You dont have javascript enabled! Please enable it!

হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন

স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডে ২৬২ জন প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীর জবানবন্দি প্রকাশিত হয়েছে, যাঁরা সাধারণভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক নির্যাতন ও গণহত্যার বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু শতকরা আশি ভাগই নির্দিষ্টভাবে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্যের নাম বলতে পারেননি। নাম বলতে না পারার একটি কারণ হচ্ছে শারীরিক নির্যাতন চালানোর সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈন্যরা তাদের নাম ও পদমর্যাদাসূচক ব্যাজ খুলে রাখত।
নতুনভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার বিবরণ সংগ্রহ করার সময় প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ব্যক্তির নাম ও পরিচয় জানার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যাতে এই যুদ্ধাপরাধীদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে অসুবিধে না হয়।
সমগ্র দেশব্যাপী একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নিবেদিতকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের মাধ্যমে সংগৃহীত প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী এমন অনেকের জবানবন্দি পাওয়া গেছে যাঁরা দায়ী ব্যক্তির নাম বলতে পারেননি। রিপোর্ট প্রকাশের জন্য জবানবন্দি বাছাই করা হয়েছে অভিযোগকারীদের সামাজিক অবস্থানের বৈচিত্র্য, অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম ও পদমর্যাদা, হত্যা ও নির্যাতনের বিচিত্র নিষ্ঠুর পদ্ধতি এবং প্রদত্ত বিবরণের সঠিকতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে।
বর্তমান প্রতিবেদনের জন্য গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি ছাড়াও সদ্য আবিষ্কৃত দুটি বধ্যভূমির ওপর প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়ে আমরা খুঁজে পেয়েছি দুইশ পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তার নাম, যাদের বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধের দায়ে ‘৭২ সালে বিচার করতে চেয়েছিল, কিন্তু বিভিন্ন কারণে পারেনি। এই তালিকা ইতিপূর্বে কোথাও প্রকাশিত হয়নি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা তিরিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। আড়াই লাখেরও বেশি অসহায় নারী তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত শত শত জনপদ তারা ধ্বংস করে দিয়েছিল। সহায় সম্বল হারিয়ে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ ও বর্বরতা সইতে না পেরে তখন এক কোটি মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। যারা দেশে ছিল তাদের অধিকাংশই নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পলাতকের জীবনযাপন করেছে।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে বাঙালির অপরাধ ছিল এই যে, তারা গণতন্ত্র চেয়েছিল, সকল প্রকার শোষণ-পীড়নমুক্ত একটি সমাজ চেয়েছিল। তারা এমন একটি রাষ্ট্র চেয়েছিল যেখানে ধর্মের নামে হানাহানি থাকবে না, নিজেদের কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে তারা মাথা উঁচু করে বাস করতে পারবে। বাঙালির এই আকাঙ্ক্ষা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত, কারণ পাকিস্তান এমন একটি সমরতান্ত্রিক মৌলবাদী রাষ্ট্র যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কোনো স্থান নেই।
‘৭১-এ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা স্মরণকালের বৃহত্তম গণহত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করেছে। তারা ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা’ ও ‘ইসলাম রক্ষা’র দোহাই দিয়েই গণহত্যা ও নারী নির্যাতনসহ যাবতীয় দুষ্কর্ম করেছে। এই হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে ‘৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে এবং শেষ হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের নিকট প্রায় বিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে।
‘৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঘুমন্ত, নিরস্ত্র মানুষদের ওপর। রাজধানী ঢাকায় প্রথমে তারা হামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসে এবং পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী ইপিআর-এর সদর দফতরে। এরপর তারা ধ্বংস করেছে ঢাকার বস্তি, বাজার এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাসমূহে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র- শিক্ষক-কর্মচারীদের ঘরে ঢুকে কিংবা ঘর থেকে বের করে এনে হত্যা করেছে তারা। বাজার ও বস্তিগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আগুনের ভয়ে হাজার হাজার মানুষ যখন ঘর থেকে দলে দলে বেরিয়ে এসেছে তখন ওদের ওপর মেশিনগানের গুলি বর্ষিত হয়েছে একটানা, যতক্ষণ না প্রতিটি মানুষ নিহত হয়। এসব মানুষ জানতেও পারেনি কেন তাদের হত্যা করা হচ্ছে কিংবা কারা হত্যা করছে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ২৫ মার্চে রাতের অন্ধকারে শুধু ঢাকায় পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার নিরীহ মানুষের জীবন অকারণে হাসতে হাসতে কেড়ে নিয়েছিল।
ঢাকার এই পদ্ধতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অনুসরণ করেছে দেশের প্রায় সকল শহরে। এই ধরনের ব্যাপক গণহত্যা চলেছিল নয় মাসজুড়ে। নির্বিচারে গণহত্যার পাশাপাশি শনাক্তকরণের মাধ্যমে হত্যার প্রক্রিয়াও আরম্ভ হয়েছিল ২৫ মার্চ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের হত্যার মাধ্যমে আরম্ভ হয়েছিল এই প্রক্রিয়া, যার চূড়ান্ত বহি:প্রকাশ ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় লাভের পূর্ববর্তী কয়েক সপ্তাহে। বিশেষ করে ডিসেম্বরের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানিরা পরাজয় অনিবার্য জেনে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের তালিকা প্রস্তুত করে হত্যা করেছিল।
নির্বিচার গণহত্যার ভেতর ক্ষেত্র বিশেষে অগ্রাধিকারেরও একটি বিষয় ছিল। পাকিস্তানিরা তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল- (১) আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের, (২) কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের, (৩) মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোগীদের, (৪) নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে হিন্দু সম্প্রদায়কে এবং (৫) ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের।
হত্যার কোনো নির্দিষ্ট ধরন ছিল না। পাকিস্তানিরা প্রথমে ট্যাঙ্ক ও মর্টারের গোলাবর্ষণ করে এবং মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করেছে এক একটি জনপদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে। বাড়ি থেকে ধরে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে গুলি করে বা বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়েছে। গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। জ্যান্ত কবর দেয়ার বহু ঘটনাও ঘটেছে। কখনো পশুর মতো জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। কখনও শারীরিক নির্যাতন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে হত্যা করা হয়েছে। শেষোক্ত পদ্ধতি তারা সাধারণত অনুসরণ করত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে। মুক্তিযোদ্ধাদের জিপের পেছনে বেঁধে প্রচণ্ড বেগে জিপ চালিয়ে সারা শহর টেনেহিঁচড়ে হত্যা করারও বহু প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছে।
আমাদের কাছে জবানবন্দি দিতে গিয়ে ক্যাপ্টেন সুজাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সন্দেহকারীদের গায়ে গ্রেনেড বেঁধে পিন খুলে তাদের পালাতে বলত পাকিস্তানিরা। হতভাগ্যরা দৌড়াতে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর গ্রেনেড বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। পাকিস্তানিরা এই দৃশ্য দেখে উল্লাস প্রকাশ করত।
মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালিদের হত্যার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্যাতনের এমন ভয়ঙ্কর সব পদ্ধতি অনুসরণ করত যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। যাঁরা এ নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁরা বলেছেন, ‘৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বর্বরতার চেয়ে ঢের বেশি ভয়ঙ্কর ছিল।
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে’র অষ্টম খণ্ডে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের বেশ কিছু বিবরণ নথিবদ্ধ করা হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানিতে। নির্যাতিত ব্যক্তিদের যে সকল জবানবন্দি আমরা ধারণ করেছি সেখানেও নির্যাতনের ভয়ঙ্কর সব বিবরণ রয়েছে।
নির্যাতনের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি পকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈন্যরা গ্রহণ করত তা হচ্ছে- (১) অশ্লীল ভাষায় গালাগালি, তৎসঙ্গে চামড়া কেটে রক্ত না বেরুনো পর্যন্ত শারীরিক প্রহার, (২) পায়ের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা, তৎসঙ্গে বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে প্রহার, (৩) উলঙ্গ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উন্মুক্ত স্থানে দাঁড় করিয়ে রাখা, (৪) সিগারেটের আগুন দিয়ে সারা শরীরে ছ্যাঁকা দেয়া, (৫) হাত ও পায়ের নখ ও মাথার ভেতর মোটা সুচ ঢুকিয়ে দেয়া, (৬) মলদ্বারের ভেতর সিগারেটের আগুনের ছ্যাঁকা দেয়া এবং বরফ খণ্ড ঢুকিয়ে দেয়া, গরম ডিম মলদ্বারে ঢুকানো (৭) চিমটে দিয়ে হাত ও পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, (৮) দড়িতে পা বেঁধে ঝুলিয়ে মাথা গরম পানিতে বার বার ডোবানো, (৯) হাত-পা বেঁধে বস্তায় পুরে উত্তপ্ত রোদে ফেলে রাখা, (১০) রক্তাক্ত ক্ষতে লবণ ও মরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয়া, (১১) নগ্ন ক্ষতবিক্ষত শরীর বরফের স্ল্যাবের ওপর ফেলে রাখা, (১২) মলদ্বারে লোহার রড ঢুকিয়ে বৈদ্যুতিক শট দেয়া, (১৩) পানি চাইলে মুখে প্রস্রাব করে দেয়া, (১৪) অন্ধকার ঘরে দিনের পর দিন চোখের ওপর চড়া আলোর বাল্ব জ্বেলে ঘুমোতে না দেয়া, (১৫) শরীরের স্পর্শকাতর অংশে বৈদ্যুতিক শক প্রয়োগ প্রভৃতি। এছাড়া যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রেও ভয়ঙ্কর নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যরা।
ঢাকা পৌরসভায় কয়েকজন সুইপারের জবানবন্দি থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংসতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা লাভ করা যেতে পারে। এই সুইপারদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল লাশ সরাবার জন্য। ‘৭১-এর ২৯ মার্চের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে ছোটন ডোম-এর পুত্র সরকারি পশু হাসপাতালের সুইপার পরদেশী বলেছেন-
“২৯ শে মার্চ সকালে আমি পৌরসভা অফিসে হাজির হলে আমাকে ট্রাক দিয়ে লাশ তোলার জন্য আরও কয়েকজন সুইপারের সাথে শাঁখারি বাজারে যেতে বলা হয়। জজ কোর্টের সম্মুখে আগুনের লেলিহান শিখা তখনও জ্বলছিল, আর পাক সেনারা টহলে মোতায়েন ছিল বলে আমরা ট্রাক নিয়ে সে পথ দিয়ে শাঁখারী বাজারে প্রবেশ করতে পারি নাই। পাটুয়াটুলি ঘুরে আমরা শাঁখারী বাজারের পশ্চিম দিকে প্রবেশ করে পাটুয়াটুলি ফাঁড়ি পার হয়ে আমাদের ট্রাক শাঁখারী বাজারের মধ্যে প্রবেশ করল। ট্রাক থেকে নেমে আমরা শাঁখারী বাজারের প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রবেশ করলাম-দেখলাম মানুষের লাশ, নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বালক বালিকা, কিশোর, শিশুর বীভৎস পচা লাশ। চারদিকে ইমারতসমূহ ভেঙে পড়ে আছে। মেয়েদের অধিকাংশ লাশ আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখলাম। দেখলাম তাদের বুক থেকে স্তন তুলে নেয়া হয়েছে। কারও কারও যোনিপথে লাঠি ঢুকানো আছে। বহু পোড়া, ভস্ম লাশ দেখেছি। পাঞ্জাবি সেনারা পাষণ্ডের মতো লাফাতে লাফাতে গুলিবর্ষণ করছিল। বিহারি জনতা শাঁখারী বাজারের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করে মূল্যবান আসবাবপত্র, সেনা-দানা লুন্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা অবিরাম গুলিবর্ষণের মুখে প্রাণের ভয়ে দুই ট্রাক লাশ তুলে সেদিন আর শাঁখারী বাজারের প্রবেশ করার সাহস পাই নাই। ৩০ মার্চ সকালে আমার দলকে মিলব্যারাক থেকে লাশ তুলতে বলা হয়। আমি মিলব্যারাক ঘাটে পৌরসভার ট্রাক নিয়ে গিয়ে দেখলাম নদীর ঘাটে অসংখ্য মানুষের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বহু লাশ রশি দিয়ে বাঁধা দেখলাম। প্রতিটি রশির বন্ধন খুলে প্রতি দলে দশজন পনের জনের লাশ বের করলাম। সব যুবক ছেলে ও স্বাস্থ্যবান বালকদের লাশ দেখলাম। প্রতিটি লাশের চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা, শক্ত করে পেছন দিক থেকে। প্রতিটি লাশের মুখমণ্ডল কালো দেখলাম, এসিডে জ্বলে বিকৃত ও বিকট হয়ে আছে। লাশের সামনে গিয়ে ওষুধের অসহ্য গন্ধ পেলাম। লাশের কোনো দলকে দেখলাম মেশিনগানের গুলিতে বুক ও পিঠ ঝাঁঝরা হয়ে আছে, অনেক লাশ দেখলাম বেটন ও বেয়নেটের আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে, কারও মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মগজ বের হয়ে আছে, কারও হৃৎপিণ্ড বের হয়ে আছে। নদীর পাড়ে ছয়জন রূপসী যুবতীর বীভৎস ক্ষতবিক্ষত উলঙ্গ লাশ দেখলাম। চোখ বাঁধা, হাত, পা শক্ত করে বাঁধা প্রতিটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা, মুখমণ্ডল, বক্ষ ও যোনিপথ রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ও বীভৎস দেখলাম। দুবারে দুই ট্রাকে আমি সত্তরটি লাশ উঠিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি।
এরপর আমাকে সদরঘাট, শ্যামবাজার, বাদামতলী ঘাট থেকে লাশ তুলতে বলা হয়। আমি উপরোক্ত এলাকার নদীর ঘাট থেকে পচা লাশ তুলে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। আমি যেদিন কালীবাড়ি লাশ তুলেছি সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পেছনে স্টাফ কোয়ার্টার, রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে জনৈক অধ্যাপকের বাসা থেকে আমি লাশ তুলেছি। রোকেয়া হলের পেছনের স্টাফ কোয়ার্টারের ভেতর থেকে আমি পুরুষ ও শিশুসমেত নয়টি লাশ তুলেছি। আর অধ্যাপকের বাসা থেকে সিঁড়ির সামনে লেপের ভেতর পেঁচানো জনৈক অধ্যাপকের লাশ আমি তুলে নিয়ে গেছি।
বর্বরতা কতটা চরম রূপ ধারণ করলে হত্যা করা যেতে পারে শিশুর মতো নিষ্পাপ, ঋষির মতো সরল এবং সংসার সম্পর্কে উদাসীন বৃদ্ধ দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেবকে-পাকিস্তানিরা তা প্রদর্শন করেছে একাত্তরে।
‘৭০-এর নির্বাচনে জয়ী পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের সদস্য আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা মশিহুর রহমানকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কী নৃশংস নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে তার বিবরণ ‘৭২-এর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-
“ভীষণ যন্ত্রণা দিয়ে পাকহানাদার বাহিনী তিলতিল করে তাঁকে সংহার করেছে। এই ঘৃণিত পশুর দল প্রথমে তাকে নীতিচ্যুত করার জন্য নানা ধরনের অত্যাচার চালায়। শরীরের নানা স্থানে আগুনে পোড়ানো, দেহকে বেত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে তাতে লবণ মাখানো থেকে আরম্ভ করে ইলেকট্রিক শক পর্যন্ত লাগানো হয়েছে। অত্যাচারে যখন তাঁর বলিষ্ঠ দেহটা ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল তখনও তাঁর মনের বলিষ্ঠতা একটুও কমেনি। সব সময় তিনি একই কথা বলেছেন, ‘আমি আমার জনগণের বিরুদ্ধে কিছু বলতে বা লিখতে পারব না।’
সত্যিই তিনি তা পারেননি। হানাদার বাহিনী যখন তাঁর বাম হাত কেটে ফেলে ডান হাতে লেখার জন্য হুকুম চালায় তখন যন্ত্রণায় শুধু কেঁপেছেন তিনি 1 কিন্তু তাঁর বলিষ্ঠ ঠোঁট দুটো একটুও কাঁপেনি। প্রতিদিনে একে একে হানাদার পশুরা যখন তাঁর দুই পা, দুই হাত কেটে বিকলাঙ্গ দেহের পরে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে তখনও একটু কেঁপে ওঠেনি তাঁর দৃঢ়ভাবে বন্ধ ঠোঁট দুটো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে ফিরে যখন এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর শুনেছেন তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।”
দখলদার বাহিনী কর্তৃক নারী নির্যাতন কোনো ব্যতিক্রম ঘটনা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনী, ইতালির ফ্যাসিস্ট বাহিনী কিংবা জাপানি সৈন্যদের নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বহু ঘটনা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে এবং চলচ্চিত্রেও রূপায়িত হয়েছে। কিন্তু একাত্তরের পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে যে নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে তার দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। আড়াই লাখেরও বেশি নারী এই সময় পাকিস্তানি হায়েনাদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বহু নারী আত্মহত্যা করেছেন। পাকিস্তানিরাও তাদের ধর্ষকামী প্রবৃত্তির কারণে বহু নারীকে ভয়ঙ্কর সব নির্যাতনের পর হত্যা করেছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, গণহত্যার বহু সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেলেও নারী নির্যাতনের বিবরণ সেভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। এ সমাজে একজন ধর্ষিত নারী এ বিষয়ে সাধারণভাবে বলতে চান না সংস্কার এবং সামাজিক ও পারিবারিক বৈরিতার কারণে।
মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ সরকার নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তিগতভাবেও এঁদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং এঁদের ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। সেই সময়ে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের দায়িত্বে নিযুক্ত সমাজকর্মী মালেকা খান বলেছেন, তখন কোনো তালিকা তৈরি করা হয়নি, কারণ তাঁরা চেয়েছিলেন এই সব নারীকে পৃথকভাবে চিহ্নিত না করে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ঢাকায় মালেকা খান পাঁচ হাজারের বেশি নির্যাতিতা নারীর জবানবন্দি নিজে পাঠ করেছেন। এসব কাগজপত্র বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ধ্বংস করে ফেলা হয়। মালেকা খান আমাদের আরও জানিয়েছেন, প্রথম পর্যায়ে যাদের গর্ভপাত করানো সম্ভব ছিল তাদের গর্ভপাত করানো হয়েছে।
মালেকা খান আমাদের সন্ধান দিয়েছেন বাহাত্তরে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা ডা. জিওফ্রে ডেভিসের। নির্যাতিতা নারীদের চিকিৎসা সেবাদানের জন্য সিডনির এই চিকিৎসক বাংলাদেশের সকল জনপদ পরিভ্রমণ করেছেন। তাঁর মতে, মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা নারীর সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। তাঁর সম্পর্কে ‘৭২-এর বাংলার বাণীতে তখন এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল।
“দখলদার আমলে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক ধর্ষিত বাংলাদেশের মহিলাদের একটা বিরাট অংশ বন্ধ্যাত্ব ও পৌনঃপুনিক রোগের সম্মুখীন হয়েছে বলে একজন অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক মত প্রকাশ করেছেন।
সিডনির শল্য চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস সম্প্রতি লন্ডনে বলেন যে, নয় মাসে পাক বাহিনীর দ্বারা ধর্ষিতা ৪ লাখ মহিলার বেশির ভাগই সিফিলিস অথবা গনোরিয়া কিংবা উভয় ধরনের রোগের শিকার হয়েছেন। এদের অধিকাংশ ইতিমধ্যেই ভ্রূণ হত্যাজনিত অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। তিনি বলেন, এরা বন্ধ্যা হয়ে যেতে পারেন কিংবা বাকি জীবনভর বারবার রোগে ভুগতে পারেন।
ড. ডেভিস বলেন, বাংলাদেশে কোনো সাহায্য এসে পৌছুবার আগেই পাকিস্তানি সৈন্যদের ধর্ষণের ফলে ২ লাখ অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ স্থানীয় গ্রামীণ ধাত্রী বা হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে গর্ভপাত ঘটিয়েছেন। তিনি বলেন, ক্লিনিক্যাল দিক থেকে গর্ভপাত কর্মসূচি সমাপ্ত হয়েছে, কিন্তু মহিলাদের কঠিন সমস্যা এখনো রয়ে গেছে।
ড. ডেভিস বলেন, আমরা বিরাজমান সমস্যা সম্পর্কে অবগত হবার আগেই অনিবার্য ও অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির চাপে ২ লাখ ধর্ষিতার মধ্যে দেড় লাখ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা মহিলা গর্ভপাত করেছেন।
ড. ডেভিসের মতে দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা খুবই গুরুতর। বেশ কিছু সংখ্যক তরুণী যৌনমিলনের উপযোগী না হওয়ায় সমস্যা বেশি জটিলত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগা মহিলারা যদি রোগের চিকিৎসা লাভে সক্ষমও হন তবুও তাদের বিয়ে করার মতো কোনো একজনকে খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর।
ধর্ষিতা মহিলারা যখন কমপক্ষে ১৮ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা তখন ড. ডেভিস ঢাকা এসে পৌঁছান।
ধর্ষিতাদের চিকিৎসার জন্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় একটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের হিসাব মতে ধর্ষিতা মহিলাদের আনুমানিক সংখ্যা ২ লাখ। ড. ডেভিসের মতে, এই সংখ্যা অনেক কম করে অনুমান করা হয়েছে। তিনি মনে করেন এই সংখ্যা ৪ লাখ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজারের মধ্যে হতে পারে। ড. ডেভিস বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই ২ লাখ।
অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের সাহায্যসংক্রান্ত কর্মসূচির শুরু হবার আগেই দেড় লাখ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার মহিলার গর্ভপাত করেছেন। অবশিষ্ট ৩০ হাজারের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন, কেউ কেউ তাদের শিশুদের নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।…
ধর্ষিতা মহিলাদের যে হিসাব সরকারিভাবে দেয়া হয়েছে ড. ডেভিসের মতে তা সঠিক নয়। সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশের জেলাওয়ারি হিসাব করেছেন। সারা দেশের ৪৮০টি থানা ২৭০ দিন পাকসেনাদের দখলে ছিল। প্রতিদিন গড়ে ২ জন করে নিখোঁজে মহিলার সংখ্যা অনুসারে লাঞ্ছিত মহিলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ। এই সংখ্যাকে চূড়ান্তভাবে নির্ভুল অঙ্ক রূপে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
কিন্তু হানাদার বাহিনী গ্রামে গ্রামে হানা দেবার সময় যেসব তরুণীকে ধর্ষণ করেছে তার হিসাবরক্ষণে সরকারি রেকর্ড ব্যর্থ হয়েছে। পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করার জন্যে হানাদার বাহিনী অনেক তরুণীকে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এসব রক্ষিত তরুণীর অন্তঃসত্ত্বার লক্ষণ কিংবা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে হয় তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছে, নয়তো হত্যা করা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকা ১২ ও ১৩ বছরের বালিকাদের শাড়ি খুলে নগ্ন করার পর ধর্ষণ করা হয়েছে। যাতে তারা পালিয়ে যেতে বা আত্মহত্যা করতে না পারে।
হতভাগা বন্দি নারীদের যখনই শাড়ি পরতে দেয়া হয়েছে তখনই তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উদ্বন্ধনে আত্মহত্যা করেছে। ড. ডেভিস বলেন, অনেকেই বুকে পাথর বেঁধে পুলের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। যারা প্রাণে বেঁচে গেছে তেমন ধরনের হাজার হাজার মহিলা তাদের পরিবার কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছেন। কারণ তাঁরা ধর্ষিতা, অন্তঃসত্ত্বা। বর্তমানে দেখতে ‘অপরিচ্ছন্ন’। এ ধরনের ঘটনা বড়ই মর্মান্তিক।
ড. ডেভিস বলেন, ‘চট্টগ্রামে আমি একজন মহিলাকে দেখেছি, তিনি বিধবা। যুদ্ধে তাঁর ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। তাঁর সন্তান দুটি এবং তিনি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গর্ভপাত ঘটানোর পর এই মহিলার থাকার মতো স্থান নেই। ছেলেমেয়েদের আহার জোগানোর কোনো সংস্থান নেই।
আরেকজন মহিলার স্বামী যখন যুদ্ধে-গেছেন তখন তাকে হানাদাররা ধর্ষণ করে। স্বামী এসে স্ত্রীকে দেখেন গর্ভবতী। তিনি স্ত্রী এবং দুটি সন্তানকে ফেলে চলে যান। এবং এ বলে যান যে, আর তিনি তাদের গ্রহণ করবেন না।
আরেকজন তরুণী বয়স ১৯। অশিক্ষিতা। সে ছিল ছয় মাসের গর্ভবতী। তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব তাকে ত্যাগ করে চলে যায়। সে স্বল্পকালের জন্য সাহায্য কেন্দ্রে আশ্রয় পেয়েছে। কিন্তু তারপর সে কোথায় যাবে কেউ জানে না।” বাহাত্তরে যেসব যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছে তাদের সম্পর্কেও তথ্য খুব কমই রয়েছে। অধিকাংশ শিশুকে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন পরিবার দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেছে।
সরকারি পুনর্বাসন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম। নির্যাতিত নারীদের কয়েকজনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নামে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থও তিনি লিখেছেন। তাঁর গ্রন্থে যাঁদের উল্লেখ রয়েছে তাঁরা মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের সন্তান, যাঁদের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আটক রাখা হয়েছিল বাঙ্কারে বা বন্দিশিবিরে। এঁদের একজন লিখেছেন-
না।
“…পরদিন হঠাৎ একটি মেয়ে মারা যায়। অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সকাল থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ওরা বন্ধ দরজায় অনেক চেঁচামেচি করল। কেউ এলো মেয়েটার নাম ছিল ময়না। বছর পনের বয়স হবে। কাটা পাঁঠার মতো হাত-পা ছুড়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল, মুখখানা নীল হয়ে গেল। বয়স্কা সুফিয়ার মা একটা ছোট কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল কারণ ঘরে ওরা চাদর দেয় না। সন্ধ্যার পরা ওরা লাশটা নিয়ে গেল।”
এ ধরনের বিবরণ রয়েছে নীলিমা ইব্রাহিমের গ্রন্থের সর্বত্র।
বীরাঙ্গনাদের তালিকা সম্পর্কে অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম বলেছেন, “স্বয়ং বঙ্গবন্ধু এই তালিকা ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কারণ তিনি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আমাদের সমাজ এঁদের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার মতো উদার নয়। বঙ্গবন্ধু আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন একাত্তরের নির্যাতিতা নারীরা যেন স্বাভাবিক পারিবরিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন।”
নীলিমা ইব্রাহিম আরও বলেছেন, ‘৭২ সালে যখন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিরা ভারতের উদ্দেশে বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছিল তখন তিনি খবর পান যে, প্রায় তিরিশ-চল্লিশজন ধর্ষিতা নারী তাদের সঙ্গে দেশত্যাগ করছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় এঁদের সঙ্গে দেখা করেন এবং বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু আপনজন কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁরা দেশ ত্যাগে অনড় ছিলেন। এঁদের ভেতর চোদ্দ-পনের বছরের এক কিশোরীও ছিল।” নীলিমা ইব্রাহিম এই কিশোরীকে বলেছিলেন, “তুমি আমার বাড়িতে থাকবে, আমার মেয়ের মতো।” তবু সে রাজি হয়নি। বলেছে, ‘আপনি যখন থাকবেন না তখন কী হবে? যখন লোকে জানবে পাকিস্তানিরা আমাকে স্পর্শ করেছে তখন সবাই আমাকে ঘৃণা করবে।” নীলিমা ইব্রাহিম বলেছেন, “তুমি কী জানো পাকিস্তানিরা তোমাকে নিয়ে কী করবে?” মেয়েটি জবাব দিয়েছে, “জানি, ওরা আমাকে নিয়ে বিক্রি করে দেবে। কিন্তু ওখানে কেউ আমাকে চিনবে না।”
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘৯২-এর ২৬ মার্চ যখন গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার হয়- কুষ্টিয়া থেকে তিনজন বীরাঙ্গনা ঢাকা এসেছিলেন সাক্ষ্য দিতে। তখন বিভিন্ন দৈনিকে তাঁদের কথা লেখা হয়। এঁরা তিনজন গ্রামে ফিরে নিজেদের আবিষ্কার করেন একরকম একঘরে অবস্থায়। লোকজন তাদের বিভিন্নভাবে বিদ্রূপ করেছে। তাঁদের জীবনে নেমে এসেছে আরেক বিড়ম্বনা। একাত্তরের নির্মম ক্ষত আবার তাঁদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ হয়েছে। তাঁরা যত দিন বেঁচে থাকবেন এ রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে না। তাঁদের একজন ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, বিচারের আশায় অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন। আজ অবধি তাঁরা বিচার পাননি অথচ প্রতিনিয়ত গঞ্জনার শিকার হচ্ছেন।
একাত্তরে আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সীমাহীন নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা যেমন প্রত্যক্ষ করেছি, পাশাপাশি দেখেছি ভারতীয় সেনাবাহিনীর মহত্ত্ব। পাকিস্তানি বন্দিশিবির থেকে বেরিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধা কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের গোলাগুলির আঘাতে আহত কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন হাসপাতালে করা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে যে সব যুদ্ধাহত ছিলেন তাদেরও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর মানবিক আচরণের একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে নীলিমা ইব্রাহিমের গ্রন্থ থেকে। বাঙ্কারে বন্দি নির্যাতিতা নারীরা ১৬ ডিসেম্বর যখন প্রথম ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান শুনলেন তখন তাঁরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন দেশ হানাদারমুক্ত হয়েছে, কিন্তু তাঁদের তখন বেরুবার উপায় নেই। কারণ তাঁদের পরিধানে কোনো বস্ত্র ছিল না। নীলিমা ইব্রাহিম নির্যাতিতা শেফার জবানিতে লিখেছেন-
“হঠাৎ অনেক লোকের আনাগোনা, চেঁচামেচি কানে এল। একজন বাঙ্কারের মুখে উঁকি দিয়ে চিৎকার করল, কোই হ্যায়; ইধার আও। মনে হয় আমরা এক সঙ্গে কেঁদে উঠলাম। ঐ ভাষাটা আমাদের নতুন করে আতঙ্কগ্রস্ত করল। এরপর কয়েকজনের মিলিত কণ্ঠ, এবারে মা আপনারা বাইরে আসুন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আমরা আপনাদের নিতে এসেছি। চিরকালের সাহসী আমি উঠলাম। কিন্তু এত লোকের সামনে আমি সম্পূর্ণ বিবস্ত্র, উলঙ্গ। দৌড়ে আবার বাঙ্কারে ঢুকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যে বলিষ্ঠ কণ্ঠ প্রথম আওয়াজ দিয়েছিল, ‘কোই হ্যায়,’ সেই বিশাল পুরুষ আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে নিজের মাথার পাগড়িটা খুলে আমাকে যতটুকু সম্ভব আবৃত করলেন। ভেতরে আরও ছয়জন আছে বলায় আশপাশ থেকে কিছু লুঙ্গি, শার্ট জোগাড় করে ওরা একে একে বেরিয়ে এল এবং ওদের কোনো রকমে ঢাকা হলো। আমি ওই শিখ অধিনায়ককে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। ভদ্রলোক আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘রো মাৎ মায়ি’।
এরপর শেফা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। বিয়ের পর তাঁর প্রথম সন্তানের নাম শ্বশুর রেখেছিলেন আরমান। কিন্তু শেফা ওকে ডাকেন ‘যোগী’ বলে।
“কেউ জানে না এ নামের পরিচয়। শুধু শেফা এ নামটা তার হৃদয়ে রক্ত দিয়ে লিখে রেখেছে। শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে শেফা সেদিন একজন দেবদূত প্রত্যক্ষ করেছিল, তার নাম যোগীন্দর সিং, যে তার পবিত্র শিরস্ত্রাণ খুলে শেফার অপবিত্র দেহটাকে ঢেকে দিয়েছিল আর কয়েকবার তাকে মাতৃ সম্বোধন করেছিল। তাই শেফা মনে মনে যোগীন্দরকে তার প্রথম সন্তান ভাবে। আরমানকে যোগী ডেকে তাকে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। মনে মনে বলে আল্লাহ যেন তেমনই জীবন মায়ের সম্মানের হেফাজত করে।”
ভারতীয় সেনাবাহিনীর এসব মানবিক আচরণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতাকে আরও প্রকট করে তুলেছিল।
[১১৫] শাহরিয়ার কবির

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!