শাঁখারীকাঠি গণহত্যা, বাগেরহাট
মোরেলগঞ্জ থানার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত দৈবজ্ঞাহাটি বাজারের কাছে বিশ্বাস বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি শক্তিশালী রাজাকার ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এই রাজাকার বাহিনীর বেশ কয়েক বার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ ধরনের একটি যুদ্ধ হয় ৪ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার ঐদিন সারারাত ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হয়। এদিন ছিল দুই কিলোমিটার অদূরে অবস্থিত কচুয়া থানার শাঁখারীকাঠি গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত একটি হাট। দৈবজ্ঞাহাটির রাজাকার সংগঠকগণ হাটটি আক্রমণ করে সেখানে আগত হিন্দু যুবকদের খতম করে ফেলার নির্দেশ দেয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ নভেম্বর, শুক্রবার সূর্য ডোবার বেশ আগেই শতাধিক অস্ত্রধারী রাজাকার তিন দিক থেকে বাজারটিকে ঘিরে ফেলে। বাজারটিকে ঘিরে ফেলার পর রাজাকাররা বলে, “আপনাদের কারো কোনো ভয় নেই। আমরা গোপন সূত্রে খবর পেয়ে এসেছি, কয়েকজন দুষ্কৃতকারী বাজারে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা শুধু তাদের অ্যারেস্ট করব।” এই কথা বলেই রাজাকাররা রাইফেলের বাঁট দিয়ে যাকে খুশি প্রহার করে, কিল-চড়-ঘুষি দিয়ে সবাইকে ভীতসন্ত্রস্ত করে মোট ৮২ জন লোককে ধরে এবং দড়ি, গামছা প্রভৃতি দিয়ে কনুই-বরাবর দুজন লোক একত্রে বেঁধে বাজারসংলগ্ন বিষখালী খালের তীরে এনে জড়ো করে। বন্দিদের মধ্যে কোনো মুসলমান ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল খালেক শেখ এই ঘটনা বর্ণনা করে লিখেছেন :
একটা হুইসেলের শব্দ। শুরু হলো গুলি, আর্তনাদ চিৎকার, পুরো বাজারজুড়ে যেন তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে গেল। যে যেদিকে পারছে, দৌড়াচ্ছে, ভয়ে চিৎকার করছে, শোকে কাঁদছে। আমি দুই কান চেপে ধরে বসে পড়লাম। কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। এরপর যখন উঠে দাঁড়ালাম, তাকিয়ে দেখি বেঁধে রাখা মানুষগুলো যেখানে ছিল, সেখানে আর নেই। একটু এগিয়ে গেলাম, দেখলাম, কতগুলো দেহ পড়ে আছে। রক্তে খালের পাড়ের মাটি ভিজে লাল হয়ে আছে। খালের ঘোলা পানি রক্ত মিশে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা দেহগুলোর মাঝ থেকে গোঙানির শব্দ শুনতে পেলাম। তার মানে কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছে। আমার মতো অনেকেই এই গোঙানির শব্দ শুনে ছুটে গেল। এই মৃত্যুপথযাত্রীদের শেষবারের মতো একটু পানি খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু রাজাকাররা রাইফেল উঁচু করে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়াল।
রাজাকাররা এভাবে লাশগুলো ফেলে রেখে সন্ধ্যার আগেই তাদের ক্যাম্পে ফিরে যায়। পরের দিন শনিবার প্রাইমারি স্কুলের একজন স্থানীয় শিক্ষক হাবিবুর রহমান লাশগুলোর একটা সদ্গতি করার জন্য রাজাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর রাজাকারদের উপস্থিতিতে হাবিবুর রহমান একজন লোককে ৫০ টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিষখালী খালের পূর্ব তীরে রামচন্দ্রপুর গ্রামের এক প্রান্তে লাশগুলোকে একটি গণকবরের মধ্যে পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করেন। এই গণহত্যায় নিহত নিরঞ্জন দাসের বড় ভাই মনোরঞ্জন দাস ঘটনার দুই দিন পর অর্থাৎ গণকবরটি দেখতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন:
দেখি একটা শৃগাল ও একটি কুকুর বিরোধবিহীনভাবে একটা শবদেহ খাচ্ছে। ঐ স্থানে একটা সুড়ঙ্গ, তার ভেতর থেকে ওপর পর্যন্ত একটা লুঙ্গি। ঐ লুঙ্গিটা আমার, যা আমার ভাই নিরঞ্জন পরে বাজারে গিয়েছিলেন। আমি কেন যেন ঐ রক্তমাখা লুঙ্গিখানা তুলে ঐ নদীতে মাটি দিয়ে ধুচ্ছিলাম। লুঙ্গিটা নিয়ে আসি এবং জঙ্গলে নিয়ে শুকিয়ে বাড়িতে লুকিয়ে রাখি। তারপর বৌদি ও মাতাঠাকুরানীর অজ্ঞাতে মাঠে গিয়ে সাবান দিয়ে শুকিয়ে রাখি।
সেদিন মোট ৮২ জনকে বাঁধা হলেও মৃতের সংখ্যা তার চেয়ে কিছু কম ছিল। তবে এ সংখ্যা কোনোক্রমেই পঞ্চাশ জনের কম নয়।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত