You dont have javascript enabled! Please enable it!

সুজালপুর প্রাইমারি স্কুল মাঠের বধ্যভূমি, গাইবান্ধা

এখানে পাকসেনারা ছিলমানের পাড়া ও সুজালপুর গ্রামের ছয়জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। বেঁচে যাওয়া একজন বলছেন –
ডিসেম্বরের এক সকালে মহিমাগঞ্জের দিক থেকে ৭০-৭২ জন ফৌজি যখন মহিমাগঞ্জ থেকে রওয়ানা দেয় তখুনি খবর হয় ‘অ্যাই ফৌজি আসতাছে, ফৌজি আসতাছে। ‘তখন সবাই বাড়িঘর ছেড়ে পালায়। আমি পালাতে পারলাম না। কাপড়ের ব্যবসা করতাম। তিন গাঁট কাপড় ধানের ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম। পাটগুলো ঘর থেকে বের করে জমির মধ্যে রাখলাম। সেগুলোর দিকে নজর রাখতে হবে। তাই পালাতে পারলাম না। আমি, আমার বাবা আর এক জ্যাঠা বাড়িতেই থাকলাম। ফৌজিরা সুজালপুরের কাছে এসে দুভাগ হলো। একভাগ গেল উত্তর দিকে, আরেক ভাগ আমাদের গ্রামে ঢুকল। গ্রামে কোনো লোকজন নেই। ওরা ঘুরে ঘুরে বেড়ায় প্রত্যেক বাড়িতে। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, ইধার মুক্তিফৌজি হ্যায়? বল্লাম নাই। ওরা পূর্ব ছিলমানের পাড়ার কাজেম, ফয়েজ উদ্দিন, এদের বাড়িগুলো পুড়ে দিল। বাড়িতে কোনো লোকজন ছিল না। ওরা আমাদের বাড়িতে আমগাছের নিচে বসল। বলল পানি খাবে। আমার বাবা বাড়ির ভেতর যেয়ে পানি এনে দিল। ওরা জমি থেকে মূলা তুলে এনে ছিল। সেই মূলা খাইয়ে পানি ‘খালো’। খাওয়ার পর বলল, আপতো মুসলমান আদমি হ্যায়; আপকো ইমানদার আদমি হ্যায়। আপকো কোই ডর নাহি হ্যায়। চলিয়ে হামরা সাথ। হামারা ওস্তাদ উধার বইঠা হুয়া হ্যায়। ওস্তাদ পার চলিয়ে।’ তখন আমি বললাম আমি যে ওদিকে যাব, তখন আমার বাড়ি লুট হয়ে যাবে। তখন তারা বলল: কোনো লুটতরাজ করে না, হাম দেখেগা’। ওরা ছাড়ল না, আমাকে, আমার বাবাকে এবং ভিটের মধ্যে পালিয়ে থাকা কয়েকজনকে ধরে স্কুলের মাঠে নিয়ে গেল। যেয়ে দেখি সেখানে সুবেদার বসে আসে। যারা আমাদিগকে সেখানে জড়ো করল তারা আমাদের সুবেদারের সামনে দাঁড় করিয়ে নিজেরা মাঠের চারদিকে বসে পড়ল। আমি তখন মাদ্রাসার শিক্ষক। মুখে দাড়ি ছিল। আমার সুফি চেহারা দেখে এবং সামান্য উর্দু বলতে পারি যার জন্য সুবেদার আমাকে বসতে দিল এবং বাকিদের দাঁড় করিয়ে রাখল। সে আমাকে বলল, তুমতো মুসলমান আদমি হ্যায়, সাচ বাত কহেগা। এধার সে কোনো কোনো লাড়কা মুক্তিফৌজ মে গিয়াথা। উনকো নাম বাতায়ে, আওর মাকাম দেখায়ে। আমি বললাম, নেই, হামারা উধারছে কোহি লাড়কা মুক্তিফৌজ মে নেহি গিয়া, হাম কেসকা নাম বাতায়ে। সুবেদার বলল তুম ঝুট বলতাহে। এভাবে কথোপকখন হলো। সে বারবার মুক্তিফৌজের নাম বলার জন্য চাপ দিতে লাগল। এক পর্যায়ে সে একটা ছুরি বের করে আমার গলায় ধরে বলল যে, ফের ঝুট কহেনাতো আমি খতম কর দেখা। এই অবস্থা দেখে ফয়েজ ভাই বলল, ‘ক্যাগো, ২-৪ জনের নাম বললেই তো হামরা বাঁচে যাই।’ এই কথা শুনে সুবেদার এক রাজাকারকে জিজ্ঞেস করল যে, এই লোক কী বলল। জবাবে রাজাকার জনাল; এই লোক ২-৪ জন মুক্তিফৌজের নাম বলতে বলছে, কিন্তু সুফি সাব নাম বলছে না। তখন সুবেদার বলল, অ, ঠিক আদমিকো হামারা হাতমে আয়া গিয়া। ইসকো সুফি নায়া হ্যায়। ইয়া মুক্তিফৌজ কা লিডার হ্যায়। এরপর সে কী যেন ইশারা করল। তখন আর্মিরা এসে আমাকেসহ সাতজনের হাত বাঁধল। বাঁধার পর প্রাইমারি স্কুলের ঘরের পেছনে চারজনকে এক লাইনে, আর অপর তিনজনকে আরেক জায়গায় লাইনে দাঁড় করাল। তখন আমাদের সবাই কান-াকাটি ’করতেছে’। আমি ওদের বললাম; তুমভি মুসলমান হ্যায়, হামভি মুসলমান হ্যায়। তো মুসলমান হোকে মুসলমান কতল করনা ইয়া কুফুরি কাম হায়। তুম কাফের বনেগা। তখন সুবেদার বলল, হাম কিয়া করেনগা সুফি সাব? তুম কলেমা পড়গা, কলেমা পড়গা। এই বলতে বলতে গুলি হলো। আমরা পড়ে গেলাম। আমার মনে হলো আগুন জ্বলছে। মনে হলো গরমে গরমে ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। অন্যেরা দাপাদাপি আরম্ভ করছে। গরু জবাই করলে যেমন করে। আমার মনে আছে, আমি জ্ঞান হারাতে হারাতে বলি; তুম সব কাফের বনেগা, তুম সব . . .। আর ওরা বলতে থাকে, সুফি সাব, কলেমা পড়েগা, কলেমা পড়েগা। এভাবে আমি জ্ঞান হারাই। পরে শুনেছি চারজন ওখানেই মারা যায়, জীবিত অবস্থায় তিনজনকে যার যার বাড়িতে আনা হয়। একজন ঐদিন বিকেলে মারা যায়, পরদিন মারা যায় আরেকজন। আমি বারদিন অজ্ঞান অবস্থায় থাকি। আমার বুক ও পেটের ভেতর দিয়ে গুলি পার হয়ে গিয়েছিল। ভেতরটা ঝাঁঝরা হয়েছিল। অলৌকিকভাবে বেঁচে ছিলাম।
[৫৮০] ড. মো. মাহবুবর রহমান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!