শ্রীরামসির গণহত্যা, সুনামগঞ্জ
জগন্নাথপুর সুনামগঞ্জ জেলার একটি থানা। এ থানারই পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত শ্রীরামসি একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। মধ্যস্থলে বাজার, উচ্চবিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডাকঘর, তহসিল অফিস, মাদ্রাসা প্রভৃতি বিদ্যমান থাকায় বহু সংখ্যক সরকারি- বেসরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, ব্যবসায়ীর বসবাস এ গ্রামে। ভৌগোলিক দিক থেকেও গ্রামটির গুরুত্ব অত্যধিক। পূর্ব দিকে বিশ্বনাথ থেকে পশ্চিম দিকে জগন্নাথপুর পর্যন্ত যোগাযোগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে শ্রীরামসির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত একটি ছোট্ট খাল।
পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের পদলেহী দোসররা নীলনকশা আঁকছিল জগন্নাথপুরের পূর্বাঞ্চল আক্রমণের। সেই নকশা অনুযায়ী ২৯ আগস্ট গ্রামে আসে দুজন রাজাকার। এসেই যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানাল। প্রলোভন দেখাল আকর্ষণীয় বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়ার। কিন্তু শ্রীরামসির মুক্তি পাগল বাঙালি প্রত্যাখ্যান করল তা ঘৃণাভরে। সাথে সাথে ওই দুজন রাজাকারকেও তাড়িয়ে দিল গ্রাম থেকে। বিতাড়িত হয়ে যাবার সময় তারা শাসিয়ে গেল গ্রামবাসীকে। গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। সর্বত্র আলোচিত হতে লাগল আসন্ন বিপদের কথা। ফলে অধিকাংশ লোক গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেও এত কম সময়ের মধ্যে স্ত্রী-পুত্র পরিজন নিয়ে সমস্ত লোকজনের চলে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। আবার অনেকেরই অন্যত্র চলে যাবার কোনো সুযোগ বা সংস্থান ও ছিল না। তাই অধিকাংশ লোক গ্রামেই রয়ে গেল।
তারপর এলো সেই ভয়াবহ দিন ৩১ আগস্ট। গ্রামের ভেতরের খাল দিয়ে অসংখ্য নৌকা এসে ভিড়ল শ্রীরামসি গ্রামে। নৌকার ভেতরে বহু পাকিস্তানি দস্যু সৈন্য। তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনীর বহু সদস্য ও দালাল। জনশ্রুতি আছে, শ্রীরামসিতে গণহত্যার জন্যে পাকিস্তানি বাহিনী সংখ্যায় ছিল বিরাট। তাদের নাকি ধারণা ছিল এ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান রয়েছে এবং তারা বিনা বাধায় গণহত্যা সম্পন্ন করতে পারবে না।
সকাল ১০টায় তারা গ্রাম প্রায় ঘেরাও করে শান্তি কমিটি গঠনের নাম করে গ্রামবাসীকে এক জায়গায় সমবেত হবার আহ্বান জানায়। গ্রামবাসী তাদের ভাঁওতা সম্পর্কে অবহিত ছিল এবং এই আহ্বানে মোটেই সাড়া দেয়নি। ফলে শুরু হলো নির্যাতন। বহু লোককে অস্ত্রের মুখে ধরে আনা হলো শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয়ে। শুধু গ্রামবাসী নয়, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিভিন্ন অফিসের কর্মচারী এবং ব্যবসায়ীরাও এদের মধ্যে ছিলেন, সমবেত হওয়ার পর উপস্থিত সবাইকে ভাগ করল দুটি ভাগে। প্রথম ভাগে অশিক্ষিত বৃদ্ধ আর কিশোর যুবক। প্রৌঢ়রা থাকলেন দ্বিতীয় ভাগে। বিদ্যালয় গৃহের দুটি কক্ষে প্রবেশ করানো হলো দুটি গ্রুপকে। শুরু হলো প্রথম গ্রুপের সাথে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা। জানতে চাইল তারা পাকিস্তান বিরোধীদের নাম। কিন্তু না; বৃদ্ধরা কোনো তথ্য প্রকাশ করতে রাজি হলেন না। সশস্ত্র হায়েনারা তখন ব্যর্থ হয়ে চলে আসে দ্বিতীয় কক্ষে। বেঁধে ফেলল ঐ গ্রুপের সকল দামাল ছেলেকে। তাদের আবার বিভক্ত করল দুটি দলে এবং নিয়ে গেল দুটি বাড়িতে। প্রথম দলকে নিয়ে গেল রসুলপুর পাড়ায় মছয়ম উল্লার বাড়িতে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করাল সবাইকে। এর আগেই হাত বেঁধেছে। কেউ কেউ প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করলেন শেষবারের মতো। ৬ জন লোক নিজেদের মুসলিম লীগের কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে প্রাণ ভিক্ষা চায়। সৌভাগ্যক্রমে পাকবাহিনীর এক দালাল ছিল তাদের আত্মীয়। হত্যামঞ্চে ঐ দালাল নিজে জড়িত থাকায় মুক্ত হয়ে গেল ওই বন্দি ৬ ব্যক্তি। তবে এক শর্তে, সমস্ত বাজার তাদের নিজেদের উদ্যোগে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে হবে। অবশ্য মুক্ত হবার পর সে শর্ত পূরণ না করে সুযোগ বুঝে পালিয়ে যান তারা। এই সময়ে অতি কষ্টে বন্ধন মুক্ত হয়ে পালিয়ে বাঁচেন কিছু ব্যক্তি। কিন্তু যারা এই বন্দিত্ব থেকে পালাতে পারলেন না পাকসেনাদের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন তাদের অনেকেই। অন্যদিকে নজির মিয়ার পুকুর পাড়ে দ্বিতীয় গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত যাদের নেয়া হয়েছিল তাদের বুকগুলো লক্ষ্য করে একইভাবে গুলি ছোড়া হয়। ফলে ওখানেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বহু লোক। উভয় গ্রুপে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে অনেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। একদিকে চলছিল গণহত্যা, অন্যদিকে খাল দিয়ে যাতায়াতকারী নৌকাগুলো থামিয়ে এর আরোহীদের আটক করা হলো। তাদের এ জাতীয় তৎপরতা সফল হবার পরপরই পাকবাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসররা প্রবেশ করে বাজারে। লুটপাট চালায় বাজার এবং এখানকার প্রসিদ্ধ বাড়িগুলোতে। শ্রীরামসি উচ্চবিদ্যালয়ও লুটপাটের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এত কিছুর পরও তারা আগুন ধরিয়ে দিল বাজার ও গ্রামে। লাশগুলো ভাসিয়ে দিল তারা খালের জলে। তাই শ্রীরামসি গ্রামে কতজনকে হত্যা করা হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা বের করা বড়ই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ঐ দিন গ্রামে কোনো লোক থাকেনি। পরদিনও ভয়ে ফিরল না তারা। গ্রামজুড়ে তখনো টহল চলছে পাকসেনাদের। গ্রামের অবশিষ্ট বাড়িগুলোতেও তারা আগুন ধরিয়ে দিল। শহীদের লাশগুলো পড়ে থাকল। একই স্থানে এর পরদিন আশপাশের কিছু লোকজন শুধু মানবিক কারণে সাহস সঞ্চয় করে এল শ্রীরামসি। শনাক্ত করল কিছু লাশ। ডেকে আনল তাদের আত্মীয়স্বজনদের।
কবরস্থ করল তাদের দীঘির পাড়ের নামের গোরস্থানে। নিহতদের সংখ্যা ৮০ জনের বেশি বলে ধারণা করা হয়।
[২০৪] মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত