শ্রীপুর, সোনাপুর ও করিমপুর গ্রাম গণহত্যা, নোয়াখালী
সোনাপুর, নোয়াখালী পৌরসভার দক্ষিণাঞ্চলে একটি ছোট গ্রাম। এর চারপাশে মহব্বতপুর, শ্রীপুর, করিমপুর, গোপাই ও পশ্চিম বদরীপুর।
এপ্রিলে পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর হাতে শহর পতনের পর থিতিয়ে আসছিল উত্তেজনা। নোয়াখালী শহর জেঁকে বসে গেছে মুসলিম লীগ ও জামায়াতের পাকিস্তানি দালালদের প্রশাসন। গঠিত হয় শান্তি কমিটি, ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানি দোসররা বাঘ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর। ঘরবাড়ি, দোকানপাট সব লুট হয়ে ছারখার। শহরের হিন্দু বসতি প্ৰায় নিশ্চিহ্ন। শোনা যায় এই হিন্দুর বাসা দখলের পর টাইটেল পাস জামায়াতিদের শহর নেতা স্বহস্তে ফুলগাছ কেটে সাফ করে ফেলেছেন। বিস্মায়িত দর্শকের জিজ্ঞাসা ছিল, গাছের কী দোষ, ইসলামপন্থী মাওলানার সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘হিন্দুর চিহ্নও রাখব না, হিন্দু কাফের, হিন্দুর ফুলও কাফের’—এই ছিল পাকিস্তান প্রেমীদের মানসিকতা। আরেক কোরআন হাফেজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা নিধনের অজুহাতে খলিফারহাট এলাকায় তিন মাসের প্রসূতি মহিলাকে গণধর্ষণের পর তারা বিভিন্ন অঙ্গে লবণ মরিচ মেখে দিয়ে বীরের মতো যুদ্ধজয় করে পাষণ্ডরা। নাদির শাহীর কায়দায় লুণ্ঠিত দ্রব্য এরা পরস্পরের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করত।
বেলা চারটায় উত্তরের পাকা সড়ক ধরে ছুটে এল শব্দময় দানব বাস, ট্রাক, লরি। স্থানে স্থানে উগড়ে দিল চাইনিজ অটোমেটিক হাতে পাকিস্তানি সেনাদের সর্ব দক্ষিণে ছুটে এসে একটি বাস থামল। ‘টি’-এর পশ্চিম বাহুতে ছুটে গেল একদল। উত্তর দিকের শ্রীপুর এবং করিমপুর গ্রামে ঢুকল একদল সেনা। মোক্তারবাড়ির চারপাশ ঘিরে ঘনবসতির ঘেরে ঢুকে গেল পাকিস্তানি হানাদার। উত্তর সোনাপুর এলাকায় আগেই নেমে পড়েছিল একদল। পাকিস্তানি সেনাদলের কোনো ঘোষণা নেই, অনুসন্ধান তৎপরতা নেই, নেই কোনো প্রতিরোধের প্রতীক্ষা। ‘টি’-এর পশ্চিম প্রান্ত থেকে প্রথম গুলির সংকেত পাওয়া গেল। সন্ত্রস্ত ভীত দোকানে বসা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, অসহায় ছুটোছুটি, নির্বিচারে লুট করছে। গুলি করছে, আগুন লাগাচ্ছে তারা। মুহূর্তে চারশ গজ এলাকা নরকে পরিণত হলো, দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। জ্বলে গেল দোকান, ঘরবাড়ি। খুন হয়ে গেল অনেকেই। নির্যাতিত হলো পনের অধিক নারী। তাদের পথ দেখিয়ে আনে স্থানীয় রাজাকার এবং শান্তি কমিটির মাইজদী শাখার নেতারা। দুই ঘণ্টা সময়ের মধ্যে প্রতিবাদ, প্রতিরোধহীন সোনাপুর আর এর চারপাশের গ্রামে নেমে এলো এক শ্মশানের নিস্তব্ধতা। দোকানে লাশ, গ্রামে ঢোকার মুখে লাশ, দোকানের সামনে লাশ, ডাক্তার, ডাক্তারের কাছে আসা রোগী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ কোনো স্তরের মানুষই রেহাই পায়নি। আশ্চর্যের ব্যাপার এই লাশ হয়ে যাওয়া নির্বিরোধ মানুষগুলোর কাছ থেকে বেঁচে থাকার আকুতি ছাড়া পাকিস্তানি বীর সৈনিকেরা কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি।
[88] জোবাইদা নাসরীন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত