You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.16 | সাড়েচারআনি গণহত্যা | বাগেরহাট - সংগ্রামের নোটবুক

সাড়েচারআনি গণহত্যা, বাগেরহাট

বাগেরহাট সদর থানার অন্তর্গত বাঁশবাড়িয়া সাড়েচারআনি গ্রামে ১৬ মে রোববার গণহত্যার ঘটনাটি ঘটে। পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে সেদিন এখানে অর্ধশতাধিক সাধারণ মানুষ নিহত হয়।
এপ্রিলে পাকবাহিনী কর্তৃক বাগেরহাট শহর আক্রান্ত হওয়ার পর নাগেরবাড়ির ক্যাম্প থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এই গ্রামের মজুমদার বাড়িতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে, যাঁরা সকলেই ছিলেন প্রাক্তন ইপিআর বাহিনীর সদস্য। তাঁরা এই গ্রামের যুবক ও তরুণদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন যাতে লুটকারী ও রাজাকারদের হাত থেকে গ্রামের মানুষকে রক্ষা করা যায়। এভাবে একটি স্থানীয় প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে ওঠে।
১০ মে তারিখ বাগেরহাট শহরে দ্বিতীয়বারের মতো হানাদার বাহিনীর আগমন ঘটার পর স্থানীয় রাজাকার ও লুটকারীদের মধ্যে আগ্রহ ও উৎসাহ বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিত ১৫ মে শনিবার ৩১ বৈশাখ তারিখে বাগেরহাট শহরের নিকটবর্তী গ্রামগুলো থেকে লুটকারীদের একটি দল সাড়েচারআনি গ্রামের হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করার জন্য চড়াও হয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ বাহিনী বন্দুক, ঢাল- সড়কি প্রভৃতি নিয়ে লুটকারীদের তাড়া করে। এক পর্যায়ে পলায়নরত লুটকারীদের কয়েকজন সড়কির আঘাতে আহত হয়।
লুটকারীরা ঐদিন রাতেই রাজকার বাহিনীর অধিনায়ককে খবর দেয়। ১৬ মে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি দল গানবোট নিয়ে গ্রামের প্রান্তের নদীতীরে পৌছে যায়। মনীন্দ্র সমাদ্দার নামের এক গ্রামবাসী খুব ভোরে উঠে মাঠের দিকে যাচ্ছিলেন, পাকবাহিনী তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করলে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান। গানবোটটি এরপর ছয়বাঁকি নদীর গোড়ায় এসেই সুতার বাড়ি ও সমদ্দার বাড়িকে লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। গোলাগুলির শব্দে গ্রামবাসীর ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে যে যেদিকে পারে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করতে থাকে। গানবোটটি এক পর্যায়ে ছয়বাঁকি নদীর মধ্যে ঢুকে নদীর দুই তীরে গুলিবর্ষণ শুরু করে দেয়। তারপর সন্ন্যাসী গ্রামের যে ঘাটে ভারত গমনেচ্ছু শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছিল গানবোটটি সেদিকে এগিয়ে যায়। গানবোট দেখেই অনেকে নৌকা থেকে নেমে গ্রামের ভেতরে গিয়ে পালাচ্ছিলেন, তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয় এবং এক পর্যায়ে গোলার আঘাতে সমাদ্দার বাড়িরে দালানকোঠা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়।
নদীর পূর্ব তীর ধরে পালাতে চেষ্টা করছিলেন সখীচরণ মসীদ এবং নকুল মণ্ডল। ব্রাশফায়ারে তাঁরা জীবন হারান। এরপর গানবোটটি সাড়েচারআনি গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া আন্ধারিয়া খালের গোড়ায় এসে ভেড়ে এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র হাতে নিয়ে হানাদাররা গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করে। ইপিআর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর এমন অপ্রত্যাশিত আগমনে ঘাবড়ে যান। অত বড় একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো শক্তি ও অস্ত্র তাঁদের না থাকায় তাঁরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। অন্যদিকে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা মজুমদার বাড়িতে গিয়ে কাউকে না পেয়ে তারা উন্মত্তের মতো আচরণ শুরু করে। চারদিকে চলতে থাকে অবিরাম গুলিবর্ষণ আর অগ্নিসংযোগ। লুকিয়ে থাকা কোনো পুরুষকে পাওয়া মাত্রই তাঁকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হতে থাকে। আর মহিলাদের সঙ্গে চলতে থাকে নিষ্ঠুর রসিকতা। পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের শেষ পর্যায়ে আগের দিনের লুটকারীদের পুনরাগমন ঘটে। এভাবে সবাই মিলে গ্রামটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে চলে যাওয়ার পর অর্ধশতাধিক মৃতদেহ এখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এই হতভাগ্যদের কয়েকজন ছিলেন অন্য গ্রামের অধিবাসী, যাঁরা ভারতের দিকে যাত্রা করে এই গ্রাম পর্যন্ত এসে থেমেছিলেন।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত