হাদল-কালিকাপুর গ্রাম গণহত্যা, গণকবর ও বধ্যভূমি, পাবনা
পাবনা জেলার উত্তর-পূর্বে ২৫ কি. মি. দূরের ফরিদপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম এই হাদল-কালিকাপুর। ৭০-এর দশক পর্যন্ত এই গ্রামটি হিন্দুপ্রধান ছিল। ২৫ মার্চের পরপরই পাক সেনাবাহিনী পাবনা শহরসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও লুটপাট করে। ফলে এ সময় পাবনা শহর ও বিভিন্ন জায়গা থেকে আনুমানিক ১০- ১২শর মতো লোক হাদল-কালিকাপুর গ্রামে এসে আত্মীয়-স্বজন কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেন। মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প ও আশ্রিত পরিবারগুলোর কাছে প্রচুর অর্থ ও স্বর্ণ অলংকার আছে—এ তথ্য পাকবাহিনীর কাছে পৌঁছালে তারা ২৪ মে, সোমবার রাতে ৩০০ সদস্যসহ পুরো গ্রামটি ঘিরে ফেলে। ভোরবেলা অপারেশন শুরু করে বেলা ১১টা পর্যন্ত হত্যা, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ হেন কাজ নেই যা তারা করেনি। সেনাদের নির্দেশে তাদের সহযোগীরা গ্রামের যুবতী হিন্দু মেয়েদের ধরে এনে সেনাপ্রধানের কাছে জড়ো করা, অলংকার ছিনিয়ে নেয় এবং কলেমা পড়ে মুসলমান হতে বলে এবং মুসলমানদের- যারা তাদের সহযোগী তাদের একাধিক নিকা করতে বলে। কিছু কিছু হিন্দু মহিলা ও পুরুষ প্রাণের ভয়ে মুসলমানও হন। শোনা যায় পাকবাহিনী এই গ্রাম থেকে কয়েক বস্তা স্বর্ণ, রৌপ্য, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সম্পদ লুট করে বস্তাবন্দি করে গ্রামের সাধারণ মানুষের দ্বারা মাথায় বহন করিয়ে ভাঙ্গুরা রেল স্টেশনে নিয়ে যায়। এ হত্যাযজ্ঞে নিহতের অধিকাংশই ছিল পাবনা শহর ও অন্যান্য এলাকার। নতুন জায়গাতে পথঘাট না চেনার ফলে তারা পালাবার পথ খুঁজে পাননি
পাক সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা অবরুদ্ধ গ্রামের যে স্থানগুলোকে বধ্যভূমিতে পরিণত করে তার মাধ্যমে বিশেষভাবে বলা যায় কালিকাপুর গ্রামের সাহাপাড়ার বধ্যভূমি। ৯ জ্যৈষ্ঠ সকাল বেলাতেই পাকসেনারা ১০-১৫ জন নিরীহ সাধারণ লোককে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরের দিন কালিকাপুরের লোকেরা তাদের কুমড়াগাড়া শ্মশানে (নদীর পাড়ে) নিয়ে একটি কবরে লাশগুলো সমাহিত করে এবং সেই সকালেই হাদল গ্রামের হিন্দুপাড়াতে হত্যাকাণ্ড শুরু করলে গ্রামটি নিমিষেই বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। এছাড়া গোয়াল গাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছিল সে স্থানটিতে অসহনীয় নির্যাতন করে অসংখ্য ব্যক্তিকেও হত্যা করেছিল।
হাদল-কালিকাপুর গ্রামের হত্যাযজ্ঞে নিহত পরিচিত ও অপরিচিত লাশগুলো গ্রামের বিভিন্ন স্থানে কবর দেয়া হয়। এখানে ৯টি গণকবরের কথা উল্লেখ করা যায়—
১. কালিকাপুর গ্রামের নিতাই মাস্টারের বাড়ির পশ্চিম পাশে নদীর ধারে ৪ জন শহীদকে একই কবরে সমাহিত করা হয়।
২. কালিকাপুর গ্রামে ‘বাইদার ভিটা’ নামে পরিচিত স্থানে একই কবরে সাত জনকে গোর দেয়া হয়।
৩. হাদল গ্রামের হারান চন্দ্র সাহার বাড়ির ওপরে সমাহিত করা হয় আরো তিনজন শহীদকে।
৪. কালিকাপুর গ্রামে প্রাশেন বাবুর বাগানবাড়িতে নদীর পাড়ে পাশাপাশি দশজনকে কবর দেয়া হয়।
৫. হাদল গ্রামের মধু সাহার বাড়িতে মধু সাহাসহ আরো দুজনকে সমাহিত করা হয়।
৬. কালিকাপুর গ্রামের ডা. বৈদ্যনাথ সাহার বাড়ির পশ্চিম পাশে পাশাপাশি পাঁচজনকে কবর দেয়া হয়।
৭. পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের মনশ্বর মৌজা অর্থাৎ চিকনাই নদীর দক্ষিণপাড় (কুমড়াগাড়া শ্মশানের দক্ষিণে) দুজন শহীদ হন এবং তাদের ঐ স্থানে সমাহিত করা হয়।
৮. কালিকাপুর গ্রামের গোয়াল গাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫০০ গজ পূর্ব দিকে খামাচিয়া ধরের পূর্ব ধারের বধ্যভূমিতে সমাহিত হয়েছে আটজন শহীদ।
৯. হাদল-ইউনিয়নের খেতাবাখা গ্রামের পূর্বে কুমড়াগাড়া শ্মশানের পূর্বপাশ সংলগ্ন চিকনাই নদীর উত্তর পাড়ে হাদল কালিকাপুর গ্রামের হত্যাকাণ্ডের শিকার অবশিষ্ট লাশগুলো ৯ ও ১০ জ্যৈষ্ঠ পাশাপাশি কবরে সমাহিত করা হয়। এটাই সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত।
হাদল-কালিকাপুর গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে অগণিত শহীদের অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর।
[৫৯২] হাসিনা আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত