সুনামগঞ্জ গণহত্যা, সুনামগঞ্জ
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন একটি দুর্গম এলাকা সুনামগঞ্জ জেলা। জেলা সদরে ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল প্রবেশ করে। স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত স্থানীয় জনতা তখন সার্কিট হাউস ঘেরাও করে। এই ঘেরাও অভিযানে যোগ দেন আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ এবং ইপিআরের জোয়ানরা।
শুরু হয় জনতা আর পাকবাহিনীর মধ্যে লড়াই। শহীদ হন গণেশ নামের একজন রিকশা শ্রমিক। অন্যদিকে পাকবাহিনীর একজন সদস্য মারা যায়।
সুনামগঞ্জে ক্যাম্প স্থাপন করে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এ প্রতিষ্ঠানেই ১০ মে পুনরায় আসে তারা। খনন করে একটি বড় গর্ত, যেখানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে অগণিত লোককে। জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য নিরীহ লোকজনকে ধরে এনে এ জায়গায় হত্যা করত তারা। পবিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আটকে রাখত অসংখ্য রমণীকে। এদের ধরে আনা হতো বিভিন্ন জায়গা থেকে। ধর্ষণ চালাত তাঁদের ওপর পর্যায়ক্রমে। তারপর হত্যা করে তাঁদের ফেলে দিত সামনের গর্তে|
এ সময় স্থানীয় বেশ কিছু লোক পাকিস্তানি প্রভুদের সেবাকাজে এগিয়ে আসে। গঠন করে তারা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী। এদেরই প্ররোচনায় পুড়িয়ে দেয়া হয় আলফাত উদ্দিন, হোসেন বখত ও আবদুল বারির ঘরবাড়ি। লুটপাটও করে আরো বেশ কিছু বাড়িঘর। ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে বহু লোককে।
উজানগাঁওয়ের আবদুস সাত্তারের প্ররোচনায় পাকসেনারা হাজির হয় তেঘরিয়া গ্রামে। সমগ্র গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। সেই আগুনের লেলিহান শিখায় নিক্ষেপ করে জয়কলস ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য গয়ানাথসহ বেশ কজন গ্রামবাসীকে। পাথারিয়ায় হিন্দুদের পবিত্র আখড়ায় স্থাপিত স্বর্ণমূর্তিটিও দস্যুরা ‘ভেঙে দিয়ে যায়। পাগলায় হত্যা করে তারা দীপালি চক্রবর্তীর কাজের ছেলেকে। দিরাইয়ে হত্যা করা হয় নির্বাচিত চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী চৌধুরীকে। নীলপুর অপারেশনে শহীদ হন উজান তাহিরপুরের ইসমাইল।
পাক জল্লাদদের অমানুষিক নির্যাতনে জেলার ৫ লাখ লোক ভারতে আশ্রয় নেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ৭ হাজার ছাত্র যুবক জনতা। এসব যোদ্ধা দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন। শত্রুর হাতে ধরা পড়েন বহু তরুণ। এঁদের হত্যা করা হয় পাশবিক কায়দায়। অকুতোভয় বীর মুক্তিসেনা জগৎজ্যোতিকে পাকসেনারা হাওর এলাকায় হত্যা করে। বহু কুকর্মের নায়ক ছাত্তারকে ধরতে গিয়ে হানাদারদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যান কমিউনিস্ট নেতা গিয়াস উদ্দিন, ছাত্রলীগ নেতা তালেব হোসেন এবং কৃপেশ দাস। সেই বেড়িগাঁওয়েই নিহত হন গিয়াস উদ্দিন। তালেব হোসেন ও কৃপেশ দাসকে তারা পিটিআইতে এনে বন্দি করে শারীরিক নির্যাতন চালায়। অবশেষে সুনামগঞ্জ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা জয়কলসের পুলের নিচে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তাঁদেরকে ফেলে রেখে চলে যায়। ইপিআর সদস্য রহিম বখত প্রাণ হারান রেডিগাঁওয়ের যুদ্ধে। ভোলাগঞ্জে নিজের মর্টারের গুলিতে নিহত হন কিশোরগঞ্জের মোস্তফা তালুকদার। শত্রুর তিন ইঞ্চি মর্টারে আহত হন সুবেদার সিরাজুল ইসলাম। ভারতে যাওয়ার পথে দিরাইয়ের শ্যামারচর গ্রামের খালেদ মিয়ার বাড়িতে এনে তাঁকে হত্যা করা হয়। সেই সাথে তাঁর নয় বছরের কন্যাসন্তান সিতারা বেগমকেও হত্যা করে পাকবাহিনী।
বাছিতপুর থানা ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি সিরাজ উদ্দিন সাচনার যুদ্ধে শহীদ হন। টেকেরঘাটে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। জামালগঞ্জের কুখ্যাত দালাল লাল মিয়া তাহিরপুর থেকে তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে এনে হত্যা করে। জামালগঞ্জ ও সাচনা এলাকায় হত্যা করে তারা প্রায় ১৫০ জনকে। ২৮ আগস্ট একটি অপারেশনে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের।
স্বাধীনতার পর সুনামগঞ্জ পিটিআই-এর সম্মুখস্থ বধ্যভূমিটি খুঁড়ে ওঠানো হয় শতাধিক লোকের কঙ্কাল। এসবের মধ্যে ছিল বৃদ্ধ-যুবক এবং তরুণী-যুবতীর লাশ। ক্যাম্পের মধ্যেও পাওয়া যায় বিবস্ত্র-বিবর্ণ মা-বোনের প্রাণহীন দেহ। এদের প্রত্যেকের ক্ষত-বিক্ষত দেহেই পাকপশুদের নির্যাতনের স্বাক্ষর অঙ্কিত ছিল।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত