শেরপুর গণহত্যা, সিলেট
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভৌগোলিক দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানের কারণেই শেরপুরের পক্ষে এই ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়। এখানে মিলিত হয়েছে চারটি জেলা-সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। আবার সিলেট ও ঢাকার মধ্যে সড়ক যোগাযোগের এক সেতুবন্ধন শেরপুর। এছাড়া জলপথ দ্বারাও শেরপুর যুক্ত হয়েছে দেশের বিভিন্ন বন্দরের সাথে। মুক্তিযুদ্ধকালে এ স্থানটির দখল নিয়ে বারবার যুদ্ধ হয়েছে মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে। প্রাণ দিয়েছেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও নিরস্ত্র বাঙালি। অবশেষে ১০ এপ্রিল শেরপুরের ওপর তাঁদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে পাকবাহিনী। আর তখন থেকেই শুরু হয় নিরস্ত্র জনতার ওপর দানবীয় হামলা। তাদের আচরণ তখন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানায়। প্রতিদিন আশপাশের গ্রামগুলোতে হানা দিত পশুরা। ধরে আনত যাঁকে ইচ্ছে তাঁকে। তারপর শেরপুরের ফেরিঘাটে কিংবা আশপাশে কোথাও সারিদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে তাঁদের বুকে গুলি করে হত্যা করা হতো। শুধু তাই নয়, পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে তারা এখানকার গ্রামের পর গ্রাম। ইজ্জত হরণ করেছে অসংখ্য মা-বোনের। কুশিয়ারা নদী দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করেই তারা ঢুকে পড়ত কোনো গ্রামে। পাকড়াও করত সুন্দরী রমণীদের। আর মা-বাবা বা আত্মীয়স্বজনের চোখের সামনেই তাদের হতে হয়েছে ধর্ষিত। এ জাতীয় জঘন্য অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁর ভাগ্যে জুটত একটি চীনা বা আমেরিকান বুলেট। তাই শেরপুরের পার্শ্ববর্তী চারটি জেলার অসংখ্য মা- বোন হয়েছেন বীরাঙ্গনা।
ওই সময়ে পাক হায়েনাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে বাংলার কিছু পদলেহী। অমানুষ লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারী ধর্ষণসহ প্রভৃতি বহু ক্ষেত্রে তাদের মনিবদেরও হার মানায়। দালালরা বিনা প্ররোচনায় নিজেরাই হত্যা করেছে বহু বীর বাঙালিকে।
এসব দালালের সহায়তা নিয়ে পাকবাহিনী একদিন আক্রমণ চালায় শেরপুর গ্রামে। বাড়ি থেকে ধরে আনে গ্রামের বাসিন্দা আকলু মিয়া মাস্টারকে। তারপর তাঁকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। এভাবে সুভাষিণী রায়কেও বাড়ি থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। হত্যা করে একই গ্রামের চন্দ্রকিশোর আচার্য ও কুঞ্জবিহারি আচার্যকে। রাজাকারদের সাথে নিয়ে পাকবাহিনী এরই মধ্যে একদিন হাজির হয় ব্রাহ্মণ গ্রামে। ধরে আনে তারা ওই গ্রামের মন্টু শুক্লা বৈদ্যকে। তাঁকেও প্রাণ দিতে হয় তাদের বুলেটে। ১০ এপ্রিল থেকে বাকি ৮ মাস যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের সংখ্যা নিরূপণ বা পরিচয় উদ্ধার করা আজ খুবই কষ্টকর। এছাড়া গ্রামে গ্রামে ঢুকেও তারা হত্যা করে অগণিত লোককে। ফোটার গ্রামে হানা দিয়ে একদিন হত্যা করে দুজন অজ্ঞাত পরিচয় গোয়ালাকে। তাঁদের মৃতদেহ বধ্যভূমিতেই পড়ে থাকে। সালামতপুরে গিয়ে হত্যা করে হবিব উল্লাকে। আলমপুরের আখড়ার মোহান্তও রেহাই পাননি পশুদের হাত থেকে। তাঁকেও প্রাণ দিতে হয় হায়েনা বাহিনীর হাতে। এই সাথে হত্যা করে তারা ব্রাহ্মণ গ্রামের সুনীল ভৌমিকসহ জনতৈলের একজন অধ্যাপক ও ভূমিরবাঁকের একজন কৃষককে। আট মাসে এভাবে শুধু শেরপুরেই প্রাণ দিতে হয়েছে শতাধিক লোককে।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত