কাশিমপুর গণহত্যা হাজিগঞ্জ, চাঁদপুর
৪ মে, ২০১০। ১৯৭১ সালের এই দিনে বর্তমান হাজিগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কাশিমপুরে এক নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত করেছিল পাকিস্তান বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার বাহিনী। হাজিগঞ্জের কুখ্যাত বাচ্চু রাজাকার পাকিস্তানী বাহিকে পথ চিনিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত এই গ্রামে নিয়ে আসে নারকীয় হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী সকল অপকর্ম সংঘটিত করেছিল।
হাজিগঞ্জ থেকে কাশিমপুরের দূরত্ব প্রায় ৪ মাইল। হাজিগঞ্জের দক্ষিণে এই গ্রামটি অবস্থিত। ১৯৭১ সালে এই গ্রামে এই সময়ে হাঁটা ছাড়া যাওয়ার কোন উপায় ছিল না। পাকিস্তানী বাহিনী এবং রাজাকার বাহিনী হেঁটেই হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম কাশিমপুরের উত্তর অঞ্চলের বাড়িগুলো দিয়ে প্রবেশ করে। তখন সকাল ১০টা, কেউবা মাঠে খামারে কাজ করছিলেন, কেউবা বাড়িঘরে যে যার মতো গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত ছিলেন। বুঝে ওঠার আগেই অনেক বাড়িতে পাকিস্তানী সৈন্য এবং রাজাকাররা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ে। যাকে যেখানে দেখে গেছে, পাওয়া গেছে তাকেই পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। প্রথমেই তারা ঢুকল কানুমাস্টারের বাড়ি। কৃষক কালিমোহন দেবনাথকে পথে পেয়ে তাকে গুলি করে। ১০ ঘণ্টা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন তিনি। পাশের বৈষ্ণববাড়ির অনিল তাঁর বৃদ্ধ অন্ধ মাকে কোলে নিয়ে বাগানে পালাতে চেষ্টা করলেন। বাঁচতে পারলেন না দু’জনই। গোটা বাড়িটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হলো। রায়বাড়ির লোকজনের অবস্থা কিছুটা ভাল ছিল। এই বাড়ির অনেকেই পালাতেপারলেও বৃদ্ধা সন্দুর বালা পারেননি, তার দেহকে বেয়নেট দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হলো। আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো বসতঘর, রান্নাঘর, গোয়ালঘর, পূজোঘরসহ সর্বত্র। কাশিমপুরের গণহত্যায় যে বাড়িটি সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো তা হলো যুগীবাড়ি। এই বাড়ির নকুলেশ্বর দেবনাথ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এমন অভিযোগের খবরেই হানাদার এবং রাজাকার বাহিনী বাড়িটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। নকুলের বড় ভাই ললিত মোহনকে হত্যা করে ঘাতকরা, এরপর নকুলের ঘরে প্রবেশ করে। তার বৃদ্ধা মা সুখদা দেবী ১৪ বছরের নাতনি পারুলকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। জোরাজুরি করেও যখন বিচ্ছেদ ঘটানো গেল না, তখন প্ৰথমে হত্যা তার পর আগুন দিয়ে ঘর ও লাশ দুটো পুড়িয়ে দেয়া হলো। ললিতের স্ত্রী চারুবালা এবং তার ১০ বছরের শিশু বিজয়কে বেয়নেটের খোঁচায় াড়িভুড়ি বের করে দেয়া হলো। ললিতের পরিবারের কেউ বাঁচতে পারেনি। ললিতের বড় ভাইয়ের স্ত্রী ইন্দু রানীর নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায় পাকিস্তানীদের গুলিতে, শেষ জলটুকু খাওয়ার জন্য চিৎকার করেও তা পেলেন না ইন্দুরানী। এই বাড়ির অপর বধূ শ্রীমতি দেবী তার বড় ছেলে সুবাস দেবনাথকে ধানের গোলায় লুকিয়ে রেখে এক মাসের শিশু জয়দেবকে নিয়ে পালাতে চেষ্টা করেও পারলেন না। ঘাতকরা শ্রীমতি দেবী উঠানে গুলি করলে কোলের শিশুটি মাটিতে পড়ে যায়। শ্রীমতি দেবী অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। একইভাবে হাতে বুলেটের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে ছিলেন যুগীবাড়ির বেণুবালা। ২০০৮ সালে তিনি মারা যান। যুগীবাড়িতে মোট ৯ জন নিহত হলেন, তাদের সৎকারের ব্যবস্থা করা যায়নি। এক িগর্তে পুঁতে রাখা হয় ললিত, সুখদা, চারুবালা, পারুল, বিজয় ইন্দ্রবাণী, বিলাসী, চারুবালাকে (২) শ্রীমতিকে কবর দিরেন তাঁর বেঁচে যাওয়ার ছেলে সুবাস। বাকি রয়ে গেছে সূত্রধর বাড়ির কথা। পাশে সৈয়দ আলী সরদারের বাড়ি সূত্রবাড়ির বিমলা আর সরদার বাড়ির সৈয়দ আলীর পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সৈয়দ আলীর স্ত্রী আমেনাকে সূত্রবাড়ির বিমলা মা বলে ডাকত। পাকিস্তানী বাহিনী আসছে শুনে বিমা শিশুপুত্রকে নিয়ে আমেনা মায়ের কাছে ছুটে যায়। ততক্ষণে জল্লাদ বাহিনী সেই বাড়িতেও হাজির। আমেনা ও বিমলা একই সঙ্গে গুলিতে শহীদ হন।
বড় যুগীবাড়ির পর ঘাতকরা প্রবেশ করে নবচন্দ্রের বাড়ি। তার দুই মেয়ে চারুবালা ও লক্ষ্মী বালাকে বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই নিয়ে একপ্রকার চলছিলেন মৃত নবচন্দ্রের স্ত্রী চন্দনী দেবী। পাক বাহিনী চন্দনী দেবী, মেয়ে লক্ষ্মী রাণী, লক্ষ্মী রাণীর স্বামী মনোরঞ্জন এবং তাদের ১০ মাসের কন্যা শিশু নিয়তিকে উঠোনে গুলি করে হত্যা করে। চারুবালা পালিয়ে বাঁচতে পারলেও সারাজীবন পরিবারের মৃত্যুযন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। পাশের সরকার বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিল পাকিস্ত ানী ও রাজাকার বাহিনী, পালাতে পারলেন না পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধ অমিয় বালা। পণ্ডিত বাড়ির বিদ্যাদেবীর দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হলো। ছালাল বাড়িতে ৯টি পরিবার ছিল। এই বাড়ি লুট হয় আগুনে বসতঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। ঐ বাড়ির বিপীন দেবনাথ মাঠে ছিলেন। বাড়িতে কি হচ্ছে তা দেখতে দৌড়ে বাড়িতে আসতেই রাজাকার মমিনুল খন্দকারের সম্মুখে পড়ে যান। মমিনুলের নির্দেশেই পাকিস্তানী বাহিনী গুলি করলে বিপীন লুটিয়ে পড়েন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পাক বাহিনী এবং রাজাকাররা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে কাশিমপুর ত্যাগ করার পর আহতদের শহরের কোন হাসপাতালে নেয়া যায়নি। চিকিৎসা দেয়া যায়নি। স্থানীয় ওজা-কবিরাজের চিকিৎসায় যে ক’জন বাঁচলেন তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত