হরিরামপুর বধ্যভূমি, ঢাকা
ঢাকার মিরপুর থানার হরিরামপুর গোরস্তান থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরের একটি গর্ত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন শিক্ষক ও একজন চিকিৎসকের লাশ উদ্ধার করা হয়। এই কবর নামের গর্তের আর একটু দূরেই পাওয়া গেছে আরো তিনজনের গলিত লাশ। প্রথম স্থানটি থেকে যে চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়, তাঁদের আত্মীয়- স্বজন সবাইকে শনাক্ত করেন। যে চার জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর লাশ শনাক্ত করা হয়, তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ড. সিরাজুল হক খান (১৯২৪-১৯৭১), ইতিহাস বিভাগের সন্তোষ ভট্টাচার্য (১৯৩০-১৯৭১), বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা (১৯৩১-১৯৭১)।
অপর গর্ত থেকে যে তিনজনের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয় তাঁরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের ড. এম. এ. খায়ের (১৯২৯-১৯৭১), ইংরেজি বিভাগের রাশীদুল হাসান (১৯৩২-১৯৭১) এবং বাংলা বিভাগের মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। শহীদদের আত্মীয়স্বজন এসব লাশ শনাক্ত করেন।
অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কোয়ার্টার থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পাক সামরিক জান্তার দোসর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ড. সিরাজুল হক খানকে ১৪ ডিসেম্বর ফুলার রোডের ১৬ নং বাসভবন থেকে, ড. ফয়জুল মহীকে ১৪ ডিসেম্বর তাঁর ফুলার রোডের বাসভবন থেকে, সন্তোষ ভট্টাচার্যকে ১৪ ডিসেম্বর ঈসা খাঁ রোডের ৩১ নং বাসভবন থেকে, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজাকে ১৪ ডিসেম্বর তাঁর ফুলার রোডের ১৪/এ নং বাসভবন থেকে এবং ড. এম. এ. খায়েরকে ১০ ডিসেম্বর তাঁর ফুলার রোডের ৩৫ নং বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে যায়। রাশীদুল হাসানকেও ১৪ ডিসেম্বর আনোয়ার পাশার ঈসা খাঁ রোডের ৩০ নং বাড়ি থেকে এবং মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে তাঁর ছোটভাই লুৎফুল হায়দার চৌধুরীর ইন্দিরা রোডের ৬৮/১ নং বাড়ি থেকে আলবদররা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। গর্ত খুঁড়ে যখন এসব লাশ তোলা হলো, তখনো তাঁদের প্রতেকের চোখ বাঁধা ছিল। এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি ‘পূর্বদেশ’ প্রতিনিধি লেখেন:
মফিজউদ্দীন নামক বিআরটিসির একজন ড্রাইভার গত ডিসেম্বর মাসের ১৮ তারিখে সকাল সাড়ে দশটায় রমনা থানায় হাজির হয়ে এই মর্মে একটি এজাহার দেয় যে, সে এবং তার আরও তিনজন সহকর্মী ড্রাইভার কারফিউর সময় আলবদরের নরঘাতকদের নির্দেশ ও প্রাণের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কোয়ার্টার থেকে প্রফেসরদের তুলে নেয়ার কাজে সাহায্য করে। উক্ত মফিজউদ্দীন আরও জানায় যে, সে ছাড়া বাকি তিনজন সহকর্মীকে শেষ পর্যন্ত আলবদরদের পশুরা হত্যা করেছে। সে কোনো রকমে রক্ষা পেয়েছে। মফিজউদ্দীন আরও জানিয়েছে, আলবদরের যে পশুর নির্দেশে সে কাজ করেছে- সেই পশুই গত ১৪ ডিসেম্বর সকাল দশটায় মিরপুরের হরিরামপুর গোরস্তানের কিছুদূরে (বিহারি গোরস্তান) সাতজন লোককে একসাথে দাঁড় করিয়ে তার সামনেই গুলি করে মেরেছে। ….
৪ জানুয়ারি এই বধ্যভূমি উদ্ধার অভিযান চালানো হয়। গোয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন ডিএসপি আবদুস সামাদ তালুকদার এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মিত্রবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য।
৬ জানুয়ারি বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে বদর বাহিনীর হাতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. এ. আর. মল্লিকসহ বিপুল সংখ্যক শোকাভিভূত ছাত্র-শিক্ষক-জনতা জানাজায় অংশ নেন। মসজিদ প্রাঙ্গণেই শহীদদের লাশ দাফন করা হয়। অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্যের লাশ শ্যামপুর শ্মশানে সৎকার করা হয়।
[১৩৭] সুকুমার বিশ্বাস
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত