স্টার চা বাগান গণহত্যা, সিলেট
১৭ এপ্রিল সিলেটের রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল (বর্তমান ক্যাডেট কলেজ) থেকে একজন পাক মিলিটারি স্টার চা বাগানের মালিক রাজেন্দ্র লাল গুপ্তের বাসভবনে এসে দেখা করে। এর পরদিন আবার সকাল দশটায় তারা আসে তারাপুরে। সংক্ষিপ্ত রাস্তা বলে মালনিছড়া চা বাগানের মধ্য দিয়ে আখালী ইপিআর ক্যাম্পে চলে যায়। ফেরার পথে আবার রাজেন্দ্রলাল গুপ্তের বাসভবনে প্রবেশ করে। অসৎ উদ্দেশ্যকে আড়াল করে গুপ্ত পরিবারের প্রতিটি পুরুষ সদস্যকে ‘ডান্ডি কার্ড (পরিচয় পত্র)’ প্রদান করার কথা বলে। ওরা আরও বলে যে, ডান্ডি কার্ড প্রদান করার পরই তারা অবাধে চলাফেরা করতে পারবেন। স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করা সম্ভব হবে। তাই এই পরিবারের প্রত্যেকেরই ‘ডান্ডি কার্ড’ থাকা একান্ত অপরিহার্য। পাকবাহিনী ওই দিনই ডান্ডি কার্ড ইস্যু করার কথা বলে প্রত্যেককেই উপস্থিত পাকবাহিনীর সদস্যদের সাথে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে যাওয়ার কথা বলে।
রাজেন্দ্রলাল গুপ্ত পাকবাহিনীর হীন উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করতে পারলেও তখন আর পালাবার পথ খোলা ছিল না। তার বাসভবনের চারদিকে তখন শত শত পাকসেনা। পরিবারের সকল সদস্য, বাগানের কর্মচারী ও শ্রমিক সবাইকে জড়ো করে তারা গুপ্ত বাবুর বাড়িতে। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের ঘরে ঘরে চৌকিদার পাঠিয়ে তাদেরও নিয়ে আসা হলো। তারপর গাড়ি ভর্তি করে লোকজনকে নিয়ে যাত্ৰা শুরু হলো মালনিছড়া বাগান হয়ে। এদিকে গাড়িতে ওঠার সময় বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য ছেলেদের বাড়িতে রেখে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন গুপ্ত বাবু। পাকবাহিনীর সদস্যরা রাজেন্দ্র গুপ্তের এক ছেলে পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে (শঙ্কর) বাড়িতে থাকার অনুমতি দেয়। বাকি সবাইকে নিয়ে চলে যায় তারা সামরিক গাড়িতে করে। ঠিক এ সময় সুবেদারের বাঁশি বেজে উঠলে অসংখ্য পাকসেনা বাগানের বিভিন্ন টিলার আড়াল থেকে বের হয়ে সুবেদারত্রয়কে অনুসরণ করতে থাকে। পথিমধ্যে সবকটি সামরিক যানই থেমে গেল পার্শ্ববর্তী মালনীছড়া চা বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের বাংলোর পাশে। এ টিলাকেই তারা বেছে নিল বধ্যভূমি হিসেবে। গাড়ি থেকে বের করে আনা হলো সমস্ত বন্দিকে। তারপর মালিক, কর্মচারী ও শ্রমিক-এই তিন ভাগে বিভক্ত করা হলো তাদের। ধরে আনা লোকজনকে টিলার তিন পাশে তিনজন সুবেদারের নেতৃত্বে তিনটি দলকে নিয়ে গেল হানাদার পশুরা। তারপর তারা তাদের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে নির্বিচারে হত্যা করল ৩২ জন মানবসন্তানকে। দুজন শ্রমিক গুরুতর আহত হয়েও বেঁচে যায় এবং তাঁদের ফিরে আসার পরই তারাপুরবাসী জানতে পারেন স্বজন বিয়োগের এই নৃশংস কাহিনী।
এই ৩২ জন শহীদের লাশ পড়ে থাকে বধ্যভূমিতে। শৃগাল-কুকুর ভক্ষণ করে। ঠিক তখনই ৩২ জন শহীদের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত মালনীছড়া বাগানের ভেতর দিয়ে একটি সামরিক জিপ এগিয়ে চলল দ্রুতগতিতে। এবার সৈন্য নয়, শুধু তিনজন সুবেদার। সোজা চলে গেল শহীদ রাজেন্দ্র গুপ্তের বাড়িতে। অনুগ্রহপূর্বক পিতাকে দেখাতে নিয়ে যেতে চাইল রাজেন্দ্র গুপ্তের তিন মেয়ে পূর্ণিমা, খুকু ও কিন্তিকে। মানুষরূপী পশুদের এই অনুগ্রহ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করল তিন বোন। কিন্তু রেহাই পেল না হায়েনাদের হাত থেকে। জোর করে তাঁদের তুলে নিল তারা গাড়িতে। তারপর অজ্ঞাত গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করল সামরিক যান। বিকেলের দিকে তারা আবার একই গাড়িতে করে নামিয়ে দিল তিন বোনকে ক্ষত-বিক্ষত দেহে।
উভয় ঘটনার মুখে বাগানের অবশিষ্ট মানুষজন দারুণ আতঙ্কিত হয়ে ওই রাতেই ভারতের দিকে রওয়ানা হয়। এদিকে প্রায়ই চলল সুবেদার তিনজনের আনাগোনা। কিন্তু হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার সামগ্রী হাতছাড়া হওয়ায় পুরোপুরি হিংস মূর্তি ধারণ করে পাক বর্বররা। ১ মে আবার আসে সুবেদারত্রয়- রাজেন্দ্র গুপ্তের তিন মেয়েকে না পাওয়ার আক্রোশে গুলি করে হত্যা করে তারা বাড়ির প্রহরী নভিরামকে। ঘরে ঢুকে তন্নতন্ন করে খোঁজ করে বাড়ির রমণীদের। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বন্দি করে তাঁরা পঙ্কজ কুমার গুপ্ত, নরেশ চক্রবর্তী ও তাঁর ছেলে নারায়ণ চক্রবর্তী, বাড়ির কাজের লোক দুর্গেশ দাস ও মহেন্দ্র পালকে। সবাইকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আধমাইল দূরবর্তী ঘোষপাড়া গ্রামে। সে গ্রামের প্রেমানন্দ বাড়ি ছেড়ে আগেই চলে গেছে ভারতে। পরিত্যক্ত এই ঘরে ঢুকে পাকবাহিনী নরেশ চক্রবর্তীকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর নিয়ে যায় পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে। কিন্তু তিনজনের মধ্যে একজন সুবেদার ছেলেমানুষ হিসেবে পঙ্কজ গুপ্তকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে প্রকাশ করে। বাকি দুজন কিন্তু ঘটনাস্থলেই তাঁকে বধ করতে চায়। এদিকে নারায়ণ, মহেন্দ্র ও দুর্গেশকেও একে একে ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তারপর আগুন লাগিয়ে দেয় ঘরে। মুহূর্তেই পাঁচটি লাশ পুড়ে কাঠ ও ছনের ভস্মের সাথে একাকার হয়ে যায়। পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে এবার নিয়ে যাওয়া হলো বাগবাড়ি স্থ পাকবাহিনীর ক্যাম্পে। এখানে তাঁর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলেও পূর্বোক্ত সুবেদার তাঁকে সিলেট শহরের দর্জিপাড়াস্থ হাজী নজির উল্লার বাড়িত রেখে দেয়। এখানেই তাঁকে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু পঙ্কজ গুপ্ত এখান থেকে চলে যায় নয়াসড়কস্থ আরেক মুসলিম বাড়িতে এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করে।
গুপ্ত পরিবারের ধন-সম্পদও লুণ্ঠিত হয়। পঙ্কজ কুমার গুপ্ত জানান, তাঁদের পরিবারের ১০ লক্ষ টাকার মালামাল পাকবাহিনী ও তাদের সহযাগীরা লুট করে নিয়ে যায়।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত