আলী সিকদারের গায়ে তিনটি গুলির ক্ষতচিহ্ন, বুকের সামান্য উপরে ও ডান কাঁধের নীচে, অন্য দুটির একটি ডান বাহুতে, অন্যটি ডান হাতের কব্জি ও কনুইয়ের মাঝামাঝি। তিনটি গুলির একটিও হাড় স্পর্শ করেনি। হাতের দু’টো ক্ষত শুকিয়ে গেছে, কাঁধের নীচের ক্ষতটা তখনও কিছুটা কাঁচা। নিখুঁতভাবে ক্ষতস্থান দেখে সিকদার সাহেবকে বললাম, “আমি আপনার কথা শুনেছি। আপনি মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে আহত হওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধে কেন অংশ গ্রহণ করতে চান, শুধু সেই কথাটা বুঝতে পারলে, আপনি আমাদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়তো বা পেলেও পেতে পারেন। আপনার যা বলার, নির্ভয়ে বলতে পারেন।” “মারতে হয়, আপনি নিজ হাতে গুলি করে মেরে ফেলুন” – একথা বলেই আক্কেল আলী সিকদার তার গুলি খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ও প্রাণ বাঁচানোর কাহিনী বর্ণনা করলেন, “খালের পাড়ে দাঁড় করিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে প্রথম গুলি করে। আমার ডান হাতে লাগে। আমি খালে ঝাঁপিয়ে পড়ি, সাথে সাথে আমার উপর আরোও দু’টি গুলি ছোড়া হয়। এ অবস্থাতে নড়াচড়া না করে, খালের ধারেই একটি গাছের গুড়ির আড়ালে আত্মগোপন করে থাকি। মুক্তিবাহিনী আমার অবস্থানের চার-পাঁচ হাতের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করেছে। তখন শুধু আমি ইয়া আল্লাহ্, করছি। খোঁজাখুঁজির পর মুক্তিবাহিনী একটু দূরে সরে গেলে, ক্ষতস্থান চেপে ধরে সামান্য দূরে একটি বাড়ীতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সে বাড়ী থেকে আমাকে প্রথমে কালিয়াকৈরে ও পরদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। কুড়ি দিন চিকিৎসার পর, আমি মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলাম। এখন আপনার সামনে এসেছি। আপনি যা ভাল মনে করেন, তাই করুন। আমি মুক্তিবাহিনীতে কাজ করতে চাই। আমাকে এ সুযোগ দিলে দেশের জন্য জীবন কোরবান করে দেব।”
ইতিমধ্যে আক্কেল আলী সিকদারের অতীত কার্যকলাপ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছিলাম। আক্কেল আলী একজন গোঁড়া মুসলীম লীগার। ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত সে পাকিস্তানের সমর্থক ছিল। তবে ২৫ শে মার্চের পর তার মানসিকতার পরিবর্তন এসেছে এবং দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে চায় এ রকম একটি বিশ্বাস সৃষ্টি হওয়ায় তার উপর থেকে পূর্বঘোষিত মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করে তাকে মুক্তিবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে সে একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে অতুলনীয় অবদান রেখেছে।
আক্কেল আলী সিকদার শুধু একা আত্মসমর্পন করতে আসেনি, সে ফুলবাড়িয়ার একশ সাইত্রিশ জন সশস্ত্র রাজাকারের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। রাজাকাররা তখন হতেয়া
পৃষ্ঠা নং ~ ২৮৮

থেকে দুমাইল দক্ষিণে আবদুল বারেকের স্বেচ্ছাসেবকদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। রাজাকারদের একটি শর্তে তারা আত্মসমর্পন করবে তবে তাদের ষোল জনকে থাকবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, বাকীদের ক্ষেত্রে যে ধরনের সিদ্ধান্ত হবে, তাই-ই তারা মেনে নেবে। রাজাকাররা বোল্ট ও ম্যাগজিন ছাড়া ৩০৩ রাইফেল কাঁধে হতেয়া স্কুলের সামনে এসে সামরিক অভিবাদন জানিয়ে আত্মসমর্পন করল। ষোল জন রাজাকারের থাকার ব্যবস্থা করে বাকীদের মুক্তি দিলাম। যারা মুক্তি বাহিনীতে ভর্তি হতে চাইল তাদের পনের দিন পর এসে শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হতে বলা হলো।

হতেয়ার জনসভা
ঠিক দু’টায় হতেয়া স্কুল মাঠে সভা অনুষ্ঠিত হলো। মকবুল হোসেন খোকা, এইখানে প্রথম আমার নামে এক নতুন শ্লোগান তুলল। মুক্তিবাহিনীতে আমি প্রথমে ‘কাদের ভাই’ পরে ‘ওস্তাদ’ তার পরে ‘স্যার’ বলে অভিহিত হয়ে আসছিলাম। পর্যায়ক্রমে এই সম্বোধনগুলো কেউ কাউকে বলে দেয়নি, মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের সুবিধা মত করে নিয়েছে। তখন পর্যন্ত এই তিন ভাবেই মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে সম্বোধন করত। কেউ কেউ আবার আমাকে ‘বজ্রভাই’ বলেও ডাকত (আমার ডাক নাম বজ্র)। মকবুল হোসেন খোকা আবার একটি নতুন বিশেষণ যোগ করল। ‘বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।’ আমি এ পর্যন্ত সহ-যোদ্ধাদের কোন সম্বোধনে আপত্তি তুলিনি। আমি মনে করতাম, সম্বোধনে এমন কিছু এসে যায় না। সংগঠনের প্রতি আনুগত্য সহযোদ্ধাদের প্রতি ভালবাসা, সাংগঠনিক রীতিনীতিতে সুশৃঙ্খল ও কর্তব্যে অটল থাকাই হলো প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার আবশ্যিক যোগ্যতা। মকবুল হোসেন খোকার নতুন বিশেষণ যুক্ত সম্বোধন শুনার সাথে সাথে প্রবল আপত্তি করলাম। খোকাকে ডেকে আচ্ছা রকম ধমক লাগালাম। আমার চোখমুখ দেখে খোকা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। মকবুল হোসেন খোকার মুখ থেকে যে শ্লোগান বেরিয়ে গেছে, সেই শ্লোগান তখন সমবেত মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত বজ্রনিনাদে পরিণত হয়েছে। তারা জোর কন্ঠে শ্লোগান তুলছে, ‘বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জিন্দাবাদ, বঙ্গবীর লও সালাম – লও সালাম,’ এমনি ধরনের হাজার শ্লোগানে তখন হতেয়া আপগ্রেড স্কুলের মাঠ মুখরিত।
সভার শুরুতে মুক্তিবাহিনীর হতেয়া কোম্পানী কমাণ্ডার বামন হাটার হবি স্বাগত জানিয়ে বক্তৃতা করল। স্থানীয় একজন প্রবীন লোকও এই সভায় মুক্তিবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা জানিয়ে উদ্দীপনাপূর্ণ বক্তৃতা করলেন। এর পর আমি বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে স্থানীয় জনগণকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালাম, মুক্তিযোদ্ধাদের বার বার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলাম। অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও জনগণকে আশ্বাস দিলাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের নানা দিক বিশ্লেষণ করে কুড়ি মিনিট এক আবেগময়ী বক্তৃতা করলাম। মাইকের ব্যবস্থা না থাকায় আমাকে পুরোটা সময় উচ্চ কন্ঠে বক্তব্য রাখতে হলো। বক্তৃতার শেষ প্রান্তে বললাম,
“আজ আমাদের মাঝে এমন একজন লোক হাজির আছেন, তিনি হয় শয়তান, না হয় ফেরেশতা। দুই মাস আগে হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসাবে চিহ্নিত করে মুক্তিবাহিনী ফুল-
পৃষ্ঠা নং ~ ২৮৯

বাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আক্কেল আলী সিকদারকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল এবং তা কার্যকরী করার জন্য তারা তিন-রাউণ্ড গুলিও সিকদারের উপর চালিয়ে ছিল। কিন্তু খোস কিসমত, সিকদার বেঁচে গেছেন। আমি যদি আক্কেল আলী সিকদার হতাম আর আমাকে যদি মুক্তিবাহিনী ঐ ভাবে গুলি করত, বেঁচে গিয়ে আমি কিছুতেই মুক্তিবাহিনীর কাছে আসতাম না। শুধু তাই নয়, আমি জীবন দিয়ে মুক্তিবাহিনীর সর্বনাশের চেষ্টা করতাম। অথচ সিকদার আমাদের কাছে এসেছেন, শুধু এসেছেন তাই নয়। তিনি দেশের জন্য, জাতির জন্য আত্মোৎসর্গ করতে চান। যদি সত্যিকারেই তিনি তাই-ই চান এবং তাই-ই করেন, তাহলে আক্কেল আলী সিকদারের মত মানুষ আমাদের দেশে বিরল। তিনি আমার নমস্য। আশা করি তিনি আমার সশ্রদ্ধ সালাম গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন।” এর পর সিকদারকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো, সবাই তাকে এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন।
এই হতেয়ার ছোট্ট একটি ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অর্থ সংগ্রহের গতিই পাল্টে দিয়েছিল। আমি যখন বক্তৃতা করছিলাম, তখন এক পূর্ণ বয়সী লোক খালি গায়ে গামছা কাঁধে বক্তৃতা শুনছিলেন। প্রায় দু’তিন হাজার জনতার মাঝে হঠাৎ সেই লোকটি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “এই যে কাদের সিদ্দিকী, মুক্তিবাহিনীর কি আমাগোর টেকার ঠেকা নাই?” লোকটি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল আমি তাকে কাছে আসতে বললাম। আমার পাশে এলে বললাম, “এবার বলুন।” তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে আবারো সেই আগের কথা বলতে যাচ্ছিলেন। তাকে বুঝিয়ে বললাম, “আমাকে নয় সামনের জনতাকে উদ্দেশ্য করে যা বলার বলুন।” যখন লোকটিকে ডেকেছিলাম, তখনই আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল, ভুল করলাম নাতো! ভীড়ের মধ্যে লোকটি যা বলতে চাচ্ছিল, এখানে এসে তা যদি আর বলতে না পারে। না, ভুল করিনি। আমার পাশে দাঁড়িয়েও লোকটি প্রচণ্ড আবেগে বলে চললো, “আমরা গরীব বইলা আমাগোর টেকার কি মুক্তিগোর দরকার নাই। আপনের মাইনসেরা গেরামের বড় বড় মাইনসের কাছ থিকা টেকা নেয়, আমরা দুই এক টেকা দিতে গেলে তারা কয়, ‘তোমাগো টাকা লাগবেনা’। আপনি আইজ কইয়া যাইবেন, আমাগো টেকার আপনের দরকার আছে কি নাই।”
লোকটির কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। লোকটি বলছে কি? আমার গরীবের সহযোগীতারই তো দরকার। তাদের সাহায্যই সবার আগে চাই। সবাইকে বললাম, “গরীব মানুষের টাকাই আমার বেশী প্রয়োজন। কিভাবে তা নেয়া হবে দু’একদিনের মধ্যে হ্যাণ্ডবিল ছেপে তা জানিয়ে দেয়া হবে।” পরে জানলাম লোকটির রাগের মূল কারন কি? আমাদের যারা চাঁদা সংগ্রহ করে তারা বড় বড় অংকের প্রতি বেশী গুরুত্ব দেয়। বড় বড় অংক জমা নেওয়ায় সুবিধা, লিখতে হয় কম। বড় অংকের কারণে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে অনেক কম আর আয়ও পরে বেশী। অন্যদিকে দুই এক টাকা করে নিলে লিখতে হয় অনেক, ভুলের সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশী। অথচ সারাদিন শেষে খুব একটা আয় পরে না। তাই চাঁদা তোলার দায়িত্বে নিয়োজিতরা সরলমনে খুচরা চাঁদা প্রত্যাখান করেছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৯০

আমাদের তহবিল সংগ্রহ হতো নানা ভাবে :-
১। স্বতঃস্ফূর্ত চাঁদা।
২। জরিমানা।
৩। জুলাই-আগষ্টের দিক থেকে ট্যাক্স থেকে।
৪। নানা বিষয়ে লাইসেন্স প্রদান এবং ফি গ্রহনের মাধ্যমে।

হতেয়া থেকে হেড কোয়ার্টারে ফিরে জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত অর্থ সংগ্রহের উত্তম পন্থা আবিস্কার নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। চাঁদা সংগ্রহে সাধারন মানুষের মনে এমন ধারনা হলো যে আমরা গরীব মানুষের দু’ এক টাকা চাঁদা নেইনা, তাহলে এর দারুন প্রতিক্রিয়া হবে। অনেক আলাপ আলোচনার পর স্থির হলো, সকলকে ইউনিয়ন পরিষদের প্রাপ্য ট্যাক্স দিয়ে দিতে বলা হবে। সেই মত লিফলেট প্রচার করা হলো, যে যে ইউনিয়ন পরিষদ আমাদের নিয়ন্ত্রনে ছিল সেখানে পরিষদের লোকেরাই ট্যাক্স উঠাবে, যে যে পরিষদ পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই সেখানে আমরা প্রতিনিধি ঠিক করে দেবো, তারা ইউনিয়নের যাবতীয় ট্যাক্স সংগ্রহ করবেন।
বিজ্ঞপ্তি জারীর সাত দিনের মধ্যে ট্যাক্স সংগ্রহ শুরু হয়ে গেল। মাত্র চৌদ্দ দিনে ৮০ লক্ষ টাকা মুক্তিবাহিনীর তহবিলে জমা পড়লো। এই অভাবনীয় ব্যাপার দেখে আমি বিস্মিত হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে ১৪-১৫ বছরে অনেক পীড়াপীড়ি ও ঘটি বাটি ক্রোকের পরও অনেক ক্ষেত্রে সমস্ত ট্যাক্স আদায় হয়নি, সেখানে তেলেসমাতির মতো দুসপ্তাহে সমস্ত ট্যাক্স কি করে যে আদায় হলো ভাবাই যায়না। পরে খোজ নিয়ে দেখলাম সর্বনিম্ন দেড় টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৮ শত টাকা পরিবারের প্রতি ট্যাক্স এসেছিল।
ট্যাক্সের টাকা আদায় হওয়ার সাথে সাথে প্রথমে চকিদার ও দাতব্য চিকিৎসালয় এবং অন্যান্য যে সংস্থার ইউনিয়ন পরিষদ দায় ভার বহন করতো তাদের বেতন ও অন্যান্য দায় মেটাতে নির্দেশ দেয়া হলো। ১৪-১৫ বছর যেমন ট্যাক্স আদায় হয়নি তেমনি চকিদার, দফাদার ও চিকিৎসালয়ের এল. এম. এফ. ডাক্তার ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কেরানী, পিয়ন ও অন্যান্যদের ৫-৬ বছরের বেতনও বাকী পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের অমন উত্তাল সময়েও একবারে তাদের সকলের বেতন শোধ করে দেয়ায় তারাও কম বিস্মিত হননি। ইউনিয়ন পরিষদের সাথে সংশ্লিষ্টরা একত্রে বকেয়া বেতন পেয়ে তারা যেমন হাতে চাঁদ পেয়েছিলেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোমড় বেধে নেমেছিলেন।
বিকেলে আবার হতেয়া থেকে রওনা হলাম। সন্ধ্যায় কলিদাস বাজারে স্থানীয় পাঁচ- ছয়শ লোকের সামনে কয়েক মিনিটের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করে, আবার উত্তর দিকে এগিয়ে চললাম। কালিয়ান প্রাইমারী স্কুলের কাছাকাছি হামিদুল হককে ডেকে বললাম, “আমার একটু পুবে যাওয়া দরকার। আজ রাতে চলতে চাইনা। আশে পাশে কোথাও থাকা যায় কিনা চিন্তা করে দেখুন।” এই বলে স্কুলের মাঠেই বসে পড়লাম। হামিদুল হক ও আর. ও. সাহেব আলোচনা শুরু করলেন। এই শলা পরামর্শে আরো অংশ নিল এলাকার সফল স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার
পৃষ্ঠা নং ~ ২৯১

মোজাম্মেল হক। কোথায় রাত কাটানো হবে, তা তারাই তিনজনে মিলে ঠিক করলেন।
স্কুলের মাঠে যখন বসেছিলাম তখন কালিয়ানের পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বৎসর বয়সী মোটামুটি সম্পদশালী আবদুল হক নিজেই তার পরিচয় দিয়ে আহলাদে গদ গদ হয়ে আমার সাথে মোসাফা করতে এলেন। উঠে দাঁড়িয়ে তার সাথে হাত মিলালাম। তবে ভুল করে সেই সময় হাল্কা ভাবে একটি কথা বলে হক সাহেবের হাত মেলানোর আনন্দ স্তিমিত করে দিলাম। হাত মিলানো ও পরিচয় শেষে হক সাহেবকে বললাম, “আপনাকে কেন জানি জামাতে ইসলামের লোক বলে মনে হচ্ছে। সত্যিই কি আপনি জামাতে ইসলাম করেন?” ভদ্রলোক নানা ভাবে বলতে লাগলেন, “না না স্যার, আমি জামাতে ইসলাম করি না। আমি হইলাম আপনাগোর লোক।”
ওখান থেকে একটু পরেই আমরা চলে এসেছিলাম। কিন্তু হক সাহেবের যে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল, তা আমি অনেক দিন পর জানতে পারি।
আমরা চলে আসার পর হক সাহেবের ছটফটানি দেখে কে? মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ আছে, এমন যাকেই পাচ্ছেন, তাকেই বলছেন, “সি-ইন-সি স্যারের কাছে আমার নামে কে যে কি লাগাইছে, কেন আমাকে জামাতে ইসলামের লোক মনে করলেন? হায়, হায়, এখন আমার উপায়?” স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার মোজাম্মেল হককেও তিনি বার বার জিজ্ঞেস করেছেন, সি-ইন-সি সাহেবের ঐ কথার অর্থ কি? সবার আন্তরিক আশ্বাসেও যুদ্ধ কালীন সময়ে তার কিন্তু কোন রাতেই পুরো ঘুম হয়নি।
কালিয়ান স্কুল থেকে আমরা পূবদিকে হেঁটে চলছি। কয়েক মিনিট চলার পর হামিদ সাহেব পাশে এসে খুব নিচু গলায় বললেন, “স্যার, সামনে সবুর চেয়ারম্যানের বাড়ি, আমরা সেখানে উঠতে পারি। চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশ দিয়ে একটি রাস্তা পূব পশ্চিমে চলে গেছে। অন্যটি বাটাজোর থেকে বাড়ির মাইল খানেক কিংবা দেড়েক উত্তর দিয়ে কীর্তন খোলায় গিয়ে মিশেছে। জায়গাটা খুব নিরাপদ।” যথা আজ্ঞা বলে রাজী হয়ে গেলাম। আনুমানিক সাড়ে সাতটায় চেয়ারম্যানের ছোট্ট দোতলা ঘরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। ভাল করে হাত মুখ ধুয়ে ছোট্ট দোতলায় বসলাম। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে দোতলায় থাকাটা প্রথম মনঃপুত হলোনা। কিন্তু জায়গাটা খুবই নিরাপদ। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ চতুর্দিকে কুড়ি পঁচিশ মাইল সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত, তাই দোতলায় থাকা নিয়ে বেশী আপত্তি তুললাম না। দেহরক্ষী দলের সবুর, সাইদুর, ফেরদৌস, তমসের, হালিম, দুলাল, বেনু, আমজাদ, রফিক, কুদ্দুস ও অন্য সহযোদ্ধাদের তেমন আপত্তি নেই। দোতলাতেই রাতটা কাটাব স্থির হলো।
হাতমুখ ধুয়ে বসে আছি। পাশে হামিদুল হক ও আর. ও. সাহেব। বারান্দায় রাইফেল হাতে সাইদুর ও অন্যান্যরা বসে নানা ধরনের কথাবার্তা বলছে। বাড়ির চারদিকেই কঠোর পাহারার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। অনেকপথ পায়ে হেঁটে বেশ পিপাসা বোধ করছিলাম, তাই পানি চাওয়া হলো। একটু পরে দেখলাম, কুড়ি-বাইশ বছরের এক যুবক রঙ্গিন চশমা পড়ে পানির জগ গ্লাস নিয়ে দোতলার সিড়ি বেয়ে উঠছে। যুবকটিকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেলাম। এ আবার কে? এ, এখানে কেন? আর রাতের বেলায় চোখে রঙিন চশমাই বা কেন? আমি ধারনা করে নিলাম,
পৃষ্ঠা নং ~ ২৯২

যুবকটি নিশ্চয়ই ‘হঠাৎ বাবু’ হবে। অল্প বয়স তো। বোধ হয় বাইরে থেকে এসেছে, তাই রাতেও রঙিন চশমা দেখানোর লোভ সামলাতে পারেনি। আমি ঠিক করে ফেললাম, সকালে যাওয়ার পথে যদি এই বেমানান ছেলেটিকে পাই, কষে এক ধমক লাগিয়ে যাব। গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়েই ছেলেটি সরে পড়ল। হামিদুল হক ও আর. ও. সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই উদ্ভট চীজটা কে?’
— কে, এই যে পানি দিয়ে গেল? ওতো স্যার, এই বাড়ীর বড় ছেলে। আবদুস সবুর চেয়ারম্যানের বড় ছেলে লুৎফর।
আমি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সৈনিকের চাকুরীতে ইস্তাফা দিয়ে লেখা পড়ায় তিন বছর ক্ষতি করে ১৯৬৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে করটিয়া সাদত কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ৬৮ সালেরই অক্টোবর-নভেম্বরের কোন এক সন্ধ্যায় করটিয়া বাজারে বানিজ তালুকদারের ছেলে কবীরদের দোকানের সামনে ঢাকা-টাংগাইল রাস্তার উপর, ছেলেটিকে ঐ একই চশমা পরা দেখেছিলাম। তবে সেই সন্ধ্যায় কোন কথা হয়নি। এক বছর পর, করটিয়া কলেজের নির্বাচনের সময় আবার দ্বিতীয়বার ঠিক সেই একই জায়গায় ছেলেটিকে পেয়েছিলাম। সেবার কলেজ ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে আমাদের সমর্থনপুষ্ট আবুল কালাম আজাদ ও শামসুল হক যথাক্রমে সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। আবুল কালাম আজাদ ও শামসুল হক প্যানেলে আনন্দ মজলিস সম্পাদক পদে মনোনীত হয়েছিল কচুয়ার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ্। লুৎফর সেবার আবদুল্লাহর সমর্থনে প্রচার অভিযানে নেমেছিল। চোখে রঙিন চশমা, কোমরে জাম্পার বাধা সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী শ্যামলা যুবকটিকে দ্বিতীয় সাক্ষাতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘ক্যানভাসে বেরিয়েছি।’ বাস, ঐ পর্যন্তই।
গজারিয়ার সবুর চেয়ারম্যানের বাড়িতে রাত দুটায় উত্তরের আছিম লহরের বাইদ থেকে কমাণ্ডার ইদ্রিস এল। তার ঠিক পরেই রাঙ্গামাটির কোম্পানী কমাণ্ডার মনিরুল ইসলাম এসে হাজির। এদের দুজনেরই গুলি এবং আমার সাথে রণ কৌশল নিয়ে আলাপ আলোচনার প্রয়োজন ছিল। এসেই আমার সাথে আলোচনায় বসল। আছিম লহরের বাইদ ও রাঙ্গামাটি যুদ্ধের গুরুত্ব উপলব্ধি করে হেডকোয়ার্টারের সামরিক বিভাগকে এদের প্রয়োজনীয় গুলি ও রসদ সরবরাহের নির্দেশ দিলাম। এবং দুতিন দিনের মধ্যে আমিও উভয়ের প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে যাব, আশ্বাস দিয়ে বিদায় জানালাম।
নানা জায়গা ঘুরে ৪ঠা আগষ্ট সকালে লহরের বাইদ পৌঁছলাম। বিকেলে সেখান থেকে পনের মাইল দূরে রাঙামাটিতে গেলাম। এই সময় রাঙ্গামাটি ও লহরের বাইদে শত্রুর চাপ অনেকটা কমে এসেছিল। জুলাই মাসের পনের-কুড়ি তারিখের পর আমাদের বেশ কয়েকটি ঘাঁটির পতন হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সামান্য একটু হতাশার ভাব দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ২৫শে জুলাই থেকে সেই হতাশা আস্তে আস্তে কেটে যেতে থাকে। দেওপাড়া ও পাথরঘাটা যুদ্ধে আমাদের যে সাফল্য এসেছিল, তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বহুগুণ বেড়ে যায়। পরপর চরম ঝুঁকি নিয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে সাধারণ মানুষের মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, আমি যেখানেই যুদ্ধ পরিচালনা করব, সেখানেই মুক্তিবাহিনীর জয় অবধারিত। অন্যদিকে রাজাকার
পৃষ্ঠা নং ~ ২৯৩

আলবদরদের মধ্যেও দারুন পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তাদের অনেকেই মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করতে শুরু করেছে। ২৮শে জুলাই একশ সাঁইত্রিশ জন রাজাকার আত্মসমর্পন করেছিল, ২৮শে জুলাই থেকে ৪ঠা আগষ্ট নাগাদ আত্মসমর্পিত রাজাকারদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট’শ আশিতে।

কচুয়ার জনসভা
৫ই আগষ্ট ভোরে রাঙ্গামাটি থেকে রওনা হয়ে কোথাও না থেকে একটানা কুড়ি মাইল পায়ে হেটে কচুয়ার উত্তরে কালিয়াপাড়া ঘোনারচালা স্কুলে অল্পক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিলাম। বিকাল তিনটায় কচুয়া হাইস্কুল মাঠে সেই সময়ের সব চাইতে বড় জনসভা অনুষ্ঠিত হলো। সমস্ত মাঠ ভরে গেছে, কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। স্থানীয় এক কবিয়াল শাহানাশাহ খুব সুন্দর বাউল সুরে স্বরচিত দুখানা দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করলেন। এখানেই প্রথম লাউডস্পীকারের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর পর্যায় ক্রমিক শক্তি বৃদ্ধি ও জনগণের অবদানের কথা তুলে ধরলাম। জনগনকে বার বার আশ্বাস দিয়ে বললাম, “আপনাদের মনোবল যদি অটুট থাকে আর আমরা যদি মুক্ত এলাকার নিরাপত্তা রক্ষা করতে পারি, তা হলে এখন থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ আঘাত হানা সম্ভব। টাংগাইলের মুক্তিবাহিনী হানাদারদের কাছে তাচ্ছিল্যের বিষয় নয়। হানাদাররা ইচ্ছা করলেই যা খুশী করে নিস্তার পাবেনা। হ্যা, ওদের কাছে ভারী ভারী কামান আছে, ট্যাংক আছে, যুদ্ধ বিমান আছে। আমাদের আছে তার চাইতেও শক্তিশালী অস্ত্র, ঈমান। আমরা জীবন বিলাতে ওদের থেকে মোটেই পিছপা নই। মুক্তিযোদ্ধারা দেশপ্রেমে নিবেদিত প্রাণ স্বেচ্ছা সৈনিক! আমাদের মরাণাস্ত্র ওদের মত আধুনিক না হতে পারে, ওদের মত বছরের পর বছর ট্রেনিংয়ের অভিজ্ঞতা না থাকতে পারে, কিন্তু জীবন দেয়া-নেয়ার খেলায় ওরা মোটেই আমাদের সমকক্ষ নয়। আপনারা শুনে থাকবেন, ইতিমধ্যে সংঘটিত ছোট বড় প্রায় ষাটটি যুদ্ধের দশটিতেও ওরা আংশিক জয়ী হতে পারে নি। আমরা কম করেও ত্রিশটি যুদ্ধে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছি।
আপনারা হয়তো এক সপ্তাহ আগের পাথরঘাটা যুদ্ধের ফলাফল পুরোপুরি না হলেও কিছুটা শুনেছেন। ঐ যুদ্ধে আমাদের কারও গায়ে সামান্য আঁচড় লাগেনি। কিন্তু ওদের জীবিত ও মৃত ছাব্বিশ জন আমাদের হাতে ধরা পড়েছিল। আমরা তাদের লাশ ও জীবিতদের বিনিময়ে নিরীহ নিরাপরাধ স্বাধীনতাকামী সত্তর জনকে ফিরিয়ে দিতে হানাদারদের বাধ্য করেছি। এতেই প্রমাণ করে, ওদের কাছেও আমাদের অস্তিত্ব স্বীকৃত। বিপর্যয় মাঝে মধ্যে আসতে পারে। তবে আমি বিশ্বাস করি, কোন বিপর্যয় আমাদের উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারবে না। যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, ত্যাগ ও যুদ্ধ কৌশল আয়ত্বের অসীম আগ্রহ লক্ষ্য করছি, তাতে জয় খুব একটা বেশী দূরে নয়। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা সর্বস্ব বাজী রেখে অতীতের মত অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখুন এবং আরো বিশ্বাসবোধ জাগিয়ে তুলুন। আপনারা যদি আমাকে আপনাদের ভাই, বন্ধু অথবা সন্তান মনে করেন, তাহলে আমি অনুরোধ করছি, আজ থেকে এই পাহাড়ের ছোট বড় কোন গাছ কাটা যাবে না। আমি মনে করবো, একটি গাছ বা গাছের ডাল কাটা মানেই আমার একটি হাত কেটে ফেলা। আপনারা যদি আপনাদের সস্তানের হাত
পৃষ্ঠা নং ~ ২১৪

কাটতে চান, তাহলে আমার বলার কিছুই নেই। তবে আমার আশা, আপনারা আপনাদের সস্তানদের হাত কাটবেন না।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী।’

‘বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী, জয় কাদের সিদ্দিকী,’ এই ধরনের মূহুর্ত ধ্বনির মধ্যে সভার কাজ শেষ হলে বেসামরিক সদর দপ্তর মহানন্দপুরে চলে এলাম।

কমান্ডারের পদ্যচুতি
পরদিন মরিচার প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কমাণ্ডার সুবেদার নবী নেওয়াজকে আমার সামনে হাজির করা হলো। তার অপরাধ যুদ্ধ পরিচালনায় ব্যর্থতা। ফলে শত্রুর সুবিধা লাভ। ২৫শে জুলাই দেওপাড়া থেকে মিলিটারীদের একটি বড় দল মরিচার দিকে এগুতে থাকে। হানাদার দলটি মরিচা পশ্চিমে রেখে, বাঘেরবাড়ী ও মরিচার মাঝ দিয়ে নবী নেওয়াজ কোম্পানীর পুব-উত্তরে একমাইল পেছনে যখন অবতরণ করে, তখন নবী নেওয়াজ শত্রুর এগিয়ে আসার সংবাদ পায়। হানাদারদের রোখার প্রস্তুতি নিতে নিতে তারা আরও আধমাইল এগিয়ে আসে। এই সময় নবী নেওয়াজ তার দলের একশ জন যোদ্ধা নিয়ে, তিন দিক থেকে হানাদার দলটির উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু সে বিফল হয়। কারণ ইতিমধ্যে শত্রুরা একটি মসজিদের আড়াল পেয়ে যায়। শুধু তাই নয়, মসজিদের ভেতর অবস্থান নিয়ে তারা মজবুত একটা রক্ষাব্যূহও রচনা করে ফেলে। ধর্মভীরু নবী নেওয়াজ তার যোদ্ধাদের মসজিদের উপর গুলি ছুঁড়তে দিতে নারাজ। মসজিদ আল্লাহর ঘর। পবিত্র স্থান। শত্রু পবিত্র মসজিদে আশ্রয় বা অবস্থান নিলে সেখানে আক্রমণ চালাতে তার মন সায় দেয় না। শত্রুরা মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসার পর, সে আক্রমণের কথা ভাবতে থাকে কিন্তু তার ভাবনাই সার। শত্রু তাকে সুযোগ দেবে কেন? হানাদাররা যে সুযোগ পেয়েছে তারা তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করবে-এটাই স্বাভাবিক। ঘটলও তাই। মসজিদকে আড়াল করে, হানাদাররা এগিয়ে এসে নেওয়াজকে প্রচণ্ড অসুবিধায় ফেলে দেয়। দিশেহারা নবী নেওয়াজ কোন উপায় না দেখে সহযোদ্ধাদের আত্মরক্ষার্থে পিছু হটতে নির্দেশ দেয়। এতে মরিচা স্থায়ী ঘাটির শোচনীয় পতন ঘটে। অস্ত্র ছাড়া আর সব কিছুই হানাদারদের দখলে চলে যায়।
পরিস্থিতির জটিলতা ও ভয়াবহতা অনুধাবনে বিলম্ব ও অক্ষমতা, ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা-এই সমস্ত কারণে মুক্তিবাহিনীর মরিচা ঘাটির পতন ঘটেছে। এহেতু নেওয়াজকে সাথে সাথে অপসারিত করে রাতেই আছিমের কোম্পানী কমাণ্ডার গোলাম সরওয়ারকে মরিচার দায়িত্ব বুঝে নিতে বেসামরিক প্রধান আনোয়ার-উল-আলম শহীদ নির্দেশ দেন।
নবী নেওয়াজকে এক সপ্তাহের জন্য দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাকে সাধারণ সৈনিকের কাজ করতে দেওয়া হলো। সে এক সপ্তাহ নয়, পুরো এক মাস সুষ্ঠুভাবে সাধারণ সৈনিকের দায়িত্ব পালন করে পুনরায় তার মরিচার ক্যাম্পেই কমাণ্ডার পদ অলঙ্কৃত করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সফল সমাপ্তি পর্যন্ত সে এ পদে দক্ষতা ও সফলতা দেখিয়েছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৯৫

বহেরতলীতে বিভ্রান্তি

৬ই আগষ্ট। সকালে খবর পেলাম নূরুন্নবী, নুরুল ইসলাম ও গণপরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকী তাদের সফল সফর শেষে ভুয়াপুর আঞ্চলিক দপ্তরে পৌঁছে পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছেন।

প্রতিনিধিদের প্রত্যাবর্তন
নুরুন্নবী ও বাসেত সিদ্দিকী ২৪শে জুলাই মহানন্দপুর হেড কোয়ার্টার থেকে দ্বিতীয়বার ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ২৬শে জুলাই তারা ভুয়াপুর আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টারে এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় সদর দপ্তরের প্রতিনিধিত্ব করেন। আমার বার্তা নিয়ে ভুয়াপুর থেকে নুরুন্নবী, নুরুল ইসলাম, বাসেত সিদ্দিকী ও লুৎফর রহমান ছোট্ট একটি কোষা নৌকায় ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। পাল খাটানো ছোট্ট নৌকাটি দেখতে দেখতে একদিনেই বাহাদুরাবাদ ঘাটের কাছাকিছি পৌঁছে গেল।
৩০শে জুলাই সন্ধ্যায়, আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে বৃদ্ধ মাঝি প্রমাদ গুণলেন। তিনি তাড়াতাড়ি যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে শরণার্থীদের নৌকাগুলোর কাছে যেতে প্রাণপণে নৌকা বাইতে লাগলেন। কিন্তু মাঝ নদীতে আসতেই ঝড় উঠে গেল। বাতাসের প্রবল ধাক্কায় পুরানো পালটি ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে জীর্ণ নৌকার তলা ফেটে প্রবল বেগে পানি উঠতে লাগল। মহা বিপদ, মাঝি দিশেহারা। যাত্রী চার জন আর মাঝির উপর ভরসা করে বসে থাকতে পারলেন না। তাঁরাও আল্লাহর নাম স্মরণ করে বৈঠা নিয়ে, সর্বশক্তি দিয়ে বাইতে শুরু করলেন। এদের মনে কবিগুরুর সেই গানটি গুণগুনিয়ে উঠল। কিন্তু বাইরে তার কোন প্রকাশ নেই-
“যদি মাতে মহাকাল
উদ্দাম জটা জাল
ঝড়ে হয় লুন্ঠিত
ঢেউ উঠে উত্তাল
হয়ো নাকো কুণ্ঠিত
তালে তাল দিও তাল
জয়, জয়, জয় গান গাইয়ো
হেই মারো, মারো টান
হেইয়ো।”

নৌকা পানিতে ভরে গেছে। প্রায় আধ ঘন্টা দাড় টেনে সবাই ঘর্মাক্ত কলেবর। ঝড়ের
পৃষ্ঠা নং ~ ২৯৬

প্রকট অনেকটা কমেছে। ডুবু ডুবু নৌকাটিও পারে ভিড়ে ভিড়ে অবস্থা। ঠিক হাপানী রোগীর মত প্রাণপণ দৌড়ের পর হৃদক্রিয়া বন্ধ হবার উপক্রম। পাড় থেকে দশ-পনের গজ দূরে নৌকাটি তলিয়ে গেল। তবে চারজনই জামা কাপড় ভিজিয়ে পাড়ে উঠে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হলো। নৌকা ডুবে গেল—এটা বড় কথা নয়। মাল্লাসহ সবাই প্রাণে বাঁচল এটাই বড় কথা।
এরপর সমস্যা দেখা দিল নৌকা নিয়ে। চরে কোন নৌকা থাকে না। অথচ চরের মধ্যে খোলা আকাশের নীচে কোথায় মিলবে তাদের আশ্রয়, এবং কেমন করেই বা ভারতে যাবেন। যে জরুরী কাজে তারা যাচ্ছেন তাতে বিলম্বও চলে না। আস্তে আস্তে তারা শরণার্থীদের নৌকার কাছে গেলেন। নৌকাগুলো খালি ছিল না, ছিল যাত্রী বোঝাই। নতুন কোন যাত্রীর স্থান সংকুলানের কোন উপায় নেই। যাত্রীরা সিরাজগঞ্জ থেকে ভারতে আশ্রয়ের আশায় চলছেন। নারী-পুরুষ বোঝাই নৌকায় চার জন অচেনা পুরুষের জায়গা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যখন তারা জানালেন চার জনই মুক্তিযোদ্ধা এবং কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিবাহিনীর সদস্য, তখন নিজেদের শত অসুবিধা সত্ত্বেও তারা তাদের আপন জনের মত জায়গা দিলেন। শরণার্থীদের কাছে ভালবাসা ও সহানুভূতি পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের করিগুরুর সেই বিখ্যাত যুগান্তকারী গানটি মনে পড়েছিল,
‘বাংলার প্রাণ, বাংলার মন
বাংলার ঘরে যত ভাই-বোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক
হে ভগবান।”
শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর চারজন কৃতি পুরুষ ভারতের মানকাচর শিবিরে পৌঁছলেন। মানকাচরে বি. এস. এফ. কমাণ্ডার মেজর বিন্দার সিং নুরুন্নবীদের আগমন বার্তা ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল গিল, ব্রিগেডিয়ার সান সিং ও বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর আঞ্চলিক হেড-কোয়ার্টারের কর্নেল জিয়ার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
পরদিন সকালে গনপরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকী ও নূরুন্নবী গারো পাহাড়ের তুরা রওনা হলেন। নূরুল ইসলাম ও লুৎফর রহমান মানকাচরেই থেকে গেল। তুরায় সেনাবাহিনীর একটি শিবিরে যখন তারা পৌঁছলেন, তখন সন্ধা নেমে এসেছে। অনবরত ঝির ঝির বৃষ্টিও পড়ছে। একটি ছোট্ট তাঁবুতে নুরুন্নবীরা যখন ব্রিগেডিয়ার বাবাজীর সঙ্গে আলোচনা করছিলেন, তখন ধীরে ধীরে একজন বাঙালী সামরিক অফিসার তাবুতে প্রবেশ করলেন। গায়ে বর্ষাতি। চোখে রঙিন চশমা। মাথায় সামরিক টুপি, দেহ ও মুখাবয়বে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তার ছাপ। ব্রিগেডিয়ার বাবাজী বাঙ্গালী অফিসারের সাথে বাসেত সিদ্দিকী ও নুরুন্নবীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। নুরুন্নবী তাঁর হাতে আমার পত্রখানা তুলে দিলেন। তিনি ধীরে ধীরে বাংলায় লেখা পত্র পড়লেন এবং বাবাজীকে তা ইংরেজী অনুবাদ করে শুনালেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৯৭

ছোট্ট পত্রে লেখা রয়েছে-
‘আমার প্রতিনিধি নুরুন্নবী ও গণপরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকীকে আপনার কাছে পাঠালাম। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের কথাই আমার কথা। আমাকে একবার ভারতে আসতে বলেছেন কিন্তু এক্ষুণি আমার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। আমার এলাকার ত্রিশ লক্ষ লোককে নিরাপদে রাখার দায়িত্ব বোধ হয় আল্লাহ তালা আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। যুদ্ধ করছি অন্যদের বাঁচানোর জন্য, নিজেকে বাঁচাতে নয়। আপনাদের সহযোগীতা পেলে আমরা হানাদারদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারবো। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি। এদিকের অবস্থা ভাল। আপনারা আমার দেশবাসীর ও আমার শুভ কামনা গ্রহণ করুন।
ইতি-
আপনাদের,
কাদের সিদ্দিকী
২৩-৭-৭১

চিঠি পড়া শেষে অফিসারটি নুরুন্নবী ও বাসেত সিদ্দিকীকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বাংলার স্বাধীনতার আহ্বান যিনি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করেছিলেন, বাঙালী সৈনিকদের যিনি পাক-হানাদারদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে ধরতে আহ্বান জানিয়ে ছিলেন, ইনি সেই বিখ্যাত জিয়াউর রহমান। তার দর্শন ও সান্নিধ্য পেয়ে প্রতিনিধিরা আনন্দ ও আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েন। আবেগে ও উচ্ছ্বাসের রেশ কেটে গেলে, টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনকেক্ষণ আলাপ আলোচনা হলো। প্রতিনিধিরা বললেন, ‘সীমান্তের দিক থেকে শত্রুদের উপর চাপ না বাড়ালে, তারা আমাদের উপর তীব্রতর আক্রমণ চালাবার সুযোগ পাবে। চাপ বাড়ালে টাংগাইল-ময়মনসিংহ সড়কে দুশমনদের উপর বারবার আঘাত হেনে যেমন সরবরাহ ব্যবস্থা ও সৈন্য চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো যাবে, তেমনি মুক্তিবাহিনীর উপর চাপ অনেকাংশে কমে যাবে। এছাড়া ভারতীয় কমাণ্ডারের সাথে স্থায়ী যোগাযোগের জন্য দূর-পাল্লার বেতার যন্ত্রের অত্যন্ত প্রয়োজন।
জিয়া ( তখন জেড ফোর্সের কমাণ্ডার ) ও ব্রিগেডিয়ার মানসিং অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনলেন। এবং পরদিন সকালে জেনারেল গিলের সাথে চুড়ান্ত আলোচনা শেষে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অপক্ষোয় রইলেন। সেই রাতে তৎসময়ের কর্নেল জিয়া, নুরুন্নবী ও বাসেত সিদ্দিকী কিছু সময় একই তাবুতে কাটালেন। তাদের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হলো। রাত বারটায় সীমান্ত ঘাটি নক্সীতে আক্রমণ পরিচালনা করতে জিয়া চলে গেলেন।
দুশমনদের উপর আঘাত হানার জন্য যিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে এক ব্রিগেডের একটি বাহিনী গড়ে তুলেছেন, তার সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রাণপণে যুদ্ধরত দলের প্রতিনিধিদের এই ঐতিহাসিক যোগাযোগ সুদিনের ইঙ্গিত বলে প্রতীয়মান হলো। কর্নেল জিয়া বারবার আমার নিরাপত্তার কথা বললেন এবং যুদ্ধ সম্পর্কে অনেক অনেক উপদেশ দিলেন। কোন এক সময় সম্ভব হলে, আমি যেন ভারতে এসে তাদের সাথে দেখা করি, এই অনুরোধও জানালেন। যিনি বীর
পৃষ্ঠা নং ~ ২৯৮

তিনিই কেবল বীরের প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। কর্নেল জিয়ার কথায় সেদিন তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। প্রায় এক বছর পর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে দাড়ি চুল মণ্ডিত নুরুন্নবীকে দেখে ব্রিগেডিয়ার জিয়া সহজেই তাকে চিনে ছিলেন। মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে পরিচয় ও বন্ধন রচিত হয়, তা কি সহজে মুছে ফেলা যায়? যায় না।
তুরা শিবিরে নূরুন্নবী, বাসেত সিদ্দিকী জেনারেল গিলের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই শিখ সামরিক নেতা সম্ভবত আমার জন্য মনের মাঝে এক সাগর প্রীতি ও শুভেচ্ছা জমা করে রেখেছিলেন। তা তিনি প্রতিনিধিদের কাছে উজার করে দিলেন। জেনারেল গিল বললেন,
“আমার প্রথম প্রথম বিশ্বাস হয়নি যে, ঢাকা থেকে ত্রিশ মাইল দূরে পুরানো ধরনের সামান্য অস্ত্র নিয়ে, একটি শক্তিশালী বাহিনীর মোকাবেলা করা সম্ভব হতে পারে। যার কোন সরবরাহ ব্যবস্থা নেই, নেই কোন রণ কুশলী সেনানী, সে কেমন করে যুদ্ধ চালাবে? কিন্তু গত দেড় মাস যাবৎ যখন পাক-সামরিক বেতারের খবর ইন্টারসেপ্ট করে দুশমনদের চরম নাজেহাল অবস্থার কথা জানলাম এবং তোমাদের সাথে আলাপ করে সব বুঝলাম, তখন কাদের সিদ্দিকীর বীরত্বের প্রশংসা করার ভাষা খুঁজে পাঁচ্ছি না। আমার দীর্ঘ দিনের সেনাপতিত্বের অভিজ্ঞতায় যা অর্জন করতে পারিনি, সিদ্দিকীর কাছে তাই অর্জন করেছি, অর্জন করতে চলেছি। জনযুদ্ধের জন্য সর্বাধুনিক অস্ত্র ও একমাত্র কুশলী সৈন্য অপরিহার্য নয়, প্রথম ও প্রধান অপরিহার্য বিষয় হলো অফুরন্ত মনোবল ও জনসাধারণের আন্তরিক আস্থা অর্জন এবং তাদের যুদ্ধে সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে ফেলা। এই দুঃসাধ্য কাজটি সিদ্দিকী অনায়াসেই করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তিনি আমার নমস্য।”
জেনারেল গিল সব রকম সাহায্য ও সহাযোগীতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বারবার আমার নিরাপত্তার গুরুত্বের কথা প্রতিনিধিদের স্মরণ করিয়ে দেন। জেনারেল গিল দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তদারক করেছেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীন বাংলায় তিনি একবারও আসতে পারেন নি। স্বাধীনতার চার-পাঁচ দিন আগে জামালপুর শত্রুমুক্ত হয়। তিনি এবং ব্রিগ্রেডিয়ার ক্লের একটি জীপে কামালপুর থেকে অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে যাচ্ছিলেন। পথে পাকবাহিনীর পোতা একটি ট্যাংক বিধ্বংসী মাইনের আঘাতে তাদের জীপটি বিধ্বস্ত হয় এবং জেনারেল গিলের দুটি পা গুরুতর জখম হয়। ব্রিগ্রেডিয়ার ক্লের অবশ্য অক্ষত দেহে বেঁচে যান। তুরাতে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সাথে নুরুন্নবী ও বাসেত সিদ্দিকীর দেখা হয়। লতিফ সিদ্দিকী যখন নুরন্নবীদের কাছে শুনলেন, তাঁর অনেক সহকর্মী আমার নেতৃত্বে দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে, তখন তিনি টাংগাইলে ফিরে আসতে চাইলেন। নূরুন্নবী ও বাসেত সিদ্দিকী উভয়েই তাকে বললেন, “আপনার দেশে যাওয়ার মত এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সর্বাধিনায়ককে জিজ্ঞেস না করে নিতে পারি না। আর তিনিও আমাদের বলে দিয়েছেন, এই সময় আপনার ভারতে থেকে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার কাজ বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে উনি যে পত্র দিয়েছেন, তাতেও নাকি ঐ ধরনের অনুরোধ আছে বলে আমাদের জানিয়েছেন।”
পৃষ্ঠা নং ~ ২৯৯

তুরা মুক্তিবাহিনীর শিবিরে বাসেত সিদ্দিকী ও নুরুন্নবীর গণ-পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ ও ফজলুর রহমান খান ফারুকের সাথেও দেখা হয়। এই দুজন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য তুরা মুক্তিবাহিনী শিবিরে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের ভার নিয়েছিলেন। গণ- পরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকীকে হুমায়ুন খালিদ ও ফজলুর রহমান খান ভারতে থাকতে অনুরোধ জানালে, সে অনুরোধ বাসেত সিদ্দিকী সাথে সাথে প্রত্যাখান করলেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে তাঁদের বললেন, “আমার স্থান এখন এখানে নয়, সিদ্দিকী সাহেবের পাশে এখন আমার দাঁড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।” বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী বাসেত সিদ্দিকীর এই বক্তব্য জোরের সাথে সমর্থন করে বললেন, “হ্যা, এই সময় কাদেরের পাশে ওনার যত বিশ্বাসী, অভিজ্ঞ ও বয়সী কিছু ভাল লোক থাকা দরকার। না হলে কাদের সময় সময় হাপিয়ে উঠবে। অনেক সময় ওর সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হবে।”
তুরা মুক্তিবাহিনী শিবিরে বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নুরুন্নবী ও বাসেত সিদ্দিকীর সাক্ষাৎ হলো। এদের মধ্যে নেত্রকোণার হাবিবুল্লাহ খান, কিশোরগঞ্জের রতন, রংপুরের মাহবুব, বগুড়ার মুন্সী, জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ, টুকু ও ময়মনসিংহের অজয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। এসব মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদারদের বর্বরতার কাহিনী প্রতিনিধি দ্বয়কে শুনালেন। টাংগাইলের বিরাট এলাকা নিয়ে মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছে, এই খবর শুনে সকলে আনন্দে ফেটে পড়লেন। কারণ দখলদার বাহিনীর বর্বরতা তারা দেখে এসেছেন কিন্তু প্রতিরোধ সংগ্রাম দেখে আসেননি। মাত্র চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সের এক তরুণের নেতৃত্বে বিশ্বের অন্যতম সেনাবাহিনীর বিপর্যয়ের কাহিনী শুনে তাদের উৎসাহ শতগুণ বেড়ে গেল। জয়ের নেশায় তারা মনে মনে গেয়ে উঠলেন,
“ভয় নেই, ওরে জাগিয়া উঠেছে
হিমালয় চাপা প্রাচীর।
পাষাণ বেদীতে উঠেছে আবার
নবীন সব্যসাচী।!
তুরার মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে তাঁদের অন্তর-নিংড়ানো অভিনন্দন জানাতে প্রতিনিধি- দ্বয়কে বার বার অনুরোধ জানালেন। এই সময় থেকে ‘রওশন আরা’ ক্যাম্পে নিয়মিতভাবে টাংগাইল-মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। পাক-বাহিনীর বেতার ইন্টারসেপ্ট করে সংবাদ সংগ্রহের মাধ্যমে ২রা আগস্ট থেকে নিয়মিত ভাবে টাংগাইল-যুদ্ধ সংবাদ তৈরীর কাজ চলতে থাকে।
৩রা আগস্ট। প্রতিনিধিদ্বয় তুরা থেকে রওনা হয়ে মানকাচর ঘুরে টাংগাইলের পথ ধরলেন। সাথে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল, আর রইল কয়েকটি বেতার যন্ত্র। কয়েকশ নানা ধরনের অস্ত্র, পাঁচ হাজার পাউণ্ড বিস্ফোরক, কয়েক হাজার হাতবোমা ও অন্যান্য অস্ত্র-শস্ত্র বোঝাই করে নুরুন্নবী ও বাসেত সিদ্দিকী আবার স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩০০

১১ নম্বর সেক্টর কমাণ্ডার মেজর আবু তাহের (পরে কর্ণেল) তাদের পথ-প্রদর্শক দিয়ে হুঁশিয়ার করে দিলেন, বাহাদুরাবাদ ঘাটের কাছে খুব সাবধানে যেতে হবে। কারণ ২৫শে জুলাই তার ঘাটি থেকে হানাদারদের উপর প্রচণ্ড হামলা চালনা হয়েছিল। তাতে ওদের প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। এজন্য খান সেনারা এখন নদীর উপর কড়া নজর রাখছে। কৌশলে ওদের দৃষ্টি এড়াতে হবে।
সংকল্পে অটল মুক্তিযোদ্ধারা যাত্রা শুরু করল। নৌকাগুলো যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলল। রাত বারটায় নৌকাগুলো যমুনা নদীতে এসে পড়ল। সেখানে বিরতি দিয়ে সামান্য চিড়া-মুড়ি খেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুন্নিবৃত্তি করল।
উদরের জ্বালা কমল। কিন্তু মনের জ্বালা বেড়েই চলল। রাতের আঁধারে নিরাপদে বাহাদুরাবাদ ঘাট পার হওয়া যাবে কিনা সেটাই এখন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। হাতে সময় আছে মাত্র দুই ঘন্টা। দিনের আলোয় হানাদারদের নজর এড়িয়ে কোনক্রমেই বাহাদুরাবাদ ঘাট অতিক্রম করা যাবে না। হাত গুটিয়ে বসে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ধর্ম নয়। রাতেই বাহাদুরাবাদ ঘাট পেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। আবার যাত্রা শুরু। প্রকৃতি যেন তাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত হয়েই ছিল। একে তো ভাটি পথ তার উপর আবার উত্তরে ঘনিয়ে আসা মেঘের সাথে প্রবল হাওয়া। স্রোত ও হাওয়া অনুকুলে পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা যেন উড়তে লাগল। বাহাদুরাবাদ ঘাট তখনও পনের মাইল দূরে। নৌকাগুলো নিরাপদে ও স্বচ্ছন্দে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু বাহাদুরাবাদ ঘাটের চার-পাঁচ মাইল দূরে থাকতেই হাওয়া থেমে গেল। এতে নৌকা- গুলোর গতি আর আগের মত রইল না, অনেকটা কমে গেল।
নূরুন্নবী, নুরুল ইসলাম ও বাসেত সিদ্দিকী সব নৌকার দায়িত্বশীল যোদ্ধাদের পই পই করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কোন নৌকা যদি বাহাদুরাবাদ ঘাটে আক্রান্ত হয়ে ডুবেও যায়, তবুও যেন গুলি ছোড়া না হয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য, দু’একটি নৌকা খোয়া যায় থাক। তবুও বাকী গুলোকে যথাস্থানে নিরাপদে পৌঁছাতে হবে।
মুক্তিবাহিনীর নৌকাগুলো বাহাদুরাবাদ ঘাটের কাছাকাছি এসে গেল। নৌকাগুলো বাহাদুরাবাদ ঘাটের পশ্চিমে চরের পাশ ঘেঁষে বেশ দ্রুত গতিতে দক্ষিণে চলেছে। ভোরের আলো তখন একটু একটু উকি মারছে। প্রথম ও দ্বিতীয় নৌকা নিরাপদেই ঘাট অতিক্রম করল। প্রত্যেক নৌকাই বেশ দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল। তৃতীয় নৌকাটি যখন বাহাদুরাবাদ ঘাটের প্রায় এক মাইল পশ্চিম দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, তখন ঘাট থেকে নৌকাটিকে লক্ষ্য করে হানাদাররা প্রবল ভাবে গুলি ছোড়া শুরু করল। নৌকার আশ-পাশে গুলি পড়ছে দেখে, মাঝিরা দাড় টানা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল।
এ সময় চতুর্থ নৌকাটিও হানাদারদের গুলির আওতায় এসে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বার বার তাদের কমাণ্ডারের কাছে গুলি ছোড়ার আদেশ চায়। অথচ কমাণ্ডার গুলি ছোড়ার আদেশ দিতে একেবারে নারাজ। চতুর্থ নৌকার ছইয়ের উপর বসে আবদুল বাসেত সিদ্দিকী ফজরের
পৃষ্ঠা নং ~ ৩০১

নামাজ পড়ছিলেন। শত্রুর গুলি এসে তার নৌকার মাস্তলে লেগে মাস্তলটি দু’টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে। বাসেত সিদ্দিকী নামাজ ছেড়ে, ছই থেকে লাফিয়ে নীচে পড়লেন। পনের মিনিট অনবরত গুলি চালিয়েও হানাদাররা যখন কোন প্রত্যুত্তর পেল না, তখন ব্যবসায়ী নৌকা মনে করে গুলি ছোঁড়া বন্ধ করল। এত গুলি ছোঁড়ার পরও নৌকগুলোর কোন ক্ষতি হলো না।
বাহাদুরাবাদ ঘাট পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তারা যখন জগন্নাথগঞ্জের চেংগালিয়া চরের কাছে এসে পৌঁছে, তখন হানাদারদের নিয়মিত টহলদারী লঞ্চ জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে পশ্চিমে বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানার দিকে যাচ্ছিল। হানাদারদের দেখে মুক্তিযোদ্ধারা সমস্ত নৌকা যমুনায় পূব পাশে একটি শাখা নদীর আড়ালে নিয়ে যায়। লঞ্চ চলে যাওয়ার পর তারা নিরাপদে সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্রসহ ভুয়াপুর মুক্তিবাহিনীর ঘাটিতে এসে পৌঁছে।
টাংগাইল মুক্তাঞ্চলের দিকে তখন শত্রুর লোলুপদৃষ্টি। যে কোন সময় তারা হামলা করতে পারে। তাই অস্ত্র-শস্ত্র ও মজুদ গোলাবারুদ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলা প্রয়োজন। ভুয়াপুর পুরোপুরি নিরাপদ নয়। তাই ওখান থেকে সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্র সরিয়ে ফেলা আবশ্যক। হেড কোয়াটার থেকে সেই মত নির্দেশও গেছে। এনায়েত করিমের উপর হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ, বাসেত সিদ্দিকী, নূরুন্নবী ও নুরুল ইসলামসহ ভুয়াপুরের সমস্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ হেড- কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়া হোক।’ কিন্তু এত অস্ত্রসম্ভার সরিয়ে নেয়া কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রয়োজন স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগীতা। স্বেচ্ছাসেবকরাও এগিয়ে এল। তারা অস্ত্র সরানোর কাজ সম্পন্ন করল অনেকটা পথ নৌকায় এবং পায়ে হেঁটে।
৭ই আগস্ট। বেসামরিক উপ প্রধান এনায়েত করিম ও মোয়াজ্জেম হোসেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে সন্ধ্যায় ভুয়াপুর বাজারে সমবেত হতে নির্দেশ দিলেন। যথা সময়ে দলে দলে স্বেচ্ছাসেবকরা ভুয়াপুর বাজারে এসে সমবেত হতে লাগল। সন্ধ্যার পর প্রায় ছ’শ স্বেচ্ছাসেবকসহ বেসামরিক উপ প্রধান মোয়াজ্জেম হোসেন খান, নুরুন্নবী, গণপরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকী ও নুরুল ইসলাম মালপত্র নিয়ে ভুয়াপুর ত্যাগ করেন। তিন মাইল নৌকায় অতিক্রম করে তারা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়কের দুমাইল পশ্চিমে, পোড়াবাড়ী পাকুটিয়ার কাছে পৌঁছে নৌকা থেকে অস্ত্রসম্ভার নামিয়ে তা মাথায় তুলে নেন। কারণ নৌকাগুলো যে সেতুর নীচ দিয়ে রাস্তার অপর পারে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেই সেতুতে হানাদাররা কড়া পাহারা বসিয়েছে। অগত্যা মাথায় করে বয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন গত্যান্তর নেই। আর অন্ধকার ছাড়া এই একমাত্র পথ অতিক্রম করাও সম্ভব নয়।
দেওপাড়া পতনের আগে ভুয়াপুর থেকে হেড-কোয়ার্টারের দূরত্ব ছিল পচিশ মাইল। কিন্তু দেওপাড়া পতনের পর, ঘাটাইলের উত্তরে পাকুটিয়া হয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এতে দূরত্ব আরো পনের মাইল বেড়ে যায়। কোম্পানী কমাণ্ডার বেণুর অধিনায়কত্বে এক কোম্পানী মুক্তিফৌজ, পোড়াবাড়ীর দুমাইল পশ্চিমে নৌকা থেকে মাল নিয়ে নেমে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা ও স্বেচ্ছাসেবক সবাই ছিল খালি গায়। দূর থেকে যাতে দেখা না যায়,
পৃষ্ঠা নং ~ ৩০২

তার জন্যই এ ব্যবস্থা। মুক্তিসেনা ও স্বেচ্ছাসেবকরা অস্ত্র-শস্ত্রের বোঝা নিয়ে সারিবদ্ধভাবে এগুচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল পথের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য আগে আগে চলেছে। সড়কের আশে-পাশে রাজাকার ও দালাল থাকতে পারে বিধায় পথের নিরাপত্তা সম্পর্কে অগ্রিম সতর্কতার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পোড়াবাড়ী পাকুটিয়ার স্থানীয় গোয়েন্দা বিভাগের কাছ থেকে খবর এল, রাস্তা নিরাপদ। আধমাইল দক্ষিণে এবং এক মাইল উত্তরে দুটি পুলে শুধু রাজাকাররা পাহারায় আছে। উত্তরে বাসস্ট্যাণ্ডেও কিছু রাজাকার রয়েছে। তবে মুক্তিবাহিনী যে জায়গা দিয়ে সড়ক অতিক্রম করতে যাচ্ছে, তা থেকে উভয় দিকের রাজাকার ঘাঁটির দূরত্ব প্রায় তিনপোয়া মাইল।
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অতি সন্তর্পণে ক্ষেত ও গ্রামের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। কারও মুখে কোন কথা নেই। সাড়া শব্দ নেই। সকলের মাথায় আধমন-ত্রিশ সের বোঝা। দেখতে দেখতে সবাই পাকা সড়কের কাছে এসে গেল। মাদ্রাসার গা ঘেঁষে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দ্রুততার সাথে সড়ক অতিক্রম করতে লাগল। এক সময় কাছাকাছি কয়েকজন লোককে দেখে তারা একটু ভয় পেয়ে যায়। সড়কের কাছাকাছি কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। তাদের দুশমন মনে করে স্বেচ্ছাসেবকরা ভয়ে বসে পড়েছিল। ভুল ভাঙলে আবার চলা শুরু করল। প্রায় আটশ লোকের এই দলটির সড়ক অতিক্রম করতে মিনিট দশেক সময় লাগল। পথ অতিক্রমের পুরো সময়টা কমাণ্ডার বেণুর দল রাস্তার উভয় দিকে রক্ষাব্যূহ রচনা করে ছিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আটশ স্বেচ্ছাসেবক ও মুক্তিযোদ্ধা গ্রামের ঘরবাড়ীর এত কাছ দিয়ে সড়ক অতিক্রম করলেও স্থানীয় জনগণ এত বড় একটা ঘটনার কিছুই জানতে বা বুঝতে পারেন নি।
পাকা সড়কের দু’মাইল পূর্বে জঙ্গন শুরু হয়েছে। এই জঙ্গলে কোন রকমে ঢুকতে পারলেই মুক্তিসেনারা সম্পূর্ণ নিরাপদ। রাত তিনটায় তারা জঙ্গলে প্রবেশ করল। অন্ধকার রাস্তা, এতে নতুন ও অপরিচিতদের রাস্তা ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তার উপায় নেই। কুড়ি- পঁচিশ হাত দূরে দূরে জঙ্গলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে স্বেচ্ছাসেবকরা দাড়িয়ে রয়েছে।
৮ই জুলাই, সুবেহ সাদেকে স্বেচ্ছাসেবক ও মুক্তিযোদ্ধারা গোলাবারুদ নিয়ে ছনখোলা বাজারে উপস্থিত হল। এখান থেকে ভুয়াপুরের অর্ধেক স্বেচ্ছাসেবক ফিরে যাবে এবং ছনখোলার স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের রসদ ও অন্যান্য মালপত্র বহন করে হেড় কোয়ার্টারে নিয়ে যাবে। এই জন্য পাঁচশ স্বেচ্ছাসেবক সেখানে আগে থেকেই হাজির ছিল। তারা ভুয়াপুর থেকে আসা ক্লান্ত স্বেচ্ছাসেবকদের মাথা থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদের বোঝা নিজেদের মাথায় নিয়ে পথ চলা শুরু করুন। অন্যদিকে স্থানীয় পঞ্চাশ জন স্বেচ্ছাসেবক ভুয়াপুরের স্বেচ্ছাসেবকদের খাওয়া ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করল। খাওয়া দাওয়া শেষে, কিছুটা ক্লান্তি দূর করে দুপুরের পর দলে দলে ভাগ হয়ে তারা আবার ভুয়াপুরের দিকে রওনা হলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩০৩

মহাবীর নেপোলিয়ানের ইউরোপ বিজয়ের পথে আল্‌পস পর্বতমালা এক প্রচণ্ড বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই পর্বতমালা অতিক্রম অসম্ভব। একথা তার সেনাপতিরা জানালে, নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘দেয়ার শেল বি নো আল্‌পস’। ‘আমার ও আমার সৈনিকদের প্রচণ্ড ইচ্ছা ও অভিযানের সামনে আল্‌পস পর্বতমালা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। একেবারে গুঁড়িয়ে যাবে। অসম্ভব বলে কোন কিছু আমি জানি না।’ মহাবীর নেপোলিয়ান বলেছিলেন, ‘আমার কাছে সারা পৃথিবী মানচিত্রের মত সমান, কোথাও কোন উঁচু-নিচু নেই, থাকতে পারেনা।” ঠিক তেমনি দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও যেন কোন বাধাই অলঙ্ঘনীয় নয়। বাংলার তথা টাংগাইলের মুক্তিযোদ্ধাদের অভিধানে ঐ অসম্ভব কথাটা যেন একেবারে মুছে গেছে।
পাক হানাদার বাহিনী তাদের রসদ বহন করে বিরাট বিরাট ট্রাকে, জাহাজে ও বিমানে, আর মুক্তিবাহিনী বহন করে মাথায় এবং সময় সময় নৌকায়। তবুও মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করে চলেছে সর্বাধুনিক অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত দুধর্ষ এক আধুনিক সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। এটা কেমন করে সম্ভব হলো? তা হয়তো ভবিষ্যৎ সমর বিশারদ ও ঐতিহাসিকের কাছে রীতিমত এক গবেষণার বিষয় হয়ে থাকবে। কিন্তু দলীয় শৃঙ্খলা, সাংগঠনিক যোগ্যতা, অটল সংকল্প ও দেশপ্রেমের আদর্শ থাকলে বাঙালী যে অসাধ্য সাধন করতে পারে, টাংগাইলের মুক্তিবাহিনী তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। মাঠের কৃষক, কারখানার শ্রমিক, পথের ভিখারী ও স্কুল কলেজের ছাত্ররা যেমন এক হয়ে পথে নেমেছেন—তেমনি উকিল, মোক্তার, অধ্যাপক, ডাক্তার, ব্যবসায়ী কেউ বাদ যায় নি! সবাই যেন “জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরিয়সী’ এই মহামন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বন্ধন মুক্তির প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করেছেন। কোথাও কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই প্রাণে প্রাণে এক, আত্মার আত্মায় এক। লক্ষ্য একটাই, মুক্তিযুদ্ধের মহাযজ্ঞে অংশ গ্রহণ এবং মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচন। তাদের কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। অসম্ভব বলে তারা কোন কিছু মানতে রাজী নয়।
ছাত্রনেতা সিরাজ তালুকদার, স্কুলমাষ্টার রহিম মিয়া, অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক পুলিশ সাদেক মিঞা, দিন মজুর খোকা, কৃষক করম আলী, কুমুদিনী কলেজের অধ্যাপক বীর ঘাটাইলের আবদুস সাত্তার, সরকারী উচ্চ পদ মর্যদায় অধিষ্ঠিত পাকিস্তানের তথ্য ও বেতার বিভাগের চাকুরে শামসুল আলম। আরও শত শত তরুণ প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ যেন এক নতুন প্রাণশক্তিতে বলীয়ান হয়ে দুশমনের যান্ত্রিক সরবরাহ ব্যবস্থাকেও হার মানিয়ে দিচ্ছেন। তাদের দৃঢ় পা, বলিষ্ঠ কাঁধ, কঠিন বাহু ও উন্নত শিরই যেন মারণাস্ত্র। এদের শক্তির উৎস জ্বলন্ত দেশ প্রেম, আর বঙ্গবন্ধুর সেই অমর আহ্বান—“ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার যা আছে—তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। “

রাঙ্গামাটির রাঙ্গাফাঁদ
আগস্টের প্রথমে সপ্তাহ থেকে হানাদাররা মুক্তিবাহিনীর উপর ক্রমাগত আঘাত হানতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি ঘাঁটিতে আক্রমন চালায়। মুক্তিবাহিনী সেই আক্রমন প্রতিহত করতে তৎপর হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা দুশমণের উপর পাল্টা আক্রমণও চালায়। ৭ই আগস্ট
পৃষ্ঠা নং ~ ৩০৪

মধুপুরে টাংগাইল-ময়মনসিংহ সড়কের জলছত্র – রসুলপুরের দিক থেকে সাগরদীঘির দিকে হানাদাররা এগুতে থাকে। ঐ পথে রাঙ্গামাটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল মুক্তিবাহিনীর ১১ নম্বর কোম্পানী। তারা সংবাদ পায়, নিয়মিত বাহিনীর এক কোম্পানী হানাদার ও শতাধিক রাজাকার রাস্তার আশ-পাশে ঘরবাড়ি জ্বালাতে জ্বালাতে এগিয়ে আসছে। দুশমনের হামলার সম্ভাব্য ধরন দেখে কোম্পানী কমাণ্ডার মনির আরও মুক্তিযোদ্ধা চেয়ে পাঠায়। দক্ষ কমাণ্ডার আবদুল হাকিমকে তার কোম্পানী নিয়ে মনিরের সাহায্যে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিই। সিনিয়র কমাণ্ডার মেজর আবদুল হাকিম মনিরের কাছ থেকে ফুল নেতৃত্বভার নিয়ে দুশমনদের হামলা প্রতিহত করতে সচেষ্ট হয়। সে স্থায়ী ঘাঁটি থেকে এগিয়ে রাস্তার নানা স্থানে এমবুশ লাগায়।
আছিমের কোম্পানী কমাণ্ডার লাল্টুকেও নির্দেশ পাঠানো হয়, সে যেন ঘাটির দায়িত্ব কমাণ্ডার ইদ্রিসের হাতে তুলে দিয়ে কোম্পানীর অর্ধেক যোদ্ধা নিয়ে হাকিমকে সাহায্য করতে রাঙ্গামাটির দিকে এগিয়ে যায়। শত্রুরা এক কোম্পানী নিয়মিত সৈন্য ও শতাধিক রাজাকারসহ এগিয়ে আসছিল। জুলাই মাস থেকে রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে তাচ্ছিল্যের বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের খুব একটা হিসাবের মধ্যে ধরত না। মনিরের নেতৃত্বে তিনশ ও হাকিমের নেতৃত্বে দু’শ মুক্তিযোদ্ধা রাঙামাটিতে ঘাঁটি গেড়েছে। তদুপরি পুব দিক থেকে ক্যাপ্টেন লাল্টু যখন একশ মুক্তিযোদ্ধাসহ মেজর হাকিমের কাছে গিয়ে তার উদ্দেশ্যের কথা জানাল, তখন রাঙ্গামাটির সকল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উৎসাহের বান ডেকে যায়। তাদের তখন এমন অবস্থা- মনের জোরেই তারা যেন খালি হাতে হানাদারদের মোকাবেলা করতে পারবে, অভিজ্ঞ কমাণ্ডার হাকিম সহযোদ্ধাদের মনোবল দেখে আনন্দিত হয়। কিন্তু সে জানত শত্রুর অস্ত্রবল মুক্তিযোদ্ধাদের চাইতে অনেক উন্নত ও বেশী। তাই মনোবল ও কৌশলে শত্রুকে ঘায়েল করতে হবে। সে জন্য সম্মুখ যুদ্ধে প্রাধান্য না দিয়ে, নানা দিক থেকে শত্রুর উপর চোরাগুপ্তা আক্রমণ হানার পরিকল্পনা নিল। শত্রুদের উত্যক্ত ও নাজেহাল করার রণকৌশল হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি দলকে আশে- পাশের প্রায় দু’তিন মাইল জায়গা জুড়ে গ্রামের ভিতর রাখল।
হানাদাররা তাণ্ডব চালাতে চালাতে এগিয়ে আসছিল। রাঙ্গামাটির তিন মাইল উত্তরে হানাদাররা প্রথম মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ল। আর সে আক্রমণও সামনে থেকে হয়নি, হয়েছে একেবারে পেছন থেকে। আচমকা পেছন থেকে আক্রান্ত হয়ে, খানসেনারা খুব বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে তাদের বেশী সময় লাগে না। হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে, জ্বালাও পোড়াও বন্ধ করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে অগ্নিবৃষ্টি শুরু করে। এতে আশ-পাশের দশ বার মাইল এলাকা থর থর করে কেঁপে উঠে। তবে হানাদারদের মেশিনগান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রের গর্জনে মুক্তিযোদ্ধাদের বুক যে এতটুকু কাঁপেনি, তা তাদের আঘাতের পর আঘাত হানা থেকেই বোঝা যায়। প্রথম আঘাতেই জনা দুই হানাদার নিহত ও সাত আট জন গুরুতর আহত
পৃষ্ঠা নং ~ ৩০৫

হয়। এই শেষ নয়, হানাদাররা যে চারটি মহিষের গাড়ীতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসছিল সেই গাড়ীর মহিষগুলো গুলির সাথে সাথে আর্তচিৎকার করে উন্মত্তের মত বিদ্যুৎ বেগে ছুটতে থাকলে, রাস্তার পাশে গাছে লেগে গাড়িগুলি উল্টে-পাল্টে পড়ে যায়। পায়ে গুলি লাগা একটা মহিষ অচল হয়ে পড়ে। একটির জোয়াল, অন্য দুটির দুটি ঢাকা গাছে লেগে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। অন্য একটির ডলনা ভেঙে বেরিয়ে পড়ে। এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে হানাদাররা আরও মাইল দুই এগিয়ে আসে। কিন্তু তারপরেই তাদের লেজ গুটিয়ে পিছু ফেরার পালা শুরু হয়।
রাজাকারদের সামনে রেখে হানাদাররা পেছনে পেছনে এগুতে থাকে। একটি সুরু রাস্তা ধরে উত্তর দিক থেকে তারা দক্ষিণে এগিয়ে চলেছে। হানাদারদের ডান ও বামে মুক্তিযোদ্ধারা সংগীন উচিয়ে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। মেজর হাকিমের কোম্পানীর অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা পুলিশ সাইদুর খুব কাছ থেকে হানাদারদের আঘাত হানে। তাদের আঘাতের প্রধান লক্ষ্য, দলনেতা। দলনেতা ও সহকারীকে বেছে বেছে দেখে দেখে গুলি করা। হানাদার বাহিনীর নেতা একজন ক্যাপ্টেন এবং তার সহকারী একজন সুবেদার। সাইদুর ও তার সাথীরা মাত্র ছয় সাত রাউণ্ড গুলি খরচ করে হানাদার নেতা ও উপনেতার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয়। দলনেতা নিহত হওয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহনের ব্যাপারে হানাদাররা বিপাকে পড়ে যায়। তাদের যুদ্ধ করার খায়েশ মিটে গেছে। তারা গোলাগুলির তুফান ছুটিয়ে পেছনে সরে পড়া শুরু করে। তারা পালানোর এক নতুন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। কয়েকটি ছোট ছোট দল রাস্তায় দুপাশে জঙ্গলের ভিতর ছড়িয়ে দেয় এবং রাস্তা আগলে রেখে আস্তে আস্তে উত্তরে পিছুতে থাকে। হানাদারদের পিছুতে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তার দুপাশ থেকে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে হানাদারদের দূর্দশার অন্ত থাকে না। একে তো অনেক অস্ত্রের বোঝা, উপরন্তু ষোল-সতের জন আহত-নিহত। সর্বোপরি তারা কমাণ্ডারহীন, নেতৃত্ববিহীন। একেবারে লেজে-গোবরে অবস্থা। এরকম নাস্তানাবুদ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে তারা চারটি মৃতদেহ, তিনজন আহত সহ ষোল সতেরটি রাইফেল ও কারবাইন এবং হাজার দশেক গুলি ফেলে পালিয়ে বাঁচে। শুনেছি দুচার ঘা খেয়েও নাকি শুয়োরের গোঁ যায় না। এত ঘা খেয়ে, এতবার নাজেহাল হয়েও, নর-পিশাচ খান সেনারা আরও দুবার পাহাড়ে ঢোকার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সদা সতর্ক মুক্তিবাহিনীর হাতে একই রকম মার খেয়ে প্রতিবারই পালিয়েছে।
৮ই আগষ্ট সকাল আটটায় ভুয়াপুরের রসদ সম্ভার নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল সেহরাবাড়িতে বাসেত সিদ্দিকীর বাড়ীতে পৌঁছল। বিজয়গর্বে বাসেত সিদ্দিকী দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরলেন। বাসেত সিদ্দিকী, নুরুন্নবী ও নরুল ইসলাম খুশীতে টগবগ করতে করতে বললেন, ‘দেখেছেন স্যার, আমরা ঠিক ঠিক আপনার কথা মত সব কাজ শেষ করে এসেছি।”
এবার বাসেত সিদ্দিকী, নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলাম একমাস আগে আনা অস্ত্রশস্ত্রের চাইতে দশগুণ বেশী অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ এনেছেন। ৮ই আগষ্ট সারাদিন অস্ত্র লুকিয়ে রাখার জোর তৎপরতা চলল। সমস্ত অস্ত্র নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রাখা শেষ হলে অস্ত্রের
পৃষ্ঠা নং ~ ৩০৬

একটি নির্ভুল ও সুন্দর তালিকা নিয়ে রাতে হেড-কোয়ার্টারে পৌঁছলাম। আমার সাথে রইলেন বাসেত সিদ্দিকী, নুরুন্নবী, মোয়াজ্জেম হোসেন ও নুরুল ইসলাম। হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে তারা ভারত সফরের একটি সুন্দর রিপোর্ট দিলেন। রিপোর্টে মানকাচরে পৌঁছানো, বি. এস. এফ. মেজর বিন্দার সিংয়ের আন্তরিক আতিথিয়তা, পরদিন তুরা ক্যাম্পে গমন, ব্রিগেডিয়ার মানসিং ও কর্নেল জিয়াউর রহমানের সাথে আলাপ-আলোচনা, বড়ভাই গণপরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীসহ ফজলুর রহমান খান ফারুক, হাতেম আলী তালুকদার ও হুমায়ুন খালিদের সাথে সাক্ষাৎ। বগুড়া, রংপুর, পাবনা, জামালপুর ও ময়মনসিংহের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ এবং মেজর (পরে কর্ণেল) আবু তাহেরের আস্তরিক ও কার্যকর সহযোগিতা মূলক ব্যবহার-এর কোন কিছুই রিপোর্টে বাদ পড়েনি। রাত দেড়টা পর্যন্ত গভীর আগ্রহ নিয়ে ভারতে সফরের বিপজ্জনক ও রোমাঞ্চকর ঘটনার বর্ননা শুনলাম।
ভারতে যাবার সময় তাঁদের নৌকা ডুবে যাওয়া, শরনার্থীদের আন্তরিক সহযোগিতায় ভারত পৌঁছানো, ফেরার পথে শত্রুর গুলিতে বাসেত সিদ্দিকীর নৌকার মাস্তুল ভেঙে পড়া, তাদের নৌকার উপর দশ-পনের মিনিট নিরবচ্ছিন্ন গুলির পরও চরম সংযম প্রদর্শন এবং সমস্ত অস্ত্র সম্ভারসহ সবাইকে নিয়ে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন—এসব শুনে খুবই অভিভূত হলাম। বার বার তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও বাহবা দিয়ে তিন প্রতিনিধিকে বললাম, “আপনারা যে সফলতার সাথে আপনাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন, বিশেষ করে সিদ্দিকী সাহেবের মত বয়সী লোক যে মনোবল ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে আমার এটা মনে করবার কোন সুযোগ নেই যে, আমি আপনাদের চাইতে খুব একটা বেশী কিছু করেছি বা করতে পারছি।” কথাবার্তা বলতে বলতে রাত অনেক হয়ে গেলে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।

বিভ্রান্তির অবসান
৯ই আগষ্ট। সকালে হেড কোয়ার্টার থেকে শুড়ীরচালায় মা-বাবার কাছে এলাম। নুরুন্নবী, বাসেত সিদ্দিকী ও নূরুল ইসলাম তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হেড কোয়ার্টারে থেকে গেলেন। শুড়ীরচালায় মা- বাবার সাথে সময় কাটাচ্ছি, হঠাৎ বহেরতলীর দূত এসে হাজির। দূতের চোখ মুখ ও চাউনি কোন শুভ সংবাদের ইঙ্গিত বহন করছেনা। তৎক্ষনাৎ তাকে আমার কাছে নিয়ে আসা আসা হলো। অন্যরা দূতের মুখের অবস্থা ও তার ভীতিপ্রদ চাহনি দেখে একটা দুঃসংবাদের আঁচ করেছিল। দূত এসে একটু অস্বাভাবিকভাবে বলল, “স্যার আমি একা আপনার সাথে কথা বলতে চাই।” হাবভাব দেখে মনে হলো, সংবাদটি খুবই গুরুতর ও গোপনীয়। সংবাদ দিতে পারলেই যেন সে তার দায়িত্বের বোঝা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। সবুর খান দূতকে বলল, “তোমার ভাই একার কথা কওয়ায় আমাগো আপত্তি নাই। তোমারে তার আগে তল্লাসী করন লাগবো।”
দূত সঙ্গে সঙ্গে বলল, “সবুর ভাই, যত তাড়াতাড়ি পারেন তল্লাসী করুন। আমার খবরটা খুবই জরুরী। আমার কাছে একটা মিনিট একটা দিনের মত মনে হচ্ছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩০৭

সংবাদ বাহক বহেরতলী থেকে এসেছে। কী এমন গুরুতর খবর থাকতে পারে? আর সংবদটা যে নিঃসন্দেহে দুঃসংবাদ তা দূতকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু কত বড় দুঃসংবাদ যে, সে এতটা বিচলিত হয়ে পড়েছে !
বহেরাতলীর দূত আবুহেনা মোস্তফা কামাল। বয়স আঠার-উনিশ। মুক্তিবাহিনীর অত্যন্ত দক্ষ ও বিশ্বস্ত সংবাদ সংগ্রাহক। এর পূর্বে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসংখ্য সংবাদ সংগ্রহ করেছে। নিয়ম মাফিক সবুরের তল্লাসী শেষ হলে মুক্তিযোদ্ধারা অনেকটা দূরে সরে গেল। তবে দৃষ্টি সীমার বাইরে নয়। কথাবার্তার শব্দ যাতে না শোনা যায়, এতটা দূরে গিয়ে তারা দাঁড়িয়ে রইল। আবু হেনা হাঁপাতে হাঁপাতে ভীত কন্ঠে বলল,
— স্যার, বহেরতলীর অবস্থা খুব খারাপ।
— কি হয়েছে? খুলে বল।
— ক্যাপ্টেন ফজলু স্যার আপনাকে গালিগালাজ করেছে। সে আপনাকে পেলেই নাকি গুলি করবে।
— সে আমাকে গুলি করবে কেন? ব্যাপার কি?
— স্যার ! আজ সকালে ক্যাপ্টেন ফজলু স্যার ষাট-সত্তর জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বল্লা আক্রমণ করতে গিয়েছিল। তারা ঘোনাবাড়িতে হানাদারদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে। ক্যাপ্টেন সাহেব কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে সবার আগে চলে এসেছিলেন। কিন্তু অন্যরা খুব অসুবিধায় পড়ে। তাদের গুলি ফুরিয়ে যায়৷ এতে একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও তিনজন আহত হয়েছে। নিহত ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তারা বহেরতলী পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। নিহতের দাফন কাফনের কাজ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাহেব এদিক ওদিক পায়চারী করছেন আর উন্মাদের মত চিৎকার করছেন, শালা, অস্ত্র দিতে পারবে না, গুলি দিতে পারবেনা; আমাদেরকে যুদ্ধে পাঠাইয়া মারবার ব্যবস্থা করছে। পাইছে কি? আমি আজই হেড-কোয়ার্টার আক্রমন করুম। আসুক কাদের সিদ্দিকী। পাইলে শালারে গুলি করমু।
ঘেরাও হয়ে অস্ত্র-শস্ত্র হারিয়ে কোন ক্রমে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে ক্যাপ্টেন ফজলু অনবরত এই ধরনের দাম্ভিক ও উদ্ধত আচরণ করে চলেছিলেন। এটা দেখে ঐ কোম্পানীর গোয়েন্দা প্রধান বক্সার নজরুল খুব সন্তর্পনে আবু হেনাকে একটি রিপোর্টসহ হেড-কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়। আবু হেনা হেড-কোয়ার্টারের কাছাকাছি এসে জানতে পারে, আমি শুড়ীরচালা রয়েছি। তাই সে সোজাসুজি এখানে চলে এসেছে। সব শুনে আবু হেনাকে বললাম, “হেনা, তুই এত কাপছিস কেন? তোর এত ভয় কিসের? এর চাইতে কত মারাত্মক খবর তুই বয়ে এনেছিস। তখন তো তোকে এ রকম করতে দেখি নি।
হেনার ভীতি ও আতঙ্ক তখনো পুরোপুরি কাটেনি। সে বলল, “খবরটা মারাত্মক কিনা জানি না। তবে দলের মধ্যে এই ধরনের ক্যুর খবর আমি বহন করিনি। তাই শুধু অস্বস্তি নয়, বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। এখন খবর পৌঁছে দিয়েছি। আমার দায়িত্ব শেষ। আপনি ভেবে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩০৮

দেখবেন, ব্যাপারটার গুরুত্ব কতখানি। এতক্ষন কান্না পাঁচ্ছিল, এখন আমার হাসতে ইচ্ছে করছে।”
হেনার খবর শুনে সবুরকে ইশারায় ডাকলাম। সবুর এসেই জিজ্ঞেস করল, “স্যার, খবর কি? কোথাও নতুন পাইট লাগছে?”
— না, তেমন কিছু না। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে। তাই ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এ কথা শুনে আবু হেনা ফিক করে হেসে ফেলল।
মাকে তাড়াতাড়ি খাবার দিতে বললাম। খাওয়া শেষে দশ জনকে সাথে রেখে বাকী সহযোদ্ধাদের হেড-কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিলাম। তাদের জানিয়ে দিলাম, ‘বিকেলে অথবা পরদিন তাদের ডেকে নেয়া হবে।’ আবু হেনার খবর শুনে আমি যে কিছুটা উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হইনি, তা নয়। তবে বাইরে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। কিন্তু আবু হেনা যখন দেখল, দশজন যোদ্ধা নিয়ে বহেরতলী যাচ্ছি, তখন সে আরেকবার বিচলিত হয়ে উঠল। আমি যেন মহাবিপদের দিকে পা বাড়াচ্ছি, নিশ্চিস্ত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এটা ভেবে আবু হেনা আর স্থির থাকতে পারল না। সে কাছে এসে খুব আস্তে আস্তে বলল, “স্যার, কি করছেন? বহেরতলী যাচ্ছেন? এত কম যোদ্ধা নিয়ে, স্যার আপনার বহেরতলী যাওয়া ঠিক হবেনা। আমি ক্যাপ্টেন সাহেবের যে মতি গতি দেখে এসেছি তাতে তাকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করতে মন সায় দিচ্ছে না। স্যার, একবার ভেবে দেখেন।”
— তুই চল। একটু পরেই দেখবি, আমি এই কজন নিয়ে যাচ্ছি না।
বহের তলী বাজারের উত্তরে জাফর চেয়ারম্যানের বাড়ির কাছাকাছি এসে গেলাম। এখানে শুকনো খালের মত রাস্তার মুখে আসতেই সামনের চারজন থমকে দাঁড়াল। আমার সামনে চারজন, পেছনে দুজন। খালের দু’পাশের উঁচু দিয়ে দুই+দুই = চার জন এইভাবে এগিয়ে চলছিলাম। সম্ভবতঃ শুকনো পাতার উপর কিছু দৌড়ে যাওয়ায় সরাৎ সরাৎ শব্দে সবাই থমকে দাঁড়িয়েছে। মিনিট দুই চারিদিকে ভাল করে দেখে আবার এগিয়ে চললাম। সামনের দলটি বহেরতলী ঘাঁটির উত্তর পূর্ব দিকে পাহারারত মুক্তিযোদ্ধার সামনে পৌঁছে গেল। পাহারারত মুক্তিযোদ্ঘাঁটি যথারীতি চ্যালেঞ্জ করল, সদুত্তর পেয়ে স্বসম্মানে স্যালুট করে রাস্তা ছেড়ে দিল। আমরা আরো একশ গজ এগিয়ে যাওয়ার পর দশ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান এসে সামরিক সালাম জানালেন। এরপর গার্ড-অব-অনার সহ সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে বহেরাতলী তহশিল অফিসের সামনে এলাম।
বল্লা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধারা খাওয়া শেষে কেবল নানা ধরনের কথাবার্তা শুরু করেছিল। সেই সময় অফিসের সামনে গার্ড-অব-অনারের আওয়াজ পেয়ে তারা অনুমান করেছিল, বাইরে থেকে দায়িত্বশীল কেউ এসেছেন। তবে আমি স্বয়ং এসেছি, এটা তারা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি। আচমকা আমাকে দেখে কেউ কেউ যেমনি ভয়ে একেবারে মুষড়ে যায়, তেমনি আবার বেশী সংখ্যক সদস্য আমাকে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠে। আমি তখন
পৃষ্ঠা নং ~ ৩০৯

খুবই সতর্ক। ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমানের বাড়িতে পৌঁছে বেসামরিক দায়িত্বে নিয়োজিতদের ডেকে পাঠালাম
সমস্ত প্লাটুন ও সেকশন কমাণ্ডার ও ডিউটির বাইরের সকল যোদ্ধাদেরও তাৎক্ষণিকভাবে হাজির করতে বললাম। ফজলু কোম্পানীর যোদ্ধারা তাদের অস্ত্র পাশের একটি ঘরের বেড়ায় ঠেকিয়ে রেখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াল। বসতে বললে তার চুপ করে মাটিতে বসে পড়ল। আমার সাথের দশ-জনই শুধু তখন নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত, সবুর এবং সাঈদ আমার একেবারে পাশে। দুলাল, সামসু বেড়ায় হেলান দিয়ে রাখা অস্ত্রের পাশে দাঁডিয়ে, হালিম, খোকা, কদ্দুস ও অন্যরা চারদিকে পাহারারত। সহযোদ্ধাদের সামনে তিন চার মিনিট বক্তৃতা করলাম। তারপর বল্লাযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের দল থেকে সরে আলাদা বসতে নির্দেশ দিলাম। তারা মূল দলের বামপাশে গিয়ে বসল। এরপর ফজলুর রহমানকে জিজ্ঞেস করলাম, বল্লাযুদ্ধের খবর কী?”
ফজলুর রহমান মোটামুটি স্বাভাবিক ভাবে বল্লাযুদ্ধের একটি বর্ণনা দিলেন এবং যুদ্ধের সময় তাঁরা প্রচণ্ড অসুবিধার মধ্যে পড়েছিলেন বলেও উল্লেখ করলেন। বিপদ সঙ্কুল পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কিছুটা যে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন, তা স্বীকার করে তিনি বললেন, আমি কিছুটা স্বাভাবিকতা হারিয়ে মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দুএকটি আপত্তিকর কথাও বলেছি। যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধা ও ক্যাপ্টেন ফজলুকে কঠোর তিরস্কার করে বললাম, সর্বত্র হানাদাররা নাস্তানাবুদ হয়, আর তোমরা হানাদারদের হাতে চরম বিপর্যস্ত হলে? আমাদের এক সাথী তাই শহীদ হলো। তিনজন গুরুতর আহত হলো। নয়টি হাতিয়ার খুইয়ে পাঁচশ গুলি খরচ করে তোমরা মুক্তিবাহিনীর জন্য কি সংগ্রহ করেছে? ভর্তি হওয়ার সময় তোমাদের সঙ্গে আমার কি কথা ছিল? তোমরা শপথ করে বলেছিল, এক গুলি খরচ করলে পাঁচ গুলি উপহার দেবে। তোমরা পাঁচশ গুলি খরচ করেছ, আমকে পঁচিশ শত গুলি দেখাও। যারা যুদ্ধে যায়নি তাদের বললাম, “ভাইয়েরা, তোমরা আমার সহযোদ্ধাকে ফিরিয়ে দিতে বল।” এ ধরনের কথাশুনে বল্লাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা কেঁদে কেটে নিয়ম শৃঙ্খল ভেঙে কয়েক জন বলল, ‘আমাদের কোন দোষ নেই। আমরা এর আগে কোনো যুদ্ধে যায়নি। কমাণ্ডার সাহেব আমাদের যা বলেছেন, আমরা তাই করেছি। তার কাছে সঠিক খবর ছিল না। তাই আমরা ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়েছিলাম। আমরা না হয়ে অন্যরা হলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হতো। ক্যাপ্টেন আমাদের ফেলে চলে এসেছিলেন। এখানে এসেও অনেক লম্বা লম্বা কথা বলেছেন। আমরা তাকে অত বাড়াবাড়ি করতে বারণ করেছিলাম। আমাদের কোন দোষ নেই তবুও সমস্ত দোষ আমাদের ঘাড়েই চাপছে। আমরা সাধারণ যোদ্ধা কি করব? যা ইচ্ছা শাস্তি দিন। হাতিয়ার হারিয়ে আমরা যতটা দুঃখিত, এক ভাইকে হারিয়ে আমরা তার চাইতে অনেক বেশি দুঃখিত, অনুতপ্ত।
(অস্পষ্ট)
পৃষ্ঠা নং ~ ৩১০

পারেন, তা হলে তাকে বদলী করে দিন। আমাদের অন্য ক্যাপ্টেন দিন।
সহযোদ্ধাদের এই ধরনের অনুযোগ, অভিমান ও খেদ শুনে বললাম, ‘আমি তোমাদের মনোভাব বুঝতে পারছি। যুদ্ধ আমাদের করতে হবে। আমরা যেমন জয়ী হব তেমনি মাঝে মধ্যে যে পরাজিত হব না, তা নয়। কিন্তু আমাদের জয়-পরাজয় দুটোকেই সহজভাবে মেনে নিতে হবে। আমার শুধু দুঃখ হচ্ছে, তোমরা একটা পরাজয়ের ধাক্কা সহজভাবে মেনে নিতে পারছ না। তোমাদের এই কমাণ্ডার ফজলু তিনি তার সমস্ত স্বাভাবিকতা হারিয়ে আবোল-তাবোল পাগলের মত প্রলাপ বকেছেন। সবার জেনে রাখা উচিত-মুক্তিবাহিনীতে পাগলের কোন স্থান নেই।
ফজলু সাহেবকে কঠোর ভাবে বললাম,
“মুক্তিবাহিনী গঠন করতে আমাদের মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছে। এখানে হয়তো এমন একজন মুক্তিযোদ্ধাও নেই, যার সাথে আমি দুচার মাইল হাঁটিনি অথবা দুবেলা একত্র খাইনি। এদের সাথে আমার নাড়ীর সম্পর্ক। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সামান্য অবহেলা যেমন সহজ- ভাবে নেব না, তেমনি কোন কমাণ্ডারের বাড়াবাড়ির কাছেও মাথা নুইয়ে দেব না। আমি বেঁচে থাকার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিইনি। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেই অস্ত্র হাতে নিয়েছি। আপনাকে পরিষ্কার করে বলছি, এবারের মত মার্জনা করা হলো। এরপর উদ্ধত আচরন করলে আপনাকে মুক্তিবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে। এমন কি শাস্তিও হতে পারে। আমার ইচ্ছা নয়, আপনাকে অপমান করা। কারণ আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সবাইকে সম্মানিত দেখতে চাই। তাই কথা বাড়িয়ে আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না। এইখানেই আজকের ভুলের সমাপ্তি হোক। ভবিষ্যতে ভাল কিছু করুন, এটাই আমার আশা।”
এরপর সহকর্মীদের সাথে বসে খাবার খেয়ে বহেরাতলী থেকে সোজা দক্ষিণে দাড়িয়াপুর রওনা হলাম।
ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান সত্যিকার অর্থে এরপর আর কোনদিন মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব সম্পর্কে অনাস্থাবোধ বা অসম্মান দেখাননি। যুদ্ধের পরেও না, এখনও না। তিনি যে আন্তরিক ভাবেই আমাকে শ্রদ্ধা করতেন এবং করেন—তার ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে। বল্পাযুদ্ধে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েই ক্যাপ্টেন ফজলু অমন আচরণ করেছিলেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩১১

অস্ত্র বোঝাই জাহাজ দখল

বহেরাতলী থেকে বিড়ি পাতার পাঠান ব্যবসায়ীদের সংগ্রামপুর ক্যাম্পে এলাম। সংগ্রামপুরের এই অবাঙালী ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করে যাচ্ছিল। তিন-চারদিন আগে সংগ্রামপুর বিড়ি পাতা ক্যাম্পের মালিক, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক কর্ণেলের ছোটভাই মমতাজ খানকে একটি খবরের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। ৫ই আগস্ট দুপুরে আমাদের বেতারে ধরা পড়েছিল, ঢাকার সদরঘাটে ই. পি. আর. জেটিতে বেশ কয়েকটি বড় বড় জাহাজে অস্ত্র বোঝাই হচ্ছে। একই ধরনের খবর লোক মারফত নবী নেওয়াজের কাছেও এসেছিল। খবর পেয়ে সাথে সাথে তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য মমতাজ খানকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। মমতাজ খান খবর নিয়ে এসেছে অথবা কোন খবর পাঠিয়েছে কিনা, তা জানতে সংগ্রামপুর বিড়ি পাতার ক্যাম্পে এসেছি। মমতাজ খানও আমি ক্যাম্পে পৌঁছানোর কয়েক মিনিট আগে ঢাকা থেকে এসেছে। মুক্তিবাহিনীর ওয়ারলেসে ধরা খবরের উৎস ও সত্যতার আদি-অন্ত সমস্ত কিছু মমতাজ খান জানাল। সদরঘাটে সাতটি জাহাজে অস্ত্র বোঝাই হচ্ছে, জাহাজ- গুলোর গন্তব্যস্থল বগুড়ার ফুলছড়ি ঘাট। সেখানে অস্ত্রশস্ত্র খালাস করে রংপুরের সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে।
বেতারে জাহাজে অস্ত্র বোঝাইয়ের খবর পাওয়ার পরই যমুনা নদীতে কঠোর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে ভুয়াপুরের আঞ্চলিক দপ্তরকে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। ১৫ তারিখের মধ্যে তাদের কাছে ভাল শিকার আসতে পারে, এরপর ইঙ্গিত নির্দেশে ছিল। ভুয়াপুর আঞ্চলিক দপ্তরকে জানানো হয়েছিল, ‘১০ তারিখের পর যে কোন সময় আমি ঐ অঞ্চলে যাব। আমার পৌঁছানোর আগেই যদি শিকার এসে যায়, তা হলে যে কোন উপায়ে তাকে বধ করতে হবে। এই সংবাদ কোন ক্রমেই শুধু মাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত কমাণ্ডার ছাড়া আর কাউকেই যেন জানানো না হয়। নির্দেশ পেয়ে এনায়েত করিম যথাযথ ব্যবস্থা নেন। সংগ্রামপুর মমতাজ খানের কাছ থেকে খবর পেয়ে দক্ষিণে না এগিয়ে উত্তরে যাওয়া স্থির করলাম। সংগ্রামপুর থেকে নৌকা পথে তেজপুর, রতনপুর ও ধানগড়া হয়ে ১০ তারিখ সন্ধ্যায় নবী নেওয়াজের কোম্পানীর সদর দপ্তর মরিচাতে পৌঁছলাম। মরিচাতে রাতে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি কামনা করে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। আমরা সবাই মিলাদে যোগ দিলাম এবং মরিচাতেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। গভীর রাতে এক পাঠান যুবক এসে জাহাজ সম্পর্কে আরও নতুন খবর দিল।
পরদিন ১১ই আগস্ট সকাল এগারোটায় লোকমান কোম্পানীর সদর দপ্তর ধলাপাড়াতে গেলাম। ধলাপাড়া থেকে বিকেলে সিদ্দিকী সাহেবের বাড়ি সেহরাবাড়িতে এলাম। ১২ তারিখ বিকালে পোড়াবাড়ি পাকুটিয়ার মাঝ দিয়ে সড়ক পার হব, এমনি একটি পরিকল্পনা ছিল। বাসেত
পৃষ্ঠা নং ~ ৩১২

সিদ্দিকীর বাড়িতে এসেই মনে হলো, আরো একবার দেওপাড়াতে নিজে আক্রমণ পরিচালনা করি। দেওপাড়া হানাদার ঘাঁটির পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর লোকমান সব সময় রাখত। ঐদিন নতুন করে দেওপাড়া ঘাটির সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চার-পাঁচটি দল পাঠানো হয়েছিল। কমাণ্ডার লোকমান আমাকে দেওপাড়ার তাজা খবর দিল। সর্বশেষ খবর যখন পাওয়া গেল, তখন আক্রমণ চালানোর কোন অসুবিধাই রইল না।

দেওপাড়া তছনছ
রাত দশটায় ত্রিশজনের একটি দল নিয়ে দেওপাড়া ঘাঁটি আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ধলাপাড়া, চম্বলতলা হয়ে দেওপাড়ার পশ্চিম-উত্তরে শিবের পাড়ার কাছাকাছি এসে মুক্তিযোদ্ধাদের দুভাগে ভাগ করে, তাদেরকে বিশ্রামের আদেশ দিলাম। শিবের পাড়ার করিম মুন্সিকে আনতে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হলো। কয়েক মিনিট বিশ্রামের পর সবাইকে রাতের আক্রমণ কি ধরনের হবে, তা ভালভাবে বুঝিয়ে বললাম, “আমি চাই, তোমরা অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করবে। আমাদের উদ্দেশ্য, যতটুকু সম্ভব নিজেদের ক্ষতি এড়িয়ে শত্রুর ক্ষতি করা। যুদ্ধ শেষে আমরা নির্ধারিত স্থানে যখন পুনর্মিলিত হব, আশা করি তখন আমরা সবাই অক্ষত মিলিত হতে পারব।’ সম্মিলিতভাবে সকল সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দিয়ে আলাদাভাবে খোকা, শামসু ও দুলালকে সতর্ক করে দিলাম, কোন পরিস্থিতিতে তারা যেন আমার থেকে দশ গজের বেশী দূরে না যায়। সব মুক্তিযোদ্ধাদের শেষবারের মত কঠোরভাবে সতর্ক করে দেয়া হলো, “কোনক্রমেই কোন স্থানে দুজনের কম হতে পারবে না। তোমরা একা বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কোনদিকে কুড়ি-পঁচিশ হাত দূরেও যেতে পারবে না।”
করিম মুন্সি এলে তাঁর কাছ থেকেও হানাদার ঘাঁটির সর্বশেষ খবর নিয়ে নিশ্চিত হতে চাইলাম। পঞ্চাশ-ষাট বৎসর বয়সী করিম মুন্সি আমাদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু। আমি তাকে যেমন শ্রদ্ধা ও সম্মান করি, মুন্সিও আমাকে তেমনি সম্মান ও শ্রদ্ধা করেন। করিম মুন্সি আমাকে দূরে নিয়ে নীচু গলায় বললেন, “পশ্চিমে লুৎফর ও রিয়াজের বাড়ীর দিক থেকে আক্রমণ করতে পারলে, সামান্য কিছু গুলি ছুঁড়লেও হানাদারদের বিপুল ক্ষতি সাধন করা সম্ভব হবে। ঐ দিক দিয়ে এগিয়ে যাওয়া যেমন নিরাপদ, পিছিয়ে আসাও সুবিধাজনক।”
আমরা পশ্চিম ও পশ্চিম-উত্তর দিক থেকে দেওপাড়া হানাদার ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালালাম। ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন যে, দুজন নিয়মিত পাক হানাদার ও দুজন রাজাকার টহল দিতে দিতে আমাদের ওৎ পেতে থাকা ফাঁদে এসে হাতেনাতে ‘শিয়ালে মুরগী ধরার মত’ ধরা পড়লো। তারা একটু টু-টা করার সুযোগ পেল না। আমাদের প্রথম মোক্ষম আঘাতে চারজনই কুপোকাত। টহলদারী আমাদের হাতে অতর্কিত ধরা পড়ায় হানাদারদের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানো আরো সহজতর হল। ত্রিশজনকে একত্রে আক্রমণ চালাতে দিলাম না। সবুরের নেতৃত্বে মাত্র দশজনের একটি দলকে দু’শ গজ সামনে যে ঘরে হানাদাররা ঘুমিয়ে আছে, সেই ঘরে আক্রমণ চালাতে নির্দেশ দিলাম। এবং কোন ক্রমেই দশ মিনিটের বেশী গুলি চালাতে বারণ
পৃষ্ঠা নং ~ ৩১৩

করলাম। পেছনে ও দুই পাশে রক্ষাব্যূহ রচনা করে আমরা সবুরদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সবুর সহযোদ্ধাদের নিয়ে ত্বরিত গতিতে এগিয়ে গিয়ে, হানাদারদের ঘর থেকে মাত্র পঞ্চশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত হানাদারদের উপর বৃষ্টির মত গুলি ছুঁড়ল। মুক্তিযোদ্ধারা দশ মিনিটও গুলি চালায়নি। মিনিট পাঁচেক অবিশ্রান্ত গুলি ছুঁড়ে তারা পিছিয়ে আসে। সবুরের দল পিছিয়ে নিরাপদ স্থানে আসার সময় শুধুমাত্র ডানদিক থেকে অর্থাৎ দেওপাড়া বাজারের হানাদার ঘাটি থেকে দুইটি এম. জি. ও দুই-তিনটে চাইনীজ রাইফেলের কয়েক ঝাঁক গুলি আসে, তবে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন ক্ষতি হয়নি।
সাত-আট মিনিটের মধ্যেই দেওপাড়া হানাদার ঘাঁটি থেকে নিয়মিত পাক-হানাদার ও দুইজন রাজাকারকে সাথে নিয়ে নিরাপদ স্থানে ফিরে এলাম। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল, যেখানে এসে মিলিত হবার স্থান নির্ধারত ছিল, সেখানে আর আমাদের যেতে হলোনা। কারণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ার কোন ঘটনাই ঘটেনি। সমস্যা দেখা দিল বন্দী দুজন মিলিটারী ও দুজন রাজাারকে নিয়ে। বন্দী চারজনের অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গেছে কিন্তু এই কুলাঙ্গারগুলোকে নিয়ে কি করা যায়? ভীষণ সমস্যায় পড়লাম। রাত বারটা। মুক্তিযোদ্ধাদের দুই-তিন জনের কিছুটা জ্বরও এসেছে। স্থায়ী শিবির তখনও সাড়ে চার মাইল দূরে। যত দ্রুতই যাওয়া যাক না কেন, এক ঘন্টার আগে পাহাড় জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কোনক্রমে স্থায়ী শিবিরে যাওয়া সম্ভব নয়৷ তাই ধৃত দুজন মিলিটারী ও দুজন রাজাকারকে নিয়ে আমরা সোজা উত্তরে চললাম। আবার সেই চাম্বুলতলা। চাম্বুলতলায় এসে রাজাকার দুজনকে আলাদা করা হলো। তাদের দুজনকে চোখ বেঁধে মরিচায় নবী নেওয়াজের কোম্পানীতে পাঠিয়ে দেয়া হল। যারা রাজাকার দুজনকে নিয়ে গেল, তাদের বলে দেওয়া হলো, মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ঘাঁটির ভেতর যেন রাজাকারদের না নেয়া হয়। রাজাকারদের সম্ভব হলে পারখীর আশে পাশে কোথাও রেখে, কমাণ্ডার নবী নেওয়াজ যেন বিচার বিবেচনা করে, এদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। তবে কোনক্রমেই যেন রাজাকারদের হত্যা করা না হয়। এর পরও নিয়মিত হানাদার বাহিনীর দুইজনকে নিয়ে সমস্যা রয়েই গেল। হানাদার বাহিনীর দুজনই বালুচী। দেওপাড়া থেকে চাম্বুলতলা আসার পথে তারা অনেক কথাবার্তা বলেছে। তারা কেন এসেছে? এতদিন তাদের কি অভিজ্ঞতা হয়েছে? মুক্তিবাহিনীকে তারা কিভাবে দেখে? মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে ক্যাম্পে কি ধরনের আলাপ-আলোচনা হয়? এই সবের কিছু কিছু তারা ইতিমধ্যে চলার পথে উল্লেখ করেছে। উত্তর দিকে চলতে চলতে এদের সম্পর্কে কি করা যায় ভাবছিলাম। চাম্বুলতলা এসেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। ঠিক এই সময় মুশকিল আসানকারীর মত মাকড়াইয়ের শাজাহান এসে হাজির হলো। সে সব শুনে বলল, স্যার এই দুজনকে আমার কাছে দিয়ে চলে যান। ঝরকার কাছে গভীর জঙ্গলে বেশ কয়েকটি শক্ত ও ভাল বাড়ি আছে। সেখানে একটি কমিউনিটি সেন্টারও আছে। আমার দল নিয়ে এই দুজনকে সামলাই। এই দু’জনকে সেখানে রেখে আমরা এদের কাছ থেকে হানাদারদের খোঁজ খবর নিই, তারপর আপনি যে রকম নির্দেশ পাঠাবেন, সেই রকম ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৩১৪

বন্দীদের নিয়ে যাবার সময় শাজাহানকে দূরে ডেকে বললাম, ‘সাবধানে থাকবে। এরা সাংঘাতিক উন্নত ধরনের ট্রেনিংপ্রাপ্ত। সামান্য অসতর্ক হলে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। হাত পা শক্ত করে বেঁধে রাখবে। তবে খুব মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করবে এবং যত্ন করে খাওয়াবে। আর যে কথাই বলে, তাই লিখে আমাকে জানাবে। এদের নাম, বাড়ি, কবে এসেছে, রেজিমেন্টের নাম, টাংগাইল কবে এসেছে, কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছে,, দেওপাড়ায় কবে এসেছে, এই যুদ্ধ কেন হচ্ছে, দেশের মানুষ সম্পর্কে তাদের ধারণা কি-এই সব প্রশ্ন খুঁটিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে জিজ্ঞেস করে জানার চেষ্টা করবে। আগামী চারদিনে এদের সম্পর্কে যদি লিখিত কোন নতুন নির্দেশ না পাঠাই, তাহলে চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় ঘাটাইলের কাছাকাছি ছেড়ে দিয়ে আসবে। ছেড়ে দেয়ার সম্ভাবনা বলেই খুব ভাল আচরণ করবে। তবে এদের সামনে তোমরা মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে কোন আলোচনা করবে না। দেখ, এদের যেন কোন ক্ষতি না হয়। আমি আবার পরে খোঁজ করব।”
আমি চম্বলতলা থেকে বিদায় নিয়ে রাত আড়াইটায় সেহরাবাড়ির বাসেত সিদ্দিকীর বাড়ির বৈঠকখানায় এসে ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়লাম। সাথে সাথে নিদ্রাদেবী কোলে টেনে নিল।

জাহাজ দখল
শেষ রাত। সবুর আমাকে ডাকছে, ‘স্যার, সার, উঠেন।’ দু’ডাকেই ঘুম ভেঙে গেল। সবুরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুসংবাদ না দুঃসংবাদ?”
― স্যার ভুয়াপুর ও হেড-কোয়াটার থিকা সিগন্যাল আইছে। তারা বাইরে খাড়াইয়া আছে। ভুয়াপুর থিকা বল্লার রশিদ আর হেড-কোয়াটার থিকা তিনজন, খবর তাগোরে এড্ডাই।
— দেরী কেন? ওদের ডেকে আন।
ডেকে আনতে হল না। তারা ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। রশিদ ও অন্য তিন সিগন্যাল- ম্যান সামনে এল। রশিদের আবেগ উচ্ছ্বাস ও আনন্দ যেন উপচে পড়ছিল। সে ধূপ করে মাটিতে বসে পড়ে আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলল, “স্যার। গতকাল আমরা মাটিকাটায় মস্তবড় জাহাজ মেরেছি। বাইশটি গ্রামে গোলাবারুদ রাখা হয়েছে। সে কি বড় বড় গুলির বাক্স। একজনে নড়ান- চড়ান যায় না। স্যার, আমি এর আগে এতবড় জাহাজ দেখি নাই। একটা নয়, দু’দুটা জাহাজ মেরেছি। আমাকে কমাণ্ডার হাবিব সাব রাত আটটায় খবর দিতে পাঠিয়েছেন। তখনও জাহাজ থেকে অস্ত্র আর গোলা-বারুদ নামানো হচ্ছে। আমি শেষ দেখে আসি নাই। আমি হেড- কোয়ার্টারের দিকে যাচ্ছিলাম। শহর গোপিনপুরে স্বেচ্ছাসেবকরা আমাকে আটকায়। তারা রাতে হেড কোয়ার্টারে যেতে দেবে না। সেই সময় হেডকোয়ার্টার থেকে এরা ঐ রাস্তা দিয়ে আসছিলেন। এরাও ঐ একই খবর হেড কোয়ার্টার থেকে নিয়ে এসেছেন। এদের কাছেই জানলাম, আপনি ধলাপাড়া অথবা এম. পি. সাহেবের বাড়িতে। তাই এখানেই চলে এলাম। আমার না স্যার, আনন্দে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। অস্ত্রের জন্য আমাদের আর কোন চিন্তা করতে হবে না। এমনি আর দু’একখানা জাহাজ মারতে পারলেই কয়েক দিনের মধ্যে পাক-বাহিনীকে একেবারে তাড়িয়ে দিতে পারব।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৩১৫

এরপর সবুরকে উদ্দেশ্য করে মাটিতে থাপ্পর দিয়ে রশিদ বলল, “হায়, হায়। সবুর ভাই, কি মস্ত বড় জাহাজ। না দেখলে তা বিশ্বাস করতে পারবেন না। আর কত যে অস্ত্র আমরা নামাইছি, দেখবেন এরপর লড়াই করতে কত সুবিধা হয়।”
পাঁচ মিনিট নীরবে রশিদের কথাশুনে বললাম, “তোর কথা শুনে তো মনে হয়, সত্যিই তোরা একটা কিছু করেছিস্। আচ্ছা রশিদ, তোরা তো কোন লঞ্চ-টঞ্চ মারিস নি?” রশিদ ভুত দেখার মত লাফিয়ে উঠে বলল, “না, না, স্যার, বলেন কি? আমরা যে জাহাজ মেরেছি, তার মধ্যে মস্ত বড় বড় পঁচিশটা লঞ্চ ঢুকিয়ে রাখা যাবে।
এই সময় হেড-কোয়ার্টারের সিগন্যালম্যানরা রশিদের বক্তব্য সমর্থন করে, আমার হাতে একটি কাগজ তুলে দিয়ে বলল, “হেড কোয়ার্টার বেতারে, আজ দুপুরে রশিদ ভাইয়ের এই সংবাদই ধরা পড়েছে৷ আমরা বিকাল তিনটায় হেড-কোয়ার্টার বেতারে, আজ দুপুরে রশিদ ভাইয়ের এই সংবাদই ধরা পড়েছে। আমরা বিকাল তিটায় হেডকোয়ার্টার থেকে রওনা হয়েছি। প্রথম দক্ষিণে চলেছিলাম। পাথরঘাটার কাছে গিয়ে সিগন্যাল পেলাম যে, আপনি দক্ষিণে যাননি উত্তরে এসেছেন। রাত এগারটায় আমরা নবী নেওয়াজ সাহেবের কোম্পানীর হেড কোয়ার্টার মরিচাতে আসি। নবী নেওয়াজ সাহেব আমাদের খাবার ব্যবস্থা করেন এবং তিনিই জানান আগের রাতে আপনি মরিচাতে ছিলেন। সম্ভবতঃ এখন আছিম বা রাঙ্গামাটিতে থাকতে পারেন। তাই আমরা মরিচা থেকে নৌকায় পলাশতলী হয়ে, শহর গোপিনপুরে এসে নেমে হাঁটা শুরু করতেই স্বেচ্ছাসেবকরা আটকে দেয়৷ শহীদ সাহেবের চিঠি দেখে আবার আমাদের যাবার অনুমতি দেয়। কিন্তু কোথায় যাব জিজ্ঞেস করলে আমরা যখন বললাম, ‘স্যারের কাছে যেতে পারলে বেশী ভাল হয়, নতুবা অন্য কোন কমান্ডারের কাছে যাব। আমাদের কথা শুনে রশিদ ভাই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, আমি সিগন্যাল কোম্পানীর লোক না হওয়ায়, এখানকার সিগন্যাল পাস ওয়ার্ড জানিনা বলে আমাকে রাতের মত আটকিয়ে রেখেছে। সকালের আগে এরা আমাকে কিছুতেই যেতে দিবে না। অথচ আমার এক্ষুণি স্যারের কাছে যাওয়া দরকার। আমি খুব জরুরী খবর নিয়ে এসেছি।” এই সব কথা শুনে শহর গোপিনপুরের স্বেচ্ছাসেবকরা নৌকায় করে সোজা আপনার কাছে পৌঁছে দিয়ে গেছে। ”
সমস্ত খবরা-খবর শুনে এবং শহীদ সাহেব ও আজীজ বাঙালের যুক্ত স্বাক্ষরিত বেতার সংকেত পড়ে আমার শরীরে এক অনাস্বাদিত আনন্দের ঢেউ খেলে যেতে লাগল। মুক্তিযুদ্ধ চালাতে গেলে যে বিপুল অস্ত্রের প্রয়োজন, তা সব সময় হাড়ে হাড়ে উপলদ্ধি করছিলাম। সংবাদ শোনার সাত-আট মিনিট পর বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে সংবাদ বাহক রশিদকে জাপটে ধরে কোলে তুলে নিলাম। রশিদ বেশ সবল ও সুঠাম। কিন্তু আমার কাছে তখন রশিদের কোন ওজনই না৷ হাল্কা বস্তুর মত, রশিদকে পাজাকোলা করে তুলে সারা ঘরময় ধেই করে নাচতে লাগলাম। হেডকোয়ার্টারের সিগনালম্যানদেরও পাঁজাকোলা করে দু’একটি চক্কর দিয়ে, রশিদের মতোই ধূপ করে মাটিতে ছেড়ে দিলাম। সবুর ও সামসুকে নিয়েও অনুরূপ আনন্দে নাচলাম। আমি যেন কিছু সময়ের জন্য বেসামাল হয়ে গেলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩১৬

সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা জেগে গেছে। তারা জেনে গেছে নিশ্চয়ই আনন্দের বিরাট কোন ঘটনা ঘটেছে। আমি আর বিছানায় গেলাম না। তখনই হাত মুখ ধুয়ে তৈরী হয়ে নিলাম। গণ- পরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকী হৈ-হুল্লোড় শুনে ঘরে এসে কোন কিছু না বুঝেও আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার চলে গেলেন। এতটুকু বুঝে নিয়েছেন, অল্পক্ষণের মধ্যেই নতুন কোথাও আমরা রওনা হয়ে যাব। তাই তিনি খিচুড়ী ও চা বানাতে লেগে গেলেন। ঘন্টা খানেকের মধ্যে পেট পুরে খিচুরী খেয়ে, চা পান করে ভুয়াপুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
টাংগাইল-মধুপুর সড়কের পশ্চিমে ধলেশ্বরী যমুনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র ভুয়াপুর উত্তর টাংগাইলের এই বিস্তীর্ণ এলাকা পাক-হানাদারদের কাছে এক বিভীষিকাময় অঞ্চল। পাক-হানাদারদের বিভিন্নমুখী আক্রমণ এই ভুয়াপুর রক্ষাব্যূহের কাছে বারবার প্রতিহত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা আবার নতুন করে হানাদারদের জন্য বিপদ সৃষ্টি করল আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে। নতুনভাবে অস্ত্র বলে বলীয়ান হয়ে, মুক্তিবাহিনী নব উদ্যমে শত্রু হননে তৎপর। ৭ই আগস্ট হেড-কোয়ার্টার থেকে এনায়েত করিমের কাছে ছোট্ট একটি নির্দেশ গিয়েছিল, ‘নদী পথের উপর কড়া নজর রাখ। সাথে সাথে তিনি হেড-কোয়ার্টারের নির্দেশ মেজর হাবিবকে জানিয়ে দেন।
৯ই আগস্ট, ১৯৭১। ধলেশ্বরী নদীর পারে সিরাজকান্দি ঘাটে পাক-হানাদার বাহিনীর সাতটি জাহাজ এসে নোঙর করল। জাহাজগুলোর তিনটি আকারে বিরাট এবং দু’টি সযত্নে ত্রিপল দিয়ে মোড়া। জাহাজের বহর দেখে অনেকেই ভাবলেন, পাকবাহিনী সম্ভবতঃ ভুয়াপুরে ব্যাপক হামলা চালানোর মতলব আঁটছে। কিন্তু জাহাজের মধ্যে সৈন্যদের তৎপরতার অভাব লক্ষ্য করে অনেকে অনুমান করলেন, ওদের গন্তব্যস্থল হয়ত অন্যত্র। এখানে বোধহয় বিশ্রাম নিতে নোঙর ফেলেছে। সিরাজকান্দি ঘাটে সাতটি জাহাজ রাতে দেখলে কারো সন্দেহ হতো না যে, ঐ এলাকায় নতুন একটি শহর পত্তন করা হয়েছে। রাতে সাতটি জাহাজের বৈদ্যুতিক আলো এলাকাটিকে দিনের মত আলোকিত করে তুলেছিল।
নদী পথ পাহারার ও খোঁজ-খবর নেয়ার ভার ছিল মেজর হাবিবের উপর। সে সিদ্ধান্ত নিল, ওদের উদ্দেশ্য যাই হোক, তথ্য সংগ্রহ প্রয়োজন। যদিও কাজটা রীতিমত দুঃসাহসিক। তবুও তথ্য সংগ্রহ করা চাই। কারণ সর্বাধিনায়কের পরিষ্কার ও জোরালো নির্দেশ, ‘যে করেই হোক শিকারকে খতম করতে হবে। হাবিব ডাক দিল তার গেরিলা গ্রুপকে। তাকে সাহায্য করতে কয়েকজন কমাণ্ডো এগিয়ে এল। এদের মধ্যে—মোতাহার হোসেন, জিয়াউল হক, গোলাম নবী, সামাদ গামা, রেজাউল করিম, লুৎফর রহমান, ছোট ফজলু, জামসেদ আলী, জগৎপুরা চরের আলী আকবর ও ছালাম উল্লেখযোগ্য। প্রথম হাবিব স্বয়ং মোতাহার, জিয়া ও জামসেদকে নিয়ে জেলের বেশে বের হলো। হাবিবের পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি, মাথায় গামছা, কাঁধে ঝাকি জাল। অন্যদের কাছেও মাছ ধরার সাজ-সরঞ্জাম। ছদ্মবেশী ‘জেলেরা’ স্বাভাবিকভাবে জাহাজের কাছে আসতেই তিন জন খান সেনা ও পাক সমর্থক একজন বাঙালী সৈনিক স্পিডবোট নদীর কিনারায়
পৃষ্ঠা নং ~ ৩১৭

এসে চমচম, খাসি, মুরগীর খবরাখবর জিজ্ঞেস করল। জেলেরা পোড়াবাড়িতে চমচম এবং সস্তায় খাসি, মুরগী, ভাল চাল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র পাওয়া যায় বলে হানাদারদের জানাল। কথার ফাঁকে নানা কৌশলে তারা কিছু খবর সংগ্রহের চেষ্টাও করল, তবে বেশী কথা বললে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে ভেবে, জেলেবেশী মেজর হাবিব ও তার সঙ্গীরা নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে এল।
সংগৃহীত তথ্য যথেষ্ট নয়। আরও তথ্য চাই। তাই মোতাহার হোসেন, জিয়া, ছোট ফজলু ও জামসেদকে পুনরায় পাঠানো হলো। তারা স্থানীয় জনসাধারণের সাথে যোগাযোগ করল এবং কয়েকটি স্থানে স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েন করল। তারা দেখল, দুটি বড় বড় জাহাজ ও দুটি মটর লঞ্চ পাশাপাশি বাধা রয়েছে। জাহাজ ঘাটের কাছের বাসিন্দা মানিক মিয়া অনেক খবর জানালেন এবং প্রয়োজন হলে তিনি আরও খবর সরবরাহ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদের কোন জাহাজে কি আছে ইত্যাদি সমস্ত খবরই মুক্তিযোদ্ধারা সংগ্রহ করতে সমর্থ হলো। খাবারের প্রতি ক্ষুধার্তের লোভ যেমন তীব্র, তেমনি প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্রের প্রতিও মুক্তিযোদ্ধাদের লোভ দুর্দমনীয়। অস্ত্র দখল করে বহু দিনের ক্ষুধা মিটানোর নেশায় তারা যেন পাগল প্রায়। তারা মেজর হাবিবকে প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য সরবরাহ করে বলল, “অস্ত্র-ক্ষুধার জ্বালা আর সহ্য হয় না। যেমন করেই হোক জাহাজ দখল করতেই হবে।”
কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব? এত অল্প মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ চালানো কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
সিরাজ কান্দি থেকে মেজর হাবিব ভুয়াপুর উপ দপ্তরে সিগন্যাল পাঠাল ‘আরও সাহায্য পাঠান।’ এ সময় মেজর হাবিবের কাছে ছোট্ট একটি বার্তা এল, ‘এইমাত্র সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে নির্দেশ এসেছে, সুবিধা মত অবস্থান থেকে জাহাজে শুধু আক্রমণ কর। আক্রমণ করলেই জাহাজের পতন ঘটবে।” কিন্তু কেন? কি করে? তার কোন উল্লেখ নেই। মুক্তিযোদ্ধারা তো জাহাজ আক্রমণ করতে ষোল আনার উপর আঠার আনা প্রস্তুত। তদুপরি এসেছে সর্বাধিনায়কের নির্দেশ, ‘আক্রমণ কর, সুতরাং আর বসে থাকা যায় না। এই নির্দেশের পর বসে থাকার বা বিলম্ব করার উপায়ও নেই।
দ্রুত আক্রমণের প্রস্তুতি চলল। একটি সম্ভাব্য আক্রমণের সর্বশেষ প্রস্তুতি হিসাবে সিরাজকান্দি থেকে কিছুটা উত্তরে মাটিকাটা গ্রামের স্বেচ্ছাসেবকরা তৈরী হতে লাগল। জামসেদ আলী, মোতাহার, জিয়া, ভোলা ও লুৎফরের সাথে পরামর্শ করে মেজর হাবিব বিভিন্ন স্থানে এমবুশ বসাবার ব্যবস্থা করল। ১০ই আগস্ট রেজাউল করিম একটি শক্তিশালী দল নিয়ে মাটিকাটা গ্রামে এসে অবস্থান নিল। ভুয়াপুরের চার পাশে রক্ষাব্যূহ আরও মজবুত করা হলো। রাতের আঁধারে নদীর পাশে রাস্তা ধরে মেজর হাবিব দুশমনদের অবস্থানের কাছে গিয়ে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করল। সঙ্গীদের নিয়ে অনেকক্ষণ ঘুরে ফিরে মেজর হাবিব দেখল, হানাদাররা বড় একটা বের হচ্ছে না।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩১৮

১১ই আগস্ট সকালে, অবস্থান ত্যাগ করে মেজর হাবিব আবার কিছুদুর পিছিয়ে এল। একটু পরে একজন স্বেচ্ছাসেবক দৌড়ে এসে জানাল, জাহাজগুলো উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করেছে। শিকার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে ভেবে, মেজর মুক্তিযোদ্ধাদের অবিলম্বে যার যার অবস্থানে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিল। প্রতিটি মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধারা অসীম ধৈর্য্য, সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে আত্মগোপন করে সুযোগের প্রতীক্ষা করছে। মেজর হাবিব আরও কিছুটা উত্তরে, মাটিকাটা চরের কাছে দুটি বাড়ীর আড়ালে অবস্থান নিল। সকাল নটায় দেখা গেল, জাহাজগুলো আর অগ্রসর হচ্ছে না। মনে হলো, ওরা কোন নতুন মতলব এঁটেছে। দুশমনরা আক্রমণ করতে পারে, মনে করে গ্রামবাসীরা যে যেদিকে পারলেন ছুটে পালালেন। জাহাজগুলো অগ্রসর ক্ষান্ত দিলেও হঠাৎ দেখা গেল, একটি ছোট লঞ্চ পানি মাপতে মাপতে উত্তরে সিরাজগঞ্জের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আত্মগোপনকারী প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাই জাহাজ আক্রমণ করতে অধীর। তারা ধৈর্য্য ও সংযমের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে। আর একটু হলেই তাদের হাতের তাক করা হাতিয়ারগুলো কর্ কর্ করে গর্জে উঠে আর কি। কিন্তু অধিনায়কের কঠোর নির্দেশ, সে গুলি ছোড়ার আগে কেউ গুলি ছুঁড়তে পারবে না। সামনে দিয়ে ছোট লঞ্চটি চলে যাওয়ার সময় কমাণ্ডার যখন কোন নির্দেশ দিল না, তখন দুচারজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা প্রবল উত্তেজনায় জবাই করা মুরগীর মত ছটফট করতে থাকে। কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই তাদের উৎকণ্ঠা, রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা ও ছটফটানির সমাপ্তি ঘটল। দেখা গেল, সাতটি জাহাজই সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে ধীরে ধীরে উত্তরে এগিয়ে চলেছে। মেজর হাবিব নির্দেশ দিল, ‘উত্তর দক্ষিণের মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থানে দৃঢ়ভাবে বসে থাক, কেউ উত্তেজিত হবে না। শত্রুর শক্তি আমাদের চেয়ে অনেক বেশী। ঠাণ্ডা মাথায় বুদ্ধি খাটিয়ে ওদের ঘায়েল করতে হবে। আমি গুলি ছোঁড়ার সাথে সাথে তোমরা এক সাথে শত্রুর উপর মরণাঘাত হানবে।’
হাবিবও যে পুরোপুরি উত্তেজনার উর্ধ্বে ছিল, এমন নয়। তার মনের মধ্যেও একটা আশা-নিরাশার খেলা চলছিল। কিন্তু বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন অধিনায়কের মত সে তা কখনো বাইরে প্রকাশ পারেনি। তার মনেও নানা প্রশ্ন জেগেছিল। তবে কি কোন গোপন রহস্য লুকানো রয়েছে? সর্বাধিনায়কের নির্দেশ, ‘আঘাত হানো’ এটাই যেন মেজর হাবিবের কাছে এক অব্যর্থ মারণাস্ত্র।
সকলকে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে সে বুকে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে গেল। তাদের কাছে দুটি এল. এম. জি. একটি দুই ইঞ্চি মর্টার ও কয়েকটি চাইনীজ ও ব্রিটিশ রাইফেল। দলের অন্যদের কাছে, চারটি ব্রিটিশ এল. এম. জি., দুটি ২ ইঞ্চি মর্টার ও একটি ব্রিটিশ রকেট লাঞ্চার।
মুক্তিযোদ্ধাদের বুক টিপ্ টপ্ করছে। কয়েকজন উত্তেজনায় অধীর অস্থীর হয়ে ছট্‌ফট্ করছে। তবে ভয়ে নয়, শত্রুকে চরম আঘাত হানার মাহেন্দ্রক্ষণের প্রতীক্ষায়। ১২ই আগস্ট বেলা
পৃষ্ঠা নং ~ ৩১৯

এগারটা, দুশমনদের জাহাজগুলো আবার এগিয়ে চলল। মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে দিয়ে অতিক্রম করল ছোট আকারের দুটি জাহাজ। মুক্তিযোদ্ধারা যে পাড়ে অবস্থান নিয়েছে, জাহাজগুলোও ঠিক সেই পাড় ঘেঁষে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ পূব পাড়ে পানির গভীরতা বেশী। মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে চর আর চর। দু’টি জাহাজ চলে গেল অথচ মেজর হাবিব কোন নির্দেশ দিল না। সকলেই হাতিয়ার তাক করে, ট্রিগার আঙ্গুল রেখে, অধীর আগ্রহ ও উত্তেজনায় অপেক্ষমান। হানাদার পশুতে ভরা আরও একটি জাহাজ চলে গেল। অধিনায়ক তবুও নীরব। মুক্তিযোদ্ধাদের মনে প্রশ্ন, কানাঘুষা, চাঞ্চল্য—কি করছেন অধিনায়ক? গুলি ছুঁড়ছেন না কেন? নির্দেশ দিচ্ছেন না কেন? সবগুলো জাহাজই তো চলে যাচ্ছে।
এবার কাছাকাছি এলো ত্রিপল ঢাকা অতিকায় দু’টি জাহাজ। একটি এস. ইউ. ইঞ্জিনিয়ারস এল, সি-৩, অন্যটি এস. টি. রাজন। জাহাজ দুটির দুপাশে দুটি মেশিনগান নিয়ে খান সেনারা চটুল গল্প গুজবে মশগুল। মৃত্যু যে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা-কিন্তু তারা তখনও জানে না। জাহাজ দু’টি মুক্তিবাহিনীর গুলির আওতায় আসতেই মেজর হাবিবের এন. এম. জি. গর্জে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সহযোদ্ধারা মর্টার, এল. এম. জি. ও রাইফেল থেকে দোজখের অগ্নি বর্ষণ শুরু করে দিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এম. এ. শেষ বর্ষের ছাত্র রেজাউল করিম অব্যর্থ নিশানায় পর পর দশ-বারটি দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করল। ডান পাশ থেকে মঞ্জু সামনে অত বড় টার্গেট পেয়ে যেন উম্মাদ হয়ে উঠল। সে পনের-কুড়িটি রকেট সেল ছুঁড়ে জাহাজের সারেংয়ের কেবিন ও নীচ তলায় খান সেনাদের অবস্থান ঝাঁঝরা করে ফেলল। খান সেনারা মেজর হাবিবের আক্রমণের ধাক্কা সামান্য সামলাতে পারলেও, রেজাউল করিম ও মঞ্জুর অব্যর্থ আঘাতে একেবারে ঘাবড়ে যায়। জাহাজের খানসেনা কমাণ্ডার চিৎকার করে উঠে, শত্রুরা কামান দাগছে। তোমরা তাড়াতাড়ি সরে পড়। জাহাজে আগুন ধরে যেতে পারে।’ যে দুটি জাহাজ একটু পিছনে পড়েছিল, আক্রান্ত জাহাজ দুটিকে কোন প্রকারের সাহায্যের চেষ্টা না করে, তারা দ্রুত দক্ষিণ দিকে পালাতে শুরু করে। সামনের রসদ বোঝাই জাহাজ দু’টিও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে ভরসা পেল না। তারাও সিরাজগঞ্জের দিকে ত্বরিৎ পালাতে লাগল।
আক্রান্ত জাহাজ দুটি গুলি-গোলার আঘাতে তেমন ক্ষতিগ্রস্থ না হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে পাঁচ-ছয় গজ দূরে পশ্চিম দিকে বেঁকে নদীর বুকে বালুর চরে আটকে গেল। চৌদ্দ-পনের জন খানসেনা গোলার আঘাতে পটল তোলে। বাকীরা এক মুহূর্তে জাহাজে থাকার চেষ্টা না করে, তিন-চারটি ছোট ছোট স্পীড বোট নামিয়ে, তাতে চড়ে, জাহাজের আড়ালে পশ্চিম দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সকল হানাদার জাহাজ থেকে পালিয়ে গেলে, জাহাজের দু’জন নাবিক ছাদের উপর দঁড়িয়ে, ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এর পর আরও একজন ততোধিক জোরে ‘বাচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে নদীতে ঝাঁপ দিল। মুক্তিযোদ্ধারা তখন গোলা-গুলি বন্ধ করে দিয়েছে। জাহাজের দিক থেকেও কোন গোলাগুলি আসছে না।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩২০

মেজর হাবিব পানীতে ঝাঁপিয়ে পড়াদের উদ্ধার করতে মাটিকাটার স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার হাসানকে নির্দেশ দিল। হাসান একটি ছোট্ট নৌকা নিয়ে জাহাজের প্রায় দুমাইল ভাটি থেকে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে এল। ভয় পেয়ে, পানি খেয়ে খেয়ে, ক্লান্তিতে ওদের তখন মুমূর্ষ অবস্থা। প্রাথমিক সেবা-শুশ্রূষার পর তারা জানাল, গোলার আঘাতে সারেংয়ের কেবিন উড়ে গেছে এবং পনের-কুড়ি জন হানাদার নিহত হয়েছে। জাহাজে একজন হানাদারও নেই। প্রায় এক কোম্পানী হানাদার জাহাজে ছিল কিন্তু তারা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে, নিহতদের ফেলে পালিয়ে গেছে। তারা আরও জানাল, জাহাজে অনেক অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে। এই সব অস্ত্র-শস্ত্র ফুলছড়ি ঘাটে নামিয়ে, রংপুর, সৈয়দপুরে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সবশেষে সারেং বলল, ‘আপনারা তাড়াতাড়ি জাহাজে গিয়ে মাল খালাস করুন। ওরা সিরাজগঞ্জ, টাংগাইল ও ঢাকায় সাহায্য চেয়ে বারবার বেতার বার্তা পাঠাতে চেষ্টা করছিল। পিছনের জাহাজগুলো তো একটু পরেই ওদের ঘাঁটিতে আক্রমণের খবর পৌছে দেবে।’
সারেংয়ের কথা শুনে জামসেদ, জিয়া ও সামাদ গামা সারেংকে নিয়ে ছোট্ট একটি নৌকায় জাহাজে গিয়ে উঠল। তারা অবাক বিস্ময়ে দেখল, জাহাজের মাস্তুল পর্যন্ত গোলা-বারুদ ভর্তি। বড় বড় কাঠের বাক্স। এছাড়া দুশমনদের হাতের অস্ত্রও এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিশালদেহী খান সেনাদের লাশগুলো কাটা কলাগাছের মত নানা স্থানে পড়ে আছে। সামাদ গামা রান্না ঘরে ঢুকে দেখতে পেল বড় বড় ডেকচিতে রান্না করা লোভনীয় প্রচুর খাবার। বুকে প্রচণ্ড তৃষ্ণা আর সম্মুখে শীতল পানি, এ অবস্থায় যেমন কারো পক্ষে ধৈর্য্য ধারণ সম্ভব নয়। তেমনি সামাদ গামা রান্না ঘরে ঢুকে সব ভুলে, মুরগীর মাংস খাওয়া শুরু করে দিল। এক কোম্পানী হানাদারদের জন্য তৈরী মাংসের প্রায় বার আনা খেয়ে, আধ ঘন্টা পরে সে বেরিয়ে এল। সামাদ এমনিতে একটু বেশী খেতে ভালবাসে। তাই খাবার দেখে তার আর অন্য কোন খেয়াল ছিল না। যে কাজের জন্য তাকে জাহাজে পাঠানো হয়েছিল, তাতে অবশ্য কিছুটা অবহেলা হলো বটে তবে কাজ পড়ে থাকেনি। সামাদ গামা বেরিয়ে দেখল, জাহাজ দু’টিতে প্রায় পাঁচশ লোক উঠে পড়েছে। তারা জাহাজ থেকে বড় বড় বাক্স নামিয়ে নিচ্ছে।
জাহাজ দখলের ঘন্টা খানেকের মধ্যে জাহাজের মাল খালাস শুরু হয়ে গেল। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বেচ্ছাসেবকরা বাক্সের পর বাক্স নামিয়ে নিচ্ছে। মেজর হাবিব জাহাজের এ মাথা থেকে ও মাথা, একতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে তেতলা দৌড়াদৌড়ি করে সব কিছু তদারকি করছে।
অস্ত্র নামানোর সময় একটি অভাবনীর অসুবিধা দেখা দিল। অধিনায়ক হাবিব প্রয়োজনীয় বাক্সগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে এবং সেগুলোই নামিয়ে নিতে অনুরোধ করছে কিন্তু স্বেচ্ছাসেবক ও জনগণ তা মানতে রাজী নন। তাঁরা বড়বড় বাক্স নামিয়ে নিচ্ছেন। তাঁদের কথা, মুক্তিবাহিনীর বড় বড় অস্ত্রের প্রয়োজন, নিশ্চয়ই বড় বড় বাক্সে বড় বড় অস্ত্র আছে। সুযোগ যখন পেয়েছি, তখন বোকার মত ছোট ছোট বাক্স নামানো কেন, বড় বড় বাক্সই চাই। এ অবস্থায়
পৃষ্ঠা নং ~ ৩২১

হাবিব, জয়া, জামসেদ, রেজাউল করিম ও আরও কয়েকজন সব সময় দৌড়াদৌড়ি করে প্রয়োজনীয় অস্ত্রের বাক্সগুলো দেখিয়ে দিতে লাগলো। এরপরও স্বেচ্ছাসেবক ও জনগণ অনেক অপ্রযোজনীয় অস্ত্রের বাক্স নামিয়ে ফেলেন। ছঘন্টা প্রায় পাঁচশ জন অস্ত্র ও গোলাবারুদের বাজ খালাস করলেন; তবুও জাহাজের পুরো মালামাল নামানো সম্ভব হলো না। প্রায় ষাট ভাগ অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েই গেল।
রাত দশটায় মেজর হাবিব আর জাহাজে থাকতে সাহস করল না। সে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। অন্যদের জাহাজ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। জাহাজে মাত্র তিনজন রয়ে গেছে, জিয়া, জামসেদ ও সারেং মোস্তফা। জিয়া ও জামসেদ ‘এস. ইউ. ইঞ্জিনিয়ারস্ এল. সি. –৩’ অস্ত্র বোঝাই জাহাজের সর্বত্র ডিজেল ঢেলে দিল। পাশের এস. টি. রাজন ট্যাংকারে (ট্যাংকারটির মালিক পাবনার কুখ্যাত চোরা মতিন) এক লক্ষ আশি হাজার গ্যালন ডিজেল ছিল। ডিজেল ঢালার পরও ম্যাচ দিয়ে আগুন জ্বালাতে জিয়া ও জামসেদ বারবার ব্যর্থ হল। আগুন খুব একটা ছড়িয়ে পড়ছে না দেখে জাহাজের সারেং চট্টগ্রামের মোস্তফা তার কৃতিত্বের ছাপ রাখল। সে জিয়া ও জামসেদকে বলল, ‘আপনারা সরে দাঁড়ান। আমি আগুন ধরিয়ে দিচ্ছি। সে ব্যাটারী রুমে গিয়ে মোটা-সোটা দুটা তারের মাথা দুহাতে ধরে টানতে টানতে জাহাজের মাঝে নিয়ে এল। সারেং মোস্তফা, জিয়া ও জামসেদকে জাহাজের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে অনুরোধ করল, যাতে আগুন জ্বলে উঠার সাথে তারা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সারেং ব্যাটারীর তারের দুই মাথায় টোকা মারতেই, প্রচণ্ড অগ্নিশিখার সৃষ্টি হলো, সেই আগুন দাউ দাউ করে জাহাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। জিয়া, জামসেদ ও সারেং নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক মাইল ভাটিতে যেতে না যেতেই জাহাজে কেয়ামতের আলামত শুরু হয়ে গেল।
মুক্তিযোদ্ধারা যখন জাহাজ দখল করে অস্ত্র নামাতে ব্যস্ত, তখন পারদিঘুলিয়ার আবদুস ছালামকে অর্ধমৃত অবস্থায় চাঙারীতে করে কয়েকজন ভুয়াপুরে নিয়ে এল। আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম, মোয়াজ্জেম হোসেন ও নুরুল ইসলাম ছালামকে জাহাজের খোঁজখবর সংগ্রহ করতে একদিন আগে একটা দূরবীন দিয়ে পাঠিয়েছিলেন।
চাঙারীতে করে ছালামকে নিয়ে আসতে দেখে ভুয়াপুরের নেতৃস্থানীয়রা হতভম্ব হয়ে পড়েন৷ ছালামের গায়ে কোন গুলির আঘাত নেই, রক্তের চিহ্ন নেই, কিন্তু এক ছালাম তিন ছালামের মত মোটা হয়ে গেছে। তাকে জিজ্ঞেস করলে ব্যাপারটা পরিস্কার হল। বড় কষ্টে ছালাম সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলঃ
‘আমারে তো আপনেরা জাহাজের খবরে পাঠাইলান। আমি পয়লা গেলাম সিরাজকান্দি, হেনে যাইয়াও নদী দেহি কিন্তুক জাহাজ দেহিনা। অহন কি করি? হেন থনে গেলাম মাটিকাটা। হারাদিন না খাইয়া থ্যাইকা বড় কষ্টে মাটিকাটায় যাইয়াও জাহাজ দেখলাম না। হেইনকার পাবলিকে কইল, জাহাজ ত এহান থিকা বহুতদূরে, অতদূরে যাইয়া কি করবাইন। আপনার কাছে দেহুইনা যন্ত্র আছে, এহান থেক্যাই এডা বড় গাছে উইঠ্যা ভালা কইরা জাহাজ দেইখ্যা নেইনা।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩২২

জাহাজের কাছে গেলে মেলেটারীরাও আপনেরে দেখতে পারে। পাবলিকের বুদ্ধিমত বড় একটা আম গাছে উঠতে থাহি। গাছে উঠতে …..উঠতে যমুনার পানি দেহা যায়, জাহাজ দেহা যায়না। আমি যহন গাছের অর্ধেক উঠলাম, তহন জাহাজের চাল দেহা গেল। চাল দেহার পর, আমি আরো উপরে উঠতে থাহি। আমি উঠতাছি আর উঠতাছি, জাহাজও এটু দেহা যাইতেছে। ভাল কইরা দেহার নিগা আমি আরো উপরে উঠতাছি। আমার মাথার উপরে আছিল এড্ডা বল্লার চাক কিন্তুক আমি তা দেহি নাই। আমি খালি জাহাজই দেখতাছি, কোন সুম যে আমার মাথা বল্লার চাইকের ভিতর ঢুইকা গেছে তা বুঝনের আগেই হুম্মুত কইরা একটা ডাক দিল। আমার দুরবীনডা কোন সুম যে পইড়া গেল কিছুই জানিনা। যে গাছে আমি কত কষ্ট কইরা আধা ঘন্টায় উঠছিলাম, হেই গাছ থিকা মনে অয় আধা মিনিটে নাইমা পড়লাম। মাটিতে পইড়া আমার সাথে সাথে জ্বর আইয়া গেল। তয় গ্রামের মেয়া মাইনষেরা আইস্যা আমারে অন্ততঃ চল্লিশ- পঞ্চাশটা বল্লার শাল তুইলা দিছে। তারাই চুনা-টুনা লাগাইয়া এগোর খবর দিয়া আইনা দিছে। আমি জাহাজের কোন খবর-টবর জানিনা।’
জাহাজের অবশিষ্ট গোলাবারুদ প্রচণ্ড শব্দে ফাটতে লাগল। আগুনের ফুলকিতে দিগদিগন্ত আলোকিত হয়ে উঠল। গোলা প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে আকাশে উঠে আবার বিস্ফোরিত হতে লাগল। পনের কুড়ি মাইলের মধ্যে মানুষের চলাফেরা এমনকি টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়ল। জাহাজে আগুন লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন নিরাপদ স্থানে সরে পড়ল, তেমনি গ্রামবাসীদেরও বহুদূর পর্যন্ত সরিয়ে নেয়া হল। এনায়েত করিম ও ভোলার তত্ত্বাবধানে গোলাবারুদ অস্ত্র শস্ত্র নিরাপদ স্থানে পাঠানো হল। মাটিকাটা, গোবিন্দাসী, নিকড়াইল, বামন আটা, জোগার চর, জগৎপুরা ও শশুয়ার চরের জনসাধারণ ও স্বেচ্ছাসেবকরা মোয়াজ্জেম হোসেন খান, খোদা বক্‌স, আবদুল আলীম, জলিল, আলম, আবদুল বারী তালুকদার ও চেয়ারম্যান দুদুমিয়া প্রমুখের নেতৃত্বে গোলাবারুদ সরানোর দুঃসাধ্য কাজ সুসম্পন্ন করল।
জাহাজের লগবুক ও মুভমেন্ট অর্ডারের হিসাবে জাহাজে ছিল এক লক্ষ কুড়ি হাজার বাক্সে একুশ কোটি টাকার নানা ধরনের চাইনীজ, ব্রিটিশ ও মার্কিন অস্ত্র-শস্ত্র:-
(১) চাইনীজ ও ব্রিটিশ রাইফেল : যথাক্রমে সাত হাজার ও তিন হাজার।
(২) চাইনীজ এম. জি ও এল. এম. জি : একশ টি।
(৩) চাইনীজ ৮২ ব্লাডার সাইট : পঞ্চাশটি।
(৪) চাইনীজ তিন ইঞ্চ মর্টার : পঞ্চাশটি।
(৫) চাইনীজ আড়াই ইঞ্চি মর্টার : পঞ্চাশটি।
(৬) চাইনীজ ৭২ আর. আর. : কুড়িটি।
(৭) ৬ পাউণ্ডার গান : চারটি।
(৮) ১২০ এম. এম. গান : চারটি।
(৯) চাইনীজ কারবাইন : দু’হাজার।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩২৩

গোলা-গুলির সংখ্যা হলঃ-
(১) নানা ধরনের চাইনীজ গুলি : দু’কোটি রাউণ্ড।
(২) ৩০৩ রাউণ্ড : পঞ্চাশ লক্ষ।
(৩) চাইনীজ ৩ ইঞ্চি মর্টার সেল : দু’লক্ষ।
(৪) চাইনীজ আড়াই ইঞ্চি মর্টার সেল : পাঁচ লক্ষ।
(৫) ব্রিটিশ ২ ইঞ্চি মর্টার সেল : দু’লক্ষ।
(৬) ৮২ ব্লাণ্ডার সাইট সেল : দু’লক্ষ।
(৭) স্মোক গ্রেনেড : পঞ্চাশ হাজার।
(৮) ৩৬ হ্যাণ্ড গ্রেনেড : দু’লক্ষ।
(১) ১২০ এম. এম. গোলা : পঞ্চাশ হাজার।
(১০) ৭২ আর. আর. সেল : এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার।
(১১) ৬ পাউণ্ডার সেল : পঁচিশ হাজার।
এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা যা উদ্ধার করতে পেরেছিল :-
(১) চাইনীজ ৩ ইঞ্চি মর্টার সেল : এক লক্ষ কুড়ি হাজার।
(২) চাইনীজ আড়াই ইঞ্চি মর্টার সেল : দশ হাজার।
(৩) ব্রিটিশ ২ ইঞ্চি মর্টার সেল : চল্লিশ হাজার।
(৪) ৮২ ব্লাণ্ডার সাইট সেল : ষাট হাজার।
(৫) ৭২ আর. আর. সেল : বার হাজার।
(৬) ৬ পাউণ্ডার সেল : সাত হাজার।
(৭) ১২০ এম. এম. সেল : পাঁচ হাজার বাক্স।
(৮) চাইনীজ রাইফেল : পাঁচশটি।
(৯) ৩০৩ রাইফেল : একশটি।
(১০) ৩৬ হ্যাণ্ড গ্রেনেড : সত্তর হাজার।
(১১) স্মোক গ্রেনেড : দশ হাজার।
(১২) চাইনীজ এম. জি. : দুটি।
(১৩) চাইনীজ ৭.৬২ গুলি : দশ লক্ষ।
(১৪) চাইনীজ ৭.৬৫ : দু’লক্ষ।
(১৫) ৩০৩ গুলি : এক লক্ষ।
(১৬) চাইনীজ এম. জি. গুলি : পাঁচ হাজার।
জাহাজের নেতৃত্বে ছিল ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ ও লেফন্যান্ট আতাউল্লাহ। ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ প্রাণে বেঁচে গেলেও সহকারী কমাণ্ডার আতাউল্লাহ ও সুবেদার রহিম খান মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে মারা যায়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩২৪

মাটিকাটার এই যুদ্ধে, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ অধিকার করতে মুক্তিবাহিনীকেও মূল্য দিতে হয়। এই জাহাজ মারা যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও সাতজন আহত হয়।
টাংগাইলে ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে আগস্ট পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী যতগুলি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, তার মধ্যে মাটিকাটার জাহাজ মারা যুদ্ধ বিশেষ স্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের দাবীদার। কারণ এই যুদ্ধে পাকবাহিনী সব চেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র সম্ভার বিপুলভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠে।
যেমনটা আশঙ্কা করা গিয়েছিল, তাই ঘটল। পরদিন ১২ আগস্ট পাকবাহিনীর ৪৭ তম ব্রিগেড দক্ষিণ দিক থেকে এলেঙ্গা ও পালিমা হয়ে, ভুয়াপুরের দিকে এগুতে লাগল। খোরশেদ আলম ও হুমায়ুন কোম্পানী হানাদার বাহিনীর অগ্রগতিতে গেরিলা কায়দায় বার বার হামলা চালিয়ে বাধার সৃষ্টি করতে লাগল। কিন্তু ভারী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত দুশমনদের একটি ব্রিগেডের সামনে মুক্তিবাহিনী কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে? তবুও সারাদিন যুদ্ধ চলল। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান থেকে সাময়িকভাবে পিছিয়ে এল। এখানে সরিষা বাড়ির লুৎফর, দেওপাড়ার লুৎফর রহমান, শামসু ও পুলিশ সাইদুর অত্যন্ত সাহস ও দক্ষতার সাথে যুদ্ধ করল। চতুর্দিক থেকে ভুয়াপুর ঘাঁটি হানাদারদের দ্বারা ঘেরাও হলেও, ১২ই আগস্ট সন্ধ্যার একটু পর ভুয়াপুরের তিন মাইল উত্তরে ফলদা বাজারে এসে হাজির হলাম। এসেই রশিদকে ভুয়াপুরে পাঠিয়ে দিলাম। আমি ফলদা স্কুলের বারনদায় বসেছি, এমন সময় বাজারের পাঁচ-ছশ’ গজ দূরে, মেঘের গর্জনের মত আওয়াজে একটা গোলা এসে পড়ল। মাটিকাটা জাহাজ আগের রাত দশটায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারপর থেকেই কুড়ি-পঁচিশ ঘন্টা অনবরত বার তের মাইল জায়গা জুড়ে জাহাজ থেকে দিনরাত গোলা এসে পড়ছিল। বর্ষাকাল না হলে, জাহাজ থেকে আসা ঐ লক্ষ্যহীন গোলার আঘাতে অসংখ্যা মানুষের প্রাণ যেত।
১২ই আগস্ট রাত দশটায় ভুয়াপুরের পাঁচটিকরি এসে হাজির হলাম। ১২ই আগস্টের সারাদিন যখনই মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল, তখনই বারবার এনায়েত করিম অগ্রবর্তী ঘাঁটির অধিনায়কের কাছে খবর পাঠিয়েছে, ‘স্যার এসে গেছেন।’ এই সংবাদ শুনে তারা আবার দ্বিগুন উৎসাহে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। কে কত বেশী করে ডিফেন্সে সফলতা দেখাতে পারে, এই নিয়ে পশ্চিম অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একটা মরণ প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেছে। ১২ তারিখ সারাদিন তিনবার এনায়েত করিম মিথ্যা সংবাদ দিয়েছে। সত্য হোক, মিথ্যা হোক, শত্রুকে ঐভাবে সারাদিন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। আমি পাঁচটিকরিতে এসেছি, এটা শুনে এনায়েত করিম, আলীম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, নুরুল ইসলাম, জিয়া ও ভোলা সহ অন্যেরা আনন্দ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে ভুয়াপুর থেকে আধ-মাইল উত্তর-পুবের পাঁচটিকরিতে ছুটে এল। ভুয়াপুরের কৃতী বীরদের দেখে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করলাম। মোয়জ্জেম হোসেন খান নীচু গলায় কথা বললেও, পঞ্চাশজন তা শুনতে পাবেন। তাঁর গলার আওয়াজটাই বোধ
পৃষ্ঠা নং ~ ৩২৫

করি ঐরকম৷ অথচ মোটেই কর্কশ নয়, শ্রুতিমধুর। তাঁরা কে কার আগে বিগত দু’দিনের যুদ্ধের সংবাদ ও ফলাফল আমাকে জানাতে পারেন এ নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা বেঁধে গেল। বাইরের কেউ এ পরিবেশ দেখলে অবশ্যই বলতেন, ‘ওখানে বোধ করি একটা হাট বসেছে।’ এই খানেই কিন্তু আমাদের সাফল্য। এইখানে আমরা অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। শত্রু হননে সহযোদ্ধারা যেমন কঠোর, কঠিন ও নির্মম, বিজয়েও তেমনি প্রাণখোলা, খোলামেলা ও সকল বন্ধন মুক্ত।

জাহাজ মারার পূর্ব রহস্য
জাহাজের সারেংকে রাতেই আমার সামনে হাজির করা হলে মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারল কেন চিঠিতে লিখেছিলাম, মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করলেই জাহাজের পতন ঘটবে। এর মূল নায়ক জাহাজের সারেং চট্টগ্রামের গোলাম মোস্তফা। ঘটনাটা এই রকম- খান সেনারা ২৫শে মার্চের পর যখন তার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, এই মোস্তফা তখন খুলনার চালনা বন্দরে ছিল। ওখানেই তাকে গ্রেফতার করে নারায়ণগঞ্জ জেটিতে নজরবন্দী করে রাখা হয়। হানাদার কর্তৃক তার বাড়ি আক্রান্ত হলে, তার নিকট আত্মীয় মারা যায়। উপরন্তু তার বড় ভাই মেজর জিয়ার সাথে ভারতে ট্রেনিং নিচ্ছিল। জুন মাসের শেষের দিকে সারেং এর উপর হানাদারদের নজরদারী কিছুটা শিথিল হয়ে আসে। এর পরে তাকে এস. ইউ. ইঞ্জিনিয়ারস এল. সি. -৩ জাহাজের মূল সারেং এর দায়িত্ব দেয়া হয়। তার উপর সতর্ক নজর কিছুটা কমে এলে সে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে মনস্থির করে ফেলেছিল। তবে তারই এক বন্ধু তাকে বিরত করে। বন্ধুটির পরামর্শ হলো, ‘মুক্তিবাহিনীতে গেলেই তো তোমাকে নেবে না। এমন কিছু করে যাও যাতে ঐ কাজের কথা বলে তুমি মুক্তিবাহিনীর দলভূক্ত হওয়ার আবেদন জানাতে পার। বন্ধুটির পরামর্শ ত্রিশ চৌত্রিশ বছর বয়স্ক সারেংয়ের মনঃপুত হয়।
৩রা আগস্ট তার জাহাজ নারায়ণগঞ্জ থেকে সদর ঘাট ই পি. আর. জেটিতে নেয়া হয়। ৩রা আগস্ট থেকে ছশ বন্দী বাঙালী ই. পি. আর. সাতটি জাহাজে ঔষধ, খাদ্য, বস্ত্র, ও গোলাবারুদ বোঝাই শুরু করে। এই সময় বন্দী ই. পি. আর. দের একজন এই খবরটা নবী নেওয়াজের জনৈক পরিচিত লোককে দেয়। নবী নেওয়াজ এই জেটিতে গত তিন বৎসর কর্মরত ছিল। সুবেদার নবী নেওয়াজ এই জেটি থেকে দুমাসের ছুটিতে বাড়িতে এসেছিল। তারপর মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। হানাদারদের গোলামী করতে আর যায়নি। ৪ঠা আগস্ট মুক্তি বাহিনীর কাছে জাহাজ ভর্তির খবর আসে। খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ত্বরিৎ ব্যবস্থা হিসাবে পাঠান ব্যবসায়ী মমতাজ খানকে ঢাকায় পাঠানো হয়। মমতাজ খানের সুবিধা ছিল, একাঁধারে সে ব্যবসায়ী। তার পাতার কারবারের সাথে তখন প্রায় শতাধিক অবাঙালী জড়িত। অধিকন্তু তার বড় ভাই পাক সামরিক বাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এবং তার ব্যাটেলিয়ান পুরানো ঢাকার দায়িত্বে নিয়োজিত। এই সমস্ত কারণে তার পক্ষে সঠিক খবর সংগ্রহ করা ছিল খুবই সুবিধাজনক।
১০ই আগস্ট, মমতাজ খান খবর নিয়ে ফিরে আসে এবং আমার সাথে তার দেখাও হয়,
পৃষ্ঠা নং ~ ৩২৬

ভুয়াপুরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাতে মরিচাতে অবস্থান করছিলাম। রাত দশটায় দূর্বল স্বাস্থ্যের লিক লিকে ধরনের এক অবাঙালীকে আমার সামনে হাজির করা হয়। এর আগে কোন অবাঙালী মুক্তিবাহিনীর শিবিরে এইভাবে প্রবেশ করেনি। কোন পূর্বসংবাদ ছাড়া নবী নেওয়াজ ও পাপুড়িয়া চালার বাদল ছেলেটিকে আমার সামনে হাজির করল। তার হাত-পা বাঁধা নেই। কিল-ঘুষি-লাথি চড় খেয়েছে-তেমনও মনে হল না। একেবারে স্বাভাবিক। তবে এই ছেলেটি কে? তার উদ্দেশ্যই বা কি? সেকি এখানে ভুলে এসেছে। অপরিচিত যে কেউই বিনানুমতিতে শিবিরে ঢুকুক না কেন, তার শাস্তি হবেই। আমার মনে নানা ধরনের প্রশ্ন জেগেছিল। তবে বেশীক্ষণ নয়, মুহুর্ত মাত্র। হাপাতে হাপাতে দুর্বল ক্ষীণদেহী পাঠান যুবকটি আমার হাতে দুই টুকরা কাগজ তুলে দিয়ে বলল, ম্যায় ভাগতে হুয়া চলা আয়া।’ ছোট টুকরো কাগজ। একই কথা ইংরেজীতে আর উর্দুতে লেখা। পত্রের মূল কথাঃ জাহাজ ফুলছড়ি ঘাটের দিকে যাচ্ছে। ৭ই আগষ্ট কোন এক সময় জাহাজগুলো যাত্রা শুরু করবে। বহরের অতিকায় ত্রিপল দিয়ে ঢাকা জাহাজটি আক্রান্ত হলেই সারেং তা চরে উঠিয়ে দেবে অথবা ইঞ্জিন বিকল করে দিয়ে সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়বে অথবা সে নিজে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেবে।
এখানে একটি প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক সারেং এর ঐ বক্তব্য মমতাজ খান পর্যন্ত এল কি করে। সে এক চমকপ্রদ ব্যাপার। ৭ই আগষ্ট মমতাজ খান কিছুটা খবরা খবর সংগ্রহ করতে পেরেছিল। ১০ই আগষ্ট সন্ধ্যায় সে আমাকে তার সংগৃহীত তথ্য জানিয়ে দেয়। খবর সংগ্রহের সুবাদে সারেং মোস্তফার এক বন্ধুর সাথে মমতাজ খানের এক সহকর্মীর পরিচয় হয়। তার মাধ্যমেই মমতাজ খান আগের খবরটুকু সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল। মমতাজ খান মোস্তফার সহকর্মীকে টাংগাইলের মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে দুএকটি কথা বলেছিল। সহকর্মীর কাছ থেকে এটা জানতে পেরে মোস্তফা উতলা হয়ে উঠে এবং সহকর্মী বন্ধুকে বলে, ‘তুই তা হলে মুক্তিবাহিনীকে সামান্য একটু খবর দিবি? আমি বেশী সময় অপেক্ষা করতে চাই না। এবার যে সুযোগ এসেছে তা কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের কপালে লাথি মেরে গোলামী থেকে মুক্তি পেতে চাই।’ বন্ধুটি তাকে বলে, নিশ্চয়ই পারবো। এর পরেই মোস্তাফা ঐ চিঠিটা লিখে দেয়। চিঠিতে যেমন কোন সম্বোধন নেই তেমনি কোন ইতি-টিতি নেই। এই ছিল জাহাজ পতনের পূর্ব রহস্য।
স্বাধীনতা যুদ্ধের দৃষ্টিতে গোলাম মোস্তফা কেবল একজন সাধারণ সারেং মাত্র নয়। পাক জাহাজ পতন প্রক্রিয়ার সে অন্যতম বীর। প্রশংসার দাবীদার। তার মনোবল, সাহস ও বীরত্ব দেখে আনন্দিত হলাম। সেহরাবাড়িতে রশিদকে নিয়ে যেমন ধেই ধেই করে নেচে আনন্দ করেছিলাম। জাহাজ মারার অন্যতম বীর সারেং মোস্তফাকেও তেমনি জড়িয়ে ধরে নাচতে লাগলাম। গত দেড় দিনে এত গোলাগুলির পরও মোস্তফা ও তার দুসাথীকে মুক্তিবাহিনী যে আদর আপ্যায়ন করেছিল তাতে তারা মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে পড়েছিল। তার উপর আমার উষ্ণ অভ্যর্থনা মোস্তফাকে মোমের মত গলিয়ে দিল। মোস্তফাকে বললাম, “আপনি আমার লোকদের সাথে যান। কোন অসুবিধা হবে না। দু’চার দিন অপেক্ষা করুন। আমরা আগে এই নমরুদদের সামাল দিয়ে নিই। তারপর আপনার জন্য যা করা দরকার করছি।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৩২৭

জাহাজ মারার পরবর্তী যুদ্ধ পরিস্থিতির দরুন আমার সাথে মোস্তফার প্রায় দুই মাস আর দেখা হয়নি। আমি আহত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী যখন দারুণ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, তখনও মোস্তফা স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় আশে-পাশে ছিল। আমি ভারত থেকে ফিরবার পর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মোস্তফা এসে দেখা করে এবং ছুটি নিয়ে বাড়ীতে যায়। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে ফিরে এসে আবার মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর টাংগাইল মুক্তিবাহিনী থেকে সে সরাসরি তার পূর্বের কাজে যোগ দেয়।
১৩ই আগস্ট। ভুয়াপুরের ছ’মাইল পশ্চিমে মাটি কাটা-জাহাজমারা ঘাটে তখনও ছশ মুক্তিযোদ্ধা বীরবিক্রমে হানাদারদের বাধা দিয়ে চলেছে। হানাদাররা মরিয়া হয়ে বিধ্বস্ত জাহাজের কাছে আসতে চাইছে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রবলভাবে তাদের বাধা দিচ্ছে। তৃতীয় দিনে জাহাজের বিস্ফোরন অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। শুরুতে যেমন মিনিটে শতাধিক বিস্ফোরণ হচ্ছিল, এখন তা পাঁচ-দশ মিনিট দু’ একটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। জাহাজ থেকে ছিটকে আসা বিস্ফোরিত গোলা-গুলিতে এখন তেমন ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
হানাদারদের চাপ বেড়েই চলল। তাদের কোন মতেই ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না, এ অবস্থায় একটি কৌশল অবলম্বন করলাম। মাটিকাটা-জাহাজমারা ঘাটের দিকে না গিয়ে, মূল সড়ক অকেজো করতে দক্ষিণে এগুলাম। আমাদের হাতে তখন প্রচুর বিস্ফোরক। ভুয়াপুর- টাংগাইল রাস্তা এক মাইল বায়ে রেখে, সয়া-পালিমা পার হয়ে হানাদারদের পিছনে সয়া পুলে এক বিস্ফোরণ ঘটালাম। আমি জীবনে এই প্রথম বিস্ফোরণ ঘটালাম। বারুদের ব্যবহার এর আগে বলতে গেলে কিছুই জানতাম না। এই বিস্ফোরণ ঘটানোর সব মাল-মসলা তৈরী করে দিল মুক্তাগাছার আই. এ. ক্লাসের ছাত্র হাবিবুর রহমান। এরপর থেকে হাবিবুর রহমানকে উস্তাদ বলে ডাকতাম। সত্যিই বিস্ফোরক ব্যবহারের শিক্ষায় হাবিবুর রহমানই আমার উস্তাদ বা শিক্ষক। পিছনের পুল অকেজো হয়ে যাওয়ায় সড়ক ধরে এগিয়ে আসা হানাদারদের গতি স্তিমিত হয়ে এল। এরপর শত্রুর সামনে গিয়ে ভুয়াপুর সিঙ্গুরিয়ার মাঝামাঝি আরেকটি পুল উড়িয়ে দিলাম। দ্বিতীয় পুলটি উড়িয়ে দেয়ার বার আনা কাজ নিজ হাতে করলাম। পুল ভাঙতে গিয়ে সামান্য আহত হলাম। বিস্ফোরণের সময় পুলের হাজার হাজার ইট ও সিমেন্টের টুকরো অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। উপরে উঠা একটি ইটের টুকরা সরাসরি কপালে এসে আঘাত করুন। এতে টাল সামলাতে না পেরে ঘুরপাক খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। পরক্ষণেই আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। কপাল থেকে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগল। পাশ থেকে সামসু ও খোকা দৌড়ে এসে ক্ষত স্থানে ভেজা রুমাল বেঁধে দিল।

বিমান হামলা
পর পর দুটি পুল ভেঙে চলাচলের অযোগ্য করে দেয়ায় রাস্তা ধরে হানাদারদের এগিয়ে আসা বন্ধ হয়ে গেল। হুমায়ূন ও খোরশেদ আলমের দলকে দ্বিতীয় পুলটিতে অবস্থানে রেখে আড়াই মাইল পিছনে ভুয়াপুরে ফিরতে লাগলাম। এই সময় দুটি বোমারু বিমান উড়ে এল। তারা মাটিকাটায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থান অনুমান করে একঘন্টা অবিরাম মেশিনগান থেকে স্ট্রাপিং ও
পৃষ্ঠা নং ~ ৩২৮

অসংখ্য রকেট ফায়ার করল। মুক্তিযোদ্ধারা বালু সরিয়ে উত্তর দক্ষিণে প্রায় তিন মাইল রাস্তা জুড়ে অবস্থান নিল। পাক বোমারু বিমানের হামলায় একজন মুক্তিযোদ্ধা সামান্য আহত হয়। বিমান হামলায় গ্রামের ঘরবাড়ি গুলো ছেঁড়া কাগজের মত এদিক ওদিক ছিটকে পড়ে। এই হামলায় মুক্তিবাহিনীর তেমন ক্ষতি না হলেও বেশ কয়েকটি গরু ছাগল মারা গেলে। একঘন্টা হামলা চালিয়ে বোমারু সেবর জেট দুটি তাদের ঘাঁটিতে ফিরে গেল। বোমারু বিমান দুটি চলে গেল নদীর মাঝখানে অপেক্ষমান পাঁচ-ছ’টি লঞ্চ থেকে হানাদাররা পাড়ে নামতে লাগল। হানাদারদের প্রায় অর্ধেক ডাঙায় উঠে আসতেই মুক্তি যোদ্ধাদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠল। আবার ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। জাহাজ দখলের পর তাদের গুলির অভাব নেই। আগের রীতি ছিল হানাদাররা একশ গুলি ছুঁড়লে মুক্তিবাহিনী চালাত এক গুলি। ১২ই আগস্ট থেকে নতুন নিয়ম, একেবারে উল্টো। হানাদারদের এক গুলির জবাবে একশ গুলি চালাও। ফূর্তিতে এ সময় জনৈক কমাণ্ডার বলেছিল, ‘মাছের তেলে মাছ ভাজব, একটু, বেশী ভাজলে ক্ষতি কী? ওদের গুলি চালাতে আমাদের তো আর আসল খরচ করতে হচ্ছেনা। লাভেরটা খরচ করতে কৃপণতা কিসের?”
একঘন্টা বিমান হামলায় ঘরবাড়ি, এমনকি গাছের পাতা পর্যন্ত ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। এরপরও মুক্তিবাহিনী ছিল কোথায়? বিস্মিত হানাদারদের প্রশ্ন, ‘শালা লোগ ক্যায়া হ্যায়? ইয়ে লোগ দানব হ্যায়, ইয়া দানব। শালা লোগ জরুর শয়তান হোগা।’
শত্রুপক্ষের বিমান হামলা ও চতুর্দিক থেকে সাড়াশী আক্রমণের উদ্দেশ্য আমার বুঝতে বাকী রইল না। হানাদারদের বহুমূল্যবান অস্ত্র-শস্ত্র বোঝাই জাহাজ তিন দিন হল আমরা দখল করে নিয়েছি। শত্রুরা গত তিনদিন জাহাজ দুটির ধারে কাছে আসতে পারেনি, তবুও তারা হাল ছাড়েনি। অস্ত্রগুলো পাবার আশায় তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভুয়াপুরের সকল কমান্ডারদের এক জরুরী বার্তা পাঠালাম, ‘আজ রাতেই তোমরা যার যার ঘাটি ছেড়ে দেবে। সরে যাবার স্থান পূর্বাঞ্চলের জঙ্গল। সাধ্যমত পূর্বাঞ্চলে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি সুরক্ষিত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাবে।”
১৩ই আগস্ট সারাদিন খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারের জন্য ৪৭তম ব্রিগেড ও ৫১ কমাণ্ডো ব্রিগ্রেড দুটি খুবই তৎপর রইল। টাংগাইল মূল ঘাঁটি থেকে এলেঙ্গা হয়ে ভুয়াপুর। ঘাটাইল, গোপালপুর ও হেমনগর হয়ে শত্রুর একটি কলাম, কালিহাতি থেকে সোজাসুজি পশ্চিম দিকে নদী পথে লঞ্চযোগে আর একটি কলাম। এবং সিরাজগঞ্জ থেকে পনের বিশটি লঞ্চ নিয়ে সোজাসুজি যমুনা পার হয়ে আরো একটি দল পূর্বদিকে আক্রমণ পরিচালনা করছিল। ভুয়াপুরের সমস্ত এলাকা হানাদাররা চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।
কালিহাতি থেকে বেশী নদী পথে আগুয়ান কলামটি ধনবাড়ির কাজী কোম্পানীর হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে তাদের অগ্রগতি বন্ধ হয়ে গেল। শুধু বন্ধ নয়, কালিহাতির দিকে আবার তাদের ফিরে যেতে হল। অন্যদিকে গোপালপুর থেকে হেমনগর হয়ে ভুয়াপুরের দিকে এগিয়ে আসা হানাদার দলটিকে হুমায়ুন কোম্পানী বিপুল বিক্রমে বাধা দিল। সারাদিন প্রচণ্ড যুদ্ধ চলল এবং যুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে রইল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩২৯

