বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৩শে নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৭৩, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
বুনো ওলের জন্যে চাই বাঘা তেঁতুল
গ্রাম বাংলায় একটা চালু প্রবাদ রয়েছে, ‘ঠেলা-ঠুলির ঘর খোদায় রক্ষা কর।’ অর্থাৎ কেতাবী ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ভাগের মা নাকি গঙ্গা পায় না। গতকাল স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় চট্টগ্রাম বন্দরে মাল খালাস সম্পর্কিত যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাতে ঔ ঠেলা-ঠুলির ব্যাপার স্যাপারই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সংবাদে প্রকাশ, চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে স্তূপীকৃত আমদানী পণ্য দশদিনের মধ্যে খালাস করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে নির্দেশে দিয়েছিলেন তদানুযায়ী কিছু কিছু মাল খালাস হয়েছে বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে গত ১২ই নভেম্বর বিভিন্ন ব্যাংকের প্রতিনিধি এবং ক্লিয়ারিং এজেন্টদের সাথে পোর্ট কর্তৃপক্ষের বৈঠক হয়। এতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক ব্যাংকারগণকে অনতিবিলম্বে আমদানীকারকদের নাম ঠিকানা এবং তাদের আমদানী পণ্যাদির বিবরণ সহ পোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একটি রিপোর্ট দাখিলের অনুরোধ করা হয়েছিলো। কিন্তু ব্যাংকারগণ আজ পর্যন্ত সে রিপোর্ট প্রদান করেননি বলে জানা গেছে। ফলে মাল খালাসের কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলা যেতে পারে। অন্যদিকে গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো রেল কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ওয়াগন সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ওয়াগনের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে অনেকেই মাসের পর মাস বসে আছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। অন্যদিকে আবার ব্যাংক মূল আমদানী লাইসেন্স ছাড়া শুধুমাত্র এক্সচেঞ্জ কন্ট্রোলের কপি দিয়ে কাষ্টমস-এর সাথে কাগজপত্রাদি খালাস করতে পারছে না। কাষ্টমস ও আমদানীকারকদেরকে ভীষণ হয়রানি করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখিত সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যা হয়েছে তা হলো প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ সত্ত্বেও যেখানকার মাল সেখানেই রয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, গতকালই ছিলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার দিন।
চট্টগ্রাম বন্দরের মাল খালাস নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। কাজ কিছুই হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন তাতেও অবস্থা তথৈবচ। কাজেই বোঝা যাচ্ছে আসল ব্যাপার কোথায় তার সন্ধান করতে না পারলে নির্দেশ, অনুরোধ বা আদেশেও কোনো কাজ হবে না। তার আগে সবচেয়ে যা প্রয়োজন তা হলো ঠেলা-ঠুলির ব্যাপারটা বন্ধ করা। ব্যাংক, কাষ্টমস, রেল কর্তৃপক্ষ একের সঙ্গে অন্যের কাজের কোনো যোগাযোগ না থাকলে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না কারণ রোগটা জটিল। তাই জটিল সমস্যার সমাধান করতে হলে বুনো ওলের জন্যো বাঘা তেঁতুলই আজ সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
অভিযোগটি মারাত্মক
গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে কোথায় কী ঘটনা ঘটছে, সুদূর রাজধানীতে বসে সব খবর আমরা সঠিকভাবে পাইনা। কিন্তু তবুও হাজার খবরের ভীড়ে এমন কিছু খবর আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়, যাকে কোনোক্রমেই উপেক্ষা করা যায় না। নোয়াখালী জেলার লক্ষ্মীপুর থানাধীন দক্ষিণাঞ্চলের চর এলাকা থেকে একটি খবর এসেছে। খবরে বলা হয়েছে যে, ঐ এলাকার গরীব চাষীদের উপর জোতদাররা পুলিশের সাহায্যে নিদারুণ অত্যাচার চালাচ্ছে। পুলিশ জোতদারদের কাছ থেকে নগদ নারায়ণ নিয়ে গরীব চাষীদের ধান লুন্ঠন করে জোতদারদের গোলা ভরে দিচ্ছে। পুলিশ শুধু দান লুন্ঠন নয়, চাষীদের হাঁস-মুরগী জোর করে নিজেদের জন্যে নিয়ে যাচ্ছে। এই সীমাহীন অত্যাচারের মধ্যে গ্রামের কৃষকরা আজ অসহায় পুতুলের মতো সব অত্যাচার, সব গ্লানি মাথা পেতে মেনে নিচ্ছে। কিন্তু গরীবের উপর এহেন অত্যাচার আর কত দিন? তাই চরাঞ্চলের চাষীরা খবরের কাগজে পত্র পাঠিয়ে এই অনাচার অবসানের প্রতিকার চেয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের চর এলাকার চাষীদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত অভিযোগটি খুবই মারাত্মক। জোতদাররা সব সময়ই অত্যাচারীর ভূমিকা পালন করে থাকে। তাদের অত্যাচার অভিযানের দোসর হিসেবে পুলিশবাহিনীও যদি অবলীলাক্রমে যোগদান করে, তাহলে আর দুঃখ ঢাকবার জায়গা থাকে না আমাদের। আমরা জানি, পুলিশ বাহিনী শান্তি রক্ষার কাজে নিয়োজিত। কিন্তু এর পরিবর্তে যদি পুলিশ বাহিনী অশান্তির কারণ হয়ে দেখা দেয়, তাহলে তা দেখে প্রশাসন যন্ত্রের টনক নড়া উচিত। দক্ষিণাঞ্চলের চর এলাকায় পুলিশ যে নীতি বিগর্হিত অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে ঘটনাটি সত্যি কি মিথ্যে তা তলিয়ে দেখার জন্যে আমরা সরকারের কাছে দাবী জানাচ্ছি। ঘুষ কিংবা উৎকোচ গ্রহণ পুলিশের জন্যে একটি গুরুতর অপরাধ। অথচ পুলিশ নাকি লক্ষ্মীপুর থানাধীন চর এলাকার চাষীদের ধান লুন্ঠন করতে গিয়ে জোতদারদের কাছ থেকে নগদ প্রাপ্তিটা হাত পেতে নিতেও কিছুমাত্র দ্বিধা কিংবা কার্পণ্য করেনি। এ ধরনের মারাত্মক অভিযোগ যদি পুলিশের বিরুদ্ধে সঞ্চিত হতে থাকে, তাহলে সরকারের প্রতি দেশবাসীর মনে একটা আস্থাহীনতার প্রশ্ন দেখা দিতে পারে বলে আমরা অনুমান করছি। কাজেই পুলিশবাহিনী যাতে উৎকোচ গ্রহণ করে কোনো অঘটন না ঘটাতে পারে, সেদিকে জনগণের সরকারকে সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকারী পুলিশ যদি জনগণের সুখ-সুবিধা সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনজীবনে দেখা দেয় হতাশার কালো মেঘ। সেজন্যেই গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যেন শান্তি বিরাজিত থাকে, সেদিকে সরকারের সজাগ দৃষ্টি থাকা একান্ত দরকার বলে আমরা মনে করি। গ্রামের জোতদাররা যাতে গরীব চাষীদের উপর অত্যাচার না চালাতে পারে, সেজন্যে পুলিশের ভূমিকা চাষীদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে নিয়োজিত থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু পুলিশ সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্নতর ভূমিকা পালন করে চাষীদের পথের ভিখেরীতে পরিণত করেছে। যে দেশ সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে সেদেশের পুলিশের এ ধরনের কান্ডজ্ঞানহীন অপকর্মের একটা সমীচীন ব্যবস্থা না হলে ভবিষ্যতে জল আরো ঘোলা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। কাজেই ঘটনার তদন্ত করে সরকার যেন একটা কিছু বিহিতের ব্যবস্থা করেন, এটাই আমাদের কাম্য।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক