You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাউথ সেন্ট্রাল রোড গণহত্যা, খুলনা

৩১ মার্চ খুলনা শহরের সাউথ সেন্ট্রাল রোডে পাকসেনাদের গুলিতে অ্যাডভোকেট নকুলেশ্বর সাহার দুই পুত্র এবং মহাদেব চক্রবর্তী, তার ১ জন পাচক, ১ জন কর্মচারী ও ২ জন ভাড়াটে নিহত হয়। এ হত্যাকাণ্ড সংখ্যালঘু নির্যাতনের অংশ ছিল। এদিন থেকে খুলনা শহরের বসবাসরত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শহর ছাড়তে শুরু করে।
এভাবে দেখা যায় যে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্মম গণহত্যা ও নির্যাতন কর্মকাণ্ডে মেতে ওঠে। এর সাথে যুক্ত হয় খুলনার মুসলিম লীগের সমর্থক ও অবাঙালিদের দখলদারিত্ব ও প্রতিশোধ পরায়ণতা। ফলে মার্চ মাসের মধ্যেই খুলনা শহর আতঙ্কের শহরে পরিণত হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, শ্রমিক, আওয়ামী লীগ সমর্থকসহ সাধারণ মানুষ শহর ছেড়ে নিকটবর্তী গ্রামসমূহে আশ্রয় নিতে থাকে। পাকিস্তানি সহযোগীরাও খুলনা শহরের ওপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পর গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান নৌবাহিনী তাদের খুলনা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়। তারা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ঐ সকল অঞ্চলে যথারীতি গণহত্যা ও নির্যাতন চালায়। ফলে খুলনা শহর ও শহরতলিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে নৌবাহিনী গণহত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে খুলনা জেলায় একটি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তাদের আক্রমণের মুল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা। দক্ষিণ খুলনা বিশেষ করে বটিয়াঘাটা, দাকোপ, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া এমনকি, ফুলতলা এলাকা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। এপ্রিল ও মে মাসজুড়ে এ সকল এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা আকস্মিক হামলা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। ফলে এ এলাকার শতকরা ৯০ ভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের ভিটামাটি, ধন- সম্পদ ফেলে রেখে ভারতে চলে যায়। এ সুযোগে মুসলিম লীগ ও পিস কমিটির সদস্যরা সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি, গবাদি পশুসহ সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যায়। এমনকি লুণ্ঠনকারীরা বিভিন্ন এলাকার ওপর নিজ নিজ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যথারীতি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, কে কোন এলাকা আগে দখল করতে পারে, কে বেশি সংখ্যক বিধর্মীকে হত্যা করতে পারে তা নিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। তারা এসব কাজেই সর্বদা ব্যস্ত থাকত। এপ্রিলের প্রথম দিকে দাকোপ ও ডুমুরিয়ায় নকশাল বাহিনী লুণ্ঠনকারীদের গতিরোধ করতে সক্ষম হলেও সবুর খানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র ব্যক্তিরা মে মাসে ঐ সকল এলাকায় প্রবেশ করলে এলাকার ওপর পুনরায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয। এরপর রাজাকার বাহিনীর মোতায়েনে পাকিস্তান সমর্থক মুসলিম লীগ ও পিস কমিটির সদস্যদের কর্তৃত্ব আরও দৃঢ় হয় এবং গণহত্যা ও নির্যাতন আরও বেগবান হয়। আগস্ট সেপ্টেম্বর মাসে এ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সুদৃঢ় হওয়া পর্যন্ত তাদের গণহত্যা ও নির্যাতন নির্বিঘ্নে চলতে থাকে এবং ডিসেম্বরে বিজয়ের মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটে। দীর্ঘ ৯ মাসের এই গণহত্যা ও নির্যাতনে খুলনার বিভিন্ন এলাকা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। খুলনার বধ্যভূমিসমূহের মধ্যে গল্লামারী বধ্যভূমি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
[৯২] মোল্লা আমীর হোসেন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!