শিরনিরটেক বধ্যভূমি, ঢাকা
রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে যাওয়ার আগের রাস্তাটি অর্থাৎ উত্তর দিকে ভেড়িবাঁধ যাওয়ার রাস্তাটি দিয়ে উপরে উঠলেই ডানদিকে ভেড়িবাঁধ সংলগ্ন স্থানটি শিরনিরটেক। বাঁয়ে ৯নং ওয়ার্ড এলাকা, পশ্চিমে কাউইন্দা গ্রাম। শিরনিরটেক ও কাউইন্দা গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে তুরাগ নদী।
১৯৭১ সালের মার্চের পর থেকেই এই শিরনিরটেকে চলে নারকীয় হত্যাকাণ্ড। দিয়াবাড়ি, কাউয়িন্দা, বাঘসাত্রা ও চান্দারটেকের বাসিন্দাদের হত্যা করা হতো এই শিরনিরটেকেই। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালালরা পৈশাচিক হত্যা উৎসবে মেতে ছিল এই শিরনিরটেকে। বস্তুত টেকের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে তুরাগ নদী। হত্যার পর লাশের গতি করাটা একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশে বেশির ভাগ গণহত্যা ঘটেছে নদী বা খাল-বিলের ধারে। তার একটা বড় কারণ নদীর স্রোত বা জলগ্রাস প্রক্রিয়ায় লাশ সহজেই বিলীন হয়ে যাওয়া অর্থাৎ হত্যা চিহ্ন সহজেই মুছে ফেলা সহজ বলে। যেখানে নদী ছিল না সেখানে হত্যার পর লাশগুলোকে কাটা হতো টুকরো টুকরো করে। মুক্তিকামী নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হতো। শুধু এই গ্রামগুলোর ‘অধিবাসীদেরই নয়, শিরনিরটেকে হত্যা করা হয়েছে মিরপুর ও ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে।
তৎকালীন সময়ে গাবতলী রাস্তাটিই ছিল দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর অঞ্চলে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। মাজার রোডের মোড় থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়ার সময় গাড়ি থেকে নামিয়ে এই শিরনিরটেকে নিয়ে আসা হতো হত্যার জন্য। চোখ, হাত বেঁধে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। নদীতে লাশ ভেসেছে কচুরিপানার মতো। বাঘসাত্রা গ্রামের বাসিন্দা, ঘাটমাঝি আব্দুল কাদির (৫০) জানান, ‘৭১-এ আমার বয়স ছিল ১৫ বছর।
শিরনিরটেকে প্রচুর লাশ দেখি। বেশির ভাগ লাশই খুবলে খাওয়া। হাত ও চোখ বাঁধা লাশগুলো শেয়াল, কুকুরে খেত। শিরনিরটেকে দিনের বেলায় প্রচুর কুকুর ও কাক, রাতে শেয়ালের ঝাঁক ঘুরঘুর করত। ‘৭১-এর আগে কখনোই এই অঞ্চলে এত কুকুর দেখিনি। বিহারিরা যখন আসত তাদের হাতে ও কপালে কালো কাপড় বাঁধা থাকত। বিহারিরা এলেই কুকুরের দল তাদের পিছু নিত। হত্যা করার পর লাশ ফেলে দিলেই খুবলে খাওয়া শুরু করত। মানুষের শরীর খেতে খেতে কুকুরগুলোর এমন অবস্থা হয়েছিল একা কোনো মানুষকে পেলেই দল বেঁধে হায়েনার মতো আক্রমণ করত। আব্দুল কাদির আরও জানান, মিরপুর ব্রিজে মানুষ হত্যার পর নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হতো। নদীতে প্রচুর লাশ ভাসতে দেখতাম। কচুরিপানার মতো ভাসত মানুষের লাশ। আজকের শিরনিরটেক এক সময় আরও বড় ছিল। টেকের পাড়ে যেসব মানুষকে হত্যা করা হতো, জোয়ার- ভাটার টানে সে লাশগুলো ভেসে যেত। আমরা ছোট থাকায় নদীর এই পাড় (বাঘসাত্রা) থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বিহারিদের হত্যাকাণ্ড নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করি। বীভৎস ও নারকীয় কায়দায় তাদের হত্যা করা হতো। বিহারিরা হত্যা করত জবাই করে। মানুষ (বাঙালি) বেশি হলে গুলি করে হত্যা করত, শিরনিরটেকে মানুষের টুকরো টুকরো করা লাশও দেখেছি। প্ৰতিদিনই কোনো না কোনো অভাগা বাঙালিদের হত্যা করা হতো এই শিরনিরটেকে
শিরনিরটেক সম্পর্কে কাউয়িন্দা গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা কাইয়ুম খান (ঝন্টু) জানান, ‘৭১-এ মিরপুর সিদ্ধার্থ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। একাত্তরের মার্চের দিকে সাভারে পালিয়ে যাই, মাঝে মাঝেই লুকিয়ে গ্রামে আসতাম। শিরনিরটেক থেকে মিরপুর ব্রিজ পর্যন্ত নদীর দুই পাড়ে ও নদীতে শুধুই লাশ ভাসতে দেখি। মিরপুর ব্রিজেই প্রচুর মানুষ হত্যা করা হতো। হত্যার পর লাশগুলো নদীতে ফেলে দেয়া হতো। শিরনিরটেকে প্রচুর মানুষ হত্যা করা হয়। এত পরিমাণ হত্যা আর কোথাও হয়েছে কিনা আমি জানি না। পুরো শিরনিরটেক জুড়েই ছিল মানুষের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্ষত-বিক্ষত লাশ। দিনের বেলায় কুকুর ও রাতে শেয়াল দল বেঁধে খুবলে খেত শহীদদের লাশ। আমাদের বাড়িটিই ছিল ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প’। তাই মুক্তিযুদ্ধকে দেখি খুব কাছ থেকে। আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থাকায় বিহারিরা এই গ্রামে খুব একটা ঢুকতে পারত না। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বিশাল ফোর্স একদিন পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। আমরা পেছনের দিক দিয়ে সাভার চলে যাই। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই গ্রামে ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও বিহারিরা। শিরনিরটেকে প্রচুর মানুষের লাশ দেখেছি। উলঙ্গ, বীভৎসভাবে খুবলে খাওয়া মানুষের লাশ। পুরো একাত্তর জুড়েই নারকীয় হত্যাকাণ্ড চলেছে এই শিরনিরটেক বধ্যভূমিতে। বেশির ভাগ লাশের চোখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি। বিহারিরা মূলত জবাই করে হত্যা করত, হত্যার পর টুকরো টুকরো করা লাশও দেখেছি। যখন দল বেঁধে বাঙালি ধরে আনত তখন গুলি করে হত্যা করত।
একটি ঘটনা আমার এখনো মনে পড়ে, শিরনিরটেকে অসংখ্য লাশ দেখেছি। এর মধ্যে একটি লাশ দেখে মনে হলো মানুষটি বেঁচে আছে। মানুষটির পরনের লুঙ্গি খুলে গিয়েছিল। খোলা চোখে যেন তাকিয়ে ছিল সাহায্যের জন্য। হাত ছিল পেছনে বাঁধা। হাঁটু গেড়ে বসার ভঙ্গিতে বসে ছিল। পায়ুপথ দিয়ে মল বের হয়ে এসেছিল। সামনে গিয়ে দেখি নাভির একটু ওপর থেকে দু ভাগ করে হত্যা করা হয়েছে।
শিরনিরটেক বধ্যভূমি সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন কাউয়িন্দা গ্রামের বাজার সংলগ্ন বাড়ির বাসিন্দা কাজিম আলী (৮৫)। তিনি জানান, শিরনিরটেকে প্রচুর মানুষ হত্যা করা হতো। টেকের ওপর আনুমানিক ৪-৫শ মানুষের লাশ দেখেছি। আমাদের বাড়ি থেকে শিরনিরটেক স্পষ্ট দেখা যেত, এখনো দেখা যায়। আমরা প্রতিদিনই নিরীহ বাঙালিদের কিভাবে হত্যা করত তা নিজ চোখে লুকিয়ে প্রত্যক্ষ করতাম। সন্ধ্যার পর বাড়ির বাতি নিভিয়ে রাখতাম। আলো দেখলেই বিহারিরা গুলি চালাত, আমাদের বাড়িটি গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। প্রায় রাতেই শিরনিরটেক থেকে গুলির শব্দ পেতাম। সকাল বেলায় দেখতাম প্রচুর লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বিহারিরা বেশির ভাগ সময় হত্যা করত টেকের কিনারে। ফলে জোয়ার-ভাটার টানে লাশগুলো ভেসে যেত। সকাল ৯টায় জোয়ার, দুপুর ১টার সময় ভাটা, আবার রাতে ৯টার দিকে জোয়ার এবং রাত ১টার দিকে ভাটা। মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে হত্যা হওয়া লাশগুলো জোয়ার-ভাটার টানে ভেসে যেত। তাই শিরনিরটেক বধ্যভূমির হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মানুষ কেবল টেকের ওপর ছড়িয়ে থাকা লাশের কথাই বলে। কিন্তু শয়ে শয়ে মানুষ হত্যা করা হয় শিরনিরটেকের পাড়ে, যা জোয়ার-ভাটার টানে ভেসে যেত। এছাড়া টেকের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রচুর লাশ। ভয়ে ও দুর্গন্ধে শিরনিরটেকের কাছে কেউ ঘেঁষত না। প্রতিটি লাশই ছিল শেয়াল- কুকুরে খুবলে খাওয়া। যে একবার এই বীভৎস দৃশ্য দেখত সে ভয়ে আর কখনোই শিরনিরটেকের আশপাশেও ভিড়ত না।
এছাড়া ‘মিরপুর ব্রিজ’ বর্তমানে আমিন বাজার ব্রিজের দক্ষিণে যে লোহার পুরনো ব্রিজটি আছে ঐ ব্রিজেই হাজার হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। হত্যার পর ব্রিজের ওপর থেকে লাশ নদীতে (তুরাগ নদী) ফেলে দেয়া হতো। মিরপুর ব্রিজের ওপর তখন রক্তের যে স্তরটি ছিল তা পায়ের গোড়ালির গাঁট পর্যন্ত পুরু ছিল। লাশগুলো ভাসত কচুরিপানার মতো।
[৬৬] মিরাজ মিজু
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত