You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীনতা’ ৭১
কাদের ‍সিদ্দিকী বীরোত্তম

সামনে জনযুদ্ধ, চাই সশস্ত্র প্রস্তুতি

শেষ পর্যন্ত ওরা বাঙালি জাতির সঙ্গে চরম বিশ্বাস ঘাতকতাই করল। মধ্য রাতের নিঃসীম থমথমে অন্ধকারে নিরস্ত্র দুর্জয় বাঙালি জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বর্বর হানাদার বাহিনী। বাংলার রাজধানী ঢাকায় বিশ্ব ইতিহাসের সবচাইতে নির্মম ও জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত হল বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে।
সারাদিন ঢাকা ছিল অশান্ত-উদ্বেল। দুর্বার-দুর্জয় জনতা মিটিঙে-মিছিলে-শ্লোগানে মুখরিত করে রেখেছিল ঢাকার অলি-গলি-রাজপথ। আর নাৎসী বাহিনীর ভয়ঙ্কর মুখোশ এঁটে সশস্ত্র পশ্চিমা কুকুর বাহিনী মেশিন গানের ব্যারেল উঁচিয়ে টহল দিয়ে ফিরছিল সারা শহর। হানাদার বর্বরদের ব্যারেলের মুখে বাংলার নিরস্ত্র বীর ছাত্র-জনতা শোভাময় রমনার রাস্তায় রাস্তায় গড়ে তুলেছে ব্যারিকেড।
ধীরে ধীরে রাত নেমে এল। রাজধানী ঢাকায় নিঃশব্দে নেমে এল অন্ধকার। সারাদেশে উথাল-পাথাল রাজনৈতিক অস্থিরতা। মার্চের শুরু থেকেই দেশবাসীর মনে উৎকণ্ঠা, অবিশ্বাস আর সন্দেহ দোল খাচ্ছিল–সেই উৎকণ্ঠা আর অবিশ্বাস এখন হয়েছে তীব্রতর। সবার মনে প্রশ্ন—খুনী ইয়াহিয়া শেষতক কথা রাখবে তো? কী বলবে সে বেতারে?
পঁচিশে মার্চের রাত ক্রমশ গভীর হয়ে এল, একসময় বন্ধ হয়ে গেল বেতার-প্রচার। অথচ সরকারি ঘোষণা প্রচারিত হল না। জনতার উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে গেল। তবু এই সীমাহীন উৎকণ্ঠা ও গভীর উদ্বেগের মধ্যেও স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতা তাদের প্রস্তুতি চালিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নির্দেশ দিলেন।
মধ্যরাত পার না হতেই বাংলার দুর্জয় বীর-জনতার ব্যালটের রায় বুলেটে প্রতিহত করতে বর্বর পাকিস্তান বাহিনী ট্যাঙ্ক, মেশিনগান, কামান ও সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলিতে নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বহরকে নিরস্ত্র বীর জনতা যেভাবে পারলেন বাধা দেবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার দুর্বল বাধা দানবীয় পশুদের বেশিক্ষণ ঠেকাতে পারল না। পশু-শক্তি ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান ও স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে নির্বিচারে অবিরাম গোলাগুলি বর্ষণ করতে করতে ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে। শত শত বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যশালী ঐতিহাসিক ঢাকা নগরী দানবীয় বাহিনীর একতরফা আক্রমণের বিভীষিকায় নিমজ্জিত হল। চারদিকে শুধু প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকাণ্ড, ধ্বংস আর মর্মন্তুদ মৃত্যু-চিৎকার। আগুনের লেলিহান শিখা আর বর্বর সেনাবাহিনীর মনোভূমির মতো বিষাক্ত কালোধোঁয়ায় তলিয়ে গেল ঢাকা শহর।
বর্বর হানাদার বাহিনীর একটি বিশাল দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল,
পৃষ্ঠা নং ~ ৯

সূর্যসেন হল, জগন্নাথ হল ও রোকেয়া হলে ট্যাঙ্ক, মেশিনগান ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে নিহত হয় অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী। রোকেয়া ও শামসুন্নাহার হলের ছাত্রীরাও পশুদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। প্রাণ ও ইজ্জত বাঁচাতে ছাত্রীরা হলের বিভিন্ন তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেয়। ছাত্রীবাসের প্রতিটি কক্ষ তল্লাসি চালিয়ে শত শত ছাত্রীর ইজ্জত লুঠ করে নির্মমভাবে বেয়োনেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তাদের। শুধু ছাত্র-ছাত্রীরাই নয়, ঢাকা ও দেশের অন্যত্র শিক্ষক, অধ্যাপক, রাজনীতিবিদ, শ্রমিক ও সর্বস্তরের অসংখ্য মানুষ হানাদারদের নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারায়। এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও কিছু ছাত্র-ছাত্রী ও জনতা কোনক্রমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচেন।
পঁচিশে মার্চের সেই ক্রুর কালোরাতে হানাদাররা প্রচণ্ড বাধা পায় পিলখানার ই-পি-আর ব্যারাক ও রাজারবাগের পুলিশ লাইনে। বীর বাঙালি পুলিশ ও ই-পি-আর বাহিনী হানাদারদের প্রথম আক্রমণের দাঁতভাঙা জবাব দেয়। বলতে গেলে পিলখানা ও রাজারবাগেই স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সারারাত ব্যাপী ই-পি-আর ও পুলিশ বাহিনী হানাদারদের অত্যাধুনিক ভারি ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মুখে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে। হানাদারদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রতিরোধ-যুদ্ধে ভোরের দিকে গোলাবারুদ ফুরিয়ে এলে এবং হানাদার বর্বররা নতুন শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে ই-পি-আর ও পুলিশরা আরো ব্যাপক প্রতিরোধ-যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। পঁচিশে মার্চের অভিশপ্ত কালরাতেই রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলায় তিন থেকে পাঁচ লক্ষ মানুষ হানাদারদের বর্বর আক্রমণে শহীদ হন।
বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ ও আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনগুলি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষত রাজনৈতিকভাবে সুশিক্ষিত প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর ভূমিকাই স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে। আপোস আলোচনার অজুহাতে ইয়াহিয়া যখন সময় কাটাচ্ছিল, তখন বাংলার ঘরে-ঘরে ব্যাপক অবিশ্বাস ও সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছিল। ছাত্র-শ্রমিক সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই বুঝে নিয়েছিল, পশ্চিম-পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদী-চক্র বাঙালির ন্যায্য অধিকার আপোসে ছেড়ে দেবে না। কারণ এই কায়েমী স্বার্থবাদী সাম্রাজ্যবাদী-চক্র যুগ-যুগ ধরে বাঙালিকে শোষণ করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বাঙালির হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থহানি ঘটাতে পারেনা তারা। ফলে যুদ্ধ যে অনিবার্য, সচেতন কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা তা বুঝে নিয়েছিলেন। কৃষক শ্রমিক-ছাত্র-জনতার মতো বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর চিন্তাও একই খাতে প্রবাহিত হচ্ছিল। এই সময়কার অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার চিন্তা-চেতনার সঙ্গে জনতার চিন্তা-চেতনার তেমন কোন সঙ্গতি ছিল না। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন একমাত্র নেতা যাঁর চিন্তা-চেতনা জনতার স্বপ্ন-চৈতন্যের সঙ্গে ছিল সঙ্গতিপূর্ণ। জনগণের সঙ্গে ছিল তাঁর নাড়ির বন্ধন। জনতার প্রাণের দাবি মনের কথা বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে আপনি ধ্বনিত হতো।
ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা,
পৃষ্ঠা নং ~ ১০

আনন্দ-বেদনা, ক্ষুধা ও দারিদ্রের কথা নিজের কণ্ঠে ধারণ করে বাংলার মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। তখন থেকেই সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, হাসি-কান্না ও সুখ দুঃখের মূর্ত প্রতীক বলে ভাবতে ও বিশ্বাস করতে শুরু করেন। এসব কারণেই পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত বাংলার ঘরে ঘরে উদ্বেগ, সন্দেহ ও বিভাষী-বিজাতীয় সামরিক শাসকদের প্রতি যে পুঞ্জীভূত ঘৃণার বাতাস বইছিল, বঙ্গবন্ধু সে বাতাসে কান পেতে অশনি সংকেত শুনতে পাচ্ছিলেন।
পঁচিশে মার্চ রাতে যখন হানাদার বর্বর বাহিনী রাজধানীসহ সারাদেশে ট্যাঙ্ক, কামান ও সাঁজোয়া গাড়ির বহর নিয়ে স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালিদের উপর আদিম বন্য প্রতিহিংসায় ঝাঁপিয়ে পড়ে গণতন্ত্র ও বিশ্বমানবিকতার ললাটে কলঙ্কচিহ্ন এঁকে দিয়ে শতাব্দীর নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের সূচনা করে, তখন সারা বাংলা স্বাধীনতা অর্জনের নেশায় উন্মত্ত, শপথে প্রদীপ্ত।
অতীতের যে-কোন আন্দোলনের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামেও টাংগাইল পিছিয়ে থাকেনি। তখন আমি টাংগাইল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং টাংগাইল জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পয়লা মার্চ থেকে সারাদেশে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, জেলায়-মহকুমায় ‘জয় বাংলা বাহিনী’ গঠিত হয়েছে। এই বাহিনীর কাছে কোন অস্ত্র ছিল না সত্য, তবে পৃথিবীর যে কোন সশস্ত্র সুশৃঙ্খল বাহিনীর চাইতে নিঃসন্দেহে ত্যাগ-সাহসিকতা ও আত্মবলিদানের উৎসাহ অনেকগুণ বেশি ছিল। এর প্রমাণ, ন’মাসের যুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল বিজয়। টাংগাইলে তখন ‘জয় বাংলা বাহিনী’ গঠিত হয়েছে এবং এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন টাংগাইলের জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম। আমি একজন অন্যতম সংগঠক মাত্র। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ মাঠে দীর্ঘ একমাস ধরে ‘জয় বাংলা বাহিনীর’ প্রায় শ’চারেক সদস্যের প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। ধরের বাড়ির জয়নাল আবেদীন ছিলেন এই বাহিনীর প্রশিক্ষক। প্রশিক্ষণের মান ও ব্যবস্থা অবশ্য উন্নত ছিল না। প্রশিক্ষণ মানে শুধু বাম-ডান করানো, বন্দুক ধরা ও কিভাবে গুলি ছুঁড়তে হয় তার একটা সাধারণ ধারণা দেওয়া। প্রশিক্ষণকালে সংগঠন ও উদ্যোক্তাদের কাছে সত্যিকার রাইফেল ও বন্দুক খুব একটা ছিল না। এন. সি. সি. ক্যাডেটদের কাঠের রাইফেল দিয়েই প্রশিক্ষণ চলত। কখনো কখনো অবশ্য সুহৃদ পুলিশ ও আনসাররা দু’একটা সত্যিকার রাইফেল ধার দিয়ে প্রশিক্ষণ সাহায্য করেছেন। ১৫ মার্চের পর অবস্থার সামান্য উন্নতি ঘটে। সকল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেই তখন কয়েকটা করে সত্যিকার রাইফেল দেওয়া সম্ভব হয়। ‘জয় বাংলা বাহিনী’র সদস্যরা হাতিয়ার চালানোর প্রশিক্ষণই শুধু দিয়েছিলেন, গুলি ছুড়বার সুযোগ পাননি। কারণ আমাদের হাতে কোন গুলি ছিল না।
পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত অনেক জাতীয় নেতা ও ব্যক্তিবর্গ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলেন। তাঁরা তখনো ভাবছিলেন হয়তো নিয়মতান্ত্রিক শলাপরামর্শ ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হবে। ভাবছিলেন অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলা-বারুদ নিয়ে নড়াচড়া ও ঘোরাফেরা করলে পরিস্থিতি শান্ত
পৃষ্ঠা নং ~ ১১

হবার পর নিদারুণ অসুবিধায় পড়তে হতে পারে। অনেকের এমন ধারণাও ছিল, এখন যেসব পুলিশ ও আনসার উপযাচক হয়ে প্রশিক্ষণের জন্য অস্ত্র দিচ্ছেন, অবস্থা পরিবর্তন হলেই তাঁরাই অনেককে বেআইনি অস্ত্র ব্যবহারের দায়ে জেলে পুরবেন। এটা সত্য যে, দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। অনেক নেতার চিন্তা ছিল একবার অস্ত্র হাতে নিলে লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত তা হাতছাড়া করার উপায় থাকবে না। এসব কারণে অনেক বড় বড় নেতারা তখন পর্যন্ত খুব একটা আগ্রহভরে এগিয়ে আসেননি। ‘অপেক্ষা কর এবং দেখ’—এই নীতিতে যতটা না করলেই নয়। ততটাই করছিলেন। অথচ ছাত্র-জনতা পরিষ্কার বুঝে গেছেন সাপ মারতে যেমন লাঠি চাই, তেমনি সশস্ত্র লড়াই ছাড়া উদ্ভূত সংকট সমাধানের কোনও পথ নেই। টাংগাইলে তখন একদিকে যেমন এ ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, অন্যদিকে তেমনি প্রতিরোধ যুদ্ধের জোর প্রস্তুতি চলছে।
এই পটভূমিতে পঁচিশে মার্চ বসন্তের মধ্যরাতে বাংলার শাশ্বত শান্তরূপকে তছনছ করে রূপসী বাংলাকে ক্ষত-বিক্ষত করে যখন পাকিস্তানী হানাদাররা শান্তিপ্রিয় নিরস্ত্র নিদ্রামগ্ন বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা চালায়, তখন সারাদেশের মতো টাংগাইলেও এর গুরুতর প্রতিক্রিয়া হয়।
ছাব্বিশে মার্চ সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষ উদ্ভ্রান্তের মতো টাংগাইলের দিকে ছুটে আসতে থাকে। বন্যার মতো ছুটে আসা ছিন্নমূলদের মধ্যে নারী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ-শিশু সবাই রয়েছে। তাঁদের দিশেহারা আতঙ্কগ্রস্ত চোখ-মুখের দিকে তাকানো যায় না। তাঁদের ভীত-সন্ত্রস্ত আতঙ্কিত হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোন হিংস্র নর-খাদক তাঁদের পিছু ধাওয়া করেছে। ঢাকা থেকে ষাট মাইল এসেও তাঁরা নিরাপদ বোধ করছিলেন না, যত শিগগির-সম্ভব আরো দূরে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছিলেন। এই দলে এমন অসংখ্য মানুষ ছিলেন যাঁরা জানেন না কেন তাঁরা পালাচ্ছেন, কেন তাঁরা ছুটছেন। তবু ছুটবার বিরাম নেই। যেন যতক্ষণ ছুটবেন ততক্ষণই জীবন, থেমে গেলেই অবধারিত মৃত্যু। ঢাকার খবর জিজ্ঞাসা করলে অনেকেই উত্তর দিতে পারছিলেন না। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে, বিস্ফারিত চোখ ফেটে পড়তে চাইছে। ক্লান্ত অভুক্ত নিদ্রাহীন দেহ বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চাইছে, হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন, উঠে আবার ছুটছেন। শুধু ছুটে পালাচ্ছেন পেছনে ধাবমান মৃত্যুর কুৎসিত নৃশংস থাবা এড়িয়ে। এঁদের মধ্যে যাঁরা একটু সাহসী তাঁদের কেউ কেউ অতিকষ্টে দ্রুতকণ্ঠে জানালেন, ঢাকা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটি নেই। পিলখানা রাজারবাগে তুমুল যুদ্ধ হচ্ছে। পিলখানায় হানাদার বাহিনী ঢুকতে পারেনি। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় জল্লাদ বাহিনী যাকে পাচ্ছে তাকেই খতম করছে। রাজপথ রক্তে লাল। ট্যাঙ্ক ও কামানের গোলায় ঘরবাড়ি মাটিতে মিশে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে ঢুকে মিলিটারিরা সবাইকে গুলি করে এবং বেয়োনেটে খুঁচিয়ে হত্যা করছে।
ঢাকার দিক থেকে প্রাণভয়ে ভীত পলায়নপর মানুষদের দেখে এবং তাঁদের কাছে এইসব সংবাদ শুনে ক্ষোভে-দুঃখে আমি মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম।
এসময় একজন বুক চাপড়ে আহাজারি করতে শুরু করেন। আমরা কয়েকজন তাঁর কাছে
পৃষ্ঠা নং ~ ১২

দৌড়ে গেলাম। লোকটিকে জিজ্ঞাস করলাম,
—কী হয়েছে ভাই? অমন করছেন কেন?
লোকটির গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুতে চাচ্ছিল না; অঝোরে কাঁদছে আর বুক চাপড়াচ্ছে, যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। অনেক সান্ত্বনা দেওয়ার পর ভদ্রলোক মুখ খুললেন,
—কী বলব! সব শেষ হয়ে গেছে। আমার বাসা ধানমণ্ডিতে। বঙ্গবন্ধুর বাসার পাশেই। রাত বারোটার পর একদল সেনা এসে বঙ্গবন্ধুর বাসা ঘিরে ফেলে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। গুলির আঘাতে বাসার ইট একটার পর একটা খসে পড়তে থাকে। হঠাৎ মাইক্রোফোনে শোনা গেল বঙ্গবন্ধুর গলা,
—তোমরা কারা? তোমরা পেয়েছ কী? গুলি বন্ধ করো।
সত্যিই গুলি বন্ধ হয়ে গেল। উৎসুক হয়ে উঠলাম। দেখলাম বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে ধীর পায়ে নিচে নেমে এলেন। হানাদারদের সামনে এসে বললেন,
—তোমরা পেয়েছ কী? আমি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। তোমরা এভাবে কারো বাড়িতে গুলি চালাতে পারো না।
এসময় হানাদার নেতা, খুব সম্ভবত একজন কর্নেল, বঙ্গবন্ধুকে বলল,
—আমরা আপনাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে এসেছি।
—কোথায়?
—ক্যান্টনমেন্ট।
—আমাকে গ্রেফতার করতে হলে, অন্তত ‘আই-জি’র উপস্থিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এটাও কি তোমরা ভুলে গেছ?
এসময় কয়েজন অফিসার ও বঙ্গবন্ধুকে বন্দুকের বাঁট ও নল দিয়ে ঠেলা ও গুঁতা মারছিল। হানাদারদের দুর্ব্যবহারে আমি অঝোরে কেঁদে ফেলি। বঙ্গবন্ধু গর্জে উঠেন,
—তোমরা অভদ্রতা বন্ধ করো।
হানাদার নেতার হস্তক্ষেপে তারা বিরত হয়। হানাদাররা বঙ্গবন্ধুকে জোর করে জিপে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আল্লাহ জানেন, এখন বঙ্গবন্ধু কোথায়। আল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা কর। লোকটার কথা শুনে পাগলের মতো দৌড়ে জেলা পরিষদ অফিসের সামনে গিয়ে হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা প্রতিরোধকল্পে অপরিকল্পিতভাবে এক বক্তৃতা দিয়ে বসলাম। মাইক্রোফোনের সামনে ঘৃণা আক্রোশে ফেটে পড়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম—
“আমাদের পাকিস্তানী খুনী বাহিনী ট্যাঙ্ক, কামান মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হাজার-হাজার, লাখো লাখো মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। রক্তের বন্যায় সারাদেশ ভাসিয়ে দিচ্ছে। এই রক্তের জবাব রক্ত দিয়েই দিতে হবে। রক্তের জবাবে রক্ত চাই। দীর্ঘ ২৫ বৎসর ওরা তিল তিল করে শোষণ করে মেরেছে। সভ্য জগতের রীতিনীতি অগ্রাহ্য করে বর্বরতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিরপরাধ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের বুকে যে পৈশাচিক দানবীয় থাবা হেনেছে, সেই নৃশংস কালো হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব চিরদিনের
পৃষ্ঠা নং ~ ১৩

জন্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আমাদের প্রমাণ করতে হবে—ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে দানবীয় পশুশক্তি হার মানতে বাধ্য। আপনারা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের কথা স্মরণ করুন, ‘যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, আমরা ওদের ভাতে মারব, পানিতে মারব, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মত আমাদের ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। জীবন দিয়েও নেতার নির্দেশের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। আসুন, আমরা শপথ নেই, জীবন দেবো, তবুও অধিকার দেবো না, কোন শক্তির কাছে মাথা নোয়াব না।
“জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।”

এটা সত্য, এই বক্তৃতার আগে কারো সাথে কোন পরামর্শ করিনি। যুদ্ধশেষে আমার অবস্থান থেকে এটা বিচার করলে হয়তো তেমন বেমানান এবং গুরুতর ব্যাপার মনে হবে না। তবে যুদ্ধের শুরুতে নেতৃবৃন্দের কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না-করে ঐ ধরনের বক্তৃতা করাটা আমার জন্য প্রচণ্ড ঝুঁকি পূর্ণ ছিল। এমনিতেই শত শত ছিন্নমূল মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। তার উপর সত্য হোক, মিথ্যা হোক, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে খবর শোনার পর আমার মাথা ঠিক ছিল না। সত্যিকার অর্থেই হয়তো পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।
২৬ মার্চ সকাল দশটায় আদালত পাড়ার নূরুল ইসলাম এ্যাড্‌ভোকেটের বাড়িতে উদ্ভুত পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এক সর্বদলীয় সভা বসে। এই সভায় স্বাধীনতাকামী কমবেশি সব দলের নেতা ও প্রতিনিধি উপস্থিত হন। বদিউজ্জামান খানকে সভাপতি করে সভার কাজ শুরু করা হয়। সভার শুরুতে টাংগাইলের বিখ্যাত শ্রমিক নেতা সৈয়দ আব্দুল মতিন প্রস্তাব করেন, “বর্তমানে আমাদের জেলার সমস্ত প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে সবকিছু পরিচালনা করা উচিত। এখন আমাদের প্রধান কাজ হবে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত একটি মুক্তি-বাহিনী গঠন করা। কারণ ঢাকার দিকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে টাংগাইল আর দু’একদিনও নিরাপদ থাকবে না। পাকিস্তান জল্লাদ বাহিনী আমাদের প্রিয় জেলায় প্রবেশ করলে ঢাকার মতো এখানেও হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালাবে। তাই আমাদের সবার কর্তব্য ওদের গতিরোধ করা।” এরপর আর-একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি দৃঢ়তার সাথে বলেন, “কথা বলে সময় নষ্ট করা এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর এখন এমন একটা কমিটি গঠন করা উচিত, যে-কমিটি জেলার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবে। ডি.সি., এস. পি-কে ডাকা হোক। তাঁরা যদি এই কমিটির ডাকে সাড়া না দেয়, তাহলে তাদেরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। আমাদের এই কমিটির নির্দেশ অমান্য করলে প্রয়োজনে শাস্তির বিধান করা যেতে পারে।” এইধরনের অসংখ্য প্রস্তাব নানাজনে তুলতে থাকেন। তবে মূল প্রস্তাব একটাই—সশস্ত্র প্রতিরোধ-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে এবং তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কমবয়সী কয়েকজন এও বললেন, “বঙ্গবন্ধু তো বলেই দিয়েছেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা সবকিছু বন্ধ করে দিবে’। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মত নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরকেই করতে হবে। বঙ্গবন্ধু আরও বলেছেন—‘যার যা আছে তাই
পৃষ্ঠা নং ~ ১৪

নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’। এই নির্দেশের পরও শত্রুর মোকাবেলা করতে নিশ্চয়ই আমাদের দ্বিধা থাকতে পারে না।”
একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে টাংগাইলের প্রশাসনব্যবস্থা হাতে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন আওয়ামী লীগের জেলা সম্পাদক মীর্জা তোফাজ্জল হোসেন (মুকুল) প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে সমবেতদের বললেন, “হ্যাঁ বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা সবকিছু বন্ধ করে দিবে— তার অর্থ এই বলেন নাই যে, আপনারা সমস্ত ক্ষমতা হাতে নিয়ে নেবেন। আমি আপনাদের সাথে একমত নই। তাছাড়া আর একটা কথা আছে—ঢাকা থেকে নির্দেশ না এলে আমি কিছুতেই কিছু করতে পারব না।”এই সময় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম লাফিয়ে উঠে বললেন, “রাখেন এম. পি. সাহেব, ঢাকার সব মানুষরে মাইর‍্যা ফালাইছে, আর আপনি নির্দেশের জন্য বইসা রইছেন। সত্য কথা কন, আপনি ডরাইছেন।” এ কথা শুনে এম. পি. সাহেব রুদ্রমূর্তি ধরে বিকট চিৎকার করে উঠেন, “আমার কথার মধ্যে তুমি করিম… …. কথা বলার কে? জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে আইন পাশ করার জন্য, যুদ্ধ করার জন্য নয়। আর আপনারা যে এখন বীরগিরি দেখাইতেছেন, মিলিটারি আসলে আপনাদের কী দশা হবে ভেবে দেখেছেন? আর দেখেন তো! কাদের সিদ্দিকী! একটু আগে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে যে বক্তৃতা করল, তার জন্য কে দায়ী হবে? ঐ রকম বক্তৃতা করার আগে সে কার অনুমতি নিয়েছে? যে যার মতো দেখছি সবাই হঠাৎ মাতব্বর হইয়া গেছে। আপনাদের এই হঠকারিতার জন্য টাংগাইলের কোন ক্ষতি হলে আপনারাই দায়ী থাকবেন। আমি আপনাদের সাথে একমত নই, তাই আমি এই সভা ত্যাগ করলাম।” মীর্জা তোফাজ্জল হোসেন রেগে মেগে গজগজ করতে করতে সভা ত্যাগ করলে সকলে একমত হয়ে একজন চেয়ারম্যান ও একজন আহ্বায়কসহ কয়েকজন সদস্যের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে নিম্নলিখিত প্রস্তাব নেনঃ
(১) এই কমিটি হবে জেলার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
(২) এই কমিটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটির আদেশ-নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করবে।
(৩) এই কমিটির নাম হবে– টাংগাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ।
(8) এই পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সুসংগঠিত শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা হবে।
(৫) সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্ব থাকবে সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের উপর। তিনি স্বয়ং অথবা অন্য কাউকে, অথবা কয়েকজন মনোনীত করে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবেন।
(৬) সশস্ত্র বাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া কোন কাজ রূপায়িত করতে পারবে না।
(৭) কমিটি গঠনের মুহূর্ত থেকে টাংগাইল জেলার সমস্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব, আপনা আপনি এই কমিটির উপর বর্তাবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৫

(৮) বদিউজ্জামান খান চেয়ারম্যান ও আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী সর্বসম্মতিক্রমে এই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হলে পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে পদাধিকার বলে সশস্ত্র গণবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হল। এই সভায় টাংগাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদে অন্য কয়েকজন সদস্যকে নির্বাচিত করা হল। সদস্যবৃন্দ হলেন,
(১) ন্যাপের সৈয়দ আবদুল মতিন, (২) জাতীয় লীগের জনাব আল-মুজাহিদী, (৩) মোটর এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হবিবুর রহমান হবি মিয়া, (৪) শামসুর রহমান খান (শাজাহান), (৫) ফজলুর রহমান খান (ফারুক), (৬) এড্‌ভোকেট নুরুল ইসলাম, (৭) আলী আকবর খান খোকা ও (৮) বীরেন্দ্র কুমার সাহা।
পরিষদের একজন উপদেষ্টা মনোনয়ন করা হল। তিনি হলেন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব খোন্দকার আসাদুজ্জামান (মঞ্জু)। সভাশেষে তাৎক্ষণিকভাবে পরিষদের স্থায়ী কার্যালয় হিসাবে টাংগাইলের পুরানো কোর্টবিল্ডিং বেছে নেওয়া হল এবং মাইক্রোফোনে শহরের সর্বত্র সভায় গৃহীত প্রস্তাবসমূহ প্রচার করে দেওয়া হল। পরিষদের ঘোষণা শুনে সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। অনেকে আনন্দিত হলেন। কেউ-কেউ প্রকাশ্যেই বললেন, ‘আমাদের নেতারা তাহলে ভেঙে পড়েননি। হানাদারদের মোকাবেলা করার শক্তি সাহস ও মনোবল সবই তাদের আছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৬

প্রথম অভিযান

হাইকমাণ্ড নেতৃবৃন্দ তাঁদের দপ্তরে বসে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে চলেছেন। অন্যদিকে প্রশাসনযন্ত্রের নানা শাখা থেকে প্রশাসন-প্রধানরা একে একে তাঁদের বিভাগের আনুগত্য প্রকাশ করছেন। এই আনুগত্য প্রকাশে কেউ বাদ নেই—ব্যাঙ্ক, বীমা, আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা থেকে শুরু করে বিচার ও শাসন বিভাগ সকলেই একে-একে তাঁদের নিঃশর্ত আনুগত্যের শপথ নিচ্ছেন।
এই সময় কাগমারী বেতারে ২৫ মার্চ ‘৭১ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ধরা পড়ে—
Pak-Army suddenly attacked E.P.R. Base at Pilkhana, Rajarbag Police Line and Killing citizens. Street battle are going on in every streets of Dhaka-Chittagong. I appeal to the Nations of the world for help. Our freedom-fighters are gallantly fighting with the enemies to free the motherland. I appeal and order you all in the name of Almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country. Ask Police, E. P. R. Bengal Regiment and Ansar to stand by you and to fight, no compromise, victory is ours. Drive out the last enemy the holy soil of motherland. Convey this message to all Awami League leaders, workers and other patriots and lovers of freedom. May Allah bless you. Joy Bangla.
SK. Mujibur Rahman.
26. 3. 71
পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ঢাকার পিলখানা ও রাজার বাগে পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্ ও পুলিশ বাহিনীর উপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালিয়েছে। বহু নাগরিক নিহত। ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরের পথে-পথে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলেছে। আমি বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি। মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে শত্রুর মোকাবেলা করছে। আমি সবাইকে আহ্বান করছি, নির্দেশ দিচ্ছি, সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে সামিল হউন। পুলিশ, পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং আনসার বাহিনীকেও শত্রুর প্রতি রুখে দাঁড়াবার জন্য আপনারা আহ্বান জানান। শত্রুর সাথে কোন আপোস নাই। আমাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে উৎখাত করুন। আমার এই বার্তা সকল আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী, অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে পৌঁছে দিন। জয় বাংলা।
শেখ মুজিবুর রহমান
২৬. ৩. ৭১
পৃষ্ঠা নং ~ ১৭

এই বার্তা দু’জন পুলিশ দিয়ে টাংগাইল থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব বদিউজ্জামান খান থানায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বার্তাটি গ্রহণ করেন এবং প্রচার বিভাগকে সর্বত্র প্রচার করতে নির্দেশ দেন। বদিউজ্জামান খান, সৈয়দ আবদুল মতিন ও লতিফ সিদ্দিকী ২৬ মার্চ সারাদিন স্থানীয় লোকজনদের কাছ থেকে রিভলবার, পিস্তল ও একনলা-দোনলা বন্দুক সংগ্রহ করে আমাদের মধ্যে বিতরণ করেন।
সারাদেশে তখন পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের সবুজ লাল ও সোনালি তিনরঙা পতাকা উঠানো হয়েছে। সারা বাংলায় লক্ষ লক্ষ উড্ডীয়মান বাংলাদেশের পতাকার মাঝে সেনা ছাউনিগুলিতে তখনও দু’একটি পাকিস্তানী পতাকা উড়তে দেখা যাচ্ছিল। টাংগাইল সার্কিট হাউসেও বিষফোঁড়ার মতো একখানা পতাকা পত পত করে উড়ছিল। এটা টাংগাইলবাসীর কাছে বড় বেমানান, বড় যন্ত্রণাদায়ক ঠেকছিল। আমার মনেও পতাকাটি কাঁটার মতো প্রতি মুহূর্তে বিঁধছিল।
তাই ২৭ মার্চ, দুপুরে কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বড় ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে টাংগাইল সার্কিট হাউসের সৈন্যদের ব্যাপারে ভেবে দেখতে অনুরোধ করি, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সার্কিট হাউসের মিলিটারিদের ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করে ফেলা উচিত। কারণ একাধারে হাজার হাজার বাংলাদেশের পতাকার মাঝে একখানা পাকিস্তানী পতাকা যেন পাকিস্তানের অস্তিত্ব ঘোষণা করে চলেছে, তেমনি এই সেনারা যদি রাতের আঁধারে আচমকা শহরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে সহজেই আমাদের ছত্রভঙ্গ করে ফেলতে পারবে। শত্রু নয়, বন্ধু নয়, এমন একটি সশস্ত্র দলকে একেবারে পেটের ভিতরে থাকতে দেওয়া যুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেই সমীচীন নয়।”
বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী, পরিষদ চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান খান ও উপদেষ্টা খোন্দকার আসাদুজ্জামানের সাথে সার্কিট হাউসের মিলিটারিদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সত্যিই এটা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। যেহেতু সার্কিট হাউসের সৈন্যরা প্রায় সকলেই বাঙালি, সেইহেতু তারা যদি আমাদের সাথে যোগদান নাও করে, তারা যাতে আমাদের কোন ক্ষতি করতে না পারে সেটা দেখা উচিত। কিংবা তাদেরকে অন্য কোন উপায়ে কাবু করে অস্ত্রগুলো নিজেদের করায়ত্ত করা যায় কিনা, তার চেষ্টা করা উচিত।
ঘটনাচক্রে এদিন থেকেই আমার উপর টাঙ্গাইলের পুলিশ কোথের যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া সার্কিট হাউসে সৈনিকদের সংখ্যা কত, মনোভাব কি, উদ্দেশ্য কি এবং কোন উপায়ে তাদের আমাদের প্রতি অনুগত করা যায়— এইসব যাবতীয় খোঁজখবর নিয়ে কার্যে রূপায়ণের সমস্ত দায়িত্ব উপদেষ্টা খোন্দকার আসাদুজ্জামানের পরামর্শে সর্বাধিনায়ক আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আমার উপর ছেড়ে দেন। এই গুরুদায়িত্ব অর্পণে হয়তো তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, যেহেতু আমি কিছু সময়ের জন্য সেনাবাহিনীতে ছিলাম, সেইহেতু আমার পক্ষে যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যাপার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হতে পারে। দায়িত্ব পাবার পর আমি খুব উৎসাহিত হয়ে সার্কিট হাউসের সৈন্যদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করি। সহকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে
পৃষ্ঠা নং ~ ১৮

নানাভাবে খোঁজ খবর নিয়ে সন্ধ্যার দিকে জানতে পারলাম যে, এরা দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি। সৈন্য সংখ্যা ১৫০ জন। দুইজন পাঞ্জাবি অফিসার ছাড়া সকলেই বাঙালি। এদের ব্যাটেলিয়ন হেড-কোয়ার্টার ঢাকার জয়দেবপুরে। তারা ১৩ মার্চ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে টাঙ্গাইলে এসেছে এবং সেইদিন থেকে সার্কিট হাউসে অবস্থান করছে।
‘৭০-এর নির্বাচনের পর পাকিস্তানীদের মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, বাঙালি সৈন্যরা যদি ছাউনিতে সংঘবদ্ধভাবে থাকে তাহলে সংকটময় পরিস্থিতিতে হয়তো তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। সংঘবদ্ধভাবে বাঙালি সৈন্যরা যদি বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাহলে তা সামাল দেয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে, অসম্ভবও হতে পারে। সেইজন্য পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিল। সেসময় যে সাতটি পূর্ণ ও একটি অসম্পূর্ণ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল, তাদেরকে সুকৌশলে বিভক্ত করে রাখতে পাকবাহিনী সক্ষম হয়েছিল। পাকিস্তানী সামরিকচক্রের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি সৈন্যরা যতক্ষণ পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুগত থাকবে, ততক্ষণ তারাই বাঙালিদের আন্দোলন দাবিয়ে রাখুক। আর খণ্ড খণ্ড ছড়ানো-ছিটানো বাঙালি সৈন্যরা যদি বিদ্রোহ করেও বসে, বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অল্প অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানী মিলিটারিদের উপর তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। অন্যদিকে পাকিস্তানী মিলিটারিদের ছাউনিতে রেখে শক্তি সুসংহত করাই তাদের উদ্দেশ্য। এই কৌশল ২৫ মার্চ পর্যন্ত তারা অত্যন্ত সফলতার সাথে চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। টাঙ্গাইলে যে-কোম্পানিটি এসেছিল, সেও ঐ একই কারণে। তবে এই সৈন্যদল ১৩ মার্চ টাংগাইল আসার পর ২৭ মার্চ পর্যন্ত কোনদিন কখনও মহড়া দিয়ে শহরে আসেনি। যাওবা দু’একজন এসেছে তারাও সাধারণ পোষাকে। সার্কিট হাউসে সৈন্যদের ব্যাপারে অনুসন্ধানের তথ্য যখন জানানো হল, তখন হাউকমাণ্ড বিচার-বিবেচনায় বসলেন। যেহেতু পুলিশ-আনসারারা সবাই আমাদের পক্ষে, সেহেতু মিলিটারিদের শান্তিপূর্ণভাবে অথবা প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে দলে আনা যায় কি না।
ডি. সি., এস.পি., আনসার এ্যাডজুটেন্ট ও আমাদের গণবাহিনীর সাথে ব্যাপক আলোচনা করে হাইকমাণ্ড সিদ্ধান্ত নিলেন, রাতেই সার্কিট হাউস ঘেরাও করতে হবে। পরিকল্পনামতো, রাত নয়টায় পরিষদের নেতারা গণবাহিনীর চল্লিশ-পঞ্চাশজন সশস্ত্র যুবককে নিয়ে জেলা শহরের রিজার্ভ পুলিশের হেডকোয়ার্টারে এলেন। রিজার্ভ পুলিশের তিরিশ-চল্লিশজন সার্কিট হাউস অভিযানে আমাদের সাথী হল। সশস্ত্র পুলিশদের পেয়ে আমরা বেশ উৎসাহিত হলাম। এতক্ষণ যারা ছিলাম তারা প্রায় সবাই ছাত্র, শ্রমিক, রিকশাওয়ালা ও দু’একজন আনসার। পুলিশরা যোগ দেওয়ায় আমাদের শক্তি আরো বৃদ্ধি হল। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ অভিযানের সফলতা কামনা করে প্রত্যেকের সাথে বুকে বুক মিলিয়ে বিদায় জানালেন। বদিউজ্জমান খান, খোন্দকার আসাদুজ্জামান, ও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আমাদের বিদায় জানিয়ে দুরু দুরু বুকে অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন।
আমরা সত্তর-পঁচাত্তরজন প্রথম অভিযানে চলেছি। অস্ত্রের মধ্যে পুলিশ, আনসারের
পৃষ্ঠা নং ~ ১৯

পুরোনো রাইফেল ও দু’একটা মান্ধাতা আমলের ব্রেটাগান। অভিযান সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ার জন্য ২টি আর. বি. কেন্দ্র ঠিক হয়। একটি হাইকমাণ্ড অফিস, অন্যটি রিজার্ভ পুলিশ হেড-কোয়ার্টার। আমরা খুব সন্তর্পণে বিবেকানন্দ আশ্রমের পাশ দিয়ে লৌহজং নদীর পাড় ঘেঁষে এগুচ্ছি। এমন সময় আমাদের সাথে ফজলুর রহমান এসে যোগ দিলেন। ফজলুর রহমান প্রাক্তন সৈনিক। তাঁকে পেয়ে আমরা আরও উদ্বুদ্ধ হলাম।
ফজলুর রহমান আমাদের সাথে সাথে শ্মশানঘাট পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। আমরা বেশ সন্তর্পণে এগুচ্ছি। হঠাৎ একটু দূরে টাংগাইল ময়মনসিংহে রোডের কোদালিয়া পুলের উপর থেকে কে বা কারা সার্কিট হাউস লক্ষ করে তিন চার রাউন্ড গুলি ছোড়ে। আমরা তখনও সার্কিট হাউস থেকে হাজার গজ দূরে। গুলির জবাবে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সার্কিট হাউস থেকে চাইনিজ মেশিনগান গর্জে উঠল। আমরা সাথে সাথে উল্টে পাল্টে যে যেদিকে পারলাম হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। গুলি কোন দিকে হচ্ছে, সেদিকে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। শুধু কচ্ছপের মতো মাটি খামচে আড়াল নিয়ে জীবন বাঁচাবার চেষ্টা করছি। আমরা সবাই তখন দিশেহারা হয়ে গড়াগড়ি করছি। হঠাৎ কানে এল, ‘হে আল্লাহ একেবারে মরছি’। পাশে আরেকজন বলল, ‘বাবাগো, মাগো গেছি গো’, অন্যদিক থেকে ভেসে এল, বোধহয় মা-বাবারে আর দেখবার পারমু না। কিসে যে মরবার লাইগ্যা আইলাম। শালাগোরে খাইয়া কাম নাই। আমাগো আগে পাঠাইয়া দিয়া শালা আর. আই. এস. পি., নেতারা আরামে বইস্যা মজা দেখত্যাছে। আমরা অইলাম পুলিশ। আমাগো কি যুদ্ধের ট্রেনিং আছে, যে যুদ্ধ করমু?’ এইসব কথা মিনিট দুই শুনলাম। তারপর শ্মশানের নীরবতা।
সার্কিট হাউস থেকে ছোঁড়া মেশিন গানের গুলির ভয়ঙ্কর শব্দে সবার বুক থর থর করে কাঁপছে। টাংগাইলবাসীরা এর আগে হয়তো কোনদিন মেশিন গানের গুলির শব্দ শুনেননি। আমি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে আড়াই বছর ছিলাম। ‘৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের লড়াইয়ে নিজে প্রত্যক্ষভাবে ছিলাম। মেশিনগান, ট্যাঙ্ক ও ভারি কামানের মুহুর্মুহু গুলি ও গোলা আশেপাশে পড়তে দেখেছি। কিন্তু ২৭শে মার্চ রাতে সার্কিট হাউস থেকে ছোঁড়া মেশিন গানের গুলির আওয়াজে আমার বুকও থরথর করে কাঁপছিল। মেশিন গানের আওয়াজ যে এত বিকট, গগনবিদারী হতে পারে—পশ্চিম পাকিস্তানের মরু অঞ্চলে যুদ্ধ করেও তেমন অভিজ্ঞতা অর্জন করিনি। খোলা জায়গার চাইতে জনবহুল বাড়িঘর ঠাসা শহরঅঞ্চলে মেশিন গানের প্রতিটি গুলির নিদারুণ বুকফাটা আওয়াজ আমাদের দিশেহারা করে ফেলেছিল। মুহূর্তে সারা শহরে কান্নার রোল পড়ে যায়। ঘরবাড়ি বিষয়-সম্পত্তি ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ পঙ্গপালের মত শহর ত্যাগ করতে শুরু করে।
যতক্ষণ গুলি চলে ততক্ষণ আমি উপুড় হয়ে মাটি আঁকড়ে ছিলাম। কয়েক মিনিট পর তর্জন গর্জন বন্ধ হলে আস্তে আস্তে সবাইকে ডাকাডাড়ি শুরু করলাম। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার। সোহরাওয়ার্দী, এন. এ. খান আজাদ, মনীন্দ্র মোহন ঘোষ, ইকবাল, আবদুস সবুর খান, রিকশাওয়ালা আলী হোসেন ও আরো সাত-আট জন ছাড়া বাকি সবাই উধাও। কেউ নেই। একজন পুলিশেরও নেই। একজন পুলিশের ও পাত্তা নেই। আমরা বুকে হেঁটে আস্তে আস্তে এক জায়গায় জড়ো হয়ে, হাকিহুকি করে কথা বলে
পৃষ্ঠা নং ~ ২০

ঠিক করলাম, আমাদের কিছুটা পিছিয়ে যাওয়া উচিত। বিবেকানন্দ স্কুলের বটতলা পর্যন্ত পিছিয়ে এসে আলোচনায় বসলাম, এখন আমাদের কর্তব্য কী? আলোচনার একপর্যায়ে সবুর বলে উঠল, “অক্ষণি আমাগো আওয়ামী লীগ অফিসে যাইয়া দেহা দরকার, হাইকমাণ্ড কনে? নেতাগো খুঁইজা বাইর করন লাগবই। এই যে পুলিশরা পলাইয়া গেল, এর একটা রিপোর্ট অক্ষণি হাইকমাণ্ডরে দেওন উচিত। আমি মূর্খসূর্খ মানুষ। নেহাপড়া জানি না। কিন্তুক আমার বিচারে কয়, যুদ্ধের বিষয় খবর-টবর সাথে সাথে কমাণ্ডাররে দিতে অয়।” সবুরের কথাগুলো সকলেই সমর্থন করল। আমারও মনঃপুত হল। তাই আমরা পুরানা শহরে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে এসে দেখি এক হুলস্থুল কারবার। সকলেই উদ্বিগ্ন, আর্মির গুলিতে শহরে যে বিশৃঙ্খলা ও ভয়ার্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে নেতারা ভীষণ উৎকণ্ঠিত। বিশেষ করে আমরা সার্কিট হাউস আক্রমণ করতে গেছি, আর সেই সার্কিট হাউস থেকে গুলি হয়েছে। গুলিতে আমাদের কোন ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে কিনা, আমরা জীবিত আছি কিনা, কিভাবে আমাদের সংবাদ পাওয়া যাবে—এ সমস্ত চিন্তা-ভাবনা নিয়ে হাইকমাণ্ড যখন চিন্তিত, তখন আমরা উস্কোখুস্কো চুল, চোখ মুখ লাল, ধূলি-কাদা গায়ে হতাশ অবস্থায় ভূতের মতো তাদের সামনে হাজির।
আমাকে দেখে সর্বাধিনায়ক লতিফ সিদ্দিকী ছুটে এসে জাপটে ধরেন। তারপর একে একে অন্যদেরও জড়িয়ে ধরলেন। আমরা ফিরে এসেছি শুনে, চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান, উপদেষ্টা খোন্দকার আসাদুজ্জামান ও অন্যান্য নেতারা দৌড়ে এসে আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “গুলি কেন হল? কী হল? আমাদের কেউ হতাহত হয়নি তো?” সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে অনুযোগের সাথে আমরা পুলিশদের পিছিয়ে যাওয়ার কথা বললাম। পরে অনেক আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হল, আপাততঃ সার্কিট হাউস অভিযান স্থগিত রইল। তখন রাত ১২টা। অনেকেই ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। পরিষদের নেতারা একত্রে থাকবেন বলে মনে হল। আমরা ১৮ জন হাতিয়ারসহ আওয়ামী লীগ অফিসের পাশে ক্ষিতীশবাবুর চায়ের দোকানে ঢুকলাম। সেখানেই জানতে পারলাম প্যাড়াডাইস্-পাড়ার মুসলিম লীগের নজরুল দোনালা বন্দুক দিয়ে ঐ গুলি ছুড়ছে। পরিষদের সিদ্ধান্ত আমার মনঃপুত হয়নি। চায়ের দোকানে দু’একটা কথাবার্তার পরই বুঝতে পারলাম, সিদ্ধান্তটা আমার মতো অনেকেরই মনঃপুত হয়নি। তাই ঠিক করলাম নিজেরাই আবার সার্কিট হাউস আক্রমণ করব। চা-পান শেষে সাবালিয়া ঘুরে সার্কিট হাউসের পূর্বদিকে সি. এন্ড. বি-র ইঁটের পাঁজার মাঝে পজিশন নিলাম। যে ইঁটের পাঁজার কাছে দিনে যেতেও ভয় করত, সেই ইঁটের পাঁজার ভিতর অনায়াসে অবলীলায় শুয়ে পজিশন নিলাম। এক মুহূর্তের জন্যও সাপ খোপের ভয় হল না। সাব্যস্ত হল সূর্যোদয়ের মুহূর্তে সার্কিট হাউস আক্রমণ করা হবে।
আমাদের থেকে সার্কিট হাউসের দুরত্ব ২০০ গজ। সাপের ভয় এড়াতে পেরেছি, সর্বাধুনিক অস্ত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছি। আমরা প্রতিমুহূর্তে জান দিতে প্রস্তুত। বলতে গেলে সবকিছুই জয় করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু আমাদের সেই বীরদের একঘন্টায় মশা কামড়ে নাস্তানাবুদ করে ফেলল। মিলিটারিদের আক্রমণ করার পূর্বেই মশাকে আক্রমণ শুরু করলাম। অসাবধানে হাত-পা চালাতে গিয়ে স্তূপ থেকে দু’একটা
পৃষ্ঠা নং ~ ২১

ইট খসে পড়ে শব্দ হওয়ায় সার্কিট হাউস থেকে আমাদের দিকে আবার মেশিন গানের গুলি চলল। মেশিন গানের গুলির আগুনের ফুলকি আমাদের মাথার উপর দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দে চলে যেতে লাগল। কয়েক মুহূর্ত গুলি চলার পর অবস্থা শান্ত হলে আমরা বুকে হেঁটে ৫০-৬০ গজ পিছিয়ে ময়মনসিংহ-টাংগাইল পাকা রাস্তার পূর্বপাশে এসে আশ্রয় নিলাম। রাত তখন ২টা। সূর্যোদয়ের তখনও আড়াই-তিনঘন্টা বাকি। তাই ওখান থেকে সরে এসে সাবালিয়ায় একটি বাসে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। এখানেও মশা আমাদের পিছু ধাওয়া করল। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে মণীন্দ্রমোহন ঘোষকে মশা তাড়ানোর ঔষধ আনতে দোকানে পাঠানো হল। কিন্তু মণীন্দ্রমোহন ঘোষ মশার ঔষধ আনতে গিয়ে খোদ সর্বাধিনায়ককে নিয়ে এসে আর-এক বিপদে ফেলে দিল। বড়ভাই এসে হুড়মুড় করে বাসে উঠে বললেন, “এসব কী হচ্ছে? তোদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমি তো পরিষ্কার মানা করে দিয়েছি, সার্কিট হাউস আক্রমণ করা চলবে না। তোরা তারপর কী শুরু করেছিস?” আমি মৃদুস্বরে বললাম, “না, আমরা সার্কিট হাউস আক্রমণ করতে আসি নাই। আমরা একত্রে শুধু রাতটা কাটানোর জন্যে এসেছি।”— ‘রাখ তোর বাজে কথা। আমি সব শুনেছি; মণি আমাকে সব বলে দিয়েছে। রাত পোহালেই তোরা সার্কিট হাউসে গিয়ে গুলি ছুড়তি।’ এরপর শান্ত গলায় স্নেহের সুরে বললেন, ‘দেখ, তোরা পাগলামি করিস্ না। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। এতে করে তেমন একটা লাভ হবে না। বরঞ্চ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তোরা বাড়ি চলে যা।’
—রাতটা শেষ হলেই আমরা যার যার মতো চলে যাব।
—রাখ তোদের চালাকি। আমি এখান থেকে সরলেই তোরা কাদেরের কথামতো কাজ করবি। আমি তোদের হাতিয়ার আটক করলাম।
আমরা পড়লাম মহা ফ্যাসাদে। এখন উপায়! স্বয়ং প্রধান সেনাপতি আমাদের হাতিয়ার আটক করলেন। তারপর তাঁর আস্থাভাজন আবদুস সবুর খান ও আর একজনকে পাহারায় রেখে চলে যাবার সময় বলে গেলেন, “আমি যেয়েই ফোর্স ও গাড়ি পাঠাচ্ছি। এই হাতিয়ার এক্ষুণি অস্ত্রাগারে জমা হয়ে যাবে।” সবুরকে কড়া নির্দেশ দিয়ে বললেন, “দেখ, আমি আশা করি তুমি আমার আস্থা হারাবে না। ঠিকমতো ডিউটি করবে। ওদেরকে অস্ত্রের কাছে ঘেঁষতে দেবে না। তোমাদের দুইজনের হাতে যে অস্ত্র দিয়ে গেলাম তা এই হাতিয়ার রক্ষা করার জন্যে, প্রয়োজনে গুলি ছুঁড়তেও দ্বিধা করবে না।”
সর্বাধিনায়ক চলে যাবার পর আমরা সবাই বিষণ্ন বদনে মনমরা হয়ে বসে আছি। তখন আর মশার কামড় তেমন মালুম হচ্ছে না। সময় সংক্ষিপ্ত, কী করব? সর্বাধিনায়কের আদেশ অমান্য করব? আর কিভাবে করব? হাতিয়ারের দিকে গেলেই সবুর গুলি ছুঁড়বে। এমনিতে সবুর ভীষণ আইনের লোক। সোহরাওয়ার্দী খুব আস্তে করে বলল, ‘আমি সবুর ভাইয়ের সাথে দু’একটা কথা বলে দেখি। কী ফল দাঁড়ায়।’ সোহরাওয়ার্দী হাঁক ছাড়ল, — “কী সবুর ভাই। লাটের হালে আছেন
পৃষ্ঠা নং ~ ২২

দেখি? আপনারই পোয়াবারো! আপনারে আমরা সবাই ভালোবাসি, আমাগো নেতাও ভালোবাসে। আসলে আপনিই আমাগোর আশা। নেতা তো আপনিই।”
— ছিঃ ছিঃ সোহরাওয়ার্দী ভাই, আমারে আর নজ্জা দিয়েন না। আমি তো আপনাগো সবার লগেই আছি। দেহেন চে, কী বিপদেই না পড়লাম। শালার মিলিটারিগো সাথে পাইট করমু, এদিকে সি-ইন-সি সাব গোলারুদ এ্যারেষ্ট কইরা ফেলাইল। এহন করিডা কী?
সবুরের কথায় আমরা কিছুটা সাহস পেলাম। সবুর আমাদের পূর্ব পরিচিত নয়। আজ সন্ধ্যায় সে আমাদের সাথে পরিচিত ও মিলিত হয়েছে। তখন আমরা কেউ সবুরের কাছে আসল কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। এই সময় আজাদ বলল, “সবুর ভাই, মশার কামড়ে আর পারি না। আমরা একটু গাড়ির নিচে যাই।” সবুর কোন আপত্তি করল না। বরঞ্চ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল— “আরে বলতাছেন কেন? আপনারা তো আর এ্যারেষ্ট না। খালি অস্ত্রগুলো এ্যারেষ্ট কইরা গেল। আমি তো খালি অস্ত্রের ডিউটি করতাছি, আপনাগোরতো না!’ আমরা বেরুলাম। অনেক কথাবার্তার পর স্থির হল যে, আমরা একজনকে নেতা বানাব এবং সবুরকে গিয়ে বলব যেহেতু আমরা সবাই নেতার কথা শুনি, সেহেতু আপনাকেও শুনতে হবে। যদি না শোনেন তাহলে হাই কমান্ডের কাছে আমরা রিপোর্ট করব, আপনি কারো কথা শোনেন না। তাই আপনাকে যেন আর কোন সময় যুদ্ধে না পাঠায়। পরামর্শ করে আমরা গাড়িতে উঠলাম। এবার সবাই কিছুটা অস্ত্রের কাছাকাছি বসলাম। সোহরাওয়ার্দী শুরু করল।
– সবুর ভাই, আমার কিছু কথা আছে।
– কন আপনার কী কথা?
– দেখেন, সব জিনিসের একটা আইন আছে তো! আমাগো তো আইন মাইন্যাই চলতে হবে। তা না হইলে আমরা স্বাধীন হতে পারব না। আমাগোরে যখন পুলিশ লাইন থেইক্যা বিদায় করে দিল তখন আপনি তো দেখছেন, পুলিশগো একজন কমাণ্ডার আছিল।
— আছিলই তো! দুইটা লাল ফিতাঅলা হাওলাদার।
— তাহলে দেখেন। পুলিশগোরে যদি কমাণ্ডার থাকে, তাইলে আমরা যারা জনসাধারণ আছিলাম আমাগোরে একজন কমাণ্ডার আছিল।
সবুর লাফ মেরে বলে উঠল, ইয়েস কথা, হক কথা।
— আপনি জানেন আমাগো কমাণ্ডার কে?
— আমি তো ঠিক বুঝবার পারি নাই। কিন্তু টারেটুরে মনে অইল সি. ইন. সি. স্যারের ভাই, কাদের ভাই বোধহয় আমাগো নেতা। হে তো ছাত্রগোরও নেতা। সবুরের কথা শুনে সবাই সোল্লাসে বলল – আপনি ঠিক কইছেন, কাদের ভাইইতো—আমাদের নেতা। সোহরাওয়ার্দী আবার বলল—আপনার মনে নাই, সন্ধ্যায় সময় সবাইকে বলে দেয়া হয়েছে যাকে কমাণ্ডার করা হবে, তার কথা সবাইকে মেনে চলতে হবে। যদি কমাণ্ডারের কথা না-মানা হয়, তাহলে তাঁকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। আপনি স্বীকার করেন তো যে আমাদের কমাণ্ডার কাদের ভাই।
পৃষ্ঠা নং ~ ২৩

— হ্যাঁ, স্বীকার করি তো।
— তাহলে কাদের ভাইয়ের কথা না শুনলে আমাদের কী হবে?
সবুর জোর দিয়ে বলল — তাইলে তো সবার জেল হইয়া যাইব।
— তাইলে দেখেন আমাদের কমাণ্ডার হুকুম দিয়েছে, হাতিয়ার নিয়ে নিতে, এখন আমরা কী করি? আমরা তো আমাদের হাতিয়ার নিয়ে নেব। আপনি গুলি করলে করেন। তাইলে আর পাকিস্তানীদের গুলিতে মরতে হবে না। নিজের ভাইয়ের গুলিতে মরব। এর চাইতে শান্তি, এর চাইতে বড় পাওয়া আর কী আছে?’ এই বলে সোহরাওয়ার্দী মহা নাটকীয় ভঙ্গিতে কেঁদে ফেলে আস্তে আস্তে অস্ত্রের কাছে এগিয়ে যায় আর কি? সোহরাওয়ার্দীর কথায় সবুরও খুব চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছিল। সবুর বলল, সোহরাওয়ার্দী ভাই, হুনেন, হুনেন। কাইন্দেন না, কাদের ভাইতো আমারও কমাণ্ডার। হেতো আমারে বন্দুক দিয়া দিবার অর্ডার দেয় নাই। হে আমারে অর্ডার দেইক্, কাল যদি হাইকমাণ্ড আমারে এ্যারেষ্ট করে তহন আমি কমু, আমার কমাণ্ডার হুকুম দিছে, আমি অস্ত্র দিয়া দিছি—গুলি করবাইন, জেল দিবাইন, না ফাঁসি দিবাইন, আমার কমাণ্ডারের দেন গিয়া, আমি আইন মানছি।
সবুর খানকে বললাম, ‘অর্ডার দিচ্ছি। আপনি সব হাতিয়ার দিয়ে দিন।’ সবুর কোন প্রতিবাদ করল না। অনুগত সহযোদ্ধার মতো সবাইকে হাতিয়ার দিয়ে দিল। এভাবেই আধ ঘন্টার নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটল। আধঘন্টা একটা প্রচণ্ড মানসিক উথাল পাথালের পর হাতিয়ার ফিরে পেয়ে আমরা অনেকটা স্বাভাবিক হলাম। হাতিয়ার নিয়ে তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে সোজা কোদালিয়ার দিকে ছুটলাম। আমরা গাড়ি থেকে এক-দেড়শ’ গজ দূরে যাবার পরই বাসের দিকে ধেয়ে আসা ২-৩টা গাড়ির হেড-লাইটের তীব্র আলো দেখতে পেলাম। আমরা গ্রামের কাঁচা পায়েচলা আঁকাবাঁকা পথের আশেপাশে লুকিয়ে পড়লাম। গাড়িগুলো এসে বাসের সামনে থামল। ধুপধাপ করে সবাই গাড়িতে উঠল। কিন্তু সব ফাঁকা। কোথাও কিছু নেই। আমাদের আর একমিনিট দেরি হলে হাতিয়ারগুলো হাতছাড়া হয়ে যেত।
রাত ৩টা। কোদালিয়া প্রাইমারি স্কুলে হাজির হলাম। উদ্দেশ্য, বাকি রাতটা কাটিয়ে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সার্কিট হাউস আক্রমণ করব। দুই-তিনজনকে বাইরে নজর রাখতে দিয়ে আমরা চেয়ার-বেঞ্চিতে বসে আছি। বিশ্রাম করছি। সময় কাটাচ্ছি। এখানে তেমন মশার উপদ্রব নেই। সহকর্মীদের মধ্যে দু’তিনজন মত দিল, রাত চারটার দিকে সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলা উচিত। অন্য দু’জনের মত না, সূর্যোদয়ের আগে কোনক্রমেই নয়। এখানেও কথাবার্তার একফাঁকে সবুর তার নতুন চিন্তার কথা প্রকাশ করল। সে বলল, “দেহেন, আপনাগোর মধ্যে আমি হইলাম গিয়া সবচাইতে মূর্খ-সুখ নোক। আমার একটা কথা মনে হইছে। আপনারা সবাই যদি পারমিশন দেন, তাইলে কই।” আমরা সবাই সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘তা আপনি বলবেন না তো কে বলবে? বলুন, বলুন, আপনার বুদ্ধি ছাড়া আমাদের কোন কাজই হবে না।” আমাদের কথায় সবুর উৎসাহিত হয়ে বলল, “পাইট দিমু তো! আমাগোর কাছে যে অস্ত্র-শস্ত্র আছে, —ওগোরে
পৃষ্ঠা নং ~ ২৪

কাছে তো অনেক বড় বড় অস্ত্র। আমি হুনছি, যুদ্ধে বড় বড় অস্ত্রই লাগে। আমাগো কাছে তো বড় বড় অস্ত্র নাই, তাই বইলা কি যুদ্ধ বন্ধ রাখন যাইব? ভয় পাইলে চলব? বড় বড় অস্ত্রের কাম বুদ্ধি দিয়া চালান লাগব। দেহেন, আমি একটা কথা কই। আমরা একটা মাইক আনি। আমাগো তো মাইক আনতে কোন অসুবিধা নাই। আমরা মাইকের কাছে গুলি করুম। আর মাইকে হেইডার আওয়াজ মটরের মতো মনে হইব।” সবুরের কথা শুনে সোহরাওয়ার্দী বলল, “আমি একটা কথা বলতে চাই” আমাদের উদ্দেশ্য তো বাঙালি মিলিটারিদের ধ্বংস করা নয়, ওদেরকে আমাদের সাথে শরিক করা। ওদেরকে যে আমরা চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছি, তা ওদের জানানো উচিত। এবং আমরা কী করতে চাই, সবুর ভাইয়ের পরামর্শ মতো মাইকে তা বলতে পারি।” এবার অস্ত্র হিসাবে মাইকের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। সূর্যোদয়ের আগে কোথায় মাইক পাওয়া যাবে? মণি, ইকবাল দায়িত্ব নিল, ‘আমরা এক্ষুণি মাইক নিয়ে আসতে পারি। আমাদের মাইক আনতে পারমিশন দেন।’ মণি ও ইকবাল মাইকের জন্য চলে গেলে আমরা সার্কিট হাউসের পাশে টাংগাইল-ময়মনসিংহ রাস্তার গা ঘেঁষে অবস্থান নিলাম।
সূর্যের রক্তিম আভা পূর্ব দিগন্তে উদ্ভাসিত। বিশ্বপ্রকৃতির বুকে নবজাগরণের সাড়া প্রকৃতি ও প্রাণীকুল এক নতুন আশার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত। ভোরের আলোয় সার্কিট হাউসে মিলিটারিদের চলাচল লক্ষ করছি। সার্কিট হাউসের অবস্থা মোটেই স্বাভাবিক নয়। রাতটা ওদের ভালো কাটেনি। রাতে ওরা বেশ কয়েকবার গুলি ছুড়েছে। সারা রাতেই ওদের ধারণা ছিল, পাকিস্তানী গেরিলারা ওদেরকে নিরস্ত্র করার জন্য ঘেরাও করেছে। ভোর হলে অন্যদিনের মতো পাকা রাস্তা দিয়ে লোকজন চলাচল শুরু করল। জনসাধারণ আপনমনে যাওয়ার পথে আমাদের রাস্তার পাশে অস্ত্র হাতে শুয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হয়ে গেল।
মাইক এল ভোর সাড়ে পাঁচটায়। একসেট নয়, আট-দশ সেট। তাড়াতাড়ি রাস্তার কোল ঘেঁষে অনেকগুলো মাইকের হর্ন লাগানো হল। ছ’টার মধ্যে মাইকে কথা বলা শুরু হয়ে গেল। একটা কথা নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা হল আমরা তাদেরই ভাই। সাড়ে ছ’টায় আমি মাউথপিস হাতে নিলাম। মিলিটারিদের উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলাম— “বন্ধুগণ, আজ বাঙালির বাঁচামরার যে সংগ্রাম শুরু হয়েছে, তাতে সমস্ত বাঙালিই এক ও অভিন্ন। আমরা যদি সকলে সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যে স্বৈরাচারী পাকিস্তানী শক্তিকে হাত গুটাতে হবে। ২৫ মার্চ রাত বার’টার পর থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম। বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিতেও বিদেশী শক্তির কর্তৃত্ব বাঞ্ছনীয় নয়। এখন থেকে বাংলাদেশের একমাত্র সেনাবাহিনী হবে বাঙালি এবং তা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। আপনারা যারা বাঙালি তারা আমাদের ভাই। বাংলার লাখো লাখো মানুষ বছরের পর বছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রক্ত পানি করে আপনাদের বেতন জুগিয়েছে। আজ পাকিস্তানীরা আমাদের আক্রমণ করেছে।
তাই স্বাভাবিক কারণে আমরা আপনাদেরকে আমাদের পাশে পেতে চাই। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ, আপনারা আমাদের সাথে শরিক হন, মুক্তি বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করুন। আমি পরিষদ কর্তৃক
পৃষ্ঠা নং ~ ২৫

নির্দেশিত হয়ে আপনাদের অনুরোধ করছি, আপনারা আমাদের সাথে শরিক হন। অন্যথায় শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ রয়েছে। গত রাত থেকে আপনারা চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছেন, আপনাদের সাথে বাইরের যোগাযোগ এখন ছিন্ন। প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুর সেই নীতি—ভাতে মারব, পানিতে মারব অবলম্বন করতেও আমরা পিছপা হব না। আমরা যে মাটি ও আলো-হাওয়ায় মানুষ হয়েছি, আপনারা সেই মাটিরই মানুষ। আমরা একই মায়ের সন্তান। বঙ্গজননীর লাঞ্ছনার প্রতিবাদে আসুন আমরা একত্রিত হয়ে দখলদার পাকিস্তানীদের মোকাবেলা করি। আমরা আপনাদের সাথে সামনা সামনি কথা বলতে চাই। আমরা আমাদের দূত আপনাদের কাছে পাঠাতে চাই। দূত পাঠানোর প্রথম শর্ত হল, উভয়পক্ষ থেকে সবুজ পতাকা উত্তোলন। আমরা আমাদের পতাকা উত্তোলন করছি। আপনারাও আপনাদের পতাকা উত্তোলন করুন।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী!”

বক্তৃতা শেষে করে আমাদের দিক থেকে বাংলাদেশের ছোট্ট একটি পতাকা উত্তোলন করা হল। একটু পরে দেখা গেল, ওদের দিক থেকে একটা সবুজ কাপড় উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা সকলে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী’ শ্লোগানে ফেটে পড়লাম। ইতিমধ্যে রাস্তা আড়াল করে আমাদের পিছনে শত শত লোক সমবেত হয়েছেন। তারাও আমাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে শ্লোগান দেওয়া শুরু করলেন। শ্লোগান শেষে শুরু হল শলাপরামর্শ, সার্কিট হাউসে কে যাবে? কিভাবে যাবে? খালি হাত, না সশস্ত্র? নানা শলা-পরামর্শের পর সাব্যস্ত হল, একজন সার্কিট হাউসে যাবে এবং খালি হাতেই। সার্কিট হাউসে যাবার প্রার্থী পাঁচজন। এন. এ. খান আজাদ, ইকবাল, মণীন্দ্রমোহন ঘোষ, সবুর খান ও মিন্টু। প্রার্থী পাঁচজন হওয়ায় দূত পাঠানোয় সমস্যা দেখা দিল। পাঁচজনের সবাই বলল, ‘আপনি যাকে বলবেন সেই যাবে। আমি যাকে বলব সেই সার্কিট হাউসে যাবে, এ তো মহা ফ্যাসাদে পড়লাম! কার নাম বলব? সে যদি আর ফিরে না আসে, তখন কী হবে? আর এটা খুবই সত্য, তখন পর্যন্ত আমার মধ্যে নির্দেশ দেবার মতো আত্মপ্রত্যয় ছিল না। শেষে বাধ্য হয়ে একজনকে বললাম, আমাকে পাঁচ টুকরা কাগজ এনে দাও। পাঁচ টুকরা কাগজে পাঁচ জনের নাম লিখে পকেটে রাখলাম। লটারির মতো অন্য একজন সহকর্মীকে পকেট থেকে মাত্র একটি কাগজ তুলতে বললাম। সহকর্মীর হাত থেকে কাগজ নিয়ে খুলে দেখি মণীন্দ্রমোহন ঘোষের নাম লেখা রয়েছে। মণি প্রথমে যাবে। সবার মনে একটা অজানা আশঙ্কা, সকলের মুখ গম্ভীর, থমথমে। সকলে মণীন্দ্র মোহন ঘোষের সাথে বুকে বুক মিলিয়ে রওনা করিয়ে দিয়ে তার চলার পথে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মণি স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাচ্ছে। আমরা একে অপরের সাথে কথা বলছি। বাঙালির মধ্যে বিশ্বাসঘাতকের অভাব নেই। যদি ওরা বেইমানি করে? তাহলে আমরা কোন কথা শুনব না। সোজা সার্কিট হাউসে গিয়ে উঠব। মরি মরব। তবে দুই-চাউরডা মাইরা মরুম। আমার বুকও ধুক ধুক করছে। মণি এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ওদের কাছাকাছি পৌঁছেছে, কিন্তু ওরা কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। মণি সার্কিট হাউসের গেটে পৌঁছতেই দেখলাম,
পৃষ্ঠা নং ~ ২৬

ওরা কয়েজন এসে মণিকে আলিঙ্গন করে তার সাথে কথা বলল। আমরা কিছুই শুনতে পেলাম না। কারণ আমরা সার্কিট হাউস থেকে ৩০০ গজ দূরে। মণি আবার স্বাভাবিকভাবে পূর্বের চেয়ে একটু দ্রুত ফিরে আসছে। আমরা সবাই উৎকণ্ঠিত জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। কাছে আসতেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিরে, কী বলছে ওরা?’
— ওরা বলছে আমরা আপনাদের সব কথা শুনেছি। আমরাও বাঙালি। মিলিটারীতো, আমাদের একটা ‘ডিসিপ্লিন’ আছে। আমাদের অফিসাররা নির্দেশ দিলেই আপনাদের সাথে যোগাযোগ করব। আমরা আমাদের হেড-কোয়ার্টার জয়দেবপুরে যোগাযোগের চেষ্টা করছি।
আমি যখন মণীন্দ্রমোহন ঘোষের সাথে কথা বলছিলাম তখন একজন ছাত্র দৌড়ে এল। সে আমাদের মাঝে এসে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘চিটাগাং বেতার আমাদের দখলে। মেজর জিয়া নামে একজন বাঙালি মিলিটারি অফিসার চিটাগাং বেতারে বক্তৃতা করছে। এই যে আমি টেপ করে এনেছি’ এই বলে সে ক্যাসেট রেকর্ডার হাতে তুলে দিল। আজ আমি তার নাম স্মরণ করতে পারছি না। যদিও মনে রাখা উচিত ছিল, কিন্তু ক্যাসেটটা পেয়ে এতই খুশি হয়েছিলাম যে আমার কিছুই খেয়াল ছিল না। ক্যাসেট রেকর্ডার নিয়ে প্রথমে নিজেরা শুনলাম। হ্যাঁ, একজন বাঙালির কণ্ঠ। তিনি ইংরেজিতে নিজেকে মেজর জিয়া বলে দাবি করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে সকল বাঙালি সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু সুস্থ আছেন। তিনি নিরাপদে কন্ট্রোল রুম থেকে আমাদের সর্বরকম নির্দেশ দিচ্ছেন। বিশ্ববাসীর কাছে আমরা সাহায্য চাই। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।’
মেজর জিয়ার বক্তৃতা শুনে তাড়াতাড়ি তা আবার মাইকে প্রচার শুরু করা হলো। মণিকে এরমধ্যে আরেকবার পাঠিয়েছি। তাকে বলে দিয়েছি, আমরা সেনা বাহিনীর কারো সঙ্গে সামনা সামনি কথা বলতে চাই। আপনারা কেউ আসুন। মেজর জিয়ার বক্তৃতা তখন মাইকে বেজে চলেছে। মণি এবার তার সাথে ইকবালকে নিয়ে গেছে। মণি সার্কিট হাউসে থাকবে, তার বদলে সেনাবাহিনীর একজন আমাদের কাছে আসবে। হলও তাই। ওরা সার্কিট হাউসে গেটের সামনে পৌঁছলে তিন-চার জন এগিয়ে এসে কিছু কথাবার্তা বলল। মণি ওদের সাথে থেকে গেল আর ইকবাল মিলিটারিদের একজনকে নিয়ে আমাদের কাছে এল। ইকবালের সাথে আসা হাওয়ালদার সাহেবকে খুব হাসিখুশি ও বিনম্র মনে হল, তিনি যেন আমাদের কতকালের পরিচিত। উনি এসেই বললেন, “দেখেন, আপনারাতো আমাদেরই ভাই। আমরাও আপনাদের ভাই। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি, কিন্তু মিলিটারি তো! আমাদের আলাদা ডিসিপ্লিন আছে। আমরা নিজে থেকে কিছু করতে পারি না। নিজেরা কিছু করলে কোর্ট মার্শাল হয়ে যাবে হেড-কোয়ার্টার থেকে বললেই আমরা আপনাদের সাথে এক হয়ে যাব। সুবেদার সাহেব অনুরোধ করেছেন, আপনারা আমাদের মতামত জানাতে একদিন সময় দিন।” হাওলদারের কথা শুনে আমি বললাম, “দেখুন, সুবিধা-অসুবিধা আমরাও বুঝি। কিন্তু এখন এমন একটা সময় এসেছে যখন অনেক কিছুই নিয়মের
পৃষ্ঠা নং ~ ২৭

সাথে তাল রেখে নির্দেশ মতো হবে না। আজ একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে কিছু কিছু এমন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটবে যা ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমি আপনার সুবেদার সাহেবের সাথে সরাসরি কথা বলতে চাই। আপনাদের কোম্পানি কমাণ্ডার কে? ক’জন অফিসার আছেন? তারা বাঙালি, না অবাঙালি?” আমার প্রশ্ন শুনে শুধু এক মুহূর্ত চিন্তা করে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমাদের কোম্পানিতে পাঁচজন অফিসার। এদের তিনজন বাঙালি, দুইজন পাঞ্জাবী। আমাদের কোম্পানি কমাণ্ডার পাঞ্জাবী।’
— ঠিক আছে, চলুন আমি আপনাদের সুবেদার সাহেবের সাথে কথা বলব।
— তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি সুবেদার সাহেবের কাছ থেকে শুনে আসছি। এই বলে তিনি ইকবালকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন এবং একটু পরে মণিকে নিয়ে আবার ফিরে এলেন। এসেই বললেন, ‘সুবেদার সাহেব উনার সাথে কথা বলেছেন। আপনার লোকের কাছেই শুনে দেখুন।’
মণি বলল, “সুবেদার সাহেব বেলা বারটা পর্যন্ত সময় চাইছেন।”
অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর সবুর তার মুখ খুলল, “একজন আরেকজনের সাথে কথা কইব, তা আবার বারটা-তেরটা ক্যান? দেহেনতো হাওলদার সাব। আপনাগোর কমাণ্ডার আমাগো কমাণ্ডারের সাথে কথা কইব, তা আর বারটা লাগব ক্যান? যক্ষন-তক্ষন কথা বলতে পারে। হাওলদার সাবগো আপনে যাইয়া বুঝাইয়া বলেন, নয় আমি যাইয়া বুঝাই।” আমি হাওলদার সাহেবকে বললাম, “ঠিক আছে কোন সিদ্ধান্তে আসতে হবে না। সিদ্ধান্তে আসতে হলে হয়তো সময়ের দরকার হতে পারে। কিন্তু সাধারণ কথা বলতে তো কোন বাধা দেখছি না। সিদ্ধান্ত আপনারা বারটার পরেই নেবেন। আমরা এখন শুধু কথা বলতে চাই।” ‘এখনই সুবেদার সাহেবকে জানাচ্ছি’ বলে হাওলদার একাই চললেন। আমরাও পাঁচ-সাতজন তার পিছুপিছু চললাম। হাওলদার শুধু যাচ্ছেন আর পিছু ফিরে বারবার বলছেন, “আপনারা এখানেই থাকেন। আমি আগে সুবেদার সাহেবের অনুমতি নেই। অনুরোধ করছি, আপনারা সাথে সাথে আসবেন না। আপনাদের ক্ষতি হতে পারে। আপনারা দয়া করে আমার কথা শোনেন।” কিন্তু কে কার কথা শুনে! আমরা তাঁর পিছু পিছু সার্কিট হাউসে প্রধান গেটে পৌঁছে গেলাম। শেষ মুহূর্তে ভদ্রলোক আমার হাত ধরে কেঁদে ফেলে বললেন, “আপনারা নিজেরা তো মরবেনই, আমাকেও মারবেন। আমার স্ত্রী-পুত্র আছে। আপনারা একটু পিছিয়ে দাঁড়ান, আমি সুবেদার সাহেবকে আগে বলি।” এতকিছুর পরেও কিন্তু আমরা হাওলদারের মুখে বিরক্তি কিংবা রাগের লেশমাত্র দেখলাম না বা রূঢ় কণ্ঠেরও কোন আভাস পেলাম না। শেষ পর্যন্ত হাওলদারের অনুরোধে গেটের সামনে দাঁড়ালাম। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির সহকারী কমাণ্ডার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুবেদার জিয়াউল হক ভূইঞা তখন আমাদের থেকে মাত্র ২৫ গজ দূরে। ইকবাল আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ইকবালের মুখে শঙ্কার ছাপ। জেল গেটে দাঁড়ানো অপরাধীর মতো দেখাচ্ছে। হাওলদার সাহেব সুবেদারের কাছে পৌঁছানো মাত্র জিয়াউল হক সাহেব আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। এসেই
পৃষ্ঠা নং ~ ২৮

নম্রভাবে সালাম জানালেন। আমরাও তাকে সালাম জানালাম। সুবেদার বললেন, “ভাই, আপনারা ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। আমরা আপনাদের সাথেই আছি। আমরা আপনাদের ভাই। জয়দেবপুর থেকে খবর এলেই আমরা আপনাদের সাথে মিলিত হব।” এই সময় একজন নায়েব সুবেদার এসে বললেন, “১২টা নয়, ১০টার মধ্যে আমরা যদি জয়দেবপুরের সাথে যোগাযোগ করতে না পারি তাহলেও আপনাদের সাথে মিলিত হব।” আমাদের পেছনে ইতিমধ্যে প্রায় হাজারখানেক লোক এসে দাঁড়িয়েছে। এবারে আর আড়ালে নয়, উন্মুক্ত প্রান্তরে। আমাদের এই তুলকালাম কাণ্ডের খবর হাইকমাণ্ড অফিসেও পৌঁছে গেছে। আমার ঠিক মনে নেই, সোহরাওয়ার্দী অথবা ছাত্রলীগের ফারুক ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে বসল। পিছনে হাজার জনতার মুখে মুখে শ্লোগান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল। জনতার শ্লোগান শুনে সার্কিট হাউসের বাঙালি মিলিটারিরাও স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠ মেলালেন। শ্লোগানে শ্লোগানে নতুন জেলা শহর প্রকম্পিত ও মুখরিত হল। সাধারণ সৈন্যরা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দেয়ায় আমরা খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠলাম। কে কার বাধা মানে। গেট ঠেলে সবাই ভিতরে ঢুকে পড়লাম। জনতার ভিড় বন্যার জলের মতো মুহূর্তে মুহূর্তে বেড়ে চলেছে। আমাদের সাথে তিন-চারশত মানুষ সার্কিট হাউসের ভিতরে ঢুকলেন। জনতা এবং আমরা এলোমেলো বিশৃঙ্খলভাবে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর বাঙালি ভাইদের সাথে বুকে বুক মিলাতে শুরু করলাম। কোথায় গেল হেড-কোয়ার্টারের অনুমতি, কোথায় গেল ১০টা-১২টার বেঁধে দেওয়া সময়। সকাল ৭টাতে সৈন্য-জনতার মহামিলন ঘটল। কোলাকুলি করে, নানা কথাবার্তা বলে সুবেদার সাহেবকে অনুরোধ করলাম, ‘সার্কিট হাউসের পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে ফেলুন। সুবেদার সাহেব তখন ১০টার ধান্ধায় আছেন। অনেক অনুরোধের পরও তিনি রাজি হলেন না। তখন আমরা সাধারণ সৈনিকদের কাছে গিয়ে পাকিস্তানী পতাকা সম্পর্কে কথা বললাম। সাধারণ সৈন্যরা অত্যন্ত আগ্রহভরে বললেন, আপনারা পতাকা নামিয়ে ফেলুন। আমরা কেউ বাধা দেব না।’ এরপর আর আমাদের পায় কে? টাংগাইল সার্কিট হাউস থেকে এ. ডি. সি-র হেডলাইট ভাঙা (২৪ মার্চ বাংলা ছাত্রলীগের শামীম-আল-মামুনরা ইট-পাটকেল মেরে গাড়ির কাচ ও হেডলাইট ভেঙে দিয়েছিল) টাংগাইল ক-৩ টয়োটা জিপ নিয়ে একই শহরের দিকে ছুটলাম। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের একটি ভালো পতাকা সংগ্রহ করা। গাড়ি নিয়ে সোজা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে গেলাম। সেখানে হাজার হাজার জনতার ভিড়। অফিসের সামনে হুমায়ুন দাঁড়িয়েছিল। হুমায়ুন তখন শহর ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক। পতাকা বানানোর দায়িত্ব তাঁরই। হুমায়ুনকে বললাম, তোর কাছে ভালো পতাকা আছে?’
— এখানে নেই, বাসায় আছে।
হুমায়ুনকে নিয়ে আবার ছুটলাম তাদের বাসায়। গাড়ি স্টার্ট দিতেই বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী দৌড়ে এসে চিৎকার করে থামতে বললেন, কিন্তু আমি থামলাম না। হুমায়ুনের বাড়ি থেকে ভালো পতাকা ও ‘কোরান শরিফ’ নিয়ে ঝড়ের বেগে সার্কিট হাউস অভিমুখে ছুটলাম। টাংগাইল ময়মনসিংহ রাস্তা ধরে আমাদের বাড়ির সামনে আসতেই দেখি, যমদূতের মতো রিভলবার হাতে
পৃষ্ঠা নং ~ ২৯

বড়ভাই রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বারবার চিৎকার করে বললেন, “থাম, থাম”। এখানেও আমি গাড়ি থামালাম না। গাড়ির গতি সামান্য কমালাম মাত্র। বড়ভাই পাগলের মতো চিৎকার করে বললেন, “তুই যদি সার্কিট হাউসের দিকে যাস, তাহলে আমি তোকে গুলি করব।” কিন্তু ততক্ষণে আমি তার রিভলবারের নাগালের বাইরে চলে গেছি। হতাশ হয়ে তিনি মোটরসাইকেলে আমার গাড়ির পিছু পিছু ছুটলেন। তার একমাত্র ভয়, আমি হঠকারিতা করছি। মিলিটারিরা আমাকে হত্যা করবে। তাই তিনি অত্যন্ত স্নেহান্ধ হয়ে গুলির ভয় দেখিয়ে আমাকে বিরত করতে চাইছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে তিনিও আমার পিছু পিছু সার্কিট হাউস পর্যন্ত এলেন। আমি ঝড়ের বেগে সার্কিট হাউসে ঢুকলাম। চারপাশে জনতা তখন উপচে পড়ছে। গাড়ি থেকে নামতেই বড়ভাইও হাওয়ার বেগে এসে ভিড়ের মধ্যে মোটর সাইকেল থেকে লাফিয়ে পড়লেন। তিনি তখন গম্ভীর নির্বিকার। আমি বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে কোরান শরিফ অতীব শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে জড়িয়ে বড়ভাইয়ের হাতে দিলাম। তারপর আমরা সুবেদার জিয়াউল হকের সামনে এগিয়ে গেলাম। বড়ভাই দু’হাতে বাংলাদেশের পতাকা ও কোরান শরিফ ধরে আছেন। সুবেদার জিয়াউল হক আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। বড়ভাইকে অনুরোধ করলাম, “সুবেদারকে আপনার হাত থেকে পতাকা তুলে নিতে অনুরোধ করুন।” বড়ভাই বললেন, ‘তুই কর।’ আদেশ পেয়ে আমি সুবেদারকে আহ্বান জানালাম, “বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ তাঁদের রক্ত পানি করে এতদিন আপনাদের বেতন জুগিয়েছে। আপনারা এতদিন পাকিস্তানের পতাকার সম্মান রক্ষা করেছেন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনতার কামনা, আজ এই মুহূর্ত থেকে আপনারা তাদের সম্মান রক্ষা করুন। বাংলা ও বাঙালির সম্মানের প্রতীক—স্বাধীন বাংলার এই পতাকা আপনারা সমুন্নত রাখুন। আমি জনতার পক্ষ থেকে অনুরোধ করছি, আমাদের সর্বাধিনায়ক গণপরিষদ সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর হাতের কোরান ও পতাকা স্পর্শ করে শপথ নিন, আপনারা জীবন পণ করে এই পতাকা সমুন্নত রাখবেন।” আমার কথা শুনে সুবেদার জিয়াউল হক মাথা নত করে অত্যন্ত শান্তভাবে কোরান ও পতাকার উপর ডান হাত রাখলেন। ফারুক ও সোহরাওয়ার্দীকে আমি বললাম, ‘সেই হাওলদার ও একজন সাধারণ সৈনিককে নিয়ে এসো।’ তারা দৌড়ে গিয়ে তাদের নিয়ে এল। চারজন হাত রেখেছেন পতাকা ও কোরান শরিফের ওপর। বড়ভাইকে বললাম, ‘শপথ করান।’ তিনি শপথবাক্য উচ্চারণ করলেনঃ
“আমি আজ বাঙালি জাতির নামে, দেশমাতৃকার নামে কোরান ও বাংলাদেশের পতাক স্পর্শ করে শপথ করছি, গত ২৫ বছর যে মর্যাদায় পাকিস্তানের পতাকাকে সমুন্নত রেখেছি, বাংলাদেশের পতাকাকে তার চাইতে অধিক মর্যাদা দেব। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে এর মর্যাদা রক্ষা করব। বাংলা ও বাঙালির সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষায় আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করব। ন্যায়ের সংগ্রামে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ আমাদের ইয়াজিদদের মোকাবিলা করার তৌফিক দিন। আমিন।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৩০

শপথ শেষে সুবেদার জিয়াউল হক বড়ভাইয়ের হাত থেকে কোরানসহ পতাকা নিয়ে নিজের মাথায় এবং এক-এক করে অন্য তিনজনের মাথায় ঠেকালেন। তারপর পতাকায় জড়ানো কোরান বড়ভাইয়ের হাতে এবং পতাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “ভাই, এটা আপনারাই উঠান।” জনতা তখন আনন্দোন্মাদ হয়ে গেছে, চিৎকার করে না বললে কিছুই শোনা যায় না। সবুর ও মণীন্দ্র মোহন ঘোষ বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এক দৌড়ে সার্কিট হাউসের চূড়ায় উঠে গেল। পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে তারা সোনালি সূর্যকরোজ্জ্বল রোদে সবুজ শ্যামল বাংলার বুকে নব প্রভাতের রঙিন আকাশে বাংলাদেশের বিজয়-পতাকা উড়িয়ে দিল। পাকিস্তানী পতাকা যেমন পত পত্ করে উড়ে আমাদের বুকে প্রতিমুহূর্তে শেলের মতো আঘাত হানছিল, তেমনি বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখে আমাদের হৃদয়-মন অনাবিল আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠল।
এই সময় গণমুক্তি পরিষদের অন্যান্য নেতারাও সার্কিট হাউসে এসে উপস্থিত হন। পতাকা উত্তোলন শেষে পরিষদের চেয়ারম্যান গণ-বাহিনীর সর্বাধিনায়ককে সবার উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে নির্দেশ দেন। বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকী আধঘন্টা এক আবেগময়ী বক্তৃতা করেন। পতাকা উত্তোলন ও বক্তৃতা শেষে স্থির হল, এখন থেকে সৈন্যদের খাওয়া-দাওয়া যাবতীয় প্রয়োজন পরিষদ মেটাবে।
শহরের সাথে তাঁদের টেলিফোন সংযোগ করে দেওয়া হল। আমরা সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু হাজার হাজার জনতা কিছুতেই যেন তাদের ভরসা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের ছাড়তে চান না। তারা কলসি ভরা দুধ, কলা, ঘি, মাছ, মাংস, পেঁপে, পান, বিড়ি-সিগারেট—যে যা পারছেন তাই-ই সার্কিট হাউসে এনে স্তূপ করে ফেলছেন।
বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করায় হাইকমাণ্ড আমার উপর এত খুশি হন, যা আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। বড়ভাই এবং আসাদ ভাই সব চাইতে বেশি খুশি হয়েছিলেন। টাংগাইলের সর্বস্তরের মানুষ এই সফলতার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দেন। দলমত নির্বিশেষে সবার প্রশংসা পেয়ে আমি খুবই উৎসাহিত বোধ করি এবং আরো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা পাই।
সারা রাত ঘুমাইনি। তার উপর আবার মশার কামড় ও দারুণ উৎকণ্ঠায় আমরা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই সার্কিট হাউস অভিযানে আমরা যারা জড়িত ছিলাম, তারা হাইকমাণ্ডের কাছে বিকেল পর্যন্ত ছুটি চেয়ে নিলাম। অভিযানের সাথে জড়িত ছিলাম— (১) সোহরাওয়ার্দী (২) আবদুস সবুর খান (৩) ফারুক আহমেদ (৪) মণীন্দ্র মোহন ঘোষ (৫) ইকবাল (৬) এন. এ. খান আজাদ (৭) আলী হোসেন (৮) মতি (৯) আবুল (১০) শোকন (১১) মিন্টু (১২) মণি সাহা ও অন্যান্যেরা।
কিছু খেয়ে আমাদের আকুর টাকুরের বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিকেল তিনটায় বড়ভাই এসে আমাকে ডেকে তুললেন।
—তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। আমার সাথে যেতে হবে। জয়দেবপুর থেকে বাঙালি মিলিটারি এসেছে। তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য হবি মিঞা ও বদি ভাই চলে গেছে। তুই তাড়াতাড়ি চল।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৩১

সার্কিট হাউসে সফল অভিযানে আমার প্রতি বড়ভাইর খুবই আস্থা জন্মেছে। শুধু বড়ভাই কেন, টাংগাইলের সবার মুখে তখন আমার সম্পর্কে একটা ধন্য ধন্য রব।
ভাবতেই পারিনি, এত তাড়াতাড়ি বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আমাদের সাথে পাব। সকালে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলে, টাংগাইলের মানুষ যারপরনাই আশান্বিত হন। তদুপরি ঢাকার দিক থেকে আবার বাঙালি মিলিটারি এসেছেন এবং আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। এতে আমরা ভীষণ আশান্বিত হয়ে ভাবতে শুরু করে দিই, স্বাধীনতা আর বেশি দূরে নয়। আমরা সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানী হানাদারদের উপযুক্ত জবাব দিয়ে স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হব। আনন্দিত চিত্তে নানা কথা ভাবতে ভাবতে বড়ভাইয়ের সাথে গাড়ি ছুটিয়ে আরফান খানের পেট্রোল পাম্পের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি, সুন্দর সুদর্শন বেঁটে-খাটো গোলগাল একজন মেজর একটা টুলের উপর বসে আছেন। তার পাশে আরও দুই-তিনজন ক্যাপ্টেন ও লেফটেন্যান্ট। সালাম জানাতেই হবি মিঞা আমাদেরকে মেজর শফিউল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আমরা মেজর শফিউল্লাহর পরিচয় পেয়ে আরও আনন্দিত হলাম। অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে সাধারণ সৈন্যদের সার্কিট হাউসে ও অফিসারদের সংগ্রাম পরিষদ অফিসে নিয়ে আসা হল। মেজর শফিউল্লাহ সংগ্রাম পরিষদ অফিসে রুদ্ধদ্বার কক্ষে চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান খান, আহ্বায়ক লতিফ সিদ্দিকী ও উপদেষ্টা খোন্দকার আসাদুজ্জামানের সাথে আলোচনা করলেন। আমরা সবাই খাবারের ব্যবস্থা করলাম। জয়দেবপুর থেকে আসতে শফিউল্লাহর দলের দু’তিনটি গাড়ি বিকল হয়ে গিয়েছিল। তাদের জন্য বিকল্প গাড়ির ব্যবস্থা করা হল। আলোচনা শেষে শফিউল্লাহ বেরিয়ে এলে আমরা হাইকমাণ্ডের চেয়ারম্যান, আহ্বায়ক ও উপদেষ্টাদের কাছে শুনতে পেলাম, জয়দেবপুরে তখনও এক কোম্পানি বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য যানবাহনের অভাবে পড়ে রয়েছে। আর শফিউল্লাহ নিজে দুই কোম্পানি নিয়ে এসেছেন। হাইকমাণ্ডের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনা শেষে শফিউল্লাহ অফিসারদের নিয়ে সার্কিট হাউসে চলে গেলেন। তখন আমরা খুবই উৎসাহিত বোধ করছিলাম। কিন্তু আমাদের এই উৎসাহ-উদ্দীপনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।

হতাশ পরিস্থিতি
পাঁচটা সাড়ে-পাঁচটা বাজতেই দেখলাম শফিউল্লাহ তার দল নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছেন। তার হাবভাব দেখে আমরা ব্যথিত হলাম। শফিউল্লাহকে সবসময় আতঙ্কগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। তবে সাধারণ সৈন্যরা প্রাণবন্ত ও দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। শফিউল্লাহ ময়মনসিংহের দিকে চলে যেতেই টাংগাইলবাসীর সকালের সেই আনন্দোল্লাস আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসতে শুরু করল। আমিও মনমরা হয়ে গেলাম। রাত ৯টায় ম্যালেরিয়া অফিসের জিপে সবুর, আজাদ, মণি ও রতনকে নিয়ে খবরের আশায় মির্জাপুরের দিকে এগুলাম। গোড়ানের কাছে যেতেই
পৃষ্ঠা নং ~ ৩২

সারিবদ্ধ অসংখ্য আলো দেখে জিপ রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে, রাস্তা থেকে অনেক দূরে কয়েকটা বাড়ির আড়ালে পজিশন নিলাম। মিনিট কয়েকের মধ্যে গাড়িগুলো এসে আমাদের জিপের পাশে থামল। কয়েকজন আমাদের গাড়ি খুব ভালো করে তল্লাসী করে আবার টাংগাইলের দিকে এগিয়ে চলল। তাদের কথাবার্তায় বুঝলাম, এরাও বাঙালি। মিলিটারিরা পার হয়ে গেলে, আমরাও তাদের পিছুপিছু টাংগাইল ফিরে এলাম। এই কোম্পানি কমাণ্ড করছিল একজন ক্যাপ্টেন। এরা রাত সাড়ে-দশটায় সার্কিট হাউসে আসেন। এদেরও গাড়ি চাই। একটি হবি মিয়া, অন্যটি টাংগাইল-ট-১ ট্রাক সাবালিয়া গ্রামের ভিতর থেকে আমি নিজে চালিয়ে এনে দিলাম। এই ভদ্রলোকেরাও খুবই আতঙ্কিত। তারা টাংগাইল এসেই বললেন, গাড়ির জন্য তাদের খাবার-দাবার, বিছানা-পত্র ও গোলা-বারুদ ফেলে এসেছেন। হাইকমাণ্ড যখন গাড়ি দিয়ে জয়দেবপুর থেকে তাদের মালপত্র এনে দিতে চাইলেন, তখন তারা নিজেরা সাথে না গিয়ে হাই কমাণ্ডের নেতাদের কাছে তাদের ব্যারাকের চাবিগুলো তুলে দিলেন। সর্বশেষ আশা, বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানিটি যখন ময়মনসিংহের দিকে পিছিয়ে যেতে লাগল ততক্ষণে হাই কমাণ্ডের নির্দেশে ফিরোজ, রতন, ই. বি. আর. টি. সি-র হেল্পার হরি, চানমিয়া ও অন্যান্যারা দশ-বারটি গাড়ি নিয়ে জয়দেবপুরের দিকে রওনা হয়ে গেল। পশ্চিমাদের ভয়ে বাঙালি মিলিটারিরা যে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট সন্ধ্যায় তাড়াহুড়ো করে ছেড়ে এসেছে, সেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে এরা রাত ১টায় গিয়ে জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে ভোর পাঁচটার মধ্যে ১৬ ট্রাক গোলা-গুলি, কাপড়-চোপড় ও রেশন টাংগাইল নিয়ে এসে এক অসাধ্য সাধন করল। পরদিন সকাল সাতটায় কাপড় চোপড়, খাদ্য ও গোলাগুলি বোঝাই গাড়ি ময়মনহিংহের দিকে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
ফিরোজদের জয়দেবপুরে রওনা হবার একটু পরেই টাংগাইল সার্কিট হাউসে এতদিন যে ‘বি’ কোম্পানি ছিল তারাও ময়মনসিংহের দিকে সরে যেতে তৈরি হতে লাগলেন। সকালে ‘বি’ কোম্পানি আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে কিন্তু আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত তিনজন বাঙালি ও দুইজন পাঞ্জাবি অফিসারের কাউকেই দেখিনি। তারা কেউ আমাদের সাথে কথা বলেননি। ‘বি’ কোম্পানির বাঙালি অফিসারেরা টাংগাইল ছেড়ে পিছিয়ে যাওয়ার পথে দুইজন পাঞ্জাবি অফিসারকে হত্যা করে লাশ সামলানোর দায়িত্ব হাই কমাণ্ডের হাতে দিয়ে যায়। সমস্ত মিলিটারিরা যখন টাংগাইল ছেড়ে গেল, তখন হতাশা ও ব্যথায় আমার বুক টনটন করছিল, ডুকরে কান্না আসছিল। আর্মি উত্তরে পিছিয়ে গেলে আমাদের লাভ কী? দক্ষিণে ঢাকার দিকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে হানাদাররা যে-কোন সময় বিনা বাধায় টাংগাইলে এসে যাবে। আমি যখন ব্যথায় কাতর, হাইকমাণ্ড তখন পাঞ্জাবি দুই অফিসারের লাশ নিয়ে বিব্রত। লাশ সামলানোর ব্যাপারে হাইকমাণ্ড হবি মিঞাকে মূল দায়িত্ব দিলেন। লাশ দুটি প্রথমে সার্কিট হাউসে ২৫ গজ পিছনে মাটি চাপা দেয়া হয়। রাত ২টায় ডি. সি. জালালউদ্দীন ও এস. পি. উদভ্রান্তের মতো হাইকমাণ্ড অফিসে এসে কাঁদোকাঁদো ভাবে নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করলেন। লাশ সার্কিট হাউসের আশেপাশে রাখা ঠিক হবে না। ওখান থেকে সরিয়ে ফেলা উচিত। তাই করা হলো। হবি মিঞা একটি বাস নিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৩

সার্কিট হাউসে গিয়ে মাটির নিচে থেকে লাশ তুলে কাগমারি ব্রিজের কাছে লৌহজং নদীর ধারে আবার মাটি চাপা দিলেন। ওখানে মাটি চাপা দিয়েও অনেকে স্বস্তি পেলেন না। রাত তিনটায় আবার লাশ উঠানো হলো এবং কবর দেওয়া হল টাংগাইল গোরস্থানে।
২৯ মার্চ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবাই চলে গেলে হাইকমাণ্ড খুব ব্রিবত হয়ে পড়লেন। ঢাকার দিকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে, যে-কোন মুহূর্তে বিনা বাধায় হানাদাররা টাংগাইল চলে আসতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত হলো, আজ রাতেই ঢাকার দিকে রাস্তার পাশে সমস্ত গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করতে হবে এবং যে-কোনভাবে কয়েকটা পুলও ভেঙে ফেলতে হবে। রাত ৮টায় আমরা চললাম পুল ভাঙতে। আরও কয়েকটি দল গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করতে বিভিন্ন দিকে চলে গেল। আমাদের কাছে পুল ভাঙার অস্ত্র হিসাবে ট্রাক-বোঝাই কেরোসিন, ডিজেল, ১০-১৫ সের ওজনের অনেকগুলো হাতুড়ি, শাবল, গাঁইতি, কয়েক মণ কাঠ। আমাদের ধারণা ছিল, কংক্রিটের ব্রিজে অনেকক্ষণ আগুন জ্বালাতে পারলে এবং বড়বড় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে পুল ভেঙে পড়তে পারে। আমরা প্রথমে গেলাম কোদালিয়া ব্রিজে। সবুর আমাদের মূল গাইড। কারণ সবুর একজন রড মিস্ত্রি। পুলের কোথায় নরম, কোথায় শক্ত সে ভালো করে জানে। কোদালিয়া ব্রিজের উপর খড়িকাঠ ছড়িয়ে তার উপর টিনকে-টিন কেরোসিন ঢাললাম। তারপর আগুন দেয়া হলো। দুই ঘন্টা আগুনে পুড়ে ব্রিজের অনেক অংশ টকটকে লাল হয়ে গেল। এর উপর আমরা হাতুড়ি মারলাম। কিন্তু পুল থেকে একচিলতে সিমেন্টও উঠল না। আমরা হতাশ হলাম। শেষে পুলের দু’পাশের ৫-৬টা বড় বড় গাছ কেটে ফিরে এলাম মির্জাপুর ব্রিজে। এখানে এসে এক মুশকিলে পড়লাম। শত শত জনতা পুল আগলে বসে রয়েছেন। তারা পুল ভাঙতে দেবেন না। তাদের ভয় পুল ভাঙলে মিলিটারিরা আশপাশের সমস্ত বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেবে। আমরা পুলের কাছে আসতেই মাসুদকে ধরে জনতা দারুণভাবে প্রহার শুরু করল। তাকে মেরে ফেলে আর কী! অনেক অনুনয়-বিনয়ের পরও জনতা তাকে ছাড়ছে না। মাসুদ ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছে। শেষে বাধ্য হয়ে শূন্যে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়লাম। জনতা মাসুদকে ছেড়ে দিলে তাকে নিয়ে হতাশ মনে ভোর ৫টায় টাংগাইলে ফিলে এলাম। যদিও পুল ভাঙতে পারলাম না তবু সারা রাস্তায় ২৫-৩০ জায়গায় শতাধিক গাছ কেটে, ইট ফেলে ভাঙাগাড়ি দিয়ে ব্যারিকেড গড়ে তোলা হলো।
৩০ মার্চ। হাইকমাণ্ড খুব একটা স্বস্তিবোধ করছেন না। শুধু গাছের ব্যারিকেড দিয়ে যে হানাদারদের বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, তা সকলেই জানতেন। তাই উপদেষ্টা খোন্দকার আসাদুজ্জামানকে ময়মনসিংহের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনা করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হলো। আমাকে বলা হলো, যতদূর সম্ভব ঢাকার দিকে গিয়ে শেষ খবর নিয়ে আসতে। এতকিছুর মধ্যেও হাইকমাণ্ড থেকে একটার পর একটা আদেশ জারির বিরাম নেই। ৩০ তারিখে হাইকমাণ্ড নতুন পাঁচটি আদেশ জারি করল—
(১) কোন বাঙালি থানায় অস্ত্র জমা দিতে পারবেন না। অস্ত্র হাই কমাণ্ডের কাছে জমা
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৪

দিতে হবে। স্বেচ্ছায় না দিলে বাধ্য করা হবে, শাস্তি দেয়া হবে।
(২) ট্রেজারি ও থানার অস্ত্র হাই কমাণ্ডের হাতে সমর্পণ করতে হবে।
(৩) স্থানীয় ব্যাঙ্কসমূহ হাই কমাণ্ডের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে। হাই কমাণ্ডের অনুমোদন ছাড়া টাকা জমা দেওয়া বা উঠানো চলবে না।
(৪) ধনী লোকদের কাছ থেকে নির্ধারিত অঙ্কের টাকা নিয়ে হাই কমাণ্ডের তহবিল গঠন করা হবে।
(৫) স্বাধীনতাকামী জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে গণবাহিনীকে আরো সুসংগঠিত করা হবে।

৩০ মার্চ দুপুর। আমি ঢাকার দিকে এগুলাম সর্বশেষ খবর জানতে। বলতে গেলে গোড়াই পর্যন্ত রাস্তার পাশের চকের উপর দিয়ে গাড়ি নিয়ে যেতে হলো। আমার সাথে বাস এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি হবি মিঞা, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি শওকত মোমেন শাজাহান, সবুর, মণীন্দ্র মোহন ঘোষ ও আজাদ। আমরা মৌচাক বাজারে থামলাম। আমাদের থেকে ১০০-১৫০ গজ সামনে মিলিটারি জিপ। সেদিন যদিও সফিপুরে হাটবার নয়, তবুও অনেক লোক কেনাকাটা করছিলেন। গাড়ি আমিই চালাচ্ছিলাম। খুব ভালো করে দেখলাম, শেষে আমাদের সবারই মনে হলো সামনের সৈন্যরা বাঙালি, তাই সাহস করে আস্তে আস্তে এগুতে লাগলাম। বাঙালি মনে হওয়ার সবচাইতে বড় কারণ—মিলিটারিদের সাথে লুঙ্গিপরা, ছাতা বগলে এক ভদ্রলোক। ওদের ৫০ গজের মধ্যে পৌঁছতেই আমার ভুল ভাঙে। আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। গাড়ি থামতেই মিলিটারিরা বলে উঠল, “রুখ কিউ, আগে তাও।” কে আর আগে যায়। এক ঝটকায় গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললাম। গাড়ি যে কেন উল্টে গেল না আর কিভাবেই বা সেইদিন ওখান থেকে ছুটে আসতে পেরেছিলাম আজও তা বুঝে উঠতে পারিনি। গাড়ি ঘুরিয়ে ফাস্ট গিয়ার দিতেই হানাদাররা আমাদের উপর গুলি ছোঁড়ে। প্রথম গুলি ছুঁড়বার সময়ই আমাদের গাড়িতে প্রায় ২৫ মাইল স্পিড উঠে গেছে। তারপর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি, কিন্তু তখন আর পায় কে! গাড়ির মিটারের কাটা ৮০-৯০ মাইলে উঠানামা করছে। সফিপুর থেকে আমরা সবাই অক্ষত ফিরে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মহিষবাথান পুলের কাছে আবার গাড়ি থামালাম। উদ্দেশ্য মিলিটারিরা পিছু ধাওয়া করছে কিনা তা দেখা। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করলাম না, যদি স্টার্ট করতে দেরি হয়ে যায়! হবি মিঞা গাড়ির সামনে বসেছিলেন। ভদ্রলোক বেশ সাহসী ও কর্মঠ। কিন্তু সফিপুরের ঘটনায় তিনি ভয়ে কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিলেন। মহিষবাথান পুলের কাছে গাড়ি দাঁড় করাতে তার খুবই আপত্তি ছিল। তিনি বারবার বলছিলেন, চলুন এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আমিও গাড়ি থেকে বেশি দূরে গেলাম না। এক ভয় মিলিটারিদের, অন্য ভয় হবি ভাই যদি গাড়ি নিয়ে চলে যায়? উর্ধ্বশ্বাসে মিলিটারিদের দুটি জিপ ছুটে আসতে দেখে লাফ মেরে গাড়িতে উঠলাম। আবার দে ছুট! এবার প্রায় শ’চারেক গজ দূরে থেকে মিলিটারিরা গুলি ছুড়ল। কিন্তু ছুটন্ত গাড়িতে কী করে আমাদের গুলি লাগবে! আমরা ঝড়ের বেগে কালিয়াকৈর পুলের কাছে এলাম। মিলিটারিরা আমাদের পিছু ছাড়েনি। পুলের সামনে এসে পড়লাম বিপদে। পুলের মাঝে একটা গরুর গাড়ি আমাদের দিকে আসছে। পিছনে মিলিটারি
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৫

কিন্তু গরুর গাড়ি পার না হলে যাবার কোন উপায় নেই। আর গরুগুলোও সামনে গাড়ি দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসার চাইতে খুঁটি মেরে দেরি করতে লাগল। সত্যিই তখন দেরি সইছিল না। হবি ভাই দুইবার গাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইলেন। আমারও দু’একবার মনে হলো গাড়ি ছেড়ে দিই। আমাদের পিছনে একটা বাস , তার শতেক গজ পিছনে মিলিটারিদের গাড়ি আসতেই সামান্য একটু ফাঁক পেয়েই সাঁ করে বেরিয়ে এলাম। মিলিটারিরা আবার গুলি চালাল। তিনবার গুলি চালিয়েও ওরা আমাদের কিছু করতে পারল না। মির্জাপুর পর্যন্ত চলে এলাম। মির্জাপুর থেকে আমার বারবার মনে হল—রাস্তার পাশে ওঁৎ পেতে থাকলে গাড়ি দুটি হয়তো মারা যেতে পারে। ওদের মেরে টাংগাইলে নিয়ে যেতে পারলে জনতার মনোবল আরও বেড়ে যাবে। হবি মিঞাকে আমার ইচ্ছার কথা জানালাম। কিন্তু হবি মিঞা অপেক্ষা করতে নারাজ। আমি যদি অপেক্ষা করি তাহলে তাকে গাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। যদিও গাড়িটা আমার দায়িত্বে ছিল, তবুও হবি মিঞা পরিষদের একজন সম্মানিত সদস্য। তাই তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া যায় না, সমীচীনও নয়। শেষ অবধি বাঐখোলায় এসে গাড়ি থেকে নেমে হবি মিঞাকে বললাম, “আপনি গাড়ি নিয়ে যান। আমরা পায়ে হেঁটে চলে আসব।” আজাদ, সবুর ও আমি রয়ে গেলাম। দুই ঘন্টা অপেক্ষা করেও মিলিটারিদের টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। পরে শুনেছি ওরা গোড়াই পর্যন্ত এসে ফিরে গিয়েছিল। আমরা সন্ধ্যায় টাংগাইল ফিরলাম।

হাইকমাণ্ড আন্তরিকতার সাথে একটা সত্যিকার প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছিল। বদিউজ্জামান, লতিফ সিদ্দিকী, সৈয়দ আবদুল মতিন, আল মুজাহিদী, ডি. সি. ও এস. পি. -কে নিয়ে আর্মস সেল গঠিত হয়েছিল। তারা সারা জেলায় যে যেখান থেকে পারছিলেন, আর্মস সগ্রহ করে গণমুক্তি বাহিনীর হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। ২৭ মার্চ তাঁরা বাশাইল যান। নেতৃবৃন্দকে ভোলা মিঞা ও মিন্টু মিঞা তাঁদের ব্যক্তিগত রিভলবার উপহার দেন।
৩১ মার্চ। আমরা পাঁচজন পিছিয়ে যাওয়া বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের খোঁজে মধুপুর এলাম। মধুপুরে তারা নেই। তারপর মুক্তগাছা। সেখানেও নেই। অনেক খোঁজ খবরের পর ময়মনসিংহ টাউন হলে পেলাম। সুবেদার জিয়াউল হককে চিনতাম। একদিনেই ভদ্রলোককে আমার ভালো লেগেছিল। তাকেই জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা বললেন, মধুপুরে ডিফেন্স গড়বেন। এতদূর পিছিয়ে এলেন কেন?” জিয়াউল হক কয়েকটা চাইনিজ রাইফেলসহ কয়েক বাক্স গুলি দিতে চাইলেন। আমি বললাম, “না, ওগুলো আপনাদের কাছেই থাক। আপনারাই ভালো ব্যবহার করতে পারবেন। সেদিন আমার ধারণা ছিল, বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে হাতিয়ার থাকাই ভালো। চলে আসার সময় সুবেদার আমাকে চাইনিজ ৭.৬৫ পাঁচ রাউন্ড গুলি উপহার দিলেন।
এগারটার মধ্যেই আমরা টাংগাইল ফিরে এলাম। আমাদের মন ছটফট করছিল। বিকাল তিনটায় হাইকমাণ্ড অফিসে গিয়ে খবর পেলাম—ময়মনসিংহের দিক থেকে একদল বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য আসছে। খোন্দকার আসাদুজ্জামান সাহেব ময়মনসিংহের নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে এই ব্যবস্থা করেছেন। আমরা কজন ছুটলাম কালিহাতির দিকে। আমাদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৬

মনে আবার নতুন আশার ঝিলিক। ইছাপুর পার হতেই বহুদূরে শোলাকুড়া পুলের নিচে ধুলো উড়িয়ে আস্তে আস্তে বেশ কয়েকটি মিলিটারি গাড়ি আসতে দেখলাম। আমরা আর বেশিদূর না এগিয়ে আজাদ, ইকবাল ও মণিকে খালি হাতে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলাম। তাদের বলে দিলাম, ওরা যদি বাঙালি এবং আমাদের লোক হয়, তাহলে তোরা বারবার মাথার উপর হাত তুলবি। ওরা আস্তে আস্তে কনভয়ের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর মাথার উপর দুইবার হাত তুলল। বুঝলাম, ওরা আমাদের লোক। কাছে গিয়ে দেখি—মিলিটারি নয়, ই. পি. আর.।

প্রথম যুদ্ধ
ই. পি. আর. কমাণ্ডারদের পরম যত্নে হাই কমাণ্ড অফিসে নিয়ে আসা হলো। ই. পি. আর. কমাণ্ডারদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের মতো তেমন ভীত-সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল না। একজন সুবেদার ও একজন নায়েব সুবেদার, তাদের সেকি যত্ন! রাজ-রাজড়াদেরও অমন যত্ন হয়নি। আন্তরিকভাবেই সকলে যত্ন করলেন, সম্মান দেখালেন। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা পর্যন্ত ই. পি. আর. কমাণ্ডারদের হাতপাখা দিয়ে বাতাস করলেন।
ঢাকার দিকে প্রতিরোধ-পরিকল্পনা নেয়া হলো। আশিকপুরের প্রখ্যাত জাদুকর জাদু সম্রাট পি. সি. সরকারের বাড়ির পাশে টাংগাইল থানা উন্নয়ন অফিসে ই. পি. আর. -রা ৩১ মার্চের রাত কাটালেন। আমরা আবার কিছুটা মনোবল ফিরে পেলাম। ই. পি. আর. -দের মনোবলও খুব উঁচু মানের। কোন ভয়-ভীতি, শঙ্কার চিহ্ন নেই। পয়লা এপ্রিল ই. পি. আর-রা করাতিপাড়া পর্যন্ত এগিয়ে গেল। আমরা কয়েকজন তাদের সাথে রইলাম।
২৮ মার্চের মধ্যরাতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবাই পিছিয়ে গেলে টাংগাইলের এম. এন. এ. ও এম. পি. এ. সাহেবরা গা ঢাকা দেন। হাইকমাণ্ড তাদের উপর নির্দেশ জারি করে, ২৪ ঘন্টার মধ্যে শহরে ফিরে আত্মপ্রকাশ না করলে গণপরিষদ সদস্যদের ধরে আনা হবে। এমনকি তাঁদের সদস্যপদ বাতিল বলে ঘোষণা করা হবে। হাই কমাণ্ডের এই হুঁশিয়ারি খুব কাজ দেয়। ১লা এপ্রিল সকালে গণ-প্রতিনিধিরা একে-একে টাংগাইল হাই কমাণ্ডের সামনে হাজির হন এবং সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
মুক্তি বাহিনী ঢাকার দিকে এগুনোয় টাংগাইলের মানুষ আবার মনোবল ফিরে পান। শত শত হাজার হাজার মানুষ সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন। ১লা এপ্রিল সন্ধ্যায় ই. পি. আর. সহ মুক্তি বাহিনী নাটিয়াপাড়া গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে। এরপর টাংগাইলের অনেক নেতৃবৃন্দকে টাংগাইল থেকে নাটিয়াপাড়া পর্যন্ত মুক্তি বাহিনীর খোঁজ-খবর নিতে ও তদারকি করতে দেখা যায়। নেতাদের অনেকের মধ্যে দেশপ্রেমের এক অপূর্ব জাগরণ লক্ষ করা যায়। এদের মধ্যে চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান খান, মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লতিফ সিদ্দিকী, পরিষদ উপদেষ্টা খোন্দকার আসাদুজ্জামান, সদস্য হবিবুর রহমান (হবি মিঞা), সৈয়দ আবদুল মতিন, আল-মুজাহিদী, ফজলুর
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৭

রহমান খান ফারুক, নঈমুদ্দিন আহমেদ, ডি. সি. ও এস. পি. সহ আরও অনেকেই ছিলেন। ১লা এপ্রিল ই. পি. আর-দের সাথে ডিফেন্স লাইনে রাতটা আমাদের ভালো ভাবেই কাটল। নাটিয়াপাড়াকে দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা লাইন করে ২ তারিখ সকালে অর্ধেক ই. পি. আর ও মুক্তি বাহিনী বাহিনী জামুর্কী পাকুল্লা পর্যন্ত এগিয়ে যায়। এই সময় গোড়াই থেকে নাটিয়াপাড়া পর্যন্ত টেলিফোন-সংযোগ করা হয়। নাটিয়াপাড়া টেলিফোনের দায়িত্ব দেয়া হয় টেংগুরিয়াপাড়া প্রাইমারি স্কুলের রহিম মাষ্টারকে। বিকেলে ই. পি. আর-রা গোড়ান সাটিয়াচরায় বাংকার খুঁড়ে তাদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করে। আনসার-ছাত্র-জনতাসহ মুক্তি বাহিনীকে গোড়ান সাটিয়াচরা থেকে আরও দেড়-দুই মাইল আগে ধল্লা পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দিয়ে পজিশন দেয়া হয়। পাঁচটার সময় যখন আমি ধল্লা গ্রামের পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলছিলাম তখন টাংগাইল ক-১ নম্বর জিপে সর্বাধিনায়ক লতিফ সিদ্দিকী ও খোন্দকার আসাদুজ্জামান খাবার-দাবার নিয়ে ধল্লা ডিফেন্সে আসেন।

গত তিনদিন ধরে হাইকমাণ্ড আমাদের খাবার-দাবারের প্রতি যেরকম যত্ন নিচ্ছেন অনেক মা-ও তাদের সন্তানের প্রতি এমন যত্ন নিতে হিমসিম খেয়ে যাবেন। আমরা সবাই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম আমাদের প্রতি হাই কমাণ্ডের যত্ন দেখে। লতিফ সিদ্দিকী এমনিতেই দিল দরিয়া মানুষ অন্যকে খাওয়ানোর ব্যাপারে তার জুড়ি নেই। আবার সাথে জুটেছেন খোন্দকার আসাদুজ্জামান। তাদের কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের ঠিকমতো খাবার ব্যবস্থা না করলে ওরা কষ্ট করে যুদ্ধ করবে কেন? যোদ্ধাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা না দেখাতে পারলে তারা হাইকমাণ্ডের আদেশ-নির্দেশ মানবে কেন? যোদ্ধারা যেমন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করবে, আমাদেরকেও তেমন পিছন থেকে সবসময় যথাযথ রসদ জোগানোর যুদ্ধ করতে হবে। আমরা যদি ঠিকমতো যোগান দিতে না পারি তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে কিছুতেই ভালো ফল ফলবে না।
নেতৃবৃন্দ আমাদের জন্য প্রচুর মাছ-মাংস ও রুটি এনেছেন। আমাদের সাথে সামান্য খেয়ে ফিরে যাবার সময় বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আমার হাতে ৬ হাজার টাকা তুলে দিয়ে বলেন, “আমরা তো সবসময় প্রয়োজনীয় সরবরাহ করবই, তারপরও যদি তাৎক্ষণিকভাবে কারো কিছু দরকার হয়, তুই এই টাকা থেকে ব্যবস্থা করবি। পরিষদের তহবিল থেকে তোর নামে এ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আমি নিজে তোর পক্ষে স্বাক্ষর করে টাকাটা তুলে এনেছি।” ঠিক সন্ধ্যায় নেতৃবৃন্দ চলে গেলেন। আজাদ ও মণীন্দ্র মোহন ঘোষকে ধল্লার দায়িত্বে রেখে সবুর, মাসুদ, ইকবাল, মিন্টু, শোকন, সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে নাটিয়াপাড়া রিয়ার ক্যাম্পে এলাম। সুবেদার আবদুর রহিম রিয়ার ক্যাম্পেই ছিলেন। কিন্তু নায়েব সুবেদার আজিজ সাটিয়াচরায় ফ্রন্ট লাইনে আছেন।
২রা এপ্রিলের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, হাইকমাণ্ড সকল জেল বন্দীদের ছেড়ে দেন। তাদেরই ৮০ জনের একটি দলকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে নাটিয়াপাড়ায় পাঠানো হয়েছে। তাঁদের কাছে হাইকমাণ্ড আমার জন্য চিঠি দিয়েছেন, সদ্য মুক্তরা আমার কথামতোই কাজ করবেন। বন্দী মুক্তির সিদ্ধান্তে খুবই আনন্দিত হলাম। আরও আনন্দিত হলাম তাঁদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৮

ব্যবহারে। আমি জীবনে অত বিনম্র করিতকর্মা মানুষ দেখিনি। তাদের যা বলা হচ্ছে, তাই জাদু মন্ত্রের মতো করে দিচ্ছেন। ২রা এপ্রিল রাতটা নাটিয়াপাড়া প্রাইমারি স্কুলে কাটলো। আমার সঙ্গীদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী, সবুর, শোকন, মিন্টু, ফারুক, সাইদুর, আনিস, কালো ফারুক, মাসুদ, দুলাল ও সড়ক পরিবহন সংস্থার হবি।
রাত দশটায় একবার ফজলুর রহমান খান ফারুক এলেন। আমাদের বললেন, ‘আমি পাকুল্লাতে রাতে থাকব, কেমন হয়?’ আমরা কোন আপত্তি করলাম না। কারণ তখনও পাকুল্লা নিরাপদ। তিনি সাটিয়াচরা চলে গেলেন। শুধু সাটিয়াচরা নয়, সাটিয়াচরা ফ্রন্ট লাইনে ই. পি. আর, ও মুক্তি বাহিনীর সাথে রাত কাটালেন। তাঁর সাথে ছিলেন পাকুল্লা আওয়ামী লীগের মুজিবুর রহমান ছানা।
আমরা আধ ঘন্টা পরপর টেলিফোনে খবর পাচ্ছি। গোড়াই পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক আছে। গভীর রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ টেলিফোনে রহিম মাস্টারের গলার আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙল। মাষ্টার বলছেন— এ্যা, গোড়াই পর্যন্ত এসে গেছে। কয় গাড়ি? আমরা ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠলাম। আমি টেলিফোনের কাছে যেতেই লাইন কেটে গেল। দৌড়ে সুবেদারের কাছে গেলাম। তখন ভোর পাঁচটা। সুবেদার খবর শুনে টেলিফোন-ঘরে ছুটে এলেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও গোড়াইকে আর পাওয়া গেল না। তবে মির্জাপুরের সঙ্গে তখনও যোগাযোগ আছে। মির্জাপুরকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর এল, এখনও বুঝতে পাচ্ছিনা। তবে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফ্রন্ট লাইনে খবর দেয়ার কোন বেতার বা টেলিফোন নেই। আমি ছুটলাম খবর দিতে। পাকুল্লা ব্রিজের মুখে যেতেই শ’তিনেক গজ দূরে লম্বা গাড়ির সারি দেখে সফিপুরের মত চকিতে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললাম। তখন আমাদের দিক থেকে গুলি ছোঁড়া শুরু হয়ে গেছে। আমি হাওয়ার বেগে ফিরে এলাম পিছনে। মাটি-কাঁপানো গোলাগুলির আওয়াজে সুবেদার সাহেবের মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে। তিনি শুষ্কমুখে বললেন, ‘আমাদের গুলি ফুরিয়ে যাবে। যত তাড়াতাড়ি পারেন কয়েক হাজার গুলির ব্যবস্থা করুন।’ বাধ্য হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে টাংগাইলে ফিরে এলাম। আমার কাছেই পুলিশ কোথের চাবি। হাইকমাণ্ড অফিসের সামনে আসতেই চেয়ারম্যান আহ্বায়কসহ পরিষদের সবাই ঘিরে ধরলেন। তারা শুধু গোলাগুলির আওয়াজ শুনছেন, কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। আমি জানালাম, উভয়পক্ষ থেকে গোলাগুলি হচ্ছে। হেলিকপ্টার থেকেও স্ট্র্যাফিং করছে, কিন্তু আমাদের পজিশন খুবই ভালো। আমি গুলি নিতে এসেছি। বড়ভাই, বদিউজ্জামান, আসাদুজ্জামান, আল-মুজাহিদী ও অন্যান্যরা অনেক ধরাধরি করে গুলির বাক্সগুলি গাড়িতে তুলে দিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যারা আছে, তাদের জন্য সামান্য কিছু হতে পারলে তারা যেন ধন্য হন। পনের বাক্স ৩০৩ গুলি নিয়ে এক ঘন্টার মধ্যেই নাটিয়াপাড়া ফিরে গেলাম। তখন গোড়ান-সাটিয়াচরাতে বজ্রপাতের মতো গোলা ফাটছিল। এর মধ্যেই ছয়-সাতজন মুক্তিযোদ্ধা চার বাক্স গুলি নিয়ে ফ্রন্ট লাইনে এগিয়ে গেল। আমিও রাস্তার উপর দিয়ে জামুর্কী ব্রিজ পর্যন্ত গেলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৩৯

ধল্লায় যারা পজিশন নিয়েছিল তারা সকাল সাড়ে-পাঁচটায় শ’দেড়েক গাড়ির কনভয় দেখে গুলি ছুড়তে সাহস করেনি। তারা ওখান থেকে পিছিয়ে আসে। সামনে দু-তিনটি খালি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি রেখে হানাদাররা আপন তালে এগিয়ে আসতে থাকে। সাড়ে-পাঁচটায় বিনা বাধায় গোড়ান-সাটিয়াচরায় এসে যায়। আমাদের যারা ডিফেন্সে ছিলেন, তাঁরাও আচমকা সামনে হানাদারদের দেখে চমকে যান ও কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়েন। হানাদাররা তখন একেবারে মুক্তি বাহিনীর নলের মুখে। রাস্তার পাশ থেকে নায়েব সুবেদার আবদুল আজিজ প্রথম তার লাইট মেশিনগান থেকে গুলি শুরু করেন। সাথে সাথে প্রায় পঞ্চাশটি রাইফেল ও ছ’টি এল. এম. জি. থেকে হানাদারদের উপর অগ্নিবৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। তিনটি রকেটলাঞ্চার ও তিনটি ২ ইঞ্চি মর্টার থেকেও ই. পি. আর-রা বিরামহীন গোলাবর্ষণ শুরু করে। অকস্মাৎ আক্রান্ত হয়ে হানাদাররা প্রথম অবস্থায় দিশেহারা হয়ে যায়। তারা ভাবতেই পারেনি এমনভাবে আক্রান্ত হবে। আর আক্রান্ত হয়েই তারা মনে করে বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাধা দিয়েছে। মাত্র সত্তর-আশি গজ দূরে থেকে আক্রান্ত হলে সবার যা হয়, হানাদারদেরও তাই হলো। মুক্তিযুদ্ধে টাংগাইলে এক যুদ্ধে একসঙ্গে এত সৈন্য আর কোথাও হানাদারদের খোয়াতে হয়নি। পাল্টা আঘাত হানতে প্রায় তিন-চার মিনিট লেগে যায়। এরমধ্যে তাদের সৈন্য-বোঝাই দশ-বারটি গাড়ি হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় নিচে উল্টে যায়। গাড়ি থেকে লাফিয়ে-পড়া সৈন্যরা রাস্তার দুইপাশে পজিশন নিতে গেলে তাদের উপর মুক্তি বাহিনী ই. পি. আর-রা পাখি শিকারের মতো তাক করে-করে গুলি করতে থাকেন। মুক্তি বাহিনী রাস্তার দুইপাশেই পজিশন নিয়েছে। তাই হানাদারদের পক্ষে আড়াল করে যুদ্ধ করার কোন সুযোগ ছিল না। হানাদারদের যে গোটা-পঁচিশ গাড়ি মুক্তি বাহিনীর মাঝে এসে পড়েছিল, তাদের এক-শতাংশও অক্ষত ছিল কিনা সন্দেহ।
গোড়ান-সাটিয়াচরায় ই. পি. আর-রা যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তার দ্বিতীয় কোন নজির আছে কিনা জানা নেই। ই. পি. আর-রা জানের পরোয়া করেননি, তারা মাতৃভূমির জন্য জীবন দিতেই যেন এসেছেন। একপর্যায়ে গোড়ানের দিকের হাবিলদার আবদুল খালেকের এল. এম. জি. নষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধ শুরু হলে ফজলুর রহমান ফারুকও হাবিলদারের পিছনে গিয়ে বসেছিলেন। এল. এম. জি. নষ্ট হয়ে গেলে হাবিলদার ফারুক সাহেবকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। ভীত-সন্ত্রস্ত ফারুক সাহেব বলেন, “আমরা চলে গেলে আপনারা যাবেন কিভাবে?” হাবিলদার একজন খাঁটি দেশপ্রেমিকের মতো উত্তর দেন, “আপনি চলে যান, আপনি একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। আপনার জীবনের মূল্য অনেক। আর আপনার ট্রেনিংও নেই। আপনারা যান, আমরা এক ব্যবস্থা করতে পারবই।” ফারুক সাহেব হাবিলদারের কাছ থেকে একশ গজও পিছিয়ে যেতে পারলেন না, হানাদারদের এক ঝাঁক মেশিনগানের গুলি হাবিলদারের বুক ঝাঝরা করে দিল। তার নিষ্প্রাণ দেহ অচল এল. এম. জির উপর লুটিয়ে পড়ল। বাংলা-মাকে ভালোবেসে নিজের রক্ত দিয়ে তিনি স্বাধীনতাকামীদের প্রতি অনুপ্রেরণার এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর রেখে গেলেন। শত শহীদের সাথে হাবিলদার আবদুল খালেকের নামও ইতিহাসের পাতায় সোনালি অক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে রইল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪০

হানাদারদের পাল্টা আক্রমণ শুরু হবার পর আমাদের গোড়ান-সাটিয়াচরা ডিফেন্স বেশিক্ষণ টেকেনি। ৭২ এম. এম. আর. আর. ও ১২০ এম. এম. কামান থেকে একে এক গোলা ও হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগানের গুলিবৃষ্টি আমাদের বাঙ্কারগুলি গুঁড়িয়ে দেয়। গোড়ান-সাটিয়াচরা যুদ্ধে তেইশ-চব্বিশজন ই. পি. আর. সহ তিরিশজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। এদের মধ্যে ফরিদপুরের ই. পি. আর. গফুর, বগুড়ার হাবিলদার আঃ খালেক। এ ছাড়া গোড়ান, সাটিয়াচরা, পাকুল্যা, গুনটিয়া, আছিমতলা এলাকার আরো যে মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হয়, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ (১) জুমারত আলী দেওয়ান, পিতা—রাজ্জাক আলী দেওয়ান (২) এস. এম. জিল্লুর রহমান (টেপু মিয়া), পিতা—এস. এম. আঃ সাত্তার (৩) সৈয়দ নূরুর রহমান (জাহাঙ্গীর), পিতা—মৌঃ এ. এফ. এম. নুরুদ্দিন শাহ (৪) পান্না সিকদার, পিতা—ইয়াদ আলী সিকদার (৫) মোঃ নুরুদ্দিন, পিতা—সোমেজ উদ্দিন (৬) আবুল কাশেম (হাসি), পিতা—আবু হানিফ (৭) মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন, পিতা—দবির উদ্দিন, (৮) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম (মানিক), পিতা—এখলাসউদ্দিন (৯) আলহাজ মৌঃ খঃ আঃ হাকিম, পিতা—খঃ আশিকুর রহমান, (১০) মোঃ দুদু মিয়া, পিতা—মাজম আলী (১১) মোঃ লেবু মিয়া, পিতা-রমজান আলী (১২) ভিকু চৌধুরী (১৩) মোঃ আঃ হক মিয়া, পিতা—আঃ আজিজ (১৪) মোঃ শাহ আলম, পিতা, ছামানুর রহমান (১৫) নঈম বক্স, পিতা—করিম বক্স (১৬) দুলাল মিয়া, পিতা—মেজবাহ উদ্দিন (১৭) আবু রায়হান, পিতা—মোতালেব মিয়া (১৮) হাবিবুর রহমান চৌধুরী, পিতা—মুজিব হোসেন চৌধুরী (১৯) মোঃ ইব্রাহিম মিয়া, পিতা—রমেজ মিয়া, (২০) এস. এম. তফাজ্জল হোসেন, পিতা—এস. এম. আফজাল হোসেন (২১) এস. এম. আফজাল হোসেন, পিতা—এস. এম. হোসেন আলী মুন্সি (২২) মোঃ আজমত আলী, পিতা—ইয়াকুব আলী (২৩) মোঃ শরীফউদ্দিন, পিতা—মোঃ নূর হোসেন, (২৪) মোঃ নূরুল ইসলাম (লেবু), পিতা—মোঃ ওয়াজেদ আলী (২৫) গাজী শামসুল আলম, পিতা—গাজী কবির উদ্দিন (২৬) মোঃ মজিবুর রহমান, পিতা—দেনাতুল্লাহ মুন্সি (২৭) মোঃ নাজমুল আলম, পিতা—নূরুল ইসলাম (২৮) মোঃ আবুল হোসেন, পিতা—হাজী আঃ লতিফ মুন্সি (২৯) মোঃ কাজিম উদ্দিন, পিতা—ফকির মাহমুদ সরকার (৩০) আঃ মান্নান, পিতা—দারোগ আলী (৩১) দারোগ আলী (৩২) জিয়াউর রহমান, পিতা—মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ।
এছাড়া হানাদাররা গ্রামে ঢুকে (১) সৈয়দা মেহেরুন নেছা (খুকী) (২) মিলি চৌধুরী (৩) নূরজাহান বেগম (৪) করিমন নেছা (৫) কহিনুর আক্তার (৬) আমেনা খাতুন (৭) মজিরন নেছা (৮) নছিরন বেওয়া (৮) জয়গন বেগম (১০) লাল বানু (১১) সুফিয়া বেগম (১২) এস. এম. মোস্তাফিজুল হক (শাহিন)সহ আরো প্রায় ২৫-৩০ জন নানা বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশুকে বেয়োনেটে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে।
এই যুদ্ধে আহতদের মধ্যে ছিলেন, (১) মোঃ মোশারফ হোসেন (২) এস. এম. বদরুল আলম ফারুক (৩) এস. এম. জিয়াউল হুদা, (৪) নূরুল ইসলাম (৫) দুলাল (মৃত) (৬) আবুল বাসার (৭) মোঃ জামালউদ্দিন (৮) রমিজউদ্দিন (৯) মোঃ ইন্তাজ আলী (১০) গানু শিকদার (১১) মোঃ আক্কাছ মিয়া (১২) আঃ লতিফ (১৩) হালিমন নেছা (১৪) ফুলমতি বেগম (১৫) মাহমুদা খাতুন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৪১

এখানে হানাদারদের তিনশ নিহত ও দেড়শো জন আহত হয়। এছাড়া প্রচুর পরিমাণ গোলাগুলি অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস হয়।
ন’টার দিকে বুঝতে পারলাম, গোড়ান-সাটিয়াচরা ডিফেন্স ভেঙে গেছে। জামুর্কী থেকে নাটিয়াপাড়া পিছিয়ে এলাম। এসেই দেখি সুবেদার তার দল গুটাচ্ছেন। তিনি আমাদের কোন কথা শুনলেন না। ই. পি. আর-দের দুটো ট্রাকে উঠিয়ে ঝড়ের বেগে টাংগাইলে চলে গেলেন। আমরা শ’তিনেক মুক্তিযোদ্ধা নাটিয়াপাড়ায় বিস্ফারিত চোখে ই. পি. আর-দের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কাঁদো কাঁদো হয়ে সবাইকে বললাম, “ই. পি. আর-রা যখন রকেট লাঞ্চার, ২ ইঞ্চি মর্টার ও এল. এম. জি. থাকতে পিছাচ্ছে, তখন আমাদের আর ৩০৩ রাইফেল নিয়ে ডিফেন্স আগলে বসে থাকার কোন মানে হয় না।” সত্যিকারে আমরা তখন নাটিয়াপাড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছিলাম না। বজ্রপাতের মতো গর্জন করে একটার পর একটা শেল আশেপাশে পড়ে আমাদের পিলে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। সবাইকে ডিফেন্স ছেড়ে দিতে অনুরোধ করে আমিও দশ-বারজন নিয়ে জিপে টাংগাইল রওনা হলাম। এই যুদ্ধে আমার একটা গুলিও ছোঁড়া হল না। নাটিয়াপাড়া ব্রিজে উঠে আশেপাশে ঘন ঘন গোলা পড়তে দেখে ভয়ে গাড়ি ছেড়ে সবাই ব্রিজের নিচে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। একটু পরে গোলাবৃষ্টি কমলে আমরা টাংগাইলের দিকে ছুট দিলাম। আমি বিদ্যুৎবেগে জিপ চালিয়ে যখন টাংগাইল আসছিলাম তখন আরফান খানের পেট্রল পাম্পের কাছে সৈয়দ আবদুল মতিন সাহেবকে দেখলাম। তিনি তখনও প্রচার করে চলেছেন— ‘আজ বিকেল চারটায় বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে এক বিরাট জনসভা।’ মতিন সাহেবকে পর্যন্ত কিছু বলতে পারলাম না।
বাসস্ট্যান্ড থেকে সোজা ময়মনসিংহের রাস্তা ধরে আমাদের বাসার কাছে এসে পাকা রাস্তায় না গিয়ে সুরুজের কাঁচা রাস্তা ধরলাম। কুমুদিনী কলেজের কোণে গাড়ি থামাতেই লুঙি পরা ফজলুল হক দৌড়ে এল। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘আমিও আপনার সাথে যাব’ দুই-তিন দিন ডিফেন্স যায়নি তবে কাগমারী কলেজ মাঠে সবার সাথে সেও প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ফজলুকে বাধা দিতে পারলাম না। সবাইকে নিয়ে ঘারিন্দা পর্যন্ত আসতেই মনে হলো, আমরা যে পাহাড়ের দিকে যাচ্ছি, খাবার-দাবার পাব কোথায়? সাময়িকভাবে কিছু খাবারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। গুলি-বোঝাই টাংগাইল ক-৩ নম্বর জিপ ঘারিন্দা কার্তিক বসাকের বাড়ির পাশে রেখে সবুরকে নিয়ে ঘারিন্দায় লুকিয়ে-রাখা টাংগাইল ৩৯ নং ট্রাক ধাক্কা দিয়ে স্টার্ট করে নিজেই চালিয়ে টাংগাইল হাইকমাণ্ড অফিসের সামনে এলাম। অফিসের সামনে তখনও প্রায় অধিকাংশ নেতৃবৃন্দই রয়েছেন। আমাকে দেখে তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শেষ খবর কী?’ বললাম, ‘ডিফেন্স ভেঙে গেছে। কিছু খাবার-দাবার নিতে এসেছি।’ ঘারিন্দা থেকে ফেরার পথে বারবার মনে হচ্ছিল শুধু খাবার নয়, পুলিশ-কোথে যে অস্ত্র ও গুলি আছে, তাও নিয়ে যাব। যদি কিছু করতে নাও পারি, অস্ত্রগুলো তো অন্তত হানাদারদের হাতে পড়বে না। হাই কমাণ্ডের নেতৃবন্দরাই চার বস্তা আটা, দু’বস্তা চিড়া, চার বস্তা চাল, এক বস্তা চিনি, আট-দশ টিন বিস্কুট গাড়িতে তুলে দিলেন। আমি দৌড়ে পুলিশ কোথে-গেলাম। তালা খুলতে গেলে পুলিশ বাধা দিল। ক্ষেপে গিয়ে বাঘের মতো গর্জে উঠে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২

ঝটকা মেরে পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়ে বাঁট দিয়ে একধাক্কায় বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিলাম। চিৎকার করে উঠলাম— ‘ব্যাটাকে বাঁধুন।’ পুলিশকে আর বাঁধতে হলো না, এতেই তার জাকানদানি উঠে গেছে। কোথের দরজা খুলে ফেললাম। আবদুস সবুর, হাই কমাণ্ডের হবি মিঞা, মীরের বেতকার আনোয়ার, বাসস্ট্যান্ডের হবি, থানাপাড়ার আলী হোসেন এবং আরো প্রায় সত্তর-আশিজন বিদ্যুৎগতিতে আর্মস এ্যামুনিশন ট্রাকে তুলে দিলেন। প্রত্যেকেই চেষ্টা করেছেন স্বাধীনতার জন্য কিছু একটা করতে, অবদান রাখতে।
৩০৩ রাইফেলের তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার ও ৯ এম. এম-এর হাজার পাঁচেক গুলি, সত্তরটা ৩০৩ রাইফেল, কুড়িটা একনলা-দোনলা বন্দুক, গোটা ত্রিশেক ‘ডেমি-রাইফেল’ ট্রাকে উঠানো হল। অস্ত্র উঠানোর সময় ছয়-সাতটি রিভলবার নেতারা পকেটে পুরলেন। একবার ভাবলাম নেতাদের তল্লাসি করে রিভলবারগুলো নিয়ে নিই। আবার মনে হলো, না, এটা ঠিক হবে না। নেতারা অপমানিত হবেন। আর কাজটা মোটেই সমীচীন নয়। যে সম্মানিত নেতারা রিভলবার নিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—জাতীয় লীগের আল মুজাহিদী, সৈয়দ আবদুল মতিন, বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের হামিদুল হক মোহন। গাড়িতে অস্ত্র বোঝাই-কাজে যে সবচাইতে বেশি পরিশ্রম করল সে হলো বাসস্ট্যান্ডের হবি। অস্ত্র ও খাদ্য বোঝাই ট্রাক নিয়ে নতুন জেলাশহরের দিকে বেরিয়ে পড়লাম।
পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমার কাছে টাংগাইল পুলিশ অস্ত্রাগারের চাবি থাকার পরও পাহারারত পুলিশ বাঁধা দিয়েছিল কেন? তার কারণ হয়তো এ হতে পারে, গোড়ান-সাটিয়াচরা ও নাটিয়াপাড়ায় আমাদের ডিফেন্স ভেঙে গেছে শুনে টাংগাইল থানার ও. সি. পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়ে দেয়। হঠাৎ থানায় পাকিস্তানী পতাকা উড়তে দেখে লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। পুলিশ-কোথে পাহারারত পুলিশটির গায়েও বোধহয় থানার হাওয়া লেগেছিল। আমি যখন হাইকমাণ্ড নেতাদের ডিফেন্স ভেঙে যাওয়ার কথা বললাম, তখন কোথের পুলিশটি আমার কথা শুনেছিল। তাতেই বোধ হয়, এতদিন যে আমাদের সেবা করেছে, এখন সেই আবার পাকিস্তানীদের সেবা করে বিগত কয়েকদিনের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিল।
টাংগাইল জেলাশহর থেকে একটা ‘পিক আপ’ নিয়ে তাতে এক ড্রাম ডিজেল ও এক ড্রাম পেট্রোল এবং রিলিফ ডিপার্টমেন্ট থেকে দুই বস্তা পুরানো কাপড় ও পাঁচটি স্পিডবোটের ইঞ্জিন নিলাম। ট্রাকের দায়িত্ব দিলাম সবুরকে। ট্রাকে ড্রাইভার ছিল না, সহকারী গাড়ি চালাচ্ছিল। সে ভালো চালাতে পারে না। তবুও চালিয়ে নিচ্ছিল। ‘পিক-আপ’ নিয়ে ঘারিন্দায় গিয়ে আমি জিপে উঠলাম। ‘পিক-আপ’ চালানোর দায়িত্ব নিলেন টাংগাইল ই. পি. আর. টি. সি-র এক ড্রাইভার (আমি আজ কিছুতেই তার নাম মনে করতে পারছি না)। জিপ ও ‘পিক-আপ’ নিয়ে বাংড়ার কাছে গিয়ে দেখি, রাস্তার পাশে আমাদের ট্রাক কাত হয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখলাম সামনের চাকা অনেকখানি গর্তে দেবে গেছে। বাংড়া আমার নানার গ্রাম। আর ছাত্র-রাজনীতি করার সুবাদে গ্রামের প্রায় সবাই আমাকে চেনেন। ট্রাকের সাথে দুটি লম্বা দড়ি বেঁধে গ্রামের লোকজন তার একটি
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৩

ধরলেন, অন্যটি আমার ফোর হুইল জিপে বেঁধে অনেক কষ্টে গাড়ি গর্ত থেকে উঠালাম। বাংড়া থেকে সোহরাওয়ার্দীও ট্রাকের সাথে গেল। ‘পিক-আপ’ ও ট্রাক আগে পাঠিয়ে পেছনে রইলাম।
কালিহাতি থেকে ট্রাক ও ‘পিক-আপ’ কাঁচা রাস্তা ধরল। কালিহাতি মুন্সীপাড়া সি. ও. অফিস থেকে একটিন মবিল নিয়ে আমিও কাঁচা রাস্তা ধরলাম। কামার্তির সাইদুরদের বাড়ির কাছে এসে চকের মধ্যে ট্রাক ও ‘পিক-আপ’ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ‘পিক-আপের’ ক্লাশপ্লেট জ্বলে গেছে। সেটা আর চলবে না। ডিজেল, পেট্রোল, কাপড়ের বস্তা ও অন্যান্য জিনিসপত্র ইতোমধ্যে ট্রাকে উঠিয়ে সহকর্মীরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ‘পিক-আপের’ ব্যবস্থা করেছি বলে ট্রাক পাঠিয়ে দিলাম। ‘পিক-আপ’ আমার গাড়ির পেছনে বেঁধে সাইদুরদের বাড়ির কাছাকাছি যেতেই টাংগাইল ক-১ নম্বর জিপ আমাদের সামনে এসে থামল। জিপে খোন্দকার আসাদুজ্জামান, বড় ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আসাদ ভাইয়ের স্ত্রী আশা আপা ও তার ছেলেমেয়েরা। তারা নাগবাড়ি থেকে আসছেন। বড়ভাই ও আসাদ ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কোথায় যাচ্ছিস? জিনিসপত্র ঠিকমতো রেখে ময়মনসিংহের দিকে চলে আসিস। আমি ময়মনসিংহ গিয়ে দেখি কী করা যায়।” এরপর আসাদ ভাইয়ের সাথে আর আমার দেখা হয়নি। ওনাদের কাছে বিদায় নিয়ে ‘পিক-আপ’ কামাৰ্তির পাশে এক বাড়িতে রেখে আমাদের গ্রামের দিকে এগুলাম। পাছচারান এসে দেখি কড়কড়ে বালিতে ট্রাকের চাকা আবার দেবে গেছে। চারানের তিন-চারশত লোকের সহায়তায় ঘন্টা-দুই পরিশ্রম করে ট্রাক উঠানো হল। ট্রাক যে চালাচ্ছে সে এমনিতেই ড্রাইভার নয়, তার উপর শঙ্কিত থাকার কারণে কাঁচা রাস্তায় মাঝে মধ্যে গাড়ি আটকে দিচ্ছিল। সর্বশেষ গাড়ি আটকাল আমাদের গ্রামের একেবারে কাছে, আগচারানের তিনমোড়ায়। এখানে কিন্তু শত চেষ্টা করেও বোঝাই-গাড়ি উঠানো গেল না। বাধ্য হয়ে সমস্ত মাল নামিয়ে ট্রাক উঠানো হলো। এখানেও আগচারান, পাকুটিয়া ও ছাতিহাতির শ’তিনেক লোক অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন।
৩ এপ্রিল রাত আটটায় গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলাম। আমরা আগেই খাবার তৈরি করতে খবর পাঠিয়েছিলাম। বাড়িতে গিয়ে সাথেসাথে পনের-ষোল জনে খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে বেরোবার সময় ছোট চাচা ওয়াদুদ সিদ্দিকীর কাছে পাঁচটা স্পিডবোট ইঞ্জিন দিলাম। উনি সেগুলো ছাতিহাতির পুবের পাড়ায় রাখলেন। আমরা এবার এগুলাম সোজা পুবে পাহাড়ে দিকে। অন্যেরা না জানলেও আমি জানতাম—কোন ক্রমেই ট্রাক বেশিদূর নেয়া যাবে না। আমাদের বাড়ি থেকে মাইল-দুই এগিয়ে মাল নামিয়ে সেই মুহূর্তেই ট্রাক ছেড়ে দিলাম। যে আনাড়ি চালক অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে দিনের বেলায় আসতে বারবার ট্রাক আটকে দিয়েছে, সেই কিন্তু নির্বিঘ্নে রাতেই কালিহাতি ফিরে গেল, কোন অসুবিধা হলো না। আমরা অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে বস্তাবাঁধা অস্ত্র এবং গুলির বাক্সগুলো, চাল, আটা, চিনি, বিস্কুট কয়েকটি গরুর গাড়িতে তুলে গভীর রাতে মরিচাতে নিয়ে গেলাম। সেখানে শুধু দুই ড্রাম তেল রেখে গেলাম। রাতে মহানন্দাপুরের হাসান ডাক্তারের ভাই আমাদের আবার গরুরগাড়ির বন্দোবস্ত করে দিলেন। ৪ তারিখ খুব সকালে মাসুদ, সোহরাওয়ার্দী, শোকন, মিন্টু, স্মৃতি, মতি এবং বরিশালের কামালকে গাড়ির সাথে বড়চওনায় ইদ্রিসের কাছে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৪

পাঠিয়ে দিলাম। সবুর, ইকবাল, ফজল ও ফারুককে নিয়ে আমি এলাম নাগবাড়ি, উদ্দেশ্য পাঞ্জাবি এ. ডি. সি-কে পাকড়াও করা। আমরা শুনেছিলাম এ. ডি. সি. খুব দুর্দান্ত প্রকৃতির লোক। তার স্ত্রী জিনসের প্যান্ট পড়ে, ‘বব ছাটে’ চুল রাখে, দুনিয়ার অভদ্র—আরো কত কী! কিন্তু নাগবাড়ি চৌধুরী-বাড়িতে লুকিয়ে রাখা এ. ডি. সি. কে ডাকতেই তার স্ত্রী দরজা খুলে দিলেন। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। একী! কোরান হাতে শাড়ি-পরা এ সুন্দরী মহিলা এল কোথা থেকে? তখনো বিদ্বেষ ও ঘৃণা আমাদের মন জুড়ে ছিল। মহিলার সুন্দর সুশ্রী মুখ দেখে আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলাম। রূঢ়তার সাথে বললাম, “আপনি কে?” মহিলা কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে আধা-বাংলা আধা-উর্দুতে বললেন, ‘এ. ডি. সি. সাহেবের স্ত্রী।’ এ. ডি. সি. ভদ্রলোক ভয়ে আধখানা হয়ে স্ত্রীর পিছনে লুকিয়ে ছিলেন। আমার মনে তখন দারুণ দ্বন্দ্ব চলছিল। প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে না হয় মুহূর্তে শাড়ি-পরা যায়। বিপদে পড়লে ভণ্ডরাও কোরান শরিফ আঁকড়ে ধরে, আল্লাহুর কসম খায়। কিন্তু চুল, এটা রাতারাতি হলো কী করে? এ. ডি. সি. কে বললাম, “আপনার স্ত্রীর চুল ধরে টান দিন।” বেচারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আচমকা স্ত্রীর চুল ধরে এক ঝটকা মারলেন। মহিলা টাল সামলাতে না পেরে প্রায় পড়েই গিয়েছিলেন। এরপরও আমার সন্দেহ গেল না। মহিলাকে বললাম, “আমি আপনার চুলটা দেখতে পারি।” কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে বললেন, “কী দেখবেন ভাই” আর কোন কথা বললাম না। অল্প ক’টা চুল ধরে টান দিয়েই বুঝতে পারলাম, না নকল নয়। সবটাই আসল। মুহূর্তে আমার মনের সমস্ত ঘৃণা, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা স্নেহতে বদলে গেল। আমার আর মনে হলো না, সামনে দাঁড়ানো কুড়ি-বাইশ বছরের মহিলাটি পাঞ্জাবি এ. ডি. সি-র স্ত্রী। আমার বারবার মনে হতে লাগল, এ হয়তো আমারই বোন। এতে আর আমার বোন রহিমাতে কোন পার্থক্য খুঁজে পেলাম না। মনের ভিতর তোলপাড় করতে লাগল। আমরা কতকিছুই ভুল শুনি এবং বিদ্বেষ বশতঃ কত ভুলই না করি। ভিতরে ভিতরে আমার কান্না পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রকাশের সময় ছিল না। তবু আমরা এ. ডি. সি-কে সাথে নিলাম। তার স্ত্রী কুড়ি-বাইশ বৎসরের মহিলা কোরান হাতে আমাদের হাতে-পায়ে ধরার চেষ্টা করল। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, “আপনার স্বামী যদি নতুন করে কোন অঘটন না ঘটায় তাহলে তার গায়ে আঁচড় পর্যন্ত লাগবে না এবং সসম্মানে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব।” মহিলার হয়তো আমার কথায় বিশ্বাস হয়েছিল। ‘ভাই’ বলে সে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। আমরা এ. ডি. সি-কে নিয়ে চললাম কচুয়ার দিকে। ভদ্রলোক প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন, রীতিমতো কাঁপছিলেন। গাড়িতে আমাদের কিছু কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে বলেন, ‘আমি খুব ভালো গাড়ি চালাতে পারি, আমি খুব ভালো রুটি বানাতে পারি।’ এ. ডি. সি-র কথা শুনে অত উত্তেজনার মাঝেও আমি হেসে ফেলাম। এ দুটির কোনটাই আমাদের কাজে লাগবে না। উত্তর শুনে হতাশ হয়ে এ. ডি. সি. আবার বললেন, ‘ভাই আমি আপনাদের লেখাপড়ার কাজ করে দিতে পারব।’ এবারও ভদ্রলোককে হতাশ করলাম, “এখন তো যুদ্ধ। লেখাপড়া প্রথম অবস্থায় খুব একটা কাজে আসবে না।” ভদ্রলোক হতাশ হলেও আস্তে আস্তে তার ভয় কেটে গেল। আমি তাকে বুঝাতে পারলাম—অযথা কারো উপর উৎপীড়ন, অত্যাচার করা আমাদের নীতি নয়। তিনি নতুন করে কোন
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৫

কিছু না করলে আমরা আমাদের কথা রক্ষা করব।
দুপুরে কচুয়াতে পৌঁছলাম। হামিদুল হক বাজারের এক দোকানে বসেছিলেন। আমাদের দেখে দৌড়ে এলেন। তাকে অনুরোধ করলাম, খাবারের ব্যবস্থা করুন। তিনি খাবারের ব্যবস্থা করলেন। আমাদের জন্য তৈরি করা খাবার এ. ডি. সি. খেতে পারছিল না। হামিদ সাহেবকে বললাম, কষ্ট হলেও এর জন্য কয়েকটা ভালো রুটির ব্যবস্থা করুন। এ. ডি. সি কষ্ট করে খাচ্ছিলেন। আমি তাকে বারণ করলাম। এতে ভদ্রলোক ভয় পেয়ে খাওয়া বন্ধ করলেন। তিনি ভাবলেন, হয়তো তাঁর খাওয়া বারণ। আমরা খাবার খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে উঠে পড়লাম। এ. ডি. সি. তখন পর্যন্ত অভুক্ত। দু’ একবার ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন। আমাদের খাওয়া শেষ করার পঁচিশ মিনিট পর এ. ডি. সি-র জন্য রুটি ও ঝাল-ছাড়া মাংস এনে দেওয়া হলে তাঁর দু’চোখ দিয়ে দরদরিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। ভদ্রলোক কাঁদলেন আর খেলেন। এরপরেই বোধহয় আমাদের প্রতি তার আস্থা জাগে। হামিদ সাহেবের সাথে আলাপ করে এ. ডি. সি-কে আনসার-কমাণ্ডার ইয়াকুবের বাড়িতে লুকিয়ে রাখবার ব্যবস্থা হলো। ইয়াকুব কমান্ডারের বাড়িতে এ. ডি. সি. -কে রেখে যাবার সময় আবার তাকে আশ্বাস দিলাম, ‘আপনি ভালোভাবে থাকলে সর্বদা ভালো আচরণ পাবেন।’
সন্ধ্যার একটু আগে আমরা এলাম বড়চওনাতে। ইদ্রিস বড়চওনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে আমাদের অপেক্ষায় বসেছিল। আমাদের দেখে সবাই মহাখুশি। আমস-এ্যামুনিশন ততক্ষণে মোটামুটি লুকিয়ে রাখা হয়ে গেছে। আমাকে তারা জিনিসপত্রের একটা নিখুঁত হিসাব দিল। চারটা রাইফেল বের করে ইদ্রিসের হাতে দিয়ে আর্মসগুলো রক্ষার দায়িত্ব দিলাম। এরা হচ্ছে বড়চওনার ইদ্রিস আলী, আবেদ আলী ও খলিল। রাতে দু-তিনজনকে নিয়ে কালিয়াপাড়া ঘোনারচালার খোরশেদ মাষ্টার এলেন। তিনি নিজেই আমার থেকে ষোলটা রাইফেল চেয়ে নিয়ে গেলেন। আমি সত্যি একটু অবাক হলাম। অনেকে অস্ত্র রাখতে চায় না, খোরশেদ মাষ্টার সাহেব আগ্রহ করেই অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখলেন। পরবর্তী সময় আগ্রহ করেই অস্ত্রগুলো আবার আমার হাতে তুলে দিয়েছেন।

তিক্ত অভিজ্ঞতা
৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় বড়চওনা থেকে রওনা হয়ে ৬ এপ্রিল খুব ভোরে ময়মনসিংহে পৌঁছাই। শহরে কিছু সময় কাটানোর পর আরো উত্তরে সার্বিক অবস্থা ও পরিবেশ জানার জন্য ফুলপুর হালুয়াঘাট হয়ে কড়ইতলি ও হাতিপাগড়ি এলাম। ময়মনসিংহ থেকে হালুয়াঘাট হয়ে কড়ইতলি যাবার পথে ময়মনসিংহের যুবনেতা হাশেমের সাথে দেখা হয়। তাঁর কুশলাদি জেনে কড়ইতলি ই. পি. আর. ক্যাম্পে গেলাম। সারাদিন সেখানে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসার পথে টাঙ্গাইলের তদানীন্তন জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব হুমায়ুন খালিদ এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফের সাথে দেখা হয়। যথারীতি কিছু কথাবার্তার পর আবার গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হয়ে কয়েক মাইল পাড়ি দিয়ে আমরা ফুলপুর বাজারে এলাম। আমার গায়ে বহু-ব্যবহৃত একটি পুরনো ছেঁড়া জামা ছিল। সাথী মাসুদের অবস্থাও একই। এজন্য ফুলপুর
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৬

বাজার থেকে দু’টি শার্ট তৈরি করিয়ে নিই।
ফুলপুর বাজার থেকে দু-তিন মাইল দক্ষিণে ইদুলপুর গ্রাম। এ গ্রামেই মাসুদের ভগ্নিপতির বাড়ি। সেখানেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত হলো। মাসুদের ভগ্নিপতির বাড়ি পৌঁছে খবর পেলাম। গোপালপুরের সংসদ সদস্য হাতেম আলী তালুকদার পাশের বাড়িতে আছেন। সাথে সাথে তালুকদার সাহেবের কাছে ছুটলাম। কারণ তাঁরাই নেতা, তাঁরাই পথ দেখাবেন, নির্দেশ দেবেন। কিন্তু তালুকদার সাহেবের সাথে দেখা করে হতাশ হলাম। ভদ্রলোক আমাদের কোন সাহস ও সৎপরামর্শ তো দিলেনই না বরং নিরুৎসাহিত করলেন। আমরা ফিরে এলাম মাসুদের ভগ্নিপতির বাড়ি। দুলাভাই যারপরনাই যত্ন করলেন। তার সুন্দর ব্যবহার ও আতিথেয়তা আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করল। আজও আমি তাঁর সেই পরম আন্তরিকতা ও যত্নের পরশ অনুভব করি।
পরের দিন সঙ্গীদের নিয়ে পুনরায় সীমান্তের দিকে অগ্রসর হলাম। হালুয়াঘাট আওয়ামী লীগ অফিসে হালুয়াঘাটের তদানীন্তন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব শামসুল হককে পেলাম। তার সাথে দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছু আলোচনা করলাম। তাঁকে বললাম, ‘এই এলাকাকে শত্রুমুক্ত রাখতে হলে, শক্তি সঞ্চয় করে ঢাকার দিকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।’ ৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনী কিভাবে টাংগাইলে প্রবেশ করেছে—তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বললাম, ‘অদ্যাবধি টাংগাইলের উত্তরের সমস্ত এলাকা শত্রু-নিয়ন্ত্রণমুক্ত। এমতাবস্থায় যদি কিছু সাহায্য পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের যেমন উপকার হবে তেমনি সমগ্র ময়মনসিংহও নিরাপদ থাকবে’ আমার কথাবার্তায় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব শামসুল হক খুবই অনুপ্রাণিত। তিনি কাল বিলম্ব না করেই ই. পি. আর-এর জনৈক সুবেদার জিয়াউল হক এর সাথে যোগাযোগ করলেন। জিয়াউল হক এলে তাঁর কাছে নিজের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করলাম। তিনি সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ জানতে ও তাৎক্ষনিকভাবে দিতে অনুরোধ করলে সুবেদার সাহেব দু’দিন সময় চেয়ে যে পরিমাণ সাহায্যের উল্লেখ করেন, তাতে আমি খুবই হতাশ হই। কারণ গোড়ান-সাটিয়াচরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম তার প্রেক্ষিতে বিচার করলে জিয়াউল হকের সাহায্যের আশ্বাস খুবই অপ্রতুল।
সুবেদার জিয়াউল হক চার-পাঁচটি এল. এম. জি. গোটা তিনেক ২ ইঞ্চি মর্টার, দু’টি ওয়্যারলেস সেট ও ৩০৩ রাইফেল সহ সত্তর-আশিজন ই. পি. আর-এর জোয়ান পাঠাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
দু’দিন পর হালুয়াঘাট এসে আমি আবার দেখা করব—জিয়াউল হককে এই আশ্বাস দিয়ে পুনরায় ময়মনসিংহে রওনা হলাম। ফেরার পথে শুধু ভাবছিলাম, এই ধরনের মনোবল, মানসিকতা ও প্রস্তুতি নিয়ে কিছুতেই পাক-বাহিনীর মোকাবিলা করা যাবে না। তাই মনে মনে স্থির করলাম, আবার টাংগাইলের পাহাড়ি এলাকায় ফিরে যাব। নিজেদের প্রচেষ্টায় প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলা-বারুদ সংগ্রহ করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার চেষ্টা করব। কিন্তু পথে ফুলপুর পুলে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৭

বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই জোয়ান এল. এম. জি. হাতে আমাদের গাড়ির গতিরোধ করে বসল। তারা বলল, ‘আপনাদের থানায় যেতে হবে’ কারণ জিজ্ঞাসা করায় বলল, ‘জানি না।’
পুল থেকে থানা আনুমানিক এক’শ গজ। আমাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। এখানে মমতাজ হোসেন নামে এক ছোট দারোগা বলল, ‘আপনাদেরকে অবাঙালি বলে মনে হচ্ছে। আপনারা পাকিস্তানী গুপ্তচর। আপনাদের গাড়িতে আর্মস আছে। আমার সাথে আঠারটি রাইফেল ও হাজার কয়েক গুলি ছিল। ‘পাকিস্তানের গুপ্তচর’ এই উক্তি শুনে খুবই ব্যথিত ও মর্মাহত হলাম।
কে এই মমতাজ হোসেন? কী তার পরিচয়? যদি চিনে থাকে তবে না-চেনার এই ভান কেন? রহস্য কী? মাত্র কয়েক বছর আগে মমতাজ হোসেন কোর্ট-পুলিশ হিসাবে টাংগাইলে ছিল। আর ঐ কোর্টে আমার বাবা আবদুল আলী সিদ্দিকী একজন স্বনামধন্য ও প্রভাবশালী প্রবীণ আইন-ব্যবসায়ী। এই পুলিশ ভদ্রলোক নানা উপলক্ষে আমার পিতার সহানুভূতি, সহযোগিতা ও করুণা পেয়ে বাধিত ও ধন্য হয়েছে। শুধু তাই নয়। দু’চারবার আমার মায়ের রান্না খেয়ে শরীরের পুষ্টিসাধন করেছিল। অথচ কী আশ্চর্য! সে আজ আমাকে না-চেনার ও না জানার ভান করছে। অবাঙালি বলতেও এতটুকু দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। পুলিশ অফিসারটির বিবেকহীন অভাবনীয় দুর্ব্যবহার আমার মনে সীমাহীন অসন্তোষ ও প্রচণ্ড ঘৃণার উদ্রেক করে।
পুলিশ অফিসারের সাথে কথাবার্তা চলার সময় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র-সংসদের তদানীন্তন ভি. পি. গোলাম হাফিজ সেখানে এসে হাজির হন। আমি তাঁর কাছে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করতে শুরু করলে এক ফাঁকে পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি এদের চেনেন?’ হাফিজ সাহেবের সাফ জবাব—এদের আমি চিনি না।’ এখানেও প্রশ্ন জাগেঃ আমাকে কি গোলাম হাফিজ চিনতেন? অবশ্যই, আমরা পরস্পর সুপরিচিত। উভয়ে একই মতবাদে বিশ্বাসী এবং একই দলের সক্রিয় সদস্য। পনের দিনও হবে না, ময়মনসিংহের অনেকগুলো সভায় একত্রে যোগ দিয়েছি। একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছি। ঘুষখোর দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ অফিসারটির আচরণ আমাকে যত না আঘাত করেছিল, তার চাইতে হাফিজের ব্যবহারে আমি হাজারো গুণ বেশি বিস্মিত ও আহত হলাম।
পরে অবশ্য হাফিজ জানিয়েছিলেন, কেন তিনি তখন অপরিচিতের ভান করেছিলেন। তার যুক্তিঃ কাদের সিদ্দিকীকে চিনি, একথা বললে হয়তো পুলিশ অফিসারটি শুনবে না, তাঁর অনুরোধ রাখবে না। তাই পরিচিতি গোপন রেখে আমার হয়ে উর্ধ্বর্তন কোন নেতাকে দিয়ে কিছু চেষ্টা-তদবির করাতে পারেন কি না, এটাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। অন্যদিকে পুলিশ ভদ্রলোক অচেনার অভিনয় করলেন কেন? কারণ তখন তার তেমন কোন কাজ ছিল না। অথচ দেশে উলটপালট ও যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে। এ সময়ে অনেকে একাধিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন গৌরববোধ করছেন, বাহবা কুড়াচ্ছেন। তার মধ্যেও লোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। কৃতিত্ব কুড়াবার সুযোগ চায়। সুযোগও এসে গেল। একটি কাজের মতো কাজ করেছে। অতএব গৌরব ও কৃতিত্বের দাবিদার—এটা প্রমাণ করতে ভদ্রলোক ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবাহিত বুগাই নদীর উত্তর পাড়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৮

হাতিপাগার ক্যাম্পে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের কাছে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। বুগাই নদীর দক্ষিণপাড়ে পৌঁছে পুলিশ ভদ্রলোক আমাকে বললে ‘এখানে অপেক্ষা করুন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের মতো নেতার সামনে আপনাকে হঠাৎ নিয়ে যেতে পারি না। আপনার মতো সন্দেহ জনক লোককে তার ঠিকানা জানানো ঠিক নয়। তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা চাই, গোপনীয়তা রক্ষা করা দরকার।’ পুলিশ অফিসারটি কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে নদী পেরিয়ে হাতিপাগাড় ক্যাম্পে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের সামনে হাজির হয়ে বলল, ‘স্যার, আমরা ফুলপুরে কয়েকজন অবাঙালিকে আটক করেছি। মনে হয় তারা পাক-বাহিনীর গুপ্তচর। অবস্থার সুযোগ নিয়ে তারা হয়তো চুরি-ডাকাতি পর্যন্ত করেছে। তাদের কাছে বেশ কিছু আর্মসও পাওয়া গেছে।’
সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের বিস্তারিত পরিচয় ও বিবরণ জানতে চাইলে পুলিশটি আমতা-আমতা করে অস্পষ্টভাবে বলল, ‘এই দলে কাদের সিদ্দিকী বলে একজন আছে।’ সিদ্দিকী নাম শুনেই নজরুল ইসলাম সাহেব ভয়ানক চটে যান। অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় বললেন, “তোমরা আর কোন কাজ পাওনা? আমাদের যত ভালো ভালো লোক পাও, তাদেরকেই তোমাদের গুপ্তচর বলে মনে হয়। তোমাদের স্বভাব মরার আগেও বদলাবে না। এখন কাদের সিদ্দিকীকে মিলিটারি লোক বলে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাহবা কুড়াবে, ফায়দা লুটবে। এটাই তোমাদের স্বভাব।”
সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, যাও, ‘এক্ষুণি গিয়ে তাদের ছেড়ে দাও।’ কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, পুলিশ অফিসারটি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কী, অমন করে দৌড়াচ্ছেন কেন? আর আমাদের বা কী হলো?’ অতিশয় বিনয় ও ব্যস্ততায় বলল, ‘স্যার, আপনাদের ভালো করেই চিনেন। আমি চলে যাচ্ছি। আপনারাও আসুন। হাফিজ ও রফিক ভুইয়া সাহেবরাও এখানে আছেন। তারাও আসছেন। এই বলেই আমাকে রেখে পাহারাদার দুই সশস্ত্র পুলিশকে তাড়াহুড়া করে গাড়িতে উঠিয়ে ফুলপুর থানার দিকে দ্রুত চলে গেল। থানায় পৌঁছেই আমার লোকজনদের কোথাও কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না, কার কী দরকার, কী খেতে চায় ইত্যাদি খোঁজ-খবর নিতে শুরু করে দেয় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই খাসি জবাই করে খাওয়া ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে। যেন জামাইকে আদর করে খুশি রাখার প্রাণান্ত প্রয়াস।
যদিও বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই জোয়ান এল. এম. জি. উঁচিয়ে আমার গাড়ির গতিরোধ করেছিল, কিন্তু আমাদের আটক করার ব্যাপারে তাদের কোন হাত ছিল বলে আমি সেদিন মনে করিনি, আজও মনে করি না। বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকেরা সেসময় ওখানকার কর্তৃপক্ষের আদেশ পালন করেছিলেন মাত্র।
রাত দশটা নাগাদ বি. এস. এফ, ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং, রফিক ভূঁইয়া ও হাফিজসহ আমি ফুলপুর থানায় এলাম। সন্ধ্যায় মণীন্দ্র মোহন ঘোষ ও এন. এ. আজাদ, পাবনা-সিরাজগঞ্জ
পৃষ্ঠা নং ~ ৪৯

ঘুরে ময়মনসিংহ হয়ে ফুলপুর এসে মিলিত হয়েছিল। ফুলপুর থেকে আমরা ময়মনসিংহ ফিরে ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে রাত কাটালাম। পরদিন সকালে ময়মনসিংহের হানিফ সাহেবের সাথে দেখা হলো। তিনি বললেন, “আপনার বড়ভাইলতিফ সিদ্দিকী আপনার জন্য খুবই উদগ্রীব। তিনি এখন জামালপুর পি. টি. আই. স্কুলে রয়েছেন।” বড় ভাইয়ের কথা শুনে তখনি জামালপুর রওয়ানা হলাম। ময়মনসিংহ থেকে মনতলা, চেচুয়া, নুরুন্দি ও নান্দিনা হয়ে জামালপুর পৌঁছলাম। কিন্তু পি. টি. আই. স্কুলে খবর নিয়ে জানতে পারলাম বড়ভাইএকদিন আগে শেরপুরে নিজাম সাহেবের বাড়িতে চলে গেছেন। ফলে শেরপুর যাওয়ার জন্য ব্রহ্মপুত্র নদীর খেয়াঘাটে কিছু লোক জটলা পাকিয়ে নানা ধরনের আজেবাজে গাল গল্প করছিল। বড়ভাইলতিফ সিদ্দিকী সম্পর্কেও মুখরোচক গুজব ও কথাবার্তা চলছিল। এদের কিছু কথা আমার কানে আসায় সেখানে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করা সমীচীন বোধ হলো না, তাই শেরপুর যাওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করে টাংগাইলের দিকে ফিরে এলাম।
গোপালপুর বাজারে এক হোটেল দুপুরের খাবার খেয়ে প্রখ্যাত কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতা বেহুলার হাতেম আলী খানের বাড়িতে গেলাম। আমাদের দলের অন্যতম সদস্য মিন্টু জনাব হাতেম আলী খানের নাতি। রাতের খাওয়া শেষে ওই বাড়িতে বসেই ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ও পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলো। আমি অভিমত প্রকাশ করলাম, আপাততঃ শত্রু যাদের চিনবে না তাদের নিজ নিজ বাড়িতে অথবা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত। প্রথম অবস্থায় কেউ আমার অভিমত সমর্থন করল না। সবার একই বক্তব্যঃ আমরা ঘরে ফিরে যেতে আসিনি। বিশেষতঃ ফজলু, ফারুক, ইকবাল, মতি, কামাল, মাসুদ ও সবুরের কথা হলো, “কাদের ভাই, আপনি যেখানে যাবেন, আমরাও সেখানে যাব।” অনেক কথাবার্তা, অনুনয়-বিনয় ও আলোচনার পর ঠিক হলো, আপাতত ইকবাল তার সিরাজগঞ্জের চাচার বাড়িতে যাবে। শোকন ও মিন্টু ওখানেই থাকবে। কামাল যাবে বরিশালে। আজাদ, মণি, সবুর, সোহরাওয়ার্দী, স্মৃতি ও মতি যার-যার গ্রামের আত্মীয়-স্বজনের কাছে থাকবে। সবশেষে বাধ সাধল মাসুদ, ফজলু, আর টাংগাইল ক-৩ নম্বরের গাড়িটা।
সকলের গন্তব্যস্থল যখন ঠিক, উপলদিয়ার ফজলু কাছে এসে নিচু-গলায় বলল, “বজ্রভাই আমাদের বাড়িতে চলেন। যতদিন কোনকিছু না করা যায় ততদিন আমাদের বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকবেন। কেউ জানতে পারবে না।” সেই মুহূর্তে অবশ্য ফজলুর কথায় তেমন গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু তার ঐ আন্তরিক উক্তির মূল্য ও তাৎপর্য কতটা—কয়েকদিন পরেই আমি আমার সমস্ত অন্তর দিকে অনুভব করেছি- যা কোনদিনই ভুলব না, ভুলতে পারব না।
পরের দিন যার-যার আলাদা হয়ে যাবার কথা। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না। কেউ কারও সাথে কথা বলছে না। সবাই শুধু কাঁদছে আর কাঁদছে। ৩ থেকে ৯ এপ্রিল। মাত্র এই ছয়-সাত দিনের সহাবস্থান। একমাত্র পাহাড় ও সীমান্তে গমন ও কিছু কিছু তৎপরতায় অংশগ্রহণ। এরই প্রেক্ষিতে সবার মধ্যে যে মধুময় সান্নিধ্য, অকৃত্রিম বন্ধুত্বের নিবিড়
পৃষ্ঠা নং ~ ৫০

সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আর মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তার পরিসমাপ্তি ঘটবে, এই বিচ্ছেদের বেদনা তারা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। সকলেই ব্যথিত, দুঃখ ভারাক্রান্ত ও নির্বাক। এই সকরুণ দৃশ্য দেখে আমার নিজের পক্ষেও স্থির, চঞ্চল থাকা সম্ভব হয়নি। তবুও আমি সবাইকে সান্তনা দিতে এগিয়ে যাই। কেউ কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আমিও অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলাম না। তবু সবাইকে শান্তনা দিতে লাগলাম, “আবার আমরা মিলিত হব, যুদ্ধ চালাব, দেশ স্বাধীন করব।”
আমার হাতে তখন ছয় হাজার টাকা ছিল। প্রয়োজন ও চাহিদা মত কাউকে কাউকে এক’শ আবার কাউকে তিনশ’ চারশ’ টাকা দিলাম। তারা অশ্রু সজল নয়নে যার-যার গন্তব্যের দিকে চলে গেল। সোহরাওয়ার্দী, স্মৃতি, সবুর, কামাল ও মতিকে কিছু পথ এগিয়ে দেবার জন্য ফারুক, ফজলু, ইকবাল ও মাসুদসহ ভুয়াপুরের দিকে এগুলাম। ভূয়াপুর পার হয়ে এলেঙ্গার সামান্য কিছুদূর এগিয়ে আলীমের সঙ্গে দেখা। আলীম সিরাজগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের রেখে যাওয়া অস্ত্র সম্পর্কে অবহিত করল। (এই আলীমই পরবর্তী পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধের এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।) আলীমকে বললাম, “কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন। দেখা যাক- কি করা যায়।” তারপর আরও এগিয়ে ফুলতলা স্কুলের সামনে সোহরাওয়ার্দী, সবুর, মতি, স্মৃতি ও কামালকে বিদায় জানালাম। বিদায় পর্ব শেষ হলে দুরু দুরু বুকে শুধু ভাবতে লাগলাম, এর পর কী? এবার কোথায় যাবো? আপাততঃ ফজলুদের বাড়িতেই যাব। কিন্তু গোপনীয়তার জন্য সহকর্মীদের কারও কাছে তা প্রকাশ করিনি।
থাকার সমস্যা হয়তো আপাতত মিটে গেল, কিন্তু গাড়িটা কী করব? কোথায় রাখব। একবার ভাবছি, এখানে ছেড়ে চলে যাই। আবার ভাবছি, নদীতে ফেলে দেব। কিন্তু যখন মনে হচ্ছে এটা দেশের সম্পদ, তখন গাড়ির ক্ষতি করতে মন সায় দিচ্ছিল না। তাছাড়া ভুয়াপুর এলাকায় গাড়ি রেখে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কারণ এই এলাকার মানুষ আমাকে খুব ভালো জানেন ও বিশ্বাস করেন। তাই ফেলে-যাওয়া গাড়ি সম্পর্কে যদি পাক বাহিনী প্রচার করে দেয় যে, এটা কাদের সিদ্দিকী চুরি করে এনেছিল, আত্মসাৎ করতে পারেনি বলে ফেলে গেছে, তাহলে সরলপ্রাণ মানুষ তা বিশ্বাস করলেও করতে পারেন। কারণ এই এলাকার অগণিত মানুষ আমাকে এই গাড়ি চালাতে দেখেছেন। তাই মনে মনে স্থির করলাম, এই এলাকায় গাড়ি ছাড়া চলবে না। যে-কোন ভাবেই হোক টাংগাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়কে গাড়ি ছাড়তে হবে এবং তা আজ রাতেই।
ভূয়াপুর থেকে গর্জনা। গর্জনা থেকে শুধু চকের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ঘাটাইল পাকা রাস্তায় পৌঁছলাম। সেখানে থেকে ব্রাহ্মণশাসন রাস্তার পাশে একটি গাছের নিচে গভীর রাতে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে উপলদিয়া ফজলুদের বাড়িতে চলে এলাম। বাড়িতে পৌঁছে ফজলুর মার হাতে গাড়ির চাবিটা দিয়ে বললাম, “খালাম্মা, এই চাবিটা রেখে দিন। গাড়িটা একদিন আবার আমার হাতে আসবে।”
আমার কথা মিথ্যে হয়নি। একদিন গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে যে-কথা বলেছিলাম, তা পরবর্তীকালে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫১

অক্ষরে-অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর টাংগাইল ক-৩ নম্বরের গাড়িটা নানা হাত নানা জায়গা ঘুরে আবার আমার কাছে আসে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সামান্য ভূমিকা ও অবদান রাখার নিদর্শনস্বরূপ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের পক্ষ থেকে গাড়িটা আমাকে উপহার দেন। তবে ফজলুর মার কাছে সযত্নে রাখা চাবি কোনও কাজে আসেনি।
তিনবার আমি ফজলুদের বাড়িতে আশ্রয় নেই। প্রথমবার সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছয় দিনের জন্য। দ্বিতীয় পর্যায়ে পাঁচ-ছয় দিন। তৃতীয়বার সম্ভবতঃ একদিন। শেষবার উপলদিয়া অবস্থানকালে আমার এক বন্ধু রতনপুরের ফারুক এসে যোগ দিয়েছিল।
ফজলুল হক (ফজলু) আমার বিশ্বস্ত সহচর। সদ্য যৌবনের দীপ্তিতে টগবগে তরুণ ফজলু মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ছায়ার মতো আমার পাশে থেকেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে এই ছোট্ট গোলগাল তরুণটি ছিল করটিয়া মহাবিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষের ছাত্র। টাংগাইল শহরে মা-বাবার সঙ্গে থাকত। বাবা ওসমান গণি থানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইন্সপেক্টর। টাংগাইল শহরে আমরা একই পাড়ায় বাস করতাম। ছেলেবেলা থেকেই আমরা একে অপরের সাথে পরিচিত। আমি কলেজ জীবনে ওকে বহুবার দেখেছি। তখন অন্যান্য ছেলের মতো ফজলুকেও অতি সাধারণ বিনম্র ব্যতিক্রমহীন শান্ত ছেলে বলে মনে করতাম। কিন্তু বেহুলায়, এই স্নেহভাজন ছোট্ট ছেলেটির সেই কথা (আমাদের বাড়িতে চলেন। আপনাকে আমাদের বাড়ি লুকাইয়া রাখমু) শুনে এবং ওদের বাড়িতে এসে ওর উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য হতে দেখে শুধু অবাকই হইনি, রীতিমতো অভিভূত হয়েছি।
ফজলুর গ্রামের নাম উপলদিয়া। ঘাটাইল থানার ছোট্ট একটি গ্রাম। ব্রাহ্মণশাসনের সোজা দেড়-দু’মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং কালিহাতি থানার দু’ আড়াই মাইল উত্তর-পশ্চিমে উপলদিয়ার অবস্থান। জনসংখ্যা বড়জোর তিন চারশ’। নারী-পুরুষ প্রায় সমান-সমান। উপলদিয়ার মাইল দেড়েক পুবে টাংগাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়ক। গ্রামের হাজার গজ পশ্চিমে প্রবাহিত যমুনার অন্যতম শাখা, কোদালধোয়া নদী। কুড়ি-পঁচিশজন নিয়ে ফজলুদের শরিক বসতবাড়ি। ফজলুদের ঘরের উত্তরপাশে একই সমান বড় বড় আরও দু’টি ঘর। ঘর দু’টো তার চাচার। চাচাতো ভাই ছয়-সাতজন। তাদের মধ্যে শামসু করটিয়া কলেজের ছাত্র। সবার ছোট বজলু। মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে সেপ্টেম্বর মাসে শহীদ হয়। বড় ভাই নুরু ’৭১ সালে জামালপুর মহকুমা সমবায় অফিসার ছিলেন। সংগ্রাম ও যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তখন সবাই বাড়িতে।
এই বাড়িতে আত্মগোপন কালে পাকিস্তান সামরিক সরকার আমার মাথার দাম একলক্ষ টাকা ঘোষণা করে। টাংগাইল-ময়মনসিংহ সড়ক বরাবর মাইকে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিল, “যিনি বা যারা দেশদ্রোহী আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে জীবিত অথবা মৃত ধরে দিতে পারবে, সরকার তাকে বা তাদেরকে এক লক্ষ টাকা পুরষ্কার দেবে। আর সরকারের আদেশ অমান্য করে যদি কেউ দেশদ্রোহী পাকিস্তানের দুশমন কাদের সিদ্দিকীকে আশ্রয় দেয়, তাহলে তাদের ঘর-বাড়ী
পৃষ্ঠা নং ~ ৫২

জ্বালিয়ে দেয়া হবে এবং দেশদ্রোহীদের সাহায্য ও আশ্রয়দানের অপরাধে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।” পাক হানাদার বাহিনীর এই বিশেষ ঘোষণা আমি নিজ কানে শুনলাম। ঘোষণাটি ঐ বাড়ীর আরও অনেকেই শুনতে পান। ঘোষণার মর্ম কী এবং এর পরিণতি কী হতে পারে, তা নিয়ে আমি যখন গভীর ভাবে ভাবছি, ঠিক তখন পিছু থেকে ফজলুর মা এসে আমাকে নাড়া দিয়ে বললেন, “বাবা! তুমি কী ভাবছ? কোন চিন্তা করো না। আমার কাছে ফজলু ও তুমি একই সমান। আমরা বেঁচে থাকতে তোমার কোন ক্ষতি হবে না।” একটু পরেই নুরু মিয়া এলেন। তিনিও অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বললেন, “দেখুন, অনেকের বাড়ি ঘর তো পুড়েছে। দরকার হলে আমাদের বাড়িও পুড়বে। আর লক্ষ টাকার চাইতে আপনাদের দাম আমাদের কাছে অনেক অনেক গুণ বেশি।” এর জবাবে প্রথম-প্রথম আমি কিছু বলতে পারলাম না। আমার কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে এল। চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলাম। ফজলু, দুই ফারুক আমার চোখে পানি দেখে অঝোরে কাঁদতে লাগল। অনেক কষ্টে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ধরা গলায় বললাম, “আমার কথা ভাবছি না। ভাবছি আমার একার জন্য আপনাদের এতগুলো জীবন বিপন্ন হতে পারে।” ফজলুর মায়ের কথাই সত্যে পরিণত হয়েছে। আমাকে বিপদে পড়তে হয়নি। একটি অপরিচিত অনাত্মীয় ছেলেকে আশ্রয় দেবার কারণে বাড়ির সবার জীবনই প্রতিমুহূর্তে বিপন্ন হবার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও ফজলুর বাপ-মা এতটুকুও অসন্তোষ বা বিরক্ত প্রকাশ করেনি। ফজলুর চাচা-চাচী ও চাচাতো ভাই-বোনদের একই মানসিকতা—তারাও একই পথের পথিক। আমি ঐ কঠিন সময়েও তাদের মানসিক অবস্থা জানার ও প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু ভিতরে-বাইরে কোন পার্থক্য আবিষ্কার করতে পারিনি।
নিরাপদে ছয়-সাতদিন কাটল। একদিন দুপুরে খেতে বসেছি। ফজলুর ছোট ভাই রতন তার বোনের বাড়ি দেওপাড়া থেকে ঘুরে এসেছে। খাওয়ার একপর্যায়ে নয়-দশ বছরের ছোট্ট ছেলে রতন তার মাকে বলল, “মা, বজ্ৰভাইয়ের ছোট ভাই বেল্লালরে দেইখ্যা আইল্যাম।” আমি তক্ষুণি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় দেখলি?” “দেখলাম, দেওপাড়া থিইক্যা বাড়ির দিকে বেল্লাল কাঁদতে কাঁদতে যাইতেছে।” ফজলুর ছোট ভাইর এই খবর আমাকে ব্যাকুল করে তুলল। আমি বাড়ি যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। কিন্তু ফজলুর মা অনুমতি দিতে নারাজ। অনেক পীড়াপীড়ির পর ফজলুর মা খুব সাবধানে বাড়ি যাবার অনুমতি দিলেন। ফজলু ও ফারুক কাছতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।
ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রথমে আমার ফুপুর বাড়ি ভোজদত্ত এলাম। আমাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এই ফুপুই সবচাইতে গরিব। এই ফুপু শাহ আলম ও নূরজাহানের মা। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে সবসময় তিনি আমাদের নিজের সন্তানের মতো দেখতেন, স্নেহ ও আদর করতেন। তাঁর মানসিকতায় কখনও কোন তারতম্য ঘটেনি। মা-বাবার বিপদ-আপদের দিনে তাঁদের প্রতি অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের দুর্ব্যবহার ও অবাঞ্ছিত আচরণের কথা ফুপুর অজানা ছিল না। আমার পায়ে পায়ে বিপদ, হানাদার বাহিনী আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাও তিনি শুনেছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৩

তবুও তাঁর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তাঁর বাড়িতে পৌঁছতেই তিনি আগের মতোই উল্লসিত হলেন। যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। আমাকে নিয়ে তিনি কী করবেন, কি খাওয়াবেন এ নিয়েই ব্যস্ততা। সন্ধ্যায় সেখান থেকে আমাদের গ্রাম ছাতিহাটি রওনা হলাম। পাঁচ-ছয় মাইল পায়ে হেঁটে রাত বারোটায় বাড়িতে এসে একেবারে হতবাক হলাম। একী! বাড়ির চেহারা এমন কেন? চারদিকে মাথা সমান উঁচু বেড়া। বাড়ির ভেতর ঢুকবার পথ কোথায়! একবার ভাবলাম কার বাড়িতে এলাম! এতো আমাদের বাড়ি নয়! অবশেষে কিছুক্ষণ হাঁক ডাকের পর বাড়ির ভিতর থেকে ছোট চাচা বেরিয়ে এলেন। তিনি জানালেন, “ভাই তো এখানে নেই। দু’তিন দিন হলো মিয়াভাই সবাইকে নিয়ে ধানগড়া নাজিরের বাড়ি চলে গেছেন।”
গ্রামের পথ। আঁকাবাঁকা পথ। মাইলের পর মাইল পায়ে হাঁটছি। নিজের জীবনের নেই নিশ্চয়তা। এর উপর আবার বাবা-মার নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা। অন্ধকার রাত। মিলিটারির আনাগোনা। যখন-তখন বিপদের আশঙ্কা। পা দুটো বিদ্রোহ করতে চায়। শরীরটাকে আর বইতে পারছি না। একটু স্বস্তি চাই, বিশ্রাম চাই। কিন্তু বিশ্রাম নিলে চলবে কেন? আমার জীবনে বিশ্রাম ও শান্তির স্থান কোথায়? আবার ছুটলাম ধানগড়ার দিকে। ছাতিহাটি থেকে ধানগড়ার দূরত্ব দু’মাইল। কিন্তু সেদিন আমার কাছে ঐ দু’মাইল পথই বড় দীর্ঘ বলে মনে হয়েছিল। রাত দু’টায় ধানগড়া নাজিরের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। বাড়ির বাইরে নাজিরের ছেলে শাজাহানের সাথে দেখা। সে জানাল, চাচা মিয়ারা ভিতরের ঘরে আছেন। দরজার সামনে মা, মা বলে ডাক দিতেই দরোজা খুলে গেল। ছোট ভাইবোনেরাও লাফালাটি করে ঘুম থেকে জেগে উঠল। বাবাও জেগে গেলেন। তিনি তখন খুব অসুস্থ। বড় দু’ছেলেকে বহুদিন না-দেখে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। তাঁর দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না। এজন্যে তাঁর শরীর অনেকটা ভেঙে পড়েছিল।
সেই ২৭ মার্চ থেকে আমি ঘরছাড়া, নিরুদ্দেশ। ’৬৭ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে আসার পর একটানা এতদিন বাবা, মা, ভাইবোন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকিনি। এরমধ্যে অবশ্য মাঝেমাঝে জেলে যেতে হয়েছে, জেল খেটেছি। কিন্তু আমার জেল জীবনের পরিধিও এর চেয়ে বেশি হয়নি। দীর্ঘদিন যোগাযোগহীন বিচ্ছিন্ন থাকার পর আবার বাপ-মা, ভাইবোনদের কাছে ফিরে আসায় এক নতুন জীবনের স্বাদ পেলাম। সে যে কী আনন্দ! কী উল্লাস! কী মধুময় অনুভূতি। যা শুধু অনুভবের, প্রকাশের নয়। মা ছেলের জন্য সবসময় খাবার তৈরি করেই রাখতেন। তাই যাওয়ার সাথে সাথে আমাকে ও সঙ্গী ফারুককে পেট ভরে খাওয়ালেন। খাওয়া শেষে মায়ের পাশেই শুয়ে পড়লাম।
মা-বাবা, বড় ভাইর কথা বারবার জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু বড় ভাই কোথায় তা আমি জানি না। শুধু অনুমান তিনি ভালো আছেন। ১৮ এপ্রিল ছোট ভাইবোনেরা আমাকে মৌমাছির মতো ঘিরে রাখল। বিকালের দিকে দু’হাজার টাকা (একশ’ টাকার নোটের) মায়ের হাতে দিয়ে বললাম, “মা, এ টাকাগুলো শিগগির ভাঙিয়ে নিও। কিছুদিন পর হয়তো একশ টাকার নোটের ভাংতি পাওয়া যাবে না। অথবা একশ’ টাকার নোট অচল হয়ে যেতে পারে। মায়ের সঙ্গে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৪

আমার যখন কথাবার্তা হচ্ছিল তখন ছোটবোন রহিমা, শুশুমা ও সাহানা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, “আজ আপনাকে আমরা যাবার দিমু না।” বাধ্য হয়ে সেদিন ওখানে থাকতে হলো।
ধানগড়ায় আমার পিতা স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে যখন ছিলেন, তখন আমার ছোটবোন রহিমা সিদ্দিকী কুমুদিনী কলেজের বি.এ-র ছাত্রী। শুশুমা বিন্দুবাসিনী হাইস্কুলে দশম শ্রেণীর এবং সবার ছোট বোন শাহানা তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। অন্যদিকে ছোট চার ভাইয়ের মধ্যে বাবুল পঞ্চম শ্রেণীর, বেল্লাল চতুর্থ শ্রেণীর এবং মুরাদ দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। সবার ছোট আজাদের বয়স মাত্র সাড়ে চার বছর। পরিবারের সবার বড় লতিফ সিদ্দিকী তখন সম্ভবতঃ জামালপুর অথবা শেরপুরে ছিলেন। দ্বিতীয়া মা ছোট ভাই মনুকে নিয়ে করটিয়ায় কোনক্রমে দিন কাটাচ্ছিলেন।
আপনাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে মা-বাবা এ অনাত্মীয় সাধারণ গরিব মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন কেন? সে এক দুর্ভাগ্যজনক মর্মান্তিক ইতিহাস। আর এ ইতিহাসের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে বাঙালির দীর্ঘদিনের চিন্তা-চেতনা, মন মানসিকতার প্রকৃত রূপ। ২৭ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল। এই কয়েকদিনের মধ্যে সবাই গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। আমি নিজে মাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। ঐ সময় আমার সাথে বন্ধু ফারুকের মাও ছিলেন। তাকেও ঘাটাইলের মোগলপাড়ায় পৌঁছে দিই। ১ এপ্রিল বাবা নিজে একটি মোটর সাইকেলে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। অবশ্য ভাই-বোনেরা কয়েকদিন আগে থেকেই গ্রামের বাড়িতে ছিল। সময় তাদের মোটামুটি ভালোই কাটছিল। হঠাৎ ৩রা এপ্রিল টাংগাইল শহরের পতন ঘটল। আর ঐ দিন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে আমি এক ট্রাক অস্ত্র ও গোলা-বারুদ নিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যাই। এবং বড়চওনার ইদ্রিসের সহযোগিতায় তা লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হই।
টাঙ্গাইল পতনের পর বাপ-মা ভাই-বোনদের আর গ্রামের বাড়িতে থাকা সম্ভব হলো না। কারণ বাড়ীর কেউ কেউ বলাবলি শুরু করে দিল, “লতিফ সিদ্দিকী করে রাজনীতি। কাদের সিদ্দিকী হইছে গেরিলা বাহিনীর দুশমন। পাকবাহিনী ওদের সম্পর্কে লোকের কাছে জিজ্ঞেস করছে। লোকজন দিয়ে সন্ধান চালাচ্ছে। নিজেরাও খুঁজছে। পাকবাহিনী যদি জানতে পারে লতিফ সিদ্দিকী, কাদের সিদ্দিকীর বাপ-মা, ভাইবোন এই গ্রামেই আছে তাহলে আর কারও রক্ষা নেই। ওদের খুঁজতে এসে আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেবে, মা-বোনদের অপমান করবে। আমাদের ধরে ধরে জবাই করবে। ওদের জন্য আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারি না। ওদের জন্যই আমাদের এই দুরবস্থা। দিনেও স্বস্তি নেই, রাতেও ঘুমাতে পারছি না। তারা ও মরবে, আমাদেরও মারবে। আরজু আর বজ্র আমাদের পরিবারের কলঙ্ক, অভিশাপ। তারা করবে যুদ্ধ? পাকবাহিনীর সাথে? কত এম. পি. এ., এম. এল. এ., নেতা-উপনেতা, মন্ত্রী মিনিস্টার ই. পি. আর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট—সবাই গেল পালিয়ে, আর বজ্র করবে যুদ্ধ! তার মতো আমরা তো আর পাগল না। ওদের ধরিয়ে দেওয়া উচিত। খতম হয়ে যাক। নইলে আমরা বাঁচব না। তাড়াতাড়ি গ্রাম ছাড়ুন।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৫

চলমান পরিস্থিতিতে ঐ সময়ে বাবা-মার কিছু বলার অথবা করার ছিল না। আর-এক নিদারুণ ঘটনা ঘটলো। বিপদের দিনে কখনো-কখনো আত্মীয়রা যে শত্রু হয়ে যায়, তা আর একবার প্রমাণিত হলো। কয়েকদিন আগে আমার দু’বোনকে দীঘলকান্দির মতিয়ার রহমানের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। মতিয়ার মিয়া আমার বাবার আপন মামা। সম্পর্কে আমার দাদা। শুধু তাই না, মতিয়ার মিয়ার তিন ছেলে মঞ্জু, দেলখোশ ও আনোয়ার—তিনজনই আমাদের টাংগাইল শহরের বাড়িতে দশ-পনের বৎসর থেকে লেখাপড়া করেছে। আমার বাবা তাদের সবরকম সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন। নিজের ভাইদের মতো তাদের স্নেহ করেছেন। মাত্র কয়েকদিন আগেও মতিয়ার মিয়ার ছোট ছেলে আনোয়ার আমাদের বাসায় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে করটিয়া সাদৎ কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু আত্মীয়, রক্তের সম্পর্ক ও তাঁর তিন সন্তানের প্রতি আমার বাবার সাহায্য-সহানুভূতি ও স্নেহের কথা মতিয়ার মিয়া বেমালুম ভুলে গেলেন। তাঁর কাছে এসবের কোন মূল্য নেই। বোনদের দেখে, চোখে মুখে ভীতি ও বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, “তোমাদের ভাইয়েরা করে রাজনীতি। আমি রাজনীতি করি না, বুঝি না। রাজনীতির ধারেকাছেও আমি নেই। যারা রাজনীতি করে তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি তোমাদের আমার বাড়িতে থাকতে দিয়ে নিজের ঘরে বিপদ ডেকে আনতে পারি না। তোমরা আমার বাড়িতে থাকতে পারবে না।”
আমার দুই অবলা অসহায় বোনকে তাঁর বাড়িতে একঘন্টার জন্য থাকতে দিতে রাজি হননি। অথচ যার মাথার মূল্য একলক্ষ টাকা—তাকে পাশের গ্রামের অনাত্মীয় এক পরিবার হাজারো বিপদ ও ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পরম যত্ন সহকারে রেখেছেন। পরে, অর্থাৎ পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে এই মতিয়ার মিয়ারই আরেক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। তিনিই তখন মুক্তিযুদ্ধকে অভিনন্দন জানাবেন। আমার সীমাহীন প্রশংসা করবেন, বড় গলায় আত্মীয়তার পরিচয় দেবেন, আমার ভাইবোনদের মাথায় তুলে নাচবেন।
১২ অথবা ১৩ এপ্রিল গ্রামের বাড়ির পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করল। আমার ছোট চাচা ওয়াদুদ সিদ্দিকী বাবাকে সময় দিতে রাজি নন। ঘর থেকে বাবা-মার পোঁটলা-পুঁটলি বাইরে ছুড়ে দিয়ে বললেন, “এক্ষুনি আপনারা চলে যান। আপনাদের জন্য আমাদের বাড়িঘর পুড়বে, আমরা মরব এটা হতে পারে না।”
গ্রামের বাড়িতে আমাদের কোন বসতঘর ছিল না। কিছুদিন আগে এক ঝড়ে বহুদিনের পুরানো ঘরখানা ভেঙে যায়। তারপর তা আর মেরামত করে বসবাসের উপযোগী করা হয়নি। ওয়াদুদ সিদ্দকী পোঁটলা-পুঁটলি, কাপড়-চোপড় বাইরে ফেলে দিয়ে যখন এক অভিনব দৃশ্যের অবতারণা করছিলেন, তখন ধানগড়ার হামিদ, সিরাজ, নাজির ও নাজিরের ছেলে শাহজাহান তা দেখছিলেন। ওয়াদুদ সিদ্দিকীর এই কাণ্ডকারখানা দেখে বাবা-মা শুধু বিস্মিত হননি, অন্য সবাইও বিস্মিত ও হতবাক হয়ে যান। এই অবস্থায় নাজির ও সিরাজ বললেন, “চাচা মিয়া, কোন চিন্তা কইরেন না। আমাগো বাড়িতে চলেন। আপনাগোর যেমনি পারি, হেমনি রাখমু। এতে যদি
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৬

আমাগোরে বাড়িঘর পুড়াইয়া দেয়, দিব।” বলেই তারা একটার পর একটা পোঁটলা-পুঁটলি কুড়িয়ে মাথায় তুলে নিতে লাগল। ওদিকে হতভম্ব ও দিশেহারা রহিমা, শুশুমা, বাবুল, বেল্লাল, শাহানা, আজাদ ও মুরাদ কেবল কেঁদে চলেছে।
সহোদর ভাই কল্পিত বিপদের আশঙ্কায় জায়গা দিতে নারাজ অথচ এই ভাইয়ের জন্য কী না করেছেন? বাবা, ১৫-১৬ বছর পর্যন্ত ওয়াদুদ সিদ্দিকীর পড়াশুনার খরচ বহন করেছে সাতবার মেট্রিক ফেল করার পরও তিনি এতটুকু বিরক্তি প্রকাশ করেননি। বরং ভাইকে উৎসাহ- উদ্দীপনা জুগিয়েছেন। জীবনে প্রতিষ্ঠা ও সম্মান অর্জনের পথে তাকে সমস্ত সহযোগিতা সাহায্য দিয়ে এসেছেন। অথচ পিতৃতুল্য সেই বড় ভাইকে বিপদের সময় একটু জায়গা দিতে এই গুণধর ভাই অক্ষম-নারাজ। আত্মীয় মতিয়ার রহমান তাঁর আত্মীয়তা ও ভাই ওয়াদুদ সিদ্দিকী তাঁর ভ্রাতৃত্ব শুধু অস্বীকার করলেন না, কোন বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান না দিয়ে আশ্রয়চ্যুত করে সবাইকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিলেন। অন্যদিকে অনাত্মীয় ফজলু, অনাত্মীয় নাজির, সিরাজ সব বিপদের ঝুঁকি নিয়ে শুধু আশ্রয়ই দেননি, পরম যত্ন ও নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করেন। শুনেছি, রক্ত নাকি পানির চেয়ে ঘন। আরো শুনেছি, রক্তের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, চিরন্তন। কথাটা কি সব ক্ষেত্রেই ঠিক? সুখের সময় নয়, বরং দুঃখ ও বিপদের দিনেই রক্তের সম্পর্কের পরীক্ষা, বন্ধুত্বের পরিচয় ও ভ্রাতৃত্বের প্রমাণ। ঐ সময়ে আমার বাবা-মা ও ভাইবোনদের প্রতি মতিয়ার মিয়া ও ওয়াদুদ সিদ্দিকী যেরকম ব্যবহার করলেন, যে মানসিকতার পরিচয় দিলেন, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক লজ্জাকর কলঙ্কজনক অধ্যায়। মতিয়ার মিয়াও ওয়াদুদ সিদ্দিকীর মতো, মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি যারা এই রকম ন্যাক্কারজনক আচরণ করেছেন, তারা চিরদিন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির ধিক্কার, ঘৃণ্য ও নিন্দার পাত্র হয়েই থাকবেন।
ভাইবোনদের অনুরোধ, কান্নাকাটি ও বাবা-মায়ের ইচ্ছায় রাতটা তাদের সাথে কাটানো ঠিক হলো। তবে এবার এক বাড়িতে নয়। নাজিরদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে অন্য একটি বাড়িতে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা, আমি কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন। হঠাৎ কে যেন বাইরে থেকে ডাকল, ‘কাদের ভাই, কাদের ভাই, দরজা খুলুন।’ ডাকাকাকি আর দরজা ধাক্কার শব্দে তন্দ্রা কেটে গেল। দরজা খুলে দেখি, পরিচিত মুখ। প্রিয় সহচর-ফজলু, ফারুক ও মোঙ্গলা।
—তোরা এত রাতে?
—লতিফ ভাই বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক সৈন্য নিয়া কালিহাতি আইছে। তাই আপনাকে নিতে পাঠাইছে।
দেরি না করে বাবা-মার কাছে বিদায় নিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, চার বছরের আজাদসহ সবাই জেগে বসে আছে। আমি যে চলে যাচ্ছি তা তারা জেনে গেছে। কারণ ফজলুরা আমার খোঁজে প্রথম এ বাড়িতেই এসেছিল। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দু’ঘন্টায় আট মাইল পায়ে হেঁটে কামার্তীর সাইদুর রহমানদের বাড়িতে পৌঁছলাম। সাইদুর বাড়িতে ছিল না। থাকার
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৭

কথাও নয়। কারণ সাইদুরদের মতো আরো অনেকেই তখন বাড়িতে থাকত না। সবল যুবক হলেই মুক্তি বাহিনী সন্দেহে তাঁদের অন্ধকারে ধরে নিয়ে হত্যা করত। আমরা বাইরের ঘরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে টিউবওয়েলের পানিতে হাত মুখ ধুয়ে, সকাল সাড়ে পাঁচ-ছয়টায় দুই ফারুক ও ফজলুসহ কালিহাতিতে এলাম। একটু পরেই বড়ভাই সিদ্দিকীর সাথে দেখা। ৩রা এপ্রিলের পর এই আমাদের দু’ভাইয়ের মুখোমুখি সাক্ষাৎ।

কালিহাতি যুদ্ধ
লতিফ ভাই তার নেতৃত্বাধীন ই. পি. আর. বাহিনীর কথা আমাকে বললেন। গোড়ান-সাটিয়াচরা যুদ্ধে যে ই. পি. আর-রা ছত্রভঙ্গ হয়ে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল—তারাই আবার তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন মনোবল ও উৎসাহ নিয়ে, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করতে এগিয়ে এসেছে।
এদের কাছে ভারি অস্ত্র আছে কিনা জানতে চাইতে বড়ভাই বললেন, ‘মোটামুটি সব ধরনের অস্ত্রই আছে। তুই সুবেদারের সাথে কথা বলে জেনে নে।’ আমি সুবেদার রহিম সাহেবের কাছে ভারি অস্ত্রের কথা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, “পুলের কাছে মেশিনগান ও অন্যান্য ভারি অস্ত্র-শস্ত্র রয়েছে।” সুবেদার সাহেব আমাকে নদীর দক্ষিণ পাড়ে অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে গিয়ে সেগুলো দেখে আসতে বলেন। কিন্তু অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে ঘুরে ফিরে ভারি অস্ত্র না-দেখে খুব চিন্তিত হলাম। ইতিপূর্বে অর্জিত অভিজ্ঞতায় আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল, হানাদার বাহিনীর মেশিনগান ও কামানের গোলার মুখে ৩০৩ রাইফেল, কয়েকটি বৃটিশ এল. এম. জি. নিয়ে বেশিক্ষণ টিকে থাকা যাবে না।
খোঁজ-খবর নিয়ে গিয়ে দেখলাম, ই. পি. আর-দের কেউ কেউ অস্ত্র-শস্ত্র রেখে নদীতে গোসল করতে নেমেছে। কেউ কেউ বসে চিড়ে-মুড়ি খাচ্ছে। কেউ গাছের ছায়ায় শুয়ে আছে। আবার কেউ ঘুমের আয়োজনে ব্যস্ত। এ রকম অপ্রত্যাশিত অবস্থা দেখে সুবেদার রহিমের কাছে জানতে চাইলাম, “ফ্রন্ট লাইনে এখন প্রস্তুত অবস্থায় কারা আছেন? হানাদার বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করে তা আমাদের জানাবার কোন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে কি?”
আমার কথা শুনে সুবেদার সাহেব কয়েকজন সৈনিককে ঠিক মতো কর্তব্য সম্পাদনের নির্দেশ দিলেন। সুবেদার সাহেবের নির্দেশ শুনে কয়েকজন সৈনিক উদাসীনভাবে বলল, “আমরা এখন বেতনভূক্ত নিয়মিত সৈনিক নই। আমরা স্বেচ্ছাসৈনিক। আমরা সব নিয়ম কানুন সব সময়ে মেনে চলতে পারব না।” সৈনিকদের এ কথার পর সুবেদার সাহেবের আর কিছু করার রইল না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তথাকথিত অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে কিছুমাত্র বাঁধা না পেয়ে পাক হানাদার বাহিনী পাকা সড়ক বরাবর নির্বিঘ্নে এগিয়ে এল। হানাদার বাহিনী কালিহাতি সেতুটি প্রায় অতিক্রম করে একেবারে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাড়ের উপর এসে পড়ল। হানাদার বাহিনীর এই আকস্মিক উপস্থিতি ও একেবারে ঘাড়ের উপর চেপে পড়ায় ই. পি. আর. মুক্তিবাহিনী একেবারে হতভম্ব ও দিশেহারা হয়ে যায়। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধাদের পালাবার কোন পথই ছিল না। ফলে মরিয়া হয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮

তারা গুলি চালাতে শুরু করে। কিন্তু তা কতক্ষণ? দিশেহারা অবস্থা, প্রস্তুতির চরম অভাব, অস্ত্র-শস্ত্রের অপ্রতুলতার জন্য ই. পি. আর. ও মুক্তি বাহিনীর পক্ষে বেশিক্ষণ হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করা সম্ভব হলো না। বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করে ঘন্টাখানেকের মধ্যে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।
অন্যদিকে পাক-হানাদার বাহিনী এর আগেও টাংগাইল-ময়মনসিংহ সড়কে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছে। তারা কোথাও কোন বাঁধা ও বিপদের সম্মুখীন হয়নি। তাই আগের চাইতে আরো বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিশ্চিন্তে ময়মনসিংহের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু গাড়ির বহরের বিরাট অংশ কালিহাতি সেতুর প্রায় চৌদ্দআনা অতিক্রম করতেই তাদের ওপর হঠাৎ গুলিবর্ষণ শুরু হয়। এই অভাবিত ও আকস্মিক আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনীও একেবারে বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে পড়ে। তারা মুক্তি বাহিনীর মাঝখানে পুরোপুরি ঘেরাও হয়ে পড়েছে বলে অনুমান করে। এ অবস্থায় সেতুর শেষ প্রান্তে এগিয়ে-যাওয়া গাড়ি ও সৈনিকদের পক্ষে আর সামনে এগুবার কিংবা পেছনে সরে যাবার উপায় ছিল না। সামনে মুক্তি বাহিনী, পিছনে তাদের অগণিত সৈনিক ও গোলা-বারুদ-বোঝাই গাড়ির সারি। সরে পড়বার, পালাবার বা বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই দেখে তারাও মুক্তি বাহিনীর মতোই এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। কে কোথায় পজিশন নিয়ে কার নেতৃত্বে কিভাবে গুলি চালাচ্ছে তার কোন হদিস নেই।
সামনে কী ঘটছে—তা না-জেনে এবং বুঝতে না-পেরে পেছনের গাড়িগুলো সামনের গাড়িগুলোর উপর প্রচণ্ড বেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলে পিছনের গাড়িগুলোর প্রচণ্ড ধাক্কায় টাল সামলাতে না-পেরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, সামনের চার-পাঁচটি সৈন্য ও গোলা-বারুদ বোঝাই চার-পাঁচটি গাড়ি পুলের নিচে, গভীর খাদে পড়ে চুরমার হয়ে যায়।
এখানেই বিভ্রান্তির শেষ নয়। বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তির চরম আকার ধারণ করে তখন, যা পেছনের হানাদার বাহিনী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নিজেদের আক্রান্ত মনে করে এলোপাথাড়ি বেপরোয়া গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে তাদের গুলিতে তাদেরই অগণিত সৈন্য মারা যায়।
এই ভয়াবহ, চরম বিভ্রান্তিকর যুদ্ধে হানাদার বাহিনী বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রায় তিনশো সৈনিক কালিহাতির যুদ্ধে নিহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা নিহত সৈনিকদের অনেক লাশ ট্রাকে করে ঢাকার দিকে নিয়ে যেতে দেখেছেন। অবশিষ্ট লাশগুলো কালিহাতি যুদ্ধক্ষেত্রের পাশে কবর দেওয়া হয়েছে। কবরগুলো এখনও সেখানে আছে। এই যুদ্ধে পাক বাহিনীর একজন মেজর মারা যায়। কালিহাতিতে তাদের চার-পাঁচটি বিধ্বস্ত গাড়িও ফেলে রেখে যায়। কালিহাতি যুদ্ধে এগারজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদৎ বরণ করে। সাত-আটজন আহত হয়।
নিরবচ্ছিন্ন গোলাগুলির মুখে মুক্তি বাহিনী একপর্যায়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমার আশপাশের যারা মুক্তি বাহিনীকে খাবার-দাবার দিয়ে সাহায্য করছিলেন, তারা এলোপাথাড়ি দৌড়াতে থাকেন। আমিও তাদের মতো হতভম্ব ও দিশেহারা হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করি। কখনও মাথা নিচু করে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, যেভাবে সুবিধা সেভাবেই দৌড়াতে থাকি। এক পর্যায়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯

ক্লান্ত হয়ে কিছুটা বিশ্রামের জন্য বসলাম। তখনও প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে আবার উঠে দৌড়াতে লাগলাম। এমনি করে দিক-বিদিক জ্ঞান হারা অবস্থায় দৌড়াতে দৌড়াতে একটু নিরাপদ জায়গায় গিয়ে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর দু’হাত পিছনে দিয়ে মাথা নুইয়ে, চিন্তা করতে করতে দুর্বল শরীরে পথ চলছি। অনেকদূর হেঁটে একটি গ্রামের কাছাকাছি এলে ছোট একটা ছেলে এসে বলল, “কাদের ভাই! আপনি এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? আমাদের বাড়ি চলুন।” কালিহাতি স্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্র কাছতলার নজরুল আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে গেল।
বাড়িতে পৌঁছে আমরা অবাক! বাড়িতে কোন লোকজন নেই। সব ফাঁকা। বাইরের কিছু আত্মীয়-স্বজন আশ্রয় নিতে এসেছেন, কিন্তু বাড়ির লোকজন না থাকায় আত্মীয়-স্বজনরাও অন্যত্র সরে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় নজরুল বলল, “ভাইজান! কিছু মনে করবেন না। পাক বাহিনীর ভয়ে হাঁড়ি-পাতিল ঘটি-বাটি সব মাটির নিচে পুঁতে রেখেছে।” নজরুল মাটির শানকিতে কিছু ছাতু নুন নিয়ে এলো। আমি তাতে সামান্য পানি মিশিয়ে পরম তৃপ্তির সাথে খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে নজরুল বলল, “পাশেই আমার মামার বাড়ি। চলুন যাই। সেখানে লোকজন থাকতে পারে।”
কাছতলা থেকে আবার রওনা হলাম। যেতে-যেতে চারপাশে যা দেখলাম তা খুবই মর্মান্তিক। দেখলাম, ছোট-বড়, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত—সবাই ছুটছেন, প্রাণভয়ে পালাচ্ছেন। সবারই লক্ষ্য আশ্রয়। আশ্রয় চাই। নিরাপত্তা চাই। কেউ কেউ বহুদূরে থেকে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পথে বসে পড়েছেন। জিরিয়ে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ দৌড়াতে দৌড়াতে মাটিতে পড়ে হাঁপাচ্ছেন। সবার দৃষ্টি সামনের দিক, কেউ পেছনে তাকাচ্ছেন না। তাকাতে পারছেন না। তাকাবার সময় কোথায়? ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কাঁদছে, চিৎকার করছে। মা-বাবারা তাদের সাবধান করে দিচ্ছেন। আবার কখনও তাদের মাটিতে দাঁড় করিয়ে, একটু বিশ্রাম করে, শক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। একটি অশীতিপর বৃদ্ধাকে কখনও ‘ভার’-এ উঠিয়ে, আবার কখনও কাঁধে তুলে কয়েকজন যুবক দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভয়ে ভয়ে পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে।
এই আতঙ্ক ও বিপদের মুখে দু-তিনটি লোককে একটি হিজল গাছের নিচে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকতে দেখে কৌতূহল বশতঃ জিজ্ঞেস করলাম, “সবাই দৌড়াচ্ছে, আর আপনারা এখানে শুয়ে আছেন?” তারা আমার দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে ক্লান্তস্বরে বলল, হাঁটতে হাঁটতে দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা এখানে পড়ে গেছি? উঠবার শক্তি নাই। পাক-বাহিনী গুলি করবে করুক। আমাদের আর মৃত্যুভয় নাই।”
একটি পরিবারের চলার শক্তি মন্থর হয়ে আসছিল। পালাতে গিয়ে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় তাঁরা হেরে যাচ্ছিলেন। তাই সাথের কাপড়-চোপড় ও পোঁটলা-পুঁটলি রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলে নিজেদের হাল্কা করে নিচ্ছিলেন।
সবাই ছুটছেন, দৌড়াচ্ছেন। তাড়াহুড়া করে একটি খাল পার হতে গিয়ে কয়েকটি বাচ্চা পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর অবশিষ্টরা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে খালের মধ্যে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০

লাফিয়ে পড়ছেন। আবার কে একজন মাঠ থেকে চিৎকার করতে করতে আসছে, পালাও, পালাও জল্লাদ বাহিনী আসছে।’ সবাই পালাচ্ছেন। কে কোন দিকে যাচ্ছেন, কার গন্তব্যস্থল কোথায়-তার ঠিক নেই। হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃস্টান, সাধারণ, অসাধারণ—সকল শ্রেণীর মানুষ পালাবার পথ খুঁজছেন, পালাচ্ছেন। সেই সময় সমগ্র বাংলার এটাই ছিল পরিচিত চিত্র, সাধারণ ছবি।
চলতে চলতে এক সময় নজরুল বলল, ‘ঐ তো আমার মামার বাড়ি।’ বাড়িতে পৌঁছে আমাকে বৈঠকখানায় বসতে দিয়ে নজরুল ভিতর বাড়িতে চলে গেল। একটু পরেই ঘাটাইল কলেজের জনৈক অধ্যাপক এসে বিশেষ ভদ্রতার সাথে কুশল বিনিময় করলেন।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আসে না। রাত পোহালেই যেন বেঁচে যাই। কত কথা মনে পড়ছে, নিজের কথা, বাবা-মার কথা, ভাইবোনের কথা। দেশ ও জন মানুষের কথা। সুখের-দুঃখের আরও কত কথা মনের পর্দায় ছায়াছবির মতো একের পর এক ভেসে উঠে। সব-স্মৃতি সব-চিন্তা শেষে মনের মধ্যে একই চিন্তা বারবার ঘুরে ফিরে আসেঃ কিভাবে হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করা যায় এবং দেশকে স্বাধীন করা যায়। এই চিন্তাই আমাকে উতলা করে তোলে, ঘুম কেড়ে নেয়। গোড়ান-সাটিয়াচরা ও কালিহাতি যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থেকে পাক-বাহিনীর শক্তিসামর্থ্য ও মুক্তি বাহিনীর মনোবল ও রণকৌশল সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ হয়। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই ছিল পরবর্তীতে আমার পক্ষে মুক্তি বাহিনী সংগঠন, রণনীতি নির্ধারণ ও সাফল্য অর্জনের মূল চাবিকাঠি। কালিহাতি যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে ও তাতে জড়িত থেকে বুঝতে পারি, ই. পি. আর-দের মনোবল, অস্ত্র-শস্ত্র ও রণকৌশল সময়োপযোগী নয়, আমার মনঃপুতও নয়। আমার পক্ষে ই. পি. আর-বাহিনীর সাথে জড়িত থেকে হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করা আর সম্ভব নয়। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কোন মানুষই রাত্রে ঘুমাতে পারে না। আমার পক্ষেও ঘুমানো সম্ভব হলো না।
পরদিন সকালে হাতমুখ ধুয়ে খেসারির ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে আবার নজরুলদের বাড়িতে এলাম। সারাদিন নজরুলদের বাড়িতে কাটিয়ে দুপুরে আগের দিনের মতো সেই একবাটি ছাতু, একটু লবণ আর পানি খেয়ে বিকালে অন্য সঙ্গীদের খোঁজে উপলদিয়া রওনা হলাম। ময়মনসিংহ-টাংগাইল পাকা সড়ক অতিক্রম করে উপলদিয়া গ্রামে ফজলুদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতেই ফজলু ও রতনপুরের ফারুক আমাকে দেখে দৌড়ে এলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১

সংযোগ সন্ধানে

২০ এপ্রিল। আমি উপলদিয়ায়। মনে স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। নানা ভাবনা ও দুর্ভাবনায় মরছি। গোড়ান-সাটিয়াচরা ও কালিহাতি যুদ্ধের ব্যর্থতা ও করুণ অভিজ্ঞতা আমাকে অবসন্ন করে দিয়েছে। সামনে আর কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। অন্যদিকে বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকীরও সঠিক খবর জানি না। এতদিন বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ও নির্দেশে যা কিছু করার করেছি, এখন তিনিও নেই। শুধু ভাবছিঃ এখন কী করা যায়? কী করা উচিত? আমি কী করব? একার পক্ষে কি একটা প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব? আমি তেমন ভরসা পাই না।
সারারাত নানা কিছু ভেবে সকালে স্থির করলাম, আবারও লতিফ ভাই এবং তার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধানেই বেরিয়ে পড়ব। ২১ এপ্রিল রতনপুরের ফারুককে নিয়ে ধনবাড়ী রওনা হলাম। উপলদিয়া থেকে ধনবাড়ীর দুরত্ব প্রায় পঁচিশ মাইল। সারাদিন পায়ে হেঁটে সন্ধ্যায় গোপালপুরের একাশি কোণাবাড়ীতে এলাম। এ গ্রামে কলেজ-জীবনের সহপাঠী কাশেমের বাড়ীতে রাত কাটালাম। রাতে মধুপুর-ধনবাড়ীর দিকে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনলাম। বন্ধু আবুল কাশেমও পাকিস্তানী মিলিটারিদের খবর জানাল। কালিহাতির কথা চিন্তা করে আরো উত্তরে যাবার চিন্তা ত্যাগ করলাম। আমার মনে হলো মুক্তি বাহিনী থাকলেও এত প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। তাই উত্তরে গিয়ে তাদের যে পাওয়া যাবে, সে ভরসা পাচ্ছিলাম না।
বন্ধু আবুল কাশেমের বাড়ীতে সকালে খেয়ে আবার উপলদিয়ার পথ ধরলাম। সারাদিন হেঁটে সন্ধ্যায় উপলদিয়ার কাছে এলে করটিয়া সাদৎ কলেজের অধ্যাপক আখতার হোসেন সাহেব আমাদেরকে তাঁর বাড়ীতে নিয়ে যান। পরম যত্নের সাথে হাতমুখ ধোয়ার পানি দেন এবং খাওয়ার ব্যবস্থাও করেন। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আখতার হোসেন সাহেব খাবার সময় নিজে আমাদের পাখা দিয়ে বাতাস করেন এবং নানা রকম উৎসাহব্যঞ্জক উপদেশ ও বহুদেশের মুক্তিআন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধাদের আন্তরিক ত্যাগ ও অমর অবদানের ইতিহাস তুলে ধরেন। বিদায়ের সময় আমার হাতে দুটি দশ টাকার নোট দিয়ে বললেন, “তোমাদের হাতে কোন টাকা আছে কিনা জানিনা। থাক বা না থাক এটা তুমি নাও। মনে করো না যে, এ সামান্য কটি টাকা। আমার অন্তরের সমস্ত শুভকামনা, ভালোবাসা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি আমার নিবেদিত অর্ঘ্য।” সবশেষে স্যার বললেন, “কাদের! ভয় পেয়োনা। ভেঙে পড়োনা। শক্ত হয়ে মোকাবেলা কর। তোমরা অবশ্যই জয়ী হবে।”
আবার উপলদিয়া। রাতের খাবার একটু আগে বাড়ীতে খেয়ে এসেছি, তাই শুয়ে পড়লাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২

কিন্তু ঘুম এলো না। শুধু ভাবনাঃ এখন কী করব? কী করা যায়? খুব তাড়াতাড়ি লতিফ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগের সম্ভাবনা নেই। এছাড়া ই. পি. আর, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক সমন্বিত মুক্তি বাহিনী, তাদেরও সহজে পাওয়া যাবে না। এমতাবস্থায় কী করা যায়? সারারাত্রি ভেবেচিন্তে স্থির করলাম, প্রথমে সারা জেলা ঘুরে বেড়িয়ে সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করব। জনগণের মন-মানসিকতা উপলব্ধি করে যে-ধরনের সাড়া পাব তার উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করব।
আগেই উল্লেখ করেছি, ইতিপূর্বে হানাদার বাহিনী আমার নামে এক লক্ষ টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে যে কেউ লোভনীয় লক্ষ টাকা পুরষ্কার পেতে পারে। এমতাবস্থায় আমার অবাধে ঘোরাফেরা মোটেই নিরাপদ ছিল না। বরং পদে পদে ছিল বিপদ ও জীবনের ঝুঁকি। বিপদ ঝুঁকি ও যে-কোন মুহূর্তে ধরা পড়ার সম্ভাবনা উপেক্ষা করে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি, আমাকে ঘুরতে হয়েছে।
ফজলুদের বাড়ীতে আমার একটা ‘ব্র্যাটাগান’ ছিল। তাতে একটি মাত্র ম্যাগাজিন। তাও, আবার গুলিশূন্য। গুলিভর্তি ম্যাগাজিন খানা সবুরের সাথে চলে গেছে। এ অবস্থায় কী করি? গুলিশূন্য ম্যাগাজিনটি ব্র্যাটাগানে লাগিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে পরদিন সকালে রতনপুরের ফারুককে নিয়ে পাহাড়ের দিকে রওনা হলাম। আবার সেই আঠারদানা, কাছতলা ও কস্তুরীপাড়া হয়ে দেওপাড়া ফজলুর ভগ্নিপতির বাড়ীতে এলাম। দুপুরে খেতে বসেছি, এমন সময় ছাত্রলীগের ফারুক ও নুরু হুড়মুড় করে এসে হাজির। নুরু ও ফারুককে দেখে আমি অবাক!
_তোরা কোথা থেকে? ফারুক, তুই বড় ভাইয়ের সাথে যাসনি!
ফারুক তখন বড় ভাই সম্পর্কে আদিঅন্ত সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। তারপর দু’জনের জন্যে তৈরী করা খাবার চার জনে ভাগ করে খেয়ে নিলাম। দেওপাড়াতে টাংগাইলের আরেকজনের সাথে আমার দেখা হয়। তিনি তখন মিলিটারিদের ভয়ে বাড়ীঘর ছেড়ে দেওপাড়াতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। টাংগাইলের পারদিঘুলিয়ার আবদুস ছালাম নামের এই ভদ্রলোক আমাকে দেখে তাঁর হারানো মনোবল ফিরে পান।
নরু তার গ্রামের বাড়ী ‘গোলরা’ চলে গেল। আমি দুই ফারুককে নিয়ে পাহাড়ের দিকে এগুলাম, সন্ধ্যায় বড়চওনার ইদ্রিসের বাড়ীতে উঠলাম। রাতে শুনতে পেলাম, বড়চওনা থেকে দক্ষিণে গভীর জঙ্গল কালমেঘায় কিছুদিন হলো অনেক বাঙালি ই. পি. আর. ঘাঁটি গেড়ে অবস্থান করছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তারা সকলেই উৎসাহী। খবর শুনে কিছুটা আশান্বিত ও আনন্দিত হয়ে উঠি। কালমেঘায় গিয়ে তক্ষুণি তাদের সাথে যোগাযোগের চিন্তা করি। পরদিন সকালে বড়চওনার আবদুল আজিজকে সাথে নিয়ে দুটি সাইকেলে কালমেঘার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। কালমেঘায় পৌঁছে আশেপাশের দু’এক জায়গায় খবর নিই, সত্যিকারেই ই. পি. আর আছে কিনা? থাকলে কোথায় আছে এবং কার মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
সেখানকার লোকজনেরাই পরামর্শ দেন কিতাব আলী মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করতে। কালমেঘা স্কুলেই ই. পি. আর-রা কয়েকদিন যাবৎ আছে। কিতাব আলীই ঐ স্কুলের মাষ্টার। মাস্টারের বাড়ী
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩

থেকে স্কুল আধ মাইল দূরে। আমরা কিতাব আলীর বাড়ীতে খোঁজ-খবর নিতে গেলাম। কিন্তু সে তখন বাড়ীতে ছিল না, ই. পি. আর-দের কাছে গিয়েছিল। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়ে তাকে আনা হলো। আমি মাষ্টারকে আমার উদ্দেশ্য জানালাম। আমার কথায় কিতাব আলী মাষ্টার খুবই আনন্দিত ও উৎসাহিত হলো। সে তখনই ই. পি. আর সুবেদারের সাথে আলাপ করিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলো।
ই. পি. আর. সুবেদারের সাথে কথা বলার সময় নানা বিষয়ের অবতারণা হয়। সুবেদার সাহেব মোটামুটি আগ্রহ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। সুবেদার সাহেব বললেন, “আমরা নিশ্চয়ই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করব। যখন ব্যারাক থেকে চলে এসেছি তখন আর ফিরে যাবার উপায় নেই। লড়াই আমাদের করতেই হবে। কিন্তু কিভাবে করব? কোথায় পাব অস্ত্র-শস্ত্র এবং রসদ? আমাদের কাছে যে অস্ত্র-শস্ত্র আছে তা যুদ্ধের জন্য মোটেই যথেষ্ট না। আরও অস্ত্র, আরও গোলাবারুদের দরকার।”
নানা কথাবার্তার পর সাব্যস্ত হলো, আমি প্রথমে তাদের জন্য খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করবো ও নানা জায়গায় যেসব অস্ত্র ছড়িয়ে আছে তা সংগ্রহ করে মজুতভাণ্ডার গড়ে তোলার চেষ্টা করবো এবং এক সপ্তাহ থেকে দশ দিনের মধ্যে অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলা-বারুদ সংগ্রহ করে আবার সুবেদার সাহেবের সাথে দেখা করব। এই এক সপ্তাহ থেকে দশ দিন আমার পক্ষ থেকে কারা তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য দেবে, তা সুবেদার সাহেবকে জানিয়ে দিলাম। সুবেদার সাহেব তার ক্যাম্পে চলে গেলে দূরে অপেক্ষমান কিতাব আলী মাষ্টার এগিয়ে এলে তাকে আলোচনার কিছু জানালাম। সে ও বড়চওনার ইদ্রিস এই অন্তবর্তী সময়ে ই. পি. আর-দের সাথে যোগাযোগ রাখবে। এ ব্যাপারে ইদ্রিসের কাছ থেকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা পাবে। আমার কথায় সে খুব খুশি হলো এবং সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিল।
কিতাব আলী মাষ্টার তার বাড়ীতে দুপুরে খাওয়ার অনুরোধ করলো। আমি ও আজিজ, অনুরোধ রক্ষা করলাম। খাদ্যের মধ্যে খুব ভালো চালের ভাত, ডাল আর প্রচুর মুরগির মাংস এত ঝাল দিয়ে রান্না করা হয়েছিল যে তা খেতে আমার নাকের পানি চোখের পানি এক হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কিতাব আলী মাস্টারের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠার পর ঠাট্টা করে ঝালের কথা তাকে অনেকবার বলেছি।
কিতাব আলী মাষ্টার মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অনেকবার ভর্তি হবার চেষ্টা করেছে কিন্তু আমি তাকে সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হতে বারণ করেছি। আমি তাকে বার বার বলেছি, “একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চাইতে তুমি একজন স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার হিসাবে অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।” সে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে একজন অত্যন্ত সার্থক ও সফল স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার হিসাবে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। কিতাব আলী মাষ্টারকে আমি অনেকদিন পর্যন্ত ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছি। কিন্তু কাজের মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক এত নিবিড় হয় যে, কিতাব আলী মাষ্টারকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা শুরু করি। অবশ্য
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪

বয়সের দিক থেকে কিতাব আলী আমার চাইতে বড় নাও হতে পারে।
কালমেঘা থেকে আবার বড়চওনা ফিরে এলাম। যাওয়া-আসার পথে কয়েক জায়গায় থামতে হয়েছে। অনেক পরিচিত ও অপরিচিতরা বারবার প্রশ্ন করেছেন, “আমাদের মুক্তি বাহিনীতে নেবেন না? কবে যাব? কোথায় যাব?”
বড়চওনায় আজিজদের বাড়ীতে রাত কাটালাম। আজিজ আমাদের টাংগাইলের বাসায় থেকে করটিয়া মহাবিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত। ফুলপুর থেকে আমি একটি জামা বানিয়ে নিলেও বড়চওনা পৌঁছতে পৌঁছতে সে জামারও কাঁধ ছেঁড়ার উপক্রম হয়েছিল। দুইবারের অভিজ্ঞতায় ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম যোদ্ধাদের জন্যে পাতলা কাপড় উপযোগী নয়। তাই একটি মোটা কাপড়ের জামা বানানোর প্রয়োজনীয়তা বেশ কয়েকদিন যাবৎ অনুভব করছিলাম। কিন্তু টাকা, কাপড় ও দর্জির অভাবে তা হয়ে উঠেনি। বড়চওনায় আক্কাস দর্জিকে পেয়ে একটি জামা বানানোর প্রয়োজনীয়তা প্রকটভাবে অনুভব করলাম। টাকা নেই, কাপড় নেই, দর্জি আছে। এমনি অবস্থায় এ সমস্যা সমাধানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আজিজ এগিয়ে এলো, তার ব্যবহৃত পাতারঙের একটি সুন্দর সুতি চাদর আমাকে দিয়ে বলল, “এটি দিয়ে আপনি জামা বানিয়ে নিন।” চাদরটি চটের মতো মোটা হলেও আমার তা খুবই পছন্দ হলো। আজিজের দেওয়া জামা জুন-জুলাই পুরো সময়টাই ব্যবহার করেছি। আগস্টের গোড়া পর্যন্ত বলতে গেলে আজিজের দেওয়া কাপড়ের জামা-ই ছিল আমার একমাত্র পোশাক।
পরদিন বড়চওনা থেকে বাঘের বাড়ীর আবু বকরদের বাড়ীতে এলাম। আবু বকর আমার পূর্ব-পরিচিত এবং বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। আবু বকরদের বাড়ীতে একরাত থাকলাম। আবু বকর আমাকে বারবার বলল, “এভাবে আর চলতে পারে না। কিছু বন্দুক আর গুলির ব্যবস্থা করুন। আর কিছু হোক বা না হোক, মিলিটারিদের সাথে পারি বা না পারি, এই যে প্রতিরাত্রে ডাকাতি হচ্ছে— দু’চারটা ডাকাত মেরে হয়তো ডাকাতি বন্ধ করতে পারব, তাতে মানুষ কিছুটা শান্তি পাবে।” আবুবকরের কথা আমার মনে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো।
বাঘের বাড়ী থেকে ছাতিহাটিতে এসে বাবা-মার সাথে মিলিত হলাম। পরদিন সকালে দুই ফারুককে সাথে নিয়ে ছাতিহাটি থেকে চারান, বাগুটিয়া, বাগুনডালি হয়ে দুপুরে নাগার বাদশা মিয়ার বাড়ীতে পৌঁছি। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে সামান্য বিশ্রাম করে বিকাল পাঁচটায় আরও পশ্চিম-দক্ষিণে চলা শুরু করলাম। টাংগাইল-ভূয়াপুর রাস্তা পার হবার সময় ভূয়াপুরের চেয়ারম্যান দুদু মিয়ার সাথে দেখা হলো। এই দুদু মিয়া আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী সংগঠক। ’৪৭-এর পর থেকে মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন আদর্শ অনুসারী হিসাবে কাজ করছেন।
ভূয়াপুর-টাংগাইল রাস্তার উপর দুদু মিয়া ব্র্যাটাগান কাঁধে আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠে বললেন, “হায় হায়! আপনারা এখানে। আপনাদের পাইলেই এ্যারেস্ট করবে। আর বন্দুক কাঁধে নিয়ে ঘুরছেন! সর্বনাশ! কী যে হয়!” আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বললাম, এ বন্দুক
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫

আর নামবে না। এতে জান যায়, যাক্। আপনি এ নিয়ে চিন্তাভাবনা ছাড়ুন। আপনার কাছে যদি কোন টাকা পয়সা থাকে, তাহলে তাই দিয়ে আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারেন কিনা দেখুন।”
-আমার কাছে তো তেমন টাকা পয়সা নেই। তবে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা হবে। আপনারাও কিছু নেন, আমারও কিছু থাক। এই বলে তিনি চল্লিশটি টাকা আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি দশটাকা ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, “ভাগ বড় বেশি অসমান হয়ে গেল। এটা নিন, কিছুটা সমতা আসবে।”
সন্ধ্যায় সল্লা ইউনিয়নের কদিমহামজানীর এক হাজী সাহেবের বাড়ীতে উঠলাম। এই বাড়ীর এক ছেলে টাংগাইল কাগমারী মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজের ছাত্র। সেই সুবাদে ফারুকের পরিচিত। বাড়ীর লোকেরা আমাদের খুবই সমাদর করলেন। মধ্যরাতে গোলাগুলির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। পূর্বদিকে মাঝে মাঝে গুলির শব্দ হচ্ছে। এই সময় বাড়ীর এক ছেলে ও তার দু’তিনজন বন্ধু এসে বলল, “তাড়াতাড়ি আপনারা গানটা দিন, পাশের গ্রামে ডাকাত পড়েছে। আমরা দু’একটা ডাকাত মেরে আসি। আমি তাদের বললাম, “না ভাই, আমি আপনাদের বন্দুক দিতে পারি না। এর অপব্যবহার হলে আমার আর উপায় থাকবে না।” আসলে কিন্তু আমার কাছে যে বন্দুক আছে, তাতে একটাও গুলি নেই। গুলিবিহীন বন্দুক নিয়েই আমি উপলদিয়া থেকে গোপালপুরের একাশিকোণাবাড়ী, উপলদিয়া, সেখান থেকে দেওপাড়া হয়ে বড়চওনা, কালমেঘা, আবার বড়চওনা, বাঘের বাড়ী, ছাতিহাটি ইত্যাদি নানা জায়গা হয়ে এই কদিমহামজানী এসেছি।
অনেক সময় আমারও মনে হয়েছে, গুলি ছাড়া এ বন্দুকের কথা সুযোগ-সন্ধানী সুবিধাবাদীরা জানতে পারলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। তাই ৩রা এপ্রিলের পর একদিনও একসাথে সবাই ঘুমাইনি। যখন যে সাথে থেকেছে, পালা করে একজন ঘুমিয়েছি তো অন্যজন পাহারা দিয়েছি। পাশেই ডাকাত পড়েছে। হাতে বন্দুক। অথচ আমি নিজেও যাচ্ছি না, অন্যকেও বন্দুক দিয়ে সাহায্য করতে পারছি না। বন্দুকের ভিতরটা যে একেবারে খালি, তা তো আর কেউ জানে না। এমন একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় আর ঘুমাতে পারলাম না। সকাল হলেই এখান থেকে চলে যাব, তাই সকাল হওয়ার আশায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। কাকডাকা ভোরে আবার তিনজন বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় আট-দশ মাইল পায়ে হেঁটে টাংগাইলের পশ্চিম পাঁচকাউনার রশিদের বাড়ীতে এসে উপস্থিত হই। এখান থেকে বেড়াডোমার জাহাঙ্গীরকে খবর দেওয়া হয়। খবর পেয়ে জাহাঙ্গীর ছুটে আসে। একে অপরকে দেখে যারপরনাই উৎসাহিত ও আনন্দিত হই।
জাহাঙ্গীর আমার চেয়ে বয়সে ছোট। ছাত্রলীগের ফারুকেরও ছোট। জাহাঙ্গীরের কাছে টাংগাইলের সব খবরা-খবর নিলাম। মিলিটারিরা কোথায় কিভাবে আছে, টাংগাইলে আমাদের পরিচিত লোক কে কে আছেন, একটা মোটামুটি চিত্র জাহাঙ্গীর তুলে ধরতে সমর্থ হলো। খোঁজ-খবর নেওয়ার পর জাহাঙ্গীরকে বললাম, “ভাই, তোকে একটা কাজ করতে হবে। করটিয়া গিয়ে সবুরকে নিয়ে আসতে হবে।” এক কথায় জাহাঙ্গীর রাজী হয়ে গেল। জাহাঙ্গীর ও ফারুক সবুরের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬

খোঁজে ঢেলি করটিয়ার উদ্দেশে চলে গেল। সবুরকে ওরা বাড়ীর পাশেই পেয়ে যায়। ফারুকের কাছে সবুরের জন্য একটি চিরকুট দিয়েছিলাম। ফারুক ও জাহাঙ্গীরকে দেখে এবং অবিলম্বে দেখা করার অনুরোধ সম্পর্কিত চিরকুট পেয়ে সবুর আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে।
সে ছুটাছুটি করে পাশের গ্রামের মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা টেপরেকর্ডার এবং গুলিভর্তি ব্রাটাগানের ম্যাগাজিন নিয়ে পাঁচ কাউনিয়া এসে উপস্থিত হয়, আমি সবুরকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি। বিশেষ করে সবুরের হাতের গুলিভর্তি ম্যাগাজিন দেখে আমার হৃদয় ময়ূরের মতো নেচে উঠে। মনে হলো যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। গুলিশূন্য বন্দুক নিয়ে ঘোরা ফেরার সময় প্রতি মুহুর্তে আমার বুক দুরদুর ছিল। কারণ শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে মোকাবেলা করার কোন উপায় ছিল না। সবুর বলল, “কবে আমরা কাম শুরু করমু? এ্যাহনও কি সময় অয় নাই? আর এমনে থাহন যায় না। যহন তহন মরতে অইতে পারে। মরণ আওনের আগেই কিছু এডা কইরা ফেলান নাগবো।” আগের মত এবারও বললাম, “আর বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। সময় হয়ে এসেছে।”

৩রা এপ্রিল, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী টাংগাইলে এসে যে কয়েকটি বাড়ী ধ্বংস করে তার মধ্যে আমাদের বাড়ী অন্যতম। খোন্দকার আসাদুজ্জামান ও বদিউজ্জামানের বাড়ী পাক-হানাদার বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। যেহেতু আমাদের পাকাবাড়ী ছিল না—ঘরগুলো সব টিনের, সেহেতু তা আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয় এবং বাড়ীর আঙিনায় বড় বড় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সবকিছু ওলট পালট করে ফেলে। বহুদিনের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ীখানা কিভাবে পাক-বাহিনী ধ্বংস করেছে সে খবর বেশ কয়েকদিন আগেই জানতে পেরেছিলাম। ধ্বংস বাড়ীখানা একনজর দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। পাঁচকাউনা থেকে আবার পাহাড়ি অঞ্চলের উদ্দেশে রওনা হবার সময় বহুদিনের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ীখানা একবার দেখে যাওয়া স্থির করলাম।
সন্ধ্যায় রশিদের বাড়ী থেকে রওনা হয়ে প্রথমে বেড়াডোমা জাহাঙ্গীরের বাড়ী। ওখানে কিছু সময় অপেক্ষা করে শহরে মিলিটারিদের চলাফেরা ও অবস্থান সম্পর্কে আরও সঠিক খবর নিয়ে রাত ন’টায় টাংগাইল পার্কের পশ্চিমপাশ দিয়ে লৌহজং নদীর পাড় ঘেঁষে উত্তরে পৌঁছলাম বিবেকানন্দ হাইস্কুল ও খালেক এ্যাডভোকেটের বাড়ীর পাশের রাস্তা ধরে আকুর টাকুরের ভিতর দিয়ে রাত দশটায় বহু আকাক্ষিত বাড়ীটি দেখতে পাই। বাড়ীটি দেখেই আঁতকে উঠি। আমি খবর পেয়েছিলাম, বাড়ীর নানা স্থানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মাটি উলট-পালট করে ফেলা হয়েছে এবং সমস্ত জিনিসপত্র পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে খবর পেয়েছি আর দূর থেকে যা দেখেছি—এর মধ্যে কোন মিল নেই। আমি দেখেছি বাড়ীর সর্বত্রই পানি। সারা বাড়ী যেন পানির উপর ভাসছে। পানি থৈ থৈ করছে, টলমল করছে। আমাদের বাড়ী ধ্বংস হয়েছে। এটা জানতাম, কিন্তু সেটা যে পানিভর্তি মস্তবড় এক পুকুরে পরিণত হয়েছে, তা জানতাম না। আমি খুব বেদনাহত হয়ে অতি সন্তর্পণে বাড়ীর দিকে এগুতে লাগলাম। কাছে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭

আসতেই আমার ভুল ভাঙল। না, আমাদের বাড়ী তো পুকুর নয়! এটাকে পুকুর করা হয়নি।

ভস্মীভূত নিজ বাড়ীতে
সেটি ছিল চাঁদনী রাত। সর্বত্র আলোর প্লাবন। জ্যোৎস্নার মায়াময় আলো ছায়া সারা বাড়ীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পোড়া টিনগুলোর উপর এসে পড়ছিল। সর্বত্র জ্যোৎস্নার আলোয় বাড়ীটি চিক চিক করছিল। দূর থেকে আমি এই অবস্থাকে থৈ থৈ পানি বলে মনে করেছিলাম। সারাবাড়ী বার বার ঘুরে দেখে তন্ময় হয়ে গেলাম। আমার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। সাথীরা আমাকে তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করতে অনুরোধ করলো। কিন্তু সেদিকে আমার কোন খেয়াল নেই। শুধু টিনের ফাঁকে ফাঁকে পা বাঁচিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছি। আমার চোখে অশ্রুর বন্যা নেমেছে। বুক হাহাকার করছে। বারবার বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস। অনেকক্ষণ উদাসীনভাবে কেটে গেল, সবুরকে বললাম, “ছোট দেখে একটা বাঁশ আনো”। কোন প্রশ্ন না করে সে সাত-আট হাত লম্বা দু’তিন ইঞ্চি মোটা একটা বাঁশ এনে দিল। প্যান্টের পকেট থেকে বাংলাদেশের একটা মাঝারি ধরনের জাতীয় পতাকা বের করে বাঁশের ডগায় লাগিয়ে সাথীদের সাহায্যে বাড়ীর একেবারে মাঝে পুঁতে দিলাম। আমার একার পক্ষ থেকে নয়, মুক্তিপাগল সমগ্র বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে। আসন্ন বিজয়ের প্রতীক হিসেবে পতাকাটি গর্বভরে পত পত করে উড়তে লাগল। দুই ফারুক, সবুর, জাহাঙ্গীর ও আমি এক সারিতে দাঁড়িয়ে পতাকাকে সামরিক কায়দায় ছালাম জানালাম। তারপর অশ্রুসিক্ত নয়নে আস্তে আস্তে সরে এলাম।
আমাদের বাড়ীর সামনে দুলালদের বাড়ী। সেখানেই গেলাম। দুলালের বাবা সাঈদ আহমেদ ঠিক সেই দুদু মিয়ার মতো একইভাবে বললেন, “হায় হায়! আপনি এখানে? আপনাকে পেলেই মেরে ফেলবে। কোন মতেই আর এক মুহূর্ত শহরে থাইকেন না। পারলে ভারতে চলে যান। সাঈদ আহমেদ কথাগুলো আন্তরিকভাবেই বললেন। কারণ সে সময়ে আমাকে পেলে সত্যি সত্যি টুকরো-টুকরো করে ফেলত। দুলালদের বাড়ীতে একগ্লাস সরবত পান করে বেরিয়ে পড়লাম।
দুলালদের বাড়ী থেকে রওনা হবার সময় জাহাঙ্গীর থেকে গেল। নতুনভাবে সাথী হল দুলাল। দুলাল আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। দুলালের বড়ভাই ফরহাদ আহমেদ আমার সহপাঠী গোড়ান-সাটিয়াচরা যুদ্ধে দুলালকে একটা পয়েন্ট টু-টু রাইফেল দিয়েছিলাম। ছত্রভঙ্গ হওয়া পর দুলালের সাথে এই প্রথম দেখা। দুলালকে রাইফেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো, ঘারিন্দায় তার নানার বাড়ীতে খুব ভালো করে মাটির নীচে পুঁতে রেখেছে। রাইফেলটা আমার হাতে তুলে দেওয়ার জন্যই দুলাল সাথী হলো। ঘারিন্দা পৌঁছেই সে নির্দিষ্ট স্থানে মাটির নিচ থেকে রাইফেলটি তুলে আনে। প্রায় বাইশ-তেইশদিন মাটির নিচে থাকায় সামান্য মরিচা ধরেছে। তবে অন্য কোন ক্ষতি হয়নি।
পরদিন আবার সেই পথচলা। দুলাল ঘারিন্দায় থেকে গেল। সবুরকেও তার নিজ নিজ গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এবার ঘারিন্দা থেকে গোলরা, উদ্দেশ্য নূরুর সন্ধান। নুরু খুবই পরিশ্রমী,
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮

বিশ্বস্ত কর্মী। নুরু তখন ঢাকা কলেজের আই. এস. সি. দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। গোলরায় নুরুকে পাওয়া গেল না। তার ছোটবোন জানালো সে কয়েকদিন আগে ছাত্রলীগের রবিউল আলমের সাথে ভারতে চলে গেছে। নুরুদের বাড়ীতে দুপুরে খাবার সময় আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হুমায়ুন কবীরের ছোট ভাই আকবর এসে হাজির। আকবরকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “তুই কোথা থেকে এলি? কেনইবা এলি?” সে বলল, “একটু আগে একজনের কাছে খবর পেলাম, আপনি এখানে এসেছেন। তাই মা আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।” কেন নিয়ে যেতে বলেছেন, জানতে চাইলে বলল, “মা এবং আমরা মাঝে মধ্যেই শুনছি আপনি মরে গেছেন। আবার দু’দিন তিনদিন পর শুনছি বেঁচে আছেন। আবার শুনলাম মিলিটারিরা টাংগাইল বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে আপনার দু’হাতে রশি লাগিয়ে জিপের পেছনে বেঁধে হাজার হাজার মানুষের সামনে টেনে-হিচড়ে মেরে ফেলেছে। এ রকম শুনে শুনে আজ যখন খবর পেলাম আপনি এখানে, তখন এক মুহূর্ত দেরি করতে দিলেন না। স্বচক্ষে দেখার জন্য ছুটে এসেছি। মাও খুব ব্যাকুল হয়ে আছেন। আপনাকে আমার সাথে যেতেই হবে। হুমায়ুন ভাইও বাড়ীতে।”
এখন আর কী করি? বন্ধু ও বন্ধুর মাকে চিন্তামুক্ত করতে স্বশরীরে দেখা দিতেই হয়। গেলাম পাইকরাতে। আমাকে দেখে হুমায়ুনের মা, হুমায়ুন ও ছোট ভাইবোনেরা খুব খুশি। হুমায়ুনের মা শুধু খুশি নয়, মহাখুশি। ইতিপূর্বে কিন্তু হুমায়ুনের মা আমাকে দু’চোখে দেখতে পারতেন না।

অচেনা বাড়ীতে আশ্রয়
হুমায়ুনদের বাড়ীতে খাবার খেয়ে, আবার হাঁটা দিলাম। চলছি আর ভাবছি কোথায় রাত কাটাই? আমাদের বাড়ী এখনও অনেকটা পথ। শরীরও তেমন সাহায্য করছে না। আমি পারলেও সাথী দু’জনের খুবই কষ্ট হচ্ছে। রতনপুরের ফারুক তো দু’তিন দিন থেকে সবসময় অনেকটা পথ পিছিয়ে পড়ছে। হেঁটে সাথে থাকতে পারছে না। ফলে আমাকে মাঝে মাঝে হাঁটা বন্ধ করে ফারুককে সাথে নিতে হচ্ছে। এতে শুধু সময়ই নষ্ট হচ্ছে না, চলার গতিও কমে যাচ্ছে। পথও কমছে না। কী করা যায় ভাবছি আর চলছি। পথে সাদৎ কলেজের ছাত্র মকবুল হোসেনের সাথে দেখা। তখন সূর্য প্রায় অস্তাচলে। কেমন আছেন? কী করছেন? এখানকার অবস্থা কেমন? প্রশ্ন করেই আবার চলতে শুরু করলাম। অন্ধকার হয়ে আসছে। শুধু চলা আর চলা, এ চলার যেন শেষ নেই। জ্যোৎস্না উঠবে রাত ন’টায়। অন্ধকারে পথ চলা মুশকিল। কারও বাড়ীতে উঠা যায় কিনা, ভাবতে ভাবতে চলছিলাম। গোপালদিঘি গ্রামের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি। এই সময়ে কিছু লোক মাছ ধরে বাড়ী ফিরছেন। আশেপাশের বাড়ীতে কেউ কেউ উঠে যাচ্ছেন। বুঝলাম, এরা প্রায় সবাই এ গ্রামের লোক। পাশ দিয়ে যেতে কয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? রাত হয়ে গেল, আমাদের বাড়ীতে থেকে যান। কাল সকালে যাবেন।’ এই বলে কিছুটা এগিয়ে তারা দাঁড়িয়ে পড়লেন। এখানে পথ দু’দিকে চলে গেছে। তবুও দু’এক পা এগিয়ে গেলাম। তারপর ধীরে ধীরে থামলাম। কারণ রাতের আশ্রয় চাই। চলা বন্ধ করলে লোকগুলো আরো আন্তরিকভাবে বললেন, আমরা আপনাদের চিনি, কোন অসুবিধা হবে না। আপনারা থাকেন।’ আমার কাঁধে ব্র্যাটাগান
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯

ঝুলানো। এবার কিন্তু তা গুলিশূন্য নয়। ম্যাগাজিন ভর্তি গুলি। আর টুটুবোর রাইফেলও রয়েছে, তারও প্রায় চার-পাঁচশ’ গুলি আছে। টু-টু রাইফেল দিয়ে হয়তো কাউকে দু’এক গুলিতে মেরে ফেলা যাবে না। কিন্তু টু-টু বোরের গুলিতে যে কাউকে গুরুতর আহত করা সম্ভব।
আগে ব্রাটাগানটি সাথে ছিল, অথচ একটি গুলিও ছিল না। তবুও অপরিচিত বাড়ীতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আজ তো সব কিছু আছে। তারপরও লোকগুলোর আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার কোন যুক্তি সংগত কারণ খুঁজে পেলাম না। এঁরা সত্যিই যদি হিতৈষী হন, তাহলে কথাই নেই। আর যদি না হন, তবুও নিজেদের রক্ষা করার শক্তি, সাহস ও ক্ষমতা আমাদের আছে। তাই তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁদের বাড়ীতে গিয়ে উঠলাম।
কাছারি ঘরের সামনের উঠানে আমাদের জন্য একখানা ছোট চৌকি, দু’তিনখানা চেয়ার দু’টি বেঞ্চ পেতে দেয়া হলো। আমরা মাত্র তিনজন। আমাদের বসবার জন্য এতকিছুর এ প্রয়োজন ছিল না। এর কোন কিছুই যে অপ্রয়োজনীয় নয়, তা একটু পরেই বোঝা গেল। হাত ধুয়ে সুস্থির হয়ে বসার পর দেখা গেল গ্রামের অসংখ্য যুবক, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধারা এসে হাজির হলেন। সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলাম। গ্রামবাসীদের হৃদ্যতাই ছিল বেশি।
আমি এক মুহূর্তের জন্যও ব্র্যাটাগানটি হাতছাড়া করিনি। মাটিতে পর্যন্ত নামিয়ে রাখিনি। আমার মনের ভিতর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের একটা দ্বন্দ্ব চলছিল, অথচ গ্রামবাসীদের মন শুধু বিষ আর ভালোবাসাতেই ভরপুর ছিল। কারণ তাঁরা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। দোয়া, শুভ কামনা করেছেন। বিপদে ফেলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ তাঁদের মুখাবয়বে লক্ষ করিনি।
সন্ধ্যার আসর বেশ ভালোই জমলো। নানাজন নানা কথা বলছেন। একজন বললেন, “কাইল আছিল কাইট্টা হাট। হাটে মেলেটারি মইরা গেছে।” আর একজন বললেন, “ওরা যতই গোলাগুলি করুক, যত আওয়াজ করুক। শুধু আসমান ট্যারাই করব। একটা মুক্তিও মারতি পারব না।” আর-একজন একটু নড়েচড়ে বসে খুব উৎসাহের সাথে বলতে লাগলেন, “দেহেন আমরা যদি পয়লা ওগর তলেও পড়ি, নিচের থিক্যাই ওগরে জাইতা মারুম।” এরকম অনেক কথাবার্তার পর রাত সাড়ে ন’টায় আসর ভাঙলো।
প্রায় সত্তর-আশিজন আবাল-বৃদ্ধ আসরে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁদের কারও মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব অথবা স্বাধীনতার প্রতি অনীহা দেখলাম না। বরং তাঁদের সকলের মধ্যে স্বাধীনতার প্রতি প্রবল আগ্রহ ও উৎসাহ দেখলাম। এমনকি তাঁদেরকে স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের সাহায্য করতে ও স্বাধীনতার জন্য চরম ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত বলে মনে হলো। এতে আমার অন্তর কেবল আলোড়িতই হলো না, শক্তির সন্ধানও পেলাম।
রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটল। ঘুম থেকে উঠে একবার ভাবলাম, সকাল-সকাল চলে যাব। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম, আজ রাতটা নিজ বাড়ীতেই কাটাব। গোপালদিঘি থেকে ছাতিহাটি পৌঁছাতে ঘন্টা আড়াইয়ের বেশি লাগবে না। সন্ধ্যার পর যাতে নিজ গ্রাম ছাতিহাটিতে পৌঁছানো যায়, এরকম একটা সময়ে এখান থেকে রওনা হব। তাই দুপুরে রওনা হওয়াই
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০

শ্রেয় মনে করলাম। বাড়ীর মালিককেও সেভাবে বলা হলো। আমাদের থাকার কথা শুনে বাড়ীর মালিক খুবই খুশি।
সকালে শুনলাম, ওখান থেকে দুই মাইল দূরে সমৃদ্ধশালী রামপুর গ্রামে গতরাতে এক মস্তবড় ডাকাতি হয়েছে। ডাকতরা নগদ তিন লাখ ষাট হাজার টাকা নিয়ে গেছে। ন’টার দিকে এ ডাকাতির খবর এলাকার প্রায় সবাই জেনে যান। তখন ঐ ডাকাতি সম্পর্কে আবার নতুন খবর এলো। টাকা তিন লাখ ষাট হাজার নয়, শুধুমাত্র ষাট হাজার। এরও ঘন্টা খানেক পর আরও চমকপ্রদ খবর পাওয়া গেল। জানেন এ ডাকাতি কে করেছে? এটা কাদের সিদ্দিকীর কাজ। সে নিজে ডাকাত দলে ছিল, বাড়ীর লোকেরা তাকে দেখেছে। গোপালদিঘি গ্রামের লোকেরা এ খবরে বেশ হাসাহাসি ও বলাবলি শুরু করেনঃ “শালাগরে খাইয়া আর কাম নাই। যত ভালা ভালা মাইনসের নামে আজগুবি কথা ছড়াইতেছে। যার বাড়ীতে ডাকাতি হইছে, হে শালায় নিশ্চয় মুসলিম লীগের দালাল।” ঐ গ্রামে মোটামুটি শেষ খবর যা এলো, তা হলো তিন লাখ ষাট হাজার নয়, ষাট হাজারও নয়। বস্তাভর্তি তিন হাজার কাঁচা টাকা।
ডাকাতির এই মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার কানে আসতেই আমার মনের পর্দায় পরপর ভেসে উঠল তিনটি ঐতিহাসিক নাম—হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর ও সূর্যসেন তদানীন্তন ইংরেজ সরকার ও জমিদার-সম্প্রদায় বাংলার তথা বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, নিপিড়িত মানুষের তিন মহানায়কের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ও কুৎসিত অপপ্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁদের ডাকাত বলে অপপ্রচার করেছে। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের বিরুদ্ধেও যে স্বার্থবাদী মহল ও মীর জাফরের দল নানা ভাবে অপপ্রচার চালাবে, ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে স্বাধীনতা যুদ্ধের পিছনে ছুরিকাঘাত করবে, জনগণের মহান লক্ষ্য নস্যাৎ করে দেবার ষড়যন্ত্র করবে। এটাইতো স্বাভাবিক।
বিকেল তিন-সাড়ে তিনটায় গোপালদিঘি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য নিজ গ্রাম ছাতিহাটি। এরপর কী করব, তারও একটা রূপরেখা মনে-মনে প্রায় তৈরি করে ফেলেছিলাম।
গোপালদিঘি থেকে কোকডহরা এসে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতি দিলাম। এখানেও প্রায় শ’দুই লোক সমাগম হলো। গতরাতে গোপালদিঘির সেই মানুষদের মতো এদের মনোভাবও একই। যথাসম্ভব সবার সাথে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলে আবার চলা শুরু করলাম।
আমরা তিনজন হেঁটে চলেছি। আজ দু’তিন দিন ধরে রতনপুরের ফারুক আর কিছুতেই চলতে পারছে না। সব সময় অনেক পিছে পড়ে থাকছে। যদিও আমি, আমার সাথী উভয় ফারুকের চাইতে দেহ গঠনে বেশ বড় ও লম্বা, তার উপর আবার দ্রুত চলতে অভ্যস্ত। এতে স্বাভাবিক ভাবেই ছোটখাটো গড়নের লোকদের পক্ষে আমার সাথে পায়ে হেঁটে সমতা বজায় রাখা ছিল খুব কঠিন। দুইজনের মধ্যে ছাত্রলীগের ফারুক কষ্ট হলেও আমার সাথে পা মিলিয়ে চলছে। সে যেন পণ করে বসেছে জান যায় যাক, তবুও চলার পথে কোন ক্রমেই পিছে পড়বে না। মাইল দুই হাঁটার পরই দেখা যাচ্ছে, ফারুক প্রায় আধ মাইল পিছিয়ে পড়ছে। ফারুককে দাইন্যা থেকে বলতে শুরু
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১

করেছিলাম, “দেখো ভাই, সব কাজ সবসময় সবার দ্বারা হয়ে উঠে না। তাই তুমি যদি এই অমানুষিক পরিশ্রম সইতে না পারো, তাহলে আপাততঃ কিছুদিন নিজের বাড়ীতে গিয়ে থাকো। আমি যদি তেমন কিছু করে উঠতে পারি, তখন তোমাকে খবর দেবো।” গতরাতেও গোপালদিঘির বাড়ীতে এই কথাগুলো বন্ধু ফারুককে বলেছি। আরও বলেছি, “দেখো, উপলদিয়া থেকে গোপালপুরের একাশিকোনা বাড়ী, সেখান থেকে উপলদিয়া, তারপর দেওপাড়া—এ সময়টা আমরা শুধু দু’জনেই ছিলাম। তুমি যদি ঐ সময় সাথী না হতে, তাহলে আমাকে হয়তো একাই চলতে হতো। ঐ সময় আমার সঙ্গ দিয়ে আমার যে উপকার করেছ, তা আমি কোনদিন ভুলব না। পরবর্তীতে দেওপাড়া থেকে বড়চওনা, সেখান থেকে বাঘের বাড়ী, ছাতিহাটি, নাগা, কদিম হামজানী, দাইন্যা, টাংগাইল, ঘারিন্দা ও গোপালদিঘি—এই যে এতটা পথ পায়ে হেঁটে তুমি আমার সহযাত্রী হয়েছ, এরপর যদি তুমি নাও পারো, তাতে দোষের কিছু নেই। প্রতিটি মানুষ কোন মহাযজ্ঞের কোন অংশে তার উজ্জ্বল ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় বা রাখে। তাই একটি খণ্ড অংশে তোমার ভূমিকা মোটেও গৌণ নয়। তুমি যদি চাও, বাড়ী চলে যেতে পারো। আমি খুশি মনে তোমার বাড়ী চলে যাওয়া মেনে নেব।” এত কথার পরও ফারুক চুপচাপ, নির্বিকার। তাই কোকডহরা থেকে রওনা হবার সময় একটা কৌশল অবলম্বন করলাম। সহযাত্রী দুই ফারুককে বললাম, “সামনে চারানের কাছে রাস্তা দুইদিকে গেছে—একটা সোজা, অন্যটা ডানে বেঁকে চারানের মাঝ দিয়ে ছাতিহাটি হয়ে পাহাড়ের দিকে। আমি ডানের রাস্তা ধরব। তোমরা ইচ্ছা করলে আমাকে অনুসরণ করতে পারো। সোজা চলে গেলে রতনপুরের ফারুকও যেমন কালিহাতি হয়ে তার বাড়ী যেতে পারবে, ছাত্রলীগের ফারুকও তেমনি কালিহাতি হয়ে ইচ্ছে করলে তার বাড়ীতে বা অন্যত্র যেতে পারবে।” এই সময় আমাদের কাছে ব্র্যাটাগান ও একটি টু-টু বোর রাইফেল ছিল। রাইফেলটি ছাত্রলীগের ফারুক বহন করছিল। ভাগ হয়ে যাবার প্রশ্ন, তাই ফারুকের কাছ থেকে রাইফেলটা নিয়ে নিলাম।
আমি আগে আগে। সামান্য পিছনে ছাত্রলীগের ফারুক। তার একটু পিছনে রতনপুরের ফারুক। আমরা এগুচ্ছি, এগুতে এগুতে সেই চিহ্নিত রাস্তা এসে গেল। আমি ডাইনে মোড় নিলাম। মুহূর্তের জন্যও পিছু ফিরে তাকালাম না। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর এগিয়ে গেলাম। আমার পিছনে ছাত্রলীগের ফারুকও মোড় নিল। তারপর রতনপুরের ফারুকের সামনে এলো সেই বাঁক। সে থমকে দাড়াল। সম্ভবত সে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। তার মন তখন বাড়ীর দিকে যেতে সায় দিচ্ছিল না। আবার হেঁটে সমতা রাখতে না পারায় আমার সাথে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। সে তখন মানসিক দ্বন্দ্ব ও যন্ত্রণায় ভুগছিল, অথচ হাতে সময়ও নেই, সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। মিনিট খানেক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে নিতান্ত অসহায়ের মতো সে আস্তে সোজা রাস্তা ধরে চলতে শুরু করলো। আমাকে ছেড়ে যেতে ফারুকের যে কষ্ট হচ্ছিল, এটা পরিষ্কার বোঝা গেল। আমাকে বার বার দেখতে দেখতে ফারুক এগিয়ে যাচ্ছে। তার চোখের পানি বাঁধ মানছে না। ফারুক চলে যাওয়ায় আমার মনেও যে কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি, এমন নয়। সে বার বার
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২

আমার দিকে তাকাচ্ছে আর খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। ফারুক আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছে দেখে আমি স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলি। আমার চোখেও অশ্রু আসে। এরপর দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত চলতে-চলতে আমরা একে অপরের দিকে বার বার তাকাতে থাকি। এমনি করে আমরা পরস্পরের দৃষ্টি থেকে এক সময় মিলিয়ে যাই।
ছাত্রলীগের ফারুক সম্পর্কে দু’একটা কথা বলা প্রয়োজন। রতনপুরের ফারুকের চেয়ে ছাত্রলীগের ফারুক তিন-চার ইঞ্চি খাটো। আমার চেয়ে প্রায় আট-দশ ইঞ্চি। ফারুকের উচ্চতা বড় জোর পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি। এত বেঁটে খাটো ছেলেটি মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার পাশে ছায়ার মতো ঘুরেছে। কখনও হার মানেনি। অভিযোগ করেনি। ক্লান্ত হয়নি। ‘আর পারি না’—এমন কোন উক্তি কখনও করেনি।
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। সামনে চারান গ্রাম। চারানের কাছে আসতেই পূর্ব-পরিচিত বিশ্বস্ত সহকর্মী বাবুলের সাথে দেখা। বাবুল আমাদের দূর থেকে দেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কোথা থেকে আসছেন? আপনাদের কথাই ভাবছিলাম। জানেন, কালিহাতি যুদ্ধের পর সেখানে পালিয়ে-আসা আর্টিলারির এক সিপাই সত্তরটা হাতবোমা ও চারটি রাইফেল এই গ্রামে লুকিয়ে রেখেছে। সে এ গ্রামেরই জামাই। হাতবোমা ও রাইফেল আমাদের দিতে অস্বীকার করছে। এখন কী করা যায় আপনি ঠিক করুন। শুনলাম, আপনি নাকি বাঘের বাড়ীর দিকে মুক্তি বাহিনী গঠন করেছেন? আমি মুক্তি বাহিনীতে যাব। আমাকে কিন্তু নিতেই হবে।”
এক নিশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে বাবুল শান্ত হলো। আমরা আরও কিছুটা এগিয়ে একটি আম গাছের ছায়ায় বসলাম। তখন আমার মনে দু’টি বিষয় আলোড়িত হচ্ছিল। প্রথমতঃ কয়েক মিনিট আগে ছেড়ে আসা ফারুকের কথা। অন্যটি বাবুলের পরিবেশিত খবরের প্রতিক্রিয়া। বাবুলকে কী বলব, আর ঐ হাতবোমা ও রাইফেল সম্পর্কেই বা কী করব? প্রায় আধঘন্টা গাছের নিচে চুপচাপ বসে আছি। সাথী দুজনও নির্বিকার। ইতোমধ্যে ঐ গ্রামের সাত-আটজন যুবক ও বয়স্ক লোক আমাদের পাশে এসে জড়ো হয়েছেন। তারাও তেমন জোরে বলছেন না। কারণ আমি মাথা নিচু করে গম্ভীর হয়ে বসেছিলাম। উঠতে যেয়ে আশেপাশের লোকজনদের দেখে আবার বসলাম। সবার সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পর বুঝতে পারলাম এঁরা সবাই আমাদের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। এদের মধ্যে আবার দু’তিনজন পরিচিত ও আস্থাভাজন সহকর্মীও আছে।
বাবুলের দেওয়া খবর এঁরাও সমর্থন করলেন। এঁরা এ ব্যাপারে কিছু একটা করতে অনুরোধ করলেন। তাই মিলিটারি সিপাইয়ের খোঁজে যাওয়াই সমীচীন মনে করে আমরা সবাই তার সাথে দেখা করতে গেলাম। তার সাথে কাদের সিদ্দিকী দেখা করতে এসেছে, এ খবর ভদ্রলোককে জানান হলো। কিন্তু সে বেরিয়ে আসতে বা আমাদের সাথে কথা বলতে অস্বীকার করলো। আমাদের সাথে গ্রামের দু’একজন অত্যন্ত সম্মানী লোক ছিলেন। তাঁদের কথায় বাড়ীর মালিক তার জামাইকে আমার সাথে কথা বলতে পরামর্শ দেন। কথা না-বলা যে মোটেই সমীচীন হবে না,
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩

তাও জামাইকে তিনি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিলেন।
একরকম বাধ্য হয়ে, জামাই ভদ্রলোক বাড়ীর বাইরে এলে, তার সাথে খুবই ভদ্রভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলাম। এবং তার কী কর্তব্য তাও বুঝিয়ে বললাম।
১৯ এপ্রিল ভদ্রলোক সত্যিই কালিহাতির যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে সে শুধু বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকেই দেখেনি, আমাকেও দেখেছে। তাই আমার কথায় সে কিছুটা হতভম্ব ও অবাক হয়। সে মুখ ব্যাদান করে বলল, “আপনি বিশ্বাস করুন, আমার কাছে কোন অস্ত্র-শস্ত্র নেই। আমি কালিহাতি থেকে কোন কিছু আনিনি। শুধু প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি।” ভদ্রলোক পালিয়ে আসার কাহিনীর বর্ণনার মধ্যে প্রচুর জড়তা। তাই তাকে কালিহাতি যুদ্ধ কিভাবে সংঘটিত হয়েছিল, তা বর্ণনা করতে বললাম। আর সেইবা কিভাবে, কোথা দিয়ে পালিয়ে এসেছে
আমার অনুরোধ ও মৃদু চাপের মুখে সে কালিহাতি যুদ্ধের বর্ণনা ও চারান গ্রামে তার পালিয়ে আসার কাহিনী পর পর তিনবার বর্ণনা করলো। একই কাহিনী তিনবার বর্ণনার সময়, তার কথার মধ্যে বেশ অসামঞ্জস্য ধরা পড়ল। এতে গ্রামের লোকজন জামাই ভদ্রলোকের উপর খুবই বিরক্ত হন এবং যুবক ও মুরুব্বিরা তাকে মিথ্যুক বলে অভিহিত করেন। আমি নানাভাবে, নানা কৌশলে, একসময় ভদ্রলোককে স্বীকার করতে বাধ্য করি যে তার কাছে বেশ কয়েকশ’ গুলি এবং চারটি রাইফেল আছে এবং সে তক্ষুনি সেগুলো আমাদের দিয়ে দিতে তৈরি। এতে গ্রামের লোকেরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হন। “এই সিপাই ব্যাটা মিথ্যাবাদী ও চোর। ও প্রথমে বলেছে ওর কাছে কিছুই নেই। এখন বলছে কয়েকশ’ গুলি ও চারটি রাইফেল আছে। ওর কাছে বোমাও আছে। ও সুযোগ পেলে সেগুলো দিয়ে ডাকাতি করবে। তাই মিথ্যা কথা বলছে।” দু’একজন মুরব্বি আমাকে বললেন, “দেখুন, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। ওর কাছে হাতবোমাও আছে। সেগুলোও নিয়ে নিবেন। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, ব্যাটা না দিয়ে যাবে কোথায়?”
বাড়ীতে তখন প্রায় শ’ ছয়েক লোক সমবেত হয়েছেন। এমন সময় ঐ গ্রামের আরেকজন জামাই, নবী নেওয়াজ নামে এক বয়সী ও সুদর্শন ভদ্রলোক সেখানে এলেন। সে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ই. এম. ই-র সুবেদার। তাঁকে দেখা মাত্রই সিপাই ভদ্রলোক স্যালুট করলো। কারণ আর্মীতে সিপাই আর সুবেদারের মাঝে সাতটি স্তরের ব্যবধান। সিপাই থেকে সাতটি প্রমোশন পেলে তবেই সুবেদার হওয়া সম্ভব। আর সাতটি প্রমোশন পেতে ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ কম করে চব্বিশ-পঁচিশ বছর সময়ের প্রয়োজন। তাই বোঝা যায়, একজন সিপাইয়ের সামনে সুবেদার কত বড় ঊর্ধ্বতন কর্তা। নবী নেওয়াজ আসাতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলো। ভদ্রলোক এসে কথাবার্তা শুনে এবং গ্রামের মুরব্বিদের মনোভাব বুঝে সিপাই-ভদ্রলোকটিকে সামান্য দূরে নিয়ে নিভৃতে কিছু কথাবার্তা বলেন। তারপর আবার আলাদাভাবে আমার সাথে আলোচনা করে সবার মধ্যে গিয়ে সিপাই ভদ্রলোকটির পক্ষ থেকে বললেন, “রাইফেল এবং গোলাগুলি এক্ষুণি সিদ্দিকী সাহেবের হাতে তুলে দিচ্ছি। বাকি জিনিস যা-ই আছে, দু’দিন পর আমি
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪

নিজে সিদ্দিকী সাহেব যেখানে বলবেন, সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসব।” নবী নেওয়াজের প্রস্তাব আমি মেনে নিলাম। গ্রামবাসীরাও বেশ সন্তোষ প্রকাশ করলেন। সিপাই ভদ্রলোকটি বাড়ীর পিছনের জঙ্গলে পুঁতে রাখা চারটি রাইফেল এবং তিনশ’ পঞ্চাশটি রাউন্ড গুলি তুলে এনে নবী নেওয়াজের হাতে দিল। নবী নেওয়াজ গুলি ও রাইফেলগুলো আমার হাতে অর্পণ করলেন।
আমি খুব ক্লান্ত ও অবসন্ন ছিলাম। তাছাড়া সেই গাছের নিচে বসে-থাকা সময় থেকে হাতে রাইফেল ও গোলাগুলি আসা পর্যন্ত এই দেড়-দু’ঘন্টা স্থানীয় লোকেরা আমার প্রতি যে আস্থা ও বিশ্বাসের পরিচয় দিয়েছেন, তার প্রতি সম্মান জানানো প্রয়োজন বলে চিন্তা করছিলাম। তাই এখানেই আপাততঃ রেখে যাওয়া স্থির করলাম। তবে কার বা কাদের কাছে অস্ত্রগুলো রেখে যাব, তা নিজে উল্লেখ করুক, এটাই আমি চাইছিলাম। আমি শুধু বললাম, “কার বা কাদের কাছে রাখলে এগুলো নিরাপদে থাকবে এবং সময়মতো পাওয়া যাবে।” তখন ওখানকার কয়েকজন মিলে ভেবে চিন্তে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেন। তাদের কাছে হাতিয়ারগুলো জমা রেখে চলে এলাম। এখানে একটি মজার বিষয় লক্ষণীয় যে, আমি যাদের কাছে রাইফেলগুলো রাখার কথা মনে মনে ভাবছিলাম, গ্রামবাসীরাও ঠিক তাদের নামই উল্লেখ করেন।
নবী নেওয়াজ সম্পর্কে দু’একটা কথা বলা প্রাসঙ্গিক। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সুবেদার নবী নেওয়াজ পঁচিশে মার্চের পর নারায়ণগঞ্জের তার কর্মস্থল থেকে পালিয়ে এসে চারানে শ্বশুরালয়ে অবস্থান করছিল। কালিহাতি যুদ্ধে নাকি সে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিল কিন্তু ঐ যুদ্ধ যারা পরিচালনা করেছিলেন তারা তাকে কিভাবে নেবে এটা ভেবেই নাকি সে ১৯ এপ্রিল কালিহাতির যুদ্ধে অংশ নিতে যায়নি। তবে ১লা মে আমার সাথে প্রথম দেখা হবার পর সে একরকম। মনস্থির করে ফেলে যে, সম্ভব হলে সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবে। রাইফেলগুলো রেখে চলে যায়। সময় চারদিন পর সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে যে-কোন সময় মরিচাতে আমার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য নবী নেওয়াজকে অনুরোধ জানালাম এবং আশ্বস্ত করলাম মরিচায় গেলে তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হবে।
তবে চারদিন পর ঠিক কখন দেখা করব, তা নবী নেওয়াজকে বলে যাইনি। তাকে কোন নির্দিষ্ট সময় এই জন্য দিইনি যে, তাতে কোন বিপদ হলেও হতে পারে। নবী নেওয়াজের মনে কোন কুমতলব আছে কি-না, তা তখন পর্যন্ত জানতাম না। তাই সাবধানতার জন্য এরকম ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। নবী নেওয়াজ নির্দিষ্ট দিনে সাক্ষাৎ করার পর আমাদের আন্তরিকতায় এত উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয় যে, সে আর তার শ্বশুরালয়ে ফিরে যায়নি। সারাটা মুক্তিযুদ্ধে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে সে এক অনন্য ও অসাধারণ গৌরবাজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর প্রতীক’ পদক দিয়ে সম্মানিত করেছেন।
গোড়ান-সাটিয়াচরা যুদ্ধের পর গোড়ান গ্রাম হানাদাররা জ্বালিয়ে দেয়। সেখানে স্থানীয় ও বাইরে থেকে আসা একশ ছয় জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এতে শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ কেউ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫

বাদ পড়েনি। গোড়ান থেকে টাংগাইল পর্যন্ত চৌদ্দ মাইল রাস্তার দুইপাশে সর্বত্র হানাদার বাহিনী ধ্বংসলীলা চালিয়েছে।

অধিকৃত টাংগাইল
করটিয়া থেকে অবিরাম গুলি চালাতে চালাতে সন্ধ্যার একটু আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী টাংগাইল এসে উপস্থিত হয়। টাংগাইলের পশ্চিমে কাগমারী পুলের কাছে হানাদার বাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে ছাত্রলীগের বিশিষ্ট কর্মী ছানোয়ার হোসেন ও তার বাবা শহীদ হন। টাংগাইল শহরে প্রবেশের অনেক আগেই শহর প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়। রাস্তা-ঘাটগুলো খা-খা করতে থাকে। গাড়ি-ঘোড়া নেই, জনমানবও নেই। অধিকাংশ বাড়ীঘর ফাঁকা। কোনও ঘরের জানালা বন্ধ তো দরজা খোলা, আবার কোন কোন ঘরের দরজা-জানালা কোনটাই বন্ধ নেই, সব খোলা। মিলিটারির খবর শুনে যে যেভাবে পেরেছে, প্রাণভয়ে পালিয়েছে। ঘরের দরজা-জানালা পর্যন্ত বন্ধ করার সময় পায়নি। শহরের দোকানপাটের অবস্থাও একই রকম। দোকানদার বসে বেচাকেনা করছেন, হঠাৎ মিলিটারি এসে পড়ার কথা শুনে, ডাইনে-বাঁয়ে না তাকিয়ে, দোকানপাট ফেলে দে ছুট। শহরের রাস্তা-ঘাটে গাড়ি ঘোড়া, লোকজন তো দূরের কথা, কুকুর পর্যন্ত নেই। সমগ্র টাংগাইল শহরে একটা থমথমে ভাব। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই, যেন একটা ভুতুড়ে শহর। এ অবস্থায় বর্বর হানাদার বাহিনী হঠাৎ শহরে ঢুকে থমকে দাঁড়ায়, ঘাবড়ে যায়। কিন্তু তা কিছুক্ষণের জন্য মাত্র।
সন্ধ্যার একটু আগে শহরে ঢুকেই তারা যে দু’একজন লোককে পেয়েছে, ধরে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছে মুক্তি বাহিনী কোথায়? বেঙ্গল রেজিমেন্ট কোথায়? কোনদিকে গেছে? মুক্তি বাহিনীকে কারা পরিচালনা করছে? হানাদার বাহিনী বিশেষভাবে লতিফ সিদ্দিকী, বদিউজ্জামান খান ও খোন্দকার আসাদুজ্জামানের বাড়ীর খোঁজ-খবর নেয়। এই তিনটি বাড়ীই তখন টাংগাইল শহরের শতকরা নব্বইজন মানুষের পরিচিত।
হানাদার বাহিনী টাংগাইল শহরে প্রবেশ করে তাদের দোসরদের কাছ থেকে খবর নিয়ে প্রথমে বদিউজ্জামান সাহেবের বাড়ী ডিনামাইটের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়। আরেকদল এসে আমাদের বাড়ীতে আগুন লাগায়। বড়ভাই মুক্তি বাহিনী পরিচালনা করছিলেন বলে শুধু বাড়ী পুড়িয়ে তাদের মনের জ্বালা মেটেনি। বাড়ীর নানা জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বড় বড় খাদ ও গর্ত করে ফেলে। হানাদার বাহিনী সম্ভবত বাড়ী পুড়িয়ে ও বড় বড় গর্ত করে প্রতিবেশীদের এটাই বুঝাতে চেয়েছিল যে, দুষ্কৃতকারীদের এটাই স্বাভাবিক পরিণতি। আমাদের বাড়ীতে যখন আগুন দেওয়া হচ্ছিল, তখন প্রতিবেশীরা কেউ কেউ আগুন নেভাতে বালতি ও কলসভর্তি পানি নিয়ে দৌড়ে এসেছিলেন, মিলিটারিরা তাঁদের অকথ্য গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দেয়।
টাংগাইলের শতকরা নব্বইজন লোকই শহর ছেড়ে বাইরে চলে গেছেন। বিজু মিয়া, হেকিম হাবিবুর রহমান, আশরাফ মীর্জা, পটু হাফেজ, ভাদু দারোগা, সাইদ দারোগা, আজিজুল হক বাঁকা মিয়া-এরা সবাই মুসলিম লীগের সদস্য। আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে সুপ্রতিষ্ঠিতও বটে। এছাড়া জামাতে ইসলামীর অধ্যাপক খালেকসহ ঐ ধরনের কিছু লোক তখন শহরে অবস্থান
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬

করছিল। এদের প্রায় সবাইকে হাতের আঙুলে গোনা যায়।
শহর জনশূন্য দেখে হানাদার বাহিনীও কিছুটা হতভম্ব। কারণ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও কাজ করিয়ে নেবার লোকের অভাব তারা প্রকটভাবে অনুভব করে। এদিকে পাকিস্তান-সমর্থক নেতৃস্থানীয় কুখ্যাত লোকেরাও সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। তারা পাকিস্তানকে রক্ষা করবেই। এজন্য সমস্ত শক্তি দিয়ে সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করতে তারা প্রস্তুত।
৪ঠা এপ্রিল। বিন্দুবাসিনী স্কুল-মাঠে একটি ক্ষুদ্র সভার মাধ্যমে এরা একটি ‘শান্তি কমিটি’ গঠন করে। মুসলিম লীগের হেকিম হাবিবুর রহমান শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়। আহ্বায়ক হয় জামাতে ইসলামীর অধ্যাপক খালেক। আরও চল্লিশ-পঞ্চাশ জনকে নিয়ে টাংগাইল শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এই শান্তি কমিটিই পরবর্তীকালে যত অশান্তি সৃষ্টি করে, ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে অনেক প্রাণহানির কারণ হয়েছিল। এদের পরামর্শে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ফেলে-যাওয়া বিষয়-সম্পত্তি ও ঘরবাড়ী লুটতরাজ শুরু হয়ে যায়। তারা হানাদারদের পরামর্শ দেয়, যারা মুক্তি বাহিনী গঠন করেছে তারা পাকিস্তান ধ্বংস করতে চায়, ওদের সমূলে ধ্বংস করতে হবে। এ জেলায় মাত্র কয়েকজন লোককে খতম করলে পাক-শত্রুরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। সিদ্ধান্ত হলো, খোন্দকার আসাদুজ্জামান খান, লতিফ সিদ্দিকী এবং আওয়ামী লীগের সব এম. এন. এ. ও এম. পি. এ. এবং আওয়ামী লীগ কমিটির সব সদস্যের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। সিদ্ধান্তমতো এম. এন. এ, এম. পি. এ-দের সমস্ত সম্পত্তি—এমনকি অন্যান্য দলের যাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর মধ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সৈয়দ আবদুল মতিন, জাতীয় লীগের আল-মুজাহিদী, হবি মিয়া এবং আরও অনেকের নাম উল্লেখযোগ্য।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত

২রা মে, সন্ধ্যার কিছু পর আবার ছাতিহাটির বাড়ীতে এলাম। এবার বিপুল অভিজ্ঞতা ও মনোবল সঞ্চয় করেছি। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর বাবা বললেন, ‘বজ্র, আমাদের আর এখানে থাকা ঠিক হবে না। আমি মনে-মনে স্থির করেছি গ্রাম ছেড়ে গভীর জঙ্গলে চলে যাব।’ দু’তিন দিন ধরে আমিও এমনটাই ভাবছিলাম। তাই বাবার কথায় সাথে সাথে সায় দিলাম। আলোচনা করে ঠিক করা হলো গভীর জঙ্গলে আবু সাঈদ চৌধুরীর খামারবাড়ী শুরীরচালাই সবচাইতে নিরাপদ ও উপযুক্ত স্থান।
রাত গভীর, বৈঠকখানায় শুয়ে আছি। অথচ ঘুম আসছে না। পাশে ফারুক অঘোরে ঘুমুচ্ছে। আমি ভাবছি এখন কী করা যায়? ২০শে এপ্রিল থেকে ২রা মে—এই ক’দিন সারা জেলা অবিরাম ঘুরে মানুষের আগ্রহ ও সহযোগিতা দেখে আশান্বিত হয়েছি। কিন্তু পূর্ব-অভিজ্ঞতা না থাকায়, কোন ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে বারবার দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছিলাম। এত বড় মহাযজ্ঞে পা বাড়িয়ে সফলতা অর্জন করতে না পারলে, লাভের চাইতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। কারণ এটা একটা বাঘের গায়ে খোঁচা দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার মতো, অথচ ঝুঁকি নিয়ে জীবনকে বাজি রেখে এগিয়ে যেতে পারলে সামনে বিপুল সম্ভাবনা।
মনে হলো, সমমানসিকতা সম্পন্ন কয়েকজন সহকর্মীকে যদি একবার একত্রিত করা যায়, তাহলে হয়তো চিন্তাভাবনা বাস্তবায়িত হতেও পারে। ত্যাগী ও নিবেদিত প্রাণ কিছু মানুষের একবার সমন্বয় ঘটাতে পারলে, আমি না থাকলেও যুদ্ধ থেমে থাকবে না। চূড়ান্ত পরিণতির দিকে আপনা-আপনি এগিয়ে যাব—এরকম চিন্তা-ভাবনা, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই বিনিদ্র রজনী কাটালাম। ভোরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। আর বিলম্ব নয়, শুরু আমরা করবই। মহাযজ্ঞের সূচনাতেই যার সাহস, যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার উপর নির্দ্বিধায় নির্ভর করা যায়—এমন একটি নামও ঠিক করে ফেললাম। নামটি হলো, কামার্তীর সাইদুর রহমান। ৩রা মে সকালে সাইদুর রহমানকে একটি চিঠি লিখিঃ
প্রিয় সাইদুর,
আজ কিছুদিন হলো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়েছে এবং প্রিয় জেলা টাংগাইলে প্রবেশ করেছে। আমরা গোড়ান-সাটিয়াচরাতে এদের কিছুটা গতিরোধ করতে পারলেও উপযুক্ত জবাব দিতে পারিনি। পরবর্তীতে কালিহাতির যুদ্ধেও আমরা আশানুরূপ সফলতা অর্জন করতে পারিনি। যদিও দু’টি যুদ্ধেই ক্ষতির পরিমাণ আমাদের চাইতে শত্রুর অনেকগুণ বেশি, তবুও গোড়ান-সাটিয়াচরা ও কালিহাতির যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে- আমরা যতদিন জনগণকে একটি সুদৃঢ়, সুশৃঙ্খল সশস্ত্র
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮

বাহিনীতে রূপান্তরিত করতে না পার, ততদিন বিজয়ের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। রাজনীতিতে আসার পর তুমি ও আমি যার নেতৃত্বে ও ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করেছি, সেই বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকীও এখন আমাদের মধ্যে নেই। তিনি কতদিনে আবার আমাদের সাথে মিলিত হতে পারবেন তা আমার জানা নেই। গোড়ান-সাটিয়াচরা ও কালিহাতি যুদ্ধে লতিফ ভাইয়ের নেতৃত্ব ছিল আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় ভরসা। আমরা আজ সেই ভরসা থেকেও বঞ্চিত। উপরন্তু, যে নেতার নির্দেশে সারাদেশ আন্দোলিত ও উদ্বেলিত, মুক্তিপাগল বাঙালির নয়নের মণি, মাথার মুকুট, সর্বত্যাগে ব্ৰতী সেই প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু আজ কোথায়, তা আমাদের সঠিক জানা নেই। মাঝে মাঝে আকাশবাণী বঙ্গবন্ধু সুস্থ আছেন এবং মুজিবনগরে আছেন বলে প্রচার করলেও আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, তিনি পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী। তাই দেশ স্বাধীন না হলে আমরা যেমন আর সভ্যতার আলো দেখতে পাব না, মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকেও আর ফিরে পাব না। এমতাবস্থায় হাত গুটিয়ে বসে থাকা, কোন কিছু না করা অথবা সুখের সন্ধানে পালিয়ে বেড়ানোর মনোবৃত্তি আমার কাছে জঘন্য অপরাধ বলে মনে হচ্ছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কালবিলম্ব না করে আমরা মুক্তিবাহিনী গঠন শুরু করব। প্রথম অবস্থায় আমার কাছে আপাতত যে অস্ত্র আছে, তাই তাদের হাতে তুলে দেবো। পরবর্তীতে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব। আমার বিশ্বাস, অতীতে যেমন সব সময়, সকল সংগ্রামে তোমাকে সাথী হিসেবে পেয়েছি এবার এ মহাসংগ্রামেও পাব। পত্র পাওয়া মাত্র পাঁচ-ছয়জন সবল, সাহসী ও নিবেদিত প্রাণকর্মী নিয়ে চলে এসো।
তোমাদেরই,
কাদের ভাই
৩/৫/৭১

বিঃ দ্রঃ—আজ বিকেলে মধ্যেই আসতে হবে।

পত্রখানা পাশের বাড়ীর রাঙ্গাকে দিয়ে সাইদুরের কাছে পাঠিয়ে দিই। ছাতিহাটি থেকে কামার্তী সাইদুরদের বাড়ীর দূরত্ব পাঁচ মাইল। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে সাইদুরের হাতে চিঠি দিয়ে রাঙ্গা ফিরে আসে। সাইদুরের প্রতিক্রিয়া বলতে গিয়ে রাঙ্গা জানায়, “সাইদুর আপনার চিঠি পেয়ে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো আনন্দিত হয়েছে। সে ঘন্টা দু’য়েকের মধ্যেই ছয়-সাত জনকে নিয়ে আসছে।”

অস্ত্র উদ্ধার
সাইদুরের আশাতীত সাড়া দেবার সংবাদ পেয়ে তার জন্য গভীর আগ্রহে, আনন্দ চিত্তে অপেক্ষা করছি। এসময় একজন দেখা করতে এলো। ভদ্রলোককে আমি অল্প সময়ের জন্য দেখেছিলাম ১৯ এপ্রিল কালিহাতির যুদ্ধে। সেও আমাকে দেখেছিল। মনিরুল ইসলাম নামের এই লোকটি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে চাকুরি করত। যুদ্ধের শুরুতে অন্যান্যদের মতো সেও চাকরি ছেড়ে মাতৃভূমির মুক্তির জন্য অস্ত্র তুলে নেয়। কালিহাতির কস্তুরীপাড়ার অধিবাসী মনিরুল ইসলাম। মনিরুল ইসলামের সাথে কথাবার্তা বলে ফারুক আমাকে খবর দেয়। ভিতর বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসতেই মনিরুল ইসলাম স্যালুট
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৯
করে। মনির দেখতে কিছুটা বেঁটে খাটো, শ্যামলা, সুদর্শন। মনির আমাকে নিজের ভাইয়ের মতো জড়িয়ে ধরে। এই মনিরের অনুপ্রেরণা ’৭১ সালে আমার কর্মকাণ্ডের মোড় দ্রুততালে ঘুরিয়ে দেয়। মনির সাধারণ দেশপ্রেমিক নয়। তার আচরণ কিছুটা ভিন্ন ধরনের। সে খালি হাতে আসেনি। কোমরে জড়িয়ে একখানা গ্রেনেড নিয়ে এসেছে। জড়িয়ে ধরার সময় তার কোমরে একটা শক্ত জিনিসের স্পর্শ অনুভব করি। আমি ’৬৫ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে ছিলাম। তাই গ্রেনেডের স্পর্শ বুঝতে সময় লাগেনি।
কোলাকুলি শেষে মাটিতে বসতে যাব, এমন সময় মনির তার কোমরে জড়ানো গামছা খুলে গ্রেনেডখানা আমার সামনে রাখল। দু’জনের মাঝখানে তাজা গ্রেনেডখানা রেখে মনির বলল,
—আর এমনভাবে চলা যায় না। একটা কিছু করেন। দালালরা যেভাবে অত্যাচার শুরু করেছে, তা যদি আমরা মোকাবেলা করতে না পারি, তাহলে সাধারণ মানুষ আমাদের ক্ষমা করবে না। যুদ্ধ করতে পারি বা না পারি, মিলিটারিদের সাথে যদি নাও পারা যায়, দালালদের সাথে তো পারব। আর সহ্য হয় না। হুকুম দেন। আগে দালাল খতম করি। আমার কাছে শুধু একটা হাতবোমা নয়, আরও অস্ত্র আছে। আর একটা ভালো খবর নিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। এখন আপনি আমাদের ভরসা।
—এটা কী বলছেন? আমি হুকুম দেবার কে? আর হুকুমই বা লাগবে কেন?
—না, না, হুকুম লাগবে। কারণ লতিফ ভাই আমাদের সর্বাধিনায়ক ছিলেন। তিনি এখন নেই। তাঁর ছোট ভাই হিসেবে আপনি কাজে হাত দেবেন। কে না মানে, তা আমরা দেখব। দেখছেন, আমি এসেই আপনাকে স্যালুট করেছি। আপনাকে মনে-মনে সেনাপতি নির্বাচন করেই আমি এখানে এসেছি। আর দ্বিধা নয়। কী করব, কিভাবে শুরু করব, বলে দিন।
মুক্তিযুদ্ধের সারাটা সময় তার আনুগত্যে কিছুমাত্র চিড় ধরেনি। যদিও আমরা যখন ব্যাপকভাবে সুসংগঠিত ও যুদ্ধের তীব্রতা যখন প্রচণ্ড, তখন মনিরুল ইসলাম যুদ্ধক্ষেত্রে একটা ব্যর্থতার পরিচয় যেমন দিয়েছে, তেমনি আবার অনেক সফলতা অর্জন করেছে। সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা উজ্জ্বল। শুরুতেই তার চেষ্টা, ত্যাগ ও নিয়মানুবর্তিতা মুক্তিবাহিনী গঠনে আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। মনিরকে ঐ সময় না পেলে আমাকে হয়তো আরও অনেক বেগ পেতে হতো, সংগঠন এগিয়ে নেয়া আরও কঠিন হতো। এক্ষেত্রে মনিরুল ইসলাম অদ্বিতীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। টাংগাইলের আঠার হাজার মুক্তিযোদ্ধার সে অন্যতম প্রধান কৃতী-সংগঠক।
মনির আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে বহু সময় ধরে কথাবার্তা বলল। কিন্তু তার সব কথা শেষে, ঘুরে ফিরে ঐ একই কথাঃ আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা চলবে না। এখনই ট্রেনিং শুরু করতে হবে। একপর্যায়ে সে বলল, “কালিহাতি যুদ্ধের পর ছত্রভঙ্গ হয়ে-যাওয়া ই. পি. আর-রা অনেক অস্ত্র ফেলে গেছে। আমি খবর পেয়েছি, বেশ কয়েকটি রাইফেল ও একটা মেশিনগান কালিহাতির কুমারপাড়ার এক বাড়ীর পাশে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। অস্ত্রগুলো আমাদের উদ্ধার
পৃষ্ঠা নং ~ ৮০

করা উচিত।” এই ধরনের কথা হতে হতে সময় কেটে যায়। মনির সামনে রাখা গ্রেনেডখানা তুলে নিচ্ছে না। ফেরত নিতে বললে সে বলল, “এটা বাংলার মুক্তি আন্দোলনের জন্য আমার কমাণ্ডারকে উৎসর্গ করেছি। এটা আমি আর নিতে পারি না।”
প্রথমে হাতিয়ার উদ্ধার করতে যাওয়াই শ্রেয় মনে করি। সাইদুরদেরও আসার কথা। বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করে অবশেষে বেলা একটায় কাঠফাটা রোদ মাথায় করে মনির ও ফারুককে নিয়ে ছাতিহাটির বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়ি। বাবা-মাকে বলে যাই সাইদুররা এলে তাদের বলবেন, তারা যেন আগামীকাল মরিচা ফরেস্ট অফিসে আমার জন্য অপেক্ষা করে। আমরা বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সাইদুররা এসে উপস্থিত হয়। তারা আর কোথাও না গিয়ে রাতে আমাদের বাড়ীতেই থেকে যায়। আমরা বাড়ী থেকে বেরিয়ে প্রথমে কস্তুরীপাড়ায় আসি। সেখানে পনের-ষোল বছরের সুন্দর ছিপছিপে একটি ছেলের সঙ্গে দেখা হয়। সে ঐ গ্রামেরই এক গরিব ঘরের ছেলে, সামসুল হক। এই ছেলেটি ৩রা মে দুপুরের পর থেকে আর আমার সঙ্গ ছাড়েনি। সন্ধ্যার একটু পর কস্তুরীপাড়া থেকে যাত্রা করে আরও উত্তরে ভাবনদত্ত গ্রামে করটিয়া সাদৎ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সোহরাব স্যারের বাড়ীতে উপস্থিত হই। সেখানে আমাদের সাথে আরও তিনজন মিলিত হন। এরা হলেনঃ এক, করটিয়া সাদৎ কলেজের বি. এ. ক্লাসের ছাত্র শাজাহান। সে ছাত্র জীবনে ন্যাপ সমর্থিত ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য। দুই, কাগমারী কলেজের প্রাক্তন ভি. পি., ঘাটাইল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন খান। তিন, মামুনুর রশিদ। ইনি মোয়াজ্জেম হোসেনের নিকট আত্মীয়। মামুনুর রশিদ তৎকালীন সাহিত্যজগতে প্রবন্ধ, নাটক ও নাট্যাভিনয়ে এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার অধিকার ছিলেন। উনি ’৭১ সালের জুন মাসের পর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অবদান রাখেন। মামুনুর রশিদ পরবর্তী পর্যায়ে টাংগাইলের মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে স্বাধীন বাংলা বেতার ও আকাশবাণী থেকে তা নিয়মিত প্রচারের ব্যবস্থা করেন। ’৭১ সালের নভেম্বরের শেষে টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের উপর তার তিনখানা তথ্যবহুল বেতারনাট্য প্রচার শুরু হয়। দু’খানা বেতারনাট্য প্রচারের পর তৃতীয়টি কোন অদৃশ্য কালো হাতের কারসাজিতে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে প্রচার করা সম্ভব হয়নি। তবু মামুনুর রশিদ আকাশবাণী থেকে ঐ তৃতীয় বেতার নাট্যটি প্রচার করতে সক্ষম হন।
বেতার প্রচারে যারা বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিলেন তাঁদের কথা ছিলঃ বেতার নাট্যের মাধ্যমে সিদ্দিকীকে হীরো বানানো হচ্ছে। এতে কাদের সিদ্দিকী রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে সবার উপরে উঠে গেলে আর তাদের টেনে নিচে নামানো যাবে না। অতএব প্রচার বন্ধ কর। যাক, এ সম্পর্কে যত কম কথা বলা যায়, ততই ভালো।
মূল কথায় ফিরে আসা যাক। ভাবনদত্তে এসে মুক্তি বাহিনীর দল আরেকটু ভারি হলো। দলের মোট সদস্য-সংখ্যা দাঁড়াল সাত। ফারুকের বয়স কুড়ি-একুশের বেশি নয়। সামসুর ষোল-সতের
পৃষ্ঠা নং ~ ৮১

মনিরের তেইশ-চব্বিশ। শাজাহানের বয়স ছাব্বিশ। মোয়াজ্জেম হোসেন খান আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক, সম্ভবত ত্রিশ পেরিয়ে গেছেন। মামুনুর রশিদের বয়স চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয়, আর আমি তখন চব্বিশ-সাড়ে চব্বিশ বছরের যুবক। তবুও কেন জানি না শিক্ষা-দীক্ষায়, গুণ-গরিমায় অতি নগণ্য আমার উপরই সকলের প্রত্যাশা।
ভাবনদত্ত থেকে রাত সাড়ে আটটায় রওনা হবার সময় মোয়াজ্জেম হোসেন খান বললেন, “দেখুন, আমরা আপনাদের সাথে যাব। অস্ত্রের সংবাদ আমরাও পেয়েছি। অস্ত্র উদ্ধার করা আমাদের সকলের কর্তব্য। তবে অস্ত্র উদ্ধার করে আমরা তিনজন আবার ফিরে আসব। আপনারা অস্ত্র নিয়ে চলে যাবেন। পরে দরকার পড়লে খবর দিলেই আমরা গিয়ে হাজির হব। এখন কিভাবে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করতে হবে, তা আপনারাই বলবেন। আপনারা যেভাবে বলবেন, আমরা ঠিক সেভাবেই কাজ করব।”
ভাবনদত্ত থেকে কালিহাতির দূরত্ব তিনমাইল। তবে পথ বড় দুর্গম। সোজা যাবার তেমন কোন রাস্তা নেই। উত্তরে ঘুরে গেলে পথের দূরত্ব বেড়ে দাঁড়াবে সাত মাইল। আর দক্ষিণ দিক গেলে তাও পাঁচ মাইলের কম হবে না। তবে দক্ষিণ দিকে যাওয়ায় বিপদ বেশি, রাস্তা মোটেই নিরাপদ নয়। তাই সোজাসুজি দুর্গম পথে যাওয়াই স্থির হয়।
ভাবনদত্ত সোজা পশ্চিমে কালিহাতি। সামনের প্রায় সমস্ত পথটাই ‘বিলাভূমি’ মাঝে কিছুটা শস্যক্ষেত, তাতেও প্রায় হাঁটুপানি। অনেক ভেবে চিন্তে সোজাসুজি বিল পার হওয়াই স্থির করি। বিলে পানির পরিমাণ কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও কোমর, আবার কোথাও কোথাও বুক-সমান। সেদিন কিন্তু ঐভাবেই কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে, কোথাও কোথাও বুক-পানি ঠেলে আমরা ঐ তিন মাইল পথ পাড়ি দিই। তিন মাইল পথের প্রায় আধ মাইল বিস্তৃত বিলাভূমি পার হতেই আমাদের সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছিল। অবশ্য ’৭১ সালে কোন বাঁধাই মুক্তিযোদ্ধাদের গতিরোধ করতে পারেনি। এ বাঁধাও আমরা অতিক্রম করি। তবে এই বিলাভূমিতে ফারুক ও মামুনুর রশিদকে নিয়ে কিছুটা বিপদ হয়েছিল। যাবার সময় অবশ্য সমস্যাটা তেমন কঠিন হয়ে দেখা দেয়নি। তবে ফেরার সময় তা চরম আকার ধারণ করে।
আমরা এগিয়ে চলেছি লুকিয়ে-রাখা অস্ত্র পাবার আশায়। এর আগেই মনির ও মোয়াজ্জেম হোসেন খান উভয়ে মোটামুটি একটা অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। কোথা থেকে কাকে নিলে অস্ত্রগুলো সহজে পাওয়া যেতে পারে, এরকম একটা পরিকল্পনা করেছিলেন মাত্র। এর বেশি এগুতে পারেননি। কারণ ১৯ এপ্রিলের পর কালিহাতি একটা বিপজ্জনক স্থানে পরিণত হয়েছে। কালিহাতি পুলের কাছাকাছি পৌঁছানো অসম্ভব। অথচ পুলের গা ঘেঁষে কুমারপাড়া, আর অমূল্য সম্পদ অস্ত্র-শস্ত্র ওখানেই। কুমারপাড়ায় যাওয়াটা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে ভবিষ্যতের কর্মসূচিও বাস্তবায়িত করা যাবে না। তাই ওখানে যেতেই হবে এবং অস্ত্র আনতেই হবে। সেদিন সমস্ত ঝুঁকি উপেক্ষা করে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম বলে পরবর্তীতে আমরা একটা ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮২

কুমারপাড়ার কাছাকাছি এসে মনির আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে মোয়াজ্জেম হোসেন খানকে নিয়ে একটি বাড়ীতে গেল। তাদের কাছে খবর ছিল, ঐ বাড়ীর একজন কুমারপাড়ার লুকানো অস্ত্রের সঠিক খবর জানেন। লোকটিকে ডাকতেই এক অভাবনীয় কাণ্ড বেঁধে গেল। লোকটি কিছুতেই ঘর থেকে বেরুতে রাজী নন। তাঁর স্ত্রী ঘরের ভিতর থেকে নিচু গলায় বললেন, ‘দেহেন, আমাগোর উনি কিছুই জানে না। আপনারা আমাগোর ধর্মের ভাই।’ কথাগুলো শুনে বাড়ীর ভেতরে চলে গেলাম এবং মহিলাকে নানাভাবে অভয় দিয়ে তার স্বামীকে বের করে দিতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু কে শুনে কার কথা! মহিলাটি কিছুতেই তার স্বামীকে ছাড়বে না। শক্তি প্রয়োগও যে এখানে অর্থহীন, বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারলাম। বিল পার হয়ে আসতে আমাদের যত-না কষ্ট হয়েছিল, বাড়ী থেকে লোকটিকে বের করতে তার চাইতে অনেক বেশি কষ্ট সেদিন স্বীকার করতে হয়েছিল। প্রায় ঘন্টা খানেক অনুনয়-বিননয় করে মুক্তিযোদ্ধারা যখন একেবারে ক্লান্ত, তখন একটি বাচ্চা ছেলের সহযোগিতায় ব্যর্থ-প্রায় আমরা সাফল্য অর্জন করলাম। ছেলেটি অনেকক্ষণ ঘরের ভিতর থেকে বাইরে উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখছিল। প্রায় ঘন্টা খানেক মুক্তিযোদ্ধারা নানাভাবে অনুরোধ, কাকুতি-মিনতি করায় গৃহকর্তী যখন কিছুটা নরম হয়ে আসছিলেন, ঠিক সেই সময় ছেলেটি এক ফাঁকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে উঠানে দাঁড়ায়। তার বয়স নয়-দশ বছরের বেশি হবে না। সে বাড়ীর উঠানে দাঁড়িয়ে সাতজন লোককে বারবার ঘুরে ফিরে দেখে। আমার ও মনিরের কাঁধে তখন দু’খানা গান ঝুলানো ছিল। সবশেষে ছেলেটি আমার কাছে এসে কাঁধে ঝুলানো গানটি হাতিয়ে দেখতে থাকে। সে একবার ব্রাটাগানটি দেখে, আবার ঘুরে ফিরে আমাকে দেখে। এমনি করে প্রায় তিন-চার মিনিট চক্কর মেরে ছেলেটি চিৎকার করে বলে উঠে, ‘মা গো, বাবা গো, এগোরে আমি চিনি। এই যে ইনি আমাগোরে এম. পি সাবের ভাই। আমাগো কোন ডর নাই।” এ যেন আল্লাহর পরম আশীর্বাদ। বাড়ীর কর্ত্রী বেরিয়ে এলেন। সাথে সাথে কর্তাও। বাড়ীর কর্তা খুব গরিব। দিন মজুরের কাজ করে খান। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে এক ঘন্টা ধরে অন্ততঃ পক্ষে পঞ্চাশ বার নানাভাবে নিজেদের পরিচয় দিয়েছে। আমি নিজে বড়ভাইয়ের নাম উল্লেখ করেছি। নিজের কথাও বলেছি। ঐ মহিলাকে ‘মা’ পর্যন্ত ডেকেছি। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। অথচ ছেলেটির একবার, ‘মা গো’ একবার ‘বাবা গো’ ডাকে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। ছেলেটি যখন বলল, “এগোরে আমি চিনি। ইনি এম. পি সাবের ভাই। আমাগোর কোন ডর নাই” তখন তাঁরা যেন মুক্তি বাহিনীর পরম আত্মীয় হয়ে গেলেন। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব নয়। কর্ত্রী কর্তাকে ঠেলা দিলেন, “তাড়াতাড়ি যাও। আর দেরি কইর না। যা আছে, সব ঠিকঠাক মতো বাইর কইরা দেও। কোনকিছু জানি ভুল না অয়।”
গৃহ কর্তার সে কী উৎসাহ! তিনি আগে-আগে খুব সন্তর্পণে চললেন। তার পিছনে আমি ও মনির, আমাদের পিছনে অন্যান্যরা। কারও গায়ে কোন জামা-কাপড় নেই। জামা-কাপড় থাকলে শত্রুর নজর পড়ার ভয়, তাই এ ব্যবস্থা। পুলের প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে একটি বাড়ীর পিছনে লোকটি থামলেন। বাড়ীর পিছনে অনেকগুলো মাটির বড় বড় ‘চাড়ি’র মাঝখান থেকে একটা
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৩

‘চাড়ি’ আস্তে করে উঠালেন। একদম নির্ভুল নিশানা। চাড়ির নিচে ম্যাগাজিন লাগানো একটি বৃটিশ এল. এম. জি.। চাড়ি উঁচু করতেই আমি এল. এম. জি. টা ধরলাম। আস্তে আস্তে। ম্যাগাজিন খুলে ককেন হ্যান্ডেল ধরে, সন্তর্পণে ট্রিগার টিপে ব্রিজ ব্লক গ্রুপ যথাস্থানে স্থাপন করে গানটি নিয়ে সেখান থেকে সরে এলাম। এল. এম. জি. কাঁধে যখন আস্তে আস্তে সরে আসছি, তখন লোকটি পাশের আরেকখানা বড় চাড়ি সরিয়ে সেখান থেকে দু’খানা গুলিভর্তি বাক্স এবং আরেকটি চাড়ি সরিয়ে এল. এম. জি. ম্যাগাজিনের একখানা বাক্স বের করলেন। তারপর ওখান থেকে সামান্য একটু সরে অন্য একটি বাড়ীর মাচার উপর থেকে চারটি রাইফেল পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে আমাদের হাতে তুলে দিলেন। বাড়ীর আরেক জায়গা থেকে একটি গুলিভর্তি কলসি বের করে আনলেন। সবশেষে একটি সাদা পুঁটলি এনে আমার হাতে দিলেন। পুঁটলিটা প্রচণ্ড ভারি। হাতে নিয়েই বুঝতে পারলাম ভিতরে কী আছে। পোঁটলায় সতেরটা হাতবোমা।
অস্ত্র ও গোলাবারুদের পরিমাণ দাঁড়াল একটা এল. এম. জি. চারটা রাইফেল, দু’বাক্স ও এক কলসি ৩০৩ গুলি, গুলিভর্তি বারোটা ম্যাগাজিনের একটি বাক্সসহ সতেরটি গ্রেনেড। এই অস্ত্র ও গুলি বের করে দিতে লোকটির চার-পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। ছয়-সাত মিনিটের মধ্যে আমরা গন্তব্যস্থলের দিকে এগুতে শুরু করলাম। নিরাপদে তার বাড়ীতে পৌঁছে দেয়ায় লোকটি ও তার স্ত্রী কৃতজ্ঞতায় ভেঙে পড়েন। প্রথম অবস্থায় লোকটিকে বের করতে মুক্তিযোদ্ধাদের যতই কষ্ট হোক, আমরা যতই যন্ত্রণা পাই না কেন, কাজের সময় তার ক্ষিপ্রতা দেখে আমাদের অন্তর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে উঠেছিল।
অস্ত্রগুলো উদ্ধারে সাহায্য করায় আমরা কৃতজ্ঞ। আর কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ আমি লোকটির হাতে যখন একটা একশ’ টাকার নোট তুলে দিতে যাই, তখন লোকটি ও তার স্ত্রী অত্যন্ত ঘৃণাভরে টাকাটা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “দেহেন, এহন ঐ টাকা আপনাগোরে বেশি দরকার আর আমি যে আপনাগোরে সাহায্য করছি তা টাকার জন্য না। আমি নিজের ইচ্ছায় করছি” একথা শুনে আমি একেবারে হতবাক! স্তম্ভিত!
লোকটির আচরণে আমি নতুন শিক্ষা পেলাম, মানুষকে মর্যাদা দিতে শিখলাম। মুক্তিবাহিনী পরে ঐ লোকটিকে নানাভাবে অনেক টাকা-পয়সা, ঔষধ ও জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করেছে। লোকটিও অত্যন্ত আগ্রহভরে সে সাহায্য গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ঐদিন তারা এক কপর্দকও গ্রহণ করতে রাজী হননি।
আবার পথ চলা। হাতে এল. এম. জি., রাইফেল ও গ্রেনেড। ফেরার পথে আবার সেই বিলাভূমি। বিলাভূমির যেখানে আমার বুক-পানি, বেঁটে খাটো ফারুক ও মামুনুর রশিদের সেখানে গলা সমান। কোন কোন জায়গায় তা বেড়ে ওদের নাক পর্যন্ত উঠে যায়। যাবার সময় যদিও সহজেই যাওয়া গেছে, কিন্তু ফেরার সময় মামুনুর রশিদের মাথায় আধমণ ওজনের গুলিভর্তি মাটির কলসি। আর এটাই তার মরণ ফাঁদ হয়ে দাঁড়াল। ফারুকের মাথায়ও আধমণের মতো গুলিভর্তি কাঠের বাক্স। যাবার সময় বিলের যেখানে ওদের নাক অবধি পানি উঠেছিল, ফেরার সময় সেখানে
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৪

ওরা তলিয়ে যাচ্ছিল। কোন ক্রমেই আর থই পাচ্ছিল না। যাবার সময় বিলের নরম মাটিতে যেখানে ওদের পা দু’তিন ইঞ্চি গেড়েছে, সেখানে ফেরবার পথে বোঝার ভারে আরও অতিরিক্ত দু’তিন ইঞ্চি গাড়ছে। ফলে ওরা সামাল দিতে পারছে না। এমনি এক জায়গায় মামুনুর রশিদ যখন হাবুডুবু খাচ্ছিল, আর থ্রু থ্রু করে মুখ থেকে পানি বার করছিল, তখন ব্যাপারটা আমার চোখে পড়ে। তাড়াতাড়ি পানির নিচ থেকে মামুনুর রশিদকে টেনে তুলি। এতে আমিও অনেকটা গেড়ে যাই। ওদিকে ফারুকের অবস্থাও তথৈবচ। ফারুককে মোয়াজ্জেম হোসেন খান উদ্ধার করেন। এভাবে গুলির বাক্স নিয়ে তাদের পক্ষে কোনক্রমেই যে বিল পাড়ি দেওয়া আর সম্ভব নয়, এটা বুঝে গেলাম। আর সে সময় উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সাতজনের পক্ষে বহন করা খুবই কঠিন। তাই অতিরিক্ত জিনিস নিয়ে কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারছে না।
এমনি অবস্থায়, উপায়ন্তর না দেখে ফারুকের গুলির বাক্স ও মামুনুর রশিদের মাথার গুলিভর্তি মাটির কলসি পানিতে নামিয়ে দেওয়া স্থির হলো। ঐ বিশেষ মুহূর্তে আমাদের সবারই মনে হয়েছিল পাত্রগুলো পানিতে ডুবিয়ে ধরলে তাতে ওজন কমে যাবে। আর গুলিরও তেমন ক্ষতি হবে না। সত্যিই যখন গুলির বাক্স ও মাটির কলসি পানিতে ডুবিয়ে ধরা হলো, তখন ওরা আর তলিয়ে যায়নি, নাক উঁচু করে কোনমতে বিলটি পার হতে সক্ষম হলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৫

প্রথম শিবির

ভাবনদত্তে রাত কাটিয়ে খুব ভোরে চারজনে বেরিয়ে পড়লাম। কস্তুরী পাড়ায় একটি গাছের নীচে বসে রাতের উদ্ধার-করা এল. এম. জি. -টা মাজা-ঘষা করে, যুদ্ধ-উপযোগী করে নিলাম। কস্তুরী পাড়ায় দুপুরের খাবার সেরে আবার সেই পথ চলা। চলতে চলতে এক সময় সাইদুরের কথা মনে পড়ল। তাই কিছুদূর এগুনোর পর কস্তুরী পাড়ার সামসুকে সাইদুরের খোঁজ নিতে ছাতিহাটি পাঠিয়ে মরিচাতে মিলিত হতে বললাম। সামসু একটি সাইকেলে ছাতিহাটি চলে গেল, আমি পায়ে হেঁটে সঙ্গীদের নিয়ে মরিচার দিকে এগুলাম। মরিচার কাছাকাছি পৌঁছলে সামসু সেখানে এসে আবার মিলিত হলো। সে জানালো “সাইদুররা সকাল থেকে মরিচাতেই অপেক্ষা করছে।”
মরিচায় পাঁচজনের একটি দলসহ সাইদুরকে দেখতে পেলাম। সাইদুরকে জড়িয়ে ধরে বাড়ীর খোঁজ-খবর করলাম। পরে সুস্থ হয়ে বসে ধীরে ধীরে সাইদুরকে পরিকল্পনার কথা জানালাম। সাইদুরের সঙ্গে তার ছোট ভাই আব্দুস সাত্তারকে দেখে বললাম, “শেষ পর্যন্ত ছোট ভাইটাকেও নিয়ে এলি।” উত্তরে সাইদুর বলল, “হ্যাঁ নিয়ে এলাম। দেখা যাক, যদি না পারে তখন একটা ব্যবস্থা করা যাবে। এখন তো কাজ চলুক।” আমরা এখানে এক দিন ও রাত কাটাই। বলতে গেলে এখানেই আমার নেতৃত্বে যুদ্ধের মূল পরিকল্পনার খসড়া প্রণীত হয়। ৩রা এপ্রিল গোড়ান-সাটিয়াচরায় ছত্রভঙ্গ অবস্থা, কালিহাতিতে পশ্চাদপসরণ ইত্যাদি ঘটনা আমাকে খুবই মর্মাহত করেছিল, তবে ভেঙে পড়িনি। হাল ছেড়ে দেইনি। বসেও থাকিনি। সাধ্যমতো তৎপরতা চালিয়ে গেছি। একই সাথে ৩রা মে কালিহাতি থেকে কিছু অস্ত্র সংগ্রহ হওয়াকে আমি শুভ ইঙ্গিত বলে মনে করেছিলাম। সন্ধ্যায় খাওয়া-দাওয়া শেষে ফারুক, মনির, সাইদুর এবং বাঘের বাড়ীর আবু বকরকে নিয়ে একটা আলোচনায় বসলাম। অনেক আলাপ আলোচনার পর ঠিক হলোঃ বাঘের বাড়ীর আশেপাশে একটা ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হবে। পনের দিন ট্রেনিং দিয়ে কয়েকটি দলে ভাগ করে মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের এলাকার সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এদের প্রধান কাজ হবেঃ আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং চোর-ডাকাত ও লুটতরাজকারীদের দমন করা।
দ্বিতীয় পর্যায়ে লোক সংগ্রহ করে ট্রেনিং দিয়ে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। স্থির হলো, ট্রেনিং শুরু হবে সাতদিনের মধ্যে। ত্রিশজন সংগ্রহ করবে বাঘের বাড়ীর আবু বকর, কুড়িজন মনিরুল ইসলাম, কুড়িজনকে আমি এবং বড়চওনার ইদ্রিস ও সখীপুরের শওকত মোমেন শাজাহান পনেরজন সংগ্রহ করবে। সখীপুরের শাজাহানকে পাওয়া না গেলে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আস্থাশীল অন্য কোন লোককে ঐ অনুরোধ করা হবে।
সর্বশেষ সিদ্ধান্তঃ সশস্ত্র সহকর্মীদের নিয়ে প্রথমে আমাকে পাহাড়ি এলাকায় চিহ্নিত
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৬

দালালদের শাস্তি বিধান করতে হবে। তিন দিনের মধ্যে এই এলাকায় চিহ্নিত দালালদের মধ্যে কমপক্ষে চারজনকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। এরপর বাঘের বাড়ীর আশে পাশে আবু বকরের নির্ধারিত স্থানে এসে মিলিত হতে হবে। আলোচনায় আরেকটি বিষয় গুরুত্ব লাভ করে, তা হলোঃ পাহাড়ি এলাকার দালাল আবদুল মান্নান তালুকদার ও কয়েকজন অবাঙালি উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানী বিড়ি পাতার ব্যবসায়ী। খবর পাওয়া যাচ্ছিল, তাদের কাছে কয়েকটা রাইফেলসহ বেশ কয়েকটি রিভলবার ও পিস্তল আছে এবং এরা হয়তো পাক সেনাদের সাথে সহযোগিতা করে এই এলাকার মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে পারে। দুর্দান্ত দালাল মান্নান তালুকদারের বাড়ী না অবাঙালি বিড়ি পাতার ব্যবসায়ীদের ক্যাম্প, কোনখানে প্রথম আঘাত করা হবে তা নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে আমি বললাম, “আমরা অন্ততঃপক্ষে একটা ব্যাপারে ঐকমত্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি যে, বিড়ি পাতার অবাঙালি ব্যবসায়ী ও আবদুল মান্নান তালুকদারকে উৎখাত করতেই হবে। এর মধ্যে কাকে বা কাদের আগে ধরতে হবে, কিভাবে ধরতে হবে, আমার উপরে থাক। আমি যথাসময়ে এটা স্থির করব।”
৪ঠা মে, ১৯৭১ সাল। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম মুক্তি বাহিনী শিবিরে রাত্রি যাপন। শিবির বলছি এই জন্য যে, ঐ দিন আমরা দশজন একত্রিত হয়ে মরিচাতে শিবির স্থাপন করি। সামরিক ছাউনিতে যেভাবে পালাক্রমে পাহারা রেখে রাত্রি যাপন হয়, ঐদিন থেকে আমরাও সেইভাবে রাত্রি যাপনের সূত্রপাত করি। রাতে পর্যায়ক্রমে দু’জন করে ডিউটি করবে, এটা ঠিক করে ঘুমোতে যাই। বাঘের বাড়ীর আবু বকরও আর রাতে বাড়ী ফিরে গেল না। কারণ রাস্তা অতিদুর্গম, দূরুত্বও প্রায় দু’মাইল। রাতে খাবার শেষে শুয়ে পড়েছি। আমার মনের ভিতর শুরু হলো প্রচণ্ড তোলপাড়। যুদ্ধ এড়ানো যাবে না। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চাই, জয়লাভের জন্য অস্ত্র। কিন্তু অস্ত্র পাব কোথায়? আবার মনে হলো, চিন্তার কী আছে? মানুষের সহযোগিতা যদি পাওয়া যায়, সুশৃঙ্খল দল গঠন করা যায়, আর জনগণ যদি আমাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন, তা হলে আমরা অবশ্যই জয়ী হতে পারব। জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারলে, অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ হতে তেমন বেগ পেতে হবে না। আমরা যুদ্ধ করব গেরিলা কায়দায়। আমাদের অস্ত্র ভাণ্ডার কত সমৃদ্ধ তা বিচার্য নয়, আমাদের মনোবল ও শক্তি-সাহস কতটা, সেটাই হবে বিচার্য বিষয়। গত দেড় সপ্তাহ ঘুরে যে সাড়া পেয়েছি তাতে না পারার কী থাকতে পারে? আর সাইদুর যেভাবে সাড়া দিয়েছে, মনিরের যে অবিচল আস্থা রয়েছে, অস্ত্র উদ্ধার করতে মোয়াজ্জেম হোসেন খান, মামুনুর রশিদ এবং শাজাহান যে উৎসাহ ও তৎপরতা দেখিয়েছেন, তারপর না পারার কী আছে? আমি অবশ্যই পারব। পারতে আমাদের হবেই। না পারলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। আর আমিতো একা নই। আজ বাংলার লক্ষ কোটি মানুষ স্বাধীনতা চায়। আমি পারব। আমি পারব।
এমনি ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। শেষ ডিউটি ছিল আমার। ডিউটির সময় ছিল ভোর চারটে থেকে পাঁচটা। রাত চারটায় আমাকে ডেকে দেয়া হয়। আমার ডিউটির সাথী সামসু। হাত-মুখ ধুয়ে বন্দুক কাঁধে পায়চারি করছি, সামসু আমার পাশে পাশে। সে
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৭

সময় আমি ও মনির ছাড়া কেউই অস্ত্র চালনা জানত না। সাইদুর হয়তো বন্দুক ধরতে হয় কিভাবে তা জানতে পারে, তবে গুলি চালাতে জানে কিনা সন্দেহ। ফারুকের অবস্থাও তাই। কলেজের এন. সি. সি-র সদস্য থাকার কারণে শুধু বন্দুক ধরতে শিখেছে। এই মাস খানেক নানা জায়গায় আমার সাথে ঘুরে-ঘুরে বন্দুক ধরা ও বহনের কায়দাটা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করে নিয়েছে। তবে একখানা গুলিও ছোঁড়েনি। গতকাল বিকেলে এরা যখন মরিচাতে সমবেত হয়, তখন মনির ও আমি সবাইকে বন্দুক কিভাবে ধরতে হয়, কিভাবে গুলি চালাতে হয়, কিভাবে বন্দুকের ভিতর গুলি ভরতে হয়, কিছুটা দেখিয়েছি। এই পর্যন্তই এদের অভিজ্ঞতা, এর বেশি কিছু নয়।
রাতে পর্যায়-ক্রমিক ডিউটি নির্ধারণের সময় সবাইকে বলে দেয়া হয়েছিল, পাঁচটার পর কেউ শুয়ে থাকতে পারবে না। ডাক দেয়ার সাথে সাথে ঝটপট উঠতে হবে। বাড়ীর মতো সকালে ঘুম থেকে উঠতে গড়িমসি করলে চলবে না। এটা যুদ্ধক্ষেত্র। পাঁচটা বাজতেই সবাইকে ডেকে তুলতে সামসুকে নির্দেশ দিলাম। তাড়াতাড়ি উঠে সবাই তৈরি হয়ে নেবে। কারণ আমরা সাড়ে পাঁচটা-ছটার মধ্যে মরিচা থেকে বেরিয়ে পড়ব।
বাশাইল থানার ডুবাইল গ্রামের বাসিন্দা, মরিচা ফরেস্ট অফিসের গার্ড সোহরাব আলী দু’দিন ধরে আমার দলের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এজন্য তিনি যে পরিশ্রম করেছেন, তা অতুলনীয়। ঐ সময় যে-কাউকে ব্যবস্থা করতে বললে হয়তো করতেন। কিন্তু একজন পাক-সরকারের বেতনভুক্ত সরকারি কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও এই ব্যক্তি সেদিন যে-আন্তরিকতার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা যত্ন করেছেন, সেটাই হলো তাঁর মহত্ত্বের পরিচয়।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমাদের বেরিয়ে যাবার কথা। সোহরাব আলী অনেক আগে উঠে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। লোক সংগ্রহের পরিকল্পনা অনুযায়ী আবু বকর তার উপর অর্পিত দায়িত্ব নিয়ে বাঘের বাড়ীর উদ্দেশ্যে চলে গেছে। আর আমরা চললাম, মান্নান তালুকদার অথবা পশ্চিম পাকিস্তানী বিড়ির পাতার ব্যবসায়ীদের ব্যবস্থা করতে। কোথায় প্রথমে যাব তা তখনও স্থির করতে পারিনি। আমরা মোট দশজন, সাইদুর ও তার ছোট ভাই আবদুস সাত্তার, সামাদ এবং আরও দু’জন। এছাড়া ফারুক, মনির, সামসু, মহব্বত ও আমি। অস্ত্রের মধ্যে একটা এল. এম. জি. একটা ব্রাটাগান ও ছয়টি রাইফেল। লোক দশজন, অস্ত্র আটটি।

প্রথম সংগঠিত অভিযান
আমরা প্রথম অভিযানে চলেছি। যেতে যেতে আমি ভাবছি, মান্নান তালুকদারকে ধরাই বোধহয় সুবিধা হবে। কারণ দশজনের সশস্ত্র দলের সামনে মান্নান তালুকদারের দিক থেকে কোন প্রতিরোধ আসার সম্ভাবনা খুবই কম কিম্বা একেবারেই নেই। আবার চিন্তা হচ্ছে মান্নানকে যদি বাড়ীতে না পাওয়া যায়, তাহলে সে সতর্ক হয়ে যাবে এবং তাকে আর ধরাও যাবে না। অন্যদিকে মান্নান তালুকদারের বাড়ীতে মুক্তি বাহিনীর অভিযানের খবর অবাঙালি ব্যবসায়ীরা যদি আগেভাগে জানতে পারে, তা হলে তারাও সতর্ক হয়ে যাবে। তখন তাদের সাথেও আর পেরে উঠা যাবে না। সূচনাতে কিছুটা
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৮

নির্ঝঞ্ঝাটে কাজ সারতে চেয়েছিলাম। গোড়াতেই ব্যর্থতার পরিচয় দিলে দলের সদস্যদের মনোবল ভেঙে যাবে, উৎসাহ-উদ্দীপনাও কমে যেতে পারে, তাই প্রারম্ভেই ঝুঁকিপূর্ণ কোন অবস্থার সম্মুখীন হতে চাইনি। সহকর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগানো ও সাহস বাড়ানোর জন্য প্রথম অভিযান যে করেই হোক, সফল করতেই হবে। তখনও স্থির করতে পারিনি, কোথায় যাব।
প্রায় তিন সাড়ে তিন মাইল হেঁটে, আমাদের সবারই বেশ ক্ষুধা পায়। তাই ভাবলাম কোথাও খেয়ে, একটু শক্তি সঞ্চয় করে শত্রু ঘাঁটিতে মরণ ঝাঁপ দেবো। এটা ভালো করেই জানতাম ক্ষুধা ও ক্লান্তি নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে এগিয়ে যাওয়া একটা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়। দূর থেকে শক্তি সঞ্চয় করে রাস্তা অতিক্রম করতে করতেই যদি সেই শক্তি শেষ হয়ে যায়, তবে নিঃশেষিত শক্তি নিয়ে শত্রুর উপর আঘাত হেনে সফলতা অর্জন করা যায় না। যুদ্ধের সময় প্রতিটি যোদ্ধার পূর্ণ মাত্রায় শারীরিক শক্তি থাকা চাই। আমার এ বোধটা ছিল অতিশয় প্রখর। পরবর্তী প্রতিটি যুদ্ধে যোদ্ধার দৈহিক ও মানসিক শক্তি পূর্ণ মাত্রায় সঞ্চিত করে তবেই আমরা শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি। পরবর্তীকালে আমি অনেক সময় অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে অবিরাম গুলির মুখেও যোদ্ধাদের পেট ভরে খেয়ে নিতে উপদেশ দিয়েছি। যুদ্ধের সময় গুলির ঘাটতির চেয়ে খাদ্য কম পড়লে বা অভাব দেখা দিলে বেশি বিচলিত বোধ করেছি।
আমরা বহেরাতলিতে গফুরের বাড়ীতে উঠলাম। উদ্দেশ্য দুপুরের খাবার খাওয়া। এখানেই খবর পেলাম, গতরাতে শানবান্ধার মান্নান তালুকদার মারা গেছে। লাশ ময়না-তদন্তের জন্য নিয়ে যেতে তার বাড়ীতে পুলিশ এসেছে। খবর পেয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি। মান্নান মারা গেছে, কিন্তু কিভাবে? আর পুলিশ এসেছে, পাহাড়ের এত গভীরে? ভাবলাম, বিনা বাঁধায় পুলিশ এসে যদি আবার বিনা বাঁধায় চলে যাওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে ওদের সাহস বেড়ে যাবে। তখন মুক্তি বাহিনী গঠন করা দায় হয়ে উঠবে। অতএব আর দেরি নয়। না খেয়ে চটপট তখনই বেরিয়ে পড়লাম।
বহেরাতলী থেকে দেড় মাইল পূর্ব-দক্ষিণে শালগ্রামপুর। পরবর্তীকালে যার নাম সংগ্রামপুর হয়েছে, সেই শালগ্রামপুরে পাতার ব্যবসায়ীদের শিবির। তাদের উপরে প্রথমে অভিযান চালানো হবে। অভিযান সফল হলে যেমন কয়েকটি অস্ত্র পাবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে, তেমনি কাছাকাছি পুলিশের উপস্থিতির পরও এমন ঘটনা ঘটলে পুলিশেরাও ভয় পেয়ে যাবে। তাই অবাঙালি ব্যবসায়ীদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালানোই সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলাম।
গফুরদের বাড়ী থেকে আধমাইল সংগ্রামপুরের দিকে এগিয়ে সহকর্মীদের একত্র করে পরবর্তী কর্মপন্থা বুঝিয়ে দিলাম। কোথায় যেতে হবে, কিভাবে যেতে হবে, কী করতে হবে বিশদভাবে বুঝিয়ে তাদের তিন দলে বিভক্ত করে দেয়া হলো। একদলকে সামান্য পূর্বদিক দিয়ে ঘুরে পাতার ক্যাম্পের পাশে সংগ্রামপুর বাজারে অবস্থান নিতে নির্দেশ দিলাম। বলা হলো, যদি ক্যাম্পের দিক থেকে প্রতিরোধ আসে, তা হলে যেন তারা দু’চারটি গুলি ছোঁড়ে। অবস্থা খারাপ হলে, ওখান
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৯

থেকে সোজা উত্তরে সরে গিয়ে গফুরদের বাড়ীতে অপেক্ষা করবে। এই দলের দায়িত্ব দিলাম সাইদুরের ছোটভাই সাত্তারের উপর। অন্যদল ওখান থেকে ক্যাম্পে উঠবে। এর দায়িত্ব মনিরের। তার সাথে রইল সামসু, মহব্বত ও আরেকজন। অন্যদল নিয়ে আমি সামান্য পশ্চিম দিক দিয়ে সোজা দক্ষিণে চলে যাব এবং পাতার ক্যাম্পের দক্ষিণে টিলার উপর এল. এম. জি. নিয়ে অবস্থান নেব। মনির ক্যাম্পে ঢুকতে বাঁধা পেলে সামান্য পশ্চিমে সরে টিলার পাসে অবস্থান নেবে। তখন আমি উপর থেকে সোজা ক্যাম্পে গুলি চালাব। টিলা থেকে ক্যাম্প বড়জোর পঞ্চাশ গজ নিচে।
যুদ্ধের জন্য আমাদের অবস্থান খুবই সুবিধাজনক। এমন সুবিধাজনক যে, আমাদের সামনে এক প্লাটুন নিয়মিত সৈন্যরও টিকে থাকা মুশকিল। একটা এল. এম. জি. ও ব্র্যাটাগানসহ সাথী সাইদুর ও ফারুককে নিয়ে অবস্থান নিয়ে পরিকল্পনা মতো মনিরকে সংকেত দিলাম। মনিররা চারজন এগিয়ে আসছে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ওদিকে সংগ্রামপুর হাটে একটি গাছের নিচে, দোকানের আড়ালে সাত্তার ও তার দল অবস্থান নিয়েছে। সেও আমাদের দেখতে পাচ্ছে। এতে সুবিধা হলো নতুন কোন অবস্থা বা সমস্যা দেখা দিলে আবার নতুন করে সংকেত দেয়া যাবে।
মনিররা এগিয়ে আসতে আসতে ক্যাম্পের আড়াল হয়ে গেল। এমন সময় এক অবাঙালি লোক প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এক ঘটি পানি হাতে আমার অবস্থানের দিকে ক্রমাগত এগিয়ে আসা শুরু করলো। মলত্যাগের স্থান আমার অবস্থানের পঁচিশ-ত্রিশগজ দক্ষিণে। অবাঙালি ভদ্রলোক এগিয়ে আসছে আর আমি তা লক্ষ করছি। লোকটি আমাদের দেখতে পায়নি। হঠাৎ সামনে বন্দুক হাতে আমাদের দেখতে পেয়ে ভদ্রলোক একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। তার হাত থেকে ঘটিখানা মাটিতে পড়ে গেল। লোকটি কিছু বুঝার আগেই হুংকার ছাড়লাম, “অ্যায়, এধার আও।” লোকটি বোবার মতো আমাদের কাছাকাছি এলে, সাইদুর তাকে এক ঝটকায় বসিয়ে দিল। ফারুক তার দিকে ব্র্যাটাগান তাক করে ধরল। সাইদুর এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করে সামান্য একটু গরুর দড়ি এনে লোকটার হাত দু’টি পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলল। লোকটি কোন বাঁধা দিল না। আমি বললাম, “হিলন্যা নেই। চুপসে বইঠ্যা রহ।” প্রায় দশ মিনিট কেটে গেল। কোন সাড়া শব্দ নেই। কোনও গোলাগুলি নেই। আমি অধীর হয়ে পড়ি। ভীষণ উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছি। কী হলো? তবে কি খারাপ কোন কিছু? ঠিক আছে ওরা যদি ধরা পড়ে থাকে, বিনিময়ে একটা সুযোগতো রয়েছেই। এমনি ভাবতে ভাবতে অধৈর্য হয়ে সাইদুরকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য যখন এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেবো, ঠিক তখন মনিরকে দেখা গেল। সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার সাথে পিছনে হাতবাঁধা চারজন অবাঙালি পাতার ব্যবসায়ী। আমি অবাক! বিনাযুদ্ধে ওরা কেল্লাফতে করে ফেলল!
মনির হাতবাঁধা চারজনকে আমার সামনে এনে হাজির করলো। আর আগে থেকেই একজনকে তো আমি ধরেই রেখেছি। মনির বলল, “চারজনই ছিল। ধরে এনেছি। আর একজন বাঙালি কাজের লোক আছে, তাকে বসিয়ে রেখে এসেছি। তবে কোন অস্ত্র বা গোলা-বারুদ পেলাম না। এরা বলল, এদের কাছে কোন অস্ত্র নেই। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলাম।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৯০

বন্দীদের নিয়ে আমরা আবার পাতার ক্যাম্পে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি, এগুবো, এমন সময় টিলার পশ্চিম পাশ দিয়ে এক ভদ্রলোক সাইকেলে চড়ে যাচ্ছিলেন। ইনি আর কেউ নন, গজারিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, শওকত মোমেন শাজাহানের পিতা মোক্তার আলী। লোকে বলে, মোক্তার আলী চেয়ারম্যান।
সাইকেল আরোহীকে দেখে চিৎকার করে বলে উঠলাম, “এই মিয়া, কোথায় যাও? এদিকে এসো।” ডাক শুনে চেয়ারম্যান থ’ বনে গেল। টিলার উপরে আবার কারা? আমার হাতে লাইট মেশিনগান দেখে তার মূৰ্ছা যাবার অবস্থা। সাইকেল ফেলে তর তর করে উপরে উঠে এলো। কাছাকাছি এলে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাও?” সে যেন স্বপ্ন দেখছে। তার মুখ দিয়ে কথা সরছে না। থর থর করে কাঁপছে। ততক্ষণে কিন্তু মোক্তার আলীকে পিঠমোড়া করে বাঁধা হয়ে গেছে। অবাঙালি পাতার ব্যবসায়ীদের মতো সেও কোন ওজর-আপত্তি করলো না, নড়াচড়াও না। মুক্তিযোদ্ধারা যাই বলল, সুবোধ বালকের মতো তাই করলো। বাঁধাবাঁধি শেষে জিজ্ঞেস করলাম “কোথায় যাচ্ছিলে?” মোক্তার আলী চেয়ারম্যান বলল, “বাশাইল সি. ও. সাহেবের ওখানে একটু কাজ আছে।” কথাটা শুনে অগ্নিমূর্তি ধরে চিৎকার করে উঠলাম, “বদমাইশীর আর জায়গা পাওনা? বাশাইল থানায় যাচ্ছ দালালি করতে? বেটা, তুই যে এই অঞ্চলের দুই নম্বর দালাল সবাই জানে। এক নম্বরটা শেষ হয়েছে। এবার তোর পালা।” মোক্তার আলী চেয়ারম্যান একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো ভেউ ভেউ করে কেঁদে বলল, “দেখেন, আপনি আমাকে অনেকদিন ধরে জানেন। আপনার বড়ভাইও আমাকে চেনেন। আমার ছেলে আপনাদের সাথে কাজ করে। আমি মুসলিম লীগ করছি, কিন্তু কোনদিন আপনাদের ক্ষতি করি নাই। আমারে ছাইড়্যা দেন। আমি কথা দিচ্ছি, আপনাদের কথার একচুল নড়চড় করমু না।”
“সত্যিই কি এই কথাগুলো মনে থাকবে? আমাকে না বলে বংশাই নদী পার হওয়া যাবে না। পশ্চিমে বংশাই, পূর্বে বাটাজোড়, উত্তরে বড়চওনা আর দক্ষিণে নলুয়া, আমাকে জিজ্ঞেস না করে এর বাইরে গেলেই তোর জীবন শেষ। যদি এটা মানতে পারিস, তা হলে এবারের মত ছেড়ে দিচ্ছি।”
আমার কথা শুনে কান্নাপ্লুত কণ্ঠে চেয়ারম্যান বলল, “আমার জন্য এ তো অনেক বেশী, শুধু ঘরে বসে থাকতে বললেও আমি রাজী আছি।”
“ঠিক আছে, আপনি চলে যান। তবে আর পশ্চিমে নয়। সোজা পুবে, বাড়ীতে। আমি পরে খোঁজ নেব।” মোক্তার আলী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মেশিনের মতো তর তর করে নিচে নেমে সাইকেল চড়ে দে ছুট।
সেদিন আমার ‘তুই’ সস্বোধনে মোক্তার আলী চেয়ারম্যানের মনে হয়তো প্রশ্ন জেগেছিল। তেমনি পাঠকের মনেও প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। আমি তখন এবং এখনও ছোটদের পর্যন্ত প্রথম ‘আপনি’ বলে সস্বোধন করে থাকি। বড়দের তো কথাই নেই। বাংলাদেশের সমাজ বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে ‘আপনি’ ‘তুই’ ও ‘তুমি’র মধ্যে পার্থক্য অনেক। ইংরেজদের ‘You’ তে ‘তুমি’ ও
পৃষ্ঠা নং ~ ৯১

‘আপনি’ বুঝায়—এটা বৃটিশ কৃষ্টি ও সভ্যতা। তবে বাংলায় ‘আপনি’, ‘তুই’ ও ‘তুমি’র মধ্যে পার্থক্য বিচার করে চলতে হয়। আমার যেমন সুনাম আছে, তেমনি কিছু কিছু দুর্নামও যে নেই এমন নয়। তবে আমার চরম শত্রুরাও এ অপবাদ দিতে পারবে না যে, আমি কারও সাথে ব্যবহারিক জীবনে ভদ্রতার অভাব দেখিয়েছি অথবা অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছি। কিন্তু ঐসময় বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই অর্থাৎ ভীতি প্রদর্শন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্যেই মোক্তার আলী চেয়ারম্যানের সাথে আমি ঐরকম আচরণ করেছিলাম।
মোক্তার আলী চেয়ারম্যান চলে গেলে পাঁচজন ব্যবসায়ীকে নিয়ে তাদের ক্যাম্পে গেলাম হাতবাঁধা অবস্থায় ব্যবসায়ীদের বসিয়ে রেখে পাতার গুদাম তন্নতন্ন করে প্রায় একঘন্টা তল্লাসি চলল। কিন্তু কয়েক ডজন ব্লেড, একটা দা, একটা বটি ছাড়া অস্ত্র বলতে আর কিছু আবিষ্কার করা গেল না। যদিও আমাদের কাছে খবর ছিল, ক্যাম্পে চার থেকে পাঁচটা রাইফেল, গোটা চারেক রিভলবার ও পিস্তলসহ দু’একটা লাইট মেশিনগান থাকাও সম্ভব। অথচ কোন অস্ত্রই পাওয়া গেল না। ফলে খুব বিরক্ত ও হতাশ হলাম।
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, কী কী অস্ত্র আছে কোথায় আছে? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের একই কথা, “আমাদের কাছে অস্ত্র নাই। এখানে যদি একটা চাকুও পান তাহলে আপনাদের যা-ইচ্ছা তাই করবেন। আমরা আপনাদের শত্রু নই। আমরা এখানে ব্যবসা করতে এসেছি। আমরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের লোক। ইয়াহিয়ার এই কার্যকলাপ আমরাও সমর্থন করি না। আমরাও আপনাদের মতো স্বাধীনতা চাই।” তাদের কথাগুলো আমাকে বারবার নাড়া দিচ্ছিল। তল্লাসি চালাবার সময় যখন কিছু পাওয়া গেল না, তখন ওদের কথাই সত্য বলে মনে হচ্ছিল। যা হোক, দু’ঘন্টা খোঁজাখুঁজির পর অস্ত্র উদ্ধারের আশা ত্যাগ করে ব্যবসায়ীদের কথায় মোটামুটি আস্থা স্থাপন করলাম। অবশেষে পাক-ব্যবসায়ীদের মুক্ত করে দিতে সহকর্মীদের নির্দেশ দিলাম।
ক্যাম্পের সমস্ত কিছু আমরা তল্লাসি করেছি, বাকি শুধু লোহার সিন্দুক। সিন্দুকের চাবি কার কাছে জানতে চাইলে, ওদের একজন তাড়াতাড়ি চাবিছড়া আমার হাতে তুলে দেবার জন্য এগিয়ে এলো।
—না, চাবি আমাকে দিতে হবে না। আপনাদের দু’জন চাবি নিয়ে আমার সঙ্গে এসে সিন্দুক খুলুন। যেমনি কথা তেমনি কাজ। ওদের দু’জন এগিয়ে এলে ফারুক ও মনিরকে নিয়ে সিন্দুক খুলতে গেলাম। সিন্দুকটি খুলে মনির তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল, কিন্তু টাকা ছাড়া ভিতরে আর কিছু পাওয়া গেল না। টাকার পরিমাণ সাড়ে ছয় হাজার। সিন্দুক আবার তালাবন্ধ করা হলো। এইসময় ব্যবসায়ীদের একজন বারবার বললেন, “আমাদের কাছে এখন বেশি টাকা নেই। সমস্ত টাকা দিয়ে পাতা কিনে ফেলেছি। দু’একদিনের মধ্যে আমরা পাতা চালান দেবো এবং পাতা কেনার জন্য ঢাকা থেকে টাকা আনাব। আপনাদের টাকা পয়সার দরকার হলে, এ টাকা নিয়ে যান।”
আমাদের টাকার খুবই দরকার, কিন্তু তবু ঐ অবাঙালি ব্যবসায়ীদের কথায় মোটেই কান
পৃষ্ঠা নং ~ ৯২

দিলাম না। ২রা এপ্রিল ধল্লার কাছে ডিফেন্স পরিদর্শনকালে টাংগাইল মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকী খরচপত্র মেটানোর জন্য আমাকে ছয় হাজার টাকা দিয়েছিলেন, তা ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে এসেছে। এখন আমার কাছে মাত্র তিনশ পঞ্চাশ টাকা আছে। সুতরাং টাকার প্রয়োজন ছিল।
মুক্তিযোদ্ধারা কেন এসেছে, তাদের কেন গ্রেফতার করা হয়েছিল, দেশের চলমান পরিস্থিতি কী, ইত্যাদি অবাঙালি ব্যবসায়ীদের বুঝিয়ে বললাম। আমি তাদের আশ্বাস দিলাম, তারা যদি পাকিস্তানীদের সাথে হাত না মেলায়, তাহলে তাদের ব্যবসা চালাতে কোন অসুবিধা হবে না। বরং সুবিধাই হবে। ব্যবসায়ীরা আবার সব টাকা দিতে চাইলে আমি বললাম, “অমনটি হবে না। এই ছয় হাজার টাকায় আমাদের কিছুই হবে না।” একথা শুনে ব্যবসায়ীরা বলল, “আমরা দু’তিন দিনের মধ্যে আরও টাকা আনিয়ে দিচ্ছি। আপনারা এটা নিয়ে যান। তাদের এ কথার পর খুব জোরের সাথে বললাম, “দেখুন, আমাদের অনেক টাকার দরকার। তার অর্থ এই নয় যে, তা আপনাদেরকেই দিতে হবে। অস্ত্র দেখিয়ে টাকা নিয়ে যাব, তা হবে না। আমরা ক্যাম্প লুট করতে বা ডাকাতি করতে আসিনি। আমরা এসেছি একটা মহান উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রয়োজন হলে আমরা অবশ্যই আপনাদের কাছ থেকে টাকা নেব। তবে আপনাদেরকে আজকে গ্রেফতার করেছিলাম বলে, বাঁচবার জন্য বা ছুটবার জন্য টাকা ঘুষ দেবেন—এটা হবে না। আমি আপনাদের এমনিতেই বিশ্বাস করে ছেড়ে দিয়েছি। আশা করি বিশ্বাসের মূল্য দেবেন। আপনাদের কাছে এখন ছয় হাজার পাঁচশত টাকা আছে। এর থেকে তিন হাজার পাচশত টাকা নিয়ে নিচ্ছি। এটা ধার হিসেবে নিচ্ছি। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা এ টাকা ফিরিয়ে দেবো।”
—না, না, আমরা খুশি হয়ে আপনাদের দিচ্ছি। আর ফিরিয়ে দিতে হবে না।
—দেখুন আপনারা আমাদের বুদ্ধু ভাববেন না। আমরা দশজন সশস্ত্র মানুষ। আপনাদের পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধেছিলাম। যা খবর ছিল, তল্লাসি চালিয়ে তা না-পাওয়াতে আপনাদের কথাই কিছুটা বিশ্বাস করেছি। এবং সে বিশ্বাসের উপর ভরসা করে আপনাদের ছেড়ে দিয়েছি। এই অবস্থায় আপনারা যে কত খুশি, তা বুঝবার মতো বয়স ও বুদ্ধি আমাদের হয়েছে। আজ এই পর্যন্ত থাক। পরে দেখা যাবে, আপনারা খুশি হয়েছেন, কি দুঃখিত।
মুক্তিযোদ্ধারা তখনও অভুক্ত। তার উপর প্রায় তিন ঘন্টা ক্যাম্প অভিযান ও তল্লাসি চালিয়ে তারা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অভিযানের আগে পাতার ক্যাম্পে ব্যবসায়ীরা নিজেদের জন্য খাবার তৈরি করেছিল। আমরা তাই খাব বলে স্থির হলো। দলটিকে সমান দু’ভাগে ভাগ করে, খেতে বসলাম। সঙ্গে অবাঙালি ব্যবসায়ী একজন। আমাদের দশজন ও ওদের দু’জন বারোজনের খাবার শেষে দেখা গেল, খাবারের অর্ধেকটাও শেষ করতে পারিনি। খাবার শেষ করে অবাঙালি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আরও কিছু কথাবার্তা হলো। পারস্পরিক কথাবার্তার ভিত্তিতে ঐ অবাঙালি ব্যবসায়ীদের প্রতি আমার বিশ্বাস জন্মেছিল। ব্যবসায়ীরাও মুক্তি বাহিনীর প্রতি আস্থা এনেছিলেন, তা তাদের পরের কার্যকলাপ থেকে প্রমাণ পাওয়া যাবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৩

ক্যাম্প অভিযান শেষ করে সখীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি, এমন সময় দেখলাম, পূব দিক থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে শওকত মোমেন শাজাহান এবং আরো তিনজন ছুটে আসছে। শাজাহান হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসেই জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছেন? কোথেকে আসছেন কোথায় যাবেন? একটু আগে সংবাদ পেলাম আপনি এখানে। তাই ছুটে এলাম। বাবা কোথায়? জানি, বাবা মুসলীম লীগ করেন। এ সময় কারও সাথে আপোস করা ঠিক হবে না। তবে বাবাকে আর দেখতে পেলাম না।”
– তোমাদের ঐদিকেই যাচ্ছি, বাবাকে দেখতে পাবে।

এক গুলিতেই
সেদিনের আরও কিছু ঘটনা তুলে ধরা দরকার। ক্যাম্পের ভিতর নয়—যা বাইরে ঘটেছিল, মুক্তি বাহিনীর সামনেও ঘটেনি, ঘটেছে অগোচরে। আমরা যখন পাতার ক্যাম্পে খাচ্ছিলাম, তখন পর্যায়ক্রমে দু’জন করে পাহারা দিচ্ছিল। খাওয়া প্রায় অর্ধেক, এমন সময় দরজার সামনে পাহারারত মুক্তিযোদ্ধার হাতের রাইফেল গর্জে উঠে। আমি ঝটপট খাবার ছেড়ে উঠে পড়লাম। কিন্তু ঐ এক গুলিই, আর নয়। সব নীরব। অবাক হয়ে ঘরের বাইরে এসে বুঝতে পারলাম, পাহারারত মুক্তিযোদ্ধাদের অসাবধানতার জন্য কারো বন্দুক থেকে ফাঁকা গুলি হয়েছে। আল্লাহর মেহেরবানিতে কারও কোনও ক্ষতি হয়নি।
বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলাম, “গুলি কোথেকে হল? কে করলো?” কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারল না। সন্দেহ বশতঃ তাদের বন্দুক পরীক্ষা করে দেখতে পেলাম, দরজায় পাহারারত বন্ধুটির রাইফেলের ‘সেফটি কেস’ সামনের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তার মানে, এই রাইফেল থেকেই মিস ফায়ারটি হয়েছে। সহকর্মীর হাত থেকে বন্দুকটি নিয়ে বোল্ট পিছনে টানতেই বুলেটের খোসা বেরিয়ে এলো। বন্ধুটি তো হতবাক! তাহলে তোর বন্দুক থেকেই গুলি হয়েছে। অতএব শাস্তি থেকে রেহাই নেই। সে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেল।
সেদিন এক ফাঁকা আওয়াজে কোথায় কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেটাই এখন বলছি। গুলির আওয়াজের সাথে সাথে অবাঙালি ব্যবসায়ীরা একেবারে চুপসে যায়। তারা মাটিতে শুয়ে পড়ে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে। ওদের ধারণা, হয়তো কারও কোন ত্রুটি হয়েছে। যার জন্য এমন করে গুলি চালানো হলো। ওরা যখন বুঝতে পারল, গুলি কারো গায়ে লাগেনি তখন আবার শান্ত হয়ে উঠে বসল। এদিকে, মান্নান তালুকদারের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য শহরে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দু’জন পুলিশ ও দু’জন চৌকিদার তার বাড়ী থেকে ফিরে আসছিল। তারা ক্যাম্পের পাশে খালের অপরপারে যখন উপস্থিত হয়েছে, এমন সময় সেই মারাত্মক মিসফায়ার। ইতোমধ্যে মুক্তি বাহিনী এসে উপস্থিত হয়েছে অথবা ঐ এলাকায় মুক্তি বাহিনী গঠিত হয়েছে কিনা, একথা পুলিশরা জানত না। তবে পুলিশদের ভয় ছিল, কাদের সিদ্দিকী তাদের উপর হামলা করে বসতে পারে। কাদের সিদ্দিকী যে অস্ত্র-কাঁধে সারা এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ খবর পুলিশদের জানা
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৪

ছিল। তাই পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশের পর থেকেই পুলিশরা আক্রান্ত হবার আশঙ্কা নিয়ে দুরু দুরু বুকে মান্নান তালুকদারের বাড়ীতে গিয়েছিল। কাজ সমাধা করে ফিরে যেতে পারছে, এজন্য খোদার শুকরিয়া জানাতে যাবে, ঠিক সেই সময় ঐ বিপর্যয়। গুলির শব্দ শুনে দুই পুলিশ রাইফেল ফেলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা মনে করে নিশানা তারাই। মুক্তি বাহিনী তাদেরই গুলি করেছে। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যখন দেখে তাদের গায়ে গুলি লাগেনি তখন তারা তড়িঘড়ি খাল পার হয়ে আরও পশ্চিম-দক্ষিণে ছুটে।
মান্নানের লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু দু’জন পুলিশই আসেনি। টাংগাইলের এস. পি., বাশাইল থানার ও. সি. ও বারোজন পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল এসেছিল। কী মনে করে তারা পাতার ক্যাম্পের এক মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বাড়ীতে বিশ্রাম করতে থাকে এবং চারজন পুলিশকে মান্নান তালুকদারের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। ক্যাম্প থেকে মান্নানের বাড়ী তিন মাইল পূব-উত্তরে, আর এস. পি. -র অবস্থান একমাইল পশ্চিম-দক্ষিণে। খালে ঝাঁপিয়ে পড়া পুলিশ দু’জন ছিল মান্নান তালুকদারের বাড়ীতে পাঠানোর চারজনের অন্তর্ভুক্ত। বাকি দু’জন গরুর গাড়িতে আনা লাশের সঙ্গে আসছিল। ওদের বিভক্ত হবার কারণ হয়তো এরকমঃ চারজন পুলিশই মান্নানের বাড়ীতে নিরাপদে পৌঁছে যায় এবং গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারে যে, আশে পাশে মুক্তি বাহিনী-টাহিনী কিছু নেই। এতে হয়তো ওদের সাহস টা বেড়ে যায়। গরুর গাড়িতে লাশ তুলে দু’জন গাড়ির সাথে সাথেই আসতে থাকে। বাকি দু’জন এস. পি. -কে আগাম খবর দেয়ার জন্য অতি উৎসাহের সঙ্গে আগে-আগে আসছিল। কিন্তু সংগ্রামপুরে আসা-মাত্র এই বিপত্তি।
ঝাঁপিয়ে খাল পার হয়ে পুলিশ দু’জন পড়িমরি করে ছুটতে ছুটতে এস. পি. যেখানে বিশ্রাম নিচ্ছিল, সেই বাড়ীর উঠানে পৌঁছে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “স্যারেরা, … মুক্তি বাহিনী আইস্যা পড়ছে।” এই বলে পুলিশ দু’জন আবার ছুট। এস. পি. নিজেও মিনিট কয়েক আগে গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছে। এস. পি., ও. সি. ও পুলিশ দলটি তখন ভীষণ দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল। ঠিক সেই সময় পুলিশ দু’জনকে জামা-প্যান্ট-গেঞ্জিবিহীন দেখে তারাও হতভম্ব হয়ে যায়। পুলিশ দু’জনের হাল-হকিকত দেখে তারাও বেহাল হয়ে তাদের পিছনে পিছনে ছুটতে শুরু করে। পুলিশরা যখন খবর দেয় তখন এস. পি ও ও. সি. গেঞ্জি গায়ে লুঙি পরে চা পান করছিল। ঘড়ি ও চশমা পাশেই ছিল। জামা-কাপড় ও ঘড়ি-চশমা নেবার কথা এস. পি. বেচারা একেবারে ভুলে যায়। মুক্তি বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল তাদের ধরতে আসছে, একথা ভেবে এস. পি. ও অন্যান্য পুলিশরা একটা রাইফেল ও আরও কিছু জিনিস ফেলে দৌড় শুরু করে। সবাই পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে সাড়ে তিন মাইল পশ্চিমে বংশাই নদী পার হবার আগ পর্যন্ত আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। সে এক দেখবার মতো দৃশ্য! দু’জন পুলিশ শুধু জাঙিয়া পরে নদীর পাড়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। এস. পি. ও ও. সি. লুঙিপরা, গেঞ্জি গায়ে বাকি ছয় জন, কারও একপায়ে জুতা, কারও দু’পা-ই খালি। লুঙি উঠানো, কাছামারা। কারও প্যান্টের বোতাম লাগানো হয়নি। এ দৃশ্য দেখে গ্রামের লোকজন হাসাহাসি করে। হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৫

এদিকে আমি যখন মোক্তার আলী চেয়ারম্যানকে পিছ-মোড়া করে বাঁধছিলাম, তখন এটা একজন লোক দেখতে পেয়ে সোজা পূবদিকে ছুট দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু তা বুঝতে পারেনি। আমি শালগ্রামপুরে এসেছি, এ খবর পাওয়ার পর শাজাহান আমার সাথে মিলিত হবার জন্য শালগ্রামপুরেই আসছিল। আর সেই সময় মোক্তার আলী চেয়ারম্যানকে আমরা বেঁধেছি, এ খবরটা দেবার জন্য তার বাড়ীর দিকে ধাবমান লোকটির দেখা পায় শাজাহান। দেখা হতেই লোকটি জানায়, “শাজাহান ভাই, আপনার বাবারে মুক্তিরা মারবার জন্য বাইন্দা ফেলেছে।” শাজাহান যেখানে দাঁড়িয়ে এ খবরটা শুনছিল, সেখান থেকে পাতার ক্যাম্পের দূরত্ব বড়জোর একমাইল। আর ঠিক তখনই আমাদের বন্দুকের মিসফায়ার হয়। সাথে সাথে লোকটি চিৎকার করে বলে উঠে, “এই বুঝি আপনার বাবারে গুলি করলো।” গুলির শব্দ শুনে শাজাহানও দিশেহারা হয়ে যায়।
শাজাহানের সঙ্গী আমজাদ হোসেন মাষ্টার, আবু হানিফ ও নূরে আজম, বাকি এক মাইল রাস্তা মোটামুটি বলতে গেলে তাকে ধরাধরি করে, আমার সামনে এনে হাজির করে। সেই কারণেই শাজাহান মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে আমাকে বলেছিল, “বাবা মুসলিম লীগ করেন। আর স্বাধীনতার জন্য কোনও আপোস করা চলবে না।” অর্থাৎ তার ভাবটা ছিল এই, বাবা তো মরে গেছে। ঠিক আছে। তার লাশ কোথায়? সেটা আমাকে দিন। শত হলেও তো বাবা। আমি তখন শাজাহানকে বলেছিলাম, “চল আগে সখীপুর যাই। পরে বাবার ব্যাপার দেখা যাবে।”
সংগ্রামপুর থেকে সখীপুর সারা রাস্তাই শাজাহান কাঁদতে কাঁদতে আসে। তখন আমার চোখ-মুখের যা অবস্থা, তাতে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার সাহস পায়নি। সখীপুর পৌঁছে ফারুক ও নূরে আজমকে পাঠিয়ে দিই মোক্তার আলী চেয়ারম্যানকে ডাকতে আধঘন্টা সখীপুর স্কুলে অপেক্ষা করার পর শাজাহানের বাবা মোক্তার আলী চেয়ারম্যান সেখানে এসে উপস্থিত হন। সংগ্রামপুরে এই অভিযানের পিছনে যে উদ্দেশ্য ছিল, তা পূর্ব নির্ধারিতভাবে এগিয়ে না গেলেও পুরোমাত্রায় সফল হয়েছিল। একটি গুলি কখনও এতগুলো শিকার বধ করতে পারে না। অথচ সেদিন কিন্তু তাই করেছিল।
পাহাড়িয়া এলাকার লোক মান্নান তালুকদার সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। মুসলিম লীগ একটি শক্তিশালী স্তম্ভ, মান্নানের উপর তখন পাকিস্তানপন্থীরা যথেষ্ট ভরসা করছিল। আর মান্নানও কম যাবার পাত্র ছিল না। ৬/৭ এপ্রিল থেকে বাশাইল ও তার আশেপাশে মুক্তিবাহিনী যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, তার জন্য সখীপুরের কয়েকজন পুলিশ মোতায়েন করার ব্যবস্থা সে প্রায় পাকাপাকি করে এনেছিল। সেই সময় সখীপুরে যে দু’চারজন পাকিস্তানপ্রেমিক ছিল, তারাও এই মান্নান তালুকদারকে আশ্রয় করে মনোবল অর্জন করেছিল। আর মান্নান তালুকদার এপ্রিল মাসের ২৫ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত এ ছয়-সাতদিন কচুয়া, সখীপুর বহেরাতলীসহ আরও বহু গ্রাম ঘুরে ঘুরে পাকিস্তান-প্রেমিকদের সংঘবদ্ধ করে শান্তি কমিটি গঠন করেছিল। মান্নান তালুকদার পাকিস্তান রক্ষায় নিবেদিত, অন্যদিকে আমিও বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ফিরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করছিলাম। মান্নান যদি বেঁচে থাকত, তাহলে পাহাড়ি এলাকার
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৬

সমর্থন অর্জনে আমাদের আরো বেগ পেতে হতো। আদৌ সমর্থন অর্জন করতে পারতাম কিনা, নিশ্চিত করে বলা যায় না।
৪ঠা মে রাতে, সশস্ত্র কয়েকজন লোক তাকে বাড়ী থেকে বের করে গুলি করে রাস্তায় ফেলে যায়। যারা গুলি করেছে তারা যেই হোক না কেন, সাধারণ মানুষের ধারণা এটা মুক্তি বাহিনীর কাজ। এ খবর বিদ্যুৎগতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এতে এলাকায় মুক্তি বাহিনীর স্বপক্ষে ভালো ফল ফলেছিল। এরপর দালাল শ্রেণীর যে দু’চারজন ছিল, তারা একেবারে ঘাবড়ে যায়। মোক্তার আলী চেয়ারম্যান এ এলাকায় মুসলিম লীগের দ্বিতীয় খুঁটি। অনেক সময় মোক্তার আলী চেয়ারম্যানকে প্রধান খুঁটি হিসেবেও মনে করা হতো। মান্নান তালুকদার ও মোক্তার আলী চেয়ারম্যান—এ দু’জনের মধ্যে কে প্রধান মুসলিম লীগার, তা কোন দিনই পরিষ্কারভাবে নিরূপণ করে বলা যায়নি। দু’জনেই সমানে সমান। তাই আগের রাতে মান্নান মারা গেলে, পরের দিন মোক্তার আলী চেয়ারম্যান যখন আমার হাতে ধরা পড়ে, তখন তার বাঁচার কোন আশাই ছিল না। সে নিঃসন্দেহ ছিল যে, এই তার শেষ।
মান্নান তালুকদার ও মোক্তার আলী চেয়ারম্যান কয়েকদিন আগেও তাদের দালালির পরিচয় দিয়েছিল। টাংগাইলের পাঞ্জাবি এ. ডি. সি. -কে তাদের এলাকায় লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। এ. ডি. সি. ভদ্রলোক পাকিস্তানের ক্ষমতাবান মেজর জেনারেল পীরজাদার ছোট ভগ্নিপতি। মান্নান তালুকদার ও মোক্তার আলী চেয়ারম্যান টাংগাইলে গিয়ে মিলিটারিদের খবর দিয়ে নিয়ে এসে পাকিস্তানীদের কাছে তাকে হস্তান্তর করে। এই করে ঐ দু’জন মিলিটারিদের প্রিয়পাত্র হতে চেয়েছিল।
মান্নান তালুকদার ও মোক্তার আলী চেয়ারম্যান প্রথমে টাংগাইলে মিলিটারিদের খবর দেয়। আট-দশটি জিপ নিয়ে মিলিটারিরা এ. ডি. সি-র অবস্থান স্থলে আসে। জনৈক কর্ণেল তাকে গাড়িতে উঠার অনুরোধ জানালে এ. ডি. সি. সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলে, “না, আমি যেতে পারি না। কাদের সিদ্দিকী সাহেব নিজে আমাকে এখানে রেখে গেছেন। যাবার সময় বলে গেছেন, ‘পরে এসে আপনার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেব। আপনি যদি এর মধ্যে আমাদের মতের পরিপন্থী কোন কাজ না করেন, তবে সম্মানের সাথে আপনাকে আপনার স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়ে আসব। আপনার স্ত্রীকে আমরা এ ধরনের কথাই দিয়ে এসেছি।” এ. ডি. সি. আরো বলেন, “সিদ্দিকী সাহেব আমার সাথে যে মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার করেছেন, তা এর আগে গ্রেফতারকৃত অন্য কোন লোকের প্রতি কেউ কোনদিন করেছে কিনা, জানি না। আমি সিদ্দিকী সাহেবের কথার খেলাপ করতে পারব না।” কর্নেল ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে। যাকে সে নিতে এসেছে, তিনি নিজে মেজর জেনারেল পীরজাদার ভগ্নিপতি। শত্রু শিবিরে বন্দী। অথচ তিনি শত্রুর শিবির ত্যাগ করতে নারাজ। এখন উপায়! জোর করে এ. ডি. সি-কে নিয়ে যাবে? তারও সাহস পাচ্ছে না। আবার রেখে যাবারও উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত অনেক পীড়া পীড়িতেও যখন কোন কাজ হলো না, তখন এ. ডি. সি’র ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে জোর করে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে উঠানো হয়। এ. ডি. সি. চিৎকার করে
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৭

আশে-পাশের লোকজনদের বলে, “আপনারা সাক্ষী থাকবেন, আমাকে এরা জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। সিদ্দিকী সাহেব যদি আসেন, তাহলে আপনারা এটা বলবেন। তিনি যেন আমাকে বিশ্বাসঘাতক না ভাবেন।”
৫ই মে আমরা সখীপুর হাইস্কুলের ভাঙা টিনের ঘরে। রাতে খাবার ব্যবস্থা শাজাহানের বাবাই করলেন। সে এক এলাহি-ব্যাপার! মুক্তি বাহিনীর জন্য ব্যবস্থা হলো মাংস-ভাত। মোক্তার আলী চেয়ারম্যান তার অতি-আদরের কোন একটি খাসি জবাই করে আমাদের খাইয়ে তুষ্ট করার চেষ্টা করলেন। যে খাসি জবাই করে আমাদের খাওয়ানো হলো, সেই খাসিই হয়তো অন্য কোন পুলিশ অফিসার বা মিলিটারি অফিসারের জন্য বরাদ্দ ছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৮

ই. পি. আর-দের সন্ধানে

সখীপুরে এসেই কালমেঘার ই. পি. আর. -দের খবর নিতে শুরু করি। একজনকে বড়চওনা, আরেকজনকে কালমেঘায় পাঠিয়ে দিই। উদ্দেশ্য, ই. পি. আর-দের সঠিক অবস্থান জানা ও পরবর্তী কার্যক্রম স্থির করা। সার্বক্ষণিক সাহায্যের জন্য স্থানীয় তিন-চারজন কর্মী সংগ্রহ করে দিতে অনুরোধ করলে মোতালেব (গুর্খা), হানিফ, হবি ও নূরে আজমকে শাজাহান এনে দিল। আমি তাদের একজনের কাছে এক গ্লাস পানি চাইলে মোতালেব গুর্খা এক কলসি পানি, একটা জগ ও চার-পাঁচটা গ্লাস এনে আমার সামনে রাখল। হাত-মুখ ধোয়ার জন্য পানি আনতে বললে, সে নিজে দুটো এবং অন্যের সাহায্যে আরো দুই কলসি পানি নিয়ে এলো। সন্ধ্যার কিছু আগে তাকে আবার অনুরোধ করা হলো দাঁত মাজার জন্য মেছওয়াক (ডাল) এনে দিতে, সে তখন আরেক কাণ্ড বাধিয়ে বসল। এত ডাল নিয়ে এলো যে, যা দিয়ে হাজার লোক দাঁত মাজতে পারবে। এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা সেদিনে মোতালেব গুর্খা ঘটিয়েছিল, যা একটিও আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। এইসব দেখে মনে-মনে খুশিই হয়েছিলাম।
মনে মনে স্থির করেছিলাম, প্রথম অবস্থায় এমন লোকই দরকার। রাত ন’টায় কালমেঘার দূত ফিরে এলো। বড়চওনার দূত আগেই এসেছিল। ইদ্রিসকে পাওয়া যায়নি। পরদিন বিকেলের আগে তাকে পাওয়ার খুব একটা সম্ভাবনাও নেই। কালমেঘার দূত কিতাব আলী মাষ্টারকে পেয়েছে। কিতাব আলী জানিয়েছে, ‘ই. পি. আর-রা গত রাত্রে ওখান থেকে আংগারগারার দিকে চলে গেছে।’ খবর পেয়ে আমি মোটামুটি খুশি হই, কারণ আমাদের অবস্থান থেকে আংগারগারার দূরত্ব কালমেঘার অর্ধেক।
রাতে খাবার সময় দু’জন আমাদের সাথে মিলিত হন। মুক্তিযুদ্ধে এদের ভূমিকা ঐতিহাসিক। এদের একজন বিখ্যাত খোরশেদ আলম, যিনি সবার কাছে আর. ও. সাহেব নামেই সমধিক পরিচিত। আরেকজন মানবতার সেবায় নিবেদিত, শিক্ষককুলের গৌরব, সবার প্রিয় আমজাদ মাষ্টার।
খাবার শেষে পরবর্তী কর্মসূচি স্থির হলো, পরদিন সকালে অন্যদের ওখানেই রেখে শাজাহান ও মনিরকে নিয়ে আংগারগারায় ই. পি. আর-দের সাথে মিলিত হতে যাব। সখীপুর হতে আংগারগারা বড় জোর সাত-আট মাইল। খোরশেদ আলম ঐ এলাকার রাস্তা-ঘাটের সাথে ব্যাপক পরিচিত। তাই খোরশেদ আলমকেও দলভুক্ত করা হলো। ই. পি. আর-দের দেখা পেলে, হয় তাদেরকে সখীপুর নিয়ে আসা হবে অথবা সখীপুরে যারা রইল, তাদেরকে খবর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
৬ই মে। পূর্ব দিগন্তে উষার আলো একটু উঁকি-ঝুঁকি দিয়েই আবার মেঘের আড়ালে মুখ
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৯

লুকালো—অবিশ্রান্ত ধারায় প্রকৃতি অশ্রু ঝরাতে শুরু করলো।
বেলা প্রায় এগারটা। তবুও বৃষ্টি থামছে না। কী করা যায়? খোরশেদ আলম এই বৃষ্টি উপেক্ষা করে দেড় মাইল পায়ে হেঁটে সকাল সাতটায় আমাদের সাথে মিলিত হয়েছেন।
আবার সেই মন্ত্রণাসভা। অনেক আলোচনা। অথচ কোন পথ বের করা যাচ্ছে না। একস ময় স্থির হলো, এই বৃষ্টির মধ্যেই পথচলা শুরু করতে হবে। বসে থাকলে চলবে না! চলতে যে হবে—এ ব্যাপারে সবাই একমত এবং বৃষ্টি উপেক্ষা করেই চলতে হবে। চারজন বেরিয়ে পড়লাম। বৃষ্টিই শুধু বাঁধা নয়, বৃষ্টির বাঁধা অতিক্রম করতে পারলেও পাহাড়ি লালমাটির সাথে কিছুতেই পেরে উঠছি না। পা দু’তিন ইঞ্চি কাদায় গেড়ে যাচ্ছে। আর শুধু মাটিতে পা গেড়ে যাওয়াই সমস্যা নয়, কঠিন সমস্যা তারও পরে, পা তুলতে গিয়ে দেখেছি, একচাপ লালমাটি পায়ের সঙ্গে উঠে আসছে। সহজে পা চালানো কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। বারবার পায়ের মাটি ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে আর কাহাতক চলা যায়! এভাবে আর পারা যাচ্ছে না। পাহাড়ি রাস্তাঘাটে চলায় অভিজ্ঞ খোরশেদ আলম সাহেব বিশেষজ্ঞদের মত প্রকাশ করে বললেন, “প্রবল বর্ষণে পাহাড়ের কোন কোন এলাকায় চলা একেবারে অসম্ভব। আবার সামান্য বৃষ্টি হলেও কোন কোন এলাকায় চলা মুশকিল। বিশেষ করে সখীপুর থেকে কচুয়া পর্যন্ত সামান্য বৃষ্টির মধ্যে যাওয়া সম্ভব হলেও কচুয়া থেকে আংগারগারা, ফোঁটা বৃষ্টিতেও পথ চলা প্রায় অসম্ভব। তাই বৃষ্টি থামা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিত।” বিশেষজ্ঞের যখন এই মত, তখন আর কি করা! আবার ফিরে এলাম সখীপুর স্কুলে।
আমার মন তখন ছটফট করছিল। কখন আংগারগারায় আবার ই. পি. আর-দের সাথে দেখা হবে। দেরি হলে তারা যদি অন্যত্র চলে যায়, এটাই ভয়। সেইদিন আমার কাছে ই. পি. দের খুব আকর্ষণীয় না হলেও তাদের অস্ত্রগুলো বেশি প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান ছিল। তাই ই. পি. আর-দের পিছু পাগলের মতো হন্যে হয়ে ঘুরছিলাম। আমি মনে করতাম ই. পি. আর. বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পুলিশ—এদের যত পাওয়া যায়, ততই লাভ। তারা যদি যুদ্ধ নাও করে, তাতে কিছু যায় আসে না। তাদের অস্ত্রগুলো পেলে নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করা যাবে। দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত মানুষের অভাব কোনদিন হয়নি, আজও হবে না।
দুপরের খাওয়া শেষ। প্রকৃতি আমাদের ডাকে সাড়া দিল। আল্লাহর আরশে আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর হলো। বৃষ্টি থেমে গেল। আবার আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম প্রথম হাটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কারণ নরম মাটি বারবার তার কাছে টেনে নিতে চায়। এগুতে দিতে চায় না। সখীপুরের মাটি যেন বলে, আর যেও না। এখানেই থাক। আমরা তোমাদের বুকে আগলে রাখব। অথচ মুক্তির নেশায় ছুটন্ত পথিক আমরা। আমাদের কোন বাঁধা আটকাতে পারে না। দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলি। মাটির পিছু টানও আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে আসে। কচুয়ার কাছে পৌঁছালে মাটি আর আমাদের পিছু টানতে চেষ্টা করলো না। কারণ ততক্ষণে নরম মাটি আবার শক্ত হতে শুরু করেছে। পাহাড়ের মাটির এমনই মহিমা যে, বৃষ্টির একটু ছোঁয়া পেলে সে একেবারে নরম কাদা
পৃষ্ঠা নং ~ ১০০

হয়ে যায়। আবার রোদের স্পর্শে সে হয় ইস্পাতের মতো কঠিন।
সেদিন ছিল কচুয়ায় হাটবার। হাটে হামিদুল হক সাহেবের সাথে দেখা হলে দেশ ও বর্তমান রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হলো। তাঁর সঙ্গী খোরশেদকে এই প্রথম দেখলাম।
কচুয়ার হাট থেকে একটাকা দিয়ে মস্তবড় একটা কাঁঠাল কিনে ছয়জনে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। তারপর আবার আংগারগারার দিকে যাত্রা। কচুয়া থেকে মাইল খানেক যাবার পর হামিদুল হক ও খোরশেদ আলীকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারাও কি আমাদের সাথে যাচ্ছেন?” হামিদুল হক ও খোরশেদ প্রশ্ন করলেন, “আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?”
‘জানি না।’
একথা শুনে হামিদ সাহেব বলেন, “আমি আপনাদের সাথে আছি। আজ তিন-চারদিন ধরে এমন একটা কিছু ভাবছিলাম। কিছু একটা করা দরকার। আমি আর আলাদা হচ্ছি না।
কচুয়ার খোরশেদ বলল, “আমি আপাততঃ যাই। আবার ডাকলেই আমাকে পাবেন।” চলে যাবার পর খোরশেদের চরিত্রের দুর্বলতা সম্পর্কে সাথীরা অনেক আলোচনা করেন। শাজাহান, হামিদুল হক ও আর. ও. সাহেবের কথায় বোঝা গেল খোরশেদের চরিত্রে কোন দৃঢ়তা নেই। যখন যেমন, তখন তেমন। তবে কাজে লাগাতে পারলে, সে সব কাজের উপযোগী।
আমরা এগিয়ে চলেছি। সাথীরা নানা ধরনের হাল্কা মেজাজের কথাবার্তা বলছে। মাঝে মাঝে ’৬৯-এর গণ আন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন ও পরবর্তী পর্যায়ে ২৫শে মার্চের স্মৃতিচারণ করছে। হামিদুল হক মাঝে মাঝে ছয়-দফা আন্দোলন ও তাতে তার অংশগ্রহণের কথা বলছেন। প্রসঙ্গত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর দুর্জয় সাহসের কথাও এসে পড়ছে। সহযোদ্ধা হামিদুল হক লতিফ ভাইর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী।
সন্ধ্যার আগে আমরা আংগারগারা পৌঁছে যথাস্থানে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রথম আংগারগারায় ই. পি. আর-দের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। এক বুক আশা নিয়ে এসে ই. পি. আর-দের না পাওয়ায় আমার বুকটা হতাশায় ভরে গেল। কেবলি আফসোস হলো, মাত্র দু’দিনের জন্য এদেরকে হারালাম। যেদিকে দৃষ্টি রেখে এতটা পথ এগিয়েছি, তবে কি সেটা ব্যর্থ হবে? এমন সময় একটু ক্ষীণ আশার আলো দেখা দিল। কে একজন খবর দিল, গত রাতে ই. পি. আর-রা এখান থেকে চলে গেছে। তারা এখন মল্লিকবাড়ীর কাছাকাছি কোথাও আছে।
আমরা আর তেমন কোন খোঁজ-খবর না করে সোজা মল্লিক বাড়ীর দিকে ছুটলাম। আমার সহকর্মীরাও অস্ত্র পাবার জন্য ব্যাকুল। তাই অস্ত্রের আশায় এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছুটতে কারও বিন্দুমাত্র উৎসাহের অভাবে ছিল না।
আংগারগারা থেকে এবার মল্লিকবাড়ী। মুক্তি পাগল কয়েকটি তরুণ ছুটছি অস্ত্রের সন্ধানে। কোন বাঁধাই আমাদের কাছে বাঁধা নয়। মাত্র দু’থেকে আড়াই ঘন্টায় সাড়ে-বারো মাইল পথ অতিক্রম করে মল্লিকবাড়ী এসেও ই. পি. আর-দের পেলাম না। এদিক ওদিক প্রায় তিন চার মাইল ছোটাছুটি করেও ই. পি. আর-দের কোন হদিস পাওয়া গেল না। তাদের অবস্থান সম্পর্কে
পৃষ্ঠা নং ~ ১০১

অনেককেই জিজ্ঞেস করা হলো। প্রায় সবাই বললেন, এই এলাকায় কোনদিন ই. পি. আর, বা অন্য কোন অস্ত্র-সজ্জিত দলই আসেনি। এত কষ্ট করে, এতটা পথ এসে ই. পি. আর-দের না পেয়ে এবার আমরা অন্ধকারে তলিয়ে যেতে বসেছি। সামনে আর কোন আশা নেই, ভরসা নেই। বার বার মনে হলো, আংগারগারা থেকে আরেকটু খোঁজ-খবর নিয়ে আসলে বোধহয় ভালো হতো। এতক্ষণে যাদের দেহে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি ছিল না, তারা এখন আর পা চালাতে পারছে না। সবাই যে যেখানে পারছি বসে পড়ছি।
আমার মন নিরুৎসাহিত, ভারাক্রান্ত। তবুও বসে থাকার উপায় নেই। সবাইকে নিয়ে মল্লিকবাড়ী একটি চায়ের দোকানে চা খেতে গেলাম। চা পান করলে, আর কিছু না হোক অন্তত কিছুটা ক্লান্তি দূর হবে। আমাদের কাছে তখন একটি ব্র্যাটাগান ও একটি রাইফেল। ব্র্যাটাগানটি আমি বহন করছি আর রাইফেলটি কাঁধে তুলে নিয়েছে মনির। চায়ের দোকানে চা পান করার সময় আর. ও. এবং হামিদুল হক সাহেবের কৃতিত্বে অস্ত্র উদ্ধারের একটি ক্ষীণসূত্র আবিষ্কার হলো। তারা খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারেন, গতকাল ঠিক এমন সময় একদল ই. পি. আর. বাজারের উপর দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। সেটা বাজারের কেউকেউ দেখেছেন। দর্শকদের একজনের সাথে ভাগ্যক্রমে হামিদুল হক ও আর. ও. সাহেবের কথা হয়। লোকটির সাথে আলাপ করে ঐ অঞ্চলের দু’তিনজনের নাম ও তাদের গ্রামের নামও তারা জেনে নেন। এঁদের মধ্যে ভালুকার আফসারউদ্দিন আহমেদের নাম উল্লেখযোগ্য। আফসার মেম্বার ই. পি. আর-দের সঙ্গে সহযোগিতা করছিলেন এবং তাদের অবস্থানও তিনি জানেন।
আমরা যেন এবার ক্ষীণতম আশার আলো দেখতে পেলাম। এই সূত্র ধরে, আবার পথ চলতে শুরু করলাম। পথ চলা তো নয়, যেন শরীরটাকে কোনও মতে টেনে নেয়া। তবুও বসে থাকার উপায় নেই। এগুতেই হবে। এবার গন্তব্যস্থল, মল্লিকবাড়ী থেকে চার মাইল দক্ষিণে ভালুকা থানার একটি গ্রাম।
রাত এগারটায় একটি গ্রামে এসে উপস্থিত হলাম। মল্লিকবাড়ী বাজার থেকে সংগ্রহ করা ঠিকানা মতো খোঁজ-খবর নিয়ে তিনজনকে পাওয়া গেল। তাদের কথাবার্তায় জানা গেল, ই. পি. আর-রা সত্যিই ওখানে এসেছিল এবং এই তিন ভদ্রলোক তাদের সহযোগিতাও করেছেন। তবে ই. পি. আর. দল এখন ওখান থেকে পূবদিকে ঢাকা-ময়মনসিংহের রেল লাইন কাওরাইদ হয়ে কুমিল্লার দিকে চলে গেছে। তাদের ধারণা, ই. পি. আর-রা এখান থেকে আট-দশ মাইলের বেশি যায়নি। তারা আরও জানান, আফসার মেম্বার এ ব্যাপারে একেবারে সঠিক তথ্য দিতে পারবেন। আফসার মেম্বারের বাড়ী এখানে থেকে চার মাইল দক্ষিণ-পূবে। অন্যান্য আর দশজন প্রাক্তন বিডি মেম্বারের মতোই আফসার ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। অথচ স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রবল হাওয়ায় তিনি উদ্বেলিত হয়ে উঠেন।
বিচিত্র সংযোগ
৬ই মে রাতে আমরা আফসার মেম্বারের গ্রামের বাড়ীতে পৌঁছলাম। তখন মেম্বার বাড়ীতে ছিলেন না অন্যত্র গিয়েছিলেন। আফসার মেম্বার তখন কোথায় আছেন তাঁর জনৈক
পৃষ্ঠা নং ~ ১০২

বিশ্বস্ত সহকর্মী জানেন বলে ঐ গ্রামের একটি লোক জানালেন। লোকটির কথা মতোই যাওয়া স্থির হলো। আমরা পাঁচজন। তিনজনকে আফসার মেম্বারের প্রিয় সহচরকে খুঁজে বের করতে পাঠিয়ে আমি একটি ভাঙা বাড়ীর উঠোনে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটা পেরিয়ে গেছে। আমি পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত ও কাতর। গভীর রাত। চারদিকে অন্ধকার। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই, শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। আর. ও. সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে চুপচাপ বসে আছি। কত কী ভাবছি! এক সময় ঘর থেকে বাড়ীর মালিক বেরিয়ে এলে তার কাছে পানি চাইলাম। তিনি একটি মাটির পাত্রে পানি এনে দিলেন। পানি খাওয়া হলে লোকটি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনেরা কোদারে যাবেন?” আমি বললাম, “জানেন? দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে?”
—অয় আমিও হুনছি। এই আইত বিরাইত এগর নগে ঘুইরেন না। এহানকার নোক ভালো না। আপনেরা কোদারে থিকা আইছেন। আমিও এহানকার নোক না। কুড়ি বছর আগে আমিও আমার গেরাম থিকা এহেনে আইছি।।
—আপনার বাড়ী কোথায় ছিল?
—আমার বাড়ী? কাইলাতির পাকুইটা গেরাম। পাকিস্তান হওয়ার পরে বানে বাড়ী ভাইঙ্গা নেয়। খুব আহাল পড়ে। তাই এই মুখি আইছি। ওহানে অন্যের ক্ষেতে কাম করতাম, নাঙ্গল চালাইতাম।
—আমার বাড়ীও কালিহাতি থানাতেই। আমার কথায় লোকটির উৎসাহ আরো বেড়ে গেল।
—আপনার বাড়ী কাইলাতি কোন গেরামে?
—ছাতিহাটি।
—অ্যাঁ, আপনাগোর ছাতিহাটি গেরামে কত গেছি … ছাতিহাটি ঠাণ্ডু মোক্তারের জমি চাষ করছি।।
ঠাণ্ডু মোক্তারের নাম শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
—আপনি ঠাণ্ডু মোক্তারকে চেনেন?
আমার প্রশ্নের আঘাতে, অতীত স্মৃতি অতীত কাহিনী লোকটির চোখের সামনে যেন ছায়াছবির মতো একের পর এক ভেসে উঠতে লাগল। তিনি একগাল হেসে, অতীত অধিকারের সুরে বেশ জোরের সাথে বললেন, “কী কন মিয়া ভাই? ঠাণ্ডু মোক্তাররে চিনমু না? সব চিনি। ভাবীজিরেও চিনি। ঠাণ্ডু মোক্তারের তিন পোলা। এক মাইয়াতো আমিই দেইখা আইছি। তাগোরে কোলেও নিছি।”
আরো অবাক হলাম। লোকটি বলছে কী? তাহলে আমাকেও তো এই লোকটি ছোটবেলায় কোলে নিয়েছেন। তাকে চ্যালেঞ্জ করলাম, “সত্যিই কি আপনি তাকে চেনেন? তাহলে বলুন তো, ঠাণ্ডু মোক্তারের ছেলে-মেয়েদের নাম কি?” লোকটি যেন এ রকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন
পৃষ্ঠা নং ~ ১০৩

হবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অতীত স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, “অ্যাইজকার কথা তো নয়। অনেক দিন হইয়া গেছে। তেমু তার পোলা-মাইয়ার নাম মনে আছে। ভুলমু কী কইরা? মেলা কোলে পিঠে নিছি তো। ভুলতে পারি না। আর যেহেনে জন্ম অয় সেহানের কথাই মাইনষের
বার বার মনে অয়। ঠাণ্ডু মোক্তারের তিন পোলা—আরজু, হিটলার, বজ্র আর এক মাইয়া রমিমারে আমি দেইখ্যা আইছি। তারা তহন ছোট। এহন বোধ করি মস্ত বড় অইয়া গেছে। তোগোরে বোধ করি মনে নাই। গত বছর হুনলাম, ঠাণ্ডু মোক্তারের বড় পোলা আরজু ভোটে খাড়াইছে। জিতছেও নাকি অনেক ভোটে। গরিব মানুষ। সারাদিন অন্যের ক্ষেতে খাইট্যা মরি। সময়-টময়ও পাই না। ইচ্ছা অয়, খোঁজ-খবর নেই কিন্তু পারি না।”
লোকটির কথা শুনে আমি অভিভূত হয়ে বললাম,
“ভালো করে দেখুন তো? এর আগে আমাকে কখনো দেখেছেন কি না?” লোকটি অন্ধকারের মধ্যে নিভু নিভু একখানা প্রদীপ হাতে একটু কাছে এসে, বারবার এপাশ-ওপাশ থেকে আমার মুখ অবলোকন করলেন। বেশ কিছু সময় দেখে বললেন, “না, আপনেরে কহনো দেহি নাই।”
“আমি ঠাণ্ডু মোক্তারের পোলা ‘বজ্র’। হিটলার ভাই প্রায় আঠার বৎসর আগে গেছেন।” ‘আমি ঠাণ্ডু মোক্তারের পোলা ‘বজ্র’ কথাটা শুনতেই লোকটি আমাকে কোলে তুলে নিতে চাইলেন। তাঁর যেন তখনও মনে হচ্ছিল—বজ্র সেই ছোট্টটিই আছে। হয়তো তিনি বজ্রকে দু’তিন বছরের রেখে এসেছেন। আর এতদিনের ব্যবধানে সেই ছোট্ট ‘বজ্র’ও যে একজন পূর্ণ যুবক বলিষ্ঠ তরুণে পরিণত হতে পারে, তা এই লোকটি হয়ত কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়েছিলেন।
আমাকে জড়িয়ে ধরে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। খোরশেদ আলম তখন আমার পাশে। লোকটির কান্নায় তিনিও কেঁদে ফেললেন। পরিচয় জানার পর লোকটি পূর্বের চাইতে আরো অধিক ব্যাকুল হয়ে পড়েন। তিনি বললেন, ‘আর ওগর সাথে ঘোরাফিরা কইরেন না। অয় এহেনেই আইতে থাকেন, নয় সোজা পশ্চিমে চইল্যা যান। দশ মাইলের মধ্যে থাইকেন না।’
আমাদের কথাবার্তা চলার মাঝেই হামিদুল হক ফিরে এসে খবর দিলেন, মেম্বার সাহেবের বিশ্বস্ত লোকটিকে পাওয়া গেছে। আর আফসার মেম্বার খুব একটা বেশিদূরে নেই। এখান থেকে হয়তো মাইল-দুয়েক গেলেই তাকে পাওয়া যাবে। ঐ বাড়ীর লোকটির সাথে কোলাকুলি করে বিদায় নিয়ে আধ মাইল এসে আফসার মেম্বারের লোকদের বললাম, “একটা জরুরি খবর এসেছে। এখনই অন্যত্র যেতে হবে। আমি আর যেতে পারছি না। তবে আফসার সাহেবকে হাতিয়ারসহ লোকজন নিয়ে, সাত দিনের মধ্যে সখীপুরে আমার সাথে দেখা করতে বলবেন। তিনি যদি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চান, ভালো ভাবে কাজ করতে চান, তাহলে আমার পূর্ণ সহযোগিতা অবশ্যই পাবেন। আর যদি সাত দিনের মধ্যে হাতিয়ার নিয়ে দেখা না করেন, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করব।” আফসার মেম্বারের লোকেরা বললেন, “না না, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমরা
পৃষ্ঠা নং ~ ১০৪

বলব তিনি অবশ্যই আপনাদের সাথে দেখা করবেন।” এরপর আর দশ মাইল পশ্চিমে এসে ভোর চারটায় শাজাহানের পরিচিত এক বাড়ীতে উঠলাম। এসেই আমরা খাবার চাইলাম। সময়ের দিকে কোন খেয়াল নেই। যেহেতু বাড়ীর মালিক শাজাহানের দূর সম্পর্কীয় দুলাভাই, তাই আবদারটাও অতিরিক্ত। বাড়ির ভিতরে যে শাজাহানের প্রভূত প্রতিপত্তি তা অনুমান করা গেল। ধূমায়িত ডাল-ভাত আর আলু ভাজা চল্লিশ মিনিটের মধ্যে পেয়ে আমরা সবাই পেটপুরে খেলাম। গতকাল দুপুর একটায় আমরা খেয়েছিলাম। পরে কচুয়াতে ছয়জনে একটা কাঁঠাল খাই। এরপর ষোল-সতের ঘন্টা পর খাবার সামনে পেয়ে আমরা কী যে আনন্দিত হয়েছিলাম এবং কিভাবে গোগ্রাসে উদরপূর্তি করেছিলাম তা রীতিমতো এক মনে রাখার মতো ব্যাপার।
খাওয়া শেষ। সবার শরীর ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়তে চাইছে। দুপুর থেকে রাত চারটে নাগাদ একটানা ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রায় পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ মাইল রাস্তা হেঁটে সকলের হাত-পা টনটন করছে। কিন্তু না, তবুও সবার আরাম করা চলবে না। দু’জন জেগে থাকবে। আর তিনজন ঘুমাবে। পর্যায়ক্রমে ঘুমানো ও পাহারা চাই। স্থির হলো, আমি ও আর. ও. সাহেব প্রথম-পর্যায়ে পাহারায় থাকব। এতে মনির আপত্তি জানিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এটা ঠিক। অস্ত্র চালানোয় পারদর্শী দু’জনের মধ্যে একজনকে পাহারা দিতে হবে। কারণ ডিউটিতে দু’জনেই যদি অস্ত্র চালানো না জানে, তবে ডিউটি দেয়া না-দেয়া সমান কথা। আর অস্ত্র চালাতে জানি আমরা দু’জন। আমি আর আপনি। আপনার অনেক কাজ। তাই এ মুহূর্তে আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন। আমি আপনাকে কমাণ্ডার হিসেবে মেনে নিয়েছি। তাই আজ আমিই প্রথম ডিউটি দিতে চাই। পরের শিফটে দরকার হলে আপনি দেবেন।”
ঘুমের জন্য অপেক্ষা করতে হলো না, শোবার সাথে সাথে নিদ্রাদেবী আমাদের কোলে টেনে নিলেন। ঠিক ছিল, যেমন করেই হোক সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যেই সখীপুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। ঘুম ভাঙতেই দেখি, সকাল ছয়টা কুড়ি। মাঝখানে আর আমাকে ডাকা হয়নি। হামিদুল হকের জায়গায় শুধু আর. ও. সাহেব পরিবর্তন হয়েছেন। মনির এই পৌনে দু’ঘন্টার মত সময় দাঁড়িয়ে বসে কাটিয়ে দিয়েছে।
সবাই হাতমুখ ধুয়ে সখীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে প্রস্তুত। বাড়ীর মালিক চা পান করার জন্য পীড়াপীড়ি করলেন। আমি বললাম, “আমরা সাড়ে ছয়টায় এ বাড়ী থেকে পা বাড়াব। বেঁচে থাকলে জীবনে অনেকবার চা খাওয়া যাবে। আমরা যে পথে নেমেছি, এ পথে নিয়মানুবর্তিতা খুবই প্রয়োজন। ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পাল্টালে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। প্রথম দিনেই যদি সময়ের হেরফের হয়ে যায়, তাহলে কাজে বিঘ্ন ঘটবে।” বাড়ীর মালিক তবুও চা করতে ব্যস্ত। এদিকে ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে ছ’টা বাজার সাথে সাথে চা না-খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম।
সবারই চোখ জ্বালা করছে। সূর্যের দিকে কেউ তাকাতে পারছি না। মনিরের চোখে বোধ হয় সবচাইতে বেশি জ্বালা। কারও শরীর চলতে চাইছে না। হাত, পা, পিঠ ও কোমর ব্যাথায় টন টন করছে। তবুও কেবল মনের জোরে দেহটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। গতকালের মতো তেমন
পৃষ্ঠা নং ~ ১০৫

গতি নেই। তবুও চলছি, এগিয়ে যাচ্ছি।
ঘন্টা খানেক চলার পর পথে এক বাড়ীতে সকালের নাস্তা খাওয়ার জন্য উঠে পড়লাম। বাড়িটি আমাদের পূর্ব পরিচিত। বাড়ীর লোকেরা তাড়াতাড়ি মুড়ি ও কাঁঠাল দিয়ে নাস্তা দিলেন। সাথে চাও পরিবেশন করলেন। আমাদের নাস্তা সারতে আধ ঘন্টার বেশি লাগল না। তারপর আবার পথে। এখনও সখীপুরের দূরত্ব ছয়-সাত মাইল। আগের দিন যেমন আনন্দে পথের কোন দূরত্বই অনুভব করিনি, পা বাড়ালেই যেন পথ শেষ। আজ কিন্তু তেমন পথ ফুরাতে চায় না। দু’মাইল পথ অতিক্রম করতেই ঘন্টা কেটে গেল। নাস্তা সেরে পথে বেরিয়ে পড়তেই হঠাৎ মনে হলো, পশ্চিম দিক থেকে কে যেন উড়তে উড়তে আসছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, লোকটি আমাদেরই একজন। সবাই অবাক! ও কিভাবে আসছে? দৌড়ে, না হাওয়ায় ভেসে? পরে আরও কাছে এলে দেখা গেল ভেসে নয়, হাওয়ায় চড়েও নয়, সে একখানা সাইকেল চালিয়ে আসছে। রাস্তা ছাড়া পাহাড়ি চকের মাঝ দিয়ে ও রকম বেগে সাইকেল চালাতে এর আগে আমরা কেউই দেখিনি।
আগন্তুক আর কেউ নয়, নতুন কর্মী আবু হানিফ। সবাই উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছি, কেন হানিফ অমন করে ছুটে আসছে? তবে কি কোন সুসংবাদ? না, সুসংবাদ থাকলেই কি অমনভাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে মরণপণ করে ছোটা যায়? না, তেমন কোন সুসংবাদ এই সময় নেই। তবে কি কোন দুঃসংবাদ? হয়তো তাই। ততক্ষণে হানিফ কাছে এসে গেছে। সে সাইকেল থেকে লাফিয়ে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে খবর দিল যে, বাশাইলের দিক থেকে সখীপুরে মিলিটারি আসছে। সংবাদ শুনে একটু বিচলিত হয়ে পড়ি। জিজ্ঞেস করলাম, “কতক্ষণ আগে এ সংবাদ পাওয়া গেছে? যখন সংবাদ পাওয়া গেছে, তখন মিলিটারিরা কোথায় ছিল, কতদূরে ছিল? তুমি নিজের চোখে দেখেছ?”
হানিফ জানালো, “কাঙ্গালীরছ্যাও-এর কাছে বংশাই নদীর পশ্চিম তীরে মিলিটারিরা থাকা অবস্থায় আমরা খবর পাই। তাও দেড় ঘন্টা আগে।” খোঁজ-খবর নিচ্ছি আর এগিয়ে চলছি। এতক্ষণ আমাদের শরীরে ব্যথা, আর চোখে ছিল প্রচণ্ড জ্বালা। আমরা চলতে পারছিলাম না। কিন্তু মিলিটারির কথা শুনে শরীরের ব্যথা ও চোখের জ্বালা বেমালুম ভুলে গেলাম। আবার গতি ফিরে পেলাম। বাঘ বা সাপে ধাওয়া করলে মানুষ যেমন দিক বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছোটে, আমরা তেমনি ছুটছি। তবে আমাদের দিক ঠিক আছে। চলতে চলতে হানিফ বলল, “আমি যখন এদিকে চলে আসি, তখন দলের অন্যান্যদের এইদিকে চলে আসতে বলে এসেছি। তারা আড়াইপাড়ায় দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।”
আড়াইপাড়ার দিকে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি। অন্যান্য সহকর্মীদের তখন আমার নাগাল পাওয়া ভার। সবাই হাঁটছি. দৌড়াচ্ছি, আবার হাঁটছি। এমনিভাবে পড়িমরি করে সেদিন আড়াইপাড়ায় এসে পৌঁছাই। আড়াইপাড়া মাদ্রাসার পাশে পুকুরপাড়ে সাইদুর, ফারুক এবং আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের দেখে অনেকটা আশ্বস্ত হলাম। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, রাতে যে বাড়ীতে উঠেছিলাম, সেখান থেকে সাড়ে ছয়টায় যাত্রা করে এক ঘন্টায় দু’মাইল পথ অতিক্রম
পৃষ্ঠা নং ~ ১০৬

করেছি। আবার হানিফের কাছে মিলিটারি আসার খবর পেয়ে পচিশ মিনিটে তিন মাইল রাস্তা পাড়ি দিই। অথচ এক ঘন্টায় দু’মাইল অতিক্রম করতে হাঁটু কাঁপছিল। চোখ জ্বালা করছিল, প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দুঃসংবাদ পেয়ে কিভাবে আমাদের চোখের জ্বালা সেরে গেল এবং হারানো শক্তি ফিরে পেলাম, কি ভাবেই তিন মাইল রাস্তা এত দ্রুত অতিক্রম করলাম, তা বুঝতেই পারলাম না। একেই বলে ‘ঠেলার নাম বাবাজি।’ ঠেলায় খোঁড়াও যে দৌড়াতে পারে, দুর্বলও যে শক্তি ফিরে পায়- এরকম উদাহরণ একেবারে দুর্লভ নয়।
বাশাইল থেকে মিলিটারি আসার খবরটি সত্য না হলেও এতে একটি উপকার হাতে হাতে পেয়েছিলাম। সারারাত হাঁটায় যে অবসাদ, ক্লান্তি, হাত-পা শরীর জ্বালাপোড়া, ব্যথা তা কিন্তু ঐ মিলিটারির আগমন দাওয়া-তে সেরে গিয়েছিল।
৭ মে। খোঁজ-খবর নেবার জন্য বাশাইলের দিকে লোক পাঠানো হলো। প্রেরিত লোক ঘন্টা খানেকের মধ্যে সংগ্রামপুর পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এলো। এতে সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেলাম। কারণ শুন্যা-কাঙ্গালীরছ্যাও থেকে এতক্ষণে মিলিটারিদের সখীপুরে এসে পৌঁছবার কথা। অথচ সংগ্রামপুর পর্যন্তই আসতে পারল না। এটা কী করে সম্ভব? এদিকে আসার অন্য কোন রাস্তা নেই। তবে কি মিলিটারিরা ফিরে গেল? দুপুরে আবার লোক পাঠানো হলো। তাকে বলে দেওয়া হলো, শুন্যা পর্যন্ত যাবে। নিরাপদ বোধ করলে, আরও এগিয়ে যাবে। সম্ভব হলে একেবারে বাশাইল পর্যন্ত।
আড়াইপাড়া মাদ্রাসার পাশে এক বাড়ীতে আমাদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করা হয়। সখীপুর থেকে আসা রাস্তাটির দিকে আমরা তীক্ষ্ণদৃষ্টি রেখে চলেছি। মিলিটারিরা একমাত্র এই রাস্তা ধরেই আসতে পারে। তখন একদিকে ই. পি. আর-দের, অন্যদিকে বাশাইল থেকে আসা মিলিটারিদের কথা চিন্তা করছি। ই. পি. আর-দের কোন নতুন খবর পাওয়া যায় কিনা, তার জন্য আর. ও. সাহেব, হামিদুল হক ও শাজাহানকে খোঁজ নিতে বলেছি। তারা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। দুপুরের দিকে আর. ও. সাহেব ও হামিদুল হক দু’দিকে বেরিয়ে পড়লেন। কোন দিক থেকে চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই। আড়াইপাড়া বাংলাদেশের, বিশেষ করে টাংগাইলের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় স্থান। আশা-নিরাশায় দোদুল্যমান আমরা এখান থেকেই হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ই. পি. আর-দের কয়েকজনকে পেয়ে যাই। বাশাইলের দিকে মিলিটারিদের সংবাদ সংগ্রহ করতে যাকে পাঠানো হয়েছিল, সে শুধু শুন্যা নয়, একেবারে বাশাইল পর্যন্ত ঘুরে এসে জানালো, বাশাইল থানাতে কোন মিলিটারি নেই। শুধু তাই নয়, পাক সেনারা তখন পর্যন্ত বাশাইলেই আসেনি।

বিপুল অস্ত্র উদ্ধার
এই সংবাদে বেশ আশ্বস্ত হলাম। এদিকে হামিদুল হক সাহেবও একটি শুভবার্তা এনেছেন। ই. পি. আর-দের সহযোগিতাকারী চারজনকে পাওয়া গেছে। এদের একজনের নাম আবদুল মালেক। হামিদুল হক সাহেব মালেকের সাথে কথা বলে বাকি তিনজনকে নিয়ে আসার জন্য তাকে পাশের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে এসেছেন। হাতিয়ারসহ তারা যেকোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারে। অন্যদিকে আর. ও. সাহেব অন্য
পৃষ্ঠা নং ~ ১০৭

তিন জনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ করে ফেলেছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ই. পি. আর-দের সহযোগী আবদুল মালেক, আবদুর রাজ্জাক সিদ্দিকী, ছাবদুল ও আরেকটি কিশোর রসদপত্র নিয়ে উপস্থিত হলো। প্রত্যেকের কাঁধে দু’টি করে রাইফেল ও একটি গুলিভর্তি ব্যাগ। এতগুলো রাইফেল ও গুলি একসাথে পেয়ে বেশ আনন্দিত ও আশান্বিত হয়ে উঠলাম। শুধু যে এরা আটটি রাইফেল ও ছয় হাজার গুলি এনেছে, তা নয়। গতকাল সারাদিন আমরা যে উদ্দেশ্যে ছোটাছুটি করেছি, পাগলের মতো এলাকা চষে বেড়িয়েছি, সেই অমূল্য সম্পদের সন্ধানও তারা এনেছে। এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি।
আমার ভিতর তখন আনন্দের বান ডেকেছে। আবদুল মালেকই ই. পি. আর-দের ফেলে যাওয়া অস্ত্রের সন্ধান দিল। আংগারগারা ফরেস্ট অফিসের এক মাইল উত্তরে পরশুরাম মেম্বারের বাড়িতে ই. পি. আর-রা তাদের অস্ত্র-শস্ত্র মাটিতে পুতে গেছে। অস্ত্র তো নয়, যেন গুপ্তধনের সন্ধান। এবার ওগুলো পেতে আর কোন বাঁধা নেই। জায়গা চিহ্নিত করার লোকেরও প্রয়োজন নেই।
কারণ কোথায় কী কী আছে তা মালেকদের নখদর্পণে। আর. ও. সাহেব, শাজাহান ও মনিরকে অস্ত্র আনার দায়িত্ব দেয়া হলো।
সন্ধ্যার পর আবার নতুন অভিযান শুরু হলো। ৩রা মে কালিহাতির অস্ত্র উদ্ধার অভিযান আমি যেমন আনন্দিত হয়েছিলাম, তেমনি ৭ই মে রাতে আবার নতুন করে অস্ত্র সংগ্রহ অভিযানে সহকর্মীদের পাঠিয়ে আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মাঝরাতে তারা ফিরে এলো অস্ত্র নিয়ে। কোথাও কোন বেগ পেতে হয়নি। উদ্ধার পর্বটি মনির সেদিন খুবই দক্ষতার সাথেই সম্পন্ন করেছিল। এটা যে টাংগাইলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কত বড় সাফল্য, কত বড় অবদান, তা পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যাবে।
পরশুরাম মেম্বারের বাড়ী থেকে উদ্ধার-করা অস্ত্রের মধ্যে দু’টি বৃটিশ রকেট লাঞ্চার, তিনটি দুই ইঞ্চি মর্টার, তিনশ’র উপর হাত বোমা, চল্লিশ হাজার নানা ধরনের গুলি, কুড়িটি স্টেনগান, একশ চল্লিশটি রাইফেল, তিনটি বেরি লাইট এবং বারোটি বৃটিশ এল. এম. জি’র গুলিভর্তি ম্যাগাজিন বক্স। ই. পি. আর-দের কাছে আটটি এল. এম. জি. আছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছিল। এল. এম. জি. যে তাদের বেশ কয়েকটি ছিল, তা বারোটা এল. এম. জি ম্যাগাজিন বক্স থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ স্বাভাবিক অবস্থায় একটি এল. এম. জি-র জন্য তিনটি ম্যাগাজিন বক্স বরাদ্দ থাকে। মালেক বলল, “সার, ই. পি. আর-রা খালি এল. এম. জি. নিয়া এট্টু যাইয়াই এল. এম. জি. গুলো গজারি গাছে বাইরাইয়া ভাইঙ্গা থুইয়া গেছে।”
অস্ত্রভর্তি গাড়িগুলো এলে সবার আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ার মতো অবস্থা হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর, অস্ত্র নিয়ে কী করা যায়, কোথায় রাখা যায়, এই সকল প্রশ্ন এলে আনন্দের মাত্রা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তখন যে অস্ত্র আছে, তাদের জন্য বেশি। তার উপর আবার এই নতুন অস্ত্রের তাৎক্ষণিক কী ব্যবস্থা করব? কোথায় রাখব?
৭ই মে গভীর রাত। এ সময়ে আমার দলের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে ছিল— মনিরুল
পৃষ্ঠা নং ~ ১০৮

ইসলাম, সাইদুর রহমান, ফারুক আহমেদ, শামসুল হক, আবদুস ছাত্তার, মহব্বত, গুরখা, হবি, আবু হানিফ, নূরে আজম, আবদুস সামাদ। আর বিকালে আসা আবদুল মালেক, আবদুর রাজ্জাক সিদ্দিকী ও ছাবদুলসহ আরেকজন। আরো আছেন—হামিদুল হক, খোরশেদ আলম, আর. ও. শওকত মোমেন শাহজাহানসহ আরো দু’জন। এদের নিয়েই আপাততঃ আমার দল।
গরুর গাড়িতে যে পরিমাণ অস্ত্র মজুত রয়েছে, তা বণ্টন করে হাতে-হাতে রাখলে কম করে হলেও আরো তিনশ’ লোকের দরকার। অথচ লোকসংখ্যা চব্বিশ কি পঁচিশ। অবশ্য যেকোন জায়গা থেকেই কিছু লোক সংগ্রহ করা যায়। তবে হুট করে, বিচার-বিবেচনা না করে কাউকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিতে রাজী ছিলাম না। আমার ভয় ছিল, প্রথম কোন কাজে ভুল করলে বা কোন ব্যাপারে ব্যর্থ হলে তা সামাল দেয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। তাই প্রথম-প্রথম বিশেষ সতর্কতার সাথে এগুনো উচিত। একবার মুক্তিযোদ্ধারা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠলে,
তখন দু’একটি আঘাত বা ভুলভ্রান্তি মোকাবেলা করা খুব একটা কঠিন হবে না। অস্ত্র বোঝাই গাড়িগুলো রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িগুলো রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকুক, এটা চাই না। জানাজানি হয়ে যেতে পারে। তাই অন্যত্র সরিয়ে নেয়া দরকার। কিন্তু কোথায় নেব। অস্ত্রগুলোই বা কোথায় লুকিয়ে রাখব? গাড়িগুলোকে কচুয়ার দিকে এগিয়ে যেতে বলা হলো। সামনে-পেছনে সশস্ত্র পাহারা। হামিদুল হক, শাজাহান ও আর. ও. সাহেবের সাথে পরামর্শ করতে করতে আমিও গাড়িগুলোর পিছনে-পিছনে চলছি। চলতে চলতে শাজাহান প্রস্তাব করলো, “সখীপুরের ছালাম ফকির বেশ বিশ্বস্ত ও সাহসী। তার বাড়ীটা সখীপুর থেকে মাইল দেড়েক দূরে গভীর জঙ্গলে। ছালাম ফকিরের বাড়ীতে গিয়ে উঠলে কেমন হয়? নিজে ইচ্ছা করে জায়গা দেয় তো ভালো না দেয়, দরকার পড়লে বলপ্রয়োগ করতে হবে।” আমি বললাম, “শুরুতেই নিজেদের লোকের উপর বলপ্রয়োগ করা কোন কাজের কাজ হবে না।”
শাজাহানের প্রস্তাব হামিদুল হক ও আর. ও. সাহেবও সমর্থন জানালেন। ফলে সালাম ফকিরের বাড়ীতে যাওয়াই স্থির হলো। গরুর গাড়িগুলো এগিয়ে চলেছে। কিন্তু চালকরা জানেন না কোথায় যাচ্ছেন, মুক্তিযোদ্ধারাও না। অস্ত্রভর্তি গাড়িগুলো কচুয়া বাজারের কাছ তাদের থামিয়ে দেয়া হলো এবং অন্যদিক থেকে বেশ কয়েকটি খালি গাড়ি অস্ত্রভর্তি গাড়িগুলোর পাশে এসে দাঁড়াল। এতে গাড়ির চালকরা বুঝে নেন তাদের কাজ ওখানেই শেষ। তাড়াতাড়ি খালি গাড়িগুলোতে অস্ত্র বোঝাই করা হলো। অস্ত্রবাহী গাড়ির চালকদের তাদের চাহিদার চাইতে বেশি পরিমাণ অর্থ দিয়ে, কোলাকুলি করে, ভাই, চাচা বলে অনেক সম্মান দেখিয়ে বিদায় দেয়া হলো। পরশুরাম মেম্বারের বাড়ী থেকে প্রথম দলের গাড়িগুলোকে আংগারগারা হাটের পাশেই একটি মাঠে অস্ত্রগুলো নামিয়ে রেখে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় গাড়ির দল মাঠ থেকে অস্ত্রগুলো বোঝাই করে কচুয়ার দিকে যাত্রা করে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে গামছা দিয়ে খুব সুন্দর করে উভয় দলের গাড়িচালকের মুখ ঢেকে দেয়া হয়েছিল, যাতে তাদের কে চিনতে না পারে। অস্ত্র-বোঝাই তৃতীয় দলের গাড়িগুলো অনেকদূর চলে না-যাওয়া পর্যন্ত উভয়
পৃষ্ঠা নং ~ ১০৯

চালকদের কোন কথা না বলতেও অনুরোধ করা হয়েছিল। রাস্তায় গাড়ি বদলাতে দেখে প্রথম প্রথম আর. ও. সাহেব, মনির ও শাজাহান এর প্রয়োজনীয়তা বা কারণ বুঝতে পারেনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার গাড়ি বদলের সময় কারণটা মোটামুটি সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। মনির যখন অস্ত্র আনতে আংগারগারা যায় তখনই হামিদুল হককে দিয়ে তিন বহর গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। একদল আংগারগারা, দ্বিতীয় দল বড়চওনা ও তৃতীয় দলটি আন্ধি ও মহানন্দপুর এলাকা থেকে জোগাড় করা হয়। বড়চওনা থেকে আসা গাড়িগুলো চকের মধ্য দিয়ে সখীপুরের মাইল আড়াই উত্তর-পূবে, বর্তমান মুজিব মহাবিদ্যালয়ের সামনে খোলা প্রান্তরে অস্ত্রগুলো নামিয়ে চলে যায়। বড়চওনার গাড়িগুলোকেও অর্থ ও সম্মান দেখিয়ে বিদায় করা হয়। যদিও আর. ও. সাহেব এসময় আমাকে বলেছিলেন, “কাদের ভাই, এত বেশি টাকা দিলে এবং সম্মান দেখিয়ে ঘাড়ে তুললে, এদের দাবি বেড়ে যাবে। পরে কোন কাজে দরকার পড়লে, আরও বেশি টাকা চাইবে, নিজেদের দাম বাড়াবে।”
আমি কিন্তু সেদিন আর. ও. সাহেবের সাথে একমত হইনি। আর. ও. সাহেবকে বলেছিলাম, “আমরা এদের যতবেশি সম্মান দেখাব, পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে এঁরা তত বেশি আগ্রহ নিয়ে আমাদের সাথে সহযোগিতা করবেন। আর বেশি অর্থ দিলাম বলে বিচলিত হচ্ছেন কেন? এরা সাধারণ দরিদ্র মানুষ। এভাবেই এঁদের পেট চলে। বর্তমান যা পরিস্থিতি তাতে স্বাভাবিকভাবে অনেকদিন হয়তো এরা উপার্জন করতে পারবেন না। তাই বেশি অর্থ দেয়া আমার কিন্তু মোটেই অনুচিত মনে হচ্ছে না। আপনি ভাবছেন, পরবর্তীতে এদের বেশি পয়সা দিতে হবে? আমার কিন্তু ধারণা, পরে আর কাউকে হয়তো তেমন দিতে হবে না। দেয়া যাবে না। তারা নিজেরাই হয়তো গ্রহণ করবেন না।” আমার সেদিনের অনুমান পরে নির্ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।

ছালাম ফকিরের কেরামতি
আকাশের নিচে খোলা মাঠে অস্ত্রগুলো পড়ে রয়েছে। সাথীরা ক্লান্ত, দুর্বল। হামিদ সাহেবকে অনুরোধ করলাম, “এক্ষুণি যেভাবে হোক, সাথী বন্ধুদের আশেপাশে কোথাও বিশ্রামের ব্যবস্থা করুন।” হামিদ সাহেবের কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপি চুপি
বললাম, ‘তবে কোনক্রমেই ছালাম ফকিরের বাড়ীর আগে নয়। সাইদুর, ফারুক, মনির, শাজাহান ও আর. ও. সাহেব রয়ে গেল। বাকিদের নিয়ে হামিদ সাহেব চলে গেলে ছালাম ফকিরকে খবর দেয়া হলো। তিনি এসেই এমন ভাব দেখাতে লাগলেন যে, অস্ত্রগুলো সামাল দেয়া তার পক্ষে সাধারণ ব্যাপার। এ নিয়ে আবার চিন্তা-ভাবনা কিসের? তিনি যেন এখনই অস্ত্রগুলো রাখার পাকা ব্যবস্থা করতে পারেন।
পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দা ছালাম ফকির। তার এলাকার সে-ই মাতব্বর, সর্দার। ফকিরকে আমি এই প্রথম দেখলাম। প্রথম সাক্ষাৎতেই কোন মানুষ সম্পর্কে চূড়ান্ত মতামত প্রকাশ করা যায় না, উচিতও নয়। তবে লোকটিকে আমার অদ্ভুত মনে হলো। লোকটি হয় সৎ, নয়তো অতি বদ। এর মাঝামাঝি তিনি কোনটাই নন। ফকির যে অত্যন্ত সৎ, আদর্শবান, ত্যাগী দেশপ্রেমিকদের অন্যতম, তা কিন্তু তিনি পরবর্তীতে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ১১০

সেই রাতের, রাত বললে ভুল হবে, শেষরাতের ঘটনার মূল নায়ক ছালাম ফকির। ছয় গাড়ি অস্ত্র আনা হয়েছে। অথচ মাত্র দু’ঘন্টায় ছয়জন লোক এক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে নানা জায়গায় এতগুলো অস্ত্র কিভাবে রেখেছিল, সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। রাতে ছালাম ফকিরের বাড়িতে কিন্তু অস্ত্র রাখা হয়নি, অথচ পরবর্তীতে প্রায় সবাই জানতেন অস্ত্রগুলো ছালাম ফকিরের বাড়ীতেই রাখা হয়েছিল। ভোর চারটায় ছালাম ফকিরের বাড়ীতে বিশ্রাম নিতে গেলাম। তখনও অস্ত্র লুকানো-পর্ব অতি উৎসাহের সাথে পূর্ণোদ্যমে অব্যাহত গতিতে চলছে। ভোর সাড়ে চারটার মধ্যে অস্ত্রগুলোর একটু সুষ্ঠু ব্যবস্থা শেষে আমার কাছে একটা পূর্ণ রিপোর্ট দাখিল করা হয়। কোনটি কোথায় আছে, প্রয়োজনে কিভাবে পাওয়া যেতে পারে, সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে তার একটি নক্সা প্রণয়ন করা হয়েছে। এমন সুন্দর রিপোর্ট দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। সেদিন পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, এ ধরনের কর্মঠ, কৌশলী বাঙালিদের ঠেকিয়ে রাখা আর পাকিস্তানীদের পক্ষে সম্ভব নয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ১১১

প্রথম রিক্রুটিং

৮ মে, সকাল সাতটা। মুক্তি বাহিনীর অন্য দলটিকে ছালাম ফকিরের বাড়ীতে আনা হলো। এখানেই সিদ্ধান্ত হলো এক, আর বিলম্ব নয়, আজ থেকেই মুক্তি বাহিনীতে লোক সংগ্রহ করা হবে। প্রথমেই সখীপুর স্কুলের সামনে লোক নেওয়া হবে। দুই, বিখ্যাত দাগী ডাকাত বলে পরিচিত দু’চারজনকে ধরা হবে এবং তারা সত্যিই দোষী এটা প্রমাণিত হলে প্রকাশ্যে গুলি করে শাস্তি দেওয়া হবে। তিন, চার পাঁচ দিনের মধ্যে সমস্ত অঞ্চলে সাংগঠনিক সফর শেষ করে ফেলতে হবে।
৮ই মে, বিকেল চারটা। ছালাম ফকিরের বাড়ী থেকে সখীপুর আসার পথে সহকর্মীদের বললাম, “কি, লোক আসবে তো? মোটামুটি কুড়ি জন ভালো তরুণ পেলেই হলো।” শাজাহান ও আর. ও. সাহেব বললেন, “আজ না পেলেই বা কী? লোকের অভাব হবে না।” হামিদ সাহেবের বক্তব্য, “আমার ধারণা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি লোক আসবে। প্রতি দু’জনের মধ্যে একজন বেছে নিয়ে আমরা প্রয়োজনীয় লোক সংগ্রহ করতে পারব।” মোট কতজন নেয়া হবে, তা পথে আসতে আসতেই ঠিক হয়ে যায়। আজকে কুড়িজনের বেশি নেয়া হবে না। আর যদি লোক কম হয়, তাহলে সখীপুর থেকে যেমন করেই হোক, দশজন লোক সংগ্রহ করতেই হবে।
দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে সখীপুর স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছে আমরা অবাক ও অভিভূত হলাম। মুক্তি বাহিনীতে লোক নেওয়া হবে—এ খবর এলাকায় সামান্যই প্রচারিত হয়েছে, অথচ লোক হয়েছে আশাতীত। লোক নেয়া হবে মাত্র কুড়িজন। সেখানে ছাত্র, তরুণ, যুবক, কৃষক, মধ্য বয়সী ও বৃদ্ধ সব মিলিয়ে লোক দাঁড়িয়েছেন প্রায় দু’হাজার।
আমি একটি চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আমাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও দেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে অনুরোধ জানালাম, “যারা আমাদের সাথে শরিক হতে চান, সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হতে চান, তারা মাঠের বাঁ-পাশে আমার দিকে মুখ করে পাশাপাশি দাড়ান। সাথে সাথে লাইনে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। কার আগে কে দাঁড়াবেন, এই নিয়ে। হুড়োহুড়ি। লাইন মাঠ পেরিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে দু’লাইনের ব্যবস্থা করতে হলো। তাতে কুলাচ্ছে না। আবার তৃতীয় সারি। হিসাব করে দেখা গেল, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রায় সাতশ’র উপর লোক দাড়িয়েছেন। বাকিরা অন্যদিকে গাদাগাদি করে অপেক্ষা করছেন। তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত, তাৎক্ষণিকভাবে নয়, বাড়ী থেকে বিদায় নিয়ে অথবা টুকিটাকি কাজ সেরে।
লাইনে দাঁড়ানো শ’সাতেক লোককে উদ্দেশ্য করে বললাম, “আপনারা সত্যিই কি সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারবেন? হাসিমুখে জীবন দিতে পারবেন? মুক্তিযোদ্ধা হতে অনেক কষ্ট আছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ১১২

প্রতিদিন ত্রিশ-চল্লিশ মাইল হাঁটতে হতে পারে। মাঝে মধ্যে দিনের পর দিন খাবার না-পাবার অনিশ্চয়তাও আছে। তাছাড়া আছে শত্রুর হাতে জীবন যাবার ভয়। ভালো করে ভেবে দেখুন। এগুলো যারা পারবেন, তাঁরা আর-একটু এগিয়ে এসে লাইনে দাঁড়ান। যাদের অসুবিধা আছে। তারা একটু ভেবে দেখুন। যুদ্ধ তো কেবল শুরু। অনেক সময় পড়ে আছে। কবে শেষ হবে আল্লা মালুম।”
মাত্র পঁচিশ-ত্রিশজন লাইন থেকে বেরিয়ে গেলেন। তাদেরও বাদ যাবার বড় একটা ইচ্ছে ছিল না। সখীপুর স্কুলের মাঠ উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। পশ্চিম দিকে মুখ করে তিন সারিতে প্রায় সাত’শ লোক দাঁড়িয়ে আছেন। এদের মধ্যে বারো বছরের কিশোর থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধও আছেন। বয়স যাই হোক না কেন, কেউই মুক্তিযোদ্ধা হওয়া থেকে বাদ পড়তে চান না। সবাইকে বসতে বলে স্কুল ঘরের ভিতর গেলাম। লোক নেব মাত্র কুড়িজন অথচ লাইনে দাঁড়িয়েছেন প্রায় সাত’শ। কী করা যায় এ নিয়ে শাজাহান, হামিদুল হক, মনির ও ফারুকের সাথে আলোচনা করলাম। এখন উপায়! সবাই মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতে চান। পরামর্শ শেষে বাইরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সমবেতদের বললাম, “আমাদের সত্যিই বহুলোকের প্রয়োজন। তবে আজ এই মুহূর্তে নয়। আমরা আপনাদের মাঝখান থেকে বেছে বেছে পরীক্ষা করে কিছু লোক নেব। আজ পনের বছরের নিচে ও পচিশ বছরের উপর কাউকে নেব না। এই বয়স সীমার মধ্যে যাঁরা পড়েন না, তারা দয়া করে লাইনে ছেড়ে জনতার মধ্যে গিয়ে দাঁড়ান। আমরা আপনাদের পরের সপ্তাহে নেবার চেষ্টা করব।” এরপরেও কিন্তু সংখ্যা তিনশ’র নিচে নামল না।
বাছাই শুরু হলো। জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, না-খেয়ে থাকতে পারবে তো? গুলির শব্দ শুনলে ভয় পাবে না? পঁচিশ মাইল একটানা হাঁটতে পারবে? ‘সব পারব।’ সবার এক কথা, একই জবাব! কারও পিঠে কষে দু’তিন ঘা বেত মারা হলো। কিন্তু মুখে কোন প্রতিক্রিয়া নেই, কালিমা নেই। কেউ একটু “উ” শব্দ করছে না। একজনকে তো পনের-বিশখানা বেত মারার পরও সে একটু ‘উহ-আহ্’ করলো না। পরে তার জামা উঁচু করে দেখা গেল, পিঠে প্রতিটি আঘাতের দাগ। বেত্রাঘাত, এক ধরনের পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় ফেল করলে অথবা ভয় পেয়েছে এটা প্রকাশ পেলে সে হয়তো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবে না। অন্য সবারই একই ভয়। তবে এদিন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বাছাই করা সবাইকে কিন্তু বেত মেরে নেয়া হয়নি।
সেদিন চার-পাঁচজনকে হাজারো লোকের সামনে প্রচণ্ডভাবে বেত মেরে মুক্তি বাহিনীতে নেয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে একজনকে আবার সরাসরি গুলি করে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। গুলি করার কাহিনীটি এবার বলছি, ছেলেটির নাম শামসু, বাড়ী আন্ধি। তাকে দু’তিন খানা বেত মারার পর সে বলল, ‘বেত মারলে কী হবে? মিলিটারিরা গুলি করলেও ভয় পাব না।’ এটা শুনে রূঢ় ভাষায় ছেলেটিকে বললাম, “তোমাকে যদি গুলি করে মেরে ফেলি? তাতেও তোমার কোন চিন্তা নেই?” ‘না, বাড়ী থেকে যখন বের হই, তখন এটা মনে করেই এসেছি, একদিন মরতে আমাকে হবেই; তাই আমার কোন ভয় নেই।” তখন আরো ক্রুদ্ধ হয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ১১৩

বললাম, “ঠিক আছে। তোমার মতো লোকের আমার দরকার নেই। তোমাকে গুলি করে মেরেই ফেলব।” তাকে মাঠের পূব পাশে সখীপুর স্কুলের বিজ্ঞান ভবনের বারান্দায় পশ্চিম-মুখ দাঁড় করানো হলো। আমি মাঠে পজিশন নিয়ে ছেলেটির দিকে বন্দুক তাক করলাম। ছেলেটি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। গুলি ছোঁড়ার আগে বললাম, “এখনও সময় আছে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বায়না ছেড়ে ঘরে ফিরে যাও। নইলে এই শেষ।” আমি গুণছি, “এক, দুই, তিন। মনে রেখ আর একবার গুণব। তিন বলার সাথে সাথে তোমার প্রাণ পাখি উড়ে যাবে। আবারও ভেবে দেখ।”
আবার উচ্চস্বরে এক, দুই, তিন বলে ট্রিগার টিপলাম। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক প্রকম্পিত করে বুলেট ছুটে গেল। না, ছেলেটির গায়ে লাগেনি। সে বেঁচে আছে। সবাই কিন্তু তখন চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিল। আমার মনের কথা কেউ জানত না। দলের লোকেরাও না। ছেলেটিও নয়ই। তবে আশ্চর্য ব্যাপার! গুলির শব্দ শুনে ছেলেটি একটা ঝাঁকিও দেয়নি। সম্ভবতঃ চোখও বন্ধ করেনি। তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে, নির্ভীক নির্বাক।
ছেলেটির দিকে বন্দুক তাক করার সময় আমার দুর্ভাবনা ছিল, ছেলেটি যদি দৌড় দেয়। তাতে হয়তো তার গায়ে গুলি লাগতে পারে। আর বন্দুকের নিশানা যদি ঠিক না থাকে, চাহলেও বিপত্তি ঘটতে পারে। একটি অমূল্য প্রাণ ধ্বংস করার ইচ্ছা আমার ছিল না। শুধু পরীক্ষা করে দেখা। ছেলেটি যদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যেতে পারে। তাহলে সমবেতদের মনে এর শুভ ক্রিয়া হবে। স্থানীয় লোকেরাও গর্ববোধ করবে। তারাও যে সাহসী, এটা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নামবে।
এরকম অনেক ভেবে চিন্তে, সোজা ছেলেটির মাথার চার-পাঁচ হাত উপরে নিশানা করে গুলি ছুঁড়েছিলাম। গুলি হয়ে যাবার পর মাটিতে হাত থাপড়ে আফসোস করতে করতে রাইফেলটি তাচ্ছিল্যের সাথে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সীমাহীন খেদোক্তি করে সহকর্মীদের বললাম, “আমার এই প্রথম ব্যর্থতা। এমনভাবে গুলি ফসকে গেল। আমার দ্বারা আর কিছু হবে না। নিরাপদে এমন একটা টার্গেটের গায়ে গুলি লাগাতে পারলাম না। শত্রুর সামনে দুরু দুরু বুকে কী করে গুলি চালাব?” অনুশোচনা করতে করতে সায়েন্স ল্যাবরেটরির বারান্দায় শামসুর কাছে গেলাম। দেখলাম, যে বিন্দুতে নিশানা করেছিলাম তা থেকে ইঞ্চি তিনেক নিচে বারান্দার কার্নিশে গুলিটি লেগেছে। অর্থাৎ ছেলেটির একেবারে সোজাসুজি হাত চারেক উপরে। এতে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। সেই ’৬৭ সালের পর একটিও গুলি ছুড়িনি। তবুও নিশানা অটুট রয়েছে। খুব ভালো ভাবে লক্ষ করলাম, গুলি নিশানা-বিন্দুর একচুল ডানে-বাঁয়ে যায়নি। সোজা তিন ইঞ্চি নিচে লেগেছে। এতে বোঝা গেল, হয় লক্ষ্যবিন্দুর সামান্য নিচে নিশানা হয়েছিল, যা আমি বুঝতে পারিনি। নয় রাইফেলের ফোর সাইট নবে কিছুটা গোলমাল রয়েছে। আরেকবার গুলি চালালেই সেটা বোঝা যাবে।
ছেলেটির কাছে গিয়ে প্রথমে তার বুকের উপর হাত রাখলাম। না, হৃদপিণ্ডের গতি স্বাভাবিক। কোনও ধড়ফড় নেই। একেবারে অবাক হয়ে গেলাম। ছেলেটিতো সত্যিই অসম্ভব ক্ষমতার ধারক। জীবনের প্রতি সামান্যতম মায়া থাকলে এমন নিশ্চল হয়ে গুলির সামনে
পৃষ্ঠা নং ~ ১১৪

কেউ কি কখনও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? শামসুকে বললাম, “ঠিক আছে, আমি হেরে গেলাম। আমার গুলি যখন ফসকে গেল, তখন আর কী করা যাবে। তুমি থাকো আমাদের সাথে। শত্রুর গুলিও যেন তুমি এমনি এড়িয়ে চলতে পারো।”
আরেকজন লোক আরেকটি কাণ্ড বাঁধিয়ে বসল। লোকটির বয়স পনের থেকে পঁচিশ-এর মধ্যে পরে না। তার বয়স মোটেও পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ এর নিচে নয়। অথচ সে জোর করেই বলছে, আমার বয়স কুড়ি। আমারে মুক্তি বাহিনীতে নিতে অইবো’। আমি যখন চ্যালেঞ্জ করলাম, “আপনার বয়স কুড়ি হতেই পারে না। ত্রিশের ঊর্ধ্বেতো অবশ্যই।” তখন লোকটি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে রাগের সাথে চিৎকার করে বলল “আপনাদের গোলা বারুদ অস্ত্র-শস্ত্র আছে দেখতাছি, বয়স মাপার কি যন্ত্র আছে? আমি কইত্যাছি আমার বয়স কুড়ি, আর আপনারা জোর কইরা কইত্যাছেন ত্রিশ পার অইয়্যা গ্যাছে। আমারে একটু সময় দেন। আমি আমার বাপ-মারে নিয়া আইতাছি। আর আমার বয়স যদি কুড়ি বছরই না হইবো তাইলে হেদিন মান্নান তালুকদার এ. ডি. সি-রে উদ্ধার করাইয়া দিবার জন্য মিলিটারিগো নিয়ে আইছিল, হেই মিলিটারিগো গাড়িতে কেরোসিনের টিন নিয়া আগুন দিতে গেছিলাম কি কইর‍্যা?”
লোকটি কিন্তু এতটুকু লেখাপড়া জানে না। এগুলো তার নাটক-করা কথা নয়, প্রাণের কথা, অন্তরের অভিব্যক্তি। তার বয়স পঁয়ত্রিশের উপরে এবং সত্যিই সে একটিন কেরোসিন ও দেশলাই নিয়ে মিলিটারিদের রাস্তা আগলে বসেছিল। উদ্দেশ্য, মিলিটারিরা কাছে এলেই তাদের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া। লোকটির নাম নাছির। বাড়ী সখীপুরের কাহারতা। সখীপুর স্কুলের সামনে থেকে যাদের মুক্তি বাহিনীতে নেয়া হলো তাদের মধ্যে নাছির, শামছু, কাহারতার আবদুল হালিম, শানবান্ধার মকবুল হোসেন তালুকদার খোকা, গোয়াইল বাড়ীর আবুল কাশেম ও মুচারিয়া পাথারের আবু নঈম উল্লেখযোগ্য। মুক্তি বাহিনীর সদস্যসংখ্যা এখন চল্লিশ। অস্ত্রের মধ্যে একটা এল. এম. জি, তিনটা দুই ইঞ্চি মর্টার, কয়েকশ’ হাতবোমা, ও ছয়-সাতটি স্টেনগান, যার নাম পাক-সামরিক ভাষায় চাইনিজ কারবাইন।
৯ই মে। সারাদিন সখীপুরে অবস্থান করে প্রয়োজনীয় খবরা-খবর ও অন্যান্য টুকি-টাকি জিনিসপত্রের ব্যবস্থার করা হলো। রকেট লাঞ্চারের গোলা বহন করার মতো কোন হ্যাঁঙ্গার ছিল না। আর. ও. সাহেব সারাদিন পরিশ্রম করে খুব সুন্দর দু’খানা বাক্স তৈরি করলেন। প্রতিটি বাক্সে দু’সারিতে ছয়টা করে রকেট লাঞ্চারের গোলা নিরাপদে বহন করা যেতে পারে। কিভাবে বাক্স বানাতে হবে, এ সম্পর্কে আর. ও. সাহেবকে কিছুটা ধারণা দিয়েছিলাম। বাক্স দু’টো এমন হতে হবে যাতে কোন অবস্থাতেই দু’খানা সেল একত্র হতে না পারে বা বাক্সর ‘কাঠকি না লাগে। দু’টি সেলের মধ্যে সামান্য সংঘর্ষ হলেই বিস্ফোরণের সমূহ সম্ভাবনা। আমার পরামর্শের চাইতেও বেশি সাবধানতা অবলম্বন করে আর. ও. সাহেব সেদিন বাক্স দু’টি তৈরি করেছিলেন। এ বাক্সে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় রকেট-সেল বহন করা হয়েছে। বাহকদের হাত থেকে দু’একবার বাক্সটা পড়ে গেলেও কোনদিন কোন বিপত্তি ঘটেনি।
পৃষ্ঠা নং ~ ১১৫

৯ই মে সন্ধ্যায়, আমরা আবার সংগ্রামপুরের দিকে রওনা দিলাম। পাঁচ-ছয়দিনে আমার আস্থাবোধ, আত্মপ্রত্যয় ও সাহস বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে সহকর্মীদের উপর যথেষ্ট প্রভাব বেড়েছে। রাতের অন্ধকারে পথ চলছি। চার মাইল পাড়ি দিতেই অনেকে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাচ্ছে অথচ কেউ বলতে সাহস পাচ্ছে না আর পারি না, একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ক্লান্তি ও পথচলার অপারগতার কথা প্রকাশ না করলেও আমার তা বুঝতে বাকী থাকে নি। একবার বলে বসলাম, ‘খুব হয়রান হয়ে গেছি। একটু জিরিয়ে নিলে কেমন হয়?’ সাথে সাথে সবাই আমার কথা সমর্থন করলো।
মুক্তিযোদ্ধারা সংগ্রামপুর বাজার থেকে আধমাইল দূরে সিলিমপুরে বসে ক্লান্তি দূর করছে, কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছে। সখীপুর থেকে রওনার আগে অন্ধকারে কিভাবে চলতে হবে, সব কিছু নিয়মকানুন, ইশারা-ইঙ্গিত, সবাইকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল। রাতে পথচলার সময় যাতে কারো পায়ের শব্দ অথবা কথার আওয়াজ তৃতীয় ব্যক্তি না শুনতে পারে, তার তালিমও দেওয়া হয়েছিল। জোরে যেতে হবে অথবা আস্তে। দাঁড়াতে হবে অথবা আবার চলা শুরু, এ সব ক্ষেত্রে কোন অবস্থাতেই কথা বলা চলবে না। সামনের দিকে যদি দাঁড়াতে হয়, তাহলে সামনের জন চলতে চলতে তার পিছনের সহকর্মীকে টোকা মারবে। টোকার অবশ্য নিজস্ব একটা ধরন থাকবে। সামনের সহকর্মীর টোকা পেলে সঙ্গে সঙ্গে পিছনের সহকর্মী দাঁড়িয়ে যাবে। এমনিভাবে পিছনের শেষ সহকর্মীটি পর্যন্ত দাঁড়াবে। কেউ হয়তো অনেক পথ পিছনে পড়ে গেছে। তাকে দলের সাথে মিলিয়ে নেয়া প্রয়োজন। এমতাবস্থায় একেবারের পিছনের কর্মী সামনের কর্মীর পিঠে টোকা দেবে। এমনিভাবে এই টোকা পিছন থেকে সামনে যেতে-যেতে সামনের প্রথম ব্যক্তিটি পর্যন্ত পৌঁছে যাবে এবং সবাই দাঁড়িয়ে যাবে। পথচলা শুরু করতে হলে একজন উঠে আস্তে করে শিস দেবে। তাকে অনুসরণ করে আস্তে আস্তে অন্যেরাও শিস দিতে শুরু করবে। মুক্তিসেনারা যখন চলতে থাকবে, তখন দু’তিন জন দায়িত্বশীল ব্যক্তি দু’পাশ দিয়ে সামনে থেকে পিছনে, আবার পিছন থেকে সামনে চলাচল করবে।
আধ ঘন্টা বিশ্রামের পর আবার পথচলা শুরু হলো। কিন্তু পথচলা শুরুর মিনিট খানেকের মধ্যে দেখা গেল হঠাৎ যন্ত্রের মতো মুক্তিযোদ্ধারা সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে-পেছনে আমরা কয়েকজন তদারক করছিলাম। একেবারে সামনে গিয়ে কী হয়েছে জানতে চেষ্টা করলাম। না, প্রথমজন কিছু জানে না। সংকেত পেয়ে সে থেমে গেছে। তারপরের জনও কিছু জানে না। এমনি করে পরপর কুড়িজন পার হয়ে গেলাম। অথচ হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাবার কারণ জানতে পারলাম না। আরো এগিয়ে যাব, এমন সময় অন্যপাশ থেকে শাজাহান এসে আস্তে করে জানালো, দলের কনিষ্ঠতম সদস্য সহকর্মী তের-চৌদ্দ বছরের নূরে আজমের পা কেটে গেছে।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে যেসব সংকেত ও কলাকৌশল শেখানো হয়েছিল, তা এরা মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছে। চলতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাওয়া এর যেন একটা মহড়া। বিশ্রামের সংকেত দেয়া হলো। যথারীতি সবাই চারদিকে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে বিশ্রাম নিতে শুরু
পৃষ্ঠা নং ~ ১১৬

করলো। আগে থেকেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল বিশ্রামের সময় কার কী দায়িত্ব, কতজন পাহারা দেবে, কে বা কারা পিপাসার্তদের পানির ব্যবস্থা করবে, অথবা কেউ ব্যথা পেলে বা অন্য কোন কিছু হলে কারা দেখাশোনার ভার নেবে। আহত বন্ধুটির কাছে গেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। চার-পাচ হাত দূরের কোন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। যার পা কেটেছে তার কাছে গিয়ে, প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। সাথে অবশ্যই টর্চ আছে, তবে জ্বালানো যাবে না। আহত বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার কী হয়েছে?” সে বলল, ‘না, তেমন কিছু না। কিসে যেন পা-টা একটু কেটে গেছে। এতে কোন অসুবিধা হবে না। এ নিয়েই হাঁটতে পারব।’ ‘কোথায় কেটেছে দেখি?’ ছেলেটি কিন্তু অন্ধকারে তার ক্ষতস্থানে আমাকে হাত দিতে দিল না। ক্ষতটা ওর পায়ের নিচে। আর আমার বয়স প্রায় ওর দ্বিগুণ। বয়োজ্যেষ্ঠের হাত লাগবে, এটা হতে পারে না। এমনি ভাবনাতেই হয়তো সে দ্বিধা করছিল।
বাধ্য হয়ে হাত বুলিয়ে পা দু’টি খুঁজে নিলাম। প্রথমে যে পায়ে হাত পড়ল, তা অক্ষত। আরেক পায়ে হাত দিতেই চমকে উঠলাম। পা’টা পিচ্ছিল, সামান্য একট উষ্ণও। ব্যাপারটা বুঝতে একমুহূর্তও লাগল না। ছেলেটির সমস্ত পা রক্তে ভিজে গেছে। ক্ষতের পরিমাণ মোটেই অল্প নয়, প্রায় এক ইঞ্চি গভীর, তিনইঞ্চি লম্বা। চলার শুরুতেই এমন বিপত্তি! তাড়াতাড়ি পানি আনতে বললাম। ডেটল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথেই ছিল। শাজাহান পানি নিয়ে এলে, ছেলেটির পা ধুয়ে দেয়া হলো। পায়ের উপরিভাগের রক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করা গেলেও ক্ষতস্থানের রক্ত-ঝরা অব্যাহত রইল। এমনিতেই পাহাড়ের মাটি লাল। একটি তরুণের রক্ত মিশে সে মাটি যেন আরো রক্তলাল হয়ে উঠল।
পা’টা ভালো করে ধুয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধার চেষ্টা করলাম। অথচ অন্ধকারে ভালোভাবে ব্যান্ডেজ বাঁধতে পারলাম না। ছেলেটি আবার দলের সাথে চলতে শুরু করলো। সংগ্রামপুর বাজার পর্যন্ত যেতে-যেতেই তার ব্যান্ডেজ খুলে গিয়ে আবার আগের মতো রক্তঝরা শুরু হলো। উপায়ন্তর না দেখে, পকেট থেকে রুমাল বের করে খুব শক্ত করে ক্ষতস্থান বেঁধে বলিষ্ঠ তিনজন সহকর্মীকে নির্দেশ দিলাম নূরে আজমকে কাঁধে তুলে নিতে।
নূরে আজমের পা কেটে যাওয়ায় মুক্তি বাহিনীর গতি মন্থর হয়ে পড়ল। সংগ্রামপুর থেকে আরো দু’মাইল পশ্চিমে অগ্রসর হওয়ায় পর স্থির হলো, নূরে আজমের একটা ব্যবস্থা করা দরকার। ওকে এভাবে বয়ে বেড়ানো যাবে না। তাই আর বেশিদূর না গিয়ে আশে পাশে কোথাও আশ্রয় নেয়া উচিত। টাংগাইল মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজের অধ্যক্ষ জনাব আবদুল জলিল সাহেবের কাঙ্গালীছ্যাও-এর গ্রামের বাড়ীতে উঠলাম। বাড়ীর লোকেরা তেমন কোন আগ্রহ না দেখালেও এ বাড়ীতে আপাততঃ থেকে যাওয়াই স্থির করা হলো।
যোদ্ধারা ঐ বাড়ীতে খাবে ও থাকবে, একথা জানালে বাড়ীর লোকেরা অনেক টালবাহানার পর ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করেন। রাত তিনটায় খাওয়া-দাওয়া করে আমরা শুয়ে পড়লাম। এখানেও যথারীতি পাহারার ব্যবস্থা করা হলো। বাড়ীর লোকেরা বারবার প্যানপ্যান করতে থাকে,
পৃষ্ঠা নং ~ ১১৭

আপনারা ভোর হওয়ার আগেই চলে যান। আপনাদের জন্য আমরা মরতে পারি না। আপনাদের চলে যেতেই হবে। ভাবখানা এই, তারা পারলে যেন মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাড় ধরে বাড়ী থেকে তক্ষুণি বের করে দেয়।
৩রা মে রাতেই ই. পি. আর-রা সিদ্ধান্ত নিল। নিরাপদে থাকতে হলে প্রথমে স্থানীয় দালালদের সমুচিত শাস্তি দিতে হবে। তাই স্থানীয় কয়েকজনের সহায়তায় একটি ই. পি. আর. গ্রুপকে মান্নান তালুকদারের বাড়ীতে পাঠানো হয়, এদের হাতেই মান্নান তালুকদার নিহত হয়। স্থানীয় লোকেরা সশস্ত্র ব্যক্তিদের আসা-যাওয়া উভয়ই লক্ষ করেছেন। তবে অপারেশন কারা চালিয়েছে তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারে না। অভিযান শেষে ই. পি. আর. গ্রুপটি যখন মূল দলের সঙ্গে আবার মিলিত হয়, তখন তারা দেখতে পায় মালপত্র গরুর গাড়িতে উঠিয়ে ওখান থেকে ঘাঁটি সরানো হচ্ছে। ৩রা মে রাত্রিশেষে ই. পি. আর. দল আংগারগারার সামান্য দক্ষিণে অবস্থান নিয়েছিল। ৪ঠা মে সারাদিন তাৱা ওখানেই কাটায়। বিকালের দিকে আবার উত্তর দিকে রওনা হয়ে ৪ঠা মে মধ্যরাত্রে মল্লিকবাড়ী পৌঁছে। ৫ই মে মল্লিকবাড়ী থেকে দু’মাইল উত্তরে এক বাড়ীতে সারাদিন কাটায়।

প্রথম বিচার
৭ই মে, আড়াইপাড়া বাজারের আর একটি ঘটনা। সে ঘটনা থেকে তৎকালীন বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতার কিছুটা আন্দাজ করা যাবে। সে সময় প্রত্যেকদিন বিকাল ছ’টায় পাকিস্তান রেডিও থেকে বাংলা খবর প্রচারিত হতো। আকাশবাণী (অল ইন্ডিয়া রেডিও) ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও সন্ধ্যার সময় বর্তমান পরিস্থিতির উপর সংবাদ পরিবেশন করা হতো। আমাদের কাছে তখন কোন রেডিও ছিল না। খবর শোনা দরকার। কী করা যায়? উপায়ন্তর না দেখে আড়াইপাড়া বাজারের জনৈক দোকানদারের কাছে তার রেডিও চাওয়া হলো। প্রেরিত লোককে দোকানদার বলে দিল, “আপনি যান, রেডিও পাঠিয়ে দিচ্ছি।” কিন্তু খবরের সময় বয়ে যাচ্ছে দেখে আমি আবার সহকর্মীটিকে পাঠাই। সে গিয়ে দেখে, দোকানদার দোকান বন্ধ করে বাড়ী চলে গেছে। পাশের দোকান খোলা। সে দোকানে রেডিও নেই। সহকর্মীটি ফিরে এসে খবর দিলে আমি খুবই দুঃখ পেলাম। ভাবলাম, শুরুতেই যদি কেউ এমনভাবে অবজ্ঞা করার সুযোগ পায়, তাহলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার জন্য লোকটাকে কড়া শাস্তি দেওয়া দরকার। হামিদ সাহেবকে ব্যাপারটা জানানো হলে, তিনি বলেন, “হ্যাঁ, দু’একজন বাজে লোককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে পরিস্থিতি আয়ত্বে আসবে না। কেউ মুক্তি বাহিনীকে গ্রাহ্য করবে না, এটা হতে দেয়া যায় না। দোকানটা জ্বালিয়ে দিতে কয়েকজনকে নির্দেশ দিলাম।
মুক্তিযোদ্ধারা কেরোসিনের ড্রাম থেকে তেল বের করে দোকানে ছিটাতে শুরু করলো। আমি দোকানের সামনে গিয়ে বুঝতে পারলাম, এ দোকানে আগুন দেয়া সম্ভব নয়। কারণ পাশে তিনটি দোকান। সেগুলো কিছুতেই রক্ষা করা যাবে না। অথচ পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। একবার নির্দেশ দিয়ে তা পরিবর্তন করা দুর্বলতারই লক্ষণ। তাই ভয়-ভীতি ও হাম্বি-তাম্বি করে
পৃষ্ঠা নং ~ ১১৮

যাতে কাজ সারা যায়, সেদিকে বেশি দৃষ্টি দিলাম। সহকর্মীরা দোকানে তেল ছিটিয়ে চলেছে, পাশের দোকানদারদের বললাম, “এই দোকান জ্বালিয়ে দেবো। দোকানদার মিথ্যাবাদী। সে মুক্তিযোদ্ধাদের অবজ্ঞা করেছে। আপনাদের দোকান যাতে না পোড়ে তার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব। দয়া করে আপনাদের মালপত্র সরিয়ে নিন। তারপরও যদি দোকান পোড়ে, আমরা ক্ষতিপূরণ দেবো।”
একদিকে দোকান ঘরে কেরোসিন ছিটানো হচ্ছে, অন্যদিকে পাশের দোকানগুলো থেকে মালপত্র বের হচ্ছে। দোকানগুলোর বেড়াতে পানি ছিটানো হচ্ছে। এ এক দেখবার মতো দৃশ্য! ইতিমধ্যে ঐ দোকানদারের কাছে খবর পৌঁছে গেছে। মুক্তি বাহিনীর সাথে তার আচরণ যে ঠিক হয়নি, সে তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে। তাই সে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে, লোক মারফত রেডিওটা পাঠিয়ে দিয়েছে। পাঠানো লোকেরা এসে বললেন, “লোকটাই অমন। অর মাথায় ছিট আছে। মাফ করে দেন। এই যে রেডিও নিয়া আইছি, দোকানটা পুইড়েন না। তাইলে একেবারে না খাইয়া মরব।”
কার কথা কে শোনে? আমার তখন অগ্নিমূর্তি। রেডিও দিতেই ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। এতে লোকটির ক্ষতি না হলেও রেডিওটার বেশ ক্ষতি হলো। এদিকে জ্বালাও-পোড়াও কর্মে উৎসাহের ভাটা নেই। বালতি-বালতি তেল ছিটানো হচ্ছে।
এদিকে বাশের বেড়ার ঘরে আগুন লাগাতে তেল ছিটনোর কোন প্রয়োজনই ছিল না, তবুও ছিটানো হচ্ছে হচ্ছে। পাশের ঘরটাতো বাঁচাতে হবে? ঘর থেকে মালপত্র পুরোপুরি বের করা হয়নি। তাই আগুন লাগাতে দেরি হচ্ছে। এ সময় এলাকার অনেক মুরুব্বি এসে হামিদ সাহেবকে বার বার অনুরোধ করতে থাকেন, “যা হবার হয়ে গেছে। এর জন্য অন্য শাস্তি দিন। সিদ্দিকী সাহেবকে একটু বলুন। এ দোকানে আগুন লাগলে পাশের দোকানগুলো কিছুতেই রক্ষা পাবে না। আপনারা যে বিচার করবেন, যে শাস্তি দেবেন, তাই সে মেনে নেবে। আপনি মেহেরবানী করে দোকানগুলো রক্ষা করুন।”
হামিদ সাহেব বললেন, “আপনারা নিজেরা কাদের ভাইয়ের সাথে কথা বলুন।” আড়াইপাড়ার পনের-ষোলজন বর্ষীয়ান লোক এসেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রখ্যাত ধনী বি. এ. মৌলভী সাহেবও (আলহাজ্ব মৌলভী আবদুর রহমান) আছেন। সবাই মিলে আমার কাছে। সবাই মিলে আমার কাছে অনুরোধ করলেন, “গ্রামের মধ্যে ঐ লোকটাই একটু বেয়াড়া ধরনের। ওর মাথায় কিছুটা ছিট আছে। সে আপনার সাথে একটু মিথ্যা কথা বলেছে। রেডিও দিতে চেয়েও দেয় নাই। এজন্য দোকানটা জ্বালিয়ে দেয়া কি ঠিক হবে? সে অপরাধ করেছে এটা ঠিক। এজন্য আপনি অন্য কিছু করুন। অন্য রকম শাস্তি দিন।” আমি এমন একটা অনুরোধের জন্যই এত সময় ধরে অত তেল ও পানি ঢালাচ্ছিলাম। বললাম, “আপনারা যখন বলছেন, তখন বিরত হলাম। কিন্তু ঐ অসভ্য বদমাশের বিচার আপনারা করুন।” এতে স্থানীয় মুরুব্বিরা গৌরববোধ করলেন। তাঁরা যেন মনে মনে এলাকার লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, দেখ! আমরা শুধু তোমাদেরই মাতব্বর নই, মুক্তি বাহিনীরাও আমাদের কথা রাখে।
পৃষ্ঠা নং ~ ১১৯

দোকানে আগুন লাগানোর সিদ্ধান্ত বাতিল হলো। মুরুব্বিরা সেই অপরাধী দোকানদারকে এনে হাজির করলেন। আমি স্থানীয় লোকদের বললাম, “আমি এর বিচার করতে চাইনা, আমাদের সামনে আপনারাই বিচার করুন।” জবাবে স্থানীয় কয়েকজন মুরুব্বি বললেন, “দোকানে আগুন দিতে আমরা বারণ করেছিলাম। আপনি আমাদের সে অনুরোধ রক্ষা করে বিচারের ভার আপনারা হাতে তুলে নিয়েছেন। আমরা সবার পক্ষ থেকে অনুরোধ করছি, এর বিচার আপনাকেই করতে হবে। বেত মারুন, জরিমানা করুন, কয়েদ করুন—আমরা খুশি মনে মেনে নেব।”
সবাই বিচারের ভার আমার কাঁধে তুলে দিলেন। বার বার এ দায়িত্ব আন্তরিকভাবে এড়াতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না। মুক্তি বাহিনীর সামনে অন্য কেউ অপরাধীর বিচার করবেন। এমন দুঃসাহস তখন কোন মাতব্বর সর্দারের ছিল না। বাধ্য হয়ে সমবেতদের বললাম, “আমি আপনাদের অনেকের চাইতে নবীন। আপনাদের উপস্থিতিতে আমার হাতে বিচারের ভার দিয়ে বড় বিপদে ফেলেছেন। দয়া করে আপনারা এর বিচার করে আমাকে রেহাই দিন।” তখন ঐ এলাকার অত্যন্ত সম্মানী এক মওলানা সাহেব সোজা দাঁড়িয়ে উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বললেন, “সিদ্দিকী সাহেব বয়সে আমাদের চাইতে অনেক ছোট হতে পারেন তবে জ্ঞান-গরিমা, শক্তি-সাহসে তিনি আমাদের সবার উপরে। এটা আমি তার গুটি কয়েক কথা ও এই অল্প সময়ের আচার-ব্যবহারে বুঝতে পেরেছি। বেশ অনেকদিন যাবত তরুণদের কাছ থেকে বয়সীদের প্রতি এত বিনয়, এত সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে শুনিনি, দেখিনি। তাই আমি এলাকার সবার পক্ষ থেকে সিদ্দিকী সাহেবকে নিঃসঙ্কোচে আমাদের এলাকার এই কুলাঙ্গারটির বিচার করতে অনুরোধ করছি।” এরপর বিচারের ভার নিজ হাতে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় রইল না।
ইতিমধ্যে সমগ্র বাজার-এলাকা লোকারণ্য হয়ে গেছে। তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই। আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, সমবেত জনতাকে সম্মান জানিয়ে বললাম, “আমি আপনাদের সবার কাছ থেকে আদেশ পেয়ে, এই লোকটির অপরাধের শাস্তির বিধান করতে চেষ্টা করছি। আপনারা নিশ্চয় জেনেছেন মুক্তি বাহিনী এর রেডিও অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিল। মুক্তি বাহিনীকে রেডিও দিতে অস্বীকার করলে সেটা তার কোন অপরাধ হতো না। কিন্তু রেডিও পাঠিয়ে দিচ্ছি বলে, তা পাঠিয়ে না দিয়ে দোকান বন্ধ করে বাড়ী চলে যাওয়া, মুক্তি বাহিনীকে ভুয়া আশ্বাস দেয়াটাই তার অপরাধ হয়েছে। এ অপরাধের জন্য বেত্রাঘাত অথবা আটক রাখা আমি সমীচীন মনে করছি না। আমার মনে হয়, একে অর্থদণ্ড দেয়াই সমুচিত হবে।”
আমার কথা শুনে স্থানীয় দু’তিনজন সম্মানী মাতব্বর শ্রেণীর লোক প্রায় একই সাথে বলে উঠলেন, “আপনি ঠিক বলেছেন। এর অর্থদণ্ড হওয়াই উচিত।” এর মধ্যে একজন বললেন, “একে পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা করলেও কম করা হবে।” কেউ বলে, “না, দশ হাজার টাকার বেশি করলে একটু বেশি হয়ে যায়। আর অল্প বয়সীরা বলল, “এ রকম লোকের সব মালামালই বাজেয়াপ্ত করা উচিত।”
এমনি নানা লোকের নানা কথার মাঝে আবার বললাম, “এর অর্থদণ্ড হওয়া উচিত, এতে
পৃষ্ঠা নং ~ ১২০

কি আপনারা সবাই একমত?” সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ’, আমরা সকলে একমত। “বিচারের দায়িত্ব যখন আমার হাতে দিয়েছেন, শাস্তি কী হওয়া উচিত তাও যখন ঠিক হয়ে গেছে। তাহলে অর্থের পরিমাণ কত হওয়া উচিত, তা ঘোষণা করার অধিকারটাও দয়া করে আমাকেই দিন।”
শত শত তরুণ, ছাত্র, কৃষক, ব্যবসায়ী, মাতব্বর সর্দার সবাই আবার সমস্বরে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, পরিমাণটা আপনিই বলে দিন।” সবাই অপলক চোখে আমার মুখের দিকে গভীর কৌতুহল ও উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। সকলের এক চিন্তা, এক কথা, এক প্রশ্ন, জরিমানার পরিমাণটা কত? দশ হাজার? বিশ হাজার? পঞ্চাশ হাজার?
জরিমানার টাকাটা কত ভেবে-চিন্তে তা ইতিমধ্যেই মনে-মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম। কিছুক্ষণ চুপ-চাপ দাঁড়িয়ে থেকে সবার দিকে একবার তাকিয়ে শান্তভাবে বললাম, “আজ ৭ই মে। আড়াইপাড়ার এই দোকানদারের কাছে খবর শুনতে মুক্তি বাহিনী কিছুক্ষণের জন্য তার রেডিও চেয়েছিল। পাঠিয়ে দিচ্ছি বলে সে তা না-দিয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। তাছাড়া দোকান বন্ধ করে চলে গিয়ে মুক্তি বাহিনীর প্রতি দারুণ অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। তার উভয় অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। এই বিচারের দায়িত্ব এলাকার জনগণ আমার উপর অর্পণ করায় আমি তাকে পাঁচ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করলাম।” পাঁচ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করায় সমবেত জনতা স্তম্ভিত হয়ে গলেন। অপরাধী অত্যন্ত বাজে চরিত্রের জেদী লোক। সুতরাং জরিমানার পরিমাণ হবে অনেক, অনেক বেশি, এটাই ছিল অনেকের ধারণা। অন্যদিকে অপরাধী দোকানদার মনে-মনে ভাবছিল, অর্থদণ্ডের পরিমাণ বেশি হলে মুক্তি বাহিনীর সমালোচনা করে প্রচার চালাবার সুযোগ হবে। তখন সে জোর গলায় বলতে পারবে, এটা আবার কিসের বিচার? সুযোগ পেয়েছে, অস্ত্র হাতে আছে, তাই ভয় দেখিয়ে জোর করে কিছু টাকা নিয়ে গেল। কিন্তু পাঁচ টাকা জরিমানা করায় অপরাধী দোকানদারের একথা বলার বা প্রচার চালাবার আর সুযোগ রইল না। তাছাড়া দণ্ডিত অর্থের পরিমাণ এত সামান্য হওয়ায় দোকানদার ভদ্রলোক খুবই লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলো। অপরাধী প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক। পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করলেও না-দিয়ে উপায় ছিল না। পাঁচ টাকা জরিমানা করায় এটাই প্রমাণিত হলো যে, অর্থের প্রতি মুক্তি বাহিনীর কোন দুর্বলতা নেই। সম্পদের প্রতি তাদের কোন লোভ নেই। অবস্থার সুযোগ নেয়াও মুক্তি বাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। এতে মুক্তিবাহিনীর প্রতি স্থানীয় জনগণের মানসিকতায় আসে এক বিরাট বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মুক্তি বাহিনীর প্রতি তাঁদের সহানুভূতি, সহযোগিতা ও ভালোবাসা অনেকগুণ বেড়ে যায়। সমস্ত লোক এক-এক করে আমার হাতে হাত এবং বুকে বুক মিলিয়ে স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গ করার শপথ নেন।
কত অজানারে
১০ই মে। মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা তাদের ইচ্ছামতো সময়েই যাবে, এমনটা বুঝে রাতে যারা বার বার মুক্তিযোদ্ধাদের চলে যেতে অনুরোধ করেছিল, সকালে তাদের অন্যরূপ দেখা গেল। রাতের বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট চেহারা ভোরের আলোতে ঢেকে রাখার প্রাণান্তকর প্রয়াস শুরু হলো। রাতের অযাচিত, অবাঞ্ছিত অতিথিরা
পৃষ্ঠা নং ~ ১২১

সকাল হলেই যেন আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের ভোজবাজিতে পরম আরাধ্য অতিথি হয়ে গেল। শুরু হলো তোষণ আর চাৰ্যবাক্য। একই নাটকের দু’টি বিপরীতধর্মী অধ্যায়। আর. ও. সাহেব তখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় তদারকিতে ছিলেন, তাঁকে ঘিরেই শুরু হলো আপন হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। প্রিয় হওয়ার বাসনায় আহ্লাদে গদগদ হয়ে আর.ও. সাহেব যেদিকে যাচ্ছেন, বাড়ীর কয়েকজন সদস্যও তার পিছু পিছু সেই দিকে যাচ্ছে। রাতের ঘটনা নেহায়েত দুঃস্বপ্ন। তারা যে সত্যিই ঐতিহ্যশালী বনেদি পরিবার এবং কোন ক্রমেই তারা ক্ষতি করতে পারে না বা ক্ষতির চিন্তা করতে পারে না, তা প্রমাণ করার সে কী হাস্যকর অবান্তর চেষ্টা! বহুক্ষণ ধরে বাড়ীর একজন মাতব্বর গোছের লোক পরিবারের অল্প বয়সী আরো চার-পাচজনকে নিয়ে আর. ও. সাহেবের পিছু পিছু ঘুরছিল। ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে মাতব্বর ধরনের লোকটি কণ্ঠে রাজ্যের মধু মিশিয়ে পরিবারের ঐতিহ্য ও আভিজাত্য জাহির করে আর. ও. সাহেবকে বললেন, “দেখেন, এই-ই-ই-ই যে ছেলেটাকে দেখছেন, এ-এ এনা এবার মেডিক্যাল কলেজে পরীক্ষায় ফার্স্ট হচ্ছে। এ-এর বড়জন আই. এস. সি-তে ছয় নম্বর হইছিল। সে-এ-না এখন বিলাতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। সে-ও গতবার পরীক্ষায় গোল্ড মেডেল পাইছে।” লোকটা কথাগুলো বলছিল আদুরে আহ্লাদী স্বরমুদ্রার সঙ্গে। গর্ব আর অহঙ্কারের মিশ্রণে চোখেমুখে প্রতিফলিত বোকা-বোকা হাসি, কথা বলতে গিয়ে লোকটার সিনা যেন কয়েক আঙুল ফুলে উঠছিল। শ্রোতাকে নিজেদের পরিবারের ভালো মানুষি চরিত্র, শিক্ষা ও ঐতিহ্যের ইতিহাস বেশ ভালো বোঝাতে পারছে, আত্মতুষ্টির এমন প্রশান্তির ছায়াও লোকটার মুখে বার বার উঁকি দিচ্ছিল। আর. ও. সাহেব নীরব। লোকটার অহমিকার একঘেয়ে শব্দ যেমন চৈত্রের মতো যতই বেড়ে যাচ্ছিল, আর. ও. সাহেবের চোখে মুখের বিরক্তির ভাব ততই স্পষ্ট হচ্ছিল এবং তাঁর ক্রোধও বাড়ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগই কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি, নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দেশপ্রেমিক সারাদেশের সব প্রান্ত থেকে এ আদর্শের মোহনায় মিলিত হয়েছে। তাদের কোন পিছুটান নেই, বন্ধন নেই, আছে শুধু সামনে চলা, দেশ, লড়াই, স্বাধীনতা। তাদের কাছে সবচেয়ে সুখবর, হানাদাররা মুক্তি বাহিনীর মার খেয়ে পর্যুদস্ত হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের খবর, কোন সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছে, তাদের কাছে মূল্যবান তথ্য, শত্রু সেনাদের অবস্থান ও গতিবিধি, তাদের ধ্যান, খান-সেনাদের খতম ও উচ্ছেদ করা। অন্য সব বৃত্তান্ত তাদের কাছে জলো, কোন মূল্য নেই। এ অবস্থায় লোকটার পোষা বিড়াল-বিড়াল ভাব নিয়ে আর. ও. সাহেবের পিছু পিছু ঘোরা ও তার অবিশ্রান্ত আত্মপ্রচার কপচানি শ্রোতার মনে শুধুই যে ঘেন্না জন্মাতে সাহায্য করছে এবং শ্রোতা যে নিদারুণ বিরক্ত তা বোঝার ক্ষমতাও তার নেই। শ্রোতার নীরবতায় কিংম্বা নীরব সুবোধ শ্রোতা পেয়ে বরফ গলানো গেছে এমন আত্মম্ভর আশায় দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে লোকটি বলতে থাকে, “আর এ-এ এই যে ছোট ছেলেটি দেখছেন? এ এবার এইটে সরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় তিন নম্বর হইছে, এর বড় ভাই ডাক্তার। সে কানাডাতে থাকে। মেম বিয়ে করেছে।” লোকটি এবার বংশানুক্রমিক ভাবে
পৃষ্ঠা নং ~ ১২২

আরো দীর্ঘ ফিরিস্তি দিতে উদ্যত, আ … র বলে পরবর্তী শব্দ উচ্চারণের আগেই আর. ও. সাহেব যারপর নাই বিরক্ত হয়ে লোকটার উৎসাহ আর উত্তেজনার টগবগানিতে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে প্রচণ্ড ধমকে বললেন, “আরে রাখেন আপনার ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, মেম, ফার্স্ট ক্লাস, গোল্ড মেডেল। আমরা করতাছি যুদ্ধ, এখন ঐগুলো দিয়া কী করুম? তার চাইতে ঐ এল. এ. বি. টি. ডিগ্রি-ডাগ্রি বংশাই নদীতে ডুবাইয়া রাখেন। ঝাঁটার কাজ চলব, তাতে অনেক মাছও থাকব।”

নতুন পরিকল্পনা
এখানে বসেই মুক্তি বাহিনীর নতুন পরিকল্পনা আলোচিত হলো। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো, প্রথম বাশাইল থানার পাকিস্তান পন্থীদের ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান চালাতে হবে। বিশেষতঃ থানার কাছাকাছি পাকিস্তান পন্থীদের খুঁজে বের করতে হবে এবং বিচার-বিবেচনা করে শাস্তি দিতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে দু’টি সমস্যা মোকাবেলায় এগিয়ে যাবে। পাকিস্তানী সহযোগী দালালদের নির্মুল ও চোর-ডাকাতের হাত থেকে শান্তিপ্রিয় নিরীহ জনগণকে রক্ষা করা।
১০ই মে। বিয়াল্লিশ জনের দলটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হলো। প্রথম দলে রইলাম কুড়িজন নিয়ে আমি নিজে। দ্বিতীয় দলে পনের জন নিয়ে মনিরুল ইসলাম। তৃতীয় দল, সাত জনের দুই জনই আহত—একজন নুরে আজম, অন্যজন কালিহাতি যুদ্ধে আহত এক ই. পি. আর.। তৃতীয় দল নিয়ে ফারুক আহমেদ লাঙ্গুলিয়া হায়দারদের বাড়ী চলে গেল।
একদিকে মুক্তিযুদ্ধ-সমর্থক আওয়ামী লীগ ও জনগণ, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধ পাকিস্তানী সমর্থক—এ দু’দলের মধ্যে একটা ভেদরেখা ছিল। মুক্তিবাহিনী এ ভেদরেখা উঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। কারণ এ ভেদরেখার ভিত্তিতে পাক-সহযোগীরা হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আদায় করত, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেবার চেষ্টা চালাত। মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী দালালদের আবিষ্কৃত ভেদরেখা নস্যাৎ করে দেবার জন্যই বেছে-বেছে মুসলিম লীগের ও পাক-সহযোগীদের বাড়ীতে থাকা, খাওয়ার অথবা রান্না করিয়ে নেয়ার কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। আমরা পাক-হানাদার বাহিনীর কাছে এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম যে, মুসলিম লীগের ও পাক-সহযোগীরাও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি ভিতরে-ভিতরে সমর্থন জানাচ্ছে এবং মুক্তি বাহিনীকে সর্বপ্রকার সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। এটা দেখিয়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী মুসলিম লীগারদের মধ্যে প্রথমে সন্দেহ ও পরে বিভেদ সৃষ্টি করা। এভাবে হানাদার বাহিনীকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলাই ছিল আমার নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য। তাদের বাড়ীতে চা-নাস্তা, খাবার খাওয়ার ফলে দালাল সহযোগীরা মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে হানাদার বাহিনীর কাছে পূর্বের মতো উৎসাহ নিয়ে নালিশ করতে বা প্রচার চালাতে পারত না।
১১ই মে সকাল। সবাইকে শূন্যার কাছাকাছি রেখে পচাবন্নির এক বাড়ীতে অপেক্ষা করছিলাম। মুক্তিবাহিনী হিসাবে যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেজন্য আমরা তিনজন সাধারণ পোষাকে দশ-বারোটি গ্রেনেড নিয়ে বাশাইলের খবর নেওয়ার উদ্দেশ্যে পচাবন্নি এসেছি।
পৃষ্ঠা নং ~ ১২৩

কাল দশটার দিকে বিছানায় শুয়ে কী যেন ভাবছিলাম। আর. ও. সাহেব পাশে বসে আছেন। শাজাহান বাইরে দৃষ্টি রাখছে। একমুহূর্ত আগেও একটা প্রসঙ্গ নিয়ে আর. ও. সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি চুপ করতেই আর. ও. সাহেব অন্য কী একটা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন, হঠাৎ কে একজন ঝড়ের বেগে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। একেবারে চমকে উঠলাম। হাতের কাছেই গ্রেনেড ছিল। তবে একেবারে জাপটে-ধরা লোকের বিরুদ্ধে যে গ্রেনেড ছোঁড়া যাবে না, এটা আমার ভালো করেই জানা ছিল। তাই পায়ের দিকে যে জড়িয়ে ধরেছে—তার মাথায় সজোরে গ্রেনেড মারতে যাব, এমন সময়ে কানে এলো, “পাইছি, এবার আইছি। আর ছাড়ুম না।” এ কথা শুনেই হাত থেমে গেল। এ তো পরিচিত কণ্ঠস্বর! এ আর কেউ নয়, টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের একজন বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব আবদুস সবুর খান।
৩০ এপ্রিল সবুরকে ঘারিন্দায় ছেড়ে এসেছিলাম। তারপর আমাদের এই প্রথম দেখা। ৩০ এপ্রিল ঘারিন্দা থেকে সবুর বাড়ীতে চলে যায়। তার পক্ষে বাড়ীতে থাকা আর সম্ভব নয় একথা সে আমাকে বারবার বলেছিল। তবু তাকে আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। তার এলাকায় জমিদার মেহেদী খান পন্নী ও সেলিম খান পন্নীর সহায়তায় দালালরা ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বাংলার অনেক আন্দোলনের সূতিকাগার করটিয়া মহাবিদ্যালয়ে তখন রাজাকারদের প্রথম ব্যাচ ট্রেনিং নিচ্ছে। রাজাকার গঠন, লুটতরাজ পরিচালনা, দালালদের সংঘবদ্ধকরণ, মেহেদী খান পন্নী ও সেলিম খান পন্নীকে মদত-দান, ইত্যাদির প্রধান নায়ক হচ্ছে করটিয়ার কলঙ্ক দালাল জাবেদ খাঁ ও তার ছেলে হাতেম আলী।
সবুর ৩০শে এপ্রিল বাড়ী ফিরে মনে-মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে, মরি তো মরলাম, তয় শালার দালালগো শেষ কইরা মরুম। ১লা মে রাতে সবুর কুখ্যাত দালাল হাতেম আলী ঠাকুর দাশের যে বাড়ী দখল করেছিল সেই বাড়ীর পিছনে একটা জাম গাছে চড়ে দোতলার জানালা দিয়ে হাতেমকে লক্ষ করে নিখুঁত নিশানায় গুলি চালায়। গুলিতে দালাল হাতেম আলী মারা যায়। সবুর এর আগে কখনও গুলি ছোঁড়েনি। কিভাবে নিশানা করে গুলি ছুঁড়তে হয়, ২৬ মার্চের পর দু’চারদিন তাকে সামান্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল মাত্র। অন্য দু’তিন বারের মতো এবারও সবুরকে পেয়ে খুবই খুশি হয়ে বললাম, “বড় ভালো সময়ে এসেছ। তিন-চার দিন যাবৎ তোমার কথাই ভাবছিলাম। আর অপেক্ষা করতে হবে না। আমি কাজ শুরু করেছি। শেষ করার দায়িত্ব সবার।” বিকেলে চারজনে মিলে বাশাইল থানার আরো কাছে গেলাম। টাংগাইলের কে কে স্বাধীনতার বিরোধিতা করছে, তার একটা তালিকা ইতিমধ্যেই সংগ্রহ করেছিলাম। বাশাইল থানার দু’চার জনের নামও তালিকায় ছিল।

দালালের কীর্তি
বাশাইল থানার তিন-চার শ’ গজ পূবে একটি গুদামের পাশে অপেক্ষা করছি। এখান থেকে বাজার ও বাশাইল থানার খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করছি। কী কী খোঁজ-খবর নিতে হবে এবং কিভাবে নিতে হবে তা শাজাহান ও সবুরকে বুঝিয়ে দিচ্ছি, এমন সময় থানার দিক থেকে একজনকে সাইকেলে চড়ে আসতে দেখে আর. ও. সাহেব বললেন,
পৃষ্ঠা নং ~ ১২৪

“কাদের ভাই, এই লোকটিকে আমি চিনি। মারাত্মক লোক। বাশাইলের এক নম্বর দালাল না হলেও দু’নম্বরের নিচে নয়। এ যদি সুযোগ পায় তাহলে আমাদের সব কাজ লণ্ড ভণ্ড করে দেবে।” আমিও এরকম একটা সুযোগ খুঁজছিলাম। পরিকল্পনা ছিল, দোষ কম-বেশি যাই হোক, দু’চার জন পাক-সহযোগীকে প্রথম অবস্থায় ধরতেই হবে। অন্যথায় দালালরা উৎসাহী হয়ে উঠবে। তখন খোদ পাকিস্তানীদের চাইতে দালালরাই মুক্তিযোদ্ধাদের অসুবিধা করবে বেশি। এরা আমাদের জ্বালিয়ে মারবে। তাই কাছে আসা মাত্রই লোকটাকে ধরা হবে স্থির হলো। আমাদের কাছ দিয়ে যাবার সময় একপাশ থেকে সবুর, অন্যপাশ থেকে আর. ও. সাহেব এবং পিছন থেকে শাজাহান, তিন জনে প্রায় এক সাথে লোকটাকে জাপটে ধরল। সাইকেলখানা রাস্তাতেই পড়ে থাকল। আর. ও. সাহেব জানতেন লোকটা বড় বজ্জাৎ, ধুরন্ধর। সাথে সাথে একখানা গ্রেনেড দেখিয়ে বললেন, “বেটা চিনিস, এইটা কি? নড়াচড়া করবি তো একটা মারলে দলা পাকিয়ে যাবি। আর বউ-পোলাপানের মুখ দেখতে হবে না। তাই চালাকি করার চেষ্টা করিস না। পালাতে চেষ্টা করলে তোকে এগুলো দিয়ে একেবারে ভর্তা বানাব।”
আর. ও. সাহেব, সবুর ও শাজাহান লোকটিকে নিয়ে আমার দিকে আসছিল। আমিও তাড়াতাড়ি লোকটির দিকে এগিয়ে গেলাম। লোকটির নাম ছানা কাদের। তাকে সেদিন একজন মারাত্মক লোক হিসাবেই পাকড়াও করা হয়েছিল। সত্যিকার অর্থেই মারাত্মক। তবুও কিন্তু সে বেঁচে যায় ও পরে আমাদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনীর জন্য সে প্রচুর কাজও করেছে, এখনও বহাল তবিয়তে একজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা নিয়ে তার এলাকায় বসবাস করছে।
ছানা কাদেরকে পাকড়াও করা হয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে এখন আমরা কী করব? বিচার করব? শাস্তি দেবো, অথবা মেরে ফেলব? কিংবা ছেড়ে দেবো? ছানা কাদের সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। ঠিক হলো, তাকে নিয়ে প্রথমে মূল দলের সাথে মিলিত হব। রাতে দলের সবাই কাউলজানি স্কুলে মিলিত হব, এরকম একটি সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া হয়েছিল।
বাশাইল থানার লেবু মিয়ার বাড়ীর উত্তর-পশ্চিমে একটি পুরানো মসজিদে ছানা কাদেরকে নিয়ে উপস্থিত হলাম। এখানে আগে থেকেই দলটির একটি অংশ অপেক্ষা করছিল। তাদের হাতে ছানা কাদেরকে তুলে দিয়ে অল্পক্ষণের জন্য লেবু মিয়ার বাড়ীতে গেলাম। লেবু মিয়া আমার পূর্ব পরিচিত। তাঁর এক ছেলে শামসু, বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ ও প্রিয়পাত্র। শামসুল আলম আল-মজিদী লতিফ ভাইয়ের বন্ধু মনি ভাইর বোনকে বিয়ে করেছেন। সেই সুবাদে আমাদের ঘনিষ্ঠতা নিবিড়। বাড়ীতে গিয়ে শামসু মিয়াকে ঢাকা ও টাংগাইলের প্রয়োজনীয় কিছু খবরা-খবর এনে দিতে অনুরোধ করলাম। শামসু ভাই-এর স্ত্রী আমাকে খুব স্নেহ করতেন। সেদিনও চরম মুহূর্তে তাঁর স্নেহে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। লেবু মিয়া, তাঁর ছেলে শামসু ভাই ও শামসু ভাইর স্ত্রীর স্নেহ ও আন্তরিকতায় কোন অভাব দেখতে পাইনি। তাঁরা আমাকে খাওয়ানোর জন্য খুব চাপা-চাপি করলে বললাম, “ইচ্ছা করলেই যেখানে-সেখানে এখন আমি খেতে পারি না। আমাদের আরো সহকর্মী আছে, তাদের বাদ দিয়ে যেখানে-সেখানে খাওয়াটা ঠিক হবে না।” বাড়ীর লোকেরা
পৃষ্ঠা নং ~ ১২৫

নাছোড়বান্দা। বাধ্য হয়ে এককাপ চা পান করে বাড়ী থেকে বিদায় নিলাম। পাশেই দুলালদের বাড়ী। বাড়ীতে অবশ্য তেমন কেউ থাকে না। তবুও দুলালদের বাড়ী একবার দেখে মসজিদের কাছ থেকে বাকি সহকর্মীদের নিয়ে কাউলজানি রওনা হলাম। রাত প্রায় বারোটায় কাউলজানি স্কুলে পৌঁছলাম। সেখানে আগে থেকেই ফারুক, শামসু ও আরো দু’তিন জন সহকর্মী অপেক্ষা করছিল। মনির ও হামিদুল হকের দলটি তখনও আসেনি। তাদের খোঁজ-খবর নেবার চেষ্টা করে কোনও খবর সংগ্রহ করতে পারলাম না। এ সময় আমার মাথায় একটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। বাশাইল থেকে ধরে-আনা ছানা কাদের সমস্যা কিভাবে সমাধান করব? একবার ভাবছি ছানা কাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলব। আবার মনের এক নিভৃত কোণ থেকে কে যেন প্রশ্ন করে মেরে ফেলবে কেন? তুমি হাজার মানুষ মারতে পার, একজন মানুষকে জীবন দিতে পার কি? ভালো করে না জেনেশুনে, কোনও মানুষকে মারার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে? সাবধান এমন কাজ কখনো করো না।
মনের ভিতর এ ধরনের প্রশ্ন উঁকি-ঝুঁকি মারতেই চমকে উঠলাম। সত্যিই তো! ছানা কাদের কে? কী তার অপরাধ? এটা ভালো ভাবে দেখা দরকার। সে কিছু একটা অন্যায় করতে পারতো অথচ করেনি। করার সময় পায়নি, পারত সন্দেহে কি মেরে ফেলা যায়? খারাপ কিছু হয়তো নাও করতে পারতো! মানুষের কি পরিবর্তন আসে না? সঙ্গদোষে মানুষ খারাপ হয় আবার সঙ্গগুণে মানুষ ভালোও তো হতে পারে। এ দ্বন্দ্বের কাছে আমাকে নতি স্বীকার করতে হলো। ছানা কাদেরের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত, এ সম্পর্কে দু’তিন জন সহকর্মীর কাছে পরামর্শ চাইলাম। তাদের অভিমত, এ মুহূর্তে এত কিছু ভাবাভাবির প্রয়োজন নেই। ঝামেলা রেখে লাভ নেই। লোকটা খারাপ তার অতীত কার্যকলাপ মোটেই প্রশংসনীয় নয়। সে বেঁচে থাকলে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই।
সহকর্মীদের বক্তব্য শুনে বললাম, “ছানা কাদেরকে মেরে ফেলাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, মুখ্য উদ্দেশ্য দালালদের মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা, তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনা। অন্য কথায়, ভীতির সঞ্চার করে পাক-বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করা থেকে তাদের বিরত রাখা। সম্ভব হলে আমাদের দলে টানা। কিন্তু রাতের অন্ধকারে মেরে ফেললে বাঞ্ছিত ক্রিয়া হবে কি? উদ্দেশ্য সফল হবে কি? বরং ফল উল্টো হতে পারে। আমরা তাকে শাস্তি দিলাম। কিন্তু সরল সহজ জনগণ যদি ভাবে, লুটতরাজের জন্যই লুটেরারা একে মেরে ফেলেছে। তা হলে আমাদের উদ্দেশ্য কি ব্যর্থ হচ্ছে না? আর টাকার জন্য ডাকাতরা মেরে ফেলেছে, অথবা যারা মেরে ফেলেছে তারা ডাকাত-এধরনের কথা বলার বা অপপ্রচার চালাবার লোকের অভাব হবে না।”
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। তাকে মেরে ফেলতে হবে, এটা ঠিক। তবে প্রকাশ্যে জনগণের সামনে দাঁড় করিয়ে তার অপকীর্তির কথা আগে জনগণের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে। তারপর জনগণের অনুমতি নিয়ে গুলি করে হত্যা করতে হবে। অন্য সব পাকিস্তান সমর্থকদেরও একই দশা হবে, এটা আর ঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে হবে না। জনগণের মুখে মুখে সর্বত্র বিদ্যুৎগতিতে প্রচারিত হয়ে যাবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ১২৬

রাতের মতো ছানা কাদের রক্ষা পেয়ে গেল। কারণ তার সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে হবে। জনসমাবেশ করতে হবে। তারপর বিচারের ব্যবস্থা, সবশেষে মৃত্যুদণ্ড। আর এ কাজ তাড়াহুড়া করে করা যাবে না। কম করে হলেও দু’তিন দিন সময় দরকার।
রাত দু’টা। মনিরুল ইসলাম ও হামিদুল হক তাঁদের অপারেশন শেষ করে কাউলজানি স্কুলে আমাদের সাথে মিলিত হলো। রাত তিনটায় আমরা খাবার খেলাম। কাউলজানির কলিবুর রহমান বাঙালি (কলি বাঙালি), রঞ্জু, ইব্রাহীম, খালেক, তমসের ও আরো কয়েকজন আমাদের খাবার ব্যবস্থা করলো।
১২ই মে সকাল। আবার আমরা উত্তর দিকে রওনা হলাম। গান্ধিনা গ্রামের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলেছি। উদ্দেশ্য, বল্লার কুখ্যাত দালাল আবদুর রাজ্জাক আনসারীকে পাকড়াও করা। আমি অনেকটা এগিয়ে। পিছনে শামসু, খোকা আর কাশেমের দায়িত্বে ছানা কাদের। ছানা কাদেরের দু’হাত বাঁধা। কোমরে রশি লাগানো। আপন মনে বল্লার দিকে এগিয়ে চলেছি। এমন সময় পিছন থেকে বক্তৃতার সুর ভেসে এলো। বেশ সুন্দর কণ্ঠস্বর। বলার ভঙ্গিও অপূর্ব। কে বক্তৃতা করছে? পিছনে তাকালাম, এ কী! এ যে আসামি ছানা কাদের! সে হাঁটছে, আর বাঁধা হাত তুলে তুলে প্রচণ্ড আবেগের সাথে একজন সুদক্ষ বক্তার মত বলে চলেছে, “আমি মুসলিম লীগের লোক। আমার বাড়ী বাশাইল। বাশাইলে আমার মতো দালাল আর নাই। আমি পাকিস্তানের দালাল। তাই আমাকে মুক্তিবাহিনী ধরছে। আমার মৃত্যু অবধারিত। এ মৃত্যু থেকে আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। তবে মরার আগে সবাইকে বলে যেতে চাই—আপনারা যদি কেউ দালালি করেন তাহলে আমার মতো শাস্তি হবে। আমার চাইতেও কঠিন শাস্তি আপনাদের হবে। হুঁশিয়ার! আমি মরি, দুঃখ নাই। আপনারা আর কেউ পাকিস্তানের দালাল হইয়েন না।”
বক্তৃতা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। কে একে বক্তৃতা করতে বলেছে? নাকি নিজেই মরিয়া হয়ে শুরু করে দিয়েছে? আমি বক্তৃতা শুনতে পেয়েছি—এটা জেনে খোকা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কাদের ভাই, দালালটা বক্তৃতা করছে। এটা কি বন্ধ করব?” “না, কোন দরকার নেই। কিছুক্ষণ পরেই যখন মরবে, দু’চার কথা বলেই মরুক। বাঁধা দেয়া ঠিক হবে না।”
সে যে দালাল, তা নিজেই বলতে চায়। এটা সে গত রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছিল। দালালটির এ কাজে ইন্ধন জুগিয়েছিল মকবুল হোসেন খোকা। তার যুক্তি ছিল, “ওকে দালাল বলে ধরেছি। রাস্তার মানুষ যখন জিজ্ঞেস করে তখন তা আমরা বলতে যাব কেন? ও নিজেই মৃত্যুর আগে সেটা ঘোষণা করে যাক।” গান্ধিনা থেকে বল্লা, এ রাস্তায় সে যাকে যেখানে পেয়েছে—তার কাছেই চিৎকার করে উৎসাহী বক্তার মতো তার বক্তব্য পেশ করেছে। জানিয়ে দিয়েছে, সে দালাল, তার ক্ষমা নেই।
বল্লা আসার পর আব্দুর রাজ্জাক আনসারী বাড়ীতে আছে কিনা—তার খবর নেয়া হল। রাজ্জাক আনসারী বাড়ী নেই। তখন সে টাংগাইলে মিলিটারিদের সাথে অবস্থান করছে। বল্লা বাজার থেকে কিছু কাপড় ও পনের-জোড়া কাপড়ের জুতা কেনার পর আমরা যখন যাবার উদ্যোগ নিচ্ছি, ঠিক তখন ছানা কাদের বলল, “সাহেব, আমি এখানে আমার শেষ কথা বলতে চাই।” বাজার
পৃষ্ঠা নং ~ ১২৭

এলাকায় তখন পাঁচ-ছয়শো লোক সমবেত হয়েছিল। একটি খালি ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে ছানা কাদের বক্তৃতা শুরু করে দিল। আবেগ-গম্ভীর কণ্ঠস্বর। প্রচণ্ড জোর। বক্তৃতার ধারা ও বক্তব্য একই। কোনও হের-ফের নেই। কিছুমাত্র আত্মপক্ষ সমর্থন করছে না। বক্তৃতার মাঝে সে তার এক হাতের বাঁধন খুলে দিতে অনুরোধ জানালো। বাঁধন খুলে দিলে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে চিৎকার করে সকলের উদ্দেশ্যে বলল, “সাবধান! আমার মতো কেউ দালালি করবেন না। তা হলে অবস্থা আমার চাইতেও খারাপ হবে।” সত্যিই ছানা কাদের সেদিন বল্লা বাজারে এক অদ্ভুত বক্তৃতা করেছিল।

দালাল বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ
পুরো দলটিকে নিয়ে বল্লা বাজারের পূর্ব পাশে রাজ্জাক আনসারীর বাড়ীতে গেলাম। বাড়ীতে মোট তিনটি ঘর। একটি রাজ্জাকের, একটি তার মা’র এবং অন্যটি ছোট ভাইয়ের। বাড়ীতে রাজ্জাক আনসারীর বৃদ্ধা মা ও ছোট ভাই ছিলেন। আমরা রাজ্জাক আনসারীর মাকে বললাম, “দেখুন, আপনার ছেলে পাকিস্তান আর্মির সাথে সহযোগিতা করছে। আমরা তার ঘরটি পুড়িয়ে ফেলব। দয়া করে আপনি একটু অন্য বাড়ীতে চলে যান। আমরা শুধুমাত্র রাজ্জাকের ঘরটিই পুড়াব। অন্য ঘরের যাতে কিছুমাত্র ক্ষতি না হয়, তার আপ্রাণ চেষ্টা করব। তারপরও ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকব।”
রাজ্জাক আনসারীর মা-ও, অন্যান্য মায়েদের মতো পরিষ্কার বললেন, “আমার ছেলে যা করুক, আমার অনুমতি নিয়ে তার ঘর তোমরা জ্বালাতে পার না। তোমরা আমাকে অপমান করতে পার, বাড়ী-ঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পার কিন্তু আমার অনুমতি পেতে পার না।” “দেখুন আপনি আমার মায়ের সমান, অপমানের প্রশ্ন উঠে না। মা হিসাবে আপনার ছেলেকে ভালোবাসুন। তাতে আমাদের কিছুমাত্র আপত্তি নেই। বরং আপনাকে সম্মান জানাব। তবে মা হয়েও কি সন্তানের কাজের কোন বিচার করতে নেই?” জবাবে তিনি বললেন, “আমি বুঝি। সব সময় আমার ছেলে ঠিক কাজ করে না। তবে তোমরা যা খুশি করতে পার। আমার মত নিয়ে কিছু করতে পারবে না।”
ভদ্র মহিলার বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে। তিনি তার ঘর ছাড়লেন না। মুক্তিযোদ্ধারা রাজ্জাক আনসারীর উত্তর-মুখো ঘরে আগুন দিল। রাজ্জাক আনসারীর মা এক দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন। কোন প্রতিবাদ করলেন না। রাজ্জাক আনসারীর ছোটভাইও মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। রাজ্জাক আনসারীর ঘর জ্বলছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে। আর তার মায়ের এবং ছোট ভাইয়ের ঘর রক্ষার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা অনবরত পানি ছিটাচ্ছে। আশপাশ থেকে কলাগাছ এনে ফেলেছে।
রাজ্জাক আনসারীর ঘরের পনের-বিশ হাত দক্ষিণে একখানা কুঁড়ে ঘর ছিল। সেটাই মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় ফেলেছিল। অনবরত পানি ছিটিয়ে ও কলাগাছ ফেলে রাজ্জাক আনসারীর মায়ের ও ছোট ভাইয়ের ঘর রক্ষা করা সম্ভব হলো কিন্তু পনের-ষোলজন
পৃষ্ঠা নং ~ ১২৮

মুক্তিযোদ্ধা ঘর্মাক্ত হয়ে সব রকম চেষ্টা চালিয়েও কুঁড়ে ঘরখানা পুরো রক্ষা করতে পারল না। সামান্য ক্ষতি হলো এবং ক্ষতিপূরণ হিসাবে ঘরের মালিককে দু’শত টাকা দেয়া হলো।
রাজ্জাক আনসারীর ঘর যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল, পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছিল, তখনও তার মা ত্রিশ-চল্লিশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আগুনের তাপে তিনি ঝলসে যাচ্ছিলেন। অথচ বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি সরে যেতে অস্বীকার করেন। এমতাবস্থায় আমি তাঁকে জাপটে ধরে সেখানে থেকে বেশ খানিকটা দূরে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিই। ঘর পোড়া শেষ হলে বাড়িতে তিন-চারটি বোমা ফাটিয়ে ও এল. এম. জি-র এক ম্যাগাজিন গুলি খরচ করে পরীক্ষা করে নিলাম গ্রেনেড কেমন আছে, আর লাইট মেশিনগানটি ঠিক কাজ করছে কি-না।
আনসারীর বাড়ী ত্যাগ করার সময়, তাদের ঘরের সব মালামাল যথাস্থানে আছে কিনা রাজ্জাক আনসারীর মাকে দেখতে অনুরোধ করলাম। রাজ্জাক আনসারীর মা ঘরগুলো পরীক্ষা না করেই বললেন, “তোমরা যাও। সবই ঠিক আছে।” ওখান থেকে নাগবাড়ীতে এলাম। আমার দূর-সম্পর্কের এক দাদা আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়ীর ম্যানেজার। মুক্তিযোদ্ধারা চৌধুরী বাড়ীতে উঠলে বাড়ী থেকে সামান্য দূরে, নাগবাড়ী হাইস্কুলের ছাদে বসে দূরবীনের সাহায্যে চারান ও বল্লার দিকে নজর রাখছিলাম। ওদিকে আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়ীতে রান্না হচ্ছিল। এক সময় দাদা মুচু মিয়া ইয়ার্কি করে বললেন, “আমার দাদা ভাইটি যদি আসে তাহলে খাসি জবাই করে খাওয়াব। সে না এলে তোমাদের এই ডাল-ভাত খেতে হবে।” এ কথা শুনে একজন মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে এলে সব শুনে বলে পাঠালাম, “শুধুমাত্র ডাল-ভাতেরই যেন ব্যবস্থা করা হয়। অন্যকিছু হলে আমরা খাবার ছোঁব না।”
মুচু মিয়া তামাশা করে বিপদে পড়ে গেলেন। কারণ ডাল-ভাত বলতে তিনি ডাল-ভাতই বোঝাতে চাননি। আর এটা তো সকলেরই জানা, বাংলাদেশে কোন বাড়ীতে ডাল-ভাত খাওয়ানোর কথা বলতে শুধু ডাল-ভাতই বোঝায় না। অথচ সেদিন মুচু মিয়াকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শুধু ডাল-ভাতেরই ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তিনি আমাকে ছেলেবেলায় থেকে দেখে এসেছেন। কথার খেলাপ যে মানব না, এতে তার কোন সংশয় ছিল না।

ছত্রভঙ্গ সহযোদ্ধারা
এদিকে চৌধুরী বাড়ীতে খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে একই সময়ে হানাদার বাহিনী বল্লার বাজার পোড়াতে শুরু করেছে। রাজ্জাক আনসারীর ঘর পুড়িয়ে দেবার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বল্লা বাজার পোড়ানো শুরু হয়েছিল। রাজ্জাক আনসারীই ছিল এই জ্বালাও-পোড়াও অভিযানের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। বল্লা বাজার দাউ দাউ করে আগুনে জ্বলছে। দোকানের মালিক, ব্যবসায়ী, বাজারী সবাই যে যেদিকে পেরেছেন প্রাণভয়ে পালিয়েছেন। মিলিটারিরা উদ্দেশ্যহীনভাবে মাঝে মাঝে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ছে। হানাদার বাহিনীর এসব কাণ্ডকারখানায় আমার মনে শান্তি চলে গেল। অস্থির হয়ে উঠলাম। কতদিন হয়ে গেল মিলিটারিরা যা খুশি তাই করছে এবং নিরাপদেই করছে। কোনও বাঁধা পাচ্ছে না। এভাবে বেশিদিন চলতে দিলে ওদের সাহস আরও বেড়ে যাবে। মিলিটারিদের কিছু
পৃষ্ঠা নং ~১২৯

একটা করা দরকার, এরকম ভাবতে ভাবতে চৌধুরী বাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যাচ্ছি, হঠাৎ লক্ষ করলাম পূর্বদিক থেকে ফারুক ছুটে আসছে।
– এই ফারুক, তুই কোত্থেকে ছুটে আসছিস?
— সবাই বাশাইলের দিকে চলে গেছে। আমিও যাচ্ছিলাম। কিছু দূর গিয়ে মনে পড়ল, আপনার স্যান্ডেল ফেলে গেছি। তাই ওটা নিতে এসেছি। গুলির আওয়াজ পাওয়ার সাথে সাথে চৌধুরী বাড়ীতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা পড়ি কি মরি করে পূর্বদিকে ছুটেছে। বংশাই নদীর ওপারে না যাওয়া পর্যন্ত তারা মোটেই স্বস্তিবোধ করেনি। একবারও পিছনে তাকায়নি। সংগ্রামপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের মিসফায়ারে এস. পি., ও. সি., ও পুলিশদের যে দশা হয়েছিল, বল্লার মিলিটারিদের গুলির আওয়াজে মুক্তিযোদ্ধাদেরও সেই একই হাল হয়েছে।
ফারুকের কথা শুনে সাংঘাতিকভাবে ক্ষুব্ধ হলাম। মুক্তিযোদ্ধারা গুলির শব্দে এমন অর্বাচীনের মতো আচরণ করবে, এটা মোটেই আশা করিনি। ৩রা এপ্রিলের পর এই প্রথম আমি এত ক্ষুব্ধ হলাম। গভীর ক্ষোভ ও বেদনায় ফারুককে বললাম, “স্যান্ডেল নেবার কথা তোদের মনে রইল আর যার স্যান্ডেল তাকেই ফেলে ভাগলি?” আমার এই প্রশ্নের মুখে ফারুক বড়ই অসহায়। সে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, “কাদের ভাই, আমি একা কী করব? সবাই যেখানে ছুটে পালাচ্ছে, আমার কী করবার আছে? আমি তো ওদের অনেকের থেকে ছোট।” আর দেরি না করে পালিয়ে-যাওয়া দলের সন্ধানে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম। বংশাই নদীর পূবপারে ডাবাইল পৌঁছে দেখি, সহকর্মীরা একটা আমগাছের নিচে বসে বাতাস খাচ্ছে। বিশ্রাম নিচ্ছে। আমার চোখে মুখে তখন আগুন। হাতে বন্দুক। সহকর্মীদের সামনে উন্মাদের মত চিৎকার করে বললাম, “তোমরা না জীবন দিতে এসেছ? লজ্জা করে না, বসে বসে খেতে? ভর্তি হবার সময় না সবাই বলেছিলে ‘জান দিতে পারব?’ বল্লায় মিলিটারিরা এলো আর নাগবাড়ী থেকে লেজ গুটিয়ে পালালে? এটা জীবন দেয়ার নমুনা? আবার মুক্তিযোদ্ধা বলে বাহাদুরী কর, নাম জাহির কর। শিয়াল-কুকুরও তোমাদের মতো পালায় না।”
দু’চার জন বাদে আর সব সহকর্মীকে তখন পর্যন্ত ‘আপনি’ বলে সস্বোধন করতাম, সেদিন দুঃখ-বেদনা ও উত্তেজনায় ‘আপনি’ বলে সস্বোধন করার কথা পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম। আমি রাগারাগি গালি-গালাজ করে চলেছি, আর সবাই হাউমাউ করে কাঁদছে। আর. ও. সাহেব, শাজাহান, সেই গুলি-খাওয়া বীর শামসু কেউ বাদ নেই। প্রত্যেকেই যেন বিবেকের দংশন অনুভব করছে, কারো মুখে কোন কথা নেই, জবাব নেই। সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। একসময় ফারুক বলল, “ভুল হয়ে গেছে। আমরা বুঝতে পারিনি। মাফ করে দিন।”
ফারুকের এ কথা বলার পিছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। সে আমার বহুদিনের পুরোনো সহকর্মী। সুখে-দুঃখে পাশে-পাশে ছায়ার মতো থেকেছে। একাত্তরের এই দুর্যোগেও একসময়ে সে-ই আমার একমাত্র সাথী ছিল। তাই যখন বললাম, “তোমরা যেখানে খুশি যাও। আমি একাই বল্লা যাব।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৩০

মারতে না পারি, একা-একা মরতে তো পারব। মরার তো অধিকার আছে।” তখনই ফারুক বলে বসল, ‘ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দিন।’ তার সাথে সবাই সুর মেলাল। সবাই বল্লা যেতে প্রস্তুত, “আমরাও আপনার সাথে যাব।” আমি রাগে-ক্রোধে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে বললাম, “তোমাদের আর বীরত্ব দেখাতে হবে না। আমার সাথে যাবে। রাস্তায় আবার পিছন থেকে পালাবে।” সহকর্মীরা বলল, “কথা দিচ্ছি আমরা আর পালাব না। সবাই যাব এবং আপনার হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।”
অনেক চিল্লাচিল্লি করে শান্ত হলাম। না হয়ে উপায় কী? “ঠিক আছে। তবে সবাই যাবে না। আমরা শুধু দশ জন যাব। যাদের ভালো মনে করছি এক-এক করে তাদের নাম বলছি। তারা আলাদা সারিতে দাঁড়াও, আমার সাথে যাবে। বাকিরা অপেক্ষা করবে।” সবাই সম্মত হলো। এত গালি-গালাজ ও বকাঝকার পর সবাই কিছুটা খুশি হলো। এ যেন মুষলধারে বৃষ্টিপাতের পর ঝিলিক দিয়ে সূর্যোদয়। যাদের সাথে নিলাম তারা হলোঃ আবদুস সবুর, খোরশেদ আলম আর. ও., মনিরুল ইসলাম, সাইদুর রহমান, আবদুল হালিম, আবু নাসির, বল্লার আবদুর রশিদ, ছাবদুল, আন্ধির শামসু।
যারা রয়ে গেলঃ হামিদুল হক, শাজাহান, ফারুক আহমেদ, শামসু, ছাত্তার, মহব্বত, মোতালেব গুরখা, হবি, আবু হানিফ, মকবুল হোসেন খোকা, আঃ মালেক, আঃ রাজ্জাক সিদ্দিকী, কাউলজানির তমছের, গোহাইলবাড়ীর আবুল কাশেম, আবদুস সবুর, সামাদ, লোকমান হোসেন, শূন্যার খলিল, আসামি ছানা কাদের, আবু নঈম ও অন্যান্যরা।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৩১

চারানে সফল গেরিলা অপারেশন

এই প্রথম শত্রুর গতিরোধ করতে চলেছি। যেতে যেতে ভাবছি, এখন বল্লায় গিয়ে কিছু করা যাবে না। হানাদার বাহিনী রাতে কিছুতেই গ্রামে থাকবে না। তারা ফিরে যাবেই। বল্লা থেকে টাংগাইলের দূরত্ব প্রায় বারো মাইল, আর কালিহাতি পাঁচ মাইল। যেহেতু হানাদার বাহিনী পায়ে হেঁটে এসেছে, সেহেতু তারা আবার হেঁটেই ফিরবে—এটা ভেবে ডাবাইল থেকে নাগবাড়ীকে বামে ও ধানগড়া ডানে রেখে শুধু চকের মাঝ দিয়ে আমরা উল্কার বেগে ভণ্ডেশ্বর পর্যন্ত ছুটে এলাম। মিলিটারিরা যে রাস্তা দিয়ে ফিরে যাবে, সে রাস্তা এক থেকে দেড় মাইল বামে রেখে কালিহাতির দিকে এগিয়ে চলেছি যাতে মাঝপথে ঘাপটি মেরে বসে থেকে খানসেনাদের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। ভণ্ডেশ্বর থেকে জোয়াইর পেরিয়ে চারান গ্রাম। টাংগাইল-ধলাপাড়ার রাস্তা, চারান গ্রামের পূব পাশে কালিহাতি-বল্লা রাস্তাকে সমান্তরালভাবে বিভক্ত করেছে। এখানেই শত্রুকে অভ্যর্থনা করা চাই।
জেয়াইরবাসীরা পানি, মুড়ি ও মিঠা আলু নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় বললেন, “আপনাদের ক্লান্ত দেখা যাচ্ছে। পানি খেয়ে যান। শরীরে বল না থাকলে কি যুদ্ধ করা যায়?” তাঁদের অনুরোধ বা আবদার শেষ হবার আগেই মুক্তিযোদ্ধারা পানি পান শুরু করে দিল। তারা খুবই পিপাসার্ত। সেই সকালে নাস্তার পর আর কিছু খায়নি। নাগবাড়ীতেও খাওয়া হয়নি। ক্ষুধার জ্বালায় সবাই কাতর, মুহ্যমান। চিড়া, মুড়ি, পোড়াআলু যে যা পাচ্ছে গোগ্রাসে খেয়ে নিচ্ছে। গ্রামবাসীদের কেউ কেউ দুধ এনে মুক্তিযোদ্ধাদের পান করাচ্ছিলেন। খাওয়ার পর্ব শেষ করে আমরা ওঁৎ পাতার জন্য এগুতে থাকলাম।
ফটিকজানী নদীর ওপারে টাংগাইল-ধলাপাড়ার রাস্তা। রাস্তার পাশে পূব-দক্ষিণ দিকে মুখ করে বল্লা-কালিহাতির রাস্তায় ওঁৎ পাতার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দেখি হানাদার বাহিনীর কয়েকজন ধলাপাড়া-টাংগাইলের কাঁচা সড়ক ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গেছে। বাকিরাও অতিক্রম করছে। মিলিটারিরা প্রায় দেড় থেকে দু’শ গজ লম্বা লাইনে এগুচ্ছে। সংখ্যায় তারা আনুমানিক ষাট-সত্তর জন। অবস্থা দেখে পরিকল্পনা পরিবর্তন করলাম। টাংগাইল-ধলাপাড়া রাস্তার পশ্চিম পাশ থেকে পূব দিকে মুখ করে, বল্লা-কালিহাতি রাস্তায় সামনা-সামনি হানাদারদের মোকাবেলা করা যাবে না। ধলাপাড়া-টাংগাইল রাস্তার পূব পাশে অবস্থান নিয়ে বল্লা-কালিহাতি রাস্তায় চলে যাওয়া খানসেনাদের পিছনে আক্রমণ করাই সমীচীন। তাতে হয়তো হানাদারদের ক্ষতির পরিমাণ কম হবে তবুও সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না।
আমরা ফটিকজানী নদীর ধারে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের অবস্থান থেকে বল্লা কালিহাতি রাস্তার দূরত্ব মাত্র তিনশ’ গজ। মিলিটারিদের প্রায় সব কথাই আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৩২

হানাদার বাহিনীর অর্ধেকেরও বেশি যখন টাংগাইল-ধলাপাড়ার রাস্তা অতিক্রম করেছে, তখন আর. ও. সাহেব একটি ছাতা বগলদাবা করে ধলাপাড়া রাস্তা ধরে খুব ধীরে ধীরে টাংগাইলের দিকে এগুলেন। আর. ও. সাহেবের কাছ থেকে বল্লা-কালিহাতির রাস্তার দূরত্ব বড়জোর এক’শ গজ। তিনি টাংগাইলের দিকে যাচ্ছেন। আর পাকবাহিনী তাঁর সামনে দিয়ে বাম থেকে ডানে এগিয়ে চলেছে। বল্লা-কালিহাতি রাস্তা মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে থাকতে জল্লাদ বাহিনীর শেষ সেনাটি টাংগাইল-ধলাপাড়া রাস্তা অতিক্রম করার সাথে সাথে নির্দেশমতো আর. ও. সাহেব সংকেত দিলেন। আর. ও. সাহেব তার ডান বগলের ছাতাখানা চট করে বাম বগলে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা টাংগাইল-ধলাপাড়া রাস্তার পূব পাশ দিয়ে ছুটে বল্লা-কালিহাতি রাস্তার পাশে পজিশন নিয়ে গুলি ছুঁড়তে লাগলাম। সংকেত দেয়া আর গুলি ছোঁড়ার মধ্যে ব্যবধান ত্রিশ সেকেন্ড। অন্যদিকে আর. ও. সাহেব ডান বগলের ছাতাখানা বাম বগলে নিয়ে পেচ্ছাব করার ঢঙে রাস্তার পাশে বসে পড়ে, আস্তে আস্তে ধলাপাড়া-টাংগাইল রাস্তার পূব পাশের খালে নেমে পড়লেন। আমি এল. এম. জি. সহ বল্লা-কালিহাতি রাস্তার পাশে অবস্থান নিয়ে প্রথম গুলি ছুঁড়লাম। সহকর্মীরাও অনুসরণ করলো। বাম পাশে সবুর খান, ডানে সাইদুর, হালিম, মনির, শামসু ও আরো কয়েকজন গুলি ছুঁড়ছে। মিনিট-দুই গুলি চালানোর পর, শত্রুপক্ষও প্রতিউত্তরে গুলি বর্ষণ শুরু করে দিল। হানাদার বাহিনীর কাছে যে ভারি অস্ত্র রয়েছে, তা মুহূর্তেই বোঝা গেল। উন্মুক্ত প্রান্তর কাঁপিয়ে ওদের মেশিনগানগুলো গর্জন করে উঠল। সাঁ সাঁ করে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি আমাদের ডান-বাম ও মাথার উপর দিয়ে যেতে লাগল। ওদের মোকাবেলা করার প্রয়োজনীয় ভারি অস্ত্র তখন মুক্তিবাহিনীর হাতে নেই। তবু ছেড়ে দেয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’
আমি তাড়াতাড়ি এল. এম. জি. সাইদুরের হাতে দিয়ে হালিম ও নাসিরের কাছ থেকে ২ ইঞ্চি মর্টার নিয়ে পর পর ছ’টি গোলা ছুঁড়লাম এবং প্রত্যেককে একটি করে গ্রেনেড ছুঁড়তে নির্দেশ দিলাম। রকেট লাঞ্চার থেকেও পর পর তিনটি গোলা ছোঁড়া হলো। এতে কাজ হলো অস্বাভাবিক ধরনের। রকেট লাঞ্চার ও মর্টারের গোলা পড়তে দেখে এবং একসঙ্গে গ্রেনেড ফাটার আওয়াজে শত্রু সৈন্যরাও কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে গুলি বন্ধ করে কালিহাতির দিকে দ্রুত সরে যেতে থাকলো। সকালের দিকে মিলিটারিদের এ রাস্তা দিয়ে বীরদর্পে যারা যেতে দেখেছেন তারাই আবার মার খেয়ে প্রাণভয়ে ভীত পাক-বাহিনীর পলায়নপর অবস্থা দেখে তাজ্জব বনে গেলেন।
অতর্কিতে প্রথম এক ঝাঁক গুলিতে মিলিটারিদের বেশ ক্ষতি হয়েছিল। ক্ষতির চাইতে তারা বেশি হতাশ ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। আমার ধারণা ছিল, শত্রুর যা ক্ষতি হবার তা প্রথমদিকেই হবে। প্রত্যেক অস্ত্র ব্যবহার করে শত্রুকে বুঝিয়ে দেয়া মুক্তি বাহিনীর কাছে সব রকমের অস্ত্রই আছে। আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল, পিছন থেকে আক্রান্ত হবার পর মিলিটারিরা যাতে ঘুরে দাঁড়াতে না পারে বা প্রতিরোধের সাহস না পায়, তার জন্যও নানা অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল।
আক্রান্ত জল্লাদরা প্রাণভয়ে দৌড়ে কালিহাতির দিকে যাচ্ছে। ঘামে সবার জামাকাপড় ভিজে গেছে। ভয়ে চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। কথা বলতে পারছে না। সঙ্গে আবার নিহত ও আহতরা। এমনি অবস্থায় যখন তারা কালিহাতি পাকা সড়কে পৌঁছে, সূর্য তখন শেষ বিকালের আলো ছড়াচ্ছে। রাস্তায় গিয়েও তাদের শান্তি নেই। হুড়মুড় করে গাড়িতে উঠছে, যত তাড়াতাড়ি সরে পড়তে পারে, ততই যেন মঙ্গল।
সকালে বল্লা যাবার সময় হানাদার বাহিনীর অহংকার, আস্ফালন ও উদ্ধত আচরণ অনেকেই দেখেছিলেন। জ্বালাও-পোড়াও করার সময় জনগণের অনেকেই তাদের কাছে শালা, হারামজাদা, কুত্তার বাচ্চা, নানা বিশেষণে ভূষিত হয়েছিলেন। কিন্তু বিকাল বেলায় রণে ভঙ্গ দিচ্ছে পালিয়ে যাবার সময় হানাদারদের সেই তেজ, সেই দাম্ভিকতা আর নেই। কালিহাতি বাসষ্ট্যাণ্ডে সমবেত কিছু লোক হানাদার বাহিনীর সকাল ও বিকালের দুই বিপরীত চেহারা প্রত্যক্ষ করে হাসবেন, না কাঁদবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। মিলিটারিরা আহত ও নিহতদের আলাদা আলাদা গাড়িতে উঠিয়ে টাংগাইল চলে যায়। সেদিনের যুদ্ধে খানসেনাদের মোট ৮ নিহত ও চৌদ্দজন আহত হয়েছিল। এলাকার মানুষ তাদের মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য সম্ভবত প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। কালিহাতি থেকে মিলিটারিদের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল, “এবার শালারা মার খাইছে। কয়জন যে মরছে তার হিসাব নাই। যারা আহত হইছে তারাও বাঁচবনা। বল্লার দিকে যারা গেছিল, অর্ধেকতো মুক্তিবাহিনী রাইখ্যাই দিছে। সব লাশ কি আর আনতে পারছে? রাস্তা ভাইস্যা গেছে। কালিহাতি বাসষ্ট্যাণ্ড তো রক্তে ডুইব্যাই গেছে।”
এরকম প্রচার হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। কালিহাতির যেখানে হানাদার বাহিনী অল্প সময়ের জন্য থামে, সেখানে প্রচুর রক্ত পড়েছিল। কালিহাতি থেকে টাংগাইল পর্যন্ত তের মাইল রাস্তার নিহত-আহতদের ট্রাক দু’টির গতি সামান্য কমেছে, সেখানেই দেখা গেছে চাপ চাপ রক্ত। টাংগাইল শহরের সীমানা থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত গাড়ির গতি ছিল খুবই কম। সারা রাস্তাতেই কম বেশি রক্ত পড়েছিল। বিশেষ করে টাংগাইল জেলা সদর গেট, বাসষ্ট্যাণ্ড, নিরালা মোড় ও হাসপাতালের সামনে গাড়ি দাঁড়ানোয় প্রচুর রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। গাড়িগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢাকা থাকায় ভিতরে আহত-নিহতের সংখ্যা হয়েছে অতিরঞ্জিত যা জনসাধারণের মনোবল বাড়ানোর জন্য খুবই সহায়ক হয়েছিল।
চারান যুদ্ধের ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল তা ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকগণ বিচার করবেন। তবে এ যুদ্ধের প্রেক্ষিতে এলাকায় জনগণের আত্মবিশ্বাস জোরদার হয়েছিল। তাদের মনোবল বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বহু মানুষ বীরের মতো চিন্তা, কথা ও কাজ, এক কথায় আচরণ শুরু করেছিলেন।

সহযোদ্ধার যুদ্ধভীতি
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সহযোদ্ধাদের অবস্থান ছেড়ে ফটিকজানী নদীর পূবপারে একত্রিত হতে বললাম। সবাই একত্রিত হলে গুনে দেখা গেল, নয়জন। হওয়া চাই দশজন। একজনের
পৃষ্ঠা নং ~ ১৩৪

হাতিয়ার পাওয়া যাচ্ছে না। কে হারানো গেল, তা কেউ বুঝে উঠতে পারলাম না। আর হাতিয়ার আটের জায়গায় সাত কেন, তাও বুঝে উঠা মুশকিল হলো। যার হাতিয়ার পাওয়া যাচ্ছে না, তার নাম আবদুর রশিদ। বাড়ী বল্লা। সে চার-পাঁচ বছর যাবৎ বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ও আমার সাথে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। আগে জানা ছিল ছেলেটি বেশ সাহসী। অথচ তারই রাইফেল প্রথম প্রত্যক্ষযুদ্ধে খোয়া গেল। চারানের যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীকে এক মুহূর্তের জন্যও শঙ্কিত হতে হয়নি, কারণ আমাদের অবস্থান খুব অনুকূলে ছিল। মিলিটারিরা খুব বেশি গুলি ছোঁড়েনি। মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন দৌড়াদৌড়িও করতে হয়নি। প্রায় দেড় ঘণ্টা বলতে গেলে একই অবস্থান থেকে ডানে-বামে ঘোরাফিরা করে গুলি চালানো হয়েছে। অতএব হাতিয়ার খোয়া যাবার কোন প্রশ্নই উঠে না। তবুও কিন্তু একশ পঁচিশটি বুলেটসহ একটি রাইফেল সেদিন মুক্তি বাহিনীকে খোয়াতে হয়েছিল। আমি দুঃখিত হলেও এই ক্ষতি মেনে নিই। রশিদকে শুধু কঠিনভাবে তিরস্কার করে বললাম, “যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র খোয়ানোর অপরাধে গুলি করার নিয়ম আছে। ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হও। বর্তমান অবস্থায় এত বুলেটসহ একটি হাতিয়ার আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান।”
কিভাবে রশিদ রাইফেলটি হারাল? মুক্তিযোদ্ধারা যার-যার পজিশন নিয়েছে। রশিদও পশ্চিম দিকে মুখ করে পজিশন নিয়েছে। সবাই গুলি ছুঁড়ছি। মিনিট-দুই পর, যখন পাক-বাহিনীর দিক থেকে প্রান্তর কাঁপিয়ে মেশিনগানের গুলি আসা শুরু করলো, তখন রশিদ দিক বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পজিশন ছেড়ে পিছনে ধানক্ষেতের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। উদ্ভ্রান্তের মতো ধানক্ষেতে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খাওয়ার সময় কখন যে হাতের রাইফেল ও পিঠে গুলিভর্তি থলেটি পড়ে গেছে, উত্তেজনার মধ্যে তার কোন খেয়াল ছিল না। গোলাগুলি থেমে গেলে তার কিছু কিছু মনে পড়ে। তার কাছে একটি হাতিয়ার ও কিছু গুলি ছিল। সেদিন কিন্তু রশিদ অযথাই গুলির শব্দে ভয় পেয়ে অমন অদ্ভুত কাণ্ড বাঁধালেও পরবর্তীতে মাটিকাটা-জাহাজ মারা যুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ রাখে।
পূবদিকে এগিয়ে চলেছি। তবে বিজয়-আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছিলাম না। ক্ষুধার জ্বালা এবং জনৈক সহকর্মীর নিখোঁজ হবার ঘটনায় আমরা বিমর্ষ। অনেক চিন্তা-ভাবনা, খোঁজাখুঁজির পর নিখোঁজ সহকর্মীর নাম জানা গেল, নাম তার ছাবদুল।
প্রথমে জানা গিয়েছিল, ছাবদুল সেনাবাহিনীতে কাজ করত। পরে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গল, ছাবদুল সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল তবে রান্নার কাজ করত। তাতে কিছু যায় আসে না। সে এখন মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে উৎসর্গকৃত প্রাণ। আমরা সবাই তার জন্য ব্যথিত।
আর. ও. সাহেব তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা থেকে একসময় বললেন, “লোকটি যখন ছাবদুল তখন আমি জোর দিয়ে বলতে পারি ও যুদ্ধে যাওয়ার ভয়ে আশে-পাশে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। ওর ট্রেনিং আছে। তাই যুদ্ধকে তো ভয় পাবেই।”
আর. ও. সাহেবের কথাই সেদিন সত্য প্রমাণিত হলো। কিছু দূর এগুতেই ছাবদুলকে দেখা
পৃষ্ঠা নং ~ ১৩৫

গেল সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছে। “কী ব্যাপার ছাবদুল? তুমি কোথায় ছিলে?”
– ওস্তাদ, আর কী বলব। আমি পজিশনে ছিলাম, আমার মাথার কাছে পাকবাহিনীর গুলি পড়ে। ভাবলাম ওদের গ্রেনেড ছুঁড়ে মারব। আমার পোচ থেকে গ্রেনেড বের করে যখন ছুঁড়তে গেলাম, তখন পোচের মধ্যে গ্রেনেডটা ফেটে পায়ে লাগল।
কথা শুনে আমিতো অবাক! বলছে কি? পা-টা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খতিয়ে দেখলাম।
– কই? কোথায় আঘাত লেগেছে?
– এই যে, এইখানে।
আমি কিন্তু কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না। আর. ও. সাহেবও ছাবদুলের পা-টা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন। তিনিও কোন আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলেন না।
আমি ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে ছাবদুলের রাইফেল, গুলি ও গ্রেনেডগুলি অন্য একজনের হাতে তুলে দিলাম। একখানা গ্রেনেড নিয়ে বললাম, “এই যে এর চাবি খুলছি। তোমার পোচের মধ্যে ছেড়ে দেবো। এতে যদি তোমার বর্ণনামতো বেরিয়ে গিয়ে পায়ে আঘাত করে, তাহলে আমার বলার কিছু নেই।” অন্যান্য সহকর্মীদের সামান্য দূরে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে বলে যেই গ্রেনেডের চাবিতে হাত রাখলাম, অমনি ছাবদুল আমার পায়ে লুটিয়ে পড়ল।
– বাবা গো, আপনি আমার ধর্মের বাপ। পোচের মধ্যে গ্রেনেড ছাড়লে আমি আর বাঁচমু না।
– কেন? তুমিও তো বলেছ, তোমার এই পোচের মধ্যে গ্রেনেড ফেটে পায়ে আঘাত করেছে। অথচ কোন চিহ্ন নেই।
পেটের কাছে কাছে গ্রেনেড ফাটলে যে-কোন মানুষ আস্ত থাকে না, মিলিটারিতে সামান্য ট্রেনিং নেয়ায় ছাবদুলের এ জ্ঞানটুকু হয়েছিল। যুদ্ধের প্রতি তার ভয় আছে। অথবা প্রাণের ভয়ে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়, এটা সে বললেই পারত। অথচ তা না বলে, বলল মিথ্যা কথা। এতে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। সবুর ও মনির আক্ষেপের সুরে বলল, আমরা না খাইয়া যুদ্ধ কইরা মরি, আর শালা তুই কিনা দুধকলা খাইয়া ভুঁড়ি বানাস। মুক্তিযোদ্ধারা যখন যুদ্ধ করছিল, ছাবদুলকে তখন গ্রামের লোকেরা দুধ-কলা মুড়ি-মিঠাই খাওয়াচ্ছিলেন। আবেগহীন ও শান্ত আর. ও. সাহেব নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। হাতের বেতখানা দিয়ে ছাবদুলের পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিলেন এবং পিঠমোড়া দিয়ে হাত বেঁধে ফেললেন। ছাবদুলের অপরাধ ছোটখাটো নয়—রীতিমতো গুরুতর। এখন ছাবদুলকে নিয়ে কী করা যায়? কী শাস্তি দেয়া যায়? এই নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমরা পূবদিকে এগিয়ে চললাম। রাত গভীর হয়ে এলে ভণ্ডেশ্বরের ময়েজউদ্দিন সরকারের ছেলে হানিফদের বাড়ীতে উঠলাম। এখানে অবস্থানকালে ছাবদুলকে বেশ উত্তম-মধ্যম দেয়া হলো। আমি এ ব্যাপারে নির্বিকার রইলাম। ভবিষ্যতে নিজেকে ঠিক করে নেবে—এই প্রতিশ্রুতি দিলে, তাকে সংশোধিত হবার সুযোগ দেয়া হলো। ভণ্ডেশ্বর থেকে আমরা দুর্গাপুর, বাঘের বাড়ী হয়ে সকাল ন’টায় ভবানীপুরের হাসান ডাক্তারের বাড়ী
পৃষ্ঠা নং ~ ১৩৬

পৌঁছলাম। সেখানে আগে থেকেই হামিদ, শাজাহান, আবু বকর, ফারুকসহ আরো কয়েকজন সহকর্মী উপস্থিত ছিল। হাসান ডাক্তারের বাড়ী এসে দেখলাম, অর্পিত দায়িত্ব আবু বকর সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছে। চাল, ডাল, টাকা-পয়সা ও লোক সংগ্রহ, কোনটাই বাকি রাখেনি। ইদ্রিসও তার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছে। ইদ্রিছ, শাজাহান, আবু বকর, হামিদুল হক-সবাই মিলে শ’দেড়েক স্বাস্থ্যবান আস্থাশীল কর্মী সংগ্রহ করেছে। আগের দিনের সংঘটিত চারান-বল্লার ঘটনা ও যুদ্ধের কথা শুনে আরো বেশ কিছু উৎসাহী যুবক ভবানীপুরে একত্রিত হয়েছে। সমবেত লোকের সংখ্যা পাঁচশ’র কম নয়।
দুপুর বারোটায় মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হতে আসা ব্যক্তিদের সাথে মিলিত হলাম। দলের মধ্যে আমার তিন-চারজন পরিচিত রাজনৈতিক সহকর্মীকেও দেখতে পেলাম। এদের দেখে আমার ধারণা আরও বদ্ধমূল হলো যে, প্রয়োজন ও উপযুক্ত সময়ে সবাইকে পাওয়া যাবে। যা হোক, অপেক্ষমান চার-পাঁচশ’ জনের মধ্য থেকে প্রায় আড়াইশ’ জনকে মুক্তি বাহিনীতে ভর্তি করা হলো। উল্লেখযোগ্যরা হলো-লাবিবুর রহমান, লোকমান হোসেন, আবদুল গফুর, মোহাম্মদ সরোয়ার, লালটু, সোহরাব, নবী নেওয়াজ, আবদুল খালেক, আনোয়ার হোসেন, ছাত্রলীগের হাবিবুর রহমান তালুকদার খোকা, সেনাবাহিনীর হাবিলদার মোসলেমউদ্দিন। যারা হতে পারল না, তাদের কিছুদিনের মধ্যে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে খাবার খাইয়ে বিদায় করে দেয়া হলো। ভর্তি-বহির্ভূতদের মধ্যে যার নাম কোনমতেই অনুল্লেখ্য রাখা যায় না, সে অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে এক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের দাবিদার।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৩৭

প্রথম প্রশাসনিক বিন্যাস

গোয়েন্দা বিভাগের গোড়া পত্তন
ভর্তি করা মুক্তিযোদ্ধা ও ভর্তি-বহির্ভূতদের নাম, ঠিকানা ও অন্যান্য খোঁজ-খবর রাখার জন্য একটি গোয়েন্দা বিভাগের প্রয়োজনীয়তা সর্বপ্রথম তীব্রভাবে অনুভব করলাম। অনেক অজানা, অপরিচিত লোককে ভর্তি করার ফলে কোন অসুবিধা বা অবাঞ্ছিত অবস্থার উদ্ভব হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ অবস্থা এড়াতে স্বতন্ত্র একটি বিভাগের প্রয়োজন। এ বিভাগ ভর্তি- বহির্ভূতদের নাম, ঠিকানা, বয়স, চরিত্র ও প্রয়োজনীয় আরও অন্যান্য তথ্যাদি সংগ্রহ করে রাখবে। যাতে পরে ভর্তি হতে এলে তাদের সম্পর্কে নতুন করে অনুসন্ধানের প্রয়োজন দেখা না দেয়। এজন্য খবর ও তথ্য সংগ্রহ বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র বিভাগের গোড়াপত্তন করা হলো।
বিকেলে মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের ভবানীপুরের হাসান ডাক্তারের বাড়ীর সামনে সামর্থ্য ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কয়েকজনের নেতৃত্বে দলের বিন্যাস করা হলোঃ
১. কোম্পানি নম্বর এক। অধিনায়ক মনিরুল ইসলাম (মনির)। আওতাভুক্ত এলাকা- বড়চওনা, বাটাজোর ও ভালুকা।
২. কোম্পানি নম্বর তিন। অধিনায়ক শওকত মোমেন শাজাহান। আওতাভুক্ত এলাকা-দেওপাড়া, সাগরদিঘী ও সখীপুর।
৩. কোম্পানি নম্বর চার। অধিনায়কদ্বয়-লোকমান হোসেন ও আঃ গফুর। এলাকা—গোপালপুর, ভূয়াপুর এবং চলমান কোম্পানি হিসাবে।
৪. কোম্পানি নম্বর পাঁচ। অধিনায়ক লাবিবুর রহমান। এলাকা- বাশাইল অঞ্চল।
৫. কোম্পানি নম্বর বারো। অধিনায়কদ্বয় লালটু ও সরোয়ার। এলাকা—ভূয়াপুর ও সখীপুর (ভ্রাম্যমাণ দল হিসেবে)।
৬. কোম্পানি নম্বর তেইশ। এ কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ার ও সিগন্যাল প্লাটুন নামে চিহ্নিত। অধিনায়কদ্বয়—আবদুল খালেক ও আনোয়ার। স্থায়ী দপ্তর-মহানন্দপুর।

দায়িত্ব নির্ধারণ
কোম্পানিগুলোর প্রধান দায়িত্বসমূহঃ এক, সমস্ত এলাকা দ্রুততার সাথে পরিভ্রমণ করা। দুই. স্বাধীনতাপক্ষীয়দের উৎসাহ প্রদান। তিন, প্রয়োজনবোধে রাস্তা-ঘাট ভেঙে দেওয়া। চার, চুরি-ডাকাতি নিবারণ। কুখ্যাত চোর-ডাকাতদের স্থানীয় জনসাধারণের মতামত নিয়ে শাস্তিবিধান করা অথবা প্রয়োজনবোধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া।
মুক্তিবাহিনী কোম্পানিগুলোর উপর অর্পিত দায়িত্ব তারা অত্যন্ত সফলতার সাথে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। তেইশ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ও সিগন্যাল প্লাটুনের উপর দায়িত্ব ছিল, যত
পৃষ্ঠা নং ~১৩৮

তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত সদস্যদের খবরা-খবর-সম্বলিত একটি নিখুঁত তালিকা প্রণয়ন করে পনের দিনের মধ্যে আমার কাছে পেশ করা এবং নানা স্থান থেকে টেলিফোনের তার এনে এলাকার দুর্গম স্থানসমূহের সাথে প্রধান কার্যালয়ের সংযোগ স্থাপন। ২৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ও সিগন্যাল প্লাটুন তার যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেয়।

বন্দীর বিবেক
এবার একটু পিছনের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাই। আমি ডাবাইল থেকে দশজন সহযোদ্ধা নিয়ে পাক-হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালাতে গেলে বাকি সদস্যরাও ডাবাইল থেকে সোজা পূর্বদিকে বহেরাতলীর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। তারা সবাই ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত। কাকড়াজানের জনৈক ভদ্রলোকের বাড়ীতে খাবার খেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আবার পথচলা শুরু করলো। মিনিট-দুই পরে তুমুল গোলাগুলির শব্দ। আচমকা গোলাগুলির শব্দ শোনার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। গোলাগুলির শব্দ শুনে বিস্মিতই শুধু নয়, একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। তাদের ধারণা, তারা পাক-হানাদার বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তাদের দিকেই গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। আর উপায় নেই। যে যেদিকে পারল, পালাল। নাগবাড়ী আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়ী থেকে যেভাবে পালিয়েছিল, তার চাইতেও দিশেহারা হয়ে ছুটোছুটি শুরু করলো। কয়েক মিনিট উতলা হয়ে দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে দৌড়াদৌড়ির পর তাদের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আগে সবাই সংঘবদ্ধ হয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থান বহেরাতলীতে অবস্থান নিয়ে লোকগণনা করে দেখে দু’জন কম। চারানের যুদ্ধেশেষে যেমন একজনের হিসাব মিলছিল না, এখানেও একই ফ্যাসাদ। শুধু সংখ্যার ব্যবধান ধরা পড়ল। সবাই মিলে চিন্তাভাবনা করে দেখল, নিখোঁজদের একজন কদিমহামজানীর পুলিশ কাশেম, অন্যজন আসামি ছানা কাদের।
তারা আরও দেখল, আটহাজার গুলিভর্তি দুইটা বস্তা নেই। নিখোঁজ দু’জন ও বুলেটের বস্তা হারিয়ে-যাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা উন্মাদের মতো খুঁজতে লাগল।
যেখান থেকে কিছুক্ষণ আগে তারা পাগলের মতো পালিয়ে এসেছিল, এখন সেখানে যেতেও তাদের ভয় নেই। যে বাড়ীতে তারা খাবার খেয়েছিল, প্রথমে সেখানে খোঁজ-খবর নিল, কিন্তু কিছুই পেল না। নদীর যে-স্থান থেকে আমি তাদের বিদায় জানিয়েছিলাম সেখানে তল্লাসি চালাল। না, কিছুই নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচজনের একটি দল বস্তা খুঁজতে আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে গেল। চারজন করে চারটি দল ছানা কাদের ও কাশেম পুলিশকে খুঁজতে চারদিকে বেরিয়ে পড়ল।
সারাদিন খোঁজাখুঁজির পর, রতনগঞ্জ আর বল্লার মাঝামাঝি কাশেমকে পাওয়া গেল। বল্লার দিকে যেতে থাকা কাশেমের মাথায় একটি গুলিভর্তি বস্তা ছিল। অন্যদিকে বহেরাতলীর কাছাকাছি পাওয়া গেল ছানা কাদেরকে। তার হাতবাঁধা এবং মাথায় একটি গুলির বস্তা। ছানা কাদের যে চরম ধুরন্ধর লোক, এতে কোন সন্দেহ নেই। তাকে যে মুক্তি বাহিনী মেরে ফেলবে, এমন সম্ভাবনা চোদ্দ আনা। ছানা কাদের তিনবার মুক্তি বাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়ী থেকে পাগলের মতো পালিয়ে যাবার সময় মুক্তিযোদ্ধারা ছানা কাদেরকে
পৃষ্ঠা নং ~ ১৩৯

ফেলে গিয়েছিল। সে মিলিটারিদের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতে পারত অথবা রাস্তা-ঘাট জানা থাকায় নিজের বাড়ীতে চলে যেতে পারত। সে কিন্তু কোনটাই করেনি। দ্বিতীয়বার কাকড়াজানের বাড়ী থেকে বেরোবার পর মুক্তি বাহিনী যখন ছত্রভঙ্গ হলো, তখনও ছানা কাদের পালিয়ে যেতে পারত, কিন্তু সে পালায়নি। গোলাগুলি চলার ঘণ্টা দুয়েক পর মুক্তিবাহিনীর দিকে অগ্রসরমান ছানা কাদেরকে দেখতে পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ধরে ফেলে এবং শিবিরে নিয়ে যায়। আমি ভবানীপুর শিবিরে এলে সহযোদ্ধারা জানায়, ‘ছানা কাদের পালিয়ে যাচ্ছিল।’
ছানা কাদেরের বক্তব্য, সে নিজেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ধরা দিয়েছে। কাকড়াজানের যে বাড়ী থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়েছিল, সেখানে থেকে পশ্চিমে বল্লা বাজার। তিন মাইল দক্ষিণে-পশ্চিমে রতনগঞ্জ বাজার। রতনগঞ্জ থেকে প্রায় চার মাইল দক্ষিণে ছানা কাদেরের নিজ গ্রাম বাশাইল। কাকড়াজান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নিজ গ্রামে যাওয়ার পথ তার মোটেই অচেনা নয়। বরঞ্চ পূবে গভীর জঙ্গলের রাস্তা-ঘাট না-চেনাই স্বাভাবিক। অথচ কাকড়াজানের সেই বাড়ী থেকে প্রায় দুই মাইল পূবে বহেরাতলীর উত্তরে ছানা কাদেরকে পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকদের কাছে সে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে তিন-চারবার জিজ্ঞাসাও করেছিল। এমনকি ধরা পড়ার পর সে বলেছিল, ‘আমি রাস্তা-ঘাট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এক ঘণ্টার মতো এক জায়গায় বসেও ছিলাম। তার পরেও যখন কোন রাস্তা-ঘাট পেলাম না, আপনারা কোনদিকে গেলেন, আমাকে বলে গেলেন না, সাথে করে নিয়েও গেলেন না, তখন পূবদিকে আসাই উচিত মনে করলাম। আপনারা সবাই যখন চলে গেলেন তখন গুলির বস্তাটি পড়ে থাকল। ভাবলাম এখানে তো গুলির অভাব, তার উপর এ বস্তা হারিয়ে গেলে মুক্তি বাহিনীর বড় ক্ষতি হবে। আমার হাত বাঁধা। চেষ্টা করেও বস্তাটি মাথায় তুলতে পারছিলাম না। তখন একজন লোকের সাহায্যে বস্তা মাথায় তুলে নিই এবং ঘুরতে ঘুরতে আপনাদের সাথে মিলিত হই।’
কাশেম পুলিশের বক্তব্য, সে পূবে না এসে পশ্চিম দিকের পথ বেছে নেয়। যারা তাকে ধরে ফেলে তাদের সন্দেহ, সে গুলি নিয়ে শত্রুর এলাকায় চলে যাবার পরিকল্পনা করেছিল।
বারবার পলায়নপর দলটি এবার নিজেদের মনকে ধিক্কার জানাতে থাকে। বিবেকের দংশনে তারা ক্ষত-বিক্ষত হয়। এরপর আর কোনদিন হানাদার বাহিনীর কামানের গর্জন ও মেশিনগানের প্রান্তর-কাঁপানো হুংকার—কোনটাতেই তারা ভয় পায়নি। সবকিছুকেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে।
পৃষ্ঠা নং ~১৪০

সাংগঠনিক তৎপরতা

আতঙ্কিত শওকত আলী খান
তিনশ’ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সাতটি দলে ভাগ করে, আলাদা আলাদা দায়িত্ব দিয়ে বড় চওনার মিয়া উল্লাহ চৌধুরীর বাড়ীতে গেলাম। আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জনাব শওকত আলী খান তখন সাগরদীঘিতে ছিলেন। তাঁকে আনার জন্য পাঁচজন সহযোদ্ধাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হলো, যেন শওকত খান ব্যারিস্টার সাহেবকে কোন ভালো ঘোড়ায় চড়িয়ে বা পালকিতে নিয়ে আসা হয়। যাতে তাঁর কোন কষ্ট না হয়।
বন্দুক কাঁধে সাইকেলে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী খানকে নিয়ে আসতে বেরিয়ে পড়লো। ২৫শে মার্চের পর তিনি সাগরদীঘির এক বাড়ীতে আত্মগোপন করে আছেন—এ খবর বড়চওনার ইদ্রিস এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখে আমাকে সর্বপ্রথম জানিয়েছিল। খবর পেয়ে ইদ্রিসকে নিয়ে শওকত আলী খানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
একটি ভাঙা ছনের ঘর, নড়বড়ে বেড়া, মেঝেতে দু’তিনখানা ছেঁড়া কাঁথা বিছানো, তার উপর একটি চাঁদর। তাতে শওকত সাহেব বসে আছেন। চোখে মুখে দারুণ দুশ্চিন্তার ছাপ। উষ্কখুষ্ক চুল। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, লম্বা জুলফি। আশঙ্কা, আতঙ্ক আর মৃত্যুভয়ে মুহ্যমান। পঁচিশ-তিরিশ দিন নিজের অভ্যস্ত পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। এর ভেতর একদিনও শওকত আলী খান বের হননি। তাঁর বিশ্বাস তাঁর খবর কেউ জানে না, কেউ রাখে না।
এমনি অবস্থায় বিনা নোটিশে হঠাৎ আমরা তাঁর সামনে উপস্থিত হলাম। আমাদের দেখে যমদূত দেখার মতো তিনি চমকে উঠলেন। হঠাৎ আমি ওখানে কেন? আমার উদ্দেশ্য কী? গোপন আস্তানার খবরই বা পেলাম কী করে? শওকত সাহেবের এই দিশেহারা অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কিছুক্ষণ পরেই তিনি বুঝতে পারলেন, আমরা তাঁর খোঁজ-খবর নিতে এসেছি। আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। আবেগের আতিশয্যে শওকত সাহেব নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তাঁর ব্যর্থ ও বেদনার কাহিনী বর্ণনা করতে করতে শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন। শওকত আলী খান আর দশজনের মতো সাধারণ নন। তিনি টাংগাইলের ধনকুবের আরফান আলী খানের একমাত্র পুত্র। নিজে একজন ব্যারিস্টার ও জাতীয় পরিষদ সদস্য। কোটি কোটি টাকার মালিক। দুঃখ-দারিদ্র্য কী, তা কোনদিন জানতেন না। আজীবন সুখ-শান্তি, আরাম আয়েশে আনন্দ উপভোগের মধ্যেই কাটিয়েছেন। দুগ্ধ ফেননিভ সুশোভিত শয্যায় রাত কাটিয়েছেন। তাঁর পা কোনদিন মাটিতে পড়েনি। সেই আকাশের চাঁদ ধুলায় লুণ্ঠিত। আমি নিজেও গাছের নিচে ও অন্যের ভাঙা ঘরে অনেকদিন কাটিয়েছি, কিন্তু শওকত আলী খানের নতো একজন ধনবান লোককে এ অভাবনীয় অবস্থায় দেখে ব্যথিত হলাম।
সেদিন শওকত আলী খান সাহেব আমাকে বারবার বলেছিলেন, “কাদের ভাই, আপনি
পৃষ্ঠা নং ~ ১৪১

এসেছেন, এ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। বেঁচে থাকব কিনা, এ কথা ভাবতেই পারছিনা। সবাই ভারতে চলে গেছে। আমাকে শুধু ভারতে যাবার ব্যবস্থা করে দিন।”
আমি তাঁর সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলেছিলাম। তবে তেমন কোন জরুরি কথা বলার উপায় ছিল না। মানসিকভাবে দুর্বল ও ভেঙে পড়া মানুষের সাথে জরুরি আলোচনা দূরে থাকুক, সামান্য সমস্যা নিয়েও আলোচনা করা যায় না। শুধু সান্ত্বনা দিয়ে, দু’চারটা গতানুগতিক কথা বলেই শেষ করতে হয়েছিল। শওকত সাহেবের একই কথা, কাদের ভাই, এখানে যদি পাকবাহিনী এসে যায়! যদি কেউ ধরিয়ে দেয়? আমাকে তাড়াতাড়ি ভারতে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন।’
আমি সেদিন কথা দিয়ে এসেছিলাম, “আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই। এখানে এই মুহূর্তে পাকবাহিনী আসতে পারবে না। আর এখানে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দেবে না। আমি আপনার ব্যাপারে এখানকার দু’চারজন লোকের সঙ্গে কথা বলেছি। সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে আপনার সঙ্গে আবার দেখা করব। অথবা আপনাকে লোক পাঠিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করব।”
কিছুদিন পরের কথা। দশ দিনের মধ্যে আমি শওকত সাহেবের সাথে দেখা করতে অথবা তাঁকে নিয়ে আসতে পারিনি। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে প্রাণিকুল যেমন বারিধারার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে—তেমনি হতাশ, আতঙ্কিত ও মুহ্যমান শওকত সাহেবও আমার অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন। এমন এক মুহূর্তে একটি ভালো ঘোড়াসহ মুক্তিযোদ্ধারা শওকত সাহেবের নিকট উপস্থিত হলো। কবিগুরুর সেই পুরাতন ভৃত্যের মতো একজন লোক শওকত সাহেবের সেবায় সবসময় লেগে থাকত। চরম অবস্থাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। শওকত সাহেব তাকেও সাথে নিয়ে আসতে চান। তার জন্য আরো একটি ঘোড়া চাই। লোকটি ঘোড়া ছাড়াই স্বচ্ছন্দে হেঁটে আসতে পারত। কিন্তু তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের চলার গতি কিছুটা কমে যেত। তাই আরো একটি ঘোড়া জোগাড় করা হলো।
গভীর রাতে বড়চওনা মিয়া উল্লাহ চৌধুরীর বাড়ীতে আমার সাথে মিলিত হয়ে শওকত সাহেব আনন্দিতই শুধু নন, একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েন। যেন শত্রু-পরিবেষ্টিত এলাকা থেকে আপনজনদের কাছে ফিরে এলেন। শওকত সাহেবের সাথে একত্রে খাবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। শওকত সাহেব এলে রাতের খাবার-পর্ব সম্পন্ন হলো। শওকত সাহেবের আবার সেই কথা, “আমাকে নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করুন।” তবে এবার শওকত সাহেবের মানসিক অবস্থা সেদিনের মতো অতটা বিপর্যস্ত ছিল না। তাঁকে আরো সাত-আটদিন অপেক্ষা করতে অনুরোধ করলাম। বড়চওনার উত্তরে চারিবাইদার ইয়াছিন সরকার নামে এক ধনীলোকের বাড়ীতে তাঁর থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করা হলো। সেখানে ভালো না লাগলে এবং প্রয়োজনবোধ করলে তিনি আরও পূবে উথুরার চৌধুরী বাড়ীতে থাকতে পারেন। এর পরও কোন অসুবিধা দেখা দিলে বানিয়াসিটের চেয়ারম্যান আবদুল হাফিজের বাড়ীতে চলে যেতে পারেন। হাফিজ সাহেব বহুদিনের পুরোনো আওয়ামী লীগ নেতা এবং শওকত আলী খান সাহেবের পূর্ব-পরিচিতক
শওকত আলী খান এই সব ব্যবস্থায় খুবই আনন্দিত হয়ে বললেন, “আমার জন্য এত
পৃষ্ঠা নং ~১৪২

কিছু করতে হবে না। আপনি এই জাতীয় দুর্যোগের সময় যে সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। আপনি শুধু মেহেরবানি করে আমাকে নিরাপদে ভারতে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। তাহলেই আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।” শওকত সাহেবের কাছ থেকে সাতদিনের সময় চেয়ে নিলাম। শওকত সাহেব চারিবাইদা গিয়ে থাকবেন। যাবার সময়ে তিনি হাত বাড়িয়ে বললেন, “এই নিন, আমার রিভলভার আপনাকে দিয়ে গেলাম।”
– না, ওটা আপনার কাছেই থাক। আমি বরঞ্চ আপনার কাছে একটি রাইফেল রাখতে চাই। প্রয়োজনে আপনি তা ব্যবহার করতে পারবেন।

ডাকু হলো মুক্তিযোদ্ধা
জনগণের হারানো মনোবল ফিরিয়ে আনা দরকার। আর এটা করতে হলে সমগ্র এলাকা পরিভ্রমণ প্রয়োজন। মুক্তি বাহিনী এখন সুসংগঠিত ও তৎপর—এটাও জনগণের মধ্যে সর্বত্র প্রচার করা চাই।
সাগরদীঘি, আছিম, আবদুল বাসেত সিদ্দিকীর গ্রাম সেহরাবাড়ী, ধলাপাড়া, দেওপাড়া, শহর গোপিনপুর এলাকা সফর করে ব্যাপক প্রচারকার্য চালালাম। বড়চওনা থেকে কালিয়াপাড়া যাওয়ার পথে একটি লোককে বড়চওনা হাইস্কুলের মাঠে দেখে সহযোদ্ধারা তার পরিচয় জানতে চাইলে সে বলল,
– আমার বাড়ী বাটাজোর। কমাণ্ডার মনিরুল ইসলাম আমারে পাঠাইছেন। আমি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে যামু। কাদের সিদ্দিকী সাহেবের সাথে দেখা করমু।
-আপনি কখনো কাদের সিদ্দিকীকে দেখেছেন? ভদ্রলোক ‘না’ সূচক জবাব দিল। আবার তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প কোথায় তা আপনি জানেন? আর মনিরুল হসলাম আপনাকে পাঠিয়েছে তার কোন প্রমাণ আছে? লোকটির এবারও ‘না’ সূচক জবাব।
-আপনি কী করে মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পে যাবেন? আমরা যদি আপনাকে আটক করে নিয়ে যাই? তাহলে কেমন হয়?
-আমারে ধইরা নিলে বা আটক করলে কিছু আসে যায় না। আমি খালি কাদের সিদ্দিকী সাবের কাছে যাইতে চাই। আমি মুক্তি বাহিনীতে ভর্তি হবার চাই। তিনি যদি আমারে নেন, তাইলে দেশের জন্য জান বিলাইয়া দিমু। আর যদি না নেন আমার কিছু করবার নাই।
-ঠিক আছে, আপনি মুক্তি বাহিনীর শিবির খুঁজতে থাকুন। একথা বলে কালিয়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হলাম। সেখানে মুক্তিবাহিনীর কিছু অস্ত্র-শস্ত্র মজুত ছিল। অস্ত্রগুলি বাঘের বাড়ীর ভবানীপুরে নিয়ে যেতে ইদ্রিসের দূরসম্পৰ্কীয় মামাতো ভাই মোক্তার আলীকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। দু’টি মহিষের গাড়িতে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ তুলে প্রায় ষাটজন সহকর্মীসহ শুড়ীরচালা আবু সাঈদ চৌধুরীর খামারবাড়ীতে এলাম। ৫ই মে থেকে বাবা এখানে অবস্থান করছিলেন। মধ্যরাতে শুড়ীরচালায় খাবার খেয়ে মহানন্দপুর এক বর্মণ ডাক্তারের বাড়ীতে উপস্থিত হলাম। ডাক্তারের বারান্দায় বড়চওনায় দেখা লোকটিকে দেখে অবাক হলাম। নাম জিজ্ঞাসা করতেই লোকটি জানালো, তার নাম মহু সর্দার। মুক্তিবাহিনী মহানন্দপুর আছে এ খবর সে কী করে
পৃষ্ঠা নং ~ ১৪৩

জানল? কী করেই বা সে এখানে এলো? মহু সর্দার বলল, “আমারে কেউ মুক্তিবাহিনী কোথায় আছে তা বলে নাই। আমি দু’চাইর জনরে মুক্তিবাহিনীর কথা জিজ্ঞাস করছি। কেউ কয় নাই। মনের টানে, খোঁজাখুঁজি করতে করতে এখানে এসেছি। এখানে আসার পরে মুক্তিবাহিনী আমারে এরেস্ট কইরা রাখছে। আমি এদের কাছে আমার ইচ্ছার কথা কইছি। আর আপনারেতো কইছি। তাইলে আপনি কি কাদের সিদ্দিকী? মুক্তিবাহিনীর কমান্ডর?”
মহু সর্দারের কথাবার্তা আর আকস্মিক অনাহুত আগমন মনে সন্দেহ সৃষ্টি করলো। তাকে বললাম, “এতদূরে এসে আপনি ভালো করেননি। এখন যদি আপনাকে আমরা হানাদার বাহিনীর লোক বলে গুলি করে মেরে ফেলি, আপনার কী করার আছে, বলুন?”
—দেখেন, আমার সব কথা শুনেন, তারপর আমারে মারতে চান, মারেন। এরেস্ট কইরা রাখতে পারবেন না। এরপর মহু ডাকাত তার অতীত জীবনের কাহিনী শুনাল।
সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় মহু সর্দারের জীবনের বিচিত্র ঘটনাবলী শুনতে আমার বেশ ভালোই লাগছিল। সর্দার তার বিচিত্র জীবনের বিচিত্র কাহিনীর পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, “আমি জীবনে বহু ডাকাতি করছি। আসামের গৌরীপুর, ডিব্ৰুগড় পর্যন্ত ডাকাতি করতে গেছি। ভাড়ায় রাজশাহীতেও কত ডাকাতি করছি। সারাদেশে আমার দু’তিনশ শিষ্য আছে। ডাকাতি করার সময় বাড়ীর লোকজনরে কোন অত্যাচার করি নাই, মা-বোনদের অসম্মান করেছি এমন কোন নজির নাই। আমার ডাকাতি জীবনে খুন করারও তেমন দরকার পড়ে নাই। আপনি আমার এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, একজনও আমারে খারাপ বলতে পারবে না। আমার এলাকার আশেপাশে দূরের কথা, সারা টাংগাইল-ময়মনসিংহ জেলার কোথাও ডাকাতি করি নাই। অন্যদেরও করতে দেই নাই।”
এখনও ডাকাতি করে কিনা এ রকম একটি প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ‘দু’-চার বছর না, আট-দশ বছর থেকে ডাকাতি ছাইড়া দিছি। দুই বছর আগে ছাত্ররা যখন মেম্বার-চেয়ারম্যান, চোর-ডাকাত মারা শুরু করে, তখন আমারে ধরছিল। আল্লাহ বাঁচানেওয়ালা। তাই বাইচ্চা আছি। এবার যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হইছে, তখন মনস্থির কইরাই ঘর থেকে বাইরাইছি। এতকাল নিজের ঘরে ডাকাতি করলাম, এবার পরের ঘরে ডাকাতি কইরা নিজের দেশরে বাঁচাতে চাই। সুযোগ যদি পাই তাইলে মরতেও রাজী।’
বহু ঘটনাই সে বলল। খুব ধৈর্য সহকারে তার কথা শুনলাম। সব কথা গভীরভাবে রেখাপাত করলো, আপনারা আমাকে গুলি করে মারতে পারেন, তবে বেঁধে রাখতে পারবেন না। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাকে মুক্তি বাহিনীতে নিলে ঠিকমত কাজ করতে পারবেন তো?” মহু সর্দারের জবাব, “যে কাজ দেবেন, সেটাই পারব। যে কাজ দেবেন, সেটাই করব।”
কেন জানি না মহুর কথা কিছুটা বিশ্বাস হলো। তাকে মুক্তিবাহিনীতে কাজ করার সুযোগ করে দিলাম। বিশ্বাস অপাত্রে স্থাপন করা হয়নি। পরে তাকে কারা রক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৪৪

মহু সর্দার তার দায়িত্ব গভীর আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে পালন করেছিল। মহু সর্দার যুদ্ধশেষে মুক্তি বাহিনীর তহবিলের নিরাপত্তা-প্রধান ছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর সে আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে। আমাদের পরিবারেও তার প্রচণ্ড প্রভাব। লোক হিসাবে সে হৃদয়বান, মহান।
দুর্গাপুর থেকে মরিচাতে নবী নেওয়াজকে নতুন দায়িত্ব দিয়ে দেওপাড়া গেলাম। পরদিন দলসহ বংশাই নদীর পাড়ে গোলাবাড়ীর ফরেস্ট ক্যাম্পে রাত কাটালাম।

দলীয় শাস্তিবিধান
চারানের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর অপরাধে ছাবদুলকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। যদিও তাকে পরে সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করে কমাণ্ডার শাজাহানের তিন নম্বর কোম্পানির হতেয়া ও নলুয়া এলাকায় পাঠানো হয়েছিল।
ছাবদুল নলুয়া গ্রামের অধিবাসী। সেখানে গিয়েও ছাবদুল ভালো হয়নি। গ্রামের বেশ কয়েকজন লোককে খারাপ আখ্যায়িত করে হত্যা করেছে। হত্যার সংখ্যা যখন পাঁচ, তখন স্থানীয় লোকজন কোম্পানি-কমাণ্ডার শাজাহানকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন, ছাবদুলকে দিয়ে নির্বিচারে লোকহত্যা করা হলে গ্রামবাসীরা মরে গেলেও মুক্তি বাহিনীকে সমর্থন করতে পারবে না। ছাবদুল পূর্ব থেকেই তার এলাকায় একজন বাজে ও লম্পট বলে পরিচিত। অবিলম্বে ছাবদুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গ্রামবাসীর কোম্পানি-কমাণ্ডার শাজাহানকে অনুরোধ করলেন। অন্যথায় তাঁরাই সবাই মিলে মুক্তি বাহিনীকে প্রতিহত করতে বাধ্য হবেন বলে জানিয়ে দিলেন।
ব্যাপক নিরপেক্ষ তদন্ত চালানো হলো। চূড়ান্ত রিপোর্টে দেখা গেল, ছাবদুল যাদের অপরাধী বলে ধরে এনে হত্যা করেছিল, তাদের চারজন সম্পূর্ণ নির্দোষ। অন্যজনও মৃত্যুদণ্ড পাবার মতো গুরুতর অপরাধ করেনি। তদন্তে আরও জানা গেল, নিহত পাঁচজনের সঙ্গে ছাবদুলের পূর্ব-শত্রুতা ছিল। তখনও আটক চোদ্দজনের ব্যাপারে একই কথা প্রযোজ্য। তারাও ছাবদুলের পুরাতন শত্রু।
এলাকার খারাপ লোক, বিশেষ করে চোর-ডাকাত সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও চুড়ান্ত রিপোর্ট প্রণয়নের দায়িত্ব ছাবদুলকে দিয়েছিল তিন নম্বর কোম্পানি-কমাণ্ডার শওকত মোমেন শাজাহান ছাবদুলকে দিয়েছিল। তদন্ত করে যখন দেখা গেল ছাবদুল তার পূর্ব-শত্রুতার বদলা নিচ্ছে, তখন তাকে গ্রেফতার করা হলো এবং পরদিন হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। রাতে ছাবদুল আরেকটি ঘটনা ঘটিয়ে বসে। হাত-পা বেঁধে ছাবদুলকে একটি ঘরে রাখা হয়েছিল। কৌশল করে হাতের বাঁধন খুলে প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, মধ্যরাতে ঘর থেকে বেরিয়ে একটি হাতবোমা নিয়ে কোম্পানি-কমাণ্ডার শাজাহানকে হত্যা করতে গেলে শাজাহানের দেহরক্ষী গ্রেনেড ছুঁড়তে উদ্যত ছাবদুলকে হাতে-নাতে ধরে ফেলে। শিবিরের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা অকস্মাৎ শোরগোল। হুড়মুড় করে উঠে পড়ে। ছাবদুল যদি গ্রেনেডটি ছুঁড়তে পারত, তাহলে ঢালাও বিছানায় শুয়ে থাকা কমাণ্ডার শাজাহানসহ কতজন যে হতাহত হতো, তা বলা মুশকিল। রাতের ঘটনা বর্ণনা করে আরো
পৃষ্ঠা নং ~১৪৫

একখানা নতুন রিপোর্ট লিখে পরদিন সকালে ছাবদুলকে কড়া পাহারায় আমার কাছে পাঠানো হলো। নিজের জীবনের উপর হামলা হওয়া সত্ত্বেও শাজাহান তার স্বাভাবিকতা হারায়নি। শত অপমান, উস্কানী ও উত্তেজনার মুখেও প্রতিশোধ নেয়নি বা বিচারের ভার নিজ হাতে তুলে নেয়নি। আক্রমণকারীর সাথে স্বাভাবিক ও বীরোচিত আচরণ, অন্যদিকে আমার উপর তার গভীর আস্থা ও বিশ্বাস শাজাহানের চরিত্রে এ দু’টি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল।
ছাবদুলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সর্বসম্মত মতামতের ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।
ছাবদুলের যখন বিচার চলছিল, তখন ধলাপাড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মোশাররফ হোসেনকে দালালির অভিযোগে গ্রেফতার করে আনা হয়। এর কিছুক্ষণ পর আওয়ামী লীগের স্থানীয় বিশিষ্ট নেতা বর্গার আবুল কাশেম বাতেন সাহেবকে নিয়ে ফরেস্ট ক্যাম্পে এলেন। গেট পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানালাম এবং ফরেস্ট ক্যাম্পের সামনে একটি বেঞ্চিতে বসলাম। বেঞ্চ ছাড়া সেখানে বসার আর কিছুই ছিল না। প্রায় মাস-দেড়েক পর বাতেন সাহেবের সাথে এই প্রথম দেখা। অস্ত্রে সজ্জিত আমাকে বাতেন সাহেব এই প্রথম দেখলেন। কচুয়ার হামিদুল হক, আর. ও. সাহেব এবং টাংগাইলের ফেরদৌস আলম রঞ্জুকে বাতেন সাহেবের সাথে আলাপ করতে বলে ধলাপাড়ার হেডমাষ্টার মোশাররফ হোসেনের ব্যাপারে হাত দিলাম।

দালাল হেডমাষ্টারের বিচার
হেডমাষ্টারকে যারা ধরে এনেছে, তারা তিনজন অভিযোগ করলো। প্রথম অভিযোগঃ হেডমাষ্টার তার স্কুলে ২৫ মার্চের পর থেকে অনেকবার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলেছে এবং নেতাদের গালি-গালাজ করেছে। দ্বিতীয়ঃ যারা স্বাধীনতা চায় এবং স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, তাদেরকে সে দেশের শত্রু বলে চিহ্নিত করছে। তৃতীয়ঃ চার-পাঁচদিন ধরে হেডমাষ্টার ধলাপাড়া স্কুলের সামনে লোকজন ডেকে তাদেরকে পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিবাহিনীর বিপক্ষে সোচ্চার হতে ও অস্ত্র ধরতে অনুরোধ করেছে। সর্বশেষ অভিযোগঃ এদিন সকালে ধলাপাড়া খেয়াঘাটে কয়েকজন লোকের কাছে সে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছিল যা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নিজ কানে শুনেছে।
হেডমাষ্টারকে বলা হলো, অভিযোগ সম্পর্কে তার কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন? হেডমাষ্টার বলল,
– একথা ঠিক যে আমি সভা করেছি, জনগণকে বলেছি, আমি আমার অধিকার প্রয়োগ করেছি। পাকিস্তান ধ্বংস হোক, তা আমরা কিছুতেই চাইতে পারি না।
– এই ক্রান্তিলগ্নে আপনি আপনার অধিকার প্রয়োগ করছেন? দেশের সমস্ত জনগণ বঙ্গবন্ধুকে ভোট দিয়েছেন অথচ পাকিস্তানীরা আমাদের অধিকার প্রয়োগ করতে দিল না কেন?
– না, এখানে পাকিস্তানের কোন দোষ নেই। আওয়ামী লীগ ইচ্ছা করে তাদের অধিকার প্রয়োগ করেনি।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৪৬

– ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানী সেনারা যে লক্ষলক্ষ লোক মেরেছে, হাজার হাজার মা-বোনের সম্মান নষ্ট করছে, এটা কোন অধিকারে?
– লক্ষ লক্ষ লোককে পাকিস্তানীরা মোটেই মারছে না। আর মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করার প্রশ্ন সেটা একেবারে বানিয়ে বলা, ভূয়া। যাদেরকে মারছে তারা দেশপ্রেমিক নয়, পাকিস্তানের শত্রু, দুষ্কৃতকারী।
মাষ্টারের এ ধরনের কথাবার্তা শুনে আমার পক্ষে স্বাভাবিক থাকা সম্ভব হলো না। সে আমার দু’তিন হাত দূরে একটি বেঞ্চিতে বসেছিল। তার মুখে ‘দুষ্কৃতিকারী’ শব্দ শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। সজোরে মাষ্টারের পেটে এক লাথি মারলাম। লাথি খেয়ে মাষ্টার ফরেস্ট অফিসের রেলিঙের উপর দিয়ে প্রায় তিন হাত নিচে মাটিতে পড়ে গেল।
তাকে ধরে এনে আবার বসানো হলো। এবার তার অন্য চেহারা। সে আমার পায়ে লুটিয়ে পড়ে জীবন ভিক্ষা চাইলো। আমি তখনও রাগে থর থর করে কাঁপছিলাম। নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য ঘরের ভিতরে গেলাম। জানালা দিয়ে প্রায় দশ মিনিট বাইরে খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুটা শান্ত হলাম। তারপর মাষ্টারের সামনে এসে বললাম, “আপনার অপরাধ এত গুরুতর যে, আপনাকে গুলি করে হত্যা করলেও আমার বিবেচনায় তা লঘুদণ্ড হবে। আপনি লেখাপড়া জানার পরও অন্ধ। আপনার এ অপরাধের শাস্তি আমার জানা নেই। লঘু শাস্তি দিয়ে আপনাকে মুক্তি দিতে চাই না। আপনাদের মতো লোকেরাই দেশের মানুষকে অন্ধ করে রেখেছে। আপনাদেরকে প্রথমে ধ্বংস করা উচিত। আপনি একজন শিক্ষক। উত্তেজনায় আপনার গায়ে লাথি মেরেছি। আপনি যদি সত্যিকারের শিক্ষক হয়ে থাকেন। সত্যিকারের গুণ এবং মনুষ্যত্বের বিন্দুমাত্রও যদি আপনার মধ্যে অবশিষ্ট থাকে, তা হলে আমার পা যেন অচল হয়ে যায়। যদি আমার পা সচল থাকে তাহলে আমি চিরকাল মনে করব, একটি বদলোক বা শয়তানের গায়ে আঘাত করেছি, কোন মানুষের গায়ে আঘাত করিনি। আপনি আপনার স্কুলে চলে যান। মনে রাখবেন, আপনাকে মুক্তিবাহিনী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলো। অতীতের অপরাধের একটিরও পুনরাবৃত্তি হলে সাথে সাথে এ দণ্ডাদেশ কার্যকরী হবে।”
আমার পা অচল হয়নি। মাষ্টার সাহেবও তার পূর্বের মানসিকতা বজায় রাখেননি, অতীত অপরাধের পুনরাবৃত্তিও তিনি করেননি। তিনি এখন আমূল পরিবর্তিত একটি নতুন মানুষ। মুক্তিযোদ্ধারা মাষ্টার ভদ্রলোকের উপর ঝুলন্ত মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাস্তবায়িত করার সুযোগ পায়নি। ভদ্রলোক বহাল তবিয়তে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হিসেবে আজও বেঁচে আছেন।

সাক্ষাৎপ্রার্থী বাতেন
ধলাপাড়ার মাষ্টার সাহেবকে বিদায় করে বাতেন সাহেবের কাছে গেলাম। গত মাস দেড়েকের ঘটনাবলী খোলাখুলি দুজনে আলাপ-আলোচনা করলাম। ইতিমধ্যে বাতেন সাহেব একবার বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের আগরতলা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে আমার সাথে দেখা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। এতদিনে তাঁর চেষ্টা সফল হলো। আলোচনার একপর্যায়ে বাতেন সাহেব বললেন, “পাকিস্তানীরা
পৃষ্ঠা নং ~ ১৪৭

সম্ভবত সুদক্ষ গেরিলা বাহিনী ছেড়েছে। তারা গ্রামবাসীদের সাথে মিশে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে হত্যা এবং গ্রেফতার করার প্রচেষ্টা চালাবে।” “দেখুন, বাতেন ভাই, বাঙালিরা যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে, তা হলে পাকিস্তানী ট্রেনিং প্রাপ্ত সুদক্ষ গেরিলারা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে একেবারে অচল। যত উন্নত ট্রেনিং থাকুক না কেন, লোকের সাথে মিশে কাজ করার মতো সুযোগ তাদের নেই। পাকিস্তানীরা গোপনে কিছু করতে পারবে না। সবরকম অবস্থার জন্যই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।”
আমার কথা শুনে খন্দকার বাতেন বললেন, “এ দিককার মতো নাগরপুরে যদি মুক্তিবাহিনী গঠন করা যেত তবে খুবই ভালো হতো। ওখানেও আপনি মুক্তি বাহিনী গঠনের ব্যবস্থা নিন। আমি আপনাকে যথাসাধ্য সাহায্য ও সহযোগিতা করব।” আলাপ-আলোচনার পর স্থির হলো, এক সপ্তাহের মধ্যে বাতেন সাহেবকে নানা ধরনের একশ’খানা অস্ত্র দেবো। তা দিয়ে তিনি তার এলাকায় মুক্তি বাহিনী গঠন করবেন। বাতেন সাহেব ও আবুল কাশেম আমার সাথে রাতের খাবার খেলেন। বংশাই নদীর পূর্বপারে এক বাড়ীতে তাঁদের রাত কাটানোর ব্যবস্থা করা হলো।

জনগণের অভিযোগ
পরদিন আমরা আবার দেওপাড়ার শিবেরপাড়ায় দেলাম। সেখানে ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ করিম মুন্সির সাথে সাক্ষাৎ হলো। বৃদ্ধ করিম মুন্সি মুক্তিযুদ্ধে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। শিবেরপাড়ায় উপলদিয়ার ফজলু এসে আমার সাথে দেখা করে মুক্তি বাহিনীতে আবার যোগদানের অনুমতি চাইল।
পরদিন শিবেরপাড়া থেকে বর্গাতে এসে ঘাঁটি গাড়লাম। বর্গাতে খবর পেলাম, বাশাইলে যে দল পাঠানো হয়েছে, তারা স্থানীয় লোকজনের উপর নানা ধরনের অত্যাচার করছে। যদিও খবরটি কোনও নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া যায়নি, তবুও খবর শুনে শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। খবরের সত্যতা যাচাই করতে বাশাইল যাওয়া স্থির করলাম। আমার দল দু’ভাগে ভাগ করে, একদলকে বাঘেরবাড়ী গিয়ে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিয়ে অন্যদল নিয়ে বাশাইলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
বাশাইলে যাবার দুটো রাস্তা এক, পায়ে হেঁটে। দুই, নৌকায়। নৌকায় যেতে পারলে পথের ক্লান্তি যেমন দূর হবে তেমনি বংশাই নদীর ভাটিপথে দ্রুততার সাথে অল্পসময়ে পৌঁছানো যাবে। এলাকার ছাত্রদের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত নৌকায় রওনা হলাম। একে ভাটি পানি, তার উপর দশজন ছাত্র বন্ধু সমান তালে বৈঠা টেনে চলেছে। মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধারা টানছে। নৌকা উল্কার গতিতে ছুটে চলেছে। বর্গা থেকে রতনগঞ্জ। মাইল ছয়েক পথ অতিক্রম করতে ত্রিশ মিনিট সময় লাগল। রতনগঞ্জে পৌঁছে কৃতজ্ঞ চিত্তে ছাত্রদের বিদায় জানাতে গিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরে বললাম, “আমাদের এগিয়ে দিতে এতটা ভাটিপথ এসেছ। এখন তোমাদের স্রোতের উজানে যেতে খুবই কষ্ট হবে। তোমরা হাসিমুখে এই কষ্ট স্বীকার করে নিচ্ছ দেখে বড় দুর্বল হয়ে পড়েছি। তোমাদের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মন ভরে উঠেছে। তোমাদের সহযোগিতার কথা আমি চিরদিন মনে রাখব।”
পৃষ্ঠা নং ~ ১৪৮

ছাত্রদের রতনগঞ্জে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খেয়ে যেতে অনুরোধ করলাম। ছাত্র বন্ধুরা অস্বীকার করে বলল, “যতক্ষণ খাবারের জন্য আমরা এখানে অপেক্ষা করব ততক্ষণে অর্ধেক পথ চলে যেতে পারব।” এরপর আর কী বলা যেতে পারে। তাদের জন্য কিছু চিড়া, মুড়ি, গুড় ও বিস্কুটের ব্যবস্থা করে দিলাম।
আমরা রতনগঞ্জ থেকে কাউলজানির দিকে দ্রুত ছুটছি। কেবলি ভাবছি, মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার যদি এমনি করে স্থানীয় জনগণের সাথে দুর্ব্যবহার করে, অত্যাচার চালায়, তাহলে জনগণের সমর্থন পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। পাঁচ নম্বর কোম্পানি-কমাণ্ডার লাবিবুর রহমানের কার্যকলাপ আপত্তিকর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ একটি নয়, অনেক। কোন অভিযোগই সামান্য নয়, রীতিমতো গুরুতর। তার বিরুদ্ধে দু’জনকে হত্যা, জোর করে বারো হাজার টাকা সংগ্রহ, পনের-ষোলজনকে অহেতুক বেত্রাঘাত, পাঁচ-ছয়টি বাড়ীঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেবার গুরুতর অভিযোগ। মুক্তিবাহিনীর কোন কমাণ্ডার এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ও গণবিরোধী কার্যকলাপ চালাতে পারে—এটা ছিল কল্পনার অতীত। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল, নিয়মশৃঙ্খলা কঠোরভাবে মেনে চলার ও জনগণের উপর অহেতুক অন্যায় অত্যাচার না-করার। কমাণ্ডার লাবিবুর রহমান আমার নির্দেশ শুধু অমান্যই করেনি, সে নির্বিচারে লোক হত্যা করেছে। সর্বোপরি মুক্তি বাহিনীর নিয়ম-শৃঙ্খলা ও আদর্শের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞা দেখিয়েছে। এসব কথা চিন্তা করে আমি শঙ্কিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম।
ঘণ্টাখানেক পর কাউলজানি বাজারে পৌঁছে খবর পেলাম, লাবিবুর রহমান তার কোম্পানি নিয়ে একদিন আগে বহেরাতলী চলে গেছে। লাবিবুর রহমানকে না-পেয়ে যেমন অসুবিধা হলো আবার কিছুটা সুবিধা যে হলো না, এমন নয়। ঠিক করলাম, কাউলজানি বাজারে কিছুক্ষণ অবস্থান করব এবং পাঁচ নম্বর কোম্পানির কার্যকলাপ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেব।
ভাবলাম, লাবিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তার আচার-আচরণ সম্পর্কে নিরপেক্ষভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারব। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে জানতে পারলাম, মুক্তিবাহিনীর নির্যাতনের যেসব খবর ইতিমধ্যে পেয়েছিলাম, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এলাকার প্রায় সমস্ত লোকজন পাঁচ নম্বর কোম্পানি-কমাণ্ডার লাবিবুর রহমানের চালচলন ও আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ এবং তারা কমান্ডারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
হতেয়া, কালমেঘা ও নলুয়াতে তিন নম্বর কোম্পানির ছাবদুল যেসব ঘটনা ঘটিয়েছিল, এ এলাকাতে পাঁচনম্বর কোম্পানির আলাউদ্দীন একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। সে এলাকায় এসে তার পুরোনো শত্রুদের দালাল আখ্যা দিয়ে বেদম প্রহার, খুন, ঘরবাড়ী জ্বালানো, ভীতি প্রদর্শন করে হাজার হাজার টাকা সংগ্রহ, রেডিও জবর দখলসহ আরো জঘন্য কার্যকলাপ চালিয়েছে। কমাণ্ডার লাবিবুর রহমান এসব ঘটনার প্রতিবাদ করলে আলাউদ্দিন তাকেও বিপদে ফেলবার চেষ্টা করেছিল। সে সর্বত্র রটিয়ে দেয় যে, এলাকায় যা-কিছু হচ্ছে সবই কোম্পানি কমান্ডারের নির্দেশে করা হচ্ছে। লাবিবুর রহমান এর কঠোর প্রতিবাদ জানালে তাকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়। ভয়াবহ
পৃষ্ঠা নং ~ ১৪৯

পরিস্থিতিতে উপায়ন্তর না দেখে লাবিবুর রহমান তার কাজ অসমাপ্ত রেখে বহেরাতলী হয়ে সখীপুরের দিকে চলে যায়।

সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি
লাবিবুর রহমান ও তার কোম্পানির কার্যকলাপের খোঁজ-খবর নিয়ে ও স্থানীয় প্রতিক্রিয়া জেনে বহেরাতলীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কালিয়ান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে কয়েকজন লোককে বহেরাতলীর দিকে যেতে দেখে লোকগুলো সম্পর্কে সন্দেহ ও কৌতুহল জাগল। তাদের ডেকে আনার জন্য কয়েকজনকে পাঠিয়ে দিলাম। তারা প্রায় পোয়া-মাইল পিছিয়ে কালিয়ান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে আমাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল। আমিও তাঁদেরকে দেখে আনন্দিত আমরা সবাই সবার কাছে পরিচিত।
এ দলে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেনঃ ফজলুর রহমান, ফজলুর রহমানের ছোটভাই মোহাম্মদ মুসা, মোকাদ্দেছ আলী, আলী আজগর খান দাউদ, এন. এ. খান আজাদ, মোহাম্মদ ইকবাল, মোহাম্মদ আলী হোসেন, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, সোহরাব আলী খান আরজু, মোঃ সোহরাওয়ার্দী। তাঁদের উদ্দেশ্য কী এবং তারা কোথায় যাচ্ছেন, এ প্রশ্ন করা হলে তারা সবাই বললেন, “আমরা আপনার সাথে মিলিত হতে যাচ্ছিলাম। বেশ কিছুদিন ধরে নানা ধরনের সংবাদ পাচ্ছিলাম। এসব সংবাদের ভিত্তিতে নিশ্চিত হলাম যে, পাহাড়ি এলাকায় এলে আপনার সঠিক সন্ধান পাওয়া যাবে। তাই আমরা সবাই পাহাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম।” দশ জনের মধ্যে ইকবাল এবং আজাদ পূর্ব থেকেই আমার সঙ্গে কাজ করছিল। ফজলুর রহমান বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সাথে কিছুদিন একই শ্রেণীতে লেখাপড়া করেছেন। মোকাদ্দেছ আলী সুরুজ-এর গুমান খাঁর ছেলে। গুমান খাঁ আর আমার বাবা আবদুল আলী সিদ্দিকী একে অপরের চিরশত্রু। মোয়াজ্জেম হোসেন খান ঘাটাইল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আলী আজগর খান দাউদ আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং একজন ত্যাগী ও বলিষ্ঠ ছাত্রনেতা হিসাবে সুপরিচিত এবং শ্রদ্ধেয়। ফজলুর রহমানের ছোটভাই মুসা আমার সমবয়সী, রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে মওলানা ভাসানীর আদর্শে অনুপ্রাণিত, বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য।
সন্ধ্যার কিছু পর সবাইকে নিয়ে বহেরাতলীতে পৌঁছলাম। মোকাদ্দেছ, ফজলুর রহমান এবং মুসার থাকার ব্যবস্থা বহেরাতলীতেই করা হলো। বহেরাতলী থেকে মাইলখানেক পূবে এক গ্রামে লোকমান হোসেন ও গফুরের চার নম্বর কোম্পানির শিবিরে মোয়াজ্জেম হোসেন খান, আলী আজগর খান দাউদ, সোহরাব আলী খান আরজু এবং সোহরাওয়ার্দীর থাকার বন্দোবস্ত করা হলো। সবার থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করে বহেরাতলীর জাফর চেয়ারম্যানের বাড়ীতে গেলাম। এ বাড়ীতে বসেই খবর পেলাম, বর্গার কাছে বইলানপুরে ইব্রাহীম মেম্বারের বাড়ীতে একদল পুলিশ এসে আস্তানা গেড়েছিল। তাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে। বিনা রক্তপাতে মুক্তিবাহিনী তের জন পুলিশ আটক এবং তিন হাজার গুলি ও কুড়িটি রাইফেল দখল করেছে।

বইলানপুরে পুলিশের দূরবস্থা
পাঁচনম্বর কোম্পানি-কমাণ্ডার লাবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করার জন্য আমরা
পৃষ্ঠা নং ~ ১৫০

যখন রতনগঞ্জ হয়ে কাউলজানিতে যাই, ঠিক তখন একদল পুলিশ কালিহাতি থেকে দেওপাড়া, বর্গা হয়ে বইলানপুরে পৌঁছে। মুক্তিযোদ্ধারা পুলিশ দলের আসার খবর পেয়ে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়। ৩শরা ও ১৯ এপ্রিল গোড়ান-সাটিয়াচরা, কালিহাতি যুদ্ধ ও বল্লার ঘটনার পর পাক-হানাদার বাহিনী আর পাকা সড়ক ছেড়ে গ্রামের ভিতর ঢুকতে সাহস করেনি। তাই মুক্তি বাহিনীর খোঁজ-খবর নিতে হানাদাররা এক নয়া কৌশল অবলম্বন করে। টাংগাইলের প্রত্যেকটি থানা থেকে বেশকিছু সবল পুলিশের সমন্বয়ে একটি বাহিনী গঠন করে। তাদের মাধ্যমেই হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর আস্তানা ও গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। বইলানপুরে পুলিশ বাহিনীর অভিযান এরই একটি অংশ।
পুলিশ দল এদিন দুপুরে কালিহাতি থেকে পাহাড়ি এলাকায় খোঁজ-খবর নিতে আসে। বিকেলে তারা নির্বিবাদে বইলানপুরে ইব্রাহীম-মেম্বারের বাড়ীতে উপস্থিত হয়। এ বাড়ীতে খানাপিনার ব্যবস্থাও চলতে থাকে।
খবরের সত্যতা যাচাই করা ও অন্যান্য খবর সংগ্রহ করতে ২৩ নম্বর কোম্পানি-কমাণ্ডার আবদুল খালেক এবং সহকারী কমাণ্ডার আনোয়ার হোসেন ইঞ্জিনিয়ার এবং সিগন্যাল কোম্পানীর দুলালকে তার নিজের এলাকা ইন্দ্রজানী, বইলানপুর ও বর্গা পাঠায়। ইব্রাহীম মেম্বারের ছেলে দুলাল ফিরে এসে তাদের বাড়ীতে পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতির কথা জানায়। দুলাল পরিবেশিত খবর ‘সিগন্যাল’ হেডকোয়ার্টার বাঘের বাড়ীতে জানানো হয়। পুলিশের পাহাড়ি এলাকায় ঢুকে পড়ার উদ্দেশ্য কী এবং এ পরিস্থিতিতে তাদের কী করা উচিত কোম্পানী কমাণ্ডার আবদুল খালেক এবং সহকারী কমাণ্ডার আনোয়ার হোসেন কিছুই স্থির করতে পারছেন না। তারা আমার সঠিক অবস্থান সম্পর্কেও অবহিত ছিল না। এমনি অবস্থায়, কমাণ্ডার আবদুল খালেক শুড়ীরচালা আবু সাঈদ চৌধুরীর খামারবাড়ীতে ছুটে যায়। খামার বাড়ীতে আমার বাবা-মা ও ভাই-বোনেরা ছিল। আবদুল খালেক বাবাকে বইলানপুরে পুলিশ আসার কথা জানায়। পুলিশ বাহিনীকে কখনও অক্ষত অবস্থায় ফিরে যেতে দেয়া উচিত নয়, অবিলম্বে তাদের উপর আক্রমণ চালানো উচিত বলে আমার বাবা তাঁর অভিমত জানান।
এতে আবদুল খালেকের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে গেল। বাঘেরবাড়ীতে সদ্য-আগত আমার দলের বাকি অংশ এবং কমাণ্ডার লোকমান হোসেন ও গফুরের নেতৃত্বাধীন প্রায় সত্তর-আশিজন মুক্তিযোদ্ধাদের সে বইলানপুরে পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতি এবং বাবার অভিমত ও নির্দেশের কথা জানায়। কমাণ্ডার আবদুল খালেকের কথা শুনে আবদুস সবুর, ফারুক আহমেদ, ফজলু, দেওপাড়ার রিয়াজ, লোকমান ও গফুরের কোম্পানি-সদস্যরা পুলিশদের উপর আক্রমণ করা অবশ্য কর্তব্য বলে স্থির করে।
বিকাল পাঁচটার দিকে তারা বাঘের বাড়ী থেকে উত্তরে প্রায় চার মাইল উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে বইলানপুরের কাছাকাছি পৌঁছে। মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় নব্বই জন। তারা নিজেদের তিন দলে
পৃষ্ঠা নং ~ ১৫১

বিভক্ত করে। দক্ষিণদিক থেকে আক্রমণের নেতৃত্ব দেবে আবদুস সবুর ও গফুর। পশ্চিম দিকের নেতৃত্বে রইল লোকমান। উত্তরে রিয়াজ ও তার দল। পূব দিক খোলা।
এদিকে পুলিশ বাহিনী দীর্ঘ চলায় শ্রান্ত, ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। তারা গোসল সেরে কেবল খেতে বসেছে। দু’চার লোকমা ভাত মুখেও দিয়েছে। এমন সময় গুলির আওয়াজ। দক্ষিণ দিক থেকে সবুর প্রথম গুলি চালায়। সাথে সাথে পশ্চিমে লোকমান ও উত্তর দিক থেকে রিয়াজ গুলি ছোঁড়া শুরু করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান পুলিশদের থেকে শ’গজের বেশি দূরে নয়। তিন দিক থেকে প্রচণ্ড গুলির শব্দ শুনে পুলিশরা হতভম্ব হয়ে পড়ে। যমদূত তাদের সামনে, মরণ তাদের ধরতে আসছে, পুলিশের দল পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে থাকে। দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর তিন দিক থেকে গুলি আসছে, খোলা শুধু পূব দিক। তারা পূব দিকে ছুটতে শুরু করে। কয়েকজন ঘরের মাচার নিচে ও সিলিঙের উপরে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। কেউ গাছে উঠে লুকোবার চেষ্টা করে। আকস্মিক আক্রমণের প্রত্যুত্তরে পুলিশের দিক থেকে বড়জোর চার রাউন্ড গুলি চলেছিল। যারা অস্ত্র হাতের কাছে পেয়েছে, তারাও তা ব্যবহার করার চেষ্টা করেনি। অস্ত্র বগল দাবা করতে ভরসা পায়নি, খালি হাতে ছুটে পালিয়েছে। পুলিশের দিক থেকে চার-পাঁচ রাউণ্ডের অতিরিক্ত কোন জবাব না-পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আস্তে আস্তে বাড়ীর আরও কাছাকাছি চলে যায়। উত্তর ও দক্ষিণে আবদুস সবুর ও রিয়াজের হাতে তিনজন পুলিশ পালিয়ে যাবার সময় ধরা পড়ে। বাড়ীর ভেতর থেকে কয়েকজন নারী-পুরুষ চিৎকার করে উঠে, “আপনারা আর গুলি চালাইবেন না। এহানে পুলিশ নাই—সব পালাইছে।”
পনেরজন মুক্তিযোদ্ধা তিনদিক থেকে ইব্রাহীম-মেম্বারের বাড়ীতে ঢুকে পড়ে। সমস্ত ঘর তল্লাসি করে মাচার নিচে চারজন ও কারের উপরে লুকিয়ে থাকা তিনজন পুলিশকে পাকড়াও করে। বাড়ীতে আর কোন পুলিশ নেই—এরকম সন্দেহমুক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পলায়নরত পুলিশ দলের পিছু ধাওয়া করতে যাবে, ঠিক এমন সময় বাড়ীর পূব দিকে একটা প্রকাণ্ড ‘জয়না’ গাছের উপর জনৈক উলঙ্গ পুলিশকে দেখতে পায়। সে গাছের ডালের সাথে একেবারে লতার মতো জড়িয়ে রয়েছে। তাকে নামতে বলা হলে অত্যন্ত করুণ কণ্ঠে বলল, “দেহেন, আমাকে মাফ করেন। আমি একটাও গুলি চালাই নাই। আমি আপনাগো হাতে ধরা দিতেছি। আমারে জানে মাইরেন না।”
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো—পঞ্চাশ বছরের পুলিশটি জামা কাপড়হীন হলেও রাইফেলটি নিয়েই সে গাছে উঠেছিল। পুলিশটি নেমে এলে তার রাইফেল পরীক্ষা করে দেখা গেল রাইফেলের ম্যাগাজিন একেবারে খালি। একটিও গুলি নেই। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তুমি গাছে উঠেছিলে কেন?’ তখন সে বলল, “দেহেন, আমি গেনজি গায়ে একটি তোয়াইলা জড়াইয়া খাইতে বইছিলাম। হেই সময় আপনাগোরে গুলির শব্দ আইল। আমরা দিশেহারা হইয়া যে যেদিকে পারলাম ছুটলাম। পলাইতে যাইয়া দিকবিদিক জ্ঞান হারাইয়া খাবার থালায় পা পইড়া অনেকে চিৎপাত হইয়া যায়। আমি বুড়া মানুষ। ত্রিশ বছর চাকরী হইয়া গেল। কোনদিন গোলাগুলি কইরতে ভয় হয় নাই। এত কাছে নিজেগো উপরে গুলি চলার আওয়াজও কোনদিন শুনি নাই।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৫২

গুলির আওয়াজ শুইন্যা আমার আর কোন জ্ঞান আছিল না। হাতের কাছে রাইফেলটা পাই। তাই নিয়া ঘরের বাইরে আইস্যা দাঁড়াই। ঘর থেইক্যা বাইর হইতে কহন যে তোয়াইলাটা পইড়া গেল, কিছুই বুঝতে পারি নাই। সবাই শুধু ছুটতাছে। আমি আর কী করি! রাইফেলের ম্যাগাজিন খুইল্যা দেহি একটাও গুলি নাই। আরও ভয় খাইয়া গেলাম। কহন যে গাছে চইড়া বইছি আমি কইতে পারুম না। গাছে উঠার পর হুশ হইল যে , আমার গায়ে খালি গেঞ্জি। তাড়াতাড়ি গায়ের গেঞ্জি টান মাইর‍্যা খুইল্যা দলা পাকাইয়া গাছের ডালের আড়ালে রাখি। আপনারা বিশ্বাস করেন আল্লার কছম, বাপ মা’র কছম আমি গাছে উইঠাই চোখ বন্ধ কইরা আছিলাম।”
পূর্বদিকে পলায়নপর আরো দু’জন পুলিশকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে ফেলে। বইলানপুরে এদিন তের জন পুলিশ ধরা পড়েছিল। ইব্রাহীম মেম্বারের বাড়ীতে পুলিশের দল কুড়িটি রাইফেল, তিন হাজার গুলি, চল্লিশ জোড়া জুতা, ত্রিশটি সার্ট-প্যান্ট ফেলে গিয়েছিল।
পুলিশদের বহেরাতলীর মাইল-দেড়েক পূবে এক গ্রামে আটকে রাখা হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর অপারেশন ও সফলতার কথা শুনে খুব খুশি হলাম। অভিযান যারা পরিচালনা করেছিল, তাদের সাথে সাথে অভিনন্দন-বার্তা পাঠালাম।
আটক তের জন পুলিশের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেব? অভিযুক্ত আলাউদ্দীনের কী বিচার করব? অনেক ভেবে-চিন্তে আলাউদ্দীনের বিচার প্রথম করব বলে স্থির করলাম। রাতেই আলাউদ্দীনকে গ্রেফতার করতে সখীপুরে কোম্পানি-কমাণ্ডার লাবিবুর রহমান এবং তিন নম্বর কোম্পানি-কমাণ্ডার শাজাহানকে বার্তা পাঠালাম।
সকালের নাস্তা সেরে সখীপুরের দিকে রওনা হব অথচ মুষলধারে বৃষ্টি। আটটা বেজে গেল। বৃষ্টির বিরাম নেই। শেষে বৃষ্টি মাথায় করে, সকাল সোয়া আটটায় সখীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ৫ই মে সখীপুর থেকে আংগারগারায় যাবার সময় আমাদের যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল, বহেরাতলী থেকে সখীপুরের পথে একই রকম চরম দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হলো। সাত মাইল রাস্তা পাড়ি দিতে আমাদের প্রায় তিন ঘন্টা সময় লেগে গেল।

সহযোদ্ধা ও ডাকাতের মৃত্যুদণ্ড
সখীপুর হাইস্কুলে পৌঁছানোর কিছু পর বৃষ্টি থামল। স্কুলের চারপাশে লাবিবুর ও শওকত মোমেন শাজাহানের কোম্পানির সদস্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান নিয়ে আছে। অন্যদিকে আলাউদ্দীনের বিরুদ্ধে যাদের অভিযান ছিল, তাদেরকেও সখীপুর আসতে বলা হয়েছিল। ঝড়, তুফান ও দুর্যোগ উপেক্ষা করে আলাউদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীরা ইতিমধ্যেই সখীপুরে পৌঁছে গেছেন।
প্রথমে কমাণ্ডার লাবিবুর রহমানের কাছ থেকে লিখিত ও মৌখিক রিপোর্ট নিলাম। কাউলজানি থেকে আগত ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনলাম। লাবিবুর রহমানের রিপোর্ট ও কাউলজানি থেকে আগতদের অভিযোগ—দু’য়ের মধ্যে তেমন কোন গরমিল দেখা গেল না। আনীত অভিযোগসমূহ একটি একটি করে আলাউদ্দীনকে পড়ে শোনানো হলো। আলাউদ্দীন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল,
পৃষ্ঠা নং ~ ১৫৩

‘আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ কোনটাই মিথ্যা নয়। আমি দু’জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি, পাঁচ-ছয়টি বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছি, টাকা-রেডিও সহ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়েছি। কয়েকজনকে বেত মেরেছি। কারণ এ সবই আমার দৃষ্টিতে ন্যায়সঙ্গত। যাদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছি, তারা সবাই এলাকার বজ্জাত লোক বলে পরিচিত।’
আলাউদ্দীনের জবানবন্দীর পর সবাই যথারীতি দুপুরের খাবার খেলাম। আলাউদ্দীনও স্বাভাবিকভাবে দুপুরের খাবার শেষ করলো। আলাউদ্দীনকে জিজ্ঞাসা করা হলো “বাড়ীঘর জ্বালানো অথবা কাউকে মেরে ফেলার ক্ষমতা এককভাবে কোন মুক্তিযোদ্ধাকে কি দেয়া হয়েছে? কোন সহযোদ্ধা যদি মনে করে যে, কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত তা’হলে কোম্পানী কমাণ্ডার, সহকারী কোম্পানী কমাণ্ডার ও অন্য তিনজন সহযোদ্ধার অনুমতি নেয়া অবশ্য প্রয়োজন। তুমি অনুমতি নিয়েছিলে?” “আমি কারো অনুমতি নেয়া প্রয়োজনবোধ করিনি। আমার বিচার-বুদ্ধিতে যা ভালো মনে করেছি, নির্দ্বিধায় তা করেছি।”
সওয়াল-জবাব শেষ হলে শাজাহানসহ বেশ কয়েকজনের সাথে আলাউদ্দীনের ব্যাপারে আলোচনা করলাম। সবাই ঐকমত্য পোষণ করলো যে, আলাউদ্দীন ছাবদুলের চাইতেও জঘন্যতম অপরাধ করেছে। যেহেতু ছাবদুলকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, সেহেতু আলাউদ্দীনকে মৃত্যদণ্ড দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। সর্বসম্মত রায় সমবেত জনতার সামনে ঘোষণা করা হলো। বিকাল চারটায় সখীপুর স্কুলের উত্তর পাশে আলাউদ্দীনকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হলো। এদিন সখীপুরে আরেকজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। আলাউদ্দীনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরী হবার আধঘন্টা পর উত্তর দিক থেকে ইদ্রিসের নেতৃত্বে প্রায় চল্লিশ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল এলো। ইদ্রিস সাগরদিঘী থেকে একটি ডাকাত ধরে এনেছে। ডাকাতকে দেখার জন্য সখীপুর স্কুল মাঠে সে কি ভীড়! লোকজন বলাবলি করতে থাকেন, ‘একে পাঁচ ছয় বছর চেষ্টা করেও পুলিশেরা ধরতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা ওকে ধরল কিভাবে?’
ইদ্রিসের সাথে এসেছে সাতজন সাধারণ মানুষ এবং কুড়ি-বাইশ বছরের দু’জন মহিলা। কুখ্যাত ডাকাত এ দু’জন মহিলাকে ধর্ষণ করেছে। এদের একজনকে ধর্ষণের সময় গ্রামের তিন চারজন লোক ইদ্রিসের সহায়তায় ডাকাতকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। ডাকাতির অভিযোগে হয়তোবা ডাকাতটিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো। তবে শুধু ডাকাতির অভিযোগ থাকলে সত্য যাচাইয়ের জন্য আরো দু’তিন দিন অপেক্ষা করতাম। ধর্ষণের অভিযোগ শুনে তাৎক্ষণিক বিচার করার ও শাস্তি দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম। মহিলা দু’জনকে তাঁদের বক্তব্য পেশ করতে বলা হলো। তারা দু’জনেই বললেন, ‘লোকটা আমাদের জোর কইরা ঘর থাইক্যা বাইর কইরা নিয়া অপমান করছে। স্বামীর কাছ থাইক্যা ছিনাইয়া নিয়া গহীন জঙ্গলে এক সপ্তাহ ধইরা আটক রাইখ্যা যখন ইচ্ছা তখন জোর কইরা ইজ্জত মারছে।’ মহিলা দু’জন অভিযোগ করতে করতে তাদের ক্ষত বিক্ষত শরীর দেখিয়ে কেঁদে-কেঁদে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। মা-বোন ডেকেও
পৃষ্ঠা নং ~ ১৫৪

তাঁদের শান্ত করা যাচ্ছিল না। ডাকাতটি অভিযোগ স্বীকার করে বলল, ‘এবারের মতো আমারে মাফ কইর‍্যা দেন। ভবিষ্যতে আর এরকম কাম করুম না। ভবিষ্যতে আর ডাকাতিও করুম না। আমারে প্রাণভিক্ষা দেন।’ মুক্তি বাহিনী ডাকাতটিকেও প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে।

আফসার মেম্বার
সাগরদিঘীর কুখ্যাত ডাকাতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরী হওয়ার কুড়ি মিনিট পর হঠাৎ দেখা গেল, উত্তর দিক থেকে ধূলি উড়িয়ে একদল লোক আসছে। সখীপুর থেকে প্রায় এক মাইল উত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অগ্রবর্তী দল পাহারায় ছিল। তারা পুলিশের ইউনিফর্ম ও সাধারণ পোষাকে সজ্জিত সত্তর-আশিজন লোকের দলটির গতিরোধ করে। দক্ষিণ দিকে অগ্রসরমান দলটির অগ্রবর্তী ক্ষুদ্র অংশকে মুক্তিযোদ্ধা চ্যালেঞ্জ জানালে, তাদের পিছনের মূল দলটি রাস্তার আশে-পাশে তড়িৎ গতিতে শুয়ে, বসে, হাঁটু গেড়ে পজিশন নেয়। অগ্রবর্তীদলের লোকেরা পজিশন নেবার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে বলল, “সাবধান! নড়াচড়া করলে গুলি চালাতে বাধ্য হব। আপনারা কারা? কোথা থেকে আসছেন? কোথায় যাবেন? নড়াচড়া না-করে প্রশ্নের জবাব দিন।’ অগ্রবর্তী দলের একজন বললো, আমরা মল্লিকবাড়ী থেকে আসছি।
আফসার মেম্বার আমাদের দলের নেতা। কমাণ্ডার মনিরুল ইসলাম আমাদের সখীপুর হাইস্কুলে উপস্থিত হতে বলেছেন। আমরা সেখানে কাদের সিদ্দিকীর সাথে দেখা করব।” একথা শুনে চ্যালেঞ্জ-প্রদানকারী মুক্তিযোদ্ধারা দায়িত্বশীল কোন ব্যক্তিকে তাদের কাছে পাঠাতে অনুরোধ করে। আগত দলের একজন একটু পিছনে গিয়ে তাদের মূল দলের সহকারী নেতাকে নিয়ে আসে। সে প্রমাণাদি দেখিয়ে চ্যালেঞ্জকারী দলকে সন্দেহ মুক্ত করতে সক্ষম হয়।
এই দলের নেতা আফসারউদ্দিন আহমেদ, আফসার মেম্বার বলে সকলের কাছে পরিচিত। বাড়ী ভালুকা। মুক্তিবাহিনীর দু’জন দায়িত্বশীল সদস্য আফসার মেম্বারকে আমার সামনে হাজির করলো। আফসার মেম্বার এসেই সামরিক কায়দায় সালাম করলো। সালামের প্রতি-উত্তর জানিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম।
আফসার মেম্বারের দলের যোদ্ধাদের চা-নাস্তার ব্যবস্থা করা হলো। আমরা দু’জন সামনা-সামনি বসে আলোচনা শুরু করলাম। আফসার মেম্বার বললেন, “আপনি আমাদের এলাকায় কুড়ি দিন আগে গিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য, আমার দেখা হয়নি। সাত দিনের মধ্যে আমরা আসতে পারিনি। আমি ভেবেছি, একটি সুশৃঙ্খল দল গঠন করে তারপর আপনার কাছে হাজির হব। আর এটা করতে কয়েকদিন বিলম্ব হয়ে গেল। আশা করি, এই দু’সপ্তাহের বিলম্ব আপনি অন্যভাবে নেবেন না। আমি আমার দলের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করছি ও আপনার নেতৃত্ব মেনে নিচ্ছি। এখন আপনি আমাদের যে ধরনের কাজ দেবেন আমরা তাই করব এবং যেখানেই পাঠাবেন সেখানেই যাব।” তিনি আরও বললেন, “আপনার প্রেরিত কোম্পানি-কমাণ্ডার মনিরুল ইসলামের সাথেও এ ব্যাপারে আমার কথাবার্তা হয়েছে।” চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের এই ভদ্রলোকের অগাধ দেশপ্রেম ও আন্তরিকতা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসার দাবিদার।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৫৫

নিরলস ত্যাগী মুক্তিপাগল এই মানুষটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর এক সন্তানকে হারিয়েছেন।
ঘন্টাখানেক আলোচনার পর, আফসার মেম্বারের পুরো দলের নিয়ন্ত্রণের ভার শওকত মোমেন শাজাহানের উপর অর্পণ করলাম। এ দলের প্রতিটি সদস্যকে ভালো করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে এবং তাদের বড়চওনা থেকে পাথরঘাটা পর্যন্ত একবার পরিভ্রমণ করবার নির্দেশ দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে আবার দেখা হবে, আফসার মেম্বারকে এ আশ্বাস দিয়ে বহেরাতলার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

প্রচার পরিকল্পনা
লোকমান হোসেনের কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে বইলানপুর অভিযানের নেতা ও যোদ্ধাদের সাথে বুকে বুক মিলিয়ে, অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন খানদের সঙ্গে আলোচনায় বসলাম। আলোচনা চলাকালে এক সহকর্মীকে বললাম, “এদের সাথে আলোচনা শেষ করে একসাথে খাবার খেয়ে বিদায় অভিনন্দন জানিয়ে তবে অন্য কাজে হাত দেবো।” আলোচনায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, তাঁরা প্রাথমিক অবস্থায় সমগ্র এলাকা পরিভ্রমণ করবেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা সবাইকে বুঝিয়ে বলবেন হানাদার পাকিস্তানীদের মোকাবেলা করতে একটি সুশৃঙ্খল ও সংঘবদ্ধ দল কত অপরিহার্য, জনসাধাণের মধ্যে প্রচার করবেন। প্রচারের মাধ্যম হবে প্রধানত দু’টি:
এক- এলাকার মানুষের সাথে আলাপ-আলোচনা ও ছোটখাটো সভা অনুষ্ঠান।
দুই- প্রচারপত্র ছাপিয়ে তা জনগণের মধ্যে বণ্টন।
প্রথম অবস্থায় পনের থেকে একুশ দিন এই ধরনের প্রচার-অভিযান পরিচালনা করে মোয়াজ্জেম হোসেন খান ও অন্যান্যরা আবার আমার সঙ্গে একত্রিত হবেন অথবা ঐ সময় আমি তাদের কাছাকাছি কোথাও থাকলে নিজে গিয়ে মিলিত হব। গভীর জঙ্গলে চার নেতার আলাপ-আলোচনায় আমি তাঁদের নেতৃত্ব করছি বা নেতার মতো নির্দেশ দিচ্ছি, এমন কিন্তু হয়নি। চারজনের প্রতি আমার প্রতিটি কথা ছিল অনুরোধসূচক। চারজনের অন্ততঃ তিনজন ছিলেন আমার চাইতে রাজনৈতিক দিক থেকে প্রবীণ। বিশেষ করে মোয়াজ্জেম হোসেন খান তখন ঘাটাইল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সোহরাব আলী খান আরজু তখন পর্যন্ত আমার নেতা হিসাবে সম্মানিত। দাউদ খানের অবস্থাও তাই। শুধু সোহরাওয়ার্দীই ছিল আমার সমসাময়িক। আর তখন পর্যন্ত ঠিক নেতৃত্ব কে দেবে তার কোন ফয়সালা হয়নি। যদিও তখন আটশ’র অধিক মুক্তিযোদ্ধা আমার কথাকেই বেদবাক্য হিসাবে ধরে নিতে শুরু করেছিল। তবুও আমি আমার এই প্রবীণ রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্ব দিতে চাইনি। তাঁদেরকে দেশ ও জাতির স্বার্থে অনুরোধ করতে চেষ্টা করেছি মাত্র। আমি একটাও লক্ষ করেছি, তাঁরা যেন কোন মতেই মনে না করেন যে, আমি তাঁদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করছি বা করার চেষ্টা করছি।
আলোচনা শেষে চারজনকে খাবার খাইয়ে প্রচার-অভিযানের জন্য পনের’শ টাকা দিয়ে এবং প্রয়োজন হলে তাঁরা মুক্তি বাহিনীর নামে জনগণের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করতে পারেন,
পৃষ্ঠা নং ~১৫৬

এরকম অনুরোধ জানিয়ে মুক্তিবাহিনীর শিবির থেকে আধমাইল রাস্তা নিজে এগিয়ে দিলাম। শুধু তাই নয়, পথঘাট-চেনা দু’জন পথপ্রদর্শককেও তাঁদের সাথে দেয়া হলো।
আমি একটি গাছের নিচে চুপ-চাপ বসেছিলাম। ডানে-বাঁয়ে সঙ্গীন উঁচিয়ে ত্রিশজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা পাহারা দিচ্ছিল। এদের চারজন আমার খুব কাছাকাছি। তাদের দৃষ্টি যেন বর্তমান যুগে মহাশূন্যে উৎক্ষেপিত সর্বাধুনিক উপগ্রহের চোখগুলোর চাইতেও তীক্ষ্ণ।

পুলিশদের বিচার
পুলিশদের হাত বেঁধে আনা হলো। এদের বয়স তেইশ-চব্বিশ থেকে আরম্ভ করে পঞ্চাশ পর্যন্ত। তাদের মাটিতে বসতে বলে হাতের বাঁধন খুলে নিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দিলাম। পুলিশদের বললাম, “আমাকে প্রথমে বুঝতে হবে, আপনারা ধরা দিয়েছেন, না ধরা পড়েছেন। আপনাদের দেখে আমার ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ২৫ মার্চ ঢাকার রাজারবাগে বীর বাঙালি পুলিশ ভাইয়েরা স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে শৌর্য-বীর্যের পরিচয় দিয়েছেন, তার ছিটেফোঁটাও যে আপনাদের স্পর্শ করেনি এটা দেখে আপনাদের দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা ও লজ্জা হচ্ছে। এবার আপনারাই বলুন, আপনারা আত্মসমর্পণ করেছেন, না ধরা পড়েছেন। তারা প্রায়ই সবাই একসাথে বলল, “দেখুন, আমরা ইচ্ছা করে পাহাড়ে ঢুকিনি। আমরা পেটের দায়ে চাকরি করছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে যাবার কোন সুযোগ পাইনি। তাই পাকিস্তানীরা আমাদের ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে।” সমস্বরে উচ্চারিত পুলিশদের কথার অর্থ কী, তা উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ায় এক-এক করে বক্তব্য পেশ করতে পুলিশদের নির্দেশ দিলে সবাই এক-এক করে নির্ভুলভাবে উপরোক্ত বক্তব্য পেশ করে বলল, “আমরা আত্মসমর্পণ করেছি।”
এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্য পেশ করার পালা। তারা পরিষ্কার উল্লেখ করলো, “পুলিশদের একজনও আত্মসমর্পণ করেনি। পলায়নপর ও লুকিয়ে থাকা অবস্থায় তারা আমাদের কাছে ধরা পড়েছে। তবে এটা ঠিক আমাদের উপর পুলিশ বাহিনী চার-পাঁচ রাউণ্ডের বেশি গুলি ছুঁড়েনি। পাকড়াও করার সময় কোন বাঁধাও দেয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্য শুনে পাকিস্তানীদের পক্ষে অংশ গ্রহণের জন্য কঠোর ভাষায় পুলিশদের তিরস্কার করে বললাম, “আপনারা প্রত্যেকে নিজেদের বিচারক সেজে এক এক-করে বলুন, আপনাদের কী শাস্তি হওয়া উচিত?” আটজনের এক বক্তব্য, ‘আমাদের এইবারের মতো ক্ষমা করে দিলে আমরা আল্লাহ ও রসুল, পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততির নামে কসম খেয়ে বলছি আর কিছুতেই পাকিস্তানীদের পক্ষে অস্ত্র ধরব না।’
বিক্রমপুরের সফি ও কুষ্টিয়ার একজন পুলিশ—এ দু’জনের বয়স বাইশ-তেইশ বছরের বেশী নয়। এই দু’জন বলল, “আমরা সামান্য পুলিশ। উপরন্তু আমরা ভিন্ন জেলার লোক। এখানকার রাস্তা-ঘাট ও মানুষদের সাথে পরিচিত নই। তাছাড়া কার প্রেরণায়, কার নেতৃত্বে
বা কার ভরসায় আমরা স্বাধীনতার পক্ষে আমাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র ব্যবহার করতে পারি—তা বুঝে উঠতে পারিনি। আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে চাই। আল্লাহ-রসুল, মা-বাপ ও দেশের মাটির নামে কসম করে বলছি, যদি বিশ্বাস করে আমাদের বাঁচার সুযোগ দেন এবং মুক্তিযুদ্ধে
পৃষ্ঠা নং ~ ১৫৭

অংশ নেবার সুযোগ পাই, তাহলে আপনার বিশ্বাসের অমর্যাদা করব না।”
বাকি তিনজন বললো, আমরা জীবন ভিক্ষা চাই। আমাদের বয়সও হয়ে গেছে। নিজের এলাকাতে গিয়েও হয়তো ঠিক থাকতে পারব না। মুক্তিযোদ্ধা হবার শারীরিক সামর্থও নেই। যদি আমাদের প্রাণভিক্ষা দেন, তাহলে আপনাদেরই আমাদের খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।’
পুলিশের ব্যাপারে এলাকার লোকদের কোন অভিযোগ আছে কিনা–থাকলে বিচারের সময় উপস্থিত হয়ে তারা তা জানাতে পারেন, এরকম একটি বিজ্ঞপ্তি ইতিমধ্যেই প্রচার করা হয়েছিল। দেওপাড়া, বারগা ও বইলানপুর (এসব গ্রামের মধ্যদিয়ে পুলিশ দল এসেছিল ১ গ্রামের পনের-ষোলজন উপস্থিত হয়েছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার, মারধোর ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। আঠার-উনিশ বছরের এক যুবক জনৈক পুলিশকে চিহ্নিত করে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলল, গতকাল ঐ পুলিশটা আমার ভাইকে বিনাদোষে বারগায় গুলি করে হত্যা করেছে। আমি আপনার কাছে বিচার চাই। এর উপযুক্ত বিচার না করলে আল্লাহ আপনার বিচার করবে।” দাখিলকৃত রিপোর্ট ও অভিযান পরিচালনকারী কমাণ্ডারগণও চিহ্নিত পুলিশের বিরুদ্ধে মারধোর ও একটি হত্যার অভিযোগ উল্লেখ করেছে।
আটজনের দল থেকে অভিযুক্ত পুলিশটিকে দূরে সরিয়ে দিতে বললাম। তাকে তার বক্তব্য পেশ করতে বলা হলে আত্মপক্ষ সমর্থন করে অভিযুক্ত পুলিশটি জানালো, “এসব কিছুই আমি করিনি। সামান্য যা করেছি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশে করেছি। আমি নির্দোষ। আমাকে ক্ষমা করেন। আমার ছোট ছোট দু’টি সন্তান আছে। আমার বৃদ্ধা মা ও বাবা আমার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে প্রাণভিক্ষা দেন।” পুলিশটির কথা শেষ হতে না হতে মাটিতে লুটোপুটি খেতে থাকা আঠার-উনিশ বছরের যুবকটি চিৎকার করে উঠল, “এই অল্প কয়েকদিনেই শুনেছি, কাদের সিদ্দিকী তুমি নাকি দয়ার সাগর হয়ে গেছ। এ পুলিশের যেমন বউ ও দু’টি সন্তান আছে, বৃদ্ধা বাপ-মা যেমন তার উপর নির্ভরশীল; আমাদের সংসারেও বড় ভাই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম। তারও চারটি সন্তান আছে। আমারও মা-বাবা বৃদ্ধ। আমরা দুই ভাই ও একবোন পিতৃতুল্য বড় ভাইয়ের উপর নির্ভর করতাম। তোমার বাবাকে হত্যা করলে তুমি কি মহানুভবতা দেখাতে পারতা? তুমি ন্যায় বিচার না করলে আল্লাহ্ তোমাকে কোনদিন ক্ষমা করবে না। তোমার সমস্ত শরীর পচে গলে যাবে।”
বিচারের দাবি জানাতে জানাতে যুবকটি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল। আগের কথাগুলোও যে সে সচেতনভাবে গুছিয়ে বলতে পেরেছিল তা মনে হয় না। পিতৃতুল্য ভাইয়ের মৃত্যুতে সে পাগলপ্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তার কোন ভয়-ডর ছিল না। তার শুধু কামনা ছিল, পিতৃতুল্য ভাইয়ের হত্যাকারীর ন্যায়বিচার হোক। ‘ন্যায়’ বলতে বোধ করি তার শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণু ও রক্তকণা বারবার বলছিল, ‘আমার ভাইকে যে হত্যা করেছে, তার মৃত্যুই হল একমাত্র ন্যায়বিচার।’
পৃষ্ঠা নং ~ ১৫৮

আগত অন্যান্যদের কেউ কেউ তাদের গায়ের জামা উঠিয়ে পিঠের ক্ষতস্থান, আবার কেউ কেউ পায়ের দিককার কাপড় উঠিয়ে রক্তাক্ত ক্ষতস্থান দেখাতে শুরু করলেন। সঙ্গে এও বললেন, ‘এই যে দেখুন, কী নির্দয়ভাবে এই সীমারটা আমাকে মেরেছে। এ হারামজাদা রাস্তার যেখানে যাকে পেয়েছে, তাকেই অমনি নির্দয়ভাবে মেরেছে।’ বইলানপুরের ইব্রাহীম মেম্বারের বাড়ীর দু’তিন জন এসময় এসেছিলেন। তাঁরাও পুলিশটির আপত্তিকর ও উদ্ধত আচরণের কথা অকপটে স্বীকার করলেন।
দু’পক্ষের কথা শুনে আমার মনে দ্বন্দ্বের ঝড় শুরু হলো। আমি স্থির থাকতে পারছিলাম না। তাই বিচার স্থান থেকে উঠে একটি গাছের নিচে পনের মিনিট চুপ-চাপ বসে থাকলাম। একবার ভাবলাম চরম দণ্ড দিলে পুলিশটির দু’টি নাবালক সন্তান ও বৃদ্ধা পিতা-মাতা পরনির্ভরশীল হয়ে পড়বে, অর্ধাহারে-অনাহারে কষ্ট পাবে, পথে বসবে। তাদের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে। তাছাড়া যিনি চলে গেছেন, তাকেও আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। সুতরাং একটি মূল্যবান জীবন নষ্ট করে লাভ কী?
কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনের কোণে প্রশ্ন জাগল, না না এ আমি কী ভাবছি? এটা কী করে সম্ভব? অপরাধ করেও যদি অপরাধী সাজা না পায়, মুক্তি পেয়ে যায়, তাহলে দ্বিগুণ উৎসাহে সে আবার পূর্ববত অপরাধ করে যাবে। দ্বিতীয়তঃ যারা অত্যাচারের শিকার হলো, প্রতিকার না হলে তারাও সুবিচার থেকে বঞ্চিত হবে। তৃতীয়তঃ অপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার কারণে সমাজে দেখা দেবে নানা প্রতিক্রিয়া। আইন ও শৃঙ্খলা, শাসন ও বিচার বলে কোন কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। গণস্বার্থ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য অপরাধীর অবশ্যই ন্যায় বিচার হওয়া উচিত।
আমার মনের নিভৃতে প্রশ্ন জাগল অপরাধীকে আমি ছেড়ে দেবার কে? অপরাধীকে মুক্তি দেবার কোন অধিকার বা ক্ষমতা দেবার আমি কে? অপরাধীকে মুক্তি দেবার কোন অধিকার বা ক্ষমতা আমার আছে কি? এরকম ক্ষমতা আমাকে কে দিয়েছে? আমি যেমন একটি সৎ মানুষকে শাস্তি দিতে পারি না, তেমন একটি অপরাধীকেও বিনা-বিচারে মুক্তি দিতে পারি না। এরকম ক্ষমতা কারোও থাকা উচিত নয়।
এরকম চিন্তা-ভাবনার পর কিছুটা শান্ত হয়ে আস্তে আস্তে পূর্বের জায়গায় এসে বসলাম। মিনিট খানেক বসে থাকার পর সোজা দাঁড়িয়ে উপস্থিত লোকজনদের দিকে ভালোভাবে একবার দেখে বললাম, “আমরা ঘটনার সকল দিক পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি, আসামীর অপরাধ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার অপরাধ অতিশয় গুরুতর। এহেতু মুক্তিবাহিনী তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলো। আর মৃত্যুদণ্ডাদেশ অবিলম্বে দুই গুলিতে কার্যকর করা হবে।”
রায় ঘোষণার সাথে সাথে দু’তিনজন মুক্তিযোদ্ধা পুলিশটিকে দুদিক থেকে শক্ত করে ধরে ফেলল। কান্নায় ভেঙে পড়া পুলিশটি আবার প্রাণভিক্ষা চাইল। তাকে বললাম, “আল্লাহু … আপনাকে ক্ষমা করুন। সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও। মৃত্যুর প্রাক্কালে আপনার কোন আকাক্ষা যা তাৎক্ষণিকভাবে পূরণ করা সম্ভব, থাকলে তা জানাতে পারেন। আপনার আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা পূরণের
পৃষ্ঠা নং ~ ১৫৯

আপ্রাণ চেষ্টা করব।” এবার পুলিশের বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকল না যে, তার প্রাণরক্ষা পাওয়ার আর কোন সম্ভাবনা নেই।
মৃত্যু অবধারিত জেনে, পুলিশটি কিছুটা সাহস ফিরে পেল। সে বলল, “সত্যিই আমি জীবনে অনেক অপরাধ করেছি। আজ তারই কর্মফল পেতে চলেছি। আমার শেষ অনুরোধ, আপনারা আমার লাশ সম্মানের সাথে ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন করবেন আর আমার মৃত্যুর সংবাদ আমার বাড়ীতে পৌঁছে দেবেন।” তার নাম ও ঠিকানা ভালোভাবে নোট করে নেয়া হলো। তারপর পশ্চিমমুখী দাঁড় করিয়ে সামনের দিক থেকে পর পর দু’খানা গুলি ছোঁড়া হলো। দু’টি গুলিই তার বক্ষ ভেদ করলো। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সাথে সাথে লোকমান, গফুর, ফজল ও সবুর তার কাছে গেল। সে একটু পানি খেতে চাইল। তার মুখে পানি তুলে দেয়া হলো। এক বা দুই ঢোক পানি পান করার পরই তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল। এরপর পূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে তাকে দাফন করা হলো।
একজনের মৃত্যুদণ্ড, বাকি বারোজনের মধ্যে সাতজনকে দু’ঘা, শারীরিকভাবে দুর্বল তিনজনকে এক ঘা, শফি ও কুষ্টিয়ার পুলিশকে প্রচণ্ড জোরে পাঁচ ঘা করে বেত্রাঘাত করার জন্য আর. ও. সাহেবকে নির্দেশ দিলাম।
দশজনকে মুক্তি এবং বাকি দু’জন পুলিশকে কিছুদিন পর্যবেক্ষণের পর উপযুক্ত হলে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হবে বলে ঘোষণা করা হলো। মুক্তিপ্রাপ্ত দশজন পুলিশকে আড়াই’শ করে টাকা হাত খরচ দিয়ে মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার বাইরে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হলো।
পুলিশদের ব্যবস্থা করে সেখান থেকে সোজা বাঘেরবাড়ী গেলাম। লোকমানের কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধাদের মতো বাঘেরবাড়ী, ভবানীপুরে তেইশ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানী কমাণ্ডার ও সহকর্মীদের বইলানপুরে সফল অভিযানের জন্য উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলাম। সিগন্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীর কমাণ্ডার আবদুল খালেক ইতিমধ্যে কাকড়াজান, বহেরাতলী, কাউলজানি, গজারিয়া, নাগবাড়ী, দেওপাড়া, ধলাপাড়া, সাগরদীঘি ও কালিয়াপাড়া ঘোনারচালার স্বেচ্ছাসেবকদের একটি নামের তালিকা তৈরি করেছিল। সেই তালিকা আমার হাতে তুলে দিল।

বাঘের বাড়ী থেকে শুড়ীরচালা
বাবা-মার সাথে দেখা করার জন্য বাঘের বাড়ী থেকে শুড়ীরচালা আবু সাঈদ চৌধুরীর খামার বাড়ীতে গেলাম। খাবার সময় খামার বাড়ীর দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ ভেসে আসল। প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। বাবা-মা ও বাড়ীর তত্ত্বাবধায়ক ত্রিশ বছর বয়সের বলিষ্ঠ যুবক মইশাল জানালো, পাশের গ্রামে হয়তো ডাকাতি হচ্ছে।
এ কথা শুনে হাতের ভাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে গুলির আওয়াজ লক্ষ করে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম। ছয়জন সহকর্মী আমাকে অনুসরণ করলো। খামার বাড়ী থেকে দুই-আড়াই মাইল যাওয়ার পর আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম। গ্রামের লোকেরা জানালো, “ডাকাত পড়েছিল। তবে
পৃষ্ঠা নং ~১৬০

কোন অঘটন ঘটাতে পারেনি। পাশের বাড়ীতে বন্দুক আছে। তারা পর পর কয়েকটি গুলি ছুড়লে ডাকাতদল ভয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালিয়ে গেছে।”
সাহসের সাথে ডাকাতদের মোকাবিলা করার জন্য গ্রামবাসীদের ধন্যবাদ জানিয়ে আশ্বাস দিলাম, “আগামী দশদিনে সমস্ত এলাকা যদি চোর-ডাকাত মুক্ত করতে না-পারি, তাহলে শাস্তির জন্য আমিই আপনাদের সামনে দাঁড়াব। আপনারা একটু কষ্ট করে, আর দশটা দিন অবাঞ্ছিত লোকদের মোকাবেলা করুন।”
পৃষ্ঠা নং ~ ১৬১

শপথ অনুষ্ঠান

আবার খামার বাড়ীতে ফিরে এসে বাবা-মার সাথে প্রয়োজনীয় কিছু কথাবার্তা সেরে দলবলসহ বেরিয়ে পড়লাম। খামার বাড়ী থেকে প্রায় চার মাইল পূবে বড়চওনা কমিউনিটি সেন্টারে উপস্থিত হয়ে ইদ্রিছকে খবর দিয়ে আনা হলো। সর্বত্র কোম্পানী কমাণ্ডারদের কাছে বার্তা পাঠানো হলো, “পত্র পাওয়া মাত্র অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে, কোম্পানী সহ বহেরাতলীতে সমবেত হও।” সকল কমাণ্ডারদের কাছে একই বার্তা পাঠানো হলেও কোন কোম্পানী কমাণ্ডারই নিজের পরিধির বাইরে অন্যদের খবর জানত না। অভূতপূর্ব গোপনীয়তা রক্ষা করে, নির্দিষ্ট দিনে নির্ধারিত সময়ে একে-একে সবাই বহেরাতলীতে সমবেত হলো।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর এখানে আবার একত্র হয়েছে এবং হচ্ছে। একদল আরেক দলকে দেখে যারপরনাই আনন্দিত ও আহ্লাদিত। বিগত দিনের অভিযান নিয়ে একদল অন্যদলের সাথে আলোচনা করছে। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে কেউ কেউ বলছে, ‘দেশকে শত্রুমুক্ত না করা পর্যন্ত বিয়ে করব না।’ কেউ কেউ আবার বলছে, ‘হানাদার বাহিনী উৎখাত না করে আর স্ত্রীর মুখ দেখতে চাইনে।’ কেউ আবার শপথ নিচ্ছে, ‘স্বাধীনতা ছিনিয়ে না আনা পর্যন্ত পিতা-মাতার কাছে ফিরে যেতে চাই না। মা, মাটি, সবই আজ শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত, পদদলিত। মা, মাটি ও মানুষকে উদ্ধার করতে জীবন দেব, তবুও অস্ত্র ত্যাগ করব না।’
একই উদ্দেশ্যে সমর্পিতপ্রাণ অনেকগুলো মানুষ একত্রিত হলে, কত কথা কত আলোচনা হয়! বহেরাতলীতে সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদের ঐসব কথাবার্তার সার-সংক্ষেপ একটাই—শত্রু সংহার। শত্রু খতম করে দেশোদ্ধার। অন্যথা তাদের স্বস্তি নেই, শান্তি নেই, মুক্তি নেই। এক কথায় কিছুই নেই।
বহেরাতলীর নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দেয়া হলো লাবিবুর রহমানের পাঁচনম্বর কোম্পানী, গোলাম সরোয়ার ও লাল্টুর বারো নম্বর কোম্পানীর উপর। নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হলে, দ্বিতীয় পর্যায়ে নিরাপত্তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে শওকত মোমেন শাজাহানের তিন নম্বর কোম্পানী এবং লোকমান ও গফুরের এক নম্বর কোম্পানী। শত্রু আসার সম্ভাব্য সকল রাস্তায়, তিন সাড়ে তিন মাইল দূর দিয়ে চক্রাকারে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সকাল আটটায় যথারীতি স্নান সেরে একটি পরিষ্কার জামা ও প্যান্ট পরে, খালি পায়ে বহেরাতলী বাজারে উপস্থিত হলাম। বহেরাতলীতে সমবেতদের তিন দলে বিভক্ত হয়ে সব সময় একটি দলকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় রেখে, সবাইকে পর্যায়ক্রমে স্নান সেরে নিতে বললাম। এত সতর্কতা এইজন্য যে, হানাদার বাহিনী খবর পেলে দূরপাল্লার গোলাবর্ষণ করতে পারে। অথবা বিমান হামলা কিংবা সশস্ত্র সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে পারে।
পৃষ্ঠা নং ~১৬২

সকলের স্নান হলে তিন দলে বিভক্ত সহযোদ্ধাদের বললাম, “দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াই করতে নেমেছি। সেই লড়াই অব্যাহত রেখে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য আজ আমরা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে শপথ নেব।”
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি দু’সারিতে পূব-পশ্চিমে মুখ করে দাঁড়ালো। দু’সারির মাঝে দু’আড়াই হাত ফাঁক। আমি কোরআন, গীতা, বাইবেল হাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো দু’শ মুক্তিযোদ্ধার মাঝ দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছি, প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে দু’পাশে দাঁড়ানো দু’জন করে মুক্তিযোদ্ধা কোরআন-গীতা-বাইবেল পরমশ্রদ্ধা ও ভক্তিভরে স্পর্শ করছে, এমনিভাবে সারির একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়ে শপথবাক্য উচ্চারণ করলাম-
“আমি … পিতা …
কোরআন-গীতা-বাইবেল স্পর্শ করিয়া স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্যরূপে শপথ গ্রহণ করিতেছি। আমি শপথ করিতেছি যে, মুক্তিবাহিনীর সকল আইন, কানুন, নিয়ম শৃঙ্খলা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে মানিয়া চলিব এবং মুক্তিবাহিনীর সুনাম রক্ষায় সদাসর্বদা সচেষ্ট থাকিব। আমি কোনক্রমে এমন কোন কাজ করিব না যাহাতে সংগঠনের সুনাম নষ্ট হয়।
আমি এও প্রতিজ্ঞা করিতেছি, কমাণ্ডারের নির্দেশে আগুনে, পানিতে অথবা হানাদারদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিব না।
আমি সদা-সর্বদা সর্বোচ্চ কমাণ্ডের প্রতি শত প্রতিকূল অবস্থাতেও আস্থাশীল থাকিব। কর্তৃপক্ষ যখন যাহাকে কমাণ্ডার নিযুক্ত করিবেন, তখন তাহাকে আস্থার সাথে মানিয়া চলিব। তাহার সকল আদেশ, নির্দেশ ও উপদেশ নির্দ্বিধায় পালন করিব এবং সকল সহযোদ্ধাদের সাথে ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করিব।
আমি আরও শপথ করিতেছি, কোন অবস্থাতেই শত্রুর কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দিব না বা ধরা পড়িব না। আমি সবসময় মুক্তিবাহিনীর সকল গোপনীয়তা রক্ষা করিতে সচেষ্ট থাকিব। আমার জানা কোন গোপন খবর কাহারও নিকট প্রকাশ বা প্রচার করিব না।
আমি সৃষ্টিকর্তার নামে শপথ করিতেছি, নিরপরাধ মানুষের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করিব। আমাদের লক্ষ্য, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হানাদারদের জিন্দানখানা হইতে মুক্ত করা ও তাহার নির্দেশিত পথে অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোঁটানো। আমরা এই শোষকের সমাজ ভাঙিয়া শোষণহীন নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়িব।
আমি শপথ করিতেছি যে, আমার দেহে একবিন্দু রক্ত থাকিতেও হানাদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ চালাইয়া যাইব এবং স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গপিতাকে আমরা মুক্ত করিব।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৬৩

লোভ-লালসার উর্ধ্বে থাকিয়া বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ বাস্তবায়িত করিয়া স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনাইয়া আনিতে সৃষ্টিকর্তা আমাকে শক্তি দিন।
আমীন।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। জয় মুক্তি বাহিনী।
১০/৬/৭১ ইং।

প্রথম দলের শপথ শেষ হবার সাথে সাথে দ্বিতীয় দল পূর্বের মতো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। পূর্ববৎ দ্বিতীয় সারির মাঝ দিয়ে আবার উত্তর থেকে দক্ষিণে এগিয়ে যেতে লাগলাম এবং প্রতি পদক্ষেপে দু’জন করে মুক্তিযোদ্ধা পবিত্র ধর্মীয়গ্রন্থ স্পর্শ করে, যার-যার হাত বুকে-মুখে-মাথায় স্পর্শ করে নামিয়ে রাখল।
সারির শেষপ্রান্তে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার যথারীতি শপথবাক্য উচ্চারণ করলাম। এইভাবে তৃতীয় দলের শপথ অনুষ্ঠান হলো। দ্বিতীয় দলের শপথ গ্রহণের সময় নিরাপত্তার দায়িত্বভার গ্রহণ করলো প্রথম দল। দ্বিতীয় দলের শপথ শেষ হবার সাথে সাথে এসে দাঁড়ালো তৃতীয় দল। আর এদিকে দ্বিতীয় দলটি বহেরাতলী থেকে বেরিয়ে পড়লো লাবিবুর রহমানের পাঁচ নম্বর কোম্পানী ও গোলাম সরওয়ার এবং লালটুর বারো নম্বর কোম্পানীকে ডিউটি থেকে অব্যাহতি দিতে।
পাহারার দায়িত্ব মুক্ত হয়ে পূর্ব-নিদের্শমতো লাবিব-লালটু ও গোলাম সরোয়ারের কোম্পানী উল্কার মতো ছুটতে ছুটতে বহেরাতলীতে এসে হাজির হলো। তাদের বহেরাতলীতে পৌঁছবার আগেই তৃতীয় দলের শপথ নেয়া শেষ হয়েছিল। লাবিব-লালটু ও গোলাম সরোয়ারের কোম্পানীর সকল সহযোদ্ধাকে সকালে স্নান সেরে নিতে বলা হয়েছিল। তাই শপথ অনুষ্ঠানে দাঁড়াতে তাদের কোন অসুবিধা হলো না। হাতের অস্ত্রগুলো পাশের এক ঘরের দেয়ালে রেখে প্রথামতো একে অপরের মুখোমুখি হয়ে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে গেল। আমি সবাইকে শপথবাক্য পাঠ করালাম।
পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলির স্পর্শ মুক্তিযোদ্ধাদের এক অমোঘ শক্তির উৎস। শপথ নামার প্রতিটি প্রতিটি বাক্যের মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে মাতৃভূমির বেদনা ও আনন্দ, লাঞ্ছনা ও বিজয়। আনুষ্ঠানিক শপথের পর মুক্তিযোদ্ধারা এক নতুন প্রাণ, নতুন শক্তি, নতুন জীবন পেল। শপথবাক্য উচ্চারণ করার সাথে সাথে তারা দেশমাতৃকাকে মুক্ত ও স্বাধীন করার পবিত্র দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এবার মুক্তিযোদ্ধারা হলো বাঁধ-ভাঙা জোয়ারের মতো দুর্বার, দুরন্ত এ আপোষহীন। শুরু হলো নতুন ইতিহাসের পথে বিপদসঙ্কুল যাত্রা। শপথ অনুষ্ঠান শেষ হলে, প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার মুখে একটি করে মিষ্টি তুলে দিলাম।
প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধারা ছাড়া সবাইকে (সংখ্যায় ছয়শত) সমবেত করে বললাম, “সহকর্মীরা, যোদ্ধা ভাইয়েরা; অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের স্বপক্ষে আমাদের এই অস্ত্রধারণ কিছুতেই বিফল হতে পারে না। তোমরা আজ যে পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি স্পর্শ করে শপথবাক্য পাঠ করেছ, তার মর্যাদা রাখতে চেষ্টা করবে। আমার মূল্য
পৃষ্ঠা নং ~১৬৪

তোমাদের কাছে কম হতে পারে কিন্তু বহুযুগ ধরে অত্যন্ত সম্মানের সাথে রক্ষিত এই ধর্মগ্রন্থগুলির মর্যাদা তোমাদের কাছে যেন কখনও ক্ষুন্ন না হয়। তোমরা সৃষ্টিকর্তার নামে, দেশের নামে, দেশের স্বাধীনতার নামে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে যে শপথ করেছ, আমি আশা করব তোমরা তা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করবে।
“তোমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে আমরা বেতনভুক্ত ভাড়াটে সৈনিক নই। আমরা দেশমাতৃকার মুক্তিতে আত্মনিবেদিত স্বেচ্ছাসৈনিক। জনগণ, জনগণের সুখ ও শান্তি, তাদের মানসম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তা বিধানই হবে আমাদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। আমাদের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা ভাইকে মনে রাখতে হবে আমরা দেশ ও জাতির সেবক, আমরা দেশের মালিক নই। তাই যেমন নিরপরাধ সাধারণ মানুষের সাথে কোনক্রমেই অন্যায় আচরণ করা যাবে না, ঠিক তেমনি অন্যায়কারী নিজের পরম প্রিয়জন, এমনকি পিতা-মাতা হলেও তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র দুর্বলতা প্রকাশ হবে জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। তোমরা মনে রাখবে, জনগণের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া কোনক্রমেই সফল হতে পারব না। আমাদের জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। কথা বলে নয়। প্রতিটি মুহূর্তে কাজ দেখিয়ে।”
পাশে দাঁড়ানো কয়েকশ, জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “এই মুক্তিযোদ্ধারা মাটির নিচে থেকে অথবা হাওয়ায় ভেসে আসেনি। এরা আপনাদেরই সন্তান। আমরা আপনাদেরই ভাই, ভাতিজা। আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতার জন্যে কোন ভুল-ত্রুটি হলে তা আপনারা তৎক্ষণাৎ ধরিয়ে দেবেন। মুক্তিযোদ্ধারা আপনাদের জান-মাল ও সম্মান রক্ষার জন্য সর্বদা নিয়োজিত। আপনাদের আদেশ মানাই হবে আমাদের কাজ। আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নির্ভয়ে আচরণ করবেন।”
আবার মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে সর্বশেষে বললাম, “মনে রেখ, কোনও অভিযানে কারো প্রতি অহেতুক পীড়ন করবে না। প্রমাণ ছাড়া কারো প্রতি পীড়ন বা নির্যাতন মুক্তিবাহিনীর ন্যায় নীতির বিরোধী। এটা করা হলে তা কিছুতেই বরদাস্ত করা হবে না। কোন অভিযানে কোনও শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলার গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগানো যাবে না। কারো কাছ থেকে ব্যবহারের জন্য কোন জিনিস নিলে, স্থান ত্যাগের আগে আবার তা মালিকের কাছে পৌঁছে দেবে। যদি কারো কাছ থেকে চেয়ে নেয়ার মতো কোন জিনিসের প্রয়োজন হয়, তাহলে বাজার মূল্য অনুযায়ী জিনিসের ন্যায্য মূল্য পরিশোধ করবে। আরো মনে রেখ, শর্তগুলি প্রতিটি দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ও প্রধান সহায়ক শক্তি। এর আগে শোষণহীন, শ্রেণীহীন সমাজ গঠন ও স্বাধীনতার নামে যত দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, এই নীতি যারা মানেনি তাদের বার বার ব্যর্থ হতে হয়েছে। যারা মানতে পেরেছে তারাই সফলতার চৌকাঠ পেরিয়ে গেছে। আমাদের কাজ কর্ম ও ব্যবহারের দ্বারা জনগণকে অবশ্যই বুঝিয়ে দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধ শুধু আমাদের নয়, হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের এ যুদ্ধটা সকলের।
তোমাদের এতজনকে সামনে দেখে আমার বুকটা আনন্দে ভরে যাচ্ছে, কালিহাতি যুদ্ধের পর, ছিন্নমূল দিশেহারা হয়ে যখন ঘুরছিলাম, তখন ভাবতেও পারিনি, এত অল্প
পৃষ্ঠা নং ~ ১৬৫

সময়ে আমরা এমনিভাবে সুসংগঠিত হয়ে একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারব। আজ যদি বঙ্গবন্ধুর সঠিক সন্ধান জানতাম, তাহলে এই অনুষ্ঠানের আনন্দ পূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারতাম। প্রিয় বন্ধুরা, বঙ্গবন্ধুকে না পাওয়ার ব্যথাই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হোক। তাঁর অমর বাণীই হোক সকল শক্তির আধার। আমি তোমাদের প্রত্যেককে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা তোমাদের সহায় হোন।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। জয় মুক্তি বাহিনী।”

সব কমাণ্ডারকে সামনে বসিয়ে বললাম, “আমি সবসময় চাই যার উপর যে দায়িত্ত্ব, তা স্বাধীনভাবে ও নির্বিঘ্নে পালন কর। কারো এলাকায় আমি ঘন-ঘন হাত দিতে যাব না। তবে মনে রাখবে আমাদের মূল লক্ষ্য জনগণের সমর্থন আদায় করা। তবে তা পীড়ন করে নয়, কাজের মাধ্যমে মন জয় করে।’
নীতিমালা প্রণয়ন
১. শপথ অনুষ্ঠানের পর, কোন কমাণ্ডার কোন লোককে কোনও অপরাধের জন্য এককভাবে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে না।
২. কারো বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে—সম্ভব হলে তাকে আমার কাছে পাঠাতে হবে। অভিযুক্তকে পাঠাবার সময় যুক্তি সঙ্গত প্রচুর প্রমাণ থাকা চাই।
৩. সাধারণ ছোটখাটো ব্যাপারে স্থানীয় অবস্থার উপর দৃষ্টি রেখে মীমাংসা করতে হবে।
৪. একমাত্র খুন ও নারী-ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্তকে তোমরা মুক্তি দিতে পারবে না। খুন ও ধর্ষণের কাছাকাছি হলেও নয়।
৫. এর চাইতে কম অপরাধমূলক যে-কোনও ঘটনার বিচার তোমরা করতে পারবে। তবে প্রতিটি বিচার-সালিশের রেকর্ড সদর দফতরে পাঠাতে হবে।
৬. কোনও বিচার এককভাবে করা যাবে না। কম করে দু’জন সহযোদ্ধা ও একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করে সম্পন্ন করতে হবে।
৭. বিশেষ অপরাধের (যেমন খুন, নারী-ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ) বিচারের জন্য তাকে সদর দফতরে পাঠানো অনেক সময় সম্ভব নাও হতে পারে। এমতাবস্থায়, কমাণ্ডার সহকারী কমাণ্ডার, একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত একটি বিচার-সভা অপরাধীকে চরমদণ্ড প্রদান করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে কম করে চার জনকে একমত হতে হবে।
৮. যুদ্ধে ধৃত কোন ব্যক্তির সঙ্গে অসদাচরণ করা চলবে না। খবর সংগ্রহের জন্য যদি কিছু করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে সেটা সম্পূর্ণ আলাদা। কোন সশস্ত্র সৈন্যও যদি অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করতে চায় বা করে, তাহলে তার প্রতি ন্যায়বিচার করতে হবে।
৯. কোনও অপরাধের সন্দেহে ধরে-আনা কোন লোক সত্যিকারভাবে অপরাধী প্রমাণিত হলেও তার আত্মীয়স্বজন পিতা-মাতা, স্ত্রী বা পুত্র-কন্যার সাথে অসম্মানজনক ব্যবহার করা চলবে না। পিতার অপরাধে সন্তান, সন্তানের অপরাধে পিতা কিছুতেই অপরাধী বলে
পৃষ্ঠা নং ~১৬৬

চিহ্নিত হবে না।
এক কথায়, একজনের অপরাধ অন্যের ঘাড়ে চাপানো চলবে না। সত্যিকার আত্মীয়-স্বজন, পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতির সাথেও সম্মানজক আচরণ করতে হবে।
১০. সব ব্যাপারে সবাই একমত হবে, এমন কোন কথা নেই। তবে সংখ্যাগুরুর রায়কে সঠিক বলে মেনে নিতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব প্রধানত দু’টি: (১) এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। (২) শত্রুর মোকাবেলা করা। যদিও শক্রর মোকাবেলা করাই আমাদের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য তবুও অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় না রেখে তা করা সম্ভব নয়। সুতরাং আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রশ্নটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
অনুষ্ঠান শেষে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একত্রে খেয়ে নিলাম। সাধারণত তখন একত্রে খাওয়াটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল না। তবু ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ করে আমার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একত্রে বসেই খাবার খেত। আমার বেলাতেও বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম ঘটেনি। সাথে যে ক’জনই থাকুক-না কেন, যথোপযুক্ত পাহারার ব্যবস্থা বেখে বাকিদের সাথে নিয়ে খাবার খেতাম। অন্যান্য কমাণ্ডারও এর ব্যতিক্রম করতে পারেনি। তবে এটা ঠিক যে, বেশিসংখ্যক কমাণ্ডারই আগ্রহ করে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে খাবার খেত।
শপথ অনুষ্ঠান শেষে আমি একটা তৃপ্তিবোধ করছিলাম। একটা সান্ত্বনা পাচ্ছিলাম। যাক, আজ আমরা একটা পাকাপাকি সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি। কোরআন, গীতা ও বাইবেল স্পর্শ করে যারা শপথবাক্য পাঠ করেছে, তাদের প্রত্যেকেই যে তা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করবে তাতে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। আমি এখন হারিয়ে গেলেও কোন ক্ষতি হবে না। মুক্তিযুদ্ধ থেমে থাকবে না।

নতুন কোম্পানী গঠন
বহেরাতলীতে আফসার-মেম্বারের নেতৃত্বে ছয় নম্বর কোম্পানী গঠিত হলো। কয়েকদিন আগে তাঁর সাথে আসা প্রায় সব সহযোদ্ধাদের ছয় নম্বর কোম্পানীর অন্তর্ভুক্ত করা হলো। আমার সাথে মিলিত হবার পর সব সহযোদ্ধাসহ আফসার-মেম্বারকে শাজাহানের নেতৃত্বে দেয়া হয়েছিল। সেখানে আফসার-মেম্বারের বিশেষ কোন মর্যাদা ছিল না। তিনি একজন সাধারণ সৈনিক হিসাবে দশ দিন বিনা-বাক্য ব্যয়ে এলাকা ভ্রমণ করেছেন। আমি কেবল দেখতে চেয়েছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এই বয়স্ক ভদ্রলোকটির কতটা আগ্রহ রয়েছে এবং আমার প্রতি তিনি কতটা আস্থাশীল ও অনুগত।
ছয় নম্বর কোম্পানীর প্রত্যেক সহযোদ্ধাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করতে কয়েক দিনের জন্য নিজের কাছে রেখে দিলাম। একদিন তাদের বললাম, “বন্ধুরা, শুধু পাহাড়ে ঘুরলে চলবে কেন? সমতল ভূমিতে কিছু সময় ঘুরে দেখ। মনে হয় এরমধ্যে শিকার পাওয়া যেতে পারে। তাতে যেমন তোমাদের মুখোমুখি লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা হবে, তেমনি আমরা কিভাবে শত্রুর মোকাবেলা করি তা প্রত্যক্ষ করতে পারবে।”
পৃষ্ঠা নং ~১৬৭

আফসার-মেম্বারকে বললাম, আপনার উপর আমার গভীর বিশ্বাস ও আস্থা জন্মেছে। আপনি বয়সে প্রবীণ। আমার বিশ্বাস চার-পাঁচ দিন আমার সাথে থাকলে আপনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন তা আপনার এলাকায় কাজে লাগাতে সক্ষম হবেন।’
এরপর কোম্পানী কমাণ্ডার শওকত মোমেন শাজাহানকে পূর্বাঞ্চলের (পাহাড়ি অঞ্চলের আঞ্চলিক) অধিনায়কের দায়িত্ব দিলাম। শাহাজানকে পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব নেয়ার প্রধান কারণ ছিল প্রায় মাসখানের আগে টাংগাইলের পশ্চিমের চর এলাকা সফরের সময় টাংগাইলের সমস্ত থানাগুলি দখলের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম।
ফজলুর রহমানকে নতুনভাবে একটি কোম্পানীর দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হলো, তিনি বল্লা-রামপুর ও সিংগাইর এলাকায় তিন দিন অবস্থান করে ভূয়াপুর হয়ে গোপালপুর পর্যন্ত যাবেন।
পাঁচ নম্বর কোম্পানী কমাণ্ডার লাবিবুর রহমানকে রাতে বল্লায় শিবির স্থাপন করতে নির্দেশ দেয়া হলো। লোকমান ও গফুরের কোম্পানী সোজা দেওপাড়া হয়ে ভূয়াপুর পাঁচটিকরিতে অবস্থান নিতে চলে গেল।
পৃষ্ঠা নং ~১৬৮

বল্লার যুদ্ধ

গোহাইল বাড়ীতে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে রতনগঞ্জ বাজারে এলাম। বাজারে লোকদের পক্ষ থেকে ঘোনাবাড়ীর আহাম্মদ, রতনগঞ্জের বেদে (সান্দার) ফজলুল ও শিতু সাহার অনুরোধে সমবেত তিন-চার’শ লোকের সামনে প্রায় কুড়ি মিনিট বক্তৃতা করলাম।
বহেরাতলীতে শপথ অনুষ্ঠানের পর মুক্তিবাহিনী এই ধরনের সভা বিরামহীনভাবে করতে থাকে। দুপুরে বল্লায় এলাম। রতনগঞ্জ থেকে বল্লা। এর মাঝের একটি ঘটনা তুলে না-ধরলে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধ্যান-ধারণার যথার্থ মূল্যায়ন সম্ভব হবে না। বল্লার পূর্ব-দক্ষিণে আফীল সরকারের বাড়ী ঘেষে একটি চাপা-রাস্তা দিয়ে বল্লা স্কুলে এগিয়ে চলেছি। বল্লা স্কুল তখনও প্রায় আধ মাইল দূরে। পথের দু’পাশে লোক আর লোক। বামদিকে কয়েকজন বেশ রোষের সাথে বলতে বলতে সরে গেল, “দেশের যে কী অইল। চেঙড়া চেঙড়া গুদা-গুদা পোলারা বন্দুক কান্দে ঝুলাইয়া ঘুরছে। এরা একটা খ্যালা পাইছে। মেলিটারী আইলেই পলাইব। এরা তো কিছু করবো না, দেশটারে জ্বালাইবো। আর দেহেন, ঠাণ্ডু মোক্তারের পোলা বজ্জ! ঐ করবো যুজ্জ? দেশটারে একেবারে জ্বালাইবো। পারলে এগোরে ধইরা দেওন উচিত।” কথাগুলো অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা শুধু নয় আমিও শুনলাম। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। স্কুলের পোয়া মাইলের মধ্যে এলে ফজলুর রহমান, লাবিবুর রহমান ও তাদের পাঁচ সাতজন আমাকে স্বাগত জানালো।

জনসভা
গতানুগতিক সামান্য কথাবার্তার পর ফজলুর রহমানকে সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রথমেই বললেন, “আপনি আমাদের কালকেই হাত-পা বেঁধে দিয়েছেন। তা না হলে আমি এতক্ষণ অন্ততঃ চল্লিশ-পঞ্চাশটারে গুলি করে মারতাম। শালার, সারা গায়েই দালাল আর দালাল। এদের বেতের মাথায় রাখতে না-পারলে একজনকেও ঠিক রাখতে পারবেন না। আমি চোদ্দ-পনের জনকে ধরে রেখেছি। চার-শালায় মসজিদের মধ্যে পালাইয়াছে। আপনাম পরবর্তী আদেশের অপেক্ষা করছিলাম। একটারে ঐ বড় ট্রাংকটার মধ্যে ভরে রেখেছি। শালায় দুনিয়ার খচ্চর।” এই বলে ফুলস্কেপ কাগজের পনের পাতার একটি লিখিত রিপোর্ট আমার হাতে তুলে দিলেন। কমাণ্ডার ফজলুর রহমানকে বললাম, “খাওয়ার পর গ্রামের লোকদের সাথে কথা বলতে চাই। যারা আসতে চান তাঁদের সভায় আসার অনুরোধ করুন।” বল্লার নজরুল, শহীদ, যশোরের মোস্তফা ও সহযোদ্ধা আবদুর রশিদ গ্রামবাসীদের সভায় সমবেত করতে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করলো। দুপুরে খাবার শেষে বল্লার সমবেত জনতার প্রতি এক উদাত্ত আবেদন রাখলাম। মুক্তিযুদ্ধ কী এবং কেন, সবাইকে ওয়াকিবহাল করতে চেষ্টা করলাম। নিরপরাধের প্রতি যে কখনো কোনও অমর্যাদা
পৃষ্ঠা নং ~১৬৯

করব না এবং পাকিস্তানী দালালরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তাদেরকে কোন ক্রমেই শিয়াল কুকুরের পর্যায়ে বিচার করা হবে না, এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে সবাইকে বুঝিয়ে দিলাম।
বল্লার তিন-সাড়ে তিন হাজার অধিবাসীর মধ্যে হাজার-দুই মানুষ এই সভায় হাজির হন। তাঁরা সবাই পাকিস্তানপন্থী নন, প্রথম অবস্থায় মুক্তি বাহিনীর প্রতি আস্থা না-থাকলেও পরে তাঁদের মানসিকতায় যে আমূল পরিবর্তন আসে তার প্রমাণ তাঁরা পরবর্তী সময়ে নানাভাবে দিতে সক্ষম হয়েছেন। ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে বল্লার ইতিহাস একদিকে দুঃখের ও বেদনার। বল্লার অগণিত মানুষ মুক্তি বাহিনী ও হানাদারদের হাতে জীবন দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, কোটি টাকার ব্যবসাকেন্দ্র বল্লা বাজারটি হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। অন্যদিকে আবার বল্লার আরেক ইতিহাস অতীব সম্মান ও গৌরবের। কারণ পরে বল্লার প্রায় সমস্ত লোকই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ও মুক্তি বাহিনীকে নানাভাবে সহযোগিতা ও সাহায্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
সভা শেষে তিন-চারশ’ লোক আমার সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে এলেন। তাঁদের সাথে যথাসম্ভব কম সময়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে কথাবার্তা বললাম। আমার সম্মানজনক আচরণে অনেকেই অভিভূত হন। এতে সমগ্র এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শুভ প্রতিক্রিয়া হতে শুরু করে।
বিকেল পাঁচটা। সবাইকে যার-যার বাড়ী চলে যেতে অনুরোধ করা হলো। ঘোষণা করে দেয়া হলো, সাড়ে পাঁচটার পর কাউকে বাড়ীর বাইরে দেখা গেলে গুলি করা হবে। বল্লাতেই মুক্তিবাহিনী প্রথম কারফিউ জারি করলো।
সন্ধ্যায় অন্যান্য কমাণ্ডারদের নিয়ে আলোচনায় বসলাম। আলোচনায় স্থির হলো, দু’তিন দিন পর ফজলুর রহমান তার কোম্পানীসহ আইশড়া, পাইকরা, পুংলী, এলেঙ্গা হয়ে গোপালপুর থানায় পৌঁছবেন। লাবিবুর তার কোম্পানীসহ প্রথমে যাবে ভূয়াপুর। সেখানে তাকে নতুন নির্দেশ দেয়া হবে।
ছয় নম্বর কোম্পানী কমাণ্ডার আফসার মেম্বার তাঁর কোম্পানীসহ আমার দলের সাথেই আপাতত থাকবেন। আরো সিদ্ধান্ত হলো, পরদিন আমি বল্লা ত্যাগ করার দুই-তিনঘন্টা পর লাবিব ভূয়াপুর রওনা হবে।
বল্লা থেকে চারান হয়ে কালিহাতির দিকে একটি কাঁচা রাস্তা চলে গেছে। বল্লা থেকে আরেকটি রাস্তা দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর টাংগাইল গেছে। বল্লা থেকে কালহাতির দূরত্ব প্রায় ছয় মাইল, আর টাংগাইলের দূরত্ব তের মাইল। এ সময় এই দু’রাস্তা মোটেই নিরাপদ ছিল না। যে কোন মুহূর্তে শত্রুবাহিনী এগিয়ে আসতে পারে।
সারাদিনের মতো রাতেও বল্লা-চারান রাস্তায় কঠোর শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রাখা হলো। অন্যদিকে বল্লা-টাংগাইল কাঁচা সড়কে তিন মাইল এগিয়ে রচনা করা হলো প্রতিরক্ষা ব্যুহ। এই দু’টি প্রতিরক্ষা-ঘাটির সাথে ফিল্ড-টেলিফোনের সাহায্যে সংযোগ স্থাপন করা হলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৭০

ইতোমধ্যে মুক্তিবাহিনী তিনটি সিভিল ওয়ারলেস-সেট, পনের খানা ফিল্ড-টেলিফোন (ডাকঘর টেলিফোন) দখল করে নিয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর কাছে এই সময় কয়েক মাইল তারও ছিল। সর্বত্র তার ও বেতারের যোগাযোগ করা হলো। ফজলুল রহমান বল্লা হাইস্কুলে, লাবিবুর রহমান বল্লার পূর্ব-দক্ষিণে ঘোনাবাড়ীতে এবং আমি বল্লার সামান্য দক্ষিণ-পশ্চিমে সিঙ্গাইরে রাত কাটাবার ব্যবস্থা করলাম। ঘুমুতে যাবার আগে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিতদের নির্দেশ দিলাম, ঘন্টায় ঘন্টায় যেন আমাকে অগ্রবর্তী ঘাঁটির সর্বশেষ পরিস্থিতি জানানো হয়। রাতটা নির্বিঘ্নে কাটল! সিঙ্গাইরে আবার গোলরার মতো হুমায়ুনের ছোট ভাই আকবর এসে হাজির। আকবরকে আদর যত্ন করে কিছু খাইয়ে টেপরেকর্ডার দিয়ে সাথে সাথে পাইকরা পাঠিয়ে দিলাম। উদ্দেশ্য, হুমায়ুনের কণ্ঠে কয়েকটি গান টেপ করে আনা। কারণ হুমায়ুনের গান আমার খুব ভালো লাগত।
হানাদারদের মুখোমুখি
১২ জুন, ১৯৭১ সাল। সকাল সাতটায় টেলিফোনে কমাণ্ডার ফজলুর রহমান আমাকে সুপ্রভাত জানালেন। মিনিট-পনের পর লাবিবের পক্ষ থেকেও এলো সুপ্রভাত। এরপর অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোও একে-একে সুপ্রভাত জানালো। আমিও তাদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানালাম এবং কামনা করলাম, সবার জন্য নতুন দিন অর্থবহ হোক।
সকাল আটটায় ফজলুর রহমান আবার টেলিফোন করলেন,
—স্যার, আপনার জন্য কিছু মিষ্টি পাঠাচ্ছি, এখানকার মিষ্টি খুব ভালো। আশা করি মিষ্টি খেয়ে খুশি হবেন।
—দেখা যাক, আপনার মিষ্টি কতক্ষণ মুখ মিঠা রাখে।’ সাড়ে আটটায় আবার টেলিফোন বেজে উঠল। এবারও ফজলুর রহমানের কণ্ঠ। তবে আগের মতো শান্ত নয়। বেশ উত্তেজিত অতিশয় উদ্বিগ্ন-কণ্ঠে তিনি বলেন,
—স্যার! কালিহাতি থেকে মিলিটারিরা বল্লার রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে। খুব একটা পরিষ্কার খবর পাওয়া যায়নি। তবে তাদের সংখ্যা একশ’র কম নয়। তারা সকাল আটটায় হাঁটা শুরু করেছে। আমার ধারণা, তারা পাছচারানের কাছাকাছি এসে গেছে। আমি তখন ফজলুর রহমানের পাঠানো মিষ্টি মুখে তুলতে যাচ্ছিলাম। খুব সম্ভবতঃ একটি মিষ্টি খেয়েছিলামও।
—আপনি টেলিফোনে অগ্রবর্তী ঘাঁটিকে আমার সাথে মিলিয়ে দিন।
অগ্রবর্তী ঘাঁটির টেলিফোনের দায়িত্বে যে ছিল সে তখন টেলিফোন ধরেই ছিল। সে খুব চিৎকার করে বলল,
—আমি কুমিল্লা থেকে বলছি। কুমিল্লা মানে চারানের অগ্রবর্তী ঘাঁটি। ফজলুর রহমান টেলিফোন ছেড়ে দিলে অগ্রবর্তী ঘাঁটির খবর জানতে চাইলাম। অগ্রবর্তী ঘাঁটি থেকে যে টেলিফোনে কথা বলছিল তার নাম পিন্টু। বয়স আঠার-উনিশ। বাড়ী কাউলজানী। বলল,
—আমরা মিনিট-কয়েক আগে খবর পেয়েছি, কালিহাতি থেকে মিলিটারিরা আসছে। এদের
পৃষ্ঠা নং ~ ১৭১

উদ্দেশ্য যদি বল্লা হয়ে থাকে, তাহলে তারা পাছচারান পর্যন্ত এসে গেছে বলে মনে হয়।
—টেলিফোনের তার গুছিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমরা বল্লা স্কুলের সামনে চলে এসো। তোমাদের আর কোন দায়িত্ব নেই। যা করার আমরা করছি।
আমার দলকে প্রস্তুত করে নিলাম। বল্লা-টাংগাইল রাস্তায় যারা অবরোধ গেড়ে বসে আছে, দ্বিতীয় নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাদের অবস্থান থেকে এলাকার সর্বত্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে খবর পাঠালাম। পাঁচ মিনিটে সিংগাইরের বাড়ী থেকে বল্লা স্কুলে ছুটলাম।
কমাণ্ডার ফজলুর রহমান, লাবিবুর ও আফসার তাঁদের কোম্পানী নিয়ে আমার জন্য গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কাছে গিয়ে ফজলুর রহমানকে বললাম, “আপনার সহযোদ্ধাদের বল্লা গ্রামের দক্ষিণে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দিয়ে আপনি শুধু দশ-বারোজন নিয়ে অপেক্ষা করবেন। লাবিব ও আফসার দু’জন করে সহযোদ্ধা নিয়ে আমাকে অনুসরণ করুন। আপনাদের পুরো দলকেও বাজারের দক্ষিণে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে বলুন।”
এ সময় চারানের দিক থেকে ত্রিশজন মুক্তিযোদ্ধা সামনে এসে হাজির হলো। তাদেরকেও বল্লা গ্রামের দক্ষিণে অত্যন্ত নিরাপদ জায়গায় অপেক্ষা করতে বললাম।
এরপর মাত্র তের জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে বল্লা-বাজারের নদীর পারে এলাম। তখন হানাদারদের নাম নিশানা দেখা যাচ্ছে না। বল্লার উত্তরে প্রায় এক মাইল খোলা প্রান্তর। জুন মাসের ১২ তারিখ। নদীতে অনেক পানি। প্রান্তর বরাবর সূতার মতো উত্তর দিকে একটি রাস্তা। রাস্তার পশ্চিমে পুরোটাই বিল। পূব পাশে নিচু জমি। তাতেও কোন-কোন জায়গায় বুক অব্দি পানি। শুধু এই একটি মাত্র রাস্তা ধরে উত্তর থেকে দক্ষিণে আসা সম্ভব। বল্লা-বাজারের চৌদ্দ আনা অংশ হানাদাররা ১২ই মে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তারা সেদিন অক্ষত যেতে পারেনি। ১২ই জুন কিভাবে যে বল্লার দিকে আসছে, সেটা তারাই ভালো বলতে পারে। তবে এবারের পরিণতি হলো আরও ভয়াবহ।
তেরজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নদীর দক্ষিণ তীরে শত্রুর দৃষ্টির আড়ালে পজিশন নিলাম। সহযোদ্ধাদের করণীয় কী, কখন ও কিভাবে তারা গুলি চালাবে, এই সমস্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশ ইতোমধ্যেই দিয়েছি। আমার হাতের লাইট-মেশিনগান থেকে গুলি ছোঁড়াটাকেই মনে করতে হবে যুদ্ধের সংকেত বা শুরু। শত প্রলোভন, উস্কানি ও উত্তেজনার মাঝেও কিছুতেই আগে গুলি ছোঁড়া যাবে না, এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে সাহস ও শক্তি সঞ্চারের জন্য বলেছি, “শত্রু যত প্রবলই হোক, নদী অতিক্রম করে তারা আমাদের কোন মতেই বিপদে ফেলতে পারবে না। নদীতে একটি নৌকাও রাখা হয়নি। বন্ধুরা, নির্ভয়ে উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকো।”
কালিহাতি থেকে উদ্দার করা লাইট মেশিনগানটি নিয়ে চারান থেকে আসা সুতার মতো সরু রাস্তাটির মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছি। ডান পাশে পনের গজের মধ্যে দু’জন, ৩০৩ রাইফেল নিয়ে ওৎ পেতে বসে আছে। বামে কুড়ি গজের মধ্যে দু’জন। বামে একশ’ গজ দূরে আরও দু’জন।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৭২

ডানে একশ’ গজ পর পর দু’জন করে মোট ছয় জন। ডানে-বামে সকলেই নেকড়ের দৃষ্টি নিয়ে শত্রুর অপেক্ষায়।
সকাল সাড়ে ন’টা। বল্লা থেকে প্রায় এক মাইল দূরে চারান গ্রামের মুখে সর্বপ্রথম মিলিটারীদের দেখা গেল। আস্তে আস্তে পুরো দলটি আমাদের দৃষ্টি-সীমানার ভিতরে এসে গেল। তাণ্ডব লীলা চালাতে চালাতে আপন মনের সুখে তারা এগিয়ে আসছে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা জল্লাদ বাহিনীকে উপযুক্ত সংবর্ধনা জানাতে ওঁৎ পেতে বসে আছে। আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। দৃষ্টি বর্শার ফলার মতো ধারালো। নানা প্রশ্ন বুকের মধ্যে তোলপাড় করছে। ডান ও বামের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মনেও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া।
আমি শুধু বারবার ভাবছি, কল্পনা করছি, যদি এদের সবাইকে ধরা যেত, তাহলে প্রচুর অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হাতে আসত। পরবর্তীতে ছোট-বড় যুদ্ধগুলোও ঠিকমতো করা যেত। আর এতগুলো জল্লাদ ধরা পড়লে বা নিহত হলে জনগণের মধ্যে তার ব্যাপক শুভ প্রতিক্রিয়াও হতো। মিলিটারিরা এগিয়ে আসছে। আমি নিজেই বলছি, ‘কাদের, আজ তোর পরীক্ষা। তুই যদি পরাজিত হোস, তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা তো আশাহত হবেই, জনগণও আস্থা হারাবে। হারাবে বলছি কেন, আস্থা আনবেই না!”
হানাদাররা চিরাচরিত নিয়মে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বেশ সতর্কতার সাথে বল্লার দিকে এগিয়ে আসছে। মূল দলটি তখনও আমার এল, এম. জি-র নলের হাজার গজ দূরে। বল্লা-চারানের মাঝামাঝি ওরা বসে পড়ে। এরপর দশজনের একটি অগ্রবর্তী দল আস্তে আস্তে খুব সতর্কতার সাথে বল্লার দিকে এগুতে থাকে। নদীর শতেক গজ দূরে থাকতে নিঝুম জনমানব শূন্য বল্লার অবস্থা দেখে ওদের মনে সন্দেহ জাগে। কারণ কালিহাতি থেকে বল্লার রাস্তা ধরার সময়ে ওদের কাছে খবর ছিল বল্লায় মুক্তিবাহিনী (ওদের ভাষায় দুষ্কৃতকারী) এসেছে। অথচ এখন বল্লার কোন লোকজনের সাড়াশব্দ নেই। একটা কুকুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। মিনিটখানেক চারদিকে লক্ষ করে হানাদার বাহিনী বল্লার দিকে বেপরোয়া গুলি চালাতে শুরু করলো। পেছনের মূলদল থেকেও পচিশ-ত্রিশটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করলো। সামনের একজন উদ্দেশ্যহীনভাবে বল্লার দিকে দশ-পনেরটি রকেটশেল নিক্ষেপ করলো। এতকিছুর পরও অন্য দিক একেবারে নীরব, নিস্তব্ধ। এতে হানাদার বাহিনী হয়তো মনে করলো, বল্লায় দুষ্কৃতকারীরা আসলেও আসতে পারে। তবে তাদের আসার খবর পেয়ে একমুহূর্ত বিলম্ব করেনি। ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে।
হানাদার বাহিনীর প্রথম দলটি আরো সত্তর-আশিগজ এগিয়ে আসছে। আমার এল. এম. জি. গুলি ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত। নিশ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। হাত নিসপিস করছে। কেবলি ভাবছি, আর-একটু আসুক না! এখনও ঠিক সীমানার মধ্যে, নলের সামনে এসে পৌঁছেনি। আর একটু অপেক্ষা মাত্র! ঠিক এই সময় ঘটল এক বিপর্যয়। ডানদিকের একেবারে শেষ প্রান্তে রফিক প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে এসে ‘মিসফায়ার’ করে বসল। পাক-জল্লাদ বাহিনী এতক্ষণ
পৃষ্ঠা নং ~১৭৩

যে নিরাপত্তাবোধ নিয়ে এগিয়ে আসছিল তা মুহূর্তেই কেটে গেল। মিসফায়ারের সাথে সাথে তারা ত্বড়িতবেগে পজিশন নেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু অবস্থান ও পরিবেশ তাদের মারাত্মক প্রতিকূল। সামনের যে দশজন আমার এল. এম. জি’র আশি-নব্বই গজের মধ্যে এসে গিয়েছিল, তাদের পজিশন নেবার কোন জায়গাই নেই। গুলির শব্দ শোনার সাথে সাথে ট্রিগার টিপে ধরলাম। লক্ষ্য সামনের দশজন। পর পর তিন-সাড়ে তিন ম্যাগাজিন গুলি ছুঁড়ে পিছনের মূল দলকে লক্ষ করে গুলি চালাতে লাগলাম। সহযোদ্ধারা আমাকে অনুসরণ করলো। প্রায় শ’ চারেক গুলি ছোঁড়ার পর সামনের সত্তর-আশি গজ দূরের প্রথম দলটির প্রতি আবার দৃষ্টি দিলাম। দেখি, দু’জন বুকে হেঁটে পিছুতে চেষ্টা করছে। তাদের লক্ষ করে পর পর চার-পাঁচ রাউণ্ড গুলি ছুঁড়লাম। ঠিক এসময় প্রথম দলের আরেকজনকে রাস্তার পাশ দিয়ে পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে, পিছিয়ে যেতে দেখে তাকে লক্ষ্য করেও প্রায় পনের রাউন্ড গুলি ছুঁড়লাম। এতেও পশ্চাদপসরণরত হানাদারটির গতি বন্ধ হলো না। আর পনের-বিশ গজ পিছিয়ে যেতে পারলেই সে একটি আড়াল পেয়ে যাবে। এত গুলি ছোঁড়ার পরও জল্লাদটির গায়ে না লাগায় এল. এম. জি-র নিশানা সম্পর্কে মনে সন্দেহ জাগল। তখন একখানা রাইফেল নিয়ে পর পর দু’টি গুলি ছুঁড়লাম। এ গুলিও বোধকরি হানাদারটির গায়ে লাগেনি। এসময় বিরল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আর. ও. সাহেব বললেন, “স্যার, আমার হাতে দোনালা বন্দুক আছে। ছররা ভর্তি গুলি। আমি গুলি ছাড়ি। বেটাশালার গায়ে বসন্ত বানাইয়া দিমু।” বলেই তিনি তাঁর সিভিল গান থেকে দু’টি গুলি ছুঁড়েন। মনে হলো এবার জল্লাদটির চলা বন্ধ হয়েছে। সে একেবারে থেমে গেছে। এরপরও যুদ্ধ চলতে থাকলো। তবে মুক্তিবাহিনীর এক গুলির জবাবে জল্লাদ বাহিনীর একশ’ গুলি। ভীষণ রক্তাক্ত এই লড়াই প্রায় চার ঘন্টা অব্যাহত থাকে। শেষের দিকে হানাদার বাহিনীর মুখ্য উদ্দেশ্য যুদ্ধ ছিল না। ছিল মৃতদেহগুলো উদ্ধার। মৃতদেহগুলো উদ্ধার করার জন্য তারা মরিয়া প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। কারণ মৃত দেহগুলো উন্মুক্ত প্রান্তরে মুক্তিবাহিনীর এত কাছে ছিল যে তা সংগ্রহ করা হানাদারদের পক্ষে মোটেই সম্ভব ছিল না।

বিভ্রান্ত গোলাগুলি
এ সময় আবার আরেকটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। আগের দিন গোলাম সরোয়ার ও লাল্টুর এগার নম্বর কোম্পানী এবং লোকমান হোসেন ও গফুরের দলকে ভূয়াপুর পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারা ভূয়াপুরের পথে দেওপাড়া অবস্থান করছিল। বল্লার যুদ্ধ শুরু হবার ঘন্টা খানেক পর তারা খবর পায়, কাদের সিদ্দিকী হানাদার বাহিনীকে প্রচণ্ডভাবে ঘায়েল করে প্রচুর অস্ত্র ও গোলা-বারুদ হস্তগত করেছেন। এই শুভ সংবাদ পেয়ে দুই কোম্পানী থেকে ত্রিশজনের একটি দল দেওপাড়া থেকে প্রায় আট মাইল দূরে বল্লার দিকে আনন্দে নাচতে নাচতে ছুটে আসতে থাকে। চারানের কাছাকাছি তিনমোনায় এলে তারা একচোট প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পায়। এতে আর অগ্রসর না হয়ে তিনমোনায় ফটিকজানী নদীর পূর্বপারে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পজিশন নেয়। কমাণ্ডার লোকমান হোসেন সেনাবাহিনীতে বেশ কিছুদিন কাজ করেছে। সে বেশ উচ্ছল, প্রাণবন্ত ও বেপরোয়া গোছের
পৃষ্ঠা নং ~ ১৭৪

লোক। বেশ কিছুক্ষণ চুপ-চাপ থাকার পর সে চারান লক্ষ করে সহযোদ্ধাদের এক দফা গুলি চালাতে বলে। মিনিট-পাঁচেক প্রত্যেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালায়। ২ ইঞ্চি মর্টার থেকেও তারা দশ-বারটি গোলা নিক্ষেপ করে। এ সময় হানাদার বাহিনী দক্ষিণ দিকে গোলাগুলি ছোড়া বন্ধ করে, পূবদিকে অবিশ্রান্তধারায় গুলি চালাতে শুরু করে। এতে যা হবার তাই হলো। লোকমান হোসেন, ও তার দল যতটা আনন্দ ও উৎসাহের সাথে বল্লার দিকে ছুটে আসছিল, ততোধিক ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে ‘দে ছুট’।
লোকমান হোসেন ‘ছুট’ দিলেও তাদের অপরিকল্পিত কয়েকশ’ রাউন্ড গুলি অভাবনীয় ফল দেয়। পূবদিক থেকে গুলি আসায় হানাদাররা লাশ উদ্ধারের সকল আশা ত্যাগ করে আরো ক্ষতি ও বিপদের আশঙ্কায় রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে। ফলে ১২ই মে’র পরাজয় থেকে আরও শোচনীয় পরাজয় বরণ করে, লেজ গুটিয়ে রাস্তার দু’পাশ দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে কালিহাতির দিকে পিছিয়ে যায়। বিগত ১২ই মে পাছচারান থেকে কালিহাতি তিন মাইল অতিক্রম করতে ভয়ে, আতঙ্কে তাদের চোখমুখ শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে গিয়েছিল। এবার ঘামে-ক্লান্তিতে জামা-কাপড় ভিজিয়ে ভয়ে পালিয়েও তারা পার পেল না। আগচারান থেকে কালিহাতি, এই পাঁচমাইল পথের অর্ধেকটা বুকে হেঁটে, হামাগুড়ি দিয়ে যেতে-যেতে তাদের সর্বাঙ্গ ক্ষত বিক্ষত। উপরন্তু এবার হানাদারদের আহত-নিহতদের সংখ্যা অনেক বেশি। যা তাদের বয়ে বা টেনে নিতে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছে।

হানাদারদের লাশ: শুভ প্রতিক্রিয়া
আমার সামনে দু’টি লাশ ছিল। সবুর ও আবদুল মালেককে সাঁতরে গিয়ে লাশগুলো আনতে নির্দেশ দিলাম। ওদের সাথে অনেকখানি দড়িও দিয়ে দেয়া হলো। সবুর ও মালেক অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে গুলি-বৃষ্টির মাঝে সাঁতরে ওপারে গিয়ে একটি লাশের মাথা লক্ষ করে দড়ির ফাঁস ছুঁড়ে মারলো। ছুঁড়ে মারা দড়ির ফাঁস লাশের মাথায় আটকে গেল। মালেক ও সবুর লাশটিকে টেনে নীচে নামিয়ে আনল। আগের মতো আবার ফাঁসটি ছুঁড়ে দ্বিতীয় লাশের মাথায় আটকে ফেলল। এবারও লাশটি দু’জনে টেনে নামিয়ে আনলো। দূর থেকে দড়ির ফাঁস ছুঁড়ে লাশগুলো টেনে আনার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এই জন্যে যে, হানাদারদের গুলির মুখে মুক্তিবাহিনী লাশগুলোর কাছে যেতে পারছিল না। আবার মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড গুলির সামনে হানাদার বাহিনীও তাদের লাশগুলি নিতে পারছিল না।
সবুর ও মালেক দু’টি হানাদার লাশ সাঁতরে এপারে নিয়ে এলে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণে বল্লা স্কুলের সামনে পাঠিয়ে দেয়া হলো। ঘন্টাখানেক পরে হানাদার বাহিনী পিছু হটে গেলে পিছন থেকে আরও চল্লিশ জনকে নদীর পারে আসতে নির্দেশ দেয়া হলো। তারা নদীর পারে এসে পজিশন নিল। সবুর, মালেকসহ সাত-আটজন আবার নদীর ওপারে গিয়ে রাস্তার উপরে একটি এবং সামান্য একটু দূরে আরও একটি, আর. ও. সাহেবের গুলি-খাওয়া সেই লাশ, সারা গায়ে ক্ষত নিয়ে পড়ে থাকতে দেখে।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৭৫

এই সময়ে বল্লার কয়েকজন উৎসাহী যুবক নদীর অপর পারে যেতে অনুমতি চাইলে তাদের বললাম, “এই সময় ওপারে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। আপনারা বিরত হোন।” কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। তারা যাবেনই, অতএব আর কী করা যায়। অগত্যা অনুমতি দিলাম। ওপারে গিয়ে তারা ডানপাশের জঙ্গলাকীর্ণ কবর স্থানটি খুঁজে দেখতে উদ্যত হলেন। জায়গাটি সন্দেহমুক্ত নয় বলে সবুর তাদের থামিয়ে দেয়।
আমি চিৎকার করে সবুরের কাছে জানতে চাইলাম, “ওখানে আর ক’টি লাশ আছে?” সবুর আমার চাইতে জোরে চিৎকার করে উত্তর দিল, “খালি দুইডা দ্যাখতাছি। আর গুলা গেল কনে বুঝতাছিনা।”
আমিও সবুরের মতো জঙ্গলাচ্ছন্ন গোরস্থান সম্পর্কে সন্দিহান ছিলাম। সবুরের দলকে গোরস্থানে বেশ কিছু গুলি ছুঁড়তে নির্দেশ দিলাম। সবুর ও তার সাথে আরও ছয়-সাতজন বিপুল উৎসাহে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালাল। কিন্তু গোরস্থানে কোন সাড়াশব্দ নেই। এরপর আমিও নদী পেরিয়ে অপর পারে গেলাম।
কয়েকজন ছাত্র যুবক দা দিয়ে কুপিয়ে দু’তিন মিনিটের মধ্যে জঙ্গল পরিষ্কার করে ফেললেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! মোট চারটি ছাড়া আর কোন লাশ পাওয়া গেল না। আমি আরও উত্তরে এগুলাম। পেছনে-সামনে চল্লিশজন মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তখনও নিশ্চিত নই, হানাদার বাহিনী কতটা পশ্চাদপসরণ করেছে। আমাদের প্রথম দলটি যখন চারান গ্রামে গেল, আমি তখনও মাঝ পথে।
হানাদার বাহিনী রাস্তায় যেখানে হুড়মুড় করে অবস্থান নিয়েছিল—সেখান চাপচাপ রক্ত। আগচারানের মুখে একটি জুম্মা ঘর। হানাদার বাহিনী পিছু হটে যাবার সময় এখানে কিছুক্ষণের অন্য আশ্রয় নিয়েছিল। দেখলাম, ঘরে কিছু ছেঁড়া জামা-কাপড় পড়ে আছে। আট-দশ হাত প্রশস্ত ও পনের-কুড়ি হাত লম্বা ঘরটির সারা মেঝে রক্তে ভেসে গেছে। আর উত্তরে এগুলাম না। আবার বল্লার দিকে ফিরলাম। বল্লা আর চারানের মাঝামাঝি যেখানে কিছুক্ষণ আগেও হানাদাররা জাঁকিয়ে বসেছিল, সেখানে এলে বিজয়ের এমন একটা অনাবিল স্বর্গীয় আনন্দের শিহরণ অনুভব করলাম, যা পরবর্তীতে অসংখ্য যুদ্ধে হানাদার বাহিনীকে পরাজীত করেও পাইনি। এমনকি ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয় ও যুদ্ধশেষে বঙ্গপিতার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র হস্তান্তর, এ দিনের স্বর্গীয় আনন্দের চাইতে বেশি আনন্দ দিতে পারেনি। মুক্তিবাহিনীর অনুমতি নিয়ে পনের-কুড়িজন লোক ইতোমধ্যে নদী পার হয়ে এসেছেন। দু’তিন জনের হাতে আবার মাছ-ধরার ঝাঁকি জাল। এই দলের সামনে লম্বা গোছের মধ্যবয়সী একজনকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম। এ আর কেউ নয়, বল্লার নজরুল। নজরুল ইসলামকে আগেও দেখেছি। তবে আজকে তাকে চিনলাম, আবিষ্কার করলাম।
আমরা আবার গোরস্থানের কাছে ফিরে এসেছি। নদী পেরিয়ে-আসা কয়েকজন উৎসাহী যুবক, বিশেষ করে নজরুল ইসলাম রাস্তার দু’ধারের পানিতে হানাদার বাহিনীর লাশ ও অস্ত্র খুঁজে
পৃষ্ঠা নং ~১৭৬

দেখার অনুমতি চাইল। জল্লাদ বাহিনীর প্রথম দলটিতে ছিল দশজন। তাদের যাবার কথা ছিল না, সবাই ছিল মুক্তিবাহিনীর নলের মুখে। কিন্তু মৃতদেহ পাওয়া গেল মাত্র চারটি। বাকি লাশ গেল কোথায়? মরার পরে তো কেউ চলতে বা দৌড়াতে পারে না। তবে কি ভূত হয়ে পালিয়ে গেছে? রাস্তার দু’পাশে লাশ ও অন্যান্য জিনিস খোজাখুঁজির কাজ অব্যাহত গতিতে চলতে লাগল।
মুক্তিবাহিনীর ষাট জনের একটি দল দুই চারানের মাঝামাঝি কালিহাতির দিকে পজিশন নিতে এগিয়ে গেল। নদী অতিক্রম করে আবার আমি বল্লা-বাজারে এলাম। শত বাঁধা উপেক্ষা করে এর মধ্যে হাজার খানেক লোক নদীর ধারে এসে গেছেন। হানাদার বাহিনী প্রভুত ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করে পালিয়ে যাওয়ায় তারা উল্লাসিত। মুক্তিবাহিনীর সফলতায় অভিভূত। কিভাবে যে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানাবেন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন, তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তাঁরা মুহুর্মুহু শ্লোগান দিচ্ছেন, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ; কাদের সিদ্দিকী জিন্দাবাদ। শেখ মুজিব-কাদের সিদ্দিকী জিন্দাবাদ। জয় বাংলা, জয় মুক্তিবাহিনী।’
এইখানেই সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে গুরুত্বহীন পঁচিশ বছরের একটি ছাত্র কাদের সিদ্দিকীর নামে শ্লোগান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো।
বল্লা স্কুল মাঠে, জল্লাদদের লাশ ঘিরে লোক আর লোক। দূর-দূরান্ত থেকে দশ-পনের হাজার লোক সমবেত হয়েছেন। এ কী দৃশ্য! এ কী উৎসব! সুদূর বাশাইল, কাউলজানী, রামপুর, পূবের বেড়াবাড়ী, বহেরাতলী ও কালিয়ান থেকে তারা দলে-দলে এসে হাজির হয়েছেন। বিচিত্র অনুভূতি, মন্তব্য, বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে-করতে সমবেত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। এ তো কেবল লাশ দেখা নয়, হানাদার বাহিনীর লাশগুলোকে কেন্দ্র করে বাঙালির যেন বিজয় উৎসব। পাঁচ-সাত মাইলের মধ্যে এমন কোন গ্রাম বাকি নেই যেখান থেকে দু’একশ’ লোক আসেননি। মনে হলো বল্লার সমস্ত লোকই বুঝি স্কুলমাঠে এসে ভেঙে পড়েছেন।
মহিলারাও পিছিয়ে থাকেননি। তাদের মন-প্রাণ-হৃদয়ে হানাদারদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের আগুনে জ্বলছিল। বহুদিনের পর্দাপ্রথাও তাদের ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। পর্দাপ্রথায় অভ্যস্ত শত শত মা-বোন মাঠে এসে জড়ো হয়েছেন।
বাঙালি মা-বোনদের গর্ব যেন আর ধরে না, তাঁদের অনেকেই বিস্মিত। অনেকের চোখেই আনন্দাশ্রু। অনেকে আবার বলাবলি করছেন, “আমাগরে এই গুদা-গুদা পোলারা কি কইরা ‘ভুইট্টা (বড় বড়) মেলেটারিগোরে মারল?” বিগত ১২ই মে এই বল্লাতেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সত্তর-আশিজন নিরপরাধ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে শত বছরের সমৃদ্ধ বল্লা বাজারটি নিশ্চিহ্ন করে। হিন্দু-মুসলিম জাতি-ধর্মের কোনও বিচার করেনি। বল্লা হত্যাযজ্ঞের মূল নায়ক এই গ্রামের কুখ্যাত দালাল আবদুর রাজ্জাক আনসারী। তাকে উপযাচক হয়ে বল্লারই যারা সাহায্য করেছিল, তাদের দশ-বারোজন এখন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী। হানাদার বাহিনী বল্লার দিকে এগিয়ে না এলে এবং যুদ্ধ না বাঁধলে তাদের বিচার এর মধ্যেই সমাধা হয়ে যেত। বল্লা স্কুল
পৃষ্ঠা নং ~১৭৭

মাঠে অগণিত লোক। রক্তাক্ত ঐতিহাসিক বল্লা যুদ্ধের নায়ককে তারা দেখতে চান, তার স্পর্শ পেতে তারা ব্যাকুল। কে কার আগে আমার কাছাকাছি আসবেন, স্পর্শ করবেন, একটু হাত মেলাবেন, এ নিয়ে শুরু হলো প্রতিযোগিতা। আমি এখন আর তাঁদের কাছে অজ্ঞাত-অপরিচিত নই, ঠাণ্ডু মোক্তারের পোলা বজ্র অথবা চব্বিশ-পঁচিশ বছরের একজন ছাত্রও নই। আমি তাদের কাছে প্রধান সেনাপতি, বল্লা যুদ্ধের সফল নায়ক। তাদের কথায়, বীর-মহাবীর। আমার দর্শন ও স্পর্শ পাবার আশায় প্রথমে জনগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা, পরে ধাক্কাধাক্কি হুড়োহুড়ি শুরু হলো। তবে এত ব্যাকুলতা সত্ত্বেও জনতা আমার কাছাকাছি কোথাও কোন বিশৃঙ্খলা ঘটতে দিলেন না। বা হয়ে যেত। বল্লা। যতে চান, তার স্পর্শ ণ করবেন, একটু হাত।
ভীড়ের মাঝ দিয়ে, আস্তে আস্তে মাঠের মধ্যে এসে একটি অভাবনীয় ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। যুদ্ধেক্ষেত্র থেকে ফেরার পথে মনে-মনে ভাবছিলাম, হানাদারদের লাশ মর্যাদার সাথে দাফন করে ফেলব। কারণ লাশ ফেলে রাখা যেমন ভালো নয়, তেমনি মৃতের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শনে প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কিন্তু এই জনসমুদ্রের মাঝে এসে যা দেখলাম, তাতে পূর্ব সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রাখতে পারলাম না। মৃতদেহগুলো মাঠের ঠিক মাঝখানে রাখা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা লাশগুলোর চারপাশে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত জায়গা জুড়ে বেষ্টনী সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে। জনতার শত চাপের মুখেও তারা বেষ্টনীর আয়তন সংকুচিত হতে দিচ্ছে না। তবুও দু’একজন হঠাৎ করে বেষ্টনী ভেদ করে ভেতরে ঢুকে হানাদারদের গায়ে থুথু ছিটাচ্ছেন, লাথি মারছেন। তাও আবার ডানপায়ে নয়, বামপায়ে। আমার ‘ঘেরাও’র ভেতরে প্রবেশের পরও বিক্ষুব্ধ জনতার কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকল। কেউ কেউ উন্মাদের মতো চিৎকার করে বলছেন, “হায়! হায়! এই সীমার, এই এজিদরা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে।” কেউ কপালে করাঘাত করে বলছেন, “এরা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে।” কেউ আবার বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলছেন, “এই জল্লাদরা আমার দোকানপাট, ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে।” এমনি ধরনের অগণিত অভিযোগের স্রোত বয়ে যেতে লাগল। নানাভাবে হানাদারদের বিরুদ্ধে জনতার ঘৃণা-নিন্দা ও বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকল।
জনতার নিন্দা ও অভিযোগের মিছিল দেখে বিহ্বল হয়ে গেলাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এদের কী করা যায়? সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল গতকালের কথাবার্তা। গতকাল এই বল্লারই দু’এক জায়গায় লোকজন বলাবলি করেছেন, ব্যাঙ্গোক্তি করেছেন, “ঠাণ্ডু মোক্তারের পোলা বজ্জ! হে করবো যুজ্জ? আগলা মাদবরী পাইছে। ওদের মাদবরীটা দিল কেডা? এগোরে শায়েস্তা করা উচিত।” তাঁদেরই মুখে আজ আবার অন্য কথা, “দেখছ, আমাগর গুদা গুদা (ছোট ছোট) পোলারা কত ভুইট্ট্যা ভুইট্ট্যা মেলেটারি মাইরা ফেলাইছে। আমাগর পোলাগর সাথে কি মেলেটারিরা পারে? আগেই কইছি না, মুক্তি গো সাথে কিছুতেই পারব না। অত মেলেটারিরাও বল্লা আইতে পারল না। আইজ অরা বল্লা আইতে পারলে অন্তত দশটা মানুষতো মারত। দেইখ্যো, মুক্তিগোর সাথে আর পারব না।”
পৃষ্ঠা নং ~১৭৮

হাজার হাজার মানুষ এই ধরনের অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। এখানে বাইরের কেউ উপস্থিত থাকলে এটা অবশ্যই বুঝতে পারতেন, ঠাণ্ডু মোক্তারের পোলা বজ্জ, হে করবে যুজ্জ! জনতার একথা যেমন ছিল আন্তরিক; পরের দিন তারাই আবার উল্টোটা বলছেন—এখানেও তাদের আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে এটাই এক মস্ত বড় বিস্ময়।
এ বিস্ময়ের ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে, সংক্ষেপে এটাই বলা যায় যে, বল্লা যুদ্ধের পূর্ব-পর্যন্ত হানাদার বাহিনী বাংলার গ্রামে গঞ্জে তেমন বাঁধা প্রাপ্ত হয়নি। ছোট-খাটো ঝুঁকি ও বাঁধার সম্মুখীন হলেও তা তারা অনায়াসেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি ছিল হানাদার বাহিনীর সম্পূর্ণ অনুকূলে। এতে জনতার মধ্যে একটা বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছিল যে, অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনী দুর্জয়, অজেয়। বিশ্বের কোন শক্তিই তাদের পরাজিত বা পর্যুদস্ত করতে পারবে না। এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে, নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে ধাবমান ‘নির্বোধ’ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের নেতা বজ্র সম্পর্কে অনেকে সেদিন ব্যাঙ্গোক্তি-বক্রোক্তি করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, তাদের এ উক্তি ছিল খুবই সরল, স্বাভাবিক ও আন্তরিক। এতে ঘৃণা, হিংসা বা বিদ্বেষের লেশমাত্র ছিল না।
কিন্তু পরের দিন বল্লার যুদ্ধে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে বিপুল ক্ষয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারা মুক্তিবাহিনীর ভয়ে এতই ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যে, মৃতদেহ ও অস্ত্রগুলো পর্যন্ত কুড়িয়ে নিতে সাহস করেনি। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থায় তাড়াহুড়া করে পালিয়ে যায়। হানাদার বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি, লাশ ও অস্ত্র-সংগ্রহে সাহসের অভাব, সর্বোপরি পরাজয় বরণ করে পলায়ন ইত্যাদি ঘটনা জনতার পূর্ব-বিশ্বাসে প্রচণ্ড আঘাত হানে। তাদের এত দিনের বিশ্বাসের ভিত্তিমূল উপড়ে ফেলে। জনতার চিন্তা ও বিশ্বাসে শুরু হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। হানাদার বাহিনী যে অজেয় নয়—এটা তারা বুঝতে ও দেখতে পায়। ‘হাজার কথা—এক কাজ।’ মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ অর্থাৎ যুদ্ধ জয় দেখে জনতা চিন্তাধারাও পাল্টাতে শুরু করে। জনতার এ মানসিকতার মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হয় যে, জনতা কথা চায় না, ভাষণ ভালোবাসে না, বড় বড় প্রতিশ্রুতির প্রতিও তাদের শ্রদ্ধা নেই। জনতা কাজ চায়, কাজের লোক চায়। কাজের প্রতিই তাদের অন্তরের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সত্যিকার নির্ভেজাল কর্মীর প্রতিই তাদের সহানুভূতি ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত। বল্লা যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর উপর জনতার যে আস্থা আসে- যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত তা অটুট ছিল।
লাশের চার পাশে যখন জনতার ভিড়, তখন কয়েকজন উৎসাহী যুবক ও দশ-বারো জন মুক্তিযোদ্ধাকে দু’টি করে কলাগাছ দিয়ে চারটি ভেলা বানিয়ে রাখতে বলেছিলাম। জনতার লাশ দেখা শেষ। অন্যদিকে কলাগাছের ভেলা তৈরি। তখন লাশগুলোর যে সে কী অবস্থা তা বলার মতো নয়। এক জায়গায় জড়ো-করা চারটি মৃত দেহই এদিক-ওদিক সরে গিয়েছে। দু’তিন ইঞ্চি পুরো কফ, কাশি ও থুথু পড়েছে। এ ছাড়া অসংখ্য মানুষের আনাগোনা ও চলাফেরার ফলে
পৃষ্ঠা নং ~ ১৭৯

লাশগুলো ধুলিতে একাকার হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকে সাপে কাটা রোগীদের কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়ার একটি রীতি আছে। গ্রামকে-গ্রাম যখন কলেরা বা ওলাউঠায় নিষ্প্রাণ, উজাড় হয়ে যেত তখন। কবরে বা শ্মশান ঘাটে বয়ে নেবার লোকের অভাবে মৃতদেহগুলো কলা গাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হতো। আমরাও এখানে প্রাচীনপ্রথার আশ্রয় নিলাম। সামরিক পোষাকে চারটি লাশ কলা গাছের ভেলার উপর শক্ত করে বেঁধে ভাটিতে ভাসিয়ে দিলাম।
দখলকৃত চারটি লাশ তল্লাশি করে প্রথম হানাদারটির কাছে একশ’ টাকার ছয়টা নোট ও একটি ঘড়ি, দ্বিতীয়টির কাছে ত্রিশটি টাকা ও উর্দু-লেখা একটুকরো কাগজ, জনপ্রিয় চিত্র-তারকা নিলুর ছবি, তৃতীয় জনের পকেটে সোনার হার আনুমানিক দু’তোলা ওজনের, রুমালে বাঁধা তিনটি আংটি ও পাঁচ-ছয় ভরি ওজনের একটি সোনার চেইন এবং সর্বশেষ জনের কাছে তেরশ’ টাকা, একটি ঘড়ি, কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী চিত্রাভিনেত্রীর ছবি, কিছু চুড়ি, মালা ও আংটিসহ ভরি সাতেক স্বর্ণালংকার পাওয়া গেল।
বল্লা যুদ্ধে উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলোর মধ্যে চারটি চাইনিজ রাইফেল, ছয়শত গুলি, দশটি গ্রেনেড, চারটি ২ ইঞ্চি মর্টারশেল আর বল্লার উৎসাহী যুবকবৃন্দের রাস্তার দু’পাশে ঝাঁকি জাল ফেলে তুলে আনা একটি রাইফেল এবং চারশত গুলি। বল্লা যুদ্ধের দু’দিন পরে আরও এ হানাদার-লাশ যুবকেরাই উদ্ধার করেছিল।
বল্লা যুদ্ধে যে সকল সহযোদ্ধারা ছিল তাদের মধ্যে লাবিবুর রহমান, হুমায়ুন, খোরশেদ আলম আর. ও. সাহেব, সাইদুর রহমান, আফসার উদ্দিন আহমেদ (আফসার মেম্বার), সবুর খান, আবদুল মালেক, আবদুল হালিম, রফিক, নিতাই পাল, বাবুল সাহা, কুমিরা বাড়ীর আমজাদ উল্লেখযোগ্য।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৮০

থানা দখল

১৩ই জুন। সাথীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে টাংগাইলের সবগুলো থানা দখলের একটা ছক আঁকলাম। ১৩ই জুন রাতে বাশাইলের শুন্ন্যার কাছে অবস্থান নিলাম এবং ১৪ তারিখ দুপুরে খাবারের পরও সহযোদ্ধাদের ঘর থেকে বেরুতে দেয়া হলো না। তাদের সবাইকে প্রায় গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হলো।

বাশাইল অভিযান
আমার সাথে চল্লিশ ও আফসার মেম্বারের সাথে একশ’ পঁচিশ—মোট একশ’ পয়ষট্টি জন। বেলা একটার পর মুক্তিযোদ্ধাদের তিন দলে ভাগ করে বাশাইল থানা অভিযানে বেরিয়ে পড়লাম। দিনটি বাশাইলের হাটবার। পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূব, আমরা এই তিন দিক থেকে বাশাইল থানা আক্রমণ করব। পশ্চিম দলের নেতৃত্বে থাকবে সোহরাব, মোকাদ্দেছ ও আর. ও. সাহেব, দক্ষিণে অবস্থান নেবে-ফেরদৌস আলম রঞ্জু ও আবদুস সবুর খান। আর পূবের দলকে নেতৃত্ব দেবো আমি। স্থির হলো, পশ্চিমের দল থানার একশ’ গজ থেকে দু’শ গজের মধ্যে অবস্থান নেবে। অন্যদিকে দক্ষিণে সবুর ও ফেরদৌসের নেতৃত্বাধীন দল বাশাইল থানা উন্নয়ন অফিসকে সামনে রেখে অবস্থান গ্রহণ করবে। তৃতীয় দলটি নিয়ে আমি থানার পূব পাশে কয়েকটি পুরানো ভাঙা দালানের আড়ালে অবস্থান নেব। কোন দলের দূরত্ব থানা থেকে এক-দেড়শ’ গজের বেশি হবে না।
আমরা অবস্থান নিয়েছি। থানা এবং আমাদের অবস্থানের মাঝে ছোট্ট একটি পাগাড়। তাতে অথই পানি। ডানে বাশাইল সাহাপাড়া আর বামে থানা উন্নয়ন অফিস। নির্দেশমতো সোহরাব, মোকদ্দেছ ও আর. ও. সাহেবের দল প্রথম আঘাত হানবে। প্রয়োজন হলে দক্ষিণের সবুর ও ফেরদৌসের দল তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। এই দু’দল থানায় প্রবেশ করবে না। থানায় ঢোকার দায়িত্ব আমাদের।
নির্ধারিত সময়ের জন্য রুদ্ধশ্বাসে বন্দুক উঁচিয়ে অপেক্ষা করছি। এদিকে বাজারের কিছু কিছু লোক মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পেয়ে আস্তে আস্তে সরে পড়ছেন। এরকম অবস্থায় বেশি সময় অপেক্ষা করা যায় না। দেখতে দেখতে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে দু’ মিনিট চলে গেল। কিন্তু এ কী ব্যাপার! অপরদিক থেকে গুলি ছোঁড়ার কোন শব্দ নেই। আমি ধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম। এমন হবার কথা নয়। এক ঘন্টাও হয়নি, ঘড়ির সাথে প্রতিটি দলের দু’টি করে ঘড়ির সময় মিলিয়ে দিয়েছি। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে ঘড়ির কাঁটার সাথে এত হেরফের হবার সম্ভাবনা নেই। তবে হলো কী? তবে কি পশ্চিমের দল ঠিক সময় যথাস্থানে পৌঁছাতে পারেনি? না, তাও নয়। তারা নির্ধারিত সময়ে যথাস্থানে পৌঁছে গেছে। তবে কেন ওরা আক্রমণ করছে না? কোন অঘটন ঘটল! এমনি নানা চিন্তা-ভাবনায় প্রায় পাঁচ মিনিট কেটে গেল। খবর সংগ্রহের জন্য একজন দূত
পৃষ্ঠা নং ~১৮১

পাঠাতে যাব এমন সময় নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হবার ছয় মিনিট পর, থানা থেকে চিৎকার ভেসে এলো, “স্যার, আমরা থানা দখল কইর‍্যা ফেলাইছি। সব পুলিশগোরে বাইন্দ্যা ফেলাইছি। আপনে আইস্যা পড়েন,” বলেই আর. ও. সাহেব, সোহরাব ও দলের কয়েকজন পাগাড় সাঁতরে আমার সামনে এসে হাজির। অন্যদিকে থানার ভেতর থেকে ওসি আরও জোরে চিৎকার করে উঠল, “স্যারেরা! আমরা সারেণ্ডার করছি। আপনারা গুলি ছুইড়েন না।” ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা থানার মধ্যে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী, জয় কাদের সিদ্দিকী,’ শ্লোগান শুরু করে দিয়েছে।
দৌড়ে থানায় গেলাম। চারিদিকে প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা একবার ভালো করে দেখে থানার সামনে মাটিতে বসে পড়লাম। কমাণ্ডার সোহরাব ও মোকাদ্দেছকে অভিনন্দিত করে ঠাট্টাচ্ছলে বললাম, “তোমাদের তো থানায় ঢোকার কথা ছিল না। তোমরা চালাকি করে আমাদের ঠকিয়েছ। থানা দখলের পুরো কৃতিত্বটাই নিয়ে নিলে? তোমরা ভীষণ লোভী। আমাদের একটুও ভাগ দিলে না। আমরা যদি পাঁচটা গুলিও ছুড়তাম তবুও অন্ততঃ বলতে পারতাম, থানা দখলে আমাদের কিছু অবদান আছে।”
সবুর তো রেগেই অস্থির। তার কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। তার কথা, “আমাগরে ঠকাইয়া আপনেরা একাই থানা দখল কইরা ফেলাইলাইন? ভাবছেন, বাংলাদেশে এডাই থানা আছে? আমরা আর সুযোগ পামুনা? পরশু বল্লায় কী পাইটটাই না করলাম। আমি আর মালেক গুলির ভিতর দিয়া দুইড্যা ভুইট্টা ভুইট্টা মেলেটারীর লাশ আনছি। ঠিক আছে দেহা যাবো, কেডা আবার আগে থানা দহল করে?”
এ যেন এক প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় কেউই পিছিয়ে থাকতে চায় না, সতের জন পুলিশকে হাত বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পুলিশদের বাসাগুলোতে তখন কান্নার রোল পড়ে গেছে। আমি পুলিশদের পরিবার-পরিজনদের সাথে কথা বলতে তাদের কোয়াটারে গেলাম। পুলিশদের মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে সংখ্যায় প্রায় পঞ্চাশ। তাঁরা সকলে আমাকে ঘিরে ধরে আলু-থালু হয়ে কেঁদে বললেন, “আমাদের প্রিয়জনেরা নির্দোষ। পেটের দায়ে কাজ করছে। এরা কারও ক্ষতি করেনি। আপনারা এদের জীবন ভিক্ষা দিন।”
সেই সময়, যে কেউ মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়লেই মনে করা হতো, পাক বাহিনীর দালাল। অতএব তার জীবন শেষ। হাত-পা বাঁধা পুলিশদের পরিবার-পরিজনদের মধ্যেও এইরকম একটা ধারণা বদ্ধমূল ছিল। বাঘের সামনে ছাগলের যেমন বেঁচে থাকার আশা নেই, এই রকম আতঙ্কিত ওদের পরিজনদের কেউ কেউ আমার পা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলেন। কেউ কেউ আবার হাত তুলে মায়ের দাবি, বোনের দাবি নিয়ে পুলিশদের প্রাণভিক্ষা চাইলেন। সবাইকে বললাম, “আপনারা এরকম করলে ফল ভালোর চেয়ে খারাপ হতে পারে। আপনারা শান্ত হোন। এখানে কারো প্রতি অন্যায় করা হবে না। দোষী ব্যক্তিকে যেমন আমরা রেহাই দেব না, তেমনি নির্দোষীর গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগাতে দেবো না।” একথা শোনার পর, ধৃত পুলিশদের পরিবার-পরিজনের অনুনয়-বিনয়, হাতে-পায়ে ধরা, কান্নাকাটি—এককথায় সকল কলরব নীরব হয়ে গেল।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৮২

ধরা পড়ার পর পুলিশগুলো না ছুঁতেই আধমরা হয়ে গিয়েছিল। আমি সামনে যাওয়ার সাথে সাথে একেবারে নিশ্চল হয়ে গেল। দেখলে মনে হয়, যেন তারা মরেই গেছে। পুলিশদের সামনে মাটিতে বসে একে-একে সকলের নাম, বাড়ী ও অন্যান্য কথা জিজ্ঞেস করলাম। এখানেও বইলানপুরের মতো একজনও স্থানীয় পুলিশ ছিল না।
ও. সি-র বাঁধন খুলে দিতে বললাম। থানার ছোট দারোগাকে নির্দেশ করেছি, “তুই ঐ দিকে একটু সরে দাঁড়া।” সকল পুলিশদের নাম ধাম জিজ্ঞেস করার পর ছোট দারোগার কাছে গেলাম।
—এই ভদ্রলোক! তোর নাম কিরে? এর আগে কোথায় কাজ করেছিস?
একটি মিহি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে ছোট দারোগা আপ্লুত হয়ে বলল,
—আপনি আমারে চিনতে পারছেন না স্যার, আমি আপনাদের বাড়ীতে কত গেছি। আপনে তখন একটু ছোট ছিলেন।
একটু ব্যঙ্গ করে বললাম,
—না তো ঠিক মনে করতে পারছি না। তখন হয়তো আমার জন্মই হয়নি।”
আমার ভুল শুধরে দেবার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে বলল,
—না, না, অত আগে নয়। এই তো মাত্র কয়েক বছর আগে আপনাদের বাড়ী গিয়েছিলাম, আপনার বাবা আমার বন্ধু।
এতে কিছুটা ধৈর্য হারিয়ে ফেলাম। ছোট দারোগাকে সপাৎ সপাৎ কয়েক ঘা বসিয়ে দিলাম। আঘাত দারোগার মাথায় লাগায় ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগল। হাত দিয়ে মাথার রক্ত মুছতে মুছতে সে বলল,
—হায় হায়! আপনারা কী করছেন? রক্তে আমার সারা শরীর ভেসে গেল যে?
আপনারা কি আমায় মেরে ফেলবেন?
—না, না তোকে মেরে ফেলব কেন? বেটা নচ্ছার! তোকে আদর করব?
এখানে একটি প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। অন্য পুলিশদের কিছু না বলে এই ছোট দারোগার পেছনে লাগলাম কেন? সে কথাই বলছি। কাহিনীটা বড়ই মর্মান্তিক। এই মহান (?) দারোগা ইতিমধ্যে আট জন মুক্তিযোদ্ধার বাবা-ভাই ও আত্মীয় স্বজনকে গ্রেফতার করে টাংগাইলে চালান করেছে। তাদের তিন জনকে হানাদার বাহিনী হত্যা করেছে। অন্ততঃ সাত-আটটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে নানাভাবে হয়রানি করে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা এই পনের দিনের মধ্যে ঘুষ খেয়েছে। এই বিশ্ব নমরুদকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার জন্য গত দশদিন উতলা হয়েছিলাম।
থানার উত্তরে দাঁড়িয়ে বাজারের সমস্ত লোক পুলিশদের বিচার দেখছিলেন। দেখে আশ্চর্য হচ্ছিলেন। কারণ এতদিন তারা দেখে এসেছেন, ঐ থানায় সাধারণ মানুষের হাত-পা বেঁধে পুলিশেরা ফেলে রাখত। আর আজ সেই থানায়, সেই থানারই পুলিশদের বেঁধে রাখা হয়েছে। এ এক তাজ্জব ব্যাপার। সাধারণ মানুষ আরও তাজ্জব বনে যায় এই দেখে যে, পুলিশরা যেমন থানার গাছে ঝুলিয়ে অযথা লোককে নির্দয়ভাবে পেটাত, আজ মুক্তিবাহিনী ঝুলিয়ে না হলেও ছোট দারোগাকে পেটাচ্ছে।
পৃষ্ঠা নং ~১৮৩

ছোট দারোগার মাথা থেকে অনেকক্ষণ রক্ত ঝরার পর রক্তের ধারা কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলে চিৎকার করে শয়তানটকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন বলতো কেমন লাগে? আমাদের আটটি মুক্তিযোদ্ধা-পরিবারকে তুই ধ্বংস করেছিস। তিনজনকে হানাদার দিয়ে হত্যা করেছিস। আটজনের বাপ-মাকে হয়রানি করে চল্লিশ হাজার টাকা ঘুষ খেয়েছিস। এখন দেখ, বাবার উপরেও বাবা আছে।”
দারোগা ভদ্রলোকটির বুঝতে বাকি থাকে না যে, তার প্রতি খুব একটা ভদ্র আচরণ করা হবে না। তার ভবিষ্যৎ বড়ই ঝরঝরে—এ বোধটি জাগার পর তার পূর্বের দাম্ভিকভাব আর থাকল না। সে করুণা প্রার্থনা করে কেঁদে-কেঁদে বলল, “আপনি আমার ধর্মের বাপ। আমি উপরওয়ালার হুকুমে দু’চার জনকে ধরেছি, তারা যে মুক্তিবাহিনীর লোক আমার জানা ছিল না। ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা ঘুষ আমি নিইনি। আল্লাহর কসম, এই কয়েকদিনে মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা নিয়েছি। তবে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বাপ-ভাই, তা আমি জানি না। আমি টাকাটা আজই ফিরিয়ে দেবো। আপনি যদি চান এখনই এনে আপনার হাতে তুলে দিই। আর যারা টাকা দিয়েছে, তাদের নাম-ঠিকানাও দিচ্ছি।”

অভিজাত শোষকরা ফাটকে
আমরা থানায় উঠে থানার উত্তরের বাসিন্দা ভোলা মিঞা ও মন্টু মিঞাকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাঠিয়ে ধরে এনেছিলাম। আমি যখন দারোগাকে বেদম প্রহার করছিলাম তখন বাশাইলের অন্যতম ধনী ও দাম্ভিক ভোলা ও মন্টু মিঞা তা দেখছিল। দারোগাকে পিটাতে দেখে মন্টু ও ভোলা মিঞা বিস্মিত হলেও ভয় পায়নি। আমি চেয়ারে বসলে তারা আমার সাথে সাগ্রহে কুশল বিনিময় করতে এগিয়ে এসে ডানে-বায়ে তাকিয়ে বলল, “দেখতো ভাইয়েরা, আমাদের জন্য দুটো চেয়ার আনতে পার কিনা?”
মন্টু ও ভোলা মিঞা চেয়ার চাইলে আবার গর্জে উঠলাম, “বহুকাল তোমরা মানুষের রক্ত শোষণ করে ভুরি ভুরি টাকা বানিয়েছ। এটা ভেবোনা যে, সব জায়গায় তোমাদের চেয়ার এগিয়ে দেয়ার জন্য চাকর-বাকর আছে। তোমাদের আদর করতে আনা হয়নি। অভিযোগ আছে বলে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। মনে পড়ে তালুকদারি করতে যেয়ে গরিব মানুষকে ধরে এনে কয়টা চেয়ার দিয়েছ? হাড্ডিসার মানুষগুলোর পিঠে তোমরা বেত মেরেছ। সাধারণ মানুষ কি তা ভুলে গেছে?”
আমার মুখে এসব কথা শুনে ভোলা মিঞারা একেবারে চুপসে যায়। পাশে সমবেত জনতাও যে কিছটা বিস্মিত হয়নি, তাও নয়। এই রকম ধনী ও প্রভাবশালী লোকদের যে দাঁড় করিয়ে রাখা যায় তা এর আগে এলাকার সাধারণ মানুষের ধারণারও বাইরে ছিল। তবে একটু আগে ছোট দারোগাকে পিটানো দেখে সাধারণ মানুষ এটা বুঝে নিয়েছিল যে, মুক্তিবাহিনীর কাছে ধনী-নির্ধন, বাদশা-ফকির, দারোগা-পুলিশ সব সমান।
অগত্যা মন্টু মিঞারা দাঁড়িয়ে রইল। উপরন্তু তাদের হাত বেঁধে দেয়া হল। এই সময়
পৃষ্ঠা নং ~১৮৪

আরেকটি যুবককে গ্রেফতার করে আনা হয়। মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে এই যুবককে বিজু মিঞা পাঠিয়েছে।
বিজু মিঞা টাংগাইল শহরের ধনী প্রভাবশালী ও দাম্ভিক ব্যক্তি। পাকিস্তানীদের দালাল। সাধারণ দালাল নয়। দেশের সেরা দালালদের মধ্যে অন্যতম। যুবকটিকে তার বক্তব্য পেশ করতে বললে, প্রথম জবানিতেই সে অসংখ্য হেরফের করে বসল। দ্বিতীয় বার করতে বললে, হেরফরের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। তবে বিজু মিঞা যে তাকে পাঠিয়েছে এবং তার সাথে যুবকটির যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে—এ বিষয়টা প্রতিবারেই প্রকাশ পেল। তখন তাকে বললাম, “এখন যাও। ভালোভাবে ভেবে-চিন্তে সুস্থ হয়ে পরে তুমি তোমার বক্তব্য পেশ কর।”
এ সময় সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলামঃ
“আমার মুক্তিযোদ্ধাদের যারা ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করবে, অথবা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের যারা বিব্রত করবে, অস্বস্তিতে ফেলবে কিংবা পীড়ন করবে, তাদের শাস্তি হবে বড়ই কঠিন, বড়ই কঠোর। আমি তাদের লাওয়ারিশ মরা কুকুরের মর্যাদাও দেবো না। বাংলার একটি বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবন নিলে আমরা দশটা পাক-সহযোগী দালালের উপর তার প্রতিশোধ নেব।”
জালেম দারোগার শাস্তি সম্পর্কে বললাম, “বাংলার কুলাঙ্গার এই দারোগার জীবন রক্ষা পাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। ও বাংলা মায়ের তিন জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করিয়েছে। একজনকে মারলেই ওকে আমি অপ্রয়োজনীয় কুকুরের মতো গুলি করে মারতাম। ও মেরেছে তিনজন। গুলি করে মেরে আমি ওর মৃত্যু যন্ত্রণা কমতে দেবো না, মৃত্যুর প্রক্রিয়া হবে দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক। ওকে পিটিয়ে পিটিয়ে মারা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আমার দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য থানায় যে গর্ত খোঁড়া হয়েছে, সেই গর্তেই ওকে পোঁতা হবে। ও আজীবন মাটির নিচে বাংকারে বসে বসে মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি লক্ষ করুক।”
বক্তৃতা শেষ হবার পর পরই গুপ্তচর সন্দেহে ধৃত সেই যুবকটিকে আবার আনা হলো। যুবকটির ব্যাপারে কী করা যায় চিন্তাভাবনা করছি, তখন এলাকার কিছুলোক বলতে শুরু করলো, “এই লোকটি আজ দশ-বারদিন যাবত মাঝে মাঝে এখানে ঘোরাঘুরি করছে। এতে আমাদের সন্দেহ হয়েছে। বাইরের লোক ঘোরাঘুরি করছে অথচ থানা কর্তৃপক্ষ কোন খবর জানে না, এটা কখনও হয় না।”
সমবেত জনতার এ ধরনের মন্তব্য ও অভিযোগের প্রেক্ষিতে ও. সি. কে ডাকলাম। ও. সি. যেন এরকম ডাকের অপেক্ষাতেই বসেছিল। সে পোষ্য বিড়ালের মতো মিউ মিউ করে দৌড়ে এলো একগাল হেসে, ভক্তিতে গদ গদ হয়ে হাতজোড় করে বলল-
– স্যার, আমাকে ডাকছেন?
– হ্যাঁ, এই লোকটিকে আপনি চেনেন?
– স্যার, আপনার কাছে মিথ্যা বলা যায় না। আমি একে ভালোভাবে চিনি না। তবে এর
পৃষ্ঠা নং ~ ১৮৫

যাতে কোন অসুবিধা না হয়, এই মর্মে একটি চিঠি আমার কাছে আছে। চিঠিটি লিখেছেন, টাংগাইল জেলা শান্তি কমিটির সভাপতি হেকিম হবিবুর রহমান ও বিজু মিঞা সাহেব। চিঠিতে তাঁদের দু’জনেরই স্বাক্ষর রয়েছে। তবে এর কাজ কী তা আমি জানি না স্যার। এই বলেই ও. সি. দৌড়ে গিয়ে অফিস থেকে চিঠি এনে আমার হাতে দিল।
চিঠিখানা ভালো করে পড়ে যুবকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা তুমি নিয়ে এসেছিলো?” সে প্রথমে ‘না’ করলেও পরে অবশ্যই স্বীকার করলো। স্বীকার না-করে উপায়ও ছিল না। পত্রে যুবকের স্বাক্ষর আছে। তাকে একটুকরো সাদা কাগজে তার নাম লিখতে বলা হলো। দু’বার নাম লিখে সে বলল, “স্যার, একটা ভুল করে ফেলেছি, চিঠিটা আমি নিয়ে এসেছিলাম। এখানকার খোঁজ-খবর নিতে আমাকে বিজু মিঞা পাঠিয়েছেন। তবে আমি কোন অন্যায় করি নাই। আমাকে তাঁরা পঁচশ টাকা দেবেন। তাই আমি পেটের দায়ে এখানে এসেছি। আমি বড়ই গরীব। আমাকে মাফ করেন।”
যুবকটির কথায় জনতার মাঝে দেখা দিল ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। তারা প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলেন,
– কমাণ্ডার সাব, এর কথা বিশ্বাস কইরেন না। গুপ্তচররে শাস্তি না দিলে, ওগর সাহস বাইড়্যা যাবো। এরা গ্রাম-গঞ্জ জ্বালাইয়া দিবো। অরে আমাগর হাতে দেইন, যা করার আমরা করি। অরে আমরা পাড়াইয়া মারুম।
জনতার অভিযোগ ও দাবীর মুখে মুক্তিবাহিনী গুপ্তচরটিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলো। থানার ছোট দারোগাকে লাঠিপেটা করে ইতোমধ্যেই আধমরা করে ফেলা হয়েছিল। অধিকন্তু, জনতার মধ্য থেকেও দু’চারজন প্রতাপশালী ছোট দারোগাকে কোদালের বাঁট দিয়ে আঘাত ও জুতো দিয়ে পাড়াতে থাকেন। জুতা আর গুঁতা খেতে খেতে দশ-বার মিনিটের মধ্যেই সে পরপারে চলে যায়।
থানার ও. সি. আবদুল খালেককে ২৫ মার্চের পর থেকে এতদিনের সমস্ত কাগজপত্র আমার আমার হাজির করতে নির্দেশ দিলাম। ও. সি. আগের মতো দৌড়ে গিয়ে থানা থেকে সমস্ত কাগজ-পত্র নিয়ে এলে তাকে বললাম, “জনাব বদিউজ্জামান ও লতিফ সিদ্দিকী এম. পি. এর বিরুদ্ধে মন্টু ও ভোলা মিঞা যে এজাহার দিয়েছে, তা বের করুন।” ও. সি. একান্ত বাধ্যগত, সুবোধ বালকের মতো ৪ঠা এপ্রিলের দেয়া এজাহারটি বের করে দিল।
সাদা কাগজে লেখা অভিযোগপত্র। অভিযোগকারী দু’জন। মন্টু ও ভোলা মিঞা। অভিযুক্তরা দু’জন স্থানীয় এম. পি. এবং টাংগাইলের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা বদিউজ্জামান খান ও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। অভিযোগ পত্রটি খাতায় পিন দিয়ে আটকানো। ও. সি. আবদুল খালেক খাতাটি আমার সামনে সুন্দর করে খুলে ধরল। এ যেন মস্তবড় উর্ধ্বতন কর্তাকে খুশি করার অধঃস্তন কর্মচারীর রুদ্ধশ্বাস প্রাণান্ত প্রয়াস। আর হবেই বা না কেন? সামান্য আগে ছোট দারোগার হাল-হকিকত দেখে, বড় দারোগাও বেহাল হয়ে পড়েছে। অটোমেটিক
পৃষ্ঠা নং ~১৮৬

মেশিনের মতো ও. সি. সব কাজ করছে, আর ম্যালেরিয়া রোগীর মতো থরথর করে কাঁপছে। অভিযোগ পত্রটি এজাহার খাতা থেকে খুলে একবার মন্টু ও ভোলা মিঞার চোখের সামনে তুলে ধরলাম, “কি মিয়ারা? এ লেখাটা চিনতে পারছ?” তারা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, “নিজেদের বাঁচানোর জন্য এজাহার দিয়েছি। আমাদের কোন দোষ নেই।”
এজাহার কেন? তারা এজাহারের ঘটনা ঘটাল কেন? সে আরেক ইতিহাস। আর এ ইতিহাস জানতে হলে কিছুটা পিছনে দৃষ্টি ফেরানো প্রয়োজন।
২৬শে মার্চ, ১৯৭১ সাল। টাংগাইলের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য বদিউজ্জামান খানের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম গঠিত হলো, টাংগাইল স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ। আর এ পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হলেন তরুণ উদ্যমী প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ‘গণবাহিনী’ নামে একটি সশস্ত্র বাহিনী অবিলম্বে গঠন করা হবে এমন একটি সিদ্ধান্তও গণমুক্তি পরিষদে গৃহীত হয়েছিল। ইতোমধ্যে ছাত্রদের উদ্যোগে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ নামে সশস্ত্র বাহিনী সারা দেশে গড়ে উঠেছিল। ২৬শে মার্চের পর টাংগাইল গণবাহিনী ছিল তারই একটি বর্ধিত রূপ। গণমুক্তি পরিষদের আহ্বায়ক লতিফ সিদ্দিকী ছিল গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক।
২৭শে মার্চ তারা টাংগাইলের তদানীন্তন জেলা প্রশাসক জনাব জালালউদ্দীন আহমেদ (সি. এস. পি) ও এস. পি. কে সাথে নিয়ে টাংগাইল জেলার সব কয়টি থানা সফর করেন। ২৭শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে উল্লেখিত নেতৃবৃন্দ বাশাইল থানাতেও এসেছিলেন। শুধু তাই নয়, এখানে তাঁরা বড়োসড়ো একটি জনসভাও করেছিলেন। সভাশেষে পূর্বোল্লেখিত মন্টু ও ভোলা মিঞা দেশপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে নেতৃবৃন্দের কাছে আসে এবং দেশ ও জাতির সেবায় তাদের সবকিছু উৎসর্গ করার আগ্রহের কথা বিশেষভাবে ব্যক্ত করে। আর তাদের কথা যে কেবল কথার কথা নয় অন্তরের কথা, তার প্রমাণ হিসেবে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবহৃত দু’টি রিভলবার টাংগাইল গণমুক্তি পরিষদের কাছে হস্তান্তর করে বলেন, “এই রিভলবার পরিষদকে উপহার হিসাবে দিতে পারায় আমরা নিজেদের ধন্য ও কৃতার্থ মনে করছি। মানুষের জীবনে এমন গৌরবময় মুহূর্ত বেশি আসে না। আজকের এই পবিত্র মুহূর্তে আপনাদের কথা আমাদের চিরদিন মনে থাকবে। ভবিষ্যতে পরিষদকে আমরা আরও সাহায্য করব।” ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেদিন নেতৃবৃন্দই শুধু নন, সমবেত জনতাও তাদের মনোভাব, দেশাত্মবোধ, রিভলবার উপহার ও অন্যান্য কার্যকলাপ দেখে শতকণ্ঠে প্রশংসা করেছিল, ধন্যবাদ ও বাহবা দিয়েছিলেন। অনেকে আবার তাদের মতো করতে না পারার জন্য নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও অক্ষমতা অনুভব করে অনুশোচনাও করেছিলেন। যাক সে কথা।
২৭শে মার্চ থেকে ৪ঠা এপ্রিল। সাত-আট দিন পরের ঘটনা। ৩রা এপ্রিল , হানাদার বাহিনীর সাথে গোড়ান-সাটিয়াচরায় সামনা-সামনি লড়াই। অবশেষে মুক্তিবাহিনীর পশ্চাদপসরণ। মুক্তিবাহিনীর সাময়িক পশ্চাদপসরণই হলো ভোলা ও মন্টু মিঞার দেশাত্মবোধের কাল। তাদের দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম ও দেশ সেবার উদগ্র বাসনা মুহূর্তেই কর্পূরের মতো উড়ে গেল।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৮৭

মুক্তিবাহিনীর আর কোন আশা নেই, ভরসা নেই, ভরসা নেই, ভবিষ্যৎ নেই। ‘দেশপ্রেম এখন আশীর্বাদ নয়-অভিশাপ’ এরকম একটি সিদ্ধান্তে এসে তারা ৪ঠা এপ্রিল বাশাইল থানায় গিয়ে এই কর্মটি করে। তারা হয়তো ভেবেছিল, পরিষদকে রিভলবার উপহার দিয়ে ২৭শে মার্চ যে পাপ করেছে, সাত দিন পর ৪ঠা এপ্রিল বাশাইল থানায় এজাহার দায়ের করে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ব করতে পারবে।
আরও মজার ব্যাপার, ২৭শে মার্চ, ভোলা ও মন্টু মিঞারা যখন উপযাচক হয়ে দেশ-প্রেমের নিদর্শন স্বরূপ তাদেরকে রিভলবার উপহার দেয়, তখন ওখানে ও. সি. আবদুল খালেক উপস্থিত ছিল এবং তাদের সেও আন্তরিক প্রশংসা করেছিল। এ ঘটনায় পাঠক হাসবেন না কাঁদবেন জানি না। তবে একটা প্রশ্ন করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। তা হলো, এই মন্টু ও ভোলা মিঞা থানায় এজাহার নথিভুক্ত করতে গেলে ও. সি. আবদুল খালেক তাদের কী বলেছিল। আবার পূর্বের ভূমিকার জন্য ও. সি. খালেককেই বা ভোলা মিঞা-মন্টু মিঞা তখন কী বলেছিল? এ প্রশ্নের জবাব আজও মেলেনি। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অনেক প্রশ্ন আছে যার কোন জবাব নেই। ও. সি. আবদুল খালেকের কাছে মন্টু ও ভোলা মিঞা পরিষদ নেতাদের বিরুদ্ধে এজাহার লিপিবদ্ধ করতে গেলে উভয় পক্ষের মধ্যে তখন কী কথাবার্তা, কী প্রশ্ন, পাল্টা প্রশ্ন হয়েছিল, তাও সম্ভবতঃ কোনদিন জানা যাবে না। কারণ মনুষ্য-প্রকৃতি বড়ই, রহস্যময়, বড়ই দুর্বোধ্য।
মন্টু ও ভোলা মিঞা এজাহারে লিখেছে—
টাঙ্গাইলের দু’জন লোক—যথাক্রমে বদিউজ্জামান খান ও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বাশাইল এসে, বাড়ী থেকে ডেকে এনে জোর-জবরদস্তি করে, আমাদের আত্মরক্ষার বৈধ অস্ত্র কেড়ে নিয়ে যায়। ঐ অস্ত্র কোথাও কোন দুষ্কর্ম বা কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে পড়লে আমাদের যাতে দায়ী করা না হয় তজ্জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। উপরন্তু, এই ধরনের দুর্দান্ত প্রকৃতির লোকদের হাত থেকে আমাদের মতো শান্তিপ্রিয় মানুষদের রক্ষা করার জন্য সরকার কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’ এজাহারটি মোটামুটি এই রকমই ছিল। তবে আইন-কানুনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে অত্যন্ত সুন্দর, সাজানো-গোছানো। শুধু এজাহার দায়ের করেই ভদ্রলোকেরা ক্ষান্ত হয়নি। তারা দু’জনে টাংগাইল ও ঢাকা পর্যন্ত ছুটেছে। এ সমস্ত খবর আমরা একমাস ধরে সংগ্রহ করেছি। তাই বাশাইল থানায় ঢুকেই মুক্তিবাহিনী পাঠিয়ে দু’টি শিকার মন্টু ও ভোলা মিঞাকে ধরে এনেছি।
তাদের জিজ্ঞেস করলাম, “তোমাদের আজ ধরে আনা হয়েছে, এটাই তো পরে সুযোগ পেলেই পাকিস্তানীদের কাছে অভিযোগ করবে। সারা জীবন তো জোঁকের মতো সাধারণ মানুষের রক্ত চুষেছ, তাই তোমাদের খাছিলৎ বদলায়নি। জনাব লতিফ সিদ্দিকী ও জনাব বদিউজ্জামান খান আমাদের নেতা। তাঁদের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক গর্হিত ও মিথ্য অভিযোগ আনার অপরাধে, আমরা ইচ্ছা করলে তোমাদের দু’শয়তানকে গুলি করে ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারি। তবে আমরা তোমাদের এই অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের কথা ভাবছি না। তোমাদের শাস্তি হবে
পৃষ্ঠা নং ~১৮৮

দু’টি। যা দেখে অন্যেরা এই সব অপকর্ম থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হবে। তোমাদের প্রথম শাস্তি—অর্থদণ্ড আর দ্বিতীয় শাস্তি—বেত্রাঘাত।”
আমার কথা শুনে দু’জনে সমস্বরে বলে উঠে, “দেখুন আমাদের দোষ নেই। আমরা বাধ্য হয়ে এই অভিযোগ করেছি। আমাদের মন প্রাণ আপনাদের প্রতি পড়ে আছে। আমাদের বাড়ীর সবাই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। আমরা যেকোন ভাবে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে চাই। আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না।”
—এই কারণেই তো তোমাদের মৃত্যুদণ্ডের কথা ভাবছি না।
এবার ভোলা মিঞা মুখ খুলল,
— আমাদের আপনি বেত মারবেন না। বিনিময়ে যত খুশি অর্থদণ্ড করুন। বেত মারলে আমরা কাউকে মুখ দেখাতে পারব না। এই কথা শোনার অপেক্ষায়ই ছিলাম।
দাম্ভিক ও অভিজাত্যের গর্বে অন্ধ ভোলা মিঞার কথা শেষ হলে বললাম,
— তাহলে দেখছি লজ্জা-শরমের মাথা একেবারে খেয়ে ফেল নাই। লজ্জা-শরম কিছুটা হলেও আছে। বেত মারলে লজ্জা পাওয়া যাবে। ব্যথা পাওয়া যাবে না? এই যে হাত বাঁধা হয়েছে। এতে লজ্জা হচ্ছে না?
—হলে আর কী করব, আমাদের যখন কিছু অন্যায় হয়ে গেছে, তখন এটা মানতেই হবে।
—শাস্তি তোমাদের দু’টোই হবে।
—আমাদের পঁচিশ হাজার টাকা করে জরিমানা করুন। যদি চান আরও বেশি। আমরা খুশি মনে দিচ্ছি। তবে আমাদের দয়া করে বেত মারবেন না। আমাদের অনেক বয়স হয়ে গেছে।
সময় সংক্ষিপ্ত। তাই এদের ব্যাপারে আর বিলম্ব করতে চাইলাম না। ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। সমবেত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “এই সমস্ত ধনকুবের প্রভাবশালীরা তাদের সমস্ত দোষ, সমস্ত অপরাধ, সমস্ত কালিমা অর্থের বিনিময়ে অর্থের নিচে চাপা দিতে চায়। এই মন্টু ও ভোলা মিঞা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। এদের অপরাধ প্রমাণিত। অতএব মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রত্যেককে পাঁচ-ঘা বেত ও এক টাকা করে জরিমানা করা হলো। উভয় শাস্তিই তাৎক্ষণিক ভাবে কার্যকর হবে।”
আর. ও. সাহেব বোধ করি বেত মারার জন্য তৈরি হয়েই ছিলেন। রায় ঘোষণার সাথে সাথে অপরাধীদের সপাং সপাং পাঁচ-ঘা করে বেত বসিয়ে দিলেন।
এরপরও তারা জরিমানা পরিশোধ করার ব্যাপারে লজ্জাবোধ করতে থাকে। কারণ অঢেল টাকা প্রচুর সম্পদের মালিক তারা। এত কম জরিমানা দিলে তাদের মান থাকে না। জরিমানা পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে দেখে বললাম, ‘দুই মিনিটের মধ্যে জরিমানার টাকা পরিশোধ না করলে পারশোধ করতে অক্ষম হলে, এদের প্রত্যেককে জরিমানার বদলে আরও পাঁচ-ঘা করে বেত মারা হোক।’ আরও পাঁচ-ঘা বেত মারার কথা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া হল
পৃষ্ঠা নং ~ ১৮৯

তাৎক্ষণিক। মুহূর্ত বিলম্ব না করে সুড়সুড় করে একজন একটি পাঁচ টাকার ও আরেকজন একটি দশ টাকার নোট বের করে দিল। তাদের এই পাঁচ ও দশ টাকার নোট দেখে প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে বললাম, “বদমাশের জাতেরা। পাঁচ টাকা দশ টাকার নোট দেখাচ্ছ? তোমাদের পকেটে এক টাকা নেই?” মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পকেট তল্লাসি করলে, তাদের উভয়ের পকেটে বেশ কয়েকটি এক টাকার নোট ও খুচরা পয়সা পাওয়া গেল। সেখান থেকে এক-এক করে দুই টাকা নিয়ে এক-টুকরা কাগজে জরিমানা কেন, কতটাকা জরিমানা, কাদের কাছ থেকে জরিমানা এবং স্থান ও তারিখসহ সবকিছু কাগজে লিখে তাদের স্বাক্ষর নিয়ে এবং আমরা স্বাক্ষর করে এক কপি তাদের দিলাম ও এক কপি রেখে ছিলাম।
এরপর থানার অন্যান্য পুলিশদের ব্যাপারে দৃষ্টি দিলাম। সকলের কথা শুনে শুধু বেত মেরে ছেড়ে দেব বলে মনে মনে স্থির করেছিলাম। তবে তা প্রকাশ না-করে সহকর্মীদের মতামত যাচাই করে দেখার জন্য তাদের সাথে প্রায় দশ মিনিট আলোচনা করলাম। তারাও আমার মতো ভাবছিল। সুদীর্ঘ সময় পুলিশদের বেঁধে রাখার পরও জনতার ভেতর থেকে কোন অভিযোগ এল না। ছোট দারোগা ছাড়া এ থানার বাকি পুলিশ ও ও. সি. -র বিরুদ্ধে তেমন কোন অভিযোগ আমাদেরও ছিল না।
পুলিশদের উর্ধ্বতন-নিম্নতন সকলকে সাত-ঘা করে বেত মারার নির্দেশ দেয়া হলো। এবার বেত মারা শুরু করলো নাসিরাবাদ কলেজের ছাত্র, সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী আবুল কালাম। সে প্রথমে ও. সি. -কে দিয়ে শুরু করে একে-একে অন্যান্য পুলিশদের পর্যায়ক্রমে বেত মারল। বেতমারা শেষ হলে প্রত্যেককে তিন থেকে সাতশ’ পর্যন্ত টাকা রাহা খরচ দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে বাশাইল ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হলো।
বাশাইল থানা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলা-বারুদ উদ্ধার করলো। উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গোলা বারুদের মধ্যে ছয় হাজার গুলি, বাইশটি রাইফেল ও ষাট হাজার টাকা। টাকাগুলির মধ্যে ছোট দারোগারই ছিল চল্লিশ হাজার আটশ। সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করে দিলাম, “গত পনের দিনের মধ্যে ছোট দারোগা যার-যার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেছিল, তারা যেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে তাঁদের টাকার পরিমাণ ও দারোগা-কর্তৃক টাকা সংগ্রহের বিবরণ ইত্যাদি জানিয়ে লিখিত দরখাস্ত করেন। মুক্তিবাহিনী দরখাস্ত গ্রহণের সাত দিনের মধ্যে দরখাস্তের বিবরণ সত্য প্রমাণিত হলে, আবেদনকারী বা কারিণী টাকা ফেরত পাবেন।”
দারোগা-পুলিশদের বিচার চলার সময় আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আরিফ আহমেদ দুলাল। বাশাইল থানার পশ্চিম পাশের রাস্তা দিয়ে বারবার এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছিল। বার বার দুলালের এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা আমার দৃষ্টি এড়ায় নি। একজন সহযোদ্ধাকে দিয়ে দুলালকে ডেকে আনলাম। এ সময় থেকেই আরিফ আহমেদ দুলাল সর্বক্ষণের জন্য ঘরবাড়ী ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৯০

১৪ই জুন, বাশাইল থানার পাশে সাহা পাড়ায় একটি বাড়ীতে রাত কাটালাম। ঠিক করলাম, থানা দখলের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য আরও দু’একদিন বাশাইলে থাকব। কয়েকজন লোক সকাল দশটার দিকে গোড়ান-সাটিয়াচরা, নাটিয়াপাড়া এলাকায় ৩রা এপ্রিলের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ফেলে আসা বেশ কিছু অস্ত্র আমার হাতে জমা দিল। অস্ত্র ও গোলা-বারুদ হলো—স্টেনগান, দু’টি স্টেনগানের প্রায় তিন শ’ গুলি, গ্রেনেড ষোলটি ও ৩০৩ রাইফেলের গুলি চার হাজার।
১৫ই জুন। এলাকার নানা টুকিটাকি খবর সংগ্রহ, সুষ্ঠু প্রশাসন চালানোর নিয়মকানুন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমেই কেটে গেল। ১৬ই জুন, দুপুরে সাহাপাড়া ঘুরে ঘুরে দেখার সময় ভূপতি মোহন সাহার সাত-আট বছরের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হে! তুমি আমাদের সাথে ঘুরে ঘুরে কী দেখছ? তুমি মুক্তিবাহিনী হবে নাকি?” এ সময় ভূপতি মোহন সাহার স্ত্রী এগিয়ে এলেন। মহিলাটি বেশ মনোবলের অধিকারিণী। মহিলাটি এগিয়ে এলে বললাম, “দেখুন আপনাদের এমন সুন্দর পাড়াটা, আমার তো মনে হয়, অক্ষত থাকবে না। জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এটা সইতে পারবেন তো?” মায়ের কথা বলার আগেই ছেলেটি বলে উঠল, ‘কাকা, তোমরা যুদ্ধ কর। আমাদের বাড়ী পুড়ে পুড়ুক।” বাচ্চাটির মা, এবং পাড়ার অনেকের মুখেও একই কথা।
—পাকিস্তানীরা বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিলে আপনারাই বা কী করবেন? এ নিয়ে ভাববেন না, আপনারা যুদ্ধ করুন। আমাদের যা হবার হবে।

কামুটিয়া যুদ্ধ
১৭ই জুন, সকাল আটটা। আমরা অন্যত্র যাবার জন্য প্রস্তত। দু’এক মিনিটের মধ্যেই রওয়ানা হব। এমন সময় খবর এলো, টাংগাইল থেকে করটিয়া হয়ে একদল মিলিটারি বাশাইলের দিকে আসছে। খবর পেয়ে আমার কর্মসূচি বাতিল করে ঐ অবস্থাতেই বাশাইল থানার পশ্চিমে কামুটিয়া নদীর দিকে ছুটলাম। কামুটিয়া নদীর পাড়ে পূর্ব থেকেই মুক্তিবাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছিল। ত্রিশ জনের একটি দল নিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যে তিন মাইল অতিক্রম করে নদীর পারে হাজির হলাম। এখানে যারা ছিল তাদের কাছ থেকে খবরা-খবর সংগ্রহ করে যে কুড়ি জন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিয়েছিল, তাদের পিছিয়ে যেতে নির্দেশ দিলাম।
আমরা ত্রিশজন, শত্রুর জন্য শিকারীর মতো ওঁৎ পেতে বসে আছি। কামুটিয়া নর্থখোলা খেয়া পারে পশ্চিমমুখী দৃঢ় অবস্থান নিয়েছি। হাত ট্রিগারে, দৃষ্টি সামনে শক্রর গতিবিধির উপর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছয় সাত জন হানাদার নদীর পাড়ে এসে ডানে-বামে দেখতে থাকল। ঘাটে খেয়া না দেখে তারা ডাকাডাকি করতে লাগল, ‘ভাইলোগ। তোম লোগ কাহা হো। হামলোগ দুশমন নেহি। দোস্ত হু কিস্তি লে আও।’ এসময় আরও দশ-পনের জন এগিয়ে এলো।
আর বসে থাকা যায় না। শিকার নাগালের মধ্যে বন্দুকের নলের সামনে এসে গেছে। এই তো মোক্ষম সময়। মাত্র ষাট-সত্তর গজ দূরে অপর পারে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা সতের জন
পৃষ্ঠা নং ~১৯১

হানাদারদের উপর আমরা অতর্কিতে গুলি ছোঁড়া শুরু করলাম। গুলি তো নয়, যেন মরণ শেল। প্রথম ঝাঁক গুলিতে ফল যা হবার হয়ে গেল। চারটি বিশাল দেহী হানাদার-দানব গড়িয়ে নদীতে পড়ে গেল। তিনজন নদীর পাড়ে, উঁচু বাঁধের উপর পড়ে রইল। তাদের কোন সাড়াশব্দ নেই, নড়াচড়াও নেই। বুঝলাম দেহে প্রাণ নেই। তবুও আরো কয়েক রাউন্ড গুলি চালালাম।
এবার হানাদার বাহিনীর পক্ষ থেকে পাল্টা গুলি শুরু হল। হানাদারদের মেশিনগান দিক বিদিক কাঁপিয়ে বৃষ্টির মতো অবিশ্রান্ত গুলি ছুঁড়ে চলছে। দুই ইঞ্চি ও তিন ইঞ্চি মর্টার এবং রকেট লাঞ্চার থেকে গোলা নিক্ষেপের বিরাম নেই। গোলাতে চারদিক প্রকম্পিত করে গগন বিদারী আওয়াজ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কেয়ামতের আলামত, মহাপ্রলয় শুরু হয়ে গেছে।
প্রায় আধ ঘন্টা হানাদার বাহিনী অবিশ্রান্ত গুলিগোলা বর্ষণ করে কোন উত্তর না-পেয়ে ভাবল, আর মুক্তি-টুক্তি কিছু নেই। যা ছিল ভয়ে পালিয়েছে অথবা নিপাত গেছে। তাই খুশি মনে আবার আস্তে আস্তে দু’একজন করে বাঁধের কাছে এগিয়ে এলো। এ সময় মালেকের গুলি তাদের একজনের বক্ষ ভেদ করে যাওয়ায় সে উল্টে নদীতে পড়ে। এরকম একটা হতাশাজনক বিভ্রান্তিকর অবস্থার মুখে হানাদার বাহিনী সাহস ও শক্তি ফিরে পাবার জন্য চিৎকার করে শ্লোগান তুলে ‘ইয়া আলী, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ মুক্তিযোদ্ধারা ততোধিক জোরে চিৎকার করে আকাশ-বাতাশ মাটি কাঁপিয়ে মুহূর্তের শ্লোগান তুলে, “ইয়া আলী, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী।” গ্রামবাসীরাও মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে হিম্মত বাড়ানোর উদ্দেশ্যে শ্লোগানে যোগ দিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেলেন। তাদের সে কী আনন্দ! সে কী উল্লাস! মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীদের তখনকার মিলিত অনুভূতি প্রকাশ করা রীতিমতো কঠিন ব্যাপার।
মুক্তিযোদ্ধাদের শ্লোগান শুনে হানাদাররা চিৎকার করে উঠল, ‘শালা কাফের লোগ। শালা লোগ ইয়া আলী ভী বলতা হ্যাঁয়, জয় বাংলা ভি বলতা হ্যাঁয়। শালা লোক এ কিয়াচিজ হ্যাঁয়।”
এই সময় আমি একটি অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিই। মোটামুটি জোরে-জোরে ওয়ারলেসে ম্যাসেজ পাঠানোর মতো কোম্পানীগুলিকে ডান ও বামে শত্রুদের ঘিরে ফেলতে ম্যাসেজ পাঠাতে থাকি। আমি যখন ডানের কোম্পানীকে এগিয়ে যেতে বলি তখন মিলিটারিদের বন্দুকের নলও ডানদিকে ঘুরে যায়। আবার বাম দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সরে যেতে বললে হানাদারদের বন্দুকের নলও সেই দিকে ঘোরে। এই যুদ্ধে আবদুস সবুর নদীর পাড়ে প্রায় আধা মাইল ব্যাপী একবার ডানে, একবার বামে দৌড়াদৌড়ি করে প্রায় তিনঘন্টা গুলি চালায়। এই আধ মাইল এলাকা জুড়েই মুক্তিবাহিনী পজিশন নিয়েছে, শত্রুকে এটা বুঝিয়ে দেয়াই ছিল সবুরের উদ্দেশ্য। এ কাজে সবুর পুরো মাত্রায় সফল হয়। সে দুই হানাদারকে গুলি করে বালুচরে ফেলে রেখেছে। এমন জায়গায় হানাদার দু’টির লাশ পড়ে আছে যেখান থেকে তা উদ্ধার করা জল্লাদদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
যুদ্ধ তখন মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে। ছয়-সাত জন সহযোদ্ধা নিয়ে অনেকটা উত্তরে গিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~১৯২

নদীর পাড়ে গেলাম। নদী পার হওয়ার ঘটনাও অভিনব। পানিতে ডুবিয়ে-রাখা দশ-বারো হাত লম্বা একটি ডিঙি নৌকা কয়েকজন যুবক একটানে ডাঙায় তুলে কাত করে পানি ফেলে দিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিল। নৌকা ডাঙায় তোলা ও নদীতে ভাসানো একাজে যুবকদের মাত্র এক মুহুর্ত সময় লাগলো।
যুবক বন্ধুরা দুই মিনিটে নদী পার করে দেয়। আবদুস সবুর, সামসু, সাইদুর ও ছানোয়ারকে নিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে কিছু পশ্চিমে এগিয়ে দক্ষিণ দিকে ছুটলাম। হানাদারদের অবস্থানের তিন শ’ গজের মধ্যে গিয়ে গুলি ছুঁড়লাম। কিন্তু এ কী! কোন উত্তর নেই। কোন সাড়াশব্দ নেই। দূরবীন দিয়ে খুব ভালভাবে দেখতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম হানাদাররা অনেকদূর পিছিয়ে গেছে। তাদের সর্বশেষ সদস্যটি বাংড়া পর্যন্ত চলে গেছে। শত চেষ্টা করেও পালিয়ে যাওয়া হানাদারদের তিন’শ গজের বেশি কাছে যেতে পারলাম না। তিন’শ গজ দূরে থেকেই একচোট গুলি ছুঁড়লাম। হানাদার বাহিনীর অবস্থা তখন পাগলপ্রায়। আমাদের গুলির জবাবে তারা একটা গুলিও ছুড়ল না। আপনি বাঁচলে বাপের নাম, কার আগে কে পালাতে পারে- তারও প্রতিযোগিতা বাঘে তাড়া করা হরিণের মতো তারা করটিয়ায় এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে হুড়মুড় করে বাসে ট্রাকে উঠে টাঙ্গাইলের দিকে দে চম্পট।
মোকাদ্দেছ, রঞ্জু, মালেক ও সোহরাব করটিয়ার সাবেক জমিদারদের বাড়ী পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে কয়েকটি দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলা ছুড়লো। আমি তাড়াতাড়ি লোক পাঠিয়ে তাদের গোলাগুলি ছুঁড়তে নিষেধ করলাম। শত্রু পালিয়ে যাওয়ার পর গোলাগুলি ছোঁড়ার কোন মানে হয় না। বরঞ্চ ক্ষতি হতে পারে। মুক্তিবাহিনীর গুলিতে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাক, তা মুক্তিযোদ্ধাদের কোনক্রমেই কাম্য হতে পারে না। পরপর তিনবার একইভাবে ঘা খেয়ে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পশ্চাদপসরণ করে, হানাদারদের মনোবল যেমন কিছুটা ভেঙে যায়। ঠিক তেমনি মুক্তিবাহিনী ও জনগণের মনোবল অনেকটা বেড়ে গেল।
যুদ্ধশেষে বাথুলী স্কুল হয়ে ঝনঝনিয়া মাদ্রাসার সামনে এলাম। এখানে সৈয়দ নুরুকে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি করা হয়। মুক্তিবাহিনীতে সৈয়দ নুরুর ভর্তির ব্যাপারটা গতানুগতিক নয়, একটু ভিন্ন ধরনের। সৈয়দ নুরু এর আগে আমার সাথে প্রথমে দেওপাড়া ও পরে বাঘের বাড়ীতে মিলিত হয়েছিল। বাঘের বাড়ী থেকে তাকে গোপলদীঘি স্কুলের দূরবীনটি সংগ্রহ করতে পাঠিয়েছিলাম। নুরু গোপালদীঘি হাইস্কুল থেকে একটি দূরবীন ঠিকই এনেছে, তবে মুক্তিবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেনি। দূরবীন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে নুরু বলল, “ওটা আমার কাছে। আছে।” দূরবীনটি মুক্তিবাহিনীকে দিয়ে দিতে বললে সে জানালো, “ওটা আমার কাছেই থাক। আমিও তো ওটা ব্যবহার করতে পারি। সবই মুক্তিবাহিনীর কাছে জমা দিতে হবে এর কি কোন মানে আছে?”
মুক্তিবাহিনীর নাম করে গোপালদীঘি স্কুল থেকে নুরু দূরবীন সংগ্রহ করেছে, সুতরাং মুক্তিবাহিনীর অনুমতি ছাড়া সে তা নিজের কাছে রাখতে পারে না। তার এ ধরনের আচরণ মেনে
পৃষ্ঠা নং ~১৯৩

নিলে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাও অনুরূপ প্রলুব্ধ হতে পারে। এতে মুক্তিবাহিনীর জন্য মোটেই ভালো হবার কথা নয়। এসব চিন্তা করে সৈয়দ নুরুকে বাঁধতে নির্দেশ দিলে তাকে বেঁধে মাদ্রাসা ঘরের ভিতরে চারজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাহারায় বসিয়ে রাখা হয়। নুরু কিন্তু এতটা ভাবতে পারেনি। ইতোমধ্যে ঝনঝনিয়া মাদ্রাসার মাঠে নানা বয়সের প্রায় শ’দুয়েক লোক মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হতে একত্রিত হয়েছে। মাদ্রাসার সামনে তাদের সবাইকে ভর্তির জন্য দাঁড় করানো ও তাদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের কষ্টকর দিকের ভয়াবহ বিবরণ এক এক করে তুলে ধরে সর্বশেষ বললাম, “এরপর যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চান তারা আমার সামনে পাশাপাশি দাঁড়ান।” ভীষণ কষ্টকর ও রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ কথা শুনে দু’শ জনের মধ্যে চব্বিশ-পঁচিশ জন লাইনে দাঁড়াল।
লাইনে দাঁড়ানোদের মধ্যে বন্ধু হুমায়ুনের ছোট ভাই আকবরও আছে। আকবরকে দেখে খুব অস্বস্তিতে পড়লাম। কারণ এই কষ্টকর বিপজ্জনক পথে আকবরের মতো সাদাসিদে ছেলের টিকে থাকা মোটেই সম্ভব নয়। অথচ মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য তার আগ্রহ ও উৎসাহের অভাব নেই, তাকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র ও ভয়াবহ অবস্থার কথা বর্ণনা করে যখন আকবরকে দুর্বল করা গেল না, লাইন থেকে সরানো সম্ভব হলো না, তখন এক সহযোদ্ধাকে দিয়ে তাকে লাইন থেকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। সহযোদ্ধাটি আকবরকে সরিয়ে নিয়ে তাকে আমার সাথে খাবার খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে বলল। ঝনঝনিয়াতে চৌদ্দজনকে মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি করা হল। ভর্তি শেষে মাদ্রাসা ঘর থেকে নূরুকে আনা হল। তারপর অবশ্য তাকে আর কিছু বলতে হয় নি। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলোতে সে পূর্ণ আস্থা ও প্রশংসার সাথে কাজ করেছে। টাংগাইলের মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দ নুরুর ভূমিকা খুবই উজ্জ্বল।
১৭ই জুন, সন্ধ্যায় ঐ গ্রামের এক বাড়ীতে খাবার শেষে দেওপাড়ার দিকে রওনা হওয়ার আগে আকবরকে কাছে ডেকে স্নেহভরে বললাম, “তুই মুক্তিযোদ্ধা হতে চাস, এতে আমার আপত্তি নেই। তবে এখনও তোর মুক্তিযোদ্ধা হবার সময় হয়নি। তুই আমার সাথে যোগাযোগ রাখিস, সময় হলেই আমি তোকে ডেকে নেব।” এরপর বার-তের মাইল পায়ে হেঁটে আমরা দেওপাড়ার শিবের পাড়া এলাম। ফজলুর দল দু’দিন আগেই এখানে পৌঁছেছিল। রাতে শিবের পাড়ার করিম মুন্সি ও অন্যান্যদের সাথে নানা বিষয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হলো।

ঘাটাইল থানার পতন
১৮ই জুন। সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা শিবেরপাড়া থেকে পশ্চিমে রওনা হলাম। আমাদের লক্ষ্য ঘাটাইল থানা। আমরা শিবের পাড়া থেকে মোগলপাড়া, ব্রাহ্মণশাসন হয়ে দ্রুত উত্তরে চললাম। করটিয়া সাদৎ কলেজের অধ্যাপক আবুল হোসেন সাহেবের বাড়ী বাঁয়ে রেখে বীর ঘাটাইল। সেখান থেকে আরও উত্তরে রাত এগারটায় ঘাটাইল বাজার বাঁয়ে রেখে ঘাটাইল হাইস্কুলের পিছনে এসে অবস্থান নিলাম। ঘাটাইল হাইস্কুল থেকে এক-দেড়শ গজ উত্তরে ঘাটাইল থানা। ইতোমধ্যেই স্থানীয় দু’তিন জন পরিচিত লোক খুঁজে এনেছি। তৎকালীন ঘাটাইল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক
পৃষ্ঠা নং ~১৯৪

আবদুর রশিদ এদের অন্যতম। এদের কাছে জেনেছি থানায় মাত্র এক বা দু’জন পুলিশ-পাহারা থাকে। কুড়িজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ঘাটাইল থানার চারদিকের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক দিয়ে থানা ঘিরে ফেললাম।
থানার পুলিশদের বিভ্রান্ত করার জন্য সাধারণ পোশাক পরে চারজন মুক্তিযোদ্ধা খুনের মামলার এজাহার দেয়ার ভান করে থানায় ঢুকে। এরপর ডাকাতি মামলার এজাহার দিতে আরও তিনজন একই কৌশলে থানার ভেতরে ঢুকে। রাইফেল ধারী এক পুলিশ প্রথম চারজনকে থানায় ঢুকতে দেখে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো, “আপনারা কেন আসছেন?” তারা জানালো, আমাদের গ্রামে খুন হয়েছে। আমরা এজাহার দিতে এসছি।” পুলিশটি আবার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাদের গ্রাম কোথায়?”
—ঝরকা।
এর মিনিট দুই পর আরও তিনজনকে থানায় ঢুকতে দেখে পুলিশটি আবার চেঁচিয়ে উঠে এবং ঐ একই প্রশ্ন করে। আগন্তুকরা জানায়, তাদের গ্রাম কালিদাসপাড়া। তাদের গ্রামে মস্ত বড় ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতরা তিনজনকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। তাই এজাহার দিতে এসেছে।
আগন্তুকের কথা শুনে ও মামলার গুরুত্ব উপলব্ধি করে পুলিশটি থানার সামনে-রাখা একটি বেঞ্চিতে তাদেরকে বসতে দেয়। খুন ও ডাকাতির কথা শুনে বোধকরি পুলিশটি মনে-মনে বেশ খুশি হয়েছিল।
একটু পরে পেশাবের কথা বলে, দু’জন মুক্তিযোদ্ধা থানার পিছনে যায়। তারা যথারীতি পেশাবের ভান করে এদিক-ওদিক ভালো করে দেখে আবার গিয়ে বেঞ্চিতে বসে। ছদ্মবেশী, অভিনয় পটু মুক্তিযোদ্ধারা এর মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, পাহারায় একজনই, পাশের ঘরে থানার সমস্ত অস্ত্র ও গোলা-বারুদ মজুত রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের থানার ভেতর ঘুরে ফিরে খোঁজ-খবর নিতে পাঁচ-ছয় মিনিটের বেশি লাগেনি। সব খোঁজ খবর শেষ; অতএব আক্রমণ শুরু করা যায়। পূর্ব পরিকল্পনা মতো ইশারা করলে সাথে সাথে দু’জন পুলিশটিকে জাপটে ধরে। অন্যজন এক ঝটকায় পুলিশটির হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নেয়। আরেকজন সাথে সাথে রিভলবার বের করে পুলিশের বুকে তাক করে ধরে। চোখের পলকে ঘটনাটি ঘটে যাওয়ায় সে হতভম্ব হয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। টু-টা করারও কোন সুযোগ পায় না। দলনেতা একটি নাম ধরে সংকেত পাঠায়। (একটি বিশেষ নাম ধরে ডাকার অর্থই হচ্ছে অপারেশন সফল ও ভেতরে ঢোকার ইঙ্গিত।) সংকেতের সাথে সাথে দশজনকে নিয়ে থানার ঘরে উঠে পুলিশদের থাকার ঘরটি ঘিরে ফেললাম। অন্যদিকে, স্কুল মাঠের বাকি মুক্তিযোদ্ধারা থানার ‘ফ্যামেলী কোয়ার্টার’ ঘিরে ফেলল।
ঘুমন্ত পুলিশদের এক এক করে ডেকে উঠানো হচ্ছে, তারা এক এক করে বাইরে আসছে আর বাইরে পনের-কুড়ি জন সশস্ত্র লোক দেখে ভিমরি খাচ্ছে। থানায় তের জন পুলিশ,
পৃষ্ঠা নং ~ ১৯৫

দু’জন এ. এস. আই. এবং একজন এস. আই. মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ল।
দু’জন এ. এস. আই. ও একজন এস. আই. কে থানার পাশের বাড়ী থেকে ডেকে আনা হলো। তাদের একজন আচমকা এসব দেখে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পেশাব করে দেয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের পুলিশটির কাপড়-চোপড় ও তার পায়ের নিচের মেঝে পেশাবে ভেসে গেল। সত্যিই একটা হাসির ব্যাপার হলো, অন্যদিকে বেদনারও।
ঘাটাইল থানার পুলিশরা ধরা পড়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কোন বেত্রাঘাত বা গালমন্দ করেনি। তাদের সবাইকে শুধু চাকুরি ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়। সাথে সাথে সাবধান করে দেয়া হয়, এরপর ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাছাড়া পুলিশদের কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে তো কোন কথা নেই। একেবারে জীবন শেষ।
ঘাটাইল থানা থেকেও আমরা কিছু অস্ত্র ও গোলা-বারুদ কব্জা করতে সমর্থ হই। এ থানা থেকে আঠারটি রাইফেল ও আট হাজার গুলি সংগ্রহ করি। তাছাড়া নগদ দশ হাজার টাকাও পাওয়া যায়।
থানা অপারেশন শেষ করে আমরা ঘাটাইল থেকে অনেকটা পশ্চিমে রাত কাটালাম।
সকাল সাতটায় রওনা হয়ে ন’টায় গোপালপুরের কাছাকাছি পৌঁছে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে, দ্রুততার সাথে থানা ঘোরাও করে ফেললাম। বাশাইল ও ঘাটাইল থানা যেমন আমরা গুলি খরচ না করে দখল করেছিলাম, এখানে তেমনটি হলো না। গোপালপুর থানা দখল করতে আমাদের বেশ কিছু গুলি খরচ করতে হলো।

গোপালপুর থানা দখল
পূবদিকের দলটি থানার উপর প্রথম আঘাত হানল। ফলে থানার পুলিশরা পূবদিক লক্ষ করে মুক্তিবাহিনীর উপর (তাদের ভাষায় দুষ্কৃতকারী) পাল্টা গুলি ছোঁড়া শুরু করে। দক্ষিণ পাশ দিয়ে কুড়ি জনকে নিয়ে আমি নির্বিঘ্নে থানা অফিসের সত্তর-আশি গজের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। পুলিশরা ভাবতেই পারেনি, তাদের উপর আরও কোনদিক থেকে আক্রমণ আসতে পারে। কাছাকাছি গিয়ে আমরাও থানার উপর আঘাত হানলাম। দক্ষিণ-দিক থেকে গুলি আসতে দেখে পুলিশ দল একেবারে ঘাবড়ে যায়। তারা চতুর্দিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়েছে ভেবে গুলি ছুঁড়তে আর ভরসা পায় না। গুলি ছুঁড়ে অনর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেপিয়ে বিপদ বাড়াতে কেই বা চায়! কোন উপায় না দেখে বারবার চিৎকার করে বলল, “সারেন্ডার করছি। আমাগরে মাইরেন না।” জবাবে চিৎকার করে বললাম, “এক মিনিটের মধ্যে থানার সামনে অস্ত্র ফেলে দাঁড়ান।” সম্ভবত এরকম একটি নির্দেশের জন্যই পুলিশরা জোরে জোরে চিৎকার করছিল। নির্দেশ পাওয়া মাত্র ছুটোছুটি করে আটজন পুলিশ ও একজন এ. এস. আই. যার যার রাইফেল মাটিতে ফেলে উপরে হাত তুলে দাঁড়াল। কারো পায়ে জুতা একটা আছে তো, আরেকটা নেই। কারও পা একেবারে খালি। কেউ লুঙি পরা, আবার কারও গায়ে গেঞ্জি। মুক্তিযোদ্ধারা তড়িৎ বেগে তাদের ঘিরে ফেলল। গোহাইল বাড়ীর কাশেমকে থানা আক্রমণ সফল হওয়ার সংকেত
পৃষ্ঠা নং ~ ১৯৬

দিতে বললাম। কাশেম বেরি-লাইট থেকে একটি সবুজ আলোর গুলি ছুড়লো। গুলি ছোঁড়ার সাথে সাথে গোপালপুর শহর সবুজ আলোতে আলোকিত হয়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই সবুজ আলো বিজয়ের সংকেত।
যুদ্ধক্ষেত্রে নানা রঙের আলোর কার্টিজ ব্যবহার করা হয়। সাদা, লাল, হলুদ, সবুজ ও গোলাপী নানা ধরনের আলো সময় সময় নানা অর্থ বহন করে। কোন সময় হয়ত লাল আক্রমণের সংকেত বহন করে, আবার লালই হয়তো কোন সময় পশ্চাদপসরণ সংকেত বলে বিবেচিত হয়। বিদ্যুৎ চমকানোর মতো এই আলো ত্রিশ সেকেন্ড স্থায়ী হয়।
সফলতার সংকেত পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে এলো। গ্রেফতার হলো সি. আই. মমতাজ আলী, যে মমতাজ আলী বইলানপুরে পুলিশদের অভিযানে নেতৃত্ব দিতে গিয়েছিল। ধুরন্ধর ও ঘুষখোর মমতাজ আলী যে গোপালপুর থানায় আছে এ সংবাদ আমরা আগেই সংগ্রহ করেছিলাম। সি. আই. মমতাজ আলীর ধরা পড়াটা বেশ অভিনব, রীতিমতো চমকপ্রদ ঘটনা। গোপালপুর থানা ঘেরাও করে প্রথম গুলি ছোঁড়ার সাথে সাথে চতুর ও ধুরন্ধর মমতাজ আলী বুঝে ফেলে মুক্তিবাহিনী এসে গেছে। অতএব ধরা পড়লে উপায় নেই। সে তার ঘর থেকে ছুটে সোজা পায়খানায় গিয়ে পালায়। আত্মসমর্পণকারী পুলিশদের মমতাজ আলী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানায়, ‘সে পালিয়েছে।’ অনেক খোঁজাখুঁজি করা হলো কিন্তু মমতাজ আলীকে পাওয়া গেল না।
খোঁজাখুজি করে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসবে, এমন সময় গোহাইল বাড়ির ষোল-সতের বছরের আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলল, “বিপদ দেখলে আমাগোর অনেকেই পায়খানায় গিয়া পলায়। পায়খানাটা দেইখ্যা যাই না ক্যান?” এই বলেই তারা কয়েকজন এগিয়ে যায়। পায়খানার দরজা ধরে টান মেরে দেখা গেল, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেক টানাটানি হলো। অথচ কোন উত্তর নেই। ভেতরে মানুষ কি ভূত, তা জানা গেল না। ফলে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো। মুক্তিযোদ্ধারা তর্জন গর্জন ছেড়ে পায়খানার দরজায় কয়েকটা লাথি মারল। তবুও কোন সাড়াশব্দ নেই। দলীয় নেতা শানবান্ধার মকবুল হোসেন খোকা আবু হেনা মোস্তফা কামালকে সরে আসতে বলল। খোকা চিৎকার করে বলল, “অত টানাটানি করার দরকার নেই। আমরা গুলি চালাচ্ছি। যে বেটা ভেতরে আছে বের হলে হবে, না হলে ওখানেই ভর্তা হয়ে যাবে।”
সাথে সাথে উলঙ্গ মমতাজ আলী সুড় সুড় করে পায়খানা থেকে বেরিয়ে এলো। এই লোকটা যে সত্যিকার অর্থেই বেশরম-বেহায়া তার ভুরি ভুরি নজির আছে। বইলানপুর থেকে পালাবার সময় সে সবকিছু ফেলে শুধু একটি জাইঙ্গা পরে সাগরদীঘি হয়ে ত্রিশাল পর্যন্ত দৌড়ে পালিয়েছিল। আজও সে উলঙ্গ অবস্থায় পায়খানা থেকে বেরিয়ে এসেছে।
গোপালপুর থানায় খুব অল্প অস্ত্র পাওয়া গেল। এর আগে বাশাইল থানা থেকে প্রচুর অস্ত্র গোলা-বারুদ দখল করেছি। গোপালপুর থানায় ছ’টি রাইফেল ও দু’হাজার গুলি ছাড়া আর
পৃষ্ঠা নং ~ ১৯৭

কিছুই পাওয়া গেল না। যখন এ. এস. আই-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘এত কম অস্ত্র কেন?’ সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “স্যার, পরশু রাতে আরেকটি মুক্তিবাহিনীর দল এসে থানা আক্রমণ করে ও. সি. মানিক সিকদারকে এবং কুড়িখানা অস্ত্রসহ কয়েক হাজার গুলি নিয়ে গেছেন। তাঁরাও আপনার কথা বলেছেন। পরে মিলিটারিরা এই সামান্য অস্ত্র দিয়ে গেছে।”
উল্লেখ্য, দু’দিন আগে ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল থানা আক্রমণ করে অস্ত্র ও গালাবারুদ নিয়ে চলে যায়। ঘাটাইল থানার পুলিশদের যেমন ছেড়ে দেওয়া হয়, ঠিক তেমনি গোপালপুর থানার পুলিশদেরও ফজলু অব্যাহতি দিয়েছিল। তবে দ্বিতীয়বার ধরা পড়লে যে রক্ষা নেই—এ সতর্কবাণীও উচ্চারণ করে গিয়েছিল। গোপালপুর থানা দখল করে ফজলুর দল মমতাজ আলীকে পাকড়াও করার চেষ্টা করেছিল তবে সেদিন সে গোপালপুরে ছিল না। তাই দৈবাৎ রক্ষা পেয়ে যায়।
আজ যারা ধরা পড়েছে, দু’দিন আগে তাদের কেউ এ থানায় ছিল না। তাই আটজন পুলিশকে ছেড়ে দিয়ে বলা হলো, আর একবার ধরা পড়লে ক্ষমা করা হবে না। হয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করুন, নয়তো পাকিস্তানীদের দল ত্যাগ করে ঘরে বসে থাকুন। এর অন্যথা হবার উপায় নেই।
ফজলুর রহমান থানা ঘর অক্ষত রেখে গেলেও আমরা তা অক্ষত রাখলাম না। সহযোদ্ধাদের বললাম, “এই ছারপোকার বাসা রেখে কাজ নেই। এটা জ্বালিয়ে দাও।” সাথে সাথে থানা ঘরটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হলো।
গোপালপুর থানা শহর থেকে মাইল খানেক দক্ষিণে সুতি গোপালপুর থানা উন্নয়ন কেন্দ্র। সেখানে হাজার তিনেক মানুষের সামনে বক্তৃতা করলাম। বক্তৃতার সময় লক্ষ্য করলাম, থানা উন্নয়ন কেন্দ্রের বারান্দায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাহারায় একটি লোক বসে আছে। লোকটিকে চেনা চেনা বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু অনেক দূরে থাকায় চিনে উঠতে পারছিলাম না।
সভাশেষে একজন মুক্তিযোদ্ধা এসে জানালো, “আমরা ভূয়াপুরের একজন মারাত্মক দালালকে ধরেছি। সে বলছে ‘কাদের সিদ্দিকী আমাকে চেনেন। লোকটির নাম দুদু মিয়া।’ কুড়ি পঁচিশ দিন আগে এই দুদু মিয়া আমাকে দেখে যেমন ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলেন, এবারও ঠিক তেমনি অবস্থা। দুদু মিয়ার হাতের বাঁধন খুলে দিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দিয়ে তাকে বললাম, “আপনি বাড়ী চলে যান। ওখানেই আপনার সাথে আমার দেখা হবে।” দুদু মিয়া চলে যাবার পর, মুক্তিযোদ্ধা নেতা বলল, “স্যার! একে ছেড়ে দিলেন! থানা দখল করে যখন আমরা এদিকে আসছিলাম, তখন পাঁচ-ছয় জন লোক আমাদেরকে জানিয়েছিল, এই দুদু মিয়া ভূয়াপুর, গোপালপুর এলাকায় হানাদার বাহিনীর অন্যতম সহায়।” সহযোদ্ধার কথা শুনে একটু হেসে বললাম, “আমি দুদু মিয়াকে ছেড়ে দিইনি, বাঁধন খুলে দিয়েছি মাত্র। কেন খুলে দিয়েছি, তা দু’দিন পরেই দেখতে পাবে।”
আমরা দ্রুত ভূয়াপুরের দিকে এগিয়ে চলেছি। আমি একটু পিছনে। আমরা পিছনে পনের জনের পশ্চাৎ রক্ষাকারী দল। সামনে ধৃত মমতাজ আলীর সাথে চারজনসহ আরও পনের জন।
পৃষ্ঠা নং ~ ১৯৮

গোপালপুর-ভূয়াপুরের মধ্যবর্তী নন্দনপুর মির্জাপুরে এলে আমাদের সামান্য সময়ের জন্য থামতে হলো। সামনে ছোট্ট একটি খাল। খালে গভীর পানি এবং তাতে ছোট্ট একটি নৌকা। চারজনের বেশি একত্রে উঠা যায় না। তাই সামনের দিক থেকে আস্তে আস্তে মুক্তিযোদ্ধারা খালটি অতিক্রম করেছে। সামনের সকলে খালের ওপারে গেলে তারপর আমি পার হব, সবশেষে পিছনের দল।
প্রথমবার চার জন ও দ্বিতীয়বার তিন জন মুক্তিযোদ্ধাসহ মমতাজ আলীকে পার করার পর তৃতীয় দলের চার জনকে নিয়ে যখন ডিঙি নৌকাটি খালের অপর পারে যাচ্ছে, ঠিক তখন অবিরাম গুলির আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। প্রায় দশ মিনিট চার পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে গুলি চলার পর আওয়াজ থেমে গেল। আমরা খুবই সতর্ক হয়ে গেলাম। প্রথম অবস্থায় বুঝে উঠতে পারিনি, আসলে ঠিক কী ঘটেছে। এ পথে শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হবার তেমন সম্ভাবনা ছিল না। আর রওনা হবার আগে স্বেচ্ছাসেবকদের দু’তিনটি দলকে পাঠিয়েছিলাম। তারা প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর এসে সামনের রাস্তার সঠিক খবরা-খবর সরবরাহ করছিল। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় আশ-পাশের গ্রামগুলোর সংবাদও আমরা রাখছিলাম।
গুলি শুরু হবার মিনিট দুই আগে জনৈক স্বেচ্ছাসেবক পথ নিরাপদ বলে রিপোর্ট করেছিল। এমন অবস্থায় হঠাৎ গুলির আওয়াজ। ফলে একটু বিভ্রান্তি দেখা দেয়। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত চার জনকে সামনের খবর সংগ্রহের জন্য পাঠানো হলো। মিনিট খানেকের মধ্যে খবর এলো গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে হয়েছে। আর ধৃত মমতাজ আলীর পলায়ন-প্রচেষ্টার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এ গুলি ছোঁড়া।
আগেই উল্লেখ করেছি, খালে একটি ডিঙি নৌকা থাকায় এবং তাতে লোকজন কম ধরায় মুক্তিযোদ্ধাদের পার হতে দেরি হচ্ছিল। গ্রেফতারকৃত মমতাজ আলীকে সাথে করে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা খাল পার হয়ে পথ চলছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যার স্বল্পতা দেখে মমতাজ আলীর মধ্যে পালানোর বাসনা জাগে। যে মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ আলীর হাতে ও কোমরের দড়ি ধরে চলেছিল, সুযোগ বুঝে ও মুক্তিযোদ্ধাটিকে দুর্বল মনে করে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে আসামি মমতাজ আলী রাস্তার পাশের মাথা সমান উঁচু পাটক্ষেতের ভিতর লুকিয়ে পড়ে। সাতজন মুক্তিযোদ্ধা যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি পাটক্ষেত ঘিরে ফেলে।
মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে পাটক্ষেতটি ঘিরে ফেললে ক্ষেতের ভেতর চলার শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। মমতাজ আলীর নাম ধরে তারা ডাকাডাকি শুরু করে। অথচ সে কোন সাড়া শব্দ দেয় না। পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা পাট ক্ষেতটির এপাশ-ওপাশ বারবার তল্লাসী চালায়। এতে পাট ক্ষেতটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। তবুও মমতাজ আলীর কোন পাত্তা নেই। তাকে খুঁজে বের করার আর কোন উপায় নেই দেখে আর. ও. সাহেবের নির্দেশে মুক্তিসেনারা ক্ষেত লক্ষ্য করে প্রায় চার পাঁচশ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। তারপর উকুন খোঁজার মতো তন্ন তন্ন করে তল্লাসি চালিয়ে মমতাজ আলীকে পাওয়া যায়। প্রায় কুড়ি-পঁচিশটি গুলির আঘাতে তার সমস্ত শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। মমতাজ আলীকে এখানেই কবরস্থ করে পাশের এক গ্রামে রাত কাটানো হল।
পৃষ্ঠা নং ~১৯৯

দলীয় শৃঙ্খলা বিধান

১৯শে জুন, আমরা পাঁচটিকরীতে উপস্থিত হলাম। এই পাঁচটিকরীতে মিরপুরের আনিস নামের এক ওয়ারলেস-অপারেটরের সাথে দেখা হলো। ভূয়াপুর ওয়ারলেস স্টেশনটি এই আনিসই পরিচালনা করছিল। মুক্তিযোদ্ধারা অন্যান্য সরঞ্জামসহ বেতার যন্ত্রটি ভূয়াপুর থেকে পাঁচটিকরীতে নিয়ে এসেছে। যোগাযোগের জন্যে পূর্বে এই ধরনের আরো চারখানা ওয়ারলেস সংগ্রহ করা হয়েছিল। তবে পাবলিক ওয়ারলেসগুলো চালনার তখন অবধি কোন অভিজ্ঞ লোক সংগ্রহ করতে পারেনি। আনিসের সাথে কথাবার্তা বলে মনে মনে স্থির করে ফেললাম, একে দিয়েই আপাতত যন্ত্রগুলো চালনার ব্যবস্থা নেব অথবা যন্ত্রগুলোর ব্যবহার শিখে নেব।
২০শে জুন ভূয়াপুরে এলাম। এখানে পর পর অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল। ভূয়াপুরে পৌঁছেই কলেজের সামনে এক সমবেত জনতার কাছে গেলাম। উদ্দেশ্য, একটি বক্তৃতা দেয়া। বক্তৃতা করার সময় গোপালপুরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পেলাম। এখানেও সেই দুদু মিয়া। সেই হাতবাঁধা অবস্থা।
বক্তৃতা শেষে ভূয়াপুরে সরকারি ডাক বাংলোতে গেলে হাতবাঁধা দুদু মিয়াকে আমার সামনে আনা হলো। এবারেও সেই পূর্বের অভিযোগ। লোকমান কোম্পানী কর্তৃক ধৃত দুদু মিয়াকে আমার সামনে আনা হলে পূর্বের মতো এবারও তার হাতের বাঁধন খুলে দিতে নির্দেশ দিলাম। তাঁকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
– কী ব্যাপার দুদু ভাই?
– আমারও তো একই প্রশ্ন।
– আমি কিন্তু বুঝতে পেরেছি।
– আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না ভাই!
দুদু মিয়াকে গ্রেফতারের ব্যাপারটা আমার বুঝতে বাকি থাকে না। মুক্তিবাহিনীর যে সব গ্রুপ ভূয়াপুরে এসেছে, তাদের অনেকেই স্থানীয় নয়। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে হোক গোপালপুর ও ভূয়াপুর এ দু’স্থানেই দুদু মিয়ার বিরোধীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। তাই স্বাভাবিক কারণেই দুদু মিয়া ‘খুব খারাপ লোক’ বলে তারা জানান। আর সে সময় খারাপ লোক ঠিক করার জন্যে মুক্তিবাহিনী উঠে পড়ে লেগেছিল। অবশ্য গ্রাম পর্যায়ে, দলাদলির অভাব ছিল না। কে কার বিরুদ্ধে বলবে, কে কার উপর কিভাবে প্রতিশোধ নেবে, এসব ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধারা পরে বুঝে নিয়েছিল। তাই এরপর থেকে কোন পক্ষের কথা শুনে কাউকে ধরে আনা বা বেত মারা তো দূরের কথা, খোঁজ-খবর পর্যন্ত করতে যায়নি। এ যাত্রায় দুদু মিয়া মুক্তি পেয়ে যাওয়ার পর তাঁকে আর গ্রেফতার বরণ করতে হয়নি। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক দু’বার বন্দী ও দড়ি দিয়ে বাঁধার পরও দুদু মিয়া কোন দুঃখ, অভিমান বা অপমানবোধ করেন নি।

পৃষ্ঠা নং ~২০০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!