এদিকে সিরাজগঞ্জ থেকে একটি কলাম যমুনা নদী পেরিয়ে বারবার মাটিকাটা নামতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। ১৩ই আগস্ট কম করে ছয়-সাতবার হানাদাররা পাড়ে নামার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। এমনি অবস্থায় আমার নির্দেশ পেয়ে সকল কমাণ্ডার দূত পাঠিয়ে জানাল, যুদ্ধ তাদের অনুকূলে। নিজেদের বিন্দুমাত্র ক্ষয়-ক্ষতি নেই। তারা শুধু হানাদারদের আক্রমণ নস্যাৎ করতে সমর্থই নয়, দুশমনের উপর পাল্টা আঘাত হানতেও সক্ষম। তারা আরও জানাল, আমাদের ধারণা, আমরা কাল থেকে শত্রুর উপর পাল্টা আঘাত হানা শুরু করতে পাবো। দূতদের হাতে আবার বার্তা পাঠালাম, ‘তোমরা আমার আদেশ পালন কর। সারাদিন বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসলেও, সয়া-পালিমার অবস্থা ছিল কিছুটা ভিন্ন। সয়া- পালিমার পথ ধরে যে তিন ব্যাটেলিয়ন পাক সৈন্য এগিয়ে আসছিল, তাদের ভারী অস্ত্র-শস্ত্রের সামনে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে তাদের গতি মন্থর হলেও বিভিন্ন কৌশলে তারা ঘন্টায় আধ মাইল এক মাইল করে এগুচ্ছিল।
আমি তাড়াতাড়ি ভুয়াপুর বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়ে সেখানে রাখা সমস্ত গোলা বারুদ তাৎক্ষণিকভাবে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলাম। আলীম, ভোলা, সিরাজ, খোদাবক্স, আবদুল বারী, দুদু মিয়ার অভূতপূর্ব তৎপরতায় গোলাবারুদ অন্যত্র সরিয়ে ফেলা সম্ভব হল।
নির্দেশ মত সকল কোম্পানী তাদের ঘাঁটি ত্যাগ করে পূর্বাঞ্চলের দিকে যাত্রা শুরু করল। সহযোদ্ধাদের অধিকাংশ দুর্বল, ক্লান্ত, ক্ষুধায় কাতর। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনদিন তাদের নিয়মিত খাবার জুটেনি। এই কদিন খাদ্য সংগ্রহও যেমন অনিয়মিত হয়ে পড়ে, তেমনি খাবার জুটেনি। এই কদিন খাদ্য সংগ্রহও যেমন অনিয়মিত হয়ে পড়ে, তেমনি খাওয়াও ছিল প্রায় দুঃসাধ্য।
সবাই ভুয়াপুর ছেড়ে চলে গেছে, শুধু চল্লিশ জন সহযোদ্ধা নিয়ে আমি পিছে পড়ে আছি। এদিন বিকালেও ভুয়াপুর ছিল প্রাণবস্তু, উচ্ছ্বল ও কোলাহলে ভরপুর। সন্ধ্যার পর সেই ভুয়াপুরে নেমে আসে শ্মশানের নীরবতা, কবরের স্তব্ধতা। রাতক ন-টায় যখন আমি ভুয়াপুর ত্যাগ করছি, তখন ও দেখছি বুলবুল খান মাহবুব একা ঘাটপাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
— আপনি আর দাঁড়িয়ে কেন। চলুন আমার সাথে।
— চলে যাব, কোন খবর যদি আসে?
— আর কোন খবর আসবে না, উঠে পড়ুন আমার নৌকায়।
বুলবুল খান মাহবুব লাফিয়ে নৌকায় উঠে বসলেন। আমাদের সাথে সাথে শেষ মুক্তিযোদ্ধাটিও ভুয়াপুর ত্যাগ করল।
উল্লেখ্য যে, জাহাজ খোয়ানোর পর ভুয়াপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের উৎখাত অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছিল হানাদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান সেনাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি। আমি যে ডাক বাংলোতে বসে সকালে সামান্য খাবার খেয়েছিলাম, মুক্তি যোদ্ধারা ভুয়াপুর ত্যাগ করলে হানাদার সেনাপতি সেইখানেই ১৪ আগস্টের রাত কাটায়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৩০

মাকড়াই যুদ্ধ

ইবলিশের খপ্পরে
দিনের আলোয় টাংগাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়ক পার হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের নৌকা খুব দ্রুত এগিয়ে চলল। কিন্তু রাস্তা খুব একটা নিরাপদ নয়। তাই নৌকার গতি সবসময় একরকম রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একবার চলা, আবার থামা, একবার নৌকার গতি বাড়িয়ে দেয়া, আবার কমিয়ে আনা-এমনি করে ভোর চারটায় আমরা গর্জনার কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম। পাকা সড়ক আরো তিন মাইল, রাস্তার ওপাশেও তিন মাইল খোলামেলা এলাকা। এই ছয় মাইল অন্ধকারে, খুব সাবধানে পাড়ি দিতে না পারলে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। দেড় ঘন্টায় এতটা পথ অতিক্রম করা মোটেই সম্ভব নয়। নানা দিক চিন্তা করে, সারাদিন ওখানেই থেকে যাওয়া স্থির করলাম। কিন্তু মাঠের মধ্যে তো আর থাকা যাবেনা। কোনও একটি বাড়িতে উঠা চাই! অবশেষে ঘাটাইল থেকে তিন মাইল পশ্চিমে গর্জনা গ্রামের জনৈক ভদ্রলোকের বাড়ীতে উঠে পড়লাম। সহযোদ্ধাদের দুদলে ভাগ করে পাশের দুটি বাড়িতে বাকী রাতটুকু থাকার ব্যবস্থা হল। সারাদিন পেটে কিছুই পড়েনি, এলাকার অবস্থা খুবই অস্বাভাবিক। তাই স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক সাহায্য পাওয়ারও তেমন সম্ভাবনা নেই।
খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল, বাড়িটি একটি বি. ডি. মেম্বারের। মেম্বার রাত চারটায় সদিচ্ছা, শ্রদ্ধা ও বিনয়ে গদগদ হয়ে খাওয়া দাওয়া এবং অন্যান্য সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দিল। সদিচ্ছা ও সহযোগিতার প্রমাণস্বরূপ সে প্রথমেই চিড়া-মুড়ির ব্যবস্থা করল। তিন তিনটি খাসি জবাই করে রান্না চলছে। বেলা এগারটা বেজে গেল। তুবও রান্নার শেষ নেই। পাশের বাড়ির মুক্তিযোদ্ধারা আশেপাশের বাড়ি থেকে চেয়ে ডাল-ভাত ও খিচুড়ী খেয়ে নিয়েছে। তিন তিনটি খাসি জবাই করায় এবং রান্নাবান্নায় দেরী হওয়ায় আমার সন্দেহ জাগল। কমাণ্ডারদের ডেকে সতর্ক করে দিলাম, “আমরা চারদিক থেকে শত্রুর দ্বারা বেষ্টিত। চোখ কান খোলা রাখবে। সামান্য ভুলে প্রচণ্ড ক্ষয় ক্ষতি হতে পারে, যা কল্পনাও করতে পারিনা।”
একটু পরে খবর এল, খোরশেদ আলম ও বেনুর কোম্পানী গতরাতে সড়ক পার হতে পারেনি। তারা পাশের গ্রামে আত্মগোপন করে আছে। খোরশেদ ও বেনুকে ডেকে এনে বিশেষভাবে সতর্ক করে দিলাম।
দুপুর বারটা। রান্না তখনও চলছে। এদিকে বাড়ীর লোকজনের তৎপরতায় কিছুটা অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ল। বাড়ীর মেয়েরা পোঁটলা-পুটলি নিয়ে দুএকজন করে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। এই সব অস্বাভাবিক তৎপরতা ও কর্মকাণ্ড দেখে মেম্বারকে ডেকে আনা হল। ভদ্রলোকের তখনও ভোররাতের গদগদভাব। এতে কিছুটা বিরক্ত ও বিক্ষুদ্ধ হলাম। আমি বিশেষ করে অধিকাংশ বি. ডি. মেম্বারদের ৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের পর থেকে লোভী, লম্পট, মিথ্যাচারী ছাড়া আর
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৩১

কিছু মনে করতাম না। এরা একহাত জায়গার জন্য প্রতিবেশীকে ভিটে ছাড়া করতে পারে, ক্ষুদ্রতম স্বার্থের জন্য অন্যের গলায় ছুরি চালাতে কিছুমাত্র দ্বিধা করেনা। এই সব মানবতার শত্রুদের বহুবার বহুভাবে দেখেছি। এই বি. ডি. মেম্বার তো তাদেরই একজন, এটা উপলব্ধি করতে সময় লাগেনি। মেম্বারকে পাশের ঘরে বসিয়ে রাখা হল।
বিপদ আসন্ন। অতএব আর বসে থাকা যায়না। প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। সহযোদ্ধাদের ডেকে বললাম, “দেখ, আমি জানি তোমরা দেড় দিন ধরে ভালভবে খেতে পাওনি। আমিও তোমাদের সামনেই খেয়েছি। দু-এক বেলা বা দু-একদিন খাবার না পেলে আমরা মরে যাবনা। তবে শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাদের প্রতিহত না করতে পারলে মৃত্যু অবধারিত। শত্রুকে আক্রমণ থেকে নিবৃত্ত করার একমাত্র সহজ উপায়, শত্রুর আক্রমণের আগেই তার উপর আক্রমণ করা। সহযোদ্ধারা এক সাথে সোল্লাসে বলে উঠল, “আপনি না খেয়ে থাকতে পারলে আমরা কেন পারবনা? আমরা খাইনি বলে আমাদের আঘাতের ধার বিন্দুমাত্র কমেনি। কি করা দরকার আপনি শুধু আদেশ করুন। সহযোদ্ধাদের বাড়ির চারপাশে কঠোর দৃষ্টি রাখতে বললাম। নিজে দূরবীন নিয়ে বাড়ির চারপাশে ঘুরে ঘুরে বহুদূর পর্যন্ত নজর রাখতে লাগলাম। বারটার কিছু পর ব্রাহ্মণ শাসন-ঘাটাইলের দিক থেকে এগিয়ে আসা আট-দশটি নৌকা নজরে পড়ল। ভাল করে দূরবীন দিয়ে দেখলাম, নৌকাগুলি হানাদারদের। তৎক্ষণাৎ পাশের বাড়ি থেকে ভোলা, আলীম ও সিগন্যাল ম্যান লতিফকে ডেকে পাঠালাম। তাদের হেফাজতে গোলা বারুদ বোঝাই চারটি নৌকা দূরে অন্য গ্রামে পাঠিয়ে দিলাম। তাদের নির্দেশ দেয়া হলো, ‘গোলাবারুদ রাখার কোন নিরাপদ জায়গা না পেলে, রাতে কোন চিহ্নিত স্থানে, গভীর পানিতে বাক্সগুলো ফেলে দেবে। সীল করা বাক্সগুলো পানির নীচে পাঁচ-ছয় মাস থাকলেও নষ্ট হবেনা। তবে পানি গভীর হওয়া চাই। ফেলে দেবার সময় কেউ যেন না জানে, না দেখে। এমন কি মাঝি-মাল্লারাও নয়।’ (১৪ই আগষ্ট রাতে পানিতে ফেলে দেয়া বাক্সগুলো একমাস পর ১৪ই সেপ্টেম্বর আবার তুলে আনা হয়েছিল।) গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা খবর নিয়ে এল, ঘাটাইল থানা থেকে দশ নৌকা বোঝাই হয়ে হানাদাররা গর্জনার দিকে আসছে। আর ব্রাহ্মণশাসনের দিকে হানাদার বোঝাই দশটি নৌকা আসতে ত নিজেরাই দেখেছি। খবর পেয়ে এক মুহুর্ত দেরী না করে পাশের বাড়ি থেকে নূরুল ইসলাম, নুরুন্নবী ও বুলবুল খান মাহবুব সহ আরো কয়েকজনকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে শুধু কুড়ি জন বাছাই করা যোদ্ধা নিজের সাথে রাখলাম। বাড়ির বাইরে এসে আবার দুরবীন নিয়ে দেখলাম। হানাদার বোঝাই ছ’টি নৌকা এগিয়ে আসছে। চারটি অন্যপথ ধরেছে। তাদের মতলব সবদিক থেকে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলা। এই অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে পাশের একটি উঁচু মাটির ঢিবি এবং খড়ের পালার আড়াল নিয়ে দুশমনদের চারটি নৌকা যে পথ ধরেছিল, সেই পথ আগলে বসে রইলাম। নৌকা চারটি কিছুদুর এগিয়ে আমাদের দিকে না এসে, খোরশেদের অবস্থানের দিকে মোড় নিল। অন্য ছ’টি বেনুর অবস্থানের পাশে ওৎ পেতে রইল।
বেনু, খোরশেদ আলম আমার সাথে কথাবার্তা শেষ করে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৩২

নিজের অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছতে না পৌঁছতেই বেনু আক্রান্ত হন। বেনুর অবস্থান নেয়া বাড়ির চারপাশে হানাদাররা নেমে পড়েছে। বেনু ও খোরশেদ আলম বাড়ির দুদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করতে লাগল। বাড়ীর পূর্ব পাশের অবস্থান থেকে খোরশেদ আলম দেখল, একটু দূরে খান সেনার একটি দল নৌকা থেকে নেমে পেছনের বাড়িতে অবস্থান নিতে যাচ্ছে। সুযোগ বুঝে খোরশেদ আলম ও তিনজন মুক্তিযোদ্ধা স্টেনগান নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শত্রুরাও পাল্টা জবাব দিতে লাগল। স্টেনগান, রাইফেল থেকে মূহুর্মুহু অগ্নি বর্ষিত হচ্ছে, ফাটছে গ্রেনেড। মুক্তি যোদ্ধাদের ক্রমাগত আঘাতে হানাদাররা পিছিয়ে গিয়ে পাশের বাড়িতে অবস্থান নিয়ে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ চালাতে লাগল। অন্যদিকে বেনু ও তার সহযোদ্ধারা ওৎ পেতে থাকা নৌকাগুলোর উপর মুষলধারে গুলি ছোড়া শুরু করল। এতে হানাদারদের নৌকার ভিতর দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। একে অন্যের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ায় একটি নৌকা সাথে সাথে ডুবে গেল। অথৈ পানি। সাতার না জানা হানাদারদের ভাগ্যে কি ঘটল, আল্লাহ্ মালুম। ঠিক এই সময় বাড়ির পুব পাশে খোরশেদের খুব কাছে হামাগুড়ি দিয়ে দুজন খানসেনা অবস্থান বদল করছিল। খোরশেদ আড়াল থেকে বেরিয়ে হানাদাররে উপর ব্রাশ ফায়ার করায় দুজন সেখানেই অক্কা পেল। কিন্তু পাশ থেকে হানাদারদের দুটি গুলি ক্যাপ্টেন খোরশেদ আলমের বাহু ও পেটের ডান পাশ ভেদ করে চলে গেল। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সহযোদ্ধা মুক্তাগাছার জাহাঙ্গীর কমাণ্ডারকে দুহাতে জাপটে ধরে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে গেল।
উভয় পক্ষের প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। কোন পক্ষেরই বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। একদিকে মাতৃভূমির স্বাধীনতাকামী মুক্তিপাগল দামাল ছেলের দল অন্যদিকে সাম্য, স্বাধীনতা ও মানবতার চরম দুশমন, হিংস্র হানাদার বাহিনী। উভয়ে উভয়ের রক্তোর নেশায় মাতোয়ারা, উন্মাদ প্রায়। হানাদার বাহিনীর লক্ষ্য মুক্তিবাহিনীর নেতা কাদের সিদ্দিকী। আর মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্য পশু হনন। চরম গোলাগুলি চলছে। অথচ এ পর্যন্ত একটি গুলিও ছুঁড়তে পারলাম না। হানাদাররা আমাকে জীবিত কিংবা মৃত গ্রেফতার করতে এলেও যুদ্ধ চলছে আমার অবস্থান থেকে প্রায় এক হাজার গজ দূরে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে হাজার গজ দূর থেকে শত্রুকে গুলি ছুঁড়েছি, এ অপবাদ আমার শত্রুরাও দিতে পারবে না। যদিও সাময়িকভাবে আমাকে দর্শকের ভূমিকাই পালন করতে হল।
অবিরাম লড়াই চলছে। বেনু ও খোরশেদের খবর জানা প্রয়োজন। সহযোদ্ধাদের আহ্বান করলাম, “তোমরা কে কে যুদ্ধ পরিস্থিতির খবর আনতে পারবে?” চার-পাঁচ জন মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছায় এগিয়ে এল। এই সময় কালিহাতি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী খন্দকার নূরুল ইসলাম বললেন, “স্যার অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ না করলেও আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আজকের এই প্রয়োজনে আমাকে ব্যবহার করা হোক। আমি যুদ্ধ করতে পারি না বলে, খবর আনতে পারব না, বা ঝুঁকি নিতে পারব না, এমন নয়।” “এর চাইতেও ঝুকি পূর্ণ কাজ আছে। আপনি বয়সী মানুষ। এই জায়গায় না হয় নাই গেলেন।” নূরুল ইসলাম সাহেব কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, “উপযুক্ত মনে করলে আমাকে অবশ্যই পাঠাবেন। পাঠান না পাঠান
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৩৩

সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার। তবে আমি চাই, আমাকে পাঠানো হোক।”
অগত্যা আরো চারজন মুক্তিযোদ্ধাসহ নুরুল ইসলামকে খবর সংগ্রহে পাঠানো হল। দু’টি নৌকায় পাঁচ জন নুরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে এগিয়ে গেল। ঐদিন নুরুল ইসলাম সাহেব এত গুলির মধ্যেও যে বেপরোয়াভাবে বেনু ও খোরশেদের অবস্থানে গিয়ে হাজির হন, তা মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। একবার দু’বার নয় তিনবার ঐ বাড়িতে গিয়ে ছিলেন। প্রথমবার খবর নিয়ে এলেন কমাণ্ডার খোরশেদ আলম গুরুতর আহত হয়েছে। বেনুর কোম্পানীর আসালত, স্মৃতি, মতি, আনিস, কামাল, ও মিন্টু অসীম সাহস ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে খানসেনাদের অনেকটা পিছু হটিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধ তখন তাদের অনুকূলে। তিনটি খান সেনার লাশ তাদের দখলে। নুরুল ইসলামকে আবার পাঠিয়ে দিলাম। তাঁকে বলে দেয়া হল, আহত খোরশেদকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি নৌকায় তুলে উত্তরে গলগণ্ডা ও রতনপুরের পশ্চিমে কোন গ্রামে সরিয়ে দিতে এবং বেনু ও খোরশেদ কোম্পানীকে মাইল দুয়েক উত্তরে গিয়ে আশ্রয় নিতে। যুদ্ধ অনেকটা স্থিমিত হয়ে এসেছে। যে উদ্যম ও উৎসাহ নিয়ে হানাদাররা আক্রমণ করতে এসেছিল, তার ছিটে ফোটাও এখন আর তাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। এসেছিল দশ নৌকায়, এখন ফিরে যাচ্ছে গাদাগাদি করে ছ’নৌকায়।
কুড়িজন সহযোদ্ধাসহ ওৎ পেতে বসে আছি। আমাদের পাশ কাটিয়ে হানাদাররা যাচ্ছিল। দু’শ গজের মধ্যে তারা এসেও গেল। শত্রুরা আরো কাছে আসে কিনা তা অনেকক্ষণ দেখলাম। কিন্তু ওদের দূরত্ব কোনক্রমেই দু’শ গজের কম হচ্ছে না। হানাদাররা এক সময় যখন আরো দূরে যাওয়া শুরু করল, ঠিক তখন লাইট মেশিনগান থেকে গুলি চালিয়ে অন্যদেরও গুলি চালাতে নির্দেশ দিলাম। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার হাতেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি হানাদারদের নৌকায় আঘাত করতে লাগল। খোলা জায়গায় গভীর পানিতে আক্রান্ত হলে যে কি অবস্থা হয়, আক্রান্ত হানাদাররা তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করল। দু’তিন মিনিটের গুলিতেই দুটি নৌকা কাগজের নৌকার মত হেলে দুলে ডুবে গেল। হানাদাররা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে কভারিং সৃষ্টি করে, দূরে সরে যাবার কৌশল অবলম্বন করল। প্রায় চারশ গজ দূরে গিয়ে আরেকটি নৌকা ডুবে গেল। নৌকা- গুলো যে কেবল গুলির আঘাতেই ডুবে গেল, তা নয়। গুলির মুখে পড়ে আত্মরক্ষায় উন্মাদ হানাদাররা নৌকায় একপাশে জড়ো হওয়াতে, নৌকা তিনটি উল্টে ডুবে যায়। অন্য তিনটি নৌকা গ্রামের আড়ালে গিয়ে রক্ষা পায়। ডুবন্ত নৌকার অনেক হানাদারই যে পটল তুলেছিল, তা বলাই বাহুল্য।
পাঁচ মিনিটের বেশী যুদ্ধ হয়নি, এর মধ্যেই সব শেষ। আমরা তাৎক্ষণিকতাকে তল্লাসী চালিয়ে পাঁচটি লাশ পেলাম। গুলিতে কতজন নিহত হয়েছিল ও কতজন পানিতে ডুবে মরেছিল, তা জানা না গেলেও হানাদারদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবরাখবর এলাকার কারও অজানা রইল না। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী শত্রুর কাছ থেকে একটি ২ ইঞ্চি মর্টারসহ ষোলটি অস্ত্র ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়। আমাদের গুলির আঘাতে যেখানে শত্রুর নৌকা ডুবে গিয়েছিল-পরে সেখান থেকে স্বেচ্ছসেবকরা দশটি অস্ত্র উদ্ধার করে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৩৪

মানুষের চরিত্র বড় বিচিত্র। একলক্ষ টাকা পুরস্কারের লোভে অসহায় অবস্থায়ও আমাকে এপ্রিল-মে মাসে কেউ ধরিয়ে দেননি, বরং টাংগাইল জেলা ও আশ-পাশের দেশপ্রেমিক জনগণ চরম ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও আমার জীবন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব বহন করেছেন। অথচ হানাদার নরপশুদের জানী দুশমন, আট-দশ হাজার সুসংগঠিত মুক্তিযোদ্ধা ও চল্লিশ হাজার সুশৃঙ্খল স্বেচ্ছাসেবকদের যখন আমি নেতৃত্ব দিচ্ছি এবং মুক্তাঞ্চলের ত্রিশ- চল্লিশ লক্ষ মানুষ যখন আমাকে তাদের সন্তানের চাইতেও বেশী আপন বলে ভাবেন, তখন আমাকে ধরিয়ে দিয়ে, একলক্ষ টাকা পুরস্কার পাওয়ার লোভ এই নরপশু সংবরণ করতে পারেনি। ১৪ই আগষ্ট এই পাপিষ্ঠ কুলাঙ্গার বি.ডি. মেম্বার একলক্ষ টাকা পাওয়ার উদগ্র বাসনায় সকালেই ঘাটাইল হানাদার ক্যাম্পে খবর পাঠিয়েছিল। ঘাটাইল খবর পাঠিয়ে সে যেমন অধীর আগ্রহ ও আনন্দে হানাদার বাহিনীর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল, অন্যদিকে তিন তিনটি খাসির লোভ দেখিয়ে, বিভ্রান্ত করে মুক্তিযোদ্ধাদের তার বাড়িতে আটকে রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সবই বৃথা। ফেরাউন নমরুদের যেমন শেষ রক্ষা হয়নি, মীরজাফর যেমন কলঙ্কিত হয়ে আছে ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশে, জল্লাদ ইয়াহিয়া আর তার নরপশুরূপী খানসেনাদের পদলেহী দেশদ্রোহী এই বি. ডি. মেম্বারের ভাগ্যেও তার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। সেদিন এই লোভী দালাল প্রাণে বেঁচে গেলেও পাঁচ-ছয় দিন পরে এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও স্বেচ্ছসেবকরা তাকে গ্রেফতার করে, টেনে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে, জাহান্নামে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে আর কোথাও ঐ রকম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। এই ইবলিশকে হত্যা করার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই তার প্রতি দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও জনগণের তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছিল। প্রকাশ পেয়েছিল বিদেশী হানাদারদের পা-চাটা দেশী দালালদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব। যাহোক, এরপর অভুক্ত অবস্থায় বেলা দুটায় গলগণ্ডা ও রতনপুরের পশ্চিমের এক গ্রামে খোরশেদ আলমকে দেখতে গেলাম। তার পেট ও ডান বাহুতে গুলি লেগেছে। তখনও ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা হয়নি। মুক্তিবাহিনীর সমস্ত সরবরাহ ব্যবস্থা যেন একেবারে এলোমেলো হয়ে পড়েছে। পয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের খোরশেদ আলম আমাকে দেখে খুব মৃদু স্বরে কান্নাবিজড়িত কন্ঠে বলল, ‘স্যার আপনি আমার ধর্মের বাপ। আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না।”
খোরশেদ আলমের কথা শুনে এবং তার অবস্থা দেখে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। তাকে আশ্বস্ত করে বললাম,
— আহত মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা চালানো আমাদের কর্তব্য। নিহত সাথীদের মর্যাদাপূর্ণ দাফন ও আহতদের উপযুক্ত চিকিৎসা না করলে মুক্তিযুদ্ধ চালাব কি করে। আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি আপনাকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করব। ইনশাল্লাহ আপনি অবশ্যই সুস্থ হয়ে উঠবেন। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা আপনার আরোগ্য কামনা করে। খোরশেদের ক্ষতস্থানে বার বার হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনার ক্ষত গভীর হলেও, আমার বিশ্বাস অতটা মারাত্মক নয়, দুটি গুলিই বেরিয়ে গেছে। রক্ত ঝরা বন্ধ করা গেলেই আপনি বিপদ মুক্ত
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৩৫

হবেন।’ এ ঘটনার পর কমাণ্ডার খোরশেদ আলম আমাকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করা শুরু করে। বয়সের দিক থেকে পার্থক্য থাকলেও সে ঐ সম্বোধন আর পরিবর্তন করেনি।
কমাণ্ডার খোরশেদ আলমকে দেখে ঘাঁটিতে ফিরে আসছিলাম। ঐ দিনের যুদ্ধে মতি, স্মৃতি, আনিস, মিন্টু, কালাম, আসালত সহ আরো কয়েজনের সাহসিকতার কথা আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু বেনু ও খোরশেদ আলম কোম্পানীতে ওদের কাউকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ওরা কোথায়?” কমাণ্ডার বেনু কোন সদুত্তর দিতে পারল না। শুধু বলল, “ওরা ছ’- সাত জন বাড়ির উত্তর দিক দিয়ে পশ্চিমে যাচ্ছিল, আমি তাই দেখেছি।”
কমাণ্ডার বেনুর কথা শুনে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ দুটো অশ্রু সজল হয়ে এলো। স্মৃতি, মতি, আনিস, কালাম, মিন্টু এরা সবাই আমার ছাত্র-সহকর্মী। ছোট ভাইয়ের মত। সন্দেহ হলো, ওদের কেউ হয়ত আহত বা নিহত হয়েছে। তাড়াহুড়োর মাঝে কোম্পানী কমাণ্ডার ওদের খোঁজ না নিয়েই পিছিয়ে এসেছে। পাশে দাঁড়িয়ে খন্দকার নুরুল ইসলাম সব কথা শুনছিলেন, তিনি আরেকবার ত্রাণ কর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।
— স্যার, আমার সাথে পাবলিকের পোশাকে দুজন মুক্তিযোদ্ধা দিন। আমি আর একবার গিয়ে ঐ বাড়ি এবং তার আশে-পাশে ভাল করে দেখে আসি। আপনি এখান থেকে ফিরে যেতে যেতে খবর নিয়ে আমিও আপনার কাছে পৌঁছে যেতে পারব।
যেমন কথা তেমন কাজ। আমি ফিরে আসার ঠিক দশ মিনিটের মধ্যেই প্রায় অর্ধমৃত সব কজনকে নিয়ে খদকার নুরুল ইসলাম হাজির। মতি, স্মৃতি, আসালত, মিন্টু ও আনিসের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। গুলিতে অবশ্য আহত হয়নি। কাহিল হয়ে পড়েছে পানিতে ঠাণ্ডায়। ওদের সকলের মুখ, হাত-পা কুঁচকে গেছে। সবাই ক্লান্ত, অনাহার ক্লিষ্ট, অর্ধমৃত।
এদের অবস্থা এরকম হলো কেন? কমাণ্ডার বেনু যখন তার কোম্পানী নিয়ে উত্তর দিকে সরে যাচ্ছিল, তখন বাড়ীর পশ্চিমে অবস্থান নিয়ে এরা হানাদারদের উপর বিপুল বিক্রমে গুলি ছুঁড়ে চলেছিল। এক সময় তাদের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় গুলির জন্য বাড়ীর পুব দিকে গিয়ে দেখে, একজন মুক্তিযোদ্ধাও নেই। এই সময় হানাদাররা আর একবার ঐ বাড়ীতে উঠে তাদের উপর হামলা চালাতে থাকে। ফলে উপায়ন্তর না দেখে এরা পানিতে নেমে পড়ে। রক্ষা যে, পানিতে নামার পর হানাদাররা আর গুলি ছোড়েনি। পানিতে নেমে সাঁতার কেটে, অনেকটা উত্তরে গিয়ে তারপর পশ্চিমে এগুতে থাকে। কিন্তু গভীর পানি ও ধানক্ষেত থাকায়, চক পেরিয়ে পাশের গ্রাম পর্যস্ত তারা যেতে পারেনি। পানিতে, পানা মাথায় নিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে। ঘন্টা দুই এইভাবে চলে। কিন্তু তারপর তাদের ভেসে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে। ক্ষেতের পানা ঠেকানোর বাঁধা একটি বাঁশ ধরে কোন মতে ভেসে থাকে। এভাবে প্রায় তিন ঘন্টা কাটার পর, নুরুল ইসলাম হতাশ হয়ে তাদের পাশ দিয়ে ফিরে আসছিলেন। তিনি পানার মধ্যে একটু অস্বাভাবিক নড়াচড়া লক্ষ্য করেন। তাই সন্দেহ ও কৌতূহল বশতঃ এগিয়ে যেতেই তাদের দেখতে পান এবং সবাইকে নৌকায় তুলে নেন। তিন-চার ঘন্টা এক নাগাড়ে পানিতে থাকলে অবস্থা যা হবার, তাই হয়েছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৩৬

ঠাণ্ডায় শরীর কুঁচকে গেছে। সবাইকে কাপড় চাপা দিয়ে, সেঁক দেয়া শুরু হলো। প্রায় দুই ঘন্টা সেঁক দেয়া ও কাপড় জড়িয়ে রাখার পর তারা স্বাভাবিক হয়ে উঠল। কাথা এনে দিয়ে এবং গরম সেঁক দিয়ে দীঘলআটার সান্দাররা (বেদে) যেভাবে সাহায্য করল তা কোনদিন ভুলব না।
রাতে আমরা টাংগাইল-ময়মনসিংহ সড়ক অতিক্রম করব। কিন্তু সড়ক অতিক্রম খুব সহজ ও নিরাপদ ছিল না, ছিল রীতিমত বিপদ সঙ্কুল। আমরা রতনপুর গলগণ্ডার অনেকটা পশ্চিম দিক থেকে রাত নটায় সড়ক পার হওয়ার জন্য রওনা হলাম। পুরো পথটাই বিপদ সঙ্কুল। টাংগাইল- ময়মনসিংহ সড়ক পাকহানাদাররা ১৩ই আগষ্ট থেকে আগলে বসে আছে। এর মধ্য দিয়েই পেরিয়ে যেতে হবে। সড়ক অতিক্রম করতে না পারলে, ধ্বংস অনিবার্য। ছোট্ট একটি দলকে সামনের রাস্তার খোঁজ খবর নিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের পিছু পিছু রাস্তার দিকে এগুতে লাগলাম। স্থানীয় তিন-চার স্বেচ্ছাসেবককে রাস্তার খোঁজ-খবর সংগ্রহে নিয়োগ করা হয়েছিল। তাদের দুজন এসে জানাল, সারাদিন ধরে দশ-পনেরটি গাড়ি একবার উত্তর থেকে দক্ষিণে আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। যাওয়া এবং আসার মাঝে পনের মিনিট ফাঁক থাকছে। এর মধ্যে রাস্তা অতিক্রম করতে হবে। অন্যথা যুদ্ধ ভিন্ন রাস্তা অতিক্রম করার কোন উপায় নেই।
আমাদের অবস্থা তখন তেমন ভাল নয়। তদুপরি, সাথের আহত সহযোদ্ধাকে নিয়ে দুর্ভোগ আরও চরমে। খোরশেদ আলম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার মুখে এক ফোঁটা ঔষধও দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় যুদ্ধ পরিহার করে চলাই যুক্তি সঙ্গত।
রাত সাড়ে দশটা। উত্তর দিক থেকে পাক সেনাবাহিনীর গাড়ির বহর পাকুটিয়া পেরিয়ে ঘাটাইলের দিকে চলে গেল। এ সময় আমরা রাস্তা থেকে তিনশ গজ পশ্চিমে জঙ্গলের আড়ালে অপেক্ষা করছিলাম। গাড়ি চলে গেলে কমাণ্ডার বেনুর দলের ত্রিশ+ত্রিশ = ষাট জন রাস্তার দু’দিকে পাঁচশ গজ জায়গা জুড়ে উত্তর-দক্ষিণ আগলে অবস্থান নিল। মুক্তিযোদ্ধাদের নিঃশব্দে দ্রুত পেরোতে বললাম। প্রথম রাস্তা পেরিয়ে গেল অগ্রগামী রসদবাহী একটি দল। এর পিছনে একটু এলো মেলো অবস্থায় কমাণ্ডার খোরশেদকে বহনকারী দলটি। তক্তা দিয়ে বানানো একটি চাঙারীতে করে খোরশেদকে চারজন করে মুক্তিযোদ্ধা পর্যায়ক্রমে বহন করে নিয়ে চলেছে। এর পর একে একে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা সড়ক পেরিয়ে গেল। শেষ মুক্তিযোদ্ধাটির সড়ক পার না হওয়া পর্যন্ত রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমাদের রাস্তা পেরোতে মাত্র দশ মিনিট লাগল। উত্তরের দলটি পাকুটিয়া সৎ সংঘ আশ্রমের ভিতর দিয়ে, পুব দিকে আধ মাইল গিয়ে, মূল দলের সাথে মিলিত হল। দক্ষিণের দলটি পোড়াবাড়ী বটতলা রাস্তায় মূলদলের সাথে যোগ দিল।
পোড়াবাড়ী থেকে তিন মাইল পুবে, বটতলার এক মাইল পূব-দক্ষিণে আবার এক বি.ডি. মেম্বারের বাড়ীতে উঠলাম। প্রায় দশ-বারটি বাড়ীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এবং পাকুটিয়া থেকে পাহাড়ের দিকে আসা একমাত্র রাস্তা আগলে রেখে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত হলো। যোদ্ধাদের ডেকে বললাম, “ভাইয়েরা, তোমরা খুবই ক্লান্ত। তাই খাবার খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম না নেয়া পর্যন্ত তোমাদের আর এগুতে বলতে পারিনা। তোমরা শুধু পোড়াবাড়ী থেকে আসা রাস্তাটির উপর পালা করে কঠোর
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৩৭

নজর রাখার ব্যবস্থা কর৷ আমি খাওয়া-দাওয়া ও খোরশেদের একটা ব্যবস্থা করছি।”
রাত বারটা থেকে দুটার মধ্যে চার মণ চাল ও পনের-কুড়ি সের ডাল রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাল করে পেট পুরে খাওয়ানো হল। যারা খুবই ক্লান্ত তাদের বিশ্রাম নিতে বলা হল। তাদের এও জানিয়ে দেয়া হল, ভোর ছটার আগে কোনও ক্রমেই ডাকা হবে না। তবে ছটার পর সবাইকে চটপট তৈরী হয়ে নিতে হবে। রাতেও খোরশেদ আলমের কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেল না। তাকে শুধু দু’বার দুগ্লাস গরম দুধ খাওয়ানো হল, এবং কাপড় ছিড়ে কয়েকবার তার ক্ষত স্থান বাঁধা হল। ক্যাপ্টেন খোরশেদ আলমকে দেখা-শোনার ভার মূলতঃ তিন জনে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এরা হলেন, বুলবুল খান মাহবুব, নুরুল ইসলাম ও নুরুন্নবী। বলতে গেলে মূল দায়িত্ব নিলেন বুলবুল খান মাহবুব।
গঠনের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন।
বুলবুল খান মাহবুব মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নিজেই একটি দল গঠনের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। জুন মাসে আমি দত্তগ্রামে গিয়ে খবর পাঠালে বুলবুল খান মাহবুব আমার সাথে দেখা করেন। আমি যখন বুলবুল খান মাহবুবকে বললাম, “ছোট ছোট আলাদা দল গঠন করা যাবে না।” তখন খুব একটা ইচ্ছা করে না হলেও আমার কথা তিনি মেনে নেন। এবং তার সমস্ত অস্ত্র আমার হাতে তুলে দিয়ে ঐ দিনই আমার দলের সাথে ভুয়াপুরে চলে যান। বুলবুল খান মাহবুবের ভয় ছিল, যেহেতু আমি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পুরোপুরি আস্থাশীল। আর তিনি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে বিশ্বাসী। এ অবস্থায় তাঁর এবং তাঁর পরিচিতদের সাথে কি ধরনের আচরণ করা হবে। মাহবুব সাহেবের এক কর্মী হাতেমকে আমার আদেশে বেত মারা হয়েছিল। তাই তাঁর অমন ভাবা মোটেই দোষের ছিল না। কিন্তু ভুয়াপুরে কয়েকদিন থেকে অবাধে কাজ করার সুযোগ পেয়ে তিনি মুগ্ধ হন। তিনি যখন দেখলেন, মুক্তিবাহিনীতে দল মতের কোন পার্থক্য করা হচ্ছে না, তখন মন প্রাণ ঢেলে দিয়ে কাজে লেগে গেলেন।
আমি মুগ্ধ হলাম, ১৪ই আগস্ট দুপুর থেকে ১৫ই আগস্ট সকাল পর্যন্ত তাকে দেখে। অত হাল্কা পাতলা শরীর নিয়ে আহত সহকর্মীর প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা ও পরিশ্রম সত্যিই মনোমুগ্ধকর ও বিস্ময়ের।
গর্জনা যুদ্ধের পর আহত সাথী খোরশেদ আলমকে নিয়ে পাহাড়ের মহানন্দপুর ক্যাম্পে পৌঁছানোর সেই দুর্যোগময় রাত্রির স্মরণে লেখা তাঁর একটি কবিতার বই ‘জখমী সাথীকে নিয়ে আমরা দশজন’ স্বাধীনতার পর প্রকাশিত হয়েছে। এই বইয়ে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভুয়াপুরসহ বিভিন্ন যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা কবিতা স্থান পেয়েছে। রণাঙ্গনের বাস্তব পরিবেশে এবং মুক্তাঞ্চলে বসে লেখা মুক্তিযুদ্ধের উপর এই কবিতার বই আমাদের বিভিন্ন যুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রেখেছে।
পরদিন ভোর সাড়ে ছ’টায় আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। ছনখোলা এলে ছনখোলা ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে দেখা হল। স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার বলল, “স্যার, আমাদের উপর কোন আদেশ থাকলে, বলুন।” নূরুল ইসলাম সাহেব যেমন গর্জনায় ত্রানকর্তার ভূমিকা নিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৩৮

ছিলেন, এখানেও তেমনি ছনখোলা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার ত্রানকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হল। চলতে চলতে তাকে বললাম, “শ’চারেক লোকের ঘন্টা খানেকের মধ্যে ডালভাতের ব্যবস্থা করা যাবে? আশ-পাশের কোথাও থেকে কুড়ি সের চিড়া-মুড়ি-গুড় সংগ্রহ করতে পারবে?”
স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার খুব দৃঢ়তার সাথে বলল, কেন যাবে না, এই তো পাঁচ-ছ দিন আগে আমরা ভুয়াপুরের চার শ’ স্বেচ্ছাসেবককে এক ঘন্টায় খাবার খাওয়ালাম। আর আপনি নিজে আছেন, তারপরও খাবার দিতে পারবো না, এটা কেমন কথা? আমরা স্যার, আধ-ঘন্টার মধ্যে ডাল ভাতের ব্যবস্থা করছি।” গত দেড় দিনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অসহায় অবস্থায় থাকার পর, আবার পূর্বের মনোবল ফিরে পেলাম। স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডারকে জিজ্ঞেস করলাম,
— আশে পাশে কোন ডাক্তার আছে? অথবা ঔষধের দোকান?
— সামনে পেঁচারআটা বাজারে ঔষধের দোকান আছে। কিন্তু ডাক্তার নেই।
— কয়েকটি পেনিসিলিন ইনজেকশন, সূঁচসহ একটা সিরিঞ্জ, নোভালজিন, এ্যানালজিন অথবা ব্যারালজিন জাতীয় টেবলেট ও একটি এ. টি. এস. ইঞ্জেকশন নিয়ে এসো। আমরা চলা বন্ধ করতে চাইনা। সামনে পেঁচারআটায় আশ-পাশের তিন জায়গায় ঘন্টা খানেকের মধে শুধু ডাল-ভাতের ব্যবস্থা কর।’ স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার সাথের আট-দশ জনকে নিয়ে নিমিষে মিলিয়ে গেল। পেঁচার আটা তখনও দুমাইল। আমাদের চলার গতি খুব ধীর। পেঁচারআটা হাট অতিক্রম করে চলে যাবার সময় সেই স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডারকে দেখলাম। কমান্ডার দৌড়ে এসে আমার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, “স্যার, আধ মাইল সামনেই রাস্তার পাশে খাবার ব্যবস্থা করেছি। স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারাই বাড়ী দেখিয়ে দেবে। আমি চিড়া-মুড়ি নিয়ে আপনাদের পিছে পিছে আসছি।”
ঔষধ পেয়ে যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম। এক মূহুর্ত দেরী করলাম না। বাজারের পাশে চাঙারীসহ খোরশেদকে নামানো হল। শুধু মনের জোরে খোরশেদ তার যন্ত্রণা কিছুটা আয়ত্বে রেখেছিল। একটু নেতিয়ে পড়লেও তার কথাবার্তা আগের চেয়ে স্পষ্ট। পাশের একটি ঘর থেকে গরম পানি এনে সিরিঞ্জ ও সুঁই ধুয়ে ফেললাম। ঔষধের বাক্সটি খুলে দেখলাম, তাতে সবই রয়েছে। তুলা, ডেটল ও প্রচুর গজ স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার নিজের বৃদ্ধিতেই এনেছে। বুলবুল খান মাহবুব, নুরুন্নবী, নুরুল ইসলাম, খোকা, দুলাল ও হালিমের সহায়তায় চট্‌পট্ ক্ষতস্থান ডেটল দিয়ে ধুয়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে ফেললাম। প্রথমে এ. টি. এস. ও একটু পরে দশ সি. সি. পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন দিলাম। এরপর তাকে দু’টো ব্যারালজিন টেবলেট খাইয়ে দেয়া হল। এরপর আবার চলা শুরু করলাম। কিন্তু দশ মিনিট পর থামতে হল। কারণ পাশের বাড়িতে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সত্যিই এক আশ্চর্যের বিষয়, মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িতে পৌছাবার আগেই পাটি বিছিয়ে ভাত-ডাল ও আলুভর্তা সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রথমে নুরুন্নবী, নুরুল ইসলাম ও বুলবুল খান মাহবুব সহ চল্লিশ জনের একটি দলকে খাবার খাওয়ানো হল। এরপর অন্য আর একটি দল খেতে বসল। প্রথম চল্লিশ জনের দলটিকে আহত খোরশেদ আলমকে দিয়ে সোজা হেড—
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৩৯

কোয়ার্টারের পথে পাঠিয়ে দিলাম। খোরশেদ আলমকে পাঠিয়ে দেয়ার সময় সে আগের দিনের মত কেঁদে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, “বাবাগো, আমারে কিন্তু ফেলে যাইয়েন না।” আমি পূর্বের কথাই বললাম। নুরন্নবী ও বুলবুল খান মাহবুবের হাতে অবশিষ্ট ঔষধ তুলে দিয়ে বললাম, “তিন-চার ঘন্টা পর পর যেখানে যেভাবে থাকুন, একটা করে পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন দেবেন। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে মুক্তিবাহিনীর হাসপাতালে পৌঁছে দেয়াই হবে আপনাদের প্রধান কাজ। হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে এর সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে আমাকে খবর দেবেন।”
মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া দাওয়া শেষে দেড় ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে, আবার পুবদিকে সেহরাবাড়ীর উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করলাম। চারদিন পর ১৫ই আগস্ট দুপুরে সেহরাবাড়ীতে এসে হাজির হলাম। ধলাপাড়ার প্রতিরক্ষা ঘাঁটি পরিদর্শন করে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে পরদিন হেড- কোয়ার্টারে চলে যাব, এই রকম একটি পরিকল্পনা মনে মনে স্থির করে ফেললাম।
এই সময় পাকিস্তান আর্মির ১৪তম ডিভিশনের দুটি ব্রিগেড পাহাড়ের মুক্তাঞ্চলের উপর সাঁড়াশী আক্রমণ চালাচ্ছিল। সেহরাবাড়ী থেকে পনের-ষোল মাইল পূবে আছিম-লহরের বাইদ। সেহরাবাড়ী থেকে দশ মাইল উত্তরে রাঙ্গামাটি এবং মহানন্দপুর হেডকোয়ার্টার থেকে কুড়ি মাইল দক্ষিণে হতেয়া, পাথর ঘাটা, হেড কোয়ার্টার থেকে মাইল দশেক দক্ষিণ-পশ্চিমে বহেরাতলী। তেজপুর, কাউলজানী, ও পুবে ফুলবাড়িয়া, ভালুকা, রাজঘাট এবং কাচিনা। সর্বত্র প্রায় তিন চার দিন ধরে মুক্তিবাহিনীর সাথে হানাদারদের চরম সংঘর্ষ চলছিল। দশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা হানাদারদের প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করে চলছিল। সেহরাবাড়ীতে এসে মনে মনে স্থির করলাম, পরদিন ন-টা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। আছিম, রাঙ্গামাটি ও ধলাপাড়া এই তিন ঘাঁটির যেদিক থেকে প্রথম আক্রমণের খবর বা গোলাগুলির শব্দ আসবে, সে দিকেই যাব। ন-টা পর্যন্ত কোন নতুন আক্রমণ না হলে হেড কোয়ার্টারে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নতুন পরিকল্পনা করব।
১৬ই আগস্ট নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল না। সেহরাবাড়ীর দুই মাইল পশ্চিমে ধলাপাড়া ঘাট থেকে মাটি কাঁপিয়ে গুলির আওয়াজ আসতে লাগল। খবরের জন্য লোক পাঠাব, এমনি সময় ধলাপাড়া মুক্তিবাহিনী প্রতিরক্ষা ঘাঁটি থেকে শত্রু আক্রমণের খবর এল। দ্রুত কর্তব্য ঠিক করে ফেললাম। ধলাপাড়া প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে তখন দুহাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এর আগে ও পরে কোন প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে একসাথে এত মুক্তিযোদ্ধা আত্মরক্ষামূলক লড়াইতে অংশ নেয়নি। ভুয়াপুর থেকে মেজর হাবিব, মেজর গফুর, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন ১৪ই আগস্ট বিকেলে ধলাপাড়া এসে পৌঁছে। পূর্ব নির্দেশ মত, ধলাপাড়া ঘাটির কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর লোকমান হোসেন, মেজর হাবিবের হাতে ধলাপাড়া প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তুলে দেয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, দু’হাজার মুক্তিযোদ্ধার নিচ্ছিদ্র রক্ষা ব্যূহ ভেদ করে ঐ দিন বংশাই নদী পার হওয়া কোন ক্রমেই হানাদারদের পক্ষে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়তঃ শত্রুরা যেখানে একবার অবস্থান নিয়ে ফেলেছে, সেখানে দ্বিতীয়বার হামলা চালিয়ে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না। বংশাই নদী পার হতে না পারলে শত্রু পক্ষেরও নদীর পারে রাত কাটানো সম্ভব হবে না। তাদের ফিরে যেতেই হবে। সেহেতু শত্রুর পিছনে গিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৪০

ওৎ পেতে বসে থাকতে পারলে ভাল রকম একটা শিক্ষা দেয়া সম্ভব। আকস্মিক আঘাত হেনে হয়তো আরো কিছু অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করা যেতে পারে। এই পরিকল্পনা করে ক্যপ্টেন বেনুকে সাথে নিয়ে বাসেত সিদ্দিকীর সেহরাবাড়ীর বাড়ী থেকে সামান্য একটু পশ্চিমে, তারপর অনেকটা উত্তরে এগিয়ে আঙ্গারখোলা বাজারের পাশ দিয়ে বংশাই নদী পার হয়ে পশ্চিম পারে এলাম। এরপর সোজা মাইল খানেক পশ্চিমে গিয়ে খুব সন্তর্পণে দক্ষিণ দিকে ঝরকা-এলাপাড়া রাস্তার দিকে এগুতে শুরু করলাম। হাটঁতে হাটঁতে ধলাপাড়া চৌধুরী বাড়ীর ঘাটের দুমাইল পশ্চিমে মাকড়াই জুম্মা ঘরের কাছে ঝরকা-এলাপাড়া রাস্তার উপরে এলাম। এখান থেকে কমাণ্ডার বেনুর দলকে আরও দুমাইল পশ্চিমে গিয়ে ঘাটাইলের দিক থেকে আসা রাস্তাটি আগলে থাকার নির্দেশ দিলাম। বেনু চলে গেলে, খুব আস্তে আস্তে নিঃশব্দে আশপাশে ঘুরে ঘাটাইল-ধলাপাড়া কাঁচা রাস্তার দক্ষিণ পাশে একটি অনুকূল জায়গা বেছে পজিশন নিলাম। ডান পাশে পাঁচশ গজের মধ্যে রাস্তা আগলে রইল ভুয়াপুরের কুদ্দুস, শানবান্ধার খোকা ও বাসেত সিদ্দিকীর ছেলে সেলিম সিদ্দিকী, বামে হালিম, দুলাল ও কাশেম। মাঝে আমি। সাথে কস্তুরী পাড়ার সামসু, কুষ্টিয়া কামাতীর সাইদুর ও দিগর ইউনিয়নের ফজলু। ডান বামের উভয় দলকে বলে দিয়েছি, তারা যেন কেনো ক্রমেই শত্রুকে প্রথম আঘাত না হানে। রাস্তা থেকে আমি মাত্র চল্লিশ পঞ্চাশ গজ দূরে। ডান বামের সহযোদ্ধারাও রাস্তা থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ গজের বেশী দুরে নয়। সবার অবস্থান খুব ভাল। সবাই অধীর আগ্রহে মহেন্দ্র ক্ষণটির অপেক্ষায়।

আমি আহত হলাম
১৬ই আগস্ট, বেলা একটা পনের মিনিট। হানাদারদের প্রথম দলটি পরস্পর বেশ দূরত্ব বজায় রেখে সারিবদ্ধ ভাবে, সতর্ক হয়ে পশ্চিমে ফিরে যাচ্ছে। তারা ধলাপাড়া নদীর ঘাটে হাকিম, হাবিব, গফুর, লোকমান ও হুমায়ুন কোম্পানীর হাতে আচমকা মার খেয়ে ঐ দিনের মত নদী পার হওয়ার আশা ত্যাগ করে, পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। আমি শত্রুদের এই পিছু হটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। শত্রুর উপর আঘাত হানতে আমরা মানসিকভাবে পুরোপুরি তৈরী। পনের কুড়ি জন হানাদারের প্রথম দলটি চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ সামনে দিয়ে চলে গেল। তাদের মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। এর পর শুরু হল একের পর এক হানাদারদের পশ্চিমে যাওয়ার পালা। এক দৃষ্টিতে হানাদারদের চলে যাওয়া লক্ষ্য করছি। উপযুক্ত সময়টির জন্য আষাঢ়ের ভেজা কাকের মত নিশ্চল বসে আছি। বেশী অপেক্ষা করতে হল না। আকাঙ্ক্ষিত সময়টি এসে গেল। বেলা একটা কুড়ি মিনিটে বিশৃঙ্খল ভাবে দৌড়াদৌড়ি করে পিছুতে থাকা পঞ্চাশ জনের দলের উপর আচমকা আঘাত হানলাম। এমন আকস্মিক হামলা হানাদাররা কল্পনাও করেনি, স্বপ্নেও ভাবেনি। খোলা মাঠ। হানাদারদের কোন কিছুর আড়ালে নেয়ার উপায় নেই, নড়াচড়ারও না। সাইদুর, সামসু ও আমি গুলির তুবড়ি ছুটালাম। আমাদের ব্রাশ ফায়ারে হানাদাররা লুটিয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে দু–একজন হানাদার মৃতদেহের আড়ালে শুয়ে পড়তে সক্ষম হল। তারাই মাঝে মধ্যে দু-একটা গুলি ছুঁড়ল। তবে অবস্থা তাদের প্রতিকূল। প্রতিরোধহীন অবস্থায় মার খাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। পুব
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৪১

দিক থেকে পাক-হানাদাররা যখন আমাদের দিকে আসতে চেষ্টা করে, তখন আবার অতর্কিতে খোকা, কুদ্দুস, সেলিম তাদের উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। চাইনিজ এল. এম. জি-র চেইন শেষ হয়ে গেলে, সাইদুরের ব্রিটিশ এল. এম. জি. নিয়ে গুলি চালাতে লাগলাম। প্রতিটি মূহুর্ত তখন মূল্যবান। সাইদুর নতুন করে এন. এম. জি-র চেইন ভরে দিতে লাগল। দ্বিতীয় চেইন শেষ হবার পর তৃতীয় বার সামসুর চাইনীজ স্টেনগান নিলাম। হানাদারদের দিকে থেকে গুলি আসছে তবে খুব কম। তারা এমন এক বিভ্রান্তিকর ও ঘোলাটে অবস্থায় পড়ে গেছে যে, আসল শত্রু কোন দিক বা কোথা গুলি আসছে, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। তৃতীয়বার চাইনীজ এল. এম. জি. নিয়ে গুলি ছোঁড়া শুরু করেছি। পঁচিশ-ত্রিশ রাউণ্ড বেরিয়েও গেছে। এমন সময় চেইন আটকে গেল। চেইন খুলে ঠিক করে আবার গুলি ছোড়া শুরু করলাম। দশ-বার রাউণ্ড গুলির পর আবার আটকে গেল। খুলে আবার চেইনের গুলি টিপে টিপে ঠিকমত লাগাচ্ছি। সাইদুর, সামসু সামনে ডানে-বামে বিরামহীন গুলি ছুঁড়ে চলেছে। শেষ রাউন্ডটি টিপে ঠিকমত লাগাতে যাব এমন সময় আমার এল. এম. জি. একটু নড়েচড়ে উঠল। হাতে যেন কিসের স্পর্শ অনুভব করলাম। পায়েও একটু তাপ লাগল। সেকণ্ডে এতসব ঘটে গেল। কিছু বুঝতে পারলাম না। আবার এল. এম. জি. চালাতে গেলাম। ডান হাত থেকে ফিকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। রক্তে চোখমুখ ঢেকে গেল। এত রক্ত চোখে মুখে লেগেছে যে, কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। বাম হাত দিয়ে চোখ মুখ মুছে, ক্ষতস্থান চেপে ধরে আবার এল. এম. জি-র ট্রিগার চেপে ধরলাম কিন্তু না, মাত্র কয়েক রাউণ্ড গুলি চলার পর আবার চেইন আটকে গেল। রক্তে এল. এম. জি-র বাট ভেসে গেছে। আমার শরীরে যে এত রক্ত আছে, তা নিজেই জানতাম না। সামসু সাইদুর বারবার আমাকে পিছিয়ে যেতে অনুরোধ করতে লাগল। “হ্যা, আমিও তাই ভাবছি। সামসু, তোর গানটা দে। তুই এল. এম. জি-টা নিয়ে আয়।” দশ-বার হাত ঢাল বেয়ে নীচে নেমে এলাম। সামসু প্রথমে নীচু হয়ে এল. এম. জি. মাটি থেকে তুলে নিয়ে সে গড়িয়ে নীচে নেমে এল। আমার গায়ে গুলি লাগার পর হানাদারদের দিক থেকে আর একটি গুলিও আসেনি।
আমরা নিরাপদে সরে গেলাম। এখানে মাত্র দশ মিনিট যুদ্ধ হল। আমাদের তিনজনের গুলিতেই ত্রিশজন খানসেনা নিহত এবং আহত হয়। ডানে ও বাঁয়ে খোকা, কুদ্দুস, সেলিম, দুলাল, হালিম, আমজাদ ও কাশেমও হানাদারদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ক্ষতির মধ্যে আমি গুরুতর আহত হলাম। হানাদারদের একটি গুলি আমার এল. এম. জি-র ফোর সাইট নবে লেগে নব ভেঙে ইসপ্লিনটার হাতের তালু ভেদ করে চলে যায় ও বুলেটটি হাঁটুর ইঞ্চি খানেক উপরে আঘাত করে।
মাকড়াই–ধলাপাড়ায় আটকে থাকা হানাদাররা তাদের দুরবস্থা ও লড়াইয়ের কথা সম্ভবতঃ ওয়ারলেসে ঘাটাইল ঘাঁটিতে জানিয়ে দেয়। ফলে তাদের উদ্ধারে ঘাটাইল থেকে খান সেনাদের একটি কলাম রওনা হয়। কমাণ্ডার বেনুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা রাস্তার উপর ওৎ পেতে বসেছিল। ক্যাপ্টেন বেনুর কোম্পানীর হাতেম, আসালত, ছোট ফজলুর হাতে চাইনিজ রাইফেল
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৪২

আর অন্যদের কাছে স্টেনগান। হানাদাররা কমাণ্ডার বেনুর একেবারে কাছে এসে গেল। ক্যাপ্টেন বেনু স্টেনগানের ট্রিগার টিপে ধরল। কিন্তু ফায়ার হলনা। নিরুপায় বেনু উচ্চস্বরে ‘ফায়ার’ ‘ফায়ার’ বলে চিৎকার করে নির্দেশ দিল। মুক্তিযোদ্ধারা গুলি চালাবার আগেই হানাদাররা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে বৃষ্টির মত গুলি ছুঁড়তে লাগল। হাতেম সহ ছ-সাত জন মুক্তিযোদ্ধা হানাদারদের এত কাছাকাছি গিয়ে পড়েছিল যে, তাদের পক্ষে সহজে পিছিয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। প্রথম আঘাত হানতে পারলেই লড়াই মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে চলে আসত।
কমাণ্ডার বেনু তার সহযোদ্ধাদের পিছিয়ে যেতে নির্দেশ দিল। কিন্তু হাতেম সে নির্দেশ শুনতে পেলনা। ঝোপের আড়াল থেকে হাতেম সমানে হানদারদের উপর গুলি ছুঁড়ছিল। হাতেমের একার গুলিতেই চারজন খান সেনা নিহত ও সাতজন আহত হয়। তাঁর চাইনীজ রাইফেলের শেষ গুলিটিও ছুঁড়তে সে যখন উদ্যত, তখন দুশমনদের তিনটি গুলি তার গায়ে আঘাত করলে, সেখানেই সে পড়ে গেল। হানাদাররা তাকে খোঁজাখুঁজি করল কিন্তু পেলনা। পশ্চাদপসরনের নির্দেশ পেয়ে সকল মুক্তিযোদ্ধাই নিরাপদে সরে পড়ে। কেবল হাতেম আহত ও ফজলু মূল দল থেকে ছিটকে পড়ে। ফজলু এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে হালিম ও দুলালের সাথে মিলে নিরাপদ স্থানে চলে আসে। যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকে শুধু একা আহত হাতেম।

শহীদ হাতেম
হানাদাররা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছিয়ে গেলে স্বেচ্ছাসেবকরা হাতেমকে সেহরাবাড়ীতে নিয়ে আসে। হাতেমের গায়ে গুলি লেগেছে এবং সে পিছনে পড়ে আছে, কমাণ্ডার বেনু এর বিন্দু বিসর্গও জানেনা বা জানতে পারেনি। তার ধারণা, পিছানোর নির্দেশের সাথে সাথে সব সহযোদ্ধা নিরাপদে পিছিয়ে এসেছে। সেহরাবাড়ী আনা হলে হাতেমের প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা হলো কিন্তু অবস্থা প্রতিমূহুর্তে অবনতির দিকে যেতে লাগল। হাতেম বলতে লাগল, “আমি বাঁচব না। মরার আগে আমার নেতা কাদের ভাইকে দেখে যেতে চাই। তিনি আমাকে নানাভাবে দারুণ পরীক্ষা করে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি করেছিলেন। তাকে বলে যেতে চাই, তার বিশ্বাস আমি রক্ষা করেছি।” তার যন্ত্রণা যত বাড়ছে, একই কথা সে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছে, “আমি কাদের ভাইকে দেখতে চাই। এটাই আমার জীবনের শেষ আশা, শেষ ইচ্ছা।”
তিনটি গুলি হাতেমের গায়ে লেগেছে। তিনটি গুলির দুটি ডান কাঁধ ভেদ করে চলে গেছে। একটি বুকের সামান্য নীচে বিদ্ধ হয়ে পিছনে পিঠের চামড়ার সামান্য নীচে জ্বলজ্বল করছিল। হাতেমের আহত হবার খবর আমার কাছে অনেক দেরীতে পৌঁছে। হাত-পায়ে দারুণ আঘাত সত্ত্বেও হাতেমকে দেখতে গেলাম। কিন্তু প্রিয় শিষ্যকে দেখা- আমার ভাগ্যে হলোনা, দুর্ভাগ্য আমার পৌঁছানোর আগেই হাতেম আমাদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে শাহাদাৎ বরণ করেছে।
প্রিয় সহযোদ্ধা হাতেম সম্পর্কে দুচারটি কথা না বললেই নয়। যে কঠোর কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে সে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিল, সে এক অনবদ্য কাহিনী। হাতেম যখন প্রথম মুক্তি
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৪৩

বাহিনীতে যোগ দিতে এলো, তখন একজন কমাণ্ডার তাকে অযোগ্য ঘোষণা করে বিদায় করে দেয়। এতে হাতেম ক্ষুদ্ধ হয়ে কমান্ডারের সাথে দুর্ব্যবহার করে। এ অপরাধের শাস্তি স্বরূপ তাকে কঠোর প্রহার করা হয়। এতে তার সমস্ত শরীর জখম হয়। পরে চিকিৎসার জন্য তাকে টাকা দেয়া হয়। সুস্থ হয়ে আবার ফিরে এসে সে বলে, “আমাকে মুক্তিবাহিনীতে নিতেই হবে। অন্যথা আমি এখান থেকে যাবনা। এই মানসিক দৃঢ়তা দেখে তাকে ভর্তি করে নিই। এবং প্রথম প্রথম তাকে কঠিন কঠিন কাজ দিতে থাকি। হাতেমের তাতে অনীহা নেই, ক্লান্তি নেই। কাজ যত কঠিনই হোকনা কেন, তাতে তার উৎসাহ ও উদ্দীপনার অভাব নেই। সব কাজ সে সমান দক্ষতা ও নৈপুন্যের সাথে করে যেতে লাগল। এটা দেখে, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতই তাকে আপন করে নিলাম। গরীব-বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান হাতেম দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন তুচ্ছ করল, বাংলার জনগণ কোন দিন হাতেমের ত্যাগের সব কথা জানতে পারবেন কিনা জানি না। তবে টাংগাইলের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও জনগণের কাছে হাতেম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান হাতেম বাংলার স্বধীনতা সংগ্রামে যে অবদান রেখে গেল, তা কি ভবিষ্যতে আমরা তুলে ধরতে পারবো? মনে রাখতে পারবো? না ভুলে যাবো?
গুলিবিদ্ধ হয়ে মাকড়াই থেকে মাইল খানেক দক্ষিণে একটি বাইদ পার হয়ে অন্য একটি চালায় এলাম। তখনও হাত-পা থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে। দুলাল ও খোকা নিজেদের কাপড় ছিড়ে খুব শক্ত করে হাত বেঁধে দিল। পায়ের দিকেও দরদরিয়ে রক্ত ঝরছিল। আস্তে আস্তে প্যান্ট উপরে তুলে পায়ের জমাট বাধা রক্ত মুছে দেখলাম, হাটুর উপরে একটি ক্ষত হয়েছে। ক্ষত থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝরছে। ক্ষতস্থানটি ভাল করে ধুয়ে দেখলাম, গুলি বেরিয়ে যায়নি ভিতরে রয়ে গেছে। আস্তে আস্তে বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল ক্ষতের ভিতর ঢুকিয়ে দিলাম। ইঞ্চি খানেক ঢুকতেই শক্ত স্পর্শ অনুভব করলাম। আঙ্গুল বের করে, ক্ষত স্থানের দু’পাশে একটু জোরে বার বার চাপ দিতেই বুলেটটি বেরিয়ে এলো। পায়ের ক্ষত স্থানে যখন আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেখছিলাম এবং টিপে টিপে বুলেট বের করছিলাম, তখন কিন্তু কোন ব্যথা অনুভব করিনি। আমার অবস্থা দেখে বাসেত সিদ্দিকীর ছেলে সেলিম সিদ্দিকী বুক ও মাটি চাপড়ে কাঁদতে থাকে। তার এক কথা, ‘হায় হায়। আমাদের এখন কি হবে?’ আমি বার বার তাকে শান্ত করে বললাম, “আমার কিছু হয়নি, দেখ আমি ঠিক আছি।” এর পরও তার কান্না থামল না। অন্য সহকর্মীদের চোখেও বেদনাশ্রু। প্যান্ট পরতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। জীবনে প্রথম পয়তাল্লিশ টাকার কেনা টেট্রনের প্যান্ট আমাকে ত্যাগ করতে হল। গ্রাম থেকে একটি লোক ডেকে এনে তার পুরানো মশারীর মতো একটি লুঙ্গি পাঁচ টাকায় কিনে তা পরে প্যান্টখানা খুলে ফেললাম। এর পর ঐ প্যান্ট আর কখনও ব্যবহার করিনি বা করতে পারিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সার্ট, প্যান্ট ও হাত বাঁধা রক্তাক্ত রুমাল মা ঢাকা যাদুঘরে দিয়েছিলেন। ঐ অবস্থায়ও ধলাপাড়ার প্রতিরক্ষা কমাণ্ডার মেজর হাবিব ও মেজর হাকিমকে মাকড়াইয়ের যুদ্ধের সংবাদ দিয়ে একটি পত্র দিলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৪৪

‘তোমরা নদী পেরিয়ে মাকড়াই পর্যন্ত যাও। শত্রুর লাশ ও অস্ত্র-শস্ত্র পড়ে আছে। আমার হাতে সামান্য চোট লাগায় আমি নিজে লিখতে পারলাম না। আমি বাম হাতে স্বাক্ষর করছি। তাই স্বাক্ষর হয়তো অন্য রকম হতে পারে। পত্র নিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা ধলাপাড়া চলে গেল। এদিকে আমি মাকড়াই ও ধলাপাড়া বাঁয়ে রেখে চম্বলতলার স্বেচ্ছসেবক তুলাদের বাড়ীতে এসে উঠলাম। তখন আমার কেবলই ভয় হচ্ছিল, কখন অচল হয়ে পড়ব। তাই সচল থাকতে থাকতে কিছুটা নিরাপদ স্থানে সরে যেতে চাইলাম। হাত পায়ের ক্ষত নিয়ে প্রায় দুমাইল হেঁটে তুলাদের বাড়ীতে আসতেই জ্বর এসে গেল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মাথাও ঘুরছিল। বমি বমি ভাব শুরু হলো। তুলাদের কাচারী ঘরে মস্তবড় একটি টেবিলের উপর সহযোদ্ধারা আমাকে ধরাধরি করে শুইয়ে দিল। টেবিলের উপর শুয়ে মনে হলো, সব কিছু ঘুরছে। আমি অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। সারা শরীর যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে। অন্ধকার রাতে জোনাকি পোকার মত আলোর ঝিলিক দেখতে দেখতে কখন যেন অচেতন হয়ে পড়লাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৪৫

ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত

পত্র পেয়ে মেজর হাবিব, হাকিম ও গফুর বংশাই নদী পেরিয়ে মাকড়াই এসে পৌঁছল। মাকড়াই পর্যন্ত আসার পথে তারা রাস্তার উভয় পাশে পড়ে থাকা প্রায় সত্তরটি নানা ধরনের অস্ত্র ও ছয়-সাত বাক্স গুলি উদ্ধার করে। তারা হানাদারদের লাশও রাস্তার উভয় পাশে যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখে। মেজর হাবিবের দল মাকড়াই পৌঁছানোর আগেই ঘাটাইল থেকে হানাদারদের নিয়মিত সৈন্যের একটি দল মাকড়াইয়ে পর্যুদস্ত হানাদারদের সাথে মিলিত হয়ে আহত ও নিহতদের নিয়ে ঘাটাইলের দিকে চলে যায়। মেজর হাবিব ও অন্যান্য সহযোদ্ধারা মাকড়াই গিয়ে দেখতে পায়, দশজন রাজাকারের লাশ মাকড়াই জুম্মা ঘরের পাশে ছড়িয়ে পড়ে আছে, আর কুড়ি-পঁচিশ জন আহত রাজাকার কেউ চিৎ হয়ে, কেউ উপুড় হয়ে, কেউ বা বসে যন্ত্রণায় আর্ত চিৎকার করছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে হানাদাররা নিজেদের স্বজাতীয় পাঁচ জনের লাশও ফেলে গেছে। ঘাটাইলের দিকে কিছুদূর এগিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের আর একটি দল অতর্কিতে হানাদারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ায় হানাদারদের কয়েকজন আহত ও নিহত হয়। এইভাবে বারে বারে আচমকা আক্রমণে হানাদাররা যারপরনাই বিপর্যস্ত ও আঁধার ঘরে সর্বত্র সাপ দেখার মত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আবারও আক্রান্ত হবেএই আশঙ্কায় তারা লাশ নিয়ে বোঝা বাড়াতে সাহস করে না। লাশ ফেলে শুধু আহতদের নিয়ে ঘাটাইলের দিকে দ্রুত পালিয়ে যায়।
আট’শ নিয়মিত সৈন্য ও দু’শ রাজাকার নিয়ে হামলা চালাতে এসে, ধলাপাড়া, মাকড়াই এবং মাকড়াইয়ের দুমাইল পশ্চিমে, তিন তিনবার মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত চোরাগুপ্তা হামলায় প্রচণ্ড মার খেয়ে, হানাদাররা আট জন নিয়মিত সৈনিকের লাশ ও সতের জন আহত খান সেনাসহ পঁয়তাল্লিশ জন আহত নিহত রাজাকার ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনীর হাতে আট জন পাক হানাদার অক্ষত ধরা পড়ে এবং নব্বই জন রাজাকার বন্দী হয়। রাজাকাররা অধিকাংশই স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল তা তাদের কার্যকলাপ থেকেই বোঝা যায়। নব্বই জনের মধ্যে ষাট জন রাজাকারকে কোন প্রকার কসরত ছাড়া স্থানীয় জনগণ ও স্বেচ্ছাসেবকরা ধরতে সক্ষম হয়।
মেজর হাবিব, হাকিম ও গফুর সম্মিলিতভাবে সমস্ত জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজে এই অস্ত্র-গুলো উদ্ধার করে-
(১) ৮২ ব্লাণ্ডার সাইট:- একটি।
(২) চাইনীজ এল, এম, জি:- পাঁচটি।
(৩) চাইনীজ এম. এম. জি :- একটি।
(৪) জি-৩ রাইফেল:- দশটি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৪৬

(৫) ৩০৩ রাইফেল:- কুড়িটি।
(৬) নানা ধরণের গুলি:- পনের-ষোল হাজার।
মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষয়-ক্ষতির মধ্যে হাতেম শাহাদৎ বরণ করে, ধলাপাড়া প্রতিরক্ষা ঘাঁটির আনোয়ার এবং আমি গুরুতরভাবে আহত হই। মেজর হাবিবের হাতে ও মেজর গফুরের পায়ে গুলি লাগে।
আমি অচেতন হয়ে পড়লে বাড়ীর মেয়ে ও মায়েরা সন্তান হারানোর মত আলু থালু অবস্থায় চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। এ সময় বাড়ীর একজন শিক্ষিত নববধূ ঝটপট তার শাড়ী ছিঁড়ে তা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দিয়ে ভাল করে আমার ক্ষত স্থান বেঁধে দিতে অনুরোধ জানান। বউটিই গরম পানি ও ডেটল এনে দেন। অচেতন অবস্থাতেই আমার হাত-পায়ের ক্ষত স্থানে ভাল করে ব্যাণ্ডেজ করা হয়। প্রায় দুঘন্টা পর গা ঘেমে জ্বর ছেড়ে গেল। আমি চোখ খুলে একটু নড়াচড়ার চেষ্টা করলাম, একবার উঠে বসতেও চাইলাম। কিন্তু বসতে পারলাম না। মাথা চক্কর দেয়ায় আবার শুয়ে পড়লাম। এই সময় মাথার কাছে নানা বয়সের দশ-বারো জন মহিলা দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ বাতাস করছিলেন। একজন পূর্ণবয়স্কা মহিলা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রৌঢ়া মহিলা বললেন,
— বাবা, এখন তোমার কেমন লাগছে?
— উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি আবার বললেন,
— এক গ্লাস দুধ খাও। দেখবে, তোমার ভাল লাগবে। যে বউটি শাড়ী ছিঁড়ে দিয়েছিলেন, তিনি দৌড়ে একগ্লাস দুধ নিয়ে এলেন এবং দুইজন আমাকে ধরে দুধ খাইয়ে দিলেন। দূধ পান করে, আস্তে আস্তে একটু শক্তি ফিরে পেলাম। এর মিনিট দশ পর উঠে বসলাম। হাত ও পা দেহ থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাইছে, শুধু মনের জোরে তা সহ্য করছি। একবার টেবিল থেকে নেমে, দাড়ানোর চেষ্টা করলাম। পায়ের ক্ষতে এমন প্রচণ্ড টান লাগল, যন্ত্রণায় আবার বসে পড়লাম। একটু পর আবার দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম। তিন-চারবার চেষ্টার পর পায়ের ব্যথা কিছুটা কমে এলে, দাঁড়াতে এবং মাথা নীচু করে ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে পারলাম। গুলি লেগেছে হাতে এবং পায়ে কিন্তু মাথা সোজা রাখতে পারছিলাম না। বুকের নানা জায়গায় অযথাই যন্ত্রণা করছে। থেকে থেকে টান লাগছে। এত কিছুর পরও যখন একটু দাঁড়াতে এবং হাঁটতে পারলাম তা তখন মনে হলো, এবার আর মাথা ঘুরে পড়ে যাবোনা। ক্ষতের যন্ত্রণা যত তীব্রই হোক, সহ্য করতে পারবো। দাঁতে দাঁত কামড়ে আবার চলার সিদ্ধান্ত নিলাম। যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ‍ই যোগাযোগ রাখা উচিৎ। মা-বোনদের ছালাম জানিয়ে তুলাদের দুইটা নৌকা নিয়ে ধলাপাড়া- দেওপাড়া কাঁচা সড়কে ধলাপাড়ার এক মাইল দূরে নৌকা থেকে নামলাম।
কিউবা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চীন, আলজেরিয়া ও অন্যান্য দেশে মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষ ভাবে মেয়েরা যুদ্ধে অংশ গ্রহন করলেও আমার নেতৃত্বাধীন টাংগাইলের মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র হাজেরা সুলতানা ছাড়া আর কোন নারী যোদ্ধা ছিলেন না। তবে এর অর্থ এই নয় যে, মায়েরা
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৪৭

বোনেরা মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোন ভূমিকা বা অবদান রাখেননি। তাদের অমূল্য অবদান না থাকলে আমরা এত তাড়াতাড়ি সফল হতে পারতাম না। আমার এবং অন্যান্য প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে মা-বোনেরা মন প্রাণ দিয়ে সব সময় সেবা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার ব্যাপারে বলতে গেলে শতকরা নব্বই ভাগ দায়িত্বই মা-বোনেরা নিয়েছেন। এ ছাড়াও চরম সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানে মেয়েদের ভূমিকা ছিল সব চাইতে বেশী। প্রত্যক্ষভাবে নারী সমাজ টাংগাইলের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করলেও, তারা মুক্তিযুদ্ধের অর্ধেক দায়-দায়িত্ব বহন করেছেন।
সন্ধ্যার একটু আগে ধলাপড়া ঘাটে এলাম। ওপারে গণপরিষদ সদস্য বাসেত সিদ্দিকী ও মেজর লোকমান হোসেন দাঁড়িয়ে ছিল। এপার থেকেই বাসেত সিদ্দিকীকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলাম। আমার ধারণা ছিল, সারাদিন যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে তাতে নির্ঘাত বাসেত সিদ্দিকী বারো- তের মাইল পূবে তার শ্বশুর বাড়ী উথুরাতে চলে গেছেন। কিন্তু সিদ্দিকী সাহেবকে ধলাপাড়া স্কুল ঘাটে দেখে আমার ভুল ভাঙল। নদী পার হয়ে এক হাতে বাসেত সিদ্দিকী সাহেবকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি এখনও এখানে?
বাসেত সিদ্দিকীর সহজ ও সরল উত্তর,
— স্যার, আপনি পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলেন আর আমি তিন-চার মাইল পিছনেও আপনার জন্য অপেক্ষা করতে পারবো না? তাহলে কেমন মুক্তিযোদ্ধা হলাম। এত দুঃখের মাঝেও তাকে বললাম,
— স্যার, আজ থেকে আবার নতুন করে আপনার উপর আমার ভরসা জাগলো। আপনাদের এমন বিশ্বাস আর ভালবাসা আছে বলেই হয়তো আমরা এখনও লড়াই করে চলেছি। আমার হাতে ব্যাণ্ডেজ দেখে বাসেত সিদ্দিকী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। বার বার জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার হাতে কি হয়েছে?” বাসেত সিদ্দিকী জানতেন না যে, আমার হাতে-পায়ে গুলি লেগেছে। বললাম,
— অবস্থান বদলের সময় হামাগুড়ি দিতে গিয়ে হাতে একটু চোট লেগেছে। সামান্য আঘাত, একদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। বাসেত সিদ্দিকীর সাথে কথাবার্তা শেষ হলে মেজর হাবিব ও মেজর হাকিম এসে সারাদিনের যুদ্ধের পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট পেশ করল।

ধলাপাড়ায় যুদ্ধ
১৬ই আগষ্ট, সকাল সাতটা ত্রিশ। হানাদাররা বিনাবাধায় ধলাপাড়া চৌধুরী বাড়ীর ঘাট পর্যন্ত এসে নদীর উঁচু পাড় ঘেঁষে শুয়ে অবস্থান নেয়। শুধু কমাণ্ডাররা ডান-বামে ঘোরাফেরা করে নদীয় অপর পারের অবস্থা দেখতে থাকে। পুব-পার একেবারে নীরব। কোন সাড়া-শব্দ নেই দেখে পঁচিশ-ত্রিশ মিনিট পর হানাদার নেতা নির্দেশ দিল, ‘তুম লোগ উঠ যাও। কিস্তিকা এন্তেজাম করো। উস কিনারা পার যানা হোগা। এদিকে নদীর পুব পাড়ে, মৃত্যু যে ওৎপেতে বসে আছে তা হানাদাররা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে নি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৪৮

কমান্ডারের নির্দেশ পেয়ে পাক-হানাদাররা ঘাটের কাছাকাছি জড়ো হলো। জায়গাটা শত্রুমুক্ত এবং নিরাপদ ভেবে তাদের মধ্যে আর আগের সতর্কতা রইলো না। দশ-বারো জন হানাদার নদীর নীচে নেমে এলো। এবং বিকট চিৎকার করে পূর্ব পারের লোকজনকে ডাকতে শুরু করে দিল, ‘ভাইলোগ, কিস্তি কাহা হ্যায়, ঘাবড়ানা নেহী, বাহার আ যাও। হামলোগ দোস্ত হু।’ চেঁচামেচি ও শোরগোল তুলে হানাদাররা যখন মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দুকের নলের মুখে অসতর্ক ও এলোমেলো দাঁড়িয়ে ছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধারা অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। এত ভালো সুযোগ, একেবারে নলের মুখে শত্রু। তারা বাঙ্কারে আর হানাদাররা উন্মুক্ত স্থানে। গুলি চালালেই অবধারিত মৃত্যু, তবুও কমাণ্ডার কোন নির্দেশ দিচ্ছে না? ট্রিগারে রাখা আঙ্গুল গুলো নিশপিশ করছে, মুক্তিযোদ্ধাদের আর যেন তর সইছে না। চাই শুধু নির্দেশ, সংকেত। এমনি ভাবে মিনিট পাঁচ-ছয় পার হলে হানাদাররা যখন আরো সুবিধাজনক জায়গায় এলো, তখন মেজর হাবিব, মেজর হাকিম, মেজর গফুর ও ক্যাপ্টেন হুমায়ূন, এই চার কোম্পানী কমান্ডারের এল. এম. জি. গর্জে উঠল। সাথে সাথে ন’শ মুক্তিযোদ্ধার সব ক’টি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র অগ্নি উদ্‌গীরণ শুরু করে দিল। উড়ন্ত নয়, খাঁচায় পোরা পাখী শিকারের মত হানাদারদের খতম করতে লাগলো। আইয়ুব খানও ১৯৬৮ সালে, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে সফরে এসে সিলেটের সুনামগঞ্জের কাছে একটি বাঁধা হরিণ শিকার করেছিল। এক্ষেত্রে পার্থক্যটা হলো, আইয়ুব খান বাধা নিরীহ পশু শিকার করেছিল, আর মুক্তিযোদ্ধারা শিকার করছে মানুষের মত দেখতে অথচ পশুর চেয়ে অধম হিংস্র কিছু দুপেয়ে জন্তু।
মাত্র পনের মিনিট মুক্তিযোদ্ধারা অবিশ্রান্ত ধারায় হানাদারদের উপর গুলি ছুঁড়লো। এরপর শুরু হলো হানাদারদের গুলি-গোলার পালা। হানাদাররা ভারী মেশিনগান, মাঝারী মেশিনগান, রিকোয়লেস রাইফেল, ৩ ইঞ্চি-২ ইঞ্চি মর্টার, ব্লাণ্ডার সাইট ও অন্যান্য অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে অবিরাম গুলিগোলা নিক্ষেপ করে আশ-পাশের এলাকা কাঁপিয়ে তুললো। কিন্তু আচমকা পনের মিনিটের অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে ফেলেছিল। প্রাথমিক ভাবে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পর হানাদাররা কিছুটা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিতে সক্ষম হয়েছে। ব্যাপক গুলি ছোড়া নিরর্থক তাই শুধুমাত্র হানাদারদের অবস্থান পরিবর্তনের সময় নিখুঁত লক্ষ্যে গুণে গুণে মুক্তিযোদ্ধারা দু’একটি গুলি ছুঁড়ে তাদের খতম ও বিব্রত করতে থাকলো। এমন অবস্থায় এক ব্যাটেলিয়ন অর্থাৎ আটশ নিয়মিত সেনা ও দুশ রাজাকারের নেতৃত্বদানকারী লেঃ কর্নেল মোক্তার মোহাম্মদ ও মেজর মমিন যখন বুঝলো, নিজেদের একশ পঁচিশ জন সৈন্য, আহত হবার পরও নদী পার হওয়া কিছুতেই সম্ভব হলো না, তখন দুপুর বারোটা ত্রিশ মিনিট থেকে পিছিয়ে যেতে শুরু করলো। যুদ্ধের রিপোর্ট নিয়ে ধলাপাড়া থেকে শেওড়াবাড়ী গেলাম। কিন্তু আমি শেওড়াবাড়ী পৌছার ঘন্টাখানেক আগে হাতেম প্রান ত্যাগ করেছে। হাতেমের পাশে গিয়ে মূহুর্তে আমার শরীরের সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা ভুলে গেলাম। নিমিষে আমি আমার সমস্ত অস্তিত্ব ও অনুভূতি হারিয়ে ফেললাম। হাতেমকে শেওড়াবাড়ী মসজিদের পাশে যথাযোগ্য মর্যাদায় কবর দেয়া হলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৪৯

একবুক দুঃখ এবং হাতে-পায়ে দারুণ ক্ষত নিয়ে শেওড়াবাড়ী থেকে নৌকায় সদর দপ্তর মহানন্দপুর রওনা হলাম। মাঝপথে সহযোদ্ধাদের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করা হলো, সদর দপ্তর মহানন্দপুরে না গিয়ে মা-বাবা ও ভাই-বোনেরা যেখানে আছে সেই শুড়ীরচালাতে যাবো। আমি চাইছিলাম, আমার আহত হবার খবর যাতে প্রচারিত না হয়। মুক্তিযোদ্ধারা যাতে জানতে না পারে। সে জন্য সদর দপ্তরে না গিয়ে শুড়ীরচালাতে এলাম।
রাত আটটায় লুঙ্গি পরা, হাতে ব্যাণ্ডেজ ধাধা অবস্থায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমাকে আসতে দেখে মা চমকে উঠলেন। ছোট ভাই-বোনেরা আমার হাতে ব্যাণ্ডেজ দেখে কেঁদে ফেললো। বাবাও কাঁদো কাঁদো, ধরা গলায় উদ্বেগের সাথে জিজ্ঞেস করলেন,
— বজ্র। তোর হাতে ব্যাণ্ডেজ কেন? কি হয়েছে?
মা-বাবা সহজেই ব্যাপারটা বুঝে গেল। হাত ও পায়ের ক্ষত থেকে প্রচুর রক্ত ক্ষরণে আমার মূখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। হাজারো চেষ্টা করেও ক্ষত জনিত যন্ত্রণার ছাপ মুখ থেকে মুছে ফেলতে পারছিলাম না। যতদূর সম্ভব স্বাভাবিকভাবে ছোট ভাই-বোনদের শান্ত করার ছলে বললাম, “তোরা কাঁদছিস্ কেন? আমার কিছু হয়নি। সামান্য একটু চোট লেগেছে। এ-একদিনেই ঠিক হয়ে যাবে।”
ছোট ভাই-বোনেরা কেঁদেই চলেছে, বাঁধ ভাঙা অশ্রু তাদের সকলের চোখে। ভাই- বোনদের কাছে ডেকে বাম হাত মাথায় বুলিয়ে, অনেক আদর করে, তাদের শান্ত করলাম।
রাত দশটায় শুড়ীরচালা থেকে তিন মাইল দক্ষিণে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর মহানন্দপুরে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হলো। তারা ডাঃ শাহজাদা চৌধুরীকে সাথে নিয়ে আবার শুড়ীরচালা ফিরবে। এ দিকে ক্ষতের যন্ত্রণা বেড়ে চলেছে। এক সময় মনে হলো, বোধ হয় আর সহ্য করতে পারবোনা। অল্প সময়ের জন্য হলেও অচল হয়ে পড়বো। অথচ তখন দু’তিন দিনও বিছানায় শুয়ে থাকার কোন উপায় ছিল না। হানাদাররা মুক্তিবাহিনী নির্মূল অভিযানে মরিয়া হয়ে উঠেছে, তারা চাপ বাড়িয়েই যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা হতোদ্যম হয়ে পড়বে। এই সমস্ত কারণে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। হাত-পায়ের ক্ষতের চিন্ চিন্ ব্যথা মাথা সোজা রাখতে দিচ্ছেনা, মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি তবুও মাঝে মাঝে যন্ত্রণার কাছে হার মানতে হচ্ছে। তীব্র ব্যথায় মাঝে মাঝে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ছি, আবার উঠছি। যন্ত্রণার যেন শেষ নেই। রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিটে আমার দলের দুইজন সদর দপ্তর মহানন্দপুরে পৌঁছে, বেসামরিক প্রধান অ্যানোয়ার-উল আলম শহীদের হাতে একখানা পত্র দেয়। তাতে লেখা,
“বাহকদের সাথে ডাঃ শাহজাদা চৌধুরীকে পাঠিয়ে দেয়া হোক।”
আমার স্বাক্ষর খুবই অস্পষ্ট, তবুও দেহরক্ষী দলের সদস্যদের দেখে শহীদ সাহেব ক্ষণিকভাবে ডাঃ শাহজাদা চৌধুরীকে তাদের সাথে পাঠিয়ে দিলেন।
তখন থেকেই শহীদ সাহেবসহ সদর দপ্তরের দুচার জন দায়িত্বশীল ব্যক্তির মনে উৎকণ্ঠা
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৫০

দেখা দেয়। স্যার কোথায়? স্যারের দলের লোকেরা এলো কেন? স্যারের স্বাক্ষর এত হিজিবিজি কেন? নানা প্রশ্ন, নানা সন্দেহ তাদের মনে উকি দিতে লাগলো।
ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী রাত বারোটা পনের মিনিটে শুড়ীর চালায় এসে আমাকে বিছানায় দেখে কেঁদে ফেলল।
— স্যার আপনার কি হয়েছে?
শাহজাদাকে আশ্বাসের সুরে বললাম,
— দূর, তুমি কাঁদছো কেন? তোমাকে তো কাঁদার জন্য আনা হয় নাই? আমার কিছু হয়নি। তুমি শুধু ভাল করে হাত ও পায়ের জমাট রক্ত পরিস্কার করে দাও। দেখ, হাতে কোন কিছু রয়ে গেছে কি না। আমার কথায় ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে পুর্বের মনোবল ফিরে পেল। গরম পানি করাই ছিল। ডেটল, গজ ও অন্য সব কিছু হাতের কাছেই রয়েছে। ডাঃ শাহজাদা তার ব্যাগ থেকে সিরিঞ্জ বের করে তাতে একটি এ. টি. এস. ইন্জেকশন ভরে আমার শরীরে একফোঁটা ঔষধ ঢুকিয়ে, সুই বের করে মিনিট দুই ঔষধের ক্রিয়া দেখলো। কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না দেখে পুরো ইন্জেকশনটা দিল। এরপর একটি এ্যান্টিবায়োটিক ইন্জেকশনও দিল। তারপর ডাঃ চৌধুরী আমার হাতে পায়ে জমাট শুকনো চটচটে রক্ত অত্যন্ত যত্নের সাথে পরিস্কার করা শুরু করলো। পায়ের ক্ষত গভীর হলেও পা ফুলেনি। অথচ হাত অস্বাভাবিক রকমে ফুলে গেছে। হাত গরম পানি ও ডেটল দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার করার পর দেখা গেল তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলির মাঝ দিয়ে ‘ইসপ্লিনটার’ ঢুকে অনামিকা ও মধ্যমার মাঝামাঝি বেরিয়ে গেছে। কোথাও হাড়ে লাগেনি। হাত থেকে প্রচুর রক্তক্ষরনের কারণ, তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলির মাঝের শিরা ইনসপ্লিন্টারের আঘাতে কেটে গেছে। ডাঃ চৌধুরী হাত-পায়ের ক্ষত খুব ভালভাবে পরিস্কার করে ব্যাণ্ডেজ করে দিল। এতে কিছুটা আরামবোধ করতে লাগলাম। ইন্জেকশন ছাড়াও আমাকে ‘ব্যারালগন টেবলেট’ খাইয়ে দেয়া হলে যন্ত্রণার প্রচণ্ড দপদপানি কিছুটা কমে এলো। ব্যাণ্ডেজ বাধা শেষ হলে শাহজাদা চৌধুরীকে বললাম,
— কি ডাক্তার, অন্য রোগীদের এমনি তুলুতুলু করে ব্যথা না দিয়ে কাটা-ছেঁড়া কর নাকি?
সব সময় চেষ্টা করি। কিন্তু আপনার কথা শুনে হাসিও পাঁচ্ছে, কান্নাও আসছে। এত যন্ত্রণায়ও আপনি স্বাভাবিক আছেন কি করে, তা বুঝতে পারছি না। আমি এই পর্যন্ত অনেক রোগী দেখেছি কিন্তু এত মারাত্মক ক্ষত নিয়ে কাউকে রসিকতা করতে দেখিনি।
বাঁ হাতে নিজের কান চেপে ধরে বললাম,
— তওবা তওবা, এরপর এই ব্যাপারে আর রসিকতা করব না। আমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। তুমি শুধু আমার মাথার চিন্ চিন্ করে উঠা ব্যথাটা কমিয়ে দেয়ার ঔষধ দিয়ে চলে যাও। তোমার রোগী আমি একা নই। আরো অসংখ্য রোগী আছে। তুমি যে তাদেরকে আমার মতই যত্ন নাও, তা আমি বিশ্বাস করলাম। যাওয়ার সময় ডাঃ শাহজাদা চৌধুরীকে কঠোরভাবে বলে দেয়া
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৫১

হলো, সে যেন আমার আহত হবার কথা সদর দপ্তরে প্রকাশ না করে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, “স্যারের দু’তিনজন সহযোদ্ধার সামান্য জ্বর ও পেটের পীড়া হয়েছে তাই তাকে ডাকা হয়েছিল।”

সদর দপ্তর প্রধানদের বৈঠক
১৭ই আগষ্ট চতুর্দিক থেকে লড়াইয়ের সংবাদ আসতে লাগলো। সব দিকেই মুক্তিবাহিনীর জয় ও বীরত্বের সংবাদ। সন্ধ্যায় আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও নূরুন্নবীকে শুড়ীরচালায় ডেকে পাঠালাম। শুড়ীরচালায় এসে শহীদ সাহেব বললেন,
— আমরা কিছুটা সন্দেহ করেছিলাম কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ যে এতটা কল্পনা করতে পারিনি। কম করে হলেও পনের-বিশ দিনের আগে আপনি আবার যুদ্ধপোযোগী হয়ে উঠতে পারবেন না। এই সময় আমরা কি ভাবে হানাদারদের ঠেকিয়ে রাখবো। তবে এখন যে অবস্থা, এই আক্রমণ কোন প্রকারে প্রতিহত করা গেলে আর দুই এক মাসের জন্য তারা যে আমাদের মুক্তাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারবে না, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। মুক্তিযোদ্ধাদের এখনও যে মনোবল আছে তাতে মুক্তাঞ্চলে প্রবেশ করা হানাদারদের পক্ষে বলতে গেলে একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু আপনার আহত হওয়ার সংবাদ প্রচার হলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল সাময়িকভাবে হলেও ভেঙে পড়বে, এটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন।
শহীদ সাহেবকে যাবতীয় জিনিস পত্র সদর দপ্তর থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিলাম। ভারতে ওখানকার কর্তৃপক্ষকে টাংগাইলের যুদ্ধ পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলে সীমান্তে কিছুটা চাপ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানাতে পরদিন ১৮ই আগষ্ট সকালে নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলামকে দূত হিসাবে আর একবার ভারতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো। ১৭ই আগষ্টে তিন-চার জন মিলে প্রায় চার-পাঁচ ঘন্টা খেটে নূরুন্নবীর হাতে পাঠানোর জন্য একটি পত্রের খসড়া তৈরী করে আমার কাছে গভীর রাতে এনে হাজির করলো। খসড়া পত্রটি পড়ে সামান্য সংশোধন করে কোন রকমে স্বাক্ষর করে দিলাম।
রাতে পদচ্যুত অধিনায়ক শওকত মোমেন শাজাহান সহ অন্য বন্দিদের মুক্তি দেয়া হলো।
১৮ই আগষ্ট সকালে নুরুন্নবী ও নূরুল ইসলাম ভারতের উদ্দেশ্যে তৃতীয় বারের মত রওনা হলেন। তবে এবারের যাত্রা গত দুই বারের মত সহজ হলো না। পূর্বাঞ্চল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সমস্ত রাস্তা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই বিকেলের দিকে তাদের ফিরে আসতে হলো। ফিরবার পথে তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে এলেন। ১৮ তারিখ দুপুরে মুক্তিবাহিনীর ধলাপাড়া ঘাঁটির পতন ঘটেছে, হানাদাররা ধলাপাড়া এসে তাদের ঘাটি সুদৃঢ় করেছে। অন্যদিকে রাঙ্গামাটি, আছিম, ভালুকা, রাজঘাট, ফুলবাড়িয়া, হতেয়া, পাথর ঘাটা, তেজপুর ও বল্লাতে মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে হানাদারদের বাধা দিয়ে চলেছে। এই সমস্ত ঘাটির প্রত্যেকটিতে মুক্তিবাহিনী প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।
ধলাপাড়া প্রতিরক্ষা ঘাঁটির পতন হওয়ায় বিপদের আঁচ করলাম। কারণ ধলাপাড়ার পর
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৫২

এ পথে শত্রুকে শক্তভাবে বাধা দেয়ার মত তেমন কোন ভাল অবস্থান আর মুক্তিবাহিনী নিতে পারবে না। উপরন্তু ধলাপাড়া থেকে সোজা পূর্বদিকের রাস্তা ধরে হানাদাররা যদি একবার সাগরদীঘি পর্যন্ত পৌঁছতে পারে, তাহলে রাঙ্গামাটিতে মনিরুল ইসলাম, লহরের বাইদ আছিমে লাল্টু, গোলাম সরোয়ার ও ইদ্রিসের কোম্পানীগুলো পিছন দিকে আক্রান্ত হবে। আমি কিছুতেই আমার বাহিনীকে পিছন থেকে আক্রান্ত হতে দিতে পারি না। সাথে সাথে মেজর মনির, ক্যাপ্টেন লাল্টু, ক্যাপ্টেন সরোয়ার ও ক্যাপ্টেন ইদ্রিসকে ডিফেন্স গুটিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিলাম।
আহত হওয়ায় আমার পক্ষে এই সময় হানাদারদের আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। একমাস আগে থেকে আমিও একবার ভারতে গিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে একটা যোগাযোগ স্থাপনের কথা ভাবছিলাম। ১৮ই আগস্ট নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলাম যখন ফিরে এলেন, তখনই বুঝে নিলাম, এবার কোন প্রতিনিধি পাঠালে চলবে না। নিজেকেই চিকিৎসা ও যোগাযোগের জন্য ভারতে যেতে হবে। ১৮ই আগষ্ট সন্ধ্যায় আবার শহীদ সাহেব, নুরুন্নবী, ফারুক আহমেদ, সৈয়দ নুরু, খোরশেদ আলম (আর. ও.) ও ডাঃ শাহজাদা চৌধুরীকে ডেকে আনা হলো। অনেকক্ষন ধরে যুদ্ধের নানা দিক নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলো। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো, অল্প সময়ের জন্য হলেও যুদ্ধের গতি কমিয়ে ফেলতে হবে। শুধু ঘাটি রক্ষা করার জন্য আমরা প্রচণ্ড ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করতে পারিনা। নিয়মিত বাহিনীকে সর্বশক্তি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখাও আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। আমাদের মূল উদ্দেশ্য, আক্রমণের পর আক্রমণ হেনে ওদের পুরো বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া। আমাদের সহযোদ্ধারা দীর্ঘ পনের-কুড়ি দিন ধরে বিরামহীন লড়াই করে স্বভাবতই ক্লান্ত। হতাহতের সংখ্যাও পঞ্চাশের উর্ধ্বে উঠে গেছে। যে গতিতে লড়াই চলছে তা আর দিন পনের অব্যাহত থাকলে আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ ভাণ্ডারে টান পড়বে। এই লড়াইয়ে শত্রুর কাছ থেকে গোলাবারুদ ছিনিয়ে আনার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। তাই সাময়িক ভাবে যুদ্ধ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ওরা পাহাড়ে ঢুকতে চায়, ঢুকুক। পাহাড়ে ঢুকলে ওদের পিছন থেকে আক্রমণ করা সম্ভব হবে। ওরা পাহাড়ে ঢুকলে আমাদের ক্ষতি অবশ্যই হবে। জনসাধারণের উপর হানাদাররা অত্যাচার করবে কিন্তু তবুও এ ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। নিশ্চিত ধ্বংস এড়াতে সামান্য ক্ষতি স্বীকার করতেই হবে। সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের কড়া নির্দেশ দিলাম, “আমি চাই সদর দপ্তর থেকে আপনারা শুধু দলিল দস্তাবেজ ও কাগজপত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলুন এবং তা রক্ষা করার ব্যবস্থা করুন। আপনারা কারো হাতে কোন দায়িত্ব অর্পণ করলেন অথচ সেই বিশ্বস্ত কমিটির বিশ্বাস ভঙ্গের ফলে দলিল-দস্তাবেজের ক্ষতি হল। তার জন্য আপনাদের আমি মোটেই দায়ী করব না। বিশ্বাসঘাতকদের শায়েস্তা করতে আমরা জানি। আপনারা শুধু আজ রাতের মধ্যে সমস্ত কিছু সরিয়ে ফেলুন।”

ঢাকার পথে মা
পরদিন ১৯শে আগষ্ট সকালে সদর দপ্তর থেকে ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী, নুরুন্নবী ও রসুল- পুর ইউনিয়নের কাশেমকে শুড়ীরচালায় ডেকে পাঠালাম। ওরা এলে বললাম, “সারারাত ভেবে ঠিক করেছি তোমাদেরকে একটি দায়িত্ব
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৫৩

দেব। দায়িত্বটি মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার হিসাবে নয়, তোমাদের ভাই হিসাবে দিতে চাই। তোমরা যদি তা করার চেষ্টা কর তাহলে আমি খুশী হবো।
নুরুন্নবী, ডঃ শাহজাদা চৌধুরী ও আবুল কাশেম আমার কথা শুনে তো অবাক। আবুল কাশেম অশিক্ষিত-গ্রামের লোক। সে কেঁদে ফেলে বলল,
— স্যার, আপনার গায় গুলি লাগছে, তাইতো আপনে ভাইঙ্গা পড়ছেন? আমরা তো ভালো আছি। আপনে যা কইবেন, আমরা জান দিয়া দিমু।
ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী ও নুরুন্নবীরও একই কথা।
— না, ভেঙে পড়ার কথা নয়। কাজটা ব্যক্তিগত, তাইতো জোর দিয়ে বলতে পারছি না। এবার ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী মুখ খুলল,
— স্যার, এখন আর আপনার ব্যক্তিগত কি আছে? সবাই তো মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। মা–বাবা, ভাই-বোন এবং আপনি নিজে, সবাই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বিলীন। এই খানে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কি আছে।
আমার চোখে পানি এসে গেল। একেতো গুলির যন্ত্রণা, তার উপর সহযোদ্ধাদের কথা শুনে বুকের ভিতর যেন কিসের একটা ব্যথা অনুভব করলাম, কান্না পেয়ে গেল। “আমি ঠিক করেছি, এই সপ্তাহের মধ্যে যে কোন সময় ভারতের পথে রওনা হব। আমার মা অতদূর যেতে পারবে না। আর আমিও চাইনা, আমার পুরো পরিবার বাংলাদেশ থেকে বাইরে চলে যাক। যেখানে লক্ষ লক্ষ মা-বোন শত্রুর মুখে রয়েছে, সেখানে শুধু আমার মা-বোনকে আমি নিরাপদ স্থানে সরাতে চাইনা। তাই স্থির করেছি, পরিবারটিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলব। যদি একভাগ বিনষ্ট হয়ে যায়, তবুও কারও না কারও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকবে। আমার সাথে বাবা, ছোট দুই ভাই বাবুল ও বেলালকে নিতে চাই। মার সাথে থাকবে তিনবোন ও ছোট দুই ভাই। তোমরা মা ও ভাই-বোনদের, ঢাকায় ‘সারাহ’ খালার বাড়ীতে পৌঁছে দিতে পার কিনা একবার চেষ্টা করে দেখ।”
এই সময় প্রথম জানতে পারলাম, ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী বিবাহিত, তার শশুর বাড়ী নারায়ণগঞ্জে, ঢাকায়ও তাদের বাড়ী আছে। নুরুন্নবী জোরের সাথে বলল, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে ওখানে আমারও দু’চার জন পরিচিত লোক আছে। তাই খালাম্মাকে নিয়ে যেতে পারলে, থাকার অসুবিধা হবেনা।”
১৯শে আগষ্ট, দুপুর বারোটায় মা, তার তিন মেয়ে ও ছোট ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে আহত পুত্র থেকে আলাদা হয়ে গেল। মা ও ছোট ভাই আজাদের মুখ দেখে অঝোরে কেঁদে ফেললাম। মার কান্না পেলেও তা সংবরণ করলো। এমন বিয়োগান্তক ঘটনা মা’র জীবনে অসংখ্যবার ঘটেছে। স্বৈরাচারী আইয়ুবের আমলে বাবাকে বার বার জেলে যেতে দেখেছে। আমাদের দুই ভাইকে কখনও একত্রে, কখনও বা আলাদা জেলে যেতে হয়েছে। এ যেন আমাদের পরিবারে হামেশার
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৫৪

ব্যাপার ছিল। আমাদের বাড়ী বছরে অন্ততঃ একবার পুলিশ তছনছ না করলে মনে হতো, বাড়ীটা সাজানো-গোছানো নেই। কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে।
বিদায় কালে অশ্রুসিক্ত নয়নে মায়ের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “জানিনা, তোমাদের কি হবে? আল্লাহ তোমাদের নিরাপদে রাখুন।” আহত পুত্রকে ছেড়ে যেতে মায়ের চোখ ছল ছল করে উঠলো। বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠা দীর্ঘশ্বাস গোপন রাখার চেষ্টা করে ধরা গলায় মা বললো, “আল্লাহ তোকে সফল করুন। তুই আবার শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠ।”
নুরুন্নবী, ডাঃ শাহাজাদা চৌধুরী ও আবুল কাশেম মা, তিন বোন ও দুই ভাইকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। শুড়ীরচালা থেকে পায়ে হেঁটে তারা বহেরাতলী পৌঁছে। বহেরাতলীতে ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান মা, ভাই ও বোনদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে স্বাগত জানালেন। মা কোথায় যাচ্ছেন, তা তিনি জানেন না। তবুও পরম আন্তরিকতার সাথে তাদের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করে দিলেন।
২০শে আগষ্ট ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী, নুরুন্নবী ও আবুল কাশেম মা, ভাই-বোনদের নিয়ে ধল্লা ও শতুল্লার মাঝামাঝি ছোট একটি কালভার্টের পাশে নৌকা থেকে নামল। বাসের জন্য তাদের বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। নৌকা থেকে নেমেই তারা ঢাকার বাস পেয়ে গেল। মা ও অন্যান্যরা বাসে উঠে বসলে বাস আবার চলতে শুরু করলো। মির্জাপুর পার হয়ে ড্রাইভার নুরুন্নবীকে ইশারায় পাশে বসতে অনুরোধ করেন। ড্রাইভার ভদ্রলোক বাস চালানোর ফাঁকে এক সময় খুব আস্তে আস্তে নীচু স্বরে নূরুন্নবীকে বললেন, “চেকিংয়ের সময় আপনারা কিছু বলবেন না। আমি আপনাদের চিনতে পেরেছি। খালাম্মাকে বলে দিয়েন, চিন্তার কোন কারণ নেই। আমরা ঠিক ঠিক আপনাদেরকে ঢাকা পৌঁছে দেবো। বাসস্টেন্ডে আপনারা নাইমেন না। যে দিকে যাবেন আমি গাড়ী নিয়ে সেই দিকেই এগিয়ে দিয়ে আসব।’
কালিয়াকৈর বাজারের একটু আগে বাসে চেক হলো। কিন্তু হানাদার মিলিটারী ও রাজাকাররা মা, ভাই-বোন ও নুরুন্নবী সহ দলের অন্যান্যদের কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। নূরুন্নবী কালিয়াকৈর থেকে আবার পিছনে এসে ডাঃ শাহজাদা চৌধুরীর পাশে বসলো। মাকেও সে এক ফাঁকে বলে দিল, বাসের ড্রাইভার ও কন্ট্রাকটাররা স্যারকে চিনেন। আমাদের ওরাই ঠিকমত পৌঁছে দেবে। কড্ডা ব্রিজের কাছে বাসে আবার চেকিং। এবার সমস্ত যাত্রীদের নামতে বলা হলো। ড্রাইভার, মা ও ভাই-বোনদের নামতে মানা করলেন। যাত্রীরা সবাই বাস থেকে নেমে গেল। চার- পাঁচ জন বাচ্চা নিয়ে একজন মহিলা কেন গাড়ী থেকে নামছেনা জিজ্ঞেস করলে, ড্রাইভার বললেন, “এনারা আমার বাসের মালিক। তাই আমি নামতে দিইনি।” মিলিটারীরা ‘মালিক’ শুনে আর উচ্চ বাচ্য করলো না। সমস্ত বাস তন্নতন্ন করে তল্লাসী করে সন্তুষ্ট হয়ে গাড়িটি ছেড়ে দিল। এরপর চৌরাস্তা, টংগী এবং কুর্মীটোলাতে বাসে চেক হয়। তবে শুধুমাত্র কুর্মীটোলাতে কড্ডার মত একই রকম কঠিন চেকের সম্মুখীন হতে হলো। কিন্তু সেখানেও মা, ভাই-বোনদের কোন
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৫৫

জবাব দিতে হয়নি। ড্রাইভার যা বলার বলেছেন। ঢাকার গুলিস্তানে পৌঁছার পর যাত্রীরা নেমে গেলে মা, ভাই-বোন ও নুরুন্নবীসহ অন্যদের নিয়ে বাসটি সোজা নারায়ণগঞ্জের দিকে চলে গেল। টিকাটুলির কাছে বাস থেকে নুরুদ্নবী মা সহ সবাইকে নিয়ে নেমে পড়লো। ভাড়া দিতে গেলে বাস ড্রাইভার ও কন্টাক্টার কোনক্রমেই ভাড়া নিতে রাজী হলেন না। পরে জেনেছি ড্রাইভার ভদ্রলোকের নাম নজর আলী ও কন্টাক্টরের নাম সুশীল রাজবংশী।
মা, ভাই-বোনেরা টিকাটুলী থেকে ১০৩ শরৎ গুপ্ত লেনের বাসার গেল। এই বাসায় আমার বিধবা খালা থাকেন। ২০শে আগষ্ট থেকে ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত কখনও এই সারাহ খালার বাড়ীতে, কখনও ডাঃ শাহাজাদা চৌধুরীর স্ত্রী ডাঃ লায়লার নারায়ণগঞ্জের বাড়ীতে, কখনও তার চাচার বাড়ী চাষাড়ায়। কখনও আবার পাঠান বন্ধু মমতাজ খানের বাড়ীতে মা ও ভাই-বোনেরা কাটিয়েছে, তাদের কোনদিন বিপদে পড়তে হয়নি।

গুজব
আমার গায়ে গুলি লেগেছে, এই খবর কঠোরভাবে গোপন করার চেষ্টা সত্ত্বেও ১৮-১৯শে আগষ্টের মধ্যে তা প্রচার হয়ে গেল। উড়ো খবর যেটুকু পেল, সেই টুকুতেই গোয়েবল্স- এর তত্ত্ব অনুসারে রং মেখে হানাদাররা অপপ্রচারে মাঠে নেমে পড়লো। ১৮ই আগষ্ট টাংগাইলের সর্বত্র হানাদাররা মাইকে বলে বেড়ানো, “কাদের সিদ্দিকী ধলাপাড়ার যুদ্ধে মারা গেছে।” হানাদাররা ও রাজাকাররা এই ভুয়া সংবাদে খুবই উল্লাসিত ও আনন্দিত হলো। দাম্পত্য জীবনের অনেক বছর পর কারো সন্তান জন্মালে অথবা জনপ্রিয় কোন ক্লাব বিশেষ খেলায় জিতলে সমর্থকদের মধ্যে যে আনন্দের বান ডাকে, আমার মৃত্যু সংবাদে তার চাইতেও হাজার গুণ বেশী আনন্দের বান ডাকলো হানাদারদের শিবিরে! তারা মণ মণ মিষ্টি খেল। কিন্তু ১৯শে আগষ্ট হানাদারদের প্রচার যন্ত্র আমার মৃত্যু সংবাদ আর সমর্থন করতে পারলো না। তখন তারা আবার দ্বিতীয়বার ভিন্নভাবে খবরটা পরিবেশন করলো, “পাকিস্তানের দুশমন কাদের সিদ্দিকী তার ডান হাত হারিয়েছে। তার আর যুদ্ধ করার কোন ক্ষমতা নেই। বিনা চিকিৎসায় দু-চার দিনের মধ্যেই মরবে।” ১৭ই আগষ্ট থেকে ২৫শে আগষ্ট পর্যন্ত হানাদারদের নিয়মিত বাহিনী, রাজাকার এবং তাদের সমর্থকদের বিপুল পরিমাণে মিষ্টি খাওয়ার ও খাওয়ানোর জোর প্রতিযোগিতা চলে। তাদের শান্ত্বনা একটাই, প্রধান শত্রু খতম হয়েছে।

ভারতের পথে
১৯শে আগষ্ট মাকে বিদায় জানিয়ে হামিদুল হক ও খোরশেদ আলম আর. ও. কে ডেকে অস্ত্রশস্ত্র নিরাপদ স্থানে রাখার দায়িত্ব দিলাম। মাষ্টার আমজাদের উপর দায়িত্ব পড়লো হাসপাতালের রোগীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, সৈয়দ নুরু, ফারুক আহমেদ ও আনোয়ারকে সমস্ত কাগজ-পত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রেখে, অধ্যাপক রফিক আজাদ, অধ্যাপক মাহবুব সাদিক, অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম, বুলবুল খান মাহবুব, আলী আজগর খান দাউদ, আলী হোসেন, সোহরাব আলী খান আরজু, নুরুল ইসলাম সহ অন্যান্যদের প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়ে কয়েকদিন
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৫৬

নিজেদের গ্রামে গিয়ে থাকতে বলতে হবে। এবং সবশেষে সব কজন কোম্পানী কমান্ডারের কাছে কয়েক দিনের জন্য যুদ্ধ বন্ধ রাখার নির্দেশ পাঠিয়ে তারাও ভারতে চলে আসবে। নির্দেশ দিয়ে ২০শে আগষ্ট সকাল নটায় ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। চলতে চলতে মনটা ব্যথায় কাতর হয়ে উঠলো। হাজার হাজার ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য একাত্ম হয়ে যেভাবে সাহস ও বীরত্বের সাথে হানাদারদের মোকাবেলা করে চলেছে, বাঙালী ভীরু জাতি এ অপবাদ ঘুচাতে যেভাবে শপথে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে এসেছে, সেই প্রিয় সহযোদ্ধা ও একই লক্ষ্যের বন্ধনে আবদ্ধ ভাতৃপ্রতিম জনগণকে ছেড়ে দূরে যেতে মন বেদনায় ভারাক্রান্ত এবং দেহ অবসন্ন হয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু না যেয়েও কোন উপায় নেই। যেতে আমাকে হবেই। অসুস্থ অবস্থায় যুদ্ধ পরিচালনা সম্ভব নয়। মুক্তিবাহিনী যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে তাতে প্রয়োজন পূর্ণ সুস্থতার সাথে আবার মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে সব সময় অবস্থান করে হানাদারদের আঘাতের পর আঘাত হানা। তাই চিকিৎসা ও বন্ধু দেশের সাথে যোগাযোগ সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভারতে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
শুড়ীরচালা থেকে বড়চওনা, তারপর বড়চওনা-সাগরদীঘির রাস্তা ধরে সোজা জোড়দীঘি ছাকেদ আলী চৌধুরী মেম্বারের বাড়ীতে। জোড়দীঘিতেই আজাদ, মিনু ও অন্যান্য কয়েক জনের সাথে দেখা হলো। হামিদ সাহেবের সাথেও এখানে একবার দেখা হয়। হামিদ সাহেব তখন সাগরদীঘি এলাকার রসদ-পত্র নিরাপদ স্থানে রেখে ফিরছিলেন। তাকে ফিরে গিয়ে হাসপাতালের রোগীদের ভালোভাবে দেখতে নির্দেশ দিলাম। জোড়দীঘিতেই খবর পেলাম, হানাদার বাহিনী এদিন বিকাল চারটায় সাগরদীঘি বাজারে এসে উঠেছে। এবং তারা সাগরদীঘি-জোড়দীঘি রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে দক্ষিণে এগিয়ে আসছে। তাই আমাদের ঐ রাস্তা ছেড়ে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। সাগরদীঘি-জোড়দীঘি রাস্তাকে বাঁয়ে ফেলে, গুপ্ত বৃন্দাবন ডাইনে রেখে, সাগরদীঘির দুই মাইল পূর্ব দিয়ে সতেরজন মুক্তিযোদ্ধা সহ বাবা ও ছোট দুই ভাইকে নিয়ে এগিয়ে চললাম।
সাগরদীঘির তিন চার মাইল উত্তর-পূর্বে ইদুলপুরে ২০ তারিখের রাত কাটালাম। ইদুল- পুরে যে বাড়ীতে উঠেছি, বাড়ীর মালিক আমার বক্তৃতা শুনতে কয়েক দিন আগে লহরের বাইদ গিয়েছিলেন, কিন্তু তার পৌছার আগেই সভাশেষ হয়ে যায়, তাই তার আপসোসের অন্ত ছিলনা। আমি যখন তার বাড়ীতে উঠি, তখন তার আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা। প্রচুর আন্তরিকতার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যত্ন করে থাকতে দিলেন।
পরদিন ২১শে আগষ্ট সকাল, আবার উত্তরে রওনা হলাম। আমরা কাঠ বল্লার কাছে পৌঁছলে কমান্ডার মনিরের সাথে দেখা হলো। কমান্ডার মনিরকেও সাথে নিলাম। রসুলপুর ফরেষ্ট অফিসের কাছ দিয়ে ২১ তারিখ রাত নটায় টাংগাইল- ময়মনসিংহ পাকা সড়কের পশ্চিমে এলাম। ময়মনসিংহ-টাংগাইল পাকা সড়ক থেকে তিন মাইল পশ্চিমে দোখলার মাইল খানেক উত্তরে পীরগাছা গ্রামের একটি বাড়ীতে রাত কাটানো ব্যবস্থা হলো। পাশের বানার পাড়া পাকা সেতুর হানাদাররা বলতে গেলে সারারাতই লক্ষ্যহীন ভাবে এদিক-ওদিক গুলি চালালো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৫৭

২২শে আগষ্ট ভোর চারটায় আবার বেরিয়ে পড়লাম। এর আগে আমরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই রাতে পথ চলতাম, কিন্তু আহত হয়ে ভারত পর্যন্ত সমস্ত পথ রাতের পরিবর্তে দিনের বেলায় পাড়ি দিয়েছি। আমার ভয় ছিল, রাতের বেলা চলতে গিয়ে অপরিচিত জায়গায় হঠাৎ করে যদি কোন শত্রু শিবিরে গিয়ে পড়ি। আহত অবস্থায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যে কোন ধরনের সংঘর্ষ এড়াতে চেয়েছি। অচেনা জায়গায় অচেনা হাজার হাজার মানুষ আমার দলকে এল.এম.জি. রাইফেল ও ষ্টেনগান কাঁধে চলতে দেখেছে। শত্রুর গুপ্তচরেরাও দেখেছে। কিন্তু চলন্ত দল মুক্তিবাহিনী অথবা পাকহানাদার বাহিনী তা বুঝে উঠার আগেই আমরা বহুদূর চলে এসেছি৷ ঐ সমস্ত রাস্তায় দিনের বেলায় কোন মুক্তিযোদ্ধা এর আগে অস্ত্র কাঁধে চলাফেরা করেনি। তাই পকিস্তান সমর্থক দাললদেরও খুব একটা সন্দেহ হয়নি। সকাল সাত টার কিছু আগে মধুপুর চাঁদপুরের কাছে একটি জীর্ণ বাড়ীর সামনে এসে বসলাম। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই খুবই ক্লান্ত। আর এক নাগাড়ে হাঁটার কারণে আমার পায়ের ক্ষতের যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেছে হাতেও প্রচণ্ড যন্ত্রণা। এই অবস্থায় হাঁটায় খুব একটা গতি রাখতে পারছিলাম না। এক নাগাড়ে চার-পাঁচ মাইল হাঁটার পরই বসতে হচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ীর সামনে আসতেই বাড়ীর মালিক বেরিয়ে আসেন। বাড়ীর মালিককে অনুরোধ করলাম, “আমাদের জন্য কিছু খাবার ব্যবস্থা করা যাবে?” বাড়ীর মালিক খুবই দরিদ্র, তা সত্ত্বেও একটি মোরগ জবাই করে খাবারের ব্যবস্থা করলেন। খাবার শেষে রওনা হওয়ার সময় বাড়ীর মালিককে কৃতজ্ঞচিত্তে পঁচিশটি টাকা দিলাম। আবার সেই হাঁটা। পাঁচ-ছ’ মাইল পথ হেঁটে চেচুয়ার কাছে একটি ক্রিশ্চিয়ান মিশনারীর সামনে এসে একটু জিরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতি দিলাম। আমারা খুব পিপাসার্ত, মিশনারীদের কাছে পানি চাইলে মিশনের লোকেরা বড় এক চাড়ি ভর্তি করে পানি এনে দিলেন, কিন্তু পানি পান করার কোন পাত্র দিলেন না। তাই বাধ্য হয়ে সবাইকে দু’হাতের আঁচলা ভরে পানি পান করতে হলো। কিছুটা ক্লান্তি ও পিপাসা দূর করে আবার চলা শুরু। পিয়ারপুরের কাছাকাছি এক স্থানে কমাণ্ডার হুমায়ুনের দলে ছ-সাত জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা হলো। তারা আমাদের দেখে বহুদুর থেকে কয়েক রাউণ্ড গুলি ছুঁড়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে ‘হ্যাণ্ডস্ আপ’ ‘হ্যান্ডস্ আপ’, চিৎকার করতে করতে বন্দুক উঁচিয়ে এগিয়ে আসছিল। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের দলের মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম অবস্থায় আমাদের শত্রু মনে করেছিল। অগ্রবর্তী দলের ক্যাপ্টেন মনির চিৎকার করে এগিয়ে আসা ছ-সাত জনকে বললো,“সবাই একসাথে এগিয়ে এলে গুলি করবো। মাত্র একজন এগিয়ে আসুন।” উভয় দলের কাছে উদ্যত স্বয়ংক্রিয় হাতিয়ার। বিন্দুমাত্র ভুল বুঝাবুঝিতে উভয় পক্ষের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। অস্বস্তিকর উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি। ছুটে আসা দলটি আস্তে আস্তে আরো কিছুদূর সামনে এসে যখন বুঝতে পারে, তাদের সামনে হানাদার নয়, মুক্তি বাহিনীরই আর একটি দল, তখন তারা আগের চেয়ে জোরে শ্লোগান দিতে দিতে আমার সামনে এসে হাজির হলো। এই দলে সরিষাবাড়ী বাউসীর নুরু, আনোয়ার-উল-আলম শহীদের চাচাতো ভাই আবদুল করিম, মুক্তাগাছার আবদুস সাত্তার, আবদুর রাজ্জাক ও আরো দু’জন। দলের সাথে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৫৮

পাশের গ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিল। তারই সহায়তায় পিয়ারপুরের পাশে একটি গ্রামে দুপুরের খাবার বিকেলে খাওয়া হলো।
আবদুস সাত্তার ও আব্দুর রাজ্জাককে পথ প্রদর্শক হিসাবে সাথে নিয়ে আমরা উত্তর দিকে চলা শুরু করলাম। পিয়ারপুর রেল সড়ক পার হয়ে দুটি নৌকায় ব্রহ্মপুত্রের উত্তরে চন্দ্রকোনা চরে গিয়ে একটা ভাল বাড়ী দেখে উঠে পড়লাম। বাড়ীর মালিক অত্যন্ত আগ্রহের সাথে রাতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। পাশের গ্রাম বাছুর আগলায় এ, কে, এম, শহীদুল হকের বাড়ী। একবার ভেবেছিলাম তাদের বাড়ী গিয়ে উঠি। কিন্তু আর যেতে হয়নি। পথে বিপদ কিছুনা ঘটলেও দীর্ঘপথ হাঁটার ফলে পায়ের ক্ষতের অবনতি প্রতি মুহূর্তে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এতে সহযোদ্ধারা খুবই বিচলিত হয়ে পড়ে। চন্দ্রকোনা থেকে সীমান্ত তখনো পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে।
২৩শে আগস্ট ভোর পাঁচটায় আবার চলা শুরু হলো। চলার আর বিরাম নেই। রাতটা কোথাও কোনমতে কাটিয়ে আবার শুরু হয় চলা। আমার হাত পায়ের ক্ষতের উত্তরোত্তর অবনতি হচ্ছে। তাই যত তাড়াতাড়ি নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো যায় ততই মঙ্গল। চন্দ্রকোনা থেকে আট-নয় মাইল হেঁটে আমরা একটি বাড়ীর বৈঠকখানায় বসলাম। বাড়ীতে আগের দিন এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল, তাই প্রচুর খিচুড়ী পাওয়া গেল। বাড়ীর লোকেরাও বেশ যত্নসহকারে আমাদের খিচুড়ী খাওয়ালেন। আমরা মুক্তিবাহিনী কিংবা পাক-হানাদার বাহিনী তা তারা বুঝতে পারলেন না। খিচুড়ী খাওয়ার পর আবার শুরু হলো হাঁটা, আমরা আরো সাত-আট মাইল গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হলাম।
তিনদিন আগে রওনা হয়ে ইতিমধ্যে আমরা প্রায় একশ পয়ত্রিশ-চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করে এসেছি। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে আসতে আমাদের সবারই পা টনটন করছে। আমার সাথে বাবা আবদুল আলী সিদ্দিকী, ছোট দুই ভাই বাবুল ও বেল্লাল সিদ্দিকী এবং আঠার জন সহযোদ্ধা। বাবা পিয়ারপুর রেল সড়ক পার হওয়ার পর থেকে আর হাঁটতে পারছেন না। চন্দ্রকোনা চরে এসে তিনি হাল ছেড়ে দেন, তারপরও চন্দ্রকোনা চর থেকে কাশিমগঞ্জ বাজার পর্যন্ত ছয় মাইল পথ পাড়ি দিয়ে অসহায়ের মত মাটিতে বসে পড়লেন। শুরু থেকে তিনি অনেকদূর পিছিয়ে পড়ছিলেন। এতে আমাদের গতি বারে বারে ব্যাহত হচ্ছিল। চন্দ্রকোনা অতিক্রম করেই বাবা আমাকে কাছে ডেকে খুব কাতর স্বরে বললেন, “আর পারি না। তোরা আমাকে এখানে মেরে কবর দিয়ে যা।” পঞ্চান্ন-ছাপান্ন বৎসর বয়সী আমার বাবা পূর্বে অনেকবার আইয়ুব-মোনায়েমের চরম নির্যাতন ভোগ করেছেন। ৬০ থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত আইয়ুব-মোনায়েম-ইয়াহিয়ার সাথে পাঞ্জা লড়তে গিয়ে পাঁচ-ছয় বৎসর পর্যায়ক্রমে জেল খেটেছেন, দিনের পর দিন অনাহারে থেকেছেন কিন্তু কখনও এমনভাবে ভেঙে পড়েন নি। বাবকে বললাম,
— না, আমার পক্ষে আপনাকে হত্যা করা সম্ভব নয়। আর আপনার জন্য কুড়ি জন তরুনের তাজা প্রাণ বিনষ্ট করার জন্য দেরী করতেও পারিনা। আপনার দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ আমাদের সাথে সমান তালে পা মেলাতে হবে। আপনার লজ্জা হওয়া উচিৎ, এখানে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৫৯

আপনার অর্ধেক বয়সী একজনও নেই। তারা যদি হাঁটতে পারে আপনি কেন পারেবেন না? আর আপনি তো বেল্লালের মত দশ-বারো বছরের বাচ্চা নন যে, আপনাকেও কাঁধে তুলে নিতে হবে। বেল্লাল তো ইতিমধ্যেই কাঁধে চড়ে বসেছে, এর পক্ষে যা শোভা পায়, আপনার পক্ষে তা মোটেই শোভা পায় না। আর এটাও ঠিক যে, আপনি মারা গেলে, আপনাকে দাফন-কাফন না করে আমি স্থান ত্যাগ করব না। বাবার পৌরুষ প্রচন্ডভাবে জেগে উঠলো। এরপর তিনি বাকী পনের মাইল রাস্তা বিনা বাক্যে অতিক্রম করলেন, যদিও তাঁর যথেষ্ট কষ্ট হাচ্ছিল এবং তাঁর পা দু’টি অস্বাভাবিক রকম ফুলে গিয়েছিল। এগার-বারো বছরের ছোট ভাই বেল্লাল। তারও অবস্থা বাবার মত। ছোট গোলগাল খুব ফর্সা সুন্দর বাচ্চা ছেলে। সে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হেঁটে কুলোতে পারছে না। তাকে সেই পিয়ারপুর থেকে কাঁধে, কোলে, পিঠে ও হাঁটিয়ে আনা হচ্ছিল। সীমান্ত থেকে পনের-ষোল মাইল দূরে কাশিগঞ্জ নখলার কাছে এসে সে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। সে কাঁধেও বসে থাকতে পারছেনা। এই অবস্থায় কাশিগঞ্জ বাজার পেরিয়ে নৌকাপথে আরো দু’তিন মাইল পাড়ি দিয়ে পিয়ারপাড়া আপগ্রেড স্কুল ঘাটে নৌকা ছেড়ে দিলাম। আমাদের আসার একটু আগে স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছে। তবে স্কুল হোটেলে কিছু ছাত্র ছিল। ছাত্রদের কাছে খাবার চাওয়া মাত্র তারা তাদের জন্য তৈরী রাতের খাবার শুধু ডাল-ভাত সাথে সাথে ব্যবস্থা করলো। এইখানে ক্যাপ্টেন মনিরুল ইসলাম বেল্লালকে আখের একটা টুকরো খেতে দিয়ে বললো, “আমি মন্ত্র জানি। এটার মধ্যে মন্ত্র পড়ে দিয়েছি। এটা খেলে তোমার ব্যথা-বেদনা কিছুই থাকবেনা। দশ-বারো মাইল কি, তুমি এক নাগাড়ে চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল হাঁটতে পারবে।” ক্যাপ্টেন মনিরের মন্ত্রে যারপরনাই কাজ দিল। পিয়ারপাড়া থেকে চলা শুরু করার পর বেল্লাল মাঝে মধ্যে বলল, ‘হ্যাঁ, মনির ভাই, আমার পায়ের ব্যাথা কমে যাচ্ছে। আবার ব্যাথা করলে আপনি আমাকে মন্ত্র পড়ে আর একটা খণ্ড দিয়েন, তাহলে আমাকে আর কাঁধে নিতে হবে না। আমি হেঁটেই যেতে পারব।’ বেল্লালের চাইতে বছর দুয়েকের বড় বাবুল কিন্তু সারা রাস্তাই সহজভাবে হেঁটে চললো।
আমরা গন্তব্যস্থলের খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছি। সীমান্ত আর মাত্র পাঁচ-ছয় মাইল। সন্ধ্যা সমাগত অথচ আমরা কেউ সীমান্তের রাস্তাঘাট চিনিনা, জানিনা। ভরসা শুধু হাতের একটি ম্যাপ, তাও আবার দিক ঠিক করার কম্পাস নেই। পিয়ারপাড়া থেকে মাইল দুই উত্তরে এগুতেই সীমান্তে সারাদিন কাজ করে ফিরে আসা একজন লোকের সাথে দেখা হলো। লোকটির সাথে দেখা হওয়ার পর নানা কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম, সে নকশীর হানাদার ক্যাম্পে বাঙ্কার খুঁড়ে ফিরছে। এই লোকটিই পথ প্রদর্শক হিসাবে উত্তম হবে মনে করে তাকে বললাম, “আমরা নকসী ক্যাম্পে যাচ্ছি। যেহেতু আপনি ক্যাম্পে কাজ করে এসেছেন, সেই হেতু আপনি পথ চেনেন। আমাদের ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে আসুন। আপনাকে আমরা দু’দিনের মজুরী দেব।” লোকটি খুশী মনে পথ দেখিয়ে আগে আগে চলতে লাগলেন। আমরা উত্তরে এগিয়ে চলেছি, চলার ফাঁকে ফাঁকে লোকটিকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করছি,‘নকসী ক্যাম্প এখন কতদূরে কোনদিকে? নকসী ক্যাম্পের পাশে হাতী পাগাড় ক্যাম্প কতদূরে এবং কোন্ দিকে? কড়ইতলী
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৬০

ক্যাম্প কতদূরে। কড়ইতলী ক্যাম্প এখন কোন দিকে হবে?” লোকটি মোটামুটি ঠিক ঠিক তিনটি ক্যাম্পের দিক্ নিশানা দেখিয়ে দিতে সক্ষম হল। সীমান্তের কাছাকাছি এসেছি মনে করে আবার লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, “এবার বলুন তো, নকসী ক্যাম্প এখন কোন দিকে এবং কতদূরে?’ লোকটি উত্তর দিলেন, ‘স্যার এহান থনে খুব বেশী হইলে এক মাইল পুব- উত্তরে’। তারপর তর্জনী দিয়ে দিক নির্দেশ করে বললেন, ‘ঐ দিকে’। আমরা তখনও এগিয়ে চলেছি। এমন সময় সামনের দিক থেকে মেশিনগানের গুলির শব্দ ভেসে এল। গুলির শদ্ধ থেকে হানাদারদের অবস্থান ও দুরত্ব আন্দাজ করে নিলাম। গুলির শব্দ পেয়ে সবাইকে একটা ধান ক্ষেতে বসিয়ে দিলাম। কমান্ডার মনির, কমান্ডার সাইদুর ও রফিকের সাথে পথ প্রদর্শককে দিয়ে বললাম, “আমার মনে হয় ঐ দিক উত্তর। তোমরা মাত্র দশ মিনিট ঐ দিকে যাবে (আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে)। যদি এর মধ্যে দশ বারো হাত পাশ একটি রাস্তা পাও, তা হলে সাথে সাথে ফিরে আসবে। তোমাদের আর এগুবার দরকার হবে না। আর যদি না পাও, তবে দশ মিনিট গিয়ে আশ পাশ লক্ষ্য করে ফিরে আসবে।”
ক্যাপ্টেন মনিরকে আলাদাভাবে ডেকে কানে কানে বলে দিলাম, “সাবধান, লোকটির উপর কঠোর নজর রেখো। এই সময় লোকটি যদি চলে যায়, তাহলে হিতে বিপরীত হবে। ক্যাপ্টেন মনির সহ চারজন উত্তর দিকে গেল। বাকী দলটিকে নিয়ে ধানক্ষেতের ভিতর চুপচাপ বসে আছি। সবার গায়ে দু’তিনটি করে জোঁক ধরেছে। কিন্তু নড়াচড়া বা শব্দ করার কোন উপায় নেই। জোঁকগুলো রক্ত চুষেই চলেছে। নিরাপদ স্থানে ঐ জোক কাউকে ধরলে সে হয়তো লাফিয়ে উঠতো। মৃত্যু যেখানে পায়ে পায়ে সেখানে জোকের ভয়ে ছটফট করার সুযোগ কারো নেই, করছেও না। আমি বার বার আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করে চলেছি, গত তিনদিন যেভাবে কেটেছে সেই ভাবেই যেন গোলাগুলি ছাড়া সীমান্ত অতিক্রম করা যায়। গোলাগুলি হলে, এত কাছে এসেও কেউ না কেউ ছিটকে পড়বে। গোলাগুলি ছাড়া শেষ পথটুকু পাড়ি দিতে পারলেই সব চেয়ে মঙ্গল।
ক্যান্টন মনির সহ চার জনের দলটির দশ মিনিট চলতে হলো না, পাঁচ মিনিটও না, মাত্র এক থেকে দেড় মিনিট পর তারা ফিরে এলো। ওদের ফিরে আসার শব্দ পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। তবে কি সামনে দুশমন আছে? নাকি অন্য কোন ব্যাপার? ক্যাপ্টেন মনির কাছে এসে নীচু গলায় বললো, “স্যার, পাশেই রাস্তা। রাস্তার পাশে একটা শিমুল গাছও আছে।” আমার সমস্ত শঙ্কা কেটে গেল। ঝটপট সকলকে ইশারায় উঠতে বললাম। একটু এগিয়ে আমরা পূব পশ্চিমে চলে যাওয়া সীমান্ত রাস্তা পেরিয়ে গেলাম। এই রাস্তাটা আগে থেকেই চিনতাম। এপ্রিল মাসে একবার এইখানে এসেছিলাম। সীমান্ত রাস্তাটি পার হয়ে দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তি, অবসাদ মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেলাম। দীর্ঘ বিপদ সঙ্কুল রাস্তা অতিক্রমের পুরো সময়টা যে অস্বস্তির কাঁটা বিধছিল, রাস্তা পেরোবার পর সেই বোধ মুহূর্তে উবে গেল। ২০শে আগস্ট ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার সময় যে শঙ্কা ছিল, তার অর্ধেকটা এ সময় কেটে গেল। কারণ ভারত সীমান্ত আর মাত্র কয়েক মিনিটের পথ।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৬১

সীমান্ত সড়ক পার হয়ে চার-পাঁচ মিনিট উত্তরে চলার পর একটি নদীর তীরে পৌঁছলাম। নদীটি আমার আগে থেকে চেনা, নাম বুগাই। বুগাই নদীর পার ঘেঁষেই ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমারেখা। নদী পেয়ে খুবই স্বস্তিবোধ হলো। তবু নদী পার হওয়ার আগে আর একবার নদীর ওপারের খোঁজ-খবর নিতে নদী পারে একটি গারো বাড়ীতে ঢুকলাম। বাড়ীটি পরিত্যক্ত। ছোট ছোট চার-পাঁচটি ঘর নিয়ে বাড়ীটা রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। সহযোদ্ধারা ঝট পট বাড়ীটির তল্লাসী নিল। সাড়া-শব্দ করার কোন সুযোগ নেই। সবই চলছে ইশারায়। প্রয়োজনে কাছে ডেকে খুব নীচু গলায় সব কিছু বুঝতে হচ্ছে। একটু আওয়াজ হলেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সমস্ত বাড়ী তল্লাসী চালিয়ে মাত্র একটি গ্রেনেড পাওয়া গেল। তাও আবার আমাদের কাছে যে গ্রেনেড আছে, হুবহু একই রকম। গ্রেনেডের বেসপ্লেট একেবারে ঢিলা। খালি হাতে মোচড় দিয়ে তা খোলা সম্ভব। এমন একটি গ্রেনেড পেয়ে মনে হলো, এখানে কিছু আগেই হয়তো মুক্তিবাহিনীর অন্য কোন দল আশ্রয় নিয়েছিল।
বুগাই নদীর উত্তর পারের খবর নিতে কমাণ্ডার মনিরুল ইসলাম, কমাণ্ডার হুমায়ূন ও কমাণ্ডার সাইদুরকে পাঠানো হলো। নদীর অপর পারে মুক্তিবাহিনীর কোন শিবির না থাকলে ভারতীয় সেনাবাহিনী কিংবা সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর কোন শিবির আছে কিনা? সব কিছুর তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, যার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করা হবে। ক্যাপ্টেন মনির তার দুই সহযোদ্ধাকে নিয়ে রাত তিনটায় নদী পার হয়ে ভারতের মাটিতে পা রাখল। তারা ডালু বাজারের কাছে একটি পরিত্যক্ত বাড়ীতে একদল মুক্তিযোদ্ধা দেখতে পেল। তাদের কাছে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে, কেন এসেছে, তা জানালো। যথারীতি কথাবার্তা বলে কমাণ্ডার তিন জন আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরে এল। রাতের অন্ধকারেও তাদের থমথমে মুখ স্পষ্ট উপলব্ধি করা যাচ্ছিল। তারা আসতেই জিজ্ঞেস করলাম,
— কি ব্যাপার? ও পাশে কোন মুক্তিবাহিনীর শিবির আছে? ভারতীয় সীমানা কি নদীর ওপারেই?
— মুক্তিবাহিনীও আছে আর ভারতীয় সীমানা নদীর উত্তর পার ঘেঁসেই।
— তবে অমন গম্ভীর হয়ে আছ কেন? কি হয়েছে?
— ওরা আমাদের মুক্তিবাহিনী বলে মনেই করতে চায় না। আমরা গেলে ওরা নাকি আমাদের বেঁধে রাখবে। তারপর সকালে আমাদের পরিচয় নেবে।
— তাতে কি হয়েছে। ওরা যে মুক্তিবাহিনী এ ব্যাপারে তো নিশ্চিত? বেঁধে রাখতে চায় রাখুক না! পরিচয় জানার পর সবই ঠিক হয়ে যাবে। এক রাত যদি আটক করে রাখে তাতে অপমানের কি থাকতে পারে। চল দেরী না করে এখনই আমাদের নদী পার হওয়া উচিত। একে বারে শেষ প্রান্তে এসে বিপদ মাথায় নিয়ে বসে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর আমার প্রচণ্ড জ্বর এসেছে। আমার সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। ১৬ই আগস্ট শরীরে গুলি লেগেছে, তারপরও সব সময় মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি, সহযোদ্ধারা বারে বারে কান্নায় ভেঙে পড়লে অভয়
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৬২

দিয়ে বলেছি, ‘আমার কিছু হয়নি, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ সহযোদ্ধারা যখন দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে ক্লান্ত হয়েছে তখন উৎসাহ দিয়েছি, ‘এই সামান্য পথ আমি আহত হয়ে হাঁটতে পারলে তোমরা পারবেনা। চল, যত তাড়াতাড়ি পাড়ি দেয়া যায় ততই মঙ্গল।’ গুলি লাগার আট দিন পর ২৩ শে আগস্ট রাত সাড়ে তিনটায় পথ চলায় যখন প্রায় শেষ, তখন যন্ত্রনার কাছে হার মানলাম। প্রথম মুখ ফুটে বললাম, ‘আমার খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে, আর সইতে পারছি না। আমার কথায় সহযোদ্ধারা বিচলিত হয়ে উঠে নদী পার হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিল। বাবা ও ছোট দুভাই পথের ক্লান্তিতে মাটিতেই শুয়ে পড়েছে। কয়েকজন সহযোদ্ধা মাটিতে বসে ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়েছে, সবাইকে ডেকে তোলা হলো। অন্ধকারে গায়ে হাত দিয়ে সংখ্যা মেলানো হলো। তারপর আস্তে আস্তে একে একে সবাই নদীতে নেমে পড়লাম।
কয়েক ঘন্টা আগে উজানে, বৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ী নদী এমনিতেই খরস্রোতা। বৃষ্টি হলে স্রোত খরতর হয়। বৃষ্টির পানি পেয়ে বুগাই নদী আরো খরস্রোতা ও বেগবতী হয়েছে। সবকিছু বুঝি তার সাথে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। নদীর পার ঘেঁষে এদিক ওদিক চার পাঁচটা বাস-ট্রাক পড়ে রয়েছে। বাস-ট্রাকগুলো নদী পার করে হয়তো ভারতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তা সফল হয়নি। কারণ নদীর উত্তর পাড় খুবই উঁচু।
ক্যাপ্টেন মনিরুল ইসলাম বেল্লালকে কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে নদী পার হয়ে গেল। নদী পাড় হতে গিয়ে আমাকে নিয়ে ঝামেলা হলো। একে তো ভীষণ খরস্রোত তার উপর আবার বুক অব্দি পানি। সুস্থ শরীরে দুপায়ে সমান জোর দিয়ে ধীরে ধীরে নদী পার হতেও অসুবিধা হচ্ছিল। আমার দুপায়ে সমান জোর নেই। সারাটা রাস্তা খুড়িয়ে এসেছি। কিন্তু খরস্রোতা নদীতে পা রাখতে পারছি না। বারে বারে পা ফসকে যাচ্ছে। কমান্ডার হুমায়ূন ও কমান্ডার সাইদুর দুপাশ থেকে ধরে অনেক কষ্টে আমাকে নিয়ে পার হলো। উত্তর পাড়ে উঠা নিয়ে আবার ঝামেলা বাঁধলো। নদীর উত্তর পাড় দক্ষিণ পাড় থেকে অনেক উঁচু। উত্তর পাড়ে গিয়ে বুক অব্দি পানিতে দাঁড়িয়ে রইলাম। ক্যাপ্টেন মনির, কমান্ডার সাইদুর, কমান্ডার হুমায়ূন, খোকা, দুলাল মিলে বলতে গেলে আমাকে টেনে হিচড়ে পাজাকোলা করে পাড়ে টেনে তুললো। এতে দুই তিনবার আঘাত লেগে ডান পায়ের ক্ষতের বেশ অবনতি ঘটলো। দীর্ঘ পথ হাঁটার কান্তি, তার উপর আবার নদী পার হওয়ার ধকল আমাদের একেবারে কাহিল করে ফেলেছে। সবাই ভিজে গেছি। নদী পার হয়ে সবাই ক্লান্ত দেহে খুব ধীরে ধীরে সীমান্ত অতিক্রম করলাম। সীমান্ত পার হতেই সহকর্মী ও প্রিয়জনদের পিছে ফেলে আসার ব্যাথা আমার বুক দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে চাইলো। পথ চলার উৎকণ্ঠা আমাকে অনেকটা ভুলিয়ে রেখেছিল। চলা সাময়িক বন্ধ। সামান্য নিরাপদ হতেই সহযোদ্ধাদের ফেলে আসার শূন্যতা বেশী করে অনুভব করতে লাগলাম। শূন্য বুক হু হু করছিল, দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল। চোখের পানি মুছতে মুছতে সীমানা পেরোলাম।

ভারতে পদার্পণ
ভারত সীমানার শতেক গজ ভিতরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। ক্যাম্প মানে একদল
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৬৩

মুক্তিযোদ্ধার আবাসস্থল। আমরা ক্যাম্পে হাজির হলাম কিন্তু ক্যাম্পের কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে না দেখে ক্যাপ্টেন মনিরকে বললাম, “কই, কেউ তো কিছু জিজ্ঞেস করছে না। আমাদেরকে চ্যালেঞ্জও করা হলো না। ব্যাপার কি?” ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ আমাদের কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। প্রয়োজনটা যেহেতু আমাদের সেহেতু কেউ আমাদের সম্পর্কে আগ্রহী নয় দেখে নিজেই ভিজে কাপড়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে পাহারারত একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বললাম,
— আপনাদের কমান্ডার কিংবা সহকারী কমান্ডারকে অথবা অন্য কাউকে ডেকে দিন। আমরা বহুদুর থেকে এসেছি। আমাদের একটু থাকবার জায়গা প্রয়োজন।
পাহারারত মুক্তিযোদ্ধাটি শুষ্ক কন্ঠে কোন প্রকারে উচ্চারন করলো,
— এখানে বসে আপনারা অপেক্ষা করুন। সকালের আগে কাউকে ডেকে দেয়া যাবে না। এই সময় টহলরত আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা বললো,
— হ্যাঁ, আপনাদের কথা শুনেছি। একটু আগে তিনজন এসে বলে গেছে। আপনারা পাশে বসে অপেক্ষা করুন। ঘন্টা খানেকের মধ্যে সকাল হয়ে যাবে। তখন আপনাদের জন্য যা করার একটা কিছু করা যাবে।
তাকে খুব বিনীতভাবে বললাম,
— দেখুন, আগস্টের শেষ সপ্তাহ, ঠান্ডাও মোটামুটি পড়ে গেছে। আমরা সবাই ভিজে কাপড়ে, শুধু কয়েকটা কাপড় দিন, যাতে আমরা ভিজা কাপড় গুলো একটু বদলাতে পারি। টহলরত দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধাটির এক কথা,
— না, বদলানোর মত কোন অতিরিক্ত কাপড়-চোপড় আমাদের কাছে নেই। আমরা কিছু করতে পারছি না।
এই সময় ঠিক বুঝা গেল না, কেন ক্যাম্পের কর্তাব্যক্তিটি রাতের ঘুমের আমেজ নষ্ট করে ঘরের বাইরে এলো। বেরিয়ে আসা ভদ্রলোকই যে ক্যাম্পের কমান্ডার তা তার চাল-চলন, হাব-ভাব ও কথাবার্তা থেকে বেশ বুঝা গেল। পূর্বের দুজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে যাও সামান্য সহানুভূতি পেয়েছিলাম এই কর্তাব্যক্তিটির কাছে তাও পাওয়া গেল না। তার প্রতিটি কথা প্রায়শঃ আদেশ সূচক। সে বললো,
— আপনারা ভিতর থেকে এসেছেন, বেশ ভালো। আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। আপনারা ঘন্টা খানেক এই ঘরের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করুন। আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা মূল শিবিরে খবর পাঠাবো।
ক্যাপ্টেন মনিরুল ইসলাম তাকে বললো,
— আমাদের সমস্ত কাপড়-চোপড় ভিজা। আমাদের কিছু শুকনো কাপড় এবং একটু শোবার জায়গা দিন। জিজ্ঞাসাবাদ যা করার তা আপনারা করবেন।
ডালু মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের কমান্ডার মনিরের কথা অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে ‘কাপড়
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৬৪

ভেজা তো আমি কি করবো’ বলে উড়িয়ে দিয়ে আমাদের বার বার সোজা হয়ে লাইনে দাঁড়াতে বললো। কিন্তু তার নির্দেশে কেউ লাইন করে দাঁড়াচ্ছেন না দেখে ধৈর্য্য হারিয়ে গর্জে উঠলো, আপনারা কি পেয়েছেন, বার বার বলছি লাইনে দাঁড়াতে। আপনারা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন না। আপনারা ভেবেছেনটা কি? আমি কমাণ্ডারকে বললাম,
— ইনারা আপনার কথা হয়তো বুঝতে পারেননি। কি করতে হবে বলুন, আমি এদের লাইনে দাঁড়াতে বলছি।
— না, কিছু করতে হবে না, আমি এদের গুণবো।
— বাইশ জন আছে।
এলোমেলো ভাবে থাকা অবস্থাতেও কমাণ্ডার ভদ্রলোক আমার সাথের লোকজনদের কোন রকমে গুণে ফেলেছিল। তার হিসাব তেইশজন। সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। আমাকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,
— আমি দেখছি তেইশজন। আপনি বলছেন বাইশজন। এর মানে কি?
— আপনি ভুল গুণেছেন। আমরা বাইশজন। এর বেশী হলেও বাইশজন।
ক্যাম্পে কমান্ডার বিকারগ্রন্থ রোগীর মত চিৎকার করে উঠলো,
— খেলা পেয়েছেন? আপনারা লাইনে দাঁড়ান। আমি গুণে দেখছি।
এইবার একটু জোরের সাথে ক্যাম্প কমাণ্ডারকে জানিয়ে দিলাম
— না, এরা আপনারা হুকুমে লাইনে দাঁড়াবে না।
এতক্ষণ পর্যন্ত বাবা চুপচাপ ছিলেন। এতটা সময় হয়তো তিনি আগে কখনও চুপ থাকেন নি। তিনি তার স্বমূর্তি ধারণ করলেন। বাবা আবদুল আলী সিদ্দিকী গর্জে উঠলেন,
— বেটা ছেলে, দেখতে পাঁচ্ছ না, আমরা সবাই ভিজে কাপড়ে আছি। তুমি হিসাব মিলাচ্ছ। তুমি আগে আমাদের বসবার জায়গা দাও। শুকনো কাপড় দাও। তারপর তুমি সারারাত ধরে তোমার হিসাব মিলাও। আমাদের কি তুমি চোর-ডাকাত পেয়েছো? আদব-কায়দা জান না? বাড়ীতে অতিথি এলে তার সাথে এমন অভদ্র আচরণ কেউ করে? কে তোমাকে শিক্ষা দিয়েছে। আমি তোমার বাবার বয়সী। তোমার বাপ নেই? তুমি খুব ফটফট করছো।
বাবার কথার মাঝে দুতিনবার পঁচিশ-ছাব্বিশ বৎসর বয়স্ক ক্যাম্প কমান্ডার কথা বলার চেষ্টা করেও বাবার অনর্গল কথার স্রোতে কোন প্রকার বাধা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। হঠাৎ প্রচণ্ড ধমক খেয়ে ক্যাম্প কমাণ্ডার ভদ্রলোক কিছুটা হকচকিয়ে গেল। আমি বাবাকে থামালাম।
— দেখুন, যা বলার আমি বলছি। আপনার এখানে কথা বলা ঠিক না।
— ঠিক নাতো বুঝলাম, তা তুই বেটাছেলেকে বুঝা।
এই সময় একটা মজার ঘটনা ঘটলো। বাবা যখন প্রচণ্ড জোরে ক্যাম্প কমাণ্ডারকে ধম্‌কে চলছেন, তখন ক্যাম্পেরই একজন মুক্তিযোদ্ধা আমার দলের একজন যোদ্ধাকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করে,
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৬৫

— হাতে ব্যান্ডেজ বাধা লোকটি কে?
সহযোদ্ধাটি যখন বললো, উনার নাম কাদের সিদ্দিকী। তখন মুক্তিযোদ্ধাটা ত্বরিৎ তর্করত তার ক্যাম্প কমান্ডারের কাছে গিয়ে পিছন থেকে বার বার টানতে লাগলো আর আস্তে আস্তে ফললো, “স্যার, উনার নাম কাদের সিদ্দিকী, উনার নাম কাদের সিদ্দিকী।”
ক্যাম্প কমাণ্ডার তখনও রেগে আছে। তার সহযোদ্ধা যখন তাকে পিছন থেকে টানছে তখন সে যেন তার সমস্ত রাগ সহযোদ্ধাটির উপর ঝাড়বার সুযোগ পেল। সহযোদ্ধাটি পিছন দিক থেকে টানছেন আর কমাণ্ডার ঝটকা মেরে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। সহযোদ্ধাটি কি বলছে, তার কানে বোধ করি তা যাচ্ছে না। নিরুপায় সহযোদ্ধাটি তার কমাণ্ডারকে জোরে এক হেচকা টানে একটু সরিয়ে নিয়ে বললো, “উনার নাম কাদের সিদ্দিকী।” সাথে সাথে সম্বিত ফিরে এলো। ‘কাদের সিদ্দিকী’ নামটি শোনার সাথে সাথে ক্যাম্প কমাণ্ডারের সমস্ত তর্ক এক নিমিষে বন্ধ হয়ে গেল। জ্বলন্ত আগুনে পানি ঢালার মত সে হঠাৎ করেই নিভে গেল এবং স্যালুট করে ‘স্যার’ সম্বোধন করা শুরু করলো। কমাণ্ডার ভদ্রলোক তদানীন্তন ই. পি. আর. বাহিনীর একজন ল্যান্স নায়েক, নাম আবুল কালাম আজাদ। আমার নাম শুনেই স্যালুট করে বললো, ‘স্যার, আমি আপনার নাম শুনেছি। আমি বুঝতেই পারিনি। মাফ করে দিন, স্যার। বড় ভুল হয়ে গেছে। ‘
মুহুর্তের মধ্যে সবার শোবার ও সামান্য কিছু কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল। আবুল কালাম আজাদ যে ঘরে, যে বিছানায় ছিল, সেখানে শয্যা নিতে আমাকে বারবার অনুরোধ করলো। শুতে যাবার আগে পিয়ারপাড়া থেকে রাস্তা দেখাতে নিয়ে আসা লোকটিকে বুকে চেপে ধরে বললাম,
— দেখুন, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। আমরা কারা তা তো আপনি এখন বুঝতেই পারছেন, আপনি ইচ্ছে করলে কিছু সময় এখানে থাকতে পারেন, ইচ্ছা করলে যেতেও পারেন। আমরা গরীব মানুষ। কি করবাম? পেটের দায়ে পাকিস্তানীগো ক্যাম্পে গিয়া কাম করতে অয়। আমারে অনুমতি করলে আমি এ রাতেই চইল্যা যাইতে চাই। বাড়ীর সবাই খুব চিন্তায় থাকবো। আমি রাতের মধ্যেই বাড়ী পৌইছ্যা যাইতে পারবাম। লোকটির হাতে একটি পঞ্চাশ টাকার নোট তুলে দিয়ে বললাম “দেখুন, ডান হাতে ভীষণ ব্যথা, আমি ডান হাত উঠাতে নামাতে পারি না। তাই বাম হাতে দিচ্ছি। আপনি দয়া করে টাকাটা নিন।” লোকটি যেমন বারে বারে আপত্তি করতে থাকলো, আমিও তেমনি পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম। অবশেষে বহু অনুনয়- বিনয় করে টাকাটা দিয়ে তাঁকে বিদায় জানালাম।
ভোর সাড়ে চারটায় ডালু বাজারের পাশে এক মহাজনের ঘরে একটি চৌকিতে শুয়ে পড়লাম। আমার গায়ে তখন ১০২ ডিগ্রি জ্বর। জ্বরের চাইতেও হাত-পায়ের যন্ত্রণা প্রচণ্ড। আমি ছট্‌ফট্ করছিলাম। না বলতেই খোকা, দুলাল ও সামসু কোথা থেকে গরম পানি এনে কাপড় ভিজিয়ে হাতে-পায়ে ছ্যাক দিতে লাগলো। এতে হাত-পায়ের চিন চিন করা ব্যথা কিছুটা কমে এলো। একটানা ৪০ মাইল চলার ক্লান্তিতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৬৬

আমরা সম্বর্ধিত
ঘুমিয়ে পড়ার একটু পর বারেঙ্গা পাড়া বি. এস. এফ. ক্যাপ্টেন বালজিত সিং ডালুতে আসেন। ক্যাপ্টেন বালজিত সিংকে আমার সংবাদ জানানো হয়েছিল। খবর পাওয়া মাত্র ক্যাপ্টেন বালজিত সিং তাৎক্ষণিক ভাবে তুরা সদর দপ্তরকে জানিয়েছেন। ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ নাকি তিন দিন আগে থেকে অনুমান করেছিলেন, যে কোন মুহুর্তে আমি সীমান্ত অতিক্রম করতে পারি। সেইহেতু মানকাচর থেকে ডাউকি পর্যন্ত আমাদের স্বাগত জানাতে সীমান্ত সতর্ক করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তারা কেউ আমাকে ঠিক সময় ধরতে পারেননি। এইজন্য সামান্য একটু বিড়ম্বনা আমাদের সইতে হয়েছে।
ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ পাক ওয়ারলেসের ইন্টারসেপ্ট করে তারা প্রথম জানতে পারেন, ধলাপাড়ার যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী নিহত হয়েছে। একদিন পরেই তারা আবার খবর পান, ‘না, কাদের সিদ্দিকী নিহত হয়নি, সে ডান হাত ও একটি পা খুইয়েছে। এত খবর ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব প্রাপ্ত মেজর জেনারেল গিল, ব্রিগেডিয়ার সান সিং ও লেঃ কর্নেল প্রিতম সিংকে ভীষণ উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত করে তোলে।
১৮ই আগষ্ট সন্ধ্যায় গৌহাটি সদর দপ্তর থেকে মেজর জেনারেল গিল ব্রিগেডিয়ার সান সিংকে জানান, ‘কাদের সিদ্দিকী আহত হলেও তার হাত-পা কিছু খোয়া যায়নি। তিনি পাকিস্তানীদের সাথে এখনও লড়ে যেতে সক্ষম। উদ্বেগের তেমন কোন কারণ নেই। তবে তিনি যে কোন মূহুর্তে যে কোন স্থান দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারেন। তাকে যেন বীরোচিত মর্যাদায় স্বাগত জানানো হয়। তিনি যে সুস্থ আছেন, ভালো আছেন—এ খবর ইস্টার্ন কমাণ্ডের মি. ইন. সি.লেঃ জেনারেল অরোরা আমাকে জানিয়েছেন এবং খবরটা তিনি আপনাকেও জানাতে বলেছেন। তাই খবর সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। মুক্তিবাহিনীর কেউ কিন্তু ভিতরের এই সমস্ত কিছুই জানতো না। আমি নিজেও না। ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং ডালুতে এসে আমাকে ঘুমন্ত দেখে ফিরে যান। ক্যাপ্টেন বালজিত সিং-এর বার্তা পেয়ে পূর্বাঞ্চলের মুক্তি যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার সানসিং তুরার রওশন আরা ক্যাম্প থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ডালু রওনা হন।
২৪শে আগষ্ট, সকাল ছ’টা ত্রিশ মিনিটে ভারতের মাটিতে প্রথম ঘুম ভাঙলো। আমি যেমন নিরাপদ বোধ করছিলাম, তেমনি পিছনে ফেলে আসা শত শত সহযোদ্ধা ও আমার প্রতি স্নেহ পরায়ন দেশ বাসীর কথা ভেবে অন্তর ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছিল। ঘুম থেকে উঠতেই সহযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন বালজিত সিং-এর আগমনের বার্তা দিল। তৈরী হয়ে নেয়ার জন্য খোকাকে বললাম,
— খোকা, গায়ে গুলি লেগেছে অনেকদিন হয়ে গেল। এর মধ্যে একদিনও স্নান করা হয়নি। আজ তোরা আমাকে একটু স্নান করিয়ে দে না?
দুলাল ও শামসু কেউই রাতে ঘুমোয়নি। ভোর ছটার মধ্যে তারা পানি গরম করে ফেলেছে। তারাও ভাবছিল আমাকে গোসল করানো উচিত। আমার কথায় খোকা যেন নিজের ভাবনার প্রতিধ্বনি শুনতে পেল। আমাদের প্রভাতী চা দেয়া হলো। গরম পানিতে কুলি করে চা
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৬৭

পান করলাম। পাশেই একটি টিউবওয়েলের কাছে দুজন সহযোদ্ধা আমাকে স্নান করাতে নিয়ে গেল। সহযোদ্ধারা কোন প্রকারে গরম পানি ঢেলে স্নান করিয়ে দিল। স্নান সেরে কাপড় চোপড় পড়ে তৈরী হয়ে নিচ্ছি। এমন সময় রাতের সেই কোম্পানী কমাণ্ডার আবুল কালাম আজাদ অধীনস্থ কর্মচারীর মত একটি খাতা নিয়ে দৌঁড়ে এসে বললো, ‘স্যার, আপনি কিছুতেই আমাদের এখানে একবেলা না খেয়ে যেতে পারবেন না। আমি আপনার খবর রাতেই দিয়েছিলাম। ক্যাপ্টেন সাহেব একটু আগে এসেছিলেন। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন বলে আপনাকে আর জাগাননি। উনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে আবার আসবেন।’ এরপর আবুল কালাম আজাদ তার কন্ঠে আর একটু বিনয় ঢেলে দিয়ে বললো, ‘স্যার, এই ভিজিটর খাতায় আপনার নাম কি লিখবো? নাম তো জানি। কিন্তু স্যার র‌্যাঙ্কটা কি? মেজর লিখবো কি স্যার?”
— না ভাই, ক্যাপ্টেন, মেজর, কিছুই লিখতে হবে না। আমার নাম কাদের সিদ্দিকী। আপনি শুধু তাই লিখুন।
সে আরো বিগলিত হয়ে বললো, ‘না, না, স্যার, তা হয় না। আমি কিন্তু অনেকদিন আগে শুনেছিলাম, আপনি মেজর, তারপর নাকি কর্নেলও হয়েছেন, একটু একটু শুনেছি। তাই স্যার, র‌্যাঙ্ক কি লিখবো, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
আসলে সামরিক অথবা আধা-সামরিক বাহিনীর বিচারে একজন ল্যান্স নায়কের কাছে ক্যাপ্টেন, মেজর বা কর্নেল মস্ত বড় ব্যাপার। তাই আবুল কালাম আজাদের অমন দশা হয়েছিল।
এর পরও যখন বললাম, ‘না ভাই, কিছুই লিখতে হবে না। হ্যাঁ, আমার সাথে দুচারজন ক্যাপ্টেন, মেজর কাজ করছেন বটে তবে আমি কিছু নই। আপনি শুধু কাদের সিদ্দিকী লিখুন। “
বারে বারে একই কথা জোর দিয়ে বলা সত্ত্বেও আবুল কালাম আজাদ ভিজিটর বুকে নাম লিখতে সাহসী হলো না। তখন নিজেই বাম হাত বাড়িয়ে তার কাছ থেকে ভিজিটর বুকটি নিয়ে নিলাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মকবুল হোসেন খোকার হাতে খাতাটি তুলে দিয়ে বললাম, ‘তুমি লিখ,
আমি, ডালুর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ২৩শে আগষ্ট রাতে অবস্থান করে তাঁদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে অত্যন্ত খুশী ও যুগ্ধ হয়েছি।
কাদের সিদ্দিকী

আমি নিজেও আবার খোকার লিখা কাদের সিদ্দিকীর উপর স্বাক্ষর করলাম। তবে বাম হাতে। তাই সেই লেখা যদি ভবিষ্যতে দলিল হিসাবে কোনদিন প্রকাশিত হয়, তা হলে কেউ হয়তো বুঝতে পারবেন না যে, আমি নিজে ঐ ভিজিটর বুকে স্বাক্ষর করেছিলাম। ডান হাত গুলিবিদ্ধ হবার পর অন্য হাতে লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। পরিস্থিতির অবসানের সাথে সাথে আবার
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৬৮

পূর্বের মত ডান হাতে লেখা শুরু করি। আমার স্বাক্ষর যারা চিনেন কিংবা দেখেছেন তারা ঐদিনের স্বাক্ষরের সাথে পরবর্তী কালে স্বাক্ষরের কোন মিল খুঁজে পাবেন না।
ভিজিটর বুকে স্বাক্ষর দিয়ে দুলাল, হাকিম ও সাইদুরকে নিয়ে ডালু সীমান্ত পার হয়ে হাতি পাগাড়ের দিকে কিছু দূর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এলাম। বাংলাদেশের জায়গা হলেও স্থানটি তখনও হানাদার মুক্ত। ছ-সাত জন বি. এস. এফ. জওয়ান হাফ-প্যান্ট পরে গেঞ্জি গায়ে এস. এন. আর. কাঁধে আগে আগে বেশ অনেকটা এগিয়ে আবার ফিরে এলেন। বি. এস. এফ. জওয়ানদের আগে আগে যাওয়া এবং ফিরে আসার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। বি. এস. এফ. জওয়ানরা ফিরে আসার পরও ধীরে ধীরে আর একটু দক্ষিণে এগুলাম। সীমান্ত থেকে প্রায় তিনশ গজ ভিতরে মিনিট খানিক এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ফিরতে যাব, এমন সময় পিছনে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসা একটি জীপের জোর ব্রেকের শব্দ পেলাম। দেখলাম, চালকের আসন থেকে একজন ভারতীয় সামরিক অফিসার নামছেন, নেমেই তিনি আমার দিকে হাঁটা ও দৌড়ের মাঝামাঝি গতিতে আসতে লাগলেন। আমিও তখন ফিরে চলেছি আমি পঞ্চাশ গজ এগুতেই সামরিক অফিসারটি প্রায় দুশ গজ এসে গেলেন। সামরিক অফিসারটির কাঁধে ব্রিগেডিয়ারের চিহ্ন দেখে তাকে সামরিক কায়দায় শুধু এটেনশান হয়ে সম্মান প্রদর্শন করব এমনি মুহুর্তে ব্রিগেডিয়ার আমাকে জাপটে ধরলেন। ব্রিগেডিয়ার সান সিং পাঁচফুট সাত- আট ইঞ্চি লম্বা। পঞ্চাশের উর্ধ্ব বয়সের সুন্দর ও বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যের অধিকারী। তিনি ছয় ফুট লম্বা আমাকে জাপটে ধরে তুলে ফেললেন। আমাকে উঁচু করতে হয়তো ব্রিগেডিয়ার সান সিং-এর সামান্য কষ্ট হলো কিন্তু আনন্দ উচ্ছ্বাস ও আবেগের বানে তিনি অনায়াসে বুকে তুলে নিলেন। দুজনেরই চোখে অশ্রু। তবে বেদানায় নয়, আনন্দের। একই উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রাণ, দু’টি দেশ প্রেমিকের মহামিলনের মহান অশ্রু।
মিলিত হবার পর বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার কোন সুযোগই পেলাম না। ব্রিগেডিয়ার সান সিং এককভাবে এক নাগারে বলেই চলেছেন, ‘আমি ১৭ই আগষ্ট থেকে তোমার প্রতিটি কাফ-
কলাপের খবর রেখে চলেছি। তুমি কেমন হবে, দেখতে কেমন, আমি নুরুন্দর নবীর (নুরুন্নবী) কাছ থেকে সব শুনেছি। তাই তোমাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। সারা সীমান্ত তোমার জন্য সতর্ক করে রাখা হয়েছে অথচ কেউ তোমাকে ধরা-ছোয়ার মধ্যে পেল না। এমনিই হয় সত্যিই তুমি যোগ্য গেরিলা নায়ক।’ কথা বলতে বলতে মুক্তিযোদ্ধাদের একরাত্রির আবাসস্থলে এসে গেলাম। বাবা অত্যন্ত পীড়িত অবস্থায় শুয়ে ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার সান সিং তাকে নানাভাবে শাস্ত্রনা দিতে লাগলেন। তার ফোলা হাতে-পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘কষ্ট করে যখন আপনারা এসে পড়েছেন, তখন আপনার এই শারীরিক কষ্ট আর বেশী দিন থাকবে না। আমি এখনই ডাক্তারের ব্যবস্থা করছি।”
এরপর ব্রিগেডিয়ার সান সিং আমাকে বললেন, ‘আমার সঙ্গে দুইটি জীপ আছে। এতে আমরা অনায়াসে আট-দশ জন যেতে পারব। বাকীদের নেয়ার জন্য আর একটা গাড়ী চাই। তুমি
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৬৯

তোমার ইচ্ছামত সাত-আট জনকে নিয়ে দুই জীপে আমার সাথে ভাগাভাগি করে চল। বাকীদের এখনই অন্য গাড়ী এসে নিয়ে যাবে। ব্রিগেডিয়ার সান সিংকে বললাম, ‘এখানকার ক্যাম্প কমাণ্ডার আমাকে প্রাতঃ রাশের নিমন্ত্রণ করেছে। আমি তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করবো বলে কথা দিয়েছি৷ তাই আমাকে কিছু সময় দিতে হবে। ব্রিগেডিয়ার সান সিং বললেন, ‘বেশ তো, তুমি উনার নিমন্ত্রণ রক্ষা করার পরে এসো। আমি তোমার জন্য বারেঙ্গাপাড়া ক্যাম্পে অপেক্ষা করছি। আমি দুটি গাড়ীই রেখে গেলাম এখান থেকে বারেঙ্গা পাড়া মাত্র মাইল খানেক। আমি ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এইটুকু হেঁটে যাবো।”
আবুল কালাম আজাদের খাবার তৈরী হয়ে গেল। খাদ্যের তালিকা সংক্ষিপ্ত, সাদামাটা। ভাত, ডাল ও বিলাতি লাউ ভাজি। আমাদের যে তাড়া আছে তা কমাণ্ডার আজাদ জানে। কারণ ব্রিগেডিয়ার সান সিং এবং আমার কথার সময় সে উপস্থিত ছিল। ভোজন শুরু হলো। ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পরিবেশনে পরম আন্তরিক, মোটা চালের ভাতে গুমা গন্ধ, (ধান কাটার পর ঠিক সময় তা ঝাড়াই বাছাই এবং শুকনো না গেলে চালে একটা গন্ধ হয়। তাকে আমাদের এলাকায় গুমানো বলে) ডাল এবং বিলাতি লাউ ভাজি, এই সামান্য উপকরণের দুর্বলতাকে ম্লান করে দিল। ২০শে আগষ্ট, ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া অব্দি কোথাও কখনো স্বস্তিতে খেতে পারিনি। তাই ডালুর মুক্তিযোদ্ধাদের আন্তরিক আদর-আপ্যায়নে আমি তো বটেই, সমস্ত সহ- যোদ্ধারা ভীষণ খুশী ও মুগ্ধ হলো। সামর্থ্যের বিচার না করে অন্তরের বিচার করলে সাত্যিকার অর্থে এইদিন ডালুর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ ক্লান্ত বীর মুক্তি সৈনিকদের মনপ্রাণ কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল।
খাবার শেষে ব্রিগেডিয়ার সান সিং-এর দু’টি জীপে, একটিতে আমি, বাবা আবদুল আলী সিদ্দিকী, ছোট দুই ভাই বাবুল ও বেল্লাল, এবং আবদুল হালিম। অন্য জীপে – আরিফ আহমদ দুলাল, মকবুল হোসেন তালুকদার খোকা, সাইদুর রহমান ও সামসুল হক। বাকী সাথীরা হলো- মোতালেব গুর্খা, আবুল কাশেম, মিনু, এন. এ. খান আজাদ, তমছের আলী, ক্যাপ্টেন মনিরুল ইসলাম, মুক্তাগাছার আবদুস সাত্তার, আবদুল কুদ্দুস, আমজাদ হোসেন, রফিক, ভুয়াপুরের দুলাল ও ক্যাপ্টেন হুমায়ূন।
প্রথম জীপের চালক ব্রিগেডিয়ার সান সিং বাবাজী নিজে। সাথে তিন-চার হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের বুকে এঁকে বেঁকে যাওয়া রাস্তা। ব্রিগেডিয়ার সান সিং স্বচ্ছন্দ্যে জীপ চালাচ্ছেন। আমি বাদে জীপের অন্য আরোহীদের বেসামাল অবস্থা। কারণ তারা এর আগে এত উঁচু পাহাড়ে উঠেনি কিংবা পাহাড়ী আঁকাবাকা রাস্তায় গাড়ীতে চড়েনি। তার উপর আবার আগের রাতের ধকল তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আমি বেসামাল হতাম যদি এর আগে কখনও পশ্চিম পাকিস্তানে পাহাড়ী রাস্তাগুলো না দেখতাম। কিছুদিন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে থাকার কারণে কোয়েটা, ডেরা ইসমাইল খান, ইসলামাবাদ, ভাল্লু এই সমস্ত এলাকায় পাহাড়ী রাস্তায় জীপে, বাসে ও অন্য যানে চড়ার সামান্য অভিজ্ঞতা না থাকলে আমিও অস্বস্তিতে পড়তাম। সাড়ে বারটা-পৌনে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৭০

একটার সময় রওশন আরা ক্যাম্পে পৌঁছলাম। মেঘালয়ের তুরাতে ‘রওশন আরা ক্যাম্প’ নামে মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়েছেল। ঢাকার বোন রওশন আরা বুকে মাইন বেঁধে হানাদার বাহিনীর ট্যাঙ্কের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে দশ-বার জন হানাদারবাহী ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিয়েছিল। তার স্মৃতি, সাহস ও উদ্দীপনাকে সমুজ্জ্বল রাখার উদ্দেশ্যেই এই প্রশিক্ষণ এলাকার নামকরণও করা হয়েছে, রওশন আরা নগর।
রওশন আরা ক্যাম্পে পৌঁছবার সাথে সাথে বাবা ও ছোট ভাই সহ আমাকে ব্রিগেডিয়ার সান সিং-এর অফিস কক্ষে সযত্নে নিয়ে যাওয়া হল। সাথের সহযোদ্ধাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে পাশের একটি তাবুতে। ব্রিগেডিয়ার সানসিং-এর তাবুতে নানা কথাবার্তার ফাঁকে পাঁচ ফুট ছ’সাত ইঞ্চি লম্বা, রঙিন চশমা পরা একজন সামরিক অফিসার এলেন। ঘরে ঢুকে যথারীতি সামরিক কায়দায় ব্রিগেডিয়ার সানসিংকে অভিবাদন জানালেন। তার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, ভদ্রলোক বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার। তার মাথার টুপিতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিখ্যাত বাঘ চিহ্ন তখনও শোভা পাঁচ্ছিল। কাঁধে পাক-সামরিক বাহিনীর লেঃ কর্নেলের চিহ্ন। এক পলক দেখে ভদ্রলোকটিকে চিনতে পারলাম না, একটু সময় লাগলো। এই সামরিক নায়ক আর কেউ নন, মুক্তিযুদ্ধের স্বনামধন্য বীর জিয়াউর রহমান। মাত্র কুড়ি দিন আগে উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করে জিয়াউর রহমান নুরুন্নবীর হাতে আমার জন্য যে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়ে ছিলেন, তাতে স্বাক্ষরের জায়গায় ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান বলে উল্লেখ ছিল। তাই লেঃ কর্নেল পদ চিহ্নে ভদ্রলোককে চিনতে একটু কষ্ট হয়। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার সান সিং দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিলে মুহুর্তেই সেই ত্রুটি মিলে গেল। দুইজন একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। তারপর পরস্পর পরস্পরকে প্রচণ্ড জোরে জাপটে ধরে পালাক্রমে দুজনই দুজনকে মাটি থেকে উপরে তুলে ফেললাম। জিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে মূহুর্তে হাত ও পায়ের ব্যথা ও যন্ত্রণা ভুলে গেলাম। এই দিন থেকেই জিয়াউর রহমানের সাথে আমার একটা মর্যাদাপূর্ণ নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে পাশাপাশি বসে ব্রিগেডিয়ার সান সিংয়ের সাথে আবার কথা শুরু হল। তবে এবার আর আমার সাথে না। জিয়াই আবেগে আপ্লুত হয়ে, আমার সম্পর্কে অনবরত কথা বলতে লাগলেন। তার মূল বক্তব্য, ‘আমি এ মুহুর্তে কাদের ভাইকে যেভাবে দেখলাম, তাতে তাঁর সম্পর্কে অতীতের ভাল ভাল যা কিছু শুনেছিলাম মনে হচ্ছে কমই শুনেছি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কাদের ভাইয়ের মতন আর এক জনও হানাদারদের বিরুদ্ধে অমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। কাদের ভাই যে ভাবে হানাদারদের পেটের মধ্যে থেকে, ক্রমাগত আঘাত হেনে চলেছেন, তাতে চূড়ান্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনিই হবেন প্রধান সহায়ক।’
কথার ফাঁকে এক পর্যায়ে খাবার এসে গেল।
ডান হাতে প্রচণ্ড ব্যথা, ব্যথা ও যন্ত্রণার তীব্রতা মাঝে মাঝে আমাকে দুর্বল করে ফেলছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৭১

তিন চার দিনের পথ চলার ক্লান্তিতে ভেঙে না পড়লেও, দুটি ক্ষতই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ডান হাতে ব্যাণ্ডেজ থাকায় বাম হাতে খাবার খেতে হচ্ছিল। এ জন্যে সাত দিন ভালভাবে খেতে পারিনি। আজও পারলাম না। খাবার শেষে সিদ্ধান্ত হল, আমার ভারতে পৌছার কথা তিন- চার দিন চেপে রাখা হবে। ইন্টারসেন্টিং বিভাগের সার্বক্ষনিক টাংগাইল সেক্টরের খবর ইন্টারসেপ্ট করতে আলাদা ভাবে নির্দেশ দেয়া হবে। এবং সব সময় আমার দুজন সহকর্মী ইন্টারসেন্টিং রুমে বসে শুধু বেতার সংকেত শুনবে। প্রয়োজনে তারা নোট করে আমাকে জানাবে। আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম, মা ও ভাই-বোন সম্পর্কে। ১৯শে আগষ্ট থেকে পাকিস্তান রেডিওর এমন কোন খবর নেই যা আমি শুনিনি। কিন্তু মা-ভাই- বোনদের সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই। মা-ভাই-বোন নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছেছে কিনা, ভারতে এসে তা জানতে না পেরে ভীষণ উতলা হয়ে পড়েছিলাম। আমি ভারতে চলে এসেছি, এ খবর প্রচারিত হবার সাথে সাথে শত্রুর মনোবল প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যাবে। ঠিক অনুরুপ ভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে মুক্তিবাহিনী। তাই মুক্তিযোদ্ধারা যাতে কিছুটা নিরাপদ স্থানে যাবার অতিরিক্ত সময় পায়, তার জন্যই এই গোপনীয়তা অবলম্বন এবং টাংগাইল এলাকায় কি ঘটছে তা বুঝবার জন্য ‘ইন্টারসেপ্টিং সেকশনে’ দুজন সহযোদ্ধা নিয়োগের ব্যবস্থা।
আমাদের খাওয়ার সময়ের ছোট্ট দুটি ঘটনা। ‘রওশন আরা ক্যাম্পে’ আসার পর, ভারতের রাজপুত ব্যাটেলিয়ন আমার সহ যোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র চাইলে, তারা অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকার করে। তাদের বক্তব্য-
— আমরা কোন ক্রমেই আপনাদের অনুরোধে অস্ত্র ত্যাগ করতে পারি না, করবও না। জনৈক রাজপুত ক্যাপ্টেন ঠাট্টা করে বললেন,
— আপনারা এই দশ বারো জনে আমাদের সাথে লড়াই করবেন? চারিদিকে ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকেও আপনাদের গুলি চালাতে সাহস হবে?
জবাবে ছোট্ট খাটো হালিম ক্যাপ্টেনকে বলে,
— আমরা এর চাইতে আরও একটু বেশী ভয়ঙ্কর ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকে সর্বদা যুদ্ধ করে এসেছি। তাই ঘেরাও আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। আমাদের নেতার আদেশ ছাড়া অস্ত্র
ত্যাগ করব না।
এ কথা শুনে ওখানকার কোয়ার্টার মাষ্টার, গুজরাটী ভদ্রলোক দৌড়ে ব্রিগেডিয়ার সান সিংয়ের অফিসে আসেন এবং সব বৃত্তান্ত খুলে বলেন।
আমি বললাম, ‘এইবার আপনি গিয়ে বলুন, আমি তাদের অস্ত্র দিতে বলেছি।’
এই কথাটুকুতে যে কাজ হবে, কোয়ার্টার মাষ্টার তেমন ভরসা পেলেন না। তবুও সন্দেহাতুর মন নিয়ে ফিরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বলেন, ‘আপনাদের স্যার, আমাদের কাছে অস্ত্র দিয়ে দিতে বলেছেন।
তিনি আরও বললেন, ‘যেহেতু আমরা আপনাদের বন্ধু সেহেতু তিনি আমাকে বিশ্বাস করে, আপনাদের এই কথাটি জানাতে বলেছেন। আশাকরি আপনারাও বিশ্বাস করবেন যে, আমি আপনাদের স্যারের অনুমতি নিয়েই অনুরোধ করছি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৭২

কোয়ার্টার মাষ্টারের অনুরোধের জবাবে মুক্তিযোদ্ধা দলের সিনিয়র কমাণ্ডার মনিরুল ইসলাম কোয়াটার মাষ্টারকে শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি যা বলেছেন, তা কি আমাদের স্যারের নির্দেশ?
— হ্যা।
এর পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র রাজপুত ব্যাটালিয়নের কাছে জমা দিয়ে দেয়। যার প্রতিটি অস্ত্রই দেশে ফেরার পথে তারা নিয়ে এসেছিল।
অস্ত্র জমা নেবার পর, অতিথিদের খুব যত্ন সহকারে খাবারের ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু এখানেও ঘটল আরেক ঘটনা। অতিথিরা খাবার খাচ্ছে না। অতিথিদের বক্তব্য, ‘আমাদের স্যার খেয়েছেন কি? তিনি আমাদের খেতে বলেছেন কি?”
গুজরাটি ভদ্রলোক বোধকরি কিছুটা ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি ছুটে আবার ব্রিগেডিয়ারের তাবুতে এলেন। ‘আবার কি হল’ বলে ব্রিগেডিয়ার প্রশ্ন করলে গুজরাটি মেজর ব্রিগেডিয়ার ও আমাকে গোটা ঘটনা অবহিত করলেন। আমি তাকে বললাম, ‘আপনি তাদের গিয়ে বলুন আমি তাদের খেতে বলেছি।’
মেজর বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘সিদ্দিকী সাহেব এদের কি যে বানিয়েছেন। অস্ত্র চাইলেও স্যার, খেতে দিলেও স্যার। স্যারের অনুমতি ছাড়া এদের কাছে বোধকরি জগতের আর কিছু নেই।
ব্রিগেডিয়ার সানসিং মেজরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এতটা বিশ্বাস আস্থা ও মর্যাদা আছে বলেই এরা চারদিকে শত্রু বেষ্টিত হয়েও সফলতার সাথে লড়াই করতে সক্ষম হয়েছে। এটা দোষনীয় নয়, বরং এটা একটা দুর্লভ সৎগুণ। সহযোদ্ধাদের এই মনোভাব ও বিশ্বাসে আরও উৎসাহিত করুন। এখানেও যারা ট্রেনিং নিচ্ছে, তাদের সামনে এটা তুলে ধরুন যে, শত্রুর মাঝখানে থেকে যারা লড়াই করেছেন তারা পরস্পরকে কত ভালবাসেন এবং বিশ্বাস করেন। নেতার প্রতি তাদের কি সীমাহীন আস্থা ও অপরিসীম ভালবাসা।”
ব্রিগেডিয়ার সাহেবের উপদেশ নিয়ে কোয়ার্টার মাষ্টার চলে গেলেন এবং আমরা সবাই দপ্তর থেকে একটু উত্তরে একটি নতুন তাবুতে এলাম। তাবুর ভিতরে ছ’টি খাটিয়ায় সুন্দর বিছানা পাতা, এছাড়া লোহার দু’তিনটি চেয়ার একটি টেবিল। তাঁবুতে পৌঁছে দিয়ে ব্রিগেডিয়ার সান সিং বললেন, “আপনারা ক্লান্ত। এখন আরাম করুন, আমি ডাক্তার পাঠাচ্ছি। সিদ্দিকী, এই যে সামনে তাঁবু রয়েছে এই তাবুর ক্যাপ্টেন ‘কর’ তোমার লোককে ইন্টারসেপ্টিং রুমে নিয়ে যাবে এবং যত রকম সাহায্যের দরকার, সে করবে। এছাড়া প্রয়োজন বোধে কোয়ার্টার মাষ্টার অথবা ব্রিগেড মেজর মুখার্জিকে খবর দিলেই তারা চলে আসবেন এবং তোমাকে সাহায্য করবেন।”
ব্রিগেডিয়ার সানসিং চলে গেলে বাবা একটি খাটিয়ায় এলিয়ে পড়লেন। জিয়াউর রহমান তার পাশের খাটিয়ায় বসে বাবার হাত-পা নিজের বাবার মত টিপে দিতে লাগলেন। জিয়াউর রহমান এখানে ভিন্নরুপে আবির্ভূত, তার এই আলাদা চরিত্র ও অকৃত্রিম সেবামূলক আচরণ দেখে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৭৩

আমরা সকলে অভিভূত হলাম। বেশ কিছুক্ষন বাবার সাথে কথা বলে তিনি আমার পাশে এসে বসলেন। জিয়াউর রহমান বললেন ‘কাদের ভাই, আমি মিলিটারী মানুষ, কি ভাষায় আপনার বীরত্বের প্রশংসা করব, তা আমার জানা নেই। আমাকে একজন সামরিক অফিসার ভেবে আপনি দ্বিধা করবেন না। আপনি যে শক্তি ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তাতে আপনি আমাদের নেতা। যে পরামর্শ দেবেন, যা বললেন, তাই আদেশ হিসাবে আমরা মেনে নেব।’
আমি জিয়াউর রহমানের হাত চেপে ধরে বললাম, “দেখুন, আপনিও আমার কাছে স্বপ্নপুরীর রাজপুত্রের মত বহু আকাঙ্খিত। কেন এই সমস্ত কথা বলে আমাকে ছোট করছেন? বেঙ্গল রেজিমেন্টে আপনার মতো লোক ছিল বলেই তো এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করা সম্ভব হয়েছে। আপনার অবস্থান আমার চাইতে হাজার হাজার গুণ নয়, লাখো লাখো গুণ উপরে। আদেশ-নির্দেশের প্রশ্ন নয়। পারস্পিরিক আস্থা, বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের সাথে কাজ করতে পারলেই যথেষ্ট।”
আমার কথায় অত্যন্ত খুশী হয়ে জিয়াউর রহমান বললেন, “কাদের ভাই, আগেই বলেছি, মিলিটারী মানুষ তাই ভাষার মালা গাঁথতে জানিনা। আমি আপনার কথাগুলোই আন্তরিক ভাবে বলার চেষ্টা করেছি। হয়তো পারিনি। আমি আপনার সথে বন্ধুর মতো কাজ করতে চাই। এরপর যখন যা বলবেন, আমি তা বন্ধুর মতো গ্রহণ করব।”
বহু আলোচনার পর জিয়াউর রহমান প্রথম দিনের মত বিদায় নিলেন। এরপর তিনি প্রতিদিন দুপুরে আমার তাঁবুতে এসেছেন এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি ও কলাকৌশল নিয়ে হাজারো আলোচনা ও পরিকল্পনা করেছেন।
তিনদিন হলো তুরার রওশন আরা ক্যাম্পে এসেছি। অথচ একটি কাক-পক্ষীও জানেনা। কে এসেছে, কেন এসেছে। তবুও তিন হাজার প্রশিক্ষনরত মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে একটি গুঞ্জরন উঠেছে, ‘ক্যাম্পে বড় সড় ভি.আই.পি. ধরনের কেউ নিশ্চয়ই এসেছেন। এ ধরনের গুজরণের বা অনুমানের কারণও ছিল। আমাকে যে তাঁবুতে থাকতে দেয়া হয়েছে, তার নাম ভি. আই. পি. টেন্ট। মানে ওখানে শুধু ভি. আই. পি.রাই উঠেন। আমি আসার আগে আসাম সরকারের কৃষি মন্ত্রী এ তাবুতে রাত কাটিয়েছেন। দু’দিন আগে অন্য দুজন মন্ত্রী রাত কাটিয়ে গেছেন। এ রকম অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের অবস্থানের কারণে এটা ভি. আই. পি. টেস্ট নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। আমার দলের অন্য সদস্যদেরও তাঁবু থেকে বাইরে বেরুতে নিষেধ করা হয়েছিল। ২৬শে আগষ্ট নিজে ইন্টারসেন্টিং রুমে গিয়ে প্রায় দুঘন্টা কাটালাম। আমার ইন্টারসেন্টিং রুমে যাওয়ার মূল কারণ, এইদিন সকাল নটা থেকে শুধু টাংগাইলের উপর শত্রুর খবর ধরা পড়ছিল। ইন্টারসেন্টিং রুমের স্পীকারগুলোতে অনবরত ভেসে আসছিল, “আমাদের পজিশন ঝনঝনিয়ার কাছে, কিন্তু ফুলকির দিক থেকে দুষ্কৃতিকারীরা আমাদের উপর গোলা নিক্ষেপ করছে। আমরা তিন ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ করেও তাদের বিরত করতে পারছিনা। শত্রুর সংখ্যা হাজারের নীচে নয়। আমারা এখন কি করব, নির্দেশ পাঠাও।’ পাশের আর একটি সেটে অনুরুপ চিৎকার, ‘আমরা
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৭৪

পাথরঘাটা থেকে ফেরার পথে বড়দামের কাছে আক্রান্ত হয়েছি। দুষ্কৃতিকারীরা মাঝে মধ্যে চুরাগুপ্তা আঘাত হানছে। দেওপাড়া মরিচার কাছে তিনশ’ জন দুষ্কৃতিকারী ধরা পড়েছে। মুহূর্ত না পেরোতেই আর একটি খবর, ‘আমরা সতের-আঠার বছরের একটি যুবককে ধরেছি। অন্য একজন মারা গেছে, নিহতের নাম বাকু। যাকে ধরেছি, তার বাড়ী টাংগাইল। সে দুষ্কৃতকারীদের দলে ছিল। নাম আবুল কালাম। বাকু এবং কালামের নাম শুনে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো।
আগের মেসেজগুলো শুনে আমি আন্দাজ করেছিলাম সহযোদ্ধারা একেবারে অসহায় হয়ে পড়েনি। কিন্তু আবুল কালামের ধরা পড়া এবং বাকুর মরার সংবাদ আমার বুকের পাজর ভেঙে দিল। আবুল কালাম আজাদ ও বাকু গ্রেনেড গ্রুপে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ঘাটাইল ঘাঁটিতে হানাদারদের রাতের নিদ্রা যারা হারাম করে দিয়েছিল, সেই বাকু শহীদ হলো, আবুল কালাম আজাদ ধরা পড়লো। হানাদারদের হাতে আবুল কালাম আজাদেরও মৃত্যু অবধারিত। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ইন্টারসেন্টিং রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
ঠিক ছিল, শিক্ষানবীশ মুক্তিযোদ্ধারা ২৭শে আগষ্ট বিকালে আমাকে প্রকাশ্যে সম্বর্ধনা জানাবেন। ২৬শে আগষ্ট বিকেল থেকে, সেই প্রস্তুতি চলল পুরোদমে। ২৬শে আগষ্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনটি দিন চলাফেরা করিনি, কোথাও বেরুইনি। বার বার ডাক্তার এসে হাতে পায়ে (অস্পষ্ট) করে গেছেন। ডাক্তারকে বলে রেখেছি, যেদিন বেরুব সেইদিনই এক্স-রে করিয়ে নিবো। ডাক্তার ভদ্রলোকও সানন্দে রাজী হয়েছেন।
সন্ধ্যা উরে যায় যায়, এমন সময় দুটি অভাবনীয় সুসংবাদ এলো। ভারতে এসেই ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে দেখতে চেয়েছিলাম। গণপরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী তখন কলকাতায়। সুর্য ডুবু ডুবু সময় বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকী আমাদের তাঁবু আলো করে প্রবেশ করলেন। তাবুতে ঢুকেই আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেললেন। ৩রা এপ্রিলের এই প্রথম দুভাইয়ের দেখা। আমি আহত হয়েছি, তাও তিনি জানতেন না। বড়ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তুই ভাল আছিস? বেঁচে আছিস? তুই এখানে?” এক নিশ্বাসে আরো কথা। আর দুচোখে অশ্রুর ধারা। হাতের ব্যাণ্ডেজ দেখে বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকীর আশঙ্কা বেড়ে গেলো। আমিও বড় ভাইকে পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “এখনও তো আমরা সবাই ঠিক আছি। কাঁদছেন কেন? আপনি শান্ত হোন। আপনাকে দেখার জন্য এই কদিন মন ছট্‌ফট্ করছিল।”
এরপর আমাকে ছেড়ে বাবাকে জাপটে ধরলেন। পিতা পুত্রের সে কি অঝোরে কান্না। বাবা বললেন, “আরজু। তুই বেঁচে আছিস্। কত রকম গুজব শুনেছি কেউ বলেছে-তুই মরে গেছিস। বলেছে, তোকে মিলিটারীরা ধরে নিয়ে গেছে। কত যে শুনলাম। আজ তোকে পেলাম, আবার তোর মা, রহিমা, শুশু, শানু, আজাদ, মুরাদ, তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ওরা কেমন আছে, জানিনা। পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে ওদের আর রক্ষা থাকবে না।” বাবাকে বললাম, মা ও ভাই বোনেরা ভাল আছে, বড়ভাই এখানে আসার চার-পাঁচ মিনিট আগে আমাকে কলকাতা
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৭৫

থেকে খবর পাঠানো হয়েছে। তারা কোথায় আছে, সে জায়গার নামও আমি জানি। তবে বলব না, আপনি চিন্তা করবেন না। পনের দিনের মধ্যে, মা ভাই-বোন সবার চিঠি ও ছবি আনিয়ে দেব।”
আমার কথা শুনে বাবা শাস্ত হলেন। বড়ভাইও আশ্বস্ত হলেন।
মায়ের জন্যে লতিফ সিদ্দিকীর ভাবনা ছিল খুব বেশী। কারণ শত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রনা ও নিপীড়নের মাঝে আমাদের পরিবারে মা-ই একমাত্র ভরসা। মা তার নয়টি সন্তানকে শত বিপত্তির মাঝেও বাহুতলে আগলে রেখেছে। বড় ভাই ছোট দুই ভাইকে কোলে তুলে নিলেন। তাদেরকে আদর করে চুমু খেয়ে বার বার জিজ্ঞেস করলেন, “তোরা ভালো আছিস? এখানে এসে গেছিস। আর চিন্তা নেই। এখান থেকে আমি তোদের সব ব্যবস্থা করব।”
তাবুতে তখন দুলাল ও হালিম ছিল। ওরাও বড়ভাইকে দেখে আনন্দিত ও অভিভূত হয়ে পড়েছে। ওদের দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বার বার উৎসাহিত করে বললেন, ‘সত্যিই তোরা কাদেরের যোগ্য ভক্ত শিষ্য। তোদের যা দেখে এসেছি, আজও তোরা তাই আছিস্। তোরাই শেষ অব্দি পাক হানাদারদের নাজেহাল করে ছাড়বি, তা ভাবতেই পারিনি। তোদের কখনও মিছিলে পাওয়া যায় নি। তোরা শুধু ডাংগুলি খেলতি, আজ তোরাই সত্যিকার দেশ প্রেমিকের ভূমিকায় অগ্রনী হলি। সত্যিই আমাদের নতুনভাবে শিক্ষা নেয়ার আছে, কেউ অপাংক্তেয় নয়, কেউ ফেলনা নয়।’
লতিফ ভাই কিছুটা শাস্ত হয়ে এলেন। তাঁবুতে অন্যান্য সবাইও কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে৷ ব্রিগেডিয়ার সান সিং অনুমান করতে পেরেছিলেন, ভাই ও পিতা-পুত্রের মিলন হলে কি অবস্থার সৃষ্টি হবে, তাই তিনি আগে থেকেই মিষ্টি ও অন্যান্য খাবার জোগাড় করে রেখেছিলেন। তিনি নিজে ও লেঃ কর্নেল প্রীতম সিং মিষ্টির পাত্র নিয়ে আমাদের তাঁবুতে এলেন। আমরা সবাই মিষ্টি মুখ করলাম।
আমরা সবাই শান্ত, আনন্দিত। এক পর্যায়ে লতিফ সিদ্দিকী বললেন,
— কাদের, আমি খুব তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি। আমার কাছে একটি টাকাও নেই। তুই কয়টা টাকা দিতে পারবি?
— হ্যাঁ, তবে এখন আমার কাছেও কোন টাকা নেই। অন্য তাঁবুতে সাইদুরের কাছে বাংলাদেশের কিছু টাকা আছে।
আমি তখনও জানতাম না, বাংলাদেশের টাকা ভারতে চলে কিনা, চলবে কিনা। বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম,
— আপনার কত টাকা দরকার?
— আমার এখন দু’তিনশ টাকার দরকার। তবে কয়েক হাজার টাকা হলে ভাল হয়।
— তিন-চার হাজার টাকায় হবে কি?
— হ্যাঁ, হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৭৬

এরপর ব্রিগেডিয়ার সান সিং বাবাজীর কাছে তিন হাজার ভারতীয় টাকা চাইলাম। ব্রিগেডিয়ার সান সিং তার অফিসে একটু ক্ষণের জন্যে যেতে অনুরোধ করলেন। অফিসে গেলে সান সিং বললেন, “দেখ, তোমার সম্পর্কে আমরা গত দুই মাস থেকে ভীষণ আগ্রহী। তোমার জন্য এখানে আনুমানিক একটা বাজেট হয়েছে। তা যেভাবে খুশী তুমি খরচ করতে পার, হাত খরচা হিসাবে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতিমাসে পঞ্চাশ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। কাউকে কাউকে আবার কুড়ি-পঁচিশ টাকা বেশী দেয়া হয়। অন্যদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টে যারা আছে, তাদের পুরো বেতন দেয়া হচ্ছে। এই সমস্ত নানা দিক বিবেচনা করে তোমার জন্যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। আমাদের কাছে আনুমানিক একটা হিসাব আছে। এই পর্যন্ত তোমার যোদ্ধাদের সংখ্যা আট হাজার। এই দুমাসের খরচের জন্য তোমার দলের নামে পনের লক্ষ ভারতীয় মুদ্রা জমা আছে। তা তুমি যে কোন সময়, যে কোন ভাবে, খরচ করতে পার।
আমার কাছে ভারতীয় একশ টাকাও নেই। দু এক জনের কাপড় চোপড় কেনা এবং বড়ভাই রিক্ত হস্তে এসেছেন বলে এই মুহূর্তে আমার তিন হাজার টাকা দরকার। আমার জন্য বরাদ্দকৃত টাকা নিয়মিতভাবে গ্রহণ করতে রাজী নই। আমার সহকর্মী যারা এখানে আসবে, তাদের শুধু রাস্তা খরচা নিতে রাজী আছি।
ব্রিগেডিয়ার সানসিং-এর কাছ থেকে ফিরে তিন হাজার টাকা বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর হাতে তুলে দিলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৭৭

রওশন আরা ক্যাম্পে সম্বর্ধনা

২৭শে আগষ্ট। অপরূপা তুরা, মনোরম অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ছোট বড় পর্বতমালা প্রকৃতির বুকে যেন এক শাশ্বত রূপের সম্ভার ছড়িয়ে রয়েছে। শাল বীথিকার অপূর্ব সমারোহে অপরূপ প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের ডালি উপহার দিয়ে আমার মনকে করেছে বিমোহিত। পূব আকাশে সূর্যের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝিক্ ঝিক্ করা শুভ প্রভাতে ঘোষণা করা হলো, আমাদের আগমন বার্তা।
এ সময় টাংগাইলের দুজন গণ-পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ হুমায়ুন ও ফজলুর রহমান খান ফারুক এই প্রশিক্ষণ শিবিরে ছিলেন। আমি শিবিরের কোথায় আছি, জানার জন্য তাঁরা উতলা হয়ে পড়েছিলেন। সকাল দশটায় মাইকে ঘোষণা করা হলো, বিকাল চারটায় টাংগাইল মুক্তিবাহিনীর নেতা কাদের সিদ্দিকীকে রওশন আরা ক্যাম্পের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ ময়দানে আন্তরিক সম্বর্ধনা জানানো হবে। প্রচুর আন্তরিকতা, কিন্তু সাদা মাটা ব্যবস্থা। কোন মঞ্চ নেই। তোরণ নেই, নেই কোন মানপত্র। বুকভরা প্রীতি আর ভালবাসা নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবিরের মুক্তিযোদ্ধারা অধীর আগ্রহে বিকেল চারটার অপেক্ষায় রইলেন। বিকেল চারটার কিছু আগে বাঁশী বেজে উঠলো। সমগ্র শিবিরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ মাঠে এসে সমবেত হলেন। সংখ্যায় তাঁরা আঠারশ। ক্যাম্পে তখন তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ চলছিল। এক মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হচ্ছিল। ২৭শে আগষ্ট প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রায় এক হাজার মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিংয়ের জন্য ক্যাম্পের বাইরে ছিলেন। তাদের অনেকেই অবশ্য পরে এসে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তবুও ২৭শে আগষ্টের সেই সুন্দর অনাড়ম্বর প্রথম সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের অভূতপূর্ব আনন্দ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হন। মুক্তিযোদ্ধারা মাঠের পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তর জুড়ে আট-নয় লাইনে ইউ প্যাটার্নে দাঁড়িয়েছেন। সামনে পশ্চিম মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন গণপরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ, ফজলুর রহমান খান ফারুক, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এবং মিত্র বাহিনীর কর্নেল প্রিতম সিং। বিগ্রেড মেজর মুখার্জী আমাকে তাঁবু থেকে প্রশিক্ষণ মাঠে নিয়ে এলেন। আমি গণ-পরিষদ সদস্যদের সারিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। সামনে মাইক্রোফোন। কর্নেল প্রিতম সিং এগিয়ে গিয়ে শিবিরের পক্ষ থেকে প্রথম আমাদের অভিনন্দিত করলেন। কর্নেল প্রিতম সিং রওশন আরা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত অফিসার। প্রিতম সিং- এর পর রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র আবুল হোসেন সমবেত আঠারশ মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে আমাদেরকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালবাসা জ্ঞাপন করলেন। গণ-পরিষদ সদস্য ফজলুর রহমান খান ফারুক অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি প্রথমে আমার ভূয়সী প্রশংসা করে, বড়ভাই গণ-পরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে কিছু বলতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৭৮

অনুরোধ করলেন। লতিফ সিদ্দিকী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ভাষায় তিন-চার মিনিটের একটি স্মরণীয় বক্তৃতা দিলেন।
তিনি বললেন, ‘যদিও আমি টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিলাম, তবুও আমার ছোট ভাই কাদের সিদ্দিকী যেভাবে তার নেতৃত্বে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ মুক্তি বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, তাতে আমি নির্দ্বিধায় তাকে মুক্তি সংগ্রামে আমারও নেতা হিসাবে স্বীকার করতে গর্ববোধ করছি। আজ আমাদের পালিয়ে বেড়ানোর মনোবৃত্তি ত্যাগ করতে হবে। আমার যা পারিনি, আমাদের ছোট ছোট ভাইয়েরা তা যদি পারে, তাহলে আমাদের আনন্দিত ও গর্বিত হওয়া উচিত। এবং তাদের পূর্ণাঙ্গ ও আন্তরিক সমর্থন করা উচিত। আজ এই ক্যাম্পে কাদের সিদ্দিকীকে যেভাবে সম্মানিত করা হলো, সেই সম্মান বাংলাদেশের ভেতর যুদ্ধরত প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার প্রাপ্য। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিভূ হিসাবে এই সম্মান তাকে দেখানো হলো। আমি আশা করব, কাদের সিদ্দিকী- সহ প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা আমাদের আস্থা, বিশ্বাস ও ভালবাসার পূর্ণ মর্যাদা রক্ষায় সক্ষম হবে। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম জানাই। আর মাগফেরাত কামনা করি তাঁদের, যাদেরকে আমরা আর ফিরে পাবো না।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী, জয় হিন্দ।’

ফজলুর রহমান খান ফারুক একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে গণ-পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ হুমায়ূন খালিদকে বক্তব্য রাখতে আহ্বান জানালেন। ফজলুর রহমান খান ফারুক তার ভাষণে বললেন,
‘বীরত্ব, সাহসিকতা, যুদ্ধনৈপুণ্য এবং সাংগঠনিক শক্তিতে কাদের সিদ্দিকী আমাদের নেতার আসনে আসীন হয়েছে। আমি আস্তরিকভাবে তাকে সমর্থন করছি। আজ আমি কাদের সিদ্দিকীর নাম উচ্চারণ করতে গর্ববোধ করি। যেহেতু আমি তার পূর্ব পরিচিত।’
গণ-পরিষদ সদস্য হুমায়ুন খালিদ সব চাইতে বেশী সময় ধরে অত্যস্ত সহজ ও সাবলীল ভাষায় তার বক্তব্য রাখলেন। তিনি বললেন, ‘যুদ্ধের শুরু থেকে আমি অন্য কোথাও যাইনি। মুক্তিবাহিনীর শিবিরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেছি, এখনও করছি। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা এবং কি কারণে আমরা মুক্তিযোদ্ধা হলাম, লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলাম, এই সমস্ত দিনের পর দিন বলেছি। আজ আমি তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু বলতে পারছি বলে গর্বিত। আমার একটা কিছু বলা মানেই কাদের সিদ্দিকীর মত মহাবীরকে আপনাদের সামনে অভিনন্দিত করতে পারা। কাদের সিদ্দিকীর মত এমনি বীরেরই আমাদের দেশে দরকার। তিনি শত্রুর পেটের ভেতরে থেকে যে সাহস ও শৌর্য-বীর্য্যের পরিচয় দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন, তা সমস্ত মুক্তিযুদ্ধে একটা বিরাট শুভ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আপনাদের, যারা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য দেশমাতৃকার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে এগিয়ে চলেছেন। আমি আপনাদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৭৯

মতই বীর কাদের সিদ্দিকীর কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। আপনাদের পক্ষ থেকে, আমার পক্ষ থেকে, আমাদের সকলের পক্ষ থেকে তাকে এবং তার সহযোদ্ধাদের সংগ্রামী সালাম জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী, জয় হিন্দ।’

গণ-পরিষদ সদস্য ফজলুর রহমান খান ফারুক আমাকে তরুণের স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিবেদিত প্রাণ, মুক্তিবাহিনীর সংগঠক, জননেতা ও বাংলার পরম বীর আখ্যায়িত করে আহ্বান জানালেন। আমি মাথা নিচু করে, ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হাতে খুব ধীর গতিতে মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। আস্তে আস্তে মাথা তুলে সামনে সমবেত সকলের প্রতি দু’বার তাকিয়ে উচ্চারণ করলাম,
“আপনাদের সবার উপর পরম করুনাময় সৃষ্টিকর্তার দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক। উপস্থিত মাননীয় ও সম্মানীত নেতৃবৃন্দ, আমার পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা। আমি আপনাদের থেকে আলাদা কেউ নই। অনেকক্ষণ ধরে শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ এবং আপনাদের মাঝ থেকে আমাকে যে সমস্ত বিশেষণে ভূষিত করেছেন তার একটি বিশেষণের যোগ্যও আমি নই। আমার পাশে যারা দাঁড়িয়ে আছেন। এতকাল আমি তাদের আগে দুচারটি জায়গায় দু’একটি কথা বলেছি। প্রধান বক্তাদের বক্তৃতার পর, অপ্রধান বক্তারা কোনদিনই বক্তৃতা করতে পারে না। আমার নেতা ও বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী, মাননীয় হুমায়ুন খালিদ, শ্রদ্ধেয় ফজলুর রহমান খান ফারুক-এদের মূল্যবান বক্তৃতার পর, আমার কাছ থেকে আপনারা নতুন কিছু আশা করতে পারেন না। তবুও যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের আত্মার শান্তি ও মাগফেরাত কামনা, যারা আহত হয়েছেন তাদের আশু সুস্থতা প্রার্থনা করে, দেশের অভ্যন্তরের দুএকটি সংবাদ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই৷ আজ আমি অত্যন্ত আনন্দিত হতাম, যদি বঙ্গপিতা শেখ মুজিব শত্রুর কারাগারে না থেকে আমাদের মাঝে থাকতেন। বন্ধুগণ, আমি দেখেছি বাংলার গ্রামে গ্রামে প্রতিটি মানুষের মনে হানাদারদের হাত থেকে বন্দী বঙ্গপিতাকে ছিনিয়ে আনার সে কী দুর্বার আকাঙ্খা। বঙ্গবন্ধু আজ শত্রুর শিবিরে বন্দী। এটা একদিকে যেমন আমাদের বুকের পাঁজর ভেঙে দিচ্ছে, তেমনি অন্য দিকে শত্রুর কামান ও গোলার সামনে আমাদের কঠোর, কঠিন ও নির্মম পাহাড়ের মত অটল করেছে। যুদ্ধ করে হানাদরদের বন্দী করে, আমরা যেমন বাংলাদেশকে মুক্ত করব, তেমনি আমাদের নেতা ও পিতা বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করব।
আপনারা জানেন, আমরা বেশ কয়েকটি জায়গায় হানাদারদের সফল ভাবে প্রতিহত করেছি। যারা হানাদারদের হিংস্র চেহারা দেখেছেন, তারা মার খেয়ে পালিয়ে যাওয়া হানাদারদের দেখলে বিস্মিত হতেন। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি, হানাদাররা শুধু মার দেয় না, তারা প্রচণ্ড মার খেয়ে ভেজা বেড়ালের মত পালিয়েও যায়। আজ থেকে মাত্র ষোল দিন আগে আমরা পাক-হানাদার বাহিনীর দু’টি অস্ত্র বোঝাই জাহাজ দখল করে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করেছি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮০

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “ওদেরকে আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব।” বন্ধুরা, আপনারা জানেন বাঙালীদের অনেকে মাছের তেলে মাছ ভাজতে অভ্যস্ত। আমি আপনাদের বলি, আমরাও ওদের অস্ত্র, ওদের বন্দুক দিয়ে ওদেরকে বাংলা ছাড়া করব।
এখানে আপনারা যে ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তা দেখে আশায় আমার বুক ভরে উঠেছে। এর অর্ধেক প্রস্তুতিও যদি দেখতাম, তাতেও আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম। আমরা দেশের ভিতরে যখন লড়াই করেছি, তখন এটা ভেবেই করেছি, হয় মৃত্যু, না হয় মুক্তি। দু’টির একটি আমাদের বেঁছে নিতেই হবে। মহান ভারত আমাদের যেভাবে সাহায্য করছে, এতটা সাহায্য করছেন, তা আমি কল্পনাতেও আনতে পারিনি। আপনারা বিশ্বাস করুন, শুধু বাঙালীদের মারের সামনেই হানাদারেরা বেশীদিন টিকতে পারবে না। এর উপর মহান ভারত যে আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে, তাতে আমাদের স্বাধীনতা সুদূর পরাহত নয়। আমি মহান ভারতকে, মহান ভারতের পঁয়ষট্টি কোটি মানুষকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে সালাম ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আমি মহান ভারতের মহান প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে সালাম জানাচ্ছি। আমি সালাম জানাই বন্ধুপ্রতীম ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। আর নিন্দা করছি, আগ্রসী নীতির ধারক-বাহক পাকিস্তান ও তার সহযোগীদের। সাম্রাজ্যবাদের বিষদাত ভেঙ্গে শোষণহীন সমাজ আমরা গড়বোই। শোষিত মানুষ আমাদের পক্ষে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিটি দেশকে আমি মোবারকবাদ জানাই এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রামে তাঁদের সক্রিয় সমর্থনের জন্য আকুল আহ্বান জানাচ্ছি। বন্ধুগণ, আহত হয়ে আপনাদের কাছে এসে, আপনাদের উষ্ণ সান্নিধ্য পেয়ে যারপর নাই অভিভূত হয়েছি। আমার প্রতি আপনাদের এই অকৃত্রিম ভালবাসা, আমার যুদ্ধ জীবনের প্রধান স্মৃতি হয়ে থাকবে। আপনারা আমার শ্রদ্ধা, সালাম ও নমস্কার গ্রহণ করুণ। আমি আবার শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা ও শান্তি কামনা করছি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী, জয় হিন্দ।”

অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষনা করা হলো। মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করে প্রিতম সিংকে অনুরোধ করলাম, ‘মেহেরবানী করে এদের বলুন, দয়া করে আজ এরা সামরিক নিয়ম-শৃঙ্খলা ছেড়ে আমার সঙ্গে বন্ধুর মত, সাধারণ মানুষের মত মিশুক। লাইনের বাধাবাধি উঠিয়ে দিন।” আমার অনুরোধে প্রীতম সিং আবার মাইক্রোফোনে বললেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের যে কেউ লাইন ছেড়ে সাধারণভাবে মিশতে পারেন। আজ লাইনের কোন দরকার নেই।” মাইকে এই শব্দগুলো উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা হুড়মুড় করে আমার দিকে আসতে থাকেন। আমিও দৌঁড়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এগিয়ে গেলাম। এক মুহুর্তেই আঠার শ’ মুক্তিযোদ্ধা আমাকে ঘিরে ফেলল। কেউ হাত স্পর্শ করছেন, কেউবা পিঠ অথবা মাথা। এত হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে নানা জনে নানা কথা জিজ্ঞেস করছেন। অথচ কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। সবাই এক সাথে কথা বলতে চান। এক সাথে বুক মিলাতে চান। মিনিট খানেকের
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮১

মধ্যে অতি উৎসাহীরা আমাকে কাঁধে তুলে নাচতে শুরু করলেন। এই নাচানাচি, জয়ধ্বনি ও আনন্দ প্রকাশ প্রায় দশ মিনিট ধরে অব্যাহত গতিতে চললো। তারপর তাদের রান্নাঘরের সামনে নিয়ে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিল। ভিড় একটুও কমছেনা দেখে মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের বললাম, এইভাবে একসাথে সকলের সাথে পরিচিত হতে পারবোনা, মিশতে পারবো না, সম্ভবও নয়। আমি আরও বেশ কয়েদিন থাকব। কথা দিচ্ছি, আপনাদের সকলের সাথে এক এক করে কথা বলে তারপর এখান থেকে যাব। আপনাদের যাদের কাজ আছে, তারা ইচ্ছা করলে কাজে যেতে পারেন। এই আশ্বাসের পর ভিড় অনেকটা কমে গেল। ক্যাম্পের সদস্যদের সাথে চা পান করে গণ-পরিষদ সদস্যদের তাঁবুতে গেলাম। এখানে আরো একজন গণ-পরিষদ সদস্যের দেখা পেলাম। ইনি টাংগাইলের গোপালপুর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হাতেম আলী তালুকদার। তালুকদার সাহেব একটু দেরীতে খবর পেয়েছেন বলে ঠিক সময় আসতে পারেন নি। সেই সময় তিনি মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যেতেন না, থাকতেনও না। হুমায়ুন খালিদ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে বললেন, “কত কিছু শুনেছি, আমি প্রতিদিন নামাজ পড়ে বাবা, তোমার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া মাগি। আমি কত শুকরিয়া আদায় করি। তোমাকে পেয়ে আমি এতদিনের ব্যথা ভুলে গেছি। তোমাকে দেখার পর আমার বিশ্বাস হয়েছে, আমরা দেশে ফিরে যেতে পারব।”
ফারুক সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরে বার বার বললেন, “ভাই, তোমার কথা কি করে ভুলি? আমরা চলে এসেছি। তুমি আমার বাড়ীতে আমার বৃদ্ধ বাপ-মায়ের জন্য ঔষধ পাঠিয়েছ। গত তিন মাস ধরে আমার মা-ভাই ও বোনদের জন্য হাত খরচের টাকা পাঠিয়েছ। এটা কি করে সম্ভব হলো? এত ঝড়-ঝঞ্চা ও যুদ্ধের মাঝেও তুমি যে দায়িত্ব পালন করেছো- সত্যিই তুমি ছোট ভাই না হয়ে, বড় ভাই হলে খুশী হতাম। ভাই, তুমি তো চলে এলে। এখন আমাদের অনেকের সংসার ভেসে যাবে।”
হাতেম আলী তালুকদারেরও প্রায় একই কথা। লতিফ সিদ্দিকী এই সময় পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনজন গণ-পরিষদ সদস্যের কথা শুনে তিনি মিটি মিটি হেসে ছিলেন কিনা জানিনা। তবে তুরা ক্যাম্পে তিন জন গণ-পরিষদ সদস্যের কথা যে আন্তরিক ছিল তা তাদের আবেগাপ্লুত কন্ঠ ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে বোঝা যাচ্ছিল।
গণ-পরিষদ সদস্যদের তাবুতে আবার চায়ের ব্যবস্থা হলো। অনেক কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনার পর প্রতিদিন একবার গণ-পরিষদ সদস্যদের সাথে দেখা করবো বলে কথা দিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলাম।
আমার নিজের তাঁবুতে যখন ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যা সাতটা। তাঁবু থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসা, এই গোটা সময়টাই সাইদুর রহমান, মকবুল হোসেন খোকা, আব্দুল হালিম, আরিফ আহমেদ দুলাল ও তমছের আলী আমার পাশে পাশে ছায়ার মতো ছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮২

ছত্রভঙ্গ ও বিশৃঙ্খল মুক্তিবাহিনী পুনর্গঠিত

২০শে আগষ্ট যখন ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম, তখন হেডকোয়ার্টার ও হাসপাতালের সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিরাপদ স্থানে রেখে, ২২শে আগষ্ট, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, ফারুক আহমেদ, সৈয়দ নূরু, আবদুস সবুর খান, ইদ্রিস আলী ও আরও তিন-চার জন ভারতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, আমি ২০শে আগষ্ট শুড়ীরচালা থেকে রওনা হয়ে, ২৩শে আগষ্ট যে রাস্তা ধরে ভারতে প্রবেশ করেছি, এরাও ঠিক দু’দিন পর, কোন কোন স্থানে তিনদিন পর একই রাস্তা দিয়ে ভারতের সীমান্তের নকসী গ্রাম পর্যন্ত যেতে সক্ষম হয়। এমন কি, যে লোকটি রাস্তা দেখিয়ে আমাদেরকে সীমান্ত পার করে দিয়েছিল, সেই লোকটির নাগালও তারা পায়, কিন্তু তবুও তারা সীমান্ত অতিক্রম করে সে যাত্রায় ভারতে যেতে পারেনি।

সীমান্ত থেকে শহীদের প্রত্যাবর্তন
ঘটনাটি ছিল এই রকম, সম্ভবতঃ ২৭শে অথবা ২৮শে আগষ্ট। নকসী গ্রামের একটি বাড়ীতে আনোয়ার উল-আলম-শহীদ তার দল নিয়ে উঠলেন। বাড়ীর মালিক খুব ধনবান। ‘সন্ধ্যা না হলে সীমাস্ত পার হওয়া যাবে না’ বলে গৃহকর্তা তাদের নিশ্চিন্তে থাকতে অনুরোধ করলো। দুর্ভাগ্যক্রমে গৃহকর্তা নকলা থানার শান্তি কমিটির একজন মেম্বার। সে বোধ করি এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায়নি। এমনিতেই পাকিস্তানীদের সাথে তার যেটুকু দহরম মহরম তা আর একটু বাড়িয়ে নেয়ার মানসে সে নিজে গিয়ে মিলিটারী ক্যাম্পে খবর দেয়। বিকেল তিনটার দিকে হঠাৎ বাড়ির পুবদিকে দু’একজন খাকি পোষাকের লোক দেখে পাহারারত একজন মুক্তিযোদ্ধা ছুটে গিয়ে দলপতিকে খবর দিল। উত্তরে পাহারারত মুক্তিযোদ্ধাটিও দৌড়ে এসে অনুরূপ খবর জানালো। আশ্রয় প্রার্থীরা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ও বহুদিনের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, সম্ভবতঃ এটা বুঝতে বাড়িওয়ালার ভুল হয়েছিল। তাই হানাদারদের ক্যাম্পে খবর দিতে যাবার সময় গৃহকর্তা ভাবতেই পারেনি যে, অতিথিরা সাধারণ পোষাকে বাড়ির চারদিকে লোক বসিয়ে রাখবে। মিলিটারীদের এগিয়ে আসতে দেখে, সবুর শহীদ সাহেবদের তাড়াতাড়ি বাড়ির দক্ষিণ— পশ্চিম দিকে সরে যেতে অনুরোধ করে পূব দিকে দৌড়ে গিয়ে মিলিটারীদের উপর এক ঝাঁক গুলি ছুঁড়লো। এতে মিলিটারীরা মাটিতে শুয়ে পড়লো। ইদ্রিসও ছুটে গিয়ে উত্তর দিক থেকে আসা হানাদারদের উপর আচমকা এক ঝাক গুলি ছুঁড়ে আসলো। এ সময় হানাদার বাহিনী প্রচণ্ডভাবে গুলি ছুঁড়তে থাকে। সবুর পশ্চিমে পিছু হটতে হটতে বেশ কিছু গুলি ছোড়ে এবং দু’টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। হানাদারদের দিক থেকে গুলি আসাতে বাড়ির লোকেরা দৌড়ে পশ্চিম ও দক্ষিনে যেতে থাকে। বাড়ির শিশু ও মা-বোনদের আতঙ্ক দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। অথচ সেই
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৩

আতঙ্কের হোতা ঐ বাড়িরই মালিক। শহীদ সাহেব, সবুর, ইদ্রিস তাদের দল নিয়ে বাড়ির লোকজন ও অন্যান্যদের সাথে মিশে আস্তে আস্তে দক্ষিণ পশ্চিমে সরতে থাকে। হানাদাররা খুব সম্ভবত এই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের দৃষ্টি থেকে হারিয়ে ফেলে। কারণ মাইল খানেক দক্ষিণ- পশ্চিমে আসার পর বুক অবধি পানির জন্য মুক্তিযোদ্ধারা আর যেমন দক্ষিণে যেতে পারছিল না, তেমনি পশ্চিমেও না। তাদের কাছে শুধু খোলা ছিল পূব আর উত্তর দিক। তারা বুক অবধি পানির মধ্যে পানার আড়ালে প্রায় ঘন্টা দুই কাটিয়ে দিল। এই সময় হানাদাররা শান্তি কমিটির মেম্বারের বাড়িতে এসে নানাদিকে গোলাগুলি চালিয়ে কাউকে না পেয়ে চলে যায়। কিন্তু অত্যন্ত দূঃখের ব্যাপার, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে একজন হানাদার না মরলেও বাড়ি লক্ষ্য করে ছোড়া হানাদারদের গুলিতে একজন মহিলা সহ দুজন শিশু মারা যায়। হানাদাররা চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা আবার আস্তে আস্তে পূবদিকে এগুতে থাকে। আধ মাইল পূবে এগুনোর পর তারা দক্ষিণে যাওয়ার রাস্তা পেল। এই রাস্তা ধরেই তারা এতটা উত্তরে এসেছে।
বুক সমান পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে, আর উত্তরে নয়, যত অসুবিধাই হোক, আবার দেশের ভেতরে, নিজের চেনা মাটিতে ফিরে যাবে। (যেমনটা আমি এপ্রিল মাসে এই এলাকার কাছাকাছি এসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম) দক্ষিণে যাবার রাস্তা পেয়ে সবুর এবং ইদ্রিস শহীদ সাহেবকে বললো, ‘আপনারা যদি এইখানে একটু অপেক্ষা করেন এবং আমাদের যদি পারমিশন দেন, তাহলে মেম্বারের বাকী ঘরগুলো জ্বালাইয়া ছাই করে দিয়া আহি।’
মেম্বারের বাড়ির দূরত্ব বেশী নয়। আর তখন সন্ধ্যাও হয়ে আসছে। সবুর ও ইদ্রিসকে অনুমতি দিতেই হলো। কারণ তারাই শহীদ সাহেবের একমাত্র ভরসা। বিপদের সময়ও হানাদার সমর্থক দালালদের শায়েস্তা করার অমন ঝুঁকি নেয়া অসীম সাহসী, বীর মুক্তিযোদ্ধা সবুর ও ইদ্রিসের পক্ষেই সম্ভব।
তারা দুজনে মেম্বারের বাড়িতে ঢুকে পড়লো। বাড়িতে জনা দুয়েক কাজের লোক ছাড়া আর কাউকে পাওয়া গেল না। সবুর প্রচণ্ড হাঁক-ডাক শুরু করে বেশ কিছু গুলি চালালো। এই সময় বাড়ির কাজের দুজন লোকও পালিয়ে গেল। সবুর গুনে গুনে চারটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দিল। তার কাছে যেটাকেই মেম্বারের ঘর বলে মনে হলো সেটাতেই আগুন লাগিয়ে দিল। চারটি ঘরই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। তীব্র আগুনের আলোতে পথ দেখে তারা দক্ষিণে চলতে শুরু করল। কাজ শেষ করে তাদের শহীদ সাহেবের কাছ ফিরে যেতে বড়জোর ত্রিশ- চল্লিশ মিনিট লেগেছিল। এতোদিন সীমান্ত এলাকায় দেখা যেতো, হানাদাররা দেশপ্রোমিকদের ঘর বাড়ি জ্বালাচ্ছে-পোড়াচ্ছে। এবার হলো উল্টো-হানাদার সমর্থক দালালদের ঘর-বাড়ি মুক্তি বাহিনীরা পুড়িয়ে দিল।

নকলা থানা দখল
শহীদ সাহেব, সবুর ও ইদ্রিস তাদের দল নিয়ে আবার দক্ষিণে চলতে শুরু করলো। রাত দশটায় নকলা থানা থেকে মাইল তিনেক পুব-দক্ষিণে একটি বাড়িতে তারা আশ্রয় নিল। মধ্য রাতে সে বাড়িতে ভারত থেকে একদল
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৪

মুক্তিযোদ্ধা এসে পৌঁছে। তাদের উদ্দেশ্য নকলা থানা আক্রমণ। ভারত থেকে আগত আরও দু’টি দল ঐ থানা আক্রমণের জন্যে পাশের দু’টি গ্রামে অবস্থান নিয়ে ছিল। নকলা থানা আক্রমণ করা হবে, এই খবর শুনে সবুরও নকলা থানা আক্রমণে অংশ নিতে শহীদ সাহেবের কাছে বায়না ধরলো, ‘স্যার বর্ডারে আইল্যাম একটা পাইটও করলাম না। এখানকার মানুষ আমাগো কথা কি মনে রাখবো। আমি খালি এগোর লগে যামু আর আয়ু।’
রাত একটায় সবুরকে আবার অনুমতি দেয়া হলো। তিন জন সাথী নিয়ে সবুর থানা দখলের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল।
ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের নেতার সাথে সবুর দেখা করলো। সবুর আমার দলের লোক, এ কথা জানতে পেরে দল নেতা খুবই খুশী হলেন। তাদের সাথে অভিযানে অংশ গ্রহনের অভিপ্রায় জানানোর জন্যে সবুরকে বার বার ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘আপনাদের নেতাকে আমি দেখেছি। তাকে আমাদের যারপর নাই ভাল লেগেছে। তার সহকর্মী হিসাবে আপনাকে সাথে পেয়ে আমরা গর্ববোধ করছি। যুদ্ধ করার অনেক অভিজ্ঞতা আপনাদের আছে। আজকের যুদ্ধে আপনি আপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবেন। আমাদের যে ধরনের পরামর্শ দেবেন, সেই পরামর্শের পূর্ণ মর্যাদা দেয়া হবে।
— আমার স্যারও আমাদের আপনাগোর মতন ভালবাসেন, কাম কাইজ দেন। আপনাগোর কথায় আমি খুশী। দেইখেন এই পাইটে আমরা জিতমুই জিতমু।
কখন আক্রমণ করা উচিত, কিভাবে আক্রমণ করা উচিৎ, এই সমস্ত ব্যাপারে সেদিন সবুরের মতামত অনেকাংশে গৃহীত হয়েছিল।
নকলা থানায় মুক্তিবাহিনী রাতে হামলা করেনি, হামলা করল প্রত্যুষে। থানায় পুলিশ ও রাজাকাররা শারীরিক ব্যায়াম করতে শিবির থেকে বেরিয়ে সামান্য একটু দূরে গিয়েছে, ঠিক তখন মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে হামলা চালায়। থানায় রাজাকার পুলিশসহ প্রায় সত্তর আশি জন থাকলেও হামলা চালাবার সময় ছিল মাত্র দশ-বারো জন, এদের মধ্যে জনা চারেক ছিল প্রস্তুত, বাকীরা অপ্রস্তুত। বলতে গেলে বিনা যুদ্ধে ২৮শে আগষ্ট নকলা থানার পতন ঘটলো। এতে একজন পুলিশ নিহত ও দুজন আহত হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হলো প্রচুর অস্ত্র- শস্ত্র। অস্ত্রগুলোর মধ্যে ৩০৩ রাইফেল পঞ্চাশটি, কুড়িটি স্টেন গান, গোটা চারেক রিভলবার ও পিস্তল এবং একটি ব্রিটিশ এল. এম. জি. সহ প্রায় পঁচিশ হাজার নানা ধরনের গুলি। পুলিশ ও রাজাকার মিলিয়ে ত্রিশ জন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হয়। বাকীরা শরীরচর্চার পোষাক নিয়েই পালিয়ে যায়।
শহীদ সাহেব সারারাত উৎকণ্ঠায় কাটালেন। সবুর সকাল সাড়ে সাতটায় ফিরে এলো। তার সে কী আনন্দ! সে যেন দেশ জয় করে ফেলেছে। থানা দখলের পর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে শোনা গেল, কুড়ি-পঁচিশ জনের একটি দল নিয়ে সবুর কাঁটা তারের বেড়া ডিঙিয়ে থানায় প্রথম প্রবেশ করে গুলি চালাতে শুরু করে। গুলি চলেছে এক তরফা। যুদ্ধ বলতে যা বুঝায়, তা
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৫

মোটেই হয়নি; থানার দশ-বারজন পুলিশ এমন আকস্মিক ভাবে আক্রান্ত হয়ে কেউ পায়খানায় কেউ ঘরের পেছনে আবার কেউ বা চৌকির তলায় পালায়। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নেবার সুযোগ তাদের আর হয়নি। থানা দখলে সবুর যত আনন্দিত, ভারত থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধারা ততোধিক আনন্দিত। কারন তারা অন্ধকারেই আবার ভারতে ফিরে যেতে চান। অমন ভাবে বিন্দুমাত্র ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়া এতবড় সফলতা অর্জন করতে পারবেন একথা তারা স্বপ্নেও ভাবেননি। তাই দলের মূল নেতা শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করে তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে সবুরের সাথেই এসেছেন। সামনে এসে তিনি সবুরকে অনুসরণ করে শহীদ সাহেবেকে সামরিক অভিবাদন জানিয়ে পাশে একটি চৌকিতে বসলেন এবং অভিযানে সবুরের সাহস ও যুদ্ধ নৈপুন্যের ভূয়সী প্রশংসা করলেন।
এই কমাণ্ডারের সাথে আমার ২৪শে আগষ্ট ভোরে ডালুতে দেখা হয়েছিল। তবে এই ভদ্রলোক ই. পি. আর. এর ল্যান্স নায়েক আবুল কালাম আজাদ নন, অন্য একজন। কমাণ্ডার ভদ্রলোকের কাছ থেকে শহীদ সাহেব আমার সম্পর্কে সামান্য কিছু খবরা-খবর সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। কমাণ্ডার তাকে অবহিত করেন যে, জনৈক ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার নিজে এসে আমাকে নিয়ে গেছেন, এতে শহীদ সাহেব আন্দাজ করে নেন ভারতেও আমাকে প্রভূত সম্মান করা হচ্ছে। এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই আর নকলার আশে-পাশে থাকা সমীচীন মনে করেনি। ভারতের মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর দিকে, আর শহীদ সাহেবের দল দক্ষিণ দিকে যাত্রা করে।
আনোয়ার-উল-আলম শহীদ তার দল নিয়ে দুপুরের দিকে ব্রহ্মপুত্র নদীর কাইজার চরে এসে উপস্থিত হন। সেখানে থেকে আস্তে আস্তে নানা স্থানে পূর্বের মত সময় কাটাতে কাটাতে ৫ই সেপ্টেম্বর নিজেদের পুরানো ঘাঁটি বড়চওনায় ইদ্রিসের বাড়িতে এসে হাজির হন। তাদের হাতে ছিল আটচল্লিশ হাজার টাকার একটি প্যাকেট। ২০শে আগষ্ট হিসাব-পত্র শেষে, উদ্বৃত্ত টাকা প্যাকেটে পুরে গালা দিয়ে সীলমোহর করা হয়েছিল। টাকার প্যাকেট ইদ্রিসের মায়ের হাতে তুলে দিয়ে শহীদ সাহেব বলেন,
— স্যারের নির্দেশে, হিসাব-পত্র শেষে এই টাকাগুলো আমরা প্যাকেট করেছি। সর্বাধিনায়কের নির্দেশ ছাড়া, এই প্যাকেট আমাদের খোলা উচিৎ নয়। তাই এটা আপনি রেখে দিন। আমরা অন্যভাবে অর্থ সংগ্রহ করে নেব।

বৃদ্ধদের অভিনব কৃতিত্ব
২০শে আগষ্ট আমি ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম। ঐ দিন সাগরদীঘিতে হানাদার বাহিনী ঘাঁটি গেড়েছিল। পাক-সেনারা ঘাটাইল থেকে ধলাপাড়া হয়ে সাগরদীঘিতে আসে। আর একটি টহলদারী দল কালিহাতি থেকে বল্লা হয়ে বহেরাতলীতে এসে ঘাঁটি গাড়ে। দক্ষিণ দিকে আরেকটি দল বাশাইল হয়ে পাথর ঘাটায় ঘাঁটি গাড়ে, অন্য দুটি কোম্পানী কালিয়াকৈর ফুলবাড়িয়া হয়ে হতেয়াতে শিবির স্থাপন করে৷ পুবে ভালুকার দিক থেকে একটি দল ভালুকা বাটাজোরের মাঝে এসে তাদের গতি থামিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৬

দেয়। পুব-উত্তরে আছিম লহরের বাইদের কাছে এসে পাকবাহিনীর আর একটি কলাম অপেক্ষা করতে থাকে। সর্বশেষ দল ময়মনসিংহ থেকে কচুয়া, সাগরদীঘি পাহাড়ী এলাকার রাস্তা ধরে দক্ষিণে এগিয়ে এসে রাঙ্গামাটিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। পশ্চিম দিকেও একটি দল পাহাড়ী এলাকার পাদদেশে মরিচাতে তাদের শিবির স্থাপন করে। এই ভাবে আমার নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর মূল ঘাটির চার দিকে হানাদার বাহিনী সমাবেশ ঘটায়। উদ্দেশ্য একটাই, চতুর্দিকে জাল বিস্তার করে মুক্তিবাহিনীকে ঘিরে ফেলা। এমনি একটি শিকলের মত ঘেরাও দেয়া নিশ্চিদ্র প্রতিরোধ দেওয়াল অতিক্রম করেও কিন্তু সে যাত্রায় মুক্তিযোদ্ধারা বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
পাহাড়ী এলাকার চতুর্দিকে কাজ শেষ হলে ২৪শে আগষ্ট সাগরদীঘি ঘাঁটির প্রায় ছয়শত হানাদার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোক্তার মোহাম্মদের নেতৃত্বে আস্তে আস্তে দক্ষিণে সখীপুরের দিকে এগুতে থাকে। এগুতে এগুতে হানাদাররা রাস্তার আশে-পাশে ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল। একরাত তারা কুতুবপুর হাইস্কুলে কাটায়। পরদিন সকালে বড়চওনার দিকে রওনা হয়। পাক সেনাদের কাছে খবর ছিল, বড়চওনাতে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালি দল আছে, তাই বড়চওনা আসার আগে তারা সিক্স পাউণ্ডারের অসংখ্য গোলা বর্ষণ করে। এতে বড়চওনা স্কুলসহ বেশ কয়েকটি বাড়ির ক্ষতি হয়। বাজারে এসে সাত-আটটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ দলটির এতো জেদ ও গোস্বার কারণ, ধলাপাড়া ও মাকড়াইয়ের যুদ্ধে দু’শ হানাদার মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল। এমনকি ব্যাটেলিয়ানের সহ অধিনায়ক মেজর মোহসিন ধলাপাড়া যুদ্ধে নিহত হয়।
হানাদাররা যখন বড়চওনা বাজারে ও আশে-পাশের ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল, তখন বড়চওনার তিন চার জন বৃদ্ধ একটি দুঃসাহসিক কাণ্ড বাঁধিয়ে বসেন। এদের মধ্যে শুকুর মামুদ ও কান্‌ছা বেপারীও ছিলেন। পাকা দাড়ি ও টুপি মাথায় বৃদ্ধরা ভয় ভীতি ত্যাগ করে সেনা- বাহিনীর সামনে গিয়ে বলেন, ‘আমরা জামাতে ইসলাম ও মুসলীম লীগের লোক, আপনাদের কমাণ্ডার সাহেবের কাছে আমাদের কিছু কথা বলবার আছে। দাড়িওয়ালা টুপি মাথায় মৌলভী গোছের লোকদের দেখে ও তাদের মুখে লম্বা আচ্ছালামু আলাইকুম শুনে জনৈক হাবিলদার তাদেরকে কর্নেল মোক্তার মোহাম্মদের সামনে হাজির করে। পাক সেনাবাহিনীর সদস্য হলেও কর্নেল মোক্তার মোহাম্মদ বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ও ভদ্রলোক। স্থানীয় লোকদের সমাদর করে জিজ্ঞাস করে, ‘আপনারা কি চান?”
– দেখুন, আপনাদের কোন ক্ষয় ক্ষতি হোক, তা আমরা চাইনা। আমরা আন্তরিক ভাবে আপনাদের কল্যাণ কামনা করি। আমরা যে এখানে এসেছি, এটা প্রকাশ পেলে আমাদের জান থাকবে কিনা জানি না। আপনি সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদেরকে আপনাদের দলের ভিতর লুকিয়ে রাখবেন, যাতে আমরা অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে এখান থেকে চলে যেতে পারি। আমরা এখান থেকে বের হচ্ছি, এটা কেউ দেখলে আমাদের মৃত্যু অবধারিত।
— ঠিক আছে অন্ধকার হলেই, আপনারা এখান থেকে যাবেন। এখন বলুন, কি কথা?
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৭

দেখুন কমান্ডার সাহেব, গতকাল রাত দু’টায় এই বাজার মুক্তিবাহিনীতে ভরে গিয়েছিল। আমরা দূর থেকে দেখেছি। সংখ্যা কত, তা বলতে পারবনা। তবে দশ হাজারের নীচে হবেনা। চতুর্দিক থেকে তারা যখন এল আর গেল, তখন তাদের আপনাদের মতন এই সমস্ত (অঙ্গুলি নির্দেশে অস্ত্রগলো দেখিয়ে) অস্ত্র নিয়ে যেতে দেখেছি। এ ছাড়াও কত যে জোয়ালের মতন, মোটা মোটা চোঙ্গার মতন অসংখ্য যন্ত্র আমরা দেখেছি তা আর কি বলব। চাকাওয়ালা চার-পাঁচটি যন্ত্রও ছিল। অত বড় চাকাওয়ালা আট-দশ হাত লম্বা চোঙ্গা লাগানো যন্ত্র আপনাদের কাছে তো দেখতাছিনা।
কমান্ডার ভদ্রলোক ভালো করেই জানে, চাকাওয়ালা চোঙ্গার মতন যন্ত্র কি, আর খালি চোঙ্গার মত যন্ত্রই বা কি? সে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করে,
— আপনারা আর কিছু দেখেছেন? শুনেছেন?
— শুনবো না কেন। তারা যে এখানে মিটিং করেছে, চিৎকার করে বক্তৃতা করেছে। দুই-তিন দিন শুনলাম, কাদের সিদ্দিকীর নাকি গুলি লেগেছে। কিন্তু না তো, কাল রাতে কাদের সিদ্দিকী তো উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বক্তৃতা করল। কাদের সিদ্দিকীকে চিনতে ভুল হবে। এমন হওয়ার জো নেই। তার গলাও আমাদের সকলের পরিচিত। এই যে ইনাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন। আমার ভুল হলেও হতে পারে। ইনারা কি বলেন শুনুন।
বাকিরা সমস্বরে বলে উঠেন, ‘না, না স্যার, আমরা তো ঘরের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনলাম। আর জ্যোৎস্নার আলোতে দেখতেও পেয়েছি। কাদের সিদ্দিকীই বক্তৃতা করেছে। কর্নেল আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তিনি কি বললেন?”
— স্যার, আমরা সেই কথাটিই আপনাকে জানাতে এসেছি। এখানে স্যার সবাই মুক্তিবাহিনী। আমরাই এই দুচার জন পাকিস্তানকে সমর্থন করি। তারা কাল রাতে সভা করে বলেছে, যদি মিলিটারীরা কোন জ্বালাও পোড়াও অত্যাচার না করে এমনিতেই চলে যায়, তা হলে মিলিটারীদের কোন বাধা দেয়া হবেনা। কিন্তু তারা যদি জ্বালাও পোড়াও করে, লোকজন হত্যা করে, তা হলে, একটা মিলিটারীকেও জীবিত ফিরে যেতে দেয়া হবে না। কাদের সিদ্দিকীর এই কথায়, সকলেই হাততালি ও জয়ধ্বনি দিয়ে যার যার মত কোথায় মিলিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। স্যার, আমাদের মনে হয়, মুক্তিবাহিনী আপনাদের সব সময় চোখে চোখে রাখছে।
শেষের কথাগুলো কর্নেলের সম্ভবত বিশ্বাস হয়েছিল। কারণ দীর্ঘ পাঁচ দিন লড়াই করে দু’শ সৈন্য ও সহকারীকে খুইয়ে ধলাপাড়া দখল করেছে। অথচ গত চার দিনে তাদের উপর শত্রুপক্ষের একটি গুলিও আসেনি। সাগর দীঘি আসার পর থেকে কর্ণেল মোক্তার মোহাম্মদের মনে এই সন্দেহ সব সময় ছিল। তারা আস্তে আস্তে শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত হচ্ছে কিনা? বিগত যুদ্ধ গুলোতে মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে। তাই কর্নেলের মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারনা ছিল। স্থানীয় লোকদের কথাবার্তার মধ্যেও সে তার ধারনার কিছুটা মিল খুঁজে পায়। উপরন্তু কাদের সিদ্দিকী তখনও যুদ্ধক্ষেত্রে আছে, তার আহত হওয়ার
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৮

সংবাদও সত্য নয়, এটা শুনে কর্ণেল কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ কাদের সিদ্দিকীর প্রতিরোধ শক্তি সম্পর্কে কর্ণেলের খুব ভালো ধারণা ছিল।
২৫শে আগষ্ট দুপুরে বড়চওনার এই তিন-চার জন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ঐ কথাগুলো যাদু মন্ত্রের মত ফল দিয়েছিল। এর পর হানাদার বাহিনী একটি ঘর বাড়ীও পোড়ায় নি। কাউকে মারধোর করেনি অথবা কারও খাসী মুরগী খাওয়ার লোভ করেনি। ২৫ শে আগষ্ট সন্ধ্যায় বড় চওনা থেকে রওয়ানা হয়ে রাতে তারা সখীপুরে ঘাটি গাড়ে। ২৫শে আগষ্ট সখীপুরে কাটিয়ে ২৭শে আগষ্ট কর্নেল মোক্তার মোহাম্মদ তার দল নিয়ে বহেরতলী হয়ে পাহাড় ত্যাগ করে।
২৬শে আগষ্ট সখিপুরেও ছোট্ট একটি ঘটনা ঘটে। সেখানকার লোকদের যখন কর্ণেল ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করে, ‘আপনাদের এখানে মুক্তিবাহিনী আছে?’ এ প্রশ্নের জবাব দিতেও বৃদ্ধরা অগ্রণী ভূমিকা নেন। তারা বলেন, ‘কি বলুম স্যার। কে যে মুক্তিবাহিনী, আর কে যে মুক্তিবাহিনী না, তা বুঝবার উপায় নাই। পাহাড়ের প্রত্যেক গাছের গোড়ে গোড়ে দুচারটি মুক্তিবাহিনী আছে। তারা যে কোথা থেকে আসে আর কোথায় যায়, কিছু বুঝবার উপায় না।’ অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তারা বললেন, ‘সাহেব যুদ্ধ টুদ্ধ তো দেহি নাই, অস্ত্রশস্ত্রও আমরা চিনি না। এর আগে দোনালা বন্দুক দেখলেই ভয়ে কাপতাম। দোনালা বন্দুক দিয়া বাঘ মারন যায়। মুক্তি বাহিনীর কাছে কত রকমের যে বন্দুক আছে তার হিসাব আমরা দিতে পারুম না। যাদের দেহি হের কান্ধেই ছাগলের ঠ্যাং ওয়ালা একটি কি যত্নর। মোটা মোটা চোঙ্গার মতন কি জানি কান্ধে নিয়া যায়। আর গরুর গাড়ীর চাকার মতন লাগাইন্যা লম্বা চোঙ্গাওয়ালা ওটা কি? তাতো স্যার আমরা জীবনে দেহি নাই। স্যার, বোধ হয় এহনও মুক্তিবাহিনী আশেপাশেই আছে।’
সাগরদীঘি থেকে বড়চওনা, কচুয়া, সখীপুর ও বহেরতলী হয়ে হানাদার বাহিনী টাংগাইল প্রত্যাবর্তন করলো। প্রত্যাবর্তনের সময় পাহাড়ের মুক্তিবাহিনী সদর দফতর তাদের রাস্তা থেকে বড়জোর পাঁচ ছয় মাইল দূরে ছিল। তাই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, মুক্তিবাহিনীর হেড কোয়ার্টারের এত কাছে এসেও কেন হানাদাররা সরে গেল। এর কারণ অনুসন্ধান করলে আপাতত দুটি জবাব পাওয়া খায়, প্রথমতঃ তারা হয়তো ভাবতেই পারেনি মুক্তিবাহিনীর কোনও সুসংগঠিত হেড- কোয়ার্টার আছে, মুক্তিযোদ্ধারা ছোট ছোট দলে বিচ্ছিন্ন হয়ে হামলা চালায়। অথবা কোন জায়গায় যে মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর, তার সঠিক সন্ধান তাদের জানা ছিল না। দ্বিতীয়তঃ এটাও হতে পারে, গভীর জঙ্গলে থাকায় আরও ভিতরে প্রবেশ করা তারা সমীচীন মনে করেনি। রণ কৌশলের দিক থেকে এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা হানাদারদের পক্ষে যেমন অসুবিধাজনক ছিল, তেমনি মুক্তিবাহিনীর আঘাত করার ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের কোন সুনিশ্চিত ধারনা বা অভিজ্ঞতা ছিল না। উপরন্তু স্থানীয় জনসাধারনের কথা শুনে তারা আর অপেক্ষা করার সাহস করতে পারেনি।
২০শে আগষ্ট শুড়ীরচালা থেকে আনোয়ার-উল-আলম শহীদ হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে সবাইকে ডেকে আলোচনা করে পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করে ফেলেন। তিনি হেড-কোয়ার্টারের
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮৯

লোকজনদের ভাগ করে দেন। নুরু, ফারুক, সবুর, ইদ্রিস ও আরো কয়েজনকে তার নিজের দলভূক্ত করেন। আমজাদ, খোরশেদ আলম আর. ও., হামিদুল হক ও আরো কয়েজনকে রসদপত্র ও হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেন। অন্য আরেক দলকে প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়ে কিছু দিন যার যার এলাকায় গিয়ে আত্মগোপন করে থাকার নির্দেশ দেন। শহীদ সাহেব যেমন ভারত সীমান্ত পর্যন্ত এগিয়ে আবার ফিরে আসেন, আমজাদ মাস্টার, খোরশেদ আলম আর. ও., হামিদুল হক ও আউয়াল সিদ্দিকীরা তেমনি অশেষ কষ্ট করে গোলা-বারুদ ও অসুস্থদের নিরাপদে রেখেছিলেন।
২০শে আগষ্ট, তৃতীয় দলে, নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক মাহবুব সাদিক, অধ্যাপক রফিক আজাদ, সোহরাব আলী খান আরজু, আলী হোসেন, আলী আজগর খান দাউদ ও বুলবুল খান মাহবুব হেডকোয়াটার থেকে পশ্চিমে বহেরাতলীর দিকে বেরিয়ে পড়েন। সত্যিকার অর্থে এঁরা কেউই জানেন না, কেন এভাবে হেডকোয়ার্টার গুটিয়ে ফেলা হলো। এঁদের মধ্যে দুএকজন ছিলেন যারা আমার ভারত রওনার সিদ্ধান্তের বিন্দু বিসর্গও জানতেন না। একমাত্র নুরুল ইসলাম ছাড়া প্রায় সবাই নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে বহেরাতলী থেকে আইসড়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বহেরাতলীতে তখনও ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান শক্তভাবে শত্রুর মোকাবেলা করে চলেছিলেন।

শ্বশুড়ের বিয়ে
হেড-কোয়ার্টারের এত বড় দলকে যেতে দেখেও তিনি বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ করেননি। সত্যিকার অর্থে, হেড-কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে যাওয়া এই দলকে মুক্তিবাহিনীর চরম দুঃসময়েও কোন বিপদের মুখে পড়তে হয়নি। হেড-কোয়ার্টারের এই দল বহেরাতলী থেকে নৌকায় ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত হয়ে অনেক রাতে সোহরাব আলী খান আরজুর শ্বশুর বাড়ী পাইকরাতে পৌঁছে। গভীর রাত, ক্ষুধায় তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এতরাতে খাবার মিলবে কিভাবে এই নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। কিন্তু তাদের এই চিন্তা ও দুর্ভাবনায় বেশী সময় কাটাতে হলোনা। সোহরার আলী খান আরজু বাড়ীর ভেতর থেকে ফিরে এসে এক দুর্লভ খবর পরিবেশন করলেন। চমৎকার বিরল খবর। তাঁর শ্বশুর ঐ রাতেই একটি নতুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। প্রচুর লোকজন খাইয়েছেন। তখনও অঢেল খাবার আছে। তাই খাবারের জন্যে আর চিন্তা নেই। সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন দুর্লভ ঘটনা বিরল। বড় মেয়ের জামাই শ্বশুরের নতুন বিয়েতে এমনি করে ভুড়িভোজন করলেন। পরদিন দলটি কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। মাহবুব সাদিক, রফিক আজাদ ও বুলবুল খান আইসড়া, আলী হোসেন তার গ্রামের বাড়ী দাপনাজোড়, আলী আজগর খান দাউদ তার ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ী তারটিয়া-ভুক্তা ও নুরুল ইসলাম ভুয়াপুরের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন।
মুক্তিবাহিনীতে সর্বোদয় গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব বলে খ্যাত নুরুল ইসলাম পাইকরা থেকে শোলাকুড়া, পালিমা হয়ে ভুয়াপুরের উপর দিয়ে শ্বশুয়ার চরে এনায়েত করিম ও মোয়াজ্জেম হোসেন খানের সাথে ২২শে আগষ্ট মিলিত হয়ে ২৪শে আগষ্ট ভোরে মানকাচর পৌঁছেন। আমি
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯০

নুরুল ইসলামের খবর প্রথম পাই, মধুপুরের রসুলপুরের কাছে। একজন স্বাধীনতা প্রেমিক আমাদের সমর্থক জানায়, ২১ তারিখে দুপুরে নূরুল ইসলামকে ভুয়াপুরের উপর দিয়ে উত্তর— পশ্চিমে যেতে দেখা গেছে এবং তাকে কয়েকজন রাজাকার পথ দেখিয়ে এগিয়ে দিয়েছে। পরে ভারতে নুরুল ইসলামের কাছে আমি নিজেও এ কথা শুনেছি। শোলাকুড়া পুল থেকে দুজন রাজাকার তাকে ভুয়াপুরের রামপুর ঘাট পর্যন্ত নিরাপদে এগিয়ে দিয়েছিল।
অন্যদিকে সোহরাব আলী খান আরজু, দাউদ খান কোনক্রমে তাদের গ্রামে ও আশ পাশে ঘোরাফেরা করে পনের-কুড়ি দিন কাটিয়ে আবার সুসংগঠিত হেডকোয়ার্টারে তাঁদের কাজে যোগ দেন।
বুলবুল খান মাহবুব, রফিক আজাদ, মাহবুব সাদিক এঁরা তিনজন কয়েকদিন একত্রে থেকে মিলিটারীর ভয়ে এগ্রাম-সেগ্রাম দৌড়াদৌড়ি করেন। তিরযে মিলিটারী এসেছে খবর শুনে জশিহাটিতে গিয়ে তারা আত্মগোপন করেন। জশিহাটিতেই তারা আলাদা হওয়ার পরিকল্পনা নেন। রফিক আজাদ চলে যান ঢাকাতে, বুলবুল খান মাহবুব ময়থার দুর্দান্ত সাহসী যুবক মুক্তার আলীর সহায়তায় একটি ছোট্ট ডিঙি নৌকা নিয়ে অনেক কষ্টে তার গ্রামের বাড়ী দিঘলকান্দি চলে যেতে সক্ষম হন। রফিক আজাদ স্বাধীনতার শেষ মুহুর্তে আবার মুক্তিবাহিনীতে এসে কাজে যোগ দেন। কিন্তু বুলবুল খান মাহবুব ও মাহবুব সাদিক আক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আবার তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করা শুরু করেন।
আগষ্টের বিপর্যয়ে মুক্তিবাহিনীর বিশেষ কোন ক্ষতি হয়নি। তবুও এই বিপর্যয়ের সময় আমার নির্দেশ ঠিক সময়ে না পৌঁছার কারণে দু’একটি কোম্পানীকে কিছুটা বিপদে পড়তে হয়। এর মধ্যে কাপ্টেন ফজলুর রহমান ২৩ তারিখ পর্যন্ত তার বহেরাতলী ডিফেন্স অটুট রেখেছিলেন। ২৩ তারিখে যখন তার কাছে আমার নির্দেশ পৌঁছে, তখন তাঁর ঘাটি ছেড়ে নিরাপদে সরে পড়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তবু তিনি দুর্দান্ত সফলতার সাথে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। অন্যদিকে পাথরঘাটা, ফুলবাড়িয়া, হতেয়ার কোম্পানীদের বিলম্বে খবর পাওয়ার কারণে তাদের কিছুটা কষ্টভোগ করতে হয়েছিল। কিন্তু সফল ভাবেই মুক্তিবাহিনী এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে।

সাংগঠনিক সভা
৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল। আনোয়ার-উল-আলম শহীদ সিদ্ধান্ত নেন, তারা আবার বিশৃঙ্খল মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করতে চেষ্টা করবেন। এই সময় ডাঃ শাহজাদা চৌধুরী ও নুরুন্নবী ভারতে না গিয়ে ঢাকা থেকে আবার পাহাড়ী এলাকায় ফিরে আসেন। ৭ই সেপ্টেম্বরে তারাও শহীদ সাহেবের সাথে মিলিত হন। শহীদ সাহেব হামিদুল হক, খোরশেদ আলম. আর. ও., সরোয়ার, লাল্টু, লতিফ ও নবী নেওয়াজকে নিয়ে এক বৈঠকে বসেন। ঐ বেঠকে শহীদ সাহেব বলেন, “আমি ভারতে গিয়েছিলাম। সর্বাধিনায়ক আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। উনি ২০শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরবেন। আমাদেরকে উনি এই
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯১

সময়টা মোটামুটি চালিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।” শহীদ সাহেবের কথা নুরুন্নবী, শাহজাদা চৌধুরী, হামিদুল হক ও আর. ও. সাহেব সহ সবাই বিশ্বাস করে ঐক্যমত পোষন করেন। কারণ আসল খবর সবুর, ইদ্রিস, নূরু, ফারুক ও আরও কয়েকজন সহযোদ্ধা ছাড়া আর কেউ জানতো না। কমাণ্ডারগণ আনুগত্য প্রকাশ করলে শহীদ সাহেব আমার স্বাক্ষর যুক্ত সাইক্লোস্টাইল করা এক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেন। তাতে জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই বলে আহ্বান জানানো হয়, ‘আমি এখন শারিরীক দিক থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ। শত্রুদের আঘাত করার ক্ষমতা আমার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আমি চাই, মুক্তিযোদ্ধারা যেমন সুসংগঠিত হয়ে ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে শত্রুর ঘাটিতে আঘাত হানুক, তেমনি জনগণও তাদের আন্তরিক ভাবে সহযোগিতা এবং সমর্থন করুন। আমি আর এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত সফর শেষ করে ইন্‌শাল্লাহ্ আপনাদের মাঝে হাজির হব।
১ই সেপ্টেম্বর প্রচারিত এই বিজ্ঞপ্তি বিদ্যুৎ গতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এতে আলাদিনের আশ্চর্য্য প্রদীপের চাইতে বিস্ময়কর ফল ফলতে শুরু করে। কমাণ্ডার মতি, কমাণ্ডার মোকাদ্দেস, কমাণ্ডার লতিফ সবাই আনুগত্য জানায়। নবী নেওয়াজ, কমাণ্ডার লালটু ও সরোয়ারকে যথাক্রমে লহরের বাইদ ও রাংগামাটি, আফসার মেম্বার কে পূর্বাঞ্চলের ভালুকা, মল্লিক বাড়ী ও ফুলবাড়ীয়া, কমাণ্ডার হবি ও ইউনুসকে হতেয়া, কমাণ্ডার মতিকে পাথরঘাটা, ইদ্রিস ও মোকাদ্দেসকে দিয়ে বহেরাতলীতে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু মাত্র ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান, তার ছোট ভাই মোহাম্মদ মুসা ও রবিউল আলম সহ দুচার জনের আনুগত্য পেতে অপেক্ষা করতে হয়। তবে মোহাম্মদ মুসার অনুগত্যে চিড় ধরলেও ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান ও রবিউলের আনুগত্য ছিল নিটোল ও নির্ভেজাল। কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির কারণে ফজলুর রহমান ও রবিউলের সাথে অল্প সময় হেডকোয়ার্টারের সামান্য টানা পোড়ন চলেছিল।
২২ থেকে ৩০শে আগস্টের মধ্যে ছত্রভঙ্গ মুক্তিবাহিনীর দুএকটি অংশ আস্তে আস্তে চরম বিশৃংখল অবস্থায় পতিত হয়। তারা কোন কোন স্থানে এমন ন্যাক্কার জনক ঘটনা ঘটিয়ে ছিল, যার কাছে পাক হানাদাররাও হার মেনেছিল। কিন্তু ১৫ থেকে ২১শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনী আবার তাদের সমস্ত দুর্বলতা, বিশৃংখলা কাটিয়ে উঠে পূর্বের সুসংহত ও সুশৃংখল এবং জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত হয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯২

ভারতে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির

এদিকে ২৮শে আগস্ট মেজর জেনারেল গিল আমার সাথে দ্বিতীয়বার আলোচনার জন্য মেঘালয়ের তুরায় এলেন। ২৫শে আগস্ট তিনি প্রথম এসেছিলেন। ২৮শে আগস্ট আমাদের তিনশ জনের একটি দল ডালু সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করলো। এই দলের নেতৃত্বে ছিল মেজর আব্দুল হাকিম। ওদিকে নুরুল ইসলাম, এনায়েত করিম ও অন্যান্য কয়েকজন যে মানকাচরে আছে –এই সংবাদ ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ২৭শে আগস্ট বিকেলে দিলেন। মেজর জেনারেল গিলের দ্বিতীয় দফা আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল দুটিঃ এক, আমাকে বুঝে নেয়া, আমার নেতৃত্ব সম্পর্কে জানা এবং আমি কতটা কার্যকর সে ব্যাপারে ধারণা নেয়া। দুই, পরবর্তী পরিকল্পনা কি ধরনের হবে এবং ইতিমধ্যেই আমার যে সব সহযোদ্ধারা ভারতে আসতে শুরু করেছে, তাদের কি ব্যবস্থা করা হবে।
২৮শে আগস্টের আলোচনায় জেনারেল গিলকে পরিষ্কারভাবে জনিয়ে দিলাম, ‘সুস্থ হলেই আমি দেশে ফিরতে চাই। এ সময় পর্যন্ত যে সব সহকর্মীরা ভারতে আসবে, তাদের আলাদা ক্যাম্পে বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হয়।’ আমার অনুরোধে ২৮শে আগস্ট বিকেল থেকে রওশন আরা ক্যাম্পের আধমাইল পূব-উত্তরে সহযোদ্ধাদের জন্য আলাদাভাবে শিবির তৈরীর কাজ শুরু হলো। ক্যাম্প তৈরী মানে, জঙ্গল পরিষ্কার আর তাবু খাটানো।
২১শে আগস্টের মধ্যে ক্যাম্পের প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে গেল। রওশন আরা ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা যে আন্তরিকতা ও মমতা নিয়ে নতুন ক্যাম্প তৈরীতে সাহায্য করেন তা শুধু অতুলনীয়ই নয়, অভূতপূর্বও। ২১শে আগস্ট সন্ধ্যায় হাকিম ও বেনুর নেতৃত্বে চারশ মুক্তি যোদ্ধাকে ডালু সীমান্ত থেকে ক্যাম্পে আনা হলো। এইবার আর কারো কাছে তাদের হাতিয়ার জমা দিতে হলোনা কেননা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হিসাব নিকাশ দেয়ার কোন বালাই নেই। পুরোপুরি মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব প্রশাসন এখানে চালু হলো।
২৭শে আগস্ট থেকে ১০ই সেপ্টেম্বর, এ চৌদ্দ দিন আমার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের যেন ভারতে আসার একটা প্লাবন শুরু হয়েছিল। এই দুসপ্তাহে প্রায় তেইশ-চব্বিশশ’ মুক্তিযোদ্ধা ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে। আমাদের ক্যাম্পের প্রশিক্ষণের ধরন ছিল আলাদা, রওশন আরা ক্যাম্পের মত নিয়ম কানুনের বালাই নেই। আমাদের কথা হলো দেশের অভ্যন্তরে, যুদ্ধের ময়দানে, প্যারেডে কোন কাজ হবেনা। আমি চাই, প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা সুন্দরভাবে হাতিয়ার ব্যবহার করতে শিখুক, যাতে অব্যর্থ লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে। আমার এই বক্তব্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ ভাবে অনুধাবন করেন। নতুন শিবিরে একে অন্যের সাথে পরিচিত হওয়া, অতীত যুদ্ধের বর্ণনা এবং যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে ডেমোনেস্ট্রেশান, তাত্ত্বিক ক্লাশ নেয়া এবং যারা তেমন কোন
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৩

যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি, তাদের অস্ত্রবহন, অবস্থান নেয়ার কলাকৌশল শেখানো হতে থাকে। অনেককে আবার ২ ইঞ্চি ইঞ্চি মর্টার ও হাত বোমা ছোঁড়া এবং বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হলো।
৩০শে আগস্ট বারেঙ্গা পাড়া গেলাম। বারেঙ্গা পাড়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। রওশন আরা ক্যাম্পের মত এখানেও আমার সাথে মিলিত হতে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করলাম। তবে ব্যতিক্রম শুধু একজন, জহুরুল হক। যদিও সে আমার সাথে কোলাকুলি করলো, কথা বললো কিন্তু তার মধ্যে কোন প্রাণ চাঞ্চল্য ও আগ্রহের ভাব লক্ষ্য করলাম না।

মানকাচরে সহযোদ্ধাদের সাথে
পরদিন ৩১শে আগস্ট জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্সের হেডকোয়ার্টার তেলঢালা ক্যাম্পে গেলাম। ক্যাম্পে জিয়াউর রহমান, মেজর শাফায়াত জামিল, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন অলি আহমদের সাথে দুপুরের খাবার খেলাম। জিয়া ছাড়া অন্যদের সাথে এই প্রথম পরিচিত হলাম। এরপর জিয়ার ক্যাম্প থেকে মানকাচরে এলাম। মানকাচরে কামাখ্যা মন্দির ও মোগল সেনাপতি মীর জুমলা খানের কবর দেখলাম। এখানেই ফ্লাইট লেফ্‌টন্যান্ট মাহমুদুল্লাহর সাথে প্রথম দেখা হল।
মানকাচরে বি. এস. এফ. প্রধান মেজর বিন্দার সিং আমাদের স্বাগত জানালেন। বিন্দার সিং-ই আমাকে শিবিরে নিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে মানকাচরে আমার নেতৃত্বাধীন তিন-চারশ সহযোদ্ধা এসে হাজির হয়েছিল। অনেকদিন পর ভারতের মাটিতে আমাকে কাছে পেয়ে ম্রিয়মান রণক্লান্ত মুক্তিসেনারা আনন্দে উতলা হয়ে উঠলো। নুরুল ইসলাম হানাদার বাহিনীর চোখে ধূলো দিয়ে নানা জায়গা ঘুরে ২৪শে আগস্ট মানকাচরে এসে পৌঁছান। এনায়েত করিমও তাঁর সাথে এসেছেন। তবে তাঁকে শিবিরে পেলাম না। এনায়েত করিম কোথায় জিজ্ঞেস করলে নুরুল ইসলাম জানালেন, ‘এনায়েত করিম তেলঢালাতে কর্ণেল জিয়াউর রহমানের শিবিরে কিছু খাদ্য সংগ্রহ করতে গেছেন। ওখান থেকে তিনি মহেন্দ্রগঞ্জও যাবেন।’ ‘খাদ্য সংগ্রহ কেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে মেজর বিন্দার সিং বললেন, ‘আমরা আমাদের নিজেদের রেশন থেকে আপনার এই ক্যাম্পে কয়েকদিন খাবার যোগান দিয়েছি। কিন্তু আলাদাভাবে এই ক্যাম্পে রেশন দেয়ার কোন সুযোগ আমাদের নেই বলে অসুবিধা দেখা দিয়েছে। আমি তুরা হেড কোয়ার্টারকে লিখে জানিয়েছি। যদিও দুচার দিন পর আর এই ধরনের কোন অসুবিধা থাকবে না। দু’চারদিন যা একটু কষ্ট করতে হবে। তবে আপনি যদি ব্রিগেডিয়ারকে বলেন তাহলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হতে পারে।’ এই সময় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহমুদুল্লাহ আগ্রহ করে বললেন, ‘কাদের ভাই, যখন আপনার ক্যাম্পে ষাট-সত্তর জন ছিল, তখন আমাদের পক্ষে কিছু কিছু রেশন দিয়ে চালানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এত জনের রেশন আমাদের ভাগ থেকে দেয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৪

খাওয়ার অসুবিধা, সহযোদ্ধাদের কাপড় চোপড়ের অসুবিধা, এই সব শুনে এবং দেখে ভারতের মাটিতে আমি প্রথম কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লাম। সহকর্মীদের কাছে বসে খাওয়া দাওয়া সম্পর্কে বারবার জিজ্ঞেস করলাম। সহযোদ্ধারা জানালো, ‘এখনও আমাদের খাওয়া দাওয়ার তেমন কোন কষ্ট হয়নি। তবে প্রতিদিনই শুনছি খাবার সংগ্রহ করতে কমাণ্ডার সাহেবদের খুব কষ্ট হচ্ছে। আমরা শুনছি অথচ কিছুই করতে পারছি না। তাই যা মনকষ্ট পাচ্ছি।’ সহযোদ্ধাদের সাথে কথা— বার্তার ফাঁকে একসময় নুরুল ইসলাম বললেন, ‘স্যার আমার কাছে অচল একশ ও পাঁচশ টাকার পাঁচ লক্ষ বাহান্ন হাজার টাকা আছে। আমি এখনও টাকাগুলো ভাঙাইনি। টাকাগুলো ভাঙিয়ে গণপরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর মাধ্যমে শরণার্থী ক্যাম্পে দুঃস্থদের দিতে বলেছিলেন? এখানে পাকিস্তানী অচল একশ’ টাকার বিনিময়ে ভারতীয় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। আমি কি ওখান থেকে এদের জন্যে কোন ব্যবস্থা করবো?’ ‘না, লতিফ ভাই বোধ হয় দু’তিন দিন খুব ব্যস্ত আছেন, আমি গাড়ী পাঠিয়ে দেব। আপনি লতিফ ভাইয়ের কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে পরামর্শ করে পূর্বের নির্দেশ মত ঐ টাকার পাই পাই দুঃস্থদের মধ্যে আমাদের শুভেচ্ছা ও শুদ্ধা হিসাবে পৌঁছে দেবেন। সহযোদ্ধাদের থাকা খাওয়া যাবতীয় ব্যাপার আমি দেখছি। এরপর হাসি ঠাট্টার ছলে পরিবেশকে হালকা করতে বললাম, ‘তোমরা যতক্ষণ এখানে থাকবে, ততক্ষনই দেশের জন্যে, দেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা কর। আলাপ আলোচনা কর। আর যা কিছু প্রয়োজন নুরুল ইসলাম অথবা এনায়েত করিমকে জানাবে। আমি কথা দিচ্ছি, তোমরা যা চাইবে তাই-ই পাবে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে এরপর থেকে আর কোন চিন্তা করো না।’ আমি ভাল করে জানতাম, সহযোদ্ধাদের চাহিদা কি হতে পারে। তারা যে অযৌক্তিক অপ্রয়োজনীয় কিছুই চাইবে না, সে সম্পর্কে আমার প্রচণ্ড আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। ক্যাম্প ত্যাগের সময় নুরুল ইসলামকে বললাম, ‘আমি দুই ঘন্টা পর তুরার পথে রওয়ানা হব। এর মধ্যে এনায়েত করিম এলে তাকে মানকাচর তুরা রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করতে বলবেন। যদি আমার সাথে দেখা না হয়, তাহলে তিনি যেন রাতেই তুরায় আসেন। সহযোদ্ধাদের বললাম, ‘এখন থেকে আমি প্রতিদিন না পারলেও একদিন পরপর এসে তোমাদের সাথে দেখা করব। আমার হাতের জখম পুরোপুরি সারেনি। এখনও ব্যাথা ও যন্ত্রণা বোধ করি। তাই নিজে গাড়ী চালাতে পারিনা। এজন্য একজন চালকের উপর নির্ভর করতে হয়। হাত ঠিক হয়ে গেলে প্রত্যেকদিনই একবার করে আসব আর তোমাদের তুরা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও হয়তো করব। আশা করছি তোমাদের সাথে দৈনিকই দেখা হবে।’ সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বি. এস. এফ. মেজর বিন্দার সিংকে অনুরোধ করলাম, ‘আপনি দয়া করে ব্রিগেডিয়ার সান সিং এর কাছে খবর পাঠান যে, আমি চাই উনি যেন চারশ জনের চার দিনের রেশন আপাততঃ তাৎক্ষণিক ভাবে মানকাচরে পাঠিয়ে দেন। তুরাতে এসেই ওনার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলব। উনি দয়া করে রেশন পাঠিয়ে দিলে আমি খুশী হব।’
জীবনে এই প্রথম আমার মানকাচরে আসা। মানকাচর এক ঐতিহাসিক স্থান। বৃটিশ
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৫

আমলে এক সমৃদ্ধ নদী-বন্দর ছিল এই মানকাচর। কৃষক আন্দোলনেও স্থানটির অবদান অপরিসীম। ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর উদ্যোগে এখানে এক বিরাট কৃষক সম্মেলনের প্রস্তুতি চলাকালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়। পূর্ণ সম্মেলন তাই আর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। আগেই বলেছি, অন্যদিকে কামাখ্যা মন্দির ও মোগল সেনাপতি আট ফুট লম্বা মীর জুমলা খানের কবর। দুধর্ষ মোগল সেনাপতি মীর জুমলা খান বাংলার বুকে মোগল সাম্রাজ্যে নিশান উড়াতে সক্ষম হলেও আসাম বিজয় করতে এসে আসামের কালাজ্বর তিনি জয় করতে পারেননি। মানকাচর পর্যন্ত এসে কালাজ্বরে আক্রান্ত হন এবং মারা যান। তাঁর আসাম বিজয় তাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বাংলা-আসামের সীমান্তরেখার কাছে মীর জুমলার কবর যেন সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। মানকাচরের একদিকে যেমন বিরাট অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে, তেমনি অন্যদিকে এই স্থানটির অন্ধকার দিকও আছে। শত বৎসর ধরে বা তারও আগে থেকে এই জায়গা চোরাচালানের অন্যতম ঘাটি হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে এবং তা এখনো অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানকাচর আবার ইতিহাসের পাতায় নিজের ঠাই করে নিয়েছে। ময়মনসিংহ, পাবনা, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, বগুড়া ও রংপুরের লাখো লাখো শরণার্থীর ঢল নেমেছে এই মানকাচরে। দিনরাত লোক গিজগিজ করছে। মানকাচর বাজারের আশে পাশে অসংখ্য শরণার্থী শিবির খোলা হয়েছে। শরণার্থীদের দূরাবস্থার অন্ত নেই। ভারত সরকার এবং জনগণ আপ্রাণ চেষ্টা করেও বাংলাদেশ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দূরাবস্থা সম্পূর্ণ দূর করতে পারছে না। কারণ শরণার্থীরা তো পরিকল্পনা মাফিক আসছেন না? শরণার্থীদের জন্য পূর্ব থেকে গৃহীত সকল ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির চাপে শরণার্থী সমস্যা আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে। মেঘালয় রাজ্যের পুরো জনসংখ্যা মাত্র বারো লক্ষ। অথচ সেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণর্থীর সংখ্যাই প্রায় পনের লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। আসামের লোকসংখ্যাও খুব বেশী নয়। আসামের ধুবড়ী ও মানকাচর এলাকায় জনসংখ্যা খুব বেশী হলে চার লাখের বেশী নয়। আর শরণার্থীদের সংখ্যা সেখানে পনের-ষোল লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এই অভাবনীয় পরিস্থিতি সামাল দেয়া সত্যিই দুঃসাধ্য ব্যাপার। এমনি একটা সময়ে আমি মানকাচরে উপস্থিত হয়েছি। মানকাচর বাজারে কোন কাজ ছিল না। বাজারটি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এতো বাজার নয়, যেন মেলা দেখা। মানুষের পদচারণা সমস্ত বাজার এলাকা সর্বদা ধূলিঝড়ে আবৃত। এই ধূলির আস্তরণ সকাল, সন্ধ্যা, রাত, চব্বিশ ঘন্টার জন্যই মানকাচর বাজারের আকাশ ঢেকে রেখেছে। মানকাচর বাজারের খেয়াঘাট পাড়ে গিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য দাঁড়ালাম। দেখলাম শুধু মানুষের স্রোত। শত শত নর-নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ব্যাকুল হয়ে পাড়ে নামছেন। এঁরা সবাই ভারতের মাটিতে প্রথম পা রাখছেন হানাদারদের আক্রমণের আতঙ্কে তাদের চোখ মুখ শুকনো, নিরাপত্তার সন্ধানেই তারা এতদিন যেন পথ চলেছেন। হানাদারদের অত্যাচার আমি দেখেছি। কত সোনার সংসার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, পিতার কাছ থেকে পুত্র ছিটকে পড়েছে, মা জানেন না তার মেয়ে কোথায়? ছিন্নমূল শরণার্থীদের অন্তহীন মিছিল
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৬

আমাকে ব্যথিত করে তুললো। আমার মনে পড়ে গেল মার কথা, ভাই-বোনদের কথা, সহযোদ্ধাদের কথা। তারা পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে কেমন করে। দেশের অভ্যন্তরে হানাদারদের হিংস্র উন্মত্ত থাবার নীচে যে সব মা, বাবা, ভাই, বোনেরা আছেন তাদের অসহায় অবস্থার কথা ভেবে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো, আমি নিজেকে হারিয়ে ফেললাম লক্ষ কোটি মানুষের চরম দূর্ভোগ আর সীমাহীন দুরাবস্থার মাঝে।
হঠাৎ একজনের স্পর্শে আমার তন্ময়তা কেটে গেল। পিছু ফিরে দেখলাম, টাঙ্গাইলের এক ভদ্রলোক, নাম বীরেন সাহা। বীরেন সাহা সম্পর্কে অনেক শুনেছি। চিনিও সেই ছোটবেলা থেকে। তিনি টাঙ্গাইলের ধনী ব্যবসায়ী, তবে সৎ বলা মুশকিল। বীরেন সাহা বললেন, ‘ভাই, আমি আপনার কথা অনেক শুনেছি, আমি কালকেই দিল্লী থেকে এসেছি। কোন চিন্তা নেই ভাই, ইন্দিরাজী বলেছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ একথা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক বড্ড বকেন, তা আগে থেকে জানতাম। কিন্তু চরম দূরাবস্থার মধ্যে সবাই যখন বিদেশ বিভূঁয়ে এসেছেন, তখনও বীরেন সাহা (তার) অভ্যাস বদলাতে পারেনি ভেবে প্রথমটায় খুবই অবাক হলাম। কোন রাজনৈতিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে শুধু বললাম, ‘আপনি কেমন আছেন? কিভাবে আছেন?’ ‘কি আর থাকি ভাই? সবতো ফেলেই এসেছি তবে এখানে আগে থেকে আমার এক দাদা আছেন তার আট-দশখানা ট্রাক আছে। আমারও সাত-আটটি ট্রাক ছিল। আগে দাদাই দেখাশুনা করতেন। কিন্তু তিনি যেন কেন ইদানীং হিসাবপত্র ঠিক দিতে চাইছেন না। তাই তার কাছ থেকে গাড়ীগুলো নিয়ে এসেছি। ঐগুলো দেখা শুনা করে কোনরকমে চলছি আর কি।’ আগে থেকে সাত-আটটি ট্রাক ছিল কিনা তা আমার জানা নেই। কিন্তু টাঙ্গাইল থেকে আসার সময় তিনি তাঁর দোকান এবং চার-পাঁচখানা ট্রাকের কোন ব্যবস্থা করে আসতে না পারলেও খালি হাতে যে ভারতে আসেননি তা টাঙ্গাইলের সকলেই জানেন। গৌর বসাক, হরিদাস বসাক এং বীরেন সাহার কাছে টাঙ্গাইলের শাড়ী প্রস্তুতকারী তাতীরা টাকা ও গয়না গাঁটি জমা রাখতেন। যুদ্ধ চলাকালে অসংখ্য তাতী সর্বস্বান্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী তাদেরকে প্রায় সাত-আট লাখ অর্থ সাহায্য মঞ্জুরও করেছেন। কিন্তু তাতে তাঁতীদের তেমন কোন উপকার হয়নি। টাঙ্গাইলের শাড়ী প্রস্তুতকারী তাতী সম্প্রদায় বাজিতপুর হাটে (এলাকার সবচাইতে বড় হাট) তাদের তৈরী টাঙ্গাইল শাড়ী বিক্রী করে প্রয়োজনীয় সুতা কিনে উদ্বৃত্ত সমস্ত টাকা এই ভদ্রলোকেদের কাছে প্রতি সপ্তাহে জমা রাখতেন। তাতীরা ব্যাঙ্কে টাকা রাখার চাইতে গৌর বসাক, হরিদাস বসাক ও বীরেন সাহার কাছে টাকা ও গয়না গাটি গচ্ছিত রাখা অনেক নিরাপদ মনে করতেন। এই ব্যবস্থা চলে এসেছিল প্রায় কুড়ি বৎসর ধরে। কয়েক হাজার তাঁতীরা শত শত, কারো কারো হাজার হাজার টাকা বীরেন সাহার কাছে জমা ছিল। প্রতি তাঁতীকে মাথাপিছু মুক্তিবাহিনী দু’শ থেকে বারশ টাকা দিলেও তাতীদের ক্ষতিপূরণ হয়নি। আমি বীরেন সাহাকে নমস্কার জানিয়ে উত্তর দিকের রাস্তা ধরলাম। সামান্য একটু এগুতেই বাম পাশে একটি মস্ত বড় দোকান। দোকানদার গদী থেকে টলতে টলতে এসে নমস্কার জানিয়ে বললেন,
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৭

‘আপনি দয়া করে আমার দোকানে একটু আসুন। আমি আপনার কথা অনেক শুনেছি। আমার দোকানে একটু পদধূলি দিয়ে যান।’ মাতাল ভদ্রলোক বলতে গেলে আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গদীতে বসালেন। তারপর চা, মিষ্টি ও নানা ধরনের সুস্বাদ খাদ্য সামগ্রী দিয়ে আপ্যায়নের আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। আমি শুধু চা পান করে তুরার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লাম।
দোকানদার ভদ্রলোক, যিনি আমাকে দোকানে বসিয়েছিলেন তার নাম বিহারীলাল আগরওয়াল (সম্প্রতি তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন)। যুদ্ধের সময় মানকাচর গেছেন অথব বিহারীলাল আগরওয়ালের নাম জানেন না, এমন মুক্তিযোদ্ধা বা একজন শরণার্থী খুঁজে বের করা দুষ্কর। বিহারীলাল আগরওয়ালের অনেক গুণ। দিনরাত মদ খাবেন আর দোকানে বসে মাঝে মাঝে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ফাইট করবেন। উন্মাদের মতো চিৎকার করতে করতে তিনি হয়তো কোনদিন বলতে শুরু করেছেন, ‘আমাকে মর্টার দাও, মেশিনগান দাও। আমি ফুলছড়ি ঘাট পর্যন্ত দখল করে আসছি। আবার কোনদিন হয়তো উচ্চস্বরে চিৎকার করতে করতে পাকিস্তানীদের আক্রমণ করার জন্য নদীর ঘাট পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসলেন। এমনি হাজারো নাটকের বিচ্ছিন্ন অংশে অভিনয়ের নায়ক বিহারীলাল আগরওয়াল।
মানকাচর ত্যাগের আগে সহযোদ্ধা সাইদুরকে দিয়ে বাংলাদেশের দুই হাজার টাকা ভাঙ্গিয়ে নিলাম। (বাংলাদেশ সরকার তখনও কোন মুদ্রা ছাপাননি। পাকিস্তানী মুদ্রা যা স্বাধীনতা পক্ষীয়রা ব্যয় বা ব্যবহার করেছেন তা আলোচনার সুবিধার্থে বাংলাদেশের মুদ্রা হিসাবে আমরা গণ্য করবো) আমাদেরকে দেয়া হলো একশ টাকার বিনিময়ে ভারতীয় মুদ্রায় একশ ষোল টাকা। আমার গাড়ী মানকাচর সড়ক ছেড়ে তুরার সড়ক ধরবে, এমন সময় দেখা গেল সামনের দিক থেকে একটা খোলা জীপ ধূলো উড়িয়ে দ্রুত ছুটে আসছে। জীপে চালক ছাড়া দ্বিতীয় কোন আরোহী নেই। গাড়ীটা একটু আসতেই চালককে যেন একটু পরিচিত মনে হতে লাগলো। কাছে আসতে দেখা গেল, ইনি আর কেউ নন, মোহম্মদ এনায়েত করিম। আমি গাড়ি থেকে নামতেই এনায়েত করিম লাফিয়ে গাড়ী থেকে নেমে সামরিক অভিবাদন করলেন। আমি তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিঞ্জেস করলাম, ‘কেমন আছেন?’ এনায়েত করিমেরে সামরিক শৃঙ্খলা আগের চাইতে কমেনি বরং বেড়েছে। তিনি বললেন, ‘স্যার ভালো আছি।’ ‘কি ব্যাপার? আপনি একা একা খোলা জীপ চালাচ্ছেন? আপনার কোন অসুবিধা হচ্ছে না? আর এই মিলিটারী জীপই বা পেলেন কোথায়?’
‘স্যার সেনাবাহিনীতে আমি ট্যাংক চালিয়েছি আর একটা জীপ চালাতে অসুবিধা হবে?’ তিনি উল্লাসিত ও বিজয়ীর ভঙ্গীতে আরো বললেন, ‘একটা জীপ কেন? আপনি বললে এখনও দশটা জীপ সংগ্রহ করতে পারি।’
এনায়েত করিম ষাট–বাষট্টি সালে সামরিক বাহিনীর ট্যাংক রেজিমেন্টে ছিলেন। ট্যাংক চালিয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। তবে তিনি যে কোন গাড়ী অত্যন্ত ভালো চালাতে পারেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৮

— না ভাই, দশটা জীপের কথা নয়, আপনি এই একটাই পেলেন কি করে?
— স্যার, আমি সকালে কর্ণেল জিয়ার হেড কোয়ার্টার তেলঢালাতে গিয়েছিলাম। জিয়া সাহেবের সাথে দেখা করেছি। আমি আপনার লোক শুনে আমাকে যারপর নাই সম্মান করলেন।
আমি তাঁর কাছে রেশন চাওয়ার সাথে সাথে একটি তিন টনারে তিন দিনের রেশন পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন। তারপর যখন বললাম যে, আমি একটু মহেন্দ্রগঞ্জ যেতে চাই, আমাকে কোন গাড়ী দিয়ে সাহায্য করতে পারেন কিনা? জিয়া সাহেব বললেন, ‘আমাদের গাড়ী আছে, তবে চালাবার লোক নেই। আপনি যদি নিজে নিতে চান, তবে নিয়ে যেতে পারেন। যখন খুশী ফিরিয়ে দেবেন, এই হলো আমার গাড়ী পাওয়ার ইতিবৃত্ত।
তেলঢালা ক্যাম্প থেকে এনায়েত করিম চলে আসার ঘন্টা তিনেক পরে আমি কর্ণেল জিয়াউর রহমান ও অন্যান্যদের সাথে দুপুরের খাবার খেয়েছি। কিন্তু কর্ণেল জিয়া আমাকে রেশন অথবা গাড়ী দিয়ে সাহায্য করার কথা কিছুই জানাননি।
এনায়েত করিম সাহেবকে শিবিরের প্রতিটি সহযোদ্ধার প্রতি যত্ন নিতে এবং তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন তেল সাবান, কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য যাবতীয় জিনিসের চাহিদা মেটাতে বলে গাড়ীতে উঠলাম। গাড়ীতে উঠে করিম সাহেবকে আবার বললাম, ‘দেখুন, জুতার ব্যাপারটি একটু লক্ষ্য রাখবেন। জুতা আমাদের প্রয়োজনীয় নয়। যেদিনই দেশের ভিতর যাব সেই দিনই জুতার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। জুতা বাদে প্রয়োজনীয় যে কোন জিনিস চাইলেই আপনি যেন তাদের চাহিদা মেটান। আপনাকে কিভাবে টাকা দেয়া যায় আমি আজই তুরা গিয়ে তার চেষ্টা করেছি। আপনার ক্যাম্পে যাতে একটি ফিল্ড টেলিফোন লাগিয়ে দেয় তার জন্য মেজর বিন্দার সিংকে অনুরোধ করছি। তুরা গিয়ে ব্রিগেডিয়ার সানসিংকেও ফিল্ড টেলিফোন লাগিয়ে দেয়ার ব্যাপারে অনুরোধ করবো। কাল নাগাদ হয়তো আপনার ওখানে ফোন লেগে যাবে। গাড়ী পৌঁছে দিতে যখন তেল ঢালা ক্যাম্পে যাবেন, তখন জিয়া সাহেবকে আমার সালাম জানিয়ে বলবেন, আমাদের সাহায্য এবং দুপুরের খাওয়ানোর জন্য খুশী হয়েছি। আর একটা অনুরোধ তাকে বলবেন, আপনার সব সময়ের ব্যবহারের জন্য একটা গাড়ী যদি তিনি দিতে পারেন তাহলে আমি যারপর নাই কৃতজ্ঞ হব।’
এনায়েত করিমকে তাৎক্ষণিক ভাবে গাড়ী দিয়ে এবং তারপরেও যখনই সাহায্যের প্রয়োজন নির্দ্বিধায় তা চাইতে কর্ণেল জিয়া অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যুদ্ধকালীন সময় আমাদের প্রতি কর্ণেল জিয়াউর রহমানের ব্যবহার বরাবরই ছিল আন্তরিক, বন্ধুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক।
ভারতে আসার পর থেকে ভারতীয় সেনাপতিদের রওশনআরা ক্যাম্পে আসার বিরাম নেই, একজন যাচ্ছেন, অন্যজন আসছেন। কেউ ব্রিগেডিয়ার কেউ মেজর জেনারেল, আবার কেউ বা লেঃ জেনারেল ক’জনের নাম বলবো? মেজর জেনারেল গিল এর মধ্যেই তিনবার এসে গেছেন। তিনি সময় পেলেই আসছেন। তুরায় এলেই আমাকে তার একবার চাই-ই চাই। মেজর জেনারেল ওভানও একবার এসে আলাপ করে গেছেন। মেজর জেনারেল বি. এন. সরকারও দু-দুবার এসে নানা আলাপ আলোচনা করছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯৯

অরোরার সাথে মত বিনিময়
এবার এলেন ইষ্টার্ণ কমাণ্ডের প্রধান সেনাপতি লেফ্‌টন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। সকাল নটার আমাদের দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ হল। জেনারেল অরোরার স্ত্রীতো আমাকে জাপটে ধরে কোলেই তুলে নিতে চাইলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন। কারণ আমিতো ছোট্ট শিশুটি নই। সারাটা ক্যাম্প আমাকে সাথে নিয়ে ঘুরলেন এবং সেনাপতিদের শুনিয়ে শুনিয়ে বার যার বললেন, আমি সিদ্দিকীকে এই অল্প সময়েই যা দেখলাম, তাতে সে যে সবার আগে ঢাকা যাবে এতে আমি নিঃসন্দেহ। আমি ঢাকা গিয়েই কাদেরের জন্য সুন্দর একটি পাত্রী দেখব। এই সময় অরোরা তার স্ত্রীকে আংশিক সমর্থন করে বললেন, ‘সামরিক ব্যাপারেও যে তোমার এত দূরদৃষ্টি আছে তা কিন্তু আমার জানা ছিল না। তুমি এই তরুণ সেনাপতির জন্য স্ত্রী খুঁজতে পারবে কিনা জানিনা, তবে ঢাকা যাবার ব্যাপারে আমি তোমার সাথে একমত। এই তরুণ বেঁচে থাকলে সবার আগে ঢাকা জয় করবে।’ ঘুরে ঘুরে ক্যাম্প দেখা শেষ হলে জেনারেল অরোরা ব্রিগেডিয়ার সান সিং, মেজর জেনারেল গিল ও আরও দুই জন মেজর জেনারেল ও জনা তিনেক ব্রিগেডিয়ার আমাকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন। আলোচনা মানে এক তরফা কথাবার্তা। আমার এতদিনের যুদ্ধ অভিজ্ঞতা পাক সামরিক বাহিনীর সংখ্যা ও শক্তি সম্পর্কে আমার আন্দাজ, এরপর কি করতে চাই-এ বিষয়গুলি সম্পর্কে ভারতীয় সেনাপতিরা জানতে এবং বুঝতে চান। আমি বিস্তারিত ভাবে আমার অভিজ্ঞতা তুলে ধরলাম। সেনাপতিদের দৃঢ়তার সাথে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। পর্যন্ত আমার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা যতগুলি যুদ্ধ করেছে, তার শতকরা বড়জোর পাঁচটিতে হানাদাররা মুক্তিবাহিনীকে কিছুটা অসুবিধায় ফেলতে পেরেছে। বাকী সব যুদ্ধেই তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রচণ্ড মার খেয়েছে। নিয়মিত ভাবে প্রয়োজনীয় সরবরাহ পেলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হানাদার বাহিনী অজয় নয়।
আলোচনার এক পর্যায়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা ও অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ে কেন্দ্রীয় কমাণ্ডের কি ধরনের পরিকল্পনা থাকা উচিত, এই সম্পর্কে তারা মতামত জানতে চাইলে আমি তাদের বললাম, “ভিতরে সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে আপনাদের অবশ্যই প্রয়োজনীয় অস্ত্র, ঔষধপত্র ও কিছু শীতবস্ত্র সরবরাহ করা উচিত। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যুদ্ধ সরঞ্জাম। বাকীগুলো নিতান্তই গৌণ, এ ছাড়া ভিতরে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ বা অন্য কোনো ভাবে সাহায্য করা হলে তা তাদের কার্যকরী ক্ষমতাকে কমিয়ে দেবে। আলোচনা শেষে লেফ্‌টন্যান্ট জেনারেল অরোরা, ব্রিগেডিয়ার সান সিং- কে ছেড়ে বাকী সেনাপতিদের নিয়ে তুরা ক্যাম্প ত্যাগ করলেন।
আমাদের জন্য নতুন করে তৈরী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। কি ধরনের ট্রেনিং হচ্ছে তা আগেই উল্লেখ করেছি। প্রতিদিন দু-তিনশ সহযোদ্ধা সীমান্ত অতিক্রম করে আসছে। তাই ক্যাম্পের সীমা প্রতিদিন বেড়েই চলছে। এর মধ্যে মানকাচর থেকেও দুশ জনকে নিয়ে আসা হয়েছে। দুশ জন আসতে না আসতেই আবার সেখানে তিনশ জন এসে হাজির।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০০