You dont have javascript enabled! Please enable it!

সুরিকোনা গণহত্যা, সিলেট

কুশিয়ারা নদীর উত্তর পাশে সুরিকোনা। শেরপুর থেকে প্রায় তিন মাইল পশ্চিমে। এ জায়গাটি বালাগঞ্জে অন্তর্ভুক্ত। সুরিকোনার ঠিক বিপরীত দিক থেকে নদী অতিক্রম করলেই নবীগঞ্জ থানার দুর্গাপুর গ্রাম। সেখানে বাস করেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য আলফু মিয়া। পাক সেনাবাহিনীকে সাহায্য- সহযোগিতা করতে তিনি অস্বীকৃত হওয়াতে তারা তার ওপর ক্ষেপে যায়। আক্ৰমণ করে বসে দুর্গাপুর। কিন্তু আলফু মিয়া গেরিলা কায়দায় লাফিয়ে পড়েন কুশিয়ারায়। তারপর নদী সাঁতরে ওঠেন অপর তীরে। আশ্রয় নেন সুরিকোনায়। নিভৃত পল্লী। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই আশ্রয় নিয়েছে এ গ্রামে। আর এঁদের মধ্যে সর্বশেষ আশ্রয় প্রার্থী দুর্গাপুরের আলফু মিয়া।
কিন্তু ব্যাপারটা সহ্য হলো না স্থানীয় পাক দোসরদের। এ খবর জানিয়ে দিল তাদের পাক প্রভুদের। শুরু হলো হায়েনাদের গাত্রদাহ। সিদ্ধান্ত হলো আক্রমণের। ফলে গভীর রাতে স্পিডবোটে করে তারা এসে পৌছায় গ্রামে। তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা ওত পেতে বসে থাকে সুবিধাজনক স্থানে। সে খবর জানল না সুরিকোনার সহজ-সরল মানুষ। ভোরে নামাজ আদায় করতে যায় তাঁরা মসজিদে। কিন্তু নামাজ শেষ করতে পারল না। তার আগেই আক্রান্ত হলো মসজিদটি। প্রার্থনারত অবস্থায় পাকিস্তানি সৈন্যরা মুসল্লিদের বেঁধে ফেলে। নিয়ে আসে বাইরে। এ সময় সমগ্র গ্রাম আক্রান্ত। বিভিন্ন স্থনে ওত পেতে থাকা পাকবাহিনীর সদস্যরা মুহূর্ত খানেকের ভেতরে গ্রামবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত লোকজনকে ধরে নিয়ে আসে। আর বাড়ির পর বাড়িতে ধরিয়ে দিল আগুন। দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুনের লেলিহান শিখা। নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রাণের ভয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। ছুটে চলে তাঁরা অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে।
মসজিদের মুসল্লিদের পাকবাহিনী তখন নিয়ে আসে গ্রামের দক্ষিণ দিকের কুশিয়ারা নদীর তীরে। সুরিকোনার দক্ষিণ অংশ থেকে ধরে আনা লোকজনকে ও এখানে জড়ো করা হয়। তাঁদের ১৮ জনকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে গুলি ছুড়ে তারা। অবশ্য গুলি ছোড়ার ঠিক আগমুহূর্তে নদীতে ঝাঁপ দেন তিনজন। তাঁর সাঁতার কেটে অপর তীরে উঠতে সক্ষম হন অক্ষত দেহে।
হানাদার বাহিনীর দ্বিতীয় গ্রুপ তখন গ্রামের ঘুমন্ত মানুষদের ধরে নিয়ে এসেছে গ্রামের উত্তর পাশে ভাঙ্গার পাড়ায়। সেখানে এনে তাঁদের একই কাতারে দাঁড় করানো হয়। সংখ্যায় তাঁর ১৭ জন। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছেন কেউ কেউ। তাজপুর গ্রামের রমজান মিয়াও এখানে শহীদ হন। গুরুতর আহত হন আতাউর রহমান ও মানিক মিয়া প্রমুখ। আতাউর রহমানের দাঁতের দুটি পাটিই উড়ে গিয়েছিল গুলিতে। কিন্তু পাকবাহিনীর ভয়ে কোনো ডাক্তার তাঁর চিকিৎসা করতে রাজি হননি। পরে নূরপুর গ্রামের তাঁর এক চাচা এই চিকিৎসা করেন। আজ বেঁচে আছেন তিনি বিকল মুখ নিয়ে। তৃতীয় দলটি যাঁদের ধরেছিল তাঁদের তারা নিয়ে আসে গ্রামের পশ্চিম পাশে। তাঁদের প্রতিও তারা গুলি ছোড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে। এই সাথে শহীদ হন তাজপুরের আগন মিয়াসহ আরো দুজন। এঁদের লাশও তিন দিন পর্যন্ত পড়ে থাকে বধ্যভূমিতে।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!